১. সাম্প্রদায়িকতা

প্রথম সংস্করণের মুখবন্ধ

কোনো পাঠক এ বইয়ের মধ্যে যদি নতুন তথ্যের সন্ধান করেন তাহলে তিনি নিরাশ হবেন। কারণ পণ্ডিতজনের সুপরিচিত তথ্যসমূহের গণ্ডীর মধ্যেই এ আলোচনা ও বিশ্লেষণ বিশেষভাবে সীমাবদ্ধ।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক আবহাওয়াকে সাম্প্রদায়িকতাই সব থেকে বেশি দূষিত এবং বিষাক্ত করেছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার এই ভূমিকা আজ পর্যন্ত জনসাধারণ বিশেষ করে রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী জনসাধারণ, সম্যকভাবে উপলব্ধি করেননি। এই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাটির চরিত্র এবং ভূমিকাকে উপলব্ধির অভাবের প্রধান কারণ সাধারণ মানুষের চিন্তায় কতকগুলি সংস্কারের প্রভাব। এ সংস্কারগুলি আমাদের মনে রাজ্যবিস্তার করে আমাদের বিশ্লেষণবিমুখতার জন্য। বৃহত্তর সমাজের মধ্যে যে সকল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য শক্তি কার্যকরী তাদের বিশ্লেষণ এবং গুরুত্বনির্দেশ করতে সক্ষম হলে শুধু সাম্প্রদায়িক সংস্কার নয়, অন্যান্য বহু সংস্কারের রাজ্যও বিলুপ্ত হয়। আমাদের দেশে অনেক লোকের ধারণা সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিষ্ঠার মধ্যে যোগাযোগ খুব ঘনিষ্ঠ। সাম্প্রদায়িকতার চরিত্রকে বিশ্লেষণ করলে এ ধারণা যে বিভ্রান্তিমূলক সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। শুধু তাই নয়। এ বিভ্রান্তি যে বহুলাংশে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির উৎপত্তি সেটাও যথাযথভাবে প্রমাণিত হয়।

সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে পাক ভারতীয় উপমহাদেশের অগণিত বিশ্বাসপ্রবণ, সৎ এবং দরিদ্র মানুষ শ্রেণীস্বার্থ উদ্ধারের কাজে কি জঘন্যভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং হচ্ছে সে কথা জনসাধারণ যদি উপযুক্তভাবে উপলব্ধি করেন তাহলে এদেশের রাজনীতি অনেকখানি সুস্থপথে চালিত হওয়ার সম্ভাবনা। এ ব্যাপারে এ বইখানি যদি সামান্য কাজে লাগে তাহলেই নিজেকে পুরস্কৃত এবং কৃতার্থ বোধ করব।

এখানকার প্রবন্ধগুলির মধ্যে কয়েকটি ইতিপূর্বে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত পূর্বমেঘ এবং ঢাকা থেকে প্রকাশিত জনতায় ছাপা হয়েছে। এগুলি লেখার সময় যাঁদের সাথে আলাপ- আলোচনা করে বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছি তাঁদের মধ্যে আমার পিতা জনাব আবুল হাশিম অন্যতম। তিনি নিজে সক্রিয়ভাবে মুসলিম লীগ রাজনীতির সাথে বহুদিন জড়িত আছেন। কাজেই তাঁর সাথে আলোচনায় মুসলিম লীগের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে পরিচয় লাভের যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছি। এছাড়া অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন, অধ্যাপক কাজী আবদুল মান্নান, অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, পরলোকগত অধ্যাপক মাহফুজুল হক, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, জনাব কমরুদ্দীন আহমদ এবং জনাব জহুর হোসেন চৌধুরীর সাথে আলোচনা করেও বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছি। এ বইয়ে যে সকল মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব অবশ্য আমার নিজের।

জনাব জিয়াউল হক এবং মিসেস হামিদা হোসেনের কাছ থেকেও নানাভাবে সাহায্য পেয়েছি। প্রবন্ধগুলির প্রেস কপি তৈরি করেছেন আমার স্ত্রী সুরাইয়া হানম।

বদরুদ্দীন উমর
এপ্রিল ১৯৬৬

দ্বিতীয় সংস্করণের মুখবন্ধ

১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসে সাম্প্রদায়িকতার প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। তারপর চার বছর কেটে গেছে। প্রথম সংস্করণ বেশ কিছুদিন পূর্বেই শেষ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বিশেষ কতকগুলো কারণে পরবর্তী সংস্করণ বের হতে অনেক দেরী হয়ে গেল।

এই সংস্করণে ‘ভারতবর্ষে বৃটিশের ক্ষমতা দখল ও হস্তান্তর’ নামে একটি প্রবন্ধ সংযোজিত হলো। এ ছাড়া ‘একটি সাম্প্রদায়িক সমালোচনার জবাবে’ নামে পূর্ব প্রকাশিত একটি লেখাও এতে ছাপা হলো।

সাম্প্রদায়িকতার প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট অনেক প্রশ্নের অবতারণা এবং বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এই সব প্রশ্ন ও বিতর্ক সম্পর্কে সংস্কৃতির সংকট ও সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা নামে পরবর্তী দুটি বইয়ে মোটামুটিভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

বদরুদ্দীন উমর
তারিখ ১৯৬৯

চতুর্থ সংস্করণের মুখবন্ধ

ঢাকা থেকে প্রকাশিত তৃতীয় সংস্করণ নিঃশেষিত হওয়ার বেশ কিছুদিন পর সাম্প্রদায়িকতার চতুর্থ সংস্করণ এখন প্রকাশিত হচ্ছে। ‘আত্মনিয়ন্ত্রণ ও গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ’ নামে পূর্ববর্তী সংস্করণগুলির প্রথম প্রবন্ধটি এই সংস্করণ থেকে বাদ দেওয়া হলো। এ ছাড়া অন্য কোনো পরিবর্তন এই সংস্করণে করা হলো না।

বাঙলাদেশ উত্তর পর্যায়ের সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ ইতিপূর্বে আমার Politics and Society in East Pakistan and Bangladesh যুদ্ধোত্তর বাঙলাদেশ এবং ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ নামক বইগুলিতে প্রকাশিত হয়েছে। সেজন্য এই পর্যায়ে সাম্প্রদায়িকতার ওপর কোন পৃথক আলোচনা এই নতুন সংস্করণে করার কোন প্রয়োজনীয়তা বোধ করলাম না।

বইটির নতুন সংস্করণ প্রকাশের দায়িত্ব গ্রহণ করায় শ্রীচিত্তরঞ্জন সাহার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

বদরুদ্দীন উমর
ঢাকা
৬ই জুন, ১৯৮০

ষষ্ঠ সংস্করণের মুখবন্ধ

সাম্প্রদায়িকতা আমার প্রথম বই। প্রবন্ধ সংকলন হিসেবে ১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসে প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর আজ পর্যন্ত এ বইটির অনেকগুলি সংস্করণ ঢাকা এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এখনও বইটির প্রতি পাঠকদের আগ্রহ যথেষ্ট।

মনে হয়, এই আগ্রহের একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা রাজনীতির একটি প্রভাশালী দিক হিসেবে এখনও কার্যকর আছে। সাম্প্রদায়িকতার প্রভাবে এ অঞ্চলের রাজনীতি ও সেই সাথে সাধারণ জীবন নানাভাবে বিপর্যন্ত হচ্ছে।

সাম্প্রদায়িকতা হলো, রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহারের একটি বিশেষ রূপ। ঊনিশ শতকের শেষ দিকে ভারতবর্ষে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের প্রধান রূপ হিসেবে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভবের পর থেকে ক্রমাগত তাঁর প্রভাব বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৪৭ সালে তা পরিণত হয়েছিলো এক নির্ধারক রাজনৈতিক শক্তিতে। এর ফলে ব্রিটিশ ভারত বিভক্ত হয়ে গঠিত হয়েছিলো ভারত ও পাকিস্তান নামে দুই পৃথক রাষ্ট্র।

১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হলেও তার ফলে এই অঞ্চলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সমস্যা ও সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হয়নি এবং সেই সাথে ধর্মের অন্যান্য ধরনের রাজনৈতিক ব্যবহারও নতুনভাবে দেখা দিয়েছে।

১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন স্বাধীনতা যুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করে এবং শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান দ্বিধাবিভক্ত হয়ে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের। এই নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রে প্রথম দিকে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার এবং বিশেষভাবে সাম্প্রদায়িকতার অনুপস্থিতি থাকলেও অতি অল্প দিনের মধ্যেই এখানকার বুর্জোয়া শোষক শাসক শ্রেণী ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। এই উপলব্ধি থেকেই তারা ১৯৭১ সালের রাজাকার আলবদরদের যে অংশ জেলে আটক ছিলো, যাদের বিরুদ্ধে খুন, জখম, ধর্ষণ, রাহাজানি ইত্যাদির মামলা ছিলো, তাদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে দেশ গড়ার কাজে অংশগ্রহণের জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানায়। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান হিসেবে তারা মিলাদ ইত্যাদির আয়োজন করে, মাদ্রাসা শিক্ষা বহাল রাখা ও তার জন্য বর্ধিত ব্যয় বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেয়।

প্রাথমিক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ আমলে এই সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর বাঙলাদেশে ধর্মীয় ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল নতুনভাবে গঠিত ও সক্রিয় হওয়ার পথ প্রশস্ত হয় এবং জিয়াউর রহমানের সময়ে জামাতে ইসলামীসহ বিভিন্ন ধর্মীয় রাজনৈতিক দল আবার তৎপর হতে শুরু করে। তাদের এই তৎপরতা এরশাদের সামরিক শাসন আমল এবং বর্তমানে নির্বাচিত “গণতান্ত্রিক” সরকারের আমলে এত বৃদ্ধি পেয়েছে যা পাকিস্তান আমলেও দেখা যায়নি। জামাতে ইসলামী একটি ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনৈতিক দল হলেও বাবরী মসজিদ ধ্বংসের পর বাঙলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা বিস্তারের ক্ষেত্রে যে সুযোগ উপস্থিত হয় সে সুযোগের যথেষ্ট ব্যবহার তারা করে। এক্ষেত্রে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার করতে গিয়ে তারা ভারত বিরোধী প্রচারণার আশ্রয়ই বেশি করে গ্রহণ করে। জামাতে ইসলামীর অন্যান্য সহযোগী ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক দল এবং গোষ্ঠীও বাবরী মসজিদের ঘটনার সুযোগ নিয়ে সাম্প্রদায়িক প্রচারণায় অংশগ্রহণ করে।

