৫. সাম্প্রদায়িকতা ও রাজনৈতিক অগ্রগতি

সাম্প্রদায়িকতা ও রাজনৈতিক অগ্রগতি

ইংরেজ রাজত্বকালে আমাদের দেশে ধনতন্ত্রের সূত্রপাত এবং তার ক্রমপ্রসারের ফলে যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন দেখা দিল তার স্বরূপকে উপলব্ধি এবং আয়ত্ত করার সুযোগ ভারতীয় এবং বিশেষ করে বাঙালী হিন্দু মুসলমান পেল না। এদেশের লক্ষ লক্ষ কৃষক শ্রমিক নরনারী মধ্যবিত্তের সাম্প্রদায়িক শ্রেণীস্বার্থের তাড়নায় সাধারণ হিন্দু মুসলমানের বৃহত্তর স্বার্থকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে উন্মত্ত হলো পারস্পরিক দ্বন্দ্বকলহে। ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন সামগ্রিকভাবে পরিশেষে যে রূপ পরিগ্রহ করলো এ জন্যই তার মধ্যে এ উপমহাদেশের কৃষক শ্রমিকদের স্বার্থ প্রতিফলিত হলো না।

সাম্প্রদায়িক জটিলতার জন্য এদেশের জাতীয় আন্দোলনে জমিদার ও শিল্পবণিকশ্রেণীর যথার্থ চরিত্র এবং ভূমিকাও নিম্নবিত্ত কৃষক-শ্রমিকদের কাছে উচিতমতোভাবে ধরা পড়েনি। বাঙলাদেশে তাই দরিদ্র চাষী মুসলমান হিন্দু জমিদারকে সাম্প্রদায়িকতার মহিমায় জমিদার হিসাবে দেখার তেমন কোন সুযোগ পায়নি, বিশেষতঃ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় আন্দোলনের শেষ ও তীব্রতম অধ্যায়ে। অত্যাচারী হিন্দু জমিদারকে মুখ্যতঃ বিধর্মী হিসাবে দেখার ফলে তারা নিজেদের শোচনীয় দুর্দশার জন্য জমিদার শ্রেণীর শোষণকে দায়ী না করে তার জন্য দায়ী করলো হিন্দু ধর্ম এবং সম্প্রদায়কে। মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের মনোভাবও হলো অনুরূপভাবে বিকৃত। এদেশের বৃহত্তর সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে এর মাধ্যমেই এলো সব নিদারুণ আঘাত।

এ আঘাতকে দুই দেশের জনসাধারণ স্বাধীনতা অর্জনের পরও কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়নি। ঊনিশশো সাতচল্লিশ থেকে একের পর এক ছোট বড় দাঙ্গা হাঙ্গামার ঝড় এদেশের উপর দিয়ে যেভাবে প্রবাহিত হয়েছে সেটাই এর সব থেকে বড় প্রমাণ।

স্বাধীনতা অর্জনের পরও সাম্প্রদায়িকতা পাক-ভারতীয় উপমহাদেশের জীবনে নিশ্চিহ্ন না হওয়ার অন্যতম কারণ ভারত ও পাকিস্তানের পারস্পারিক সম্পর্কের মধ্যে তার নব রূপ এবং নব জীবন লাভ। সাম্প্রদায়িক সমস্যার একমাত্র সম্ভাব্য এবং সর্বগ্রাহ্য সমাধান হিসাবে ভারতীয় উপমহাদেশকে বিভক্ত করার প্রস্তাবে কংগ্রেস লীগ সম্মত হলেও এ সম্মতি এত তিক্ততার মধ্যে অর্জিত হলো যে স্বাধীনতার পরেও সে তিক্ততাকে সুস্থভাবে উত্তীর্ণ হওয়া কারও পক্ষে সম্ভব হলো না। কংগ্রেস লীগের নেতারাই অধিষ্ঠিত হলেন ভারত ও পাকিস্তান সরকারের নেতৃস্থানে এবং অবস্থার পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও পরস্পরের প্রতি তাদের মনোভাব রাতারাতি পরিবর্তন হলো না। এজন্য ভারতীয় অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক জীবনের জটিলতার ফলে যে সকল স্বার্থ ও সংস্কার ভারতবর্ষের হিন্দু মুসলমানের মানসকে গঠন করেছিল, সেগুলির বশবর্তী হয়েই উপমহাদেশের দুই রাষ্ট্রের নেতৃবর্গ নিযুক্ত হলেন ভারত ও পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিনির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণে।

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় আন্দোলনের কেন্দ্রস্থলে অধিষ্ঠিত ছিল ভারতীয় মধ্যবিত্ত। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে হিন্দু মুসলমান শিখ খৃষ্টান সকলেই ছিল এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্গত। বৃহত্তর জাতীয় আন্দোলনের কাঠামোর মধ্যে বিভিন্ন জাতিধর্ম সমন্বয়ে গঠিত এই মধ্যবিত্তের স্বার্থ এবং সংস্কারসমূহ ছিল মোটামুটি একই ধরণের। মধ্যবিত্তের এই স্বার্থসমূহের সাথে ভারতবর্ষের অগণিত কৃষক শ্রমিক ও সাধারণ দরিদ্রের স্বার্থের কোন অন্তর্নিহিত ঐক্য ও সামঞ্জস্য ছিল না। কিন্তু ঐক্যের এই অভাব সত্ত্বেও ভারতবর্ষের কৃষক শ্রমিকেরা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেনি। এদিক দিয়ে ভারতবর্ষের কোন বিশেষত্ব নেই। প্রায় সবক্ষেত্রেই দেখা যায় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে পরিচালিত হলেও অন্যান্য শ্রেণীর লোকেরাও ঐ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। বৃহত্তর অর্থে অংশগ্রহণের মূল কারণ বৈদেশিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু অন্যান্য নিম্নশ্রেণীভুক্ত লোকদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় আন্দোলনে মধ্যবিত্তের নেতৃত্ব স্বীকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ জাতীয় আন্দোলনের পটভূমিকায় মধ্যবিত্তের শ্রেণীস্বার্থের যথার্থ চরিত্র সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা। ভারতবর্ষেও সাম্রাজ্যবাদী শাসনমুক্তির এই বিশেষ আন্দোলনকে এজন্যই তারা মনে করেছিল তাদের নিজেদের স্বার্থের সম্পূর্ণ অনুকূল। বিদেশী শাসনের অবসান অবশ্য তাদের স্বার্থের পক্ষে অনুকূল নয় একথা বলা চলে না। কারণ এ শাসনের অবসান তাদের স্বার্থরক্ষার সংগ্রামকে বেশ বড় একধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বিদেশী শাসনের অবর্তমানে মধ্যবিত্তশ্রেণী, বিশেষতঃ উচ্চমধ্যবিত্তশ্রেণী, নিম্নতর কৃষক শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থসিদ্ধির পথে সর্বপ্রধান বাধা। উচ্চ মধ্যবিত্তের সাথে কৃষক শ্রমিকের শ্রেণীগত বিভেদ ও বিরোধের এই চেতনা সাধারণতঃ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় আন্দোলনের কাঠামোর মধ্যে অবৰ্তমান থাকে। এ দুই শ্রেণীর বিভেদ বিরোধও সে অবস্থায় তেমন কোন খোলাখুলি আকার ধারণ করে না। কিন্তু বৈদেশিক শাসনের অবর্তমানে এ বিরোধ ধীরে ধীরে প্রকাশ্য রূপ নেয় এবং সেজন্য সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণীসমূহের ভূমিকাও স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। ১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত পাকিস্তানের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এদেশীয় মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের চরিত্র এবং স্বার্থের স্বরূপও তাই অনেকখানি উদ্ঘাটিত হবে।

বিভাগপূর্ব ভারতবর্ষে অগণিত অল্পবিত্ত মুসলমান, হিন্দু জমিদার, জোতদার, মহাজন, ব্যবসায়ী এবং আমলার দ্বারা উৎপীড়িত হতো। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর উৎপীড়নের সে ভিত্তি এবং চরিত্র বিন্দুমাত্র পরিবর্তিত হয়নি। কিন্তু জমিদার, জোতদার এবং বিশেষ করে মহাজন, ব্যবসায়ী, কারখানার মালিক এবং অত্যাচারী আমলার শ্রেণীগত চরিত্রের পরিবর্তন না হলেও তাদের সম্প্রদায়গত চরিত্র নিঃসন্দেহে পরিবর্তন না হলেও তাদের সম্প্রদায়গত চরিত্র নিঃসন্দেহে পরিবর্তিত হয়েছে। অর্থাৎ আজকের মহাজন, কারখানার মালিক, জমিদার, আমলা প্রভৃতিরা মুসলমান খাতক, শিল্পকর্মী, বর্গাদার এবং সাধারণভাবে জনসাধারণের স্বধর্মাবলম্বী। বিভাগ-পূর্ব ভারতবর্ষের অল্পবিত্ত মুসলমানদের অবস্থার সাথে পাকিস্তানের অল্পবিত্ত মুসলমানদের অবস্থার প্রভেদ এর বেশী তেমন কিছুই নয়। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অগ্রগতির বিশ্লেষণকালে এ কথাটি স্মরণ রাখা শুধু প্রয়োজন নয়, একান্ত অপরিহার্য।

১৯৪৭ সালের চৌদ্দই আগষ্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে পাকিস্তান অন্তর্ভুক্ত এলাকাসমূহের আর্থিক কাঠামোর মধ্যে যে কোন যুগান্তকারী পরিবর্তন সৃষ্টি হয়নি একথা সাধারণভাবে স্বীকৃত। বিদেশী শাসনের অবসানের ফলে এদেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব এদেশীয়দের হাতে এলেও সে কর্তৃত্বের মহিমায় বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের পারস্পরিক পূর্ব-সম্পর্কের মধ্যে কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়নি। এজন্যেই দেখা গেল যে ‘জাতি’কে মুসলিম লীগের নেতারা ধর্মভিত্তিক বলে বর্ণনা করলেও বাস্তবতঃ পাকিস্তান সাধারণ গৃহীত অর্থেই পরিণত হলো একটি জাতীয় রাষ্ট্রে। সংবিধান সভার উদ্বোধনী বক্তৃতায় কায়েদে আজমের বিভিন্ন উক্তি থেকেও সে কথাই বিশেষভাবে প্রমাণিত হয়। পাকিস্তানের আর্থিক কাঠামোর কথা স্মরণ রাখলে সহজেই দেখা যাবে যে বৃটিশ রাজত্ব ভারতবর্ষের যে অর্থনৈতিক কারণে সাম্প্রদায়িকতার সূত্রপাত হয়েছিল ঠিক অনুরূপ অর্থনৈতিক কারণেই পাকিস্তানে সূত্রপাত হয়েছে প্রাদেশিকতা এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রেষারেষি এবং প্রতিযোগিতা। দেশ স্বাধীন হওয়ার সময়ে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বাস্তব অবস্থাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে ধনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের অপেক্ষাকৃত দ্রুত উন্নতি এবং পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে আর্থিক জীবনের ভারসাম্যের অভাবে আশ্চর্য হওয়ার অথবা তাকে অস্বাভাবিক মনে করার কোন কারণ নেই। ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বাস্তব অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক এবং আমলাতান্ত্রিক অবস্থা যদি পশ্চিম পাকিস্তানের মতো হতো তাহলে এই একই ধনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের উন্নতি অনুরূপভাবেই হতো পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় অনেক দ্রুততর।

পশ্চিম পাকিস্তানের দ্রুত উন্নতি এবং পূর্ব পাকিস্তানে অপেক্ষাকৃত পশ্চাদপদত্বের অনেক কারণ আছে। সেগুলির বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। কিন্তু তবু তার মধ্যে কতকগুলিকে এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে। যথা : ১৯৪৭ সালে সামরিক বাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানের উল্লেখযোগ্য কোন অংশ না থাকা; পাকিস্তানের আমলাগোষ্ঠীতে পশ্চিম পাকিস্তানের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা; ভারত থেকে অসংখ্য ব্যবসাদার শ্রেণীর লোকের পশ্চিম পাকিস্তান যাওয়া; পাকিস্তানের রাজধানী করাচীতে স্থাপিত হওয়া (যার ফল নূতন ব্যবসায়ী শ্রেণীর লোকের নানা ধরণের লাইসেন্স, বিদেশী মুদ্রা ইত্যাদি অর্জনের সুবিধা) ইত্যাদি। ধনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের এই প্রাথমিক পার্থক্যের ফলেই সত্যিকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতা ইসলামী রাষ্ট্র এবং গণতন্ত্রের বাহ্য আড়ম্বর সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানেই কেন্দ্রীভূত হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের ইতিহাস এই ভারসাম্যের অভাবের উপর ভিত্তি করেই শুরু হয়। এই প্রাথমিক পার্থক্যের ফলে এ দেশের পরবর্তী ইতিহাস যে পথ ধরে অগ্রসর হয়েছে সেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। শুধু পাকিস্তানের কেন যে কোন ধনতান্ত্রিক সমাজের ইতিহাসই ধনতন্ত্রের মহিমায় এ পথ ধরে অগ্রসর হতো। এদিক দিয়ে পাকিস্তানের কোন বিশেষত্ব নেই।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এদেশ মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর, বিশেষঃ উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর, শস্যক্ষেত্রে পরিণত হলো। কিন্তু এ রূপান্তরের বাস্তব চরিত্র জনসাধারণের কাছে যথাযথভাবে উদঘাটিত হলো না। তাদের বিচারবুদ্ধি এক্ষেত্রে নানা সংস্কার এবং প্রচারণার দ্বারা থাকলো আচ্ছন্ন এবং বিভ্রান্ত। এই বিভ্রান্তি সৃষ্টির ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার ভূমিকা অত্যন্ত মারাত্মক এবং উল্লেখযোগ্য।

একথা সত্য যে পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িকতার, বিশেষতঃ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির, বাস্তবভিত্তি পূর্বের তুলনায় অনেক দুর্বল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এদেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতার উচ্ছেদ এখনো সাধিত হয়নি। এর অন্যতম মূল কারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার রূপে সাম্প্রদায়িকতা এদেশে এখনো কার্যকরী এবং ব্যবহারযোগ্য।

যে কোন গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই আন্দোলনের সত্যকার বিরোধী শক্তির অর্থাৎ শত্রুর সঠিক পরিচয় লাভের প্রয়োজন অপরিহার্য্য। আন্দোলনে অংশ গ্রহণকারী ব্যক্তিদের ধারণা এ ব্যাপারে যদি স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন না হয়, তাহলে সে আন্দোলন বহুধাবিভক্ত এবং পরিশেষে বিভ্রান্ত হওয়াই স্বাভাবিক। পাকিস্তানের রাজনৈতিক জীবনক্ষেত্রে এ বিভ্রান্তি সহজেই চোখে পড়ে। এদেশের ইতিহাস এজন্যই অগ্রসর হয় গতির অন্ধ আবেগে। তার মধ্যে সচেতন দিক নির্ণয়ের কোন উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা লক্ষিত হয় না।

ইংরেজ রাজত্বকালে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বার্থকে সমস্ত জাতির স্বার্থের সাথে এক করে দেখা হয়েছিল। পরবর্তীকালে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের নিজ নিজ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বার্থকেও হিন্দু এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের স্বার্থের সাথে হয়েছে এক এবং অভিন্ন করে দেখানো। এটা শুধু ভারতীয় হিন্দু মুসলমানদের বিশেষত্ব নয়। মানুষের ইতিহাসে শোষণের এ ধারা প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত।

গ্রীক দার্শনিকেরা যখন মানুষের অধিকার, ন্যায় বিচার, শিক্ষা সম্পর্কে কথা বলতেন তখন মানুষ বলতে তাঁরা সত্য অর্থে বোঝাতেন ‘স্বাধীন নাগরিকদের’। তাঁদের সমাজের অগণিত অসংখ্য দাসদের, বিদেশীদের এমনকি নিজেদের শ্রেণীভুক্ত স্ত্রীলোকদের পর্যন্ত তাঁরা রাজনৈতিক এবং অন্যান্য অধিকারের ক্ষেত্রে মানুষ হিসাবে গণ্য করতেন না। দৈহিক আকৃতি এবং গঠনের দিক থেকে মানুষের সাথে তাদের উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য থাকলেও গ্রীক দার্শনিকদের মতে তারা ছিল স্বাধীন নাগরিকদের তুলনায় প্রকৃতিগতভাবে অনেক নিকৃষ্ট। কাজেই স্বাধীন মানুষদেরকে যে সকল অধিকার দেওয়া নিতান্ত প্রয়োজন অন্যান্যদের ক্ষেত্রে সে অধিকারসমূহ একেবারে নিষ্প্রয়োজন এবং নিরর্থক।

গ্রীকরা যে কথা সরাসরিভাবে এবং স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন পরবর্তীকালে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে সে কথা অত সরাসরি এবং স্পষ্ট ভাষায় বলা সম্ভব না হলেও কার্যতঃ সকল ক্ষেত্রে সেই একই নীতি শোষণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং ব্যবহৃত হয়েছে। সামন্ততান্ত্রিক যুগে অধিকার, সমতা, ন্যায়বিচার ইত্যাদির আলোচনাক্ষেত্রে মানুষকে নিয়ে আলোচনা হলেও সামন্ততান্ত্রিক পটভূমিকার মানুষ এবং প্রাচীন গ্রীক সমাজের মানুষ এক নয়। গ্রীকরা ‘মানুষ’ বলতে বোঝাত স্বাধীন গ্রীক নাগরিকদের। সামন্ততন্ত্রে ‘মানুষের’ অর্থ সমাজের সেই সব লোক যারা জমির মালিকানার মাধ্যমে নিজেদের শাসনকে রাখতো অব্যাহত। ফরাসী বিপ্লব প্রধানতঃ এই মানুষের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়। শুধু ফরাসী বিপ্লব কেন ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলিতে অপেক্ষাকৃত শান্তভাবে ধীরে ধীরে যে বিপ্লব মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে সংঘটিত হলো তারও লক্ষ্য ছিল সামন্ততান্ত্রিক মানুষের উচ্ছেদ এবং বিলোপসাধন। ফ্রান্স এবং ইউরোপের বিভিন্ন রাজ্যে মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে যে গণতান্ত্রিক জাতীয় রাষ্ট্রগুলির উত্থান ঘটলো সেগুলিতে প্রধানতঃ মধ্যবিত্ত অর্থাৎ বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থই প্রতিষ্ঠিত এবং সংরক্ষিত হওয়ার ব্যবস্থা হলো। একথা কিন্তু খোলাখুলিভাবে কেউই স্বীকার করলো না। এদিক দিয়ে গ্রীকরাই খুব সম্ভবতঃ একমাত্র ব্যতিক্রম। ফরাসী বিপ্লবের সময় সকল মানুষের জন্য স্বাধীনতা, সমতা এবং ভ্রাতৃত্বের আদর্শ তত্ত্বগতভাবে ঘোষিত হলেও বাস্তবতঃ সে স্বাধীনতা, সমতা এবং ভ্রাতৃত্ব মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এর অন্যতম কারণ এ আদর্শকে বাস্তব রূপ দিতে গেলে সকলের জন্য সমাজ জীবনে যে সুযোগ সুবিধার প্রয়োজন অপরিহার্য সেগুলো ধনতান্ত্রিক জাতীয় রাষ্ট্রে থাকে না। সুযোগ সুবিধা না থাকার এই ব্যাপারটিও একটি আকস্মিক অথবা কার্যকারণ সম্পর্কহীন ঘটনা নয়। ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে বুর্জোয়া স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হলে অন্যান্য নিম্নতর শ্রেণীর মানুষদেরকে স্বাধীনতা, সমতা এবং ভ্রাতৃত্বের আদর্শের উপর তাদের জীবনকে প্রতিষ্ঠা করতে দেওয়া সম্ভব নয়। কোন সমাজে শ্রেণীনির্বিশেষে সকলের জীবনেই যদি এ আদর্শের রূপায়ণ ঘটে তাহলে সেখানে শ্রেণী শোষণ সম্ভব হয় না। আবার শ্রেণী শোষণকে কায়েম রাখতে গেলে এসব উচ্চ আদর্শকে সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে দেওয়া চলে না। কাজেই ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে যা ঘটেছে ফরাসী বিপ্লবের সময় এবং তার পরবর্তীকালে বিভিন্ন দেশের এবং জাতির ইতিহাসেও ঠিক সেটাই হয়েছে সংঘটিত। মানুষ বলতে এসব ক্ষেত্রে কোন সময়েই জাতি- ধর্ম-বর্ণ এবং বিশেষতঃ শ্রেণী নির্বিশেষে সকল মানুষকে বোঝায়নি। মানুষ বলতে তাই সব সময়েই বোঝাতো বিশেষ এক শ্রেণীর অথবা জাতের মানুষ। ধনতান্ত্রিক, জাতীয়তাবাদী এবং অনেক ক্ষেত্রে তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহেও মানুষ বলতে মোটামুটিভাবে যাকে বোঝায় সে হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত মানুষ। অন্যেরা এর আওতা থেকে অবস্থা বিশেষে আংশিক অথবা সম্পূর্ণভাবে বহিষ্কৃত।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মাধ্যমে বহু নিম্নবিত্ত হিন্দু মুসলমান নিহত আহত এবং নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পাকিস্তান আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমান সমাজ জীবনে যে মানুষের উচ্ছেদ এবং বিলোপ সাধনের প্রচেষ্টা হয়েছিল সে মানুষ হিন্দু-মধ্যবিত্ত। কিন্তু শুধু এই নেতিবাচক উক্তির মধ্যেই পূর্ণ সত্য নিহিত নেই। পাকিস্তান আন্দোলনের মাধ্যমে যে মানুষের প্রতিষ্ঠা এবং রাজত্ব কায়েমের প্রচেষ্টা হয়েছিল সে মানুষ মুসলমান মধ্যবিত্ত। এ আন্দোলন মূলতঃ তাই এক মানুষের (হিন্দু মধ্যবিত্ত) হাত থেকে অন্য মানুষের (মুসলমান মধ্যবিত্ত) পরিত্রাণ পাওয়ার আন্দোলন। এজন্যই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর হিন্দু মধ্যবিত্ত দেশ ত্যাগ করলো এবং মুসলমান মধ্যবিত্ত অর্থাৎ বুর্জোয়া শ্রেণী হিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণীর আওতাবহির্ভূত হয়ে কায়েম করলো নিজের রাজত্ব। কিন্তু ইসলামের আওয়াজ তোলা সত্ত্বেও তার মধ্যে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী নির্বিশেষে মানুষ কোন স্বীকৃতি পেল না। ফরাসী বিপ্লবের পর কার্যক্ষেত্রে মানুষ বলতে যেমন বোঝত মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত মানুষ, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও ঠিক তেমনিভাবে কার্যক্ষেত্রে মানুষ বলতে বোঝালো মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত মুসলমান। অন্য বিষয়ে তফাৎ থাকলেও এদিক দিয়ে পাকিস্তানের সাথে অন্যান্য জাতীয় রাষ্ট্রের কোন প্রভেদ নেই।

সাম্প্রদায়িকতাকে বুর্জোয়া শ্রেণী স্বার্থের হাতিয়ার রূপে ব্যবহারের জন্য সব সময়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশ্রয় নেওয়ার কোন প্রয়োজন হয়না। তার থেকেও অনেক সূক্ষ্মতর পথে সাম্প্রদায়িকতার সাহায্যে উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণী সক্ষম হয় তার বিভ্রান্তির এবং শোষণের জাল বিস্তার করতে। এজন্যই দেখা যায় যে, যখনই কোন সত্যিকার গণতান্ত্রিক আন্দোলন বুর্জোয়া স্বার্থের বিরুদ্ধে চালিত হয় তখনই নিজেদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষাকল্পে তারা ধর্ম এবং সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নিতে দেরি করে না। পূর্ব পাকিস্তানের নব উত্থিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী ধর্মনিষ্ঠ না হলেও ধর্মের প্রতি তাদের এক জাতীয় অনুগত্য আছে। জনসাধারণ এবং নিম্নমধ্যবিত্তের এই আনুগত্যই বর্তমানে উচ্চমধ্যবিত্তের এক বিশাল রাজনৈতিক মূলধন। এ মূলধনের লভ্যাংশের হিসাবের কোন ধারণা সাধারণের না থাকলেও বুর্জোয়া শ্রেণীর মনে এর হিসাবে কোন ভুলভ্রান্তি নেই।

এ জন্যই দেখা যায় যে, এদেশে যখনই কোন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূত্রপাত হয় তখনই সে আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য এই শ্রেণীভুক্ত লোকেরা এবং তাদের প্রতিনিধিবৃন্দ আন্দোলনকে ভারতীয় হিন্দুদের দ্বারা অনুপ্রাণিত ও পরিচালিত, ইসলাম ধর্ম বিরুদ্ধ, পাকিস্তানের আদর্শবিরোধী ইত্যাদি আখ্যায় ভূষিত করে। ধর্মকে শোষণের কাজে উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণী কিভাবে ব্যবহার করছে তার সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকায় এদেশের জনসাধারণ এ সকল প্রচারণার দ্বারা সহজেই বিভ্রান্ত হয়। বিভ্রান্তিবশতঃ তারা মনে করে যে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূত্রপাত এবং তাকে পরিচালনা করা একমাত্র হিন্দু সমাজের দ্বারাই সম্ভব, মুসলমানদের দ্বারা নয়। মুসলমান সম্প্রদায়ের পক্ষে এই বিশ্বাস যে অত্যন্ত অগৌরবের এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কারণ এর দ্বারা এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী শুধু এ কথাই মুসলমানদেরকে বোঝাতে চায় যে সম্প্রদায়গতভাবে তারা গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে অক্ষম। ধর্মীয় বিভ্রান্তি এবং রাজনৈতিক পশ্চাদপদত্বের জন্য সাধারণভাবে জনসাধারণ এই সকল প্রচারণার স্বরূপকে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয় না। এবং তার ফলে নিজেদের শ্রেণীস্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তারা সমর্থন করে উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীস্বার্থ প্রতিষ্ঠা এবং প্রসারের বিবিধ ব্যবস্থা। ১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত সারা পাকিস্তানে, বিশেষতঃ পূর্ব পাকিস্তানে, উচ্চ মধ্যবিত্তের সাম্প্রদায়িক হাতিয়ার এই ভাবে শাসনতান্ত্রিক এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে এদেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনকেই ক্ষতিগ্রস্ত এবং ধ্বংস করার কাজে আংশিক অথবা পরিপূর্ণ সাফল্যের সাথে ব্যবহৃত হয়েছে।

১০

এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনসমূহকে বাধাগ্রস্ত এবং ধ্বংস করার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার ভূমিকা অত্যন্ত পরিষ্কার। কিন্তু বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ ভূমিকা স্পষ্ট হলেও জনসাধারণের চেতনার এ সম্পর্ক কোন স্পষ্ট ধারণা থাকে না, বিশেষতঃ সাম্প্রদায়িক প্রচারণার দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সময়ে। এর ফলে ঘটনা উত্তরকালে উচ্চ মধ্যবিত্তের সাম্প্রদায়িক দুষ্কৃতির পরিচয় কিছুটা লাভ করলেও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা পুনরুত্থিত হলে তারা সহজেই আবার পূর্বের মতই বিভ্রান্ত হয়। এবং সাম্প্রদায়িকতা শ্রেণীস্বার্থ উদ্ধার কালে ব্যবহৃত হয় বলেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং দাঙ্গার পৌনপৌনিকতাকে কিছুতেই রোধ করা যায় না। কিন্তু শ্রেণীস্বার্থের এই সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী হাতিয়ারের যথার্থ চরিত্রকে কৃষক মজুর অল্পবিত্ত জনসাধারণ যতদিন পর্যন্ত না উপলব্ধি করতে সমর্থ হচ্ছে ততদিন এদেশে কোন গণতান্ত্রিক আন্দোলনকেই সুস্থ পথে এবং সুষ্ঠুভাবে তার পরিণতির দিকে চালনা করা সম্ভবপর নয়। এ কারণে এদেশে সামাজিক এবং রাজনৈতিক অগ্রগতির জন্য সব থেকে বেশী প্রয়োজন সাম্প্রদায়িকতার স্বরূপ উদঘাটন, তার বিভিন্ন রূপ এবং বহিঃপ্রকাশের পরিচয় লাভ এবং তাকে যথাযথভাবে প্রতিরোধ করার সত্রিয় প্রচেষ্টা। এদেশে, বিশেষঃ পূর্ব পাকিস্তানে সুস্থ রাজনৈতিক চেতনা সঞ্চারের জন্য তাই সাম্প্রদায়িকতাসৃষ্ট মানসিক অচলায়তনেক সৰ্বভাবে এবং সর্বক্ষেত্রে ধ্বংস করার প্রয়োজন সম্পূর্ণ অপরিহার্য্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *