৪. সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা

সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির চূড়ান্ত পরিণতি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়। একই এলাকাভুক্ত দুই সম্প্রদায়ের লোকদের পারস্পরিক বিরোধীতা ও তিক্ততা জান্তব এবং অস্বাভাবিক পর্যায়ের অবনমিত হলে তখনি সম্পূর্ণ হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মানসিক প্রস্তুতি। এ অবস্থায় অনেক সাধারণ মানুষও লিপ্ত হয় অস্বাভাবিক আচরণে। এজন্যই সাধারণ জীবনযাত্রায় মানুষ ভালমন্দ, সৎ অসৎ এবং হিতাহিতের যে তারতম্য করে তার কোটিকেই দাঙ্গারত মানুষ আর রক্ষা করতে সক্ষম হয় না। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বের হয় সম্পূর্ণ নিবৃত্তি। হিন্দু, মুসলমান অথবা শিখ যেই হোক না কেন সাধারণ জীবনযাত্রারত মানুষের পক্ষে দাঙ্গার মানসিকতা স্বাভাবিক নয়। আদিম এবং জান্তব হিংস্রতা বহু সাধনায় অতি মনুষ্যত্বকে অল্প সময়ের জন্য পরাভূত এবং বিধ্বস্ত করলেও সাধারণ মানুষ নিজেদের মনুষ্যত্বের এ পরাভবকে দীর্ঘস্থায়ী হতে দেয় না। তাদের প্রকৃতিই এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ফলে অকস্মাৎ অসাম্প্রদায়িক হয়ে না উঠলেও তারা প্রকৃতিস্থ হয়। কাটিয়ে ওঠে দাঙ্গার উন্মত্ততা।

কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মানুষ এমন উন্মত্ত হয় কেমন করে? এর উত্তর লাভের জন্য প্রয়োজন জনমত কিভাবে গঠিত হয় তার বিশ্লেষণ।

জনমত গঠনের কতকগুলি প্রচলিত মাধ্যম আছে। যেমন সংবাদপত্র, সভাসমিতি, বেতারযন্ত্র, টেলিভিশন, ইশতাহার এবং অন্যান্য প্রচারপত্র। যে কোন নীতি অথবা কর্মপদ্ধতির সপক্ষে জনমতকে উপযুক্তভাবে গঠন করতে হলে এগুলির সবগুলি না হলেও অন্ততঃ কতকগুলিকে নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন অপরিহার্য্য। শুধু আমাদের ঘরের কাছাকাছি নয়, পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বিদারাত্রি যা ঘটছে তার সংবাদ লাভের জন্য আমরা প্রচার মাধ্যমগুলির, বিশেষতঃ সংবাদপত্র এবং বেতারের উপর নির্ভরশীল যে কোন ব্যাপারে জনমত গঠনের জন্য এই সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠানগুলির দায়িত্ব এবং গুরুত্ব সে জন্যেই খুব বেশী।

প্রচার মাধ্যমগুলি শুধু যে সংবাদ সরবরাহ করে তাই নয়। সংবাদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে জনমতকে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী গঠন ও চালনা করাও তাদের সাধারণ কার্যক্রমের অন্তর্গত। এজন্য জনমত যখন কোন ব্যাপারে গঠিত হয় তখন তার জন্য প্রচারযন্ত্রসমূহের দায়িত্বকে অস্বীকার করা চলে না।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নেই। সেজন্য কোন দেশে, প্রদেশে, শহরে অথবা পল্লী অঞ্চলে যখনই দাঙ্গার সূত্রপাত হয় তখনই তার কার্যকারণ সূত্রের সন্ধানের জন্য প্রয়োজন জনমত গঠনকালীন এই প্রচারযন্ত্রগুলির প্রচারকার্যের বিশ্লেষণ। যেখানে এই প্রচারকার্যকে উপযুক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, সেখানে সাম্প্রদায়িকতা জনসাধারণের মধ্যে যতই প্রবল হোক মানুষকে সে মনোবৃত্তি দাঙ্গার পথে চালনা করে না।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যেখানেই ঘটে সেখানেই তাই সংবাদপত্র, বেতার, রাজনৈতিক সভাসমিতি ইত্যাদির গুরুত্ব অনেক। কিছুসংখ্যক নিম্নচরিত্রের লোকজন ছাড়া সমাজের অধিকাংশ মানুষই শান্তিপ্রিয়। এই শান্তিপ্রিয় জনসাধারণের একাংশ হঠাৎ রক্তপাতের অথবা অন্যের সম্পত্তি নাশের নেশায় উন্মুক্ত হয়ে ওঠে না। তার জন্য প্রয়োজন হয় অনেকখানি মানসিক প্রস্তুতির। এ প্রস্তুতির সম্পূর্ণ দায়িত্ব তাদেরই যারা এই প্রচারযন্ত্রসমূহকে আংশিক অথবা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।

