দানিয়েলকুঠির হত্যারহস্য – কর্নেল সমগ্র ২ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
বিজনের বিবৃতি
আনন্দ একদিন এসে বলল–আচ্ছা বল্ তো, প্রেমে পড়লে তবে লোকে গাড়োল হয়, নাকি শুধু গাড়োলরাই প্রেম করে?
অবাক হয়ে বললুম–হঠাৎ এ কথা কেন রে?
সে হতাশভাবে মাথা নাড়ল। তারপর বলল–আমার বসকে খুব বুদ্ধিমান মনে করতুম। ইন দা সেন্স বুদ্ধিমান ছাড়া কেউ পয়সা কামাতে পারে না এ যুগে। কিন্তু আশ্চর্য, কিছুদিন থেকে লোকটার ব্যাপার-স্যাপার দেখে আমার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যাচ্ছে।
বাধা দিয়ে বললুম-প্রেমে পড়েছেন বুঝি ভদ্রলোক?
–প্রেম মানে কী! প্রেমেরও বাবা-মা থাকলে তাদের পাল্লায় পড়েছে। বাপস!
আনন্দ একটু বাড়াবাড়ি সব ব্যাপারেই করে। ওর কথায় গুরুত্ব কখনও দিইনে। তাছাড়া ওর বসকে আমি চিনি। রীতিমতো ঝানু ব্যবসায়-বুদ্ধির মানুষ। চৌরঙ্গি এলাকার একটা বাড়ির চারতলায় আমাদের পারুল অ্যাডভার্টাইজার্স, পাঁচতলায় আনন্দের বসের ভুবনেশ্বরী ট্রেডিং কনসার্ন। বাড়িটা বছরখানেক হয়েছে। এই এক বছরেই সাতটা ফ্লোরে গাদা গাদা ছোট-বড় কনসার্ন এসে ভিড় করেছে। ভুবনেশ্বরী এসেছে মাস ছয়েক আগে। আনন্দর সঙ্গে তারপর থেকে আলাপ ও বন্ধুত্ব। হয়েছে। সে রীতিমতো কোয়ালিফায়েড, গুণী ছেলে যাকে বলে। কমার্সের খাসা একটা ডিগ্রি আছে। অথচ ভীষণ সাহিত্যরসিক সে। আমরা ক’জন ব্যর্থ শিল্পী সাহিত্যিক (কবিও) মিলে এই পারুল ব্যাপারটা গড়ে তুলেছিলুম। অবশ্য পারুল বলে আমাদের কারো কোন প্রেমিকা বা আত্মীয়া নেই, ওটা জাস্ট একটা নাম। অর্থাৎ রূপকথার সেই ‘সাতভাই চম্পার এক বোন পারুল’ আইডিয়া। তা, আনন্দ। কীভাবে টের পেয়ে গিয়েছিল যে আমরা শিল্প-সাহিত্যের একদল বাউণ্ডুলে ছেলে। যেচে পড়ে সে আলাপ করতে এসেছিল। তাদের বিজ্ঞাপনের সব দায়িত্বও আমাদের মতো খুদে প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিয়েছিল। সেই দিক থেকে একটা কৃতজ্ঞতা বোধ না ছিল এমন হতে পারে না। তবে, আসলে আনন্দের মধ্যে বন্ধুতার অনেক গুণ তো ছিলই। মাঝে মাঝে বেমক্কা রুচিবিগহিত স্ল্যাং বলে ফেললেও তার মধ্যে একটা তীক্ষ্ণ সংস্কৃতিবোধ আমরা লক্ষ্য করেছি এবং কালক্রমে আনন্দ আর আমাদের মধ্যে তুই-তোকারিও এসে পড়েছে।
তখন সময় কাটায় কাটায় সাড়ে এগারোটা। শেখর রঞ্জন সেলিম কেউ তখনও আসেনি। তাদের আসতে বারোটা হয় সচরাচর। কোন নিয়মকানুনের বালাই অবশ্য নেই। শুধু আমাকে নিয়মিত সময়ে আসতেই হয়। কারণ এক অলিখিত চুক্তি অনুসারে নেতৃত্ব আমার কাঁধেই বর্তেছে। তাছাড়া, আমাদের কোন কর্মচারী নেই–এক বেয়ারা বা পিওন কাম-বিল কালেক্টর মধুসূদন বাদে।
আনন্দ চোখ বুজে মাথাটা হেলিয়ে পা নাচাচ্ছিল। ওইভাবেই বলল–চা আনতে বল্।
মধু ফাইল ঝাড়পোঁছ করছিল। ধুলো না জমলেও তাকে এসব করতে হয়। চাকরি যাবার ভয় তার প্রচণ্ড। তাকে চা আনতে বললুম। সে তক্ষুণি কেটলি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
এবার আনন্দকে একটু তিরস্কারের ভান করে বললুম–মধুর সামনে বসের নিন্দে করছিস! জানিস বেয়ারাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ব্যাপার থাকে? তোদের বেয়ারার কানে তুলতে পারে–তারপর মিঃ গুস্টার কানে ওঠা অসম্ভব নয়।
আনন্দ হাসতে লাগল।–মধু তেমন লোক নয়।
বললুম–মিঃ গুপ্টা কার প্রেমে পড়েছেন রে? ওঁর তো বউ-ছেলেমেয়ে রয়েছে।
আনন্দ বলল–আরে, সে তো প্রথমপক্ষ।
–প্রথমপক্ষ! তাহলে দ্বিতীয়পক্ষ আছে নাকি?
–আছে তা কি আমিই জানতুম? কিছুদিন আগে জানতে পারলুম। আপন গড়, বিশ্বাস কর, এ জিনিস বস কীভাবে ম্যানেজ করল ভাবা যায় না। বছর তেইশ-চব্বিশ বয়েস, স্লিম অ্যান্ড ট্রিম চেহারা, যাকে বলে বিউটিফুল! আর সে কী গ্ল্যামার মাইরি! নির্ঘাত ফিলম-লাইন থেকে বোঁটা ছিঁড়ে তুলে এনেছে।
–দুই বউ এক জায়গায় থাকে না নিশ্চয়?
-পাগল! বড় বউ জানেই না কিছু। তাহলে তো গোড়াতেই জানতে পারতুম। ইনি থাকেন ক্যামাক স্ট্রিটের এক দশতলা বাড়ির সাততলায়। সে ফ্ল্যাটের বর্ণনা আমি দিতে পারব না। ওসব তোদের জিনিস। প্রথমে আমি তো ক্যাবারে গার্ল ভেবেছিলুম!
–কিন্তু আইনে তো দুটো বউ মানা।
আনন্দ উদাসীন সুরে বলল–কে জানে! বড় বউ তো জানে না কিছু।
–তাহলে তোরই ভুল হয়েছে। বউ-টউ নয়-জাস্ট মেয়েমানুষ।
–মোটেই না বিবাহিতা স্ত্রী। এবং বাঙালি মেয়ে।
বাঙালি মেয়ে!
-হ্যাঁ। গুপ্টাসায়েবের মা-ও তো বাঙালি মেয়ে। বুড়ি বোম্বে থেকে মধ্যে মধ্যে আসে। অবশ্য সেও কিছু জানে না। যথারীতি বড় বউয়ের কাছে গিয়েও ওঠে। গুপ্তাসায়েবের এই গুপ্টা ব্যাপারটা আমি আর দু-চারজন ছাড়া কেউ জানে না।
একটু ভেবে নিয়ে বললুম–তাই গুপ্টাসায়েব অমন চমৎকার বাংলা বলতে পারেন। অ্যাদ্দিনে বুঝলুম, তাই…
— আনন্দ বাঁকা ঠোঁটে বলল–তুই সাহিত্যিক হলে কী হবে? সবকিছু বড্ড দেরিতে বুঝিস।
–যাক গে! তা আনন্দ, তোর বস অমন দ্বিতীয়পক্ষ থাকতে ফের প্রেমে পড়লেন কোথায়?
আনন্দ অবাক হয়ে বলল–তুই লিখিস কীভাবে? নির্ঘাত বিদেশী নভেল মেরে চালাস। আরে, সুন্দরী তরুণী বউয়ের প্রেমে পড়তে বারণ আছে মানুষের?
হাসতে হাসতে বললুম–ভ্যাট! সে তো দাম্পত্যপ্রেম!
বাঃ! দাম্পত্যপ্রেম প্রেম নয়?
–মোটেও না। ওটা পুরুষের স্ত্রৈণতা।
আনন্দ হতাশ ভঙ্গিতে বলল–তোর সঙ্গে তর্কে আমি পারব না। স্ত্রৈণতা কী জানি না, আমি শালা এক ব্যাচেলার। আমার চোখে ব্যাপারটা প্রেম ছাড়া কিছু নয়। তা না হলে ভাবতে পারিস, আমার বস গাড়ি বেচে ঊর্মিলাসুন্দরীর বায়নাক্কা মেটাচ্ছে! আপন গড়–অত ভালো গাড়িটা সতের হাজারে বেচে দিলে গুপ্টাসায়েব। বললে–আনন্দবাবু, তেলের যা আকাল পড়েছে, আর গাড়ি চাপা যাবে না। ভাবলুম, তাই হবে। উরে হালুয়া! পরদিন আমাকে যেতে বলল ক্যামাক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে। গেলাম। তারপর ঊর্মিলাসুন্দরীকে নিয়ে বেরোলেন। ট্যাক্সি করে আমরা চললুম সোজা ব্যারাকপুর। তখন বুঝিনি কিছু। সেখানে গিয়ে দেখি, একটা পুরনো আমলের বাগানবাড়ি কেনা হচ্ছে। ছোট বউকে ইতিমধ্যে করে এনে দেখিয়েছে। পছন্দও হয়েছে বিবির। এবার অ্যাডভান্স করা হবে। বিবির সামনেই সেটা করতে চায় গুপ্টাসায়েব!….
মধু চা আনল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আনন্দ ফের বলল বাগানবাড়িটা কিন্তু অপূর্ব! সাত একর জায়গার মধ্যে একতলা বাড়ি দুই পার্টে পাঁচটা করে দশটা ঘর। চারপাশে মাঠে অজস্র গাছপালা। ছ-ফুট উঁচু পাচিলের বাউন্ডারি। লোকে বলে, দানিয়েল সায়েবের কুঠি।
–দানিয়েল সায়েবের কুঠি! অবাক হয়ে বললুম।
–কেন, চিনিস নাকি?
নিশ্চয় চিনি। ওর মালিক ভদ্রলোককেও চিনি। সেলিমের এক মাসতুতো ভাই ওঁর কনসার্নে চাকরি করে। চিৎপুরে ব্যবসা আছে মস্তোবড়ো। সেলিমের ভাইয়ের সূত্রে আমরা বার দুই ওখানে পিকনিক করে এসেছি। এবার জানুয়ারিতেও গিয়েছিলুম। রাত্রে ছিলুম আমরা। কিন্তু বাড়িটায় নির্ঘাত ভূত আছে রে!
আনন্দ খিকখিক করে হাসল।–তাহলে তো ভালই জমবে!
–সে এক অদ্ভুত রাত্রি ছিল! শেখররা তো মাল-টাল খেয়ে মেঝেয় গড়াচ্ছিল। আমার একেবারে ঘুম হয়নি। অদ্ভুত অদ্ভুত আওয়াজ শুনেছি সারা রাত!
আনন্দ গম্ভীর হয়ে বলল–বাড়িটার একটা হিস্ট্রি আছে।
–শুনেছি।
–দানিয়েল সায়েব ছিল মিলিটারির বড় অফিসার। রিটায়ার করে বাড়িটা বানায় ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে। সিপাহি বিদ্রোহের শুরু তো ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্টে। ব্যাটা অনেক সিপাহি মেরেছিল। পরে নাকি পাগল হয়ে যায়। তারপর…
আনন্দর বলার দরকার ছিল না। আমি সব জানতুম বাড়িটা অনেকে কিনেছে, তারপর বেচে দিয়েছে। কারণ নাকি যে-ই কিনেছে, তারই একটা না একটা অঘটন ঘটেছে। ফলে অনেককাল খালি পড়ে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সৈন্যরা ওখানে ছিল। কী একটা উপলক্ষে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে তাদের চারজন খুন হয়ে যায়। দলটাকে ছত্রভঙ্গ করে নানা জায়গায় বদলি করা হয়। তারপর ফের বাড়িটা খালি পড়ে ছিল। সরকারি সম্পত্তি তখন। সেই সময় শ্রীলঙ্কার এক মুসলমান ব্যবসায়ী সাহস করে বাড়িটা কিনে নেন নেহাত জলের দামে। বাড়ির দোষ কাটাতে খুব ধুমধাম করে মৌলবি এনে মিলাদ অনুষ্ঠান হয়েছিল। ভাবতে অদ্ভুত লাগে, একা এক বৃদ্ধ মৌলবি ওই ভুতুড়ে জনহীন বাড়িতে সারারাত জেগে সুর ধরে কোরানের শ্লোক উচ্চারণ করে যাচ্ছেন।
মৌলবি বলেছিলেন বাড়িটায় দুষ্ট জিনের উপদ্রব আছে। তবে সবগুলোকে আমি এই আতুরের শিশিতে ভরে ফেলেছি। নিয়ে গিয়ে আরবসাগরে ফেলে দিয়ে আসব।
কিন্তু বর্তমান মালিক ইদ্রিস মিয়া বলেন, তার আগে মৌলবিসায়েবকে জিনগুলো কম জ্বালায়নি। মার্কিনিরা থাকার সময় ইলেকট্রিক লাইন নিয়েছিল। ফাটা ছাদে জল চুঁইয়ে সব ড্যামেজ হয়ে যায়। তারপর আর মেরামত হয়নি। নানাসায়েব (মাতামহ) কিনেছিলেন তো মাত্র দশ হাজারে। মেরামতি খরচা হিসেব করে দেখা গেল, বারো হাজারেও পার পাওয়া যাবে না। তাই উনিও বেচবার ফিকির খুঁজছিলেন। যাইহোক, মৌলবিসায়েব লণ্ঠন জ্বেলেই রাত কাটাতেন। এক রাতে কীভাবে তার মশারিতে আগুন ধরে যায়। মশারির ভেতর বসে উনি কোরান পড়ছিলেন। সে এক কাণ্ড। বেরোতে গিয়ে লেপটালেপটি হয়ে দাড়ি-টাড়ি পুড়ে একাকার হল। তবে অমন তেজী নাছোড়বান্দা মৌলবি দেখা যায় না। কোরান-পাঠ শেষ করে তবে আতরের শিশিতে জিন পুরে নিয়ে মক্কা রওনা হলেন। নানাসায়েব ওঁকে হজে যাবার মতো টাকাকড়ি দিয়েছিলেন।
ইদ্রিস মিয়ার ছেলেপুলে নেই। সুশিক্ষিত আধুনিক যুগের মানুষ। ধর্মকর্মের ধার ধারেন না। ভূত-প্রেতে বিশ্বাস নেই একটুও। নানার মৃত্যুর পর এ সম্পত্তির মালিক হলেন তিনি। কলকাতায় এসে ব্যবসা পাতলেন। কিন্তু দানিয়েল কুঠিতে গিয়ে তার চক্ষু চড়কগাছ। তখন দেশ ভাগ হয়েছে। দলে দলে পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গে চলে আসছে। তাদের একটা দল বাড়িটা জবরদখল করে ফেলেছেন।
ইদ্রিস খান মানুষ হিসেবে দয়ালু সন্দেহ নেই। ছিন্নমূল পরিবারগুলোকে তাড়ানোর কথা তাঁর মাথায় আসেইনি। বরং তাদের সঙ্গে ভাড়ার বন্দোবস্ত করে নিলেন। কিন্তু ভাড়াটা দেবে কোত্থেকে? কেউ মাস গেলে কিছু দেয়, কেউ দেয় না। ভাড়া বাকি পড়তে লাগল। শেষ অব্দি মামলা করতে হল। মামলা চলল। তিন-চার বছর ধরে। তারপর দখল পেলেন। ততদিনে অনেক পরিবার ওখান থেকে চলেও গেছেন। দখল নিতে গিয়ে দেখা গেল, একটি পরিবার বাদে আর কেউ নেই। কারণ?
কারণ, স্রেফ ভূত। কীভাবে হয়তো আতরের শিশির ছিপির ফাঁক গলিয়ে দু একটা ভূত বেরিয়ে পড়েছিল। বেরিয়ে সোজা ফিরে এসেছিল নিজেদের পুরনো আস্তানায়। রাত দুপুরে কড়িকাঠে তারা বাদুড়ের মতো ঝোলে আর নাকি সুরে গান গায়। অদ্ভুত-অদ্ভুত রোগ জন্মায় বাসিন্দাদের শরীরে। নানা অঘটন।
বাড়িটা তো এল হাতে। কিন্তু ওখানে কলকাতায় ব্যবসা রাখা আর এখানে এতবড় বাড়ি খালি ফেলে রাখা, দুটোর তাল সামলাতে ভদ্রলোক হিমশিম খাচ্ছেন। একজন নেপালি দারোয়ান রেখেছেন। সে বাউন্ডারির গায়ে বানানো ছোট্ট ঘরটায় সপরিবারে থাকে। তাহলেও ইদ্রিস খান দুদিন অন্তর রাত্রে এসে ওখানে থাকেন। সঙ্গে থাকে আমাদের শিল্পী সেলিমের সেই মাসতুতো ভাই রনু। রোববার সারাটা দিনরাতই থাকেন ওঁরা। খানিকটা দূরে বসতি এলাকায় হোটেলে খেয়ে আসেন। কখনও নিজেরাও রান্না করেন। কিচেনে রান্নার সব সরঞ্জামই রয়েছে। সামনের বড় হলঘরে দুটো খাঁটিয়া, একটা টেবিল আর গোটা দুই চেয়ার আছে। দেয়ালে পেরেক পুঁতে দড়ি টাঙানো হয়েছে কাপড়চোপড় রাখার জন্যে। একটা ক্যালেন্ডারও দেখেছিলাম–সুন্দরী তরুণীর হাসিভরা মুখ।
দুবার গিয়ে আমরা খুব হই-হল্লা করেছিলুম। ওখানে অনেকেই কলকাতা থেকে ছুটির দিন গিয়ে পিকনিক করে আসে। কিছু চার্জ নেন ইদ্রিস। আমাদের অবশ্য কিছু দিতে হয়নি।
শুনেছিলাম, বাড়িটা বেচবার তালে আছেন ভদ্রলোক। সত্তর হাজার দাম দিতে চেয়েছে কোন এক মারোয়াড়ি। ভেঙে কারখানা বানাবে। কিন্তু লাখের কমে দেবেন না ইদ্রিস। তবে লাখ টাকা পাওয়াও আপাতত লাক। যা বদনাম বাড়িটার! জেনেশুনে কি কেউ নিতে চাইবে? যারা জানে তারাই এসে দরাদরি করে। তারপর পিছিয়ে যায়…
.
সেই ভুতুড়ে বাড়ি গুপ্টাসায়েব তাঁর তরুণী স্ত্রীর জন্যে কিনছেন শুনে আমি রীতিমতো তাজ্জব বনে গেলুম। ওঁরা নিশ্চয় জানেন না এ বদনাম।
সেদিনই বিকেলে করিডোরে গুপ্টাসায়েবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। যথারীতি হাত চেপে ধরে বলে উঠলেন–হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো!
-কেমন আছেন স্যার?
–ভেরি গুড। কোন তকলিফ নেই।
ইয়ে, সেলিম বলছিল, ওর এক আত্মীয়ের কাছে শুনেছে, নাকি ব্যারাকপুরে দানিয়েল সায়েবের কুঠিবাড়ি আপনি কিনছেন!…খুব স্বাভাবিকভাবে বললুম কথাটা।
মিঃ গুপ্টা একটুও বিচলিত না হয়ে জবাব দিলেন–দ্যাটস্ রাইট। সেলিমের আত্নীয়-ও, বুঝেছি। রনু? খানসায়েবের কর্মচারী তো?
-হ্যাঁ।
–বাড়ি কিন্তু অপূর্ব! আপনাকে নিয়ে যাব একদিন। লেখার ম্যাটার পাবেন যথেষ্ট।
একটু হেসে বললুম–আমি গেছি। একরাত্রে ছিলুমও।
“তাই নাকি? বলে হো হো করে হাসলেন মিঃ গুপ্টা।ভূতে জ্বালায়নি তো? কেউ কেউ আমাকে নিষেধ করছে, বাড়িটার খুব বদনাম আছে নাকি।
–আমিও শুনেছি। তবে ওসব সুপারস্টিশন তো থাকেই। সব পুরনো খালি বাড়ি কেন্দ্র করে নানান অদ্ভুত গল্প ছড়ায়।
–ইউ আর রাইট। সুপারস্টিশন! তবে আমার স্ত্রীর ভীষণ পছন্দ হয়ে গেছে। সত্যি বলতে কী, ও গোলমাল হই-চই একেবারে পছন্দ করে না। কলকাতায় এসে হাঁপিয়ে উঠেছে, যা ভিড়! ফ্ল্যাট ছেড়ে একবারো বেরোতে চায় না। বলে, রাস্তায় নামলেই গা ঘিনঘিন করে।
বলেই মিঃ গুপ্টা হাসতে হাসতে আমার হাত ধরে টানলেন।আসুন না, আমার চেম্বারে। গল্প করা যাক। মনটা খুব ভালো আছে আজ। ইমপোর্ট লাইসেন্সটার জন্যে খুব ছুটোছুটি করছিলাম। এবার নাইনটি পারসেন্ট সফল হওয়া গেছে। শুধু টেন পারসেন্ট ঝুলছে-জাস্ট এ সিগনেচার। হয়ে যাবে! আসুন।
মিঃ গুপ্টার বয়স কমপক্ষে বাহান্ন হবেই। চুলে পাক ধরেছে নিশ্চয়, কিন্তু কলপ করেন। চাঁছাছোলা ঝকঝকে মুখ, খাড়া নাক, ঠোঁটের কোনায় বুদ্ধিময় ব্যক্তিত্বের ছাপ স্পষ্ট। চোখে চশমা আছে, কিন্তু দৃষ্টি খুব জ্বলজ্বলে। হঠাৎ এই সাড়ে ছ’ফুট উঁচু বলিষ্ঠ ফরসা লোকটিকে দেখলে যুবক বলে ভুল হতে পারে। কিন্তু একটু পরে বয়সটা ধরা পড়তে বাধ্য। কারণ, হঠাৎ-হঠাৎ এমন গম্ভীর হয়ে পড়েন বা গুরুতর ভঙ্গিতে কথা বলে ওঠেন।
তাহলেও মিশুকে লোক। ওঁর চেম্বারে যাবার পথে আনন্দ কোনার টেবিল থেকে আমাকে বক দেখাল।
চেম্বারটা ছোট্ট। কিন্তু রুচির পরিচয় আছে গোছ-গাছে। ছোট্ট সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপর আর্টসের সামগ্রীও দু-একটা রয়েছে।
–হট না কোল্ড বলুন?
মার্চের দু তারিখ আজ। গরম পড়েও এবার যেন পড়ছে না। রাতের দিকে সিরসির করে শীত আসে। এ সময় হট কোল্ড আমার কোনটাই ভাল লাগে না। বছরের এই সময়টা ভারি অদ্ভুত। ঠাণ্ডা খেলে মনে হয় ঠাণ্ডা লাগবে, গরম খেলে মনে হয় ভীষণ গরম লাগবে।
বললুম-কিছু না। এইমাত্র চা খেয়েছি।
–দেন, কফি?
না, থাক্।
একটু চুপ করে থেকে দুলতে দুলতে মিঃ গুপ্টা বললেন–আপনি কী বলেন?
–কিসের?
বাড়িটা। আমার স্ত্রীর ভীষণ পছন্দ। সে তো এ-বেলায় পেলে ও-বেলায় গিয়ে ওঠে! আসলে হয়েছে কি জানেন, ও বোম্বের শহরতলি এলাকায় এমন জায়গায় মানুষ, যেখানে কোন ভিড় নেই, গোলমাল নেই, স্রেফ নির্জন একটা-একটা বাড়ি–প্রচুর ফাঁকা জায়গা, বাগান, গাছপালা! ছোট ছোট হিলকও রয়েছে, অন্যদিকে সি-বিচ। কলকাতা ওর একদম পছন্দ নয়। এখানকার অ্যাসোসিয়েশনেও ও ঠিক মানিয়ে নিতে পারছে না। তাই বাইরে একটা বাড়ি খুঁজছিলাম। মিলেও গেল। কিন্তু…।
ওঁকে চুপ করতে দেখে বললুম–তাহলে আর কিন্তু কী?
–কিন্তু আমি তো সারাদিন এখানে থাকব। ও একা কীভাবে ওখানে কাটাবে?
–একজন আয়া-টায়া ঠিক করে দিন। সারভ্যান্টও দরকার হবে।
–দেখা যাক্। মোটা টাকা অ্যাডভান্সও করা হয়েছে. পাক্কা রিসিপ্ট বা ডিড কিছু হয়নি এখনও। নব্বই হাজারে রফা হয়েছে। ইন ইকোয়াল সিক্স ইয়ারলি ইনস্টলমেন্টে টাকা শোধ করতে হবে। এমন চমৎকার সুযোগ হয় না। ওনার। ভদ্রলোক রিয়্যালি ও ভেরি কাইন্ডহার্টেড ম্যান। যদ্দিন টাকা পুরো শোধ না হয়, আমাকে উনি অর্ধেক অংশে দখল দিচ্ছেন। তবে ভাড়াটে হিসেবে!
–ভাড়াটে হিসেবে! সে কী? ভাড়াও দিতে হবে নাকি?
সামান্য। মাসে একশো টাকা। তবে কিস্তি শোধ হলে ভাড়ার টাকাটা পুরো ফেরত পাব আমি। এর চেয়ে আর কতটা বেনিফিট আশা করা যায় বলুন? তার মানে ছ’বছরে কথামতো টাকা শোধ হলে আমি ফেরত পাচ্ছি বাহাত্তর শো টাকা।
–একেবারে নিলেই তো পারতেন।
হেসে উঠলেন মিঃ গুপ্টা। –মশাই, কী ভাবেন আমাকে! স্রেফ পরের টাকায় ব্যবসা করি। ধার-দেনায় ডুবে আছি। ব্যাঙ্কের লোনের সুদই দিতে হয় মাসে দেড় হাজার টাকা। বাইরে উঁট বজায় রেখেছি মাত্র। তবে ইট ইজ সিওর, ইমপোর্ট লাইসেন্সটা হাতে এসে গেলেই তখন দেখবেন প্রকাশচন্দ্র গুপ্টা কী কাণ্ড করে!
উনি আবার হেসে উঠলেন। আমার মাথায় ওঁর এই স্ত্রীমহোদয়া সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন গজগজ করছিল। কিন্তু অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো যায় না। শেখরটা থাকলে অবশ্য আলাদা কথা। সে এসব ব্যাপারে যেমন নির্ভীক, তেমনি বেহায়া। কিন্তু আমিও নিজেকে দাবায়ে রাখতে পারলুম না! অভিমানী সুরে বললুম–মিঃ গুপ্টা, এটা কী হচ্ছে বলুন তো?
কী, কী? বলে ঝুঁকে এলেন মিঃ গুপ্টা।
–অমন গুণবতী বউদির সঙ্গে একবারও আলাপ হল না এ অভাগার।
–নিশ্চয়, নিশ্চয়। কেন নয়? আসুন না একদিন!
–বাঃ! কোথায় যাব, কখন যাব–তার ঠিক নেই..
বাধা দিয়ে মিঃ গুপ্টা বললেন–আনন্দ আপনাকে নিয়ে যাবে। সামনের রোববার আসুন। বলে কোন গুপ্তস্থানে চাবি টিপলেন। ঘণ্টা বাজল।
একজন বেয়ারা এল। বললেন–আনন্দবাবুকো বোলাও।
একটু পরেই আনন্দ এসে দাঁড়াল। আমার সঙ্গে তার প্রবল বন্ধুতা–অথচ তার বসের সামনে এখন বসে আছি এবং বন্ধুত্বপূর্ণ আবহাওয়া, তাই সে সপ্রতিভ হেসে আমাকে বলল কতক্ষণ? আমি লক্ষ্যই করিনি তুই…।
মিঃ গুপ্টা গম্ভীরমুখে বললেন–আনন্দ, তুমি এঁকে বাসা থেকে নিয়ে সামনের রোববার ক্যামাক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে যাবে। ডোন্ট ফরগেট দ্যাট। তোমার আবার কিছু মনে থাকে না। লিখে রেখো। সকাল ন’টা।
–আচ্ছা স্যার।
–ও-কে। এসো।
বেচারা আনন্দ বিরসমুখে চলে গেল। আমি বললুম–কেন? একা আমিও যেতে পারতুম! ওকে কষ্ট দিয়ে লাভ কী ছুটির দিনে?
না। ওকেও ওদিন যেতে হবে। দরকার আছে। আপনার বাসা হয়ে আসবে। ও চেনে তো? সরি!… বলে ফের বোতাম টিপলেন।
বললুম-ওকে ডাকার দরকার নেই। আমি বলে দেব’খন।
–উঁহু। ভুলে যাবে। …সেই বেয়ারা এসে দাঁড়িয়েছিল। তাকে বললেন ফির আনন্দবাবুকো বোলাও।
আমি মনে মনে হাসছিলুম। এবার আনন্দ এল কঁচুমাচু মুখে। হাতে একটা নোটবই, খোলা কলম। স্যার?
–তোমাকে বললুম যে এঁকে বাসা থেকে নিয়ে যেতে হবে–আর তক্ষুণি ঘাড় নেড়ে বললে–আচ্ছা স্যার। কিন্তু চেনো এঁর বাসাটা কোথায়?
-না স্যার।
মিঃ গুপ্টা হেসে ফেললেন। কে–আনন্দ আপনারাই নিন বিজনবাবু। ও আসলে আর্টসলাইনের ছেলে, ভুল করে কমার্সে এসে পড়েছে! ভীষণভীষণ আত্মভোলা! নিন, বলুন বিজনবাবু।
ওর হাত থেকে খাতাটা নিয়ে ঠিকানা লিখে দিলুম। দেখে আনন্দ বলল আরে! আমার বড়দার বাসার কাছেই তো! ঠিক আছে।
ও চলে গেলে মিঃ গুপ্টা বললেন–আপনার বউদি ভীষণ বই-টই পড়ে। আপনার তো বই-টই আছে। পারলে দু-একটা নিয়ে যাবেন, ভাব হয়ে যাবে।
এই সময় সেই বেয়ারাটা ঢুকে আমাকে বলল–আপকা লিয়ে সেলিম সাহাব ইন্তেজার করছে, স্যার। বহুৎ জরুরি কাম আছে। মধু আভি এসেছিল।
বিরক্তমুখে উঠে দাঁড়ালাম।–চলি মিঃ গুপ্টা।
উনি কাগজের পাতায় চোখ রেখে বললেন–ওকে। উইশ ইউ গুড় লাক। রোববার সকাল ন’টা। রাইট?
–নিশ্চয়।
আমাদের অফিসে আসতেই সেলিম তেড়ে এল।–শালাকে আজ মেরেই ফেলব। কী ফুসুর ফুসুর করতে গিয়েছিলি রে গুপ্টার কাছে? ওর দ্বিতীয় পক্ষ ডাইনী মেয়েছেলে তা জানিস? রক্ত চুষে ছিবড়ে করে ফেলবে–মরে যাবি বলছি। এখন শোন্ মোহিনী জুয়েলার্স পেমেন্ট দেবে না। নট এ সিঙ্গল ফার্দিং!
ঘাবড়ে গেলুম তক্ষুণি। সর্বনাশ! ওদের বিজ্ঞাপনের টাকা থেকে বরাবর মোটা কমিশন আমরা পেয়ে থাকি। এই বিজ্ঞাপনটা ছিল চারটে দৈনিকে। কম করেও শ’পাঁচেক আমাদের পাওনা। এর দিকে হাপিত্যেশ করে সবাই বসে আছি। দৈনিকগুলো আমাদের কাছে যথারীতি বিল পাঠিয়েছে। অথচ পেমেন্ট দেবে না পার্টি, এর কী মানে হয়?
হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে সেলিম বলল–বিজ্ঞাপনে যা ছবি দিয়েছ তোমরা, মোহিনী জুয়েলার্সের বুড়ো মালিক আগুন হয়ে গেছে। আমাকে তো জুতো ছেড়ে আর কী!
বাঃ! ওরা তো ডিজাইন ম্যাটার সব অ্যাপ্রুভ করেছে!
–কে করেছে? খোদ মালিক করেছে কি? মালিকের নাতি তো একরত্তি চ্যাংড়া। তার সইয়ের কোন দাম নেই।
শেখর চুপচাপ বসেছিল। বলল–সিল তো দিয়েছে। চালাকি নাকি? মামলা করব।
বললুম–বুড়োর বক্তব্য কী?
সেলিম বলল–ছবিটা অশ্লীল। তার ওপর নাকি ভুল হিসট্রি বলা হয়েছে। প্রাচীন ভারতবর্ষে মেয়েরা ন্যাংটো থাকত বলে কোন ব্যাটাচ্ছেলে?
–যা বাবা! ন্যাংটো কোথায়? বুকে কাঁচুলি, কোমরে ঘাগরা! ও তো জাস্ট কালিদাসের নায়িকা!
সেমিল বলল–বোঝা গে না বুড়াকে। আমি ভাই আর যাচ্ছি নে!
রঞ্জন বাইরে থেকে ঢুকে বলল–হলটা কী? চ্যাঁচাচ্ছিস কেন?
বললুমহল মাথা আর মুণ্ডু! সেলিম, তুই কিন্তু ছবিটা এঁকেছিস! মাইন্ড দ্যাট! তখনই আমি বলেছিলুম–যে মেয়েরা অমন ন্যাংটামি মানত, তারা সোনারুপোর গয়না পরত না। স্রেফ ফুল আর পাতা দিয়ে সাজত। তুই শুনলিনে!
সেলিম বলল–থাম। ইতিহাসের পণ্ডিত তুই!
রঞ্জন বলল ঠিক আছে। গোলমাল পরে করিস। আমাকে বুঝিয়ে বল্ তো, কী হয়েছে।
ওকে সেলিম বোঝাতে থাকল। আমি শেখরকে বললুম–এই, চ–তুই আর আমি ব্যাপারটা দেখে আসি।
শেখর বলল–ছেড়ে দে। টাকা ওর বাপ দেবে।
–সবটাতেই তোর ওই? পেমেন্টটা না পেলে আমাদের নামে কেস করে টাকা আদায় হবে জানিস?
শেখর হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল। চল্, দেখে আসি। এক মিনিট, সেই অজন্তা সংক্রান্ত ইংরিজি বইটা সঙ্গে নিই। বুড়োর তাক লেগে যাবে।
আমরা বিশাল সেই ভারী কেতাবটা নিয়ে এক বুড়ো মক্কেলের সঙ্গে লড়তে বেরোলুম।
.
সেই রোববার আসার আগেই অপ্রত্যাশিতভাবে আলাপ হয়ে গেল ঊর্মিলা গুপ্টার সঙ্গে। শনিবার বিকেলে আর সব অফিস তখন বন্ধ হয়ে গেছে। আনন্দকেও যেতে দেখেছি। যাবার সময় সে একটা অদ্ভুত ইশারা করে গিয়েছিল, তখন বুঝিনি। একটু পরে বুঝলুম–যখন গুপ্টাসায়েব বাইরে থেকে সাড়া দিলেন–মে উই কাম ইন জেন্টলমেন?
আমরা চারজনে কেউ টেবিলে কেউ চেয়ারে পা তুলে গাঁজাচ্ছিলুম। তক্ষুণি সিরিয়াস হয়ে নড়েচড়ে বসলুম। সেলিম লাফ মেরে খাড়া হল। রঞ্জন হকচকিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। শেখরের চোখদুটো গোল হয়ে যেতে দেখলুম।
আনন্দর বর্ণনায় বাড়াবাড়ি তো ছিলই না, বরং বেচারার ভাষায় কুলোয়নি– শ্ৰীমতী ঊর্মিলা (পরে জানতে পারি ওঁর নাম আসলে ঊর্মিমালা) প্রচণ্ড পরীমূর্তি, অবিশ্বাস্য শরীর! আমি ওঁর ডানাদুটোও দেখতে পাচ্ছিলুম। পরে রঞ্জন বলেছিল, আরব সাগরের এই ঢেউ হুগলি নদীর সব জেটি ভাসিয়ে দেবে।
হালকা নীল শাড়ির জমিনে সোনালি বিন্দুর ঝিকিমিকি, জোরালো আবেগের মতো দুই স্বাধীন বাহু, ডিমালো খোঁপায় গোঁজা একটি তাজা গোলাপ ইত্যাদি মিলে মিসেস গুপ্টার অস্তিত্ব আমাদের ক্ষুধার্ত ঘর ভরে দিল। তীব্র সুগন্ধের ঝঝ ভনভন করে উঠল।
মনে হল, গন্ধটা এ ঘরে চিরকাল থেকে যাবে।
সুন্দর কিছু দেখলেই বরাবর আমি সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়ি। ধুরন্ধর মিঃ গুপ্টা নিশ্চয় টের পেলেন আমাদের চার-আনাড়ি ব্যাচেলারের হকচকানি ভাব। মৃদু হেসে বললেন–আলাপ করিয়েই দিই। ঊর্মি, এনারা সেই শিল্পী-সাহিত্যিক গ্রুপ! আর…
বলার দরকার ছিল না। চারজোড়া হাত এক সঙ্গে নমস্কার করল। জবাবে শ্ৰীমতী ঊর্মিও ঠিক ফিল্মস্টারের ঢঙে নমস্কার করলেন। ঠোঁট থেকে সেন্টের ফোঁটার মতো হাসি ঝরে পড়ল। তারপর বললেন–বিজনবাবু কে?
খুশিতে ভরে গেলুম। মিঃ গুপ্টা বললেন–উনি বিজন আচার্য, ইনি রঞ্জনবাবু…
রঞ্জন বলে দিল রায়!
ইয়া। রঞ্জন রায়। আই থিংক, হি ইজ এ পোয়েট।
শেখর বলল–আমি শেখর ব্যানার্জি। ছবিটবি আঁকি।
সেলিম ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল। এবার শুধু বলল–আমি সেলিম আমেদ।
হঠাৎ ঊর্মি তার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকালেন। কেমন যেন চমকে উঠলেন মনে হল। ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক হল–কিন্তু শুধু ‘আচ্ছা’ বলে থেমে গেলেন।
এতক্ষণ বললুম দাঁড়িয়ে কেন আপনারা? বসুন, বসুন।
মিঃ গুপ্টা ব্যস্তভাবে ঘড়ি দেখে বললেন–না ব্রাদার। বসা যাবে না। জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। ঊর্মি এল, তো ভাবলুম আপনাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। এনিওয়ে, ঊর্মি, এঁদের তাহলে কাল সকালে চায়ে জন্যে ইনভাইট করি?
ঊর্মি একটু হাসলেন–কেন নয়? বিজনবাবুর তো যাবার কথা ছিল, বলছিলে।
শেখররা আমার দিকে ট্যারা চোখে তাকাল। বললুম–আমার নামটা আপনার জানা আছে দেখছি।. এমন কোন সুকৃতি আমার আছে কি?
মিঃ গুপ্টা বললেন–খু-উ-ব। ঊর্মি ভীষণ ফিল্ম ম্যাগাজিন পড়ে। আপনার লেখার ফ্যান।
এটা মিঃ গুপ্টার বাড়াবাড়ি হতে পারে। কারণ এসব স্ত্রীলোক বাংলায় আদৌ কিছু পড়েন বলে আমার ধারণা নেই। যা পড়েন, তা ইংরিজি ব্ল্যাস ধরনের আজেবাজে সব পত্রিকা–যাতে বিজ্ঞাপনই বেশি টানে পাঠককে।
কিন্তু ঊর্মি বললেন–নববঙ্গ পত্রিকায় আপনার একটা থ্রিলার পড়লুম। ভালো লেগেছে।
বলে কী। থ্রিলার আমি কবে লিখলুম? স্রেফ গুল ঝাড়ছে। আমতা আমতা হাসতে হয় এসব ক্ষেত্রে। ও আর এমন কী লেখা, বাজে, ইত্যাদি বলতে হয়।
ঊর্মি পরক্ষণে ফের বলে উঠলেন–মেয়েরা প্রেমিককে খুন করতে পারে কি না, আই ডাউট। তবে আপনি নিশ্চয় অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন। দ্যাটস্ অ্যান এক্সসেপশান, আই থিংক।
তাহলে সত্যি পড়েছেন তো? কিন্তু ওটা থ্রিলার হতে যাবে কেন? নিছক প্রেমের গল্প। প্রেম নিয়ে চিরকাল একটু আধটু খুনোখুনি কি হয়ে আসছে না?
তারপর হঠাৎ আমাদের চমকে দিয়ে সেলিমের দিকে ঘুরে বলে উঠলেন– আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো?
সেলিম আস্তে জবাব দিল–বোম্বোতে।
ভুরু কুঁচকে স্মরণ করার চেষ্টা করলেন ঊর্মি। ঠোঁটের একটুখানি কামড়ে ধরলেন। বোম্বে ইজ এ বিগ প্লেস। ঠিক কোথায়…
বান্দ্রায়। মিঃ লাহিড়ীর স্টুডিওতে।
লাহিড়ী। ও। দ্যাট–পেইন্টার।
–হ্যাঁ। তাছাড়া অবনীদার পাশেও আমাকে দেখেছেন। ফিল্ম ডাইরেকটার।
তাই বুঝি।… বলে ঊর্মি স্বামীর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন।
মিঃ গুপ্টা ঘড়ি দেখলেন আবার। ওকে ফ্রেন্ডস? আজ চলি। তাহলে কথা রইল, আগামী কাল সকালে আপনারা কাইন্ডলি একটু ম্যানেজ করে চলে যাবেন। বাই দ্য বাই, আনন্দকে একটু অন্য কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে, ওকে পাচ্ছেন না। আমি রাস্তার ডাইরেকশন দিচ্ছি।…
একটু পরেই গুপ্টা দম্পতি চলে গেলেন। তখন সেলিমকে ধরলুম আমরা, অ্যাই শালা। শিগগির! ফ্ল্যাশ ব্যাক। এক্ষুণি!
সেলিম গম্ভীর হয়ে বলল–আরে বাবা, তেমন কিছু নয়। গত বছর বোম্বেতে কয়েক মাস হন্যে হয়ে ঘুরছিলুম, তখন ভদ্রমহিলাকে নানা জায়গায় নানা ব্যাপারে দেখেছিলুম!
শেখর বলল-নানা ব্যাপারটা কী?
লাহিড়ীদার নাম শুনেছিস? তুই তো একজন শিল্পী।
–জ্ঞানেশ লাহিড়ী? সে তো কমার্শিয়াল আর্টিস্ট।
–পেট চালাতে হবে না? যেমন তুইও চালাচ্ছিস।
শেখর তেড়ে কী বলতে যাচ্ছিল, আমি বাধা দিয়ে বললুম–স্টপ ইট! সেলিম, ফ্ল্যাশব্যাকটা চালিয়ে যা।
সেলিম বলল–তখন ওঁর নাম ছিল মিলি সেন। মডেল হয়ে পয়সা রোজগার করতেন। কখনও ঘোরাঘুরি করতেন। অবনীদা একটা হিন্দি ছবিতে ছোট্ট রোল দিয়েছিলেনও। তেমন সুবিধে করতে পারেননি। চেহারা থাকলেই তো হয় না! স্ক্রিন টেস্টে তেমন ওত্রাতে পারেননি, তার ওপর ভয়েস কেমন ক্র্যাকপড়া– লক্ষ্য করলি নে?
রঞ্জন বলল–যাঃ অমন চেহারা স্ক্রিন টেস্টে ওত্রাল না। কোন্ শালা ক্যামেরাম্যান ছিল রে?
সেলিম বলল-বাজে বকিস নে! অবনীদা নিজেই নামকরা ক্যামেরাম্যান। তিনটে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছেন।
শেখর বলল–গলার স্বর তো বেশ মিঠে লাগল!
সেলিম বলল–না, সাউন্ড রেকর্ডিং ঠিকমতো হয়নি। ও সব তোরা বুঝবি নে!
আমি বললুম–তা ভদ্রমহিলা এই গুপ্টার ঘাড়ে এসে চাপলেন শেষ অব্দি? ব্যাপারটা খুব রহস্যময় মনে হচ্ছে।
রঞ্জন বলল–তোর অবনীদাকে চিঠি লেখ না।
-কেন?
ব্যাপারটা ডিটেলস জেনে নে।
–লাভটা কী?
শেখর বলল–কিছু জানা। অর্থাৎ জ্ঞান অর্জন। মানুষের এটা স্বভাব। .. জ্ঞানের জন্যেই তো মানুষকে স্বর্গ থেকে চলে আসতে হয়েছিল।
রঞ্জন বলল–তাছাড়া, তোরও টু-পাইস রোজগার হতে পারে সেলিম।
সেলিম বলল কিসে?
ব্ল্যাকমেইল করবি মিসেস্ গুপ্টাকে। বলবি, মালকড়ি না ছাড়লে পুলিশে জানিয়ে দেব যে, আপনি একজন ফেরারি আসামী!
সেলিম চটে গিয়ে বলল–তোরা সবটাতেই বাড়াবাড়ি করিস। উনি ফেরারি আসামী কে বলল তোকে?
এইসব কথাবার্তা বিকেল পাঁচটা অব্দি চলল আমাদের। তারপর আফিসে তালা আটকে একটা বারের দিকে বেরিয়ে পড়লুম।…
.
পরদিন সকালে আমার বাসায় এসে জুটল ওরা। রঞ্জন এল ঢাকুরিয়া থেকে, শেখর এল পাইকপাড়া থেকে, আর সেলিম এল পার্ক সার্কাস থেকে। আমি থাকি রিপন স্টিটের এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান অধ্যুষিত বাড়িতে–ছাদের ওপর একটা মোটামুটি ভাল ঘর।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে ক্যামাক স্ট্রিটে গেলুম। গেটে লেখা : দা ইভনিং ভিলা। অদ্ভুত নাম! কোন ধনী সায়েবের বাড়ি ছিল। এও এক বাগানবাড়ি বলা যায়। পুরনো ভিতে মাল্টিস্টোরিড দালান গড়া হয়েছে। টেনিসলন আর বাগিচা আছে। লিফট আছে।
দরজা খুলে মিঃ গুপ্টা আমাদের অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেলেন। এ কোথায় এলুম! প্রকাণ্ড বসার ঘর, পুরোটায় লাল কার্পেট, মধ্যিখানে একটা সোফা সেট। দেয়ালের ধারে বিশাল পিয়ানো রয়েছে। এখানে-সেখানে ছোটবড় ভাস্কর্য, দেয়ালে মডান আর্ট, কোনায় একটা সেলফে চমৎকার গোছানো বইপত্তর। ভঙ্গিটা সেকাল-একালে মেশানো।
আমাদের বসতে বলে গুপ্টা গেলেন। শেখর চোখ টিপে ফিসফিস করে বলল–মেয়েমানুষের জন্যে কত কী দিতে হয় রে! ভাবা যায় না।
রঞ্জন কী বলতে যাচ্ছিল, সেই সময় ঊর্মি একরাশ সেন্টের গন্ধ নিয়ে বেরিয়ে এলেন হাসিমুখে। আজ খোঁপা নেই। সদ্য স্নানের আভাস দিচ্ছে খোলা চুল। ঘিয়ে রঙের তাঁতের শাড়ি পরনে, খুব স্বাভাবিক চেহারা। ঠোঁটে রঙ বা কোন প্রসাধন নেই। আমার তো মনে হল, নিতান্ত কচি কলেজ গার্ল হয়ে উঠেছেন ভদ্রমহিলা! বয়স কম দেখাচ্ছে আজ। স্নিগ্ধতা ফুটে উঠেছে। নমস্কার করতে করতে এলেন। কার্পেটেই বসে পড়লেন। আমরাও ব্যস্ত হয়ে সোফা ছেড়ে নেমে বসলুম। সারা ঘর গন্ধে মউমউ করছিল।
ঊর্মি বললেন–ভীষণ আনন্দ হচ্ছে, আপনারা এসেছেন! ফ্ল্যাটটা বেশ বড়–এত একা লাগে! হাঁপিয়ে উঠি। ও তো কাজের মানুষ! একা থাকতে হয়।
বললুম–মিঃ গুপ্টা বলছিলেন, আপনি নাকি নির্জনতাই পছন্দ করেন!
-কে জানে! বলে অস্ফুট হাসলেন ঊর্মি। তবে বেশি ভিড়ও ভাল লাগে না। আপনাদের কলকাতায় বড্ড ভিড় কিন্তু।
শেখর বলল–যা বলেছেন! কলকাতায় আর থাকা যাবে না। বর্ষার অবস্থা দেখলে তো আরও ভয় পাবেন।
বর্ষার অনেক পরে এসেছি। তবে সব শুনেছি অলরেডি। রাস্তাঘাট সব ফ্লাডেড হয় নাকি।
আমি বললুম–কিন্তু আগামী বর্ষার অনেক আগেই তো ব্যারাকপুরের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন?
ঊর্মি খুশি হয়ে তাকালেন আমার দিকে। কথা তাই। বাড়িটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
রঞ্জন বলল–আমরা সেখানে মাঝে মাঝে যাই কিন্তু। পিকনিকের স্পট হিসেবে চমৎকার!
তাই বুঝি!
এই সময় মিঃ গুপ্টা বেরিয়ে এলেন। স্ত্রীর কাছাকাছি বসে পড়লেন। বললেন–বেডরুমে এয়ারকন্ডিশনারটা সারানো হচ্ছে। মিস্ত্রী এসেছে, তাই দেরি হল। কিছু মনে করবেন না ব্রাদার!
ওরে বাবা! বউয়ের জন্য শোবার ঘরে এয়ারকন্ডিশন! ভাবা যায় না। আমরা নিশ্চয় চমৎকৃত হয়ে বোকার মতো হাসলুম। তারপর নানান গল্পগাছা চলতে থাকল। একাকে ফের গুপ্টা কাজ দেখতে ভেতরে চলে গেলেন।
এতক্ষণ সেলিম চুপচাপ বসে ছিল। তার দিকে তাকিয়ে ঊর্মি বলল– আপনি কিন্তু কোন কথা বলছেন না!
শেখর বলল–কী রে? পেটব্যথা করছে নাকি?
আমরা হেসে উঠলুম। সেলিম ঊর্মির দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল– আচ্ছা মিসেস্ গুপ্টা, অবনীদার সঙ্গে আপনার আর যোগাযোগ নেই?
ঊর্মি একটা অপ্রস্তুত হলেন যেন। না, মানে, ফিল্মের লাইনে আমার চেনাজানা খুব কমই ছিল। তাই যোগাযোগের প্রশ্ন ওঠে না। …পরক্ষণে একটু হাসলেন। তবে সে একটা চাইল্ডিশ ব্যাপার। আমার নেশা কেটে গেছে অলরেডি।
রঞ্জন সোৎসাহে বলল–কেন, কেন? আপনি তো দুর্দান্ত হিরোইন হতে পারতেন!
ঊর্মি মাথা দোলালেন। কিন্তু লক্ষ্য করলুম, সেলিম যে জেনে বা না জেনে ওঁকে কোথায় আঘাত করে বসেছে। সেলিমটা বড্ড একগুঁয়ে।
গুপ্টাসায়েব আবার এলেন। তার সঙ্গে একটা ছোকরা ট্রেতে চা-ফা আনছে। দেখা গেল। একগাদা সব চানাচুর, কয়েকরকম বিস্কুট, সন্দেশও আছে। কিছুক্ষণ জমকালো ভঙ্গিতে খাওয়া চলতে থাকল।
এক সময় মিঃ গুপ্টা বলে উঠলেন–দা আইডিয়া! ঊর্মি, আমরা তো নাইনটিনথ মার্চ একটা ছোটখাট পার্টি দিতে পারি!
শেখর বলল–অকেশানটা কী?
বাগানবাড়িতে ওদিনই যাচ্ছি আমরা।
ঊর্মি বলল–বেশ তো। ইউ অ্যারেঞ্জ! আমার ভাল লাগবে।
ঊর্মির মধ্যে একটা রূপান্তর ঘটেছে, আমি অন্তত টের পাচ্ছিলুম।
তার সেই স্মার্টনেস, ঔজ্জ্বল্য কেমন যেন মিইয়ে গেছে কখন। সন্দেহ ঘনীভূত হল। সেলিম নিশ্চয় কোথায় আঘাত করে বসেছে। আমাদের দলে ওর. উপস্থিতিটা যেন ঊর্মি সইতে পারছেন না–অস্বস্তি অনুভব করছেন।…
সেদিন চায়ের পার্টিটা অবশ্য জমানোর চেষ্টা করা হল খুব। গুপ্টাসায়েবের রসিকতা, শেষে শেখরের রবীন্দ্রসঙ্গীত, সেলিম পিয়ানো বাজালও চমৎকার, কিন্তু তা সত্ত্বেও ঊর্মির ভাবান্তর ঢাকা গেল না। ওঁর সুন্দর মুখের ওপর মাঝে মাঝে একটা ছাইরঙের আভা ভেসে উঠতে লাগল।…
পরদিন সেলিম বলেছিল, অবনীদা শিগগির কলকাতা আসছেন শুনলুম। এলে সব জানতে পারব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মিলি সেন একটা সাংঘাতিক কিছু করেই বোম্বে থেকে চলে এসেছেন। মিঃ গুপ্টার পাশে ওঁকে স্ত্রী বলে কিছুতেই ভাবতে পারছিনে আমি। দেয়ার ইজ সামথিং মিসট্রিয়াস!
রঞ্জন বলেছিল–কিন্তু দিব্যি তো বাস করছেন দু’জনে একসঙ্গে।
–আজকাল অমন অনেকে থাকে। ওটা কোন ব্যাপার নয়।
আমি বলেছিলুম–তাহলে তুই বলছিস, ওঁকে মিঃ গুপ্টা বিয়ে করেননি?
–হয়তো না!
–কেন না?
–আরে বাবা, গুপ্টার রীতিমতো বউ-ছেলেমেয়ে সব রয়েছে তো! সে আমি খোঁজ নিয়েছি। উনি কাজের অছিলায় সপ্তায় তিনরাত্তির থাকেন মিলি সেনের কাছে, বাকি রাত্তির বড় বউয়ের কাছে। আনন্দটা সব জানে। জিগ্যেস করিস।
শেখরের ‘সাইকলজি নিয়ে বাতিক আছে। মাঝে মাঝে খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে সে আলোচনা করে। সে বলেছিল–তবে সবচেয়ে মিসট্রিয়াস ব্যাপার হচ্ছে সেন্ট!
সেলিম ট্যারা তাকিয়ে বলেছিল-সেন্ট মানে?
গন্ধ। সুগন্ধ। সুরভি!
তার মানে?
শেখর উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। ভদ্রমহিলা অত কড়া ঋজের সেন্ট ব্যবহার করেন কেন? বাড়াবাড়ি মনে হয় না তোদের? সব সময় সারা গায়ে সেন্ট মেখে থাকেন যেন।
–হ্যাঁ! তুই শুঁকে দেখেছিস?
রঞ্জন বলেছিল–কোথায় নাক ঠেকিয়েছিলি রে?
শেখর রেগে গিয়ে বলেছিল–বুকে।
এরপর রসিকতাটা বাড়তে বাড়তে অশ্লীলতায় পৌঁছে গিয়েছিল নিশ্চয়। তাহলেও শেখরের কথাটা ভাববার মতো। কোথাও একটা গা ঘিনঘিনে ব্যাপার না থাকলে সত্যি তো, অত বাড়াবাড়ি কেন সেন্ট নিয়ে? সে-কি ঊর্মির শারীরিক ক্ষেত্রে কদর্য স্মৃতির ব্যাপার? না কি আরও জটিল কিছু? ঊর্মি কি বাইরের সবকিছু নোংরা দুর্গন্ধময় মনে করেন? কেন মনে করেন? সুগন্ধিতে মানুষের বিশেষ করে স্ত্রীজাতির আসক্তি খুব স্বাভাবিকভাবেই বেশি। কিন্তু ঊর্মির আসক্তিটা যেন মাত্রাহীন। আমি কল্পনায় মাঝে মাঝে ঊর্মির দেহের কোথাও কোথাও নাক ঠেকিয়ে পরীক্ষা করছিলুম। উরে ব্বাস! প্রতিটি লোমকূপে একগাদা করে দুর্মূল্য তরল সুরভি চবচব করছে। আমার বুক অজানা ভয়ে ঢিবঢিব করে ওঠে।
ইতিমধ্যে আনন্দ যথারীতি এসেছে। তার ওই এক কথা। তার বস প্রেমে পাগল হয়ে যাচ্ছেন। এরপর বড় বউকে না ডিভোর্স করে বসেন, সেই ভয়। কারণ বড় বউ আজকাল আনন্দকে মাঝেমাঝে ডেকে পাঠান। আনন্দ বুঝতে পারে, কৌশলে স্বামীর দ্বিতীয় জীবন বা গতিবিধির খবর আদায় করতে চান ভদ্রমহিলা। আনন্দ বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। চাকরি গেলে খুব বিপদে পড়ে যাবে।
এইসব জেনে বেচারা বড় বউটির প্রতি মমতা হচ্ছিল আমাদের। গুপ্টাসায়েবকে আর ভাল চোখে দেখতে পারছিলুম না। যত বেলেল্লাই হই, নীতিবোধ ইত্যাদি আমাদের সংস্কারে শেকড় বসিয়ে রয়েছে। তবে আশ্বস্ত হয়েছিলুম যে গুপ্টাসায়েবের কোম্পানিটি তার বড় বউয়ের নামে। এমন কি কয়েকটা ব্যাংক অ্যাকাউন্টও তার নামে আছে। তাই তার অজান্তে এক পয়সাও তোলা যায় না। আর সেজন্যেই বাগানবাড়ি কিনতে গুপ্টাকে গাড়ি বেচে ফেলতে হয়েছে। আনন্দ বলেছে, প্রথম পক্ষ খুব হিসেবী মানুষ। লেখাপড়াও জানেন। ভাল করে না বুঝে কোথাও সই করেন না।
শুধু একটা ব্যাপার অবাক লাগল। এমন গোপনীয় ব্যক্তিগত ব্যাপার গুপ্টাসায়েব আমাদের কাছে প্রকাশ্য করে তুললেন কেন? আনন্দ তার কাছে। হয়তো বিশ্বস্ত কর্মচারী। কিন্তু আমরা তো বাইরের লোক!
তাছাড়া প্রকাশ্যে ঊর্মি ওঁর অফিসে আসেন মাঝে মাঝে। অফিসের অন্য, কেউ ওঁর প্রথমার কানে তুলে দেবার সম্ভাবনা প্রচুর। আনন্দ এর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিল। আজকাল দিশি সায়েসুববাদের এমন সঙ্গিনী থাকে, এটা সবার গা সওয়া হয়ে গেছে। তাছাড়া চাকরি যাবার ভয় তো সবারই। কেন মিছিমিছি রিস্ক নেবে কেউ? লাভটা কী? চাকরি করতে এসেছে, মাইনে পাচ্ছে। বসের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে চায় না কেউ।
তা ঠিক। আজকাল অনেক কিছু গা-সওয়া হয়ে গেছে মানুষের। ক্রমশ সবাই নির্লিপ্ত হয়ে পড়ছে। নিজেদের জীবনেই লক্ষ-কোটি ঝঞ্ঝাট। পরের জীবন নিয়ে কেউ মাথা ঘামাতে চায় না। মুখে পরচর্চা একটু-আধটু করা যেতে পারে, তার বেশি উৎসাহ কারো থাকে না আজকাল।
এবং এ কথা গুপ্টাসায়েব বোঝেন বলেই পরোয়া করছেন না। তিনি জানেন, আমরাও যথারীতি মাইন্ড করবো না–যাকে বলে। নেহাত বড় বউয়ের প্রতি অনেক নৈতিক ও আবশ্যিক দায়-দায়িত্ব আছে, তাই সেক্ষেত্রে চক্ষুলজ্জা মেনে চলছে। তবে কতদিন মেনে চলবেন, তাও অনিশ্চিত। কবে শুনব, ডিভোর্সের মামলা উঠেছে আদালতে। এমন তো আজকাল আকছার হচ্ছে। খবরের কাগজে কত খবরও বেরোচ্ছে।
তবে এই প্রথম কলকাতা শহরটাকে বড় রহস্যময় মনে হল আমার। বাপস, কী প্রকাণ্ড এই শহর! না–আয়তনের কথা ভাবছিনে। আশি-পাঁচাশি লাখ লোক নিয়েই তার বিশালতাটা রহস্যময় হয়ে উঠেছে দিনে দিনে। এ শহরে যে কেউ তিনটে-চারটে কেন, দশটা বউ দশ জায়গায় মেনটেন করলেও কোন বউ কোন বউয়ের অস্তিত্ব টেরও পাবে না। চিৎপুরের কোন বউ ক্যামাক স্ট্রিটের কোন সতীনের খবর পেতে কয়েক জন্ম লেগে যাবে! তাছাড়া এ শহরের বড় গুণ, কেউ কারো খবর রাখে না, রাখতে চায় না। নাক গলায় না অন্যের পারসোনাল ব্যাপারে। মেট্রোপলিটন শহরের সব বৈশিষ্ট্য এখন কলকাতার গায়ে ঘায়ের মতো দগদগ করছে।….
এর মধ্যে হঠাৎ একদিন আনন্দ এসে আমাকে ফিসফিস করে বলল–শোন, তোকে একবার যেতে বলেছিল, সেকেন্ড লেডি। এক্কেবারে ভুলে গিয়েছিলুম বলতে।
অবাক হয়ে বললুম–আমাকে! কেন?
–ডাইনী তোর মেটেটা খুব পছন্দ করেছে! চলে যাস যে কোন সময়।
কী বলিস যা তা! কেন যেতে বললেন, বলেননি?
না। ফোনে জেনে নে. এই নে, নম্বর দিচ্ছি। কিন্তু খবদার, কাকেও দিবিনে। বসের বারণ আছে। আর একটা কথা, ফোন করার আগে দেখে নিবি, গুপ্টা অফিসে আছে নাকি।
-উনি ফোন করলেন না কেন?
–কেন করলেন না, আমি জানি নাকি? এখন তো গুপ্টা অফিসে আছে। তুই শ্ৰীমতীকে ফোন কর না! কী বলে শোন্।
বলে আনন্দ চলে গেল। ও এক অদ্ভুত ছেলে। যত কৌতূহল, তত ওর নিরাসক্তি সব ব্যাপারে। ভীষণ খামখেয়ালিও।
শেখর পিছনের চেম্বারে ছবি আঁকছিল। সেলিম নেই। রঞ্জন এ ঘরের কোনার টেবিলে ফাইল নিয়ে ব্যস্ত। ফোন আমার টেবিলে। দুরু দুরু বুকে রিসিভার তুলে ডায়াল শুরু করলুম। রঞ্জন তাকাল না।
চাপা সুদূর রিঙের শব্দ ভয়ে ভয়ে সাড়া দিচ্ছিল ক্যামাক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে। বার তিন বাজার পর বন্ধ হল। উত্তেজনায় আমার দম আটকে যাচ্ছিল। তারপর পৃথিবীর সবচেয়ে মিঠে শব্দ ভেসে এল–হ্যালো!
মিসেস্ গুপ্টা বলছেন?
–কে আপনি?
–বিজন আচার্য।
—ও!
স্পষ্ট বুঝতে পারছিলুম, ওঁর কণ্ঠস্বর কেমন আড়ষ্ট মনে হচ্ছিল এর আগে, হঠাৎ যেন আশ্বস্ত হওয়ার আভাস ফুটে বেরোল ‘ও’ শব্দটার মধ্যে। হয়তো একটু হাসিও শুনলুম। তারপর স্পষ্ট সুন্দর উচ্চারণে ঊর্মি বললেন–আপনি! কিন্তু আমার নাম্বার পেলেন কোথায়?
আনন্দবাবুর কাছে।
–ও! আমি ওকে বলেছিলুম, আপনাকে আমার খুব দরকার। আচ্ছা, আপনি কি এখন খুব ব্যস্ত?
না। তেমন কিছু নয়।
–মিঃ গুপ্টা কি এখন অফিসে? প্লিজ, একবার খোঁজ নিন না!
নিয়েছি। অফিসেই আছেন।
-ওঃ! ওয়েল, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, এখনই একটু সময় করতে পারবেন?
-খুব পারব।
–চলে আসুন না, প্লিজ!
–আসছি।
–হ্যালো, হ্যালো!
–আছি। বলুন।
–আপনার বন্ধু সেই আর্টিস্ট ভদ্রলোক কি আছেন এখন?
–শেখর?…..সরি, সেলিম? সেলিম নেই।
–ও। ঠিক আছে। চলে আসুন।
–সেলিমকে কিছু বলতে হবে?
না, থাক। আপনি আসুন। দেরি করবেন না কিন্তু। তাহলে দেখা না হতেও পারে।
-ফোন রাখার শব্দ হল। এক মিনিট পরে আমি আমারটা রাখলুম। এতক্ষণ কানের ভিতর দিয়েই যেন মগজে হুশহুশ করে কড়া সুগন্ধের ঝাঁজ ঢুকছিল। সেই গন্ধ এখনও মউমউ করছে।
–রঞ্জন মুখ তুলে বললকী রে? অমন ভ্যাবলা হয়ে বসে আছিস কেন?
নারভাস হয়ে পড়েছিলুম। সুন্দরী-শ্ৰেষ্ঠাদের সঙ্গে কথা বললে আমার এমন হয়। কিন্তু শ্ৰীমতী ঊর্মিমালা তো আস্ত সৌন্দর্য। হেসে বললুম-তুই শুনছিলি না?
–শুনছিলুম। গুপ্টার ছোট বউয়ের কাছে যাচ্ছিস।
–যাঃ! কিসে বুঝলি?
–ওসব বোঝা যায়। যা। উইশ গুড লাক। কিন্তু সাবধান! কোনরকম বদ মতলব নিয়ে যাসনে।
আমি হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালুম। রঞ্জন ডাকল–শোন্।
-কী?
–গুপ্টাকে বেরোতে দেখলে আমি যাতে তোদের খবর দিতে পারি শ্ৰীমতীর ফোন নম্বরটা আমাকে দিয়ে যা!
ও খুব গম্ভীর হয়ে কথা বলছিল। হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলুম।…
ক্যামাক স্ট্রিটে ট্যাক্সি থেকে নেমে ইভনিং ভিলার কাছাকাছি একটা দোকানে সিগারেট কিনছি, ফুরিয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ দেখি গেটের কাছে আরেকটা ট্যাক্সি এসে থামল এবং গুপ্টাসায়েব নামলেন। আমি হতভম্ব।
ফোন লাইনে ট্যাপ করা আছে নাকি? পরে মনে হল, ব্যাপারটা নেহাত আকস্মিক। কিন্তু পয়সা খরচ করে এসে এভাবে অযথা ফিরতে হবে ভেবে রাগে বিরক্তিতে জ্বালা ধরে গেল। লোকটা অমন করে হঠাৎ-হঠাৎ ঊর্মির কাছে চলে আসে জানা ছিল না। এখন তো মোটে দুটো বাজে। একটু সরে গিয়ে গাছের নিচে একটা চায়ের আড্ডায় হাজির হলুম। বেয়ারা ড্রাইভার ইত্যাদি উর্দিপরা লোকেরা সেখানে আড্ডা দিচ্ছে। মাটির ভঁড়ে চা খেতে খারাপ লাগে না। একপাশে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে চা-টা খেলুম। লক্ষ্য রাখলুম গেটের দিকে, কখন গুপ্টাসায়েব বেরিয়ে যান।
একটি ঘণ্টা কেটে গেল। হতাশ হয়ে ফেরার জন্য পা বাড়াচ্ছি, তখন দেখি গেটের কাছে গুপ্টাসায়েব একা নন, সঙ্গে শ্রীমতী ঊর্মিও রয়েছেন–চোখে সানগ্লাস, গুপ্টা ট্যাক্সির জন্যেই দাঁড়িয়ে রইলেন সম্ভবত।
হ্যাঁ, তাই। একটা ট্যাক্সি এসে খালি হতেই দু’জনে এগিয়ে চেপে বসলেন। ট্যাক্সিটা এদিকে এগিয়ে আসতে দেখে আমি ঘুরে দাঁড়ালুম এবং লোকগুলোর আড়ালে থাকার চেষ্টা করলুম।
ওঁরা অদৃশ্য হলে তারপর হাঁটা শুরু করলুম।
অফিসে ফিরে দেখি, সেলিম এসেছে। আমাকে দেখে রঞ্জন চেঁচিয়ে উঠল–ফিরতে পেরেছিস? বেঁচে আছিস তো তুই?
সেলিম বলল–কেন ডেকেছিল রে?
শেখর বেরিয়ে এল পিছনের ঘর থেকে। কী? জমেছিল তো খুব? ডিটেলস বলবি কিন্তু। নৈলে মেরে ফ্ল্যাট করে ফেলব।
রঞ্জনের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললুম–এরই মধ্যে সব রটিয়ে বসে আছ!
রঞ্জন বলল–বেশ করেছি! এমন নোবেল প্রাইজ পেতে যাচ্ছিস, আর আমরা চুপ করে বসে থাকবো? নে–ঝেড়ে ফ্যাল ঝুলি। তারপর অগত্যা একটা করে বিয়ার আন।
সেলিম বলল–ফোনে আমার কথা জিগ্যেস করছিল, রঞ্জন বললে। কেন রে?
আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল ওরা। বসে বললুমব্যাড লাক, বয়েজ! গিয়ে দেখি, গুপ্টা ঢুকছে। একটু পরে শ্রীমতীকে নিয়ে বেরিয়ে ট্যাক্সি চেপে কোথায় চলে গেল। আমাকে দেখতে পায়নি। কারণ, আমি তখন ভাগ্যিস ঢুকিনি!
রঞ্জন বলল–কিন্তু গুপ্টা বেরোল কখন অফিস থেকে? বুঝেছি–বাথরুমে গিয়েছিলুম–তখনই! যাকগে, নেক্সট চান্স তো পাবি।
–সেলিম বলল–খুব জটিল হচ্ছে ব্যাপারটা। অবনীদা–সেই ফিল্ম ডিরেকটার ভদ্রলোক এসে গেছেন। আমার সঙ্গে দেখা হল আজ কিছুক্ষণ আগে। গ্রেট ইস্টার্নে উঠেছেন। একজনের কাছে খবর পেয়েই গিয়েছিলুম।
রঞ্জন বলল–তারপর? ঊর্মিমালার কথা নিশ্চয় বললি!
বললুম–সে এক সাংঘাতিক কাণ্ড রে! মিলি সেন সত্যি ফেরারি আসামী। অবনীদার এক মাদ্রাজি বন্ধু একটা ছবি প্রোডিউস করছিলেন। তার ডাইরেকশানের ভার অবনীদাকে দেওয়া হয়। মাদ্রাজি ভদ্রলোক কোন এক সূত্রে মিলিকে চিনতেন। উনি তাকেই হিরোইন করার জন্যে জেদ ধরেন। এদিকে মিলি তো অবনীদার রিজেক্টেড জিনিস! প্রচণ্ড আপত্তি করলেন। কিন্তু টিকল না–ওকে নিতেই হবে। অগত্যা নিলেন। ওদিকে নায়কও কিন্তু সম্পূর্ণ নবাগত। যাই হোক, স্যুটিং শুরু হল যথারীতি। অবনীদা পাগল হয়ে যাবার দাখিল। ওই শিমূলফুল দিয়ে কাজ করানো দুঃসাধ্য তো! যাই হোক, আউটডোরে গিয়ে এক সাংঘাতিক ঘটনা। নায়িকা হচ্ছে এক ডাকাতের পালিতা কন্যাসেও ডাকাতনী হয়ে উঠেছে। নায়ক এক বড়লোকের ছেলে। বিয়ে করে গাড়ি চেপে বউ নিয়ে আসছে পাহাড়ী পথে। নায়িকা দলবল নিয়ে গাড়িতে হামলা করবে। নতুন বউয়ের গা ভর্তি গয়না, বাপের বাড়ির যৌতুকও রয়েছে প্রচুর। নায়ক গাড়ি থেকে বেরিয়ে রুখে দাঁড়াল মুখোমুখি। মিলি সেন ঘোড়ার পিঠ থেকে রিভলবার তুলেছে তাকে মারতে। দারুণ উত্তেজনার সিন! রিভলভার তাক করেই মিলি সেনের প্রেম জাগবে প্রচণ্ড। একটু হেসে–”আচ্ছা! ফির মিলেঙ্গে বলে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যাবে। এখন–হল এক অদ্ভুত কাণ্ড! রিভলবারটা তো স্বভাবত নকল মাল। মিলি সেন তুলল। তারপর তিনবার প্রচণ্ড গুলির শব্দ হল এবং নায়ক বাপরে, মার দিয়া’ বলে পড়ে গেল! হই-হই ব্যাপার। অবনীদা দৌড়ে গেলেন। প্রথমে বুঝতে পারেননি–ভেবেছিলেন কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। চিত্রনাট্যে তো এমন ঘটনা নেই! কিন্তু সর্বনাশ!….
শেখর অস্ফুটে বলে উঠল–সত্যিসত্যি খুন নাকি?
–হ্যাঁ। মিলি সেন সত্যিকার রিভলবার দিয়ে হিরোকে মেরে ফেলেছে।
রঞ্জন বলল–কোন সত্যিকার কারণে নিশ্চয়!
–সেলিম বলল–সেটাই রহস্য। কেন রূপেশকুমারকে মিলিকুমারী খুন করল, পুলিস আজও তা জানতে পারেনি। পরস্পর আলাপও ছিল না। তদন্তে সেটা জানা যায়।
আমি বললুম–তারপর কী হল? ঊর্মিমানে, মিলি সেন কী করলেন তারপর?
সেলিম বলল–সেটাই তো ধাঁধা। ঘোড়া ছুটিয়ে তক্ষুণি সে পালিয়ে যায়। যদি এমন হয় যে রূপেশকুমারের কোন শত্রু নকল রিভলবারটার বদলে গুলিভরা আসল রিভলবার রেখে দিয়েছিল যথাস্থানে এবং তা না জেনে মিলি সেন ব্যবহার করেছেন, তাহলে সে পালাবে কেন? তাই না?
–ঠিক বলেছিস! হতভম্ব হয়ে পড়ত। মূচ্ছা যেত। কান্নাকাটি করত।
রাইট। অথচ সে পালাল। ঘোড়াটা পরে একটা নদীর ধারে পাওয়া যায়। মিলি সেন হাওয়া। ওখানে একটা গ্রাম আছে। গ্রামের একজন লোক বলে যে নদীর ব্রিজের পাশে একটা গাড়ি দাঁড় করানো ছিল। ঘোড়ায় চেপে এক ঔরৎ আসে এবং ঘোড়াটা ছেড়ে দিয়ে গাড়িতে ওঠে। গাড়িটা চলে যায়। তার মানে কেউ অপেক্ষা করছিল সেই গাড়িতে। পুলিস তন্ন-তন্ন চেষ্টা করেও গাড়ি বা তার মালিকের হদিস পায়নি।
শেখর বলল–সব জলের মতো পরিষ্কার হল। মানে সেন্ট রহস্য ইজ ক্লিয়ার।
সেলিম বলল–মোটেও না। অবনীদাকে আমাদের আড্ডায় আসতে বলেছি। সময় পাবেন কি না জানি না। এলে ওর মুখে শুনবি সব। অবশ্য অবনীদা বলছিলেন, ছেড়ে দাও। পুরনো কেস। আর, আমারও ওসব পুলিসকে জানিয়ে এখন নষ্ট করার সময় নেই। মিলিকে নিয়ে আর ঝামেলা বাড়াবো না।
আমি বললুম–আচ্ছা, গুপ্টাসায়েব তো বোম্বেতে ছিলেন শুনেছি। তাহলে কি রূপেশকুমারকে উনিই মিলি সেনকে দিয়ে খুন করিয়েছেন?
রঞ্জন বলল– বাঃ এটা তো ভাবিনি! ঠিক বলেছিস!
এই সময় আনন্দ এল। কী রে, খুব জমেছে মনে হচ্ছে। ইসুটা কী?
রঞ্জন বলল–আবার কী? মিলি সেন।
–সে আবার কে?
–তোদের ঊর্মিমালা গুপ্টা। সেলিম রঞ্জনের দিকে চোখ টিপে বলল–আনন্দ, তোর বস কোথায় গেল রে একটু আগে?
আনন্দ বলল-দানিয়েল সায়েবের বাগানবাড়ি।
–সে তো একুশে মার্চ যাবার কথা।
–উঁহু। ডেট এগিয়ে দিয়েছে।
–পার্টি দেবে বলছিল যে?
–জানি না। গুপ্টার সবই গুপ্ত ব্যাপার।
আমি বললুম–ভ্যাট, ওইভাবে হঠাৎ চলে যাবে কী? জিনিসপত্তর যাবে না?
যাবে। ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা হয়ে আছে। আমি লরিতে ক্যামাক স্ট্রিটের মালপত্তর নিয়ে যাব।
–আজই?
–হাঃ। সব ব্যবস্থা করা আছে।
–আগে বলিসনি তো?
আনন্দ চটে গিয়ে বলল–যা বাবা! আমিও কি জানতুম নাকি! আজই দুপুরে হঠাৎ ডেকে সব বললেন। ট্রান্সপোর্টে ফোন করে নিজেই ব্যবস্থা করলেন। আর তোদেরও শালা খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই। যতসব আজেবাজে ব্যাপারে নাক গলাতে যাস। এই আপার ক্লাস লোকগুলো আজকাল কী হয়েছে, জেনেও ন্যাকামি করিস। কই শেখর, সিগ্রেট দে। এক্ষুণি বেরোতে হবে।
.
এয়ারকন্ডিশনড ঘর ছাড়া যে মেয়ের নাকি ঘুম হয় না, সে দানিয়েল কুঠিতে রাত কাটাবে কেমন করে? ইলেকট্রিক লাইন কবে ওখানে কাটা গেছে, আর দেওয়া হয়নি জানতুম। এবার নিশ্চয় শিগগির নেওয়া হবে। কিন্তু ততদিন শ্ৰীমতী ঊর্মির রাত কাটবে কেমন করে?
আমরা এসব জল্পনা-কল্পনা করছিলুম। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, অমন হুট করে কলকাতা ছেড়ে ওখানে চলে গেলেন কেন? এর সঙ্গে সেলিমের সেই অবনীদার কলকাতা আসার কোন যোগাযোগ নেই তো?
পরদিন দুপুরে সেলিম পরিচালক ভদ্রলোককে নিয়ে এল। নামী মানুষ ফিল্ম জগতের। ছবি দেখা ছিল, প্রত্যক্ষ দেখলাম এতদিনে। ভারি অমায়িক আর ভদ্র। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। মাথায় টাক রয়েছে। ফরসা ধবধবে গায়ের রঙ। বাংলা উচ্চারণে সামান্য টান আছে, দীর্ঘকাল প্রবাসে অবাঙালিদের সঙ্গে কথা বলার পর এ টানটা থাকা খুবই স্বাভাবিক। পুরো নাম অবনী ভরদ্বাজ।
আলাপ হওয়ার পর আমরা হিন্দি বনাম বাংলা ছবি নিয়ে খুব জমিয়ে তুললুম। কিন্তু আসল প্রশ্নটা মনে যতই তীব্র হোক, মুখে আসতে প্রত্যকের বাধছিল। হঠাৎ উনি নিজে থেকেই বললেন–মিঃ প্রকাশ গুপ্টার অফিস তো এ বাড়িতেই আছে?
ঘাড় নাড়লুম। অবনীবাবু আমাদের সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিশ্চয় কিছু আঁচ করলেন। তারপর একটু হেসে বলেন–আমার প্রাক্তন হিরোইনের সঙ্গে ইতিমধ্যে আপনাদের আলাপ হয়েছে শুনলুম।
সেলিম বলল–অবনীদা, আপনি প্লিজ ওদের সেই স্যুটিংয়ে মার্ডারের। ঘটনাটা বলুন না! আপনার নিজের মুখে ওরা শুনলে খুশি হবে!
অবনীবাবু হেসে বললেন–খুনখারাপির ঘটনা শুনে খুশি হবেন? বল কি সেলিম?
সেলিম অপ্রস্তুত হল। শেখর আগ্রহ দেখিয়ে বলল–আপনি বলুন।
সেদিন সেলিম যা-যা বলেছিল, তা ডিটেলস বর্ণনা করে বললেন অবনীবাবু। শেষে বললেন–যাই হোক, এসব ব্যাপারে আমি তখনও জড়িয়ে পড়তে চাইনি, এখনও চাইনে। কারণ বুঝতেই পারছেন যে এতে আমার কেরিয়ারের পক্ষে অসুবিধের সৃষ্টি হয়। হ্যাঁ, এমন যদি হত যে মিলি নামকরা নায়িকা ছিল, তাকে না হলে আমার ছবি চলবে না, কিংবা ধরুন, সেই নবাগত রূপেশকুমাব ছেলেটিও কোন সুপারহিট নায়ক ছিল–তাহলে ভিন্ন কথা। অহেতুক এসব স্ক্যান্ডাল বাড়তে দিয়ে আমার ক্ষতি করা ছাড়া কিছু হত না।
শেখর বলল–কিন্তু র্যাদার হিউম্যান পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে…
ওকে বাধা দিয়ে অবনীবাবু বললেন–মশাই, পৃথিবীতে প্রতিমিনিটে লক্ষ লক্ষ অন্যায় বা খুনখারাপি হচ্ছে। আমি তো ত্রাণকর্তা প্রফেট নই। তাছাড়া, কে বলতে পারে যে, রূপেশকুমার মিলি সেনের কিংবা অন্য কারো জীবনে কোন সাংঘাতিক ক্ষতি করেনি? খুন বড় সহজে মানুষ করে না। আর, আমি তো জজসায়েব নই!
অবনীবাবু একটু গম্ভীর হয়ে থাকার পর ফের আগের মতো সহজ হলেন। বললেন–এনিওয়ে! আমি বুঝতে পারছি–আপনারা সব ব্যাচেলার ইয়ংম্যান– আপনাদের কাছে এটা ভীষণ থ্রিলিং। খুবই স্বাভাবিক তা। আপনারা আসলে তাজ্জব হয়ে গেছেন। কারণ, সত্যি তো, অমন সুন্দর স্ত্রীলোক, তাতে তরুণী, মানুষ খুন করে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আপনাদের কৌতূহল বা চাঞ্চল্য খুবই স্বাভাবিক।
সেলিম বলল–অবনীদা, মিলি সেন রাতারাতি ব্যারাকপুর বাগানবাড়িতে কেন পালাল, তা কিন্তু আমরা টের পেয়েছি। আপনার ভয়ে।
অবনীবাবু বললেন-যাঃ। আমাকে ও জানে। ভয় করে না।
–তাহলে অমন রাতারাতি পালাল কেন?
–মিলির রহস্য আমার জানা নেই। আরও নানা কাণ্ড করা ওর পক্ষে স্বাভাবিক।
অবনীদা, এক কাজ করা যাক। আপনি আজ বিকেলে একটু সময় করুন না!
অসম্ভব। অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে একগাদা।
–প্লিজ দাদা! চলুন, আমরা বেড়াতে যাবার ছলে কুঠিবাড়িতে হানা দিই। তারপর দেখি, শ্ৰীমতী কী করেন!
সেলিম ও বাকি সবাই হেসে উঠলুম। অবনীবাবু বললেন–সেলিমের চ্যাংড়ামি এখনও যায়নি। ছেড়ে দে! খামোকা বেচারিকে বিব্রত করে কী হবে? লেট হার এনজয় উইথ দা ওল্ড ফেলো!
আমি বললুম-মিঃ গুপ্টাকে আপনি চেনেন না?
অবনীবাবু বললেন–মনে পড়ছে না ঠিক। চিনতে পারি, নাও পারি।
একটু পরে অবনীদা চলে গেলেন। সেলিম ওঁকে বিদায় দিতে নেমে গেল। তারপর ফিরে এসে বলল–অবনীদা অদ্ভুত মানুষ! এমন নির্লিপ্ত আর উদাসীন লোক দেখা যায় না। বিজু, আমার মাথায় কিন্তু কট কট করে পোকা কামড়াচ্ছে!
শেখর নিজের মাথায় টোকা মেরে বলল–আমারও।
রঞ্জন বলল–হ্যাঁ, যা বলেছিস!
আমি বললুম কামড়ানিটা আমারই বেশি। কারণ, মিলি সেন আমাকে ডেকেছিলেন কী জন্যে বলা হল না। শিগগির ওঁর কথাটা না শুনলে মাইরি। আমি মরে যাব!
সেলিম বলল–তাহলে চল, বেরিয়ে পড়ি। এখন তো দুটো বাজে। : পিকনিকের ছলেই যাই। আমি রনুকে ফোনে বলে দিচ্ছি, ও ইদ্রিস সায়েবকে বলবে এবং ঘরের চাবিটা নিয়ে যাবে ওখানে।
শেখর বলল–ও-কে। আয়, আমি ডায়াল করে দিচ্ছি। নাম্বার বন্।
রনুকে ওখানে চাবি নিয়ে অপেক্ষা করতে বলে আমরা বেরোলুম। রান্নার সরঞ্জাম সব ওখানেই মিলবে। শুধু চাল-ডাল-মসলাপাতি সঙ্গে নিতে হবে। নিউ মার্কেটে গিয়ে জাঁকজমকের সঙ্গে মাংস ইত্যাদি কেনা হল। তারপর সব জিনিসপত্র ভাগাভাগি করে নিজের নিজের ব্যাগে নিয়ে আমরা রওনা দিলুম। পথে হুইস্কির বোতল নেওয়া হল গোটা তিন। ট্যাক্সি বিটি রোডে গিয়ে উঠলে শেখর মনের আনন্দে গান জুড়ে দিল।
ব্যারাকপুর পৌঁছতে তখন সূর্য প্রায় ডুবছে। দানিয়েল সায়েবের বাড়ির গায়ে ইতিমধ্যে সন্ধ্যার ধূসরতা ঘনিয়ে উঠেছে। গাছপালায় পাখিরা তুমুল চেঁচামেচি করছে। গেটের কাছে রনু চাবি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। ও মোটর সাইকেলে এসেছে। এক্ষুণি চলে যাবে। ও নিজে এসে দরজা না খুলে দিলে গোঁয়ারগোবিন্দ বাহাদুর ঝামেলা বাধাবে কিনা। অবশ্য ওর দোষ নেই। ইদ্রিস খানের সবসময় ভয়, আবার কেউ এসে জবরদখল না করে ফেলে। তাই কড়াকড়ি বলা আছে। তাছাড়া আজকাল প্রতিদিন উনি আর আগের মতো রাত্রিবাস করতে আসেন না। কলকাতাতেই থেকে যান।
রনু এসব জানিয়ে চলে গেল। ওর কাছে মিঃ গুপ্টার খবরও পেলুম। বাড়ির উত্তরের অংশ এখন ওঁর দখলে। মাঝামাঝি বাড়িটা দু’ভাগ করা। মাঝের দেয়ালে কোন জানালা না থাকায় ওপাশের ঘরগুলোর টু শব্দটিও এপাশে শোনা যায় না। হ্যাঁ, গুপ্টাসায়েব গতকাল থেকে আজ সারাদিনই এখানে রয়েছেন। আমরা পিকনিক করতে আসছি, তাও শুনেছেন রনুর কাছে।
আমরা দক্ষিণের গেটে থাকায় গুপ্টা সায়েব বা শ্ৰীমতী ঊর্মিকে দেখার আশা ছিল না। তবে বাইরে বেড়াতে বেরোলে দেখতে পেতুম।
দরজা খুলে জিনিসপত্র রাখা হল। বাহাদুর এল হাসিমুখে। শেখর জিগ্যেস করল–কী বাহাদুর, কেমন আছ?
বাহাদুর ঘাড় নাড়ল মাত্র। ভাল আছে।
ভূত দেখতে পাচ্ছ তো বাহাদুর?
বাহাদুর তাতেও ঘাড় নাড়ল। পাচ্ছে কিংবা পাচ্ছে না।
–আমি বললুম–পাশের ঘরের সায়েব মেমসায়েবের খবর কী বাহাদুর?
বাহাদুর আবার ঘাড় নাড়ল। ভালই আছেন। না থাকার কী আছে!
এক বালতি জল চাই, বাহাদুর!
বাহাদুর জলের বালতিটা নিয়ে রাস্তার দিকে টিউবয়লে চলে গেলে সেলিম বলল–প্রতিবেশীরা একেবারে সাইলেন্ট ডেড! ব্যাপার কী? গুপ্টাও তো এল না রে! টের পায়নি মনে হচ্ছে! আয়, কোরাসে গান জুড়ে দিই।
শেখর গম্ভীর মুখে বলল–থা। আগে ছিপি খুলি।
চারটে গ্লাস পাশের কিচেন থেকে এনে রীতিমতো সেলিব্রেট করা হল। তারপর আমরা কোরাস গান জুড়ে দিলুম। গানটা লিখেছিল রঞ্জন, সুর শেখরের। খুব প্রিয় গান আমাদের।
দারা দিরি দারা দিরি দ্রও দ্রও দুমুম্বা
ট্র্যাও ট্র্যাও টিরিটিরি টেরেমেরে লুমুম্বা
হুম হুম হুম হুমা
গুম গুম গুমা গুমা
চাঁও চটাস চাঁও চটাস।
ধড়াস ধড়াস বুক কাবুক টাবুক কুক হুড়ম্বা
এ্যাও দুমুম্বা লুমুম্বা….
লারা লিরি হো
দারা দিরি হো.. হোঃ হোঃ হোঃ।
বাহাদুর বালতিভরা জল মেঝেয় রেখে হাঁ। বাবুরা বেদম নাচছেন তখন। এই নাচ খাঁটি তাহিতি দ্বীপপুঞ্জের, তা কি বেচারা জানে? ঘরে তখন বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। আমরা চালিয়ে গেলুম। পুরনো বাড়িটা ভুতুড়ে নাচগানে কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকল। আক্ষেপ হচ্ছিল, একটা গিটার আনলে ভাল হত। সেলিম ভাল বাজায়।
এক সময় বাহাদুর বলল–আলো, সাব!
হ্যাঁ, আলো জ্বালা উচিত এবার। এখন কৃষ্ণপক্ষ চলছে। বাইরে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে। মোমবাতি বের করে জ্বালা হল। তারপর বাহাদুর চলে গেল। দরকার হলে তাকে ডাকা যাবে আবার।
কিচেনে একটা মোমবাতি নিয়ে গেল সেলিম আর রঞ্জন। আমি আর শেখর মালমসলার প্যাকেট বয়ে রেখে এলুম। সেলিম রাঁধবে। আমরা সব ঠিকঠাক করে দেব। এ ঘরটা বিরাট। ফায়ার প্লেসও আছে। ডানদিকে বাথরুম। ভিতরে আরও অনেকগুলো ঘর। মোমবাতি হাতে আমি আর শেখর সব দেখে এলুম চোর এসে লুকিয়ে আছে নাকি। কেন থাকবে? চুরি করার কী-ই বা আছে? আসলে আমরা প্রতিবেশীদের কোন সাড়া পাওয়ার মতো ঘেঁদা খুঁজছিলুম। দেয়াল একেবারে নিরেট। ফাটলও নেই।
কিচেনটাও বিশাল। ডাইনিং ঘরের সংলগ্ন সেটা। কিন্তু ডাইনিং ঘর এখন আর বলা যাবে না। একেবারে ফাঁকা। সদর দরজা বন্ধ করে সেখানে আমরা মেঝেতে শতরঞ্জি বিছিয়ে বসলুম। দরজা দিয়ে সেলিমকে কুকারের সামনে রান্নায় ব্যস্ত দেখতে পাচ্ছিলুম। মদ্যপান টুকটাক চলছে চারজনের। রঞ্জন সেলিমকে খাইয়ে দিয়ে আসছে। মাঝে আমরা গান গাইছি, নাচছিও। কিন্তু গুপ্টা-দম্পতির কোন সাড়া নেই। প্রতিমুহূর্তেই আশা করি ওঁরা কেউ এসে আমাদের দরজায় কড়া নাড়বেন। কিন্তু না, সে আশা যেন নেই-ই।
ফলে উৎসাহ লম্ফঝম্প ক্রমশ মিইয়ে পড়ছিল। এক সময় রঞ্জন বলল– গুপ্টার হল কী রে? একবারও যে টিকি দেখায় না!
শেখর গম্ভীরভাবে বলল–বউ নিয়ে শুয়ে আছে।
–বিজু! রঞ্জন ডাকল। –আয় না, একবার ওদিকটায় ঘুরে দেখে আসি!
উঠে পড়লুম। শেখরকে দেখলুম অমনি সেলিমের কাছে গিয়ে বসল। বাইরে ঘন অন্ধকার। দূরে রাস্তার ধারের আলোগুলো গাছের ফাঁকে গঙ্গার বুকেও আলো দেখা যাচ্ছে। এদিকটা সুনসান নির্জন। মাঝেমাঝে রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলার গরগর শব্দ শোনা যাচ্ছে।
আমরা সিগারেট টানতে টানতে বাগান ঘুরে উত্তরদিকে গেলুম। অবাক হয়ে দেখলুম, গুপ্টার দিকটা ঘুরমুটি অন্ধকার। দরজা-জানালার ফাঁক দিয়েও কোন আলো আসছে না। এই সন্ধ্যাবেলায় শুয়ে পড়ল নাকি ওরা?
যা আছে বরাতে বলে সেদিকে এগিয়ে গেলুম। এতক্ষণে মনে পড়ল, টর্চ আনা হয়নি। কী আর করা যাবে!
পা টিপে ধাপবন্দী বারান্দায় উঠে বুক টিপটিপ করতে থাকল। রঞ্জন আর চুপ করে থাকতে পারল না। একবার কেশে ডাকল–মিঃ গুপ্টা আছেন নাকি?
কোন সাড়া এল না। তখন আমি ডাকলুম-মিঃ গুপ্টা! মিঃ গুপ্টা আছেন?
তবু কোন সাড়া নেই। এবার দরজার সামনে দেশলাই জ্বাললুম। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ! পর্দা তুলতেই সেটা বোঝা গেল। সেই সময় সেদিনকার সেই কড়া সেন্টের গন্ধ নাকে এল।
আশ্চর্য তো! এই সবে সাড়ে সাতটা বাজে। এরই মধ্যে বেঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে ওরা? দরজায় ধাক্কা দিলুম আস্তে। ব্যাপারটা খুব অস্বাভাবিক লাগছিল।
অমনি দরজাটা ফাঁক হয়ে গেল। কেন কে জানে, অজ্ঞাত ভয়ে দু’জনেরই বুক কেঁপে উঠল। রঞ্জন ফিসফিস করে বলল, দরজা খোলা কেন রে?
দরজাটা ঠেলে মরিয়া হয়ে ভিতরে ঢুকে গেলুম আমরা। তারপর আবার দেশলাই জ্বাললুম! ঘরটা বড়। এরই মধ্যে বেশ সাজানো হয়েছে। আলমারি হোয়াটনট সেলফ সোফাসেট রয়েছে। সামনের দিকে ভিতরের দরজাতেও পর্দা তুলে ভিতরে গেলুম দুজনে। সঙ্গে সঙ্গে একরাশ তেজী সুগন্ধ আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এসে।
ফের দেশলাই জ্বালাতেই যা নজরে পড়ল, আমাদের দুজনের গলায় একই সঙ্গে অস্ফুট একটা আওয়াজ বের করার পক্ষে যথেষ্টই। মেঝেয় মিঃ গুপ্টা উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছেন। পিঠের দিকে চাপচাপ রক্ত। আর ঊর্মি ওরফে মিলি সেন বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে আছে।
আবার দেশলাই জ্বেলে ব্যাপারটা দেখে নিয়ে আমরা দুজনে দৌড়ে বেরিয়ে এলুম। বিভ্রান্ত হয়ে চেঁচাতে থাকলুম–সেলিম! শেখর! বাহাদুর!
শেখরের সাড়া পাওয়া গেল প্রথমে। তারপর সেলিমের। বাহাদুর একটা হারিকেন হাতে দক্ষিণ-পূর্ব কোণের একতলা ঘর থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এল। লোকটা অদ্ভুত। সে যেন একজন পাথরের মানুষ।…
.
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার
টেবিলের একদিকে বিজন, রঞ্জন, শেখর ও সেলিম বসেছে, অন্যদিকে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বসেছেন। বয়স ষাটের কোঠায়। মুখে সাদা গোঁফ-দাড়ি, মাথায় টাক, হাসিখুশি বুড়ো মানুষটির খ্যাতি অপরাধতাত্ত্বিক হিসেবে প্রচুর।
তাঁর ইলিয়ট রোডের বাসায় বসে বিজন বিবৃতি দিচ্ছিল। একই বিবৃতি পুলিশকেও সে দিয়েছে। দানিয়েল কুঠির জোড়া খুনের কিনারা এখনও করতে পারেনি পুলিশ। এমনকি চোরের কাণ্ড বলে চালানোর চেষ্টাও চলছে। সত্যি তো! চোর-ডাকাত ছাড়া আর কে খুন করবে গুপ্টাদম্পতিকে? কী চুরি হয়েছে, সেটা বলা কঠিন। আপাতদৃষ্টে তেমন কোন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। ঊর্মি। গহনা পরতেন সামান্যই। শুধু গলায় একটা দামী পাথরের হার ছিল, তা চোর নেয়নি। কানে বা হাতে যা সোনা ছিল, তাও ঠিকঠাক আছে!
আজকাল এত বেশি মানুষ খুন হয় যে পুলিশ তেমন আর গা করে না। নাক গলিয়ে অহেতুক ঝামেলা বরদাস্ত করতে চায় না তারা। কাজেই গুপ্টাদম্পতির হত্যাকাণ্ডের কিনারা বেশিদূর এগোয়নি।
কর্নেল মন দিয়ে শুনছিলেন বিজনের স্টেটমেন্ট। বিজন থামলে এবার বললেন–ঊর্মি বা মিলি সেনের ব্যাকগ্রাউন্ড জানা থাকলে খুনের কিনারা হত, এ বিষয়ে আমি আপনাদের সঙ্গে একমত ইয়ং ফ্রেন্ডস! কিন্তু পুলিশকে আজকাল কাজ করতে হলে প্রভাবশালী লোক কিংবা গোষ্ঠীর দরকার হয়। …বলে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সকৌতুকে হেসে উঠলেন।
কর্নেলকে যাঁরা চেনেন, তাঁরাই জানেন–মানুষটি মোটেও বদমেজাজি গোমড়ামুখো গোয়েন্দা নন। যেমন খামখেয়ালি, তেমনি মিশুক আর কৌতুকপরায়ণ। বিশেষ করে একালের যুবক-যুবতীদের সঙ্গে চমৎকার মিশে যেতে পারেন।
বিজন বলল–কর্নেল, আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু এ খুনের ব্যাপারে আমরা চারজনে এক অদ্ভুত অবস্থায় পড়েছি। মোটেও এটা বরদাস্ত করতে পারছি না যে আমাদের নাকের জগায় এমন সাংঘাতিক কাণ্ড করে কেউ নিরাপদে কেটে পড়বে আর আমরা কিছু করতে পারব না।
শেখর বলল–রিয়্যালি কর্নেল! একটা কিছু না করলে আমাদের ভীষণ কষ্ট হবে।
রঞ্জন ও সেলিমও সায় দিল। –হ্যাঁ, ভীষণ কষ্ট পাব।
কর্নেল সকৌতুকে বললেন–আপনাদের বয়সের পক্ষে নিশ্চয় সেটা স্বাভাবিক। যৌবনের মূল্য যৌবন ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না। তাছাড়া ঊর্মি দেবীর সেই দামী সেন্টও সম্ভবত একটা হিপ্নোটিক ব্যাপার–তাই না? আপনারা হিপ্নোটাইজড হয়ে পড়বেন, তাও কিছু দোষের নয়। আই এগ্রি ইতিহাসে ও পুরাণে সুন্দরীদের জন্যে অনেক বড় যুদ্ধ হয়ে গেছে!
বলে ফের হো হো করে হেসে উঠলেন। এ সময় তাঁর বিশ্বস্ত পরিচারক ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে চা ও স্ন্যাক্স রেখে গেল। সবাই কাপ তুলে নিল। নিঃশব্দে কিছুক্ষণ চা খাওয়ার পর কর্নেল হঠাৎ বললেন–অচ্ছা বিজনবাবু, সেই সন্ধ্যা রাত্রে আপনারা কেউ কোন অস্বাভাবিক বা দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো কিছু লক্ষ্য করেছিলেন কি? বেশ ভেবে বলবেন কিন্তু। যত তুচ্ছ হোক, এমন কোন ব্যাপার নজরে পড়েছিল?
বিজন একটু ভেবে বলল কই, তেমন কিছু তো…নাঃ। দেখিনি।
রঞ্জন বলল–আমিও দেখিনি।
শেখর বলল কই? আমার চোখে কিছু পড়েনি।
সেলিম বলল–না!
কর্নেল একটু হেসে বললেন–আপনারা প্রত্যেকেই কিন্তু ঠিক কথা বলছেন না ভাই!
ওরা চমকে উঠল। বিজন বলল–কেন কেন কর্নেল?
–আপনাদের স্টেটমেন্ট কিন্তু ভিন্ন কথা বলছে। আপনারা প্রত্যেকেই অন্তত একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলেন!
ওরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। সেলিম অস্ফুট স্বরে বলল– অস্বাভাবিক ব্যাপার!
-হ্যাঁ। মিঃ এবং মিসেস গুপ্টার সঙ্গে আপনাদের অন্তরঙ্গতা হয়েছিল। আপনারা যখন কুঠিবাড়িতে গেলেন, আশা করেছিলেন ওঁরা আপনাদের হইহল্লা শুনে বেরিয়ে এসে আপনাদের সঙ্গে আড্ডা দেবেন। আপনারা পৌঁছান সন্ধ্যা পৌনে ছটা নাগাদ। তারপর অত কাণ্ড হল, ওঁরা কেউ এলেন না। এটা আপনাদের অস্বাভাবিক লেগেছিল। তাই না?
এবার সবাই হইচই করে বলল–ঠিক, ঠিক। ঠিকই তো!
এবং সেজন্যেই বিজনবাবু ও রঞ্জনবাবু ওঁদের ঘরে গিয়ে হানা দেন!
বিজন বলল–সেটা তো বলেইছি। এছাড়া কিছু অস্বাভাবিক তো দেখিনি।
কর্নেল হাসলেন। “ওকে, ফ্রেন্ডস। তাহলে এবার আমাদের সভা ভঙ্গ হোক। আপনাদের প্রয়োজন আমার নিশ্চয় হবে, তখন ডাকব। অপাতত আমি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখি, ওঁরা কী বলেন।
ওরা উঠে দাঁড়াল। সেলিম হতাশ মুখে বলল–পুলিশ কিছু করবে না কর্নেল!
কর্নেল সে বিষয়ে কোন মন্তব্য না করে হঠাৎ বললেন–আচ্ছা মিঃ সেলিম, আপনার সেই অবনীদা ভদ্রলোক কি এখনও আছেন কলকাতায়?
সেলিম বলল–না। ঘটনার পরদিন অর্থাৎ গতকাল দুপুরের ফ্লাইটে বোম্বে চলে গেছেন শুনেছি। কুঠিবাড়ি থেকে ফিরে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছিলুম। হয়নি। ভীষণ ব্যস্ত মানুষ তো! হোটেল ছেড়ে এক বন্ধুর বাসায় উঠেছিলেন। ঠিকানা যোগাড় করে গেলুম, বেরিয়ে গেছেন ওখান থেকে। তারপর কাল দুপুরে ফোন করলুমবলল, রওনা হয়ে গেছেন।
কর্নেল বললেন–হুম! আচ্ছা, আপাতত এই।
ওরা বেরিয়ে গেলে কর্নেল কিছুক্ষণ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকলেন। সেই সময় ফোন বেজে উঠল। এগিয়ে এসে রিসিভার তুললেন–সত্যেন্দ্র নাকি? মেঘ না চাইতেই জল। আশ্চর্য যোগাযোগ বটে। এক্ষুণি তোমাকে রিঙ করব ভাবছিলুম।
কর্নেল, আমি বিপন্ন।
তুমি কি দানিয়েল কুঠির মার্ডার কেসের ব্যাপারে কথা বলছ?
–আশ্চর্য কর্নেল, আশ্চর্য!
কেন?
–আপনি নিশ্চয় টেলিপ্যাথি জানেন।
–নিছক দৈবাৎ যোগাযোগ বলতে পারো।
–যাকগে, শুনুন। আপনি কেসটার কতখানি জানেন, জানি না। গত রাত্রে হঠাৎ কেসটা ব্যারাকপুর পুলিশ লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টে পেশ করেছে। কারণ…
–কারণ মর্গের রিপোর্টে অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া গেছে। কেসটা বার্গলারি নয়।
–আশ্চর্য, কর্নেল!
–একটু কম আশ্চর্য হওয়া ভাল, সত্যেন্দ্র।
–আমি আসছি, কর্নেল। পনের মিনিটের মধ্যেই।
এসো।…
কর্নেল একটু হেসে ফোন রাখলেন। আজকের সকালটা বেশ চমৎকার ছিল। সব গুলিয়ে গেল। আসলে সেই চিরকালের ধুরন্ধর হত্যাকারীটি তাকে নিয়ে অদ্ভুত খেলা করে চলেছে। একটি নির্মল বিশুদ্ধ সময়ের অংশও সে হত্যার রক্ত ছড়িয়ে লাল না করে ছাড়বে না। বয়স এদিকে বেড়ে যাচ্ছে। এই খেলায়। জড়িয়ে পড়তে আর ইচ্ছে করে না। অথচ ক্রমশ মানুষের জীবন এত মূল্যবান মনে হয়ে উঠছে যে জীবনবিরোধী ওই হন্তারক শক্তির বিরুদ্ধে লড়ে যেতে ইচ্ছে করছে ক্লান্তিহীনভাবে। এমন কোন সমাজ কি সম্ভব, যেখানে মানুষের এই ভয়ংকর বৃত্তিটা লোক পাবে? হননবৃত্তি যেন প্রকৃতির একটা আইন, যার নাম আমরা দিয়েছি পশুত্ব।
কিন্তু দেবত্ব বলেও একটা আইনকানুন প্রকৃতি মানুষের জন্য দিয়েছেন। পশুত্বের সঙ্গে তার লড়াই চলেছে আবহমানকাল ধরে। খ্রিস্টানিটিতে এই পশুত্বকেই বলা হয়েছে শয়তান। শয়তান অজর অমর। …
ঘণ্টা বাজল বাইরের ঘরের দরজায়। গোয়েন্দা বিভাগের ইন্সপেক্টর সত্যেন্দ্র ব্যানার্জির সাড়া পাওয়া গেল।
–হ্যাল্লো ওল্ড বস!
–এস সত্যেন্দ্র, তোমার ওই ফাইলটা দেখে অস্বস্তি হচ্ছে কিন্তু।
সত্যেন্দ্র তরুণ অফিসার। সে গোয়েন্দা বিভাগের অন্য অফিসারদের মতো গোমড়ামুখো নয়। প্রচণ্ড হাসতে পারে। কর্নেলের সঙ্গে কৌতুকে ও হাসিতে সে ছাড়া আর কেউ পাল্লা দিতে পারে না। সে বসে ফাইলটা রাখল। তারপর কপালের ঘাম মুছে বলল–অস্বস্তি হবেই। কারণ কে কবে শুনেছে যে ভিকটিমের দেহ খুবলে হত্যাকারী মাংস তুলে খেয়েছে!
–খেয়েছে! বল কী?
তাছাড়া কী? দানিয়েল কুঠির কেসটা চুরিচামারি বলেই মনে করা হচ্ছিল। লাশ দুটোর গায়ে মারাত্মক ক্ষতচিহ্ন, মেঝেয় রক্ত। দেখলে মনে হয়, ছোরাটোরা মারা হয়েছে। অথচ মর্গের রিপোর্টে বলছে–মোটেও তেমন কিছু নয়। মারাত্মক বিষ পটাসিয়াম সাইনায়েডই মৃত্যুর কারণ। গুপ্টা দম্পতির হাতের কাছে ছোট ছোট্ট টেবিলে মদের বোতল ছিল। গ্লাস দুটো মেঝেয় পড়ে ছিল–দুটোই ভেঙে গেছে। একটা গ্লাসের টুকরোয় লিপস্টিকের দাগ পাওয়া গেছে। তার মানে দুজনে মদের গ্লাসে চুমুক দিয়েই বিষক্রিয়ার ফলে ঢলে পড়ে। এবার অদ্ভুত ব্যাপার হল, মারা যাবার আন্দাজ ঘণ্টা দুই পরে কেউ মিঃ গুপ্টার পিঠ কোন ধারাল কিছুতে খুবলে মাংস তুলেছে। বিছানায় ঊর্মি গুপ্টার লাশটা কিন্তু যত্ন করে শোয়ানো ছিল। বিষক্রিয়ার পরে ওভাবে সটান চমৎকার শুয়ে থাকা সম্ভব নয় কারো পক্ষে। তারপর কেউ ওঁর বুকের কাপড় সরিয়ে একইভাবে কিছু কিছু মাংস খুবলে নিয়েছে। কিন্তু কুঠির সমস্ত ঘর তন্নতন্ন করে দেখা হয়েছে আজ সকালে। ফোরেনসিক এক্সপার্ট টিম ওখানে এখনও রয়েছে। ফোনে জানলাম, আর কোথাও এক ছিটে রক্ত,ওঁদের নজরে পড়েনি, কোন রকম ক্লও ওঁরা পাচ্ছেন না। কুকুর স্কোয়াডও কোন সুবিধে করতে পারেনি। শুধু বোঝা গেছে যে খুনী বাইরে থেকে এসেছিল।
ভাঙা গেলাস দুটোয় তাহলে সাইনায়েড পাওয়া গেছে?
–হ্যাঁ।
মৃত্যুর সময় ঠিক করতে পেরেছেন ডাক্তাররা?
–বিকেল পাঁচটার কাছাকাছি। তার আগে নয় এবং ছ’টার পরেও নয়! তারপর মাংস খুবলে নেওয়া হয়েছে সাড়ে সাতটার মধ্যেই। কারণ…
–পারুল অ্যাডভারটাইজার্সের ছেলেরা ঠিক সাড়ে সাতটায় লাশ দুটো আবিষ্কার করে!
–সে কী! আপনি কেমন করে জানলেন?
–জানি। পরে বলব’খন। আর কী ফ্যাক্ট আছে, বলো।
-ফ্যাক্ট আপাতত কিছু হাতে নেই। সব দিকে যোগাযোগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুপুরের মধ্যে গুপ্টা ফ্যামিলির ব্যাকগ্রাউন্ড পেয়ে যাব, আশা করছি।
এবার বলো, আমি কী করতে পারি?
–আপনি আমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ুন কর্নেল, প্লিজ!
কর্নেল, একটু ভেবে নিয়ে বললেন–কেসটা বেশ ইন্টারেস্টিং। ঠিক আছে, চলো–বেরিয়ে পড়া যাক্। ইয়ে–ব্যারাকপুর যাচ্ছি আমরা, তাই না?
–হ্যাঁ কর্নেল। আপনারই থিওরি-হত্যাকাণ্ডের জায়গাটাই হত্যাকারীকে সনাক্ত করে।…
.
সারা পথ আর মুখ খুললেন না কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। চুরুটও খেলেন না অভ্যাসমতো, গম্ভীর হয়ে বসে থাকলেন। গভীর চিন্তায় মাঝে মাঝে এমনভাবে ওঁকে ডুবে যেতে দেখেছে সত্যেন্দ্র ব্যানার্জি। এসময় ডাকলে সাড়া পাওয়া যায় না।
দানিয়েলকুঠির সামনে কিছু পুলিশ ছিল। উত্তরের বারান্দায় ফেরেনসিকের লোকেরা ফিতে দিয়ে মাপজোক করছিলেন। দু’জনে কাছে যেতেই ওঁরা কাজ থামিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। সত্যেন্দ্র পরিচয় করিয়ে দেবার আগেই কর্নেল তার সমবয়সী একজনের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে উঠলেন–হ্যালো, হ্যালো! ডাঃ পট্টনায়ক যে!
কর্নেল সরকার! আপনাকেও তাহলে পাকড়াও করা হল!
ফোরেনসিক বিশেষজ্ঞ ডাঃ সীতানাথ পট্টনায়ক জড়িয়ে ধরলেন কর্নেলকে। তারপর কর্নেল বললেন–আপনাদের কাজের ব্যাঘাত ঘটালাম নিশ্চয়, ডাঃ পট্টনায়ক?
–মোটেও না। আসলে কী জানেন? ফ্যাক্টস একটা মার্ডারের কেসের পক্ষে মুখ্য উপাদান। কিন্তু ফ্যাক্টস থেকে ডিডাকশান করে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোটাই হল কৃতিত্বের পরিচয়। ডিডাকশানের বোধ তো অনেকের থাকে না। একই ফ্যাক্টস থেকে একজন একরকম সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন, আরেকজন তার উল্টোও যেতে পারেন এসব ব্যাপারে আপনার কৃতিত্ব অস্বীকার করে কে? ইউ আর ওয়েলকাম, কর্নেল সরকার।
সত্যেন্দ্র কর্নেল আর ডাঃ পট্টনায়ক এবার ভিতরে ঢুকলেন। প্রথমে বসার। ঘর। বেশ বড়। যথারীতি ফায়ার প্লেস আছে। সেকালে ইউরোপীয়রা এই গ্রীষ্মপ্রধান দেশেও স্বদেশের পরিবেশ তৈরি করে বাস করতেন। জানালাগুলো এমনভাবে তৈরি যে বন্ধ করে দিলে ঘর ঘন অন্ধকার হয়ে যায়। এখন সব খোলা ছিল। ঘরে আলো ছিল যথেষ্ট। কর্নেল ঘরের ভিতরটা দেখছেন লক্ষ্য করে, এগিয়ে গেলেন সোফা সেটটার দিকে। তারপর একটা কিছু লক্ষ্য করে বললেন–ঘরের কোন কিছু আশা করি নাড়াচড়া করা হয়নি।
–মোটেও না। সব ঠিকঠাক আছে।
কর্নেল হাঁটু দুমড়ে সোফার নীচের দিকটা দেখতে থাকলেন। তারপর বললেন–দারোয়ান বাহাদুর আর তার বউ তো দক্ষিণের পাঁচিলের কাছে। থাকে?
–হ্যাঁ।
–এখানে আসার পর কেউ মিঃ গুপ্টার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল কি না বলেনি? নিশ্চয় তাদের স্টেটমেন্ট নেওয়া হয়েছে?
হয়েছে। কাকেও আসতে দেখেনি ওরা।
এলেও ওদের চোখে পড়ার কথা নয়!
–কিন্তু গেট তো দক্ষিণে! ওদের ঘরের কাছাকাছি।
–আমি দেখলুম উত্তরের পাঁচিলে একজায়গায় একটা ভাঙা জায়গা রয়েছে। যে কেউ ওপথে এদিকে আসতে পারে। ওরা টের পাবে না।
সত্যেন্দ্র চিন্তিতমুখে বলল–তা পারে!
আমার মনে হচ্ছে, এই সোফাটায় কেউ বসেছিল–যে বাইরের লোক। কারণ, তার জুতোর তলায় সুরকি গুঁড়ো ছিল। ..বলে কর্নেল পকেট থেকে একটা আতস কাঁচ বের করে পরীক্ষা করতে থাকলেন। –হুঁউ! তাই বটে। তুমি প্লিজ দেখে এসো তো সত্যেন্দ্র, ওই ভাঙা পাঁচিলের ফাঁক গলিয়ে এলে জুতোর তলায় সুরকি গুঁড়ো লাগে কি না।
সত্যেন্দ্র বেরিয়ে গেল। ডাঃ পট্টনায়ক বললেন–ওটা আমিও লক্ষ্য করেছি। তবে মিঃ গুপ্টার কর্মচারী আনন্দবাবু আসতে পারেন!
–পারেন। কিন্তু ওইভাবে আসেননি–তা চোখ বুজে বলা যায়। কেন লুকিয়ে আসবেন তিনি? আনন্দবাবুর ব্যাকগ্রাউন্ডে কিছু আছে বলে মনে হয় না। অন্তত আমার যা শোনাজানা আছে!
ডাঃ পট্টনায়ক একটু হাসলেন। কোন গ্যারান্টি নেই কর্নেল। সন্দেহ সকলকেই করা উচিত। যে চার বন্ধু খুনের দিনে পিকনিক করেছিলেন বা লাশ দেখতে পান, তাঁদেরও সন্দেহের আওতায় রাখা কর্তব্য।
রাইট, রাইট! বলে কর্নেল সোফার চারপাশটা ঘুরে দেখতে থাকলেন। সদর দরজা অব্দি মেঝে পরীক্ষা করলেন।
এই সময় সত্যেন্দ্র ফিরে এসে নিজের জুতোর তলায় আঙুল ঘষে বলল কর্নেল, ইউ আর কারেক্ট।
কর্নেল ও ডাঃ পট্টনায়ক পরীক্ষা করে মাথা নাড়লেন। তারপর কর্নেল হঠাৎ ফায়ার প্লেসের দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর কী একটা কুড়িয়ে নিলেন। ডাকলেন–সত্যেন্দ্র শোন, এবং আতস কাঁচে সেটা পরীক্ষা করতে থাকলেন।
সত্যেন্দ্র এগিয়ে গিয়ে বলল–কী ব্যাপার?
–মিঃ গুপ্টা কী ব্র্যান্ডের সিগারেট খেতেন জানা আছে তোমাদের?
হা। ব্যারনেস-৪০। বিদেশে রপ্তানি হয়। বেশ দাম আছে।
–কিন্তু এই সিগারেটটা সে ব্র্যান্ড নয়। এটা ফাইভ স্টার। এও দামী কিন্তু।
–ফাইভ স্টার। এ তো ফিল্ম মহলে খুব চালু সিগারেট!
–সত্যেন্দ্র প্লিজ। তোমাকে একটু কষ্ট করতে হবে।
বলুন না!
–তুমি লোকাল থানা থেকে তোমার অফিসে কনট্যাক্ট করো।
অফিসকে বলো এখনই বোম্বে পুলিসকে কনট্যাক্ট করতে। প্রখ্যাত ফিল্ম ডিরেক্টের অবনী ভরদ্বাজের এ ব্যাপারে কিছু বলার থাকতে পারে। ওঁর একটা বিবৃতি চাই। কলকাতা এসে কোথায়-কোথায় গেছেন বা কী করেছেন, সব ওঁর নিজের মুখের কথায় জানা দরকার। তারপর বিবৃতিটা তোমরা ভেরিফাই করবে।
–আসার আগে সে কাজটা করে এসেছি। রাত্রে বিজনবাবু নামে পারুল অ্যাডের সেই ভদ্রলোকের স্টেটমেন্ট পড়েই আমার সন্দেহ তীব্র হয়েছিল। এই; খুনের সঙ্গে ফিল্ম হিরো রূপেশকুমারের খুন হওয়ার কোন যোগসূত্র না থেকে পারে না।
কর্নেল ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন–চলুন ডাঃ পট্টনায়ক। আমরা এবার বেডরুমে যাই।
বেডরুমটা মাঝারি শুধু পূবদিকটা ছাড়া জানালায় আলো আসার উপায় নেই। একটা ডবলবেড খাট রয়েছে। চাদর ইত্যাদি সবকিছু ফোরেনসিকের জিম্মায় চলে গেছে। গ্লাসের টুকরো, মদের বোতলটাও। কর্নেল মেঝেয় হাঁটু দুমড়ে আতস কাঁচটা পেতে অদ্ভুত ভঙ্গিতে পরীক্ষা করছিলেন। ডাঃ পট্টনায়কের ঠোঁটে একটু হাসি দেখা গেল। তিনি বললেন কর্নেল কি এ ঘরে সেই সুরকির ধুলো আশা করছেন?
কর্নেল পাল্টা হেসে বললেন–জানি না।
কিছুক্ষণ পরীক্ষা করার পর তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর এগিয়ে সংলগ্ন বাথরুমটা দেখলেন। অব্যবহার্য হয়ে পড়ে ছিল বোঝা যায়। সম্প্রতি সামান্য ব্যবহার করা হয়েছে। কোমোড বেসিন সব ভাঙা। জলের একটা চৌবাচ্চা আছে। সেটা ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে কিন্তু জল নেই। জলের পাইপে মরচে ধরে রয়েছে। একটা বড় প্ল্যাস্টিকের বালতিতে তলায় কিছু জল রয়েছে, সম্ভবত বাইরে থেকে আনা হয়েছে।
এবার বাঁদিকে আরেকটা ঘরে ঢুকলেন। কিচেন কাম ডাইনিং ঘর। তার পাশে স্টোর। স্টোরের ভিতর ঢুকে কর্নেল বললেন–মাই গুনেস! ওপাশে জানালাটা ভাঙা। যে কেউ বাইরে থেকে ঢুকে পড়তে পারে। কিংবা পালাতে পারে। ডাঃ পট্টনায়ক, এসব ঘরের দরজা কি ভোলা ছিল?
–সেটাই তো অদ্ভুত। ভোলা ছিল। তার মানে খুনী ওই পথে পালিয়েছে। অবশ্য আমরা কোন সুরকি পাইনি কোথাও! বলে ডাঃ পট্টনায়ক হেসে উঠলেন।
কর্নেল বললেন–প্রিয় ডঃ পট্টনায়ক! পটাসিয়াম সাইনায়েড যে দিয়েছে, সেই খুনী কিন্তু। তার অমনভাবে না পালালেও চলত।
–তাহলে কি মাংস খুবলেছে যে, সে আলাদা লোক বলে মনে করেন?
–এখনও আমি কিছু মনে করি না ডাঃ পট্টনায়ক। শুধু সম্ভাবনার কথাই বলছি। পটাসিয়াম সাইনায়েড মেশানো মদ কিন্তু বোতলে নেই–গ্লাসে পাওয়া গেছে, তার মানে গ্লাস দুটোর তলায় আগে থেকে রাখা ছিল বিষ, অথবা মদ ঢালার পর মেশানো হয়েছে। আগে থেকে রাখার চান্স শয়ে এক। সেটার চেয়ে বরং মদ ঢালবার পর মেশানোটাই সম্ভাব্য।
তাহলে তৃতীয় একজন ছিল মদ্যপানের সময়।
–রাইট। এবং তার কোন গ্লাস আমরা পাচ্ছি না। অথচ খুনী নিজে মদ না খেলে বিষ মেশানোর চান্স নেবে কীভাবে? এটাই অবাক লাগছে।
–আপনি কি তাহলে বলতে চান যে সেই ফিল্ম ডিরেক্টর ভদ্রলোকও ওদের মদ্যপানের সময় উপস্থিত ছিলেন এবং তিনিই খুনী?
–কিছু বলতে চাইনি ডাঃ পট্টনায়ক। শুধু সম্ভাবনাগুলো নেড়েচেড়ে দেখছি। তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার যে লোকটি পাঁচিলের ফোকর গলিয়ে এসেছিল, সে ফিল্মের নোক হতেও পারে–চান্স অন্তত সেভেনটি ফাইভ পারসেন্ট। দুই? সে অসম্ভব ধূর্ত। তাই আসার সময়ই জুতো পরে ঢুকলেও খালি পায়ে বেরিয়েছে-সদর দরজার পথেই হোক কিংবা ওই স্টোরের পিছনকার জানালা। গলিয়েই হোক। কারণ, জুতোর সুরকির ছাপ বেডরুমে নেই। আবার, বসবার ঘরের জুতোর ছাপগুলো সব ঘরে ঢোকার, বেরিয়ে যাবার নয়। তিন : সে গুপ্টা দম্পতির সঙ্গে মদ খেতে বসেছিল, তা না হলে বিষ মেশানোর সুযোগ করা খুবই কঠিন। এবং বিষ মেশাতে হলে ওঁদের অন্যমনস্কতা থাকা চাই। আমার ধারণা, এমন সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল–যাতে উভয়েই গুপ্টা দম্পতি ভীষণভাবে ইনভলভড। এমনও হতে পারে, একটা গুরুতর জীবনমরণ প্রশ্ন জড়িত ছিল আলোচনায়।
সত্যেন্দ্র বলল কারেক্ট। আমি একমত।
ডাঃ পট্টনায়ক সন্দিগ্ধভাবে মাথা নেড়ে বললেন কিন্তু মৃত মানুষকে আঘাত করতে গেল কেন খুনী?
কর্নেল বললেন–পুলিশকে বিভ্রান্ত করার জন্য। এটা আজকালকার চুরিডাকাতির ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিল সম্ভবত।
–কিন্তু সে যদি অত ধূর্ত, তাহলে কিছু চুরির নমুনা রাখেনি কেন?
–সময় পায়নি।
–কেন?
মনে রাখবেন, ডাক্তারের হিসেবে ওঁদের মৃত্যু হয়েছে সম্ভবত পাঁচটা থেকে ছ’টার মধ্যে। পাঁচটা পঁয়তাল্লিশে পারুল অ্যাডের ছেলেরা এসে পৌঁছেছে। এখানে, সবদিক বিচার করে আমার অনুমান, ওঁদের মৃত্যু পাঁচটা পঁয়ত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে হয়ে থাকবে। তারপর খুনী ডেডবডিতে ছুরি বা ধারালো কিছু চালিয়েছে। কিন্তু চুরির অজুহাত দেখানোর সুযোগ পায়নি বিজনবাবুরা এসে পড়ায়। ওরা খুনীকে দেখতে পেত না। দিব্যি ঊর্মিদেবীর হার বা চুড়ি নিয়ে পালাতে পারত। কিন্তু মনে রাখবেন, খুনের পর খুনীর মানসিক অবস্থা কেমন থাকে। সে একটু শব্দেই তখন চমকে ওঠে। হঠাৎ সেই সময় বিজনবাবুরা হল্লা করে পৌঁছেছিলেন। কাজেই তীর তখনই বিভ্রান্ত হয়ে পালানো স্বাভাবিক। অবশ্য, সবই আমার হাইপোথিসিস যাকে বলে।
–কিন্তু তাহলে শেষ অব্দি অবনী ভরদ্বাজই আপনার ধারণা অনুসারে এই কেসের আসামী। আমি অবাক হচ্ছি যে অমন নামী ভদ্রলোক নিজের কেরিয়ার নষ্ট করার চান্স নেবেন এভাবে? এটা উদ্ভট লাগে না কি? নিশ্চয় ওঁর হাতে একগাদা ফিল্মের দায়িত্ব রয়েছে–আর উনি…
কর্নেল হাত তুলে বললেন–আমরা এখনও সত্যে পৌঁছাইনি ডাঃ পট্টনায়ক। সত্যে পৌঁছাতে হলে অনেক ঘুরপথে যেতে হয়।…
.
বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের এক ভদ্রলোক
বাগানবাড়ির পাঁচিল ঘেরা মাঠে একটা শিরীষ গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল। কর্নেল, সত্যেন্দ্র, ডাঃ পট্টনায়ক আর স্থানীয় পুলিশ অফিসার হিতেন চক্রবর্তী আলোচনা করছিলেন। কর্নেল হিতেনবাবুকে প্রশ্ন করছিলেন। এবার সত্যেন্দ্রের দিকে ঘুরে বললেন–খুনের দিন তাহলে ইদ্রিস খানের সেই কর্মচারী রনু ছেলেটি এসেছিল বিকেল চারটেয়। তাই না?
সত্যেন্দ্র বলল–হ্যাঁ। একটু-আধটু এদিক-ওদিক হতে পারে, তবে চারটের কাছাকাছি বলা যায়।
–রনু দেখা করেছিল মিঃ গুপ্টার সঙ্গে। ইজ ইট?
–হ্যাঁ। মিঃ চক্রবর্তী, ওর স্টেটমেন্টটা এই ফাইলে আছে। প্লিজ, বের করে এঁকে দিন না।
হিতেনবাবু ফাইলের নির্দিষ্ট জায়গাটা খুলে কর্নেলের সামনে ধরলেন। কর্নেল চোখ বুলিয়ে দেখে নিলেন। তারপর বললেন–হুম! রনুর সঙ্গে বারান্দায় কথা বলেন মিঃ গুপ্টা। তারপর রনু চলে যায় দক্ষিণের পোর্শনে–ওদের ঘরটায়। বিজনদের জন্যে সে অপেক্ষা করতে থাকে। সত্যেন্দ্র, আমি ছেলেটির সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলতে চাই।
–তাকে এখন এখানে পাবেন কোথায়?
হিতেনবাবু বললেন না স্যার। রনু আর ইদ্রিস সায়েব সকালে এসেছেন। চলুন, দেখা হয়ে যাবে।
মাঠ ঘুরে আগাছার জঙ্গল পেরিয়ে সবাই দক্ষিণের অংশে গেলেন। সদর ঘরের দরজা খোলা। বারান্দায় চেয়ারে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরে বসে রয়েছেন। একটি আঠারো-ঊনিশ বছরের ছেলে সামনে বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
এঁদের দেখে ভদ্রলোক শশব্যস্তে উঠে দাঁড়ালেন। হিতেনবাবু আলাপ করিয়ে দিলেন। কর্নেল বললেন–আপনিই তাহলে এ বাড়ির মালিক? বাঃ, আলাপ করে খুশি হলুম মিঃ খান। অবশ্য, আপনার মানসিক অবস্থা বুঝতেই পারছি একে ছিল ভূতের বাড়ি, এবার খুনের ঘটনা বেচারার বরাতে এসে পড়ল। এসব পুরনো বাড়ির কী যেন অভিশাপ আছে!
ইদ্রিস সায়েব অমায়িকভাবে হাসলেন। হাসিটা বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল।
–আর তুমিই তাহলে মিঃ সেলিমের আত্মীয়রনু?
রনু মাথা নেড়ে হাসবার চেষ্টা করল।
“তুমি আমার ছেলের বয়সী। তাই নাম ধরে ডাকছি বা তুমি বলছি। রাগ করছ না তো ইয়ংম্যান?
না স্যার। কী যে বলেন?
–এস, আমরা ওই গাছটার নীচে যাই। একটু গল্প করে আসি।
কর্নেল তার হাতে ধরে অন্তরঙ্গভাবে একটা অর্জুন গাছের তলায় নিয়ে গেলেন। সত্যেন্দ্ররা ইদ্রিস সায়েবের সঙ্গে গল্প করতে থাকল।
কর্নেল বললেন–আচ্ছা রনু, তুমি খুনের দিন ঠিক ক’টায় এখানে এসেছিলে?
–সে তো একবার বলেছি, স্যার! প্রায় চারটে-টারটে হবে। ঘড়ি দেখিনি!
–এসে ঠিক কী কী করেছিলে একটু বলো তো বাবা?
রনু নার্ভাস হয়ে বলল–এসে? এসে তো বাহাদুরকে ডাকলুম প্রথমে। বাহাদুরকে বললুম–আমার সেই দাদা আর তার বন্ধুরা আসছেন। সে যেন ফাইফরমাশ খেটে দেয় আগের মতো। বাহাদুর শুনে নিজের ঘরে চলে গেল। ওর বউটা খুব দজ্জাল মেয়ে স্যার! পাকা কুল শুকাতে দিয়েছিল, তার পাহারার ভার ছিল বাহাদুরের ওপর। তাই.. ।
তারপর তুমি কী করলে?
–ঘর খুললুম। কিচেনে গিয়ে কুকার জ্বালালুম। তারপর চায়ের জল চাপিয়ে দিলুম। তারপর মিঃ গুপ্টাকে খবরটা দিতে গেলুম।
–ঠিক কতক্ষণ লাগল এসব কাজে?
—কতক্ষণ?
–ভেবে বলবে কিন্তু।
বড়জোর মিনিট পনেরোর বেশি নয়।
–কোন পথে মিঃ গুপ্টার কাছে গেলে?
–কেন? এই আগাছার ঝোঁপ পেরিয়ে। ওই তো পথটা রয়েছে।
–বেশ। গিয়ে কী করলে?
–আমি ওদিকের বারান্দায় উঠতেই মিঃ গুপ্টা বেরিয়ে এসে বললেন কী খবর রনু? আমি বললুম–আজ সেলিমভাই আর তার বন্ধুরা পিকনিক করতে আসছে একটু পরেই। রাত্রে থাকবে। আপনাকে জানাতে বলেছে।
মিঃ গুপ্টা কী বললেন?
খুব খুশি হলেন মনে হল। কী আর বলবেন?
সত্যি খুশি হলেন?
-হ্যাঁ।
–ভাবো। তোমাকে সময় দিলুম ভাবতে। ভেবে বলো!
রনু আরও নার্ভাস হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কর্নেল ওর কাঁধে হাত রেখে ফের বললেন–কোন ভয় নেই। জাস্ট থিঙ্ক, মাই বয়!
–স্যার!
হু?
–মিঃ গুপ্টা বোধ হয় খুশি হননি!
–কেন, কেন?
–ওর মুখটা মনে পড়ছে স্যার। হা–মনে পড়ছে, উনি, ভুরু কুঁচকে ছিলেন। বলেছিলেন–তাই নাকি? এ অসময়ে পিকনিক! আছে ভালো সব! তারপর “ঠিক আছে’ বলে তক্ষুণি ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। আমার বেশ অবাক লেগেছিল কিন্তু। একটু খারাপ লেগেছিল। এলুম তার কাছে, আর উনি হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়লেন…
–আচ্ছা, আচ্ছা! এবার বলো, কতক্ষণ তুমি দাঁড়িয়ে থাকলে?
–এক মিনিটও নয়। মনে হয়েছিল–হয়তো ব্যস্ত ছিলেন, তাই আমার সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বললেন না!
–ওঁর ঘরের কোন আওয়াজ তোমাদের কোন ঘরে পৌঁছায়?
না স্যার। সলিড দেয়াল রয়েছে ছাদ অব্দি। শুনেছি, দানিয়েল সায়েব তার এক বন্ধুর জন্যে পরে বাড়িটার মাঝামাঝি দেয়াল তুলে দিয়েছিলেন। পরীক্ষা করলেই দেখতে পাবেন–সেজন্যেই ঘরগুলো ছোট হয়ে গেছে। সেই বন্ধু দানিয়েল সায়েবের স্ত্রীকে নাকি এলোপ করে পালান। তাই সায়েব শেষে পাগল হয়ে যান!
–তুমি অনেক খবর রাখো দেখছি। আচ্ছা রনু, তোমার কি মনে হয়েছিল, মিঃ গুপ্টার ঘরে তখন ওঁর স্ত্রী বাদে আর কেউ ছিল?
-আমি তো ভেতরে যাইনি স্যার।
–তাহলেও জাস্ট একটা আইডিয়ার কথা বলছি।
–স্যার!
–হুঁ, বলো রনু।
–স্যার, আপনি ঠিকই বলেছেন।
–হুউ?
–আমার তাই মনে হয়েছিল বটে। ঘরে কারো সঙ্গে কথা বলতে বলতে উঠে এসেছিলেন যেন গুপ্টা সায়েব। কারণ, আমার পায়ের শব্দ পেয়েই উনি বেরোলেন। তারপর হঠাৎ আবার চলে গেলেন! হা-একটা আবছা ধারণা হয়েছিল মনে পড়ছে। তাছাড়া…
“তাছাড়া?
–ওঁকে একটু মাতালও মনে হচ্ছিল। মদের গন্ধ পেয়েছিলুম।
–সেই ঠিকই। কারণ, যে বোতলটা পাওয়া গেছে, তাতে মদ আর অল্পই ছিল। আচ্ছা, চলো–আমার কথা শেষ হয়েছে।
চলতে চলতে রনু বলল–কোন বিপদ হবে না তো স্যার?
-কেন?
–এত সব তো পুলিশকে বলিনি!
না, না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। বলে কর্নেল বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলেন। কর্নেল ভাবছিলেন, দুটো গ্লাস পাওয়া গেছে। তৃতীয়টা গেল কোথায়?..
.
ফেরার পথে পুলিশের গাড়িতে বসে কর্নেল ফাইলটা খুললেন। মিঃ গুপ্টার কর্মচারী আনন্দের বিবৃতিটা পড়তে লাগলে।
আনন্দ ৭ই মার্চ বিকেলে ক্যামাক স্ট্রিট ফ্লাটের জিনিসপত্তর ট্রাকে যাবার সময় সঙ্গে যায়। সব গোছগাছ করতে রাত দশটা বাজে ওখানে। মিঃ গুপ্টা জানান, পরদিন অফিস বন্ধ থাকবে। তিনি বিশ্রাম নেবেন। আনন্দরও ছুটি। তবে ৮ই মার্চ সকালে ওঁর বড় বউকে যেন সে জানিয়ে আসে–সায়েব হঠাৎ কাজে দিল্লি গেছেন। ফিরবেন ১০ই মার্চ। হ্যাঁ, আনন্দ জানে–বড় বউ এতে কিছু হইচই করেন না। স্বামীর খামখেয়ালি আচরণে তিনি অভ্যস্ত। যাই হোক, আনন্দ কথামতো সব করেছিল।
এসব বিবৃতির প্রতি বরাবর কর্নেল গুরুত্ব দেন না। প্রচলিত গতানুগতিক ঢঙে একজন পুলিশ অফিসার খসখস করে লিখে যান এবং সই করিয়ে নেন। খুঁটিয়ে কিছু প্রশ্ন করা হয় খুব কমই। অর্থাৎ পুলিশের পদ্ধতি হল, আগে সিদ্ধান্তে পৌঁছেই ওঁরা প্রমাণ হাতড়াতে ব্যস্ত হন। কর্নেলের হল উলটো। আগে প্রমাণ, পরে সিদ্ধান্ত।
সুতরাং আনন্দকে মুখোমুখি চাই। একটা প্রশ্ন খুব তীব্র। মিঃ গুপ্টা হঠাৎ রাতারাতি কেন বাগানবাড়িতে চলে এলেন ঊর্মিকে নিয়ে? আনন্দকে তিনি এর কৈফিয়ত দিয়েছিলেন কি? কিংবা আনন্দের কি কোন কৌতূহল হয়নি?
ইদ্রিস সায়েব বলছেন–২১শে মার্চ ও বাড়িতে মিঃ গুপ্টা আসার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ ৭ই মার্চ দুপুরে মিঃ গুপ্টা ইদ্রিস সায়েবের কলকাতার অফিসে ফোন করে বলেন যে এদিনই তিনি যেতে চান। ইদ্রিস সায়েব আপত্তি করেননি। তাজ্জব হয়েছিলেন কি? তা তো হবারই কথা। তবে তাজ্জব হয়েছিলেন অন্য কারণে নয়– লোকে ওই বয়সেও কচি বউয়ের বায়না মেটাতে অমন পাগল হয়, সেটা লক্ষ্য করেই। ইদ্রিসের ধারণা, ওঁর দ্বিতীয়পক্ষটি খুব খামখেয়ালি বিবি ছিলেন। হঠাৎ ‘উঠল বাই তো মক্কা যাই’ গোছের স্রেফ খেয়াল ছাড়া আর কিছু নয়।
তাছাড়া গুপ্টা সায়েব ও বাড়িতে গিয়ে থাকলে ইদ্রিসের একটা বড় অস্বস্তি দূর হয়। কেউ আর গিয়ে জবরদখল করে বসতে পারবে না। সরকারও খালি কোঠি’ বেমক্কা কেড়ে নিতে পারবেন না। ঠিক এজন্যেই তো ইদ্রিস কষ্ট করে মাসের পর মাস কলকাতা থেকে গিয়ে ওখানে রাত কাটাতেন।
তাই উনি প্রস্তাবটা শোনামাত্র বলেছিলেন–ইশা আল্লা! খুব ভালো, উদা বাত আছে। চলে যান এক্ষুণি, কোঠি তো আপনার আছে গুপ্টা সায়েব। রনু বাহাদুরকে চাবি দিয়ে আসছে। সব সমঝে দিচ্ছি ওকে। আভি পাঠাচ্ছি। বাহাদুর ঝামেলা করবে না।
ইদ্রিস খানের কাছে কিছু আর নতুন জানার নেই। এখন আনন্দকে দরকার। কর্নেল একটু কেশে বললেন–সত্যেন্দ্র আমি মিঃ গুপ্টার কর্মচারী আনন্দবাবুর সঙ্গে একবার কথা বলতে চাই।
সত্যেন্দ্র বলল–নিশ্চয় বললেন। চলুন, লালবাজার পৌঁছেই ওকে ডেকে পাঠাচ্ছি।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন–আমি এখন কিন্তু যাচ্ছি না তোমার সঙ্গে। বাসায় ফিরতে চাই। তুমি বরং আনন্দবাবুকে আমার বাসায় যেতে বলো। ঠিকানা দিয়ে দিও।
কর্নেল বাকি পথ চুপ করে থাকলেন। হুম, বাহাদুর লোকটা বউকে বড় ডরায়। রনু ঠিকই বলছিল। সব সময় সে বাচ্চা কোলে নিয়ে পাকা কুল পাহারা দেয় বউয়ের হুকুমে। আর দক্ষিণের গেটের দিকে লক্ষ্য রাখে। কেউ ঢুকলে ওখান থেকেই ধমক দেয়। উত্তরের দিকে কিছু ঘটলে সে টেরও পায় না। ৭ই মার্চ মাত্র একবার ওদিকে গিয়ে নতুন সায়েবকে দরজা খুলে দিয়েই দৌড়ে নিজের কাজে চলে এসেছিল সে। সেদিন আর যায়নি। গিয়েছিল ওর বউ লক্ষ্মীরানী। লক্ষ্মী সায়েবদের এক বালতি জল দিয়ে আসে সন্ধ্যার দিকে। তারপর সেও আর সেদিনের মতো যায়নি। পরদিন ৮ই মার্চ সকালে বাহাদুরকে ডাকেন সায়েব। বাহাদুরকে এক বালতি জল দিতে বলেন। সে জল দিয়ে আসে। দুপুরে একবার সায়েব ও মেমসায়েব বেরিয়েছিলেন। দক্ষিণের গেট দিয়ে হেঁটে দু’জনে বেরোন। সেই সময় বাহাদুরকে জিগ্যেস করেন, কোন্ রাস্তায় গেলে বাজার বা হোটেল পড়বে। ওঁরা খেতে বেরিয়েছিলেন। ফেরেন আন্দাজ ঘণ্টা দুই পরে। বাজারের দিকে তিনটে বড় হোটেল আছে। পান্থনিবাস হোটেলের মালিক যা বর্ণনা দিয়েছে, তাতে বোঝা যায় যে ওঁরা সেখানেই লাঞ্চ সেরেছিলেন। বাহাদুরের বউ লক্ষ্মী খুব চাপা মেয়ে। খুব কম কথা বলে। কী যেন জানে ও, বলতে চায় না।
কর্নেল একবার ভাবলেন, এ তাঁর নিছক অনুমান–পরে ভাবলেন, তাহলে লক্ষ্মীর মুখে কেন হঠাৎ অমন ভাবান্তর লক্ষ্য করলেন তখন?
ভাবান্তর একটা ঘটেছিলই। উত্তরোত্তর এ সন্দেহ দৃঢ় হল। লক্ষ্মী কিছু একটা গোপন করেছে, এ ধারণা কিছুতেই গেল না কর্নেলের মন থেকে।
কিন্তু ওই অশিক্ষিতা লক্ষ্মীর কাছ থেকে কথা আদায় করা স্বয়ং ঈশ্বরের পক্ষেও যেন অসম্ভব। অনেক কূট প্রশ্ন করেও পাত্তা পাননি কর্নেল। লক্ষ্মীর এক কথা–সে ওদিকে আর যায়নি। কিছু শোনেনি বা দেখেওনি।
অথচ……।
কর্নেল নড়েচড়ে বসলেন। শ্যামবাজার চৌমাথা পেরোচ্ছে পুলিশের গাড়ি। বললেন–আমাকে চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউতে মহাত্মা গান্ধী রোডের মোড়ে নামিয়ে দেবে, সত্যেন্দ্র।
সত্যেন্দ্র বলল–কেন বাসায় ফিরবেন না?
–ফিরব। ওখানে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে যাব। আমার জন্যে ব্যস্ত হয়ো না।
–আপনার লাঞ্চের দেরি হয়ে যাবে কিন্তু।
কর্নেল হাসলেন। না। ওখানে আমার নেমন্তন্ন আছে। এইমাত্র মনে পড়ল।
বড় রাস্তার ওপর বাড়িটা। পাঁচতলা বিশাল বাড়ি। রাজস্থানি স্থাপত্য। কর্নেল মুখ তুলে এক মিনিট বাড়িটার ছাদ অব্দি দেখলেন। তারপর সরু গলিতে ঢুকলেন। বাঁদিকে চওড়া সিঁড়ি। লিফট নেই। বুড়োদের পক্ষে নিশ্চয় খুব কষ্টকর ব্যাপার। তবে কর্নেল অন্য মানুষ। এখনও অনেক কুস্তিগীরকে ধরাশায়ী করার মতো জোর ও কৌশল তাঁর আছে।
অবশ্য কেউ তাঁকে এ বাড়িতে লড়াই দেবার জন্যে অপেক্ষা করছে না। চারতলায় উঠে একটা ফ্ল্যাটের বোতাম টিপলেন। এখন অসময় দেখা করার পক্ষে। কিন্তু কাজটা সেরেই যেতে হবে।
একটি সুন্দর স্বাস্থ্যবান কিশোর দরজা খুলে হিন্দিতে বলল–কাকে চান?
–তোমার নাম কী বাবা? …বলে কর্নেল মিষ্টি হেসে ওর চিবুকটা নেড়ে দিলেন।
কিশোরটি ভুরু কুঁচকে ওঁকে দেখছিল। এবার বিরক্ত হয়ে বলল–কে আপনি?
–তোমার বাবার বন্ধু। মাকে বলো আমার কথা।
কিশোরটি মুখ ঘুরিয়ে ডাকল–মা, দেখ তো কে এসেছেন।
একটি মহিলা-চল্লিশের মধ্যে বয়স, সুশ্রী চেহারা, দরজার কাছে এসে বললেন–কাকে চাই আপনার?
কর্নেল একটু হাসলেন। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। মিঃ গুপ্টার… ।
মহিলাটি গম্ভীর হয়ে বললেন–আপনি কি পুলিশের লোক?
কর্নেল জবাব দিলেন–মোটেও না। আমি মিঃ গুপ্টার একজন বন্ধু। দুঃখের ব্যাপার, কাগজে ওঁর মৃত্যুর খবর দেখলুম–প্রথমে বুঝতেই পারিনি উনি আমার বন্ধু প্রকাশ গুপ্টা কি না। পরে খোঁজ নিয়ে জানলুম, ব্যাপারটা তাই! খুব বিচলিত হয়ে পড়লুম। ওঁর সঙ্গে আমার বহুকালের দোস্তি ছিল। বেচারা গুপ্টা..
মহিলাটির দু’চোখ হঠাৎ জ্বলে উঠল। –থাক্। আর দোস্তের জন্য আপনি সিমপ্যাথি দেখাবেন না। আপনারাই তো ওঁকে পাপের পথে ঠেলে দিয়েছেন! আপনারাই অমন ভাল মানুষটার সর্বনাশ করেছেন! এখন এসেছেন আমাকে সান্ত্বনা দিতে! আমি কারও সান্ত্বনা চাইনে! আপনি দয়া করে আসুন।
কর্নেল বিব্রতমুখে কিছু বলতে যাচ্ছেন, সেই সময় একটি যুবক মিসেস গুপ্টার পিছনে এসে দাঁড়াল। তার চেহারা দেখে মনে হল, সে বাঙালি। সে বলল–কী হয়েছে ভাবীজী? কে উনি?
কর্নেল বাংলায় বললেন–যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে, মাই ডিয়ার ইয়ং ম্যান, আপনি নিশ্চয় আনন্দ সান্যাল?
-হ্যাঁ। আপনি কে?
বলছি। কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে তো কথা বলা যাবে না আনন্দবাবু!
মিসেস্ গুপ্টা আর একবার ওঁর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে সন্দিগ্ধভাবে বললেন–খুব জরুরি কিছু বলার থাকলে আসুন। তবে আগেই বলে রাখছি, কোম্পানির কোন ব্যাপারে আমি এখন কথা বলব না। বোম্বে থেকে আমার দেওর আসছে। সে এলে কথা হবে।
কর্নেল একটু হেসে বললেন–আনন্দবাবু, আপনার বন্ধুরা আপনার বন্ধুরা মানে পারুল অ্যাডের বিজনবাবুরা আমাকে চেনেন। আমি…
আনন্দ এবার লাফিয়ে উঠল। চিনেছি স্যার! আপনি কর্নেল সরকার। ডেসক্রিপসন মিলে যাচ্ছে। আমি আপনার কাছে যেতুম, স্যার।
মিসেস্ গুপ্টা অবাক হয়ে আনন্দের দিকে তাকালেন। আনন্দ ওঁর কানেকানে কিছু বলল। তখন উনি বললেন–আপ অন্দর আইয়ে!
মিঃ গুপ্টার বড় বউ জাঁদরেল ধরনের গৃহিণী সন্দেহ নেই। ঘরদোর পরিচ্ছন্ন, সাজানো-গোছানো। সবখানে পরিবারের ধর্মানুরাগের পরিচয় সুপ্রকট। বসার ঘরে ঢুকে কর্নেল লক্ষ্য করলেন–মিঃ গুপ্টার একটি বিশাল ছবিতে মালা দেওয়া রয়েছে। ভারতীয় নারীরা সত্যি খুব অবাক করে দেয়! একটি বারো তের বছরের ফুটফুটে মেয়ে ও একটি আট-ন’বছর বয়সের সুন্দর ছেলে একবার উঁকি দিয়ে চলে গেল। আঃ, এমন সুন্দর পবিত্র সংসার ফেলে প্রকাশ গুপ্টা কী খুঁজে পেয়েছিল মিলি সেনের কাছে? ভাবতে কষ্ট হয়।
কর্নেল বসলেন। আনন্দও একপাশে বসল। মিসেস গুপ্টা সামনে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে রইলেন। শোকের মলিনতা এরই মধ্যে কাটিয়ে উঠেছেন মহিলাটি। এটা মেয়েরাই পারে সম্ভবত। তারা সর্বংসহা। কর্নেল মনে মনে তারিফ করলেন।
আনন্দ বলল–জানেন? আমিও বিজনদের সঙ্গে আপনার কাছে যেতুম। কিন্তু এ বাড়িতে ভাবীজীকে সামলানো, ওদিকে কোম্পানি–এসব নিয়ে একটু ফুরসত পাচ্ছিলুম না।
কর্নেল বললেন–আনন্দবাবু, আপনাকে আমি পরে প্রশ্ন করব। আপাতত মিসেস্ গুপ্টার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা সেরে নিই।
মিসেস্ গুপ্টা বললেনবলুন।
–আপনি বসুন, প্লিজ।
উনি বসলেন। কর্নেল এক মিনিট চুপ করে থাকার পর বললেন–ঊর্মি দেবীর সঙ্গে মিঃ গুপ্টার সম্পর্কের কথা কি আপনি জানতেন?
মিসেস্ গুপ্টা মুখ নামিয়ে জবাব দিলেন–হ্যাঁ।
আনন্দ চমকে গেল, তা লক্ষ্য করলেন কর্নেল। তারপর বললেন–আনন্দের কাছে শুনেছিলেন, নাকি অন্য কোন উপায়ে জেনেছিলেন?
–আনন্দ আমাকে কিছু জানায়নি। বেচারিকে আমি এর জন্যে এতটুকু দোষ দিইনে। ও খুব ভাল ছেলে। ও মাথার ওপর না থাকলে আজ খুব বিপদে পড়ে যেতুম। ও কী করবে? মনিবের বদমাইসি কি তার কর্মচারী মনিবের স্ত্রীর কাছে বলতে সাহস পায়? তবে আমি বরাবর জানতুম। জেনেও আর কী করব? মিঃ গুপ্টাকে ফেরাবার সাধ্য আমার ছিল না।
–কীভাবে জানতে পেরেছিলেন?
–সে অনেক কথা। গত বছর অব্দি আমরা বোম্বেতে ছিলুম। ওঁর ব্যবসাও ছিল সেখানে। মেসিনারি জিনিসপত্রের দালালির কারবার ছিল কতকটা অর্ডার সাপ্লায়ের মতো। হঠাৎ উনি কলকাতায় ব্যবসা করবেন বললেন। চলেও এলেন। দু’মাস পরে আমাদের নিয়ে এলেন। আমি ভাবলুম, ভাল হল। বেশ্যা মেয়েটার হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেল। কিন্তু এখানে এসেই টের পেলুম, ওঁর কলকাতা আসার কারণ কী। মেয়েটা ক্যামাক স্ট্রিটের একটা ফ্ল্যাটে রয়েছে। আর…
বাধা দিলেন কর্নেল। আপনার প্রথম প্রশ্নের জবাব পাইনি কিন্তু!
-হ্যাঁ, বোম্বাতে উনি ফিল্ম লাইনেও ঘুরতেন। বলতেন–ছবি প্রডিউস করবেন। ওঁর এক বন্ধু ছিলেন প্রডিউসার। ভদ্রলোক মাদ্রাজিনাম, নারায়ণ কুমারমঙ্গলম।
–মাদ্রাজি! কর্নেল চমকে উঠলেন।
–হ্যাঁ। …বলে একটু চুপ করে গেলেন মিসেস্ গুপ্টা। তারপর বললেন– এসব কথা বলা হয়তো উচিত নয়। কিন্তু বলছি। পাপ কখনও চাপা থাকে না। কুমারমঙ্গলমের সঙ্গে মিলে উনি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কুমারমঙ্গলমও খুব একটা পয়সাওয়ালা ছিলেন না। কিন্তু মাথায় ফিল্মের হাওয়া ঢুকলে যা হয়। দুই বন্ধু মিলে ষড়যন্ত্র করলেন। মিঃ গুপ্টার দু’ভাই। বড়ভাই মারা গিয়েছিলেন অনেক পয়সা কামিয়ে। ওঁর একটি মাত্র ছেলে ছিলনাম রূপেশ।
কর্নেল দ্বিতীয়বার চমকে উঠলেন। –রূপেশকুমার!
-হ্যাঁ, ফিল্মে ওই নাম নিয়েছিল বেচারা। বোকা ছেলে! চাচার ষড়যন্ত্র জানতে পারেনি। রূপেশের মাও সরল সাদাসিধে মেয়ে। আমার স্বামী ভেবেছিলেন, রূপেশকে সরাতে পারলে ওঁর সম্পত্তি কায়দা করতে দেরি হবে না। সেই লোভে আমার স্বামী স্যুটিংয়ের সময় নকল রিভলবারের বদলে আসল গুলিভরা রিভলবার পাচার করলেন বেশ্যা মেয়েটার হাতে। সে ছিল ওই ছবির হিরোইন। আগে থেকে সব ঠিক করা ছিল।
–কিন্তু আপনি জানলেন কীভাবে, এখনও বলেননি কিন্তু।
আমাদের সোফার ছিল আমার বাবার দেশের লোক। তার কাছে। জেনেছিলাম। কলকাতায় এসে তার কাছেই জানতে পারলুম, এখানে আমার স্বামী কী করছেন।
-হুম্ তারপর?
–গাড়িটা বেচে দিলেন উনি গত মাসে। বেচারার চাকরিও গেল। ও বোম্বে ফিরে গেল। যাবার দিন দেখা করেও যায়নি। এখন ভাবছি, লোকটা থাকলে হয়তো আরও অনেক কিছু জানতে পারতুম।
–মিঃ গুপ্টা এবং ঊর্মি দেবীকে কে খুন করেছে বলে আপনার ধারণা, জানতে পারি কি মা?
মাথা নাড়লেন মিসেস্ গুপ্টা। জানি না। তবে আমার সন্দেহ…
–হ্যাঁ, বলুন বলুন!
–সন্দেহ করতুম না। কিন্তু আনন্দ এতদিনে সন্দেহটা মাথায় ঢুকিয়ে দিল। আনন্দই বলুক বরং।
কর্নেল আনন্দের দিকে সপ্রশ্ন তাকালেন। আনন্দ কুণ্ঠিত মুখে বলল– সন্দেহটা ভুল হতেও পারে। তবে মাঝেমাঝে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের একটা বাড়িতে এক ভদ্রলোকের কাছে আমাকে পাঠাতেন সায়েব। একটা প্যাকেট দিতেন উনি। প্যাকটটা গুপ্টা সায়েবকে পৌঁছে দিতাম। বেশ বড় প্যাকেট। বলতেন স্মাগলিং করে আনা বিলিতি মদ আছে। কখনও বলতেন কাপড় আছে। বার তিনেক আমি এনেছি গত তিনমাসে। প্রতি মাসের প্রথম সপ্তায় নির্দিষ্টা একটা তারিখে আমাকে যেতে হত। কোন মাসে দু তারিখ, কোন মাসে সাত তারিখে। ভদ্রলোক খুব বদরাগী। সায়েবেরই বয়সী। ফেব্রুয়ারি মাসের সাত তারিখে গেলে প্যাকেট দিলেন–বেশ ভারী। কিন্তু খুব ধমকালেন আমাকে। তারপর বললেন–গুপ্টাকে বলো, আর কারবার চলবে না এভাবে। সব কিছুর শেষ হয়ে যাবে। আমি তো তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলুম। ফিরে এসে ওঁকে বললে উনি রেগে গেলেন। বললেন, ঠিক আছে, আমি এবার থেকে নিজেই যাব মোকাবিলা করতে।
কর্নেল হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। আজ চলি তাহলে। আনন্দবাবু, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের সেই ঠিকানাটি কি আপনার মনে আছে?
আনন্দ বলল-খুব আছে স্যার।
–একটা কাগজে লিখে দিন।
মিসেস্ গুপ্টা শশব্যস্তে বললেন কর্নেল সাহাব, প্লিজ মাফ করবেন। এক গেলাস সরবত খেয়ে যান। আমার ভুল হয়ে গেছে।
কর্নেল হাত তুলে মিষ্টি হাসলেন। পরে হবে মা, আজ চলি।…
.
শেষ দৃশ্য
পরদিন সকালে কর্নেলের ফ্ল্যাটের দরজায় ঘণ্টা বাজল।
ষষ্ঠীচরণ এসে বলল–কে একজন দেখা করতে এসেছেন!
কর্নেল বললেন–পাঠিয়ে দে।
একটু পরেই ভদ্রলোক ঢুকলেন। খুব উদ্বিগ্ন, ব্যস্ত আর উত্তেজিত। কর্নেল বললেন–আসুন মিঃ ভরদ্বাজ, বসুন।
–আপনি আমাকে চেনেন?
–ছবি দেখেছিলুম। বসুন দয়া করে।
অবনীবাবু বললেন।– কী ব্যাপার কর্নেল সরকার? সেলিম ট্রাঙ্ককল করল– ওদিকে বোম্বে পুলিস গতকাল স্টেটমেন্ট নিল, আমি বোম্বে থেকে রওনা হওয়ার সময় থেকে বোম্বে ফেরা অব্দি কোথায় কোথায় গেছি বা কী করেছি! হরিবল্ ব্যাপার!
–উদ্বিগ্ন হবার কোন কারণ নেই মিঃ ভরদ্বাজ।
–অদ্ভুত ব্যাপার। সেলিম খুলে কিছু বলেনি। শুধু বলল–যদি স্ক্যান্ডালের হাত থেকে বাঁচতে চান অবনীদা, এক্ষুণি কলকাতা এসে কর্নেল সরকারের সঙ্গে দেখা করুন। ও আপনার ঠিকানাও জানিয়েছিল। আমি এইমাত্র দমদম এয়ারপোর্ট থেকে সটান আপনার কাছে চলে এসেছি।
–সেলিমকে আমিই কাল বিকেলে ট্রাঙ্ককল করতে বলেছিলুম।।
–কিন্তু ব্যাপারটা কী?
কর্নেল ওঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বললেন–৮ই মার্চ বিকেলে ঠিক ক’টায় আপনি ব্যারাকপুর কুঠিবাড়িতে গিয়েছিলেন?
অবনীবাবু চমকে উঠে বললেন–আমি? আমি…
–প্লিজ, গোপন করবেন না।
হা। গিয়েছিলুম। মিলি আমাকে বলেছিল ওইদিন বিকেলে ওখানে যেতে।
মিলির সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ছিল তাহলে?
–মোটেই না। হঠাৎ বোম্বেতে ওর চিঠি পেয়েছিলুম। দীর্ঘ চিঠি। রূপেশকে হত্যার ষড়যন্ত্র এবং আদ্যোপান্ত সব লিখেছিল। ও নাকি এতদিনে ভুল বুঝতে পেরেছে। তাছাড়া খুব বিপন্ন হয়ে পড়েছে। মাসের পর মাস ওকে ব্ল্যাকমেইল করছে একজন। আমি গিয়ে যেন ওকে বাঁচাই। চিঠি পেয়ে খুব মায়া হল। ইতিমধ্যে কলকাতা যাবার প্রোগ্রাম ছিল আমার। এলুম–এসে ওর কথামতো ফোন করলুম। ও একটা জায়গার নাম বলল–দক্ষিণ কলকাতার একটা রেস্তোরাঁর। সেখানে দেখা হল। খুব কান্নাকাটি করল। ওকে বাঁচাতে হবে। ওকে ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে অদ্ভুতভাবে।
–রাইট, রাইট। এমন আজব ব্ল্যাকমেইলের কথা শোনা যায় না! ওকে ব্ল্যাকমেলারের স্ত্রী সেজে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে। নয়তো ফেরারি আসামীকে তক্ষুণি পুলিসের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
-আপনি তাহলে জানেন!
–আমার ধারণা তাই। আপনি এবার বলুন।
–মিলির মতে, এতে একটা সুবিধে অবশ্য তার হচ্ছে। ব্ল্যাকমেলার মিঃ গুপ্টার আশ্রয়ে থাকায় পুলিসের দিক থেকে নিশ্চিন্ত থাকছে সে। বিনিময়ে বেচারাকে দেহটা ভোগ করতে দিতে হচ্ছে। কিন্তু এ তো বরাবর মানুষ পারে না। ও একটা মুক্তি খুঁজছে। আমি ছাড়া কেউ নাকি ওকে বাঁচাতে পারে না। যাই হোক, আমি উদ্বিগ্ন হলুম। আফটার অল, অমন চেহারা শিখিয়ে-পড়িয়ে ভবিষ্যতে স্টার করার সম্ভাবনা নিশ্চয় ছিল। আমি ভাবতে থাকলুম, কী করা যায়। ও আমার হোটেলের ঠিকানা নিল। পরদিন দুপুরে–৭ই মার্চ তারিখে ফের ফোন করবে বলল। তারপর ঠিকই ফোন করল। কিন্তু হঠাৎ নাকি মিঃ গুপ্টা ওকে ব্যারাকপুর বাগানবাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। অতএব আমি যেন ৮ই মার্চ বিকেলে ওখানে চুপি চুপি গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করি। মিঃ গুপ্টা ওসময় কলকাতায় থাকবে। মিলি জানে, গুপ্টাকে নাকি ওইদিন বিকেলে কলকাতায় থাকতেই হবে।
–আপনি তাহলে কথামতো গেলেন?
–হ্যাঁ। কিন্তু গেটের কাছে ট্যাকসি থেকে নামতেই দেখি এদিকের বারান্দায় একটি ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মিলি আমাকে উত্তর দিক ঘুরে যেতে বলেছিল। কঠোরভাবে নিষেধ করেছিল যে, যেন কেউ আমাকে না দেখতে পায়। কারণ, মিলির কাছে কে আসে–গুপ্টা তার কড়া খবর রাখতে অভ্যস্ত। সে জানতে পারলে মিলিকে মারধর করবে। অতএব উত্তর দিক ঘুরে ভাঙা পাঁচিল গলিয়ে ঢুকলুম। ঢুকে দরজায় কড়া নাড়লুম। কোন সাড়া পেলুম না। ঠেলতেই দরজা ফাঁক হল। তখন ঢুকে ওর নাম ধরে ডাকলুম। কানের ভুল হতেও পারে আবছা শব্দে মনে হল, ও আসছে। তখন নিশ্চিন্ত হয়ে বসার ঘরের সোফায় বসলুম। বসে আছি তো আছিই। তখন অবাক লাগল। হঠাৎ দেখি কে একজন সাঁৎ করে ঘর দিয়ে বেরিয়ে গেল। চেনা মনে হল। ওই ঘরটায় দেখেছেন নিশ্চয়, একেবারে আলো থাকে না দিনদুপুরেও। কিন্তু যেমনি ও বাইরের দরজার পর্দা তুলল, চিনলুম। তখন অজানা ভয়ে বুক কেঁপে উঠল। এ যে মিঃ গুপ্টার সেই জুটি! তখন বেডরুমে গিয়ে উঁকি দিলুম। তারপর যা দেখলুম, আমার দম বন্ধ হয়ে গেল।….
কিন্তু জুতো খুলে রেখে কেন?
–পায়ে হাল্কা স্লিপার ছিল। পা তুলেই বসেছিলুম। সেই অবস্থায় ব্যস্ত হয়ে উঠে গেছি।
–প্লিজ, গোপন করবেন না।
একটু ইতস্তত করে অবনীবাবু বললেন–মানে, আমার সাবকনসাস মনে হয়ত ধারণা হয়েছিল যে কোন ফাঁদে পড়ে গেছি। নির্ঘাৎ মিলিকে ব্যাটা খুন করেছে! জাস্ট ইনটুইশান! এ অবস্থায় আমার সতর্ক হওয়া দরকার মনে হয়েছিল। ..
–আপনি বুদ্ধিমান, মিঃ ভরদ্বাজ। যাই হোক, গিয়ে দেখলেন দুটি মৃতদেহ পড়ে রয়েছে।
–হ্যাঁ। সে এক বীভৎস দৃশ্য! আমি জুতো আর পায়ে দিলুম না–পাছে জুতোর ছাপ পড়ে। অমনি বেরিয়ে সেই পাঁচিল ডিঙিয়ে পালালুম।
–আপনি কিন্তু ওই ঘরে বসে একটি সিগারেট খেয়েছিলেন।
–হ্যাঁ।
–দেখুন মিঃ ভরদ্বাজ, খুনীকে আপনি ছাড়াও আরো দু’জন দেখেছিল। তার আসার সময় দেখেছিল, যাবার সময় কিন্তু দেখতে পায়নি আর। কারণ, সে পালিয়েছিল সেই ভাঙা পাঁচিলের পথে। তার কাছে একটা গ্লাস ছিল আপনি দেখেননি নিশ্চয়?
–না। লক্ষ্য করিনি। কেন, গ্লাস কেন?
–পরে বলব’খন। গ্লাসটা কাল বিকেলে ফরেনসিক এক্সপার্টরা ভাঙা পাঁচিলের ইটের তলায় আবিষ্কার করেছে। আমি কাল সন্ধ্যায় আবার ওখানে গিয়েছিলুম। অবশ্য ছুরিটা পাইনি।
–কিন্তু আর কারা দেখেছিল ব্যাটাকে?
বাহাদুর দারোয়ান আর তার বউ। বাহাদুর তো বউকে ভীষণ ভয় করে। ওর বউ চেপে গিয়েছিল–পাছে পুলিসের হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়ে। কাল চাপে পড়ে বাহাদুরের বউ সব কবুল করেছে।
–কিন্তু কর্নেল সরকার, এখনও আমি বুঝতে পারছি না, কেন কুমারমঙ্গলম খুন করল গুপ্টা আর মিলিকে?
এ ব্যাপারটাকে বলব এ সার্কেল অফ ব্ল্যাকমেলিং! একটা বৃত্তের মতো। গুপ্টা ব্ল্যাকমেইল শুধু মিলিকেই করত না, কুমারমঙ্গলমকেও করত। কারণ রিভলভারটার মালিক ছিল কুমারমঙ্গলম। অস্ত্রটা মিলি স্যুটিংয়ের জায়গাতেই ফেলে রেখে আসে–তা আপনি নিশ্চয় জানেন! রীতিমতো লাইসেন্স ছিল কুমারমঙ্গলমের নামে। তাই তাকেও ফেরার হতে হয়। ঘুঘু প্রকাশ গুপ্টা কীভাবে জানতে পারে যে লোকটা কলকাতায় রয়েছে। সম্ভবত মিলি কুমারমঙ্গলমের সঙ্গে যোগাযোগ। রাখত।’সে রহস্য অবশ্য এখন আর জানা কঠিন। যদি কুমারমঙ্গলম কবুল করে, তবে অন্য কথা।
এইসময় ফোনে রিঙ বাজল। কর্নেল রিসিভার তুলে বললেন–হ্যালো, এন. এস. কথা বলছি।
কর্নেল! সত্যেন্দ্র বলছি। গুড নিউজ।
–পাখি ধরেছ?
–হ্যাঁ। চলে আসুন কর্নেল।
–অবশ্যই।
.
মিঃ কুমারমঙ্গলমকে তখন বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের বাড়ি থেকে লালবাজারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাহাদুর, তার বউ, অবনী ভরদ্বাজ–তিনজনেই সনাক্ত করেছে। আনন্দও একসময় এসে সনাক্ত করল। হা-এর কাছ থেকেই প্যাকেট নিয়ে যেত সে।
প্যাকেটে থাকত টাকা। কুমারমঙ্গলম কলকাতায় এসে চোরা নার্কোটিকসের ব্যবসা ধরেছিল। বেশ কামাচ্ছিল। কিন্তু মনে শান্তি ছিল না। প্রকাশ গুপ্টার চোখকে সে ফাঁকি দিতে পারেনি।
এমন ঢালাও অবাধ চোরাকারবারের জায়গা তো আর কোথাও নেই। টাকার লোভে কুমারমঙ্গলম চলে যেতে পারছিল না। অতএব ঠিক করল যে গুপ্টাকে, সরাতে হবে। তাই সে মিলির সঙ্গে যোগাযোগ করল। মিলি গুপ্টাকে অনেক আগেই জানে মেরে দিতে পারত। সাহস পাচ্ছিল না। এবার দোসর জুটে সাহস পেল। কিন্তু ক্যামাক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে কাজটা করার চেয়ে কোন নির্জন জায়গা সে খুঁজল। দানিয়েল কুঠি কিনতে চেয়েছিল গুপ্টা নিজে বড় বউয়ের দৃষ্টির আড়াল হবার জন্যে। মিলি প্ল্যানটা কাজে লাগাল। তবে গুপ্টা তড়িঘড়ি বাগানবাড়িতে চলে যাবার কারণ অবনী ভরদ্বাজের আবির্ভাব। মিলির ফোনে ট্যাপ ছিল। গুপ্টা সব টের পেয়েছিল তাই।
পটাসিয়াম সাইনায়েড কুমারমঙ্গলম দিয়েছিল মিলিকে। গুপ্টার সেদিন টাকা আনতে যাবার কথা ওর কাছে। কিন্তু মনে সন্দেহ। তাই থেকে গেল সেদিনটা। নড়ল না। মিলি ওকে আদর করে মদ দিল। গুপ্টা কিন্তু এদিকটা ভাবেনি কখনও। মদে চুমুক দিয়েই পড়ে গেল। মিলি তখন ছটফট করছে। পালাতে হবে। কুমারমঙ্গলমের অপেক্ষা করছে সে। অবশেষে কুমারমঙ্গলম এল। লাশের কাছে দাঁড়িয়ে কিন্তু হঠাৎ ভয় হয়ে গেল তার।
কর্নেল বর্ণনা করছিলেন কেসটা। এবার থামলেন একটু। তারপর বলেন, এটা অদ্ভুত হিউম্যান সাইকলজি। কুমারমঙ্গলম কোনদিন মহিলাদের প্রতি আসক্ত ছিল না। একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ছিল টাকা গুপ্টার লাশের কাছে দাঁড়িয়ে হঠাৎ তার প্রচণ্ড ভয় হল মিলিকে। এই যুবতী সুন্দরী মেয়েটি টাকার লোভে একদিন নির্দোষ নিরীহ একটি ছেলেকে গুলি করতে পেরেছিল। এবার অক্লেশে গুপ্টাকেও বিষ দিয়ে মারতে পারল। এপর যদি কেউ ওকে কুমারমঙ্গলমকে খুন করতে বলে–সে চোখ বুজে তাই করবে–একটুও হাত কাঁপবে না। অতএব সে তীব্র ঘৃণায় উত্তেজিত হয়ে পড়ল। এ একটা হঠকারী সিদ্ধান্ত মাত্র। এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল ওর পক্ষে। ও সুযোগ খুঁজল। মিলির হাতে তখনও মদের গ্লাস। মিলি নির্বিকার। ওর মতো ঠাণ্ডা নির্বিকার মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না। ও হাসতে হাসতে বলল– এবার তুমি মনের আনন্দে ফিল্ম করতে পারবে। অবনী ভরদ্বাজকে আমি. আসতে বলেছি এখানে। ও আসুক। ও খুব প্রভাবশালী লোক। পুলিশকে ম্যানেজ করে দেবে। তারপর আমরা ফিল্ম প্রডিউস করব। তোমার তো অনেক টাকা এখন।
কুমারমঙ্গলম অমনি ভড়কে গেল আরও। নাঃ, এক্ষুণি পালাতে হবে এই ডাইনীর হাত থেকে। কিন্তু পালানোর আগে তাকে শেষ করে যেতে হবে। সঙ্গে ছোরা ছিল। কিন্তু এ কাজে সে আনাড়ি। সে নার্ভও নেই। তখন ও চালাকি করল।–মিলি, আমার মনে হচ্ছে, কে যেন এসেছে বা আসছে। পায়ের শব্দ পেলুম। দেখে এস তো, মিঃ ভরদ্বাজ এলেন নাকি? মিলি ব্যস্ত হয়ে অপেক্ষা করছিল। বেরিয়ে গেল তক্ষুণি।
মদের গ্লাসটা রেখে গিয়েছিল মিলি। ছোরা মারার চেয়ে বিষ প্রয়োগ নিরাপদ নিঝাট। কুমারমঙ্গলমের পকেটে পটাসিয়াম সাইনায়েডের পুরিয়ে ছিল–যা থেকে খানিকটা সে গুপ্টাকে আগে দিয়েছিল।
ব্যস, মিলি ফিরে এসে ‘কেউ আসেনি’ বলল এবং নির্ধিধায় নিজের গ্লাসে চুমুক দিল। বিছানাতে ঢলে পড়ল। বিছানাতে পা ঝুলিয়ে বসে চুমুক দিয়েছিল সে। তারপর….
তারপর কুমারমঙ্গলম ভাবল, সে এবার মুক্ত। কিন্তু পাপী নিজের অলক্ষ্যে ফাঁদে গিয়ে পড়ে এবং ধরা দেয়।…..
কর্নেল চুপ করলেন। চুরুট ধরালেন। তারপর সত্যেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে বললেন–চলি, সত্যেন্দ্র।
আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার রাস্তায় নামলেন। আকাশ দেখলেন। চমৎকার আজ মার্চের সকালবেলাটা। আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকলেন। এখন কিছুক্ষণ হাঁটতেই ভাল লাগবে।…
Leave a Reply