বাঙলাদেশে ১৯৭১ সালের পর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কোনো বাস্তব ভিত্তি না থাকলেও একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে সাম্প্রদায়িকতা এ দেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে থাকার কারণে, বিশেষতঃ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এখনো শক্তিশালী থাকায় বাঙলাদেশকে সম্পূর্ণভাবে সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত রাখা বাস্তবতঃ সম্ভব নয়। এ কারণে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার যারা করে তাদের মধ্যে ক্ষেত্রবিশেষে, সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী, সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা দেখা যায়। মূলতঃ একটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল না হলেও এ জন্যেই জামাতে ইসলামী প্রয়োজনে সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নেওয়া থেকে বিরত থাকে না।

সাম্প্রদায়িকতা নামক এ বইটিতে মূলতঃ সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে আলোচনা করা হলেও সাধারণভাবে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার এবং বিশেষভাবে ভারতীয় উপমহাদেশ নামে পরিচিত দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলে ধর্মীয় রাজনৈতিক বিস্তারের বাস্তব কারণগুলিও সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে। এ কারণে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের বিরোধিতার ক্ষেত্রেও এই সংস্করণটিতে অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলি এখনও খুব প্রাসঙ্গিক।

সাম্প্রদায়িকতা এখন আবার মাওলা ব্রাদার্স থেকে নোতুনভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। এর জন্য মাওলা ব্রাদার্স এবং আহমেদ মাহমুদুল হককে ধন্যবাদ।

বদরুদ্দীন উমর
ঢাকা
৩০.০১.১৯৯৪

সাম্প্রদায়িকতা

ধর্ম এবং সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে যোগসম্পর্ক থাকলেও সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিষ্ঠা স্বতন্ত্র জিনিস। শুধু তাই নয়। সাম্প্রদায়িকতা এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে স্বতন্ত্রভাবে না দেখলে তার স্বরূপকে ঠিক বোঝা যাবে না। ধর্মের আচার-বিচার এবং তত্ত্বের প্রতি নিষ্ঠা থাকলে তাকে আমরা বলি ধর্মনিষ্ঠা। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা পৃথক জিনিস। কোন ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেওয়া হয় যখন সে এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য এক ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধাচরণ এবং ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত থাকে। এক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিবিশেষের ক্ষতিসাধন করার মানসিক প্রস্তুতি সেই ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ পরিচয় অথবা বিরুদ্ধতা থেকে সৃষ্ট নয়। ব্যক্তিবিশেষ এক্ষেত্রে গৌণ, মুখ্য হলো সম্প্রদায়।

ধর্মনিষ্ঠার সাথে সম্পর্ক আছে ধর্মীয় তত্ত্ব এবং আচার-বিচারের। সাম্প্রদায়িকতার যোগ হচ্ছে সম্প্রদায়ের সাথে। অর্থাৎ ধর্মনিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজের আচরণ এবং ধর্মবিশ্বাসের গুরুত্ব বেশি। সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে নিজের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ এক জাতীয় আনুগত্যের গুরুত্ব বেশি। এছাড়া সত্যিকার ধর্মনিষ্ঠা পরকালমুখী। পরকালেই তার সত্যকার পুরস্কারের আশা। সাম্প্রদায়িকতার মুনাফা ইহলোকে। ধর্মনিষ্ঠার জন্য অন্যের বিরুদ্ধাচরণের প্রয়োজন নেই। অন্যের বিরুদ্ধাচরণ এবং ক্ষতিসাধনের মধ্যেই সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ এবং পরিণতি। ধর্মের সাথে তাই সাম্প্রদায়িকতার কোন প্রয়োজনীয় তত্ত্বগত সম্পর্ক নেই। ধর্মীয় তত্ত্ব এবং আচার-আচরণকে ভিত্তি করে যে সমাজ ও সম্প্রদায় গঠিত হয় সেই সম্প্রদায়ের ঐহিক স্বার্থই সাম্প্রদায়িকতার জনক। সাম্প্রদায়িকতার জন্য তাই ধর্মে নিষ্ঠাবান হওয়ার প্রয়োজন নেই। সাম্প্রদায়িকতা এ অর্থে পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ।

ধর্মনিষ্ঠা এবং সাম্প্রদায়িকতার এই প্রভেদ সত্ত্বেও অনেকের ধারণায় তারা অবিচ্ছেদ্য। এ ধারণাকে একটি সংস্কার হিসাবে গণ্য করা চলে। কিন্তু এ সমস্যার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে এর থেকে একদিকে বিকৃত সামাজিক চিন্তা এবং অন্যদিকে সক্রিয় রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির উৎপত্তি। মুসলমান অথবা হিন্দুর সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখতে সমর্থ হওয়ার অক্ষমতা আমাদের দেশের লোকের পক্ষে স্বাভাবিক মনে হয়। কারণ চিন্তার এ বিকৃতি আমাদের মধ্যে এসেছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারণে। এ বিকৃতি আমাদের মানসিকতাকে এমনভাবে গঠন করেছে যে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দেশবাসীকে আমরা ধনী- দরিদ্র, শাসক-শোষিত, উৎপীড়ক-উৎপীড়িত মানবসন্তান হিসাবে না দেখে তাকে দেখতে শিখেছি এক এক ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্ত জীবজন্তু হিসাবে। এ বিকৃতির ফলে তাই আমাদের সামজে সুস্থ শ্রেণী চেতনা থেকে অসুস্থ সম্প্রদায় চেতনা অনেক বেশি প্রবল। এ জন্যেই তাই আমাদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবন ও চিন্তা এত পশ্চাদপদ এবং অনগ্রসর।

আমাদের দেশে হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় এবং সামাজিক চিন্তার ব্যবধান অনেক। এই ব্যবধানের ফলে এ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক পর্যায়ে যে পরিমাণ লেনদেন হওয়ার কথা কোন দিনই তা হয়নি। সামাজিক লেনদেন এবং বিবেচনাই ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্য, প্রীতি এবং মিলন সংস্থাপনের অন্যতম পথ। সে পথ বিভিন্ন কারণে সন্তোষজনকভাবে উন্মুক্ত না থাকাই অন্যতম কারণ যার জন্য ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলমান শত শত বছর পাশাপাশি থাকা সত্ত্বেও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি। হিন্দু মুসলমানের এ ব্যবধান জনসাধারণের ক্ষেত্রে গোড়াতেই সক্রিয় বিরোধে পরিণত না হলেও ইংরেজদের আবির্ভাবের পূর্বেই পার্থক্যের একটা অস্বাস্থ্যকর চেতনা উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই বর্তমান ছিল। এই ভেদজ্ঞানকে তাই পুরোপুরি ইংরেজদের সৃষ্ট বলা চলে না। ইংরেজরা অবশ্য এই চেতনাকে সুযোগ মতো তীব্রতর করে উভয় পক্ষেরই মনুষ্যত্বকে বহুলাংশে খর্ব করেছে। শুধু তাই নয়। হিন্দু মুসলমানের ধর্মীয় এবং সামাজিক ব্যবধানকে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী প্রয়োজনে সক্রিয় প্রচেষ্টায় তারা পরিণত করেছে রাজনৈতিক বিরোধে। এ পরিণতির নামই সাম্প্রদায়িকতা।

বৃহত্তর ভারতীয় জীবনক্ষেত্রে ইংরেজদের আগমন যে গতি এবং চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলো তার ফলে অনেক পুরাতন সমস্যা নিশ্চিহ্ন হল এবং উদ্ভব হল অনেক নতুন সমস্যার। ইংরেজদের আগে ভারতবর্ষ বহুবার পরাভূত হয়েছে বৈদেশিক শক্তির কাছে। ধর্ম, জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে তারা এসেছে। তাদের এ আগমনে সমাজের উপরতলায় রাজরাজেশ্বরেরা পেয়েছে আঘাত কিন্তু ভারতবর্ষের বৃহত্তর জীবনকে তারা স্পর্শ করেনি। হাজার হাজার বছর ধরে ভারতীয় জীবন যে খাতে প্রবাহিত হয়েছে ইংরেজদের পূর্বে অন্য কোন বিদেশীর আবির্ভাব তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন আনেনি।

ইংরেজ-পূর্ব যুগে ভারতে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামসমূহই ছিল তার সমাজ ও আর্থিক জীবনের প্রাণকেন্দ্র। এ গ্রামগুলি ছিল দ্বীপসদৃশ এবং সারা ভারতবর্ষ ছিল বিশাল এক দ্বীপপুঞ্জ। অন্ন-বস্ত্র এবং জীবনের যাবতীয় আয়োজনের দিক থেকে গ্রাম বহির্ভূত কোন কিছুর প্রতি তাদের বিশেষ কোনো নির্ভরতা ছিল না। প্রয়োজন তাদের ছিল অতি পরিমিত এবং ব্যাপক বিনিময় ব্যবস্থার পরিবর্তে যৌথ গ্রাম্য প্রচেষ্টায় তারা সে প্রয়োজন পরিতৃপ্ত করতে সক্ষম ছিল। ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় অল্পবিস্তর পার্থক্য থাকলেও এই ছিল তখন সারা দেশের বৃহত্তর অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিক জীবনের ভিত্তিতে তাদের যে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবন তারও মধ্যে ছিল সেই সনাতন স্বয়ংসম্পূর্ণতা। ভারতের সাধারণ গ্রাম্য জীবনযাত্রার মধ্যে বিপুল সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও গ্রামসমূহের মধ্যে কোন বিশেষ পারস্পরিক প্রয়োজনগত যোগাযোগ ছিল না। এই আত্মনির্ভরশীলতাই ভারতীয় জীবনযাত্রার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং এই বৈশিষ্ট্যের মাহাত্ম্যেই রাজ্য সাম্রাজ্যের উত্থান পতনকে অগ্রাহ্য করে প্রাচীন জীবনব্যবস্থা ভারতবর্ষে নিজেকে রেখেছিল অব্যাহত।

ইংরেজদের আগমনে সে জীবনযাত্রা ব্যাহত হল। একদিনে নয়, ধীরে ধীরে এ পরিবর্তন এল প্রায় দুই শতাব্দী ধরে। এই দুই শতাব্দীর ইংরেজ রাজত্বের পর ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের ভিত্তি প্রায় আমূলভাবে পরিবর্তিত হলো। সংখ্যাতীত বিচ্ছিন্ন গ্রামসমূহ নিয়ে গঠিত ছিল যে ভারতবর্ষ সেই উপমহাদেশে বিকশিত হলো জাতীয় চেতনা, গঠিত হলো জাতীয় আন্দোলন। এ পরিবর্তন ভারতবর্ষের পক্ষে নিঃসন্দেহে কল্যাণকর। কিন্তু তবু জাতীয়তার উত্থান এদেশে কতকগুলি বিশেষ বিশেষ অবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার ফলে আমাদের জাতীয় জীবনে সৃষ্টি হল কিছু জটিলতা। এ জটিলতার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতাই সর্বপ্রধান। সাম্প্রদায়িক সমস্যাকে তাই তার যথার্থ পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে হলে ভারতবর্ষে জাতীয়তার উত্থান ও বিকাশের বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা প্রয়োজন।

ইংরেজদের পূর্বে অন্যান্য দেশীয় এবং বৈদেশিক রাজচক্রবর্তীদের সাথে ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের সম্পর্ক ছিল রাজস্ব লেনদেনের। রাজা এবং রাজবংশের পতন উত্থানের অর্থ তাদের কাছে তাই ছিল রাজস্বগ্রহীতার পরিবর্তন মাত্র। কিন্তু ইংরেজদের আগমনে শাসক-শাসিতের সম্পর্ক শুধু রাজস্ব লেনদেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল না। তারা ভারতবর্ষে শুধু নতুন সাম্রাজ্যের পত্তন করে নতুন রাজবংশ আমদানী করেই ক্ষান্ত হল না—তারা সাথে নিয়ে এলো নতুন জীবন ব্যবস্থা, জনসাধারণের জীবনে স্থাপন করলো আর্থিক যোগাযোগ। নিজেদের পণ্যদ্রব্য ভারতবর্ষের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে দিয়ে ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জকে তারা পরিণত করলো ভারতীয় মহাদেশে। অশোক-আকবরের সুদূর বিস্তৃত সাম্রাজ্য ভারতবর্ষের যে ঐক্য এবং অখণ্ডতা এনেছিল সে ঐক্য ছিল বাহ্যিক শাসনের। ইংরেজ তার পণ্যদ্রব্যের মাধ্যমে এ দেশে যে ঐক্যের সূচনা করলো সে ঐক্য শাসনের যেটুকু তার থেকে অনেক বেশি জীবনযাত্রার।

ইংরেজ-পূর্ব যুগে ভারতবর্ষে শ্রমবিভাগ ছিল জন্ম-নির্ভর। ইংরেজরা এদেশে ধনতন্ত্রের বীজ বপন করে শ্রমবিভাগকে করলো জন্ম নিরপেক্ষ। ভারতবর্ষের আর্থিক এবং সামাজিক জীবনে আজ পর্যন্ত এই হল সব থেকে বড় বিপ্লব। এই বিপ্লবই এদেশে বিচ্ছিন্ন জীবনপ্রবাহকে ধীরে ধীরে করলো নিরবচ্ছিন্ন। সামাজিক অচলাবস্থার অবসানে শুরু হল চলাচলের বিপুল ব্যবস্থা।

ইংরেজরা ভারতবর্ষের জীবনযাত্রার যে নতুন আয়োজন করল তাতে জাতি-ধর্ম- নির্বিশেষে সকলে কিন্তু সমানভাবে এগিয়ে এল না। নতুন সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠায় মুসলমানদের প্রভাব- প্রতিপত্তি আগের তুলনায় খর্বই হল অনেকখানি। ইংরেজরাও তাদের পূর্ববর্তী হিসাবে পুরাতন হিন্দু এবং বিশেষ মুসলমান আমীর ওমরাহ এবং রাজন্যবর্গকে সুনজরে দেখল না। উপরতলার মুসলমান সমাজে তাই দেখা দিল ক্ষয়িষ্ণুতার লক্ষণ। সে ক্ষয়িষ্ণুতা তাদের অনেকখানি নিজেদের দোষে হল আরও ত্বরান্বিত এবং দীর্ঘস্থায়ী। সেই সাথে মুসলমানদের বিরাট এক অংশ মোগল এবং মুসলমান সাম্রাজ্যের পতনকে তাদের নিজেদের পতন বলে গণ্য করে নিজেদেরকে করলো একঘরে।

অন্যদিকে ভারতের অমুসলমান জনসাধারণ জীবনের যোগাযোগ এবং চলাচলের এ নতুন আয়োজনে যোগ দিল বিপুল উৎসাহে। মোগল সাম্রাজ্যের পতনকে নিজেদের পতন বলে ভুল করার কারণ তাদের ছিল না। উপরন্তু সে পতনের মধ্যেই তারা দেখল নিজেদের উত্থানের সুস্পষ্ট নির্দেশ। এ নির্দেশ শিরোধার্য করে তারা অবতীর্ণ হল নতুন জীবন সংগ্রামে। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, শিক্ষা-দীক্ষা এবং জীবনের বিভিন্ন ও বিস্তীর্ণ কর্মক্ষেত্রে তারা নিজেদেরকে এক শতাব্দী ধরে করল সুপ্রতিষ্ঠিত।

এর পর এল সিপাহী বিদ্রোহ। বিদ্রোহের অবসানে মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যে এল এগিয়ে চলার তাগিদ। এই সর্বপ্রথম তাদের মধ্যে অনুভূত হল ইংরেজদের সাথে সহযোগিতার প্রয়োজন। ইংরেজরাও মন থেকে অপসারণ করল তাদের দ্বিধা এবং সন্দেহ। দুই পক্ষই প্রস্তুত হলো সহযোগিতার আয়োজনে।

এদিকে হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজ নিজেকে ঐশ্বর্য্য, প্রতিপত্তি, শিক্ষাদীক্ষায় অনেকখানি প্রতিষ্ঠিত করার পর তার মধ্যে সহযোগিতার উদ্দীপনা সিপাহী বিদ্রোহের পর অনেকখানি কমে এল। মুসলমানদের পিছনে রেখে তারা অনেকখানি এগিয়ে এল ইতিমধ্যে। ইংরেজদের সাথে পুরোপুরি সহযোগিতার পালা শেষ করে শুরু হলো এবার তাদের রেষারেষির পালা-এ রেষারেষির থেকেই জন্ম নিল জাতীয় চেতনা। এ রেষারেষিই গঠন করলো জাতীয় আন্দোলন, যে আন্দোলনের গোড়াপত্তন ১৮৮৫ খৃস্টাব্দে।

হিন্দুদের এই অগ্রসর পদক্ষেপ এবং মুসলমানদের পশ্চাদমুখীনতাই রচনা করল সাম্প্রদায়িকতার অর্থনৈতিক বুনিয়াদ। জাতীয় আন্দোলনের ক্ষেত্রে কোনো সময়েই সারা দেশ সমানভাবে অগ্রবর্তী হয় না। আয় এবং সম্পদও সকলের সমান থাকে না। প্রত্যেক দেশেই এক শ্রেণী অগ্রসর এবং অন্য এক শ্রেণী পশ্চাদপদ থাকে। জাতীয়তার ক্ষেত্রে জনসাধারণের এই অসমান উন্নতি কোন বাধা সৃষ্টি করে না। সেদিক থেকে ভারতবর্ষের সমাজ জীবনে কোন বৈশিষ্ট্য নেই। কিন্তু তবু বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে ছিল। কারণ সাধারণভাবে দেশের মধ্যে যারা অগ্রসর তারা হল হিন্দু এবং মুসলমানরা হল সাধারণভাবে পশ্চাদপদ। ভারতবর্ষে শ্রেণী বিভাগের বৃহত্তর কাঠামোর মধ্যে এইভাবে দেখা দিল সাম্প্রদায়বিভাগ। অন্যান্য দেশের মত তাই ভারতেও জাতীয় আন্দোলন মোটামুটি মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক হলেও সে মধ্যবিত্ত দ্বিধাবিভক্ত হল দুই সম্প্রদায়ে।

আধুনিক হিন্দু মধ্যবিত্তের উত্থানের মুহূর্তে অন্য কারো সাথে তার কোনো রেষারেষি ছিল না। ইংরেজ ছিল তার বহু ঊর্ধ্বে। মুসলমান তার থেকে ছিল অনেক পশ্চাতে। এক শতাব্দী ধরে তাদের প্রগতি তাই থাকল অব্যাহত। কিন্তু মুসলমানদের ক্ষেত্রে ঠিক তেমনি ঘটল না। ইংরেজদের সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে মুসলমান মধ্যবিত্তের উত্থান পদে পদে বাধাপ্রাপ্ত হলো হিন্দু মধ্যবিত্তের দ্বারা। শুরু হলো তাদের প্রতিযোগিতার পালা।

এর পর থেকে হিন্দু এবং মুসলমানের সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন এই প্রতিযোগিতার দ্বারাই মোটামুটিভাবে নিয়ন্ত্রিত হল। ইংরেজদের কাছে হিন্দু সমাজ প্রথম দিকে ছিল সহযোগিতা-প্রার্থী। কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের পর হিন্দু সমাজের এক অংশ হল ইংরেজ বিরোধী। মুসলমান সমাজ এক শতাব্দী ধরে আত্মাভিমানে নিজেকে রেখেছিল বিচ্ছিন্ন করে। কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের পর তারা আবার এগিয়ে এল ইংরেজদের সাথে সহযোগিতা করতে। ভারতবর্ষে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জাতীয় আন্দোলনের সূচনায় হিন্দু মুসলমানের এই স্বার্থগত সংঘর্ষকে ইংরেজরা উপেক্ষা করল না। উপরন্তু নিজেদের সাম্রাজ্যের প্রয়োজনে এই বিভেদকে স্বীকৃতি দিয়ে অনেক কৌশলে একে অন্যের বিরুদ্ধে তারা স্থাপন করল। এ ভেদনীতির মুনাফা নিয়ে ইংরেজের হিসাবে কোন ভুল ছিল না। ভারতীয় সমাজজীবনে সিপাহী বিদ্রোহের পর যে সাম্প্রদায়-চেতনা দেখা দিল সে চেতনা জাতীয় চেতনার মধ্যে সৃষ্টি করল অনেক বিভ্রান্তি। সুযোগ সুবিধা হিসাব নিকাশের রণক্ষেত্রে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সাথে অবতীর্ণ হল দুই ভারতবর্ষ।

পশ্চাদপদ মুসলিম সম্প্রদায় হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য এবং চাকরি ক্ষেত্রে সরাসরি প্রতিযোগিতায় দ্রুত উন্নতির ভরসা পেল না। ইংরেজদের কাছে তারা দাবি করল বিশেষ সুবিধা। ১৯০৬ সালে আগা খাঁর নেতৃত্বে লর্ড মিন্টোর কাছে তারা পেশ করল তাদের এই প্রার্থনা। গভর্নর জেনারেল তাদেরকে নিরাশ করলেন না। এমন কি নতুন শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনে মুসলমান হিন্দুর পৃথক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা পর্যন্ত মঞ্জুর করার ভরসা তিনি দিলেন। এ ভরসা শুধু মৌখিক ছিল না। ১৯০৯ সালের শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনে ভারতে প্রচলিত হল সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচন। এর পর থেকে ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনে হিন্দু মুসলমান মিলিত সংগ্রামের আর সুযোগ পেল না। লক্ষ্ণৌ চুক্তি এবং খেলাফত আন্দোলনের সমঝোতা হল নিতান্তই সংক্ষিপ্ত।

পৃথক নির্বাচনই ইংরেজদের ভেদবুদ্ধির সব থেকে নিদারুণ অস্ত্র। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে হিন্দু মুসলমানের পার্থক্য মিলিত রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অনেকখানি নিশ্চিহ্ন হওয়ার যে সম্ভাবনা ছিল পৃথক নির্বাচন তাকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করল। ভারতবর্ষে জাতীয় আন্দোলন পরিচালিত হল সংকীর্ণ শাসনতান্ত্রিক পথে এবং পৃথক নির্বাচনের মহিমায় হিন্দু মুসলমানের এক পথ ধরে চলার পথ হল বন্ধ।

শাসনতান্ত্রিক পথে মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে অগ্রসর না হয়ে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন যদি বৃহত্তর বিপ্লবের পথে চালিত হতো তাহলে পৃথক নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়াকে এতখানি বিষাক্ত করতে সমর্থ হতো না। কিন্তু কংগ্রেস অথবা মুসলিম লীগের নেতারা সকলেই মোটামুটি মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি। শাসনতন্ত্রের সরল পথ ত্যাগ করে অন্য পথ ধরার কোনো সামর্থ্য তাঁদের ছিল না। কাজেই ভারতীয় আন্দোলন ভারতবর্ষে জোরদার হল শাসনতান্ত্রিক পথে এবং সেই সাথে মধ্যবিত্ত হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক স্বার্থ ব্যস্ত হল পরস্পরকে খর্ব করতে।

১০

কংগ্রেস হিন্দু মুসলমানের মিলিত সংগঠন হিসাবে গঠিত হলেও শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের নেতৃত্ব গেল মুসলিম লীগের হাতে। শুধু তাই নয়, কংগ্রেসের মধ্যে যে সমস্ত খ্যাতিমান মুসলমান নেতৃস্থানে ছিলেন তাঁদের অধিকাংশ একে একে এলেন মুসলিম লীগে। নেতৃত্ব দিলেন এই প্রতিষ্ঠানকে। এদিকে কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী অসাম্প্রদায়িক নেতৃত্বের মধ্যেও ফাটল ধরলো। কিছু সংখ্যক কংগ্রেস সদস্য সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে থাকলেও কংগ্রেসের পূর্বতন চরিত্র অনেকখানি পরিবর্তিত হলো। তার মধ্যও ঊনিশশো তিরিশের দিকে সাম্প্রদায়িকতা এবং প্রতিক্রিয়াশীলতা বিশেষভাবে হলো চিহ্নিত।

পৃথক নির্বাচনের ফলে নির্বাচনে হারজিতের ক্ষেত্রে সংগঠন নিরপেক্ষভাবে হিন্দু হিন্দুর উপর এবং মুসলমান মুসলমানের উপর হলো নির্ভরশীল। এর ফলে শুধু নির্বাচনী প্রতিযোগীতায় নয়, নির্বাচনোত্তর রাজনৈতিক আবহাওয়ার মধ্যেও সাম্প্রদায়িকতা রইলো অহরহ জাগ্ৰত। ভারতের বৃহত্তর অর্থনৈতিক জীবনে শ্রেণী সংঘাতের সত্যকার রূপ এইভাবে আচ্ছন্ন হলো সাম্প্রদায়িকতার দ্বারা।

১১

পৃথক নির্বাচন প্রথা চালু হওয়ার পর হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায় স্ব স্ব নির্বাচকমণ্ডলীর উপরই হলো ক্ষমতার রাজনীতিতে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। এর ফলে মধ্যবিত্ত হিন্দু মুসলমানের সুবিধাবাদিত্বের পথ হলো আরও পরিষ্কৃত। তারা নিজ নিজ সম্প্রদায়ের এবং দেশের বৃহত্তর স্বার্থকে উপেক্ষা করে অন্য সম্প্রদায়ের নেতিবাচক মনোভাবকে সাধারণের মধ্যে প্রবলতর করে ভারতের হিন্দু মুসলমান মধ্যবিত্ত স্থগিত রাখলো বৃহত্তর গণবিপ্লব।

শুধু তাই নয়। এর ফলে ভারতীয় আন্দোলনের চরিত্রও পরিবর্তিত হলো। জাতীয় আন্দোলন হিসাবে বৃটিশ সাম্রাজ্যের কাঠামোর মধ্যে তার একটা প্রগতিশীল ভূমিকা থাকলেও সাম্প্রদায়িক প্রভাবে সে আন্দোলন একটা প্রতিক্রিয়াশীল আকার ধারণ করলো। সাম্প্রদায়িক নির্বাচকমণ্ডলীকে কোন সুস্থ চিন্তার অবকাশ না দেওয়ার জন্য উভয় সম্প্রদায়ের বিরোধ এবং পার্থক্যের উপরই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্ব পড়লো বেশী। এই বিরোধ-পার্থক্যকে বিলোপের চেষ্টা না করে তারা অনেক ক্ষেত্রে শান্তিপ্রিয় মানুষকে ইচ্ছাকৃতভাবে চালনা করলো দাঙ্গার পথে। এর পর উপমহাদেশের রাজনৈতিক সংগ্রামে দাঙ্গাই হয়ে দাঁড়ালো উভয় পক্ষের এক নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার। হিন্দু মুসলমান এবং বিশেষ করে ইংরেজ এ হাতিয়ারকে করলো ইচ্ছে মতো ব্যবহার।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা এবং খুনজখমের মাধ্যমে পারস্পরিক বিরোধ ক্রমশঃ তীব্রতর হলো এবং ঊনিশমো চল্লিশের দিকে মিলিত জাতীয় আন্দোলনের কোন পথ আর খোলা রইলো না। ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলমান জনসাধারণ, এমনকি কংগ্রেস লীগের নেতারাও, মাত্র কয়েক বৎসর আগেও যে পরিণতির কথা চিন্তা করেননি তাই ঘটলো। লাহোর প্রস্তাব পাশ হলো ১৯৪০ সালে এবং তার মাত্র সাত বৎসর পরই ভারতবর্ষ হলো দ্বিধাবিভক্ত। ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনে সাম্প্রদায়িক সমস্যার একমাত্র সম্ভাব্য সমাধান হিসাবে ভারতবর্ষে স্থাপিত হলো দুই রাজ্য।[১] কিন্তু যে তিক্ততা এবং বিরোধের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত কার্যকরী হলো তাতে মূল সমস্যার কোন সমাধান হলো না। উপরন্তু সাম্প্রদায়িকতা নবজীবন লাভ করলো উভয় রাজ্যের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ক্ষেত্রে।

১২

ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস অনুসরণ করলে দেখা যায় যে মুসলমানরা ভারতে পদার্পণ করার ঠিক পরবর্তী যুগে সাধারণ হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় বিষয় ছাড়া অন্যান্য যে তফাৎ ছিল সেটা নিতান্তই সামাজিক। মুসলমানরা কয়েক শতাব্দীকাল এদেশে হিন্দুদের সাথে বসবাস করলেও সাধারণ হিন্দু মসলমানের পার্থক্য সামাজিক গণ্ডীর মধ্যেই প্ৰায় সীমাবদ্ধ ছিল। এর প্রধান কারণ ইংরেজরা আসার পূর্বে ভারতবর্ষের সমাজ জীবনে এমন কোন মৌলিক পরিবর্তন আসেনি যে পরিবর্তন জনগণের জীবনে রেষারেষি এবং প্রতিযোগীতা সৃষ্টি করতে সক্ষম। সে পরিবর্তন এলো ইংরেজের সাথে। তারা এদেশে বপন করলো ধনতন্ত্রের বীজ। ভারতবর্ষের সমাজ ও আর্থিক জীবনে ধীরে ধীরে এলো বৈপ্লবিক পরিবর্তন জীবনের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে শুরু হলো প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতা বিভিন্ন কারণে হিন্দু মুসলমানের আর্থিক জীবনের মধ্যে নিয়ে এলো বিরোধ, সংঘর্ষ এবং রেষারেষি।

আর্থিক জীবনের এ বিরোধ বিস্তৃত এবং অধিকতর পরিণতি হয়ে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেই রূপান্তরিত হলো ঘোরতর রাজনৈতিক বিরোধে। এ রাজনৈতিক বিরোধ ক্রমশঃ তীব্রতর হয়ে দেশকে করলো বিভক্ত এবং সাম্প্রদায়িকতাকে নিশ্চিহ্ন না করে তাকে উভয় দেশের জাতীয় জীবনে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-ক্ষেত্রে আজ পর্যন্ত রাখলো অনির্বাণ।

১৩

সাম্প্রদায়িকতাকে উপমহাদেশের জীবনে নিশ্চিহ্ন করতে হলে যে মূল কারণে তার উৎপত্তি এবং বিস্তৃতি সেই কারণসমূহের প্রতিই দৃষ্টি দেওয়ার দরকার। এজন্যে তাই প্রয়োজন আমাদের, শুধু আমাদের নয়, সারা পাক-ভারত উপমহাদেশের বৃহত্তর সমাজ জীবনকে নোতুন অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করা। যে পর্যন্ত না দেশের উন্নতি শ্রেণী এবং সম্প্রদায় নির্বিশেষে সমগ্র জাতির উন্নতির পথে চালিত হবে সে পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সমস্যার আর্থিক এবং সমাজতান্ত্রিক ভিত্তি অটল থাকবে। সাম্প্রদায়িকতার অগ্নিশিখাকে নির্বাপিত করার জন্য তাই প্রয়োজন দেশের আর্থিক জীবনের বৈপ্লবিক রূপান্তর।

***

১. ক. লাহোর প্রস্তাবের উপর কায়েদে আজম মহম্মদ আলী জিন্নাহের বক্তৃতা, মার্চ, ১৯৪০। Speeches and Writings of Mr. Jinnah, Vol. I, p. 164 Edited by Jamiluddin.

খ. Jinnah Gandhi Talks – September, 1944. Foreword by Nawabzada Liaquat Ali Khan.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *