ডেয়ার অর ডাই – ১০

(১০)

‘শর্বাণী বিদ্যুৎ, বাজকে ভীষণ ভয় পেত। বাজ পড়ার ভয়ে ঝড়-বৃষ্টি আসার আগেই সব দরজা জানালা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে বসে থাকত।’

শর্বাণী ঘোষের স্বামী অতনু কান্নামাখা স্বরে বললেন, ‘ঝড়-বৃষ্টির ফোরকাস্ট হলে ও বাইরে বেরোতই না। বাজ পড়লে কানে হাত চাপা দিয়ে থরথর করে কাঁপত। অথচ আজ বেরোল। আমি বারণ করেছিলাম… আমি ওকে বারণ করেছিলাম। কিন্তু ও শুনল না!’

কথাটা শেষ করতে পারলেন না ভদ্রলোক। প্রবল কান্না এসে তাঁর শব্দগুলোকে গ্রাস করে নিল। তিনি আর কথা বলতে না পেরে দু-হাতে মুখ ঢাকলেন। অধিরাজ ভদ্রলোককে খুব মন দিয়ে জরিপ করছিল। বছর বেয়াল্লিশ-তেতাল্লিশের ছিমছাম ভদ্র চেহারা। ফরসা চোখ-মুখ কান্নার প্রাবল্যে লাল হয়ে উঠেছে।

সে অতনুকে কিছুক্ষণ সময় দিল। অর্ণব একদৃষ্টে তাকিয়েছিল অতনুর দিকে। ওঁর কান্নাটা জেনুইন বলেই মনে হয়। স্বামী, স্ত্রী আর সন্তান নিয়ে একটা সুখী ছোট্ট পরিবার ছিল তাঁর। দশ বছরের মেয়ে জেনি একটানা কেঁদেই চলেছে। সে এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না যে মা নেই! যে কর্তৃী এতদিন সংসারটাকে সামলে রেখেছিল সে আর কোনোদিনই ফিরে আসবে না।

‘উনি কোথায় যাচ্ছিলেন কিছু বলেছেন?’

‘না।’ মাথা নাড়লেন অতনু, ‘তেমন নির্দিষ্ট কিছুই বলে যায়নি। শুধু বলেছিল এক বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছে।’

‘কোন্ বন্ধুর বাড়ি?’ অধিরাজ কৌতূহলী, ‘বন্ধুর নাম বলেননি?’

‘না। ও বলেনি, আমিও জিজ্ঞাসা করিনি। ওর অনেক বন্ধু-বান্ধবীই ছিল। ফেসবুকে একটা গ্রুপও চালাত। সেই গ্রুপ থেকেই ওর অনেক বন্ধু হয়েছিল। তাদের গেট টুগেদারও হত। কিটি পার্টিও থাকত। আমি ভেবেছিলাম, তেমনই কোথাও যাচ্ছে।’

‘ওঁর তেমন কোনো শত্রু ছিল?’

‘শত্রু!’

কথাটা শুনে প্রায় আকাশ থেকে পড়লেন অতনু। মুহূর্তের জন্য মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল তাঁর। বিস্মিত গলায় বললেন, ‘কেন? ওর তো অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে!

অধিরাজ খুব শান্তভাবে বলল, ‘হ্যাঁ। জাস্ট রুটিন প্রশ্ন।’

অতনু নিজেকে কোনোমতে সামলালেন, ‘না। ওর কোনো শত্রু ছিল না। শত্রুতার কোনো কারণও ছিল না। আমরা সাধারণ মধ্যবিত্ত। কারোর সাতে পাঁচে থাকি না। শর্বাণীর মতো ভদ্র মেয়ে খুব কমই ছিল।’

অধিরাজ ও অর্ণব পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। শর্বাণী অতীতে যে দলের সদস্য ছিলেন তারা যে আদৌ ভদ্র ছিল না সে তথ্য হয়তো জানা নেই অতনুর। সম্ভবত অতীতের কথা অতীতেই চাপা পড়ে গিয়েছিল। তার কথা অতনুকে বলেননি শর্বাণী। এককালের দস্যি মেয়ে শান্ত হয়ে ঘর সংসার করছিল। কিন্তু তারপর? এতদিন পর আবার কার প্রতিশোধস্পৃহা জেগে উঠল!

‘কখনও আপনার স্ত্রী কোনো কারণে ভয় পেয়েছিলেন? কিংবা কোনোরকম হুমকি দেওয়া হয়েছিল তাঁকে?’

‘না। তেমন কিছু নয়। ও শুধু ঝড় বৃষ্টি হলেই ভয় পেত। ছোটোবেলা থেকেই এই ভয়টা ওর আছে। এছাড়া আর কোনোরকম ভয় ওর ছিল না।’

‘আই সি।’

‘ট্রাক ড্রাইভারটার কোনো হদিশ পেয়েছেন আপনারা?’ অতনু হঠাৎই ফুঁসে উঠলেন, ‘শয়তানটা কী ধরা পড়েছে?’

‘যেখানে অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছিল সেখানে সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না। তবুও আমরা চেষ্টা করছি।’ অধিরাজ তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে, ‘আশা করছি ধরা পড়বে।’

অতনু আর কোনো উত্তর দিলেন না। তাঁর চোখ বেয়ে বিন্দু বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ল। অধিরাজ আর অর্ণব আর কোনো কথা বাড়াল না। শোকসন্তপ্ত মানুষটাকে ছেড়ে দিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।

‘কী মনে হল অর্ণব?’ অধিরাজ হাঁটতে হাঁটতেই প্রশ্ন করে, ‘লোকটা সত্যি কথা বলছে?’

‘মনে তো হয়।’ অর্ণব আস্তে আস্তে বলল, ‘স্ত্রী-র মৃত্যুতে যথেষ্ট শোকার্ত।’

‘শোকার্ত ঠিকই, কিন্তু কিছু কথা ভদ্রলোক বেমালুম চেপে গেলেন।’

অর্ণব চমকে উঠল, ‘কী?’

‘ঠিক কী চেপে গিয়েছেন তা বলতে পারব না, কিন্তু কিছু তো ডেফিনিটলি লুকিয়েছেন।’ বলতে বলতেই সে অর্ণবের দিকে মিনতি ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়েছে। ইঙ্গিত স্পষ্ট।

‘ঠিক আছে। একটা।’

অর্ণব স্মিত হেসে অনুমতি দেয়। অধিরাজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে ইন্ডিয়া কিংসের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরাল। একটা সুখটান মেরে বলল, ‘যে ঝড় বৃষ্টিতে বাইরে বেরোতে ভয় পায়, সে আজ হঠাৎ এত বীরাঙ্গনা হয়ে উঠল কী করে? সকাল থেকেই মেঘ করেছিল, ওয়েদার ফোরকাস্টেও বারবার বলা হচ্ছিল যে আজ বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিপাতের প্রবল সম্ভাবনা। যেখানে ওঁর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল তার আশেপাশে কোনো বিল্ডিং, কোনো হাউজিং সোসাইটি বা বাড়ি ছিল না। চতুর্দিক শুনশান। ঐ ফাঁকা মাঠের মধ্যে শর্বাণী করছিলেনটা কী! কোন্ বন্ধুর বাড়ি ছিল ফাঁকা মাঠে! তাছাড়া এই দুর্যোগের মধ্যে গিন্নী বাইরে যাচ্ছিলেন, অথচ কৰ্তা ঠিকমতো জানেনও না যে তিনি কোথায় যাচ্ছেন! এটা কি আদৌ সম্ভব?’

অর্ণব একটু চিন্তা করল। সত্যিই ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়। যেখানে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে তার আশেপাশে কোথাও বন্ধুর বাড়ি থাকার কথা নয়।

‘আর যদি ধরেও নিই যে অতনু সত্যি কথা বলছেন, তাহলেও কিছু প্রশ্ন থাকে। শর্বাণী স্পটে পৌঁছলেন কীভাবে? বাসে? না অটোতে? অথবা ওলা বা উবের-এ? যদি তাই হয় তবে সোজা বন্ধুর বাড়ি না গিয়ে ওরকম শুনশান রাস্তায় কী করছিলেন? বন্ধু নিশ্চয়ই তাঁকে মাঝপথে দেখা করতে বলেনি! সবচেয়ে বড় কথা অর্ণব…।’ সে রিং বানাতে বানাতে বলল, ‘টুয়েন্টি ফোর সেভেন নিউজে ফোনটা কে করল? সে তো শর্বাণীর বন্ধু বলে মনে হয় না। নয়তো পোয়েটিক জাস্টিসের কথা উঠত না।’

‘তবে?’

‘এখানেই তো প্রবলেম। মনে হয়, অতনু সব কথা খুলে বলছেন না। তবে একটা জিনিস লক্ষ্য করেছ?’

‘কী?‘

‘উৎপল মিত্র হাইরাইজ থেকে পড়ে মারা গেলেন, তাঁর স্ত্রী জানালেন যে তিনি হাইটে ভয় পেতেন। শর্বাণী ঝড়-বৃষ্টির দিনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেলেন, তাঁর স্বামী জানালেন যে তিনি বজ্র-বিদ্যুতে ভয় পেতেন! যে লোক রোপ ওয়েতে চড়েই অজ্ঞান হয়ে যায়, সে সতেরোতলা থেকে লাফ মারে কী করে? আর যে বাজ পড়লে কানে হাত চাপা দিয়ে কাঁপে, সে দিব্যি গটগটিয়ে ঝড়বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে গেল! এটা কি নিতান্তই কো-ইনসিডেন্স? না এর মধ্যেও কোনো গল্প আছে?

অর্ণব বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তাই তো! এই ব্যাপারটা তো সে একেবারেই লক্ষ্য করেনি! যে যে জিনিসটাতে ভয় পেত, সে ঠিক সেই কাজটাই করেছে। এ কি নিতান্তই কাকতালীয়!

‘শর্বাণী আর অতনুর সম্পর্কে আরও খবর বের করতে হবে। আমি খুনীর মহানুভবতায় আদৌ বিশ্বাসী নই।’

‘স্যার!’

একটু বিস্ময়মাখা কণ্ঠেই বলল অর্ণব। অধিরাজ তীর্যক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়, ‘ভেবে দেখো অর্ণব, যদি আজ কেউ শ্রুতি চ্যাটার্জিকে ফোনটা না করত, কিংবা পোয়েটিক জাস্টিসের কথা না বলত, তবে সন্দিগ্ধের লিস্টে প্রথমেই অতনুর নাম থাকত। আসলে আমরা তদন্ত করছি না। কোনো এক মস্তিষ্ক আমাদের তদন্তের রাস্তা বাতলে দিচ্ছে। আমাদের মাথার মধ্যে কেউ ঢুকে পড়েছে অর্ণব। সে ঠিক যে পথে আমাদের নিয়ে যেতে চাইছে, আমরা সে পথেই যাচ্ছি। সে যা চাইছে, অবলীলায় তাই করে বেরিয়ে যাচ্ছে। সে চেয়েছিল পরপর এই মৃত্যুগুলোর খবর প্রকাশ্যে আসুক। এসেছে। সে চেয়েছিল, আমরা ফোবিয়ান্সের অতীত নিয়ে চিন্তায় পড়ি। আমরাও তাই পড়েছি। আশ্চর্যভাবে মৃতের কোনও আত্মীয় স্বজনকে ইন্টারোগেট করার উপায় নেই! কারণ আপাতদৃষ্টিতে কোনোটাই মার্ডার নয়।’

অর্ণবের মুখ চিন্তান্বিত হয়ে ওঠে। সে আস্তে আস্তে বলে, ‘তবে?’

‘অপরাধী যে জালটা তৈরি করার চেষ্টা করছে সেটা ছিঁড়তে হবে। যে বক্সের মধ্যে ও আমাদের রাখতে চাইছে, তার বাইরে গিয়ে ভাবতে হবে। এমন হওয়া আশ্চর্য নয় যে কতগুলো সমাপতনের মধ্যে খুনী নিজের কাজ করে বেরিয়ে গেল। হয়তো হার্টফেলে মৃত্যুগুলো নেহাৎই কো-ইনসিডেন্স। কিন্তু সেগুলোকে সামনে রেখে যে কেউ নিজের কাজটা গুছিয়ে নিতে পারে। এবং যাতে সেটা অন্য কারোর ঘাড়ে চাপে সেজন্য শ্রুতি চ্যাটার্জিকে ফোন করে ‘পোয়েটিক জাস্টিস’-এর অবতারণা করতে পারে।‘

‘তবে কি আমাদের সাসপেক্ট লিস্টে ভিকটিমদের আত্মীয় স্বজনরা থাকবেন?’

‘অবভিয়াসলি থাকবেন। প্রত্যেককে জেরা করতে হবে। তার সঙ্গে আকাশ এবং সুজিতের বাড়ির লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কাউকে বাদ দেব না। প্রত্যেকটা অ্যাঙ্গেলেই তদন্ত চালাতে হবে।’

‘কিন্তু সুজিতের বাড়ির কেউ হলে শ্রুতি কি তার গলা চিনতে পারতেন না?‘

অধিরাজ ঝরঝর করে হেসে ফেলল, ‘তুমি বড্ড ভালোমানুষ অর্ণব। তোমায় নিয়ে যে কী করি!

এবার আবার কী বোকামি করে বসল সে! অর্ণব একটু অপ্রতিভ হয়! কে জানে, হয়তো প্রশ্নটা একদম বোকার মতো করে বসেছে। অধিরাজ সস্নেহে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেয়, ‘শ্রুতি চ্যাটার্জির কাছে যে সত্যি সত্যিই ফোন এসেছিল তার গ্যারান্টি কী? গোটাটাই গল্প হতে পারে আমাদের মিস লিড করার জন্য। শ্রুতিও আমাদের প্রাইম সাসপেক্ট যে! কে বলতে পারে, হয়তো পোয়েটিক জাস্টিসটি তিনি নিজেই ঘটিয়েছেন।’

অর্ণব একটু কিন্তু কিন্তু করে বলে, ‘কিন্তু এত বছর পরে কেন?’

‘সেটা তো আমারও প্রশ্ন।’ অধিরাজ চিন্তান্বিত স্বরে বলল, ‘কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। বনোয়ারিলালকে পাওয়া গেলেও কিছু বোঝা যেত। কিন্তু তা-ও হল না। ধোঁয়া এতই বেশি যে আগুন কোথায় জ্বলছে বুঝতেই পারছি না! হসপিটালের সিসিটিভি ফুটেজগুলো ভালো করে দেখতে হবে। যদি কিছু পাওয়া যায়।

অর্ণব সত্যিই এখনও গোটা ব্যাপারটার তল খুঁজে পাচ্ছিল না। একই গ্রুপের প্রাক্তনীদের একের পর এক মৃত্যু আদৌ কাকতালীয় বলে মনে হচ্ছে না। অন্তত শ্ৰুতি চ্যাটার্জির বক্তব্যের পর মার্ডারের সম্ভাবনা আরও বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে। কিন্তু এ কীরকম মার্ডার? তার অস্ত্রই বা কোথায়? দুনিয়ায় এমন কোনও ভাইরাস নেই যা মানুষকে হার্টফেল করিয়ে মারে। এমনকি নভেল করোনা ভাইরাসও শুধুমাত্র কার্ডিয়াক ফেইলিওরে মানুষকে মারতে পারে না। কোনো ড্রাগের প্রয়োগও হয়নি। তবে লোকগুলো মারা গেল কী করে?

আস্তে আস্তে সে প্রশ্ন করল, ‘স্যার, মানছি মৃত্যুগুলো যতটা স্বাভাবিক দেখাচ্ছে, ঠিক ততটা নয়। কিন্তু অস্ত্র কই? যদি মার্ডারই হয়, তবে মার্ডার ওয়েপন কোথায়?’

অধিরাজ একটু হেসে বলে, ‘মার্ডার ওয়েপন আমাদের গ্লোবমস্তক ডাক্তারের চুলের মতো।’

‘মানে স্যার?’

‘কোনো সময়ে ছিল, কিন্তু এখন নেই। ধরে নাও মার্ডার ওয়েপন নেই অর্ণব। ছুরি, ছোরা, গুলি, গোলা, বিষ, কোনোরকমের ড্রাগ—কিচ্ছু নেই!’

‘তবে?’ অর্ণব বিস্মিত, ‘হার্টফেইলিওরের ঘটনা যদি বাদ দিই, তবে কি সুইসাইডের কেসটা সুইসাইড নয়? কেউ লোকটাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে? আর অ্যাক্সিডেন্টের কেসটাও কি তবে…?’

‘নাঃ! লোকটা নিজেই পড়েছে। কিন্তু তবুও এটা মার্ডার। অ্যাক্সিডেন্টটাও যেমন দেখাচ্ছে আদপে তা নয়। আর শুধু এখানেই শেষ নয় অর্ণব। এরপর কে, সেটাই প্রশ্ন।’ বাকি আছে তিনজন। সৌরীশ দত্ত, উমা রায় এবং আবীর সেন। এরপরের টার্গেট কে? কী-ই বা ঘটবে? হার্টফেইলিওর, সুইসাইড না অ্যাক্সিডেন্ট? কোটা!

গাড়িতে উঠে বসে অধিরাজ একটি কথাও বলল না। তার মুখ চিন্তান্বিত। পবিত্র-রা তখন ব্যুরোয় ফিরে ট্র্যাফিকের সিসিটিভি ফুটেজ দেখছিল। যে ট্রাকটা শর্বাণীকে ধাক্কা মেরেছে তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছে ওরা তিনজন। অধিরাজ পবিত্রকে ফোনে ধরল, ‘আপডেট কী? ‘

‘ট্রাকটাকে মনে হচ্ছে পেয়ে গিয়েছি।’ পবিত্র জানায়, ‘ওখানে কোনো সিসিটিভি নেই ঠিকই, কিন্তু কিছুটা এগিয়েই একটা মোড়ে সিসিটিভি ছিল। সেখানেই ধরা পড়েছে।’

অধিরাজ একটা শ্বাস টানল। যাক, তবু একটা তো লিড পাওয়া গেল। সে বলে, ‘নম্বর দেখতে পেয়েছ?’

‘নম্বরটা এখনও স্পষ্ট নয়। নাম্বারপ্লেটটা ছবিতে ক্লিয়ার আসেনি। আমরা ল্যাবে পাঠাব ফুটেজটাকে আরও একটু ক্লিয়ার করার জন্য।’ পবিত্র বলল, ‘তবে রাজা, ট্রাকটার হাবভাব যথেষ্ট সন্দেহজনক। যেরকম হাই স্পিডে চালাচ্ছে, তাতে মনে হয় অকুস্থল থেকে পালাচ্ছে। টাইমিং একদম অ্যাক্সিডেন্টের আশেপাশেই। আর কোনো বড় গাড়িকে ঐ রাস্তাতে দেখা যাচ্ছে না। বাসও এখন লকডাউনের মধ্যে চলছে না। কোনো লরিকেও দেখতে পাইনি। সম্ভবত এই ট্রাকটাই কালপ্রিট।’

‘নম্বরটা পেলে আর.টি.আই-কে পাঠিয়ে দাও। ট্রাক ডাইভারকে জিরো ইন করো। যে করেই হোক, ওকে আমার চাই।’

‘ওকে।’

অধিরাজ ফোনটা কেটে দিল। এখন তাদের গন্তব্য ভিকটিমদের বাড়ি। তাদের আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে কথা বলা দরকার।

কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল সৌমিত্র চৌধুরীর বিধবা স্ত্রীকে জেরা করা আর জেনেশুনে নিজের মাথা খারাপ করা প্রায় একই। তাঁকে দেখামাত্রই দুই অফিসারের চক্ষু চড়কগাছ। ভদ্রমহিলা এই ভর সন্ধেবেলা নাক অবধি নেশা করে বসে আছেন! পরনে অতি স্বচ্ছ স্লিভলেস গাউন। লম্বা চুল পরিপাটি করে বাঁধা। মুখে প্রসাধনীর ছাপ প্রকট। দরজা খুলতে এসেই প্রায় উলটে পড়ছিলেন। অধিরাজ তাড়াতাড়ি তাঁকে ধরে ফেলে। ভদ্রমহিলা তাতেও বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে মদির হেসে বললেন-’হাই হ্যান্ডসাম!’

অধিরাজের শক্তিশালী বাহু ধরে আছে ভদ্রমহিলার কোমর। ভদ্রমহিলাও প্রায় নির্লজ্জের মতো তার দেহে লেপ্টে আছেন। নড়াচড়ার নামই নেই। অধিরাজ কাতর চোখে অর্ণবের দিকে তাকায়। এই মুহূর্তে সে দুই লেডি অফিসারের অভাব অনুভব করছিল। বিপদ দেখে অর্ণবও তাড়াতাড়ি হাত লাগাল। কোনোমতে তাকে অধিরাজের সুঠাম দেহ থেকে এক খামচা মেরে সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, সি.আই.ডি হোমিসাইড থেকে আসছি।’

‘হোমিসাইড!’

ভদ্রমহিলার ঢুলুঢুলু চোখে কয়েক মুহূর্তের জন্য একটা সতর্কতা খেলে গেল। তিনি নিজেকে একটু সামলানোর চেষ্টা করতে করতে অধিরাজের দিকে তাকিয়ে স্খলিত স্বরে বললেন, ‘সরি, আমি আপনাকে জিগোলো ভেবেছিলাম। তারও প্রায় আসার সময় হয়েছে।

দুই অফিসারের মাথায় প্রায় বাজ পড়ার উপক্রম। ভদ্রমহিলার স্বামী কিছুদিন আগেই মারা গিয়েছেন। এই তার আফটার এফেক্ট! মদ, জিগোলো! এই কি শোকের প্রকাশ! অধিরাজ আর অর্ণব দু-জনেই দু-জনের দিকে দেখছে। এই মহিলাকে কী ইন্টারোগেট করবে? ইনি তো সজ্ঞানেই নেই!

মিসেস চৌধুরী এবার যেন খানিকটা নিজেকে সামলে নিয়েছেন। তাঁর মুখে আগের চটুল চাপল্য আর নেই। এখন কিছুটা সংযত স্বরে বললেন, ‘বলুন, কী দরকার। এমনিতেই যা বলার ছিল আগেই বলেছি, নতুন কিছু বলার নেই। তবু আবারও বলছি। আমার স্বামী অত্যন্ত ভালোমানুষ ছিলেন। তার কোনো শত্রু ছিল না। সাংসারিক কোনো জটিলতা ছিল না। তিনি মর্গে কী করতে গিয়েছিলেন তা আমার জানা নেই।

মহিলা যেন তোতাপাখির মতো গড়গড়িয়ে মুখস্থ কয়েকটা লাইন বলে গেলেন। কিন্তু ওরা দু-জনেই লক্ষ্য করছিল যে কথাগুলোয় আদৌ প্রাণের স্পর্শ নেই। বলতে হবে, তাই বলে যাওয়া। অধিরাজ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘ম্যাডাম, আপনার স্বামীর অকালমৃত্যুর জন্য আমরা দুঃখিত। কিন্তু আপনি যদি সত্যি কথা বলেন তাহলে সুবিধা হয়।’

মিসেস চৌধুরীর মুখে একটা হাসি ভেসে ওঠে। সেটা ঠিক যতটা মিষ্টি, ততটাই মিস্টিক। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আসুন, আপনারা ভেতরে আসুন।’

‘তেমন হলে আমরা পরেও আসতে পারি। যখন আপনি কমফোর্টেবল থাকবেন।’

অধিরাজ একটু ইতস্ততঃ করছিল। এমনিতেই মহিলা নেশায় টং হয়ে আছেন, তার ওপর আবার বিশেষ কারোর জন্য অপেক্ষা করছেন। এই পরিস্থিতিতে তাঁর সঙ্গে কথা বলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছিল না ওরা। কিন্তু তিনি ফের হেসে বললেন, ‘আমি জাতে মাতাল, তালে ঠিক। আপনার সব প্রশ্নের একদম ঠিকঠাক উত্তর দেব। চাইলে সতী সাধ্বী স্ত্রীয়ের মতো কেঁদে ভাসিয়েও দিতে পারি। ডেমো দেখবেন?’

এরকম প্রত্যুত্তরের আশা অধিরাজ বা অর্ণব, কেউই করেনি। ভদ্রমহিলা হয়তো সত্যি সত্যিই কাঁদার উপক্রম করছিলেন, তার আগেই অধিরাজ বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘ডেমো দেখানোর প্রয়োজন নেই। আমরা শুধু কয়েকটা প্রশ্নের সঠিক উত্তর আশা করি। তার বেশি কিছু নয়।

মিসেস চৌধুরীর মুখে ফের সেই মিস্টিক হাসিটা ঝিলিক দিয়ে উঠল, ‘তবে ভেতরে আসুন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলার অভ্যাস আমার একেবারেই নেই।

অগত্যা! দুই অফিসারই আর কথা না বাড়িয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। সৌমিত্র চৌধুরী যে অর্থকষ্টে ভুগছিলেন, তা তাঁর ফ্ল্যাট দেখে একেবারেই মনে হয় না রীতিমতো ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাট। ধবধবে সাদা দামি মার্বেলের মেঝে, দেওয়ালে গ্র্যানাইটের কারুকাজ। বসার ঘরটা চমৎকার সাজানো। দেখলেই বোঝা যায়, বহু অর্থব্যয় করে ইন্টেরিয়ের ডেকোরেশন করা হয়েছে। ঘরের মধ্যেই ছোটো ছোটো টবে বনসাই সাজানো। দুধ সাদা নরম সোফা, তার সঙ্গে ম্যাচিং কার্পেটে ঘরের সৌন্দর্য আরও খোলতাই হয়েছে। মাথার ওপর বিরাট একটা ঝাড়বাতি সোনালি আলোয় ঝলমল করছে। এক পাশে বড়োসড়ো বার কাউন্টার চোখে পড়ল। মিসেস চৌধুরী সেদিকেই ইঙ্গিত করে বললেন, ‘কিছু নেবেন আপনারা? ‘

‘না।’ সপাটে জবাব দিল অধিরাজ, ‘আমরা শুধু প্রশ্নের সঠিক জবাব চাই। আর কিছু লাগবে না।’

‘হো-য়া-ট এ-ভা-র!’ তিনি কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিজের জন্য একটা ড্রিঙ্ক তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, ‘বলুন কী জানতে চান?’

‘আপনার সঙ্গে আপনার স্বামীর সম্পর্ক কেমন ছিল?’

মিসেস চৌধুরী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘কোন্ ভার্সানটা শুনবেন বলুন?’

‘মানে?’

‘আমাদের সম্পর্কের দুটো ভার্সান। বাইরের লোকের সামনে একরকম। আর ঘরের ভেতরে আরেকরকম।’ তিনি এবার পায়ের ওপর পা তুলে আরাম করে বসে গ্লাসে চুমুক দিলেন, ‘বাইরে থেকে আমাদের মতো জুটি খুব কমই ছিল। সৌমিত্র যে কোনো পার্টির মধ্যমণি হয়ে যেতে পারত। অত্যন্ত হাসিখুশি ভালোমানুষ। কিন্তু আমি জানি ওর মতো শয়তান খুব কম লোকই ছিল। একাধিক মেয়ের সঙ্গে ওর অ্যাফেয়ার ছিল। সুদর্শন ছিল, তার সঙ্গে কথা বলার আর্টটাও জানত। দারুণ গানও গাইত, বিশেষ করে ওয়েস্টার্ন। ওর এই ক্যারিশমাতেই আমি ওর প্রেমে পড়েছিলাম। এখনও ও সেই গুণগুলোর ব্যবহার করছিল। কত মেয়েকে যে বিছানায় তুলেছে তার ইয়ত্তা নেই। রিসেন্ট যে মেয়েটির সঙ্গে প্রেম করছিল সে একেবারেই ওর হাঁটুর বয়েসী!’ বলতে বলতেই ভদ্রমহিলার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে, ‘কিছুদিন এরকম ঘোরাফেরা করত। হোটেলে, রিসর্টে রাত কাটাত। তারপর শখ মিটে গেলে মেয়েগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দিত। মেয়েগুলো তখন গায়ের জ্বালায় আমার কাছে এসে নালিশ করত। আমার স্বামীর রাসলীলার কথা আমাকেই শুনতে হত। সে যে কী যন্ত্রণা…!’

অধিরাজ একদৃষ্টে ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে তাঁর কথা শুনছে। নেশার দৌলতে হোক বা অন্য কারণে, ওঁর ভেতরের কথাগুলো নিজে থেকেই বাইরে আসছে। সে তাঁকে নিজের জ্বালার কথা বলতে দিল।

‘আমি ক্রমশই একা হয়ে যাচ্ছিলাম। দেখতেই পাচ্ছেন, আমাদের কোনো সন্তান ও নেই। অনেকবার ভেবেছি ওকে ডিভোর্স দিয়ে দেব। এভাবে কোনো সম্পর্ক টেঁকে না। কিন্তু ও ডিভোর্স দিতে চাইত না। দেবে কী করে? ডিভোর্স হয়ে গেলে সোসাইটিতে ওর তথাকথিত ভালোমানুষের ইমেজ অনেক প্রশ্নের মুখে পড়ত আমাকে শিখন্ডী রেখে পেছনে ও যে বেলেল্লাপনা চালাচ্ছিল তা সবার সামনে চলে আসত না? এই নিয়ে অশান্তি, রাগারাগি!’ মিসেস চৌধুরী একটু থেমে বললেন, ‘আমি একটু স্মোক করলে আপনারা কি মাইন্ড করবেন?’

‘প্লিজ, প্রসিড’।

‘থ্যাঙ্কস।’

ভদ্রমহিলা সামনের টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট তুলে নিয়ে একটা কিং সাইজ সিগারেট আরাম করে ধরালেন। অধিরাজ লক্ষ্য করল তাঁর হাত একটু একটু কাঁপছে। এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘আমার এই জীবন আর সহ্য হচ্ছিল না। কতদিন আর সতী সাধ্বী স্ত্রী সেজে বসে থাকতাম? সৌমিত্র বাইরে ফুর্তি করে বেড়াত। আর আমি ঘরে বসে বসে দমবন্ধ হয়ে মরতাম। ওর জীবনে আমার একটাই ভূমিকা ছিল। ঝাড়ুদারের কাজ! যখনই কোনো মেয়ের ওপর ওর আকর্ষণ শেষ হয়ে যেত তখন তাকে হটানোর জন্য ও আমাকেই দেখাত। সেই আবর্জনা সরানোর কাজ ছিল আমার! কিন্তু আমারও তো দেহ আছে, আমারও মন আছে। সেই দেহেও জ্বালা ধরে। কিন্তু সৌমিত্র’র আমার প্রতি আর কোনো আকর্ষণ ছিল না। ফলস্বরূপ আমি ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছিলাম। মুঠো মুঠো অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট খেতে শুরু করলাম। তাতেও যখন হল না তখন মদ, সিগারেট ধরলাম। নিজের প্রয়োজন মেটানোর জন্য নিত্য নতুন জিগোলো বুক করতে শুরু করলাম…!’

বলতে বলতেই থেমে গেলেন তিনি। নার্ভাসভাবে চুপচাপ সিগারেটে দুটো টান মারলেন। অধিরাজ গভীর দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। ভদ্রমহিলার মনের কথা কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে সে। আস্তে আস্তে বলল, ‘ওঁর কোনো শত্রু ছিল?’

‘ওঁর একজনই শত্রু ছিল অফিসার।’ তিনি হাসলেন, ‘সে আমি। যে মেয়েগুলোকে ও ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল তারা কেউ ওঁকে খুন করতে চাইত কিনা জানি না। কিন্তু আমি চাইতাম। মনে হত, কোনোদিন ওর খাবারে বিষ মিশিয়ে দিই। অথবা ছুরিটা ওর গলায় বসিয়ে…!’

‘সত্যিই সেরকম কিছু করেছেন কি?’

অধিরাজের প্রশ্নটায় যেন সামান্য কেঁপে উঠলেন মিসেস চৌধুরী। তিনি একমনে কার্পেটটার দিকে তাকিয়ে আছেন। একটু চুপ করে থেকে দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘না অফিসার। আমার অত সাহস নেই। আমি খুব ভীতু মানুষ। তাছাড়া সৌমিত্র’র মৃত্যুটা তো মার্ডার নয়!’

‘তা নয়।’ অধিরাজ জবাব দেয়, ‘কিন্তু আপনি জানেন না, সৌমিত্রর সুপারি দেওয়া হয়েছিল এক সুপারিকিলারকে’।

‘তাই যদি হয়, তবে সেই ব্যক্তিটিকে অগাধ কৃতজ্ঞতা। যদি তাকে ধরতে পারেন, আমার হয়ে থ্যাংকস জানিয়ে দেবেন। দুনিয়া থেকে একটি জানোয়ারকে অন্তত সরানোর কথা ভেবেছিল সে!’

‘সৌমিত্র অর্থাভাবে পড়েছিলেন?’

ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বরে জ্বালা প্রকট, ‘অর্থাভাবে পড়বে না তো কী করবে? অল্পবয়েসী ছুঁড়িদের পেছনে টাকা ছড়ানোরও একটা সীমা আছে। তার ওপর চাকরিটাও হঠাৎ করে চলে গেল। আমাকে ওর আরও একটা কারণে দরকার ছিল। আমার বাবার সম্পত্তি আমি পেয়েছিলাম। ওর সে টাকাটাও দরকার ছিল। আমারই টাকা নিয়ে আমারই সামনে ফুর্তি করতে ওর লজ্জাও হত না।’ বলতে বলতেই হাসলেন, ‘একটাই বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছে। নিজের আর আমার নামে কোটি টাকার লাইফ ইনশিওরেন্স করেছিল। লাভের মধ্যে সেই টাকাটা এখন আমি পাব। এবার ওর টাকায় ফুর্তি করার পালা আমার।’

অধিরাজ প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেয়, ‘সেদিন মিঃ চৌধুরী মর্গে কী করছিলেন জানেন? ‘

‘না। ও আমায় কোনো কথাই বলত না। লকডাউনের মধ্যেও বৃন্দাবনলীলা দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মর্গে কেন গিয়েছিল তা জানি না। ওর মৃত্যুটা যদি কোনো হোটেলে, রিসর্টে বা নিদানপক্ষে ব্রথেলে হত, তবু বোঝা যেত। এত জায়গা থাকতে ও মর্গে কেন গিয়েছিল তা জানি না। ব্যাপারটা আমার কাছেও ধাঁধার মতো।

‘কারোর সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারেন কি?’

‘মর্গে! অসম্ভব!’ তিনি হেসে উঠলেন, ‘যে নিজের বাবার মৃতদেহ দেখেই ফেইন্ট হয়ে পড়ে সে মর্গে কী করতে যাবে?’

অধিরাজের চোখের দৃষ্টি তীব্র হয়ে ওঠে, ‘নিজের বাবার মৃতদেহ দেখে ফেইন্ট হয়ে পড়েছিলেন মিঃ চৌধুরী?’

‘হ্যাঁ। কয়েক বছর আগে আমার শ্বশুরমশাই মারা যান। হসপিটাল থেকে তাঁর ডেডবডি আনতে আত্মীয়স্বজন, আমি আর সৌমিত্র গিয়েছিলাম। সেখানে বাবার মৃতদেহ দেখে ও ফেইন্ট হয়ে গিয়েছিল। সবাই ভেবেছিল শোকে হয়েছে। কিন্তু আমি জানতাম ওর মৃতদেহে ভয় আছে।

‘স্ট্রেঞ্জ!’ অধিরাজ জানতে চায়, ‘এর আগেও এরকম হয়েছে?’

‘না, এরকম হয়নি। কারণ ও কখনও কোনো মৃতদেহ দেখতে চাইত না। ওর কোনো আত্মীয় স্বজনের মৃত্যু হলেও ও শেষ দেখা দেখতে যেত না। এমনকি রাস্তা দিয়ে কোনো বড়ি গেলেও ও সেদিকে তাকিয়েও দেখত না! বলত, ওর ভয় লাগে।’

অর্ণব লক্ষ্য করল অধিরাজের দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আস্তে আস্তে সে আবার উচ্চারণ করল পরিচিত লজটা, ‘কি-উ-রি অ–সার অ্যান্ড কি-উ-রি অ—সার!’

(১১)

‘ইন্টারেস্টিং লেডি!’

সৌমিত্র চৌধুরীর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে একটা শব্দই উচ্চারণ করল অধিরাজ। মিসেস চৌধুরী যতক্ষণ কথা বলছিলেন ততক্ষণ অর্ণবের গা কেমন শিরশির করছিল। ভদ্রমহিলা বড্ড স্পষ্ট বক্তা। ওঁর মধ্যে কেমন যেন একটা শীতল ঔদাসীন্য আছে যেটা যতটা আকর্ষণ করে, ঠিক ততটাই বিকর্ষণ করে।

‘সৌমিত্র খুব একটা সুবিধের লোক ছিলেন না।’

অর্ণবের কথায় স্মিত হাসল অধিরাজ, ‘এরা কেউই খুব সুবিধের নন অর্ণব। নেহাৎ মিসেস চৌধুরী মুখ খুলেছেন বলে তুমি জানতে পারলে। বাকিরা কেউ মুখ খুলবে না দেখে নিও।’

সত্যিই তাই! বাকিদের কথা শুনলে মনে হয় মৃত ব্যক্তিরা সবাই সত্যযুগ থেকে উঠে এসেছেন। মৃন্ময় দত্তরায়ের স্ত্রী কণিকা দত্তরায়ের মতে মৃন্ময়ের মতো ভালো মানুষ খুব কমই ছিল। অসম্ভব ফিটনেস ফ্রিক ছিলেন। নিয়ম করে জিমে যেতেন, ক্যালোরি মেপে মেপে খেতেন। কণিকার ভাষায়, ‘ওকে কখনও আমি জাঙ্ক ফুড খেতে দেখিনি। চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার অ্যাভয়েড করত। আমাদের ফ্ল্যাটটা টেনথ ফ্লোরে। কিন্তু কেউ কখনও ওকে লিফটে উঠতে দেখেনি। আমিও দেখিনি। সবসময়ই সিঁড়ি ইউজ করত। বলত এটাও নাকি একরকম ওয়ার্ক আউট।’

‘ওঁর কি কোনোরকম ভয় ছিল?’

প্রশ্নটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না কণিকা, ‘ভয়!’

‘হ্যাঁ। কোনোরকম ভয়?’ সে বুঝিয়ে বলল, ‘যেমন উৎপল মিত্র’র হাইটে ভয় ছিল, সৌমিত্র চৌধুরীর ডেডবডিতে, শর্বাণী ঘোষের থান্ডারস্টর্মে, তেমন কি মৃন্ময়ের কোনো ভয় ছিল?’

‘কই—না তো!’

‘ওঁর সম্প্রতি কোনো কারণে এম.আর.আই স্ক্যান করানোর কথা ছিল?’

‘না’। কণিকা বিহ্বলভাবে বলেন, ‘এটাই তো আমি ভেবে পাচ্ছি না যে ও এম.আর.আই করতে কেন গিয়েছিল!’

মৃন্ময়ের বারো বছরের ছেলে করুণ মুখে তাদের দিকে তাকিয়েছিল। অর্ণব দেখল তার চোখ বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় জল গড়িয়ে পড়ছে। তার মনের মধ্যে অব্যক্ত একটা কষ্ট হচ্ছিল। ছেলেটা নিশ্চয়ই বাবাকে মিস করছে। এইটুকু বয়েসেই পিতৃহারা হল! এই ধাক্কা সামলে কী করে এগোবে কে জানে! বড় অল্প বয়েসেই জীবন ওকে দাগা দিল।

উৎপল মিত্র’র স্ত্রী আগেই বয়ান দিয়েছিলেন। এখনও সে বয়ানের নড়চড় হল না। উৎপলের মেয়ে একবার ভীরু চোখে ওদের দেখে নিয়ে ভেতরে চলে গেল। বাচ্চা মেয়েটার মুখে অকৃত্রিম বিষণ্ণতা। তার বৃদ্ধ পিতা ঘরের এক কোণে চুপচাপ বসেছিলেন। তিনি অসহায়ভাবে ওদের দু-জনের দিকে তাকিয়েছিলেন। তাঁর দু-চোখে যেন প্রকট হয়ে উঠেছে একটাই জিজ্ঞাসা, এবার আমার কী হবে?

অনেক অসহায় দৃষ্টি, অনুক্ত প্রশ্নের সামনে দিয়ে ওরা জেরা শেষ করে বেরিয়ে এল। অর্ণব দেখল অধিরাজ ঘেমে নেয়ে অস্থির হয়েছে। সে কথা না বাড়িয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার আর জলের বোতল এগিয়ে দেয়। অধিরাজ গাড়ির ভেতরে বসে প্রথমেই মুখের মাস্কটা খুলে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর হাত স্যানিটাইজ করে ঢকঢক করে জল খেল।

‘সবচেয়ে খারাপ এই ডিউটিটা!’ অধিরাজ আফসোস মাখা কণ্ঠে বলে, ‘মৃত ব্যক্তিদের আপনজনদের জেরা করা বড্ড কষ্টের। উৎপলের বাবা কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন। আমার খুব খারাপ লাগছিল। নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছিল।

অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মুশকিল এটাই। কারোর কৃতকর্মের ফল অন্য কাউকে ভুগতে হয়। এটাই দুনিয়ার দস্তুর। অতীত কাউকে মাফ করে না। কিন্তু এখানে যে লোকগুলোর ভবিষ্যৎ গেল তারা নিরপরাধ!

সৌরীশ গাঙ্গুলি একা মানুষ। এখনও অকৃতদার। টালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে একা থাকেন। সচরাচর ব্যাচেলর মানুষ যেমন ঝাড়া ঝাপটা থাকে তেমনই দায়দায়িত্বহীন বাউন্ডুলে জীবন। এখন মাথায় চমৎকার একটি টাক থাকলেও অতীতে যে ঝাঁকড়া চুল ছিল তার নিদর্শন হিসাবে কয়েকগাছ ‘স্মৃতি টুকু থাক’ এখনও আছে। ঠোঁটের নীচে পুরুষ্টু গোঁফটা হয়তো বীরাপ্পনের গোঁফকেও টেক্কা দিতে পারে। তবে সর্বাঙ্গে বোহেমিয়ান জীবনযাত্রার ছাপ প্রবল।

সৌরীশ ইতিমধ্যেই টুয়েন্টি ফোর সেভেনের নিউজটা দেখে ফেলেছেন এবং রীতিমতো ভয়েই আছেন। অর্ণব ও অধিরাজ যখন তাঁর কাছে পৌঁছল, তখন তিনি ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে বসেছিলেন। প্রথমে তো কিছুতেই দরজা খুলবেন না। শেষমেষ যখন অর্ণব আর অধিরাজ নিজেদের আই কার্ড দরজার আই হোল দিয়ে দেখাল তখন দরজা খুললেন।

‘কিছু মনে করবেন না’। কাঁপা স্বরে বললেন তিনি, ‘আমি এখন আননোন্ ভিজিটর একেবারেই অ্যালাউ করছি না।’

‘ঠিকই করছেন।’ অধিরাজ গম্ভীর স্বরে বলে, ‘এমনিতেও এই কোভিডের মধ্যে বাইরের লোক অ্যালাউ করাই উচিত নয়। আমাদের নেহাৎ উপায় নেই তাই…!’

অর্ণব ভালো করে লোকটাকে দেখল। ফরসা মুখে পিঙ্গল ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। চোখদুটোয় এক অজানা ত্রাস! গলার অ্যাডামস অ্যাপ্‌টা থেকে থেকে নড়ে উঠছে। যেন কিছু বলতে চাইছেন, কিন্তু বলে উঠতে পারছেন না। তার দৃষ্টি গোটা ঘরটাকে ছুঁয়ে গেল। একলা মানুষের ঘর বলেই হয়তো বড্ড অগোছালো। বিছানার ওপর একটা পেল্লায় ছাতা পড়ে আছে। অর্ণব লক্ষ্য করল, ছাতার গায়ে একটা স্টিকার। তাতে লেখা আছে ‘ছাতুমণি’! সে হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেল না। ভদ্রলোক ছাতার নামকরণও করে রেখেছেন!

শুধু ছাতাতেই শেষ নয়। চোখে পড়ল শ্য-কেসের ওপরেও এরকমই একটা স্টিকার। তাতে লেখা, ‘জুতুয়ারাম’! ঘরের এক কোণে একটা ঝাঁটা উকি মারছে। তার নাম আবার ‘ঝাঁটুচরণ’! আশ্চর্য তো! ভদ্রলোক কি সমস্ত জিনিসেরই একটা করে নাম রেখেছেন! এর মানে কী!

সে কথা বলতেই সৌরীশ হেসে ফেললেন, ‘আসলে একা মানুষ তো। পরিবার বলতে এই জিনিসপত্রগুলোই। তাই ওদের প্রত্যেকের নাম রেখে দিয়েছি। জানি ব্যাপারটা অদ্ভুত। কিন্তু আমার ওদের নামকরণ করতে ভালো লাগে। মনে হয়, ওরা শুধু ঝাঁটা, জুতো বা ছাতা নয়, ওরা আমার নিত্যসঙ্গী!

অধিরাজ তাকে একটু থিতু হতে দিল। প্রথমে এদিক ওদিকের কথা বলে সৌরীশকে একটু সহজ করে নিল। তারপর আস্তে আস্তে প্রসঙ্গে এল।

‘আপনি তো ফোবিয়ান্সের সদস্য ছিলেন। ফোবিয়ান্সের কোনো শত্রু ছিল?’

প্রশ্নটা শুনে একটু থমকে গেলেন সৌরীশ। আস্তে আস্তে বললেন, ‘না।’

তাঁর বলার ধরন দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, ভদ্রলোক কিছু চেপে যাচ্ছেন। অধিরাজ একটু চুপ করে থেকে ফের প্রশ্ন করল, ‘আকাশের কেসটা ঠিক কী ছিল?’

সৌরীশ এবার রীতিমতো ঘামতে শুরু করেছেন, ‘আকাশ কে?

‘যে ছেলেটির অকালমৃত্যুর দায় আপনাদের ঘাড়ে পড়েছিল।’

অর্ণব দেখল অধিরাজের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। সৌরীশ যে খুব ভালোভাবেই আকাশকে চিনতে পেরেছেন তা তার ভয়ার্ত মুখই বলে দেয়। যে ছেলেটির বাবা-মা ওদের খুনী বলে চিহ্নিত করেছিলেন, ওদের বিরুদ্ধে সোজা পুলিস স্টেশনে রিপোর্ট করেছিলেন, তাকে এত সহজে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সৌরীশ এমন ভান করলেন যেন ঠিক মনে করতে পারছেন না, ‘ছেলেটার নাম আকাশ ছিল কি? এত বছর পরে মনে রাখা মুশকিল।’

ভদ্রলোকের চোখের দৃষ্টিতে সতর্কতা। অধিরাজ এবার কঠোর গলায় প্রশ্ন করল, ‘আকাশের মৃত্যুর পেছনে আপনাদের কোনোরকম হাত ছিল কি?’

সৌরীশ প্রায় লাফিয়ে উঠলেন, ‘এসব কী কথা! আমাদের হাত থাকবে কেন! ও তো হার্ট ফেইলিওরে মারা গিয়েছিল!’

অধিরাজের চোখ সরু হয়ে আসে, ‘এত বছর পরে ছেলেটার নাম মনে না থাকলেও সে কীসে মারা গিয়েছিল তা দেখছি আপনার স্পষ্ট মনে আছে! স্ট্রেঞ্জ!’

সৌরীশ বুঝলেন উত্তেজনায় মুখ থেকে বেফাঁস কথা বেরিয়ে গিয়েছে। তিনি কোনোমতে সামলে নিলেন, ‘আপনি বললেন বলে মনে পড়ল। নয়তো সত্যিই মনে ছিল না।’

‘গ্রেট!’ অধিরাজ খুব ধীরস্বরে বলল, ‘এমনিতে কলেজে আপনাদের রেপুটেশন খুব একটা ভালো ছিল না। সুজিত বলে একটি ছেলেকেও…!’

সে কথা শেষ করার আগেই সৌরীশ বলে উঠলেন, ‘দেখুন অফিসার, অল্প বয়েসে অনেকেই অনেক কিছু করে। মানছি আমরা অল্পবিস্তর র‍্যাগিং করতাম। কিন্তু সেটা নিতান্তই ছেলেমানুষি। র‍্যাগিংটাও ফ্রেন্ডলিই ছিল। অনেক জুনিয়র পরে আমাদের ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। আপনি ব্যাপারটাকে যতটা সিরিয়াসলি নিচ্ছেন, আদতে তা নয়।’

‘আপনাদের ‘অল্পবিস্তর’ র‍্যাগিং মোট ক-জন ছেলে মেয়েকে পথে বসিয়েছে?’

অধিরাজের প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারলেন না সৌরীশ, ‘মানে? ‘

সে একটা শ্বাস টানল, ‘দেখুন, আমরা আদৌ এখানে ঠাট্টা-তামাশা করতে আসিনি। আপনাদের গ্রুপের সদস্যরা এক এক করে মারা যাচ্ছে তা নিশ্চয়ই খবরে শুনেছেন। চারজন ইতিমধ্যেই মারা গিয়েছেন যার মধ্যে দু-জনের হার্ট ফেইলিওরে মৃত্যু হয়েছে, একজন সতেরোতলা থেকে ঝাঁপ মেরেছেন, আরেকজন অ্যাক্সিডেন্টে মারা গিয়েছেন। আশ্চর্য বিষয়, এর কোনোটাই মার্ডার নয়! যেমন আকাশের মৃত্যুটা ছিল না, সুজিতের মৃত্যুটাও সুইসাইড…!’

‘সুজিত মারা গিয়েছে!’

কথাটা শুনে শিউরে উঠলেন সৌরীশ, ‘কবে?

‘বছর পনেরো আগে। এবং সুজিতের বোন শ্রুতিকে কেউ ফোন করে জানিয়েছে যে প্রত্যেকটি মৃত্যু ‘পোয়েটিক জাস্টিস’।’ অধিরাজ একটু থেমে বলল, ‘আমরা চাই না আরও কারোর সাথে এই পোয়েটিক জাস্টিস হোক। কে বলতে পারে, এরপরের কো-ইনসিডেন্সটা হয়তো আপনার সঙ্গেই ঘটবে।’

ভয়ে সৌরীশের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসে। দরদর করে ঘামছেন তিনি। কোনোমতে উত্তর দিলেন, ‘কিন্তু আমি কী করেছি? আমি তো কিছুই করিনি।’

‘তবে কে করেছে?’

বন্দুকের গুলির মতো প্রশ্ন ছুটে গেল, ‘আর কী-ই বা করেছে? এগজ্যাক্টলি কী হয়েছিল আকাশ আর সুজিতের সঙ্গে? কে করেছিল? ‘

‘আমি জানি না… আমি কিছু করিনি…!’

সৌরীশের দু চোখে ত্রাস। যেন বহুদিনের চাপা পড়ে যাওয়া অতীতের সমাধি থেকে অশরীরী পাপ উঠে আসছে। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘আমি আপনাকে কোনোরকম হেল্প করতে পারব না অফিসার। আমি সত্যিই কিছু জানি না…

‘তবে ভয় পাচ্ছেন কেন?’

অর্ণব স্পষ্ট বুঝতে পারল এখানে নার্ভের যুদ্ধ চলছে। সৌরীশ এমনিতেই ভয় পেয়ে আছেন। তার ওপর তার স্নায়ুর ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করছে অধিরাজ। শাণিত গলায় বলল সে, ‘আপনি নিরপরাধ হলে তো ভয় পাওয়ার কোনো কারণই নেই। তবে আপনার এত ভয়ের কারণ কী? নাকি জানেন যে শর্বাণীর পর এবার

আপনার পালা!’

কেঁপে উঠলেন সৌরীশ। কোনোমতে বললেন, ‘আমি জানি না… আমি জানি না…!’

‘যদি আপনারা সত্যি কথাটা না বলেন তবে আমরাও আপনাদের কোনো হেল্প করতে পারব না।’ অধিরাজ বলল, ‘এখনও পর্যন্ত কোনো মৃত্যুকেই মার্ডার বলা যাচ্ছে না। আপনাদের লাইফ থ্রেট আছে তা যতক্ষণ না প্রমাণ হচ্ছে, ততক্ষণ অফিশিয়ালি পুলিস প্রোটেকশন দেওয়া সম্ভব নয়। প্লিজ, সত্যি কথাটা বলুন। অতীতে ঠিক কী ঘটেছিল? আকাশ এবং সুজিতের সঙ্গে কী করেছিল ফোবিয়ান্স যে তার মাশুল এখন গুণতে হচ্ছে? বলুন, প্লিজ।’

ভদ্রলোক ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমি জানি না। কিছু বলতে পারব না।’

অধিরাজ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে তাঁর দিকে। ওঁর চোখমুখেই স্পষ্ট যে অনেক কথাই জানেন তিনি। কিন্তু গোপন করে যাচ্ছেন। সে মনে মনে ক্লান্তি বোধ করে। লোকটা ভাঙবে, তবু মচকাবে না।

‘আপনি কোনো জিনিসে ভয় পান?’

কথাটা শুনেই চমকে উঠলেন সৌরীশ। ঢোঁক গিলে বললেন, ‘ভয়?’

‘হ্যাঁ, কোনোরকম ভয় আছে আপনার? এমন কোনো জিনিস যাকে আপনি ভয় পান?’

এবার বিস্মিত স্বরে বললেন তিনি, ‘না তো!’

অধিরাজ হাল ছেড়ে দিল। সে এখনও সম্ভাবনার সমুদ্রে সাঁতার কাটছে। পায়ের তলায় মাটি পায়নি। শুধুমাত্র অনুমানের ওপর নির্ভর করে এর থেকে বেশি অগ্রসর হওয়া যায় না! সৌরীশ গাঙ্গুলি মুখ খুললে তবু একটা চান্স ছিল। কিন্তু সে লোকটাও একেবারে মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইল।

পরের গন্তব্যস্থল উমা রায় এবং আবীর সেনের বাড়ি। ওঁদের দু-জনকে খুঁজে পেতেও খুব একটা পরিশ্রম করতে হল না কারণ উমা রায় এখন আর মিস্ রায় নেই, বরং মিসেস সেন হয়েছেন। আবীর সেনের সঙ্গে উমার কলেজে পড়াকালীনই প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল যা পরবর্তীকালে পরিণয়ে পরিণত হয়। দুই প্রাক্তন সহপাঠী অধুনা দম্পতি। তাই একই ঠিকানায় দু-জনেরই খোঁজ পাওয়া গেল।

‘বলুন অফিসার, আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?’

আবীর সেনের হাসি ঝলমলে মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিল অধিরাজ। ছোটো ছোটো কুকুতে দুই চোখ, চৌকো চোয়াল, তীক্ষ্ণ নাকের মানুষটির প্রোফাইল বেশ নিষ্ঠুর। জলপাইগুড়ি পুলিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার জানিয়েছিলেন, দলের নিষ্ঠুরতম সদস্য ছিলেন আবীর। অধিরাজ খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিল তাঁকে। কটা চোখ, তীক্ষ্ণ।

‘যদি আপনারা সত্যি কথাটা না বলেন তবে আমরাও আপনাদের কোনো হেল্প করতে পারব না।’ অধিরাজ বলল, ‘এখনও পর্যন্ত কোনো মৃত্যুকেই মার্ডার বলা যাচ্ছে না। আপনাদের লাইফ থ্রেট আছে তা যতক্ষণ না প্রমাণ হচ্ছে, ততক্ষণ অফিশিয়ালি পুলিস প্রোটেকশন দেওয়া সম্ভব নয়। প্লিজ, সত্যি কথাটা বলুন। অতীতে ঠিক কী ঘটেছিল? আকাশ এবং সুজিতের সঙ্গে কী করেছিল ফোবিয়ান্স যে তার মাশুল এখন গুণতে হচ্ছে? বলুন, প্লিজ।’

ভদ্রলোক ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমি জানি না। কিছু বলতে পারব না।

অধিরাজ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে তাঁর দিকে। ওঁর চোখমুখেই স্পষ্ট যে অনেক কথাই জানেন তিনি। কিন্তু গোপন করে যাচ্ছেন। সে মনে মনে ক্লান্তি বোধ করে। লোকটা ভাঙবে, তবু মচকাবে না।

‘আপনি কোনো জিনিসে ভয় পান?’

কথাটা শুনেই চমকে উঠলেন সৌরীশ। ঢোঁক গিলে বললেন, ‘ভয়?’

‘হ্যাঁ, কোনোরকম ভয় আছে আপনার? এমন কোনো জিনিস যাকে আপনি ভয় পান?’

এবার বিস্মিত স্বরে বললেন তিনি, ‘না তো!’

অধিরাজ হাল ছেড়ে দিল। সে এখনও সম্ভাবনার সমুদ্রে সাঁতার কাটছে। পায়ের তলায় মাটি পায়নি। শুধুমাত্র অনুমানের ওপর নির্ভর করে এর থেকে বেশি অগ্রসর হওয়া যায় না! সৌরীশ গাঙ্গুলি মুখ খুললে তবু একটা চান্স ছিল। কিন্তু সে লোকটাও একেবারে মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইল।

পরের গন্তব্যস্থল উমা রায় এবং আবীর সেনের বাড়ি। ওঁদের দু-জনকে খুঁজে পেতেও খুব একটা পরিশ্রম করতে হল না কারণ উমা রায় এখন আর মিস্ রায় নেই, বরং মিসেস সেন হয়েছেন। আবীর সেনের সঙ্গে উমার কলেজে পড়াকালীনই প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল যা পরবর্তীকালে পরিণয়ে পরিণত হয়। দুই প্রাক্তন সহপাঠী অধুনা দম্পতি। তাই একই ঠিকানায় দু-জনেরই খোঁজ পাওয়া গেল।

‘বলুন অফিসার, আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?’

আবীর সেনের হাসি ঝলমলে মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিল অধিরাজ। ছোটো ছোটো কুৎকুতে দুই চোখ, চৌকো চোয়াল, তীক্ষ্ণ নাকের মানুষটির প্রোফাইল বেশ নিষ্ঠুর। জলপাইগুড়ি পুলিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার জানিয়েছিলেন, দলের নিষ্ঠুরতম সদস্য ছিলেন আবীর। অধিরাজ খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিল তাঁকে। কটা চোখ, তীক্ষ্ণ গোঁফ, ফরসা চেহারার অধিকারী আবীরের ঠোঁটের এককোণে অম্লরসাক্ত একটা হাসি লেগে আছে। চেহারাতেই বেপরোয়া ভাব স্পষ্ট।

‘আপনারা টুয়েন্টি ফোর সেভেনের বুলেটিনটা দেখেছেন?’

‘দেখেছি।’ আবীর মৃদু হাসেন, ‘অবশ্য আমি দেখেছি বললে ভুল বলা হবে। আমার স্ত্রী চ্যানেল সার্ফ করতে করতেই আচমকাই খবরটা দেখতে পায়। ও-ই আমাকে ডেকে দেখাল। বেশ ইন্টারেস্টিং নিউজ।’

কথাবার্তাতেও ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব! অর্ণবের মনে হল, এই তথাকথিত স্মার্টনেসের পেছনেও হয়তো অল্পস্বল্প ভয় লুকিয়ে আছে। সৌরীশ ভয়টাকে প্ৰকাশ করেছিলেন। আর আবীর ভয় লুকিয়ে রাখছেন।

‘আমার বেটার হাফ খুব ভয় পেয়েছে।’ এবার আবীরের মুখে চিন্তার ছাপ পড়ল, ‘সচরাচর আমি আমার স্ত্রীকে এসব জানতে দিই না। যেদিন থেকে কোভিডে মানুষ পোকা মাকড়ের মতো মরতে শুরু করেছে সেদিন থেকেই ও খবর দেখা বন্ধ করেছে। মৃত্যুর খবর শুনলে ভয় পায়। যদিও আমি ভয় পাই না, ভয় পাওয়ার কোনো কারণও নেই।’

‘আপনার স্ত্রী-ও তো ফোবিয়ান্সের সদস্য ছিলেন।’

‘হ্যাঁ’। আবীর জানালেন, ‘ও একসময়ে খুবই অ্যাকটিভ ছিল। আমাদের ব্যান্ডের অন্যতম লিড সিঙ্গার ছিল। অসাধারণ গান গাইত। কিন্তু…!’

‘কিন্তু’র পরের বাক্যটা আর বললেন না তিনি। বরং একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অধিরাজ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকায়।

‘আমাকে চাকরি সূত্রে ইউ.এস.এ যেতে হয়েছিল। উমা আবার ওর দাদুর একমাত্র উত্তরাধিকারী। ওঁদের হোটেলের বিজনেস। দাদুর মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারসূত্রে হোটেলের মালিকানা পেয়েছিল ও। কিন্তু উমাও ওসব ছেড়েছুড়ে আমার সঙ্গে বিদেশে গেল। ভালোই কাটছিল। আমাদের এক সন্তানও হয়েছিল। সব মিলিয়ে আমরা হ্যাপি ফ্যামিলিই ছিলাম। বাট্…।’ আবীরের মুখে বিষণ্নতার ছায়া, ‘একটা কার অ্যাক্সিডেন্ট আমাদের জীবন ছারখার করে দিল। আমাদের একমাত্র ছেলে পিকু অ্যাক্সিডেন্টেই মারা যায়। উমার পা দুটো পুরো পিষে গিয়েছিল। বাঁচানোর উপায় ছিল না। ডাক্তাররা বাধ্য হয়ে দুটো পা-ই অ্যাম্পুট করেছিলেন।’

অধিরাজ এবং অর্ণব পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করে। উমা রায় ওরফে উমা সেন সম্পর্কে এ তথ্যটা ওদের জানা ছিল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবীর সেন বলেন,

‘কাম্ অন্ অফিসার!’ তিনি বলেন, ‘আপনি তো এমনভাবে বলছেন যেন আমরা পাইরেট! আমরা সাধারণ স্টুডেন্ট ছিলাম। হাসি ঠাট্টায় অল্প বিস্তর দাদাগিরি ফলাতাম, ব্যস্ এই পর্যন্তই।’

‘আর কার কার ওপরে দাদাগিরি ফলিয়েছিলেন?’

আবীর একটু থমকে গেলেন, ‘সে তো অগুনতি! তাদের অনেকেই পরে আমাদের বন্ধু হয়েছিল। এখন এত বছর পর তাদের সবাইকে মনে রাখা অসম্ভব। তাছাড়া এত বছর পর কেউ প্রতিশোধ নিতেই বা যাবে কেন!

অধিরাজ বুঝল, আবীরও মুখ খুলবেন না। যদিও তাঁর যুক্তি অকাট্য। প্রতিশোধ নেওয়ার হলে আগেই তো নিতে পারত, এখন কেন? সেদিক দিয়ে ভাবলে রিভেঞ্জের অ্যাঙ্গেলটা ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু ব্যাপারটা বোধহয় অত সহজ নয়। ভেতরে একটা গুরুতর প্যাঁচ আছে। কিন্তু সেটা কী? সৌরীশ এবং আবীর দু-জনেই জানেন তাদের জীবন বিপন্ন। তা সত্ত্বেও দু-জনেই কিছু একটা চেপে যাচ্ছেন। কী?

‘কলেজ ছাড়ার পর বন্ধুদের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ রাখেননি কেন?‘

এবার একটু অন্যদিক থেকে আক্রমণ শানালো অধিরাজ। আবীরের চোখে সতর্কতা, ‘এমনিই। কাজের ব্যস্ততায় আর যোগাযোগ রাখা হয়নি।’

অত্যন্ত খারাপ যুক্তি! মুহূর্তের জন্য আবীরের চোখে মুখে ধূর্ততার ছাপ ছায়া ফেলে সরে গেল। তিনি একটু থেমে যোগ করলেন, ‘তাছাড়া আমি বিদেশে চলে গিয়েছিলাম। যোগাযোগ রাখার উপায় ছিল না। এই কয়েকবছর হল দেশে ফিরেছি।’

‘কেন? আজকাল তো ওভার ফোন, হোয়াটস অ্যাপ, ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামেও যোগাযোগ রাখা যায়।’ অধিরজের অকাট্য যুক্তি, ‘টেকনোলজির কাছে এখন স্বদেশ বা বিদেশ বড় ফ্যাক্টর নয়। তবে এতদিনের প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলেন না কেন?’

আবীরের মুখ শক্ত হয়ে গিয়েছে। মুখভঙ্গিতেই স্পষ্ট যে এই প্রশ্নের উত্তর তিনি দেবেন না। লোকটাকে যতটা সহজ মনে হয়, অতটা আদৌ নয়। বরং যথেষ্টই গোঁয়ার! তুলা শুনিতে নরম, ধুনিতে লবেজান।

‘আপনারা কি আমার মিসেসের সঙ্গে দেখা করবেন?’

চট করে প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলেন আবীর। অধিরাজ আলতো মাথা ঝাঁকায়,’এসেছি যখন তখন একবার দেখা করেই যাই।’

‘দয়া করে ওকে এরকম জেরা করবেন না,’ তিনি সতর্ক, ‘উমা অত্যন্ত নরম মনের মানুষ। তার ওপর অসুস্থ…!’

‘এখন কিন্তু আপনিও আমাদের পাইরেট ভাবছেন মিঃ সেন।’ অধিরাজ হাসল, ‘আমরা এতখানি নিষ্ঠুরও নই যে একজন অসুস্থ মানুষকে কাঠগড়ায় তুলে প্রশ্ন করব।’

‘থ্যাঙ্কস। আসুন।’

এতক্ষণ ওরা বাইরের হলে বসে কথা বলছিল। এবার আবীর ওদের বেডরুমের দিকে নিয়ে চললেন। সম্ভবত ভদ্রলোক নিজে যথেষ্ট গুছোনো প্রকৃতির। হলঘরটাও সুন্দর সাজানো গোছানো ছিল। দেখলে কেউ বলবে না এ বাড়ির কর্তী গুরুতর রকমের অসুস্থ। একটু পরেই যে বেডরুমে ওরা ঢুকল সেটাও সুন্দর করে সাজানো। ক্রিম রঙের দেওয়ালে সুন্দর সুন্দর ছবি। ফুলদানিগুলোয় তাজা ফুল শোভা পাচ্ছে। বেডসাইড টেবলে একটা চকচকে লাল গিটার রাখা। তার পাশে একটা সিডি প্লেয়ার। তার মাথায় যে অ্যালবামটা রাখা আছে সেটা এলভিসের ‘মুডি ব্লু’।

সাদা ধপধপে বিছানায় যে নারীটি শুয়েছিলেন, একসময়ে নিশ্চয়ই সুন্দরী ছিলেন। দুরারোগ্য ক্যান্সার তাঁর রূপের অনেকটাই কেড়ে নিতে পেরেছে। কিন্তু স্নিগ্ধতাটুকু মুছে দিতে পারেনি। সাদা চাদর দিয়ে পা দুটো ঢাকা। কিন্তু পায়ের দিকে নজর পড়তেই বোঝা গেল যে হাঁটুর নীচের অংশ নেই! আবীর তাঁর সঙ্গে অধিরাজদের পরিচয় করিয়ে দিতেই স্মিত হাসলেন। অধিরাজের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বললেন, ‘ওঁকে চিনতে পেরেছি। কয়েকদিন আগেই টিভিতে দেখাচ্ছিল। সার্জিক্যাল স কিলারের মিস্ট্রি উনিই সভ্ করেছিলেন। সি.আই.ডি হোমিসাইডের হিরো। যদিও আপনাকে হলিউডেই বেশি ভালো মানাত মিঃ ব্যানার্জি।’

অধিরাজ একটু অপ্রতিভ হয়ে পড়ে। তার চেহারা নিয়ে কেউ মন্তব্য করলে কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। এসব পরিস্থিতিতে গাধার মতো দাঁত বের করা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো উপায় নেই। সে একটু হাসার চেষ্টা করে,’থ্যাঙ্কস ফর দ্য কমপ্লিমেন্ট ম্যাম।’

‘আমি কিন্তু আপনার রীতিমতো ফ্যান অফিসার।’ ইঙ্গিতে বিছানার পাশের চেয়ারে ওদের দু-জনকে বসতে বললেন তিনি, ‘সার্জিক্যাল স কিলারের কেসটা যেভাবে আপনি সলভ করলেন তা প্রশংসার যোগ্য।’

অর্ণব আড়চোখে অধিরাজের মুখের দিকে তাকায়। সার্জিক্যাল স কিলিং-এর কেসটার কথা উঠলেই আজও অধিরাজ গুটিয়ে যায়। সেই বিভীষিকা আজও তার পেছন ছাড়েনি। কেসটা সে সলভ করেছিল ঠিকই, কিন্তু পরিবর্তে তাকে যে কী কী সহ্য করতে হয়েছে তা অধিরাজের পাশাপাশি অর্ণবও জানে। সে-ও সাক্ষী সেই প্রাণান্তকর লড়াইয়ের!

‘আপনার কথা বলতে কোনোরকম কষ্ট হচ্ছে না তো?’ অধিরাজ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে, ‘আপনি বোধহয় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আমরা বিরক্ত করলাম।’

‘না না!’ উমা মাথা নাড়লেন, ‘এখন আমার কোনোরকম কষ্ট হচ্ছে না। বরং একা একা থাকলেই কষ্টটা বেশি হয়। আর কেমো নেওয়ার পর কষ্ট হয়। আপাতত তেমন কোনো সমস্যা নেই।’

‘তবু…।’

‘আপনি আমায় যতটা দুর্বল ভাবছেন, আমি কিন্তু ততটা নই।’ উমা হাসলেন, ‘তথাকথিত অথর্ব হয়ে থাকতে আমার আপত্তি আছে। ঘরে বসে থাকাটা পছন্দের নয়। তাই এখনও আমি নিজেই হোটেলের বিজনেস দেখি। নিজেই ড্রাইভ করে হোটেলে যাই। গোটা বিজনেসটাই এখন আমার কাঁধে।

‘মা।’

একটা কণ্ঠস্বর ওদের সবাইকেই সচকিত করে দিল। অধিরাজ দেখল, ঘরের দরজায় একজন লম্বা মজবুত কাঠামোর ব্যক্তি এসে দাঁড়িয়েছে। শক্ত, সবল পেটানো চেহারা! নাকের নীচে পাকানো ইয়া বড় মোচ! দেখলেই মনে হয়, যেমন দু-ঘা নিতে পারে, তেমন দিতেও পারে। লোকটাকে দেখেই প্রাচীনকালে জমিদারদের বাড়ির লেঠেলদের কথা মনে পড়ে গেল অর্ণবের। মাথার একরাশ কাঁচাপাকা চুল না থাকলে ওর বয়েস বোঝা দায় হত। কিন্তু নুনমরিচ চুল সাক্ষী দেয়, লোকটার বয়েস চল্লিশের বেশি।

‘রতন!’

উমা লোকটার পরিচয় দিলেন, ‘আমার অ্যাটেনডেন্ট। কম্বাইন্ড হ্যান্ডও বলতে পারেন। ও সবসময়ই আমার সঙ্গে থাকে। অত্যন্ত বিশ্বস্তও। আমার বাড়ির সব চাবি ওর কাছেই থাকে। এমনকি প্রত্যেকটা আলমারির চাবিও ওরই হাতে। আমরা দরকার পড়লে চেয়ে নিই। ওকে আমি চোখ বুজে বিশ্বাস করি।

অর্ণব অধিরাজের কানের কাছে ফিসফিস করে, ‘আমি তো ভেবেছিলাম জমিদারদের লেঠেল! ‘

অধিরাজও চাপা গলায় বলল, ‘তবু ভালো। আমি ভেবেছিলাম ডাকাত!’ বলতে বলতেই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘পাপী মন অর্ণব।’

রতন উমাকে ওষুধ খাওয়াতে এসেছিল। আবীর জানালেন, সে অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ মানুষ। গত পাঁচবছর ধরে সে এই পরিবারের সঙ্গে আছে। উমাকে হোটেলে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে তাঁর উনকোটি কাজ সে নির্বিবাদে করে। চব্বিশ ঘণ্টাই সতর্ক থাকে। যে কোনো প্রয়োজনে সবসময়ই তাকে পাওয়া যায়।

‘তোমরা এখন বাইরে যাও।’ উমা মিষ্টি হাসলেন, ‘আমার মিঃ ব্যানার্জির সঙ্গে একটু প্রাইভেট কথা আছে।’

আবীরের মুখে বিস্ময় এবং বিপন্নতার যুগপৎ ছাপ অধিরাজের চোখ এড়াল না! স্ত্রীয়ের এরকম উদ্ভট আবদারে তিনি যতটা বিস্মিত হয়েছেন, ঠিক ততটাই ভয় পেয়েছেন। কিন্তু কীসের ভয়! এই অদ্ভুত ভয়টা সৌরীশের মুখেও ছায়া ফেলেছিল। কী চেপে যাচ্ছেন ওঁরা!

রতন বিনাবাক্যব্যয়ে হুকুম তামিল করল। আবীর একটু অপ্রস্তুত হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ওরা দু-জনেই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই অধিরাজের দিকে তাকালেন উমা। এবার তাঁর দু-চোখে আশঙ্কা স্পষ্ট। একটু আগের কৌতুক মিলিয়ে গিয়ে ফুটে উঠেছে অকৃত্রিম ভয়।

‘অফিসার, আপনারা কি ফোবিয়ান্সের সদস্যদের মৃত্যুর ব্যাপারে তদন্ত করতে এখানে এসেছেন?’

অধিরাজ ইতিবাচকভাবে মাথা নাড়ে, ‘আজ্ঞে।’

‘সত্যিই কি কেউ প্রতিশোধ নিচ্ছে? এত বছর পর?’

‘এখনই বলা মুশকিল। তবে আমরা ওই অ্যাঙ্গেলটার কথাও ভাবছি।’

অধিরাজ একটু থেমে শান্ত স্বরে বলল, ‘আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?’

উমা মাথা নাড়লেন। তার মুখে চিন্তার ছাপ প্রকট। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘নিয়তি!’

অধিরাজের চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। নিয়তি বলতে ঠিক কী বোঝালেন ভদ্রমহিলা!

তিনি একটু চুপ করে থেকে ফের যোগ করলেন, ‘নিজের জন্য ভয় পাই না। আমি তো পা বাড়িয়েই আছি। এখন শুধু ডাক আসার প্রতীক্ষা। কিন্তু আমার স্বামীর জন্য বড্ড চিন্তা হয়। আমি চলে গেলে ও এমনিতেই খুব অসহায় হয়ে পড়বে।’

অধিরাজ আর অর্ণব দু-জনেই চুপ করে থাকে। মৃত্যুপথযাত্রী মহিলাকে ঠিক কী বলা উচিত, কীভাবে সান্ত্বনা দেওয়া উচিত তা ওদের জানা নেই।

‘আপনার মনে হয় আকাশের ফ্যামিলি এর সঙ্গে জড়িত?’

‘শিওর নই। হতেও পারে।’

উমা কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন,’আকাশের বাবা-মাকে ইন্টারোগেট করেছেন আপনারা? ‘

‘এখনও করিনি, তবে শিগগিরিই করব।’

‘আকাশের মা তো আমাদের শাপশাপান্ত করতে বাকি রাখেননি। শুনেছি তিনি ঈশ্বরের নামে শপথ করেছিলেন যে আকাশের মৃত্যুর বদলা নেবেন। রীতিমতো হুমকি দিয়ে গিয়েছিলেন যে আমাদের সবাইকে দেখে নেবেন।’

নিটোল একটা রিভেঞ্জ স্টোরি। আকাশের বাবা-মা আগেই প্রাইম সাসপেক্ট ছিলেন। তার মা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে ছেলের মৃত্যুর বদলা নেবেন। তবে কি তিনিই? নাকি সুজিতের বাবা-মা কিংবা বোন? অথবা অন্য কেউ, যার দেখা এখনও পাওয়া যায়নি! যার ইতিহাস এখনও অতীতের ধুলিধূসরিত অধ্যায়ে পড়ে রয়েছে।

‘ফোবিয়ান্সের সঙ্গে অন্য আর কারোর ঝামেলা হয়েছিল?’

এই প্রশ্নটা আগেও বেশ কয়েকবার করেছে অধিরাজ। কিন্তু সন্তোষজনক উত্তর পায়নি। এবার প্রশ্নটা শুনে মৃদু হাসলেন উমা, ‘একজন নয়, একাধিক মানুষের সঙ্গে ফোবিয়ান্সের শত্রুতা ছিল। রজত চৌধুরী নামের একটি ছেলে তো কলেজ ছেড়ে দিতে বাধ্যই হয়েছিল। রূপা বিশ্বাস নামের একটি মেয়েকে এমন ভূতের ভয় দেখিয়েছিল যে সেই মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।’

‘আপনিও তো সেই গ্যাঙে ছিলেন।’

‘ছিলাম।’ ভদ্রমহিলা একটু ক্লান্তভাবে বললেন, ‘কিন্তু ওদের মতো অ্যাকটিভ ছিলাম না। আমার ইন্টারেস্ট গান বাজনা নিয়েই বেশি ছিল। ব্যান্ডে গান গাইতাম। তবে ওদের অন্যান্য কাজের সঙ্গে খুব একটা যোগ ছিল না।’

‘রজত চৌধুরী বা রূপা বিশ্বাস কোথায় থাকে জানেন? ‘

‘নাঃ। ওদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। তবে জেজিইসির অ্যালামনি অ্যাসোসিয়েশনের কাছ থেকে ওদের ঠিকানা পেয়ে যাবেন আপনি।’

‘থ্যাঙ্কস।’ সে একটু থেমে ফের রুটিন প্রশ্নটা করে, ‘আপনাদের কারোর কোনো বিষয়ে ভয় আছে?’

‘ভয়?’ প্রশ্নটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি উমা, ‘মানে?’

সে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল। তিনি জানালেন, ‘আবীরের তেমন কোনো ভয় নেই। সাপ খোপে অবশ্য ভয় পায়। তবে আমার মারাত্মক হিমোফোবিয়া আছে। সচরাচর আমার যখন ব্লাড টেস্ট হয় বা চ্যানেল তৈরি করা হয়, আমি সেদিকে তাকাই না।’

‘ওকে। থ্যাঙ্কস এগেইন।’ অধিরাজ উঠতে গিয়েও থমকে গেল। টেবিলের ওপরে শোয়ানো লাল গিটারটা দেখে বলল, ‘ওটা কার? ‘

‘আমার।’ উমা স্মিত হাসলেন, ‘গান আমার প্যাশন। তাই মাঝেমধ্যে আপনমনেই গান গাই। যে ক-টা দিন বেঁচে আছি, একটু আনন্দে থাকার চেষ্টা করছি আর কী!

‘মুডি ব্লু’র অ্যালবামটা তুলে নিয়ে বলল সে, ‘এলভিসের ফ্যান?’

‘হ্যাঁ।’ ভদ্রমহিলার মুখে বিষণ্নতার ছাপ, ‘কিন্তু আমার মিউজিক সিস্টেমটা গেছে। গান ছাড়া জীবনটা অসহ্য লাগে। শরীরটা এতটাই খারাপ যে এখন গলা দিয়েও সুর বেরোতে চায় না। ‘

‘হুম্।’

অর্ণব হাঁ করে দেখল অধিরাজ টেবিলের ওপর থেকে গীটারটা তুলে নিয়েছে। তার আঙুলের স্পর্শে ঝংকার দিয়ে উঠল তারগুলো। গীটারের তারে আঙুলগুলোর চলাফেরায় অনেকদিনের অনভ্যাসের ছাপ স্পষ্ট তবুও নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে থাকা যন্ত্রটা যেন প্রাণ ফিরে পেল। উমা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। গীটার বাজাতে বাজাতেই সে ভরাট কণ্ঠে গান ধরল—

‘লাভ মি টেন্ডার, লাভ মি সুইট
নেভার লেট মি গো,
ইউ হ্যাভ মেড মাই লাইফ কমপ্লিট
অ্যান্ড আই লাভ ইউ সো।
লাভ মি টেন্ডার, লাভ মি ট্রু
অল মাই ড্রিম্‌স্‌ ফুলফিল
ফর মাই ডার্লিং আই লাভ ইউ
অ্যান্ড আই অলওয়েজ উইল।’

নিঃসন্দেহে এলভিস! অর্ণবের বিস্ময় সীমা পরিসীমা ছাড়িয়েছে। অধিরাজ কী অবলীলায় গানটা গাইছে! আর তার ভরাট কণ্ঠস্বরে গানটাও অপূর্ব শোনাচ্ছিল। পেলব কণ্ঠস্বরে চড়াই উৎরাই একদম মসৃণ। অর্ণব যেন একেবারে মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে আছড়ে পড়ল। অধিরাজ গানের ব্যাপারে উৎসাহী, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুরাগী তা তার জানা ছিল। কিন্তু সে যে এমন চমৎকার গান গাইতে পারে তা জানত না!

তার কণ্ঠস্বর সুরের মাদকতায় পরিপূর্ণ। মুহূর্তের মধ্যে যেন চতুর্দিক শান্ত হয়ে গেল। অর্ণব দেখল, গান গাইতে গাইতেই অধিরাজ ছেলেমানুষের মতো হাসছে। উমা সেনের চোখ ছলছল করছে। তিনি মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন অধিরাজের দিকে। অর্ণবের বিস্ময়ের অবধি নেই। এতদিন পর্যন্ত লোকটার সঙ্গে সঙ্গে থেকেছে, অথচ এমন একটা মোক্ষম গুণের কথাই জানত না সে!

‘লাভ মি টেন্ডার, লাভ মি ডিয়ার
টেল মি ইউ আর মাইন।
আই’ল বি ইওরস্ থ্রু অল দ্য ইয়ারস
টিল দ্য এন্ড অফ টাইমস্।

গান শেষ করল অধিরাজ। উমার চোখে জল। আস্তে আস্তে বললেন, ‘অপূর্ব!’

সে গীটারটা নামিয়ে রেখে লাজুক হেসে বলে, ‘থ্যাংকস। কলেজে পড়ার সময় আমারও ইংরেজি গান গাওয়ার শখ ছিল।’

আস্তে আস্তে নিজের দেহটাকে বিছানায় এলিয়ে দিলেন উমা। ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘এখন আর কথা বলতে ভালো লাগছে না। বড্ড ভালো গাইলেন আপনি। এখন আর সবকিছুই বিরক্তিকর মনে হচ্ছে।

‘ওকে ম্যাম।’

ওরা ভদ্রমহিলাকে বিদায় জানিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। অর্ণব তখনও প্রভূত বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ। একটু আগেই যা হয়ে গেল তা তার তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। তার অধিরাজের ওপর অভিমানও হচ্ছিল। স্যার কখনও তাকে গান শোনাননি। এত কাছে থেকেও সে কিছুই জানতে পারেনি। অথচ এই অপরিচিতা মহিলাকে কেমন সুন্দর গান শুনিয়ে দিলেন।

‘কী বুঝছ অর্ণব?’

অধিরাজের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেল অর্ণব। তার মনের মধ্যে অভিমান শাখাপ্রশাখা ছড়াচ্ছিল। সে একটু থেমে বলল, ‘স্যার!’

‘আরও দু-জনকে পাওয়া গেল! রূপা বিশ্বাস এবং রজত চৌধুরী।’ অধিরাজ আপনমনেই বলে, ‘শেষে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় না হয়ে যায়। এখন তো মনে হচ্ছে গোটা কলকাতাই ওঁদের শত্রু!’

‘কিন্তু আকাশের মৃত্যুটার ব্যাপারে সকলেই কিছু না কিছু চেপে যাচ্ছেন।’

‘ঠিক।’ অধিরাজ আত্মমগ্নভাবে বলল, ‘এই আকাশের গেরোটা কী! তার মৃত্যুটাও আপাতদৃষ্টিতে মার্ডার ছিল না। এদের মৃত্যুকেও মার্ডার বলা যাবে না। এই মুহূর্তে সৌরীশ, আবীর ও উমার প্রোটেকশন দরকার। বিশেষ করে উমার। কিন্তু আমাদের হাত-পা বাঁধা। লোকগুলো মুখও খুলছে না!

‘উমা!’

‘এরপরের টার্গেট হওয়ার তাঁরই হাই চান্স। এমনিতেই অসুস্থ। সফট্ টার্গেট। এবং তাঁর যদি হার্ট ফেল হয় তবে সেটা স্বাভাবিক মৃত্যু হিসাবে গণ্য হবে। কারণ সচরাচর ক্যানসারের পেশেন্টরা কার্ডিয়াক ফেইলিওরেই মারা যায়।’

অর্ণব মাথা ঝাঁকায়। অর্থাৎ পয়েন্টটা সে বুঝেছে। উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, ‘তবে?’

‘অফিশিয়ালি পুলিস প্রোটেকশন দেওয়া যাবে না। সে উপায় নেই। দেখি, যদি আন-অফিশিয়ালি কিছু করা যায়।’

অর্ণব একটু নিশ্চিন্ত হয়। তার মানে অধিরাজ লোকগুলোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা কিছু না কিছু করবেই। এমনিতেই তার মন বলছিল ওঁরা প্রত্যেকেই যথেষ্ট বিপন্ন

‘একটা হিসাব কিছুতেই মিলল না।’ অধিরাজ় আপনমনেই বলল, ‘সৌমিত্র আর উৎপলের মৃতদেহে আর উচ্চতায় ভয় ছিল। শর্বাণীর বজ্র বিদ্যুতে। কিন্তু মৃন্ময়ের তেমন কোনও ভয়ের কথা আমরা শুনতে পাইনি। সৌরীশও কিছু বলেননি। উমার রক্তে ভয় আছে, কিন্তু আবীরের তেমন কিছু নেই। এরকম পার্থক্য কেন! এমন তো হওয়ার কথা নয়। ‘

অর্ণব বুঝতে পারছিল না যে ওই মানুষগুলোর ভয়ের সঙ্গে পরপর মৃত্যুর সম্পর্ক কী! তার মনের কথা বুঝতে পেরেই অধিরাজ বলল, ‘হ্যারি পটারের বোগার্টকে মনে আছে তোমার? যে মানুষের মনের সবচেয়ে বড় ভয়ের রূপ ধরত?’

অর্ণব মাথা ঝাঁকায়। হ্যারি পটার সিরিজ সে পড়েছে। বোগার্টের কীর্তিকলাপও জানা। কিন্তু এই কেসের সঙ্গে বোগার্টের সম্পর্ক কী!

‘বোগার্ট যেটা করত, সেটাই এখানে কেউ করছে। তুমি জানতে চাইছিলে না, মার্ডার ওয়েপ কী? মার্ডার ওয়ে আসলে ভয়—ফোবিয়া।’ অধিরাজের চোখদুটো ঝকঝক করে উঠল, ‘লক্ষ্য করে দেখো, যার যে জিনিসে ভয় ছিল, সে ঠিক সেই জিনিসটাই করেছে। সৌমিত্রর নেক্রোফোবিয়া ছিল। উনি মৃতদেহে ভয় পেতেন। একটা দুটো ডেডবডি হলে তবু কথা ছিল। কিন্তু সেই লোককে যদি মর্গে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তবে সে হার্টফেল করবে না তো কী করবে! উৎপলের হাইটে ভয়। মানে অ্যাক্রোফোবিয়া! তাঁকে যদি সতেরোতলার কার্নিশে কেউ দাঁড় করিয়ে দেয়, তবে অবধারিত মৃত্যু। হার্টফেলের সম্ভাবনা তো আছেই, তার সঙ্গে কিছুক্ষণ পরেই তাঁর পা ভয়ে কাঁপতে শুরু করবে। তখন ব্যালান্স হারিয়ে নীচে পড়াটাই স্বাভাবিক। তোমার ডঃ চ্যাটার্জির কথাগুলো মনে আছে অর্ণব?’

‘হ্যাঁ স্যার।’

‘উৎপল যদি ওপর থেকে পড়ে মারা না যেতেন, তাহলেও তার হার্টফেল অবধারিত ছিল। বারবার ডঃ চ্যাটার্জি বলেছেন স্কেয়ারড টু ডেথ! কিন্তু মাথামোটা আমিই বুঝতে পারিনি। দেখবে শর্বাণী ঘোষের পোস্টমর্টেমের রেজাল্টও সেই একই আসবে। ফাইট অর ফ্লাইট পজিশন এবং স্কেয়ারড টু ডেথ। ভদ্রমহিলার থান্ডারস্টর্মে ভয় ছিল। অ্যাস্ট্রাফোবিয়া! সেই মহিলাকে চূড়ান্ত ঝড় জল বজ্রপাতের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হল! ব্যস্! হার্টফেল হওয়ার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ভদ্রমহিলা ভয়ের চোটে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে পালাতে চাইছিলেন। পেছন থেকে ছুটে আসা ট্রাকটাকেও দেখতে পাননি। ফলস্বরূপ অ্যাক্সিডেন্ট!

‘শুধুমাত্র ভয় দিয়েই কাউকে মারা সম্ভব?’

‘ভয়ের চেয়ে মোক্ষম মার্ডার ওয়েপ আর নেই অর্ণব’। অধিরাজ একটু অন্যমনস্কভাবে বলে, ‘এটা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না! বিলিভ মি!’

সত্যিই! ভয় কাকে বলে তা অধিরাজ ছাড়া আর কে জানে! প্রায়ই ঘুমের মধ্যে তার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়! মনে হয় এবার বুঝি হার্টফেলই করবে! লোকটা… সেই লোকটা কিছুতেই তার পেছন ছাড়ে না! যখন তখন এসে পড়ে ভয় দেখায়। অধিরাজের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। বুকের মধ্যে একটা চাপা ব্যথা! মনে হয়, দুনিয়ায় ভালো কিছু আর থাকতেই পারে না, তার জীবনে ভালো কিছু হতে পারে না। সেসব কথা অর্ণবকে বলা যায় না। কাউকেই বলা যায় না!

অগাধ বিস্ময়ে অধিরাজের দিকে তাকিয়ে থাকে অর্ণব। সে এমনভাবে ঘটনাগুলো বলে চলেছে, যেন ঘটনার সময়ে সে অকুস্থলে উপস্থিত ছিল। একটু আমতা আমতা করে বলল, ‘কিন্তু মৃন্ময়…?’

‘আপাতদৃষ্টিতে মৃন্ময়ের কোনোরকম ফোবিয়া দেখা যাচ্ছে না। ওঁর স্ত্রীও বলেছেন যে ভদ্রলোকের তেমন কোনো ভয় ছিল না। কিন্তু তার সঙ্গে আরও একটা কথাও বলেছেন উনি।’

‘কী?’

‘মৃন্ময় এতটাই ফিটনেস ফ্রিক ছিলেন যে লিফটে উঠতেন না। ওঁর স্ত্রী বলেছেন, কেউ ওঁকে কখনও লিফটে উঠতে দেখেনি, এমনকি স্বয়ং তিনিও দেখেননি। অথচ ফ্ল্যাটটা টেনথ্ ফ্লোরে! এটা কি তোমার স্বাভাবিক মনে হচ্ছে! একটা লোক যতই ফিটনেস কনশাস হোক, সে জিমে যেতে পারে, ওয়ার্ক আউট করতে পারে, ডায়েট চার্ট ফলো করতে পারে, কিন্তু সারাদিনের পরিশ্রমের পর রোজ টেনথ ফ্লোরের সিঁড়ি ভাঙবে কোন্ দুঃখে! বাড়াবাড়ি নয়?’

অর্ণব চুপ করে থাকে। ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত। আজকাল মানুষের তিন চারতলার সিঁড়ি ভাঙতেই প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়, ইনি আবার এগারোতলার সিঁড়ি ভাঙতেন।

‘এর দুটোই অর্থ হয়। হয় লোকটার ভয়াবহ বাতিক আছে, অথবা পাগল, নয় তিনি লিফটে উঠতে পারতেন না। লিফটে উঠতে তাঁর ভয় করত।’ অধিরাজ সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বলল, ‘তাঁর নিজস্ব গাড়ি আছে, তাই ভিড় বাস, ট্রেন বা মেট্রোয় ওঠার বালাই নেই। কিন্তু আমার ধারণা তিনি মশারিতে শুতেও ভয় পেতেন। একবার ওঁর স্ত্রীকে ফোন করে জেনে নাও তো।’

অর্ণব মাথা ঝাঁকিয়ে মোবাইলে কণিকা দত্তরায়কে ধরল। ভদ্রমহিলা প্রথমে প্রশ্নটা শুনে অবাক হলেন। তাঁর স্বামী মশারিতে শুতেন কি না তা জেনে সি.আই.ডি অফিসারদের লাভ কী! তারপর বিস্ময়টা কোনোরকম গলাধঃকরণ করে বললেন, ‘না। ও মশারিতে শুতে পারত না। বলত ওর নাকি দমবন্ধ হয়ে আসে। কেন বলুন তো?’

‘জাস্ট রুটিন প্রশ্ন। থ্যাঙ্কস। ‘

ফোনটা কেটে দিয়ে বিস্মিত দৃষ্টিতে অধিরাজের দিকে তাকায় অর্ণব,’ক্লস্ট্রোফোবিয়া!’

‘চূড়ান্ত ক্লস্ট্রোফোবিয়া! এমন মানুষকে এম.আর.আই স্ক্যান করানোর জন্য ঢুকিয়ে দিলে হার্টফেল করাই স্বাভাবিক।’

অর্ণব দেখল অধিরাজ তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। অর্থাৎ অনুমতির অপেক্ষা করছে। সে মৃদু হাসল, ‘ঠিক আছে।’

‘থ্যাঙ্কস।’ সিগারেটটা ধরিয়ে আস্তে আস্তে বলল অধিরাজ, ‘আমি যা ভাবছি, সত্যিই যদি তাই হয় তবে যে মাথা থেকে এই দুর্বুদ্ধি বেরিয়েছে, সে মাথাটার প্রশংসা না করে পারছি না। কী অদ্ভুত খ্যাঁচাকলে ফেলেছে দেখো অর্ণব। একটা মৃত্যুকেও মার্ডার বলার উপায় নেই, লোকগুলোকে প্রোটেকশন দেওয়ারও উপায় নেই! সন্দেহ অবধিই করা যায়, কোনো প্রমাণ নেই। লোকগুলো শুধু মরেইনি, প্রচণ্ড ভয়, যন্ত্রণা পেয়ে মরেছে। গুলি করে মারলে তো অনেক সহজ মৃত্যু হত। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে ভয় পেতে পেতে মরা যে কী যন্ত্রণাদায়ক তা শুধু ভুক্তভোগীই জানে। শর্বাণীর মৃত্যুটা অবধি বুঝেছি, কিন্তু এখানে এসেই থমকে যেতে হচ্ছে। কারণ উমার হিমোফোবিয়া থাকলেও আবীর এবং সৌরীশের কোনও ফোবিয়া আছে বলে জানা নেই।’

‘হয়তো ওদের কোনো ফোবিয়া নেই স্যার।’

অর্ণবের কথায় আলগোছে মাথা নাড়ল অধিরাজ, ‘উঁহু। কোনো না কোনো ফোবিয়া আছেই। নয়তো সৌরীশ ব্যান্ডের নাম ফোবিয়ান্স রাখতেন না।’

অর্ণব অবাক। ব্যান্ডের নামের সঙ্গে ফোবিয়ার কী সম্পর্ক!

‘সৌরীশের নামকরণের ধাঁচটা লক্ষ্য করেছ?’ সে এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলে, ‘যেটা যে জিনিস, নামকরণও তদনুরূপ। জুতোর নাম ‘জুতুয়ারাম’, ঝাঁটার নাম ‘ঝাঁটুচরণ’, ছাতার নাম ‘ছাতুমণি’! যে এমন অর্থপূর্ণ নাম রাখে সে কি ব্যান্ডের নাম যা খুশি তাই রাখবে? আমার ওঁর এই স্বভাবটা দেখেই সন্দেহ হয়েছিল। দুনিয়ায় এত কিছু থাকতে উনি ব্যান্ডের নাম ফোবিয়ান্স রাখলেন কেন?’

‘হয়তো ওরা প্রত্যেকেই মূর্তিমান ফোবিয়া—তাই।’

অর্ণবের কথার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল অধিরাজ, ‘অথবা এদের প্রত্যেকের কোনো না কোনো ফোবিয়া আছে। সেজন্যই ব্যান্ডের নাম ফোবিয়ান্স। অন্তত সাতজনের মধ্যে পাঁচজনের ফোবিয়া আছে। বাকি দু-জনেরও হয়তো আছে, কিন্তু ওঁরা চেপে গিয়েছেন।’

‘মাই গুডনেস!’

অধিরাজ চিন্তিত স্বরে বলে, ‘কিন্তু এই বোগার্টটি কে, এবং কীভাবে কাজ হাসিল করছে, সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না! সে কী করে এদের প্রত্যেককে ভয়ের মুখে দাঁড় করাল সেটাও অজানা! মোডাস অপারেন্ডি কী তা এখনও জানা নেই। কেন করছে, তাও জানি না! সত্যিই কি রিভেঞ্জ… না অন্যকিছু…!’

সে নিজের মনেই বিড়বিড় করে অঙ্ক মেলানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু তার চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে দিয়ে সেতারের ঝঙ্কারে দেশ রাগ বেজে উঠল। অধিরাজ দেখল ডঃ চ্যাটার্জি ফোন করছেন।

‘হ্যালো।’

ওপ্রান্ত থেকে পাতলা রিনরিনে স্বর ভেসে এল, ‘অফিসার ব্যানার্জি?’

অধিরাজ মুখ টিপে দুষ্টু হাসি হাসে, ‘এ কী ডক! আপনার গলার কী হল! বাঘের গলা এমন মিকি মাউসের মতো শোনাচ্ছে কেন?’

ওপ্রান্তের স্বর রাগে ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে, ‘আমার গলা মিকি মাউসের মতো!’

‘সরি… সরি…।’ মনে মনে হেসে বলল সে, ‘মিনি মাউস বলা উচিত ছিল বোধহয়।’

ওপ্রান্তের ফোনটা হস্তান্তরিত হল। সম্ভবত আগের মানুষটির প্রেস্টিজে লেগেছে। এবার প্রকট হল ডঃ চ্যাটার্জির হেঁড়ে গলা, ‘তুমি কি কিছুতেই ফিচলেমি করা ছাড়বে না! এমনিতে তো হনুমান-জাম্বুবানের জুটি মিস মুখার্জিকে মিস করে সবসময়। আর যেই মিস মুখার্জিকে ফোনটা দিয়েছি অমনি চ্যাংড়ামি শুরু করেছ।

‘আচ্ছা!’ অধিরাজ বলল, ‘এই মুখে কুলুপ আঁটলাম।’

‘দ্যাটস বেটার।’

ডঃ চ্যাটার্জির গলায় এবার সিরিয়াসনেস, ‘এবার যা বলছি মন দিয়ে শোনো। বনোয়ারিলালকে জ্যান্ত পাওয়ার সম্ভাবনা কম।’

এ রকম একটা ধারণা অধিরাজের আগেই হয়েছিল। সে চুপ করে ডঃ চ্যাটার্জির কথা শুনছে।

‘ওর ঘর থেকে যেসব জিনিসপত্র তোমরা নিয়ে এসেছ তাতে বিশেষ ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই। এমনকি মদের বোতলেও কোনো আঙুলের ছাপ নেই। এটা প্রায় অসম্ভব। বোতলটা থেকে কিছুটা খাওয়া হয়েছে। আর কারোর না থাক বনোয়ারিলালের ফিঙ্গারপ্রিন্ট থাকা উচিত। কিন্তু কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্টই পাওয়া যায়নি!’

‘তার মানে কেউ ফিঙ্গারপ্রিন্ট মুছে দিয়েছে।’

‘এগজ্যাক্টলি। বোতলের তরলে কোনো কিছু পাওয়া যায়নি। তবে অত্যন্ত ফাইন কোয়ালিটির মদ। ভিন্টেজ বলা যেতে পারে। এত দামি পানীয় ও পেল কী করে সেটাই আশ্চর্য। এ সব অত্যন্ত শৌখিন মানুষের কালেকশন ছাড়া থাকে না। ‘

‘ওকে। আগে?’

‘আসল গেরোটা হল নোটের বান্ডিলে।’

কথাটা শুনেই অধিরাজ উত্তেজিত হয়ে ওঠে, ‘নোটের বান্ডিলে কিছু আছে?’

‘ঠিক নোটে আছে বললে ভুল হবে। নোটগুলো যে পিন দিয়ে আটকানো আছে তাতেই আসল কেরামতি’। ডঃ চ্যাটার্জি বললেন, ‘মালটা টাকা খেল ঠিকই, কিন্তু হজম করতে পারল না!

‘মানে!’

‘আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যে হয়তো নোটগুলোর মধ্যে কিছু আছে। কিন্তু নোটে কিছুই পাওয়া যায়নি। তখন একবার পিনগুলোও পরীক্ষা করে দেখলাম। পিনগুলোয় পটাশিয়াম সায়ানাইড লাগানো আছে!’

‘হো—য়া—ট!’

অধিরাজ স্তম্ভিত! খুনীর মস্তিষ্ক কী অদ্ভুত উপায়ই না বের করেছে! সবাই ভাববে যে নোটগুলো বিষাক্ত। কিন্তু নোটের পিনেই যে আসল কারিকুরি তা কারোর মাথাতেই আসবে না। নেহাৎ ডঃ চ্যাটার্জি পরীক্ষা করে দেখেছেন!

‘নোটের পিনগুলো এমনভাবে উঁচিয়ে রয়েছে যাতে টাকা গোনবার সময়ে হাতে ফুটে যায়। একটা পিনে ব্লাড ট্রেসও আছে। সম্ভবত রক্তটা বনোয়ারিলালের। খুব স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুযায়ী হাতে পিন ফুটে গেলে, রক্ত বেরিয়ে এলে লোকে আঙুলটা মুখে পুরে দেয়। বনোয়ারিও নির্ঘাৎ দিয়েছিল। তারপরের ঘটনা সহজেই অনুমেয়।’

‘কিন্তু আমরা ওর ঘরে কোনো লাশ পাইনি।’

‘সেটা তো আমি বলতে পারব না।’ ডঃ চ্যাটার্জি একটু থেমে বললেন, তবে আরও একটা অদ্ভুত জিনিস পাওয়া গিয়েছে।’

অধিরাজ কোনো উত্তর দিল না। সে দমবন্ধ করে ডঃ চ্যাটার্জির কথা শুনছে। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ জানালেন, ‘বনোয়ারির জামা কাপড়ে, জিনিসপত্রে গুঁড়ো গুঁড়ো মাটি পাওয়া গিয়েছে। আশ্চর্য বিষয় যে সেই মাটিতে নাইট্রোজেন, ফসফরাস আব পটাশিয়ামের মিশ্রণ আছে। জিঙ্ক এবং আরও কিছু মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টসের ট্রেন্সও আছে।’

‘এর মানে কী?’

‘এর মানে হল বনোয়ারির ঘরে, জামা কাপড়ে যে মাটি আছে তার সঙ্গে ফার্টিলাইজার মিশে আছে। নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম আর মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টসের কম্বিনেশন মূলত ফার্টিলাইজারেই থাকে।’

‘আন্ডারস্টুড বস।’

অধিরাজ ফোনটা কেটে দিয়েই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল অর্ণবের দিকে, অর্ণব, বনোয়ারির ঘরের আশেপাশে কোনো বাগান আছে?’

‘বাগান!’ অর্ণব একটু ভেবে নিল, ‘ফুলের বাগান নেই। তবে বনোয়ারির ঘরের পেছনে এক চিলতে সবজি বাগান আছে। নানারকম শাক, লাউ, কুমড়ো, টম্যাটো আর লঙ্কার গাছ দেখেছি।’

‘ফ্যান্টাস্টিক।’

উত্তেজনায় অর্ণবের পিঠ দমাস করে চাপড়ে দিল অধিরাজ। ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘চলো, অর্ণব। এখনই বনোয়ারির বাড়ি যেতে হবে।’

‘এখন!’ প্রায় আকাশ থেকে পড়ল অর্ণব, ‘কিন্তু…!’

‘কোনো কিন্তু নয়।’ সে দ্রুতভঙ্গিতে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘পবিত্র, মিস দত্ত আর মিস বোসকেও বনোয়ারির বাড়িতে চলে আসতে বলো। আমি জানি বনোয়ারিলাল কোথায় আছে।’

অর্ণব লক্ষ্য করল অধিরাজের চোখদুটো উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে। কথাবার্তায় উত্তেজনা প্রকট। সে নম্রস্বরে বলল, ‘ওকে স্যার।’

(১২)

মানুষটা চুপ করে অন্ধকারের মধ্যে মুখ গুঁজে বসেছিল।

অন্ধকারকে তার বড্ড ভয়। নীরব ঠান্ডা আঁধারের গর্ভে কত কিছু যে লুকিয়ে থাকে তার ইয়ত্তা নেই। কখনও কখনও কিছু ছায়া ছায়া অস্তিত্ব ভিড় করে দাঁড়ায় চতুর্দিকে। যেন তারা কিছু বলতে চায়। বুঝি তাদের কোনও অভিযোগ আছে! কঙ্কালসার আঙুল তুলে তার দিকে নির্দেশ করে ওরা। কখনও বা হাতছানি দিয়ে ডাকে। ভাবটা এমন, যেন বলছে, ‘চলে এসো, তুমিও চলে এসো! এখানে কোথাও কোনো ভয় নেই। কেউ তোমাকে ভয় দেখাতে পারবে না।’

কোথায় যেন কর্কশ স্বরে একটা পাখি ডেকে উঠল। বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল তার। কেমন যেন একটা ভয়-ধরানো ডাক! হঠাৎ করে শুনলে মনে হয় কোনো অতৃপ্ত আত্মা বুঝি বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েছে। অন্ধকার যেন এবার ঘন হয়ে এসে জড়িয়ে ধরল। এমন অন্ধকারে দমবন্ধ হয়ে আসে তার। বুকের ওপর যেন কেউ কয়েকমণ পাথর চাপিয়ে দিয়েছে। আঃ, বড় কষ্ট! বড় অন্ধকার! বড় একাকীত্ব!

‘ডেয়ার অর ডাই! ডেয়ার অর ডাই…!’

অস্ফুটে শব্দগুলো বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল সে। সাহস অথবা মৃত্যু! এই দুনিয়া ভীতু, কাপুরুষদের জন্য নয়। জীবন অত্যন্ত সযত্নে তাকে এই পাঠ শিখিয়েছে। প্রতি পদক্ষেপে সে বুঝেছে, বাঁচতে গেলে সাহসী হতে হবে। আর যারা ভয় পায়, তাদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই! এই মুহূর্তে ভয় করছিল তার। ভীষণ ভয়! আশে পাশে বহু অনাকাঙ্ক্ষিত ছায়ার উপস্থিতি টের পাচ্ছিল। ও টের পাচ্ছিল অনেকগুলো ফ্যাকাশে মুখ তার চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা অপেক্ষায় আছে। ওরা ডাকছে তাকে। বারবার ফিসফিস করে বলে যাচ্ছে, ‘চলে এসো… চলে এসো…!’

তার সামনে অনেকগুলো পুতুল পড়ে আছে। চকচকে ঝকঝকে পুতুল। কোনোটা বার্বি, কোনোটা কাউ বয় ডল, কোনোটা আবার স্পাইডারম্যান। তার ঠিক পাশেই লাফিং বয় বেবি ডল। স্পর্শ করলেই খিলখিল করে হেসে ওঠে। ঠিক যেমন শৈশবে সুরেলা হাসির ঝংকার দিয়ে উঠত সে, অবিকল তেমন করেই হাসে পুতুলটা। শৈশব! বড় সুন্দর সময়! একেবারে নির্ভীক, নিশ্চিন্ত জীবন। দুনিয়ায় ভয় বলে যে কোনো বস্তু আছে তা মনেই হত না।

ভাবতেই তার ভুরুতে ভাঁজ পড়ল। সত্যিই কি তাই? ছোটোবেলায় কি সত্যিই কোনো ভয় ছিল না? তখনও তো অন্ধকারকে ভয় পেত সে। মা যখন ঘরের আলো বন্ধ করে দিতেন, তখন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে থাকত। ভয়ে ঘুম আসত না। মনে হত, ঘরের মধ্যে সতর্ক পা ফেলে কারা যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে! এই বুঝি খাটের তলার অন্ধকারটা জীবন্ত হয়ে উঠল! অথবা রাতের প্রেক্ষাপটে একজোড়া জ্বলন্ত চোখ আড়াল থেকে জরিপ করে নিচ্ছে তাকে!

সে আস্তে আস্তে বার্বি ডলটাকে তুলে নিল। পুতুলটার মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল। এমন একটা পুতুল নিয়েই সোমের সঙ্গে তার ঝগড়া হয়েছিল। সোমকে সে ভয় পেত। অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় অনেকটাই লম্বা চওড়া সোম বুলিং করতে খুব ভালোবাসত। সহপাঠী বা সহপাঠিনীকে কীভাবে চাপে রাখতে হয় তা শৈশবেই শিখে গিয়েছিল সে। প্রায় রোজই যে কোনো একটি দুর্বল শিশুকে বেছে নিয়ে তার ওপর অত্যাচার করত। কখনও কারোর টিফিন কেড়ে নিয়ে খেয়ে নিত, কখনও বা কোনো কারণ ছাড়াই মারপিট করত। ছোটোবেলায় গুন্ডাগিরি কাকে বলে তা জানা ছিল না। নয়তো সোমের কার্যকলাপকে সে গুন্ডাগিরি বলে শনাক্ত করতে পারত।

ছোটোবেলায় একটা বিশেষ পুতুল বড়ো প্রিয় ছিল তার। পুতুলটার মাথায় এমনই থোকা থোকা কোঁকড়া কোঁকড়া চুল ছিল। ঝলমলে নীল দুটো চোখ, বড়ো বড়ো ও ঘন অক্ষিপল্লব নিয়ে সরল বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকত পুতুলটা। সে পুতুলটার নাম দিয়েছিল ‘পলি’। পলিই ছিল তার একমাত্র বন্ধু। পলির অন্যতম গুণ ছিল সে কিছুতেই বিরক্ত হত না। দুনিয়ার সব গল্প তার সঙ্গে করা যেত। যখন খুশি কথা বলার একমাত্র সঙ্গী। পলি বিন্দুমাত্রও বিরক্তি প্রকাশ করত না। একবারও বলত না, ‘এখন শুনব না। পরে হবে।’ বাবা-মায়ের মতো ধমকও দিত না। একা জীবনে একমাত্র সঙ্গী ছিল পলি। তার সঙ্গে খোশমেজাজে গল্প করা যেত, তার চুল নিয়ে নানারকম স্টাইল করা যেত। এমনকি খেলাও যেত। পলি কখনও বারণ করত না, কোনো কিছুতে বাধা দিত না।

সেই পলিকে নিয়েই একদিন ঝামেলা বাঁধল। সোম তার দশাসই চেহারাটা নিয়ে সেদিন ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। খপ্ করে পলিকে এক ঝটকায় কেড়ে নিয়ে বলেছিল, ‘এটা আমার!

তখন কারোর এত সাহস ছিল না যে ওর কথার প্রতিবাদ করবে! সবাই জানত সোমের বিরুদ্ধে কোনো কথা বললেই চড়, থাপ্পড়, ঘুষির বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে। সোম বিনা কারণেই অন্যের গায়ে হাত তুলতে ভালোবাসত। তাই তাকে মারার একটা যুৎসই কারণ দিতে সকলেই নারাজ ছিল।

সে ভীরু দু-চোখ তুলে বলেছিল, ‘পলি আমার বন্ধু। আমি ওকে দেব না। ‘

‘পলি!’ সোম হেসে উঠেছিল, ‘পুতুল আবার বন্ধু হয় না কি!’

‘ও আমার বন্ধু।’ ও দৃঢ়স্বরে বলে, ‘ওকে দিয়ে দে। নয়তো আমি তোর বাবা-মাকে বলে দেব।’

‘বাবা-মাকে বলবি!

তার নরম গালে সজোরে এসে আছড়ে পড়েছিল একটা জোরালো চড়। টাল সামলাতে না পেরে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ল সে। মাটিতে কপাল ঠুকে গেল। ঠোঁটের কোণে রক্তের নোনতা স্বাদ! সে ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে। সোম তার চুলের মুঠি ধরে মাটিতে কপাল ঠুকতে ঠুকতে বলল, ‘বাবা-মাকে বলবি? কী বলবি? দাঁড়া, মজা দেখাচ্ছি!’

আশেপাশের বিমূঢ় ভিড় নিঃশব্দে এই দৃশ্য দেখছিল। কেউ সামান্য সাহায্য করতে এগিয়েও আসেনি। সবাই যেন পাথরের মূর্তিতে পরিণত হয়েছে। অথবা ওরাও সব পুতুল! প্রতিবাদ করা তো দূর, কারোর মধ্যে এতটুকুও সাহস ছিল না যে সোমের বিরুদ্ধে টু শব্দটিও করবে। সে কাঁদতে কাঁদতে সেই মূঢ় ভিড়ের মধ্যে একটা সহৃদয় চোখ খুঁজছিল। একটা মানুষ, যে বলবে, এটা অন্যায়। কিন্তু সেখানে তেমন কেউ ছিল না! কেউ না!

‘এটা তোর বন্ধু না?’

রাগে হিসহিসিয়ে উঠেছিল সোম। সে ব্যথিত দৃষ্টিতে দেখল পলির ঘাড় মুচড়ে মাথা টেনে ছিঁড়ে ফেলল ছেলেটা! তার চোখদুটো কী হিংস্র! প্রতিশোধস্পৃহায় বাঘের মতো জ্বলছে! সমস্ত আক্রোশ পুতুলটার ওপর মিটিয়ে দু-টুকরো করে ছুঁড়ে ফেলে দিল মাটিতে! পলির নিষ্পাপ দেহটা গড়াগড়ি খাচ্ছে ধুলোয়!

তার পেটে এক লাথি কষিয়ে দিল সোম, ‘নে, এবার বন্ধুকে নিয়ে বাড়ি যা!’

ভিড়ের মধ্য থেকে হাসির শব্দ ভেসে এল। এই নিষ্ঠুরতায়ও কারোর হাসি পায়! সে কোনোমতে উঠে বসল। পরনের জামা ধুলোয় ম্লান! কপালে কালশিটে পড়েছে। ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে। পলির দিকে তাকিয়ে চোখ ভিজে এল। ওর মাথাটা একদিকে, ধড়টা আরেকদিকে। একদিকের চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এতদিনের আদরের, যত্নের বস্তুটা মুহূর্তের মধ্যেই ছিন্নভিন্ন। এখন কার সঙ্গে কথা বলবে সে? কার সঙ্গে গল্প করবে?

সেদিন সোমের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলেনি। সে-ও আর কথা না বাড়িয়ে নিজের একমাত্র বন্ধুর শবদেহ নিয়ে ফিরেছিল বাড়িতে। মনে মনে ইচ্ছা করছিল ফেটে পড়তে! সম্ভব হলে সোমকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলত। ওর সমস্ত দত্ত মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার প্রবল ইচ্ছেকে মনে দমন করেছিল। কারণ সোমের সঙ্গে লড়ার ক্ষমতা তার ছিল না। সোমকে সে ভয় পেত। ওর বন্য স্বভাবকে ভয় পেত জানত লড়াই করে পেরে উঠবে না!

তার শিশুমনে তখন থেকেই ভয়ের প্রতি একটা ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। যারা ভয় দেখায় তাদের সে মনে প্রাণে ঘৃণা করত। কিন্তু সরব হওয়ার সাহস ছিল না। চিরকালই তার রাগ, ক্ষোভ অবদমিত!

সে আস্তে আস্তে পুতুলটার কোঁকড়া কোঁকড়া চুলে হাত বোলায়। আজ সোম কোথায় আছে কে জানে! হয়তো ছোটোবেলার গুন্ডামির কথা তারও মনে নেই! হয়তো আর পাঁচটা সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতোই হাসিখুশি জীবন কাটাচ্ছে। হয়তো সেই হিংস্র স্বভাবের ছেলেটা আজ ভীষণ ভদ্র, নম্র। কিন্তু তার ছোটোবেলার ক্ষততে প্রলেপ লাগবে কী করে? একবার সোমের মুখোমুখি দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে একবার জানতে, কী সুখ পেত সে সবাইকে অমন ভয় দেখিয়ে! সবাইকে মেরেধরে, কষ্ট দিয়ে কোন্ আনন্দ পেত!

আচমকা লাফিং ডলটা খিলিখিলিয়ে হেসে উঠল। কোথাও কিছু নেই, পুতুলটা হঠাৎই হাসতে শুরু করেছে। তার মনে হল লাফিং ডল আড়চোখে তার দিকেই দেখছে। ওর চোখদুটো তার ওপরেই নিবদ্ধ! কেউ এসেছে! ওকে কেউ স্পর্শ করেছে! কিন্তু কে! এই অন্ধকারে যে কাউকে দেখা যায় না! সে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, ‘কে?’

কোনো উত্তর নেই। শুধু একরাশ ঠান্ডা হাওয়া তাকে স্পর্শ করে গেল। পুতুলটা হাসতে হাসতেই হঠাৎ থেমে গেল। এখন চতুর্দিকে অখণ্ড নীরবতা! সে অনুভব করল কেউ যেন তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে! ভীষণ ভয়ে তার বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। কে এল! আবার কে এল তাকে ভয় দেখাতে! সৌমিত্র? মৃন্ময়? উৎপল? না শর্বাণী? ওদের মধ্যে কে আবার ফিরে এল! ওদের তো ফেরার কথা নয়!

একটা অস্ফুট কান্নার শব্দ! কে যেন গুমরে গুমরে কাঁদছে! সে উৎকর্ণ হয়ে শব্দটা শোনে। কোথা থেকে আসছে এই কান্নার আওয়াজ! মেঝের ওপরে কান পেতে শোনার চেষ্টা করে। কে কাঁদে! চতুর্দিকে অন্ধকার। তার ভেতরেই কান্নার শব্দ মাথা কুটে মরছে। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চতুর্দিকটা জরিপ করে নেয়। তার মনে হল, হাতের মধ্যে পুতুলটা যেন আকস্মিকভাবে নড়ে উঠল!

‘তুমি আমাকে ভয় দেখাতে চাও!

অস্ফুট স্বরে বলল সে, ‘তুমি আমায় ভয় দেখাতে চাইছ, তাই না?’

এবারও কোনো প্রত্যুত্তর নেই। উলটে লাফিং ডলটা খলখল করে হেসে উঠল। এমনভাবে হেসে উঠেছে সে যেন দুনিয়ার সমস্ত রহস্য জানে। সমস্ত ভয়ের উৎসের খবর তার জানা আছে।

সে মাথা ঝাঁকায়! সত্যিই কি লাফিং ডলটা হাসছে না আবার ভুল শুনছে ও! পুতুলটা তাকে ভয় দেখাতে চায়? কিন্তু কেন? ওর সঙ্গে তো কোনও শত্রুতা নেই! তবে কীসের শোধ তুলতে চায়! চারজন তো গেল। এখন আরও তিনজন বাকি! আর ভয় দেখানোর কেউ থাকবে না। সব শেষ হয়ে যাবে। সব শেষ…!

ও আস্তে আস্তে পুতুলের মুখে হাত বোলায়, ‘তুমি আমাকে ভয় দেখাতে পারো না।

কারণ তুমি দুর্বল! তুমি আমার সঙ্গে লড়াই করতে পারবে না!’

বলতে বলতেই তার মুখে একটা কুটিল হাসি ভেসে ওঠে। পরক্ষণেই মট্ করে একটা শব্দ!

পুতুলটার মাথাটা ধড় থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে!

(১৩)

তখন বেশ রাত হয়ে এসেছে।

আলতো আলতো ধোঁয়াশা চতুর্দিকে ছেয়ে আছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। শুধু একটানা ঝিঁঝিঁর ডাক শোনা যায়। আর মাঝেমধ্যে পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ, কখনও কখনও বা একটা দুটো পাখির ডাকও কানে আসছে। তাও যেন বড় সন্ত্রস্ত। যেন ভারী ভয়ে ভয়ে ডাকছে। চারিদিকে কেমন যেন থমথমে ভাব। যেন এখনই কিছু একটা ঘটবে! বুঝি আসন্ন প্রলয়ের আশঙ্কায় স্থির হয়ে আছে গোটা পৃথিবী।

চাঁদের আলো পূর্ণ প্রভায় উপছে পড়ছে। আশেপাশের বাড়িগুলোর মাথায় রুপোলি জ্যোৎস্না পড়ে কেমন যেন এক মায়াময় ছবি তৈরি করেছে। বড়ো বড়ো গাছগুলোকে মনে হচ্ছে এক বিশালকায় দৈত্য! রাতের নেশায় যেন তারাও ঘুমিয়ে আছে। শিরশির করে গাছের পাতা মৃদু মৃদু হাওয়ায় দুলছে। ফটফটে জ্যোৎস্নায় পৃথিবীটাকে কেমন যেন অলৌকিক মনে হয়। মনে হয়, শুধু মানুষ নয়—আরও অনেক কিছুর অস্তিত্ব আছে এই পৃথিবীতে। তাদের দেখা যায় না—অনুভব করা যায়

এই আলো-আঁধারি পরিবেশেই দাঁড়িয়েছিল ওরা পাঁচজন। বনোয়ারিলালের বাড়ির পিছনদিকে এক চিলতে জমি আছে। সেখানেই পরিপাটি করে কে যেন সবজি বাগান করেছে। হয়তো বনোয়ারিরই কীর্তি। লাউ, কুমড়োর পাশাপাশি কাঁচালঙ্কা, টম্যাটো, পুঁইশাকও চোখে পড়ল। একপাশে কলাগাছে বড় মোচা ধরেছে। একটা লেবুগাছও আছে উলটোদিকে। তার গন্ধে চারিদিক মাতোয়ারা!

‘আমরা কি এখানে ফ্রেশ স্যালাড খেতে এসেছি রাজা?’

পবিত্রর কথা শুনে মিষ্টি হাসল অধিরাজ, ‘তাও ভালো বলোনি যে বাজার করতে এসেছি কি না!’

‘বলো তো সেটাও করে ফেলি।’ পবিত্র মুখ ব্যাজার করেছে, ‘দুঃখের বিষয় যে বাজারের ব্যাগটা বাড়িতেই ফেলে এসেছি। তুমি এরকম ভেজিটেব্‌ল্ গার্ডেনে বেড়াতে নিয়ে আসবে জানলে ব্যাগটা নিয়েই আসতাম।’

অধিরাজের হাতে টর্চটা দপ্ করে জ্বলে ওঠে। সে পবিত্রর কথায় কান না দিয়ে আশেপাশের জমি জরিপ করছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করছে এই সবজি বাগানে কোথাও মাটি খোঁড়া আছে কি না। কিংবা কোনো জায়গার মাটি সদ্য ফেলা হয়েছে কি না!

অধিরাজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি টর্চের আলোর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখানেই আশেপাশে কোথাও সামান্য চ্যুতি থাকা উচিত। এই সবজি বাগানের মধ্যেই রহস্যটা লুকিয়ে আছে। কিন্তু কোথায়?

‘স্যার…!’

মিস্ বোসের কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা, ‘ঐ দেখুন।’

তার অঙ্গুলিনির্দেশ লক্ষ্য করে ওরা সবাই দেখল কলাগাছের ঠিক সামনের মাটিটা কেমন যেন এবড়ো খেবড়ো। দেখলে মনে হয় সম্প্রতিই খোঁড়া হয়েছে। আশেপাশে ঘাস থাকলেও ঐ বিশেষ জায়গাটা একেবারেই ন্যাড়া। কোনো ঘাসই নেই। সম্ভবত এটাই সেই জায়গা!

‘গ্রেট জব সেনোরিটা!’ অধিরাজ হাতে গ্লাভস পরতে পরতে বলল, ‘লেটস্ ডু ইট।’ অধিরাজের প্রশংসা পেয়ে মিস বোসের কর্ণমূল আরক্ত হয়ে ওঠে। আত্রেয়ী অর্থ পূর্ণ হাসি হেসে অর্ণবের দিকে তাকায়। অর্ণব তার উত্তরে মৃদু হেসে ইঙ্গিতে তাকে

গ্লাভস পরে নিতে বলল।

ওরা সঙ্গে কোদাল, শাবল ইত্যাদি নিয়েই এসেছিল। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে অধিরাজ, অর্ণব এবং পবিত্র কোদাল তুলে নিয়েছে। অধিরাজ কৌশানী বোসের হাতে টর্চটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনি ওদিকে গিয়ে দাঁড়ান। আমরা দেখছি।’

তিনজন পুরুষ অফিসার নিঃশব্দে মাটি খুঁড়ছে। একদম অভ্যস্ত, দ্রুত হাতে কোদাল চালাচ্ছে। মাটি কাটার সামান্য শব্দটুকুও শোনা যায় না। আত্রেয়ীর বুকের মধ্যে ধুকপুক করে। যার খোঁজ চলছে, তা কি আদৌ পাওয়া যাবে?

বেশ কিছুক্ষণ মাটি কাটা পর্বই চলল। অধিরাজের মুখ, কপাল বেয়ে টপটপ করে ঘামের ফোঁটা পড়ছে। অর্ণবও ঘেমে নেয়ে একসা হয়েছে। ওরা তিনজনে মিলে অনেকটা মাটিই খুঁড়ে ফেলেছে। তা সত্ত্বেও এখনও কিছুই পাওয়া যায়নি। শুধু মাটি কাটাই সার। অর্ণবের হতাশ লাগছিল। এটাও কি ওয়াইল্ড গুজ চেজ চলছে! স্যারের সন্দেহ আদৌ কি সঠিক! সত্যিই কি মাটির নীচে কিছু পাওয়া যাবে?

তবুও ওরা বিনাবাক্যব্যয়ে খুঁড়ে যেতেই থাকে। কৌশানী একদৃষ্টে অধিরাজের দিকেই তাকিয়েছিল। খেয়াল করেনি যে টর্চের আলোটা তারই মুখে পড়ছে। অধিরাজ বিরক্ত, ঘর্মাক্ত মুখ তুলে তাকায় কৌশানীর দিকে, ‘টর্চের আলোটা আমার মুখে না ফেলে মাটির দিকে ফেলুন মাদমোয়াজেল!’

মিস্ বোস একরকম জিভ কেটে আলোটা তার নির্দেশমতোই একটু এগিয়ে ফেলল। তারপর নীরবেই নিজের রুমালটা এগিয়ে দিল তার দিকে।

‘থ্যাঙ্কস।’

অধিরাজ তার ঘামে ভেজা মুখ রুমালে মুছল। তারপর রুমালটা আবার ফিরিয়ে দিল মিস বোসকে। কৌশানী অধিরাজের হাতের স্পর্শসুখটুকু তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে। আত্রেয়ীর ঝকঝকে কালো চোখে কৌতুক উপছে পড়ল। সে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে! অর্ণব মনে মনে প্রমাদ গোণে। মিস দত্ত এমনিতেই একটু বেশিই বুঝদার। তার ওপর কৌশানী বোস আহেলি বা আইভি’র মতো লাজুক নয়! আজ আত্রেয়ী বুঝেছে, কাল গোটা হোমিসাইড বুঝবে!

আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল। কোদালের মাটি কাটার ঝুপঝুপ আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। ঝিঁঝিঁরাও আচমকা চুপ করে গিয়েছে। যেন তারাও কোনো ঘটনার অপেক্ষায় রয়েছে! দুই লেডি অফিসারের হাতের টর্চ থেকে আলো এসে পড়ছে মাটির ওপরে। দেখতে দেখতে রীতিমতো লম্বা চওড়া গর্ত খোঁড়া হয়ে গেল, কিন্তু এখনও কোনো কিছুরই দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।

‘আমরা এখানে প্রত্নতত্ত্ববিভাগের মতো মাটি খুঁড়ে মরছি, আর শালার ব্যাটা শালা বনোয়ারি কোথায় শুয়ে গাছে সার দিচ্ছে তা ভগাই জানে!’ পবিত্র বিরক্ত হয়ে উঠেছে।

অধিরাজ একটু হতাশ ভঙ্গিতেই হাতের কোদালটা সরিয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য বিশ্রাম নিতে দাঁড়াল। তার চোখে বিভ্রান্তি। এত বড় ভুল হল! ডঃ চ্যাটার্জি যে লিডটা দিলেন তার কি তবে কোনো অর্থই নেই? এতক্ষণের সব পরিশ্রম জলে গেল! হয়তো বনোয়ারি নিজেই বাগানের পরিচর্যা করে এসে ফার্টিলাইজার মাখা হাত দিয়ে জিনিস পত্র ছুঁয়েছিল! কিন্তু তাই বা কী করে হয়! ডঃ চ্যাটার্জি বলেছিলেন যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট মুছে দেওয়া হয়েছে। বনোয়ারি নিজে ফিঙ্গারপ্রিন্ট মুছতে যাবে কোন্ দুঃখে! মিলছে না! অঙ্কটা কিছুতেই মিলছে না!

একরাশ ঠান্ডা হাওয়া ফুরফুর করে ছুঁয়ে গেল তাকে। কোথাও বোধহয় বৃষ্টি হচ্ছে। হাওয়ায় বাষ্পের রেশ বেশি। অধিরাজ একটা শ্বাস টেনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ স্বরে বলল, ‘দরকার পড়লে আজ আমি গোটা সবজিবাগান খুঁড়ে দেখব, কিন্তু এত সহজে ছাড়ব না পবিত্র।’

‘গোঁয়ার আর কাকে বলে!’ পবিত্র মুখ ভঙ্গি করে, ‘চলো, কোদাল চালাই।’

কৌশানী একদৃষ্টে ওদের দিকে তাকিয়েছিল। তিনজনই প্রায় নাছোড়বান্দার মতো খোঁড়াখুঁড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। দু-পাশে জমে গিয়েছে মাটির স্তূপ। গর্তটা আরও গভীর হয়েছে, কিন্তু আদৌ কিছু পাওয়া যাবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। আশেপাশে কোথাও একটা কুকুর সশব্দে কেঁদে উঠল। তার বুকের মধ্যে ধ্বক করে ওঠে। কুকুরের কান্না বড় অলুক্ষুণে। তার ওপর এইরকম পরিবেশে শুনলে রীতিমতো ভয় লাগে। আশঙ্কা হয়, কোথাও কোনো অমঙ্গল ঘটতে চলেছে!

আত্রেয়ীও চুপচাপ ওদের দিকেই দেখছিল। আচমকা মাথার ওপরে একটা ঝটপট শব্দে চমকে উঠল। একজোড়া জ্বলন্ত চোখ ঠিক তার সামনে! সে আঁৎকে উঠে প্রায় চেঁচিয়েই উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই আগুনে চোখের মালিক সজোরে ডেকে উঠল! প্যাঁচা! আত্রেয়ী নিজেকে সামলে নিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। বাপ রে! কী ভয়টাই না পাইয়ে দিয়েছিল! তার বুক তখনও ধড়ফড় করছে। সে একটা গভীর শ্বাস টেনে নিজেকে সামলে নেয়!

‘স্ট—প!’, হঠাৎই মাটি কাটতে কাটতেই থমকে গেল অধিরাজ। উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল, ‘দাঁড়াও।’

তার নির্দেশে বাকি দু-জনও থেমে যায়। পবিত্র আর অর্ণব অবাক হয়ে অধিরাজের দিকে তাকায়, ‘কী হল!

অধিরাজ আস্তে আস্তে অঙ্গুলিনির্দেশ করে, ‘ওটা কী?’

অধিরাজের অঙ্গুলিনির্দেশ লক্ষ্য করে উপস্থিত চারজনই দেখল, গর্তের একপাশ দিয়ে একটা ধুলো কাদামাখা মানুষের তর্জনী উঁকি মারছে। যেন কেউ মাটির তলা থেকে ইঙ্গিত করতে চাইছে, ‘আমি এখানে আছি।’

‘মাই গড!’

মিস বোসের মুখ দিয়ে শব্দ দুটো বেরিয়েই গেল! স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে মাটির তলায় কেউ শুয়ে আছে। এবং সে লোকটির বনোয়ারিলাল হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল।

‘সাবধানে… সাবধানে অর্ণব।’

আবার শুরু হল খননকার্য। এবার একেবারে পূর্ণোদ্যমে। খুব সাবধানে কোদাল চালাচ্ছে ওরা যাতে মৃতদেহের গায়ে বিন্দুমাত্র আঁচড়টিও না পড়ে। দেখতে দেখতেই কিছুক্ষণের মধ্যে গোটা মানুষটার দেহ বেরিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গেই মাংস-পচা দুর্গন্ধও এসে ঝাপটা মারল নাকে। কৌশানী বোসের মনে হল এবার তার অন্নপ্রাশনের ভাত ও উঠে আসবে। অথচ তিন অফিসার কী নির্লিপ্ত! যেন কোনোরকম দুর্গন্ধ ওরা পাচ্ছেই না! সে অসহায় দৃষ্টিতে আত্রেয়ীর দিকে তাকায়। আত্রেয়ী ততক্ষণে মুখে মাস্ক পরে নিয়েছে। কোনো কথা না বাড়িয়ে সে কৌশানীর দিকে আরেকটা মাস্ক এগিয়ে দিল।

‘থ্যাঙ্কস আত্রেয়ী।’

আত্রেয়ীর চোখে চাপা হাসি ছড়িয়ে পড়ে। সে মৃদু স্বরে বলল, ‘ওয়েলকাম।’

‘তোলো… সাবধানে তোলো ওপরে।’

তিনজন অফিসার ধরাধরি করে লাশটাকে ওপরে তুলল। পবিত্র একটা রুমাল মুখে চাপা দিয়েছে। অর্ণব আর অধিরাজের মুখ ভাবলেশহীন। তাদের দেখে বোঝাই দায় যে আদৌ কোনোরকম গন্ধ তাদের নাকে যাচ্ছে কি না!

‘এটা কি বনোয়ারিলাল?’

পবিত্র’র কথায় ইতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল অধিরাজ, ‘নো ডাউট ইনিই। অর্ণবরা ওর বাড়ি থেকে যে যে এভিডেন্স নিয়ে এসেছিল তার মধ্যে একটা মোবাইলও ছিল। মোবাইলে ওর ছবি দেখেছি আমি। এটা বনোয়ারিলালেরই লাশ। তবু শনাক্তকরণের জন্য হসপিটালের লোকদের ডাকতে হবে। বাড়ির লোককেও খবর দিতে হবে!’

বলতে বলতেই সে হতাশ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকায়, ‘প্রথম রাউন্ডেই হেরে গেলাম আমরা। যার মস্তিষ্কই এর পেছনে থাক, সে বুঝতে পেরেছিল আমরা বনোয়ারি অবধি ঠিকই পৌঁছব। তাই আগেই সরিয়ে দিয়েছে।’

‘কিন্তু বনোয়ারির এখানে ফাংশন কী?’

পবিত্র’র প্রশ্নটা শুনে একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায় অধিরাজ, ‘বনোয়ারির ওপর মর্গের দায়িত্ব ছিল। যেদিন সৌমিত্র চৌধুরী মারা যান সেদিন সে নাইট ডিউটিতে ছিল। একটা জ্যান্ত লোক মর্গে ঢুকে গেল, আর সে কিছুই জানে না তা হতে পারে না! বনোয়ারিলাল কিছু জানত। অথবা হয়তো সৌমিত্রকে মর্গের ভেতরে সে-ই ঢুকিয়ে দিয়েছে।’

‘কিন্তু তাতে বনোয়ারির লাভ?’ পবিত্র অবাক, ‘ওর সঙ্গে তো ফোবিয়ান্সের কোনো সম্পর্কই নেই!’

‘টাকার সম্পর্ক আছে।’ অধিরাজ এবার হাঁটু গেড়ে বনোয়ারিলালের লাশের পাশে বসে পড়েছে, ‘অতগুলো টাকা ওকে কেউ এমনি এমনিই দেয়নি। বনোয়ারি বোড়ে মাত্র। এর পেছনের মস্তিষ্কটি অতি ধুরন্ধর। সে জানত টাকা দিয়েও বনোয়ারিকে হয়তো চুপ করানো যাবে না। তাই পিনে বিষ মাখিয়ে দিয়েছে।’

সে আস্তে আস্তে লাশের তল্লাশি নিতে থাকে। লাশের পরনে অতি মলিন একটা গেঞ্জি ও পাজামা। ধুলো-মাটিতে তা আরও ম্লান হয়ে গিয়েছে। পায়ে কোনো জুতো নেই। লোকটার সারা গায়ে চাপড়া চাপড়া মাটি। বডি বেশ খানিকটা ডিকম্পোজড়ও হয়েছে। লোকটার মৃত্যু-কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে দুঃখ হচ্ছিল অর্ণবের। কোথাও কিছু নেই, বেঘোরে মারা গেল মানুষটা! এমনিতে তার ঘর তল্লাশি করে যেটুকু বোঝা গেছে তাতে বনোয়ারির জীবন সাদামাটাই ছিল। ছাপোষা মানুষ বলতে যা বোঝায় সে তাই! কী করতে যে এই খুনোখুনির মধ্যে জড়িয়ে পড়ল কে জানে!

‘নাঃ, বডিতে কিছু নেই।’ তল্লাশি শেষ করে উঠে দাঁড়ায় অধিরাজ,’ফরেনসিককে খবর দাও। ওরা অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে লাশ নিয়ে যাক।’

‘ওকে স্যার।’

অর্ণব ডঃ চ্যাটার্জিকে ফোন করে আপডেট দিল। বুড়ো মহা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তোমাদের এতগুলো ফ্রেশ লাশে হচ্ছে না যে এখন মাটি খুঁড়ে যেখান সেখান থেকে লাশ খুঁজে বের করছ? বলি, রাজকুমারী কি কম পড়িয়াছে?’

বেচারি অর্ণব ঢোঁক গিলল। বলাই বাহুল্য সে শেষ লাইনটার মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারেনি। কোনোমতে মিনমিন করে বলল, ‘স্যার বললেন আপনাকে খবর দিতে…!’

‘স্যার তো বলবেনই।’ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ এবার সত্যি সত্যিই বাঘের মতো গর্জন করে উঠলেন, ‘ও ছোঁড়ার তো আমায় না জ্বালালে খাবারই হজম হয় না! আগের কেসটাতেও লাশের ছড়াছড়ি ছিল। এটাতেও তাই শুরু হয়েছে!’

মিনিট খানেক অধিরাজের বাপান্ত করে একটু ঠান্ডা হলেন ডঃ চ্যাটার্জি। তারপর বললেন, ‘ঠিক আছে। অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দিচ্ছি। তবে একটু সময় লাগবে বাপু। অ্যাম্বুলেন্সটা আমার শ্বশুরের নয়। ‘

‘ওকে স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ।’

অধিরাজ, অর্ণব, পবিত্র, মিস বোস আর মিস দত্ত ততক্ষণে চারদিকটা ভালো করে দেখে নিচ্ছে। যদি আশেপাশে কোনো ব্লু বা কোনো কিছু পাওয়া যায়। স্বাভাবিকভাবেই এটা এখন ক্রাইম সিন। ক্রাইমসিনের তল্লাশি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তাই ওরা তন্নতন্ন করে চারপাশটা খুঁজে দেখছিল। চতুর্দিক তখন রুপে ালি জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। তার মাঝেই কয়েকটা টর্চের তীব্র আলো মাটি ঘেঁষে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আশেপাশের ঝোপে বিন্দু বিন্দু আলো নিয়ে ঝিকমিক করে জোনাকি জ্বলছে। চতুর্দিকে ছায়া ছায়া অন্ধকার! সব মিলিয়ে অদ্ভুত অলৌকিক এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।

সবজিবাগানের উলটোদিকেই বেশ কয়েকটা বড়ো বড়ো গাছ। একটা প্রাচীন বটগাছ শিরা উপশিরা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শিকড়ের বিস্তার দেখলেই বোঝা যায় গাছটা বহু যুগ পুরনো। তার সামনে কিছু বুনো করমচা গাছের লাইন। বটগাছের পাশে অমলতাস, একটা বিরাট আমগাছও আছে। তার চতুর্দিকে নারকেল গাছ প্রান্তরেখা টেনে দিয়েছে। মাঝে মাঝে কিছু ছোটো ছোটো গুল্মের দেখা মেলে। তাতে নাম না জানা বুনোফুল ফুটে আছে।

অধিরাজ সতর্ক দৃষ্টিতে চতুর্দিকটা দেখে নিচ্ছিল। আচমকা তার মনে হল একটা ছায়া যেন সরীসৃপের মতো বটগাছের সুবিশাল দেহ’র পিছনে সরে গেল। সন্দেহে তার চোখ কুঁচকে গিয়েছে। তাকে ওভাবে তাকাতে দেখে অর্ণব জানতে চায়, ‘কী ব্যাপার?’

‘জানি না অর্ণব।’ তার কণ্ঠস্বরে একটু অস্বস্তি, ‘আমার কেমন যেন একটা আনক্যানি ফিলিংস হচ্ছে।’

‘আনক্যানি ফিলিংস?’

‘হ্যাঁ!’ সে আস্তে আস্তে বলল, ‘মনে হচ্ছে ঐ বড় বড় গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে আমাদের কেউ দেখছে।’

অর্ণব বিস্ময়ে হতবাক। এত রাতে কে এখানে দেখতে আসবে! আর তাদের ওপর নজরই বা রাখবে কেন! সে একটা ঢোঁক গিলে বলে, ‘দেখব স্যার?’

অধিরাজ ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তাকে কথা বলতে বারণ করে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখল পবিত্র, মিস্ বোস আর মিস্ দত্ত একটু দূরেই দাঁড়িয়ে টর্চের আলোয় ব্লু খুঁজছে। সে প্রথমে হাতের টর্চটা নিভিয়ে পিছনের পকেটে গুঁজে নেয়। তারপর অতি সন্তর্পণে নিজের রিভলভারটা বের করে এনে অর্ণবকে ইশারা করে। অর্ণবের হাতেও ফণা তুলল আগ্নেয়াস্ত্র। তারপর দু-জনেই পা টিপে আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় বটগাছটার দিকে।

এখন ওদের কারোর হাতেই টর্চ জ্বলছে না। কিন্তু ফটফটে সাদা জ্যোৎস্নায় প্রায় সবকিছুই স্পষ্ট দেখা যায়। তার মধ্যে ওরা দু-জন যেন দুই ছায়ামূর্তি। অধিরাজ লিড করছে, পেছনে অর্ণব। অর্ণবের বুক দুরু দুরু করছিল। কে লুকিয়ে আছে এই গাছপালার মধ্যে? সত্যিই কি কেউ লুকিয়ে আছে, না সেটা অধিরাজের কল্পনামাত্র! সচরাচর এরকম ভুল অধিরাজ করে না। সে যখন বলছে, তখন কেউ আছেই। কিন্তু সে কে? নিতান্তই এক কৌতূহলী দর্শক? না অন্য কেউ!

‘কুব!… কুব!… কুব…!

কোথায় যেন একটা রাতচরা পাখি ডেকে উঠল। বটগাছের তলায় যেতে না যেতেই পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ শুনতে পেল অর্ণব। চতুর্দিক এত নিস্তব্ধ যে নিজের নিঃশ্বাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছিল সে। ঝিঁঝিঁর কনসার্ট আবার শুরু হয়েছে। বটগাছটা মহাকায় প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মতো চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। তার পাতা খসে খসে পড়েছে মাটিতে। অধিরাজ তার ওপর দিয়েই অদ্ভুত নৈপুণ্যে নিঃশব্দ পায়ে এগোচ্ছে। অর্ণবও যথাসাধ্য পা টিপে টিপে এগোল। কোনোরকম আওয়াজ করা চলবে না এখন। সামনে পাতলা ধোঁয়াশার স্তর। কানে এখন শুধু শিশিরের শব্দ—টপ্‌ টপ্‌ টপ্প্‌…!

কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা। আরেকটু এগোতেই দু-জনেরই চোখে পড়ল জ্যোৎস্নার সাদা প্রেক্ষাপটে একটা রহস্যময় ছায়ামূর্তি আমগাছের পেছন থেকে উঁকি মারছে! ওরাই শুধু মূর্তিটাকে দেখেনি, মূর্তিটাও ওদের দেখেছে। সেকেন্ডের ভগ্নাংশের নিস্তব্ধতা। পরক্ষণেই মচর মচর করে পাতার শব্দ! আগন্তুক পালিয়ে যাচ্ছে!

‘এ–ই!’ চেঁচিয়ে উঠল অধিরাজ, ‘থা–ম! ‘

কিন্তু তার কথায় কোনো কাজ হল না! লোকটা থামে নি। বরং তীর বেগে সাঁৎ করে চলে গেল উলটো দিকে! শিকারী চিতার মতো এক লাফে টপকে গেল বটগাছের মোটা মোটা শিকড়। অধিরাজও তড়িৎগতিতে তার পশ্চাদ্ধাবন করে। সে-ও একটা পেলব লাফ মেরে সামনের সব বাধা এড়িয়ে গিয়েছে। তার পেছন পেছন অর্ণবও!

‘রা—জা!’

অধিরাজের কণ্ঠস্বর পেয়ে পবিত্ররাও সচকিত হয়ে উঠেছিল। এখন তাদের দু-জনকেই দৌড়তে দেখে ওরাও পিছু ধাওয়া করল।

‘থা—ম!’

আগন্তুক কিন্তু থামল না। উলটে তার গতিবেগ আরও বাড়ছে। সে বনোয়ারির বাড়িকে পিছনে ফেলে একটা কাঁচা মেটে রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে। তার পেছনে পাঁচ সি.আই.ডি অফিসার!

দৌড়তে দৌড়তেই লোকটাকে ভয় দেখানোর জন্য হাওয়ায় একটা ফায়ার করল অধিরাজ। আগন্তুক যেন এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই ফের ছুটতে শুরু করেছে। খাঁ খাঁ শূন্য রাস্তায় সে এক মরণপণ দৌড়! দাঁতে দাঁত চেপে গতিবেগ আরও বাড়াল আগন্তুক। তার হাবেভাবেই স্পষ্ট, এত সহজে ধরা দেবে না! চতুর্দিকে অন্ধকার ও শূন্যতা! সেই অন্ধকার গায়ে মেখেই তুমুল গতিবেগে ছুটে চলেছে লোকটা। পেছনে ধেয়ে আসছে সি.আই.ডি অফিসাররা। আর মাত্র কয়েক গজ দূরত্ব!

আত্রেয়ী ছুটতে ছুটতেই লক্ষ্য করল তার পাশ দিয়ে প্রচণ্ড স্পিডে ছুটে যাচ্ছে কৌশানী বোস। তার হাতে ততক্ষণে উঠে এসেছে রিভলভার। আবছা অন্ধকারেই ছুটন্ত লোকটির পা লক্ষ্য করে গুলি চালাল সে। নিস্তব্ধতা চিরে গর্জন করে উঠল তার হাতের আগ্নেয়াস্ত্র। কোথায় যেন কুকুরের পাল সেই আওয়াজে ভয় পেয়ে আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠল।

লোকটা যেন জানত এমনই কিছু একটা ঘটবে। সে দৌড়তে দৌড়তেই সরে গেল গুলির গতিপথ থেকে। আফসোসে ঠোঁট কামড়াল কৌশানী। সে আবার ফায়ার করতেই যাচ্ছিল তার আগেই অধিরাজ চেঁচিয়ে উঠল, ‘ডোন্ট শ্যুট! ডোন্ট শ্যুট!’

আগন্তুকের মাত্র কয়েক হাত পেছনেই রয়েছে অধিরাজ। সে গতিবেগ বাড়ায়। কিন্তু লোকটা যেন হাওয়ায় উড়ছে! কী স্পিড! সে লাফ মেরে কাঁচা রাস্তা থেকে নেমে পড়ল পাশের মাঠে। অধিরাজ ভেবে পায় না ও ঠিক কোথায় যাচ্ছে! এই মাঠটা ক্রস করলেই সামনে লোকালয়। একটা ঘিঞ্জি বস্তিও আছে। ও কি সেদিকেই যেতে চায়? অধিরাজ স্প্রিন্ট টানতে শুরু করে। এত সহজে ছাড়বে না লোকটাকে। তার স্পিড বাড়ছে… আরও বাড়ছে…!

লোকটার জোরে জোরে শ্বাস টানার শব্দ শুনতে পাচ্ছিল অধিরাজ। সে তাকে মেপে নেওয়ার চেষ্টা করে। মুখে মাস্ক থাকায় ওর মুখ দেখা যাচ্ছে না! আবছা অন্ধকারে যেটুকু অবয়ব বোঝা যায়, তাতে বেশ শক্তপোক্ত চেহারা বলেই মনে হয়। গায়ে একটা চাদর জড়ানো। যেরকম স্পিডে দৌড়চ্ছে তাতে ওকে দৌড়বীরের খেতাব দেওয়াই যায়। কিন্তু অধিরাজ জানে যে সে দমে পেরে উঠবে না। এখনই যেভাবে শ্বাস টানছে তাতে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর ফুসফুস জবাব দিয়ে দেবে।

দেখতে দেখতেই মাঠ ক্রস করল লোকটা। একদম সটান ঢুকে গেল বস্তির মধ্যে। বস্তির সংকীর্ণ গলি-ঘুঁজি দিয়ে সে দৌড়তে শুরু করে! এই বস্তির রাস্তা যেন এক গোলকধাঁধার মতো। দু-দিকে ছোটো ছোটো ঝুপড়ি, একপাশে কাঁচা ড্রেন। একফালি সরু পথ দিয়ে একজনের বেশি হাঁটা যায় না। তাও আবার কারা যেন মাঝে মাঝে জলের ড্রাম, ঝুড়ি রেখে দিয়েছে। যেখানে সেখানে কুকুরেরা কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে! মাঝরাতে এতগুলো লোককে এলোপাথাড়ি দৌড়তে দেখে তারাও মহা শোরগোল লাগিয়ে দিল।

সামনেই একটা বিশালাকৃতি ড্রাম পড়ল। লোকটা অদ্ভুত দক্ষতায় লাফিয়ে সেটাকে টপকে গেল। অধিরাজও সমান গতিবেগে তাকে চেজ করছে। পবিত্র’র মনে হচ্ছিল এই চেজিঙের বোধহয় শেষ নেই। লোকটা আঁকাবাঁকা গলিপথ দিয়ে কোথায় চলেছে কে জানে। এই অঞ্চলটা তাদেরও অচেনা। কিন্তু অধিরাজ একেবারে আঠার মতো লেগে আছে ওর পেছনে। দু-জনের মধ্যে এখন দূরত্ব অনেকটাই কমে এসেছে। আগন্তুকের ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট। তার দম শেষ হয়ে আসছে। এই সুযোগ…।

অধিরাজের দেহটা স্প্রিঙের মতো যেন ছিটকে গেল! বিদ্যুৎবেগে ডাইভ মেরেছে সে। শূন্যে ভাসমান অবস্থাতেই সে জোড়া পায়ে কিক্ ছুঁড়ে দিল লোকটার কোমর লক্ষ্য করে। আগন্তুক বুঝতে পারেনি পেছন থেকে এরকম একটা আক্রমণ আসবে। সে সেই মোক্ষম লাথি খেয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ল একটা ইঁটের পাঁজার ওপর! মুহূর্তের জন্য হকচকিয়ে গেলেও পরক্ষণেই সামলে নিল। অর্ণব আর পবিত্র তাকে ধরে ফেলতেই যাচ্ছিল, তার আগেই পবিত্র’র কানের পাশ দিয়ে সাঁই করে কী যেন চলে গেল। পরক্ষণেই কানে এল অর্ণবের কাতরোক্তি!

‘অর্ণব!’

অধিরাজ দেখল অর্ণব মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে। সে তাড়াতাড়ি ছুটে যায় তার দিকে। অর্ণবের কপাল বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে! কোনোমতে বলল, ‘ইঁট ছুঁড়ে মেরেছে…!’

‘শা-লা!’

পবিত্র তেড়ে গেল লোকটার দিকে। তার আগেই তার মাথা লক্ষ্য করেও একটা আধলা ইঁট ছুটে এল। পরক্ষণেই এলোপাথাড়ি ইঁটের বৃষ্টি! পবিত্র বিদ্যুৎবেগে ডাক করল ঠিকই, কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় টাল সামলাতে না পেরে উলটে পড়ল। অধিরাজ অর্ণবকে টেনে একপাশে সরিয়ে কভার নিল। তার সুযোগ নিয়েই লোকটা লাফ মেরে উঠে দাঁড়ায়। অধিরাজ অসহায় দৃষ্টিতে দেখল, আগন্তুক অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে! তার পেছন পেছন দুই লেডি অফিসারও ছুটল ঠিকই। কিন্তু তারা কিছু করার আগেই লোকটা যেন একেবারেই অদৃশ্য হয়ে গেল তাদের সামনে থেকে।

‘যাঃ! পালিয়ে গেল! ‘

হতাশ স্বরে পবিত্র বলল। অধিরাজের সমস্ত মনোযোগ এখন অর্ণবের দিকে। সে নিজের রুমাল দিয়ে অর্ণবের ক্ষতস্থান চেপে ধরে রক্তক্ষরণ বন্ধ করার চেষ্টা করতে করতে বলে, ‘অর্ণব, তুমি ঠিক আছ? খুব পেইন হচ্ছে?’

অর্ণবের মাথা ফাটেনি। ইঁটটা তার মাথা স্পর্শ করে চলে গিয়েছে। কিন্তু ইঁটের ধারালো দিকটা কপালে লাগার ফলে কপাল কেটে গিয়েছে। সে আস্তে আস্তে বলল, ‘আমি ঠিক আছি স্যার। সামান্য কেটে গিয়েছে।’

ইঁটের পাঁজার ওপর কী যেন একটা পড়ে ছিল। অধিরাজ এবার উঠে দাঁড়িয়ে সন্তর্পণে জিনিসটাকে তুলে নিল। একটা রুমাল! তাও আবার মেয়েদের! রুমালটার গা থেকে মিষ্টি গন্ধ আসছে। নিঃসন্দেহে লেডিজ পারফিউম!

‘যাচ্চলে!’ পবিত্র চোখ কপালে তুলে ফেলেছে, ‘এতক্ষণ যে মিলখা সিং আমাদের দৌড় করিয়ে মারল, সে কি তবে মিলখা সিং নয়—পি টি ঊষা? নয়তো লেডিজ রুমাল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন?’

দুই লেডি অফিসার ততক্ষণে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে। আত্রেয়ী হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ‘ও যখন দৌড়চ্ছিল তখন একটা চাপা ছমছম আওয়াজও পাচ্ছিলাম স্যার। অনেকটা চুড়ি বা পায়েলের শব্দের মতো!’

অধিরাজ ভালো করে রুমালটাকে দেখল। নরম সিল্কের রুমাল। যথেষ্ট শৌখিন এবং দামিও বটে। কোনো সন্দেহই নেই লেডিজ রুমাল।

তার ভুরুতে সন্দেহের ভাঁজ পড়ল—’স্ট্রেঞ্জ’!

(১৪)

সারা রাত কাটল দুই হসপিটালের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে।

অর্ণব, পবিত্র আর অধিরাজ বাড়ি যায়নি। ফেরার পথেই হসপিটাল থেকে অর্ণবের মাথার চোটের প্রাথমিক শুশ্রূষা করিয়ে নিয়েছে অধিরাজ। লেডি অফিসারদের অবশ্য বাড়ি চলে যেতে বলেছিল সে। কিন্তু আত্রেয়ী দত্ত বলল, ‘আমি বাড়ি যাব না স্যার। আমার প্রয়োজন এখানে বেশি।’ তার দেখাদেখি কৌশানী বোসও বাড়ি গেল না। অর্ণবের রীতিমতো পোয়াবারো। সে ঘুরঘুর করতে করতে আত্রেয়ীর কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘আপনার স্পেশ্যাল চা পাওয়া যাবে?’

আত্রেয়ীর বড় বড় চোখদুটো হেসে ওঠে, ‘আমার স্পেশ্যাল চা?’

‘হ্যাঁ… মানে… আপনি যেভাবে চা বানান আর কী…! ‘

অর্ণব অপ্রতিভ। তার কথা শুনে আত্রেয়ী এবার সজোরে হেসেই ফেলল, ‘আমি যেভাবে চা বানাই, পৃথিবীশুদ্ধ লোক সেভাবেই বানায়।

‘কিন্তু আপনার চায়ের স্বাদই আলাদা। ‘

কথাটা বলেই থমকে গেল অর্ণব! এই রে! বেশি প্রগলভতা হয়ে গেল না তো! কে জানে মিস দত্ত আবার কী ভেবে বসে!

আত্রেয়ী মুখ টিপে হাসে, ‘বেশ। এখনই আনছি।’

হাঁফ ছেড়ে বাঁচল অর্ণব। যাক! মেয়েটা কিছু মনে করেনি। আত্রেয়ী মাঝেমধ্যে এমন অর্থপূর্ণভাবে হাসে যে নার্ভাস হয়ে পড়ে সে। এমনিতেই মেয়েদের সঙ্গে কখনোই খুব ফ্রি নয়। তার ওপর মিস্ দত্ত অত্যন্ত ম্যাচিওর। কিছু বলার আগেই সব বুঝে বসে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে অর্ণবের নিজেকে কেমন বেকুব বলে মনে হয়। আবার ভালোও লাগে!

‘বারবার মাত খেয়ে যাচ্ছি অর্ণব।’

অধিরাজের মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট, ‘এখনও পর্যন্ত একটাও ক্লু নেই আমাদের হাতে! টোট্যালি ব্যাকফুটে! কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে—কিছুই বুঝতে পারছি না! আমার বারবার মনে হচ্ছে কেউ আমাদের তদন্তকে ইচ্ছাকৃত লিড দিচ্ছে! আমরা যা দেখছি, যা শুনছি—সবই অন্য কারোর পরিকল্পনামাফিক।’

‘মানে?’

পবিত্র’র কথার উত্তরে সে চিন্তান্বিত স্বরে বলল, ‘প্রত্যেকটা লিড লক্ষ্য করো। আমার মনে হচ্ছে এগুলো আমরা পাইনি, কেউ পাইয়ে দিয়েছে। অফকোর্স সে চায়নি যে বনোয়ারিলালের লাশ আমাদের হাতে পড়ুক। এইখানে আমরা একচুলের জন্য হলেও তাকে হারিয়েছি। কিন্তু কী টাইমিং দেখো! যে মুহূর্তে আমরা গিয়ে পৌঁছেছি, তখনই আরেকজনকে সেখানে এসে উপস্থিত হতে হল! পি টি উষা হোক কী মিলখা সিং, এতেই স্পষ্ট সে একদম আমাদের মতো করেই ভাবছে। একদম আমাদের অ্যাঙ্গেলেই খেলছে এবং ওর অ্যাঙ্গেলে আমাদের খেলাচ্ছে।’

‘তবে?’ পবিত্র একটু ঘাবড়ে গিয়েই বলে, ‘এখন কী করণীয়?’

‘ব্রেক থ্রু আমাদের নিজেদেরই খুঁজে বের করতে হবে। এখনও পর্যন্ত যত ক্যারেক্টারকে পেয়েছি সবার সি.ডি.আর বের করো। কাউকে বাদ দেবে না। এমনকি ফোবিয়ান্সের সদস্যদের, তাদের পরিবারের সবার কল ডিটেইল রেকর্ডও আমার চাই। আগে রুটিন প্রসিডিওরগুলো কমপ্লিট করে দেখি কোনো রাস্তা পাওয়া যায় কি না। কিছু না হলে নতুনভাবে ভাবতে হবে।’ অধিরাজ চিন্তিত স্বরেই যোগ করে, ‘আরও তিনটে মানুষের জীবন বিপন্ন পবিত্র। আমার সিক্সথ সেন্স বলছে, ওদের ওপর খুব তাড়াতাড়িই অ্যাটাক হবে।

‘তাড়াতাড়ি অ্যাটাক হবে!’ অর্ণব অবাক, ‘কিন্তু স্যার প্রথম দুটো মৃত্যু বেশ সময়ের ফারাকেই ঘটেছে।’

‘ঠিকই, কিন্তু লাস্ট দুটো ডেথ একদম কাছাকাছি। আমার মনে হচ্ছে এই মাস্টারপ্ল্যানের পেছনে যে-ই থাক, সে বেশি সময় নেবে না। যদি তার অ্যাঙ্গেল থেকে ভাবি তবে আগে ধরা পড়ার ভয় ছিল না। কিন্তু এখন পুলিস সিনে চলে এসেছে। পুলিস আনার প্ল্যানিংটাও তারই। সব দিক দিয়েই ফোবিয়ান্সের সদস্যরা হাই অ্যালার্টে আছে। কারণ তারা খবরে জেনেছে পর পর মৃত্যুর কথা। এবং অলরেডি তাদের বাড়িতে পুলিস উপস্থিত হয়ে জানিয়েছে যে তাদের জীবন বিপন্ন। মিডিয়া আর পুলিস এমনই দুটো প্রজাতি যাদের উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা কারোর নেই। কিন্তু এখন পুলিস প্রোটেকশনের চান্সও এসে যায়। বাই এনি চান্স যদি এরা কেউ পুলিস প্রোটেকশন চেয়ে বসে, তবে খুনীর কাজটা কঠিন হয়ে যাবে। তাই সে চাইবে তার আগেই এদের নিকেশ করার।’

‘এরপর কার পালা বলে তোমার মনে হয়?’

‘এইভাবে বলা মুশকিল। কিন্তু আমার মন বলছে উমার চান্স বেশি।’ অধিরাজ নিরূ পায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকায়, ‘সবটাই আমার ওয়াইল্ড গেস। এখনও পর্যন্ত খুনীর প্যাটার্নকে বা মোডাস অপারেন্ডি আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। শুধু এইটুকু বুঝতে পে রেছি যে প্রত্যেকটা মৃত্যুর পেছনে ফোবিয়ার বিরাট ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু তার বেশি কিছুই বুঝতে পারছি না।

অর্ণব অধিরাজকে দেখছিল। অদ্ভুত অসহায় লাগছে তাকে! জানে, এরপর আরও মৃত্যু হবে। কিন্তু ঠেকাবে কী করে বুঝে উঠতে পারছে না। সত্যিই এই কেসটা ভারী অদ্ভুত। প্রত্যেকেই কিছু না কিছু চেপে যাচ্ছে। আকাশের মৃত্যুটা ঠিক কীভাবে হয়েছিল। তার সঙ্গে কি এই মৃত্যুগুলো জড়িত? সুজিতের বোন শ্রুতির এখানে ভূমিকা কী? কেউ তাকেই ফোন করে শর্বাণীর মৃত্যুর খবর কেন দিল? ওদিকে সৌরীশ বা আবীরও মুখ খুলছেন না! সৌরীশের অবস্থা এর মধ্যেই খারাপ। ভয়ে রীতিমতো কুঁকড়ে আছেন। কিন্তু কেন? কারই বা ভয়?

‘দুই হসপিটালের সিসিটিভি ফুটেজ এনেছ?’

‘হ্যাঁ স্যার।’

‘কতদিনের?’

‘সৌমিত্র আর মৃন্ময়ের মৃত্যুর সাতদিন আগে থেকে মৃত্যুর ডেট অবধি যত ফুটেজ আছে সব নিয়ে এসেছি।’

অধিরাজ ক্লান্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে এলিয়ে পড়ে, ‘গ্রেট। চালাও দেখি।’

শুরু হল সিসিটিভি ফুটেজ দেখা। সতর্ক দৃষ্টিতে প্রতিটি দৃশ্য মাপছে ওরা। পাঁচজোড়া চোখ ফুটেজ তল্লাশি করছে।

কোথাও কি কোনো সন্দেহজনক গতিবিধি আছে? হসপিটালের পরিচিত দৃশ্যের মধ্যে কি লুকিয়ে আছে এমন কোনো দৃশ্য যা স্বাভাবিক নয়? আপাতদৃষ্টিতে তো তেমন কিছু মনে হয় না। নেহাৎই ব্যস্ত হসপিটালের অতি স্বাভাবিক দৃশ্য। কখনও রিসেপশনের ফুটেজ, কখনও বা করিডরের।

‘মর্গের ফুটেজ নেই?’

‘না স্যার’। অর্ণব জানায়, ‘মর্গের সামনে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা নেই।’

‘আই সি।’

ওরা আবার ফুটেজ দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এখনও পর্যন্ত তেমন সন্দেহজনক কিছু দেখা যাচ্ছে না। একবার দু-বার বনোয়ারিলালকে দেখা গেলেও কোনোরকম সন্দেহ করার মতো কিছু নেই। সে কখনও মৃতদেহের ট্রলি ঠেলে নিয়ে চলেছে মর্গের দিকে। আবার কখনও বা ব্যস্তসমস্ত হয়ে করিডর দিয়ে হেঁটে চলেছে। বেশির ভাগ লোকই নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। কারোর দিকে খেয়াল করার সময়ই নেই।

অধিরাজ ফুটেজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আদৌ কি এর মধ্যে কোনো লিড পাওয়া যাবে? সবটাই কেমন যেন ধাঁধায় মোড়া! এত বড়ো হসপিটালের কোন্ অলিন্দে কী ঘটছে তা কি শুধুমাত্র এই ফুটেজের মাধ্যমে বের করা সম্ভব! হয়তো সিসিটিভির আওতার বাইরে আরও অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে যার খবর কেউ রাখেনি।

‘ওয়েট ওয়েট…!’

ফুটেজ দেখতে দেখতেই প্রায় লাফিয়ে উঠল অধিরাজ। কম্পিউটার স্ক্রিনের ওপর হাত রেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘ইনি কে?’

মনিটরে তখন ধরা পড়েছে এক বোরখা পরা পরদানসীন মহিলার ছবি। তার কাঁধে একটা ঢাউস ব্যাগ। বনোয়ারিলাল তার সঙ্গে কথা বলছে। ভাবভঙ্গি অত্যন্ত সন্ত্রস্ত। মহিলার মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু দু-জনেই যে কিছু গোপন পরামর্শ করছে তা বডি ল্যাঙ্গোয়েজেই স্পষ্ট। বনোয়ারিলাল বারবার সতর্ক দৃষ্টিতে ক্যামেরার দিকেই তাকাচ্ছে। তারপর সে মহিলাকে ডেকে নিয়ে মর্গের দিকে চলে গেল।

‘মর্গের সামনে ক্যামেরা লাগায় না কেন এরা!’ অধিরাজ বিরক্ত, ‘আমার এই মহিলাকে যথেষ্ট সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। বনোয়ারি জানত যে এখানে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে। সেই জন্যই মর্গের দিকে চলে গেল। সামথিং ইজ ফিশি।’

কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভদ্রমহিলাকে ফের দেখা গেল। মর্গের দিক থেকেই হেঁটে আসছেন। কিন্তু এখন তার কাঁধে ব্যাগটা নেই!

‘পজ করে জুম করো তো অর্ণব।’ অধিরাজ নিজের চেয়ারে সোজা হয়ে বসেছে, ‘মহিলা নিঃসন্দেহে সন্দেহজনক। এত বড় একটা ব্যাগ নিয়ে গেলেন, সেটা গেল কোথায়? হস্তান্তরিত হল?’

‘ঐ ব্যাগেই টাকা ছিল বলছ?’

পবিত্রর কথা শুনে ইতিবাচক মাথা ঝাঁকায় অধিরাজ, ‘অসম্ভব নয়। অন্তত একেবারে ক্লিনচিট দিতে পারছি না! ভদ্রমহিলার হাবভাবই কেমন যেন সন্দেহজনক।’

পবিত্র আরও বলল, ‘লক্ষ্য করে দেখো, বোরখা পরেছেন, অথচ পায়ে ছেলেদের বুট! ‘

‘শুধু তাই নয়…।’ অধিরাজ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বলে, ‘মহিলার হাঁটাটা লক্ষ্য করেছ? সচরাচর মেয়েদের হাঁটা একটু নরম, সরম, পেলব হয়। একটু কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে মসৃণ ছন্দে হাঁটে মেয়েরা। কিন্তু ইনি তো রীতিমতো দুমদাম করে বুক চিতিয়ে রোড রোলারের মতো হাঁটছেন! কোনো মহিলাকে আজ পর্যন্ত এরকম দারা সিং-এর মতো হাঁটতে দেখেছ!

‘তাহলে কি ইনি মহিলা নন্?’

‘গুড ডিডাকশন অর্ণব।’ অধিরাজ সিগারেটটা ধরিয়ে একটা সুখটান মেরে বলল, ‘হাই চান্স আছে যে ইনি মহিলাই নন্। বোরখার তলায় কোনো মিনি নয়, হুলো আছে। বোরখার থেকে ভালো ডিসগাইজ আর নেই।’ সে বুঝিয়ে বলে, ‘অন্যান্য ছদ্মবেশে যতই মুখে দাড়ি-গোঁফ লাগাও, হুলিয়া ঠিকই দেখা যাবে। কিন্তু বোরখায় একেবারে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা! শুধু চোখদুটো ছাড়া আর কিছুই দেখার উপায় নেই। ধরা পড়ার চান্সও নেই।’

‘এ তো পুরোপুরি হাঁসজারু কেস। যে লোকটাকে আমরা আজ তাড়া করেছিলাম, সে লেডিজ রুমাল নিয়ে ঘুরছে! যে মহিলা বনোয়ারিলালকে টাকা দিয়েছিল সে ছেলেদের বুট পরে ঘুরছে! আদতে এ পাবলিক কী রাজা? ছেলে? না মেয়ে? নাকি দুটোই?’

‘তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, আদতে এ পাবলিক কে বা কারা! আদৌ কি একজন? না একাধিক মানুষ জড়িত আছে?’ অধিরাজ অর্ণবের দিকে তাকায়, ‘ঠিক আছে। এর পর দেখি।’

অর্ণব ফুটেজটাকে পজ করে রেখেছিল। নির্দেশ পেতেই আবার চালিয়ে দিল। অজস্র মানুষ হসপিটালে আসছে যাচ্ছে। কেউ আউটডোরে দেখানোর জন্য আসছে, কেউ বা আবার এমার্জেন্সিতে। অসুস্থ মানুষ এবং তাদের আত্মীয় স্বজনদের চিন্তিত মুখ বারবার ভেসে উঠছে সিসিটিভি ফুটেজে। আবার পাশাপাশি কেউ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন, সেই স্বস্তিরও একমাত্র সাক্ষী সিসিটিভি। রাত নেই, দিন নেই জলস্রোতের মতো পেশেন্ট এসেই চলেছে। কোভিডের মারণখেলায় প্রায় সমস্ত হসপিটালের বেডই ভর্তি। হসপিটাল কর্তৃপক্ষও স্বাভাবিকভাবে চাপে। সিসিটিভি ফুটেজে সেই টেনশনটাও ধরা পড়ছে।

এরই মধ্যে বনোয়ারিকে বেশ কয়েকবার মর্গের দিকে যেতে দেখা গিয়েছে। ট্রলিতে মৃতদেহ নিয়ে সে চলেছে মরচুয়ারির দিকে। সম্ভবত কেসগুলো কোভিডের। কারণ লাশগুলো প্লাস্টিকে মোড়া। এ ছাড়া তার বিশেষ কোনো সন্দেহজনক অ্যাকটিভিটি দেখা যাচ্ছে না।

‘সৌমিত্রর মৃত্যুর দিনের ফুটেজ দেখাও অর্ণব।’

অর্ণব অধিরাজের কথা মতো সৌমিত্রর মৃত্যুর ডেটের সিসিটিভি ফুটেজটা চালিয়ে দিল। যথারীতি হসপিটালের ব্যস্ত ছবি। সিস্টার ওয়ার্ডবয়রা যে যার কাজে ব্যস্ত। তার মধ্যেই পিপিই কিট-পরা ডাক্তারদের যাতায়াত। পেশেন্ট আর তাদের আত্মীয় স্বজনদের ভিড়। এর মধ্যেও বনোয়ারিলালকে বার দুয়েক দেখা গেল। তাকে একটু নার্ভাস বলে মনে হচ্ছে। এছাড়া বিশেষ কোনো অস্বাভাবিকতা নেই।

আস্তে আস্তে রাতের দিকে ভিড় কমে এল। করিডর শুনশান। কিন্তু ডাক্তার-সিস্টার-ওয়ার্ডবয়রা নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে তাদের যাতায়াতও কমে আসে। হসপিটালের পরিবেশ এখন শান্ত। নাইট ডিউটির সিস্টার ওয়ার্ডবয়রা একে একে ডিউটিতে আসছে। আর যারা এতক্ষণ ডিউটি দিচ্ছিল তারা বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটা কর্মব্যস্ত দিন কাটিয়ে গোটা হসপিটাল এবার যেন একটু বিশ্রাম নেওয়ার অবসর পেয়েছে। এখন রিসেপশনও ফাঁকা।

‘এই দ্যাখো…!’

অধিরাজের কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা, ‘বনোয়ারিকে দ্যাখো।

কম্পিউটার স্ক্রিনে আবার দেখা যাচ্ছে বনোয়ারিকে। সে যথারীতি একটা মৃতদেহ নিয়ে মর্গের দিকেই যাচ্ছে। এবার তার হাবভাব বেশ সন্ত্রস্ত। দেখলেই বোঝা যায় যে বেশ ভয় পেয়ে আছে। মৃতদেহ সাদা চাদরে ঢাকা। কিন্তু মৃতদেহের একটা হাত নীচে ঝুলছে। অধিরাজ প্রায় লাফিয়েই ওঠে, ‘পজ্… পজ্‌…!’

সঙ্গে সঙ্গেই ভিডিও পজ করল অর্ণব। অধিরাজ উত্তেজিত গলায় বলল, ‘জুম করো অর্ণব। মৃতদেহের হাতের ওপর জুম করো।’

অর্ণব সঙ্গে সঙ্গেই নির্দেশ পালন করল। এবার কম্পিউটার স্ক্রিনে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মৃতদেহের হাত। হাতে একটা সোনালি ঘড়ি। আঙুলে দুটো সোনার আংটি।

‘মাই গড! এটা কোনো মৃতদেহ নয়!’ সে ফিসফিস করেই আপনমনে বলে, ‘এ তো জ্যান্ত মানুষ! মোস্ট প্রব্যাবলি এটাই সৌমিত্র!’

‘সৌমিত্র!’ পবিত্র অবাক, ‘কী করে বুঝলে!’

‘আমি আজ পর্যন্ত হাজারটা কেসে মর্গে গিয়েছি। কিন্তু কোনও লাশের হাতে ঘড়ি, গলায় চেইন বা আঙুলে আংটি দেখিনি। পেশেন্ট যখন হসপিটালে ভর্তি হতে আসে তখনই তার গায়ের সমস্ত অলংকার খুলে দেয় হসপিটাল কর্তৃপক্ষ। ওটাই নিয়ম। তাই যদি হসপিটালের কোনো রোগী মারা যায়, তার হাতে অলংকার বা আংটি থাকাই সম্ভব নয়। আর যদি কোনো লাশ অ্যাক্সিডেন্টে বা অন্যান্য কোনো কেসে হসপিটালে এসে পৌঁছয়, তাহলেও মরচুয়ারিতে পাঠানোর আগে জামাকাপড়, আর সমস্ত জুয়েলারি খুলে পুলিসকে দিয়ে দেওয়া হয়। তাহলে এই মৃতদেহটির হাতে ঘড়ি, আঙুলে সোনার আংটি এল কোথা থেকে?’

মোক্ষম যুক্তি। পবিত্র একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘তবে সৌমিত্র বাধা দিচ্ছেন না কেন? নাকি তিনি আগেই মারা গিয়েছেন?’

‘না পবিত্র।’ অধিরাজ পেপারওয়েটটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, ‘মর্গের ভেতরে সৌমিত্র’র দেহ এমনভাবে পড়েছিল যা দেখলেই বোঝা যায় যে তিনি মর্গের ভেতরে দৌড়োদৌড়ি করছিলেন। আপ্রাণ বেরোনোর চেষ্টা করেছিলেন। হার্ট অ্যাটাকটা তাঁর মর্গের ভেতরে ঢোকার পরেই হয়।’

‘তার মানে যখন সৌমিত্র-কে মর্গে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল বনোয়ারিলাল, তখন তিনি অজ্ঞান অবস্থায় ছিলেন।’ পবিত্র কোনোমতে বলল, ‘লোকটাকে সাময়িক বেহুঁশ করে সটান মর্গে ঢুকিয়ে দিল! খুনী নিশ্চয়ই জানত যে ওর নেক্রোফোবিয়া আছে।’

‘টু হান্ড্রেড পার্সেন্ট জানত!’ অধিরাজ চিন্তিত গলায় বলে, ‘নয়তো লোকটাকে মর্গে ঢুকিয়ে দিত না। ওঁকে মারার প্ল্যান করেই কাজটা করেছিল সে। আর বনোয়ারিলালও ব্যাপারটা জানত। অন্তত ওর নার্ভাসনেস তাই বলছে। হতে পারে ব্ল্যাকমেলিং এর চেষ্টাও করেছিল। ফলস্বরূপ তাকেও মরতে হল।’

দ্বিতীয় হসপিটালের ফুটেজে কিছুই পাওয়া গেল না কারণ ঘটনার কয়েকদিন আগে থেকেই হসপিটালের সিসিটিভি ক্যামেরা গোলমাল করছিল। যেটুকু ফুটেজ পাওয়া গেল তাতে কোনো কিছুই স্পষ্ট নয়। এম.আর.আই রুমের সামনের সিসিটিভিটা অনেকদিন ধরেই নষ্ট। তাই সেখানকার ফুটেজ পাওয়া সম্ভবই নয়। অধিরাজ হতাশ হয়ে হালই ছেড়ে দিল, ‘ধুস্! পণ্ডশ্রম! এরা যে কেন সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নেয় না কে জানে! অর্ণব, সেকেন্ড হসপিটালের কোনো স্টাফ মিসিং নয়তো?’

‘না স্যার। টেকনিশিয়ানরা সবাই আছে।’

‘যাক।’ অধিরাজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, ‘আমার মনে হয় না কল ডিটেইল রেকর্ড থেকেও বিশেষ কিছু পাওয়া যাবে। আশ্চর্য ব্যাপার, খুনী নিঃসন্দেহে জানত যে এক হসপিটালের মর্গের সামনে এবং অন্য হসপিটালের এম.আর.আই স্ক্যান রুমের সামনে সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। আর মৃন্ময়ই বা লক্ষ্মী ছেলের মতো যন্ত্রের মধ্যে ঢুকে গেলেন কী করে? নাকি তাঁকেও সৌমিত্র’র মতো অজ্ঞান করে নেওয়া হয়েছিল? ‘ ‘কিন্তু অজ্ঞানটা করল কী করে?’ অর্ণব বলে, ‘যদি কোনো ওষুধ বা ড্রাগ অথবা ক্লোরোফর্মের ব্যবহার হত তাহলে ফরেনসিক নিশ্চয়ই ধরতে পারত।’

‘ব্রিলিয়ান্ট কোয়েশ্চেন অর্ণব।’ অধিরাজ উত্তর দেয়, ‘কোনোরকম ওষুধ, ড্রাগ বা ক্লোরোফর্ম ইউজ হয়নি। আমার ধারণা স্যান্ডব্যাগ বা ঐ জাতীয় কোনো টেকনিক ইউজ করা হয়েছে। ঘাড়ের দু-পাশে হাত দিয়ে মারলেই কিছুক্ষণের জন্য অজ্ঞান হয়ে যাবে। অথবা তেমনই কোনো টেকনিক। খুব জোরে মারেনি, তাহলে ব্রুইজেস বা অন্য কোনো দাগ গায়ে থেকেই যেত। ফরেনসিক তেমন কিছু পায়নি।’

‘এ কাজ কি আদৌ কোনো মহিলার রাজা!’

পবিত্রর কথায় মুখে চিন্তার ছাপ পড়ল অধিরাজের, ‘টু বি ভেরি অনেস্ট, আমি এখনও কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। কোনো মহিলা মার্শাল আর্ট এক্সপার্ট হলে অবশ্য পারে। কিন্তু এখানে মার্শাল আর্ট এক্সপার্ট একমাত্র শ্রুতি চ্যাটার্জি হতে পারেন। ক্রাইম রিপোর্টার। নিজেকে রক্ষা করার টেকনিক তাঁর জানা উচিত। কিন্তু বাস্তবে তিনি তা জানেন কিনা তা আমরা জানি না। গোটাটাই থিওরি বেসড। আমার এখনও মনে হচ্ছে সত্য থেকে আমরা অনেক দূরে আছি।’

বলতে বলতেই সে হতাশভাবে মাথা নাড়ল, ‘এভাবে হবে না। আমরা যে ছকে ইনভেস্টিগেশন করব তা খুনী আগে থেকেই বুঝে বসে আছে। দেখলে না বনোয়ারিলালের দি এন্ড হয়ে গেল! হসপিটালের ফুটেজ আমাদের শুধু বিভ্রান্তই করেছে। এখনও পর্যন্ত আমরা বুঝেই উঠতে পারিনি যে আমাদের অজানা বন্ধুটি নারী না পুরুষ! তার থেকেও বড় প্রশ্ন যে মৃতদের কোন্ বিষয়ে ভয় ছিল বা ফোবিয়া ছিল, তাই-ই বা সে জানছে কী করে? ‘

পবিত্র সন্দিগ্ধ স্বরে বলল, ‘একমাত্র কাছের মানুষ ছাড়া এসব বিষয়ে কেউ জানতে পারে না।’

‘সেইজন্যই বলছি, পরিবারের লোকদেরও ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। এমনকি আমার তো আবীর সেন, মিসেস সেন, সৌরীশ গাঙ্গুলিকেও সন্দেহ হয়।’

‘তুমি ফোবিয়ান্সের সদস্যদেরও সন্দেহ করছ রাজা!’ পবিত্র বিস্মিত, ‘কিন্তু ওরাই তো মরছে। তাছাড়া যে বন্ধুদের সঙ্গে ওদের কোনোরকম যোগাযোগ ছিল না, তাদের খামোখা মারতে যাবে কেন!’

‘মোটিভ সত্যিই নেই!’ অধিরাজ স্বীকার করল, ‘কেউ এত বছর পর পুরনো বন্ধুদের খুন করতে যায় না। কিন্তু এই অ্যাঙ্গেলটাও ছাড়ব না। যেমন পরিবারের লোকেরাও সন্দেহের বাইরে নয়। কারণ কার কোন্ জিনিসে ফোবিয়া আছে তা পরিবারের লোকেরা জানত আর জানত ফোবিয়ান্সের সদস্যরা। আর এখানে অতীতটাই হল বড় ফ্যাক্টর। ফোবিয়ান্সের অতীত যে আদৌ ক্লিয়ার নয় তা ইতিমধ্যেই জানতে পেরেছি। কে বলতে পারে, হয়তো অতীতের কুয়াশাতেই লুকিয়ে আছে এমন কোনো অপরাধ যা এখন সামনে আসার সম্ভাবনা আছে। তাই হয়তো বাকি সাক্ষীদের এক এক করে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’

‘তোমার সামনে রিভেঞ্জের মতো একটা চমৎকার মোটিভ আছে, একগাদা সাসপেক্ট রয়েছে—তারপরও অন্য অ্যাঙ্গেল খুঁজছ কেন?’

‘খুঁজছি কারণ রিভেঞ্জের অ্যাঙ্গেলটা আমাদের সামনে নিজে থেকে আসেনি। খুনী আমাদের নাকের সামনে রিভেঞ্জ নামক মোটিভটি তুলে ধরেছে। সে জানে, আমরা আকাশের বাবা-মা, সুজিতের বাবা-মা, বোনকেই সন্দেহ করব। এমনও হতে পারে সে প্রতিটি আঘাত কোথা থেকে আসছে বোঝানোর জন্য এই অ্যাঙ্গেলটাকে সামনে রেখেছে। আবার এমন হওয়াও অস্বাভাবিক নয় যে আমাদের মিলিড করার জন্যই এই ব্যবস্থা। তাই মোটিভহীন হলেও অন্য দুটো অ্যাঙ্গেলও আমি ছাড়ছি না।’ সে আস্তে আস্তে বলল, ‘খবরিদের মাঠে নামাও অর্ণব। সৌমিত্র চৌধুরীর মিসেস নিজেই বলেছেন যে সুযোগ পেলে সৌমিত্রকে তিনিই খুন করতেন। যথেষ্ট জোরদার সাসপেক্ট। মিসেস চৌধুরীর সম্পর্কে আরও খোঁজখবর করতে বলো। শুধু তাই নয়, উৎপল মিত্রর স্ত্রী, মৃন্ময় দত্তরায়ের স্ত্রী, শর্বাণী ঘোষের স্বামীরও ডিটেইলস যেন বের করে। এদিকে আবীর, উমা এবং সৌরীশের খবর চাই আমার। ইনফর্মার নেটওয়ার্ককে অ্যাক্টিভ করো। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তথ্যও যেন মিস না করে। সাসপেক্টরা কখন ঘুম থেকে ওঠে, কখন দাঁত ব্রাশ করে, কখন খায়, কখন ঘুমোতে যায়—সব তথ্য চাই।’

অর্ণব মাথা ঝাঁকায়, ‘ওকে স্যার।’

‘যাদবকে আরেকবার ইন্টারোগেট করতে হবে।’ অধিরাজ আপনমনেই বিড়বিড় করে, ‘আমার ধারণা খবরটা ওর কাছে একেবারে লোপ্পা ক্যাচের মতো এসে পৌঁছেছে! কালুর খবরটার উৎস কী সেটা জানা জরুরি।’

পরদিন যাদব গুটিগুটি পায়ে এসে হাজির হল সি.আই.ডি ব্যুরোয়। তার সঙ্গে আরও একজন লোক। অর্ণব সটান তাকে অধিরাজের কাছে নিয়ে যায়। অধিরাজ তখন হসপিটালের সিসিটিভি ফুটেজ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল। যাদবকে দেখে গম্ভীর গলায় বলল, ‘বোস।’

যাদবকে অবিকল ভিজে বিড়ালের মতো দেখাচ্ছিল। সে তার পাশের লোকটির দিকে তাকিয়ে একটু ঢোঁক গিলে শান্ত ভঙ্গিতে বসে পড়ল।

‘সঙ্গে কে?’

যাদব একটু হাসার চেষ্টা করে, ‘ও আমার ভাই। মাধব।’

‘যাদবের ভাই মাধব! ইন্টারেস্টিং!’ কৌতুকে অধিরাজের ভুরু নেচে ওঠে, ‘ক-ভাই তোরা?’

যাদব যেন এবার একটু সহজ হয়েছে, ‘আজ্ঞে চার ভাই। যাদব, মাধব, কেশব আর উদ্ধব।’

‘বাপ রে!’অধিরাজ চোখ কপালে তুলে বলল, ‘সব মিলিয়ে মিলিয়ে নাম! ভাগ্যিস তোদের আরেকটা ভাই নেই!’

এ কথার মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে যাদব বলে, ‘কেন স্যার?’

‘আরেকটা ভাই হলে নাম কী হত? যাদব, মাধব, কেশব, উদ্ধবের পরে কী?’ অধিরাজ নির্লিপ্ত মুখে বলল, ‘আমি তো গর্দভ ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না!’

‘কী যে বলেন স্যার! হেঁ হেঁ হেঁ…!’

যাদব কান এঁটো করা হাসি হাসল। তার ভাই মাধবও অল্প অল্প হাসছে। অধিরাজ এবার পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, ‘চা খাবি?’

‘চলবে স্যার।’

‘বেশ।’

অর্ণবের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করল অধিরাজ। অর্ণব ইতিবাচকভাবে মাঝা ঝাঁকিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।

‘এবার বল, অফিসার অর্ণব সরকারকে তুই যে টিপটা দিয়েছিলি, সেটা কার কথায় দিয়েছিলি?’

যাদব এবার তার ভাইয়ের দিকে তাকাল। দু-জনে পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। সে বলল, ‘এই প্রশ্নটা সরকার স্যারও করেছিলেন স্যার। সেইজন্যই আমি ভাইকে নিয়ে এসেছি। ও-ও খবরি।’

‘টিপটা তোর ভাই পেয়েছিল?’

এবার অধিরাজের দৃষ্টি যাদবকে ছেড়ে মাধবের ওপর স্থির হল। মাধব সপ্রতিভভাবে বলে, ‘হ্যাঁ হুজুর। ও টিপ আমিই দাদাকে দিয়েছিলাম।’

‘আর তোমাকে এ কথাগুলো কে বলেছিল?’

‘কালুর গার্লফ্রেন্ড শ্যারনের এক বান্ধবী।’

‘শ্যারনের বান্ধবী?’ অধিরাজ একটু অবাক হয়েই বলে, ‘তুমি তাকে চেনো?’

‘না স্যার। আমি তাকে চিনি না। সে একটা বোরখা পরে এসেছিল। তার মুখও আমি দেখতে পাইনি। সে একটা চিঠি নিয়ে এসেছিল।’

‘চিঠি?’

মাধব যা বলল তার মর্মার্থ, সে একদিন চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিল আর তার ঠিক সামনেই একটি বোরখা পরা মেয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই মেয়েটিকে মাধব আগেও বেশ কয়েকবার ঐ চায়ের দোকানে দেখেছে। সে দূর থেকে লক্ষ্য করে, কিন্তু কখনও কাছে আসেনি বা কোনোদিন কথা বলার চেষ্টা করেনি। তার মনে হয়েছিল মেয়েটা তার ওপর নজর রাখে। সে ভেবেছিল একদিন ডেকে কথা বলবে, কিন্তু তার আগেই সেদিন মেয়েটি তার কাছে এল। সবার অলক্ষ্যে তার হাতে একটা চিঠি গুঁজে দিয়ে চলে গেল। মাধব জাতে খবরি। তাই সে অবাক হয়নি। অনেকে এভাবেই টিপ দিয়ে থাকে। সেই চিঠিতেই কালুর টিপটা দেওয়া ছিল। আর যে লিখেছিল সে নিজেকে শ্যারনের বান্ধবী হিসাবে পরিচয় দিয়েছে।

চিঠিটা মাধব অধিরাজকেও দেখাল। এবড়ো খেবড়ো হাতের লেখায় একটা চিঠি হস্তাক্ষরেই স্পষ্ট, যে লিখেছে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা খুব বেশি নয়। অসংখ্য বানান ভুলে ভরা কাঁচা হাতে লেখা চিঠিতে কালুর টিপই দেওয়া আছে।

‘মেয়েটা মনে হয় বোবা স্যার।’

‘কেন এরকম মনে হল তোমার?’

‘যতদিন ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, একদিনও কথা বলেনি। মেয়েটাকে অন্য কারোর সঙ্গেও কখনও কথা বলতে দেখিনি। টিপটা ও বলতেও পারত, চিঠি দেওয়ার দরকার ছিল না। কিন্তু চিঠি লেখার দরকার পড়ল কেন! তাছাড়া…!’

‘তাছাড়া?’ অধিরাজ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায়।

‘ও একদিন যখন চায়ের দোকানের একপাশে দাঁড়িয়েছিল, ঠিক তখনই একটা সবজির ঠ্যালা যাচ্ছিল ওর সামনে দিয়ে। আমি পষ্ট দেখলাম ঠ্যালাটার চাকা ওর পায়ের ওপর দিয়ে চলে গেল। অথচ মেয়েটা টু শব্দটাও করল না! নির্ঘাৎ লেগেছিল। আমার পায়ের ওপর দিয়ে গেলে আমি তো চেঁচিয়ে উঠতাম। অথচ ও মেয়ে একটুও শব্দ করল না!’

উত্তেজনায় অধিরাজের চোখ ঝিকিয়ে ওঠে। মেয়েটার বোবা হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ কথা বললে কণ্ঠস্বরেই ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ইনিই কি তবে তিনি যাকে বনোয়ারির সঙ্গে হসপিটালের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছিল? কিন্তু তিনি তো কথা বলছিলেন! অন্তত তাকে বনোয়ারির সঙ্গে কথা বলতে দেখা গিয়েছে!

বেশি কথা না বাড়িয়ে মাধবকে সিসিটিভি ফুটেজটা দেখাল অধিরাজ। বোরখাধারিণীকে পজ করে, জুম করে দেখিয়ে বলল, ‘দেখো তো, এই সেই মেয়ে কি না।

মাধব মাথা চুলকায়, ‘বলা মুশকিল। বোরখা পরা সব মেয়েকেই আমার এক রকম লাগে। হতেও পারে, না-ও পারে।’

এভাবে বললে কোনো সিদ্ধান্তেই পৌঁছনো অসম্ভব। অধিরাজ যেন একটু হতাশ হয়েই বলল, ‘ঠিক আছে। আপাতত তোমরা যাও। পরে দরকার হলে ডেকে পাঠাব।’

‘আজ্ঞে হুজুর।’ দু-জনেই গুটিগুটি পায়ে বিদায় নিল। অধিরাজ একদৃষ্টে তাদের গমনপথের দিকে তাকিয়েছিল। আস্তে আস্তে বিড়বিড় করল, ‘কিউরিঅ-সার অ্যান্ড কিউরিঅ-সার!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *