হনিমুন লজ

হনিমুন লজ

০১.

 শ্রুতি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখল, সোমক ব্যালকনিতে বসে সিগারেট টানছে। শ্রুতি ব্যস্তভাবে বলল, এ কী! তুমি এখনও তৈরি হওনি?

সোমক একটু হাসল। আমি যাচ্ছি না।

 যাচ্ছ না মানে? শ্রুতি চমকে উঠে ওর দিকে তাকাল। হঠাৎ আবার কী হল তোমার?

কিছু না। আসলে ভিড় হইচই ছোটাছুটি আমার ভালো লাগছে না। সোমক মুখটা করুণ করল। ভেবে দেখলাম, যে জন্য এখানে তুমি আর আমি এসেছি, তার সঙ্গে এই প্রোগ্রামটা ঠিক যেন ফিট করছে না।

আশ্চর্য! শ্রুতি জোরে শ্বাস ছাড়ল। কাল রাত্রে প্রোগ্রামটা তুমিই করেছ।

 হুঁ! করেছিলাম। কিন্তু সোমক হঠাৎ থেমে গিয়ে দূরে দৃষ্টিপাত করল।

 ব্যাপারটা একটু খুলে বলবে?

না না! তেমন কিছু নয়। সোমক হাত বাড়িয়ে শ্রুতির একটা হাত নিল। আস্তে বলল, হনিমুনে এসে ভিড়ে তোমাকে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে না।

তার চোখে হাসি ছিল এবং কণ্ঠস্বরে প্রেম। কিন্তু শ্রুতি চটে গেল। কোনও মানে হয়? ওঁরা কী ভাববেন বলো তো? সাড়ে ছটা বেজে গেছে। সবাই নীচে অপেক্ষা করছেন। আর হঠাৎ তুমি বলছ যাবে না।

প্লিজ শ্রুতি! বরং তুমি ওঁদের সঙ্গে যাও। বলো, আমার শরীর একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এখানে এসে হিম লাগিয়ে জ্বরমতো হয়েছে।

আমি সত্যি কিছু বুঝতে পারছি না।

তুমি বোঝবার চেষ্টা করছ না। কাল রাত্রে ধারিয়া ফস্ দেখতে যাওয়ার কথা যখন তুলি, তখন আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমরা হনিমুনে এসেছি।

সোমক শ্রুতিকে কাছে টেনে আদর করার ভঙ্গি করল। কিন্তু শ্রুতি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, প্রশ্নটা ভদ্রতার। তুমিই প্ল্যান-প্রোগ্রাম করলে। এখন আমরা যদি ওঁদের সঙ্গে না যাই, ব্যাপারটা মোটেও ভালো দেখাবে না। তা ছাড়া ওঁরাও তো হনিমুনে এসেছেন।

সোমক জোরে হাসল। সবাই নয়। কেউ কেউ। যাই হোক, ভদ্রতারক্ষার খাতিরে তুমি ওঁদের সঙ্গ দাও।

শ্রুতি বিরক্ত হল। কী বলছ তুমি!

হ্যাঁ। তুমি বরং যাও। আমি এখানে চুপচাপ বসে প্রকৃতি দেখি। জাস্ট ভদ্রতার খাতিরে অন্তত ঘণ্টা দু-তিন তোমার বিরহ-যন্ত্রণা সহ্য করতে পারব। তবে প্লিজ, যাবার সময় একটা চুমু-টুমু দিয়ে যাও।

শাট আপ! চুমু-টুমু অত শস্তা?

 হনিমুনে ওটা খুবই শস্তা–যাকে বলে ড্যাম চিপ।

সোমক উঠে দাঁড়িয়ে শ্রুতিকে টেনে ঘরে ঢোকাল। তারপর যখন সে ওকে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করছে, তখন কেউ দরজায় নক করল। শ্রুতি ছিটকে সরে গিয়ে দরজা খুলল।

দরজার সামনে কুমকুম দাঁড়িয়ে ছিল। বলল, পায়েলদি পাঠালেন। সবাই লনে অপেক্ষা করছেন। ওঁর হাজব্যান্ড ভদ্রলোক একটা জিপ ম্যানেজ করেছেন।

শ্রুতি আস্তে বলল, এদিকে আমার হাজব্যান্ড ভদ্রলোকের হঠাৎ শরীর খারাপ।

 কুমকুম সোমকের দিকে তাকিয়ে বলল, জিপে বসে যাবেন। পায়ে হেঁটে তো যেতে হচ্ছে না আর।

সোমক কাঁচুমাচু মুখে বলল, কাল রাত্রে খোলা আকাশের নীচে বসে ছিলাম। অক্টোবরের শেষাশেষি এখানে বড় হিম পড়ে যায়। ঠাণ্ডা লেগে একটু জ্বরমতো হয়েছে। সারা শরীরে ব্যথা। তো শ্রুতি আমাকে ফেলে রেখে যেতে চাইছে না। আপনি ওকে টেনে নিয়ে যান বরং।

কুমকুম বলল, ঠিক আছে। শ্রুতিদি আসুন। জাস্ট ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ফিরে আসব আমরা। জানেন শ্রুতিদি? চমনলালজি বলছিলেন, ধারিয়া ফলসের কাছে। নাকি প্রি-হিস্টোরিক এজের কিছু কেভ-পেন্টিং খুঁজে পাওয়া গেছে। একটা ডাইনোসরের ছবি পর্যন্ত! ভেরি ইন্টারেস্টিং নয়?

শ্রুতি সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল। সোমক হাসল। জুরাসিক পার্ক ফিল্মের প্রভাব! মার্কিন কালচার ক্রমশ আন্তর্জাতিক মডেল হয়ে উঠছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিনরাই উফো দেখতে হিড়িক ফেলে দিয়েছিল। এখন উফো-হুঁজুগ তো ঝিমিয়ে পড়েছে। ডাইনোসর-হুঁজুগ মাথাচাড়া দিয়েছে। বলে সে শ্রুতির দিকে ঘুরে চোখের ঝিলিক ফেলল।

শ্রুতি হ্যান্ডব্যাগটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল। তার চলে যাওয়ার ভঙ্গিতে ক্ষোভ ছিল।

সোমক দরজা বন্ধ করে ব্যালকনিতে গিয়ে বসে পড়ল। সিগারেটটা টানতে গিয়ে দেখল, ফিল্টার টিপে পৌঁছে আগুন নিভে গেছে। সে ওটা নীচে ছুঁড়ে ফেলল। এদিকটাতে খাড়া পাথরের নৈসর্গিক দেওয়াল। তবে দেওয়ালের ফাটলে রঙ্গনা ফুলের মতো অজস্র বুনো লাল ফুলে ঢাকা ঝোপ গজিয়ে আছে। তার নীচে ঢেউখেলানো উপত্যকা। কোথাও ঘন ঘাস ঝোপঝাড় উঁচু-নিচু গাছের জঙ্গল। আবার কোথাও নগ্ন পাথুরে মাটি। কাছে ও দূরে নীল-ধূসর পাহাড় কুয়াশায় কিছুটা অস্পষ্ট।

কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকার পর সোমক জোরে শ্বাস ফেলল। তার ধারণায় ভুল ছিল না। ফস্ দেখতে শ্রুতি যেতই এবং গেল। অনির্বাণ নামে যে লোকটা পায়েলকে বিয়ে করেছে, শ্রুতি তাকে চেনে। শুধু চেনে না, যেন কোনও সময়ে বেশ ঘনিষ্ঠতাও ছিল। জলপ্রপাত দেখতে যাওয়ার প্রোগ্রাম করে সোমক আসলে বুঝতে চেয়েছিল, শ্রুতির প্রতিক্রিয়াটা এখন কেমন–কেন না পায়েল ওই লোকটাকে বিয়ে করেছে।

লোকটার বয়স পায়েলের চেয়ে অন্তত পনের বছর বেশি। সোমকের এটা অনুমান। পায়েল পঁচিশ বছরের যুবতী! তা হলে অনির্বাণ রুদ্র চল্লিশ। বলিষ্ঠ আঁটোসাঁটো গড়ন। সে নাকি কলকাতার কোনও বড় কোম্পানির চিফ একজিকিউটিভ। তবে সে খুব আলাপী আর হাসিখুশি প্রকৃতির লোক। সবতাতেই উৎসাহী আর নাকগলানো। সব সময় বকবক করে।

কিন্তু আশ্চর্য লাগে, পায়েল ব্যানার্জির মতো মেয়ে ওকে বিয়ে করে বসল কেন? আরও একটা আশ্চর্য, সোমক ও শ্রুতি বিয়ের পর যেখানে হনিমুনে এসেছে, ওরাও সেখানে হনিমুনে চলে এসেছে। কাকতালীয় যোগাযোগ? শ্রুতি রাত্রে বলছিল, সে জানত না পায়েল বিয়ে করেছে এবং সে নাকি অবাক হয়েছে। ওকে এখানে দেখে। অনির্বাণ সম্পর্কে শ্রুতির ব্যাখ্যা হল, ও তার দাদা ধৃতিমানের বন্ধু।

কে জানে কী ব্যাপার! শুধু এটাই স্পষ্ট যে, শ্রুতি ও অনির্বাণ রুদ্রের মধ্যে ভালোরকমের জানাশোনা আছে। পায়েলের সঙ্গে কথাবার্তায় শ্রুতির যেন কিছু ঈর্ষার আভাস লক্ষ্য করেছে সোমক।

আবার এও ঠিক, পায়েলকে এখানে তার স্বামীর সঙ্গে হনিমুনে আসতে দেখে সোমকও মনে মনে রুষ্ট আর ঈর্ষান্বিত। পায়েল সোমককে ল্যাং মেরেছিল। টানা তিন বছর চুটিয়ে প্রেম করাটা যে পায়েলের নিছক খেলা,। বুঝতে পারেনি সোমক। প্রতারিত হওয়ার যন্ত্রণা খুব তীব্রগভীরে একটা ক্ষত থেকে যায়।

সোমক আবার একটা সিগারেট ধরাল।

ছোটনাগপুর শিল্পাঞ্চলের একটি প্রত্যন্ত ও ছোট শিল্পকেন্দ্র ধারানগর। সেখান থেকে প্রায় পাঁচ কিমি দূরে এবং ধারিয়া নদীর তীরে একটা টিলার মাথায় এই হনিমুন লজ। কাছাকাছি কোনও বসতি নেই। বছর দুই আগে এক মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী এই দোতলা লজটি তৈরি করেছেন। ইতিহাসের অধ্যাপক চমনলালের সঙ্গে এখানে এসে আলাপ হয়েছে সোমকের। তিনি বলছিলেন, তার যৌবনে এখানে একটা পাথরের পুরনো বাংলো ছিল। বাংলোর মালিক ছিলেন ফাদার পিয়ার্সন। তখন সেই পাদ্রি ভদ্রলোক অথর্ব বৃদ্ধ। কেউ এসে থাকতে চাইলে ঘর ভাড়া দিতেন। এখনকার মতো বিদ্যুৎ ছিল না। টেলিফোন থাকার কথা তো ভাবাই যায় না। চমনলালজি বিয়ের পর সেই বাংলোতে হনিমুনে এসেছিলেন। তো এতকাল পরে রাজেন্দ্র অগ্রবাল বাংলোর ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে দোতলা বাড়ি তৈরি করেছেন। বিদ্যুৎ আর টেলিফোনের ব্যবস্থাও হয়েছে। সে-খবর পেয়ে চমনলাল সস্ত্রীক এসে পড়েছেন স্মৃতির টানে।

একসময় চারদিকে ঘন জঙ্গল ছিল। বুনো জন্তু-জানোয়ারও ছিল প্রচুর। হনিমুনে এসে রীতিমতো রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল চমনলালজির। এখন এখানে প্রকৃতির সেইসব চমকপ্রদ সৌন্দর্য আর বিভীষিকা নেই। তবু স্থানটির আকর্ষণ আছে। বিশেষ করে এই শেষ শরতে আবহাওয়া যেমন মনোরম, ধারিয়া নদী আর ছোট ছোট উপত্যকার সৌন্দর্যও চোখ-জুড়োনো। নব বিবাহিত যুবক-যুবতীদের হনিমুনের জন্য যে নির্জনতা আর স্বাধীনতা দরকার, তা এখানে অপরিমিত।

ইতিহাসের প্রাক্তন অধ্যাপক ভদ্রলোকের বয়স প্রায় সত্তর বছর। তার স্ত্রী রজনীদেবীর বয়সও ষাটের ওধারে। কিন্তু দুজনেই শক্তসমর্থ। যুবক-যুবতীদের সঙ্গে আলাপ জমাতে পটু।

হনিমুন লজের একতলায় দুটো এবং দোতলায় পাঁচটা স্যুইট। এ ছাড়া আধুনিক কেতায় নীচে ডাইনিং, লাউঞ্জ এসবও আছে। রিসেপশন কাউন্টার আছে। ম্যানেজার রঘুবীর রায় অতিশয় সজ্জন মানুষ। তিনি হাসতে হাসতে বলছিলেন, এখানে হনিমুনের জন্যই সবাই আসে। তবে এ ব্যাপারে কড়াকড়ি কোনও নিয়ম নেই। একা কেউ এসে থাকতেও পারেন। স্যুইট খালি থাকলে তো তাকে না বলা যায় না। আগামী এক সপ্তাহ ধরে কোন সুইট খালি থাকছে না। এখন কোনও দম্পতি হনিমুনে এলে দুঃখের সঙ্গে তাকে না বলতেই হবে। অবশ্য ধারানগরের কাছাকাছি অনেক হোটেল আছে।

সিগারেট শেষ করে সোমক উঠল। প্রায় পৌনে সাতটা বাজে। আবহাওয়ায় শীতের আমেজ আছে। রাত-পোশাক ছেড়ে সে প্যান্ট-শার্ট পরে নীচে গেল। ম্যানেজার রঘুবীর লাউঞ্জের সামনে বড় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মর্নিং স্যার বলে সম্ভাষণ করলেন। আপনি ফল্স্ দেখতে গেলেন না?

সোমক বলল, না। শরীর ভালো নেই।

 ডাক্তারের দরকার হলে বলবেন স্যার।

বলব।

সোমক লনে নেমে ডানদিকে ঘুরে বাগানে গেল। সবুজ ঘাসে ঢাকা মাটি। এখানে-ওখানে পাথরের মসৃণ বেদি আর কাঠের বেঞ্চ। চৌকে! বা গোল রঙিন মরশুমি ফুলের কয়েকটা বাগিচা এবং কোথাও কোথাও ঘন পাতায় ভরা বেঁটে দেশি-বিদেশি গাছ। এটা লজের দক্ষিণ দিক। কোণে একটা গাছের তলায় বেঞ্চে এক যুবতাঁকে দেখে সোমক থমকে দাঁড়াল।

গতরাত্রে লাউঞ্জে সোমক ওকে এক যুবকের সঙ্গে দেখেছিল। ডিনারের আগে অনির্বাণ রুদ্র সাইট-সিইং প্রোগ্রাম নিয়ে আলোচনার সময় ছোটখাটো ককটেল পার্টি মতো দিয়েছিল। এসব ক্ষেত্রে যা হয়। কড়া ও মিঠা পানীয়ের গ্লাস হাতে যথেচ্ছ হইহল্লা, অতিউৎসাহীদের একটু নাচানাচি, ওয়েস্টার্ন পপ মিউজিক। চমনলালজির মতো মানুষও নিজের স্ত্রীর সঙ্গে নাচতে চাইছিলেন। কিন্তু রজনীদেবীর অনিচ্ছা। অগত্যা পায়েল বৃদ্ধের সঙ্গে নাচল। অনির্বাণ শ্রুতির সঙ্গে নাচতে চাইছিল। কিন্তু সোমক শ্রুতিকে ছাড়েনি। কুমকুম তার স্বামী দীপকের নাচের জুড়ি। শেষের দিকে দীপক ধপাস করে কুশনে বসে পড়লে অনির্বাণ কুমকুমকে পেয়ে যায়। দীপকের একটু নেশা হয়েছিল।

আর হ্যাঁ–সে সময় এই যুবতী তার সঙ্গীকে নিয়ে একটু তফাতে বসে ছিল। অনির্বাণ পরস্পরের মধ্যে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় ওদের লক্ষ্য করেনি। সোমকের মনে হয়েছিল, যারা দলে মিশতে চায় না, তাদের টানাটানির অর্থ হয় না, তা ছাড়া ভুল করে অপমানজনক কথা বলে বসতেই পারে।

কাল রাতের পুরো ছবিটা মনে ভেসে এসেছিল সোমকের। এখন সকালে যুবতীটি এখানে একা চুপচাপ বসে আছে এবং ওর সঙ্গীটি নেই। দাম্পত্যকলহ নাকি?

অবশ্য যারা এই লজে আসে, তারা সবাই দম্পতি কি না বলা কঠিন। প্রেমিক প্রেমিকা স্বামী-স্ত্রী সেজেও আসতে পারে। রঘুবীর বলছিলেন এসব কথা। বলছিলেন, তেমন কোন জুটি এলেও তার কী করার আছে?

এই বাগানে সোমক নির্জনতা চেয়েছিল। সে একটু বিরক্ত হয়ে তাকাল। চোখে চোখ পড়তেই যুবতী অপ্রতিভ ভঙ্গিতে ইংরেজিতে বলল, আপনি ইচ্ছে করলে এখানে বসতে পারেন।

সোমক বলল, নাহ। আপনাকে ডিসটার্ব করা উচিত হবে না।

কেন একথা বলছেন?

আপনি সম্ভবত আপনার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছেন। সোমক একটু হাসল। হনিমুন লজের নাকি একটা রোমান্টিক ট্রাডিশন ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে।

আমি কারও জন্য এখানে অপেক্ষা করছি না। কাজেই এক্ষেত্রে কোনও রোমান্টিসিজম নেই।

আপনার স্বামী কি কোথাও বেরিয়েছেন? বলেই সোমক মুখটা একটু কাচুমাচু করল। সরি! আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে চাই না।

নাক গলানো কেন হবে? প্রশ্নটা খুব স্বাভাবিক। ভোরে শোভন কোথায়। বেরিয়েছে। আমাকে বলে যায়নি!

সোমক তাকাল। একটু পরে আস্তে বলল, তাই বুঝি? তাহলে তো এটা উদ্বেগের বিষয়।

যুবতী ঠোঁটের কোনায় হাসল। নাহ্। ওর জন্য আমার কোনও উদ্বেগ নেই। আপনারা অনেকেই কলকাতা থেকে এসেছেন!

হ্যাঁ। আপনারা?

বার্নপুর থেকে। আমার নাম ঋতুপর্ণা রায়। পর্ণা নামে সবাই ডাকে। আমার বাবার বাড়ি কলকাতায় ছিল। বাড়িটা আর নেই। তাই কলকাতা যাওয়া হয় না। আগের মতো।

সোমক এগিয়ে গিয়ে বেঞ্চে বসল। আমি সোমক চ্যাটার্জি। আমার স্ত্রী শ্রুতি একটু আগে দল বেঁধে জলপ্রপাত দেখতে গেল। আমি যাইনি। আসলে ভিড় হইহল্লা আমার পছন্দ নয়।

কাল রাতে লাউঞ্জে ককটেল পার্টিতে আপনি নাচছিলেন।

সোমক শুকনো হাসি হাসল। ওটা নিছক ভান বলতে পারেন। একালীন সংস্কৃতির পাল্লায় পড়েছিলাম। তো আমরা বাংলায় কথা বলছি না কেন? আমরা দুজনেই বাঙালি!

ঋতুপর্ণা হাসল না। এবার বাংলায় বলল, একালীন সংস্কৃতির পাল্লায় আমাকে সব সময় পড়তে হয়। তাছাড়া আমার স্বামী শোভন রায় আমেরিকায় পড়াশুনা করে এসেছে। মার্কিন ইংলিশ বলে। কদাচিৎ বাংলা।

কিন্তু উনি কাল রাতে আমাদের পার্টিটা এড়িয়ে থাকলেন। আমরা যা করছিলাম, তা মার্কিন কালচার।

ঋতুপর্ণা একটু চুপ করে থাকার পর বলল, কাল ওর মন ভালো ছিল না।

তাই বুঝি?

 হ্যাঁ। কতকটা আপনার মতো।

কেন?

একটু আগে বললেন না?

 কী বললাম বলুন তো?

 ভিড় হইহল্লা আপনার পছন্দ নয়। তাই স্ত্রীর সঙ্গে ফলস্ দেখতে গেলেন না। তার মানে, আপনার মন আজ আজ ভালো নেই।

সোমক সিগারেটে শেষ টান দিয়ে চপ্পলের তলায় নেভাল। তারপর আস্তে শ্বাস ছেড়ে বলল, আসলে আমরা হনিমুনে এসেছি। এটা ভুলে যাওয়া উচিৎ নয়।

ঠিক। দুজন বাদে আমরা সবাই হনিমুনে এসেছি।

 দুজন বাদে? আপনি লক্ষ্য করেছেন দেখছি!

আপনি করেননি?

হুঁ। করেছি। দোতলায় আমার পাশের স্যুইটে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক আছেন। পাদ্রিদের মতো চেহারা। ম্যানেজার বলছিলেন, রিটায়ার্ড মিলিটারি অফিসার। সাম কর্নেলকী যেন নামটা! দেখলে বিদেশি মনে হয়।

নীচের সুইটে এক অবাঙালি মহিলা একা আছেন।

হ্যাঁ। সুভদ্রা ঠাকুর। আলাপ তাঁর সঙ্গেও হয়নি। ম্যানেজার বলছিলেন, উনিও নাকি চমনলালজির মতো স্মৃতির টানে এখানে এসেছেন। ওঁর স্বামীওঃ! সে একটা সাংঘাতিক গল্প মনে হয়।

বলুন না শুনি!

সোমক একটু চুপ করে থাকার পর বলল, প্রায় পঁচিশ বছর আগে এখানে ছিল ফাদার পিয়ার্সনের বাংলো। সুভদ্রা দেবী স্বামীর সঙ্গে হনিমুনে এসেছিলেন। ধারিয়া ফসে বেড়াতে গিয়ে কী ভাবে মিঃ ঠাকুর নাকি পা হড়কে প্রপাতের; জলে পড়ে যান। আশ্চর্য ব্যাপার হল, তার ডেডবডি পাওয়া যায়নি।

ঋতুপর্ণা চমকে উঠল। সে কী!

 প্রপাতের নীচে একটা লেক মতো আছে। সেখানে নাকি প্রচুর কুমির থাকত। পুলিসের মতে, ডেডবডি কুমিরে খেয়ে ফেলেছে।

তাই ভদ্রমহিলাকে ছিটগ্রস্ত মনে হচ্ছিল।

সোমক সিগারেটের প্যাকেট বের করে বলল, আপনার সঙ্গে আলাপ হয়েছে?

তেমন কিছু না। ওই গেট খুলে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। চোখে চোখ পড়লে বললেন, জলপ্রপাতের ভূত দেখতে যাচ্ছেন। ইচ্ছে করলে আমি ওঁর সঙ্গে যেতে পারি। পায়েচলা রাস্তায় ধারিয়া ফস্ এখান থেকে মাত্র এক কিলোমিটার। কখন গেলেন উনি?

আধঘণ্টা আগে।

সোমক একটু হাসল। আপনি ওঁর সঙ্গে গেলে পারতেন!

কেন?

আপনার স্বামী ফিরে এসে আপনাকে খুঁজে পেতেন না। বেশ একটা শোধ নেওয়া হত।

ঋতুপর্ণা কথাটা কানে নিল না। সে সোমকের মুখের দিতে তাকিয়েছিল। হঠাৎ বলে উঠল, আপনাকে আমি দেখেছি। ভীষণ চেনা মনে হচ্ছে। ঠিক মনে করতে পারছি না।

বার্নপুরে আমি কখনও যাইনি।

ঋতুপর্ণা চঞ্চল হয়ে উঠল। না না! আপনাকে দেখেছি। আচ্ছা, আপনি কি বিজ্ঞাপনে মডেলিং করেন?

সোমক আস্তে বলল, ঠিক ধরেছেন। কয়েকটা টিভি ফিল্মেও হিরোর রোল করেছি।

তাই বলুন! কাল রাতের পার্টিতে আপনাকে দেখে আপনার ভয়েস শুনে একবার মনে হয়েছিল—-

ও কথা থাক। আপনার স্বামী শোভনবাবু সম্পর্কে আমার কেন যেন উদ্বেগ হচ্ছে। উনি কী করেন?

ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু ওর জন্য আপনার উদ্বেগের কারণ নেই। ও একটু খেয়ালি। ঋতুপর্ণা উঠে দাঁড়াল। বরং চলুন না আমরা নদীর ধারে গিয়ে বসি। কী? আপত্তি আছে?

সোমক একটু ইতস্তত করার পর উঠে দাঁড়াল। বেশ তো! চলুন।

.

০২.

সওয়া আটটা নাগাদ কর্নেল নীলাদ্রি সরকার হনিমুন লজে ফিরলেন। রিসেপশন কাউন্টার থেকে ম্যানেজার রঘুবীর রায় সম্ভাষণ করলেন, মর্নিং কর্নেল সাব!

মর্নিং রঘুবীর!

কতদূর ঘুরলেন আজ?

 ধারিয়া ফলস্ অব্দি।

কতগুলো প্রজাপতি ধরলেন?

একটাও না। এমন কি দুষ্টু প্রজাপতিগুলো ছবি তোলারও সুযোগ দেয়নি। তবে একটা সুন্দর অর্কিডের চারা পেয়েছি। আর বাইনোকুলারে ধারা লেকের ধারে দুটো নীল সারস দেখেছি। গত বছর তুমি নীল সারসের কথা বলেছিলে। তখন ভেবেছিলাম জোক!

আমি সব সময় সত্যি কথা বলি কর্নেলসাব।

ধন্যবাদ। নীল সারস দম্পতিও সম্ভবত এ সময় হনিমুনে আসে। কারণ বাইনোকুলার দিয়ে সারা এলাকার গাছপালা তন্নতন্ন করে খুঁজে ওদের বাসা দেখতে পাইনি।

আমার হনিমুনারদের দেখেছেন!

 দেখেছি। তবে আলাপ করতে যাইনি। নববিবাহিত দম্পতিদের এ সময় এড়িয়ে থাকাই ভালো। কর্নেল লাউঞ্জে ক্লান্তভাবে বসলেন। রঘুবীর! এখানেই এক পেয়ালা কফি খেয়ে সুইটে যাব।

ম্যানেজার তখনই কিচেনে খবর পাঠিয়ে কাছে এলেন। আস্তে এবং মুচকি হেসে বললেন, গতবছরের মতো এবারও না হনিমুনাররা বউ বদল করে ফেলে!

কর্নেল একটু হাসলেন। আমি ওদের লক্ষ্য করিনি। তুমি তেমন কিছু দেখেছ নাকি?

চ্যাটার্জিসাব ফলস্ দেখতে যাননি। ওঁর বউ গেছেন। এদিকে রায়সাব একটু, আগে ধারানগর থেকে টেলিফোনে তার বউকে ডেকে দিতে বললেন। রঘুবীর শব্দ করে হাসলেন। বলছিলাম আমি সব সময় সত্যি কথা বলি। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা আমাকে কোনও কোনও সময় মিথ্যা বলতে বাধ্য করে। অকারণ দাম্পত্যকলহে ইন্ধন যোগানো কি উচিত? বলুন কর্নেলসাব!

ঠিক। তো রায়সায়েবের স্ত্রীকে তুমি খুঁজে পাওনি?

চ্যাটার্জিসাবের সঙ্গে রায়সাবের বউকে বাগানে কথা বলতে দেখেছিলাম। তারপর ওঁরা দুজনে বেরিয়ে গেলেন।

তা হলে ধারিয়া নদীর ধারে দুজনকে দেখে এলাম। কিন্তু তুমি রায়সায়েবকে কী বললে?

বললাম আপনার স্ত্রী কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে গেছেন। ব্যস! আর কিছু বলিনি।

কর্নেল টুপি খুলে টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, এবারও কি বউবদলের সম্ভাবনা লক্ষ্য করছ রঘুবীর?

রঘুবীর মুখোমুখি বসে মিটিমিটি হেসে বললেন, চ্যাটার্জিসাব শরীর খারাপ বলছিলেন। কিন্তু উনি দিব্যি সুস্থ। তারপর দেখুন, মিসেসকে ফল্স দেখতে পাঠিয়ে বাগানে গেলেন। তখন সেখানে মিসেস রায় একা বসে ছিলেন। আপনি মিসেস চ্যাটার্জিকে যদি ফসের ওখানে না দেখে থাকেন–

লক্ষ করিনি। আমি নীল সারসদম্পতিকে দেখছিলাম। দুর্লভ প্রজাতির সারস।

কফি এল। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে সাদা দাড়ি থেকে একটা পোকা ঝেড়ে ফেললেন। রঘুবীর বললেন, কাল রাতে ডিনারের পর মিসেস রুদ্রকে লনে একা বসে থাকতে দেখেছি। মিঃ রুদ্রের নেশা হয়েছিল। সম্ভবত কিছু টের পাননি। মিসেস রুদ্র কারও জন্য যেন অপেক্ষা করছিলেন।

কর্নেল হাসলেন। রঘুবীর! তুমি গোয়েন্দাগিরি করো দেখছি!

স্যার! অগ্রবালজির হুকুম আছে, যেন হনিমুন লজের সুনাম হানি না হয়। নববিবাহিত দম্পতিরা স্বভাবত ঈর্ষাকাতর হয়ে থাকে। দৈবাৎ সাংঘাতিক কিছু ঘটে গেলেই আমার চাকরি যাবে।

কর্নেল ভুরু কুঁচকে তাকালেন। সাংঘাতিক কিছু ঘটবে বলে কি আঁচ করছ রঘুবীর?

রঘুবীর একটু চুপ করে থেকে বললেন, আপনাকে মিসেস ঠাকুরের কথা বলেছি। ওঁর হাবভাব দেখলে কেমন গা ছমছম করে। হনিমুনারদের দিকে এমন চোখে তাকিয়ে থাকেন, যেন তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন। ওঁর চোখের চাউনি লক্ষ্য করেছেন। অগ্রবালজির চিঠি না আনলে ওকে এবার স্যুইট দিতাম না। গত মরশুমে এসে রাত দুপুরে মালীর ঘর থেকে চুরি করেছিলেন। সে এক অদ্ভুত উপদ্রব।

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। মানসিক রোগীরা অনেক অদ্ভুত কাজ করে। যাই হোক, অর্কিডের চারাটা বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। আমি উঠি রনবীর। আমি নটায় ব্রেকফাস্ট খেয়ে আবার বেরুব।

ঠিক আছে স্যার

 কর্নেল দোতলায় তাঁর স্যুইটে ফিরলেন। অর্কিডের চারাটা দক্ষিণের জানালার গোবরাটে রেখে বাথরুমে গেলেন। তারপর পোশাক বদলে ব্যালকনিতে গিয়ে বসলেন।

প্রতিটি স্যুইটের ব্যালকনি আছে। কিন্তু এক ব্যালকনি থেকে অন্য ব্যালকনি দেখা যায় না। ডানদিকে একটা করে দেওয়াল তোলা আছে। বাড়িটির পশ্চিমে ব্যালকনিগুলো থাকার একটা সুবিধে, বহুদূর অব্দি প্রসারিত নিসর্গদৃশ্য চোখে পড়ে। পূর্বদিকে সারিবদ্ধ গাছের ভেতর দিয়ে উৎরাই রাস্তাটি একটা হাইওয়েতে মিশেছে। সেখানে যানবাহনের উপদ্রব। কর্নেলের সুইট থেকে দক্ষিণে ধারিয়া নদী চোখে পড়ে। নীচের সুদৃশ্য বাগানটিও দেখা যায়।

বাইনোকুলার তুলে নদীর ধারে সোমক চ্যাটার্জি আর ঋতুপর্ণা রায়কে একবার দেখে নিলেন কর্নেল। ওরা একটা গাছের তলায় পাথরের ওপর বসে কথা বলছে। একটু পরেই কর্নেলের মনে হল, তিনি যা করছেন, তা অশালীন। রঘুবীর রায় হনিমুনারের ব্যাপারে নাক গলাতেই পারেন। কর্নেল কেন নাক গলাবেন?

বরং নিসর্গের অবাধ স্বাধীনতায় যুবক-যুবতীদের দেখতে তার ভালো লাগে। কেন না তার ধারণা, প্রেমিক-প্রেমিকারাই প্রকৃতিকে অর্থপূর্ণ করে। অবশ্য রঘুবীর বউ বদলের কথা বলছিলেন। হনিমুনে এসে নাকি একজনের বউ অন্যজন ভাগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। বোঝা যায়, বিয়ে-করা বউ নয়, প্রেমিক প্রেমিকা। তবে ব্যাপারটা রঘুবীরের দৃষ্টিতে যত আপত্তিকর হোক, এমন কিছু তো স্বাভাবিক ঘটনাই। শুধু কোনও সাংঘাতিক ঘটনা–

সাংঘাতিক ঘটনা বলতে কী বোঝাতে চাইছেন রঘুবীর? ঈর্ষা থেকে হিংসা এবং হিংসা থেকে খুনোখুনি?

নড়ে বসলেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। না না! তেমন কিছু না ঘটাই উচিত। বহু বছর ধরে খুনোখুনির ব্যাপারে নাক গলিয়েছেন। আর নাক গলাতে ইচ্ছে করে না। প্রকৃতি আর প্রেমের মধ্যে রক্ত জিনিসটা বড় কদর্য। অথচ তার এই যেন নিয়তি, যেখানেই যান সেখানেই এক চিরন্তন ঘাতক তার সামনে লাশ ছুঁড়ে ফেলে চ্যালেঞ্জ করে।

নিভে যাওয়া চুরুটটা জ্বেলে কর্নেল নীল সারসদম্পতির কথা ভাবতে থাকলেন। ক্যামেরায় টেলিলেন্স ফিট করে কীভাবে ওদের ছবি তোলা যায়, সেজন্য একটু কলাকৌশল দরকার। কিছুক্ষণ পরে অন্যমনস্ক হাতে বাইনোকুলার তুলে চোখে রেখে কর্নেল পশ্চিমের অসমতল উপত্যকা দেখতে লাগলেন।

সহসা চোখে পড়ল পশ্চিমে ধারিয়া নদীর উত্তর পাড়ে জঙ্গলের ভেতর থেকে কে বেরিয়ে এল। দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটারের বেশি। লোকটার পেছন দিক দেখা যাচ্ছিল। পরনে প্যান্টশার্ট মাথায় টুপি। সে একটু পরেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথরের আড়ালে অদৃশ্য হল। ওদিকেই ধারিয়া জলপ্রপাত।

বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও আর তাকে দেখা গেল না। কে সে? ওখানে সে কী করছিল?

কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে নিজের প্রতি বিরক্ত হলেন। সম্ভবত ম্যানেজার রঘুবীর নানাধরনের গল্প বলে তাকেও নিজের মতো সন্দেহবাতিকগ্রস্ত করে ফেলেছেন!

নটা বাজলে কর্নেল নীচের ডাইনিং হলে ঢুকলেন। ডাইনিং হল এখন ফাঁকা। রঘুবীরকে দেখা যাচ্ছিল না। কিচেনবয় জগদীশ ব্রেকফাস্ট আনল। তাকে ম্যানেজার সায়েবের কথা জিজ্ঞেস করলেন কর্নেল। সে আস্তে বলল, ম্যানেজারসাব একটু আগে মোটরবাইকে চড়ে বেরিয়ে গেছেন।

কর্নেল ব্রেকফাস্ট করতে করতে দেখলেন, সুভদ্রা ঠাকুর লাউঞ্জে ঢুকে এদিকে-ওদিকে তাকাচ্ছেন। পাগলাটে চাউনি। দরজা দিয়ে কর্নেলকে দেখার পর প্রৌঢ়া মহিলা ডাইনিং হলে ঢুকলেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, কাল থেকে দেখছি আপনি আমাকে ফলো করে বেড়াচ্ছেন। আপনার উদ্দেশ্য কী? কে আপনি?

কর্নেল হাসলেন। মর্নিং মিসেস ঠাকুর!

 সুভদ্রা চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে কাছে এলেন। আমাকে এভাবে ভোলাতে পারবেন না! আমি জানতে চাই কে আপনি?

আপনাকে ফলো করে বেড়াচ্ছি, এ ধারণা আপনার মাথায় কেন এল বলুন

সুভদ্রা মুখোমুখি বসে বিকৃত মুখে বললেন, আপনার ওই বাইনোকুলার! আমি ওটাকে ভীষণ ঘৃণা করি। আপনি জানেন না, আমার চোখ দুটো ওটার মতো শক্তিশালী। অনেক দূরের জিনিস আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। যখনই যেখানে গিয়ে যেদিকে তাকাচ্ছি, আপনাকে দেখতে পাচ্ছি। আপনি আমাকে আলবাত্ ফলো করে বেড়াচ্ছেন। কাজেই এর একটা ফয়সালা হওয়া উচিত। কে আপনি?

কর্নেল পকেট থেকে তাঁর নেমকার্ড বের করে দিলেন।

সুভদ্রা কার্ডটা খুঁটিয়ে পড়ে দেখার পর বললেন, আপনি একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এবং বাঙালি! আপনি নেচারিস্ট! আমার স্বামী জিতেন্দ্রও প্রকৃতিপ্রেমিক ছিল। বাইনোকুলার তারও ছিল। কিন্তু সে ওটা দিয়ে আপনার মতো কারও গতিবিধির ওপর নজর রাখত না।

আপনি ভুল করছেন ম্যাডাম!

কারও কারও বিকৃত রুচি থাকে। সুভদ্রার মুখে-চোখে পাগলাটে হাসি ফুটে উঠল। তারা আড়াল থেকে যুবক-যুবতীদের আচরণ উপভোগ করে। আমি দেখেছি। কিন্তু আমাকে দেখার কী আছে? আমার বয়স প্রায় বাহান্ন বছর। অনেক আগেই অকালবার্ধক্য আমাকে গ্রাস করেছে!

কিচেনবয় জগদীশ এসে সেলাম ঠুকে বললে, ব্রেকফাস্ট ম্যাডাম?

 হ্যাঁ। নিয়ে এস। এই কর্নেল ভদ্রলোকের সঙ্গে ফয়সালা করব এবং খাব।

সুভদ্রা নিষ্পলক চোখে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দৃষ্টিটা অস্বস্তিকর। কর্নেল দ্রুত ব্রেকফাস্ট শেষ করে কফির পেয়ালায় চুমুক দিলেন। তারপর মৃদুস্বরে বললেন, রঘুবীরের কাছে শুনলাম আপনি প্রতি বছর এখানে স্মৃতির টানে চলে আসেন।

আসি। পঁচিশ বছর ধরে আসছি। রাজেন্দ্র এই লজ যখন তৈরি করেনি এবং ফাদার পিয়ার্সনের বাংলো হানাবাড়ি হয়ে গিয়েছিল, তখনও এসেছি। একা! চিন্তা করুন!

আপনার সাহস আর শারীরিক সামর্থ্য দেখে অবাক হয়েছি।

আপনাকে অবাক করার মতো আরও অনেক কিছু আমার আছে কর্নেল সরকার!

যেমন?

আমি গুপ্তবিদ্যা জানি। উইচক্র্যাফট। এবং তার সাহায্যে আমার স্বামীর। আত্মাকে ডেকে আনতে পারি। লোকে বলে ভূত। আমার সঙ্গে কেউ একা ধারিয়া ফসে গেলে জিতেন্দ্রর আত্মাকে দেখাতে পারি। কিন্তু কেউ সাহস করে যেতে চায় না।

জগদীশ ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেল। কর্নেল লক্ষ্য করলেন ভদ্রমহিলা নিরামিষাশী। দুধে কর্নফ্লেক ফেলে চামচে মাখাতে মাখাতে খুব আস্তে বললেন, জিতেন্দ্রর আত্মা আমাকে বলেছে কে তাকে ধাক্কা মেরে প্রপাতে ফেলে দিয়েছিল। আমি আসলে তাকে খুঁজতেই এখানে আসি। কাকেও বলবেন না, আমি তার দেখা পেয়ে গেছি।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, রঘুবীর বলছিল আপনার স্বামীর লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি।

পুলিস ভালো করে খোঁজেনি! সুভদ্রা ফের ফিসফিস করে বললেন, হত্যাকারী লাশতা কোথায় পুঁতেছিল জিতেন্দ্র আমাকে বলেছে।

কোথায়?

বলব না।

বললে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি।

ভুলে যাবেন না আমি ডাকিনীবিদ্যা জানি। কারও সাহায্য আমার দরকার হবে না।

আপনার স্বামীর হত্যাকারীকে দেখতে পেয়েছেন বললেন!

হ্যাঁ। পেয়েছি। তাকে এমন শাস্তি দেব–সুভদ্রা অদ্ভুত শব্দে হেসে উঠলেন

সর্বনাশ! আপনি তাকে মেরে ফেলবেন নাকি? মিসেস ঠাকুর! তা হলে কিন্তু আপনি খুনের দায়ে পড়বে।

সুভদ্রা ভেজিটেবল স্যান্ডউইচে কামড় দিয়ে বললেন, তাকে ঠিক এই ভাবে কামড়ে খাব।

কর্নেল ওঁর কথাবার্তা উপভোগ করছিলেন। ভদ্রমহিলা সত্যিই মানসিক রোগী। একটু পরে কর্নেল বললেন, গত অক্টোবরে এসে আপনি নাকি মালীর ঘর থেকে একটা খন্তা নিয়েছিলেন? তা কি আপনার স্বামীর লাশ উদ্ধারের জন্য?

চুপ! মুখ ফসকে অনেক কথা বলে ফেলেছি। আর একটা কথা নয়। সুভদ্রা চোখ কটমট করে ফেলে বললেন, আপনার খাওয়া হয়ে গেছে। এবার কেটে পড়ুন। আমার খাওয়ার দিকেও আপনি নজর রেখেছেন, সে কি বুঝতে পারছি না?

কর্নেল হাসি চেপে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বেরিয়ে গেলেন। নীল সারস দম্পতিকে যদি কোনও কৌশলে ক্যামেরাবন্দি করা যায়!

নিচু কম্পাউন্ড ওয়ালের বাইরে গিয়ে কর্নেল ডানদিকে ঘুরলেন। ওদিকে একটুখানি হেঁটে গেলে পূর্বগামিনী ধারা নদী। ঢালু অসমতল মাটির ওপর নানা গড়নের পাথর, ঝোপঝাড় আর গাছপালা চমৎকার ল্যান্ডস্কেপ হয়ে আছে। নদীর কাছাকাছি পৌঁছে সেই গাছটার দিকে তাকালেন কর্নেল। সোমক চ্যাটার্জি ও ঋতুপর্ণা রায়কে দেখতে পেলেন না। বাইনোকুলারে ওদের খুঁজতে থাকলেন। একটু পরে দেখলেন, কিছুটা দূরে বাঁদিকে হনিমুন লজের রাস্তা ধরে সোমক চ্যাটার্জি একা হেঁটে চলেছে। রাস্তার দুধারে ঘন শ্রেণীবদ্ধ গাছ। তাই তাকে তত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না।

ঋতুপর্ণা পরস্ত্রী। কাজেই সে সম্ভবত অন্য পথে গাছপালা বা পাথরের আড়াল দিয়ে লজে ফিরে যাচ্ছে।

নেহাত খেয়ালবশে কর্নেল দুর্লভ প্রজাতির কোনও পাখির মতো বাইনোকুলারে তাকে খুঁজতে থাকলেন। এখান থেকে হনিমুন লজের সদর গেট সোজাসুজি একটু উঁচুতে চোখে পড়ে। কারণ বাড়িটা একটা টিলার মাথায়। কিছুক্ষণ পরে সোমক চ্যাটার্জি গেটে ঢুকে গেল। কিন্তু ঋতুপর্ণা কোথায়?

আরও কিছু সময় কেটে গেল। তারপর কর্নেল নদীর ধারে সেই গাছটার দিকে নেমে গেলেন। যে পাথরে ওরা দুজনে বসে ছিল, সেখানে ফিরে দাঁড়ালেন। অমনি চমকে উঠলেন। পাথরের ওপর একটুখানি লালরঙ ছিটকে পড়েছে। রক্ত?

.

০৩.

 ধারিয়া জলপ্রপাতের একধারে ঝকড়া মহুয়া গাছের তলায় হনিমুনাররা ব্রেকফাস্ট করছিল। অনির্বাণ রুদ্রের আয়োজন ছিল তাক লাগানো। স্যান্ডউইচ, সেদ্ধ ডিম, কলা আর আপেল। আসার পথে শালপাতার ছাউনি দেওয়া এক আদিবাসীর দোকানে প্রচুর তেলেভাজা কেনা হয়েছিল। এখানে পৌঁছেই সেগুলো সাবাড় হয়েছে। বেলা নটায় এখন ব্রেকফাস্ট। দুটো বড় ফ্লাস্কভর্তি চা পেপার কাপে বিলি করছিল পায়েল। ততক্ষণে প্রপাত দেখতে আসা আরও মানুষের ভিড় বেড়েছে। কয়েকটি পিকনিকপার্টিও এসে গেছে। টেপরেকর্ডার বাজাচ্ছিল তারা। তবে প্রপাতের প্রচণ্ড গর্জনে সব শব্দই চাপা পড়ছিল।

শ্রুতির হাবভাবে অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করেছিল পায়েল। সে একটু তফাতে দাঁড়িয়েছিল। পায়েল তাকে চা দিতে গিয়ে চোখে হেসে বলল, ফিরে গিয়ে সোমককে একটু ধাঁতানি দেব। তুমি জানো ও আমাকে ভয় পায়।

শ্রুতি অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটু হাসল। কে কাকে ভয় পায় বলা কঠিন পায়েল। আমার ধারণা, তুমিই ওকে ভয় পাও।

কেন ভয় পাব শুনি?

তুমি গিয়ে ইনসিস্ট করলে ও নিশ্চয় আসত!

পায়েল চোখেমুখে কপট রোষের ভঙ্গি করল। বয়ে গেছে আমার! তোমার বর।

সত্যি কথাটা বলব পায়েল?

 স্বচ্ছন্দে।

এখানে এসে সোমককে দেখে তুমি কেমন যেন নার্ভাস হয়ে পড়েছিলে! মডেলিংয়ে তোমার জুটি ছিল ও।

সোমককে দেখে আমি নার্ভাস হব কোন দুঃখে? হাসালে শ্রুতি! বরং তুমিই আমার বরকে দেখে–পায়েল চোখ নাচিয়ে সকৌতুকে চাপা স্বরে ফের বলল, শ্রুতি! লেটস্ হ্যাভ এ ফান। অনির্বাণের সঙ্গে একটু প্রেম-প্রেম খেলো না দেখি!

দেখ পায়েল, সবকিছুর একটা সীমা থাকা উচিত।

 ও মা! তুমি যে রেগে গেলে মনে হচ্ছে!

শ্রুতি হেসে বলল। নাহ! রাগিনি। বরং তোমার বরকে পরীক্ষা করে দেখতে চাইলে কুমকুমকে অ্যাপ্রোচ করতে পারো। কাল রাতে কুমকুম তোমার বরের সঙ্গে নাচছিল।

নাহ্। কুমকুম বোকাসোকা মেয়ে। তা ছাড়া ওর মধ্যে তেমন কোনও চার্ম নেই।

আমার আছে?

আছে। পায়েল হেসে কুটিকুটি হল। কাল রাতে ডিনারের পর দেখি অনির্বাণ প্রায় ড্রাংক। কী বলছিল জানো? শ্রুতি একজন রং ম্যানকে বেছে নিয়েছে দেখে। ওর নাকি খারাপ লাগছে।

দীপক প্রপাতের ধারে একটা পাথরের ছোট্ট চাতালে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল। সেখান থেকে উঠে এসে বলল, পায়েলদি, বড্ড বেশি ভিড় হয়ে যাচ্ছে এখানে। চলুন! আমরা ডাইনোসরের ছবি দেখতে যাই।

ঠিক বলেছ। তবে তোমার বউয়ের দিকে লক্ষ্য রাখো। ওই দেখ কুমকুম আমার বরের সঙ্গে ভাব জমিয়েছে।

দীপক হেসে উঠল। তার চেয়ে ফানি ব্যাপার আপনার চোখে পড়ছে না পায়েলদি!

কী বলো তো?

চমনলালজি এ বয়সেও অসাধারণ রোমান্টিক। ওই দেখুন, উনি রজনী দেবীকে নিয়ে নিভৃতে প্রেমালাপ করছেন!

পায়েল চোখ পাকিয়ে বলল, ইউ নটি বয়! গুরুজনদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে নেই।

চমনলালজি ঠিক গুরুজনটাইপ নন! আপনার সঙ্গে কেমন জমিয়ে নাচছিলেন!

তোমার সঙ্গেও নাচতে আমার আপত্তি ছিল না!

 দীপক শ্রুতির দিকে তাকাল। আপনার শরীর খারাপ নাকি শ্রুতিদি?

পায়েল বলল, না। মন খারাপ! সোমক এল না! তো দীপক তুমি শ্রুতির মন ভালো করে দাও। আমি তোমার কচি বউকে প্রোটেকশন দিই ততক্ষণ।

পায়েল অনির্বাণের কাছে গেল। দীপক বলল, পায়েলদি অদ্ভুত মহিলা! সবসময় হাসিখুশি এবং স্মার্ট থাকতে পারেন। তা শ্রুতিদি, সত্যি আপনাকে যেন মনমরা দেখাচ্ছে।

শ্রুতি উদাসীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, শি ইজ ওভারস্মার্ট। আপনি জানেন কি না জানি না ও মডেলিং করত বিজ্ঞাপনে। এখন করে কি না জানি না।

শ্রুতিদি! আমাকে তুমি বললে ভালো লাগবে।

শ্রুতি আস্তে বলল, আচ্ছা দীপক, আমাদের হনিমুনারদের মধ্যে আমার হাজব্যান্ড ছাড়া আরও দুজন এখানে আসেনি লক্ষ্য করেছ?

হ্যাঁ। কিন্তু ওঁরা তো আমাদের সঙ্গে মেশেননি। কোথা থেকে এসেছেন– নামটাম কিছুই জানি না। কাল রাতে লক্ষ্য করেছি, ওঁরা চুপচাপ লাউঞ্জে বসে ছিলেন। দীপক সঙ্কোচের সঙ্গে বলল, আমি কিন্তু আপনার সামনে স্মোক করছি। কিছু মনে করবেন না যেন।

মনে করার কী আছে? শ্রুতি ঠোঁটের কোণে হাসল। তুমি আমার সামনে ড্রিঙ্ক করেছ। নেচ্ছে। স্মোকও করেছ। এখন হঠাৎ এ কথা কেন?

ওঃ শ্রুতিদি! সে তো পার্টিতে। এখানে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে একটু ভদ্রতা মেনে চলতে হয়।

ভ্যাট। আমি ওসব মানি না। তুমি দেখে থাকবে আমার হাজব্যান্ড চেইন স্মোকার।

দীপক সিগারেট ধরাল। তারপর বলল, অনির্বাণদা তো আপনার পরিচিত?

হ্যাঁ। আমার দাদার বন্ধু। সেই সূত্রে চেনাজানা আছে। কেন এ কথা?

 ওঁকে কোথায় যেন দেখেছি, ঠিক মনে করতে পারছি না।

 কথাটা ওঁকেই জিজ্ঞেস করতে পারো।

দীপক প্রপাতের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ বলল, আরে! দেখুন তো শ্রুতিদি, সেই ভদ্রলোক কি না? কাল রাতে ককটেলপার্টির সময় লাউঞ্জের এক কোণে সস্ত্রীক বসে ছিলেন। হা–মনে হচ্ছে তিনিই বটে!

কোথায়?

 ফলসের ওপরে পাথরের ফাঁকে দাঁড়িয়ে আছেন।

শ্রুতি দেখে নিয়ে বলল, হ্যাঁ। তিনিই মনে হচ্ছে।

কিন্তু একা!

ওঁর স্ত্রী আশেপাশে কোথাও আছেন নিশ্চয়।

 উনি চলে গেলেন হঠাৎ! ওঁর মিসেসকে কোথাও দেখছি না।

শ্রুতি একটু হাসল। কাউকে খুঁজতে এসেছিলেন সম্ভবত! ম্যানেজার রঘুবীর বলছিলেন না? হনিমুনাররা অনেক সময় বউকে হারিয়ে ফেলে!

ভদ্রলোক খুব রসিক। গত অক্টোবরে বউবদলের গল্পও বলছিলেন।

এই সময় অনির্বাণ মুখের কাছে দু হাতে চোঙ বানিয়ে চিৎকার করে বলল, হারি আপ ফ্রেন্ডস। এবার আমরা ডাইনোসর দেখতে যাব।

শ্রুতি নড়ে উঠল। মাই গুডনেস! ক্যামেরার কথা ভুলেই গেছি। এক মিনিট। কয়েকটা ছবি তুলে নিই।

সে ক্যামেরা তৈরি করে জলপ্রপাতের কয়েকটা ছবি তুলল। তারপর বলল, দীপক! তুমি আমার জন্য প্লিজ একবার শাটার টেপো! আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি। দেখবে, ছবিতে যেন আমি একা থাকি। ব্যাকগ্রাউন্ডে ফস্। আর ওই ওপরের টিলার গাছটা।

দীপক ক্যামেরা নিল। শ্রুতি পোজ দিয়ে দাঁড়াল। জোরে হাওয়া দিচ্ছিল। ছবি তুলে দীপক বলল, আমার ক্যামেরা কুমকুমের কাছে। আসলে ভিড়ভাট্টা দেখে ছবি তুলতে ইচ্ছে করছিল না। এক মিনিট! ওকে ডাকি।

শ্রুতি বলল, কেন? আমি তোমার ছবি তুলে রাখছি! ঠিকানা দিলে পাঠিয়ে দেব। নাকি বউকে পাশে নিয়ে ছবি তুলবে?

থাক। অনির্বাণদা তাড়া দিচ্ছেন।

শুতি দ্রুত দীপককে ক্যামেরাবন্দি করল। তারপর বলল, ওই দেখ, তোমার বউয়ের হাত ধরে অনির্বাণদা নিয়ে যাচ্ছেন। সীতাহরণের সিন! তাই না?

দীপক জিভ কেটে বলল, ছিঃ! অনির্বাণদা রাবণ নন।

শ্রুতি পা বাড়িয়ে বলল, সাবধান দীপক! কচি বউটিকে হারিয়ে ফেলো না।

দীপক হাসতে হাসতে ওকে অনুসরণ করল। অনির্বাণ লম্বা পা ফেলে পাথরের ধাপ ডিঙিয়ে উঠছে। কুমকুমের একটা হাত তার হাতে। কুমকুম একটু নাকাল হচ্ছিল অবশ্য। পায়েল চমনলাল দম্পতিকে পাকড়াও করে নিয়ে যাচ্ছিল। চমনলালজি হঠাৎ ঘুরে এসে ব্রেকফাস্টের আবর্জনাগুলো কুড়িয়ে একটা আবর্জনা-পাত্রে ফেলে দিলেন। পাত্রটা একটা বড় ড্রাম। সেটার গায়ে লেখা আছে, প্লিজ ইউজ মি!

দীপক গিয়ে বলল, সরি চমনলালজি! আমাদের খেয়াল ছিল না!

চমনলাল সহাস্যে বললেন, নেভার মাইন্ড! আপনারা চলুন! ধাপ বেয়ে উঠতে আমি একটু সময় নেব। রজনী! তুমি এগোও!

রজনী দেবী মুচকি হেসে ডাকলেন, পায়েল! তুমি আমার হাজব্যান্ডকে রাতারাতি যুবক করে তুলেছিলে। আবার ও বৃদ্ধ হয়ে গেছে। ওকে সামলাও।

পায়েল রজনী দেবীর হাত ধরে টানল। চলে আসুন দিদি! আমরা ওঁকে ফেলে গেলে উনি আবার যুবক হতে বাধ্য হবেন।

রজনী দেবী স্বামীকে বলে গেলেন, তুমি ভালো করে হাত ধুয়ে নেবে কিন্তু। আবর্জনা ঘেঁটেছ।

ওপরের দিকটায় বিশাল বিশাল গাছ। তার ভেতর একটা পুরনো সরকারি বাংলো। দেখতে হানাবাড়ির মতো। প্রাঙ্গণে আগাছার সঙ্গে ফুলের ঝোপ মিশে আছে। একপাশে মোরাম রাস্তায় জিপটা দাঁড়িয়ে আছে। অনির্বাণ ড্রাইভারকে খুঁজছিল। কুমকুম দীপককে বলল, জানো না তুমি কী মিস করলে!

দীপক কিছু বলার আগেই শুতি বলল, তোমাকে মিস করল বেচারা!

না শ্রুতিদি! অনির্বাণদা বলছিলেন, এই পোড়ো বাংলোয় ভূত আছে। এখানে আমরা একটা রাত কাটিয়ে গেলে দারুণ হয়। তাই না?

দীপক বলল, তার চেয়ে আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের মধ্যে একটা করে ভূত খুঁজলে পেয়ে যাব!

তার মানে? কুমকুম ভুরু কুঁচকে তাকাল। তোমার কথাবার্তা মাঝেমাঝে অদ্ভুত লাগে।

শ্রুতি বলল, কুমকুম! তোমার বর একটু জেলাসটাইপ। জানো? আমি ওকে করতলগত করতে চাইছিলাম। বাট আই ফেল্ড।

কুমকুম বলল, লক্ষ্য করেছি আপনি দীপকের ছবি তুলছিলেন।

 এবং দীপক আমার।

বলে শ্রুতি দীপকের কাঁধে হাতের চাপ দিল। আস্তে বলল, বড্ড শক্ত। হজম করা যাবে না। কিন্তু সাবধান! পায়েলদি একে–

পায়েল জিনিসপত্র গুছিয়ে জিপে তুলছিল। তার কথার ওপর বলল, শ্রুতি! আমার নামে কী যেন রটাচ্ছ! ওদিক থেকে বাতাসে ভেসে আসছে।

এই সব হাসিপরিহাসের মধ্যে চমনলালজি এসে গেলেন। মুখটা বেজায় গম্ভীর। দীপক বলল, আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে লালজি।

চমনলাল বললেন, আমার ছড়িটা আনতে ভুলে গেছি। খেয়াল থাকে না। বছর বছর আমার শরীরের শক্তি কমে যাচ্ছে। যাই হোক, গুহাচিত্র দেখতে গেলে আর দেরি করা ঠিক নয়। বেলা যত বাড়বে, হুজুগে লোকেদের ভিড় তত বেড়ে যাবে।

অনির্বাণ জিপের ড্রাইভারকে এতক্ষণ খুঁজে পেয়েছিল। সে জৈবকৃত্যে গিয়েছিল। নীচের দিকে প্রপাত যেখানে একটা হ্রদ সৃষ্টি করেছে, সেদিক থেকে ঝোপঝাড় ঠেলে সে বেরিয়ে আসছিল। হ্রদের দুই তীরই দুর্গম এবং ঘন জঙ্গলে ঢাকা। অনির্বাণ রসিকতা করে বলল, রাম সিং! আমি ভাবছিলাম তুমি বাঘের পাল্লায় পড়েছ।

ড্রাইভার রাম সিংকে কেমন হতচকিত দেখাচ্ছিল। সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, বড়াসাব! আমার মনে হচ্ছে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।

অ্যাকসিডেন্ট! কী অ্যাকসিডেন্ট?

কথাটা কানে যেতেই হনিমুনাররা তার কাছে এগিয়ে এল। রাম সিং নার্ভাস মুখে বলল, আমার চোখের ভুল হতেও পারে। তবে আমি যেন একটা লাশ দেখতে পেলাম। ফলসের দিক থেকে এসে লেকের মধ্যে একটা পাথরে আটকেছিল। তারপর ভেসে গেল।

সবাই হইচই করে বলল, কোথায়? কোথায়?

রাম সিং আঙুল দিয়ে নীচে যেদিকটা দেখাল, সেখানে ঘন জঙ্গল। লেকটা দেখা যায় না। দীপক বলল, কই! চলো তো দেখি!

অনির্বাণ বলল, দীপক! আমরা এখানে দুর্ঘটনা দেখতে আসিনি। শুনেছি, ফলস্ দেখতে এসে অত্যুৎসাহী কেউ পা হড়কে পড়ে যায়। তো যদি কেউ পড়ে গিয়ে থাকে, সে আমাদের দলের কেউ নয়। তাছাড়া এসব ব্যাপারে আমাদের জড়িয়ে পড়াটা ঠিক নয়।

পায়েল বলল, অনির্বাণ ঠিক বলেছে। হনিমুন এবং সাইটসিইংয়ে এসে অন্য কোনও ব্যাপারে নাক গলানো উচিত হবে না।

রজনী দেবী বললেন, রাম সিং! তুমি কি ঠিক দেখেছ?

 রাম সিং বিব্রতভাবে বলল, আমার মনে হল মাঈজি!

পুরুষ না মেয়ের লাশ?

 চমনলাল একটু চটে গিয়ে বললেন, রাম সিং নিশ্চিত নয়। যা দেখেছে, তা লাশ না অন্য কিছু

তাঁর কথার ওপর অনির্বাণ তাড়া দিয়ে বলল, জিপে ওঠ সবাই। আমাদের প্রোগ্রাম ভেস্তে যাওয়া ঠিক নয়। হারি আপ!

চুপচাপ দলটি জিপে উঠল। অনির্বাণ এবং চমনলাল সামনে বসলেন আগের মতো। বাকি সবাই পেছনে। জিপ স্টার্ট দিলে শ্রুতি বলল, ফসের ওপর থেকে কেউ পড়ে গেলে আমরা টের পেতাম। আরও কত লোক তো ছিল। কারও চোখে পড়ত। হইচই শুরু হত। তাই না পায়েলদি?

পায়েল বলল, ছাড়ো তো! রাম সিং কী দেখতে কী দেখেছে।

 কুমকুম বলল, ডাইনোসরের গুহাটা কত দূরে?

 রজনী দেবী একটু হাসলেন। কাছেই। তবে গুহায় ডাইনোসর নেই। ছবি আছে নাকি। আমার স্বামীকে প্রাচীন ইতিহাস ভূতের মতো পেয়েছে। উনি কাগজওয়ালাদের খবর নিয়ে মাথা ঘামান। সরেজমিন পরীক্ষা করতে ছোটেন। বাতিক!

পায়েল বলল, আমার ধারণা কেউ চালাকি করে সম্প্রতি ছবিটা এঁকে রেখেছে।

কুমকুম সায় দিয়ে বলল, সোমবাবু ঠিক একথাই বলছিলেন। তাই না শ্রুতিদি?

শ্রুতি কিছু বলল না। পায়েল বলল, শ্রুতি! তোমরা কি ঝগড়াঝাটি করেছ?

রাস্তা বলতে কিছু নেই। তাই জিপটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগোচ্ছিল। শ্রুতি পায়েলের দিকে তাকাল। কিন্তু টালমাটাল অবস্থার দরুন তার কথা বলতে ইচ্ছে করল না। এক জায়গায় জিপ এমনভাবে কাত হল যে টাল সামলাতে সে দীপককে আঁকড়ে ধরল। জিপ আবার সোজা হলে পায়েল বলল, কুমকুম! এবারও একটা বউবদলের চান্স আছে। তোমার. বর সম্পর্কে সাবধান কিন্তু!

শ্রুতি চটে গিয়ে ইচ্ছে করেই দীপকের কাঁধে হাত রাখল। এই সময় জিপটা থেমে গেল। রাম সিং বলল, এখানেই নেমে হেঁটে যেতে হবে সাব! আর গাড়ি চলার রাস্তা নেই।

অনির্বাণ নামল। তারপর চমনলালজি আড়ষ্ট ভঙ্গিতে নেমে দাঁড়ালেন। পেছন থেকে হনিমুনাররাও নেমে দাঁড়াল। পায়েল বলল, কোথায় সেই গুহা?

সামনে উঁচু পাহাড়। কোনওটা ঘাসে বা জঙ্গলে ঢাকা, কোনওটা নগ্ন। চমনলাল পকেট থেকে খবরের কাগজের একটা কাটিং বের করে মিলিয়ে দেখছিলেন। একটু পরে বললেন, একটা ম্যাপ ছেপেছিল সানডে এক্সপ্রেস। কিন্তু এটা থেকে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। রাম সিং! তুমি তো স্থানীয় লোক। ছবি আঁকা গুহাটা কোথায় জানো?

রাম সিংকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। সে আস্তে বলল, আমার মালিক গত মাসে এসেছিলেন সার! আমি ওঁর সঙ্গে যাইনি। আর একটা কথা স্যার! এসব পাহাড়ে অজগর সাপের উপদ্রব আছে।

অনির্বাণ একটু এগিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে বলল, রমেশ পাণ্ডেও বলছিলেন পাইথনের কথা। কিন্তু ওঁর কথামতো গুহাটা সহজেই চোখে পড়ে। কারণ গুহামুখে সব জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করা হয়েছে। এক মিনিট। আমি খুঁজে বের করছি।

পায়েল মুখে আতঙ্ক ফুটিয়ে বলল, পাইথন সাপ নাকি সাংঘাতিক। মানুষ গিলে খায়। তোমরা যে যাবে যাও। আমি যাচ্ছি না।

অনির্বাণ তার কাঁধে ঝোলানো কিটব্যাগ থেকে একটা ভিউফাইন্ডার বের করে পাহাড়গুলো দেখছিল। হঠাৎ বলল, একটা লোক কাঠের বোঝা মাথায় নেমে আসছে। ওকে জিজ্ঞেস করা যাক।

সবাই মিলে লোকটার প্রতীক্ষা করতে থাকল। লোকটাকে খালি চোখে দেখা যাচ্ছিল না। কিছুক্ষণ পরে সামনেকার টিলার জঙ্গল থেকে সে বেরিয়ে এল। একজন আদিবাসী প্রৌঢ়। তার মাথায় চেলাকাঠের বোঝা। কাঁধে একটা কুড়ুল। সে দলটিকে দেখে থমকে দাঁড়াল।

অনির্বাণ হিন্দিতে বলল, এই যে ভাই। ওখানে একটা গুহায় ছবি আঁকা আছে। তুমি গুহাটা চেনো?

লোকটা ভাঙা-ভাঙা হিন্দিতে বলল, ওটা আমাদের দেবতার থান সায়েব! আমরা ওখানে আর কাকেও যেতে দিচ্ছি না। তবে আপনারা টাকাকড়ি দিলে অন্য কথা।

অনির্বাণ বলল, নিশ্চয় দেব। কত দিতে হবে বলো?

 লোকটা গম্ভীর মুখে বলল, ওই যে পিপুলগাছ দেখছেন, ওখানে আমাদের সর্দার বসে আছে। তার সঙ্গে কথা বলুন।

পিপুলগাছটা সামনেকার টিলার গায়ে এবং সেখানে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড পাথরের ফাঁকে ঝোপ গজিয়ে আছে দলটি উৎসাহে এগিয়ে চলল। রাস্তা নেই। রজনী দেবী তার স্বামীকে বললেন, তুমি কি উঠতে পারবে? ছড়িটা তো ফেলে এসেছ!

শুনতে পেয়ে অনির্বাণ বলল, আমি একটা ডাল ভেঙে ছড়ি বানিয়ে দিচ্ছি।

চমনলাল বললেন, না। দরকার হবে না। আপনারা এগোন। আমি আস্তে সুস্থে এগোচ্ছি। তারপর একটু হাসলেন বৃদ্ধ ঐতিহাসিক। এবার আমি কিন্তু আমার স্ত্রীকে পাশে রাখতে চাই।

সবাই হেসে উঠল। রজনী দেবী বললেন, গুহাচিত্র স্বচক্ষে দেখার কী দরকার? এরা ক্যামেরা এনেছে। তুমি ছবি পেয়ে যাবে।

অনির্বাণ একটা পাথরে উঠে বলল, হারি আপ! লাঞ্চের আগে ফিরতে হবে, মাইন্ড দ্যাট!

ওরা তাকে একে-একে অনুসরণ করল। ঝোপজঙ্গলের আড়ালে দলটি অদৃশ্য হওয়ার পর রজনী দেবী বললেন, তোমাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে লাল!

চমনলাল খুব আস্তে বললেন, রজনী! ড্রাইভার রাম সিং বলছিল লেকে একটা লাশ দেখেছে। এদিকে আমি আবর্জনার পাত্রে একটা সাংঘাতিক জিনিস কুড়িয়ে পেয়েছি!

রজনী ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। চমকে উঠে বললেন, কী?

 চমনলাল একটু তফাতে জিপের দিকে তাকিয়ে রাম সিংকে দেখে নিলেন। সে জিপের গায়ে হেলান দিয়ে খৈনি ডলছে। চমনলাল বললেন, পেপারকাপগুলো ফেলতে গিয়ে প্রথমে ভেবেছিলাম খেলনা। কিন্তু সন্দেহ হল। তুলে নিয়ে বুঝলাম খেলনা নয়।

আহ! জিনিসটা কী?

একটা ছোট্ট ফায়ার আর্মস। ওজন আছে।

 সর্বনাশ! এখানে ফায়ার আর্মস ফেলল কে?

চমনলাল বললেন, এদিকে এস। আড়ালে বসে পরীক্ষা করে দেখি। ফায়ার আর্মস সম্পর্কে আমার কিছু জ্ঞান আছে।

দুজনে একটা ঝোপের ধারে গেলেন। চারদিক দেখে নিয়ে চমনলাল কোটের ভেতর পকেট থেকে রুমালে জড়ানো আগ্নেয়াস্ত্র বের করলেন। বললেন, আঙুলের ছাপ যাতে না পড়ে তাই রুমাল দিয়ে তুলে নিয়েছিলাম।  

রুমালে আঙুল জরিয়ে বুলেটকেস খুলে চমলাম বললেন, সিক্স রাউন্ডার পয়েন্ট টোয়েন্টিটু ক্যালিবার রিভলবার একটা বুলেট ফায়ার করা হয়েছে। ও মাই গড, রাম সিং তা হলে ঠিকই দেখেছে!

রজনী দেবী ভয়-পাওয়া গলায় বললেন, ওটা এখনই কোথাও ফেলে দাও!

 নাহ! আমার নাগরিক দায়দায়িত্ব আছে। তুমি জানো আমি কেমন মানুষ।

 কিন্তু এটা মার্ডার-উইপন লাল!

সেইজন্যই এটা গুরুত্বপূর্ণ। তুমি সতর্ক হও! কোনওভাবে মুখ ফসকে যেন–

না না! রজনী দেবী দ্রুত বললেন। কিন্তু তুমি এখনই ওটা লুকিয়ে ফেলো।

.

০৪.

 কর্নেল নীলাদ্রি সরকার একটু ঝুঁকে লাল রঙের ছিটেগুলো আতস কাচে খুঁটিয়ে দেখার পরও নিশ্চিত হতে পারেননি, জিনিসটা রক্ত কি না। পাথরটা মসৃণ এবং বেলেপাথর। এখানেই ফাদার পিয়ার্সন নাকি একটা পার্কমতো করেছিলেন। তার কোন চিহ্ন আর নেই। শুধু এই পাথরটা ছাড়া। নদীটা ফুটতিনেক নীচে। প্রপাতের জলাশয় থেকে মাটি ক্রমশ বেগে। নদীগর্ভে ডুবো পাথর থাকার দরুন জলোচ্ছ্বাসপূর্ণ আর আবর্তসঙ্কুল। নদীতে কেউ পড়ে গেলে তার বাঁচার আশা নেই, তা সে যতই দক্ষ সাঁতারু হোক না কেন।

কিন্তু লাল রঙের ছিটেগুলো এখনও জ্বলজ্বল করছে। রক্ত বা রঙ যা-ই হোক ওগুলো টাটকা।

নীল সারদসম্পতির কথা ভুলে গেলেন কর্নেল। এ মুহূর্তে সোমক চ্যাটার্জির সঙ্গে দেখা করা জরুরি।

হনিমুন লজের দিকে উঠে যেতে যেতে নিজের এই আচরণের প্রতি বিরক্ত হচ্ছিলেন কর্নেল। কিন্তু এখন তাঁর ভূতগ্রস্ত দশা। মাঝে মাঝে বাইনোকুলার তুলে তিনি তখনও ঋতুপর্ণাকে খুঁজছিলেন। শেষবার খোঁজায় সময় দক্ষিণ পশ্চিম দিকে জঙ্গলের ফাঁকে এক মুহূর্তের জন্য সুভদ্রা দেবীকে দেখতে পেলেন। ভদ্রমহিলা ব্রেকফাস্টের পর আবার জলপ্রপাতের দিকে চলেছেন। বহু মানসিক রোগীর অবচেতনায় কোনও বিষয়ে একটা বদ্ধমূল বিশ্বাস থাকে, ইংরেজিতে যাকে বলে ফিক্সেশন।

ডাইনিংয়ে সোমক একা। ব্রেকফাস্ট প্রায় শেষ। সে সিগারেট ধরিয়ে হেলান দিয়ে বসে আছে। চোখ বন্ধ। রিসেপশন কাউন্টারে রঘুবীর নেই। সিদ্ধেশ নামে এক কর্মচারী খবরের কাগজ পড়ছে। কর্নেলকে একবার সে দেখে নিয়ে কাগজে মন দিল। কর্নেল সোমকের টেবিলের সামনে গিয়ে আস্তে বললেন, বসতে পারি?

সোমক তাকাল। নির্লিপ্ত মুখ বলল, পারেন। তবে সব টেবিলই খালি আছে।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, কিছুক্ষণ আগে আমি ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়েছি।

আপনি আমার সঙ্গে আলাপ করতে চান। ইজ ইট?

দ্যাটস রাইট মিঃ চ্যাটার্জি!

কর্নেল বসলেন। সোমক বলল, আমাকে আপনি চেনেন মনে হচ্ছে। কিন্তু আপনাকে এখানে এই প্রথম দেখছি। আমাদের মধ্যে অবশ্য আলাপ-পরিচয় হয়নি। কে আপনি?

কর্নেল তার নেমকার্ড দিতে গেলে সোমক বলল, থ্যাঙ্কস্। ম্যানেজারের কাছে শুনেছি আপনি একজন রিটায়ার্ড কর্নেল। আপনার নেমকার্ডের দরকার আমার নেই।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, আমি একজন নেচারিস্ট। প্রকৃতি সম্পর্কে আমার প্রচুর আগ্রহ আছে।

বেশ তো!

আপনি–মানে আপনারা কিছুক্ষণ আগে নদীর ধারে বসে ছিলেন। আপনার সঙ্গিনী কোথায় গেলেন?

সোমক আগের মতোই নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বরে বলল, আপনি নেচারিস্ট। প্রকৃতি সম্পর্কে আপনার নাকি আগ্রহ আছে। তো হঠাৎ আমাদের সম্পর্কে আপনার আগ্রহের কারণ কী জানতে পারি?

আপনারা নদীর ধারে যে পাথরটার ওপর বসে ছিলেন, সেখানে এইমাত্র একটু রক্ত দেখে এলাম।

সোমক এবার একটু চমকে উঠল। রক্ত?

 সম্ভবত।

আপনি কী বলতে চাইছেন?

কিছু না। এবার যা বলার তা আপনিই বলুন!

ননসেন্স! ঋতুপর্ণার সঙ্গে আজ মর্নিংয়ে আমার আলাপ হয়েছে। তাকে আমি এর আগে কখনও দেখিনি। নদীর ধারে গল্প করার ছলে সে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। সোমক উত্তেজনা দমন করে শ্বাস ছাড়ল। ফের বলল, কথা বলতে বলতে সে হঠাৎ উঠে গেল।

কোন দিকে গিয়েছিল সে?

উত্তরে রাস্তার দিকে। সোমক বিকৃত মুখে বলল, আমি অপমানিত বোধ করলাম। একটু বসে থাকার পর চলে এলাম।

আপনি তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি?

আই ওয়াজ সো পাজড়–সোমক তীক্ষ্ণদৃষ্টে কর্নেলের দিকে তাকাল। এখন আপনি বলছেন ওখানে নাকি রক্ত দেখে এলেন! আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আপনার যদি মনে হয়ে থাকে, আমি মিথ্যা কথা বলছি–তার মানে আমি ঋতুপর্ণাকে মার্ডার করেছি–হাউ ফানি কাউকে মেরে ফেলতে চাইলে ধাক্কা মেরে নীচে নদীতে ফেলে দেওয়াই যথেষ্ট নয় কি?

কর্নেল মাথা দোলালেন। দ্যাটস্ রাইট। বাট বাই এনি চান্স

বলুন!

কেউ ঝোপের আড়াল থেকে ঋতুপর্ণাকে গুলি করলে আপনার পক্ষে তখনই ছুটে পালিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক ছিল।

সোমক সিগারেট অ্যাশট্রেতে ঘষটে নিভিয়ে বলল, আমি মিথ্যা বলেছি, আগে তা প্রমাণের দায়িত্ব আপনার। বাট–হু আর ইউ?

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, দেখুন মিঃ চ্যাটার্জি, ঋতুপর্ণার ভাগ্যে সাংঘাতিক কিছু ঘটলে আপনার একটা দায়িত্ব থেকে যাবে। ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড ইট?

ইজ ইট এ থ্রেটনিং কর্নেলসায়েব?

 দ্যাট ডিপেন্ডস।

সোমক উঠে দাঁড়াল। আপনার কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই। ইউ আর এ ফানি ওল্ডম্যান! এটা দেখছি আসলে লুনাটিক অ্যাসাইলাম। মিসেস ঠাকুরও আমাকে যত সব আবোলতাবোল কথা বলছিলেন। উনিও আপনার মতো যত্র-তত্র রক্ত বা ডেডবডি দেখতে পান।

কর্নেল মৃদু স্বরে বললেন, আপনার সহযোগিতা চাইছি মিঃ চ্যাটার্জি।

বাট ইউ আর ইমাজিনিং ফানি থিংস!

বলে সোমক সোজা করিডরের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকল। কর্নেল রিসেপশনের দিকে ঘুরে বললেন, সিদ্ধেশ! তোমাদের ম্যানেজার কোথায়?

সিদ্ধেশ বলল, উনি মার্কেটিংয়ে গেছেন স্যার!

আমি এক পেয়ালা কফি চাইছি সিদ্ধেশ।

সিদ্ধেশ বেরিয়ে এসে কিচেনের দিকে গেল। কর্নেল চোখ বুজে চেয়ারে হেলান দিলেন। সোমক চ্যাটার্জির প্রতিক্রিয়া স্মরণ করতে থাকলেন। তারপর তার মনে হল, রক্ত পড়ে থাকার কথা শুনে সোমকের তখনই নদীর ধারে গিয়ে স্বচক্ষে তা দেখে আসা স্বাভাবিক ছিল। কথাটা শোনামাত্র এটাই এক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। অথচ সোমক রক্তের কথা শুনে চমকে উঠেছিল। হু, সম্ভবত সে গোপন করেছে।

রিসেপশনের দিকে টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল দ্রুত উঠে গিয়ে ফোন ধরে সাড়া দিলেন। কেউ ইংরেজিতে বলল, হনিমুন লজ?

হনিমুন লজ।

ম্যানেজার রঘুবীর রায় বলছেন?

 উনি বেরিয়েছেন। আপনি কে বলছে—

চিনবেন না। আপনি-প্লিজ দেখুন তো দোতলার ৪ নম্বর স্যুইটের কর্নেল সায়েব আছেন কি না?

কর্নেল অবাক হলেন। একটু ইতস্তত করে বললেন, তাকে কি খুবই দরকার?

দিস ইজ আর্জেন্ট।

হুঁ। বলুন!

বলুন মানে? আপনাকে কী বলার আছে? আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন না কী বলছি?

পাচ্ছি। কিন্তু আপনি কে সেটা জানা দরকার।

ড্যাম ইট! আমি কর্নেল সায়েবের সঙ্গে কথা বলতে চাইছি। শিগগির দেখুন। উনি আছেন কি না।

আছেন। এখানেই আছেন।

তা হলে তাকে ফোন দিচ্ছেন না কেন?

কর্নেল এতক্ষণ চাপা কণ্ঠস্বরে কথা বলছিলেন। ফোন একপাশে রেখে দেখলেন সিদ্ধেশ নিজের হাতে কফির কাপপ্লেট আনছে। ইসারায় তাকে একটা টেবিলে কফি রাখতে বলে আবার ফোন তুললেন। ভরাট গলায় সাড়া দিলেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।

কর্নেল সরকার! আমি কে, তা জানাতে চাই না। তবে আপনাকে আমি জানি। ফর ইওর ইনফরমেশন, হনিমুন লজ এরিয়ায় একটা সাংঘাতিক মিসহ্যাপ হয়েছে।

মিসহ্যাপ? হোয়াটস্ দ্যাট?

এ মার্ডার।

 ফানি! কে কাকে মার্ডার করল?

 ধারানগরের কাছে বাঁকের মুখে জেলেরা এইমাত্র একটা ডেডবডি পেয়েছে। পুলিশের কাছে খবর গেছে। ডেডবডিটা আমি দেখামাত্র চিনেছি। ঋতুপর্ণা রায়।

আমার জোক শোনার মুড নেই। আপনি কি তার স্বামী শোভন রায় বলছেন?

শোভন রায়কে আমি চিনি না। তবে ঋতুপর্ণাকে চিনি। আমি কে তা জানতে চাইলে বলব না। আপনি ইচ্ছে করলে এখনই থানায় ফোন করে জেনে নিতে পারেন। ছাড়ছি।

ওয়েট, ওয়েট! ঋতুপর্ণা মার্ডার্ড, তা কী করে বুঝলেন? সে দৈবাৎ নদীতে পড়ে গিয়ে

তার মাথার পিছনে ক্ষতচিহ্ন আছে কর্নেল সরকার। শি ওয়াজ শট ফ্রম হার ব্যাক।

লাইন কেটে গেল। কর্নেল একটু পরে ফোন রেখে দেখলেন, সিদ্ধেশ তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। সে বলল, কোথায় কে মার্ডার হয়েছে স্যার?

ধারানগরে। তবে এ কিছু না। কর্নেল একটু হাসলেন। চেপে যাও সিদ্ধেশ! খামোকা পুলিশের হাঙ্গামায় জড়িয়ে লাভ নেই।

কর্নেল কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এলেন। সিদ্ধেশ ভয় পাওয়া গলায় বলল, স্যার! আমাদের বোর্ডারদের কেউ নয় তো?

জানি না। আমার এক বন্ধু ধারানগর থেকে ফোন করে কথাপ্রসঙ্গে খবর দিল।

কর্নেল চেয়ার টেনে বসে কফিতে চুমুক দিলেন। তার ইনটুইশন মাঝে মাঝে সক্রিয় হয়ে ওঠে। টেলিফোন বেজে ওঠার পর তিনি কাউন্টারে বেশ জোরে এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুলেছিলেন অবশ্য এর একটা ব্যাখ্যা অন্যভাবেও করা যায়। ঋতুপর্ণা সম্পর্কে তার আগ্রহ জেগেছিল এবং সিদ্ধেশ বলছিল, শোভন রায় একটু আগে ফোনে ওকে ডেকে দিতে বলেছিল। তাই তিনি শোভন রায়ের ফোন ভেবেই ওভাবে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে ফোন তুলেছিলেন।

সিদ্ধেশ আস্তে বলল, একটা কথা বলব স্যার!

 বলো সিদ্ধেশ!

হনিমুন লজের তরুণ কর্মচারীটি একটু ইতস্তত করার পর বলল, রুদ্রসাব ধারানগর থেকে যার জিপ আনিয়েছেন, সেই লোকটার খুব দুর্নাম আছে। একসময় সে লুঠেরা ডাকু ছিল। পরে পলিটিসিয়ান হয়েছে। বড় বড় অফিসার থেকে মিনিস্টার পর্যন্ত তাকে খাতির করে চলেন। আমার অবাক লেগেছে স্যার! রুদ্রসাবের সঙ্গে তার ফ্রেন্ডশিপ আছে।

 কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন, নাম কী?

রমেশ পাণ্ডে। রুদ্রসাব পরশু এখানে এসেছে। পরশু সন্ধ্যায় রমেশ পাণ্ডে জিপে চেপে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তাকে এখানে দেখে আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম স্যার।

কেন?

 রমেশ পাণ্ডে লম্পট। কোনও মেয়ের দিকে তার চোখ পড়লেই বিপদ। এদিকে দেখুন, এই লজে এবার সুন্দর সুন্দর সব লেডি এসেছেন। রুদ্রসাবের স্ত্রী–

হুঁ। বলো!

আমার ধারণা মিসেস রুদ্র ফিল্মের হিরোইন। মিঃ রুদ্রের চেয়ে ওঁর বয়স অনেক কম। আমার সন্দেহ ওঁরা বিবাহিত কি না। কাল অনেক রাতে মিসেস রুদ্র লনে একা বসেছিলেন।

তাতে কী?

রমেশ পাণ্ডের ফাঁদে মেয়েরা সহজে পা দেয়। বলেই সিদ্ধেশ মুখটা করুণ করল। দয়া করে এসব কথা যেন ম্যানেজারসাবকে বলবেন না স্যার।

বলব না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো সিদ্ধেশ! আর কফি খাওয়া হলে আমি একটা টেলিফোন করব।

কোনও বাধা নেই স্যার!

 সিদ্ধেশ রিসেপশন কাউন্টারে ফিরে গেল। তারপর দুই কানে ওয়াকম্যানের তার গুঁজে গান শুনতে থাকল। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া এক তরুণ ড্রপ আউটের পক্ষে এ ধরনের চাকরি আজকাল সুলভ। এরা রিসেপশনিস্ট হিসেবে স্মার্ট এবং বাকপটু। তবে সিদ্ধেশ একটু সরলপ্রকৃতির ছেলে এবং অনুগত ইংরেজিতে যাকে বলে ওবিডিয়েন্ট।

কর্নেল কফি শেষ করে চুরুট ধরালেন। তারপর একটু ভেবে নিলেন। ঋতুপর্ণা সংক্রান্ত খবরটা কোনও ফাঁদ নয় তো? কিংবা কেউ তাঁর পরিচয় পেয়ে তাকে নিয়ে কৌতুক করছে কি? নদীর ধারে গাছটার তলায় পাথরের ওপর যে লাল রঙের ছিটে দেখে এলেন, তা নেলপালিশ লিপস্টিক বা সিঁদুরও তো হতে পারে!

এখন থানায় ফোন করা ঠিক হবে না। ম্যানেজার রঘুবীর বাজার করতে গেছে। খবরটা সত্যি হলে এতক্ষণ রটতে দেরি হবে না এবং তার কানে যেতে পারে। কাজেই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা উচিত।

এই সময় সোমক চ্যাটার্জি নেমে এল। তার হাতে সিগারেট। সে লাউঞ্জ পেরিয়ে গিয়ে দরজার কাছে একটু দাঁড়াল। তারপর লনে নামল। কর্নেল লক্ষ্য করলেন, সে ডানদিকে ঘুরে বাগানে যাচ্ছে।

কর্নেল উঠলেন। তিনি লাউঞ্জের দিকে যাচ্ছেন দেখে সিদ্ধেশ বলল, টেলিফোন করবেন না স্যার?

নাহ্। পরে করব।

কর্নেল বেরিয়ে গিয়ে দেখলেন, সোমক বাগান থেকে দক্ষিণের গেট খুলে চলে যাচ্ছে। কর্নেল তাকে অনুসরণ করলেন। ধারিয়া ফসে যাওয়ার পায়ে চলা পথ ওটা। পিছনে পায়ের শব্দ শুনে সোমক ঘুরে দাঁড়াল। রুষ্ট মুখে বলল, কী চান আপনি?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, একটা খবর দিতে চাই। কিন্তু আপনি এমনভাবে বেরিয়ে এলেন যে সুযোগই পেলাম না।

বলুন!

 কিছুক্ষণ আগে কেউ আমাকে ফোনে জানাল, ধারানগরের কাছে জেলেরা একটা টাটকা ডেডবডি পেয়েছে। মাথার পিছনে গুলি করা হয়েছে ঋতুপর্ণার।

সোমক প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, হোয়াট?

কেউ আমাকে ফোনে তা-ই বলল। সে ঋতুপর্ণাকে চেনে।

 বাট আই ডিডনট কিল হার!

আমি তা বলছি না। তাছাড়া এখনও আমি খবরটার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত নই। দিস ইজ জাস্ট ফর ইওর ইনফরমেশন মিঃ চ্যাটার্জি।

সোমক জোরে শ্বাস ছাড়ল। একটু পরে বলল, আপনি অদ্ভুত সব কথাবার্তা বলছেন! ভেরি ব্যাড জোক। অন্য কেউ হলে আপনাকে–

সে থেমে গেল। কর্নেল আস্তে বললেন, আমি আপনার হিতৈষী মিঃ চ্যাটার্জি। খবরটা সত্য হলে আপনি জড়িয়ে পড়বেন। কারণ ঋতুপর্ণাকে শেষ বার দেখা গেছে আপনারই সঙ্গে। দুই ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড ইট?

সোমক শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, আপনাকে বলেছি। সে কথা বলতে বলতে হঠাৎ উঠে চলে গেল। তারপর সে কোথায় গেল কিংবা তার কী হল আমি জানি না।

আমি আপনাদের কথা বলতে দেখেছি প্রায় আটটা পাঁচে।

 ঘড়ি দেখিনি। তবে আপনাকে দেখতে পেয়েছিলাম।

 তার কতক্ষণ পরে ঋতুপর্ণা হঠাৎ চলে গিয়েছিল?

সোমক ক্রমশ নার্ভাস হয়ে পড়ছিল। বলল, মে বি ফাইভ অর টেন মিনিটস! আমার মনে পড়ছে না। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না কেন আপনি ঋতুপর্ণাকে নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছেন! কে আপনি?

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। নেচারিস্ট।

ড্যাম ইট! সোমক আবার উত্তেজিত হল। ঋতুপর্ণাকে আপনি চেনেন এবং সেও আপনাকে চেনে বোঝা যাচ্ছে। আর ইউ এ ডিটেকটিভ!

কর্নেল মাথা নেড়ে এবং জিভ কেটে বললেন, না না মিঃ চ্যাটার্জি! আমার কাছে ওই কথাটা একটা গালাগাল। কারণ বাংলা স্ল্যাং টিকটিকি এসেছে ইংরেজি ডিটেকটিভ থেকে। তবে কোথাও কোন রহস্য দেখলে আমি তার পিছনে নিজেকে লড়িয়ে দিই।

আমার কাছে আপনার রহস্যের কোনও ক্লু নেই। আপনি আমার মানসিক শান্তি নষ্ট করছেন কর্নেল সরকার! তাছাড়া কাল রাত থেকে আমার শরীরও একটু অসুস্থ। প্লিজ লিভ মি অ্যালোন।

কর্নেল ঘুরে লজের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ পিছু ফিরলেন। একটা প্রশ্ন মিঃ চ্যাটার্জি। ঋতুপর্ণা চলে যাওয়ার পর, আমার হিসেবমতো আপনি প্রায় এক ঘণ্টা বা আরও বেশি ওখানে ছিলেন কেন?

একা বসে থাকতে ভালো লাগছিল। বলে সোমক এগিয়ে গেল। তার পা ফেলার ভঙ্গিতে আড়ষ্টতা ছিল।

.

০৫.

 চমনলাল এবং রজনী দেবী জিপের কাছে ফিরে এসেছিলেন। ড্রাইভার রাম সিং তখন ছিল না। কিছুক্ষণ পরে সে ফিরে এসে নমস্তে করল। তারপর বিষণ্ণ মুখে বলল, রাত থেকে আমার আমাশা মতো হয়েছে সার। কিন্তু মালিকের হুকুম। আমাকেই আসতে হবে। তাই বাধ্য হয়ে এসেছি। আপনারা ওদের সঙ্গে যাননি?

চমনলাল হাসলেন। দেখতেই পাচ্ছ রাম সিং। আমাদের বয়স হয়েছে, পায়ে। হেঁটে চড়াইয়ে উঠতে পারব না।

রজনী দেবী বললেন, আচ্ছা রাম সিং, তুমি লেকে যে লাশটা দেখেছিলে—

 চমনলাল স্ত্রীর ওপর চটে গেলেন। আর লাশের কথা নয় রজনী! আমি ক্লান্ত। ফিরে যেতে পারলে বাঁচি!

রাম সিং অন্যমনস্কভাবে বলল, লেকের মাঝখানে স্রোত আছে। লেক যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে আবার ধারা নদী। লাশটা ওখানে গিয়ে পড়লে। বিশ-তিরিশ মিনিটের মধ্যে পাঁচ-সাত কিলোমিটার দূরে চলে যাবে। আমার ধারণা, এতক্ষণ ওটা ধারানগরের কাছে পৌঁছে গেছে।

চমনলাল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন, আমার দুর্ভাগ্য! গুহাচিত্র স্বচক্ষে দেখতে পেলাম না।

রজনী দেবী আস্তে বললেন, আসলে তুমি নার্ভাস হয়ে পড়েছ লাল!

ঠিক বলেছ। আমার প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু ভদ্রতার খাতির ওঁদের জন্য অপেক্ষা করতেই হবে।

লাল! রাম সিংকে বলো না, আমাদের লজে পৌঁছে দিয়ে আসুক। ওঁদের ফিরতে দেরি হতে পারে!

কী বলছ! প্রায় পাঁচ কিলোমিটারের বেশি দূরত্ব। ওঁরা দৈবাৎ ফিরে এসে জিপটা দেখতে না পেলে–চমনলাল ফোঁস শব্দে শ্বাস ফেলে ফের বললেন, আমাদের দলে ভেড়া উচিত হয়নি। ইচ্ছেমতো ঘোরা যাচ্ছে না। জলপ্রপাতের ওপরদিকে একটা রোপওয়ে ছিল তোমার মনে পড়ছে রজনী?

রজনী দেবী ম্লান হাসি হাসলেন। মনে পড়ছে লাল! ফাদার পিয়ার্সনের বাংলো থেকে নদীর ওপর দিয়ে শর্টকাটে আমরা আসতাম। রোপওয়েতে দাঁড়িয়ে জ্যোৎস্না দেখতাম।

ওঃ! সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা!

অথচ দেখ, তখন বুনো জানোয়ারের উপদ্রব ছিল। আমরা গ্রাহ্য করতাম না।

যৌবন মানুষকে দুঃসাহসী করে! তা ছাড়া তুমিও তখন যুবতী। তোমার রূপলাবণ্যে–

শাট আপ! রজনী দেবী তাকে থামিয়ে দিলেন। আচ্ছা লাল, সেই রোপওয়ের পিলারটা আসার পথে দেখতে পেলাম না কেন? গত বছরেও তো ওটা দেখেছি।

ভেঙে পড়ে গেছে সম্ভবত।

 দুই দম্পতি এইসব কথা বলছিলেন। ইতিমধ্যে রাম সিং আবার জৈবকর্ম সেরে এসেছিল। ওর চেহারায় অসুস্থতার আদল ক্রমশ ফুটে উঠছিল। তারপর দলটিকে ফিরতে দেখা গেল। তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। সার বেঁধে ওরা আসছিল। পাথর বেয়ে নামতে পরস্পরকে সাহায্য করছিল।

অনির্বাণ এগিয়ে এসে বলল, কী ব্যাপার চমনলালজী? আমরা আপনার জন্য গুহার মুখে অপেক্ষা করছিলাম!

বৃদ্ধ ঐতিহাসিক কাচুমাচু মুখে বললেন, সম্ভব হলো না। আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তো আপনারা কি সত্যি ডাইনোসরের ছবি দেখতে পেলেন?

অনির্বাণ হাসল। গুহার ভেতর ভীষণ অন্ধকার। দেওয়াল কোথাও কোথাও মসৃণ করা হয়েছে। রঙবেরঙের অদ্ভুত-অদ্ভুত ছবি দেখেছি। তবে

দীপক তার কথার ওপর বলল, ওটা ডাইনোসর, না হাতি বোঝা গেল না চমনলালজি!