যে প্রচারমাধ্যমগুলির উল্লেখ করা হলো সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে কারা? এবং কোন্ স্বার্থের তারা প্রতিনিধি? সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চরিত্রকে যথাযথভাবে বোঝার জন্য একথা জানা প্রয়োজন।

আমাদের দেশের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দলসমূহ এখনো মোটামুটিভাবে মধ্যবিত্ত অর্থাৎ বুর্জোয়া স্বার্থের প্রতিনিধি। মধ্যবিত্তের মধ্যে অবশ্য অনেক স্তরভেদ আছে। কাজেই মধ্যবিত্তের প্রতিনিধিত্ব বলতে সবক্ষেত্রে একই জিনিষ বোঝায় না। কোন কোন রাজনৈতিক দলের মধ্যে নিম্নমধ্যবিত্ত, কোনটির মধ্যে মধ্যবিত্ত আবার কোনটির মধ্যে হয়তো উচ্চ মধ্যবিত্তের প্রাধান্য। এজন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষেত্রে সকল রাজনৈতিক দলের অথবা মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত লোকদের দায়িত্ব সমান থাকে না। তবে একথা বললে খুব বেশী ভুল হয় না যে, যে সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে উচ্চ মধ্যবিত্তের প্রাধান্য বেশী দাঙ্গার দায়িত্বও তাদের সেই তুলনায় অধিকতর। কারণ বৃহত্তম মাধ্যমে সচেতনভাবে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী উচ্চবিত্তের স্বার্থকেই তারা পরিপুষ্ট করে। সারা পাক-ভারত উপমহাদেশের ক্ষেত্রেই একথা সাধারণভাবে প্রযোজ্য।

উচ্চমধ্যবিত্ত স্বার্থ-প্রধান রাজনৈতিক দলগুলিই অধিকাংশ সংবাদপত্র এবং অন্যান্য প্রচার মাধ্যমসমূহের সমর্থক, মালিক এবং নিয়ন্ত্রেতা। এ জন্য এগুলির মাধ্যমে শুধু দাঙ্গার ক্ষেত্রেই নয় জীবনের সকল ক্ষেত্রেই উচ্চমধ্যবিত্তস্বার্থ সূক্ষ্মভাবে রক্ষার ব্যবস্থা হয়। এজন্যই দেখা যায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষেত্রে দেশের সকল সংবাদপত্রের ভূমিকা এক হয় না, কোন কোন সংবাদপত্র হয়তো দাঙ্গা মনোবৃত্তির বিরোধীতা করে। কিন্তু জনমত গঠনে তাদের প্রভাব অন্যগুলির তুলনায় থাকে অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক দুর্বল।

কিন্তু উচ্চমধ্যবিত্ত স্বার্থরক্ষার জন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রয়োজন কি? এর উত্তর খুবই সহজ। এ প্রয়োজন হয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দ্বিবিধ কারণেই। দেশ শাসন এবং দেশের বিভিন্ন কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীই তার আর্থিক শক্তির প্রতাপে সব থেকে প্রতিপত্তিশালী। এই প্রতিপত্তির মাধ্যমে তারা যা কিছু করে তার অধিকাংশই নিজেদের শ্রেণীস্বার্থ উদ্ধারের উদ্দেশ্যে। কিন্তু দেশের অগণিত জনসাধারণকে তাদের শাসন এবং শোষণের সত্যিকার চরিত্র এবং তাৎপর্যকে বুঝতে না দেওয়া তাদের নিজেদের কাজকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য নিতান্ত প্রয়োজন। শুধু দুঃখ দুর্দশার মধ্যে জীবন যাপন করলে এবং অন্যের দ্বারা শোষিত হলেই মানুষের মনে গণতান্ত্রিক এবং বৈপ্লবিক চেতনার সঞ্চার হয় না। এ চেতনার জন্য প্রয়োজন তারা যেভাবে এবং যাদের দ্বারা শোষিত হয় তার সম্পর্কেও উপযুক্তভাবে সচেতন এবং অবহিত হওয়া। সমাজ জীবনে এটা যাতে না ঘটে তার জন্য মধ্যবিত্ত বা বুর্জোয়া স্বার্থ সর্বদাই জাগ্রত ও সচেষ্ট থাকে। এজন্য বৃহত্তর রাজনৈতিক জীবনে মানুষ যাতে সুস্থ চিন্তার অবকাশ না পায় তার জন্য তারা ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্টি করে চলে নানা বিভ্রান্তির জাল। অসাবধানী এবং বিশ্বাসপ্রবণ জনসাধারণ তার দ্বারা সহজেই হয় প্রতারিত এবং বিপথগামী।

মধ্যবিত্ত শ্রেণী সকল সময়ে সচেষ্ট হয় নিজের স্বার্থের সাথে দেশের স্বার্থকে এক করে দেখতে। এ প্রচেষ্টায় তারা সাধারণত বিফল হয় না। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে অসুবিধার আশঙ্কা দেখা দিলে অথবা সত্যিকার কোন অসুবিধা সৃষ্টি হলে তখনই তারা চাতুর্যের সাথে রচনা করে কোন না কোন রাজনৈতিক বিভ্রান্তি। আমাদের দেশের এই বিভ্রান্তিসমূহের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা এখনো সর্বপ্রধান, সর্বাপেক্ষা কার্যকরী এবং সর্বাপেক্ষা মারাত্মক। সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে মধ্যবিত্ত শ্ৰেণী চেষ্টা করে অন্যান্যদের শ্রেণী চেতনাকে বিনাশ করতে। স্বাধীনতাপূর্ব যুগে সাম্প্রদায়িকতার প্রয়োজন ছিল অন্য সম্প্রদায়ভুক্ত মধ্যবিত্তের প্রতিযোগিতা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তরকালে সাম্প্রদায়িকতার প্রয়োজন নিজেদের সম্প্রদায়ভুক্ত নিম্নবিত্ত লোকদের শ্রেণী-চেতনার কণ্ঠরোধ করার জন্য। সম্প্রদায়গত মধ্যবিত্ত স্বার্থের প্রতিষ্ঠা এবং সম্প্রসারণ দুই ক্ষেত্রেই সাম্প্রদায়িকতার মুনাফা তাই পর্বতপ্রমাণ। এজন্যই এ হাতিয়ার আজ পর্যন্ত সমগ্র পাক-ভারতীয় উপমহাদেশে মধ্যবিত্ত স্বার্থ উদ্ধার কার্যে ব্যবহারযোগ্য।

মধ্যবিত্তের বৃহত্তর আর্থিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ দাঙ্গার মাধ্যমে কিভাবে রক্ষিত হয় সেটা যে কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কার্যকারণ এবং ফলাফলের বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে। এর জন্যে এখানে মাত্র দুটি উদাহরণ উল্লেখ করা গেল।

প্রথমটি হলো ১৯৪৬ সালে সংঘটিত বিহার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এ দাঙ্গায় মুসলিম লীগের হিসাবে বিশ থেকে ত্রিশ হাজার, হিন্দু চরমপন্থীদের (কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভাভুক্ত) হিসাবে দুই থেকে তিন হাজার এবং ইংরেজদের হিসাবে সাত থেকে আট হাজার মুসলমান নরনারী এবং শিশু নিহত হয়।[১] ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত এত বড় হত্যাকাণ্ড কলকাতা ছাড়া অন্য কোথাও ঘটেনি। গ্রামাঞ্চলের সেটাই অবশ্য ছিল বৃহত্তম হত্যাকাণ্ড।

এ দাঙ্গার উপর লিখতে গিয়ে বৃটিশ সেনাবাহিনীর তৎকালীন পূর্বাধিনায়ক (যিনি সে সময়ে ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের সামরিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন) লেফটেনেন্ট জেনারেল স্যার ফ্রান্সিস টাকার বলেন যে, এই হত্যাকাণ্ড একটি সুগঠিত পরিকল্পনা অনুযায়ী সংঘটিত হয়।[২] কারা এ পরিকল্পনার সাথে জড়িত ছিল সে বিষয়ে অবশ্য প্রথম দিকে তিনি নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু অন্যত্র আবার তিনি বলেছেন যে ঘটনার বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে তাঁরা গুজব শুনেছিলেন যে কলকাতার দাঙ্গায় যে সমস্ত মাড়োয়ারী এবং হিন্দু ব্যবসায়ীরা কলকাতাস্থ বিহারী মুসলমানদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তারাই এ পরিকল্পনা প্রস্তুত এবং কার্যকর করে। তাঁর নিজের মতে এ দাঙ্গা হিন্দু মহাসভার দ্বারা সংগঠিত হয়।[৩] ফ্রান্সিস টাকারের এই স্বীকারোক্তির মধ্যে দুটি জিনিস উল্লেখযোগ্য। প্রথমতঃ তিনি আংশিকভাবে স্বীকার করেছেন যে এই দাঙ্গায় উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর হিন্দু ব্যবসায়ীদের হাত ছিল এবং হিন্দুমহাসভাই এতে প্রধান অংশ নিয়েছিল। দ্বিতীয় জিনিষটি অধিকতর উল্লেখযোগ্য। টাকারের মতে এই হত্যাকাণ্ড পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী হলেও এর খবর তাঁদের একেবারেই জানা ছিল না। শুধু তাই নয়। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন যে, এই দাঙ্গার সময় বিহারের অভিজ্ঞ গভর্ণর স্যার হিউ যাও ৩১ শে অক্টোবর থেকে ৫ই নভেম্বর (অর্থাৎ ঠিক দাঙ্গার সময়টিতে!) বিহারে অনুপস্থিত থাকার ফলে অবস্থা আওতাধীনে আনা সেখানকার সামরিক কর্তৃপক্ষের দ্বারা সম্ভব হয়নি। সামরিক কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার জন্য তিনি বিহারের মন্ত্রীসভাকে দোষারোপ করেই ক্ষান্ত হয়েছেন।[৪]

বৃটিশ রাজত্বে গোয়েন্দা বিভাগের যোগ্যতা দক্ষতা এবং কর্মতৎপরতা সর্ববিদিত। এহেন গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারীগণ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার এত বিস্তৃত পরিকল্পনা এবং পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ ছিল একথা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। যে বৃটিশ গোয়েন্দা বিভাগ সন্ত্রাসবাদীদের সতর্কতা এবং সাবধানতা সত্ত্বেও সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সময় তাদেরকে গোপন স্থানগুলি থেকে একটি একটি করে খুঁজে বের করতে সতর্ক ছিল সেই গোয়েন্দা বিভাগ বিহার দাঙ্গার এত সুবিস্তৃত প্রস্তুতির কোনই খবর সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়নি এ যুক্তি নিতান্ত্রই অক্ষম। এর অসারতা প্রমাণের জন্য বেশী আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। ভারতবর্ষকে নিজেদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভক্ত করার কাজকে সহজ এবং ত্বরান্বিত করার জন্য ভারতবাসীর চেতনায় যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রয়োজন ছিল সে বিভ্রান্তি তারা দাঙ্গার মাধ্যমেই সৃষ্টি করেছিল সম্পূর্ণ এবং চরমতমভাবে। কংগ্রেস লীগের নেতৃবৃন্দকে নানাভাবে আলোচনার গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ রেখে এবং প্রয়োজনমতো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটিয়ে তারা নিজেদের পরিকল্পনার উপযোগী ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে সমর্থ হয়েছিল। এজন্য ১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসে ভারতবর্ষ যেভাবে বিভক্ত হলো সেটা কংগ্রেস লীগের যৌথ পরিকল্পনা অনুযায়ী নয়। দেশ বিভক্ত হলো ইংরেজের পরিকল্পনা অনুযায়ী। তার ফলে তারা শুধু ভারতবর্ষকে ‘ভারত ও ‘পাকিস্তানে’ বিভক্ত করলো তাই নয়। তারা বিভক্ত করলো বাঙলাদেশ। বিভক্ত এবং বিধ্বস্ত করলো পাঞ্জাব। অনেক কৌশলে তারা বিভক্ত করলো কাশ্মীর (এ ব্যাপারে মাউন্টব্যাটেনের দক্ষতা প্রশংসনীয়!) এবং তার মাধ্যমে আজ পর্যন্ত পাক-ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতাকে রাখলো অনির্বাণ।

১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসে পাঞ্জাবে সমগ্র উপমহাদেশের ইতিহাসে জঘন্যতম এবং বিস্তৃততম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। এই দাঙ্গায় লক্ষ লক্ষ হিন্দু মুসলমান শিখ নরনারী এবং শিশু নিহত, আহত এবং উদ্বাস্তু হয়। এ সম্পর্কে ধম্বন্তরী এবং পুরাণচন্দ্র যোশী পাঞ্জাব দাঙ্গার সময়কার অবস্থা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে লিখিত তাঁদের একটি বইয়ে বলেন যে, বৃটিশ শাসনে প্রতিপালিত জাতীয়তা বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলিই সেক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা জঘন্য ভূমিকা পালন করেছিলো। নিজ নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে তারাই ছিল এ ব্যাপারে সর্বপ্রধান আসামী। এ প্রসঙ্গে তারা আরও বলেন :

পাঞ্জাবের দেশীয় রাজারা নিজ নিজ সম্প্রদায়ের দলবদ্ধ গুণ্ডাদের অস্ত্রশস্ত্র যুগিয়েছেন। ন্যাশনাল গার্ডদের অস্ত্র যুগিয়েছে ভাওয়ালপুর রাজ্য; আকালীদের দিয়েছে পাতিয়ালা ও ফরিদ কোট। গ্রামাঞ্চলে বড় বড় জমিদারেরা নিজেরাই বড় বড় সশস্ত্র গুণ্ডাদল পরিচালনা করে সংখ্যালঘুদের হত্যা করেছে, উৎখাত করে নিজেরা তাদের ঘরবাড়ি জমিজমা হাত করেছে, কৃষকদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ করেছে এবং এইভাবে নিজেদের সামন্ততান্ত্রিক শাসনের বুনিয়াদ পাকা করে ফেলেছে।

শহরে যে সব ব্যবসায়ীরা যুদ্ধের মধ্যে চোরাকারবারে পয়সা করেছে, তারাই নিজ নিজ সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলির পৃষ্ঠপোষক, তারাই অজস্র টাকা পয়সা যুগিয়েছে। কারখানার হিন্দু মালিকেরা মুসলমান শ্রমিকদের বরখাস্ত করেছে; আবার মুসলমান মালিকদের দ্বারা হিন্দু শ্রমিকেরা পাইকারীভাবে ছাঁটাই হয়েছেন।

যে সমস্ত ধনিকেরা যুদ্ধের মধ্যে পয়সা করে বড়লোক হয়েছে তাদের উদ্দেশ্যে-ব্যবসা ও শিল্পের ক্ষেত্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ীদের হটিয়ে দিয়ে বাজারে একচেটিয়া প্রভূত্ব স্থাপন করা।

দাঙ্গা অধ্যুষিত পাঞ্জাবে গত ছয় মাস ধরে যে বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছে, তার মাঝে প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক নেতারা জনপ্রিয়তা অর্জন করবার জন্য কার্যক্ষেত্রে নেমে পড়েছে। এদের সাহায্য ছাড়া অগ্নিসংযোগকারী বৃটিশ আর তাদের অনুচর কায়েমী স্বার্থবাদীদের চক্রান্ত কখনো সফল হত না।[৫]

পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্তমান জেনারেল অফিসার কমাণ্ডিং মেজর জেনারেল ফজল মুকিম খান পাকিস্তান সৈন্য বাহিনীর উপর লিখিত একটি বইয়ে পাঞ্জাব দাঙ্গার সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন। সেখানে তিনি এ কথা উল্লেখ করেছেন যে ১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসের এবং তার পূর্বের দাঙ্গার বিস্তৃত প্রস্তুতির সমস্ত খবর ‘ক্রিমিনাল ইনভেসটিগেশন ডিপার্টমেন্ট’ বৃটিশ ভারতীয় সরকারের কাছে পেশ করেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও বড়লাট মাউন্টব্যাটেন এবং পাঞ্জাবের গভর্ণর জেঙ্কিস্ দাঙ্গা রোধ করার কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করেননি।[৬]

পাঞ্জাবের দাঙ্গার ক্ষেত্রে মাউন্টব্যাটেনের প্রত্যক্ষ ব্যক্তিগত দায়িত্ব যে কত গভীর ছিল একথা কিছুদিন পূর্বে প্রকাশিত একটি বইয়ে একজন ইংরেজ লেখকও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন।[৭]

উপরে বর্ণিত বিহার এবং পাঞ্জাবের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকেই বোঝা যাবে দাঙ্গায় সক্রিয় অংশ থেকে কাদের এবং এর দ্বারা লাভবান হয় কারা।

পাক-ভারতীয় উপমহাদেশে মধ্যবিত্তশ্রেণীই এখন ইংরেজের উত্তরাধিকারী। এ উত্তরাধিকার সূত্রে তারা যে এদেশে শুধু ব্যবসাবাণিজ্য শিল্পের এবং শাসনের অধিকারই লাভ করেছে তাই নয়। এ সূত্রে তারা ইংরেজের ব্যবহৃত বিভেদ সৃষ্টির হাতিয়ারগুলিও যথার্থভাবে ব্যবহার করতে শিখেছে। এজন্যই প্রয়োজনমতো রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশ্রয় নিতে তারা দ্বিধা অথবা কুণ্ঠাবোধ করে না।

একথা যে কোন সাধারণ বালকের পক্ষেও সহজবোধ্য যে পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদেরকে হত্যা করা অথবা তাদের উপর অন্যান্য অত্যাচার করার অর্থ ভারতের সংখ্যালঘু অর্থাৎ মুসলমানদেরকে হত্যা করা এবং তাদের উপর অত্যাচার করার জন্য ভারতীয় হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীদেরকে সুযোগ দেওয়া। আবার ভারতে সংখ্যালঘুদেরকে হত্যা করা অথবা তাদের উপর অন্যান্য অত্যাচার করার অর্থ পাকিস্তানের সংখ্যালঘু অর্থাৎ হিন্দুদেরকে হত্যা করা এবং তাদের উপর অত্যাচার করার জন্য পাকিস্তানী মুসলমান সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের সুযোগ দেওয়া। অর্থাৎ ভারতীয় মুসলমানদের দুঃখে বিগলিত হয়ে যারা পাকিস্তানে সংখ্যালঘুকে বিনাশ করতে চায় তারা ভারতীয় মুসলমানদের শত্রু। এবং পাকিস্তানী হিন্দুদের দুঃখে বিগলিত হয়ে যারা ভারতে সংখ্যালঘুকে বিনাশ করতে চায় বাস্তবতঃ তারা পাকিন্তানী হিন্দুদের শত্রু।

কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় একজন সাধারণ বালকের পক্ষে যা বোধগম্য সে কথা সাম্প্রদায়িক প্রচারণা এবং উন্মত্ততার মধ্যে অনেক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরও বোধগম্য হয় না। সাম্প্রদায়িকতার বাস্তব ভিত্তি স্বাধীনতাপূর্ব যুগের থেকে বর্তমানে অনেক দুর্বলতর হলেও তার মানসিক ভিত্তি এখানে পর্যন্ত পূর্ব প্রভাবে অনেক শক্তিশালী। স্বাধীনতা-উত্তরকালে পাক-ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হিসাব নিলে এ বিষয়ে সন্দেহের আর কোন অবকাশ থাকে না।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মাধ্যমে তাই কোনমতেই ধর্মের গৌরব বর্ধন অথবা হিন্দু মুসলমান সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ভিত্তি দৃঢ়তর হয় না। উপরন্তু এর মধ্যে দিয়ে ধর্মের অবমাননা এবং সংখ্যালঘুদের দুঃখ দুদর্শাকে দীর্ঘস্থায়ী এবং অধিকতর নিদারুণ করার পথই প্রশস্ত হয়। শুধু তাই নয়। সাম্প্রদায়িকতা এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মাধ্যমে ভারত এবং পাকিস্তানের অগণিত অসংখ্য দরিদ্র কৃষক শ্রমিক এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের নিজেরা লাভবান না হয়ে উচ্চ মধ্যবিত্তের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষার্থে কল্পনাতীতভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

পাক-ভারতীয় উপমহাদেশের জীবনে সাম্প্রদায়িকতাকে উচ্ছেদ করতে হলে তার জন্য শুধু ভারত অথবা পাকিস্তানের জনসাধারণের একক প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয়। কারণ এ সমস্যাটি এক হিসাবে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্যানাল জলের সমস্যা অথবা পূর্বপাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ সমস্যার সাথে তুলনীয়। এ সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন দুই দেশের সরকার এবং জনসাধারণের শুভেচ্ছা এবং যৌথ প্রচেষ্টা।

ভারতীয় সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা, বিশেষ করে দাঙ্গা সংগঠনকারীরা, পাকিস্তানী সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের এবং দাঙ্গা সংগঠনকারীদের বন্ধু এবং হিতাকাঙ্ক্ষী। এ দুই দেশের জনসাধারণ যে পর্যন্ত না এই পরম সত্যকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করবে এবং স্ব-স্ব সম্প্রদায়ভুক্ত সাম্প্রদায়িকতাবাদীদেরকে শত্রু হিসাবে গণ্য করে নির্ণয় করবে তাদের নীতি সে পর্যন্ত এ উপমহাদেশে সার্থক এবং ব্যাপক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনের উদ্বোধন হবে না।

***

১. Sir Francis Tuker, While Memory Serves, p. 182

২. Ibid p. 181 – 82

৩. Ibid p. 182

৪. Ibid p. 181

৫. ধন্বন্তরী ও পূরণচন্দ্র যোশী, রক্তক্ষয়ী পাঞ্জাব, পৃ ৪৮-৪৯

৬. ‘All these happenings were extensively (বাঁকা নির্দেশ আমার নিজস্ব – বউ) reported to the Government by the Criminal investigation Department of the Police. These alarming reports, together with the events of the year preceding Independence made it all too clear what was to follow. Yet the Viceroy and Governor of the Punjib paid no attention to them’. Major General Fazal Muqeem Khan SQA, The story of the Pakistan Army. p. 63

৭. Leonard Mosley, The last days of the British Raj. p 245-47 and 261-65 Jaico Publishing House, Bombay.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *