ইভনিং ভিলা – কর্নেল সমগ্র ৫ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
০১.
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বীতশোক পিছনে ঘুরল। একটু হেসে বলল, “তা হলে যা বলেছিলুম”।
কথাটা নীপার উদ্দেশে বলা। থামিয়ে দিল সোমনাথের উদাত্ত গলার ইংরিজি আবৃত্তি :
“And now we have come to the place,
Where, I toldst thee, thou shouldst see
The wretched men and women
Who have lost the good of their intellect….”
নীপা চটে গিয়ে বলল, “নাও! শুরু হল আঁতলামি।”
সোমনাথ বলল, “স্মৃতি থেকে বলা। ভুল হতেও পারে। দান্তের ইনফেনো। তো হাঃ! তুই ঠিকই বলেছিলি। আ স্ট্রেঞ্জ কাপল। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস বোস। টেরিফিক ডেকাডেন্স!”
ইঞ্জিন চাপা গরগর করছিল। সুমিত ফাঁসফেঁসে গলায় বলল, “চাকা গড়াবে না কি? অশোক, তোর বউয়ের ওজন মইরি দুশো কিলোগ্রাম। ওঃ। এইসব ধুমসি মহিলা কেন–সরি, অফুলি সরি ম্যাডাম! তুমি সানন্দে বসে থাকো। আমি রবি ঠাকুরের ‘দে দোল’ রিসাইট করি।”
ব্যাক সিটে পাঁচজন। নীপা, তার ডেনিস বন্ধু ক্রিস্নান (যাকে সবাই কৃষ্ণা বলে ডাকে), সোমনাথ, সুমিত এবং সুমিতের ঊরুর ওপর ঈশিতা। সামনে বীতশোকের বাঁপাশে বেঁটে গোলগাল নায়ার এবং শক্তসমর্থ গড়নের আরিফ খান। দুজনেরই ঠাসাঠাসি অবস্থা!
ঈশিতা হাসল। “আর দশ কিলোগ্রাম বাড়িয়ে দিই?” সে চাপ দিয়ে বলল, “রবিঠাকুর বাঁচান এবার!”
সুমিত আর্তনাদ করল, “মরে যাব! মরে যাব! মাইরি! নো রবিঠাকুর। দান্তে ইজ ওকে।”
সবাই হেসে উঠল। কিন্তু ক্রিস্নান বিব্রতভাবে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলল, “আমার চিন্তা হয়, যদি নীপা অল্প সামনে বসে, স্থান সংকুলান হবে।”
নায়ার গম্ভীর হয়ে বলল, “কৃষ্ণাকে আমি বাংলা ইউসেজ শেখাব। কৃষ্ণা, তুমি কি জানো আমি এদের মতো বাঙালি নই? কিন্তু এদের চেয়ে ভাল বাংলা জানি। কারণ আমি শান্তিনিকেতনে বাংলার ছাত্র ছিলাম।”
সোমনাথ গেয়ে উঠল, শান্তিনিকেতন আমাদের শান্তিনিকেতন। নীপা বাদে সবাই গলা মেলাল।
গাড়ির চাকা এতক্ষণে গড়াল। নীপার মনে হল, স্টার্ট দিয়ে থেমে বীতশোক কী যেন ভাবছিল। গাড়িটা পুরনো মডেলের অ্যাম্বাসাডর। কিন্তু পৌরাণিক বীরদের মতো স্থিতধী এবং দার্শনিকও। নীপার এইরকম মনে হয়। সে। সোমনাথের আঁতলামিকে ব্যঙ্গ করে। অথচ কোনও-কোনও সময়ে সে নিজের। চিন্তায় আঁতলামি লক্ষ্য করে।
আলোকিত মসৃণ রাস্তা থেকে সংকীর্ণ আঁধার রাস্তায় গাড়িটা পৌঁছুলে নীপা বোস-দম্পতির কথা ভাবতে থাকল। তাদের ঘরবাড়ি-জীবনযাপন তাকে মধ্যযুগের ইউরোপের ব্যারনদের কথা মনে পড়িয়ে দিয়েছে। আশ্চর্য সাদৃশ্য! ব্যারন ব্যারনেস। আর ওই অন্ধ ভদ্রলোক! বোস-সায়েবের কাকা না জ্যাঠা, নাকি দাদা? মনে পড়ছে না নীপার। বাগানে প্রতিমূর্তির মতো এখনও হয়তো দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে একটা মোটা ছড়ি। অন্ধজনেদের হাতের ছড়ি সম্ভবত কীটপতঙ্গের গুঁড়ের কাজটা করে। তীক্ষ্ণ বোধসম্পন্ন একটা ইন্দ্রিয়–ওই ছড়িটা। তখন গেটের দিকে আসতে আসতে নীপা কথাটা সোমনাথের কাছে পেড়েছিল। শোনার পর সোমনাথের শ্বাসাঘাত পীড়িত ছন্দে ট্রেডমার্ক মন্তব্য, “তো–হ্যাঁ! চোখ ১৮০ ডিগ্রি দেখতে পায় মেরেকেটে। ওই শুড়, আই মিন ছড়ি, পুরোটাই। হ্যাঁ! দা হোল পারস্পেকটিভ। বোধ নীপা, ল্যাংগুয়েজ নয়, বোধই মূল ব্যাপার।”
গানের হল্লায় নীপা আবার চটে গেল। “কী হচ্ছে সব?”
গান থামল। নায়ার বলল, “তোমরা বাঙালিরা কী হারাচ্ছ জানো না। গুরুদেব কী দিয়ে গেছেন, বুঝতে আরও একশো বছর লাগবে। কৃষ্ণা, তুমি তো শান্তিনিকেতনে গেছ?”
ক্রিস্নান বলল, “হ্যাঁ। আইম বালিকা হলে সুবিধা নিতাম। নায়ার, তুমি সৌভাগ্যবান।”
নায়ার আরিফের কাঁধে হাত রেখে বলল, “ছাপরা জেলার এই বালকটিও। একবার এর খাটের তলায় ভূত হয়ে ঢুকেছিলাম জানো? জাস্ট আ সর্ট অব র্যাগিং! আরিফ কলমা পড়তে শুরু করল।”
“কলমা?” ক্রিস্নান বলল। “কলমা কার রচনা? কবিতা কিংবা সংস্কৃত শ্লোক?”,
আবার সবাই হেসে উঠল। নীপা বাদে। আরিফ বলল, “এই এর্নাকুলামের ভূতটাকে নিয়ে পারা যায় না!”
সুমিত হাঁসফাঁস করে বলল, “দক্ষিণীটাকে এক্ষুণি অ্যারেস্ট করছ না কেন খান সায়েব? তুমি তো পুলিশের এক বড়কর্তা, ভাই!”
বীতশোক বলল, “তাতে আমার একটা সুবিধা হবে অবশ্য।”
নায়ার ফিক করে হাসল। “হ্যাঁ, বউকে তুমি পাশে পাবে।”
ঈশিতা বলল, “পাওয়াচ্ছি!”
সুমিত আর্তনাদ করল, “উ হু হু হু! গেছি, গেছি! আরও দশ কেজি চাপল রে বাবা!”
গাড়িটা যে আস্তে চলছিল, সেটা এতক্ষণে আবিষ্কার করল নীপা। বীতশোক মাঝে মাঝে কেমন যেন অন্যমনস্ক। নাকি নীপারই মনের ভুল? একজন ঝানু কোম্পানি-একজিকিউটিভ। পাবলিক রিলেশনস ম্যানেজার-পদে সদ্য বসেছে। বীতশোকের চেহারায় সেই আলো-আঁধারি ভাবটা স্পষ্ট। কখনও চপল, কখনও গম্ভীর। ব্যক্তিত্বে রহস্য না থাকলে একজিকিউটিভ হওয়া যায় না হয় তো।
হঠাৎ সোমনাথ চেঁচিয়ে উঠল, “রোখকে! রোখকে! জাস্ট আ মিনিট।”
গাড়ি থেমে গেল। সোমনাথ ডানদিকে বসেছিল। দরজা খুলে ছিটকে নামল। ক্রিস্নান ছটফটিয়ে বলল, “কী ঘটনা সোমনাথ?”
“সিগারেটের প্যাকেট।” বলে সোমনাথ লম্বা পায়ে হাঁটতে থাকল।
নীপা বলল, “কোনও মানে হয়?”
সুমিত বলল, “হয়। নীপু প্লি-ই-জ! আমাকে মাল খালাসে সাহায্য করো। সরি, অফুলি সরি ঈশু! লক্ষ্মী মেয়ে!”
ক্রিস্নানের তাড়ায় নীপা সোমনাথের শূন্যস্থান পূরণ করল। ঈশিতা শেষ চাপ দিয়ে সুমিতের ঊরু থেকে পাশে নামল। সুমিত ‘আহ্’ বলে উইন্ডো দিয়ে মুখ বের করল। শ্বশ-প্রশ্বাস নেওয়ার কপট ভঙ্গি।
নায়ার চোখে ঝিলিক তুলে বলল, “লেট আস স্টার্ট বীতশোক! আমরা কাট করি। হেভি ফান হবে!” সে বীতশোকের কঁধ খামচে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল।
বীতশোক গুম হয়ে বলল, “বুঝি না, সোমনাথ তো চারমিনার খায়। তার জন্য–
ঈশিতা হাসতে হাসতে বলল, “ইভলিং ভিলায় ওকে ঢুকতে দেবে না। জাস্ট লাইক আ ফোর্ট, তাই না নীপু?”
নীপা রাগ করে বলল, “অশোকদা! ও হেঁটে ফিরবে। চলো! আমার মাথা ধরেছে।”
সুমিত বলল, “আর আমার অবস্থা ক্লান্ত বলদের মতো। ঈশু! এগেন আইম সরি। অফুলি সরি!”
ঈশিতা কপট চোখ পাকিয়ে বলল, “দাড়ি ছিঁড়ে ফেলব সুমিত! সব সময় খালি সেক্সসিম্বল!’
“প্রব্লেম হল ঈশু, তুমি রিয়ালি আ বিট সেক্সি–সরি!” বলে সুমিত পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। সুমিত জানে, সেক্স-সংক্রান্ত তার কথাবার্তা অতি-ব্যবহারে এত জীর্ণ যে কেউ ওসবে আর কান করে না।
নায়ার আবার খোঁচাল বীতশোককে। “চলো! চলো! সোমনাথের সাহস পরীক্ষার এমন চান্স আর পাওয়া যাবে না।”
আরিফ বলল, “সোমনাথ খুব সাহসী। আমি যখন বর্ধমানের গুসকরা এরিয়ায় ছিলাম, কঁকসার জঙ্গলের নাম শুনে থাকবে, একটা নকশাল বেস ছিল জঙ্গলে। অ্যান্ড লেটার আই ডিসকভারডগেস ইট!”
সে হাসতে লাগল। সুমিত চোখ বড় করে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। তখন সোমনাথ আ ব্লাইন্ড ওয়াইল্ড হর্স। মাইরি! সোমনাথকে দেখলে ভাবা যায় না–”
নীপা খাপ্পা হয়ে বলল, “স্টপ ইট! অশোকদা, চলো! ও একটু শাস্তি পাক।”
নায়ার ষড়যন্ত্রসংকুল স্বরে বলল, “কুইক বীতশোক! কুইক!”
সুমিত উইন্ডোতে মুখ বের করে পিছনের দিকটা দেখে নিয়ে বলল, “যেতে দশ আসতে দশ, মোট বিশ মিনিট। এখান থেকে আমাদের বাংলোর দূরত্ব কত হে খানসায়েব?”
আরিফ বলল, “জাস্ট ওয়ান কিলোমিটার।”
“তা হলে চল্ বীতশোক! সোমনাথ একটু অ্যাডভেঞ্চার করুক!”
“হ্যাঁ, ওই তো চাঁদ-টাদ আছে। জ্যোৎস্না-ট্যোৎস্না আছে। ওই কালো কালো জিনিসগুলো নিশ্চয়ই জঙ্গল। বাঘ-ভালুকও নিশ্চয় আছে।”
ক্রিস্নান গাড়ির ভেতর আবছা আঁধারে নীপার মুখের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, “তোমরা যাও। আমি এবং নীপা এখানে অপেক্ষা করি। নীপা, এ বিষয়ে তোমার মত কী?”
নীপা আস্তে বলল, “এটা স্রেফ আঁতলামি ছাড়া কিছু নয়–এই সিগারেটের প্যাকেট ফেলে এসে এভাবে আনতে যাওয়া। জাস্ট আ শো বিজনেস! অশোকদা, চলো!”
বীতশোক একটু হেসে গিয়ার ঠিক করে নিল। তারপর গাড়িটার গতি বেড়ে গেল। হেডলাইটে দেখা যাচ্ছিল রাস্তা কিছুটা এবড়োখেবড়ো হয়ে আছে কোনও কোনও জায়গায়। একটু পরে উতরাই শুরু হল। নীপা সুমিতের কথাটা ভাবছিল, আ ব্লাইন্ড হর্স! অন্ধ বুনোঘোড়া। কিন্তু ব্লাইন্ড শব্দের অনুষঙ্গে আবার ইভনিং ভিলার বাগানে দেখে আসা প্রতিমূর্তির মতো স্থির অন্ধ সেই ভদ্রলোক ভেসে এসেছেন। হাতে কালো একটা ছড়ি। মুখে একরাশ কাঁচাপাকা দাড়ি। মাথায় এলোমেলো চুল। চোখে কালো চশমা। চেহারা ও পোশাক ক্যামোফ্লাজের উপযোগী।
নীপা ডাকল, “আচ্ছা অশোকদা!”
বীতশোক আনমনে বলল, “উ।”
“ওই অন্ধ ভদ্রলোক বোসসায়েবের কে যেন?”
বীতশোক একবার ঘুরে নীপাকে দেখে নিল। তারপর বলল, “দূর সম্পর্কের শ্যালক।”
আরিফ বলল, “সর্বেশ রায় মিসেস বোসেরই দাদা। কাজিন ব্রাদার। এরিয়ার লোকে ওঁকে ‘আমেরিকান সাব’ বলে। জাস্ট আ ফান! ওদিকে একটা জায়গায় সেকেন্ড গ্রেটওয়ারের সময় আমেরিকান মিলিটারি বেস ছিল। মিঃ রায় ছিলেন সেখানকার কনট্রাক্টর। ক্যান্টিনে ফুডমেটিরিয়্যালস সাপ্লাই করতেন। একটু বদনামও আছে। এখানে মহিলারা আছেন। তাই এবার আমার চুপ করাই উচিত।”
ঈশিতা বলল, “তুমি বড্ড ন্যাকা আরিফ।”
আরিফ খান হাসছিল। বলল, “তোমার চেয়ে?”
ঈশিতা চোখে হেসে আস্তে বলল, “আমার এক আত্মীয়ও শুনেছি অ্যামেরিকান সোলজারদের মেয়ে সাপ্লাই করে বড়লোক হয়েছিলেন।”
নীপা বলল, “ভদ্রলোকের বয়স কত তাহলে?”
আরিফ বলল, “অ্যাবাভ সেভেনটি, আই থিং।”
“ওঁকে দেখে তো মনে হয় না!” নীপা আলতো হাতে চুল গুছিয়ে নিয়ে বলল, “উনি অন্ধ হলেন কী করে জানে আরিফদা?”
“শুনেছি ডাকাতরা নাকি ওঁকে অন্ধ করে দিয়েছিল।” আরিফ বলল। “পুলিশ রেকর্ড ঘাঁটলে আমি তোমাকে সিওর করতে পারি। আর য়ু ইন্টারেস্টেড নীপা?”
তার কথায় দুষ্টুমি ছিল। নীপা আনমনা ভঙ্গিতে বলল, “ইন্টারেস্টিং ম্যান। মানে, ওইভাবে ছড়ি হাতে বাগানে দাঁড়িয়ে থাকা, একেবারে চুপচাপ–গাছের মতো! হঠাৎ আলাদা করে চেনা যায় না। ক্যামোফ্লাজ!”
নায়ার মন্তব্য করল, “মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি।”
সুমিত বলল, “খেয়েছে রে! কিছুক্ষণ আগে বাঙালি-বাঙালি করছিল। শালুক চিনেছে গোপালঠাকুর! কী বাংলা শিখেছে মাইরি! মানসিক আঘাত-প্রাপ্ত ব্যক্তি!”
ক্রিস্নান আস্তে মাতৃভাষায় কী একটা শব্দ উচ্চারণ করল। ঈশিতা বলল, “কৃষ্ণা! বাংলায় বলো!”
ক্রিস্নান বিব্রত মুখে বলল, “ও কিছু না। আমি নীপার কথা ভাবছিলাম। নীপার যা চিন্তা হয়েছে, আমারও তা হয়েছে। ভদ্রলোকের ভিতরে কিছু গুরুতর বিষয় আছে। গম্ভীর কোনও বেদনা।
সুমিত জোরে হেসে উঠল। “চালিয়ে যাও, চালিয়ে যাও! জয় বাংলা! জয় বাংলা!”
নায়ার হেঁড়ে গলায় গান ধরল, আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালবাসি-ই-ই’..
ডাকবাংলোর লনে গাড়ি ঢুকছিল। কাছিমের খোলের মতো উঁচু জমিতে এই দোতলা টালির চালের বাংলো। চারদিকে বিস্তৃত ঢালু সুদৃশ্য লন। ফুল, ক্যাক্টি এবং নানারকম সুন্দর উদ্ভিদে সাজানো। বিদ্যুৎ আছে। জমিটার নীচে বৃত্তাকারে জঙ্গল কালো হয়ে ঘিরেছে। এখান থেকে হাথিয়াগড় টাউনশিপের আলো দেখা যায় দূরে। আরও দূরে কলকারখানার ব্লাস্টফার্নেসের আগুনের হল্কা আকাশের জ্যোৎস্না চাটছে। গাড়ি থেকে নেমে নীপা ও ক্রিস্নান হাঁটতে হাঁটতে গেটের কাছে ফিরল। আসলে নীপাকে অনুসরণ করেছে ক্রিস্নান।
সুমিত লনে দাঁড়িয়ে আবার সিগারেট ধরিয়ে চাঁদটাকে দেখতে থাকল। নায়ার, আরিফ ও বীতশোক বারান্দায় গিয়ে বসল। ঈশিতা কী করবে ভেবে না পেয়ে সুমিতের কাছে এসে ডাকল, “এই ভারবাহী চতুস্পদ!”
সুমিত বলল, “বিলিভ মি ঈশু! আমার দুই জাংয়ে জ্যাম ধরে গেছে। বউ থাকলে ডলে দিতে বলতুম।”
“একটা সিগারেট দাও, টানি!”
ঈশিতা মাঝে মাঝে সিগারেট টানে। সুমিত সিগারেট দিল। লাইটার জ্বেলে ধরিয়ে দিল। তারপর বলল, “সোমনাথটা কী মাইরি! ওর চারমিনারের প্যাকেটে যদি সিগারেট থাকেও, বড়জোর একটা বা দুটো। তার জন্য এমনভাবে দৌডুল, অবিশ্বাস্য!”
ঈশিতা গলার ভেতর বলল, “মিসেস বোসের সঙ্গে প্রেম করতে গেল।”
“যাঃ! তুমি মাইরি”
“মাইরি-টাইরি ছাড়ো তো! গেঁয়ো ভূতের মতো সব কথাতেই–” ঈশিতা সিগারেটের ধোঁয়া ইচ্ছে করেই সুমিতের মুখের দিকে ছাড়ল। “বাট শি ইজ অ্যাট্রাকটিভ–মিসেস বোস। পার্শি মেয়েদের মতো গড়ন। আর তুমি তো সর্বত্র। সেক্সসিম্বল ছড়িয়ে বেড়াও। ভদ্রমহিলা সম্পর্কে একটা উপযুক্ত সিম্বল ছাড়ো, শুনি!”
“তুমি ফেমিনিস্টের ভান করো, ঈশু! কিন্তু তুমি সর্বাঙ্গে রমণী।” সুমিত চাঁদটার দিকে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু মিসেস বোস খাঁটি ফেমিনিস্ট। তোমার দিকে সারাক্ষণ কেমন চোখে তাকাচ্ছিলেন–ঈশু, শি ইজ লেসবিয়ান।”
ঈশিতা হাসল। “লেসবিয়ানের চোখে নীপু ইজ অলরাইট। চয়েসেবল পার্টনার। কিন্তু মাইন্ড দ্যাট, ফেমিনিজমের সঙ্গে লেসবিয়ানিজমের একটুও সম্পর্ক নেই।”
সুমিত ভারিক্কি চালে বলল, “জানি রে বাবা, জানি। তুমি সেদিনকার কচি খুকি। একটু গায়ে-গতরে হয়েছে, এই যা। তবে তোমার ওজনের সেভেনটি ফাইভ পার্সেন্ট বীতশোকের চর্বি। মাইরি! ছেলেটা কী রোগা হয়ে গেল দেখতে দেখতে। ঈশু, তুমি সেই রূপকথার মোহিনী রাক্ষুসি–সরি! মেরো না!”
দুহাত তফাতে সরে গেল সুমিত। ঈশিতা হাত তুলেছিল। বলল, “কাল ইভনিং ভিলায় ককটেল-ডিনারের নেমন্তন্ন। আমি মিসেস বোসকে সোজা জানিয়ে দেব, তুমি ওঁকে লেসবিয়ান বলেছ। তুমি জানো, আই ক্যান ডু দ্যাট।”
“কালকের পার্টিতে আমি যাচ্ছি না।” সুমিত আস্তে বলল। “ওইসব ইডিওটিক ব্যাপার আমার একটুও ভাল্লাগে না। হুঁ! এলুম আলাদা করে একটু প্রকৃতি ট্রকৃতির মধ্যে ফুর্তি মারতে। এসে দেখি, তোমার হাজব্যান্ড এখানেও পাবলিক রিলেশন লাগিয়ে বসে আছে।”
“মিঃ বোস ওদের কোম্পানির পার্টনার জানো না তুমি?”
“তাই বুঝি?” সুমিত একটু অবাক হল। “আই সি! তাই আমার খটকা লাগছিল ককটেল ডিনার দেবেন বোসসায়েব, অথচ অশোকের সঙ্গে নামের তালিকা নিয়ে কলসাল্ট করছেন কেন?”
“তুমি সবকিছু দেরিতে বোঝমাইরি!”
“ভেংচি কাটা হচ্ছে? ওক্কে! তুমি পরস্ত্রী। কাজেই ক্ষমা করে দিলুম। দেখ ঈশু, তুমি যতক্ষণ আমার কোলে বসে থেকেছ, ততক্ষণ কিন্তু ঠিক এই : অ্যাটিচিউড মানে, মনে-মনে বেম্মচারী হয়ে হিমালয়ের মাথায় বসেছিলুম। এখন কিন্তু ওঠানামা করছি।” সুমিত অভিনেতার ভঙ্গিতে বলল। “এই জ্যোৎস্না। এই প্রকৃতি। এই রমণী! এই পুরুষ! আমি শালা এক চণ্ডীদাস।”
ঈশিতা আস্তে বলল, “তুমি সত্যিকার এক ভারবাহী চতুষ্পদ!”
বলে চলে গেল গেটের দিকে নীপাদের কাছে। সুমিত হাসতে হাসতে বারান্দার দিকে গেল।
তখন আরিফ খান সবে তার কিটব্যাগ থেকে স্কচের বোতল বের করেছে। অ্যাংলো কেয়ারটেকার ম্যাথু কিচেনের ফ্রিজ থেকে কয়েকটা সোডার বোতল আর গ্লাস রেখে গেল। আরিফের জিপে বিকেলে আসা দুজন সাদা পোশাকের পুলিশ কিচেনের ভেতর বসে চা খাচ্ছে আর চাপাস্বরে কথা বলছে। ইভনিং ভিলায় যাওয়ার সময় আরিফ তার জিপ এবং সঙ্গীদের রেখে গিয়েছিল।
সুমিত বেতের চেয়ারে বসে বলল, “মহিলারাই সবচেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক। বুঝলি অশোক বীতশোক? সরি! নীপর দেখাদেখি আমারও অশোক এসে যাচ্ছে। হ্যাঁ রে, সোমনাথটার জন্য একটু অপেক্ষা করা উচিত ছিল না? আঁতেল লোক। আঁতে ঘা লাগবে।”
নায়ার বলল, “মহিলারা বেশি সাম্প্রদায়িক মানে?”
“দেখতেই পাচ্ছ। তিনজনেই আলাদা দল বেঁধে গেটের কাছে চক্রান্ত করছে।”
“বিচ্ছিন্নতাবাদী!” নায়ার হাসতে লাগল। “তবে এমুহূর্তে আমি চাই ওরা বিচ্ছিন্নতাবাদী থাক। কারণ মহিলাদের সামনে আমার ড্রিংক করতে বাধে।”
আরিফ বলল, “বোতল শেষ করার আগে ওরা এসে যাবে।”
“তারও আগে আমার ড্রিংক শেষ।” নায়ার চোখ নাচিয়ে বলল। “তুমি জানো, আমি মাত্র পেগটাক খাই। আমি অল্পেই তুষ্ট।”
“শান্তিনিকেতন লাইফে তা অবশ্য দেখেছি। সাঁইত্রিশটি মেয়ের সঙ্গে অল্প অল্প প্রেমের রেকর্ড কম কথা নয়।”
আরিফের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে সুমিত বলল, “এই ফো ভুড়িওয়ালা দক্ষিণী! মাই গড়!”
নায়ার সোজা হয়ে বসে বলল, “তাদের একজনও বাঙালি নয়, বিলিভ মি।”
বীতশোক বলল, “বাঙালি নয় কেন?”
তার মুখে ও কণ্ঠস্বরে অন্যমনস্কতা ছিল। নায়ার বলল, “থাকলেও কি বলা যাবে? সুমিত আমাকে মারবে। আমার সন্দেহ, ও ‘আমরা বাঙালি’ করে।”
আরিফ গেটের দিকে তাকিয়ে বলল, “কাজটা ঠিক হয়নি। বরং জিপ পাঠিয়ে দিই। রাস্তায় সোমনাথকে পিক আপ করবে। আজকাল হাথিয়াগড়ের। আশেপাশে ছিনতাই হয়। অবশ্য সোমনাথকে তেমন রইস আদমি মনে হবে না। তাদের। তারা তোক চেনে।” বলে সে ঘড়ি দেখল।
নায়ার বলল, “গান গাইতে গাইতে কিংবাকী সব যেন আলোচনা করছিল নীপার সঙ্গে, স্ট্রাকচারালিজম, সেমিওটিকস্–সেই সব ভাবতে ভাবতে আসছে আমাদের প্রিয় বুদ্ধিজীবী সোমনাথ।”
সুমিত গেটের দিকে তাকিয়ে ছিল। বলল, “এল মনে হচ্ছে। মাইরি। দেখ, দেখ, মহিলারা যেন ফুলের মালা দিয়ে বরণ করার মতো তৈরি!” সে হেলান দিল হতাশ ভঙ্গিতে। দিয়েই হঠাৎ সোজা হল। “যা বাব্বা! এ আবার কে? পাদ্রিবাবা নাকি? এদিকে আমরা তো মাল খুলে বসে আছি। ছ্যা ছ্যা ছ্যা ছ্যা! মাতাল ভেবে সুসমাচার শোনাতে আসবে না তো?”
আরিফ দেখছিল। তারপর উঠে দাঁড়াল এবং ধাপ বেয়ে নীচে গেল। “হ্যালো ওল্ড বস!” সে চেঁচিয়ে উঠে হাত বাড়াল। “আ সারপ্রাইজ ভিজিট ইনডিড!”
আগন্তুক জোরালো হ্যান্ডশেক করে বললেন, “বিকেলে পৌঁছে ম্যাথুকে জিজ্ঞেস করছিলুম জিপে কে এসেছে। জেনে খুশি হয়েছিলুম। আশা করি, তেমন কিছু ঘটেনি ডার্লিং?”
আরিফ পা বাড়িয়ে বলল, “আমিও আশা করছি তেমন কিছু ঘটেনি, যে জন্য আপনাকে হাথিয়াগড়ে ছুটে আসতে হয়েছে?”
আগন্তুক হো হো করে হাসলেন। “না, না! তুমি তো জানো বসন্তকাল আসন্ন এবং–”
“হ্যাঁ। অর্কিড এবং রেয়ারস্পিসিজ বাটারফ্লাই এটসেট্রা। আসুন। আলাপ করিয়ে দিই আমার কলকাতার বন্ধুদের সঙ্গে। বীতশোক ব্যান্যার্জি… সুমিত চৌধুরী…কে টি নায়ার! ইনি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।”
কর্নেল টুপি খুলে বিলিতি ভঙ্গিতে বাও করলেন। টাকে আলো পড়ে ঝকঝকিয়ে উঠল।
বীতশোক বলল, “আই থিংক, দা নেম ইজ ওয়েলনোন…মাই গুডনেস! আপনিই সেই বিখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ কর্নেল সায়েব?”
কর্নেল জিভ কেটে মাথা নেড়ে বললেন, “দ্যাটস আ ননসেন্স জোক মিঃ ব্যানার্জি। র্যাদার, কথাটা একটা গালাগাল। ইউ নো দা টার্ম টিকটিকি। যাই হোক, এনজয় অ্যান্ড হ্যাভ আ গুডটাইম! আরিফ! আবার দেখা হবে।”
কর্নেল লবিতে ঢুকে গেলেন। তারপর সিঁড়ির কর্পেটে চাপা শব্দ শোনা যেতে থাকল। শব্দটা থেমে গেলে সুমিত চোখ নাচিয়ে চাপা স্বরে বলল, “বুড়োটা হোমো’ নাকি রে? আরিফকে ডার্লিং বলছিল। সর্বনাশ!”
আরিফ বলল, “সবকিছুতে তোমার সেক্সয়াল টার্ম চাপানো অভ্যাস হয়ে গেছে সুমিত। ঈশিতা ইজ রাইট। তোমার শিগগির বিয়ে করা উচিত।”
নায়ার বলল, “বীতশোক, তুই প্রাইভেট ডিটেকটিভ বললি। আরিফ, তুই ওল্ড বস বলছিলি। প্রমোদ-পর্যটনে এসে এ কার পাল্লায় পড়লাম রে?”
সুমিত বলল, “অ্যাট আ গ্ল্যান্স ভেবেছিলুম পাদ্রিবাবা। মুখে সাদা সাদা দাড়ি আর চেহারা দেখে। পরে দেখি, জ্যাকেট আর পেণ্টল সাফারি বুট। গলায় ঝুলছে বাইনোকুলার, ক্যামেরা। পিঠের কিটব্যাগে ছাতার বাঁট উঁকি মেরে আছে।”
‘ আরিফ বলল, “প্রজাপতি ধরা নেটের হ্যান্ড!” “এনিওয়ে মাথায় আবার ইয়া বড় টাক। টাক না থাকলে সান্তা ক্লস।” সুমিত হাসল। “মাইরি! এখানে এসে কতরকম এক্সপিরিয়েন্স হচ্ছে।”
নায়ার বলল, “আবার ডার্লিং বলল পুলিশ অফিসারকে!” সে ফিক করে হেসেই হাসি ঢাকতে মুখে হাত চাপা দিল। “আরিফ! কৈ, ঢা। নিজের স্বাস্থ্য পান করি। ছেলেবেলায় একবার বাড়ি থেকে পালিয়ে এক হোমোর পাল্লায় উঃ! সে বলে কী, আমার সঙ্গে না যাবে তো বন্ধু হবে কী করে?”
সুমিত বলল, “বুড়ো আমাকে যদি ডার্লিং বলতে আসে, আমি মাইরি ওকে ছুঁড়ে নদীতে ফেলে দেব।”
“কর্নেল তোমার মতো দশজন সুমিত চৌধুরীকে ছুঁড়ে ফেলতে পারেন। ওঁকে চেনো না।” বলে আরিফ ছিপি খুলে একটু স্কচ ঢেলে নায়ারকে গ্লাসটা দিল। ফের ঘড়ি দেখে বলল, “নাহ! জিপ পাঠাই। এতক্ষণ চলে আসা উচিত ছি সোমনাথের।”
বীতশোক ভুরু কুঁচকে কিছু ভাবছিল। গেটের দিকে ঘুরে বলল, “এসে গেছে।”
সুমিত ও নায়ার একসঙ্গে বলল, “কাম অন ডার্লিং!”
দৃশ্যটা একটু অদ্ভুত বলা চলে। সোমনাথ কেমন এলোমেলো পা ফেলে দ্রুত হেঁটে আসছে। চোখের চাউনি অস্বাভাবিক জ্বলজ্বলে। তার সঙ্গ ধরতে পারছে না নীপা, ক্রিস্নান, ঈশিতা। তাদেরও ভীষণ অবাক আর চঞ্চল দেখাচ্ছে।
সোমনাথ বারান্দায় উঠে একটা খালি চেয়ারে ধপাস করে বসে বলল, “তো হাঃ। এই একটা ব্যাপার। একটা বোধ। গেট খোলাই ছিল। লোকজন না। কী বলব ওটাকে? হাঃ! হলঘর। যেখানে আমরা ঢুকেছিলুম। দরজা খোলা। সামথিং অড! তো আমি ডাকলুম। অবশ্যি ভদ্রতা সহকারে–গলার স্বর যতটা সম্ভব সিভিলাইজড করা যায়, সেভাবে। হল ঘরে আলো নেই, অথচ দরজা খোলা। অড! তো আমার চারমিনার একটা পয়েন্ট। ঢুকে পড়লুম। দেশলাইটাও ফেলে গিয়েছি টেবিলে। সেই সোফা-টেবিল। ডাইনে পাঁচ-ছটা স্টেপ দূরত্ব আমার হিসেব। তোহাঃ! টেবিলটা পেলুম। হাতড়ে সিগারেট দেশলাই অ্যাজ ইট ইজ পেলুম। তারপরই শব্দটা হল। খুব কাছে। কিছু ভারী জিনিস পড়ে যাওয়ার শব্দ। সেই বোধ! আমার মনে হল, আর এখানে থাকা উচিত নয়। বেরিয়ে এলুম। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে সিগরেট-দেশলাই আমার হাতেই ছিল কারণ ওটা আমার অ্যালিবাই। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে হা! একটা সিগারেট খাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্যাকেট আর দেশলাই, এবং আমার ডান হাতের আঙুলে রক্ত। এই যে! লুক! টাটকা রক্ত। আমি এবার জল খাব।”
শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ করে সবাই শুনছিল। রক্ত দেখার পর নড়াচড়া শুরু হল। আরিফ উঠে দাঁড়িয়ে ডাকল, “রামভক্ত! গিরিধারী! জিপকি পাস চলো।”
আরিফ তার জিপে গিয়ে উঠল। ক্রিস্নান ব্যস্তভাবে একগ্লাস জল নিয়ে এল। বীতশোক বলল, “আমি আসছি।”
আরিফের জিপের পেছনে বীতশোকের গাড়ি বেরিয়ে গেল। বারান্দায় সবাই চুপ। ক্রিস্নান আস্তে বলল, “রক্ত না হতেও পারে। কোনও তরল রঙিন পদার্থ হতেও পারে। প্রসাধন সামগ্রী!”
সোমনাথ জল খেয়ে গ্লাস রাখল। নীপা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, “হাত ধুয়ে আসছ না কেন?”
সোমনাথ উঠল, “তো হাঃ! লাতিন কবি ওভিদের ‘ফাস্তি’। আমি লাতিন জানি না। কিন্তু লাইন দুটো মুখস্থ করেছিলুম। হায়! যারা ভাবে, হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ নদীর জলে ধুয়ে যাবে, তারা কী হতভাগ্য! সারা পথ লাইন দুটো মন্ত্রের মতো আবৃত্তি করেছি। হাঃ, এটা একটা পয়েন্ট।
‘Oh! faciles numium qui tristia crimina.
Cacdis flumina: tolli posse putatis aqua?”.
সবাই বেতের সাদা টেবিলে রাখা রক্তমাখা হলুদ রঙের সিগারেট প্যাকেট আর দেশলাইটা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে দেখছিল। সত্যিই কি রক্ত?…
.
০২.
পূর্বমুখী এই সরকারি ডাকবাংলোটির গড়ন বিলিতি কান্ট্রিহাউসের মতো। দোতলা এবং রঙিন টালির ঢালু কয়েকটি তিনকোনা জ্যামিতিক ছাঁদের চাল আছে। আসলে বাড়িটি ছিল কোনও এক স্টিফেন সায়েবের। স্বাধীনতার পর সরকার নিয়ে নেন। পুরনো বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেই একে একালীন করা হয়েছে। চওড়া ড্রয়িং রুম দু’ভাগ করে ডাইনিং এবং লবি হয়েছে। পুরনো ফায়ারপ্লেস পড়েছে লবি অংশে। ফায়ারপ্লেসের চিমনি চাল ফুঁড়ে বেরিয়ে আছে আগের মতোই এবং শীতের সময় আমলারা এলে ফায়ারপ্লেসে আগুনও জ্বলে। অথচ এয়ারকন্ডিশনের ব্যবস্থা আছে। লবির ভেতর থেকে সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। সেই সিঁড়ি কাঠের এবং ঘোরালো। সিঁড়িতে নারকোল-ছোবড়ার রঙচঙে কাপেট আছে। একই কার্পেট সব ঘরের মেঝেতেও। দোতলার মেঝেও কাঠের।
পুব-দক্ষিণ কোনার ঘরে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার টেবিলবাতি জ্বেলে একটা চিঠি পড়ছিলেন। হরফগুলোর ওপর আতস কাঁচ রেখে খুঁটিয়ে দেখছিলেন। হাতের লেখা থেকে লোক চেনা যায়। তবে খানিকটা। সবটা নয়। তা বিশেষজ্ঞরা যতই দাবি করুন না কেন। কর্নেল ভাবছিলেন। বয়স্ক এবং বিচক্ষণ মানুষ বলেই মনে হয়। কিন্তু
এই চিঠিটি লেখা হয়েছে ২৩ মার্চ। আজকাল ডাকদফতরে কী একটা ঘটেছে। কর্মীদের অসন্তোষ? সম্ভবত। কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ধরিয়ে তাকিয়ে রইলেন চিঠিটার দিকে। আজ ৩০ মার্চ। সম্বোধনহীন চিঠি। নোটবই বা ডায়রির লাইনটানা পাতা ছিঁড়ে লেখা।
‘হাথিয়াগড়ের ইভনিং ভিলায় আগামী ৩১ মার্চ ককটেলডিনার পার্টিতে একজনের প্রাণ যাবে।’
তলায় কোনও নামও নেই। হরফগুলো আঁকাবাঁকা আর বড়। তাড়াহুড়ো করে লেখা। খামে কর্নেলের নাম-ঠিকানাও একই হাতের লেখা। খামের মুখে আঠার ছাপ থাকে, আঠা থাকে না। মুখটা কোনওরকমে আটকানো ছিল শুধু।
কিন্তু এটা চ্যালেঞ্জ, না অনুরোধ? কিছু বলা যায় না। আতস কাঁচের সাহায্যে একটা ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়েছেন। লেখক লেখাপড়া জানা লোক। কিন্তু লেখালিখিতে তত অভ্যস্ত নয়। আপাতদৃষ্টে নিছক সাক্ষর লোকের হস্তাক্ষর, অথচ ভাষা এবং বাক্যগঠনরীতিতে শিক্ষার পরিচয় স্পষ্ট। কোনও নিছক সাক্ষরকে দিয়ে লেখানো হয়েছে কি? বানান ভুল তো দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া কাউকে দিয়ে লেখালে গোপন কথাটি দ্বিতীয় জনের জানা হয়ে যায়। অথচ চিঠিটা যথেষ্ট গোপনীয়তা আষ্টেপৃষ্ঠে বহন করছে। আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, সে কর্নেলকে ভাল চেনে। ঠিকানা জানে। কর্নেলের কাছে হাথিয়াগড় চেনা জায়গা, তা-ও জানে। সে জানে, ইভনিং ভিলা’ কর্নেল চিনতে পারবেন।
কিন্তু হাথিয়াগড়ে কয়েকবার এলেও কর্নেল ওই বাড়িটা লক্ষ্য করেননি। আজ বিকেলে এখানে পৌঁছে খোঁজাখুঁজি করে দেখে এসেছেন বাইরে থেকে। একটা নিচু টিলার গায়ে কতকটা কেল্লার গড়নের পুরনো বাড়ি। হাথিয়াগড়ের ওদিকটায় একসময় বাঙালি বড়লোক-রাজা মহারাজাদের বাড়ি ছিল অনেক। চেঞ্জার ভদ্রলোকেরা, মরশুমি হাঁসের মতো আসতেন। এখনও অনেকে আসেন। বহু বাড়ি ভেঙেচুরে গেছে। কিছু কিছু বাড়িতে মাইনেকরা কেয়ারটেকার আছে। ইভনিং ভিলার গেট বন্ধ ছিল। বাইরে একটা অ্যাম্বাসাডর গাড়ি ঢোকানো যায় না কি? পশ্চিমের জানালায় গেলেন কর্নেল। এতক্ষণে আবার সেই প্রশ্নটা মনে খোঁচা দিল।
এদিকটায় হাথিয়া নদী। পাথরে জলের আছড়ে পড়ার চাপা শব্দ কানে এল। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে লনের শেষে সিমেন্টের বেঞ্চে দুটি মেয়ে বসে আছে। গেটের কাছে দেখেছেন মনে পড়ল। দুজনের একজন বিদেশিনী তরুণী। যথেষ্ট আলো পড়েছে ওখানে। দুজনে উত্তেজিতভাবে কথা বলছে। বাতাস উল্টোদিকে। শোনা যাচ্ছে না।
ঘড়ি দেখলেন কর্নেল। নটা সতের। দরজায় টোকা দিচ্ছিল কেউ। টেবিলের কাছে এসে চিঠি ও আতস কাঁচ জ্যাকেটের ভেতর পকেটে গুঁজে কর্নেল উঠে গিয়ে দরজা খুললেন। দরজায় ইন্টারলকিং সিস্টেম। বাইরে থেকে খোলা যায় না। কেয়ারটেকার-কাম-ম্যানেজার ম্যাথু স্যালুট ঠুকে বলল, ‘ইওর টেলিফোন সার!”
“হু ইজ হি?”
“অ্যাডিশনাল পুলিশ সুপার মিঃ খান, স্যার!”
ম্যাথু পেছনে সিঁড়িতে নামতে নামতে চাপা স্বরে জানাল, কিছু একটা ঘটেছে। কলকাতার এক ভদ্রলোকের হাতে রক্ত ছিল। বেসিনে ধুচ্ছিলেন। পুলিশ সায়েব হন্তদন্ত, তখনই জিপ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তাঁর বন্ধু ব্যানার্জি সায়েবও নিজের গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। তারপর কলকাতার ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলাদের মধ্যে ফিসফিস কথাবার্তা। হঠাৎ চাঁচামেচি। দু’ঘণ্টা ধরে কী সব চলেছে, মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছে না ম্যাথু। হয়তো মারামারি করে এসেছে স্থানীয় মস্তানদের সঙ্গে। মেয়েদের নিয়ে আজকাল এখানে চলাফেরা করা বিপজ্জনক।
ডাইনিং সংলগ্ন কাঠের ছোট চেম্বারে ম্যাথুর রীতিমত একটা অফিস। সেখানে টেলিফোন আছে। লবি হয়ে ঢোকা যায়। লবি জনশূন্য। দরজা দিয়ে দেখা গেল বারান্দায় তিনজন ভদ্রলোক এবং এক ভদ্রমহিলা বসে আছেন। ফোন তুলে কর্নেল বললেন, “এনিথিং রং ডার্লিং?”
আরিফের সাড়া এল। “হাই ওল্ড বস! তা হলে আমি ঠিকই ধরেছিলাম–”
“আরিফ! কী হয়েছে?”
“যা হয়ে থাকে, তা-ই মার্ডার।”
“ইভনিং ভিলায় নয় তো?”
আরিফের হাসি ভেসে এল। “ধরা দিলেন, কর্নেল! আপনাকে দেখেই আমার বরাবরকার মতো অস্বস্তি হচ্ছিল।”
“ইভনিং ভিলায় কে খুন হয়েছে?”
“ও-বাড়ির কেউ নয়। একজন আউটসাইডার। বাড়ির কেউ চেনেন না। আমরাও শনাক্ত করতে পারছি না।”
“বডি কি মর্গে?”
“হ্যাঁ। অপেক্ষা করুন, আমি যাচ্ছি।” আরিফের হাসি শোনা গেল। “আপনাকে একটু বাজিয়ে দেখার জন্য ফোন করতে চেয়েছিলাম। নাও আই অ্যাম গড্ড্যাম রাইট। রাখছি বস!”
কর্নেল ফোন রেখে দেখলেন, ম্যাথু তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কাচুমাচু মুখে আস্তে বলল, “মার্ডার স্যার?”
কর্নেল মাথাটা একটু দুলিয়ে পা বাড়ালেন। যেতে যেতে বলে গেলেন, বারান্দায় এক পেয়ালা কড়া কফি পাঠালে খুশি হবেন। আর ডিনারটা যেন ওপরে তার ঘরে পাঠানো হয়। খেতে দেরি হতে পারে।
বারান্দায় তাঁকে দেখে কলকাতার দলটি চুপ করে গেল। ঈশিতার চোখে চোখ পড়ায় কর্নেল বললেন, “হাই!”
ঈশিতা আস্তে “হাই” বলে তাকিয়ে রইল। নায়ার এবং সুমিত অর্থপূর্ণ চোখাচোখি করল। সোমনাথ কর্নেলের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল, “তো আপনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ! হা! আমি এরকুল পোয়ারোর ফ্যান। লিটুল গ্রে সে’–বোধ! দ্যাটস দা পয়েন্ট।”
এবার ঈশিতা বলল, “আপনি স্বচ্ছন্দে বসতে পারেন।”
কর্নেল একটা খালি চেয়ারে বসলেন। দাঁতে কামড়ানো চুরুট। ঈশিতাকে বললেন, “তখন গেটে আপনারা দাঁড়িয়ে ছিলেন। কারও জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমার ধারণা তিনি–”
সোমনাথের দিকে তাকাতেই সে বলল, “হ্যাঁ। আমার জন্য। আপনি সত্যিই তা হলে–ওই যে বলছিলুম, “লিটল গ্রে সেলস’–বোধ। আপনার এটা আছে। তো নায়ার বলছিল, আপনার মধ্যে কিছু অড ব্যাপার লক্ষ্য করেছে। হ্যাঁ! সিসেরো বলেছিলেন, অডিটির সঙ্গে জিনিয়াসদের সম্পর্ক আছে। একমাত্র জিনিয়াসরাই অড় চিন্তাভাবনা কাজকর্ম করে থাকেন। তো আমি–হ্যাঁ, আমি সোমনাথ দাশগুপ্ত, ফর ইওর অনার স্যার, আপনার স্বাস্থ্য পান করার অনুমতি চাইছি।”
তার কণ্ঠস্বর একটু জড়িয়ে যাচ্ছিল। গ্লাসে শেষ চুমুক দিল। জনি ওয়াকারের বোতলটার অর্ধেক খালি। কর্নেল নায়ারের দিকে তাকালেন। নায়ার গোঁফে হাত রাখল। মুখটা গম্ভীর।
ঈশিতা হঠাৎ উঠে স্কচের বোতলটা নিয়ে লবিতে ঢুকে গেল। সুমিত একটু হাসল। “আপনি আমাদের কমনফ্রেন্ড আরিফ খানের ওল্ড বস। বাই এনি চান্স, আপনি কি সি বি আই অফিসার ছিলেন? নাকি রেভেনিউ ইনটেলিজেন্সে ছিলেন? পুলিশে ছিলেন না, এবিষয়ে আমি সিওর। কারণ কোনও কর্নেল পুলিশের লোক হতে পারেন না। রিটায়ার্ড মিলিটারি অফিসাররা–”
তাকে থামিয়ে সোমনাথ বলল, “তো–হ্যাঁ! রক্ত! দ্যাটস দা পয়েন্ট। অন্ধকারে কেউ পড়ে যাওয়ার শব্দ। যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নয়? তবে হ্যাঁ– চারমিনারের প্যাকেট এবং দেশলাই আমার স্ট্রং অ্যালিবাই। মাত্র দুটো সিগারেট ছিল–সো হোয়াট? নীপু প্যাকেটটা এখানে ছুঁড়ে ফেলল। আসলে রক্ত সম্পর্কে মানুষের একটা প্রিমিটিভ আতঙ্ক আছে। হাঃ। প্যাকেটে রক্তের দাগ ছিল। ফেলে দিয়েছে, বেশ করেছে। সিগারেটে তো ছিল না! লাস্ট সিগারেটটা এবার খাওয়া যেতে পারে।”
সে বুক পকেট থেকে দোমড়ানো একটা সিগারেট বের করে বলল, “সুমিত! জ্বেলে দে। নীপু দেশলাইটা কোথায় ছুঁড়ে ফেলল, খুঁজে পেলুম না।”সে নীপার দিকে তাকাল। “তো প্যাকেটটা যদি বা পেলুম, ছেঁড়া অবস্থায়। নীপু তুমি প্যাকেট ছিড়লে কেন?”
নীপা গলার ভেতর বলল, “আমি ছিড়িনি।”
কর্নেল লাইটার জ্বেলে ধরিয়ে দিলেন। সোমনাথ বলল, “থ্যাংকস!” তারপর সে টেবিলের তলা থেকে খালি প্যাকেটটা মুড়িয়ে টেবিলে রাখল। “দেখুন মশাই, রক্তটা দেখুন। অথবা এটা ক্ল হিসেবে রেখে দিতেও পারেন।”
সুমিত একটু নার্ভাস হেসে বলল, “সোমনাথ। এঁকে ব্যাপারটা বলতে পারিস।”
কর্নেল প্যাকেটটা দেখে ভাজ করে জ্যাকেটের ভেতর পকেটে চালান করলেন।
ঈশিতা ফিরে এসে বসল। ম্যাথু কর্নেলের কফি দিয়ে গেল। বারান্দা ঘুরে নীপা আর ক্রিস্নানও এসে গেল এতক্ষণে। নায়ার গোঁফ থেকে হাত নামিয়ে বলল, “প্রমোদ-পর্যটনে এসে ফেঁসে গেলাম। কখন যে বীতশোক ফিরবে কে জানে! আমার ঘুম পাচ্ছে।”
নীপা ও ক্রিস্নান কর্নেলকে দেখছিল। সুমিত হঠাৎ স্মার্ট হয়ে বলল, “পরিচয় করিয়ে দিই। অধ্যাপিকা নীপা সেন, ক্রিস্নান ফ্রম কোপেনহাগেন, ঈশিতা ব্যানার্জি-ওয়াইফ অব বীতশোক ব্যানার্জি! নীপু, ইনি কর্নেল। প্রাইভেট ডিটেকটিভ।”
কর্নেল মাথা একটু ঝুঁকিয়ে বললেন, “কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আ নেচারিস্ট।”
ক্রিস্নান বলল, “আমি ইংলিশ জানি না। শব্দটি চেনা মনে হয়।”
নায়ার বলল, “প্রকৃতিবিদ। মানে যাঁরা প্রকৃতি সম্পর্কে আগ্রহী।”
সুমিত সোমনাথকে খোঁচাল। “পুরোটা রিপিট কর সোমনাথ! সত্যি কিছু রক্তারক্তি হয়ে থাকলে ফেঁসে যাওয়ার চান্স তোর। আমাদের নয়। ইভনিং ভিলায় তুই-ই ফিরে গিয়েছিলি এবং রক্তক্ত মেখে ফিরে এলি।”
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, “ইভনিং ভিলায় একটা ডেডবডি পেয়েছে পুলিশ। মার্ডার।”
সবাই নড়ে উঠে মূর্তি হয়ে গেল, সোমনাথ বাদে। সে হাসল। “তো হ্যাঁ– বলেছিলুম সামথিং অড দেয়ার। গেট খোলা। হলঘরের দরজা খোলা। অন্ধকার। ডেকে সাড়া পেলুম না। তারপর ভারী কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ। শেষে ব্লাড।”
সে ডানহাতটা তুলে দেখতে থাকল, যেখানে রক্ত লেগে ছিল। সুমিত ফাসফেঁসে গলায় বলল, “মা-মার্ডার! সোমনাথ! তা হলে ফেঁসে গেছিস। অ্যাই সোমনাথ! ওয়েক আপ টু ইওর সেন্সেস। হলঘরে ডেডবডি পেয়েছে পুলিশ। তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে দ্যাখ! আমরা চলে আসার পরই খুনটা হয়েছে এবং খুনটা হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তুই গিয়ে ঢুকেছিস।”
ঈশিতা এতক্ষণে কথা খুঁজে পেল। কর্নেলকে বলল, “ডেডবডিটা কার?”
কর্নেল একটু হেসে বললেন, “কার হতে পারে বলে আপনার ধারণা মিসেস ব্যানার্জি?”
“আমার কোনও ধারণা নেই।” ঈশিতা চটে গিয়েছিল। ফের বলল শ্বাসপ্রশ্বাস মিশিয়ে, “আমি ডিটেকটিভ নই।
সোমনাথ বলল, “বোধ! ‘দা লিটু গ্রে সেলস’ অব এরকুল পোয়ারো। যে ডেডবডিটা পড়ে যাওয়ার শব্দ আমি শুনেছিলুম, সেটা-হাঃ, চান্সের অনুপাত ৯০ : ১০। মিসেস বোস। অবশ্যই। মক্ষিরানি টাইপ। খুনের যোগ্য। হাঃ।”
কর্নেল নীপার দিকে তাকালেন। “মিস সেন, সিরিয়াসলি নেবেন না। আরিফ আসছে। তার আগে আমরা একটু তাস খেলে নিই।” কর্নেলের চোখে কৌতুক ঝিলিক দিচ্ছিল। “নিছক আই কিউ টেস্ট ধরনের খেলা। ডেডবডিটা কার হতে পারে? মনে করুন, একটা তাসের উল্টো পিঠ দেখিয়ে প্রশ্ন করছি।”
নায়ার বলল, “তাসটা আপনার তা হলে দেখা।”
“দেখা হলেও আমি চিনি না। কারণ ইভনিং ভিলায় আমি যাইনি কখনও। মিস সেন, বলুন!”
নীপা একটু ইতস্তত করে বলল, “মিসেস বোস। ভদ্রমহিলার গলায় মুক্তোর হার দেখেছি।”
“মিঃ নায়ার!”
নায়ার গোঁফে হাত রেখে বলল, “মিঃ বোস। প্রচণ্ড উদ্ধত প্রকৃতির লোক। হত্যার যোগ্য। ভৃত্যের দ্বারা হত।”
“মিঃ চৌধুরী?”
সুমিত ফের নার্ভাস হাসল। “মাইরি–ওয়েল, মিসেস বোসের খুন হওয়ার চান্স আছে। গয়না কোনও ফ্যাক্টর নয়। ইউ নো কর্নেল সরকার, দা লেসবিয়ান টাইপ। একটা দেহাতী হেলদি চেহারার সুন্দর মেয়ে আমাদের চা-স্ন্যাক্স সার্ভ করছিল। আমার সেই জন্যে মনে হচ্ছে, বুঝলেন? হয়তো মেয়েটি সহ্যের সীমা পেরিয়ে গিয়েছিল। ডেলিবারেট মার্ডার নয়। রাগের মাথায়–”
“মিস ক্রিস্নান?”
“আমাকে কৃষ্ণা বললে আনন্দিত হই।”
“বেশ। কৃষ্ণা?”
ক্রিস্নান ভুরু কুঁচকে ঠোঁটে আঙুল রাখল। “আমাকে স্মরণ করতে দিন। আমরা ঘর থেকে বাহিরে এলাম। অশোক বলল, গাড়িতে গিয়ে বসো। আমি যাচ্ছি। মিসেস বোস তখন দোতলার বারান্দাতে চলে গিয়েছেন। আমরা গাড়িতে উঠলাম। দুই কিংবা তিন মিনিট পরে অশোক এল। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলল, ‘তা হলে যা বলেছিলাম’ কিংবা বলেছিলুম–সে ঠিক বলেছিল। ভারতীয় প্রাচীন অভিজাত ধনবানদের পরিবার দেখাতে চেয়েছিল।”
কর্নেল হাসলেন। “আমরা তাস খেলছি কৃষ্ণা। আমার প্রশ্ন, ডেডবডি কার হতে পারে?”
“মিঃ বোস সুগঠিত দেহ। বলবান পুরুষ। এবং সেবক-সেবিকা কিংবা পরিচারক-পরিচারিকা ওই প্রকার অল্পক্ষণে নিহত হতে পারে না। তারা নিহত হবে কেন? যুক্তি কোথায়? সুতরাং বহিরাগত। আত্মগোপনকারী দস্যু হতে পারে।”
কর্নেল চুরুট অ্যাশট্রেতে গুঁজে বললেন, “এবার মিসেস ব্যানার্জি। বলুন, কার ডেডবডি?”
ঈশিতা ততক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। বলল, “অন্ধ ভদ্রলোক। মানে মিসেস বোসের কাজিন ব্রাদার। আরিফের কাছে ওঁর পাস্ট লাইফের আভাস পেয়েছি। এইসব লোক ব্ল্যাকমেল করে। আগে চোখ গিয়েছিল, এবার প্রাণ গেল।”
“হুঁ, আপনি কি কখনও আমেরিকায় ছিলেন?”
“কেন?”
“প্যাস্ট বললেন আমেরিকানদের মতো!” কর্নেল কফিতে চুমুক দিলেন।
ঈশিতা বলল, “ছিলুম। আরও শুনুন। বীতশোকের সঙ্গে সেখানে আলাপ। বিয়ে করে ফিরে এসেছিলুম। বীতশোকের কোম্পানির এক পার্টনার এই মিঃ বোস। কোম্পানির এখানে একটা ব্রাঞ্চ আছে।
কর্নেল প্রায় অট্টহাসি হাসলেন। “আপনি এ বৃদ্ধের প্রতি অকারণ ক্রুদ্ধ কেন মিসেস ব্যানার্জি?”
“আপনি ডিটেকটিভ। খেলার ছলে আস্কিং মোটিভেটেড কোয়েশ্চেনস্। বুঝি না?” ঈশিতা শ্বাস ছেড়ে ট্রাম্পকার্ড ফেলার ভঙ্গিতে সুমিতের দিকে তাকাল।
সুমিত বলল, “মাইরি–যাই হোক। তাসটা দেখিয়ে দিন কর্নেলসায়েব!”
কর্নেল চুরুট বের করেছিলেন। একটা চুরুট বেছে নিয়ে বললেন, “সত্যিই বলছি, আমি ইভনিং ভিলার কাকেও চিনি না। এইমাত্র আরিফ ফোনে জানাল, একটা ডেডবডি পাওয়া গেছে সেখানে। তবে কৃষ্ণা সঠিক জবাব দিয়েছে।”
সুমিত ও নায়ার একগলায় বলল, “আউটসাইডার?”
“আউটসাইডার বলা চলে। কারণ, নাকি ও বাড়ির কেউ বডি শনাক্ত করতে পারেনি।” কর্নেল চুরুটটা লাইটার জ্বেলে ধরালেন। “আরিফ আসছে মনে হচ্ছে। কারণ, গাড়ির হেডলাইট দেখতে পাচ্ছি।”
সবাই গেটের দিকে তাকাল। একটু পরে বীতশোকের অ্যামবাসাডর ঢুকতে দেখা গেল। ঈশিতা উঠে দাঁড়াল। গাড়ি গ্যারেজে ঢুকিয়ে লক করে চাবির রিং আঙুলে জড়াতে জড়াতে বীতশোক এগিয়ে এল। ঈশিতা বলল, “সত্যিই মার্ডার? কে মার্ডার হয়েছে?”
বীতশোক বারান্দায় উঠে একটা খালি চেয়ারে বসে বলল, “বোতল খালি করে দিয়েছিস তোরা?”
সুমিত বলল, “তোর বউ লুকিয়ে রেখেছে। ঈশু! এনে দাও। তোমার হাজব্যান্ড ভীষণ আপসেট মনে হচ্ছে।”
ঈশিতা আস্তে বলল, “কফি-টফি খাক। আমি নিয়ে আসছি।”
কর্নেল বললেন, “মিঃ ব্যানার্জি কি ইভনিং ভিলা থেকে আসছেন?”
ঈশিতা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, “ওই ভদ্রলোকের একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে না কিন্তু। খেলার ছলে ইনভেস্টিগেট করছেন।”
নায়ার খুবই গম্ভীর হয়ে বলল, “তাতে ক্ষতি কী? তুমি কি মনে করো তোমার স্বামী ঘাতক? অদ্ভুত তোমার ধারণা ঈশিতা! একমত না হওয়ার জন্য দুঃখিত।”
কর্নেল চোখ বুজে বললেন, “আগামীকাল ককটেল ডিনার কি ক্যানসেল হল মিঃ ব্যানার্জি?”
বীতশোক ঠোঁটের কোনা কামড়ে ধরে তাকাল কর্নেলের দিকে। তারপর ভুরু কুঁচকে একটু হেসে বলল, “লিস্টে আপনার নাম দেখিনি। তবে পার্টিটা ক্যানসেল হয়নি। আরিফ আশ্বাস দিল ইউ নো, আরিফ ইজ মাই ফ্রেন্ড। তা ছাড়া কে একজন ভবঘুরে মার্কা লোক কোথায় মার খেয়ে এসে ইভনিং ভিলায় আশ্রয় নিতে ঢুকেছে এবং দৈবাৎ তার শেষ নিঃশ্বাস পড়েছে, এটা কোনও ব্যাপার নয়। সো মাচ আই ক্যান টেল য়ু–অনেস্টলি! ককটেল ডিনার হচ্ছে। কারণ আমার কোম্পানি হাথিয়াগড়ে ইস্পাত কারখানায় এক্সটেনশন প্রজেক্ট হাতে নিতে চায়। অল দা লোকাল বিগ গাইজ আর কামিং। ইভ আ মিনিস্টার। এ ছাড়া কুখ্যাত বলুন কি বিখ্যাত বলুন, এরিয়ার মাফিয়া লিডার কেতন সিং আসছে। মে বি, ইউ নো হিম।”
কর্নেল হাসলেন। “তালিকা বেশ লম্বা তা হলে?”
“বাদ-সাদ দিয়ে শেষ অবধি তেরো।”
“আনলাকি থারটিন!” কর্নেল জিভ কেটে মাথাটা একটু দোলালেন। “হোয়াই নট মেক ইট ফরটিন অর টুয়েলভ?”
বীতশোক পকেট থেকে বিদেশি সিগারেটের প্যাকেটের বের করল। বলল, “লিস্ট ওখানে শেষ হয়নি। কারণ ওটা অফিসিয়াল লিস্ট। মাই টিম ইজ এক্সক্লডেড ইন দা লিস্ট। আমাকে বাদ দিন। আমি হোস্ট পক্ষের লোক। আমার মিসেস আমার টিমের চার্জে থাকবে। কাজেই তেরো প্লাস পাঁচ আঠারো।”
ঈশিতা কিচেন থেকে কফি নিয়ে ফিরে এল। বলল, “সোমনাথ! ইউ আর ড্রাংক! নীপু, ওকে ডাইনিংয়ে নিয়ে যাও। ম্যাথু বলল, এখনই ডিনার সেরে নিলে ভাল হয়। কৃষ্ণা, সুমিত, নায়ার! খেয়ে নাও গে। আমরা যাচ্ছি।”
সোমনাথকে সুমিত টানল। “অ্যাই! দু’ পেগেই মাইরি কাত! ওঠ। খাওয়া রেডি।”
সোমনাথ চোখ বুজে হেলান দিয়েছিল। চোখ খুলে সোজা হয়ে বসে বলল, “তো–হ্যাঁ! টিবেটান মংক সং খাপার একটা কথা ভাবছিলুম। The human form is won with difficulty. It is easy to lose!’ কী অসাধারণ কথা! একটা লোক তা হলে হিউম্যান ফর্ম হারিয়ে ফেলল? এত সহজে? আঁঃ?”
নীপা বলল, “আবার আঁতলামি?”
নায়ার ফিক করে হেসেই স্বভাবমতো গোঁফ ঢাকল। “আঁতলামি নয়, মাতলামি। ওঠ ব্যাটা!”
সোমনাথ সুমিত ও নায়ারের টানে উঠে দাঁড়াল। কর্নেলের দিকে তাকিয়ে বলল, “জানেন মশাই? ইনটুইশন–বোধ! তা না হলে অতটা পথ চলে এসে হঠাৎ আমার চারমিনার প্যাকেটের কথা মনে পড়বে কেন? তো ‘রোখকে’ বলে গাড়ি দাঁড় করিয়ে প্রায় দৌড়ে চলে গেলুম। এখন মনে হচ্ছে, হ্যাঁঃ–একটা মহৎ কাজ করতে পেরেছি। ওই মধ্যযুগীয় বাড়িগুলোর যা ব্যাপার, সকালে বঁটা হাতে কেউ এসে তবে দেখতে পেত এটা হিউম্যান বডি পড়ে আছে। ওই লোকগুলোকে তা জানি। ট্রিপিক্যাল ড্রাকুলা–আই রিপিট, ড্রাকুলা। হাঃ—ভ্যাম্পায়ার।”
সুমিত ও নায়ার তাকে টানতে টানতে ডাইনিং ঘরে নিয়ে গেল। ক্রিস্নান কর্নেলের দিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেল। বাঁ হাতে নীপার কোমর জড়িয়ে ধরে আছে। ঈশিতা বলল, “বেশ ঠাণ্ডা দিচ্ছে বাইরে। বরং কফিটা নিয়ে এসো। ডাইনিংয়ে বসে খাবে। আমার খিদে পেয়েছে।”
সে জোর করে কফির পেয়ালা তুলে নিল। অগত্যা বীতশোককে যেতে হল তার সঙ্গে। কর্নেল একা বসে রইলেন। আরিফ আসতে বড্ড দেরি করছে।
তা হলে ককটেল-ডিনার পার্টিটা হচ্ছে। কর্নেলকে লেখা চিঠিটার কথা দৈবাৎ কেউ জেনে আগেই তাড়াহুড়ো করে প্রাণটা নিয়ে ফেলল কি? কিন্তু আরিফের কথায় আঁচ পাওয়া গেল, তত কিছু উঁচুদরের লোক নয়। হলে শনাক্ত করতে পারত ওরা। বীতশোক বলল, ভবঘুরে কেউ এবং বাইরে মোক্ষম মার খেয়ে আশ্রয় নিতে ঢুকেছিল। এখন কথা হল, ইভনিং ভিলার ফটক খোলা ছিল এবং হলঘরও ভোলা ছিল। কেন? ঘরে আলো ছিল না। কেন? ক্রিস্নান বলল, বীতশোক সবার শেষে আসে গাড়িতে। এটা প্রশ্নযোগ্য নয়। কোম্পানির এক পার্টনারের সঙ্গে একা কথা বলার দরকার থাকতেই পারে। কিন্তু গাড়িটা ফটকের বাইরে দাঁড় করানো ছিল। এ-ও একটা কেন।
ক্রিস্নানের মাথায় আউটসাইডারের কথাটা এসেছে। সে কি ওর বুদ্ধিমত্তার পরিচয়? ওর প্রখর পর্যবেক্ষণবোধ আছে। ক্রিস্নান সম্ভবত নীপা সেনেরই বন্ধু এবং নীপা সেন যেন সোমনাথ দাশগুপ্তের গার্জেন। প্রেম থাকা সম্ভব। তবে সোমনাথের ‘ভোলে-ভালে’ হাবভাব এবং কথাবার্তা থেকে মনে হয়, সে সিগারেটের প্যাকেট ফেলে আসতেই পারে এবং আনতে যেতেও পারে। সোমনাথ আগাথা ক্রিস্টির ডিটেকটিভ এরকুল পোয়ারোর বিখ্যাত উক্তি ‘লিটল গ্রে সেলস’ উল্লেখ করছে। কিন্তু হাতে প্রচুর প্রয়োজনীয় তথ্য না থাকলে মাথার ভেতরকার ক্ষুদ্র ধূসর কোষগুলো কোনও কাজ করতে পারে না।
শুধু বোঝা যাচ্ছে, এই কলকাতা টিমের চলে আসার এবং সোমনাথের ফিরে যাওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে ঘটনাটা ঘটেছে! পাঁচ, দশ, পনের, কুড়ি, যত ন্যূনতম মিনিট হোক, তার মধ্যেই।
আর একটা কথা, চিঠির লেখক জানেন, কর্নেলের ওই পার্টিতে যাওয়ার সুযোগ জুটে যাবে। কিন্তু হাথিয়াগড়ে তো তার তত চেনা-জানা হোমরা-চোমরা কেউ নেই, পুলিশের উঁচুতলার কিছু অফিসার বাদে। তাদের বদলির চাকরি। অতএব সিদ্ধান্তে আসতে হয়, আরিফের সঙ্গে কর্নেলের সম্পর্কের কথা চিঠির লেখক জানেন। তার চেয়ে বড় পয়েন্ট, আরিফ পার্টিতে থাকবে, অজ্ঞাত পরিচয় লোকটির কি তা-ও জানা? এ দিকে আরিফের বন্ধু বীতশোক মুখার্জি!
নাকি আরিফ খান আমন্ত্রিতদের তালিকায় ভদ্রতাজনিত সর্বশেষ সংযোজন? তাই পার্টি দেওয়ার আগেই প্রাণটি নেওয়া হল?
তা যদি হয়ে থাকে, তা হলে চিঠির কথা দ্বিতীয় কেউ টের পায়নি। হঠাৎ হয়তো বন্ধুর সঙ্গে আরিফের উপস্থিতিই খুনিকে খুনের সময় বদলাতে বাধ্য করেছে।
এতক্ষণে আবার হেডলাইটের আলো গেটের নীচের দিক থেকে ছড়িয়ে এল। আরিফের জিপটা ঢুকল। তারপর সোজা বারান্দার নীচে এসে থামল। জিপ থেকে নেমে আরিফ বলল, “সরি বস! বড্ড দেরি করে ফেললাম। আমার বন্ধুরা শুয়ে পড়েছে নাকি?”
“নাহ। খাচ্ছে।” কর্নেল নিবুনিবু চুরুট টেনে উজ্জ্বল করলেন। “এখানে বসবে, নাকি ওপরে যাবে?”
“এখানেই বসি।” আরিফ খান বসে বলল, “ফার্স্ট কার্ড আপনিই খেলেছেন? নেক্সট কার্ড আমার হাতে। ইট ইজ আ ট্রাম্পকার্ড, আই ওয়ার্ন য়ু কর্নেল!”
“বডি শনাক্ত হয়েছে?”
“ইয়া। অ্যান্ড য়ু নো হিম। সিওর।”
“কেমন করে সিওর হচ্ছ, ডার্লিং?”
আরিফ হাসল। “সিগারেটের প্যাকেটের একটা টুকরো রোল করা অবস্থায় প্যান্টের পকেটে দেশলাইয়ের বাক্সে পাওয়া গেছে। কোনও সিগারেটের প্যাকেট অবশ্য ছিল না। তো প্যাকেটের টুকরোয় আপনার নাম ঠিকানা লেখা।” বলে সে পকেট থেকে ওটা বের করে দিল কর্নেলকে।
কর্নেল দেখে বললেন, “মাই গুডনেস! এ তো একই হাতের লেখা।” জ্যাকেটের ভেতর থেকে সেই চিঠিটা বের করে মিলিয়ে নিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, “লোকটা কে?”
“আরিফ চিঠিটা পড়ে দেখে বলল, “বুঝলাম। এনিওয়ে, আপনার ক্লায়েন্ট বসন্ত হাজরা মারা পড়েছে।”
“বসন্ত হাজরা?” কর্নেল অবাক হয়ে বললেন। “কস্মিনকালে কোনও বসন্ত হাজরাকে আমি চিনতুম না।”
“দেখলে চিনতে পারবেন–সিওর। তবে খুনটা ওখানে হয়নি।” আরিফ গম্ভীর হয়ে গেল। “রক্তের দাগ গেটের বাইরে রাস্তায় একটু পাওয়া গেছে। মাথার পেছনে শক্ত ভোতা কিছু দিয়ে মারা হয়েছিল। হলঘরে গিয়ে মারা পড়ে। হলঘরের দরজা পর্যন্ত রক্তের দাগ আছে। আমরা চলে আসার পর হলঘরের দরজা এবং গেট বন্ধ করতে দেরি হয়েছিল। গণেশ নামে একজন এ সব করে। সে অন্য কাজ করছিল। আমি গিয়ে দেখি, বডি ইজ অলরেডি ডিসকভার্ড। ঘর অন্ধকার ছিল। কিন্তু তারও এক্সপ্ল্যানেশন আছে। বসন্ত হাজরা। আততায়ীদের ভয়ে সুইচ টিপে আলো নিভিয়েছিল। সুইচে রক্তের ছাপ আছে। চলুন, আপনার ক্লায়েন্টকে দেখবেন।”
কর্নেল জোরে মাথা নেড়ে বললেন, “নাহ্ ডার্লিং! আমি ক্লান্ত।”
.
০৩.
নায়ার সবচেয়ে উঁচু এবং বড় কালো রঙের পাথরটাতে বসে ডাকল, “এই বুদ্ধিজীবী! এখানে আয়। এটা গজদন্তমিনার।” সোমনাথ তার বসার যোগ্য পাথর খুঁজছিল। নীপা ও ক্রিস্নান বসেছে স্রোতের ধারে ঢালু হ্রস্ব একটা চাতালে। জলের শব্দে তাদের কথা শোনা যাচ্ছে না। সুমিত ও ঈশিতা বসেছে তাদের প্রায় দু মিটার ওপরে মসৃণ বেদির গড়ন একটা পাথরে। নীচে নদী, পেছনে উঁচুতে ডাকবাংলো। বেলা নটার সূর্যের আলো নদীর ওপর পড়েছে। কিন্তু এখানে এখনও ছায়া। পশ্চিমের ঢালু লনের শেষে গ্রিলের ছোট দরজাটা কিন্তু এখয়ে গেছে চেকআরকামস্টালে হতে পারে। থিয়া নদীর ছুনো যায়
‘আনঅ্যাভয়েডেবল সারকামস্ট্যান্সে’র দরুন দুঃখপ্রকাশ করে বীতশোক গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে। ফিরতে দেরি হতে পারে। তার ক্যালকাটা টিম’ ইচ্ছে করলে একটা অ্যাডভেঞ্চার সেরে নিতে পারে। হাথিয়া নদীর একটা প্রপাত আছে মাত্র দেড় কিমি. ভাটিতে এখান থেকে নদীর ধারে-ধারে পৌঁছুনো যায়। তবে পাথর সম্পর্কে সাবধান। ক্রিস্নান এবং নায়ার খুব উৎসাহ দেখিয়েছিল। ঈশিতা, সুমিত এবং সোমনাথ নিমরাজি হয়েছিল। কিন্তু নীপার আপত্তিতে উৎসাহটা কেঁচে যায়। তার নাকি একটু হাঁপের টান আছে। বেশি হাঁটাচলা বা শারীরিক খাটুনি বারণ। অতএব সবাই সহানুভূতিশীল হয়েছে এবং নায়ারের মতে, “এটি বিবেচনাযোগ্য বিষয়।”
সোমনাথ জায়গাটা ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, “তো হাঃ। এটা ঠিক ঘাট নয়, অথচ ঘাটের মতো। কেয়ারফুলি কেয়ারলেস টাইপ। গোর্কির লেখায় শেখভের একটা কোট পড়েছি : ‘যে যার নিজের জায়গা সুন্দর করে ফেললে পৃথিবী বাসযোগ্য হয়।”
নায়ার বলল, “তুমি খালি কোটই পড়েছ। মূল কিছু পড়নি!”
সোমনাথের ত্বরিত উত্তর, “হাঃ! আমি অন্যের মুখে পড়ি।”
“অ্যাঁঃ!” নায়ার একটা শব্দ করল। বিস্ময়সূচক। “ব্যাটা বলে কী! অন্যের মুখে পড়ে।”
সোমনাথ তার পছন্দসই পাথর পেল সুমিত এবং ঈশিতার পাথরের নীচে। বসে বলল, “এগেন আ কোট ফ্রম ক্লাসিক স্যান্সক্রিট। ভবভূতি। নিরবধি কাল বিপুলা চ পৃথ্বী এবং হাঃ! দা গ্রেট টিবেটান মংক সং খাপা। “The life you must know as the tiny splash of a raindrop’. 71698 Tato?”
সুমিত তার কাঁধে চপ্পলের ডগা ঠেকিয়ে বলল, “মাইরি লাথি মেরে ফেলে দেব নদীতে। খালি আঁতলামি।”
“তার আগে একটা সিগারেট দে। চৌকিদারকে চারমিনার আনতে পাঠিয়েছি। ততক্ষণ—”
সোমনাথ ঘুরে পিঠের কাছে সুমিতের চপ্পল দেখেই একটু চমকের ভঙ্গি করল। “মাই গুডনেস! রাত্তিরেই কথাটা ভেবেছিলুম। কিন্তু চোখে তখন ঘুমের আঠা। রোজ খাই ৫ মিলিগ্রাম নাইট্রাজেপাম। কাল দরকার ছিল ১০ মিলিগ্রাম। পুরো একটা নাইট্রোসাম। একই ওষুধ।”
সে তার চপ্পল দুটো খুলে খুঁটিয়ে তলা দেখতে থাকল। সবার দৃষ্টি তখন তার দিকে। সুমিত পা গুটিয়ে নিয়ে বলল, “মারবি নাকি রে? তুই পারিস মাইরি। ক্ষমা করে দে। এই নে, সিগারেট নে!”
সোমনাথ চপ্পল নীচে রেখে পা গলিয়ে বলল, “হাঃ। এটা একটা পয়েন্ট। আরিফ বলছিল, গেটের বাইরে থেকে হলঘর অবধি রক্ত। কিন্তু আমার জুতোর তলায় ছিটেফোঁটাও লাগেনি। কেন? আমি ওই ডিটেকটিভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলব। বডি নাকি পড়ে ছিল নিচু টেবিলের ওপাশে, অ্যাজ পার আরিফ তো আমার চারমিনারের প্যাকেট আর দেশলাইয়ে রক্ত! মৃত্যুর আগে কি লোকটার সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল, অথবা আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা। করেছে কিলার? অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। হাঃ! সে সিগারেট বের করতে গিয়ে দৈবাৎ ভেতরকার কাগজটিও একটু ছিঁড়েছে। সিগারেট তিনটেও থাকতে পারে। পেলুম দুটো। মৃত্যুর আগে সে সিগারেট খেয়েছে।”
ক্রিস্নান কথাটা শুনছিল। বলল, “তুমি নতমুখে হাঁটো দেখেছি সোমনাথ! তোমার রক্ত দেখতে পাওয়া উচিত ছিল। উজ্জ্বল আলো ছিল গেটে এবং বাহিরে।”
সোমনাথ জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে বলল, “হাঃ! আমি ঠিক ওইরকম হাঁটি। তবে আমি চোখ দিয়ে কিছু দেখি না, মন দিয়ে দেখি।”
নায়ার মন্তব্য করল, “যে অন্যের মুখে পড়ে, সে অন্যের চোখেও দ্যাখে। তার কোনও নিজস্বতা থাকতে পারে না। সে পরনির্ভরশীল। তাকে গুরুবাদী বলা চলে।”
ঈশিতা সুমিতের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিল। সোমনাথকে সিগারেট দিয়ে সুমিত নিজেও নিল। তিনটে সিগারেট জ্বালানো হলে ঈশিতা হাঁ করে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “তুমি তখন অন্যমনস্ক ছিলে। তাই রক্ত দেখতে পাওনি।”
“হ্যাঁঃ।” সোমনাথ বলল। “অন্ধকার হলঘরে ওই অদ্ভুত শব্দটার কথা ভাবছিলুম। তা ছাড়া আমি প্রায় চোরের মতো পালিয়ে আসছি। কিন্তু আমার জুতোর তলায় এক ফোঁটাও তো রক্ত লাগবে! এটাই পয়েন্ট। ডিটেকটিভদ্রলোক কোথায় কেউ কি জানো?”
নায়ার আবার বিস্ময়সূচক শব্দ করল, “অ্যাঁঃ! দূরবীক্ষণ! দূরবীক্ষণে আমাদের ওপর নজর রেখেছে ব্যাটা! ওই!”
নায়ার আঙুল তুলেছিল যেদিকে, সেদিকে সবাই তাকাল। নদীটা তত চওড়া নয়। ওপারে একটা ন্যাড়া টিলার ঢালে দাঁড়িয়ে ছিলেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। এইমাত্র চোখ থেকে বাইনোকুলার নামিয়ে নীচের দিকে হাঁটতে থাকলেন।
সুমিত চাপাস্বরে বলল, “এই! হোমোটা মাইরি আমাদের কাছে আসছে। কেটে পড়া যাক।”
ঈশিতা তার পিঠে কিল মেরে বলল, “সবসময় অসভ্যতা।”
সুমিত বলল, “নদীটা অবশ্য একটা ডিফেন্সলাইন। দেখা যাক্।”
নায়ার বলল, “আমরা ওকে পাত্তা দেব না। কারণ আমরা জানি না যে–”।
সোমনাথ বলল, “হ্যাঁঃ। আ কোট ফ্রম সোক্ৰাতেস : I know that I do not know. But you do not know that you do not know. To থেকে বলা। ভুল হতেও পারে। তবে মোদ্দা কথাটা এই। এরকুল পোয়ারো বলেছিলেন, মার্ডার কেসে দেখা যায়, একটা লোক নিজেই জানে না এমন একটা ভাইটাল তথ্য তার কাছে আছে, যা খুনিকে ধরিয়ে দেবে! তো এই অজ্ঞতা–বরং বলা চলে অজ্ঞাতসারে একটা জ্ঞানই তার শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। খুনি তাকে চিরকালের মতো চুপ করিয়ে দেয়। এগেন আ মার্ডার। অথচ বেচারা জানল না কেন তাকে খুন করা হল। সি দা পয়েন্ট, নীপা!”
শুধু নীপা তার দিকে তাকিয়ে ছিল। তাই তাকেই বলা। ক্রিন ভিউফাইন্ডারে নদীর ওপারটা দেখছিল। সুমিত ও ঈশিতার দৃষ্টিও নদীর পারে। নায়ার গোল চোখে একহাতে গোঁফ ঢেকে তাকিয়ে ছিল নদীর ওপারে। কর্নেল নদীতে পড়ে থাকা পাথরগুলোতে পা রেখে জল ডিঙিয়ে-ডিঙিয়ে এপারে আসছেন। একখানে দাঁড়িয়ে গেলে ক্রিস্নান দ্রুত ক্যামেরা বের করেকয়েকটা ছবি নিল। ওখানে জলটা চওড়া এবং জল গুঁড়িয়ে সাদা হয়ে যাচ্ছে জোরালো স্রোতে।
সুমিত বলল, “দ্যাখ রে দক্ষিণী! বাঙালির ছেলে হেলায় লঙ্কা করিল জয়।”
নায়ার চটে গিয়ে বলল, “ধুর ব্যাটা! আমার কাছে শোন। পবনপুত্র হনুমান ছিলেন একজন দক্ষিণী। বাজি রেখে বলতে পারি, ভদ্রলোক মাইসোরের কোনও অভিজাত ব্যক্তির বংশধর। বাঙালি মায়ের গর্ভজাত সন্তান। পবনপুত্রের গায়ের রঙ ছিল তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ। আধুনিক ঐ আধুনিক ঐতিহাসিক তত্ত্ব আমার কাছে। জেনে নে। পবনপুত্র ছিলেন মাইসোরের অধিবাসী।”
সুমিত খ্যা-খ্যা করে হাসল। “মরেছে রে! মাইরি ওই কর্নেল ভদ্রলোককে হনুমান বানিয়ে ছাড়ল। বলছি থাম্।”
নায়ার ফিক করে হেসে গোঁফে হাত ঢাকল। বলল, “আমরা সবাই কিন্তু হনুমানের মতোই বসে আছি।”
ঈশিতা বলল, “অবিশ্বাস্য! এ বয়সে লোকটা অতটা জাম্প দিয়ে পেরুল। সার্কাসে ছিল নাকি?”
সোমনাথ বলল, “নাহ্। মিলিটারি ট্রেনিং। এগুলো ওঁদের করতে হয়–পারতে হয়।”
ক্রিস্নান ঝকঝকে দাঁতে হাসল। এতক্ষণে তার ও নীপার ওপর রোদ্দুর পড়েছে। সে বলল, “তোমরা দেখতে চাও কি? আমিও পারি।”
নায়ার বলল, “তুমি পারো। তুমি ডেনিশ যুবতী। ভদ্রলোক বৃদ্ধ বাঙালি।”
সুমিত বলল, “বেশি মাল খেলে কম বয়সেই চুলদাড়ি অমন সাদা হয়ে যায়। বয়সচোরা লোক। এই! উঠে পড়ো সব। এসে জেরা শুরু করবে। গিয়ে চা-ফা খাই। নায়ার! হারি আপ!”
কেউ উঠল না। শুধু নায়ার নেমে এসে নীচের ছায়ায় আর একটা পাথরে বসল। কর্নেল হাত পঁচিশ-তিরিশ তফাতে বাংলোর হাতার দিকে উঠে যাচ্ছিলেন। সোমনাথ উঠে দাঁড়িয়ে ডাকল, “ও মশাই! আমরা আপনার জন্য প্রতীক্ষা করছি। হাঃ! ‘ওয়েটিং ফর গোডো’। শুনুন! আমি জানি যে, কালকের হত্যা রহস্যের একটা ফ্লু আমার কাছে আছে। খুনি টের পাওয়ার আগেই জানিয়ে দেওয়া উচিত। হাঃ! তারপর আমাকে খুনি মারুক, যদিও এরপর তার চান্সের অনুপাত ১: ৯৯ পয়েন্ট। আমার জুতো! বুঝলেন কি? আসুন, জুতো দেখে যান।”
কর্নেল কথাগুলো শোনার পর শুধু হাত নাড়লেন। তারপর ওদিকে অদৃশ্য হলেন।
সোমনাথ দু-হাত কোমরে রেখে বলল, “যা বাব্বা! অফারটা কেঁচে গেল। লোকটা কি সত্যি ডিটেকটিভ? হিজ লিটল গ্রে সেলস আর ড্রাই। ড্রাই সেল! ফুঃ!”
ঈশিতা হেসে কুটিকুটি হয়ে বলল, “তুমি জুতো দেখালে ভদ্রলোককে! জুতো দেখিয়ে ডাকলে কেউ কি আসে? বরং তুমি নতমুখে গিয়ে কুটা দিয়ে এসো। ন-ত-মুখে। তাই না কৃষ্ণা?”
ক্রিস্নান বলল, “দৃষ্টি করলে তুমিও দেখবে, সে সত্যই নতমুখে হাঁটে।” নায়ার বলল, “দৃষ্টি রাখলে বা দৃষ্টিপাত করলে। কৃষ্ণা, তোমাকে বাংলা ইউসেজ শেখাব।”
সুমিত হাতে তালি বাজিয়ে সবাইকে থামিয়ে বলল, “তার আগে জানা দরকার, নীপা কথা বলছে না কেন?”
ঈশিতা বলল, “সত্যি তো। নীপু কথা বলছে না। কেন নীপু?”
নীপা বলল, “ও কিছু না। তোমরা বলছ, শুনছি। আমি কী বলব?”
“বা রে! তুমিও কিছু বলো।” ঈশিতা ফের আস্তে বলল, “শরীর খারাপ করছে নাকি?”
“নাহ্।” নীপা একটু হাসল। “আসলে আমি এনজয় করছি।”
নায়ার বলল, “ইভনিং ভিলায় আজ সন্ধ্যায় ককটেল ডিনার। তখন এনজয় কোরো। আ লট অব ফান–এইসব পার্টি। এখন তুমি আমাদের রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাও। আসার পথে গাইছিলে, ‘তুমি রবে নীরবে–”
“নীরবেই তো আছি।” নীপার মুখে সেই হাসিটা এখনও’ লেগে আছে। “সরব হলে হাঁপেন টান ওঠার চান্স আছে। প্লিজ, ইনসিস্ট কোরো না।”
“দুঃখিত।” বলে নায়ার গানটা গুন গুন করে গাইতে থাকল।
সোমনাথ বলল, “তো ড্রাই সেল কথাটার অনুষঙ্গে ব্যাটারি এসে গেল। মাই গুডনেস!” সে এতক্ষণে ধুপ করে বসল। সিগারেটটা একটানে ফিলটার টিপে ঠেকিয়ে ফেলে দিল সে। “হাঃ! ড্রাইসেল ব্যাটারি। আসলে নাইট্রাজেপামের একটা ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া আছে স্মৃতি চোট খায়। যেমন, খুব চেনা লোকের নাম আজকাল মনে থাকে না। চেনা দরকারি জিনিসের নামও মনে থাকে না। তো একটা ড্রাইসেল ব্যাটারি আমি দেখেছিলুম। অথবা ওইরকম কোনও জিনিস। আমার ভুল হতেও পারে। তোমরা কেউ কি দেখেছিলে?”
নায়ার মন্তব্য করল, “বুদ্ধিজীবীর অসম্বদ্ধ প্রলাপ!”
সোমনাথ বলল, “সুমিত! ঈশিতা! কৃষ্ণা! নীপা! নায়ার!”
সবাই তাকিয়ে রইল ওর দিকে। তারপর শুধু নীপা বলল, “কোথায়।”
“কোথায় সেটাই ঠিক মনে পড়ছে না।” সোমনাথ দু’হাত দুই গোল চেপে ধরল। এতে তার মুখের আদল বদলে গেল। লম্বাটে নাক ঠেলে বেরিয়ে এল। ঠোঁট গোল হয়ে গেল। হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ! ড্রাইসেল ব্যাটারি অথবা ওইরকম কোন জিনিস। আচ্ছা, ওই হলঘরে আমরা ফায়ারপ্লেস দেখেছিলুম, তাই না?”
নীপা বলল, “দেখেছি। কেন?”
সোমনাথ হঠাৎ আবার উঠে দাঁড়াল। “তো হাঃ। এক মিনিট! চৌকিদার আমায় চারমিনার দিয়ে গেল না। সাইকেলে যাবে আর আসবে। ছ’ মিনিটের বেশি দেরি হওয়া কখনই উচিত নয়। আসছি।”
সে হন্তদন্ত উঠে গেল গ্রিলের দরজার দিকে এবং দরজাটা জোরে ঠেলে চলে গেল। গ্রিলটা অদ্ভুত যন্ত্রণাকাতর শব্দ করল। নড়তে থাকল।
নায়ার বলল, “উন্মাদ! বুদ্ধিজীবী!”
ক্রিস্নান তার ক্যামেরায় ছবি তুলতে ব্যস্ত হল।
সুমিত হাসতে হাসতে বলল, “ও আবার রক্ত-উক্ত মেখে ফিরে না আসে। কাল রাত্রির থেকে সোমনাথ সম্পর্কে আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে।”
নীপা জলে পা দুটো বাড়িয়ে দিল। ইভনিং ভিলার হলঘরের ফায়ারপ্লেসটি তার মনে ভেসে এল। তার ওপর একটা স্টাফ করা চিতাবাঘ। বোস সায়েব বলছিলেন, ব্ল্যাক প্যান্থার। মাত্র পনের বছর বয়সে নাকি মানুষখেকো এই ভয়ংকর জন্তুটিকে মেরেছিলেন। নায়ার ঠিক বলছিল, লোকটি উদ্ধত প্রকৃতির। কণ্ঠস্বর কর্কশ। সোমনাথ বলছিল, ড্রাকুলা–ভ্যাম্পায়ার। নীপা শিউরে উঠল। বোস সায়েবের মুখ থেকে দুটো বাড়তি তীক্ষ্ণ দাঁত বেরিয়ে এসেছে! অবিকল দেখতে পেল সে। মিসেস বোসের গায়ের রঙ ফ্যাকাসে সাদা, পাণ্ডুর, নীরক্ত!
এবং ওইরকম একটা ক্যা-গড়নের পুরনো বাড়ি!
নীপা আনমনে হাসল। মনে মনে বলল, মাঝে মাঝে আমি একেবারে বালিকা হয়ে পড়ি। গতরাতে বার বার ঘুম ছিঁড়ে যাচ্ছিল। কী একটা অস্বস্তি, চোখ বুজলেই মনে হয় বোস সায়েব তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রিস্নান একবার বাথরুমে গেল। চমকে উঠেছিল নীপা। তারপর পাশ ফিরে শুয়ে আবার সেই অন্ধ ভদ্রলোককে দেখতে পেয়েছিল। আশ্চর্য! একজন অন্ধ মানুষ বাগানে গাছপালার ভেতর অমন দাঁড়িয়ে থাকেন কেন প্রতিমূর্তি হয়ে?
সোমনাথ ফিরে এল। হাতে চারমিনারের প্যাকেট, দেশলাই। আগের জায়গায় বসে নিষ্ঠার সঙ্গে একটা সিগারেট বের করে ধরাল। বলল, “তো হাঃ! ড্রাইসেল ব্যাটারি। গাড়িতে যেগুলো ব্যবহার করা হয়। আমি দেখেছি। ইভনিং ভিলার ফায়ারপ্লেসের মাথায়।”
নীপা বলল, “ওখানে একটা ব্ল্যাক প্যান্থার ছিল।”
“ছিলঃ!” সোমনাথ ধোঁয়ার মধ্যে বলল। “চিতা বাঘটার সামনের এক পা বাড়ানো, আরেক পা পিছোনো তার মধ্যিখানে। সামথিং অড। হ্যাঁঃ! সেই জন্য আমার চোখে পড়েছিল। নায়ার বলল, তুই তো মন দিয়ে দেখিস! আমরা দেখিনি। কেউ দেখছ?”
সুমিত ও ঈশিতা পরস্পরের কাঁধে হাত রেখেছিল। সুমিত তার হাত নামাল। ঈশিতা নামাল না। একটু চাপ দিয়ে বলল, “সুমিতকে স্টাফ করে ফায়ারপ্লেসের ওপর রাখলে মন্দ হয় না। এ-ও একটি চতুষ্পদ প্রাণী।”
সুমিত বলল, “সোমনাথ! বাঘটা মেল না ফিমেল রে?”
সোমনাথ বলল, “মেল ফিমেল কোনও ব্যাপার নয়। একটা চিতাবাঘ। দ্যাট মাছ। তো ওটা কি ড্রাইসেল ব্যাটারি, না অন্য কিছু? এটাই একটা পয়েন্ট।”
“অত চিন্তা না করে তুই গিয়ে দেখে আয়।” নায়ার বলল। “চলে যা! মিসেস বোস তোকে পাত্তা দেবেন বলে আমার ধারণা। তুই তাকে ম্যাডাম ম্যাডাম করছিলি।”
“হ্যাঁঃ! ইনগ্রিড বার্গম্যান।” সোমনাথ বলল। “ইনগ্রিড যখন তরুণী ছিলেন, তখনকার চেহারার সঙ্গে অসাধারণ মিল মিসেস রত্না বোসের। ঠিক এই কথাটা আমি ওঁকে বলার চেষ্টা করছিলুম।”
নায়ার ফিক করে হেসে গোঁফে হাত রাখল। “ব্যাটা নামও জেনে নিয়েছে। আমরা জানি না। ঈশিতা, তুমি জানতে? চালাকি কোরো না। তুমি জানতে না।”
“না।” ঈশিতা বলল। “তবে মিঃ বোসের নাম জানি। জে এন বোস। জগদীন্দ্রনারায়ণ। কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না, সোমনাথ একটা ড্রাইসেল ব্যাটারি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে কেন?”
সোমনাথ বলল, “কারণ জিনিসটা অড। ব্ল্যাকপ্যান্থারের পায়ের ফাঁকে একটা ওইরকম জিনিস থাকা উচিত নয়। কেন থাকবে? যে ঘর অমন ভিক্টোরিয়ান রীতিতে সাজানো এবং সৌন্দর্যের প্যাটার্নে একটা ছন্দ আছে সিমেট্রি আছে।… তো ওটা অ্যাসিমেট্রিক্যাল। ছন্দপতন যাকে বলে। সেই জন্যই আমার চোখে পড়েছিল।”
“মনে।” নায়ার মন্তব্য করল। “তুই ওটা আরোপ করেছিস। পেটিবুর্জোয়াটিক ঈর্ষাবশত তুলনা করছিলি–”।
সোমনাথ চিন্তামগ্ন ভঙ্গিতে বলল, “মে বি! কিয়ের্কেগার্দ বলেছেন, “The source of all unhappiness is comparison.’ হয় তো আমি মনে মনে নিজের ঘরটা কথা ভাবছিলুম। আমার ঘরে ব্ল্যাক প্যান্থার নেই। বই আছে। ওয়াল্টার বেঞ্জামিন–”
নায়ার ভুরু কুঁচকে বলল, “ফের কোট করলে মারব।”
“হ্যাঁঃ! কোট। কী আর করা যাবে? ওয়াল্টার বেঞ্জামিন তার ঘরের টেন পার্সেন্ট বইও পড়েননি।”
“তুই কিয়ের্কেগার্দ কার মুখ দিয়ে পড়েছিস?” নায়ার অদ্ভুত শব্দে হাসতে থাকল।
ঈশিতা বলল, “দেখ, দেখ! কৃষ্ণা কোথায় গিয়ে ছবি নিচ্ছে আমাদের! এম্মা! কী দস্যি মেয়ে!”
ক্রিস্নান প্রায় নদীর মধ্যিখানে একটা পাথরে দাঁড়িয়ে ক্যামেরা তাক করেছে। সুমিত চাপা স্বরে বলল, “আচ্ছা নীপু! ক্রিস্নানের বয়ফ্রেন্ড কেন ওকে ফেলে চলে গেছে, জানো?”
নীপা বলল, “সজোৰ্ড চলে যাবে কেন? কলকাতায় ডেনিশ কনসুলেট নেই। তাই দিল্লি গেছে। ওদের পেপারে কী একটু গণ্ডগোল আছে। পুলিশ ঝামেলা করছিল। তাই ক্রিস্নানকে হোটেল থেকে আমার কাছে রেখে গেছে।”
নায়ার জিজ্ঞেস করল, “সে বাংলা জানে?”
“সজোৰ্ড?” নাপা একটা হাসল “নাহ্। ক্রিস্নান সুইডেনের স্টকহোলমে থাকার সময় বাংলা শিখেছিল। ওখানে আমার দাদার ফ্যামিলিতে এক মাস ছিল। আমার বউদির আবার ভীষণ বাংলাপ্রেম। রাজ্যের লোককে বাংলা শেখায়। বউদির চিঠি নিয়ে কলকাতায় আমাকে মিট করল ক্রিস্নান।”
সোমনাথ চোখ বুজে সিগারেট টানছিল। চোখ খুলে বলল, “হ্যালুসিনেসান? ড্রাইসেল ব্যাটারিটা এই বাংলোতেও দেখছিলুম যেন। কখন দেখছিলুম, মনে করতে পারছি না। হ্যাঁঃ! সেইটাই। কারণ ইভনিং ভিলায় যেটা দেখেছি, সেটার গায়ে–ঠিক ক্রস নয়, ঢ্যারা বলা চলে। সাদা দুটো কাটাকাটি লাইন ছিল। ঠিক সেইরকম একটা জিনিস এই বাংলোতে–মাই গুডনেস! সকালে বাথরুমে জানালার মাথায় দেখেছি। আমি আসছি!”
সে আবার হন্তদন্ত চলে গেল। গ্রিলের দরজায় এবার জোরালো শব্দ এবং কঁপন।
নায়ার বলল, “ঈশিতা! এই উন্মাদ বুদ্ধিজীবীকে সঙ্গে আনা উচিত হয়নি। আমাদের ঘরের বাথরুমে তেমন কোনও জিনিস আমি দেখিনি। ভোর ছটায়। উঠে বাথরুমে গিয়েছি।”
সুমিত বলল, “আমি সাতটায় গেছি। তেমন কোনও জিনিস দেখিনি।”
নীপা আস্তে বলল, “শোবিজনেস। সোমনাথ দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে। কফি হাউস-আঁতলামির একটা এক্সটেনশন। বাইরে এলে এটা দেখা যায়। একবার কোনারকে–” সে থেমে গেল।
ঈশিতা চোখ নাচিয়ে হাসল। “হ্যাঁ রে নীপু! তোরা লিভিং টুগেদার পার্টি নোস তো?”
নীপা তার চোখে নিষ্পলক চোখ রেখে বলল, “সোমনাথ একবার প্রোপোজ করছিল বটে।”
“তারপর? তারপর?” ঈশিতা সাবধানে নেমে তার কাছে গেল। “সুমিত! নায়ার! কেটে পড়ো তোমরা।”
নীপা একই কণ্ঠস্বরে বলল, “আমি এই ব্যাপারটাতে ভীষণ সেকেলে। মন্ত্রপাঠ, অগ্নিসাক্ষী, সপ্তপদী এবং ফাইনালি বাসরঘর পছন্দ করি।”
“নীপা তেজস্বিনী মহিলা!” নায়ারের মন্তব্য। তার মুখে সিরিয়াস ভাব।
সুমিত ফিক করে হাসল। “নীপা! সাবধান! ঈশু তোমাকে নিয়ে খেলছে।”
ক্রিস্নান এসে গেল লাফাতে লাফাতে। “শোনো তোমরা! এখানে বসে থাকার তুলনায় আমরা বনের ভিতর যেতে পারি। সকলকে অনুরোধ করছি। সোমনাথ কোথায় গেল?”
নায়ার বলল, “আবার একটা মৃতদেহ দেখতে।”
ক্রিস্নান মাতৃভাষায় কী একটা বলল। মুখে চমক। সবাই হেসে উঠল। তারপর ঈশিতা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চলো। দেখি, সোমনাথ ড্রাইসেল ব্যাটারিটা পেল নাকি।”
ক্রিস্নান বলল, “কী তা?”
“চলো দেখবে।” তার হাত ধরে টানল ঈশিতা।
ওরা বাংলার লন-এ ঢুকল। চৌকিদার একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। গ্রিলের দরজায় তালা আটকাতে এল।
বাংলোর বারান্দায় কর্নেল এবং সোমনাথ মুখোমুখি বসে ছিলেন। টেবিলে সত্যি ড্রাইসেল ব্যাটারির মতো জিনিস। কর্নেল ঈশিতাকে ‘হাই’ করলেন এবং অন্যদের প্রতি মাথা ঝুঁকিয়ে ঈষৎ বাও। ঈশিতা ছটফটিয়ে বলল, “এটা কী? কী এটা?”
সোমনাথ বলল, “হ্যাঁ। এটাই সেই জিনিস, যেটা দেখেছিলুম। তবে জিনিসটা ইনি কুড়িয়ে পেয়েছেন নদীতে। কেউ বাংলার বাউন্ডারি ওয়াল পার করে ছুঁড়ে ফেলেছিল। তো স্রোতে ভেসে গিয়ে আটকে ছিল। ইনি পেয়েছেন। ইনি ডিটেকটিভ। এঁর এটা চোখে পড়া উচিত ছিল। পড়েছে। তবে এটা ড্রাইসেল ব্যাটারি নয়। অথচ অবিকল সেইরকম মনে হবে। তো ভেতরটায় অসহ্য দুর্গন্ধ! আর রঙিন কাগজের কুচিঠাসা! কিন্তু হ্যাঁ! ইনি যা বলছেন, আই এগ্রি। কিছু মূল্যবান জিনিস ছিল এর মধ্যে। যে হাতিয়ে নেবার নিয়ে ফেলে দিয়েছে। দা পয়েন্ট ইজ : কে এটা নিয়ে এল ইভনিং ভিলা থেকে? আমার বিশ্বাস, আমরা কেউই এটা আনিনি। এনেছিলুম কি?”
নায়ার বলল, “অবাস্তব চিন্তা। আমাদের কারও হাতে কোনও জিনিস ছিল না।”
ঈশিতা বলল, “আমার যে হ্যান্ডব্যগটা ছিল, দেখাচ্ছি। এত বড় জিনিস ধরবে না। অশোকের ব্রিফকেস ছিল। ওতেও ধরবে না।”
ক্রিস্নান বলল, “আমার বড় ব্যাগ ছিল। ওতে আনা সম্ভব ছিল। কিন্তু আমি আনিনি। দেখাচ্ছি।”
কর্নেল হাত তুলে বললেন, “দরকার নেই আনার। আপনারা বসুন।”
ক্রিস্নান ফুঁসে উঠল। “আমি বিদেশী। আমার প্রতি সন্দেহ হতে পারে। আপনি আরিফকে ডাকুন। অনুসন্ধান করবে পুলিশ। কারণ এ একটা গুরুতর ঘটনা।”
ঈশিতা সায় দিল। সেও রাগে ফুঁসছিল। “নাহ্। সার্চ করা হোক। আমিই টেলিফোনে থানায় খবর দিচ্ছি।”
সে পা বাড়ালে নীপা বাধা দিল। “সিন ক্রিয়েট করে লাভ কী? লেট আস সিট টোগেদার অ্যান্ড সলভ দা মিসট্রি।”
“হ্যাঁঃ! মিসট্রি।” সোমনাথ বলল। মুঠোয় সিগারেট, “আসলে নাট্রাজেপাম ‘লিটল গ্রে সেলস’-কে ঘষে ভোতা করে দেয়। ক্রমশ আমি স্মরণশক্তি হারিয়ে ফেলছি। তো মশাই! আমার সিগারেট-দেশলাইয়ে রক্তের ছাপ এবং আমি যে ঘরে উঠেছি–সুমিত, নায়ার এবং আমি, সেই ঘরের বাথরুমে এই জিনিসটা এনে রেখে কেউ আমাকেই ইনক্রিমিনেট করতে চাইছে কি না, দ্যাটস আ পয়েন্ট। তাই নয় কি? নায়ার তুমি কটায় বাথরুমে গেছ। বলছিলে?”
নায়ার গুরুগম্ভীর স্বরে বলল, “ছটায়। এটা দেখিনি।”
“আমি সাতটায়।” সুমিত ঝটপট বলল। “এরকম কোনও জিনিস ছিল না।”
সোমনাথ বলল, “তারপর আমি গেছি। সাড়ে সাত হতে পারে, আটটা হতে পারে। মোট কথা, আমি পরে গেছি, তখন সবাই ডাইনিংয়ে ছিলিস তোরা। তারপর ডাইনিংয়ে আর্লি ব্রেকফাস্ট করলুম আমরা। হাঃ। তখন কেউ ওটা ফেলে দিয়েছিল নদীতে।”
ঈশিতা বলল, “তা হলে আমরা কেউ তা করিনি, এটা সিওর। আর অশোক সাতটায় বেরিয়ে গেছে।”
“হাঃ!” সোমনাথ মুঠো খুলে সিগারেটে টান দিন। “এগেন দা আউটসাইডার এসে পড়ছে। এবং এগেন কেউ আমাকেই ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। তার রিয়াল টার্গেট সম্ভবত আমি। এবার ডিটেকটিভ কর্নেল সরকার বলুন। ইউ অলরেডি নো দা ব্যাকগ্রাউন্ড। হাঁঃ! আপনি বলুন। তোমরা বসছ না কেন? তোমরা আমার বন্ধু। তোমরা বুঝতে চেষ্টা করো ব্যাপারটা। ম্যাথু! ব্রাদার! আমরা সবাই চা খাবো!” সোমনাথ মুখ ঘুরিয়ে কিচেনের দিকে তাকাল। “ব্রাদার ম্যাথু! হারি আপ প্লিজ!”
এবার সবাই বসল। কর্নেলের হাতে কফির পেয়ালা। অন্য হাতে জ্বলন্ত চুরুট। বললেন, “ব্ল্যাক প্যান্থার রেয়ার স্পিসিজ। কাজেই কাছে গিয়ে ভাল করে দেখার জন্য আপনাদের কৌতূহল জাগতে পারে। কেউ কি গিয়েছিলেন?”
ক্রিস্নান বলল, “হ্যাঁ আমি গিয়েছিলুম। শরীরে হাত দিয়েছিলুম। কিন্তু এই জিনিসটা দেখিনি।”
নায়ার বলল, “আমিও গিয়েছিলাম। কারণ ব্ল্যাকপ্যান্থার সাউথ ইন্ডিয়ার জঙ্গলের প্রাণী। নর্থের জঙ্গলে ব্যাকপ্যান্থার পাওয়া গিয়েছিল। অবশ্যই দ্রষ্টব্য আমার পক্ষে। কিন্তু আমি এটা দেখিনি।”
কর্নেল বললেন, “আর কেউ?”
সুমিত, ঈশিতা ও নীপা মাথা নাড়ল। তবে তারা তাকিয়ে দেখেছে কালো চিতাটাকে। কারণ ঘরে ঢুকলেই প্রথমে ওটা চোখে পড়ে। অবশ্য ঘরে আলো তত উজ্জ্বল ছিল না।
কর্নেল ক্রিস্নানকে বললেন, “আপনি নিশ্চয় ফটো তুলেছেন?”
ক্রিস্নান হকচকিয়ে গেল। মাতৃভাষায় কী একটা বলে হাসল একটু। বলল, “ছবি তোলার যোগ্য অনেক কিছু ওই ঘরে ছিল। বাইরেও ছিল। অনেক ছবি তুলেছি। কিন্তু এখনও ফিল্ম শেষ হয়নি।”
সে ক্যামেরা তুলে দেখে নিয়ে ফের বলল, “আর চার বা পাঁচটা ছবি তোলা যায়। আমি এখনই শেষ ছবি তুলে রোলটা আপনাকে দিচ্ছি। আপনি স্টুডিওতে দিন এবং দেখুন।”
ক্রিস্নান লনে নেমে বারান্দায় বসে-থাকা দলটির ছবি তুলল। তারপর পিছিয়ে গিয়ে ডাকবাংলো এবং লনের ছবি তুলে এনে ক্যামেরা থেকে ফিল্মের রোলটা বের করল। কর্নেলকে দিল।
কর্নেল বললেন, “ধন্যবাদ কৃষ্ণা!”
ক্রিস্নানের মুখে ঘামের ফোঁটা। সে শব্দ করে বসল। নায়ার বসল। নায়ার বলল, “সোমনাথ! যদি দেখা যায়, ছবিতে ব্ল্যাক প্যান্থারের পায়ের তলায় ওটা ছিল না, তাহলে আমরা পালাক্রমে তোমাকে মারব।”
সে ফিক করে হেসে গোঁফে হাত রাখল। কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর হাত ভরে সবুজ রঙের একটা ছোট্ট পাথর বের করে বললেন, “হ্যাভারস্যাকের মধ্যে এটা ছিল। দৈবাৎ এই একটা থেকে গিয়েছিল কি না জানি না।”
“অ্যাঃ?” নায়ার নড়ে উঠল। “কী ওটা?”
কর্নেল একটু হেসে বললেন, “পান্না নামে রত্ন আছে। তার রঙ সবুজ। এটা সম্ভবত পান্না।…”
.
০৪.
প্রত্যেকে পান্নাটা পালাক্রমে হাতে নিয়ে একটি রহস্যময় বাস্তবতাকে বোঝার চেষ্টা করছিল। সেই সময় আরিফের জিপ ঢুকল গেটে। জিপ বারান্দার নীচে এসে থামলে নায়ার ছ্যাতরানো গলায় বলে উঠল, “পোড়ি ইয়াকুমু!”
সুমিতের রসিকতার মেজাজ ছিল না। তবু চেষ্টা করল একটু। আড়ষ্ট হেসে বলল, “সড়া অন্ধা’র গল্প হয়ে গেল! ট্র্যান্সলেট করে বল্!”
নায়ার জবাব দিল না। গোঁফে হাত। আরিফ পুলিশ উর্দি পরে এসেছে। চেহারায় এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যক্তিত্ব। হাতে ছোট্ট ব্যাটন। জিপে কয়েকজন পুলিশ বসে আছে। সোমনাথ বলল, “আমি সারেন্ডার করছি। হ্যাঁ–সম্পূর্ণ। নিরস্ত্র অবস্থায়।”
আরিফ খান হাসল। “কী ব্যাপার?”
ঈশিতা আস্তে বলল, “আমার হাজব্যান্ড কি অ্যারেস্টেড?”
“কেন?” বলে আরিফ কর্নেলের দিকে তাকাল। “ওটা কী আপনার হাতে?”
কর্নেল বললেন, “পান্না।”
“আমার চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ–” সোমনাথ আবৃত্তি করে বলল, ‘আ কোট ফ্রম রবিঠাকুর। তবে হ্যাঃ! বাপের জন্মে পান্না-টান্না আমি দেখিনি। আমার বাবা শুনেছি মাসিক পঞ্চান্ন টাকার স্কুলটিচার ছিলেন। ইংরিজি কাগজে আমি সপ্তায় একটা হাজার শব্দের ফিচার লিখি। কদাচিৎ মাসে একটা বই রিভিউ। প্রফেশনে হাফগেরস্থ। কাজেই পান্না আমার চেতনা-টেতনার মধ্যে পড়ে না। য়ুরি গেলারের মতো অতীন্দ্রিয় শক্তি ছিল ওই ভদ্রলোকের–রবিঠাকুর! বড় জোর বলা চলে বোধ-হ্যাঃ! মাথার ভিতরে/স্বপ্ন নয় প্রেম নয় কোনো এক বোধ কাজ করে। আ কোট ফ্রম জীবনানন্দ দাশ।”
ঈশিতা ঠোঁট কামড়ে ধরে তাকিয়ে ছিল শূন্যদৃষ্টে। নায়ার গোঁফে হাত দিয়ে ঢেকে গোল চোখে সোমনাথকে দেখছিল। ক্রিস্নান, নীপা, সুমিত রুষ্ট আর বিরক্ত মুখে একবার সোমনাথ একবার আরিফ একবার কর্নেল এবং একবার পুলিশ-জিপটার দিকে তাকাচ্ছিল। পর্যায়ক্রমে।
সোমনাথ সিগারেট ধরানোর জন্য চুপ করলে আরিফ কর্নেলকে বলল “ওটা কি হ্যাভারস্যাক?”
কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, “ইউ আর রাইট, ডার্লিং!”
“আপনি ‘হাওয়াই আড্ডির জঙ্গলে কুড়িয়ে পেয়েছেন তা হলে?” আরিফ হ্যাভারস্যাকটার মাথাটা খুলেই নাকে হাত চাপা দিল। “বিশ্রী দুর্গন্ধ! ভেতরে এসব কী? রঙিন মার্বেল পেপারের কুচি মনে হচ্ছে। কিন্তু এই কুচিগুলো কিছুতেই সেকেন্ড গ্রেট ওয়ারের সময়কার নয়?”
“তা তো নয়ই।”
“পান্নাটা এর মধ্যে ছিল?”
“হুঁ। দৈবাৎ একটা থেকে গিয়েছিল কিংবা–” কর্নেল হাসলেন। “আমেরিক্যান সোলজারদের এই কালো পুরু প্লাস্টিকের হ্যাভারস্যাক আমার খুবই চেনা। বর্মার জঙ্গলে মার্কিন ‘লং রেঞ্জ পেনিট্রেশন গ্রুপ’–এল আর টি পি-কে এগুলো দেওয়া হত। তাদের আগেও একটা গেরিলা গ্রুপ ছিল। সাংকেতিক নাম ‘চিনডিট। যাই হোক, এখানকার সেই মার্কিন ঘাঁটির কদর্য জঙ্গলে আমি ঢুকিনি। এই বাংলোর পেছনে হাথিয়া নদী কিছুক্ষণ আগে এটা আমাকে উপহার দিয়েছে। এগুলোর বৈশিষ্ট্য হল, কোনও শব্দ করে না। ভাঙলেও নিঃশব্দে ভেঙে যায়।”
সোমনাথ কথা বলার সুযোগ পেল। “তো কেউ আমাকে ফাসাতে চাইছে। আমাদের পুরনো বন্ধু আরিফ খান এখন অফিসিয়ালি অন ডিউটি। কাজেই আমি একটা স্টেটমেন্ট দেব। হাঁ! লিখিতভাবেই দেব। সই করব–সাক্ষীসহ। বাংলা ইংরিজি যে-কোনোও ভাষায়।”
আরিফ ঘড়ি দেখে নিয়ে বলল, “আপাতত তার দরকার নেই। সংক্ষেপে বলো। বাট প্লিজ! মাইনাস ইওর ম্যানারিজম। কারণ তা উপভোগ্য হলেও আমার হাতে সময় কম। খুব ব্যস্ত আমি।”
সোমনাথ একটু ক্ষুব্ধ হল। “ম্যানারিজম? না না, এটা যথাযথ ইউসেজ নয়। স্টাইল বললেও আপত্তি থাকত না। ‘স্টাইল ইজ দা ম্যান। প্রত্যেকের নিজস্ব ল্যাংগুয়েজ আছে। যার যার, তার তারটা।”
নায়ার বলে উঠল “আওয়ান তুলাইয়া টে!” তার মুখে রাগ ফুঁসছে। জোরে শ্বাস ছাড়ল।
“ধুস্ ‘সড়া অন্ধা’! সুমিত চটে গেল। কর্নেলকে বলল, “আপনিই বলুন স্যার!”
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। কালো পুরনো হ্যাভারস্যাকটা হাতে নিয়ে বললেন, “চলো! যেতে-যেতে বলছি।”
জিপ উৎরাই শেষ করার সময় কর্নেলের ঘটনার বিবরণ শেষ হয়ে গেল। আরিফ বলল, “ইভনিং ভিলায় এরকম হ্যাভারস্যাক থাকা সম্ভব। আপনাকে ওই অন্ধ ভদ্রলোক সর্বেশ রায়ের কথা বলেছি।”
“আমেরিকান সাব?” কর্নেল হাসলেন। “ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই।”
“একটু প্রব্লেম হতে পারে।” আরিফ চিন্তিতভাবে বলল। “উনি কারও সঙ্গে কথা বলেন না। মেশেন না। গত রাত্তিরে আমি অবশ্য ওঁকে মিট করতে ইনসিস্ট করিনি। মিঃ বোসের মুখে ওঁর সম্পর্কে যেটুকু শুনেছি, দ্যাটস অল।”
“বাইরে বেরোন না উনি?”
“জানি না। জেনে নিতে অসুবিধা নেই। তবে অন্ধ মানুষের পক্ষে কারও সাহায্য ছাড়া পায়ে হেঁটে বেরুনো সম্ভব নয়। বেরুলে নিশ্চয় গাড়িতে।”
“ওঁর গাড়ি আছে জানো কি?”
“ইভনিং ভিলায় দুটো গাড়ি আছে। একটা ভিনটেজ কার। মিঃ বোস ওটা ব্যবহার করেন। লাস্ট কার র্যালিতে দেখেছি। এখান থেকে ভায়া জামশেদপুর ক্যালকাটা অ্যান্ড ব্যাক। অন্য গাড়িটা মারুতি। মিসেস বোসই ওটা ব্যবহার করেন। কয়েকবার ওঁকে নিজেও ড্রাইভ করতে দেখেছি। একজন ড্রাইভার অবশ্য আছে। শ্যামলাল নাম। আরিফ কর্নেলের দিকে ঘুরল। শ্যামলাল আপনার ক্লায়েন্ট বসন্ত হাজরার বডি শনাক্ত করেছে।”
“তুমি বলছিলে হাসপাতালের সুইপার রঙ্গিয়া।”
“হ্যাঁ। প্রথমে রঙ্গিয়া। সরি!” আরিফ হাসল। “আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। রঙ্গিয়াই রাত্তিরে বলেছিল, সবজিকাটরা বস্তির শ্যামলালও লোকটাকে চিনতে পারে। কারণ শ্যামলালের মা হাসপাতালে যখন ভর্তি ছিল, বসন্ত হাজরা তার সঙ্গে একদিন বুড়িকে দেখতে গিয়েছিল। পরে বুড়ি মারা যায়। রাত্তিরেই থানায় এস আই সতীশবাবুকে এই দায়িত্ব দিয়েছিলাম। উনি শ্যামলালকে মিট করতে পারেননি। সে রাত্তিরে নাকি ইভিনিং ভিলায় ছিল। মিঃ বোস ইজ আ বিগ গাই, ইউ নো। সকালে সতীশবাবু শ্যামলালকে তার বাড়িতে নিয়ে যান। মর্গে নিয়ে যান। শ্যামলাল বলেছে, বসন্ত হাজরা ভবঘুরে টাইপ লোক। কখনও কখনও বছরে দু’একবার তার বাড়ি আসত। ফের চলে যেত।”
“শ্যামলালের সঙ্গে তার কী করে আলাপ হল, বলেনি?”
আরিফ গাম্ভীর্যের ভান করে বলল, “মাই ডিয়ার ওল্ড বস! পুলিশ অত ফুলিশ সম্ভবত নয়।”
কর্নেল হাসলেন। “কখনই নয়। তবে আজকাল যা অবস্থা, পুলিশকে ফুলিশ সেজে থাকতে হয়। একদিকে রাম, অন্যদিকে রাবণ। ক্রসফায়ারের মধ্যে পড়ে গেছে। কাজেই মেক আ চয়েস। হয় রাম, নয়তো রাবণ।”
“অসাধারণ বলেছেন।” আরিফের মুখে হাসি ফুটল। “এনিওয়ে, শ্যামলালের মা নাকি বসন্ত হাজরাকে চিনত। কী সূত্রে চিনত, শ্যামলাল জানে না। লোকটা এলে নাকি শ্যামলাল বিরক্ত হত।”
“তুমি বলেছ রঙ্গিয়া চিনত তার স্বামীর বন্ধু হিসেবে।”
“হ্যাঁ। প্রব্লেম হল, রঙ্গিয়ার স্বামী নানকুও বেঁচে নেই এবং রঙ্গিয়া এর বেশি কিছু জানে না।”
“তুমি একজন বুদ্ধিমান ও দক্ষ পুলিশ অফিসার। তুমি ডিটেকটিভ ডিপার্টেও ছিলে।” কর্নেল চোখে বাইনোকুলার তুলে বললেন, “তোমার কি মনে হয়েছে। রঙ্গিয়া সত্য কথা বলছে?”
“বলা কঠিন। আপনি ওর সঙ্গে কথা বলতে পারেন।”
বইনোকুলার নামিয়ে কর্নেল বললেন, “বাই এনি চান্স, আরিফ, তুমি। চিতাবাঘের পায়ের তলায় এই হ্যাভারস্যাকটা দেখেছিলে কি?”
“লক্ষ করিনি। করলে বলতাম।”
“এই বুড়ো তোমাকে বের করছে!” কর্নেল স্বভাবমতো অট্টহাসি হাসলেন। “আসলে বাহাত্তুরে ধরেছে আমাকে।”
ইভনিং ভিলার গেটে জিপ থামাল আরিফ। ডানদিক থেকে কর্নেল হ্যাভারস্যাকটা নিয়ে নামলেন। লোহার গরাদ দেওয়া প্রকাণ্ড গেট। আরিফ তার লোকেদের বসে থাকতে বলে গেটের কাছে গেল। বলল, “এখানে রক্তের স্পট ছিল। ধুয়ে ফেলেছে দেখছি। এই তো জল ঢালা হয়েছে।”
কর্নেল বললেন, “ধোয়ার আগে আমি দেখে গেছি। মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে এখান দিয়ে সোজা জঙ্গল পেরিয়ে হাথিয়া নদীতে গিয়েছিলুম। নদীর ওপারে। লালঘুঘুর আঁক দেখা উদ্দেশ্য ছিল।”
“আপনার লালঘুঘুর প্রতি আসক্তি আছে শুনেছি।” আরিফ ঘড়ি দেখল। “কিন্তু গেটে দুজন কনস্টেবল থাকার কথা ছিল।”
কর্নেল বললেন, “ওই যে তারা ভেতরে চা খাচ্ছে।”
ইভনিং ভিলার ভেতরটা প্রায় জঙ্গল বলা চলে। একফালি পথ চড়াইয়ে উঠে গিয়ে দোতলা বাড়ির পোর্টকোর তলা দিয়ে ঘুরে একখানে এসে মিলেছে। তাই পোর্টিকোর সামনেকার জায়গাটা তিনকোনা এবং সেখানে ঘন বর্মিবাঁশের জঙ্গল, ও একটা মৃত ফোয়ারা। ফোয়ারার মার্বেল ফাটা। বুনো ঝোঁপ গজিয়ে আছে। ফোয়ারার মাথায় একটা কবন্ধ মূর্তি। নগ্ন নারী। একটা হাত ভাঙা অন্যহাতে কুম্ভ। পোর্টিকোর থাম ঘেঁষে প্রচণ্ড লাল বোগেনভিলিয়া। বাঁদিকে খোলা ঘাসজমিতে দুজন কনস্টেবল চা খাচ্ছিল। কাপ নামিয়ে রেখে হন্তদন্ত ছুটে এসে সেলাম দিল এবং গেট খুলল।
আরিফ বলল, “বোস সাব হ্যায়?”
একজন কনস্টেবল বলল, “জি।” অন্যজন খবর দিতেই দৌড়ে গেল। কিন্তু চড়াইটা তার পক্ষে বিপত্তিকর। এলোমেলো নুড়িপাথরে ভর্তি পথ।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, “বোঝা যাচ্ছে কেন মিঃ মুখার্জি রিস্ক নিতে চাননি। তাকে কলকাতা ফিরতে হবে অক্ষত গাড়ি নিয়ে। আরিফ! বড্ড বেশি নুড়ি ফেলা হয়েছে। তাই না? বিশেষ করে ধারালো নুড়ি জিপের পক্ষে অলরাইট। কিন্তু ভিনটেজ কার এবং মারুতির মতো গাড়ির পক্ষে রিস্কি। এখানে-ওখানে গর্তও দেখছি!”
আরিফের সঙ্গে কর্নেল ভেতরে ঢুকে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। আরিফ আস্তে বলল, “আমি ইভনিং ভিলায় কাল বিকেলে প্রথম ঢুকেছি। আমারও অবাক লেগেছিল।”
কর্নেল ঝুঁকে নুড়ি পাথরগুলো দেখে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “খুব সম্প্রতি নতুন করে নুড়িপাথর ফেলা হয়েছে। অথচ এই গর্তগুলো–এ কি ইচ্ছাকৃত? একটা বিপজ্জনক রাস্তা দেখছি।”
আরিফ বলল, “বাঁদিকে এই ঘাসের ওপর রক্তের ছাপ ছিল। ধুয়ে দিয়েছে। বসন্ত হাজরা মার খেয়ে স্বাভাবিকভাবেই নুড়ির ওপর দিয়ে ছুটে যায়নি। ঘাসের। ওপর দিয়ে গিয়েছিল। আসুন, কোথায়-কোথায় রক্ত ছিল দেখাচ্ছি। হ্যাঁ, জল ঢেলে ধুয়ে দিয়েছে। এই দেখুন, ঘাসের নীচে মাটি ভিজে হয়ে আছে।”
সে জায়গাগুলো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে হাঁটছিল। কর্নেল বললেন, “গেটে দারোয়ান থাকে না। এও অদ্ভুত!”
আরিফ বলল, “মিঃ বোস বলছিলেন, দারোয়ান ছুটিতে গিয়ে আসছে না। তাই গণেশ গেটে তালা দিয়ে রাখে। কোনও বিগ গাই বা চেনাজানা কেউ এলে আগে ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রাখে। কাল বিকেলে বীতশোক বাংলো থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করল। আমাকেও যেতে বলল। আমারও একটু কৌতূহল ছিল বলতে পারেন।” আরিফ হঠাৎ আস্তে বলল, “জাস্ট পার্সোনাল এনথুসিয়াসিজম। মিঃ বোসের সঙ্গে নানা জায়গায় মিট করেছি। ওঁর মিসেসের সঙ্গেও।” সে হাসল, “ইউ নো বস, আইম আ বিট রোম্যান্টিক।”
“হুঁ!” কর্নেল বাইনোকুলারে পাখি খুঁজছিলেন হাঁটতে হাঁটতে। “বাড়িটা ক্যাসলটাইপ। র্যাদার–আ ফ্রেঞ্চ শাতো। দক্ষিণে ফ্রান্সের মোরোতে অবিকল এরকম স্থাপত্য দেখেছি। তো মিঃ দাশগুপ্ত নিশ্চয় এই ঘাসের ওপর দিয়ে যাতায়াত করেছিলেন?”
“সোমনাথ? হ্যাঁ–সেটাই স্বাভাবিক। কাল বিকেলে আমরা সবাই এই ঘাসের ওপর দিয়ে গিয়েছি এবং ফিরে এসেছি।”
কর্নেল আবার দাঁড়ালেন। ডার্লিং! এ যে দেখছি একটা বিশাল ভূসম্পত্তি! আমার ধারণা, তিরিশ একরের বেশি হবে। পুরো একটা টিলা পাহাড়ের মাথা কেটে বাড়িটা তৈরি। বাউন্ডারি ওয়াল জেলখানার মতো উঁচু। আমি নিশ্চিত, এ বাড়ির একটা রীতিমতো ইতিহাস আছে। ইট মে বি সেনসেশন্যাল।” কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে বললেন, “আমেরিকান সাব’ একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ করে চোখে পড়ে না। ক্যামোফ্লাজটা সম্ভবত মার্কিন সেনাদের দেখে শেখা। নেহাত শখ ছাড়া কী বলা যাবে? এইরকম সবুজ ছোপ দেওয়া মেটে রঙের শার্ট, স্যাডো দেওয়া গ্রে প্যান্ট। চোখের কালো চশমা গাছের গাঢ় ছায়ায় মিশে থাকে। ডার্লিং” বাইনোকুলার নামালেন কর্নেল। বললেন, “হি ইজ নট আ ম্যান, জাস্ট অ্যান ইমেজ অব আ ম্যান। আ ফসিলাইজড বডি। লোকটি সত্যি অদ্ভুত।”
আরিফ আস্তে বলল, “মিসেস বোস উত্তরের ব্যালকনির দোতলায়।”
“হু! দেখেছি। প্রকৃত সুন্দরী বলা চলে।”
“বয়স অনুমান করতে পারেন?”
“আমি চিরকুমার, ডার্লিং! তুমি বলো।”
“পঁচিশ থেকে আঠাশের মধ্যে।” আরিফ জোর দিয়ে বলল। “কিন্তু মিঃ বোস ইজ অ্যাবাউট ফর্টিফাইভ টু ফর্টিএইট। আরও বেশি হতেও পারে। বাট হি লুস্ ইয়াং।”
গাড়িবারান্দায় পাঁচটি ধাপ। হলঘরের দরজা খোলা। কর্নেল ও আরিফ বারান্দায় উঠলে ভেতর থেকে কেউ ভারী গলায় বলল, “ওয়েলকাম মিঃ খান।”
আরিফ পরিচয় করিয়ে দিল কর্নেলের সঙ্গে। ফায়ারপ্লেসের কাছে লাল ভেলভেটের গদি আঁটা সিংহাসন-ধাঁচের চেয়ার থেকে উঠে বোসসায়েব হ্যান্ডশেক করে একটু তাকাতে সোফা দেখিয়ে বললেন, “বসুন।”
প্রথম দর্শনেই কর্নেলের মনে হল লোকটি দাম্ভিক। কর্নেল কালো চিতাটার দিকে তাকালেন। বললেন, “ব্ল্যাক প্যান্থার! কী আশ্চর্য!”
“হ্যাঁ! তবে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বাই দা বাই, ব্যানার্জি বলছিল, আপনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ?” বোসসায়েব পাইপে তামাক ভরতে থাকলেন।
“না মিঃ বোস। আমি একজন নেচারিস্ট।”
“আমার লুকোবার কিছু নেই। আপনি যা জানতে চান, জিজ্ঞেস করতে পারেন।” বোসসায়েব লাইটারে পাইপ ধরিয়ে বললেন, “আজ আমি একটু ব্যস্ত। মিঃ খানের খাতিরে কথা দিয়েছি। মেক ইট উইদিন আ ম্যাক্সিমাম অফ টুয়েন্টি মিনিটস।”
“আজ সন্ধ্যায় আপনার ককটেল ডিনার।” কর্নেল ঘরের ভেতরটা দেখতে দেখতে বললেন, “সেটা কি এখানেই হবে?”
“নিশ্চয় না। ওদিকে গেস্টহাউস আছে, লন আছে। ইউ নিড এনাফ স্পেস ফর আ পার্টি।” বোসসায়েব ঠোঁটে পাইপ কামড়ে ধরে বললেন, “ব্যানার্জিকে বলে দিয়েছি, আপনাকে ইনভাইট করবে। দেখা হয়নি তার সঙ্গে? না বললেও কথা নেই। ইউ আর ওয়েলকাম। আমি বলছি। মিঃ খান, ইউ প্লিজ মাস্ট কাম। বেগমসায়েবাকে আনতে ভুলবেন না যেন। ইউ প্রমিজড, আঁ?”
আরিফ বলল, “দেখা যাক,।”
“নো, নো দেখা যাক।” বোসসায়েব একটু ঝুঁকে এলেন। “মিঃ প্রাইভেট ডিটেকটিভ কি রক্ত খুঁজছেন? ধুয়ে ফেলা হয়েছে। কী খুঁজছেন আপনি?”
কর্নেল সোফার তলার দিকে গুঁড়ি মেরে বললেন, “একটা ডটপেন।”
“হোয়াট?”
“হু। পেয়ে গেছি।
“আপনার হাত থেকে পড়ে গেছে আই থিং?”
“নাহ্। এটা আমার নয়। তবে এটা পড়ে থাকার কথা ছিল। পেয়ে গেলুম।” কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “ডটপেনটা খুব সাধারণ, কমদামি। কাজেই আপনারও নয়।”
“তা হলে কাল বিকেলে ব্যানার্জির বন্ধুরা কেউ ফেলে গেছে। এক ভদ্রলোক নাকি সিগারেটের প্যাকেট ফেলে গিয়েছিলেন। তাই না মিঃ খান।”
আরিফ মাথা দোলাল। কর্নেল হ্যাভারস্যাকটা সোফায় রেখে কালো চিতাটার কাছে গেলেন। বোসসায়েবের ঠোঁটের কোনায় বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। কর্নেল স্টাকরা চিতার সামনের দু পায়ের ফাঁকটা দেখতে দেখতে বললেন, “এখানে একটু একটু রক্ত থেকে গেছে, মিঃ বোস!”
বোসসায়েব ভারী গলায় ডাকলেন, “গণেশ!”
ভেতরের দরজার পর্দা তুলে একজন তাগড়াই চেহারার লোক উঁকি দিয়ে বলল, “চা আসছে স্যার!” তারপর সে সোফায় রাখা হ্যাভারস্যাকটার দিকে তাকিয়ে রইল।
বোসসায়েব ধমক দিলেন। “হাঁ করে কী দেখছিস? ওখানে রক্ত না কী আছে, ধুয়ে দে।”
“কোথায় স্যার?”
কর্নেল বললেন, “এখানে।”
গণেশ বিরক্তমুক্ত বলল, “ওখানে রক্ত গেল কী করে?”
বোসসায়েব গলার ভেতর বললেন, “যে-ভাবে হোক, গেছে। ধুয়ে দে এক্ষুনি।”
গণেশ চলে গেলে কর্নেল এসে সোফায় বসলেন। বললেন, “কাল বিকেলে ওখানে একটা পুরনো মার্কিন মিলিটারি হ্যাভারস্যাক ছিল। কতকটা ড্রাইসেল ব্যাটারির গড়ন। এই যে এইটা। দেখুন তো, চিনতে পারেন নাকি।”
“নাহ।” বোসসায়েব নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে গোঁফের একটা পাশ টানতে টানতে বললেন, “এ ঘরে কত কিছু থাকতে পারে। সো হোয়াট?”
“আপনি কি এমন কোনও জিনিস দেখেছেন? এটা ইভনিং ভিলাতেই থাকার কথা।”
“নাহ্। আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ নই। এভরিহোয়্যার-পোকিংনোজ-টাইপের লোকেরা হয়তো–”
“ইভনিং ভিলায় আপনি কত বছর আছেন মিঃ বোস?”
বোসসায়েবের চোখ আবার নিষ্পলক হয়ে গেল। একটু পরে বললেন, “এ বাড়ি নাইনটিন ফাইভে তৈরি। গেটে দেখে নেবেন।”
আমার প্রশ্নের উত্তর হল না কিন্তু।”
“সিন্স মাই চাইল্ডহুড, এটুকু বলতে পারি।”
“বাড়িটা কে তৈরি করেছিলেন জানেন কি?”
বোসসায়েব একটা ভুরু তুলে বাঁকা হেসে বললেন, “আপনি জানেন মনে হচ্ছে? বেশ তো, আপনিই বলুন।”
একটি দেহাতি চেহারার মেয়ে চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকল। সোফার টেবিলে রেখে বিনীতভাবে বলল, “লালুর বাবা আসবে আখুনি। বুঢ়াসাব আভি ডাকল। হাথ মালিশ করতে গেল।”
বোসসায়েব বললেন, “ঠিক আছে। তুই যা, মিঃ খান! চা নিন।”
মেয়েটি কর্নেলের দিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেল।
আরিফ চায়ের কাপ নিল। কর্নেল বললেন, “থ্যাংকস্! আমি চা খাই না।”
“বলুন, আর কী প্রশ্ন আছে? আমি ব্যস্ত।”
“মিঃ রায়ের সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই।”
“হি উইল নট অবলাইজ ইউ, কর্নেল–”
“কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।”
“কর্নেল সরকার, মাই ব্রাদার-ইন-ল ডাজ টক।”
“আশা করি তিনি বোবা নন?”
“ফর ইওর ইনফরমেশন, উনি বোবা। ডাকাতরা ওঁকে শুধু অন্ধ করে দেয়নি, জিভও কেটে নিয়েছিল।”
আরিফ বলল, “ইজ ইট?”
“হ্যাঁ মিঃ খান।” বোসসায়েব হেলান দিলেন। “আমার দুর্ভাগ্য, সে-রাতে আমি কলকাতায় ছিলুম।”
আরিফ বলল, “শুনেছি বছর দশেক আগের ঘটনা এটা?”
“এগারো বছর।”
কর্নেল বললেন, “তখন কি আপনি ব্যাচেলার ছিলেন?”
বোসসায়েব শুকনো হাসলেন। “হ্যাঁ। আমি বিয়ে করেছি মাত্র তিন বছর আগে।”
কর্নল চুরুট বের করে ধরালেন। “তা হলে মিঃ বোস, আপনার বিয়েরও আট বছর আগে মিঃ রায় এবাড়িতে ছিলেন। সম্ভবত তার কাজিন মিস রত্না রায়ও তার কাছে থাকতেন। এর একটাই মানে হয়, ওঁরা এ বাড়িতে আপনার আশ্রিত ছিলেন। কিন্তু আমার ইনফরমেশন, আপনিই এ বাড়িতে আশ্রিত। ছিলেন। কোনটা ঠিক?”
“দেখুন মশাই!” বোসসায়েব ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন, “কে একজন ভবঘুরে মার খেয়ে এ বাড়িতে শেল্টার নিতে এসে দৈবাৎ মারা পড়েছে। তার সঙ্গে যদি আমাকে জড়ানো হয়, হোক। মিঃ খান আমাকে অ্যারেস্ট করতে পারেন, করুন। যা হবার, কোর্টে হবে। কিন্তু সরি! আপনার এ সব কদর্য প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই। মিঃ খান। দিস ইজ বিয়ন্ড দা লিমিট।”
আরিফ দৃষ্টি নামিয়ে চায়ে চুমুক দিল। কর্নেল বললেন, “আমার শেষ প্রশ্ন মিঃ বোস! দয়া করে উত্তেজিত হবেন না। আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী। আপনার বিন্দুমাত্র ক্ষতি করার ইচ্ছা আমার নেই।”
কর্নেলের কণ্ঠস্বরে একটু আবেগ ছিল। বোসসায়েব আস্তে কিন্তু ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, “বলুন! কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে কোনও প্রশ্ন করলে জবাব দেব না। নেহাত মিঃ খানের খাতিরে আমি এতগুলো কথা খরচ করেছি।”
“বাড়ির গেট থেকে পোর্টিকো পর্যন্ত রাস্তায় কোনও গাড়ি যাতায়াত করুক, এটা আপনি চান না। কেন?”
“ননসেন্স। এটা অ্যাবসার্ড কোয়েশ্চেন।”
“না মিঃ বোস! অতি সম্প্রতি নতুন করে প্রচুর নুড়ি ফেলা হয়েছে।” কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। “তা ছাড়া এ ধরনের ধারালো নুড়ি কেউ লনের রাস্তায় ফেলে না। এবং অত সব গর্ত! কাজেই আমার ধারণা, আপনি চান না কোনও গাড়ি যাতায়াত করুক।”
আরিফ উঠে দাঁড়িয়ে একটু হেসে বলল, “জিপ যাতায়াতের অবশ্য অসুবিধা নেই।”
কর্নেল বললেন, “হ্যাঁ। কিন্তু কোনও ভাল গাড়ি–লাক্সারি কার, বিশেষ করে মারুতি, কনটেসা, ওয়েল! ধন্যবাদ মিঃ বোস! আপনি অসন্তুষ্ট হলেও আমি নির্লজ্জের মতো আপনার ককটেল-ডিনারে আসছি। জেন্টলম্যান’স ওয়ার্ড, মিঃ বোস! আপনি নেমন্তন্ন করে ফেলেছেন এবং আমি তা অ্যাকসেপ্ট করেছি।”
বোসসায়েব চুপচাপ বসে রইলেন। আরিফ বলল, “চলি মিঃ বোস! দেখা হবে!”
বোসসায়েব শুধু মাথাটা দোলালেন। বেরিয়ে এসে কর্নেল পোর্টিকোর সামনেকার ফোয়ারার দিকে এগিয়ে গেলেন। ফুট আট-নয়েক চওড়া নুড়ি ঢাকা পথটা পেরিয়ে যেতে হল তাকে। ফোয়ারার গোল মঞ্চের নীচে চারদিকে বৃত্তাকার শুকনো গভীর গর্ত। উঁচু ঘাস, ঝোঁপঝাড় এবং বর্মিবাশের জঙ্গল সেই খুদে প্রাক্তন জলাধারটি ঘিরে রেখেছে। উঁকি মেরে দেখে চলে এলেন কর্নেল। আরিফ বলল, “কিছু থাকার কথা ছিল কি?”
কর্নেল হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “ছিল। কিন্তু নেই। বাই দা বাই, বসন্ত হাজরার পায়ে জুতো ছিল না। তাই তো?”
আরিফ বলল, “সেটা স্বাভাবিক। মার খেয়ে এবং তাড়া খেয়ে পালানো লোকের পক্ষে
বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন, “বাইরে রাস্তায় কোথাও তার জুতো পাওনি কিন্তু।”
“হাথিয়াগড়ে প্রচুর ভবঘুরে এবং ভিখিরি আছে। জুতো পড়ে থাকলে কুড়িয়ে নেবার লোকের অভাব নেই।”
কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে বললেন, “ফোয়ারার একধারে ঘাসগুলো বেঁকে ঝুঁকে পড়েছে শুকনো ট্যাংকে। আগামী বর্ষার আগে সেগুলো সোজা হচ্ছে না। ঘাসগুলোর ডাটা ভেঙে গেছে দেখলুম। আরিফ, কেউ কাল বিকেলে ওখানে লুকিয়ে ছিল। ট্যাংকের তলা শুকনো হলেও আবছা ছাপ পড়েছে জুতোর। হ্যাঁ, একজোড়া জুতো ওখানে থাকা উচিত ছিল।”
আরিফ বলল, “হোয়াট অ্যাবাউট দা ডট-পেন?”
কর্নেল হাসলেন। বললেন, “সোমনাথ দাশগুপ্তের চারমিনার প্যাকেটের ভেতরকার কাগজটা ছেঁড়া এবং সেটাই পাওয়া গেছে বসন্ত হাজরার পকেটে দেশলাইয়ের ভেতর রোল করা অবস্থায়। ওতে আমার নাম-ঠিকানা লেখা আছে। বসন্ত হাজরার কাছে তোমরা কোনও ডট-পেন পাওনি। কাজেই একটা ডটপেন দরকার ছিল। স্বাভাবিকভাবেই সেটা হাত থেকে পড়ে যাওয়ারই কথা।”
“কিন্তু ফোয়ারার তলায় জুতোর ব্যাপারটা কী?”
কর্নেল বললেন, “দ্যাটস অ্যান আইডিয়া। যাই হোক, চলো। রঙ্গিয়া-দর্শনে যাওয়া যাক।”..
.
০৫.
এও ডাবলবেড রুম। কিন্তু তিনজন থাকার জন্য বাড়তি একটা ফোল্ডিং খাটের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেটি সোমনাথ নিয়েছিল। বাকি দুটিতে সুমিত ও নায়ার। অন্য দুটি ডাবলবেড রুমে বীতশোক ও ঈশিতা, নীপা ও ক্রিস্নান। এগারোটায় বীতশোক ফিরল। তার ‘কলকাতাটিম’ তখন বারান্দা থেকে উঠে এসেছে। লবি থেকে ঘরগুলোকে আলাদা করার জন্য কাঠের পার্টিশন থাকায় ঘরগুলোর সামনে একটা করিডর হয়েছে। করিডরে পৌঁছে সে থমকে দাঁড়াল!
সোমনাথ বলছিল, “অস্বীকার করে তো লাভ নেই। আমরা প্রত্যেকেই ভয় পেয়েছি। মানুষের ক্ষেত্রে ভয় পেলে অতীতে দু’টো রিঅ্যাকশন দেখা গেছে। হয় তারা জোট বাঁধে, নয় তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। হাঃ, এটাই মোটামুটি ঐতিহাসিক নিয়ম ছিল। কিন্তু পোস্ট-মডার্নিস্ট পিরিয়ডে রিঅ্যাকশনটা অন্যরকম। অ্যাবসোলিউট এলিয়েনেশন–চরম বিচ্ছিন্নতা। তবে কাপড়চোপড়ের মধ্যে আমরা প্রত্যেকেই যে উলঙ্গ, এই বোধটা থাকা উচিত। হাঃ! কোনও কোনও ঘটনা আমাদের কাপড়চোপড় খুলে ফ্যালে।”
নায়ার বলল, “ধুর ব্যাটা! তোর মূল বক্তব্যটা কী?”
সুমিত বলল, “মাইরি, এরপর মহিলাদের এখানে বসে থাকা আর উচিত, নয়।”
ঈশিতা বলল, “মাইরি-ফাইরি ছাড়ো! ভাগ্যিস আরিফ এখানে ছিল, তা না হলে এতক্ষণ পুলিশ সত্যি কাপড় খুলে নিত।”
নায়ার বলল, “ঈশিতা! তুমি কেন তখন আরিফকে বললে বীতশোক অ্যারেস্টেড কি না? এ কথা বলার কি বিশেষ কারণ আছে?”
ঈশিতা বলল, “জানি না। কেন যেন কথাটা আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। ইনস্টান্ট রিঅ্যাকশন!”
বীতশোক এতক্ষণে ঘরে ঢুকল। একটা চাপা হইচই পড়ে গেল। ঈশিতা চোখ বড় করে বলল, “সাংঘাতিক ব্যাপার। ইভনিং ভিলা থেকে এই বাংলোয় কে প্রচুর জুয়েল পাচার করেছে। তার মানেটা বুঝতে পারছ?
নায়ার বলল, “পান্না!”
বীতশোক টেবিলে ব্রিফকেস রেখে খাটে বসল। মুখে ধারালো হাসি এনে বলল, “নিউ টাউনশিপের মোড়ে আরিফের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সব শুনলাম। ও নিয়ে তোমাদের চিন্তার কোনও কারণ নেই। টেক ইট অ্যাজ আ ফান।”
সোমনাথ বলল, “কিন্তু এ ঘরের বাথরুমে–”
তাকে থামিয়ে বীতশোক বলল, “ছেড়ে দে না বাবা! এই বাংলোর কোনও লোক কাজটা করতে পারে। পুলিশ ঠিকই খুঁজে বের করবে। ঈশু! চাবি দাও!”
ঈশিতা তাদের রুমের চাবি দিলে বীতশোক উঠল। কিন্তু যেতে যেতে হঠাৎ ঘুরে সে ঈশিতার দিকে তাকাল। ঈশিতা বুঝতে পেরে স্বামীকে অনুসরণ করল।
সুমিত হাসল। “মাইরি! চোখে চোখে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সত্যি কথা হয় তা এতদিনে বিশ্বাস করলুম।”
“হাঃ! সেমিওটিকস্!” সোমনাথ বলল। “চিহ্ন এবং সংকেতের মাধ্যমে যোগাযোগ। সেভেনটিন সেঞ্চুরির শেষাশেষি দার্শনিক জন লক এটা লক্ষ করেন। তারপর চার্লস পিয়ার্স, চার্লস, মরিস, দা বিহেভিয়ারিস্ট। তো হাঃ। ইভনিং ভিলার কেউ এইভাবে কিছু কমিউনিকেট করার চেষ্টা করেছে কি না, ভাবা যেতে পারে। থ্রু দা সাইনস্ অ্যান্ড সিম্বলস। সেমিওটিকস একেবারে আদিম মানুষের কমিউনিকেশন পদ্ধতি থেকে সূত্র খুঁজে বের করে ডালপালা মেলেছে। ব্যাপারটা হল কমিউনিকেশন সায়েন্স। আমরা একে কাজে লাগিয়ে দেখতে পারি। কেউ কিছু বলতে চাইছে কি না।”
নায়ার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার প্রস্তাব, এই উন্মাদ বুদ্ধিজীবীকে ফেলে রেখে আমরা কিছুক্ষণ প্রমোদপর্যটন করে আসি? উঠে পড়ো সব।”
ক্রিস্নান বলল, “চলো! নীপা! বেশি দূর যাব না আমরা। নিকটে বনে ঢুকব। তোমার পরিশ্রম হবে না।”
নীপা অনিচ্ছার ভঙ্গিতে উঠল। সোমনাথ বলল, “তোমরা কেউ কি আমাকে একটু কাগজ দিতে পারো?”
সুমিত বলল, “নির্ঘাত পদ্য লিখবে মাইরি! সেবার হেসডি ডাকবাংলোয় চৌকিদার বেচারাকে দশ মাইল হাঁটিয়ে কাগজ এনে এগারোখানা পদ্য লিখেছিল। বিলিভ মি!”
নায়ার বলল, “লেখো। তবে আমরা বাইরে থেকে তালা এঁটে দিয়ে যাব। কারণ আবার কে কখন তোমার নাকের ডগা দিয়ে বাথরুমে পান্না রেখে যাবে।”
“নীপু! তোমার কাছে কাগজ নেই?” সোমনাথ বলল। “অন্তত নোটবইয়ের একটা পাতা হলেও চলবে।”
নাপা বলল, “নাহ”।
ক্রিস্নান বলল, “আমি এনে দিচ্ছি। আমার আছে। কিন্তু তুমি কি সত্যই পদ্য লিখতে চাও?”
সোমনাথ বলল, “আমি একটু অঙ্ক কষব। কৃষ্ণা, দেরি কোরো না। আজকাল আমি এক মুহূর্তের কথা অন্য মূহুর্তে ভুলে যাই। হাঃ-নাইট্রাজেপাম আমাকে ঘুম বেচে স্মৃতিশক্তি কিনে নিচ্ছে। বিনিময় পদ্ধতিতে।”
ক্রিস্নান বেরিয়ে গেল। নীপাও তার পিছন-পিছন গেল। হাতের মুঠোয় চারমিনার প্যাকেট ও দেশলাই নিয়ে সোমনাথ বেরুল। বলল, “আমি লবিতে বসে অঙ্ক কষব। অ্যালজেব্রা এবং জিওমেট্রির মাঝামাঝি আ সর্ট অব পিওর ম্যাথস।”
সুমিত বাথরুম সেরে বেরিয়ে এল। বলল, “একটা ব্যাপার লক্ষ করলুম মাইরি! বাথরুমের জানালায় গরাদ নেই। কাঁচের পাল্লাটা কাত হয়ে আছে। কাজেই বাইরে থেকে কেউ ইচ্ছে করলে ভেতরে সত্যিকার একটা ড্রাইসেল ব্যাটারিও ঢুকিয়ে রাখতে পারে। নীচে থেকে ম্যাক্সিমাম ফুট সাতেক উঁচু। পাশে পাইপ আছে। খাঁজে পা রেখে–সো ইজি!”
নায়ার ব্যস্তভাবে বলল, “পাল্লাটা আটকে দেওয়া উচিত।”
“দিয়েছি।” সুমিত চাপা গলায় বলল, “বাইরে থেকেই কেউ ওই হ্যাভারস্যাকটা পাচার করেছিল।”
নায়ার ফিসফিস করে বলল, “আরিফ কোনও গুরুত্ব দিল না! কর্নেল ভদ্রলোকও খালি দূরবীক্ষণ নিয়ে ব্যস্ত।” সে দুই হাতের তালু গোল করে চোখে রেখে কর্নেলের ভঙ্গি অনুকরণ করল এবং ফিক করে হাসল। নায়ার মাঝে মাঝে চমৎকার ক্যারিকেচার করে।
ক্রিস্নান ও নীপা এসে গেল। ক্রিস্নানের হাতে একটা লাইনটানা বিদেশি কাগজ। সোমনাথ সেটা নিয়ে বলল, “হাঃ। এবার আমার একটা কলম চাই। কেউ কি আমাকে একটা কলম দিতে পারো?”
ক্রিস্নান তার জিনসের জ্যাকেটের হাতা থেকে একটা কলম বের করে দিল। সোমনাথ লবিতে গিয়ে বসে পড়ল।
গেটের কাছে গিয়ে নায়ার থমকে দাঁড়াল। বলল, “বীতশোক আর ঈশিতাকে ডাকা উচিত ছিল।”
সুমিত মুখে গাম্ভীর্য এনে বলল, “ওদের ডিসটার্ব করা উচিত হবে না।”
“কেন?”
“তুই একটা গাড়ল মাইরি!” সুমিত হঠাৎ থেমে চোখে হেসে বলল, “ভদ্রমহিলারা এগোতে থাকো। আমি নায়ারকে একটা এরিয়ান মিথলজি শোনাব। মেয়েদের শুনতে নেই।”
নীপা ক্রিস্নানের হাত ধরে টানল। দু’জনে উৎরাইয়ে নামতে থাকল। নায়ার বলল, “তুই বলতে চাস কী?”
সুমিত হাসল। “কার্তিকের জন্মবৃত্তান্ত শোন। মাইরি! অসাধারণ। শোন না। স্বর্গে এক অসুর হানা দিয়েছে। দেবতাদের বেদম পিটোচ্ছে। তখন সবাই গেল ব্রহ্মার কাছে। ব্রহ্মা গেলেন শিবের খোঁজে। এ দিকে শিব ও পার্বতী তখন হেভি সেক্সে ব্যস্ত। বুঝলি তো? ব্রহ্মাকে দেখে শিব ধুড়মুড় করে উঠে পড়লেন। পার্বতী লজ্জায়–মাইরি! অ্যান্ড দা এনার্জি ফেল ডাউন বিসাইড দা রিভার সরস্বতী। কাশবন চিনিস তো? তার মধ্যিখানে পড়েই জিনিসটা বাচ্চা হয়ে গেল। ওঙা ওঙা করে কান্না। সেই সময় চাঁদের ছয় বউ কৃত্তিকারা এসেছে। স্নান করতে। তারা কান্না শুনে গিয়ে দেখে, একটা বাচ্চা! সবাই ব্রেস্ট ফিড। করতে চায়। মেয়েছেলের ব্যাপার–বুঝলি তো? এ বাবা শিবের বাচ্চা। ছ’খানা। মুখ দিয়ে ছ’জনের–মাইরি, বিলিভ মি! তাই কার্তিকের আরেক নাম ষড়ানন। সে বড় হয়ে অসুর ব্যাটাচ্ছেলের বডি ফেলে দিয়েছিল।”
নায়ার হঠাৎ চটে গেল। “ধুর ব্যাটা! তোর মাথার মধ্যে শিবলিঙ্গ প্রোথিত আছে। সেক্স-পার্ভার্ট!”
একটু পরে ঈশিতা বেরিয়ে এসে বলল, “বারোটায় লাঞ্চ খেয়ে রেডি থাকতে হবে। অশোক একটা গাড়ি ঠিক করেছে। হাথিয়া ফলস দেখতে যাব আমরা। সেখান থেকে পাতালেশ্বরীর মন্দির। তারপর ইভনিং ভিলা। কোথায় যাচ্ছ তোমরা?”
আশেপাশে একটুখানি ঘুরে আসি।” সুমিত পা বাড়াল। “আধ ঘণ্টাটাক ঘুরব নেচারে। মাথাটা ভো ভো করছে।”
উৎরাইয়ে একটু দূরে গাছের তলায় পাথরে বসে পড়েছে নীপা। ক্রিস্নান ভিউফাইন্ডারে দৃশ্য দেখছে। হাঁটতে হাঁটতে ঈশিতা বলল, “সোমনাথ লবিতে বসে কবিতা লিখছে দেখলুম। জিজ্ঞেস করলুম। মুখ তুলল না।”
নায়ার বলল, “বুদ্ধিজীবী অঙ্ক কষছে। সেমিওটিকসের সঙ্গে অঙ্কের কী সম্পর্ক আমি জানি না। অবশ্য আজকাল পরিসংখ্যান সবকিছুতে লাগে।”
ঈশিতা বলল, “তোমরা এই সব বিদ্যা-টিদ্যা আর ফলিও না তো! আমারও মাথা ভোঁ ভোঁ করছে।”
নায়ার ফিক করে হেসে গোঁফ ঢাকল। “সঙ্গে বিদ্বান এনেছ। আমাকে দোষ দিও না। আমি সামান্য বার্তাজীবী। তা-ও নেহাত অন্যের কপিতে টিক মারি। বানান সংশোধন করে দিই।”
সুমিত বলল, “তোদের মর্নিং টাইমসের সার্কুলেশন কত রে?”
“সাতশো। আমার মূল বেতন সাতাশ শো।”
“এই স্টোরিটা খাইয়ে দিস। সার্কুলেশন বেড়ে যাবে। আ মিটিরিয়াস মার্ডার ইন দা ইভনিং ভিলা। জুয়েলস ডিসকভার্ড ইন আ হ্যাভারস্যাক।”
নায়ার গোঁফ মুছে বলল, “পুলিশের বক্তব্য ছাড়া আমাদের কাগজে কিছু ছাপা হয় না।”
ঈশিতা সুমিতের কাঁধে হাত রেখে আস্তে বলল, “শুধু কৃষ্ণার জন্য আমার একটু ভাবনা হচ্ছে। কারণ ও বিদেশি। তা ছাড়া নীপু বলছিল, ওদের পেপারে কী গণ্ডগোল আছে। পুলিশ ঝামেলা করেছে। আমার মনে হয়, নীপু আরিফকে একটু আভাস দিলে ভাল হত। তাই না?”
সুমিত বলল, “কৃষ্ণা কাল এসেই আরিফের সঙ্গে কত সহজে ভাব করে ফেলল দেখে আমার অবাক লাগছিল। মাইরি! আর আরিফ অবশ্য বরাবর মিশুকে ছেলে। তবে আফটার অল, পুলিশ ইজ পুলিশ।
নায়ার বলল, “না, না! আরিফকে নিয়ে ভাববার কারণ নেই। পুলিশ হিসাবে ও একেবারে অযোগ্য। নেহাত বেঁকের মাথায় আই পি এস করে বসেছিল। আসলে–অ্যাডভেঞ্চারারের বাংলা কী?”
“হঠকারী বলতে পারিস।”
“না। অ্যাডভেঞ্চারারের বাংলা হয় না। জীবনে দুঃসাহসী অভিযাত্রী!”
সুমিত ধমকাল, “চো-ও-প ব্যাটা! খালি বাকতাল্লা। কাল ইভনিং ভিলার অন্ধ ভদ্রলোক সম্পর্কে কী বলছিল যেন? মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি! মাইরি ঈশু! তুমি সেন্ট মেখেছ!”
ঈশিতা বলল, “হ্যাঁ। স্কাউন্ড্রেল।”
“যা বাবা! গাল দিচ্ছ কেন? নিছক একটা কথা বললুম!”
ঈশিতা হাসতে হাসতে ওকে চেপে নুইয়ে দিল। “স্কাউন্ডেল বিখ্যাত একটা। সেন্টের নাম। এম্মা! এই গাঁইয়াটা তা-ও শোনেনি!”
“কী করে শুনব? ট্রেডিং কনসার্নের বকলমে কেরানি।” সুমিত চাপ সামলে সোজা হল। “নায়ার বলছিল ওর বেসিক স্যালারি সাতাশশো। আমার দু’হাজার। আমার বাপের ভাগ্য! দশ হাজারি মনসবদার একজিকিউটিভের বউয়ের আদর খাচ্ছি।”
ঈশিতা গুনগুনিয়ে গাইল, “মন দিল না বঁধু, মন নিল যে শুধু, আমি কী নিয়ে থাকি।”
নায়ার বলল, “জানি। শচীন দেববর্মণ! কিন্তু তুমি সুরে ভুল করছ।”
সুমিত বলল, “নীপুরা সত্যি বনে ঢুকছে। ওগুলো কী গাছ কেউ জানো?”
নায়ার বলল, “শালবন। ওই দ্যাখ, শালমঞ্জরী। বসন্তকালের পূর্বাভাস।”
একটা মহুয়াগাছের তলায় যে পাথরে নীপু বসে ছিল, সেখানে পৌঁছে ঈশিতা ডাকল, “কৃষ্ণা! নীপু! যেয়ো না। বনে বাঘ আছে।”
নীপু একটা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। ক্রিস্নান ক্যামেরায় তার ছবি তুলতে পিছিয়ে এল। ঈশিতা, সুমিত, নায়ার তাদের কাছে পৌঁছুল। শুকনো পাতা ছড়িয়ে আছে সবখানে। এলোমেলো বাতাস বইছে। শুকনো পাতা উড়িয়ে দিচ্ছে। ক্রিস্নান ক্যামেরা এদিকে তাক করলে ঈশিতা বলল, “কডজন ফিল্ম এনেছ তুমি?”
ক্রিস্নান বলল, “সর্বশেষ দ্বিতীয়।”
“তা হলে আর খরচ কোরো না। আমরা একটা নাগাদ হাথিয়া ফলস, তারপর একটা মন্দিরে যাব। মাটির তলায় মন্দির। তোমার পক্ষে অসাধারণ একটা অভিজ্ঞতা হবে, কৃষ্ণা!”
নীপা বলল, “দু’টো ফিল্ম আমার জন্য রেখে দেবে কিন্তু। ভুলো না!”
নায়ার ফিক করে হেসে গোঁফ ঢাকল। “আত্মপ্রতিকৃতির প্রতি তোমার এই অস্বাভাবিক মোহ থেকে প্রমাণিত হয়, তুমি নার্সিসিস্ট।”
নীপা বলল, “আঁতেলের পাল্লায় পড়ে তুমিও আঁতেল হয়ে গেছ দেখছি নায়ারদা!”
“বাঃ রে! তুমি দু’টো ফিল্ম সংরক্ষিত করতে বলছ?”
নীপা একটু হাসল। “ইভনিং ভিলার অন্ধ ভদ্রলোকের অন্তত দুটো ছবি আমার দরকার।”
সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। ঈশিতা বলল, “কী সর্বনাশ! শেষে তুমি ওই বুড়ো আমেরিকান সাবের প্রেমে পড়লে? না নীপু, তোমার চয়েস ঠিক হয়নি। তুমি কলেজে পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়াও। চয়েসের এ কী ছিরি!”
“হি ইজ অ্যাট্রাকটিভ।”
সবাই হেসে উঠল। ক্রিস্নান বলল, “নীপাকে আমি সমর্থন করি।”
“ওম্মা! কৃষ্ণারও মাথা খারাপ হয়ে গেছে।” ঈশিতা বলল। “লোকটা একসময় ছিল সাংঘাতিক দুশ্চরিত্র, মাতাল। রাত্তিরে অশোক ওর কথা বলছিল। এরিয়ার মাফিয়া লিডার ছিল লোকটা। ওর চোখ দুটো উপড়ে নিয়েছিল কি সাধে? তা ছাড়া, জানো? ওর জিভ পর্যন্ত কেটে নিয়েছিল। তাই কথা বলতে পারে না। মিঃ বোস ওকে প্রোটেকশন দিয়েছেন। তা না হলে কবে প্রাণে মারা পড়ত। এখনও নাকি সুযোগ পেলে ওর শত্রুরা ওকে ছাড়বে না।”
নীপা শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে বলল, “বিশ্বাস করি না।”
ঈশিতা আলতো হাতে চুল বাঁধতে বাঁধতে বলল “তোমার ইচ্ছা। কিন্তু আমি সত্যি বুঝতে পারছি না, তোমার কেন ওকে অ্যাট্রাকটিভ মনে হল?”
নীপা জবাব দিল না। ক্রিস্নান বলল, “ঠিক আছে। নীপা যা চায়, করা হবে।”
“কীভাবে করা হবে?” ঈশিতা হাসল। “ওকে পাচ্ছ কোথায়? আজ ককটেল-ডিনারে ওকে পাবে ভাবছ? লোকটা কারও সঙ্গে মেশে না। আগামী কাল সকালে আমরা যাচ্ছি কুরভি ড্যাম দেখতে। প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে। ফিরে এসে আরিফের কোয়ার্টারে লাঞ্চ খাব। তারপর যাব কোটলা ফরেস্টে। সেখানে নাইট হল্ট এবং বন্যপ্রাণী দর্শন। তারপর সকালে জামশেদপুর হয়ে ব্যাক টু কলকাতা।”
সুমিত বলল, “ঈশু! মাইরি, আমি ককটেল-ফকটেলে নেই। আমি সত্যিই একটু গাঁইয়া। ম্যানার্স জানি না। কী কেলেঙ্কারি করে ফেলব কে জানে। বেশি মাল-ফাল খেয়ে হয় তো মিনিস্টারকেই”
ঈশিতা ওঁর দাড়ি খামছে ধরে বলল, “নেকু! গ্র্যান্ডে তোমার কোম্পানির পার্টিতে আমি যাইনি?”
“ধুর! সে তো আমি বেয়ারা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলুম। নেহাত চাকরির দায়ে।”
নায়ার তার নিজস্ব হাসি হাসল। “সেদিন আমাদের মর্নিং টাইমসে এক সায়েব এসেছিল। বলে কী, ইওর গ্র্যান্ড ইজ নট সো গ্র্যান্ড।”
ক্রিস্নান বলল, “নায়ার! তুমি কখনও ইউরোপে গিয়েছে?”
“ইহজন্মে হবে না।” নায়ার মুখ তুলে শালগাছের ডগা দেখতে থাকল। “কারণ আমার কাগজের মাত্র সাতশো সার্কুলেশন।”
সুমিত বলল, “আমার কাছে খবর আছে। নায়ার এর্নাকুলামের কোথায় ওর গ্রামে সাতশো নারকোল গাছ কিনে ফেলেছে। কাগজ উঠে গেলে দেশে গিয়ে নারকোল আর ছোবড়ার ব্যবসা করবে।”
নায়ার বলল, “পান্নাগুলো আমি পেলে সাত লক্ষ নারকেল গাছ কিনতাম। কে পেল কে জানে?” বলে সে রাস্তার দিকে ঘুরল। “ওই ব্যাটা বুদ্ধিজীবী আসছে। আমার ধারণা, পান্নাগুলো ও-ই হাতিয়েছে। তাই অঙ্ক কষে দাম হিসাব করছিল।”
সোমনাথ লম্বা পায়ে আসছিল। মহুয়া গাছটা পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে সুমিত মুখে হাত রেখে টার্জানের অনুকরণে অদ্ভুত শব্দ করল। তখন সোমনাথ দাঁড়াল। এদের দেখতে পেয়ে শুকনো পাতায় জোরালো শব্দ তুলে এগিয়ে এল। তার হাতে সেই কাগজটা। বলল, “তো হাঃ! ব্যাপারটা এইরকম দাঁড়াল শেষ অব্দি। তো–আ কোট ফ্রম জাঁ পল সার্ত : I was trying to find out New York, But I could not find it.’ মোদ্দা কথা বুঝতে হবে, কী তুমি খুঁজতে চাইছ।”
সে কাগজটা মেলে ধরল। সবাই ঝুঁকে পড়ল। সুমিত ও ঈশিতার মুখে হাসি। নীপা ও ক্রিস্নান গম্ভীর।
চিহ্ন ১। কালো চিতা = সামন্ত প্রভু।
চিহ্ন ২। এগোনো-পিছনো পা = গতিশীলতা
চিহ্ন ৩। পায়ের ফাঁকে হ্যাভারস্যাক = গুপ্তধন
চিহ্ন ৪। চারমিনার প্যাকেটে রক্ত = সতর্কতা
চিহ্ন ৫। প্যাকেটটা ছেঁড়া = টেংরি খুলে নেব
চিহ্ন ৬। সবুজ পান্না = গ্রিন সিগন্যাল = এগিয়ে যাও
চিহ্ন ৭। মার্কিন হ্যাভারস্যাক = আমেরিকান কানেকশান (হাওয়াই আড্ডির জঙ্গলে কি কিছু আছে?)
সোমনাথ সিগারেট ধরিয়ে কাগজটা নীপাকে দিল। সুমিত শুকনো পাতার ওপর সোমনাথের ফেলে দেওয়া দেশলাই কাঠিটা জুতোয় ঘষে দিল। নায়ার ফিক করে হেসে বলল, “এই বুদ্ধিজীবী ডেসমন্ড ব্যাগলির থ্রিলার পড়েছে।”
নীপা ও ক্রিস্নান কাগজটা মন দিয়ে দেখতে থাকল। ঈশিতা হেসে অস্থির হয়ে বলল, “এটা ওই ডিটেকটিভদ্রলোকের ঘরে পাচার করে দাও কেউ। বুড়ো দাড়ি ছিঁড়বে।”
সুমিত বলল, “হ্যাঁ রে সোমনাথ! এটাই কি তোর সেমিওট্রিকস?”
“সেমিওটিক্স্” নায়ার একটু সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল। “কিন্তু কোনও মেথডলজি অনুসরণ করা হয়নি।”
সোমনাথ বলল, “চিহ্ন ১ থেকে চিহ্ন ৭ অব্দি একটা ল্যাংগুয়েজ পরিষ্কার পড়া যাবে। হ্যাভারস্যাকটা আমাদের বাথরুমে চলে আসা মানে কেউ আমাদের কথাগুলো বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে। হয়তো আমাকেই। কারণ সিগারেটের প্যাকেটটা আমার। অথচ প্রবলেম হল, এ বিষয়ে জ্ঞানত আমি কিছু জানি না। কিন্তু অজ্ঞাতসারে কিছু জানি কি, যা কারও পক্ষে বিপজ্জনক? হাঃ। আমি সাত্রের মতো নিউইয়র্ক খুঁজছি। অথচ আমি নিউইয়র্কেই আছি।”
নায়ার বলল, “আমেরিকান কানেকশনটা কী?”
ঈশিতা বলল, “আমরিকান সাব। তাই না সোমনাথ?”
তার চোখে কৌতুক ঝিলিক দিচ্ছিল। সোমনাথ কৌতুক গ্রাহ্য করল না। মুখ নিচু করে পায়চারির ভঙ্গিতে কয়েক পা এগিয়ে গেল। তারপর চমকে ওঠা গলায় বলল, “মাই গুডনেস! আরেকটা সাইন আমি মিস করেছি। হ্যাভারস্যাকের। গায়ে ঢ্যারা। এই চিহ্নটাও কথা বলছে। নীপা কাগজটা দাও।”
সে নীপার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে কলম খুঁজল। “এই রে! কৃষ্ণার কলমটা আমি লবিতে ফেলে এসেছি।”
সে হন্তদন্ত এগিয়ে গেল রাস্তার দিকে। নায়ার বলল, “এস! আমরা সিদ্ধান্ত করি, ওই উন্মাদ বুদ্ধিজীবীকে পাত্তা দেব না। দিলে আমাদের প্রমোদ-পর্যটন ব্যর্থ হবে।”
ঈশিতা ঘড়ি দেখে বলল, “এই! তোমরা সব এস। স্নান করবে তো আর দেরি কোরো না।”
সে তাড়া দিলে সবাই পা বাড়াল। হঠাৎ নীপা বলে উঠল, “এ কী!” নীপা সামনে ঝুঁকে লাল-নীল-হলুদ কয়েকটা মার্বেল কাগজের কুচি শুকনো পাতার ফাঁক থেকে কুড়িয়ে নিল। নায়ার গেঁফে হাত রেখে গোল চোখে তাকাল। ক্রিস্নান মাতৃভাষায় কিছু বলল। ঈশিতা নীপার হাত থেকে কাগজ কুচিগুলো নিয়ে দেখতে দেখতে বলল, “হ্যাভারস্যাকটার ভেতরে এইরকম কাগজ ঠাসা ছিল। মনে হচ্ছে, যে ওটা পাচার করতে যাচ্ছিল, সে এখানে বসেই এগুলো ঠেসে ভরেছে।”
নীপা বলল, “এখানে কেন?”
ক্রিস্নান বলল, “আমি একটা ধারণা করতে পারি। যে-লোকের হাত দিয়ে কেউ রত্ন পাঠিয়েছিল, সে এখানে বসে চুরি করেছে। মাত্র একটা রত্ন আমরা দেখেছি। সে অন্ধকারে কাজ করছিল। সুতরাং একটা রত্ন পেতে সে ব্যর্থ হয়েছে।”
সুমিত সায় দিয়ে বলল, “ঠিক, ঠিক। চোরের ওপর বাটপাড়ি।”
ঈশিতা হাসল। “চলো, এগুলো ডিটেকটিভদ্রলোকের ঘরে পাচার করা যাক।”
নায়ার বলে উঠল, “আইয়ো! এন্তা পরেন্তু।”
হাঁটতে হাঁটতে নীপা আনমনে বলল, “আমার কিন্তু ভাল লাগছে না। খালি মনে হচ্ছে–
সে থেমে গেলে ঈশিতা তার কাঁধে হাত রাখল। “ছাড়ো তো বাবা! আরিফ যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ আমরা সবটাই ফান বলে এনজয় করব। তা ছাড়া নীপু, তুমি তো বালিকা নও। কী সব অদ্ভুত ঘটছে, এতে ভয় পাওয়ার কী আছে? এতো একটা দারুণ মজা। আরও মজার-মজার ব্যাপার ঘটুক না! রীতিমতো অ্যাডভেঞ্চার হবে। তাই না কৃষ্ণা?”
ক্রিস্নান শ্বাস ছেড়ে বলল, “কিন্তু একটা নরহত্যা হয়ে গেল!”
“এই এরিয়ায় খুনোখুনি সবসময় হচ্ছে।” ঈশিতা হালকা চালে বলল। “আজ ককটেল-ডিনারে মাফিয়ালিডার কেতন সিংকে দেখতে পাবে। মিঃ বোসের ডান হাত নাকি লোকটা। সুমিত! জানো? হিন্দি ফিল্মে যা-সব দেখা যায়, তা নাকি সবই সত্যি। অশোক বলছিল। কেতন সিংকে নাকি লোকে গব্বর সিং বলে আড়ালে। লোকটা একসময় মধ্যপ্রদেশের চম্বল এরিয়ায় ছিল। একটা। থ্রিলিং এক্সপিরিয়েন্স হবে। চিয়ার আপ ডিয়ারি!”
সে নীপার কাঁধে চাপ দিল। সুমিত মুখ ফিরিয়ে বলল, “মাইরি! ঈশু, তুমিও দেখছি লেসবিয়ান–সরি! অফুল্যি সরি ম্যাডাম। চালিয়ে যাও।” বলে সে হনহন করে হেঁটে রাস্তায় পৌঁছুল।
ঈশিতা গলা চড়িয়ে বলল, “বডি ফেলে দেব, সুমিত!”
“দাও। আমি তো কবে থেকে চাইছি।”
“তবে রে!” ঈশিতা দৌডুল।
সুমিতও দৌডুল। রাস্তায় উঠে ঈশিতা দাঁড়াল। নায়ার, ক্রিস্নান ও নীপা পৌঁছুলে সে বলল, “সুমিতটা সত্যিই চতুষ্পদ প্রাণী। ওর দৌডুনোর ভঙ্গি লক্ষ করলে নায়ার? দেখ, দেখ! মানুষ ওভাবে দৌড়য় না।”
নায়ার হাসল। “তোমাদের দু’জনের সম্পর্ক আমার কাছে রহস্যজনক। সুমিত কি তোমার ক্রীড়াবস্তু?”
“বলতে পারো।” ঈশিতা চোখে ঝিলিক তুলল।
“তোমারও কি ক্রীড়াবস্তু হতে লোভ হচ্ছে?”
“নাহ্। আমি পরনারীদের ক্রীড়াবস্তু হতে চাই না।”
ঈশিতা চোখের কোনা দিয়ে নীপাকে দেখে নিয়ে বলল, “এই অধ্যাপিকাটি যে অলরেডি এনগেজড!”
নীপা এতক্ষণে হাসতে পারল। বলল, “কথাটা ক্রীড়াবস্তু কেন? ক্রীড়নক। তবে আরিফদা বলছিল, নায়ারদা নাকি প্রেম-ট্রেমের ব্যাপারে স্বল্পাহারী।”
নায়ার বলল, “কিন্তু প্রশ্নটা হল, প্রেম বলে সত্যি কি কিছু আছে? আমরা আধুনিক মানুষ।” বলে সে চড়াইয়ের মাথায় বাংলোর গেটের দিকে তাকাল। সুমিত দুই হাঁটুতে হাত রেখে গেটে কিছু দেখছে। তারপর সে সোজা হয়ে দাঁড়াল এবং ঘুরে হাতের ইশারায় ডাকতে থাকল।
কাছে গেলে সুমিত ফাঁসফেঁসে গলায় বলল, “একটা ঢ্যারা আঁকা। দেখতে পাচ্ছ?”
নায়ার বলল, “নিশ্চয় বুদ্ধিজীবীর কীর্তি! চলো তো! ব্যাটাকে পালাক্রমে আমরা মারব।”
.
০৬.
হাসপাতালের গেটে আরিফের জিপ পৌঁছুলে কর্নেল বললেন, “ব্যস! এখানেই আমাকে নামিয়ে দাও। এবার আমি একলা হতে চাই।”
কর্নেল জিপ থেকে নামলে আরিফ বলল, “ঠিক আছে বস্! কিন্তু আপনি কি ওই হ্যাভারস্যাকটা হাতে নিয়েই ঘুরবেন?”
কর্নেল হাসলেন। “হ্যাঁ। জিনিসটা হাল্কা। নিয়ে বেড়াতে অসুবিধা নেই।”
“কিন্তু আপনার মতো সায়েবসুবো লোকের হাতে ভাঙাচোরা এবং যথেষ্ট নোংরা জিনিসটা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। তাছাড়া, আই’ম আফ্রেড কর্নেল, য়ু আর টেকিং টু মাচ রিস্ক।”
“এটা একটা ফাঁদ, ডালিং! দেখা যাক, অন্তত একটা মাছিও এতে পড়ে কি না।”
“ইভনিং ভিলায় আপনার ফাঁদটা কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে।”
কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, “হয়তো হয়নি।”
“কর্নেল! প্লিজ একটু হিন্ট দিয়ে যান, সো দ্যাট উই ক্যান টেক আপ দা নেক্সট কোর্স অফ অ্যাকশন।”
কর্নেল ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি বরাবর লক্ষ করেছি, আমার সংসর্গে এলেই তুমি ওভার-স্মার্ট হয়ে যাও। দ্যাটস ব্যাড, ডার্লিং!”
আরিফ হেসে ফেলল। “ওকে! উইশ য়ু গুড লাক।” বলে সে জিপ ঘোরাল এবং জোরে বেরিয়ে গেল।
এখানে রাস্তাটা নতুন এবং চওড়া তবে দুধারে নোংরা ঘিঞ্জি দোকানপাট, ফিরিওয়ালাদের গাড়ি এবং সুস্থ-অসুস্থ লোকেদের ভিড়। রাস্তায় ট্রাক-বাস টেম্পো-সাইকেল রিকশো মিলেমিশে একটা তুমুল বিশৃঙ্খলা। হাসপাতালটা বড়। পেরিয়ে গিয়ে আরও একটা ছোট গেট এবং তারপর স্টাফ কোয়ার্টার এলাকা। মধ্যিখানে নির্মীয়মাণ পার্ক। চতুর্থ শ্রেণী’-র হাসপাতালে কর্মীদের জন্য অ্যাজবেস্টসের চাল দেওয়া সারবন্দি খোপরিগুলো সহজে চেনা যায়। একটি পুকুর দুটি শ্রেণীকে পৃথক করেছে। কর্নেল পুকুরপাড়ের বটতলায় ঘাটের মাথায় দাঁড়ালেন। পুকুরের জলে কমবয়সীরা বড্ডবেশি স্বাধীনতার আনন্দ উচ্ছ্বঙ্খলতায় ভোগদখল করছে। হু, এখনও যদি স্বাধীনতা বলে মানুষের জন্য কিছু টিকে থাকে, তা প্রকৃতিতেই আছে। বয়স্কদের ধমক ওরা গ্রাহ্য করছিল না। ঘাটে যারা কাপড় কাঁচছিল, তারা কর্নেলকে একবার দেখে নিল মাত্র। আশেপাশে একদঙ্গল শুয়োরও যথেচ্ছ স্বাধীনতাভোগী। বটতলার গোড়া মাটি দিয়ে বাঁধানো এবং যথারীতি সেটা দেবস্থান। সন্ন্যাসী চেহারার একটা লোক উদাসীন বসে ছিল। কর্নেলের চোখে চোখ পড়লে কেন কে জানে সে সেলাম দিল। কর্নেল এগিয়ে গিয়ে দেবস্থানে একটা দু’টাকার নোট অর্ঘ্য দিয়ে হ্যাভারস্যাক বগলদাবা করে করজোড়ে মাথা নোয়ালেন। লোকটির উদাসীনতা পুরো চিড় খেল। প্রসন্ন হেসে সে বলল, “আপ কঁহাসে আতা হ্যায়, স্যার? মালুম, আপ কৈ বাহারকা আদমি।”
“হ্যাঁ ভাই! কলকাত্তাসে আতা। হসপিটালমে মেরা এক দোস্ত বিমার হ্যায়।”
“জি। হম সমঝা।” সে ঘুরে সন্ত রবিদাসের ছোট্ট বাঁধানো ছবিটা দেখাল। “উনহিকা কিরপা মিলে তো জলদি বিমার উমার ভাগ যাতা।”
“আপ হেঁয়া রহতে হেঁ?”
“জি। উও দেখিয়ে মেরা কোয়ার্টার।”
“হসপিটালকি স্টাফ?”
“জি।” সে কর্নেলের হাতের হ্যাভারস্যাকটা দেখিয়ে বলল, “ইয়ে কেয়া চিজ হ্যায়, স্যার?”
কর্নেল হাসলেন। “কভি দেখা নেহি ইয়ে চিজ?”
“নেহি তো!”
“হাওয়াই আড্ডিকি জঙ্গলমে মিলা।”
“হাঁ, হাঁ।” লোকটি একটু সিরিয়াস হল। “উও জঙ্গলমে কভি কভি হরকিসিমকি চিজ মিল যাতা। হম শুনা, ছুপে হুয়ে খাজনা ভি হ্যায়।”
লোকটা গুপ্তধনের কথা বলছে। কর্নেল একটু আগ্রহ দেখালে সে একটা গল্প ফেঁদে বসল। এর আগে হাথিয়াগড়ে এসে গল্পটা শুনেছিলেন কর্নেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ছকবাঁধা এই গল্প পৃথিবীর সর্বত্র চালু। বেশির ভাগ পপ্লেই গুপ্তধনটা সোনার বাট। কোনও সৈনিক বোমাবিধ্বস্ত ব্যাঙ্ক লুট করে সোনার বাট হাতিয়ে কোথাও পুঁতে রাখবে এবং সে মারা পড়বে। ফলে পুঁতে রাখা সোনাটা গুপ্তধন হয়ে উঠবে। এ নিয়ে অসংখ্য থ্রিলার লেখা হয়েছে। যুদ্ধের পরবর্তীকালে। কিছু গপ্পে হিরে-জহরত মণিমুক্তো হয়েছে গুপ্তধন। কিন্তু কাঠামোটা একই। বোমা-বিধ্বস্ত কোনও শহরে কোনও জুয়েলারি থেকে লুঠ।
লোকটার নাম হরিয়া। জগৎ-সংসার তাকে আকৃষ্ট করে না। মাঝেমাঝে সে ঠিক করে ফেলে, চাকরি ছেড়ে সাধু হয়ে চলে যাবে। ঝগড়াটে বউ। একদঙ্গল কাচ্চাবাচ্চা। আজ সকালেই তার বউ হাসপাতালের ভেতর গিয়ে তার সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছে। জমাদারনি রঙ্গিয়া না আটকালে একটা কিছু ঘটে যেত। ডিউটি শেষ করে তাই সে কোয়ার্টারে ফেরেনি। এখানে বসে প্রভু রবিদাসের সান্নিধ্যে শান্তি খুঁজছে। হা–প্রথম সে কিছুটা শান্তি পেয়েছে।
রঙ্গিয়ার স্বামী নানকুকে নাকি কর্নেল চিনতেন। শুনে হরিয়া বলল যে, রঙ্গিয়া ভাল মেয়ে বলেই নানকুর সদ্গতি হয়েছিল। নানকু ছিল বেজায় নেশাখোর লোক। তাই রাজ্যের নেশাখোর লোকেরা ছিল তার বন্ধু।
নানকুর সঙ্গে এক বাঙালিবাবুকে দেখেছিলেন কর্নেল। হরিয়া কি তাঁকে চিনত?
হরিয়া নড়ে বসে বলল যে, আশ্চর্য ব্যাপার। রঙ্গিয়া বলছিল, তার স্বামীর এক বাঙালি বন্ধু খুন হয়ে গেছে। সে মরা লোকটাকে চিনতে পেরেছে। হরিয়া তার কাছে খবরটা জেনেছে সকালে তার ডিউটির সময়। এও আশ্চর্য মনে হয়েছে হরিয়ার, রাতে তো রঙ্গিয়ার ডিউটি ছিল না।
তাছাড়া মর্গেই বা সে গেল কেন অত রাতে? মর্গ তো হাসপাতালের প্রায় বাইরে একটেরে। ওই যে দেখা যাচ্ছে।
হরিয়া কি কিছু জিজ্ঞেস করেনি রঙ্গিয়াকে, কেন অত রাতে সে মর্গে গিয়েছিল?
ঝুটঝামেলা পছন্দ করে না হরিয়া। তবে তার বরাবর সন্দেহ, মর্গের মরা মানুষগুলোর পোশাক আর পকেটের জিনিসপত্র হাতিয়ে নেবার জন্য হাসপাতালে যে চক্রটি আছে, রঙ্গিয়া তার সঙ্গে জড়িত। অবশ্য রঙ্গিয়া বলেছে, সিধুয়া ডোমের কাছে সে পাঁচটা টাকা পায়। সিধুয়া দিচ্ছে না। গত রাতে চরম বোঝাপড়া করতে গিয়েছিল নাকি। হরিয়া এ কথা বিশ্বাস করে না। হ্যাঁ, রঙ্গিয়া ভাল মেয়ে তার বিচারে। কারণ সে হরিয়ার বউয়ের মত মুখরা দজ্জাল আউরত নয়। তাই বলে সে বাড়তি রোজগারের ফিকির খুঁজবে না, এমন তো। নয়। হরিয়া বাদে এই হাপসাতালের সব্বাই, এমন কি চুহা-ছুছুন্দরগুলো (ইঁদুর ছুঁচো) পর্যন্ত বাড়তি রোজগারের ফিকিরে আছে। ওই খুদে জীবগুলো মর্গের মড়ার আঙুল খায়। চোখ খেয়ে ফেলে। নাকও খায়।
খুন হওয়া বাঙালিবাবুকে কি কখনও দেখেছে হরিয়া?
দেখে থাকতেও পারে। মনে পড়ছে না। এখানে তো অনেক বাঙালি বাবু। বাস করেন। সবাইকে হরিয়া চেনে না। চেনার কথাও না! বলে হরিয়া হাসল। “উও দেখিয়ে, রঙ্গিয়া জমাদারনি আতি হ্যায়। বারাহতক ডিউটি। লেকিন মালুম আভি এগারা ভি বাজা নেহি।”
কর্নেলও হাসলেন। “তো ভাই, তুম ভি রঙ্গিয়াকি বহুত আগাড়ি ডিউটি ছোড় কর আয়া।”
“হুম ছুটি লেকে আয়া স্যার! হাঁ।” হরিয়া অভিমানে বলল। “হম কভি এইসা না করতা, হাঁ।”
প্রৌঢ়া জমাদারনি কর্নেলকে দেখতে দেখতে এগিয়ে আসছিল। কাছাকাছি এসে মুখ টিপে হেসে বলল, এ হরিয়া! তেরা বহু ভাগ যায়গি! যা, যা। ঘর যা।”
“হম দুসরি বহু আনে গা দেহাতসে।” হরিয়ার ত্বরিত জবাব। “আ রি রঙ্গিয়া, ইয়ে দে। ইয়ে সাবলোগ তেরা বুডটা নানকুয়াকো পচানতা।
রঙ্গিয়া কর্নেলের দিকে তাকাল। আস্তে বলল, “আপ কঁহাসে আতা সাব?”
হরিয়া বলে দিল, “কালকাত্তা। ইনহে উও বাঙালিবাবুকো ভি পহচানতা। যো মার্ডার হো গেয়া–”
“সাচ?”
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, “হাঁ। তো ইস লিয়ে হম্ তুমহারি পত্তা করনে আয়া!”
“হসপিটালমে থি। পত্তা উহা পর মিল যাতা। আপ পুছা নেহি কিসিকো?”
রঙ্গিয়া জিজ্ঞাসু মুখে বলল। তারপর আরও কাছে এগিয়ে এল। কর্নেল বললেন, “বসন্তবাবু মেরা পাশ কুছ রুপেয় উধার লিয়া।”
রঙ্গিয়া এসে হরিয়ার পাশে বসল। করুণ হেসে বলল যে, “আর সে টাকা ফেরত পাওয়ার আশা ছেড়ে দেওয়াই ভাল। বাবু খুব নেশাখোর লোক ছিল। রঙ্গিয়া মানুষ চেনে। মাঝেমাঝে বাঙালিবাবুর কাছে সে অনেক টাকা দেখতে পেত। নানকু আড়ালে বলত, বাবুজি খুব ফিকিরবাজ লোক। আর বোসোবের কোঠিতে ড্রাইভার আছে, তার নাম শ্যামলাল। শ্যামলালের মা ছিল বাঙালি আউরত। রঙ্গিয়ার সন্দেহ, শ্যামলালের মায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বাবুর। বাবু তাকে দিদি বলত। তাছাড়া শ্যামলালের মা মারা গেলে বাবু খুব কেঁদেছিল। শ্যামলাল ওই বাবুকে বলত মামা। হয়তো বসন্তবাবু আর শ্যামলালের মা ভাই বোনই ছিল। নৈলে অমন করে সে কাঁদবেই বা কেন? তো সায়েব শ্যামলালকে গিয়ে বলতে পারেন, ভাগ্নে মামার ধারের টাকা শোধ করুক। করলে মামার পরকাল মুক্তি। শ্যামলাল লোকটা খারাপ নয়।”
“রঙ্গিয়ার স্বামীর কাছে বসন্তবাবু কি শুধু নেশা করার জন্যই আসত?”
“হ্যাঁ। যারা মরে গেছে, তাদের নিন্দা করা উচিত নয়। তবে অমন গাঁজাখোর আর দেখেনি রঙ্গিয়া। গাঁজা খেয়ে বাবু বারান্দার মেঝেয় পড়ে থাকত।” কিন্তু ভোরে উঠে তাকে আর দেখতে পেত না রঙ্গিয়া। অজিব আদমি।
এই হ্যাভারস্যাক জিনিসটা কি কখনও রঙ্গিয়া দেখেছে?
রঙ্গিয়া একটু অবাক হল। কেন এ কথা তাকে জিজ্ঞেস করছেন সায়েব?
এটা বসন্তবাবু কর্নেলের কাছে জিম্মা রেখে টাকা ধার করেছিলেন।
হরিয়া চমকে উঠে বলল, “আপ হমরে বোলা–”
কর্নেল হাসলেন। “হাঁ। হাওয়াই আড়িকি জঙ্গলমে মিলা। লেকিন বসন্তবাবু পায়া ঔর হমকো দিয়া। দেখো ভাই, হম তো তুমকো ইয়ে বোলা নেহি কি হম পায়া। বোলা?”
“জি নেহি।”
“হম সির বোলা কি হাওয়াই আড্ডিকি জঙ্গলমে মিলা।”
হরিয়া মাথা দোলাল। “জি, জি! আপ ওহি বাত বোলা। সাম্।”
রঙ্গিয়া কিছু ভাবছিল। কর্নেল তা লক্ষ্য করে বললেন যে, “জিনিসটা বসন্তবাবুর কাছে রঙ্গিয়ার দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।”
রঙ্গিয়া জোর দিয়ে বলল যে, না। জিনিসটা সে দেখেনি। কোথাও দেখেনি। তবে হাওয়াই আড্ডির জঙ্গল বলায় তার একটু-একটু মনে পড়ছে, তার স্বামী নানকু যেন বলেছিল, বসন্তবাবু একসময় নাকি হাওয়াই আড্ডিতে চাকরি করতেন।
বসন্তবাবু হাওয়াই আড্ডিতে চাকরি করতেন? কী চাকরি?
তা রঙ্গিয়া জানে না। শ্যামলাল জানতে পারে। সবজিকাটরায় গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়।
আমরিকান সাব’কে কি রঙ্গিয়া চেনে?
না। এ কথাই বা তাকে কেন জিজ্ঞেস করা হচ্ছে?
হরিয়া বলে উঠল, “আমেরিকান সাব বহত জবরদস্ত আদমি থা। হম ইয়ে ভি শুনা, হাথিয়াগড় মুলুককা মালিক থে আমরিকান সাবকা খান্দান। উনহিকা পিতাজিকো রাজাসাব বোলতা সাবলোগ।”
রঙ্গিয়া সায় দিয়ে বলল যে, রাজাসাবের কথা তারও জানা। কিন্তু তার মতে, ওঁদের বংশ পাপী বংশ। তাই দিনে-দিনে হালত খারাপ হয়ে গেছে। এই কলকাতার সায়েব যদি তাকে জিজ্ঞেস করেন পাপটা কী, তা হলে রঙ্গিয়া তার প্রমাণ দিতে পারে। কী প্রমাণ? রঙ্গিয়া বাঁকা হেসে হরিয়ার দিকে কটাক্ষ করল। “এ হরিয়া। সমঝা দে ইনহিকো।”
হরিয়া খুব গম্ভীর হয়ে ব্যাখ্যা দিল। রাজাসাবের খান্দান বাঙালি নয়। এই মুলুকের ভূঁইহার ব্রাহ্মণ। তাদের পদবি হল রায়। পরে বাঙালি মেয়ে বিয়ে করে আধুবাঙালি হয়ে যায়। তো এই ব্রাহ্মণবংশের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। একজন অব্রাহ্মণের। এটা পাপ নয়। সেই অব্রাহ্মণও আবার বাঙালি। হরিয়ার মতে, এই এলাকাতে অনেক কায়েথ আছে। কিন্তু বাঙালি কায়েথ আর এই এলাকায় কায়েথ এক জাত নয়। হ্যাঁ, হরিয়া বোসোবের কথাই বলছে। বোসোব কেমন লোক জানতে চাইলে হরিয়া শুধু বলবে যে, তিনি কেতন সিংয়ের দোস্ত। কে কেতন সিং জানতে চান কি?
হরিয়াকে চোখ কটমট করে থামিয়ে দিল রঙ্গিয়া। কর্নেল একটু ইতস্তত করে বললেন, “হম শুনা, বসন্তবাবু বোসসাবকো কোঠিমে খুন হোগেয়া।
রঙ্গিয়া চাপা স্বরে বলল, “হাঁ। মালুম, কোই ফিকিরমে ঘুস গয়ে থে। ঔর বোসসব উনকো মারা। মারতে মারতে জান নিকাল দিয়া। তো এহি হালত হ্যায়, বড় আদমি যে কুছ করনা চাহে, কর সকে। উসকা হাথমে পুলিশ, উঁচা উঁচা আফসার, মিনিস্টারভি। গরিবোকো রাখনেওয়ালা কৌন হ্যায়?”
হরিয়া একটু হেসে সন্ত রবিদাসের ছবিটা দেখিয়ে বলল, “আ রি। তেরা বাত শুনকর ঠাকুরবাবা হাস রহা। দেখ, দেখ। গরিবকো রাখনেওয়ালা ঠাকুরবাবা রি, ঠাকুরবাবা।”
সে করজোড়ে ঠাকুরবাবার উদ্দেশে প্রণাম নিবেদন করল। কর্নেলও ফোঁস করে শ্বাস ফেলে করজোড়ে প্রণাম করে পা বাড়ালেন। স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে বললেন যে, এ সব কথা শোনার পর তিনি বেচারা বসন্তবাবুকে ক্ষমা করে দিলেন। ধার দেওয়া টাকার কথা আর ভুলেও মুখে আনবেন না।
কর্নেল যেতে-যেতে শুনতে পেলেন হরিয়া ও রঙ্গিয়া এবার স্ট্যান্ডার্ড হিন্দি ছেড়ে মাতৃভাষা ঠেঠবোলিতে কী সব আলোচনা শুরু করেছে। আঁচ করলেন, রঙ্গিয়ার মতে, বসন্তবাবু কোনও ফিকিরবাজি করতে ওই কোঠিতে ঢুকেছিল এবং হরিয়ার মতে, চুরি করতেই ঢুকেছিল। তবে দুজনেই একমত যে, ধরা পড়ে বেদম ঠ্যাঙানি খেয়ে মারা পড়েছে বাঙালিবাবু। নেশাখোর আদমির প্রাণ বেজায় ঠুনকো।
হাসপাতাল এলাকা থেকে বেরিয়ে কর্নেল একটা সাইকেলরিকশো নিলেন। বললেন, “সবজিকাটরা।”
একটা নতুন তথ্য জানা গেল। বসন্ত হাজরা মার্কিন ঘাঁটি হাওয়াই আড্ডি’-তে চাকরি করত। তখন তার বয়স ছিল পুলিশি মতে পঁচিশ থেকে সাতাশের মধ্যে। তা হলে তখন সে ছিল সদ্য যুবক। হুঁ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দলে দলে তরুণরাও যুদ্ধসংক্রান্ত নানা ধরনের চাকরির সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু বসন্ত হাজরা কি মিলিটারিতে চাকরি পেয়েছিল? চাকরিটা কেরানির হতে পারে না। ক্যান্টিনবয়ের হওয়া সম্ভব। অথবা আর্দালি-বেয়ারার? কারণ তার হাতের লেখা নেহাত সাক্ষর। লোকের। এদিকে ‘আমরিকান সাব’ সর্বেশ রায় ছিলেন সেখানকার এক কন্ট্রাক্টর। ইভনিং ভিলার সঙ্গে কি বসন্ত হাজরার যোগাযোগের ক্ষীণ সূত্র এটি? কিন্তু সে কর্নেলের ঠিকানা জানল কীভাবে? এর পরের অনিবার্য প্রশ্ন : কর্নেলের ঠিকানাটা ফের সে লিখল কেন? এর একটা জবাব হয়তো দেওয়া যায়। হলঘরে বসে সোমনাথ দাশগুপ্তের ফেলে যাওয়া সিগারেট প্যাকেটের ভেতরের কাগজ ছিঁড়ে ওটা লেখার কারণ সম্ভবত এই যে, সেই মুহূর্তে তার হাতের কাছে কোনও কাগজ ছিল না। কিন্তু কাগজটা রোল করে নিজের দেশলাইয়ের ভেতর লুকিয়ে রাখল কেন? তা কি পুলিশকে একটা সূত্র দিতে যে কর্নেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে’? আপাতদৃষ্টে তা-ই দাঁড়াচ্ছে। যেহেতু সে কর্নেলকে কলকাতায় বেনামী চিঠিটা লিখেছিল, তাই সাংঘাতিক আহত অবস্থায় কর্নেলকেই তার ত্রাণকর্তা ভাবা স্বাভাবিক।
তা হলে ঘুরে ফিরে সেই একই প্রশ্নে ফিরে আসতে হয়; কর্নেলকে সে চিনত। কিন্তু কোন সূত্রে?
এবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন : ইভনিং ভিলার ককটেল-ডিনার পার্টি হবে সে জানতে পেরেছিল এবং সেই পার্টিতে কাকেও খুন করা হবে কোন ছলে, তা ও সে জেনেছিল। রঙ্গিয়ার মতে, বসন্ত হাজরা ফিকিরবাজ লোক ছিল। মাঝেমাঝে তার কাছে অনেক টাকা থাকত। সে কোনও ফিকিরবাজি করতে বোসসায়েবের কোঠিতে গিয়েছিল।
বসন্ত হাজরা কি তাহলে ব্ল্যাকমেলার ছিল এবং ইভনিং ভিলায় কাকেও ব্ল্যাকমেল করত? তাই একজন ব্ল্যাকমেলারকে চিরকালের মতো চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে?
আপাতদৃষ্টে ঘটনাটা এরকম দাঁড়াচ্ছে; ইভনিং ভিলায় যাকে বসন্ত হাজরা ব্ল্যাকমেল করত, সে ভাড়াটে গুণ্ডা দিয়ে তাকে মেরেছে। গেটের কাছে রক্তের দাগ ছিল। তার মানে, ব্ল্যাকমেলার গতকাল বিকেলে আসার কথা ছিল এবং ভাড়াটে গুণ্ডা ওত পেতে ছিল। গেটের কাছে আসতেই সে বসন্ত হাজরার পেছন থেকে মাথায় ডাণ্ডা মারে (মর্গের রিপোর্টে ভোতা জিনিসের আঘাত)। দৈবাৎ গেট খোলা পেয়ে আক্রান্ত ও আহত ব্ল্যাকমেলার ইভনিং ভিলায়। ঢোকে।
কিন্তু ইভনিং ভিলায় তো তার শত্রু আছে। সেখানে সে ঢুকবে কেন?
এর দুটো সম্ভাব্য জবাব হয়। এক : আঘাত মারাত্মক হওয়ায় সে বুঝতে পেরেছিল মারা পড়ার চানস আছে এবং ইভনিং ভিলার যাকে ব্ল্যাকমেল করত, তাকে তার মৃত্যুর সঙ্গে জড়াতে চেয়েছিল।
পোর্টিকোর সামনে ফোয়ারার একপাশে বেঁকে পড়া এবং উঁটাভাঙা ঘাস চোখে পড়েছে কর্নেলের। বোঝা যাচ্ছে, সেইসময় হলঘরের ভেতরে বা দরজায় এমন কেউ ছিল, যাকে দেখে বসন্ত হাজরা ফোয়ারার ট্যাংকে আত্মগোপন করে। তারপর হলঘরে ঢোকার সুযোগ পায়।
হলঘরে ঢোকার কি বিশেষ কারণ ছিল? এটাই বোঝা যাচ্ছে না। বোঝা যাচ্ছে না কালো চিতার পায়ের ফাঁকে এই হ্যাভারস্যাক থাকার কারণ কী? চিতার পায়ের ফাঁকে রক্তের দাগ দেখেছেন কর্নেল। সোমনাথ অন্ধকারে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনেছিল। বসন্ত হাজরা কর্নেলের ঠিকানা লিখে দেশলাই। বাক্সে লুকিয়ে ফেলার পর এই হ্যাভারস্যাকটা হাতাতে গিয়েই হয়তো পড়ে যায়। তার মৃতদেহ অবশ্য সোফার কাছে পাওয়া গেছে। এমন তো হতেই পারে, উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করার সময় তার অন্তিম মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে এবং সে ছিটকে এসে সোফার কাছেই পড়ে যায়। সম্ভবত সোমনাথের কাছে কথাটা শোনার পর আরিফ খুব শিগগির গিয়ে পড়ায় ইভনিং ভিলা থেকে বসন্ত হাজরার বডি বাইরে পাচারের সুযোগ মেলেনি।
দুই : নাকি ইভনিং ভিলায় বসন্ত হাজরার কোনও হিতৈষীও আছে, যার কাছে পৌঁছুতে চেয়েছিল?
“ইয়ে সবজিকাটরা সাব! আপ কাহাপর উতরেগা?”
রিকশোওয়ালার কথায় কর্নেল চোখ খুললেন। হাসি পেল। কিছু চিন্তার সময় তার চোখ নিজের অজান্তে বুজে যায়। ভারি বদঅভ্যাস। চুরুটটাও নিভে গেছে। সেটা জ্বেলে নিলেন। রিকশো দাঁড়িয়ে গেছে। প্রচণ্ড ভিড় আর হল্লা এখানে। সবজির বাজার। কর্নেল বললেন, “আচ্ছা ভাই, ইহা কোই শ্যামলাল ড্রাইভারকা ঘর হ্যায়। পছানতা উসকো?”
“জি হাঁ।” রিকশোওয়ালা বলল। “উও গলিমে পয়দল যানা পড়েগা আপকো। থোড়াসা দূর।”
গলিটা হাত তিনেক চওড়া। কর্নেল ভাড়া মিটিয়ে হাঁটতে থাকলেন। একে ওকে জিজ্ঞেস করতে করতে একটা খাপরার চালের বাড়ির সামনে পৌঁছুলেন। বস্তি এলাকা এটা। একটা মেয়ে শ্যামলালকে ডেকে দিল। রোগা টিঙটিঙে চেহারা, দেখার মতো গোঁফ এবং পরনে মোটামুটি ধোপদুরস্ত প্যান্ট, স্পোর্টিং গেঞ্জি, বছর পঁচিশেক বয়সের এক যুবক। অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, “বোলিয়ে!”
কর্নেল ইচ্ছে করেই বাংলায় বললেন, “আমি শ্যামলালের খোঁজে এসেছি।”
“সে আমি। বলুন।”
“বসন্ত হাজরা আমার চেনা লোক। সে তোমার ঠিকানা দিয়ে বলেছে, তুমি নাকি ওর ভাগ্নে। সে তোমার বাড়িতেই থাকে।” কর্নেল কাচুমাচু মুখে হাসলেন। “আমার কাছে একটা জিনিস বেচেছে। জিনিসটা মেকি।” বলে কর্নেল সেই পান্নাটা বের করে দেখালেন। “পুলিশের কাছে যাওয়ার আগে ভাবলুম”
শ্যামলাল বলল, “মামা গতরাতে মার্ডার হয়ে গেছে।”
“সে কী! কোথায়? কী সর্বনাশ!”
“থানায় যান সব জানতে পারবেন। মামা হারামিপনা করত। সাজা পেয়েছে। আমি কী করব?”
সে দরজা বন্ধ করতে কপাটে হাত রেখেছে, কর্নেল বললেন, “এক মিনিট শ্যামলাল! তুমি তো ইভনিং ভিলায় ড্রাইভারের চাকরি করো।”
“আর করি না। বোসসায়েব হারামি লোক আছে। পরশু রোজ ঝামেলা করল। চলে এলাম।”
শ্যামলালের বাংলায় হিন্দিভাষীর টান স্পষ্ট। কর্নেল বললেন, “তোমার মামা বলছিল, আমার ভাগ্নে শ্যামলাল ইভনিং ভিলায় মেমসায়েবের গাড়ি চালায়। জিনিসটা যদি মেকি হয় আমার ভাগ্নের কাছে গেলেই আমার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবে। ভাগ্নেকে না পেলে ইভনিং ভিলায় মেমসায়েবের কাছে যাবেন।”
“মামা খুব চিটিংবাজ ছিল।” শ্যামলাল রুষ্টমুখে বলল। “মেমসাবের কাছে যেতে বলেছিল তো তার কাছেই যান।”
“কিন্তু সত্যিই কি মেমসায়েবের সঙ্গে তোমার মামার খাতির ছিল?” কর্নেল মুখে উদ্বেগ ফুটিয়ে বললেন। “বুঝে দেখ শ্যামলাল, মেকি জুয়েল বেচে আমার কাছে হাজার টাকা নিয়েছে তোমার মামা! তোমার কি মনে হয়, মেমসায়েব-”
“মেমসায়েব মামাকে যতই খাতির করুক, টাকা স্যার আপনি আর পাচ্ছেন না।”
“মেমসায়েবেরই জিনিস এটা। মামা বলেছিলেন।”
“ঝুট। মিথ্যা কথা।”
“কেন, কেন?”
শ্যামলাল উত্তেজিতভাবে বলল, “মেমসায়েব জুয়েল বেচবে কেন? সব প্রপার্টি মেমসায়েবের। হারামি বোসসায়েব মুখে লম্বে লম্বে বাত করে। মেমসায়েবের নোকর আছে সে। আপনি জানেন? নিমকহারাম বোসসায়েব ডাকু কেতন সিংহকে বন্ধু করেছে। কোনও খারাপ মতলব আছে। জরুর আছে। বেচারি মেমসায়েবের জন্য আমার ভয় হয়।” সে ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। ফের বলল, “তো আপনি কোথায় থাকেন? আপনাকে মামা কোথায় ঝুটা জুয়েল বেচল?”
কর্নেল বললেন, “আমি কলকাতায় থাকি। এখানে বেড়াতে এসেছি। গতকাল সকালে তোমার মামার সঙ্গে নিউটাউনশিপে একটা চায়ের দোকানে আলাপ হল। কথায় কথায় সে চুপিচুপি বলল, সস্তায় দামি জুয়েল কিনতে চাই কি না। এখানকার রায়রাজাদের ফ্যামিলি আছে। তাদেরই–”
“থানায় চলে যান।” বলে শ্যামলাল মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল।
কর্নেল রাস্তায় এসে আবার একটা সাইকেল রিকশো নিলেন। বললেন, “নিউ টাউনশিপ জলদি যানা ভাই।” রিকশোর চাকা গড়ালে কর্নেলের মাথায় এল, শ্যামলাল তাঁর হাতের হ্যাভারস্যাকটা সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন করল না। লক্ষ্যও করল না।
আরিফের জিপে আসার সময় ‘জয়রাম ইলেকট্রোপ্রিন্টো’-তে ক্রিস্নানের ফিল্মটা দিয়েছিলেন। সঙ্গে অ্যাডিশনাল পুলিশ সুপার থাকার সুবিধা অনেক। যাবার পথে নেগেটিভ দেখে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল।
ব্যাগি প্যান্টশার্ট পরা স্মাট তরুণটি কর্নেলকে দেখে হাসল। “সরি মিস্টার! নাথিং ক্যান বি ডান। লাইট পাসড থ্রু ইওর ক্যামেরা গট্টা হোয়াইট লট ওনলি।”
ক্যামেরা থেকে ফিল্মের রোল বের করতে গিয়েই আলো ‘পাস করেছে এবং সব ছবি নষ্ট হয়ে গেছে, এই তার মত। নষ্ট রোলটা নিয়ে কর্নেল ডেভলাপ করার খরচ দিতে গেলেন। সে নিল না। “থ্যাংকস স্যার! দ্যাটস ওকে। প্লিজ কাম এগেন। বাট স্যার, বি ভেরি কেয়ারফুল নেক্সটাইম।”
“ও! শিওর!” কর্নেল চুরুট ধরালেন। তারপর অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে থাকলেন। এ কি ক্রিস্নানের ইচ্ছাকৃত, নাকি তাড়াহুড়োয় দৈবাৎ ঘটে গেছে?…
.
০৭.
বাংলোর গেটের কাছে হল্লা শুনে বীতশোক বারান্দায় বেরিয়ে এল। সবে স্নান করে পাজামা-পাঞ্জাবি পরেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করল। ম্যাথু, চৌকিদার এবং আরও কয়েকজন বাংলো-কর্মী গিয়ে ভিড় করেছে। সোমনাথ কিছু বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু নায়ার তাকে বলতে দিচ্ছে না। সুমিত ম্যাথুকে জেরা করছে। ঈশিতা চৌকিদারকে আঙুল তুলে শাসাচ্ছে। নীপা পাথরের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রিস্নান চঞ্চল হয়ে চক্কর দিচ্ছে এদিকে-সেদিকে। তারপর মুখ তুলে বীতশোককে দেখে সে উত্তেজিতভাবে ডাকল, “অশোকদা! তুমি এস। গুরুতর ঘটনা।”
লনে নেমে বীতশোক বিরক্ত মুখে বলল, “আবার একটা ডেডবডি পড়ে আছে নাকি?”
সোমনাথ বলল, “হ্যাঁ। ঠিক এই কথাটাই আমি বোঝাতে চাইছি। এরা বুঝবে না তো–”
নায়ার তাকে থামিয়ে দিল। “পালাক্রমে মারব। আর একটা কথা বলবে না। তুমি।”
ঈশিতা বলল, “আরিফকে ফোন করো এক্ষুনি। আমার সন্দেহ হচ্ছে, চৌকিদার সব জানে। ওর কথাবার্তা শুনেই বোঝা যাচ্ছে, ওকে দিয়ে কেউ আমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে।”
চৌকিদার নাথুরাম বীতশোকের পা ধরতে এল। “হামি কুছু জানে না হুজুর! কুছু সমঝাতে পারছে না।”
ম্যাথু কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে দু’হাত চিতিয়ে বলল, “ফানি থিং! হোয়াই সো মাচ ফাস অ্যাবাউট নাথিং? হোয়াটস রং?”
বীতশোক বলল, “হয়েছেটা কী?”
সুমিত গেটের বাঁদিকের থামে ঢ্যারা চিহ্নটা দেখিয়ে বলল, “দেখছ? মাইরি ঠিক এইরকম ঢ্যারা সেই হ্যাভারস্যাকটার গায়ে আঁকা ছিল। তাই না?”
বীতশোক চটে গিয়ে বলল, “তোদের মাথা সত্যিই খারাপ হয়ে গেছে। ঈশু! চলে এস। নীপা কৃষ্ণা! চলে এস তো। অকারণ সিন ক্রিয়েট করার কোনও মানে হয়? সুমিত! নায়ার! আয়। সোমনাথ একলা যত খুশি আঁতলামি চালিয়ে যাক।”
বীতশোক ম্যাথুকে চলে যেতে ইশারা করল। তারা গম্ভীরমুখে চলে গেল। ঈশিতা চাপা গলায় বলল, “কিন্তু ব্যাপারটা স্মিটিরিয়াস। তুমি পুরো ব্যাকগ্রাউন্ডটা লক্ষ্য করো। আমার ধারণা, কেউ চাইছে না আমারা এই বাংলোয় থাকি।” সে হাতের মুঠো খুলে রঙিন কাগজের কুচিগুলো দেখাল। “দেখতে পাচ্ছ? এমনি কাগজ হ্যাভারস্যাকটার ভেতর ছিল। আমরা ওখানে এগুলো কুড়িয়ে পেলুম। জঙ্গলের ভেতরে পড়ে ছিল। এবার বুঝতে পারছ, কেন মিসটিরিয়াস বলছি?”
বীতশোক কাগজগুলো দেখে বলল, “ঠিক আছে। আরিফকে জানিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু এ জন্য এত হইচই করার কোনও মানে হয় না। বাংলো সুষ্ঠু সবাইকে ডেকে জানাজানি করার দরকার কী ছিল?”
সুমিত বলল, “ঢ্যারাচিহ্নটা কিন্তু রেডসিগনালের মতো। লালরঙের ঢ্যারা।”
বীতশোক হাসল। “এখানে প্রচুর ইটের খোয়া পড়ে আছে। কেউ তাই দিয়ে দাগ টেনেছে। এটুকু তোদের মাথায় আসা উচিত ছিল।”
সোমনাথ বলল, “নায়ার! প্লিজ আমাকে বলতে দাও।”
নায়ার বলল, “বলো, কিন্তু আমি শুনছি না। সুমিত! তুমি কি এই বুদ্ধিজীবীর অসম্বদ্ধ প্রলাপ শুনতে প্রস্তুত?”
সুমিত বলল, “নাহ্। আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। মাইরি!”
নায়ার লনে ঢুকে হাঁটতে থাকল। সুমিত তাকে অনুসরণ করল। ঈশিতা বলল, “সুমিত! শোনো! সুমিত ঘুরে দাঁড়াল। ঈশিতা দ্রুত লনে এগিয়ে গেল।
সোমনাথ শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, “তো হ্যাঁঃ! সুমিত ইজ রাইট। আ রেড সিগন্যাল। তবে এটা হল, যাকে বলে সারফেস রিয়্যালিটি। বীতশোক তুমি নিশ্চয় লক্ষ্য করেছ, হাইপাওয়ার বিদ্যুতের ক্ষেত্রে একটা বিপদসংকেত আঁকা থাকে। দুটো আড়াআড়ি হাড় এবং ওপরে একটা মাথার খুলি। এখানে খুলিটা নেই। কিন্তু হাড়ের ব্যাপারটা আছে। তা হলে সারফেস রিয়্যালিটির এ ক্ষেত্রে। আমরা পাচ্ছি দুটো ডাইমেনসন–দুটো মাত্রা। কেমন তো? এবার ইনার রিয়্যালিটিতে আসছি। দুটো হাড়কে দুটো হিউম্যানবডির প্রতীক বলে মনে করা চলে। একটা বডির ওপর আরেকটা বডি পড়ে আছে–আড়াআড়িভাবে। যদি এটা ক্রসচিহ্ন হত, ল্যাংগুয়েজ একেবারে বদলে যেত। নাও রিড দা ল্যাংগুয়েজ। দুটি বডি। হাঃ। হিউম্যান বডি। ডেডবডি। রক্তাক্ত মৃতদেহ। লালরঙ সেটাই বলছে। একটা অলরেডি আমরা দেখেছি। সম্ভবত আবার একটা। দেখতে পাব। তারই সারফেস রিয়্যালিটি হল রেডসিগন্যাল। তো–ডাজ ইট সিগনিফাই এনিথিং? হ্যাঁ। একটা মার্ডার হয়ে গেছে, আরেকটা সম্ভবত হবে। একটা অতীত ঘটনা, অন্যটা অন্যটা ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ঘটনা। রেখাদুটো যেখানে পরস্পরকে ক্রস করেছে, সেটাই বর্তমান। তার মানে, আমরা এই সিং পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আছি এ মুহূর্তে। অতীত এবং ভবিষ্যতের মধ্যবিন্দুতে। বার আমি একটা সিগারেট খাব।”
সে সিগারেট ধরাল। বীতশোক বলল, “আর কিছু বলবি?”
“সোক্রাতেসের কথাটা ঘুরিয়ে বলতে চাই : I do not know that I know.’ সোমনাথ ঢ্যারাচিহ্নটার দিকে তাকাল। “আমি কি কিছু সত্যিই জানি? দ্যাটস দা পয়েন্ট, বুঝলি বীতশোক? আমি খুঁজছি।”
“খোঁজ তুই।” বীতশোক ঘুরে পা বাড়াল। “নীপা! কৃষ্ণা! একটায় গাড়ি আসবে। চলে এস।”
ক্রিস্নান ঘড়ি দেখে বলল, “নীপা! চলো। আমি ক্লান্ত।”
নীপা বলল, “তুমি চলো। আমি এই আঁতেলের সঙ্গে একটু বোঝাপড়া করে নিই।”
বীতশোক ও ক্রিস্নান চলে যাওয়ার পর নীপা আস্তে বলল, “আমি বুঝতে পারছি না, কাল রাত্তির থেকে তোমার ম্যানারিজম এত বেশি বেড়ে গেল কেন? কেন তুমি এত বাড়াবাড়ি করছ?”
“ম্যানারিজম?” সোমনাথ বলল। “নীপু, তুমি বুঝতে পারছ না আমি না জেনে একটা ফাঁদে পা দিয়েছিলুম।”
নীপা বিরক্ত হয়ে বলল, “তোমার মাথায় একটা কিছু ঢুকে গেলে তুমি তা-ই নিয়ে বড্ড বেশি হুলস্থূল বাধাও! আবার কেউ খুন হবে বললে অশোকদাকে। যদি সত্যিই তেমন কিছু ঘটে, তুমিই ফেঁসে যাবে বুঝতে পারছ না? তুমি কেন ওকথা বললে ওর সামনে? তুমি কী করে জানলে আবার কেউ খুন হবে?”
সোমনাথ নীচের দিকে বুকের ওপর সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “এ একটা সম্ভাবনা। কেউ সাংকেতিক ভাষায় কিছু বলতে চাইছে এবং হ্যাঁ–আমি তা সম্ভবত বুঝতে পেরেছি। এই কাগজটা তুমি খুঁটিয়ে দেখ। চিন্তা করো। নাও!”
নীপা ওর কাগজ ধরা হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিল। “তোমার এইসব উদ্ভট ব্যাপার নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে। কেন তুমি–”।
তাকে থামিয়ে দিয়ে সোমনাথ একটু হাসল। “নাহ্। আমার ধারণা নিয়ে আর ওরা হাসাহাসি করবে না। ওরা বুঝে গেছে–হ্যাঁ, যে-যার মতো করেই বুঝেছে, আমি একটা ভাইটাল এবং সেন্সিটিভ পয়েন্ট টাচ্ করেছি। খুব স্পর্শকাতর জায়গায় আমি আঙুল রেখেছি। এই ঢ্যারা। লুক! এবার কী দাঁড়াচ্ছে, দেখ।”
বলে একটুকরো ইটের খোয়া কুড়িয়ে নিল সে। ঢ্যারাচিহ্নটার ওপর একটা মড়ার খুলি এঁকে দিল। তারপর পিছিয়ে এসে বলল, “ওই খুলিটা থাকার কথা ছিল। অথচ আমরা ওটা দেখিনি। কাল সন্ধ্যায় ইভনিং ভিলার হলঘরে ফায়ারপ্লেসের মাথায় একটা স্টাফড় ব্ল্যাক প্যম্বারের পায়ের ফাঁকে নীপু, তুমি আমরা প্রত্যেকটি শব্দের ডাইমেনসান লক্ষ্য করো–হ্যাঁ, একটা রদ্দি হ্যাভারস্যাক এবং তার গায়ে এমনি ঢ্যারা ছিল। সেই ঢ্যরাচিহ্নটা তোমরা সবাই দেখেছ। তার ওপরও ওইরকম খুলি থাকার কথা। কিন্তু ছিল না। কেন ছিল না? বলো–কেন?”
নীপা ঝাঁঝালো স্বরে বলল, “আমি জানি না। তুমি আমার কথা শুনবে কি না বলো?”
“শুনব।” সোমনাথ সিগারেটটা মুঠোয় ধরে টান দিল। “তো হা। যে ঢ্যারাচিহ্ন এঁকেছিল, সে ওপরে খুলি আঁকার সময় পায়নি। সেই মুহূর্তেই কি আমরা গিয়ে পড়েছিলুম? মে বি। আবার এক্ষেত্রেও তা-ই। সে সময় পায়নি। নীপু! আমরা যদি আমাদের ‘লিটল গ্রে সেলস’ এর ওপর একটু নির্ভর করি, আমরাও এরকুল পোয়ারো হতে পারি। জাস্ট আ মিনিট। একটু ধৈর্য ধরে আমার পয়েন্টটা শোনো। সাধারণত ঢ্যারাচিহ্ন কিসের প্রতীক? কিছু নাকচ করা, কিছু ভুল বলে সাব্যস্ত করা। জাস্ট আ নেগেটিভ সাইন। কেমন তো? কিন্তু সেই কমন ঢ্যারাচিহ্ন বেশ কিছুটা লম্বালম্বি থাকে। ঠিক এইরকম।” সে কাগজটার উল্টোপিঠে ক্রিস্নানের কলমটা দিয়ে ঢ্যারা এঁকে নীপাকে দেখাল।
“নীপু! দেখতে পাচ্ছ? গেটে আঁকা ঢ্যারাচিহ্ন এবং হ্যাভারস্যাকের ঢ্যারাচিহ্ন হল এই দু নম্বর সাইন।” সোমনাথ সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ফেলে দিল। “এই এক নম্বর সাইনটা কিন্তু কমন। তুমি টিচার। তুমি ভাল বুঝবে ছাত্রীরা ভুল লিখলে তুমি এক নম্বরি কমন সাইনটাই ব্যবহার করো।”
নায়ারের গম্ভীর গলার ডাক ভেসে এল, “এই বুদ্ধিজীবী! আমরা খেতে যাচ্ছি।”
সোমনাথ গ্রাহ্য করল না। বলল, “দু নম্বর সাইনের স্ট্রাকচার হাইপাওয়ার বিদ্যুতের কিংবা বিষাক্ত কোনও জিনিসের ক্ষেত্রে দেখা যায়–হ্যাঁ! ওপরে একটা খুলিসহ। তা না হলে এমন দুটো রেখা একটা পারফেক্ট ল্যাংগুয়েজ হয়ে উঠতে পারে না। তো এবার ভেবে দেখ, কেন আমি এ নিয়ে এত চিন্তাভাবনা করছি। নীপু, আমি কি কারও টার্গেট হয়ে পড়েছি? আমি কি নিজের অজ্ঞাতসারে এমন কিছু জানি, যা তাকে বিপদে ফেলতে পারে? আরও স্পষ্ট করা যেতে পারে এই পয়েন্টটা। আমার সিগারেট প্যাকেট ফেলে-আসার সুযোগ নিয়েই কি একটা লোককে মারা হল?”
নীপা শ্বাসপ্রশ্বাসে জড়িয়ে ‘অশোকদা’ বলেই থেমে গেল।
সোমনাথ দ্রুত বলল, “নাহ্। বীতশোকের প্রশ্নই ওঠে না। সে আমার পুরনো বন্ধু। ধরা যাক, তার কোনও গোপন তথ্য আমি জানি, যা তার পক্ষে বিপজ্জনক। কিন্তু সে-জন্য সে হাথিয়াগড়ে আমাকে এনে–নাহ্। আরিফ ইজ হিয়ার। তা ছাড়া বীতশোকই আরিফকে ফোনে জানাল, আমরা এসে গেছি। তুমি চলে এস। হা! আরিফ না থাকলে এ পয়েন্টটা ভাবা চলত।”
নীপা পা বাড়িয়ে বলল, “আমি বলিনি! সব তাতেই তোমার বাড়াবাড়ি করা চাই-ই।”
সোমনাথ তাকে অনুসরণ করে বলল, “তুমি কী বলতে যাচ্ছিলে বলো। আমার জানা দরকার।”
নীপা খুব আস্তে বলল, “গতরাতে অশোকদা বলছিল একটা মরা বেড়াল নিয়ে সোমনাথ মাথা ঘামাচ্ছে কেন?”
সোমনাথ হাসল। “তাহলে আ কোট প্রম বোদলেয়ার : A fine strong gentle cat is prowling/As in his bedroom, in my brain. GOT THEY নীপু? আমার প্রব্লেম হল, এই বোদলেয়ারের বেড়ালই মগজ থেকে বেরিয়ে জীবনানন্দের বেড়াল হয়ে ওঠে। আবার জীবনানন্দের বেড়াল, মগজে ঢুকলে বোদলেয়ারের বেড়াল হয়ে পড়ে। হা! বোধ। বোধের চলাফেরা। মাই গুডনেস!” সোমনাথ থমকে দাঁড়িয়ে চুল খামচে ধরল।
নীপা ঘুরে দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে তাকাল।
সোমনাথ বলল, “ইভনিং ভিলায় আমরা কোনও কুকুর দেখিনি। কুকুর থাকলে সে চাঁচাবেই। আমার কি কুকুরের চাঁচানি শুনেছি? নাহ্। তুমি শুনেছ?”
“নাহ্।”
“এ-ও একটা পয়েন্ট।” সোমনাথ পা বাড়াল। “আসলে বেড়াল শব্দের অনুষঙ্গে কুকুর এসে পড়েছে। কুকুর-বেড়াল। দা কমন টার্ম। কিন্তু কেন ইভনিং ভিলায় কুকুর নেই? থাকা অবশ্যই উচিত ছিল। ওইসব ফ্যামিলিতে কুকুর তো অ্যারিস্টোক্রেসির প্রতীক। কিন্তু কোন কুকুর নেই।”
“ভেতরে কোথাও থাকতে পারে। অত বড় বাড়ি।”
“নীপু! ভারতীয় এরকুল পোয়ারো বলছেন, বাইরের লোকের কাছে কুকুর শো করা এদেশি অ্যারিস্টোক্রেসির কমন লক্ষণ। বিশেষ করে মিঃ বোসের মতো দাম্ভিক হামবড়াই লোককে একটা কুকুর ছাড়া মানায় না। হলঘরের সিঁড়ি দিয়ে যখন লোকটা নামছিল, আমি সিওর ছিলুম, তার পেছনে কুকুরও নামছে। একটু পরে মাদাম বোস নামলেন। তখনও আশা করেছিলুম–এই তো বীতশোক!”
বীতশোক তাদের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, “খুঁজে পেলি?”
“বলছি।” সোমনাথ বারান্দায় উঠে বলল, “হ্যাঁ রে! ইভনিং ভিলায় কুকুর পোষে না?”
“কেন?”
“জানতে ইচ্ছে করছে। কাল আমরা কোনও কুকুরের চ্যাঁচানিও শুনিনি।”
“এক বার চুপিচুপি গিয়ে ঢুকে দেখে আয় না!”
“আছে?”
“একটা অ্যালসেশিয়ান, একটা ডোবারম্যান পিঞ্চার, একটা টেরিয়ার আর একটা বুলডগ। সন্ধ্যা থেকে ভোর অব্দি ছাড়া থাকে।”
“কিন্তু কাল সন্ধ্যায় ছিল না।”
“কাল, সন্ধ্যায় আমরা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে গেলুম। তাই বেঁধে রেখেছিল।”
“চ্যাঁচাবে তো! আমরা আউটসাইডার!”
বীতশোক হাসল। “ইভনিং ভিলার কুকুর চাঁচায় না। নিঃশব্দে গলায় কামড় বসায়।”
সোমনাথ মাথা নেড়ে বলল, “এ তুই ঠিক বলছিস না। আইম নট জোকিং –হ্যাঁ! একটা উন্ডেড লোক দিব্যি ঢুকে গেল আমরা চলে আসার পর। হলঘরে গিয়ে মারা পড়ল সে! বিনা প্রতিরোধে!”
বীতশোক হঠাৎ একটু চটে গেল। “তুই ওই দাড়িওয়ালা টিকটিকি ভদ্রলোকের অ্যাসিস্টান্ট হয়ে যা, সোমনাথ! আমার ধারণা, ভদ্রলোকের একজন অ্যাসিস্টান্ট দরকার।”
– “এটা একটা ইমপর্টান্ট প্রশ্ন বীতশোক!”
বীতশোক বিরক্ত হয়ে বলল, “গণেশ অন্য কী কাজে ব্যস্ত ছিল। তাই দরজা আর গেট বন্ধ করতে দেরি হয়েছিল।” বীতশোক আবার হালকা মেজাজে ফিরে এল। “কুকুরগুলো থাকে পেছনের দিকে। ডগহাউসের দরজা খুলতেও দেরি। করেছিল গণেশ। ইতিমধ্যে মালতী হলঘরে কাপ-প্লেট নিতে এসে দেখে দরজা। খোলা। অথচ ঘর অন্ধকার। সে আলো জ্বেলে ডেডবডিটা দেখতে পায়। ক্লিয়ার?”
“এক মিনিট বীতশোক!”
“তুই একটা বদ্ধ পাগল। কেন এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিস?”
“আমি বলতে চাইছি, গণেশের দেরি করাটা ইচ্ছাকৃত কি না?”
বীতশোক বলল, “স্নান-টান করবি তো করে নিয়ে খেয়েদেয়ে রেডি হ। একটা গাড়ি আসবে। বারোটা পনের বাজে। আমি সাড়ে বারোটায় বেরুব। তোদের সঙ্গ দিতে পারছি না বলে দুঃখিত।”
সে ব্যস্তভাবে করিডরে ঢুকে গেল। নীপা তার ঘরে চলে গেছে। সোমনাথ সোজা ডাইনিংয়ে ঢুকল। সুমিত ও নায়ার খাচ্ছিল। সোমনাথকে দেখে দুজনেই চোখে-চোখে হাসল। সোমনাথ তাদের টেবিলে বসে বলল, “খিদে পেয়েছে। কী কী আইটেম রে?”
নায়ার বলল, “এ সব তোকে দেওয়া হবে না। কারণ তুই বুদ্ধিজীবী। আমরা জানিয়ে দিয়েছি ম্যাথুকে। তোর জন্য কচুসেদ্ধ হচ্ছে। একটু ডাল পেতেও পারিস।”
সুমিত বলল, “এ কী মাইরি! স্নান না করিস, হাত-ফাত ধুয়ে আয়।” সে ফিসফিস করল, “ওয়েস্টার্ন মেয়েছেলের কাগজ-কলম ঘেঁটেছে! এডস হবে কিন্তু।”
নায়ার ফিক করে হাসল।
ঈশিতা স্নান করেছে। কাছে এসে বললু, “কৃষ্ণাকে জোর করে বাথরুমে ঢুকিয়ে শাওয়ার খুলে দিয়ে এলুম। ডেনিশ ভাষায় আমার মুণ্ডুপাত করছে। নীপুকে বললুম, আমার বাথে চলো। মড়াকান্না জুড়ে দিল। কী মেয়ে! স্নান না করে থাকে কী করে? সামারে তো আমি দুবেলা তিনঘণ্টা করে বাথটাবে পড়ে থাকি।”
নায়ার বলল, “এই বুদ্ধিজীবী স্নান করবে না।”
“সে কী সোমনাথ!” ঈশিতা বলল। “স্নান করবে না কেন?”
সোমনাথ বলল, “আমি সপ্তাহে একদিন স্নান করি। তা-ও কয়েক পেগ ড্রিংক করে নিয়ে। তুমি কি জানো ড্রাংক অবস্থায় মানুষের চামড়া গণ্ডারের চামড়া হয়ে যায়?”
ঈশিতা বলল, “সেজন্যই তোমার ইনসমনিয়া। তোমাকে ঘুমের ওষুধ খেতে হয়। ভেরি ব্যাড সোমনাথ! তুমি রেগুলার স্নান করো। দেখবে চমৎকার ঘুম হচ্ছে।”
একজন বয় এসে বলল, “আপকি খানা ইহা দেঙ্গে মেমসাব?”
“না। ওই টেবিলে দেবে। একটু পরে। ওরা দুজন আসুক। তিনজন একসঙ্গে খাব।”
সুমিত বলল, “মাইরি! মেয়েরা সত্যিই সাম্প্রদায়িক।”
সোমনাথ বলল, “এই যে ভাই! আমারটা এখানে দিয়ে যাও।”
ঈশিতা বলল, “আমরা যে সাম্প্রদায়িক নই, তার প্রমাণ দিতে সোমনাথকে আমাদের টেবিলে বসাব। ওঠ সোমনাথ!”
সুমিত বলল, “ও হাত-ফাত না ধুয়ে খাবে কিন্তু! ওকে বেসিনে ধুয়ে আনো ঈশু। কাল রাত্তিরে নেহাত রক্তের ভয়ে হাত ধুয়েছিল। আমার বিশ্বাস, ব্রেকফাস্টের সময় ও হাত ধোয়নি। তাছাড়া এখন ওর হাতে এডসের ভাইরাস আছে।”
“ধুর ব্যাটা।” নায়ার তাকে থামিয়ে বলল, “তখন না হয় কাঁটাচামচে খেয়েছিস। এখনও কি তাই খাবি নাকি? কী রে!”
“হ্যাঁ! এখনও কাঁটাচামচেই খাব।” সোমনাথ বলল। “তবে আমার আর নড়তে ইচ্ছে করছে না। ঈশু! প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। ও ভাই! জলদি খানা লাও। হাম ভুখিপিঢ়ি হ্যায়।”
“অ্যাঃ!” নায়ার বিস্ময়সূচক শব্দটা করল। “তুই জানিস ভুখিপিঢ়ি’ বলতে কী বোঝায়। বাংলা সাহিত্যে তোদের যেমন হাংরি জেনারেশন’ ছিল, হিন্দিতে তেমনি–আঁ! বলে কী, হাম ভুখিপিঢ়ি হ্যায়! কী রে!”
ঈশিতা হাসল। “নায়ার, তুমিও কম আঁতেল নও! মাইরি!”
সুমিত বলল, “ভেংচি কাটা হচ্ছে? ওক্কে! আজ পাতালেশ্বরীর মন্দিরে বডি ফেলে দেব।”
“কে কার বডি ফেলে দেয় দেখা যাবে।” বলে ঈশিতা পাশের টেবিলে গেল। ক্রিস্নান ও নীপা এসে গেছে। সোমনাথের টেবিলে খাদ্য এল। সে চামচে খাওয়া শুরু করল। সুমিত ও নায়ারের খাওয়া শেষ। ওরা বেসিনে হাত ধুয়ে লবিতে ঢুকল।
ক্রিস্নান বলল, “সোমনাথ! তুমি একা কেন? এখানে এস।”
ঈশিতা বলল, “ওকে আমরা ত্যাগ করেছি।”
“কেন?”
ঈশিতা বলল, “সোমনাথ একজন নোংরা দ্বিপদপ্রাণী। সে স্নান করে না।”
সোমনাথ বলল, “কৃষ্ণা! তোমার কলম আমার কাছে।”
ক্রিস্নান হাসল। “তোমাকে উপহার দিলাম। কিন্তু তুমি এখানে এস।”
“ধন্যবাদ। আচ্ছা কৃষ্ণা, গতকাল সন্ধ্যয় আমরা যখন ইভনিং ভিলায় ছিলুম, তখন কী কী অস্বাভাবিক ব্যাপার তোমার চোখে পড়েছিল?”
নীপা বলল, “উত্তর দেবে না কৃষ্ণা। সোমনাথের মাথা খারাপ হয়ে গেছে।”
ক্রিস্নান একটু হাসল। “না। এসব কথা আমিও চিন্তা করেছি। তাই বলা উচিত। প্রথম, আমাদের গাড়ি বাড়ির মধ্যে গেল না। রাস্তায় ক্ষুদ্র পাথর। কিন্তু হাঁটারও অনুপযুক্ত। দ্বিতীয়, প্রহরী ছিল না। তৃতীয়, যথেষ্ট আলো ছিল না। ভাবলাম, বনের মধ্যে একটা বাড়িতে যাচ্ছি। অশোকদা ডাকল। তখন একটা লোক দেখলাম। চতুর্থ, সেই অন্ধ ভদ্রলোক। প্রাঙ্গণ? প্রাঙ্গণের বনের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভাবলাম, প্রস্তর মূর্তি। এই ঘটনা বেশি অস্বাভাবিক।”
সোমনাথ বলল, “আর কিছু?”
খাদ্য এল টেবিলে। ক্রিস্নান খাদ্যের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলল, “আর কিছু চিন্তা করিনি।”
ঈশিতা চোখে হেসে বলল, “আমাকে জিজ্ঞেস করো!”
“বলো।” বলে সোমনাথ স্যালাডের দিকে ঝুঁকে পড়ল।
“মিসেস বোস তোমার যেন কত পরিচিত মনে হচ্ছিল। নীপু, তুমি বলো! অদ্ভুত লাগেনি?”
নীপা কিছু বলল না। সোমনাথ বলল, “এটা কেন অদ্ভুত মনে হল তোমার?”
ঈশিতা বলল, “একজন জাঁদরেল কোটিপতি লোকের তরুণী স্ত্রী। নীপুর চেয়েও বয়সে ছোট। আর তুমি এক চালচুলোহীন বাউণ্ডুলে। হ্যাঁ, বাংলা ইংরেজি দুটোতেই তোমার কী বলব, কিছু পিকিউল্যারিটি আছে। তোমার ওই থেমে-থেমে একটা করে শব্দ উচ্চারণ এবং শেষ শব্দটায় জার্ক। এ সবই অ্যাট্রাকটিভ। কিন্তু সিসেস বোস তো আঁতেল মহিলা নন যে আঁতেলের মর্ম বুঝবেন।”
“তো আমাকে তুমি হ্যাটা করছ!”
“ইশ! কী অভিমান রে!” ঈশিতা চোখ টিপে বলল, “সত্যি বলো না সোমনাথ! এটাই কিন্তু রিয়্যাল মিস্ট্রি।”
“হ্যাঁ! ব্যাখ্যা চাও তো দিতে পারি। চাও কি?”
“অবশ্যই চাই।”
সোমনাথ মিনিট দু-তিন চুপচাপ খাওয়ার পর একটু জল গিলল। তারপর বলল, “সুমিত দেখেছি একমাত্র তোমার কাছেই স্মার্ট। অন্য মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে নার্ভাস হয়ে পড়ে। তা ছাড়া সে বরাবর ভিতুটাইপ। নায়ার তো মিঃ বোসের সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে বাক্তাল্লা চালিয়ে গেল। কৃষ্ণা ছবি তুলতে ব্যস্ত। এদিকে আরিফ পুলিশ অফিসার। কৃষ্ণা! ভুল বললে ক্ষমা কোরো। হ্যাঁ। কৃষ্ণা আরিফের সঙ্গে ভাব জমাতে চাইছিল। সে বিদেশি মেয়ে। তার পেপারে নাকি গণ্ডগোল আছে–তো নীপু। নীপু তত মিশুক নয়, আমরা জানি। তাছাড়া নীপুর পক্ষে এ ধরনের পরিবেশ পছন্দসই নয়। এটা আমার ধারণা।” সোমনাথ শ্বাস ছেড়ে বলল, “তো হ্যাঁ। দেখলুম ভদ্রমহিলার ‘ইমেজ’ কথা বলতে চায়। কিন্তু কাকেও পাচ্ছে না। বলা চলে নির্বাক ফুলের গাছ। কোথায় যেন পড়েছি, তার মনই তার শরীর। আর হ্যাঁ! ওই সৌন্দর্য! বোদলেয়ারের অসাধারণ সেই লাইনটা মাথায় এসে গেল। “Angel of gaiety have you tasted grief? আমার জানতে ইচ্ছে হল। মাই গুডনেস! সঙ্গে সঙ্গে সাড় এল।”
ঈশিতা বাঁহাতে ভিজে চুল সরিয়ে বলল, “ওই ‘টেস্টেড গ্রিফ’ ব্যাপারটা?”
“ঈশু, সৌন্দর্য আর বিষাদের এই কেমিক্যাল কম্পাউন্ড আমি কখনও দেখিনি।”।
বীতশোক এল। ঘরের চাবি ঈশিতার টেবিলে রেখে বলল, “গেলুম। গাড়ি এস যাবে এখনই। তোমরা ঘুরে এস। ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় ইভনিং ভিলায় পৌঁছানো চাই।”
ঈশিতা বলল, “আমি কিন্তু ড্রাইভ করব না। রাস্তাও চিনি না।”
বীতশোক হাসল। “বলা হয় বটে অটোমোবিল। কিন্তু ড্রাইভার ছাড়া গাড়ি নিজে থেকে গড়িয়ে আসবে না। ড্রাইভার থাকবে।”
বীতশোক চলে গেল। তার হাতে ব্রিফকেস এবং পরনে ডিনারস্যুট। সোমনাথ খাওয়া শেষ করে উঠল। বলল, “শোনো ঈশু! আমি কিন্তু তোমাদের সঙ্গে যচ্ছি না। আমার একটা জরুরি কাজ আছে। তবে হাঃ। ঠিক সাড়ে ছটায় ইভনিং ভিলায় আমাকে দেখতে পাবে।”
ক্রিন বলল, “তুমি কোথায় যাবে?”
সোমনাথ হাসল। “সেটা গোপনীয়। বলা যাবে না।”
.
০৮.
সুমিত সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় এল। তারপর থমকে দাঁড়িয়ে চাপা স্বরে ডাকল, “নায়ার! নায়ার!”
নায়ার লবিতে বসে নীপার সঙ্গে কথা বলছিল। বিরক্ত হয়ে সাড়া দিল, “কী হল?”
“মাইরি! সোমনাথ সত্যি সত্যি ডিটেকটিভদ্রলোকের অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়েছে। শিগগির দেখে যা।”
নায়ার ভেতর থেকে বলল, “নরক্কাতিল পোট্টে!”
বিরক্তি, রাগ বা উত্তেজনার ঝোঁকে নায়ারের মুখ থেকে মাতৃভাষা বেরিয়ে আসে। সুমিত চটে গিয়ে লবিতে ঢুকে চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে বলল, “অ্যাই ব্যাটা! তুই আমাকে গাল দিলি?”
নায়ার ফিক করে হেসে বলল, “তোকে নয়, ওই বুদ্ধিজীবীকে। গাল নয়। বললাম, গোল্লায় যাক। লেট হিম গো টু হেল। নরক্কাতিল পোট্টে।”
নীপা ব্যাপারটা দেখতে বারান্দায় গেল। সে দেখল, গেটের ওধারে সোমনাথ সেই কর্নেল ভদ্রলোককে হাত নেড়ে কী সব বোঝাচ্ছে।
সুমিত ও নায়ার এসে গেল। সোমনাথ একটা হাতের ওপর আরেকটা হাত আড়াআড়িভাবে ফেললে সুমিত বলল, “সেমিওটিকস বোঝাচ্ছে। মাইরি! শালুক। চিনেছে গোপালঠাকুর।”
নীপা আস্তে বলল, “আমি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না নায়ারদা। সোমনাথ কেন এত বেশি পাগলামি করছে?”
নায়ার বলল, “অবচেতনায় আক্রান্ত। সুমিত! ফেরার পথে আমরা ওকে রাঁচির কাঁকে মানসিক চিকিৎসালয়ে রেখে যাব।”
সুমিত বলল, “আরে। সোমনাথ যাচ্ছে কোথায়। গাড়ি আসার সময় হয়ে গেছে।”
নীপা বলল, “সোমনাথ বেড়াতে যাবে না। বলছিল, কোথায় যাবে, সেটা নাকি গোপনীয়। কাকেও বলা যাবে না।”
নায়ার বলল, “তুমি ওকে নিষেধ করলে না? আমার ধারণা, সে তোমার নিষেধ অগ্রাহ্য করতে পারত না। নীপা! তুমি গিয়ে ওকে বলো–”
“নায়ারদা! বাড়াবাড়ি কোরো না।” বলে নীপা দ্রুত চলে গেল লবির ভেতর দিয়ে করিডরের দিকে।
নায়ার ফিক করে হেসে অভ্যাসমতো গোঁফ ঢাকল। চাপা স্বরে বলল, “আমার ধারণা ছিল, প্রেম ক্ষণস্থায়ী। সেটা শেষ পর্যন্ত সত্য প্রমাণিত হল বলা চলে। সোমনাথনীপার ঘটনা ব্যতিক্রম ভাবতাম। দেখা গেল, প্রেমে ব্যতিক্রম নেই।”
সুমিত বলল, “ধুর ব্যাটা। ডুবে ডুবে জল খাওয়া কাকে বলে জানিস?”
কর্নেল এসে সম্ভাষণ করলেন, “হ্যালো!”
নায়ার বলল, “কর্নেলসায়েব। আমাদের বুদ্ধিজীবী বন্ধুকে কি আপনার সহকারী হওয়ার যোগ্য মনে হল?”
কর্নেল হাসলেন। “সোমনাথবাবুর থিওরিটা মন্দ নয় অবশ্য।”
সুমিত বলল, “ওর থিওরিটা আপনি বুঝতে পেরেছেন! সেমিওটিকস বোঝেন তো স্যার?”
কর্নেল বললেন, “আপনাদের বুদ্ধিজীবী বন্ধুর থিওরি হল, একটা বডি পড়েছে। এবার তার ওপর আড়াআড়িভাবে আরেকটা বডি পড়বে।”
নায়ার বলল, “উন্মাদ। কিন্তু ও গেল কোথায় আপনাকে বলেছে?”
কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, “ইভনিং ভিলায় কুকুর আছে কি না জানতে গেলেন সোমনাথবাবু।”
সুমিত বলল, “কোনও মানে হয়। আমরা হাথিয়া ফলস দেখতে যাব। গাড়ি আসার সময় হয়ে গেল। আর ও গেল গোয়েন্দাগিরি করতে? কুকুর কামড়ে দিলে পেটে চৌদ্দখানা ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ ঢোকাতে হবে, জানে না?”
কর্নেল ভেতরে ঢুকে যাওয়ার পর নায়ার বলল, “জানিস সুমিত? ওই বুদ্ধিজীবীর জন্য আমার ভয় হচ্ছে।”
“আমারও।” সুমিত একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “অকারণ এভাবে যেখানে সেখানে নাক গলানোর কোনও মানে হয়? কে একজন আজেবাজে লোক খুন হয়েছে, তার জন্য পুলিশ আছে। এই ডিটেকটিভদ্রলোক আছেন।”
ঈশিতা সেজেগুজে এসে বারান্দার চেয়ারে বসল। বলল, “কী হল তোমাদের? তুষোমুখে দাঁড়িয়ে আছ কেন?”
সুমিত শ্বাস টেনে বলল, “উঃ! জ্বলে গেলুম! পুড়ে গেলুম! একশোখানা বসন্তের সেন্ট।”
“মাইরি?” ঈশিতা হাসল।
“এই। তুমি দারুণ সেজেছ।” সুমিত তার পাশে বসে বলল। “তোমার ফুলপরি-মুখে এখন ভেংচিকাটা উচিত নয়। কী যেন সেন্টটার নাম?”
নায়ার বলল, “তোর স্মৃতিশক্তি ক্ষীণ। সেন্টটার নাম স্কাউন্ড্রেল।”
ক্রিস্নান এসে বলল, “একটা পাঁচ বাজল। কিন্তু গাড়ি আসছে না কেন ঈশিতাদি?”
ঈশিতা বলল, “তুমি হঠাৎ দিদি-টিদি শুরু করলে কেন কৃষ্ণা?”
“তোমাকে পবিত্র দেবী ধারণা হচ্ছে।” ক্রিস্নান বসে বলল। “জানো? কোনও কোনও ভারতীয় নারীর মুখ দেখে আমার ধারণা হয়েছে, ভারতীয় দেবীদের প্রতিমূর্তি।”
“পাতালেশ্বরী দেবীকে দেখলে তোমার ধারণা বদলে যাবে কৃষ্ণা।”
নায়ার বলল, “এ বিষয়ে আমার বক্তব্য আছে। ভারতের সব দেবদেবী দেখতে সুন্দর নয়। আমাদের দক্ষিণে গেলে দেখবে দেবদেবীরা”
সুমিত বাধা দিয়ে বলল, “রামায়ণে তোদের দেশের কথা আছে। তোরা অনার্য আমরা আর্য।”
নায়ার ফিক করে হাসল। “তোরা আর্য? বাঙালিরা? যা, আয়নায় নিজের চেহারা দেখে আয়।”
নীপা এল। ঈশিতা তার হাত ধরে টেনে অন্য পাশের চেয়ারে বসিয়ে বলল, “সোমনাথটা জানবে না কী হারাল। হাথিয়া ফলস আমি একবার দেখেছি। ওয়েস্ট হলে এমন সুন্দর একটা ফলসবাহ! আমাদের গাড়ি আসছে।”
একটা কালো অ্যাম্বাসাডর চড়াইয়ে উঠলে সবাই দেখতে পেল। এই সময় লবি থেকে কর্নেল বেরিয়ে এলেন। ঈশিতা তাকে ‘হাই’ করে একটু হেসে বলল, “কী কর্নেলসাহেব? আমাদের সঙ্গে যাবেন নাকি? আমাদের সম্পর্কে ইনভেস্টিগেশনের একটা চান্স পেয়ে যাবেন কিন্তু। আমাদের মধ্যে মার্ডারার, স্মাগলার, ব্ল্যাকমেলর, ছিঁচকে চোর সবই পেয়ে যাবেন।”
কর্নেল হাসলেন। “সরি মিসেস ব্যানার্জি। আমি এখন ক্ষুধার্ত। বাই দা বাই, আপনাদের জানানো উচিত মনে করলুম, মিস ক্রিস্নানের ফিল্মরোলটা কীভাবে আলো পাস করে নষ্ট হয়ে গেছে। পুরো ফিল্মটাই নষ্ট।”
বলে ফিল্মরোলটা হাত থেকে মেঝে পর্যন্ত ছড়িয়ে দিলেন। ক্রিস্নান মাতৃভাষায় কিছু বলে উঠেছিল। সবাই তার দিকে তাকালে সে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, “অসম্ভব ঘটনা।”
নায়ার বলল, “তা হলে ফিল্মটাই খারাপ ছিল।”
কর্নেল বললেন, “ফিল্মটা নষ্ট না হলে কালো চিতাবাঘের পায়ের তলায় একটা হ্যাভারস্যাক তখন ছিল কি না, জানা যেত। একটা ইমপর্টান্ট ক্ল। সোমনাথবাবুর কথার সত্যতা যাচাই করা যেত।”
নীপা ফুঁসে উঠল, “সোমনাথ কখনও মিথ্যা বলে না।”
কর্নেল একটু হেসে বললেন, “সরি মিস সেন। আমি সোমনাথবাবুকে মিথ্যাবাদী বলিনি। উনি একটু আগে আমার কাছে স্বীকার করেছেন, উনি চোখ দিয়ে কিছু দেখেন না। মন দিয়ে দেখেন।”
নায়ার সায় দিল। “ঠিক, ঠিক।”
“কাজেই যখন সোমনাথবাবুকে বললুম, চিতাবাঘের পায়ের তলায় হ্যাভারস্যাকটা তিনি মন দিয়ে দেখেছিলেন, না চোখ দিয়ে, তখন উনি বললেন, তা অসম্ভব নয়। হয়তো অন্য কোথাও দেখে থাকতে পারি। দেখার পর সেটা। কালো চিতাবাঘের পায়ের তলায় আরোপ করে থাকতেও পারি। আরোপ। কথাটা বুঝে দেখুন। কর্নেল ফিল্মরোলটা জড়াতে জড়াতে বললেন, “সোমনাথবাবু আমাকে বলছিলেন, উনি একসময় ছবি আঁকতে পারতেন। সেই অভ্যাসটা মনে থেকে গেছে। আ সর্ট অব কোলাজ। আপনারা কোলাজ রীতির ছবি নিশ্চয় দেখেছেন? আমার মতে, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে খেলা করা। একটা হ য ব র ল। তবে তার পুরো চেহারা থেকে অবশ্যই একটা আর্ট বেরিয়ে আসে। এনিওয়ে, সোমনাথবাবু নাকি মনে মনে কোলাজরীতিতে ছবি গড়েন। হুঁ গড়েন’ই বলছিলেন। তাই একটা অদ্ভুত চেহারার হ্যাভারস্যাক কালোচিতার পায়ের তলায় এনে বসিয়ে দিতেও পারেন।”
গাড়িটা গেটে এসে হর্ন দিয়ে এক চক্কর ঘুরে বিপরীতমুখী হচ্ছিল। সবাই লনে নেমে গেল। ক্রিস্নান যেতে যেতে একবার ঘুরল। থমকে দাঁড়াল। কিন্তু ঈশিতা ওকে টানল। চাপা স্বরে বলল, “লেট দা ওল্ড হ্যাগার্ড স্ট্র্যাংগল হিমসেলফ টু ডেথ উইদ্দা গড্ড্যাম থিং। চলে এস।”
সুমিত বলল, “কৃষ্ণা ইংরিজি জানে না। বাংলায় ট্রানস্লেট করে দাও।”
গাড়ির ব্যাকসিটে ক্রিস্নান, নীপা ও ঈশিতা বসল। সুমিত সেখানে ঢুকতে যাচ্ছিল। ঈশিতা বলল, “তুমি বার বার বলেছ আমরা সাম্প্রদায়িক। কাজেই হবে না। দূর থেকে গন্ধ শুঁকেই সন্তুষ্ট থাকো।”
সামনে নায়ার ও সুমিত বসল। নায়ার বলল, “ঠাই নাই, ঠাই নাই, ছোট সে তরী/আমারই সোনার ধানে গিয়াছে ভরি।”
সুমিত বলল, “ধুস! সোমনাথটা থাকলে দারুণ হত মাইরি! গান গেয়েটেয়ে জমিয়ে তুলত।”
ঈশিতা বলল, “আসলে সোমনাথ থাকলে তোমার সুবিধে হত ভাবছ তো? এবার আমি সোমনাথকে বাহন করতুম। তাতে নীপু হয় তো–নাহ। নীপু কেমন চোখে তাকাচ্ছে। আমার ভয় করছে কিন্তু।”
গাড়ির ড্রাইভার প্রৌঢ়। বিনীতভাবে বলল, “ঔর কোই আনেবালা হ্যায় সাব?”
সুমিত বলল, “নেহি ভাই। চলো। সিধা হাথিয়া ফলস।”
গাড়ি চলতে থাকল। নায়ার ঘুরে ক্রিস্নানকে বলল, “কৃষ্ণা। তুমি অত্যন্ত চিন্তিত।”
ক্রিস্নান একটু হাসল। “হ্যাঁ। আমি সত্যই চিন্তিত।”
“তোমার চিন্তার কোনও কারণ নেই।” ঈশিতা বলল। তারপর সে কণ্ঠস্বর চাপা করল। চোখেমুখে কৌতুক। বলল, “বুড়োর ঘরের দরজার ফাঁকে মার্বেল পেপারের কয়েকটা কুচি ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছিলুম।”
সুমিত হাসল। “মাইরি?”
“মাইরি।” ঈশিতা হাসতে লাগল। “বুড়োর চোখে পড়েনি মনে হচ্ছে। পড়লে বলত।”
নায়ার বলল, “আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে। কৃষ্ণা বিদেশি মেয়ে। কৃষ্ণা আমাদের সঙ্গে এখানে প্রমোদপর্যটনে এসেছে এবং তারপর এখানে একজন ডিটেকটিভের আবির্ভাব। নিশ্চয় গভর্মেন্ট ওকে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ওর ওই সাদা দাড়ি ছদ্মবেশ।”
সুমিত চাপা স্বরে সকৌতুকে বলল, “বুড়ো বলল হাথিয়া ফলসে দেখা হবে। নায়ার, আমরা ওকে তখন চিট করলে মন্দ হয় না। পেছন থেকে চুপি চুপি দুজনে ওকে জাপটে ধরে খি খি খি খি–দাড়ি-টাড়ি খুলে নিয়ে খি খি খি খি–এক্কেবারে হাথিয়া ফলসে খি খি খি খি-মাইরি!”
“ঠিক বলেছিস।” নায়ার সায় দিল। “প্রমোদ-পর্যটনে সব সময় অস্বস্তি নিয়ে ঘোরার মানে হয় না। ব্যাটাচ্ছেলে বাইনোকুলার তাক করে ঘুরছে। আমাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ!”
সুমিত বলল, “আর প্রাইভেসি? প্রাইভেসি নষ্ট হচ্ছে না?”
নায়ার আরও গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, “সমস্যা হল আরিফ। আরিফের সঙ্গে ওর খাতির।”
“আরিফ কিছু বলবে না।” সুমিত বলল। “আরিফকে বুঝিয়ে বলব, বড্ড বেশি তাঁদড়ামি করছিল। কাজেই ইন্সটান্ট রি-অ্যাকশনে ওকে জব্দ করেছি। কেন? তুই তো একবার গল্প করছিলি, শান্তিনিকেতনে কোন অধ্যাপককে আরিফ আর তুই কেমন জব্দ করেছিলি!”
নায়ার বলল, “কৃষ্ণা। তুমি চিন্তা কোরো না। বুড়ো তোমার পেছনে লাগতে এলে আমরা ওকে জব্দ করব।”
ঈশিতা গুন গুন করে গাইছিল। গাড়ি ডাইনে সংকীর্ণ একটা রাস্তায় জঙ্গলের ভেতর ঢুকছিল। গান থামিয়ে সে ক্রিস্নানকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “চিয়ার আপ বেবি। চিয়ার আপ। সুমিত। নায়ার। ওই বুড়োকে যদি ওখানে সত্যিই দেখি, আমি কী করব জানো?”
সুমিত হাসল। “আর যাই করা ঈশু, প্রেম নিবেদন কোরো না। আমার কষ্ট হবে।”
সুমিত বলল, তারপর ওটা নদীতে ছুঁড়ে ফেলল কে?”
নায়ার গম্ভীরমুখে বলল, “সেটা তদন্তসাপেক্ষ। আমরা প্রাইভেট ডিটেকটিভদ্রলোকের সাহায্য নিতে পারি। আমি তাকে বলব।”
“সর্বনাশ! ওই হোমোর পাল্লায়” বলে সুমিত থেমে গেল।
ঈশিতা তার চিবুকের দাড়ি টেনে দিয়ে বলল, “সব সময় সেক্স আর সেক্স!”
নীপা বলল, “একটা ব্যাপার আমার আশ্চর্য লাগছে।”
নায়ার বলল, “ফিল্মরোলটা নষ্ট করে দেওয়া ইচ্ছাকৃত। তাই না?”
“হ্যাঁ। সে-ও একটা ব্যাপার।” নীপা বলল, “তা ছাড়া ক্রিস্নান হাথিয়াগড় আসতে এককথায় রাজি হয়ে গেল কেন? ঈশিতাদি ফোনে প্রোপোজালটা দেওয়ার পর আমি ওকে বলমাত্র নেচে উঠল। এখন মনে হচ্ছে, ক্রিস্নানের পক্ষে হঠাৎ কলকাতা ছেড়ে চলে আসাটা স্বাভাবিক ছিল না। কারণ সজোর্ড ওকে দিল্লি থেকে ট্রাঙ্ককল করতে পারে। পরের ফ্লাইটে ফিরে এসে খোঁজ করতেও পারে। ক্রিস্নানকে তখন সে পাবে না। এমনও তো হতে পারে, সজোৰ্ড, ধরো, পুলিশ কলকাতা ফেরামাত্র ওকে অ্যারেস্ট করল।” নীপা শ্বাস ফেলে মাথা নাড়ল। “কিছু বুঝতে পারছি না। আমি ক্সিস্নানকে তার সেফটির জন্য সঙ্গে নিয়ে আসতে চাইতে পারি। কিন্তু ক্রিস্নানের পক্ষে কলকাতায়। আমাদের বাড়িতে থেকে সজোর্ডের জন্য অপেক্ষা করাটাই কি স্বাভাবিক ছিল না?”
ঈশিতা তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “তুমি বড্ড বেশি ভাবছ নীপু! কৃষ্ণা কিছু কুকর্ম করলে তোমার কোনও ক্ষতি হবে না, সো মাচ আই অ্যাসিওর য়ু।”
নায়ার বলল, “আরিফ আছে। এত চিন্তার কিছু নেই। আরিফকে আমি বলব। আগে দেখা যাক, কৃষ্ণা বাংলোয় ফিরেছে কি না।”
নীপা বলল, “বাংলোতে ওর ব্যাগ আছে।”
সুমিত বলল, “ঘরের চাবি?”
“ক্রিস্নানের কাছে।” নীপা বলল। “কারণ আমি রুম থেকে বেরুনোর বেশ কিছুক্ষণ পরে ও বেরিয়েছিল।”
সুমিত কপট গাম্ভীর্যে উদাস চোখে তাকিয়ে বলল, “ফিরে গিয়ে কী দেখব কে জানে!”
নায়ার ধমকের ভঙ্গিতে বলল, “কী দেখবি রে ব্যাটা?”
ঈশিতা বলল, “এই চতুষ্পদ প্রাণীকে কে বোঝাবে, সোমনাথের মতো আঁতেলের পক্ষে ওই কাঠখোট্টা ডেনিশ মেয়ের চেয়ে ইভনিং ভিলার এঞ্জেল অব বিউটি বেশি প্রেফারেবল?”
সুমিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “পাত্তা পাবে না রে ভাই! কুকুরের তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসবে। অবশ্যি ইভনিং ভিলাতে কুকুর আছে কি না, তা-ই নিয়ে সোমনাথের মাথাব্যথা একটা চালাকি।”
বলে সে ঈশিতার দিকে ঘুরল। ঈশিতা ভুরু কুঁচকে বলল, “আর কিছু বলার আছে?”
“আছে।”
“বলে ফেলো!”
“তুমি কি এই পোশাকেই ককটেল-ডিনারে যাবে?”
“গেলে তোমার আপত্তি আছে?”
“বীতশোক তার বউ হারাবে। কারণ পার্টিতে কে এক মাফিয়ালিডার আসছে। ঈশু, আমার পরামর্শ শোনো। বঙ্গবন্ধু হয়ে যেও। ফর ইওর সেফটি। আর দেখ ঈশু! বীতশোক বউ হারালে বউ পাবে। কিন্তু আমি যে মাইরি– ওঃ! ভাবতে আমার ভয় করছে।”
ঈশিতা ওকে কাতুকুতু দিয়ে অস্থির করে তুলল। নায়ার ফিক করে হেসে গোঁফ ঢাকল। নীপা বিরক্ত হয়ে উইন্ডো দিয়ে হাওয়াই আড্ডির জঙ্গলে ভাঙা টাওয়ারটার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ পরে গাড়ি বাঁদিকে মোড় নিয়ে জঙ্গলের রাস্তায় ঢুকলে হঠাৎ তার মনে হল, ঈশিতা ও সুমিতের ধারণা যদি সত্যি হয়? সোমনাথ আর ক্রিস্নান তার অগোচরে কোনও সম্পর্কে পৌঁছুতেও তো পারে! নীপার মনে হল, এই কালোরঙের গাড়িটা তাকে একটা চরম কোনও মুহূর্তের দিকে পৌঁছে দিতে চলেছে। একটু পরে বাংলোগামী রাস্তার চড়াইয়ে ওঠার পর নীপা হঠাৎ মরিয়া হয়ে গেল।
চৌকিদার হর্ন শুনে বাংলোর গেট খুলে দিল। কালো অ্যাম্বাসেডর বারান্দার নীচে গিয়ে থামল। নায়ার এবং সুমিত একইসঙ্গে ব্যস্তভাবে নামল। দুজনেই লবির দিকে চলে গেল।
ড্রাইভার মোতি সিং বলল, “মেমসাব! হম জারা ঘুমকে আতা। চায়উয় পিয়েঙ্গে। আভি সাড়ে পাঁচ বাজা। আধাঘণ্টেকি বাদ লোটেঙ্গে।”
ঈশিতা নেমে বলল, “ঠিক আছে। আমরা এখান থেকে সওয়া ছটায় বেরুব কিন্তু।”
গাড়িটা চলে গেল। ঈশিতা বারান্দার চেয়ারে বসে বলল, “নীপু! এখানে চুপটি করে বসো।”
নীপা বসল না। দাঁড়িয়ে রইল।
সুমিত ও নায়ার ফিরে এল। সুমিত শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, “ঘণ্টাদুই আগে কৃষ্ণা এসেছিল। তারপর বেরিয়ে গেছে। ম্যাথুকে চাবি দিয়ে গেছে। বোঝো ব্যাপারটা।”
নায়ার বলল, “দুপুরে আমরা ম্যাথুকে চটিয়ে দিয়েছি। নীপার ঘরের চাবি চাইলাম। দিল না। নীপা! তুমি চাবি নিয়ে তোমাদের ঘর খুলে দেখ, তোমার কিছু হারিয়েছে নাকি।”
নীপা চলে গেল।
ঈশিতা বলল, “আশ্চর্য! ম্যাথু ওকে যেতে দিল?”
নায়ার বলল, “ম্যাথু কেমন করে জানবে যে সে পালিয়ে যাচ্ছে?”
সুমিত বলল, “ম্যাথুকে আমি বললুম কথাটা। ম্যাথু বলল, সব রুম মিঃ ব্যানার্জির নামে বুক করা আছে। কাজেই কেউ চেক আউট করলে লিগ্যালি ম্যাথুর কিছু করার নেই। বিল পেমেন্টের ব্যাপারে দায়ী তো বীতশোক। আমরা হিজ হিজ হুজ হুজ শেয়ার করব কি না ম্যাথুর তা জানার কথা নয়।”
ঈশিতা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চলো তো নীপুর কী অবস্থা দেখি। বেচারি ভীষণ আঘাত পেয়েছে মনে।”
নীপা ক্রিস্নানের বেডের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। ঈশিতাদের দেখে সে একটু হাসল। এই হাসিতে কেমন একটা স্বস্তির ছাপ ছিল।
ঈশিতা ব্যস্তভাবে বলল, “তোমার জিনিসপত্র ঠিক আছে তো?”
নীপা বলল, “আমার জিনিসপত্র নিয়ে ক্রিস্নান কী করবে?”
“আহা, তোমার টাকাকড়ির কথা বলছি!”
নীপা তার হ্যান্ডব্যাগটা দেখাল।
সুমিত বলল, “হ্যাঁ। বাইরে গেলে সবাই টাকাকড়ি সঙ্গে নিয়েই ঘোরে। চোরের জন্য ঘরে রেখে যায় না। কিন্তু আমাদের এখনই একটা কিছু করা দরকার।”
নায়ার ক্রিস্নানের বেড ওলট-পালট করছিল।
ঈশিতা বলল, “নায়ার কি জুয়েল খুঁজছ? স্মাগলার মেয়েরা অত বোকা নয়।”
সুমিত হাসল। “ভাল করে খুঁজে দ্যাখ, দু-একটা হাত ফসকে পড়ে থাকা অসম্ভব নয়। রাজা হয়ে যাবি রে।”
ঈশিতা হঠাৎ খুব গম্ভীর হয়ে গেল। আমার ধারণা, মেয়েটা এখনও হাথিয়াগড় ছেড়ে যেতে পারেনি। আরিফকে ফোন করে জানিয়ে দিই।”
সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
নায়ার খাটের তলায় উঁকি মেরে বলল, “সুমিত আলো জ্বেলে দে।”
সুমিত ঘরের আলো জ্বেলে দিল। তারপর নিজেও উঁকি দিয়ে দেখার পর বলল, “উঁহু! টর্চ নিয়ে আসি।”
নীপা তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে ছোট্ট এক টর্চ বের করে দিল। একটু হেসে বলল, “এই পেন্সিল টর্চটা কিন্তু ক্রিস্নানেরই উপহার।”
“মাইরি!” বলে খি খি করে হেসে সুমিত টর্চটা নিল। সে টর্চ জ্বেলে দুটো খাটের তলা তন্নতন্ন খুঁজতে ব্যস্ত হল। নায়ার গিয়ে ঢুকল বাথরুমে।
বাথরুমের আলো জ্বলে উঠল। একটু পরে নায়ারের মাতৃভাষায় চিৎকার শোনা গেল। “আইয়ো! আইয়ো”।
সুমিত ও নীপা বাথরুমের দরজায় গিয়ে দেখল, নায়ার কয়েকটা রঙিন মার্বেল পেপারের ভিজে কুচি কুড়িয়ে নিচ্ছে কোমোডর পেছনদিক থেকে। তারপর আবার সে কী একটা কুড়িয়ে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ফাঁসফেঁসে গলায় বলল, “রত্ন। সবুজ রত্ন!”
তার হাতের তালুতে একটা ‘সবুজ পান্না’! নীপা চমকানো গলায় বলল, “আশ্চর্য! আমার তো চোখে পড়েনি।”
নায়ার সোমনাথের ক্যারিকেচার করে বলল, “এরকুল পোয়ারোর লিটল গ্রে সেলস! মস্তিষ্কের ক্ষুদ্র ধূসরবর্ণের কোষগুলি! তবে সহজে চোখে পড়ার মতো জায়গায় এগুলো ছিল না। অতি দ্রুত ব্যস্ততাবশত রত্নপাচারকারিণীর হস্তচ্যুত হয়েছিল।”
“ধুর ব্যাটা!” সুমিত চটে গেল। “ওই মেয়েছেলেটার মতো অখাদ্য বাংলা বলছে। আবার ওকেই বাংলা ইউসেজ শেখাতে চেয়েছিল। বেরিয়ে আয় বলছি বাথরুম থেকে। মেয়েছেলের বাথরুমে দাঁড়িয়ে পণ্ডিতি ফলাতে হবে না।” বলেই সে নীপার দিকে তাকিয়ে জিভ কাটল। “সরি! অফুল্যি সরি নীপু!”
নায়ার বাথরুম থেকে দাপটে বেরিয়ে এল।
নীপা আস্তে বলল, “বুঝতে পেরেছি। গত রাত্তিরে ক্রিস্নানকে কেউ জুয়েল পাচার করেছিল। বাথরুমে গিয়ে জুয়েলগুলো বের করে নেওয়ার সময় একটা পড়ে গেছে। টের পায়নি। অথবা টের পেলেও খুঁজে পায়নি। নায়ারদা তখন ঠিকই বলছিল। জুয়েল বের করে নিয়ে সে হ্যাভারস্যাকটাবুঝলে নায়ারদা? তোমাদের বাথরুমে পাচার করে এসেছিল!”
সুমিত বলল, “কিন্তু আমাদের বাথরুমে কেন? বাউন্ডারিওয়াল পার করে ছুঁড়ে ফেললেও পারত! একেবারে নদীতে গিয়ে পড়ত।”
নায়ার বলল, “পারেনি। রাত্তিরে বাংলোর চারদিকে আলো জ্বলে। চৌকিদারের চোখে পড়ার রিস্ক ছিল। কাজেই করিডরের শেষে ব্যাকডোর খুলে আমাদের বাথরুমে পাচার করা খুবই সহজ। কয়েকটি পদক্ষেপ মাত্র। চল, দেখাচ্ছি।”
ওরা দরজা খুলে বেরিয়ে করিডরে ঈশিতাকে দেখতে পেল। ঈশিতা বলল, “আরিফকে পেলুম না। সে বহুক্ষণ আগে বেরিয়েছে। থানায় ফোন করলুম। লাইন পাওয়া গেল না। এক্সচেঞ্জ অপারেটর বলল, এনগেজড। পরে ট্রাই করবেন।”
নায়ার হাত বাড়িয়ে তালুতে রাখা ভিজে কয়েকটা রঙিন মার্বেল পেপারের কুচি আর সবুজ পান্না দেখিয়ে বলল, “আমার আবিষ্কার!”
ঈশিতা চমকে উঠে বলল, “কোথায় পেলে? ওম্মা! মেয়েটা তোমাকেও ফাঁসানোর তাল করে পালিয়ে গেছে দেখছি।”
নায়ার বলল, “না। আমার সিদ্ধান্ত, গত রাত্তিরে বাথরুমে রত্নগুলো বের করার সময় একটা রত্ন পড়ে গিয়েছিল। আর একটা রত্ন হ্যাভারস্যাকের তলায় আত্মগোপন করেছিল। সেটা ওই প্রাইভেট ডিটেকটিভদ্রলোকের কাছে আমরা দেখেছি।”
সুমিত বলল, “আমার মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরছে। চলো, বারান্দায় কিংবা লনে বসে চা-ফা খাই।”
চৌকিদার বেতের টেবিল-চেয়ার লনের সবুজ ঘাসে পেতে দিল। ওরা বসল। একটু পরে চায়ের ট্রে রেখে গেল একজন ক্যান্টিনবয়। ঈশিতা পট থেকে কাপগুলোতে চা ঢালতে ঢালতে বলল, “মেয়েটাকে পালানোর জন্য প্রচুর সময় দেওয়া হল। কিন্তু কী আর করা যাবে? চা খেয়ে আরেকবার ফোনে ট্রাই করব। আমাদের দিক থেকে যতটা ক্লিয়ার থাকা যায়, থাকব। তবে আমি শুধু ভাবছি সোমনাথটার কথা।”
নায়ার চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “বুদ্ধিজীবী সম্ভবত হাওয়াই আড্ডির জঙ্গলে গুপ্তধন খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমরা জলপ্রপাত থেকে ফেরার পথে ওকে ওখানে। নিশ্চয় আবিষ্কার করতে পারতাম।”
সুমিত বলল, “নাহ্। সোমনাথ ইভনিং ভিলায় যেভাবে হোক ঢুকেছে। পাঁচিল ডিঙিয়েও ঢুকে থাকতে পারে।”
ঈশিতা হাসল। “তা হলে বুলডগটা ওকে এতক্ষণ হজম করে ফেলেছে। কারণ ইভনিং ভিলায় সত্যিই বুলডগ আছে।”
সুমিত বলল, “মিসেস বোস সোমনাথকে বাঁচাবেন। কাল সন্ধ্যায় ভদ্রমহিলার সঙ্গে ওর একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেছে।”
ঈশিতা ঘড়ি দেখে বলল “ছ’টা বেজে গেল। মোতি সিং এলে আমরা বেরুব। সওয়া ছটায় বেরুলেই চলবে। নীপু! তুমি বরং শাড়িটা বদলে এস। বুঝলে না? হোমরাচোমরা লোকেরা সব আসবে। অল দা ডালহেডেড ফুলস অ্যান্ড ড্যান্ডিজ। আফটার অল আমাদের একটা প্রেসটিজ আছে। ক্যালকাটা প্রেসটিজ বলো, কিংবা বাঙালি প্রেসটিজ বলোনা, না। আমি আপস্টার্ট কিংবা ফ্যাশানেবল কিছু মিন করছি না। ট্রাডিশনাল বাঙালি কালচারের একটা বৈশিষ্ট্য আছে। আসছি। ফোনে আরেকবার চেষ্টা করে দেখি।”
বলে সে হাল্কা পায়ে বারান্দায় গিয়ে উঠল। তারপর লবিতে ঢুকে গেল। বাংলোর আলোগুলো জ্বলে উঠল এতক্ষণে। নীপু বসে রইল।
নায়ার ভুরু কুঁচকে বলল, “আমার মতে, নীপার সাজগোজের প্রয়োজন নেই। ঈশিতার মধ্যে কিছু স্মবারি আছে।”
সুমিত হাসল। চাপা স্বরে বলল, “কোম্পানি এগজিকিউটিভের বউ। ওসব একটু-আধটু থাকতেই পারে। তবে বীতশোকের পাল্লায় পড়ে ঈশুর ভবিষ্যৎ কোনদিকে গড়াচ্ছে কে জানে! হা রে, বীতশোক ওকে নিয়ে ক্যাপিটালিজম করছে না তো?”
নীপা চটে গেল। “আড়ালে কারও সম্পর্কে কুৎসিত মন্তব্য করা উচিত নয়।”
সুমিত হাসতে লাগল। “তুমি ভাবছ ঈশুকে সামনা-সামনি এ কথা বলতে পারি না?”
“সে যখন তুমি একা থাকবে, তখন ওকে বোলো।”
“যা বাব্বা! তোমার হলটা কী? তোমাদের সবার সামনেই তো ওকে কত–যাক গে। সিগারেট টানি।” সুমিত সিগারেট ধরানোর জন্য হাওয়া আড়াল করতে গেটের দিকে ঘুরল। তারপর বলল, “গাড়ি আতা হ্যায়। হেডলাইট দেখা যাতা হ্যায়।”
নায়ার বলল, “ধুর ব্যাটা! হিন্দিতে গাড়ি স্ত্রীলিঙ্গ। আতি হ্যায়।”
সুমিত বলল, “আচ্ছা নায়ার! তোদের দক্ষিণীদের দুটো সাবজেক্টে মাথা ভাল খোলে দেখেছি ল্যাঙ্গুয়েজ আর ম্যাথমেটিকস। এর কারণ কী রে? এ পর্যন্ত যত দক্ষিণী আমি দেখেছি, বাংলা তো জানেই, আরও এক ডজন ভাষা জানে। তারপর ধর, শকুন্তলা দেবী–”
ঈশিতা বারান্দায় এসে বলল, “লাইন পেলুম না। এক্সচেঞ্জ অপারেটর বলল, কোথায় কী হাঙ্গামা হয়েছে। থানার লাইন নাকি ‘হেভিলি এনগেজড’ বুঝি না বাবা!” বলেই সে হাতে তালি দিল। “বাহ্! মাই হাজব্যান্ড’স কামিং! সুমিত! আমি কিন্তু আমার হাজব্যান্ডের গাড়িতে যাব। তোমরা যাবে মোতি সিংয়ের ব্ল্যাকহোলে।”
“তুমি পতিপ্রাণা সতী। তাই যেও। কিন্তু আমাদের এই খুকি অধ্যাপিকা হঠাৎ কেন এত নীতিবাগীশ হয়ে উঠল বলো তো?” সুমিত নীপার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল। তারপর নায়ারের দিকে ঘুরল। “নায়ার, তুই তো লিঙ্গ-টিঙ্গ বুঝিস! নীতিবাগীশের স্ত্রীলিঙ্গ কী রে? না, না! থাক্। নীপু চোখ কটমট করে তাকাচ্ছে।”
চৌকিদার দৌড়ে গিয়ে গেট খুলে দিল। বীতশোকের গাড়ি এসে বারান্দার নীচে থামল। গাড়ি থেকে নেমে এসে সে লনের একটা চেয়ারে ধপাস করে বসল। মুখে অস্বাভাবিক গাম্ভীর্য। ঈশিতা বাঁকা মুখে বলল, “কৃষ্ণা কী কেলেঙ্কারি করেছে জানো?”
নায়ার হাতের মুঠো খুলে বলল, “রত্নপাচারকারিণীর হস্তচ্যুত রত্ন।”
সুমিত হাসল। “এতক্ষণ রত্নপাচারকারিণী আকাশচারিণী!”
বীতশোক হঠাৎ ফুঁসে উঠল। “শি ইজ অ্যারেস্টেড। প্রাইভেট ডিটেকটিভটি মহা ধড়িবাজ। কখন পুলিশকে তাতিয়ে রেখেছিল। স্টেশনে ওকে অ্যারেস্ট করেছে। কিন্তু এদিকে একটা সাংঘাতিক মিসহ্যাপ হয়ে গেছে।”
নীতা চমকে উঠে বলল, “সোমনাথ”
“সোমনাথও অ্যারেস্টেড।”
“সে কী! কেন?”
“মিঃ বোস ইজ মার্ডার্ড।”
ঈশিতা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, “মার্ডার্ড! মিঃ বোস? ও মাই গড! কখন? কোথায়?…
.
১১.
বাংলোর সব আলো জ্বলে উঠল। বীতশোক জল খেয়ে সিগারেট ধরাল। তারপর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “ইভনিং ভিলা থেকে বোসসায়েবকে নিয়ে যখন বেরোলুম, তখন প্রায় সওয়া একটা। হ্যাঁ, টাইমফ্যাক্টরটা ইমপটান্ট। আমরা গেলুম নিউ টাউনশিপের নর্থে লেক এরিয়ায়। ওখানে ভি আই পি-দের কয়েকটা কটেজ আছে। ইন্ডাস্ট্রি মিনিস্টারেরও একটা কটেজ আছে। পাটনা থেকে তার পৌঁছুনোর কথা দেড়টা নাগাদ। আমরা প্রায় আধঘণ্টা অপেক্ষা করার পর স্টিল অথরিটির লোকাল ডিরেক্টরের অফিসে গেলুম। সেখান থেকে আবার মিনিস্টারের কটেজে যাওয়ার কথা। কিন্তু বোসসায়েব কেন যেন হঠাৎ ইভনিং ভিলায় ফোন করলেন। লাইন পেলেন না। আমাকে চেষ্টা করতে বললেন। এবার এক্সচেঞ্জ অপারেটর বলল, ‘সামথিং রং। দা লাইন ইজ ডেড। কথাটা শুনেই বোসোহেব বললেন, বাড়ি ফিরতে চান। বাকি কাজগুলো যেন আমি সেরে নিই। তো ওঁকে ইভনিং ভিলার গেটে পৌঁছে দিলুম। তখন প্রায় পৌনে তিনটে। হর্ন শুনে যথারীতি গণেশ এসে গেটের তালা খুলে দিল। আমি ফিরে গেলুম নিউ টাউনশিপে। কেটারিং কোম্পানিকে তাগিদ দিয়ে মিনিস্টারের খোঁজে গেলুম। তিনি এসে পৌঁছাননি। বুঝলুম, আর ওঁর আসার চান্স নেই। যাই হোক, ইভনিং ভিলার কাছে গিয়ে দেখি, পুলিশের কয়েকটা গাড়ি। আমি তো ধরেই নিয়েছিলুম, প্রাইভেট ডিটেকটিভদ্রলোক সেই ভ্যাগাবন্ডটাকে খুনের দায়ে বোসোহেবকেই ফাঁসিয়েছেন, অ্যান্ড হি ইজ অ্যারেস্টেড। মাই গড! ব্যাপারটা তা নয়। বোসসায়েবকেই কেউ খুন করেছে। দোতলায় ওঁর ড্রয়িং রুমের মেঝেয় বডি পড়ে আছে। মাথার পেছনে আঘাত করেছে খুনি। খুলি ফেটে-ওঃ! হরি!”
বীতশোক চোখ বুজে দুই কাঁধ নাড়া দিল।
ঈশিতা শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, “দোতলায় কেউ ছিল না তখন?”
বীতশোক বলল, “নাহ্। সেটাই তো অদ্ভুত!”
“মিসেস বোস কোথায় ছিলেন?”
“এগেন দা টাইম-ফ্যাক্টর ইজ ইমপর্টান্ট।” বীতশোক সিগারেটের ধোঁয়ার রিং বানানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, “মিসেস বোস দুটো নাগাদ আরিফের সঙ্গে এই বাংলোয় এসেছিলেন। ডিটেকটিভদ্রলোকের সঙ্গে কী সব কথাবার্তা বলতে এসেছিলেন। কী ব্যাপার জানি না। আরিফ ওঁকে ইভনিং ভিলার গেটে পৌঁছে দেয় সওয়া তিনটে নাগাদ। তারপর আরিফ চলে যায়। নাও সি দা ফান! বোসসায়েব যে খুন হয়ে পড়ে আছেন, সেটা আর কেউ টের পেল না। গণেশ দেখল না। তার বউ মালতী দেখল না। ওপরে গিয়ে দেখতে পেলেন মিসেস রত্না বোস!”
“পুলিশ ওঁকে অ্যারেস্ট করেনি?”
“নাহ্। আরিফ খান ইজ হার স্ট্রং অ্যালিবাই।” বীতশোক চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “মার্ডার উইপনটা এবার পাওয়া গেছে। ওই ঘরের কার্পেটেই পড়ে ছিল। রক্তমাখা ফুট আড়াই তিন লম্বা হেভি লোহার রড। এদিকে টেলিফোনের তার কাটা। পুলিশের ধারণা, খুনি পর্দার আড়ালে ওত পেতে দাঁড়িয়ে ছিল। অ্যান্ড নাও ইমাজিন হু হি ইজ? সোমনাথ!”
নীপা চেঁচিয়ে উঠল, “মিথ্যা! আমি বিশ্বাস করি না। ওকে ট্র্যাপ করা হয়েছে!”
তাকে থামিয়ে বীতশোক বলল, “ঘটনাটা শোনো আগে। উত্তেজিত হয়ে কোনও লাভ নেই। পাশের একটা ঘরের দরজা বন্ধ ছিল এবং দরজার পর্দা একেবারে ফর্দাফাই। বুলডগ কুকুরটা নখের আঁচড় কাটছিল। ভেতরে চুপচাপ বসে সিগারেট টানছিল সোমনাথ। হাতে আর জামাপ্যান্টে রক্ত। তো হাজবন্ডকে ওই অবস্থায় দেখে মিসেস বোস নাকি চিৎকার করেই ফিট হয়ে পড়ে যান। মালতী চিৎকারটা শুনেছিল। যাই হোক, টেলিফোন ডেড দেখে গণেশ থানায় খবর দিতে ছোটে। পুলিশ আসার পর বুলডগের দিকে চোখ পড়ে। গণেশ কুকুরটা সরিয়ে নিয়ে যায়। তারপর পুলিশের হুমকি শুনে সোমনাথ দরজা খোলে।”
নীপা কী বলতে যাচ্ছিল। বাধা দিয়ে ঈশিতা বলল, “সোমনাথ কী বলছে?”
বীতশোক বিরক্তমুখে বলল, “সোমনাথ একটা ইডিয়ট। শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ কোট করছে।”
নায়ার বলে উঠল, “বুদ্ধিজীবীর অসম্বদ্ধ প্রলাপ। কিন্তু তার বক্তব্য কী?”
বীতশোক বলল, “পেছনদিকের ভাঙা বাউন্ডারিওয়াল ডিঙিয়ে ঢুকেছিল। তারপর অ্যালসেশিয়ানের তাড়া খেয়ে ড্রেনপাইপ বেয়ে দোতলায় ওঠে। তোমরা লক্ষ্য করে থাকবে, ও-বাড়ির দোতলায় প্রায় সব ঘরেই ফ্রেঞ্চ উইন্ডো। গরাদ বা গ্রিল নেই। নিচের তলায় অবশ্য আছে। তো সোমনাথ মরিয়া হয়ে ফ্রেঞ্চ উইন্ডো দিয়ে যে ঘরটাতে ঢোকে, সেটাই মিঃ বোসের ড্রয়িং রুম। তখনও নাকি মিঃ বোস নড়াচড়া করছিলেন। সে তাকে নাকি তুলে বসানোর চেষ্টা করে। সেইসময় বুলডগটা দরজা দিয়ে ঘরে ঢোকে। অমনি সে ভয় পেয়ে পাশের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। সে ড্রেনপাইপ বেয়েই পালাতে পারত। কুকুরের ভয়ে নাকি পালায়নি। ওপরে কুকুর, নীচেও কুকুর।”
সুমিত বলল, “ব্যাটা আঁতেল কেন অমন করে ইভনিং ভিলায় ঢুকতে গেল, বলেনি?”
বীতশোক সিগারেটটা জুতোর তলায় ঘসে ডলে দিয়ে বলল, “অদ্ভুত ওর কথাবার্তা! মিসেস বোসের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিল। পুলিশ ওই অ্যালিবাই মেনে নেবে কোন যুক্তিতে? মিসেস বোসের সঙ্গে কথা বলতে হলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে গেল না কেন? পাঁচিল ডিঙিয়ে গেল কেন?”
নীপা আস্তে বলল, “আরিফদা যায়নি ওখানে?”
“হ্যাঁ। হি ইজ দেয়ার।” বীতশোক বাঁকা হাসল। “প্রাইভেট ডিটেকটিভও খুব দাড়ি নাড়ছে দেখলুম। বুড়ো যেন তক্কেতক্কে ছিল। তবে একটা ব্যাপারে খটকা লেগেছে আমার। সোমনাথ আজ দুপুরে আমাকে বলছিল, একটা বডি পড়েছে। আরেকটা বডি পড়বে। এটা কি নেহাত অ্যাসিডেন্টাল, নাকি সত্যি সে কোনও আভাস পেয়েছিল?”
নায়ার দু’হাত নেড়ে বলল, “অ্যাকসিডেন্টাল। সোমনাথ চোখ দিয়ে কিছু দেখে না, মন দিয়ে দেখে।”
বীতশোক উঠে দাঁড়াল। “আমাকে বাফুন দেখাচ্ছে সম্ভবত। জেন্টলম্যান সেজে আসি চাবি দাও!”
ঈশিতা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চলো।”
বীতশোক তার গাড়ি থেকে ব্রিফকেস আর বান্ডিলবাঁধা একতাড়া ফাইল বের করল। ঈশিতা বান্ডিলটা নিল।
দুজনে লবিতে ঢুকে গেলে সুমিত চাপা স্বরে বলল, “সব স্টোরির ফ্রন্টসাইড ব্যাকসাইড থাকে। আমরা ফ্রন্টসাইডটা শুনলুম। ঈশিতা এবার ব্যাকসাইডটা শুনবে।”
নায়ার চটে গিয়ে বলল, “ব্যাকসাইড আবার কী?”
“আছে রে বাবা, আছে?” সুমিত চোখে ঝিলিক তুলল। তারপর হাততালি দিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে-থাকা ক্যান্টিনবয়কে ডাকল। “এই যে ভাই! তোমার নামটা যেন কী? ঔর এক পট চায় হোগা?”
উর্দিপরা কিশোরটি এসে এঁটো কাপপ্লেট আর পটগুলো ট্রেতে সাজিয়ে দিয়ে গেল। নায়ার নীপার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার আশঙ্কার কোনও কারণ নেই। সোমনাথ হঠকারী নয়। তা ছাড়া আরিফ থাকায় সে নিরাপদ। আমরা চা খেয়ে আরিফের কাছে যাব। এটা আমাদের কর্তব্য। বিশেষ করে এই রত্নটা। শীঘ্র পুলিশকে হস্তান্তর করা উচিত।”
সুমিত সায় দিয়ে বলল, “হ্যাঁ। এটা একটা রিস্ক। নীপু! তুমি গিয়ে দেখ না, ফোনে আরিফকে পাও নাকি? ম্যাথু আমাদের ওপর চটে আছে। ফোন করতে দেবে না হয়তো। মহিলাদের কথা আলাদা। নীপু! দেরি কোরো না।”
নীপা অনিচ্ছা-অনিচ্ছা করে উঠে গেল।
একটু পরে বীতশোক ও ঈশিতা ফিরে এল। দুজনেই পোশাক বদলেছে। বীতশোক বলল, “নীপা কোথায়?”
নায়ার বলল, “আরিফকে ফোন করতে গেছে।”
ঈশিতাকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। আস্তে বলল, “কার মুখ দেখে যে বেরিয়েছিলুম! পালাতে পারলে বেঁচে যাই। আমার আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না।”
সুমিত বলল, “মাইরি! শুধু সোমনাথটাকে কোনওরকমে ছাড়িয়ে আনতে পারলে ব্যস! আমরা কাট করব।”
ক্যান্টিনবয় চায়ের ট্রে রেখে গেল। ঈশিতা বলল, “আবার চা? আমি খাব না।”
বীতশোক বলল, “খাওয়া যাক। আমি এবার র’টি খাব।”
ঈশিতা চা করতে থাকল। সেই সময় নীপা ফিরে এল। সুমিত বলল, “পেলে ওকে?”
নীপা বসে বলল, “হ্যাঁ। থানায় কনফারেন্স বসেছে। আধঘণ্টা পরে আসবে।”
নায়ার বলল, “সোমনাথ সম্পর্কে ওর কী বক্তব্য?”
“জিজ্ঞেস করিনি। আরিফদা বলল, কনফারেন্স চলছে। বড় ব্যস্ত। তবে সে। আসবে।”
সুমিত বলল, “সোমনাথ সম্পর্কে কিছু বলল না? আশ্চর্য তো!” বলে সে চায়ের কাপ-প্লেট নিল। চায়ে চুমুক দিয়ে ফের বলল, “হু! ও যতই বন্ধুতা থাক বাবা, পুলিশ ইজ পুলিশ।”
নীপা চা খেল না। বলল, “আচ্ছা অশোকদা, ক্রিস্নান কিছু স্বীকার করেছে।, জানো?”
বীতশোক মাথা দোলাল। “জানি না। আরিফই বলল যে, ওকে স্টেশনে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। প্রাইভেট ডিটেকটিভ কর্নেল সরকারই নাকি ওকে হিন্ট দিয়েছিলেন, ক্রিস্নান পালিয়ে যেতে পারে।”
ঈশিতা বলল, “একটা ব্যাপার আমার আশ্চর্য লাগছে। সোমনাথ যখন অ্যালসেশিয়ানের তাড়া খেয়ে ড্রেনপাইপ বেয়ে দোতলায় উঠল, তখন তো অ্যালসেশিয়ানটা বোবা হয়ে যায়নি! আমার অ্যালসেশিয়ান আছে। একটুতেই চেঁচামেচি করে অস্থির করে।”
বীতশোক বলল, “ঠিক। কিন্তু ইভনিং ভিলা একটা বিশাল বাড়ি। আজই পুরোটা প্রথম ভাল করে দেখলুম। গণেশ আর মালতী থাকে নীচের তলায় সাউথ-ইস্টে। সোমনাথ কুকুরের তাড়া খেয়ে উঠেছে বাড়ির নর্থ-ওয়েস্ট উল্টোদিকে। কাজেই কুকুরের ডাক ওরা নাও শুনতে পারে। এখন, বোসসায়েব খুন হয়েছেন পৌনে তিনটে থেকে সওয়া তিনটের মধ্যে। মালতী তখন নাকি তার ঘরে বাচ্চাদুটোকে ঘুম পাড়াচ্ছিল। গণেশ বোসসায়েবকে গেট খুলে দিয়ে তালা এঁটে সোজা নিজের ঘরে যায়। কিছুক্ষণ পরে রায়সায়েব ঘণ্টা বাজিয়ে তাকে ডাকেন। গণেশের ঘরে ইলেকট্রিক বেল আছে। দরকার হলে রায়সায়েব তাকে এ ভাবেই ডাকেন। হ্যাঁ, উনি থাকেন নীচের তলায় হলঘরের কাছাকাছি একটা ঘরে। প্রতিদিন তিনবেলা ওর একটা হাতে কবরেজি তেল মালিশ করে দেয় গণেশ। হাতটা অবশ। এ দিন তেল মালিশ করতে একটু দেরি হয়েছিল। তো গণেশ তেল মালিশ করছিল। কিছুক্ষণ পরে গেটের দিকে গাড়ির হর্ন। গণেশ গেট খুলতে যায়। মিসেস বোস ফিরে এসেছেন। সো হিজ অ্যালিবাই ইজ অলসো স্ট্রং।”
ঈশিতা বলল, “টেলিফোন কোন ঘরে থাকে?”
“একটাই লাইন। কিন্তু বেডরুমে একটা টেলিফোন, ড্রইং রুমে আরেকটা। দুটোতেই একসঙ্গে রিং হয়। অদ্ভুত ব্যাপার, তার কাটা হয়েছে দুটো লাইনের জয়েন্টের নীচে। কাটা বলা ঠিক হবে না, টেনে ছেঁড়া। গায়ে যথেষ্ট শক্তি না থাকলে এটা সম্ভব নয়। আবার, ও-ভাবে লোহার রড মেরে খুলি ক্র্যাক করাও সম্ভব নয়। দা মার্ডারার ওয়জ আ ভেরি স্ট্রং ম্যান।”
ঈশিতা শ্বাস ছেড়ে বলল, “তাহলে গণেশ! পুলিশ ভুল করছে।”
নায়ার বলল, “গণেশের প্রভুহত্যার উদ্দেশ্য কী থাকতে পারে?”
ঈশিতা জোর দিয়ে বলল, “মিসেস বোস গণেশকে দিয়ে মার্ডার করিয়েছে। আরিফকে ফোন করে ডেকে এই বাংলোয় আসা ওঁর নিছক অ্যালিবাই। আমি ভদ্রমহিলাকে দেখেই বুঝেছিলুম। সামথিং রং ইন হার ইমেজ। স্বামী-স্ত্রীর বয়েস পার্থক্যও চোখে পড়ার মতো। তাই না সুমিত?”
সুমিত সায় দিল। “মাইরি! আমার মনে পড়ছে কাল রাত্তিরে গাড়িতে আসার সময় সোমনাথ বলছিল ‘আ স্ট্রেঞ্জ কাল। সোমনাথকে আমরা যতই আঁতেল-ফঁতেল বলে ঠাট্টা করি, হি ইজ ভেরি ইনটেলিজেন্ট, এটা কিন্তু স্বীকার করতেই হবে।”
বীতশোক চা শেষ করে সিগারেট ধরিয়ে বলল, “তো যাক গে। আমার কোম্পানির একটা সেটব্যাক হয়ে গেল। বোসসায়েব কেতন সিংকে ম্যানেজ করেছিলেন। এবার কেতন সিং হারামজাদা কাকে ব্যাক করবে কে জানে! মিসেস বোস আলটিমেটলি কোম্পানিতে হাজবান্ডের শূন্যস্থান পূর্ণ করবেন। কিন্তু প্রব্লেম হল, কেতন সিংকে তিনি একেবারে নাকি সহ্য করতে পারেন না। কী একটা স্ক্যান্ডালাস এপিসোড আছে শুনেছি। এদিকে কেতন সিং যাকে ব্যাক করবে, সে-ই এক্সটেনশন প্রজেক্টের কনট্রাক্টটা পাবে।
ঈশিতা চাপা স্বরে বলে উঠল, “ও অশোক! তা হলে কেতন সিংয়ের সঙ্গে মিসেস বোসের কোনও গোপন আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়নি তো? তাকে দিয়েই মার্ডার করাননি তো?”
বীতশোক একটু হাসল। “তোমার ধারণা সত্য হলে আমার কোম্পানি খুশি হবে।”
বীতশোক মাফিয়ালিডারের রোমাঞ্চকর কিছু গল্প বলতে থাকল। কিছুক্ষণ পরে গেটের বাইরে হেডলাইটের ঝলক দেখা দেল। চৌকিদার আগের মতো দৌড়ে গিয়ে গেট খুলে দিল। আরিফের জিপ এসে ঢুকল।
জিপ থেকে আরিফ এবং কর্নেল নামলেন।
নায়ার গম্ভীর মুখে বলল, “আরিফ! সোমনাথ কোথায়?”
আরিফ খান হাসল। “শ্বশুরালয়ে আছে। সোমনাথের কাছে এটা নতুন কিছু নয়। সে একজন প্রাক্তন বিপ্লবী, তা তো ভালই জানো।”
চৌকিদার দুটো চেয়ার এনে দিল। আরিফ ও কর্নেল বসলেন। কর্নেল চৌকিদারকে বললেন, “ম্যাথু সাবকো বোলো, দো কাপ কফি।”।
নীপা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আরিফদা! সোমনাথ কি সত্যিই খুন করেছে?” নায়ার ফুঁসে উঠল। “অসঙ্গত প্রশ্ন! কিন্তু আমার প্রশ্ন সম্পূর্ণ ভিন্ন। বীতশোকের বর্ণনা অনুসারে সোমনাথ হত্যাকারী হতে পারে না। সোমনাথ ক্ষীণকায়। বুদ্ধিজীবী। আরিফের উচিত ছিল তার অবিলম্বে জামিনের ব্যবস্থা করা।”
আরিফ বলল, “একটু টেকনিকাল প্রব্লেম আছে। তবে আশা করি, আগামীকালই ওর জামিন হয়ে যাবে নীপা! তোমার চিন্তার কারণ নেই। সোমনাথ জামাই আদরেই থাকবে। রাতের ডিনার আমার বাড়ি থেকে যাবে। বিরিয়ানি!”
সে হাসতে লাগল। ঈশিতা বলল, “ক্রিস্নান কনফেস করেছে কিছু?”
আরিফ কর্নেলের দিকে তাকাল। কর্নেল বললেন, “হ্যাঁ। করেছে।”
নায়ার হাতের মুঠো খুলে বলল, “রত্নপাচারকারিণীর হস্তচ্যুত রত্ন। নীপার বাথরুমে উদ্ধার করেছি। আর এই দেখুন, রঙিন মার্বেল পেপারের অংশ।”
সুমিত বলল, “তার আগে বলা দরকার, কীভাবে আমাদের সঙ্গে হাথিয়া ফসল থেকে সে পালিয়ে এসেছিল। তারপর–
কর্নেল হাত তুলে তাকে থামিয়ে বললেন, “আমি সন্দেহ করেছিলুম, ক্রিস্নান পালিয়ে যেতে পারে। ফিল্মরোলটা সে ইচ্ছে করেই নষ্ট করেছিল। কারণ ওতে চিতাবাঘের পায়ের তলায় রাখা হ্যাভারস্যাকের ছবিটা ছিল। নাহ্। আমি অন্তর্যামী নই। কিন্তু আজ সকালে হ্যাভারস্যাকটা দেখার পর ক্রিস্নানের প্রচণ্ড উত্তেজনা আমার চোখ এড়ায়নি। আমাদের মনে পড়তে পারে, সে তার ব্যাগ এনে দেখাতে চাইছিল। এটা যাকে বলে ‘ঠাকুরঘরে কে রে? আমি তো কলা খাইনি!’ যাই হোক, বার্ড ওয়াচিংয়ের মতো ম্যানওয়াচিংও আমার হবি। ক্রিস্নানের মুখের রেখায় লেখা ছিল, এটা সে শুধু দেখেছে তা-ই নয়, এর সঙ্গে সে যেন জড়িত। তাই বিপন্ন বোধ করছে। স্মরণ করুন তার কথা : ‘আমি বিদেশি। আমার প্রতি সন্দেহ হতে পারে।‘ যাকে বলে ‘বিটুইন দা লাইনস’, সেইরকম একটা প্রচ্ছন্ন মানে তার কথার মধ্যে ছিল।”
ঈশিতা বলল, “কৃষ্ণা কী কনফেস করেছে, বলুন?”
“মিসেস ব্যানার্জি!” কর্নেল একটু হাসলেন। “আপনার হাজব্যান্ডকে জিজ্ঞেস করুন। তিনি সো-কল্ড স্মাগলিং এপিসোডের গোড়ার অংশটা জানেন।”
সবাই তাকাল বীতশোকের দিকে। ঈশিতা চমকে উঠেছিল। আস্তে বলল, “আই সি!”
বীতশোক সিগারেট ধরিয়ে কর্নেলের দিকে তাকাল। “ক্যান য়ু প্ৰভ দ্যাট?”
“হ্যাঁ।” কর্নেল একটু হাসলেন। “সোমনাথবাবু একটা চমৎকার কথা বলেছেন, ‘আমরা অনেক সময় জানি না যে, আমরা কী জানি। কাজেই এই বাংলোর চৌকিদার কিষেনলালও জানত না যে, সে কী জানে। দুপুর রাতে ওই গ্যারেজে আপনার গাড়ি থেকে কোনও জিনিস নিয়ে আসা, কিংবা ওই গেটের সামনে আপনার ঝুঁকে পড়ে কিছু করা তার কাছে সন্দেহজনক মনে হওয়ার কোনও কারণই ছিল না। সে ভেবেছিল আপনার পকেট থেকে কিছু পড়ে গেছে। আপনি তা খুঁজছেন। সে গতরাতের মতো আপনাকে সাহায্য করতে ছুটে এসেছিল। তাই প্রথমেই চোখে পড়ার মতো জায়গায় ‘ডেঞ্জার সিগনাল’ পুরোটা আঁকতে বাধা পান আপনি। অর্থাৎ আড়াআড়ি দুটো হাড়ের ওপর খুলিটা আঁকা হয়নি। আজ দুপুরে ওই অসমাপ্ত সাইনটা নিয়ে আপনার স্ত্রী এবং বন্ধুরা হইচই বাধান। কিষেনলাল ক্ষুব্ধ হলেও কিছু সন্দেহ করেনি। আজ বিকেলে তার সঙ্গে কথা বলার সময় প্রথমে সে দ্বিতীয় ঘটনাটাই উল্লেখ করল আমার কাছে। তার সেন্টিমেন্টে লেগেছিল। তবে সে আপনার খুব প্রশংসা করল। আপনিই এঁদের হুমকি থেকে তাকে বাঁচিয়েছিলেন, তা-ও বলল। হ্যাঁ, এবার বাকিটা আপনিই বলুন।”
বীতশোক চুপ করে আছে দেখে আরিফ বলল, “তোমার নিজের স্বার্থেই ব্যাপারটা বলা উচিত, অশোক!”
বীতশোক আস্তে বলল, “ইউ নো মিঃ বোস ওয়াজ মাই লোকাল কোম্পানি চিফ। তার কোনও অনুরোধ যত অদ্ভুত হোক, আমার পক্ষে না মেনে উপায় ছিল না।”
নীপা বলে উঠল, “তা হলে তুমিই হ্যাভারস্যাকটা আমাদের বাথরুমে পাচার করেছিলে?”
ঈশিতা শক্তমুখে বলল, “অশোক আমার সাহায্য চেয়েছিল। আমিই ওকে বললুম, ইট ইজ সো ইজি। বাইরে থেকেই ক্রিমানদের বাথরুমে ঢোকানো যায়।”
বীতশোক বলল, “অনেস্টলি বলছি। তখনও আমি জানতুম না ওটার মধ্যে কী আছে।”
সুমিত বলল, “কিন্তু তারপর ওটা আমাদের বাথরুমে গেল কী করে? সোমনাথ দেখেছিল বলেছে।”
এতক্ষণে কফি এল। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, “এগেন সোমনাথবাবুর থিওরি এসে যাচ্ছে। আমরা অনেকসময় জানি না যে, আমরা কী জানি। সকালে ব্রেকফাস্টের সময় ক্রিস্নানকে হঠাৎ কি কেউ উঠে যেতে দেখেননি?”
নীপা নড়ে বসল। “মনে পড়েছে! সোমনাথকে ডেকে আসি বলে সে হঠাৎ উঠে গিয়েছিল।”
কর্নেল বললেন, “ক্রিস্নান সব কথা খুলে বলেছে। রাত্তিরে সে বাথরুমে সন্দেহজনক শব্দ শুনেছিল। সে সাহসী মেয়ে। বাথরুমে গিয়ে সে হ্যাভারস্যাকটা দেখে ভড়কে যায়। কারণ তখনই তার মনে পড়ে গিয়েছিল, ইভনিং ভিলায় ঠিক এই জিনিসটাই সে দেখেছে। ভেতরে কী আছে দেখার জন্য মুখটা টেনে খোলার চেষ্টা করে। কাত করে খুলতে গিয়েই কী একটা সবুজ রঙের ছোট্ট জিনিস নীচে পড়ে যায়। সেটা খুঁজে পায়নি।”
নায়ার বলল, “আমি খুঁজে পেয়েছি।” সে আবার মুঠো খুলে সবুজ পান্না দেখাল।
কর্নেল বললেন, “থ্যাংস্। তো ক্রিস্নান এবং তার বয়ফ্রেন্ডের ভিসায় একটা টেকনিকাল এরর আছে। তার ওপর রহস্যময় একটা জিনিসের আবির্ভাব তার বাথরুমে। এবং তার ভেতর সম্ভবত ‘জুয়েল’ রয়েছে! চিন্তা করুন তার মনের অবস্থা। ভয় পেয়ে সে ওটা বাইরে ফেলতে গিয়েছিল। কিন্তু চৌকিদারের কাসির শব্দ শুনে ফিরে আসে। নিজের বেডরুমের খাটের তলায় লুকিয়ে রাখে। সকালে ব্রেকফাস্টের সময় সে মরিয়া হয়ে ওঠে। জিনিসটা সে সবার চোখের বাইরে দূরে কোথাও ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু করিডরের শেষে ব্যাকডোর খুলে বেরিয়ে সে দ্বিধায় পড়ে। বাউন্ডারিওয়াল অব্দি অন্তত তিরিশমিটার খোলা জায়গা পেরুতে হবে। কিন্তু সেখানে মাত্র তিন পা দূরত্বে সোমনাথবাবুদের বাথরুম। সোমনাথবাবু ঘুমুচ্ছিলেন তখনও। ক্রিস্নান লম্বা মেয়ে। উঁকি মেরে কেউ নেই দেখে সে ওটা ওখানেই ঢুকিয়ে দেয়।”
নায়ার ফিক করে হেসে বলল, “আমার তত্ত্ব! সুমিত, স্মরণ কর!”
সুমিত বলল, “কিন্তু ওটা নদীতে ফেলল কে?”
কর্নেল তার বাইনোকুলারটি দেখিয়ে বললেন, “এই জিনিসটি দূরকে নিকটে আনে। মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে নদীর ওপারে টিলায় উঠেছিলুম। দেখতে পেলুম সুইপার হন্ডুরাম কী একটা জিনিস পাঁচিল পার করে নদীতে ছুঁড়ে ফেলল। পরে ওটা খুঁজে পেলুম, সে তো আপনারা জানেন। বিকেলে হচ্ছুরামকে একলা পেয়ে আলাপ জমিয়েছিলুম। ঘটনাটি খুব স্বাভাবিক। হন্ডুরাম বাথরুম ‘সাফা করতে গিয়ে জিনিসটা দেখতে পায়। কৌতূহল অনেকেরই মজ্জাগত। সে ওটার মুখ খুলেই বিকট দুর্গন্ধ পায়। সে ধরেই নিয়েছিল, সাবলোগ’ মাতাল অবস্থায় এর মধ্যে জৈবিক কুকর্ম করেছেন। অতএব স্বভাবত এটা ফেলার দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে।”
কর্নেল চুরুট ধরালেন। নায়ার বলল, “এই রত্নপাচারের উদ্দেশ্য কী হলে?”
কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, “ওই সবুজ জিনিসটা রত্ন নয়। ইভনিং ভিলায় সেকেলে ঝাড়বাতি আছে। তার ঝালরের সবুজ ডিমালো কাঁচ।”
“অ্যাঁঃ!” নায়ার অবাক হয়ে গেল। “এন্তাপরেন্তু!”
কর্নেল প্রায় অট্টহাসি হাসলেন। “সো-কল্ড স্মাগলিং এপিসোড আসলে একটা রেড হেরিং। কথাটা জানেন, ‘চেজিং আফটার আ রেড হেরিং। যা নেই, তার পেছনে ছুটোছুটি! বসন্ত হাজরার হত্যারহস্য গোপন রাখার উদ্দেশ্যেই আমাকে এবং পুলিশকে বিভ্রান্ত করে ভুলপথে ছোটানোর চেষ্টা মাত্র। অ্যাজ ইফ বসন্ত হাজরার মৃত্যুর সঙ্গে একটা স্মাগলিং র্যাকেটেরই সম্পর্ক আছে। দৈবাৎ একজন বিদেশি মেয়ে আপনাদের দলে থাকার জন্যই এই উপায়টা বেছে নেওয়া হয়েছিল। যাই হোক, জুয়েলারির দোকানে ওটা পরীক্ষা করিয়েই আমি আরিফকে বলেছিলুম, ক্রিস্নান বস্তুত আমাদের ভাইটাল এভিডেন্স হয়ে উঠবে। কিন্তু ভয় পেয়ে তার পালানোরও চান্স আছে। কাজেই বাস এবং রেলস্টেশনের দিকে পুলিশ যেন নজর রাখে।”
আরিফ গম্ভীর মুখে বলল, “আমরা সর্বত্র জাল পেতে রেখেছিলাম।”
ঈশিতা রুষ্ট ভঙ্গিতে বলল, “সেই জালে সম্ভবত আমার হাজব্যান্ডও পড়েছে?”
আরিফ হেসে ফেলল। “তা তো পড়েছেই।”
“তা হলে ওকে অ্যারেস্ট করছ না কেন?”
“দরকার হচ্ছে না। কারণ বীতশোক আমাদের প্রসিকিউশন-উইটনেস।”
সুমিত বলল, “তা হলে আসল খুনি ধরা পড়েছে? নাকি সোমনাথকে ফাসাচ্ছ তোমরা?”
“নাহ্। সোমনাথও প্রসিকিউশন-উইটনেস। তবে প্রব্লেম হল, এখনও খুনি ধরা পড়েনি।”
নায়ার বিরক্ত হয়ে বলল, “বাংলায় কী যেন বলে? গাছে কাঁটাল গোঁফে তেল! হত্যাকারী ধরা পড়ল না, উইটনেস প্রস্তুত! তা ছাড়া দুটি হত্যাকাণ্ড। প্রথমটি বাইরে, দ্বিতীয়টি ঘরে।”।
কর্নেল বললেন, “না মিঃ নায়ার! বসন্ত হাজরাকে ইভনিং ভিলার হলঘরেই মারা হয়েছিল। তার বডি দেখতে পাওয়ার পর গেটের বাইরে থেকে হলঘর অব্দি রক্ত ছড়ানো হয়। এর একটাই কারণ। মিঃ বোস খুনিকে বিশেষ একটা উদ্দেশ্যে এই খুনের দায় থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য, সেই খুনির হাতেই তাকে মরতে হল।”
বীতশোক চমকে উঠে বলল, “কে সে?”
এই সময় ম্যাথু এসে সেলাম ঠুকে আরিফের উদ্দেশে বলল, “স্যার! ইওর টেলিফোন।”…
আরিফ বাংলোর কেয়ারটেকার ম্যাথুর অফিসে টেলিফোন ধরতে গেল।
বীতশোক কর্নেলকে আবার প্রশ্ন করল, “কে সে?”
কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, “আপনাদের বন্ধু আরিফ খানকে তো বলতে শুনলেন, খুনি এখনও ধরা পড়েনি।”
“তার মানে সে গা-ঢাকা দিয়েছে?”
“তা-ও জানি না। শুধু এটুকু জানতে পেরেছি, বসন্ত হাজরা এবং মিঃ জে এন বোসের খুনি একই লোক।”
সুমিত একটু নার্ভাস হেসে বলল, “লাইফে স্যার আমি এই প্রথম একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ দেখতে পেলুম। তাই আমার জানতে আগ্রহ হচ্ছে, খুনি যে একই লোক, তা আপনি স্যার কী মেথডে জানলেন?”
কর্নেল গম্ভীর হয়ে বললেন, “আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ নই মিঃ চৌধুরি। কেউ আমাকে ডিটেকটিভ বললে অপমানিত বোধ করি। কাল রাত্তিরে আপনাদের সঙ্গে আলাপের সময়ই কথাটা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলুম–মিঃ ব্যানার্জির এটা মনে পড়া উচিত।”
বীতশোক বলল, “ওয়েল! কিন্তু আপনি এখানে আসার পর যে কাজগুলো করছেন, তা প্রাইভেট ডিটেকটিভরাই করে থাকে। তাছাড়া গতকাল মিঃ বোস। আমাকে কথায় কথায় বলছিলেন, তার পেছনে নাকি প্রাইভেট ডিটেকটিভ লাগিয়েছে কেউ।”
কর্নেল দ্রুত তার দিকে ঘুরলেন। “মিঃ বোস বলছিলেন?”
“হ্যাঁ। তবে আমি ভেবেছিলুম, আমাদের কোম্পানির এই বিগ ডিলটা কেউ বানচাল করার জন্য এনিওয়ে, ইউ নো, বহু কোম্পানি নানা ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির সাহায্য নিয়ে থাকেন।”
কর্নেল আবার বললেন, “মিঃ বোস আপনাকে বলেছিলেন কেউ তার পেছনে প্রাইভেট ডিটেকটিভ লাগিয়েছে?”
“ঠিক তা-ই করব। একটু প্রেম-প্রেম ফ্লার্টিং, একটুখানি ঈশিতা চোখে ঝিলিক তুলল। “তোমরা কিন্তু লক্ষ রাখবে। ওই চান্স তোমরা ছাড়বে না। কেমন তো?”
নায়ার বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু একটা ব্যাপার তোমরা লক্ষ করোনি। বীতশোক লোকটাকে চেনে। কাল রাত্তিরে বীতশোকই বলল, আপনি সেই বিখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ! আরিফ কিন্তু ওর পরিচয় দেয়নি। আরিফ আমাদের বন্ধু হলেও একজন পুলিশ অফিসার। বীতশোক না বললে আমরা তো জানতেম না লোকটা কে। এটাই অত্যন্ত চিন্তার বিষয়। কৃষ্ণার গতিবিধির ওপর দৃষ্টি রাখতে গভর্মেন্ট ওকে পাঠিয়েছে।”
ঈশিতা নায়ারের পেছনের চুল খামচে ধরে বলল, “খালি কৃষ্ণা বেচারাকে ভয় দেখাচ্ছে! আর একটা কথা নয়।”
রাস্তাটা এবড়োখেবড়ো। জঙ্গল পেরিয়ে বিশাল খোলামেলা মাঠ। রুক্ষ পাথুরে মাটি। এখানে-ওখানে কিছু ঝোঁপঝাড় এবং গাছের জটলা। মাঝখান দিয়ে যে রাস্তাটা গেছে, সেটা এবার মোটামুটি মসৃণ। গাড়ির গতি বাড়ল। .
ড্রাইভার গাইডের ভঙ্গিতে ঘোষণা করল, “উও দেখিয়ে। হাওয়াই আড্ডিকি জঙ্গল।”
দূরে টুকরো-টুকরো ধংসস্তূপ। কোথাও ভাঙাচোরা টাওয়ার বা পাঁচিলের খানিকটা অংশ মাথা তুলে আছে জঙ্গলের ভেতর। সুমিত বলল, “সোমনাথের থিওরি, ওখানে নাকি গুপ্তধন খুঁজতে রীতিমতো একটা এক্সপিডিশনে নামব। নাহ্। সঙ্গে মহিলা থাকবে না। কারণ শাস্ত্রে বলেছে ‘পথি নারী বিবর্জিতা’!”
ঈশিতা বলল, “তোমাদের এক্সপিডিশনের আগেই অশোকদের কোম্পানি হাওয়াই আড্ডির জিওগ্রাফি বদলে দেবে। স্টিল ফ্যাক্টরির এক্সটেনশন প্রজেক্ট এরিয়া ওটা।”
গাড়ি আবার ডাইনে মোড় নিয়ে চড়াইয়ে উঠল। একটু পরে মোটামুটি সমতল একটা জায়গায় গিয়ে থামল। ঘন গাছপালায় ঢাকা মাটি। বড়-বড় পাথর। পড়ে আছে। গাড়ি থেকে সবাই নামল। কয়েকপা এগিয়ে যেতেই জলপ্রপাতের গর্জন শোনা গেল। আরও কয়েকটা পাথরের ফাঁক দিয়ে হেঁটে গিয়ে চোখে পড়ল হাথিয়া ফলস। ছোট্ট প্রপাত। ধাপবন্দি পাথর বেয়ে জল আছড়ে পড়ার। দরুন জলের গর্জনটা বেশি। কিন্তু আসলে এটা কয়েকটা টুকরো-টুকরো প্রপাতের সমন্বয়। নীচের জলটা গভীর এবং দেখতে একটা ছোটখাটো দের মতো।
সুমিত বলল, “ছ্যা ছ্যা! এটা কি একটা ফসল নাকি? লোক নেই, জন নেই।”
নায়ার বলল, “পর্যটক বর্জিত স্থান।”
ঈশিতা হাসল। “এটা নাকি ভুতুড়ে ফলস। ভূতের ভয়ে কেউ আসে না।”
সুমিত ও নায়ার পাথরের ধাপ বেয়ে নেমে একটা চাতালে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর সুমিত ঈশিতাকে হাত নেড়ে ডাকল। ঈশিতা বুড়ো আঙুল দেখাল। ক্রিস্নান জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেল। একটু পরে তাকে প্রপাতের মাথায় কাছে দেখা গেল। সে ক্যামেরা বের করে ছবি তুলছিল।
ঈশিতা বলল, “আমি বাবা নামছি না এই ধুমসি শরীর নিয়ে। নীপু, নামবে নাকি?”
নীপা বলল, “নাহ্।”
“তা হলে এখানেই বসি এসো।” ঈশিতা একটা পাথরে বসল।
নীপা তার পাশে গিয়ে বসে আস্তে বলল, “একটা কথা ঈশিতাদি!”
ঈশিতা ভুরু কুঁচকে তাকাল।
নীপা শ্বাসপ্রশ্বাসে মিশিয়ে বলল, “ক্রিস্নানকে আমার বিশ্বাস করা হয়তো। ভুল হয়েছে।”
“সে কী! কেন এ কথা বলছ?”
“কাল রাত্তিরে আমার ভাল ঘুম হয়নি। চোখ বুজে পড়ে ছিলুম।” নীপা চাপা স্বরে বলল। “একটা শব্দ শুনে চোখ খুলে দেখলুম ক্রিস্নান বাথরুমে ঢুকছে। আবার চোখ বুজে পড়ে রইলুম। ক্রিস্নান বাথরুমে ঢুকেছে তো ঢুকেছে। বেরুচ্ছে না। তারপর হয়তো ঠিক ঘুম নয়, একটু তন্দ্ৰামতো এসেছিল। আবার একটা শব্দ হল। তন্দ্রাটা কেটে গেল। চোখ খুলে দেখি, ক্রিস্নান এসে ওর। বেডে শুল। তখন কিছু মনে হয়নি। কিন্তু সকালে হঠাৎ মনে হল–ঈশিতাদি! তুমি নিশ্চয় লক্ষ করেছ, বাথরুমের কাছে আমার বেড। ক্রিস্নানের বেড রুমের দরজার সামনাসামনি। বাথরুম থেকে বেরিয়ে সে নিজের বেড়ে গেলে তার একটা পাশ আমি দেখতে পাব। কিন্তু ক্রিস্নান তার বেড়ে যখন যাচ্ছিল, তার বডির ফ্রন্টটা আমার চোখে পড়ল। তার মানে, সে বাইরে থেকে ঢুকছিল। নিশ্চয় সে বাইরে গিয়েছিল।”
ঈশিতা আস্তে বলল, “তুমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলে?”
“নাহ্।” নীপা বিব্রত মুখে বলল। “অমন একটা সিচুয়েশনে ও কথা জিজ্ঞেস করলে কী ভাবতে বলো? তা ছাড়া বাথরুমের দরজা বন্ধ করার শব্দ অন্যরকম। দ্বিতীয়বার শব্দটা শুনেছিলুম ইন্টারলকিং সিস্টেমের দরজায় যেমন শব্দ হয় ঠিক সেইরকম। তা না হলে ঘুমটা ছিঁড়ে যেত না। বাংলোর সব রুমের দরজায় ইন্টারলকিং সিস্টেম আছে।”
“হু। কিন্তু কৃষ্ণা বাইরে কোথায় গিয়েছিল বলে তোমার ধারণা?”
“ওই জুয়েলের ব্যাপারটা–” বলে নীপা থেমে গেল।
ঈশিতা ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে বলল, “হ্যাঁ। কৃষ্ণা ফিল্মরোলটা হয়তো ইচ্ছে করেই নষ্ট করেছে। বুঝলে নীপু? অশোকের কাছে শুনেছি ইভনিং ভিলায় একসময় প্রচুর জুয়েলস ছিল। রাজা-রাজড়ার ফ্যামিলি। কাজেই তা থাকতেই পারে। কিন্তু অনেক দামি জুয়েলস নাকি আউট অফ ট্রেস। অশোকের মতে, মিঃ বোসও লুকিয়ে বেচতে পারেন। কারণ ওসব প্রপার্টি নাকি মিসেস বোসের পৈতৃক। এনিওয়ে, কৃষ্ণার দিকে তুমি লক্ষ রেখো। ওর জন্য আমরা কিন্তু ফেঁসে যাব।” বলে ঈশিতা জোরে শ্বাস ছাড়ল। “যেতুম–যদি ভাগ্যিস আরিফ এখানে না থাকত। একে তো একটা মার্ডারকেস। তার ওপর ওই জুয়েলভর্তি হ্যাভারস্যাক। নায়ার ইজ ড্যাম রাইট। গভর্মেন্ট সি বি আই থেকেই ওই বুড়োকে এখানে পাঠিয়েছেন। গভর্মেন্টের সোর্সে নিশ্চয় তেমন কোনও ইনফরমেশন আছে যে, কৃষ্ণা আর তার বয়ফ্রেন্ড, আসলে স্মাগলার। মিঃ বোস সম্পর্কে তো অশোক কথায় কথায় বাস্টার্ড বলে। ওর কোম্পানির ইন্সট্রাকশন, বি ভেরি কেয়ারফুল অ্যাবাউট দ্যাট ম্যান। শুনলে না এরিয়ার মাফিয়া লিডার কেতন সিং ওর বন্ধু! নাও থিং নীপু!”
ঈশিতা ঘড়ি দেখল। নীপা বলল, “সোমনাথের জন্য সত্যি আমার ভাবনা হচ্ছে। ইভনিং ভিলায় কুকুর আছে না নেই, তা নিয়ে ওর মাথাব্যথা কেন? আমি সত্যি কিছু বুঝতে পারছি না ঈশিতাদি!”
ঈশিতা হাসল। “ওটা ওর চালাকি। আসলে মিসেস বোসের সঙ্গে প্রেম করতে গেছে।”
নীপা আড়ষ্টভাবে হাসল। পাত্তা পাবে না। ওসব ব্যারনেসটাইপ মহিলারা। বড় ডাল। তবে সোমনাথ ইজ আ গুড টেবল্টকার।”
“মিসেস বোস কনভেন্টে পড়া মহিলা কিন্তু।”
“হুঁউ। তা তো ইংরিজি বলার স্টাইল দেখেই বুঝতে পারছিলুম। স্যুডো আঁতেল টাইপ।”
ঈশিতা চোখ বড় করে বলল, “ওমা! তুমি এত্তো সব লক্ষ করেছ?”
নীপা একটু ঝুঁকে পাথরের ফাঁকে গজিয়ে ওঠা একটা গুল্মের পাতা ছিঁড়ে নিল। কিছু বলল না।
“কিন্তু তুমি ব্ল্যাক প্যান্থারের পায়ের তলার হ্যাভারস্যাকটা লক্ষ করোনি?”
“তুমিও করোনি!”
ঈশিতা এলোমেলো চুল গোছাতে গোছাতে বলল, “একটা ব্যাপার কেউ লক্ষ করেনি আসলে। হল ঘরে যথেষ্ট আলো ছিল না। সেকেলে ঝাড়বাতিতে বাল্ব ফিটকরা। অবশ্য চোখের পক্ষে সুদিং।”
সুমিত ও নায়ার কখন আরও নীচে নেমে গিয়েছিল। সেখানে থেকে সুমিত মুখে হাত রেখে টার্জানের ডাক ছাড়ল। ঈশিতা উঠে দাঁড়িয়ে দু হাতের বুড়ো আঙুল দেখাল। নীপা বলল, “আমি ক্রিস্নানের কাছে যাই।”
ঈশিতা প্রপাতের মাথার দিকটা দেখে নিয়ে বলল, “কৈ সে? চলো তো দেখি।”
দুজনে জঙ্গলের ভেতর পায়েচলা পথ দিয়ে এগিয়ে প্রপাতের মাথার কাছে গেল। ঈশিতা ডাকল, “কৃষ্ণা!”
ক্রিস্নানের সাড়া পাওয়া গেল না। ঈশিতা ও নীপা এগিতে-ওদিকে তাকিয়ে তাকে খুঁজছিল। ঈশিতা আরও কয়েকবার ডেকে বিরক্ত হয়ে বলল, “অদ্ভুত মেয়ে তো!”
সুমিত নীচে থেকে পাথরের ধাপে পা রেখে ওপরে উঠছে দেখা গেল। তার পেছনে নায়ার। ঈশিতা হাসতে হাসতে ঝুঁকে পড়ল। “নীপু! মাউন্টেনিয়ারিং দেখ। সাধে কি সুমিতটাকে চতুষ্পদ প্রাণী বলি? দেখ, চার পায়ে হাঁটছে।”
প্রপাতের ডান কাঁধের ওপর ঘাস আর ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা একটা টিলা। টিলায় একজন আদিবাসী রাখাল দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকটা গরু চরছে। রাখাল বাবুবিবিদের রঙ্গ দৃশ্যটি উপভোগ করার ভঙ্গিতে নীচের দিকে তাকিয়ে আছে। নীপা টিলায় ওঠার চেষ্টা করছিল। ঈশিতা দেখতে পেয়ে বলল, “তুমিও মাউন্টেনিয়ারিং করছ নাকি নীপু? হাড়গোড় ভেঙে যাবে। চলে এস।”
নীপা হাত নেড়ে রাখাল ছেলেটিকে ডাকল। সে আস্তেসুস্থে নেমে এল। নীপা বলল, “তুমি কোনও মেমসায়েবকে দেখেছ?”
ঈশিতা এগিয়ে গেল। হাসতে হাসতে বলল, “ও বাংলা নেহি বুঝতা নীপু! রাষ্ট্রভাষামে পুছো। অবশ্য রাষ্ট্রভাষাও ও বোঝে কি না আই ভেরি মাচ ডাউট। লুকস আ ট্রাইবাল বয়। তবু চেষ্টা করা যাক। তুম্ কৈ মেমসাব দেখা ইধার? মেমসাব! লাল চুল। সাদা ঔরত বুঝতে পারতা।”
রাখালটি টিলার ওদিকে হাতের লাঠিটা তুলে স্থাননির্দেশের পর অদ্ভুত ভঙ্গি করল। মুখে সরল হাসি। ভঙ্গিটা ক্যামেরায় ছবি তোলারই।
নীপা বলল, “কোনও মানে হয়?”
ঈশিতা বলল, “ছবি তুলতে গেছে। ওদিকে বোধ হয় এদের বটিস্তি আছে। চলে এস।”
সুমিত ও নায়ার প্রপাতের মাথায় পৌঁছে গেছে এবং হাঁপ সামলাচ্ছে। ঈশিতা তাদের কাছে গিয়ে বসে পড়ল। সুমিত বলল, “উই হ্যাভ ডান ইট! পুরস্কৃত করো ঈশু!”
“কী পুরস্কার চাও, বলো!”
সুমিত ডান হাত বাড়িয়ে বলল, “করচুম্বন!”
ঈশিতা তার হাতের আঙুল কামড়ে ছেড়ে দিল। সুমিত প্রায় আর্তনাদ করে উঠেছিল। নায়ার ফিক করে হেসে বলল, “তোর আঙুলে রক্ত পড়ছে সুমিত?”
সুমিত হাতটা বাড়িয়ে স্রোতের জলে চুবিয়ে বলল, “ছ্যাঃ! লিপস্টিকের রঙ! মাইরি! কেন এসব রঙটঙ মেখে মেয়েরা ঠোঁটের ন্যাচারাল টেস্ট অ্যান্ড বিউটি নষ্ট করে, বুঝি না।”
“আবার কামড়ে দেব। কৈ, একটা সিগারেট দাও। টানি।”
নায়ার বলল, “আরে! অধ্যাপিকা ওখানে দাঁড়িয়ে নৃতত্ত্বচর্চা করছে নাকি?”
“নাহ। কৃষ্ণাকে খুঁজছে।”
সুমিত রুমালে হাত মুছে সিগারেট দিল ঈশিতাকে, নিজেও একটা ধরাল। তারপর বলল “কৃষ্ণা কোথায়?”
“সম্ভবত ট্রাইবাল বস্তিতে ছবি তুলতে গেছে।” বলে ঈশিতা ঘুরে ডাকল, “নীপু! চলে এস। একটু ফুর্তি করা যাক।”
নীপা এসে একটু তফাতে বসল। নায়ার বলল, “পাতালেশ্বরীর মন্দির এখান থেকে কতদূর?”
ঈশিতা বলল, “আট-নয় কিলোমিটার হবে।”
“এখানে বৈচিত্র্যের অভাব।” নায়ার বলল। “কাজেই আমাদের এখনই স্থানত্যাগ করা উচিত।”
“কৃষ্ণাকে খুঁজে আনো তা হলে।”
“আমরা পর্বতারোহণে ক্লান্ত।”
“তা হলে চুপচাপ বসে অপেক্ষা করো। চা-ফা খেয়ে সময় কাটাও।” বলে সে চায়ের ফ্লাক্স বের করল ব্যাগ থেকে।
কিন্তু বিরক্তিকর দু-দুটো ঘণ্টা কেটে গেল। তখনও ক্রিস্নান ফিরল না।…
.
০৯.
লাঞ্চের পর কর্নেল কেয়ারটেকার ম্যাথুর অফিসে টেলিফোন গাইডের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। ম্যাথু ক্ষোভের সঙ্গে কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটি শোনাচ্ছিল। সে এর মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছে না। কে কখন গেটে ক্রস এঁকেছে, তাই নিয়ে কলকাতার বাবু-বিবিরা কেন তাদের ধমক দেবেন? ম্যাথুর মতে, “আ লট অব স্ট্রেঞ্জ পিপল অ্যান্ড আ লট অব মিস্ট্রি।” কর্নেল নাম্বারটা খুঁজে পেয়ে একটু হেসে তাকে বললেন, “ফরগেট ইট। দে আর ফানি পিল্ল।”
এক্সচেঞ্জের অপারেটর সাড়া দিলে কর্নেল নাম্বারটা বললেন। একটু পরে রিং হতে থাকল। ফোনের কাছাকাছি কি কেউ নেই? প্রায় তিন মিনিট পরে রিং বন্ধ হয়ে সাড়া এল, “হেলো!”
কোনও মেয়ের গলা। কর্নেল বললেন, “ইভনিং ভিলা?”
“জি। আপ কিসকো মাংতা?”
‘বোসসাবকো।”
“ছোটসাব বাহার গেয়া। দো-টাই ঘণ্টেকি বাদ লোটেঙ্গে।”
“মেমসাব হ্যায়?”
“আপ কৌন হ্যায়? কাহাসে বাত করতা?”
“পুলিশ অফসর। মেমসাবকি সাথ জরুরি বাত হ্যায়। জলদি বোলাও।”
“হায় রাম! ছোটাসাবকা কৈ খতরনাক তো নেহি?”
কর্নেল একটু অবাক হলেন। সেই কাজের মেয়েটি বলেই মনে হচ্ছে, যে চায়ের ট্রে নিয়ে হলঘরে ঢুকেছিল এবং তার দিকে কেমন চোখে তাকাচ্ছিল। সে বোস সায়েবের বিপদের কথা কেন ভেবে বসল? কর্নেল বললেন, “কৈ খতরনাক হোনে কা বাত থা?”
“জি নেহি, জি নেহি। ঠারিয়ে। মেমসাবকো বোলাতি।”
একটু পরে মার্জিত উচ্চারণে, কিন্তু কাঁপা-কাঁপা গলায় সাড়া এল। “মিসেস বোস স্পিকিং। এনিথিং রং, অফিসার?”
কর্নেল বাংলায় বললেন, “নমস্কার মিসেস বোস। আমি কর্নেল নীলাদ্রি ‘; সরকার বলছি।”
“কর্নেল…কিন্তু মালতী বলল-”
“আমার নামটা কি পরিচিত মনে হচ্ছে না মিসেস বোস? আবার বলছি। আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।”
“আই সি। আপনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তাই না?”
“সম্ভবত মিঃ বোস আমার কথা আপনাকে বলেছেন?”
“হ্যাঃ। আপনি মর্নিংয়ে ইনভেস্টিগেশনে এসেছিলেন। বলুন!”
“আমি আপনার সহযোগিতা চাই রত্না দেবী!”
“বলুন, কীভাবে সহযোগিতা করতে পারি?”
“মাত্র তিনটি প্রশ্নের উত্তর চাই। আশা করি, সঠিক উত্তর পাব। হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো!”
একটু পরে সাড়া এল, “বলুন। বাট প্লিজ মেক ইট শর্ট।”
“ইভনিং ভিলার হলঘরে ফার্নিচারগুলো কি নতুন করে সম্প্রতি সাজানো হয়েছে?”
“নাহ? নেক্সট?”
“আপনি বসন্ত হাজরা নামে কোনও লোককে চেনেন?
“সে তোহা। চিনি। চিনতুম। নেক্সট?”
“আপনার গাড়ি কি চালু আছে?”
“বুঝলুম না।”
“আপনার কনটেসা গাড়ি কি বিগড়ে গেছে?”
“কেন এ প্রশ্ন?”
“আনসার দা কোয়েশ্চেন প্লিজ?”
“ইজ ইট ইমপটান্ট কর্নেল সরকার?”
“ভেরি ইমপর্টান্ট রত্না দেবী?”
“মাই কার ইজ অলরাইট।”
“চেক করে দেখেছেন কি?”
“মাই কার ইজ অলরাইট।”
“লনের রাস্তায় কিন্তু প্রচণ্ড নুড়িপাথর!”
“কাজ এখনও শেষ হয়নি। রাস্তাটা রিপেয়ার করা হচ্ছে।”
“তার মানে আপনার গাড়ি ঠিক থাকলেও ইভনিং ভিলা থেকে বাইরে আনা যাবে না!”
“সো হোয়াট?”
“থ্যাংকস রত্না দেবী! আজ সন্ধ্যায় ককটেল-ডিনারে দেখা হবে।”
কর্নেল তখনই ফোন নামিয়ে রাখলেন না। কারণ ও-পক্ষে ফোন নামিয়ে রাখার শব্দ শোনা গেল না।
একটু পরে দ্রুত সাড়া এল, “হ্যালো! আর য়ু দেয়ার?”
“হ্যাঁ। বলুন।”
“আপনি কোথা থেকে ফোন করছেন? পোলিস স্টেশন?”
“নাহ। ডাকবাংলো থেকে।”
“স্টিফেনস বাংলো, আই থিংক?”
“হ্যাঁ।”
“আই ওয়ান্ট টু টক টু য়ু, কর্নেল সরকার!”
“আপনি চাইলে এখনই যেতে পারি।”
“না। এখানে নয়। আপনার গাড়ি আছে?
“সরি রত্না দেবী। বাট আই ক্যান ম্যানেজ আ পোলিস কার। আপত্তি না। থাকলে আপনাকে ইভনিং ভিলার গেট থেকে পিকআপ করবে।”
“এখন একটা চল্লিশ প্রায়। মাই হাজব্যান্ড উইল কাম ব্যাক বাই ফোর ও’ক্লক, আমাকে তার আগেই ফিরতে হবে। ডু য়ু আন্ডারস্ট্যান্ড কর্নেল সরকার?”
“কোনও অসুবিধে হবে না। গাড়ির ব্যবস্থা করে আবার আপনাকে রিং করছি।”
“না, না। তার দরকার হবে না। আমি লক্ষ রাখব। পোলিস কার তো?”
“হ্যাঁ। আপনি নিশ্চয় আরিফ খানকে চেনেন? অ্যাডিশনাল এস পি। সে আপনাকে পিক আপ করবে।”
“দেন ইট ইজ অল রাইট। রাখছি। থ্যাংকস!…”
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে আরিফকে রিং করলেন তার কোয়ার্টারে। একটু পরে আরিফের সাড়া পেলেন। “হাই ওল্ড বস! আবার ডেডবডি পড়েছে নাকি?”
“তোমার বন্ধু সোমনাথবাবুর থিওরি অনুসারে আবার একটা বডি পড়বে।”
“সোমনাথ এসেছিল। এইমাত্র গেল। আমাকেও বোঝাচ্ছিল, আবার একটা ডেডবডি পড়বে।”
“তাই বুঝি? ওঁর কথা থেকে কী মনে হল তোমার?”
“আসলে হি ইজ টেরিবলি শক্ড়। ওর মাথায় আজকাল সেমিওটিকস না কী ঢুকেছে। সে-ও এক বিপদ। ইভনিং ভিলায় ঢুকতে গিয়ে পারেনি। গেট খোলেনি কেউ। ওবাড়িতে কুকুর আছে কি না জানতে গিয়েছিল।”
‘আরিফ! তুমি তোমার পুলিশ-জিপটি নিয়ে এখনই ইভনিং ভিলার গেটে চলে যাও। মিসেস বোস উইল বি ওয়েটিং দেয়ার। ওঁকে পিক আপ করে সোজা আমার কাছে চলে এস। ডার্লিং! এটা অত্যন্ত জরুরি। আর শোনো! তুমি একা ড্রাইভ করে আসবে।”
“আই সি! বাট”
“ডার্লিং! মেক হে প্লিজ!”
“ওকে বস।…”
কর্নেল লবিতে ঢুকলেন। তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠে নিজের ঘরে গেলেন। দরজার কপাটের তলায় কয়েক কুচি রঙিন মার্বেল পেপার এখনও পড়ে আছে। সোমনাথ বলছিল, রাস্তার ধারে জঙ্গলে ওরা রঙিন কাগজ কুচি কুড়িয়ে পেয়েছে। কাজেই ওদেরই কারও দুষ্টুমি। দরজা খুলে কুচিগুলি এবার কুড়িয়ে নিলেন কর্নেল।
টেবিলে রাখা হ্যাভারস্যাকটার ভেতরের কুচির সঙ্গে মেলাতে গিয়ে একটু অবাক হলেন। এই কুচিগুলো পুরনো। তা ছাড়া কাঁচি দিয়ে কাটা নয়। ছেঁড়া। আতস কাঁচ দিয়ে পরীক্ষা করে মনে হল, বৃষ্টিখাওয়া কোনও ছেঁড়া ঘুড়ির অংশ হতেও পারে। অথবা ম্যাথু ক্রিসমাসে বাংলোটাকে রঙিন কাগজে সাজিয়েছিল। তারই কয়েকটা টুকরো বাতাসে ছিঁড়েখুঁড়ে গিয়ে জঙ্গলে পড়েছিল।
কথাটা ভাবতে ভাবতে একটু চমকে উঠলেন কর্নেল। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, চেজিং আ রেড হেরিং! লাল হেরিং মাছের পেছনে দৌড়ুনো! আসলে হেরিং মাছ কখনও লাল হয় না।
কেউ বা কারা কি তাকে লাল হেরিং মাছের পেছনে ছোটাচ্ছে? হয়তো সত্য জিনিসটাই এমন, যা অনেক ফালতু জিনিসের মধ্যে হেলাফেলায় পড়ে থাকে।
কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে পা ছড়িয়ে হেলান দিলেন। রত্না বোস কেন হঠাৎ তাকে কিছু বলতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন? তার তিনটি প্রশ্ন কি কোনও গভীর গোপন স্পর্শকাতর জায়গা ছুঁয়ে ফেলেছে?
প্রতীক্ষা ব্যাপারটা জীবনে একটা নির্মমতার প্রতীক যেন। মুহূর্তগুলি ধীরে এগোতে থাকে। আরও একটা চুরুট প্রায় শেষ হয়ে এল। কতক্ষণ পরে বাইরে গাড়ির শব্দ, হর্ন। কর্নেল পুবের জানালার কাছে পা ছড়িয়ে বসে ছিলেন। সোজা হয়ে বসে মুখ তুলে জানালায় দেখলেন, চৌকিদার গেট খুলে সেলাম করে দাঁড়াল। আরিফের জিপ এসে বারান্দার কাছে থামল। কর্নেল উঠে গিয়ে দরজা খুলে অভ্যর্থনার ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। তারপর ওপরের করিডরে প্রথমে আরিফকে দেখা গেল। কর্নেলের দিকে একবার দ্রুত তাকিয়ে সে ঘুরল। যাকে সঙ্গে এনেছে, সে উঠতে দেরি করছে। সংকীর্ণ কাঠের সিঁড়িতে রঙিন নারকেলছোবড়ার কার্পেট পাতা আছে। দুধারে কাঠের মসৃণ রেলিং। প্রথমে রেলিংয়ের শেষপ্রান্তে একটি উজ্জ্বল হাত, তারপর তেমনই উজ্জ্বল একটি মুখ ভেসে উঠল। টানা বড়-বড় দুটি প্রতিমা-চোখের দৃষ্টিতে ঈষৎ আর্তি।
কর্নেল মৃদুস্বরে বললেন, “আসুন!”
রত্না বোস করিডোরে উঠে নমস্কার করলেন কর্নেলকে।
আরিফ পুলিশের পোশাকে আসেনি। একটু হেসে বলল, “আমি লবিতে ওয়েট করছি।”
রত্না তার দিকে ঘুরে বললেন, “থ্যাংকস।” তারপর দ্রুত ঘরে এসে ঢুকলেন।
কর্নেল দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললেন, “বসুন।”
রত্না বসলেন। তার হাতে একটা ছোট্ট পার্স। কর্নেল একটু অবাক হয়েছিলেন। রত্নার চেহারায় সৌন্দর্য এবং ব্যক্তিত্বেরও দীপ্তি আছে। কিন্তু তার বয়স এত কম, আঁচ করতে পারেননি। পরনে সাদাসিধে একটা আসমানি নীল শাড়ি। গয়নাগাটি নেই। নীলাভ ছোট্ট রিস্টওয়াচ কাঁকনের মতো শোভা পাচ্ছে। দেহের গড়ন হাল্কা, ছিপছিপে। মুখের আদল দেখে খাঁটি বাঙালি বলে মনে হয় না। কাশ্মীরি কিংবা রাজস্থানী যুবতীদের উদ্ধত তীক্ষ্ণ লাবণ্যের সঙ্গে বাঙালি যুবতীদের কোমলতা মেশালে যেমনটি দাঁড়ায়। কাধ অব্দি ছাঁটা এলোমেলো চুল। নিটোল দুটি বাহু কঁধ থেকে নগ্ন ও সাবলীল। আঙুলে আঙুল জড়ানো।
কর্নেল বললেন, “বলুন!”
রত্না আস্তে বললেন, “বসন্তবাবুর মৃত্যুর সঙ্গে আমার হাজবান্ডের কোনও সম্পর্ক নেই।”
কর্নেল হাসলেন। “পুলিশ তো মিঃ বোসকে জড়ায়নি সে ব্যাপারে। তাছাড়া মিঃ বোস একজন ভি আই পি, তার দিকে হাত বাড়ায় এমন ক্ষমতা কার আছে?”
রত্না শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, “তা হলে এই ঘটনার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী? আপনি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আপনি ইনভেস্টিগেশনে নামলেন কেন? কে আপনাকে হায়ার করল?”
“আপনি কি এটাই জানার জন্য কথা বলতে চেয়েছেন?”
রত্না আস্তে বললেন, “হ্যাঁ। আমি জানতে চাই। আমার এটা জানা দরকার।”
“সরি! আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ নই, রত্না দেবী! আমি একজন নেচারিস্ট। অবশ্য কোথাও মিসটিরিয়াস কিছু ঘটলে আমার একটু নাক গলানো স্বভাব আছে, এই যা।”
রত্না কর্নেলের চোখে চোখ রেখে বললেন, “বসন্তবাবুর মৃত্যু কোনও মিসটিরিয়াস ঘটনা নয়। লোকটা ভাল ছিল না।”
“বসন্তবাবুকে আপনি চিনতেন বলেছেন। কোন সূত্রে?”
“মাঝে মাঝে ইভনিং ভিলায় সাহায্য চাইতে যেত। লোকটা আমার ছোটবেলায় নাকি আমাদের কর্মচারী ছিল। শুধু এটুকু জানি।”
“আপনার কি মনে হয় সে মিঃ বোসকে ব্ল্যাকমেল করত?”
রত্নার চোখ জ্বলে উঠল। “ইম্পসিবল। সে ভিক্ষে চাইতে যেত দাদার কাছে।”
“আপনার দাদাকে ব্ল্যাকমেল করত কি সে?”
রত্না উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “ইউ আর টকিং ননসেন্স।”
কর্নেল হাসলেন। “প্লিজ উত্তেজিত হবেন না। বসুন।”
রত্না বসলেন না। বললেন, “আমার হাজবন্ডকে অকারণ জড়ানোর জন্য আপনাকে কে হায়ার করেছে, আমি জানতে চাই। অ্যান্ড লেটস্ কাম টু টার্মস, কর্নেল সরকার!”
“আগে বলুন, আপনার কী ধারণা? কে হতে পারে সে?”
রত্না বললেন, “আমার কোনও ধারণা নেই বলেই আপনার কাছে জানতে এসেছি।”
কর্নেল বললেন, “জাস্ট আ মিনিট। দেখুন তো ওই হ্যাভারস্যাকটা চেনেন। কি না?”
হ্যাভারস্যাকটা রত্নার পেছনে টেবিলে রাখা ছিল। ঘুরে দেখে নিলেন। তারপর চমকানো স্বরে বললেন, “এটা আপনি কোথায় পেলেন? এতে
“ট্যক্সিডার্মির লোশন ছিল।” কর্নেল বললেন। “পয়জনাস লোশন। স্টাড় জন্তু-জানোয়ারের চামড়া মাঝে মাঝে পরিষ্কারের দরকার হয়। সেই লোশন।” কর্নেল উঠে গিয়ে হ্যাভারস্যাকটা তুলে ধরলেন। “বিষাক্ত লোশন। তাই এই সাইনটা আঁকা ছিল এতে। দুটো আড়াআড়ি হাড়। ওপরে একটা স্কাল। খুলি! খুলিটা ক্রমশ মুছে গেছে হাতের ঘষা খেয়ে। কিন্তু আতস কাঁচের সাহায্যে অস্পষ্ট দাগটা লক্ষ্য করেছি।”
“আপনি এটা নিয়ে এসেছেন কেন?”
“আমি আনিনি। গত রাত্তিরে এই বাংলোতে কেউ পাচার করেছে।”
কর্নেল হ্যাভারস্যাকটার মুখটা খুলে রঙিন কাগজকুচিগুলো দেখালেন। “এর ভেতর জুয়েল ছিল। উদ্ধার করেছি।”
“ও মাই গড!” রত্না চেয়ারে বসে পড়লেন। মুখ সাদা। ঠোঁট কাঁপছিল। কামড়ে ধরলেন। একটু পরে মুখ নামিয়ে শ্বাস ছেড়ে আস্তে বললেন, “দাদা তা হলে ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন।”
“মিঃ সর্বেশ রায় আপনার দাদা। তো–বলুন!”
রত্না বললেন, “দাদা অন্ধ। কথা বলতেও পারেন না। একটা হাত সম্পূর্ণ অবশ।” রত্নার চোখে জল এসেছিল। আলতো হাতে মুছে নিয়ে ফের বললেন, “দাদা আমাকে ইশারায় বলেছিলেন জুয়েল আলমারির দিকে লক্ষ্য রাখতে। দুমাস আগে আমার মায়ের জড়োয়া নেকলেসের হিরেটা উধাও হয়ে গেল!”
“মিঃ বোসকে বলেছিলেন সে-কথা?”
“নাহ্। হি ইজ আ ভেরি সেন্সিটিভ ম্যান। হয়তো রাগ করে চলে যেত। ও চলে গেলে আমরা হেল্পলেস। ও মাথার ওপর ছিল বলেই এখানে টিকে থাকতে পেরেছি। ফ্র্যাংকলি বলছি কর্নেল সরকার। আমার হাজবন্ড অত্যন্ত সাহসী দুর্দান্ত মানুষ। যে কেতন সিং ডাকু আমাকে তুলে নিয়ে যাবে বলে শাসাত, সে এখন ওর পায়ের তলায় কুকুর হয়ে আছে। আই লাভ মাই হাজবন্ড, কর্নেল সরকার!”
“বুঝেছি। তো ওই আলমারির চাবি কার কাছে থাকে?”
“আমার কাছেই থাকত। মায়ের হিরেটা চুরি গেলে চাবি আমার হাজবন্ডকে রাখতে বলেছিলুম। নেয়নি। তাই দাদাকে রাখতে দিয়েছিলুম। তার কাছেই আছে।” রত্না একটু চঞ্চল হয়ে বললেন, “কিন্তু তার পরও কী করে জুয়েল চুরি যেতে পারে?”
“সত্যি চুরি গেছে কি না আগে আপনার সে-বিষয়ে সিওর হওয়া দরকার, রত্না দেবী!”
“হ্যাঁ। এখনই গিয়ে দেখব। কিন্তু কী জুয়েল ছিল এতে?”
“পান্না।”
রত্না ভুরু কুঁচকে বললেন, “আর য়ু সিওর?”
কর্নেল হাসলেন। “যতদূর জানি, পান্নার রং সবুজ হয়।”
“আপনার কাছে আছে, নাকি পোলিস কাস্টডতে?”
কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর থেকে জিনিসটা বের করে দিলেন। রত্না সেটা হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখে একটু বাঁকা হেসে বললেন, “আ ব্যাড জোক কর্নেল সরকার! এটা পান্না নয়। এটা সম্ভবত”।
“ঝাড়বাতির কাঁচ!” কর্নেল হাসলেন। “ইভনিং ভিলার হলঘরের ঝাড়বাতিতে ঝালর হিসেবে এগুলো শোভা পাচ্ছে। আমি দেখেছি। আর আপনি বললেন, ব্যাড জোক। কিন্তু এমনও তো হতে পারে, ধরা যাক, ইভনিং ভিলার জুয়েল চোর এই বাংলোতে কাকেও পান্না বলেই বেচতে চেয়েছিল? ধরা যাক্, কোনও বিদেশি স্মাগলিং গ্যাংয়ের কাউকে?
রত্না ভুরু কুঁচকে তাকাল। “বুঝলুম না।”
“আপনি কাল সন্ধ্যায় একটি ডেনিশ মেয়েকে দেখেছেন। তার নাম ক্রিস্নান। বীতশোকবাবুর বন্ধুরা তাকে কৃষ্ণা বলে ডাকে। এনিওয়ে, এর আগে কখনও তাকে দেখেছেন?”
রত্না জোর দিয়ে বললেন, “নাহ্। দেখিনি।”
“আমার ধারণা এই মার্বেল-পেপারগুলোও ইভনিং ভিলা থেকে পাচার হয়েছে। আপনার কী মনে হয়, বলুন?”
রত্না একটু ভেবে নিয়ে বললেন, “লাস্ট ক্রিসমাসে ইভনিং ভিলায় আমরা পার্টি দিয়েছিলুম। হাথিয়াগড়ে এটা কতকটা য়ুরোপিয়ান–কী বলব, আ সট অব হ্যাংওভার। ট্র্যাডিশনাল হয়ে দাঁড়িয়েছে, যদিও এখানে ক্রিশ্চিয়ান পপুলেশন কম। বিশেষ করে পুরনো এরিয়ার রাস্তাঘাট রঙিন মার্বেল পেপারে সাজানো হয়। অ্যান্ড এভরিহোয়্যার দা সিম্বলিক স্টারস, ইউ নো। উই এনজয়। ইট।”
রত্না শ্বাস ছেড়ে থামলে কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, “জুয়েল-চোর বলে কাকে সন্দেহ হয় আপনার?”
“আমি জানি না। আই কান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড ইট।”
“ইভনিং ভিলায় কি দারোয়ান থাকে না?”
“থাকে। রামবাহাদুর ছুটি নিয়ে দেশে গেছে। গণেশের একটু অসুবিধে হচ্ছে। তাতে। কিন্তু আপনি যদি গণেশ সম্পর্কে প্রশ্ন করেন, আমি বলব সে অত্যন্ত বিশ্বাসী লোক। ছোটবেলা থেকে আছে। তা ছাড়া কয়েকটা কুকুর আছে! ইভন আ বুলডগ, ইউ সি।”
“মালতী?”
রত্না একটু নড়ে বসলেন। “মালতীর পক্ষে জুয়েল চুরি সম্ভব নয়। একেবারে বোকা মেয়ে। একটুতেই কেঁদে ফেলে। শি ওয়জ অ্যান অরফ্যান। দাদা ওকে কোন অনাথ-আশ্রম থেকে এনেছিলেন। গণেশের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন। দুটো বাচ্চা আছে।”
“আপনার হাজবান্ড মিঃ বোস?”
“ইমপসিবল!” রত্না ফুঁসে উঠলেন। “আমার প্রপার্টির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি তাকে দেওয়া হয়েছে। কিছু ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সেই-ই অপারেট করে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট হয়েছে তার কোম্পানির। আমাকে বলেছে সে-কথা। আমি বলেছি, ডোন্ট ওয়ারি। তা ছাড়া দেখুন, এবার তার কনস্ট্রাকশন কোম্পানি গভমেন্ট সেক্টরের একটা এক্সটেনশন-প্রজেক্ট হাতে নিতে চেষ্টা করছে। আমিই তাকে বলেছি, টেক দা চান্স হোয়াটেভার মে বি দা রিস্ক।”
“আপনি নিজে কেন কোম্পানির পার্টনার নন রত্না দেবী, টাকাটা যখন আপনারই?”
রত্না একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, “ফ্র্যাংকলি বলছি কর্নেল সরকার! ইভনিং ভিলার বাইরেকার কোনও কিছুর সঙ্গে আমি নিজেকে জড়ানো পছন্দ করি না। আই হেট দা ওয়র্ল্ড আউটসাইড মাই ওন সার্ক। এনিওয়ে, আমার লাইফহিস্টরি আপনাকে শোনাতে আসিনি। এটুকু বলতে পারি, আই লাভ মাই হাজবাড়। বিকজ আইম সোলোনলি ইন দিস উইকেড ওয়ার্ল্ড, কর্নেল সরকার!”
রত্না মুখ নামিয়ে হাতের পার্স নাড়াচাড়া করছিলেন। কর্নেল আস্তে বললেন, “আপনি কি মনে করছেন আপনার স্বামী বিপন্ন এবং সেজন্যই জানতে এসেছেন কে আমাকে হায়ার করেছে?”
রত্না মুখ তুললেন। একটু দ্বিধার সঙ্গে বললেন, “আই স্মেল আ ডেড র্যাট সামহোয়্যার।”
“প্লিজ এক্সপ্লেন ইট।”
রত্নার মুখে যুগপৎ আর্তি, হতাশা ও বিপন্নতার এলোমেলো ছায়া পড়ল। একটু পরে মাথা দুলিয়ে বললেন, “আই কান্ট এক্সপ্লেন ইট, কর্নেল সরকার!”
কর্নেল হাসলেন। “আমার ধারণা, আপনি মালতীর সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করেছেন!”
“করেছি। তবে মালতী”।
রত্না হঠাৎ থেমে গেলে কর্নেল বললেন, “বলুন!”
রত্না একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, “ওর তত বুদ্ধিসুদ্ধি নেই। ও ব্যাপারটা অন্যভাবে দেখছে। ওর মতে, ডাকু কেতন সিংয়ের সঙ্গে আমার হাজবান্ডের মেলামেশাটা ঠিক হচ্ছে না। কেতন সিংই কোনও ক্ষতি করবে।”
“কিন্তু আপনি মিঃ বোসের বিপদের আশঙ্কা করছেন অন্যদিক থেকে। ইজ ইট?”
রত্না আস্তে বললেন, “হ্যাঁ। সেজন্যই আমার জানা দরকার কে আপনাকে হায়ার করেছে।”
“তাহলে আপনি ভাবছেন আমার ক্লায়েন্টের নাম জানতে পারলেই আপনার কাছে সবটা স্পষ্ট হবে। আই মিন, আপনি ওই ‘ডেড র্যাটে’র ব্যাপারটা এক্সপ্লেন করতে পারবেন?”
“সম্ভবত।” বলে রত্না পার্স খুললেন। পার্সে একশো টাকার নোটের বান্ডিল ভর্তি।
কর্নেল দ্রুত বললেন, “সমস্যা হ’ল রত্না দেবী, আমি এখনও জানি না কে। আমার ক্লায়েন্ট। হ্যাঁ, আমি আপনার সঙ্গে একমত। আমার সত্যিই একজন ক্লায়েন্ট আছে। কিন্তু সে আছে আড়ালে। বিশ্বাস করুন, আমিও তাকে খুঁজছি। কারণ আপনার মতো আমারও বিশ্বাস, বসন্ত হাজরা আমার ক্লায়েন্ট ছিলেন না।”
রত্না তার চোখে নিষ্পলক চোখ রেখে বললেন, “ইউ আর আ ভেরি স্ফুড ম্যান কর্নেল সরকার! প্লেয়িং দা ক্যাট অ্যান্ড মাউস গেম।”।
“তা হলে আপনিই বলুন, কাকে আমার ক্লায়েন্ট বলে আপনি সন্দেহ করছেন?”
রত্না পার্স বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর কর্নেলের দিকে রুষ্ট চোখে তাকিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন…
.
১০.
ঈশিতা ও নীপা গাড়ির কাছে উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছিল। সুমিত ও নায়ার ড্রাইভার মোতি সিংকে সঙ্গে নিয়ে ক্রিস্নানের খোঁজে বেরিয়েছিল। মোতি সিং স্থানীয় লোক। এলাকার নাড়িনক্ষত্র চেনে। হাথিয়াফলসের ডান কাঁধের ওপর টিলা পেরিয়ে গেলে নদীর উজানে একটা আদিবাসী বসতি আছে। সেখানে ছবি তুলতে গিয়ে কোনও বিপদে পড়েনি তো ক্রিস্নান?
প্রায় সাড়ে চারটে বাজে। সূর্য ওপারের উঁচু পাহাড়ের আড়ালে নেমেছে। এখানে ঘন গাছপালার ভেতর ছায়া গাঢ়তর। এলোমেলো বাতাসে অদ্ভুত সব শব্দ।
নীপা এদিকে-ওদিকে তাকাচ্ছিল। ঈশিতা বলল, “নীপু! গাড়িতে উঠে বসো বরং। ওরা আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে যদি না ফেরে, আমি গাড়ি ড্রাইভ করে বাংলোয় ফিরব। দিস ইজ টু মাচ! আমার নার্ভের বারোটা বেজে গেছে।”
বলে সে স্টিয়ারিংয়ের সামনে বসল। নীপা সামনের সিটে তার বাঁদিকে বসে বলল, “সত্যি আমার কেমন একটা আনক্যানি ফিলিং হচ্ছে।”
ঈশিতা একটু হাসবার চেষ্টা করে বলল, “আমারও হচ্ছিল। আসলে নির্জন বনজঙ্গলে এমনটা হয়। তবে তোমার ভয় পাওয়ার কারণ নেই। ভূত-প্রেত হোক, মানুষ হোক, বদমাইসি করতে এলে তার বুকের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেব।”
নীপা আস্তে বলল, “ক্রিস্নানের ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি না!”
“তখন থেকে লক্ষ্য করছি তুমি ওকে কৃষ্ণা বলছ না!”
নীপা গম্ভীরমুখে বলল, “ক্রিস্নান যেন হঠাৎ আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেছে। তুমি ভেবে দেখ ঈশিতাদি, আমি ওর কতটুকু জানি?”
ঈশিতা একটু চুপ করে থাকার পর মুখে দুষ্টুমির ছাপ ফুটিয়ে বলল, “নীপু! কৃষ্ণা আমাদের আঁতেলটির সঙ্গে কোনও ইমোশনাল অ্যাফেয়ারে জড়িয়ে পড়েনি তো? কেন এ কথা মাথায় এল, শোনো। কাল রাত্তিরে কৃষ্ণা চুপিচুপি বেরিয়েছিল বলে তোমার সন্দেহ হয়েছে। তারপর দেখ, সোমনাথ আমাদের সঙ্গ ছেড়ে কোথায় কেটে পড়ল। এদিকে কৃষ্ণাও কাট করল। দেয়ার মে বি আ এঁদেভু, যেখানে ওরা প্রেম-ট্রেম করছে।”
নীপা চুপ করে থাকল।
“কী? আমার থিওরি উইক মনে হচ্ছে? বলো! ও নীপু! কথা বলো!”
আমি বিশ্বাস করি না।”
“এক্সপ্লেন ইট নীপু!”
“প্লিজ ঈশিতাদি! আমার মাথা ধরেছে।”
ঈশিতা একটু হাসল। “যা বাবা! কথা বলে সময় কাটাতে হবে তো?”
কাছাকাছি কোথাও টার্জানের ডাক শোনা গেল। ঈশিতা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। বলল, “রেসকিউ পার্টি ফিরে আসছে। কিন্তু কৃষ্ণাকে তো দেখছি না। এ কী বিপদে পড়া গেল দেখ তো!”
নীপাও নামল। দেখল, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পায়ে-চলা রাস্তায় ওরা ফিরে আসছে। কৃষ্ণা নেই। নায়ার আগে। তার পেছনে সুমিত। তার পেছনে ড্রাইভার মোতি সিং। নায়ার এসে বলল, “রহস্যজনক অন্তর্ধান!”
সুমিত বলল, “বাঘে তুলে নিয়ে যেতেও পারে। মাইরি ওদিকটায় যা জঙ্গল!”
ঈশিতা বলল, “বস্তির লোকেরা কী বলল?”
জবাবটা মোতি সিং দিল। “উওলোগ বোলা কি এক মেমসাব ইয়ে নাদিয়াকি কিনার-বরাবর সিধা যাতি থি।”।
নায়ার খাপ্পা হয়ে বলল “নরক্কাতিল পোট্টে! চলো, আমরা সেই ভূগর্ভস্থ মন্দির পর্যটনে যাই।”
ঈশিতা ঘড়ি দেখল।
মোতি সিং বলল, “আভি বহত দের হো গেয়া সাব! আন্ধেরামৈ বহ মুশকিল হোগা।”
নীপা বলল, “আমাদের এখনই বাংলোয় ফেরা উচিত। ক্রিস্নান যদি বাংলোয় না ফিরে থাকে, আরিফদাকে খবর দিতে হবে।”
ঈশিতা শ্বাস ছেড়ে বলল, “অদ্ভুত মেয়ে তো! ঠিক আছে। বাংলোয় ফেরা যাক। পাতালেশ্বরীর মন্দিরে গেলে ইভনিং ভিলার পার্টিতে যাওয়া সম্ভব হবে না। ফিরতে আটটা বেজে যাবে।”
মোতি সিং সায় দিয়ে বলল, “জি মেমসাব! রাস্তাভি বহত খারাব হ্যায়।”
গাড়ি আগের রাস্তায় চলতে থাকল। সবাই কিছুক্ষণ চুপচাপ আর গম্ভীর। পেছনের সিটে এবার নীপা ও ঈশিতার পাশে সুমিত বসেছে। নায়ার সামনে। চড়াই থেকে গাড়ি সমতলে পৌঁছুনোর পর নায়ার পেছনে ঘুরে বলল, “আমার ধারণা, কৃষ্ণার রহস্যজনক অন্তর্ধানের সঙ্গে পান্না নামক সবুজ রত্নের সম্পর্ক আছে।”
সুমিত বিরক্ত হয়ে বলল, “থাম্ ব্যাটা! খালি দাঁতভাঙা কথাবার্তা!”
নীপা বলল, “নায়ারদা যা বলছে, আমিও তা-ই ভাবছি কিন্তু!”
সুমিত একটু হাসল। “আমার থিওরি অন্যরকম। নীপা যদি রাগ না করে তো, বলতে পারি।”
“রাগ করার কী আছে?” নীপা আস্তে বলল।
“ব্যাপারটা সিরিয়াস।”
সুমিত ফিসফিস করে বলল, “সোমনাথটা মাইনাস হয়ে গেছে। তারপর কৃষ্ণাও মাইনাস হয়ে গেল। মাইনাসে মাইনাসে প্লাস।” বলেই সে অভ্যাসমতো হাসি মেশানো শব্দটি আওড়াল, “মাইরি!”
“মাইরি!” ঈশিতা তার ঊরুতে একটা থাপ্পড় মারল। “ঠিক এই কথাটাই আমি নীপুকে বোঝাতে চাইছিলুম। ও কনভিন্সড় হল না।”
নীপার গাম্ভীর্য অটল রইল। সে বলল, “এটা রসিকতার ব্যাপার নয়। ঈশিতাদিকে আমি বলেছি। এবার তোমাদেরও বলছি। গত রাত্তিরে ক্রিস্নান চুপিচুপি বাইরে বেরিয়েছিল।”
সুমিত কিছু বলতে যাচ্ছিল। নায়ার তাকে থামিয়ে বলল, “হ্যাঁ। আমি রাত্তিরে কিছু রহস্যজনক শব্দ শুনেছি। তার ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। আমার সিদ্ধান্ত, সে তাড়াহুড়ো করে জুয়েলগুলো বের করে নিয়ে ওই অদ্ভুত হ্যাভারস্যাক আমাদের বাথরুমে পাচার করেছিল। কৃষ্ণা দীর্ঘাঙ্গিনী। আমাদের বাথরুমের লিন্টেন গলিয়ে বাইরে থেকে ওটা ঢোকানো তার পক্ষেই সম্ভব। সে আমাদেরই দায়ী করতে চেয়েছিল।”
বীতশোক মাথা দোলাল। ঈশিতা ভুরু কুঁচকে বলল, “ইজ ইট সো ইমপটান্ট কর্নেল সরকার?” তারপর সে বাঁকা হাসল। “কে জানে বাবা! হয়তো এটাই একটা ভাইটাল ক্লু।”
“ইউ আর রাইট মিসেস ব্যানার্জি।” কর্নেল বীতশোকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “অ্যান্ড থ্যাংকস মিঃ ব্যানার্জি! এটা আমার জানার দরকার ছিল। যাই হোক, সুমিতবাবুর জানতে আগ্রহ, খুনি যে একই লোক, তা কী পদ্ধতিতে জানতে পারলুম। আপনারা কেউ একটুকরো কাগজ দিতে পারেন?”
নীপা তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট নোটবই বের করে একটা পাতা ছিঁড়ে দিল। ডটপেনও ছিল। কর্নেল কাগজটাতে কিছু এঁকে টেবিলে রাখলেন। সবাই ঝুঁকে পড়ল।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, “প্লিজ লুক! এ এবং বি দুজন লোক। তাদের মাথার পেছন দিকটা আমি এঁকেছি। কোনাকুনি কালো দাগদুটো ক্ষতচিহ্ন। মর্গের ডাক্তারের স্টেটমেন্টের ভিত্তিতে এই ছবিটা আমার মনে আঁকা ছিল। এখন সেটাই কাগজে এঁকে দেখালুম। লক্ষ করুন দুটো ক্ষতচিহ্নই ডানদিকে প্রায় ৬০ ডিগ্রি কোণ সৃষ্টি করেছে। অর্থাৎ বেঁকে রয়েছে খানিকটা। মাথার খুলি যেভাবে ক্র্যাক হয়েছে, সেইভাবেই এঁকেছি। দুটো খুলিরই ক্র্যাকিং লাইন একইরকম। তার মানেটা কী দাঁড়াচ্ছে বুঝতে চেষ্টা করুন।”
সুমিত কাগজটা তুলে নিয়ে দেখার পর কর্নেলের দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকাল। “আপনার মাথা আছে স্যার! খুনি একই লোক। নায়ার! দেখছিস? নীপু! দেখ, দেখ।”
নায়ার বলল, “লৌহদণ্ডের আঘাত। বীতশোক বলছিল হত্যার দণ্ডটি ঘটনাস্থলেই পাওয়া গেছে। আমার সিদ্ধান্ত, লৌহদণ্ডে হত্যাকারীর হাতের ছাপ আছে। ফরেনসিক গবেষণাগারে পাঠানো উচিত।”
ঈশিতা বলল, “গণেশের হাতের ছাপ পাওয়া যাবে। শিওর!”
কর্নেল বললেন, “গণেশের দু-দুটো খুনের মোটিভ কী থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন মিসেস ব্যানার্জি?”
ঈশিতা একটু চটে গেল। “সেটা জানেন মিসেস রত্না বোস। তাঁকে জেরা করছেন না কেন আপনারা? মাফিয়ালিডার কেতন সিংয়ের সঙ্গে মিসেস বোসের অবৈধ সম্পর্ক থাকতে পারে।”
বীতশোক স্ত্রীকে দ্রুত থামিয়ে দিল। “লিভ ইট!”
নীপা আস্তে বলল, “আচ্ছা কর্নেল সরকার ক্ষতরেখা বাঁকা কেন? মাথার পেছনে মারলে স্কালের ক্র্যাকিং লাইন সোজা হওয়াই উচিত।”
কর্নেল বললেন, “আপনি বুদ্ধিমতী মিস সেন! ঠিকই ধরছেন। ক্র্যাকিং লাইন বাঁকা কেন? আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, লাইন দুটো ডাইনে বেঁকে প্রায় ৬০ ডিগ্রি কোণ সৃষ্টি করল কেন? একটা ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। খুনি কোনও কারণে দুটি ক্ষেত্রেই সোজাসুজি আঘাত করতে পারেনি। মার্ডার উইপন মাথার ওপরে কোনও জিনিসে ঠেকে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তাই কাত করে মারতে হয়েছে। প্রথম ক্ষেত্রে সম্ভবত মাথার ওপর ছিল ঝাড়বাতি এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সম্ভবত সিলিং ফ্যান। অথচ ঘটনাস্থলে পাওয়া লোহার রডটা মাত্র আড়াই ফুট।”
নীপা বলল, “কিন্তু স্কালের ক্র্যাকিং লাইন বাঁদিকে না বেঁকে ডানদিকে বেঁকেছে কেন? বাঁদিকে বেঁকে যায়নি কেন? খুনি কি তার ভিকটিমের পেছনে বাঁদিকে দাঁড়িয়ে আঘাত করেছে? নাকি সে ন্যাটা–লে হ্যাঁনডার?”
“আপনি বুদ্ধিমতী মিস সেন!”
আরিফ এতক্ষণে ফিরে এল। কর্নেলকে বলল, “শ্যামলালের বাড়ি সার্চ করে তার মাকে লেখা বসন্ত হাজরার একটা পোস্টকার্ড পাওয়া গেছে। তবে ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর সতীশ শর্মা আপনার ওপর একটু–” আরিফ হাসল। “আই মিন, আপনার ভাষাতেই বলা চলে, ওঁকে আপনি অনর্থক রেড হেরিংয়ের পেছনে ছুটিয়েছিলেন।”
“হাতের লেখা মেলেনি তো?”
“নাহ।”
“তা হলে মিঃ শর্মাকে আমি রেড হেরিংয়ের পেছনে ছোটাইনি।”
আরিফ বসল। একটু অবাক হয়ে বলল, “আপনি কি জানতেন দুটো হাতের লেখা এক নয়?”
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুটে আগুন ধরিয়ে বললেন, “জানতুম না। জানতে চেয়েছিলুম এবং এবার জানলুম। তাতে আমার থিওরি আরও সলিড হল, ডার্লিং।”
সুমিত খুক করে কাশল। “আচ্ছা স্যার, এই যে আপনি আরিফকে ‘ডার্লিং বলেন, মানে–”ডার্লিং’ কথাটা স্যার কেমন যেন একটু মেয়েলি-মেয়েলি শোনায় আর কী! প্লিজ যদি এক্সপ্লেন করেন?”
কর্নেল প্রায় একটা অট্টহাসি হাসলেন। তারপর বললেন, “অভিধান দেখে নেবেন মিঃ চৌধুরি! নারী-পুরুষ সকলের প্রতি প্রযোজ্য শব্দ। আমি যাদের বেশি ভালবাসি, তাদের ‘ডার্লিং’ বলা আমার অভ্যাস, সম্ভবত আমার মধ্যে কিছু পিকিউলিয়্যারিটি আছে।”
আরিফ হাসল। “বড্ড বেশি-বেশি আছে।”
কর্নেল হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। “তা আছে বলেই এখন তোমাকে আবার ইভনিং ভিলায় নিয়ে যেতে চাই। লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন! ইভনিং ভিলার দু-দুটো হত্যারহস্যের পর্দা উন্মোচন দেখতে যদি আপনাদের কারও আগ্রহ থাকে, আসতে পারেন।”
প্রথমে নীতা উঠে দাঁড়াল। তারপর সুমিত, নায়ার ও ঈশিতা। বীতশোক একটু ইতস্তত করছিল। ঈশিতা রুষ্ট মুখে বলল, “বোকামি কোরো না অশোক! একবার যথেষ্ট বোকামি করেছ। আর নয়।”
বীতশোক উঠে গেল। তার ক্রিমরঙা অ্যাম্বাসাডারে এবার সামনের সিটে ঈশিতা বসল। পেছনে বসল নীপা, সুমিত ও নায়ার। আরিফের জিপকে অনুসরণ করল বীতশোকের গাড়ি। চড়াই থেকে নামার সময় নায়ার বলল, “অত্যন্ত অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি! শার্লক হোমস বা এরকুল পোয়ারোদের যুগ কবে শেষ হয়ে গেছে। আধুনিক যুগের হত্যাকাণ্ডে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিই প্রয়োগ করা উচিত। লৌহদণ্ডে হত্যাকারীর হাতের ছাপ পরীক্ষা না করে সিদ্ধান্তে আসা উচিত নয়।”
ঈশিতা পিছনে ঘুরে বলল, “তা ছাড়া গণেশকে অ্যারেস্ট করা উচিত ছিল। মিসেস বোসকেও জেরা করা উচিত ছিল।”
সুমিত বলল, “মাইরি আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। বুড়ো মহা ঘুঘু। কাকে ফসাবে কে জানে?”
নীপা বিরক্ত হয়ে বলল, “আহ! চুপ করো তো তোমরা। আমার কেমন একটা আনক্যানি ফিলিং হচ্ছে।”
ঈশিতা বলল, “আমারও।”
ইভনিং ভিলার গেটে দুটো পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকজন সশস্ত্র কনস্টেবল একটা বেঞ্চে বসে ছিল। আরিফের জিপ দেখামাত্র অ্যাটেশন-এ দাঁড়িয়ে গেল এবং স্যালুট ঠুকল। ভেতর থেকে একজন পুলিশ অফিসার এগিয়ে এলেন। আরিফ বলল, “এভরিথিং অলরাইট মিঃ পাণ্ডে?”
“ইয়েস স্যার!”
“মিঃ পাণ্ডে, কর্নেলসাব মিসেস বোসকি সাথ কুছ জরুরি বাত করনে আয়া। প্লিজ অ্যারেঞ্জ ইট। টেল হার, ইট ইজ ভেরি আর্জেন্ট।”
পুলিশ অফিসার হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেলেন। কর্নেল নুড়ির ওপর সাবধানে পা ফেলে বাঁদিকের ঘাসে ঢাকা লনে গেলেন। আরিফ তার বন্ধুদের সঙ্গ দিল। হলঘরের দিকে যেতে যেতে সুমিত বলল, “আরিফ! এত পুলিশ পাহারা দেখে মাইরি আমার গা ছমছম করছে! এ বাড়ির লোকগুলোকে নজরবন্দি রাখা হয়েছে। তাই না?”
আরিফ বলল, “মিসেস বোস নিস্ পোলিশ প্রোটেকশন।”
ঈশিতা চাপা স্বরে বলল, “ন্যাকামি! কেতন সিং থাকতে–”
বীতশোক তাকে থামিয়ে দিল। “স্টপ ইট!”
হলঘরের দরজা খোলা ছিল। পোর্টিকোর নিচে কয়েকটা চেয়ার পেতে কয়েকজন কনস্টেবল বসে ছিল। তারা উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম দিল। মিঃ পাণ্ডে বললেন, “খবর পাঠিয়েছি স্যার!”
ভেতরে ঢুকেই নায়ার ঝাড়বাতিগুলোর দিকে তাকাল। একটু হেসে বলল, “রত্নম! প্রচুর সবুজ পান্নার অলঙ্কৃত আচ্ছাদন।”
সুমিত বলল, “পরীক্ষা করে দ্যা তো কোনটা ছেঁড়া?”
কর্নেল বললেন, “বেশির ভাগই ছেঁড়া। কারণ ঝাড়ের ঝালরগুলো পুরনো। আপনারা বসুন।”
সবাই কালকের মতো সোফায় বসল। কালো চিতাটা হিংস্র জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে ফায়ারপ্লেসের মাথায়। কর্নেল ও আরিফ পাশাপাশি বসলেন। মিঃ পাণ্ডে বাইরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন। নিঝুম হয়ে আছে পরিবেশ। শুধু দেয়াল ঘড়ির টকটক শব্দ। কিছুক্ষণের জন্য সবাই চুপ। একটি চরম মুহূর্তের জন্য রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষার সময়। তারপর দেয়ালঘড়িতে আটটা বাজল। হলঘরের ভেতর থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। সিঁড়িতে রত্না বোসকে দেখা গেল। তার হাতের চেনে বাঁধা ভয়ঙ্কর একটা বুলডগ। পেছনে গণেশ। গণেশের হাতে কুকুরের চেনটা দিয়ে রত্না নেমে এলেন। গণেশ সিঁড়ির নিচে এসে দাঁড়িয়ে রইল। বুলডগটা তার পাশে পেছনের দুই হাঁটু মুড়ে বসল। রত্নার পরনে সাদা। শাড়ি, সাদা লম্বাহাতা ব্লাউস। বিধবাবেশে আজ তাকে বয়স্কা দেখাচ্ছিল। মুখ থেকে যৌবনের লালিত্য একেবারে মুছে গেছে। চোখের তলায় ছোপ পড়েছে। করজোড়ে নমস্কার করলেন। কর্নেল বললেন, “বসুন রত্না দেবী।”
ফায়ারপ্লেসের কাছে ভেলভেটে মোড়া সিংহাসনগড়নের চেয়ারে বসে রত্না আস্তে বললেন, “বলুন?”
কর্নেল বললেন, “আপনাকে এমন একটা দুঃসময়ে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। তবে আমার ধারণা, আপনার মনোবল অসাধারণ। অন্তত এই শোচনীয় ঘটনার পর আপনি যে-কোনও পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে তৈরি।”
রত্নার চোখ জ্বলে উঠল। “ইজ ইট আ গ্রেটনিং কর্নেল সরকার?”
“দ্যাট ডিপেন্ডস। কর্নেল একটু হাসলেন। “আজ আপনি আমার কাছে জানতে গিয়েছিলেন কে আমাকে হায়ার করেছে। আপনি এ-ও বলেছিলেন, ইভনিং ভিলায় সন্দেহজনক কিছু ঘটছে–আপনার ভাষায় ‘স্মেলিং আ ডেড র্যাট সামহোয়্যার। আপনার এই দুটি কথার মধ্যে একটা সম্পর্ক ছিল। নাহ! ‘সম্পর্ক যে ছিল, সে বিষয়ে আপনি আমার সঙ্গে ‘টার্মে’ পৌঁছুতেই চেয়েছিলেন। তাই প্রচুর টাকাও নিয়ে গিয়েছিলেন। এ সব থেকে আমার সিদ্ধান্ত হল–”
“আপনি কী বলতে চান, আমি বুঝতে পারছি না।”
“আমি বলতে চাইছি, আপনি আসলে জানতেন কে আমাকে হায়ার’ করেছে। কিন্তু আপনার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল কেন আমাকে সে ‘হায়ার করেছে, এটাই জানা। অর্থাৎ আমার কাজটা কী? তাই না?”
রত্না তাকিয়ে রইলেন। জবাব দিলেন না।
“রত্না দেবী! আমার কাজটা ছিল আজ এই বাড়িতে ককটেল-ডিনার পার্টিতে যেভাবে হোক উপস্থিত থাকা। কেন তা-ও বলছি। আই ওয়জ টু প্রিভেন্ট আ মার্ডার। কারণ আমার সো-কল্ড ক্লায়েন্ট’ জানতে পেরেছিল, তাকে খুনের চক্রান্ত হচ্ছে এবং কোনও-না-কোনও ছলে খুন করা হবে।”
রত্না দু’হাতে মুখ ঢেকে ভাঙা গলায় বলে উঠলেন, “ও মাই গড! বাট হোয়াই?”
কর্নেল আরিফের দিকে হাত বাড়ালেন। আরিফ খান প্যান্টের পকেট থেকে কী একটা তাকে বের করে দিল। কর্নেল সেটা তুলে ধরে বললেন, “আপনি দেখুন তো এটা চিনতে পারেন কি না?”
রত্না নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলেন। চোখের কোনায় জলের ফোঁটা। “এটা আপনার স্বামীর পকেটে পাওয়া গেছে। আপনার পূর্বপুরুষের জুয়েলচেস্টের ডুপ্লিকেট চাবি।”
রত্না কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “আই ডোন্ট বিলিভ ইট!”
আরিফ বলল, “আমরা অলরেডি এটা পরীক্ষা করে দেখেছি মিসেস বোস! এই চাবি দিয়ে জুয়েলচেস্ট খোলা যায়।”
“বাট হোয়াই? আমার হাজব্যান্ডের তো টাকার অভাব ছিল না!”
আরিফ একটু হেসে বীতশোকের দিকে তাকাল। “মাই ফ্রেন্ড বীতশোক ব্যানার্জি নোজ দিস ওয়েল। কলকাতায় মিঃ বোসের একজন মিসট্রেস আছেন। মিঃ বোস তাকে জুয়েলগুলো উপহার দিতেন। শি ইজ আ ফিল্মস্টার।”
নায়ার গম্ভীর মুখে বলল, “বীতশোকের হস্তক্ষেপ করা উচিত ছিল।”
বীতশোক বলল, “আমি কী করতে পারি? কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানোর অভ্যাস আমার নেই। তবে আমার কর্তব্য আমি করেছি। মিঃ বোস খুন হওয়ার পর আরিফকে কথাটা জানানো উচিত মনে করেছিলুম। জানিয়ে দিয়েছি।”
কর্নেল বললেন, “আমার সো-কল্ড ক্লায়েন্ট’ ক্রমাগত জুয়েল চুরি টের পেয়েছিলেন। তাই মিঃ বোস তাকে চিরকালের জন্য চুপ করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কাজটা সহজ ছিল না। কারণ এ বাড়িতে গণেশ, মালতী এবং ওই বুলডগ তিন-তিনটে বড় বাধা। তাছাড়া মিসেস বোসেরও সন্দেহ হতে পারে। তাই মিঃ বোস কুখ্যাত কেতন সিংয়ের সঙ্গে চক্রান্ত করেন। ককটেল-ডিনারের আয়োজন হয়। হোমরা চোমরা লোকেরা এমন কি একজন মিনিস্টারও আমন্ত্রিত। অতএব ‘যাক শত্রু পরে-পরে। কেতনের মতো লোক, ধরা যাক মদের নেশায় দৈবাৎ একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলার পর তা সামলানোর। হিম্মতও তারই আছে। এদিকে আমার সো-কল্ড ক্লায়েন্টও এলাকার প্রাক্তন মাফিয়ালিডার। কেতনের সঙ্গে একসময় প্রচণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। পরস্পর ঘোর শত্রু, সেটা কে না জানে? পুলিশও জানে। এ-ও জানা কথা, ওই কেতনই। ডাকাতির ছলে–আমার ধারণা, মিঃ বোসেরও হাত থাকতে পারে এর পেছনে, রাজত্ব এবং রাজকন্যা দুই-ই হাতে এসে যাবে–আমার সো-কল্ড ক্লায়েন্টকে অন্ধ অক্ষম করে দিয়েছিল।”
রত্নার ভিজে চোখ আবার জ্বলে উঠল। “কর্নেল সরকার! স্টপ ইট!”
সবাই নড়ে বসল। নীপা বলল, “রায়সায়েব আপনার ক্লায়েন্ট?”
“সো-কল্ড ক্লায়েন্ট বলেছি।” কর্নেল হাসলেন। কারণ তিনিই আমাকে একটা বেনামী চিঠি লিখে পাঠান। অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করুন। তার কাজিনসিস্টার স্বামীর অত্যন্ত অনুগত। এদিকে মিঃ বোসও এ বাড়ির পূর্ণ কর্তৃত্ব হাতের মুঠোয় এনে ফেলেছেন। তাই রায়সায়েব এ বাড়ির কাউকে বিশ্বাস করতে পারেননি। ব্যাপারটা এবার তার দিক থেকেই দেখতে হবে। তার একসময়ের কর্মচারী বসন্ত হাজরা প্রায়ই তার কাছে সাহায্য চাইতে আসত। সেই তাকে ককটেল ডিনারের সাংঘাতিক চক্রান্তের কথা জানিয়েছিল।”
নায়ার বলল, “সে কী করে জানতে পারল?”
আরিফ বলল, “শ্যামলাল ড্রাইভার কেতনের এক চেলা কালুয়ার জিগরি দোস্ত। কালুয়া নেশার ঘোরে তাকে কথাটা জানিয়ে দেয়। তারপর–”
“আমি বলছি।” কর্নেল বললেন। “বসন্ত হাজরা শ্যামলালের বাঙালিমামা। প্রচণ্ড ধূর্ত লোক। তো কথাটা শোনার পর শ্যামলাল ভয় পেয়েছিল। শ্যামলাল কথাটা তার মামার কানে তুলেছিল, যেন ‘আমরিকান সাব’-কে মামা সাবধান করে দেয়। বসন্ত হাজরা সাবধান করে দিয়েছিল প্রাক্তন মনিবকে। তারপর রায়সায়েব আমাকে বেনামী চিঠি লিখে তাকে দিয়ে ডাকে ফেলতে পাঠান। আজকাল খামের মুখে তত আঠা থাকে না। বসন্ত হাজরা চিঠিটা পড়েছিল। তারপর ডাকে ফেলেছিল বটে, কিন্তু এতে তার সামনে অর্থপ্রাপ্তিরও সুযোগ এসেছিল। অদ্ভুত চরিত্রের লোক ছিল বসন্ত হাজরা! সে মিঃ বোসকে এই গোপন তথ্য জানিয়ে নিশ্চয় বখশিস আদায় করেছিল। বোসসায়েব ভাবনায় পড়ে যান। তার সন্দেহ স্বাভাবিকভাবেই পড়ে শ্যামলালের ওপর। তার চাকরি যায়। তারপর মিঃ ব্যানার্জি আসার সঙ্গে সঙ্গে মিঃ বোস তাকে জানান, তার পেছনে প্রাইভেট ডিটেকটিভ লাগানো হয়েছে। হ্যাঁ, আমার থিওরি মজবুত। বেনামী চিঠির হস্তাক্ষর যে বসন্ত হাজরার নয়, তা-ও কিছুক্ষণ আগে জানা গেছে।”
রত্না শ্বাস ছেড়ে বললেন, “কিন্তু দাদা তো লিখতে পারেন না! তার ডানহাত সম্পূর্ণ অবশ।”
“বাঁহাতে লিখেছিলেন। কর্নেল চুরুট ধরালেন। “তো গণেশ আমাদের বলেছে, ইদানীং বড়সায়েবের কাছে ছোটসায়েব অর্থাৎ মিঃ বোস চুপিচুপি কী সব কথা বলতে যেতেন। আসলে মিঃ বোস তার শ্যালককে বোঝানোর চেষ্টা করতেন, ওসব মিথ্যা কথা। মিঃ বোসের উদ্বেগের সঙ্গে সোমনাথবাবু ম্যাকবেথের উদ্বেগের তুলনা করেছিলেন। হি ইজ ইনটেলিজেন্ট। তো ইভনিং ভিলায় এই ব্যাপারটাই মিসেস বোসের কাছে ‘স্মেলিং আ ডেড র্যাট সামহোয়্যার। তার গাড়ির ড্রাইভার শ্যামলালের হঠাৎ চাকরি যাওয়াটাও অদ্ভুত মনে হয়েছিল। রত্নাদেবী! আপনি বলেছিলেন, “আই কান্ট এক্সপ্লেন ইট। নাও ইট ইজ এক্সপ্লেনড।”
রত্না আস্তে বললেন, “বাট হোয়াট ডু য়ু ওয়ান্ট টু টেল মি কর্নেল সরকার?”
“নাথিং বাট দা টুথ। সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাই আপনাকে।”
“হোয়াটস্ দা ট্রুথ?”
“বসন্ত হাজরা গতকাল সন্ধ্যায় চুপিচুপি রায়সায়েবকে ব্ল্যাকমেল করতে এসেছিল। টাকা না দিলে সে বোসসায়েবকে জানিয়ে দেবে যে, রায়সায়েব প্রাইভেট ডিটেকটিভকে গোপনে চিঠি লিখেছেন। কিন্তু আসলে সে অলরেডি তা জানিয়েও দিয়েছে। অথচ এসেছে হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করতে। এই বেয়াদবি বরদাস্ত করতে পারেননি রায়সায়েব। তার হাতের ছড়িটিকে লাঠি বলাই উচিত। মুঠোটা প্রায় ইঞ্চি ছয়েক লম্বা রুপো দিয়ে বাঁধানো। বসন্ত হাজরা উঠে পালাতে চেয়েছিল। লাঠির বাঁটটা তার মাথায় পেছনে পড়ে। তারপর রায়সায়েবের খেয়াল হয়, কী ঘটে গেছে। সোমনাথের সিগারেটের প্যাকেটের ভেতরটা ছিঁড়ে আমার নাম-ঠিকানা লিখে হাজরার পকেটের দেশলাইয়ে চালান করেন। যেন হাজরাই চিঠিটা লিখেছিল আমাকে। এটা আত্মরক্ষার চেষ্টা মাত্র। গণেশ! ঠিক বলছি?”
গণেশ মুখ নামাল।
নীপা বলে উঠল, “বাঁ হাত দিয়ে লাঠির আঘাতের জন্যই স্কালের ক্র্যাকিং লাইন ডানদিকে বেঁকে আছে। তাই না? তাছাড়া বাঁহাতেরও অসম্ভব জোর বলতে হবে।”
ঈশিতা বলল, “আনবিলিভেবল! একজন অন্ধ মানুষের পক্ষে।
কর্নেল তার কথার ওপর বললেন, “রায়সায়েব সম্পূর্ণ অন্ধ নন। সম্পূর্ণ অন্ধ এ সব কাজ করতে পারে না, তাছাড়া এই হলঘরের প্রতিটি ইঞ্চি তার। নখদর্পণে। রত্নাদেবীকে জিজ্ঞেস করেছিলুম, হলঘরের আসবাব নতুন করে সাজানো হয়েছে কি না। হয়নি।”
সুমিত বলল, “কিন্তু আপনার থিওরি, বসন্ত হাজরার খুনিই মিঃ বোসের খুনি!”
রত্না ভাঙা গলায় হিংস্র আর্তনাদ করলেন, “গেট আউট! গেট আউট ইউ ফুলস! আমি বুলডগ ছেড়ে দেব, আই ওয়ার্ন ইউ অল।”
“ফেস দা ট্রুথ, রত্নাদেবী!” কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন। “মিঃ বোস জানতেন, এ বাড়িতে যতক্ষণ আপনি উপস্থিত আছেন, ততক্ষণ তিনি সম্পূর্ণ নিরাপদ। তাই অন্তত আজ ৩১ মার্চ পর্যন্ত আপনি যাতে বাইরে না যেতে পারেন, তার মানে, বাইরে যেতে হলে আপনি গাড়ি চেপেই যাবেন, সেজন্যই লনের রাস্তায় ও-ভাবে নুড়ি বিছানোর ব্যবস্থা করেছিলেন মিঃ বোস। আজ রাতে কেতন সিং রায়সায়েবকে খতম করত। তারপর আপনার গাড়ি বেরুনোর ব্যবস্থা দ্রুত হয়ে যেত। কিন্তু মিঃ বোসের দুর্ভাগ্য, আপনি চলে গেলেন আমার সঙ্গে কথা বলতে। রায়সায়েব এদিকে তৈরি এবং মরিয়া হয়ে উঠেছেন। কারণ আমি এসে পড়েছি, এ কথা সম্ভবত কেউ জানায়নি তাকে। আমিও তখনও জানি না, চিঠিটা তারই লেখা। তো আপনি চলে যাওয়ার সুযোগ পেয়েই রায়সায়েব ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে উঠে ফোনের লাইন টেনে ছিঁড়ে ফেলেন। এর কারণ অনুমান করা যায়। মিঃ বোস একা বাইরে গেলেই আপনাকে বারবার রিং করতেন। এটা ওঁর ভালবাসার ভান, রত্নাদেবী! মালতী বলেছে, বাইরে গেলে হরবখত’ ছোটসায়েব টেলিফোন করতেন। তবে রায়সায়েব জানতেন, এদিন ফোনে সাড়া না পেলেই বোসসায়েবের কোনও সন্দেহ হতে পারে। ইট ওয়জ আ সর্ট অফ ট্র্যাপ। মিঃ বোস এসে ঠিকই ফাঁদে পড়লেন। গণেশ এবং মালতী তাদের আসল মনিবকে খুনের দায় থেকে বাঁচাতেই একটা লোহার রডে রক্ত মাখিয়ে বাড়ির কাছে ফেলে রেখেছিল। প্রায় এগারো বছর ধরে যে জিনিসটা রায়সায়েব হাতে করে নিয়ে ঘুরছেন, সেটা অর্থাৎ হাতের ছড়ি বা লাঠিটাই তার আত্মরক্ষা কিংবা আক্রমণের মোক্ষম অস্ত্র। কী গণেশ? ঠিক বলছি না?”
গণেশ আবার মুখ নামাল। রত্না নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে কথা শুনছিলেন। ঠোঁট কাঁপছিল। বিড়িবিড় করে বললেন, “ইটস আ টোটাল লাই! গণেশ! তুমি বলো! এসব মিথ্যা। ভীষণ মিথ্যা।”
“ফেস দা হার্ড ট্রুথ, রত্নাদেবী!” কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। “আপনার সামনে এবার নতুন একটা জীবনের সুযোগ এসেছে। টেক ইট অ্যাজ আ চ্যালেঞ্জ। আরিফ! এস, আমরা রায়সায়েবের কাছে যাই।”
ভেতরের দরজার দিকে কর্নেল এগিয়ে যেতেই কেউ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। দ্রুত পদা তুললেন। মালতাঁকে দেখা গেল। সে কান্না জড়ানো গলায় বলল, “আব কিসকা পাস যাতে হেঁ, হায় রাম! বড়াসাব মর গেয়া! জহর খা লিয়া! হায় রাম! মুর্দাকা পাস যানা হ্যায় তো যাইয়ে!” সে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।
রত্না উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। হঠাৎ শ্বেতপাথরের মূর্তি হয়ে গেলেন। কর্নেল, আরিফ ও মিঃ পাণ্ডে ভেতরে ঢুকে গেলেন। তারপর গেল গণেশ। কুকুরটা তাকে অনুসরণ করল।
বীতশোক একটু ইতস্তত করে ডাকল, “মিসেস বোস!”
“ব্যানার্জি। মিসেস বোস ইজ আ ডেড পার্সন! আমি রত্না রায়। আন্ডারস্ট্যান্ড ইট, ব্যানার্জি!”
“চলুন, দাদাকে দেখবেন।”
রত্না পা বাড়িয়েই চেয়ারের হাতল আঁকড়ে ধরলেন। তারপর মূৰ্ছিত হয়ে। পড়ে গেলেন কার্পেটের ওপর।…
.
ডাকবাংলোর বারান্দায় বসে কথা বলছিল ওরা। সুমিত, নায়ার, ঈশিতা ও নীপা। বীতশোক ইভনিং ভিলায় আছে। ঈশিতা গাড়ি চালিয়ে এনেছে। ওরা তার আসার অপেক্ষা করছিল। নীপা বলছিল, “আমি যেন জানতুম! কাল সন্ধ্যায় ভদ্রলোককে গাছপালার ভেতর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনে হচ্ছিল, আ পার্ট অফ নেচার। সোমনাথ বলছিল, ওই হাতের ছড়ি বা লাঠিটা দিয়েই উনি নাকি সবকিছু দেখতে পান। আসলে ওটা একটা অন্ধ আদিম শক্তির প্রতীক। তাই না ঈশিতাদি? একজন অন্ধলোকের কাছে তার হাতের ছড়ি বা লাঠিটাই কি শেষ অস্ত্র নয়?”
ঈশিতা বলল, “অ্যাবসার্ড! রায়সায়েব একেবারে অন্ধ হতেই পারে না। একটু আধটু নিশ্চয় দেখতে পেত। ডিটেকটিভদ্রলোক বললেন না?”
দূরে হেডলাইট দেখা যাচ্ছিল। একটু পরে গেটের সামনে এসে আরিফের জিপ থামল। জিপটা ভেতরে ঢুকল না। বীতশোক ও কর্নেলকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।
সুমিত কর্নেলকে বলল, “কী দেখলেন স্যার?”
কর্নেল চেয়ারে বসে টুপি খুলে টেবিলে রাখলেন। টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, “স্লিপিং ক্যাপসুল খেয়ে সুইসাইড করেছেন রায়সায়েব। আসলে সোমনাথবাবুর ওই থিওরিটা ঠিক। আমরা জানি না যে, আমরা কী জানি। আমার মনে ছিল না, ভদ্রলোক আমার পরিচিত। বহুবছর আগে একবার এখানে। বেড়াতে এসে হাওয়াই আড্ডির জঙ্গলে ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তখন উনি। কুখ্যাত মাফিয়ালিডার! ওঁকে আমার ভুলে যাওয়ার কারণ সম্ভবত এটাই। ওঁকে আমার নেমকার্ড দিয়েছিলুম মনে পড়ছে।”
নীপা বলল, “কিন্তু সোমনাথ কেন ইভনিং ভিলায় ঢুকল, আমার মাথায় ঢুকছে না।”
কর্নেল একটু হাসলেন। “এগেন দা সেম থিওরি। আজ লাঞ্চের সময় সোমনাথবাবুর হঠাৎ নাকি মনে পড়েছিল, গতকাল সন্ধ্যায় সিগারেটের প্যাকেট আনতে গিয়ে হলঘরের ভেতরের দরজায় ছড়ির ডগা দেখেছিলেন। তাই নিয়ে রায়সায়েবের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন। জোর বেঁচে গেছেন।”…
Leave a Reply