ডেয়ার অর ডাই – ২০

(২০)

‘আমরা আবার ঘুরে ফিরে একই জায়গায় চলে এলাম।’

অধিরাজ চিন্তিত মুখে কথাটা বলল। একটু আগেই তার জ্ঞান ফিরেছে। এখন সে সম্পূর্ণ সজ্ঞানে। ড্রাগের আবেশ আর নেই ঠিকই, কিন্তু মাথাটা এখনও ভার হয়ে আছে। সে কথা বলতেই মিস কৌশানী বোস এক কাপ কফি নিয়ে এসে অধিরাজের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘মাথা ভার হওয়ার এর থেকে ভালো ওষুধ আর নেই স্যার!’

অধিরাজের চোখে বিস্ময়। সে কৌশানীর কাছ থেকে এতটা আন্তরিকতা আশা করেনি। কফির কাপটা তুলে নিয়ে মৃদু হেসে বলেছিল, ‘থ্যাঙ্কস।’

ডঃ চ্যাটার্জি প্যাঁচার মতো গোলগোল চোখ করে পুরো ব্যাপারটা দেখছিলেন। কথা নেই, বার্তা নেই হঠাৎই ফোঁৎ ফোঁৎ করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমাদের যে কেন কেউ কফি খাওয়ায় না!

অর্ণব তাঁর দিকে তাকায়, ‘কিন্তু আপনি তো বোর্নভিটা খান।’

‘সেইজন্যই তো ‘পিলানেওয়ালি’ জুটল না! তোমার তো তবু স্পেশ্যাল চা আছে। আমার কী আছে বলো?’

ডঃ চ্যাটার্জির মুখ করুণ হয়ে উঠল। অর্ণবের ভদ্রলোকের জন্য দুঃখ হয়। সে কী বলবে ভাবছিল, তার আগেই ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ বলে উঠলেন, ‘সবই কপাল!’

সত্যিই কপাল! অর্ণব আড়চোখে ডঃ চ্যাটার্জির দিগন্তবিস্তৃত কপালটি দেখে নেয়। বুড়ো সেটা লক্ষ্য করেই চটে মটে বলল, ‘ওদিকে কী দেখছ!’

‘না…! কিছু না তো!’

অর্ণব চেপে যায়। বুড়োকে চটিয়ে লাভ নেই। এমনিতেই কেউ তাঁর টাকের দিকে তাকিয়ে থাকলে তেলেবেগুনে জ্বলে যান। তার ওপর কেউ কফি অফার করছে না সেই দুঃখে মরছেন! এখন বেশি বেগড়বাঁই করলে স্রেফ জ্বালিয়ে দেবেন!

‘আমার এখনও মনে হচ্ছে যে আমাদের মাথার মধ্যে কেউ ঢুকে পড়েছে। এবং সে-ই আমাদের তদন্তকে তার ইচ্ছামতো পথে এগিয়ে নিয়ে চলেছে।’ কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল অধিরাজ, ‘আমরা শুধু পুতুলের মতো তার ইশারায় হাত পা নাড়ছি। এখনও সেই একই অ্যাঙ্গেলে আটকে আছি। রিভেঞ্জ!’

‘এটাই সঠিক অ্যাঙ্গেল হতে পারে রাজা।’ পবিত্র বলল, ‘এ ছাড়া আর কোনো অ্যাঙ্গেল তো দেখতে পাচ্ছি না।’

‘ব্যক্তিগত অ্যাঙ্গেল থাকতেই পারে। সিরিয়াল কিলিঙের মাধ্যমে নিজের পথের কাঁটাটিকেও সরিয়ে ফেলা। কিন্তু এ অ্যাঙ্গেলটা জমছে না! যেখানে একটা খুন করলেই হয়, সেখানে এতগুলো খুন খামোখা কেউ করবে কেন!’ অধিরাজ আপনমনেই বলে, যেখানে কনডাক্ট ডিজ-অর্ডারের রোগী রয়েছে, সেখানে শুধুমাত্র খুনের আনন্দেই খুনের সম্ভাবনাকেও ফেলে দেওয়া যায় না! এটা সিরিয়াল কিলিং-ও হতে পারে।

‘তাহলে তো আবীরকে গ্রেফতার করতে হয়।’

পবিত্রর কথা শুনে মাথা নাড়ল অধিরাজ, ‘না, আমাদের হাতে কোনো প্রমাণ নেই। উইদাউট এভিডেন্স কাউকে অ্যারেস্ট করলে মানহানির মামলার গুঁতো খেতে হবে!’

‘তবে? এখন কী করণীয়?’

‘সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না পবিত্র।’ অধিরাজের কণ্ঠস্বরে হতাশা ও আফসোস, ‘কী করলে এই মৃত্যুগুলোকে আটকানো যাবে তা বুঝতেই পারছি না। সৌরীশকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু হেরে গেলাম! খুনী আমাদের হারিয়ে দিল!’

‘কিন্তু স্যার, সৌরীশবাবুর চারপাশে পুতুল কী করছিল?’

‘স্বাভাবিক।’ অধিরাজ শান্ত স্বরে বলে, ‘পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কী বলছে?’

ডঃ চ্যাটার্জি আস্তে আস্তে বললেন, ‘সেম থিং। ইনফ্যাক্ট শর্বাণী ঘোষের পোস্টমর্টেম রিপোর্টও প্রায় একই। শর্বাণীর মৃত্যু অ্যাক্সিডেন্টে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেও মারা যাওয়ার আগে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিল। সৌরীশ তো ভয়ের চোটেই হার্টফেল করেছে। তবে সৌরীশের নাকে এল.এস.ডি পাউডারের ট্রেস পাওয়া গিয়েছে। মৃত্যুর আগে সে তোমার মতোই হ্যালুসিনোজেন ইনহেল করেছিল।’

‘মা-ই গু-ড-নে-স!’ অধিরাজের উজ্জ্বল বাদামি চোখ চকচকিয়ে উঠল, ‘পুতুল…. এল.এস.ডি পাউডার…! বুঝেছি!’

‘কী বুঝেছ?’ ডঃ চ্যাটার্জি বললেন, ‘পুতুলগুলো সৌরীশকে এল.এস.ডি পাউডার শুকিয়ে দিয়েছে?’

‘উঁহু।’ অধিরাজ একটা সিগারেট মুখে গুঁজে আলতো মাথা নাড়ে, ‘আমার ধারণা এই কানা, হাত-মাথা কাটা, পা ভাঙা পুতুলগুলো কিছু বলতে চায়!’

ডঃ চ্যাটার্জি থপাস করে টাকের ওপর দু-হাত জড়ো করে নমস্কারের ভঙ্গি করেছেন, ‘প্লিজ রাজা! এবার বোলো না ওকে পুতুলের ভূতে তাড়া করেছিল! চাইল্ড’স প্লে বা অ্যানাবেলের মতো!’

গভীর রহস্যমাখা দৃষ্টিতে তাকাল অধিরাজ, ‘যদি তাই বলি, তবে কি আপনি আমায় পাগল ভাববেন ডক?’

‘নো ওয়ে!’ বুড়ো বাঘের মতোই হাঁকার দিয়ে উঠল, ‘ভূতের গল্প শুনতে আমি রাজি নই।’

‘ভূতকে ছাড়ুন। পিডিওফোবিয়া নামক বস্তুটি তো মানেন।’

‘পিডিওফোবিয়া!’ তিনি কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘মাই গড! পুতুলে ফোবিয়া! এদিকটা তো আমি ভাবিইনি। আসলে পিডিওফোবিয়া এত কম সংখ্যক লোকের মধ্যে দেখা যায় যে এটার কথা মনেই হয়নি!’

‘আমার দৃঢ় ধারণা যে সৌরীশের পিডিওফোবিয়া ছিল। সে কথা তিনিও আমাদের কাছে চেপে গিয়েছিলেন। খুনী তাঁর চারিদিকে হাত-পা ভাঙা কতগুলো বীভৎস পুতুল সাজিয়ে রাখল। সঙ্গে খানিকটা হ্যালুসিনোজেনও দিয়ে দিল। একেই পুতুলে ভয়, তার ওপর আবার হ্যালুসিনোজেন। সৌরীশের মনে হতে লাগল পুতুলগুলো তাঁর দিকে তেড়ে আসছে। অথবা তাঁকে তাড়া করছে! এমনিতেই পুতুলগুলো বীভৎস দর্শন। সঙ্গে আবার হ্যালুসিনোজেনের এফেক্ট। সাধারণ পুতুল তাঁর কাছে ভয়ংকর দানবে পরিণত হল! তিনি পাগলের মতো ঘরে ছুটোছুটি করতে শুরু করলেন। কিন্তু যেদিকেই যান, সেদিকেই পুতুল! কোথায় গেলে নিজেকে বাঁচাতে পারবেন ভেবে উঠতে পারলেন না। শেষপর্যন্ত সেই বিভীষিকার কাছেই হার মানলেন। হার্ট ফেল হয়ে গেল!’

‘তুমি বলতে চাও ফোবিয়াই হচ্ছে আসল অস্ত্র?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘কিন্তু রাজা…!’ ডঃ চ্যাটার্জি শান্তভঙ্গিতেই বললেন, ‘ফোবিয়া জিনিসটা অত সহজ নয়। ওই যে গল্পে বা সিরিয়ালে দেখো না, সাইকায়াট্রিস্ট হিপনোটিজমের মাধ্যমে সবার মনের মধ্যে ফোবিয়া ঢুকিয়ে দিয়ে খুন করছে? ইটস টোট্যালি রাবিশ।’ ভদ্রলোক একটু টাক চুলকে নিলেন, ‘ওসব স্রেফ গল্পেই হয়। ফোবিয়া তৈরি করা যায় না। ওটা নিজে থেকেই জন্ম নেয়। কেন, সেটা হয়তো সাইকায়াট্রিস্টরা খুঁজে বের করতে পারেন। কিন্তু ভয়টা তৈরি করে দেওয়া যায় না…!’

‘আমি বলছি না যে ফোবিয়া তৈরি করা হয়েছে।’ অধিরাজ উত্তর দেয়, ‘ওটা আগে থেকেই ছিল। এখন ফোবিয়াকে স্রেফ ব্যবহার করা হচ্ছে! তাও মার্ডার ওয়েপন হিসাবে! খুনী কোন্ লেভেলে খেলছে ভাবুন! এদের প্রত্যেকের মধ্যে ফোবিয়া কমন। কারোর নেক্রোফোবিয়া, কারোর ক্লস্টোফোবিয়া, কারোর অ্যাক্রোফোবিয়া, আবার কারোর বা অ্যাস্ট্রাফোবিয়া! সৌরীশের তো স্পষ্ট পিডিওফোবিয়া! নাও ইট মেকস্ সেন্স ডক্!’ অধিরাজের কণ্ঠস্বর উত্তেজনায় কাঁপছে, ‘আর সম্ভবত এটাই আমাদের ফার্স্ট লিড বা ব্রেক থ্রু। বুঝতে পারছেন না ডক? ‘

‘পারছি।’ তিনি গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ালেন, ‘পয়েন্টে জোর আছে। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই কিছু না কিছু ভয় থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেটা ডেডলিও হয়। কিন্তু সে জানল কীভাবে? এইসব ফোবিয়ার কথা অত্যন্ত ব্যক্তিগত ও গোপন ব্যাপার। কেউ সচরাচর পাবলিকলি শেয়ার করে না। অবশ্য যদি না এর মধ্যে কোনো সাইকায়াট্রিস্ট ইনভলভড থাকে! একমাত্র ওই একটি ব্যক্তিই এই একান্ত ব্যক্তিগত খবরগুলো রাখে। অনেকে ফোবিয়ার ট্রিটমেন্ট করতেও যায়। তখনই সাইকায়াট্রিস্টরা জানতে পারেন। ‘

‘আমাদের কেসে একজনই সাইকায়াট্রিস্ট আছেন! কিন্তু তাঁর কাছে কি আদৌ ফোবিয়ান্সের সদস্যরা চিকিৎসা করাতে যাবে? কী জানি! বুঝতে পারছি না!

অধিরাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে। নিজের ভয়ের মুখোমুখি দাঁড়ানো যে কী পরিমাণ ভয়ংকর তা তার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। একবার তো তারও মনে হয়েছিল, এবার বুঝি হৃৎস্পন্দন থেমেই যাবে। খুনীর মস্তিষ্কের তারিফ করতে হয়। কী অভিনব উপায় নিয়েছে খুন করার! কিন্তু এখনও তার মোটিভ স্পষ্ট নয়। এর পেছনে কি শুধুই প্রতিশোধ? না অন্যকিছু?

‘শ্রুতি চ্যাটার্জি এবারও সবার আগে খবরটা পেয়ে গিয়েছিলেন।’ অধিরাজ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘ভদ্রমহিলা ভোগাবেন দেখছি। ওঁকে ব্যুরোয় ডাকো। কোয়েশ্চেনিং করার দরকার। বিশেষ করে এই কেসটার সব আপডেট তার কোন্ বন্ধু এভাবে দিয়ে চলেছেন জানা দরকার।’

‘ওকে।’ পবিত্র মিস বোসের দিকে তাকায়, ‘মিস বোস শ্রুতি চ্যাটার্জিকে ফোন করে দেবেন।’

‘শুধু শ্রুতি নয়, সব সাসপেক্টদেরই ব্যুরোয় ডাকো। কাল রাতে কে কোথায় ছিলেন তা জানা দরকার। দেখতে হবে কার অ্যালিবাই ঠিক কতটা স্ট্রং! বিশেষ করে আমাদের সাইকায়াট্রিস্ট–ডঃ সুদীপ চ্যাটার্জি।’

যেমন কথা তেমন কাজ। দু ঘণ্টার মধ্যেই এই কেসের সব সাসপেক্ট সি.আই.ডি ব্যুরোয় হাজির হল। শ্রুতি চ্যাটার্জি ব্যুরোয় এসে চমকে গেল নিজের বাবা-মাকে দেখে। ক্ষুব্ধ গলায় অর্ণবকে বলল, ‘ওঁদের কেন ডেকে এনেছেন? ওঁরা কোনোভাবেই এর সঙ্গে জড়িত নন। খামোখা ওঁদের কষ্ট দেওয়ার মানে কী?’

অর্ণব শান্ত স্বরে বলল, ‘খামোখা এখানে কাউকেই ডাকা হয়নি ম্যাডাম। আপনি নিজেও জানেন আরেকটা খুন হয়ে গিয়েছে। খুনের অনতিবিলম্বে আপনিই নিউজটা কভার করেছিলেন।’

সে তো আমি করেছি।’ শ্রুতি নাছোড়বান্দা, ‘তার সঙ্গে আমার মা-বাবার সম্পর্ক কী?‘

‘সেটা যথাসময়েই বুঝতে পারবেন।’

অর্ণব আর কথা বাড়ায় না। এমনিতেই রিপোর্টাররা একটা ইস্যু পেলে সহজে ছাড়ে না। সে মিস দত্ত-র দিকে তাকায়। আত্রেয়ী এবার এগিয়ে এসে শ্রুতির বাহু স্পর্শ করল, ‘আপনি এদিকে আসুন।’

শ্রুতি উপায়ান্তর না দেখে আত্রেয়ীর কথাই মেনে নিল। যদিও তার মুখের দুশ্চিন্তার ছাপ সরল না। একা শুধু সেই নয়, প্রায় সকলেই চাপা টেনশনে ভুগছে। সুদীপও তাঁর কন্যারত্নটিকে দেখে চিন্তায় পড়েছেন। সৌমিত্র চৌধুরীর স্ত্রী আজ সকাল সকালই টেনে বসে আছেন। অর্ণবকে দেখে অত্যন্ত খুশি হয়ে এগিয়ে আসতে গিয়েই বিপদ ঘটল! আরেকটু হলেই পা স্লিপ করে পড়ছিলেন ভদ্রমহিলা! মিস দত্ত তার আগেই তাঁকে ধরে ফেলেছে! অধিরাজ তার কেবিন থেকেই দৃশ্যটা দেখতে পেয়েই বিড়বিড় করে, ‘ইনি মহিলা না শাম্মী কাপুর! সবসময়ই কিছু না কিছু হাঙ্গামা বাঁধিয়ে রেখেছেন!’

আকাশের বাবা-মাও আজ ব্যুরোয় উপস্থিত। মায়ার মুখ দেখে তার মনের কথা বোঝার উপায় নেই। তিনি একদৃষ্টে আবীরের দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখদুটো ধ্বকধ্বক করে জ্বলছে। পারলে এখনই আবীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। অমরের দু-চোখে ত্রাস। কোনোমতে ফ্যাঁসফ্যাঁসে স্বরে বললেন, ‘একগ্লাস জল হবে?’

‘নিশ্চয়ই।’

অর্ণবের চোখের ইশারায় মিস্ বোস জল আনতে চলে গেল। অমর শুকনো ঠোঁট চেটে নিয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার বলতে পারেন? আবার আমাদের ডাকা হল?’

‘একটু পরেই জানতে পারবেন।’

অর্ণব বেশি কথা বাড়ায় না। সে উপস্থিত সবার ওপরে আলতো করে একবার দৃষ্টি বোলায়। উৎপল মিত্রর স্ত্রী মালবিকা মিত্রর মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে! মৃন্ময়ের স্ত্রী ঠিক ততটাই নির্বিকার। যেন কিছুতেই কিছু এসে যায় না। শর্বাণী ঘোষের স্বামী অতনু ভ্রূকুটি করে আছেন। যেন পুরো ব্যাপারটাই তার পছন্দ হচ্ছে না। রজত চৌধুরীর মুখেও টেনশনের ছাপ প্রবল। এতটাই টেনশন হচ্ছে যে থেকে থেকে দাঁতে নখ কাটছেন। আবীর সেন চুপচাপ বসেছিলেন। আগের দিনের তুলনায় যেন অনেকটাই নিষ্প্রভ ও মনমরা। অর্ণবকে দেখতে পেয়েই জানতে চাইলেন, ‘কত সময় লাগবে বলতে পারেন? আমার স্ত্রী কোমায়।’

এই দুঃসংবাদটা একটু আগেই ওরা পেয়েছে। উমা কাল রাত্রেই অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তার নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিল। এমনিতেই এই কোভিডের সময়ে অক্সিজেনের আকাল। তা সত্ত্বেও রতন কোনোমতে অক্সিজেনের বন্দোবস্ত করেছে। হসপিটাল থেকে উমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে আর হসপিটালের দ্বারস্থ হননি ওরা। বাড়িতে এক পরিচিত ডাক্তার এসেছিলেন। তিনি সরাসরিই জানিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, এখন শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই

অর্ণব সহৃদয় কণ্ঠে বলল, ‘বেশিক্ষণ লাগবে না। জাস্ট কয়েক মিনিটের কোয়েশ্চেনিং।’

‘আবার কোয়েশ্চেনিং কেন?’ আবীর অধৈর্য হয়ে উঠেছেন, ‘একবার তো হয়েছে। ‘আরও একটা মৃত্যু হয়ে গিয়েছে। প্লিজ, কো অপারেট করুন।

কথাটা বলেই অর্ণব অধিরাজের কেবিনে চলে যায়।

কয়েক মিনিটের প্রতীক্ষা। তারপরই শুরু হল প্রশ্নোত্তর। প্রথমেই কেবিনে ঢুকলেন শ্ৰুতি চ্যাটার্জি। ঢোকামাত্রই ঝংকার দিয়ে বলে উঠলেন, ‘আমাকে বারবার এইভাবে কোয়েশ্চেনিং করার মানে কী? ‘

তার উত্তেজনার আঁচ গায়ে মাখল না অধিরাজ। ঠান্ডা, শান্ত স্বরে বলল, ‘রুটিন প্রসিডিওর ম্যাম। আমরা জানি আপনার সময় অমূল্য। বসুন, কয়েক মিনিটেই হয়ে যাবে।’ বলতে বলতেই সে চোখ তুলে তাকায় অর্ণবের দিকে, ‘অর্ণব মিস দত্তকে একটু আসতে বলো।’

এটাও রুটিন এনকোয়ারির অংশ। ফিমেল সাসপেক্টকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময়ে লেডি অফিসারের উপস্থিতি কাম্য। অর্ণব কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে আত্রেয়ী দত্তকে ডেকে আনল। আত্রেয়ী শ্রুতির ঠিক পেছনে এসে নীরবে দাঁড়ায়।

‘কোনোরকম ভূমিকা ছাড়াই জিজ্ঞাসা করি।’ অধিরাজ পেপারওয়েটটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে বলে, ‘কাল রাতে আপনি কোথায় ছিলেন?’

‘এটা আবার কী প্রশ্ন?’ শ্রুতি বিরক্ত, ‘সবাই জানে কাল রাত্রে আমি সৌরীশ গাঙ্গুলির ফ্ল্যাটের সামনে ছিলাম। ওখান থেকেই সরাসরি রিপোর্টিং করছিলাম।’

অধিরাজ অর্ণবের দিকে তাকায়। অর্ণব মাথা নাড়ল। অর্থাৎ শ্ৰুতি সত্যি কথাই বলছে।

‘তার আগে কোথায় ছিলেন?’

‘বাড়িতেই ছিলাম।’ শ্রুতির ঠোঁটে ব্যঙ্গবঙ্কিম হাসি ফুটে ওঠে, ‘ঘুমোচ্ছিলাম।’

‘ঘুম ভেঙে একেবারে অকুস্থলে পৌঁছলেন কী করে?’ অধিরাজের ঠোঁটে মিষ্টি হাসি, ‘আপনার সেই অজানা বন্ধুটি ফোন করেছিলেন কি?’

‘হ্যাঁ, সেই ফোনটা আবার এসেছিল।’ শ্রুতির কণ্ঠস্বরে কোনোরকম নাটকীয়তা নেই, ‘সেই আমাকে সৌরীশ গাঙ্গুলির ফ্ল্যাটের ঠিকানা দিয়ে সেখানে পৌঁছতে বলেছিল।’

‘সৌরীশ গাঙ্গুলি যে মারা গিয়েছেন, সে কথা বলেছিলেন তিনি?’

‘হ্যাঁ।’

‘আপনি তখন পুলিসকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি?’

‘পুলিসে ফোন করব কেন?’ উদ্ধত জবাব এল, ‘সৌরীশ কার্ডিয়াক ফেইলিওরে মারা গিয়েছেন। তাছাড়া সেখানে তখন অলরেডি আপনারা উপস্থিত ছিলেন।’

‘ও। সেটাও আপনার অজানা ছিল না।’ অধিরাজ স্মিত হাসল, ‘হার্ট ফেইলিওরে মারা গেলে সেটাকে বোধহয় অস্বাভাবিক মৃত্যু বলা যায় না। কিন্তু রহস্যময় মৃত্যু … রহস্যময় মৃত্যু বলে আপনিই সবচেয়ে বেশি চেঁচামেচি করছিলেন ম্যাডাম। পুলিসি তদন্তের দাবি সবচেয়ে বেশি আপনিই করেছেন। অথচ এখন বলছেন পুলিসে ফোন করব কেন?’

এই প্রথম শ্রুতিকে একটু বিপন্ন দেখাল। সে প্রশ্নটার কোনো উত্তর দিল না।

‘যাই হোক, এবার বলুন ফোনটা কোথায় এসেছিল? আপনি বাড়িতে যখন ছিলেন তখন অফিসে ফোন আসার প্রশ্নই ওঠে না। নিশ্চয়ই এবার ফোনটা আপনার মোবাইলেই এসেছিল?’

শ্রুতিকে রীতিমতো কোণঠাসা লাগছে। শুকনো স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ।’

‘নম্বরটা নিশ্চয়ই আছে আপনার মোবাইলে?’

‘না। আমি ডিলিট করে দিয়েছি।’

অধিরাজ শ্রুতির চোখে চোখ রাখে। মেয়েটি অত্যন্ত উদ্ধত। এবং তার সাহসের প্রশংসাও করতে হয়। সে আস্তে আস্তে বলে, ‘ডিলিট কেন করেছেন?’

‘সোর্সের নম্বর আমি রাখি না। আমার কাছে সোর্স খবর জানার একটা উপায় মাত্র। তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার কোনো শখ আমার নেই।’

অধিরাজ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, ‘আপনি কি কাউকে কভার করার চেষ্টা করছেন?’

শ্রুতি আবার থমকে গেল। প্রশ্নটার কী উত্তর দেবে ভাবছে।

এমন নয় তো যে মোবাইলে যে নম্বরটা ভেসে উঠেছিল সেটা আপনার অত্যন্ত পরিচিত? এতটাই পরিচিত যে আপনি সবার কাছ থেকে তার পরিচয় গোপন রাখছেন? আপনার কোনো কাছের মানুষের নম্বর নয় তো?’

প্রশ্নটা যেন শ্রুতিকে ধাক্কা মেরে গেল। সে সম্পূর্ণ নির্বাক হয়ে বসে থাকে। কোনো উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করল না।

‘আপনি জানেন যে আপনার রিপোর্টিং ফোবিয়ান্সের সদস্যদের আতঙ্কিত করে তুলবে, তা সত্ত্বেও আপনি বুম হাতে নিয়ে ‘রহস্যময় মৃত্যুর’ রিপোর্টিং করেই গেলেন! একদিক দিয়ে যে এই সমস্ত মৃত্যুর পেছনে আছে, তাকেই সাহায্য করছেন!

সে চেয়েছিল প্যানিক তৈরি করতে। এবং শুধু আপনার জন্যই সে সফল হয়েছে!’

‘আই নো! আমি জানি আমি তাকে সাহায্য করছি।’ শ্রুতি এবার আর থাকতে না পেরে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘জেনেশুনেই হেল্প করছি। বেশ করছি। যারা এতদিন অন্যকে ভয় দেখিয়ে এসেছে তাদের জানা উচিত যে ভয় কাকে বলে। এক মাঘে শীত যায় না…!’

‘সেইজন্যই পরের মাঘে সবাইকে কাঁপিয়ে দিলেন!’ অধিরাজ ভীষণ ঠান্ডা গলায় বলে, ‘সব জেনেশুনেও আতঙ্ক তৈরি করতে আততায়ীকে সাহায্য করলেন। এখন তাকে আড়াল করারও চেষ্টা করছেন।‘

‘আপনি খুনীর নাম জানতে চান? ফাইন!’ শ্রুতি বেপরোয়াভাবে জবাব দেয়, ‘খুনীর নাম শ্রুতি চ্যাটার্জি। গ্রেফতার করবেন? করুন। কিন্তু প্রমাণ করতে পারবেন না।

কথাটা শোনামাত্রই আত্রেয়ী কয়েক পা এগিয়ে গেল। যেন এখনই গ্রেফতার করবে শ্রুতিকে। অধিরাজ চোখের ইশারায় তাকে অপেক্ষা করতে বলে। মুখে বলল, ‘এটা কি চ্যালেঞ্জ?’

‘তাই ভাবলে তাই।’ শ্রুতি কড়া গলায় বলে, ‘আমি দিনের পর দিন দেখেছি আমার দাদাকে একটু একটু করে মরতে। সে আপাতদৃষ্টিতে আত্মহত্যা করেছিল ঠিকই, কিন্তু আমি জানতাম ওটা খুন। ফিজিক্যালি মরার পাঁচ বছর আগেই ফোবিয়ান্স তাকে মেরে ফেলেছিল। দাদা এতটাই ভয় পেয়েছিল যে ওদের নামে নালিশও করতে চায়নি। আমরা কেউ কিছু করতে পারিনি। একটা তরতাজা মানুষ জ্যান্ত লাশ হয়ে গেলে কেমন লাগে জানেন আপনি? আমি জানি।

‘আপনি আরও অনেক কিছু জানেন, বলছেন না। ‘

‘বললাম তো। খুনগুলো আমিই করেছি, কী করবেন করুন।

অধিরাজ তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল, ‘আপনি আসতে পারেন।’

রাগে, উত্তেজনায় শ্রুতির মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। চোখে যেন রক্ত জমেছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে। অধিরাজের শীতলতা হয়তো তাকেও স্পর্শ করে গেল। সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করতে করতে উঠে দাঁড়ায়। আত্রেয়ী দত্ত চোখের কোণে তাকে একবার দেখে নিল। শ্রুতি অত্যন্ত ক্লান্ত ভঙ্গিতে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।

‘আরও একজন দাবি করল যে খুনগুলো সেই করছে!’ অধিরাজ মিটিমিটি হাসছে, ‘দেখা যাক, এরপর কী হয়।

‘আপনি ওর মোবাইলটা নিয়ে নম্বরটা বের করতে পারতেন স্যার।’ আত্রেয়ী বলল, ‘ও একদম মিথ্যে বলছে।’

‘মহিলাদের ওপর গায়ের জোর ফলাতে ভালো লাগে না সেনোরিটা।’ অধিরাজ পেপারওয়েটটাকে যথাস্থানে রেখে বলে, ‘ওঁর ফোন নম্বর আছে আমাদের কাছে। কল ডিটেইল রেকর্ড বের করলেই দেখা যাবে, কাল রাতে কোথা থেকে ফোন এসেছিল। খামোখা একজন মানুষকে হ্যারাস করা কেন, যখন সহজ উপায় হাতের সামনেই আছে? উনি মিথ্যে বলতেই পারেন, কিন্তু কল রেকর্ডস তো আর মিথ্যে বলবে না।’

আত্রেয়ী মৃদু হেসে আলতোভাবে মাথা ঝাঁকায়। অর্থাৎ, সে বুঝেছে।

উৎপল মিত্রর স্ত্রী মালবিকা মিত্র প্রচণ্ড টেনশনে আছেন। ভদ্রমহিলা ঘেমে নেয়ে একসা হচ্ছেন দেখে তার হাতে গোটা টিস্যুর বাক্সটাই ধরিয়ে দিল অধিরাজ। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, ‘কাল রাতে আপনি কোথায় ছিলেন?’

‘বাড়িতেই ছিলাম। এই লকডাউনের সময় আর কোথায় যাব?’

‘তাও ঠিক।’ অধিরাজ সামান্য মাথা ঝাঁকায়, ‘আপনি ডিপ্রেশনের ওষুধ খান?’ কথাটা শোনামাত্রই মালবিকার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তিনি কয়েক মিনিট চুপ করে থাকলেন। তারপর মাথা নাড়লেন, ‘হ্যাঁ।’

‘ডিপ্রেশনের কারণ? ‘

মালবিকার চোখে সতর্ক দৃষ্টি, ‘ওটা আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার।’

‘এই মুহূর্তে আপনার ব্যক্তিগত বলে কিছু নেই মিসেস মিত্র। এইসব কেসে মৃত ব্যক্তির চরিত্র অন্যতম ব্লু হয়ে ওঠে।’ অধিরাজের কণ্ঠস্বর কঠিন, ‘প্লিজ সহযোগিতা করুন।’

মালবিকা একটা শ্বাস টানেন। একটু যেন সময় নিলেন। তারপর বললেন, ‘আমি একসময়ে চাকরি করতাম। কিন্তু উৎপলের আপত্তি ছিল। সেই নিয়ে বাড়িতে প্রায়ই অশান্তি হত। অবশেষে আমি বাধ্য হয়েই চাকরি ছেড়ে দিই। তাতেও ওঁর শাস্তি হল না। ওঁর জীবনে যা কিছু খারাপ ঘটত, তার জন্য আমাকেই দায়ী করতেন। রোজ অশান্তি, রোজ ঝগড়া! আমার জীবন দুর্বিষহ হয়ে গিয়েছিল। ভেবে পেতাম না, ঠিক কী করলে উনি সন্তুষ্ট হবেন। এই কোভিডের সময়ে ওঁর চাকরি চলে গেল। রোজ আমায় মারধোর করতেন। বলতেন, আমি যেন বাবার কাছে দশ লাখ টাকা চাই।

কিন্তু বাবাকে আমি কিছুই বলতে চাইনি। তিনিও একজন মধ্যবিত্ত মানুষ। অত টাকা কী করে দেবেন! তাই চুপ করে মার খেয়েই যাচ্ছিলাম। আর আস্তে আস্তে ডিপ্রেশনেও চলে গেলাম।’

‘হুঁ!’ অধিরাজ একটু ভেবে নিয়ে বলে, ‘তাহলে ওঁর মৃত্যুটা আপনার জীবনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। তাই না?’

প্রশ্নটার মর্মার্থ বুঝতে অসুবিধে হল না মালবিকার। তিনি বললেন, ‘মিথ্যে কথা বলব না। হ্যাঁ, অনেকটাই সহজ হয়ে গিয়েছে জীবনটা। আমি আবার চাকরি খুঁজছি। আমার শ্বশুরমশাই তো সবসময়েই ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতেন যে উৎপল তাঁকে খুন করেই না বসেন! এখন অনেকটাই নিশ্চিন্ত।’

‘উৎপলের আর কোনো শত্রু ছিল?’

‘না। বাইরে কোনো শত্রু ওঁর ছিল বলে আমার জানা নেই। তবে…!’

অধিরাজের ভুরু কুঁচকে গেল, ‘তবে?’

‘মৃত্যুর আগে উনি বেশ খোশমেজাজে ছিলেন। কথাপ্রসঙ্গে বলেওছিলেন যে কারোর কাছ থেকে তাঁর টাকা পাওয়ার কথা আছে।’

‘কার কাছ থেকে?’

‘সেটা উনি বলেননি।’

অধিরাজের কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘স্ট্রেঞ্জ!’

এরপর আবীর সেনের পালা। ভদ্রলোককে দেখেই অদ্ভুত লাগল অধিরাজের। এই ক-দিনেই যেন একেবারে শুকিয়ে গিয়েছেন। সেই নির্ভীক ভাবটা আর নেই। চোখের তলার কালি ইঙ্গিত দেয় নিদ্রাহীন রাত্রির। মুখ রক্তহীন। নীচু স্বরে বললেন, ‘আমায় একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেবেন অফিসার? আমার স্ত্রী…!’

‘হ্যাঁ। অবশ্যই।’

অধিরাজের রুটিন প্রশ্নে আবীর জানালেন যে কাল রাতে তিনি বাড়িতেই ছিলেন। রাত জেগে টিভি দেখছিলেন।

‘কিন্তু রাত প্রায় দেড়টা নাগাদ আপনি বাড়ির বাইরে গিয়েছিলেন। তাও আবার বৃষ্টির মধ্যে! কেন?’

প্রশ্নটা শুনেই চোখে অন্ধকার জমল আবীরের। কোনোমতে বললেন, ‘কে বলল যে আমি বাইরে গিয়েছিলাম?’

অধিরাজ স্মিত হাসে, ‘আমাদের কাছে খবর থাকে মিঃ সেন। আপনি কাল রাত্রে বাড়ির বাইরে বেরিয়েছিলেন, এ কথাটা অস্বীকার করবেন না প্লিজ। আমাদের কাছে সাক্ষী আছে।’

‘ফাইন! ফাইন!’ এবার যেন একটু উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন আবীর, ‘আমার সিগারেট ফুরিয়ে গিয়েছিল। সিগারেট আনতে গিয়েছিলাম।’

‘অত রাতে কোনো সিগারেটের দোকান খোলা থাকে মিঃ সেন?’

আবীর ঢোঁক গিললেন, ‘আমার সময়ের দিকে খেয়াল ছিল না।’

‘সত্যিই আপনার সময়ের দিকে খেয়াল থাকে না। নয়তো অত রাতে বেরিয়েও আনুমানিক এক ঘণ্টা আপনি বাইরেই ছিলেন।’

এবার আবীর কী বলবেন ভেবে পান না। কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে বললেন, ‘আমি পার্কে হাঁটতে গিয়েছিলাম!’

‘পার্কে! অত রাতে!’ অধিরাজ হেসে ফেলল, ‘কিন্তু এই যে বললেন আপনি সিগারেট কিনতে গিয়েছিলেন?’

‘হ্যাঁ, সিগারেট কিনতেই গিয়েছিলাম। কিন্তু সিগারেটের দোকান অবধি গিয়ে মনে পড়ল যে এখন দোকানটা খোলা পাওয়া যাবে না। অনেকদিন হাঁটাহাঁটিও হয় না। তাই পার্কে চলে গেলাম!’

‘আপনি শিওর যে পার্কেই গিয়েছিলেন? সৌরীশের বাড়িতে যাননি?

প্রশ্নটা শোনা মাত্রই কেঁপে উঠলেন আবীর। কোনোমতে বললেন, ‘না… সৌরীশের বাড়িতে কেন…!’

‘আপনার মোবাইল লোকেশন কিন্তু বলছে যে আপনি সৌরীশের বাড়ির কাছে পিঠেই ছিলেন।’

আবীর চুপ করে থাকেন। তার মুখে কোনো শব্দ নেই।

‘সত্যি কথাটা বলবেন কি?’

‘আমি আমার লয়্যারের অনুপস্থিতিতে কোনো কথা বলব না।’ আবীর হিংস্র স্বরে বললেন, ‘আর একটা প্রশ্নেরও উত্তর দেব না আমি। আমার স্ত্রী কোমায়, এখন তখন অবস্থা, আর আপনারা আমায় এভাবে টর্চার করছেন!’

‘আপনার স্ত্রী-র জন্য আমরা দুঃখিত মিঃ সেন। কিন্তু যেভাবে তাঁর স্বাস্থ্য ডিটোরিয়েট করল তা কি আদৌ স্বাভাবিক?’

‘মানে?’ আবীর বিস্ময় বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন অধিরাজের দিকে, ‘কী বলতে চাইছেন?’

‘ক-দিন আগেই আমরা আপনার স্ত্রীয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। তখনও তিনি দিব্যি কথা বলছিলেন। দেখে মনে হয়নি যে এত তাড়াতাড়ি ডিটোরিয়েট করবেন! আর এখন শুনছি তিনি কোমায়! এটাও কি নিছক কো-ইনসিডেন্স? রাত দেড়টা থেকে প্রায় আড়াইটে অবধি আপনি অসুস্থ স্ত্রীকে ছেড়ে বাড়ির বাইরে ছিলেন। সেই ফাঁকে কোনো মিস হ্যাপ হয়নি তো? কিংবা তার আগে?’

‘হোয়াট! আপনারা বলতে চান আমি আমার স্ত্রীকে খুন করার চেষ্টা করেছি!’

‘এর আগেও কি করেননি! অত বড়ো অ্যাক্সিডেন্টে আপনার স্ত্রীয়ের পা কাটা গেল, সন্তান মারা গেল, আর আপনি ড্রাইভিং সিটে বসে থেকেও কীভাবে অক্ষত রইলেন মিঃ সেন?’

‘এনাফ ইজ এনাফ!’ আবীর এক ঝটকায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান, ‘আমার অ্যাটর্নিকে ছাড়া আমি আর একটি কথারও উত্তর দেব না।’

‘অ্যাজ ইউ উইশ!

এরপর অমর ও মায়ার পালা। দু-জনে একসঙ্গেই এলেন। মায়াকে দেখতেই শিরশিরে অনুভূতিটা ফিরে এল অর্ণবের। কালো শাড়িতে ভদ্রমহিলাকে কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। কপালে সেই বড় করে সিঁদুরের টিপ! মাথার চুল উসকোখুশকো। চোখদুটোয় একটা ক্ষুধিত ভাব। অধিরাজকে দেখে মৃদু হাসলেন। অধিরাজ খুব নম্রভাবেই জিজ্ঞাসা করে, ‘কাল রাতে আপনারা কোথায় ছিলেন?’

অমর মায়ার দিকে একঝলক দেখে নিয়ে বললেন, ‘আমরা বাড়িতেই ছিলাম অফিসার। ঘুমোচ্ছিলাম।’

‘তুমি সঠিক কথা বলছ না!’ মায়া অমরের কথার প্রতিবাদ করে ওঠেন, ‘আমি আদৌ ঘুমোইনি। আমি বাবাইয়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম।’

‘বাবাই? ‘

অধিরাজের প্রশ্নটার উত্তর অমরই দিয়ে দেন, ‘আকাশের ডাক নাম বাবাই।’

অধিরাজ একদৃষ্টে মায়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর ঠান্ডা নিরুত্তাপ স্বরে বলে, ‘আই সি!’

‘আমার স্ত্রী নানারকম তুকতাকে বিশ্বাস করেন। ওঁর ধারণা আকাশের আত্মা ওঁর সঙ্গে কথা বলে। তার জন্য নানারকম হোম যজ্ঞও করান।’

অধিরাজ এ ব্যাপারটা আগেই বুঝেছিল। সে মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী বলল বাবাই?’

‘বলল, কেউ বাঁচবে না! সবাইকে মরতে হবে।’ মায়া তৃপ্তির হাসি হাসেন, ‘আমি ওদের সবার পেছনে মারণবাণ ছেড়ে দিয়েছি। মরতে তো ওদের হবেই।’ বলতে বলতেই তাঁর মুখ বিষাদঘন হয়ে ওঠে। গলাটা একটু কেঁপে যায়, ‘বাবাই কাঁদে। বলে, ওখানে ওর একা একা ভালো লাগছে না। ও আমাদের কাছে আসতে চায়, আমাদের কাছে থাকতে চায়।

বলতে বলতেই তাঁর চোখ জলে ভরে ওঠে। উপস্থিত তিন অফিসার অপ্রস্তুত। এই শোকার্ত মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা মানে যন্ত্রণা দেওয়া। কিন্তু কপালদোষে সেই নিষ্ঠুরতম কাজটাও ওদের করতে হবে।

‘আপনি সৌরীশের মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী আগেই করেছিলেন। কী করে সেটা সম্ভব হল?’

মায়ার মুখে আত্মপ্রসাদের হাসি ভেসে ওঠে, ‘আমি জানতাম। আমায় বাবাই বলেছে।’

আবার সেই বাবাই এসে ঢুকে পড়েছে! অধিরাজ বুঝল এক শোকসন্তপ্তা মা নিজের ছেলের মৃত্যু পরবর্তী অস্তিত্ব অনুভব করে বেঁচে থাকার আশ্রয় খুঁজছেন। হয়তো তাঁর বলা কথাটা নেহাৎই কো-ইনসিডেন্স। অথবা তিনি জেনেশুনেই চ্যালেঞ্জটা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। বাস্তবে কী ঘটেছে তা বলা মুশকিল। কারণ মায়ার কাছে একমাত্র বাস্তব তাঁর বাবাই। অধিরাজ নরম সুরে বলল, ‘বাবাই আর কিছু বলেছে আপনাকে? এরপর কে মারা যাবে?

মায়া হাসলেন। ভীষণ রহস্যময় সে হাসি। ফিসফিস করে বললেন, ‘সে কথা বলতে বারণ আছে। আপনি জানেন? বাবাই রোজ রাতে আমার ঘরে আসে। অনেক কথা বলে। ওর এখন আর কোনো কষ্ট নেই। শুধু একা থাকাটাই বড় কষ্টকর। প্রতিরাতে ও আমার পাশেই শোয়। আমি ওর মাথায় বিলি কেটে দিই, যেমন আগে দিতাম। মা চুলে বিলি কেটে না দিলে ওর যে ঘুমই হয় না…!’ বলতে বলতেই তাঁর চোখ দপ করে জ্বলে ওঠে, ‘সেই ছেলের চুল ধরে হিড়হিড় করে হিঁচড়ে টেনে বিছানা থেকে ফেলে দিত ওরা! শান্তিতে ঘুমোতেও দিত না! কতগুলো অশিক্ষিত, অসভ্য ছেলেমেয়ের দল! মৃত্যুই ওদের যোগ্য শাস্তি। আর সে শাস্তি আমিই ওদের দিয়েছি। অফিসার, আপনি শুধু শুধুই সময় নষ্ট করছেন। আগেও বলেছি, এখনও বলছি। আমিই ওদের খুন করেছি। আমি বাবাইকে কথা দিয়েছিলাম ওদের মারব। আমি কথা রেখেছি।’

অধিরাজ শান্ত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। ভদ্রমহিলা সত্যিই কি ব্ল্যাকম্যাজিকের ভ্রমেই আছেন? নাকি অন্য কোনো ব্যাপারও আছে? কিছুই স্পষ্ট নয়।

‘সৌরীশ মারা গিয়েছে, আমি খুশি হয়েছি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি খুশি হব, যখন আবীরটা মরবে। আমি আজই বাড়িতে গিয়ে প্রস্তুতি শুরু করে দেব। ওকে মরতেই হবে! ও আমার হাতেই মরবে।’

অধিরাজ অমরের দিকে তাকায়, ‘ঠিক আছে। আপনারা আসতে পারেন।’

‘কিন্তু আপনি আমার কথা কেন বিশ্বাস করছেন না অফিসার?’ মায়ার গলায় আকুলতা, ‘আমিই ওদের খুন করেছি… বিশ্বাস করুন…!’

বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন মায়া। কান্নামাখা গলায় বললেন, ‘কী করব! মা হওয়ার বড় জ্বালা!

তিন অফিসার লজ্জিত মুখে অধোবদন হয়ে থাকে। এরকম পরিস্থিতিতে সান্ত্বনা দেওয়াও অসম্ভব। অমর কোনোমতে মায়াকে শান্ত করলেন। তারপর আস্তে আস্তে দু-জনেই উঠে দাঁড়ালেন। অধিরাজ লক্ষ্য করল মায়া একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। সে কী যেন ভেবে জিজ্ঞাসা করে, ‘ম্যাডামের কি আর্থরাইটিস আছে?’

অমর একটু হাসার চেষ্টা করেন, ‘হ্যাঁ, অস্টিও আর্থাইটিস আছে। হাঁটুতে সবসময়ই ব্যথা। নি-ক্যাপ ছাড়া হাঁটতেই পারে না।

নি-ক্যাপ শব্দটা শুনে অর্ণব চকিতে অধিরাজের দিকে তাকায়। অধিরাজের মুখ নির্লিপ্ত। সে খুব মন দিয়ে মায়ার হাঁটাটা দেখছে। তার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। অর্ণব লক্ষ্য করল মায়ার হাত-পা অল্প অল্প কাঁপছে।

শর্বাণী ঘোষের স্বামী অতনু এবং মৃন্ময় দত্তরায়ের স্ত্রী বিশেষ কিছু বলতে পারলেন না। দু-জনেই কাল রাতটা ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। অতনু অবশ্য ঘুমোনোর আগে কিছুক্ষণ টিভিতে সিনেমা দেখেছেন। তাই বৃষ্টি যে নেমেছে তা টের পেয়েছিলেন। মিসেস দত্তরায় তো ঘুমের ওষুধ খেয়েই ঘুমিয়েছিলেন, কিছুই টের পাননি

‘সকলেরই দেখছি এক অ্যালিবাই। বাড়িতে ছিলাম, ঘুমোচ্ছিলাম।’ অধিরাজ বিরক্ত হয়ে বলে, ‘ঠিক যেন একজনের জবাব সবাই মিলে কপি পেস্ট করছে। এটা একটা অ্যালিবাই হল!’

‘এই লকডাউনে অন্যরকম অ্যালিবাই পাওয়ার সম্ভাবনা কম।’ আত্রেয়ীর বুদ্ধিদীপ্ত চোখ চকচক করে ওঠে, ‘এখন কলকাতার নাইট লাইফ তো বন্ধ। আর দেড়টার সময় ওঁরা আর কী-ই বা করবেন!

‘হুঁ।’ অধিরাজ বিরক্তিমাখা মুখে বলে, ‘মিসেস চৌধুরীকে ডাকো অর্ণব। আর সেনোরিটা, এই বিশেষ মহিলাকে সামলানোর দায়িত্ব কিন্তু আপনার। ইনি শাম্মী কাপুরের মতো যেখানে সেখানে উলটে পড়েন।’

আত্রেয়ী ফিক করে হেসে ফেলল। অধিরাজ হাসতে গিয়েও চেপে যায়। অর্ণব মিসেস চৌধুরীকে নিয়ে এদিকেই আসছে। ভদ্রমহিলা যথারীতি আজও অদ্ভুতুড়ে একটা ব্লাউজ পরে আছেন। পিঠটা সম্পূর্ণ ফাঁকা। তার ওপর শিফনের শাড়ি আবার পিন করা নেই। কেবিনের ভেতরে ঢুকতে গিয়েই সুড়ুৎ করে আঁচলটা বুক থেকে খসে পড়ে গেল। আত্রেয়ী নীচু স্বরে বলে, ‘কী টাইমিং!’

শঙ্খের মতো বুক, বিভাজিকা প্রকট। অর্ণব লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছে। অধিরাজ এমনভাবে ঘরের ছাদটাকে দেখছে যেন সব রহস্য ছাদেই লুকিয়ে রয়েছে। আত্রেয়ী তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে তাঁর আঁচলটা তুলে দিল, ‘ম্যাম, আপনার আঁচল! ‘

‘থ্যাঙ্কস।’ ভদ্রমহিলা মদির হাসলেন, ‘আসলে হ্যান্ডসাম ইয়াংম্যান দেখলেই আমার আঁচলটা বেগড়বাঁই করতে শুরু করে!

অধিরাজ এবার সাহস করে চোখ তাঁর দিকে ফেরাল, ‘কাল রাতে কোথায় ছিলেন?’

‘ঘুমোচ্ছিলাম।’ মিসেস চৌধুরীর মুখে ফের সেই মিস্টিক হাসিটা ভেসে উঠেছে, ‘রাত্রে লোকে কী করে অফিসার? সেক্স করে, ঘুমোয়। তাই না? আমিও তাই করছিলাম। ডেমো দেখবেন? অ্যালিবাই চাইলে কিন্তু দিতে পারব না। জিগোলোরা পুলিসের ঝামেলায় পড়তে চায় না।’

উত্তরের ঘায়ে দুই পুরুষ অফিসারই উলটে পড়েছে। অধিরাজ ভদ্রমহিলাকে কী প্রশ্ন করবে ভাবছে। অন্তত কী প্রশ্ন করলে তিনি একটু ভদ্রসভ্য উত্তর দেবেন! অনেক ভেবে চিন্তে বলল, ‘সৌরীশ গাঙ্গুলিকে চিনতেন? ‘

‘না।’ তিনি একটা ভুরু উঁচিয়ে বললেন, ‘চেনা উচিত ছিল?’

‘আপনি আপনার স্বামীর বন্ধুদের কখনও দেখেননি?

‘বন্ধু!’ ঝঙ্কার দিয়ে হেসে উঠলেন মিসেস চৌধুরী, ‘সৌমিত্র অত্যন্ত স্বার্থপর লোক ছিল। ওরকম লোকের বন্ধু থাকে না। কলেজ লাইফে কী করে হল তা জানি না। কিন্তু তারপর বন্ধুর বদলে স্রেফ বান্ধবীই ছিল।’

‘ওঁর টাকার প্রবলেমের ব্যাপারে আপনাকে কিছু বলেছিলেন?’

তিনি একটু ভাবলেন, ‘অ্যাকচুয়ালি একটা ইন্টারেস্টিং কথা আপনাকে বলতেই ভুলে গিয়েছিলাম।’

‘বলুন।’

‘ওর টাকার প্রবলেমটা পরে অনেকটাই মিটে গিয়েছিল। সম্ভবত ওকে কেউ স্পনসর করছিল

‘হোয়াট?’

অর্ণব ও অধিরাজ দৃষ্টিবিনিময় করে। একটু আগেই মিসেস মিত্রও অনেকটা এরকম কথাই বলেছেন। উৎপলকেও কারোর টাকা দেওয়ার ছিল। আবার সৌমিত্রকেও কেউ টাকা দিচ্ছিল। ব্ল্যাকমেলিঙের কেস নাকি!

‘কে টাকা দিচ্ছিল?

ভদ্রমহিলা ঠোঁট উলটেছেন, ‘সৌমিত্রর আমায় বলতে বয়ে গেছে। ওর কোনো গার্লফ্রেন্ডই হয়তো সমস্ত খরচ বহন করছিল। ও আমায় কোনোদিন মানুষ বলে গণ্য করেনি। তাই আমি এসব ব্যাপারে কিছু জানি না।’

‘আর কিছু যা আপনি আমাদের বলতে ভুলে গিয়েছেন? ‘

‘হ্যাঁ, আপনাকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি।’

‘বলুন।’

‘আপনি অত্যন্ত রূপবান! ‘

অধিরাজ প্রায় লাল হয়ে ওঠে। অর্ণব গলার গভীরে বলল, ‘সেরেছে! এ তো আরেক লুচ্চি বেগম!’

মিসেস চৌধুরীকে আর কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার সাহস ওদের আর কারোরই নেই! তিনি অধিরাজের দিকে একটা কটাক্ষপাত করে মৃদুমন্দ চালে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন। মিসেস চৌধুরী বেরিয়ে যেতেই অর্ণব জোরে শ্বাস ফেলল। অধিরাজ রুমালে মুখ মুছে বলল, ‘নেক্সট?

এরপরে এলেন ডঃ সুদীপ চ্যাটার্জি এবং সুপর্ণা চ্যাটার্জি। সুজিত ও শ্রুতির বাবা-মা। যথারীতি তাঁরাও আগের দিন রাতটা ঘুমিয়েই কাটিয়েছেন। একই উত্তর শুনতে শুনতে অধিরাজ বোর হয়ে গিয়েছিল। তাই অন্য প্রশ্ন করল।

‘আপনি জানলেন কী করে যে আবীরের কন্ডাক্ট ডিজ-অর্ডার আছে?’

সুদীপ একটু সতর্ক দৃষ্টিতে তাকালেন, ‘আমার এক বন্ধুর কাছে আবীরের ট্রিটমেন্ট চলছিল। আমি একবার ওর চেম্বারে গিয়েছিলাম। ঠিক তখনই আবীর ওর চেম্বার থেকে বেরোচ্ছিল। আমি আমার বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করতেই ও বলল, আবীরের কনডাক্ট ডিজ-অর্ডারের ট্রিটমেন্ট চলছে।’

‘ফোবিয়ান্সের সদস্যরা যে প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ফোবিয়ায় আক্রান্ত তা জানতেন আপনি?’

‘আমি জানব কী করে? ওরা কেউ আমার কাছে চিকিৎসা করতে আসেনি।’

অধিরাজ বুঝল যে সুদীপ অত্যন্ত সতর্ক মানুষ। সে প্রশ্নের ধরণ পালটাল, ‘আকাশের বাবা-মা আকাশের মৃত্যুর জন্য সরাসরি ফোবিয়ান্সের বিরুদ্ধে র‍্যাগিঙের রিপোর্ট করেছিলেন। আপনারা করেননি কেন?’

‘কারণ সুজিত কিছুতেই মুখ খুলছিল না। তার ওপর পরিস্থিতি তারই প্রতিকূল ছিল। তাকেই নেশাচ্ছন্ন অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। হস্টেল কর্তৃপক্ষ কোনো কথা শুনছিলেন না!’

‘সুজিতের মৃত্যুর পরও আপনারা কোনোরকম স্টেপ নেননি?’

‘কার বিরুদ্ধে স্টেপ নিতাম?’ তিনি যেন একটু উত্তেজিত, ‘তখন ওরা সবাই কলেজ থেকে বেরিয়ে সেটলড হয়ে গিয়েছে। কে কোথায় আছে কিছুই জানা ছিল না। তাছাড়া স্টেপ নিতাম কোন্ গ্রাউন্ডে? সুজিত সুইসাইড করেছিল।’

‘আপনি নিজে একজন সাইকায়াট্রিস্ট। সুজিতের ঠিকমতো চিকিৎসা হলে হয়তো বেঁচে যেত।

সুদীপ কিছুক্ষণ মুখ নীচু করে বসে রইলেন। তারপর খুব আস্তে বললেন, ‘ঈশ্বর জানেন, চেষ্টার ত্রুটি রাখিনি। আমি নিজে ওর ট্রিটমেন্ট করিনি পর্যন্ত। আমার থেকে অনেক বড়, অনেক বেশি নামী দামি সাইকায়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম ওকে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না! ও ক্রমশই ডিপ্রেশনে ডুবতে শুরু করেছিল। কিছুতেই ওকে সেখান থেকে বের করা গেল না!’ ভদ্রলোকের চোখ সজল হয়ে ওঠে, ‘আমাদেরই দোষ। আরও একটু নজরে নজরে রাখলে হয়তো এটা হত না।

‘আপনার স্ত্রী…?’

‘ও অ্যালঝাইমারের পেশেন্ট। দেখতেই তো পাচ্ছেন, ও কথা বলতেও ভুলে গিয়েছে। সবসময়ই এভাবে চুপ করে বসে থাকে। আমাকেও মাঝেমাঝে চিনতে পারে না। ওকে একা একা বাড়িতে রেখে আসার সাহস নেই বলেই সব জায়গায় সঙ্গে করে নিয়ে যাই। একা থাকলেই ও বাইরে বেরিয়ে যায়। বেশ কয়েকবার হারিয়েও গিয়েছিল। অতি কষ্টে খুঁজে পেয়েছি।’

অদ্ভুত ট্র্যাজেডি! সন্তান মারা গিয়েছে। স্ত্রী অ্যালঝাইমার রোগগ্রস্ত। ডঃ সুদীপ চ্যাটার্জি নিজে সাইকায়াট্রিস্ট হওয়া সত্ত্বেও স্ত্রী বা সন্তান, কাউকেই বাঁচাতে পারলেন না! এ যন্ত্রণা যে ঠিক কতখানি প্রাণান্তকর, তা একমাত্র ভুক্তভোগীই জানে। ভদ্রলোক অসীম জ্বালায় বলে উঠলেন, ‘ওই ছেলেমেয়েগুলোকে একসময় অনেক শাপ-শাপান্ত করেছি। প্রত্যেকদিন ওদের শাস্তি চেয়েছি। সম্ভব হলে আমি নিজেই শাস্তি দিতাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ওদের মৃত্যুতে আমাদের কোনো হাত নেই। যদি থাকত, তবে আমি বুক ঠুকে সগর্বে স্বীকার করতাম।’

‘তবে আপনার মেয়ে দাবি করছেন কেন যে খুনগুলো তিনিই করেছেন?’

সুদীপের মুখ রক্তহীন হয়ে যায়। তিনি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছেন, ‘শ্রুতি এ-কথা বলেছে?’

‘বলেছেন।’ অধিরাজ স্থির দৃষ্টিতে সুদীপকে জরিপ করছে, ‘হয়তো কাউকে বাঁচাবার চেষ্টা করছেন।

‘আমি জানি না, বলতে পারব না।’ তিনি যেন একটু বিচলিত, ‘আমি জানি না ও কাকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এইটুকু জানি যে এই ঘটনার সঙ্গে ওর কোনোরকম যোগাযোগ নেই।’

‘হয়তো।’ অধিরাজ বলল, ‘কিন্তু আপনি জানেন কিনা জানি না, প্রত্যেকবার উনি প্রায় পুলিসের আগেই অকুস্থলে পৌঁছে যান। ওঁকে নাকি কেউ মৃত্যুগুলোর খবর দেয়! কিন্তু কে খবর দেয় তা বলতে রাজি নন। ব্যাপারটা সন্দেহজনক নয় কি?’

সুদীপ ঠান্ডা শান্ত দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ অধিরাজের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর চোখে একটা অদ্ভুত দ্বিধা কাজ করছে। গলার হাড়টা বেশ কয়েকবার নড়ল। যেন কিছু বলতে গিয়েও বারবার থেমে যাচ্ছেন ভদ্রলোক। অবস্থা দেখে শেষপর্যন্ত অধিরাজ‍ই জানতে চাইল, ‘কিছু বলবেন আপনি?’

তিনি যেন একটা উদগত আবেগকে রোধ করলেন, ‘না।’

রজত চৌধুরী বিশেষ কিছু সাহায্য করতে পারলেন না। তিনি অবশ্য রাতটা ঘুমিয়ে কাটাননি। একটা ইন্টারন্যাশনাল ওয়েবাইনার অ্যাটেন্ড করতে হয়েছিল বলে প্রায় সারা রাতই জেগে ছিলেন। কোনো প্রমাণ আছে কিনা জিজ্ঞাসা করতেই জানালেন, উক্ত ওয়েবাইনারের সম্পূর্ণ রেকর্ডিং তার কাছে আছে। প্রয়োজন পড়লে তিনি দেখাতেও পারেন। এ ছাড়া তার অগণিত কলিগ ও বসও সেই ওয়েবাইনারে উপস্থিত ছিলেন। সি.আই.ডি তাঁদের জেরা করলেই জানতে পারবে।

রজত চৌধুরীই সম্ভবত একমাত্র মানুষ, যার অ্যালিবাই বেশ শক্তপোক্ত। অধিরাজ প্রসঙ্গান্তরে গেল, ‘আপনি আকাশ বা সুজিতের ব্যাপারে কিছু শুনেছিলেন? কিছু কানে এসেছিল?’

‘সুজিতের ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না। কিন্তু আকাশ দত্ত সম্পর্কে বেশ কিছু কথা শুনেছি।’

‘কী রকম?’

‘অনেকেই বলে যে আকাশের মৃত্যুর সঙ্গে ওই হন্টেড রুম কোনোভাবে জড়িত। সবাই মানত ঘরটা অভিশপ্ত। শ্রেয়স নামের একটি ছেলে ওই ঘরে মারা গিয়েছিল। তার ওপর আবার আকাশের মৃত্যু।’

এই মুহূর্তে ভূতের গল্প শোনার কোনো ইচ্ছে ছিল না অধিরাজের। সে বাধা দিয়ে বলে ওঠে, ‘ভৌতিক গল্প ছাড়া অন্য কিছু?’

‘তেমন কিছু নয়, তবে আমাদের এক সিনিয়র রাণাদা একবার একটা কথা বলেছিল। আকাশের মৃত্যুর সঙ্গে তার কতটা যোগ আছে তা জানি না।’

‘কী রকম? ‘

‘ও বলেছিল যে আকাশের মৃত্যুর দিন রাতে ও বাইরে দাঁড়িয়ে একটু সিগারেট খাচ্ছিল। তখন দেখতে পায়, একটা ছায়ামূর্তি চুপি চুপি এসে কী যেন ঝোপের মধ্যে ফেলে দিয়ে চলে গেল। রাণাদার খুব কৌতূহল হয়। ও দেখতে গেল যে জিনিসটা কী। একটু খোঁজাখুঁজি করতেই কিছু ছোট ছোট কাগজের টুকরো পেল। রাণাদা বলেছিল, ওগুলো একটা মুখোশের টুকরো ছিল। ও টুকরোগুলো জোড়া দিয়েও দেখেছিল। ওটা একটা ভয়ংকর মুখোশ। সেটাকে কে যেন কাঁচি দিয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে ঝোপের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।’

‘ইন্টারেস্টিং!’ অধিরাজের চোখ যেন জ্বলে উঠল, ‘মুখোশের টুকরোগুলো কে ফেলেছিল তা বলেনি?’

‘না। ও ঠিকমতো দেখতে পায়নি।’

অধিরাজ হঠাৎই যেন অন্যমনস্ক হয়ে যায়। ভাসা ভাসা চোখে রজতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে। ধন্যবাদ।’

(২১)

‘তোমার কী মনে হয়?‘

একরাশ অন্ধকারের মধ্যে বসেছিল দুটো প্রাণী। এখানে শুধু অন্ধকার, আর নীরবতা। তার সঙ্গে বিধ্বংসী একাকিত্ব। যে একাকিত্বের কোনো সীমা পরিসীমা নেই। কেউ সে একাকিত্বের প্রাচীর ভেঙে দিতে আসবে না! কেউ সেই নির্জনতাকে ভেঙে হেসে উঠবে না। এই মানুষদুটো আজ হাসতে ভুলে গিয়েছে! জীবনের কোনো আনন্দই আর তাদের স্পর্শ করতে পারে না। তাঁরা নিস্পৃহ, নিরাসক্ত।

‘কী মনে হবে?’

অমর ধীর স্বরে উত্তর দেন, ‘এটা রুটিন এনকোয়ারি ছিল।’

‘অফিসাররা কি এখনও বোঝেননি যে আমিই খুনী?’ মায়ার কণ্ঠস্বরে রাগ, ‘এতবার বলছি খুনগুলো আমিই করেছি, ওদের সবাইকে আমিই মেরেছি, ভবিষ্যতেও মারব, ওঁরা তবু বুঝছেন না! ‘

‘কারণ ওরা জানেন যে আসলে তুমি কাউকেই মারোনি।’ একটু বিরক্ত হয়ে অমর বললেন, ‘শুধু বললেই হয় না। প্রমাণ লাগে।’

‘প্রমাণ দিতে তো আমি রাজি আছি। স্বীকারোক্তিও দেব।’ তাঁর কণ্ঠস্বরে হতাশা, ‘কিন্তু অফিসাররা পাত্তাই দিচ্ছেন না! কত করে বললাম, আমিই ওদের খুন করেছি, ওদের পেছনে মারণবাণ আমিই ছেড়েছিলাম, কেউ শুনছে না!’

‘মায়া, ওসব মারণবাণে কিচ্ছু হয় না। সব বুজরুকি!

‘বললেই হল!’মায়া ফুঁসে ওঠেন, ‘তাহলে এতদিন ধরে দিনরাত্রি এক করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যা করে গিয়েছি, সবটাই নিতান্তই ছেলেমানুষী!

অমর এর উত্তরে কী বলবেন ভেবে পান না। বহুদিন ধরেই মায়ার মধ্যে এই উপসর্গ দেখা দিয়েছে। প্রথমে শুরু হয়েছিল পূজা-পাঠ দিয়ে। দিন নেই, রাত্রি নেই ঠাকুর ঘরে পড়ে থাকতেন তিনি। ঈশ্বরের কাছে বারবার কাতর প্রার্থনা করেছিলেন, যেন তাঁর ছেলের খুনীদের উচিত শাস্তি হয়। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। তলে তলে সবারই খবর রেখেছিলেন অমর। মায়ার অভিশাপে ওদের কোনো ক্ষতিই হয়নি। বরং বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে ওরা! চাকরি বাকরি করে সুখে সংসার করছে। ভাবতেই অমরের বুকের ভেতরে এক অন্তহীন জ্বালা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠত। তাঁর ছেলেটা বেঁচে থাকলে আজ তারও এমন সুখে থাকার কথা! একটা সুন্দর সংসার, সন্তান নিয়ে ভরভরন্ত ঘর হওয়ার কথা। কিন্তু কিছুই হল না! কিছুই হল না…!

মায়া ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন অমরের দিকে। কী বলছেন অমর! এতদিনের সব পরিশ্রম কি তবে বৃথা গেল! ওরা যখন একে একে মরতে শুরু করল তখন একটা অদ্ভুত তৃপ্তিতে মন ভরে গিয়েছিল তাঁর। হয়েছে…! এতদিনের সমস্ত প্রচেষ্টা, সমস্ত কষ্টের ফল ফলেছে! দিবারাত্রি ঈশ্বরের দরবারে মাথা ঠুকেছেন, হাত জোড় করে কাতর প্রার্থনা জানিয়েছেন, নানারকমের হোম-যজ্ঞ করেছেন, এমনকি শ্মশানে গিয়ে অঘোরী তান্ত্রিকের শরণাপন্নও হয়েছেন। কী করেননি মায়া! প্রতিদিন ভাবতেন, কী করলে প্রতিশোধ নেওয়া যাবে! ইচ্ছে হত, সবক-টাকে খুন করে ফেলেন! কিন্তু কী করে কী করবেন ভেবে পাননি।

আর আজ যখন তাঁর একান্ত সাধনার ফল ফলল, তখন ভীষণ আনন্দিত হয়েছিলেন তিনি। রাত্রে আকাশের ছবির সামনে বসে বলেছিলেন, ‘আমি শোধ নিয়েছি বাবাই। আমি তোর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছি।’

পেরেছেন তিনি…! অবশেষে পেরেছেন! মোমের পুতুলগুলো তো পুতুল নয়, ওগুলো ওদেরই প্রতিমূর্তি! প্রচণ্ড প্রতিশোধস্পৃহায় পুতুলগুলোর মাথা থেকে পা পর্যন্ত পিন ফুটিয়ে গিয়েছেন। যদি মোমের বদলে ওখানে জ্যান্ত মানুষগুলো থাকত, আর পিনের বদলে তাঁর হাতে ছুরি থাকত, তাহলেও বোধহয় হাত কাঁপত না তাঁর! একের পর এক আঘাত করে যেতেন তিনি! একের পর এক…!

‘কিন্তু সত্যি সত্যিই তো আমি ওদের মেরেছি।’ মায়া কিছুতেই হার মানবেন না, ‘আর কেউ না জানুক, আমি জানি।’

‘ঠিক কী হলে তুমি খুশি হবে মায়া!’ অমর বিরক্ত হয়ে উঠেছেন, ‘পুলিস তোমায় গ্রেফতার করলে তুমি স্যাটিসফায়েড হবে?’

‘ওদের খুনের দায়ে আমাকে ফাঁসি দিলেও আমার দুঃখ হবে না!’ মায়া আস্তে আস্তে বললেন, ‘সেই দায় আমি মাথা পেতে নেব।’

‘একটা কথা ভালো করে শুনে রাখো…!’ অমর উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন, ‘তুমি যা করে চলেছ সেসব ভন্ডামি আর বুজরুকি! ওতে কারোর ক্ষতি হয় না। স্রেফ অর্থ ও সময় নষ্ট! আমি তোমাকে বাধা দিইনি, কারণ তুমি এসব করে শান্তি পেতে। কিন্তু এখন ব্যাপারটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে! তুমি পুলিসকে পর্যন্ত বলেছ যে খুনগুলো তুমিই করেছ! ভাগ্য ভালো যে পুলিস তোমার কথা বিশ্বাস করেনি। নয়তো এই বুড়ো বয়েসে আমাদের দু-জনকেই জেলের ভাত খেতে হত। তুমি কি তাই চাও?’

মায়া যেন এই দুনিয়াতেই নেই! তার দু-চোখে এক রহস্যময় কুয়াশা জমেছে। তিনি ফিসফিস করে বললেন, ‘বুঝবে না… তুমি বুঝবে না!’

অমর বিরক্ত হয়ে স্থান পরিত্যাগ করলেন। সত্যিই অন্য কারোর পক্ষে বোঝা অসম্ভব! এটা যে তার কত বড়ো পরিতৃপ্তির জায়গা সেটা অন্য কেউ বুঝে উঠতে পারবে না। যখন মনে হয়, ছেলের মৃত্যুর শোধ তিনি নিয়েছেন, তখন ঠিক কতটা শান্তি পান তা বলে বোঝানো যাবে না। এতদিনের সমস্ত জ্বালা, সমস্ত যন্ত্রণা জুড়িয়ে যায়। সমস্ত দুঃখ কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যান। এক অনাবিল তৃপ্তিতে বিড়বিড় করেন, ‘পেরেছি… আমি পেরেছি… আমি পেরেছি…!’

কিন্তু অমর এসব কী বললেন! সব বুজরুকি! তাহলে কি মায়া যা জানেন, যা অনুভব করেন, সব ভুল! ওদের মৃত্যুর পেছনে তাঁর কোনও কৃতিত্বই নেই! সবটাই ফাঁকি! যে বিশ্বাসে মনকে বেঁধে রেখেছেন, সেই বিশ্বাসেই যে চিড় ধরল! তাহলে সবটাই মিথ্যে! মায়ার শপথ মিথ্যে! তাঁর প্রচেষ্টা মিথ্যে!

এক লহমায় দুনিয়ার সব কিছু মিথ্যে হয়ে গেল তাঁর কাছে! হা হা করে প্রবল যন্ত্রণায় কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি।

ডঃ সুদীপ চ্যাটার্জি নিজের অনলাইন সেশন শেষ করে এসে বসলেন বারান্দায়। তখন সন্ধে হয়ে আসছে। পড়ন্ত আলোর নিভু নিভু রশ্মি শেষমুহূর্তের জন্য পৃথিবীকে এক বিষণ্ণ আভায় মুড়ে দিয়েছে। আকাশে দীঘল ডানা মেলে নিজেদের নীড়ের উদ্দেশ্যে উড়ান দিয়েছে পাখিরা। তাদের কলরবে চতুর্দিক মুখরিত হয়ে উঠেছে। ছায়ার নিঃশ্বাসের মতো সন্ধ্যা নেমে আসছে পৃথিবীর মাটিতে। ঘরে ঘরে বিন্দু বিন্দু আলো জ্বলে উঠছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই টিপ টিপ করে জ্বলে উঠবে সমস্ত আলোকবিন্দুগুলো। এই ব্যালকনি থেকে দেখলে মনে হয় যেন অজস্র নক্ষত্র মাটিতে নেমে এসেছে! চিরদিনই সন্ধ্যা বড় পবিত্র তাঁর কাছে। এই মায়াবী আলোয় যখন দূর থেকে ভেসে আসে শঙ্খ ঘণ্টাধ্বনি, তখন হৃদয়ে অদ্ভুত একটা প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে।

সুপর্ণা ঠিক তাঁর পাশের চেয়ারটাতেই বসেছিলেন। ভাসা ভাসা চোখে তাকিয়েছিলেন বাইরের দিকে। তার দৃষ্টি শূন্য। ঠিক কোথাও গিয়ে পৌঁছয় না! বুঝি সব কিছু দেখেও দেখে না! অদ্ভুত এক নির্লিপ্তি মাখা দৃষ্টি। দুনিয়ার কোনো কিছুতেই বোধহয় তাঁর কিছু এসে যায় না। তিনি এক এমন জগতে রয়েছেন যার সঙ্গে বাস্তব পৃথিবীর কোনো সম্পর্ক নেই! মাঝেমধ্যে তাঁকে মৃত বলেই ভ্রম হয়! কে জানে, কবে নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে যাবেন! এখনও অবিকল পুতুলের মতো স্থির হয়ে বসে আছেন!

একসময় সুজিতও এমন বসে থাকত! বহুবার এই ব্যালকনিতে বসে সূর্যাস্ত দেখেছে সে। সূর্যের অন্তিম রশ্মি তার মুখের ওপর এসে পড়ে শূন্যতা, বিষণ্ণতাকে আরও প্রকট করে তুলত। সেও শেষের দিকে এমনই চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল।

ছেলেটা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একটা ব্যর্থ জীবনের সঙ্গে লড়ছিল। যখন সে জেজিইসিতে ভর্তি হল, তখন তার আলো ঝলমলে মুখটা মনে আছে সুদীপের। এক তরুণ, যে পূর্ণোদ্যমে এক নতুন ও সফল জীবনের দিকে পা বাড়াচ্ছিল, তার ইতিহাস শেষ হল অন্ধকারে! এ কি আদৌ ক্ষমা করার যোগ্য! তিনি সি.আই.ডি ব্যুরোয় বসে আবীরের অগোচরেই একদৃষ্টে জরিপ করছিলেন তাকে। ওকে কি কখনও ক্ষমা করা যায়! তাদের জীবন উজাড় করে দিয়ে ও শান্তিতে বসে আছে! কেমন করে মাফ করে দেবেন ওকে!

সুদীপের চোয়াল কঠিন হয়ে ওঠে। না, ওকে ক্ষমা করা যায় না! এ জীবনে অন্তত ফোবিয়ান্স ক্ষমা পাবে না। ওদের মরতেই হবে। এটাই ওদের যোগ্য শাস্তি!

ভাবতেই সুদীপের ভুরুতে ভাঁজ পড়ল। কিন্তু শ্রুতির ব্যাপারটা কী? সে আবার এর মধ্যে জড়িয়ে পড়ল না তো! অফিসার বললেন শ্রুতি কাউকে আড়াল করছে! কাকে? তবে কি শ্রুতি কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে! যে ফোনটা ওর কাছে এসেছিল তার গলা কি চিনতে পেরেছে সে? সেইজন্যই হয়তো এই অসহযোগিতা, এই নীরবতা! সি.আই.ডি ওকে সন্দেহ করছে। কোনও বিপদে পড়বে না তো মেয়েটা!

ভাবতেই সুদীপের বুকের ভেতরটা ধ্বক করে ওঠে। এক সন্তানকে তো হারিয়েছেনই, অন্যজনের ওপর কোনোরকম বিপদ এসে পড়বে না তো! শ্রুতি বড্ড বেপরোয়া! ছোটোবেলা থেকেই স্বাধীনচেতা। শৈশব থেকেই তার সমস্ত কাজকেই প্রশ্রয় দিয়ে এসেছেন সুদীপ। সেজন্যই শ্রুতি নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেয়। অন্য কারোর কথা শুনতে সে অভ্যস্ত নয়! তার মনে যা আসে, সে তাই করে। নিজের তথাকথিত সাহসী ও স্বাধীনচেতা মেয়েকে নিয়ে ভারী গর্ব ছিল সুদীপের। কিন্তু আজ বড়ো আফসোস হল! মেয়েটার মধ্যে ভয় ডর বলে কোনো বস্তুই নেই! কখনও ওর কোনো কাজে বা সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করেননি তিনি। বোধহয় করা উচিত ছিল। তাহলে হয়তো আজ এ সমস্যায় পড়তে হত না।

সুদীপ চিন্তায় পড়লেন। কী জানে শ্রুতি? কতদূরই বা জানে! সবকিছু কি জানতে পেরেছে সে? রিপোর্টাররা চিরকালই অনুসন্ধিৎসু হয়। শ্রুতি নিজেই অনুসন্ধান করতে শুরু করেনি তো?

সুদীপ সুপর্ণার দিকে তাকালেন। তিনি তখনও একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন বাইরের দিকে। কী যে দেখছেন, আদৌ কিছু দেখছেন কি না কে জানে! তাঁর দৃষ্টি নির্লিপ্ত। সে দৃষ্টি কোথাও কিছু খোঁজে না!

‘সুজিত এখনও ফেরেনি না?’

অনেক দিনের নৈঃশব্দ ভেঙে আচমকাই কথা বলে উঠলেন সুপর্ণা। সুদীপ চমকে ওঠেন। আজ হঠাৎ করে সুজিতকে কীভাবে মনে পড়ে গেল সুপর্ণার! অধিকাংশ সময়ে তিনি তো নীরবই থাকেন! দেখলে মনে হয়, জাগতিক কোনো বস্তু বা ব্যক্তির ওপর তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। তবে হঠাৎ আজ সুজিতের কথা কেন!

সুপর্ণার ভুরুতে স্পষ্ট অসন্তোষ। একটু চিন্তিত স্বরেই বললেন, ‘সন্ধে হয়ে গেল, সুজিত এখনও স্কুল থেকে ফিরল না তো!’

স্কুল! কোন্ দুনিয়ায় পড়ে আছেন সুপর্ণা! তাঁর ক্ষীণ স্মৃতি ঠিক কোথায় এসে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছে! সুদীপ কিছু বলার আগেই আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। করুণ, ক্লান্ত স্বরে ডাকলেন, ‘সুজিত! সুজিত! ফিরে এসেছিস বাবা?… সুজিত?… সুজিত!’

সুদীপের চোখ ভিজে আসে। সুপর্ণাকে কে জানাবে যে সুজিত আর কখনোই ফিরে আসবে না!

একটু পরেই অন্ধকার নামল।

আকাশ আজ মেঘমুক্ত। গোটা আকাশেই শলমা জরির মতো নক্ষত্রের কারুকার্য ঝিকমিক করছে। তার ফাঁকেই উঁকি মারছে একফালি চাঁদ। মাঝেমধ্যেই দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে যাচ্ছে হাওয়া! যেন কানে কানে কিছু ফিসফিস করে বলতে চায়। চতুর্দিক এতটাই নিস্তব্ধ যে একটা দুটো পাতা খসার শব্দও শোনা যায়। তার মাঝেই থেকে থেকে শিরশির করে উঠছে নারকেল গাছের পাতা। যেন কোনো অজ্ঞাত কারণে শিহরিত হয়ে উঠছে। অল্প অল্প হাওয়ায় ঝাঁকড়াচুলো গাছগুলো মৃদু মৃদু মাথা দোলায়। তার পাতায় পাতায় জোনাকির সবুজাভ আলো ক্রমাগত জ্বলছে নিভছে।

সেদিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন আবীর। সি.আই.ডি ব্যুরো থেকে এসে সেই যে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছেন, সারাদিনে আর সে দরজা খোলেননি। রতন বাইরে থেকে কাতর গলায় বলেছে, ‘বাবু, একবার মা’রে শেষ দেখা দেখে যান।’ অনেকবার আকুল কাকুতি-মিনতি করেছে। কিন্তু সবই ব্যর্থ! আবীর দরজা খোলেননি। এমনকি খাওয়ার জন্যও বাইরে আসেননি। তিনি সেই যে নিজেকে ঘরবন্দি করেছেন তারপর থেকে একবারও তার দেখা পায়নি রতন।

এতক্ষণ ধরে দাঁতে কুটোটিও কাটেননি। খেতে হলেই তো দরজা খুলতে হবে! কে বলতে পারে দরজার ওপারে তার প্রতীক্ষায় ঠিক কী আছে!

এমন ভয় সারা জীবনে কখনও পাননি আবীর। সবসময়ই টের পাচ্ছেন মৃত্যু তার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে! তার নিষ্ঠুর থাবা ক্রমাগতই এগিয়ে আসছে ওর দিকে। যে কোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে! কিন্তু কখন? কীভাবে? ক্ষুধা-তৃষ্ণায় জ্বলছেন। কিন্তু খাওয়ার উপায় নেই। কে বলতে পারে, রতন হয়তো খাবারে বা জলে বিষ মিশিয়ে দেবে! বিশ্বাস নেই… কাউকে বিশ্বাস নেই…!

আবীরের হঠাৎ মনে পড়ে গেল আকাশের মায়ের চোখদুটো! যতক্ষণ ওখানে বসেছিলেন একদৃষ্টে তাকিয়েছিলেন তার দিকে! ভদ্রমহিলার দৃষ্টিতে কী ভয়ংকর প্রতিশোধস্পৃহা! দুই চোখে যেন আগুন জ্বলছিল! ভয়ে তাঁর দিকে তাকাতে পারছিলেন না আবীর। আবার কী একটা অমোঘ আকর্ষণে চোখে চোখ পড়ে যাচ্ছিল। শুধু কি তিনিই? সুজিতের বাবা সুদীপের জিঘাংসাময় দৃষ্টি স্পষ্ট বলে দিচ্ছিল, সুযোগ পেলেই তিনি আবীরকে খুন করে বসবেন। কী ভয়াবহ দৃষ্টি! চোখ এড়ায়নি রজত চৌধুরীর ব্যঙ্গবঙ্কিম হাসিও! ছেলেটা হাসছিল! একসময়ে এই আবীরই ওকে এতটাই ল্যাজে-গোবরে করেছিলেন যে সব ছেড়েছুড়ে পালিয়ে গিয়েছিল! কিন্তু আজ সেই ছেলেটাই তাকে দেখে বাঁকা হাসি হাসছে! কিন্তু ওকে কেন ডেকেছিল পুলিস? তবে কি ঘটনাটা আন্দাজ করতে পেরেছে! বহুবছরের লুকিয়ে রাখা সত্য কি তবে এবার বেরিয়ে আসবে!

আবীরের দমবন্ধ হয়ে আসে! চতুর্দিকে এত শত্রু যে একটু শ্বাস নেওয়ার উপায় নেই! জানা শত্রু হলে তবু লড়া যায়। কিন্তু অজানা শত্রুর বিরুদ্ধে কীভাবে লড়বেন! সে যে কবে আসবে, কোথা দিয়ে আসবে তা কেউ জানে না! পেটের মধ্যে ক্ষুধা তান্ডব করছে! খিদের চোটে মাথা ঘুরছে! তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে আসছে। দেহটাও এখন শত্রুতা শুরু করেছে। তবু দরজা খুলবেন না! এই বদ্ধ ঘরের মধ্যেই তিনি নিরা পদ। বাইরে গেলেই হয়তো…!

ব্যালকনির দিকের দরজাটা খোলা ছিল। সেখান দিয়ে ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়া ঘরে ঢুকছে। আবীরের ভারী আরাম লাগছিল। তিনি আস্তে আস্তে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন। উমার আবার গাছপালার ভারী শখ ছিল। সুযোগ পেয়ে ব্যালকনিতে নানারকম গাছ লাগিয়েছিলেন। গাছগুলোর পরিচিত স্পর্শ পেয়ে একটু ধাতস্থ হলেন তিনি। নাঃ, এখানে গাছপালার মধ্যে নিরাপদ আবীর। তার এই অতি পরিচিত গাছগুলো কাউকে ভয় দেখাতে জানে না! তারা অপ্রয়োজনে শোরগোল করতেও পারে না! আরামপ্রদ নীরবতার মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে ভালো লাগছিল আবীরের। এখানে কোনো ভয় নেই!

রাস্তায় সার সার ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলে উঠেছে। একসময় এই রাস্তাটাই অন্যতম ব্যস্ত রাস্তা ছিল। কিন্তু এখন চতুর্দিক শুনশান। মাঝেমধ্যে একটা, দুটো বাইক বা সাইকেল চলে যাচ্ছে। এ ছাড়া আর কোনো যানবাহনের দেখা পাওয়া যায় না। এক পাশে একটা চায়ের দোকানে দু চারটে লোক এখনও রয়েছে। লকডাউনের রীতিনীতিকে একরকম কাঁচকলা দেখিয়ে দোকানটা এখনও খোলা! লোকে মহানন্দে চা খাচ্ছে। একজনেরও মুখে মাস্ক নেই!

অন্যমনস্ক দৃষ্টিতেই চতুর্দিকে চোখ বোলাচ্ছিলেন আবীর। কিন্তু দেখতে দেখতেই হঠাৎ একটা অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়তেই শিউরে উঠলেন। ডিভাইডারের অন্যপ্রান্তে ঠিক একটা ল্যাম্পপোস্টের নীচে ও কে দাঁড়িয়ে আছে! এই মেয়েটাকে চেনেন আবীর! শ্রুতি চ্যাটার্জি! আজই ওকে সি.আই.ডি ব্যুরোয় দেখেছেন! এই সেই রিপে ার্টার যে ফোবিয়ান্সের প্রত্যেক সদস্যের মৃত্যুর খবর সবার আগে জানতে পারে! শুধু তাই নয়, ও সুজিত চ্যাটার্জির বোনও বটে! কিন্তু এখানে কী করছে! অমনভাবে এইদিকেই তাকিয়ে আছে কেন!

আবীরের হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে ওঠে। শ্রুতি মৃত্যুর খবর আগে থেকেই জানতে পারে! আজও তেমন কিছুই জেনেছে কি? হয়তো অপেক্ষা করছে সঠিক সময়ের! আশঙ্কায়, আতঙ্কে তার রক্ত হিম হয়ে আসে। এই মেয়েটা আসলে মৃত্যুর দূত! মৃত্যুর সংবাদ হয়তো ও-ই বয়ে আনে! আবীরের মনে হয়, ও গৃধ্রের মতো তার মৃত্যুর অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করছে কখন আবীরের শিয়রে শমন এসে দাঁড়াবে। এ এক অদ্ভুত নিষ্ঠুর প্রতীক্ষা!

এত দূর থেকে শ্রুতির চোখদুটো দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু আবীরের মনে হল, ওর চোখে ঝকঝক করছে এক তীক্ষ্ণ, নিষ্ঠুর কৌতুক! ও এখন অধীর প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে যে কখন আবীর…!’

‘মা… ও মা!… মা গো…!’

রতনের বুকফাটা কান্না তাকে এক ধাক্কা মেরে গেল! রতন কাঁদছে! কী হল! উমা কি তবে…!

হারাধনের সাতটি ছেলে সবাই মিলে দ্যাখ

ছয়টি আগেই নিকেশ হল, রইল বাকি এক

(২২)

দেখতে দেখতে কেটে গেল আরও তিনটে দিন।

ফোবিয়ান্সের সদস্যদের মধ্যে এখন একা আবীরই বেঁচে আছেন। উমার অবস্থা ক্রমাগতই অবনতির দিকে যাচ্ছিল। অবশেষে তিনিও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। যদিও তাঁর মৃত্যুটা স্বাভাবিক কি না তা বলা মুশকিল। অর্ণবের মনে হচ্ছিল, এর পেছনেও কারোর মস্তিষ্ক নেই তো? কে বলতে পারে, হয়তো মিসেস সেনের কোমায় চলে যাওয়ার পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে! কোনো অবহেলা, বা ইচ্ছাকৃত অযত্নের ফলে হয়তো তাঁর মৃত্যুটা ঘটল! সেক্ষেত্রেও অবশ্য প্রাইম সাসপেক্ট আবীরই হন। ঐ লোকটাকে একটুও বিশ্বাস হয় না অর্ণবের।

অন্যদিকে সি.আই.ডি তাদের খবরি নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। প্রত্যেক সাসপেক্টের ওপর পালা করে নজর রাখছে ওরা। কিন্তু তেমন কোনো লিড পাওয়া যায়নি। মিসেস চৌধুরীকে শ্যাডো করছে আত্রেয়ী দত্ত। শ্রুতি চ্যাটার্জিকে কৌশানী বোস। মায়া ও অমরকে পবিত্র। ডঃ সুদীপ চ্যাটার্জি-র পেছনে আঠার মতো লেগে আছে পুলিসের ইনফর্মার। বাকিরাও খবরিদের নজরবন্দি। আবীর সেনের ওপরেও কড়া নজর রাখা হচ্ছে। খবরিদের কাছ থেকে আপডেট সংগ্রহ করার দায়িত্বে অর্ণব। হিস্ট্রি-শিটারদের রাউন্ড আপ করা হয়েছে। যদিও নিট ফলাফল শূন্য! শ্রুতি চ্যাটার্জির কল ডিটেইলস থেকে উক্ত রহস্যময় নম্বরটি বের করা হয়েছে, কিন্তু সেখানেও ডেড এন্ড! যথারীতি সেটিও একটি প্রি পেইড সিম ও এক উত্তরপ্রদেশনিবাসী রাজেন্দ্র প্রসাদ নামক ব্যক্তির নামে কেনা হয়েছে!

সবার ব্যাঙ্ক ডিটেইলসও চেক করা হয়েছে। মিসেস চৌধুরী যা বলেছেন তা সম্পূর্ণ সত্যি। সৌমিত্র চৌধুরীর ব্যাঙ্ক ডিটেইলস রীতিমতো সন্দেহজনক। একটা অ্যাকাউন্ট থেকে তার মৃত্যুর দু-মাস আগে থেকেই ক্রমাগত টাকা এসেছে। একটা, দুটো টাকা নয়, লক্ষাধিক! শুধু সৌমিত্রই নয়, উৎপল মিত্র এবং মৃন্ময় দত্তরায়ের অ্যাকাউন্টেও ওই একই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা আসছিল। কিন্তু সেই বিশেষ অ্যাকাউন্টটা শুধু এই তিনটে অ্যাকাউন্টেই মানি ট্রানজাকশনের জন্যই খোলা হয়েছিল। উপরোক্ত তিনজনের মৃত্যুর পর অ্যাকাউন্টটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। অ্যাকাউন্টের মালিক জনৈক হিমাদ্রি সরকার, মারা গেছেন বেশ কয়েকমাস আগে। বাড়ির অন্য সদস্যদের কারোর কোনো আইডিয়া নেই অ্যাকাউন্টটির ব্যাপারে। সম্ভবত অ্যাকাউন্টটি ভুয়ো।

‘ব্ল্যাকমেলিঙের অ্যাঙ্গেল থাকলেও থাকতে পারে।’ অধিরাজ চিন্তিত মুখে বলে, ‘কিন্তু এই তিনজন কাকেই বা ব্ল্যাকমেল করছিল? কেনই বা?’

‘হতে পারে যে এরা এমন কোনো গোপন কথা জানত যা প্রকাশ্যে এলে কারোর সমূহ ক্ষতি।’ পবিত্র তার মতামত পেশ করে, ‘আমার তো মনে হচ্ছে কেসটা ব্ল্যাকমেলিঙের।’

‘হুঁ।’ অধিরাজের চোখ চিন্তামগ্ন, ‘অমর দত্ত ও মায়া দত্তের আপডেট কী? ‘

‘কিছুই আপডেট নেই রাজা। এরা কেউই বাড়ি ছেড়ে বেরোননি। ওরা দু-জনে বিশেষ কোথাও যান না। অষ্টপ্রহর ঘরের মধ্যেই থাকেন। বাড়ির ভেতর থেকে হয় গাঁক গাঁক করে টিভির আওয়াজ আসছে, নয়তো শঙ্খ-ঘণ্টাধ্বনির! এর মধ্যে এক বিরাট জটাওয়ালা তান্ত্রিক এসেছিল। মায়াদেবী তান্ত্রিককে খুব শ্রদ্ধা করেন বলে মনে হল। যেদিন তান্ত্রিক এসেছিল সেদিন প্রচুর যাগযজ্ঞ হল। এই অবধিই। এ ছাড়া দু-জনের জীবনযাত্রা খুব সাধারণ। বলার মতো কিছু নেই।’

‘ইনিই সম্ভবত ওঁর ব্ল্যাকম্যাজিকের গুরু।’ অধিরাজ আত্রেয়ী দত্তের দিকে তাকিয়েছে, ‘আপনার আপডেট?

‘মিসেস চৌধুরী খুব ফিশি ক্যারেক্টার স্যার।’ আত্রেয়ী বলল, ‘দিনের মধ্যে ক-ঘণ্টা উনি সেন্সে থাকেন তা বলা মুশকিল। খুব দামি দামি মদ খান। পুরুষ সঙ্গী একাধিক। এই লকডাউনের মধ্যেও দিব্যি ব্যাটিং করে যাচ্ছেন। স্বামীর মৃত্যুতে একটুও শোকগ্রস্ত নন। বরং উলটোটাই। রক মিউজিক শুনতে খুব ভালোবাসেন। দিবা রাত্রি ওঁর ফ্ল্যাটে রক মিউজিক বাজছে। ইনশিওরেন্স ক্লেইম করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। ইনশিওরেন্স অফিসে আর ব্যাঙ্কের চক্কর কাটছেন।’

‘ওঁর স্বামীর যা ক্যারেক্টার তাতে তাঁর মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত হলেই বরং অবাক হতাম।’ অধিরাজের চোখ কৌশানী বোসের দিকে চলে যায়, ‘ইয়েস মাদমোয়াজেল?’

‘শ্রুতিও অদ্ভুত ক্যারেক্টার।’ এতক্ষণে কিছু বলতে পেরে কৌশানী যেন ধন্য হল। গড়গড়িয়ে প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে গেল, ‘এর মধ্যেও সর্বক্ষণ মুখে মাস্ক আর হাতে বুম নিয়ে দৌড়চ্ছে। মেয়েটা খুব পরিশ্রম করে। দিন রাত এক করে ছুটে বেড়ায়। কিন্তু ওদের অফিসটা আবীর সেনের ফ্ল্যাটের কাছে। মাঝেমধ্যেই ও আবীর সেনের ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আবীর সেনের ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে চুপ করে কীসের অপেক্ষায় যেন থাকে। তারপর আবার চলে যায়। এ ছাড়া আর বিশেষ কোনো সন্দেহজনক অ্যাকটিভিটি নেই।’

‘হুঁ।’ অধিরাজের চোখের দৃষ্টি অন্যমনস্ক, ‘অর্ণব, ইনফর্মারদের কী খবর?’

‘প্রত্যেকেই সাসপেক্টদের পেছনে লেগে আছে স্যার। কিন্তু সন্দেহজনক তেমন কিছু পাওয়া যায়নি।’ অর্ণব বলল, ‘ডঃ সুদীপ চ্যাটার্জি অনলাইনে বসছেন। মাঝেমধ্যে ক্লিনিকেও যাচ্ছেন। রজত চৌধুরী বাড়িতেই থাকেন। বাড়ি থেকেই ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছেন। বাকিরাও মোটামুটি সকলেই গৃহবন্দি। একমাত্র আবীর সেনের হাবভাবই সন্দেহজনক।’

‘কীরকম? ‘

‘কোথাও কিচ্ছু নেই ভদ্রলোক হঠাৎ করে গাড়িটাকে গ্যারাজে দিয়েছেন। উদ্দেশ্য গাড়ির সার্ভিসিং করা! মোবিল, ক্লাচের তার, ব্যাটারি ভালো করে চেক করতে বলেছেন। গাড়ির চারটে টায়ারই চেঞ্জ করেছেন। বলেছেন, নাকি লং ড্রাইভে যাবেন! ব্যাঙ্ক থেকে আর এ.টি.এম থেকে অল্প অল্প করে বেশ কিছু টাকা তুলেছেন। একসঙ্গে টাকা তুললেই হয়। বারবার কেন টাকা তুলছেন কে জানে! রয়্যাল হাইটসে ওঁরও ফ্ল্যাট আছে। অ্যাকচুয়ালি ওঁর নয়, ওঁর স্ত্রী-র। সেটাকেও বিক্রি করার চেষ্টায় আছেন।’ সে একটু থেমে যোগ করল, ‘তবে ইদানিং ওঁর হাবভাবে অদ্ভুত চেঞ্জ হয়েছে। রতনকে বাড়ি থেকে একরকম ঘাড় ধরে বেরই করে দিয়েছেন। টাকাপয়সা অবশ্য মিটিয়ে দিয়েছেন। বাড়িতে যে কাজের মেয়েটি আসত তাকেও ছাড়িয়ে দিয়েছেন, রান্নার লোকেরও চাকরি গেছে। যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন, ততক্ষণ যেন ভয়ে সিঁটিয়ে থাকেন। খবরিরা বলেছে, দুধওয়ালা দুধের প্যাকেট দিয়ে যায়, খবরের কাগজওয়ালা কাগজ, কিন্তু সেগুলো নিতেও দরজা খোলেন না ভদ্রলোক।’

‘রয়্যাল হাইটসে আবীরের ফ্ল্যাট আছে?’ অধিরাজের কণ্ঠস্বর উত্তেজিত, ‘এ খবরটা তো আগে জানা ছিল না!’

‘ইদানিং ওখানে যাতায়াত শুরু করেছেন। একটা থ্রি-বি-এইচ-কে ফ্ল্যাট আছে। শুনেছি, খুব কম দামে বিক্রি করছেন।’

‘রতন এখন কোথায় আছে তা জানো? ওর রিসেন্ট অ্যাড্রেস?’

‘হ্যাঁ স্যার। রতন এখন হাতিবাগানের একটা পুরনো বাড়িতে ভাড়া থাকে।’

‘হুম।’ অধিরাজের চোখে চিন্তার আবেশ, ‘বুঝলাম।’

‘রাজা, কোনোভাবে এই লোকটাই কালপ্রিট নয় তো?’ পবিত্র বলল, ‘এই ব্ল্যাকমেলিঙের অ্যাঙ্গেলটা আবীরের ক্ষেত্রে ঠিকঠাক বসছে। আমার মনে হয়, আবীরই আকাশকে মেরেছিল। ওর বন্ধুরা এতদিন বাদে হয়তো সত্যি কথা বলতে চাইছিল, তাই এক এক করে নিকেশ করে দিয়েছে। কোনো প্রমাণই নেই! আর এই সময়ে ও ব্যাটা লং ড্রাইভে কোথায় যাবে?’

‘লং ড্রাইভ নয়, পাখি উড়বে বলেই আমার ধারণা।’ অধিরাজ কী যেন চিন্তা করছে, ‘টাকা পয়সাও তুলছে একই কারণে। ভদ্রলোক আন্ডারগ্রাউন্ড হবার কথা ভাবছেন।

‘তাহলে তো ডেফিনিটলি এই লোকটাই কালপ্রিট! ‘

‘কালপ্রিট কি না জানি না।’ সে আত্মমগ্নভাবে বলে, ‘কিন্তু রজত চৌধুরী যদি সত্যি কথা বলে থাকে তবে আকাশের মৃত্যুর রহস্য ওই ছেঁড়া মুখোশটার মধ্যেই লুকিয়ে আছে।’

‘যাত্তারা!’ পবিত্র মুখ লম্বা করল, ‘মুখোশের সঙ্গে আকাশের মৃত্যুর কী সম্পর্ক?’

‘রীতিমতো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পবিত্র।’ অধিরাজ আত্মমগ্নভাবেই বলে, ‘নয়তো একটা মুখোশ কেউ ছিঁড়ে ফেলবেই বা কেন? আমার ধারণা ঐ মুখোশটাই আকাশের মৃত্যুর মূল কারণ!’

‘একটা মুখোশ কী করে মৃত্যুর কারণ হয় রাজা?’

‘হতেই পারে।’ সে বলল, ‘ভেবে দেখো, আকাশ যে ঘরে থাকত সেই ঘরটা আগেই হন্টেড বদনাম পেয়েছিল। ওর কোনো রুমমেটও ছিল না। একাই ওকে ওই ঘরে কাটাতে হত। হয়তো ছেলেটা ভয়ে ভয়েই থাকত। তার ওপর ফোবিয়ান্সের অত্যাচার! সব মিলিয়ে একটা জটিল পরিস্থিতি। ছোটোবেলা থেকেই তার হার্ট দুর্বল। এই পরিস্থিতিতে রাত্রে কেউ যদি ওরকম ভয়ংকর মুখোশ পরে তার সামনে যায়, তাহলে হার্ট অ্যাটাক অবধারিত! যারা ভয় দেখিয়েছিল, তারা এটাকে এক জাতীয় নিষ্ঠুর মজা হিসাবেই নিয়েছিল। জানত না যে ছেলেটার হার্ট দুর্বল। ফলস্বরূপ যা হওয়ার তা হল! ভয় দেখানোটা সম্ভবত বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। হয়তো সে ভয়ে ছুটোছুটি করেছিল, কেঁদেও ফেলেছিল। কিন্তু তারপরও ওরা থামেনি। আর কী! দুর্বল হৃৎপিণ্ড আর অত্যাচার সহ্য করতে পারল না। আকাশ হার্ট ফেল করল!’ অধিরাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, ‘দুঃখজনক মৃত্যু। একটা বাচ্চা ছেলে নেহাৎই কিছু মানুষের বীভৎস মজার শিকার হয়ে গেল! কিন্তু গল্প এখানেই শেষ নয়। এবার যারা ওকে ভয় দেখিয়েছিল, তাদের ভয় পাওয়ার পালা। কারণ তারা দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি যে ছেলেটা মারা যাবে। আমার ধারণা তারা ভয় পেয়েছিল। তাড়াহুড়োতে কী করবে ভেবে পায়নি। মুখোশটা ছিল একমাত্র এভিডেন্স। সেটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে চুপি চুপি ফেলে দিল। ভাবতেও পারেনি যে সে দৃশ্য কেউ দেখে ফেলবে!’

‘মাই গড!’ পবিত্র বিস্মিত, ‘এখন খুনগুলোও তো সেভাবেই হচ্ছে! যাকে বলে ভয় দেখিয়ে দেখিয়ে মারা! ‘

‘ঠিক তাই! আকাশের মৃত্যুর সঙ্গেও ভয় জড়িয়ে আছে, ফোবিয়ান্সের মৃত্যুর সঙ্গেও ভয়ই জড়িত। এই খুনগুলোর পেছনের মোটিভও হয়তো ভয়ই পবিত্র। এ কেসের মার্ডার ওয়েপনও ভয়, মোটিভও ভয়।’

‘মোটিভ ভয়!’

‘হ্যাঁ। কারোর ভয়ই এতগুলো মৃত্যুর কারণ। কিন্তু এখন স্পষ্ট করে বলা মুশকিল।’ অধিরাজ বলে, ‘ঠিক তারপরই ফোবিয়ান্সের ব্যবহারে পার্থক্য লক্ষ্য করো। তারা আর নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখেনি। একমাত্র আবীর ও উমার বৈবাহিক সম্পর্ক ছাড়া আর কারোর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না! অ্যাবসার্ড নয়? ‘

‘তার মানে ফোবিয়ান্সই আকাশকে ভয় দেখিয়েছিল!’

‘মোস্ট প্রব্যাবলি তাই। আকাশের মৃত্যুটাও কাইন্ড অব মার্ডার।‘

‘তাহলে আবীরকে গ্রেফতার করলেই তো হয়!

অধিরাজ মাথা নাড়ল, ‘এটা সম্পূর্ণ আমার ডিডাকশন। প্রমাণ নেই। বলার মতো লোকও অবশিষ্ট নেই। একে একে প্রায় সকলেই মারা গিয়েছে। যারা এ সম্পর্কে বলতে পারত তারা নিজেরাই ভয়ের শিকার হয়ে গিয়েছে। বাকি আছেন শুধু আবীর। তিনিও আবার পালাবার কথা ভাবছেন!

‘এখানে কিন্তু দুয়ে দুয়ে চার হচ্ছে রাজা।’ পবিত্র উত্তেজিত, ‘নির্ঘাৎ আকাশকে আবীর ভয় দেখিয়েছিল। তার ফলে আকাশের মৃত্যু হয়। কিন্তু তখনকার মতো সবাই ব্যাপারটাকে চেপে গেল। কেউ কারোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখল না। কিন্তু লকডাউন হওয়ার ফলে প্রত্যেকের টাকার অভাব দেখা দিল। সৌমিত্র, উৎপল, মৃন্ময়ের হয়তো কোনোভাবে দেখা হয়। ওরা ঠিক করে আবীরকে ব্ল্যাকমেল করবে। আবীরের বউয়ের পয়সার অভাব নেই। তাই আবীর ওদের টাকা দিতে বাধ্য। ‘

‘খুব ভালো ডিডাকশন। তারপর?’

‘ওরা সবাই এবার আবীরের সঙ্গে যোগাযোগ করল।’ পবিত্র উৎসাহ পেয়ে বলতে থাকে, ‘গিয়ে বলল আবীর যদি টাকা না দেয়, তবে আকাশের মৃত্যুরহস্য ফাঁস করে দেবে। স্বাভাবিকভাবেই আবীর ভয় পায়। সে একটা ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে ওদের টাকা দিতে থাকে। কিন্তু ওদের চাহিদা ক্রমাগতই বাড়তে থাকে।

‘পালাবে স্যার।’ গুল্লু জানাল, ‘গ্যারাজ থেকে এইমাত্র গাড়িটা ফিরল। একটু আগেই মালটা বড় বড় দুটো সুটকেস নামিয়ে গাড়িতে রেখে এসেছে। দরোয়ান জিজ্ঞাসা করছিল, ‘বাবু কোথাও যাচ্ছেন নাকি?’ ব্যাটা জবাবই দিল না! ওর হাবভাব মোটেই সুবিধার নয়।’

‘তুই ঠিক জানিস, পাবলিক আজই উড়বে?’

‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট আজই উড়বে স্যার। লোকটা বোধহয় পাগল হয়ে গিয়েছে। কেউ কোনো প্রশ্ন করলে জবাব দেয় না। নিজের মনেই কী যেন বিড়বিড় করে। কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ হঠাৎ চেঁচায়। কথায় কথায় মেজাজ গরম করে।

‘তুই একদম লেগে থাক গুল্লু। প্রতি মুহূর্তের আপডেট দিতে থাক। আমরা এখনই যাচ্ছি।’

‘ওকে স্যার।’

ফোনটা কেটে দিয়ে অর্ণব পবিত্রর দিকে তাকায়। ওর ডিডাকশন হয়তো সত্যি ছিল। সমস্ত খুনের পেছনে সম্ভবত আবীরই আছেন! এখন বুঝতে পেরেছেন যে ধরা পড়ে যাবেন, সেইজন্যই পালানোর চেষ্টা করছেন। যখনই গাড়ি সার্ভিসিঙে দেওয়ার খবর জানতে পেরেছিল অর্ণব, তখনই সন্দেহ হয়েছিল। এখন সে নিশ্চিত, লোকটা পালাবে!

উত্তেজিত অর্ণব শশব্যস্তে খবরটা অধিরাজকে জানায়। তার চোখের অন্যমনস্কতা মুছে গিয়ে জাগ্রত হল সেই চিরপরিচিত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। দৃঢ়কণ্ঠে বলল, ‘ওঁকে পালাতে দেওয়া হবে না।’ বলতে বলতেই সে উঠে দাঁড়িয়েছে, ‘চলো।’

মুহূর্তের মধ্যে ওরা সকলেই বেরিয়ে পড়ল। অর্ণব ড্রাইভ করবে কি না ভাবছিল। কিন্তু সে কিছু বলার বা করার আগেই অধিরাজ ড্রাইভিং সিটে বসে পড়েছে। মৃদু স্বরে বলল, ‘তুমি পাশে বসো। আজ আমি চালাব।’

প্রথম কয়েক মিনিট নিঃশব্দেই কাটল। শুনশান ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হাওয়ার গতিবেগে চলছিল ওদের গাড়িটা! অর্ণব আড়চোখে অধিরাজের দিকে তাকায়। তার শাণিত, তীক্ষ্ণ মুখ এখন যেন আরও ধারালো হয়ে উঠেছে। একটু আগেও যে দ্বিধা, যে বিহ্বলতা ছিল তা কেটে গিয়েছে। দুটো চোখ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ! চোয়াল শক্ত। এক অজ্ঞাত সংকল্পে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এখন তার দৃষ্টিতে কোনো প্রশ্ন নেই। নেই কোনো কুয়াশা। গোটাটাই স্পষ্ট, পরিষ্কার!

‘খুনী কে তা বুঝতে পেরেছ রাজা?’

পবিত্রর প্রশ্নের উত্তর দিল না অধিরাজ। তার দৃষ্টি ক্রমশই প্রখর হয়ে উঠছে। মুখে চাপা একটা উত্তেজনা। কোনোরকম জবাব না পেয়ে পবিত্র নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাব দিয়ে দেয়, ‘নির্ঘাৎ আবীর সেন। নয়তো লোকটা পালাচ্ছে কেন!

‘প্রাণের দায়ে পালাচ্ছে পবিত্র।’ এবার জবাব দিল অধিরাজ, ‘ওঁর দৃঢ় বিশ্বাস ওঁকে কেউ বাকিদের মতো খুন করবে।’

‘তার মানে আবীর সেন খুনী নয়!’ পবিত্রর চোখ কপালে উঠে গিয়েছে, ‘তাহলে কে? শ্রুতি চ্যাটার্জি? অমর এবং মায়া? না সুদীপ?’

‘এরা কেউ নয়।’

‘মা-নে!’ পবিত্রর মাথায় এবার গোটা মহাশূন্যটাই ভেঙে পড়ে, ‘এরা কেউ নয়! তবে কে?’

অধিরাজ এবারও কোনো উত্তর দেয় না। সে অখণ্ড মনোযোগে ড্রাইভ করছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, তাকে আবীরের কাছে পৌঁছতে হবে। লোকটা আজই পালাবার কথা ভাবছে। কিন্তু ওকে পালাতে দেওয়া চলবে না! যে করেই হোক আটকাতে হবে।

অর্ণব নির্বাক হয়ে অধিরাজের পাশের সিটে বসেছিল। তার মনেও অনেক প্রশ্নের উদয় হয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে অধিরাজকে সে বিরক্ত করতে চাইছিল না। সে জানে, সঠিক সময়ে স্বয়ং অধিরাজই সব প্রশ্নের জবাব দিয়ে দেবে। তাই এখন তাকে তার কাজ করতে দেওয়াই ভালো! আবীর সেন খুনী নয়, এ তথ্যটা পেয়ে সে-ও ধাক্কা খেয়েছে। কিন্তু তার থেকেও বেশি ধাক্কা খেয়েছে এই কথা শুনে যে এতদিন ধরে

যাদের মধ্যে সম্ভাব্য খুনীকে খুঁজছিল ওরা, তারাও কেউ আদতে খুনী নয়! শ্ৰুতি চ্যাটার্জি নয়, অমর কিংবা মায়া নয় এমনকি সুদীপও নয়! বাকি থাকলেন মিসেস চৌধুরী, মিসেস দত্তরায়, মালবিকা মিত্র, অতনু এবং রজত চৌধুরী! খুনী কি তবে এদের মধ্যেই কেউ!

‘অসম্ভব ওয়েল প্ল্যানড মার্ডার পবিত্র।’ অধিরাজ ড্রাইভ করতে করতে বলে, ‘যে মস্তিষ্কটি এত বড়ো প্ল্যানটা নামিয়েছে, তার প্রশংসা না করে পারছি না।’

‘কিন্তু কে সে!’

অধিরাজ প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, ‘আসলে তার গোটা প্ল্যানিং ছিল আবীর সেনের জন্য। বাকি মৃত্যুগুলো কো-ল্যাটারাল ড্যামেজ। ‘

‘সে কী!’ পবিত্র কোনোমতে উচ্চারণ করল, ‘এতগুলো মৃত্যু কো-ল্যাটারাল ড্যামেজ!’

‘ইয়েস।’

অধিরাজ আরও কিছু বলতেই যাচ্ছিল, তার আগেই অর্ণবের ফোন ফের বেজে ওঠে। গুল্লু আবার ফোন করেছে!

‘বল।’

‘আবীর সেন এইমাত্র বেরিয়েছে স্যার।’ ও প্রান্ত থেকে গুল্লুর উত্তেজিত স্বর ভেসে এল, ‘জাস্ট কয়েক সেকেন্ড হয়েছে লোকটা বেরোল।’

‘তুই কোথায়?’

‘আমি বাইকে ওর পেছনেই আছি।’ গুল্লু এক নিঃশ্বাসে বলে যায়, ‘সাদা এস.ইউ.ভি স্যার, নম্বর ফোর ফাইভ থ্রি সেভেন।’

‘কোন্ দিকে যাচ্ছে?’

‘বাইপাসের দিকে।’

‘ঠিক আছে। তুই লেগে থাক। পেছন ছাড়বি না।’

ফোনটা কেটে দিয়েই অধিরাজকে আপডেট দিয়ে দিল অর্ণব। অধিরাজ ঘড়ির দিকে তাকায়। আবীর এইমাত্রই বেরিয়েছেন। এখনও তাকে ধরা সম্ভব। সে গাড়ির স্পিড বাড়ায়। তার পাশে অর্ণব সতর্ক দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। এখন তারা আবীরের ফ্ল্যাটের কাছাকাছিই আছে। রাস্তায় আর কোনো গাড়িও দেখা যাচ্ছে না। কপালে থাকলে হয়তো চোখে পড়ে যেতেও পারে। সে মনে মনে আউড়ে নিল, সাদা এস.ইউ.ভি, ফোর ফাইভ থ্রি সেভেন!

জানলা দিয়ে হু হু করে হাওয়া এসে আছড়ে পড়ছে চোখে-মুখে। দু-পাশে শূন্য ফুট পাত সাঁৎ সাঁৎ করে সরে সরে যাচ্ছে। অধিরাজের মাথার চুলগুলো হাওয়া এসে এলোমেলো করে দিল। মিস আত্রেয়ী দত্তর চোখ সামনে থেকে সরছে না। পবিত্র বোধহয় এখনও বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তার দু-চোখে এখনও অনেক জিজ্ঞাসা। কৌশানী বোসের চোখে মুখে প্রবল উত্তেজনা! প্রত্যেকেই একটা চাপা টেনশনের মধ্যে আছে। কী হবে! ঠিক কী হতে চলেছে!

‘ওই যে! ওই যে!’

উত্তেজনায় প্রায় চেঁচিয়েই উঠতে যাচ্ছিল অর্ণব! তাদের ঠিক সামনেই একটা লাল রঙের বাইক পড়েছে। তার থেকে সামান্য দূরত্বেই সাদা এস.ইউ.ভি! অধিরাজ স্পিড আরও বাড়ায়। এখন ঠিক এক সরলরেখায় চলেছে তিনটে গাড়ি। এস.ইউ.ভি, বাইক এবং অধিরাজদের গাড়ি। অর্ণব চোখ সরু করে এস.ইউ.ভি-র নম্বর দেখার চেষ্টা করছে। ফোর ফাইভ থ্রি সেভেন কি?

‘ফোর ফাইভ থ্রি সেভেন অর্ণব।’ উত্তরটা অধিরাজই দিয়ে দিল, ‘নিঃসন্দেহে ওটা আবীরেরই গাড়ি।’

গুল্লু তখনও হাইফেনের মতো দুটো গাড়ির মাঝখানে লেগে রয়েছে। অধিরাজদের দেখে সে হাতের ইশারায় এগিয়ে যেতে বলে। অধিরাজ তাকে ওভার টেক করতে করতেই দেখল আবীর তার গাড়ির স্পিড বাড়িয়েছেন। বুঝতে পেরেছেন তাকে কেউ ফলো করছে!

‘ফি-শ… ম্যান!’

অধিরাজ আফসোসসূচক আওয়াজ করে। সে এত তাড়াতাড়ি আবীরের নজরে পড়তে চায়নি। কিন্তু এখন উপায়ও নেই। আগে ব্যস্ত ট্র্যাফিকে কোনো গাড়িকে চেজ করলে বোঝার উপায় থাকত না। বর্তমানে রাস্তা ফাঁকা থাকার দরুণ ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আবীরের এই মুহূর্তে যা মানসিক অবস্থা, তাতে ভয় পেয়ে কী করে বসবেন কে জানে! যত তাড়াতাড়ি তাকে ধরা যায় ততই মঙ্গল। সে অ্যাকসিলারেটরে চাপ বাড়াল।

সাইড ভিউ মিররে অধিরাজদের গাড়িটাকে দেখতে পেয়েছিলেন আবীর! একটু আগে একটা বাইককে তার পেছন পেছন আসতে দেখে আগেই সন্দেহ হয়েছিল। এখন পথেঘাটে খুব একটা গাড়ি চোখে পড়ে না। তার মধ্যেও বাইকটা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কারণ বেশ কিছুক্ষণ ধরেই সেটা তার ঠিক পেছনেই আছে। তিনি যেখানে থামছেন, সে-ও কায়দা করে ঠিক সেখানেই থামছে! আবার চলতে শুরু করলেই পেছন পেছন আসছে। তার সন্দেহ হচ্ছিল, বাইকটা তাকে ফলো করছে। বাইক আরোহীকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন না তিনি। আরোহীর মাথায় হেলমেট, হাবভাব দেখে চেনা মনে হয় না! ও কে! কেনই বা তাকে ফলো করছে!

নানান সম্ভাবনার কথা ভেবেই বুক দুরুদুরু করে উঠেছিল আবীরের! আরোহীর হাবভাব অত্যন্ত রহস্যময়! তবে কি তারও সময় ঘনিয়ে এসেছে? ওরা মেরে ফেলবে তাকে? যেভাবে বাকিদের মেরেছে, সেভাবেই তাকেও মারবে? খবর পেয়েছে যে তিনি পালিয়ে যেতে চাইছেন, তাই ধরতে এসেছে? কিন্তু খবর কীভাবে পেল? কাক পক্ষীতেও টের পায়নি যে আবীর কলকাতা ছাড়তে চাইছেন! এমনকি রয়্যাল হাইটসের ফ্ল্যাটটা যাকে বিক্রি করেছেন, সে-ও জানত না কেন আবীর এত কম দামে অত ভালো একটা ফ্ল্যাট ছেড়ে দিচ্ছেন। সবই তো প্ল্যানমাফিক চলছিল। তবে কে জানতে পারল তার এই গোপন কথা!

আবীর দাঁতে দাঁত পেষেন। এখন বাইকের পেছনে আরেকটা গাড়িও এসে পড়েছে। এরা কারা তা তার জানা নেই। শুধু এইটুকু জানেন যে এরা তার শুভাকাঙ্খী নয়। সম্ভবত তাকে ধরতেই এসেছে। কিন্তু আবীর সেন অত সহজে হারবে না! আবীর সেন এত সহজে মরবে না! সে এত সহজে ধরা দেবে না!

পেছনের গাড়িটা প্রায় ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে। ঠুকে দেবে নাকি! বাইক আরোহীকে আর দেখা যাচ্ছে না। সে তার নির্দিষ্ট ভূমিকাটুকু পালন করেই সরে গিয়েছে। এখন তার বদলে যমদূতের মতো একটা গাড়ি তেড়ে আসছে! ভয়ে তার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। কী করতে চায় এরা! তাকে মারবে? মেরে ফেলবে? নাকি পুলিস? ওরা জানতে পেরেছে কি সব?

অধিরাজ দেখল সামনের গাড়িটার স্পিড আরও বাড়ছে! সে বিরক্ত হয়ে স্টিয়ারিঙের ওপরে একটা চাপড় মারে। লোকটা এমনিতেই ভয়ে আধপাগল হয়ে গিয়েছে। এখনও হাবেভাবে স্পষ্ট ভয় পেয়ে আছে! এ তো থামার নামই নিচ্ছে না! ও সহজে থামবে না! সে দাঁতে দাঁত চেপে আপ্রাণ চেষ্টা করছে গাড়িটাকে ওভারটেক করার। কিন্তু আবীর সাইডই দিচ্ছেন না! স্পিডোমিটারের কাঁটা ইতিমধ্যেই একশো কিলোমিটার ছাড়িয়েছে! আস্তে আস্তে আরও স্পিড বাড়ছে! লোকটা গাড়ি চালাচ্ছে, না রেস ট্র্যাকে রেসিং কার চালাচ্ছে!

পবিত্র একদম সটান সোজা হয়ে বসেছে! আত্রেয়ী দত্তের শরীরের সমস্ত পেশীগুলো শক্ত হয়ে উঠেছে। কৌশানী টেনশনে নখ খেতে শুরু করেছে। সামনের গাড়িটার গতিবেগ উত্তরোত্তর বাড়ছে!

‘ঠুকে দাও রাজা।’ পবিত্র পেছন থেকে বলে উঠল, ‘এ ব্যাটা থামবে না!’

‘দেখি একবার চেষ্টা করে।’ অধিরাজ অর্ণবের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। অর্ণব মাথা ঝাঁকায়। তারপর সে গাড়ির জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘স্ট-প! স্ট-প!’

কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না! বরং এস.ইউ.ভি’র স্পিড আরও বাড়ছে! অধিরাজ আড়চোখে দেখল তাদের গাড়ির স্পিডোমিটারের কাঁটা এবার একশো কুড়ি ছাড়াচ্ছে!

ফাঁকা রাস্তা দিয়ে বিদ্যুতের বেগে দু-টো গাড়ি সাঁই সাঁই করে বেরিয়ে গেল। একটা গাড়ি অন্যটাকে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আর আরেকটা বাঁচবার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছে। শূন্য রাস্তায় দুটো গাড়ির মরণপণ লড়াই। কে কাকে মাত দেবে জানা নেই! কিন্তু দুটো গাড়িই সম্ভবত গতিবেগের চরম সীমায় পৌঁছেছে। আবীর কিছুতেই অধিরাজদের সাইড দিচ্ছেন না! অধিরাজ প্রাণপণ চেষ্টা করছে ওভার-টেক করার প্রয়োজনীয় জায়গাটুকু বের করার। সে একবার গাড়িটাকে ডানদিকে নিয়ে যাচ্ছে, একবার বামদিকে। কিন্তু জায়গাই পাচ্ছে না!

অর্ণব অধিরাজের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায়। যেন কিছুর অনুমতি চাইছে। অধিরাজ মাথা নাড়ল। এই মুহূর্তে গুলি চালানো ঠিক হবে না। যে স্পিডে গাড়ি চলছে, তাতে যদি কোনোমতে গাড়ির টায়ার বার্স্ট করে তবে মুশকিল! তখন সামলানো দায় হবে।

‘লোকটা জাস্ট পাগল হয়ে গেছে!’ অধিরাজ জোরে স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে বলে, ‘পুরো পাগলের মতো গাড়ি চালাচ্ছে! এখন তো ভয় লাগছে যে অ্যাক্সিডেন্টই না করে বসে!’

‘গাড়ি চালাচ্ছে না রাজা, ওড়াচ্ছে!’ পবিত্র বলল, ‘এ মাল থামবে না!

‘ওভারটেকও তো করতে পারছি না!’ অসহায়ের মতো বলল সে, ‘কী করি বলো তো!’

‘ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করে দেখো।’

অধিরাজ সঙ্গে সঙ্গে অর্ণবের দিকে তাকায়। অর্ণব মাথা ঝাঁকিয়ে রিভলভারটা তুলে নিল। হাওয়া সাঁই সাঁই করে তার হাত কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে। কোনোমতে তার মধ্যেই সে প্রথম ফায়ারটা করে। তার মনে হল, ফায়ারিঙের শব্দে আবীর যেন একটু থতমতো খেয়ে গেলেন। গাড়িটা যেন সামান্য শ্লথ হয়েই ফের গতিবেগ ধরল! হু হু করে বাতাস কেটে ক্রমাগতই এগিয়ে যাচ্ছেন আবীর!

অর্ণব উপায়ান্তর না দেখে দ্বিতীয়বার ফায়ার করে। কিন্তু তাতেও কিছু হল না। এস.ইউ.ভি-টা যেন পড়িমড়ি করে দৌড়চ্ছে! থামবার কোনো লক্ষণ নেই!

অধিরাজের মনে হল গাড়িটা যেন ঠিক নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই! এলোপাথাড়ি ডানদিক-বাঁদিক করছে! মাতালের মতো টলছে। যেন নিজের গতি এখন নিজেই সামলাতে পারছে না! কোনোমতে ছুটছে! সে আস্তে আস্তে বলল, ‘সামথিং ইজ রং…!’

আবীরের মনে হল তিনি আস্তে আস্তে গাড়ির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন। ভয়ের চোটে হাত ঘেমে গিয়েছে! স্টিয়ারিং স্লিপ করছে। হাত পা কাঁপছে।

তবু চেষ্টা করছেন অবাধ্য গাড়িটাকে নিয়ন্ত্রণে আনার। ওরা ফায়ার করছে! ওদের কাছে ফায়ার আর্মস আছে! একেবারে গোঁয়ারের মতো লেগে আছে! এত সহজে ছাড়বে না! ভয়ে তার রক্ত হিম হয়ে আসে। ওরা তাকে মারবে! ওরা তাকে গুলি করছে! তিনি মরতে চান না! তিনি কিছুতেই মরতে চান না!

ভাবতে ভাবতেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন আবীর। ঠিক তখনই দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল! আচমকা একটা বড় স্পিডব্রেকারে পড়ে গাড়িটা লাফিয়ে উঠল! পরক্ষণেই গিয়ে ধাক্কা মারল ডিভাইডারে! প্রচণ্ড গতিবেগ সামলাতে না পেরে এস.ইউ.ভি-টা উলটে গেল! চোখের নিমেষে অত বড়ো গাড়িটা খেলনা গাড়ির মতো বেশ কয়েকটা পালটি খেল!

‘মাই গড!’

অধিরাজ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ব্রেক কষেছে। এস.ইউ.ভি ভেঙেচুরে দুমড়ে মুচড়ে চৌচির হয়ে গিয়েছে। একরকম তালগোল পাকিয়েই গিয়েছে বলা যায়। চতুর্দিকে ফুয়েল ছড়িয়ে পড়ছে! অধিরাজ কোনমতে ওদের গাড়িটাকে থামিয়ে ছুটে গেল এস.ইউ.ভি-টার দিকে। তার পেছন পেছন অর্ণব এবং পবিত্র-ও।

ভাঙাচোরা গাড়ির মধ্যে অর্ধ অচেতন অবস্থায় আটকে আছেন আবীর! তার মাথা থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে! নাক, কান দিয়েও ভীষণ ব্লিডিং হচ্ছিল। একটা হাত ভেঙে ঝুলঝুল করছে! বুকে স্টিয়ারিং ঢুকে গিয়েছে! তার অবস্থা দেখে আঁতকে উঠল অধিরাজরা! যদিও এমন দৃশ্য ওরা দেখে অভ্যস্ত, তবু ঘটনার বীভৎসতায় কয়েক মুহূর্তের জন্য গা গুলিয়ে উঠল অর্ণবের। অধিরাজ এক লাথি মেরে গাড়ির ভাঙা দরজাটাকে সরিয়ে দিয়েছে। এবার স্পষ্ট দেখা গেল আবীরকে। তার অবস্থা দেখে প্রমাদ গুনল অর্ণব। লোকটার চোয়ালটা ডিসলোকেটেড হয়ে গিয়েছে! কী বীভৎস দেখাচ্ছে!

অধিরাজ, পবিত্র আর অর্ণব কোনোমতে টেনে হিঁচড়ে গাড়ি থেকে বের করে আনল আবীরকে। তিনি তখন বিড়বিড় করে কী যেন বলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোনো শব্দই স্পষ্ট নয়! কথা বলতে পারছেন না, তবু প্রাণপণ কিছু বলছেন! অধিরাজ প্রায় তার মুখের কাছে কান নিয়ে গিয়ে কথাগুলো শোনার চেষ্টা করে। আবীর কোনোমতে ফিসফিস করে বললেন, ‘আমিই আকাশকে মেরেছি!… আমায় মারবেন না!… আমি মরতে ভয় পাই!… মরতে আমার ভয় করে…!’

অধিরাজ চাপা স্বরে বলল, ‘যা ভেবেছিলাম! থ্যানাটোফোবিয়া!’

‘আমার মরতে ভয় করে… মরতে ভয় করে… ভয় করে…!

বলতে বলতেই স্থির হয়ে গেলেন আবীর!

(২৩)

আবীরকে বাঁচানো গেল না!

তাকে নিকটস্থ হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিল অধিরাজরা। কিন্তু সেখানে ডাক্তাররা আবীরকে মৃত বলে ঘোষণা করলেন। অধিরাজের মুখে ব্যর্থতা প্রকট হয়ে উঠেছে। আবীর সেনের ভয়ই লোকটাকে খেল! মৃত্যুভয় ছিল ওর, যাকে এক কথায় বলে থ্যানাটোফোবিয়া। মৃত্যুভয় সকলেরই অল্পবিস্তর থাকে। তাই তাকে কোনোমতেই অস্বাভাবিক বলা যায় না। কিন্তু যখন সেই মৃত্যুভয় চরমে পৌঁছয়, একটা মানুষ সর্বক্ষণই মৃত্যু চিন্তা করতে থাকে, ভয় পেতে পেতে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন সেটা একজাতীয় অ্যাংজাইটি ডিজ-অর্ডারে পর্যবসিত হয়। তাকেই বলে থ্যানাটোফোবিয়া!

অধিরাজের মুখে হতাশা প্রকট! বাঁচানো গেল না! একজনকেও বাঁচানো গেল না এই মাস্টারমাইন্ডের হাত থেকে! বাকি ছিলেন একমাত্র আবীর। তিনিও মারা পড়লেন। এর পেছনে অবশ্য তাদেরও খানিকটা দায় আছে। যদি আবীরকে ওরা থামানোর চেষ্টা না করত, তবে হয়তো অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটত না! অধিরাজের মনে হচ্ছিল, খুনী অজান্তেই তাদের ব্যবহার করল! গোটা কেসটাতেই তারা শুধু খুনীর হাতের পুতুলের ভূমিকায় থেকে গেল। সামান্য ক্রীড়নক মাত্র!

আবীরের মরদেহ ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়ে দেওয়া হল। তার দেহ নিয়ে চলে গেল পবিত্র, আত্রেয়ী ও কৌশানী। অধিরাজ কিন্তু ওদের সঙ্গে ফিরল না। অর্ণব লক্ষ্য করে সে গুম মেরে বসে আছে। পবিত্র জানতে চায়, ‘তোমরা ফিরবে না রাজা?

অধিরাজ মৃদু মাথা নাড়ে, ‘এখন নয়। একটা কাজ বাকি আছে। সেটা সেরে ব্যুরোয় ফিরব।’

পবিত্র এবার অর্ণবের দিকে তাকায়, ‘অর্ণব? ‘

অর্ণব কিছু বলার আগেই অধিরাজ বলল, ‘অর্ণব আমার সঙ্গে যাবে।’

পবিত্র ও অর্ণব পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করে। দু-জনের চোখেই বিস্ময়। এখন কোথায় যাওয়ার কথা বলছে অধিরাজ! কোন্ কাজই বা বাকি আছে! এমন কী কাজ যার কথা পবিত্রকেও খুলে বলা চলে না!

পবিত্র বিস্মিত হলেও কথা বাড়ায় না। সে মাথা ঝাঁকিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। অর্ণব একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে অধিরাজের দিকে। তাকে এখন পরাজিত সৈনিকের মতো দেখাচ্ছে। সারা মুখে ব্যর্থতার গ্লানি। চোখের দৃষ্টিতে ক্লান্তি ও আফসোস। আরও একটু আগে পৌঁছতে পারলে হয়তো এই মৃত্যুটাকে আটকানো যেত। আপাত দৃষ্টিতে এটাকে অ্যাক্সিডেন্ট বলে মনে হলেও আসলে এটাও একরকমের খুনই। আবীরের মনের মধ্যে এমন ভয় গেঁথে দিয়েছিল খুনী যে তিনি চতুর্দিকে নিজের মৃত্যু দেখে বেড়াচ্ছিলেন। পাগলের মতো করছিলেন! তার ওপর আবার পুলিসের তাড়া! উপায় না দেখে উন্মত্তের মতো ড্রাইভ করছিলেন। হয়তো অ্যাক্সিডেন্টটা না হলেও তিনি মরতেন! হয় অন্যদের মতো হার্টফেল করে মরতেন, নয় শেষমেষ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আত্মহত্যা করতেন। তার মৃত্যু অদৃশ্য হাতে নিশ্চিত করে দিয়েছিল খুনী।

পবিত্ররা বডি নিয়ে চলে যেতেই উঠে দাঁড়ায় অধিরাজ। অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চলো।’

অর্ণব একবারও জানতে চাইল না যে কোথায় যেতে হবে। বিনাবাক্যব্যয়ে সে অধিরাজের সঙ্গ নিল।

গাড়িতে উঠে অধিরাজ একটা কথাও বলল না। সে একদম নীরবে ড্রাইভ করছে। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। আজ সে একটু বেশিই সিগারেট খাচ্ছে। অর্ণব সেটা লক্ষ্য করলেও চুপ করে থাকে। এই লক্ষণ সে ভালোভাবেই চেনে। অধিরাজ ডিস্টার্বড থাকলেই আজকাল বেশি সিগারেট খেতে থাকে। আজও কোনো কারণে সে নিজের ও পরেই বিরক্ত হয়ে উঠেছে। আবীরের মৃত্যুটা মেনে নিতে পারছে না। সৌরীশের মৃত্যুটাও তার একেবারে সামনেই হয়েছিল। সে চেষ্টা করেও আটকাতে পারেনি। আবীরকেও বাঁচাতে পারল না! বরং তার মৃত্যুর জন্য সে নিজেকেই দায়ী করছিল।

কিছুদূর যেতেই অর্ণব বুঝতে পারল তারা হাতিবাগানের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু হাতিবাগানে কেন! এখানে তো রতন থাকে। তার কাছেই কি যাচ্ছে ওরা? কেন? তবে কি রতনই আছে এসবের পেছনে! কিন্তু মোটিভ কী!

‘অর্ণব, গুল্লুর কাছ থেকে রতনের ঠিকানাটা নিয়ে নাও।’

অর্ণব গুল্লুকে ফোন করল। গুল্লু শুনেই বলল, ‘ঠিকানাটা হোয়াটসঅ্যাপ করে দিচ্ছি স্যার।’

‘তাড়াতাড়ি করে দে।’

‘এখনই দিচ্ছি স্যার। ‘

মিনিট খানেকের অপেক্ষা। পরক্ষণেই সশব্দে হোয়াটসঅ্যাপে গুল্লুর মেসেজ ঢুকল। ঠিকানা এসে গিয়েছে।

রতনের নতুন ঘাঁটি খুঁজে পেতে বেশি অসুবিধে হল না। যদিও এখানে সবই বহু বছরের পুরনো বাড়ি। পুরু দেওয়ালের অন্ধকার ঘুপচি ঘর। পায়রার খোপের মতো এক একটা ঘরে এক একটা সংসার। বাড়িওয়ালা নিশ্চয়ই একসময় ছিল। কিন্তু এখন বোধহয় বেশির ভাগ বাড়িওয়ালার খোঁজই পাওয়া যাবে না। সেই কোন যুগের ভাড়ার টাকা এখনও বহাল আছে। ঘরগুলো এখন ভাড়াটেদেরই সম্পত্তি হয়ে গিয়েছে।

রতন তার ঘরেই ছিল। অধিরাজ আর অর্ণবকে দেখে তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ঢোঁক গিলে বলল, ‘বাবু, আপনেরা!’

অধিরাজ পূর্ণদৃষ্টিতে দেখছে তাকে, ‘তোমার সঙ্গেই দেখা করতে এলাম।’

‘আমার সঙ্গে!’ সে একটু ঘাবড়ে যায়, ‘কেন? ‘

তার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে অধিরাজ বলল, ‘তোমার মায়ের বাড়ির চাবি তোমার কাছে থাকত না?’

হঠাৎ চাবির প্রসঙ্গ! অর্ণবও বুঝতে পারে না হঠাৎ এ প্রসঙ্গের অবতারণা কেন! রতনের মুখ এবার একেবারে সাদা হয়ে যায়! সে হাত জোড় করে বলল, ‘বাবু!’

‘সেই চাবির থোকাটা সবসময়েই তোমার পকেটে থাকত। দৌড়বার সময় খেয়াল করো না কেন যে ওটায় রীতিমতো আওয়াজ হয়!’ অধিরাজ বাঁকা হাসল, ‘তোমার চাবির আওয়াজ শুনে আরেকটু হলেই আমরা তোমায় মেয়ে ভেবে বসছিলাম! আমি যদি সৌরীশের বাড়িতে দ্বিতীয়বার না শুনতাম, তবে বুঝতেই পারতাম না ওটা কী জিনিস। তার ওপর আবার মেয়েদের রুমাল নিয়ে ঘুরছ! এটা কী জাতীয় ভদ্রতা!

রতন স্তম্ভিত! অর্ণবের মাথায়ও যেন বাজ পড়ল! ওটা তবে চুড়ি বা পায়েলের আওয়াজ ছিল না! চাবির আওয়াজ ছিল। স্বাভাবিক! রতন উমার কম্বাইন্ড হ্যান্ড, তার কাছে একটা চাবির থোকা থাকবেই। স্বয়ং উমাই বলেছিলেন যে রতনের কাছে সব চাবি থাকে!

‘রুমালটা বোধহয় ইচ্ছাকৃতই ফেলেছিলে, তাই না? আমাদের মিসলিড করার জন্য।’ অধিরাজ স্মিত হাসছে, ‘ওটা তোমার মায়ের রুমাল ছিল। কোনো কারণে ওটা তোমার কাছে ছিল।’

‘মা আমায় দে’ছেল।’ অবরুদ্ধ আবেগে বলল রতন, ‘আমি জামার হাতা দে মুখ মুছি দেখি মা আমায় ওটা দে’ছেল। বলিছিল, রুমালে মুখ মুছবি রতন! নোংরা জামার হাতায় মুখ মুছিস না। নিজেই ওটায় গন্ধ দে’ দেত।’

‘মা কি তোমায় সাদা পাউডারের গুঁড়োটা আমার মুখে ছেটাতেও বলেছিল? ‘

এই একটা প্রশ্নেই যেন ভেঙে পড়ল রতন। তার মুখ কান্নায় বিকৃত হয়ে আসে। চোখ বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় জল পড়ে। সে হাতজোড় করে বলল, ‘যা করার সব আমিই করিছি বাবু। আপনি আমারেই জেলে দ্যান!’

‘লাও ঠ্যালা!’ অধিরাজ সকৌতুকে অর্ণবের দিকে তাকায়, ‘আরও একজন দাবি করল যে সেই খুন করেছে! পরিস্থিতি যা দেখছি, আরও দু একজন এই একই দাবি নিয়ে হাজির হলে আমাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না!

রতন তখনও হাপুশ নয়নে কাঁদছে। তার কান্নাবিকৃত মুখে স্পষ্ট অনুতাপ! অর্ণব হাঁ করে তাকে দেখছিল। এই সেই ব্যক্তি যাকে বনোয়ারির বাড়ির পেছনে দেখেছিল ওরা। ওকেই তাড়া করেছিল ওরা সবাই! কিন্তু সেদিন একটুর জন্য ধরতে পারেনি। এই লোকটাই তার মাথায় আধলা ইঁট ছুঁড়ে মেরেছিল! এই সৌরীশকে মেরেছে! অধিরাজকে হ্যালুসিনোজেন ও-ই দিয়েছিল। তবু এখনও ওকে গ্রেফতার করছে না কেন অধিরাজ!

‘তোমার কাজ তুমি করেছ। এখন বাকি কাজটাও করো।’

অধিরাজের কথাটা ঠিক বুঝতে পারল না রতন। সে কান্না থামিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।

‘তোমার মা আমায় কিছু দিতে বলেছিলেন? কোনো চিঠি বা ডায়রি?’

‘আপনি সেটাও জানেন!’

রতন কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকল। তারপর তক্তপোষের তলা থেকে একটা বাদামি খাম বের করে নিয়ে এল। অধিরাজ খামটা হাতে নিয়ে মৃদু হাসল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ।’

প্রিয় অফিসার ব্যানার্জি,

আপনি এই চিঠি পড়ছেন, তার অর্থ আমার হিরো শেষপর্যন্ত আমায় ধরে ফেলেছে! আপনার জয় দেখার জন্য আমি আর এ পৃথিবীতে নেই। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনি এই চিঠি অবধি ঠিকই পৌঁছবেন। আফসোস যে জীবিত অবস্থায় ধরা দিতে পারলাম না। মানুষকে কবর দিলে যদি বা উঠে এসে ভয় দেখানোর অপশন থাকে, অগ্নিসংস্কারে সে উপায়ও নেই। খুব ইচ্ছে ছিল আরও একবার আপনার সঙ্গে দেখা করি, আপনার গান আবার শুনি। বনলতা না হোক, উমা সেনকে কয়েক মুহূর্তের শান্তি দিয়েছিলেন আপনি। কিন্তু সে আশা মনে রেখেই চলে যেতে হচ্ছে।

আপনার মনে হয়তো এখন অনেক প্রশ্ন। ভাবছেন এত কাণ্ড করার কারণ কী? আমার মতো একজন অসুস্থ মানুষ কি আদৌ এতগুলো খুন করতে পারে? ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, পারে। তবে একটাই শর্ত। তার মনে প্রচণ্ড জোর আর ঘৃণা থাকতে হবে। মনের জোর মানুষের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। আর ঘৃণা যে মানুষকে দিয়ে কী কী করিয়ে নিতে পারে তার ইয়ত্তা নেই। আমাকে দিয়েও করিয়ে নিয়েছে।

হ্যাঁ, আমি স্বীকার করছি যে এতগুলো খুনের পেছনে আমিই আছি। মোটিভ? ভয় ও ঘৃণা। কিন্তু তার ইতিহাস নিতান্তই সামান্য নয়। বরং অনেকদিনের জমে থাকা রাগ, ভয় এবং ঘৃণার বেশ লম্বা ফিরিস্তি। বিস্তারিত বলার মতো সময় আমার হাতে নেই। টের পাচ্ছি, আমার আয়ু ক্রমাগতই ফুরিয়ে আসছে। আর বেশি দিন বাঁচব না। লিখতেও রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে। তবু চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব লিপিবদ্ধ করার।

আমার দাদুর হোটেলের বিজনেস ছিল। তিনি উচ্চবিত্ত মানুষ। আমার মা ছোটবেলা থেকেই বিলাস ব্যসনে মানুষ। দাদুর অত্যন্ত আদরের সন্তান ছিলেন। মাকে অদেয় তাঁর কিছুই ছিল না। চাইলে হয়তো আকাশের চাঁদটাও দিতেন। কিন্তু সেই আদুরে মেয়ে শেষে এক সরকারি ক্লার্কের প্রেমে পড়ল। তিনিই আমার বাবা। দাদু মায়ের এই বিয়েটা কোনোদিন মেনে নিতে পারেননি। প্রথমে মাকে ত্যাগ করলেও পরে যখন দুই নাতনি হল, তখন ঢেঁকি গেলার মতো ব্যাপারটা সহ্য করে নিলেন।

আমি ছোটোবেলা থেকেই ভয়ে ভয়ে মানুষ হয়েছি। শুধু আমি একা নই, আমার দিদি এমনকী মা-ও বাবাকে ভয় পেতেন। বাবা অত্যন্ত মেজাজি মানুষ ছিলেন। পরে বুঝেছি, তিনি জানতেন যে মায়ের সঙ্গে তাঁর অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক দূরত্ব কখনই যাওয়ার নয়। বাবা অত্যন্ত স্থূল রুচির মানুষ ছিলেন। মায়ের সূক্ষ্ম মনস্তত্ত্ব এবং রুচিশীলতা তিনি স্পর্শ করতে পারতেন না। এ-ও জানতেন, মা তাঁর জন্য একটা আরামের জীবন, বিলাস-ব্যসনকে ত্যাগ করে এসেছেন। সেটা তাঁর মধ্যে একটা শূন্য হীনমন্যতা তৈরি করেছিল। সেই শূন্যতা ভরার অন্য কোনো উপায় না পেয়ে ভয়টাকেই হাতিয়ার করেছিলেন। আর কিছু দিতে না পারেন, ভয় তো দেখাতেই পারেন। কারণ ভয় দেখিয়ে কাউকে দমিয়ে রাখা সবচেয়ে সহজ।

বাবার মেজাজ, ধমক-চমকের মধ্যেই আমরা দুই বোন বড়ো হয়ে উঠতে লাগলাম। বাবার হাঁকডাকের মধ্যে আমরা একটা সঙ্কীর্ণ, কুণ্ঠিত জীবন বাঁচছিলাম। কথায় কথায় ভয় পেতে পেতে আমাদের ভয় পাওয়াটাই অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। এই অবধি তবু সব ঠিক ছিল। কিন্তু দিদি আচমকা ঐ অল্পবয়েসেই ক্যানসার আক্রান্ত হল। বাবা সাফ জানিয়ে দিলেন, তিনি এত দামি চিকিৎসা করাতে পারবেন না। এখন ভাবলে মনে হয়, লোকটা বড্ড নিষ্ঠুরও ছিল! নিজেকে ছাড়া হয়তো আর কাউকে কখনও ভালোবাসেননি তিনি। সেই দুঃসহ পরিস্থিতিতে দাদু পাশে এসে দাঁড়ালেন। যতখানি চিকিৎসা করানো সম্ভব, করালেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না! দিদি চলে গেল!

আমি একা হয়ে গেলাম। আগে তবু ভয়ের একটা ভাগীদার ছিল। এখন সব ফ্রাস্ট্রেশন সহ্য করার জন্য আমি একাই ছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই আমি সবসময়েই ভয়ে ভয়ে থাকতাম। আমার ঐ ভীতু স্বভাবের জন্য সবাই আমাকে বেশি করে ভয় দেখাতে শুরু করল। আমি প্রতিবাদ করতে শিখিনি। তাই মুখ বুজে সহ্য করে গেলাম। কারণ মাকে দেখে সহ্য করাটাই শিখেছিলাম। স্কুলে আমার ওপরে নানারকমের বুলিং হত। আমি চুপ করে থাকতাম। কাঁদতাম, হাতজোড় করে নিষ্কৃতি চাইতাম। আমার হিমোফোবিয়া ছিল। রক্ত দেখলেই ভয় করত! একবিন্দু রক্তও সহ্য করতে পারতাম না। প্যানিক অ্যাটাক হয়ে যেত। কিন্তু তার জন্য সহানুভূতি তো দূর, সেটা আমার সহপাঠীনিদের মধ্যে ভারী হাসাহাসির বস্তু হয়ে উঠেছিল। আমি বুঝতে শিখলাম, পৃথিবীতে ভীতু মানুষের কোনো জায়গা নেই! তারা কখনও কারোর সহানুভূতি পায় না! মানুষ নিষ্ঠুরতাই বেশি ভালোবাসে। এই যেমন পথে চলতে চলতে কেউ যদি আচমকা পড়ে যায়, ব্যথা পায়, তবে ‘আহা’ বলার চেয়ে ‘হা হা’ করে হাসার লোকই বেশি পাওয়া যায়।

আমার দাদু চাইতেন তাঁর নাতনি ইঞ্জিনিয়ার হোক। তখনই ঠিক করে রেখেছিলেন আমাকেই উত্তরাধিকারী হিসাবে বেছে নেবেন। আমি আর কিছু না হই, পড়াশোনায় ভালো ছিলাম। জেজিইসিতে সুযোগ হল। মা কিন্তু ভারী চিন্তায় পড়লেন। আমি তাঁকে ছেড়ে কখনও দূরে যাইনি। তার ওপর তিনি আমার স্বভাব খুব ভালোভাবে জানতেন। আমি যে নিজেকে সবসময় গুটিয়ে রাখি, সেটাও তাঁর অজানা ছিল না। তবু আমায় ভাগ্যের হাতেই ছেড়ে দিলেন।

জেজিইসিতে এসে আলাপ হল আবীরের সঙ্গে। তারপর আস্তে আস্তে বাকিদের সঙ্গেও। আমাদের ওপরও অল্পবিস্তর র‍্যাগিং হয়েছিল। আমার সহ্যশক্তি অপরিসীম। তাই সহ্য করেই নিলাম। গান গাইতে ভালোবাসতাম। এলভিস প্রেসলে অত্যন্ত পছন্দের গায়ক ছিলেন। মৃন্ময়, সৌমিত্র আর উৎপলও গান ভালোবাসত। সবাই মিলে একটা দল বানালাম। আমাদের সবার মধ্যে একটা জিনিসই কমন ছিল। আমরা সবাই কোনো না কোনো ফোবিয়ায় ভুগতাম। মারাত্মক লেভেলের ফোবিয়া ছিল আমাদের। তাই আমাদের ব্যান্ডের নাম হল ‘ফোবিয়ান্স।’ কার কী ফোবিয়া ছিল এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছেন। তবু আরেকবার বলে দিই। সৌমিত্র’র ছিল নেক্রোফোবিয়া, মৃন্ময়ের ক্লস্ট্রোফোবিয়া, উৎপলের অ্যাক্রোফোবিয়া, শর্বাণীর অ্যাস্ট্রাফোবিয়া, সৌরীশের পিডিওফোবিয়া এবং আমার হিমোফোবিয়া। আবীর ওর ফোবিয়ার কথা স্বীকার করত না। কিন্তু সবাই জানত যে ওর মারাত্মক থ্যানাটোফোবিয়া আছে।

হাস্যকর নয়? যে লোকটা ওই রকমের নিষ্ঠুর, যে অন্যকে মারতে ওস্তাদ, সে নিজেই মৃত্যুকে ভয় পায়! এখানেই ঈশ্বর ওকে মেরেছেন! অল্পবিস্তর তো আমরা সবাই ভয় পাই। কিন্তু আবীরের ভয়ের কোনো সীমা পরিসীমা ছিল না। যে ভয় পায়, সেই অন্যকে সবচেয়ে বেশি ভয় দেখায়! দুনিয়ার এটাই দস্তুর! আবীর ভয়াবহ ডেয়ার ডেভিল হয়ে ঘুরে বেড়াত! অন্যের ওপর অত্যাচার করত! আমি ভীতু ছিলাম বলে হয়তো ওর ডেয়ার ডেভিল ভাবটা ভালো লাগত। ওর প্রতি একটা প্রচণ্ড আকর্ষণ তৈরি হল। আবীরও সেই আকর্ষণের সুযোগ চুটিয়ে নিল। সবাই জানল আমাদের মধ্যে একটা প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। দুর্বল সবসময়ই সবলের কাছে আশ্রয় খোঁজে। আমিও আবীরের কাছে একটা আশ্রয় চেয়েছিলাম। আবীর শুধু মনে সন্তুষ্ট ছিল না। ক্রমাগত ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলিং করে ও আমাকে শারীরীকভাবে ঘনিষ্ঠ হতে একরকম বাধ্য করল!

কিন্তু র‍্যাগিঙের ব্যাপারটা আমার দস্তুরমতো অপছন্দ। নিজে অত্যাচারিত ছিলাম বলে অন্যের ওপর অত্যাচার সহ্য করতে পারতাম না! কিন্তু ফোবিয়ান্স ঠিক সেটাই করত! ওরা জানত না, যাদের ওপর ওরা অত্যাচার করত, আমি মনে মনে তাদের সমব্যথী হয়ে যেতাম! ওদের ভীতু ভীতু চোখ, অসহায় কান্না দেখে আমার ভীষণ কষ্ট হত। ক্রমশই অত্যাচারিতের প্রতি আমার সমবেদনা বাড়তে লাগল, আর অত্যাচারীদের প্রতি ঘৃণা! কিন্তু আমি চুপ করেই থাকলাম। কারণ, আগেই বলেছি, আমি প্ৰতিবাদ করতে শিখিনি।

এর মধ্যেই একদিন আকাশ এল আমাদের কলেজে। ওর স্বভাবটা অনেকটা আমার মতোই। ওর মধ্যে আমি নিজেকে দেখতে পেলাম। তেমনই ভীতু ভীতু। তেমনই গুটিয়ে থাকা একটা একা মানুষ! আবীর ওকে নিয়ে পড়ল! যেহেতু ও সবচেয়ে ভীতু, তাই ওকেই সবচেয়ে বেশি ভয় দেখাতে হবে! এ কীরকম নিয়ম! নানাভাবে ওরা ওকে উত্যক্ত করত। কখনও কখনও দু এক ঘা বসিয়েও দিত! আমার ভালো লাগত না। সবার চোখের আড়ালে, আমার আকাশের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ও অত্যন্ত অন্তর্মুখীন ছিল। কিন্তু এখানে ওর কোনো বন্ধু না থাকায় নিঃসঙ্গতায় ভুগত। এই পরিস্থিতিতে আমার মতো একটা দিদি পেয়ে ও বড় খুশি হয়ে উঠল। ছেলেটা ভীষণ সুন্দর আঁকতে পারত। ভালো মাউথ অর্গানও বাজাত। আর আমিই ছিলাম ওর একমাত্র শ্রোতা! সুখ দুঃখের কথা ও আমার সঙ্গে ভাগ করে নিত। এখানে থাকতে ওর ভালো লাগছে না সে কথাও বলেছিল। আমি বলেছিলাম, প্রথম দিকে সবারই মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।

এর মধ্যেই সেই দুর্ঘটনাটা ঘটল। আকাশ আচমকা মারা গেল। আমি এসব পছন্দ করতাম না বলে ওরা সবসময় সব কথা আমাকে বলত না। তাই আকাশের ব্যাপারটা কী তা আমায় বলেনি। গোটাটাই আমার কাছে গোপন করে গিয়েছিল। আমিও সেদিনের ঘটনার কথা জানতাম না। আকাশের ওপর যে ওরা অত্যাচার করত তা সর্বজনোবিদিত। আকাশের মা এই নিয়ে প্রচুর ঝামেলা করলেন। কিন্তু সুবিচার পেলেন না! আর আমি অত্যন্ত শকড হলাম! কিছুদিনের মধ্যেই আকাশ আমার খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিল। ওর মৃত্যুটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না! ও একটা শান্ত, ভদ্র, নম্র ছেলে ছিল। ওর মৃত্যুতে কার কী লাভ হল জানি না, কিন্তু আমি জোরদার একটা ধাক্কা খেলাম। ফোবিয়ান্সের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেল।

আমি ফোবিয়ান্স ছাড়তে চাইছিলাম। কারণ ওদের নিষ্ঠুরতা আর সহ্য হচ্ছিল না! আমি চিরকালই অত্যাচারিতের দলে, অত্যাচারীর দলে নয়। কিন্তু আবীর আমায় ছাড়তে চাইছিল না। ফোবিয়ান্সের বাকি সদস্যরাও তেমনই। ওরা সবাই মিলে আমায় ভয় দেখাল যে যদি আমি ফোবিয়ান্স ছাড়ি তবে আমার অবস্থাও অন্যদের মতোই হবে! ওদের সমস্ত অপরাধের দায় আমাকে নিতে হবে। আমি ওদের বড্ড ভয় পেতাম! কারণ আবীর অসম্ভব নিষ্ঠুর ছিল। সৌমিত্র, মৃন্ময়, উৎপলও কিছু কম যায় না। শর্বাণী মেয়ে হলেও ওর মতো ক্রুয়েলও আমি খুব কমই দেখেছি। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ফোবিয়ান্স ছাড়ার রাস্তা রইল না।

আমি নিজেকে বিন্দুমাত্রও জাস্টিফাই করার চেষ্টা করছি না। অন্যায় করা যতটা অপরাধ, তার থেকেও বেশি অপরাধ অন্যায় সহ্য করা এবং সব কিছু দেখেও চুপ করে থাকা। আমি জানতাম যা ঘটছে তা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এবং জেনেশুনে আমিও সেই অপরাধেই অপরাধী। কিন্তু তা সত্ত্বেও সব সহ্য করে গিয়েছি।

আমি অপরাধ করেছি। তার থেকেও বেশি অপরাধ করেছি আবীরকে প্রশ্রয় দিয়ে! সবাই জানত আমাদের বিয়েটা প্রেমের। কিন্তু একা আমিই জানতাম যে বিয়েটা ভয়ের! আবীর একেবারে আমার বাড়িতে এসে হাজির হল! ও কীভাবে যেন আমার দাদুর ব্যাপারটা জেনে গিয়েছিল। ততদিনে আমি বুঝে গিয়েছি যে, এই লোকটা চূড়ান্ত নিষ্ঠুর। এবং এই নিষ্ঠুরতা আদৌ স্বাভাবিক নয়! ওর কাজকর্মের জন্য এক বিন্দু অনুতাপও কখনও আমি দেখিনি। ও আমাকে ভয় দেখাল, দরকার পড়লে আমার বাবাকে বলে দেবে যে আমার গায়ে ক’টা তিল আছে! আমি ভয় পেলাম! আবীরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছি জানলে বাবা আমায় ছেড়ে কথা বলবেন না! শুধু তাই নয়, আবীর এ-ও বলল, আমি যদি ওকে বিয়ে না করি, ওর সঙ্গে না থাকি তবে ও আত্মহত্যা করবে এবং চিঠিতে আমার নাম লিখে যাবে!

আমি আরও ভয় পেলাম। এখন ভাবলে হাসি পায়! কী মূর্খই না ছিলাম! যে মরতে ভয় পায় সে কী না আত্মহত্যা করবে! কিন্তু তখন এ কথা মনে হয়নি। বরং ভয়ে ভয়েই বিয়েতে রাজি হলাম। আবীরের মা-বাবা এসে আমার মা-বাবার সঙ্গে কথা বললেন। বিয়েটা হয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু এ বিয়েটা আমি কখনও মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। কারণ আমার আর আবীরের বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তিই ছিল ভয়! প্ৰেম সেখানে কোথাও ছিল না। বিন্দুমাত্রও না!

বিয়ের পর আবীর এবার আমার ওপরেই র‍্যাগিং করতে শুরু করল! ফুলশয্যার রাতেই ও প্রথম আমার গায়ে হাত তোলে! আমার অপরাধ, অত্যন্ত ক্লান্ত থাকার ফলে আমার দেহ সাড়া দিচ্ছিল না! কিন্তু আবীরের ক্ষুধা ছিল মারাত্মক। আমি একটু রেহাই চাইছিলাম। যাদের ছেড়ে এসেছি তাদের কথা ভেবে, বিশেষ করে মায়ের জন্য আমার বড্ড কান্না পাচ্ছিল। আমি একটু কাঁদবার অবসর খুঁজছিলাম। কিন্তু আবীর আমাকে ঐটুকু প্রাইভেসি দিতেও রাজি নয়। ও একরকম আমার ওপর ঝাঁপিয়েই পড়ল। যখন বুঝল আমার মিলনে সম্মতি নেই, তখন ঘুরিয়ে এক থাপ্পড় মারল। আমি হতবাক! এ কাকে বিয়ে করেছি আমি! এই আমার জীবনসঙ্গী! যে আমার চিন্তা ভাবনার, আমার সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোর সম্মান দিতে জানে না, তার সঙ্গে আমায় সারা জীবন কাটাতে হবে! ভাবতেই আমার আরও কান্না পেয়ে গেল। আবীর কিন্তু সে চোখের জলকে বিন্দুমাত্রও পাত্তা দিল না, বরং একটা জানোয়ারের মতো সে আমায় খুবলে খুবলে খেল। আমার ইচ্ছে আদৌ আছে কিনা তা জানারও প্রয়োজন বোধ করল না! যন্ত্রণায় আমার প্রাণ যাচ্ছিল! আবীর সম্ভবত আমায় ব্যথা দিতেই চাইছিল। স্বামীর অবাধ্য হওয়ার শাস্তি! তা সত্ত্বেও আমি টু শব্দটি করলাম না। ফুলশয্যার রাতে, স্বয়ং স্বামীর হাতেই ধর্ষিতা হলাম! বুঝতে পারলাম যে ধর্ষণ শুধু বাইরের লোকেরাই করে না, অত্যন্ত কাছের মানুষও করে!

কলেজ ছাড়ার পর আবীরের র‍্যাগিঙের একমাত্র শিকার হয়ে দাঁড়ালাম আমি। কথায় কথায় ও আমার গায়ে হাত তুলত। আমার কোনো কিছুই ওর পছন্দ ছিল না। বাবা-মা তুলে প্রায়ই গালমন্দ করত। এমনকি স্বামী স্ত্রী-র আনন্দঘন মিলনের মুহূর্তগুলোও আমার কাছে হয়ে উঠত অসম্ভব বেদনাদায়ক। আবীর আমায় নিয়ে যা খুশি তাই করত। আমার প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না। আবীর মানুষ ছিল না। অন্তত আমার চোখে মানুষ বলতে যা বোঝায়, তাও ছিল না। ওকে একটা পশু ছাড়া আর কিছুই মনে হত না! ওকে ছেড়ে চলে যেতেই পারতাম। ডিভোর্স নিতে পারতাম। কিন্তু ফিরে যাব কার কাছে? বাবা মেয়েকে ঘাড় থেকে নামিয়ে দায়মুক্ত হয়েছেন। আবার সেই জোয়াল ঘাড়ে চাপাতে তিনি রাজি নন। মাকে লজ্জার মাথা খেয়ে সবকথা বললাম। মা বললেন, ‘স্বামী স্ত্রীয়ের মধ্যে তো ওরকম অশান্তি হয়েই থাকে। তাই বলে কেউ নিজের ঘর ছেড়ে আসে? একটু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা কর মা!‘

মায়ের কাছ থেকে অবশ্য অন্য কথা আশা করিনি। তিনি নিজেও আজীবন সহ্য করেছেন। আমাকেও সহ্য করার পরামর্শ দেবেন, সেটাই স্বাভাবিক। আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। দাদুর কাছে যেতে পারতাম। কিন্তু তখন তিনি অসুস্থ। তাই তাঁকে বিরক্ত করারও কোনো ইচ্ছে ছিল না। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্যই করে গেলাম।

এর কিছুদিন পরেই দাদু মারা গেলেন। তাঁর বিজনেসের উত্তরাধিকারী হলাম আমি। তখনই আবীরের হাবভাব অনেকটাই পালটে গেল। অত্যাচারও কমে এল। মনে হল, সে যেন আমায় সমঝে চলছে। এর মধ্যেই এল আরেকটা খুশির খবর। আমি গর্ভবতী হলাম। আবীর আরও খানিকটা পালটাল। আমার ওপর সে আর অত্যাচার করত না। বরং রীতিমতো যত্ন নেওয়া শুরু করল। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না! এই সেই আবীর যার ভয়ে আমি কাঁটা হয়ে থাকতাম! সে এখন সযত্নে আমার দেখভাল করে চলেছে! মনে মনে খুশি হলাম। বুঝতে পারছিলাম, সন্তান সৌভাগ্য আমার ভাগ্য পালটাতে চলেছে।

আবীর আর আমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হল। আমি খুশি ছিলাম। বহুদিন পরে সুখের মুখ দেখেছি। স্বামী, সংসার, সন্তান নিয়ে আমি এখন এক পরিপূর্ণ নারী। হোটেলের বিজনেসও ভালোই চলছিল। আস্তে আস্তে আমাদের সন্তান বড় হয়ে উঠছে। ইতিমধ্যেই আবীরকে চাকরিসূত্রে ইউ.এস.এ তে চলে যেতে হল। কিছুদিন পরে আমরাও চলে গেলাম। আমি ব্যবসার দায়িত্ব আমাদের এক বিশ্বস্ত কর্মী দীননাথ গুপ্তকে দিয়ে বিদেশেই আবীরের সঙ্গে সেটলড হয়ে গেলাম।

কিন্তু তখনও জানতাম না আবীরের মনের মধ্যে কী চলছে! বিদেশে সে আমাকে একা পেয়ে আবার টর্চার শুরু করে দিল। দাবি, হোটেলের বিজনেসটা ওর নামে লিখে দিতে হবে। মেয়েদের আবার বিজনেস কী! মেয়েরা শুধু ঘর সংসার করবে, সন্তানের জন্ম দেবে, স্বামী-সন্তানের সেবা করবে! ওসব ব্যবসা মেয়েদের কম্মো নয়। তাই আমার দাদুর বিজনেসটার মালিকানা আমায় ওর নামে করে দিতে হবে।

জীবনে এই প্রথমবার প্রতিবাদ করলাম। বললাম, ‘না।’

আবার র‍্যাগিং শুরু হয়ে গেল। আমার সন্তান প্রতিদিন দেখত তার মায়ের কপালে কালশিটে, গায়ে মারের দাগ। সে অবাক হয়ে বারবার জিজ্ঞাসা করত। কিন্তু আমি তাকে কোনো উত্তর দিতে পারতাম না। আমি যেন ওখানেই অর্ধেক মরে গিয়েছিলাম। শুধু আনুষ্ঠানিক মৃত্যু বাকি ছিল। ঐ বিদেশ বিভূঁইয়ে আমার সহায় হওয়ার মতো কেউ ছিল না। আমি একা একাই গুমরে গুমরে মরছিলাম!

