পিছনে পায়ের শব্দ – ১

০১.

 অরীন্দ্র হাতের কালো ছড়িটি তুলে বললেন, ওই দেখ!

সাবর্ণী আস্তে বলল, কী? তার কণ্ঠস্বরে অন্যমনস্কতা ছিল। জঙ্গুলে জায়গায় একটা জরাজীর্ণ দোতলা বিশাল পোড়ো বাড়ির ভাঙাচোরা সিঁড়ি বেয়ে উঁচু ছাদে ওঠার ক্লান্তিও ছিল। তাছাড়া সে যথেষ্ট বিরক্তও। টাউনশিপের কাছাকাছি কোনও সুন্দর বাংলোই সে আশা করেছিল। তার বদলে প্রিয়গোপাল পুরনো বসতি এলাকায় তার দাদামশাইয়ের বাড়িতে তুলেছে। তারপর অফিসের কাজের নামে যখন-তখন উধাও। আর এই দাদামশাইও ঘত অদ্ভুত, তত বিরক্তিকর। কথায়-কথায় ফিসফি এবং রঙচড়ানো কোনও স্থানীয় বৃত্তান্ত নিয়ে বকবক করেন। সমস্যা হল, এই মফঃস্বলি বৃদ্ধ ভদ্রলোক বোঝেন না, যে-জিনিসগুলিকে তিনি প্রচণ্ড গুরুত্ব দিতে চাইছেন, তা একেবারেই অকিঞ্চিৎকর। সম্ভবত একটা বয়সে মানুষ নিজের প্রতিটি অভিজ্ঞতাকে খুব মূল্যবান মনে করে। অরীন্দ্র নাতবউকে এক দিনে তত বুঝতে পারেননি এবং এ মুহূর্তে লক্ষ করছিলেন না। তার দৃষ্টি সুদূরপ্রসারী। ছড়ি তুলে ধরে উদাত্ত স্বরে বললেন, মরুভূমি এবং সমুদ্রের আশ্চর্য সহাবস্থান। তারপর একটু হাসলেন! তুমি বোধ করি জান না, এখানে অনেক ফিল্মের শুটিং হয়েছে। সবে তো ডিসেম্বর চলেছে। মরশুমি হাঁসের মতো ওদের আসারও সময় হয়ে এল। তখন কিন্তু লোকে লোকারণ্য। ওই রাস্তার দু’ধারে মেলা বসে যায়। পুলিশ আসে। লাঠিও চলে।

অগত্যা সাবর্ণী একটু আগ্রহের ভান করল। নদীটা বেশ বড় দেখছি। নাম কী এ নদীর?

অরীন্দ্ৰ হা হা করে হাসলেন। গঙ্গা! গঙ্গা ছাড়া আর কী হতে পারে? ওই দেখ, এখনই কুয়াশায় ঢেকে গেছে, বড় একটা চর। চরে বসতিও আছে। কাল নৌকো করে ঘুরে আসা যাবে বরং। তোমার পি জি আসুক। বলছি!

প্রিয়গোপালকে পি জি করেছে পিউ। সাবর্ণীর বোন। পিউ বুদ্ধিমতী এবং তার অবশ্য সুযোগও ছিল অরীন্দ্রের হাত থেকে পালানোর। সামান্য দূরে ইরিগেশন ক্যানেলের ব্রিজের ওদিকে গেছে। রাণুদি, সাত্যকি এবং পিয়ালির সঙ্গে। ওদের গাইড ভগীরথ তার কর্তার মতোই বুড়ো এবং শক্তসমর্থ মানুষ।

কিন্তু অরীন্দ্রের বড়ো ইচ্ছা ছিল নাতবউকে উনিশ শতকের রেশমব্যবসায়ী ক্লিপটন সায়েবের এই বিখ্যাত কুঠিবাড়ি দেখাবেনই। বাড়িটি যত না দেখার, ছাদটি নাকি তত বেশি দেখার যোগ্য। সিঁড়ির দিকটা ভেঙে পড়েছিল। ধ্বংস্কৃপ সরিয়ে সিঁড়িটি পরিষ্কার রেখেছেন পর্যটন দফতর, তাতেই নাকি এর গুরুত্ব বোঝা যায়। এই হল অরীন্দ্রের অভিমত। তবে সাবর্ণীর অবাক লাগছিল, সত্তরের কাছাকাছি বয়স এমন একজন মানুষ প্রায় হাফ কিমি পায়ে হেঁটে এক দমে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে এত উঁচু ছাদে উঠতে পারলেন!

সাবর্ণী পশ্চিমের রেলিঙের দিকে পা বাড়াল! পিউদের দলটাকে দেখার ইচ্ছা ছিল। অরীন্দ্র বললেন, ওদিকে কী? এদিকটায় এস। আসল জিনিসটাই তো এদিকে। কিন্তু সাবধান, বেশি ঝুঁকবে না।

সাবর্ণী ঘুরে আস্তে বলল, কী ব্যাপার?

হাসলেন অরীন্দ্র। মূর্তিমান ভয়ঙ্কর বলতে পারো। আমার দেখে দেখে সয়ে গেছে। কিন্তু সত্যিই ভয়ঙ্কর। তোমার বিচ্ছু বোনটি আমাকে ফিলসফারদাদু বানিয়ে ফেলেছে। হাত ফসকে না পালালে ওকে হাতেনাতে বুঝিয়ে দিতুম, নেচারই মানুষকে ফিলসফার বানিয়ে ছাড়ে।

সাবর্ণী আস্তে এগিয়ে যাচ্ছিল উত্তরের আলিসার দিকে। অরীন্দ্র তার পাশে গেলেন। ফের বললেন, এক মিনিট। খাদ দেখলে অনেকের মাথা ঘুরে ওঠে। এও দেখেছি, কেউ-কেউ হিস্টেরিক হয়ে পড়ে। সাবধান!

এদিকে খাদ বুঝি?

নিছক খাদ বলা ঠিক হবে না। একটা গভীর দহ। অরীন্দ্র সাবর্ণীর আগে গেলেন। একটু হেসে ফের বললেন, তোমার পি জি আমাকে তোমার বডিগার্ড বহাল করেছে। তোমার ভালমন্দের দায়িত্ব…..।

আলিসার হাত চারেক তফাতে থমকে দাঁড়াল সাবর্ণী। ভুরু কুঁচকে অরীন্দ্রের কথার ওপরে বলে উঠল, তার মানে?

অরীন্দ্র কথাটা হাসিতে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বললেন, তোমার সামনেই তোমার বোন বলছিল, এই মহিলা সম্পর্কে সাবধান। ইনি বড্ড খেয়ালি। যাই হোক, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি তোমার বডিগার্ড, এটা রূঢ় সত্য। কারণ সামনে রাক্ষুসে খাদ। আমি এও জানি না, অমন একটা ভয়ঙ্করের মুখোমুখি তোমার কী রিঅ্যাকশন হবে। এস!

সাবর্ণী জেদ করেই এগিয়ে আলিসায় বুক রেখে ঝুঁকল। তার খুব কাছে অরীন্দ্র। মুখে মিটিমিটি হাসি। সাবর্ণী নীচের খাদের দিকে তাকাল। কিন্তু দৃষ্টিতে শূন্যতা ছিল। খাদটা খুবই গভীর আর ভীষণ কালো, এর বেশি কিছু মনে হল না তার। অবশ্য সোজা নেমে যাওয়া পাথরের দেয়াল দেখে একটু অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছিল এই যা। দেয়ালের ফাটলে ঝোপঝাড় গজিয়েছে এখানে। ওখানে। সাবর্ণী দৃষ্টি সামনে রাখল। দূরে ও কাছে বালিয়াড়ির ওপর হিম বিকেলের নরম রোদ পড়েছে। বুনো হাঁসের ঝাক ওড়াওড়ি করছে। এত উঁচুতে ধীরে যে বাতাস বইছিল, তা ক্রমে কনকনে ঠাণ্ডা হিম হয়ে উঠেছে। বুটিদার নীলচে স্কার্টটা আলতো হাতে গায়ে জড়িয়ে সাবর্ণী একটু বাঁকা হাসল। আমার কোনও রিঅ্যাকশন হচ্ছে না কিন্তু!

হচ্ছে না, তার কিছু ব্যাখ্যা আছে। অরীন্দ্র ভরাট গলায় বললেন। চাইলে দিতে পারি। চাও কি?

সাবর্ণী শুধু তাকাল।

আলোর অভাব। বিকেল গড়িয়ে গেছে, তাতে শীতের বিকেল। অরীন্দ্র খাদের দিকে একটু ঝুঁকে বললেন, সবটাই কালো রঙে ঢেকে গেছে তাই। আমি বলছিলুম, দেখে দেখে সয়ে গেছে। কিন্তু সব সময় নয়। অক্টোবরে আমার এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলুম। তিনি একজন রিটায়ার্ড মিলিটারি অফিসার। তো তখন দুপুর। উজ্জ্বল রোদ ছিল। ঝুঁকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ল…

উনি হঠাৎ থেমে গেলে সাবর্ণী বলল, কী দেখলেন?

— নাহ্। থাক। অরীন্দ্র পা বাড়ালেন। চলো, ফেরা যাক।

সাবর্ণী তাঁকে অনুসরণ করে চেষ্টাকৃত কৌতুকে বলল, ভুতুড়ে ব্যাপার নয় তো?

হাসলেন অরীন্দ্র। বলতেও পারো। আসলে ভয়ঙ্কর কোনও শূন্যতার সামনে পড়লে কোনও কোনও মুহূর্তে মানুষের মাথা খারাপ হয়ে যায়। পতনেরও একটা টান আছে বোঝা যায়। ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করে।

আপনার ইচ্ছে করছিল বুঝি? সাবর্ণী একটু হাসল।

আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রশ্ন নয়। অরীন্দ্র গম্ভীর হলেন। এ বয়সে অন্তত এই একটা ব্যাপার বুঝে গেছি, আমার নিজের আড়ালে কেউ আছে, আমি তার হাতে ধরা আছি। তুমি তোমার বোনের মতো আমাকে ফিলসফার বলতেও পারো। তবে এটা ফিলসফি নয়, সামথিং ন্যাচারাল। কেউ আড়ালে থেকে কাজ করছে, টের পাই।

সিঁড়ির মাথায় গিয়ে ছড়ির ডগায় ঘেঁড়া শুকনো একটুকরো গুল্ম সরিয়ে অরীন্দ্র ফের বললেন, গত অক্টোবরে তোমার বয়সী একটি মেয়ে আশাপুরা থেকে এখানে বেড়াতে এসেছিল। হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। পরে তাকে ওই খাদের জলে পাওয়া গেল। জেলেদের জালে বডিটা আটকেছিল। নইলে কেউ জানতেই পারত না।

সাবর্ণী এবার একটু চমকে উঠল, সে কী!

 পুলিশ অনেক কিছু বলেছিল। কিন্তু আমি জানি কী ঘটেছিল।

আপনি জানেন?

সিঁড়িতে সাবধানে নামতে নামতে অরীন্দ্র বললেন, জানি মানে প্রত্যক্ষদর্শী নই। কিন্তু আমি কারেক্ট। ব্যাপারটা নিয়ে আমার সেই বন্ধুর সঙ্গে ডিটেলস আলোচনা করেছিলুম। তিনিও সায় দিয়েছিলেন। এমনটি খুবই সম্ভব। কথায় কথায় ওঁর কাছে শুনেছিলুম, দিল্লিতে কুতুবমিনারে নাকি একা ওঠা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বুঝতে পারছ?

হুঁ। সাবর্ণী একটু হাসল। কিন্তু যে সুইসাইড করবে, সে এই পোডড়া কুঠির ছাদে উঠে জলে ঝাঁপ দেবে কেন? আরও তো কত সহজ উপায় আছে।

দ্যাটস দ্য পয়েন্ট। তুমি নিজেই নিজের কথা থেকে উত্তর খুঁজে নাও। অরীন্দ্র একটু দাঁড়িয়ে আগের মতো সহজ সুরে বললেন। তুমি কলকাতার মেয়ে। নিশির ডাকের গল্প জান না। সন্ধ্যার আসরে বলব’খন। ব্যাপারটা সাইকলজিক্যাল। নিজেই নিজেকে মৃত্যুর দিকে ডেকে নিয়ে যায় মানুষ। সে দিক থেকে ওই খাদটার একটা ভূমিকা আছে।

সাবর্ণী পাশ কাটিয়ে একটু জোরে নামতে থাকল। সহসা তার মধ্যে বালিকার চাঞ্চল্য এসে গিয়েছেল। পিউ দেখলে অবাক হত। দুই বোন পরস্পর উল্টো। নীচের চত্বরে দুধারে গুছিয়ে রাখা পাথরের স্তূপে জঙ্গল গজিয়ে আছে। থোকা-থোকা ফুল বেশি করে চোখে পড়ে। সাবর্ণী কয়েকটা ফুল ছিঁড়ে নিয়ে দেখল অরীন্দ্র আবার দাঁড়িয়ে গেছেন। সে বলল, আসুন। রাণুদিরা কোথায় দেখি।

অরীন্দ্র ছড়ি তুলে বললেন, ওই যে ক্লিফটনের কবর। ক্রস আর ফলকটা চোরে উপরে নিয়ে গেছে। দেখবে চলল!

কবর দেখার কী আছে?

 ক্লিফটন ওয়াজ আ পয়েন্ট। ফলকে সুন্দর করে একটা কবিতা খোদাই করা ছিল। নিজের এপিটাফ নিজেই লিখে গিয়েছিলেন। অরীন্দ্র অগত্যা এগিয়ে এলেন সাবর্ণীর দিকে। গাইডের ভঙ্গিতে বললেন, জনসাধারণের এই স্বভাব। ক্লিফটনগঞ্জকে লিটনগঞ্জ করে ছেড়েছে। তুমি নিশ্চয় জানতে না লিটনগঞ্জ আসলে ক্লিফটনগঞ্জ?

তাই বুঝি?

কিন্তু তুমি এত কম কথা বলো কেন? অরীন্দ্র হাসলেন। দম্পতি হিসেবে তোমাদের জুটিটি খাসা। উভয়েই মৌনী সাধু-সাধুনী। নাহ্, এও তোমার বিচ্ছু বোনের মন্তব্য। তবে প্ৰিয়টা এমন কাজের ছেলে হয়ে উঠেছে, অবিশ্বাস্য! তোমার বোনের মতে, কথা কম কাজ বেশি। আমি তোমার বোনের প্রেমে পড়ে গেছি। দোষ নিও না।

গেটের বাইরে গিয়ে সাবর্ণী বলল, রাণুদিরা কোথায় গেলেন বলুন তো?

ছড়ি তুলে অরীন্দ্র বললেন, ওই দেখ। আমি বুড়ো মানুষ। তুমি নবযুবতী। তোমার চেয়ে আমার দৃষ্টিশক্তি কত প্রখর দেখ।

পশ্চিম ও দক্ষিণে নীলচে টিলাপাহাড়গুলি এখন রঙিন দেখাচ্ছে দিনশেষের আলোয়। একটু দূরে আবছা দেখা যাচ্ছে ইরিগেশন ক্যানেলের ব্রিজ। সেখানে সাদা রঙের একটা মোটরগাড়ি। সাবর্ণী বলল, আপনি কিন্তু ওই সাদা গাড়িটা দেখতে পাননি!

গাড়ি? কোথায় গাড়ি?

 ওই তো।

অরীন্দ্র লক্ষ করে দেখে বললেন, কেউ বা কারা বেড়াতে এসেছে। মেলামেশা দেখে মনে হচ্ছে বাঙালি এবং সম্ভবত…হঁউ, সবাই গাড়িতে উঠেছে দেখছি। চেনাজানা কারও গাড়িই হবে।

সাবর্ণী একটু বিরক্ত হয়ে বলল, কোনও মানে হয়?

হয়। তোমার পি জি তো তার গাড়ি নিয়ে নিখোঁজ। তোমরা যে একটু চক্কর মেরে বেড়াবে, সেদিকে লক্ষ নেই হতচ্ছাড়ার। এখানে এসেও কাজ। রোসো, দেখাচ্ছি মজা।

গাড়িটা ওদিকে কোথায় যাচ্ছে?

আমার প্রেমিকাকে তুলে নিয়ে পালাচ্ছে। রসিকতা করলেন অরীন্দ্র। পালাক না রাণু আছে। সাত্যকিকেও কম ভেবো না। রোজ দু’বেলা বালির বস্তার সঙ্গে ঘুসোঘুসি করে। পিয়ালিটা অবশ্য ছিচকাঁদুনে। কিন্তু ও যত কাঁদবে, সাত্যকি তত লড়ার জোর পাবে।

অরীন্দ্র গলা নামিয়ে ফেল বললেন, তুমি কি টের পাওনি, ওরা প্রেমিক প্রেমিকা?

তার চোখে ঝিলিক এবং মুখে দুষ্টুমির জলছবি। সাবর্ণী একবার তাকিয়ে দেখে দৃষ্টি দূরে সরাল। সাদা গাড়িটা ক্রমশ অস্পষ্ট হতে হতে কুয়াশার ভেতর হারিয়ে গেল। বুনো ফুলগুলি রাগ করে ফেলে দিয়ে সে আস্তে বলল, চলুন, ফেরা যাক। ঠাণ্ডা লাগছে।

অরীন্দ্র তার স্কার্ফের দিকে তাকিয়ে বললেন, ক্লিফটনগঞ্জের ডিসেম্বর আর কলকাতার ডিসেম্বর এক জিনিস নয়। বেরুনোর সময় আমার লক্ষ করা উচিত ছিল। কিন্তু আমার প্রেমিকা তোমার চেয়ে বুদ্ধিমতী। পাতলুন জ্যাকেট পরে বেরিয়েছে। আবার বলে কী, মাই ডিয়ার গ্রান্ড ওল্ড ফেলো! আই অ্যাম আ পার্সন। মেয়ে-ফেয়ে বলা চলবে না। কী অদ্ভুত!

সাবর্ণী অন্যমনস্ক হাঁটছিল। অরীন্দ্র পুরুষ এবং মেয়ে নিয়ে সমানে কথা বললেন, সে শুনছিল না। রাস্তা তত চওড়া নয়। পিচের মোড়ক ফেটে কালো কালো পাথরকুচি ছড়িয়ে পড়েছে। দুধারে ঝোপঝাড়, একটা করে গাছ। তাকালে ভীষণ জ্যান্ত লাগে। একটু পরে সাবর্ণী বুঝতে পারল, যে চাপা অস্বস্তিটা সে কলকাতা থেকে এতদূরে বয়ে এনেছে, ক্রমশ সেটাই জোরালো হয়ে তাকে উত্ত্যক্ত করছে। তাই এখানকার কোনও কিছুতে সে মন দিতে পারছে না।

কোম্পানির কাজে প্রিয়গোপাল প্রায়ই বাইরে যায়। কিন্তু কাজের জন্য বাইরে গেলে সাবর্ণীকে কোনওবার সঙ্গে নেয় না। ব্যাপারটা এই প্রথম। দুদিন আগে সন্ধ্যা ছটায় যখন অফিস থেকে ফিরল, তখন পিউ ছিল ফ্ল্যাটে। এখানে আসার প্রস্তাব সে সরাসরি পিউকে দিল। স্মার্ট পিউ অবশ্য তক্ষুনি চার্জ করেছিল, এই লোভনীয় অফার পি জি সায়েবের বউয়েরই পাওনা। ম্যানার্স জানা উচিত। তারপর তীক্ষ্ণ হাসিতে ফালাফালা করে ফেলেছিল প্রিয়গোপালকে। কিন্তু তখন খটকা লাগেনি, এখন কেন যেন লাগছে। পিউকে কেন সঙ্গে আনল প্রিয়গোপাল? সাবর্ণীকে এড়িয়ে থাকবে বলে? তা হলে কি ডাকে আসা সেই চিঠিটা কোনওভাবে তার চোখে পড়েছে?

সাবর্ণী একটু চমকে উঠল। স্ত্রীর চিঠি পড়ার অভ্যাস প্রিয়গোপালের আছে কি? অন্তত এ তিনমাসে তেমনটি দেখেনি সাবর্ণী। তাই চিঠিটা একটা পত্রিকার ভেতর রেখে দিয়েছিল, আরও খুঁটিয়ে পড়বে বলেই। তা ছাড়া ওটা একটা অপমানজনক ক্ষত। জানে জ্বালা করবে। তবু ক্ষত বারবার দেখা এবং একটু খোঁচাখুঁচি করা যেন মানুষের অভ্যাস।

স্মৃতি যদি গণ্ডগোল না করে, চিঠিটা রাখা ছিল মেয়েদের পত্রিকার শরীরচর্চা। ফিচারটির ভেতর। অথচ এখানে আসার জন্য গোছগাছ করার সময় সেটা। ফিল্মস্টারদের পাতার ভেতর আবিষ্কার করেছিল।

পিউয়ের কাজ? পিউ নাকগলানে স্বভাবের মেয়ে। দিদির চিঠি সে কি পড়েছে?

 কিন্তু অমন চিঠি পড়লে পিউয়ের একটা দারুণ প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা। অনির্বাণকে পিউ ভাল চেনে। যা যা ঘটেছিল, সবই জানে। পিউকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল সাবর্ণীর।

একটা ব্যাপার এ মূহুর্তে অদ্ভুত লাগছে। গাড়িতে সারা পথ যেমন, তেমনই গতরাতে এখানে পৌঁছুনোর পর থেকে প্রিয়গোপাল কেমন অন্যমনস্ক আর গম্ভীর। রাতে গায়ে হাত রাখলে হঠাৎ কেন বলে উঠল, ভীষণ টায়ার্ড? সাবর্ণী বুঝতে পারছিল, প্রিয়গোপাল ঘুমুনোর ভান করে জেগেই আছে।

সকালে তাড়াহুড়োয় ব্রেকফাস্ট করে বেরুনোর আগে সাবর্ণীর সামনে দৃষ্টিকটুভাবে পিউকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে আদর করারও কি অন্য অর্থ আছে? কেন শ্যালিকাকে সঙ্গে আনার জন্য এত আগ্রহ হল প্রিয়গোপালের?

আরও একটা কথা। দাদামশাইকে বলে গেল, রেশমকুঠির বিখ্যাত ছাদটা দেখিয়ে আনবেন! তারীন্দ্রের কাছে জানা গেল ছাদটার পিছনে একটা ভয়ঙ্কর খাদের কথা! প্রিয়গোপাল ‘বিখ্যাত’ কথাটা যোগ করেছিল, এখন স্পষ্ট মনে পড়ছে।

এবং অরীন্দ্র বলছিলেন, তাঁকে সাবর্ণীর বডিগার্ড করে গেছে প্রিয়গোপাল! সত্যিই, নাকি নিছক কৌতুক?

দিনশেষের ধূসরতা, কুয়াশাও ক্রমে গাঢ়, হোঁচট খেল সাবর্ণী। অরীন্দ্র পাশ থেকে ধরে ফেললেন। পরনারীর অঙ্গস্পর্শ করতে হল! তিনি পূর্ববৎ রসিকতায় হাসলেন। তবে ভয়ের কিছু নেই রে ভাই! তোমার বোন হলে খুশি হওয়া যেত! লাগল নাকি?

নাহ।

তুমি…মানে তোমার চেহারা এক, আর তুমি অন্যরকম। বড্ড নিষ্প্রাণ! কেন? আমার সংসর্গ তোমার খারাপ লাগছে?

সাবর্ণী হাসবার চেষ্টা করল। খারাপ লাগবে কেন?

অরীন্দ্র একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, জানো? তোমার বয়সী একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়ে ছিল। রোজি ভেজিয়ার নাম। বড্ড ভাল মেয়ে। আমাকে ডাকত আঙ্কল অরা বলে। বয়স নাকি আমাকে অরা অর্থাৎ জ্যোতি উপহার দিয়েছে! তো ভেরি স্যাড। বেচারিকে খেল।

সাবর্ণী আনমনে বলল, কে?

অরীন্দ্র বিষণ্ণ এবং খসখসে গলায় বললেন, আবার কে? ওই রাক্ষুসে খাদ।

 সে কী!

সাবর্ণীর গলায় চমক লক্ষ করে অরীন্দ্র হাসতে হাসতে বললেন, তা হলে ব্যাপারটা তুমি বুঝতে পেরেছ এবার। না, এতে ভয়ের কিছু নেই। আমি তোমার বডিগার্ড। আমার প্রেমিকার জন্য কিন্তু আমার মাথাব্যথা নেই। সে নিজেই ডেঞ্জারাস।

অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়েটির কথা বলুন।

ওরা ফিরুক। সান্ধ্য আসরে জমিয়ে বলা যাবে।

আমি ভয় পাইনি কিন্তু।

অরীন্দ্র চুপ করে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে বললেন, রোজির বাবার কাছে তোমাদের নিয়ে যাব’খন। প্রায় আমার বয়সী মানুষ। রেলের গার্ড ছিলেন। অ্যাকসিডেন্টে একটা পা গেছে। কিন্তু ক্রাচে ভর করে তল্লাট চষে বেড়ান। তবে চেহারা দেখে মনে হবে একেবারে অথর্ব। ওই যে দেখছ আলো। দেখতে পাচ্ছ? ওইটে ওল্ড জেভিয়ারের বাংলো। বাংলো মানে ঝাঁঝরা কুঁড়েঘর এখন। কিন্তু গার্ডেনিংয়ের ভীষণ নেশা। ফুলে-ফুলে ছয়লাপ করে রেখেছে। সবই কিন্তু গেলাপ। বুঝলে কিছু?

একটু দেরি করে সাবর্ণী বলল, ওঁর মেয়ের নাম রোজি ছিল বললেন।

হুঁউ, তুমি ধরেছ। অরীন্দ্র শুকনো হাসির সঙ্গে বললেন, মেয়ের ট্রাজিক ডেথের পর জেভিয়ার একটু পাগলাটে হয়ে গেছেন। একমাত্র মেয়ে। জামাই ঝগড়া করে অস্ট্রেলিয়া চলে গিয়েছিল। আহ্! তুমি কিন্তু দেখে হাঁটছ না! আমাদের এদিকটায় মিউনিসিপ্যালিটির নজর কম। নতুন টাউনশিপে খুব নজর। তেলা মাথায় তেল।

সাবর্ণী হোঁচট সামলে নিয়ে বলল, আপনি কতদিন কলকাতা যাননি?

মনে নেই। বছর দশ-বারো হতেও পারে।

 গেলে দেখতেন, আমরা আজকাল কীভাবে হাঁটি।

নেচে-নেচে! অরীন্দ্র রসিকতা করলেন। হুঁ, আমার প্রেমিকার কাছে ডিটেলস শুনেছি। তার নাচুনি হওয়ার নাকি সেটাই বড় কারণ। রোসো! আজ সান্ধ্য আসরে তাকে নাচাব। মুজরো দিতে কার্পণ্য করব না। দেখবে’খন।

সংকীর্ণ একফালি পথ উঁচু জমিতে বাঁদিকে উঠে গেছে। দুধারে ঘন গাছ। সামনে পুরনো ফটক থেকে একটা বা হলুদ আলো ফেলেছে। কুয়াশায় সে আলো মলিন ও অমসৃণ। এই পথটা পাথরের ইটে বাঁধানা। সাবর্ণী এগিয়ে ছিল, হঠাৎ পেছনে থপ থপ শব্দে চমকে ঘুরল। অরীন্দ্র জুতো ঠুকে ধুলো ঝাড়ার চেষ্টা করছেন। রাস্তায় ধুলো ছিল না। হয়তো নেহাত বাতিক।

সকালে ভেতরে বাইরে ঘোরাঘুরি করে এসে পিউ বলেছিল, বিবি, জানিস তোর বরের বংশ খাঁটি লর্ড? কলকাতায় বোঝাই যায় না আমাদের পি জির পূর্বপুরুষ ব্যারন ছিলেন। আমি ভড়কে গেছি, রিয়্যালি! প্রিয়গোপাল সামনে ছিল। তার চিবুকের দাড়িতে খুঁচিয়ে পিউ বলছিল, জামাইবাবু, তোমাকে আদর, করা যাক। উরে ধ্বস! ভগীরথদা বলল, তোমার মায়ের নামেও তিনটে গোল্ডমাইন ছিল! পিউয়ের চুল টেনে প্রিয়গোপাল বলেছিল, গোল্ডমাইন! ক্লিফটনগঞ্জে গোল্ডমাইন! মাইকা। আর তখন আমার জন্মই হয়নি। বরং আমি এখন গোল্ডমাইনের মালিক। কটাক্ষটা সাবর্ণীর দিকে।

সুশীলা নামে কাজের মেয়েটি গরম জল করে দিলে সাবর্ণী বাথরুমে হাত পা এবং মুখ ধুল। ঘরে গিয়ে কাপড় বদলে এবং সামান্য প্রসাধন সেরে দোতলায় বাড়ির সামনের দিকের প্রকাণ্ড ব্যালকনিতে এল। চেয়ারে আলোয়ান মুড়ি দিয়ে বসেছেন অরীন্দ্র। বললেন, বসো। কড়া চা খাওয়া যাক। ওরা ফিরলে তখন আবার একদফা হবে। সুশি! জলদি করুনা ভাই! সাবর্ণীর দৃষ্টি বাইরে রাস্তার দিকে। কুয়াশা আর আঁধারে জমাট প্রকৃতি। দূরে ও কাছে একটি দুটি আলোর বিন্দু। সে গাড়ির আলো খুঁজছিল। বলল, ওরা ওদিকে কোথায় গেল বলুন তো? গাড়িটাই বা কার?

ওয়াটার ড্যামে ছাড়া আর কোথায় যাবে? আর গাড়িটা নিশ্চয় চেনা লোকের। অরীন্দ্র পা তুলে বসে আলোয়ান আরও জড়ালেন। কিন্তু ওই দেখ, তোমার নামটা গুলিয়ে যাচ্ছে। খুলে বলি। আজকাল ওইসব ভজকট নাম মনে রাখা কঠিন। তাই তোমাকে নাম ধরে ডাকছি না, লক্ষ করেছ? নাকি করোনি?

বিবি বলুন। সবাই বলে।

অ্যাহ! অসহ্য। বিবি কী? ফরগেট বিবি-টিবি। মেমসায়েব বলতুম। কিন্তু এটি আমার প্রেমিকার জন্য বরাদ্দ। দময়ন্তী! কেমন ভুলিনি দেখছ তো? তুমি কী যেন?

সাবর্ণী।

হ্যাঁ, তাই বটে। বোঝা যাচ্ছে, তোমার বাবা বিদ্বান মানুষ। সাবর্ণী। কিন্তু অস্যার্থ।

সাবর্ণী একটু হাসল। আমি জানি না।

ডিকশনারি ঘাঁটিয়ে ছাড়বে। ঠিক আছে। সুশীলা এসে টেবিলে ট্রে রাখলে অরীন্দ্র নিজেই চা করতে ব্যস্ত হলেন। তারপর সাবর্ণীর হাতে চায়ের কাপপ্লেট তুলে দিয়ে বললেন, জীবনে আমার এই একটা সুখের ব্যাপারই টিকে রইল। বাইরে ঘুরে এসে এক পেয়ালা কড়া চা। দারুণ না?

এই সময় গাড়ির শব্দ শোনা গেল। প্রিয়গোপালের গাড়ি নয়। সেই সাদা গাড়িটা গেটের কাছে সদ্য এসে থেমেছে। প্রথমে ভগীরথ, তারপর দলটা নামল। গাড়িটা পিছু হটতে হটতে রাস্তায় চলে গেল। নীচের হলঘরে কাঠের সিঁড়িতে নানারকম শব্দ। তার ভেতর নিজের বোনের পায়ের শব্দ সাবর্ণী খুঁজে নিতে পারে।

পিউ সোজা ব্যালকনিতে এল। পরনে জিনস, জ্যাকেট এবং মাথায় রেশমি স্কার্ফ জড়ানো। অরীন্দ্রের পাশের চেয়ারে শব্দ করে বসে বলল, থ্রিলিং। অসাধারণ!

অরীন্দ্র বললেন, তার চেয়ে অসাধারণ ব্যাপার তুমি মিস করেছ ডিয়ারি! দিদিকে জিজ্ঞেস করো! এটা আরও থ্রিলিং!

পিউ সাবর্ণীর দিকে তাকিয়ে নির্বিকার মুখে বলল, ফর ইওর ইনফরমেশন বিবি! গণাদার গাড়িতে খুব ঘোরা হল। ছবির লোকেশন খুঁজতে এসেছে গণাদা। আমরা এসেছি শুনে ভীষণ, ভীষণ খুশি। কাল মনিঙে আসবে। তবে ওর সঙ্গে যে এসেছে, সে এখানে আসবে কিনা তার গ্যারান্টি আমি দিতে পারছি না। জাস্ট ইমাজিন, হু ইজ দ্যাট ফেলো।

সাবর্ণী শুধু তাকাল।

শ্বাস-প্রশ্বাসে মিশিয়ে এবং ঠোঁটের কোনায় আলপিনহাসি রেখে পিউ বলল, আনুদা। জাস্ট থিং!

বলেই হঠাৎ সে উঠে গেল। অরীন্দ্র তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। সাবর্ণীর হাতে চায়ের পেয়ালা কেঁপে উঠেছিল। মাথার ভেতর একটা ঠাণ্ডা হিম ঢিল গড়িয়ে যাচ্ছে, টের পেল সে। অনির্বাণ হঠাৎ এখানে কেন? এমন একটা জঘন্য চিঠি লেখার পর এখানে চলে এসেছে ফিল্মমেকার গণনাথের সঙ্গে!

অজানা আতঙ্কে সাবর্ণী নিঃসাড় হয়ে গেল। তা ছাড়া ওই টোনে কথাটা বলেই পিউয়ের চলে যাওয়ার মধ্যে কী একটা রেড সিগন্যাল আছে যেন। সাবর্ণীর চারপাশ থেকে বাস্তবতাগুলি সহসা অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে। কাপ-প্লেটটা রাখতে গিয়ে শব্দ হল। হঠাৎ সেই কালো খাদটা তার খুব কাছে এসে পড়েছে, পায়ের একেবারে কাছাকাছি।..

.