কাকচরিত্র – কর্নেল সমগ্র ২ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
১. পিকনিকে দুর্ঘটনা
অনেকদিন পরে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের ইলিয়ট রোডের বাসায় গেলাম। বাড়িটার নাম সানি লজ। কর্নেল থাকেন তিন তলায়–পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তে।
আজ গিয়ে দেখি, কর্নেল পুবের জানলায় ঝুঁকে আমার দিকে পিছু ফিরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ভঙ্গিটা দেখে হাসি পেল। থমকে দাঁড়ালাম।
হঠাৎ কর্নেল ওদিকে মুখ রেখেই বললেন-জয়ন্ত, কাককে শাস্ত্রে অমঙ্গলের প্রতীক কেন বলা হয় জানো?
আমি তো থ। কর্নেল কীভাবে টের পেলেন যে আমিই এসেছি! কাছাকাছি কোন আয়না নেই যে আমার প্রতিবিম্ব দেখতে পেয়েছেন।
কর্নেল এবার ঘুরে বললেন বসো। তোমার পায়ের শব্দ শুনেই বুঝতে পেরেছি।
–পায়ের শব্দ শুনে? বলেন কী কর্নেল?
–ওটা অবাক হবার মতো কিছু নয়। নিতান্ত পর্যবেক্ষণের অভ্যাস। তবে সেই সঙ্গে তোমার সিগারেটের চেনা গন্ধটা আমাকে বলে দিয়েছে। বসো।
বসলাম না। ওঁর পাশে গিয়ে জানলার বাইরে তাকালাম। নিচে একটা বস্তি এলাকা রয়েছে। তার মধ্যে অনেকগুলো গাছ আছে। নিম কৃষ্ণচূড়া শিমূল আর জামরুল। মধ্য কলকাতায় একটা পাড়াগাঁ রয়ে গেছে, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। নিমগাছটা প্রকাণ্ড। তার ডালপালা কালো করে বসে রয়েছে কয়েকশো কাক। তাই দেখছিলেন তাহলে! বললাম কাক কিসের প্রতীক বলছিলেন যেন?
–অমঙ্গলের।..বলে কর্নেল কোণের সোফায় বসে পড়লেন।–এস জয়ন্ত, : আজ আমরা কাক নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করি।
আমিও বসলাম। বসে বললাম–সায়েবদের শাস্ত্রে কাক নিয়ে কোন প্রসঙ্গ নেই?
কর্নেল বললেন–ঘেঁটে দেখিনি। কিন্তু যাই বলো জয়ন্ত, প্রাচীন ভারতীয়রা যে কাককে অমঙ্গলের সঙ্গে অর্থাৎ এভিলের সঙ্গে যুক্ত করেছেন–তার সঙ্গত কারণ আছে। ওঃ জয়ন্ত, যে কাকগুলো দেখলে এইমাত্র–আমাকে পাগল করে ছাড়লে! কী কর্কশ ডাক, কী চ্যাঁচামেচি সারাদিন।
হেসে বললাম–ওটা নিতান্ত কাকতালীয় ব্যাপার! আপনার ক্ষেত্রে।
–ঠিক বলেছ। কাকতালীয় যোগের কথাটা মাথায় আসেনি এতক্ষণ ..বলে উনি সোজা হলেন। চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠল। কর্নেল বিড়বিড় করলেন আপন মনেহাউ ফানি! ভুলেই গিয়েছিলাম। কাকতালীয় যোগ! ঠিক, ঠিক। দ্যাটস দা আইডিয়া।
অবাক হয়ে বললাম কী ব্যাপার কর্নেল?
কর্নেল প্রশ্নে আমল না দিয়ে আমার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে বললেন-কাক এসে তালের ওপর বসল, ঠিক সেই মুহূর্তে তালটা পড়ে গেল। কেউ যদি তার থেকে ধরে নেয় যে কাকটা বসার দরুন তালটা পড়ল, তাহলে। সে নিশ্চয় ভুল করছে। অথচ ঠিক ওইরকম সিদ্ধান্তই আমরা নানা ব্যাপারে করে ফেলি। পরস্পর বিচ্ছিন্ন দুটো ঘটনা একত্র ঘটলে আমরা একটাকে আরেকটার কারণ বলে ধরে নিই অনেকক্ষেত্রে। আসলে তালটা পড়ার সময় হয়ে এসেছিল-কাকটা না এলেও পড়ত। তাই না জয়ন্ত?
–হ্যাঁ! সে তো বটেই। যেমন, আপনি তো কতদিন ধরে ওই জানালার বাইরে কাকগুলো দেখে আসছেন, নিশ্চয় আজকের মতো এমন বিরক্ত হননি, কিংবা কাক নিয়ে মাথা ঘামাননি, কাজেই কর্নেল, আজ যখন হঠাৎ কাক দেখে বিরক্ত হয়েছেন এবং আমি আসামাত্র কাকপ্রসঙ্গে প্রশ্ন করে বসলেন, তখন আমিও এক্ষেত্রে ব্যাপারটা কাকতালীয় যোগ বলতে বাধ্য হয়েছি। অর্থাৎ আপনার বিরক্তিময় ভাবনার পিছনে অন্য ঘটনা আছে। তা নিতান্ত কাক নয়।
কর্নেল একটু হাসলেন এবার। রাইট, রাইট, তবে কী জানো জয়ন্ত, ভেবে দেখলাম কাকচরিত্র সত্যি বড় রহস্যময়। ভারতীয় পণ্ডিতরা কাকচরিত্র নিয়ে কেন মাথা ঘামাতেন, টের পাচ্ছি। আশা করি, কাকচরিত্র’ নামে প্রাচীন তত্ত্বশাস্ত্র তোমার পড়া আছে।
–ভ্যাট! সে সব গাঁজাখুরি ব্যাপার। আজকাল কেউ মানে না।
–সে আলাদা প্রশ্ন, কে মানে বা মানে না। কিন্তু কাক-ওঃ! হরিবল!..আবার বিড়বিড় করে কী বলতে থাকলেন কর্নেল।
সেই মুহূর্তে ঝট করে আমার মনে পড়ে গেল, আজকের কাগজের প্রথম পাতায় বারো পয়েন্ট বোল্ড হরফে ছাপা বক্স করা ছোট্ট খবরটা। পি টি আই এর খবর। প্রখ্যাত শিল্পপতি শ্রীহিতেন্দ্রপ্রসাদ সেন গত ২৩শে মার্চ তার। বিলাসপুরের বাগানবাড়িতে এক আকস্মিক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন, উড়ন্ত একঝাক কাক লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ার সময় দৈবাৎ তিনি গুলিবিদ্ধ হন। খবরটা এত দেরি করে বেরনোর কারণ সম্ভবত পুলিশের বিধিনিষেধ।
কর্নেলের সামনের টেবিলে একটা স্টেটসম্যান পড়ে ছিল। তক্ষুনি তুলে নিয়ে দেখি, ওঁরাও প্রথম পাতায় ছেপেছেন খবরটা বক্স করেই। আর বক্সটা ঘিরে লাল পেন্সিলে দাগ দিয়ে রেখেছেন কর্নেল। এই ব্যাপার তাহলে!
কর্নেল আমার কাণ্ড দেখছিলেন চুপচাপ। তারপর বললেন–হুঁম্। তোমার উন্নতি হবে জয়ন্ত। তোমার মন খুব দ্রুত কাজ করতে পারে।
-হিতেন সেন মারা গেছেন? কি কাণ্ড! এই তো বিশে মার্চ পার্ক হোটেলে একটা কভারেজে গিয়েছিলাম, বিলাসপুরে একটা স্বদেশী মেলা বসাচ্ছেন– তারই প্রেস কনফারেন্স ডেকেছিলেন।
সর্বনাশ! তাহলে তো আর মেলাটা হবে না।
–হুঁম্। হবে না। হয়তো হত–ওঁর স্ত্রীর উদ্যোগেই তো ব্যাপারটা হবার– কথা ছিল। শ্রী সেন নিঃসন্তান। শ্ৰীমতী সেন–এসব ক্ষেত্রে যা হয়, সমাজসেবা ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু মেলাটা হচ্ছে না।
-কেন? অসুবিধা কিসের? সে তো এপ্রিলের মাঝামাঝি শুরু হবার কথা।
হবে না। কারণ, শ্রী সেনের যে উইল বেরিয়ে পড়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে উনি সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মাত্র সিকিভাগ দিয়ে গেছেন স্ত্রী এবং অন্যান্য কিছু দুঃস্থ আত্মীয়কে, প্রত্যেকে সমান-সমান হিস্যা। বাকিটার অর্ধেক একটা আশ্রমের নামে, অর্ধেক কোন এক শ্রীমতী শ্যামলীর নামে।
–সে কী? ভারি অদ্ভুত ব্যাপার তো! কে সে?
–এই শ্যামলী নামে মহিলাটিকে তুমি চিনতেও পারো। অন্তত নাম শোনা উচিত, কারণ তুমি রিপোর্টার।
লাফিয়ে উঠলুম উত্তেজনায়।–কর্নেল, কর্নেল! ক্যাবারে গার্ল মিস শ্যামলী নয় তো?
কর্নেল মৃদু হাসলেন। দ্যাটস রাইট।
–মিস শ্যামলীকে হিতেন সেনের মতো লোক–ভ্যাটু! অসম্ভব! কর্নেল জোরে হেসে উঠলেন।–সম্ভব-অসম্ভব সম্পর্কে যা শেষ কথা বলার, শেক্সপিয়ার বলে গেছেন বৎস জয়ন্ত। যাই হোক, আমার বিরক্তির হেতু কিংবা অস্বস্তির উৎস সেটা নয়। কোটিপতিরা অনেক ব্যাপার করেন–যা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে নিশ্চয় উত্তেজনা সৃষ্টি করে। সেকালে রাজামহারাজা নবাববাদশারা এর চেয়ে অনেক বিস্ময়কর কাজ করতেন। বাদশা সাজাহানের কথাই ধরো। বউয়ের জন্যে তাজমহল নামে কী এলাহি কাণ্ড করে গেলেন! জয়ন্ত, ওসব ছেড়ে দাও। এস, আমরা কাক নিয়ে আলোচনা করি।
–আর কাক!..বিরক্ত হলে বললুম। আশ্চর্য কর্নেল! হিতেন সেন একটা ক্যাবারে নর্তকীকে অত সম্পত্তি দিয়ে গেলেন? ইস্ কোন মানে হয় এর?
–মাই ডিয়ার ইয়ং ম্যান, তুমি দেখছি নেহাত ছাপোষা মানুষের চোখে ব্যাপারটা দেখছ! ভুলে যাচ্ছ যে তুমি একজন সাংবাদিক। যেখানে-সেখানে অজস্র সম্পদের অপচয় তোমাদের তো চোখে পড়ার কথা। সামাজিক বৈষম্যের বাস্তব নিদর্শন চারপাশে এত বেশি যে ও নিয়ে নতুন উত্তেজনা প্রকাশ করা বৃথা। তুমি রাজনৈতিক নেতা বা কর্মী নও, আমিও নই। তুমি-আমি সমাজের উন্নতি বা সাম্য আনবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠিনি। বলতে পারি বড়জোর–উই হ্যাভ দা ফিলিংস, উই আর কনসাস অ্যাবাউট দা রিয়্যালিটি। কিন্তু আমরা এ ব্যাপারে নিতান্ত অসহায়। যাই হোক, আমি একজন অপরাধবিজ্ঞানী এবং তুমি একজন রিপোর্টার হিসেবে এ মুহূর্তে শুধু ওই অমঙ্গলের প্রতীক কালো রঙের পাখি সম্পর্কে কিছু করতে পারি কি না দেখা যাক।
একটু হাসতে হল। কাক নিয়ে কী করতে চান?
সত্যে পৌঁছতে।
তার মানে?
–একটু আগে আমরা কাকতালীয় যোগের কথা বলছিলাম, জয়ন্ত। তাই না?
–হ্যাঁ, বলছিলুম তো।
কর্নেল ডাকলেন। ষষ্ঠী! কফি।
.
একটু পরে ষষ্ঠীচরণ নিঃশব্দে ট্রেতে কফির পট, কাপ আর একটা স্ন্যাকসের প্যাকেট রেখে চলে গেল। কর্নেল তার উদ্দেশে কতগুলো মিষ্টি বাক্য উৎসর্গ করে বললেন-কফি বানাও, জয়ন্ত।
কফির পেয়ালা হাতে না পাওয়া অব্দি মুখ খুললেন না কর্নেল।
একটা চুমুক দিয়ে বললেন–হিতেন সেনের মৃত্যুর ব্যাপারে তোমার কোন বিস্ময় জাগছে না?
না তো। উড়ন্ত কাক মারতে বন্দুক তুলেছিলেন, হয়তো পোশাকে কিংবা অন্য কিছুতে লেগে নলটা যথেষ্ট ওপরে ওঠবার আগেই ট্রিগারে চাপ পড়েছিল–অ্যাকসিডেন্ট হয়ে গেছে। এ তো খুবই স্বাভাবিক। আমার বিস্ময় জাগাচ্ছে উইলে মিস শ্যামলীকে–
বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন–হুম, অ্যাকসিডেন্টের বর্ণনাটা অবিকল তোমার ধারণার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে জয়ন্ত। পুলিশের রিপোর্ট এবং বিলাসপুর বাগানবাড়িতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সকলের বর্ণনা ওইরকম। কিন্তু কাক আমাকে জ্বালাচ্ছে সারাক্ষণ।
-কেন?
কর্নেল উত্তেজিত হলেন যেন।–মাই ডিয়ার জয়ন্ত, এটা কেন তোমার কাছে অদ্ভুত মনে হচ্ছে না যে হিতেন সেন কাক মারতে বন্দুক তুলেছিলেন? আর কিছু নয়–স্রেফ কাক? হিতেন সেন মোটামুটি ভালো শিকারী ছিলেন, আমি জানি। বয়সেও এমন কিছু বুড়ো হননি। মাথাও ছিল পরিষ্কার। কোন অসুখ-বিসুখ ছিল না। ওষুধ খাওয়ার বাতিক ছিল না। কোনরকম অ্যালোপ্যাথি ওষুধ জীবনে খাননি। বড়জোর হোমিওপ্যাথি খেতেন। তাও কদাচিৎ। তা– একজন ধুরন্ধর, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, ঝানু ব্যবসায়ী মানুষ হিতেন সেন–আর কিছু পেলেন না, কাক মারতে গেলেন?
–হয়তো ওখানে কাকের ভীষণ উপদ্রব আছে। ওই তো দেখুন না, অতসব কাক নিমগাছটাতে রয়েছে। আমারই বিরক্ত লাগছে দেখে। হয়তো হিতেনবাবুও ওদের চাঁচামেচিতে বিরক্ত হয়েছিলেন। তাই….
জয়ন্ত, জয়ন্ত! বুদ্ধির সামনে থেকে ঘষা কাঁচটা সরিয়ে ফেলল।
–কেন কর্নেল?
কাক বিরক্তির কারণ নিশ্চয়। কিন্তু তার জন্যে কেউ তাদের তাড়াতেই চাইবে–মেরে ফেলতে নয়। অন্তত যদি সে বদরাগী লোক না হয়। হিতেন সেন মোটেও বদরাগী গোঁয়ার-গোবিন্দ বা হঠকারী বুদ্ধির লোক ছিলেন না। ধরে নিচ্ছি, তিনি বন্দুকই ছুঁড়েছিলেন কাক তাড়াতে কিংবা আরও এগিয়ে ধরে নিচ্ছি, কাক মারতেই চেয়েছিলেন। কিন্তু ছররা নয় কেন? কেন সাংঘাতিক বিপজ্জনক একটা বুলেট ব্যবহার করে বসলেন? এবং ভেবে দ্যাখোবন্দুক নয়, নিতান্ত শটগান নয়–একেবারে ওঁর উইনচেস্টার রাইফেল হাতে নিলেন।
–তাও তো বটে। পুলিশের কোন সন্দেহ হয়নি এতে?
–কেমন করে হবে? সবাই বলছে এবং তাছাড়া পুলিশ তদন্ত করে প্রমাণ পেয়েছে ওই রাইফেলটা ছাড়া আর কোন অস্ত্র হিতেনবাবুর বাগানবাড়িতে ওই সময় ছিল না। রিপোর্ট বলছে, বাগানবাড়িতে প্রাঙ্গণের শেষদিকে সন্ধ্যার একটু আগে গাছপালার ছায়ায় সুদৃশ্য তাঁবু খাঁটিয়ে পিকনিক মতো করা হয়েছিল। উনুন এবং খাবারদাবার ছিল গাছের নিচে। কাকগুলোর তখন গাছে বসার সময়। তাই বারবার বিরক্ত করছিল। খাবারে পায়খানা করে দিতে পারে–সেই আশঙ্কায় সবাই মিলে অনেকবার ঢিল ছুঁড়ে তাড়া করেছিল। তারপর অবশেষে হিতেনবাবু রেগেমেগে রাইফেলটা নিয়ে বেরিয়ে আসেন। সেইসময় কাকগুলো আচমকা মাথার ওপর থেকে চাঁচাতে চাঁচাতে উড়তে শুরু করে। পিছন পিছন একা দৌড়ে যান হিতেনবাবু। বাগানের ঘন ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে তাকে আর দেখা যায় না কতক্ষণ। পিছনে ওই দিকটায় কোন বসতি নেই। জঙ্গল আর আখের খেত আর একটা ছোট নদী রয়েছে। পাঁচিল ওদিকে গত বন্যায় ধ্বসে গিয়েছিল। মেরামত এখনও হয়নি। নদী থেকে ভাঙা পাঁচিলের মধ্যে ঢালু কুড়ি গজ জঙ্গুলে জায়গার ঠিক মাঝামাঝি পড়েছিলেন হিতেনবাবু। গুলি লেগেছে। চিবুকের নীচে, গলার ওপর অংশে–ডানদিকে। গুলি সোজা মগজে গিয়ে ঢুকেছে। ইতিমধ্যে মিনিট দশকারো মতে মিনিট পনের পরে ওদিক থেকে গুলির আওয়াজ শোনা যায়। হিতেনবাবুর ফেরার নাম নেই। হ্যাঁসাগ জ্বালানো হয়েছে ইতিমধ্যে। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে যায়। তখনও উনি ফেরেন না। সাড়ে সাতটায় মিসেস সেন উদ্বিগ্ন হয়ে খুঁজতে পাঠান। একজন চাকর সঙ্গে নিয়ে যান হিতেনবাবুর অ্যাটর্নি মিঃ সুশান্ত মজুমদার। ওঁরা হিতেনবাবুকে আবিষ্কার করেন। টর্চ ছিল দুজনেরই হাতে। অবশ্য পূর্ণিমার রাত ছিল। প্রতি বছর চৈত্রের দোলপূর্ণিমার রাতে বিলাসপুর বাগানবাড়িতে পিকনিক করা অভ্যাস ছিল হিতেনবাবুর। জয়ন্ত, সমস্ত ব্যাপারটা বিচার করে আমার ধারণা হয়েছে, পুলিশ এবং হিতেনবাবুর আত্মীয়স্বজনের সিদ্ধান্তটা যেন কাকতালীয়। তুমি কী বলো?
–হুঁ, কী রকম যেন খাপছাড়া মনে হচ্ছে। অবশ্য মিস শ্যামলীর সম্পত্তি লাভের ফলে আমাদের প্রেজুডিসড় হয়ে পড়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এই অঘটনটা হিতেনবাবু না ঘটিয়ে গেলে তার মৃত্যু দুর্ঘটনা বলেই চালানো যেত।
–তোমার কথা অস্বীকার করছি না। পুলিশও পরে একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। উইলটা ওদের ধাঁধায় ফেলেছে। কিন্তু এদিকে তো মৃতদেহ আর হাতে নেই যে ফের পরীক্ষা করে দেখবে। ইতিমধ্যে সেটা ভস্মীভূত।
মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে পুলিশ নিশ্চিত তো?
-হ্যাঁ, অবশ্যই। ওই রাইফেল থেকেই গুলি বেরিয়ে মাথায় ঢুকেছে। রাইফেলের বাঁটে হিতেনবাবু ছাড়া অন্য কারো আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি। কোন উল্টোপাল্টা সাক্ষ্যও কেউ দেয়নি। আবার কোন প্রত্যক্ষদর্শীও ছিল না।
উদ্বিগ্ন মুখে বললুম কর্নেল! তাহলে কি এটা খুনের ঘটনা বলে আপনি নিঃসংশয়?
কর্নেল হাত তুলে বললেন, না জয়ন্ত। আমি ঠিক তা বলতে চাইছি না। কোন নিঃসংশয় সিদ্ধান্তেও আমি পৌঁছইনি। শুধু বলতে চাচ্ছি যে হিতেন সেনের আকস্মিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পটভূমিকা আমার কাছে যুক্তিসিদ্ধ মনে হচ্ছে না। আগেই বলেছি দুটো ব্যাপার আমার ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। এক : হঠাৎ ভদ্রলোকের কাকের ওপর তাদের খেপে গিয়ে পিছনে দৌড়নো, দুই : বুলেটভরা রাইফেল হাতে নেওয়া।
–কিন্তু সাক্ষীরা তো বলছেন, তাই দেখেছেন।
–হ্যাঁ, দেখেছেন এবং বলেছেন একবাক্যে।
–তাহলে?
কর্নেল টাকে হাত বুলাতে বুলোতে বললেন–ডার্লিং! তুমি তো দর্শনের ছাত্র ছিলে। অবভাসতত্ত্ব সম্পর্কে তুমি অজ্ঞ নও। প্রকৃত বস্তু এবং প্রতীয়মান বস্তু অর্থাৎ রিয়েলিটি ও অ্যাপিয়ারেন্সের বিষয় কি নতুন করে বোঝাতে হবে তোমাকে? রেল লাইনে দাঁড়িয়ে দূরের দিকে তাকালে মনে হয় দুটো লাইন ক্রমশ দিগন্তে গিয়ে মিশে গেছে পরম্পর। কিন্তু বস্তুত–আমরা জানি, ওরা বরাবর সমান্তরাল। হিতেন সেন কাকের ওপর রেগে গিয়ে গুলিভরা রাইফেল হাতে দৌড়ে গেলেন এবং পরে গুলির শব্দ শোনা গেল। এবং ঠিক গলার নিচে গুলি ঢুকে মগজ যুঁড়ল। একই রাইফেলের গুলি–ছটার মধ্যে একটা খরচ হয়েছে, পাঁচটা ঠিকঠাক কেসে রয়েছে। এবং আছাড় খাওয়ার চিহ্নও রয়েছে শরীরে। রাইফেলে ওঁর আঙুলের ছাপ ছাড়া কোন ছাপ নেই। সব–সবকিছু আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। মিস শ্যামলীকে বিশাল সম্পত্তি দেওয়াটা আমি ছেড়ে দিলাম। কিন্তু এটা বাদ দিয়েও যে ঘটনাটা দাঁড়ায় অর্থাৎ দুর্ঘটনায় মৃত্যু, সেটা নিছক অ্যাপিয়ারেন্স বা প্রতীয়মানও তো হতে পারে! ধরো–যদি মিস শ্যামলী উইলে নাও থাকতেন, মিসেস সেনই সব সম্পত্তি পেতেন–তবেও ব্যাপারটা কি তোমার রিয়্যাল ইনসিডেন্ট বলে মনে হচ্ছে জয়ন্ত?
–ঠিকই বলেছেন।
–কেন হিতেন সেন হঠাৎ কাকের ওপর খেপে গেলেন?
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে বললুম–তাই তো! কেন?
–কেনই বা উনি গুলিভরা রাইফেল নিয়ে দৌড়ে গেলেন?
–হ্যাঁ। কেন গেলেন?
কর্নেল খপ করে আমার হাত ধরে বললেন–ওঠ, বেরিয়ে পড়ি।
.
২. মিস শ্যামলী ও একটি ফুল
আমার গাড়িটা ফিয়াট। স্টিয়ারিং আমারই হাতে। কিন্তু কোথায় যেতে হবে, কর্নেল বলছেন না। দু’একবার প্রশ্ন করেও কোন স্পষ্ট নির্দেশ পাইনি। কর্নেল চোখ বুজে ঝিমোতে ঝিমোতে শুধু বলছেন–চলো তো!
গাড়ি পার্ক স্ট্রিটে ঢুকিয়েছি। ছুটির দিন রোববার। বেলা প্রায় নটা–এখনো অবশ্য ভো বাজেনি। কিন্তু এ এক বিদঘুটে অবস্থায় পড়া গেল দেখছি। অন্ধের মতো চলেছি যেন। চৌরঙ্গির মোড়ে একটা খালি লরি ঢনঢ়ন করে আমাদের প্রায় গা ঘেঁষে এবং বেআইনিভাবে ওভারটেক করে আচমকা সামনে দাঁড়িয়ে গেল–রোড সিগনাল লাল। ঢু মারতে গিয়ে সামলে নিল আমার ক্রিমরঙা ফিয়াট। আমি লরির শূন্য খোলটার উদ্দেশে খুব চ্যাঁচামেচি করলুম। কর্নেল আচমকা ব্রেক কষার ঝাঁকুনিতে চোখ খুলেছিলেন বন্ধ করলেন ফের। আলো সবুজ হলে অসভ্য লরিটাকে ডিঙিয়ে যাবার জন্যে বাঁদিকে মোড় নিলাম। পিছনের গাড়িগুলোর খিস্তি এবার আমাকে শুনতে হল। চৌরঙ্গি ধরে দক্ষিণে যাবার সময়, কর্নেল যেন নিজের মনে বললেন–ঠিকই যাচ্ছি।
বাঁদিকে থিয়েটার রোডে ঢুকলুম। কর্নেলের কোন সাড়া নেই। আচ্ছা মুশকিলে পড়া গেল তো! আমি যেদিকে খুশি গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতলব করলুম–তার ফলে দেখা যাক, কর্নেল বাধ্য হয়ে গন্তব্যস্থান বলে বসবেন নাকি।
খানিক এগিয়ে বাঁদিকে ছোট রাস্তায়, আবার বাঁদিকে ছোট রাস্তায়–তারপর বোঁও করে ঘুরে ক্যামাক স্ট্রিট, তারপর সামনের ছোটরাস্তায়। প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছে। কর্নেল এবার নির্ঘাৎ জব্দ হচ্ছেন।
কিন্তু একজায়গায় হঠাৎ কর্নেল বলে উঠলেন–রোখো, রোখো!
গাড়ি দাঁড় করালুম। পুরো সাহেবপাড়া এটা। উঁচুতলার সাহেবসুবোরা বিশাল সব বাড়িতে এখানে বাস করেন। পাঁচিল, গেট, প্রাঙ্গণ, গাছপালা, সুইমিং পুল, ভাস্কর্য ইত্যাদি প্রতিটি বাড়ির বৈশিষ্ট্য। বাঁদিকে একটা গেট। কর্নেল দেখলাম দরজা খুলে নামলেন। তারপর আমার দিকে না ঘুরে গেটে চলে গেলেন। উর্দিপরা দারোয়ানকে কী বললেন। দারোয়ান সেলাম করে গেটটা পুরো খুলে দিল। কর্নেল আমার দিকে হাত নেড়ে ভিতরে গাড়ি নিয়ে যেতে ইশারা করলেন।
গাড়িতে আর চাপলেন না। পাশে পাশে এগিয়ে গেলেন উনি! লনের একপাশে তিনটে দেশী-বিদেশী সুদৃশ্য গাড়ি দাঁড় করানো রয়েছে। লনে গাড়ি রেখে বেরিয়ে এলুম। সামনে দেখি একটা স্কাইক্র্যাপার বাড়ি। চারপাশের বনেদী ঐতিহ্যের ওপর আধুনিক স্থাপত্যের টানা একফালি হাসি যেন–হাসিটা অতি উদ্ধত। কর্নেল আমাকে মুখ তুলে বাড়ির উচ্চতার দিকে তাকাতে দেখে বললেন–একালের সুর সুন্দরীদের পক্ষে উপযুক্ত জায়গা, ডার্লিং!
কর্নেল স্ত্রী-পুরুষ নির্বিচারে ডার্লিং সম্বোধন করেন। আমি বললুম–কিন্তু কর্নেল, আমরা কার কাছে যাচ্ছি? কোন সুরসুন্দরীর কাছেই কি?
পরক্ষণে আমার ধাঁধা ঘুচে গেল আচমকা। আরে তাই তো!
এখানেই তো সেই ক্যাবারে নর্তকী মিস শ্যামলী থাকে! একটা সিনেমামাসিকে শ্যামলী সম্পর্কে কিছু মুখরোচক রেপোর্টাজ পড়েছিলাম বটে! অনেক অবান্তর বিষয় স্মৃতিতে আমরা দুয়ে কারণে রেখে দিই। মধ্য কলকাতায় এই ‘ইন্দ্রপুরী’ এবং মিস শ্যামলীর সেখানে অবস্থান অকারণে স্মৃতিতে স্পষ্ট ছিল।
কর্নেল আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অন্তরঙ্গভাবে একটা হাত ধরলেন। দুজনে এগিয়ে গেলুম।
উদ্দেশ্যহীনভাবে অন্ধের মতো গাড়ি চালিয়ে শ্যামলীর ফ্ল্যাটে পৌঁছনো নিতান্তই আকস্মিক ঘটনা ছাড়া কী বলব? এখানে আসবার মতলব মোটেও আমার ছিল না। লিফটের সামনে একটু দাঁড়িয়ে কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, তোমার উন্নতি হবে, জয়ন্ত। ঠিক জায়গায় নিয়ে এসেছ।
হেসে বললুম-মোটেও তা নয় কর্নেল। আমি নির্দিষ্ট কোথাও আপনাকে পৌঁছে দেবার জন্যে আসছিলুম না। এটা নেহাৎ আকস্মিক ঘটনা। আপনি গন্তব্যস্থানের কথা একবারও বললেন না। ফলে, উদ্দেশ্যহীনভাবে গাড়ি চালাচ্ছিলুম।
না ডার্লিং, মোটেও তা নয়। আমি ‘চলো তো’ বলার সঙ্গে তুমি ঠিক করে নিয়েছিলে এমন একটা গন্তব্যস্থান–যা আমাদের কেসের পক্ষে খুবই জরুরি।
বারে! আমি বলছি তো, উদ্দেশ্যহীনভাবে এসে পড়েছি দৈবাৎ!
-না, না…বলে কর্নেল লিফটের চাবি টিপলেন। লিফটা ওপরতলায় ছিল। জয়ন্ত, এই হচ্ছে মানুষের মনের রহস্য। যখনই তোমাকে ‘চলো তো’ বললুম এবং নির্দিষ্ট জায়গার নাম করলুম না, অমনি তোমার অবচেতনায় লক্ষ্যের কাটা মিস শ্যামলীর দিকেই প্রথমে নির্দিষ্ট হল। এই কেসে শ্যামলীকেই তুমি আগাগোড়া ‘ভাইটাল’ ধরে নিয়ে বসে আছো। সচেতন মনে যেহেতু যুক্তির দৌরাত্ম্য এবং কড়াকড়ি বেশি, তোমার অবচেতন মনের উদ্দেশ্যটা লুকোচুরি খেলতে আরম্ভ করল। তার ফলে যেটুকু পথ এলোমেলো গাড়ি চালিয়েছ–সবটাই তোমার সচেতন মনকে ভাওতা দিতে। নিজের সঙ্গে মানুষ এই ভাবেই লুকোচুরি খেলে।
গুম হয়ে রইলুম। লিফট এসে গেল। অটোমেটিক লিফট। ভিতরে ঢুকে কর্নেল ছনম্বর বোতাম টিপতেই দরজা বন্ধ হল এবং উঠতে শুরু করল। সাততলায় লিফট থেকে নামলুম আমরা। শ্যামলীর ফ্ল্যাট নম্বর আমি জানি না। শুধু জানি এই বাড়িতে সে থাকে।
কর্নেল, আশ্চর্য, ফ্ল্যাট নম্বর জানেন দেখছি! তিন নম্বর ফ্ল্যাটের দরজায় বোতাম টিপলেন। কোন নামফলক নেই। না থাকা স্বাভাবিক।
ভিতরে পিয়ানোর বাজনার মতো মিঠে টুং টাং শব্দ হল। আমি চাপা গলায় বললুম-আপনি ওকে চেনেন নাকি?
কর্নেল জবাব দিলেন না। দরজার ফুটোর কাছে একটা চোখ আবছা ফুটে উঠল। তারপর খুলে গেল। স্বপ্নে শিউরে উঠলুম যেন। সেই শ্যামলী! যার বিলোল নাভিতরঙ্গ দেখে আমার এক কবিবন্ধু তেত্রিশটা পদ্য লিখে ফেলেছে এবং পত্রিকায় ছাপিয়েও নিয়েছে। মধ্যরাতে চৌরঙ্গি এলাকার হোটেলের মঞ্চে রহস্যময় আলোয় পিছলে বেড়ানো অপার্থিব একটুকরো মাংস–যা যৌনতার পোষা অন্ধ গণ্ডারটা ছেড়ে দিয়ে পুরুষগুলোকে এফোঁড়-ওফোড় করে ফেলে, সেই মাংসের টুকরোটা এখন স্নিগ্ধ এবং পার্থিব দেখাল।
আর মিস শ্যামলী এখন গৃহস্থকন্যার মতো আটপৌরে বেশভূষায় এত সাধারণ যে শ্যামবাজারের শশীবাবুর মেয়ে বলেও চালিয়ে দেওয়া যায়। কর্নেলকে দেখেই তার মুখ যেন খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।আসুন, ভেতরে আসুন!
কর্নেলের পিছনে পিছনে অবাক হয়ে ঢুকলুম। ঘরের ভিতর ঐশ্বর্য আর রুচির ছাপ রয়েছে। প্রকাণ্ড ড্রয়িংরুম। ঠিক মাঝখানে সোফাসেট এবং মেঝেয় সুরম্য কার্পেটে গিটার, পাখোয়াজ ইত্যাদি পড়ে রয়েছে। এদিকের দেওয়ালে কমপক্ষে ছ’ফুট-চারফুট আকারের একটা বিশাল পোর্ট্রেট। দেখেই চিনলুম–হিতেন সেন!
আমরা দুজনে শোফায় বসলাম। শ্যামলী মেঝেয় পা দুমড়ে গ্রাম্য তরুণীর মতো বসল। হাসিমুখে আমার দিকে কটাক্ষ করে বলল–এঁকে কোথায় দেখেছি মনে হচ্ছে।
কর্নেল বললেন–উ! দেখা স্বাভাবিক। ও সর্বচর। জয়ন্ত চৌধুরী–দৈনিক সত্যসেবকের রিপোর্টার। জয়ন্ত, শ্যামলীকে তোমার বিলক্ষণ চেনা আছে।
পরম্পর নমস্কার করলুম। শ্যামলী হাসতে হাসতে বলল–সর্বনাশ! রক্ষে করুন কর্নেল! খবরের কাগজে যথেষ্ট হয়ে গেছে। আমি তো দারোয়ানকে বলে রেখেছি প্রেসের লোক জানতে পারলে যেন……
কথাটা অসমাপ্ত রেখে সে ফের আমার দিকে কটাক্ষ করল। কর্নেল বললেন না, না, ও আমার সঙ্গে এসেছে। তা ছাড়া তোমার ব্যাপারে ও আমার ডানহাত এখন। জয়ন্ত খুব বুদ্ধিমান ছেলে। খুব ইয়ে। তা, যাই হোক, শ্যামলী, শোন– যেজন্যে এলাম। কাল রাতে তুমি তো আমার ওখান থেকে চলে এলে। আমার ঘুম হল না আর। তোমাকে ফোন করলুম ঘণ্টাখানেক পরে–পৌঁছলে কি না জানতে। কিন্তু তোমার লাইনটা মনে হল ডেড। ভাবলুম, কলকাতার টেলিফোনের ব্যাপার!
সকালে ফোন করলুম–একই অবস্থা! তখন ভাবছিলুম, একবার যাবো নাকি। তুমিও রিং করছ না কথামতো। একটু উদ্বিগ্ন হলুম। সেই সময় জয়ন্ত এল। তখনি বেরিয়ে পড়লুম।
শ্যামলীর মুখটা গম্ভীর দেখাল।–কী জানি কী হয়েছে ফোনের। কাল রাত থেকে ডেড ছিল।
–গোটা বাড়ির লাইন ডেড ছিল নাকি গতরাতে?
না তো! আমারটা এক্সটেনশান লাইন। খালি আমারটা ডেড ছিল। এখন ঠিক হয়ে গেছে।
–কোন ফ্ল্যাটেই কারো নিজস্ব ডিরেক্ট লাইন নেই?
–জানি না। আছে নিশ্চয়। আমাকেও ডিরেক্ট নিতে হবে দেখছি। প্রাইভেসি রাখা মুশকিল হচ্ছে।
–যাক গে। কাল রাত থেকে এখন অব্দি তোমার দেবার মতো খবর থাকলে বলো।
-তেমন কিছু তো…
–আজ সকালে কেউ আসেননি?
–এসেছিল। সে আমার প্রফেশানের ব্যাপারে।
–ওঁদের কেউ আসেনি?
নাঃ। আর কেউ আসেনি। এলেও আমি বলে দিতুম–না, সম্ভব নয়। উইল ইজ উইল। আমি আমার লিগাল রাইটের সীমানা এক পাও পেরোতে চাইনে।
–মিসেস সেন আমাকে রিং করেছিলেন আজ সাড়ে সাতটায়।
শ্যামলী চমকে উঠল।–মিসেস সেন! চেনেন নাকি আপনাকে!
— না। কেউ পরামর্শ দিয়ে থাকবে। তবে তুমি ভেবো না ডার্লিং, আমি সবসময় সত্যের পক্ষে।
শ্যামলী উদ্বিগ্ন মুখে বলল–আচ্ছা কর্নেল, সত্যি কি আমাকে এখন কিছুদিন সাবধানে থাকতে হবে? কোথাও ফাংশান করা যাবে না?
–মানুষের এই পৃথিবীটা খুব জটিল, শ্যামলী।
–কিন্তু অতসব কন্ট্রাক্ট রয়েছে। আমাকে তো তা মিট আপ করতেই হবে। তা না হলে পার্টিরা ক্ষতিপূরণ দাবি করে বসবে।
কর্নেল হাসলেন–তুমি এখন কলকাতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনবতী মহিলা, মাই ডিয়ার গার্ল!
শ্যামলী চিন্তিতমুখে কী ভেবে তারপর ম্লান হেসে বলল কিন্তু আমি এখনও আত্মরক্ষার কোন ব্যবস্থাই করিনি। যে কেউ যখন খুশি এসে আমাকে মেরে রেখে যেতে পারে।
কর্নেল সশব্যস্তে বললেন, না। তোমাকে কেউ দৈহিক দিকে হামলা করবে–আমি মোটেও তা বলিনি শ্যামলী।
–তাহলে সাবধানে থাকার কথা বললেন কেন?
কর্নেল ওর দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন-তুমি যথেষ্ট কোমল হৃদয় বিশিষ্ট মেয়ে। আমার ভয় সেখানেই। তোমাকে সহজে কেউ কনভিনস করতে পারে।
শ্যামলী আশ্বস্ত এবং আনন্দিত মুখে বলল–মোটেও না। আমি খুব-খু-উব ভীষণ কোল্ডব্লাডেড। আমার হৃদয়-টিদয় মোটেও নরম নয়। অনেক তেতো অভিজ্ঞতার মধ্যে আমি বড় হয়েছি কর্নেল, ভুলে যাবেন না। বললুম তো–উইল ইজ উইল।
–যাক্ গে, শোন। মিসেস সেন ফোন করে বলেছিলেন, তার কিছু কথা আছে আমার সঙ্গে। খুলে কিছু বলেন না। ঠিক দশটায় যাবার কথা দিয়েছি। যাচ্ছি। তার আগে তোমাকে কিছু প্রশ্ন করতে এলুম। এগুলো গতরাতে আমার মাথায় আসেনি।
–বেশ তো, বলুন।
–হিতেনবাবু ২৩শে মার্চ সকালে তোমাকে ফোন করে বিলাসপুর যেতে বলেছিলেন। কিন্তু তুমি যাওনি। কারণ, ফোনে কোন অচেনা লোক তোমাকে শাসিয়েছিল যে গেলে বিপদ হবে। তাই না?
-হ্যাঁ। আপনাকে তো বলেছি…
–কিন্তু তুমি কি সেজন্যেই যাওনি? নাকি–কেউ না শাসালেও তুমি যেতে না?
শ্যামলী নাকের ডগা খুঁটে জবাব দিল–ঠিক বলেছেন। আমি যেতুম না।
-কেন?
আমার প্রথমত ভীষণ অবাক লেগেছিল। ওভাবে পাবলিকলি মিঃ সেন আমার সঙ্গে মেলামেশা করবেন–বিশেষ করে ওঁর স্ত্রীর সামনে, আত্মীয়স্বজনও থাকবেন– তাদের সামনে! এটা অস্বস্তির কারণ হত আমার পক্ষে।
কিন্তু মিঃ সেন তোমার সঙ্গে কখনও, মানে–কোনরকম অভব্য আচরণ করেননি!
না। তা করেননি। খুব দূরত্ব রেখেই মিশতেন। আমিও খুব সমীহ করে চলতুম। তাহলেও তো আমি আসলে একজন ক্যাবারে গার্ল।
–কেন যেতে বলছেন, জিজ্ঞেস করেছিলে?
–হ্যাঁ। বলেছিলুম–আমি কী করব ওখানে গিয়ে?
–উনি কী বলেছিলেন?
–খুলে কিছু বলেননি। শুধু বলেছিলেন যে আমার পক্ষে ওখানে উপস্থিত থাকা জরুরি। কেন জরুরি তা জানতে চাইলেও বলেননি।
–হুম্! কিন্তু ওর মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর ২৪শে মার্চ সকালে তুমি। বিলাসপুর চলে গিয়েছিলে। এবারেও অজানা কেউ ফোনে তোমাকে মিঃ সেনের দুর্ঘটনার খবর দিয়েছিল। যাই হোক, বিলাসপুর যাবার কারণ কী শ্যামলী? মিঃ সেনের দুর্ঘটনা না ছবির সুটিং?
বলেছি তো! যাওয়াটা আকস্মিক। সিনেমা পরিচালক অতীন্দ্র বসুর নতুন ছবিতে আমি একটা রোল করছি। উনি ওইদিন সকালে এসে হাজির। আউটডোর সুটিং-এ যেতে হবে এখুনি। আমি জানতুম না। বিলাসপুরেই ওর লোকেশান। হিরো পার্থকুমার অলরেডি চলে গেছে। তাই গিয়ে পড়লাম যখন, তখন এক ফাঁকে খোঁজ নিয়ে অতীন্দ্রবাবু আর আমি মিঃ সেনের বাগানবাড়িটা একবার ঘুরে এসেছিলুম। নিছক একটা কৌতূহল। আর ফুলটা তো তখনই কুড়িয়ে পাই!
–ফুলটা যেখানে পড়েছিল, তুমি শুনলে যে ডেডবডিটা ওখানেই ছিল। কেমন?
-হ্যাঁ। একটু কৌতূহলী হয়েছিলুম, ফুলটার বোঁটায় চুল জড়ানো দেখে। অতীন্দ্রবাবু ওটা রাখতে পরামর্শ দিলেন। ওঁর পরামর্শেই আপনার কাছে গিয়েছিলুম তাও বলেছি আপনাকে।
তখনও তুমি উইলের ব্যাপারটা জানতে না বলেছ!
বলেছি। জানলুম কলকাতায় ফিরে সন্ধ্যাবেলা। উকিল সুশান্তবাবু এলেন আমার এখানে। বললেন–সুখবর আছে। তারপর আমি তো হতভম্ব। তখন…
–শ্যামলী, মিসেস সেনের সঙ্গে তোমার আলাপ ছিলনাকি অ্যাটর্নি চলে যাবার পর সেই প্রথম এলেন?
–সেই প্রথম। এসে একচোট শাসালেন। তারপর লোভ দেখাতে লাগলেন। আপস করার কথা তুললেন। বললেন কতটা নগদ পেলে আমি আমার অংশ ছাড়তে রাজি ইত্যাদি।
নিশ্চয় তুমি ওঁকে ফুলের কথা বলোনি?
–মোটেও না। আমি আপনার কাছে যাবার জন্য ব্যস্ত।
–মিসেস সেনের মুখের আধখানা ঢাকা ছিল বলেছ।
-হা কালো তাঁতের শাড়ির ঘোমটা পরা ছিল। আমি তাতে অবাক হইনি। কারণ, মিঃ সেনই একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন যে ওঁর স্ত্রীর মুখে একপাশটা এক দুর্ঘটনায় পুড়ে যায়। তার ফলে সেদিকটা ঢেকে রাখেন সবসময়।
–তা হলে মিসেস সেনের মুখটাও ঢাকা ছিল?
–হ্যাঁ।
–একপাশের চুল নিশ্চয় দেখা যাচ্ছিল?
–অতটা লক্ষ্য করিনি।
কর্নেল একটু চুপ করে থেকে বললেন–পার্থবাবুর সঙ্গে তোমার বিয়ের রেজিস্ট্রেশান তো পনেরই এপ্রিল হচ্ছে?
শ্যামলী মুখ নামিয়ে ঈষৎ রাঙা হয়ে জবাব দিল–হ্যাঁ।
কর্নেল বললেন–জয়ন্ত, তুমি উদীয়মান ফিল্ম হিরো পার্থকুমারের নাম নিশ্চয় শুনেছ?
–অবশ্যই! খুব ভাল অভিনয় করছেন ভদ্রলোক।
–শ্যামলী! তোমাদের বিয়ের তারিখটা কবে ধার্য করা হয়েছিল?
–গত ফেব্রুয়ারি মাসে। বাইশ তারিখে। ফিরপোতে পার্টি হয়েছিল ছোটখাটো। মিঃ সেনও উপস্থিত ছিলেন তাতে। অ্যাটর্নি সুশান্ত মজুমদারও ছিলেন।
মিঃ সেন নিশ্চয় খুশি হয়েছিলেন? তিনি তো বরাবর তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী।
–হ্যাঁ।
–শ্যামলী, আমরা উঠি তাহলে। সময়মতো দেখা হবে কেমন?
আমরা উঠে পড়লুম। বাইরে লিফট অব্দি এগিয়ে দিতে এল শ্যামলী। কর্নেল, লিফটে পা রেখে ফের বললেন–ইয়ে, সাবধানে থেকো। না না! তোমাকে কেউ খুনজখম করতে পারে, বলছি না। তাতে কারো লাভ হবে না। তোমার অংশের সম্পত্তি সটান চলে যাবে সরকারের হাতে। কারণ তোমার। কোন সন্তানাদি এখন নেই।
শ্যামলী মৃদু হাসল। আমরা খাঁচার মধ্যে তলিয়ে যেতে থাকলুম।
নিচে নেমে গাড়িতে উঠে বসলুম। কর্নেল বললেন, কী মনে হচ্ছে জয়ন্ত?
গিয়ারে হাত রেখে জবাব দিলুমকাল রাত থেকে এত কাণ্ডে জড়িয়ে রয়েছেন আমাকে বলেননি তো!
শ্যামলী যত চালাক, তত বোকা।…বলে কর্নেল চুরুট ধরালেন। ফের বললেন–হুম, কী যেন বলছিলে জয়ন্ত? তোমাকে কিছু জানাইনি–তাই না? আগে সব জানালে তোমার রিঅ্যাকশানটা অন্যরকম হত। তার ফলে আমার। একটা জিনিস জানা হত না। ঘটনার চেহারাটা দেখে কারো মনে আপনাআপনি সন্দেহ হয় কি না–জানবার উদ্দেশ্য ছিল আমার। দেখলুম, কোন সন্দেহ হয় না–অন্তত তোমার হল না। অথচ তুমি নিতান্ত নোভিস বা লেম্যান নও একজন উঁদে রিপোর্টার। কাজেই আমি সিদ্ধান্তে এলুম যে এই দুর্ঘটনার পিছনে ক্ষুরধার মস্তিষ্ক রয়েছে।
কিন্তু শ্যামলীর সম্পত্তি পাওয়ার তথ্য জেনে আমি সন্দেহ প্রকাশ করেছিলুম।
সে তো নিছক সন্দেহ। প্রেজুডিসড হয়ে পড়া–তোমার ভাষায় কিন্তু আমি আঙুল দিয়ে না দেখালে দুর্ঘটনার বিবরণে কি তোমার কাছে কোন অসঙ্গতি ধরা পড়েছিল? অস্বীকার করো না ডার্লিং!
–ঠিক বলেছেন। কিন্তু আমরা এখন কোথায় যাব? এবারও কি অবচেতন মনের নির্দেশে গাড়ি চলবে?
-নো, নো!..কর্নেল হেসে উঠলেন।তাহলে তুমি সোজা এখন বিলাসপুরে নিয়ে তুলবে। আমি তো জানি। তাই এবার বলে দিই–আমরা যাব নিউ
আলিপুরে। মিসেস সেনের কাছে।…..
.
৩. শ্যামলীর প্রবেশ ও প্রস্থান
মিসেস সেনের বয়স অনুমান করার প্রথম বাধা হল ওঁর ঘোমটা-ঢাকা অর্ধেক মুখ। বাকি অর্ধেকও ঢাকা পড়েছে বলা যায়। শরীরে প্রচুর মেদ থাকলেও বেশ শক্তসমর্থ মনে হচ্ছিল। আমি আন্দাজে বয়সটা বিয়াল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে কোথাও দাঁড় করাতে পারি।
ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বরটা অদ্ভুত লাগল। চাপা, একটু ভাঙা, সেইসঙ্গে ফিসফিসানির মতো কতকটা ইংরাজিতে যাকে বলে হিসিং সাউন্ড। টনসিলের দোষ থাকলে এমন হতে পারে শুনেছি।
আমাদের ড্রইংরুমে ঢোকার আধ মিনিটের মধ্যে উনি এসে গিয়েছিলেন। আমার পরিচয় কর্নেল যথারীতি দিলেন। তারপর ওঁদের কথা শুরু হল। কর্নেল বললে বলুন ম্যাডাম, অধমকে কী জন্যে স্মরণ করেছেন?
মিসেস স্বাগতা সেন বললেন, আমার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় মৃগেন দাশগুপ্ত রিটায়ার্ড মুন্সেফ উনি, বলছিলেন যে উইলটা নিশ্চয় জাল। কিন্তু প্রমাণ করতে হলে অনেক ব্যাকগ্রাউন্ড ইনফরমেশান দরকার হবে। সেগুলো যোগাড় করে দিলেই উনি কেস লড়বার ব্যবস্থা করতে পারবেন। তাছাড়া আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানও বলেছেন।
কর্নেল টাক চুলকে বললেন রাইট, রাইট।
মৃগেনদাই আপনার কথা বলেছেন। আপনি তো একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার মানে, গোয়েন্দা হিসাবে আপনার কথা আমিও নিউজপেপারে পড়েছি। আপনি যদি আমাকে সাহায্য করেন, তাহলে…
কর্নেল আবার বললেন রাইট, রাইট।
স্বাগতা সেন সোৎসাহে ঝুঁকে পড়লেন ওঁর দিকে। বললেন–আপনার ফি কত জানি না–যদি কিছু না মনে করেন, আড়াই হাজার টাকা আপনাকে রেমুনারেশান দেব!
কর্নেল–আশ্চর্য, অতীব বিস্ময়কর, সহাস্যে বললেন–অগ্রিম কত দেবেন শুনি?
–আপাতত একহাজার নিন। কেস জিতলে বাকিটা অবশ্য দেব।
আমাকে হতভম্ব করে কর্নেল দরাদরি শুরু করলেন। অগ্রিম অন্তত দুহাজার চাই–কেস জিতুন আর হারুন, বাকি পাঁচশো পুরো তথ্য দাখিল করলে দিতে হবে। অনেকটা সময় এই বিচিত্র এবং অকল্পনীয় দরদস্তুর চলল। আমি ঘেমে সারা। এ কী কাণ্ড করছেন কর্নেল! জীবনে কখনও কোন কেসে একটি পয়সা কারো কাছে চাননি–দাবি করেননি, নিজের পকেট থেকে একগাদা টাকা খরচ করে গেছেন হাসিমুখে, তিনি এই কেসে টাকার অঙ্ক এবং শর্ত নিয়ে তুমুল লড়ে যাচ্ছেন!
অবশেষে রফা হল। স্বাগতা সেন কর্নেলের শর্তই মেনে নিলেন। বুকের ভিতর থেকে যাদুকরীর মতো একটা ছোট্ট পার্স বের করলেন। তার মধ্যে ভাঁজকরা চেকবই আর কলম ছিল। তক্ষুনি একটা চেক লিখে দিলেন। কর্নেল সেটা পকেটস্থ করে চুরুট ধরালেন। তারপর বললেন–হুম! তাহলে এবার আমাকে কিছু সঠিক তথ্য দিতে হবে ম্যাডাম।
মিসেস সেন হিসহিস করে উঠলেন বা রে! তথ্য যদি আমিই দিতে পারব। তাহলে আপনাকে টাকা দিলাম কেন? এ আপনি কী বলছেন?
-দেখুন মিসেস সেন, অন্ধকারে আমি এগোতে চাই না। আমি শুধু আপনাকে প্রশ্ন করে যাবো, আপনি জবাব দেবেন–যে জবাব আপনার জানা। যা জানা নয়, বলবেন–জানিনে, ব্যস! চুকে গেল।
মিসেস সেন একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, ঠিক আছে।
–বিলাসপুরের বাগানবাড়িতে পিকনিক করার প্রথা আপনাদের নতুন নয়। প্রতি বছর চৈত্রের দোল-পূর্ণিমায় আপনারা সেখানে একটা দিন ও রাত কাটিয়ে আসেন। পার্টি হয়। অনেকটা রাত অব্দি নাচগান ধূমধামও হয়। কেমন?
-হ্যাঁ।
এবার অর্থাৎ গত ২৩শে মার্চ আপনারা ওই উদ্দেশ্যে গেলেন। এবারও কি পার্টি দিয়েছিলেন?
–না। আমরা পিকনিকটা নিজেদের কয়েকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিলাম।
–কেন?
মিঃ সেন ইদানীং হইহল্লা বরদাস্ত করতে পারতেন না। একা থাকতে ভালবাসতেন। বয়স হচ্ছিল–শরীরও ভালো যাচ্ছিল না। আমি ওঁকে ফিল করতে পেরেছি বরাবর। আমরা নিঃসন্তান দম্পতি বুঝতেই পারছেন। তাই ঠিক হল, এবার মোটেও পার্টি দেওয়া হবে না।
রাইট। তা কে কে গেলেন ওখানে?
–আমরা স্বামী-স্ত্রী, আমার বোনের ছেলে ডাক্তার অমরেশ গুপ্ত, ওঁর বন্ধু অ্যাটর্নি সুশান্ত মজুমদার, এই ক’জন মাত্র। বাকি একজন আমাদের রাঁধুনি ঘনশ্যাম, দুজন চাকর জগন্নাথ আর সোফার সুরেন্দ্র। সুশান্তবাবু নিজের গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। আমার পৌঁছানোর অনেকটা পরে উনি পৌঁছান।
–এবার খুব ভাল করে স্মরণ করুন মিসেস সেন, ঘটনাটা কীভাবে ঘটল।
মিসেস সেন এতক্ষণে ফোঁস করে উঠলেন। কী বিপদ! আপনি ওঁর অ্যাকসিডেন্ট নিয়ে এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আপনি উইল সম্পর্কে কোন কথাও তো জিগ্যেস করছেন না! অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট! আর ওই ভয়ঙ্কর স্মৃতি ঘেঁটে কি আমার স্বামীকে ফিরে পাব?
মিসেস সেন ঠিক যে সুরে ‘অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট’ বললেন–লক্ষ্য করলাম–অবিকল একই সুরে বলছিল শ্যামলী। উইল ইজ উইল!’
কর্নেল মুখ গোমড়া করে বললেন-ম্যাডাম, আমার কাজে যথেষ্ট স্বাধীনতা না দিলে আমি এক্ষনি চেক ফেরত দেব এবং চলে যাব। কোন তথ্য আপনার স্বার্থে যাবে, ডিয়ার ম্যাডাম, তা যদি আপনি টের পেতেন–তাহলে এই নীলাদ্রি সরকারকে কারো দরকার হত না।
–আপনি বলছেন, অ্যাকসিডেন্টের সঙ্গে উইলের সম্পর্ক আছে?
–কে বলতে পারে নেই বা আছে? যদি থাকে?
কী জানি, আমি ওসব বুঝি না। আপনি যা জিগ্যেস করার করুন।
–যখন রাইফেল হাতে মিঃ সেন দৌড়ে যান……
–উঁহু। গোড়া থেকে শুনুন। তখন সবে সাড়ে পাঁচটার কাছাকাছি হবে— সূর্য গাছপালার আড়ালে গেছে। কিন্তু যথেষ্ট আলো আছে। আমি, অমরেশ আর সুশান্তবাবু তাঁবুর সামনে ঘাসের উপর চেয়ার পেতে গল্প করছি। ঘনশ্যাম কাছেই বটগাছটার নিচে ইট জড়ো করে উনুন জ্বেলেছে সবে। জগন্নাথ আর হরিয়া মশলা বাটা ইত্যাদিতে ব্যস্ত। সুরেন্দ্র দাঁড়িয়ে তদারক করছিল। তারপর দেখলাম, সুশান্তবাবু ঢিল ছুঁড়ে কাক তাড়াতে লাগলেন। তখন সবাই তাকিয়ে দেখি বটগাছটায় রাজ্যের কাক এসে বসে রয়েছে প্রচণ্ড চেঁচামেচি করছে। আমরাও দেখাদেখি ওর সঙ্গে কাক তাড়াতে লাগলাম হইচই করে। কাকগুলোর নড়ার নাম নেই তবু।
–তখন মিঃ সেন কোথায় ছিলেন?
–ঘরে কোথাও ছিলেন।
–ঘরে মানে?
–কি বিপদ! ওখানে আমাদের–মানে ওঁর পৈতৃক বাড়ি রয়েছে যে। কুঠিবাড়ি বলে সবাই। নীলকুঠি না রেশমকুঠির কোন ব্রিটিশ অফিসার থাকত। পরে আমার শ্বশুর নাকি কিনেছিলেন। একশ বছরের বেশি বয়স বাড়িটার। একতলা। আটদশটা ঘর রয়েছে। আমরা মোটামুটি সাজিয়ে রেখেছি বরাবর। তা–
–আপনারা যেখানটা তাবু করেছিলেন, তার কতদূরে বাড়িটা?
–আমি মেপে দেখিনি। অনেকটা দূরে। ইচ্ছে হলে গিয়ে দেখে আসবেন।
তারপর কী হল বলুন?
–আশেপাশে ভাঙা পাঁচিলের অজস্র ইট পড়েছিল। আমরা তা গুঁড়ো করে ছুঁড়তে শুরু করলাম। একসঙ্গে অতসব তাড়া খেয়ে কাকগুলো পালাতে লাগল। কুঠিবাড়ির কাছাকাছি যেতেই দেখি উনি বন্দুক হাতে নিয়ে দৌড়চ্ছেন।
কোন্দিকে?
কাকগুলো যেদিকে যাচ্ছিল, সেইদিকে।
–তারপর?
ব্যাপার দেখে আমরা হাসাহাসি করলাম।
–আপনারা কেউ গেলেন না?
কী হবে গিয়ে? আমরা আবার গল্পগুজবে মেতে গেলাম।…বলে স্বাগতা সেন আবার চটে গেলেন।–ওই দেখুন, সেই অ্যাকসিডেন্ট আর অ্যাকসিডেন্ট। মিঃ সরকার, আমি যা বলার পুলিশকে সব বলেছি। ইচ্ছে হলে ওদের কাছে গিয়ে জেনে নিন। প্লিজ, সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার কাছে আমাকে আর নিয়ে যাবেন– না।
প্লিজ মিসেস সেন, এটা ভাইটাল। শুধু বলুন–ঠিক ক’টায় মিঃ সেনকে খুঁজতে পাঠান আপনারা?
-সাড়ে সাতটায়।
তাহলে সাড়ে পাঁচটা থেকে সাড়ে সাতটা অব্দি আপনি, ডাক্তার অমরেশ গুপ্ত, মিঃ, মজুমদার, রাঁধুনী, দুজন চাকর এবং সোফার ওইখানেই ছিলেন? নাকি কেউ ইতিমধ্যে কোথাও গিয়েছিল?
মিসেস সেন হিসহিস করে উঠলেন কী বলতে চান আপনি?
–আমি ঘটনাটার একটা স্পষ্ট ছবি চাই।
কেউ আমরা নড়িনি ওখান থেকে।
–আপনার তাহলে নিশ্চয় কড়া নজর ছিল প্রত্যেকের দিকে?
তার মানে?
তা না হলে কেমন করে জানলেন যে কেউ কোথাও গিয়েছিল কি না?
দমে গেলেন স্বাগতা সেন। তিনি এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন আপনি হয়তো ঠিকই বলেছেন। আমি অত লক্ষ্য রাখিনি। কিন্তু যদি কেউ ওখান থেকে সরে গিয়ে আবার এসে থাকে, সে তো আমাদের রাঁধুনী চাকর দুজন আর সোফারের মধ্যে কেউ। অমরেশ বা মিঃ মজুমদার আমার কাছেই ছিলেন। জগন্নাথদের জিগ্যেস করলেই হবে। কিন্তু ওরা–ওরা কেন…মিঃ সরকার, আবার আপনি সাংঘাতিক কিছু হাতে নিয়েছেন! আপনি কি বলতে চাই কেউ ওঁকে খুন করেছে?
–আমি কিছুই বলতে চাইনে স্বাগতা দেবী। আমি সত্যে পৌঁছতে চাই।
মিসেস সেন এবার ছটফট করে উঠলেন। ঘোমাটি ভালো করে ঢেকে কুৎসিত ভঙ্গিতে কেঁদে উঠলেন! প্রথমে কিছুক্ষণ কিছু বোঝা গেল না কী বলছেন। অবশেষে বোঝা গেল।–এ আমি ভাবিনি! সত্যি, ভাবিনি! আপনি ঠিকই বলেছেন। ওই হারামজাদী বেশ্যা মেয়েটা ওঁকে ভুলিয়ে সর্বনাশ করবে আমি জানতাম! ঠিক-ঠিক। ওঁকে গুণ্ডা লাগিয়ে খুন করেছে। আমরা ভুল বুঝেছিলাম! পুলিশ–পুলিশকেও টাকা খাইয়ে ও মিথ্যা রিপোর্ট লিখিয়েছে!
কর্নেল ওঁকে সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত হলেন। আমার মাথা ধরে উঠেছিল। কর্নেলকে ইশারায় বললাম বাইরে একটু ঘোরাঘুরি করছি। কর্নেল আমার দিকে মনোযোগ দিলেন না। আমি বেরিয়ে এলাম। এটা দোতলা। সিঁড়ি বেয়ে নিচে গেলাম। কাকেও দেখলাম না। বাথরুমে যাওয়ার দরকার হল সেইসময়। ভাবলাম কাজটা সেরে নিই। এদিক-ওদিক খুঁজেও টয়লেটের পাত্তা পেলাম না। কোন লোক নেই যে জিগ্যেস করব। ডাইনের ঘরে ভারী পর্দা ঝুলছে। ভিতরে কথা বলার আওয়াজ পেলাম। মরিয়া হয়ে ওখানেই কাকেও জিগ্যেস করব ভেবে পর্দা একটু ফাঁক করলাম। তারপরই অবাক হয়ে পেছিয়ে এলাম। মিস শ্যামলী বসে রয়েছে।
হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি–সেইসময় একজন খাকি হাফপ্যান্ট শার্ট পরা বুড়ো সারভ্যান্ট গোছের লোক সিঁড়ি বেয়ে নামছে দেখলাম। তাকে জিগ্যেস করতেই বলল বাঁদিকে পড়বে।
টয়লেটে কাজ সেরে আরামে পাইপ ধরিয়ে আসছি, সেই দরজার কাছে এসে শ্যামলী আর কার চাপা কথাবার্তার আওয়াজটা আবার কানে এল। কৌতূহলও বটে, আবার শ্যামলীকে চমকে দেবার ছেলেমানুষি তাগিদেও বটে কর্নেলের তোয়াক্কা না করে পর্দাটা ফাঁক করলাম। দেখলাম, শ্যামলীর মুখোমুখি বসে রয়েছেন মিসেস সেন। সেই হিসহিসে ভাঙা কণ্ঠস্বর!
কখন নেমে এসেছেন ভদ্রমহিলা–আমি টয়লেটে ঢোকার পরে। তাহলে কর্নেল বেরিয়ে গেছেন! আমি বেরিয়ে লনে গেলাম। কিন্তু কর্নেলকে খুঁজে পেলাম না। কোথায় গেলেন বৃদ্ধ গোয়েন্দাপ্রবর? আমার গাড়িতে হেলান দিয়ে সিগ্রেট ধরালাম। দাঁড়িয়ে থেকে থেকে পা ধরে গেল। এগারোটা বাজল। কর্নেল বেরোচ্ছেন না। বাড়ির কোন লোকও দেখছি না যে জিগ্যেস করব। তখন ফের ঢুকলাম গিয়ে। প্রথমে সেই ঘরের পর্দাটা তুললাম, মিস শ্যামলী নেই–মিসেস সেনও নেই! তাহলে সবাই ওপরে গেছেন! যাক গে, উইলের একটা ফয়সালা হয়ে যাক।
ওপরে গেলাম। সেই ড্রইংরুমে কর্নেল নেই। কোথায় গেলেন তাহলে? হয়তো অন্য কোন ঘরে–গোপনে বোঝাপড়া হচ্ছে। টানা বারান্দা দিয়ে এগোলাম সেইসময় ফের সেই খাকি পোশাকপরা লোকটাকে দেখা গেল। বললামবুড়ো ভদ্রলোক–মানে যিনি মিসেস সেনের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তিনি কোথায়?
ও বলল–এই তো একটু আগে নিচে গেলেন। চলুন, আমি দেখছি।
সে পা বাড়াল। বললাম-তোমার নাম কী?
আজ্ঞে, জগন্নাথ স্যার।
–হরিয়া নামে আরেকজন আছে, সে কোথায়?
–দেশে গেছে স্যার। গত কালকে। মেদিনীপুর ওর বাড়ি। সেখানে গেছে। পরশু আসবে।
–জগন্নাথ, তুমি তো অ্যাকসিডেন্টের দিন বিলাসপুরে ছিলে!
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে গেল সে। সন্দিগ্ধ স্বরে প্রশ্ন করল–আপনি কি স্যার পুলিশ?
–আরে, না না! আমি এমনি জিগ্যেস করছি। আমি খবরের কাগজের লোক।
–ছিলাম স্যার। আরো সবাই ছিল–হরিয়া, অ্যাটর্নির্বাবু…ডাক্তারবাবু তো এখনও আছেন। ওনাকেও জিগ্যেস করুন। সব বলবেন।
–আচ্ছা জগন্নাথ, সেদিন পিকনিকে নিশ্চয় খুব ধূমধাম হয়েছিল?
আগেরবারের মতো কিছুই নয়।
–তবে ফুলটুল দিয়ে নিশ্চয়, ইয়ে সাজিয়েছিলে তোমরা?
জগন্নাথ ফাঁচ করে হাসল।কী সাজাব স্যার? ও তো বনভোজন। বনজঙ্গুলে জায়গা। ফুল এমনিতেই কত ফুটেছিল চারদিকে। হ্যাঁ–একসময় মালী ছিল, তখন কেতা ছিল। এখন আর যত্ন হয় না। সব জঙ্গল হয়ে গেছে।
–তাহলেও তো আমোদ-প্রমোদের জন্যে যাওয়া। নিশ্চয় তোমরা সবাই জামায় টামায় দু’একটা ফুলটুল গুঁজেছিলে? আঁ?
আমার কৌতুকি ভঙ্গিতে ও হেসে গড়িয়ে পড়ল প্রায়। বলল–আমরা কাক তাড়াব, না মশলা বাটবনা ফুল..কী যে বলেন স্যার! আমরা চাকরবাকর লোক। আমাদের ও সখ থাকতে নেই।
–তোমাদের সায়েবরা নিশ্চয় ফুল গুঁ…
জগন্নাথ পা বাড়িয়ে বলল, নাঃ–ফুল টুল…না তো!
–তোমাদের গিন্নিমা নিশ্চয় গুঁ….
জগন্নাথ ভাঙা দাঁত খুলে হেসে খুন। তারপর চাপা গলায় এবং নিজের মাথা দেখিয়ে বলল-গুজবেন কোথা? মুখ যে পোড়া হনুমান! সে জানেন না বুঝি? আর বলবেন না–যদ্দিন থেকে জুটেছেন, হাড়মাস কালি হয়ে গেল! হরিয়া কি সাধে অ্যাদ্দিন পালিয়েছে? আপনাকে বলার মতো মনে হল–তাই দুঃখের কথা বলছি স্যার। খবরের কাগজে তো আপনারা চাকরদের চোর ডাকাত খুনে বলে। নিন্দে করেন, কিন্তু মনিবের সাইডটা তো দ্যাখেন না!
–কেউ বললে তো লিখব সেকথা! এই তুমি বলছ এবার লিখব।
–লিখবেন স্যার, তবে যদি সরকারের চোখে পড়ে! বুঝলেন স্যার হরিয়া আর আসবে না। আমিও কেটে পড়ছি শিগগির।
–কেন, কেন জগন্নাথ?
বলছি তো। নতুন গিন্নিমা এসে..
নতুন গিন্নিমা মানে?
–হ্যাঁ স্যার। এই তো কমাস হল সায়েব বিয়ে করে বসলেন আবার। বোম্বে গেলেন–ফিরে এলেন একেবারে বউ নিয়ে। বউ না কালসাপ! এসেই খেল ওনাকে!
আমি অবাক হয়ে গেলাম। বললাম সায়েবের আগের স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন নাকি?
-হ্যাঁ। সে তো কবে–আট ন’বছর আগে। অমন মানুষ আর জন্মায় না স্যার। আর এনার কথা বলবেন? দজ্জাল, খটরাগী। সবচেয়ে অবাক লাগে স্যার, সায়েব আর মেয়ে পাননি–ওই মুখপোড়া রাক্ষুসীকে ঘরে নিয়ে এলেন?
বল কী জগন্নাথ! মুখপোড়া অবস্থায় ঘরে নিয়ে এলেন?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। নতুন বৌদি এসে অব্দি দেখি ঘোমটা খোলেন না। পরে শুনি কী অ্যাকসিডেন্ট হয়ে মুখটা গেছে। পেলাস্টিক করিয়েছিলেন
–প্লাস্টিক সার্জারি?
–তাই হবে। কিন্তু তাতেও নাকি কাজ হয়নি।
আমরা সিঁড়ি থেকে নেমে ইতিমধ্যে লাউঞ্জে এসে কথা বলছি। সেইসময় ফুটফুটে সাদা সায়েবচেহারার এক ভদ্রলোককে ওদিকের একটা ঘর থেকে আরেকটা ঘরে ঢুকতে দেখলাম। জগন্নাথ চোখ নাচিয়ে বলল–উনিই গিন্নিমার ভাই–সেই ডাক্তারবাবু। পিকনিকের আগের দিন এসেছেন। থাকেন বোম্বেতে।
হঠাৎ লাফিয়ে উঠল জগন্নাথ।–ওই যাঃ! আমার দেরি হয়ে গেল। আপনি ঐ ঘরে চলে যান স্যার, লাইব্রেরি ঘরে। বুড়ো সায়েব ওখানেই ঢুকেছেন।
জগন্নাথ চলে গেল। ও যে ঘরটা দেখাল, সেই ঘরেই আমি শ্যামলীকে মিসেস সেনের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি। সটান ঢুকে দেখি, কর্নেল আর মিসেস সেন, কোণে একসার আলমারির কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমাকে দেখে কর্নেল ইশারায় কাছে যেতে বললেন।
অজস্র ছোটবড় আলমারি আর বুকসেলফে ভরতি ঘরটা। কোণের দিকে সোফাসেট একটা। কাছে গিয়ে আমার শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। অস্ফুট চিৎকার করে উঠলাম–শ্যামলীর কী হয়েছে কর্নেল?
শ্যামলী মেঝেয় পড়ে রয়েছে। নিথর একেবারে। চোখ দুটো ফেটে বেরিয়ে পড়েছে। জিভটাও বেরিয়ে গেছে। কী বীভৎস দেখাচ্ছে ওকে! সেই সুন্দর শরীর থেকে একটা ভয়ঙ্কর বিকৃত সত্তা আত্মপ্রকাশ করেছে।
কর্নেল বললেন, শি ইজ ডেড। একটু আগে কেউ ওকে গলা টিপে খুন করেছে, জয়ন্ত। কিন্তু বুঝতে পারছিনে–কেন এখানে এল ও?
আমি মিসেস সেনের দিকে আঙুল তুলে বলতে যাচ্ছিলাম যে ওঁকেই একটু আগে এখানে শ্যামলীর সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি কর্নেল যেন চকিতে টের পেয়ে বলে উঠলেন–আমি আর মিসেস সেন বরাবর একসঙ্গে ছিলাম, জয়স্ত। দুজনে একইসঙ্গে এঘরে ঢুকে শ্যামলীর ডেডবডিটা দেখতে পেয়েছি।
মিসেস সেন কাঁপছিলেন। হিসহিস কণ্ঠস্বরে বললেন–কেউ পুলিসে ফোন করছেন না কেন আপনারা? আমি যে বিপদে পড়ে গেলাম। আমারই ঘরে– ওঃ! দু’হাতের তেলোয় মুখ নামালেন উনি। পিঠটা ফুলে ফুলে কাঁপতে থাকল।
কর্নেল বললেন–জয়ন্ত, লালবাজারে আরেক জয়ন্ত রয়েছে। প্রথমে ওকে ডাকো। ওই দ্যাখো, ফোন রয়েছে। শুধু বলো এখানে কর্নেল সরকার এক্ষুনি আসতে বলেছেন।
–যদি উনি না থাকেন?
ময়ূখ ব্যানার্জিকে ডেকে দিতে বলবে।
আমি ফোনের কাছে গেলাম। ফোন করতে করতে লক্ষ্য করলাম, কাছে যে বিশাল পর্দাটা ঝুলছে, তার ওধারে কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার পা দুটো দেখা গেল। পুরুষই। পায়ে হালকা চটি রয়েছে। পাজামা পরা লোক।
ময়ুখবাবুকেই পাওয়া গেল। ফোন করেই পর্দা তুললাম। ডাক্তার অমরেশ। গুপ্ত হকচকিয়ে গেলেন। বললাম–এখানে কী করছেন আপনি?
ভদ্রলোক কাচুমাচু মুখে জবাব দিলেন–কী ব্যাপার ঘটেছে লাইব্রেরির ভেতরে, আঁচ করছিলাম। কিন্তু সাহস হচ্ছিল না–পাছে আবার ডেডবডি দেখতে হয়।
–আপনি তো ডাক্তার। ডেডবডিতে ভয় হবার কথা নয়।
কর্নেল ডাকছিলেন-কার সঙ্গে কথা বলছ জয়ন্ত?
আমি অমরেশের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলাম। ভদ্রলোক গুটিসুটি দিব্যি চলে এলেনবাধা দিলেন না। তারপর আঁতকে উঠে বললেন কী সর্বনাশ!
মিসেস সেন স্প্রিঙের মতো ঘুরে ভাইয়ের বুকে ভেঙে পড়লেন। সে দৃশ্য দেখবার মতো। কর্নেল ঘড়ি দেখছেন আর টাক চুলকোচ্ছেন। আমি থ…।
.
৪. চুল এবং ফুল
সেদিন পুরোটা কী হল, সে বর্ণনা আমি দেব না। পুলিশের এসব ক্ষেত্রে যে রুটিন ওয়ার্কস অর্থাৎ ছকবাঁধা কাজকর্ম থাকে, তা যেমন ক্লান্তিকর আর বৈচিত্র্যহীন, তার বর্ণনাও তেমনি বিরক্তিকর হবে। হত্যাকারীর হাতে দস্তানা ছিল নিশ্চয়। কোথাও আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি। কোন সূত্র না–কোন নতুন তথ্যও না। অবশেষে পুলিশ যথারীতি শ্যামলীকে খুনের সন্দেহে মিসেস সেন আর অমরেশকে গ্রেপ্তার করেছিল।
আমি একটা মারাত্মক সাক্ষী হতে পারতাম কারণ শ্যামলীর সঙ্গে মিসেস সেনকে কথা বলতে দেখেছি ওই জায়গাতেই, তখন কর্নেল ওখানে উপস্থিত ছিলেন না।
অথচ কর্নেল বলছেন–তিনি আর মিসেস সেন আগাগোড়া একসঙ্গে আছেন। কথা বলছেন। তারপর একসঙ্গে নিচে নেমে এসেছেন। লাইব্রেরিতে ঢুকেছেন মিঃ সেনের কিছু কাগজপত্র পরীক্ষা করতে।
তাহলে হয় আমি ভুল দেখেছি, নয় কর্নেল মিথ্যা বলছেন। অথচ দুজনেই জোরের সঙ্গে নিজের নিজের বর্ণনা দিচ্ছে। অগত্যা পুলিশ দুজনেরই সাক্ষ্য থেকে ও প্রসঙ্গটা আপাতত বাদ রেখেছে। মাঝখান থেকে আমি রেগেমেগে কর্নেলের বার্ধক্যজনিত মতিভ্রম ও বুদ্ধিভ্রংশের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে মন খারাপ করে বসলাম। এমন কি একা গাড়ি নিয়ে চলে এলাম। কর্নেলের মুখটা গম্ভীর দেখেছিলাম। একটি কথাও বিতর্কের ছলে বলেননি। পুলিশের গাড়িতে উনি বাসায় ফিরলেন।
রাতে আর ঘুম হল না। কর্নেলের কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে আসব ঠিক করলাম। রাত তখন প্রায় বারোটা, হঠাৎ ফোন বাজল। ভাবলাম, থাকগে, নির্ঘাৎ আমার কাগজের অফিস ডাকছে।
কানে রাখতেই কর্নেলের সস্নেহ কণ্ঠস্বর শুনলাম–ডার্লিং জয়ন্ত, আশা করি। তোমার ঘুম হচ্ছে না। শোন, তাই বলে ওষুধ খেয়ে বসো না। ড্রাগ হ্যাবিট মানুষের সর্বনাশ করে। দেখছ তো, আমি কেমন ওষুধ না খেয়েই চালিয়ে দিচ্ছি! ঘুম না এলে ভালো করে ঘাড় আর হাতের কনুই অব্দি ধুয়ে ফেলো। আর ইয়ে শোন ডার্লিং, ইউ আর রাইট। তুমি লাইব্রেরি রুমে খুনীকেই দেখেছিলে। কিন্তু সে মিসেস সেনের ছদ্মবেশে বসেছিল। মুখটা কালো শাড়ির আঁচলে ঘোমটা দিয়ে ঢাকা–অবিকল যেমন মিসেস সেন ঢেকে রাখেন। ব্যাপারটা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত শ্যামলীর ফ্ল্যাটে যে ঝি মেয়েটি থাকে–সে বলেছে, একটা ফোন এসেছিল বাইরে থেকে। ফোন পেয়েই চলে যায় শ্যামলী। ওকে বলে যায়–মিঃ সেনের নিউ আলিপুরের বাড়ি থেকে কর্নেল সরকার ওকে এক্ষুনি যেতে বলেছেন। বুদ্ধিমতী মেয়ে বুদ্ধি করে বলেও গিয়েছিল। কিন্তু জয়ন্ত, আগে বলেছিলুম তোমাকেও বোকাও তত
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বললাম, কর্নেল, কর্নেল! আপনি ঠিক বলেছেন। আমি তাহলে ছদ্মবেশী খুনীকেই দেখেছিলাম। ইস্! যদি আর একটু বুদ্ধি করে ওখানটায়–
–যা হবার হয়ে গেছে। তবে আমি এদিকটা এত গুরুত্ব দিয়ে ভাবিনি! শ্যামলীকে কেউ সত্যি মেরে ফেলবে–আঁচ করতে পারিনি। কারণ নিছক প্রতিহিংসা ছাড়া ওকে মেরে তো কেউ লাভবান হচ্ছে না। প্রতিহিংসার একমাত্র জায়গা মিসেস সেন। অথচ ওঁর অ্যালিবাই অর্থাৎ অজুহাত ভীষণ শক্ত। কারণ আমি বরাবর সঙ্গে ছিলাম।
কর্নেল, আপনি জানেন, ভদ্রমহিলা আপনাকে একটা প্রচণ্ড মিথ্যা বলেছেন। উনি আগের কোন পিকনিকে বিলাসপুরে মোটেও যাননি। কারণ উনি তখন মিঃ সেনের স্ত্রীই ছিলেন না। মাত্র ক’মাস আগে বোম্বে থেকে ওঁকে মিঃ সেন বিয়ে। করে এনেছেন।…জগন্নাথের কাছে শোনা ঘটনাটা বললাম কর্নেলকে।
কর্নেল বললেন–মাই গুডনেস্!
তাছাড়া ওঁর ভাই না কে ওই অমরেশ ডাক্তার এই প্রথম ও বাড়ি আসে পিকনিকের ঠিক আগের দিন।
–ও মাই!
–স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, পুলিশ ভুল করেনি। ওই ভাইটাই কালোশাড়ি পরে খুন করেছে শ্যামলীকে। চেহারাটা বা কণ্ঠস্বর কেমন মেয়েলি নয় ওর?
কর্নেলের সাড়া না পেয়ে বললাম কী হল কর্নেল?
–কিছু না। বলে যাও!
–আরে শুনুন, মিসেস সেন তখন আপনার সামনে যা বলেছিলেন–মানে পিকনিকের ব্যাপারটা মনে হল, মিঃ সেন কাক তাড়াতে দৌড়ে যাননি। ওটা আকস্মিক যোগাযোগ। আমার ধারণা, তাড়া খেয়ে কাকগুলো যখন পালিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তেই উনি কোন কারণে কাকেও দেখে…
কী বললে, কী বললে?
–হ্যাঁ। হয়তো এমন কাকেও নদীর ধারের ভাঙা পাঁচিলের দিকে দেখতে পান কাকগুলো তখনই উড়ে যাচ্ছল। তাকে গুলি করে মারতে তাড়া করেছিলেন।
বলে যাও, ডার্লিং!
তারপরে তার সঙ্গে ওঁর ধ্বস্তাধ্বস্তি হয়। এবং সেই লোকটা বন্দুক কেড়ে নিয়ে বুদ্ধি করে ওঁকে গলার নীচে নল রেখে গুলি করে, যাতে আত্মহত্যা বলে চালানো যায় নয়তো দৈবাৎ গুলি ছুটে যায় কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে।
–তোমার উন্নতি হবে জয়ন্ত। গুলিটা অ্যাকসিডেন্টাল হলে বাঁদিকের কণ্ঠ তালু ফুঁড়ে বেরোনোর চান্স ছিল। লেগেছে ডানদিকে। দিস ইজ অড। তাছাড়া জয়ন্ত, বন্দুকের ট্রিগারে যে আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে, তা ওর বাঁ আঙুলের। আজ লালবাজারে ফরেনসিক এক্সপার্টরা ফের রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। কাজেই খুনই হয়েছেন মিঃ সেন। কুঁদোতে ডানহাতের আঙুলের ছাপ কেন থাকবে? মিঃ সেন লেফটহ্যান্ডেড ছিলেন না। ওঁর দুটো হাত স্বাভাবিকভাবে কাজ করত জানা গেছে। কাজেই খুনী বন্দুকটা তাড়াতাড়ি ওইভাবে রেখেছিল। সবচেয়ে লক্ষ্য করার বিষয়বন্দুক ওসব ক্ষেত্রে হাতে থাকবে কেন? ছিটকে পড়বে পাশে। হাতপায়ের খিচুনি হবে মৃত্যুর সময়। তাই না?
–অবশ্যই। কিন্তু ফুলের ব্যাপারে কোন সূত্র পেলেন? আমি জগন্নাথকে জিগ্যেস করেছিলাম। ও বলছিল, কেউ ফুলটুল গোঁজেনিনা চুলে, না বাটন হোলে। কর্নেল, ফুলটা কিন্তু আমার দেখাই হয়নি! কী ফুল?
লাল গোলাপ। আজ বিকেলে লালবাজার থেকে একজন নার্সারি বিশেষজ্ঞকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। তিনি পরীক্ষা করে বললেন, এই গোলাপগুলোর নাম প্রিন্স অ্যালবার্ট। এখন, মজার কথা–মিঃ সেনের নিউ আলিপুরের বাড়িতে এই ফুলের গাছ রয়েছে।
-তাই নাকি? কর্নেল, ফুলের বোঁটায় চুল জড়ানো আছে বলেছিল শ্যামলী।
–একগোছা চুল। একটু লালচে রঙের। ইঞ্চি চার লম্বা।
কর্নেল, কর্নেল! অমরেশের মাথার চুল লালচে দেখেছি। নির্ঘাৎ
–এখন সব ফরেনসিক এক্সপার্টদের কাছে গেছে। কাল ওঁদের মতামত জানতে পারব। তুমি সকাল সাতটার মধ্যে চলে এস। আমরা বিলাসপুর যাবো…
ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়েছিলাম সাড়ে ছ’টার। ঘুম ভাঙলো তার আওয়াজে কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠতে সাতটাই বেজে গেল।
কর্নেলের বাসায় পৌঁছলাম সাড়ে সাতটায়। গিয়ে দেখি, কর্নেল তৈরি। দক্ষিণের সেই জানালায় ঝুঁকে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে। ঢুকে বললাম দুঃখিত। দেরি করে ফেললাম।
কর্নেল মুখ না ঘুরিয়ে বললেন–একটা মজার কাণ্ড দেখে যাও, জয়ন্ত।
কাছে গিয়ে উঁকি দিলাম। নিচে খানিকটা পোতড়া জায়গা রয়েছে। জানলা থেকে বড়জোর চার মিটার তফাতে একটা জামরুল গাছ–তার মাথার শেষ উঁচু পাতাটি এই জানলার নিচের চৌকাঠের সমান্তরালে। বললাম–কী?
কাকের বাসা। ঐ দ্যাখো!
হা–ঠিক মাঝখানে ঝকড়া ডালপালা ও পাতার মধ্যে একটা কাকের বাসা রয়েছে। সেখানে বসে ডিমে তা দিচ্ছে একটা কাক। কর্নেল একটু হেসে বললেন–এবার ঐ শিমূল গাছটার দিকে তাকাও। ওই দ্যাখো একটা কোকিল কেমন ঘাপটি পেতে বসে রয়েছে। কদিন আগে দেখলাম, ওই কোকিল আর তার সঙ্গীটা কোত্থেকে এসে শিমূলডালে বসল। সঙ্গীটা পুরুষ-কোকিল। সে করল কী, আচমকা এসে কাকটাকে জ্বালাতন শুরু করল। কাকটা অগত্যা ডিম ছেড়ে ওকে তাড়া করল। উদ্দেশ্যটা তখনও বুঝিনি। প্রায় সকাল থেকে দুপুর অব্দি ওইভাবে ওকে ক্রমাগত জ্বালাতন করছিল কোকিলটা। অবশেষে দেখি কাকটা এবার ওকে তাড়িয়ে দূরে নিয়ে গেল। সেইসঙ্গে আরও অনেক কাক যোগ দিল দলে। ওরা ওই দূরের বাড়িটার দিকে চলে গেল। স্ত্রী-কোকিলটা অমনি এসে কাকের বাসায় বসে পড়ল ডিমগুলোর ওপর। ঠুকরে ফেলে দেবার চেষ্টাও করল। একটা পড়ে গেল। কিছুক্ষণ পরেই সে উড়ে পালাল। ডিমগুলো এখান থেকে গোনা যায় না। যাই হোক, কোকিলটা যে কাকের বাসায় ডিম পেড়ে গেল, তাতে কোন ভুল নেই।
–কাকটা ফিরল না আর?
–অনেক পরে ফিরে এল চাঁচাতে চাঁচাতে। আবার তা দিতে থাকল। ওই দ্যাখ, কেমন চুপচাপ বসে প্রকৃতির নিয়ম পালন করছে। এরপর একদা আমরা কাকের বাচ্চার দলে দুটি-একটি কোকিল বাচ্চা নিশ্চয় দেখব। ভারি অদ্ভুত ব্যাপার চলে প্রকৃতিজগতে!
–কোকিল যে বাসা বানাতে জানে না। ওরা ছন্নছাড়া হাঘরে পাখি! শুধু গানটান আমোদ স্ফুর্তি করেই জীবন কাটাতে চায়।…বলে আমি হেসে উঠলাম।
রাইট, রাইট। গানটান আমোদ স্ফুর্তি! ঠিকই বলেছ, জয়ন্ত, কিন্নরজাত।
কর্নেল কিন্তু হাসলেন না! গম্ভীর হয়েই বললেন কথাটা! তারপর আমার হাত ধরে বেরোলেন। ষষ্ঠীচরণকে বিদায় সম্ভাষণ করে আসতে ভুললেন না।
গাড়ি স্টার্ট দিলাম। পার্ক স্ট্রিটে ঢোকার পর কর্নেল মুখ খুললেন ইয়ে জয়ন্ত, আমরা আপাতত টালিগঞ্জে যাচ্ছি।
-কেন? বিসালপুর কী হল?
–আগে টালিগঞ্জে যাই তো! আটর্নি মজুমদারের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
মিঃ সুশান্ত মজুমদারের বাড়িটি অত্যাধুনিক ধাঁচের। বাগুবাগিচা, সবুজ লন, টেনিসকোর্ট রয়েছে। কিন্তু বাড়িটা ছোট। একতলা। নানারঙের স্ট্রিমলাইন দেয়াল থাকায় মনে হয় ভীষণ গতিশীল।
সুশান্তবাবু বিপত্নীক মানুষ। হাসিখুশি সৌমকান্তি। মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। কিন্তু ব্যক্তিত্ব আছে চালচলনে বিশেষ করে ঠোঁটের কোনা আর চিবুকে দৃঢ়সংকল্প মানুষের পরিচয় রয়েছে। আমাদের পরিচয় পেয়ে অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেলেন বসার ঘরে। বললেন–আজ একটু সকাল-সকাল অফিসে যাব ভেবেছিলাম। যাকগে, সেজন্যে আমার অনারেবল গেস্টদের উদ্বেগের কারণ নেই। অন্তত আধঘণ্টা সময় যথেষ্ট হবে, আশাকরি।
বুঝলাম, ভদ্রলোক খুব নিয়মনিষ্ঠ এবং কেজো মানুষ। সময়ের অপব্যবহার করেন না মোটেও।
কর্নেল বললেন–আপনার ফার্ম তো চার্চ লেনে, মিঃ মজুমদার?
-হ্যাঁ। বোস অ্যান্ড মজুমদার। পৈতৃক বলতে পারেন।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনার বাবা মিঃ রথীন্দ্র মজুমদারের খ্যাতির কথা আজও কেউ ভোলেনি। কলকাতার সবেচেয়ে বিজ্ঞ সলিসিটার বলতে…..
সুশান্তাবু হেসে বললেন–সে দিন চলে গেছে, কর্নেল সরকার। বাই দা বাই, আপনি শুনলাম মিসেস সেনের পক্ষে মিঃ সেনের রেজিস্টার্ড উইলটা চ্যালেঞ্জ করতে চান! দেখুন কর্নেল সরকার, আমরা–মানে মেসার্স বোস অ্যান্ড মজুমদার দীর্ঘ একুশ বছর ধরে মিঃ সেনের উন্নতির গোড়া থেকেই ওঁর কাজকর্ম করে আসছি। মিঃ বোস অবশ্য নেপথ্যে থাকেন বরাবর–আমি মিঃ সেনের আইন সংক্রান্ত উপদেষ্টা। অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে যে উইল সম্পাদিত এবং যথারীতি রেজিস্ট্রি করা হয়েছে–তা ওল্টানো শুধু অসম্ভব নয়, অবাস্তব, এবং হাস্যকর চেষ্টা। দেয়ার আর সাম লজ ইন আওয়ার কানট্রি।
কর্নেল হাত তুলে বললেন–যথেষ্ট, যথেষ্ট মিঃ মজুমদার! আমি একজন নগণ্য প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার মাত্র। শুধু কিছু জিজ্ঞাস্য নিয়ে এসেছি। জবাব পেলেই খুশি।
–বেশ, বলুন কী জানতে চান?
–মিঃ সেনের উইলের তারিখটা জানতে চাই।
একুশে ফেব্রুয়ারি–দিস ইয়ার।
–মিঃ মজুমদার, ইতিমধ্যে হিতেনবাবু আপনাকে এই উইল পরিবর্তন করে কোন নতুন উইলের কথা কি বলেননি?
–অ্যাবসার্ড! হাউ ডু ইউ ইমাজিন দ্যাট? কেন ভাবছেন ও কথা?
কর্নেল না দমে বললেন–এ কি সত্য যে দোলপূর্ণিমার পিকনিকের অনুষ্ঠানে হিতেনবাবু তার নতুন উইলের কথা ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন?
সুশান্তবাবুর মুখ রাঙা হয়ে গেল। চোখদুটো তীব্রতর হল। বললেন– ননসেন্স! এমন প্রশ্ন আজগুবি শুধু নয়, আমার সুনাম–আমার ফার্মের সুনামের পক্ষে ক্ষতিকর।
কর্নেল গ্রাহ্য করলেন না। বললেন–সেই নতুন উইল যথারীতি সম্পাদন করা হয়েছিল, হিতেনবাবু সইও করেছিলেন এবং পরদিন রেজিস্ট্রি করা হত। কলকাতা ফিরেই। আপনি কী বলেন?
সুশান্তবাবুর মুখটায় যেন আগুন জ্বলছে। কিন্তু কিছু বললেন না।
এই নতুন উইলের সাক্ষী হিসাবে সই করেছিলেন ওঁর শ্যালক ডাক্তার অমরেশ গুপ্ত, সোফার সুরেন্দ্র ঘটক এবং হিতেনবাবুর পারিবারিক চিকিৎসক ডাক্তার সত্যেন সিংহরায় এবং আপনি। কী বলেন মিঃ মজুমদার?
সুশান্তবাবু হো হো করে আচমকা হেসে উঠলেন।–মাথা খারাপ। মাথা খারাপ!
–এই নতুন উইলে মিস শ্যামলীকে মাত্র নগদ দশহাজার টাকা, স্ত্রী স্বাগতা সেনের নামে মোট সম্পত্তির অর্ধেক, এবং কয়েকজন দুঃস্থ আত্মীয়স্বজনের নামে…
সুশান্তবাবু পলকে মুখ বিকৃত করে বললেন–আমার সময়ের দাম আছে। মশাই। লেট ইট বি ফিনিশড হেয়ার।
উনি উঠে দাঁড়ালেন। কর্নেলের ওঠার চেষ্টা দেখলাম না। আমার ব্যাপারটা খুব অপমানজনক মনে হচ্ছিল। কর্নেলের দিকে তাকালাম। কর্নেলের দৃষ্টি সুশান্তবাবুর মুখের দিকে। বললেন–গতকাল সকাল দশটা নাগাদ আপনি মিঃ সেনের নিউআলিপুরের বাড়ি গিয়েছিলেন। তখন আমরা মিসেস সেনের সঙ্গে ওপরের ঘরে কথা বলছিলাম। কেন গিয়েছিলেন সুশান্তবাবু। কার কাছে?
-কে বলেছে আপনাকে?
জগন্নাথ। আমি ও মিসেস সেন কথা বলছিলাম, জয়ন্ত উঠে বাইরে গেল–তারপর জগন্নাথ মিসেস সেনকে গিয়ে বলল, আপনাকে নিচের লাইব্রেরি ঘরে বসে থাকতে দেখেছে। তাই একটু পরেই আমি ও শ্রীমতী সেন নিচে লাইব্রেরিতে গেলাম। গিয়ে আবিষ্কার করলাম শ্যামলীকে। ইতিমধ্যে আপনি সম্ভবত বাড়ির পেছনে ঘুরে চলে গেছেন। সামনে দিয়ে বেরোলে জয়ন্ত দেখতে পেত।
–গেট-আউট! গেট-আউট ইউ ওল্ড ফুল! গর্জন করে উঠলেন সুশান্তবাবু! থরথর করে রাগে কাঁপছেন ভদ্রলোক।
এবার কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। পা বাড়াতে গিয়ে ঘুরে বললেন ফিল্ম অভিনেতা পার্থকুমার ২১শে ফেব্রুয়ারি উইল রেজিস্ট্রির পরদিন ২২শে তারিখে শ্যামলীকে বিয়ে করবে বলে হোটেলে পার্টি হয়। হোটেলের এই পার্টির সব খরচ আপনার নামে বিল করা হয়েছিল। তার মানে আপনিই এর উদ্যোক্তা ছিলেন। মিঃ মজুমদার, পার্থ আপনার কে?
–গেট-আউট, কোন কথার জবাব আমি দেব না।
ক্যাবারে গার্ল মিস শ্যামলীকে হিতেনবাবুর প্রথম স্ত্রীর হারিয়ে যাওয়া মেয়ে বলে আপনি হিতেনবাবুকে কনভিনসড করেছিলেন। দিনের পর দিন সুপরিকল্পিত পথে ওঁর বিশ্বাস আপনি এনেছিলেন শ্যামলীর প্রতি। এমন কি হিতেনবাবুর পোর্ট্রেট আঁকিয়ে শ্যামলীর ঘরে রাখতে বলেছিলেন এবং শ্যামলী নামে হতভাগিনী পিতৃমাতৃ পরিচয়হীনা ক্যাবারে গার্লটিকে যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। সে তা টের পায়নি। কিন্তু সুটিঙে গিয়ে পিকনিকের পরদিন সে ফুলটা কুড়িয়ে পেল, পরিচালক অতীন্দ্রবাবুর কাছ থেকে পার্থকুমার তা জানল এবং আপনাকে জানাল। অমনি আপনি শ্যামলী সম্পর্কে সতর্ক হয়ে উঠলেন। বিশেষ করে শ্যামলী যখন আপনার ব্রাউন রঙের কোটের বাটনহোলে একই প্রিন্স অ্যালবার্ট গোলাপ দেখে মারাত্মক প্রশ্ন করে বসল–দ্যাট ওয়াজ ইন দা ইভনিং অফ টোয়েনটি ফিফথ শ্যামলী তারপরই আমার কাছে যায়–মিঃ মজুমদার, আপনি দেখলেন শ্যামলী আপনাকে চিনে ফেলেছে। এবং সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার–সে পার্থকে ফোনে জানিয়ে দিল যে এ বিয়ে হবে না। শ্যামলী ক্যাবারে গার্ল হলেও সে অর্থলোভী হৃদয়হীনা ছিল না। আমি তাই তাকে বারবার কোমল হৃদয়া বলেছি। মিসেস সেনের বাড়িতে আপনি আমার নাম গোপন করে ডেকে পাঠান ওকে। শ্যামলী তক্ষুনি চলে যায়। কেন যায় শ্যামলী? শুধু আমি ডাকছি বলে নয়–সে মিসেস সেনকে তার ন্যায্য সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে চায় না, উইলে যাই থাক্-একথা বলতেই যায়। শ্যামলী ছিল ভীষণ ভাবপ্রবণ মেয়ে। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য, গিয়ে আপনার ফাঁদে পড়ে যায়। আপনি মিসেস সেনের ছদ্মবেশে লাইব্রেরিতে অপেক্ষা করছিলেন ওঁর জন্যে।
–মিথ্যা! সব জঘন্য মিথ্যা! আমি একজন লইয়ার! আমি আপনার বিরুদ্ধে মামলা করব!
পর্দার আড়াল থেকে ডাক্তার অমরেশ আপনাকে খুন করার পর পালাতে দেখেছেন, সুশান্তবাবু। আপনি গরাদবিহীন ফ্রেঞ্চ জানলা গলিয়ে চলে গেলেন। আপনার হাতে কালো শাড়িটা ছিল। আপনি বাথরুম থেকে পোশাক বদলেই লাইব্রেরিতে ঢোকেন। কিন্তু আপনার দুর্ভাগ্য, তাড়াতাড়িতে আপনার ব্রাউন কোটটা পরার সময় পাননি। আলমারির পিছনে ফেলে রেখেছিলেন। পরে মানে, এখনই বেরোতে চাচ্ছিলেন কোটটা এক সুযোগে নিয়ে আসতে। কারণ গতকাল পুলিশ ছিল বাড়িটাতে–আজ নেই। এবং আজই ভোরে ঝাড়ু দিতে গিয়ে জগন্নাথ কোটটা আবিষ্কার করেছে। সুশান্তবাবু, বিলাসপুরে মিঃ সেনের ডেডবডির কাছে পড়ে থাকা ফুলে আপনার কোটের একটা ফাইবার জড়িয়ে রয়েছে–ওটা চুল নয়, আঁশ।
সুশান্তবাবুর মুখ সাদা হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। দুহাতে একটা চেয়ারের পিছনদিক ধরে ঝুঁকে পড়েছিলেন। হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন–কিন্তু বাট ইউ আর রং। পিকনিকের দিন সন্ধ্যায় আমি মিসেস সেনের আর অমরেশ ডাক্তারের সঙ্গে সারাক্ষণ গল্প করেছি।
–মোটেও না স্যার। ওঁদের কাছে ছিলেন যিনি–তিনি ফিল্ম অভিনেতা পার্থকুমার। সে সবার শেষে জুটেছিল একা–তখন আপনি মিঃ সেনের সঙ্গে বাড়ির মধ্যে মোকাবিলা করছেন। আপনার নাম মিসেস সেন জানতেন। সোফার চাকর রাঁধুনীরা সবাই জানত–অমরেশও এসে শুনেছিল, কিন্তু কারো সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় আপনার হয়নি। আপনি হিতেনবাবুর বাড়ি কখনও যাননি। কাজ যা কিছু হয়েছে-সব অফিস থেকেই। কাজেই সবার শেষে এমন সময় পার্থকুমার বটতলায় তাঁবুর কাছে হাজির হয়ে নিজের পরিচয় দিল–যখন মিঃ সেন কুঠিবাড়িতে কী কাজে রয়েছেন। তারপর
সুশান্তবাবু এবার দৌড়ে আলমারির কাছে গেলেন। চাবি বের করে গর্তে ঢুকিয়েছেন কর্নেল আচমকা রিভলবার বের করে বললেন–ও চেষ্টা করবেন না মিঃ মজুমদার।
পরক্ষণে হুড়মুড় করে বাইরে থেকে তিনজন পুলিশ অফিসার এসে ঢুকে পড়লেন। সবাই সশস্ত্র। চারটে রিভলবারের সামনে সুশান্তবাবু কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন।……
.
কর্নেল আমাদের কাছে তাঁর ড্রয়িং রুমে বসে ঘটনার বিবরণ দিচ্ছিলেন– হিতেন সেনের স্ত্রীর মৃত্যুর অনেকবছর পরে ঘটনাচক্রে এয়ারহোস্টেস স্বাগতার সঙ্গে পরিচয় এবং প্রেম হয়। বিয়ের সিদ্ধান্তে আসতে বহুদিন লেগে যায়। এদিকে হিতেনবাবুর একমাত্র মেয়ে তিনবছর বয়সে হারিয়ে গিয়েছিল। আর ছেলেপুলে হয়নি প্রথমা স্ত্রীর। অনেক চেষ্টাতেও হারানো মেয়ের সন্ধান পাননি। যাই হোক, স্বাগতার প্রসঙ্গে আসি এবার। স্বাগতার সঙ্গে বিয়ে রেজেস্ট্রি অবশেষে হল। গত সেপ্টেম্বর মাসের দশ তারিখে–বোম্বেতে। হিতেনবাবু একা কলকাতা ফিরলেন। স্বাগতার চাকরির ব্যাপারে তক্ষুনি ছেড়ে দেওয়ার কিছু বাধা ছিল। ইতিমধ্যে হঠাৎ বিমান দুর্ঘটনায় স্বাগতার মুখের একটা দিক পুড়ে বিকৃত হয়ে যায়। হৃদয়বান মানুষ হিতেন সেন বোম্বে গিয়ে অনেক খরচা করেও প্ল্যাস্টিক সার্জারিতে কাজ হল না। অ্যালার্জি শুরু হল। অগত্যা ফের অপারেশান করে বিকৃত মুখ নিয়েই দাম্পত্যজীবন যাপনের উদ্দেশ্যে স্বাগতাকে চলে আসতে হল গত নভেম্বরে স্বামীর সঙ্গে। মুখটা সবসময় ঢেকে রাখতে অভ্যাস করলেন ভদ্রমহিলা!
কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর ফের বলতে শুরু করলেন–অত খুঁটি নাটি না বললেও চলবে। সবটা তো তোমরা অনুমান করতে পারছ। মুখ পোড়ার পর থেকে স্বাগতার একটা গুরুতর মানসিক প্রতিক্রিয়াজনিত ভাব প্রকাশ হতে থাকে। সে দজ্জাল হয়ে ওঠে। কথায় কথায় স্বামীকে লাঞ্ছিত করে। হিতেনবাবু ক্রমশ তার ব্যবহারে চটে গেলেন। বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। ইতিমধ্যে সুশান্ত মজুমদার বোকা সরল মেয়ে শ্যামলীকে হাত করে টোপ ফেলে আসছিলেন। ২১ তারিখে উইল রেজেস্ট্রি হল। স্ত্রীকে যখন ডিভোর্সই করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন–তখন বেশি কী আর দেবেন হিতেনবাবু! নেহাত হৃদয়বান মানুষ বলে কিছু দিলেন উইলে। এ মাসের অর্থাৎ মার্চের মাঝামাঝি যে ভাবে হোক–আমি জানি না, জানতেও আর পারব না–হিতেনবাবু সুশান্ত মজুমদারের চক্রান্ত টের পেয়ে যান। হয়তো শ্যামলীই বেস কিছু বলে থাকবে–যাতে সুশান্তবাবুর সঙ্গে তার গোপন যোগাযোগ ইত্যাদি প্রকাশ হয়ে পড়ে হিতেনবাবুর কাছে। কিন্তু নতুন উইলে শ্যামলীকে বঞ্চনা করতে চাননি। কারণ হারানো মেয়ের জন্য স্নেহ ততদিনে শ্যামলীতে কিছু ঘন হয়ে উঠেছিল অভ্যাসের ফলে। যাই হোক, তিনি ঠিক করলেন পিকনিকের দিন শ্যামলীও উপস্থিত থাকবে এবং নতুন উইল পড়ে শোনানো হবে।
আমি এসময় বলে উঠলাম কর্নেল, ২১ ফেব্রুয়ারি উইল রেজেস্ট্রির পর দিনই শ্যামলীর সঙ্গে পার্থের বিয়ের পার্টি হয়েছিল। তা হলে দেখছি
রাইট। পার্থ হচ্ছে সুশান্ত মজুমদারেরই ছেলে। বাবার সঙ্গে থাকে না। একটু উজ্জ্বল প্রকৃতিরও বৃটে। কিন্তু তা হলেও ছেলে তো বটে! সুশান্তবাবু ওকে বলেছিলেন–শ্যামলী সম্পত্তি পাচ্ছেতার সঙ্গে প্রেম ও বিয়ে পার্থর পক্ষে মঙ্গল। নিজেই ছবি করতে পারবে। পার্থ রাজি হয়–সিনেমাই তার জীবন। এবার আমরা বিলাসপুরের কুঠিবাড়িতে যাই। মিসেস সেন, মিঃ সেন ও অমরেশ এক গাড়িতে, অন্য গাড়িতে জিনিসপত্র, জগন্নাথ, হরিয়া, ঘনশ্যাম এবং ড্রাইভার সুরেন্দ্র। মিঃ সেন চলে গেলেন ওঁর কাছে। তাবুর কাছে মিসেস সেন আর অমরেশ এবং সুরেন্দ্ররা থাকল। মিঃ সেন ও মজুমদার ঢুকলেন কুঠিবাড়িতে। একটু পরেই পার্থ বাবার মতো ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি পরে চলে এল তাঁবুর কাছে সে এতক্ষণ সুযোগের অপেক্ষা করছিল কুঠিবাড়ির পিছনে সম্ভবত গাছপালার আড়ালে। সে নিজের পরিচয় দিল মিঃ সুশান্ত মজুমদার বলে। গল্পে গল্পে জমিয়ে তুলল। ওদিকে কুঠিবাড়ির ঘরে নাটক চলছে তখন। নাটকটা ঠিক কী রকম বলা কঠিন। তবে লেটেস্ট তদন্ত থেকে আমার ধারণাই প্রমাণিত হয়। সুশান্তবাবু মিঃ সেনকে আচমকা রিভলবার বের করে গুলি করতে যাচ্ছিলেন– কিংবা অন্য কোনভাবে আক্রমণ করেছিলেন, মিঃ সেন আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হন তখনকার মতো। ওঁর রাইফেলটা ঘরেই কোথাও রেখেছিলেন–বের করে আনতে আনতে নিশ্চয় সুশান্তবাবু তখন ভোঁ দৌড়। নদীর ধারে ভাঙা পাঁচিল ডিঙিয়েই পালালেন। মিঃ সেন রাইফেল হাতে বেরোলেন। ঠিক সেইসময় কাকগুলো তাড়া খেয়ে উড়ে যাচ্ছে। ধূর্ত পার্থ সুযোগটা নিল। জগন্নাথ বলেছে–সে ওই সময় বলে ওঠে, কী কাণ্ড! মিঃ সেন কাকের ওপর রেগে গেলেন দেখছি! কাক মারতে দৌড়চ্ছেন! সবাই এই বাক্যে ধারণা দাঁড় করায়হা, মিঃ সেন কাক তাড়া করে যাচ্ছেন। পার্থ নিশ্চয় উদ্বিগ্ন হয়েছিল। যাই হোক, ওদিকে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছেন প্রাণভয়ে ভীত সুশান্তবাবু। আর সেই ঝোপের সামনে দাঁড়িয়ে বুলেট-ভরা রাইফেল হাতে এদিক-ওদিক তাকে খুঁজছেন হিতেন সেন। সুশান্তবাবুর নার্ভ শক্ত। সুযোগটা নিলেন। আচমকা বাঘের মতো লাফিয়ে পড়লেন। ধস্তাধস্তি হল। তারপর যেভাবেই হোক গুলি, বিধল মিঃ সেনের ডানদিকে গলায় কণ্ঠতালু ভেদ করে বুলেট মগজে বিঁধে হাড়ে আটকে গেল। ওখানে সবাই ভাবলেন–মিঃ সেন কাককে গুলি করলেন। অনেক পরে উদ্বিগ্ন পার্থ সুরেন্দ্রকে নিয়ে খুঁজতে বেরোল। সে আশা করেছিল– বাবার মৃতদেহ দেখবে। কিন্তু দেখল হিতেন সেনের মৃতদেহ।…..
কর্নেল চুরুট ধরালেন। ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে কফি নিয়ে এল আরেক দফা।
বললাম–ওই ফুলটাই অবশ্য শ্যামলী আর সুশান্ত মজুমদারের কাল হল।
ডিটেকটিভ অফিসার সত্যেন্দ্রবাবু বললেন জানেন? আগাগোড়া কাকের ব্যাপারটায় একমাত্র আমারই কিন্তু সন্দেহ থেকে যাচ্ছিল।
কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। কাকচরিত্র নামে প্রাচীন শাস্ত্র পড়েছি কাক যদি ডাকতে ডাকতে কারো মাথার উপর দিয়ে বায়ুকোণ থেকে অগ্নিকোণে যায়, তাহলে তার মৃত্যু অনিবার্য। মিঃ সেনের মাথার ওপর ঠিক এই দিকেই কাকগুলো যাচ্ছিল।
আমি বললাম–তাহলেও কাক সবচেয়ে বোকা পাখি। কোকিলের বাচ্চাকে নিজের ভেবে লালনপালন করে। অথচ কোকিল ইজ কোকিল।
কর্নেল হেসে বললেন–তুমি শ্যামলীর কথা বলছ! দ্যাটস রাইট, ডার্লিং। অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট, উইল ইজ উইল–এবং অবশ্যই কোকিল ইজ কোকিল। ঘরবাঁধা তার ভাগ্যে লেখেননি প্রকৃতি। বেচারা শ্যামলী!….
একসঙ্গে কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল।
Leave a Reply