নীলচক্ষু চরিতকথা

নীলচক্ষু চরিতকথা

(কর্নেলের জার্নাল থেকে)

রাতের খাওয়া সেরে অভ্যাসমতো ড্রয়িংরুমে চুরুট টানতে টানতে একটা বই পড়ছিলুম। বইটা পরগাছা সংক্রান্ত। হার্জফিল্ড হামে এক মার্কিন বিজ্ঞানী গবেষণা করে দেখেছেন প্রকৃতিতে পরগাছার প্রকৃত ভূমিকা কী। একেকটি পরগাছার শিকড়ে নাকি এক অদ্ভুত ধরনের জীবাণু থাকে এবং তাদের সংখ্যা কোটি-কোটি। বাতাসে সেইসব জীবাণু চারদিকে বহুদুর অবধি ছড়িয়ে পড়ে মাটির উর্বরতাশক্তি বাড়িয়ে দেয়। এ যুগে ক্রমাগত রাসায়নিক সার প্রয়োগে জমির উর্বরতাশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ডঃ হার্জফিল্ডের বক্তব্য, পরগাছার ওই সব জীবাণু এক্ষেত্রে কাজে লাগানো যায়।

বিষয়টি আগ্রহোদ্দীপক। তাই খুব মন দিয়ে পড়ছিলুম এবং আমার অভিজ্ঞতার সঙ্গে যাচাই করতে চাইছিলুম।

কিন্তু সহসা বিরক্তিকর টেলিফোনের শব্দ। হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলে সাড়া দিতেই কোনও মহিলার কণ্ঠস্বর ভেসে এল। আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

বলছি।

আপনাকে এত রাতে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। কিন্তু আমার উপায় ছিল না।

আপনি কোত্থেকে বলছেন?

 ভবানীপুর থেকে। আমার নাম ঊর্মিমালা রায়।

হুঁ, বলুন।

আপনাকে মুখোমুখি কিছু কথা বলার আছে। প্লিজ যদি কাল সকালের দিকে কিছুক্ষণ সময় দিতে পারেন, আমার সুবিধে হয়।

কথাটা কি টেলিফোনে বলা যাবে না?

না। প্লিজ কর্নেল সরকার—

ঠিক আছে। সকাল আটটা থেকে দশটার মধ্যে আসুন।

 ধন্যবাদ! অসংখ্য ধন্যবাদ কর্নেল সরকার! রাখছি।

আবার বইটার পাতায় মনোনিবেশ করলুম। কিন্তু একটু পরে টের পেলুম, ভবানীপুরের জনৈকা ঊর্মিমালা রায় আমাকে উত্ত্যক্ত করছে। তার কণ্ঠস্বর ছিল চাপা। খুব দ্রুত কথা বলছিল সে। বাড়ির লোকজনের অজ্ঞাতসারে কি সে আমাকে ফোন করছিল?

আমার জীবনে এ ধরনের টেলিফোন নতুন কোনও ঘটনা নয় এবং এ-ও সত্য, এ ধরনের টেলিফোন কোনও বিষয়ে আমার একগ্রতা নষ্ট করে।

বইটা অগত্যা টেবিলে রেখে শুতে গেলুম। দেওয়ালঘড়িতে তখন প্রায় সাড়ে দশটা বাজছিল।…

ঊর্মিমালা রায় এল পরদিন সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ। টেলিফোনে তার কণ্ঠস্বর শুনে মনে হয়েছিল কোনও মধ্যবয়সী মহিলা। কিন্তু যে এল, তাকে তরুণী বা যুবতী যে কোনও একটা শব্দে অভিহিত করা চলে। চেহারায়। আপাতদৃষ্টে তীক্ষ্ণ লাবণ্য সত্ত্বেও চাহনিতে বিষণ্ণ চঞ্চলতা স্পষ্ট। ঘরে ঢুকেই সে আমার পা ছুঁয়ে প্রণামের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাকে নিবৃত্ত করে বসতে বললুম।

সোফায় বসে সে মৃদুস্বরে বলল, আমার মামা অরবিন্দ চৌধুরী। মামার। বাড়িতে একবার আপনাকে দেখেছিলুম। মামা বেঁচে নেই, আপনি হয়তো জানেন।

অবাক হয়ে বললুম, তুমি অরবিন্দ চৌধুরীর ভাগনী? কী আশ্চর্য! রাতে এই পরিচয় দিলে না কেন? তা ছাড়া আমার মনে হচ্ছিল, তুমি চুপি চুপি আমাকে টেলিফোন করছ। তা-ই কি?

ঊর্মিমালা বলল, হ্যাঁ। বাবাকে লুকিয়ে আপনাকে ফোন করেছিলুম। কাল বিকেলে সাউদার্ন অ্যাভেনিউয়ে মামার বাড়ি গিয়েছিলুম। আপনার ফোন নাম্বার, ঠিকানা মামিমা জানেন কি না সন্দেহ ছিল। দেখলুম, উনি জানেন। ওখান থেকে আপনাকে ফোন করেছিলুম। কিন্তু আপনি বেরিয়েছিলেন।

হ্যাঁ। ফিরেছিলুম রাত সওয়া নটায়। কিন্তু যষ্ঠী আমাকে বলেনি।

ষষ্ঠীচরণ কফি আনছিল। আমার কথাটা কানে যেতেই জিভ কেটে থমকে দাঁড়াল। বলতে ভুলে গিয়েছিলুম বাবামশাই! তখন টিভিতে একটা ভাল বই হচ্ছিল। তাই

চোখ কটমট করে তাকিয়ে বললুম, খুব হয়েছে। কফি দে। ষষ্ঠী ঝটপট কফির ট্রে সোফার সেন্টার টেবিলে রেখে চলে গেল। ঊর্মিমালা কফি খেতে চাইছিল না। কিন্তু আমি যথারীতি বললুম, কফি নার্ভ চাঙ্গা করে। কফি খাও।

আমার পীড়াপীড়িতে সে কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, মামার কাছে আপনার অনেক গল্প শুনেছিলুম। মামিমাও আপনার কথা বলতেন।

তুমি কি তোমার মামিমাকে বলেছ, কেন আমার ফোন নাম্বার বা ঠিকানা চাইছ?

না। আমি বলেছি, আমার এক বন্ধু বিপদে পড়েছে। সে আপনার সাহায্য চায়।

তুমি কী বিপদে পড়েছ?

ঊর্মিমালা একটু চুপ করে থাকার পর বলল, আমার বাবার নাম গগনেন্দ্রনাথ রায়। জেদি আর অহঙ্কারী স্বভাবের মানুষ। পুর্বপুরুষ জমিদার ছিলেন, সেই নিয়ে তাঁর অহঙ্কার। আমি বাবার একমাত্র সন্তান। আমার মা বেঁচে নেই। গত বছর মার্চে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাবা একজনের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়েছিলেন। আমার ইউনিভার্সিটিতে আর পড়া হলো না। অনেক স্বপ্ন ছিল। সব ভেঙে গেল। আমার স্বামী সন্দীপ–

সে হঠাৎ থেমে গেল। কফির পেয়ালা রেখে মুখ নামাল। লক্ষ্য করলুম, নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে সে আত্মসম্বরণের চেষ্টা করছে। আমি আস্তে তাকে ডাকলুম, ঊর্মি!

বলছি। একটু সময় দিন প্লিজ!

 তোমার স্বামী তোমার ওপর অত্যাচার করত। এই তো?

ঊর্মি মুখ তুলে আঁচলে চোখের কোনা মুছে বলল, আমার সৌভাগ্য, সন্দীপের হাত থেকে বিয়ের প্রায় পাঁচ মাস পরে নিষ্কৃতি পেয়েছিলুম।

ডির্ভোস?

না। ওদের কোম্পানির কাজে দিল্লি যাওয়ার পথে ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে সন্দীপ মারা যায়।

ঊর্মির দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে বললুম, তোমার বিপদটা কী?

অগাস্টে সন্দীপ মারা গেল। বাবা আমাদের সম্পর্কের কথা জানতেন না। জানতে দিইনি। অভিনয় করে চলতুম বলা যায়। বাবা সেকেলে মানুষ। তাঁর অজস্র সংস্কার আছে। বাবাকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য আমি বিধবা সেজেছিলুম। পরের মাসে বাবা আমার মনে শান্তি আসবে বলে পুরী নিয়ে গেলেন। সেখানেই আমার বিপদের শুরু।

কী বিপদ?

এক বিকেলে সমুদ্রের তীরে বাবার সঙ্গে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ একটা লোক এসে সামনে দাঁড়াল। রোগা গড়ন। মাথায় একরাশ চুল। কিন্তু চমকে গিয়েছিলুম ওর দুটো চোখ দেখে। অদ্ভুত নীল চোখ। অমন চোখ হিংস্র জন্তুদের মধ্যে দেখেছি। সেই নীল চোখ থেকে যেন ছটা বেরুচ্ছে। ঊর্মি জোরে শ্বাস ছেড়ে আস্তে বলল, পরে মনে হয়েছিল আমার দেখার ভুল। কিন্তু ওটা আমার ফাস্ট ইম্প্রেশন।

হিংস্র জন্তুর মতো নীল চোখ?

হ্যাঁ। কিন্তু লোকটার আচরণ নম্র। বাবাকে নমস্কার করে বলল, আমি কাল থেকে লক্ষ্য করছি স্যার! আপনি আপনার সধবা মেয়েকে বিধবা সাজিয়ে রেখেছেন কেন? কথাটা শুনে আমি ভেবেছিলুম লোকটা শুধু পাগল নয়, দুষ্ট প্রকৃতির। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা ওর স্বভাব। এদিকে বাবা প্রথমে খুব চটে গিয়েছিলেন। লোকটাকে ধমক দিয়ে চলে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু সে বাবাকে গ্রাহ্য করল না। একটু হেসে বলল, স্যার! আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আপনার জামাই বেঁচে আছে। বাবার অদ্ভুত কিছু সংস্কার আছে, আপনাকে তা বলেছি। উনি বললেন, তুমি কি জ্যোতিষী? লোকটা বলল, না স্যার! কোনও-কোনও সময় আমার এটা হয়। ইনটুইশন বলতে পারেন। কাকেও দেখামাত্র তার ভূত ভবিষ্যত স্পষ্ট দেখতে পাই। ইনটুইশন কথাটা শুনে বুঝতে পারলুম, লোকটা শিক্ষিত। বাবা ওকে কী একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু লোকটা বলল, এখন আর কিছু বলতে পারব না স্যার! আমার ইনটুইশন যদি আবার আসে, তখন বলব।

তারপর?

লোকটাকে দেখে আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। হোটেলে ফিরে বাবাকে বুঝিয়ে বললুম, পুরীর সমুদ্রতীরে দুবৃত্তরা নানা ছলে উত্ত্যক্ত করে শুনেছি। তা ছাড়া এখানে বড় ভিড়। বরং গোপালপুরে গেলে নির্জনে সমুদ্র দেখার আনন্দ পাব। যাই হোক, আমার পীড়াপীড়িতে বাবা পরদিন সকালে আমাকে নিয়ে গোপালপুর রওনা হলেন। গোপালপুরে আমরা পূর্বাচল হোটেলে উঠলুম। পরদিন সকালে বাবার সঙ্গে সি-বিচে হাঁটছি, হঠাৎ দেখি সেই নীলচোখো লোকটা একটা পাথরের ওপর বসে আছে। আমাদের দিকে মুখ ফেরাতেই তার নীল চোখে আবার সেই ছটা দেখতে পেলুম। চমকে উঠলুম। বললুম, সেই লোকটা! বাবাও তাকে দেখে চমকে উঠলেন। এবার বাবা তাকে চার্জ করলেন, কে তুমি?কেন আমাদের ফলো করে বেড়াচ্ছ? তোমাকে পুলিশের হাতে তুলে দেব। লোকটা একটু হেসে বলল, স্যার! আমি এ মুহূর্তে বলতে পারব না কেন আমি এখানে এসেছি। হয়তো আমার সেই ইনটুইশন!

বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কে তুমি? নাম কী? কোথায় থাকো? সে বলল, আমার নাম স্যার মাধব। আমি কলকাতায় থাকি। আমি আপনাদের মতো পুরীতে বেড়াতে গিয়েছিলুম। তারপর কেন জানি না আমাকে এখানে চলে আসতে হলো। তবে স্যার, আমি আপনাদের ফলো করে আসিনি। ওই যে বললুম, আমার ইনটুইশন!

ঊর্মির কথা শুনে বুঝতে পারছিলুম না, সে সত্যি বলছে, নাকি বানিয়ে বলছে এবং তার প্রকৃত উদ্দেশ্যই বা কী। চুরুট নিভে গিয়েছিল! লাইটার জ্বেলে ধরিয়ে নিলুম। বললুম, কিন্তু তোমার বিপদটা কী?

ঊর্মি বলল, সংক্ষেপে বলছি। তারপর আমার আপত্তি সত্ত্বেও বাবা মাধবের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেললেন। তার ইনটুইশনের খেলা শুরু হলো। সন্দীপ নাকি ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যায়নি। সে কলকাতায় নাম ভাঁড়িয়ে ছদ্মবেশে ঘুরছে। তার চেয়ে সাংঘাতিক কথা, সে নাকি তার কোম্পানির কয়েক লক্ষ টাকা তছরুপ করেছিল।

বললুম, ট্রেন দুর্ঘটনা কোথায় হয়েছিল?

মোগলসরাইয়ের কাছে।

 সন্দীপের লাশ শনাক্ত করা হয়েছিল নিশ্চয়?

শনাক্ত করতে গিয়েছিলেন বাবা আর আমার শ্বশুরমশাই। কিন্তু মুখোমুখি দুটো ট্রেনের সংঘর্ষ। ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রী-তালিকায় সন্দীপের নাম ছিল। সেই কোচটা একেবারে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল। দলাপাকানো বডিগুলো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। রেলওয়ে সন্দীপের জন্য একলক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল। বাবার চাপে আমি সই করেছিলুম শুধু। টাকাটা ব্যাঙ্কে আমার অ্যাকাউন্টে জমা আছে।

কোম্পানির কয়েকলক্ষ টাকা তছরুপের জন্য সন্দীপের বিরুদ্ধে কোর্টকে থাকা উচিত।

মৃত লোকের নামে মামলা করা যায় না শুনেছি। সন্দীপের নিজের কোনও প্রপার্টিও ছিল না।

তছরুপের কথা কি কোম্পানির সূত্রে জেনেছিলে?

না। মাধবের ইনটুইশন। তবে আশ্চর্য ব্যাপার, কোম্পানি আমার শ্বশুর অজিতবাবুর সঙ্গে পরে যোগাযোগ করেছিল। শ্বশুরমশাইকে কদিন আগে বাবা ফোন করে একথা জানতে পারেন। এদিকে বাবা মাধবের ইনটুইশনের ঠেলায় অস্থির। প্রায়ই মাধবের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ছেন সন্দীপের খোঁজে।

কিন্তু তোমার বিপদটা কী?

মাধব কিছুদিন থেকে আমাকে বলছে, তার সঙ্গে আমি গেলে সন্দীপকে খুঁজে বের করা তার পক্ষে নাকি সহজ হবে। সে খুলেই বলছে, আমাকে সে টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে চায়।

তোমার বাবা জানেন একথা?

জানেন। ওই নীলচোখো লোকটার কথায় বাবার অগাধ বিশ্বাস। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, মাধবের সঙ্গে একা কোথাও গেলে আমার বিপদ হবে। আমি ওর ইনটুইশন সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারিনি। আমার ধারণা, লোকটা আমার কোনও সর্বনাশ করার উদ্দেশ্যেই বাবাকে বশ করে ফেলেছে।

একটু ভেবে নিয়ে বললুম, মাধবকে সঙ্গে নিয়ে আমার কাছে আসতে পারো?

হয়তো পারি। কিন্তু আপনার বাড়ি আসার পথে যদি

ঊর্মি হঠাৎ চুপ করল। ওর অসমাপ্ত কথাটার মানে বুঝতে পারলুম। বললুম, এক কাজ করো। আজ বিকেলে চারটেয় তোমাদের বাড়ির কাছাকাছি আমি দাঁড়িয়ে থাকব। তুমি ট্যাক্সি করে মাধবের সঙ্গে বেরুবে।

ঊর্মি দ্রুত বলল, আমাদের একটা গাড়ি আছে। সাদা মারুতি জিপসি। আমি ড্রাইভ করে এখানে এসেছি।

তাহলে তো ভালোই। আজ বিকেল চারটে। তুমি এই কাগজে তোমার বাড়ির ঠিকানা আর একটা ম্যাপ এঁকে দাও। আমি কোথায় অপেক্ষা করব, সেখানে টিক দিয়ে দিচ্ছি।

ঊর্মি ঠিকানা এবং রাস্তার ম্যাপ এঁকে দিল। আমি একটা জায়গায় টিক এঁকে দিলুম। তারপর সে বেরিয়ে গেল।….

.

কথামতো বিকেল চারটেয় আমি নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করছিলুম। মিনিট পনের পরে একটা সাদা মারুতি এসে কাছাকাছি দাঁড়াল। ঊর্মি মুখ বাড়িয়ে একটু হেসে বলল, কর্নেলমামা! আপনি এখানে?

বললুম, তুমি ঊর্মি না?

কী আশ্চর্য! আমাকে দেখে আপনি চিনতে পারছেন না?

পারছি না মানে? খুব পারছি?

আপনি এখানে কী করছেন?

একটা কাজে এসেছিলুম। ট্যাক্সির জন্য দাঁড়িয়ে আছি।

আসুন! আসুন! আপনাকে পৌঁছে দিয়ে যাব।

সামনের সিটে তার বাঁদিকে যেমন-তেমন একটা ফতুয়া আর প্যান্ট পরা লোক বসেছিল। সে আমাকে দেখছিল। তার চোখ সত্যিই অস্বাভাবিক নীলচে। তবে কোনো ছটা দেখলুম না। অনুমান করলুম, তার বয়স তিরিশ-বত্রিশের মধ্যে। মাথায় একরাশ এলোমেলো চুল। কিন্তু এই লোকটিকে কোথায় যেন দেখেছি!

ব্যাকসিটে ডানদিকে বসলুম। তারপর বললুম, ইনি কে ঊর্মি?

ঊর্মি গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলল, এর নাম মাধব। আমাদের বাড়িতে থাকে। জানেন কর্নেলমামা? মাধবের মধ্যে অলৌকিক ক্ষমতা আছে। ও মানুষের ভূত ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। বলো কী!

হ্যাঁ। ও যা বলে, ঠিকঠিক মিলেও যায়, এটাই আশ্চর্য!

 মাধব কোনও কথা বলল না। বড় রাস্তায় গাড়ি পৌঁছুলে ডাকলুম, মাধববাবু!

মাধব ঘুরল না। বলল, আজ্ঞে স্যার, আমাকে বাবু বলবেন না। আমি সামান্য মানুষ।

কিন্তু ঊর্মি যা বলল–

স্যার! আমার ওটা ইনটুইশন! সবসময় ওটা আসে না।

 এলে আমার সম্পর্কে কিছু বোলো কিন্তু!

মাধব চুপ করে থাকল।

ইলিয়ট রোডে আমার অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে পৌঁছুতে প্রায় আধঘণ্টা লাগল। লনের পাশে পার্কিং জোনে ঊর্মি গাড়ি ঘোরানোর ভান করছিল। বললুম, এ কি ঊর্মি! এতদিন পরে দেখা। অন্তত এক পেয়ালা কফি খেয়ে যাবে না? এস! মাধকেও নিয়ে এস!

মাধব বলল, আমি এখানেই থাকছি স্যার!

না, না। তুমিও এস। যা শুনলুম, তোমার সম্পর্কে আমার খুব কৌতূহল জেগেছে। এস।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও মাধব এল। তিনতলায় আমার অ্যাপার্টমেন্টের ড্রয়িংরুমে ঢুকে ষষ্ঠীকে শীগগির কফি আনতে বললুম।

মাধব আমার জাদুঘরসদৃশ ড্রয়িংরুমটা দেখছিল। হঠাৎ সে ঊর্মির দিকে ঘুরে বলল, দিদি! আজ সন্ধ্যায় তোমার স্বামী আমাকে মেরে ফেলবে।

ঊর্মি চমকে উঠে বলল, তোমার ইনটুইশন বলছে?

হ্যাঁ দিদি!

 সে কোথায় তোমাকে মেরে ফেলবে?

 তার বাড়ির সামনে।

 বাজে কথা বোলো না! এতদিন ধরে তুমি তার বাড়ি খুঁজে পাচ্ছ না!

এখন পেয়েছি।

কোথায়?

কাছাকাছি এসে পড়েছি। সে রিপন স্ট্রিটে একটা বাড়িতে আছে। দিদি! আমার ভয় হচ্ছে। আমি এখনই পালিয়ে যেতে চাই।

বলেই নীলচোখো মাধব দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ঊর্মি ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, মরুক! ওর ইনটুইশন না বুজরুকি!

ষষ্ঠী কফি আনল। বললুম, কফি খাও ঊর্মি! নার্ভ চাঙ্গা করো।

 ঊর্মি বলল, মাধবকে দেখে আপনার কী মনে হলো?

তেমন কিছু না। ওর চোখ দুটো নীলচে। তার জৈবরাসায়নিক কারণ থাকতে পারে। তো এখন তোমাদের বাড়িতে কে আছে?

বাবা বেরিয়েছিলেন। এতক্ষণে ফিরেছেন হয়তো। কাজের মেয়ে লক্ষ্মী আছে।

একটু পরে বললাম, আমার ইনটুইশন বলছে, বাড়িতে তুমি টেলিফোন করে জানিয়ে দাও, মাধব ফিরে গেলে যেন তার দিকে লক্ষ্য রাখা হয়।

ঊর্মি অবাক হয়েছিল। সে রিসিভার তুলে ডায়াল করে বলল, কে? লক্ষ্মী? বাবা বাড়ি ফেরেননি?……ঠিক আছে। শোনো! মাধবকে নিয়ে জ্বালা! হঠাৎ সে কোথায় চলে গেল। যদি সে বাড়ি ফেরে তার দিকে লক্ষ্য রাখবে। কেমন?…

আঃ! যা বলছি শোনো! আর বাবা ফিরলে বাবাকেও লক্ষ্য রাখতে বলবে। ছাড়ছি।

রিসিভার রেখে ঊর্মি বলল, আপনি কি বলতে চাইছেন সন্দীপ ওকে আমাদের বাড়িতে গিয়ে মেরে ফেলবে?

একটু হেসে বললুম, আমার ইনটুইশন বলছে, এখনই তোমার বাড়ি ফেরা উচিত।

ঊর্মি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। কফি শেষ না করে বেরিয়ে গেল।….

.

ঊর্মির টেলিফোনের প্রতীক্ষা করছিলুম। টেলিফোন এল সন্ধ্যা সওয়া সাতটায়। ঊর্মি বলল, কর্নেল সরকার! বড় অদ্ভুত ব্যাপার! মাধব তার ব্যাগ আর স্যুটকেস নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। বাবা, আমি ওকে আটকাতে পারিনি। কিন্তু নিচে যেতেই দেখি, পুলিশ মাধবকে ধরেছে। একটা পুলিশ ভ্যান অপেক্ষা করছিল একটু তফাতে। এবার অদ্ভুত ঘটনাটা বলি। আমাদের ঠাকুরঘরের ভেতর থেকে—

তার কথার ওপর বললুম, তোমাদের পূর্বপুরুষের গৃহদেবতা রাধাবল্লভের মূর্তি মাধবের কাছে পুলিশ উদ্ধার করেছে। এই তো? ওই বিগ্রহের দাম এখন প্রায় এক কোটি টাকা।

সে কী! আপনি কী করে জানলেন?

ইনটুইশন!

প্লিজ কর্নেল সরকার! জোক শোনার মুড আমার নেই।

জোক নয়, ঊর্মি। তোমার মামা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তাঁর কাছেই তোমাদের বাড়ির গৃহদেবতার কথা শুনেছিলুম। এদিকে মাধবকে দেখামাত্র আমি চিনতে পেরেছিলুম। মাধবেরও আমাকে চেনার কথা। ওই নীলচক্ষু ধূর্ত লোকটি বছর পাঁচেক আগে ভুবনেশ্বর থেকে একটা মূল্যবান বিগ্রহ চুরি করেছিল। তাকে আমিই ধরে ফেলেছিলুম। যাই হোক, আমাকে দেখতে পাওয়ার এবং আমার এখানে আসার পর মাধব স্বভাবত পালিয়ে যেতে চাইছিল। তুমি চলে যাবার পরই ভবানীপুর থানায় রিং করে আমি পুলিশকে তোমাদের বাড়ির ঠিকানা দিয়েছিলুম। মাধবের আসল নাম আমি জানি না। সেবার সে ছিল যাদব। ছাড়ছি।

রিসিভার রেখে ডঃ হার্জফিল্ডের পরগাছা সংক্রান্ত সেই বইটা টেনে নিলুম।…