অপারেশন এক্স ফাইল – কর্নেল সমগ্র ১১ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
০১.
সেবার অক্টোবরে কর্নেলের সঙ্গে বুরুডি বনবাংলোয় দিনপাঁচেক কাটিয়ে ফিরে আসছিলাম। বনদফতরের জিপগাড়ি আমাদের স্টেশনচত্বরে নামিয়ে দিয়ে দ্রুত উধাও হয়ে গেল। কর্নেলের বখশিসের তোয়াক্কা করল না ড্রাইভার। বুঝতে পারলাম, এই অবেলায় বেচারাকে পনেরো কিলোমিটার দুর্গম রাস্তায় পাড়ি দিতে হবে। তাই এই ব্যস্ততা।
ছোট্ট রেলস্টেশনটির নাম রুহা। আপে আজমগড় থেকে ডাউনে লাখানপুর জংশন পর্যন্ত প্রায় তিরিশ কিলোমিটার এই ন্যারোগেজ রেলপথের সঙ্গে শিলিগুড়ি-দার্জিলিং রেলপথের তুলনা করা চলে। আমরা লাখানপুরে পৌঁছে হাওড়াগামী ট্রেন ধরব রাত ৯টা ৪০ মিনিটে। রুহায় আজমগড় থেকে ট্রেন আসার কথা ৫টা ২০ মিনিটে। এখন প্রায় চারটে বাজে। কাছাকাছি আদিবাসীদের একটা বসতি গাছপালার আড়ালে ঢাকা পড়েছে। সেশন নিঝুম জনহীন।
কর্নেল সারাপথ গম্ভীর ছিলেন। একটা ইংরেজি দৈনিকে বুরুডি জঙ্গলে এক বিশেষ প্রজাতির অর্কিডের সচিত্র প্রতিবেদন বেরিয়েছিল। স্থাননির্দেশও ছিল। কিন্তু উনি কদিন ধরে তন্নতন্ন খুঁজে তা আবিষ্কার করতে পারেননি। ওঁর শেষমেশ সিদ্ধান্ত হলো, আজকাল রঙিন বিজ্ঞাপনের জন্য খবরের কাগজে যে ক্রোড়পত্র বেরোয়, তাতে নানা রকমের লেখা দিয়ে বাকি জায়গা ভরাট করতে হয়। অতএব যিনি এটি লিখেছেন, তিনি বুরুড়ি না এসেই কোনও পুরনো বই থেকে পুরোটাই টুকেছেন–সম্ভবত কোনও বিদেশি পর্যটকের বই। আর ছবি? অর্কিডের রঙিন ছবির বই বাজারে মেলে।
গম্ভীর মুখে স্টেশনের বারান্দায় উঠেই কর্নেল থমকে দাঁড়ালেন।
বললাম, কিছু ফেলে এসেছেন নাকি?
নাহ্। কপালে দুর্ভোগ আছে জয়ন্ত।
কেন বলুন তো?
কর্নেল স্টেশনঘরসংলগ্ন চায়ের দোকানটার ঝাঁপের দিকে আঙুল তুলে বললেন, দেখছ?
হেসে ফেললাম। চা-ফা খাওয়া যাবে না, এই তো? জংশনে গিয়ে খাবেন।
মনে হচ্ছে জংশনেও খাওয়া হবে না। বলে কর্নেল স্টেশনঘরের দরজায় গিয়ে উঁকি দিলেন। দেখলাম, পাশে একটা প্রকাণ্ড সিন্দুকের ওপর এক রেলকর্মী নাক ডাকিয়ে এই অবেলায় ঘুমোচ্ছে। প্ল্যাটফর্মে মানুষজন নেই।
কর্নেলকে দেখে ভেতর থেকে রেলকোটপরা স্টেশনমাস্টার বেরিয়ে এসে বললেন, গত রাতের বৃষ্টিতে আপে এক জায়গায় পাহাড়ের ধস ছেড়ে লাইনের ওপর পড়েছে। জংশন থেকে লোকজন গেছে। ধস সরাতে দুদিন লাগতে পারে। তিনদিনও লাগতে পারে।
ভদ্রলোক নির্বিকার মুখে কথাগুলি বলে প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দাঁড়ালেন। কর্নেল তুম্বো মুখে চুরুট ধরিয়ে তার কাছে গেলেন। বললেন, জংশন এখান থেকে সম্ভবত বেশি দূরে নয়।
স্টেশনমাস্টার বললেন, অন্তত ছ কিলোমিটার। তবে যদি পায়ে হেঁটে যাওয়ার কথা ভাবেন, আমি নিষেধ করব।
কেন?
দুধারে ঘন জঙ্গল। তাছাড়া বিকেলের দিকে মাঝেসাঝে বুনোহাতির দল। এসে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে।
কর্নেল বাইনোকুলারে ডাউনে কিছু দেখতে থাকলেন। আমি স্টেশনমাস্টারকে বললাম, হাতিরা নিশ্চয় সকালের দিকে রেললাইনে অবরোধ করতে আসে না।
স্টেশনমাস্টার একই ভঙ্গিতে বললেন, কিছু ঠিক নেই। তবে বিকেলেই ওদের উৎপাত বেশি।
তাহলে বরং রাত্তিরটা আমরা স্টেশনে কাটাতে পারি। তাই না?
প্রচণ্ড মশা। বাড়তি মশারি থাকলে দিতাম। নেই।
স্টেশনমাস্টার লোকটিকে রোবোট বলে মনে হচ্ছে। কথাবার্তা হচ্ছিল ইংরেজিতে। উচ্চারণ শুনে এবং কাছে থেকে খুঁটিয়ে দেখে এতক্ষণে মনে হলো উনি অ্যাংলা-ইন্ডিয়ান। গায়ের রঙ তামাটে, চোখের তারা ঈষৎ নীল। ওঁর সঙ্গে ভাব জমানোর জন্য নাম জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছি, কর্নেল বললেন, ওখানে কয়েকটা বাড়ি দেখলাম। ওটা কি কোনও টাউনশিপ?
স্টেশনমাস্টার বললেন, টাউনশিপ নয়। রিসর্ট এলাকা। নিচের দিকে একটা লেক আছে। নানা জায়গা থেকে ধনী, লোকেরা এসে ওখানে বাড়ি করেছে। আপনারা ওখানে গিয়ে চেষ্টা করে দেখতে পারেন। বরাত ভালো হলে জংশনে পৌঁছানোর ব্যবস্থা হয়ে যেতেও পারে।
কর্নেল বললেন, এস জয়ন্ত।
রেললাইন ধরে দুজনে হেঁটে চললাম। প্রায় এক কিলোমিটার যাওয়ার পর দেখলাম, একটা সংকীর্ণ পিচরাস্তা রেললাইন পেরিয়ে চড়াইয়ে উঠে গেছে এবং উঁচু জমির ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সুন্দর ছবির মতো কয়েকটা বাড়ি। সবগুলোই একতলা এবং নতুন। বিকেলের আলোয় ঝলমল করছে রঙবেরঙের বাড়ি আর সুদৃশ্য সব লন। শুধু একটা বাড়ি দোতলা এবং পুরনো। এই বাড়িটা শেষ দিকটায় গাছপালার আড়ালে কিছুটা ঢাকা পড়েছে।
আমরা পিচরাস্তা ধরে হেঁটে গেলাম। আসবার দিন এই বাড়িগুলো চোখে না পড়ার কারণ তখনও শেষ রাতের অন্ধকার এবং কুয়াশা ছিল।
কর্নেল বাইনোকুলার তুলে একবার দেখে নিয়েই হাসিমুখে বললেন, বরাত আমাদের আশা করি ভালো জয়ন্ত! দোতলা বাড়িটার গেটের ফলকে বাংলায় লেখা আছে, মৃন্ময়ীভবন।
বলেন কী!
এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এ তো বিহার! একসময় বাঙালি ভারতের কোন মুল্লুকে না ডেরা পেতেছিল। চলে এস। প্রবাসী বাঙালি অতিশয় সজ্জন।
পিচরাস্তাটা এই বাড়ির সামনে দিয়ে বাঁক নিয়ে পূর্বে এগিয়েছে। মৃন্ময়ীভবনের গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই কুকুরের গর্জন শোনা গেল। তারপর মধ্যবয়সী নাদুসনুদুস গড়নের হাফপ্যান্ট-হাফশার্টপরা গুফো একটা লোক এগিয়ে এসে কর্নেলকে দেখামাত্র কেন কে জানে সেলাম ঠুকল। সে বিনীতভাবে হিন্দিতে বলল, আপনারা কোথা থেকে আসছেন সার?
কর্নেল বললেন, কলকাতা থেকে।
সে গেট খুলে দিয়ে বলল, আসুন। সেনসায়েব আছেন। ওঁরা পরশু এসেছেন। উনি বলছিলেন কলকাতা থেকে কারা সব আসবেন।
ঢুকে দেখি, অ্যাজবেস্টসের ছাউনি দেওয়া গ্যারাজে দুটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। পোর্টিকো বাড়িটার পুবদিকে। পুব-দক্ষিণ জুড়ে বিশাল লন। ফুলবাগিচাও আছে। পুবের লনে ঘাসের ওপর বেতের চেয়ার-টেবিল পাতা। তাতে দুজন যুবক, দুই যুবতী এবং একজন ঝকঝকে চেহারার প্রৌঢ় বসে ছিলেন। আমাদের দেখে প্রৌঢ় ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। যুবক-যুবতীরা মুখ ফেরাল।
কর্নেল বললেন, মিঃ সেন যাদের প্রতীক্ষা করছেন, দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা তারা নই। তো বাই এনি চান্স, বিখ্যাত ভূতত্ত্ববিদ মিঃ বি কে সেনের সঙ্গে কি আপনার কোনও সম্পর্ক আছে?
উনি আমার দাদা ছিলেন বলে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। আপনারা–
কর্নেল তাঁর কথার ওপর একটু হেসে বললেন, আমরা দুর্ভোগে পড়ে আপনার এখানে এসেছি। এই আমার পরিচয়। বলে উনি পকেট থেকে একটা নেমকার্ড বের করে দিলেন।
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। নেচারিস্ট। কার্ডটা পড়ে সেনসায়েব হাঁক দিলেন, রাম সিং! জলদি আউর এক কুর্সি লাও! আপনি বসুন কর্নেল সরকার!
কর্নেল বললেন, আমার এই তরুণ বন্ধুর নাম জয়ন্ত চৌধুরি। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক।
সেই লোকটি আর একটা বেতের চেয়ার এনে দিল। একটা চেয়ার অবশ্য খালি ছিল। আমরা বসবার পর কর্নেল সংক্ষেপে আমাদের দুর্ভোগের কথা বললেন। সেনসায়েব সহাস্যে বললেন, আমার সৌভাগ্য যে আপনাদের মতো অতিথি পেলাম। তা ছাড়া আপনি আমার দাদার পরিচিত। দাদা এ বাড়িতে এসে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।
খবরের কাগজে পড়ে খুব মর্মাহত হয়েছিলাম। তবে উনি যে এখানে মারা যান, খবরে তার উল্লেখ ছিল না।
ও কথা থাক। এবার পরিচয় করিয়ে দিই এদের সঙ্গে। এ হলো আমার ছেলে তন্ময়। আমার বউমা বনশ্রী। তন্ময়ের বন্ধু সৌমিত্র। আর আমার ভাগনী সুদেষ্ণা!
সুদেষ্ণা বলে উঠল, ছোটমামা! আপনি কিন্তু এখনও নিজের পরিচয় ওঁদের দেননি।
তাই বুঝি? সেনসায়েব হেসে উঠলেন। আমি এস কে সেন। সনকুমার সেন।
কর্নেল বললেন, আমার যেন মনে পড়ছে। আপনার দাদা বলেছিলেন, তার ছোটভাই পশ্চিম জার্মানিতে থাকেন। আমার সঙ্গে ওঁর শেষ দেখা দিল্লিতে একটা সেমিনারে। প্রায় বছর দুই আগের কথা। উনি বলেছিলেন, বিহারের একটা খনি এলাকায় আপনার ঠাকুর্দার কয়েকটা খনি ছিল।
ছিল। সেনসায়েব বললেন। তিনটে খনি ঠাকুর্দার আমলেই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। বাকি দুটো গভমেন্ট নিয়ে নেন। এই বাড়িটা ঠাকুর্দা সি কে সেনের তৈরি। এখানে আমার ছোটবেলা কেটেছে।
তন্ময় বলল, বাবা! তুমি কিন্তু গেস্টদের আপ্যায়নের কথা ভুলে গেছ?
সরি! ভেরি সরি! সেনসায়েব হাঁক দিলেন, রাম সিং!
বনশ্রী উঠে দাঁড়াল। আমি যাচ্ছি। কর্নেলসায়েব! হট না কোল্ড?
সুদেষ্ণা মিটিমিটি হেসে বলল, হট। এবং অবশ্যই কফি। আমি জানিঃ কর্নেলসায়েব কফির ভক্ত।
কর্নেল বললেন, মিঃ সেন! আমার বিশ্বাস, আপনার ভাগনী আমাকে চেনেন।,
চিনি মানে? সুদেষ্ণা বলল, ভীষণ জানি। বিশেষ করে সাংবাদিক জয়ন্তবাবুর লেখার আমি ফ্যান। ওঁর লেখাতেই আপনার চেহারার বর্ণনা থাকে। কাজেই দুজনকে দেখামাত্র চিনতে পেরেছিলাম।
তন্ময় বলল, কী আশ্চর্য! তবু তুমি চুপচাপ মুখটি বুজে বসেছিলে?
বনশ্রী বলল, তিতি সবসময় একটা করে স্টান্ট দেয়।
বুঝলাম সুদেষ্ণার ডাকনাম তিতি। বনশ্রী তাকে টেনে নিয়ে বাড়ির দিকে চলে গেল। সেনসায়েব বললেন, কান্দ্রাতে যখনই আসি, একটা-না-একটা নাটকীয় ঘটনা ঘটে যায়। এবারও ঘটল তা হলে! গত মার্চে ঠিক আপনাদের মতোই আমার দাদার এক বন্ধু এসে হাজির। তিনি একজন ফিল্মডাইরেক্টর। শুটিংয়ের লোকেশন দেখতে বুরুডি গিয়েছিলেন। সঙ্গে ওঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট আর ক্যামেরাম্যান ছিলেন। রুহা নদীর প্রপাতের কাছে ওঁরা একটা গুণ্ডা হাতির পাল্লায় পড়েন। বেগতিক দেখে ওঁদের ভাড়াকরা জিপগাড়ির ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে উধাও হয়ে যায়। ভাগ্যিস হাতিটার লক্ষ্য ছিল ওই গাড়িটা। তিনজনে। পাহাড়জঙ্গলের মধ্যে দিশেহারা হয়ে রাত দুপুরে দৈবাৎ কান্দ্রাতে এসে পড়েন।
সনৎ সেন খুব রসিক মানুষ। কথাগুলো বলতে বলতে হেসে অস্থির হলেন। কর্নেল বললেন, রুহা প্রপাতের কথা শুনেছিলাম। কিন্তু যাওয়া হয়নি। আসলে সেই অর্কিডের খোঁজে আমি অন্য এলাকায় ঘুরছিলাম। অবশ্য এই কান্দ্রার কথা জানতাম না।
মিঃ সেন উঠে দাঁড়িয়ে দক্ষিণে আঙুল তুলে বললেন, ওই লেকটার নাম কান্দা। ওটা রুহা নদীর অববাহিকায় একটা প্রাকৃতিক জলাধার বলা চলে। তবে দাদা বলতেন, ওটা প্রাগৈতিহাসিক যুগের একটা আগ্নেয়গিরির ক্রেটার।
কর্নেলও উঠে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলারে লেকটা দেখতে দেখতে বললেন, অপূর্ব! প্রচুর জলহস দেখতে পাচ্ছি। মাই গুডনেস! একজোড়া সেক্রেটারি বার্ড!
উনি বাইনোকুলার চোখে রেখে দক্ষিণের নিচু পাঁচিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমার অস্বস্তি হচ্ছিল, নেশার ঘোরে পাঁচিল ডিঙিয়ে উধাও না হয়ে যান। দিনের আলো দ্রুত কমে আসছে। এই বাড়িটা উঁচুতে বলে লালচে রোদের রঙ পড়েছে লনের এদিকটায়। তন্ময় আমাকে বলল, উনি ওর্নিথোলজিস্ট নাকি?
বললাম, মুখে দাড়ি থাকলেও ওঁকে অবশ্য পক্ষিবিশারদ দ্বিতীয় সালিম আলি বলা যাবে না। এর কারণ আপনি আপনার পিসতুতো বোনের মুখে জানতে পারবেন।
সেনসায়েব সকৌতুকে বললেন, নেচারিস্টরা একটু বাতিকগ্রস্ত হন।
তিনি এগিয়ে গিয়ে কর্নেলের পাশে দাঁড়ালেন। সৌমিত্র এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল। এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি সাংবাদিক?
বললাম, বলতে পারেন। তবে আমি সবসময় সাংবাদিক হয়ে থাকি না।
সুদেষ্ণা বলছিল, আপনি ওই কর্নেল ভদ্রলোককে নিয়ে লেখেন। কী লেখেন?
গল্পটল্প লিখি।
বলেন কী! একজন জলজ্যান্ত মানুষকে নিয়ে গল্প? গল্প তো কাল্পনিক চরিত্র নিয়ে লেখা হয়।
কী, জবাব দেব বুঝতে পারলাম না। এই সময় সুদেষ্ণা ও বনশ্রী এসে গেল। টেবিলে ট্রে রেখে সুদেষ্ণা কর্নেলকে ডাকতে গেল। বনশ্রী, আমার মুখোমুখি বসে পট থেকে পেয়ালায় কফি ঢালতে ঢালতে চাপাস্বরে বলে উঠল, সৌমিত্র! তোমরা জানো? ওই কর্নেল ভদ্রলোক একজন ডিটেকটিভ। আর ইনি তার অ্যাসিস্ট্যান্ট!
দুজনে অবাক চোখে আমার দিকে তাকাল। ঝটপট বললাম, না না। ওই ধরনের ছকে আমাকে ফেলবেন না প্লিজ! আর একটা কথা। কর্নেলকে কেউ ডিটেকটিভ বললে উনি রেগে আগুন হয়ে যান। সেখানে এক মুহূর্ত থাকেন না।
বনশ্রী বলল, সে কী! কেন?
ওঁর মতে, টিকটিকি বলে যে স্ল্যাং কথাটা চালু আছে, তার উদ্ভব ডিটেকটিভ শব্দ থেকে।
সবাই হেসে উঠল। সুদেষ্ণা, কর্নেল আর সেনসায়েব ফিরে এলেন। কর্নেল উজ্জ্বল মুখে বললেন, কান্দ্রা লেকের কথা এতকাল কেউ আমাকে বলেনি। কোনও বইপত্তরেও পড়িনি। আমার পক্ষে এ একটা অসাধারণ আবিষ্কার বলা চলে। তার চেয়ে আশ্চর্য আবিষ্কার সেক্রেটারি বার্ড-দম্পতি।
সেনসায়েব ঘড়ি দেখে বললেন, বোঝা যাচ্ছে ভরদ্বাজ আর সিনহা লাখানপুর জংশনে নেমে আটকে গেছে। কর্নেল সরকারের মুখে যা শুনলাম, দু-তিন দিনের আগে রেললাইন পরিষ্কার হবে না। কিন্তু ওরা তো অনায়াসে একটা জিপগাড়ি ভাড়া করে চলে আসতে পারত।
তন্ময় বলল, হয় তো ট্রেন লেট করেছে। বিকেলের দিকে কোনও গাড়ি কান্দ্রা আসতে রাজি হবে না। রাস্তার অবস্থা যা দেখে এসেছি। তা ছাড়া জঙ্গলে নাকি বুনোহাতির উৎপাত আছে।
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, ওঁরা আপনার বন্ধু?
সেনসায়েব মাথা নাড়লেন। তাঁর মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ ফুটে উঠেছিল। সুদেষ্ণা চোখে হেসে বলে উঠল, ওঁরা এসে যাবেন। ততক্ষণ কর্নেলসায়েবের মুখে বুরুডির জঙ্গলে অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শোনা যাক।
কর্নেল হাসলেন। ব্যর্থ অ্যাডভেঞ্চার। কারণ যে অর্কিডের খোঁজে গিয়েছিলাম, তার দেখা পাইনি।
প্লিজ কর্নেলসায়েব! রহস্যের সমাধান করতে পেরেছেন কি না বলুন।
সৌমিত্র বলল, রহস্য? কী রহস্য?
জানি না বলেই তো জানতে চাইছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, অর্কিড নেহাত উপলক্ষ।
সেনসায়েব একটু অবাক হয়ে বললেন, তিতি! ব্যাপারটা একটু খুলে বলবে?
এই সময় পের্টিকোর দিক থেকে কুকুরের গর্জন শোনা গেল। রাম সিং হন্তদন্ত এগিয়ে গেল উত্তর-পশ্চিমে গেটের দিকে। তন্ময় বলল, বাবা! মনে হচ্ছে তোমার বন্ধুরা এসে গেছেন।
সেনসায়েব উঠে পড়লেন। লন পেরিয়ে এগিয়ে গেলেন। তন্ময়কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কি গাড়ি করে কলকাতা থেকে এখানে এসেছেন?
তন্ময় বলল, হ্যাঁ। তবে মাঝপথে একটা রাত আসানসোলে কাটিয়েছি। এ ছাড়া পথে বহু জায়গায় রেস্ট নিয়েছি। প্রায় সাড়ে পাঁচশো কিলোমিটার দূরত্ব। দুটো দিন লেগে যায়। কিন্তু অসাধারণ জার্নি।
কর্নেল গেটের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। গাছপালার ছায়া এখন ওখানে ঘন হয়েছে। উনি আস্তে বললেন, মনে হচ্ছে, সেনসায়েবের বন্ধুরা নন। অন্য কেউ।
লক্ষ্য করলাম, সেনসায়েব কার সঙ্গে কথা বলছেন। তাকে এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। একটু পরে রাম সিংকে ফিরে আসতে দেখা গেল। সে পোর্টিকোর তলায় অদৃশ্য হলো। তারপর গেটের দিকে আলো জ্বলে উঠল। তন্ময় বলল, বনি! তুমি দোতলার ঘরগুলোতে আলো জ্বেলে দাও! তালা দেওয়া আছে।
বনশ্রী বলল, চাবি?
চাবি তো তোমাকে দিয়েছি। কী আশ্চর্য! এত ভুল হয় কেন বুঝি না।
বনশ্রী হাতের হ্যান্ডব্যাগ খুলে দেখে হাসল। আছে। তিতি! একবারটি আসবে?
সুদেষ্ণা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, এখনও কচি মেয়ের মতো ভূতের ভয়। রাম সিং আছে না? ওর নাম ধরে মাঝে মাঝে ডাকবে। তাহলেই ভূতটুত পালিয়ে যাবে।
ভ্যাট! তুমি এস। আহা! এস না বাবা!
দুজনে চলে গেল। তার একটু পরে সেনসায়েব একা ফিরে এলেন। তাঁকে উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। চেয়ারে বসে তিনি বললেন, রাজেনবাবু এসেছিলেন। ভদ্রলোক দিনে দিনে সত্যি পাগল হয়ে যাচ্ছেন। ফের সেই একই কথা। ভেতরে ঢুকতে চাইছিলেন। বললাম, গেস্টদের নিয়ে ব্যস্ত আছি। পরে আসবেন।
তন্ময় হাসতে হাসতে বলল, আবার জ্যাঠামশাইয়ের প্রেতাত্মার সঙ্গে দেখা হয়েছে? এবার কোথায় দেখা হয়েছে?
লেকের ধারে। বলে সেনসায়েব গম্ভীর হয়ে গেলেন। বুঝলেন কর্নেল সরকার? হ্যালুসিনেশন একটা সাংঘাতিক ব্যাধি। দাদার মৃত্যুর পর আমিও কিছুদিন যেন ওই ব্যাধির পাল্লায় পড়েছিলাম। পরে ডিটেলস বলব। আপনি দাদাকে চিনতেন। কাজেই আপনার সবটা শোনা দরকার।
.
০২.
আসন্ন সন্ধ্যার হিম এবং সুদেষ্ণার তাড়ায় আমাদের উঠতে হলো। সেনসায়েব দোতলায় পোর্টিকোর ছাদের মুখোমুখি যে ঘরটাতে আমাদের বসালেন, সেটা একাধারে স্টাডি এবং ড্রইংরুম। দেয়ালে ভূতত্ত্ববিদ পি কে সেনের প্রকাণ্ড পোর্ট্রেটে ফুলের মালা এখনও তাজা হয়ে আছে। কর্নেল ছবিটার কাছে একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর সোফায় বসলেন। সেনসায়েব বললেন, এটা ছিল দাদার স্টাডি এবং ল্যাব। ল্যাবের সরঞ্জাম পাশের ঘরে যত্ন করে রেখে দিয়েছি। আমি ওয়েস্ট জার্মানিতে মাইনিং নিয়ে পড়াশুনা করেছি। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি আছে। অনেক বছর সিন্ড্রিতে সরকারি চাকরিও করেছি। কিন্তু তন্ময়ের মায়ের মৃত্যুর পর চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম। শেষে দাদার পরামর্শে এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের একটা কারবার খুলেছিলাম। মাইনিং প্রজেক্টে নানা ধরনের যন্ত্রাংশ সাপ্লাই করতাম। তারপর তন্ময় বড় হয়ে উঠল। এখন সেই কারবারটা চালিয়ে যাচ্ছে।
কর্নেল বললেন, আপনার দাদার কথা জানতে ইচ্ছে করছে।
দাদা বিয়ে করেননি। এই বাড়িতেই থাকতেন। তবে ওঁর ওই ভূতত্ত্ববিদ্যার বাতিক। সরকারি চাকরির অফার অনেকবার পেয়েছিলেন। নেননি। দেশবিদেশের সেমিনারে ওঁর ডাক পড়ত। বিশেষজ্ঞ হিসেবে সরকারি-বেসরকারি নানা সংস্থার উপদেষ্টা ছিলেন। হাতা থেকে দাদার মোটামুটি ভালো রোজগার হতো। কান্দ্রা এরিয়ায় ইউরেনিয়াম খনি থাকার সম্ভাবনা দাদাই সরকারকে জানিয়েছিলেন। পরে তা সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
সুদেষ্ণা ও বনশ্রী আরেকদফা কফি আনল। তারপর সুদেষ্ণা বলল, ছোটমামা! তখন তুমি কর্নেলসায়েব সম্পর্কে আমাকে খুলে বলতে বলছিলে। বড়মামার মৃত্যুর ঘটনাটা বরং ওঁকে খুলে বলো। কারণ তোমার মুখেই তো শুনেছি, বড়মামার মৃত্যুর মধ্যে নাকি একটা রহস্য আছে।
সেনুসায়েব কিছু বলার আগে সৌমিত্র বলে উঠল, যেটুকু অনুমান করেছি, তাতে আমার ধারণা কর্নেলসায়েব একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। সরি! জয়ন্তবাবু বলছিলেন, ডিটেকটিভ বললেন উনি রাগ করেন। বরং প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার বলছি।
কর্নেল সাদা দাড়ি থেকে কী একটা ঝেড়ে ফেলে কফিতে চুমুক দিলেন। তারপর সেনসায়েব তার দিকে তাকিয়ে আছেন লক্ষ্য করে গলার ভেতর বললেন, রহস্য জিনিসটা আমাকে টানে। আমার এ-ও একটা বাতিক বলতে পারেন।
সেনসায়েব একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, গতবছর সেপ্টেম্বরে দাদা আমাকে শিগগির আসতে লিখেছিলেন। চিঠি পেয়ে একটু অবাক হয়েছিলাম। আমার বরাবর কুকুর পোষার শখ আছে। দাদা লিখেছিলেন, সঙ্গে যেভাবেই হোক, যেন আমার অ্যালসেশিয়ান টমকে নিয়ে আসি। অগত্যা গাড়ি নিয়ে রওনা হয়েছিলাম। পৌঁছে দেখি, দাদাকে কেমন যেন বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যাচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলে বললেন, একটা পোড়ো খনির মুখ আটকানো ছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার সময় হঠাৎ খনি-মুখের পাথরের ফাটল দিয়ে বিষাক্ত গ্যাস বেরিয়ে আসে। উনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। ভাগ্যিস একটা গভীর গর্তে জলের ওপর পড়েছিলেন। তাই জলের ঝাঁপটায় জ্ঞান ফিরে আসে। অতি কষ্টে বাড়ি ফিরে আসেন। রাম সিং তখনই ডাক্তার ডেকে এনেছিল। কান্দ্রা রিসর্টে বাড়ি করেছিলেন একজন নামী ডাক্তার। তখন প্রায় সত্তর বছর বয়স ছিল তার। যাই হোক, তিনি এসে দাদার চিকিৎসা করেন। কিন্তু গ্যাসটা কী, দাদা বা তিনি কেউই বুঝতে পারেননি।
জায়গাটা কত দূরে?
প্রায় দু-কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে। কান্দ্রা লেকের একটা অংশ ওদিকে বেঁকে গেছে।
তারপর?
তারপর দাদা একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন। কিছুদিন থেকে বাড়িতে নাকি চোরের উৎপাত হচ্ছে। রাম সিং তার ভাই হরি সিংকে এনে পালাক্রমে রাত জেগে পাহারা দিত। তবু কোন ফাঁকে চোর এসে তাঁর এই ল্যাবে হানা দিত। দাদা টের পেতেন। কিন্তু তন্নতন্ন খুঁজে কাকেও দেখা যেত না। তাই অ্যালসেশিয়ান কুকুর নিয়ে আসতে বলেছিলেন। কুকুরটা ছাড়া থাকত। আমার লাইসেন্স করা বন্দুক আছে। কুকুরটা রাতবিরেতে গর্জন করলেই বন্দুকে ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করতাম।
কর্নেল চুরুট জ্বেলে বললেন, ইন্টারেস্টিং। তারপর?
তারিখটা মনে আছে। ২৩ সেপ্টেম্বর। দাদা সেদিন বেশ সুস্থ আর ভালো মেজাজে ছিলেন। রাত দশটায় দুজনে খাওয়াদাওয়া করে শুতে গেলাম। দাদা শোওয়ার আগে কিছুক্ষণ ল্যাবে থাকতেন। আমি ওই ঘরটায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। টমি অভ্যাসমতো ওপরে-নিচে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একসময় টমির গর্জনে ঘুম ভেঙে গেল। কুকুরটা আমার ঘরের দরজায় আঁচড় কেটে ডাকাডাকি করছিল। তখনই আলো জ্বেলে বন্দুক নিয়ে দরজা খুললাম। টমি লেজ গুটিয়ে আমার ঘরে ঢুকে গেল। একটু খটকা লাগল। বাইরের আলো নিভে গেছে। সেই আলোর সুইচ দাদার ল্যাবে। আর ওই যে দেখছেন, যে ঘরে দাদার ল্যাবের জিনিসপত্র রেখেছি, ওটা ছিল দাদার শোওয়ার ঘর। ল্যাবের দরজা খোলা মনে হলো। অমনি টর্চ নিয়ে এলাম আমার ঘর থেকে। তারপর টর্চের আলোয় দেখি ল্যাবের মেঝেয় দাদা কাত হয়ে পড়ে আছেন। রাম সিং আমার ডাকাডাকিতে ওপরে উঠে এল। সে থাকে নিচের ঘরে। তখন তার বউ ছেলেমেয়ে হরি সিংয়ের সঙ্গে তাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল। সেনসায়েব জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন, রাম সিং খুব সাহসী লোক। তখন রাত প্রায় সওয়া বারোটা। ডাক্তার কেতনলাল পাণ্ডেকে ডাকতে গেল। অবস্থা চিন্তা করুন।
সেনসায়েব হঠাৎ চুপ করলেন। কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হচ্ছে।
মিসটিরিয়াস। যাই হোক, ডাক্তার পাণ্ডে খুব সজ্জন মানুষ ছিলেন। ওই বয়সেও তাঁর স্বাস্থ্য চমৎকার ছিল। নিজে ড্রাইভ করে এলেন। দাদাকে পরীক্ষা করে দেখে বললেন, হার্ট অ্যাটাক। সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছেন। আর কিছু করার নেই। সেনসায়েব জোর শ্বাস ছেড়ে ফের বললেন, ডাক্তার পাণ্ডে বেঁচে থাকলে তার মুখেই ঘটনাটা শুনতেন।
কোনও চেয়ার উল্টে গিয়েছিল? মানে যে চেয়ারে বসে থাকতেন–
নাহ্। সম্ভবত চেয়ার থেকে উঠে কোনও কারণে দরজা খুলেছিলেন। আর, বন্ধ করতে পারেননি। বডি পড়ে ছিল ঠিক এখানে।
কর্নেল দেখে নিয়ে বললেন, অন্তত ফুট পাঁচেক দূরত্বে।
তন্ময় বলে উঠল, বাবা! সেই দুর্গন্ধটার কথা বলো!
সেন সায়েব বললেন, আমার ঘর থেকে বেরুনোর সময় একটা দুর্গন্ধ টের পেয়েছিলাম। মাত্র এক মিনিটের জন্য। তবে তখন ও নিয়ে মাথা ঘামাইনি। পরে মনে পড়েছিল।
কর্নেল বললেন, ডাঃ পাণ্ডে বডির পোস্টমর্টেমের কথা বলেননি?
নাহ। কারণ তার আগে দুবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। থার্ড অ্যাটাকেই তো রোগী মারা পড়ে।
রাম সিং দরজার কাছে এসে একটু কাশল। সেনসায়েব তাকে জিজ্ঞেস করলেন, সব রেডি?
হাঁ সাব!
কর্নেল সরকার! আপনারা ক্লান্ত। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নিন। মোটে পৌনে সাতটা বাজে। ঘণ্টা দুই পরে আমরা আবার বসব। আপনাকে কষ্ট করে নিচের একটা ঘরে যেতে হবে। ওপরে তেমন কোনও বাড়তি ঘর নেই। তবে নিচের ঘরটা ভালোই। দক্ষিণে বারান্দা আছে। এক ঘণ্টা পরে চাঁদ উঠবে। বারান্দায় বসে লেকের জলে জ্যোৎস্না দেখতে আপনার আশা করি ভালো লাগবে। আপনি প্রকৃতি-প্রেমিক।
সুদেষ্ণা বলল, একেই বলে সত্যিকার অ্যাডভেঞ্চারার। দুজনের মাত্র দুটো ব্যাগ। রাম সিং! তোমার বয়ে নিয়ে যাবার মতো কিছু নেই। তুমি ভাগো! আমি এঁদের নিয়ে যাচ্ছি।
বনশ্রী বলল, চলো তিতি! রাম সিং নিজে ঘরটা গোছায়নি–আমি সিওর। ওর বউকে হুকুম করেছে। দেখি কী অবস্থা!
সিঁড়িতে নামবার সময় টমির হাঁকডাক শোনা গেল। সুদেষ্ণা তার উদ্দেশে ধমক দিয়ে বলল, খুব হয়েছে। থামো! বড়মামাকে অ্যাটাক করার সময় লেজ গুটিয়ে ঘরে ঢুকেছিলে কেন?
কর্নেল আস্তে বললেন, অ্যাটাক বলছেন?
বলছেন-টলছেন নয়। তুমি বললে আরও খুশি হব। আমি আপনার ফ্যান। সরি জয়ন্তবাবুর ফ্যান।
দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরটা দেখে পছন্দ হলো। দুপাশে দুটো সিঙ্গল খাট। দেয়ালের দুদিকে দুটো ল্যান্ডস্কেপ। দুটো চেয়ার আর একটা টেবিল। বনশ্রী ও সুদেষ্ণা আবার বিছানা দুটো ঝেড়ে পেতে দিল। বনশ্রী বাথরুম দেখিয়ে দক্ষিণের দরজা খুলে বিচ্ছিরি অন্ধকার! বলে বন্ধ করে দিল।
কর্নেল তার ব্যাগ টেবিলে রেখে বললেন, তিতির মতে তাহলে হার্ট অ্যাটাক নয়? শুধু অ্যাটাক?
সুদেষ্ণা একটু হাসল। ছোটমামা যে দুর্গন্ধ টের পেয়েছিল, সেটা কিসের? একবার কোন পোড়োখনির মুখ থেকে হঠাৎ বিষাক্ত গ্যাস বেরিয়ে বড়মামাকে অজ্ঞান করে দিয়েছিল।
বনশ্রী চাপাস্বরে বলল, শ্বশুরমশাই নিজেও এ বাড়িতে কয়েকবার ছায়ামূর্তি দেখেছেন। আজ নাকি রাজেনবাবুও লেকের ধারে কাকে দেখতে পেয়েছেন।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, রাজেনবাবু কে?
উনি একজন রিটায়ার্ড জজসায়েব। পুরো নাম রাজেন্দ্রলাল দ্বিবেদী। মাথায় একটু ছিট আছে অবশ্যি। কিন্তু
তাকে থামিয়ে সুদেষ্ণা বলল, দেয়ালের কান আছে। এসব কথা এখন থাক কর্নেলসায়েব!
কর্নেল দ্রুত বললেন, জয়ন্ত আমাকে শুধু কর্নেল বলে। তুমি–তোমরাও বলতে পারো।
সুদেষ্ণা হাসল। আমি আপনার কাছেও যখন তিতি হয়ে গেছি, তখন জয়ন্তবাবুর মতো শুধু কর্নেল বলতে বাধবে না।
বললাম, উনি কিন্তু নর-নারী নির্বিশেষ প্রিয়জনদের ডার্লিং বলেন।
জানি, জানি! আর একটু পরেই ডার্লিং শুনতে পাব। আচ্ছা। চলি! রেস্ট নিন আপনারা।
তোমাদের বরাতে রেস্ট নেই ডার্লিং! আর এক পেয়ালা কফি খাব। এখনই নয়, আধঘণ্টা পরে। বলে কর্নেল ঘড়ি দেখলেন।
দুজনে চাপা হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বললাম, কর্নেল! দুর্গন্ধ নয়, ঝাঝালো সুগন্ধ পাচ্ছি। তাই না?
কর্নেল ব্যাগের চেন খুলতে খুলতে বললেন, বনশ্রী বিবাহিতা মেয়ে, জয়ন্ত! বিবাহিতা মেয়েদের সুরভিতা হয়ে থাকাই নিয়ম। যাই হোক, আগে তুমি বাথরুম সেরে পোশাক বদলে ফেলো। ততক্ষণ আমি চুরুটটার সদগতি করি।
কিছুক্ষণ পরে দক্ষিণের দরজা খুলে বারান্দায় দুটো চেয়ার নিয়ে আমরা বসলাম। সুদেষ্ণা বলছিল, বিচ্ছিরি অন্ধকার। কিন্তু দোতলা এবং নিচের এই ঘরের আলোর ছটায় অন্ধকার কাছাকাছি নেই। দূরে সরে গিয়ে থমথম করছে। আমার কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। বললাম, এই বারান্দায় আলো থাকা উচিত ছিল।
কর্নেল বললেন, আছে। আমাদের ঘরেই তার সুইচ থাকা সম্ভব। কিন্তু আলো জ্বালার দরকার কী? তুমি কি ভূতের ভয়ে আলোয় থাকতে চাইছ?
নাহ। আপনার কাছে বসে থেকে ভূতপ্রেত দেখতে মন্দ লাগবে না।
কর্নেল একটু পরে আস্তে বললেন, ভূতত্ত্ববিদ ডঃ পি কে সেন দিল্লির সেই সেমিনারে যে পেপার পড়েছিলেন, তার একটা কপি আমি রেখে দিয়েছিলাম। জানতাম না দৈবাৎ তার বাড়িতে এসে পড়ব। জানলে সঙ্গে নিয়ে আসতাম।
ওঁর পেপারের বিষয়টা কী ছিল?
ঠিক মনে পড়ছে না। তবে ভূগর্ভে কী কী গ্যাস থাকতে পারে, তার থেকে খনিশ্রমিকরা কীভাবে আত্মরক্ষা করতে পারে, এই ধরনের কোনও আলোচনা ছিল সম্ভবত। সেনসায়েব বিষাক্ত গ্যাসের কথা বলায় শুধু এটুকু মনে পড়ছে যেন। না–আমি সিওর নই। স্মৃতি অনেক সময় বড় প্রতারণা করে।
কর্নেল থেমে গেলেন। কুকুরটার গর্জন শোনা গেল। আমি একটু চমকে উঠেছিলাম। তারপর দেখলাম আমাদের বাঁদিকে লনের ওপর তন্ময় আর সৌমিত্র হেঁটে যাচ্ছে। দুজনের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। দুই বন্ধুতে কি সিগারেট খাওয়ার জন্য নেমে এসেছে? চাপা গলায় কথা বলতে বলতে ওরা এগিয়ে গেল।
তার একটু পরে সুদেষ্ণা একা কফির ট্রে আনল। বলল, বনশ্রী কিচেনে রাম সিংয়ের বউকে হম্বিতম্বি করছে। ম্যাগাজিন পড়ে ও দেশবিদেশের নানারকম রান্নার এক্সপেরিমেন্ট করে। জানি না, আজ ডিনারে কেলেঙ্কারি বাধাবে কি না।
দু পেয়ালা কফি আমাদের হাতে তুলে দিয়ে সে একটা থামে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। কর্নেল বললেন, প্রত্যেক মানুষের একটা-না-একটা হবি আছে। বনশ্রীর হবি রান্না। তোমার?
সুদেষ্ণা হাসল। আমার? কে জানে কী!
বললাম, আমি বলতে পারি। আপনার হবি ক্রাইমস্টোরি পড়া। বিশেষ করে গোয়েন্দা কাহিনী।
সে আর কে পড়ে না? বড়মামার মতো মানুষও গোয়েন্দাকাহিনী পড়তেন।
কর্নেল বললেন, আমার ধারণা, তুমি এখনও ছাত্রী।
কীভাবে বুঝলেন?
বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কোর্স নিয়ে পড়াশুনা করছ।
সুদেষ্ণা ভুরু কুঁচকে বলল, ছোটমামা কিংবা তন্ময়ের কাছে শুনেছেন বুঝি?
তুমি ছোটবেলা থেকে তোমার মামাবাড়িতে মানুষ হয়েছ।
আপনি এসেই গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছেন। সুদেষ্ণা অবাক হয়ে বলল। সত্যি কর্নেল, জয়ন্তবাবুর লেখায় আপনার আসল রূপ ফুটে ওঠে না।
কর্নেল মাথা নেড়ে বললেন, নাহ্। নিছক অঙ্ক। প্রথমত, ওপরের ঘরে তোমার মামাদের একটা ফ্যামিলি ফোটোগ্রাফ দেখেছি। তাতে তোমার বালিকা বয়সের ছবি আছে। তোমার দুই মামা এবং তোমার দাদামশাইয়ের চেহারার মিল সহজে চোখে পড়ে। তোমার দাদামশাইয়ের পাশের মহিলা তোমার দিদিমা। ছাড়া আর কেউ হতে পারেন না। তোমার দুই মামা পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। তুমি আর তন্ময় দাদামশাই-দিদিমার মধ্যিখানে। পায়ের কাছে দুপাশে দুজন মহিলা। একজন সধবা, অন্যজন বিধবা। কাজেই–
সুদেষ্ণা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আপনার চোখ আছে তা জানি। মানে–যাকে বলে তৃতীয় নয়ন। কিন্তু আমি এখনও ছাত্রী, তা কী করে বুঝলেন?
কর্নেল হাসলেন। পড়াশুনা শেষ করে ফেললে চেহারা-হাবভাবে একধরনের গাম্ভীর্য এসে যায়। ব্যতিক্রম থাকতে পারে। কিন্তু বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে এটা লক্ষ্য করেছি। ছাত্রজীবনে তারা সবসময় হাসিখুশি চঞ্চল থাকে।
বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কোর্স?
তোমার ছোটমামার কারবার এখন তন্ময় চালাচ্ছে। তাই এটা আন্দাজে ঢিল ছোঁড়া। তুমি এই ফ্যামিলিরই একজন।
বললাম, কর্নেল! সৌমিত্রবাবু কী করে বলুন এবার।
কর্নেল চোখ বুজে বললেন, আমি গণক নই। তন্ময়ের সঙ্গে তার বন্ধুতার নানা সূত্র থাকতে পারে। একটু সিরিয়াস টাইপের যুবক। কথাবার্তা কম বলে। নিজের ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা আছে। এমন হতেই পারে, সে তন্ময়ের পরামর্শদাতার ভূমিকা নিতে ব্যর্থ এবং সেনসায়েবও তাকে স্নেহ করেন।
সুদেষ্ণা বলে উঠল, প্রায় ধরে ফেলেছেন কর্নেল! সৌমিত্র সদ্য একটা কনসাল্ট্যান্সি ফার্ম খুলেছে। অ্যামেরিকায় পড়াশুনা করে এসেছে।
আমি মনে মনে বললাম, এবং সুদেষ্ণার প্রেমপ্রত্যাশী।
ঠিক সেই সময় লনের পূর্বদিকে চিৎকার শোনা গেল, চোর! চোর! পাকড়ো! পাকড়ো! রাম সিং! তারপর রাম সিংকে ছুটে যেতে দেখলাম। তার হাতে টর্চ আর বল্লম। কেউ বুদ্ধি করে টমকে খুলে দিয়েছিল। টম লনের মাঝামাঝি গিয়ে হাঁকডাক জুড়ে দিল। কর্নেল তার পকেট থেকে খুদে টর্চ বের করে আস্তেসুস্থে নেমে গেলেন। দোতলায় সেনসায়েবের বন্দুক পর পর দুবার গর্জন করল।
কয়েক সেকেন্ডের ঘটনা! সুদেষ্ণা এতক্ষণে লনে নামল। তার পিছনে আমি।
তন্ময় এবং সৌমিত্র কর্নেলকে টর্চের আলো ফেলে দেখাচ্ছিল, কোথায় তারা চোরের দর্শন পেয়েছে। কাছে গিয়ে দেখি, পূর্বের বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে একটা ছোট্ট ঝোঁপ দুমড়ে মুচড়ে গেছে। তন্ময় হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ব্যাটাচ্ছেলে এখানে গুঁড়ি মেরে বসে ছিল। জাস্ট ইনটুইশন! কী মনে হলো, টর্চের আলো ফেলতেই দেখি, একটা কালো কুচকুচে লোক। মুখের গড়ন বীভৎস। একেবারে গরিলার মতো।
সৌমিত্র বলল, পাঁচিল ডিঙিয়ে পালানোর সময় আমার কিন্তু গরিলাজাতীয় জন্তু বলেই মনে হলো।
কর্নেল তার টর্চের আলোয় জায়গাটা খুঁটিয়ে দেখে বললেন, এমন একটা পরিবেশ–তা ছাড়া সাইকোলজিক্যাল দিকটাও ধর্তব্য, মানুষকে জন্তু কিংবা জন্তুকে মানুষ মনে হওয়া বিচিত্র নয়।
তন্ময় জোর দিয়ে বলল, মানুষ। কিন্তু মুখটা কদাকার।
পরনে কী ছিল লক্ষ্য করেছেন?
না। জাস্ট দু-তিন সেকেন্ডের মধ্যে পালিয়ে গেল।
সেনসায়েব এবং তার সঙ্গে টম এল। সেনসায়েব সব শুনে বললেন, তোমাদের দেখার ভুল হতেও পারে। রাম সিং একবার
কর্নেল তাঁর কথার ওপর বললেন, না মিঃ সেন। সত্যিই কেউ এখানে এসে ওত পেতে বসে ছিল। পালানোর সময় তার পায়ের চাপে এই ঝোপটা দুমড়ে ভেঙে গেছে।
ঝোপটার ওপর আলো ফেলে সেনসায়েব বললেন, সত্যিই তো! আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কে এমন করছে? কেন করছে?…
.
০৩.
মৃন্ময়ীভবন ঘিরে একটা রহস্যের গা ছমছম করা পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। ডিনারের সময় লক্ষ্য করেছিলাম, এখানে এসে সকলের মধ্যে যে হাসিখুশি ভাব ছিল, আর তা নেই। সুদেষ্ণারও চাপল্য ফুরিয়ে গেছে। সেনসায়েব বেজায় গম্ভীর। তিনি বলেছিলেন, দাদা আমাকে কতকটা এ ধরনের ঘটনার কথা বলেছিলেন। আবার তাই ঘটতে শুরু করল। কর্নেলসায়েব! সৌভাগ্যক্রমে আপনি আমার অতিথি। আপনার যেটুকু পরিচয় পেয়েছি, তা থেকে মনে হচ্ছে, ঈশ্বর আপনাকে ঠিক সময়ে এখানে পাঠিয়েছেন। আপনিই এখন আমার ভরসা।
কর্নেল তাকে আশ্বাস দিয়ে নেমে এলেন। সুদেষ্ণা এবার সঙ্গ দিল না। সে একবার বলেছিল, টমও যাকে ভয় পায়, সে নিশ্চয় ভয়ঙ্কর কিছু। সাধারণ চোর মোটেও নয়। ছোটমামা! টমকে বাইরে না ছেড়ে নিচের হলঘরেই রাখুন। এবার ব্যাপারটা আমাদের সিরিয়াসলি নেওয়া উচিত।
ঘরে এসে কর্নেল বললেন, রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে। শুড়ে পড়ো জয়ন্ত!
বললাম, আপনি কি রাত জেগে ওত পেতে থাকবেন?
নাহ। ভোরবেলা বেরুতে হবে। সেক্রেটারি বার্ডের ছবি এ পর্যন্ত তুলতে পারিনি, যদিও বহুবার বহু জায়গায় ওদের দেখা মিলেছে। এবার মনে হচ্ছে একটা ভালো সুযোগ এসেছে।
রাতটা নিরুপদ্রবে কেটে গেল। ঘুম ভাঙল রাম সিংয়ের ডাকে। ভেতরের দরজা খুলে দিলাম। রাম সিং গম্ভীর মুখে সেলাম ঠুকে বেড-টি দিয়ে গেল। সাতটা বাজে। বারান্দার দিকের দরজা কর্নেল ভেজিয়ে রেখে বেরিয়েছেন। বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে বেড-টি খেতে খেতে দেখলাম, সুদেষ্ণা, বনশ্রী, তন্ময় ও সৌমিত্র পুবদিকে সেই দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে সম্ভবত রাতের ঘটন নিয়ে আলোচনা করছে।
বারান্দা থেকে কান্দ্রা লেক দেখে মুগ্ধ হলাম। বিস্তীর্ণ জলাশয়ের ওপর তখনও হাল্কা কুয়াশার পর্দা টাঙানো। দূরে ঘন নীল কয়েকটা পাহাড়ের আভাস। পাওয়া যাচ্ছে। পশ্চিমের পাহাড়টা জঙ্গলে ঢাকা। খালি চোখেই অজস্র সারস দেখতে পাচ্ছিলাম। গাছের ডগায় ঝিম মেরে বসে আছে।
সুদেষ্ণা এসে বলল, জয়ন্তবাবু! কর্নেল বুঝি মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছে?
বললাম, না। কাল বিকেলে বাইনোকুলারে সেক্রেটারি বার্ড আবিষ্কার করেছেন, তার ছবি তুলতে গেছেন। তো আপনারা ওখানে চোরের কোনও সূত্র খুঁজে পেলেন?
সুদেষ্ণা বলল, সূত্র বলতে একটাই। একটা আস্ত ঝোঁপ দুমড়ে মুচড়ে গেছে। মানুষ, না গরিলাজাতীয় প্রাণী?
এদেশে গরিলা নেই বলেই জানি।
না। আমি গরিলা বলছি না। ওই ধরনের কোনও প্রাণী কি থাকতে পারে না?
নিশ্চয় পারে। তবে সে পাঁচিল ডিঙিয়ে এ বাড়িতে ওত পাততে আসবে কেন?
ধরুন, এমন যদি হয়, ওই জন্তুটা কারও পোষা এবং সে আড়ালে থাকে?
একটু হেসে বললাম, অসম্ভব নয়। কিন্তু তার উদ্দেশ্য কী থাকতে পারে?
ছোটমামাকে উত্ত্যক্ত করে এখান থেকে তাড়ানো। যাতে তিনি এই বাড়িটা বেচে দিয়ে চলে যান।
কেউ কি এ বাড়ি কিনতে চায়?
নাহ্। তা হলে ছোটমামার কাছে জানতে পারতাম।
আপনার কী মনে হয় বলুন?
বুঝতে পারছি না। তবে এমনও হতে পারে, এ বাড়িতে এমন দামী কোনও জিনিস আছে–ধরুন, বড়মামার উদ্ভাবিত কোনও ফরমুলা– সুদেষ্ণা একটু হেসে ফেলল। নাহ্। রহস্যকাহিনী পড়ে খালি মাথায় এ ধরনের আইডিয়া আসে।
ঠিক বলেছেন। তবে একটা কথা আছে, টুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন।
সেনসায়েব টমকে নিয়ে সম্ভবত প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। তাঁকে পুবের লনে দেখা গেল। একেবারে সায়েবি কেতা। হাতে একটা ছড়ি। মাথায় টুপি। তাকে দেখে বনশ্রী, তন্ময় এবং সৌমিত্র এগিয়ে এল।
সুদেষ্ণা বলল, আমি আসছি জয়ন্তবাবু!
সে চলে গেল দলটার দিকে। আমি উঠে গিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম।
কর্নেল ফিরে এলেন পৌনে আটটা নাগাদ। ক্লান্তভাবে বসে বললেন, এ যাত্রা শুধুই ব্যর্থতা। পাখি দুটো একটুর জন্য উড়ে গেল। কয়েকটা সাধারণ। প্রজাতির প্রজাপতি দেখলাম।
বললাম, শুধুই ব্যর্থতা বলবেন না। মৃন্ময়ীভবনে একটা রহস্যের গন্ধ পেয়ে। যাননি কি?
কর্নেল তার টুপি, কিটব্যাগ, প্রজাপতিধরা জাল, বাইনোকুলার এবং ক্যামেরা টেবিলে রেখে বাথরুমে গেলেন। সেই সময় সেনসায়ের এলেন। কর্নেলসায়েবকে ফিরতে দেখলাম।
ফিরেছেন। তবে সেক্রেটারি বার্ডের ছবি তুলতে পারেননি।
উনি কি বারান্দায়?
নাহ। রাগ করে বাথরুমে ঢুকেছেন।
সেনসায়েব আড়ষ্টভাবে হাসলেন। তারপর হাঁক দিলেন, তিতি, কর্নেলসায়েবের কফি নিয়ে এস।
উনি আমার বিছানায় বসে পড়লেন। রাত্রে কোনও অসুবিধে হয়নি তো?
আজ্ঞে না।
আমি শুধু ভরদ্বাজ এবং সিনহার জন্য চিন্তা করছি।
তারা কে?
আমার বন্ধু বলতে পারেন। সুশীল ভরদ্বাজ কলকাতার একটি বড় বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্তা। রমেশ সিনহা একসময় গভমেন্টের কী একটা বড় পোস্টে ছিল। এখন আমার মতোই নিষ্কর্মা। চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করার শখ হয়েছিল। লোকসান খেয়ে ফেঁসে গিয়েছিল। তবে পৈতৃক সম্পত্তি যা আছে, সে বাকি। জীবনের জন্য নিশ্চিন্ত। এখন ওর হবি দুর্গম সব জায়গায় ঘুরে বেড়ানো।
সুদেষ্ণা এসে টেবিলের একপাশে ট্রে রাখল। কফির সরঞ্জামের সঙ্গে দুপ্লেট স্ন্যাক্সও এনেছে। সে বলল, তোমার সেই পালোয়ান হরি সিং এসে গেছে ছোটমামা! বউয়ের জ্বর বলে পরশু আসতে পারেনি। কাল বিকেলে জ্বর ছেড়েছে।
সে হেসে ফেলল। কর্নেল বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে অভ্যাসমতো সম্ভাষণ করলেন, মর্নিং!
সেনসায়েব মর্নিং বলে প্রজাপতিধরা জালটা হাত বাড়িয়ে তুলে নিলেন। এটা কী?
সুদেষ্ণা বলল, ওঃ ছোটমামা! তুমি প্রজাপতিধরা জাল কখনও দেখনি?
কোথায় যেন দেখেছিলাম!
প্রবীরকাকুর কাছে। প্রবীরকাকুও কর্নেলের মতো লেপিডস্টারিস্ট ছিলেন না?
হ্যাঁ। বেচারা ক্যান্সারে মারা পড়ল। জিনিয়াস ছেলে ছিল।
সুদেষ্ণা আমাদের তিনজনের হাতে কফির পেয়ালা তুলে দিয়ে চলে গেল। কর্নেল বললেন, সেই রাজেনবাবুর সঙ্গে আলাপ হলো মিঃ সেন!
সেনসায়েব তুম্বো মুখে বললেন, কোথায় আলাপ হলো?
ফেরার পথে। একটা পাথরে চুপচাপ বসে ছিলেন ভদ্রলোক। আমাকে দেখে জেরা শুরু করলেন। পরিচয় দিলাম। তখন জিজ্ঞেস করলেন, লেকের ধারে ডঃ বি কে সেন নামে কারও সঙ্গে দেখা হয়েছে কি না।
সেনসায়েবকে রুষ্ট দেখাল। বললেন, বদ্ধ পাগল হয়ে গেছেন ভদ্রলোক।
হ্যাঁ। ওঁর ধারণা, ডঃ বি কে–সেনের অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে। তাই তার প্রেতাত্মা কান্দ্রায় এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আমি বুঝতে পারি না কেন দাদাকে নিয়ে রাজেনবাবুর এত মাথাব্যথা! সেনসায়েব উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। এবার উনি আমার কাছে এলে আর ভদ্রতা রাখব না। টমকে লেলিয়ে দেব।
ছেড়ে দিন। মানসিক রোগীদের কোনও কোনও ব্যাপারে একটা ফিক্সেশন– মানে, বদ্ধমূল ধারণা গড়ে ওঠে। আপনি হ্যালুসিনেশনের কথা বলছিলেন। কর্নেল কফি শেষ করে চুরুট ধরালেন। ফের বললেন, উনি জজসায়েব ছিলেন। তা-ও বললেন। আপনার দাদার সঙ্গে নাকি ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল।
থাকতেই পারে। দাদা কান্দ্রা রিসর্টে জনপ্রিয় ছিলেন। সবাই তাকে শ্রদ্ধাভক্তি করত। বলে সনৎ সেন উঠে দাঁড়ালেন। আপনারা ব্রেকফাস্ট করবেন কটায়?
নটায়। অবশ্য যদি অসুবিধে না থাকে।
ছি ছি! কী বলছেন? আপনারা আমার সম্মানিত অতিথি।
সেনসায়েব বেরিয়ে যাওয়ার পর বললাম, ওই রিটায়ার্ড জজসায়েবের ওপর মিঃ সেন যেন বেশিরকম খাপ্পা।
কর্নেল হাসলেন। সেটা স্বাভাবিক। কারও দাদা ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বললে ছোটভাই খাপ্পা হতেই পারে।
একটা ব্যাপারে আমার একটু খটকা লাগছে।
কী ব্যাপারে?
সেনসায়েব এবার এসে আবার রাম সিংয়ের ভাই হরি সিংকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। লোকটা নাকি পালোয়ান। সে এসে গেছে। ওদিকে ওঁর দুই বন্ধুরও আসার কথা। কোন বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্তা সুশীল ভরদ্বাজ এবং দেশে-বিদেশে টো-টো করে ঘুরে বেড়ানো জনৈক রমেশ সিনহা।
কর্নেল বাইনোকুলার নিয়ে বারান্দায় গেলেন। তারপর বাইনোকুলারে লেক দেখতে থাকলেন। একটু পরে বললেন, সত্যিকার খটকা হলো, এক রিটায়ার্ড জজসায়েবের আচরণ। লেকের পশ্চিমে একটা টিলার মাথায় কোনও দেবতার পোড়োমন্দির আছে। এখনও উনি সেখানে বসে আছেন। আমাকে বলছিলেন, ডঃ বি কে সেনের প্রেতাত্মার সঙ্গে ওঁর অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে ওখানে।
হাসতে হাসতে ওঁর কাছে গিয়ে বললাম, আমাকে একবার দেখতে দেবেন?
দেখ। বলে কর্নেল বাইনোকুলার আমার হাতে দিলেন।
বাইনোকুলারে দেখলাম, ঢিলে প্যান্টশার্টপরা রোগাটে চেহারার এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক একটা পাথরে বসে ছিলেন। এইমাত্র হঠাৎ উঠে গিয়ে একটা ভাঙাচোরা মন্দিরের আড়ালে অদৃশ্য হলেন। বললাম, প্রেতাত্মা এসে গেছে মনে হচ্ছে। মন্দিরের আড়ালে চলে গেলেন রাজেনবাবু।
কর্নেল আমার কাছ থেকে বাইনোকুলার ছিনিয়ে নিলেন। তারপর নিজে দেখতে থাকলেন। কিছুক্ষণ দেখার পর উনি বারান্দা থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে দক্ষিণের পাঁচিলের দিকে গেলেন। লক্ষ্য করলাম, কর্নেল বাইনোকুলার অ্যাডজাস্ট করে নিচ্ছেন। এ সময় ওঁকে কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না, আমার যত কৌতূহলই থাক।
একটু পরে সুদেষ্ণা আর একজন ঘোমটা-ঢাকা মেয়ে ঘরে এল। মেয়েটি কফির ট্রে যত্ন করে গুছিয়ে তুলে নিয়ে গেল। বুঝলাম, মেয়েটি রাম সিংয়ের বউ। সুদেষ্ণা বারান্দায় এসে বলল, কর্নেল কি সেই পাখি খুঁজছেন?
বললাম, না। রাজেনবাবুকে।
কেন?
ঘটনাটা সকৌতুকে বললাম। সুদেষ্ণা কিন্তু হাসল না। একটু চুপ করে থাকার পর চাপাস্বরে বলল, আপনাদের বলেছি, বড়মামার মৃত্যুর ঘটনা আমার কাছে এখনও রহস্যজনক থেকে গেছে। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে, গত মার্চে ছোটমামার সঙ্গে এখানে আসার পর রাজেন দ্বিবেদী আমাকে অদ্ভুত কিছু কথা বলেছিলেন সেগুলো হয়তো পাগলামি নয়।
কী বলেছিলেন উনি?
এক মিনিট। বলছি। বলে সুদেষ্ণা ভেতরের দিকের দরজা বন্ধ করে এল। তারপর বারান্দায় দাঁড়াল। চারদিকটা দেখে নিয়ে সে বলল, চলুন! কর্নেলের কাছে যাই। ওঁরও শোনা দরকার।
ততক্ষণে কর্নেল বাঁ দিকে ফুলের ঝোপের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে একটা দরজার কপাট খোলার চেষ্টা করছেন। সুদেষ্ণা বলল, ওই দরজা দিয়ে একসময় আমরা লেকের ঘাটে যেতাম। কিন্তু দুবার দুটো বিষাক্ত সাপ দেখা গিয়েছিল বলে ঘাটে যাওয়ার সাহস হয় না। দাদামশাইয়ের বাবার আমলে তৈরি ঘাট। ফেটে গেছে। ঝোঁপ গজিয়েছে। তা ছাড়া লেকের জলটাও খারাপ। কেন জানেন? খনি এলাকার সব আবর্জনা লেকে ফেলা হয়।
সে হন্তদন্ত হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিল। কর্নেল ঘুরে আমাদের দেখে বললেন, আবার চোর ঢুকেছে নাকি?
সুদেষ্ণা হাসল। না। আপনাকে নিষেধ করতে এলাম। ওই দরজাটা খুলবেন না।
কেন?
ওখানে বিষাক্ত সাপের উপদ্রব, তা ছাড়া ঘাটে নামাও যাবে না।
দেখেছি। বলে কর্নেল দরজার আগড়টা হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেললেন। কিন্তু কপাট ঠেলে সরানো গেল না। উঁকি মেরে দেখলাম, ওপাশে ঘন ঝোঁপ গজিয়ে বাইরের দিকটাও দুর্ভেদ্য করে রেখেছে। এদিকে কপাটের তলার দিক মাটিতে কয়েক ইঞ্চি চাপা পড়েছে।
কর্নেলও উঁকি মেরে দেখে আগড়টা আটকে দিলেন। সুদেষ্ণা বলল, কর্নেল! রাজেনবাবু সম্পর্কে আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।
বেশ তো! বলো।
সুদেষ্ণা আবার চারদিকটা দেখে নিয়ে চাপাস্বরে বলল, গত মার্চে ছোটমামার সঙ্গে কান্দ্রা এসেছিলাম। একদিন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে রেললাইনের ধারে গেছি, হঠাৎ দেখি রাজেনবাবু ওপাশের রাস্তা ধরে হন্তদন্ত এগিয়ে আসছেন। ভাবলাম, এই রে! পাগলের পাল্লায় পড়ে এবার কান ঝালাপালা হবে। তক্ষুণি আমি ঘুরে হাঁটতে শুরু করেছি, যেন এঁকে দেখিনি। কিন্তু উনি দৌড়ে এসে আমার কাঁধ খামচে ধরলেন। খাপ্পা হয়ে ওঁকে থ্রেট করলাম। তখন কঁধ ছেড়ে দিয়ে উনি পাগলাটে হাসি হেসে বললেন, তোমার ছোটমামাকে বোলো তোমার বড়মামার সঙ্গে মাঝে মাঝে আমার দেখাসাক্ষাৎ হয়। সময় হলেই তোমার বড়মামা শত্রুকে ঢিট করে ফিরে আসবেন। জিজ্ঞেস করলাম, কে বড়মামার শত্রু? রাজেনবাবু বললেন, তা বলব না। নাম বললেই আমাকে সে মেরে ফেলবে। আর তো আমি জজ নই যে শয়তানটাকে জেলে পুরব বা ফাঁসিকাঠে ঝোলাব।
কর্নেল সুদেষ্ণার কথাগুলো মন দিয়ে শুনছেন বলে মনে হলো না। উনি বললেন, রাম সিং বা তার পালোয়ান ভাই যদি পাঁচিল টপকে গিয়ে এই দরজার ওপাশের ঝোঁপগুলো না কাটতে চায়, অগত্যা আমাকেই হাত লাগাতে হবে।
সুদেষ্ণা অবাক হয়ে বলল, সত্যি বলছি কর্নেল, ঘাটে বিষাক্ত সাপ আছে। দুটোই নাকি কেউটে। ছোটমামা স্বচক্ষে দেখেছিলেন। রাম সিং লাঠি নিয়ে আসার আগেই সাপ দুটো লুকিয়ে পড়েছিল।
কর্নেল হাসলেন। আমি রিটায়ার্ড সামরিক লোক। বনে জঙ্গলে গেরিলাযুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে। বিষাক্ত সাপের পাল্লায় বহুবার পড়েছি। তা ছাড়া সাপ বিষয়েও আমার মোটামুটি অভিজ্ঞতা আছে।
কথা বলতে বলতে আমরা সেই বারান্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কর্নেল বাড়ির পশ্চিম দিকটা দেখিয়ে সুদেষ্ণাকে জিজ্ঞেস করলেন, ওটা কি তোমাদের ঠাকুরঘর নাকি?
ছিল।
তার মানে, এখন নয়। কেন বলো তো?
সুদেষ্ণা আস্তে বলল, ছোটমামিমা মৃত্যুর আগে স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন, ওই মন্দিরের বিগ্রহ কলকাতার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মন্দিরটা নাকি অপবিত্র হয়েছে।
কী বিগ্রহ ছিল?
রাধাকৃষ্ণের অষ্টধাতুর বিগ্রহ।
মন্দির অপবিত্র হওয়ার কারণ কী, তুমি জানো?
শুনেছিলাম, সেবায়েত ভদ্রলোক নাকি মদ-টদ খেতেন। মাতাল অবস্থায় রাধাকৃষ্ণকে মাংস খাওয়ানোর চেষ্টা করতেন। তাকে অবশ্য মারধর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ছোটমামিমা মারা যাওয়ার আগেই মন্দিরে তালা আটকে দেওয়া হয়েছিল। আমার দুই মামাই কিন্তু ধর্মকর্মের ধার ধারতেন না। ইদানীং ছোটমামার ধর্মে একটু মতি হয়েছে। এখানে আসার পর বলছিলেন, মন্দিরটা ভেঙে নতুন একটা মন্দির তৈরি করবেন। আবার রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করবেন।
দোতলার একটা ঘরের জানালা থেকে বনশ্রী ডাকল, তিতি! এই তিতি!
সুদেষ্ণা মুখ তুলে বলল, বলো?
বাহ্। তুমি দিব্যি রহস্য নিয়ে মেতে আছ। এদিকে আমি হিমশিম খাচ্ছি শিগগির এস।
সুদেষ্ণা হাসল। বনিবউদি অকম্মার ধাড়ি। মাত্র কয়েকজন লোকের ব্রেকফাস্ট। তাতেই কুপোকাত।
সে হাসতে হাসতে চলে গেল। আমরা ঘরে ঢুকলাম। কর্নেল তার বিছানায়। বসে স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে মৃদুস্বরে বললেন, ঘাটের ঝোঁপগুলো পরিষ্কার করতেই হবে। সেনসায়েব কী বলেন দেখা যাক।
জিজ্ঞেস করলাম, ঘাটে এমন কী আছে যে এত ঝুঁকি নিতে চাইছেন?
কর্নেল একটু হেসে নিভে-যাওয়া চুরুটটি ধরালেন। তারপর ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, অন্য কোনও মানুষ যদি কেউটে সাপকে ভয় না পায়, আমিই বা পাব কেন?
অবাক হয়ে বললাম, অন্য কোনও মানুষ? তার মানে, ওখানে কাউকে দেখেছেন?
মুখটি বুজে থাকো। তিতি তোমার ফ্যান। তার প্রতি তোমারও আকর্ষণ স্বাভাবিক।
ভ্যাট! আপনি এ বয়সেও সবসময় রসে টইটম্বুর। তিতি আসলে আপনারই ফ্যান।
কর্নেল হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, অনেকদূর থেকে বাইনোকুলারে দেখা! তাহলেও আমি লোকটাকে ঘাটে ঝোপের মধ্যে বসে থাকতে দেখেছি। কিন্তু সাবধান! মুখ বুজে থাকবে।
ভেতরের দরজার কড়া নাড়ছিল কেউ। দরজা খুলে দেখি, বনশ্রী এবং সুদেষ্ণা আমাদের জন্য ব্রেকফাস্ট নিয়ে এসেছে।
.
০৪.
ঘাটের জঙ্গল পরিষ্কারের প্রস্তাবে কর্নেল সেনসায়েবকে রাজি করাতে পারলেন না। তার বক্তব্য, এতে চোরের খুব সুবিধে হবে। পালানোর জন্য কষ্ট করে, পাঁচিল ডিঙোতে হবে না। তা ছাড়া তিনি যখন থাকবেন না, তখন রাম সিংয়ের বউ ছেলেমেয়েরা লেকের দূষিত জলে স্নান করে অসুখ বাধাবে। দেহাতি মানুষজনের যা স্বভাব! ঘাটের দরজা খুলে স্নান করছে, সেই সুযোগে চোরও ঢুকে পড়তে পারে। আর বিষাক্ত সাপের ব্যাপারটা তো আছেই। সেইজন্য ঘাটের দরজার কপাটের তলায় মাটি ফেলে জ্যাম করে দেওয়া হয়েছে।
অগত্যা কর্নেল আর তাকে পীড়াপীড়ি করলেন না। সেনসায়েব তার দুই বন্ধু সুশীল ভরদ্বাজ এবং রমেশ সিনহার জন্য উদ্বিগ্ন। তন্ময় এবং সৌমিত্রকে গাড়ি নিয়ে লাখানপুরে তাদের খোঁজ নিতে পাঠালেন।
কর্নেল সেনসায়েবকে বললেন, আমি আর জয়ন্ত একটু বেরোচ্ছি। বারোটা সাড়ে বারোটার মধ্যে ফিরব। কান্দ্রা রিসর্ট এরিয়াটা এখনও দেখা হয়নি। সেক্রেটারি বার্ড আমার সকাল নষ্ট করে দিয়েছে।
সেনসায়েব হাসতে হাসতে বললেন, পাখির ছবি পরে তুলবেন কর্নেল সরকার! আগে এই চোর-রহস্যটা কিনারা করে দিন।
দেখা যাক। বলে কর্নেল পা বাড়ালেন।
গেট খুলে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম, একজন তাগড়াই চেহারার ষণ্ডামার্কা লোক এসে গেট ভেতর থেকে আটকে দিল। বললাম, কর্নেল! ওই সেই হরি সিং। ওকে পালোয়ান বলছিল সুদেষ্ণা। একটুও বাড়িয়ে বলেনি।
কর্নেল কোনও মন্তব্য করলেন না। তাঁর মুখ বেজায় গম্ভীর। আমরা সংকীর্ণ পিচরাস্তায় পুবদিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম। বাঁ দিকে খাদ ও পাথুরে রুক্ষমাটির– ওধারে রেললাইন। ডান দিকে উঁচু জমির ওপর ইতস্তত একটা করে সুদৃশ্য আধুনিক স্থাপত্যের নিদর্শন রঙ-বেরঙের বাড়ি। মাঝে-মাঝে পোড়ো ঝোঁপ জঙ্গলে ঢাকা জমি। কোথাও বাড়ির ভিত উঠেছে। লোহালক্কড়, বালি আর পাথরকুচির স্কুপ চোখে পড়ছিল। কিন্তু কোথাও কোনও মানুষ নেই।
প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটার পর দেখলাম বস্তাটা অন্য একটা চওড়া রাস্তার সঙ্গে মিশেছে। সেখানে একটা বাজার এবং চওড়া রাস্তার ওধারে নিচু জমিতে সরকারি কোয়ার্টার সারবন্দি দাঁড়িয়ে আছে। বাজারে তত কিছু ভিড় নেই। বাসস্ট্যান্ডে একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে। বাজারটাও বেশ কেতাদুরস্ত। কয়েকটা ঝকঝকে চেহারার গাড়ি পার্ক করা আছে। বললাম, একেবারে পশ এরিয়া। আপনি এখানে চুরুট কেনার জন্য যদি এসে থাকেন, দাম শুনে হয়তো দুঃখ পাবেন।
কর্নেলের মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটল। বললেন, না জয়ন্ত! চুরুটের যা স্টক আছে, তাতে অন্তত এখনও দুটো দিন চলে যাবে। আমার উদ্দেশ্য ছিল লাখানপুর জংশনে যাওয়ার বাসরুট দেখা। ওই দেখ, বাসটা লাখানপুর হয়ে ধানবাদ যাবে। তুমি এখানে অপেক্ষা করো। আমি বাসের খবরাখবর জেনে আসি।
একটা বটগাছের ছায়ায় দাঁড়ালাম। কর্নেল একটু পরে ফিরে এসে বললেন, লাখানপুর এখান থেকে প্রায় ছ কিলোমিটার। কারণ পাহাড়ি রাস্তা ঘুরে ঘুরে এগিয়ে গেছে। রেললাইন গেছে সিধে নাক বরাবর। সারাদিনে তিন বার বাস যায়। তিন বার আসে।
স্টেশনমাস্টার ভারি অদ্ভুত লোক তো! স্টেশন থেকে মাত্র দু কিলোমিটার দূরে এই বাসরুট আছে, বলেননি।
বলেননি তার কারণ স্পষ্ট। কাল এখানে পৌঁছে আমরা কোনও বাস পেতাম না। লাখানপুরের দিকে শেষ বাস ছেড়ে যায় বেলা তিনটেতে। কাজেই আমাদের এখানে রাত কাটাতে হতো। কিন্তু লক্ষ্য করো, এখানে রাত্রিবাসের জন্য এখনও কোনও হোটেল গড়ে ওঠেনি। ভবিষ্যতে গড়ে উঠতে পারে, যদি কান্দ্রা লেকের জলদূষণ বন্ধ করে শোধনের ব্যবস্থা করা যায়। যাই হোক, চলো, ফেরা যাক।
অদ্ভুত জায়গা! একটা সাইকেল-রিকশা বা একাগাড়ি-টাড়িও নেই!
সে কী! তুমি এইটুকু রাস্তা হেঁটেই নেতিয়ে পড়লে?
বিচ্ছিরি রোদ!
আহা, এমন মিষ্টি রোদকে বিচ্ছিরি বোলো না!
রাস্তার ধারে নির্দিষ্ট দূরত্বে একটা করে নানা জাতের গাছ লাগানো হয়েছে। সেগুলো এখনও তত বেড়ে ওঠেনি। কিছুক্ষণ পরে বললাম, সেনসায়েব ঘাট পরিষ্কার করতে রাজি হলেন না। স্বীকার করছি, ওঁর কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু আপনি ওখানে একটা লোককে দেখতে পেয়েছিলেন। কী ধরনের লোক?
রীতিমতো ভদ্রলোক।
আশ্চর্য! ওখানে উনি কী করছিলেন?
চুপচাপ বসে ছিলেন। তারপর হঠাৎ গুঁড়ি মেরে ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হলেন।
বয়স্ক লোক, না–
কর্নেল হাসলেন। চেপে যাও! এবার রোদ তোমার কাছে মিষ্টি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে। ওই দেখ, সুদেষ্ণা এসে দাঁড়িয়ে আছে।
কিছু দূরে একটা নিচু গাছের পাশে সুদেষ্ণাকে দেখতে পেলাম। বললাম, কারও জন্য অপেক্ষা করছে যেন।
দেখা যাক। বলে কর্নেল বাইনোকুলারে তাকে একবার দেখে নিলেন।
আমরা কাছে পৌঁছলে সুদেষ্ণা একটু হাসল। দোতলা থেকে দেখছিলাম আপনারা এদিকে কোথাও যাচ্ছেন। একা বেরুনো ছোটমামার বারণ। উনি স্নান করতে গেলেন। তখন বেরিয়ে পড়ার সুযোগ পেলাম।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, স্নান করতে গেলেন? বাইরে কোথাও?
হ্যাঁ। উনি রুহা প্রপাতের নিচে স্নান করতে যান। শর্টকাটে তত কিছু দূর নয়।
তা তোমার হাতে নতুন কোনও ক্লু এসেছে বুঝি? ঝটপট বলে ফেলো।
আপনাকে রাজেনবাবুর বাড়িটা চিনিয়ে দেওয়া উচিত। সেই ভেবে চলে এলাম। আমি কি আপনার মতো ডিসরি! আমার কি আপনার মতো চোখ। আছে যে কোনও ক্লু খুঁজে পাব?
কর্নেল তার অট্টহাসিটা হাসলেন। অমনি আমাদের বাঁ পাশের ঝোপে-ঢাকা পোড়োজমি থেকে কে বলে উঠল, সাইলেন্স! সাইলেন্স!
তারপর ঢিলে প্যান্টশার্টপরা এক রোগাটে চেহারার বৃদ্ধকে ঝোপের ভেতর থেকে উঠে দাঁড়াতে দেখলাম। সুদেষ্ণা বলে উঠল, এই রে! সেরেছে! জজসাহেব আমাকে দেখলে এক্ষুণি জেলে ভরবেন।
সে রাজেনবাবুকে দেখতে পায়নি এমন ভঙ্গিতে হনহন করে হাঁটতে থাকল। রাজেনবাবুর দৃষ্টি কর্নেলের দিকে। কর্নেল মাথার টুপি খুলে বিলিতি কেতায় অভিবাদন করে ইংরেজিতে বললেন, এই যে মিঃ দ্বিবেদী! আমি আপনার বাড়ি খুঁজে ক্লান্ত।
রাজেন দ্বিবেদী নেমে এসে আমার দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, ইনি কে?
আমার তরুণ বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরী। ও একজন সাংবাদিক।
রাজেনবাবু চাপা গলায় আমাকে বললেন, আপনাকে কিছু গোপন তথ্য দেব। খবরের কাগজে ফাঁস করে দেবেন।
কর্নেল বললেন, আপনি ওখানে কী করছিলেন?
আপনি বিকট হেসে সব ভেস্তে দিলেন। আপনার নামটা কী যেন?
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আপনার পকেটে আমার নেমকার্ডটা এখনও থাকা উচিত।
রাজেনবাবু বুকপকেট থেকে কার্ডটা বের করে অদ্ভুত শব্দে হাসলেন। হ্যাঁ। আসলে কোনও একটা দিকে মনঃসংযোগ করলে আমার আর কিছু মনে থাকে না।
আপনি ওখানে কী বিষয়ে মনঃসংযোগ করছিলেন?
রাজেনবাবু ফিসফিস করে বললেন, আমার বন্ধু ডঃ বি কে সেনের প্রেতাত্মাকে ডাকছিলাম। বড্ড ভীতু। বুঝলেন? সকালে পার্বতীর মন্দিরে দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ দেখি, শয়তান নরেশ ভার্মা নিচের দিক থেকে উঠে আসছে। অমনি আমি লুকিয়ে পড়লাম। নরেশ একটুখানি দাঁড়িয়ে থাকার পর আবার নেমে গেল। লেকের পশ্চিম পাহাড়ে কোথাও শয়তানটা ডেরা করেছে। আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে। ও হ্যাঁ! আপনি আমাকে সাহায্য করবেন বলছিলেন না?
নিশ্চয় করব। কিন্তু আপনি আমাকে বলেননি কে ওই নরেশ ভার্মা?
দাগী আসামী। গভমেন্টের খনিদফতরে উঁচু পদে চাকরি করত। ইউরেনিয়াম পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল। আমার এজলাসে সেই মামলা উঠেছিল। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলাম। কিন্তু হাইকোর্টে গিয়ে মেয়াদ কমে পাঁচ বছরের জেল হলো। তারপর শয়তানটা জেল থেকে পালিয়ে যায়। সে প্রায় পাঁচ বছর আগের কথা। বলে রাজেনবাবু সাদা চুল আঁকড়ে ধরে কিছুক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
কর্নেল বললেন, তারপর কী হলো মিঃ দ্বিবেদী?
সবটা মনে পড়ছে না। আমি একদিন এজলাস থেকে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম। তারপর কী যেন হয়েছিল।
এখানে বাড়ি করেছেন কতদিন আগে?
বাড়ি কি আমি করেছি? করেছে আমার বড়ছেলে সুরেন্দ্র।
তিনি কি এখন আছেন?
রাজেনবাবু হাসলেন। সুরেন্দ্র থাকে ওড়িশার সম্বলপুরে। সেখানকার ডি এম। মাঝে মাঝে আসে।
তা হলে এখানে আপনি একা থাকেন?
একা কি থাকা যায়? একজন কাজের লোক আছে।
নরেশ ভার্মার কথা বলুন মিঃ দ্বিবেদী!
হ্যাঁ–নরেশ! প্রায় দু বছর আগে এক বিকেলে পার্বতীর মন্দিরে গিয়ে বসে আছি। হঠাৎ দেখি নরেশ চুপিচুপি নিচে থেকে উঠে আসছে। আমি তো হতভম্ব। কে যেন বলেছিল, নরেশ জেল থেকে পালিয়েছে। যেই ওকে বলেছি, তুমি সেই নরেশ ভার্মা না? অমনি সে গা ঢাকা দিল। ফিরে এসে কান্দ্রা পুলিশপোস্টে খবর দিলাম। পুলিশ গ্রাহ্যই করল না। তারপর বেনামী একটা উড়ো চিঠি এল, মুখ বুজে না থাকলে আমি মারা পড়ব। সুরেন্দ্রকে সব জানিয়েছিলাম। সে আমাকে বলল, এ ব্যাপারে আমি যেন আর নাক না গলাই। যা করার সুরেন্দ্রই করবে। কিন্তু করেনি।
রাজেনবাবু করুণমুখে ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লেন। কর্নেল বললেন, সম্ভবত আপনার নিরাপত্তার জন্য আপনার ছেলে এ ব্যাপারে ঘাঁটাঘাঁটি করেনি। আপনি কি এসব কথা আর কাউকে বলেছিলেন?
ডঃ সেনকে বলেছিলাম। তারপর সে হঠাৎ অপঘাতে মারা পড়ল।
অপঘাতে? না হার্ট অ্যাটাকে?
তার প্রেতাত্মা আমাকে বলেছে, অপঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে। রাজেনবাবু চারদিক দেখে নিয়ে আবার ফিসফিস করে বললেন, আপনি মিলিটারির লোক। তাই আপনাকে সব জানিয়ে রাখলাম। আর একটা কথা। ডাক্তার পাণ্ডে ছিলেন সাংঘাতিক লোক। আমি কক্ষণো তার কাছে চিকিৎসা করাইনি। অসুখবিসুখ। হলে সোজা লাখানপুরে চলে যাই। আপনি কোথায় উঠেছেন যেন?
মৃন্ময়ীভবনে। সেনসায়েবের বাড়িতে।
অ্যাঁ? কী সর্বনাশ! তা হলে তো আপনাকে গোপন কথা ফাঁস করা আমার উচিত হয়নি। বড় ভুল করে ফেলেছি। ডাক্তার পাণ্ডের বউ দজ্জাল মহিলা। তা ছাড়া বিধবা হয়েও মুর্গির মাংস খায়। ছ্যা ছা!
বলে রিটায়ার্ড জজসাহেব হনহন করে হাঁটতে থাকলেন। তারপর একটা বাড়ির আড়ালে উধাও হয়ে গেলেন।
বললাম, ভদ্রলোক মানসিক রোগী তা ঠিক। তবে মাঝে মাঝে বেশ সুস্থ হয়ে ওঠেন।
কর্নেল হাঁটতে হাঁটতে বললেন, আমার মনে হচ্ছে, ইদানীং এমন কিছু ঘটছে, যা রাজেনবাবুর ওপর শক থেরাপির কাজ করছে। তার মানে, ঘটনার ধাক্কায় ওঁর স্মৃতিশক্তি মাঝে মাঝে চাঙ্গা হয়ে উঠছে।
ঘটছেটা কী? জলজ্যান্ত নরেশ ভার্মা আর মৃত ডঃ বি কে সেনের প্রেতাত্মার ঘনঘন আবির্ভাব–এই তো?
আরও কিছু ঘটছে হয় তো! রাজেনবাবু যা বুঝিয়ে বলতে পারছেন না সম্ভবত।
মৃন্ময়ীভবনের কাছাকাছি গিয়ে দেখি, সুদেষ্ণা একটা কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে সে বলে উঠল, রাজেনবাবুর পাল্লায় পড়ে খুব নাকাল হয়েছেন, দুজনে, তাই না?
কর্নেল হাসলেন। তা আর বলতে?
কী বলছিলেন উনি?
নরেশ ভার্মা নামে একটা লোকের কথা।
সুদেষ্ণা চমকে উঠল। নরেশ ভার্মা?
নামটা তোমার পরিচিত নাকি?
সুদেষ্ণা ঠোঁট কামড়ে ধরে পা বাড়াল। হাঁটতে হাঁটতে বলল, বড়মামার কাছে তাকে মাঝে মাঝে আসতে দেখেছি। মাইনিং ডিপার্টমেন্টের অফিসার ছিলেন।
তার সম্পর্কে আর কিছু জানো না?
না তো! বলে সুদেষ্ণা থমকে দাঁড়াল। হ্যাঁ। মনে পড়ছে, ছোটমামার কাছে শুনেছিলাম কী একটা খারাপ কাজের জন্য তার নাকি জেল হয়েছে।
গেটের সামনে যেতেই সেই পালোয়ান এসে গেট খুলে দিল। কুকুরটার সাড়া পেলাম না। তাই জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের টম কি ঘুমোচ্ছে নাকি?
সুদেষ্ণা বলল, না। ছোটমামা স্নান করতে গেলে টমকে সঙ্গে নিয়ে যান। হাতে বন্দুকও থাকে। কর্নেল! এখন কফি খাবেন নিশ্চয়?
কর্নেল বললেন, নাহ। প্রায় বারোটা বাজে। জয়ন্ত! তুমি স্নান করে নাও। আজ আমার স্নানের দিন নয়।
সুদেষ্ণা বলল, বাথটাবে জল ভরা আছে। তবে কুয়ো থেকে তোলা জল তো ভীষণ ঠাণ্ডা। আমি ভানুমতাঁকে বলছি এক বালতি জল গরম করে দিয়ে যাবে। জয়ন্তবাবু! একটু অপেক্ষা করুন।
সে ভেতরে চলে গেল। আমি দক্ষিণের বারান্দা দিয়ে ঘরে ঢুকলাম। কিন্তু কর্নেল হনহন করে আবার ঘাটের দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন এবং যথারীতি বাইনোকুলারে কিছু দেখতে থাকলেন। সম্ভবত সেই সেক্রেটারি বার্ড।
দুদিকের দরজা আটকে ঝটপট প্যান্টশার্ট বদলে নিয়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে নিলাম। তারপর ভেতরের দিকের দরজা খুলে দিয়ে বারান্দার দিকের দরজা খুললাম। কিন্তু কর্নেলকে দেখতে পেলাম না। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে চারদিকটা দেখে নিলাম। কোথাও উনি নেই।
অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তারপর ঘাটের দরজা থেকে একটু দূরে পাঁচিলের পুব-দক্ষিণ কোণে কর্নেলের টুপি চোখে পড়ল। উনি পাঁচিল ডিঙিয়ে ভেতরে নামলেন। তারপর পোশাক ঝেড়ে সাফ করার পর হন্তদন্ত এগিয়ে এলেন। বারান্দায় উঠলে জিজ্ঞেস করলাম, পাঁচিল ডিঙিয়ে গিয়ে কী করছিলেন?
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, সেক্রেটারি বার্ড।
ওঃ কর্নেল! আমি বাচ্চা ছেলে নই।
এবার কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, মুখটি বুজে থাকবে কিন্তু! এতক্ষণে একটা ধোঁয়াটে রহস্যের লেজ ধরতে পেরেছি। বাকিটুকু অবশ্য এখনও অস্পষ্ট। তবে না–এসব কথা এখন নয়।
উনি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে টুপি খুললেন। তারপর টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, সুইচ টিপে ফ্যানটা চালিয়ে দাও। আস্তে চলুক।
আসলে ওঁর কাণ্ডকারখানা দেখে এত অবাক হয়েছিলাম যে ফ্যানটা চালিয়ে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। সুইচ টিপে টের পেলাম, এতক্ষণ ঘরে বেশ। গরম ছিল।
কিছুক্ষণ পরে ভেতরের দরজা দিয়ে সুদেষ্ণা আর ভানুমতী এল। ভানুমতীর হাতে গরম জলের বালতি। সে বাথরুমে বালতিটা রেখে ঘোমটায় মুখ আড়াল করে চলে গেল। সুদেষ্ণা বলল, জয়ন্তবাবু! স্নান করে নিন।
কর্নেল হঠাৎ আস্তে ডাকলেন, তিতি!
বলুন!
তোমার বড়মামার শেষকৃত্য কোথায় হয়েছিল?
কেন? এখানেই লেকের পূর্বদিকে শ্মশান আছে। সেখানে।
তুমি তখন উপস্থিত ছিলে?
না। খবর পেয়ে তন্ময়দা এবং সৌমিত্রের সঙ্গে এখানে পরদিন এসেছিলাম। সুদেষ্ণা একটু অবাক হয়েছিল। কর্নেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন এ কথা জানতে চাইছেন?
নিছক কৌতূহল। তো ওঁর মৃত্যুর সময় শুধু তোমার ছোটমামা এখানে ছিলেন?
হ্যাঁ। কাল রাত্তিরে আপনাকে তো ছোটমামা ডিটেলস ঘটনাটা বললেন।
ঠিক আছে। জয়ন্ত! স্নান করে ফেলো।
এই সময় টমের সাড়া পাওয়া গেল। সুদেষ্ণা বলল, ছোটমামা স্নান করে ফিরলেন মনে হচ্ছে।
সেনসায়েব ভেতরের দরজায় উঁকি মেরে বললেন, একটা সাংঘাতিক দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরলাম কর্নেল সরকার। একটা প্রকাণ্ড পাথর পাহাড়ের ওপর থেকে গড়িয়ে এসে আমার কয়েক ইঞ্চি দূর দিয়ে জলে পড়ল। বুঝতে পারলাম না, এটা কেউ আমাকে লক্ষ্য করে ঠেলে ফেলেছে, নাকি দৈবাৎ–এনি ওয়ে! আর আমি রুহা প্রপাতে স্নান করতে যাচ্ছি না। ওঃ! কী সাংঘাতিক ব্যাপার!
.
০৫.
খাওয়ার সময় সেনসায়েব সবিস্তারে ঘটনাটা বর্ণনা করেছিলেন। তাকে খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল। সুদেষ্ণার মতে, পাহাড় থেকে পাথর খসে পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কদিন বেশ জোরালো বৃষ্টি হয়েছে। ধস ছেড়ে রেললাইন যখন চাপা পড়েছে, তখন এমন ঘটনা রুহা প্রপাত এলাকায় ঘটতেই পারে।
সেনসায়েব বলেছিলেন, যাই হোক। আমি আর ওখানে স্নান করতে যাচ্ছি না!
এদিকে তন্ময় ও সৌমিত্র লাখানপুর থেকে এখনও ফিরছে না। সেনসায়েব সেজন্যও উদ্বিগ্ন। তিনি আমাদের বিশ্রাম করতে বলে নিজের ঘরে চলে গিয়েছিলেন। সুদেষ্ণা ও বনশ্রী তখনও খায়নি। তারা তন্ময়দের জন্য আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে চায়। বেলা দেড়টা বাজে। কর্নেল ও আমি নিজেদের ঘরে ফিরে ভেতরের দরজা আটকে দিলাম। আমার ভাত-ঘুমের অভ্যাস। বিছানায় গড়িয়ে পড়লাম। কর্নেল চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চুরুট ধরালেন, এবং অভ্যাসমতো চোখ বুজে ধ্যান হলেন।
সবে আমার চোখের পাতায় ঘুমের টান লেগেছে, কর্নেল ডাকলেন, জয়ন্ত!
ঘুমের রেশ ছিঁড়ে গেল। বিরক্ত হয়ে বললাম, বলুন না। শুনতে পাচ্ছি।
উঠে পড়ো!
কেন?
এখনই বেরুতে হবে।
বেশ তো! বেরিয়ে পড়ুন।
তুমিও বেরুবে।
কী বিপদ।
হ্যাঁ। বিপদের সম্ভাবনা তো আছেই। সেইজন্য তোমাকে সঙ্গে নিতে চাই। ওঠ। কুইক!
অগত্যা উঠতে হলো। বললাম, তার মানে, আমি আপনার বডিগার্ড হয়ে থাকব?
কর্নেল হাসলেন। কতকটা তা-ই। যাই হোক, ঝটপট পোশাক বদলে ফেলো। বলে উনি কিটব্যাগ পিঠের দিকে আটকে নিলেন। বাইনোকুলার এবং ক্যামেরা বুকের ওপর ঝুলিয়ে দিলেন। তারপর বারান্দায় গেলেন।
পোশাক বদলে বেরিয়ে পড়লাম। বারান্দার দিকের দরজাটা ভেজিয়ে দিলাম। পোর্টিকোর সামনে দিয়ে ঘুরে উত্তরে গেটের কাছে যেতেই সেই পালোয়ান এসে সেলাম ঠুকল। তারপর গেটের তালা খুলে দিল।
রাস্তায় গিয়ে বললাম, সেনসায়েব হঠাৎ যেন বড্ড বেশি সতর্ক হয়ে উঠেছেন।
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু নিজের সম্পর্কে সতর্ক হওয়ার চেয়ে এই বাড়ি সম্পর্কে উনি বেশি সতর্ক। বারান্দা থেকে দেখছিলাম, রাম সিং যেন পাহারা দেওয়ার ভঙ্গিতে দক্ষিণের পাঁচিলের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সেনসায়েব প্রপাত থেকে স্নান করে ফেরার পর এই সতর্কতা। এমন হতে পারে, প্রপাতে স্নান করার পর পাথর খসে পড়া ছাড়াও আর কিছু ঘটেছে। কিন্তু উনি তা বলতে চান না।
আমরা এখন যাচ্ছি কোথায়?
রুহা প্রপাতে।
সে কী!
তোমাকে বিপদের সম্ভাবনার কথা বলেছি। কাজেই সবসময় তৈরি থাকবে।
কীভাবে তৈরি থাকব? এবার তো আমি সঙ্গে আমার ফায়ার-আর্মস আনিনি।
ফায়ার-আর্মস দিয়ে সব সময় বিপদ ঠেকানো যায় না। মোট কথা, চোখ কান খোলা রাখবে। ব্যস!
যে রাস্তা দিয়ে গতকাল আমরা স্টেশন থেকে এসেছিলাম, সেই রাস্তায় কিছুটা এগিয়ে কর্নেল একটু দাঁড়ালেন। রাস্তাটা এখানে ডান দিকে ঘুরে রেললাইন পেরিয়ে চলে গেছে। দূরে রুহা স্টেশন চোখে পড়ল। কর্নেল বাইনোকুলারে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে জঙ্গলে ভরা একটা টিলা দেখতে দেখতে বললেন, একটা পায়ে চলা পথ দেখতে পাচ্ছি। সেনসায়েব নিশ্চয় এই পথেই প্রপাতে স্নান করতে যান। কারণ এটা ছাড়া আর কোনও পথ নেই।
আপনি লেকের ধারে সেক্রেটারি বার্ড দেখতে গিয়েছিলেন কোন পথে?
বাইনোকুলার নামিয়ে কর্নেল একটু হেসে বললেন, আমার পথ আমিই তৈরি করে নিই। চলে এস!
এ ধরনের পথে কর্নেলের সঙ্গে হাঁটাচলার অভ্যাস আছে। চড়াই-উতরাই ক্রমাগত। তবে পথটা নাক বরাবর এগিয়েছে। দুধারে ন্যাড়া পাথর। তার ফাঁকে ঝোপঝাড়। কর্নেল বিপদ কথাটা বলায় অস্বস্তি নিয়ে হাঁটছিলাম। মিনিট দশেক পরে মোটামুটি সমতল একটা জমিতে পথটা দুভাগ হয়েছে। কর্নেল সেখানে দাঁড়িয়ে বললেন, বাঁ দিকের পথটা গেছে লেকের পশ্চিম পাহাড়ে পার্বতীর মন্দিরে। ডান দিকেরটা রুহা জলপ্রপাতের দিকে।
ডান দিকে আরও মিনিট দশেক হাঁটার পর জলের শব্দ কানে এল। তারপর কিন্তু প্রপাতটা দেখে হতাশ হলাম। বড়জোর ফুট পঞ্চাশেক ওপর থেকে সংকীর্ণ একটা ধারা নিচে গড়িয়ে পড়ছে। সেখানে খানিকটা জায়গায় পাথরের খাদে স্বচ্ছ জল জমে আছে। দেখতে একটা ডোবার মতো। রুহা নদী পাহাড়ের ফাটল দিয়ে এগিয়ে চলা ক্ষীণ একটা জলধারা মাত্র।
কর্নেল বাইনোকুলারে চারদিক খুঁটিয়ে দেখে বললেন, কোন পাহাড় থেকে পাথর খসে পড়েছিল, বোঝা যাচ্ছে না। এই পাহাড়টা থেকে খসে পড়লে পাথরটার জলে পড়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সেনসায়েব বলছিলেন, ওটা জলে পড়েছিল। এক মিনিট।
কর্নেল ডোবার কিনারা দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। তারপর ঝুঁকে কিছু দেখতে থাকলেন। জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার?
খসে-পড়া পাথরটা এখানে আটকে আছে।
কাছে গিয়ে দেখি, জলের ভেতর থেকে মাথাতোলা দুটো প্রকাণ্ড পাথরের মাঝখানে একটা পাথর আটকে আছে। সেটার একপিঠে লালচে মাটির চাবড়া আর কিছু ঘাস দেখা যাচ্ছে। কর্নেল ঘুরে ওপরের দিকটা দেখে নিয়ে বললেন, সেনসায়েব স্নান করার আগে বা পরে এদিকে কেন এসেছিলেন, এটাই প্রশ্ন। হুঁ, এখানে তিনটে সিগারেটের ফিল্টারটিপ পড়ে আছে দেখছি। কেউ তার জন্য এখানে অপেক্ষা করছিল কি? সেনসায়েবকে সিগারেট খেতে তো দেখিনি।
বলে কর্নেল ফিল্টারটিপগুলো কুড়িয়ে জ্যাকেটের ভেতর চালান করলেন। তারপর বললেন, আর এখানে নয়। নিরাপদ জায়গায় চলো।
যে পথে এসেছিলাম, সেই পথে কিছুটা গিয়ে উনি দাঁড়ালেন! এতক্ষণে লক্ষ্য করলাম, ডোবা থেকে আন্দাজ তিরিশ ফুট দূরে যে পাহাড়টা ঢালু হয়ে নেমেছে, তার আগাপাছতলা ছোট-বড় নানা আয়তনের পাথর মাথা উঁচু করে আছে।
কর্নেল বাইনোকুলারে দেখে নিয়ে বললেন, ওই পাথরগুলো দৈবাৎ খসে পড়ার সম্ভাবনা অস্বীকার করছি না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কে ওখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল?
বললাম, যেই খাক, সে-ও সেনসায়েবের মতো প্রাণে বেঁচে গেছে।
কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, হ্যাঁ, সে না বেঁচে গেলে সেনসায়েব–
হঠাৎ উনি থেমে গিয়ে আবার বাইনোকুলারে সেই ঢালু পাহাড়টা দেখে নিলেন। তারপর ডান দিকে ঘুরে ঝোঁপ-জঙ্গলে ঢুকে পড়লেন। বললাম, ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন?
চুপচাপ আমার পেছন-পেছন এস। চোখ-কান খোলা রাখবে।
আবার অস্বস্তি ফিরে এল। সেই পাহাড়ের উত্তর অংশ এটা। কিন্তু অনেক বেশি ঢালু। কোথাও ঘাস গজিয়ে আছে। কোথাও ঝোপঝাড়। আবার কোথাও রুক্ষ লালচে নগ্ন মাটি। কর্নেল মাঝে মাঝে থেমে বাইনোকুলারে ওপর দিকটা দেখছিলেন। আবার সাবধানে পা ফেলছিলেন। বারবার আমাকে ইশারায় সতর্ক করে দিচ্ছিলেন।
প্রায় আধঘণ্টা পরে পাহাড়টার মাথায় পৌঁছুলাম। সেখানে ঘন জঙ্গল। কিছুক্ষণ বসে জিরিয়ে নেওয়ার পর কর্নেল জঙ্গল সরিয়ে উঁকি দিলেন। তারপর আস্তে বললেন, হু। যা ভেবেছিলাম!
কী?
মৃন্ময়ীভবন।
অবাক হয়ে উঁকি মেরে দেখি, পাহাড়ের ওপাশে একই রকম ঢাল এবং পুরোটাই জঙ্গলে ঢাকা। তার নিচে মৃন্ময়ীভবনের পেছনের দিকটা দেখা যাচ্ছে। এদিকের পাঁচিল উঁচু। তবে তার চেয়ে চোখে পড়ার মতো দৃশ্য সেই বিগ্রহহীন শূন্য মন্দিরের পেছনের দেয়ালে দুদিক থেকে পাঁচিল এসে মিশেছে এবং মন্দিরের পেছনে একটা ছোট্ট দরজা। দরজাটা অবশ্য বন্ধ।
বললাম, মৃন্ময়ীভবন এত কাছে!
কাছে তো বটেই। মন্দিরের পেছনের দরজা দিয়ে সোজা এখানে ওঠা যায়। তারপর দক্ষিণে কিছুদূর এগিয়ে গেলে পাহাড়টার সেই বিপজ্জ অংশে পৌঁছনো যায়।
কিন্তু পার্বতীর মন্দিরে যাওয়ার পথটা কোথায়?
তোমাকে চোখ-কান খোলা রাখতে বলেছিলাম। রাখোনি। তা হলে দেখতে পেতে, মন্দিরের পথটা আমরা নিচে ফেলে এসেছি। নেহাত পায়ে চলা পথ। তা ছাড়া ওই পথে লোকচলাচল খুবই কম। কারণ পার্বতীর মন্দির কবে ভেঙেচুরে গেছে। যাই হোক, পার্বতীর মন্দিরে আমাদের যাওয়ার দরকার দেখছি না। চলো। এবার ফেরা যাক। কিন্তু সাবধান!
যেদিক থেকে উঠেছিলাম, সেদিকে নামবার সময় কর্নেল আমাকে পার্বতীর। মন্দিরে যাওয়ার পথটা দেখিয়ে দিলেন। পথটা সহজে চোখে পড়ে না এখানে। দুধারে ঘন ঝোপঝাড় ঝুঁকে আছে এবং কোথাও কোথাও উঁচু ঘাসের তলায় চাপা পড়েছে।
প্রপাতের কাছাকাছি নেমে এসে কর্নেল বললেন, আদিবাসীরা এখন জলপ্রপাতে আর যাতায়াত করে না মনে হচ্ছে। অথচ রুহা গ্রাম এখান থেকে তত বেশি দূরে নয়।
কীভাবে বুঝলেন?
পথের অবস্থা লক্ষ্য করলে তুমিও বুঝতে পারবে। তা ছাড়া এখনও কোনও আদিবাসী বালককেও দেখতে পাচ্ছি না। আদিবাসী বালকদের অ্যাডভেঞ্চারের প্রবণতা জন্মগত। ওরা যেখানে জন্ম নেয়, তার চারদিকটা তন্নতন্ন করে চিনেজেনে রাখা ওদের স্বভাব।
এলাকার খ্রিস্টান মিশনারিরা ওদের স্বভাব বদলে দিয়েছেন।
কর্নেল হাসলেন। স্বভাব বদলে দিতে পেরেছেন কি না, তা জানার জন্য রুহা গ্রামে যাওয়া দরকার।
সত্যি যাবেন নাকি?
আমরা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিলাম। কর্নেল দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন, ওই দেখ! রুহা গ্রাম থেকে প্রপাতে আসার পথটা কাঁটাঝোপ দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। যাওয়ার সময় ভেবেছিলাম, কোনও আদিবাসী ফসলের জমিতে বেড়া দেওয়ার জন্য কাঁটাঝোপ কেটে রেখেছে। সময়মতো নিয়ে যাবে। কিন্তু এখন দেখছি, কাঁটাঝোপগুলো মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছে।
দেখে নিয়ে বললাম, সত্যি তো। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত মনে হচ্ছে। চলো।
রুহা গ্রামে গিয়ে কারণটা জেনে আসি। এখনও যথেষ্ট বেলা আছে।
কিন্তু যাবেন কোন পথে?
রেললাইন ধরে হেঁটে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
কিন্তু কেন আদিবাসীরা প্রপাতের দিকে যেতে চায় না, সেটা জানা কি এতই জরুরী?
জরুরী ডার্লিং! কারণটা আমাকে জানতেই হবে। বলে কর্নেল আমার কাঁধে হাত রাখলেন।
অতএব লক্ষ্মী ছেলের মতো ওঁকে অনুসরণ করলাম। রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনে পৌঁছে দেখি, স্টেশন তেমনই জনহীন। রেল-সিন্দুকের ওপর কাল যে রেলকর্মীকে শুয়ে থাকতে দেখেছিলাম, সে এখন পা ঝুলিয়ে বসে খৈনি ডলছে। আমাদের দেখে সে ভাঙা-ভাঙা হিন্দিতে বলল, এখনও। ট্রেন চালু হয়নি সার!
কর্নেল আস্তে আমাকে বললেন, লোকটি আদিবাসী। এর সঙ্গে কথা বলে দেখা যাক। বলে তার পাশে গিয়ে বসে পড়লেন। তারপর হিন্দিতে বাক্যালাপ। শুরু করলেন। তোমার বাড়ি কোথায়?
সাসানডি।
সেটা কোথায়?
বুরুডির জঙ্গলে যাওয়ার পথে। এখান থেকে বেশি দূরে নয়।
তোমার বউ-কাচ্চাবাচ্চা সাসানডিতে থাকে?
সে হাসল। না সার! রুহায় আমার শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুর আমাকে সেখানেই ঘর বানিয়ে দিয়েছে।
তা হলে তো তুমি রুহার লোক হয়ে গেছ।
হা সার।
তোমার গলায় ক্রুশ ঝুলছে। তুমি কি খ্রিস্টান?
সে মাথা নেড়ে খুশি খুশি মুখে বলল, রুহায় গির্জা আছে সার। আমরা যারা খ্রিস্টান, তারা থাকি আলাদা পাড়ায়। আমার ছেলেমেয়েরা ফাদার যোশেফের স্কুলে লেখাপড়া করে। ফাদার যোশেফ অসুখ-বিসুখে আমাদের চিকিৎসা করেন।
বলে সে বুকে কপালে ক্রশ আঁকল। কর্নেল বললেন, রুহা গ্রামের কাছে একটা নদী আছে শুনেছি।
আছে। তবে শীতের সময় নদীতে জল থাকে না।
তখন জল কোথায় পাও?
কেন? গির্জার সামনে ইঁদারা আছে।
যারা খ্রিস্টান নয়, তারা জল কোথায় পায়?
সরকার তাদের জন্য টিউবেল বসিয়েছেন। আমাদের পাড়াতেও শিগগির টিউবেল বসবে। কারণ খরার সময় ইঁদারার জল কমে যায়।
কেন? রুহা নদীর ফলস–ফলস্ বোঝো তো?
লোকটির মধ্যে আদিবাসীসুলভ সরলতা লক্ষ্য করলাম। সে হাসতে হাসতে বলল, আমি সময় পেলেই ফাদার যোশেফের কাছে ইংলিশ পড়ি। আর স্টেশনমাস্টার গোমসসায়েবও আমাকে সাহায্য করেন।
রুহা ফলসের নিচের খাদে সারা বছর জল জমে থাকে শুনলাম। সেখানে রুহার লোকেরা খাঁটি জল পেতে পারে। তত দূরে তো নয়!
লোকটির মুখের ভাব বদলে গেল। ঝটপট বুকে-কপালে ক্রশচিহ্ন এঁকে বলল, কিছুদিন আগে ওখানে একটা ভয়ঙ্কর চেহারার জানোয়ার দেখা গেছে। জানোয়ারটা মানুষের মতো দুপায়ে হাঁটে। ফাদার যোশেফ নাকি নিজেও দেখেছেন। তাই ফলসে যাওয়ার রাস্তা কাটা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।
ফাদার যোশেফের সঙ্গে এখন দেখা হবে?
না সার। উনি কয়েক দিনের জন্য বাইরে গেছেন। কত জায়গায় উনি ঘুরে বেড়ান।
মোটরগাড়ি আছে ওঁর?
মোটরগাড়ির কী দরকার? ওঁর সাইকেলই যথেষ্ট।
তো সেই ভয়ঙ্কর জানোয়ার সম্পর্কে ফাদারের ধারণা কী জানেনা? উনি তোমাদের বলেননি কিছু?
আদিবাসী রেলকর্মী গম্ভীর মুখে বলল, কোনও আজব জানোয়ারই হবে। খনি এলাকায় অনেক পুরনো পোডড়া খনি আছে, তার মধ্যে জানোয়ারটার ডেরা। মাঝে মাঝে জল খেতে আসে রুহা ফসে।
এতক্ষণে স্টেশনমাস্টারকে প্ল্যাটফর্মের শেষ দিক থেকে আসতে দেখা গেল। ওঁকে দেখে কর্নেল সম্ভাষণ করলেন, গুড ইভনিং মিঃ গোমস্!
স্টেশনমাস্টার তেমনই নির্বিকার মুখে বললেন, ট্রেনের আশা করবেন না। আপনারা কান্দ্রায় বাস পেতে পারতেন।
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। বাসেই ফিরব। সৌভাগ্যক্রমে কান্দ্রা রিসর্টে আমার এক বন্ধুর বাড়ি খুঁজে পেয়েছি। সেখানেই আছি, তো একটু বেড়াতে বেরিয়েছি।
স্টেশনমাস্টার স্টেশনঘরে ঢুকে গেলেন। আদিবাসী রেলকর্মী খৈনি মুখে। দিয়ে চোখ টিপে হাসল। তারপর আমরা যখন হাঁটতে শুরু করেছি, সে আমাদের পিছু নিল এবং কাছে এসে চাপাস্বরে বলল, গোমসসায়েবের বউ পালিয়ে গেছে। তাই ওঁর মনমেজাজ খারাপ। পালাবে না, কেন বলুন সার? টাউনের মেয়ে। এমন জায়গায় মন টেকে? মাস্টারসায়েবকে বলেছিলাম, ফাদারকে ধরুন। আমাদের গ্রামের স্কুলে ইংলিশের টিচার করে দেবেন মেম-সায়েবকে। কিন্তু গোমসায়েব নিজেও তো এখানে থাকতে চান না।
কান্দ্রা রিসর্ট এলাকায় পৌঁছে কর্নেল বললেন, তা হলে বোঝা যাচ্ছে, গত রাতে তন্ময় এবং সৌমিত্র সেই আজব জন্তুটিকেই দেখেছিল।
আদিবাসীদের অনেক অদ্ভুত কুসংস্কার থাকে। ফাদার যোশেফের সেই জন্তুদর্শন চোখের ভুল হতেই পারে। তন্ময় এবং সৌমিত্রেরও ওটা চোখের ভুল।
অদ্ভুত কুসংস্কার অনেক শিক্ষিত মানুষেরও থাকে। এমনকি বিজ্ঞানীদেরও। যাই হোক, তোমাকে আবার বলছি, মুখটি বুজে থাকবে। আমরা গিয়েছিলাম সেক্রেটারি বার্ডের খোঁজে। বুঝলে তো?
বুঝলাম।
.
০৬.
মৃন্ময়ীভবনের গেটের সামনেই সেই পালোয়ান দাঁড়িয়ে ছিল। আমাদের দেখতে পেয়ে সেলাম ঠুকে গেট খুলে দিল। অ্যালসেশিয়ান কুকুরটার গর্জন শুনতে পেলাম না। লক্ষ্য করলাম, পুবের লনে কালকের মতো বেতের টেবিল-চেয়ার পাতা আছে। বনশ্রী, সুদেষ্ণা, তন্ময় ও সৌমিত্র বসে উত্তেজিতভাবে কিছু আলোচনা করছে।
কর্নেল বললেন, সেনসায়েব কি বেরিয়েছেন?
হরি সিং বলল, হ্যাঁ সার। কলকাতা থেকে তাঁর দুজন বন্ধু এসেছেন। তাদের নিয়ে কোথায় বেরিয়েছেন।
আচ্ছা হরি সিং, তুমি তো মাঝে মাঝে এ বাড়িতে এসে থাকো?
থাকি সার! দাদা যখন আমাদের গ্রামের বাড়িতে যায়, তখন আমাকে একা এ বাড়ি পাহারা দিতে হয়।
এবার বুঝি দাদার কাছে বেড়াতে এসেছ?
না সার! ছোটসায়েব খবর পাঠিয়েছিলেন, এখানে নাকি চোরের উৎপাত হচ্ছে। তাই আমি এসেছি। হরি সিং হাসল। রামজির কৃপায় চোর-ডাকাত আমার সাড়া পেলেই ভেগে যায়, সার।
আমাদের দেখে সুদেষ্ণা এগিয়ে আসছিল। কাছে এসে সে বলল, কর্নেল শুধু পাখি-প্রজাপতির পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এদিকে এক সাংঘাতিক কাণ্ড! চলুন, বলছি।
পোর্টিকোর সামনে গিয়ে সে চাপাস্বরে বলল, বিকেলে রাম সিং সাইকেলে চেপে বাজারে গিয়েছিল। সেখানে একটা লোক তার হাতে একটা চিঠি দিয়ে বলে, তোমার সায়েবকে দিও। সাংঘাতিক চিঠি। ছোটমামাকে কে হুমকি দিয়ে ইংরেজিতে লিখেছে, বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি মৃত্যু। কাল বেলা বারোটার মধ্যে এক্স ফাইল পার্বতীর মন্দিরে রেখে না এলে কেউ তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। রাম সিং একটা বুন্ধু। সে লোকটাকে ভালো করে তাকিয়েও দেখেনি। শুধু। বলছে, বেঁটে মোটাসোটা লোক। মুখে দাড়ি আর চোখে সানগ্লাস ছিল।
তোমার ছোটমামা কোথায় গেছেন?
ওঁর বন্ধুদের নিয়ে লাখানপুরে পুলিশের কাছে গেলেন। ওঁর এক বন্ধুর সঙ্গে নাকি পুলিশ সুপারের খুব জানাশোনা আছে। আমি আপনার কথা জোর দিয়ে বললাম। ছোটমামা শুনলেন না। আপনারা বসুন। আমি কফির ব্যবস্থা করি।
সে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। আমরা তন্ময়দের কাছে গেলাম। তন্ময় বলল, বসুন কর্নেলসায়েব। তিতি সম্ভবত আপনাকে ঘটনাটা বলেছে।
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। তো তোমরা ভরদ্বাজসায়েব আর সিনহাসায়েবকে কীভাবে আবিষ্কার করলে?
সৌমিত্র একটু হেসে বলল, আমরা ওঁদের আবিষ্কার করার আগেই ওঁরা এখানে আবিষ্কৃত হয়েছেন।
বনশ্রী বলল, হেঁয়ালি কোরো না। সোজা বললেই পারো। ওঁদের ট্রেন লেট করেছিল। বুঝলেন কর্নেলসায়েব! ওঁরা রাত্তিরে রেলওয়ে রেস্ট রুমে কাটিয়ে তারপর জানতে পারেন আজমগড়-লাখানপুর লাইনে ট্রেন বন্ধ। তখন সিনহাসায়েব তার বন্ধু পুলিশ সুপারের বাড়ি যান। আপনারা বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে পুলিশের জিপ দুজনকে পৌঁছে দিয়ে গেল। বনশ্রী হাসল। এদিকে এরা দুজনে খুঁজে নাকাল হয়ে একটু আগে ফিরল।
তন্ময় বলল, বাবা একটুতেই নার্ভাস হয়ে পড়েন। পুলিশের জিপের সঙ্গে রেস দিতে ছুটলেন। সিনহাসায়েবও তাই। আমি থাকলে নিষেধ করতাম।
বনশ্রী বলল, না। সিনহাসায়েব আর ভরদ্বাজসায়েবই শ্বশুরমশাইকে তাতাচ্ছিলেন। আমি নিজের কানে শুনেছি।
তুমি যা-ই বলো, বাবার এই রিস্ক নেওয়া ঠিক হয়নি।
বনশ্রী বলল, সুদেষ্ণা কর্নেলসায়েবের সঙ্গে পরামর্শ করতে বলছিল। শ্বশুরমশাই বেচারিকে পাত্তাই দিলেন না।
সৌমিত্র বলল, সনকাকু কেন যে ওই কুকুরটার ওপর এত ভরসা করেন বুঝি না। কাল রাতে টমের যা সাহস দেখেছি!
কর্নেল বললেন, সেনসায়েব টমকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন?
তন্ময় বলল, বাবা বেরুলেই টমকে সঙ্গে নেন। সৌমিত্র টমকে চেনে না। আসলে কাল রাতে কোনও হিংস্র বুনো জন্তু হয়তো পাঁচিল টপকে ঢুকেছিল। ভালুকও হতে পারে। কালো চিতাবাঘও হতে পারে। একসময় এই এরিয়ার বনে-জঙ্গলে জন্তু-জানোয়ারের অনেক গল্প শুনেছি। মাঝে মাঝে বুনো হাতির পালও এসে হানা দিত।
সুদেষ্ণা রাম সিংকে পাকড়াও করার ভঙ্গিতে নিয়ে এল। অবশ্য রাম সিংয়ের হাতে কফির ট্রে ছিল। টেবিলে সে ট্রে রেখে কাচুমাচু মুখে কর্নেলকে সেলাম দিল। সুদেষ্ণা বসে কফি তৈরি করতে করতে বলল, কর্নেলসায়েবকে সব কথা বলো। কর্নেল! আপনি ওকে জেরা করুন।
রাম সিং বলল, আমি বাজারের থলে সাইকেলে লটকে দিচ্ছি, সেই সময় লোকটা আমার হাতে একটা চিঠি দিয়ে বলল, তোমার সায়েবকে দেবে। তারপর চলে গেল।
সুদেষ্ণা বলল, কেমন চেহারা সেটা বলো।
আমার মতো সার! আমি বেঁটে। হরিয়া লম্বা।
কর্নেল হাসলেন। হরি সিং?
হা সার। হরিয়া কুস্তিগির। ওর গায়ের জোর একটা হাতির মতো।
সুদেষ্ণা চোখ পাকিয়ে বলল, খালি ভাইয়ের বড়াই। সেই লোকটার কথা বলো।
দিদি! আমি ভালো করে দেখিনি। মুখে দাড়ি, চোখে কালো চশমা আর মাথায় টুপি ছিল।
কর্নেল বললেন, তার কথা শুনে কি বাঙালি বলে মনে হয়েছিল রাম সিং?
না সার! একটু দেহাতি টান ছিল কথায়।
গায়ের রঙ মনে পড়ছে?
ফর্সা না। তত কালোও না।
আচ্ছা রাম সিং! তোমার বড়সায়েব যখন মারা যান, তখন তুমিই তো ডাক্তার ডাকতে গিয়েছিলে?
হ্যাঁ সার।
বড়সায়েবের দাহ এখানকার শ্মশানে হয়েছিল। তুমি শ্মশানে গিয়েছিলে?
না সার। ছোটসায়েব আমাকে বাড়ি পাহারা দিতে বলেছিলেন।
বড়সায়েবের লাশ কীভাবে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল?
রাম সিং তাকাল। আমার মনে হলো, প্রশ্নটা তাকে বিব্রত করেছে। একটু পরে শ্বাস ছেড়ে সে বলল, ডাক্তার পাণ্ডেজির বাড়িতে টেলিফোন আছে। উনি সৎকার সমিতিকে খবর দিয়েছিলেন। ভোরবেলা তাদের গাড়ি এসেছিল।
তন্ময় বলল, আসলে বাবা নিশ্চিত হতে পারেননি ডাক্তারের কথায়। বাবার কাছে শুনেছি, অ্যাম্বুল্যান্স এসেছিল লোকাল হেলথ সেন্টার থেকে। তারপর সেখান থেকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়।
রাম সিং বলল, তা হবে। আমি ভেবেছিলাম সৎকার সমিতির গাড়ি।
বলে সে সেলাম ঠুকে চলে গেল। তন্ময় বলল, রাম সিং একটা বুদ্বু। কিছু বুঝিয়ে বলতে পারে না।
সুদেষ্ণা বলল, ওসব পুরনো কথা থাক। চিঠিটা আমি পড়ে দেখেছি। তোমরা দেখনি। ওতে এক্স ফাইল বলে একটা কথা আছে। সেটা কী বুঝতে পারছি না।
আমি বললাম, আপনি কাল বলছিলেন আপনার বড়মামার উদ্ভাবিত কোনও ফরমুলার কথা। এক্স ফাইল সেই ফরমুলার ফাইল হতেও পারে।
তন্ময় একটু চটে গেল। তিতির মাথায় যত রাজ্যের উদ্ভট থিওরি। গোয়েন্দা উপন্যাস পড়ে আর বিদেশি থ্রিলার ছবি দেখে ওর মাথায় কত কী গজায়।
সুদেষ্ণাও চটে গেল। জয়ন্তবাবু বলছিলেন টুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন। অস্বীকার করতে পারো? বড়মামা কত সব এক্সপেরিমেন্ট করতেন তোমার জানা উচিত।
বনশ্রী বলল, তর্কাতর্কি থামাও। আলো কমে গেছে। হিম পড়বে এবার। তিতি! চলো দেখি, কিচেনে গিয়ে সুপারভাইজ করা যাক। আজ রাতে আরও দুজন গেস্ট। ওঠ!
দুজনে চলে গেল। বাড়িতে আলো জ্বলে উঠেছে। সৌমিত্র উঠে দাঁড়াল। বলল, ভীষণ ক্লান্ত। আমরা কিছুক্ষণ গড়িয়ে নিই গে। আয়!
তন্ময় উঠে তার সঙ্গে হাঁটতে লাগল। কর্নেল বললেন, আমরাও উঠছি। তন্ময়! কফির সরঞ্জাম এখানে পড়ে থাকলে সেই জন্তুটা আবার এসে হানা দেবে। ওর হানা দেওয়ার কারণ আমি বুঝতে পেরেছি।
তন্ময় দাঁড়াল না। সৌমিত্র ঘুরে দাঁড়িয়ে একটু হেসে বলল, আপনি হয়তো ঠিক বলেছেন। তারপর সে তন্ময়ের সঙ্গ ধরল।
কর্নেল আস্তে বললেন, একটু বসো জয়ন্ত! চুরুটটা শেষ করে নিই।
বললাম, বি কে সেনের মৃত্যুর ব্যাপারটা কেমন যেন গোলমেলে। রাম সিং আপনার প্রশ্নে কেমন হকচকিয়ে গিয়েছিল।
ওসব কথা থাক। চুরুটটা শেষ করে নিই। তারপর—
কর্নেল হঠাৎ থেমে গেলে বললাম, তারপর কী?
তারপর একটা কথা আমাকে জেনে নিতে হবে।
কার কাছে?
সুদেষ্ণার কাছে।
বলে কর্নেল চুপচাপ চুরুট টানতে থাকলেন। দিনের আলোর ধূসরতা ক্রমে যত কালো হয়ে আসছিল, আমার অস্বস্তি তত বেড়ে যাচ্ছিল। কাল রাতে একটা অদ্ভুত জন্তু আমাদের পেছনে ফুলের ঝোপের আড়ালে ওত পেতে বসে। ছিল। বারবার তাই পেছনের দিকটা দেখে নিচ্ছিলাম। বাড়িতে যে আলোগুলো জ্বলছে, তার ছটা এতদূরে পৌঁছচ্ছে না। হঠাৎ মনে হলো, যে-বাড়িতে প্রায়ই চোর হানা দেয় এবং গত রাতেও হানাদারি ঘটেছে, সেই বাড়ির পারিপার্শ্বিক এমন অন্ধকার করে রাখা হয়েছে কেন? এটা কি ইচ্ছাকৃত? নাকি কারও মাথায় আসেনি যে, উজ্জ্বল স্পটলাইট চারদিক থেকে জ্বেলে রাখা দরকার?
কর্নেল চুরুট শেষ করে জুতোর তলায় ঘষটে নেভালেন। পুরো একটা চুরুট ওঁকে এভাবে কখনও একবারে শেষ করতে দেখিনি। কিছু গভীর চিন্তাভাবনা বা আঁক কষছিলেন মনে মনে?
এগিয়ে যাবার সময় আলোর কথাটা কর্নেলকে বললাম। উনি শুধু বললেন, তোমার প্রশ্নটায় যুক্তি আছে। তারপর আবার চুপ করে গেলেন। লনের মাঝামাঝি রাম সিংয়ের সঙ্গে দেখা হলো। সে টর্চ জ্বালতে জ্বালতে আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আমাদের থাকার ঘরের বারান্দায় উঠে লক্ষ্য করলাম, সে কফির সরঞ্জাম গুছিয়ে নিয়ে আসছে। চেয়ার টেবিলগুলো গত রাতের মতো সেখানেই পড়ে থাকল।
ঘরের দরজা বাইরে থেকে ভেজানো ছিল। আলো জ্বলছিল। ভেতরের দরজা খোলা দেখলাম। কর্নেল বললেন, রাম সিংকে বলো, সুদেষ্ণাকে ডেকে দেবে।
রাম সিং পোর্টিকোর তলা দিয়ে সদর দরজায় ঢুকলে সুদেষ্ণাকে ডাকতে বললাম। দেখলাম, রাম সিং মেঝেয় ট্রে রেখে সদর দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর বিনীতভাবে বলল, এখনই ডেকে দিচ্ছি সার!
সুদেষ্ণা এলো মিনিট পাঁচেক পরে। তার মুখে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট। কর্নেল বললেন, আচ্ছা তিতি, তোমার ছোটমামার বন্ধুরা যখন পুলিশের জিপে এলেন, তখন তুমি কোথায় ছিলে?
সুদেষ্ণা বলল, আমি ওপরে ছিলাম। ছোটমামা নিচে থেকে ডেকে বললেন, তিতি! ওঁরা এসে গেছেন। তখন আমি নেমে এলাম।
তুমি পুলিশের জিপটা দেখেছিলে?
না। তবে জিপগাড়িটা চলে যাওয়ার শব্দ শুনেছি।
তার মানে, তুমি ওই গাড়িটা দেখনি?
সুদেষ্ণা একটু অবাক হয়ে বলল, না। কেন একথা জিজ্ঞেস করছেন?
নিছক কৌতূহল। তো তুমি কখনও তোমার ছোটমামার ওই দুই বন্ধুকে দেখেছ?
কলকাতার বাড়িতে মাঝে মাঝে দেখেছি।
ওঁরা যখন এলেন, তখন বনশ্রী কোথায় ছিল?
ওপরের ঘরেই ছিল। আমরা দুজনে একঘরে থাকি। তন্ময়দা আর সৌমিত্র আলাদা ঘরে থাকে।
কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, তুমি নরেশ ভার্মাকে কি তোমার ছোটমামার কাছে কখনও আসতে দেখেছ?
সুদেষ্ণা মাথা নেড়ে বলল, নাহ। আমি বড়মামার মৃত্যুর পর আর তাকে দেখিনি। বলেই সে একটু চঞ্চল হয়ে উঠল। কর্নেল! আপনার কথা শুনে সন্দেহ হচ্ছে, সেই লোকটাই কি ছোটমামাকে ওই চিঠিটা লিখেছে?
আপাতদৃষ্টে তা-ই মনে হচ্ছে। তবে আমি এখনও নিশ্চিত নই।
বনশ্রীর ডাক শোনা গেল, তিতি! তিতি!
সুদেষ্ণা বলল, আমি এখন যাই কর্নেল। বউদিকে সাহায্য করি গে। ভানুমতী যা নোংরা, একটু লক্ষ্য না রাখলেই কেলেঙ্কারি করে ফেলবে। দরজার। দিকে এগিয়ে সে ঘুরে দাঁড়াল। আপনি আরেকবার কফি খাবেন নিশ্চয়?
কর্নেল একটু হেসে বললেন, খাওয়ার ইচ্ছে হলে তোমাকে জানাব।
সুদেষ্ণা চলে যাওয়ার পর আমি বললাম, সুদেষ্ণাকে আপনি পুলিশের গাড়ি সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। আপনার কি সন্দেহ জেগেছে ভরদ্বাজ এবং সিনহা পুলিশের গাড়িতে আসেননি?
কর্নেল বললেন, কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
কেন?
তুমি একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে। পুলিশের জিপে সেনসায়েবের বন্ধুরা আসবার পর উড়ো চিঠি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তারপর সেনসায়েব দুজনকে সঙ্গে নিয়ে নিজের গাড়িতে বেরিয়ে গেছেন। তখনও তন্ময় এবং সৌমিত্র ফেরেনি। সেনসায়েব যদি লাখানপুর যান, পথে তন্ময়দের সঙ্গে অবশ্যই দেখা হওয়ার কথা। কিন্তু তন্ময় ও সৌমিত্রের সঙ্গে ওঁদের দেখা হয়নি। তার মানে, সেনসায়েব বন্ধুদের নিয়ে অন্য কোথাও গেছেন।
আমি অবাক হয়ে বললাম, তা-ই তো!
তা ছাড়া লাখানপুরের রাস্তায় বেলা তিনটের পর বাস বন্ধ হয়ে যায়। দুর্গম। পাহাড়ি রাস্তা। বুনো হাতির উৎপাত আছে। আজ সকালে বাসস্ট্যান্ডে খবর। নিয়েছি। তোমাকে সে-কথা বলেছিও। বাস-অফিসের লোকটা বলছিল, ওই রাস্তায় ডাকাতরাও মাঝে মাঝে রাহাজানি করে। তাই কেউ পারতপক্ষে সন্ধ্যার পর ওই রাস্তায় গাড়ি নিয়ে যায় না।
তা হলে সেনসায়েব কোন রাস্তায় গেলেন যে তন্ময়দের সঙ্গে দেখা হলো না?
কান্দ্রা বাজারের নিচে বাঁ দিকে লাখানপুরের রাস্তা। ডান দিকে গেছে খনি এরিয়ায় যাওয়ার রাস্তা। কাজেই ধরে নেওয়া যায়, সেনসায়েব খনি এরিয়ায় গেছেন।
কিন্তু আমি জানি, খনি এরিয়ার ভেতর বাইরের লোককে বিনা অনুমতিতে ঢুকতে দেওয়া হয় না।
হয় না। তবে সেনসায়েবরা যদি চালু খনি এলাকার বাইরে–ধরো, পোড়োখনিগুলোর কাছাকাছি কোথাও যান, কেউ বাধা দেবার জন্য পাহারা দিচ্ছে না। একসময় তার ঠাকুর্দার কয়েকটা খনি ছিল। কাজেই ওই এলাকা তার নখদর্পণে।
একটু পরে বললাম, আচ্ছা কর্নেল, এমনও তো হতে পারে, সেনসায়েবের সঙ্গে তার ছেলের রাস্তায় দেখা হয়েছে এবং তিনি।
কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন, এ নিয়ে জল্পনা করে লাভ নেই জয়ন্ত! রাজেনবাবুর মতো মগজ গুলিয়ে যাবে।
মগজ অলরেডি গুলিয়ে গেছে। এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচি।
কর্নেল হঠাৎ খুব আস্তে বললেন, আশা করছি, কাল দুপুরের মধ্যে আমরা পালাতে পারব। পালানোর কথা বলছি একেবারে সত্যিকার অর্থে।
ওঁর মুখের দিকে তাকালাম। মিটিমিটি হাসছেন কর্নেল। বললাম, তার মানে, আমরা এখানে নিরাপদ নই?
সম্পূর্ণ নিরাপদ। আমরা তো রুহা প্রপাতের কাছে দাঁড়িয়ে নেই যে ওপর থেকে পাথর খসে পড়বে।
তাহলে পালানোর কথা বলছেন যে?
বলছি। কারণ আমরা বেড়াতে যাচ্ছি বলে বেরোব। কিন্তু আর এ বাড়িতে ফিরব না।
কর্নেলের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম। কী বলব খুঁজে পেলাম না।
.
০৭.
প্রায় এক ঘণ্টা পরে সুদেষ্ণা নিজেই কফি নিয়ে এল। সে বলল, আপনি না ডাকলেও টের পাচ্ছিলাম, আপনার কফির তেষ্টা পেয়েছে।
বললাম, কর্নেল যাঁদের স্নেহ করেন, তাঁদের সঙ্গে টেলিপ্যাথিক পদ্ধতিতে যোগাযোগ করেন।
সুদেষ্ণা হেসে ফেলল। ঠিক তা-ই যেন।
কর্নেল বললেন, শুনেছি সূক্ষ্ম অনুভূতিপ্রবণ যারা, তাদের সঙ্গে এভাবে নাকি যোগাযোগ সম্ভব।
সুদেষ্ণা কফি তৈরি করে কর্নেলের হাতে তুলে দিয়ে বলল, আচ্ছা কর্নেল, আপনি কি টেলিপ্যাথিতে বিশ্বাস করেন?
তুমি করো নাকি?
সুদেষ্ণা আমাকে কফি দিয়ে বলল, বইয়ে পড়েছি। কখনও প্রমাণ পেলে বিশ্বাস করব।
কর্নেল হাসলেন। হ্যাঁ। প্রমাণ। ঠিক বলেছ। অনেক তত্ত্ব আছে, এখনও যে সবের নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে কিছু মানুষের অনুভূতি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ, এটা অস্বীকার করা যায় না।
কর্নেল কিছুক্ষণ এইসব নিয়ে বকবক করে গেলেন এবং সুদেষ্ণা খুব মন দিয়ে ওঁর বক্তৃতা শুনল। তারপর উনি হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, তুমি কখনও এ বাড়ির ওই মন্দিরে ঢুকেছ?
সুদেষ্ণা একটু হকচকিয়ে গেল। হ্যাঁ। ছোটবেলায় তো প্রতিদিন ভোরে ফুল রেখে আসতাম রাধাকৃষ্ণের পায়ে। মন্দির সবসময় খোলা থাকত।
তোমার বড়মামার মৃত্যুর পর কখনও ঢুকেছ?
না। তার কত আগে বিগ্রহ কলকাতার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
মন্দিরের তালার চাবি কার কাছে আছে?
জানি না। ছোটমামার কাছে থাকতে পারে।
মন্দিরের পেছন দিকে একটা ছোট্ট দরজা আছে জানো?
সুদেষ্ণা অবাক হয়ে গেল। দরজা? মন্দিরের পেছনে? জানি না তো! কে বলল আপনাকে?
আমি পেছনের পাহাড় থেকে বাইনোকুলারে দেখেছি।
তা হলে হয়তো ছোটমামা শর্টকাটে রুহা ফলসে স্নান করতে যাওয়ার জন্য দরজা করেছেন।
কিন্তু উনি যান গেটের বাইরে দিয়ে অন্য একটা পথে।
ও, হ্যাঁ। বুঝেছি! সঙ্গে টমকে নিয়ে যান তো! তাই অন্য পথে যান। কুকুর নিয়ে মন্দিরের ভেতর ঢোকা উচিত নয়। বিগ্রহ না থাকলেও মন্দির ইজ মন্দির। তাই না?
ঠিক বলেছ।
সুদেষ্ণা ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু ভাবল। তারপর বলল, কর্নেল! আমি শুধু এক্স ফাইল-এর কথাটা ভাবছি। ওটা কী হতে পারে?
তোমার ছোটমামা নিশ্চয় জানেন।
আমার ধারণা, ওটা বড়মামার উদ্ভাবিত কোনও সায়েন্টিফিক ফরমুলা। জয়ন্তবাবুকে কথাটা বলেছি। তাই না জয়ন্তবাবু?
বললাম, হ্যাঁ। আমি আপনাকে বলেছি, টুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন।
কর্নেল! আপনি কিন্তু এটাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, নিশ্চয় দিচ্ছি। সেনসায়েব ফিরে এলে তার কাছে কথাটা তুলব।
বনশ্রী এল এতক্ষণে। বলল, বাহ্ তিতি! তুমি এখনই আসছি বলে এখানে দিব্যি আড্ডা জমিয়েছ।
সুদেষ্ণা বলল, আড্ডা নয়। সিরিয়াস আলোচনা হচ্ছে। ওদের ডেকে আনি।
বনশ্রী হাসল। ওরা দুজনে বিছানায় ফ্ল্যাট হয়ে আছে। উঁকি মেরে দেখে এলাম।
খুলেই বলো না বাবা! ধকল সামলাতে ড্রিঙ্ক–সরি! বলে সুদেষ্ণা থেমে গেল।
কর্নেল বললেন, বসো বনশ্রী! তোমার ডিনারের আয়োজন শেষ?
বনশ্রী কর্নেলের বিছানার পায়ের দিকে বসল। তারপর বলল, তত কিছু আয়োজন নয়। আসলে ভরদ্বাজসায়েব আর সিনহাসায়েবের জন্য আলাদা রান্না করতে হলো। ওঁরা দুজনে নিরামিষ খান।
আচ্ছা বউদি! সুদেষ্ণা ওর পাশে বসে চাপাস্বরে বলল, তুমি কি জানো আমাদের মন্দিরের পেছনে একটা ছোট্ট দরজা করা হয়েছে?
বনশ্রী অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি? জানি না তো!
কর্নেল পেছনদিকে পাহাড়ের ওপর থেকে বাইনোকুলারে দেখেছেন।
তা হলে শ্বশুরমশাই শর্টকার্টে ফলসে স্নানের জন্য দরজা করে রেখেছেন।
আমিও কর্নেলকে তা-ই বললাম। সঙ্গে কুকুর নিয়ে যান বলে–
বনশ্রী তার কথার ওপর বলল, আজ শ্বশুরমশাই মন্দিরের তালা খুলে হরি সিংকে নিয়ে ভেতরে ঢুকেছিলেন। দোতলা থেকে দেখেছি। ভাবলাম, মন্দিরের ভেতরটা পরিষ্কার করাচ্ছেন।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, কখন?
স্নান করতে যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে।
সুদেষ্ণা হাসতে হাসতে বলল, হরি সিংকে নিয়ে আমি ছড়া বেঁধেছিলাম। হরি সিং পালোয়ান। এক কিলো ছাতু খান। ওর গায়ে সত্যি হাতির জোর আছে। পাঁচিলের ধারে রাধাচূড়া গাছের তলায় যে পাথরগুলো বেদির মতো সাজানো আছে, সেগুলো হরি সিং বয়ে এনেছিল পাহাড় থেকে। প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড পাথর।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, সেনসায়েব হয়তো পুলিশফোর্স নিয়েই লাখানপুর থেকে ফিরবেন।
সুদেষ্ণা বলল, এবং পাহাড়-জঙ্গলে চিরুনিতল্লাশ শুরু হবে। জয়ন্তবাবু! এই চিরুনিতল্লাশ কথাটা আপনাদের দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় পড়েছি। কম্বিং অপারেশনের বাংলা। তাই না?
বনশ্রী উঠে দাঁড়াল। আমি ওপরে যাই। দুই বন্ধুর অবস্থা দেখি।
সে চলে গেল। সুদেষ্ণা উঠে বারান্দায় উঁকি মেরে বলল, ছোটমামা সকালে বলছিলেন, দোতলার চারদিকে স্পটলাইটের ব্যবস্থা করবেন। কী বিচ্ছিরি অন্ধকার!
কর্নেল বললেন, আচ্ছা তিতি! ডাক্তার পাণ্ডেকে তুমি নিশ্চয় দেখেছ?
হ্যাঁ। বড়মামার সঙ্গে গল্প করতে আসতেন। ছোটমামা এলে তো ঘনঘন আসতেন। ছোটমামার দাবা খেলার নেশা আছে। ডাক্তার পাণ্ডেরও ছিল।
ডাক্তার পাণ্ডে তো মারা গেছেন। ওঁর বাড়িতে এখন কে আছে?
বাড়িতে মিসেস পাণ্ডে মাঝে মাঝে এসে থাকেন। একজন কেয়ারটেকার আছে।
ডাক্তার পাণ্ডে নাকি ৭০ বছর বয়সেও স্বাস্থ্যবান ছিলেন। তোমার বড়মামার মৃত্যুর কত পরে উনি মারা যান?।
সুদেষ্ণা একটু ভেবে নিয়ে বলল, বেশিদিন পরে নয়। বড়মামার মৃত্যুর খবর পেয়ে আমি, তন্ময়দা আর বউদি এখানে এসেছিলাম। আমরা এখানে থাকার সময় উনি মারা যান। মর্নিং ওয়াক করার অভ্যাস ছিল। বৃষ্টি হয়েছিল রাত্তিরে। পা পিছলে গিয়ে একটা পাথরের স্ল্যাবে পড়ে যান। মাথায় চোট লেগেছিল। ইন্টারন্যাল হেমারেজে মারা যান। আমরা খবর পেয়েই ওঁকে হেথ সেন্টারে দেখতে গিয়েছিলাম। অজ্ঞান অবস্থায় মৃত্যু হয়। খুব হাসিখুশি মানুষ ছিলেন। শুধু একটাই বদনাম ছিল।
কিসের?
সুদেষ্ণা হাসল। যত খাতিরই থাক, টাকার ব্যাপারে ভীষণ প্রফেশনাল। আমাদের সঙ্গে অত ভাব। কিন্তু কারও অসুখ হলে, ফেলো কড়ি মাখো তেল। সুদেষ্ণা হাসল। গভমেন্ট কোলিয়ারিতে একসময় ডাক্তারি করতেন শুনেছি। রিটায়ার করে এখানে বাড়ি করেন। সেই সঙ্গে প্র্যাকটিস।
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, যাই হোক, তোমার ছড়াটা বেশ। হরি সিং পালোয়ান/এক কিলো ছাতু খান।
সুদেষ্ণা বলে উঠল, হরি সিং-ই তো দেখতে পেয়ে ওঁকে দুহাতে তুলে হেলথ সেন্টারে নিয়ে গিয়েছিল। রাস্তাটা তো দেখেছেন। একেবারে নিরিবিলি। ওখানে পড়ে থাকতেন। দৈবাৎ কারও চোখে পড়লে তবে ওঁর বাড়িতে খবর দিত।
কর্নেল তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। দৃষ্টিটা অদ্ভুত লাগল আমার। সুদেষ্ণার দিকে অমন করে তাকিয়ে আছেন কেন?
সুদেষ্ণার দৃষ্টি বারান্দার দিকে। এতক্ষণে আমার মনে পড়ল, বারান্দায় একটা আলো আছে। উঠে গিয়ে সুইচ টিপে আলোটা জ্বেলে দিলাম। সুদেষ্ণা বলল, কী আশ্চর্য! আলোটার কথা আমার মনেই ছিল না।
দোতলা থেকে বনশ্রীর ডাক শোনা গেল, তিতি! শুনে যাও।
সুদেষ্ণা বিরক্তি প্রকাশ করে চলে গেল।
কর্নেল মিটিমিটি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে ছড়াটা আওড়ালেন, হরি সিং পালোয়ান/এক কিলো ছাতু খান। ডার্লিং! এই লোকটি সম্পর্কে সাবধান।
চাপাস্বরে বললাম, আপনি সুদেষ্ণার দিকে অমন করে তাকিয়ে ছিলেন কেন?
তোমাকে বরাবর বলেছি জয়ন্ত, আমরা অনেক সময় জানি না যে আমরা কী জানি। সুদেষ্ণা জানে না যে, সে কী জানে।
কোনও-কোনও মেয়ে বয়স যতই বাড়ুক, খুকি থেকে যায়।
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, সুদেষ্ণার মধ্যে নিষ্পাপ সারল্য আছে। ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছে। দাদু-দিদিমার স্নেহে বড় হয়েছে। দুই মামাও ওকে খুব স্নেহ করেন। এ ধরনের মেয়েরা কারও কাছে স্নেহ পেলে মন খুলে কথা বলে।
কিন্তু সুদেষ্ণা জানেটা কী?
মুখটি বুজে থাকো। ওসব কথা এখন নয়।
প্রায় আধঘণ্টা পরে সুদেষ্ণা এসে বলল, ছোটমামা ফিরে আসছেন। ওপর থেকে গাড়ির আলো দেখতে পেলাম। আমি গিয়ে দেখি কী ব্যাপার।
কর্নেল বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর লনে নামলেন। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। একটু পরে গেটের দিকে জোরালো হর্নের শব্দ হলো। তারপর সেনসায়েবের গাড়ি আলোর ছটায় দক্ষিণের লন ঝলসে দিতে দিতে পূর্বে পার্টিকোর তলায় এসে থামল। গাড়ির পেছন থেকে দুজন টাইস্যুটপরা ভদ্রলোক নামলেন। রাম সিং সেলাম দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সুদেষ্ণা ছোটমামার বন্ধুদের অভ্যর্থনা করে ভেতরে নিয়ে গেল। সেনসায়েব গাড়ি ঘুরিয়ে গ্যারাজের দিকে নিয়ে গেলেন। রাম সিং তাঁর গাড়ির পেছনে হন্তদন্ত ছুটে গেল।
কর্নেল ফিরে এসে বারান্দায় উঠলেন। বললাম, সেনসায়েব আপনাকে গাড়ির আলোয় দেখতে পেয়েও ভদ্রতা করে বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন না। গাড়ি গ্যারাজে রাখতে গেলেন।
এখন ওঁর ভদ্রতারক্ষার মতো মেজাজ নেই। বলে কর্নেল ঘরে ঢুকে চুরুট ধরালেন। চেয়ারে বসে উনি আমাকে ডাকলেন, জয়ন্ত!
বলুন!
অমন হ্যাংলার মতো দাঁড়িয়ে থেকো না। ভেতরে এস।
আমাদের পাশের ঘরে সাড়াশব্দ শুনে বুঝলাম, সেনসায়েবের বন্ধুরা ওই ঘরে থাকবেন। কর্নেল চুপচাপ বসে চুরুট টানছে। আমিও চুপচাপ বসে পড়লাম।
কিছুক্ষণ পরে টমের চাপা গর্জন কানে এল। সেনসায়েবের গলা শোনা গেল। তিতি! আমি ওপরে যাচ্ছি। ওঁদের জন্য কফি-টফির ব্যবস্থা করো। আমি এখনই আসছি।
কুকুরটা সমানে গজরাতে থাকল। বিরক্তিকর। আজ কুকুরটা বড্ড বেশি গজরাচ্ছে। একটু পরে ভেতরের দরজায় উঁকি মেরে সুদেষ্ণা বলল, কর্নেল! কফি খাবেন তো?
কর্নেল সহাস্যে বললনে, না। আমি তত বেশি কফি খাই না। জয়ন্ত একটু বাড়িয়ে লেখে।
সুদেষ্ণা চলে গেল। তার মুখটা কেমন যেন গম্ভীর। অথবা আমার চোখের ভুল।
কতক্ষণ পরে সেনসায়েবের আবির্ভাব ঘটল। ঘরে ঢুকে কর্নেলের বিছানায় বসে বললেন, আজ আমার জীবনের একটা সাংঘাতিক দিন গেল। ইতিমধ্যে কর্নেলসায়েব সম্ভবত ঘটনাটা শুনেছেন?
কর্নেল বললেন, শুনেছি। আপনারা লাখানপুরে পুলিশ সুপারের কাছে গিয়েছিলেন–
সেনসায়েব দ্রুত বললেন, যেতে পারলে তো? পাহাড়ি রাস্তা। হঠাৎ দেখি, রাস্তার ওপর আস্ত গাছ পড়ে আছে।
বলেন কী! তারপর?
তখনও দিনের আলো আছে। সাড়ে চারটে বাজে। আমার সঙ্গে বন্দুক থাকলে কী হবে? ডাকাতদেরও শুনেছি বন্দুক থাকে। অগত্যা গাড়ি ব্যাক করে একটা জায়গায় ঘুরিয়ে নিয়ে কান্দ্রায় পুলিশ ফাঁড়িতে ফিরে এলাম। এখানকার পুলিশের কোনও ব্যাপারে মাথাব্যথা নেই। সকালে লাখানপুর যেতে পরামর্শ দিল। রাতে লাখানপুর থেকে পুলিশের পেট্রলকার বেরোয়। তারা গাছ-টাছ সরিয়ে ফেলবে। সেনসায়েব শ্বাস ছেড়ে বললেন, অগত্যা মাইনিং এরিয়ায় পি আর ওর কোয়ার্টারে গেলাম। ভদ্রলোক আমার পরিচিতি। ওঁর কোয়ার্টার থেকে রমেশ সিনহা লাখানপুরে এস পি-কে ট্রাঙ্ককল করল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য! উনি কোথায় বেরিয়েছেন। যে ফোন ধরেছিল, এখন সে যদি দয়া করে ওঁকে মেসেজটা দেয়, তাহলে আশা করি এস পি: কোন অফিসারকে পাঠাবেন।
কর্নেল বললেন, সেই চিঠিটা দেখাতে যদি আপত্তি না থাকে—
কোনও আপত্তি নেই। এই নিন।
সেনসায়েব পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা খামেভরা চিঠি কর্নেলকে দিলেন। কর্নেল সেটা পড়ে দেখার পর ফেরত দিলেন। বললেন, এই এক্স ফাইল জিনিসটা কী?
সেনসায়েব মাথা নেড়ে বললেন, জানি না। আমি এর মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছি না।
আপনার দাদার ল্যাবে এই নম্বরের কোনও ফাইল আছে কি না খুঁজে দেখা দরকার।
খুঁজব খন। এখন আমার যা মানসিক অবস্থা, কী করব কিছু বুঝতে পারছি না।
কর্নেল একটু পরে বললেন, আজ বিকেলে রুহা প্রপাতে গিয়েছিলাম। সেই খসে পড়া পাথরটা খুঁজে পেলাম। লালমাটি আর ঘাসের চাবড়া আটকে ছিল।
সেন সায়েব উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। দেখেছেন? তা হলে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন কী সাংঘাতিক বাঁচা বেঁচে গিয়েছি!
তারপর ঘুরতে ঘুরতে রুহা গ্রামে গেলাম। গিয়ে শুনি এক অদ্ভুত ব্যাপার। কিছুদিন থেকে নাকি প্রপাত এলাকায় বনমানুষ জাতীয় কী একটা জানোয়ার দেখে আদিবাসীরা ওদিকে যাওয়া বন্ধ করেছে।
তা হলে রাম সিং যে গুজবটা শুনেছিল, তা সত্যি। বলে সেনসায়েব আবার উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। কাল রাতে তন্ময় আর সৌমিত্র কি সেই জানোয়ারটাকেই দেখতে পেয়েছিল?
হ্যাঁ। কারণ আজ ভোরে আমি পাঁচিলের গায়ে কয়েকটা লোম খুঁজে পেয়েছি। বলে কর্নেল আমাকে অবাক করে তার কিটব্যাগের ভেতর থেকে কাগজেমোড়া কয়েকটা লম্বাটে লোম দেখালেন।
সেনসায়েব তা দেখামাত্র বলে উঠলেন, সর্বনাশের ওপর সর্বনাশ। নাহ্, আর এ বাড়িতে থাকা যাবে না। বাড়িটা বেচে দিতে হবে। পূর্বপুরুষের স্মৃতি নিয়ে আর আমার মাথাব্যথা করে লাভ নেই।
কখন সুদেষ্ণা এসে দরজায় কাছে দাঁড়িয়েছিল, লক্ষ্য করিনি। সে বলল, ছোটমামা! কাল রাতে টম লেজ গুটিয়ে পালিয়ে এল কেন, এতক্ষণে তা বোঝা যাচ্ছে।
সেনসায়েব উঠে দাঁড়ালেন। ভরদ্বাজ এবং সিনহাকে ডেকে আনি। কর্নেলসায়েবের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। তারপর সবাই মিলে আলোচনা করে দেখা যাক।
সেনসায়েব বেরিয়ে গেলে সুদেষ্ণা কপট অভিমানের ভঙ্গিতে বলল, ওঃ কর্নেল! আপনি কিন্তু লোম কুড়িয়ে পাওয়ার কথা গোপন রেখেছিলেন। কেন? আমাকে বললে কি আমি তা নিয়ে হইচই বাধ্যতাম?
কর্নেল হাসলেন। জয়ন্তকেও বলিনি। আগেভাগে বললে পরে জয়ন্ত আজ আমার সঙ্গে রুহা প্রপাতের ওখানে কক্ষণো যেত না।
সুদেষ্ণা মুখে আত্মবিশ্বাসের ভাব ফুটিয়ে বলল, আমার সব থিওরি কারেক্ট।
সেনসায়েব তার দুই বন্ধুকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আমাদের সঙ্গে পরিচয়পর্ব শেষ হওয়ার পর রমেশ সিনহা কর্নেলের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন, আপনাকে এর আগে কোথায় যেন দেখেছি। মনে করতে পারছি না।
কর্নেল বললেন, সেনসায়েব বলছিলেন, আপনি বনে-পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে ভালবাসেন। আমিও তা-ই। কাজেই কোথাও দেখা হতেই পারে।
এর পর যা শুরু হলো, সেটা আলোচনা নয়। যত রাজ্যের উদ্ভট গল্পগাছা। বক্তা শুধু রমেশ সিনহা। তুষারমানব ইয়েতি থেকে গরিলা, তারপর ভূতপ্রেত। কর্নেল, আমি এবং সুদেষ্ণা নীরব শ্রোতা। মাঝে মাঝে সুশীল ভরদ্বাজ এবং সেনসায়েব কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু রমেশ সিনহা তাঁর অ্যাডভেঞ্চারার জীবনের গল্প না শুনিয়ে ছাড়বেন না। বনশ্রী এসে একাকে বলে গেল, রাত দশটা বাজে। এখন খেয়ে নিলে ভাল হয়। তারপর সেনসায়েব ওঁদের দুজয়াকে তাড়া দিয়ে নিয়ে গেলেন।
সুদেষ্ণা বলল, কর্নেল! আপনারা আসুন। আমি আপনাদের ডিনার রেডি করছি।
কর্নেল আস্তে ডাকলেন, তিতি!
সুদেষ্ণা অবাক চোখে তাকাল। বলুন।
আমি তোমার একটু সাহায্য চাই।
সে এগিয়ে এসে বলল, বলুন কী করতে হবে?
আজ রাতে তুমি যেভাবে পারো, চুপিচুপি নিচে এসে টমকে বেঁধে রাখবে। পারবে তো?
খুব পারব। টম আমার আদর খেতে ভালবাসে।
কর্নেল হাসলেন। আর একটা কথা। কাল ভোরবেলা যদি দেখ, আমরা তোমাদের বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে গেছি, অবাক হয়ো না। মুখ বুজে থেকো। আর আমার এই কার্ডটা রাখো। কলকাতায় ফিরে আমার সঙ্গে দেখা কোরো। আগে টেলিফোন করে যেও।
সে কী! রহস্যটা ফস না করেই চলে যাবেন?
কলকাতায় গিয়ে সব জানতে পারবে। ব্যস। আর কোনও কথা নয়। যাও, ডিনার রেডি করো।
সুদেষ্ণা কর্নেলের দিকে একটু তাকিয়ে থাকার পর ভেতরে চলে গেল।
.
০৮.
এ রাতে কোনও বনমানুষ বা চোরের উৎপাত হয়নি। কর্নেলের নির্দেশে ব্যাগ গুছিয়ে রেখে প্যান্ট-শার্ট পরেই শুয়েছিলাম। শেষ রাতে আজ একটু বেশি হিম পড়েছিল। মশারির ভেতর চাদর খুঁজছি, কর্নেল মশারি তুলে চুপিচুপি বললেন, উঠে পড়ো। সাড়ে চারটে বাজে।
উঠে পড়তে হলো। বারান্দার আলো কর্নেল কখন নিভিয়ে দিয়েছিলেন। বাইরে তখন আবছা আঁধার আর কুয়াশা। বারান্দার দিকে দরজা খুলে সাবধানে দুজনে বেরিয়ে গেলাম। আমরা যখন শিশিরভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, পেছনে কোথাও টম যেন ঘুমের ঘোরে একবার চাপা গর্জন করেই থেমে গেল।
পুবদিকের পাঁচিল ফুট ছয়েকের বেশি উঁচু নয়। দুজনে একে-একে ডিঙিয়ে গেলাম। দিনে দেখেছিলাম, ওপাশে পোড়োজমিতে একটা বাড়ির সবে ভিত উঠেছে। ইটের পাঁজা, পাথরকুচি, লোহালক্কড় আর বালির স্তূপের আড়াল দিয়ে আমরা রাস্তায় পৌঁছুলাম। তারপর কর্নেল বললেন, আমরা কিন্তু কান্দ্রা বাজারে বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছি না।
তা হলে কোথায় যাবেন?
পার্বতীর মন্দিরে।
সেখানে কেন?
কোনও প্রশ্ন নয়। চুপচাপ আমার পেছন পেছন এস।
মৃন্ময়ীভবনের গেটের সামনে দিয়ে আমরা কাল বিকেলে যে পথ দিয়ে রুহা প্রপাতে গিয়েছিলাম, সেই পাহাড়ি পথে হেঁটে গেলাম। শিশিরে ঝোপঝাড় ভিজে আছে। ক্রমাগত চড়াই-উত্রাইয়ে ওঠানামা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম। কর্নেল বারবার সতর্ক করে দিচ্ছিলেন। পা পিছলে গেলে পাহাড়ের ঢাল দিয়ে গড়িয়ে পড়ার বিপদ আছে। ততক্ষণে আঁধার অনেকটা কেটে গেছে। লক্ষ্য করলাম, বাঁদিকে নিচে লেকের ওপর কুয়াশা ঝুলছে। পাখিরা ঘুমঘুম স্বরে ডাকাডাকি করছে। আমরা চলেছি লেকের সমান্তরালে। কতক্ষণ পরে পুবের আকাশে সূর্যের রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ল। তারপর দেখি একটা ভাঙাচোরা মন্দিরের কাছে এসে পড়েছি। অজস্র নানা গড়নের পাথর পড়ে আছে। মন্দিরের ভেতর থেকে একটা বিশাল বটগাছ মাথা তুলেছে। কর্নেল বললেন, এই সেই পার্বতীর মন্দির। এস। ওই পাথরটায় বসে জিরিয়ে নেওয়া যাক।
ঘড়ি দেখলাম। সাড়ে পাঁচটা বাজে। তার মানে, আমরা প্রায় এক ঘণ্টা হেঁটেছি। বুঝতে পারলাম, দিনের আলোয় হেঁটে এলে বড় জোর আধঘণ্টা সময় লাগত।
কর্নেল তার কিটব্যাগ থেকে ফ্লাস্ক বের করে বললেন, সুদেষ্ণাকে ধন্যবাদ দাওঁ জয়ন্ত। সে রাত চারটেয় উঠে চুপিচুপি কিচেনে গিয়ে কফি করেছে। তারপর আমার ফ্লাস্ক ভর্তি করে দিয়েছে। গত রাতেই দুজনে এই চক্রান্ত করে রেখেছিলাম। তুমি বেসিনে হাত ধুচ্ছিলে। টের পাওনি।
ভেতরের দরজা তো বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
আমিও চারটেয় উঠেছি। চক্রান্ত অনুসারে দরজাটা খুলে ভেজিয়ে রেখেছিলাম।
কর্নেলের এই ফ্লাস্কে দুটো কাপ থাকে। বাসি মুখে কফি খেতে খারাপ লাগল না। তবে চায়ের মতো নয়। বেড-টির স্বাদই আলাদা।
কফি খেতে খেতে বললাম, আপনার প্ল্যানটা কী বুঝতে পারছি না।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো। বুঝতে পারবে।
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বাইনোকুলারে চারদিক দেখে নিলেন। ততক্ষণে দিনের আলো ফুটে উঠেছে। এটা পাহাড়ের শীর্ষস্থান বলে সূর্যের দেখা পেতে দেরি হলো না। বললাম, আর কতক্ষণ এখানে থাকবেন?
যতক্ষণ রাজেনবাবু না আসেন।
ওঁর সঙ্গে আপনি কখন যোগাযোগ করলেন?
করিনি। করলে তুমি জানতে পারতে।
তা হলে উনি এখানে আসবেন তা—
চুপ। উনি আসছেন। ওঁর অভ্যাস। এস। আমরা গা-ঢাকা দিই।
দুজনে পোড়োমন্দিরের পেছনে গিয়ে গুঁড়ি মেরে বসে রইলাম। প্রায় পনেরো মিনিট পরে দেখি, রিটায়ার্ড জজসায়েব ছড়ি হাতে এগিয়ে আসছেন। আমরা যেখানে বসেছিলাম, সেখানে এসে উনি সেই পাথরটাতে বসে পাশে ছড়ি রেখে করজোড়ে সূর্যপ্রণামে রত হলেন।
প্রায় তিন-চার মিনিট পরে সূর্যপ্রণাম শেষ করে রাজেনবাবু গুনগুন করে। হিন্দিতে কী একটা দোঁহা আবৃত্তি করতে থাকলেন। তারপর ওঁর পাশের একটা ঝোঁপ ঠেলে একটা ভয়ঙ্কর চেহারার গরিলা জাতীয় প্রাণী আচমকা বেরিয়ে এল। তার লোমশ হাতে ধারালো নখ। প্রাণীটাকে দেখামাত্র রাজেনবাবু হতবুদ্ধি হয়ে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন।
আমিও হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছি। ভয়ঙ্কর প্রাণীটা অদ্ভুত শব্দে গর্জন করে এক লাফে রাজেনবাবুর কাছে যেই গেছে, কর্নেল রিভলভার বের করে ছুটে গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালেন। তারপর চাপা গলায় বলে উঠলেন, এক পা নড়লে মুণ্ডু ফুটো করে দেব। জয়ন্ত! এখানে শিগগির এস!
প্রাণীটি ছবিতে দেখা দানবের মতো প্রকাণ্ড। সে পালানোর চেষ্টা করতেই কর্নেল তার পায়ের কাছে এক রাউন্ড ফায়ার করলেন। অমনি সে মানুষের ভাষায় বলে উঠল, আই বাপ। কর্নেল একলাফে তার কাছে গিয়ে গলার কাছে রিভলভারের নল ঠেকিয়ে বললেন, হরি সিং পালোয়ান/এক কিলো ছাতু খান।
ততক্ষণে আমি বুঝতে পেরেছি প্রাণীটি কে। সে কর্নেলের পায়ের কাছে। উপুড় হয়ে পড়ে দুর্বোধ্য দেহাতি হিন্দিতে কাকুতিমিনতি শুরু করল। কর্নেল ধমক দিয়ে বললেন, চুপসে বৈঠো হরিয়া। জলদি ইয়ে জানোয়ারকা পোশাক উতারো!
নিজেই পিঠের দিকের জিপ টেনে ভয়ঙ্কর বনমানুষের খোলস খুলে হরি সিং পালোয়ান করজোড়ে বলল, মাফ কিজিয়ে সার! হামকো কই কসুর নেহি। তার পরনে পালোয়ান কুস্তিগিরের জাঙ্গিয়া এবং গায়ে হাতকাটা গেঞ্জি।
রাজেনবাবু তার ছড়িটা কুড়িয়ে নিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, ওকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলাম। ওঃ। এবার বুঝতে পেরেছি, রুহা প্রপাত এলাকায়। বনমানুষের গুজব তা হলে মিথ্যা ছিল না।
কর্নেল বললেন, মিঃ দ্বিবেদী! একে কি আপনি চেনেন?
রাজেনবাবু বললেন, দেখেছি মনে হচ্ছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ। সেনসায়েবের বাড়িতেই একে দেখেছি।
এই লোকটা আজ এখানে আপনাকে নিছক ভয় দেখাতে আসেনি। এসেছিল আপনাকে মেরে ফেলতে।
রাজেনবাবু আঁতকে উঠে বললেন, কেন? কেন? আমি ওর কী ক্ষতি করেছি? নরেশ ভার্মার স্যাঙাত নাকি লোকটা?
না। আসলে সমস্যা হলো, আইনত প্রমাণ করা যাবে না যে, এই হরি সিং পালোয়ানই ডাক্তার পাণ্ডেকে ধাক্কা দিয়ে পাথরের ওপর ফেলে দিয়েছিল এবং তার ফলে ডাক্তার পাণ্ডে মারা যান। কাল রুহা প্রপাতের ওপর থেকে এই লোকটাই প্রকাণ্ড একটা পাথর উপড়ে নিচে ফেলেছিল, যাতে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা আর একটা লোক মারা পড়ে। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা সম্ভবত সেই নরেশ ভার্মা, যাকে আপনি এখানে দেখতে পেতেন।
হ্যাঁ। কালও নরেশ ভার্মাকে আসতে দেখে আমি ওই মন্দিরের আড়ালে। লুকিয়ে পড়েছিলাম।
তা হলে বোঝা যাচ্ছে, নরেশ ভার্মা আগের কথামতো রুহা প্রপাতের কাছে সেনসায়েবের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিল। সে খুব ধূর্ত লোক। তাই প্রাণে বেঁচে পালিয়ে যায়। নইলে ঠেলে ফেলে দেওয়া পাথরের আঘাতে তার শরীর থেঁতলে যেত। অ্যাকসিডেন্ট! যেমন ডাক্তার পাণ্ডের মৃত্যুকে অ্যাকসিডেন্ট ভাবা হয়েছিল।
রাজেনবাবু করুণ মুখে বললেন, আমাকে কেন মারতে এসেছিল বলুন তো?
কারণ ডাক্তার পাণ্ডে যেমন জানতেন, ডাঃ বি কে সেন মারা যাননি, আপনিও তেমনি জানেন ডাঃ বি কে সেন এখনও জীবিত।
প্রেতাত্মা! প্রেতাত্মা!
কর্নেল হাসলেন। ঠিক আছে। প্রেতাত্মা! তো ডাক্তার পাণ্ডে টাকার লোভে ডঃ বি কে সেনের হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু বলে মিথ্যা ডেথ-সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন।
আমি বললাম, কিন্তু শ্মশানে তা হলে কার লাশ পোড়ানো হয়েছিল?
অন্য একজনের। মিঃ দ্বিবেদী! আপনি কি বলতে পারেন, সেই লাশটা কার?
রাজেনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, নাহ্। আমি তো ডঃ বি কে সেনের মৃত্যুসংবাদ পরে জানতে পেরেছিলাম।
ডঃ সেনের প্রেতাত্মার দর্শন প্রথম কবে পেয়েছিলেন?
মাসখানেক পরে। এই পার্বতীর মন্দিরে।
সশরীরের দর্শন পেয়েছিলেন?
হ্যাঁ। সশরীরে ঘুরে বেড়ান উনি।
কথা মানুষকে অন্যমনস্ক করে। একটুখানি অন্যমনস্কতার সুযোগে পালোয়ান হরি সিং আচমকা কর্নেলকে এক ধাক্কায় ধরাশায়ী করে ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে উধাও হয়ে গেল। রাজেনবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, পাকড়ো! পাকড়ড়া!
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সমস্যার সমাধান আপনাআপনি হয়ে গেল। পালোয়ানটাকে নিয়ে সমস্যা ছিল। ওকে পুলিশে দিয়ে লাভ হতো না। প্রমাণ করা যাবে না কিছু। বনমানুষের খোলস কোনও প্রমাণ নয়। কারণ ও বলবে, মিঃ দ্বিবেদীকে ভয় দেখিয়ে মজা করছিলাম।
রাজেনবাবু বললেন, তাহলে এবার একা বাড়ি ফিরব কী করে? আপনারা অনুগ্রহ করে আমার সঙ্গে আসুন।
আপনার আর ভয়ের কারণ নেই। আপনি এই বনমানুষের খোলসটা হাতে নিয়ে সোজা মৃন্ময়ীভবনের গেটে গিয়ে সেনসায়েবকে ডাকবেন। তারপর এখানে যা-যা ঘটেছে সব খুলে বলবেন। মিঃ দ্বিবেদী! আপনি একজন রিটায়ার্ড জজ। আপনি হুমকি দিয়ে ওঁকে বলবেন, আপনার কোনও ক্ষতি হলে সেনসায়েব দায়ী হবেন। কিন্তু একটা কথা। আপনি ভেতরে ঢুকবেন না। বাইরে দাঁড়িয়ে খুব চ্যাঁচামেচি করে এসব কথা বলবেন। সেনসায়েবকে আরও বলবেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার সব গোপন কথা জেনে গেছেন। এই নিন আমার নেমকার্ড। এটা ওঁকে দেখাবেন।
কার্ডটা পকেটে ভরে রাজেনবাবু বললেন, ঠিক আছে। কিন্তু ওই নোংরা জিনিসটা আমি ছোঁব না।
কর্নেল বনমানুষের খোলসটা গুটিয়ে বললেন, উপায় নেই মিঃ দ্বিবেদী। এটাই আপনাকে বাঁচাবে। আপনি এটা সেনসায়েবকে কখনও যেন দেবেন না। দরকার হলে পুলিশের হাতে তুলে দেবেন।
রাজেনবাবু বাঁ হাতে খোলসটা অনিচ্ছার ভঙ্গিতে তুলে নিলেন। তারপর পা বাড়িয়ে বিড়বিড় করে বললেন, এবার আমাকে নরেশ ভার্মাকে বেকসুর খালাস দিতে হবে। সনৎ সেনকেই জেলে ঢোকাতে হবে। ডঃ বিকাশ সেনের প্রেতাত্মার সঙ্গে দেখা হলে আমি বলব, আপনার ভাই বনমানুষ পোষে।
রাজেন্দ্রলাল দ্বিবেদীর বাকি কথাগুলো শোনা হলো না। কর্নেল বললেন, এখানে আর নয়। চলো জয়ন্ত! আমাদের প্রায় পাঁচ-ছ কিলোমিটার হেঁটে যেতে হবে। কাল সকালে দেখে গেছি, এই পাহাড়ের নিচের দিকে একটা পায়ে-চলা পথ আছে। রুহা প্রপাত থেকে পথটা এদিকে এসেছে। আমাদের ব্যাগ দুটো নিয়ে এস।
ব্যাগ নিয়ে কর্নেলকে অনুসরণ করে বললাম, পাঁচ-ছ কিলোমিটার দূরে। কোথায় যাবেন?
কর্নেল পিঠে তার ব্যাগ আঁটতে আঁটতে বললেন, কান্দ্রা এলাকার মানচিত্র পেয়ে গেছি। আমরা হাঁটতে হাঁটতে বাসরাস্তা পেয়ে যাব। বাস ধরে চোরডিহা। চোরডিহা রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে আসানসোল। তারপর সোজা হাওড়া।
মানচিত্র কোথায় পেলেন?
এক্স ফাইলের সঙ্গে।
তার মানে–
কর্নেল হাসলেন। তুমি কাল দুপুরে আমাকে পাঁচিল ডিঙিয়ে আসতে দেখেছিলে। আমি পাঁচিল ডিঙিয়ে ঘাটের দিকে গিয়েছিলাম। কারণ পরশু সকালে এই পাহাড় থেকে বাইনোকুলারে এক ভদ্রলোককে ঘাটে ঝোপের ভিতর ঢুকতে দেখেছিলাম। তাই না?
হ্যাঁ। বলেছিলেন কথাটা।
কাজেই আমার জানার দরকার ছিল, ওখানে তিনি কী করছিলেন। তো ঝোপে ঢুকে দেখি, একটা কালো মোড়কে ঢাকা প্যাকেট। মোড়ক খুলে অবাক হয়ে গেলাম। তাড়াহুড়ো করে বাংলায় লেখা সম্বোধনহীন এবং বেনামী একটা চিঠি। চিঠির সারমর্ম হলো : আর যোগাযোগ রাখা সম্ভব হবে না। নরেশ টের পেয়ে গেছে। স্লিনিসটা যত শিগগির সম্ভব যেন খনিকর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া হয় ইত্যাদি। তো জিনিসটা আর কিছু নয়, একটা ডায়েরি বই। তার ভেতর কান্দ্রা এলাকার মানচিত্র, মানচিত্রে কয়েকটা জায়গায় লাল বিন্দু দিয়ে সম্ভবত স্থাননির্দেশ করা হয়েছে। ব্যস! এবার আমাদের ঊধ্বশ্বাসে পালিয়ে যাওয়ার পালা। পাখি না, প্রজাপতি না, অর্কিড না–যতক্ষণ না নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছুচ্ছি।
শুধু একটা কথা জানতে চাইছি। তারপর মুখ বুজে থাকব। সেই ভদ্রলোক কি–
কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন, ডঃ বি. কে সেন।
দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা। কখনও চড়াই, কখনও উৎরাই। আদিবাসীদের বসতিও চোখে পড়ছিল। মাঝে মাঝে রুহা নদী দেখতে পাচ্ছিলাম। এঁকেবেঁকে পাহাড় ও জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে। ক্রমশ বুঝতে পারছিলাম, কান্দ্রা লেক সত্যি প্রাগৈতিহাসিক যুগের কোনও আগ্নেয়গিরির ক্রেটার। কারণ রুহা নদীর সঙ্গে তার কোনও যোগাযোগ নেই।
বাসরাস্তায় পৌঁছুতে প্রায় নটা বেজে গেল। একটা ছোট্ট বাজার এবং বসতি চোখে পড়ল। জায়গাটার নাম সুলতানপুর। খুব খিদে পেয়েছিল। একটা দোকানে গরম গরম পুরি আর জিলিপি খেয়ে খিদে মিটল। কর্নেল কফির বদলে মাটির ভাঁড়ে তারিয়ে তারিয়ে চা খেলেন। তারপর চুরুট ধরিয়ে বললেন, তুমি বুরুডির বন-বাংলোয় বলেছিলে, বড্ড একঘেয়ে লাগছে। কারণ তুমি তোমার কাগজের জন্য একটা চমকপ্রদ স্টোরির প্রত্যাশা করেছিলে। প্রত্যাশা পূর্ণ হয়েছে। তবে না-কলকাতা ফিরেই কিছু লিখতে যেও না।
.
০৯.
কলকাতা পৌঁছুনোর দুদিন পরে বিকেল চারটেয় দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিসে টেলিফোনে কর্নেলের তলব এল। চলে এস জয়ন্ত। এক্সক্লুসিভ স্টোরির চান্স এসে গেছে। দেরি কোরো না।
তখনই বেরিয়ে পড়লাম। ইলিয়ট রোডে কর্নেলের তেতলার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে দেখি, বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ একগুচ্ছ পোস্টকার্ড সাইজের রঙিন ছবি মনোযোগ দিয়ে দেখছেন। মুখ না তুলেই বললেন, আমি কখনও খালি হাতে ফিরি না। বুরুডি আমাকে প্রতারণা করেছিল। কিন্তু কান্দ্রা আমাকে বিমুখ করেনি। তিন রকম পুষ্পবতী অর্কিড, দুরকম প্রজাপতি, তারপর অনেক রকম সারস– মোটামুটি একটা প্রবন্ধের উপাদান পেয়ে গেছি। কিন্তু না–আমার বক্তব্যের ঝোঁকটা থাকবে কান্দ্রা লেকের দূষিত. জলের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে। খনি থেকে প্রচুর আবর্জনা লেকের জলে ফেলা হয়। আন্তর্জাতিক মহলে আগ্রহ জাগলে আমাদের সরকারের টনক নড়বে।
এতক্ষণে সোফায় বসে বললাম, এই আপনার এক্সক্লুসিভ স্টোরি?
হ্যাঁ। আমার। তোমার স্টোরির জন্য পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বলে কর্নেল ছবিগুলো খামে ভরে টেবিলের ড্রয়ারে ঢোকালেন। তারপর আমার দিকে ঘুরে বসলেন। ইতিমধ্যে তুমি মৃন্ময়ীভবনের ব্যাপারে প্রশ্ন থাকলে করতে পারো।
একটু ভেবে নিয়ে বললাম, হরি সিংকে সনৎ সেন বনমানুষ সাজিয়েছিলেন কেন?
রুহা প্রপাত এলাকায় নির্জনে দাদার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য। এমনকি, নিজের বাড়িতেও ওকে বনমানুষ সাজিয়ে পাঁচিলের পাশে ওত পাতার ভঙ্গিতে বসে থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর একমাত্র কারণ, সনৎ সেন আমার পরিচয় পেয়ে আমাকেও মিসগাইড করতে চেয়েছিলেন।
আপনি কী করে বুঝলেন হরি সিংই বনমানুষ সাজে?
মন্দিরের পেছনের দরজা হলো এক নম্বর সূত্র। দুনম্বর সূত্র, রুহা প্রপাতের কাছে কিছু লোম পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। এবার স্মরণ করে দেখ, তিতি, বনশ্রী, রাম সিং সবাই খুব জোর দিয়ে বলছিল, হরি সিংয়ের গায়ে হাতির জোর। যেদিন পাহাড় থেকে পাথর খসে পড়ে, সেদিন সেনসায়েব মন্দিরের দরজা খুলে হরি সিংকে কিছু নির্দেশ দিচ্ছিলেন। তিতি বলেছিল একথা। রাধাচূড়ার তলায় রাখা পাথরগুলোর কথাও বলেছিল। কাজেই আমার অঙ্ক নির্ভুল ছিল।
তিনটে সিগারেটের ফিল্টারটিপ–
কর্নেল আমাকে থামিয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা কাগজের মোড়ক বের করলেন। খুলে বললেন, এতে দশটা ফিল্টারটিপ আছে। সাতটা কুড়িয়ে পেয়েছিলাম পার্বতীর মন্দিরের কাছে। একই সাইজ এবং একই রকম ফাইবার। এদিকে আধপাগলা রাজেনবাবু বলেছিলেন, নরেশ ভার্মাকে তিনি দেখেছেন। তুমি নিজেও বাইনোকুলারে তাকে পার্বতীর মন্দিরের আড়ালে লুকোতে দেখেছিলে।
যষ্ঠীচরণ কফি আনল। কফি খেতে খেতে কর্নেল বললেন, সনৎ সেনের পরিচয় টের পেয়ে আর তার বাড়িতে থাকা আমার বরদাস্ত হচ্ছিল না। বিশেষ করে রমেশ সিনহাকে দেখার পর সিদ্ধান্ত নিতে হলো, আমাকে চলে যেতেই হবে। জয়ন্ত! ওর আসল নাম বিনোদ সিনহা। আন্তর্জাতিক একটা স্মাগলিং র্যাকেটের লোক। বছর পাঁচেক আগে বিনোদ ধরা পড়েছিল। আমি অবশ্য নেপথ্যে ছিলাম। তবে আমাকে সে কাস্টম অফিসারদের সঙ্গে দেখে থাকবে।
ডঃ বি কে সেন যে জীবিত, তা কী ভাবে টের পেলেন?
অমন বিখ্যাত ভূবিজ্ঞানীর মৃত্যু হলো। অথচ শেষরাতে কান্দ্রা শ্মশানে চুপচাপ তার দাহ হয়ে গেল? প্রথমে এতেই আমার খটকা লেগেছিল। তারপর রাজেনবাবুর মুখে তার প্রেতাত্মার সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের কথা শুনে সন্দেহ বেড়ে গেল। কিন্তু তার আগেই পশ্চিমের পাহাড় থেকে বাইনোকুলারে তাকে অস্পষ্টভাবে দেখেছিলাম। তখন তাকে চিনতে পারিনি। পরে নিশ্চিত হলাম উনি জীবিত। যাই হোক, উনি পাঁচটায় এসে পড়বেন। তার মুখে সবটা শোনা যাবে।
সময় কাটতে চাইছিল না। পাঁচটা তিন মিনিটে ডোরবেল বাজল। তারপর ষষ্ঠী একজন রোগাটে চেহারার প্রৌঢ় ভদ্রলোককে নিয়ে এল। সনৎ সেনের সঙ্গে এঁর চেহারার মিল লক্ষ্য করেই বুঝতে পারলাম, ইনি কে!!
কর্নেল আলাপ করিয়ে দিলেন। ডঃ বি কে সেন সোফায় বসে মৃদুস্বরে বললেন, আপনাকে আমি পার্বতীর মন্দিরের আড়াল থেকে দেখেছিলাম। কিন্তু নরেশ ভার্মাকে ওখানে আবিষ্কার করার পর আমাকে খুব সতর্ক থাকতে হয়েছিল।
এতদিন আপনি কোথায় ছিলেন?
বোম্বেতে। নাম ভাড়িয়ে বিদেশে চলে যাবার জন্য পাসপোর্ট-ভিসার ব্যবস্থা করছিলাম। হঠাৎ সনৎ-এর চিঠি পেলাম। নরেশ ভার্মা তাকে উত্ত্যক্ত করছে। উত্ত্যক্ত সে করতেই পারে। কারণ তাকে আমি ইউরেনিয়াম পাচারের দায়ে হাতে-নাতে ধরিয়ে দিয়েছিলাম। তার চেয়ে সাংঘাতিক ঘটনা হলো, নরেশের ভাই সুরেশ ছিল আমার ল্যাবরেটরি-অ্যাসিস্ট্যান্ট। নরেশ জেল থেকে পালিয়ে এসে আমার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ভাইকে প্ররোচিত করেছিল। গত বছর ২৪ সেপ্টেম্বর অনেক রাত অব্দি আমি কাজ করছিলাম। সুরেশও ল্যাবে ছিল। হঠাৎ সে একটা বিষাক্ত গ্যাসের পাইপ খুলে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধস্তাধস্তির সময় দুর্ভাগ্যক্রমে পাইপটা তার মুখের দিকে ঘুরে যায়। বেচারা মারা পড়ে। পাইপটা বন্ধ করে দিয়ে সনৎকে ডাকলাম। সনৎ হঠকারী, নির্বোধ আর ভীষণ জেদি। তার পরামর্শ আমি বোকার মতো মেনে নিলাম।
কর্নেল সকৌতুকে বললেন, অর্থাৎ সুরেশের লাশ ডঃ বি কে সেনের লাশে পরিণত হলো।
হ্যাঁ। ডেথ সার্টিফিকেট পেতে অসুবিধে হয়নি। ডাক্তার পাণ্ডে আমাদের ফ্যামিলির সঙ্গে বাবার আমল থেকে পরিচিত। তবে আসল ব্যাপারটা হলো টাকা। তার টাকার লোভ ছিল প্রচণ্ড।
কিন্তু আপনি কি জানেন আপনার ছোটভাই হরি সিংকে দিয়ে ডাক্তার পাণ্ডেকে কার্যত খুনই করিয়েছিলেন?
ডঃ বি কে সেন একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, সম্প্রতি সনৎ-এর চিঠি পেয়ে কান্দ্রায় গিয়ে শুনলাম সে কী করেছিল। তাকে বকাবকি করে আর লাভ নেই। তখনও টের পাইনি সনৎ-এর প্রকৃত উদ্দেশ্য কি। নরেশ ক্রমাগত তাকে নাকি হুমকি দিয়ে উড়ো চিঠিতে আমার এক্স ফাইল দাবি করছে। তো আমি তাকে চিঠি লিখে নির্দেশ দিলাম, এক্স ফাইল খনিকর্তৃপক্ষের হাতে প্রকাশ্য অনুষ্ঠান করে তুলে দাও।
ষষ্ঠী আবার কফি দিয়ে গেল। কর্নেল বললেন, কফি খান ডঃ সেন। সৌভাগ্যক্রমে আপনার ছোটভাইয়ের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে। এক্স ফাইল আমার হাতে এসে গেছে।
ডঃ সেন কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, দূর থেকে আপনাকে ঘাটে ঝোপের ভেতর ঢুকতে দেখেছিলাম। আমি তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কলকাতা ফিরে গিয়ে আপনার অপেক্ষা করব। তারপর আপনি ফিরে এলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
এই সময় আমি জিজ্ঞেস করলাম, কর্নেল! রাজেনবাবুকে মেরে ফেলার চক্রান্ত আপনি কী করে টের পেলেন?
ডঃ সেন চমকে উঠে বললেন, রাজেনবাবু, মানে রাজেন্দ্রলাল দ্বিবেদীকে?
কর্নেল বললেন, উনি বলছিলেন, আপনার প্রেতাত্মার সঙ্গে প্রায়ই ওঁর দেখাসাক্ষাৎ এবং কথাবার্তা হয়।
ডঃ সেন বিমর্ষমুখে হাসলেন। বার দুই দৈবাৎ ওঁর সামনে পড়ে গিয়েছিলাম। ভদ্রলোক মাঝে মাঝে প্রায় পাগলের মতো আচরণ করেন। কখনও সুস্থ মানুষের মতো। প্রথমবার ভয় পেয়ে মন্ত্রতন্ত্র পড়তে শুরু করেছিলেন। অগত্যা সশরীরে প্রেতাত্মার অভিনয় করা ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু তাকে কেন মেরে ফেলতে চেষ্টা করল সনৎ?
উনি ধরেই নিয়েছিলেন, আপনি যে জীবিত, সে কথা রাজেনবাবু জানেন।
তাই বলে ওঁকে মেরে ফেলতে হবে?
আপনি মৃত সাব্যস্ত হয়েছেন। এখন যদি আপনার ভাই এক্স ফাইল কোনও আন্তর্জাতিক স্মাগলিং র্যাকেটের চাইকে বিক্রি করেন, টাকাটা তিনিই পাবেন। এদিকে আপনি জীবিত, একথা সেই চাইরা কোনওভাবে টের পেলে তাদের একটা ঝুঁকি নেওয়ার ভয় থাকবে। কারণ আপনি একজন বিখ্যাত ভূতত্ত্ববিদ। আপনার আন্তর্জাতিক খ্যাতি আছে। তাই তারা পিছিয়ে যেতে পারে। অতএব রাজেনবাবুর মুখ চিরকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া দরকার।
ডঃ সেন কফির পেয়ালা রেখে দুহাতে মুখ ঢেকে শুধু বললেন, সনৎ এই বয়সেও বদলায়নি?
কর্নেল বললেন, যে নরেশ ভার্মার ভয়ে আপনি মৃত মানুষে রূপান্তরিত হয়েছিলেন, সনবাবু তার সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে নেমেছেন। তবে তার সঙ্গে কুখ্যাত রমেশ সিনহা ওরফে বিনোদ সিনহা আছে। দেখা যাক কী হয়!
ডঃ সেন রুমালে মুখ মুছে আবার কফিতে চুমুক দিলেন।
আমি বললাম, কর্নেল! আমার প্রশ্নটার উত্তর পাইনি।
কর্নেল বললেন, রাতে খাওয়ার পর আমি বারান্দার আলো নিভিয়ে চুরুট টানছিলাম। মনে পড়ছে?
বললাম, হ্যাঁ।
হঠাৎ মন্দিরের ওদিকে টর্চের আলো জ্বলে উঠল। আমি চুরুট আড়াল করে লক্ষ্য রাখলাম। হরি সিংয়ের গলা শুনতে পেলাম। শুধু দুটো কথা। কাল সুবামে? ঠিক হ্যায়। উও পাগলাবাবু–তারপর তার চাপা হাসির শব্দ এবং সনৎ সেনের ধমক। ব্যস! আমার অঙ্ক ঠিকই ছিল।
ডঃ সেন আস্তে বললেন, আমার কষ্ট হয় খালি আমার ভাগনী সুদেষ্ণার জন্য।
তিতি খুব ভালো মেয়ে। ও আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। কলকাতা ফিরে আমার সঙ্গে দেখা করবে। ওর জন্য আপনি ভাববেন না। এবার বলুন, আপনার এক্স ফাইলে কী আছে?
কান্দ্রা এলাকায় ভূগর্ভে এক ধরনের খনিজ পদার্থ আছে, যা থেকে বিষাক্ত গ্যাস প্রতিষেধক সলিউশন তৈরি করা যায়।
আপনার দিল্লি সেমিনারে পড়া পেপারে এই বিষয়টা ছিল মনে আছে।
তখন ছিল থিওরিতে। পরে আমি তা তৈরি করতে পেরেছিলাম। সুরেশ ভার্মারও তা অজানা ছিল না। আমার সন্দেহ, তার দাদা নরেশ ভার্মার কাছে এ খবর সে-ই পাচার করেছিল।
এবার বলুন এক্স ফাইল নিয়ে কী করতে চান? বলে কর্নেল উঠে গিয়ে আলমারি খুললেন এবং লকারের ভেতর থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে এলেন।
ডঃ সেন বললেন, আমার ইচ্ছা, আপনিই ওটা কেন্দ্রীয় খনিদপ্তরের হাতে তুলে দিন। কীভাবে আপনার হাতে এই ফর্মুলা এল, সেকথা আপনি নিজের খুশিমতো জানাবেন। আমি শুধু একটা অনুরোধ জানাতে এসেছি। আমি মৃত মানুষ হয়েই থাকতে চাই। কারণ এদেশে আমার থাকার অসুবিধা আছে। বলে উনি উঠে দাঁড়ালেন। পা বাড়িয়ে দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ ঘুরে খুব আস্তে বললেন, যদি তিতি আপনার কাছে আসে, গোপনে শুধু তাকেই জানাবেন আমি বেঁচে আছি। বিদেশে পৌঁছুনোর পর তাকে আমার নতুন নামে চিঠি দেব।
কর্নেল বিদায় দিতে গেলেন। আমার জানতে ইচ্ছে করছিল, ডঃ সেনের নতুন নাম কী? কিন্তু সুযোগ পেলাম না।
দরজা বন্ধ করে ফিরে এসে কর্নেল বললেন, জয়ন্ত। এক্সকুসিভ স্টোরিটা লিখতে আরও কয়েকটা দিন দেরি করো। ডঃ সেনকে বিনা বাধায় বিদেশে যেতে দাও।
বললাম, উনি মৃত হয়েই থাকবেন আমার স্টোরিতে।
বেশ। কিন্তু একটা উপলক্ষ তো দরকার। আমি কেন্দ্রীয় খনিদপ্তরে শিগগির যোগাযোগ করছি। এক্স ফাইল আনুষ্ঠানিকভাবে
প্রায় আর্তনাদ বেরিয়ে গেল আমার গলা দিয়ে। না, না! তা হলে এক্সক্লুসিভ স্টোরি হবে কী করে? খবর এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন শুধু দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকাই দেবে।
কর্নেল হাসলেন। ঠিক আছে। আমার ঘরেই গোপনে এক্স ফাইল সরকারের প্রতিনিধির হাতে তুলে দেব। তুমি উপস্থিত থাকবে। আর ইতিমধ্যে তিতি ফিরে এলে সে-ও থাকবে।
***
একটু উপসংহার আছে। পরদিন সকালে কর্নেল আমাকে টেলিফোনে বলেছিলেন, আজকের সব কাগজে একটা ছোট্ট খবর বেরিয়েছে। তুমি কাগজের লোক হয়ে কাগজ পড়ো না ডার্লিং! শোনো, কান্দ্রা শিল্পাঞ্চলে গতকাল জেলপলাতক কয়েদি নরেশ ভার্মা এবং জনৈক হরি সিং পালোয়ানের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইউরেনিয়াম পাচারের অভিযোগে মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার নরেশ ভার্মার পাঁচ বছরের জন্য জেল হয়েছিল।
এটুকু শুনেই বললাম, আর নয়। আমি নিজেই খবরটা পড়ে নিচ্ছি। আপনাকে কষ্ট করে আর পড়তে হবে না…..
Leave a Reply