ডেয়ার অর ডাই – ৫

(৫)

কানফাটানো শব্দে কাছেই বাজ পড়ল!

গাড়ির কাচের জানালা তার ধাক্কায় থরথর করে কেঁপে ওঠে! বিদ্যুতের কঙ্কালসার আঙুল দিগন্ত জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। থেকে থেকেই ঝলসে উঠছে তার শাখাপ্রশাখা। তার সঙ্গে চাপা গুম গুম আর কড় কড় আওয়াজ। আকাশ যেন চাপা রাগে গর্জন করছে। মেঘের ভয়াল ভ্রূকুটি বুঝি সেই রাগেরই বহিঃপ্রকাশ! প্রচণ্ড হাওয়ার ধাক্কায় গাছগুলোর বেসামাল অবস্থা! তারা পড়ি মড়ি করে নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার লড়াই লড়ছে। ঝড় শোঁ শোঁ শব্দে এসে বারবার আক্রমণ শানাচ্ছে তাদের ওপর। গাছগুলো নিজের শিকড়ের জোরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের মাথাগুলো হাওয়ার দমকে দুলছে। দেখলেই ভয় হয় যে ভেঙে পড়বে! তার মধ্যেই মটমট করে ডাল ভাঙার শব্দ। ঝড় এখন প্রায় তান্ডব নাচছে। দুনিয়ার সমস্ত সৌন্দর্য উড়িয়ে পুড়িয়ে দেবে সে!

গাড়ির ছাদের ওপর প্রবল বর্ষণের শব্দ পাচ্ছিল মেয়েটা। একটা করে বাজ পড়ছে আর সে কেঁপে কেঁপে উঠছে! উদ্দাম হাওয়া এসে আছড়ে পড়ছে গাড়ির দরজায়। রূপোলি ঝলকে চোখ ঝলসে যাচ্ছে থেকে থেকে। বুকের ভেতরটা কাঁপছে। কে জানত এই পরিস্থিতিতে পড়তে হবে তাকে!

‘আমায় ছেড়ে দাও!

মেয়েটা কেঁদে ফেলল। সে ভাবতেও পারেনি তাকে এমন কালান্তক ঝড়ের মধ্যে পড়তে হবে। এ ঝড় শুধু প্রকৃতিকে নয়, তার জীবনকেও ওলোট-পালোট করে দেবে। সারা দেহ তার থরথর করে কাঁপছিল। সহ্য হচ্ছে না! অসহ্য এই ঝড়ের তান্ডব। তার থেকেও বেশি ভয় বজ্রবিদ্যুৎকে। বিদ্যুৎ থেকে থেকেই তরোয়ালের মতো ঝলসে ঝলসে উঠছে। কান ফাটানো কড় কড় আওয়াজ! যেন এখনই প্রবল শব্দে মাথার ওপর গোটা আকাশটাই ভেঙে পড়বে! মেয়েটার ভয় করছিল। বড্ড ভয় করছিল!

প্রবল বৃষ্টিতে চতুর্দিক ধোঁয়া ধোঁয়া! কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তবু মরিয়া হয়ে পালানোর পথ খুঁজছিল সে। তার পাশে যে মানুষটা বসে আছে তার মুখ অদ্ভুত ভাবলেশহীন। ও ভাবতেও পারেনি যে শেষপর্যন্ত এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। শৈশবের দুঃস্বপ্ন শেষপর্যন্ত বাস্তব হল! ওর মনে হচ্ছিল, এটাও হয়তো একটা দুঃস্বপ্ন। হয়তো বাস্তবে এসব কিছুই ঘটছে না! এখনই ঘেমে নেয়ে ঘুম ভেঙে উঠে বসবে! সে চোখ বুজল, সব মিথ্যে! সব মিথ্যে!

‘ভয় করছে?’

পাশে বসে থাকা মানুষটা চাপা হিসহিস শব্দে জানতে চাইল, ‘তোমার ভয় করছে। তাই না?’

মেয়েটা দরদর করে ঘামছিল। তার সারা শরীর যেন ঠান্ডা হয়ে আসছে। হৃৎস্পন্দন দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। এই ঝড়জলের মধ্যে তাকে এনে ফেলল কেন ও? তবে কি ও সব জানে! প্রতিশোধ নিতে চায়? কীসের প্রতিশোধ? কেনই বা?

‘ভয় জিনিসটা খুব খারাপ!’ কেমন যেন যান্ত্রিক কণ্ঠস্বরে বলল সে, ‘মানুষকে দুর্বল করে দেয়। তোমার কী মনে হয়?’

মেয়েটা ভয়ে কেঁদে ফেলে। তার গলা শুকিয়ে আসছিল। কোনোমতে আবার বলল, ‘আমায় ছেড়ে দাও।’

মানুষটার মুখে শোকের ছায়া পড়ে, ‘ছেড়ে দিতে পারলে তো খুশিই হতাম। কারণ এরপর তো তুমি আমায় ছাড়বে না!

‘মানে?’

‘আমি কাউকে মরতে দেখতে পারি না! মৃত মানুষরা আমায় হন্ট করে। বলতে বলতেই নার্ভাসভাবে ঘর্মাক্ত মুখ মুছল সে, ‘রোজ রাতে সৌমিত্র, উৎপল, মৃন্ময়রা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। এরপর থেকে তুমিও আসবে।’

কথাটা শুনে গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল মেয়েটার। কী নিরুত্তাপ কণ্ঠে নিষ্ঠুরতম কথাগুলো বলে গেল ও! সৌমিত্র, মৃন্ময় ও উৎপলকে তবে ও—ই…!

‘আমি ওদের খুন করতে চাইনি।’ তার চোখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল, ‘কিন্তু অন্য উপায়ও ছিল না! জানো, ওরা আজও আমায় ভয় দেখায়। আমি ভয় পাই, ভীষণ ভয়!’

মেয়েটা অদ্ভুত বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। ওকে এখন আদৌ স্বাভাবিক মানুষ বলে মনে হচ্ছে না! অথচ একটু আগেও সবকিছু একদম ঠিকঠাক ছিল। কোথাও কোনও অঘটনের চিহ্নমাত্রও ছিল না। তখন কে জানত ও তাকে এমন বিড়ম্বনায় ফেলবে!

মানুষটা এবার তার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে, ‘রোজ রাত্রে ওরা আসে! আমায় ভয় দেখায়। বলে, ওদের মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। আমি ঘুমোতে পারি না। ওরা আমায় ঘুমোতে দেয় না! আমি ওদের চিৎকার শুনতে পাই। ওরা আমায় অভিশাপ দেয়। আমার খুব কষ্ট হয়। আমার খুব ভয়… ভয় লাগে…!’

বলতে বলতেই অঝোরে কেঁদে ফেলল সে। সেই কান্নার মধ্যে কোনও নাটক নেই। বরং এই মুহূর্তে ওকে দেখলে মায়া হয়। বুক ফাটা হাহাকারে ভেঙে পড়ল মানুষটা, ‘তুমিও আমায় ব্যথা দেবে। এরপর থেকে তুমিও আমায় ভয় দেখাবে! তোমরা কেউ ছাড়বে না আমায়! আমি কাউকে মারতে চাইনি। কিন্তু…!’

আবার একটা বজ্রপাতে মাটি কেঁপে উঠল। মেয়েটা ভয়ে দু-হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে। হাওয়ার দাপট ক্রমাগতই বাড়ছে। বাইরের প্রেক্ষাপট এখনও ঝাপসা। ঠিকমতো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধু ঝোড়ো হাওয়া প্রবল শব্দে এসে আছড়ে পড়ছে গাড়ির দরজায়, জানালায়। উদ্দাম বাতাস করাঘাত করে মরছে। মেয়েটির বুকের ভেতরটা ধ্বক করে ওঠে। হাওয়ায় গাড়িটা উলটে যাবে না তো! কিংবা কে বলতে পারে, হয়তো গাড়ির মাথায়ই বাজ পড়ল! ভয়ে, অসহায়তায় সে কেঁদে ফেলল, ‘আমায় ছেড়ে দাও প্লিজ! আমি তোমার কী ক্ষতি করেছি?’

মানুষটা বেশ কিছুক্ষণ নিষ্পলকে তার দিকে তাকিয়ে রইল। সত্যিই তো! মেয়েটা তার কী ক্ষতি করেছে! হয়তো করেছে। অথবা কিছুই করেনি। কিন্তু সে জানে, ওর মরা দরকার। এই মুহূর্তে এটাই চরম সত্যি যে মেয়েটাকে মরতে হবে।

‘বেশ। ছেড়ে দিলাম

সে গাড়ির দরজাটা খুলে দেয়। দরজা খুলতে না খুলতেই বৃষ্টি ঝোড়ো বাতাসের সঙ্গে এসে ঝাপটা মারল। মেয়েটা আঁতকে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেবে! বাইরে ঝড়, বৃষ্টি, বজ্র-বিদ্যুৎ অতিকায় দানবের মতো পৃথিবীকে ফালাফালা করে ফেলছে! এই দুর্যোগে তাকে গাড়ির বাইরে বেরোতে হবে!

‘প্লিজ।’ মেয়েটা দু-হাত জোড় করল, ‘আমায় বাঁচাও… আমি বাড়ি যাব।’

‘সেজন্যই তো দরজা খুলে দিলাম।’ জলে ভেজা চোখ মুছল মানুষটা। দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘পালিয়ে যাও।’

বুকের ভেতরে ভয়টা গুড়গুড় করে ওঠে। এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে যাবে কোথায়? সে অস্বচ্ছ প্রেক্ষাপটের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে আশেপাশে কোনও আশ্রয় আছে কি না। এমন কোনও জায়গা আছে কি যেখানে সে নিরাপদ বোধ করবে! কোন্‌টা বেশি বিপজ্জনক সেটাই মেয়েটা বুঝে উঠতে পারছিল না। গাড়ির ভেতরে বসে থাকা, না গাড়ি থেকে নেমে পালানোর চেষ্টা করা!

‘নেমে যাও।’

ঠান্ডা, কঠিন দুটো শব্দ ভেসে আসে। মেয়েটা মুক্তির আশায় চটজলদি, কোনও কথা না বলে গাড়ি থেকে নেমে যায়। কিন্তু নেমেই বুঝতে পারল কী ভুল করেছে! এক প্রলয়ঙ্কর দৈত্যের মতো ঝড় তেড়ে আসছে এইদিকেই! ভীষণ শব্দে হাওয়া তাকে প্রায় ছিটকে ফেলার উপক্রম করছে! আকাশে মেঘের মধ্যে বিদ্যুতের করাল হাসি! মেয়েটার মনে হল, এবার বাজ অভ্রান্তভাবে তার মাথাতেই পড়বে! যে কোনো মুহূর্তে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হতে পারে সে।

মেয়েটা বাঁশপাতার মতো কাঁপছিল! তার এখন ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এর চেয়ে গাড়ির ভেতরেই বরং ভালো ছিল। মাথার ওপর তবু গাড়ির ছাদ ছিল। এখন তো কিছুই নেই। প্রবল বৃষ্টি এসে আপাদমস্তক ভিজিয়ে দিচ্ছে তাকে। নির্লজ্জের মধ্যে বিদ্যুৎরেখা তাকে ক্রমাগতই ভয় দেখিয়ে চলেছে! এখন কোথায় যাবে সে! কে তাকে বাঁচাবে! সঙ্গে একটা ছাতাও নেই। অগ্রপশ্চাৎ চিন্তা না করে গাড়ি থেকে নেমে এসে চরম বোকামি করেছে।

‘আমি পালাতে চাই না। দরজা খোলো!’

সে চিৎকার করে কেঁদে উঠে গাড়ির দরজার ওপর সজোরে করাঘাত করতে করতে বলল, ‘আমি বাড়ি যাব, প্লিজ, আমায় বাড়ি পৌঁছে দাও। তোমার পায়ে পড়ি….!’

আবার প্রচণ্ড শব্দে পৃথিবী কেঁপে উঠল। মেয়েটার মনে হল এবার সে সত্যিই হার্টফেল করবে। ওই যে! বিদ্যুৎরেখা তার দিকেই তেড়ে আসছে! তাকে আঘাত করার জন্যই আসছে! বৃষ্টির জলে ইতিমধ্যেই আপাদমস্তক ভিজে গিয়েছে, কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই। কী করে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যায় তাই ভাবছে। প্রকৃতি যেন তার অবস্থা দেখে গমগম করে অট্টহাস্য হেসে উঠল। কী বোকা সে! ও তাকে এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিতেই চেয়েছিল! এটাই ছিল ওর প্ল্যান! ঝাপসা কাচের জানালা দিয়ে দেখল, মানুষটার মুখ ভাবলেশহীন। একজন যে দরজায় মাথা কুটে মরছে সেদিকে খেয়ালই নেই। বুঝতে পারল, এখন শত অনুরোধ করলেও খুলবে না গাড়ির দরজা।

এখন কী করবে সে! যে করেই হোক তাকে এখান থেকে পালাতে হবে। নয়তো মৃত্যু নিশ্চিত। মেয়েটা আর কিছু না ভেবে পাগলের মতো দৌড়তে শুরু করল। কিন্তু কোনদিকে যাবে! যেদিকেই যায় সেদিকেই বিদ্যুৎ নিষ্ঠুর ভ্রূকুটি করে তাকে ভয় দেখায়। গাছগুলো প্রভঞ্জনের সঙ্গে লড়তে লড়তে যেন হাত নেড়ে বারণ করছে তাকে। যে কোনও মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়তে পারে। ঝড় পেছনে শোঁ শোঁ শব্দে তেড়ে আসছে! সামনে কিচ্ছু ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না! সব ঝাপসা–ধোঁয়া ধোঁয়া!

‘বাঁচাও! বাঁচাও!’

মেয়েটা উন্মত্তের মতো দিশাহারা হয়ে দৌড়তে দৌড়তেই চেঁচিয়ে ওঠে। আজ বুঝি আর পরিত্রাণ নেই! সে মনশ্চক্ষে দেখতে পেল একরাশ অন্ধকার ছায়া তাকে ধাওয়া করছে। জনশূন্য রাস্তায় পাগলের মতো দৌড়চ্ছিল ও। দেখলে মনে হয় যেন ওকে কোনো দানব তাড়া করেছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে। একবারও সে পেছনে ফিরে দেখছে না যে আদৌ কেউ তাকে তাড়া করছে কি না! মনে মনে জানে, নিশ্চয়ই তার পেছন পেছন আসছে। সবাইকে মেরে ফেলবে! সবাইকে মেরে ফেলবে ওই মানুষটা! সৌমিত্র, মৃন্ময়, উৎপল—সবাইকে মেরেছে! তাকেও মারবে! কিন্তু কেন! কোন্ অপরাধে!

বাজ পড়ল! আবার—আবার! প্রচণ্ড ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। রুপোলি ঝলক চোখ ধাঁধিয়ে দেয়! আসছে! ও আসছে!

ছুটতে ছুটতেই সে পাগলের মতো চিৎকার করে বলল… ‘বাঁ-চা-ও! ও আমায় মেরে ফেলবে! ও আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে!’

আতঙ্কে, উত্তেজনায় সে খেয়ালই করেনি, পিছন দিক দিয়ে ভীম বেগে একটা ট্রাক ছুটে আসছে!

আমি জানতাম এমনই কিছু ঘটবে।

মানুষ অন্যকে ভয় দেখানোর সময় চিন্তা করে না যে একই ঘটনা তার সঙ্গেও ঘটতে পারে। আজীবন আমি ভয় পেয়ে এসেছি। কখনও নিজের মানুষদের, কখনও পরকে। মানুষ পালটেছে, কিন্তু ভয় নামক বস্তুটি আমার জীবনে কনস্ট্যান্ট ছিল। কখনও সে আমায় ছেড়ে যায়নি। কখনও রেহাই দেয়নি।

যখন খুব ছোট ছিলাম তখন আরশোলা, টিকটিকিকে ভয় পেতাম। আমার দাদারা সেই সুযোগটা নিত। আমার গায়ে আরশোলা ছেড়ে দিত! মরা টিকটিকি নাকের সামনে এনে ধরত। আমি ভয় পেতাম, ছোটো ছোটো পা ফেলে পালাতে চাইতাম। কিন্তু ওরা আমার পিছু ছাড়ত না। আমি ভয় পেতাম, কাঁদতাম। ওরা ভারী মজা পেত। আরও বেশি করে ভয় দেখাত!

এ কেমন মজা! একটা শিশু ভয় পাচ্ছে, কাঁপছে কিংবা কাঁদছে—এই দৃশ্যের মধ্যে কোথায় আনন্দ বা মজা লুকিয়ে আছে তা আমি আজও বুঝিনি! আজকাল লোকে এই জাতীয় মজাকে প্র্যাঙ্ক বলে! এ নাকি শুধুই নির্দোষ মজা! আমি তো কোথাও মজা পাইনি! একটা শিশুর নিষ্পাপ মনের ভেতরে ভয়কে গেঁথে দিয়ে কী আনন্দ পাওয়া যায়! আমার গায়ে আরশোলাগুলো কড়কড়ে পা দিয়ে হাঁটতে শুরু করত! টিকটিকি দেখে বমি করে ফেলেছিলাম। কিন্তু তাতে কারোর দয়া হয়নি। বরং ওরা আরও বেশি ভয় দেখাতে শুরু করল! অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে দেখতাম ওরা নির্লজ্জভাবে দাঁত বের করে হাসছে। এ কোন্ মধ্যযুগীয় রুচি! মজার এ কেমনতরো সংজ্ঞা যা অন্যের কষ্টের ওপর নির্ভর করে! আর এগুলোকে প্রশ্রয়ই বা দেওয়া হয় কেন?

একটু যখন বড় হলাম, তখন বুঝলাম ভয় দেখাতে না পারলে সম্মান আদায় করা যায় না। আমরা সবচেয়ে বেশি ভয় পেতাম বাবাকে। কারণ ছোটোবেলা থেকেই শুনে আসছি, আমার বাবা খুব রাগী মানুষ। আমাদের সংসারটা চলত ভয়ের ওপরে। মাকে চিরদিনই দেখেছি সিঁটিয়ে থাকতে। কখন বাবা রেগে যাবেন সেই ভয়েই আমাদের কাঁটা হয়ে থাকতে হত। বাবার রাগ ছিল চন্ডাল! অফিস থেকে ফিরে যদি দেখতেন আমরা টিভি দেখছি বা খেলা করছি, তাহলেই কঠিন শাস্তি পেতে হত। তার সাক্ষ্য বহন করত কচি নরম গালের ওপরে পাঁচ আঙুলের লাল দাগ! অথবা কপালে কালশিটে! দিদি একবার পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল বলে বাবা দেওয়ালে ওর মাথা ঠুকে দিয়েছিলেন! মায়ের কিছু বলার মতো বা প্রতিবাদ করার মতো ব্যক্তিত্ব ছিল না! তিনিও ভয় পেতেন বাবাকে! আমার বাবার মতে স্বামীকে স্ত্রী ভয় না পেলে স্বামীত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায় না। তাই শাস্তি মাকেও পেতে হত!

কিন্তু সত্যি সত্যিই কেন ভয় পেতাম লোকটাকে! এখন ভাবলে মনে হয়, ভয় পাওয়ার কোনও কারণই ছিল না! তিনি কোনো বড়োসড়ো, হোমরা চোমরা মানুষ আদৌ ছিলেন না—বরং ছাপোষা কেরানি বলতে যা বোঝায়, তিনি তা-ই ছিলেন। অফিসে সবসময়ই ওপরওয়ালার সামনে হাতজোড় করে ‘আজ্ঞে হুজুর’ বলতেন! স্ত্রী বা সন্তানকে কোনোরকমের বিলাস-ব্যসন দেওয়ার ক্ষমতাটুকুও তার ছিল না! এমন মানুষকে সমাজ পৌঁছে না! এরকম হরিপদ কেরানি বিশ্বে অজস্র রয়েছে এবং তাদের কেউ পাত্তা দেয় না! বাবার চেহারাও ছিল অতি সাধারণ। লম্বা চওড়া, সুপুরুষ তো ননই—বরং বেঁটে-খাটো একটা খুব সাধারণ মানুষ। তার চেহারা দেখলেও ভক্তি আসে না, স্বভাব দেখে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে না, তিনি আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যেও রাখতে পারেননি যে সেজন্য শ্রদ্ধা করব! তবে ভয় পেতাম কেন!

ভয় পেতাম কারণ তিনি আমাদের ভয় দেখাতেন! নিজেও জানতেন, মেজাজ ছাড়া তার আর কিছু নেই। মানুষ তাকে সম্মান করবে কোন্ কারণে? সম্পদ আর কিছু ছিল না ভয় ছাড়া। নিজে ছোটো হয়ে যাওয়ার ভয় পেতেন, তাই আমাদের ভয় দেখাতেন। পৌরুষে খাটো হয়ে যাওয়ার ভয়, সম্মান না পাওয়ার ভয়, নিজের যোগ্যতা না থাকার ভয় ছিল বলেই গোটা পরিবারকেই আজীবন ভয় দেখিয়ে গিয়েছেন। অফিসে, সমাজে তার তেমন কোনও প্রতাপ ছিল না। তাই সবচেয়ে আপন মানুষগুলোর ওপরই অত্যাচার করেছেন। এখন মনে হয় এটাই ছিল তার এন্টারটেইনমেন্ট। অফিসে যাওয়ার আগে, ও অফিস থেকে ফেরার পর সবাই শুধু তারই মন জুগিয়ে চলবে, জুজুর ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকবে, এটা দেখে মজা পেতেন।

আমি কাউকে ভয় দেখিয়ে কোনও মজা পাই না। বরং যারা ভয় দেখায়, আমি তাদের ঘৃণা করি। কারণ ছোটোবেলা থেকেই ভয় পেয়ে এসেছি। আজও পাই! আমি কয়েকলক্ষ ভুক্তভোগীদের মধ্যে একজন যারা প্রায় গোটা জীবনই ভয়ে ভয়ে কাটিয়ে এসেছে!

তাই আমার খেলাটার নাম ডেয়ার অর ডাই! কারণ জীবনের অপর নাম ভয়!

(৬)

‘উৎপল, মৃন্ময় আর সৌমিত্র জেজিইসি, মানে জলপাইগুড়ি গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের স্টুডেন্ট ছিলেন রাজা। তোমার আন্দাজ সঠিক। ওরা সহপাঠী ছিলেন।’

পবিত্র মৃদু স্বরে জানায়। আজ সারাদিন ধরে সে আর কৌশানী বোস মৃত ব্যক্তিদের ব্যাপারে তদন্ত করে বেরিয়েছে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে যতখানি সম্ভব তথ্য সংগ্ৰহ করছিল ওরা দু-জনে। মৃত ব্যক্তিদের পরিবার, বন্ধুবান্ধব, কলিগদের জিজ্ঞাসাবাদ করে যতটুকু জানা গিয়েছে, পবিত্র তা জানাল, ‘একই ব্যাচে পড়তেন এরা সবাই। একই ইয়ারে পাশ করেও বেরিয়েছেন’।

‘বন্ধু না শত্রু?’

‘বন্ধু। রাজা, প্রত্যেকটা লোক প্রত্যেকের সঙ্গে লিঙ্কড। এরা সবাই একই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের স্টুডেন্ট, একই বোর্ডিঙে থাকতেন। খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড। এক কথায় অভিন্নহৃদয় বন্ধু।’ পবিত্র আস্তে আস্তে বলল, ‘এদের একটা ব্যান্ডও ছিল। সৌমিত্র আর উৎপল খুব ভালো গান গাইতে পারতেন। আর মৃন্ময় ভালো গিটার বাজাতেন। তবে সম্প্রতি আর যোগাযোগ ছিল না। ইনফ্যাক্ট, অদ্ভুত ব্যাপার, কলেজ থেকে বেরোনোর পর কেউ কারোর সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। আশ্চর্য নয়? সচরাচর কলেজ ফ্রেন্ডসদের মধ্যে কিছুটা হলেও কানেকশন থাকে। কিন্তু এদের মধ্যে ছিল না!’

‘কিউরিঅ—সা–র অ্যান্ড কিউরিঅ-সার! কতজনের গ্রুপ ছিল পবিত্ৰ?’

‘সাতজনের।’

‘মাই গুডনেস! সুপারিও তো সাতজনের দেওয়া হয়েছিল!’ অধিরাজের কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা, ‘টার্গেট এই সাতজনই নয়তো? বাকি চারজনের খবর পেয়েছ?’

‘জলপাইগুড়ি পুলিস কয়েকঘণ্টার মধ্যেই ডিটেলস পাঠিয়ে দেবে বলেছে। তবে…।’

পবিত্র আর কিছু বলার আগেই কৌশানী বোস বলে ওঠে, ‘লোকগুলো তেমন সুবিধার ছিল না স্যার।’

অধিরাজের চোখে কৌতূহল—’মানে?’

‘মানে স্টুডেন্ট লাইফে এরা রীতিমতো লাগামছাড়া লাইফ লিড করত। মদ, গাঁজা কিছুই বাকি রাখেনি। এমনকি র‍্যাগিঙেও সিদ্ধহস্ত ছিল। এদের গ্রুপটা রীতিমত ‘বুলিং’ করে বেড়াত। অনেক কাণ্ডই করেছে, কিন্তু ধরা পড়েনি। গোটা কলেজ, বিশেষ করে জুনিয়ররা ওদের ভয়ে কাঁপত।’

‘ইন্টারেস্টিং।’

অধিরাজের চোখে অন্যমনস্ক চাউনি, ‘ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে হচ্ছে। হঠাৎ করে এতদিন পরে বেছে বেছে ওই গ্রুপের লোকগুলো মরছে কেন! কোনও পুরনো ক্রাইমের রেকর্ড পেয়েছেন মিস…?’

অধিরাজ আবার মিস কী যেন-র গ্রামাফোন রেকর্ডে আটকাতে যাচ্ছে দেখে কৌশানী তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘আপনি আমায় কৌশানী বলেই ডাকুন স্যার।‘

‘আপনার নামটা সারনেমের চেয়েও বেশি কঠিন সেনোরিটা।’

অধিরাজ যথারীতি ‘সেনোরিটা’তেই ফিরে গিয়েছে। সে মৃদু হাসল, ‘তার চেয়ে এই ভালো। যাই হোক, আপনারা আরও একটু খোঁজ নিন। আচমকা একই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের, একই গ্রুপের মানুষগুলোর পরপর সন্দেহজনক মৃত্যু হচ্ছে কেন! সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, যারা কলেজ লাইফে ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিল, কলেজ শেষ করার পর আর যোগাযোগ রাখেনি কেন! কী এমন ঘটনা ঘটল যে এরা কেউ কারোর সঙ্গে সম্পর্কই রাখল না!’

‘তোমার মনে হয় যে এর মধ্যে কোনও গোলমাল আছে রাজা?’

‘থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।’ অধিরাজ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘তুমিই বলো, যারা একসঙ্গে পড়াশোনা করল, একসঙ্গে ব্যান্ডও করল, তুমিই বললে, ‘অভিন্নহৃদয় বন্ধু’ ছিল, তাদের হৃদয় হঠাৎ ভিন্ন হয়ে গেল কী করে? আজকাল তো ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপের যুগ। স্কুল, কলেজ ফ্রেন্ডদের মধ্যে ফিজিক্যালি যোগাযোগ না থাকলেও সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে কানেকশন থাকে। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি হয়। তার মাধ্যমেও ভার্চুয়াল যোগাযোগ থাকে। অন্তত আমার কলেজ ফ্রেন্ডরা আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড লিস্টে আছে। আমার প্রশ্ন, এদের মধ্যে কি সেই সামান্যতম যোগাযোগটুকুও ছিল না? যদি না থাকে তবে নির্ঘাৎ কোনও বড় গোলমাল আছে।’

‘ওদের সবার সোশ্যাল অ্যাকাউন্ট এখনও চেক করিনি। তবে উৎপল মিত্র-র ফোন, ল্যাপটপ আমাদের কাছেই আছে। ওঁর ফেসবুক বা ইনস্টার প্রোফাইলে কিন্তু সৌমিত্র বা মৃন্ময়কে পাওয়া যায়নি। ফোনে বা হোয়াটস অ্যাপেও নয়।’

‘বাকি দু-জনের ফেসবুক, ইনস্টা আর হোয়াটসঅ্যাপ চেক করো। আমার মন বলছে, ‘সামথিং ইজ রটেন ইন দ্য স্টেট অব ডেনমার্ক।’ একমাত্র তখনই মানুষ পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ রাখে না, যখন তাদের অতীতে কিছু দাগ থাকে।’

‘মানে?’ পবিত্র বলল, ‘তুমি বলতে চাইছ ওদের পাস্টে কোনও মিস্ট্রি আছে?’

‘থাকা অসম্ভব নয়। সাধারণ মনস্তত্ত্ব পবিত্র।’ অধিরাজের চোখদুটো গভীর চিন্তায় মগ্ন, ‘মানুষের অতীত যখন সুখকর হয় তখন তার জীবনে সেই অতীতের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকটি মানুষের গুরুত্ব থাকে। সে সেই অতীতের স্বাদ বারবার চাখতে চায়, স্মৃতি রোমন্থন করতে চায় বলেই পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে কানেক্টেড থাকে। কিন্তু যখন অতীতের কোনও স্মৃতি বেদনাদায়ক হয়, বা কেউ সেই স্মৃতি ভুলে যেতে চায়, একমাত্র তখনই সব সম্পর্ক ছেদ করে। এখানে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? একদল তরুণ যারা একসঙ্গে পড়াশোনা করেছে, একই হোস্টেলে হয়তো পাশাপাশি থেকেছে, প্যাশনের জায়গাটাও ভাগাভাগি করে নিয়েছে, একসঙ্গে হয়তো স্বপ্নও দেখেছে—আচমকা তাদের মধ্যে আর কোনো যোগাযোগই রইল না! আমার প্রশ্ন-কেন!’

পবিত্র-র মুখে চিন্তার ছাপ, ‘এই অ্যাঙ্গেলে ভাবিনি।’

‘ভাবা উচিত ছিল।’ অধিরাজ টেবিলের ওপরে পেপারওয়েটটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, ‘মাদমোয়াজেল যেটা বলেছেন, সেই অ্যাঙ্গেলটাও কিন্তু ফেলনা নয়।

পবিত্র দেখল মুহূর্তের মধ্যে কৌশানী বোসের চোখে মুখে একটা উজ্জ্বল আলো খেলে গেল। মৃদু স্বরে বলল সে, ‘স্যা!’

‘আপনিই বলেছেন যে লোকগুলো আদৌ সুবিধার ছিল না। বুলিং এবং র‍্যাগিঙে সিদ্ধহস্ত যারা হয়, তাদের জীবনে অনেক শত্রু থাকে। তেমন কোনও শত্রু আছে কি না, কিংবা র‍্যাগিঙ করতে গিয়ে কোনও অঘটন ঘটেছিল কিনা সেই খোঁজটাও নেওয়া দরকার।’ সে পেপারওয়েটটাকে যথাস্থানে রেখে বলে, ‘আপাতত বর্তমানে আমরা কোনও শত্রুকে দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু হাই চান্স আছে যে অতীত থেকে কেউ উঠে এসেছে। অন্তত এই লোকগুলোর চরিত্র তেমন সম্ভাবনাই দেখাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কে?

‘কিন্তু রাজা…।’ পবিত্র বলল, ‘এদের মধ্যে একমাত্র উৎপল মিত্র ছাড়া আর কারোরই অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। বাকি দু-জন হার্ট অ্যাটাকে মরেছে, আর উৎপল হাইরাইজ থেকে লাফিয়ে পড়ে। হার্টফেল অর প্রব্যাবল সুইসাইড!’

‘তুমি কালুর কথা ভুলে গেলে পবিত্র।’ সে স্মিত হাসে, ‘এমনি এমনিই নিতান্ত ছাপোষা কতগুলো মানুষকে মারবার জন্য নিশ্চয়ই কেউ কালুকে সুপারি দেবে না। ও নিজের হাতে মারেনি ঠিকই, কিন্তু ওকে কেউ শিখন্ডী হিসাবে সামনে রাখতে চেয়েছিল। তাছাড়া বাকি মৃত্যুগুলো দেখো! সৌমিত্র অতরাতে হসপিটালের মর্গে কী করছিলেন? মৃন্ময়কে মৃত অবস্থায় এম.আর.আই মেশিনের মধ্যে পাওয়া গেল, কিন্তু টেকনিশিয়ানরা কেউ জানেই না যে কীভাবে লোকটা সেখানে পৌঁছল! তোমার এই দুটো মৃত্যু স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে?’

পবিত্র একটু চিন্তা করে নিয়ে মাথা ঝাঁকাল। পয়েন্টে জোর আছে। মৃত্যুগুলোকে যতটা স্বাভাবিক দেখায়, আদৌ ততটা নয়। অনেক প্রশ্নই লুকিয়ে আছে এর মধ্যে।

‘সাতজনের মধ্যে তিনজনকে আমরা খুঁজে পেয়েছি। বাকি চারজনকেও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুঁজে বের করতেই হবে পবিত্র।’ অধিরাজ একটু অধৈর্য, ‘নয়তো দেরি করে ফেলব।’

‘ওকে।’

পবিত্র মাথা ঝাঁকিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। পরিস্থিতির গুরুত্ব সে বুঝতে পেরেছে। কৌশানী বোসও তার পিছন পিছন গেল।

অধিরাজ অন্যমনস্কভাবে একটা সিগারেট ধরায়। তার মুখে চিন্তার ছাপ প্রকট! এ কী অদ্ভুত রহস্যের মুখোমুখি হয়েছে সে! ভিতরে কিছু একটা প্যাঁচ আছে, তা বুঝতে পারছে, কিন্তু সেটা কী, কোথায়ই বা প্যাঁচটা রয়েছে তা বুঝে উঠতে পারছে না। যদি পরপর তিনটে মৃত্যু না হত তাহলে মৃতদের পরিবারকে সন্দেহ হত। যদিও আপাতদৃষ্টিতে কোথাও কোনও মোটিভ নেই। তিনজন মানুষ সাময়িকভাবে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। অন্যান্য মানুষদের মতো তারাও আপ্রাণ লড়াই করছিলেন বেঁচে থাকার। হঠাৎ বজ্রপাতের মতো মৃত্যু নেমে আসবে তা কে জানত! স্বামী-স্ত্রীয়ের মধ্যে জটিলতাও ছিল না। ওরা নিজেদের কেরিয়ার নিয়ে চিন্তান্বিত ছিলেন, কিন্তু আলাদা কোনও অ্যাঙ্গেল এখনও দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কালুকে কেউ সুপারি দিল কেন? তাও আবার সাতজনের! এরাও সংখ্যায় সাত বন্ধু! কেউ বেছে বেছে সাত বন্ধুকে মারবে কেন! তবে কি কলেজেরই কোনও ঘটনার ফলাফল আজকের এই দুর্ঘটনা?

ধোঁয়ার রিং বানাতে বানাতে আপনমনেই ভেবে চলেছিল সে। কী গল্প লুকিয়ে আছে এর পেছনে? ওষুধের ফয়েলটারই বা কী রহস্য? কেউ ছাদে বসে ওষুধ খাবেই বা কেন! গোটা ঘটনাটাই কেমন যেন ধোঁয়াশা ভরা! কী দেখাতে চেয়েছিলেন উৎপল মিত্র! কার দিকে নির্দেশ করেছিলেন!

মাথার মধ্যে নানারকম চিন্তাই ভিড় করে আসছিল অধিরাজের। চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে গেল তার ফেভারিট রিংটোনের শব্দে। ডঃ চ্যাটার্জী ফোন করছেন।

‘বলুন, মহাপ্রভু!’

‘হল কী!’ ও প্রান্তে ডঃ চ্যাটার্জী একদম খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠলেন, ‘আগে তো দুর্বাসা বলে ডাকতে, এখন আবার মহাপ্রভুকে ধরেছ! শয়তানের আনাষ্টম!

‘আপনি দেখছি কিছুতেই সন্তুষ্ট হন না’। অধিরাজ গম্ভীর স্বরে বলে, ‘দুর্বাসা বললে মুশকিল, মহাপ্রভু বললেও মুশকিল! কলসীর কানা খেয়েও সপ্রেমে মহাপ্রভু বলে ডাকলাম, তাতেও আপনার হচ্ছে না! এরপর থেকে শকুনি মামা বলে ডাকব।’

‘আহ্লাদ!’ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ প্রবল চটলেন, ‘ইল্লি আর কী! একবার ডেকেই দেখো! পুরো জ্বালিয়ে না দিয়েছি!

‘এই তো! একদম সঠিক লোকটাকে পাকড়াও করেছেন। এই জ্বালানোর বিজনেসটা রামায়ণে যেন কার ছিল?’

ডঃ চ্যাটার্জী নিজেই এবার স্রেফ জ্বলে গেলেন, ‘কুৎসিত–ক-দা-কা-র বাঁদর! আমায় কায়দা করে হনুমান বলা হচ্ছে! কিচ্ছু বলব না। যাও, ফো-টো!’

‘আরে ডক্!’ অধিরাজ কিঞ্চিৎ হাওয়া দেয়, ‘কথায় কথায় এত গোঁসা করলে হয়? আপনি তো মোগলসম্রাটের বউ’দের মতো রাগ করছেন! দিল্লীশ্বরের মতো এবার ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টকেও গোঁসাঘরের আমদানি না করতে হয়!’

ডঃ চ্যাটার্জী এবার নাক দিয়ে ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করে বললেন, ‘শোনো, নছল্লা করার সময় নেই। যা বলতে ফোন করেছি, সেটা আগে শোনো, তারপর যত খুশি চ্যাংড়ামি কোরো’।

‘বেশ। বলুন। আই অ্যাম অল ইয়োর্স’।

‘সৌমিত্র এবং মৃন্ময়ের ফরেনসিক রিপোর্ট দেখেছি আমি। লোকগুলো কার্ডিয়াক ফেইলিওরেই মারা গিয়েছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে উৎপলের মতো ওদেরও রক্তে ব্লাড গ্লুকোজের মাত্রা খুব বেশি ছিল। মৃন্ময়ের ব্লাড সুগারের হিস্ট্রি থাকলেও সৌমিত্র’র নেই। ক্যাটিকোলামাইন, এক্সট্রা অ্যাড্রিনালিনও রয়েছে।’

‘তার মানে উৎপলের মতো এই দু-জনও মৃত্যুর আগে ভয় পেয়েছিল?’

‘ইয়েস। ডেফিনিটলি। তবে উপরোক্ত দু-জনে স্ট্রেসডও ছিল। ওদের পরিবারের বয়ান অনুযায়ী দু-জনেই কঠিন সময়ের সঙ্গে লড়াই করছিল। দুশ্চিন্তায়, দুর্ভাবনায় স্ট্রেস কার্ডিওমায়োপ্যাথি হতেই পারে। তাই সম্ভবত ফরেনসিক ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামায়নি।’

‘আপনার কী মনে হয় ডক? মৃত্যুগুলো স্বাভাবিক? কোথাও কোনো রহস্য নেই?

‘রাজা, তুমি কি ঝোপে ঝোপে বাঘ দেখছ! একজন এম.আর.আই স্ক্যান করতে গিয়ে হার্টফেল করল, আরেকজন সতেরো তলার বিল্ডিঙের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ল। এর মধ্যে রহস্য কোথায় রে বাবা! এই কোভিড-পরিস্থিতির মধ্যে গুচ্ছ গুচ্ছ লোক আত্মহত্যা করছে বা হার্টফেলে মরছে। রোজ কাগজ খুললেই এক ডজন এরকম খবর দেখা যায়। তাদের সবার মৃত্যুকে অস্বাভাবিক মনে হয় তোমার? কোনো এক হিস্ট্রিশিটার গাঁজা খেয়ে তোমার কানের কাছে ‘লে লুল্লু’ বলল, আর তুমিও বাঁই বাঁই করে ‘লুল্লু’র পেছনে পাক খেতে শুরু করলে!’

‘রহস্যটা ইতি গজ ডক। অশ্বত্থামা হত অবধিই দেখা যায়, ইতি গজটা অদৃশ্য। মর্গের কেসটাকে কী বলবেন? লোকটা কোনো প্রয়োজন ছাড়াই মর্গে ঢুকেছিল কেন? অসময়ে লাশদের সঙ্গে হ্যালোউইন পার্টি দিতে গিয়েছিল?’

‘আরে, ওটা তো ক্লিন কার্ডিয়াক ফেইলিওরের কেস!’ ডঃ চ্যাটার্জী প্রায় বুলডগের মতো খিঁচিয়ে ওঠেন, ‘মার্ডার কি হালুয়া, যে যখন তখন প্লেটে সার্ভ করলেই হল! অত সহজ?’

‘মার্ডার খুব সহজ ডক।

‘বটে? তুমি বলতে চাও মার্ডারার হাত বাড়িয়ে খ্যাঁচ করে ভিকটিমের হার্টটাকে ধরে থামিয়ে দিয়েছে?’

‘এই তো স্যার! আপনি অবিকল মিস কাটামুণ্ডুর থিওরি ধরেছেন!’

‘হতচ্ছাড়া!’ ডঃ চ্যাটার্জী এবার প্রায় তরমুজের মতো দমাস দমাস করে লাফিয়ে ল্যাবের মেঝে দুরমুজ করতে লেগেছেন, ‘জাম্বুবান, ট্যারা তে-চোখো মাছ! এই কোভিডের জ্বালায় লোকে কীভাবে মরবে ভেবে পাচ্ছে না, আর উনি খুনের থিওরি বানাচ্ছেন! হুঃ!

‘তা নয়।’ অধিরাজ শান্তস্বরে বলে, ‘আপনার ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগছে না? তিনটে লোকই মরার আগে ভয় পেয়েছিল, এটা কি শুধুমাত্রই কো-ইনসিডেন্স?’

‘নয়তো কী?’ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ কণ্ঠস্বর ব্যঙ্গতীক্ষ্ণ, ‘ওদের সবাইকে ভূতে তাড়া করেছিল?’

‘ভূত কি না জানি না! কিন্তু এর পেছনে কোনও না কোনও গল্প তো আছেই। ‘ অধিরাজ সিগারেটের দগ্ধাবশেষ অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘আমার সন্দেহ কতটা সঠিক তা একটু পরেই বোঝা যাবে।’

‘মানে?’ ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারলেন না ভদ্রলোক, ‘কী হবে একটু পরে?’

‘অর্ণব আর মিস দত্ত দুই হসপিটালে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়েছে। ওরা মর্গের অ্যাটেনডেন্ট বনোয়ারিলালের সঙ্গেও কথা বলবে।’

‘তাতে কী?‘

‘কিছুই নয়।’ সে আস্তে আস্তে বলে, ‘যদি আমার সন্দেহ সঠিক হয় তবে বনোয়ারিলালকে পাওয়া যাবে না।’

বনোয়ারিলালকে সত্যিই পাওয়া গেল না!

অর্ণব আর মিস আত্রেয়ী দত্ত হসপিটালে গিয়ে জানতে পারল যে গত কয়েকদিন ধরে বনোয়ারি আসছে না। তার মোবাইলও সুইচড অফ! হসপিটালের কর্মীরা জানাল রাতে মর্গের ডিউটিতে বনোয়ারিই থাকত। সৌমিত্র’র মৃত্যুর দিন ঠিক কী হয়েছিল তা একমাত্র সে-ই বলতে পারে। কিন্তু বেশ কিছুদিন হল তার দেখা নেই।

‘যেদিন মর্গে লাশ পাওয়া যায় তার আগের সিসিটিভি ফুটেজ চাই। দিতে পারবেন?’

‘নিশ্চয়ই।’ অর্ণবের প্রশ্নে ইতিবাচক মাথা ঝাঁকালেন হসপিটালের অন্যতম কর্মকর্তা ডঃ বাসু, ‘কতদিনের ফুটেজ চাই আপনাদের?’

‘আপাতত মৃত্যুর আগের কয়েক সপ্তাহের ফুটেজ দিন। প্রয়োজন পড়লে আবার আসব।’

‘বেশ।’

আত্রেয়ী যোগ করল, ‘আর বনোয়ারিলালের ঠিকানাটাও লাগবে।’

‘পেয়ে যাবেন ম্যাডাম।’

হসপিটাল থেকেই বনোয়ারির ঠিকানা নিয়ে তার বাড়িতে পৌঁছে গেল অর্ণবরা। কিন্তু সেখানেও ব্যর্থতা। বনোয়ারির বাড়ির দরজায় একটা পেল্লায় তালা ঝুলছে! অর্ণব নীচু স্বরে বলল, ‘পাখি উড়েছে মনে হচ্ছে!’

‘পালিয়ে গেছে বলছেন?’ আত্রেয়ী একটু ভেবে বলল, ‘কিন্তু পালাবে কেন?’

‘সহজ হিসেব।’ অর্ণব আত্মবিশ্বাসী স্বরে বলে, ‘হয় সে কিছু জানত, নয়তো সৌমিত্র-র মৃত্যুতে তারও হাত আছে।’

ওরা বনোয়ারির প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসাবাদ করল। প্রতিবেশীরা কেউ জানে না যে বনোয়ারি কোথায় গিয়েছে। শুধুমাত্র এইটুকু জানা গেল যে দিন চার পাঁচ আগে তাকে শেষ দেখা গিয়েছে। তারপর সে কোথায় গিয়েছে তা কারোর জানা নেই। কয়েকদিন আগেই বনোয়ারির সঙ্গে তার প্রতিবেশীদের ঝামেলা হয়েছিল। একেই চতুর্দিকে কোভিড, তার ওপর হসপিটালের মর্গের ডিউটি। বনোয়ারিকে নিয়ে সেজন্য প্রতিবেশীদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল। কবে হসপিটাল থেকে করোনা ভাইরাস নিয়ে ফিরবে তার ঠিক নেই। ওটাই তো এই মুহূর্তে কোভিডের আঁতুড়ঘর। তারপর তার থেকে গোটা অঞ্চলে ছড়াবে। এমনকি তার বাড়িওয়ালাও আপত্তি করেছিল। তারপর থেকেই বনোয়ারির দেখা নেই। স্বাভাবিকভাবেই সকলে ধরে নিয়েছিল, হয়তো সে হসপিটালেই থাকার ব্যবস্থা করে নিয়েছে। তার অনুপস্থিতি নিয়ে তাই কেউ মাথা ঘামায়নি।

‘বনোয়ারি বাড়িতে কি একাই থাকত?’ মিস দত্ত স্মার্টলি প্রশ্ন করে, ‘ওর ফ্যামিলিতে কে কে ছিল?’

‘এখানে কেউ ছিল না ম্যাডাম’। এক প্রতিবেশী জানায়, ‘শুনেছি ওর বউ, ছেলে-মেয়ে আছে। তারা সবাই দেশে থাকে। এখানে ও একাই থাকত। ছুটি পেলে দেশে যেত।’

‘ওর দেশ কোথায় জানেন আপনারা?’

‘বিহারে।’ সংক্ষিপ্ত জবাব এল, ‘এর বেশি কিছু জানি না।’

প্রতিবেশীরা না জানলেও বাড়িওয়ালার কাছ থেকে বনোয়ারির পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস পাওয়া গেল। বিহারের ‘ফতেহপুর’-এ তার বাড়ি। তাদের বাড়িতে ফোন না থাকলেও পাশের বাড়ির ফোন নম্বর দেওয়া আছে ডকুমেন্টসে। অর্ণব সেখানে ফোন করে জানল, বনোয়ারি দেশেও যায়নি। এমনকি বেশ কিছুদিন ফোনে যোগাযোগও করেনি।

বার্তালাপ শেষ করে ফোন কেটে দিল অর্ণব। তার মুখে চিন্তার রেখা স্পষ্ট। আত্রেয়ী সেটাই লক্ষ্য করে বলল, ‘তাহলে কি স্যারের আন্দাজই সঠিক? মৃত্যুগুলো স্বাভাবিক নয়?’

‘একসঙ্গে এতগুলো কো-ইনসিডেন্স হতে পারে না মিস দত্ত’। অর্ণব আপনমনেই বিড়বিড় করে, ‘স্যার খুব ভুল সন্দেহ করছেন না। বনোয়ারিলালের হঠাৎ উবে যাওয়ার আর কী কারণ হতে পারে?’

‘তা ঠিক।’ আত্রেয়ী মাথা ঝাঁকায়, ‘তাহলে এখন কী করণীয়?’

অর্ণব আশেপাশে ভালো করে দেখতে দেখতে বলল, ‘অফিশিয়ালি কিছু করার নেই। কিন্তু আন অফিশিয়ালি আছে।’

‘মানে?’

‘ব্যাটার বাড়িতে ঢুকে খোঁজ করব। দেখি কী পাওয়া যায়।

‘কিন্তু আমাদের কাছে তো সার্চ ওয়ারেন্ট নেই!

আত্রেয়ী চোখ কপালে তুলে ফেলেছে, ‘সার্চ করাটা কি ঠিক হবে?’

অর্ণব মুচকি হাসল, ‘ঠিক ভুল কে দেখেছে মিস দত্ত? আমাদের কাছে সার্চ ওয়ারেন্ট নেই তা আপনি আর আমি জানি। আর কেউ জানে না।’

আত্রেয়ী হাসতে হাসতে ইশারায় বোঝাল যে সে এ বিষয়ে কোনওভাবেই মুখ খুলছে না। তার দৃষ্টিতে স্পষ্ট প্রশ্রয়।

‘চলুন, দরজাটা খোলার ব্যবস্থা করি।’

মিস দত্ত একটু বিস্মিত স্বরে বলল, ‘কিন্তু তালা ঝুলছে যে!’

অর্ণব পকেট থেকে ধাতব তার বের করতে করতে বলল, ‘এখন ঝুলছে। একটু পরেই, ‘ঝুলো না’ কেস হয়ে যাবে।’

আত্রেয়ী বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখল, সে খুব মনোযোগ সহকারে তারটাকে তালার গর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে নাড়াচাড়া করছে। এই মুহূর্তে তাকে দেখলে পাকা চোর মনে হয়! সে আস্তে আস্তে বলে, ‘আপনি কি সবসময়ই পকেটে তার নিয়ে ঘোরেন অফিসার সরকার?’

‘ঘুরতে হয়।’ অর্ণব নিজের কাজ করতে করতে বলল, ‘স্যারকে দেখে শিখেছি। কখন কোথায় দরকার পড়ে যায়?’

আত্রেয়ী সন্তর্পণে এদিক ওদিক দেখে। কেউ দেখছে না তো! সে আর কথা না বাড়িয়ে অর্ণবকে কভার করে দাঁড়ায়। যাতে সহজে কেউ বুঝতে না পারে যে ও কী করছে। অর্ণব ব্যাপারটা লক্ষ্য করে স্বস্তি পেল। সঙ্গী যদি বুদ্ধিমান হয় তবে অর্ধেক কাজ সহজ হয়ে যায়। আত্রেয়ী সেদিক দিয়ে যথেষ্টই সহায়তা করছে।

কড়াৎ করে একটা শব্দ। পরক্ষণেই অত বড় তালাটা খুলে গেল। অর্ণব অবলীলায় মুহূর্তের মধ্যে দরজাটা খুলে ফেলল। আত্রেয়ীর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘আসুন’।

ঘরের ভেতরে ঢুকতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা মারল। বেশ কয়েকদিন ধরেই সম্ভবত এ ঘরের দরজা জানালা খোলা হয়নি। জানালা বন্ধ থাকায় ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। অর্ণব একটু হাতড়াতেই সুইচ বোর্ড পেয়ে গেল। ঘরের আলো জ্বেলে দিতেই ভেতরের চিত্র দৃশ্যমান হল।

ছোট্ট এক কামরার ঘর। জিনিসপত্র সব এদিক ওদিক ইতস্ততঃ ছড়ানো ছিটানো রয়েছে। দেখলেই বোঝা যায় যে গৃহস্বামী বেশ অগোছালো প্রকৃতির। একপাশে একটা ক্যাম্পখাট। তার ওপরে একগাদা জামাকাপড়। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালে ছোট্ট একফালি সবজিবাগান দেখা যায়। লাউ, কুমড়ো, টম্যাটো আর লঙ্কাগাছ চোখে পড়ল। একটা লতা জানালা বেয়ে পেঁচিয়ে উঠে ঘরে উঁকি মারছে। তার উলটো দিকে ছোট্ট একটা স্টোভ। তার পাশে এঁটো বাসন জড়ো করা। ভুক্তাবশেষ এখনও হাঁড়িতে পড়ে রয়েছে। হাঁড়ির পাশে একটা মদের বোতল! অর্ণব দ্রুত হাতে গ্লাভস পরে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখছে সব। আত্রেয়ীর হাতেও গ্লাভস! সে মদের বোতলটা তুলে ধরে বলল, ‘এটা প্রায় ভর্তি স্যার!’

‘বিলিতি মাল!’ অর্ণব আপনমনেই বলে, ‘মনে হচ্ছে হঠাৎ করেই কিছু টাকা পেয়ে গিয়েছিল লোকটা।’

বলতে বলতেই ক্যাম্পখাটের ওপর থেকে একটা জামা তুলে নিয়েছে সে, ‘এটা নতুন কেনা হয়েছে। প্রাইস ট্যাগ এখনও চকচক করছে। ব্র্যান্ডেড!’

‘ব্র্যান্ডেড জুতোও আছে স্যার।’ আত্রেয়ী ক্যাম্পখাটের তলা থেকে চকচকে একজোড়া নতুন ব্র্যান্ডেড জুতো বের করে আনে। দেখলেই বোঝা যায় এখনও ব্যবহার করা হয়নি জুতো জোড়া। খাটের নীচে আরও দু জোড়া জুতো পড়ে রয়েছে। একটা হসপিটালের জুতো। অন্যটা সাধারণ হাওয়াই চপ্পল!

