হনিমুন রহস্য

হনিমুন রহস্য

ইলিয়ট রোডে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের তিনতলার অ্যাপার্টমেন্টে রবিবারের আড্ডাটা এদিন বেশ জমে উঠেছিল। আড্ডার যা নিয়ম। বাজারদর থেকে রাজনীতির হালচাল, তারপর দুর্নীতি-স্বজনপোষণ থেকে বাঁক নিয়ে প্রোমোটরচক্র এবং সেই সূত্রে কলকাতার বনেদি বাড়ি–তারপর সেইসব বাড়ি থেকে ভুত প্রেত অতৃপ্ত আত্মার রোমহর্ষক বৃত্তান্ত এসে গেল।

কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে থেকে একটি-দুটি সরস মন্তব্য ছুঁড়ে অবশ্য ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিলেন। তুমুল হাস্যরোল উঠে গা-ছমছম করা ভুতুড়ে আবহাওয়া নষ্ট করে ফেলছিল। আমার ধারণা, এর ফলেই গল্পের গতি ঘুরে গিয়েছিল রহস্যের দিকে। জীবনে কে কী রহস্যময় ঘটনা ঘটতে দেখেছেন, সেই প্রসঙ্গ এসে গেল।

বলা নিষ্প্রয়োজন, সুখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার, আমাদের প্রিয় হালদারমশাই প্রত্যেকের বলা রহস্যজনক ঘটনার জট ছাড়াতে বক্তাকে জেরা করেছিলেন। এতে কিন্তু আড্ডা আরও জমাট হয়ে উঠেছিল।

ইতিমধ্যে ষষ্ঠীচরণ আর এক দফা কফি দিয়ে গেল।

লক্ষ্য করছিলুম, এতক্ষণ চুপচাপ বসে চোখ বন্ধ করে সিগারেট টানছিলেন একসময়ের প্রখ্যাত চিত্রকর বসন্তকুমার রায়। বয়স সত্তরের ওধারে। শীর্ণ শরীর। মাথায় সাদা একরাশ চুল। কোটরগত চোখ। কিন্তু চোখে একটা অদ্ভুত তীক্ষ্ণ দীপ্তি আছে। কেমন যেন জান্তব আর রহস্যময়।

আমার সঙ্গে ওঁর যৎকিঞ্চিৎ পরিচয় কর্নেলের এই অ্যাপার্টমেন্টেই মাসদুয়েক আগে। কর্নেলের সঙ্গে ওঁর কোন সূত্রে পরিচয়, কর্নেল তা খুলে বলেননি। তবে দেশের বিখ্যাত মানুষজন যাঁরা, তাঁদের কার সঙ্গেই বা কর্নেলের পরিচয় নেই? তাই ওটা নিয়ে উচ্চবাচ্য করিনি।

এমন জমজমাট আড্ডায় ঐ ভদ্রলোকই নীরব, এটা অন্য কারও চোখে পড়েনি। কারণ প্রত্যেকেই নিজের কথা নিয়ে ব্যস্ত। ষষ্ঠী কফি দিয়ে গেলেও উনি চোখ বুজে আছেন দেখে বললুম, মিঃ রায়! কফি নিন।

বসন্তবাবু চোখ খুললেন। সেই বন্য দীপ্তিটা যেন আরও তীব্র মনে হলো আমার। উনি একটু নিঃশব্দ হাসি হেসে কফির পেয়ালা তুলে নিয়ে বললেন, রহস্য! আনসলভড মিস্ট্রি। হা! ঠিক তা-ই।

পুলিশ অফিসার বরেন ভদ্র সহাস্যে বললেন, আছে নাকি মিঃ রায়ের ঝুলিতে? ঝুলি খুলুন তাহলে।

ব্রিগেডিয়ার ইকবাল সিংহ ভাঙা বাংলায় বললেন, দেরি করবেন না প্লিজ! ওয়েদার ঠাণ্ডা হইয়ে গেল।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাই সম্ভবত জেরার জন্য তৈরি হয়ে বলে উঠলেন, কইয়া ফ্যালেন স্যার, হোয়াট ইজ দ্যাট আনসলভড মিস্ট্রি?

বসন্তবাবু কফিতে চুমুক দিলেন। তারপার জ্বলন্ত সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে ঘষে। আস্তে বললেন, আমার এই রহস্য আপনাদের মতো সাংঘাতিক নয়। রোমহর্ষক নয়। নেহাত সাদামাঠা। তবু–হ্যাঁ, এটা রহস্য। আমার জীবনের একটা রহস্য। এর জট বহু বছর ধরে চেষ্টা করেও খুলতে পারিনি। হাল ছেড়ে দিয়েছি শেষে। তো আপনারা যখন জানতে চাইছেন, তখন বলছি।

উত্তেজিত প্রাইভেট ডিটেকটিভ বললেন, কন শুনি! আপনার সাদামাঠা রহস্য হেভি হইতেও পারে!

বসন্তবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এখানে একজন যুবক আছে। বাকি সবাই প্রৌঢ় এবং বৃদ্ধ। আমার একটু সংকোচ হচ্ছে–

পাড়ার ডাক্তার তারক চক্রবর্তী দ্রুত বললেন, তাতে কি? জয়ন্তবাবু একালের ইয়ং ম্যান।

কর্নেল হাসলেন। জয়ন্ত আমার সংসর্গে ক্রমে নিরাসক্ত বৃদ্ধ হয়ে গেছে। আপনি বলুন।

বসন্তবাবু মিনিট দুয়েক চুপচাপ কফিতে চুমুক দিতে থাকলেন। ঘরে ততক্ষণে রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষার উত্তেজনা অনুভব করছিলুম। আসলে ভদ্রলোক এমনিতেই স্বল্পভাষী এবং আজকের আড্ডায় সারাক্ষণ নীরব থেকেছেন। তাই যেন একটা অস্বস্তিকর আবহাওয়া ঘনিয়ে উঠেছিল–তা উনি সাদামাঠা রহস্য বা যা-ই বলুন। তা ছাড়া নিজেই তিনি বহু বছর সেই রহস্যের জট ছাড়াতে পারেননি। কাজেই প্রত্যেকের আগ্রহ তীব্র হয়ে ওঠা স্বাভাবিক ছিল।

এবার একটা সিগারেট ধরিয়ে বসন্তবাবু বললেন, সে আমার যৌবনের কথা। খুলেই বলছি, আমি মশাই বরাবর উড়নচণ্ডী স্বভাবের মানুষ ছিলুম। পানদোষ ছিল। ঘরে থিতু হয়ে বসার ইচ্ছে ছিল না। কাজ বলতে একটাই ধ্যানজ্ঞান সেটা ছবি আঁকা।….

তো এদিক-সেদিক ছুঁ মারতে মারতে শেষাবধি একটা উপযুক্ত চাকরি পেয়ে গেলুম নামী বিজ্ঞাপন কোম্পানিতে। চন্দ্রাণী মজুমদারের সঙ্গে সেখানেই আলাপ। আমি ছবি আঁকতুম। লেআউট করতুম। আর চন্দ্রাণী তাতে লাগসই কথা জুড়ে দিত। চমৎকার সব বিজ্ঞাপন বেরিয়ে আসত দুজনের হাত দিয়ে।…

কথা না বাড়িয়ে বলি, চন্দ্রাণীর সঙ্গে একমাসের মধ্যে আমার প্রেম শুরু হয়ে গেল। তার একমাস পরে বিয়ে। বিয়েতে চন্দ্রাণীর একটাই শর্ত ছিল, আমাকে ড্রিঙ্ক ছাড়তে হবে। তবে হঠাৎ নয়–ক্রমে ক্রমে।….

কিন্তু– না। এসবে কোনো রহস্য-টহস্য নেই। বিয়ের পর আমরা যথারীতি হনিমুনে যাওয়ার প্ল্যান করলুম। তখন চন্দ্রাণীই বলল, তার এক বন্ধুর বাবার একটা সুন্দর পাহাড়ি বাংলো আছে বিহারের কঙ্কপুরে। একবার সে তার বন্ধু কুন্তলার সঙ্গে সেখানে গিয়েছিল। সে নাকি মর্ত্যে এক স্বর্গ।….

হ্যাঁ। স্বৰ্গই বলা চলে। বসতির শেষপ্রান্তে একটা টিলার গায়ে বাংলো। নামটাও সুন্দর, মুনভিলা। সেই টিলার পুরোটার মালিক নাকি চন্দ্রাণীর সেই বন্ধুর বাবা। টিলার দক্ষিণে পাহাড়ি নদী। আমার আক্ষেপ হচ্ছিল, ছবি আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে যাইনি। কিন্তু কি আর করা যাবে? ওই দুর্দান্ত বয়সে চন্দ্রাণী নামে এক ডানাকাটা পরীকে বউ করতে পেরেছি। ছবি নয়, রক্তমাংসের মানবী। তাই হনিমুনে গিয়ে আমার পানের মাত্রাটা একটু চড়ে গিয়েছিল। চন্দ্রাণী বাধা দিচ্ছিল। তবে তার শর্তের সঙ্গে আমার শর্তের কথা শুনিয়ে দিচ্ছিলুম-অর্থাৎ ক্রমে ক্রমে কমাব। অবশ্য জ্যোৎস্নার রাত এবং বসন্তকাল। প্রথম রাত্রে একটু বেসামাল হয়ে পড়েছিলুম, তা ঠিক।

বসন্তবাবু হেলান দিয়ে চোখ বুজে শ্বাস ছাড়লেন জোরে। হালদারমশাই বলে উঠলেন, মিস্ট্রিটা কন প্লিজ!

হ্যাঁ। মিস্ট্রি। বসন্তবাবু চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন আবার। বাংলোর কেয়ারটেকারের নাম রামধন। বুড়ো মানুষ। কিন্তু শক্তসমর্থ গড়ন। তার বউ মারা গেছে। চন্দ্রাণীর বয়সী একটি মেয়ে আছে তার। নাম সুশীলা। তার স্বামী নাকি চোরচোট্টা লোক। জেলে গেছে। তাই সুশীলা এসে বাবার কাছে আছে। আমাদের রান্নাবান্না সে-ই করে দেয়। বাবা-মেয়ে দুজনে পরিবেশন করে।…..

তো আমার মশাই আর্টিস্টের চোখ। সুশীলাকে বন্য সৌন্দর্যের প্রতীক মনে হয়। আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি দেখে চন্দ্রাণী কৌতুক করে–অথবা মেয়েলি ঈর্ষা বুঝি না। আমি বলি, এই মেয়েটি আমার ন্যুড ছবির মডেল হতে পারত। চন্দ্রাণী বলে, দেখ ওকে রাজি করাতে পার নাকি। কৌতুক!….

এভাবেই দুটো দিন গেল। তৃতীয় দিন রাত্রে আমি চন্দ্রাণীর বাধা সত্ত্বেও একটু বেশি ড্রিঙ্ক করে ফেললুম। তারপর কী হয়েছিল জানি না। একসময় ঘুম ভেঙে গেল। মাথা ভারী মনে হচ্ছিল। বুকের ভেতর অস্বস্তি। লক্ষ্য করলুম মশারি খাটানো আছে। আমার গায়ে চাদর চাপানো। জানলাগুলো খেলা। বাইরে জ্যোৎস্না। ঘরের ভেতর তত আঁধার নেই। মাথা কাত করে দেখলুম, চন্দ্রাণী আমার দিকে পিঠ রেখে একটু তফাতে শুয়ে আছে। তার গায়েও চাদর। আর ভেসে এল তার চুলের সুগন্ধ। হা-চন্দ্রাণী কি একটা সুগন্ধ ব্যবহার করত চুলে। সেক্সি গন্ধ খুলে বলতে দ্বিধা নেই।…

বসন্তবাবু আবার চুপ করলেন। হালদারমশাই বলে উঠলেন, কন।

চন্দ্রাণীর গায়ে হাত দেওয়ার সাহস পেলুম না। কারণ এতক্ষণে মনে পড়ল, সে আমাকে যাচ্ছেতাই অশালীন গাল-মন্দ করেছিল। করতেই পারে। আমার এত বাড়াবাড়ি করা উচিত হয়নি। হনিমুনে এসে মাতাল স্বামীকে কোন মেয়ে সহ্য করতে পারে?…

শরীরের অস্বস্তির চাপে মশারি তুলে বের হয়ে দরজা খুললুম। তারপর বারান্দায় গেলুম। পাহাড়ি বসন্তকালের জ্যোৎস্নারাতে বেশ হিম। অথচ বাইরে অপার্থিব প্রাকৃতিক লাবণ্য। লনে নেমে গিয়ে কয়েক মিনিট খোলা আকাশের নীচে দাঁড়াতেই শরীরের ভেতরকার অস্বস্তিটা চলে গেল। তারপরই হঠাৎ কানে এল, কারা লনের শেষপ্রান্তে চাপা স্বরে কথা বলছে। চমকে উঠেছিলুম। সুশীলা তার কোনো প্রেমিকের সঙ্গে কথা বলছে নিশ্চয়।…..

পরে মনে হয়েছিল, আসলে আমি কিছুটা ড্রাঙ্ক ছিলুম। না হলে এসব ক্ষেত্রে কোনো ভদ্রলোক নাক গলাতে যায়?…

তো আমি পা টিপে টিপে ঝোঁপের আড়াল দিয়ে ওদের কাছাকাছি গিয়ে গুঁড়ি মেরে বসে পড়লুম। আর তারপরই হতবাক হয়ে দেখলুম মেয়েটি সুশীলা নয়, আমার বউ চন্দ্রাণী।…..

প্রাইভেট ডিটেকটিভ বললেন, অ্যা কন কী? মিসেসেরে তো বিছানায় দেইখ্যা গেছেন!

বসন্তবাবু শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার মাথার ঠিক ছিল না। তখনই উঠে দাঁড়িয়েছিলুম। হয় তো মুখে কোনো শব্দও বেরিয়ে থাকবে। লনের কোনায় গাছের ছায়া থেকে দুটি মূর্তি নিমেষে উধাও হয়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে সেখানে কাকেও দেখতে পেলুম না। চারপাশে কেউ কোথাও নেই।…

টলতে টলতে ঘরে গিয়ে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিলুম। আশ্চর্য! মশারির ভেতরে চন্দ্রাণী তেমনি শুয়ে আছে। আমি দরজা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে বিছানায় গিয়ে চন্দ্রাণীর গায়ে হাত রাখলুম। চন্দ্রাণী ঘুমিয়ে আছে। হাতের চাপ বেশি হলে চন্দ্রাণী জেগে গিয়ে ঘুমজড়ানো গলায় বলল, আমাকে ছুঁয়ো না। আমি তখন ধাঁধায় পড়ে গেছি। তাহলে কি আমি নেশার ঘোরে ভুল দেখে এসেছি? হ্যালুসিনেশন?….

বসন্তবাবু সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ঘষে নিভিয়ে একটু হাসলেন। ডাঃ চক্রবর্তী বললেন, ইয়েস হ্যালুসিনেশন। বহুদিন ড্রিঙ্ক করলে রাতের দিকে এমন একটা

প্রাইভেট ডিটেকটিভ তার কথায় বাধা দিয়ে বললেন, সকালে মিসেসেরে কিছু জিগাইলেন না?

বসন্তবাবু আবার চোখ বুজে বললেন, নাহ্। কথাটা শুনে চন্দ্রাণী আমার ওপর খাপ্পা হয়ে তখনই চলে যেত বলে ভয় হয়েছিল।

হঃ। বুঝছি। তারপর?

পরের দিনটি আমরা অন্যদিনের মতোই কাটালুম। দেখলুম, চন্দ্রাণীর মেজাজ স্বাভাবিক হয়েছে। সন্ধ্যার পর চন্দ্রাণী যথারীতি আমাকে বেশি ড্রিঙ্ক করতে নিষেধ করল। আমি সেরাত্রে একটু সংযত থাকলুম। ডিনার খাওয়ার সময় সুশীলা একটু হেসে বলল, কাল রাত্রে সাহেবকে নিয়ে বহুত ঝামেলা হয়েছিল। চন্দ্রাণী বলল, আজ ঝামেলা করলে আমি সোজা স্টেশনে চলে যাব।..

তো সেদিন প্রকৃতির মধ্যে ঘোরাঘুরি করছিলুম। ক্লান্তি ছিল। খাওয়ার পর এ রাত্রে খুব শিগগির ঘুম এসে গিয়েছিল। কখন বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েছি, জানি না। একসময় গত রাতের মতো ঘুম ভেঙে গেল। সেইরকম মাথা ভার বুকের মধ্যে অস্বস্তি। ঘুরে দেখলুম, চন্দ্রাণী চাদর ঢাকা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। আমার দিকে পিঠ। ওর চুলের সেই সেক্সি গন্ধ ভেসে এল। কিন্তু ওকে জাগাতে ইচ্ছে হলো না। আসলে আমাকে গতরাতের সেই ভূতে পেয়েছিল। কিংবা বাইরে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস নিলে শরীরটা ঝরঝরে হবে এই ধারণা যে কোনো কারণে হোক, দরজা খুলে বেরিয়ে গেলুম। তারপর….. বসন্তবাবু হঠাৎ থেমে শ্বাস ছাড়লেন।

পুলিশ অফিসার বরেন ভদ্র বললেন, আবার আপনার স্ত্রীর কথাবার্তা শুনতে পেলেন নাকি?

হ্যাঃ। ঠিক গত রাতের মতোই। চন্দ্রাণী কার সঙ্গে কথা বলছে চুপিচুপি। বসন্তবাবু আবার ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, এবার একটা হেস্তনেস্ত করতেই হয়। আমি চন্দ্রাণী বলে ডেকেই দৌড়ে গেলুম। কিন্তু ঝোঁপের গায়ে লতায় পা জড়িয়ে পড়ে আছাড় খেলুম। তারপর দেখি কেউ কোথাও নেই। উত্তেজনার পর তীব্র অবসাদে যেন নিজের মৃতদেহ বয়ে নিয়ে ঘরে ফিরলুম। আলো জ্বেলে দেখি, মশারির ভেতর চন্দ্রাণী শুয়ে আছে। অথচ এ রাতে যেটা আশ্চর্য, তা হলো, এ রাতে আবছা চন্দ্রাণীকে আমি এক পলকের জন্য দেখতেও পেয়েছিলুম। আর নিজের স্ত্রীর কণ্ঠস্বর শুনে আমি চিনতে পারব না? তা ছাড়া জ্যোৎস্নায় তার পরনের নাইটিও লক্ষ করেছিলুম।…

আমি দ্রুত ঘরে গিয়ে চন্দ্রাণীকে আঁকুনি গিয়ে বললুম, ওঠ। ওঠ। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। চন্দ্রাণীর ঘুম ভেঙে গেল। সে মশারি থেকে বেরিয়ে শান্তভাবে বলল, কী হয়েছে? এমন কণ্ঠস্বরে সে প্রশ্নটা করল, আর তার চোখের দৃষ্টি এত উজ্জ্বল যে আমি কি বলব, বুঝতে পারলুম না। একটু পরে বললুম, দেখ, আমরা আর এখানে থাকব না। চন্দ্রাণী বলল, কী হয়েছে বল তো খুলে? অতিকষ্টে শুধু বললুম এটা একটা ভুতুড়ে বাংলো।

ব্রিগেডিয়ার কিবাল সিংহ হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক, ঠিক। সহি বাত। আ হন্টেড বাংলো।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ গম্ভীরমুখে বললেন, আপনার ওয়াইফেরে পরে সব কথা কইছিলেন?

বসন্তবাবু গম্ভীরমুখে বললেন, না। কঙ্কপুর থেকে ফেরার পর চন্দ্রাণী আমার মাতলামির চোটে ডিভোর্স নিয়েছিল। তারপর সে কোথায় আছে জানি না। প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর আগের কথা।

ডাঃ চক্রবর্তী উঠে দাঁড়ালেন। রায় দিয়ে গেলেন, হ্যালুসিনেশন। তাছাড়া আপনার অবচেতন মনে নিশ্চয়ই স্ত্রীর প্রতি কোনো কারণে সন্দেহ ছিল।

বসন্তবাবু বললেন, জ্ঞানত তাকে বিশ্বাস করতুম। তার কোনো প্রেমিক থাকলে টের পেতুম।

হালদারমশাই একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন, মিস্ট্রি। তবে এত বছর পর আর সৎ করণ যাইব না।

ততক্ষণে প্রায় এগারোটা বাজে। আচ্ছা ছেড়ে ডাঃ চক্রবর্তী, কিবাল সিংহ এবং বরেন ভদ্র একে-একে বেরিয়ে গেলেন। প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার মুখ নামিয়ে আঙুল খুঁটতে থাকলেন। আমি দেখলুম, বসন্তবাবু আবার চোখ বুজে সিগারেট টানছেন। ঠোঁটের কোনায় একটুখানি তেতো হাসি যেন খোদাই করা। পাথরের মূর্তির মতো স্থির তিনি। শুধু সিগারেটটা একবার করে জ্বলে উঠছে।

কর্নেল নিষ্পলক দৃষ্টে তাকে লক্ষ্য করছিলেন। হঠাৎ তিনি বললেন, আচ্ছা মিঃ রায়–

আপনি যখন ঘর থেকে বেরিয়ে যান, তখন দরজা খুলেই বেরিয়েছিলেন?

হা দরজায় ছিটকিনি দেওয়া ছিল।

বাইরে থেকে যখন ঘরে ফিরেছিলেন, তখন দরজা খোলা ছিল?

ছিল। পুরো খোলা।

পর-পর দুরাতেই—

 বসন্তবাবু চোখ বন্ধ রেখেই বললেন, হ্যাঁ। দুরাতেই দরজার অবস্থা একই ছিল।

বাংলোতে ফুলের গাছ বা ঝোপঝাড় ছিল?

 ছিল। দেশিবিদেশি ফুলের বাগান ছাড়াও কেয়ারিকরা অনেক ঝোপ-তাছাড়া উঁচু গাছও ছিল। বলেছি তো! একেবারে প্রকৃতির মধ্যিখানে মুনভিলা যেন স্বর্গপুরী।

 কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, আপনি যেখানে আপনার স্ত্রীর কণ্ঠস্বর শুনেছিলেন এবং তাঁকে দেখতে পেয়েছিলেন, সেখান থেকে আপনি যেখানে ওত পেতেছিলেন, তার দূরত্ব কত ছিল মনে আছে?

স্পষ্ট মনে আছে। বিশ-পঁচিশ হাতের বেশি দূরত্ব ছিল না।

যদি সত্যিই সেই মেয়েটি আপনার স্ত্রী হন, তা হলে তিনি যদি বাংলোর ঘরে ফিরে যান, আপনার তাঁকে দেখতে পাওয়ার চান্স ছিল কি?

এবার বসন্তবাবু চোখ খুলে সোজা হলেন। তার চোখের সেই তীক্ষ্ণ জাস্তব দীপ্তি ঝিলিক দিল। বললেন, নাহ্। দেখতে পাওয়ার চান্স ছিল না। কারণ আমার ডাইনে-বাঁয়ে দুদিকেই অনেক ঝোপ ছিল।

 আপনি সেই সময় বাংলোর দিকে ঘুরছিলেন কি?

বসন্তবাবু ঈষৎ ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বরে বললেন, না! না! আমি ওদের ঝোপঝাড় গাছের ফাঁকে খুঁজছিলুম।

তার মানে, চন্দ্রাণী ঝোপের আড়াল দিয়ে দ্রুত বাংলোয় ফিরে গেলেও আপনার তা চোখে পড়ার কথা নয়?

বসন্তবাবু নিষ্পলক তাকিয়ে বললেন, আমি বুঝতে পারছি না আপনি কী বলতে চান।

কর্নেল হাসলেন। তখন আপনার মানসিক সুস্থতা থাকার কথা নয়। নেশার হ্যাংওভার এবং তারপর আপনার স্ত্রী চন্দ্রাণীকে কারও সঙ্গে গোপনে কথা বলতে দেখে প্রচণ্ড বিস্ময়

প্রাইভেট ডিটেকটিভ ঝটপট বলে উঠলেন, মাথায় গণ্ডগোল হওনের কথা। ক্যান কী, যে ওয়াইফেরে বিছানায় দেইখ্যা গেছেন, তার বাইরে গোপনে কার সঙ্গে কথা কইতে দেখা।

কর্নেল হঠাৎ অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে বললেন, মিঃ রায় ঘুম ভাঙার পর বিছানায় দুরাতে একটু তফাতে যাকে চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে দেখেছিলেন, সে কেয়ারটেকারের মেয়ে সুশীলা।

বসন্তবাবুর মুখ দিয়ে কী একটা কথা বেরুল, বোঝা গেল না। তারপর তিনি। কপালে একবার করাঘাত করলেন শুধু। প্রাইভেট ডিটেকটিভ নড়ে বসলেন, হঃ। মাইয়াটা সুশীলা! আর কেউ হইতে পারে না।  

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ মেয়েটি সুশীলা। এটা নির্ভুল অঙ্ক মিঃ রায়। আপনার স্ত্রী চন্দ্রাণীর কোনো প্রেমিক ছিল তা স্পষ্ট। সে কঙ্কপুর পর্যন্ত অনুসরণ করেছিল চন্দ্রাণীকে। চন্দ্রাণী তার সঙ্গে রফার চেষ্টা করতেই সুশীলার সঙ্গে গোপনে একটা ব্যবস্থা করেছিলেন। আপনার স্বভাব এবং অভ্যাস চন্দ্রাণীর জানা। তিনি সুশীলার চুলে তার চুলের সুগন্ধ মাখিয়ে তাকে আপনার বিছানায় শুইয়ে প্রেমিকের সঙ্গে। কথা বলতে বেরিয়েছিলেন। আপনি যদি দৈবাৎ জেগে ওঠেন, চুলের গন্ধে চন্দ্রাণী। শুয়ে আছে ধরে নেবেন। আপনার সাদামাঠা রহস্যটার জট এই অঙ্ক দিয়েই খোলা যায়। এবার বাকিটা বুঝে নিন। চন্দ্রাণী ঘরে ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়েন এবং সুশীলা বেরিয়ে যায়।

বসন্তবাবুর হাত কাঁপছিল। কাঁপাকাঁপা হাতে সিগারেট ধরিয়ে আস্তে বললেন, আমি–আমি এত নির্বোধ!

হালদারমশাই উত্তেজিতভাবে বলে উঠলেন, না মিঃ রায়। রহস্যই আপনারে নির্বোধ করছিল।..