ডেয়ার অর ডাই – ১

ডেয়ার অর ডাই – সায়ন্তনী পূততুন্ড / প্রথম প্রকাশ – মার্চ ২০২২

ইন্দ্রাণীদি’কে দিলাম

.

মানুষটা ঠক ঠক করে কাঁপছিল।

মারাত্মক শৈত্যপ্রবাহে ওর সারা দেহ অবশ হয়ে আসছে! মনে হচ্ছে যেন তার দেহে জীবনের কোনও অস্তিত্বই নেই। যেদিকেই তাকাচ্ছে, সেদিক থেকেই বুঝি হিমশীতল ভয় গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে তার দিকে। দুঃস্বপ্নের মতো চারদিক ঘিরে রয়েছে মূর্তিমান বিভীষিকা! এ কী ভয়ংকর দৃশ্য! এর সামনে দাঁড়ানো যে অসম্ভব! তার নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসে। বুকের ভেতরে একটা চাপা ব্যথা অনুভব করছে। হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে! দরদর করে ঘামছে সে। দুনিয়ায় একটা মানুষও কী নেই যে তাকে বাঁচাতে পারে! কেউ কী নেই যে ওকে মুক্তি দিতে পারে!

সে প্রবল ভয়ে চোখ বুজে ফেলে। দেখবে না! দেখবে না এ দৃশ্য! মৃত্যুর মতো হিমশীতল হাওয়া ওকে ছুঁয়ে গেল। মানুষটা শিউরে ওঠে। শীতে, আতঙ্কে তার সারা দেহ কাঁপছে। বুকের মধ্যে ধড়ফড়ানি। এবার বোধহয় সত্যি সত্যিই হার্টফেল করবে! বাঁচার আর কোনও উপায় নেই। কে জানত লোকটা এইভাবে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে! কোন্ অপরাধের শোধ নিচ্ছে সে! তবে কী অতীতের অপরাধের ছায়া আজও তার পেছন ছাড়েনি? কিন্তু তাই বা কী করে সম্ভব? সে কথা কোনওদিন কাউকে বলেনি সে। জানত শুধু ওরা ক-জন। সবাই মিলে প্রতিজ্ঞা করেছিল গোটা ব্যাপারটাই ভুলে যাবে। কেউ কোনওদিন জানতে পারবে না যে সে রাতে কী ঘটেছিল। ঘটনাটা ওদের এতটাই ভয়ার্ত করে তুলেছিল যে নিজেদের মধ্যে কোনও যোগাযোগও রাখেনি! কারোর কাছে কোনওদিন এ ব্যাপারে মুখ খোলেনি কেউ।

ভাবতেই বুকের ভেতরটা ধ্বক্ করে উঠল তার। তবে কি লোকটা সে কথা জানে! কিন্তু জানল কী করে! ওদের মধ্যেই কেউ মুখ ফসকে বলে ফেলেনি তো! তার পিঠ বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত সরীসৃপের মতো সরসরিয়ে নেমে গেল। লোকটা সব জানে। ও সে-রাতের কথা জানে! ওদের কলঙ্কের কথা জানে! ভয়ের কথাও জানে! সেইজন্যই তাকে এখানে এনেছে। ও প্রতিশোধ নিতে চায়! শোধ নেবে! কিন্তু কেন? ও আসলে কে!

আতঙ্কিত মানুষটা চোখ বুজে এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল। অতলান্তিক ভয়ে ডুবে যাচ্ছিল সে। চতুর্দিকে স্তব্ধতা। এত নৈঃশব্দের মধ্যে একমাত্র নিজের হৃৎস্পন্দনের আওয়াজই শোনা যায়। ও জানে, আশেপাশে আরও কেউ আছে। তাদের শীতল নিঃশ্বাস এসে আছড়ে পড়ছে তার মুখে বুকে! তাদের শূন্য অক্ষিকোটরে জমাট অন্ধকার পৈশাচিক হাসি হাসছে! অনেকগুলো ছায়া তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শুধুই ছায়া, কায়া নেই! চুপি চুপি নিজেদের মধ্যে ইশারায় কথা বলছে। হয়তো বা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে তার দিকেই। ওরাও কি প্রতিশোধ নিতে চায়? ওরাও কি জানে সে-রাতটার কথা!

মাথার ওপরের বালটা দপদপিয়ে উঠল। এক অদ্ভুত আলো-আঁধারি পরিবেশ ছেয়ে আছে চারদিকে। রাত সম্ভবত মধ্যযামে। একটা শিরশিরে অনুভূতি মাঝেমধ্যেই ছুঁয়ে যাচ্ছে। যেন হিমশীতল এক মৃতদেহ স্পর্শ করে যাচ্ছে বারবার। বালবের ফ্যাকাশে রক্তশূন্য আলো যেটুকু আলোকিত করেছে সেটুকু হলদেটে ম্লান। বাকি অংশে অন্ধকার বুঝি শ্বাপদ জন্তুর মতো ওঁৎ পেতে আছে। শুধু আলোটুকু নিভে যাওয়ার অপেক্ষা! সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে!

তার মাঝখানেই বসে আছে একটা লোক। তার চতুর্দিকে সাদা কাপড়ে ঢাকা কিছু মানুষ! না, জীবিত নয়! এই মুহূর্তে অসহায় প্রাণীটা একটা মর্গে বসে আছে। প্রথমদিকে ভীষণ ছটফট করছিল। চিৎকার করে সাহায্যও চেয়েছিল। দরজায় বারবার ধাক্কাও মেরেছে। কিন্তু কেউ শোনেনি। কেউ একবারের জন্যও মর্গের দরজা খোলেনি। কেউ জানতেও পারেনি যে এখানে একজন জীবন্ত মানুষ লাশেদের ভিড়ে বন্দি হয়ে আছে। অনেক ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর এখন সে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছে। মৃত্যু-কঠিন লাশগুলোও যেন তার অবস্থা দেখে মৃদু হেসেছে। ওরাও যেন সকৌতূহলে প্রহর গুনছে অন্তিম দৃশ্যের। কী হতে চলেছে তাও জানে! মানুষটার মনে হল, তার চারপাশে জড়ো হয়েছে কিছু অদৃশ্য দর্শক। তাদের ফিসফাস স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে। ভয়ংকর এক শূন্যতার মধ্যে বিপজ্জনক কিছু অস্তিত্ব! অবয়বহীন এক আতঙ্ক!

মর্গের লাশগুলোর দিকে তাকালে ভয় হয়! কোনওটার মৃত্যু অ্যাক্সিডেন্টে হয়েছে, কোনওটা আবার রেলে কাটা পড়েছে! কারোর পুরো শরীরটাই থেঁতলে গিয়েছে, কারোর আবার শরীর দ্বিখন্ডিত! একটা লাশের মাথার একদিকটা চুরমার! একপাশ দিয়ে উঁকি মারছে খুলির ভাঙা হাড়গোড় ও শুকিয়ে যাওয়া ঘিলু! আলো-আঁধারির মধ্যে সার সার দেহ শুয়ে আছে নিস্পৃহ মুখে! এই বীভৎসতার কোনও সংজ্ঞা নেই! এই ভয়ের কোনও শেষ নেই। মানুষটা টের পেল তার গলা শুকিয়ে এসেছে। অদ্ভুত একটা বিবমিষা পাকস্থলীতে পাক মেরে উঠল। এ ঘরে এখন শুধু মৃত্যুর গন্ধ! তার দমবন্ধ হয়ে আসে।

‘না! না!’

একটা খসখসে আওয়াজ। পরক্ষণেই একটা শক্ত হাত এসে পড়ল মানুষটার পিঠের ওপরে। ভয়ের চোটে পরিত্রাহি চিৎকার করে ওঠে সে। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো লাফিয়ে ওঠে। ভয় বিস্ফারিত দৃষ্টিতে পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখল একটা লাশের হাত একটু একটু করে উঠে যাচ্ছে ওপরের দিকে। তার মনে হল, লাশটা তাকে ধরতে আসছে! এখনই উঠে বসবে!

চতুর্দিকে যেন খলখল শব্দে কারা হেসে উঠল! সে আঁৎকে উঠে পিছিয়ে যায়। কিন্তু এ কী! পিছনেও কে যেন শুয়ে রয়েছে। তার হাতে লেগে সরে গেল সাদা চাদরটা! একটা মুণ্ডহীন দেহ! তার পাশে একটা পোস্টমর্টেম করা ক্ষতবিক্ষত লাশ পড়ে আছে! মাথায়, বুকে বড় বড় সেলাইয়ের ফাঁক দিয়ে এখনও রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে! তাকে দেখেই সে যেন নীরব অথচ বীভৎস নারকীয় হাসি হাসে! তার ঘাড়ের কাছে শীতল নিঃশ্বাস ফেলছে কে!… কে!

‘বাঁ-চা-ও!’

মরিয়া হয়ে মানুষটা চিৎকার করে উঠল। বুকের ভেতরে তীক্ষ্ণ একটা ব্যথা। তার দমবন্ধ হয়ে আসছে! ফুসফুসটা কে যেন দু-হাতে চেপে ধরেছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে! প্যানিক অ্যাটাক? সে আপ্রাণ লড়তে থাকে একটু অক্সিজেনের জন্য! যন্ত্রণায় কুঁকড়ে আসছে গোটা শরীর। পৃথিবীটা দুলছে। চোখে ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছে না! তবু ঝাপসা চোখে ধরা পড়ল, অনেকগুলো ছায়া দুলতে দুলতে এগিয়ে আসছে তার দিকেই। ওদের কারোর অবয়ব নেই! শুধু একরাশ অন্ধকার ক্রমশ‍ই ঘিরে ধরছে তাকে! তার মধ্যে জ্বলজ্বল্ করছে কতগুলো ফ্যাকাশে পিঙ্গল চোখ! ওরাও কি তাকে শাস্তি দিতে চায়? অতীত থেকে উঠে আসা ভয় ক্রমাগতই চেপে ধরছে! ভয়! ভীষণ ভয়! চতুর্দিকে ভয়! এত ভয় এতদিন কোথায় লুকিয়েছিল!

মানুষটা দেহের সবটুকু শক্তি দিয়ে কোনোমতে উঠে দাঁড়াল। পালাতে হবে! তাকে পালাতেই হবে এখান থেকে! যে করেই হোক মুক্তি পেতেই হবে। পা দুটো অসম্ভব ভারী, হাঁটতে পারছে না। তবু এলোমেলো ভাবে সারা ঘরে দৌড়চ্ছে সে। চরম ভয়ে, ভীষণ আতঙ্কে পাগলের মতো এ-মাথা থেকে ও-মাথা ছুটে বেড়াচ্ছে! কোন্‌দিকে যাবে বুঝতে পারছে না! যেদিকেই যাচ্ছে সেদিকেই লাশ! সেদিকেই অন্ধকার ছায়ারা ঘনিয়ে আসছে! ওরা তাকে ধরবে! তাকে শাস্তি দেবে।

কোনোমতে শেষবারের মতো দরজায় আছড়ে পড়ল সে। সর্বশক্তি দিয়ে উন্মত্তের মতো দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে চিৎকার করে উঠল, ‘বাঁ-চা-ও! আমায় বাঁ-চা-ও! প্লিজ! দরজা খোলো! কেউ দরজা খো-লো!’

সে জানত না, ঘরটা সাউন্ডপ্রুফ!

.

জনৈক ব্যক্তির ডায়রি

‘ভয়ের চেয়ে বড় অস্ত্র দুনিয়ায় আর নেই। আর কেউ না জানুক, আমি জানি ভয় কাকে বলে। ভীতু মানুষ এ পৃথিবীর দুর্বলতম প্রাণী। তাই সবসময়ই অবদমিতও বটে। ভীতু মানুষেরা বড় অসুখী হয়। কারণ তাদের ভয় দেখিয়ে দমন করা যায়, যে কোনোভাবে ব্যবহারও করা যায়। ভয়ের কোনও রূপ নেই। কোনও নির্দিষ্ট আকার-প্রকারও নেই। তাকে পরিমাপও করা যায় না। তবু সে চুপি চুপি আসে। মনের ভেতরে অতীতের কালচে ছোপকে আশ্রয় করে গড়ে তোলে এক দানবাকৃতি চেহারা! কখন যে ভয়াবহ মূর্তি নিয়ে টুটি টিপে ধরবে সে, তা কেউ জানে না! শুধু পড়ে থাকে নিঃসীম আতঙ্ক! সে আতঙ্কের হাত থেকে কারোর নিস্তার নেই।

মানুষ ভবিষ্যতকে ভয় পায়। সেইজন্যই ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা জানার প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। এই ভয়ের ওপরেই তো গোটা বিশ্ব দাঁড়িয়ে রয়েছে। মানুষ ভবিষ্যতকে ভয় পায় বলেই ব্যাঙ্ক ও লাইফ ইনশিওরেন্সের ব্যবসা চলে, জ্যোতিষীর কারবার ফুলে ফেঁপে ওঠে। রোগ আর মৃত্যুকে ভয় পায় বলেই ডাক্তার, হসপিটালের পোয়া বারো শুধু মৃত্যুকে নয়, মানুষ জীবনকেও ভয় পায়। জীবন মানেই তো লড়াই। প্রতি মুহূর্তে এক অজানা প্রতিপক্ষের সঙ্গে পাঞ্জা কষে যাওয়া। যে কোনও সময়ে হেরে যেতে পারে। জীবনের চ্যালেঞ্জকে ভয় পায় বলেই ভুলে থাকার চেষ্টা করে। আর তার ওপ রেই নির্ভর করে আছে সমস্ত বিনোদন। গোটা বিশ্ব সেই বিনোদনেই মেতে থাকে।

তবে সবচেয়ে ভয়ংকর মানুষের অতীত। অতীত মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতাও বটে! আর অতীতের অন্ধকার আরও ভয়ংকর! প্রতি পলে পলে মারে সে। প্ৰতি মুহূর্তে নরক যন্ত্রণা দেয়। আমার অতীত মাঝেমধ্যেই আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। অসম্ভব কুৎসিতদর্শন, ক্ষতবিক্ষত একটা অন্ধকারের প্রাণী! তাকে দেখলেই কেমন যেন বুকের ভেতরটা শিরশিরিয়ে ওঠে। মনে হয়, অতীত নয়—একটা মূৰ্তিমান যন্ত্রণা দেখা করতে এসেছে। ও আমার দিকে তাকিয়ে যখন হাসার চেষ্টা করে, তখন মনে হয় ভেতরে ভেতরে কাঁদছে। সে কাঁদতে থাকে, আর আমি তার কান্না শুনতে থাকি। একটা অস্ফুট গোঙানির একঘেয়ে শব্দ শুনে যাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা! আস্তে আস্তে যত ওর কান্না উচ্চগ্রামে পৌঁছয়, ততই আমার ভয় করে। ধরাপড়ে যাওয়ার ভয়! অন্য কেউ শুনে ফেলবে না তো ওর এই ক্রন্দন! আমার অতীতের ভয়ংকর চেহারা যদি কেউ দেখে ফেলে…!

আমি মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভয় পাই। কারণ এ জীবনে মানুষই আমায় সবচেয়ে বেশি ভয় দেখিয়েছে! আমি বন্ধুত্ব করতে ভয় পাই, সম্পর্কের জাল বুনতে ভয় পাই —ভয় পাই মৃত্যুকে। নিজের নয়, পরের মৃত্যু! আমার চারপাশে যে মানুষগুলো হেঁটে বেড়ায়, তারা একে একে মরে যাবে ভাবলেই এক অদ্ভুত অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরে আমায়। আমি একটা আরশোলা মারতেও ভয় পাই! আমার অতীত কাঁদে আর বলে— ‘কেন তুমি এত ভীতু?’

আমি তাকে বলি, ‘ভীতু না হলে ওদের খুন করব কীভাবে?’

সে চমকে ওঠে! ভয়ার্ত স্বরে বলে, ‘খুন! কিন্তু তুমি যে লাশ দেখতে ভয় পেতে!’

হ্যাঁ, পেতাম! আজও ভয় পাই। আমার চোখের সামনে আমার আপনজনেরা মারা গিয়েছে! তাদের মৃতদেহ দেখার পর কয়েকমাস ঘুমোতে পারিনি। মনে হত, অন্ধকার হলেই বুঝি আমার মাথার কাছে এসে দাঁড়াবে সেই দেহ! বুকের ভেতরে কী অসহনীয় কষ্ট হত, তা বলে বোঝানো যাবে না! আজও কারোর মৃত্যুসংবাদ শুনলেই আমার ভয় করে। মনে হয়, সেই মৃত ব্যক্তি বুঝি সবসময়ই আমার সঙ্গে সঙ্গে আছে!

আমি জানি, ওরা আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে! যখনই সৌমিত্রকে মর্গে ঢুকিয়ে দিয়ে এলাম, তখনই জানতাম আজ ওর শেষ দিন! কী ভীষণ ভয় লেগেছিল কথাটা ভেবে! বুঝতে পেরেছিলাম, ও আমাকে ছাড়বে না। বারবার দেখা করতে আসবেই! আমার হাত পা কাঁপছিল! ভীষণ কান্না পেয়েছিল! একটা জলজ্যান্ত মানুষকে খুন করছি আমি। সেই পাপবোধ আমার পেছনে এখনও তাড়া করে। তাড়া করে সৌমিত্রও। আমায় একমুহূর্তের জন্যও স্থির থাকতে দেয় না সে। যখন তখন অলঙ্ঘ্য নিয়তির মতো সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি দেখতে পাই ওর ফ্যাকাশে সাদা মুখ, মাছের মতো মড়া চোখ। বুঝতে পারি, একা ও নয়— ওরা প্রত্যেকেই আসবে আমার কাছে। আমাকে ঘিরে ঘুরে বেড়াবে! বারবার প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত করবে আমায়। ভয় দেখাবে! আমার বড্ড কান্না পায়! ভীষণ কান্না….!

‘কেন?… কেন?…’

আমার অতীত আবার কেঁদে ওঠে। আমি ওর যন্ত্রণাকাতর মুখের দিকে তাকাই। সারা মুখে যেন কালশিটে পড়ে গিয়েছে ওর। ভয়ে পাংশু মুখ! আমার করুণা হয়। কী করে ওকে বোঝাই যে বেশিরভাগ অপরাধের পেছনেই আসলে ভয় থাকে। মানুষ ভয় পায় বলেই অপরাধ করে!

আমার নাম…!

আমার কোনো নাম নেই! আমার কোনও রূপ নেই। বয়েস, লিঙ্গ, বৰ্ণ, আকার—কিছুই নেই। আমি যে কেউ হতে পারি। বাড়ির গৃহিনী বা দাসী থেকে কর্তা বা ভৃত্য—তরুণী কিংবা তরুণ, ফর্সা-কালো, লম্বা-বেঁটে, রোগা-মোটা— যে কেউ, যা কিছু হতে পারি। যে ছেলেটি রোজ সকালে ঝিলের পাশ দিয়ে জগিং করে আমি সে-ও হতে পারি। যে বৃদ্ধা রোজ বিকেলে নদীর পাড়ে বসে সূর্যাস্ত দেখেন— সে-ও হতে পারি। আমার শুধু একটাই পরিচয়! আমি অসম্ভব ভীতু একজন মানুষ। কয়েককোটি ভীতু মানুষের প্রতিনিধি যারা প্রতি মুহূর্তে ভয়ে মরে! আর আমার থেকে বড় ক্রিমিনাল খুব কম আছে।

সম্প্রতি আমি একটা খেলা খেলছি। একসময় এটার নাম ছিল ‘ডেয়ার অর ট্রুথ’। ছোটোবেলায় খেলাটা অনেকবার খেলেছি। কলেজ জীবনেও খেলেছি। একটা বোতলকে ঘুরিয়ে দিতে হয় খেলোয়াড়দের সামনে। যার দিকে বোতলের মুখ থাকে, তাকে হয় কোনও সাহসিক কাজ করতে হয়, নয় কোনও প্রশ্নের উত্তরে সত্যি কথা বলতে হয়। কিন্তু এখন ‘ট্রুথ’ বা সত্যের জমানা নেই। ওরা কেউ সত্যি কথা বলেনি। কোনওদিন বলতেও পারবে না। তাই ‘টুথের’ গল্পই রাখিনি। মানুষ যতই ভীতু হোক, তাকে এত ভয় দেখানো উচিত নয় যাতে সে ভয় পেতেই ভুলে যায়। আর যদি কোনও ভীতু মানুষ ভয় পেতে ভুলে যায়, তখন তাকেই ভয় পাওয়া উচিত।

খেলার নিয়ম আজও একই। আমার সামনে বোতলটা পোষা প্রাণীর মতো শুয়ে আছে। আর রয়েছে কয়েকটা ছবি। আজও বোতল ঘুরবে অনির্দিষ্টের উদ্দেশ্যে। তার পর একসময় কোনও না কোনও ছবির দিকে মুখ করে থামবে। যার ছবির দিকে ইঙ্গিত করবে এই বোতল, তার সঙ্গেই এই ভারী মজার খেলাটা খেলব। আমার খেলাটার নাম ‘ডেয়ার অর ডাই’। সাহস কিংবা মৃত্যু! একদম ব্র্যান্ড নিউ খেলা। ভালো নয়!

যো ডর গয়া, উয়োহ মর গয়া বাবুজি’।

(১)

সামনেই উত্তুঙ্গ হিমালয়। ধবধবে সাদা রাজবেশে সোনালি সূর্যালোকের রেশমি জরি। অপরাহত দন্তে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন নগাধিপ। সর্বাঙ্গে সোনালি আলোর উচ্ছ্বাস ঠিকরে পড়ছে। কোথাও কোথাও ছোটো ছোটো বুনোফুল পাপড়ি মেলে নানা রঙের সমাবেশ বসিয়েছে। কোথাও একটু গোলাপির ছোঁয়া, কোথাও কমলা, কোথাও বা নীল, বেগুনী। একটু দূরেই রডোডেনড্রনের নিবিড় বন। গাছ আলো করে ফুটে রয়েছে টকটকে লাল রঙের রডোডেনড্রন। দেখলেই মনে হয়, আগুন জ্বলছে! শিশিরে সদ্যস্নাত ছোটো ছোটো শষ্পগুল্মের ঝাড়গুলোয় এখনও পাতায় পাতায় খেলা করছে শীতল শীকরবিন্দু। জলবিন্দুর ওপরে সূর্যালোক এসে পড়তেই হীরকখণ্ডের মতো ঝলমল করে উঠল!

কিন্তু পর্বতের পাকদন্ডী বেয়ে অস্বচ্ছ মেঘের দল সূর্যালোকের সোনালি রঙকে করে তুলেছে নিষ্প্রভ। ফ্যাকাশে কুয়াশা যেন হাজার হাজার বছরের রহস্যময় অতীত নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। যার স্যাৎসেতে শীতলতার শিহরণ অনুভব করা যায়, কিন্তু কিছু দেখা যায় না, বোঝা যায় না। চতুর্দিকে শুধু আশ্চর্য এক অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে! নীরবতা গুমরে গুমরে মরছে পাথরে পাথরে। টুপটাপ করে শিশিরের মতো ঝরে পড়ছে যেন কার কান্না! পাহাড়ের গায়ে কান পাতলে বুঝি শোনা যাবে অশ্রুত এক হাহাকার! এক অদ্ভুত বিষণ্নতায়, অজানা মনখারাপে ভুগছে গোটা দৃশ্য।

একদিকে রঙের সমাহার, অন্যদিকে ধোঁয়াশার বৈপরীত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছিল হিমালয়। সেই ধোঁয়াশা ভেদ করে আস্তে আস্তে ফুটে উঠল একজন মানুষের দেহরেখা। কেউ একজন হাঁটতে হাঁটতে কুয়াশা ভেদ করে এদিকেই আসছে। উন্নত টানটান শরীর তার। লম্বাটে মুখে চন্দনবিন্দুর মতো ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ফুটে উঠেছে। আয়ত চোখে রাগী রাগী দৃষ্টি। নিখুঁত সুগঠিত চোয়ালে দৃঢ়তা! পাহাড়ের মতোই পেশল, তার মতোই গম্ভীর, তেমনই রহস্যময়! সূর্যালোকে তার মসৃণ বাদামি দেহ ভাস্কর্যের মতো ঝলমল করে উঠল। কবাট বুক, সিংহের মতো সরু কোমর সযত্নে ঘিরে রেখেছে হালকা কুয়াশা। যৌবন সারা দেহে উপছে পড়ছে, অথচ শৈশবও যেন ছেড়ে যায়নি তাকে। অসম্ভব রূপবান পুরুষটি চোখ তুলে তাকাল পাহাড়ের দিকে শিশুর মতোই সরল, নিষ্পাপ সে দৃষ্টি। ঠোঁটে মিঠে রোদ্দুরের মতো ছেলেমানুষী হাসি। পরম বিস্ময়ে, সারল্যভরা মুগ্ধতায় দেখছে পাহাড়ের সৌন্দর্য।

মানুষটা অনিমেষে শৃঙ্গের দিকেই তাকিয়েছিল। অপরাজেয়কে পরাজিত করার নেশা তার চিরদিনের। অদম্যকে অবদমিত করা তার রক্তে! পরম কৌতূহল নিয়ে বারবার সে ফিরে আসে পাহাড়ের কাছে। তার বুকে জমে থাকা রহস্যকে ভেদ করতে চায়। প্রত্যেকবারই পাহাড় তার কাছে নতুন রূপে ধরা দেয়। নিজের সমস্ত সৌন্দর্য মেলে ধরে। পাহাড়ের এক আশ্চর্য নিয়ম আছে। কখনই সে পুরনো হয় না! যখনই মনে হয়, সব প্রশ্নের জবাব পাওয়া গিয়েছে, ঠিক তখনই আবার নতুন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। অপরূপা প্রেয়সীর মতো তার প্রতি ভাঁজে ভাঁজে সৌন্দর্য! প্রতি পদক্ষেপে নতুনত্ব! সে সজোরে শ্বাস নিল। আঃ! কী আরাম!

‘মাই সেক্সিয়েস্ট ম্যান!’

সে তড়িৎগতিতে পেছনে ফেরে। কে! কে কথা বলছে! এ কণ্ঠস্বর তার চেনা! এ আওয়াজ আজীবন ভুলবে না। বড় ভয়ের কাহিনি লুকিয়ে আছে এই কণ্ঠস্বরের পেছনে! বড় লজ্জার কথাও!

‘আমায় মনে পড়ে?’

ঠিক তার পেছনেই ধোঁয়াশা যেন একটু একটু করে অদ্ভুত এক ছায়ামূর্তি গড়ে তুলছে। সে ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে যায়। এই ছায়ামূর্তিকে চেনে! কিন্তু এ অসম্ভব! ও এখানে আসতেই পারে না! একটু আগেই যে মুক্তির আস্বাদ সে বুক ভরে নিয়েছে, তা যেন মুহূর্তের মধ্যেই মিলিয়ে গেল। এখন যেন শ্বাস টানতেও কষ্ট হচ্ছে! ওই লোকটা আবার ফিরে এসেছে! ও তাকে বন্দি করতে এসেছে! পাহাড়ের গায়ে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরল সেই অলৌকিক কণ্ঠস্বর-

‘কাম অন্! তুমি তো ফের ছোট ছেলের মতো ভয় পাচ্ছ! আমিই তো তোমায় ছুঁয়েছিলাম! মনে নেই?’

পা দুটো যেন অসম্ভব ভারী! প্রচণ্ড পাহাড়ি শীতেও দরদর করে ঘামছে! ও কেন এসেছে! কী করেই বা সম্ভব! ও তো নেই! ওর কেসটা তো ক্লোজ হয়ে গিয়েছে। গুণে গুণে ঠিক এগারোটা গুলি মেরেছিল ওকে! তবে!

‘তুমি যখন ভয় পাও, তখন তোমায় ভীষণ সুন্দর লাগে! আরও বেশি আদর করতে ইচ্ছে করে।’ ছায়ামূর্তি আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। সে প্রাণপণে নড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পা দুটো যেন বরফ হয়ে গিয়েছে। এক চুলও সরতে পারছে না। বাধা দেওয়ার জন্য হাতও নাড়তে পারছে না। গোটা শরীরই বুঝি জমে গেল! অথচ ছায়া ক্রমশই কাছে ঘনিয়ে আসছে। তার কাঁপা কাঁপা ঠোঁটের ওপর আঙুল রাখল মানুষটা, ‘আমি এখনও যে তোমার অপেক্ষায় আছি। আমার তৃষ্ণা তুমি ছাড়া আর কে মেটাবে রাজা! যে একবার তোমায় দেখেছে, তার তো আর উপায় নেই! গুলি মারার দরকার কী ছিল? একবার তোমার বুকে টেনে নিতে। আমি এমনিই মরে যেতাম!

‘না… না!’

প্রচণ্ড ভয়ে তার রক্ত হিম হয়ে গেল। এ লোকটা কিছুতেই ছাড়বে না তাকে। তার মনে হল, সে এখন আর একজন শক্তিশালী পুরুষ নয়, বরং এক অসহায় শিকার। হিংস্র দাঁত, নখ ক্রমশই এগিয়ে আসছে তাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করার জন্য, অথচ কিছুই করার নেই! একটুও নড়তে পারছে না! ছায়ামূর্তি তার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার ঠোঁটজোড়া ভীত মানুষটার কানের লতি স্পর্শ করল।

‘কাছে এসো!’

‘নো!’

‘দেখো, আমি তোমার সমস্ত আদরের চিহ্ন আজও শরীরে বয়ে চলেছি। এত ভালোবাসা তোমায় কোনও নারী দিতে পারবে? এরপরও আসবে না!’

ছায়ামূর্তিকে এবার খানিকটা রোদ আলতো করে ছুঁয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্য কুয়াশা সরে দৃশ্যপট স্পষ্ট হয়। তার মধ্যেই দেখা গেল লোকটাকে! সে সভয়ে দেখল সেখানে মানুষ নয়; একটা মৃতদেহ দাঁড়িয়ে আছে! তার সারা শরীর বুলেটে প্রায় ঝাঁজরা! এগারোটা ক্ষত চিহ্ন থেকে এখনও রক্ত গড়িয়ে পড়ছে! কী বীভৎস দৃশ্য!

‘না! না! নেভার! ‘

সে প্রায় উন্মত্তের মতো চেঁচিয়ে ওঠে—’কাছে আসবে না!… একদম কাছে আসবে না!’

‘রাজা!’

কে যেন তার কানের কাছে বলে উঠল। সে ভয়ে চিৎকার করে ওঠে।

‘না!’

‘রা―জা’!

এবার শুধু ডাক নয়, সে অনুভব করল একটা শীতল হাত তাকে স্পর্শ করেছে। তার কপালে কে যেন হাত রাখল!

‘নো-ও! নো-ও-ও!’

অসম্ভব ভয়ে ধড়মড় করে বিছানার ওপর উঠে বসল অধিরাজ। কবাট সুগঠিত বুক হাপরের মতো উঠছে নামছে। ঘেমে নেয়ে একসা হয়েছে। দু-চোখে প্রচণ্ড ভয়! যেন এক্ষুনি সেই লোকটা তাকে আবার স্পর্শ করবে! আবার সেই একই কাজ করবে যা সে আগেও করেছিল…! সেই বিভীষিকা আবার এসেছে…! আবার সে ফিরে এসেছে! চুপি চুপি এসেছে!

‘রাজা, এটা আমি!’

অধিরাজ শিশুর মতো ভয়ার্ত চোখে সামনের দিকে তাকায়। নাঃ, কোনও পাহাড়ে নয়, ও নিজের বাড়িতেই আছে। আর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তার বাবা! তিনি উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। ছেলেকে দেখেই বুঝতে পেরেছেন যে আবার সে একই দুঃস্বপ্ন দেখেছে! ওঃ, এই দুঃস্বপ্নের হাত থেকে কি এ জীবনে পরিত্রাণ নেই!

‘জল!’

কোনোমতে শব্দটা উচ্চারণ করল অধিরাজ। তার সারা দেহ তখনও থরথর করে কাঁপছে। বুকের ভেতর তোলপাড়! হৃৎপিণ্ডটা যেন দ্বিগুণ বেগে চলতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে এখনই মরে যাবে! কী অদ্ভুত ভয় তার পেছনে আজও তাড়া করে চলেছে! লোকটা আজও তাকে আতঙ্কিত করে তোলে! ঘুমে, জাগরণে, স্বপ্নে, দুঃস্বপ্নে যখন তখন এসে হাজির হয়। তার কাছে আতঙ্কের আরেক নাম হয়েই রয়ে গেছে সে!

অধিরাজের বাবা কোনও কথা না বলে বেডসাইড টেবিল থেকে জলের গ্লাস নিয়ে এগিয়ে দিলেন তার দিকে। ছেলের ঘর্মাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাসকে কোনোমতে আড়াল করলেন। আগের কেসের ওই লোকটাকে আজও ভুলতে পারেনি অধিরাজ। এখনও অগোচরে কেউ তাকে স্পর্শ করলে সে কেঁপে ওঠে। ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পায়। অপরিচিত মানুষদের সামনে গুটিয়ে থাকে। ডঃ চৌধুরী বলেছেন, ‘এই ভয়ের হাত থেকে আপনাকেই মনের জোরে বেরোতে হবে অফিসার। ওষুধ কিছুটা হেল্প করবে, আমরাও করব। কিন্তু বাকি লড়াইটা আপনাকেই লড়তে হবে।’

জলের গ্লাসটা প্রায় একনিঃশ্বাসে শেষ করে ফেলল অধিরাজ। কাঁপা কাঁপা হাতে সেটাকে যথাস্থানে রেখে বাবার দিকে অপ্রস্তুত দৃষ্টিতে তাকায়। বাইরে এখনও ভোরের আলো ফোটেনি। সম্ভবত ঘুমের মধ্যেই চেঁচিয়ে উঠেছিল বলে তিনি ছুটে এসেছেন। অপরাধীর মতো সে বলল, ‘খুব জোরে চেঁচিয়েছিলাম?’

‘না’। বাবা জানতে চাইলেন, ‘সেই একই স্বপ্ন?’

তখনও দরদর করে ঘামছে অধিরাজ। সে কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ল। লোকটা বোধহয় তাকে কিছুতেই ছাড়বে না। বেঁচে থাকতে ভয় দেখাত। এখন মরার পরেও দেখিয়ে চলেছে।

‘তুমি শুয়ে পড়ো।’ সে ধীর স্বরে বলল, ‘এখনও সকাল হয়নি।’

বাবা আলতো করে তার মাথায় হাত রাখলেন। কী বলবেন ভেবে পেলেন না। কোনও কথাই ক্ষতস্থানে প্রলেপ লাগাবার জন্য যথেষ্ট নয়। কতদিনে এই ত্রাস যাবে তার ঠিক নেই। নাকি সারাজীবনেরই ক্ষত হয়ে রইল?

তিনি আর কোনও কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। এই মুহূর্তে অধিরাজকে একা ছেড়ে দেওয়াই ভালো। ডঃ চৌধুরী ঠিকই বলেন। কিছু লড়াই নিজেকেই লড়তে হয়।

লড়ছে অধিরাজ। যতখানি সম্ভব সে লড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। স্বপ্নের মধ্যে অনেকবার পালটা আঘাতের চেষ্টা করেছে। লোকটাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিতে চেয়েছে। অথচ প্রতিবারই ভয় তার ইচ্ছাশক্তির ওপর চেপে বসে। হাত পা আড়ষ্ট হয়ে আসে। কিছুতেই প্রতিরোধ গড়ে ওঠে না। প্রত্যেকবারই হেরে যায় সে।

অধিরাজ কাঁপা হাতে সিগারেটের প্যাকেট বের করে আনে। তাকে এখন বড্ড অস্থির লাগছে। আবার ঘুমোতে ভয় লাগে। যদি আবার সেই লোকটা ফিরে আসে! তার চেয়ে বরং জেগে থাকা ভালো। অন্তত বাস্তবে আর সেই অনাকাঙ্খিত অতিথি ফিরে আসবে না! বর্তমান অনেক ভালো! অতীতের চেয়ে ভয়ংকর জিনিস খুব কমই আছে।

সে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে টিভিটা অন করে দিয়েছে। পাওয়ার অন হতেই স্মার্ট টিভির পরদায় ভেসে উঠল সংবাদপাঠিকার মুখ। অধিরাজ দেখল নীচ দিয়ে স্কুল যাচ্ছে, “হাসপাতালের মর্গের মধ্যে এক ব্যক্তির রহস্যময় মৃত্যু …”

(২)

‘অর্ণব, তোমার খবরি ঠিক কথা বলেছে তো?’ অফিসার পবিত্র আচার্য মুখের মাস্কটা খুলে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘দেড় ঘণ্টা হয়ে গেল গাড়িতে বসে মশার ফলার হচ্ছি। ওদিকে কালুর কোনও পাত্তাই নেই! ব্যাটা গর্তে সেঁধিয়ে যায়নি তো?’

অর্ণব একটু চিন্তিত দৃষ্টিতে অধিরাজের দিকে তাকায়। সে তার ছ-ফুট চার ইঞ্চির দীর্ঘ বলিষ্ঠ দেহটাকে গাড়ির সিটে এলিয়ে দিয়ে বসে আছে। হাতদুটো বুকের ওপর জড়ো করা। আপাতত মুখে মাস্ক নেই। মুখ একদম নির্লিপ্ত। তাকে দেখে বোঝা যায় না আদৌ চিন্তিত কি না। পবিত্র ইতিমধ্যেই বিরক্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু অধিরাজের মধ্যে কোনওরকম বিরক্তি নেই। সে মোলায়েম অথচ গম্ভীর গলায় বলল, ‘অর্ণবের ইনফর্মার যখন বলেছে, তখন খবরটার সত্যি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু কালু কাদের সুপারি পেয়েছে সেটাই জানা নেই! শুধু এইটুকু জানি যে ও একটা মোটা সুপারি পেয়েছে, মাস মার্ডার করবে আর আজ রাতে রয়্যাল হাইটসে আসবে। যাদব আর কিছু বলতে পারল না অর্ণব?’

অর্ণব হতাশভাবে মাথা নাড়ে। তার জাঁদরেল ইনফর্মার যাদব আজ সকালেই এসে এমন একটা অদ্ভুত সংবাদ দিল যে গোটা সি.আই.ডি হোমিসাইড নড়েচড়ে বসল। অর্ণবের কেবিনে বসে চা খেতে খেতে সে জানিয়েছিল, ‘একটা খবর আছে সাহেব। হাওয়ায় ভাসছে। তবে কত পার্সেন্ট সত্যি, কত পার্সেন্ট মিথ্যে জানি না!

‘বেশি পাঁয়তাড়া না মেরে পোস্ট বক্স খোল যাদব। সাসপেন্স থ্রিলার আমার ভালো লাগে না।’

যাদব দাঁত বের করে হাসল, ‘পোস্ট বক্স খুলব বলেই তো এসেছি। আপনি কালুকে চেনেন তো?’

‘কোন্ কালু? আমি অন্তত এক ডজন কালুকে চিনি।’ অর্ণব শান্তভাবে বলে, ‘আমাদের পাড়ার নেড়িকুত্তাটার নামও কালু। তাই স্পেসিফিকভাবে বল।’

‘সুপারিকিলার কালিয়া, ওরফে কালু।’

নামটা শুনেই সোজা হয়ে বসেছিল সে। সুপারি কিলার কালিয়াকে সি.আই.ডি হোমিসাইডের প্রায় সকলেই চেনে। এখনকার অন্যতম কুখ্যাত দাগী ক্রিমিনাল। পেশাদার খুনী। তার বৈশিষ্ট্য হল যে সে খুন করে কোনোরকম ব্লু রাখে না। এত সাফসুতরো তার কাজ যে পুলিস বুঝতে পারে ঠিকই, কিন্তু ধরতে পারে না। কোনো সাক্ষ্য প্রমাণই নেই তো কীসের বেসিসে ধরবে!

‘কালিয়া মাঝখানে খুব বিজলি বারে যাচ্ছিল। ওখানে শ্যারন নামে একটা মস্ত চিকনি আইটেম আছে। বারে ছোটো ছোটো জামা পরে নাচে। আজকাল শুনছি দু-জনের মধ্যে খুব লটঘট চলছে। বার বন্ধ, কিন্তু কালু মেয়েটার বাড়িতে প্রায়ই যায়।’

অর্ণব কিছুক্ষণ তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘আই হেট লাভ স্টোরিজ!’

‘এই লাভ স্টোরি শুনলে লাভ আপনারই সাহেব।’ ফিক্ করে একটা ফিচেল হাসি হাসল যাদব, ‘কারণ খবরটা ওই চিকনির কাছ থেকেই ছড়িয়েছে!’

‘কী খবর?’

‘কালু শ্যারনকে জবান দিয়েছে যে আর এ লাইনে সে থাকবে না!’

অর্ণব বিরক্ত হয়ে বলল, ‘বিড়াল বলে মাছ খাব না, আঁশ ছোব না, কাশী যাব! কতগুলো নিরীহ মানুষকে পগারপার করে দিয়ে তিনি সংসারি হতে চললেন! তাতে আমি কী করব? সানাই বাজাব?’

যাদব এর উত্তরে কিছু বলতে গিয়েও হেসে ফেলল। তারপর একটু গম্ভীর হয়ে বলল, ‘কালু বলেছে যে ও আর এ কাজ করবে না। কিন্তু তার আগে একটা লাস্ট অ্যাসাইনমেন্ট ও নেবে। পার্টি বলেছে মালামাল করে দেবে। তাই ও লাস্ট সুপারি তুলেছে। আর সেটা বেশ মোটা!’

এতক্ষণে ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পারল অর্ণব। যাদবের প্রেমকাহিনির মধ্যে এতক্ষণে ট্যুইস্ট এসেছে! সে সকৌতূহলে জানতে চায়, ‘সুপারিটা কার নামে জানিস?’

যাদবের মুখে রহস্যময় হাসি, ‘না। তবে এইটুকু বলতে পারি যে মাস-মার্ডার।’

‘কী!’ বিস্ময়ের আঘাতে অর্ণব স্তম্ভিত হয়ে যায়—’মাস-মার্ডার! তা-ও লকডাউনের মধ্যে!

‘তেমনই শুনেছি সাহেব।’

অর্ণবের ফর্সা লাবণ্যময় মুখ শক্ত হয়ে ওঠে। কালু দিনকে দিন বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে। পুলিস এখনও তাকে ধরতে পারেনি বলে একটু বেশিই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে! মোটা সুপারি নিয়ে বসে আছে! কিন্তু কাদের সুপারি! সে-কথা জিজ্ঞাসা করতেই যাদব মাথা নাড়ে, ‘ভিকটিম কারা জানি না। তবে…।’

‘তবে?’

‘যদি কালুকে হাতে নাতে ধরতে চান, তবে আজ রাত দশটায় রয়্যাল হাইটসে চলে যান স্যার।’, সে রহস্যময় ভঙ্গিতে চোখ টিপেছিল, ‘আজ ওখানে কিছু ঘটবে।’

যাদবের টিপের ওপর নির্ভর করেই এই মুহূর্তে ওরা রয়্যাল হাইটস থেকে সামান্য দূরত্বে, পার্কিং জোনে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সঙ্গে ফুল টিম আনেনি কারণ যাদবের খবরটায় কতটা সত্যতা আছে তার ঠিক নেই। সামনেই সতেরো তলার গগনচুম্বী অট্টালিকা। পবিত্র একটা বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে রয়্যাল হাইটসের দিকে নজর রাখছে। এখনও পর্যন্ত অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েনি। রাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জায়গাটাও শুনশান হয়ে এসেছে। কালুকেও এখনও দেখা যায়নি। ঘণ্টাখানেক আগেই ওরা ভালো করে রয়্যাল হাইটসের ভেতরটা দেখে এসেছে। সেখানেও কোনোরকম সন্দেহজনক কিছু নেই। অর্ণবের সন্দেহ ছিল, কালু হয়তো এই হাইরাইজের কোনো ফ্ল্যাটে ঘাপ্টি মেরে আছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল তার সন্দেহ সম্পূর্ণ ভুল। কালু এখানে নেই।

‘তবে যাদব এখানে আসতে বলল কেন? গাপ্পু মেরেছে? একঘণ্টা তো হয়ে গেল!’ পবিত্র এবার একটু অধৈর্য, ‘অর্ণব, তুমি ঠিক জানো মালটা পাউয়া মেরে আসেনি? তোমার খবরি তো তোমায় ডোবাবে দেখছি! কোথায় তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে বউয়ের মুখ দেখব, তা নয় এখানে বসে বসে মাস্ক পরা গুঁফো দরোয়ানের মুখ দেখে চলেছি!’

অর্ণব মনে মনে অপ্রতিভ হয়। যাদব যে কী রহস্যময় বার্তা দিয়ে গেল ভগবানই জানেন! এরকম একটা মাস-মার্ডারের খবর যদি বা পাওয়া গেল, তা-ও উড়ো খবর। কে জানে সে এত জায়গা থাকতে রয়্যাল হাইটসে আসতে বলল কেন!

‘মাস্ক ভেদ করে তুমি দরোয়ানের গোঁফ দেখতে পাচ্ছ!’ অধিরাজ মৃদু স্বরে বলে, ‘এ তো পুরো এক্স রে দৃষ্টি!’

‘এক্স রে দৃষ্টির প্রয়োজন নেই। দরোয়ানটা থেকে থেকেই মুখের মাস্কটা নীচে নামিয়ে দিচ্ছে! তখনই দেখেছি।’ পবিত্র বিড়বিড় করে, ‘ওরে, ওটা মাস্ক, জাঙিয়া নয় যে নীচে পরবি!’

তার কথা বলার ভঙ্গিতে অধিরাজ হেসে ফেলল। শিশুর মতো মিষ্টি ও নিষ্পাপ হাসিতে তার মুখ ঝলমলিয়ে ওঠে, ‘দরোয়ানের গোঁফ ছাড়া আর কী কী দেখতে পাচ্ছ?’

‘বিরিয়ানি।’ পবিত্র একগাল হেসে বলল, ‘অর্ণবের ডাব্বায়।’

‘সে কী!’ অধিরাজ এবার তড়াক করে সোজা হয়ে বসল, ‘অর্ণব বিরিয়ানি এনেছে! কই, বলেনি তো?’