কয়েকদিন পর আবীর গোঁ ধরল, সে লং ড্রাইভে যাবে। আমি আপত্তি করেছিলাম। কিন্তু আবীর কোনো কথাই শুনল না। উইকেন্ডে লং ড্রাইভে না গেলে বোধহয় গোটা জীবনটাই নষ্ট হয়ে যায়! অগত্যা আমরা রওনা হলাম। আবীর আমাদের শহরের বাইরে নিয়ে চলল। কিছুক্ষণ বাদেই শহরের ব্যস্ত রাস্তা ছাড়িয়ে আমরা একটু নিরিবিলির দিকে চললাম। আমার সন্তান ততক্ষণে ভারী মজা পেয়েছে। সে তখন চিৎকার করে নার্সারি রাইমস আওড়াচ্ছে। খিলখিল করে হাসছে। তার হাসির আওয়াজ এখনও আমার কানে বাজে।

এই সড়কটা তুলনামূলকভাবে শুনশান ছিল। তার মধ্যেও চোখে পড়ল দূর থেকে এক পাহাড়প্রমাণ ট্রাক ফুল স্পিডে এদিকেই আসছে। প্রথমে ব্যাপারটাকে পাত্তা দিইনি। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝলাম আবীর গাড়িটাকে একেবারে ট্রাকের মুখোমুখি নিয়ে যাচ্ছে! না, কোনোরকম ভুল হয়নি আমার। ও ইচ্ছাকৃতই গাড়িটাকে নিয়ে গিয়েছিল ট্রাকের সামনাসামনি। আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম। আমার শিশু সন্তান আমায় জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। আবীরের মুখের সেই শয়তানি হাসিটা কোনওদিন ভুলব না! ও ফুলস্পিডে আমাদের গাড়িটাকে ট্রাকের সামনে এনে নিজে দরজা খুলে লাফিয়ে পড়ল!

তারপর আর কী! আমার সন্তানটা ওখানেই মারা গেল। আমি পঙ্গু হয়ে কোনোমতে বেঁচে রইলাম। আবীর আবার আমায় ভয় দেখাল যে কাউকে কিছু বললে ও আমায় প্রাণে মেরে ফেলবে। ততদিনে আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে আবীর চাইলে সব কিছু করতে পারে। খুন করাও অসম্ভব নয়। ও আমায় হাসতে হাসতে বলল যে আকাশকে ওরা কীভাবে মেরেছিল! ছেলেটা রাত্রে হস্টেলের ছাদে একটু পায়চারি করছিল। পায়চারি করতে করতেই দেখে ছাদের এককোণে কে যেন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সে একটু এগোতেই মুখ তুলেছিল সেই ছায়ামূর্তি! কিন্তু তার মুখ দেখে রক্ত হিম হয়ে যায় আকাশের! ও কী! ও কে! কী ভয়ংকর!

শ্রেয়সের আত্মার কথা হস্টেলে সবাই জানত। আকাশেরও অজানা ছিল না। ওই বিশেষ ঘরটায় থাকতে তার যে ভয় লাগত সে কথা প্রসঙ্গক্রমে আমায় বলেওছিল। আকাশ প্রচণ্ড ভয় পেল! সে কোন্ দিকে যাবে বুঝতে না পেরে এলোপাথাড়ি দৌড়তে শুরু করল! কিন্তু যেদিকেই যায়, ছায়ামূর্তিও পেছন পেছন সেদিকেই হাজির। আবীর আমাকে বলছিল, কেমনভাবে ওর চোখদুটো ঠিকরে এসেছিল, কেমন করে ও দৌড়দৌড়ি করছিল, কীভাবে কেঁদেছিল ছেলেটা—সব পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেছিল! শেষপর্যন্ত প্রচণ্ড ব্যথায় কীভাবে ওর গোটা শরীর কুঁকড়ে গিয়েছিল, নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না, তবু আপ্রাণ চেষ্টা করছিল একটু অক্সিজেন নেওয়ার, তারপর একসময় ধড়ফড় করতে করতেই স্থির হয়ে গিয়েছিল—সব বলেছিল আমায়! এবং অত্যন্ত সগর্বে! ওর প্রত্যেকটা শব্দ তৃপ্তিমাখা ছিল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবছিলাম, এ ঠিক কী ধরনের জানোয়ার! মুখোশ পরে ও-ই ভয় দেখিয়েছিল আকাশকে। আর বাকিরা লুকিয়ে বসে তামাশা দেখছিল! ছেলেটা মরে গেল, অথচ এই পশুগুলোর কোনো অনুতাপ নেই! বরং সগর্বে সে কথা বলছে!

সন্তান হারানোর যন্ত্রণা আমি ভুলে উঠতে পারিনি। তার আগেই আমাকে গ্রাস করল এক নিঃসীম ভয়! হ্যাঁ, আবীর সব কিছু করতে পারে! এখন তো আমি পঙ্গু, নড়াচড়ারও উপায় নেই। আমায় মেরে ফেলে দিলেও কেউ জানতে পারবে না!

এর মধ্যে বিদেশেই আমি রি-হ্যাবিলিটেশন সেন্টারে ভর্তি হলাম। আমার হাঁটুর নীচ থেকে পা কাটা গিয়েছিল। উন্নত মানের প্রস্থেটিক লেগের ব্যবহার করতে আমায় শেখানো হল। আস্তে আস্তে আমি নকল পায়ে হাঁটতে অভ্যস্ত হলাম। শুরুর দিকে বেশ অসুবিধে হলেও পরে ব্যাপারটা অনেকটাই সহজ হল। বাড়িতে অবশ্য আমি হুইলচেয়ারই ব্যবহার করতাম। কোথাও যেতে হলে তখন প্রস্থেটিক লেগের সাহায্য নিতে হত। কত মানুষ এই নকল পায়ের সাহায্যে কত কী করছে! কেউ নাচছে, কেউ পাহাড়ে চড়ছে, কেউ সাঁতার কাটছে, আর আমি হাঁটতে পারব না! যাদের সহ্যশক্তি বেশি হয়, তাদের মনের জোরও বেশি হয়। মনের জোরেই আমি আবার উঠে দাঁড়ালাম।

ব্যাপারটা যদিও আবীরের খুব একটা পছন্দ হয়নি। একেই তো সে আমায় মারার প্ল্যানিং করেছিল, কিন্তু সে প্ল্যান ব্যর্থ হয়। যদি বা পঙ্গু করে রাখা গেল, তাও আমি প্রস্থেটিক লেগের সাহায্যে চলাফেরা শুরু করেছি! সে আমাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি হার মানলাম না! সে প্রতিদিন আমায় ভয় দেখাতে শুরু করল। হোটেলের বিজনেসটার মালিকানা ওকে না দিলে ও আমায় খুন করে ফেলবে! আমি পুলিসের কাছে যেতে পারতাম। কিন্তু কিছু প্রমাণ করা যেত না! সবচেয়ে বড় কথা, আমার অত সাহস ছিল না। ছোটোবেলা থেকেই আমি বড়ো ভীতু মানুষ। আমার জায়গায় একটা সাহসী মেয়ে থাকলে যা করতে পারত, আমি তা পারিনি! আবার হোটেলের বিজনেসটা ওর নামে করে দিতেও আমার যথেষ্ট আপত্তি ছিল। বুঝতে পেরেছিলাম, সম্পত্তিটা পেয়ে গেলেও ও আমায় বাঁচিয়ে রাখবে না! কারণ ও অবলীলায় মানুষকে খুন করে ফেলতে পারে। আর তার জন্য বিন্দুমাত্র অনুতাপও ওর হয় না!

এর মধ্যেই আমরা আবার ভারতে ফিরে এলাম। যদিও আমার পরিস্থিতি বদলালো না! আমি সারাদিন হোটেলের দেখাশোনা করতাম। দীননাথ গুপ্ত আমায় সাহায্য করতেন। কিন্তু যখন কাজের শেষে বাড়ি ফিরতাম, দূর থেকে বাড়িটাকে দেখামাত্রই বুক কাঁপত! সে ভয় বর্ণনা করা অসম্ভব! আমি প্রতিটা মুহূর্তে মরছিলাম অফিসার। সর্বক্ষণই মনে হচ্ছিল, এই বুঝি আবীর এসে আমার গলায় ছুরি বসিয়ে দিল! এই হয়তো আমার গলা টিপে ধরল! এই হয়তো খাবারে বিষ মিশিয়ে দিল। প্রতিটা মুহূর্ত আমি তিলে তিলে মরছিলাম! রতন আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকত বটে, কিন্তু কী ভরসা লোকটা হয়তো ওর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে আমায় মেরে ফেলবে। গোটা রাতটাই তো আমায় ওই লোকটার ঘরেই কাটাতে হয়। সেখানে তো আমায় বাঁচানোর জন্য রতন নেই! যতক্ষণ নিজের কাজে ব্যস্ত থাকতাম, রতনের সঙ্গে থাকতাম, ততক্ষণ স্বাভাবিক থাকতাম। কিন্তু রাত হলেই সেই বিভীষিকা ফিরে আসত! একেকটা দিন কাটত আর আমি ভাবতাম, এই আমার শেষ দিন! কাল সকালে আর এই বেডরুম থেকে আমি জীবন্ত বেরোব না!

এই মরণযন্ত্রণার কথা একমাত্র ভুক্তভোগীই জানে অফিসার। যদি ঐ অ্যাক্সিডেন্টে মরে যেতাম তাহলে হয়তো শান্তি পেতাম। মৃত্যুকে এইভাবে রোজ সঙ্গী করে বেঁচে থাকা যে কী যন্ত্রণার তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। রোজ তিলে তিলে মরছিলাম আমি। রাতে ঘুম হত না। সবসময়ই উদ্বেগের মধ্যে থাকতে থাকতে আমি বোধহয় মানসিক ভারসাম্যও হারাচ্ছিলাম। যে ছেলে মেয়েগুলোকে আমরা র‍্যাগিং করতাম তাদের যন্ত্রণা বুঝতে পারছিলাম। কারণ সেই চিরাচরিত অত্যাচারিতের জায়গায় আমি এসে দাঁড়িয়েছিলাম। আকাশ, সুজিতের প্রতি আমার সমবেদনা ক্রমশই বাড়তে থাকে। কিন্তু কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ডিভোর্স চাইলে আবীর আমায় মেরেই ফেলবে। আবার বেঁচে থাকতেও দেবে না!

কিছুদিন এমনভাবেই চলার পর ঈশ্বর সদয় হলেন। আমার ওভারিয়ান ক্যানসার ধরা পড়ল। লাস্ট স্টেজ। আবীর খুশি হল কিনা জানি না। কিন্তু এই প্রথম আমি আর ভয় পেলাম না। সারাজীবন ধরে এত ভয় পেয়ে এসেছি যে মারাত্মক কর্কট রোগকেও আর ভয়াবহ মনে হল না। কারণ আমার আর কিছু হারানোর ছিল না! ক্যানসার আমায় যথাসময়েই মারবে। আমার একমাত্র সন্তানটাকে তো আবীর আগেই মেরে ফেলেছে। তার জন্য শয়তানটার বিন্দুমাত্রও অনুতাপ, একটু অনুশোচনা বা দুঃখ—কিছুই ছিল না! ক্যানসারকে আমার আবীরের থেকে অনেক ভালো অপশন মনে হল।

যে মুহূর্তে মানুষ নিজের মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ায়, সেই মুহূর্তেই হয়তো সে নির্ভীক হয়ে ওঠে। অন্তত আমার ক্ষেত্রে ঠিক তাই-ই হয়েছে। যখন একটু একটু করে নির্ধারিত মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছি, তখন মনে হল, আমি তো মরবই, তার সঙ্গে আবীরকেও বুঝিয়ে ছাড়ব মৃত্যু কাকে বলে, মৃত্যুভয় কাকে বলে! আমার তো দিন শেষই হয়ে এসেছে, আর ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই আমার! প্রাণটা বাকি ছিল। সেটাও স্বয়ং ঈশ্বর কেড়ে নেবেন। আর কী আছে যার জন্য ভয় পাব! আর কিছু নেই!

শেষমুহূর্তে নিভু নিভু প্রদীপ একবার পূর্ণোদ্যমে জ্বলে ওঠে। আমিও জ্বলে উঠলাম। ঠিক করলাম, আবীরকে শাস্তি দেব! ওর সমস্ত কৃতকর্মের শাস্তি ওকে পেতেই হবে। আমি থাকব না, হয়তো দেখে যেতে পারব না, কিন্তু ওকে শাস্তি ভোগ করতেই হবে! ওর একমাত্র দুর্বলতা থ্যানাটোফোবিয়া! মৃত্যুভয়! সারাজীবন সবাইকে ভয় দেখিয়ে এসেছে আবীর সেন। এবার ওকে বুঝিয়ে ছাড়ব যে ভয় পেতে কেমন লাগে!

সেই মতোই প্ল্যানিং শুরু করলাম। আমার আর কোনোরকমের পিছুটান ছিল না যে ভাবব। প্রথম কিছুদিন ভেবে পেলাম না যে কী করলে আবীর ভয় পাবে, কী করলে ওকে আমি সেই যন্ত্রণা দিতে পারব, যে জ্বালায় দিনরাত আমি জ্বলে এসেছি। আকাশ, সুজিত যে ভয়ের মধ্য দিয়ে দিন কাটিয়েছে, ওকে আমি সেই ভয়ের মধ্যেই নিয়ে যেতে চাইছিলাম। প্রতি মুহূর্তে, প্রতি পলে তিল তিল করে মরবে! মৃত্যুর ভয়ে শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরের কাছে মৃত্যু ভিক্ষা করবে। কিন্তু পাবে না! আমার মতোই রোজ সকাল থেকে রাত অবধি ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতে হবে!

কাজটা সহজ ছিল না। কিন্তু অনেক ভেবে একটা উপায় বের করলাম। এক এক করে ফোবিয়ান্সের সদস্যরা মরতে শুরু করলে ঠিক কেমন হয়? অন্যদের প্রতি আমার বিন্দুমাত্রও দুর্বলতা ছিল না। ওগুলো সবক’টাই সমান শয়তান! ওদের মৃত্যু খুব সহজ হবে না! ওদের প্রত্যেককে ভয় পেয়ে মরতে হবে। আমি ওদের সবার দুর্বলতা জানতাম। কে কোন্ ফোবিয়ায় ভোগে তা আমার খুব ভালোভাবেই জানা আছে। আবীরকে ভয় দেখাতে হলে আগে ওদের মারতে হবে! এক এক করে একই গ্রুপের প্রাক্তনীদের রহস্যময় মৃত্যু হতে শুরু করলেই আবীর ভয় পাবে! ভীষণ ভয় পাবে! কারণ ওর ফোবিয়াটাই যে এমন! ওরা সবাইকে ভয় দেখাতে পারে, কিন্তু নিজের ভয়ের সামনে দাঁড়াতে পারে না! এবার ওকে ওর ভয়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যাক! দেখা যাক, আবীর সেন ঠিক কতটা বীরপুরুষ!

প্রথমেই তাড়াহুড়ো করলাম না। ফোবিয়ান্সের কারোর সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল না। অ্যালামনি অ্যাসোসিয়েশনে আমার এক পরিচিত সিনিয়র ছিলেন। তাঁকেই বললাম, আমি পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাই। তিনিই আমায় সবার ফোন নম্বর আর অ্যাড্রেস দিয়ে দিলেন। আমি ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। ওরা এতদিন বাদে আমার ফোন পেয়ে অবাক হল। সৌমিত্র অর্থকষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। নানারকম কথাবার্তা বলতে বলতে ওর আর্থিক কষ্টের কথা জানতে পারলাম! সেটাই স্বাভাবিক। কলেজ জীবন থেকেই সৌমিত্র অত্যন্ত দুশ্চরিত্র ছিল। দেখলাম, এখনও বিশেষ বদলায় নি। স্ত্রীয়ের ওপর যথাসম্ভব অত্যাচার করে। সেটা আবার গর্বের সঙ্গে বলেও ফেলল, ‘মেয়েরা হল কুকুরের জাত, বুঝলি? মাথায় চড়তে দিলেই মুশকিল। পায়ের তলায়ই ঠিক আছে।’ বুঝলাম ওর আর আবীরের মধ্যে বিশেষ ফারাক নেই। তাই আমার চোখে ওর আর বেঁচে থাকার অধিকার থাকল না।

আমি ওকে প্রথমে বেশ কিছু টাকা দিয়ে ওর বিশ্বাস অর্জন করলাম। বললাম, এ টাকাটা আমি আবীরকে লুকিয়ে দিয়েছি। ও যেন কাউকে এ টাকার কথা না বলে, এমনকি এ-ও না বলে যে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে বা কথা হয়েছে। ও খুশি হল এবং আমাকে পরোপকারী বান্ধব ঠাউরে নিল। আমার ক্যানসার হয়েছে জেনে খুব দুঃখপ্রকাশও করল। আমি এমনভাবে প্ল্যানিং করেছিলাম যাতে ওর মৃত্যুটা ভয়ের চোটেই হয়। কিন্তু মুশকিল হল, হার্টফেল করে মরলে আবার পুলিস এ কেস নিয়ে মাথা ঘামাবে না। ক্ষমা করবেন, কিন্তু পুলিসও আমার প্ল্যানের একটা পার্ট ছিল। একদিকে একের পর এক মৃত্যু, অন্যদিকে পুলিসের চাপ থাকলে তবেই না ষোলকলা পূর্ণ হবে! আবীর মুখে বড়ো বড়ো বুকনি মারলেও পুলিসকে ভয় পায়। ওর ভয়, আকাশের মৃত্যুর সত্যিটা না বেরিয়ে পড়ে! আমি ওকে পুরো কোণঠাসা করতে চেয়েছিলাম। সেইজন্যই পুলিসকে ব্যবহার করার জন্য একটা দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় এল। কালু নামের এক হিস্ট্রিশিটারকে ওদের নামের সুপারি দিলাম। এবং যাদব নামের এক খবরিকে নিজেই গিয়ে সুপারির টিপ দিয়ে এলাম। যাদব যে পুলিসের ইনফর্মার তা আমায় রতন বলেছিল। রতন যাদবকে চেনে। ও যে চায়ের দোকানটায় রোজ চা খেতে আসে, সেই দোকানটার খোঁজও রতন জানত। আমার কাজ সহজ হয়ে গেল। পুলিস হার্ট ফেইলিওরে মৃত্যুকে পাত্তা না দিক, সুপারির কেসকে নিশ্চয়ই পাত্তা দেবে। আমি ভেবেছিলাম, গন্ধ পেয়ে পুলিস ঠিক শুঁকতে শুঁকতে চলে আসবে। কিন্তু কে জানত পুলিসের জায়গায় সি.আই.ডি হোমিসাইড আসবে!

অবশেষে প্ল্যান এক্সিকিউট করার দিন এল। বনোয়ারিলালকে আগেই হাত করে রেখেছিলাম। সে তৈরিই ছিল। সৌমিত্রকে বললাম, আমার শরীরটা খারাপ লাগছে, আমাকে কি ও হসপিটালে নিয়ে যাবে? এমার্জেন্সি! সৌমিত্র টাকার নেশায় মশগুল ছিল। যে বন্ধু ওকে ফুর্তির টাকা জোগাচ্ছে তাকে কি ও মরে যেতে দিতে পারে? অগত্যা ও তাড়াতাড়ি বাড়িতে আসতে চাইল। আমি বললাম, বাড়িতে আসতে হবে না। রতন আমাকে হসপিটাল অবধি দিয়ে আসবে। কিন্তু তারপর ডাক্তারের কথা বোঝার জন্য একজন শিক্ষিত লোকের প্রয়োজন। রতন ডাক্তারের কথার বিন্দুবিসর্গও বুঝবে না। এদিকে আবীরও এই মুহূর্তে বাড়ি নেই।

আবীর সত্যিই বাড়িতে ছিল না! ওর কোনো বান্ধবীর বাড়িতে মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়েছিল। একদম মিথ্যে কথা বলিনি। যাই হোক, আমি ওকে হসপিটালের নাম বললাম। ও বলল, এখনই পৌঁছে যাবে। আমিও রতনের সঙ্গে বেরোলাম। উক্ত হসপিটালে ও আমার জন্য ওয়েট করছিল। বনোয়ারিলাল ভেতরে অপেক্ষায় ছিল। আমার ফোন পেয়ে বাইরে এল। আমি হসপিটালের ভেতরে ঢুকতে চাইছিলাম না। কারণ ভেতরে সিসিটিভি আছে। বনোয়ারি আর রতন সৌমিত্রকে ফর্ম জমা দেওয়ার নাম করে একটু ফাঁকা জায়গায় নিয়ে গেল। তারপর একটা বিশেষ পদ্ধতিতে ঘাড়ের রগে মেরে ওকে কিছু সময়ের জন্য অজ্ঞান করে ফেলল। বনোয়ারি ট্রলি নিয়েই এসেছিল। তারপরের কাজটা অত্যন্ত সহজ। বনোয়ারি ওকে ট্রলিতে চাপিয়ে সোজা মর্গে ঢুকিয়ে দিল। আমি ওকে আগেই আগাম টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু ও আরও টাকা চাইছিল। আমি কোনো প্রতিবাদ না করে ওকে বাকি টাকাটা দিলাম।

এরপর মৃন্ময়ের পালা। একই কথা বারবার রিপিট করলে আপনি বোর হবেন। তাই সংক্ষেপেই জানাই, ওকেও টাকা দিয়ে হাত করেছিলাম। দেখলাম ও-ও ওর বউয়ের লাইফ হেল করে রেখেছে! তারপর ঐ একই কথা বলে অন্য একটি হসপিটালে নিয়ে যাই। মোডাস অপারেন্ডি একই। সেখানে একজন আমায় হেল্প করেছিলেন। তাঁর নাম আমি বলব না। চাই না, ব্যক্তিটি আমার জন্য কোনো সমস্যায় পড়ুক। কিন্তু তাঁরও স্বার্থ ছিল। ঠিক একইরকম করে মৃন্ময়কেও অজ্ঞান করে ফেলা হল। তারপর এম.আর.আই মেশিনে ঢুকিয়ে দেওয়া হল! টেকনিশিয়ানরা তখন কেউ সেখানে ছিল না। আমার পরিচিত ভদ্রলোকটি জানতেন যে ঐ সময়ে টেকনিশিয়ানরা থাকবে না। সুতরাং কাজ হতে বিশেষ অসুবিধে হল না।

উৎপলের পেছনেও অনেক টাকা খরচ করেছিলাম। ওর আরও টাকার দরকার ছিল। ওই আরেকজন! গোটা সংসারটার অবস্থাই খারাপ করে রেখেছিল! ওই অ্যাপার্টমেন্টে আমারও ফ্ল্যাট ছিল। ও সেটা জানত। ব্যাপারটা এমনভাবে করেছিলাম যাতে উৎপল পুরোটাই কো-ইনসিডেন্স ভাবে। ওকে টাকা দেওয়ার ছলে ছাদে ডাকলাম। ও দিব্যি সুড়সুড় করে চলে এল। আমি বললাম, টাকা কেন, আমার সমস্ত প্রপার্টি ওর নামে লিখে দেব। শুধু কার্নিশের ওপর দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। উৎপল ভয় পেল। আমি জানতাম ওর সাহসে কুলোবে না। ও রাজি হবে না। তাই একটা অন-লাইসেন্সড রিভলবার জোগাড় করে রেখেছিলাম। প্লিজ জানতে চাইবেন না কীভাবে। হোটেলের ব্যবসায় সব ধরনের লোকেদেরকেই আমাদের ডিল করতে হয়। বন্দুকটা প্রথমে নিজের সেফটির জন্যই কিনেছিলাম। কিন্তু অন্য কাজে লেগে গেল। ও কিছু বলার বা করার আগেই ওর দিকে বন্দুক তাক করে বললাম, ‘কার্নিশের ওপর দাঁড়া! নয়তো এখানেই গুলি করে মারব।’ ও প্রচণ্ড ভয়ে কী করবে ভেবে পেল না! আমার খুব ভালো লাগছিল। ওদের চোখে মুখে ভয়ই তো দেখতে চেয়েছিলাম আমি! চেয়েছিলাম, ওরা যেন ভয়ের চরম সীমা অবধি পৌঁছয়। সারাজীবন তো অন্যদেরই লাইফ হেল করে রেখেছিল। নিজের লাইফ হেল হলে কেমন হয়, সেটাও ওর জানা উচিত।

উৎপল বাধ্য হয়ে কার্নিশের ওপর উঠে দাঁড়াল। আমি দেখলাম ওর পা থরথর করে কাঁপছে। গোটা দেহটা কাঁপছে। বুঝতে পেরেছিলাম বেশিক্ষণ টিকবে না। বড়জোর ত্রিশ সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছিল ও। তারপর সোজা নীচে …!

আপনি ভাবছেন, আন-লাইসেন্সড গানটা কেন সঙ্গে রেখেছিলাম আমি? ওটা আমার প্ল্যান বি। যদি এই ‘ডেয়ার অর ডাই’ খেলায় সত্যি সত্যিই কেউ ‘ডেয়ার’ করে ফেলে, অর্থাৎ যদি নিজের ভয় থেকে মুক্তি পেয়ে যায়, সাহস দেখিয়ে বেঁচে ফেরে, তাহলেও যাতে তার বাঁচার উপায় না থাকে। অর্থাৎ যে কোনো দিক দিয়েই ওদের মৃত্যু অবধারিত ছিল। ওদের একেবারেই মেরে ফেলার প্ল্যান ছিল।

এর মধ্যেই আপনারা কালুকে ধরে ফেললেন। আমার পরিকল্পনা মতো পুলিসের এন্ট্রি হল। নিশ্চিত ছিলাম আগের দুটো মৃত্যুর কথা জানতেও আপনাদের বিশেষ সময় লাগবে না।

পুলিস ঠিক আমাদের খুঁজে পেতে চলে আসবে, এ বিশ্বাস আমার ছিল। কিন্তু আরেকটা টেকনিক্যাল সমস্যা ছিল। আবীরকে জানাতে হত যে ওর বন্ধুরা একে একে মরছে। কোনো বন্ধুর সঙ্গেই ওর যোগাযোগ ছিল না। ওকে জানানোর একমাত্র উপায় মিডিয়া। কিন্তু মৃত্যুগুলো অত্যন্ত সাধারণ। এই কোভিডের সময়ে অনেকেই হার্টফেল করে মরছে বা আত্মহত্যা করছে। কোনো রিপোর্টার এই খবরটাকে সিরিয়াসলি কেন নেবে? কোন কালে জেজিইসিতে একটা গ্রুপ ছিল ‘ফোবিয়ান্স’ নামের, তাকে নিয়েই বা খবর করবে কেন!

সেই জন্যই আমি শ্ৰুতি চ্যাটার্জিকে বেছে নিই। শ্রুতিকে আমি চিনতাম। কলেজে পড়ার সময়ে ওকে দেখেছি। পরে টিভিতে দেখেও চিনতে পেরেছিলাম। আমি জানতাম ও নিজের ইন্টারেস্টেই খবরটা করবে। সেজন্যই টুয়েন্টি ফোর সেভেনে ফোন করে আমি ওকেই চাইলাম। ভয়েস চেঞ্জার অ্যাপের মাধ্যমে গলা পালটে ওর সঙ্গে কথা বললাম। আর যেমন ভেবেছিলাম ঠিক তেমনই ঘটল। শ্রুতি খবরটা কভার করল।

বনোয়ারিলাল ভাবতে পারেনি যে এর মধ্যে পুলিস, মিডিয়া সব এসে পড়বে। যখন ও জানতে পারল যে পুলিস এ বিষয়ে তদন্ত চালাচ্ছে, তখন ও ঘাবড়ে গেল। এতটাই ভয় পেয়ে গেল যে বলল, ও পুলিসকে সব বলে দেবে। আমি এইভাবে খেলা নষ্ট করতে চাইনি। ওকে অনেক টাকার লোভ দেখালাম। রতনকে দিয়ে টাকাও পাঠালাম। কিন্তু নোটের পিনে পটাশিয়াম সায়ানাইড মিশিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর কী হয়েছে তা আপনারা জানেন। আরেকটু হলেই রতনকে ধরে ফেলছিলেন আপনারা! আমি বুঝতে পেরেছিলাম বনোয়ারিলালের মৃতদেহ অবধি আপনারা ঠিকই পৌঁছবেন। রতনকে বডিটা সরিয়ে দিতে বলেছিলাম। কিন্তু এমনই কপাল, যখন ও বনোয়ারির বাড়ি গিয়ে পৌঁছল, তার আগেই বনোয়ারির বডি আপনারা উদ্ধার করে ফেলেছেন!

শর্বাণীকেও আমি কিছু টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছিলাম। তবে সেটা নগদে। তাই ব্যাঙ্ক ডিটেইলসে পাবেন না আপনারা। ওকেও ওই একই ছুতোয় বাড়ি থেকে বের করেছিলাম। আমার সঙ্গে হসপিটালে যাওয়ার অনুরোধ করে ওকে গাড়িতে তুলে নিলাম। আবহাওয়াবিদদের ধন্যবাদ, আজকাল তারা একদম নিখুঁত ফোরকাস্ট করছেন। ক্যান্সার যখন আছেই, তখন তার কিছু সুবিধাও নেওয়া উচিত। ওদের সবার চোখে আমি বেচারা ক্যানসারের রোগী! আমার দিক দিয়ে কোনোরকম থ্রেট থাকতেপারে, তা ওরা ভাবতেই পারেনি। শর্বাণীও ভাবতে পারেনি। ঝড়বৃষ্টির মধ্যে সুযোগ বুঝে ওকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিলাম। ভেবেছিলাম, হার্ট ফেল করবে। ও যে পাগলের মতো একটা ট্রাকের সামনে গিয়ে পড়বে তা কে জানত! যাই হোক, আমার কাজ তো হল!

শ্রুতি চ্যাটার্জির মাধ্যমে খবরটা এবার ছড়াতে শুরু করল। আমি আবীরকে দেখলাম। ও ভয় পাচ্ছে! নিউজটা আমিই ওকে ডেকে দেখাই। বিশ্বাস করবেন না, ওর মুখটা সঙ্গে সঙ্গে শুকিয়ে গিয়েছিল! তারপর আপনারাও এলেন! আবীর আপনাদের সামনে খুব পালোয়ানি করলেও ভেতরে ভেতরে ভয়ে কাঁপছিল। আপনারা চলে যেতেই ও এসে আমায় জিজ্ঞাসা করল যে আমি আপনাদের সঙ্গে কী পার্সোনাল কথা বলছিলাম। আকাশের মৃত্যুর বিষয়ে কিছু বলেছি কি? আমি উত্তর না দিয়ে মিটিমিটি হাসছিলাম। ভয় পাচ্ছে! লোকটা ভয় পাচ্ছে! আমি যা করতে চেয়েছিলাম, ঠিক তাই হচ্ছে! অন্তত শুরুটা তেমনই হয়েছে।

সৌরীশ ভীষণ ভয় পেয়ে আছে। আবীরকেও ফোন করেছিল। বলেছে, আপনাদের সব কথা বলে দেবে। সে কথা শোনার পর আবীর আরও ঘাবড়ে গিয়েছে। আমার ধারণা ও সৌরীশকে বোঝানোর চেষ্টা করবে। রতন ইতিমধ্যেই ওর দরজার সামনে একটা পুতুল ফেলে এসেছে! ও রীতিমতো ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আবার ফোন করেছিল। এবার ফোনটা আমি ধরেছি। ওকে বলেছি, চিন্তার কিছু নেই। ওর যদি রাতে একা থাকতে ভয় লাগে তবে আমি আমার অ্যাটেনডেন্টকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ও যেন দরজা খুলে দেয়। রতন যাবে ঠিকই, কিন্তু কতগুলো পুতুল, আর হ্যালুসিনোজেন নিয়ে! সৌরীশেরও গল্প শেষ হবে আজকে।

আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন, আমি ঠিক কী পরিমাণ নিষ্ঠুর! অফিসার, আজ আমার বলতে বাধা নেই। আবীরকে আমি ঘৃণা করি। ওর থেকে ঘৃণিত মানুষ আমার কাছে আর নেই! ও সবসময়ই আমাকে ভয় দেখিয়ে এসেছে, জোর খাটিয়ে এসেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত সাপও বোধহয় ওর তুলনায় অনেক কম ভয়ংকর! ভাবতে পারেন, একটা তাজা প্রাণ ওর র‍্যাগিঙে শেষ হয়ে গেল, তারপরও ওর কোনো দুঃখ নেই অনুতাপ নেই! সেই ঘটনা থেকে শিক্ষাও নেয়নি! তারপরও র‍্যাগিং করে গিয়েছে! সুজিতও সেই র‍্যাগিঙের শিকার হল! যে বাবা নিজের সন্তানকেই অ্যাক্সিডেন্ট করিয়ে মারে, সে কি আদৌ মানুষ! প্রতি দিন, প্রতি মুহূর্ত আমি ধিকিধিকি জ্বলেছি! আমার সব গেছে, কিন্তু প্রতিশোধস্পৃহাটাকে ছাড়তে পারিনি। যেমন ভয় আকাশ আর সুজিত পেয়েছিল, যেমন ভয় আমি পেয়ে এসেছি, তেমনই ভয় আবীরকেও পেতে হবে। জীবন ওকে প্রতি মুহূর্তে ভয় দেখাবে। একদিকে বহু বছর আগের পাপের ভয়, অন্যদিকে মৃত্যুর ভয়! ও কোনোদিকেই যেতে পারবে না। সবসময় মৃত্যুর পদধ্বনি শুনবে! ভয় পেতে পেতে হয় ও পাগল হয়ে যাবে, নয় অন্যদের মতোই হার্টফেল করে মরবে। সেদিনটা দেখার জন্য আমি হয়তো থাকব না। কিন্তু আবীরও মরবে… মরতেই হবে ওকে!

আপনার সঙ্গে আরেকবার দেখা করার সাধ ছিল। কিন্তু আমার এই রোগটা বোধহয় সে সময় দেবে না। শরীরটা বড় খারাপ লাগছে। অনেক কথা বলে ফেলেছি। আর লিখতে পারছি না। আমি জানি, আইন আমায় শাস্তি দিতে পারবে না। কিন্তু মনে মনে এ-ও চাই, যে আমার হিরো শেষপর্যন্ত জিতুক। এ চিঠি আপনার হাতে পড়ুক এই কামনা! আমি আপনাকে সশরীরে কনগ্র্যাটস তো করতে পারব না। চিঠিতেই আপনার জয়ের জন্য অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বাস করুন, আমি কোনো জন্মগত ক্রিমিন্যাল নই। আমার পরিচয়, আমি একজন ভীষণ ভিতু মানুষ। ওদের প্রত্যেককে মারতে আমার ভয় করেছিল। তবু মেরেছি। ইচ্ছে করলে এক গুলিতেও উড়িয়ে দিতে পারতাম। তা করিনি কারণ ভয় কাকে বলে তা ওদেরও জানা উচিত ছিল।

ভালো থাকবেন, শুভ হোক।

উমা

.

চিঠিটা পড়ে অনেকক্ষণ দু-জনেই কোনো কথা বলতে পারেনি। অধিরাজ রতনের দিকে তাকিয়ে দেখল সে অঝোরে কাঁদছে। উমার জীবনের একমাত্র বিশ্বস্ত সঙ্গী তাঁকে নিরাশ করেনি। চিঠিটা সৌরীশের হত্যার আগে লেখা। রতন তার কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছিল। আইনের চোখে ও একজন খুনী। কিন্তু ওর মতো বিশ্বস্ত মানুষও কম আছে।

‘সৌরীশের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম। তোমায় ঢুকতে দেখিনি

কেন?’

রতন চোখের জল মুছল, ‘আমি পেছনের দোর দে’ ঢুকেছিলাম বাবু। আগুন নাগলে যে দোর দে’ মানুষ পালায়। তারপর পিছনের পাঁচিল টপকে বেইরেছি এবং ও-পথেই ঢুকেছি।’

‘বুঝেছি। ফায়ার একজিট! ‘

অর্ণব বুঝতে পারল রতন এসেছিল ফায়ার একজিট দিয়ে, চলেও গিয়েছিল সেই রাস্তাতেই। যার জন্য অর্ণবও তাকে দেখতে পায়নি।

‘ওই পাউডার আপনারে দিতে মা বলে নাই!’ সে কান্না ভেজা স্বরেই জানায়, ‘আমি ভয়ে দে’ছেলাম। ‘

‘হুম।’ খামটা ভাঁজ করে পকেটে পুরল অধিরাজ। তারপর আস্তে আস্তে বলল, ‘অদ্ভুত মস্তিষ্ক! আমাদের যেভাবে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করলেন ভদ্রমহিলা, তা প্রশংসার যোগ্য!

‘আপনি বুঝলেন কী করে স্যার?’

অধিরাজ ফ্যাকাশে হাসে, ‘ডটগুলো কানেক্ট করে। আমাদের চোখের সামনেই ব্লু-গুলো ছিল। কিন্তু ধোঁয়া এত বেশি যে আগুন দেখতে পাইনি আমরা! প্রথম ব্লু-ছিল হসপিটাল। যে লোকটি মৃন্ময় ও সৌমিত্রকে মেরেছে সে ওদের হসপিটাল অবধি নিয়ে গেল কোন্ ছুতোয়? ওরা কচি বাচ্চা নয় যে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যাবে। একটাই ছুতো হতে পারে। চেক-আপ, বা অসুস্থতা। সেই মানবিক গ্রাউন্ড সবার মধ্যে একমাত্র উমারই ছিল। ক্যানসার পেশেন্ট। যখন তখন অসুস্থ হয়ে পড়তেই পারেন। দুটো পা নেই, তার ওপর মারণরোগে ভুগছেন! তিনি বললে, যে কেউ তাঁর সঙ্গে হসপিটালে যেতে রাজি হয়ে যাবে।’

‘ডঃ সুদীপ চ্যাটার্জির কাছেও ছুতো ছিল। তিনি স্বয়ং ডাক্তার।’

অর্ণবের প্রশ্নটা শুনে মৃদু হাসল অধিরাজ, ‘তিনি ডাক্তার হওয়ার পাশাপাশি সুজিতেরও পিতৃদেব। ফোবিয়ান্সের কেউ তাঁর সঙ্গে যেতে রাজিই হত না! তাই সুদীপ চ্যাটার্জির প্রশ্নই ওঠে না।’

‘আচ্ছা।’ অর্ণব বলল, ‘তারপর?’

‘ফরেনসিক স্পেশ্যাল এস.এস.আর.আই।’ অধিরাজ আস্তে আস্তে বলে, ‘উৎপল ও শর্বাণীর খুনের ক্ষেত্রে স্পটে এস.এস.আর.আই পাওয়া গিয়েছিল। এখন প্রশ্ন হল, খুনী কেন অকুস্থলে বসে ওষুধ খাবে? এস.এস.আর.আই এর মূলত তিনটে ফাংশন। ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি এবং প্যানিক অ্যাটাক। তাহলে কি খুন করে সে ডিপ্রেসড হয়ে গিয়েছিল! হাস্যকর ব্যাপার! তাহলে কি অ্যাংজাইটি? এটা আরও হাস্যকর। কারণ যে ঠান্ডা মাথার খুনী এইভাবে একের পর এক খুন করে চলেছে সে খুন করার পর অ্যাংজাইটিতে ভুগবে, তা-ও হতে পারে না। নেতি নেতি করে ছাঁকনিতে পড়ে রইল প্যানিক অ্যাটাক। এটাও অসম্ভব মনে হলেও ডঃ চ্যাটার্জির কথাগুলো মিলিয়ে নিলে এটার সম্ভাবনাই বেশি হয়। রয়্যাল হাইটসের ছাদ থেকে যে ফয়েলটা আমরা উদ্ধার করেছিলাম, মনে আছে টাকলু বুড়ো সেটা সম্বন্ধে কী বলেছিল? বলেছিল যে, যে ওষুধটা খেয়েছে সে প্রচণ্ড ঘামছিল! ঘাম অবশ্য অ্যাংজাইটি থেকেও হয়। কিন্তু শৰ্বাণী যেখানে মারা গিয়েছিলেন সেখানে তো খুনী কাদার ওপরেই বসে পড়েছিল! কেন? জীবনেও শুনেছ যে খুন করার পর খুনী স্পটে থেবড়ে বসে পড়ে! এর একটাই উত্তর হতে পারে। তার শরীর খারাপ লাগছিল। কিন্তু কথা নেই বার্তা নেই এই দুটো খুনের ক্ষেত্রেই তার শরীর খারাপ লাগছিল কেন? বা প্যানিক অ্যাটাক হলই বা কেন? এরও একটাই উত্তর। বাকি খুনগুলো ছিল ব্লাডলেস। হার্টফেল করে মারা গিয়েছিল তারা, কোনোরকম রক্তারক্তি কাণ্ড হয়নি। কিন্তু এই দুটো খুনে স্পটে প্রচুর রক্ত ছিল। ইনফ্যাক্ট ক্রাইম সিন রক্তে প্রায় ভেসেই গিয়েছিল! সেই রক্ত দেখেই খুনীর প্যানিক অ্যাটাক হয়েছিল যা সামলানোর জন্য তাকে ওষুধ খেতে হয়। হাত কাঁপছিল বলে একটা ওষুধ পড়েও যায়! রক্ত দেখে প্যানিক অ্যাটাক একমাত্র একজনেরই হতে পারে। উমা সেন, যাঁর হিমোফোবিয়া আছে।’

‘ওঃ!’ অর্ণব সবিস্ময়ে বলে ওঠে, ‘সেই জন্যই স্পটে এস.এস.আর.আই ছিল!’

‘শুধু তাই নয়, একটা জিনিস ভেবে দেখো অর্ণব। কালু আমাদের কী বলেছিল? যে সুপারি দিয়েছিল তার ফোননম্বর ট্র্যাক করতে গিয়েছিল ও। কিন্তু পারেনি। আমরাও প ারিনি। সব প্রি পেইড সিম। এবং সব ক-টা সিমই ভারতবর্ষের আলাদা আলাদা অঞ্চলের লোকের নামে আছে! নিশ্চয়ই খুনীই বেনামে সিমগুলো কিনেছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকদের ডিটেইলস সে পেল কোথায়! প্রি-পেইড সিম পেতে হলেও তো কিছু কাগজপত্র দিতে হয়। সেটা সে পেল কী করে?’ অধিরাজ ধীর স্বরে বলল, ‘এবার ভেবে দেখো একটা হোটেলে ঠিক কী কী হয়! সেখানে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ আসে, থাকে। নিজেদের পরিচয়পত্রের একটা জেরক্স কপিও দিতে হয়। বেশিরভাগ লোকই আধার কার্ডের জেরক্স দেয়। সুতরাং সেখান থেকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের কিছু মানুষের আধার কার্ডের জেরক্স জোগাড় করে প্রি-পেইড সিম নেওয়া একেবারেই কষ্টকর নয়। আর আমাদের হাতের কাছেই হোটেলের মালকিন বসে আছেন।’

অর্ণব অবাক হয়। এই সম্ভাবনাটা সে ভেবে দেখেনি। অধিরাজ বলতে থাকে, ‘যাদবের কথাতেও হিন্ট ছিল। যাদব বলেছিল যে বোরখাধারী মেয়েটি বা মহিলা ওকে কালুর টিপটা দেয়, সে বোবা ছিল। কারণ যখন সে দাঁড়িয়েছিল তখন তার পায়ের ও পর দিয়ে একটা সবজির ঠ্যালা চলে গিয়েছিল। কিন্তু সে সামান্য শব্দটুকুও করেনি। এর পর যখন পাঞ্চীকে দেখলাম, তখন ওকে সন্দেহ হয়েছিল ঠিকই, তবে পরে ভেবে দেখলাম, বোবা হলেও তার যন্ত্রণার অনুভূতি নিশ্চয়ই আছে। বোবা ঠিকই, অনুভূতিশূন্য তো নয়! এরকম কারোর পায়ের ওপর দিয়ে ঠ্যালাগাড়ি যদি চলে যায় তবে সে লাফিয়ে উঠবে, কিছু বলতে না পারুক অস্ফুট শব্দ করবে, তা ও যদি না করে তবে মুখ বিকৃত করবে অথবা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটবে! অথচ এর কোনোটাই কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়নি! তবে কি মেয়েটি অনুভূতিশূন্য? তার পা প্যারালাইসিজড হতেই পারে না কারণ সে ঐ পায়ের সাহায্যেই দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছে! তবে কি তার পা দুটো নকল! আর প্রস্থেটিক লেগ তখনই আসতে পারে, যখন কারোর পা থাকে না। প্রস্থেটিক লেগ পরেছিলেন বলেই হসপিটালের সিসিটিভি ফুটেজে ওঁর হাঁটাটা ছেলেদের মতোন মনে হয়েছিল। আমরা আবার ওঁকে হুলো ঠাউরে বসলাম!’

‘কিন্তু আমরা তো জানতাম না যে উমা প্রস্থেটিক লেগ ইউজ করেন?

‘কে বলল জানতাম না? আমি একটি গর্দভ তাই বুঝতে পারিনি। উমা নিজেই বলেছিলেন যে তিনি এখনও নিজেই ড্রাইভ করেন! কথাটা তুমি এবং আমি দু-জনেই শুনেছি। যার দুটো পা-ই নেই সে ড্রাইভ করে কী করে? উমা নিজেই ক্লু দিয়েছিলেন যে তিনি প্রস্থেটিক লেগ ইউজ করেন। আমার ধারণা ও বাড়িতে খুঁজলেই পা দুটো পাওয়া যাবে। সকলেই এই পায়ের কথা জানত। ইনফ্যাক্ট আমরাও জানতাম। কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি।’

অর্ণব গোল গোল চোখ করে শুনতে থাকে। ভদ্রমহিলার কী সাহস! নিজেই ব্লু দিয়েছিলেন!

‘চাবির ব্লুটাও কিন্তু উমাই দিয়েছিলেন। মিস দত্ত-র মনে হয়েছিল, আওয়াজটা চুড়ি বা পায়েলের। আমি সৌরীশের বাড়িতে দ্বিতীয়বার যখন শুনলাম, তখন মনে হল আওয়াজটা চাবিরও হতে পারে। আর এই কেসে এমন একজনই আছে যার কাছে চাবি থাকার সম্ভাবনা প্রবল। রতন! কারণ অ্যাকর্ডিং টু উমা সেন, রতন এতটাই বিশ্বস্ত যে ওর কাছে সবসময়ই বাড়ি এমনকি আলমারির চাবিও থাকে। দরকার হলে ওরা চেয়ে নেন। সেদিন বনোয়ারির বাড়ির কাছে কিংবা সৌরীশের বাড়িতে যাকে দেখেছিলাম, তিনি উমা সেন হতে পারেন না। তবে রতন ছাড়া আর রইল কে?’

বলতে বলতেই মাথা ঝাঁকায় অধিরাজ, ‘ইভেন ফরেনসিকও আমাদের ব্লু দিয়েছিল। মিস মুখার্জি তোমায় বলেছিলেন যে পুতুলের হাতে একটা আঁশ লেগেছিল। সেটাতে ফিফটি পার্সেন্ট ন্যাচারাল ফাইবার, থার্টি টু পার্সেন্ট নাইলন, আঠেরো পার্সেন্ট মতো লাইক্রা ও এক পার্সেন্টের মতো ন্যানো সিলভার বা ন্যানো কপার ছিল। সুতোটা সম্ভবত মোজার বা নি ক্যাপের! এই গরমকালে কে মোজা পরে বসে থাকবে! নি-ক্যা প অবশ্য হতে পারে। আরেকটা জিনিসও হতে পারে। কম্প্রেশন প্রস্থেটিক শ্রিঙ্কার! এক ধরনের মোজাই। যারা প্রস্থেটিক লেগ ইউজ করে তারা এই কম্প্রেশন স্টকিং বা বিশেষ জাতীয় মোজা পরে থাকে। এতে অ্যাম্পুট করা পায়ের শেপ ঠিক হয়, ব্যথা হয় না এবং প্রস্থেটিক লেগটা পরতে সুবিধা হয়।’ একটু থেমে সে যোগ করে, ‘সৌরীশও আমাদের কাছে উমা সেনেরই নাম বলতে চেয়েছিলেন। যখন তিনি মৃত্যুমুখে তখন তিনি ইশারায় এমন একটা পুতুল দেখিয়েছিলেন আমায় যার হাত পা ছিল না!’

‘স্যার, ওই পুতুলগুলোর তো অর্ধেকেরই হাত, মাথা কিছুই ছিল না!’

অর্ণবের কথায় মাথা নাড়ল অধিরাজ, ‘ঠিকই, ওখানে একগাদা পুতুল ছিল যার হাত এবং মাথা ছিল না, কিন্তু সৌরীশ যে পুতুলটির দিকে ইশারা করেছিলেন একমাত্র তারই হাতের সঙ্গে সঙ্গে পাও ছিল না! শেষ ব্লু-টা অবশ্য তুমিই আমায় দিলে।’

‘কোনটা?’

‘রয়্যাল হাইটসের ফ্ল্যাটের কথাটা বলে তুমিই এ কেসে শেষ পেরেকটা ঠুকলে।’ অধিরাজ হাসছে, ‘খুনীর কী মহিমা দেখো প্রত্যেকবার সে খুন করে অদৃশ্য হয়ে যায়। সৌরীশের বাড়িতেও সে কোথা দিয়ে এল, কোথা দিয়ে গেল জানতে পারিনি, এখন জানতে পারলাম। এবং রয়্যাল হাইটসেও সে কোথা দিয়ে এল ও গেল বুঝতেই পারলাম না। যখন উৎপল ওপর থেকে পড়েছিলেন তখন নীচে আমরা উপস্থিত ছিলাম। ওই সময়ে কেউ ঢোকেনি। উৎপল যখন পড়লেন, তখন আমি ওপরে ছুটলাম, তুমি আর পবিত্র রয়্যাল হাইটসের সামনে ছিলে। আমি ওপরে গিয়ে কাউকে পাইনি, তোমরাও কাউকে বেরোতে দেখোনি। তবে যে লোকটা উৎপলের সঙ্গে ছাদে ছিল, সে গেল কোথায়! কর্পূরের মতো উবে গেল! এর একটাই উত্তর হয়। লোকটা নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে গিয়েছিল। সেইজন্য আমরা তাকে পাইনি। আর তুমিই বলেছিলে, রয়্যাল হাইটসে আবীর ও উমার ফ্ল্যাট আছে।’

‘কিন্তু চিঠিতে উনি বলেছিলেন যে এক ভদ্রলোকের সাহায্য উনি নিয়েছিলেন মৃন্ময়কে খুন করার জন্য। যিনি ওঁকে এম.আর.আই মেশিনে ঢোকাতে সাহায্য করেছিলেন। তিনি কে?

‘তিনি কে তা তুমি আর আমি দু-জনেই জানি অর্ণব। প্রথমে ভেবেছিলাম তাঁর কন্যে হয়তো কিছু জানত। এখন দেখছি কন্যে নয়, স্বয়ং পিতৃদেবই জানতেন। জীবনে অনেক দুঃখ পেয়েছেন। উমা আর তাঁকে দুঃখ দিতে চাননি। তাই তাঁর নাম করেননি।’

অর্ণব চুপ করে যায়। অধিরাজ আস্তে আস্তে বলে, ‘সত্যিই অদ্ভুত মহিলা! অদ্ভুত এক খুনী! নিজে মারা গিয়েও শেষ বাজিতেও মাত দিয়ে গেলেন! আশ্চর্য!’

রতন তাদের সামনে মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়েছিল। এবার মুখ তুলে বলল, ‘বাবু, আমি…!’

অধিরাজ গম্ভীর মুখে তার দিকে তাকায়। রতন কিছু বলতে গিয়েও হোঁচট খেল। সে চুপ করে যায়। অর্ণব দেখল অধিরাজের ঠোঁটে অদ্ভুত একটা রহস্যময় হাসি ভেসে উঠেছে। সে রতনের দিক থেকে অর্ণবের দিকে দৃষ্টি ফেরায়, ‘চলো অর্ণব। এখানে আর কিছু করার নেই।’

রতন যেন শাস্তির জন্য প্রস্তুতই ছিল। সে ভাবতেই পারেনি এরকম কথা শুনবে! শিউরে উঠে বলল, ‘বাবু…!’

‘এরপর যার সঙ্গে কাজ করবে, চেষ্টা কোরো সেখানে গিয়ে কাউকে ভয় না দেখাবার।’ অধিরাজ গম্ভীর স্বরে বলল, ‘তাহলে পুলিস তোমাকে ভয় দেখাবে। বুঝেছ?’

রতনের মুখটা আবার কান্নাবিকৃত হয়ে আসে। সে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল। অধিরাজ হাসিমাখা চোখদুটো অর্ণবের দিকে ফিরিয়ে বলল, ‘চলো!’

ওরা দু-জনে রতনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। অধিরাজ রাস্তার ওপরেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। পকেট থেকে বাদামি খামটা বের করে এনে বলল, ‘দাঁড়াও, শেষ কাজটা সেরে ফেলি।’

বলতে বলতেই লাইটারটা বের করে এনে ফস করে চিঠিশুদ্ধ খামটায় অগ্নিসংযোগ করে দিল সে। অর্ণব বিস্মিত! সে বিহ্বল চোখে দেখল পুড়ে যাচ্ছে উমা সেনের স্বীকারোক্তি! এই কেসের সবচেয়ে জোরালো প্রমাণ! সে অবাক হয়ে বলল, ‘স্যার… !‘

‘সব কেসই সলভড হতে হবে এমন কোনো কথা নেই অর্ণব।’ অধিরাজ বলল, ‘পৃথিবীতে আনসলভড কেসের সংখ্যা একটি বাড়লে কারোর কোনো ক্ষতি হবে না।’

‘আপনি কি জানতেন যে চিঠিটা এইখানেই পাওয়া যাবে?’

‘আন্দাজ করেছিলাম।’ অধিরাজ নির্নিমেষে চিঠিটার পুড়ে যাওয়া দেখছিল, ‘উমাই বলেছিলেন রতন অত্যন্ত বিশ্বস্ত। ওর কাছে চাবি পর্যন্ত থাকে। এই চাবিটা শুধু ঘরের চাবি নয়, রহস্যের চাবিও বটে! উনিই ব্লু দিয়েছিলেন। ওঁর যা চরিত্র, তাতে উনি কাউকে কিছু না বলে কাপুরুষের মতো পালিয়ে যাওয়ার লোকও ছিলেন না। সুতরাং চান্সটা নিয়ে নিলাম।’

অর্ণব অধিরাজের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাঝেমধ্যে এই লোকটাকেও তার মূর্তিমান রহস্য মনে হয়। হাতের কাছে স্বীকারোক্তি পেয়েও তাকে পুড়িয়ে দেওয়ার সাহস ক-জনের থাকে। সকলেই তো কেস সলভ করার চক্করে দৌড়চ্ছে। সে বুঝতে পারল, এইজন্যই টিমকে সঙ্গে আনেনি অধিরাজ। সবাইকে এই কাজের সাক্ষী রাখার তার কোনো ইচ্ছেই নেই।

‘কিন্তু এ চিঠির কথা কাউকে বলা যাবে না অর্ণব।’

অর্ণব সকৌতুকে অধিরাজের দিকে তাকায়। নিরীহ গলায় বলল, ‘কোন্ চিঠি স্যার?’

অধিরাজ হেসে ওঠে। ভারী সুখের হাসি। অর্ণবের মুখেও হালকা হাসির আমেজ! হেরে গিয়েও জিতে যাওয়ার আনন্দ ওদের চোখে মুখে।

উমার লেখা চিঠিটা তখন জ্বলে পুড়ে ছাই হচ্ছে!

1 Comment
Collapse Comments
আমিনুল ইসলাম April 8, 2023 at 10:24 am

সায়ন্তনী পূততুন্ডর ‘সর্বনাশিনী’,’চুপি চুপি আসছে’ পড়তে চাই

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *