সুন্দর বিভীষিকা

সুন্দর বিভীষিকা

আমার এই বৃদ্ধ বন্ধু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার সম্পর্কে সব বলতে গেলে একখানা আঠারো পর্ব মহাভারত হয়ে পড়ার ভয় আছে। আইন-আদালত সংক্রান্ত পত্র পত্রিকা এবং নানান জায়গায় পুলিশ জার্নালে যারা চোখ বুলিয়েছেন, তারাই জানেন লোকটা কে বা কী।

আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পুরনো দলিল-দস্তাবেজ হাতড়ে যাঁরা যুদ্ধের ইতিহাস লিখতে চান, আফ্রিকা ও বর্মাফ্রন্টে মাঝে মাঝে এক যোদ্ধার উল্লেখ পাবেন–তার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। উনিশশো বিয়াল্লিশে বর্মায় যে মার্কিন গেরিলাদলটি জাপানিদের পিছনে গিয়ে চোরাগোপ্তা লড়াই করেছিল, তাদের রেকর্ডেও এই নাম পাওয়া যাবে। তখন উনি ছদ্মবেশে বর্মিদের গ্রামে থাকতেন এবং গেরিলাদলটিকে প্রচুর খবরাখবর যোগাতেন।

যুদ্ধ শেষ হল। তারপর একদা ভারতবর্ষ স্বাধীন হল। তারপর কর্নেল নীলাদ্রি সরকার অবসর নিলেন। এবার তার খ্যাতি ছড়াল প্রকৃতিবিদ হিসেবে। শিকারের নেশা বরাবর ছিল। সেই সুবাদে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে উদ্ভিদ, পোকা মাকড় আর পাখি নিয়ে খোঁজখবর করতেন। অবসর নেবার পর এটাই হয়ে দাঁড়াল একটা বড় নেশা। দেশবিদেশের পত্রপত্রিকায় এসব ব্যাপারে প্রবন্ধ লিখতেন। বিজ্ঞানীদের তাক লাগিয়ে দিতেন। অনেক তর্কবিতর্ক হত। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার তাদের সরজমিনে নিয়ে গিয়ে নিজের প্রতিপাদ্য বিষয় প্রমাণ করে ছাড়তেন–এমনি জেদী মানুষ তিনি।

তখন অবশ্য আমার সঙ্গে পরিচয় ছিল না। হবার কথাও না। আমি কলকাতার এক প্রখ্যাত দৈনিক কাগজের রিপোর্টার। কাজের সূত্রেই এমন এক সাংঘাতিক ঘটনার মুখোমুখি গিয়ে পড়লুম, যার পরিণামে নিজেরই প্রাণ বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ল এবং কর্নেল ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল।

সে ছিল একটা আন্তর্জাতিক গুপ্তচর চক্রের ব্যাপার। স্থানীয় এক প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে তাদের যোগসাজশ ছিল। সেটা দৈবাৎ আমি আবিষ্কার করি এবং আমার সহকর্মী এক ফটোগ্রাফার খুন হয়ে যায়। আমাকেও শাসানো হয়। পুলিশ খুব একটা সুবিধে করতে পারছিল না। কারণ ওই নেতার প্রভাব ছিল প্রচণ্ড। অথচ আমার কাছে তেমন কোনো প্রমাণ ছিল না। যেটুকু ছিল, তা ফটোগ্রাফার বন্ধুটির ক্যামেরার মধ্যে ফিল্মে। সে খুন হবার সময় ফিল্মটাও খুনীরা হাতিয়ে নেয়।

যাই হোক, পুলিশ যখন খুনটা নিয়ে তদন্ত চালাচ্ছে, তখনই প্রথম কর্নেলের নাম আমি শুনি। প্রথমে ভেবেছিলুম, উনি কোনো গোয়েন্দা অফিসার। পরে জানলুম, না–শৌখিন গোয়েন্দা। কিন্তু পুলিশ মহলে ওঁর সুনাম প্রচণ্ডশেষ অব্দি কর্নেলের সহায়তায় আন্তর্জাতিক গুপ্তচরচক্র ধরা পড়ল এবং সেই রাজনৈতিক নেতাকেও পাকড়াও করা হল। আমাদের কাগজের বিক্রিসংখ্যা দু’লাখ থেকে রাতারাতি তিন লাখে দাঁড়াল। কর্নেলের নাম এবার সাধারণ মানুষও জানতে পারল। এবং দেখতে দেখতে আমিও ওঁর ন্যাওটা হয়ে উঠলুম।

ঠিক কবে থেকে এবং হঠাৎ কীভাবে উনি গোয়েন্দা হয়ে উঠলেন, আমাকে খুলে বলেননি। প্রশ্ন করলে রহস্যময় হেসেছেন শুধু। তবে আমিও উঁদে রিপোর্টার। আবছা অনুমান করেছি–অন্তত কীভাবে উনি ঘুঘু গোয়েন্দা হয়ে গেলেন।

প্রকৃতিবিদের পক্ষে সেটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। পোকামাকড়ের আচরণ পর্যবেক্ষণ কিংবা দুর্লভ জাতের পাখির পিছনে ঘুরে বেড়ানোতে তাদের প্রায় গোয়েন্দাগিরিই করতে হয়। কত সময় যায়, কত ধূর্তামির দরকার হয় এসব কাজে, কহতব্য নয়।

অবশ্য উনি বলেন–দেখ জয়ন্ত, একবার একটা মাকড়সার আচরণ দেখতে দেখতেই আমার গোয়েন্দাগিরি শেখা হয়ে গেছে। আমার কতকগুলো দুর্লভঁজাতের পোকামাকড়ের সংগ্রহ ছিল। সেবার প্রায়ই দেখতুম, একটা করে উধাও হয়ে • যাচ্ছে। কিন্তু সারাক্ষণ পাহারা দিয়েও ধরতে পারতুম না, এর রহস্যটা কী। অবশেষে আবিষ্কার করলুম, আমার কোটের মধ্যেই একটা মাকড়সা থাকে। এবং আশ্চর্য জয়ন্ত, আমার হাত দিয়েই সে খুনটা সেরে লাশ গুম করে। বুঝতে পারলে না? কোটের হাতা বেয়ে সে এগিয়ে কাঁচের জারে ঢোকে এবং…

বাকিটা বলার দরকার ছিল না। তবে কর্নেল প্রায়ই খুনের প্রসঙ্গে তাঁর বিচিত্র মাকড়সাতত্ত্ব আওড়ান। এইসব তত্ত্বটত্ব আমার সয় না। যদি নিছক তত্ত্ববাগীশ হতেন, তাহলে তো বন্ধুত্ব টিকতই না। আসলে উনি একজন ভ্রমণরসিকও বটে। আমার মধ্যেও এই ভ্ৰমণবাতিক আছে প্রচণ্ড। মাঝে মাঝে আমরা দু’জনে আজকাল বেরিয়ে পড়ি। জঙ্গলে পাহাড়ে সমুদ্রে যাই। কিন্তু কথায় আছে? অমুক যায় বঙ্গে তো কপাল যায় সঙ্গে। গিয়েই পড়তে হয় খুনের পাল্লায়। কর্নেল বলেন–আমার খুনের কপাল। তারপর গোয়েন্দাপ্রবর আর চুপ করে থাকেন না। স্বমূর্তিতে বেরিয়ে পড়েন।

এমনি একটি ঘটনা এখানে বলছি।…

তখন আমি তরাই অঞ্চলের বনেজঙ্গলে ভুতুড়ে চরিত্রের এই সঙ্গীর পাল্লায় পড়ে টোটো করে ঘুরছি। খাওয়া নেই, নাওয়া নেই, পিঠে পয়েন্ট দুশো পঞ্চাশ হাল্কা ম্যাগনাম অ্যান্ড ম্যাগনাম রাইফেল বেঁধে শুধু ঘোরা আর হন্যে হওয়া। সামনে কোনো বধ্য জানোয়ার দেখলেও রাইফেল তাক করার উপায় নেই। আমার বিদঘুটে সঙ্গীটি অমনি কাঁধে থাবা হাঁকড়ে কড়া দৃষ্টিতে তাকান। অবাক লাগে। এই বুড়ো বয়সে ভদ্রলোক অমন দৈত্যের মতো জোর পেলেন কোথায়… আর মোটে এক ফ্লাস্ক চা ও কয়েকটা রুক্ষ বিস্কুট গিলে তিনি কখনো হুমড়ি খেয়ে, কখনো বুকে হেঁটে, কখনো লাফ দিয়ে হীরাকুণ্ডার জঙ্গল পাহাড় তুলকালাম করে ফেলেন। উদ্দেশ্য এক দুর্লভ জাতের পাখির আস্তানা আবিষ্কার। বাইনোকুলার, ক্যামেরা আর কী সব আজগুবি যন্ত্র ওঁর সঙ্গে রয়েছে। প্রত্যেকটাই সর্বশেষ মডেলের এবং বিদেশী জিনিস। আমাকে ক্লান্ত দেখলেই উনি একটু হেসে বলেন–ডার্লিং জয়ন্ত, সামনের ওই পাহাড়টা দেখছ-ওটার সানুদেশে নির্মল জলের ঝর্না আছে। সেখানে গিয়ে আমরা বসব এবং বিশ্রাম করব।

এমন করে সেই স্যাঁতসেঁতে সেপ্টেম্বর মাসের এক বিকেলে তিনি আমাকে এমন এক জায়গায় তুললেন, যা সেই বিশাল জঙ্গলে এক আশ্চর্য বস্তু।

প্রথমেই থ বনে গেলুম, যখন দেখলুম একফালি চমৎকার পিচের রাস্তায় আমরা এসে পড়েছি। রাস্তাটা অবিশ্বাস্য লাগছিল। সারাদিন কোথাও যেখানে সভ্যতার এতটুকু চিহ্ন দেখিনি, সেখানে যেন আলাদিনের জাদু-পিদিমের কারচুপিতে আমার বৃদ্ধি বন্ধুটি এই চমৎকার সভ্যতা সৃষ্টি করে বসলেন। আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে উনি বললেন-জয়ন্ত, এই জঙ্গলে আরো অনেক আশ্চর্য জিনিস তোমাকে দেখব। চলে এস।

রাস্তাটা সংকীর্ণ। ঘুরে ঘুরে একটা পাহাড়ের গা-বেয়ে উঠে উত্তরে মিলিয়ে গেছে। কিন্তু উনি আমাকে আরও অবাক করে হঠাৎ দৌড়তে শুরু করলেন। বুঝলুম, সেই উড্ডাক নামক দুর্লভ প্রজাতির পাখিটি–যাকে অনুসরণ করে সারাটি দিন কেটে গেল, আবার তাকে দেখতে পেয়েছেন। পাখিটার স্বভাব বড় অদ্ভুত। খুব জোর উড়তে পারে না এবং বার বার উঁচু গাছের মগডালে বসে পড়ে। সেইসঙ্গে বারকতক ডেকে নিজের অস্তিত্বও ঘোষণা করে। আমার বন্ধুর মতে, বেচারা সঙ্গিনীর খোঁজে বেড়াচ্ছে। যাই হোক, এবার যখন উনি দৌড়লেন, বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলুম। এই রাস্তা ছেড়ে আর একচুল নড়তে রাজি নই।

তারপর দেখলুম, উনি হঠাৎ রাস্তা ছেড়ে ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া খাদের দিকে চলেছেন। সবখানেই ঝোঁপঝাড় আর উঁচুগাছের জঙ্গল। একটু পরে ওঁকে হারিয়ে যেতে দেখলুম। ভেবেছিলাম, পিছু ফিরে আমাকে ডাকবেন কিন্তু একবারও পিছু ফিরলেন না। বেমালুম অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

তখন আমি রাস্তার ধারে একটা পাথরের ওপর বসে সিগারেট ধরালুম এবং বিকেলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে চোখ রাখলুম। সেই সকালে বনদফতরের বাংলো থেকে বেরোবার পর এতক্ষণ অব্দি এই সৌন্দর্যের দিকে তাকাবার সুযোগ পাইনি। মনও ছিল না। পশ্চিমের পাহাড়শ্রেণীর চূড়া ছুঁয়ে সূর্য নরম গোলাপী রোদ ছুঁড়ে দিচ্ছে আমার দিকে। উত্তরের পাহাড়টা ন্যাড়া। তার ধূসর পাথুরে চেহারা খুব শান্ত আর অমায়িক দেখাচ্ছে। কেউ বলে না দিলেও মনে হল, খুব সম্ভব ওদিকে আর একটু এগোলেই নেপালের সীমানা পড়বে।

সূর্য পাহাড়ের আড়ালে নামল। ধূসর হয়ে উঠল সব আলো। এবার একটু উদ্বিগ্ন হলুম। বুড়ো তো এখনও ফিরলেন না। আমাদের এখন সাত মাইলের বেশি পথ ভেঙে বাংলোয় পৌঁছতে হবে। আর পথ মানে কী? পথটথের। কোনো ব্যাপার নেই। তার ওপর জন্তুজানোয়ার বেমক্কা হানা দিতে পারে। রাইফেল আর টর্চ অবশ্য আছে সঙ্গে। কিন্তু আচমকা কিছু ঘটলে তা কাজে। লাগাতে পারব কি না বলা কঠিন।

দিনের আলো খুব শিগগির ফুরিয়ে যাচ্ছিল। ক্রমশ উদ্বেগ বাড়ছিল আমার। হঠাৎ মনে পড়ল, ওঁর সঙ্গে তো কোনো অস্ত্রশস্ত্র নেই! সচরাচর কিছু জন্তু ঠিক এই সময় রাতের শিকারের বউনিতে বেরিয়ে পড়ে। জঙ্গলের অভিজ্ঞতা যতই থাক, নিরস্ত্র মানুষের পক্ষে কি এমন ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হচ্ছে? তাছাড়া, গাছপালার ওপর এখন অন্ধকার জমতে শুরু করেছে। উড্ডাকটা দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়। আর চুপ করে থাকা গেল না। মরিয়া হয়ে ডাক দিলুম কর্নেল! কর্নেল-সায়েব! আমার ডাক পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলল। কিন্তু কোনো সাড়া এল না।

এমন মানুষ কর্নেল যে বোকার মতো এখনও পাখির পিছনে ঘুরছেন, মনে হয় না। নাকি উনি পথ হারিয়ে ফেলেছেন? পথ হারাবার সম্ভাবনা ওঁর খুবই কম। কারণ এই অরণ্য এলাকার প্রতি ইঞ্চি যে ওঁর চেনা, তার প্রমাণ আজ দুদিন ধরে পেয়ে যাচ্ছি। তবে কি উনি পা ফসকে খাদে পড়ে গেছেন? ভাবতেই গা শিউরে উঠল। রাস্তার যেখানটা দিয়ে উনি নেমেছেন, সেখানটা বেশ ঢালু হয়ে গেছে। বোঝা যাচ্ছিল, ওদিকে গভীর খাদ আছে। কিন্তু দেখতে দেখতে অন্ধকার এত ঘন হয়ে উঠল যে সেপথে আমার পক্ষে যাওয়া এখন অসম্ভব। এতক্ষণে বুকের ভিতরটা ঢিপঢিপ করে উঠল।

আবার মরিয়া হয়ে হাঁক দিলুম কর্নেল! কর্নেল-সায়েব! আবার পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলতে তুলতে ডাকটা মিলিয়ে গেল। কোনো সাড়া পাওয়া গেল না! রাস্তাটা অস্বাভাবিক নির্জন। এতক্ষণ ধরে কোনো মানুষ বা গাড়িও আসেনি। টর্চটা বের করে উপরে নিচে চারপাশে আলো ফেলে আর একটা হাঁক দিলুম-কর্নেলসায়েব! তবু কোনো সাড়া নেই। এবার উদ্ভ্রান্ত হয়ে উত্তরের দিকে রাস্তা ধরে ডাকতে ডাকতে দৌড়লুম। এসময় কেউ আমাকে দেখলে ঠিক পাগলই ভাবত।

কিছুটা এগিয়ে রাস্তা পাহাড়ের দেয়াল পাশে নিয়ে এবার পশ্চিমে ঘুরেছে। তারপর পূর্বে মোড় নিয়েছে। যেখানে পাহাড়টা শেষ হয়েছে, তার ওপাশে কিছু সমতল কিছু উঁচু ঘন ওকবনে ঢাকা খানিকটা জমি দেখা গেল। তার পিছনে একটা টিলা আকাশে মাথা তুলেছে। সেখানে একটা আলো লক্ষ্য করলুম। আলোটা দেখামাত্র সাহস বেড়ে গেল। সেইসঙ্গে টের পেলুম, আসলে এতক্ষণ কারো সাহায্য পাব আশা করেই এই সিকি মাইল পথ দৌড়ে এসেছি। ওকবনের দিকে আলো ফেলে দেখলুম, একফালি এবড়োখেবড়ো সরু পথ চলে গেছে টিলাটার দিকে। আলোটা যে ইলেকট্রিক, তাতে কোনো ভুল নেই। কিন্তু ওকবনের রাস্তার ধারে কোনো খুঁটিখাটা নেই। তাই মনে হল, নিশ্চয় টিলার ওদিকে কোনো বড় রাস্তা আছে, যেখান থেকে আলোর সংযোগটা ঘটেছে।

আপাতত যে কোনো একজন মানুষ আমার দরকার। তাকে সঙ্গে নিয়ে কর্নেলের খোঁজে বেরিয়ে পড়ব। এ এলাকার কোনো জায়গাই আমার চেনা। নয়। সেজন্যেই এমন কাকেও দরকার, যে এলাকাটা ভালভাবে চেনে।

ওকজঙ্গলটা ঢালু হয়ে নেমে আবার টিলার দিকে উঠেছে। প্রায় দৌড়ে পিচের রাস্তা থেকে নেমে ওই জঙ্গলের রাস্তায় গেলুম। তারপর জঙ্গলটা আমাকে গিলে নিল। খুব সরু রাস্তা–মনে হল, প্রাইভেট রোড। বড় বড় পাথর বসিয়ে কোনরকমে গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছে যেন।

এই পথটুকু পেরোতে খুব বেশি সময় লাগল না। তারপর দেখলুম, আমি মোটামুটি ফাঁকা একটা জায়গায় পৌঁছে গেছি। রাস্তাটা ঘুরে টিলার গায়ে উঠেছে। এবং আন্দাজ দেড়শো থেকে দুশো ফুট উঁচুতে একটা বাড়ি আবছা দেখা যাচ্ছে। ওই বাড়ির একটা জানলাতেই আলোটা দেখা যাচ্ছে। বাকি অংশ অন্ধকার।

হাঁফাতে হাঁফাতে যখন ওই দেড়শো বা দুশো ফুট উঁচুতে বাড়িটার গেটে পৌঁছেছি, তখন বড় বাস্তার দিকে যেন গাড়ির শব্দ শুনতে পেলুম। একঝলক আলোও গাছপালার মাথায় শিসিয়ে উঠল। তারপর মিলিয়ে গেল। তাহলে রাস্তায় অপেক্ষা করলেও চলত।

যাই হোক, যখন এসে পড়েছি, স্থানীয় লোকের সাহায্যই ভাল হবে। গেট খুলে লনে দাঁড়ালাম। একটু ইতস্তত করলুম। নিশ্চয় অনধিকার প্রবেশ করছি। আবছা যেটুকু দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, বাড়ির মালিক শৌখিন এবং পয়সাওলা মানুষ। নিশ্চয় কোনো শৌখিন পুঁজিপতির শৈলাবাসে হানা দিতে যাচ্ছি। লোকটা ধমক দিয়ে ভাগিয়ে দেবে না তো? আরেকটা ভয় আবশ্য ছিল–তা কুকুরের। কিন্তু গেটে টর্চের আলো ফেলেও কোনো কুকুর গজাল না যখন, তখন বাড়িতে কোনো কুকুর নেই তা নিশ্চিত।

মরিয়া হয়ে এগোলুম। নুড়িবিছানো রাস্তায় আমার গামবুট দেবে যাচ্ছিল। শব্দ হচ্ছিল জোর। কিন্তু কোনো লোকের সাড়া পেলুম না তখনও।

সামনে কয়েক ধাপ কাঠের সিঁড়ির ওপর বারান্দা দেখতে পেলুম। তিনটে হাল্কা চেয়ার রয়েছে। বারান্দাভর্তি অজস্র টব। টবে গাছপালা আছে। আলো ফেললেও কেউ ধমক দিয়ে তেড়ে এল না। অথচ একটা ঘরে আলো জ্বলছে। পর্দা থাকায় ভিতরটা দেখা যাচ্ছে না। আমি বারান্দায় ইচ্ছে করে জুতোর শব্দ তুললুম। তারপর কাশলুম। তবু কোনো সাড়া নেই। ব্যাপার কী?

এবার একটু ইতস্তত করে ইংরিজিতে বলে উঠলুম–কেউ আছেন কি। স্যার?

তবু কোনো সাড়া নেই। আবার ডাকলুম। তবু জবাব নেই। তখন খুব জোরে বাঁদিকে আলোজ্বলা ঘরটার দরজায় ধাক্কা দিলুম।

এতক্ষণে মেয়েলি গলার চাপা ভিতু ধরনের সাড়া এল–কে?

 তখন খানিকটা রাগ হয়েছে আমার। অদ্ভুত ব্যাপার তো! এই সবে সন্ধ্যা হল। এরি মধ্যে নাক ডাকিয়ে ঘুমোনা হচ্ছিল? একটু ক্ষুব্ধ স্বরে বললুম-বাঘ ভালুক নই, একজন বিপন্ন মানুষ। দয়া করে বেরোবেন কি?

পরিষ্কার কথা ভেসে এল–না।

কী আশ্চর্য। আপনি না বেরোন, কোনো পুরুষমানুষকে ডেকে দিন।

–কোনো পুরুষমানুষ নেই এখন।

–সে কী! আপনি একা আছেন?

–হ্যাঁ।

–কে আপনি?

–আপনি কে?

পাল্টা প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেলুম। ঠিকই তো! নিজের পরিচয়টা আগে দেওয়া উচিত। কণ্ঠস্বর ভদ্র ও বিনয়ী করে বললুম–দেখুন আমার নাম জয়ন্ত চৌধুরী। কলকাতা থেকে এসেছি। বিখ্যাত দৈনিক সত্যসেবকের একজন সাংবাদিক।

–আমি তো কোনো ভি আই পি নই। আমার কাছে কী চান?

–আহা! কথাটা শেষ করতে দিন! আমি এসেছিলুম হীরাকুণ্ডা ফরেস্ট বাংলোয়। শিকারের হবি আছে, তাই। আমার সঙ্গে এসেছিলেন প্রখ্যাত প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর এবং হত্যাসংক্রান্ত অপরাধবিজ্ঞানী কর্নেল নীলাদ্রি সরকার…

বাধা এল।–কী বললেন?

কর্নেল সরকার।

–হত্যা না কী বললেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ। উনি খুনটুনের ব্যাপারে শৌখিন গোয়েন্দাগিরি করেন।

–এখানে কেউ খুন হয়নি! আপনারা চলে যান এখান থেকে।

–আহা, কথাটা আগাগোড়া তো শুনবেন! কর্নেল একটু আগে জঙ্গলে হারিয়ে গেছেন। খুঁজে পাচ্ছি না, তাই… ।

–মিসিংস্কোয়াডে খবর দিন না! হীরাকুণ্ডা টাউনশিপের থানায় চলে যান। মাত্র তিন মাইল রাস্তা!

–আপনি তো ভারি অদ্ভুত! দরজাটা খুলে আগে সবটা শুনুন।

–আপনি যে চোরাডাকাত নন, তার প্রমাণ কী?

–প্রমাণ? ভীষণ খাপ্পা হয়ে পকেটে হাত ভরলুম। তারপর আমার সরকারি প্রেসকার্ড এবং অফিসের পরিচিতিপত্র (ছবিসমেত) বের করে বললুম–এই কার্ডদুটো দেখুন। দরজা ফাঁক করুন, ফেলে দিচ্ছি।

–ওপাশে জানলা খোলা আছে, ফেলে দিন!

কী অদ্ভুত! বারান্দার আলোটা জ্বেলে দিন না। আমার টর্চের ব্যাটারি শেষ হয়ে গেল যে।

বারান্দা আর ওদিকের ঘরের কানেকশান কাটা। আলো জ্বলছে না।

–কাটা মানে।

-হ্যাঁ, কেউ কেটে দিয়েছে! বলে কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকার পর ফের শোনা গেল–আমিও আপনার মতো বিপন্ন।

একলাফে নেমে গিয়ে জানলা দিয়ে কার্ডদুটো ভিতরে ছুঁড়ে দিলুম। তারপর বারান্দায় ফিরলুম। বললুম–এবার বিশ্বাস হল?

দীর্ঘ দুটি মিনিট চুপচাপ থাকার পর দরজাটা একটু ফাঁক হল তারপর একটি শরীরের ওপরের দিকটা একটুখানি উঁকি মারল। টর্চের ব্যাটারি সত্যি ফুরিয়ে এসেছিল। তাই চেহারাটা স্পষ্ট বোঝা গেল না।

মহিলাটি ডাকলেন–আসুন।

আমি প্রায় হুড়মুড় করে ভিতরে গেলুম। অমনি উনি দরজা বন্ধ করে দিলেন।

ঘরে একটা উজ্জ্বল বাল্ব জ্বলছে। ওঁর দিকে তাকিয়ে আমার চোখদুটো সঙ্গে সঙ্গে ঝলসে গেল। এক আশ্চর্য সুন্দরী যুবতী আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কিন্তু মুখে কেমন চাপা উদ্বেগ, চেহারা বেশ খানিকটা বিস্ত, চুল এলোমেলো, শাড়ির ওপর একটা ড্রেসিং গাউন চড়ানো আছে কিন্তু ফিতে খোলা। তাহলেও বোঝা গেল, উনি শুয়ে ছিলেন না–সম্ভবত ঘরের মধ্যে শ্রমসাপেক্ষ কোনো কাজ করছিলেন এতক্ষণ। সেই শ্রমের চিহ্ন ওঁর কপালে চিবুকে ও নাকের ডগায় বিন্দুবিন্দু ঘামে প্রতিভাত হচ্ছে। আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে উনি বললেন-বসুন মিঃ চৌধুরী।

বসলুম। ততক্ষণে কর্নেলের কথা চাপা দিয়ে এই যুবতীর সম্পর্কে একটা তীব্র কৌতূহল এসে পড়েছে। কে ইনি? এমন একা কেন? কোনো লোকজন আয়া পরিচারিকা বা চাকরবাকর কেউ নেই। তার ওপর ওপাশের ঘরের ও বাইরের বারান্দায় নাকি কেউ আলোর তার কেটে রেখেছে। তারের কথা। ভাবতে গিয়ে আমার চোখে পড়ল কোনার টেবিলে একটা ফোনও রয়েছে। ফোনটা দেখে আশ্বস্ত হলুম। তারপর বললুম–আমার ব্যাপার নিয়ে আপাতত আর কিছু বলতে চাইনে, কারণ, মনে হচ্ছে বিপদ আপনারাই বেশি। কী হয়েছে বলবেন কি? আর ইয়ে আপনার পরিচয় এখনও আমি পাইনি কিন্তু!

যুবতী সোফার অন্যদিকটায় বসে পড়লেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন দেখতেই তো পাচ্ছেন, আমি এ বাড়ির একজন মানুষ। আমার নাম মিসেস আরাধনা সিং। এটা আমাদের শৈলাবাস বলতে পারেন। মধ্যে মধ্যে স্বামীর সঙ্গে এখানে এসে থাকি।

বাধা দিয়ে বললুম-কিন্তু আপনি এখন একা কেন?

একটু ইতস্তত করার পর আরাধনা বললেন–আপনি একজন সাংবাদিক জেনেই আমার সাহস হল। সব কথা খুলে বলতে কোনো সংকোচের কারণ দেখছিনে। মিঃ চৌধুরী, আপনি শিলিগুড়ির বিখ্যাত টিম্বার মার্চেন্ট মিঃ শৈলেশ সিংয়ের নাম কি শোনেননি? সেই যে একবার নিউজপেপারে ওঁর নামে খবর বেরিয়েছিল।

তক্ষুনি মনে পড়ে গেল। শৈলেশ সিং গতবছর নিজের জীবন বিপন্ন করে এক আন্তর্জাতিক স্মাগলিং র‍্যারেট পুলিশকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। জনসাধারণ খবরের কাগজে এই অমিতসাহসী নেপালি ভদ্রলোকের কীর্তিকাহিনী কয়েকটি কিস্তিতে পড়েছিল। সেই শৈলেশ সিং! আর ইনি তার স্ত্রী? অবাক হলুম। কাগজে মিঃ সিংয়ের ছবি দেখেছিলুম মনে আছে। কিন্তু তিনি তো প্রৌঢ়! আর আরাধনা সিংয়ের বয়স বড় জোর তেইশ থেকে পঁচিশের মধ্যে হবে!

শুধু বললাম–কী আশ্চর্য!

আরাধনা বললেন–আশ্চর্য নয়, ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক। যে র‍্যাকেট উনি ভাঙতে সাহায্য করেছিলেন, তার সব লোক মোটেও ধরা পড়েনি। তারাই সেই থেকে ওঁর পিছনে লেগে আছে। অনেকবার একটুর জন্যে প্রাণে বেঁচে গেছেন। যেমন আজকের ঘটনা।

ওঁকে থামতে দেখে বললুম-থামবেন না প্লিজ, বলে যান।

আরাধনা এরপর যা বললেন, শুনে আতঙ্কে শরীর কাঠ হয়ে গেল। হাত ঘেমে রাইফেলটা পিচ্ছিল হয়ে উঠল।…

ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ হচ্ছে এই : শৈলাবাসটা কমাস আগে শৈলেশ কিনেছেন। একজন বিদেশি প্ল্যান্টার ছিলেন এটার মালিক। অনেক খরচা করে একটা ফোন ও ইলেকট্রিক লাইনও টেনে এনেছিলেন বাড়িটা অব্দি। যাই হোক, নির্জন পাহাড়ী জঙ্গলে সভ্যতার সবরকম সুখসুবিধা এখানে রয়েছে। কেনার পর মাঝে মাঝে স্ত্রীকে নিয়ে শৈলেশ এখানে এসে কাটিয়ে যান। সঙ্গে আরো দুজন আসে–পরিচারিকা লতা আর বাবুর্চি-কাম-ভৃত্য রঘুবীর। এবার এসেছে গতকাল বিকেলে। একটা ল্যান্ডমাস্টার গাড়ি করেই শৈলেশ এখানে আসেন।

…আজ বিকেলে, তখন বেলা আড়াইটে–আচমকা একটা জিপ আসে। তারপর জনাচার সশস্ত্র লোক জিপ থেকে দৌড়ে আসছে দেখে এঁরা দরজা বন্ধ করে দেন। শৈলেশ জানালার ফাঁক দিয়ে রিভলবারের গুলি ছোড়েন। তারাও কয়েকবার গুলি ছোড়ে। দেয়ালে লাগে। তারা দরজা ভাঙার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। তখন তারা বারান্দার ইলেকট্রিক লাইন আর ফোন লাইনটা কেটে রেখে চলে যায়।

ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার পর শৈলেশ দরজা খোলেন। কিন্তু সবচেয়ে অবাক কাণ্ড, ওদিকের ঘরে লতা আর রঘুবীর ছিল, তাদের কোনো পাত্তা নেই। তাহলে কি ওদের তারা খুন করে গেল? অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কোনো পাত্তা পাওয়া গেল না। তখন শৈলেশ হীরাকুণ্ডা থানায় যাবেন বলে পিছনের গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করলেন। আরাধনা অবাক হলেন দেখে যে স্বামী তাঁকে ফেলে পাগলের মতো একা গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন।

…..আরাধনা গাড়ির পেছনে-পেছনে কিছুদূর ছুটে যান এবং চেঁচামেচি করেন। কিন্তু শৈলেশকে যেন ভূতে পেয়েছিল। একা এই জঙ্গলে অসহায় স্ত্রীকে ফেলে রেখে চলে গেলেন।

…..আরাধনা অগত্যা কী আর করেন। প্রতিমুহূর্তে স্বামীর ফেরার প্রতীক্ষায় কাটাচ্ছেন। অথচ ভদ্রলোক এখনও ফিরলেন না…

ঘটনাটা শুনে কিছুক্ষণ আতঙ্কে চুপচাপ থাকার পর আমি শুধু বললুম আশ্চর্য তো! মিঃ সিং আপনাকে এমনি করে একা ফেলে রেখে গেলেন?

আরাধনা করুণ মুখে বললেন–উনি বরাবর ওইরকম খামখেয়ালি আর গোঁয়ার। ঝোঁক উঠলে দেবতাদেরও সাধ্য নেই ওঁকে কেউ ম্যানেজ করে।

কিন্তু আপনাকে একা ফেলে? বলে আমি ওঁর মুখের দিকে তাকালুম। আরাধনার চোখে জল দেখা যাচ্ছিল। এবার দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। আমার ওপর ওঁর তো কোন মায়া-মমতা নেই মিঃ চৌধুরী। আমি ওঁর শখের পোশা জানোয়ার মাত্র। আপনি জানেন না, আমি কীভাবে কাটাচ্ছি।

বুঝলুম, ভদ্রমহিলা এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। নার্ভের ওপর প্রচণ্ড চাপ গেছে, এবার তার বিস্ফোরণ ঘটছে। তাই দাম্পত্য সম্পর্কের ভেতরের ব্যাপারটা বেরিয়ে পড়ছে। সেটাই তো স্বাভাবিক। একজন ধনী প্রৌঢ় তার মেয়ের বয়সী এক মহিলাকে নিতান্ত শখ অথবা স্রেফ উপভোগ ছাড়া আর কেনই বা বিয়ে করবেন? কিন্তু যে মানুষ অমন দেশপ্রেমিক তিনি একটু মানবপ্রেমিক হলে কী ক্ষতি ছিল?

আরাধনা মুখ নামিয়ে হু-হু করে কাঁদছেন। কী বলে সান্ত্বনা দেব, ভেবে পেলুম না। কর্নেল বুড়ো এখন পাশে থাকলে চমৎকার ম্যানেজ করতে পারতেন! তিনিই বা কোথায় উধাও হয়ে রইলেন?

চুপচাপ বসে ঐ কান্না শোনা কঠিন। তাই সান্ত্বনা দিয়ে বললুম-মিসেস সিং। প্লিজ! এ অবস্থায় কেঁদে শুধু মনোবল হারানো। আপনি শান্ত হোন! আমি যখন এসে পড়েছি, তখন কোনো চিন্তা করবেন না।

আমার কথা শুনে মুখ তুললেন আরাধনা। কোত্থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে শান্তভাবে বললেন, আপনাকে ভগবান আমার জন্যে পাঠিয়েছেন। মিঃ চৌধুরী। এতক্ষণ আপনি না এলে আমি নিশ্চয় আত্মহত্যা করে বসতুম!

ব্যস্তভাবে একটা কিছু বলতে যাচ্ছি, হঠাৎ বাইরে বাতাসের শনশন শব্দ শোনা গেল। তারপর একমাত্র খোলা জানালাটা জোরে নড়ে উঠল। (ওই জানলাটা খুলে রাখার কারণ যে বাইরের কোনো মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, তা ততক্ষণে বেশ টের পেয়ে গেছি।) আরাধনা দ্রুত উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করে দিলেন। তারপর বললেন–প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আজকাল ওই ঝড়টা ওঠে। পাহাড়ী আবহাওয়া বড় খামখেয়ালি! দেখুন না, হয়তো বৃষ্টিও শুরু হবে।

বাইরে চাপা শনশন শব্দটা বাড়তে শোনা যাচ্ছিল। কর্নেলের জন্যে এবার উদ্বেগ জাগল মনে। বেঘোরে প্রাণ খোয়ালেন না তো হটকারি গোয়েন্দাবর? এইসব পাহাড়ী ঝড়বৃষ্টি যে কী সাংঘাতিক, তাও তো ওঁর অজানা নয়। সেপ্টেম্বর মাসে একটু বৃষ্টিতেই পাহাড়ে বড় বড় ধস নামে। আমার শরীর আবার শিউরে উঠল।

আরাধনা তখন সামলে উঠেছেন। অনেকটা সপ্রতিভ দেখাচ্ছে ওঁকে। বললেন–কিচেন আর ডাইনিং বারান্দার ওপাশে। সেই লাঞ্চের পর এখনও একফোঁটা চা বা কফি খাওয়া হয়নি। মিঃ চৌধুরী কীভাবে মাননীয় অতিথির সকার করব, জানি না।

আমরা পরস্পর ইংরিজিতেই কথা বলছি। আরাধনার মুখের গড়নে পর্বতকন্যার আদল। মিশনারিদের দৌলতে বহুকাল আগে এসব পাহাড়ে সভ্যতা ও ইংরিজি ঢুকে পড়েছে। কিন্তু আরাধনার ইংরিজিতে বিলিতিয়ানার ছাপ এত স্পষ্ট যে মনে হল নির্ঘাত কনভেন্টে পড়া মেয়ে। আমার ইংরিজি এদিকে এমন ভারতীয়, কহতব্য নয়।

ওঁর কথা শুনে চাকফির নেশা মাথায় চড়ে। গেল। ব্যস্ত হয়ে উঠে বললুম–আপনি যদি অনুমতি দেন, তাহলে কিচেনে গিয়ে অনায়াসে চা-কফির ব্যবস্থা করা যায়!

আরাধনার মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটল। বললেন–হ্যাঁ, আপনার কাছে অস্ত্রশস্ত্র আছে। আর আমার ভয় করার কিছুই নেই। চলুন, যাওয়া যাক।

বলে হঠাৎ ঘুরে একটা টেবিলের দিকে এগোলেন আরাধনা।–এক মিনিট। মোমবাতি নিই। কারেন্ট বন্ধ হলে এগুলো কাজে লাগে। তাই রাখা আছে।

দরজা খুলে বেরোলুম দুজনে। মধ্যেকার দশফুট বাই পনের ফুট খোলা বারান্দামতো জায়গায় পা দিতেই ঝড়ের ধাক্কা লাগল শরীরে। টর্চ জ্বেলে দেখলুম, ওপাশের ঘর অর্থাৎ ডাইনিং কাম-কিচেনের দরজা বাইরে থেকে শুধু আটকানো আছে মাত্র।

আরাধনা ততক্ষণে আলোকিত বেডরুমের দরজাটা লক করে দিয়েছেন। মহিলা বুদ্ধিমতী কোনো সন্দেহ নেই।

ডাইনিং ঘরটা বেডরুমের ডবল। ওপাশে কিচেন ও কাউন্টার। গ্যাসলাইনও রয়েছে দেখলুম। আরাধনা উনুনটা পরীক্ষা করে দেখে বললেন–ঠিক আছে। গ্যাসলাইনটা ওরা নষ্ট করে যায়নি।

আমি ডাইনিং টেবিলে মোমবাতির সামনে আরাম করে বসলুম। গ্যাসের নীল আগুনে আরাধনা কেটলি চড়িয়ে দিলেন। তারপর কাববোর্ড খুলে কাজে ব্যস্ত হলেন। মোটামুটি ডিনারও খাওয়া যাবে–এই আশায় উৎফুল্ল হয়ে আমি কর্নেল ও সব বিপদের কথা বেমালুম ভুলে গেলুম, আর ঠিক তখনই জোর বৃষ্টির শব্দ কানে এল। ছাদের ওপর দড়বড় করে প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। তারপর কাছাকাছি বাজ পড়ল। তারপরই শুরু হল মেঘগর্জন। বাড়িটা ওই তুমুল প্রাকৃতিক তাণ্ডবে কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকল।

কর্নেল গোল্লায় যাক–মনে মনে একথা বলে টেবিলে রাখা রাইফেলটা তুলে একবার দেখে নিলুম তৈরি আছে কি না। তারপর তাকালুম আরাধনার দিকে। ওঁর মুখের একটা পাশে মোমের আলো পড়েছে। ফরসা নিটোল গাল আর ঠোঁটের অংশ দেখা যাচ্ছে। গাউনের কিছুটা সরে ওঁর বুকের একটা দিকও চোখে পড়ছে। মনে হল, ব্রেসিয়ার পরেন না আরাধনা। আজকাল এ ফ্যাশান এদেশে চালু হয়েছে–যদিও আমাদের গ্রামের মেয়েরা এবং আগের দিনে তো অনেককেই, দারিদ্র শ্রম ইত্যাদি কারণে ব্রেসিয়ার পরতেন না। আরাধনার দৈহিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলুম। সেই সময় উনি ঘুরে আমার দিকে তাকালেন। মিষ্টি হেসে বললেন–একই সঙ্গে অল্পস্বল্প ডিনারটাও সেরে নেওয়া যাক। কী বলেন?

সানন্দে জবাব দিলুম–অবশ্যই।

এরপর টেবিলে কয়েক প্রস্থ খাবার এল এবং তার ফাঁকে ফাঁকে কথা চলতে থাকল দুজনের।

–মিঃ চৌধুরী কি বিবাহিত?

না।

কবে বিয়ে করবেন?

 –ভেবে দেখিনি।

ঝড়টা একটু কমেছে মনে হচ্ছে না?

–মনে হচ্ছে!

বৃষ্টি কিন্তু জোর হচ্ছে। নির্ঘাত ধস ছাড়বে সবখানে।

–যা বলেছেন!

–মিঃ চৌধুরী, তার মানে আমরা একেবারে বাইরে থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব! বুঝতে পারছেন? যাবজ্জীবন দ্বীপন্তর কিন্তু! (হাসি)।

–সর্বনাশ!

–সর্বনাশের কী আছে? আমার ভাঁড়ারে প্রচুর খাবার আছে। আর সঙ্গিনী হিসাবে নিশ্চয় আমি খুব একটা অযোগ্য নই?

–মোটেও না, মোটেও না! (নার্ভাস হয়ে হাসছিলুম)

–আজকের রাতটা কিন্তু আপনাকে একটা বড় কাজ দেব।

 নিশ্চয়ই তো! ঠিকই তো!

–আপনার স্মার্টনেসটা কিন্তু চলে গেছে মিঃ চৌধুরী।

–ও, হ্যাঁ। মানে আমি ব্যাপারটা ভাবছি!

–কী ব্যাপার?

–আপনার এই বিপদ। ওদিকে আমার সেই কর্নেল ভদ্রলোক…

–ধরে নিন না, আমরা ধসের ফলে বিচ্ছিন্ন। কিছু করার নেই।

–তা যা বলেছেন।

 –ওকি! আপনি তো কিছু খাচ্ছেন না!

না, না। খাচ্ছি তো!

খান। মাঝে মাঝে আমাদের ভীষণ স্বার্থপর হয়ে যাওয়া ভালো। এতে এক রকম স্যাডিজম আছে।

–নিশ্চয়, নিশ্চয়!

–এই সময় বাড়ির কাছাকাছি কোথাও ভয়ঙ্কর শব্দে বাজ পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে আরাধনা ছিটকে সামনের চেয়ার থেকে চলে এসে আমার পাশে বসলেন। তারপর টেবিলে মুখ রেখে ঝুঁকে পড়লেন। আঁতকে উঠলুম। ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন নাকি? দুহাতে ওর কাধ ধরে ঝাঁকুনি দিলুম মিসেস সিং! মিসেস সিং!

আরাধনা সোজা হয়ে বসে কড়া চোখে বললেন–কে মিসেস সিং? আমি আরাধনা–জাস্ট এ লোনলি গার্ল! আমার কেউ নেই, কিছু নেই!

ওরে বাবা! এ যে যথার্থ হিস্টিরিয়ার লক্ষণ। ভদ্রমহিলা অমন ভয়ানক ঘটনার পর নিশ্চয় তলে তলে মানসিক বিকৃতিতে ভুগছিলেন–এবার সেই বিকৃতিটা আত্মপ্রকাশ করেছে, তাতে কোনো ভুল নেই। আমি ওঁর পিঠে হাত রেখে বললুম-আপনি নিশ্চয় অসুস্থ বোধ করছেন।

করছি। প্লিজ, আমাকে ওঘরে নিয়ে চলুন। এমন ক্লান্ত বিপন্ন কণ্ঠস্বরে অভিভূত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। কিন্তু ওঁর খাদ্য অধভুক্ত পড়ে রইল যে!

অগত্যা ওকে সাহায্য করতে হাত বাড়ালুম। কিন্তু একেবারে অবশ শরীরে আমার কাঁধে ভেঙে পড়লেন। তারপর দেখি, গড়িয়ে পড়ছেন, তখন ওঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে কোনার একটা সোফায় শুইয়ে দিলুম। চোখ বুজে পড়ে রইলেন। টেবিল থেকে জলের গ্লাস নিয়ে যেই কাছে গেছি, উনি চোখ খুললেন। তারপর বললেন

–আমি কোথায়?

–আপনারই বাড়িতে। মানে…

আরাধনা আমাকে কথা বলতে দিলেন না। একটা হাত বাড়িয়ে রোগা আদুরে গলায় বললেন–আপনি আমাকে ধরে রাখুন না প্লিজ। বড় ভয় করছে।

আহা বেচারা! মায়ায় গলে গিয়ে এবং লোভে তো বটেই আরাধনার মাথাটা তুলে আমার উরুর ওপর রাখলুম। কোনো আপত্তি এল না। বরং এবার মিঠে হুকুম হল কপালে হাত বুলিয়ে দিন না প্লিজ!

আড়ষ্ট ও কাপ হাতে ওঁর সুন্দর কপালে হাত বুলোতে থাকলুম। বাইরে ঝড়বৃষ্টি তখনও থামেনি। মাঝে মাঝে মেঘ ডাকছে। বাড়িটা কেঁপে উঠছে। জীবনে এমন অদ্ভুত রাত আর একটাও আসেনি।

হঠাৎ আরাধনা এক কাণ্ড করে বসলেন। দুহাত নিজের মাথার উপর দিয়ে বাড়িয়ে আমার গলা আঁকড়ে ধরলেন। তারপর আমার মাথাটা টেনে নামালেন। তারপরই আমার ঠোঁট দুটো নিজের ঠোঁটে চেপে ধরলেন। চুমু খাওয়া–বিশেষ করে এই আশ্চর্য সুন্দরী যুবতীর ঠোঁটের চুমু, নিশ্চয় এক দুর্লভ সৌভাগ্য; কিন্তু মানসিক প্রস্তুতি না থাকায় ব্যাপারটা আমাকে হতচকিত করে ফেলল। আরাধনা কিন্তু পাগলের মতো আমার ঠোঁটটা দিয়ে কেলেঙ্কারি শুরু করেছেন ততক্ষণে।

তার ফলে অনিবার্যভাবে শারীরিক উত্তাপ জাগছিল আমার। একটু পরে আরাধনা ধনুকের মত বেঁকে আমার দিকে ঘুরলেন এবং উঠে বসলেন। তারপর বুকে মাথা গুঁজে হিপিয়ে হিপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। এতক্ষণে আমার ভুলটা ভাঙল।

না–এ কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এক অতৃপ্ত যুবতী, স্বামী প্রৌঢ় ও গোঁয়ার, আজকের এই মারাত্মক ঘটনা, তারপর এই নির্জন পরিবেশে আমার মতো এক রাইফেলধারী যুবক–এই উপাদানগুলো মিলেমিশে যা ঘটা উচিত তাই ঘটেছে। বন্যায় ভেসে যেতে একটুকরো খড়কুটো পেলেই তা আঁকড়ে ধরা মানুষের স্বভাব।

আমি পরম স্নেহ ও প্রেমে ওর মুখটা দুহাতে তুলে একটি এক মিনিটের চুমু দেওয়ার পর বললুম-আরাধনা লক্ষ্মীটি, শান্ত হও। চলো আমরা কফিটা নিয়ে বরং বেডরুমে যাই।

আরাধনা উঠল। এখন সে আমার প্রেমিকা ছাড়া আর কী! কফির ট্রে নিয়ে আমরা দুজনে বেডরুমে ফিরে গেলুম। দরজাটা ভেতর থেকে আটকানো হল।

সেফায় পাশাপাশি এবার দুজনে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে কফি খাচ্ছি, হঠাৎ আরাধনা বলল–চৌধুরী, আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে কলকাতা যেতে চাই।

বললুম-বেশ তো।

–বেশ তো নয়। কথা দাও, আমাকে নিয়ে যাবে!

–দিলুম।

–এই শৈলেশ লোকটা নিজেই আসলে সেই ‘স্মাগলিং র‍্যাকেটের অন্যতম নেতা, চৌধুরী তোমাকে জানিয়ে দিচ্ছি। ওর বিশ্বাসঘাতকতায় এখন দলের বাকি লোকেরা–যারা ফেরারী হয়েছিল, প্রতিশোধ নিতে খেপে গেছে। আমি এই শয়তানের পাল্লায় পড়ে শেষ হয়ে গেছি। আমাকে বাঁচাও, তুমি।

–তা আর বলতে? তবে কর্নেল…

ড্যাম ইওর কর্নেল। আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি চৌধুরী। তোমাকে দেখামাত্র টের পেয়েছি, সারাজীবন যাকে খুঁজছি, সে এই! তুমি আমাকে ফেলে যাবে না তো?

–পাগল! আমিও তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি আরাধনা।

–ওঃ চৌধুরী! কী ফাইন ছেলে তুমি! চলো, এবার শুয়ে পড়া যাক্। হ্যাঁ, বিছানায় যাবার জন্য তখন আমি খুব ব্যস্ত। তবে আসল কারণ, কেন হঠাৎ যেন ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু সবে সে আমার হাত ধরে বিছানায় টেনে নিয়ে গেছে, আমি প্যান্ট-শার্ট খুলতে শুরু করেছি, হঠাৎ বাইরে ঝড় বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে গাড়ির শব্দ শোনা গেল। আরাধনার মুখে চমক লক্ষ্য করলাম। তারপরই কাদের পায়ের ধুপ-ধুপ শব্দ ভার্সল কাঠের পাটাতনে। এবং দরজায় ধাক্কা পড়ল। কে ভারী গলায় ডাকতে থাকল–আরাধনা! দরজা খোল!

আরাধনা আমার দিকে ইশারা করল–চুপ!

সে কী! নিশ্চয় ওটা মিঃ সিংয়ের গলার আওয়াজ। আমি ব্যস্তভাবে চাপা গলায় বললাম–তোমার স্বামী এসেছেন যে!

আরাধনা ফিসফিস করে বলল–আমার স্বামীর গলা আমি চিনি। ও অন্য কেউ। কক্ষনো দরজা খুলবে না। বরং তুমি জানলার ফাঁক দিয়ে একবার গুলি ছুঁড়ে জানিয়ে দাও যে আমরা নিরস্ত্র নই।

দরজায় দমাদ্দম কয়েক জোড়া পায়ের লাথি পড়তে শুরু করেছে ততক্ষণে। দরজাটা ভেঙে যাবে মনে হল। ওরা যেই হোক, ঘরে এলে সকলে আমাকে নিয়েই পড়বে তাতে কোনো ভুল নেই। অতএব আমি একলাফে জানালা ফাঁক করেই রাইফেলের তিনটে গুলি পর পর ছুঁড়ে বসলুম। আওয়াজ হল প্রচণ্ড এবং তক্ষুনি লাথি-মারা বন্ধ হল। বাইরে চাপা স্বরে ওরা কথা বলছে। আমি বাকি দুটো গুলিও ঝোঁকের বশে জানালা দিয়ে ছুড়লুম। তারপর পকেট থেকে আবার পাঁচটা কার্তুজ বের করে রাইফেলটা তৈরি রাখলুম।

আর কোনো আওয়াজ নেই এবার। সাবধানে জানলা ফাঁক করে পর্দার একটুখানি তুলে দেখি, সম্ভবত জনা তিন লোক দৌড়ে গেটের ওপাশে চলে, গেল। তারপর গাড়ির আলো জ্বলে উঠল। গাড়িটা তক্ষুনি বৃষ্টির মধ্যে জঙ্গলের দিকে নেমে যেতে দেখলুম। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। ঘুরে দেখি, আরাধনার ভুরু দুটো কুঁচকে রয়েছে। আমার চোখে চোখ পড়ামাত্রা সে হেসে উঠল–চমৎকার শিক্ষা হয়েছে। আর ওরা হামলা করতে আসবে না। এসো, শুয়ে পড়া যাক।

এই রহস্যময়ী যুবতীর পাশে রাত কাটানো এবং বিপদের সম্ভাবনা–দুইয়ে মিলে আমাকে নিশ্চয় উদ্বিগ্ন দেখাল। কিন্তু শেষ অব্দি ঘুমে চোখের পাতা জড়িয়ে এল। আর বাগ মানাতে পারলুম না। শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, আমি কোন পাতালে তলিয়ে যাচ্ছি। পাশের সঙ্গিনীকে আঁকড়ে ধরতে চাইলুম কিন্তু তাকে যেন খুঁজেই পেলুম না।

.

চোখ খুলে দেখি ঘরভরা আলো। অভ্যাসমতো ঘড়ি দেখলুম–সাড়ে আটটা! কী প্রচণ্ড না ঘুমিয়েছি। তারপর সব মনে পড়ল। হুড়মুড় করে উঠে বসলুম। ঘরে কী একটা তীব্র গন্ধ। পাশে আরাধনা নেই। ডাকলুম তাকে। কিন্তু কোনো সাড়া পেলুম না। উঠে গিয়ে দেখি দরজাটা বাইরে থেকে আটকানো। অমনি অজ্ঞাত ভয়ে শিউরে উঠলুম আবার ডাকাডাকি করলুম। কিন্তু সাড়া নেই।

ব্যাপার কী? আমাকে আটকে রেখে কোথায় গেল সে? হতাশ হয়ে সিগারেট জ্বাললুম। দেশলাই কাঠিটা মেঝের কার্পেটে অন্যমনস্কভাবে ফেলেছি। তাই সেটা কুড়িয়ে নিয়ে ছাইদানিতে ফেলার জন্যে হেঁট হলুম। অমনি খাটের তলায় চোখ গেল। খাটের তলায় কে উবুড় হয়ে পড়ে রয়েছে। তার মুখটা একেবারে ধড়ছাড়া। রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভয়ে-উৎকণ্ঠায় প্রায় পাগল হয়ে গেলুম। দরজায় লাথি মেরে মেরে পায়ে ব্যথা ধরিয়ে ফেললুম। বাজখাঁই চিৎকার করে ডাকাডাকি করলুমবাঁচাও, বাঁচাও, কে কোথায় আছ, বাঁচাও! সেই বিকট আর্তনাদ কয়েকমাইল দূর থেকে লোকের শোনা উচিত ছিল। কিন্তু শোনার মতো কেউ ছিল না হয়তো। এরপর জানলাগুলোও ভাঙার চেষ্টা করলুম। রাইফেলের নল রডে টোল খেয়ে গেল দেখে ক্ষান্ত হলুম। বোঝা গেল, এই বাড়িটা মজবুত করেই বানানো হয়েছে।

এতসব তুমুল হুলুস্থূলের পর স্বভাব ক্লান্তি ও হতাশা আসে। তখন একটা জানলায় মুখ রেখে তাকিয়ে রইলুম গেটের দিকে। সকালের উজ্জ্বল আলোয় পৃথিবী ঝকমক করছে। আকাশে কোথায়ও মেঘের চিহ্ন নেই। এমন একটা চমৎকার দিনে মুণ্ডুকাটা লাশের সঙ্গে বন্দী থাকতে হল আমাকে–এর চেয়ে সাংঘাতিক ঘটনা কল্পনা করা যায় না। এক ধুরন্ধর মায়াবিনীর ফাঁদে পড়ে আমি অবশেষে কী বোকামি করেছি ভেবে আফসোস হতে থাকল। কিন্তু এখন তো আর মাথা খুঁড়েও কোনো লাভ হবে না।

 হঠাৎ মাথায় একটা যুক্তি খেলল। আমার পকেটে তো এখনও অনেকগুলো কার্তুজ রয়েছে। অন্তত গোটা পাঁচ পর পর খরচ করা যাক্ না, যদি কাঠের দেওয়ালের কোনো অংশে একটা ফাটল ধরাতে পারি। তারপর অবশ্য এক টুকরো ধারালো কিছু দরকার। তাই ব্যস্ত একোনা ওকোনা হাতড়ালুম। লোহার কোনো জিনিস, কিংবা তেমন জুতসই কিছু পাওয়া গেল না। খাটের তলায় উঁকি মারবার সাহস নেই। ওই মুণ্ডুকাটা বীভৎস লাশ আবার চোখ মেলে দেখা আমার পক্ষে অসম্ভব।

সেই সময় মাথায় একটা কথা এল। আচ্ছা, খুন যা দিয়ে করা হয়েছে, অর্থাৎ মার্ডার উইপনটা কি লাশের কাছে রেখে যায়নি খুনী? ওটা দিয়ে নিশ্চয় কাজ হবে।

যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। অনেক সাহসে ফের খাটের তলায় উঁকি দিলুম। এবার লাশটা ভালো করে দেখা হয়ে গেল। গায়ের রঙ ফর্সা, বেঁটে মোটাসোটা একটা লোক, পরনে খুব দামি স্যুট, টাই রয়েছে। সম্ভবত বাটন হোলে আস্ত একটা গোলাপ গোঁজা ছিল, সেটা বগলের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে। দেখতে দেখতে নার্ভ শক্ত হয়ে গেল। লাশটা টেনে বের করলুম। মুণ্ডুটা একটু তফাতে নাক খুঁজে পড়েছিল। সেটাকেও বাঁহাতে চুল ধরে টেনে আনলুম। তারপর লাশটা চিত করে মুখটা ঠিক জায়গায় লাগিয়ে দিলুম। এসময় আমাকে নিশ্চয় একটা ভয়ঙ্কর পিশাচ দেখাচ্ছিল।

লোকটার খোলা চোখে আতঙ্ক ঠিকরে বেরোচ্ছে যেন। আঙুলের চাপে চোখের পাতা বুজিয়ে দিলুম। কয়েক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে থাকার পর এবার অস্ত্রটার খোঁজে খাটের তলায় উঁকি দিতেই সেটা চোখে পড়ল। একটা বড় ভোজালি দেখা গেল। খুনী ওটা আমার হিসেবমতোই রেখে গেছে দেখছি। হাত বাড়িয়ে সেটা নিতেই কেমন যেন উষ্ণতা ভর করল আমার রক্তে। এসময়ে যাকে খুশি আমি খুন করতে পারতুম!

যাক, তাহলে এবার দেয়াল কেটে বেরিয়ে পড়ার অসুবিধে নেই। ভোজালি বোর করে এনে দেখি, সেটার গায়ে চাপ চাপ জমাট কালো রক্ত শুকিয়ে গেছে। লাশেরও অবস্থা একই রকম। উত্তেজনার ঘোরেও বুঝতে পারলুম যে খুনটা এখানে হয়নি। অন্য কোথাও খুন করার পর লাশটা এভাবে এনে রাখা হয়েছিল। নিশ্চয় কোনো মতলব ছিল খুনীর কিংবা খুনীদের।

রাইফেলের গুলি খরচ করার আগে ভোজালিটা কাজ দেয় কি না দেখতে ইচ্ছে হল। কিন্তু কয়েক জায়গায় কোপ বসিয়ে দেখলুম, অসম্ভব। সামান্য চোটের দাগ ছাড়া আর কিছু ঘটছে না। রাইফেলের একটা মাত্র বুলেট সহজেই কাঠে ফাটল ধরাতে পারে। কয়েকটা ফাটল একই জায়গায় পাশাপাশি সৃষ্টি হলে তখন ভোজালি ব্যবহার করলে কাজ হতে পারে।

তাই রাইফেলটা নিয়ে কোণের একজায়গায় তাক করলুম। কোণটা যেহেতু জোড়ের জায়গা, ফাটল সহজেই হবে। রাইফেলের সেফটি ক্যাচ তুলে ট্রিগারে আঙুলের চাপ দিতে যাচ্ছি, অমনি এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটল। সোফাসেটের ওদিকে ফোনটা মিঠে স্বরে ক্রিং ক্রিং বেজে উঠল।

সে কী! শয়তানীটা যে বলেছিল ফোনের লাইন কাটা!

নিশ্চয় মিথ্যে বলেছিল তাহলে। ফোনটা সমানে বাজতে থাকল। কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করার পর রাইফেলটা রেখে ফোনটা ধরলুম। আমার কণ্ঠস্বর নিশ্চয় কেঁপে গেল।হ্যালো! হ্যালো!

এবার দ্বিতীয় চমক এল। আমি কি এখনও স্বপ্ন দেখছি? হতবুদ্ধি হয়ে গেলুম। এ যে প্রত্যক্ষ মিরাকল! অন্যপ্রান্ত থেকে পরিষ্কার ভেসে আসছে চেনা একটা কণ্ঠস্বর। –হ্যালো, জয়ন্ত নাকি! গুড মর্নিং ডার্লিং, জয়ন্ত! আশা করি সুনিদ্রার কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি!

আমি থ বনে শুনে যাচ্ছি। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার–নাকি তার ভূত কথা বলছে? না–না, এ অবিশ্বাস্য! আমি এখানে আছি, তাই বা কেমন করে জানলেন উনি?

ডার্লিং, বুঝেছি! তুমি এ বুড়োর ওপর রীতিমতো খাপ্পা হয়েছ। সেটা খুবই স্বাভাবিক। ইয়ে–শোন, আমি–মানে আমরা শিগগির গিয়ে পড়ছি। ভেবো না। আর দেখ, আমরা না পৌঁছনো পর্যন্ত-ধরো জাস্ট পনের মিনিট সময় খুব সাবধানে থাকবে। আমার গলা না শুনলে কিংবা আমাকে না দেখলে কক্ষনো দরজা খুলবে না। কেমন? ছাড়ছি?

এবার অনায়াসে খাপ্পা হওয়া যায় গোয়েন্দাপ্রবরের প্রতি। রেগে ওঠাও স্বাভাবিক আমার পক্ষে। এতসব যে জানে, সে কেন এখনও বেলা নটা অব্দি এখানে আমাকে উদ্ধার করতে এল না? অদ্ভুত কারবার তো বুড়োর! অথচ আসার সময় কত ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে এসছিল।

উঁট দেখিয়ে গম্ভীর অন্যরকম গলায় বললুম-হ্যালো, হ্যালো! শুনুন– আপনি কাকে চান। এখানে জয়ন্ত বলে কেউ নেই। হ্যালো…হ্যালো!

কখন ফোন রেখে দিয়েছেন গোয়েন্দামশাই, আর আমি সমানে অতগুলো কথা বলে গেলুম! রেগে সশব্দে ফোনটা আমিও রাখলুম। কিন্তু লোকটা কি সত্যি কোনো মন্ত্রতন্ত্র জানেন? আমি তো মাত্র ‘হ্যালো’ বলেছি দুবার তাতে উনি কীভাবে টের পেলেন যে আমিই ফোন ধরেছি?

তাহলে কি যে রহস্যময় ফাঁদে আমি বোকার মতো পা দিয়েছিলুম তারই কোন আভাস হঠাৎ কাল বিকেলে উনি পেয়ে গিয়েছিলেন এবং তাই আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে উধাও হয়েছিলেন?

খুব সম্ভব, তাই বহস্যের ইশারা পেলে বরাবর ওঁর ওই বাতিকগ্রস্ত আচরণ আমি লক্ষ্য করেছি। মনে হল, কাল রাস্তার পশ্চিমের জঙ্গলে বা খালের ওদিকে হঠাৎ কীভাবে একটা রহস্যময় পরিস্থিতিতে পড়ে গিয়েছিলেন কর্নেল। এ ছাড়া, এই অদ্ভুত ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা হয় না।

এতক্ষণে আশ্বস্ত হতে পেরেছি। সিগারেট ধরিয়ে লাশটিকে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলুম। কে এই ভদ্রলোক? আরাধনাই বা আসলে কে? কেন একে খুন করা হল? আরাধনাই কি খুন করেছে? সেটা অসম্ভব। ওর এত সাহস বা জোর নেই, বুদ্ধিতে যত খল সে হোক না কেন। আর রাতের ঝড়বৃষ্টিতে সেই মোটর গাড়িতে আসা আগন্তুকেরাই বা কারা? তাদের দরজা খুলল না কেন আরাধনা? তারা কি তার শত্রু?

প্রশ্নের পর প্রশ্নে উত্ত্যক্ত হলুম। নিহত ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের বেশি, ষাটের কম। মাথায় টাক আছে অল্প। চুলে পাক ধরেছে। খুব শৌখিন মানুষ, তার পরিচয় স্পষ্ট। সেই গোলাপটা কুড়িয়ে নিলুম। শুঁকে দেখলুম। গন্ধটা বাসি। হলেও চমৎকার। লোকটার পকেট হাতড়াতে গিয়ে হঠাৎ সংযত হলুম।

সর্বনাশ! অমন একজন ঘুঘু গোয়েন্দার সাহচর্যে এতকাল কাটিয়েও আমার এতটুকু শিক্ষা হয়নি দেখছি! আমি একের পর এক সাংঘাতিক কাজ করে বসে আছি এতক্ষণ, এতটুকু ফলাফল ভাবিনি! এ একটা রীতিমতো খুন-হত্যাকাণ্ড! আর আমি লাশের গায়ে হাত দিয়েছি, টেনে বের করেছি, মুণ্ডটা এনে জোড়া লাগিয়েছি, ভোজালিটা বের করেছি, শেষ অব্দি গোলাপটাও স্থানচ্যুত করেছি বা ছুঁয়েছি! এতগুলো বুদ্ধিহীন কাজের ফলে প্রকৃপক্ষে অনেক মারাত্মক সূত্র হয়তো নষ্ট হয়ে গেছে। যেগুলোর একটামাত্র পেলেও সেই বৃদ্ধ ঘুঘুটি এবং পুলিশের কাজে লাগত। এবার নিজের প্রতি রাগে-দুঃখে অস্থির হলুম। আমি এমন ভ্যাবাকান্ত হয়ে পড়লুম কেন? নিজের প্রশ্নের একটা জবাব নিজে অবশ্য দেওয়া যায়, দরজা বাইরে থেকে আটকানো দেখেই লাশ আবিষ্কার করার পর আমার মাথা গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। নির্ঘাত এটাই সবকিছুর কারণ। লাশের সঙ্গে নিজেকে বন্দী দেখেই বুদ্ধি ঠিক রাখতে পারিনি।

এখন আর পস্তে লাভ নেই। আড়ষ্টভাবে জানালার কাছে গেলুম। কর্নেল সতর্ক থাকতে বলেছেন। তাহলে কি হত্যাকারীরা আবার ফিরে আসবে?

জানলায় উঁকি মেরে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে রইলুম। উজ্জ্বল রোদে গাছপালা বা ঝোঁপঝাড়ের তলায়, পরিষ্কার নজর চলছে। কেউ বন্দুক তাক করলেও এখন দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে না! গেটের ওপাশে পাহাড়টা আস্তে আস্তে নেমে গেছে। তারপর কিছু সমতল কিছু ঢালু জমিতে ওকবনটা রয়েছে। বাড়িটা উঁচুতে থাকায় অতদূর অব্দি এবড়ো-খেবড়ো প্রাইভেট রোডটার অনেকখানি নজর চলে। ওপথে কাকেও দেখলুম না।

মিনিট যে এত লম্বা হতে পারে, কল্পনাও করিনি। পনের মিনিট নয়–যেন পনেরটা ঘণ্টা চলে গেল। তারপর দূরে পশ্চিমে গাড়ির হর্নের শব্দ শোনা গেল। উত্তেজনায় চোয়াল শক্ত হয়ে এল। তারপর ওকবনের রাস্তায় একটা জিপ দেখতে পেলুম। জিপটা যখন ফাঁকা জায়গায় এল, কর্নেলের টুপি ও সাদা দাড়ি চোখে পড়ল। এত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুড়োর! ওখান থেকেই সে আমার অস্তিত্ব টের পেয়ে হাত নাড়ছেন।

গাড়িটা গেটে উঠে এল। সেই মুহূর্তে আমার পিছনের দিকের কোনো একটা জানলায় তিনবার ঠুকঠুক করে আওয়াজ উঠে থেমে গেল। ততক্ষণে কর্নেলের ভারী গলার আওয়াজ শোনা গেছে বাইরের বারান্দায়–হ্যাল্লো জয়ন্ত ডালিং! গুড মর্নিং! তারপর দরজার তালা ভাঙল কেউ। ম্যাজিকের মতো এক আঘাতেই তালাটা পড়ে যেতে শুনলুম।

পর্দা সরিয়ে প্রথমে ঢুকলেন কর্নেল, তারপর দুজন পুলিশ অফিসার। ঢুকেই কর্নেল অস্ফুট চেঁচিয়ে উঠলেন–মাই গড! এ কী ব্যাপার জয়ন্ত! তাহলে…..

কথাটা অসমাপ্ত রেখে উনি পুলিশ অফিসারের দিকে ঘুরলেন। একজন অফিসার এগিয়ে সাবধানে লাশের পাশে হাঁটু দুমড়ে বসে পড়লেন। অন্যজন গম্ভীর মুখে বললেন–তাহলে বেচারা শৈলেশ সিং সত্যি খুন হয়ে গেলেন!

কর্নেল লাশটা দেখার পর আমার দিকে তাকালেন।লাশটা নিয়ে নিশ্চয় তুমি টানাটানি করেছ, জয়ন্ত?

করেছি। আমার মাথার ঠিক ছিল না।

–হুম! সাক্সেনা, আসুন, আমরা আগে অন্যান্য ঘরগুলো একবার দেখে নিই। ততক্ষণ মিঃ প্রসাদ, তার কাজ সেরে ফেলুন। ওই আপনাদের লোকজন বোধহয় এস পড়ল।

বাইরে একটা গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। বারান্দায় গেলুম কর্নেলের সঙ্গে। কর্নেল আমার একটা হাত নিয়ে একটু স্নেহ প্রকাশ করেই ছেড়ে দিলেন। : একদল পুলিশ কনস্টেবল আর অফিসার দৌড়ে এলেন।

বাড়িটা ঘিরে ফেলার পর কর্নেল আর মিঃ সাক্সেনা ডাইনিং ঘরটায় ঢুকলেন–তাদের পিছনে আমি। দরজাটা খোলা ছিল। কর্নেল আমার দিকে ঘুরে বললেন-দরজাটা খেলা কেন, বলতে পারো জয়ন্ত?

মাথা দোলালুম। এখনও তো কিছু জিগ্যেস করছেন না গোয়েন্দাবর। করলে তখন সব বলা যাবে। কিন্তু এ দরজাটা তো আরাধনা বন্ধ করে দিয়ে গিয়েছিল। এটা খুলে রাখল কে?

ডাইনিং টেবিলে রাতের যা সব অভুক্ত খাবার ছিল, এখনও তেমনি রয়েছে। কিন্তু কোণের একটা সোফা কেউ টেনে একটু সরিয়ে রেখেছে মনে হল। সাক্সেনা খুঁটিয়ে সব জায়গা পরীক্ষা করছেন। কর্নেল কিচেনে গিয়ে ঢুকলেন। তারপর ফিরে এসে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে বললেন–ইয়ে জয়ন্ত, বাথরুমটা কি বেডরুমের সংলগ্ন?

জবাব দিলুম-জানি না। মানে কাল আমি আদৌ বাথরুমে যাইনি!

বুড়ো ঘুঘু চতুর হাসলেন। হুম!

–হুম কী! সত্যি বলছি! আমি ওসব ব্যাপার ভুলেই বসেছিলুম!

স্বাভাবিক মনে হয় না।

–আপনি তো এখনও কিছু শোনেননি আমার কাছে।

–পরে শুনব, ডার্লিং! এখন–এস, আমরা বেডরুমে ফিরে যাই। মিঃ সাক্সেনা কী মনে হচ্ছে বলুন তো?

সাক্সেনা বিশৃঙ্খল সোফার কাছে কী দেখছিলেন। বললেন–খুব রহস্যময় কেস, কর্নেল! আমার মাথায় যেন কিছুই ঢুকছে না।

কর্নেল হাসতে হাসতে আমার হাত ধরে ফের বেডরুমে নিয়ে গেলেন। সেখানে মিঃ প্রসাদ আর জনা তিন অফিসার ব্যস্তভাবে আলোচনা করছিলেন। কর্নেলকে দেখে প্রসাদ বললেন–আপনার ইয়ং ফ্রেন্ড লাশটাকে মনে হচ্ছে খাটের তলা থেকে টেনে বের করেছেন। আর–খুনটা এখানে–মানে এ ঘরে হয়নি।

–দ্যাটস রাইট। বলে কর্নেল ওদিকে বাথরুমের দিকে এগোলেন। বাথরুমটা আমি অন্যমনস্কভাবে রাতে বা আজ সকালেও দেখেছি কিন্তু ওদিকে এগোবার ইচ্ছে হয়নি কিংবা ভয় হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, পর্দা তুলতেই না জানি কী বিপদে পড়ে যাব।

কর্নেল এক ঝটকায় পর্দাটা তুললেন। তারপর আচমকা পকেট থেকে রিভলবার বের করে গর্জে উঠলেন–কে আছ? হাত তুলে বেরিয়ে এস।

ঘরের সবাই অবাক। প্রসাদ ও দুজন পুলিশও রিভলবার তাক করে কর্নেলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।

কিন্তু ভিতর থেকে কোনো সাড়া এল না। কর্নেল বললেন-দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ আছে। তার মানে কেউ ঢুকেছে, বেরোয়নি।

প্রসাদ ব্যস্ত হয়ে একজন পুলিশকে বললেন–দেখুন তো, বাইরের দিকে পালাবার কোনো ব্যবস্থা আছে নাকি।

পুলিশটি দৌড়ে বেরিয়ে গেল। একটু পরেই ওদিকের জানালা থেকে তার সাড়া পাওয়া গেল না স্যার! জানলা ভাঙা নেই। তাছাড়া বাথরুমের জানলাটা খুব ছোট্ট।

কর্নেল বললেন–তাহলে দরজাটা ভাঙতে হয় মিঃ প্রসাদ! এসব ব্যাপারে মনে হল মিঃ সাক্সেনা খুব সুদক্ষ। ওঁকেই ডাকুন!

মিঃ সাক্সেনা হাসিমুখে এগিয়ে এসে একটা অদ্ভুত হাতুড়ির মতো জিনিস দিয়ে বারকতক বিশেষ একটা জায়গায় ঘা দিলেন। তারপর বললেন–একটু সময় লাগবে, কর্নেল। ইন্টারলকিং সিস্টেমের ঝামেলা এই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য দরজাটা খুলে ফেললেন সাক্সেনা। তারপর কর্নেল চেঁচিয়ে উঠলেন–মাই গুডনেস! আরাধনা এখানে পড়ে আছেন।

অমনি আমি আর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলুম না। সবাইকে ঠেলে মুখ বাড়িয়ে দেখি, বাথরুমের মেঝেয় কাত হয়ে শুয়ে রয়েছে সেই রহস্যময়ী যুবতীটি! মুহূর্তে আমার সব অবিশ্বাস ঘুচে গেল। ওর প্রতি আবার মমতায় ও প্রেমে ব্যাকুল হয়ে পড়লুম। তাহলে আরাধনা আমাকে সত্যি আটকে রেখে পালায়নি। রাতে বাথরুমে ঢুকেছিল, তারপর নিশ্চয় একটা কিছু ঘটেছিল। বেচারাকে মিথ্যে সন্দেহ করছিলুম! এমন কি ওর স্বামীর লাশও যে এই খাটের তলায় আছে, নিশ্চয় তা সে জানত না!

ওকে ধরাধরি করে তুলে এনে বিছানায় শোয়ানো হল। কর্নেল নাড়ি দেখে বললেন–অজ্ঞান হয়ে আছে! মিঃ সাক্সেনা, আপনাদের ডাক্তারকে কি ফোন করা হয়েছে?

প্রসাদ বললেন–হ্যাঁ। এ ঘর থেকেই একটু আগে আমি ফোন করেছি। উনি এক্ষুনি এসে পড়বেন!

ততক্ষণে ওর চোখে-মুখে জল ছিটিয়ে দেওয়া হল। ছাদ নিচু, তাই। শিলিং ফ্যান ছিল না ঘরে। কোনায় একটা টেবিল ফ্যান ছিল। আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা। তাই আমরা রাতে ফ্যান চালাইনি। এখন ফ্যানটা চালানো হল। এসব সেবাশুশ্রূষা চলতে চলতে ডাক্তার এসে পড়লেন। তিনি প্রথমে ভীষণ .. ঘাবড়ে গেলেন। তারপর সামলে নিয়ে আরাধনার দিকে এগোলেন। বললেন– সুইসাইড কেস নাকি? ওরে বাবা! হীরাকুণ্ডে আবার জোড়া লাশ পড়ল? মিঃ সাক্সেনা, মনে হচ্ছে স্বামীকে খুন করে এই মহিলা পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়েছেন।

কর্নেল একটু হেসে বললেন–কিসে বুঝলেন বলুন তো?

তাছাড়া আর কী হবে! বলে ডাক্তার বিছানায় বসে আরাধনার নাড়ি নিলেন, প্রথমে। ওঁর মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। চোখের পাতা ফাঁক করে দেখলেন। তারপর স্টেথিসকোপে শ্বাস-প্রশ্বাস ও হার্টের অবস্থা পরীক্ষা করে বললেন–স্ট্রেঞ্জ! এবং ঠোঁট ফাঁক করে দাঁত বন্ধ দেখে ফের বললেন–স্ট্রেঞ্জ।

কর্নেল সকৌতুকে বললেন পটাসিয়াম সায়ানাইড নাকি?

ডাক্তার বিরক্ত হয়ে ভুরু কুঁচকে বললেননাঃ! যা হবার তাই হয়েছে। স্বামী খুন–স্ত্রী আতঙ্কে মূৰ্ছা গেছে!

কর্নেল হাসতে হাসতে আমার হাত ধরে বেরিয়ে এলেন। তারপর আমাকে নিয়ে ডাইনিং ঘরে ঢুকলেন। ঘরে পুলিশ রয়েছে জনা দুই। তারা গল্প করছে। নির্বিকারভাবে। আমরা কোনার দিকে দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে বসলুম। পাশে জানলাটা খোলা। কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন কাল বিকেলে তোমাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে…

বাধা দিয়ে বললুম–থাক্। আর শুনে কাজ নেই। আপনার সঙ্গে জীবনে আর কোথাও যাব ভেবেছেন?

কর্নেল চাপা গলায় সকৌতুকে বললেন–আশা করি, কাল রাতটা তোমার ভালই কেটেছিল। এ জন্যে তুমি এ বুড়োকে ধন্যবাদ দেওয়া দূরের কথা, শাসাচ্ছা! এমন সৌন্দর্য তোমার বরাতে কখনও কি জুটত ভেবেছ?

কপট ক্রোধে বললুমছাই! সৌন্দর্য না বিভীষিকা!

 কর্নেল হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন।-হুম! বিভীষিকাই বটে। ঠিকই বলেছ জয়ন্ত। তা, আমার ব্যাপারটা শোন।

–আপনি আমার ব্যাপারটা শুনবেন কি না!

–আরে, তোমার তো সবই জানি।

–জানেন! কে বললে আপনাকে?

–আরাধনা রাত্রে ফোনে…না, ভুল বলা হচ্ছে। আমি হীরাকুণ্ডা টাউনশিপের এক জায়গা থেকে ওকে ফোন করেছিলুম–তখন রাত জাস্ট বারোটা। তখন ও সব বলল আমাকে।

–আমার কথার জবাব দিন এবার। প্রথম প্রশ্ন : আপনি ওকে চিনতেন তাহলে?

-না।

তাহলে ওকে ফোন করলেন মানে?

আমাকে তো বলতেই দিচ্ছ না।

–দেব। এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন : আরাধনা আমাকে ফোন লাইন কাটা বলেছিল। কেন?

–সে জবাব ওর কাছে নিও।

 গম্ভীর হয়ে বললুম–বেশ, তাই নেব। কিন্তু আবার বলে দিচ্ছি, আর কক্ষনো আপনার সঙ্গে…

বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন–সবুর বৎস, সবুর। কাল বিকেলে রাস্তার পশ্চিম দিকের জঙ্গলে আমাকে কিছুক্ষণ বাক্শক্তিরহিত হতে হয়েছিল। তা না হলে কি তোমার ডাকে সাড়া দিতুম না ভাবছ? আমার যে সে কী অবস্থা, বোঝাতে পারব না। বুঝতে পারছি, তুমি ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছ–এমন কি তোমার গলায় পাগলামির প্রত্যক্ষ লক্ষণ ফুটে উঠছে। অথচ তখন আমার টু শব্দটি করার উপায় নেই। তারপর মনে হল, তুমি আমার খোঁজে নেমে আসছ। ভাবলুম, এই রে! এখন জয়ন্ত এসে পড়লেই বিপদ। নির্ঘাত সে ডাকতে ডাকতে আমার কাছে এসে পড়বে এবং….

–পাখিটা পালিয়ে যাবে! অদ্ভুত!

–আরে না না! পাখি কোনো ব্যাপারই নয়। এবার মুখ বুজে শুনে যাও। লক্ষ্মীটি, প্রশ্ন করে লক্ষ্যভ্রষ্ট করো না।

মুখ বুজে রইলুম। তখন কর্নেল তার নিরুদ্দেশের ঘটনাটি স্বভাবমতো বিস্তৃত করে শোনালেন। এবং তা হল মোটামুটি এরকম?

রাস্তার পশ্চিমের ঢালু জঙ্গলে নেমে যাওয়ার পর কর্নেল আচমকা একটা দড়িতে হোঁচট খেয়ে পড়েন। ভাগ্যিস তক্ষুনি দড়িটা ধরে ফেলেছিলেন। তা না হলে নিচের অতল খাদে পড়ে মারা যেতেন। দড়িটা টানটান অবস্থায় একটা গাছের সঙ্গে বাঁধা ছিল। খুব সাধারণ দড়িই বটে, মজবুত লতা পাকিয়ে তৈরি। স্থানীয় লোকেরা এই এক ইঞ্চি ব্যাসের শক্ত দড়ি দিয়ে খাদ থেকে বন্যায় আটকে পড়া গাছের গুঁড়ি টেনে তোলে। প্রতি বর্ষায় খাদে বন্যায় জল ঢেকে এবং বড় বড় গাছ ভেসে খাদে আটকে যায়। তখন ওই দড়ি বেয়েই তারা নেমে যায় খাদে। তারপর গাছের ডালপালা কেটে গুঁড়িটা মজবুত করে বেঁধে দেয়। অবশেষে অনেকে মিলে টেনে ওপরে তোলে।

…কর্নেল তাই ভেবেছিলেন। সম্ভবত পাহাড়ীরা কেনো গাছের গুঁড়ি এভাবে। আটকে রেখেছে। বেলা পড়ে আসায় তারা চলে গেছে। পরদিন সকালে এসে টেনে তুলবে। কিন্তু অবাক হয়ে উনি লক্ষ্য করলেন, দড়িটা কাঁপছে। জঙ্গলের প্রবাদ–কিছু নড়াচড়া করতে দেখলেই হুঁশিয়ার হও। কর্নেল সাবধানে এগিয়ে দেখলেন, দড়িটা খাদে সটান নেমে গেছে। কিন্তু অসংখ্য খাজ, চাতাল আর ধাপ থাকায় তলাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। তাছাড়া তখনই ঘন অন্ধকার জমে গেছে খাদে। অথচ দড়িটা মাঝে মাঝে ভীষণ কাঁপছে।

রহস্যভেদী ঘুঘু বৃদ্ধটি তখন অকুতোভয়ে নিচের একটা চাতালে গিয়ে দাঁড়ালেন। অমনি নিচে কাদের আবছা কথাবার্তার শব্দ কানে এল। তারপর মনে হল, শব্দটা ক্রমশ উঠে আসছে ওপরদিকে। এর একটিই ব্যাখ্যা হয়। তা হল, কারা উঠে আসছে খাদ থেকে। এবং নিশ্চয় এই চাতালের ওপাশের ধাপ দিয়ে খাদে ওঠানামা করা যায়। কর্নেল কী করবেন ভাবছেন। সেই সময় আমি তাকে ডাকতে শুরু করেছি। সাড়া দিয়ে বলতে যাচ্ছিলেন–জয়ন্ত, শিগগির এসে মজা দেখে যাও! কিন্তু তখনই নিচে কাদের আর্তনাদ শোনা গেল। অমনি বুদ্ধিমান গোয়েন্দামহোদয় রহস্য আঁচ করে ফেললেন। ঘাপটি পেতে সেই লোকগুলোর অপেক্ষায় রইলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনজন লোকের মাথা দেখা গেল চাতালের একপাশে। কর্নেল লুকিয়ে পড়লেন একটা পাথরের আড়ালে। দেখলেন ওরা মোটেও সাধারণ পাহাড়ী লোক নয়। তিনজনই প্যান্ট শার্ট পরা এবং সশস্ত্র। একজনের কাছে বন্দুকও আছে। তারা যে শিকারী নয়, তা এক নজরেই বুঝেছিলেন কর্নেল। আরো বুঝলেন, যখন ওদের একজন বলল কাজটা ঠিক হল না। শেষ করে দিয়ে আসাই উচিত ছিল। ফিরে যাব নাকি? অন্য একজন বলল-রাতেই মারা পড়বে। চলে এস। খুব জ্বালিয়েছে–এবার একটুখানি রয়েসয়ে মরতে দাও না বাবা! একথায় তিনজনে হো-হো করে হেসে উঠল।

…কর্নেল তো হতভম্ব। ওরা কথা বলতে বলতে চলে গেল ওপরে রাস্তার দিকে। ভয় হল, বেচারা জয়ন্তটা ওরকম খুনে লোকের মুখোমুখি পড়তে যাচ্ছে। নির্ঘাত কোনো বিপদ ঘটে যাবে। একবার ভাবলেন, জয়ন্তের কাছে যাবেন– আবার ভাবলেন, নিচের কারা মৃত্যুযন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে–আগে তাদেরই বাঁচাবেন। ইতিমধ্যে নিচের জঙ্গলে সন্ধ্যার আবছায়া দ্রুত এসে সব কিছু অস্পষ্ট করে দিচ্ছিল। সিদ্ধান্ত ত্বরিতে নেওয়া দরকার। উনি জয়ন্তের উদ্দেশেই ওপরে উঠলেন। ওর সাহায্য দরকার মনে হয়েছিল। কিন্তু হা হতোস্মি! রাস্তায় জয়ন্তের টিকিটি দেখা যাচ্ছে না। একটু পরে উত্তরে পাহাড়টার গায়ে রাস্তায় টর্চের আলো দেখতে পেলেন। বুঝলেন, জয়ন্ত কোথাও চলেছে। তখন অগত্যা নিজের টর্চের সাহায্যে নিচে নামতে থাকলেন।

..খাদে নেমে কর্নেল শিউরে উঠলেন। সেই দড়িতে একজন পুরুষ আর একজন স্ত্রীলোকের যথাক্রমে ডান ও বাঁ পা বেঁধে উল্টোদিকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের একটা পা ভীষণ জোরে নড়াচড়া করছে। দুজোড়া হাতও প্রচণ্ড নড়ছে। তাদের চেঁচাবার ক্ষমতাও তখন ফুরিয়ে গেছে। মুখ কেবল অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ হচ্ছে।

…অনেক কষ্টে কর্নেল আবার ওপরে উঠলেন। তারপর দড়িটা কোথায় বাঁধা আছে, খুঁজে বের করলেন। তারপর দড়িটা ধরে এক টুকরো পাথরের পিছনে উবুড় হয়ে শুলেন। এবং ছুরি দিয়ে সাবধানে ওটা কেটে দিলেন। আচমকা আঁকুনি লাগল। হাতে দড়িটা কেটে বসে গেল। বুকে একটু চোটও লাগল। কিন্তু তবু ছাড়লেন না দড়ি। আস্তে আস্তে ঢিলে দিতে শুরু করলেন। যখন দেখলেন, দড়িটা একেবারে ঢিলে হয়ে গেছে, তখন ছেড়ে দিলেন।

..নিচে নেমে গিয়ে কর্নেল দেখলেন, খাদভর্তি নরম বালির ওপর দুটিতে পড়ে রয়েছে। অজ্ঞান হয়ে গেছে ভেবেছিলেন। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখলেন, অজ্ঞান হয়নি। তবে, কথা বলার ক্ষমতা নেই। নড়াচড়াও করতে পারছে না।

…সাবধানী গোয়েন্দাবর ওদের এক একে বয়ে অনেকটা দূরে একটা আড়ালমতো জায়গায় শুইয়ে জল খাওয়ালেন নিজের বোতল থেকে তারপর ওদের ওই অবস্থায় রেখে চলে এলেন। তিন মাইল পথ প্রায় দৌড়ে যেতে বুড়োর একটুও নাকি কষ্ট হয়নি। মিলিটারির পুরনো ঘুঘু। ওসব অভ্যেস বিলক্ষণ আছে। হীরাকুণ্ড টাউনশিপে পৌঁছে থানায় খবর দিলেন। পুলিশকে সেই লোক তিনটের কথা বললেন না কিন্তু। ওটা তো ওঁর তুরুপের তাস। নিজে বেসরকারি ঝানু গোয়েন্দা, তাই সব রহস্যভেদ নিজের বুদ্ধিতে করাই ওঁর স্বভাব। যাই হোক, পুলিশ কথামতো অ্যামবুলেন্স ও দমকল পাঠিয়ে সে রাতে বিস্তর তোলপাড় করল। পাহাড়ী খাদটা আলোয় উত্তেজনায় হল্লায় জমাট হল। তখন বৃষ্টি আর তুলকালাম পাহাড়ী দুর্যোগ চলেছে। ততক্ষণে বেচারারা অজ্ঞান হয়ে গেছে আবার। ওদের ঝড়জলের মধ্যে হীরাকুণ্ডায় আনা হল এবং হাসপাতালে দেওয়া হল।

..এদিকে কর্নেল জয়ন্তের কথা ভেবে তখন উদ্বিগ্ন। হঠাৎ মনে পড়ল, যে পাহাড়ে সম্ভবত জয়ন্তের টর্চের আলো দেখেছেন, তার ওদিকেই একটা নির্জন বাড়ি আছে। বাড়িটার সম্পর্কে তাঁর কিছু জানা ছিল। কোন এক কাঠের ব্যবসায়ীর নাকি শৈলাবাস। খোঁজ-খবর নিয়ে বাকিটা জেনে নিলেন। ইতিমধ্যে হাসপাতালে পুরুষ ও স্ত্রীলোকটির জ্ঞান ফিরেছে। তারা বলেছে, শৈলেশ সিংয়ের তারা পরিচারক ও পরিচারিকা। হীরাকুণ্ডায় শৈলেশ সিংয়ের একটা বাড়ি আছে। আজ সকালে সাহেবের সঙ্গে তারা গাড়িতে সেখানে যায়। মাইজি আরাধনা দেবীর শিলিগুড়ি থেকে সোজা ওখানে পৌঁছাবার কথা ছিল দুপুর নাগাদ। সেই মতো লাঞ্চ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু মাইজি দুটো অব্দি পৌঁছলেন না দেখে সায়েব ওদের থাকতে বলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান। তারপর আচমকা তিনজন বন্দুকবাজ লোক হানা দেয়। ওরা তাদের ধরে নিয়ে যায় খাদে এবং ওইভাবে ঝুলিয়ে রাখে। কেন? তা জানে না রঘুবীর বা লতা।

..তখনও ঝড়বৃষ্টি সমানে চলেছে। এসব সময় আচমকা ধস ছাড়ে। তাই সকাল অব্দি অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় ছিল না। পুলিশ অত ঝামেলা পোহাতে। যাবে কেন? সকাল হোক, তখন দেখা যায়েগা সবকুছ! এই হল থানা অফিসারের বক্তব্য।

…কিন্তু কর্নেল জয়ন্তের জন্য উদ্বিগ্ন। হঠাৎ তার মনে হল, চণ্ডীপাহাড়ের শৈলাবাসে ফোন থাকা কি অসম্ভব? কারণ, বিজলি তার যে গেছে, তা লক্ষ্য করেছেন আগে। তখন কর্নেল স্থানীয় এক্সচেঞ্জে রিং করলেন। নাম্বার পাওয়া গেল। কিন্তু অপারেটার জানাল, লাইন গড়বড় হয়েছে। একেবারে ডেউ। তখন রাত্রি নটা। হীরাকুণ্ডায় ঝড়জলের মধ্যে এক বন্ধুর বাড়ি গিয়ে উঠলেন কর্নেল। কিন্তু ঘুম এল না। রাত দশটার পর আবার মরিয়া হয়ে এক্সচেঞ্জে যোগাযোগ করলেন। এবার অপারেটার অবাক হয়ে বলল–লাইন ইজ অল রাইট। বাত্ কিজিয়ে! ফোনের ওপার থেকে স্ত্রীলোকের মিঠে স্বর ভেসে এল।-হ্যালো! শৈলেশ বলছ? কোথায় তুমি? এখানে এসে দেখি, সব হাট করে খোলা। কেউ নেই ব্যাপার কী?

..আরাধনা নিশ্চয় অবাক হল, যখন শুনল শৈলেশ সিং নয়–অন্য কেউ গম্ভীর গলায় কথা বলছে! যাই হোক, জয়ন্তের হদিস মিলল। আরাধনা জানাল, হা–আশ্রয়প্রার্থী ও অতিথি বাবুজী নাক ডাকিয়ে আরামে ঘুমোচ্ছেন। কর্নেল ওকে ডেকে দিতে নিষেধ করলেন। ঘুমোক বেচারা। এখন জাগালে বেমক্কা কর্নেলের শ্রাদ্ধ করে ছাড়বে!

–হ্যাঁ, আরাধনাকে তাদের পরিচারক-পরিচারিকার কথা কর্নেল কিছু জানাননি। উনি যে রহস্যভেদী ঘুঘু! তুরুপের তাসটি সারাক্ষণ হাতের চেটোয় লুকিয়ে রাখা অভ্যাস। সময়মতো ঝেড়ে সবার আক্কেল গুড়ুম করে দেবেন কিনা!

.

এই হল কর্নেলের বিবরণ। তবে এর ফাঁকে কতখানি তথ্য ঊহ্য কিংবা গুহ্য রেখেছেন, আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কিন্তু ওঁর মুখ দেখে, তার আঁচ পাওয়াও দুঃসাধ্য। অমন নিরীহ সরল মুখ যার, সে যে কী ধুরন্ধর, আমি ছাড়া খুব কম লোকই জানে।

কথা শেষ করে কর্নেল বললেন–হুম! জয়ন্ত ডার্লিং! এবার তোমার কাহিনীটি আগাগোড়া শোনা যাক। অবশ্য, তোমার রোমান্সের মিঠে এপিসোডটুকু বাদ দিলে এ বুড়োর মনে খুব কষ্ট হবে। নানা, অত মুখ রাঙা করা লজ্জার কোনো কারণ নেই বৎস। আমি মনে মনে তোমার চেয়েও যথেষ্ট যুবক সম্ভবত। নাও, স্টার্ট!

আমি আগাগোড়া খুঁটিয়ে আমার পর্বটি শোনালুম। শোনার পর কর্নেল বললেন–তুমি খুনীকে ধরার মারাত্মক কিছু সূত্র হয়তো নষ্ট করেছ, জয়ন্ত। আই এগ্রি হাতের ছাপপুলো নষ্ট হয়েছে। এমন কি…

ওঁকে থামতে দেখে বললুম–আর কী?

কর্নেল হঠাৎ সোজা হয়ে বললেন–আচ্ছা জয়ন্ত, তুমি যখন শুতে যাও, তখন কি ঘড়ি দেখেছিলে?

–নিশ্চয়। ঠিক নটা দশে আমি শুয়ে পড়ি। ভীষণ ঘুম পাচ্ছিল। অবশ্য একটু ইতস্তত করে হেসে বললুম–আপনাকে লুকোব না। মহিলাটির সঙ্গে একই শয্যায় ছিলুম। কিন্তু গোড়ার দিকটা মনে পড়ছে কী কী করেছি, বাকিটা মনে নেই।

-হুম! এখন সবটা ফোরেন্সিক টেস্টের উপর নির্ভর করছে। জয়ন্ত, শুধু জেনে রাখো, এ একটা অদ্ভুত মার্ডার কেস!..বলে কর্নেল হাই তুলে অভ্যাসমতো বুকে ক্রস আঁকলেন।…

আরাধনার কথায় যে গোলমাল আছে, তা আমি বুঝতে পারছিলুম। আমাকে ও বলছিল, ২৩ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ পরশু সকালে এসেছে স্বামীর সঙ্গে। অথচ রঘুবীর লতার কথামতো এটা মিথ্যে হয়ে যায়। গতকাল দুপুর দুটো অব্দি ও পৌঁছায়নি দেখেই নাকি শৈলেশ সিং ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে যান। তারপর ওঁর মুণ্ডুকাটা লাশ পাওয়া গেলো ওঁর খাটের নিচেই। কিমিম?

আরাধনা কর্নেলকেও কিছু খুলে বলেনি। শুধু আমার কথাটা বলেছিল আমি নাকি ঝড়বৃষ্টিতে ওখানে আশ্রয় নিয়েছি। অস্যার্থ?

আরাধনা পতিনিন্দা করছিল আমার কাছে। তবে সবচেয়ে অবাক কাণ্ড, আমার মতো অচেনা বা সদ্যচেনা যুবকের সঙ্গে তার আচমকা প্রেমাবেশ এবং নির্দ্বিধায় এক শয্যায় শুয়ে পড়া! সে কি এতে অভ্যস্ত? তার মানে সে কি তথাকথিত সোসাইটি গার্ল অথবা নিছক বারবনিতা? অবশ্য অধুনা বিদেশে ও স্বদেশে উচ্চবিত্ত উচ্ছংখল পরিবারে মেয়েদের এই অনাচারই কালচার। সেক্স ছাড়া কথা নেই তাদের অনেকের। কিন্তু আরাধনার ক্ষেত্রে প্রকৃত সত্য কী?

সেদিনই হীরাকুণ্ডা ফরেস্ট বাংলোয় লাঞ্চ খেয়ে ঝিমোচ্ছি। এমন সময় পুলিশ ইন্সপেক্টর মিঃ সাক্সেনা এলেন নিজে। সঙ্গে এক সিভিলিয়ন পোশাকধারী ভদ্রলোক। তাকে দেখেই কর্নেল বেড়ালের মতো বিছানা থেকে লাফ দিয়ে চেঁচালেনবাই জোভ! কী মারাত্মক যোগাযোগ! যেখানে গোয়েন্দা, সেখানেই খুন এবং সেখানেই ফোরেনসিক এক্সপার্ট? হ্যালো ডঃ পট্টনায়ক! এ যে অবিশ্বাস্য!

দীর্ঘদেহী প্রৌঢ় হাসতে হাসতে কর্নেলের হাতে হাত মেলালেন। মিহি গলায় শুধু বললেন–হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো!

ইনিই তাহলে সেই দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোরেন্সিক বিভাগের প্রধান ডঃ সীতানাথ পট্টনায়ক! ব্যস, এবার তাহলে তুলকালাম শুরু হবে দুই বন্ধুতে। ওই অধ্যাপক ভদ্রলোকের খ্যাতি নাকি আন্তর্জাতিক। আমার এবার আর মাথা ঘামিয়ে কাজ নেই। শুধু চুপচাপ দেখে যাই।

কিছু সময় পরস্পর এটা ওটা কথা বলার পর এসে পড়ল শৈলেশ সিংয়ের হত্যাকাণ্ড। ডঃ পট্টনায়ক বললেন–ইনিই তাহলে জয়ন্তবাবু? আরে! আপনি তো দেখছি নেহাত বাচ্চা! জার্নালিস্টমহলে আপনার এত সুনাম শুনে ভেবেছিলুম হয়তো আমাদের বয়সী বুড়ো-টুড়ো কেউ হবেন! এ যে অবিশ্বাস্য!

কর্নেল গম্ভীর হয়ে বললেন–না, জয়ন্তকে শিশু বললেনও আমার আপত্তি হবে না। তবে ভীষণ রোমান্টিক চ্যাপ। আর রোমান্সের আঁচ পেলো তো কথা নেই। ওর দ্রবীভূত হয়ে যেতে দেরি সয় না!

কথাটা নিঃশব্দে হজম করতে হল। কারণ সামনে দুজন বাইরের লোক। ডঃ পট্টনায়ক বললেন–আজকালকার ইয়ং ম্যানরা অন্য রকম হবে না? যুগ বদলাচ্ছে যে! যাক্ গে, শুনুন কর্নেল। আমি গত রাত্রে বৃষ্টির আগে এখানে দৈবাৎ এসে পড়েছি কাঠমাণ্ডু থেকে। হীরাকুণ্ডায় আমার এক ভাগ্নী থাকে। আজ সকালে বেরিয়েছিলুম নেহালকোটা প্রপাত দেখতে। দুপুরে শুনলাম, কে একজন খুন হয়েছেন। অভ্যাস যাবে কোথায়? তক্ষুনি গিয়ে মিঃ সাক্সেনার কাছে হাজির হলুম।

কর্নেল সকৌতুকে বললেন–ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানবে, তাতে অবাক হব না। নিশ্চয় সেই পোর্টেবল ল্যাবরেটরিটিও সঙ্গে রয়েছে যথারীতি?

–তা আর বলতে! এখন রেজাল্টগুলো শুনে যান, এক ও শৈলেশ সিংয়ের মৃত্যুর কারণ নিকোটিন-ঘটিত বিষ। মৃত্যুর পর পুলিশকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে তার মুণ্ডুটা কাটা হয়েছে। দুই ও বেডরুমে কারা কফি খেয়েছিল। একটা কাপের তলায় সামান্য মর্ফিয়ার গুড়ো পাওয়া গেছে।

 বাধা দিয়ে কর্নেল বলে উঠলেন–সর্বনাশ! দ্যাটস রাইট। জয়ন্তকে কেউ ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চেয়েছিল।

বললুম-আরাধনা ছাড়া আবার কে?

 ডঃ পট্টনায়ক বললেন–তিন : ওখানে যতগুলো জুতোর ছাপ পাওয়া গেছে–তা মোট দু ভাগ করেছি। ঝড়বৃষ্টির সময়কার ছাপ আর ঝড়বৃষ্টির পরের ছাপ। ঘরে ও বাইরে সব ছাপই নেওয়া হয়েছে, দেখলুম, ঝড়বৃষ্টির সময় অন্তত জনা তিনচার লোক লন থেকে বারান্দায় হেঁটেছে। কিছু ছাপ ডাইনিং রুমে, কিছু বেডরুমে পাওয়া গেছে। ঝড়বৃষ্টির পরের ছাপ শুধু একজনের। সে ডাইনিং রুমে ঢোকেনি। বেড়রুমে গেছে এবং বেরিয়ে এসেছে। চার : বাথরুমের দরজার হাতলে আরাধনা দেবী ছাড়াও অন্তত একজনের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে।

ডঃ পট্টনায়ককে থামতে দেখে কর্নেল বললেন–শৈলেশ সিংকে কোথায় খুন করা হয়েছে বলে মনে করেন?

–কিচেন বা ডাইনিং খুঁজেছি। কোথাও বিষাক্ত জিনিস পাইনি। ডাইনিং রুমের মেঝে টেবিল সব পরীক্ষা করেছি। সন্দেহজনক কিছু নেই। তাই আমার ধারণা, ওঁকে বাইরে কোথাও খুন করে বাংলোয় আনা হয়েছিল। তারপর সম্ভবত খাটের তলায় ঢুকিয়েই ছোরা চালানো হয়। তখন তো রক্ত জমাট। রাইগর মরটিস শুরু হয়েছে। অর্থাৎ দেহ শক্ত হতে লেগেছে।

ছোরা চালানোর সময়টা আন্দাজ করেছেন কি?

হা। আমার ধারণা, রাত এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে।

আমি শিউরে উঠলুম। তখন আমি মরফিয়ার নেশায় কাঠ। আর নিশ্চয় ওই শয়তানীটা স্বামীর লাশে দিব্যি ভোজালি চালিয়েছে! কী সর্বনেশে মেয়ের সঙ্গে না ঢলাঢলি করেছি!

কর্নেল বললেন–ঝড়বৃষ্টির পরে অন্তত দুজন বেডরুমে ঢুকেছিল! তাই না। ডঃ পট্টনায়ক?

–হ্যাঁ।

ততক্ষণে আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লেগেছে। যতবার রাতের দৃশ্যটা ভাবছি, মগজের ভিতর ঠাণ্ডা আঙুল পড়ছে কার। আমাকে মরফিয়া খাইয়েছিল! সর্বনাশ! তাই আমার অত ঘুম পাচ্ছিল! ওই লাবণ্যময় মুখের আড়ালে কী নিষ্ঠুরতা!

বাইরে খোলা হাওয়ায় দাঁড়ালুম। একটা পাহাড়ের গায়ে এই ফরেস্ট বাংলো। চারদিকে ছড়ানো থরে বিথরে প্রকৃতির ঐশ্বর্য! এখন আমার চোখে শুধু মায়াবিনী আরাধনার চেহারা ভেসে উঠছে। অত সুন্দর মেয়ে আমি কোথাও দেখিনি! দেখিনি অমন আশ্চর্য যৌবন আর মধুময় শরীর। সেই শরীরের স্পর্শ ভোলা যায় না। অথচ ঘৃণায় মনটা তেতোও। অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়ে রইলুম।

চমক ভাঙল জিপের শব্দে। দেখি, মিঃ সাক্সেনা আর ডঃ পট্টনায়ক চলে গেলেন। কর্নেল লনের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছিলেন। এবার ডাকলেন– ডার্লিং! শিগগির তৈরি হয়ে নাও, আমরা বেরোব।

বললুম-রক্ষে করুন গোয়েন্দামশাই! আর উড্ডাকের পিছনে দৌড়বার সাধ্যি আমার নেই। আপনি যান, আমি ক্লান্ত।

কর্নেল এসে আমার হাত ধরে সবিনয়ে বললেন–আহা হা, তুমি তো অমন বেরসিক ছিলেন না জয়ন্ত! হল কী তোমার? প্লিজ, কথা শোন। আজ তোমাকে সত্যি এক আশ্চর্য জিনিস দেখাব!

কাল তো অত্যাশ্চর্য দেখিয়ে ছেড়েছেন। আর দেখতে চাইনে।

 কর্নেল আমাকে ছাড়লেন না। বিস্তর সাধাসাধির পর নরম হলুম। দুজনে পোশাক বদলে নিয়ে বেরোলুম। রাইফেলটা নিতে দিলেন না। বললেন–এবেলা আমরা হীরাকুণ্ডা টাউনশিপে যাব। দেখবে, পৃথিবীতে এখনও অসংখ্য বিস্ময় আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে।

সারাপথ ছেলেভুলানো ধরনের কথায় আমাকে তুষ্ট করতে করতে বৃদ্ধ সঙ্গীটি টাউনশিপে পৌঁছলেন। তখন বিকেল হয়ে গেছে। কথা বলতে বলতে হঠাৎ কর্নেল হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন। একবারে ধূলিসাৎ যাকে বলে। আমি তাকিয়ে ওঁর দুর্দশা দেখছি, উনি হাত বাড়িয়ে করুণ মুখে বললেন–ওঃ জেসাস! আমি…এবার সত্যি গেছি! প্রিয় জয়ন্ত, আমাকে ওঠাও। ও হো হো হো! একেবারে কম্পাউন্ড ফ্র্যাকচার নির্ঘাত।

আমি অবাক। এমন ঝকঝকে পিচের রাস্তা, সারাদিনের উজ্জ্বল রোদে একেবারে শুকনো খটখটে। পা ফস্কাবার কোন কারণই থাকতে পারে না। অথচ বুড়ো হোঁচট খেলেন কী ভাবে?

হাসতে হাসতে টেনে দাঁড় করালুম। কিন্তু উনি সমানে কাতরাচ্ছেন। তাহলে নিশ্চয় সত্যি সত্যি জোর চোট লেগেছে। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লুম। এ যাবৎকাল এই ষাট বছরের মানুষটিকে কোথাও আছাড় খেতে দেখিনিকতবার কত বিদঘুটে পাহাড় ভেঙে বাচ্চাদের মতো ওঠানামা করেছেন। তাঁর এ দুর্বিপাক ঘটল কেন?

ওঁকে সাবধানে ধরে চেঁচিয়ে দূরের এক টাঙাওয়ালাকে ডাকলুম। সে এলে দুজনে ধরাধরি করে ওঁকে ওঠানো হল। তারপর টাঙাওলাকে বললুম-শিগগির কোনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলো। সবচেয়ে বড় ডাক্তার যিনি তার কাছে।

একটু পরে ঘোড়ার গাড়িটা একটা বাড়ির সামনে থামল। আমি লাফ দিয়ে নেমে দরজায় কড়া নাড়লুম। একটি মেয়ে বেরিয়ে বলল–ডক্টরসাব হাসপাতালসে আভিতক নেহি ঘুমায়া।

ক লোটেগা বাতাইয়ে?

—আধাঘণ্টা পরে মিনাট বাদ!

–তো ডিস্পেনসারি খুল দিজিয়ে। পেসেন্ট হ্যায়। হামলোক ওয়েট করে গা।

মেয়েটি প্রৌঢ়া। মনে হল পরিচারিকা হতে পারে। সে আমাকে এবং গাড়ির যন্ত্রণাকাতর রোগীকে দেখে নিয়ে, অদৃশ্য হল। তারপর পাশের ডাক্তারখানার দরজা খুলে দিল। টাঙাওলার সাহায্যে কর্নেলকে নিয়ে ঘরে ঢুকলুম। তারপর অপেক্ষা করতে থাকলুম।

সেই সময় কর্নেল অস্ফুট স্বরে বললেন–জল খাব, জয়ন্ত।

উঠে গিয়ে ভেতরের দরজায় ডাকলুম–জেরা শুনিয়ে না!

সেই প্রৌঢ়া এল। মুখে স্পষ্ট বিরক্তির চিহ্ন। বললুম–এক গেলাস জল দিজিয়ে না মাইজী। পেসেন্ট পিনা মাংতা।

সে জল এনে দিল। চলে যাচ্ছিল, এমন সময় কর্নেল তাকে ডাকলেন– শুনিয়ে মাইজি!

এরপর দুজনের মধ্যে যে কথা হল, তা এই :

…এই ডাক্তারবাবুর তো ভারি নামডাক। তাই না? জরুর। এঁর চেয়ে বড় ডাগদার আর এ তল্লাটে নেই। বিলাইতি পাস ডাগদার বলেই তো সরকারি মহলে, অত খাতির। হাসপাতালে ভি ডাগদারবাবু আছেন। কিন্তু খুব কঠিন বেমার হলে তখন আমাদের ওনাকে তলব করা চাই।..হুম, তা শুনেছি বটে! সেইজন্যেই তো ওঁর জন্যে অপেক্ষা করা হচ্ছে। তা মাইজি, খুব বড় বড় পেসেন্ট হরবখত নিশ্চয় ওঁর কাছে আসেন?…তা আর আসবেন না! অনেক আসেন। নিশ্চয় গাড়িওয়ালা পেসেন্ট তারা!..জরুর! এই কালই তো এক বড়া আদমী গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন! ডাগদারসাব ওনার চিকিৎসা করলেন। কিন্তু বেচারা!…কেন, কেন?…বেচারা বেঁহুশ হয়ে গেল আচমকা। তখন আমাদের দিলওয়ালা ডাগদারসাব ওনাকে নিজের গাড়ি করে হাসপাতালে, নাকি ওনার বাড়ি, কোথায় যেন রেখে এলেন।…বাঃ, খুব উপকারী মানুষ তো?..জরুর। উনি নিজে ভি তাই বলেন–মানবকা সেবা ভগওয়ানকা…আচ্ছা মাইজি, তাহলে উনি স্ত্রীলোকেরও চিকিৎসা করেন? মানে আমার এক বহিন অনেকদিন থেকে ভুগছে।…তাকে জরুর নিয়ে আসবেন।…মাইজি, তাহলে প্রতিদিন মেয়ে রোগীও অনেক আসে?…আলবাৎ আসে।…কাল আমার এক ভাইঝি শুনলুম এখানকার কোন ডাক্তার-কে দেখিয়ে গেছে। কেমন চেহারা, বলুন তো?..খুব খুপ-সুরত! বয়স বেশি নয়। টকটকে ফরসা রঙ।

প্রৌঢ়া পরিচারিকা একটু কেমন-কেমন হাসল–উ বুঝেছি। আপনার ভাইঝিই বটে। কাল কখন এসেছিল সে?

–তা আন্দাজ বেলা আড়াই-তিন হবে।

–গেল কখন?

–তিন-সাড়ে তিন বাজে তখন।…

–হেঁটে নাকি গাড়ি চেপে এসেছিল?

না না, হেঁটে এসেছিল। টাঙা চেপে চলে গেল।

 –তখন বুঝি ডক্টরবাবু সেই বেঁহুশ রোগী নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন?

প্রৌঢ়া এতক্ষণে সন্দিগ্ধদৃষ্টে তাকাল। তারপর বলল–আমার কাজ আছে। আপ লোক বৈঠিয়ে।

–শুনিয়ে মাইজি, শুনিয়ে! উও বড়া পেসেন্ট আদমি ভি মেরা আপনা আদমি হ্যায়, আপ নেহি জানতি!

কুছ দরকার নেহি। জাননেকা ক্যা ফায়দা?

–পুছতা হ্যায়, উসকো কোন টাইমমে ডক্টরসাব পঁহুচা দিয়া, আপকী মালুম হ্যায়?

–ম্যায় নেহি জানতি!

বলে প্রৌঢ়া চলে গেল। কর্নেল আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন–এই পাহাড়ী মেয়েগুলো বড্ড সরল থাকে আজীবন। উত্তর ভারতের ওই রাজাধিরাজ হিমালয়ের শাসনের নমুনা এটা! জয়ন্ত, আশা করি তুমিও এইসব পাহাড়ী সারল্যের সঙ্গে সুপরিচিত? আর এই সারল্যই ওদের গোঁয়ার করে।

-আপনার ব্যথাটা কোথায় গেল?

কর্নেল পা দুটো ঝেড়ে সোজা রেখে বললেন–মাই গুডনেস! কী ম্যাজিসিয়া ডাক্তার দেখছ জয়ন্ত? চেম্বারে ঢোকার পরই সব সেরে গেল যে! একি, একি!

বলে উনি হঠাৎ উঠে মেঝেয় পায়চারি কিংবা মার্চ শুরু করলেন। আমি হতভম্ব। উনি এবার আমার হাতটা ধরে এক টান দিলেন।

কুইক জয়ন্ত! পা যখন সেরে গেছে ডাক্তার আসার আগেই, মিছিমিছি ফিয়ের টাকা খরচ করার মানে হয় না। এসো, চুপিচুপি কেটে পড়া, যাক্।

বলেই উনি আমাকে প্রায় লুফে নিয়ে পৃথ্বীরার্জের সংযুক্তা হরণের মতো মুহূর্তে রাস্তায় পৌঁছলেন। তারপর এক টাঙাওয়ালাকে থামিয়ে বললেন–লাফ দিয়ে ওঠ জয়ন্ত। এক মুহূর্ত দেরি নয়।

টাঙাওয়ালা বলল কঁহা যাইয়েগা সাব?

কর্নেল গম্ভীর মুখে জবাব দিলেন-চণ্ডীপাহাড়।

শৈলেশ সিংয়ের সেই সৌন্দর্য ও বিভীষিকায় ভরা বাংলোয় ফের যেতে। আমার কৌতূহল ছিল নিশ্চয়। কিন্তু গরজ দেখালুম না। টাঙাটা রাস্তায় বিদায় দিয়ে আমরা উত্রাই-চড়াই ভেঙে শালবনে পৌঁছলুম। তখন কর্নেল একটু হেসে বললেন-জয়ন্ত কি অবাক হচ্ছ?

–পাগল? পাগলদের কাজে অবাক হয় কে?

–আমাকে তুমি পাগল বলছ, জয়ন্ত? কর্নেল করুণ মুখে তাকালেন।

তাছাড়া কী?

 উনি সস্নেহে আমার একটা হাত ধরে হাঁটতে থাকলেন। শালবনটা পেরোনো অব্দি মুখ খুললেন না। ফাঁকা জায়গায় পৌঁছে মুখ তুলে টিলার গায়ে বাংলোটা লক্ষ্য করলুম। অস্বাভাবিক নির্জন হয়ে আছে। পুলিশ কাজ শেষ করে চলে গেছে বোঝা গেল। এখন আর পাহারার দরকার মনে করেনি। কর্নেল বললেন তুমি আমাকে অনায়াসে এখন প্রশ্ন করতে পারো, ডার্লিং। আমার চমৎকার মুড এসে গেছে। আহা, পশ্য পশ্য বৎস, বাংলোর গায়ে বিকেলের গোলাপি রোদ পড়ে কী স্বর্গীয় বস্তু না প্রকট হচ্ছে! এই বাড়িটি যদি আমার হত! হুম্ জয়ন্ত প্রশ্ন করতে পারো!

–মাথায় কিছু আসছে না এখন।

–জানতে ইচ্ছে করছে না যে আজ সকালে অত দেরি করে তোমাতে। উদ্ধার করতে গেলুম কেন?

উঁহু।

 কর্নেল হাসতে হাসতে এগোলেন। বাংলোর গেট খুলে আমরা ভেতরে ঢুকলুম। কর্নেল আমাকে নিয়ে বাড়িটার পিছন দিকে গেলেন। ওদিকে বুকসমান উঁচু বেড়া আর তার ওপাশে ঢালু হয়ে জঙ্গল নেমে গেছে। মনে হল, ওদিকটা গেটের দিকের মতো খাড়া নয় তাই সোজা গাড়ি চালিয়েও নামা যায়। অবশ্য পাড়ির রাস্তা ওদিকে নেই। একজায়গায় কর্নেল থমকে দাঁড়ালেন। তারপর হাঁটু দুমড়ে বসে কী সব পরীক্ষার পর অস্ফুট স্বরে বললেন–ও. কে.! জয়ন্ত, তোমার মনে হচ্ছে না, এই বেড়া গলে কেউ ঢুকেছিল এপাশে?

ভালো করে দেখে বললুম–হ্যাঁ। তাই মনে হচ্ছে।

কর্নেল কাঠের বেড়ার পাশেই একজায়গা থেকে হঠাৎ কী একটা জিনিস কুড়িয়ে নিলেন। তারপর দ্রুত সেটা পকেটে পুরলেন।

বললুম–কী ওটা? কর্নেলকে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। বেড়াটা সেই সন্দেহজনক জায়গায় উনি গলিয়ে যাবার চেষ্টা করছিলেন। জবাব দিলেন না। অবশেষে হাঁটু দুমড়ে ওপারে গলেও গেলেন। আমি ওভাবে না গিয়ে বেড়াটার ধরে ডিঙিয়ে ওপারে গেলুম। তারপর ফের বললুম কী ওটা,বলছেন না যে?

কর্নেল ভীষণ গম্ভীর। মাটিতে ঝোঁপঝাড়ে কী যেন খুঁজছেন। আমার কথা যেন শুনতেই পেলেন না।

এতে নিশ্চয় রাগ হল আমার। বললুম-অত গোয়েন্দাগিরির কী আছে? যা বোঝবার, তা তো এখন বোঝাই গেছে।

কর্নেল শুধু তাকালেন আমার দিকে।

বললুম–আজ সকালে যে ডাক্তারবাবুটিকে পুলিশ এনেছিল এবং আপনার আজব পা মচকানি সারাতে যার চেম্বারে ঢুকেছিলেন, তিনিই যে খুনী, তাতে আর গোলমালটা কোথায়? প্রৌঢ়া পরিচারিকার যা জবানী তাতে স্পষ্ট এটা বোঝা যায়।

কর্নেল বললেন–হুম! বলে যাও।

উৎসাহে বলতে থাকলুম-রঘুবীর আর লতার জবানবন্দী স্মরণ করুন। গতকাল দুটোর পর শৈলেশ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান। এবার প্রৌঢ়ার কথা মনে করুন। ওই সময় শৈলেশ ওই ডাক্তারের ওখানে যান।

-কেন?

–এটা অবশ্য আমার থিওরি। আরাধনার সঙ্গে ডাক্তারের অবৈধ সম্পর্ক আছে। শৈলেশ স্ত্রীর দেরি দেখে একটা কিছু নিশ্চয় অনুমান করেছিলেন এবং ডাক্তারের বাড়ি হানা দেন। ওই সময় আরাধনা সেখানে ছিল। তারপর যেভাবে : হোক, বিষ খাইয়ে শৈলেশকে ওরা মারে। তারপর ডাক্তার শৈলেশের লাশটা ফেলতে যান। কিন্তু হঠাৎ সম্ভবত তার মনে হয় যে এটা রিস্কের ব্যাপার হবে। তাই সে নোক পাঠিয়ে রঘুবীর-লতাকে সরায় ওখান থেকে। তারপর বডিটা বেডরুমে খাটের নিচে রেখে আসে। এবং পরে আরাধনা যায়। অবশ্য আরাধনা। জানত না বডিটা কোথায় আছে। সে ডাক্তারের অপেক্ষা করছিল। ইতিমধ্যে আমি গিয়ে পড়ি। আমাকে সে কফিতে মরফিয়া খাইয়ে এবং ভুলিয়ে শুইয়ে রাখে। তারপর আসুন ডাঃ পট্টনায়কের যুক্তিতে! ঝড়জলের পর অন্য কেউ বেডরুমে ঢুকেছিল। সে ওই ডাক্তার ছাড়া আর কে? তারপর আরাধনার সঙ্গে নিশ্চয় হঠাৎ কোনো কারণে ঝগড়া হয়। সম্ভবত বডিটা নিয়ে তর্কাতর্কি থেকে ঝগড়া। হয়তো ওভাবে বডিতে ছুরি চালানো পছন্দ করেনি আরাধনা। যাই হোক, তখন ডাক্তার ওকে বাথরুমে আটকে দেয়। ও সেখানে মানসিক যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে। ডাক্তার কাজ সেরে চলে আসে। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, এইমাত্র যে জিনিসটা পকেটে পরলেন, তা ডাক্তারের পোশাকের টুকরো। বেড়া গলাতে গিয়ে ছিঁড়ে গিয়েছিল।

কর্নেল হো-হো করে বেদম হাসলেন। তারপর বললেন ব্রাভো! চমৎকার! কিন্তু ডার্লিং, তোমার এই অনবদ্য তত্ত্ব-শৃঙ্খলটির তিনটে জায়গা এত দুর্বল কহতব্য নয়।

বলুন, কোথায়?

–প্রথম রঘুবীর লতাকে যারা বেঁধে ঝুলিয়ে রেখে আসছিল, তারা কিন্তু যা বলেছিল–আমি স্বকর্ণে শুনেছি, তা প্রতিহিংসার ব্যাপার ছাড়া আর কিছু নয়। দগ্ধে দগ্ধে মারতে চেয়েছিল ওদের। কেন?

–হয়তো ওরা ডাক্তার ও আরাধনার ষড়যন্ত্র টের পেয়েছিল, তাই।

–তার জন্যে দগ্ধে মারার মোটিফটা মেলে না। আশা করি, শৈলেশ সিংয়ের সে স্মাগলিং চক্র ফাঁস করার কথা তুমি ভোলনি!

বেশ। দ্বিতীয় দুর্বল জায়গার কথা বলুন।

–দ্বিতীয় ও একজন ডাক্তার যদি খুনী হয়, সে নালি অ্যান্ড সাইকলজিক্যালি এমন একটা পদ্ধতি বেছে নেবে–যা কারো মনে সন্দেহ উদ্রেক করবে না। নিকোটিন প্রয়োগ একটা আকস্মিক পদ্ধতি। কেন সে ওই রিস্ক নেবে? সে ধীর পদ্ধতিতে এগোবে। কারণ, কাকেও রোগে ভুগিয়ে মেরে ফেলা তার পক্ষে খুবই সহজ। ধরা যাক্, তোমার তত্ত্ব অনুসারে হঠাৎ শৈলেশ সিং গিয়ে পড়ে স্ত্রীর ব্যাপারে ঝামেলা বা ঝগড়া বাধিয়েছিলেন। তাহলে তাকে বিষ প্রয়োগ করবে কী ভাবে? সেখানে অবস্থা ও পরিবেশ আত্মীয়তামূলক হওয়া দরকার নয় কি? স্বেচ্ছায় কিছু না খেলে বিষ দেবার সুযোগ কোথায়?

–কিন্তু শৈলেশ সিং গিয়েছিলেন তা তো ঠিক?

সম্ভবত ঠিক।

–তাহলে বলব, ঝগড়া করেননি। অভিনয় করেছিলেন–মানে, চেপে গিয়েছিলেন এবং…

–তাহলেও শৈলেশের সাইকলজিক্যাল প্রসঙ্গ এসে পড়ে। স্ত্রীকে ওখানে আবিষ্কার করার পর তার পক্ষে কি হাসিমুখে বাক্যালাপ করা সম্ভব? ভেবে দেখ জয়ন্ত, এটা কি স্বাভাবিক কারো পক্ষে? যার জন্য বেচারা অধীর হয়ে প্রতীক্ষা করছিলেন, তাকে এক প্রণয়ীর বাড়ি দেখে মানুষ কী করবে?

 চুপ করে থাকলুম। গোলমালে ফেলে দিলেন বুড়ো ঘুঘু!

–এবার তৃতীয় দুর্বলতা : শৈলেশ সিংয়ের ব্যাকগ্রাউন্ড–যা পুলিশের নথিতে রয়েছে। ইদানীং শৈলেশ সবসময় শত্রুর ভয়ে কাটাতেন। কয়েকবার তাঁর প্রাণ সংশয় পর্যন্ত হয়েছিল শিলিগুড়িতে। দৈবাৎ বেঁচে যান। যাদের নামে উনি ডায়রি করে রেখেছেন, তাদের নাম শুনলে চমকাবে, জয়ন্ত।

–চমকাব না, বলুন।

রঘুবীর ও লতার নামে।

–অথচ ওঁদের ঘরে পুষছিলেন। বৎস জয়ন্ত, শৈলেশ সিং খুব মহৎ লোক ছিলেন না। রঘুবীর ও লতাও খুব সহজ মানুষ নয়। আমার ধারণা, ওদের উনি বাধ্য হয়ে সব জেনেও পুষছিলেন। ওরা তাকে ব্ল্যাকমেইল করে আসছিল। ওরা শৈলেশের সব গুপ্ত তথ্য জানত। শৈলেশ কেন স্মাগলিং চক্র ভাঙলেন, তাও ওরা জানত।

তাহলে কি ওদের মারতেই এই বাজে মরসুমে চণ্ডীপাহাড়ের বাংলোয় এসেছিলেন?

–তাই মনে হচ্ছে।

–সেই লোকগুলো তাহলে কারা?

–ভাড়াটে গুণ্ডা হতে পারে। পুলিশ শিগগির তাদের খুঁজে বের করবে। আবার স্রেফ ওর দলের লোকও হতে পারে। বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীকে নিপাত করে উনি চুটিয়ে কারবার চালাচ্ছিলেন–সে খবর পুলিশ জানে। ধরার জন্য ওঁত পেতেও ছিল।

–আমি বাংলোয় থাকার সময় ঝড়বৃষ্টির মধ্যে কারা তাহলে হামলা করেছিল? কারা আরাধনার নাম ধরে ডেকেছিল?

–হয়তো একই বাহিনী। তাছাড়া আবার কারা হতে পারে? এবং আরাধনাও সম্ভবত একই চক্রের মেয়ে। তাই নেতার হুকুম তামিল করে এসে দলের মক্ষিরানীর সঙ্গে আড্ডা দিতে চেয়েছিল। চমৎকার জমত নিশ্চয়। মাঝখানে তুমি গিয়ে পড়ে বাগড়া দিলে। আরাধনা বেচারাও তোমাকেই কাজে লাগাল– তোমারই দিক থেকে কোনো বিপদ আসার আশঙ্কায়। তুমি যে খবরের কাগজের লোক!

–আমাকে মরফিয়াটা বেশি দিলেই পারত!

–সে সাহস তখন আর কোথায়? প্রথমত তোমার কাছে রাইফেল। দ্বিতীয়ত, সদ্য একটা খুন হয়েছে। আবার দ্বিতীয় খুনের ঝামেলা পোহানো কি সহজ নার্ভের ব্যাপার?

কর্নেল কয়েকমুহূর্ত থেমে কী ভাবার পর ফের বললেন–আমার ধারণা জয়ন্ত, অবশ্য নিছক ধারণাই আপাতত–শৈলেশের ওই লোকগুলো কোনোভাবে টের পেয়েছিল যে একটা গোলমাল ঘটেছে কোথাও। কিংবা এমনও হতে পারে যে আরাধনাই ওদের জন্যে ভয় পেয়েছিল।

-তাহলে পালাল কেন? জানলা খুলে আলো জ্বেলে অপেক্ষা করছিল কার?

–হুম! বেড়ে বলেছ। নিশ্চয় সে কারো অপেক্ষা করছিল।

কারো নয়, ডাক্তারের। লাশটা সামলাতে হবে তো!

–হ্যাঁ, বিলক্ষণ।

–আপনি যাই বলুন, এবার কিন্তু আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে–ডাক্তার খুনী না হয়ে যায় না।

–কিন্তু….বলে কর্নেল পকেটে হাত পুরলেন।

 আমি হঠাৎ লাফিয়ে উঠলুম। কর্নেল! আজ যখন আপনারা বাংলায় পৌঁছান, আমি বেডরুমের ওই জানলায় কয়েকবার কাকে টোকা দিতে শুনেছিলুম। বলতে ভুলেছি।

শুনেই কর্নেল দৌড়ে এবার আমার কায়দায় বেড়া ডিঙিয়ে সেই জানলাটার কাছে গেলেন। আমি দাঁড়িয়ে থাকলুম। ওখানে হাঁটু দুমড়ে বসে কী সব পরীক্ষার পর ফিরে এলেন। তারপর বললেন–চলো! বেলা পড়ে আসছে। এক্ষুনি অন্ধকার হয়ে যাবে। ফেরা যাক্।

বলে উনি জঙ্গলের দিকে পা বাড়ালেন। বললুম–ওদিকে রাস্তা কোথায়? রাস্তা তো উল্টো দিকে!

–আহা, চলে এস না। এই যে পায়ে চলা পথটাও কি দেখতে পাচ্ছ না জয়ন্ত! নাঃ, তুমি বড় গোলমাল করে দাও সব!

কর্নেলের কণ্ঠস্বরে বিরক্ত প্রকাশ পেল। তাই ওঁকে চুপচাপ অনুসরণ করলুম। উনি ভীষণ জোরে হাঁটছে এবার। সঙ্গ ধরতে হাঁপ ধরে যাচ্ছিল। ঘন ঝোঁপঝাড়, কোথাও উঁচু উঁচু গাছপালা আর ছোটবড় পাথর–তার ফাঁকে একফালি পায়েচলা রাস্তা এতক্ষণে নজরে পড়ল। মিনিট পনের চলার পর নিচের উপত্যকাটা নজরে এল। সেখানে তখন আলো জ্বলজ্বল করছে। প্রশ্ন না করে পারলুম না-ওটা আবার কোন জায়গা?

কর্নেল জবাব দিলেন–হীরাকুণ্ডা টাউনশিপ।

অবাক হলুম।–সে কী! হারীকুণ্ডা এত কাছে হবে কেন?

–জয়ন্ত, তোমার দিকভুল হয়েছে। হীরাকুণ্ডা চণ্ডীপাহাড়ের ঠিক নিচের উপত্যকায় দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত। কিন্তু ভাল রাস্তা দিয়ে পৌঁছতে হলে পশ্চিমে দুমাইল তারপর উত্তরে একমাইল ঘুরে যেতে হয়। আর পায়ে হেঁটে কেউ যেতে চাইলে সটান এ পথে নাকের ডগাতেই চণ্ডীপাহাড়! চলে এস। এবার একদমে নামলেই বাজারে পৌঁছে যাব।

.

আমরা রাস্তায় নেমে ফের টাঙা করলুম। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কোথায় গন্তব্য জিগ্যেস করলুম না। দশমিনিট পরে এক জায়গায় কর্নেল টাঙা রুখতে আদেশ দিলেন। আমরা নামলুম। এ এলাকাটা ধনীদের বলেই মনে হচ্ছিল। অসমতল মাটির ওপর এখানে-ওখানে সুন্দর সব বাংলোবাড়ি–একেবারে ইংল্যান্ডের পাড়াগাঁর ছবি যেমন দেখেছি। কর্নেল অভ্যাসমতো আমার একটা হাত নিয়ে এগোলেন। বাঁদিকে উঁচুতে একটা বাড়ির গেটে পৌঁছলুম। মনে হল, এটা তাহলে কর্নেলের সেই বন্ধুর বাড়ি, যেখান থেকে গতরাতে চণ্ডীপাহাড়ের বাংলোয় ফোন করেছিলেন।

গেটের ওপর ঘন লতাপাতার ঝাপি। গেট খুলে ভিতরে ঢুকে দেখি, লনে জনা পাঁচছয় পুলিশ বসে ও দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে। সবাই সশস্ত্র। কর্নেল এগিয়ে যেতেই একজন দৌড়ে এল। চিনতে পারলুম তক্ষুনি। সেই মিঃ প্রসাদ। করমর্দন করে প্রসাদ বললেন–আপনার অপেক্ষা করছি স্যার! মিঃ সাক্সেনা এক্ষুনি ফোনে জানতে চাইছিলেন, আপনি এসেছেন কি না।

কর্নেল বললেন–মিঃ প্রসাদ, আগে আমাকে ফোনের কাছে নিয়ে চলুন। বাই দা বাইকত্রীঠাকুরানীর কুশল তো?

আজ্ঞে হ্যাঁ। উনিও আপনার অপেক্ষা করছেন।

কর্নেল আমার দিকে ঘুরে বললেন-জয়ন্ত, তুমি তাহলে ড্রইংরুমে একটু বসো। তারপর রহস্যময় হেসে ফের বললেন–তেমন কম্পানিয়ন পেয়ে গেলে আলাপও কোরো। আমার সামান্য দেরি হতে পারে। কেমন? তোমার জন্য গরম কফি পাঠাতে বলছি।

কৌতূহল চেপে রাখা আমার অভ্যেস নয়। কোনো রিপোর্টার কৌতূহল চেপে রাখে না। কিন্তু যেন ক্রমশ আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাচ্ছিল। এটা যে থানা বা কোনো অফিস নয়, তা স্পষ্ট! এ একটা প্রাইভেট বসতবাড়ি এবং অবশ্যই কোনো ধনী মানুষের। তাছাড়া এক কর্জীঠাকুরানীর উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যাপারটা কী?

মিঃ প্রসাদ ড্রয়িংরুমটা আমাকে দেখিয়ে দিয়ে কর্নেলকে নিয়ে অন্য ঘরে ঢুকলেন। ড্রয়িংরুমে ঢুকে দেখি, মেঝেয় সুদৃশ্য কার্পেট পাতা। সাজানো গোছানো আধুনিকতম পরিবেশ। একজন পরিচারক দাঁড়িয়ে যেন আমারই অপেক্ষা করছিল। সে সেলাম দিয়ে ওপাশের দরজার পর্দা তুলে কাকে কী বলল। তারপর বাইরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। কোনার উৎকৃষ্ট সোফায় আরাম করে বসলুম।

হাল্কা আলো জ্বলছিল ঘরে। সিগারেট ধরিয়ে নানান ছাইপাঁশ ভাবছি, চোখ ছাইদানির দিকে হঠাৎ মিঠে সুপরিচিত কণ্ঠস্বর শুনলুম। চাপা এবং হাসিতে ভিজে সেই স্বর।–হ্যালো চৌধুরী!

তাকিয়েই আমার বুকে খিল ধরে গেল। স্বপ্ন–আবার সেই অত্যদ্ভুত স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে গেছি! আরাধনা আমার সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে। জাদুকর বুড়োর এই আজব ভেলকি দেখে আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলুম।

আরাধনা একেবারে পাশে গা ঘেঁষে বসে পড়ল। তারপর কাঁধে হাত রেখে বলল–তুমি নিশ্চয় আমার ওপর খুব রাগ করেছ, চৌধুরী! প্লিজ প্লিজ, অমন করে তাকিও না! আমার বড্ড ভয় করছে।

মুহূর্তে ওর অলৌকিক সুন্দর শরীরের স্পর্শ আমাকে সব ভুলিয়ে আবার প্রেম ও কামনার আবেগে ভাসিয়ে দিল। বললুম–তোমার ওপর রাগ করে থাকা যায় নাকি? কিন্তু এ হেঁয়ালির মানে কী?

–হেঁয়ালি! কিসের হেঁয়ালি?

–তোমাকে পুলিশ প্রেফতার করেনি?

–না তো! কেন প্রেফতার করবে?

কোন জুতসই কথা খুঁজে না পেয়ে বললুম–গতরাতে তুমি আমাকে মরফিয়া খাইয়েছিলে কেন?

হাসল আরাধনা।–উপায় ছিল না। তবে তোমার কোনো ক্ষতি আমি চাইনি। ওই সামান্য ডোজে কেমন চমৎকার ঘুমটা হল, সেজন্যে আমাকে তুমি বকশিশ দাও বরং!

-কেন আমাকে ঘুম পাড়ানোর দরকার হল?

–জেগে থাকলে বা হঠাৎ জেগে গেলে তুমি নিশ্চয় হইচই বাধিয়ে বসতে। কারণ, তোমার বিছানার তলা থেকে একটা ডেডবডি বের করা হত এবং…

এবং তার গলাকাটা হত! বিদ্রূপ করে বললাম কথাটা।

আরাধনা তার সুন্দর সোনালি হাতে আমার হাত নিয়ে বলল–চৌধুরী, সবটা না জেনে আমার ওপর অবিচার করো না। আমি সত্যি এত অসহায়!

–বেশ, বলো।

সব কথা তোমাকে কর্নেলসায়েব বলবেন। ও-প্রসঙ্গ আর আমার তুলতে ইচ্ছে করছে না চৌধুরী। উঃ! কাল যা গেছে, তা একটা বীভৎস দুঃস্বপ্ন!

ও চুপ করে থাকল। একটু পরে বললুম-ফোনের তার কাটা বলেছিলে কেন?

–এই কারণে। তুমি ফোনে বাইরে যোগাযোগ করতে, সেইজন্যে। তখন বাইরের কেউ এসে পড়ুক, তা আমি চাইনি।

মিঃ সিংকে কে খুন করেছে?

আমার এই সোজা ও বেমক্কা প্রশ্ন শুনে সে চোখ নামাল। তার ঠোঁট কাঁপতে থাকল। তারপর হঠাৎ আমার কাঁধে মুখ গুঁজে দিল, চাপা কান্না শুরু হল।

এর মধ্যে ছলনা ও ছেনালি থাকা সম্ভব–আবার এটা সত্যিকার আবেগও হতে পারে-ধাঁধায় পড়ে আমি বিব্রত হলুম। তবু অমন সৌন্দর্যময়ী যুবতী মেয়ের ঘনিষ্ঠ স্পর্শ আমার মতো যুবককে শেষ অব্দি দ্রবীভূতই করল। এবং একটা হঠকারিতাও এল আমার মধ্যে। দুহাতে ওর ভিজে মুখটা তুলে গোটাকয় চুমু খেয়ে নিতে দেরি করলুম না। বিবেককে বললুম, এই সৌন্দর্যের সাতখুন মাফ। এ যদি প্রহরে-প্রহরে কাটা মুণ্ডু নিয়ে গেণ্ডুয়া খেলে, তাও সওয়া যায়। সৌন্দর্যের খাতিরে জঘন্যতম পাপকেও আমি বিলকুল ক্ষমা করে দিতে পারি।

আরাধনা ফিসফিস করে বলল–আমাকে তুমি বাঁচাও চৌধুরী। এখুনি এখান থেকে নিয়ে পালাও। এরা আমাকে এবার টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে।

রুদ্ধশ্বাসে বললুমকারা আরাধনা, কারা?

ও জবাব দেবার মুহূর্তে ভেতরের দরজার দিকে একটা শব্দ হল। তারপর ট্রে হাতে একজন পরিচারিকা এল। সে ট্রেটা রেখে চলে গেল। তখন নিঃশব্দে কিছুক্ষণ কফি তৈরি করতে থাকল আরাধনা।

সে ইতিমধ্যে একটু সরে বসেছিল। এবার কফির পেয়ালা হাতে সামনের সোফায় চলে গেল। মুখোমুখি আমরা কফি খেতে থাকলুম। অন্তত তিনটে মিনিট কোনো কথা বললুম না কেউ।

ফের যখন কথা বলতে যাচ্ছি, বাইরের দরজা দিয়ে প্রথমে ঢুকলেন কর্নেল, তার সঙ্গে এক ভদ্রমহিলা বয়স আন্দাজ চল্লিশ বিয়াল্লিশের কম বা বেশি নয়, স্নিগ্ধ কিন্তু ম্রিয়মাণ চেহারা, ভিজে চোখ, খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল ওঁকে। তারপর ঢুকলেন ডঃ পট্টনায়ক, মিঃ সাক্সেনা, মিঃ প্রসাদ এবং আরো কিছু পুলিশ অফিসার। সবার শেষে ঢুকলেন সেই ডাক্তার, যাঁকে সকালে চণ্ডীপাহাড়ের বাংলোয় দেখেছি এবং যার কাছে কর্নেল পা মচকানি সারাতে গিয়েছিলেন।

ডাক্তারটির বয়স পঞ্চাশের মধ্যে, বেশ হাসিখুশি গোলগাল চেহারা। ঢুকেই সবাইকে নমস্তে করলেন।

দুজন পরিচারককে দেখলুম চেয়ার সাজিয়ে দিতে। তারপর তারা তফাতে দাঁড়িয়ে রইল। কর্নেল এবার আমার ও আরাধনার দিকে চেয়ে একটু হাসলেন। তারপর আমার উদ্দেশে বললেন–জয়ন্ত, আলাপ করিয়ে দিই। ইনি পরলোকগত হভাগ্য মিঃ শৈলেশ সিংয়ের বউদি মিসেস সিং, এ হচ্ছে জয়ন্ত চৌধুরী কলকাতার নিউজডেলি সত্যসেবকের প্রখ্যাত রিপোর্টার। সাংবাদিকমহলে অশেষ খ্যাতি এ বয়সেই অর্জন করেছে।

আমরা পরস্পর নমস্কার করলুম। তারপর আর সবাই বসে পড়লে আমিও বসলুম। আরাধনা গম্ভীর হয়ে নখ খুঁটতে থাকল।

গাম্ভীর্যময় ও স্তব্ধ পরিবেশ সৃষ্টি হল। তারপর দেখলুম, মিঃ প্রসাদ একজন পরিচারককে ইশারা করলেন, সে ঘরে উজ্জ্বল আলোগুলো সুইচ টিপে জ্বেলে দিল।

কর্নেল বললেন–কোনো ভূমিকার দরকার নেই। আমরা এই বৈঠক ডেকেছিলুম মিঃ শৈলেশ সিংয়ের মর্মান্তিক পরিণামের ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে। কথামতো সবাই এসে পড়েছেন। এখন আমি একে একে কয়েকজনকে। কিছু প্রশ্ন করব। আশা করি, তারা সত্যিকার জবাবটিই দেবেন। মিঃ সাক্সেনা। আপনার স্টেনো ভদ্রলোক তৈরি?

সাক্সেনা মাথা দোলালেন। দেখলুম পিছনে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক নোটবুক ও পেন্সিল হাতে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। একেবারে তৈরি। কথা শুরু। হলেই পেন্সিল চালাতে ইতস্তত করবেন না–এমনি ভঙ্গি।

কর্নেল বললেন–আমি প্রথমে ডক্টর মহেন্দর শর্মাকে প্রশ্ন করতে চাই।

ডাক্তার শর্মা গম্ভীর হয়ে বললেন করুন। জানলে বলব, নয় তো না।

–ডঃ শর্মা, শৈলেশ সিং গতকাল দুপুরে ঠিক ক’টায় আপনার কাছে গিয়েছিলেন?

–দুটো পাঁচ-টাচ হবে। সঠিক কাটায় কাটায় বলতে পারব না। তবে দুটো বেজেছিল সবে, গিয়েই তো শুয়ে পড়লেন। বললেন–খুব অসুস্থ বোধ করছেন…

–হুম! মারা যান ক’টায়?

যাবার ঠিক তিন মিনিটের মধ্যেই।

–কোত্থেকে আসছেন বলেছিলেন?

–ডঃ শর্মা বিরক্ত হয়ে বললেন-কতবার বলব? এসব কথা তো পুলিশকে ইতিমধ্যে বলেছি।

কর্নেল সবিনয়ে বললেন–প্লিজ ডঃ শর্মা! জবাব দিন।

–কোত্থেকে আসছেন, সে সব কিছু বলেননি। বেশি কথা বলারই ফুরসৎ পাননি। কোনরকমে গাড়ি চালিয়ে এসে ঘরে ঢুকে পড়ে যান।

মিঃ সাক্সেনা চণ্ডীপাহাড়ের বাংলো থেকে ডঃ শর্মার বাড়ি মোটরে ম্যাক্সিমাম স্পিডে পৌঁছতে কতক্ষণ লাগতে পারে?

 মিঃ সাক্সেনা, একটু ভেবে জবাব দিলেন–পনের মিনিট।

–ডঃ শর্মা, নিকোটিন খাওয়ার পর কি কেউ পনের মিনিট গাড়ি চালিয়ে এসে আপনার ঘরে ঢুকবার ফুরসৎ পায়? ভেবে বলবেন কিন্তু!

ডঃ শর্মা খাপ্পা হয়ে বললেনবার বার বলছি যে আমি এসব ব্যাপারে কিছু জানিনে! আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমার কর্তব্য ছিল, তাঁকে বাংলোয় তার স্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেওয়া। দিয়েছিলুম।

–ডঃ শর্মা! এটা অস্বাভাবিক। কারণ, আপনি জেনেশুনে একটা ডেডবডি পৌঁছে দিয়েছেন বলছেন! আপনি সরকারের একজন আস্থাভাজন ডাক্তার। বরং তখনই পুলিশকে জানানোই আপনার পক্ষে স্বাভাবিক ছিল না কি?

–ছিল। কিন্তু….

বলুন!

ডঃ শর্মাকে একটু বিব্রত দেখাল। তারপর হঠাৎ যেন মরিয়া হয়ে গেলেন। বললেন–মিসেস সিং ফোনে আমাকে একটা অনুরোধ করায়…

আরাধনা তীব্র প্রতিবাদ জানালনা, আমি ফোন করিনি। তখন এ বাড়িতে সবে পৌঁছেছি জাস্ট দুটো দশে। দিদিকে জিগ্যেস করুন।

–আশ্চর্য! অথচ মিঃ সিংয়ের মৃত্যুর পরই আমি যখন পুলিশকে জানাবার জন্য ফোনের কাছে গেলুম, ফোন বাজল। এক মহিলা নিজের পরিচয় দিলেন মিসেস সিং বলে। উনি…

কর্নেল বললেন–আপনাকে টাকার লোভ দেখালেন?

ডঃ শর্মা খেপে গিয়ে বললেন না!

তবে?

–বললেন যে মিঃ সিং সুইসাইড করার জন্য বিষ খেয়েছেন। আপনি চলে আসুন চণ্ডীপাহাড়ের বাংলোয়। আমি বললুম, সে কী! মিঃ সিং তো আমার এখানে –নাও হি ইজ ডেড। তখন মহিলাটি কান্নাকাটি করে বললেন, আমাকে ঘরে লক করে রেখে এই কাণ্ড করেছেন। প্লিজ ডঃ শৰ্মা, এ জানাজানি হলে স্ক্যান্ডাল ছড়াবে। আপনি আমার অনুরোধটা রাখুন। ওকে এই অবস্থায় এখানে পৌঁছে দিন।

–হুম, তারপর?

–আমি পৌঁছে দিলুম। কিন্তু গিয়ে দেখি, বাংলোয় জনপ্রাণীটি নেই। আমার বুদ্ধিসুদ্ধি গুলিয়ে গেল। এভাবে ডেডবডি নিয়ে গাড়িতে আবার ফেরার রিস্ক নিতে পারলুম না। তখন বডিটা বাংলোয় বারান্দায় নামিয়ে রেখে পালিয়ে এলুম। যাক শত্রু পরে পরে।

তারপর, ফিরে গিয়ে কী করলেন?

–ফিরে গিয়ে দেখি (আরাধনাকে দেখিয়ে) ওই মহিলা আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু উনি নিজের পরিচয় লুকিয়ে ছিলেন। বলেননি যে উনি মিসেস সিং। বললেন–হজম হয় না, পেটের গোলমাল, ওষুধ চাই।

–ওষুধ বা প্রেসক্রিপশান দিলেন?

–হ্যাঁ।

–তারপর পুলিশকে জানাবার কথা ভাবলেন না?

না। আমি ও ব্যাপারে জড়িয়ে পড়াটা ভাল মনে করলুম না।

–ঠিক আছে। এবার আমি প্রশ্ন করব মিসেস আরাধনা সিংকে।

আরাধনা সপ্রতিভ ভঙ্গিতে বলল–অবশ্যই।

–আপনি শিলিগুড়ি থেকে হীরাকুণ্ডা এলেন কেন?–

–মিঃ সিং হঠাৎ অসময়ে চলে এলেন। আমার সন্দেহ হল–কোনো বিপদে ঝুঁকি নিচ্ছেন। আমি সব সময় ওঁকে চোখের সামনে রাখতুম। তাই…

–যাক গে। পৌঁছলেন দুটো দশে। কেমন? মিসেস সুচেতা, কী বলেন?

 সুচেতা সিং মাথা দোলালেন–হ্যাঁ, আরাধনা এসেই শৈলেশের কথা জিগ্যেস করল। ও এসেছে কি না আমিও জানতুম না। এলে তো আমার সঙ্গে দেখা না করে যায় না!

কর্নেল বললেন–আপনি এ বাড়ি থেকে হঠাৎ ডঃ শর্মার কাছে হজমের ওষুধ নিতে গেলেন কেন মিসেস আরাধনা?

–এ বাড়ি থেকে ডিরেক্ট যাইনি। প্রথমে হাঁটাপথে বাংলোয় গেলুম। বাংলোয় কেউ নেই। তখন ওই পথেই ফিরে এলুম। তারপর পথে আসতে আসতে হঠাৎ ডঃ শর্মার বাড়ির সামনে দেখি, আমাদের ল্যান্ডমাস্টার গাড়িটা রয়েছে। তখন দৌড়ে ওখানে চলে গেলুম। ডাক্তারের পরিচারিকা বলল যে একজন অসুস্থ লোক ওই গাড়িতে এসেছিল। তাকে কোথায় নিজের গাড়িতে পৌঁছে দিতে গেছেন ডাক্তার। আমি খুব গোলমালে পড়ে গেলুম। নিশ্চয় কিছু একটা ঘটেছে। ডাক্তার ফিরলে তাই ওঁকে কিছু খুলে বলা সঙ্গত মনে করলুম না।

নাকি আপনি তখন যা জানার জেনে ফেলেছেন কোনো সূত্রে এবং তাই আরো স্পষ্টভাবে জানতে এসেছিলেন? তাছাড়া…

-মোটেও না।

–একটা কিছু গোপন করছেন, মিসেস আরাধনা।

না!

–আপনি এসেছিলেন মিঃ সিংয়ের গাড়ি থেকে একটা জিনিস সরাতে।

–মিথ্যা! বলে উত্তেজিতা আরাধনা উঠে দাঁড়াল।

 তাকে ইশারায় বসতে বললেন কর্নেল। তারপর বললেন–হুম, আপনি ডাক্তারের বাড়ি থেকে কোথায় গেলেন?

বাংলোয়।

 –কোন পথে?

 –ওই হাঁটা রাস্তায়।

–তারপর?

–গিয়ে দেখলুম, বারান্দায় মিঃ সিংয়ের বডি রয়েছে। আমি অনেকক্ষণ কান্নাকাটির পর বডিটা বেডরুমে টেনে ঢোকালুম।

দরজা খোলা ছিল?

–হ্যাঁ।

-তারপর?

–ভয় পেয়ে ভাবলুম, আমাকেই স্বামী হত্যার দায়ে পড়তে হবে। তাই বডিটা খাটের নিচে লুকিয়ে রাখলুম। ঠিক করলুম রাতে ওটা উত্তরের খাদে গড়িয়ে ফেলে দেব। আশা করি, বাংলোর উত্তরের খাদটা দেখেছেন। নিচে একটা নদী রয়েছে।

–হুম। রাতে কারা গিয়ে আপনাকে ডাকছিল বলুন। কেন ডাকছিল?

 –ওরা মিঃ সিংয়ের লোক। নিশ্চয় কিছু আঁচ করে খোঁজ নিতে গিয়েছিল।

–আপনার নাম ধরে ডাকছিল। এর কারণ?

–ডাকছিল আমার দাদা।

–কী নাম? কোথায় থাকেন তিনি?

নাম মিঃ রাজময় রানা। থাকেন নেপালে। হীরাকুণ্ডায় ওঁর একটা ফার্ম আছে।

মিঃ সাক্সেনা এসময় বলে উঠলেন–ওঁকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে কর্নেল। তবে ওঁর সঙ্গী দুজন বেপাত্তা। মিঃ রানাই রঘুবীর আর লতাকে বেঁধে ঝুলিয়ে রেখে এসেছিলেন খাদে। রঘুবীর বলেছে, রানাসায়েবই মিঃ সিংয়ের পয়লা নম্বর দুশমন। উনি দলবল নিয়ে মিঃ সিংকে খুন করতে যান বাংলোয়। ওঁকে না পেয়ে ওদের নিয়ে যান। মিঃ সিং রানাসায়েবকে পুলিশের হাতে তুলে দিতেই এখানে আসেন গতকাল। বেচারার দুর্ভাগ্য! নিজেই খতম হয়ে গেলেন!

আমি বললুম–তাহলে রঘুবীর-লতা মিঃ সিংকে নয়, রানা-সায়েবকেই ব্ল্যাকমেইল করত? কী বলেন কর্নেল?

কর্নেল বললেন–না জয়ন্ত! আমার থিওরিটা শোন! ওরা নিজেদের মনিবকেই ব্ল্যাকমেইল করত। তাই রানাসায়েবের বোন অর্থাৎ আরাধনা দাদাকে অনুরোধ করেছিল, ওদের খতম করতে। রানাসায়েব কিংবা আরাধনাকেও ওদের ব্ল্যাকমেইল করার সম্ভাবনা ছিল। অন্তত রানাসায়েব তাই ভেবেছিলেন বলে বোনের প্রস্তাব মেনে নেন।

মিঃ সাক্সেনা বললেন সম্পূর্ণ সত্য, কর্নেল। আপনার থিওরি অভ্রান্ত। রঘুবীর আর লতা যে স্টেটমেন্ট দিয়েছে, তা থেকে এই সিদ্ধান্তই দাঁড়ায়।

কর্নেল বললেন–এবার এক জটিল রহস্যে ভরা কেসের ভাইটাল অংশে আলোকপাত হয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, আরাধনা দেবীর মানসিক অবস্থাটা কোথায় দাঁড়িয়েছিল। একদিকে স্বামী, অন্যদিকে দাদা। দুজনেই একটা দুষ্টচক্রের দুই নেতা। পরস্পর ঘোর শত্রু, অথচ কেউ কাকেও ঢিট করতে পারছে না। ঢিট না করলেও শান্তি নেই। পরস্পর পরস্পরকে এড়িয়ে থাকতেও পারছে না, তাহলে চোরা ব্যবসায়ে লোকসান হয়। এদিকে মাঝখানে বিব্রত রানাসায়েবের বোন।

আরাধনার দিকে তাকালাম। সে এবার নতমুখে নিঃশব্দে কাঁদছে।

কর্নেল বললেন–কিন্তু আরাধনা চাননি স্বামীর ক্ষতি হোক। তিনি গতিক বুঝে স্বামীকে বাঁচাতেই ছুটে এসেছিলেন। কিন্তু তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে। এবার আমি প্রশ্ন করব, ডঃ পট্টনায়ককে।

ডঃ পট্টনায়ক তাকালেন।

–আচ্ছা ডঃ পট্টনায়ক, নিকোটিন খওয়ার কতক্ষণ পরে মৃত্যু হয়?

–সেটা মাত্রার ওপর নির্ভরশীল। সেইসঙ্গে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য বা পার্সোনাল কন্সটিটিউশনের ওপরও নির্ভর করে কিছুটা। আমি অনেক কেসে দেখেছি, সবচেয়ে মারাত্মক বিষ দিলেও কেউ কেউ একঘণ্টা মোটামুটি চলৎশক্তিসক্ষম থাকে। ইতিহাসে রাশিয়ার প্রখ্যাত রাসপুটিনের কথা আমরা জানি। বিষে তার কিছুমাত্র ক্ষতি হত না। তবে মিঃ সিংয়ের স্টমাকে যা দেখেছি, মনে হচ্ছে– ডোজ খুব ভাইটাল ধরনের ছিল না। নিশ্চয় কোনো আনাড়ির কাজ। ভয়ে ভয়ে একটুখানি মিশিয়ে কেটে পড়েছিল যেন। হয়তো তক্ষুনি চিকিৎসা হলে ওঁকে বাঁচানোও যেত। কিন্তু উনিও কী ভাবে ব্যাপারটা আঁচ করে গাড়ি চালিয়ে ডাক্তারের কাছে যান। ওটাই ওঁর মৃত্যুর কারণ। এর ফলে রক্ত চলাচল বেড়ে গিয়েছিল এবং হার্ট আক্রান্ত হয়েছিল।

–ডঃ পট্টনায়ক, মিঃ সিংয়ের ক্ষেত্রে খুব ভেবে বলুন–বিষপানের পর কতক্ষণ তার সক্রিয় থাকা অর্থাৎ গাড়ি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল?

একটু ভেবে নিয়ে ডঃ পট্টনায়ক বললেন বড় জোর পাঁচ মিনিট।

কিন্তু বাংলো থেকে আসতে সবচেয়ে কম সময় লাগে পনের মিনিট।

হা। আমার ধারণা, উনি এখানে কাছাকাছি কোথাও বিষে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ডঃ শর্মার বাড়ি থেকে ধরুন আড়াই মিনিট মোটরের পথ। বাকি আড়াই মিনিট গাড়িতে ওঠা, স্টার্ট দেওয়া এবং গাড়ি থেকে নেমে ডাক্তারখানায় ঢাকায় খরচ হয়েছে।

এসময় হঠাৎ আরাধনা একটা পিস্তল তুলে চেঁচিয়ে উঠল রাক্ষসী! ডাইনী! শয়তানী!

মিঃ সাক্সেনা আমাদের পাশেই ছিলেন। তক্ষুণি ওর হাতের পিস্তলটা ধরে ফেললেন। দেয়ালে গুলি লাগল। তারপর আরাধনা মূৰ্ছিতা হল।

ওদিকে আরেক দৃশ্য। কর্নেল মিসেস সুচেতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আবার গুলির শব্দ হল। তারপর কর্নেলকে দেখলুম ওঁর হাত মুচড়ে একটা পিস্তল কেড়ে নিচ্ছেন।

পুলিশ অফিসার পিছন থেকে মিসেস সুচেতাকে ধরে ফেললেন। কর্নেল বজ্রগম্ভীর স্বরে বললেন মিঃ সাক্সেনা, মিঃ শৈলেশ সিংয়ের মার্ডারারকে প্রেফতার করুন।

আমার চোখের সামনে মিসেস সুচেতাকে ধরে নিয়ে পুলিশ অফিসারারা বেরিয়ে গেলেন। আমি হতভম্ব।

ডঃ শর্মা ততক্ষণে আরাধনার শুশ্রূষায় ব্যস্ত হয়েছেন। কর্নেল বললেন–মিঃ সাক্সেনা, রঘুবীর আর লতাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার চেষ্টার অভিযোগে রানাসায়েবের বোনকেও আপনার প্রেফতার করা উচিত।

মিঃ সাক্সেনা হাসলেন!–দ্যাটস ওকে, কর্নেল। মিঃ প্রসাদ, বি রেডি!

আরাধনার জ্ঞান ফিরল একটু পরেই।

কর্নেল আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে গেলেন। এতক্ষণ মাথা ভোঁ-ভো করছিল। লনের খোলামেলায় দাঁড়িয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম।

কর্নেল বললেন–প্রশ্ন করো, জয়ন্ত।

 কী প্রশ্ন? আর কোনো প্রশ্ন নেই।

কর্নেল একটু হেসে বললেন–আরাধনার জন্যে কষ্ট হচ্ছে? কী করব। বলো? আইনের চোখে সৌন্দর্যের কোনো নিষ্কৃতি নেই।

এ সময় ডঃ পট্টনায়ক এসে গেলেন। হ্যালো কর্নেল! আমি বোকা বনে গেছি।

কর্নেল বললেন–মোটেও না। আপনিই তো ধরিয়ে দিলেন খুনীকে।

কী ভাবে?

 –পাঁচ মিনিটের জমাখরচ হিসেব করে।

–মাই গুডনেস!

–হ্যাঁ। এই বাড়ি থেকে ডঃ শর্মার বাড়ির দূরত্ব যা-তাতে ওই হিসেবটা মিলে যায়।

–ঠিকই বলেছেন।

এবার কর্নেল তার পকেট থেকে একটুকরো দামি শাড়ির পাড়ের অংশ বের করে বললেন–এটা অবশ্য একটা ক্ল। বাংলোর বেড়ায় আটকে ছিল। মিসেস সুচেতার এক পরিচারিকাকে তখন দেখাতেই বলল–হ্যাঁ, ও রকম পাড়ের শাড়ি একটা মাইজি পরেন বটে!

আমি আর চুপ করে থাকতে পারলুম না।কর্নেল, কেন বৌদি দেওরকে বিষ খাইয়ে খুন করলেন?

কর্নেল, বললেন–শৈলেশ সিং প্রথমে এসে বৌদির কাছে ওঠেননি। আমরা রঘুবীরদের বিবরণমতো জানতে পেরেছি যে তিনি চণ্ডীপাহাড়ের বাংলোয়। ওঠেন। তারপর স্ত্রীর দেরি দেখে বেরিয়ে পড়েন। শ্যালকের সঙ্গে বোঝাঁপড়া। করতে এসেছেন, তাই প্রথমে ওখানে গিয়ে স্ত্রীর খোঁজ না করে বউদির কাছে যান। বউদি তখন যে উদ্দেশ্যেই হোক, দেব্রটিকে বিষ খাইয়ে দেন। একটা কিছু টের পেয়ে শৈলেশ ছিটকে বেরিয়ে যান ডাক্তার শর্মার কাছে। ওদিকে তখন আরাধনা দাদার বাড়ি অপেক্ষা করছে। দাদা ফেরার পর আরাধনা তার কাছে জানতে পারে, শৈলেশ বাংলোয় নেই। তখন সে তার বউদির বাড়ি খোঁজ নিতে যায় এবং শোনে যে হঠাৎ অসুস্থতার জন্য তিনি কোনো ডাক্তারের কাছে। গেছেন।

বাধা দিয়ে বললুম কিন্তু খুনের উদ্দেশ্য কী?

কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে এবং বুকে ক্রস এঁকে বিড়বিড় করে কী বললেন। আমি ফের কী বলতেই উনি হাসলেন।–সেটা এখনও বুঝতে পারিনি জয়ন্ত। আশা করি, কালকের মধ্যেই জেনে ফেলব। চলো, এখন আমার এক বন্ধুর শরণাপন্ন হওয়া যাক। তার গাড়িতে আমাদের ফরেস্ট বাংলোয় ফিরতে হবে। সকাল সকাল শুয়ে পড়তে হবে।…

.

সকালে সবে চা খাচ্ছি, কর্নেল পাখির ফটোগুলো বাছাই করছেন, এমন সময় মিঃ সাক্সেনা এলেন। কর্নেলের প্রথম প্রশ্ন শোনা গেল–শৈলেশ সিংয়ের গাড়িটা নিশ্চয় খুঁজে পাওয়া গেছে মিঃ সাক্সেনা?

মিঃ সাক্সেনা হতভম্ব হয়ে বললেন–হ্যাঁ। কিন্তু…

নিশ্চয় ডঃ শর্মার বাড়ির পিছনের খাদে এবং ভাঙাচোরা অবস্থায়?

–হ্যাঁ, হ্যাঁ। কিন্তু…

–এটাই স্বাভাবিক, মিঃ সাক্সেনা। এমন মজার কেস কখনও দেখিনি। ডঃ শর্মা প্রণয়িনী সুচেতাকে বাঁচাতে সম্ভব-অসম্ভব অনেক কিছুই করবেন, এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। তবু বলব, এ বড় অদ্ভুত কেস। ডঃ শর্মা ভালবাসেন বিধবা সুচেতাকে, সুচেতা নিজের দেওরকে। দেওরটি ভালবাসেন মক্ষিরানী আরাধনাকে। সুতরাং শেষ অবধি সুচেতা প্রণয়ী ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন। কেন? না–ঈর্ষায় ততদিনে অন্ধ প্রতিহিংসা জেগেছে সুচেতার মনে। এই ডাক্তারটি আসলে হাঁদারাম গবেট।

তাছাড়া আরেকটি বড় মোটিভ পাওয়া গেছে, কর্নেল। শৈলেশ সিং আয়কর ফাঁকি দিতে এক বিরাট সম্পত্তি বউদির অ্যাকাউন্টে রেখেছিলেন। স্ত্রী যেহেতু তার শত্রু রানাসাহেবের বোন, তাকে কখনও মনে মনে বিশ্বাস করতে পারেননি।

কর্নেল বললেন–তাহলে মোটিভ হিসেবে এটাই মুখ্য, বলব। এই কেসে আপাতত বিভিন্ন অপরাধের মূল আসামী সংখ্যা হল সর্বসাকুল্যে চারজন। তাই না? আরাধনা ও রানাসায়েবের বিরুদ্ধে অভিযোগ খুনের মোডাস অপারেন্ডি তৈরি, সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপ, প্ররোচনা ও আনুষঙ্গিক ব্যাপারে মূল খুনীকে সহায়তা। আর মিসেস সুচেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ–ডেলিবারেট মার্ডার। একেবারে ঠাণ্ডা মাথায় ইচ্ছাকৃত এবং পরিকল্পিত পদ্ধতিতে হত্যা। তাই না?

–হ্যাঁ, কর্নেল।

–একেই বলে পাপচক্র।…বলে কর্নেল একটু হাসলেন। বাই দা বাই, সুচেতাদেবীর সাহসের জন্য কিন্তু আমি প্রশংসাই করব। গতরাত্রে বারোটার পর ডঃ শর্মাকে নিয়ে পাহাড়ী বাংলোয় হাজির হওয়াটা অবশ্য সহজ। কিন্তু তারপর যা করেছেন, ভাবা যায় না। আরাধনাকে ডেকেছেন কান্নাজড়ানো গলায়। আরাধনার মাথার ঠিক ছিল না। দরজা খুলেছে। বাইরে শর্মা তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে। সুচেতা ঘরে ঢুকেছেন। কথায় কথায় ওকে অন্যমনস্ক রাখার চেষ্টা। করছেন। হঠাৎ শর্মা ঢুকে ক্লোরোফর্মে ভেজা রুমাল বেচারা আরাধনার মুখে চেপে ধরলেন। তারপর তাকে অজ্ঞান করে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিলেন। তখন সুচেতা মানবী ছিলেন না। প্রতিহিংসা ও স্বার্থ মিলে স্রেফ দানবী হয়ে গেছেন। লাশের গলা কেটে প্রতিপন্ন করতে চাইলেন যে এটা বিষ প্রয়োগ খুন নয় গলাকাটার ব্যাপার এবং এজন্যে দায়ী আরাধনা। সে তার দুর্ধর্ষ দাদার সাহায্যে এটা করেছে।

–কিন্তু ওকে বাথরুমে ঢোকালেন কেন? আর বিছানায় ঘুমন্ত জয়ন্তবাবুকেই বা রেহাই দিল কেন, বোঝা যাচ্ছে না।

–ডবল খুনের মনোবল ছিল না! তাই জয়ন্ত বেঁচে গেল।

আমি আঁতকে উঠলুম–ওরে বাবা!

কর্নেল হেসে বললেন–ডঃ শর্মা নিশ্চয় আলো ফেলে জয়ন্তের অবস্থা আঁচ করেছিলেন–তাছাড়া আর কোনো ব্যাখ্যা হয় না। মরফিয়ার ঘুমে কতকগুলো স্পষ্ট লক্ষণ ফুটে থাকে মুখে। অভিজ্ঞ ডাক্তার একবার দেখলেই তা টের পান। ঘরে অত কাণ্ড হল, অথচ জয়ন্ত জাগছে না–এতেই তো ডাক্তারের সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক। আর আরাধনাকে বাথরুমে ঢোকানোর কারণ আরাধনাকে সরাসরি খুনী না করে খুনের হুকুমদাত্রী প্রতিপন্ন করা। ওঁরা ভেবেছিলেন যদি আদালত অবিশ্বাস করে বসে যে আরাধনার মতো বাইশ-তেইশ বছরের অমন মেয়ের পক্ষে শক্তিমান এক পুরুষের মুণ্ডুটা স্রেফ এপার ওপার করা অসম্ভব! তাই নয় কি? কাজেই সে লোক দিয়ে খুন করিয়েছে এবং যেন নিজেকে বাঁচানোর জন্যে বাথরুমে ঢুকে ওই লোকের সাহায্যে দরজা লক করিয়েছে। বেডরুমে স্বামী খুনের ক্ষেত্রে স্ত্রীদের তো এমনি অবস্থাই হয়–হয় বেঁধে রাখে খুনীরা, নয়তো পাশের ঘরে আটকে রাখে। ডাক্তার ও সুচেতা এই চিরাচরিত প্রথা প্রয়োগ করে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে ওইসব কেসে যেমন হয়ে থাকে, এখানেও তাই ঘটেছে অর্থাৎ স্ত্রীই খুন করিয়ে আত্মরক্ষার জন্যে এই কৌশল নিয়েছে।

মিঃ সাক্সেনা বললেন–আপনি দেখছি, চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ফেলেছেন। চমৎকার যুক্তি সন্দেহ নেই। কিন্তু সকালে আবার সুচেতা বাংলোয় গেলেন কেন?

–হত্যাকারীর মনস্তত্ত্ব। হত্যার জায়গায় আবার যাওয়ার এক প্রচণ্ড টান থাকে। অবশ্য উনি জানালায় টোকা দিয়ে টের পেতে চেয়েছিলেন যে ঘরের ঘুমন্ত লোকটি জেগেছে নাকি। ভাগ্যিস জয়ন্ত আমার পরামর্শে সাবধান ছিল। জানলা খোলেনি। তাহলে পিস্তলের গুলিতে বেচারা…

আবার আঁতকে উঠে বলুম–যথেষ্ট হয়েছে কর্নেল! বাপস্।

 কর্নেল নির্দ্বিধায় বলে উঠলেন–হ্যাঁ। সুচেতা জয়ন্তকে সাবাড় করতেই গিয়েছিল। পেল না, তাই।

আর ঘরে থাকতে পারলুম না। বেরিয়ে এসে রোদে উজ্জ্বল সুদৃশ্য লনে দাঁড়ালুম। হাল্কা হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে গেল। বিশাল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সামনে মনে মনে নতজানু হয়ে বললুম-প্রকৃতি আমাদের ক্ষমা কোরো।