অর্ণব আর দেরি না করে অধিরাজকে ভিডিও কলে ধরল। বনোয়ারিলালকে যে পাওয়া যাবে না এ আশঙ্কা অধিরাজের আগেই ছিল। তাই খবরটা শুনে সে বিশেষ বিস্মিত হল না। কিন্তু ঘরের অবস্থা দেখে অধিরাজ নিজের লব্জটা উচ্চারণ করে, ‘স্ট্রেঞ্জ! লোকটা এত পয়সা দিয়ে বিলিতি মদের বোতল কিনল, জামা-কাপড় কিনল, জুতোও কিনল, তারপর সব ছেড়েছুড়ে পালিয়ে গেল!’

‘খুব তাড়া ছিল মনে হয় স্যার। এঁটো বাসনগুলো পর্যন্ত সাফ করার সময় পায়নি।’

অর্ণবের কথা শুনে একটু অন্যমনস্ক স্বরে বলল অধিরাজ, ‘এঁটো বাসন তবু বুঝি, কিন্তু সাধের বিলিতি, জামা, জুতো ফেলে চলে গেল! জামা পরে যায়নি! নিশ্চয়ই তার খুব বেশি জুতোও ছিল না। তিনজোড়া জুতো তো ঘরেই আছে দেখছি! জুতোও পরেনি?’

‘হয়তো অন্য জামা-জুতো পরে গেছে।’

অর্ণবের কথা ঠিক মনে ধরল না অধিরাজের। সে মাথা নাড়ে, ‘না অর্ণব। একগাদা টাকা দিয়ে ব্র্যান্ডেড জামা জুতো কিনে কেউ সেগুলো ফেলে রেখে যায় না। যদি তার হাতে শুধু একপিস জামা আর একজোড়া জুতো পরে পালানোর অপশনও থাকত, তবে সে এই নতুন জামা আর জুতো পরেই যেত।’

‘তবে?’

কয়েক সেকেন্ড কী যেন ভাবল অধিরাজ। তারপর বলল, ‘ঘরে কোনও ক্যাশ টাকা পেয়েছ?’

‘না স্যার।’

‘ওর মোবাইল?’

‘না’।

‘আরেকবার ভালো করে খুঁজে দেখো তো।’

‘ওকে স্যার।’

অর্ণব আর আত্রেয়ী ফের তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখল ঘরটা। এত ছোট ঘরে কিছু লুকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব। ক্যাম্পখাটের চাদর তুলে তোষকের তলায় হাতড়াতে হাতড়াতে আচমকা থেমে গেল আত্রেয়ী। উত্তেজিত গলায় বলল, ‘এখানে কিছু আছে স্যার।’

ভিডিও কলের মাধ্যমে অধিরাজ সবই দেখছিল।

ওরা দু-জনে মিলে তোষকটা তুলে ফেলতেই চমক! তোষকের তলায় পড়ে আছে টাকার বান্ডিল! কমপক্ষে লাখ দুই তিন তো হবেই। তার সঙ্গে একটা ছোট মোবাইল! সম্ভবত এটাই বনোয়ারির ফোন!

‘টাকা আর ফোন, কোনওটাই নিয়ে যায়নি।’ অধিরাজের কণ্ঠস্বরে বিস্ময়, ‘এত টাকা ফেলে, ব্র্যান্ডেড জামা জুতো ফেলে গেল কোথায় লোকটা! এত বৈরাগ্যের কারণ কী! ব্যাটা কি শেষমেষ হিমালয়ে গেল!’

সত্যিই ব্যাপারটা ভারী অদ্ভুত। কেউ যদি পালাতে চায় তবে আর কিছু না হোক, হাতে যথেষ্ট পরিমাণ টাকা নিয়েই পালাবে যাতে তার গা ঢাকা দিতে সুবিধা হয়।

অধিরাজের মুখ গম্ভীর। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ। সে ধীরে ধীরে বলল, ‘বনোয়ারিলাল বোধহয় একেবারেই ফস্কে গেল অর্ণব। ঘরের টাকা, মোবাইল, জামা আর জুতো এভিডেন্স ব্যাগে ভরে নিয়ে এসো। যদি ডঃ চ্যাটার্জী আর তাঁর টিম কিছু উদ্ধার করতে পারে’।

কথাটা শুনেই চমকে উঠল অর্ণব। একেবারেই ফস্কে গেল মানে কী!

উত্তরটাও অধিরাজ নিজেই দিয়ে দিল, ‘বনোয়ারির ছবি বিহার পুলিসের সঙ্গে শেয়ার করো। ওর বাড়ির লোকজন অবশ্য বলেছে সে ওখানে যায়নি, তবু একটা চান্স নাও। এখানকার খবরিদের নেটওয়ার্কেও রোটেট করো। লোকটাকে জ্যান্ত পাওয়ার আশা কম। তাও একবার চেষ্টা করে দেখি।’

‘স্যার!’

অর্ণবের কণ্ঠস্বরে বিস্ময় স্পষ্ট। অধিরাজ শান্ত স্বরেই বলল, ‘আমার ধারণা বনোয়ারিলাল বেঁচেই নেই।’

কথাটা শুনে ওদের দু-জনের মাথায় যেন বাজ পড়ল!

(৭)

‘সৌমিত্র চৌধুরী, মৃন্ময় দত্তরায়, উৎপল মিত্র, শর্বাণী ঘোষ, সৌরীশ গাঙ্গুলি, উমা রায়, আবীর সেন, এই সাতজনই ‘ফোবিয়ান্স’ নামে জলপাইগুড়ি গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে বিখ্যাত ছিল। ওদের ব্যান্ডের নাম সৌরীশ ফোবিয়ান্স রেখেছিল। একেবারে সার্থকনামা! ওরাই ছিল একেকজন মূর্তিমান ফোবিয়া। ওদের র‍্যাগিঙের জ্বালায় সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত। বেশ কয়েকবার তো রীতিমতো ফাঁসতে ফাঁসতে বেঁচে গিয়েছে। একটা তদন্তও হয়েছিল ওদের এগেনস্টে।

জলপাইগুড়ি পুলিসের ভারপ্রাপ্ত অফিসারের কথায় কৌতূহলে ভুরু বেঁকে গেল অধিরাজের, ‘কীরকম?’

‘এদের বিরুদ্ধে এক দম্পতি পুলিস স্টেশনে এফ.আই.আর করেছিলেন। মহা হাঙ্গামা বেঁধে গিয়েছিল।

‘আই সি! অভিযোগ কী? ‘

‘খুনের।’ অফিসার একটু থেমে বললেন, ‘তাদের একমাত্র ছেলে মারা গিয়েছিল। ওদের হস্টেলে একটা ঘরকে হন্টেড বলা হয়। ত্রিশ বছর আগে শ্রেয়স নামের একটি ছেলে ওই ঘরে থাকত। তার মৃত্যুটা নাকি রহস্যময় ছিল। তখন আমি ছিলাম না, তাই পুরো ব্যাপারটা জানি না। কিন্তু শ্রেয়সের মারা যাওয়ার পর থেকেই নাকি ঘরটা হন্টেড! মধ্যরাত্রে নানারকম শব্দ হয়! মনে হয় কেউ হাঁটছে, কথা বলছে। আশেপাশের রুমের ছেলেরা ওয়ার্ডেনের কাছে অভিযোগও করেছে যে মাঝরাতে তাদের দরজা কেউ নক করে। কিন্তু কে করে তা জানা যায়নি। কাউকে দেখাও যায় না! যারা ওই ঘরে থেকেছে, তারা বলেছে যে মধ্যরাতে একটা আনক্যানি ফিলিংস হয়, কিন্তু কেন তা বলা মুশকিল! ‘

‘ওকে। তারপর?’

‘আজ থেকে কুড়ি বছর আগে ওই ঘরে আরও একটি মৃত্যু হয়! ছেলেটির নাম আকাশ দত্ত। আকাশের বাবা-মা তখন থানায় অভিযোগ করেছিলেন যে ‘ফোবিয়ান্স’-এর অত্যাচারেই নাকি তার ছেলের মৃত্যু হয়।’

‘ইন্টারাপ্ট করার জন্য সরি…।’ অফিসারকে কথার মাঝখানেই থামিয়ে দিয়ে অধিরাজ বলল, ‘শ্রেয়সের মৃত্যুটা কীভাবে হয়েছিল?’

‘সবাই তো বলে কার্ডিয়াক ফেইলিওর।’ প্রবীণ অফিসার একটু ইতস্ততঃ করে বললেন, ‘শুনেছি, ঠিক শিওর নই।

‘সেকেন্ড ডেথটাও নিশ্চয়ই কার্ডিয়াক ফেইলিওরে?’

অফিসার অবাক, ‘আপনি জানলেন কী করে?

অধিরাজ স্মিত হাসল, ‘সঠিক জানি না, কিন্তু মনে হয় কার্ডিয়াক ফেইলিওরই ছিল। তাই না?’

‘একদমই তাই।’ তিনি বলেন, ‘সেইজন্যই ক্লিন চিট পেয়ে গিয়েছিল ওরা। তদন্তে তেমন কিছুই উঠে আসেনি। আকাশের হার্ট দুর্বল ছিল। সে অল্পবয়েস থেকেই হার্টের অসুখে ভুগছিল। তার ওপর যে ঘরটায় থাকত তার হন্টেড দুর্নাম। আমি বলছি না যে কোনওরকম অতিপ্রাকৃতিক শক্তি ঐ ঘরে আছে। কিন্তু হন্টেড রুমের মিথ নিশ্চয়ই জানতে পেরেছিল আকাশ। আর ভয় মানুষকে অনেকসময় মেরে ফেলে। আকাশের মৃতদেহটা দেখে মনে হয়েছিল যে সে ভয় পেয়েছিল। তাই তার মৃত্যুকে কারোর মার্ডার মনে হয়নি।’

‘সবার মনে হয়নি। কেউ কেউ নিশ্চয়ই অন্য কিছু মনে করেছিল। নয়তো আকাশের বাবা-মা এফ.আই.আর করতেন না।’

‘হ্যাঁ স্যার। আকাশের বাবা-মা স্পষ্টাস্পষ্টি বলেছিলেন যে এর জন্য ফোবিয়ান্স দায়ী। ওরা নাকি আকাশের ওপর র‍্যাগিং চালাত। যদিও তদন্তে তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি।’

‘এদের র‍্যাগিঙের আর কোনো রেকর্ড আছে?’

‘একাধিক। সুজিত চ্যাটার্জি নামের একটি ছেলেকে নাকি এমন র‍্যাগিং করেছিল যে সে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।’ অফিসার একটু থেমে যোগ করলেন, ‘এসবই অবশ্য শোনা কথা। কিছুই প্রমাণ করা যায়নি। এদের গ্যাংটাকে কলেজে, হোস্টেলে সবাই ভয় পেত। ‘বুলিঙে’ ওস্তাদ! জুনিয়ররা তো বটেই, এমনকি ওদের ক্লাসমেটরা পর্যন্ত ওদের ভয়ে বেশি মুখ খুলত না। সবচেয়ে ডেঞ্জারাস ছিল আবীর সেন নামের ছেলেটি। যেমন ক্রুয়েল, তেমনই ডেসপারেট। আমি ছেলেটিকে দেখেছিলাম। ঠান্ডা মাথার শয়তান। কোনও কুকর্ম করা ওর পক্ষে অসম্ভব ছিল না।’

‘আকাশ আর সুজিতের পরিবারের ডিটেইলস পাওয়া যাবে? আর শর্বাণী ঘোষ, সৌরীশ দত্ত, উমা রায়, আবীর সেনের তৎকালীন কিংবা বর্তমান ঠিকানা? ‘

‘মেইল করে দিচ্ছি।’

‘থ্যাংকস।’

ফোনটা কেটে দিয়ে ভাসা ভাসা চোখে সামনের দিকে তাকায় অধিরাজ। ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছেটা কী! সাতজনের একটা গ্রুপ! একটা রহস্যময় মৃত্যু! আকাশ মারা যাওয়ার আগে ভয় পেয়েছিল। উৎপল, মৃন্ময় ও সৌমিত্রও তাই। আকাশের মৃত্যু কার্ডিয়াক ফেইলিওরে। সৌমিত্র এবং মৃন্ময়ও কার্ডিয়াক ফেইলিওরে মারা গিয়েছেন। ডঃ চ্যাটার্জি বলেছেন ওপর থেকে পড়ে না মারা গেলে উৎপলও হার্ট অ্যাটাকেই মারা যেতেন! আকাশের বাবা-মা ব্যর্থ হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন। ওরা কি ফোবিয়ান্সের ক্লিনচিট পেয়ে যাওয়াটাকে আদৌ মেনে নিতে পেরেছিলেন? এতদিন পরে কোথায় এবং কেমন আছেন তাঁরা? তখনকার অত্যাচারী ছেলে মেয়েগুলো বর্তমানে শান্ত, ভদ্র জীবনযাপন করছিল। হঠাৎ করে কী হল যে…!

‘স্যার।’

পরিচিত কণ্ঠস্বরে সম্বিৎ ফিরল তার। অর্ণব উত্তেজিত ও দ্রুত পায়ে কেবিনে ঢুকেছে। অধিরাজ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়

‘একটি মেয়ে হিট অ্যান্ড রান কেসে মারা গিয়েছে।’

একটি মেয়ে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে তাতে অর্ণব এত উত্তেজিত হয়ে উঠল কেন! অধিরাজের অনুচ্চারিত প্রশ্নের জবাব পরক্ষণেই দিয়ে দিল সে,’মেয়েটির নাম শর্বাণী ঘোষ। সৌমিত্র, উৎপল ও মৃন্ময়ের ক্লাসমেট! জেজিইসির স্টুডেন্ট! ‘

কথাটা শুনেই অধিরাজ প্রায় লাফিয়ে ওঠে। কয়েক মিনিট আগেই সে এই নামটা শুনেছে। শর্বাণী ঘোষও ফোবিয়ান্সের সদস্য ছিলেন। সে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘খবরটা কোথায় পেলে?’

‘জাস্ট এই মাত্র টিভিতে দেখলাম স্যার। টুয়েন্টি ফোর সেভেন নিউজে ব্রেকিং নিউজটা দেখাচ্ছে’।

‘সে কী! এখনও পর্যন্ত আমাদের কাছে কোনও খবর নেই, মিডিয়া এত তাড়াতাড়ি জানল কী করে! এর মধ্যেই একেবারে সব খবর বের করে ফেলেছে!’ অধিরাজ তাড়াতাড়ি তার কেবিনের টিভিটা অন করে, ‘কী বলছে একবার দেখি।

টুয়েন্টি ফোর সেভেন নিউজ চ্যানেলে তখন এই খবরটাই চলছিল। টিভি রিপোর্টার শ্রুতি চ্যাটার্জী জানালেন যে সৌমিত্র চৌধুরী, মৃন্ময় দত্তরায় এবং উৎপল মিত্র’র পরে ফের রহস্যজনক মৃত্যু ঘটল তাদের আরেক সহপাঠিনীর। ভিকটিমের নাম শর্বাণী ঘোষ। কিছুক্ষণ আগেই একটি ট্রাক তাকে ধাক্কা মারে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। একই কলেজের চার সহপাঠীর রহস্যময় মৃত্যু প্রশ্নের উদ্রেক করছে। একের পর এক জেজিইসির একটি বিশেষ গ্রুপের প্রাক্তনীদের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগায় যে আদৌ কি মৃত্যুগুলো স্বাভাবিক? এ বিষয়ে অবশ্য অ্যালামনি অ্যাসোসিয়েশন কোনও মন্তব্য করেনি, কিন্তু জেজিইসি’র প্রাক্তনীদের মধ্যে নানারকম আশঙ্কা ও আতঙ্কর সৃষ্টি হয়েছে।

‘স্ট্রেঞ্জ!’ অধিরাজের মুখ থেকে বেরিয়ে এল শব্দটা, ‘যে লিঙ্ক খুঁজে বের করতে আমাদের এত সময় লাগল, টুয়েন্টি ফোর সেভেনের নিউজ রিপোর্টাররা এত তাড়াতাড়ি সেটা বের করে ফেলল কী করে! দেখে তো মনে হচ্ছে লোক্যাল পুলিস-স্টেশনও অ্যাক্সিডেন্ট কেসটার কথা জানে না!’

অর্ণব কোনও মন্তব্য করে না। মিডিয়া চাইলে সবকিছুই পারে। দরকার পড়লে বোধহয় ওরা কবর থেকেও খবর খুঁড়ে বের করবে। পুলিসের মতো ওদেরও খবরের সোর্স থাকে। সম্ভবত সেখান থেকেই খবরটা পেয়েছে ওরা। অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছে এখনও খুব বেশি সময় হয়নি। কিন্তু এর মধ্যেই ব্রেকিং নিউজ বানিয়ে ফেলেছে।

অধিরাজ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাকি নিউজ চ্যানেলগুলোও দেখল। অন্য কোনও চ্যানেলে এখনও এই মুখরোচক খবরটা দেখাতে শুরু করেনি। টুয়েন্টি ফোর সেভেন নিউজই সম্ভবত প্রথম। অর্ণব লক্ষ্য করল অধিরাজের দৃষ্টি ক্রমশই তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে। সে বিড়বিড় করে আপনমনেই বলে, ‘অন্য চ্যানেলরা কি এখনও খবরটা পায়নি?’

‘হতে পারে যে আগে দেখিয়ে দিয়েছে।’

অর্ণবের কথা শুনে মাথা নাড়ল অধিরাজ, ‘সেক্ষেত্রে নীচে বিশেষ বিশেষ খবরের স্ক্রলে খবরটা যেত। মিডিয়ার মধ্যে খবর নিয়ে সবসময়ই একটা অলিখিত কম্পিটিশন থাকে। একটা চ্যানেলে যেটা ব্রেকিং নিউজ, অন্য চ্যানেলগুলোয় তার কোনও উল্লেখই নেই—এটা প্রায় অসম্ভব!’

‘হয়তো বাকিরা এখনও জানে না।’

‘ঠিক তাই।’ অর্ণবের কথাকে সমর্থন করল অধিরাজ, ‘বাকিরা এখনও এত বিস্তারিত খবর পায়নি। যেমন আমরা জানতে পারিনি। মিডিয়ারও তো খবর বের করতে একটু সময় লাগে। কিন্তু যেখানে হেভিওয়েট চ্যানেলগুলোও এই খবরটা জানতে পারেনি, সেখানে তুলনামূলক ছোট চ্যানেলটা জানল কী করে!

বলতে বলতেই সে অর্ণবের দিকে তাকায়, ‘নরেন্দ্রপুর পুলিস স্টেশনে ফোন লাগাও তো অর্ণব। মাদমোয়াজেল অকুস্থল থেকে রিপোর্ট করছেন, অথচ পেছনে কোনও পুলিস কেন দেখছি না, কিংবা ডু নট ক্রস লাইন কেন নেই সেটা জানা দরকার।’

‘ইয়েস স্যার।’

অভ্যস্ত হাতে নরেন্দ্রপুর পুলিস স্টেশনের নম্বর ডায়াল করল অর্ণব। উক্ত পুলিস স্টেশনের ইন্সপেক্টর চক্রবর্তীর সঙ্গে অধিরাজের ভালোই আলাপ আছে। ইন্সপেক্টরকে প্রশ্নটা করতেই তিনি জানালেন, ‘পুলিস বা ডু নট ক্রস লাইন দেখবেন কী করে, আমরাই তো এইমাত্র খবর পেলাম! ‘

‘সে কী! তবে রিপোর্টাররা জেনে গেল কী করে? অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে এখনও খুব বেশি সময় হয়নি। অথচ খবরটা টি.ভিতে দেখাচ্ছে!’

অধিরাজ বিস্মিত। ইন্সপেক্টর চক্রবর্তী একটু বিব্রত হয়েই বললেন, ‘জানি না। মিডিয়া আজকাল দেখছি পুলিসের আগেও খবর পাচ্ছে!’

‘আপনারা স্পটে পৌঁছচ্ছেন কখন?’

‘এই জাস্ট বেরোচ্ছি স্যার।’

অধিরাজের মুখে চিন্তার ভাঁজ পড়ে, ‘আপনারা তাড়াতাড়ি ক্রাইমসিন সিল করুন। নয়তো মিডিয়াওয়ালারা স্পটটার সর্বনাশ করবে। আমরাও আসছি।’

‘ওকে।’

ফোনটা কেটে দিয়ে ফের টেলিভিশন স্ক্রিনের দিকে তাকায় সে। আস্তে আস্তে বলল, ‘স্ট্রেঞ্জ! আদতে ব্যাপারটা ঠিক কী হচ্ছে!’

অর্ণব উৎসুক দৃষ্টিতে অধিরাজের দিকে তাকায়। তার চোখে জিজ্ঞাসা।

‘এরকম কেস আগে কখনও দেখেছ অর্ণব? দু-জন হার্টফেল করে মরল, একজন হাইরাইজ থেকে লাফ মেরে সুইসাইড করল, আরেকজন ট্রাকের তলায় পড়ল—হিট অ্যান্ড রান কেস!’ সে আপনমনেই টেবিলের ওপরের পেপারওয়েটটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, ‘কোনওটাকেই মার্ডার বলার উপায় নেই! অথচ এই কেসে একজন সুপারি কিলার আছে যাকে সম্ভবত এদের সবাইকেই খুন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমি জীবনে এরকম অপদার্থ সুপারিকিলার দেখিনি! টাকা নিল, অথচ একটা খুনও করতে পারল না! সে কিছু করার আগেই ভিকটিমরা মরতে শুরু করল! আমি কালুর জায়গায় থাকলে লজ্জায় নিজেই গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়তাম!’

অর্ণব নীরবে অধিরাজের দিকেই তাকিয়ে থাকে। সত্যিই কেসটা প্রায় দুর্বোধ্য! এ কেসের কোনও ল্যাজামুড়ো নেই। অন্যবারের মতো এবারের মৃত্যু গুলো লিঙ্কলেস নয়। বরং যথেষ্টই জোরদার লিঙ্ক রয়েছে। অথচ তা সত্ত্বেও গোটা ব্যাপারটাই ধোঁয়াশায় ভরা।

‘এদিকে অ্যাক্সিডেন্টের কথা পুলিসের আগে মিডিয়া জেনে যাচ্ছে!’ অধিরাজ আপনমনেই বলল, ‘টুয়েন্টি ফোর সেভেন নিউজ চ্যানেলে ফোন করো। যে কন্যেটি সবার আগে অকুস্থলে পৌঁছেছেন তার সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার। সবাইকে পেছনে ফেলে তিনি ব্রেকিং নিউজটি পেলেন কী করে সেটা জানতেই হচ্ছে। তাছাড়া তাকেই বা কে বলল যে ধাক্কাটা ট্রাক মেরেছে? কোনো লরি নয়, টেম্পো নয়, কিংবা বাস নয়? কোনও বড় আকারের ফোর হুইলারও তো হতে পারত! সব ছেড়েছুড়ে ট্রাক কেন? কোনও প্রত্যক্ষদর্শী আছে? না ম্যাডামের তৃতীয় নয়ন উন্মোচিত হল! গন্ধটা বেশ সন্দেহজনক।

অর্ণব বিনাবাক্যব্যয়ে চ্যানেলে ফোন করল। চ্যানেল রিপোর্টার শ্রুতি চ্যাটার্জি তখনও অকুস্থল থেকে ফেরেনি। অর্ণবের প্রশ্নের উত্তরে চ্যানেল কর্তৃপক্ষ জানাল যে এই খবরটা শ্রুতিই সংগ্রহ করেছে। কিন্তু কীভাবে বা কার মাধ্যমে তা জানা নেই।

‘মিস চ্যাটার্জির ফোন নম্বরটা পাওয়া যাবে?’

‘শিওর।’

অবিলম্বেই শ্রুতির ফোন নম্বর দিয়ে দিল চ্যানেল। তবে তার সঙ্গে একটি বিনম্র আবেদনও রাখল, ‘সচরাচর স্কুপের সোর্স কোনো রিপোর্টার বলে না স্যার। যেমন আপনারা ইনফর্মারদের নাম, পরিচয় গোপন রাখেন, তেমন ক্রাইম রিপোর্টাররাও তাদের খবরের সোর্স শেয়ার করে না। আশা করি ব্যাপারটা আপনারা বুঝবেন। ‘

‘আন্ডারস্টুড।’

বেশি কথা না বাড়িয়ে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল অর্ণব। ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে অধিরাজ। অর্ণব রিসিভারটা নামিয়ে রাখতেই বলল সে, ‘একজন লেডি অফিসারকে সঙ্গে নাও। শ্রুতি চ্যাটার্জির সঙ্গে কথা বলতে সুবিধা হবে। একে মহিলা, তার ওপর ক্রাইম রিপোর্টার। খুব সহজে পেট থেকে কথা বেরোবে বলে মনে হয় না।‘

‘মিস বোসকে বলি?‘

অধিরাজ দুষ্টু হাসল, ‘তোমার দেখছি মিস বোসকে ভারী পছন্দ হয়েছে।’ বলতে বলতেই সে ছদ্ম দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে, ‘আমার ক্রেজ লোকজনের কাছে ক্রমশই কমছে দেখছি! হা হতস্মি!‘

অর্ণব প্রায় আপাদমস্তক লাল হয়ে উঠল। মিস কৌশানী বোসকে এক কথায় অপরূপা বললেও কম হয়। প্রায় পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি উচ্চতার দীর্ঘাঙ্গী কৃষ্ণসুন্দরীটিকেই দেখলে কেমন যেন গা শিরশির করে ওঠে। গায়ের রং কুচকুচে মসৃণ কালো! যারা কথায় কথায় ফর্সা মেয়েদেরই সুন্দরীর তকমা দিয়ে থাকেন, তাদের একবার কৌশানীকে দেখে যাওয়া উচিত। এক কথায় কালো আগুন! কোঁকড়া কোঁকড়া থোকা থোকা চুল স্টাইলিশ টপনট করে বাঁধা। পদ্মপলাশাক্ষী। মুখের গড়ন অনবদ্য। চেহারা তো নয়, অজন্তার ভাস্কর্য! হাঁটার ভঙ্গি দেখলে মনে হয় দীর্ঘ একটা কালসাপ এঁকে বেঁকে চলে যাচ্ছে। সবচেয়ে সুন্দর তার হাসি। হাসলে ঝকঝকে মুক্তোর মতো দাঁত প্রায় ঝিলিক দিয়ে ওঠে। হাসিটা খুব মায়াবীও বটে।

কিন্তু অধিরাজ জানে না যে কৌশানী বোসের প্রতি যেমন অর্ণবের কোনো বিশেষ দুর্বলতা নেই, তেমন কৌশানীর মনোযোগও আদৌ অর্ণবের দিকে নেই! প্রথমদিনেই অধিরাজের দিকে তার অনুরাগসিক্ত দৃষ্টিক্ষেপ লক্ষ্য করেছে অর্ণব। এবং তারপর থেকেই ভয়ে কুতুবমিনার হয়ে আছে। এমনিতেই ফরেনসিকে প্রায় দাঙ্গা বাঁধার উপক্রম। তার ওপর যদি আরও একজন প্রতিদ্বন্দ্বী বাড়ে তাহলে আর দেখতে হবে না! হোমিসাইডেই শেষমেষ খুনোখুনি না হয়ে যায়! কৌশানী বোস অধিরাজের অন্ধভক্ত! অর্ণবের কাছে স্বীকার করেছে যে এই ব্রাঞ্চে বদলি হওয়ার ব্যাপারে সে নিজেই উদ্যোগ নিয়েছিল। কারণ অবশ্যই অধিরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়। মেয়েটা আহেলির মতো অন্তর্মুখীন বা আইভির মতো নার্ভাস নয়। বরং ওদের থেকে অনেক বেশি ডেস পারেট এবং সোজা ব্যাটে খেলে। শুরুতেই জানতে চেয়েছিল, স্যারের ফেভারিট ডিশ কী!

সে অধিরাজের বাউন্সারটা কোনোমতে সামলে নেয়। তার ক্রেজ কেমন কমছে তা তো স্বচক্ষে দেখতেই পাচ্ছে! একটু থেমে বলল, ‘তাহলে মিস দত্ত?’

‘ফুল টিমই নিয়ে নাও।’ অধিরাজ ফিক্ করে হেসে ফেলেছে, ‘অধিকন্তু ন দোষায়।

‘অধিকন্তু’ যে কার সে বিষয়ে সন্দেহ আছে অর্ণবের। অবস্থা এখন তিন ফুল আর এক মালিতে গিয়ে ঠেকেছে। কিন্তু সে আর কথা না বাড়িয়ে আলগোছে মাথা ঝাঁকায়, ‘ওকে স্যার।’

‘ফরেনসিককে খবর দাও।’ অধিরাজ অন্যমনস্কভাবে বলে, ‘ক্রাইম-সিনে যদি কিছু পাওয়া যায়।’

অর্ণব আমতা আমতা করে বলল, ‘ফরেনসিকও কি ফুল টিম যাবে?’

‘সেটা হাঁড়িমুখো বুড়ো ঠিক করবে। আপাতত অ্যাক্সিডেন্ট কেসের কথাই বলো। যদিও ডক নিজে গেলেই সবচেয়ে ভালো হয়।’

‘এটা কি বলব?’

অর্ণবের দিকে তাকিয়ে ফের ছেলেমানুষী হাসি হাসল অধিরাজ, ‘সেরেছে! তাহলেই বুড়োর ল্যাজ মোটা হয়ে যাবে। ওসব বলে কাজ নেই। শুধু এইটুকু বোলো যে ব্যাপারটা ইম্পর্ট্যান্ট।’

‘ওকে স্যার।’

অর্ণব মাথা ঝাঁকিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।

(৮)

ঘরের ভেতরটা হালকা অন্ধকারাচ্ছন্ন। পরিবেশটা কেমন যেন চাপা চাপা—দমবন্ধ করা। হাওয়ায় একটা স্যাঁৎসেতে ভিজে ভিজে ভাব। অনেকদিন বুঝি এ ঘরের দরজা-জানালা খোলা হয়নি। ঘরটা যেন অন্ধ হয়ে পড়ে আছে। বহুদিন সূর্যরশ্মি প্রবেশ করেনি এখানে। তাজা হাওয়া ঢোকেনি কখনও। সময়ও যেন থমকে দাঁড়িয়েছে এখানে। বিগত কয়েক বছর ধরে নিঃসঙ্গ একাকীত্বে ভুগছে এ ঘরটা। বেওয়ারিশ লাশের মতো স্বজনহীন হয়ে পড়ে রয়েছে।

অন্ধকারের মধ্যে কয়েকটা মোমবাতি নীলাভ শিখায় জ্বলছিল। তার আলো পিছলে পড়ছে মেঝের ওপর। সেই ক্ষীণ আলোতেই দেখা গেল মেঝের ওপর খড়ি দিয়ে আঁকিবুকি কাটা! সিঁদুর মাখা লেবু, নারকেল, পঞ্চপ্রদীপ, কর্পূর ভস্ম—ইত্যাদি মাটিতে ইতস্ততঃ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সব কিছুর মাঝখানে এক সহাস্যমুখ তরুণের ছবি। ছবি হলেও কী ভীষণ জীবন্ত! চোখদুটোয় প্রতিভার দীপ্তি। পাতলা লম্বাটে মুখে ঝলমল করছে সপ্রতিভ হাসি। বয়স উনিশ কী কুড়ি! দেখলে মনে হয়, গোটা বিশ্বকে জিতে নিতে চায় সে।

ছবির সামনে এক ছায়ামূর্তি চুপ করে বসেছিল। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ছবির মানুষটার দিকে। অদ্ভুত স্নেহমাখা দৃষ্টিতে দেখছে ছবির তরুণটিকে। এই তো, কত কাছে আছে সে। হাত বাড়ালেই যেন ছোঁয়া যাবে তাকে! পরম মমতায় সে হাত বাড়িয়ে দেয় ছবিটার দিকে। কেমন আছে ছেলেটা? বড় কষ্ট পেয়েছিল, বড় অভিমানে দূরে সরে গিয়েছিল। যে মা-বাবার চোখের মণি ছিল, সেই মা-বাবাকে ছেড়ে বহু বছর হল পাড়ি দিয়েছে অজানার পথে। আর ফিরে আসেনি। ফিরে আসবে না!

ভাবতেই আচমকা তার চোখদুটো দপ করে জ্বলে ওঠে। না, সে নিজের ইচ্ছেয় চলে যায়নি। তাকে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। ঐ অসভ্য ছেলেমেয়েগুলোর জন্য অসময়ে চলে যেতে হয়েছিল ছেলেটাকে। কতগুলো জানোয়ারের নিষ্ঠুরতার বলি হয়েছে সে!

‘ছাড়ব না…! কাউকে ছাড়ব না…! ‘

বিড়বিড় করে বলল ছায়ামূর্তি। দাঁতে দাঁত পিষে বলল, ‘সবাইকে মরতে হবে। সব্বাইকে….!’

হ্যাঁ, মৃত্যুই ওদের একমাত্র উপযুক্ত শাস্তি। আজও মনে পড়ে শয়তানগুলোর চেহারা। সে বারবার কাকুতি মিনতি করে বলেছিল ‘ওরা আমায় রীতিমতো টর্চার করে মা! আমি এখানে থাকব না। রাত বিরেতে ডেকে তোলে। অখাদ্য কুখাদ্য খেতে বলে। জোর করে গলায় মদ ঢেলে দেয়। ছাদের পাঁচিলের ওপর দিয়ে হাঁটতে বলে। আপত্তি করলে চড়-থাপ্পড়, লাথি-ঘুষি মারে! আমি মরে যাব মা! ওরা আমায় মেরেই ফেলবে!’

ছেলেটা বড় দুর্বল ছিল। ছোটোবেলা থেকেই রুগ্ন হওয়ার ফলে মায়ের একটু বেশিই আদরের সে। বড় যত্নে মানুষ। জীবনে এই প্রথম মায়ের থেকে দূরে গিয়েছিল। মা-বাবাকে ছেড়ে থাকার অভ্যাস ছিল না তার। স্বাভাবিকভাবেই একটু মনমরা হয়ে থাকত। হস্টেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, সে বিশেষ কারোর সঙ্গে মিশত না। সবসময়ই ভয়ে ভয়ে থাকত। কীসের ভয়, কেন ভয় তা কাউকে বলেনি। ছোটোবেলা থেকেই ও অন্তর্মুখীন। বেশি কথা বলে না। তার মনের কথা একমাত্র তার মা-ই জানত।

কিন্তু সেই আশ্রয়ও যে অনেক দূরে। স্নেহমমতাময় একটা পরিবেশ থেকে সে এসে পড়েছিল নিষ্ঠুর বাস্তবতার জগতে। যেখানে কেউ তার ব্যথিত হৃদয়কে ভালোবেসে শান্ত করবে না। কেউ খোঁজ নেবে না, সে ঠিকমতো খেয়েছে কি না! যেখানে চতুর্দিকে শুধু কতগুলো নিষ্ঠুর মুখ, আর বেঁচে থাকার প্রাণান্তকর লড়াই।

তবু লড়ছিল সে। প্রথমবার ছুটিতে যখন বাড়ি এল তখনই তার ভগ্নস্বাস্থ্য দেখে চিন্তায় পড়েছিল বাবা-মা। ছেলেটা এই কয়েক মাসেই যেন আধখানা হয়ে গিয়েছে। চোখের তলায় গাঢ় কালির প্রলেপ, মুখটা শুকিয়ে গিয়েছে। ঝলমলে হাসিটা আর নেই। কেমন যেন জোর করে হাসে। আশঙ্কায় মায়ের মন কেঁপে উঠেছিল। মুহূর্তের জন্য অমঙ্গল আশঙ্কা ফণা তুলেছিল মনের মধ্যে। কিন্তু বাবার বক্তব্য, ‘সবসময় অমন পুতুপুতু কোর না। ছেলেকে একটু মানুষ হতে দাও।’

‘কিন্তু ও ঠিকমতো খেতে পায় না। তার ওপর সিনিয়রগুলো বিরক্ত করে।’ মায়ের মন মানে না, ‘এভাবে পড়াশোনা করা যায়!’

‘সবাই এভাবেই পড়াশোনা করে। বাবার দৃঢ় এবং কঠিন কণ্ঠস্বর, ‘প্রথম বছরটা অমন একটু আধটু র‍্যাগিঙের মুখে সবাইকেই পড়তে হয়। কিছুদিন পরেই দেখবে এই সিনিয়ররাই ওর বেস্টফ্রেন্ড হয়ে গিয়েছে। প্রতি বছর হাজার হাজার ছেলে এভাবেই ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বেরোচ্ছে।’

‘কিন্তু ও যে আর পাঁচটা ছেলের মতো নয় …!’

‘তাহলে আর কী! ছেলেকে কোলে বসিয়ে রাখো।’ বাবার কথায় উষ্মা প্রকট, ‘তাহলেই সব প্রবলেম সলভড।’

ছায়ামূর্তির চোখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল চুইয়ে পড়ে! সত্যিই যদি তখন ছেলেটাকে নিজের কাছে রেখে দিতে পারত! যদি তখনই সমাজের বিরুদ্ধে, মানুষের বিরুদ্ধে, আপনজনদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যেত, তবে আজ ছেলেটা বেঁচে থাকত। আস্তে আস্তে ছেলের ছবিটার ওপরে হাত বোলায় সে। এখনও চোখ বুজলে সেই দৃশ্যটা মনে পড়ে যায়! রুগ্ন ছেলেটার জীর্ণ দেহটা সাদা চাদরে জড়ানো। মুখ ফ্যাকাশে, রক্তহীন! সবাই বলেছিল, সে হার্টফেল করে মারা গিয়েছে। কিন্তু মায়ের মন সে কথা বিশ্বাস করেনি। তার মনে হয়েছিল, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। নিশ্চয়ই ওরা কিছু করেছে! অনেক যন্ত্রণা দিয়েছিল ওরা ওকে। এটা মৃত্যু নয়… খুন! ছেলেটার আশঙ্কা ছিল ওরা ওকে মেরে ফেলবে! বারবার সে কথা বলেছিল। তখন যদি তার কথা কেউ শুনত!

ছায়ামূর্তির মুখের রেখাগুলো নড়েচড়ে ওঠে। চরম ঘৃণায় চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। না, ওটা কোনও স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। ওই শয়তানগুলোই কিছু করেছিল। যার মাশুল আজ ওরা গুনছে!

ভাবতেই তার মুখে প্রশান্তির হাসি ভেসে ওঠে। এতদিনে সঠিক বিচার হয়েছে। তখন কেউ তাদের কথা শোনেনি। পুলিসও ক্লিনচিট দিয়েছিল ওদের। একটা তরতাজা ছেলে আচমকা কীকরে মারা যায়, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। তার দুর্বল হৃৎপিণ্ডকেই মৃত্যুর কারণ ধরে নিয়েছিল সকলে। কিন্তু সে জানত যে ব্যাপারটা অত সহজ নয়। চিৎকার করে সবাইকে বলতে চেয়েছিল, ‘ওরা খুনী! ওরা আমার ছেলেটাকে খুন করেছে।’ কিন্তু কেউ তার কথা মানেনি। পুলিসও তাদের কথা শোনেনি। শয়তানগুলো নির্বিঘ্নে পড়াশোনা শেষ করেছে। ওরা প্রত্যেকেই নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজে সম্মানিত ব্যক্তি, সংসারে সুখী মানুষ হয়েছে। সব খবর রেখেছে এই হতভাগিনী মা। তলে তলে সবারই খোঁজ ছিল তার নখদর্পণে। কে কোথায় চাকরি পেয়েছে, কার বিয়ে হল বা সন্তান হল—সবই জানত সে। ওদের সুখী জীবন দেখতে দেখতে রাগে, ক্ষোভে, প্রতিশোধস্পৃহায় জ্বলে পুড়ে খাঁক হচ্ছিল! আর মনে মনে ভাবছিল, কীভাবে ওদের জীবনে আগুন লাগানো যায়! এত বড় সর্বনাশ করেও এত সুখে নিশ্চিন্ত জীবন কাটিয়ে দেবে ওরা! যে অন্তহীন জ্বালায় সে জ্বলছে, তার আঁচটুকুও কি লাগবে না ওদের গায়ে! দিনের পর দিন ভেবেছে ঠিক কী করলে প্রতিশোধ নেওয়া যাবে! ঠিক কোন্ রাস্তায় ওদের মারা যায়! বারবার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিল, ‘মরে যাক! ওরাও মরে যাক! এত সহজে পার পাবে না! মরতে ওদেরও হবে।’

‘মায়া!’

ছায়ামূর্তি একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে সচকিত হয়ে ওঠে। একটু সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে নড়েচড়ে বসল। ঘরের মধ্যে দ্রুত পায়ে আরেকটি মানুষ এসে ঢুকেছে। একঝলক চতুর্দিকটা দেখে নিয়ে বিস্ময়বিহ্বল স্বরে বলল, ‘আবার এসব শুরু করেছ তুমি!’

কণ্ঠস্বরে ক্ষোভ প্রকট। কিন্তু তা বিন্দুমাত্রও রেখাপাত করতে পারল না ছায়ামূর্তির উদাসীন মুখে। খুব শান্ত স্বরে বলল, ‘কোনও খবর দিতে এসেছ কি?’

দ্বিতীয় মানুষটা চমকে ওঠে। একমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘তুমি এসব তন্ত্রমন্ত্র বন্ধ করবে মায়া? এসব মারণ, উচাটন–ব্ল্যাক ম্যাজিক বলে কিছু হয় না!

‘কে বলল কিছু হয় না!’, মায়া শান্তস্বরে বললেন, ‘বিশ্বাস করলেই সব হয়!’

মায়ার স্বামী অমর সভয়ে তাকালেন স্ত্রীয়ের দিকে। এখন তিনিও যেন নিজেরই স্ত্রীকে ভয় পেতে শুরু করেছেন। এসব কী শুরু করেছেন মায়া! নাওয়া খাওয়া ভুলে সব ভয়ংকরদর্শন তান্ত্রিকদের কাছে যাতায়াত করছেন! প্রতি অমাবস্যায় তারাপীঠে দৌড়ন। হোম-যজ্ঞ করান। মেঝের ওপর আঁকিবুকি কেটে উদ্ভট উদ্ভট মন্ত্রোচ্চারণ করেন। মধ্যরাত্রে উঠে হেঁটে বেড়ান! আপনমনেই বিড়বিড় করেন। অদৃশ্য কারোর

সঙ্গে কথা বলেন। ভয় করেখবড় ভয় করে অমরের!

তিনি আস্তে আস্তে বললেন, ‘তুমি এসব বন্ধ করো। এসব ঠিক নয়।’

‘তুমি কি কিছু বলতে এসেছ?’

মায়ার কথাটা শুনে চমকে উঠলেন অমর। মায়া তাঁর দিকে অন্তর্যামীর মতো তাকিয়ে আছেন! যেন কোনো খবরের প্রতীক্ষায় আছেন। তাঁর বুকের ভেতরটা ধ্বক করে ওঠে।

মায়া স্মিত হাসলেন, ‘আবার কেউ গেছে! তাই না?’

অমর কী বলবেন বুঝে পান না। সত্যিই আরও একটি মেয়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়েছেন তিনি। শর্বাণী ঘোষের ডেথ নিউজটা এইমাত্র টিভিতে শুনেছেন। কিন্তু মায়া জানলেন কী করে!

‘আমি জানি!‘

‘কী করে জানলে? কে বলল?’

ফিসফিস করে অতি সন্তর্পণে উচ্চারণ করলেন তিনি, ‘আমায় বাবাই বলেছে!

কথাটা শুনেই গা শিরশির করে উঠল অমরের। মোমবাতির মৃদু আলোয় কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হল ঘরের দেওয়ালে ছায়া ছায়া কে যেন সাঁৎ করে সরে গেল! এ ঘরটা বাবাইয়ের ঘর। তার মৃত্যুর পরও মায়া ঘরটাকে সযত্নে সাজিয়ে রেখেছেন। বেডরুমটা অবিকল আগের মতোই সাজানো আছে। বালিশটা এখনও পরিচিত স্পর্শের অপেক্ষা করছে। পড়ার টেবিলের প্রত্যেকটা বই গুছিয়ে রাখা। হয়তো কোনও আপনজনের প্রতীক্ষায় বসে আছে। যেন বাবাই আবার ফিরে আসবে! আবার ঘরটা তার হাসির আওয়াজে গমগম করে উঠবে! অমরের মনে হল এক অশরীরী শীতল হাওয়া তাকে নিমেষে ছুঁয়ে গেল। মোমবাতির আলোয় বড় বেশি জীবন্ত হয়ে উঠেছে ছবির চোখদুটো। যেন ছবির মধ্যেই বাবাই এখনই হেসে উঠবে, চোখের প লক ফেলবে। তাঁর মনে হল, এ ঘরে তাঁরা দু-জন ছাড়াও তৃতীয় কারোর অস্তিত্ব আছে! কেউ নীরবে আড়াল থেকে সব দেখছে, সব শুনছে!

চাপা গলায় ফিসফিসে কণ্ঠস্বরে বললেন মায়া। তাঁর মুখে রহস্যময় হাসি, ‘চারজন মারা গিয়েছে। বাকি তিনজনও মরবে। আমি জানি, ওরা একে একে সবাই মারা যাবে। ও কাউকে ছাড়বে না! কাউকে না!’

বলতে বলতেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলেন তিনি। তাঁর হাসি ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সারা ঘরে। মনে হল, শূন্য ঘরটাই যেন হা হা করে সশব্দে উন্মত্ত অট্টহাসি হাসছে। অমরের শিঁড়দাড়া বেয়ে একটা হিমেল স্রোত নেমে গেল!

কার কথা বলছেন মায়া? কে ছাড়বে না ওদের!

(৯)

‘সিম্পল হিট অ্যান্ড রান কেস বলেই মনে হচ্ছে। যদিও পোস্টমর্টেম করলে আরও ভালো বোঝা যাবে। তবু নিজের বহুবছরের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। ভিকটিমের মুখে কোনো অ্যালকোহলের গন্ধ নেই। কোনোরকম ধস্তাধস্তি বা অন্যরকমের ক্ষত চিহ্ন নেই। মৃত্যুর কারণ ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার ফলে মারাত্মক রকমের হেড ইনজুরি। আপাতত বাইরে থেকে বড়িতে ফাউল প্লে-র কোনও ট্রেস দেখা যাচ্ছে না। পোস্টমর্টেম করার পর বাকিটা বলব।’

মৃতদেহটাকে খুব মন দিয়ে দেখছিলেন ডঃ চ্যাটার্জি। তাঁর ল্যাজ মোটা হয়েছে কি না জানা নেই। তবে অর্ণবের সব আশঙ্কাকে নির্মূল করে দিয়ে স্বয়ং তিনিই এসেছেন। মিস আহেলি মুখার্জি বা আইভি ভট্টাচার্য সঙ্গে আসেনি দেখে অর্ণব একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। তবুও একবার প্রশ্ন করেছিল, ‘মিস মুখার্জি এলেন না?

‘মিস মুখার্জিকে তুমিও আজকাল খুব মিস করছ দেখছি!’ ডঃ চ্যাটার্জি ভ্রূকুটি করেছেন, ‘হল কী হোমিসাইডের! তোমার আর রাজার ব্রেক-আপ হয়েছে নাকি?’

সর্বনাশের মাথায় বাড়ি! অর্ণব দেখল মিস দত্ত তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। সে কী বলবে বুঝতে পারে না। কোনোমতে বলল, ‘না না। তেমন কিছু নয়।’

‘কী! ব্রেক-আপ হয়নি!’ ডঃ চ্যাটার্জি হাঁকার দিয়ে উঠলেন, ‘তার মানে সত্যি সত্যিই তোমাদের দু-জনের অ্যাফেয়ার চলছে…!’

এবার সর্বনাশের চোদ্দপুরুষের মাথায় বাড়ি! অর্ণব প্রায় লাফিয়ে ওঠে,’আরে না… না…!’

‘লেঃ হালুয়া!’ ডঃ চ্যাটার্জি আজ অর্ণবকে ঘোল খাইয়েই ছাড়বেন, ‘তার মানে তোমার আর রাজার মধ্যে কোনও সম্পর্কই নেই! ‘

‘আলবাৎ আছে।’

পেছন থেকে ভেসে এল গম্ভীর স্বর। অর্ণবকে ডঃ চ্যাটার্জির হাত থেকে একরকম প্রায় উদ্ধারই করল অধিরাজ। মৃদু হেসে বলল, ‘সব সম্পর্কের ট্যাগলাইন হয় না ডক! সব ভালোবাসাকে নাম দেওয়া যায় না।’

‘তাহলে তোমাদের মধ্যে কিছু কেমিস্ট্রি আছে।’ ডঃ চ্যাটার্জি টাক চুলকে বললেন, ‘তবে অর্ণব মিস মুখার্জির খোঁজ করছে কেন? তুমি অর্ণবকে চোখে হারাচ্ছ, অর্ণব তোমায় চোখে হারাচ্ছে, তুমি মিস মুখার্জি ছাড়া কাউকে দেখতে পাচ্ছ না, আবার মিস মুখার্জির খবর অর্ণবেরও দরকার! আবার তুমি মিস মুখার্জির সঙ্গে চাউমিন খেতে গিয়ে তাকে ফেলে অর্ণবের বাড়ি দৌড়চ্ছ! ভাই, এটা কী জাতীয় বোতল-মালতী-বালতি হচপচ!’

‘কোথায় তরোয়াল খুলতে এসেছ অর্ণব! এ যে পলাশী! এবার টাকলু মোহনলাল স্রেফ দুম ফটাস করে তোপ মেরে উড়িয়ে দেবে কিন্তু!’

কী কুক্ষণে যে মিস মুখার্জির নাম উচ্চারণ করতে গিয়েছিল অর্ণব! মিস দত্ত এবং মিস বোস, দুই লেডি অফিসারই হাসছে! অধিরাজ হাসতে হাসতে তার দিকে বাক্যটা ছুঁড়ে দিয়ে ইশারায় চুপ থাকতে বলে। অর্ণবও চেপে যায়। সত্যিই পলাশী! এখানে আর তরোয়াল না খোলাই ভালো। ডঃ চ্যাটার্জি ওদের দু-জনের দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, ‘এদের কেমিস্ট্রির জ্বালায় আমার বাপের নাম তকাই না বিস্কুট তা–ই ভুলে যাচ্ছি!’

তারপর থেকে সারা পথে অর্ণব একটা কথাও বলেনি। অধিরাজও প্রায় নীরব থেকেছে। সে সারা রাস্তায় আকাশ দত্ত আর সুজিত চ্যাটার্জীর পরিবারের ডিটেইলস পড়তে পড়তে এসেছে। শর্বাণী ঘোষ, সৌরীশ দত্ত, উমা রায়, আবীর সেনের বাড়ির ঠিকানা ও ফোন নম্বর পাঠিয়ে দিয়েছে জলপাইগুড়ি পুলিস। ই-মেইলে একবার চোখ বুলিয়ে চিন্তিত মুখে নিজের ট্যাবটা পবিত্র’র দিকে এগিয়ে দিল অধিরাজ, ‘সৌরীশ দত্ত, উমা রায় আর আবীর সেনের ফোন নম্বরে ফোন করে কনফার্ম করো যে নম্বরগুলো ওদেরই কি না, নাকি পালটেছে। আর ফোন নম্বর কনফার্মড হলে অ্যাড্রেসটাও কনফার্ম করবে। আজ ওদের প্রত্যেককেই বাড়িতে থাকতে বলবে। আমরা ওদের সঙ্গে কথা বলতে যাব।’

‘ব্যুরোয় ডেকে নিই।’ পবিত্র বলল, ‘বাড়িতে যাওয়ার দরকার কী?’

‘না। বাড়িতেই যাব।’ অধিরাজ উত্তর দেয়, ‘একা ওঁদের নয়, পুরো ফ্যামিলিকেই জিজ্ঞাসাবাদ করব।’

‘ওকে।’

পবিত্র আর কথা বাড়ায় না। সে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অধিরাজের চোখদুটো অন্যমনস্ক। সে নিবিষ্টমনে কী যেন ভেবে চলেছে। অন্যমনস্কভাবে সিগারেটের প্যাকেটটা সবে বের করতে যাচ্ছিল, তার আগেই অর্ণব মৃদুস্বরে বলে ওঠে, ‘চারটে হয়ে গেছে।

‘ওঃ! সরি সরি!

অধিরাজ বাধ্য ছেলের মতো সিগারেটের প্যাকেটটা আবার পকেটে চালান করে দেয়। তারপর খুব ধীর স্বরে বলল, ‘টুয়েন্টি ফোর সেভেন নিউজের রিপোর্টারটির নাম কী অর্ণব? ‘

‘শ্ৰুতি চ্যাটার্জি।’

সে একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আশ্চর্য বিষয় যে সুজিত চ্যাটার্জির বোনের নামও শ্ৰুতি চ্যাটার্জি!’

অর্ণব চমকে ওঠে। পবিত্র বলল, ‘নেমসেক হতে পারে।’

‘হতেই পারে। শ্রুতি নামটা যথেষ্টই কমন।’ অধিরাজ চিন্তিত স্বরে বলে,’কিন্তু আমি খুব আশ্চর্য হব না, যদি এই শ্রুতি চ্যাটার্জিই স্বয়ং সুজিত চ্যাটার্জির বোন হয়।

‘সুজিতের কেসটা কী রাজা?’ পবিত্র জিজ্ঞাসা করে, ‘আকাশ দত্তের কেস তো জানি। কিন্তু সুজিতের ব্যাপারটা জানা নেই।’

‘সুজিতের ব্যাপারটাও খুব খোলসা করে বলা নেই।’ অধিরাজ বোতল থেকে এক চুমুক জল খেয়ে বলল, ‘ছেলেটা একটু লাজুক, নরম প্রকৃতির ভদ্র ছেলে ছিল। সাতে পাঁচে থাকত না। পড়াশোনায় ভালো, মৃদুভাষী। তবে প্রতিবাদীও ছিল। ফোবিয়ান্স যখন তাকে র‍্যাগিং করে, তখন সে স্পষ্টাস্পষ্টি জানায় যে পুলিসে রিপোর্ট করবে। ফোবিয়ান্স তখনকার মতো চুপ করে গেলেও সুজিতের ওপর আক্রোশ ছিল। কিছুদিন পরেই সুজিতকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় হোস্টেলের ছাদে পাওয়া যায়। প্রচুর পরিমাণে মদ্যপান করার ফলে সে বেহুঁশ ছিল। যখন জ্ঞান এল ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। গোটা হস্টেল তার অবস্থা দেখে ফেলেছে। হস্টেল কর্তৃপক্ষ তার বাবা-মাকে ডেকে পাঠালেন। ছেলেটা নিজের পরিস্থিতির কথা ভেবে লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়েছিল। গোটা হস্টেল তাকে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখেছে, এটাই তার কাছে সবচেয়ে লজ্জার, সবচেয়ে ঘৃণার ছিল! সেটাই স্বাভাবিক….!

অর্ণব লক্ষ্য করল অধিরাজের গলায় তিক্ততা। যেন সুজিতের ঘটনাটা সে মনে প্রাণে অনুভব করতে পারছে। পেছনের কারণটা বুঝতে অসুবিধে হল না অর্ণবের। অধিরাজের ভেতরের যন্ত্রণাকে সুজিতের কেসটা খুঁচিয়ে দিয়েছে। সে লক্ষ্য করল অধিরাজের মুখে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম। যেন সুজিত নয়, তার নিজেরই অপমানের কথা মনে পড়ছে। অর্ণব আলতো করে অধিরাজের কাঁধে হাত রাখে। তার আকস্মিক স্পর্শে অধিরাজ প্রথমে চমকে উঠলেও পরে যেন আরাম পেল। সে রুমালে মুখ মুছে বলল, ‘সুজিতের বাবা সুদীপ, মা সুপর্ণা এবং বোন শ্রুতি ফোবিয়ান্সের বিরুদ্ধে হস্টেল কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করেছিল। কিন্তু কিছুই প্রমাণ হয়নি। কারণ কেউই কিছু দেখেনি। উলটে হস্টেল কর্তৃপক্ষ সুজিতকে মাতাল বলে ভর্ৎসনা করে। সুজিত একদম গুম মেরে গিয়েছিল। সে কোনও কথা বলছিল না। ঐ ঘটনার পর থেকে তার হাবভাবে অস্বাভাবিকতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ছেলেটা নিজের ঘর থেকে বেরোতেই চাইত না। সবসময়ই ভয় পেত। কারোর কথার কোনো জবাব দিত না! সহপাঠীরা তার ট্র্যাজেডিটায় ভারী মজা পেয়েছিল। গোটা হস্টেল তাকে নানাভাবে উত্যক্ত করত। এমনকি কে যেন তার ঐ অসহায়, নগ্ন অবস্থার ছবিও তুলে রেখেছিল। আন্দাজ, ফোবিয়ান্সেরই কারোর কীর্তি। হস্টেলে, কলেজের স্টুডেন্টদের কাছে সেই ছবি বিলিও করা হল। ছেলেটার যন্ত্রণা চরমে পৌঁছল। চতুর্দিকে ফিসফাস্, হাসাহাসি, সবার চোখে কৌতুক দেখতে দেখতে সে আস্তে আস্তে মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছিল…।’

অধিরাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘সুজিতের বাবা-মায়ের কাছে আর কোনও চয়েস ছিল না। তারা সুজিতকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ছাড়িয়ে বাড়ি নিয়ে গেলেন। তারপর থেকে তার আর কোনও খবর নেই।’

‘কিন্তু…।’ মিস বোস এতক্ষণে মুখ খুললেন, ‘নিউজ রিপোর্টার শ্রুতি চ্যাটার্জি তো সুজিতের বোন না-ও হতে পারে।

‘না-ও হতে পারে।’ অধিরাজ এতক্ষণে একটু ধাতস্থ হয়েছে, ‘আবার হওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল। শ্রুতিকে জিজ্ঞাসা করলে দেখবেন যে সে অবধারিতভাবে বলবে এই খবরটার টিপ তাকে কোনও অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি ওভার ফোন দিয়েছে। যে টিপ দিয়েছে সে সব কথাই বলেছে নিজের নাম ছাড়া।’

অর্ণব, পবিত্র বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। অধিরাজের চোখে রহস্য জমেছে, ‘সবটা বুঝতে পারছি না। কিন্তু এইটুকু বুঝতে পারছি যে কেউ আমাদের কোনও একটা গল্প শোনাতে চাইছে। যে গল্পটা কালের অতলে চাপা পড়ে গিয়েছিল, আজ তাকেই কেউ তুলে আনছে। কেউ আমাদের জানাতে চায় যে কুড়ি বছর আগে ঠিক কী হয়েছিল!’

‘রিভেঞ্জ?’

‘এগজ্যাক্টলি মিস দত্ত।’

আত্রেয়ী দত্তের কথায় মাথা ঝাঁকাল অধিরাজ, ‘রিভেঞ্জের ক্ষেত্রেই একমাত্র অতীত ফিরে আসে। খুনী প্রতিমুহূর্তে পুরনো কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চায়। এটাই রিভেঞ্জের স্টাইল।’

‘কিন্তু গল্পটা ঠিক কী?

মিস বোসের প্রশ্নের উত্তরে মৃদু হাসল সে, ‘এখনও জানি না। সবটাই এখনও ধোঁয়া ধোঁয়া! কিন্তু কেসের প্যাটার্নটা দেখুন। প্রথমেই হিস্ট্রিশিটার কালিয়া ধরা পড়ল। ওর ধরা পড়াটা খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে? কালুর মতো ঘাঘু মাল এত সহজে ধরা পড়ার নয়। ঠিক মনে হল, কেউ যেন রসোগোল্লা প্লেটে তুলে দেওয়ার মতো করে ওকে আমাদের হাতে তুলে দিল। মজার কথা হল, কালু যদি না ধরা পড়ত তবে এই তিনটে মৃত্যুর পেছনের লিঙ্ক কোনোদিনই বোঝা যেত না। কোভিডের মধ্যে এরকম মৃত্যু তো কতই ঘটছে। আর এরা নিজেদের মধ্যে কোনো যোগাযোগও রাখেনি। তাই এই ডড গ্রুপের লোকজনই যে এক এক করে মারা যাচ্ছে—বা ভবিষ্যতে মারা যাবে—তা জানার সম্ভাবনা কম ছিল। কিন্তু কালু ধরা পড়ার পরই গল্পে টার্ন এল। পুলিস জানতে পারল যে তিনটে মৃত্যুই লিঙ্কড।’

‘তবে কি কালুকে ধরিয়ে দেওয়া হল শুধু এইজন্যই?’

‘ব্রিলিয়ান্ট অর্ণব।’অর্ণবের কথা শুনে অধিরাজ তার পিঠ চাপড়ে দেয়, ‘এগজ্যাক্টলি তাই! কালুকে সুপারি দেওয়া হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তাকে খুন করতে দেওয়ার প্ল্যানিং ছিল না। নয়তো কেউ এরকম আধাখ্যাঁচড়া সুপারি দেয়! সুপারি দিতে হলে সাতজনেরই ছবি আর ডিটেলস একসঙ্গে দেবে! এরকম ইনস্টলমেন্টে সুপারি দেওয়ার কথা কখনও শুনেছ!’ সে একটু থেমে যোগ করে, ‘প্ল্যানটা অনেকটা এরকম, প্রথমে দু-জনের মৃত্যু ঘটবে। স্বাভাবিকভাবেই পুলিস তা নিয়ে মাথা ঘামাবে না কারণ তার মাথা ঘামানোর অনেক জিনিস আছে। কিন্তু তৃতীয় মৃত্যুটা থেকে ভেতরের লিঙ্কটা সামনে আসা জরুরি। নয়তো বাকি যারা আছে, তারা জানবে কী করে যে তাদেরও শিয়রে শমন! তাই কালু ধরা পড়ল। আমরা খুঁজে বের করলাম ফোবিয়ান্সের অতীত। তার মধ্যেই টুয়েন্টি ফোর সেভেন নিউজ চ্যানেলে পরদা-ফাঁস! এখন গোটা শহর জানে যে ফোবিয়ান্সের সদস্যদের একের পর এক মৃত্যু ঘটছে। যারা বাকি আছে তাদের মনের অবস্থাটা একবার ভাবো। মরার আগেই প্রত্যেক দিন, প্রত্যেক মুহূর্ত ভয়ে মরবে তারা! প্রত্যেক মুহূর্ত ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকবে যে এরপর কার পালা! আর এটাই চেয়েছিল কেউ!

‘তাহলে কালুর সুপারি পাওয়াটা পুরো ফেক!’

‘হ্যাঁ। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো আমাদের মিসলিড করার ফন্দি। পুলিসের নাকের সামনে একটা রাঙা মুলো ঝোলানোর মতো কেউ ওকে ঝুলিয়েছে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি ব্যাপারটা উলটো। পুলিসকে ব্যাপারটা জানানোর জন্যই কালুকে এত কাণ্ড করে ধরিয়ে দেওয়া হল। একেই নিজের বন্ধুরা এক এক করে রহস্যময় মৃত্যু মরছে, তার ওপরে পুলিসের জেরা! চরম যন্ত্রণা! অর্ণব…।’

অর্ণব সচকিতে তাকায় অধিরাজের দিকে, ‘ইয়েস স্যার?’

‘যাদবকে ইন্টারোগেট করতে হবে।’ সে মাস্ক পরতে পরতে বলল, ‘কোথা থেকে ও কালুর টিপ পেয়েছিল সেটা জানতে হবে। পুরো ব্যাপারটাই অসম্ভব সুচিন্তিত। ছকটা এত ভালো কষেছে আমাদের অজ্ঞাত-বন্ধু যে তারিফ না করে পারছি না!’

‘কিন্তু স্যার…!’ অর্ণব বলল, ‘পুলিসকে জানিয়ে দেওয়া তো বোকার মতো কাজ হল! পুলিস বাকিদের প্রোটেকশন দিলে ওরা বেঁচে যাবে।’

‘এইখানেই তো আমাদের বন্ধুর স্পেশ্যালিটি। তিনি পুলিসকে একটা গল্প শোনানোর চেষ্টা করেছেন। কিছু বলার চেষ্টা করছেন যেটা এখনও পর্যন্ত আমরা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি। তার সঙ্গে একটা চ্যালেঞ্জও ছুঁড়ে দিয়েছেন। কে কে মরবে বলে দিলাম, এবার পারলে বাঁচা ব্যাটাদের!’

কী মারাত্মক ছক খাটিয়েছে! যদি সত্যিই এগুলো খুন হয়, তবে খুনীর সাহসের প্রশংসা করতে হয়। সে নিশ্চুপে নিজের কাজ করে কেটে পড়তেই পারত। মৃত্যু গুলো যে প্যাটার্নে হচ্ছে তাতে সন্দেহের কিছু ছিল না। কিন্তু কেউ যেচে পড়ে পুলিস আর মিডিয়াকে কাঠি করতে এল। কিন্তু এতে তো তার নিজেরই ক্ষতি! বাকি ভিকটিমরা সতর্ক হয়ে যাবে, পুলিস তাদের প্রোটেকশন দেবে। নিজেই নিজের কাজটা কঠিন করে দিল সে!

অর্ণব অধিরাজকে কথাটা বলতেই সে বলল, ‘এইটাই প্যারাডক্স অর্ণব। এত জানান দেওয়ার কী অর্থ সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না। কাজটা চুপচাপ সাল্টে নিতেই পারত। তবে যারা রিভেঞ্জ নেয় তাদের একটা ধর্ম আছে। তারা প্রত্যেকটা আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়ে দিতে চায় যে আঘাতটা কোথা থেকে আসছে, কেন আসছে। হতে পারে তেমনই কোনও কারণ এখানেও আছে।’

‘কিন্তু আদৌ কি এগুলো খুন রাজা?’ পবিত্র আস্তে আস্তে বলল, ‘এটাও তো অ্যাক্সিডেন্ট! মার্ডার নয়। নাকি মার্ডারার নিজেই ট্রাক চালিয়ে ভিকটিমকে মেরেছে?’

‘হতে পারে।’ অধিরাজ ঠোঁট টিপে হাসল, ‘আবার পেছন থেকে একটা ছোট্ট ধাক্কা দিয়েও ট্রাকের সামনে কাউকে ফেলে দেওয়া যায়। আপাতত ক্রাইম-সিন না দেখে কিছু বলা যাচ্ছে না।’

ততক্ষণে ক্রাইম-সিনে নরেন্দ্রপুর পুলিস চলে এসেছে। দূর থেকেই নজরে পড়ল হলুদ রঙের ডু নট ক্রস লাইন আর খাঁকি উর্দিধারী পুলিসটিম। একপাশে পুলিস জিপের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে টুয়েন্টি ফোর সেভেন নিউজের গাড়ি। অর্ণবের চোখে পড়ল এক বছর পঁয়ত্রিশের মহিলা বুম হাতে নিয়ে ‘ডু নট ক্রস’ লাইনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই চিনতে পারল, ইনিই শ্রুতি চ্যাটার্জি। তার পেছনে ক্যামেরাম্যান।

‘স্যার…।’

অধিরাজ গাড়ি থেকে নামতেই পরিচিত পুলিস অফিসার এগিয়ে এলেন। উষ্ণ করমর্দন করে বললেন, ‘আমরা আসা-মাত্রই স্পট সিল করে দিয়েছি। পরিবারের লোককে এখনও খবর দেওয়া হয়নি। ভদ্রমহিলার ব্যাগটা পেয়েছি আমরা। মোবাইল ফোনও আছে। ওঁর বাড়ি, স্বামীর ফোন নম্বরও আছে মোবাইলে। এখানকার তদন্ত শেষ হলেই ওঁদের খবর দেওয়া হবে। কিন্তু ঝড়-বৃষ্টির কারণে ট্রাকের চাকার দাগ বা জুতোর ছাপ, সব ব্লু-ই ধুয়ে গেছে। এমনকি রক্তের দাগও তেমন নেই। আমাদের ফরেনসিক টিমও কিছু পায়নি।’

অধিরাজ মৃদু হাসল, ‘একবার ডঃ চ্যাটার্জিও দেখুন। ততক্ষণে আমরাও স্পটটা দেখি। বডিটা কোথায়?’

‘ওইদিকে। আসুন।’

এই মুহূর্তে শর্বাণী ঘোষের মৃতদেহই খুঁটিয়ে দেখছিলেন ডঃ অসীম চ্যাটার্জি। গাড়ি থেকে নামার আগেই মাস্ক পরে নিয়েছিলেন। এবার মাস্কের নীচ থেকেই ফসফস করে বললেন, ‘ব্লাড রাস্তায় অতটা না থাকার দুটো কারণ হতে পারে। প্রথমত, রক্ত বৃষ্টিতেই অনেকটা ধুয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয়ত, ইনজুরিগুলো বেশিরভাগই ইন্টারনাল। ব্লিডিংটাও ইন্টারনালি হয়েছে। এই দেখো, মেয়েটির নাক, কানে রক্তের দাগ আছে। সম্ভবত মারাত্মক রকমের হেড ইনজুরি হয়েছে।’

‘কোনও রকমের ফিঙ্গার বা ফুটপ্রিন্ট? চাকার ছাপ? ‘

‘মেয়েটির পায়ের ওপর দিয়ে একটা চাকা চলে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ছাপ অস্পষ্ট। জলেই ধুয়ে গেছে।’ ডঃ চ্যাটার্জি লাশের থাইয়ের দিকে নির্দেশ করে বলেন, ‘তবে যতটুকু যা আছে তাতে ট্রাক বা বড় গাড়িই মনে হচ্ছে। ছোট গাড়ির কম্মো না!’

অর্ণব এবং বাকিরা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে তদন্ত করছিল। এমনিতে এ রাস্তাটা দিনের বেলাতেও যথেষ্ট শুনশান। তারপর আবার লকডাউন এবং ঝড়-বৃষ্টির ফলে আরো যানবাহনশূন্য হয়ে গিয়েছে। ত্রিসীমানায় আর কোনো গাড়ি দেখা যাচ্ছে না। আশেপাশে সিসিটিভিও নেই যে ফুটেজ থেকে জানা যাবে যে আদতে কী ঘটেছিল।

‘রাস্তায় তো তেমন কোনো লোকজনই নেই! আশেপাশে কোনো দোকানও নেই তবে কে বলল যে ট্রাকে ধাক্কা মেরেছে? প্রত্যক্ষদর্শী আছে?’

অফিসার মাথা নাড়লেন, ‘প্রত্যক্ষদর্শীর কথা বলতে পারব না। ট্রাক ধাক্কা মেরেছে সে-তো ওই রিপোর্টার ম্যাডাম দাবি করছেন!’

‘দাবি করছেন মানে? উনি স্বচক্ষে ট্রাককে মেয়েটিকে ধাক্কা মারতে দেখেছেন? সেক্ষেত্রে ট্রাকের নম্বরটাও দেখেছেন নিশ্চয়ই?’

অধিরাজের কথা শুনে হেসে ফেললেন অফিসার, ‘নাঃ, উনি কিছুই দেখেননি। ওঁকে কে যেন ফোন করে ঘটনাটার কথা জানিয়েছে। সেই ব্যক্তিই বলেছে যে ধাক্কাটা ট্রাকেই মেরেছে, অন্য কোনও গাড়ি নয়।’

অধিরাজ আর কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে গেল শ্রুতি চ্যাটার্জির দিকে। পেছন পেছন মিস বোস আর মিস দত্ত। শ্রুতি এতক্ষণ একদৃষ্টে এদিকেই দেখছিল। এবার হাত তুলে নমস্কার করল।

অধিরাজ প্রতি নমস্কার করে বলল, ‘আপনিই খবরটা সবার আগে পেয়েছিলেন না?’

‘হ্যাঁ।’ শ্ৰুতি সপ্রতিভভাবে জানায়, ‘আমিই এ-খবরটা প্রথম পাই।’

‘কীভাবে জানতে পারলেন?’ অধিরাজ প্রশ্ন করে, ‘যখন আপনারা নিউজটা দেখাচ্ছিলেন, ইনফ্যাক্ট তখনও নরেন্দ্রপুর পুলিস জানত না এই ঘটনার কথা। পুলিসের আগেও খবর পেলেন কী করে আপনি?’

শ্রুতি রহস্যময় হাসল, ‘আমাদের ইনফর্মাররা পুলিসের ইনফর্মারদের চেয়ে বেশি অ্যাকটিভ নিঃসন্দেহে।’

রীতিমতো বাউন্সার। অধিরাজের ঠোঁটে ব্যঙ্গবঙ্কিম হাসি ভেসে ওঠে,’আপনার ইনফর্মারটির নাম বাই এনি চান্স যুধিষ্ঠির নয়তো?’

‘মানে?’শ্ৰুতি ইঙ্গিতটা ধরতে পারেনি। অধিরাজ আবার ছেলেমানুষি হাসি হাসল, ‘ইনফর্মারের কাছ থেকে শোনা কথার ভিত্তিতে যেরকম কনফিডেন্সের সঙ্গে আপনি ঘটনাটা বর্ণনা করছেন তাতে তো তাই-ই মনে হয়! মেয়েটিকে ট্রাকে ধাক্কা মেরেছে না ডাইনোসরে, তা কেউ দেখেনি! অথচ আপনি ট্রাকের কথাই বারবার বলছেন। কে বলেছে আপনাকে যে মেয়েটিকে ট্রাকে ধাক্কা মেরেছে? কে বলেছে যে এই মৃত্যুটা জেজিইসির একটি বিশেষ গ্রুপের সদস্যদের মৃত্যুর সঙ্গে লিঙ্কড? আপনি ব্যক্তিগতভাবে এদের কাউকে চেনেন?

‘না।’ শ্রুতির মুখ কঠিন হল, ‘আমার সোর্সই আমায় বলেছে।’

‘ইন দ্যাট কেস আমার প্রশ্নটাও সেখানেই রয়েছে।’ সে শান্তস্বরে বলে,’আপনার সোর্স স্বয়ং ধর্মপুত্র নন তো যে তার কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হবে?’

শ্রুতি এবার যেন খানিকটা বিব্রত বোধ করল। আস্তে আস্তে বলল, ‘আমি আমার সোর্সের কথা বলতে বাধ্য নই।’

‘তা আপনি নন, কিন্তু একবারও ভেবে দেখেছেন কি যে আপনার সোর্সটি আদৌ সুবিধার লোক নয়?’ অধিরাজ খুব শান্ত, মোলায়েম স্বরে বলে, ‘নয়তো সে জানল কী করে যে ট্রাকই মেয়েটাকে ধাক্কা মেরেছে, অন্য কোনো গাড়ি নয়? যখন সে এত নিশ্চিতভাবে জানে তখন দুটোই সম্ভাবনা হয়। প্রথমত, হয় সে একজন প্ৰত্যক্ষদৰ্শী এবং অ্যাক্সিডেন্টটা তার চোখের সামনে ঘটেছে। যদি তাই হয় সে ক্ষেত্রে সে কেন মেয়েটিকে হসপিটালে নিয়ে গেল না? অথবা আপনাকে ফোন না করে পুলিসে ফোন করল না? দ্বিতীয় সম্ভাবনা, সে নিজেই মেয়েটিকে পিষে দিয়েছে।’

এবার শ্রুতি চ্যাটার্জির চোখে একটু দ্বিধার ছায়া পড়ল। সেটা লক্ষ্য করেই অধিরাজ বলল, ‘তাছাড়া আপনি জানলেনই বা কী করে যে জেজিইসির প্রাক্তনীদের সঙ্গে এরকম দুর্ঘটনা ঘটছে? কেউ বলেছে না আপনি নিজেই খুঁজে বের করেছেন?

‘না।’ শ্রুতি মুখ নীচু করে জানায়, ‘আমার সোর্সই সেটা জানিয়েছে।’

‘সবই তো জানিয়েছে দেখছি। খুনীর নাম ঠিকানা জানায়নি? কিম্বা নিজের নাম? শ্রুতি মাথা নাড়ে, ‘নাঃ!‘

‘যে লোক প্রয়োজনের অতিরিক্ত ইনফর্মেশন জানে, আপনাকে স্কুপটা দিয়ে এত উপকার করল, সেই উপকারী বান্ধবের নিজের নামটা বলতে এত লজ্জা কেন? আপনার ব্যাপারটা ফিশি বলে মনে হয়নি?’

শ্ৰুতি চ্যাটার্জি একদম চুপ। সম্ভবত সে এতদূর অবধি ভেবে দেখেনি। কয়েকমুহূর্ত নীরব থেকে বলল সে, ‘দেখুন, আমি সঠিকভাবে বলতে পারব না যে ফোনটা কে করেছিল। সে আমার পরিচিত সোর্স নয়। ওভার ফোনে আমাদের কথা হয়।’

‘ফোনটা কি আপনার মোবাইলে এসেছিল?’

‘না। অফিসের ল্যান্ডলাইনে।’ শ্রুতি ধীর স্বরে জবাব দেয়, ‘আমার এক কলিগ ফোন রিসিভ করে। ভদ্রলোক তখন আমার নাম করে আমায় ফোনটা দিতে বলেন।’

‘আপনার নাম করে?’ অধিরাজের ভুরু কুঁচকে গেল, ‘কোনও র‍্যান্ডম রিপোর্টারকে নয়, একদম নাম করে আপনাকেই চেয়েছিল?

‘হ্যাঁ। আমিও একটু অবাক হয়েছিলাম।’ শ্রুতি জবাব দেয়, ‘আমাদের চ্যানেলে আরও অনেক অভিজ্ঞ ক্রাইম রিপোর্টার আছে। আমি খুব বেশিদিন চ্যানেলে জয়েন করিনি। তা-সত্ত্বেও লোকটা আমায় চাওয়ায় আমিও খুব অবাক হয়েছিলাম।’

‘গলাটা কোনও ভদ্রলোকের ছিল?’

‘হ্যাঁ, তেমনই তো মনে হচ্ছিল।’ শ্রুতি যেন একটু ইতস্ততঃ করে জবাব দেয়, ‘যদিও ঠিক শিওর নই।’

‘কেন?’

‘গলাটা কেমন যেন অদ্ভুত শোনাচ্ছিল। অনেকটা কম্পিউটারাইজড ভলিউমের মতো।’

‘বেশ। তারপর?’

‘ভদ্রলোক খুব নম্রভাবেই আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন। তিনিই বলেন যে কামালগাজির এখানে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। মৃতার নাম শর্বাণী ঘোষ। ট্রাকে ধাক্কা লাগার ফলে তার মৃত্যু হয়েছে। তিনি আরও জানান, এই নিয়ে এটা জেজিইসির প্রাক্তনীদের মধ্যে চতুর্থ মৃত্যু। আগের তিনজন, তথা সৌমিত্র, মৃন্ময় ও উৎপলের ঘটনাও তিনি জানান।’

‘কিন্তু সব চ্যানেল ছেড়ে টুয়েন্টি ফোর সেভেন নিউজই কেন?’ অধিরাজ বলল, ‘এবিপি আনন্দ থেকে শুরু করে আরও অন্তত হাফডজন হেভিওয়েট চ্যানেল আছে। সব ছেড়েছুড়ে আপনাদের চ্যানেলই কেন? এবং সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—একমাত্র আপনাকেই সে ফোনটা করল কেন? ক্রাইম জার্নালিস্ট তো আরও আছে।’

‘এই প্রশ্নদুটো আমিও তাঁকে করেছিলাম।’ শ্রুতি একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘বললেন যে তিনি চান এই খবরটা আমিই কভার করি।’

‘এই কথায় আপনি অবাক হননি?’

‘হয়েছিলাম। বিস্ময় প্রকাশও করেছিলাম। তার উত্তরে তিনি বললেন যে একমাত্র তাহলেই পোয়েটিক জাস্টিস হবে।’

‘আঃ!’

অস্ফুটে বলে উঠল অধিরাজ। যেন অজ্ঞাত লোকটির মনের সন্ধান সে পেয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলল, ‘আপনি সুজিত চ্যাটার্জিকে চেনেন? তিনিও জেজিইসির স্টুডেন্ট ছিলেন।’

শ্রুতির দু-চোখে অনাবিল বিস্ময় ফুটে ওঠে। তারপর শান্ত স্বরে বলল সে, ‘সুজিত চ্যাটার্জি আমার দাদা।’

‘কেমন আছেন তিনি?’

শ্রুতির চোখে যেন এবার রক্ত জমাট বেঁধেছে, ‘তিনি আর নেই।‘

এবার বিস্মিত হওয়ার পালা অধিরাজের, ‘মানে?’

‘আপনারা সব খবরই রাখেন আর এটা জানেন না যে পনেরো বছর আগেই দাদা সুইসাইড করেছে?’ মেয়েটার গলায় ক্ষোভ, তিক্ততা, রাগ সব মিলেমিশে গিয়েছে, ‘যতদিন বেঁচে ছিল, ততদিন রোজ একটু একটু করে মরত। মানুষের সঙ্গে মিশতে ভয় পেত। নিজেকে ঘরের ভেতর বন্দি করে রেখেছিল। জেজিইসি-তে পড়তে গিয়ে র‍্যাগিঙের কারণে চলে এসেছিল তা আত্মীয় বন্ধু বান্ধবরা জানত। তারা এ নিয়ে অনেক হাসি ঠাট্টাও করেছে। দাদাকে বাবা নতুন করে আবার সব কিছু শুরু করতে বলেছিলেন। কিন্তু যে কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামেই সে ভয় পেত। তার আশঙ্কা ছিল, আবার সেই একই ঘটনা ঘটবে। আবার সেই একই অপমানের মুখোমুখি হতে হবে তাকে। মেন্টালি ডিস্টার্বডও ছিল। অনেক সাইকায়াট্রিস্ট দেখানো হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই ভয়, আতঙ্ক, অপমানের দিনগুলো থেকে বেরোতে পারছিল না ও।’ সে একটু থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘একদিকে ও নতুন জীবনের দিকে এগোতে প ারছিল না, অন্যদিকে বুঝতে পারছিল ওর কেরিয়ার শেষ হয়ে যাচ্ছে। দু-দিকের এই টানাপোড়েন আর নিতে পারেনি।

তাই একরাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর মায়ের শাড়িতে ফাঁস লাগিয়ে…!’

শ্রুতি আর বলতে পারল না। অধিরাজ বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। কী পরিণতি ছেলেটার! অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। এক তরতাজা তরুণ অনেক স্বপ্ন চোখে নিয়ে জেজিইসিতে পড়তে গিয়েছিল। ঝকঝকে তকতকে কেরিয়ার হওয়ার কথা তার। মা-বাবা অনেক আশা নিয়ে ছেলেকে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। সে কী এই দিন দেখার জন্য!

এই মুহূর্তে অধিরাজের ফোবিয়ান্সের প্রতি কোনোরকম সহানুভূতি হচ্ছিল না। এ কী বিচিত্র অসভ্যতা মানুষের! দু’ দু-জন তরুণের জীবন বরবাদ করেছে এই গ্রুপ! ভগবান জানেন, আরও কতজনের সর্বনাশ করেছে এরা!

‘ওদের মরাই উচিৎ।’ শ্রুতির চোখে স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে, ‘আমি জানি না এই মৃত্যুগুলোর পেছনে ঈশ্বর আছেন না মানুষ। শুধু এইটুকু বলতে পারি, যা হয়েছে, ব্বেশ হয়েছে। এটাই হওয়া উচিৎ ছিল।’

শ্রুতির এই কথার কোনও কঠোর জবাব দিতে পারল না অধিরাজ। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘থ্যাঙ্কস ফর দ্য কো-অপারেশন ম্যাম। আপনার ফোন নম্বরটা…!’

শ্রুতির কাছ থেকে তার ফোন নম্বর আর বাড়ির ঠিকানা নিয়ে নিল সে। শ্ৰুতি এখন আর পৈতৃক বাড়িতে থাকে না। তার বিয়ের পর থেকেই ঠিকানা বদল হয়েছে। সুজিত এবং শ্রুতির বাবা-মা অবশ্য এখনও পুরনো বাড়িতেই থাকেন। তারা এখনও মৃত ছেলের স্মৃতি বুকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন।

‘স্যার…!’

অধিরাজ শ্রুতির কথা শুনে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। কতগুলো যুবক যুবতীর নিষ্ঠুরতার জন্য কী সর্বনাশটাই না হয়ে গেল! মৃত সন্তানের বাবা-মায়েরা নিশ্চয়ই এর সঠিক বিচার চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন বিচার পাননি। আইনও কিছু করে উঠতে পারেনি। পুলিসের দোষ নেই। কোনোরকম প্রমাণ ছিল না। ফোবিয়ান্সের বিরুদ্ধে শোনা কথা ছাড়া কোনোরকম পোক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। স্বাভাবিকভাবেই তারা থেকেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে!

কিন্তু হঠাৎ করে আজ কে পোয়েটিক জাস্টিসের জন্য উঠে পড়ে লাগল! তা-ও আবার এত বছর পরে! শ্রুতি চ্যাটার্জিকে যে ব্যক্তি ফোন করেছিল, নিঃসন্দেহে সে কোনো না কোনোভাবে এর সঙ্গে জড়িত। সে মৃতদের সমস্ত কুকীর্তি জানে—কে জানে তার বদলাই নিচ্ছে কি না! নয়তো শ্রুতি চ্যাটার্জিকে ‘পোয়েটিক জাস্টিসের কথা বলত না।

‘স্যার… এদিকে একবার আসুন।’

অর্ণবের ডাকে সম্বিত ফিরল অধিরাজের। অর্ণব আর পবিত্র তখন গোটা ক্রাইম-সিন খুঁজে দেখছিল কিছু পাওয়া যায় কি না। এবার অধিরাজের দিকে তাকিয়েছে দু-জনেই। অধিরাজ ওদের দিকে এগিয়ে যেতেই বলল, ‘এই দেখুন।’

রাস্তার একপাশে কাদা জমেছিল। কিন্তু কাদাটা যেন থেবড়ে আছে। বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে ঘাসও দোমড়ানো মোচড়ানো। ডঃ চ্যাটার্জির চোখেও স্পটটা পড়েছে। তিনি এগিয়ে আসতে আসতেই বললেন, ‘কী ব্যাপার! কেউ এখানে রোলার চালিয়েছে নাকি!’

অধিরাজ ঝুঁকে পড়ে জায়গাটা ভালো করে দেখছিল। ঘাসের ফাঁক দিয়ে সাদা সাদা কী যেন উঁকি মারছিল। একটু ভালো করে দেখতেই চোখে পড়ল সাদা ছোট্ট ট্যাবলেট! সে ট্যাবলেটটাকে তুলে ধরল, ‘এই ওষুধটা দেখুন তো ডঃ চ্যাটার্জি।’

‘আ-বা-র ওষুধ!’ ডঃ চ্যাটার্জি ওষুধটাকে হাতে নিয়ে জহুরিদের হীরে দেখার মতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। তাঁর কণ্ঠস্বরে প্রবল বিস্ময়, ‘এ তো সেই মাল! এস.এস.আর.আই! সিটালোপ্র্যাম!’

‘কাদাটা যেমনভাবে ধেবড়ে গিয়েছে তাতে মনে হয় কেউ এখানে বসে ছিল।’ অধিরাজ চিন্তিত স্বরে বলে, ‘তাও বেশ কিছুক্ষণের জন্য।’

‘পা পিছলেও পড়তে পারে।’

পবিত্র’র কথায় মাথা নাড়ল সে, ‘না পবিত্র, পা স্কিপ করলে কাদাটা এভাবে ধেবড়ে যেত না। জুতোর ছাপ সামান্য হলেও থাকত। কাদার ওপর দাগটাও তেরছাভাবে পড়ত। ঠিক বলে বোঝাতে পারব না। কিন্তু দেখলে বুঝতে পারি। কেউ এখানে অনেকক্ষণ বসেছিল। ঘাসগুলোও দেখো কেমন শুয়ে পড়েছে। সচরাচর কোনও ভারী জিনিসে চাপা পড়লে এরকম হয়। ছাপটা দেখে মনে হচ্ছে কেউ এখানে বসেছিল।’

‘এখানে কেউ বসেছিল!’ পবিত্র সবিস্ময়ে বলে, ‘অ্যাক্সিডেন্ট স্পটে কেউ কেন বসে থাকবে? তাও আবার ঝড়বৃষ্টির মধ্যে!

‘শুধু বসেনি, ওষুধও খেয়েছিল।’ সে ডঃ চ্যাটার্জির দিকে তাকায়, ‘আপনি শিওর যে এটা ঐ একই ওষুধ?’

‘ড্যাম শিওর।’ ডঃ চ্যাটার্জি এভিডেন্স ব্যাগে ছোট্ট ওষুধের বড়িটাকে পুরে ফেলে বললেন, ‘যে ওষুধের ফয়েলটা তোমরা রয়্যাল হাইটসের ছাদে পেয়েছিলে, এটা সেই একই ওষুধ। অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট!’

‘অদ্ভুত ব্যাপার তো!’ অধিরাজের চোখে সপ্রশ্ন দৃষ্টি, ‘এর আগেও অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট ছিল। এবারও তাই। এই অ্যান্টিডিপ্রেসান্টের চক্করটা কী!‘

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *