পাতাল গুহার বুদ্ধমূর্তি

পাতাল গুহার বুদ্ধমূর্তি

কর্নেলের জার্নাল থেকে

 হোটেল দ্য লেক ভিউ-এর ব্যালকনি থেকে বাইনোকুলারে সেই সেক্রেটারি বার্ডটিকে খুঁজছিলাম। সারস জাতীয় এই দুর্লভ পাখিকে বাংলায় বলা হয় কেরানি পাখি। কারণ, সহসা দেখলে মনে হয়, তার কানে যেন কলম গোঁজা আছে।

কাল বিকেলে হ্রদের তীর থেকে পাখিটাকে কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখেছিলাম। বিস্তীর্ণ এই প্রাকৃতিক জলাশয়ের মধ্যিখানে একটা জলটুঙ্গি আছে। সেখানে ঘন জঙ্গল। পাখিটা একলা, নাকি তার সঙ্গী বা সঙ্গিনী আছে জানি না। তবে সে অতিশয় ধূর্ত তাতে কোন সন্দেহ নেই। এমন একটা দুর্গম জঙ্গলে সে তার ডেরা বেছে নিয়েছে।

এই হ্রদের নাম বৃটিশ আমলে ছিল ‘মুন লেক’। পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছে। চন্দ্র সরোবর। আসলে এটি প্রাগৈতিহাসিককালের মৃত এক আগ্নেয়গিরির বিশাল ক্রেটার। চারদিকে ঘেরা উঁচু-নিচু পাহাড়। পর্যটন মন্ত্রকের তদারকে সম্প্রতি উত্তর এবং পূর্বদিকের পাহাড়ের গায়ে অনেক বাংলো, কটেজ, হোটেল, দোকানপাট–এমন কি একটি টাউনশিপও গড়ে উঠেছে। তবে সেই টাউনশিপটি ধনবানদের। অধিকাংশ সময় সেখানকার সুরম্য বাড়িগুলি খাঁ-খাঁ করে।

‘লেক ভিউ’ হোটেল হ্রদের পূর্বদিকের পাহাড়ের গায়ে এবং তীর থেকে। তার উচ্চতা অন্তত ষাট ফুট। এখান থেকে হ্রদের তীরে নেমে যাওয়ার জন্য একটি ঘোরালো এবং ঢালু পায়েচলা পথ আছে। বয়স্করা সে পথে নেমে যাওয়ার ঝুঁকি নেন না। উঠে আসার প্রশ্ন তো ভোলাই যায় না। তবে আমার কথা আলাদা। আমার অতীত সামরিক জীবনের সব শিক্ষা এই এই বৃদ্ধ বয়সে চমৎকার কাজে লাগছে। দেখে নিজেই বিস্মিত হই।

তো বয়স্কদের জন্য পায়ে হেঁটে বা গাড়ি চেপে চন্দ্র সরোবরের বেলাভূমিতে যাওয়ার পথটি আছে এই হোটেলের পূর্ব দিকে। ওই দিকটায় পাহাড় অতি ধীরে ঢালু হতে হতে সমতলে নেমে গেছে। বাঁক নিতে নিতে সেই পথ তাই পশ্চিমে হ্রদসীমান্তে পৌঁছেছে।

যে কাহিনীটি এখানে বলতে বসেছি, তা স্পষ্ট করে তোলার জন্যই পটভূমি ও পরিবেশের চিত্রটি ঈষৎ বিস্তৃতভাবে আঁকার প্রয়োজন হল। আর একটা কথা। নিজের সামরিক জীবনের স্মৃতির খাতিরেই চন্দ্র সরোবরের বদলে মুন লেক নামটি আমার পছন্দ। আমার তরুণ বয়সে এই দুর্গম পার্বত্যহ্রদের তীরে একটি সামরিক ঘাঁটি ছিল এবং সেই ঘাঁটিতে আমি কিছুদিন ছিলাম। শরৎকালের শুক্লপক্ষের রাতে যে বিস্ময়কর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখানে দেখেছিলাম, তা অবিস্মরণীয়। তৎকালেই বুঝেছিলাম এই হ্রদের নাম কেন মুন লেক দেওয়া হয়েছে।

মুন লেকের জলটুঙ্গিতে সেক্রেটারি বার্ডের খবর সম্প্রতি একটি ইংরেজি দৈনিকে বেরিয়েছিল। খবরটি পড়ে এখানে চলে এসেছি। নভেম্বরে পর্যটন মরশুম শুরু। হঠাৎ করে চলে আসার জন্য অগত্যা এই দোতলা হোটেলে উঠতে হয়েছে। নতুবা সরকারি বাংলো বা কটেজই আমার পছন্দ। সেখানে ভিড় ভাট্টা কম হয়।

ভোরে কুয়াশা ছিল। মুন লেকের তীরে সাড়ে আটটা অব্দি ঘোরাঘুরি করে পাখিটাকে দেখা এবং ক্যামেরায় টেলিলেন্স ফিট করে তার ছবি তোলার আশা ছেড়ে দিয়ে হোটেলে ফিরেছিলাম। তারপর দোতলার ব্যালকনিতে বসে কফি খেতে খেতে লক্ষ্য করেছিলাম, কুয়াশা সরে গিয়ে রোদ ছড়িয়েছে। তাই বাইনোকুলারে জলটুঙ্গিটা দেখছিলাম।

কিছুক্ষণ পরে আমাকে বোকা বানিয়ে পাখটা জলটুঙ্গির জঙ্গল থেকে সহসা উড়ে গেল। তার গতিপথ লক্ষ্য করতে গিয়ে একটা দৃশ্য দেখে একটু চমকে উঠলাম। মুন লেকের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে পাহাড়ের চূড়ার কাছাকাছি ঝুলে থাকা একটা চাতালের প্রায় শেষপ্রান্তে এক যুবতী দাঁড়িয়ে আছে এবং এক যুবক ক্যামেরায় তার ছবি তোলার জন্য তাকে আরও পিছনে হটে যেতে ইশারা করছে। প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা করছিলাম, আর এক পা পিছিয়ে গেলেই যুবতীটি নীচের গভীর খাদে পড়ে প্রাণ হারাবে। একটা সাংঘাতিক বিপজ্জনক ঘটনা। ঘটতে চলেছে। অথচ এত দূর থেকে আমার কিছু করার নেই। ওরা এত নির্বোধ কেন বুঝি না।

সহসা যুবতীটি পিছু ফিরে দেখেই দ্রুত সরে গেল। আমার আশঙ্কার অবসান ঘটল। এবার দেখলাম, যুবতীটি হাত নেড়ে তার সঙ্গীকে কিছু বলতে বলতে চাতালের পেছনের ধাপ বেয়ে নামতে শুরু করেছে। বাইনোকুলারে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম তার মুখে রাগের আভাস। যুবকটি অবশ্য হাসতে হাসতে তাকে অনুসরণ করছিল। পাথরের ধাপগুলির নীচে পাহাড়টা ক্রমে ঢালু হয়ে সমতলে নেমেছে। ঢালু অংশটা ঘাস আর ঝোপঝাড়ে ঢাকা। কিছুক্ষণ পরে হ্রদের তীরে তাদের আবার দেখতে পেলাম। এতক্ষণে তাদের চিনতে পারলাম। এই হোটেলেই কাল রাতে তাদের দেখেছি। নববিবাহিত বাঙালি দম্পতি বলেই মনে হয়েছিল তাদের। সম্ভবত বিয়ের পর হনিমুনে এসেছে।

কিন্তু যে দৃশ্যটা একটু আগে দেখলাম, তা নিছক নির্বুদ্ধিতা, নাকি অন্য কিছু, এই খটকাটা আমার মনে থেকে গেল। 

দশটায় নীচের ডাইনিং হলে নেমে গেলাম। মুন লেকের দিকের টেবিলগুলি ততক্ষণে আর খালি নেই। অগত্যা কোণের দিকে একটা খালি টেবিলে বসলাম। তারপর ব্রেকফাস্টের অর্ডার দিয়ে ডাইনিং হলের ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখতে থাকলাম। আসলে আমি সেই দম্পতিকে খুঁজছিলাম।

একটু পরে দেখি, আমার উল্টো দিকে তিনটে টেবিলের পর জানালার ধারে ওরা বসে আছে। যুবতীর মুখে এখন অনুচিত ধরনের একটা গাম্ভীর্য। সে চুপচাপ খাচ্ছে। যুবকটি চাপা গলায় কথা বলে সম্ভবত তার মানভঞ্জনের চেষ্টা করছে। যুবকটির চেহারা অবশ্য তত স্মার্ট নয়। একটু বোকা বোকা ছাপ আছে। যদিও চুলের কেতা আর পোশাকে সে প্রচণ্ডভাবে একালীন।

ব্রেকফাস্টের পর কফির পেয়ালায় সবে চুমুক দিয়েছি, এমন সময় যুবকটি হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। তারপর তার সঙ্গিনীকে কিছু বলে ডাইনিং হল থেকে বেরিয়ে গেল। এখান থেকে হোটেলের লাউঞ্জ চোখে পড়ে। তাকে লাউঞ্জ পেরিয়ে যেতে দেখে বুঝলাম, সে বাইরে কোথাও চলে গেল।

যুবতীটি ঘড়ি দেখে নিয়ে জানালার দিকে মুখ ঘোরাল। তার হাতে চায়ের কাপ। খুব দেরি করে সে কাপে চুমুক দিচ্ছিল।

ইতিমধ্যে ডাইনিং হল ফাঁকা হয়ে গেছে। প্রকৃতি প্রেমিকরাই এখানে পর্যটনে আসে। নভেম্বরের পাহাড়ি শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে এখন রোদের উষ্ণতা দরকার। তাই এখন মুন লেকের তীরে ভিড় হওয়ার কথা। আমিও শিগগির বেরিয়ে পড়তে চাইছিলাম। সেক্রেটারি বার্ডটি যদি দৈবাৎ ফিরে আসে, আকাশপথে তাকে ক্যামেরাবন্দি করার সুযোগ পেতেও পারি।

কিন্তু মনে খটকা থেকে গেছে। তাই কফি শেষ করে চুরুট ধরিয়ে সোজা যুবতীটির কাছে চলে গেলাম এবং মুখে উল্লাস ফুটিয়ে বলে উঠলাম, হাই ডার্লিং! তুমি এখানে?

যুবতীটি দ্রুত ঘুরে আমার দিকে তাকাল। সে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল। সামলে নিয়ে বলল, আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না।

মুখোমুখি চেয়ারে বসে সহাস্যে বললাম, ও ডার্লিং। এখনও তুমি ছোটবেলাকার মতোই দুষ্টু মেয়েটি হয়ে আছ। ওঃ! একবছর পরে তোমার সঙ্গে এখানে হঠাৎ এমন করে দেখা হয়ে যাবে কল্পনাও করিনি। বিয়ে করে ফেলেছ দেখছি। তারপর হনিমুনে আসা হয়েছে, তাই না?

সে বিরক্ত মনে বলল–দেখুন, আপনি ভুল করেছেন। আমি আপনাকে মোটেও চিনি না।

অনুরাধা। তুমি নিশ্চয় বাবা-মাকে না জানিয়ে বিয়ে করেছ! তাই

আমি অনুরাধা নয়। আপনি ভুল করছেন।

ভুল করছি? সে কি! অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে বললাম, অনুরাধাকে চিনতে ভুল করব আমি–এ তো ভারি অদ্ভুত। বুড়ো হয়েছি। দাড়ি পেকে সাদা হয়ে গেছে। মাথায় টাক পড়েছে। সবই ঠিক। কিন্তু এখনও আমার দৃষ্টিশক্তি তীক্ষ্ণ। চশমা পরার দরকার হয় না। আমি আমার ভাগনিকে চিনতে ভুল করব? সেই মুখ, সেই চোখ, সেই চেহারা। এমনকি কণ্ঠস্বরও এক এ কি করে হয়? না– তুমিই অনুরাধা।

আহ! বলছি আমি অনুরাধা নই।

তাহলে আমারই ভুল। কিন্তু

আপনি বাঙালি?

বিলক্ষণ। একেবারে ভেতো বাঙালি।

কাল রাতে আপনাকে এখানে দেখেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম আপনি বিদেশি ট্যুরিস্ট।

একটু হেসে বললাম, হ্যাঁ। এই ভুলটা অবশ্য অনেকে করে। কিন্তু আমার অবাক লাগছে, দুটি মেয়ের চেহারা আর কণ্ঠস্বর কিভাবে এক হয়!

আপনি কোথায় থাকেন?

 কলকাতায়। বলে পকেট থেকে আমার নেমকার্ডটা বের করে তাকে দিলাম।

সে কার্ডটা পড়ে বলল, আপনি মিলিটারি অফিসার?

 ছিলাম। এখন রিটায়ার্ড।

সে কার্ডটাকে আবার চোখ বুলিয়ে উচ্চারণ করল, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। নেচারিস্ট। নেচারিস্ট মানে?

প্রকৃতি প্রেমিক বলতে পারেন। প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ আমার একটা হবি। মুখটা একটু কাচুমাচু করে ফের বললাম, আই অ্যাম ভেরি সরি মিসেস

আমার নাম রাপ্তী সেন। আপনি আমাকে তুমি বলতে পারেন।

বলব। কারণ সত্যিই আমি অবাক হয়েছি। আমার ভাগনির সমবয়সী এবং অবিকল তার মতো দেখতে কোন মেয়েকে আপনি বলতে আমার বাধবে। যাই হোক, অনুরাধা যেমন আমাকে আঙ্কেল বলে ডাকত, তুমিও স্বচ্ছন্দে আঙ্কেল বলতে পারো।

রাপ্তী আমার নেমকার্ড আবার দেখতে দেখতে বলল, এটা আমি রাখতে পারি?

অবশ্যই পারো। তো রাপ্তী, তোমরা নিশ্চয় হনিমুনে এসেছ?

 রাপ্তী তার হ্যান্ডব্যাগে কার্ডটা চালান করে দিয়ে আস্তে মাথা দোলাল।

কলকাতা থেকে? নাকি

কলকাতা থেকে।

হাসতে হাসতে বললাম, আমার এই দ্বিতীয় ভাগনির বরের প্রশংসা করা উচিত। তার রুচি আছে। হনিমুনের উপযুক্ত স্থান সে বেছে নিয়েছে। কারণ এই পাহাড়ি লেকের পুরনো নাম কি জানো? মুন লেক। তো তোমার বর ভদ্রলোককে দেখছি না? আলাপ হলে ভালো লাগত।

ও ওর এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেল। ফিরতে একটু দেরি হবে বলে গেল।

তোমরা কত নম্বরে উঠেছ?

 দোতলায় ২২ নম্বর স্যুইটে। আপনি?

আমি ১৯ নম্বরে। উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, তা তুমি কি ওর জন্য এখানেই অপেক্ষা করবে? আমার মনে হচ্ছে, তোমার স্যুইট থেকে মুন লেক সরাসরি চোখে পড়ে। অবশ্য তুমি ইচ্ছে করলে এদিকের করিডর দিয়ে নেমে লেকের ধারে পৌঁছতে পারো। এখন রোদটা আরামদায়ক।

রাপ্তী উঠে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বলল, অচেনা জায়গায় একা ঘুরতে ইচ্ছে করে না। তাছাড়া তমাল ফিরে এসে আমাকে না দেখতে পেয়ে খুঁজতে বেরুবে।

তমাল? বাহ। বেশ সুন্দর নাম। তোমার নামটাও চমৎকার।

 রাপ্তী ডাইনিং হল থেকে বেরিয়ে করিডরে গেল। তারপর দোতলার সিঁড়িতে উঠতে থাকল। তাকে অনুসরণ করছি আঁচ করে সে একবার ঘুরে আমার দিকে তাকাল। বললাম, লেকের ধারে বড্ড বেশি ভিড়। আমি আমার সিঙ্গল স্যুইটের ব্যালকনি থেকে মুন লেকের সৌন্দর্য দেখব। সেজন্য এই বাইনোকুলারই যথেষ্ট।

দোতলার করিডরে গিয়ে রাপ্তী একটু দাঁড়াল। কিছু বলবে মনে হল। কিন্তু বলল না। তাদের স্যুইটের দিকে পা বাড়াল।

একটু কেশে আস্তে ডাকলাম, রাপ্তী।

রাপ্তী পিছু ফিরে বলল, কিছু বলবেন?

আস্তে বললাম, প্রায় এক ঘণ্টা আগে বাইনোকুলারে তোমাদের দেখছিলাম। না–ঠিক তোমাদের দেখছিলাম বললে আবার ভুল হবে। লেকের জলটুঙ্গিতে একটা পাখি দেখছিলাম। পাখিটা হঠাৎ উড়ে গিয়েছিল। তার গতিপথ লক্ষ করার সময় হঠাৎ দেখি, তুমি একটা বিপজ্জনক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে এবং তমাল তোমার ছবি তোলার চেষ্টা করছে। দৈবাৎ তুমি পেছনে না তাকালে কি ঘটত ভেবে শিউরে উঠেছিলাম।

রাপ্তী দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে হনহন করে চলে গেল।

একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর নিজের স্যুইটে ফিরলাম। যখন ওকে কথাগুলি বলছিলাম, তখন ওর মুখের রেখায় কি একটা ভাব ফুটে উঠেছিল, স্মরণ করার চেষ্টা করলাম। আতঙ্ক মিশ্রিত ক্ষোভ, নাকি নিছক ক্ষোভ? অথবা আতঙ্ক এবং বিস্ময়? অবশ্য আমার ভুল হতেও পারে। কিন্তু খটকাটা থেকে গেল।

ব্যালকনিতে এখন জোরালো হিম বাতাসের উপদ্রব। টুপি আঁটো করে পরে অন্য একটা পুরু জ্যাকেট গায়ে চড়িয়ে ইজিচেয়ারে বসলাম। বাইনোকুলারে জলটুঙ্গির জঙ্গল খুঁটিয়ে দেখার পর উত্তরে পাহাড়ের গায়ে কটেজ এরিয়া দেখতে থাকলাম। দেখার কোন কারণ যদি থাকে, তাহলে সেটাকে বলব একটা কটেজ না পাওয়ার দুঃখ। কটেজগুলি সত্যিই অসাধারণ। ওই দিকটায় প্রচুর গাছপালা আছে। প্রতি কটেজের সামনে একটা করে ফুলবাগান। তার ফলে ওখানে নানা প্রজাতির প্রজাপতি দেখতে পাওয়া সম্ভব। মুন লেকের দক্ষিণ তীরে কিছু জঙ্গল আর ঝোপঝাড় আছে। কাল বিকেলে সেখানে একজোড়া প্রজাপতি দেখেছিলাম। সাধারণ নাম অ্যাপোলো। প্রজাতির নাম পারনাশিউস অ্যাপেলো। শীতপ্রধান পার্বত্য অঞ্চলে এদের ডেরা। সেক্রেটারি বার্ডের দিকে মন পড়ে থাকায় ওদের ছবি তোলার চেষ্টা করিনি।

কটেজ এরিয়াটা দেখতে দেখতে হঠাৎ চোখে পড়ল দুটি লোক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যেন ঝগড়ার ভঙ্গিতে হাত নাড়ছে। বাইনোকুলারের দূরত্বনির্ণায়ক নবটা ঘুরিয়ে ঠিক জায়গায় আনতেই লেন্সে দুজন স্পষ্ট হয়ে উঠল। একজন মধ্যবয়সী, টাই-স্যুট পরা, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি এবং চোখে সানগ্লাস–সিনেমার ভিলেন টাইপ চেহারা। অন্যজন–হ্যাঁ, রাপ্তীর স্বামী তমাল সেন।

তবে নাহ্। ওরা তর্ক করছে না। দুজনের মুখেই হাসি আছে। সম্ভবত কোন বিষয়ে উপভোগ্য আলোচনা চলেছে। অতএব খটকা লাগার মতো কিছু নয়। কলকাতার কোন নববিবাহিত তমাল সেনের কোন পরিচিত লোক এখানে বেড়াতে আসতেই পারে। তমাল সেন তার সাথে দেখা করতে যেতেই পারে।

 ঠিক এই সময় কানে এল আমার স্যুইটের দরজায় কেউ জোরে নক করছে।  উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখি রাপ্তী সেন।…

.

রাপ্তীকে আমার স্যুইটের দরজায় দেখে উত্তেজনায় চঞ্চল হয়ে উঠেছিলাম তা ঠিক। কিন্তু তন্মুহূর্তে সংযত হয়ে সহাস্যে বললাম, এস রাপ্তী। আমি জানতাম তুমি এই অচেনা-অজানা জায়গায় একলা বোধ করবে এবং সময় কাটানোর জন্য বৃদ্ধ আঙ্কেলের সঙ্গে গল্প করতে আসবে।

রাপ্তী ঘরে ঢুকে নিজেই দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর মৃদুস্বরে বলল, আপনাকে দেখে মনে সাহস পেয়েছি। তাই একটা কথা বলতে চাই।

 বেশ তো। বলো। বসে বলল কি বলবে?

বসব না। যে কোন সময় তমাল এসে পড়তে পারে। কথাটা বলেই আমি চলে যাব।

কি কথা?

আপনি ঠিকই বলছিলেন। তমাল আমার ফটো তোলার জন্য একটা বিপজ্জনক জায়গায় আমাকে নিয়ে গিয়েছিল।

কথাটা বলে সে একটু থামল। তার মুখে চাপা উত্তেজনা ছিল। তারপর। আস্তে শ্বাস ছেড়ে ফের বলল, আমার বড় ভয় করছে। আর এখানে থাকতে একটুও ইচ্ছে করছে না। আমার সন্দেহ হচ্ছে, তমাল আমাকে হয় তো..

বলো।

রাপ্তীর মুখে ব্যাকুলতা ফুটে উঠল। চাপাস্বরে বলল, ব্যাপারটা ঠিক বোঝাতে পারছি না। তমালের হাবভাব এখানে এসে যেন বদলে গেছে। কাল রাতে কি একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। তারপর দেখি, তমাল বিছানায় নেই। ভাবলাম সে ব্যালকনিতে গিয়ে বসে আছে। কিন্তু উঠে গিয়ে দেখলাম সে ওখানে নেই। তাছাড়া প্রচণ্ড শীত। বিছানায় আবার শুয়ে পড়লাম। ঘুমের ভাণ করে জেগেই ছিলাম। প্রায় এক ঘণ্টা পরে আস্তে আস্তে বাইরের দরজা খুলে সে ঘরে ঢুকলো। আপনি জানেন, দরজায় ইন্টারলকিং সিস্টেম আছে। বাইরে থেকে ঢুকতে হলে চাবি দরকার।

তার মানে, সে চাবি নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল?

 হ্যাঁ।

তুমি ওকে জিজ্ঞেস করোনি কিছু?

না। বলে রাপ্তী করুণ মুখে আমার দিকে তাকাল। আমি খুব ভুল করেছি। তমাল সম্পর্কে আমার এক বন্ধু পারমিতা আমাকে সাবধান করে দিয়েছিল। কিন্তু তমালের হাবভাব আচরণে তেমন কিছু পাইনি যে ওকে খারাপ ভাবব। এখন মনে হচ্ছে, পারমিতা ওকে যতটা চেনে, আমি ততটা চিনি না। তমাল হয়তো সত্যিই খারাপ।

কোন অর্থে খারাপ?

রাপ্তী ব্যস্তভাবে বলল, পরে সময়মতো আপনাকে সব বলব। দরকার হলে আপনি প্লিজ আমাকে একটু সাহায্য করবেন যেন।

ওকে আশ্বাস দিয়ে বললাম, নিশ্চিন্তে থেকো। আমি তমালকে ওয়াচ করব। বাই দা বাই, তুমি এমন কোন লোককে কি চেনো, যার মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আর চোখে সানগ্লাস, প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি বয়স?

ট্রেনে ওইরকম চেহারার এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তাঁর নামটা কি যেন-হা, বিনয় শর্মা। নন-বেঙ্গলি হলেও ভাল বাংলা জানেন। কলকাতায় কি একটা ব্যবসা করেন। উনি ছিলেন ওপরের বার্থে। তমালের সঙ্গে খুব ভাব হয়েছিল। কেন একথা জিজ্ঞেস করছেন?

বিনয় শর্মাকে উত্তরের পাহাড়ে কটেজ এরিয়ায় এখনই দেখছিলাম। তোমার বর তার সঙ্গেই দেখা করতে গেছে। বলে একটু হেসে বাইনোকুলারটি দেখালাম। রাপ্তী, এই যন্ত্রটি দূরকে নিকট করে। যাই হোক, ব্যাপারটা আমি দেখছি। তোমার ভয়ের কোন কারণ নেই। তবে তুমি নিজেই সাবধান হতে শেখো।

রাপ্তী দরজা খুলে দ্রুত বেরিয়ে গেল।

তাহলে দেখা যাচ্ছে আমার খটকা লাগার পেছনে সঙ্গত কারণ ছিল। বরাবর আমি লক্ষ্য করেছি, আমার মধ্যে যেন কি একটা অতিরিক্ত বোধ ক্রিয়াশীল। ইনটুইশন বলা হোক, কি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়জাত বোধ বলা হোক, সামরিক জীবনেই এটা অর্জন করেছিলাম। বিশেষ করে জঙ্গলে গেরিলা যুদ্ধের তালিম নেওয়ার পর থেকে আমার ভেতরকার একটা সুপ্ত শক্তি সম্ভবত জেগে উঠেছিল। প্রাণীদের মধ্যে এটা আছে। সভ্যতা মানুষের অবচেতনার গভীরে একে নির্বাসিত করে রেখেছে বলেই আমার ধারণা।

এদিন দুপুরে হোটেলের পশ্চিম দিকের ঘোরালো পায়ে চলা পথটা দিয়ে মুন লেকের তীরে গেলাম। হ্রদে রোয়িংয়ের ব্যবস্থা আছে। একটা রোয়িং বোট পেলে জলটুঙ্গিটার কাছে যাওয়া সম্ভব হত। কিন্তু এই মরশুমে রোয়িং বোট পেতে হলে অন্তত সাতদিন আগে পর্যটন বিভাগের স্থানীয় অফিসকে, জানাতে হবে।

শেষে দক্ষিণের জঙ্গলে অ্যাপোলো প্রজাপতির খোঁজে গেলাম। জঙ্গলের ভেতরে অজস্র ছোট-বড় পাথরের চাই পড়ে আছে। সহসা পাথরের ফাঁকে একটা ফুলেভরা অর্কিড চোখে পড়ল। পাহাড়ি অর্কিড দেখতে পেলে আমার মাথার ঠিক থাকে না। পাথরের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে অর্কিডটার কাছে পৌঁছেছি। সেই সময় ওপরের দিকে ঘন পাইনবনের ভেতর থেকে সেই বিনয় শর্মা বেরিয়ে এল। সে আমাকে লক্ষ্য করেনি। কিন্তু ইচ্ছে করেই একটু কাশলাম। তখনই সে চমকে উঠে নীচের দিকে তাকাল। তারপর আমাকে দেখতে পেল।

আমি অর্কিডটার ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা তাক করলাম। কিন্তু চোখের কোনা দিয়ে তার প্রতি লক্ষ্য রাখলাম। সে আমাকে দেখছিল। একটু পরে সে আমার কাছে নেমে এসে ইংরেজিতে বলল, যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা বলব? এদিকটায় শঙ্খচূড় সাপের উপদ্রব আছে।

একটু হেসে ইংরেজিতেই বললাম, আপনি শঙ্খচূড় সাপ সম্পর্কে আমাকে সাবধান করে দিলেন, সেজন্য ধন্যবাদ।

আপনাকে বিদেশি পর্যটক মনে হচ্ছে। আপনি কি জানেন শঙ্খচূড় সাপ ঘণ্টায় পঞ্চাশ-ষাট কিলোমিটার বেগে দৌড়তে পারে?

হয়তো পারে। তবে এই শীতে নাকি শঙ্খচূড় সাপ বেরোয় না। আলাপ জমানোর ভঙ্গিতে ফের বললাম, আপনি কি স্থানীয় বাসিন্দা, নাকি আমার মতোই বেড়াতে এসেছেন?

বেড়াতে এসেছি। কিন্তু আপনি

 তার চোখে চোখ রেখে বললাম, বলুন।

হঠাৎ আপনাকে দেখে বিদেশি মনে হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে আপনি বিদেশি নন।

একটু হেসে বললাম, আপনার পর্যবেক্ষণ শক্তির প্রশংসা করছি। আমি বাঙালি।

বিনয় শর্মা চমকে উঠে বলল, অসম্ভব। বাঙালিদের সঙ্গেই আমার চেনাজানা বেশি। কারণ আমি কলকাতায় ব্যবসা করি। আপনার চেহারায় একটু বিশেষত্ব আছে।

থাকতেই পারে।

কিছু মনে করবেন না। আপনার মতো এমন লম্বা-চওড়া মানুষ সচরাচর। বাঙালিদের মধ্যে দেখা যায় না।

দেখা যায়। আপনি সম্ভবত লক্ষ্য করেননি। তাছাড়া বাঙালিরা মিশ্র জাতির মানুষ।

 বিনয় শর্মা এবার বাংলায় বলল, আপনার সঙ্গে আলাপ করে খুশি হলাম। আপনার পরিচয় পেলে খুশি হব।

আরও জোরে হেসে উঠলাম। বললাম, বুঝতে পারছি আপনি আমার কথা। শুনে আমার বাঙালিত্ব যাচাই করতে চান। তো আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি, সরকার। অবশ্য বহুবছর আগে সামরিক জীবন থেকে অবসর নিয়েছি। কিন্তু আপনার বাংলা শুনে মনে হচ্ছে, আপনি বাঙালি নন। ঠিক ধরেছি, তাই না?

বিনয় শর্মা অবাক দৃষ্টে তাকিয়ে বলল, অন্য বাঙালিরা ধরতে পারে না। কলকাতায় আমার জন্ম। সেখানেই বাস করি। হ্যাঁ, আমি বাঙালি নই। তার মানে, আমার মাতৃভাষা বাংলা নয়। আমার বাবা-মা এই উত্তরপ্রদেশের মানুষ। আমার নাম বিনয়কুমার শর্মা। যাই হোক, আপনি এখানে বেশিক্ষণ থাকবেন না। বাবার কাছে শুনেছি, শঙ্খচূড় সাপ শীতকালে অন্য সাপের মতো ঘুমিয়ে থাকে না।

কিন্তু মিঃ শৰ্মা, আপনার তো দেখছি শঙ্খচূড়ের ভয় নেই।

ভয় আছে। তবে আমি সঙ্গে লাইসেন্সড ফায়ার আর্মস রাখি। বিনয় শর্মা। ওপরের দিকে তর্জনী নির্দেশ করে বলল, সম্প্রতি খবরের কাগজে পড়েছিলাম, ওখানে কোন পাহাড়ের গায়ে নাকি প্রাচীন যুগের শিলালিপি খোদাই করা আছে। বুঝতেই পারছেন, আমি কারবারি লোক। নানা ধরনের কারবার করি। তাই ইচ্ছে ছিল শিলালিপির একটা ফটো তুলে তা থেকে কপি তৈরি করে বিদেশে কোন মিউজিয়ামকে বিক্রি করব। কিন্তু ওটা খুঁজে পেলাম না।

উৎসাহ দেখিয়ে বললাম, বলেন কি! কাগজে যখন খবর বেরিয়েছে, তখন ওটা সত্যিই কোথাও আছে। তাছাড়া স্থানীয় পর্যটন কেন্দ্রেরও সেটা জানার কথা।

ওঁরা জানেন না। বিনয় শর্মা গম্ভীর মুখে বলল, উড়ো খবর। আজকাল কাগজওয়ালারা মিথ্যা চটকদার খবর ছাপে। অকারণে আমি হয়রান হলাম। লাইফ রিস্ক নিয়ে ঘুরে বেড়ালাম। ফিরে গিয়ে ওই কাগজে প্রতিবাদ করে চিঠি লিখব।

বিনয় শৰ্মা পা বাড়িয়ে ফের বলল, আপনি বেশিক্ষণ এখানে থাকবেন না। বাবার কাছে শুনেছি দুপুরে শঙ্খচূড় সাপেরা জল খেতে নেমে আসে। বাবা একবার এই সাংঘাতিক সাপের পাল্লায় পড়েছিলেন।

সে আমায় পাশ কাটিয়ে নেমে গেল। হ্রদের তীরবর্তী সমভূমিতে গিয়ে সে একবার ঘুরে আমাকে দেখল। তারপর হনহন করে হাঁটতে থাকল। আমার হাসি পাচ্ছিল। কিছু লোক থাকে, যারা সবসময় অন্যদের নির্বোধ ভাবে। এই লোকটি সেই গোত্রের।

এখন সাড়ে বারোটা বাজে। বেলা দুটোর পর লেকভিউয়ে আর লাঞ্চ মেলে না শুনেছি। সময় হিসেব করে নিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলাম। কিছুটা ওঠার পর বাইনোকুলারে দেখলাম, বিনয় শর্মা লেকভিউ হোটেলের দিকে পায়ে চলা পথ ধরেছে। সে তা হলে তমাল সেনের কাছেই যাচ্ছে।

পাইনবনে ঢুকে সতর্কভাবে চারদিকে লক্ষ্য রেখে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করলাম। একটু পরে সহসা মাথায় এল, এভাবে আমি কিসের খোঁজে যাচ্ছি? বিনয় শর্মার গতিবিধির কোন সূত্রই তো আমার চোখে পড়ছে না। নাহ্! মাঝে মাঝে আজকাল যেন আমার কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায়। এতদিনে সত্যিই আমার বাহাত্তরে দশা ঘটেছে দেখছি।

ঢালের ঘাসে পা ছড়িয়ে বসে চুরুট ধরালাম। তারপর বাইনোকুলারে ফুটবিশেক নীচে পাইনবনটা খুঁটিয়ে একবার দেখে নিলাম। সেই সময় একটা মোটাসোটা পাইনগাছের তলায় কয়েকটা সিগারেটের টাটকা ফিল্টারটিপ চোখে পড়ল। বিনয় শর্মা তাহলে ওখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল।

তখনই নেমে গিয়ে জায়গাটা দেখলাম। পাঁচটা সিগারেট খেয়েছে বিনয় শর্মা। সে কি এখানে কারও জন্য অপেক্ষা করছিল? মাটিটা নগ্ন এবং এবড়ো খেবড়ো, জুতোর ছাপ খোঁজার চেষ্টা বৃথা। শুধু এটুকু বোঝা যাচ্ছে, স্বাভাবিকভাবে পাঁচটা সিগারেট খেতে যতটা সময় লাগে, এক্ষেত্রে তার চেয়ে দ্রুত সিগারেট খাওয়া হয়েছে। বিনয় শর্মাকে বেলা এগারোটায় প্রায় এক কিলোমিটার দূরে উত্তরের কটেজে তমালের সঙ্গে দেখেছি। প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে তাকে এই পাইনবন থেকে বেরুতে দেখলাম। তার মানে, সে বেশিক্ষণ আগে এখানে আসেনি। সম্ভবত আমি অর্কিডটার কাছে পৌঁছনোর কিছুক্ষণ আগেই সে এখানে উঠে এসেছিল। অন্য কোন দিক থেকে আমার অজ্ঞাতসারে সে দুর্গম এই জঙ্গলে উঠে আসতে পারে না। তবে এটা স্পষ্ট যে, সে খুব কম সময় এখানে ছিল এবং সেই সময়ের মধ্যে পাঁচটা সিগারেট খাওয়া তার তীব্র উদ্বেগকেই জানিয়ে দিচ্ছে।

অবশ্য এর উল্টোটাও হতে পারে। কেউ বিনয় শর্মার জন্যই কি উদ্বিগ্ন ভাবে এখানে অপেক্ষা করছিল? শর্মা এখানে আসার পর সে চলে গেছে কি?

কিন্তু তা হলে সে গেল কোন পথে? যেখানে অর্কিডটা দেখেছি এবং আমিও যেখান দিয়ে উঠে এসেছি, সেটা ছাড়া এই পাইনবনে পৌঁছনো যায় না। কারণ পাইনবনের নীচে খাড়া পাথরের পাঁচিল। কোথাও প্রকাণ্ড সব পাথর এলোমেলো পড়ে আছে একটার পর একটা। মাউন্টেনিয়ারিং-এ ট্রেনিং এবং সরঞ্জাম ছাড়া এই সব পাঁচিল আর পাথর বেয়ে এখানে ওঠা সম্ভব নয়। ওই একটামাত্র ওঠার পথ।

বাইনোকুলারে আবার চারদিক খুঁটিয়ে দেখতে থাকলাম। সেই সময় হঠাৎ  পাইনবনের ভেতরে একটা পাথরের পাশে একটা হাত নড়তে দেখলাম। শুধুই হাত। অর্থাৎ কব্জি থেকে আঙুল পর্যন্ত অংশটা।

বাইনোকুলার নামিয়ে খালি চোখে দেখলাম, হাতটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। পাথরটা আছে প্রায় কুড়ি মিটার দূরে একটু নিচু জায়গায়। দ্রুত সেখানে নেমে গেলাম। তারপর চমকে উঠলাম।

পাথরের পেছনে আষ্টেপৃষ্ঠে দডিবাঁধা অবস্থায় কেউ কাত হয়ে পড়ে আছে। এবং বাঁধনমুক্ত হওয়ার চেষ্টায় মাঝে মাঝে নড়াচড়া করছে। হাঁটু দুমড়ে বসে তার মুখটা ঘুরিয়ে দিয়ে দেখি, সে তমাল সেন।

তার মুখে টেপ সাঁটা আছে। আমাকে দেখা মাত্র সে গোঁ-গোঁ করে উঠল।

আমার সঙ্গে সবসময় নানাধরনের দরকারি জিনিস থাকে। জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে একটা ছোট্ট ছুরি বের করে দড়িটা কাটতে শুরু করলাম। লাইলনের মোটা দড়ি কাটতে একটু সময় লাগল। কাঁধে ঝোলানো জলের বোতল থেকে তার মুখে জলের ঝাপটা দিলাম। তারপর তার মুখের টেপ খুলে ফেললাম। সে অতি কষ্টে উচ্চারণ করল, জল।

জল খাইয়ে তাকে একটু সুস্থ করে টেনে ওঠাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে পাথরে হেলান দিয়ে বসে হাতের ইশারায় আমাকে নিবৃত্ত করল। দেখলাম দড়ির বাঁধন ছাড়াও তাকে চড়-কিল-ঘুষি মারা হয়েছে। চোয়ালে এবং চোখের নীচে লালচে দাগ বেশ স্পষ্ট। একটু পরে সে ভাঙা গলায় ইংরেজিতে বলল, শিগগির আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলুন। ও যে কোন সময় এসে পড়বে।

বাংলায় বললাম, তুমি আমার কাঁধে হাত রেখে ওঠার চেষ্টা করো। দেখতেই তো পাচ্ছ আমি একজন বুড়ো মানুষ। তোমাকে কাঁধে বওয়ার শক্তি আমার নেই। বিশেষ করে এটা পাহাড়ি জঙ্গল।

সে চমকে উঠে তাকাল। তারপর আমার কাধ আঁকড়ে ধরে উঠল। কি ভাবে তাকে নীচের সমভূমিতে নিয়ে এলাম, সে বর্ণনা এখানে অবান্তর। তবে শুধু এটুকুই বলা উচিত, সামরিক জীবনে আহত সঙ্গীকে বয়ে আনার যেসব কৌশল শিখেছিলাম, সেগুলি আবার কাজে লাগল।

নীচে নেমে তমাল বলল, আপনাকে আমি লেক ভিউ হোটেলে দেখেছি। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আপনাকে ছোট করতে চাই না। আপনি যে বাঙালি, তা বুঝতে পারিনি।

হ্যাঁ। আমি বাঙালি। আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। তো তুমি কি এখন হাঁটতে পারবে? নাকি ট্যুরিস্ট সেন্টারে গিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করব?

প্লিজ কর্নেল সাহেব। তমাল করজোড়ে বলল, আমাকে এখানে একা ফেলে রেখে চলে যাবেন না। আর একটু বিশ্রাম নিলেই আমি হেঁটে যেতে পারব।

তুমি কি বিনয় শর্মাকে ভয় পাচ্ছ?

আপনি চেনেন ওকে? তমাল অবাক হয়ে বলল, কি করে ওকে চিনলেন?

চিনি। কি সূত্রে চিনি, পরে বলব। আর এও জানি, তোমার নাম তমাল সেন।

কে আপনি?

না– তোমার ভয় পাওয়ার কারণ নেই। আমি থাকতে বিনয় শর্মা আর তোমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। আপাতত লেকের ওপর চল। রোদে কিছুক্ষণ বসলে তুমি ধকল কাটিয়ে উঠতে পারবে।

.

তমালকে নিয়ে হোটেলে ফেরার পথে বাইনোকুলারে লক্ষ্য রেখেছিলাম, বিনয় শর্মা আসছে কি না। কিন্তু তাকে কোথাও দেখতে পাইনি। ব্যালকনিতে রাপ্তীকে দেখতে পেয়েছিলাম। সে আমাদের দেখতে পেয়েই উঠে দাঁড়িয়েছিল। একটু পরে যখন আমার কাঁধে ভর করে তমাল হোটেলের পথে চড়াইয়ে উঠছে, তখন রাপ্তী দৌড়ে এসেছিল। তাকে বলেছিলাম, এখন কোন কথা নয়। আপাতত বেচারাকে একটু সাহায্য কর।

দোতলায় ওদের স্যুইটে তমাল বিছানায় শুয়ে পড়েছিল। তখন দুটো বেজে গেছে। কিন্তু আমার কপালগুণে ডাইনিং হলে ঢুকে খাদ্য পেয়েছিলাম। ম্যানেজার ভদ্রলোক অতিশয় সজ্জন মানুষ। গত রাতে তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আমার সাদা দাড়ি এবং নেমকার্ডের জোরে তার খাতির পেয়েছিলাম। তিনি আমার টেবিলে এসে এবেলা জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোন অসুবিধে হচ্ছে কি না। সুযোগ পেয়ে তাকে বলেছিলাম, সম্ভব হলে ২২ নম্বর স্যুইটে আমার ভাগনি এবং তার বরের জন্য যেন খাবার পাঠিয়ে দেন। ম্যানেজার সহাস্যে বলেছিলেন, কোন অসুবিধে নেই। আসলে ক্ষেত্রবিশেষে নিয়ম শিথিল না করে তাদের উপায় থাকে না। দৈবাৎ কোন হামরা-চোমরা অর্থাৎ ভি আই পি দুটোর পর এসে পড়লে তো তাদের জন্য যেকোন ভাবে একটা ব্যবস্থা করতেই হয়। কাজেই আড়াইটে অব্দি তারা কিচেন খোলা রাখেন।

গোগ্রাসে লাঞ্চ সেরে ওপরে গিয়ে ২২ নম্বরে নক করেছিলাম। রাপ্তী দরজা খুলে বলেছিল, খাবার দিয়ে গেল। আপনিই পাঠিয়েছেন বুঝতে পারলাম। কিন্তু আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। তমাল খাচ্ছে। তবে ওর চোয়াল নাড়তে কষ্ট হচ্ছে। সঙ্গে কোন পেইনকিলার আনি নি যে ওকে খাইয়ে দেব।

বলেছিলাম, পেইনকিলার খাওয়া ঠিক নয়। ওকে বিশ্রাম করতে দাও। আর একটা কথা। তোমরা দুজনেই যেন আমাকে না জানিয়ে হোটলে থেকে বেরিয়ো না। তুমি তিনটের মধ্যে আমার সঙ্গে একবার দেখা করো।

নিজের স্যুইটে ঢুকে ও পোশাক বদলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। তারপর ব্যালকনিতে গিয়ে বসলাম। জলটুঙ্গির ওপর সূর্য কাত হয়ে ঝুলে পড়ছে। বাইনোকুলারের লেন্সে সোজা রোদ পড়লে আমার চোখের ক্ষতি হবে। তাই সেক্রেটারি বার্ডের আশা আপাতত ছেড়ে দেওয়াই ভাল। বরং কিছুক্ষণ পরে হ্রদের ধারে গিয়ে একবার চেষ্টা করা যেতে পারে। এদিন আমি ক্লান্তও বটে। একটু বিশ্রাম করা দরকার।

রাপ্তীর প্রতীক্ষা করছিলাম। কিন্তু তিনটে বেজে গেল। সে এল না। ভাবলাম, তমালের মুখে বিনয় শর্মার হাতে তার দুরবস্থার বিবরণ পেয়ে গেছে বলেই আসছে না।

সেক্রেটারি বার্ড, না তমাল-রাপ্তী, কোন বিষয়টাকে অগ্রাধিকার দেব, ঠিক করতে পারছিলাম না। তাই একটা কয়েন টস করলাম। সেক্রেটারি বার্ড টসে জিতল।

হ্রদের তীরে এখন দ্রুত ছায়া ঘনিয়ে আসছে। কারণ সূর্য পশ্চিমের পাহাড়ের চূড়া ছুঁয়েছে। সেক্রেটারি বার্ড বাইনোকুলারে ধরা পড়ল না। জলটুঙ্গির জঙ্গল ঘিরে হালকা কুয়াশা জমেছে। রোয়িং বোটগুলি একে একে তীরে ভিড়ছে। আজ ঠাণ্ডাটা কালকের চেয়ে বেশি। অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে উত্তরের পাহাড়তলিতে গেলাম। পর্যটন অফিসে সবে আলো জ্বলে উঠল। কাউন্টারে এক কর্মী বসে চা খেতে খেতে রেকর্ডপ্লেয়ার বাজাচ্ছিলেন। আমাকে দেখেই তিনি ইংরেজিতে বলে উঠলেন, অত্যন্ত দুঃখিত স্যার। আপনাকে কোন কটেজ দিতে পারছি না। বাংলো দুটি তো ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বুক হয়ে আছে। আপনাকে গতকাল তা জানিয়েছি।

বললাম, না। আমি আর কটেজ বা বাংলোর জন্য আসিনি। একজন চেনা লোকের খোঁজে এসেছি। তিনি কটেজে উঠেছেন। কিন্তু কটেজ নম্বর জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি। তার নাম বিনয় শর্মা।

কর্মী ভদ্রলোক রেজিস্টার্ড খুলে তন্নতন্ন খুঁজে বললেন, না। বিনয় শর্মাকে পাচ্ছি না। তিনি কবে এসেছে?

প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বললাম, তার মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আছে। সবসময় চোখে সানগ্লাস পরে থাকে। চোখের অসুখ আছে। বেশ হৃষ্টপুষ্ট গড়ন। চল্লিশের কাছাকাছি বয়স।

ভদ্রলোক একটু হেসে বললেন, ও। আপনি তাহলে ডঃ রঘুবীর প্রসাদের কথা বলছেন? আপনি যে বর্ণনা দিলেন, তা ডঃ প্রসাদের। উনি একজন বিখ্যাত লোক। প্রায়ই এখানে আসেন।

বিস্ময় চেপে বললাম, দুঃখিত। আসলে বার্ধক্যজনিত স্মৃতিভ্রংশ। বিনয় শর্মার সঙ্গে ডঃ প্রসাদকে গুলিয়ে ফেলেছি। হ্যাঁ। ডঃ রঘুবীর প্রসাদকেই আমি খুঁজছি।

ডঃ প্রসাদ, উঠেছেন ১২৭ নম্বর কটেজে। পর্যটন কর্মী কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এসে কটেজে পৌঁছনোর পথটাও বলে দিলেন।

সেই সময় অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতো বললাম, আসলে উনি চন্দ্র সরোবর এলাকার কোন পাহাড়ে প্রাচীন শিলালিপির খোঁজ পেয়েছেন। আমিও এ বিষয়ে একটু কৌতূহলী।

পর্যটন কর্মী মন্তব্য করলেন, ডঃ প্রসাদ একজন ঐতিহাসিক।

তাঁর কাছে বিদায় নিয়ে ১২৭ নম্বর কটেজ খুঁজে বের করতে সাড়ে চারটে বেজে গেল। এখনই কটেজ এলাকায় সন্ধ্যার ধূসরতা ঘনিয়েছে। কটেজগুলি একই গড়নের ছোট্ট বাড়ি এবং রঙিন টালির চাল। সামনে সুদৃশ্য লন এবং ফুলবাগান আছে। গেটের কাছে উঁকি মেরেই পিছিয়ে এলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। ঘরের পর্দা তুলে এইমাত্র যে বারান্দায় এল, তাকে বারান্দার আলোয় চিনতে দেরি হয়নি। সে রাপ্তী সেন।

কটেজের নিচু পাঁচিলের আড়াল দিয়ে গুঁড়ি মেরে রাস্তার মোড়ে একটা উঁচু আইল্যান্ডের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কেউ আমাকে দেখল কি না লক্ষ্য করার সুযোগ ছিল না।

একটু পরে দেখলাম, রাপ্তী এবং বিনয় শর্মা চাপা গলায় কথা বলতে বলতে লেকের দিকের উৎরাইয়ে নেমে যাচ্ছে। আর এক মিনিট দেরি করলে ওরা আমাকে দেখে ফেলত। তার ফলে অন্য কি ঘটত জানি না। কিন্তু ওরা যে খুবই সতর্ক হয়ে যেত তাতে ভুল নেই।

টুপিটা কপালের ওপর নামিয়ে মাফলারে দাড়ি ঢেকে এবং একটু কুঁজো হয়ে ওদের অনুসরণ করলাম। পর্যটন অফিসের কাছে গিয়ে ওরা দাঁড়াল। তারপর রাপ্তী চলে গেল। আমি দ্রুত সামনের একটা কটেজের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালাম। ডঃ রঘুবীর প্রসাদ ওরফে বিনয় শর্মা কোন দিকে না তাকিয়ে হনহন করে নিজের কটেজের দিকে ফিরে চলল।

এবার আমি পর্যটন অফিসের কাছে গিয়ে ওদের ক্যান্টিনে ঢুকলাম। এই উত্তেজনার সময় এক পেয়ালা কফির দরকার ছিল। তাছাড়া ঠাণ্ডাটাও ক্রমে বেড়ে যাচ্ছিল।

ক্যান্টিনে লাইন দিয়ে লোকেরা কফির কুপন কিনছে এবং লাইন দিয়ে সেই কুপন দেখিয়ে পেপারকাপে কফি নিচ্ছে। বসার জায়গা খালি নেই। কিন্তু কি আর করা যাবে?

কিছুক্ষণ পরে এক কোণে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছি, সেইসময় এক যুবতাঁকে কফির লাইনে দেখতে পেলাম। তার পরনে জিনস্ আর ব্যাগি সোয়েটার। মাথায় একটা স্কার্ফ জড়ানো। মুখে উদ্ধত লাবণ্য আছে। যুবক-যুবতীদের প্রতি আমি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করি এবং আমার সমবয়সীদের চেয়ে তাদের। সঙ্গেই আমার প্রগাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এ নিয়ে আমার চেনা মহলে অনেক রসিকতা চালু আছে। আসলে নিজের যৌবনের স্মৃতিই যে আমার এই স্বভাবের মূল কারণ, সেটা কাকেও বোঝাতে পারি না। যুবক-যুবতীদের যৌবনের উষ্ণতায় নিজের অতীতকে আমি ফিরে পাই যেন। যুবক-যুবতী নির্বিশেষে আমি যে ডার্লিং বলে সম্ভাষণ করি, তার কারণও এই।

যুবতীটির কোন সঙ্গী বা সঙ্গিনী নেই। কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে সে বাঁকামুখে স্বগতোক্তি করল, ইশ! কি বিচ্ছিরি কফি।

বুঝলাম যে বাঙালি মেয়ে। একটু এগিয়ে তার কাছাকাছি গিয়ে বললাম, এখানকার ঠাণ্ডাটাও বিচ্ছিরি কি না। এরকম বিচ্ছিরি কফি ছাড়া এই বিচ্ছিরি ঠাণ্ডা জব্দ হবে না।

সে নিষ্পলক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

একটু হেসে বললাম, অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই বুড়ো বয়সে আমি যদি মুন লেকে বেড়াতে আসতে পারি, কমবয়সীদের না পারার কারণ দেখি না। তবে মুন লেকে রোয়িং করতে বললে আমি কিন্তু পারব না।

এবার সে আস্তে বলল, আপনি কে জানতে পারি?

অবশ্যই। বলে জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে একটা নেমকার্ড বের করে তাকে দিলাম।

কার্ডটা পড়ে সে বলল, আপনার নামটা চেনা মনে হচ্ছে। কোথায় যেন পড়েছি। কি মনে করতে পারছি না। আপনি কোথায় উঠেছেন?

হোটেল দ্য লেক ভিউ-তে। তুমি? তুমি বলছি, কিছু মনে করো না। তুমি আমার মেয়ের বয়সী। বলে হেসে উঠলাম। অবশ্য কোন ছেলেমেয়ে নেই। কারণ আমি বিয়ে-টিয়ে করিনি।

সে হাসল না। বলল, বিয়ে-টিয়ে বলছেন কেন? বিয়ে ব্যাপারটা জানি। টিয়ে কি জানি না।

বিয়ে যেমন আছে, তেমনি টিয়েও আছে। যাই হোক, তুমি কোথায় উঠেছ?

 ইস্টার্ন লজে।

 তোমার বন্ধুরা কোথায়?

আমার কোন বন্ধু নেই।

 সে কি! তুমি একলা এসেছ?

এতে অবাক হওয়ার কি আছে?

হু। নেই। তো

 তবে কি?

 তোমার বয়সী যারা, তাদের বন্ধু না থাকাটা অস্বাভাবিক।

 আমি একটু অস্বাভাবিক।

 বাহ। এই ঠাণ্ডায় তোমার কথাবার্তা আরাম দিচ্ছে।

তার মানে? কি বলতে চান আপনি?

 বলতে চাই, তোমার কথাবার্তায় যথেষ্ট উত্তাপ আছে।

সে কার্ডটা আবার দেখতে দেখতে কফিতে চুমুক দিল। আমি কফির কাপ আবর্জনার ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে চুরুট বের করলাম। তারপর যেই চুরুটটা লাইটার জ্বেলে ধরিয়েছি, সে অমনই আস্তে বলে উঠল, আপনাকে আমি চিনতে পেরেছি। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় আপনার কথা আমি পড়েছি। আপনি কফি এবং চুরুটের ভক্ত, তাও জানি। আপনি সেই বিখ্যাত

তাকে থমিয়ে দিলাম। মিটিমিটি হেসে বললাম, চেপে যাও। কথায় বলে দেওয়ালের কান আছে।

এতক্ষণে সে একটু হাসল। নিষ্প্রাণ হাসি। তারপর বলল, আপনার সঙ্গী ভদ্রলোক কোথায়?

তুমি নিশ্চয় সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরীর কথা বলছ। তাকে সঙ্গে আনিনি। কারণ আমি এখানে এসেছি একটি দুর্লভ প্রজাতির পাখির খোঁজে।

তাকে সঙ্গে আনলে ভাল করতেন। রহস্যটা জমে উঠেছে।

 রহস্য? বলো কি? কিসের রহস্য?

সে চারদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, চলুন। আমাকে ইস্টার্ন লজে পৌঁছে দেবেন? আমি কল্পনাও করিনি এসময়ে আপনাকে এখানে পেয়ে যাব। আমার সাহস বেড়ে গেল।

রাস্তায় নেমে গিয়ে বললাম, তোমার নামটা এখনও বলছ না।

 রাপ্তী সেন।

থমকে দাঁড়ালাম। কি বললে?

 রাপ্তী সেন।

এটা কোন ফাঁদ কি না কে জানে। একটু সতর্ক হয়ে বললাম, দেখ রাপ্তী, এখানে কোন রহস্য নিয়ে মাথা ঘামাতে আমি আসিনি। এই লেকের জলটুঙ্গিতে একটা সেক্রেটারি বার্ডের খোঁজ পেয়েছি। তাই

বিশ্বাস করছি না কর্নেল সরকার।..

তোমার ইচ্ছা।

সে আমার পাশ ঘেঁষে কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটল। তারপর বলল, আপনি যে হোটেলে উঠেছেন, সেখানে প্রবীর সেন নামে একজন আছে। তার সঙ্গে আলাপ হয়েছে?

প্রবীর সেনের কথা জানি না। তবে তমাল সেন নামে একজন আছে।

হ্যাঁ। ওর ডাকনাম তমাল। ও আমার হাজব্যান্ড।

 বলো কি। তা তুমি একখানে, তোমার হাজব্যান্ড অন্যখানে ব্যাপারটা কি?

সেটাই তো রহস্য। আমার হাজব্যান্ডের সঙ্গে একটি মেয়ে আছে দেখেছেন নিশ্চয়?

দেখেছি।

ওর নাম পারমিতা রায়। পারমিতা আমার হাজব্যান্ডকে ট্র্যাপ করে এনেছে। রীতিমতো ব্ল্যাকমেল।

বুঝলাম না।

সি ইজ ডেঞ্জারস। তমাল বোকার মতো ওর ফাঁদে পড়েছে। ও তমালকে ওর হাজব্যান্ড সাজতে বাধ্য করেছে। এমন কি আমার নামটাও আত্মসাৎ করেছে পারমিতা। ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড কর্নেল সরকার?

লেকের ধারে ল্যাম্পপোস্ট থেকে কুয়াশা মাখানো যেটুকু আলো ছড়াচ্ছিল, সেই বিবর্ণ আলোয় তার চোখে জল দেখতে পেলাম। মাথায় জড়ানো স্কার্ফের কোনা দিয়ে চোখের জল মুখে সে শ্বাস ছাড়ল। বললাম, আমি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না। তমাল তোমার স্বামী। তাকে একটি মেয়ে ব্ল্যাকমেল করছে এবং ফাঁদে ফেলেছে বলছ। কিন্তু তা হলে তুমি কেন পুলিশের কাছে যাওনি?

পুলিশের কাছে যাওয়ার প্রব্লেম আছে।

কি প্রব্লেম?

তমাল মিউজিয়াম থেকে পারমিতার সাহায্যে একটা সিল চুরি করেছিল। পারমিতা মিউজিয়ামে চাকরি করত। সিল চুরির পর ওর চাকরি যায়। সেই সিলে নাকি এই লেকের ধারে কোন পাহাড়ের গুহায় প্রাচীন বুদ্ধমূর্তির উল্লেখ আছে। বাকিটা শুনতে হলে আপনাকে একটু সময় দিতে হবে। ইস্টার্ন লজে নয়। অন্য কোথাও। আপনিই বলুন কোথায় এবং কাল কখন আপনার সঙ্গে দেখা করব?

একটু ভেবে নিলাম। এটা ডঃ প্রসাদ ওরফে বিনয় শর্মার কোন ফাঁদ কি না বুঝতে পারছি না। তাই বললাম, ঠিক আছে। কাল সকাল আটটায় তুমি বরং টাউনশিপ এরিয়ায় মহামায়া পার্কে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। তুমি টাউনশিপ যেতে সাইকেল রিকশা পেয়ে যাবে। মহামায়া পার্ক সবাই চেনে।

.

লেক ভিউয়ে ফিরে ম্যানেজারকে বলেছিলাম, এবার থেকে আমার স্যুইটে যেন খাদ্য বা পানীয় সার্ভ করা হয়। আমি বারবার কফি খাই। বারবার সেজন্য ডাইনিং হলে নেমে আসতে হয়। এটা আমার বয়সী মানুষের পক্ষে অসুবিধাজনক।

ম্যানেজার সতীশ কুমার বলেছিলেন, সে ব্যবস্থা তো আছেই। আপনি লক্ষ্য করবেন, স্যুইটের ভেতরে দরজার পাশে একট সাদা বটম্ আছে। ওটা টিপলেই লোক যাবে। দুঃখের বিষয়, আমরাও এখনও কোন স্যুইটে টেলিফোনের ব্যবস্থা করতে পারিনি। তবে শিগগির সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

তখন প্রায় সন্ধ্যা ছটা বাজে। হোটেলবয় ট্রেতে কফি পৌঁছে দিয়ে গেল। আমার মাথার ভেতরটা তালগোল পাকিয়ে গেছে। ঘরের ঠাণ্ডা দুর করার জন্য। একটা হিটার আছে। সুইচ অন করে সেটা পায়ের কাছাকাছি রেখে আরাম করে বসলাম। তারপর পট থেকে কফি ঢেলে লিকারে চুমুক দিলাম। দুধ-চিনি ছাড়া কফি আমি কদাচিৎ খাই। এখন এর দরকার ছিল।

তমাল-রাপ্তী-পারমিতা-ডঃ প্রসাদ ওরফে বিনয় শর্মা, মিউজিয়ামের সিল প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি এইসব ব্যাপার মাথার ভেতর মাছির মতো ক্রমাগত ভন ভন করছিল। কার কথা বিশ্বাস করব বুঝতে পারছিলাম না। তমাল, রাপ্তী এবং পারমিতা প্রত্যেকেই বলেছে, পরে বলব। পরে কেন? ডঃ প্রসাদ ওরফে বিনয় শর্মার হতে তমাল মার খেয়েছে এবং তাকে পাইনবনে দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা অবস্থায় দেখেছি, এই ঘটনাটি অবশ্য সত্য। কিন্তু তমালও বলেছে, সব কথা পরে জানাবে। এখন কথা হচ্ছে, ইস্টার্ন লজের মেয়েটি যদি সত্যিকার রাপ্তী এবং তমালের সত্যিকার স্ত্রী হয়, তাহলে তমালের দুর্দশার একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। চোরাই সিলটি তমাল ডঃ প্রসাদকে দিচ্ছে না বলেই সম্ভবত তার এই দুর্দশা ঘটেছে।

প্রায় এক ঘণ্টা পরে একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। ২২ নম্বর সুইটের দরজায় গিয়ে নক করলাম। রাপ্তী দরজা খুলে আমাকে দেখে করুণ মুখে বলল, বিকেলে একজন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। তাকে বললাম, আমার স্বামী পাহাড় থেকে পড়ে প্রচণ্ড আছাড় খেয়েছে। কিন্তু ডাক্তার কিছুতেই এলেন না। বললেন, ট্যুরিস্ট সেন্টারের হসপিটালে নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে পাত্তা পেলাম না। এখানকার লোকগুলো অদ্ভুত। তখন আবার সেই ডাক্তারের কাছে গেলাম। তিনি ওষুধ দিলেন। মনে হচ্ছে সেডেটিভ দিয়েছিলেন। তমাল ঘুমিয়ে পড়েছে। কিছুতেই ওকে জাগাতে পারছি না।

বললাম, আমি ওকে একটু দেখতে চাই। আপত্তি আছে?

 রাপ্তী ব্যস্তভাবে বলল, কেন আপত্তি থাকবে? আপনি আমার আঙ্কেল হয়েছেন। আসুন, ওকে দেখুন।

ঘরে ঢুকে তমালকে জাগানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। বুঝলাম, সত্যিই ওকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। ঘরে টেবিল ল্যাম্পের আলো ছিল। আলোটা নিষ্প্রভ হলেও দ্রুত চোখ বুলিয়ে মনে হলো ঘরের ভেতরটা অগোছাল অবস্থায় আছে। একটা বড় স্যুটকেসের ডালার ফাঁকে কাপড় চোপড়ের একটা অংশ বেরিয়ে আছে। এর একটাই অর্থ হয় রাপ্তী ঘরের সবখানে কিছু খুঁজছিল, অথবা জিনিসপত্র গোছাচ্ছিল, এবং আমি এসে পড়ায় তাতে ব্যাঘাত ঘটেছে।

বললাম, তুমি বলছিলে সব কথা পরে বলবে। এখন বলতে কি অসুবিধা আছে?

রাপ্তী ঠোঁট কামড়ে ধরে একটু চুপ করে থাকল। তারপর মৃদুস্বরে বলল, তমাল এখানে হনিমুনের ছলে এসেছে। বিনয় শর্মার সঙ্গে স্মাগলিং কারবার করে সে। আমি তা জানতে পেরে তাকে থ্রেট করেছিলাম। বলেছিলাম, আমি জানি তুমি কেন এসেছ। আমি আর এখানে থাকতে চাই না। এই নিয়ে কাল রাতে ওর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল। তাই সে আমাকে সকালে পাহাড়ের ওপর ফটো তোলার ছলে ডেকে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। বুঝুন আঙ্কেল। আমি খাদে পড়ে গিয়ে মরে যেতাম। আর তমাল এটা অ্যাকসিডেন্ট বলে চালিয়ে দিত।

ঠিক বলেছ। কিন্তু কিসের স্মাগলিং?

নার্কোটিক্সের।

তুমি কি করে জানতে পারলে?

তমালের কাছে একটা প্যাকেট ছিল। সেই প্যাকেটটা সকালে আর দেখতে পাইনি। আমার সন্দেহ, দরে পোষাচ্ছে না বলেই তমাল ওটা বিনয় শর্মাকে দেয়নি। তাই বিনয় শর্মা ওকে পাইনবনে মারধর করে দড়িতে বেঁধে ফেলে রেখেছিল। ভাগ্যিস আপনি সেখানে গিয়ে ওকে উদ্ধার করেছিলেন।

হুঁ। নার্কোটিক্স তমাল কলকাতায় বসেই বিনয় শর্মাকে বেচতে পারত বা তা নিয়ে নিরাপদে দরাদরি করতে পারত। সে এখানে তা বেচতে এল কেন?

রাপ্তী খুব চাপাস্বরে বলল, পরশু বিকেলে এখানে আসার পর তমাল কিছুক্ষণের জন্য বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর ও সেই প্যাকেটটা নিয়ে ফিরে এল। জিজ্ঞেস করলে শুধু বলল, এতে কিছু লাইফসেভিং ড্রাগ আছে। এখানে আমার চেনা এক ভদ্রলোক এই প্যাকেটটা কলকাতায় তার অসুস্থ আত্মীয়ের কাছে পৌঁছে দিতে অনুরোধ করেছেন।

সকালে যখন প্যাকেটটা দেখতে পেলে না, তখন ওকে কিছু জিজ্ঞেস করোনি?

জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম। দুপুরে যখন ওকে আহত অবস্থায় আপনি নিয়ে এলেন, তখন ওটার কথা মনে পড়েছিল। কিন্তু ওই অবস্থায় ওকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এখানে তমালের চেনা কোন স্মাগলার আছে। তমাল তার কাছেই নার্কোটিক্স কিনেছে। তারপর বিনয় শর্মাকে ওটা বিক্রির প্রোপোজাল দিয়েছে।

তোমার সন্দেহ যুক্তিসঙ্গত। বলে আমি উঠে দাঁড়ালাম।

 রাপ্তী দরজার কাছে এসে বলল, দরে পোষাচ্ছে না বলে তমাল প্যাকেটটা কোথাও লুকিয়ে রেখেছে আঙ্কেল।

ঠিক বলেছ। তুমি কি তমালকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে যেতে চাও?

ওর শরীরের যা অবস্থা, কি করে এখন নিয়ে যাবো? তাছাড়া আমাদের ট্রেনের রিজার্ভেশন রিটার্ন টিকিটের তারিখ ১৪ নভেম্বর। আজ ১১ নভেম্বর।

সাবধানে থেকো। বলে বেরিয়ে এলাম।

 নিজের স্যুইটে ফিরে রাপ্তীর বক্তব্য নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে বুঝলাম আপাতদৃষ্টে একটা যুক্তিসঙ্গত বিবরণ সে দিয়েছে। ওদিকে ইস্টার্ন লজের রাপ্তীর বিবরণও যুক্তিসঙ্গত। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, ইস্টার্ন লজের রাপ্তী আমার পরিচয় জানে। এবার আমার প্রথম কাজ হল, কে প্রকৃত রাপ্তী সেটা খুঁজে বার করা। দ্বিতীয় কাজ হল, তমালের সঙ্গে প্রকৃত রাপ্তীর দাম্পত্য সম্পর্কের সত্যতা যাচাই। তারপরের কাজটি হল, এটা নার্কোটিক্স সংক্রান্ত ঘটনা, নাকি মিউজিয়ামের চোরাই সিল সংক্রান্ত ঘটনা, সেটা নিশ্চিতভাবে জেনে নেওয়া।

পর্যটন কেন্দ্রের কর্মীটি বিনয় শর্মাকে জনৈক বিখ্যাত ঐতিহাসিক বলে জানেন। তাঁর এই জানাতে ভুল থাকতেই পারে।

তবে এমন অদ্ভুত রহস্যে এর আগে কখনও জড়িয়ে পড়িনি। এ একটা আসল-নকল নিয়ে জমজমাট খেলা। তমালের ঘরে রাপ্তীকে জিজ্ঞেস করতে পারতাম, সে কোথায় কি চাকরি করত। একটা জবাব নিশ্চয় পেতাম। কিন্তু মিউজিয়ামে চাকরি করত কি না জিজ্ঞেস করলে (যদি ইস্টার্ন লজের রাপ্তীর কথা সত্য হয়) সে সতর্ক হয়ে যেত। কাজেই ধীরেসুস্থে এগোনোই ভাল। তবে এখনই গিয়ে ম্যানেজারকে গোপনে জানাতে হবে, ২২ নম্বর স্যুইটের তমাল সেনকে কেউ চিকিৎসার ছলে স্ট্রেচারে চাপিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি যেন বাধা দেন এবং পুলিশকে জানান।

পরদিন ভোরে অভ্যাসমতো প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলাম। এদিনও ঘন কুয়াশা ছিল। কিন্তু সতর্কতার দরুন হ্রদের তীরে না গিয়ে উল্টো দিকে লেকভিউ হোটেলের পূর্বের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ঢালু একটা উপত্যকায় নেমে গেলাম। উপত্যকাটি ছোট-বড় নানা গড়নের পাথর আর ঝোপঝাড়ে দুর্গম হয়ে আছে। দুর্গম স্থানের প্রতি আমার আকর্ষণ প্রবল। কুয়াশা এত ঘন যে দু-তিন মিটারের দূরে কি আছে, তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। একসময় হঠাৎ মনে হল, এভাবে কুয়াশার মধ্যে বেরিয়ে পড়া উচিত হয়নি আমার। তমালকে যে আমিই উদ্ধার করেছি বিনয় শর্মা তা জানতে পেরেছে। সে যদি আমাকে এখন অনুসরণ করে থাকে, যে কোনও মুহূর্তে আমি আক্রান্ত হব।

ডাইনে-বাঁয়ে এদিকে-ওদিকে আমার এভাবে হেঁটে যাওয়া কেউ দেখলে অবশ্যই পাগল ভাবত। কিন্তু একটু পরেই যা ঘটে গেল, তাতে বুঝলাম যে, আমার সেই ইনটুইশনই আমাকে বাঁচাতে সাহায্য করেছে।

সামরিক জীবনের আরেকটা শিক্ষাও চমৎকার কাজে লেগে গেল। জঙ্গলে গেরিলাযুদ্ধের তালিম নেওয়ার সময় এটা আয়ত্ত করেছিলাম। কোথাও একটু শব্দ হলেই সেই শব্দটা কিসের এবং আমার কাছ থেকে তার দূরত্ব কত, শব্দটার উৎসস্থল এইসব কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আমি জেনে ফেলি।

একটা বড় পাথরের পাশে ঘন ঝোপের ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। এমন সময় পেছনে আবছা একটা শব্দ কানে এসেছিল। পথরগুলির ফাঁকে শীতে ঝরে পড়া গুল্মলতার পাতার স্তূপ রাতের শিশিরে ভিজে গেছে। শুকনো পাতার। ওপর কোন মানুষ বা জন্তু যত সাবধানেই পা ফেলুক, পতার শব্দ হবেই। কিন্তু ভিজে পাতার ওপর চুপিচুপি পা ফেলার শব্দ অন্যরকম। যে শব্দটা শুনেছিলাম, তা হঠাৎ থেমে যেতেই প্রথমে মনে হয়েছিল কোন চতুষ্পদ প্রাণীর তা বাঘ-ভালুকেরও হতে পারে। মুন লেক অঞ্চলে এখনও বাঘ-ভালুক থাকা সম্ভব।

কিন্তু শব্দটা আবার শুনতে পেলাম এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, ওটা কোন দ্বিপদ প্রাণীরই পায়ের শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে রিভলভার বের করে তৈরি হলাম। আগেই বলেছি, কুয়াশা এত ঘন যে দু-তিন মিটার দূরেও কিছু স্পষ্টভাবে দেখা যায় না। শব্দটার উৎস আমার হিসাবে আন্দাজ তিরিশ ফুট দূরে এবং আমার ডানদিকে। আমার পেছনে ঘন ঝোপ। তখনই গুঁড়ি মেরে বসে ডানদিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে লক্ষ্য রাখলাম। শব্দটা থেমে গিয়েছিল। তারপর আমার দুপাশে একটা করে ঢিল পড়তে থাকল।

মানুষই ঢিল ছোড়ে। যে ঢিল ছুড়ছিল, এটা তার শিকারি স্বভাবের পরিচয়। কারণ আমি দেখেছি, ধূর্ত শিকারিরা এভাবে ঝোপঝাড়ে আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে লুকিয়ে থাকা প্রাণীকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করে। রাগ হল। আবার হাসিও পেল। ব্যাটাছেলে আমাকে কি ভেবেছে?

আর চুপ করে থাকার কোন মানে হয় না। যেদিক থেকে ঢিল আসছিল, সেইদিকে রিভলভারের নল ঈষৎ উঁচু করে একটা গুলি ছুঁড়তেই হল। নরহত্যার দায় এ বয়সে আর বইতে চাই না। এটা তো যুদ্ধক্ষেত্র নয়।

স্তব্ধ ঠাণ্ডাহিম কুয়াশা ঢাকা উপত্যকায় গুলির শব্দটা যথেষ্ট জোরালো ছিল। তারপরই আবার পায়ের শব্দ ক্রমাগত। এবার শব্দটা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিল। বুঝতে পারলাম, লোকটা পালিয়ে যাচ্ছে। সে এত সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া সম্ভবত কল্পনাও করেনি। এও বোঝা যায়, তার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না। থাকলে তখনই সে পাল্টা গুলি ছুড়ত।

জোরে শ্বাস ফেলে পা ছড়িয়ে বসে চুরুট ধরালাম। তখন প্রায় সওয়া সাতটা বাজে। আটটায় আমাকে মুন লেকের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত টাউনশিপে মহামায়া পার্কে পৌঁছতেই হবে। কয়েক মিনিট চুরুট টানার পর উত্তেজনাটা চলে গেল। তখন উঠে পড়লাম।

কুয়াশার মধ্যে শর্টকাট চলা কঠিন। তবু আমার লক্ষ্য ছিল মুন লেকে যাওয়ার বড় রাস্তায় পৌঁছনো। ল্যাম্প পোস্টের বাতিগুলি জ্বলজ্বল করছিল। পনের মিনিটের মধ্যে রাস্তাটা পেয়ে গেলাম। পর্যটনের মুরসুমে এই রাস্তায় যানবাহনের অভাব নেই। কুয়াশার জন্য স্কুটার, অটোরিক্শা, ট্যাক্সি আলো জ্বেলে চলাচল করছে। তবে এখন সংখ্যায় কম। একটা অটোরিকশা আমাকে দেখেই থেমে গিয়েছিল। তাতে দুজন যাত্রী ছিলেন। ঠাসাঠাসি করে তাদের সঙ্গে যেতে হল।

মহামায়া পার্কে আটটার আগেই পৌঁছে গেলাম। এখনও পার্ক নিঝুম হয়ে আছে। কুয়াশায় চাদর মুড়ি দিয়ে বসে থাকা এক লাবণ্যময়ী যুবতীর উপমা মাথায় আসছিল। লেকের দিক থেকে যে গেট পার্কে ঢুকতে হয়, সে গেটের পাশে ইস্টার্ন লজের রাপ্তী অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখে সে বলে উঠল, কি বিচ্ছিরি ফগ।

হাসতে হাসতে বললাম, বিচ্ছিরি ফগের জন্য তুমি কিন্তু একটা বিচ্ছিরি পোশাক পরেছ।

বিচ্ছিরি পোশাক কেন বলছেন? এই টুপি আর জ্যাকেট মাউন্টেনিয়াররা পরে।

তা পরে। তবে তুমি কেন পরেছ তা বুঝতে পারছি।

 কেন?

তোমাকে বিচ্ছিরি মোটা দেখাবে এবং সহজে চেনা যাবে না।

 আপনি তো চিনতে পারলেন।

তোমার চোখ দুটি দেখে।

 আমার চোখে কি আছে?

হোটেল দ্য লেক ভিউয়ের রাপ্তীর চোখে যা নেই।

সে থমকে দাঁড়াল। পারমিতার সঙ্গে আপনার আলাপ হয়েছে?

 হয়েছে।

তাকে আপনি চার্জ করেননি যে, সে রাপ্তী নয়, পারমিতা এবং আপনি তা জানেন?

তাকে চার্জ করার আগে আমার সব কথা জানার দরকার আছে। যাই হোক, পার্কের পরিবেশ এখন শোচনীয়। তাছাড়া আমার এখনই এক পেয়ালা কড়া কফি চাই। চলো। পার্কের উত্তরে একটা রেস্তোরাঁ আছে দেখেছি। একটু কস্টলি। কিন্তু কি করা যাবে?

বিত্তবানদের রেস্তোরাঁ ব্লু মুনে এখনও তত ভিড় নেই। যারা ইতিমধ্যে লেকের ধারে জগিং করে এসেছে, তারা দাঁড়িয়ে কফি বা চা খাচ্ছে। কোণের দিকে গিয়ে মুখোমুখি বসলাম। কফি আর এক প্লেট গরম পকৌড়ার অর্ডার দিলাম।

ইস্টার্ন লজের রাপ্তী জ্যাকেটের ভেতর থেকে একটা খাম বের করে বলল, আপনাকে দেখানোর জন্য এনেছি। এর মধ্যে তমাল এবং আমার বিয়ের রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট আমার অফিসের আইডেন্টিটি কার্ড আছে।

খাম খুলে সেগুলি দেখে নিলাম। তারপর বললাম, হ্যাঁ। তুমিই আসল রাপ্তী।

তার মানে, কাল সন্ধ্যায় আপনি কি আমাকে–

সে রুষ্টমুখে কথা থামিয়ে দিল। একটু হেসে বললাম, তুমি বুদ্ধিমতী। এই কেসটা একটু জটিল। কারণ আসল এবং নকল মিলেমিশে আছে। যেমন ধরো এর সঙ্গে বিনয় শর্মা নামে একজন জড়িত। কিন্তু সে নাকি আসলে একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক ডঃ রঘুবীর প্রসাদ।

রাপ্তী শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠল, ডঃ প্রসাদের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। তমাল ইউনিভার্সিটিতে ওঁর ছাত্র ছিল। সেই সূত্রে আলাপ। খুব অমায়িক ভদ্র মানুষ। রাপ্তী জোর দেবার জন্য ফের বলল, হি ইজ এ পারফেক্ট জেন্টলম্যান।

তাঁর বয়স অনুমান করতে পেরেছিলে?

এখন ষাটের বেশি তো বটেই। তবে ওঁকে ভীষণ রোগা দেখায়। একটু খুঁড়িয়ে হাঁটেন।

তাহলে আমার দেখা লোকটি নকল ডঃ প্রসাদ। তমাল কি করে বল?

এইসময় কফি পকৌড়া এসে গেল। কফিতে চুমুক দিয়ে রাপ্তীর দিকে তাকালাম। সে একটা পকৌড়া আলতোভাবে তুলে নিয়ে কামড় দিল। তারপর বলল, তমালের একটা কিউরিও শপ আছে। অ্যান্টিক জিনিসপত্র বেচাকেনা করে। পারমিতা কলেজে আমার সঙ্গে পড়াশুনা করত। পরে মিউজিয়ামে চাকরি পেয়েছিল। সত্যি বলতে কি, পারমিতার সূত্রেই তমালের সঙ্গে আমার আলাপ এবং তারপর বিয়ে। বাট সি ইজ সো জেলাস–

সে আত্মসম্বরণ করল। বললাম, তুমি তোমার স্বামীকে তাহলে ফলো করে এখানে এসেছ?

হ্যাঁ। তমাল বলেছিল সেই চোরাই সিলের সাহায্যে বুদ্ধমূর্তি উদ্ধারে যাচ্ছে। আমার একটু সন্দেহ হয়েছিল। কারণ এখানে আসার কদিন আগে সে টেলিফোনে পারমিতার সঙ্গে কথা বলছিল।

এই সময় বিনয় শর্মা এসে রেস্তোরাঁয় ঢুকল। তারপর আমাকে দেখেও না দেখার ভাণ করে অন্যদিকের একটা টেবিলে বসল। ইশারায় রাপ্তীকে চুপ করতে বলে লোকটার দিকে লক্ষ্য রাখলাম।

.

বিনয় শর্মা কিন্তু একমিনিট বসেই হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। তারপর বেরিয়ে গেল। রাপ্তীকে বসতে বলে আমি উঠে দরজায় গেলাম। কুয়াশা একটু কমে গেছে। দেখলাম, বিনয় শৰ্মা পার্কের পাশের রাস্তা দিয়ে জোরে হেঁটে চলেছে। বাঁকের মুখে তার ছায়ামূর্তি মিলিয়ে গেল। তার এই নাটকীয় প্রবেশ ও প্রস্থানের কারণ কি বুঝতে পারলাম না।

রাপ্তীর কাছে ফিরে এলাম। রাপ্তীর চোখে প্রশ্ন ছিল। আস্তে বললাম, ওই লোকটাই সেই নকল ডঃ প্রসাদ। আমাকে বিনয় শর্মা বলে পরিচয় দিয়েছিল। পারমিতা আমাকে বলেছে, বিনয় শর্মা নামে একটা লোকের সঙ্গে ট্রেনে তাদের আলাপ হয়েছিল। সে নাকি বিজনেসম্যান।

 রাপ্তী একটু পরে বলল, লোকটাকে কোথায় যেন দেখেছি। ঠিক মনে পড়ছে না।

মনে পড়তে পারে। চেষ্টা করো। তুমি তো আমাকেও–

 রাপ্তী আমার কথার ওপর বলল, দেখেছি তা ঠিক। কিন্তু কোথায় দেখেছি মনে নেই।

বললাম, কফিটা তাড়াতাড়ি শেষ করা যাক। এখনই আমাকে হোটেলে ফিরতে হবে।

আপনি আমার সব কথা শুনলেন না।

 আর কি কথা আছে?

রাপ্তী আস্তে বলল, আমি এখানে তমালকে ফলো করে এসেছি, গত পরশু বিকেলেই তমাল তা টের পেয়েছিল।

কি ভাবে?

 লেকের ধারে আমাকে দূর থেকে দেখেছিল। তখন পারমিতা ওর সঙ্গে ছিল। তাই শুধু একবার হাত নেড়েছিল। তমাল জানে, আই অ্যাম নট সো জেলাস।

তুমি গিয়ে ওকে এবং পারমিতাকে চার্জ করোনি কেন?

সি ইজ ডেঞ্জারাস। ওর কাছে একটা ফায়ার আর্মস আছে। আমাকে দেখিয়েছিল।

হুঁ। আর কিছু?

 চলুন। যেতে যেতে বলছি।

.

দুপেয়ালা কফি এবং এক প্লেট পকৌড়ার জন্য পঁচিশ টাকা বিল মেটাতে হল। কিন্তু এই বাজে খরচের ফলে একটা লাভ হল। বিনয় শর্মার নাটকীয় প্রবেশ এবং প্রস্থান দেখলাম। এতক্ষণে মনে হলসম্ভবত ব্লু মুনে কারো সঙ্গে ওর অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। আমি থাকার দরুন ওর অসুবিধা হবে ভেবেই হয় তো চলে গেল।

পর্যটন কেন্দ্রের সেই অত্যুৎসাহী কর্মী কি তার পরিচিত ডঃ রঘুবীর প্রসাদকে বলেছেন যে, জনৈক সাদা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ তার কটেজের খোঁজে এসেছিলেন এবং সেইজন্যই কারও সঙ্গে কথা বলার জন্য সে ব্লু মুনকে কেঁদেভ করেছিল?

এটাই যুক্তিসঙ্গত পয়েন্ট। পার্কের ভেতর দিয়ে গেলে লেক রোডে পৌঁছনো যাবে। পার্কে ঢুকে বললাম, কি বলবে এবার স্বচ্ছন্দে বলতে পারো রাপ্তী।

রাপ্তী বলল, আমি ওদের দিকে লক্ষ্য রেখেছিলাম। ওরা কিছুক্ষণ পরে লেক, ভিউ হোটেলে ঢুকল। আমি তখন পূর্বদিকের রাস্তা দিয়ে ঘুরে ওই হোটেলে গেলাম। কাউন্টারে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, তমাল সেন এবং রাপ্তী সেন দোতলার ২২ নং স্যুইটে উঠেছে।

রাপ্তীর কণ্ঠস্বর বিকৃত শোনাচ্ছিল। সে জোরে শ্বাস ছেড়ে ফের বলল, একজন হোটেলবয়কে ডেকে তাকে দশটা টাকা দিয়ে বললাম, এই কাগজটা ২২ নং সুইটের তমাল সেনের হাতে গোপনে পৌঁছে দিতে হবে। যেন তার স্ত্রী দেখতে না পায়। হোটেলবয়কে একটা স্লিপে লিখে দিলাম, ইস্টার্ন লজ।

বাহ। তারপর?

ইস্টার্ন লজ একটা সাধারণ হোটেল। আর কোথাও জায়গা না পেয়ে বাধ্য হয়ে ওখানেই উঠেছিলাম। ভাগ্যিস বুদ্ধি করে সঙ্গে জিনস্, ব্যাগি শার্ট, শোয়েটার এসব এনেছিলাম। এদেশে মেমসাহেব সেজে ইংরেজি বললে, স্মার্ট দেখায়। লোকে একটু ভয়-টয় পায় ইউ নো দ্যাট ওয়েল।

ইউ আর ইন্টেলিজেন্ট।

রাপ্তী দম নিয়ে বলল, আমি ওর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। জানতাম ও আসবেই। কারণ একটা কৈফিয়তের দায় ওর থেকে যাচ্ছে। হি লাভস মি কর্নেল সরকার।

হুঁ। তারপর কি হল বল?

একতলায় একটা সিঙ্গল রুমে আমি আছি। একটা জানালা বইরের রাস্তার দিকে আছে। সেটা খুলে সেখানেই বসেছিলাম। কি বিচ্ছিরি ঠাণ্ডা। রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ দেখি, তমাল আসছে। হাত নেড়ে ওকে ডাকলাম। লজের গেট। তখন বন্ধ। আমার রুমের জানালার দিকে গাছের ছায়া ছিল। সে চুপি চুপি এসে বলল, বুদ্ধমূর্তি উদ্ধারে সাহায্য করার জন্য পারমিতাকে সঙ্গে এনেছে। কিন্তু পারমিতা এখানে এসেই একটা লাৈকের সাহায্যে তাকে ব্ল্যাকমেল করছে। স্বামী-স্ত্রী সেজে একই ঘরে থাকতে বাধ্য করছে। ওর মূল উদ্দেশ্য তাকে সবসময় চোখের সামনে রাখা, যাতে সে গোপনে মূর্তি হাতিয়ে কেটে পড়তে না পারে। তার চেয়ে সাংঘাতিক কথা, পারমিতা নাকি তার সেই চেনা লোকটাকেই মূর্তিটা দশ লাখ টাকায় বেচতে চায়। আধাআধি শেয়ার। যাই হোক, আমি বললাম, এসব কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তখন তমাল পকেট থেকে একটা ছোট্ট প্যাকেট বের করে আমাকে দিল। বলল, এর মধ্যে সেই চোরাই সিলটা আছে। খুলে আমি দেখতে পারি।

সিলটা তুমি দেখেছিলে আগে?

হ্যাঁ। আমাকেই তমাল ওটা একসময় লুকিয়ে রাখতে দিয়েছিল।

একই সিল?

একই সিল। তমাল বলল, সে খুব বিপদে পড়ে গেছে। পারমিতা ওকে। পুলিশের ভয় দেখাচ্ছে। তাই সিলটা আমার কাছে থাকলে তমাল নিরাপদ।

তাহলে সিলটী তোমার কাছে আছে?

হ্যাঁ। বলে রাপ্তী জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা ছোট্ট প্যাকেট বের করে আমার হাতে গুঁজে দিল। শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ফের বলল, সি ইজ ডেঞ্জারাস। এটা আপনার কাছে রাখুন। আমিও নিরাপদে থাকতে চাই।

প্যাকেটটা জ্যাকেটের ভেতর চালান করে দিয়ে বললাম, বিনয় শর্মা আমার সঙ্গে তোমাকে দেখে গেল। কাজেই তোমার নিরাপত্তার প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে।

কুয়াশা আরও কমে গিয়ে এখন নরম রোদ ফুটেছে। কথাটা বলে বাইনোকুলারে চারদিক খুঁটিয়ে দেখতে থাকলাম। মনে পড়ল, নকল রাপ্তী রাতদুপুরে তমালের চুপিচুপি বাইরে যাওয়ার কথা আমাকে বলেছিল।

রাপ্তী বুলল, তা হলে আমার কি করা উচিত বলুন?

ওর প্রশ্নের জবাব দিতে যাচ্ছি, (তখনও বাইনোকুলারে আমি খুঁটিয়ে লেকের পূর্ব তীর দেখছি) এমন সময় নকল রাস্তী অর্থাৎ পারমিতাকে দেখতে পেলাম। সে হনহন করে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চলেছে।

রাপ্তী বলল, কি? কোন কথা বলছেন না যে?

 বললাম, সঙ্গে এস। এখন কোন কথা নয়।

একটু পরে দেখি, পাইনবনের নীচে একটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বিনয় শর্মা এবং একটা ষণ্ডামার্কা লোক। রাপ্তী তাদের কাছে পৌঁছলে তিনজন মিলে ওপরে উঠতে থাকল। তারপর আর তাদের দেখতে পেলাম না। ওই ষণ্ডামার্কা লোকটাই কি তাহলে পূর্বের উপত্যকায় আমার পিছু নিয়েছিল?

অজানা আশঙ্কায় চঞ্চল হয়ে উঠলাম। হোটেলের ম্যানেজার সতীশ কুমারকে সতর্ক করে দিয়েছি, কেউ যেন অসুস্থ তমাল সেনকে স্ট্রেচারে শুইয়ে বা অন্য কোনভাবে চিকিৎসার ছলে বাইরে নিয়ে যেতে না পারে। জোর দেখালে তিনি যেন তখনই পুলিশে খবর দেন এবং আমার নেমকার্ড দেখিয়ে আমার নির্দেশের কথা জানান। আমার বিশ্বাস পুলিশ কর্নেল শব্দটি দেখলে একটু সমীহ করবে।

রাপ্তীকে বললাম, তুমি আমার সঙ্গে আমার হোটেলে এস।

রাপ্তী চমকে উঠল। সে কি! ওখানে গেলেই তো পারমিতার চোখে পড়ে যাব।

তুমি তার চোখে না পড়লেও সে তোমার কথা সম্ভবত এতক্ষণে জেনে গেছে। তবে এখন সে হোটেলে নেই। ওই দেখছ পাহাড়ের ওপর পাইনবন। রাপ্তী ওখানে আছে।

আপনি কি বাইনোকুলারে তাকে দেখতে পেলেন?

হ্যাঁ। আমার সঙ্গে এস।

লেক ভিউয়ে ফিরেই প্রথমে গেলাম ম্যানেজার সতীশ কুমারের কাছে। আমাকে দেখামাত্র তিনি উত্তেজিতভাবে বললেন, ২২ নম্বর সুইটের দিকে আমাদের একজন গার্ডকে লক্ষ্য রাখতে বলেছিলাম। মিসেস সেন বেরিয়ে যান সকাল সাতটা নাগাদ। আধঘণ্টা পরে তিনি একটা ট্যাক্সি নিয়ে ফিরে আসেন। আমাকে তিনি অনুরোধ করেন, আমি যেন দুজন লোক দিয়ে ওঁর অসুস্থ স্বামীকে দোতলা থেকে নামিয়ে এনে ট্যাক্সিতে তুলে দিতে সাহায্য করি। স্বামীকে উনি হাসপাতালে নিয়ে যবেন। আমি তখনই ভদ্রমহিলাকে জানিয়ে দিলাম, আমাদের হোটেলে কিছু বিধিনিষেধ আছে। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে আমরাই ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করি। আমাদের নিজস্ব ডাক্তার আছেন। তিনি সার্টিফাই করলে তবেই আপনার স্বামীকে আপনি বাইরে নিয়ে যেতে পারেন।

সতীশ কুমার একটু হাসলেন। মিসেস সেনের সঙ্গে তর্কাতর্কি হল। উনি থ্রেট করলেন। তখন আমি পাল্টা থ্রেট করে ওঁকে বললাম, ঠিক আছে। আমি আমাদের ডাক্তারকে ফন করছি এবং সেই সঙ্গে থানায় জানাচ্ছি। আমাদের ডাক্তার এবং পুলিশ এলে তবেই আপনি মিঃ সেনকে বাইরে নিয়ে যেতে পারবেন। আমাদের হোটেলে যাঁরা ওঠেন, তাদের নিরাপত্তার স্বার্থেই এই বিধিনিষেধ চালু আছে। কারণ এর আগে একবার আমরা এ ধরনের একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিলাম। যাই হোক, মিসেস সেন রাগ করে আমাকে শাসিয়ে সেই ট্যাক্সিতে চলে গেলেন। তারপর আমি ২২ নং সুইটের ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে ওপরে গেলাম। স্যুইটে ঢুকে দেখলাম, মিঃ সেন বেঘোরে ঘুমোচ্ছেন। ওঁকে বিব্রত করলাম না।

সতীশ কুমারকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, সত্যিই কি আপনাদের নিজস্ব ডাক্তার আছেন?

অবশ্যই আছেন কর্নেল সরকার। আপনি যদি বলেন, তাঁকে খবর দিই।

 তাই দিন। আর একটা কথা। ডাক্তার এলে আমি যেন জানতে পারি।

 কিন্তু ব্যাপারটা কি বলবেন আমাকে?

বলব। তবে এখন নয়। একটু ধৈর্য ধরে থাকুন প্লিজ।

সতীশ কুমার দোতলায় ওঠার সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে এসে বললেন, দেখবেন স্যার, যেন আমাদের হোটেলের সুনাম নষ্ট না হয়।

ওঁকে আশ্বস্ত করে আমার স্যুইটে গেলাম। রাপ্তী উদ্বিগ্ন মুখে বলল, তমাল অসুস্থ। অথচ আপনি আমাকে তা বলেননি। কি হয়েছে ওর?

বলছি। তুমি বস। ততক্ষণে আমি সিলটা দেখে নিই।

 রাপ্তী অস্থির হয়ে বলল, আমি তমালকে দেখতে চাই।

ডাক্তার এলেই তোমাকে সঙ্গে নিয়ে ওর কাছে যাব। বলে ওর দেওয়া প্যাকেটটা বের করলাম। তারপর প্যাকেট খুলে দেখি, কালো কাগজে মোড়া একটা গোলাকার শক্ত জিনিস, রঙিন কাগজকুচির মধ্যে ঠাসা আছে। মোড়ক খুলতেই বেরিয়ে পড়ল একটা ব্রোঞ্জের চাকতি। চাকতিটা কোন রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে। মধ্যিখানে পদ্মাসনে উপবিষ্ট বুদ্ধদেব এবং চারদিকে কারুকার্যের মতো খোদাই করা লিপি।

আতস কাচ দিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করতেই চোখে পড়ল, পদ্মাসনের উপরে ও। নীচে আঁকাবাঁকা কিছু রেখা। এক কোণে চন্দ্রকলাও আছে। চমকে উঠলাম। তাহলে চন্দ্র সরোবর নামটিই কি মুন লেকের প্রাচীন নাম? পর্যটন বিভাগ সম্ভবত মুন লেক কথাটির নিছক অনুবাদ করেননি। কোন গবেষকের কাছে জানতে পেরেই হয়তো লুপ্ত নামটি ফিরিয়ে এনেছেন। আঁকাবাঁকা রেখাগুলি জলের ঢেউয়ের প্রতীক, তাতে ভুল নেই।

আমি প্রাচীন লিপি নিয়ে একসময় কিছু পড়াশুনো করেছিলাম। আপাতদৃষ্টে এই লিপি কুষাণ যুগের ব্রাহ্মীলিপি মনে হল।

উত্তেজনা দমন করে সিদ্ধান্ত নিলাম, এখনই যেভাবে হোক, তমাল ও রাপ্তীকে কলকাতায় ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তারপর ট্রাঙ্ককলে দিল্লিতে সেন্ট্রাল আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। কলকাতার জাদুঘর থেকে চুরি যাওয়া সিল কি করে আমার হাতে এল। সেই জবাবদিহির দায়িত্ব আমার কাঁধেই পড়বে। অবশ্য সিল চুরি যাওয়ার পর সম্ভবত দায়িত্বহীনতার অভিযোগেই পারমিতার চাকরি গিয়েছিল। কাজেই তার কাঁধে দায়টা চালান করা যায় এবং আমাকে একটা মিথ্যা গল্প ফাঁদতে হয়।

তো পরের কথা পরে। সিলটা প্যাকেটে ঢুকিয়ে জ্যাকেটের ভেতর পকেটে রাখলাম। তারপর দেখলাম, রাপ্তী আমার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে। একটু হেসে বললাম, তুমি কি প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি সম্পর্কে আগ্রহী?

সে জোরে মাথা দুলিয়ে বলল, না। আমি তমালকে দেখতে চাই।

দেখতে পাবে। ডাক্তার আসুক। তবে আমার একটা প্রস্তাব আছে।

বলুন।

তোমাদের দুজনকে যেভাবে হোক, যদি নিরাপদে কলকাতায় ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিই?

রাপ্তী নড়ে বসল। প্লিজ কর্নেল সরকার। আমি সেটাই চাইছি। সেই কথাটাই আপনাকে বলব ভাবছিলাম। আর আপনি পারমিতাকে পুলিশের হাতে তুলে দিন। সি ইজ ডেঞ্জারাস। কলকাতা ফিরে গিয়ে সে তমালের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবে।

ঠিক আছে। তুমি একটু বসো। ডাক্তার আসুক। তারপর সব ব্যবস্থা করা যাবে।

ডাক্তার এলেন প্রায় আধঘণ্টা পরে। সতীশ কুমার, আমি এবং রাপ্তী ডাক্তারের সঙ্গে ২২ নং স্যুইটে গেলাম। ডুপ্লিকেট চাবিতে সতীশ কুমার দরজা খুলে দিলেন। আমরা ভেতরে ঢুকলাম।

তারপর ডাক্তার বলে উঠলেন, হোয়্যার ইজ ইওর পেস্যান্ট মিঃ সতীশ কুমার?

বিছানা খালি। তমাল সেন নেই। সতীশ কুমার বাথরুমের দরজা খুললেন। সেখানে তমাল নেই। ব্যালকনির দরজা খুলে দেখলেন। সেখানেও কেউ নেই। সতীশ কুমার খাপ্পা হয়ে গার্ডকে ডাকলেন। বললেন, তুমি কোথায় ছিলে? তোমাকে বলেছিলাম এই স্যুইটের দিকে লক্ষ্য রাখতে। কেউ ঢুকলে বা বেরুলে যেন আমি খবর পাই।

গার্ড কাঁচুমাচু মুখে বলল, আমি পাঁচ মিনিটের জন্য বাথরুমে গিয়েছিলাম স্যার।

ডাক্তার অবাক হয়ে বেরিয়ে গেলেন। সতীশ কুমার বললেন, পুলিশকে জনাতে হবে কর্নেল সাহেব।

আমি সায় দিলাম। সতীশ কুমার বেরিয়ে গেলেন। দেখলাম রাপ্তী পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে।

.

আমার পক্ষে অবশ্য এ ছিল অভাবিত সুযোগ। সুইটের ভেতরটা খোঁজাখুঁজি। করে জাল ডঃ রঘুবীর প্রসাদ ওরফে বিনয় শর্মার প্রকৃত পরিচয়ের সূত্র যদি  মেলে, তাহলে তাকে মিসপার্সোনিফিকেশনের দায়েই আপাতত পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হবে। তার বিরুদ্ধে তমালের অভিযোগ নিশ্চয় আইনের ধোপে টেকে। কারণ তমালকে সে মারধর করে দড়ি বেঁধে পাইনবনে ফেলে রেখেছিল এবং আমি তার সাক্ষী। কিন্তু তমাল নিপাত্তা হয়ে গেছে।

কালরাতে টেবিলল্যাম্পের আলোয় যে স্যুটকেসটা দেখেছিলাম, এখন সেটা গোছানো মনে হল। আমার সঙ্গে সবসময় দরকারি ছোটখাটো জিনিস থাকে। তা আগেই বলেছি। একটা খুদে স্ক্রু ড্রাইভারের সাহায্যে সুটকেসটা খুলে ফেলতে দেরি হল না। পারমিতার পোশাকে স্যুটকেসটা ভর্তি। কাজেই এটা পারমিতার বলেই ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ রাপ্তীর পাথরের মূর্তিতে প্রাণসঞ্চার লক্ষ্য করলাম। সে মৃদুস্বরে বলল, তমাল তার স্যুটকেসে পারমিতার পোশাক পর্যন্ত রাখতে দিয়েছে?. কর্নেল সরকার। এখন আমার মনে হচ্ছে, তমাল আমার সঙ্গে হয়তো প্রতারণা করেছে।

স্যুটকেসটা তন্নতন্ন করে খুঁজতে বললাম, তাহলে সে তোমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল কেন?

সিলটা লুকিয়ে রাখার দরকার ছিল। তাই গিয়েছিল।

কেন মন্তব্য করলাম না। এই স্যুটকেসে পুরুষ মানুষের কোন পোশাক নেই। চেনগুলো টেনে খুলে ভেতরে এমন কিছু পেলাম না যা বিনয় শর্মার কোন সূত্র। জোগাতে পারে। এবার ওয়াড্রোব খুলে দেখলাম, সেটা কঁকা। এতক্ষণে মনে হল, পারমিতা অন্য কোথাও চলে যাওয়ার জন্য সব গুছিয়ে রেখেছে।

বিছানা উল্টেপাল্টেও কিছু দেখতে পেলাম না। টেবিলের ড্রয়ার ফাঁকা। নেহাত খেয়ালবশে নিচু খাটের তলায় উঁকি দিলাম। একটা কাগজের প্যাকেট দেখে খুব আশা করলাম, এর মধ্যে কিছু গোপনীয় জিনিস পেয়ে যাব। কিন্তু খুলেই হতাশ হলাম। পারমিতারই দুপাটি জুতো মাত্র।

জুতো খাওয়ার ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়েছি এবং আমার মুখটা নিশ্চয় তুম্বো দেখাচ্ছিল, সেই সময় রাপ্তী টেবিলের তলা থেকে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট টেনে বার করল। বুঝলাম, সেও এই তল্লাশিতে যোগ দিতে চায়।

সে বাস্কেট থেকে দলাপাকানো ছেঁড়া কয়েকটা খবরের কাগজ বের করল। তারপর নির্বিকার মুখে বলল, আপনি যদি চিঠিপত্র দেখতে চান, দেখাতে পারি।

সে ছেঁড়া এবং দলাপাকানো দুটো ইনল্যান্ড লেটার তুলে আমার হাতে দিল।. তা পকেটে চালান করে বললাম, এই যথেষ্ট। এবার যেকোন সময় পুলিশ এসে। যাবে। আমাদের এখনই বেরিয়ে যাওয়া উচিত।

দরজায় ইন্টারলকিং সিস্টেম আছে। ভেতর থেকে বিনা চাবিতে খোলা যায়। কিন্তু বাইরে থেকে চাবি ছাড়া খোলা যায় না। ২২ নং স্যুইট থেকে বেরুলে সেই হোটেল গার্ড কেন কে জানে আমাকে সেলাম ঠুকল। তার মুখ কাচুমাচু ভাব লক্ষ্য করলাম। কিন্তু তার সঙ্গে কথা বলার সময় ছিল না। নিজের স্যুইটে ফিরে চিঠি দুটো নিয়ে বসলাম।

ডটপেনে লেখা ইংরেজি চিঠি। দুটো চিঠিই পারমিতাকে লেখা। অনেক পরিশ্রমে জোড়াতালি দিয়ে আতস কাচের সাহায্যে পড়ে বোঝা গেল, প্রথম চিঠিতে পারমিতাকে অবিলম্বে দেখা করতে বলা হয়েছে। তলায় নামসই আছে। কিন্তু তা ছেঁড়াখোঁড়া এবং অস্পষ্ট। দ্বিতীয় চিঠিটাও একই হাতের লেখা। কাটাছেঁড়া শব্দ এবং বাক্যাংশ থেকে বোঝা গেল, ট্রেন সংক্রান্ত খবর দেওয়া হয়েছে। তলায় সংক্ষিপ্ত স্বাক্ষর এস এল।

রাপ্তী ঠোঁট কামড়ে ধরে চুপচাপ বসে ছিল। ঘড়ি দেখে বললাম, তুমি এখানে ব্রেকফাস্ট সেরে নিতে পারো। পুলিশ আসার আগেই আমি ব্রেকফাস্টে বসতে চাই।

রাপ্তী উঠে দাঁড়াল। বলল, আমি যাই।

সে কি! কোথায় যাবে তুমি?

 ইস্টার্ন লজে। তারপর বাস ধরে সরডিহা যাব। সেখান থেকে ট্রেনে কলকাতা।

সরডিহায় কেন?

ওখানে আমার এক মামা থাকেন।

একটু হেসে বললাম, তুমি তমাল বেচারাকে ফেলে রেখে চলে যাবে?

 রাপ্তী ফুঁসে উঠল। তমালের ওপর আর আমার এতটুকু আস্থা নেই।

তমাল তার স্যুটকেস পারমিতাকে ব্যবহার করতে দিয়েছে। তাই কি তোমার আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে?

কর্নেল সরকার। তমাল তার সঙ্গে একই ঘরে ছিল।

দরজায় কেউ নক করছিল। তাই সে থেমে গেল। মুহূর্তেই বুঝলাম, ওই ঘরে রাপ্তীকে নিয়ে গিয়ে ভুল করেছি। কোন স্ত্রীর পক্ষে স্বামীর এই আচরণ সহ্য করা সম্ভব নয়। রাপ্তী যে ঘটনাটা একভাবে ভেবে রেখেছিল, প্রত্যক্ষ বাস্তব সেই ঘটনাটা বদলে দিয়েছে।

.

দরজা একটু ফাঁক করে দেখলাম সতীশ কুমার এবং একজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে আছেন। বেরিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। সতীশ কুমার বললেন, আলাপ করিয়ে দিই। পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর শ্রীরমেশ সিংহ। রমেশজী, ইনিই কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

রমেশ সিংহ আমাকে সোজাসুজি চার্জ করলেন। এই হোটেলের ২২ নং স্যুইটের জনৈক তমাল সেন সম্পর্কে আপনার আগ্রহের কারণ কি?

গম্ভীর মুখে বললাম, তমাল সেন আমার ভাগনি রাপ্তীর স্বামী। এখানে বেড়াতে এসে ওরা গুণ্ডার পাল্লায় পড়েছিল।

এখানে কোন গুণ্ডা নেই। আমরা গুণ্ডাদের শায়েস্তা করেছি।

তারা শায়েস্তা হয়নি। স্ত্রীকে বাঁচাতে গিয়ে তমাল একটু আহত হয়েছিল। আমাকে জানিয়েছিল যে গুণ্ডারা পাল্টা মার দেওয়ার জন্য এই হোটেলে হানা। দিতে পারে। তাই মিঃ সতীশ কুমারকে সতর্ক করে রেখেছিলাম। এখন তমালের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে আমার ভাগনিও নিখোঁজ। আপনারা তাদের খুঁজে বের করুন।

রমেশ সিংহ আরও চটে গেলেন। ওঁরা থানায় জানাননি কেন?

অচেনা জায়গা বলে সাহস পয়নি। আপনাদের জানালে গুণ্ডারা আরও খাপ্পা হয়ে যেত। তাই চেপে গিয়েছিল।

আপনি কর্নেল?

হ্যাঁ। তবে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল। কিন্তু আমি বৃদ্ধ মানুষ, তা তো দেখতেই পাচ্ছেন।

কথাবার্তা ইংরেজিতে হচ্ছিল। রমেশ সিংহ আমার দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, আপনি যে সত্যি একজন রিটায়ার্ড কর্নেল, তার প্রমাণ? আপনার পরিচয়পত্র দেখতে চাই।

নেমকার্ড বের করে দিলাম। সতীশ কুমার বিব্রত বোধ করেছিলেন। বললেন, রমেশজী, আমাদের হেঁটেলের সুনাম আছে। দয়া করে মিঃ মেন এবং মিসেস সেন সম্পর্কে একটু মনোযোগ দিলে বাধিত হব।

রমেশ সিংহ নেমকার্ড পড়ছিলেন। যথারীতি বললেন, নেচারিস্ট মানে?

যে প্রকৃতিকে ভালবাসে।

আপনার পরিচয়পত্র এটা নয়। এটা যে কেউ ছাপিয়ে নিতে পারে।

হাসতে হাসতে বললাম, আপনি কি ভাবছেন আমিই আমার ভাগনি আর তার স্বামীকে নিপাত্তা করে দিয়েছি?

সতীশ কুমার বললেন, রমেশজী, অকারণ সময় নষ্ট হচ্ছে।

 রমেশ সিংহ আমার নেমকার্ড পকেটে ঢুকিয়ে বললেন, আপনি পুলিশের অনুমতি ছাড়া হোটেল ছেড়ে যাবেন না।

কথাটা বলে উনি সতীশ কুমারের সঙ্গে ২২ নং স্যুইটের দিকে এগিয়ে গেলেন। পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর ভদ্রলোক আমার ওপর কেন খাপ্পা হলেন, বুঝতে পারলাম না। রাপ্তীকে আমার ঘরে দেখলে উনি নির্ঘাত বিভ্রাট বাধাবেন। দ্রুত দরজা খুলে ঘরে ঢুকে বললাম, রাপ্তী! চলো, আমরা বাইরে কোথাও ব্রেকফাস্ট সেরে নেব। তাছাড়া শিগগির আমাকে একটা ট্রাঙ্ককল করতে হবে।

.

বাইনোকুলার এবং ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। করিডর থেকে নেমে লেকের দিকের রাস্তায় পৌঁছে বললাম, তোমার ইস্টার্ন লজে কি ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা আছে?

রাপ্তী শুধু বলল, কি বিচ্ছিরি।

 সবকিছুই এখন সত্যি বড় বিচ্ছিরি রাপ্তী। কিন্তু কি আর করা যাবে?

লেকের ধারে গিয়ে বাইনোকুলারে পূর্ব-দক্ষিণে পাহাড়ের গায়ে পাইনবনটা একবার খুঁটিয়ে দেখলাম। কাকেও দেখা গেল না।

কিছুক্ষণ পরে ইস্টার্ন লজের কাছাকাছি গেছি, হঠাৎ রাপ্তী বলে উঠল, তমাল ওখানে কি করছে?

রাস্তার ধারে একটা ঝাকড়া বটগাছের তলায় তমালকে বসে থাকতে দেখালম। তার পাশে একটা সুটকেস এবং কোলের ওপর একটা ছোট ব্রিফকেস। চোখে সানগ্লাস। বটগাছটা ইস্টার্ন লজের উল্টোদিকে।

আমাদের দেখতে পেয়ে সে উঠে দাঁড়াল। রাপ্তী তার সঙ্গে কথা বলল না। সোজা লজের ভেতর ঢুকে গেল। তমালের কাছে গিয়ে বললাম, তুমি কি রাপ্তীর জন্য এখানে অপেক্ষা করছিলে?

আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি আর একমুহূর্ত এখানে থাকতে চাইনে। পারমিতা আমার সঙ্গে এতটা বিশ্বাসঘাতকতা করবে আমি চিন্তাও করিনি।

একটু হেসে বললাম, তুমি তার সঙ্গে একই ঘরে ছিলে। এতে রাপ্তী রেগে আগুন হয়ে গেছে। তবে তার রাগটা স্বাভাবিক।

তমাল মাথা নেড়ে বলল, একঘরে ছিলাম। তাতে কি হয়েছে? রাপ্তীকে তো আমি গত পরশু রাতে এসে সব বলে গেছি। রাপ্তী আধুনিক মনের মেয়ে। আমার ওপর তার আস্থা রাখা উচিত।

যাই হোক। তুমি নিখোঁজ হওয়ায় হোটেল থেকে পুলিশ ডাকা হয়েছে।

আপনি প্লিজ রাপ্তীকে একটু বুঝিয়ে বলুন। আই ওয়াজ রিয়্যালি ট্রাপড বাই পারমিতা। বিনয় শর্মার সঙ্গে সেই যোগাযোগ করে এসেছিল। তমাল উত্তেজিত ভাবে ফের বলল, বিনয় শর্মাও কি সাংঘাতিক লোক তা আমি জানতাম না।

তুমি দশ লাখ টাকার লোভে ওদের ফাঁদে পা দিয়েছিলে। তমাল, টাকার লোভ সাংঘাতিক লোভ। আর এও সত্যি যে, তুমি পারমিতাকে ফটো তোলার ছলে পাহাড়ে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলে। তোমার উদ্দেশ্য ছিল তাকে পাহাড় থেকে নীচের খাদে ফেলে দেওয়া।

অমনি তমাল আমার একটা হাত চেপে ধরল। আমার মাথার ঠিক ছিল না কর্নেল সরকার। হ্যাঁ, আমি ওই মেয়েটার হাত থেকে বাঁচতে চাইছিলাম। ও যে কি সাংঘাতিক চরিত্রের মেয়ে আপনি জানেন না। আমার যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গেছে।

বললাম, রাপ্তীর সঙ্গে বোঝাপড়াটা তুমি কলকাতায় গিয়ে করবে। এখন চল, আমার খিদে পেয়েছে। রাপ্তী বলছিল, ইস্টার্ন লজের খাবার বিচ্ছিরি। কিন্তু কি আর করা যাবে?

আমরা ইস্টার্ন লজে ঢোকার আগেই রাপ্তী কাঁধে প্রকাণ্ড ব্যাগ ঝুলিয়ে এবং হাতে একটা স্যুটকেস নিয়ে বেরিয়ে এল। বলল, কর্নেল সরকার। আমি বাস স্ট্যান্ডের ওখানে খেয়ে নেব। চলি।

সে তমালকে কোন কথা না বলে হনহন করে এগিয়ে চলল। তমাল তাকে ব্যস্তভাবে অনুসরণ করল। এটা দাম্পত্য সমস্যা। আমি ভেবে দেখলাম, আমার বরাতে ইস্টার্ন লজের বিচ্ছিরি ব্রেকফাস্ট নেই। কারণ আর এখানে থাকার মানে হয় না।

একটা সাইকেল রিকশা ডেকে আবার হোটেল দ্য লেক ভিউয়ে ফিরে এলাম। ডাইনিং হলে ঢুকে ব্রেকফাস্টের অর্ডার দিলাম। একটু পরে সতীশ কুমার এসে বললেন, আপনি কোথায় গিয়েছিলেন? রমেশজী খুব রেগে চলে গেলেন। আপনাকে গ্রেফতার করবেন বলে হুমকি দিচ্ছিলেন।

বললাম, সতীশজী! আপনি অনুগ্রহ করে আমার নামে লখনউতে একটা ট্রাঙ্ককল বুক করুন। নাম্বার আমি লিখে দিচ্ছি। খুব জরুরি কিন্তু।

সতীশ কুমার চিরকুটটা নিয়ে চলে গেলেন। ব্রেকফাস্টের পর কফিতে চুমুক দিয়েছি, তখন একজন হোটেলবয় এসে খবর দিল, ম্যানেজার সাহেব ডাকছেন।

টেলিফোনে সাড়া দিতেই পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল। কর্নেল সরকার। আমি কিন্তু মোটেও অবাক হইনি যে আপনি চন্দ্র সরোবরে পাড়ি জমিয়েছেন। তবে যতটা জানি, ওখানে এখন প্রচণ্ড শীত। গত ডিসেম্বরে বরফ পড়ার খবরও শুনেছিলাম।

এটা নভেম্বর মাস মিঃ সিংহ। যাই হোক, আমি আপনাকে মুন লেকে আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। জরুরি আমন্ত্রণ।

ওঃ কর্নেল সরকার। আপনি কি ওখানেও খুনোখুনি বাধিয়ে ফেলেছেন?

না, না মিঃ সিংহ। একটা বুদ্ধমূর্তির ব্যাপার।

বুদ্ধমূর্তি! প্লিজ, একটু আভাস দিন।

বুদ্ধমূর্তির আড়ালে কি আছে এখনও জানি না। তবে আপনার সদলবলে আসা জরুরি। এখানে এক সিংহের পাল্লায় পড়েছি। মনে হচ্ছে তিনি আপনার চেয়ে পরাক্রমশালী। তবে সেটা কোনও সমস্যা নয়। আপনাকে আজ বিকেল নাগাদ দেখতে পাব কি?

ঠিক আছে। আপনি যখন ডাকছেন, তখন বুঝতে পারছি

 রাখছি মিঃ সিংহ। হোটেল দ্য লেক ভিউ। স্যুইট নাম্বার ঊনিশ।

ফোন রেখে সতীশ কুমারকে ধন্যবাদ দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, মিসেস সেন কি ফিরেছেন?

সতীশ কুমার উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, না। ওঁদের স্যুইটের দরজায় অন্য একজন গার্ড বহাল করেছি। ওঁদের কেউ দৈবাৎ ফিরে এলে যেন আমায় খবর দেয়। কারণ পশ্চিমের করিডর হয়ে ওঁরা কেউ ঢুকলে আমি দেখতে পাব না। কিন্তু কর্নেলসাহেব, আপনি রমেশজীকে বললেন, মিসেস সেন আপনার ভাগনি এবং তিনিও নাকি নিখোঁজ। অথচ মিসেস সেন তাঁর স্বামীকে ট্যাক্সি করে নিয়ে যেতে চাইলে আমাকে আপনার কথামতো বাধা দিতে হল। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

সময়মতো সবই বুঝতে পারবেন। বলে দোতলায় নিজের স্যুইটে ফিরে গেলাম। তারপর ব্যালকনিতে বসে হ্রদের জলটুঙ্গিতে সেক্রেটারি বার্ডের সন্ধানে সবে বাইনোকুলার তুলেছি, সেইসময় দেখলাম লেকের তীরে বিনয় শর্মা, পারমিতা এবং ষণ্ডামার্কা সেই লোকটা হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে চলেছে। তারা হোটেলের দিকে তাকালে আমাকে দেখতে পেত। কিন্তু তারা তাকাল না। কিছুক্ষণ পরে কটেজ এরিয়ার চড়াইপথে তাদের যেতে দেখলাম। তাদের এই ব্যস্ততার পেছনে নিশ্চয় কোন কারণ আছে।

এই ষণ্ডামার্কা লোকটাই যে আজ ভোরে পূর্ব উপত্যকায় আমাকে অনুসরণ করেছিল এবং সুযোগ পেলেই আক্রমণ করত, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বিনয় শর্মা হলে সম্ভবত পাল্টা গুলি ছুড়ত। সে কাল দুপুরে পাইনবনের নীচে অর্কিডের ফুলটার কাছে আমাকে বলেছিল, তার কাছে ফায়ার আর্মস আছে। তখন ভেবেছিলাম মিথ্যা বলছে। এখন মনে হচ্ছে, আসলে পরোক্ষে সে আমাকে, হুমকিই দিয়েছিল।

এদিকে রাপ্তী বলে গেছে, পারমিতার কাছে নাকি ফায়ার আর্মস আছে।

অতএব লখনউ থেকে পুলিশ সুপার রণধীর সিংহ এসে না পৌঁছনো পর্যন্ত আমার বেশি ঝুঁকি নেওয়া উচিত হবে না। স্থানীয় পুলিশ আমাকে পাত্তা দেবে না। এ ধরনের দুষ্টচক্রের মোকাবিলা করতে হলে পুলিশের সাহায্য দরকার। শর্টকাট করতে হলে রণধীর সিংহকে সরডিহা হয়ে আসতে হবে এবং ঘণ্টা তিনেক সময় তো লাগবেই।

বাইনোকুলার তুলে আবার হ্রদের জলটুঙ্গিতে সেক্রেটারি বার্ডটিকে খুঁজতে থাকলাম। আমাকে চমকে দিয়ে পাখিটা জঙ্গল থেকে কালকের মতোই উড়ল এবং আজ তার গতি পূর্ব-দক্ষিণ পাহাড়ের দিকে। একটু পরেই পাখিটা পাইনবনের শীর্ষে গিয়ে বসল।

তখনই বেরিয়ে পড়লাম। হ্রদের তীরে এখন ভিড় জমেছে। হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। বিনয় শর্মা বা কেউ আমাকে লক্ষ্য করছে কি না গ্রাহ্য করিনি। অবশ্য ওদের উত্তরের পাহাড়ে কটেজ এরিয়ায় যেতে দেখেছি। এদিকে আর আসতে দেখিনি।

অর্কিডের ফুলটিকে কেউ নির্মমভাবে ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ফেলেছে দেখে ব্যথিত হলাম। গুঁড়ি মেরে সতর্কভাবে পা ফেলে পাইনবনের কাছে পৌঁছলাম।  তারপর বাইনোকুলারে পাখিটাকে খুঁজতে থাকলাম। খুঁজতে খুঁজতে সেই পাথরটার কাছে গেলাম, যেখানে তমাল আহত অবস্থায় বন্দি হয়ে পড়েছিল।

এবার পাখিটা চোখে পড়ল। কিছুটা ওপরে একটা পাইনগাছের শীর্ষে বসে লম্বা ঠোঁট দিয়ে সে পাখনা চুলকোচ্ছিল। দ্রুত ক্যামেরায় টেলিলেন্স ফিট করে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য। হঠাৎ সে উড়ে পাহাড়ের চুড়ার কাছে একটা বেঁটে পাইনগাছের শীর্ষে গিয়ে বসল। চুড়ার নীচে ঢালু। অংশটা ফাঁকা এবং ঘন ঘাসে ঢাকা। সেখানে অজস্র পাথরের চাই পড়ে আছে। কিন্তু যেভাবেই কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করি না কেন, তার চোখে পড়ে যাব। ক্যামেরার টেলিলেন্সের আওতা থেকে তার অবস্থান বেশ দূরে। আরও বাধা সামনাসামনি সূর্য।

তাই বাঁদিকে এগিয়ে গেলাম। চূড়ার উত্তর দিকে ঘুরে যদি ওঠা যায়, পাখিটাকে নাগালে পেতেও পারি। কিন্তু কিছুটা গিয়ে দেখি, ওদিকে খাড়া পাথরের পাঁচিল। নীচে গভীর খাদ। বইনোকুলারে খাদটা দেখছিলাম। দেখার কোন কারণ ছিল না। আসলে এটা আমার নিছক অভ্যাস। পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ মাত্র।

দেখতে দেখতে খাদের উত্তরে অনুরূপ খাড়া পাথরের পাঁচিলের গায়ে একটা চাতাল চোখে পড়ল। তার মানে, একটা পাহাড় কোন প্রাগৈতিহাসিক যুগে যেন চিড় খেয়ে দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। কিন্তু উল্টো দিকে অর্থাৎ উত্তরের পাঁচিল খাড়া হলেও স্থানে স্থানে ধাপবন্দি ছোট-বড় ব্যালকনির মতো চাতাল আছে। যে চাতালটা প্রথমে চোখে পড়েছিল, সেটা সবচেয়ে প্রশস্ত। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, চাতালের শেষপ্রান্তে একটা প্রকাণ্ড ফাটল এবং সেই কাটলের কাছাকাছি খাড়া পাথরের গায়ে পদ্ম খোদাই করা আছে।

দেখামাত্র চমকে উঠলাম। বাইনোকুলার নামিয়ে খালি চোখে পদ্মটা আর দেখা গেল না। উত্তেজনায় চঞ্চল হয়ে উঠলাম। তাহলে কি ওই ফাটলটা প্রাচীন যুগের কোন গুহা এবং সেই গুহার ভেতরই কি সেই বুদ্ধমূর্তি আছে?

সেক্রেটারি বার্ড আমাকে তার ছবি তুলতে দিতে একান্ত অনিচ্ছুক। কিন্তু তাকে ধন্যবাদ দেওয়া চলে, যদি সে আমাকে বুদ্ধমূর্তিটি আবিষ্কারের সুযোগ দিয়ে থাকে। সেই ছিন্নভিন্ন মৃত অর্কিডফুলের পাশ দিয়ে নেমে পাথর আর ঝোপঝাড়ে ভরা গিরিখাতে ঢুকলাম। এসব জায়গায় শঙ্খচূড় কেন, পাইথন। সাপও থাকতে পারে। বাইনোকুলারে খুঁটিয়ে সামনেটা দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। মাঝেমাঝে পাহাড়ি অর্কিডের দেখাও পাচ্ছিলাম। কিন্তু এখন অর্কিডের চেয়ে সেই চাতালে পৌঁছনো জরুরি কাজ।

একটা দুর্গম গিরিখাতে কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ প্রাণ গেলেও ঢুকতে চাইবে না, যদি না তার এ ধরনের অভিযানের কোন ট্রেনিং থাকে। কিছুক্ষণ পরে পাথরের কয়েকটা ধাপ এবং ছোট্ট চাতাল পাওয়া গেল। এরপর আর উঠে যেতে বিশেষ অসুবিধা হল না।

 বড় চাতালটাতে উঠে ফাটলের পাশে খোদাই করা পদ্মটা আর খুঁজে পেলাম না। তখন বুঝলাম, এই পদ্ম দূর অতীতের কোন দক্ষ ভাস্কর এমন কৌশলে খোদাই করেছিল যে, নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকেই এটা চোখে পড়বে। দক্ষিণের পাইনবনের পাহাড় থেকে সম্ভবত প্রাচীন যুগের আগ্নেয়গিরির (মুন. লেক তো প্রকৃতপক্ষে আগ্নেয়গিরিরই ক্রেটার বা জালামুখ) শেষ বিস্ফোরণ ঘটেছিল। তার ফলে অনেকটা অংশ ফেটে চৌচির হয়ে খসে পড়েছিল এবং পাঁচিলের মতো একটাই খাড়াই সৃষ্টি হয়েছিল। গিরিখাতে জমাট লাভার স্তর লক্ষ্য করেছি।

পদ্মটা দেখতে না পেলেও এখন আমি ফাটলের সামনে পৌঁছে গেছি। আগে বাইনোকুলারে তিনদিক দেখে নিলাম। তারপর ফাটলের ভেতরে টর্চের আলো ফেললাম। কিন্তু হতাশ হয়ে দেখলাম, কুয়োর মতো একটা গহ্বর যেন পাতালে নেমে গেছে। তলা অব্দি আলো পৌঁছল না।

বুদ্ধমূর্তি এর ভেতর সত্যিই আছে না নেই, সেই কাজটা বরং কেন্দ্রীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ঠিক হবে। কিন্তু খোদাইকরা পদ্ম একটা আশঙ্কার কারণ হয়ে থাকছে। যদি বিনয় শর্মা আমার মতোই বাইনোকুলার সংগ্রহ করে অভিযানে নামে?

পাহাড়ের গা বেজায় এবড়োখেবড়ো। মনে পড়ল, পদ্মটা দেখেছিলাম ফাটলের ডান পাশে আন্দাজ ফুট পাঁচ-ছয় দূরত্বে। বাইনোকুলারে দেখার হিসেবে দূরত্বটা অবশ্য বেড়ে যায়। পিঠে বাঁধা কিটব্যাগ থেকে একটা হাতুড়ি আর লোহার গোঁজ বের করলাম। পাহাড়ি এলাকায় গেলে এসব জিনিস এবং শক্ত দড়ি সঙ্গে নিই। ফাটলের ফুটখানেক তফাত থেকে হাতুড়ি দিয়ে গোঁজটা ক্রমাগত ঠুকে অনেক চাবড়া খসিয়ে ফেললাম। অতীতের এক দক্ষ ভাস্করের কীর্তি নষ্ট করার জন্য অনুশোচনা হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু একটা গোঁয়ার্তুমি আমাকে পেয়ে বসেছিল। হাতুড়ির ঘায়ে পাহাড়ের আর্তনাদ প্রচণ্ডভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। বিনয় শর্মার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। যখন মনে হল, অনেকখানি অংশ এলোমেলো করে দিতে পেরেছি, তখন ক্ষান্ত হলাম। তারপর চাতাল থেকে চাবড়াগুলি পায়ে ঠেলে নীচে ফেলে দিলাম।

এবার ফের পাইনবনের অংশে গিয়ে দেখতে হবে, আমার পরিশ্রম সফল হয়েছে কি না।

আর বিস্তারিত বর্ণনায় যাচ্ছি না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই কালাপাহাড়ি কীর্তি করতে হয়েছিল এবং আমি সফল হয়েছিলাম।

হোটেলে ফিরলাম পৌনে দুটো নাগাদ। প্রচণ্ড পরিশ্রমে আমি তখন এতই ক্লান্ত যে সেই ষণ্ডামার্কা লোকটা কেন, একজন রোগাপটকা মানুষও আমাকে ধাক্কা দিলে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতাম।

গরম জলে স্নান করার পর অনেকটা সুস্থ বোধ করলাম। বোতাম টিপে একজন হোটেলবয়কে ডেকে লাঞ্চ পাঠাতে নির্দেশ দিলাম।

রণধীর সিং-এর না এসে পৌঁছনো অব্দি কিছু করার ছিল না। লাঞ্চের পর ব্যালকনিতে বসে বাইনোকুলারে কটেজ এরিয়া খুঁটিয়ে লক্ষ্য করছিলাম। ১২৭ নম্বর কটেজ চোখে পড়ছিল। কিন্তু বারান্দা বা লনে কেউ নেই। বিনয় শর্মা কটেজ ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে উঠেছে কি? ওদের ব্যস্তভাবে ওদিকে যেতে দেখেছিলাম।

 দরজায় কেউ নক করল। উঠে গিয়ে দরজা একটু ফাঁক করে যাকে দেখতে পেলাম, তার মুখে দাড়ি এবং চোখে সানগ্লাস ছিল। তখনই জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে রিভলভার বের করেছিলাম। অমনি সে ফিসফিসিয়ে উঠল, আমি তমাল! আমি তমাল!

তাকে চিনতে পারলাম। মুখে দাড়ি, চোখে সানগ্লাস, মাথায় টুপি এবং হাতে এখন শুধু সেই ব্রিফকেসটা নিয়ে সে ঘরে ঢুকল। দরজা বন্ধ করে বললাম, তোমার ছদ্মবেশে ত্রুটি আছে।

তমাল দাড়ি খুলতে যাচ্ছিল। বাধা দিলাম। সে বলল, আমার না এসে উপায় ছিল না।

সেই সিলটার জন্য তো?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

রাপ্তী তোমাকে সিলটা কোথায় আছে তা বলে দিয়েছে। তার মানে, তোমার সঙ্গে তার রীতিমত বোঝাপড়া হয়েছে।

তমালের চেহারায় যে বোকা-বোকা ভাব লক্ষ্য করেছিলাম, নকল দাড়ি-গোঁফের ফলে তা রাপ্তীর ভাষায় বিচ্ছিরি দেখাল। সে একটু হেসে বলল, পারমিতাকে আমি ফটো তোলার ছলে পাহাড় থেকে ফেলে দিতে চেয়েছিলাম শুনে সে শান্ত হয়েছে। আপনি বাইনোকুলারে ঘটনাটা দেখেছিলেন। কাজেই আপনি একজন প্রত্যক্ষদর্শী। রাপ্তী আপনার কাছে এর সত্যতা যাচাই করলেই আমার সাতখুন মাফ।

গম্ভীর মুখে বললাম, তোমার মাফ হোক বা না হোক, একটা খুনের চেষ্টা আমি মাফ করতে পারছি না। নরহত্যা মহাপাপ।

তমাল নার্ভাস মুখে বলল, কিন্তু কিন্তু আমি পারমিতার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে বেঁকের মাথায়–

তুমি ওকে দিয়ে মিউজিয়ামের সিলটা চুরি করিয়েছ।

মিথ্যা। একেবারে মিথ্যা। তমাল এবার জোর দিয়ে বলল, রাপ্তী রাগের চোটে কথাটা অন্যভাবে আপনাকে বলেছে। আসলে পারমিতার টাকার দরকার ছিল। তাই নিজেই চুরি করে আমাকে বেচেছিল। কারণ আমার কিউরিও শপ আছে। তাছাড়া আমি অনেকদিন থেকে তার চেনাজানা। অচেনা কাকেও বেচতে সাহস পায়নি সে।

কিন্তু সে কেমন করে জানল ওতে চন্দ্র সরোবর এলাকায় প্রাচীন বুদ্ধমূর্তির কথা আছে?

পারমিতা মিউজিয়ামে চাকরি করত। সব জিনিসের রেকর্ডের হিস্টরি মিউজিয়ামের ক্যাক্লগে আছে। তমাল জোরে শ্বাস ছেড়ে বলল, আমি ওর কথার সত্যতা যাচাই করতে আমার প্রাক্তন অধ্যাপক ডঃ রঘুবীর প্রসাদের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি প্রাচীন লিপি পড়তে পারেন। তিনিই বললেন, চন্দ্র সরোবরের পূর্ব-দক্ষিণ তীরের পাহাড়ে গুহার মধ্যে বুদ্ধমূর্তি আছে এবং গুহার দ্বারে পদ্ম খোদাই করা আছে।

বিনয় শর্মার সঙ্গে কি করে তোমার যোগাযোগ হল?

পারমিতা এর আগেও মিউজিয়াম থেকে কয়েকটা জিনিস চুরি করে তাকে বেচেছিল। কিন্তু সিলটা চুরির সময় তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। পারমিতা পরে আমাকে বলেছে, বিনয় শর্মা তখন হংকংয়ে ছিল।

তাহলে পারমিতাই বিনয় শর্মাকে তোমার কাছে

তমাল ব্যস্তভাবে বলল, টাকার লোভ আমার নেই বলব না। পারমিতার লোভ কিন্তু আরও বেশি। সিলটা আমাকে মাত্র একশো টাকায় সে বেচতে বাধ্য হয়েছিল। তারপর কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে তার চাকরি গেছে। কিন্তু সে সিলটার দাম কত হওয়া উচিত, তা জানে। কারণ এর সঙ্গে কুষাণ যুগের একটা বুদ্ধমূর্তির সম্পর্ক আছে। তাই বিনয় শর্মা কলকাতায় ফেরার সঙ্গে সঙ্গে সে যোগাযোগ করেছিল। বিনয় শর্মা আমাকে বলল, মুর্তিটা পেলে সে দশ লাখ টাকা ক্যাশ দেবে। কিন্তু পারমিতা তার সঙ্গে চক্রান্ত করেছে তা জানতাম না।

একটা কথা। তুমি এখানে এসে কি সেই গুহা খুঁজে বের করতে পেরেছিলে?

আজ্ঞে না। আপনি বিশ্বাস করুন। তমাল করুণ মুখে বলল। যখন টের পেলাম ওরা দুজনে বুদ্ধমূর্তি নিজেরাই হাতাতে চায় এবং সেইজন্য সিলটাই ওদের দরকার, তখন আমি সতর্ক হয়ে উঠলাম। আমার সৌভাগ্য, সেই সময় রাপ্তী আমাকে ফলো করে এখানে চলে এসেছিল।

এখন রাপ্তী কোথায়?

সরডিহায় তার মামার বাড়িতে আছে। ওর মামা ওখানকার ইরিগেশন ইঞ্জিনিয়ার।

তাহলে তুমি সিলটা ফেরত চাইতে এসেছ তো?

সে তো আপনাকে বললাম।

সিলটা মিউজিয়ামেরই প্রাপ্য।

তমাল মুখ নামিয়ে বলল, আমার একশোটা টাকা গচ্চা গেছে। তাছাড়া শয়তান বিনয় শর্মা আমাকে কিছু অ্যাডভান্স করার ছলে ডেকে নিয়ে গিয়ে এমন করে মারধর করল। আপনি গিয়ে না পড়লে সে আমার ওপর চূড়ান্ত অত্যাচার করত।

তোমার অপরাধের আক্কেল সেলামি। এভাবে জাতীয় ঐতিহ্য সম্পদ তুমি বিদেশে পাচারে সাহায্য করেছ।

তমাল আমার পায়ে ধরতে এল। তার কাধ ধরে তুলে বসিয়ে দিলাম। সে মুখ নিচু করে বসে রইল।

চুরুট ধরিয়ে বললাম, তোমাকে একটুখানি প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।

বলুন কী করব?

তোমাকে দাড়ি-টাড়ি খুলে কটেজ এরিয়ায় যেতে হবে। বিনয় শর্মা কোন কটেজে উঠেছে তুমি জানো। যদি তাকে কটেজে না পাও, লেকের ধারে ঘুরে বেড়াবে।

তমাল আঁতকে উঠে বলল, ওরে বাবা। সে আমাকে গুলি করে মারবে।

না। সিলটা তার দরকার। কিন্তু সে কিংবা পারমিতা তোমাকে দেখতে পেয়ে কাছে এলে তুমি তাকে বলবে, গুহাটা তুমি আবিষ্কার করেছ।

কিন্তু আমি তো

চুপচাপ শোন। সে তোমাকে মেরে ফেলবে না। পারমিতাও তোমাকে গুলি করে মারবে না। কারণ ওদের দরকার শুধু বুদ্ধমূর্তি। এবার দেখ, আমি গুহাটা। কোথায় তা এঁকে দেখাচ্ছি।

আপনি গুহাটা আবিষ্কার করেছেন?

করেছি। তুমি সন্ধ্যা ছটা নাগাদ ওদের সেখানে নিয়ে যাবে। বলে হোটেলের প্যাডের একটা কাগজে গুহাটার ম্যাপ এঁকে তার হাতে দিলাম।

সে বলল, কিন্তু আমি এই হোটেল থেকে পালিয়ে যাওয়ার কি কৈফিয়ত ওদের দেব?

বলবে, সাদা দাড়িওয়ালা এক বুড়ো কর্নেল তোমার পেছনে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছিল। তাই তুমি গা-ঢাকা দিয়েছিলে। এও বলবে, কিভাবে যেন সেই বুড়ো কর্নেল তোমাদের উদ্দেশ্য পরে টের পেয়েছিল। তাই তোমাকে উদ্ধার করে আনলেও পরে সে ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল। যাইহোক, তুমি এই পয়েন্ট থেকে একটা গল্প দাঁড় করাবে। পারমিতা জানে, হোটেলের ম্যানেজার ট্যাক্সি চাপিয়ে তোমাকে নিয়ে যেতে বাধা দিয়েছিল। কাজেই তোমার কথায় ওরা আর সন্দেহ করতে পারবে না।

এইসময় দরজায় কেউ নক করল। চাপাস্বরে বললাম, কুইক। তুমি বাথরুমে ঢুকে যাও। যেই আসুক, আমি এখন বেরিয়ে যাব। তাতে তোমার বেরুতে অসুবিধে হবে না। তুমি ভালই জানো, ভেতর থেকে দরজা খোলা যায়। তুমি করিডর দিয়ে ছদ্মবেশেই নেমে যাবে কিন্তু। দাড়ি পরে খুলে ফেল।

তমাল বাথরুমে ডুকে গেল। আমি গিয়ে দরজা একটু ফাঁক করলাম। সাদা পোশাকে রণধীর সিংহ দাঁড়িয়ে ছিলেন। ফিক করে হেসে সম্ভাষণ করলেন, গুড আফটারনুন কর্নেল সরকার।

.

উপসংহার

সেবার নভেম্বরে সেক্রেটারি বার্ডের খোঁজে মুন লেকে গিয়ে যে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তার মোটামুটি একটা বিবরণ দাঁড় করিয়েছি। এরপর কেউ যদি ভাবেন, বাকি কাজটুকু সহজে সমাধা হয়েছিল, তাহলে তিনি ভুল করবেন।

আসলে বিনয় শর্মা কত ধূর্ত এবং নৃশংস, তা ভাবতে পারিনি।

রণধীর সিংহকে হোটেলের পূর্বদিকের লনে নিয়ে গিয়ে সংক্ষেপে ঘটনাটা জানিয়েছিলাম। ওঁর জিপ অনুসরণ করে একটা পুলিশ ভ্যান এসেছিল সরডিহা থানা থেকে। ভ্যানে বেতারযন্ত্র ছিল এবং সেটা একটু দূরে বড় রাস্তায় অপেক্ষা করছিল। রণধীর সিংহ জানতেন, আমি তাকে আসতে বলা মানেই একটা নাটকীয় অভিযান। মুনলেক ফাড়ির সেই সাব-ইন্সপেক্টর রমেশ সিংহ একটু ভড়কে গিয়েছিলেন। পরে আমি তাঁকে বিব্রত অবস্থা থেকে স্বাভাবিক করে ফেলেছিলাম।

 এখানে সাড়ে চারটে বাজতেই সন্ধ্যা জাঁকিয়ে বসে। পাঁচটায় একজন দুজন করে সাদা পোশাকের সশস্ত্র পুলিশ গিয়ে পূর্বদক্ষিণের পাহাড়ি খাদে ঝোপঝাড় এবং পাথরের আড়ালে ওঁত পেতেছিল। আর একটি দল পূর্বের উপত্যকা দিয়ে ঘুরে খাদের পূর্ব দিকটা ঘিরে ফেলেছিল।

আমি, রণধীর সিংহ এবং কয়েকজন সশস্ত্র কনস্টেবল বড় চাতালটার কাছাকাছি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ওঁত পেতে ছিলাম।

ওদিকে কটেজ এরিয়ায় স্থানীয় ফাড়ির কিছু পুলিশ ১২৭ নম্বর কটেজের : আনাচে-কানাচে থেকে লক্ষ্য রেখেছিল। ওদের কোন অ্যাকশান নিতে নিষেধ করা হয়েছিল। তবে ওরা কাকেও কটেজ থেকে বেরুতে দেখলে যেন তখনই একজনকে বেতার ভ্যানে খবর দিতে পাঠায়। বেতার ভ্যানের অফিসার খবর পেলেই তাকে শুধুমাত্র অনুসরণ করবেন।

এ ছিল একটা বড় ধরনের অপারেশন। কারণ জাতীয় ঐতিহ্য সম্পদ বিদেশে পাচারের কোন সুযোগ যেন কেউ না পায়, সরকারি নীতিটা ছিল এরকম কঠোর। এখনও অবশ্য তাই আছে। কিন্তু তখন পাচারের কারবার সর্বত্র জাঁকিয়ে উঠেছিল। বাস্তবে যা হয়। বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো।

সন্ধ্যা ছটা আর যেন বাজতেই চায় না। রেডিয়াম দেওয়া ঘড়ির কাটার ওপর চোখ রেখে বসে আছি। প্রচণ্ড ঠাণ্ডাহিম হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এই হাওয়াটা মধ্যরাতের পর থেমে যায় এবং তারপর কুয়াশা জমতে শুরু করে।

একসময় ছটা বাজল। কিন্তু বিনয় শৰ্মাদের সাড়া নেই। প্রতিটি মুহূর্তে টর্চের আলো দেখার আশা করছি। কিন্তু একই নিবিড় অন্ধকার এবং হাওয়ার অদ্ভুত শনশন শব্দ।

সাড়ে ছটা বাজল। কেউ এল না। রণধীর সিংহ হাত বাড়িয়ে আমাকে স্পর্শ করলেন। চাপাস্বরে বললাম, আরও কিছুক্ষণ দেখা যাক।

সাতটায় আমার ধৈৰ্য্যচ্যুতি ঘটল। উঠে দাঁড়ালাম। তারপর সাবধানে চাতালে উঠলাম। ওখান থেকে তিনটে দিক দেখা যায়। ভাবলাম, পাইনবনে বিনয় শর্মারা হয়তো অপেক্ষা করছে। সতর্কতার কারণে ওরা অপেক্ষা করতেই পারে।

কিন্তু পাইনবনে কোন আলো দেখা গেল না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ফাটলের দিকে পা বাড়াতেই কি একটা শুকনো খসখসে জিনিস জুতোয় ঠেকল। ওই মৃদু শব্দেই বুঝলাম জিনিসটা কাগজ জাতীয় কিছু। পেছন ফিরে বসে দু-হাঁটুর মাঝখান দিয়ে টর্চের আলো ফেলে চমকে উঠলাম।

একটুকরো পাথর চাপা দেওয়া একটা কাগজ। তাতে আঁকাবাঁকা হরফে ইংরেজিতে যা লেখা তার সারমর্ম হল এই :

তোমার আদরের বাচ্চা এখন পাতাল গুহায় বুদ্ধদেবের সঙ্গে খেলা করছে।

পড়ামাত্র শিউরে উঠলাম। আস্তে ডাকলাম, মিঃ সিংহ। সর্বনাশ হয়েছে।

রণধীর সিংহ উঠে এলেন। তারপর চিঠিটা পড়েই ফাটলে ঝুঁকে জোরালো টর্চের আলো ফেললেন। আমি বাইনোকুলারে সেই আলোয় পাতালগুহা দেখে নিলাম। তমাল কাত হয়ে নীচে পড়ে আছে। দেখামাত্র বললাম, মিঃ সিংহ। এখনই ওকে তুলে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।

রণধীর বললেন, ভদ্রলোকের বেঁচে থাকার কথা নয়। তবে দেখছি কি করা যায়।

বললাম, আমার কাছে একটা দড়ি আছে। কিন্তু দড়িটা তত লম্বা নয়। আপনি শিগগির কাকেও টাউনশিপে পাঠান। ওখানে একটা মাউন্টেনিয়ারিং ট্রেনিং সেন্টার দেখেছি। ওঁরা সাহায্য করতে পারেন। আর আপনার বাহিনীকে ফিরে যেতে বলুন। ওয়্যারলেস ভ্যান থেকে সরডিহা থানাকে ম্যাসেজ পাঠাতে হবে। সব রাস্তা আর রেলস্টেশন

রণধীর আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, বাকি সবকিছু আমার হাতে ছেড়ে দিন।

রণধীর সিংহের তুল্য দক্ষ পুলিশ অফিসার এ যাবৎ খুব কমই দেখেছি। তিনি তখনই একজন অফিসারকে সংক্ষেপে নির্দেশ দিয়ে টর্চের আলোর সংকেত করলেন। এদিকে ওদিকে কয়েকটা তীব্র সার্চলাইট জ্বলে উঠল। রণধীর চিৎকার করে বললেন, ডিসপার্স। ব্যাক টু দি আউটপোস্ট। অ্যান্ড ব্রিং হিয়ার টু সার্চলাইটস্।

সুশৃঙ্খলভাবে বাহিনীটি চলে গেল। দুজন সশস্ত্র কনস্টেবল দুটি সার্চলাইট নিয়ে এল। সেই আলোয় পাতাল গুহার তলা বাইনোকুলারে দেখে আশান্বিত হলাম। তলাটা বালিতে ভরতি এবং এক কোণ দিয়ে ঝিরঝিরে স্রোত বয়ে যাচ্ছে। বোঝা গেল, ওটা একটা ভূগর্ভস্থ প্রস্রবন। পাহাড়ের তলায় ফাটল দিয়ে বেরিয়ে পূর্বের উপত্যকায় ঝরনা হয়ে বইছে।

তমালের শরীরে কোন ক্ষতচিহ্ন দেখতে পেলাম না। বাইনোকুলারে যেটুকু লক্ষ্য করা সম্ভব হল, তাতে বলা চলে, ও এখনও বেঁচে আছে।

মাউন্টেনিয়ারিং ট্রেনিং সেন্টারের একদল তরুণ সদস্য এল প্রায় একঘণ্টা পরে। তারা সাহসী এবং উৎসাহী। তাদের সাহায্যে তমালকে অচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার করে যখন লেকের তীরে পৌঁছলাম, তখনই একটি অ্যাম্বুল্যান্স এসে গেল।

রাত দশটা নাগাদ জ্ঞান ফেরার পর তমালের মুখে শুনলাম, বিনয় শর্মার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল কটেজ এরিয়ায়। পারমিতাকে সে দেখতে পায়নি। শর্মা তাকে তখনই সঙ্গে নিয়ে গিয়ে গুহা দেখিয়ে দিতে বলে এবং তমালের কাধ ধরে ঘনিষ্ঠভাবে হাঁটতে থাকে। তার ফায়ার আর্মসের নল তখন তমালের পাঁজরে ঠেকানো। এর ফলে তমাল তার সঙ্গে যেতে বাধ্য হয়। তখন চারটে বেজে গেছে। আসন্ন সন্ধ্যার ধূসরতা ঘনিয়েছে। কেউ টের পাচ্ছিল না ওভাবে একটা লোক আরেকটা লোককে কিডন্যাপ করার মতো নিয়ে যাচ্ছে। গুহার চাতালে উঠে তমাল কৌতূহলবশে একটু ঝুঁকেছে, তখনই বিনয় শর্মা তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। তারপর তমালের আর কিছু মনে নেই।

আমার আশঙ্কা হয়েছিল, তাহলে আজ যখন তাদের তিনজনকে ব্যস্তভাবে ফিরে যেতে দেখেছিলাম, তখন তারা নিশ্চয় গুহার খোঁজ পেয়ে বুদ্ধমূর্তি আত্মসাৎ করে নিয়ে গেছে।

কিন্তু পরদিন দিল্লীতে কেন্দ্রীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধিকর্তার সঙ্গে ট্রাঙ্ককলে যোগাযোগ করে হাস্যাস্পদ হলাম। বহু বছর আগেই তারা পাতাল গুহা থেকে বুদ্ধমূর্তি উদ্ধার করে নিয়ে গেছেন। সেই মূর্তি দিল্লি মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। তবে তারা এ সংক্রান্ত কোন সিলের কথা জানতেন না।

স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল। কিন্তু বিনয় শর্মা, পারমিতা এবং সেই ষণ্ডামার্কা লোকটিকে পাকড়াও করা গেল না ভেবে আক্ষেপ থেকে গেল।

তমাল পরদিন বিকেলেই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল। হোটেল দ্য লেক ভিউয়ে আমার স্যুইটে ওকে নিয়ে এলাম। তারপর কফি খেতে খেতে পারমিতাকে লেখা চিঠিতে এস এল স্বাক্ষরের কথা বললাম। শোনামাত্র সে উত্তেজিত হয়ে উঠল। সে বলল, সুরেশ লাল। তাকে আমি চিনি। সে আমার কিউরিও শপ থেকে বহু অ্যান্টিক কেনাকাটা করে। অ্যান্টিক সংগ্রহ ওর হবি। কিন্তু বিনয় শর্মা অন্য লোক।

সুরেশ লালের চেহারা কেমন?

বেশ হৃষ্টপুষ্ট গড়ন। গায়ের রঙ কালো। দেখলে গুণ্ডা গুণ্ডা মনে হয়।

একটু হেসে বললাম, হ্যাঁ। তাহলে সেই ষণ্ডামার্কা লোকটাই সুরেশ লাল। তমাল বলল, কোথায় দেখলেন তাকে?

এখানেই দেখেছি।

এই সময় দরজায় কেউ নক করল। দরজা ফাঁক করে দেখি, একজন হোটেলবয় দাঁড়িয়ে আছে। সে সেলাম দিয়ে বলল, কর্নেল সায়েবের টেলিফোন আছে।

তমালকে বসিয়ে রেখে নীচে ম্যানেজার সতীশ শর্মার ঘরে টেলিফোন ধরতে গেলাম। সাড়া দিতেই রাপ্তীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল। কর্নেল সরকার। আমি রাপ্তী বলছি সরডিহা থেকে।

বলো ডার্লিং।

রাপ্তীর খুশিখুশি কথা ভেসে এল। বাহ্! তাহলে এবার আমিও আপনার জয়ন্ত চৌধুরীর পাশে ঠাই পেলাম। তো আপনি বিয়ে নিয়ে বলেছিলেন মনে আছে? এবার বলুন, আমার টিয়ে করা হাজব্যান্ডের খবর কি? ওকে নিখুঁত অবস্থায় ফেরত চাই।

পেয়ে যাবে। কাল মর্নিংয়ে তমালকে বাসে তুলে দেব।

 শুনুন কর্নেল। জয়ন্তবাবুর মতো শুধু কর্নেলই বলছি কিন্তু।

বলো ডার্লিং।

ওনলি ফর ইওর ইনফরমেশন কিন্তু। তমালকে জানাবেন না। পারমিতার সঙ্গে আজ দুপুরে হঠাৎ এখানে আমার দেখা হয়ে গেছে। ওকে জিজ্ঞেস করলাম তুমি এখানে কি করছ? ও আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইছিল। বলল। এখনই ট্রেন ধরতে হবে। আমি কি করলাম জানেন?

বিচ্ছিরি কিছু করলে?

রাপ্তীর হাসি শোনা গেল। খুবই বিচ্ছিরি কর্নেল। চেঁচামেচি করে লোক জড়ো করে বললাম, এই মেয়েটা ডাকাত। আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। ওর কাছে ফায়ার আর্মস আছে। ব্যস। লোকেরা ওকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিল। সার্চ করে পুলিশ ওর হ্যান্ডব্যাগে সত্যিই একটা স্মল গান পেয়েছে। একটু আগে মামাবাবু খোঁজ নিয়ে এসে বলেছিলেন, ওই মেয়েটাকেই নাকি পুলিশ খুঁজছিল। মুন লেকের একটা হোটেলে ও স্যুটকেস ফেলে পালিয়ে এসেছিল। পুলিশ–

ট্রাঙ্ককলের লাইন কেটে গেল। সতীশ শর্মাকে ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের স্যুইটে ফিরে এলাম।

পরদিন সকালের বাসে তমালকে সরডিহা পাঠিয়ে হোটেল ফিরছি। পথিমধ্যে পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর রমেশ সিংহ মোটর বাইক থামিয়ে বললেন, আপনার খোঁজে বাসস্ট্যান্ডে যাচ্ছিলাম। পুলিশ সুপার সিংহসায়েব ওয়্যারলেসে আপনাকে জানাতে বললেন, বিনয় শর্মা এবং সুরেশ লাল নামে তার এক সঙ্গী সরডিহা রেলস্টেশনের রেস্টরুমে ধরা পড়েছে। বিনয় শর্মা একজন দাগি স্মাগলার। তার আসল নাম রাকেশ লাল। দুই লাল এখন কালো হয়ে গেছে….