সবাই হেসে উছল। রজনী দেবী বললেন, ড্রাইভারের আমাশা। বেচারাকে শিগগির রেহাই দিলে ভালো হয়।

অনির্বাণ বলল, জানি। রাম সিংকে তো আমি দুটো ট্যাবলেট খেতে দিয়েছিলাম। খাওনি রাম সিং?

খেয়েছি স্যার! কিন্তু কমছে না।

পায়েল বলল, অনির্বাণ! তুমি ওকে গাড়ি ড্রাইভ করতে দিও না। রাস্তা খারাপ।

অনির্বাণ বলল, ওঃ পায়েল! আই অ্যাম ড্যাম টায়ার্ড।

শ্রুতি বলল, রাম সিং ড্রাইভ করতে পারবে না কেন? পেটের অসুখ তো আসার সময় থেকে শুনছি।

কুমকুম চোখে হেসে বলল, বেড়ে গেছে। আবার হয়তো মাঝরাস্তায় গাড়ি থামিয়ে দেবে।

দীপক বলল, তখন আমরা ওকে ফেলে যাব। অনির্বাণদা ড্রাইভ করে আমাদের পৌঁছে দেবেন।

হারি আপ! অনির্বাণ তাড়া দিল। ফিরে গিয়ে স্নান করতে হবে। গুহার ভেতর ঢুকে নোংরা হয়ে গেছি! রাম সিং! তুমি খারাপ রাস্তাটুকু আমাদের পার করে দাও। তারপর বরং আমি ড্রাইভ করব।

সবাই জিপে উঠল। কুমকুমের হাতে একগোছা বুনো ফুল ছিল। জিপ চলতে শুরু করলে শ্রুতি তাকে বলল, তোমার বরকে গোপনে উপহার দেবে বুঝি কুমকুম?

দীপক ফুল বোঝে না শ্রুতিদি।

 দীপক বলল, অন্তত এই ফুলগুলো বুঝি না! এই এরিয়ায় যেখানে সেখানে এই লাল ফুলগুলো ফুটে আছে। পায়েলদি! অনির্বাণদার শার্টের অবস্থা দেখেছেন?

পায়েল চটুল হেসে বলল, গুহার ভেতর তোমার বউ ওকে কিংবা ও তোমার বউকে ফুলগুলো প্রেজেন্ট করে থাকবে। অনির্বাণ ইজ ডেঞ্জারাস দীপক।

শ্রুতি বলল, অনির্বাণদার হাতে আমি কিন্তু প্রথমে এই ফুলের গোছ দেখেছিলাম। আসবার পথে।

পায়েল বলল, তাহলে সেগুলো এখন কুমকুমের হাতে চলে গেছে।

কুমকুম চ্যাঁচামেচি করে বলল, মোটেও না। এগুলো আমি গুহার কাছে তুলেছি।

শ্রুতি বলল, তাহলে অনির্বাণদার ফুলগুলো কোথায় গেল? পায়েল বলল, আমার বরকে আমি অত পাত্তা দিই না। তাই পথে কোথাও ফেলে দিয়েছিল।

দুর্গম রাস্তাটা দক্ষিণ-পূর্ব কোণ থেকে এসে জলপ্রপাতের কাছে সুগম হল এবং এবার জিপের গতি পূর্বে। বাঁ দিকে ধারা বা ধারিয়া নদী। সংকীর্ণ পিচরাস্তা তার সমান্তরালে এগিয়ে হাইওয়েতে মিশেছে। নদীর দুই তীরেই ঘন জঙ্গল আর পাথর। প্রায় চার কিলোমিটার দূরত্বে হাইওয়ে। নদী ওখানে সামান্য বাঁক নিয়ে উত্তর-পূর্বে চলে গেছে ধারানগরের দিকে। বাঁকের আগে ব্রিজ। তারপর বাঁদিকে সংকীর্ণ চড়াই রাস্তা ধরে গেলে টিলার মাথায় হনিমুন লজ। এই রাস্তাটা প্রাইভেট রোড। দুধারে শ্রেণীবদ্ধ গাছ।

জিপ প্রাইভেট রোডের মুখেই দাঁড় করাল অনির্বাণ। বলল, চমনলালজির অসুবিধা না হলে আমরা এখানেই নেমে যেতে পারি। রমেশকে কথা দিয়েছি, বারোটার মধ্যে জিপ ফেরত দেব।

চমনলাল বললেন, না। অসুবিধা কিসের? এটুকু পথ হেঁটে যেতে আমার ভালোই লাগবে।

সবাই জিপ থেকে নামল। তারপর রাম সিং জোরে জিপ চালিয়ে উধাও হয়ে গেল। দলটি হনিমুন লজের দিকে পা বাড়াল। শ্রুতি বলল, ও মা! অনির্বাণদার শার্টের কী বিচ্ছিরি অবস্থা।

অনির্বাণ হাসল। কুমকুমের শাড়ির অবস্থা দেখ।

কুমকুম বুকের কাছে শাড়ির একটা অংশ তুলে আঁতকে উঠল। এ কী! এ কী অদ্ভুত ফুল!

দীপক বলল, গন্ধ নেই। তাই রঙ ছড়ায়।

চমনলাল বললেন, লাতিন নাম ব্রাসিলিকা ইন্দিকা। আদিবাসীরা কাপড় রাঙানোর জন্য এই ফুলের রঙ ব্যবহার করে। আসলে লক্ষ্য করলে দেখবেন, ফুলের পরাগে লাল রেণু আছে. একটু নড়লেই রেণুগুলো ঝরে পড়ে। রজনী। তোমার মনে আছে? প্রথমবার এখানে এসে দুজনের হোলি খেলার অবস্থা!

রজনী দেবী সায় দিয়ে বললেন, প্রকৃতির খেয়াল! শরৎকালে এরা ফোটে। বসন্তকালে ফোঁটা উচিত ছিল।

কুমকুম ফলগুলো রাস্তার ধারে ছুঁড়ে ফেলল। বলল, বাজে ফুল! আমার হাত বিচ্ছিরি লাল হয়ে গেছে।

দীপক বলল, মনে হচ্ছে খুনখারাপি করেছ।

পায়েল চোখ পাকিয়ে বলল, তোমার একটুও রসবোধ নেই দীপক! রাঙা হাত টার্মটা তুমি ভুলে যাচ্ছ।

ক্রমে চমনলাল এবং রজনী দেবী পিছিয়ে পড়ছিলেন। অনির্বাণ সবার আগে হাঁটছে। টিলার মাটি কেটে এই রাস্তাটাকে যতটা সম্ভব কম চড়াই করা হয়েছে। কলকাতার হনিমুনাররা এগিয়ে গেলে রজনী দেবী আস্তে বললেন, কী রকম স্বার্থপর দেখছ লাল?

কেন রজনী?

তখনকার মতো আমাদের ফেলে চলে গেল ওরা।

 তাতে কী? আমাদের অত তাড়া নেই।

কিন্তু প্রশ্নটা ভদ্রতার। তা ছাড়া আমরা দুজনেই বৃদ্ধ।

শরীরে রজনী, শরীরে। মনে নই।

একটু পরে রজনী দেবী বললেন, আচ্ছা লাল, কখন থেকে কথাটা মনে আসছিল, বলতে ভুলে গেছি। কলকাতা থেকে আসা বাঙালি হনিমুনারদের মধ্যে সেই দম্পতির আচরণ অদ্ভুত নয়? ওরা এদের সঙ্গে মেশেনি। কাল রাতের পার্টিতেও ওরা দুটিতে তফাতে বসেছিল।

সবাই হইহল্লা পছন্দ করে না ওরা আলাদা থাকতে চেয়েছে।

কিন্তু–

 কিন্তু কী?

ওরা পায়ে হেঁটে শর্টকাটে গেলে ধারিয়া ফলসের ওপর দিকটায় পৌঁছুতে পারে। তাই না লাল?

তুমি কী বলতে চাইছ রজনী?

রজনী দেবী জোরে শ্বাস ফেলে বললেন, ড্রাইভার রাম সিং ধারিয়া লেকে একটা লাশ ভেসে যেতে দেখেছে।

চমনলাল থমকে দাঁড়ালেন। তুমি কেন ভাবছ–

তার কথার ওপর রজনী দেবী বললেন, আমাদের পাশের স্যুইটে ওরা উঠেছে। কাল রাতে দুজনের মধ্যে তর্কাতর্কি কানে আসছিল। তারপর আজ খুব ভোরে দরজা খোলার শব্দ শুনেছি। শব্দটা জোরালো। যেন রাগ করে কেউ বেরিয়ে গেল!

ওঃ রজনী! তুমি মাঝে-মাঝে অদ্ভুত সব কল্পনা করো!

কল্পনা নয়, লাল। আমি সত্যি শুনেছি।

 চমনলাল হাসলেন। তুমি কি বলতে চাও, এই খুদে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে যুবকটি তার স্ত্রীকে খুন করে প্রপাতে ফেলে দিয়েছে? রজনী! বোকার মতো কথা বোলো না। কেউ কাকেও মেরে ফেলতে চাইলে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়াই যথেষ্ট। তবে প্রপাতের ওপরদিকে আজ মানুষজন কম ছিল না।

রজনী দেবী একটা পরে বললেন, এমন হতে পারে নিচের দিকে–মানে লেকের কাছাকাছি। কোথাও মার্ডার করে জলে ফেলে দিয়েছে।

কিন্তু অস্ত্রটা আমি পেয়েছি আবর্জনার পাত্রে। পাত্রটা ছিল ফলসের নিচে অন্য পারে। রোপওয়েটা আর নেই যে সে নদী পেরিয়ে অস্ত্রটা ওখানে ফেলে আসার সুযোগ পাবে। চমনলাল পা বাড়ালেন। ফের বললেন, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, হত্যার অস্ত্র জলে না ফেলে আবর্জনার পাত্রে ফেলল কেন সে?

তুমি বুঝতে পারছ না লাল! সে হত্যার দায় নিশ্চয় অন্যের কাঁধে চাপাতে চেয়েছে।

তাহলে–যদি সত্যিই একটা খুনখারাপি হয়ে থাকে, সেটা হয়েছে ধারা নদীর ওপারে। যেপারে আমরা ছিলাম।

অস্ত্রটা তোমার কাছে আছে। আমার ভয় করছে লাল! এখনও সুযোগ আছে। ওটা ফেলে দাও কোথাও।

রজনী! তুমি জানো আমি আজীবন সৎ নাগরিক। আমার সামাজিক দায়িত্ববোধ প্রখর।

সে যুগ আর নেই লাল! তুমি ফেঁসে যাবে বলে দিচ্ছি।

স্যুইটে ফিরে আমাকে কিছুক্ষণ ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে।

রজনী দেবী হঠাৎ বাঁদিকে ঘুরে বললেন, আরে! মিসেস ঠাকুর ওখানে কী করছেন?

কই? কোথায়?

ওই দেখ। নদীর ধারে সেই বেদিটার কাছে।

 চমনলাল ক্লান্তভাবে হেসে বললেন, আমাদের মতো ওঁরও কিছু স্মৃতি আছে। ফাদার পিয়ার্সনের পার্কের ওটাই শেষ চিহ্ন। আশ্চর্য ব্যাপার রজনী! বেদিটার পাশে একটা গাছ কত দ্রুত বেড়ে উঠেছে। ওখানে কোনও গাছ ছিল না।

দুজনে আবার হাঁটতে থাকলেন। দুধারে ঘন শ্রেণীবদ্ধ গাছ থাকায় প্রাইভেট রোড ছায়াচ্ছন্ন। হনিমুন লজের গেটের কাছে পৌঁছে রজনী দেবী আস্তে বললেন, আচ্ছা লাল! ওই কর্নেল ভদ্রলোককে দেখতে কতকটা ফাদার পিয়ার্সনের মতো তাই না?

ঠিক ধরেছ। আমি প্রথমে তো চমকে উঠেছিলাম ওঁকে দেখে। উনিও একজন প্রকৃতিপ্রেমিক।

কিন্তু উনি যেন আমাদের এড়িয়ে চলেছেন। কেমন রহস্যময় মানুষ যেন!

চমনলাল হাসলেন। মেয়েদের চোখ একটু অন্যরকম হয়তো। আমার তা মনে হয়নি। ম্যানেজার রঘুবীর বলছিল, উনি গত অক্টোবরেও এখানে এসেছিলেন। আমরা তখন চলে গেছি। প্রকৃতি সম্পর্কে ওঁর নাকি অদ্ভুত বাতিক আছে।

পিছনে পায়ের শব্দ শুনে দুজনেই ঘুরে দাঁড়ালেন। সুভদ্রা ঠাকুর হনহন করে আসছিলেন। তাদের পাশ কাটিয়ে লনে ঢুকে গেলেন। তারপর বারান্দায় উঠে একই গতিতে লজের ভেতর অদৃশ্য হলেন।

রজনী দেবী বললেন, ভদ্রমহিলা আঁচলের ভেতর দুহাতে কী যেন লুকিয়ে নিয়ে গেলেন!

শি ইজ লুনাটিক! ওঁকে এড়িয়ে চলাই উচিত।

লাউঞ্জের কোণে রিসেপশন কাউন্টারে সিদ্ধেশ ওয়াকম্যানে গান শুনছিল। বৃদ্ধ দম্পতিকে দেখে একটু হাসল শুধু। লাউঞ্জের কোণে দুজন গুফো অচেনা লোক বসে আছে। কিন্তু ডাইনিং হল ফাঁকা। চমনলাল বললেন, তুমি চলো রজনী! আমি যাচ্ছি।

রজনী দেবী সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে চলে গেলেন।

কাউন্টারের সামনে চমনলালকে দেখে সিদ্ধেশ কান থেকে ওয়াকম্যান খুলে বলল, ক্যান আই হেল্প ইউ সার?

চমনলাল বললেন, ধন্যবাদ সিদ্ধেশ! তোমার ম্যানেজার কোথায় গেল?

ম্যানেজার সাব আবার বেরিয়েছেন সার! একটা মিসহ্যাপ হয়েছে!

 মিসহ্যাপ? কোথায়?

আপনাদের পাশের স্যুইটের ভদ্রমহিলার ডেডবডি পাওয়া গেছে। ধারানগরের কাছে জেলেরা দেখতে পেয়েছিল। সিদ্ধেশ নির্বিকার মুখে বলল। তারপর একটু হাসল। হনিমুনারদের মধ্যে খারাপ লোক তো থাকে সার!

চমনলাল কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই শক্ত হয়ে গেলেন। আস্তে বললেন, ভদ্রমহিলার স্বামী?

তার পাত্তা নেই। ম্যানেজারসাবের সঙ্গে পুলিশ এসেছিল একটু আগে। ওঁদের স্যুইট সিল করে গেছে পুলিস।

কী নাম ভদ্রমহিলার?

 ঋতুপর্ণা রায়। ওঁর স্বামীর নাম শোভন রায়।

 হনিমুনাররা এ খবর শুনেছে?

জগদীশের কাছে শুনল। তারপর চুপচাপ নিজেদের স্যুইটে চলে গেল। সিদ্ধেশ আস্তে বলল, পুলিস আমাকে জেরা করেছিল। আমাদের স্টাফদের সবাইকে করেছে। আমরা কেউ কিছু জানি না। তবে পুলিস আবার আসতে পারে।

আমাদের জেরা করতে?

 সম্ভবত।

 চমনলাল নিচের তলায় তার স্যুইটের দিকে এগিয়ে গেলেন। করিডরে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে দেখা হল। কর্নেল বললেন, নমস্তে মিঃ লাল!

নমস্তে। চমনলাল একটু ইতস্তত করার পর বললেন, একটা মিসহ্যাপ হয়েছে। শুনলাম। সিদ্ধেশ বলল।

আপনারা কেমন ঘুরলেন বলুন?

 একই জায়গা। তত কিছু নতুনত্ব দেখলাম না।

 ডাইনোসরের ছবি তো নতুনত্ব, মিঃ লাল!

আমি দেখতে যাইনি। পাহাড়ে ওঠার ক্ষমতা আমার নেই। সস্ত্রীক নিচে অপেক্ষা করছিলাম। চমনলাল পা বাড়াতে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন! কর্নেলসাব! শুনলাম পুলিস একদফা লজের কর্মচারীদের জেরা করে গেছে। আপনাকেও নিশ্চয় করেছে?

করেছে মিঃ লাল! পুলিস আবার আসবে। অবশ্য লাঞ্চের আগে কাকেও ডিসটার্ব করবে না। আর কাকেও লজ ছেড়ে যেতে নিষেধ করেছে পুলিস। জরুরি কারণ থাকলে অনুমতি নিতে হবে। সাদা পোশাকে দুজন অফিসার লাউঞ্জে বসে আছেন।

সিদ্ধেশ তো বলল না কিছু! অবশ্য লাউঞ্জে দুজন লোককে বসে থাকতে দেখলাম। আজকালকার তরুণরা সবকিছুতে নির্লিপ্ত থাকতে চায়?

চমনলাল একটু দ্বিধার পর বললেন, মেয়েটিকে কি কেউ ধাক্কা মেরে জলে–

নাহ্ মিঃ লাল! তার মাথার পিছনে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করা হয়েছে। তারপর বড়ি নদীতে ফেলে দিয়েছে হত্যাকারী।

ও মাই গড! তা হলে–পুলিস হনিমুনারদের স্যুইট সার্চ করবে। তাই না?

করা তো উচিত।

চমনলাল নড়ে উঠলেন। খুব আস্তে বললেন, আমার স্যুইটে আসুন দয়া করে। আমি দায়িত্বশীল নাগরিক। আপনার সঙ্গে কিছু গোপনীয় আলোচনা আছে। আসুন!..

.

০৬.

 কিছুক্ষণ পরে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার চমনলালের সুইট থেকে বেরিয়ে দেখলেন, সুভদ্রা ঠাকুর তাঁর স্যুইটের দরজা ফাঁক করে উঁকি দিচ্ছেন। মাঝখানের সুইটটায় শোভন এবং ঋতুপর্ণা উঠেছিল। সেটার দরজা পুলিস সিল করে রেখেছে। কর্নেলকে দেখে সুভদ্রা নিঃশব্দে হাসলেন। তেমনি পাগলাটে চাউনি।

কর্নেল বললেন, কিছু বললেন কি মিসেস ঠাকুর?

সুভদ্রা ফিসফিস করে বললেন, ফাদার পিয়ার্সনের পার্কটা আর নেই। শুধু একটা বেদি আছে। দেখেছেন?

হ্যাঁ। দেখেছি।

আপনাকে বলছি কথাটা। পুলিসকে আমি বলিনি এবং বলবও না। ওখানে সকালে লক্ষ্য করেছিলাম একজন হনিমুনার অন্যজনের বউয়ের সঙ্গে বসে ছিল। আমি লুকিয়ে ওদের দেখছিলাম।

কর্নেল হাসলেন। আমিও দেখেছি মিসেস ঠাকুর!

এইমাত্র ওখানে গিয়ে দেখলাম পাথরের বেদিতে প্রচুর রক্ত! গিয়ে দেখে আসুন।

প্রচুর রক্ত? আমি অবশ্য একটু লাল রঙের ছিটে দেখেছিলাম।

 সুভদ্রা রুষ্টমুখে বললেন, আপনি ভালো করে দেখেননি! এখন গিয়ে দেখুন।

মিসেস ঠাকুর! বুঝতে পারছি না আপনি কেন আমাকে বিভ্রান্ত করতে চাইছেন? আমি আপনার সহযোগিতা আশা করছি কিন্তু।

কী বলতে চান আপনি?

 বেদিতে যে লাল রঙের ছিটে দেখেছিলাম, তা রক্ত নয়। ব্রাসিলিকা ইন্দিকা নামে একরকম উদ্ভিদের লাল ফুল এই এলাকায় এখন প্রচুর ফোটে। ওটা তারই রঙ। এবং আপনিই চুপিচুপি ওই রঙটুকু ছড়িয়ে এসেছিলেন। কিন্তু কেন? আপনি কি এমন কিছু লক্ষ্য করেছিলেন–

তাকে বাধা দিয়ে সুভদ্রা বললেন, জিতেন্দ্রর আত্মা আমাকে বলেছিল কিছু সাংঘাতিক ঘটনা ঘটবে।

মিসেস ঠাকুর! বুঝতে পারছি, আপনি এখন আবার গিয়ে বেদিতে ওই ফুলের রঙ বেশি করে ছড়িয়ে এসেছেন। চমনলালজি একটু আগে দেখেছেন আপনি দুহাত শাড়ির আঁচলে ঢেকে লজে ঢুকছিলেন। কারণ আপনার দুহাত লাল হয়ে গিয়েছিল।

সুভদ্রা তখনই দরজা বন্ধ করে দিলেন।

কর্নেল রিসেপশনে গেলেন। সিদ্ধেশ কান থেকে ওয়াকম্যান খুলে বলল, আপনার আর কোনও টেলিফোন আসেনি স্যার!

সে ঘড়ি দেখে বলল, বড় জোর দেড়টা বাজবে। আসলে ম্যানেজার সাব মার্কেটিংয়ে দেরি করে ফেলেছিলেন। আপনার লাঞ্চ আগেই পাঠিয়ে দেব।

সিদ্ধেশ! এ বেলা আমি ডাইনিংয়েই খাব। হনিমুনারদের সঙ্গে।

কর্নেল তার স্যুইটে ফিরে আসছিলেন। ওপরে করিডরে সোমক দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, আপনাকে খুঁজছিলাম কর্নেল সরকার! আপনার স্যুইটে নক করে সাড়া পেলাম না।

বলুন মিঃ চ্যাটার্জি!

আমার স্ত্রী শ্রুতি এখন স্নান করছে। সে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়। পুলিস আবার আসার আগে সে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

আমি ঘরেই থাকছি।

কর্নেল চাবি বের করে তার স্যুইটের দরজা খুলছেন, তখন সোমক আস্তে বলল, আপনি নদীর ধারে পাথরটার ওপর যে লাল রঙের ছিটে দেখেছিলেন, শ্রুতির কথা শোনার পর তা এক্সপ্লেন করতে পারি।

জানি। তা একরকম লাল ফুলের রঙ।

 কিন্তু পুলিস আমাকেই সন্দেহ করেছে তা বুঝতে পেরেছি। সোমক ক্ষুব্ধভাবে বলল। ওই উন্মাদ মহিলা মিসেস ঠাকুরের কথায় পুলিস আমাকে জেরার ছলে অপমান করছিল। আপনি চুপচাপ ছিলেন কর্নেল সরকার। আপনার আচরণের অর্থ বুঝতে পারছি না। আমার কেরিয়ার নষ্ট করে আপনার কী লাভ?

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, মাই ডিয়ার ইয়ং ম্যান, কেউ কারও কেরিয়ার নষ্ট করতে পারে না। মানুষ নিজের কেরিয়ার নিজেই নষ্ট করে। এনিওয়ে! আপনার স্ত্রী কথা বলতে চাইলে আমি অবশ্যই শুনব। হা–আই অ্যাম রিয়্যালি ইন্টারেস্টেড। প্লিজ ডোন্ট বি ওয়ারিড।

ঘরে ঢুকে দরজা লক করে দিলেন কর্নেল। প্রায় একটা বাজে। প্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে তিনি রুমালে মোড়া খুদে আগ্নেয়াস্ত্রটি বের করলেন। চমনলালের বর্ণনা অনুসারে এতে আর হত্যাকারীর আঙুলের ছাপ আশা না করাই উচিত। আবর্জনার পাত্রে অনেক তরল পদার্থ পড়ে ছিল।

একটা ব্যাপার স্পষ্ট। ঋতুপর্ণাকে হত্যা করা হয়েছে নদীর ওপারেই সম্ভবত, লেক অর্থাৎ প্রপাত জলাশয়ের কাছাকাছি। রমেশ পাণ্ডের ড্রাইভার রাম সিং লেকের কোথায় মৃতদেহ দেখেছিল, পুলিস তার কাছে জেনে নেবে। এই অঞ্চল নাকি সে যা খুশি তা-ই করতে পারে। সে নিজে যদি ও ঘটনায় জড়িত থাকে, হত্যাকারীকে চেনা গেলেও রেহাই পেয়ে যাবে।

কিন্তু শোভন রায় গা ঢাকা দিয়ে বেড়াচ্ছে কেন? এটাই এ ঘটনার সবচেয়ে অদ্ভুত দিক।

অনেক প্রশ্ন মাথার ভেতর ভনভন করছে ক্রমাগত। হত্যারহস্য খুবই জটিল হয়ে গেল এতক্ষণে–চমনলালজির কাছে এই আগ্নেয়াস্ত্রটি পাওয়ার পর।

কর্নেল কিটব্যাগে অস্ত্রটা রুমালে জড়ানো অবস্থায় লুকিয়ে রাখলেন। চমনলাল দম্পতিকে তিনি নিষেধ করেছেন, পুলিসকে যেন ওঁরা এ সম্পর্কে কিছু না বলেন। এই জিনিসটা তার ট্রাম্পকার্ড। পুলিস এটা জেনে গেলে কী করবে সে বিষয়ে নিশ্চয়তা নেই। অনেক সময় তিনি দেখেছেন স্থানীয় পুলিস আনপ্রেডিক্টেবল। কাজেই ওপরতলার কোনও অফিসার না এসে পৌঁছুনো পর্যন্ত তাঁকে ওয়েট অ্যান্ড সিনীতি অনুসরণ করতেই হবে।

কর্নেল কিটব্যাগটা বিছানার ওপাশে রেখে এলেন। ইজিচেয়ারে বসে চুরুট ধরালেন। সোমক চ্যাটার্জি যে কেরিয়ারিস্ট, তা বুঝতে পেরেছেন। সে মডেলিং এবং অভিনয় করে। তার লক্ষ্য ফিল্মস্টার হওয়া। কিন্তু সে যে একটা কিছু গোপন করেছে, তাতে ভুল নেই এবং তা করেছে সম্ভবত কেরিয়ারের স্বার্থেই। এবার স্ত্রীকে দিয়ে সে কি তাকে ভুল পথে ছোটাতে চায়? দেখা যাক।

দরজায় কেউ নক করল। কর্নেল উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখলেন সোমক এবং তার স্ত্রী শ্রুতি দাঁড়িয়ে আছে। শ্রুতি নমস্কার করল। কর্নেল বললেন, আসুন–মিসেস চ্যাটার্জি!

সোমক বলল, আমি ঘরে যাচ্ছি। শ্রুতি! ওঁকে সব কথা খুলে বলো।

শ্রুতি সদ্য স্নান করে এসেছে। আড়ষ্টভাবে বসল। বলল, আমাকে তুমি বললেন খুশি হব কর্নেল সরকার! আমার নাম শ্রুতি।

হুঁ। বলো!

আমি আর দীপক ধারিয়া ফলসের ওপরদিকে শোভনবাবুকে দেখেছিলাম। মাত্র এক মিনিটের জন্য। আপনি দীপককে জিজ্ঞেস করতে পারেন। দুটো পাথরের ফাঁকে ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিলেন। হঠাৎ সরে গেলেন। এখন মনে হচ্ছে। উনি নিজেই স্ত্রীকে মেরে ফলসে ফেলতে এসেছিলেন।

কর্নেল হাসলেন। আমিও বাইনোকুলারে ওঁকেই দেখেছিলাম। হা–ওঁর গতিবিধি অবশ্যই সন্দেহজনক। তো তোমার স্বামী কি তোমাকে বলেছে সে ঋতুপর্ণার সঙ্গে নদীর ধারে বসে গল্প করছিল?

বলেছে। সোমককে আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু

 কিন্তু কী?

শ্রুতি আস্তে বলল, সোমকই ফলসে দল বেঁধে যাওয়ার প্ল্যান করেছিল। অথচ মর্নিংয়ে বলল, শরীর খারাপ। যাবে না। ফিরে এসে ঘটনাটা শোনার পর ওকে চার্জ করলাম। তখন ও একটা অদ্ভুত কথা বলল।

কী বলল?

পায়েল–মানে অনির্বাণদার স্ত্রী সোমকের মডেলিংয়ের জুটি ছিল একসময়। পায়েলকে এড়িয়ে থাকার জন্য সে নাকি যায়নি।  

কেন এড়িয়ে থাকতে চেয়েছে?

সোমক খুলে কিছু বলল না। শুধু বলল, শি ইজ ডেঞ্জারাস। শ্রুতি একটু ইতস্তত করার পর ফের বলল, ওদের দুজনের মধ্যে এমোশনাল সম্পর্ক ছিল একসময়। আমি জানি। তারপর সম্পর্কটা খারাপ হয়ে যায়। আমার ধারণা, পায়েল অনির্বাণদার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। সোমকের এতে রাগ হতেই পারে।

কিন্তু তুমি সোমকের স্ত্রী! কর্নেল হাসলেন। সব জেনেও তুমি

কর্নেল সরকার! আমার মন অত নিচু নয়। অ্যান্ড আই অ্যাম নট এ জেলাস ওয়াইফ।

যাই হোক! বেড়ানো কেমন এনজয় করলে বলো?

আই এনজয়েড। কিন্তু ফিরে এসে একটা সাংঘাতিক মিসহ্যাপ শুনে সব আনন্দ চলে গেছে।

ডাইনোসরের ছবি দেখেছ?

 টর্চের আলোয় কিছু বোঝা যায় না। মে বি এ হোক্স! শ্রুতি উঠে দাঁড়াল। আমি যাই। আপনি দীপককে ডেকে জিজ্ঞেস করুন। শোভনবাবুকে প্রথমে সেই দেখতে পেয়েছিল।

একটা কথা। দীপক তোমার পূর্বপরিচিত?

শ্রুতির চোখে একটু চমক লক্ষ্য করলেন কর্নেল। সে বলল, ওকে চেনা মনে হচ্ছিল, তা সত্যি। কোথায় যেন দেখেছি। তবে ওকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। দীপক আর তার স্ত্রী কুমকুমের সঙ্গে এখানে এসেই আলাপ হয়েছে। দীপককে কি পাঠিয়ে দেব?

কর্নেল বললেন, থাক্। দেড়টায় লাঞ্চ খেতে যাব। তৈরি হয়ে নিই।

শ্রুতি চলে গেল। কর্নেল দরজা ভেতর থেকে লক করে বাথরুমে গেলেন। স্নান করার পর পোশাক বদলে কিটব্যাগ থেকে সেই আগ্নেয়াস্ত্রটা বের করে জ্যাকেটের ভেতর পকেটে ঢোকালেন। তারপর নীচে ডাইনিং হলে গেলেন।

সুভদ্রা ঠাকুর এক কোণে বসে খাচ্ছেন এবং আপন মনে বিড়বিড় করে কী সব বলছেন। চমনলাল এবং রজনী দেবী অন্য কোণে গম্ভীর মুখে বসে আছেন। কিচেনবয় তাদের খাদ্য পরিবেশন করছে। কর্নেল রিসেপশন কাউন্টারের দিকে তাকালেন। সিদ্ধেশ ডাকল, কর্নেল সাব!

কর্নেল কাছে গিয়ে বললেন, বলো সিদ্ধেশ?

সিদ্ধেশ চাপা স্বরে বলল, একটা টেলিফোন এসেছিল। কেউ বলছিল, আমি শোভন রায় বলছি। আমার স্ত্রী ঋতুপর্ণাকে ডেকে দিন। তো আমি বললাম, আপনার স্ত্রী মিসহ্যাপ হয়েছে। আপনি এখনই চলে আসুন এখানে। পুলিস। আপনাকে খুঁজছে। অমনই লাইন কেটে গেল। মিঃ রায় এবার এসে পড়বেন। মনে হচ্ছে। ভদ্রলোক জানেন না কী হয়েছে।

কর্নেল হাসলেন। জানেন। জেনেও কৌতুক করছেন। বুঝলে সিদ্ধেশ?

সিদ্ধেশ হাঁ করে তাকিয়ে রইল।

কর্নেল বললেন, আবার শোভন রায় বলে কেউ টেলিফোন করলে তুমি তাকে বলবে, আপনি কর্নেল সরকারের সঙ্গে কথা বলুন।

আচ্ছা সার!

কর্নেল চমনলাল দম্পতির কাছাকাছি একটা টেবিলে বসলেন। জগদীশ সেলাম ঠুকে তার খাবার নিয়ে এলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনির্বাণ ও পায়েল, সোমক ও শ্রুতি, দীপক ও কুমকুম এসে গেল। সোমক ও শ্রুতি বসল আলাদা টেবিলে। অনির্বাণ, পায়েল, দীপক আর কুমকুম একই টেবিলে মুখোমুখি বসল। সবাই গম্ভীর। কর্নেল লক্ষ্য করেছিলেন, সোমক ও শ্রুতি ছাড়া ওরা চারজনে আড়চোখে তাকে একবার করে দেখে নিচ্ছে।

কর্নেল একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে লাউঞ্জে গেলেন। পুলিসের দুই গোয়েন্দা অফিসার এবার ডাইনিংয়ে ঢুকলেন। তাদের হনিমুন লজ খাওয়াবে। কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বাইরের বারান্দায় গিয়ে বসলেন।

কিছুক্ষণ চুরুট টানার পর তিনি রিসেপশন কাউন্টারে গেলেন। বললেন, সিদ্ধেশ! তোমার তো মোটরবাইক আছে!

সিদ্ধেশ বলল, মোপেড আছে সার!

 তোমার গাড়িটা একবার দেবে?

কেন দেব না?

 শিগগির এনে দাও। আমি একবার বেরুব। থানা থেকে ইন্সপেক্টর মিঃ দুবে এলে তাকে বলবে, জরুরি কাজে আমি একটু বেরিয়েছি। ওঁদের যা কর্তব্য, ওঁরা করবেন।

সিদ্ধেশ একটু অবাক হয়ে বলল, আপনি মোপেড চালাতে পারেন বিশ্বাস করা যায় না।

কর্নেল হাসলেন। ভুলে যেও না সিদ্ধেশ। আমি সামরিক বাহিনীতে ছিলাম। সবরকমের যানবাহন চালানোর অভ্যাস আমার আছে। হা–প্রথমে কিছুক্ষণ অসুবিধে হবে। তারপর বাহনটিকে শায়েস্তা করে ফেলব।

সিদ্ধেশ গ্যারাজের দিক থেকে তার দুচাকার গাড়িটা এনে দিল। তারপর চাবি দিল।

কর্নেল লন পেরিয়ে গেটে গেলেন। গেট খুলে বেরিয়ে মোপেড চেপে স্টার্ট দিলেন। উৎরাইয়ের রাস্তায় স্বচ্ছন্দে এগিয়ে যাচ্ছিল দুচাকার গাড়িটি। নতুন কেনা হয়েছে। তাই এমন সাবলীল গতিবেগ। হাইওয়েতে পৌঁছেই ডাইনে ব্রিজের দিকে এগিয়ে চললেন কর্নেল।

পায়ে হেঁটে প্রপাত-জলাশয়ের কাছে পৌঁছুতে দুঘণ্টার বেশি সময় লেগে যেত। হাইওয়ে সোজা দক্ষিণে চলে গেছে। ডানদিকে সংকীর্ণ পিচ রাস্তা এগিয়েছে ধারিয়া প্রপাতের দিকে। পিচ রাস্তায় গতি কমালেন কর্নেল। ডাইনে ধারা নদী গাছপালা আর পাথরের ফাঁকে মাঝে-মাঝে চোখে পড়ছিল। এতক্ষণে প্রপাত দেখে ফিরে আসছিল মানুষজন চারচাকা বা দুচাকার গাড়িতে। বিকেলের মধ্যেই নির্জন হয়ে যায় ধরিয়া প্রপাত। ইদানীং এখানেও আদিবাসীদের মধ্যে জঙ্গি গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। তাদের হামলার ভয় আছে।

লেকের একটু আগে থেকে মোপেডের গতি খুবই মন্থর করেছিলেন কর্নেল। এক জায়গায় থেমে গেলেন। পিচরাস্তার ডানদিক ঘেঁষে কোনও গাড়ির চাকার দাগ স্পষ্ট ফুটে আছে। কারণ ঘাসের কুটোভর্তি কাদা লেগেছিল কোনও গাড়ির চাকায়।

মোপেড একপাশে রেখে কর্নেল বাইনোকুলারে চারদিক খুঁটিয়ে দেখে নিলেন। তারপর চাকার দাগের দিকে তাকালেন। গাড়িটা এখানে ডাইনে ঘাসের ওপর একদিকের চাকা নামিয়েছিল। অন্য গাড়িকে সাইড দেবার জন্য?

তা হতেই পারে। ট্রাক বোঝাই মানুষজন প্রপাতের ওখানে পিকনিক করতে যায়। একটা ট্রাক এবং একটা প্রাইভেট কার বা ট্যাক্সি পাশাপাশি চলার মতো চওড়া রাস্তা এটা নয়। তবে ডানদিকে নেমে যে গাড়ি অন্য গাড়িকে সাইড দিয়েছে, সেটা প্রপাতের দিক থেকে আসছিল বলে মনে হচ্ছে।

কিন্তু একটু পরে কর্নেল লক্ষ্য করলেন, গাড়িটার চাকার দাগ ডাইনে নদীর দিকে একটুকরো ঘাসে ঢাকা জমির ওপর থেকে উঠে এসেছে। ঘাসের ওপর চাকার দাগ মুছে যায়নি। ঘাসগুলো র্থেতলে গেছে এবং কাদা ছড়িয়ে আছে।

ঘাসজমিটার দুধারে জঙ্গল এবং উঁচু পাথরের চাই। শেষ দিকটায় গিয়ে কর্নেল থমকে দাঁড়ালেন। জঙ্গলের আড়াল থাকায় বোঝা যায়নি এটা লেকের একটা প্রান্ত। জলপ্রপাতের গর্জনও কানে এল এবার। আসলে প্রপাতের কাছে। রাস্তাটা একটু ঘুরে গিয়ে পৌঁছেছে। এখান থেকে প্রপাত কাছেই।

তার মানে গাড়িটা এই ঘাসের জমিতে নেমেছিল। কর্নেল দেখলেন, নদীর দিকে জঙ্গলের মধ্যে সেই লাল ফুল প্রচুর ফুটে আছে। তারপরই চমকে  উঠলেন কর্নেল। একটা ঝোপের তলায় পাথরের ফাঁকে একপাটি স্লিপার পড়ে আছে। মেয়েদের জুতো!

এবং তার নিচেই লেকের জল ফুঁসছে। ঘুরপাক খাচ্ছে।

 তাহলে কি এখানেই ঋতুপর্ণাকে কেউ ডেকে এনে গুলি করে মেরেছে?

জুতোটা একটা চ্যাপ্টা বড় পাথর তুলে ঢেকে দিলেন কর্নেল। তারপর ঘাসজমিটা আবার খুঁটিয়ে দেখার পর রাস্তায় গেলেন। বাইনোকুলারে প্রপাতের দিকটা দেখতে থাকলেন। নীলসারস দম্পতির কথা মনে পড়ে গেল। সেই গাছটা খুঁজতে থাকলেন।

সারসদম্পতি নেই। ওরা একজায়গায় বেশিক্ষণ থাকে না।

কর্নেলের মাথায় এখন সারসদম্পতি ভর করেছে। তা ছাড়া একা কোথাও বসে ধীরে-সুস্থে চিন্তা-ভাবনা করা দরকার। কর্নেল মোপেডে চেপে ধারিয়া ফলসের দিকে চললেন।

রাস্তাটা একটা টিলা ডাইনে রেখে একটু ঘুরে প্রপাতের এপারে পৌঁছেছে। এখনই ঘন ছায়া ঢেকে ফেলেছে জায়গাটা। পুরনো সরকারি বাংলো জনহীন সুনসান। আদিবাসীদের আন্দোলনের পর বাংলোটা পোড়া হয়ে গেছে। মোপেড বাংলোর নীচে সমতল এক টুকুরো জমিতে দাঁড় করিয়ে কর্নেল নেমে গেলেন। পাথরের সিঁড়ির নীচে চওড়া পার্কমতো জায়গা। ওখান থেকেই লোকেরা প্রপাত দর্শন করে। সেই আবর্জনার পাত্রটার কাছে গেলেন কর্নেল। ওটা একটা লোহার ড্রাম। লেখা আছে, ইউজ মি। ড্রামটা আবর্জনায় ভর্তি। চমনলালজি এর মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্রটা পেয়েছিলেন।

একটা প্রশ্ন মনে এল। উনি কেন দলের লোকেদের ফেলে দেওয়া এঁটো পেপারকাপ ড্রামে ফেলতে গেলেন? কাকেও কি অস্ত্রটা ফেলতে দেখেছিলেন? চমনলালজি বলেছেন, পেপারকাপগুলো ওভাবে পড়ে থাকায় তার মনে হয়েছিল, দলের যুবকযুবতীদের একটু শিক্ষা দেওয়া উচিত। কিন্তু ওরা কেউ তার এই কাজের দিকে ফিরেও তাকায়নি।

কর্নেলের মনে খটকা থেকে গিয়েছিল। এখানে এসে সেটা বেড়ে গেল, চমনলালজি নিশ্চয় কিছু লক্ষ্য করেছিলেন। হয়তো সন্দেহ হয়েছিল কেউ গোপনে কিছু ফেলল। তাই পেপারকাপ ফেলার ছলে আবর্জনার পাত্র খুঁজেছিলেন। ফিরে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আবার কথা বলা দরকার।

হঠাৎ কর্নেল দেখলেন প্রপাতের শীর্ষে দুটো পাথরের মাঝখানে কেউ উঁকি দিচ্ছিল। এইমাত্র সরে গেল।

দ্রুত বাইনোকুলারে তাকে খুঁজলেন। কিন্তু দেখতে পেলেন না আর। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কর্নেল পাথরের সিঁড়ি বেয়ে মোপেডের কাছে গেলেন। তারপর স্টার্ট দিয়ে ফিরে চললেন হনিমুন লজ।

তার মনে এখন একটাই সাফল্যের আনন্দ। হত্যার স্থান আবিষ্কার।…

.

০৭.

 হনিমুন লজের গেটের কাছে ম্যানেজার রঘুবীর রায় দাঁড়িয়েছিলেন। কর্নেলকে দেখে উদ্বিগ্ন মুখে বললে পুলিস আমাকেই গ্রেটন করে গেল। এবার থেকে আমি যেন কোনও বিশিষ্ট লোকের রেফারেন্স ছাড়া হনিমুনারদের থাকতে না দিই! এ কী অদ্ভুত নির্দেশ দেখুন কর্নেল সাব!

কর্নেল মোপেড ঠেলে লনে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, ইন্সপেক্টর মিঃ দুবে কি জেরা শেষ করে চলে গেছেন রঘুবীর?

এইমাত্র গেলেন। আপনি থাকলে ভালো হত। কোথায় বেরিয়েছিলেন?

 নীলসারস দম্পতির খোঁজে। তুমি জানো, বিকেলের পর ওদিকের রাস্তায় জঙ্গিদের উপদ্রব হয়। তাই সিদ্ধেশের এই গাড়িটা নিয়ে গিয়েছিলাম, যাতে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারি।

রঘুবীর চাপা গলায় বললেন, মিঃ দুবে বলে গেলেন, এবার থেকে লজে, কোনও দম্পতি এলেই যেন তাদের নামধাম এবং রেফারেন্স জানিয়ে দিই!

মিঃ দুবে কি তোমার বোর্ডারদের সম্পর্কে কোনও নির্দেশ দিয়ে গেলেন?

নাহ্! মিঃ রুদ্রের সঙ্গে রমেশ পাণ্ডের বন্ধুত্ব আছে। সিদ্ধেশ বলল, রুদ্রসাব পাণ্ডেজিকে ফোন করেছিলেন। পাণ্ডেজি পুলিসকে সম্ভবত কিছু বলেছেন। তাই বোর্ডারদের একে একে আমার অফিসঘরে ডেকে শুধু জেরা করে চলে গেল। মিঃ দুবের হাবভাবে বুঝলাম, পুলিস শোভন রায়কেই হত্যাকারী সাব্যস্ত করেছে। তাঁকেই খোঁজা শুরু হবে এবার–আমার ধারণা। আর একটা কথা আপনাকে বলা উচিত।

বলো রঘুবীর।

শোভন রায়ের স্যুইটের জিনিসপত্র আবার সার্চ করা হল। আমি উপস্থিত ছিলাম তখন। মিঃ দুবে ঋতুপর্ণার সুটকেশ থেকে কিছু কাগজপত্র নিয়ে গেলেন। কিন্তু আশ্চর্য কর্নেল সাব। ওঁদের স্যুইটে শোভন রায়ের কোনও জিনিসই নেই। না কোনও সুটকেশ, না পোশাক। কিছু না।

হুঁ! ব্যাপারটা অদ্ভুত! তবে আমি এর ব্যাখ্যা করতে পারি। শোভনবাবু খুব ভোরে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ঋতুপর্ণার সঙ্গে ওঁর ঝগড়াঝাটি হয়েছিল।

আপনি শুনেছিলেন?

না। চমনলালজির স্ত্রী রজনী দেবী আমাকে বলেছেন। তা ছাড়া সোমক চ্যাটার্জিও বলেছে। বলে কর্নেল বারান্দার কাছে গিয়ে ডাকলেন, সিদ্ধেশ! তোমার গাড়িটা ফেরত নাও।

সিদ্ধেশ বেরিয়ে এসে তার মোপেডটা গ্যারাজের দিকে নিয়ে গেল।

কর্নেল লক্ষ্য করলেন, দক্ষিণের বাগানে সোমক ও শ্রুতি একটা বেঞ্চে বসে কথা বলছে। কর্নেল বললেন, রঘুবীর! আমি কফি খাব।

রঘুবীর ভেতরে ঢুকলেন। কর্নেল বারান্দায় বসে ঘড়ি দেখলেন। চারটে বেজে গেছে। ইচ্ছে করেই দেরি করে ফিরেছেন। নদীর ব্রিজের ওধারে মোপেড দাঁড় করিয়ে রেখে চুপচাপ বসে ছিলেন।

সিদ্ধেশ গ্যারাজ থেকে এসে তার কাছে দাঁড়াল। কর্নেল বললেন, তোমাদের হনিমুনাররা কে কোথায় সিদ্ধেশ?

সিদ্ধেশ হাসল। যে যার ঘরে রেস্ট নিচ্ছেন। শুধু চ্যাটার্জিসাবরা বাগানে বসে আছেন।

দেখলাম। তো মিসেস ঠাকুর?

ওঁর যা বাতিক! ধারিয়া ফলসে স্বামীর আত্মার সঙ্গে গল্প করতে গেলেন। আমাকে ডাকছিলেন সার! আমি তো ওঁর মতো পাগল নই। তবে সার, মিঃ দুবে ওঁকে যা ধাঁতানি দিয়েছেন, ওঁর পাগলামি অনেকটা সেরে যাবে দেখবেন। বলে সিদ্ধেশ হাসতে হাসতে চলে গেল ভেতরে।

জগদীশ কফি রেখে গেল। কর্নেল চুপচাপ কফি খেতে থাকলেন। কিছুক্ষণ পরে রঘুবীর এসে বললেন, কর্নেলসাব! আপনার টেলিফোন। মিঃ দুবে কথা বলতে চান আপনার সঙ্গে।

রিসেপশনে গিয়ে কর্নেল সাড়া দিলেন। তারপরই বললেন, আমি দুঃখিত মিঃ দুবে। নীলসারস দম্পতির হনিমুনের দিকেই আমার বেশি আকর্ষণ। তাই

কর্নেল সরকার! ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টার দুবের হাসির শব্দ ভেসে এল। আপনার হবির কথা আমি জানি। যাই হোক, আপনাকে জানানো উচিত মনে করছি। ঋতুপর্ণার আসল নাম পিয়ালি রায়।

তাই বুঝি?

 হ্যাঁ। ওর স্যুটকেসে কয়েকটা চিঠি পেয়েছি। বিপজ্জনক মেয়ে ছিল পিয়ালি।

 বলেন কি মিঃ দুবে?

সে একজন সঙ্গী জুটিয়ে এনেছিল। হনিমুন লজে এমন একজন এসেছে, যাকে ব্ল্যাকমেল করত সে। এখানেও সে তাকে ব্ল্যাকমেল করতে এসেছিল। আমার ধারণা, বখরা নিয়ে সঙ্গীর সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার পর সঙ্গী লোকটা তাকে খুন করেছে।

কে সেই হনিমুনার তা কি জানতে পেরেছেন?

 নাহ কর্নেল সরকার! তবে আমি সোমক চ্যাটার্জিকেই সন্দেহ করছি।

 হুঁ। কিন্তু ব্ল্যাকমেলের ভিত্তিটা কী, তা টের পেয়েছেন কি?

 পিয়ালি তার অতীত জীবন সম্পর্কে কিছু জানত। কোনও ডকুমেন্ট তার কাছে নিশ্চয় ছিল।

কিন্তু সেটা তো খুঁজে পাননি! নাকি পেয়েছেন?

স্বীকার করছি, পাইনি। তবে হনিমুন লজেই কোথাও লুকোনো থাকতে পারে। অথবা পিয়ালির সঙ্গী তথাকথিত শোভন রায় সেটা হাতিয়ে নিয়ে তাকে মেরে ফেলেছে। আমরা লোকটাকে খুঁজে বের করবই। সে এখনও এলাকা ছেড়ে যেতে পারেনি। কর্নেল সরকার! আমার দ্বিতীয় ধারণাটার ওপর জোর দিচ্ছি। পিয়ালির সঙ্গীর কাছেই ব্ল্যাকমেলিং-এর ডকুমেন্ট থাকা সম্ভব। এবার অনুরোধ কর্নেল সরকার! আপনি একটু নজর রাখুন।

আচ্ছা মিঃ দুবে, ড্রাইভার রাম সিংয়ের কোনও স্টেটমেন্ট কি নিয়েছেন? সে-ই কিন্তু প্রথমে ডেডবডিটা দেখতে পেয়েছিল।

দুবের হাসি ভেসে এল। আমাকে অত বোকা ভাববেন না কর্নেল সরকার! রাম সিংয়ের স্টেটমেন্ট নিয়েই তো ফের হনিমুন লজে গিয়েছিলাম। বেচারার সম্ভবত আন্ত্রিক হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছেন পাণ্ডেজি!

আন্ত্রিক?

এটা কি গুরুত্বপূর্ণ কর্নেল সরকার? আপনি এমন সুরে প্রশ্নটা করলেন যেন

নাহ্। ছেড়ে দিন।

ঠিক আছে কর্নেল সরকার! রাখছি। পরে দরকার হলে যোগাযোগ করব।..

কর্নেল চুরুট টানছিলেন। রোদের রঙ এখন লালচে হয়ে গেছে। দূরের পাহাড় ঘন নীল এবং গাছপালায় কুয়াশা ঘনাচ্ছে। বাতাসে হিমের আমেজ। কর্নেল জ্যাকেটের চেন টেনে দিলেন। টেবিলে রাখা টুপিটা তুলে মাথায় আঁটো করে বসিয়ে দিলেন।

এই সময় চমনলাল দম্পতি বেরিয়ে আসছিলেন। কর্নেল বললেন, নমস্তে!

নমস্তে কর্নেলসাব!

বেড়াতে বেরুচ্ছেন নাকি?

বৃদ্ধ ঐতিহাসিক ম্লান হাসলেন। নাহ্! একটু হাঁটাচলার অভ্যাস আছে। দুবেলা। কিন্তু বাইরে যাচ্ছি না। লনে বা বাগানে ঘুরব।

রজনী দেবীকে বেশি গম্ভীর দেখাচ্ছিল। দুজনে লনে নেমে গেলেন। গেট পর্যন্ত গিয়ে তারা বাগানে ঢুকলেন। একটু পরে দীপক ও কুমকুম বেরিয়ে এল। তারা কর্নেলের দিকে একবার তাকিয়েই লনে নামল। তারপর গেট পেরিয়ে গেল।

কর্নেল দেখলেন শ্রুতি বাগান থেকে হন্তদন্ত হয়ে গিয়ে তাদের সঙ্গ নিল। মিনিট দশেক পরে পায়েল একা বেরিয়ে এসে কর্নেলকে বারান্দায় দেখে মার্কিন রীতিতে বলল, হাই!

হাই মিসেস রুদ্র!

পায়েল একটু হাসল। কর্নেল সায়েব! অনির্বাণ আমার স্বামী হলেও আমি নিজের পদবি বদলাইনি। আমি পায়েল ব্যানার্জি।

ইজ ইট ফর সেব অব ইওর প্রোফেশন?

ইয়া।

আপনার হ্যাজব্যান্ড বিশ্রাম নিচ্ছেন সম্ভবত?

হি ইজ ড্যাম টায়ার্ড। বলে পায়েল বারান্দায় গেল। বসতে পারি কর্নেল সায়েব?

কর্নেল হাসলেন। কেন নয়? এই বেতের চেয়াগুলো সবার বসার জন্য।

পায়েল কর্নেলের কাছাকাছি চেয়ারে বসে আস্তে বলল, অনির্বাণের সন্দেহ হয়েছে আপনি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ।

সরি মিসেস

 মিস ব্যানার্জি বলুন!

কিন্তু আপনি মিঃ রুদ্রের স্ত্রী!

আপনার হাবভাবে মনে হয়েছে আপনি একজন মডার্ন ম্যান। কাজেই আপনাকে সত্যি কথাটা বলা উচিত। উই লিভ টুগেদার। উই আর নট এ ম্যারেড কাপল্ ইউ নো!

আই সি!

কর্নেল সায়েব! আমি সবসময় স্পষ্ট কথা বলি। আমারও সন্দেহ হয়েছে, কেউ আপনাকে আমাদের পেছনে লাগিয়েছে।

লাগানোর কি বিশেষ কোনও কারণ আছে মিস ব্যানার্জি?

আছে। অনির্বাণ একটা ফিল্ম করতে চায়। বিগ বাজেটের ফিচার ফিল্ম। আসলে সে আমাকে নিয়ে তাই লোকেশন দেখতে এসেছে। ধারানগরে তার কোম্পানির ব্রাঞ্চ আছে। বন্ধুবান্ধবও আছে।

রমেশ পাণ্ডে?

আপনি তাও জানেন দেখছি!

জেনেছি। কারণ পাণ্ডে তার জিপ আপনাদের ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন! কর্নেল হাসলেন। বাই এনি চান্স, ফিল্মটা কি ডাইনোসর নিয়ে? স্পিলবার্গের জুরাসিক পার্ক ছবিটা নাকি এ দেশে হিড়িক ফেলে দিয়েছে। এবং আপনারা ধারিয়া ফলস এরিয়ায় গুহাচিত্র দেখতে গিয়েছিলেন। কোন গুহায় নাকি ডাইনোসরের ছবি আছে।

পায়েল তীক্ষ্ণ দৃষ্টে তাঁকে দেখছিল। আস্তে শ্বাস ফেলে বলল, দ্যাটস রাইট। তা অনির্বাণ যা বলছিল, তা মিলে যাচ্ছে। সে যে একটা ফিল্ম করতে চায়, তা তার প্রতিদ্বন্দ্বী জানে। কিন্তু ফিল্মটা কী নিয়ে হবে, তা জানত না। এখন দেখছি আপনি তা জেনে গেছেন। এবং আপনার ক্লায়েন্টকে জানিয়ে দেবেন। এই তো?

কর্নেল গম্ভীর হয়ে বললেন, আপনি ভুল করছেন মিস ব্যানার্জি! প্রথমত আমি ডিটেকটিভ নই এবং কথাটা ভীষণ অপছন্দ করি। দ্বিতীয়ত এই তুচ্ছ। ব্যাপারের জন্য কেউ ডিটেকটিভ পেছনে লাগাবে বলে মনে হয় না। আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল। আমি নেচারিস্ট। বিদেশি সায়েন্স ম্যাগাজিনে নানা বিষয়ে সচিত্র প্রবন্ধ লিখি। এটাই আমার হবি।

বাট ইউ আর ভেরি মাচ ইন্টারেস্টেড অ্যাবাউট দা মার্ডার অব পিয়ালি।

কর্নেল তাকালেন। পিয়ালি? কে সে?

 যে ঋতুপর্ণা নামে এখানে এসেছিল।

 আপনি তাকে চিনতেন?

 হুঁ। অনির্বাণও চিনত।

কিন্তু পিয়ালির মার্ডারের সঙ্গে আপনাদের ফিল্মের সম্পর্ক কী?

পায়েল বাঁকা হাসল। আপনি তা জানেন। কারণ আপনার ক্লায়েন্ট তাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল।

ডু ইউ মিন শোভন রায়?

ইয়া। পায়েল বিকৃতমুখে ফের বলল, হি ইজ এ ন্যাস্টি ম্যান। তার আসল নাম বিকাশ সেন। সে একজন ফিল্ম প্রোডিউসার। অ্যান্ড ইউ নো দ্যাট ওয়েল।

কর্নেল হাসলেন। কিন্তু পুলিস তাকে খুঁজছে। সে-ই নাকি পিয়ালিকে খুন করে নদীতে ফেলে দিয়েছে।

ইয়া।

 আমি কিছু বুঝতে পারছি না মিস ব্যানার্জি।

পায়েল রুক্ষ কণ্ঠস্বরে বলল, কর্নেল সায়েব! বিকাশ আপনাকে কথাটা না বলতেও পারে। সে আপনাকে হায়ার করে অনির্বাণের ফিল্মের সাবজেক্ট সম্পর্কে সিওর হতে চেয়েছিল। তার পিয়ালিকে দিয়ে অনির্বাণকে ব্ল্যাকমেইল করতে চেয়েছিল, যাতে অনির্বাণ তার প্রজেক্ট থেকে সরে দাঁড়ায়।

এ তো দেখছি একটা জটিল–আর ফানি ব্যাপার! কর্নেল হেসে উঠলেন। তারপর নিভে যাওয়া চুরুট ধরিয়ে ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, এনিওয়ে! ব্ল্যাকমেইলের প্রশ্ন উঠলে বলব এর একটা ভিত্তি থাকা অনিবার্য। হোয়াটস্ দ্যাট মিস্। ব্যানার্জি?

অনির্বাণ তার কোম্পানির এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর। তার একটা বোকামি হয়ে গেছে। সে ডাইনোসর নিয়ে ফিল্ম করার জন্য একটা প্রজেক্টের মোটা টাকা বেনামে সরিয়ে রেখেছে। এটা তত কিছু বেআইনি অবশ্য নয়। কিন্তু শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে রটে গেলে একটু গণ্ডগোল হতে পারে। সে হোয়াট? অনির্বাণ তখন না হয় ফিল্ম করবে না। আবার দেখুন ফিল্মটা হিট করলে কোম্পানিই শেষ পর্যন্ত প্রফিট করবে এবং শেয়ার হোল্ডাররা ভাল ডিভিডেন্ড পাবে। তাই না? পায়েল দম নিয়ে ফের বলল, মোট কথা বিকাশ নিজে সম্ভবত ডাইনোসর নিয়ে ছবি করতে চায়। এক ঢিলে দুই পাখি বধ। অনির্বাণ সরে দাঁড়াবে এবং তার আগে বিকাশের সঙ্গিনী পিয়ালি বোকা অনির্বাণকে ব্ল্যাকমেইল। করে মোটা হাতিয়ে নেবে। মে বি বিকাশ পিয়ালিকে হিরোইনের রোল দিতে লোভ দেখিয়েছিল।

কিন্তু পিয়ালির কাছে এমন কী ডকুমেন্টস ছিল যে–

কর্নেল সায়েব! পিয়ালি ব্যাঙ্কে চাকরি করত। অনির্বাণের কোম্পানির অ্যাকাউন্ট ডিল করত সে। নাও ডু ইউ অন্ডারস্ট্যান্ড দ্য ব্যাকগ্রাউন্ড? আপনার নিশ্চয় জানা। তবু না জানার ভান করছেন। পিয়ালি ব্যাঙ্কের আসানসোল বার্নপুর ব্রাঞ্চের এজেন্ট। শি ওয়াজ অ্যান অ্যামবিশাস অ্যান্ড ফেরোশাস পার্সন!

বুঝলাম। বাট হোয়াই বিকাশ সেন কিল্ড পিয়ালি?

বখরা নিয়ে দুজনের মধ্যে ঝগড়া হয়ে থাকবে। কিংবা এমনও হতে পারে, পিয়ালির কাছে ব্যাঙ্ক ডকুমেন্টের যে কপি ছিল, তা বিকাশ হাতিয়ে নিয়ে চোরের ওপর বাটপাড়ি করেছে।

মিস ব্যানার্জি! আপনি কাল অনেক রাতে লনে বসে ছিলেন। কারও জন্য অপেক্ষা করছিলেন?

পিয়ালি তাকাল। আপনি ওত পেতে ছিলেন দেখছি!

ধরুন, তা-ই।

আমি বিকাশের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে কথামতো আসেনি। এনিওয়ে! আপনার ক্লায়েন্ট একজন মার্ডারার। আশা করি, তাকে বাঁচানোর চেষ্টাই আপনার এখন প্রধান কাজ হবে।

কর্নেল হাসলেন। পসিবলি! হোয়াই নট?

পায়েল উঠে দাঁড়াল। দেন আই ওয়ার্ন ইউ কর্নেল সায়েব, দ্যাট উইল বি এ ডেঞ্জারাস গেম। ইউ নো রমেশ পাণ্ডে ওয়েল!

বলে সে উঠে দাঁড়াল। তারপর লাউঞ্জে ঢুকে গেল। কর্নেল দেখলেন, লাউঞ্জে ঢোকার সময় পায়েল ব্যানার্জি একবার ঘুরে তার দিকে তাকিয়ে গেল। বুঝলেন, অনির্বাণ রুদ্র তাঁকে হুমকি দিতে পাঠিয়েছি। মেয়েটির দেহে উজ্জ্বল রূপলাবণ্য আছে। সোমকের মডেলিংয়ের জুটি ছিল নাকি। অনির্বাণের মতো বয়স্ক পুরুষের সঙ্গে লিভ টুগেদার-এর উদ্দেশ্য বোঝা যাচ্ছে। ফিল্মের হিরোইন হতে চায়। সোমক অবশ্য সে আভাস দিয়েছে। তবে এ যুগে কে-ই বা কেরিয়ারিস্ট এবং অ্যামবিশাস নয়?

কর্নেল লনে নামলেন। সময়মতো ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ দুবেকে জানাতে হবে পিয়ালি সত্যি আসানসোলবার্নপুরে কোনও ব্যাঙ্কের এজেন্ট ছিল কি না। একটা র‍্যাকেটের আভাস পাওয়া যাচ্ছে যেন। বিকাশ-পিয়ালি-অনির্বাণ। পায়েল ব্যানার্জি সম্পর্কে সোমক যেটুকু জানিয়েছে, তা সত্য হলে এই র‍্যাকেটে পায়েলের ভূমিকা গৌণ।

কর্নেল গেট পেরিয়ে গিয়ে দেখলেন, ঢালের নীচে নদীর ধারে দীপক ও কুমকুম দাঁড়িয়ে কথা বলছে। হনিমুনে আসা দম্পতির প্রেমালাপ বলে মনে হয় না। কারণ দুজনেই গম্ভীর।

কর্নেল প্রথমে গেলেন নদীর ধারে সেই গাছটার কাছে, যেখানে পাথরের মসৃণ বেদি আছে। বেদিটা সত্যিই সুভদ্রা ঠাকুর যথেচ্ছ রাঙিয়ে রেখেছেন। তবে এখন লাল রঙগুলো তত উজ্জ্বল নয়। সুভদ্রা কিছু লক্ষ্য করেছিলেন, তাতে ভুল নেই। সোমক চলে যাওয়ার পরই সেখানে লাল ফুলের একটু রঙ ছড়িয়ে রেখেছিলেন। অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন। তার পাগলামির মধ্যে কিছুটা অভিনয় আছে যেন। তার চেয়ে বড় কথা, তিনি কি নদীর এধারে শর্টকাট রাস্তায় ধারিয়া ফলসে যাওয়ার সময় পিয়ালিকে হত্যার দৃশ্য দৈবাৎ দেখে ফেলেছিলেন?

গাছটার কাছ থেকে সরে অন্যত্র যাওয়ার ভঙ্গিতে কর্নেল দীপক ও কুমকুমের সামনাসামনি গেলেন। একটু হেসে বললেন, এক্সকিউজ মি! আপনাদের ডিসটার্ব করলাম না তো?

দীপক বলল, করলেন বৈকি! আমি আমার স্ত্রীকে এখানে মেরে ফেলতে এনেছিলাম। আপনি এসে পড়ায় তা হল না!

কুমকুম চটে গেল। কী অসভ্যতা করছ ভদ্রলোকের সঙ্গে।

দীপক নির্বিকার মুখে বলল, পায়েলদি বলছিলেন উনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ।

কর্নেল তার অট্টহাসিটি হাসলেন। তারপর বললেন, ওটা আমাকে গাল দেওয়া হল দীপকবাবু! তবে হ্যাঁ–আমি কোথাও রহস্যময় ঘটনা ঘটতে দেখলে একটু নাক গলাই।

এখানে আর কোনও রহস্যময় ঘটনা ঘটবার চান্স নেই কর্নেল সায়েব!

 কুমকুম বলে উঠল, দীপক ওঁকে সেই কথাটা বলো। তুমি আর শ্রুতিদি ফলসের ওপরে

কর্নেল দ্রুত বললেন, শুনেছি। শোভনবাবুকে দেখতে পেয়েছিলেন!

দীপক বলল, অনির্বাণ-দাও দেখেছিলেন। ওঁর সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু তাড়া ছিল বলে তত লক্ষ্য করেননি।

কুমকুম বলল, অনির্বাণদা কিন্তু ফলসের ওপরে ওকে দেখেননি দীপক! জানেন কর্নেল সায়েব? অনির্বাণদা যখন আমাদের ব্রেকফাস্টের জন্য জিপ নিয়ে খাবার আনতে যাচ্ছিলেন, তখন লোকটাকে দেখতে পেয়েছিলেন।

কর্নেল বললেন, খাবার আনতে যাচ্ছিলেন অনির্বাণবাবু? একটু ডিটেলস্ বলুন তো!..

.

০৮.

 আজ সন্ধ্যা থেকেই হিমেল হাওয়ার উপদ্রব ছিল। সন্ধ্যায় আর বাইরে বেরোয়নি হনিমুনাররা। রাত নটায় লাউঞ্জে কাল রাতের মতো ককটেল পার্টির আয়োজন করেছিল অনির্বাণ রুদ্র। সেই সঙ্গে তার খরচে ডিনার। ক্যাসেট প্লেয়ারে পপ মিউজিক বাজছিল। অনির্বাণ আগেই ঘোষণা করেছিল, বিকাশ সেনকে পুলিস গ্রেপ্তার করেছে। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ দুবে টেলিফোনে তাকে এই সুখবর দিয়েছেন। তবে দুঃখের বিষয়, তার বন্ধু রমেশ পাণ্ডের। আসার কথা ছিল। আসতে পারছেন না। কারণ তার এক বিশ্বস্ত ড্রাইভার রাম সিং আন্ত্রিকে মারা গেছে। কিন্তু কী আর করা যাবে তার জন্য, এক মিনিটের নীরবতা পালন ছাড়া? বিকাশ সেন এক জঘন্য খুনী। সে ধরা পড়েছে, এটাই এসব ছোট দুঃখকে চাপা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন! পাণ্ডেজি হনিমুনারদের জন্য প্রচুর ড্রিঙ্ক উপহার পাঠিয়েছেন। সো লেট আস সেলিব্রেট দ্যা অকেশন!

রাত সাড়ে নটায় ম্যানেজার রঘুবীর রায় বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন। কর্নেলসাবের পাত্তা নেই। তার কোনও বিপদ হয়নি তো? রমেশ পাণ্ডে সাংঘাতিক লোক।

গেটের দিকে নিচে থেকে আলোর ছটা এসে পড়ল। একটু পরে একটা অটোরিকশ এসে দাঁড়াল। রঘুবীর আশ্বস্ত হয়ে দেখলেন কর্নেলসাব নামছেন। অটোরিকশ চলে গেল। তখন রঘুবীর লনে এগিয়ে গেলেন।

কর্নেল বললেন, কী রঘুবীর? এনিথিং রং এগেন?

না স্যার! আমি আপনার জন্য চিন্তা করছিলাম।

 কর্নেল হাসলেন। হ্যাঁ। তোমার চিন্তার কারণ ছিল। কিন্তু রাম সিং মরে গিয়ে রমেশ পাণ্ডেকে বিচলিত করে ফেলেছে। হাসপাতালে আলাপ হল লোকটার সঙ্গে। ডাক্তারের মতে, কারও পরামর্শে রাম সিং আমাশার রোগে কড়া ডোজের জোলাপের ট্যাবলেট খেয়েছিল। রমেশ পাণ্ডে বললেন, রাম সিং ভোরে তাকে বলেছিল আমাশা হয়েছে। কিন্তু হাতের কাছে তাকে পেয়ে জোর করে জিপ নিয়ে পাঠিয়েছিলেন। পাণ্ডেজীর ধারণা, হনিমুনারদের কেউ ওকে জোলাপের ট্যাবলেট দিয়েছিল। তো ডাক্তারের মতে, অনেক সময় একটু জোলাপ নিলে আমাশা সেরে যায়। কিন্তু ডোজটা ছিল খুব কড়া। হিতে বিপরীত হয়ে গেছে।

রঘুবীর আস্তে বললেন, পাণ্ডেজি তার বন্ধুর জন্য প্রচুর হুইস্কি, বিয়ার এবং সফ্ট ড্রিঙ্ক পাঠিয়েছেন। আজও ককটেল পার্টি হচ্ছে–উইথ ডিনার।

হওয়ারই কথা। খুনী ধরা পড়েছে। হনিমুনাররা নিজেদের নিরাপদ ভাবছে এবার।

রুদ্রসাব অ্যানাউন্স করছিলেন। কিন্তু কোথায় সে ধরা পড়ল সার?

সে নিজেই থানায় গিয়ে সারেন্ডার করেছে। তার আসল নাম বিকাশ সেন। ফিল্ম প্রোডিউসার।

ও মাই গড! কিন্তু কেন সে ঋতুপর্ণা রায়কে খুন করেছে?

কর্নেল খুব আস্তে বললেন, যথাসময়ে জানতে পারবে রঘুবীর! চলো! বড্ড ঠাণ্ডা এখানে।

লাউঞ্জে ঢুকে কর্নেল দেখলেন, পার্টি খুব জমে উঠেছে। যে-যার বউয়ের সঙ্গে নাচছে। শুধু চমনলাল দম্পতি এক কোণে চুপচাপ বসে আছেন। তবে দেখার মতো দৃশ্য, সুভদ্রা ঠাকুর একা আপন মনে উদ্দাম নাচছেন। মুখে পাগলাটে হাসি।

কর্নেলকে দেখামাত্র সুভদ্রা ছুটে এলেন। ম্যান! ড্যান্স উইথ মি!

কর্নেল অগত্যা তার সঙ্গে নাচতে শুরু করলেন। চমনলাল দম্পতি হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। পায়েল নাচ থামিয়ে বলল, হাই ওল্ড ম্যান! আই মাস্ট অফার ইউ এ ড্রিঙ্ক।

থ্যাঙ্কস্ ম্যাডাম!

অনির্বাণ হাসতে হাসতে বলল, আপনি মশাই প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আপনাকে ঝালে-ঝোলে-অম্বলে সবতাতে থাকতে হয়। এনজয় করতে হলে ভালোভাবে করুন! পায়েল, ওঁকে একটু স্কচ দাও। জনি ওয়াকার হুইস্কি মশাই! এ জিনিস খুব দুর্লভ এখানে!

পায়েল একটা টেবিলে সাজানো বোতল থেকে হুইস্কি আর সোডা ওয়াটার ঢালল। একটুকরো আইস কিউব ফেলে দিল গ্লাসে। তারপর কর্নেলের হাতে ধরিয়ে দিল। কর্নেল কাচুমাচু মুখে বললেন, ফর ইওর অনার মিস ব্যানার্জি! জাস্ট এক চুমুক খাব।

সুভদ্রা কর্নেলের হাত থেকে গ্লাসটা ছিনিয়ে নিয়ে কার্পেটে ফেলে দিলেন। তারপর ধপাস করে একটা কুশনে বসলেন। সবাই হেসে উঠল।

পায়েল গ্লাসটা কুড়িয়ে নিয়ে একজন কিচেনবয়কে ইশারায় ডাকল। গ্লাসটা তাকে ধুতে দিয়ে সে আরেকটা গ্লাসে হুইস্কি ঢালল। তারপর কর্নেলের দিকে এগিয়ে আসতেই সুভদ্রা ঝাঁপিয়ে এলেন। চিৎকার করে বললেন, নো! টেক্ অফ্ ইওর ডার্টি হ্যান্ড ফ্রম দিস সিম্বল অব হেভেনলি বিইং।

অনির্বাণ বলল, লিভ ইট পায়েল! লেটস্ ড্যান্স!

সুভদ্রা কর্নেলের হাত ধরে টেনে নিজের পাশে বসালেন। কানের কাছে মুখ এনে বললেন, আপনাকে আমার কিছু বলার আছে। আমি খুনীকে স্বচক্ষে দেখেছিলাম; কিন্তু জঙ্গলের আড়ালে থাকার জন্য চিনতে পারিনি। সে হতভাগিনী মেয়েটিকে ঠেলে নদীতে ফেলে দিচ্ছিল।

কর্নেল হাসলেন। খুনী তো ধরা পড়েছে।

পুলিসকে আমি বিশ্বাস করি না। তারা সব সময় ভুল লোককে ধরে। আমার স্বামী জিতেন্দ্রকে–বলেই সুভদ্রা নিজের মুখে হাত রাখলেন। থাক। আমি সে সব কথা বলব না। জিতেন্দ্রর আত্মা আমাকে বলেছে, চুপ করে থাকো! কর্নেল সরকার! মেয়েটিকে আমি বাগানে একা বসে থাকতে দেখে সঙ্গে যেতে বলেছিলাম। ও যায়নি। গেলে মারা পড়ত না।

কর্নেল ঘড়ি দেখলেন। রাত নটা পঞ্চাশ বাজে। সুভদ্রা ঠাকুর তাঁর কানের কাছে মুখ এনে আরও কী সব বলছেন। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না। ভদ্রমহিলা · ক্রমশ যেন উত্তেজিত হয়ে উঠছেন এবং তার পাগলামি বেড়ে যাচ্ছে। কর্নেল হনিমুনারদের দেখতে থাকলেন। সোমক ও শ্রুতি, দীপক ও কুমকুম, অনির্বাণ ও পায়েল এবার নাচের জুটি বদলাল। সোমক ও পায়েল, দীপক ও শ্রুতি, অনির্বাণ ও কুমকুম জুটি হল।

রাত দশটায় কর্নেল লক্ষ্য করলেন, ম্যানেজার রঘুবীর রায় রিসেপশন কাউন্টার থেকে বেরিয়ে দরজায় কাছে গেলেন। তারপর ঘুরে কর্নেলের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি তাকালেন।

কর্নেল উঠে গেলেন তাঁর কাছে। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ দুবে দলবলসহ লনে এগিয়ে আসছিলেন। রঘুবীরের চোখে-মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠেছিল। আস্তে বললেন, আবার পুলিস কেন কর্নেলসাব?

কর্নেল বললেন, তোমার চিন্তার কারণ নেই রঘুবীর।

 মিঃ দুবে এবং তাঁর পুলিস সঙ্গীরা লাউঞ্জে ঢুকতেই নাচ থেমে গেল। দুবে একটু চড়া গলায় বললেন, প্লিজ স্টপ দ্যা মিউজিক!

সোমক এগিয়ে গিয়ে ক্যাসেট প্লেয়ার বন্ধ করল। অনির্বাণ সহাস্যে বলল, ওয়েলকাম! ওয়েলকাম!

পুলিসের দলটি লাউঞ্জে ঢুকে চারদিক ঘিরে দাঁড়াতেই পায়েল ভুরু কুঁচকে বলে উঠল, হোয়াট দ্যা হেল্ ইউ আর ডুইং?

মিঃ দুবে বললেন, আপনারা দয়া করে বসে পড়ুন।

অনির্বাণ হাসল। ঠিক আছে। পায়েল, আমার মনে হচ্ছে পুলিস আমাদের কাছে আরও কিছু জানতে চায়। আমরা পুলিসকে সহযোগিতা করব।

মিঃ দুবে কর্নেলের দিকে ঘুরে বললেন, আপনার কিছু বক্তব্য আছে বলছিলেন কর্নেল সরকার! আপনি এবার তা বলুন!

সবাই চুপচাপ বসে পড়েছে। সবগুলি মুখে বিস্ময় এবং গাম্ভীর্য। কর্নেল বক্তৃতার ভঙ্গিতে বললেন, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টমেন! বিকাশ সেন ধরা পড়েছে। সে-কথা আপনারা ইতিমধ্যে জানতে পেরেছেন। তবু কিছু প্রশ্ন থেকে গেছে। প্রথমেই আমি প্রশ্ন করছি সোমবাবুকে। সোমবাবু! কুমকুম সিনহা আজ মর্নিংয়ে যখন আপনাদের ধারিয়া ফলসে যাওয়ার জন্য ডাকতে যান, তখন কুমকুম আপনাকে বলেছিলেন, ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ফিরে আসব।

সোমক আস্তে বলল, হ্যাঁ। সে তো আপনাকে বলেছি। আবার এ প্রশ্ন কেন?

তার মানে, তখনও ধারিয়া ফলসে গিয়ে ব্রেকফাস্টের প্ল্যান ছিল না। তাই না মিসেস সিনহা?

কুমকুম বলল, হ্যাঁ। কিন্তু ফলসের ওখানে পৌঁছে ঠিক হয়েছিল এখানে ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। কারণ গুহাচিত্র দেখে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যাবে।

কে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মনে আছে?

পায়েল বলে উঠল, একজনের সিদ্ধান্ত নয়। আমরা সবাই মিলে

কর্নেল বললেন, মিসেস সিনহা এ প্রশ্নের উত্তর দেবেন। আমি চাই, যাকে প্রশ্ন করা হবে, তিনিই কথা বলবেন। প্লিজ অন্য কেউ ডিসটার্ব করবেন না। মিসেস সিনহা!

কুমকুম বিব্রতভাবে বলল, পায়েলদি হয়তো ঠিক বলেছেন।

কিন্তু কোনও প্রসঙ্গ উঠলে একজনই প্রথমে কথাটা তোলেন। তাই না। মিসেস সিনহা।

হ্যাঁ। কিন্তু কে তুলেছিলেন কথাটা, মনে পড়ছে না।

 ঠিক আছে। তো আপনি আজ বিকেলে আমাকে বলেছেন অনির্বাণবাবু জিপ নিয়ে ব্রেকফাস্টের খাবার আনতে গিয়েছিলেন। মিঃ রুদ্র! আপনি কোথায় খাবার আনতে গিয়েছিলেন?

অনির্বাণ বাঁকা হাঁসল। সেটা কি অন্যায় কিছু? এই এরিয়া আমার চেনা। ধারানগরে আমার কোম্পানির ব্রাঞ্চ আছে।

মিঃ রুদ্র! আপনার কোম্পানির নাম কী?

চয়নিকা ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড স্মল সেভিংস। অসংখ্য জায়গায় আমাদের ব্রাঞ্চ আছে।

তার মানে, আপনার কোম্পানি জনসাধারণের কাছে আমানত নেয় এবং সেই টাকা লগ্নি করে। এসব সংস্থার খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন বেরোয়। আজকাল এ ধরনের প্রচুর সংস্থা সর্বত্র গড়ে উঠেছে। ন্যূনতম আমানত মাথা পিছু কত মিঃ রুদ্র?

এটা কি প্রাসঙ্গিক কর্নেল সরকার?

উত্তর দিন প্লিজ।

মিনিমাম পাঁচ টাকা। সুদসহ তিনবছরে তিনগুণ টাকা আমরা ফেরত দিই।

আসানসোলের একটা ব্যাঙ্কে আপনার নিজের নামে কত টাকা রেখেছেন মিঃ রুদ্র?

অনির্বাণ রুষ্ট মুখে বলল, অ্যাবসার্ড! এ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

 মিঃ দুবে বললেন, আমরা জানতে পেরেছি আপনার ব্যক্তিগত আমানতের পরিমাণ প্রায় এক কোটি তিরিশ লক্ষ টাকা।

তাতে কী? ওটা কোম্পানির একটা প্রজেক্টের জন্য আলাদা জমা রাখা হয়েছে।

কর্নেল বললেন, পিয়ালি রায় সেই ব্যাঙ্কের এজেন্ট ছিল। তাই না মিঃ রুদ্র?

হ্যাঁ। কিন্তু শয়তান বিকাশ সেন পিয়ালিকে–

জাস্ট এ মিনিট। মিস ব্যানার্জি! আপনি আমাকে বলছিলেন পিয়ালি এখানে ঋতুপর্ণা নাম নিয়ে মিঃ রুদ্রকে ব্ল্যাকমেইল করতে এসেছিল। তাই না?

পায়েল বলল, অনির্বাণ আমাকে কথাটা বলেছিল। এর বেশি কিছু জানি না।

সোমকবাবু! এবার আপনাকে প্রশ্ন করছি। নদীর ধারে বসে থাকার সময় পিয়ালি ওরফে ঋতুপর্ণা হঠাৎ রাস্তার দিকে চলে গিয়েছিল। আপনি বলেছেন–আমাকে।

সোমক আস্তে বলল, হ্যাঁ।

শ্রুতি ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বরে বলল, কী দেখেছিলে বলছ না কেন?

সোমক একটু ইতস্তত করে বলল, ঋতুপর্ণা–আই মিন পিয়ালি, ওভাবে হঠাৎ চলে যাওয়ার খুব অবাক হয়েছিল। অপমানিত বোধ করছিলাম। তো রাস্তায় কাকেও দেখে সে হনহন করে এগিয়ে যাচ্ছিল। লোকটাকে অবশ্য স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না! ভেবেছিলাম ওর স্বামীকে দেখতে পেয়ে ও চলে গেল। কিন্তু লোকটা সম্ভবত অন্য কেউ।

কর্নেল বললেন, আমি লক্ষ্য করছিলাম হনিমুন লজের গেটের দিকে যেতে যেতে আপনি পিছু ফিরে কিছু দেখছিলেন!

সোমক কিছু বলার জন্য ঠোঁট ফাঁক করল। কিন্তু বলল না।

প্রাইভেট রোড থেকে হাইওয়ে এবং ব্রিজের একটা অংশ চোখে পড়ে সোমবাবু!

হ্যাঁ। হাইওয়েতে অনেক গাড়ি যাতায়াত করছিল। কিন্তু আসলে আমি ঋতুপর্ণাকে আর দেখতে পাচ্ছিলাম না। তাই তাকে খোঁজার চেষ্টা করছিলাম।

আপনার স্ত্রীকে প্রশ্ন করছি! ড্রাইভার রাম সিংহের আমাশা হওয়ার কথা কোথায় প্রথম শুনেছিলে শ্রুতি?

ফলসে যাওয়ার সময়। সে রাস্তায় জিপ থামিয়ে নদীর ধারে গিয়েছিল।

তারপর? কতক্ষণ পরে সে ফিরেছিল?

মিনিট পাঁচেকের বেশি নয়।

 কেউ কি তাকে আমাশার ওষুধ দিতে চেয়েছিল তখন?

 শ্রুতি তাকাল। একটু পরে বলল, না তো!

কর্নেল চমনলালের দিকে তাকালেন। চমনলালজি! আপনি এঁটো পেপারকাপগুলো কুড়িয়ে আবর্জনার পাত্রে ফেলেছিলেন। আপনি আমাকে বলেছেন, আপনি দায়িত্বশীল নাগরিক। অন্যদের শিক্ষা দেবার জন্য

চমনলাল দ্রুত বললেন, আমি এসব কাজ করে থাকি।

কর্নেল মিঃ দুবেকে ইশারা করলেন। দুবের হাতে একটা ছোট্ট ব্যাগ ছিল। ব্যাগ খুলে রুমালে মোড়া অস্ত্রটা তিনি কর্নেলকে দিলেন। কর্নেল অস্ত্রটা বের করতেই লাউঞ্জে সকলের মধ্যে চমক খেলে গেল। কর্নেল বললেন, এটাই পিয়ালিকে হত্যার অস্ত্র। চমনলালজি! আপনি এটা প্রপাতের কাছে আবর্জনার পাত্রে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। তাই না?

হ্যাঁ। আমি চমকে উঠেছিলাম ওটা দেখে। তবে আমি দায়িত্বশীল নাগরিক।

আপনি দায়িত্বশীল নাগরিক, তা ঠিক। তাই আপনার কাছে আবার প্রশ্ন তুলছি, আপনি কি কাকেও এটা ফেলতে লক্ষ্য করেছিলেন? কিংবা কেউ কিছু গোপনে আবর্জনার পাত্রে ফেলে দিল বলে আপনার কি সন্দেহ হয়েছিল?

রজনী দেবী বলে উঠলেন, আপনার এ প্রশ্নের জবাব দিতে লাল বাধ্য নয়। আমাদের এখানে আসতে ভালো লাগে। যতদিন বাঁচব, ততদিন আসতে হবে। আমরা কোনও ঝুটঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চাই না। আমি লালকে খুব বকাবকি করেছি। সবকিছুতে ওর নাক গলানো অভ্যাস আছে। এটা মোটেও ভালো নয়।

চমনলালজি! আপনার কী বক্তব্য?

রজনী ঠিক বলেছে।

তার মানে, আপনি কাকেও এটা ফেলতে দেখেছিলেন।

 বৃদ্ধ ঐতিহাসিক মুখ নামিয়ে বললেন, সৎ এবং দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে যে কর্তব্যটুকু পালন করা উচিত, তা করেছি কর্নেল সরকার। এর বাইরে এক পা বাড়ানো আমার উচিত হবে না।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, ধন্যবাদ! এবার আমি আপনাদের একটা। জিনিস দেখাতে চাই। মিঃ দুবে!

 মিঃ দুবে নিঃশব্দে হেসে একপাটি লেডিজ স্লিপার বের করে দিলেন কর্নেলকে। বললেন, কর্নেল সরকার! ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলাদের জুতো দেখানোর জন্য আগে ক্ষমা চেয়ে নিন!

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। তবে জুতোটা গুরুত্বপূর্ণ। এটা পিয়ালি রায়ের জুতো। আপনারা বুঝতেই পারছেন, জুতোটা হত্যাস্থলেই পাওয়ার কথা এবং সেখানেই পাওয়া গেছে।

সোমক গম্ভীর কণ্ঠস্বরে বলল, কোথায় খুন করা হয়েছিল ওকে?

নদীর ওপারে। প্রপাতের নীচে যে জলাশয় আছে, তার একটা দিক একটু বেঁকে কোণ সৃষ্টি করেছে। সেখানেই জলের ধারে পাথরের ফাঁকে এটা পড়ে ছিল। হত্যাকারী পিয়ালিকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করে তার ডেডবডি জলে ফেলে দিয়েছিল। একপাটি জুতো খসে পড়াটা লক্ষ্য করেনি।

সুভদ্রা ঠাকুর কর্কশ কণ্ঠস্বরে বললেন, আমি ডেডবড়ি ফেলে দেওয়া দেখতে পেয়েছিলাম এপার থেকে। কিন্তু যে ফেলে দিচ্ছিল, তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। সে ছিল জঙ্গলের আড়ালে। জঙ্গলে প্রচুর লাল ফুল ফুটে ছিল। জিতেন্দ্রর আত্মা আমাকে তক্ষুনি বলল, একটা কিছু করো! তো সেই সময় কর্নেল সায়েবকে হেঁটে আসতে দেখলাম। তাই তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ফাদার পিয়ার্সনের পার্কে যে বেদিতে মেয়েটি এই ছেলেটির সঙ্গে বসে ছিল– নাহ্! আর কিছু বলব না। জিতেন্দ্রর আত্মা আমাকে নিষেধ করেছে। কারণ এখানে আমাকে–

কর্নেল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, এ একটা সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড! পিয়ালি রায় অনির্বাণবাবুকে ব্ল্যাকমেইল করত। তার কারণ একটু আগে আমি জানিয়েছি। অনির্বাণবাবুর কাজটা বেআইনি। জনসাধারণের আমানতের টাকা নিজের নামে মফঃস্বল শহরের একটা ব্যাঙ্কে জমা রাখার কথা জানাজানি হলে হইচই পড়ে যেত।

অনির্বাণ দ্রুত বলল, তেমন কিছু ঘটলে টাকাটা আমি আমার সংস্থার অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে দিতাম।

কর্নেল বললেন, এনিওয়ে! পিয়ালি এখানে একা আসতে সাহস পায়নি। তাই তার ফিয়াসে বিকাশ সেনকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু পিয়ালি বোকার মতো ফাঁদে পা দিল!

পায়েল বলল, ফাঁদ? বিকাশ বখরার লোভে তাকে মেরে ব্যাঙ্কের ডকুমেন্ট আত্মসাৎ করেছে!

না মিস ব্যানার্জি! সেই সুযোগ বিকাশ সেন পাননি। ডকুমেন্টের জেরক্স কপি পিয়ালির স্যুটকেসে পাওয়া গেছে। এনি ওয়ে! এবার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে আসা যাক। আমরা কুমকুম সিনহার কাছে জেনেছি অনির্বাণবাবু ধারিয়া ফলসে সবাইকে রেখে জিপ নিয়ে খাবার আনতে গিয়েছিলেন। তাই না?

অনির্বাণ বলল, হ্যাঁ। বলেছি তো সে কথা।

 কিন্তু ড্রাইভার রাম সিংয়ের আমাশা। তাই আপনি একা জিপ ড্রাইভ করে গিয়েছিলেন।

কিছু অন্যায় করিনি!

 দীপকবাবু! আপনি একজন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। তাই না?

 দীপক বলল, তাতে কী?

আপনার সঙ্গে নানারকম ওষুধ সবসময় রাখা অভ্যাস। বিশেষ করে বাইরে গেলে

দীপক কর্নেলের কথার ওপর বলল, অনির্বাণদা ড্রাইভারের আমাশার ওষুধ আছে কি না জিজ্ঞেস করছিলেন। আমি বললাম, আছে। কিন্তু–

কিন্তু অনির্বাণবাবু জোলাপের ওষুধই চেয়ে নিয়েছিলেন। তাই না?

 দীপক চমকে উঠল। বলল, হ্যাঁ।

এবার আসছি অন্য প্রসঙ্গে। পিয়ালির স্যুটকেসে কয়েকটা চিঠি পাওয়া। গেছে। সাম্প্রতিক একটা ইনল্যান্ড লেটারে কেউ তাকে ধারানগর এরিয়ায় হনিমুন লজে ডেকেছিল। চিঠির তলায় যে সইটা আছে, তা অস্পষ্ট। চিঠিতে এক লাখ টাকা নগদ দেওয়ার প্রস্তাব আছে। এটাই ফঁদ! পিয়ালি ওই বাগানে অপেক্ষা করছিল। তারপর সে দেখেছিল, যে তাকে টাকা দেবে সে আসছে না। এদিকে তার সঙ্গী বিকাশ সেন খুব ভোরে উঠে লনে দাঁড়িয়েছিলেন। তখন তাকে গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। জগদীশ এটা লক্ষ্য করেছিল। হুমকির পর বিকাশ প্রচণ্ড ভয় পেয়ে নিপাত্তা হয়ে যান। তিনি এমন সাংঘাতিক কিছু আশা করেননি। তিনি তা পুলিসকে বলেছেন। তিনি আড়াল থেকে লক্ষ্য রেখে বেড়াচ্ছিলেন। পিয়ালিকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তাছাড়া তিনি আমার পরিচয় জানতেন। আমাকে ফোনে জানিয়েছিলেন তার সঙ্গিনী খুন হয়েছে।

অনির্বাণ উঠে দাঁড়িয়ে ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, কী বলতে চান আপনি?

কর্নেল হাসলেন। বলতে চাই, ধারিয়া ফলসে গিয়ে সেখানেই ব্রেকফাস্ট করার কথা তুলে এবং রাম সিংকে বেশি ডোজের জোলাপের ওষুধ খাইয়ে আপনি একা জিপ নিয়ে পিয়ালির সঙ্গে বোঝাপড়া করতে এসেছিলেন। আপনি জিপ দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন হাইওয়ের মোড়ে। তারপর প্রাইভেট রোডে হেঁটে আসার সময় পিয়ালিকে সোমকবাবুর সঙ্গে দেখতে পান। নিশ্চয় তাকে ইশারায় ডেকেছিলেন আপনি। তারপর তাকে কথায় ভুলিয়ে জিপে তুলে ফলসের দিকে ফিরে যান এবং আগে থেকেই বেছে রাখা জায়গায় জিপ ডাইনের ঘাস জমিতে নামিয়ে পিয়ালির সঙ্গে বোঝাপড়ার ছলে লেকের কাছে নিয়ে যান। আচমকা তাকে গুলি করে জলে ফেলে দেন। তারপর ফের জিপ ঘুরিয়ে নিয়ে ধারানগরে খাবার আনতে যান। ফিরে গিয়ে একসময় অস্ত্রটা আবর্জনার পাত্রে ফেলে দেন। চমনলালজি! আপনি আর চুপ করে থাকবেন না। আপনি সৎ এবং দায়িত্বশীল নাগরিক!

চমনলাল বিব্রতভাবে বললেন, হ্যাঁ। আমার সন্দেহ হয়েছিল, ওভাবে লুকিয়ে মিঃ রুদ্র কী জিনিস আবর্জনার পাত্রে ফেললেন?

সুভদ্রা ঠাকুর চেঁচিয়ে উঠলেন, ওর গায়ে লাল শার্ট ছিল! ওই লোকটার গায়ে!

অনির্বাণ দাঁড়িয়েই ছিল। দুজন পুলিস অফিসার দুদিক থেকে তার দুটো হাত ধরে পেছনে টেনে হাতকড়া পরিয়ে দিলেন। লাউঞ্জে ভয়াবহ স্তব্ধতা। তারপর পায়েল ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

সোমক গর্জন করে বলল, শাট আপ!

বিশ্বাস করো সোমক! আমি এত সব জানতাম না। কল্পনাও করিনি। অনির্বাণ আমাকে যা বলেছিল, তা শুনে আমার সিম্প্যাথি জেগেছিল ওর ওপর। দ্যাটস অল!

শ্রুতি পায়েলের হাত ধরে টানল। পায়েলদি! প্লিজ ফরগেট ইট। অনির্বাণদাকে আমি তোমার চেয়ে বেশি জানি। আমার দাদার সঙ্গে একসময় বন্ধুতা ছিল ওর। হি ইজ এ ন্যাস্টি অ্যান্ড ফেরোশাস ম্যান!

মিঃ দুবে সদলবলে বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল সহাস্যে বললেন, চিয়ার আপ হনিমুনারস! নারমেশ পাণ্ডের জন্য কারও ভয়ের কারণ নেই। তার ড্রাইভারকে যে অতিরিক্ত জোলাপ খাইয়ে মেরে ফেলেছে, তার প্রতি উনি ভীষণ ক্রুদ্ধ। এবার তাকে আমি কথাটা জানানোর দায়িত্ব নিলাম। আপনারা নির্ভয়ে হনিমুন, পালন করুন। আর মিস ব্যানার্জি!

পায়েল কান্না চেপে বলল, আমি কলকাতা ফিরে যাব।

সুভদ্রা ঠাকুর উঠে এসে তার কাঁধে হাত রাখলেন। তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। আমি তোমায় ডাকিনীবিদ্যা শেখাব। এই বিদ্যার জোরে বদমাস পুরুষগুলোকে তুমি জব্দ করে রাখবে।

ম্যানেজার রঘুবীর সবিনয়ে বলল, আপনারা যদি দয়া করে ডিনার খেয়ে নেন, ভালো হয়।

কর্নেল দেখলেন, পায়েল সুভদ্রার টানে উঠে গেল। দুজনে ডাইনিংয়ে ঢুকে মুখোমুখি বসল। পায়েল ব্যানার্জি ধাক্কাটা সামলে নিয়েছে।

এবার আর অন্য কিছু নয়। নীলসারস দম্পতিকে ক্যামেরাবন্দী করার জন্য কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ঠাণ্ডা মাথায় প্ল্যান করবেন। তিনি চমনলাল দম্পতির সামনে গিয়ে বললেন, বসতে পারি এখানে?

দুজনে একগলায় বললেন, বসুন!