‘অর্ণব শুধু বিরিয়ানি আনেনি, রীতিমত নিজের হাতে রেঁধে এনেছে।’ পবিত্র মিটমিট করে হাসে, ‘আজকাল ও মিস্ দত্তের কুকিং ক্লাস একদমই মিস্ করছে না। তারই ফলশ্রুতি আজকের বিরিয়ানি!’

‘বাঃ!’ অধিরাজ আলতোভাবে অর্ণবের পিঠ চাপড়ে দেয়, ‘আশা করছি তুমি প্রথমেই চাউমিন বানাতে শিখেছ।’

অর্ণব সলজ্জভাবে নেতিবাচক মাথা নাড়ে। পবিত্রের কথা ভুল নয়। মিস্ আত্রেয়ী দত্তের রান্নার হাতটি বড়ো চমৎকার। অনেকদিন ধরেই অর্ণবের রান্না শেখার খুব শখ। তা জানতে পেরে আত্রেয়ী হেসেছে, ‘রান্না আবার একটা শেখার বস্তু হল? কী শিখবেন বলুন। চাউমিন?

অর্ণব নিজে চাইনিজের বিরাট ফ্যান। অধিরাজ বলে, ‘আসলে তার নাকি চীনদেশেই জন্মানো উচিত ছিল। কিন্তু নাক লম্বা আর চোখ বড় হওয়ার দরুণ ভগা ভুল করে অর্ণবকে ভারতবর্ষে ডেলিভারি দিয়ে দিয়েছে। তার চাউমিন প্রীতির কথা জানে না, এমন কোনও অফিসার সি.আই.ডি, হোমিসাইডে নেই। এমনকি এডিজি শিশির সেনও মাঝেমধ্যে বলে থাকেন—’কী ব্যাপার সরকার, আজ যে শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে? চাউমিন খাওনি বুঝি?’

স্বাভাবিকভাবেই চাউমিনের এমন জবরদস্ত ফ্যান রান্না শিখতে চাইলে প্রথমে চাউমিনই বানাবে বলেই আত্রেয়ীর ধারণা ছিল। কিন্তু তার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে অর্ণব সলজ্জভাবে জানতে চাইল, ‘আপনি বিরিয়ানি বানাতে জানেন?’

‘বিরিয়ানি!’ সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত কথায় একটু হকচকিয়ে গেল আত্রেয়ী, ‘কিন্তু আপনি তো চাউমিন পছন্দ করেন।’

অর্ণব বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বলল, ‘সামনে স্যারের জন্মদিন।’

ওই একটি বাক্যেই গোটা ব্যাপারটাই পরিষ্কার হয়ে গেল আত্রেয়ীর কাছে। অর্ণবের চাউমিনপ্রীতি সর্বজনোবিদিত হলেও সে নিজের জন্য রান্না শিখতে চায় না। অধিরাজের ফেভারিট ডিশ বিরিয়ানি। বিরিয়ানি পেলে সে সবকিছুই ভুলে যায়। সম্ভবত নিজের জন্মদিনের কথা অধিরাজেরই মনে নেই। কিন্তু এ মানুষটা মনে রেখেছে। আর জন্মদিনে সে তার ‘স্যারের’ জন্য স্পেশাল কিছু করতে চায়। এমনকি প্রথম হাতা খুন্তি ধরাও সেই ‘স্যারের’-ই জন্য! এর থেকে বড় গিফট আর কী হতে পারে!

আত্রেয়ী মনে মনে হেসেছে। এই আন্তরিকতার জন্যই টিমটা তার ভারী পছন্দের হয়ে গিয়েছে। সে আর কথা না বাড়িয়ে অর্ণবকে বিরিয়ানি রান্নার শিক্ষা দিয়েছিল। কাল শেষ রাত থেকেই রান্নার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছিল অর্ণব। আনাড়ি মানুষটা বেশ কয়েকবার হাতে ছ্যাঁকা খেয়ে, ঘেমেঘুমে একসা হয়ে শেষ পর্যন্ত একরকম বিরিয়ানি বানিয়েই ফেলেছে।

‘আমি দুপুরেই চেখে দেখেছি’। পবিত্র-র চোখে কৌতুক, ‘তুমি খাওনি?’

‘না তো!’ অধিরাজ অবাক, ‘সে কী! আমি বাদ গেলাম কেন অর্ণব! তোমার এ কী ধরনের ন্যায় বিচার ডার্লিং? পবিত্র চাখতে পেল, আর আমি তোমার স্পেশ্যাল ওয়ান হয়ে একটু শুঁকতেও পেলাম না! তুমি নিজের হাতে বিরিয়ানি রান্না করেছ—অথচ আমার কপালে আলুটাও জুটল না!’

অর্ণব লজ্জিত মুখে মাথা হেঁট করে থাকে। এই লোকটার জন্যই তো হাত পুড়িয়ে রান্না করা। অথচ আসল বামুনই রইল অভুক্ত। বেচারি আর কী করে বুঝবে যে ক্লান্ত দেহে, ঘুম ঘুম চোখে বিরিয়ানিতে সে এত বেশি নুন দিয়ে ফেলবে যে তা শেষ পর্যন্ত খাওয়ার অযোগ্য হয়ে দাঁড়াবে। অধিরাজকে খেতে দেওয়ার আগে সে পবিত্রকে দিয়ে টেস্ট করাতে চাইছিল। পবিত্র বিরিয়ানি দেখেই মহাখুশি হয়ে খপাৎ করে এক চামচ মুখে দিয়েই পেল্লায় লাফ মারল, ‘এটা কীঃ!’

অর্ণব এমন রি-অ্যাকশন আশা করেনি। অবাক হয়ে বলল, ‘কেন? বিরিয়ানি?’

‘ডেড সি’র জল দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করেছ নাকি অর্ণব?’

ডেড সি, আবার এর মধ্যে কোথা থেকে এসে টপকে পড়ল! অর্ণব কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘কেন স্যার?’

‘এমন নুন দিয়েছ যে গুণ গাওয়া প্রায় অসম্ভব!’ পবিত্র মুখ থেকে খাবার থু থু করে ফেলে দেয়, ‘নিজে টেস্ট করে দেখোনি? কী ভয়ংকর নুনপোড়া! এ জিনিস মানুষে খেতে পারে?’

অর্ণবের মন খারাপ হয়ে যায়। সে নিজেও এবার মুখে দিয়ে দেখল, এবং যথারীতি খেতে পারল না! পবিত্র-র কথা ভুল নয়! এত কষ্টের রান্না শেষপর্যন্ত এমন অখাদ্য হবে তা কে জানত! তাড়াহুড়োতে নিজে টেস্ট করতে ভুলে গিয়েছে। আত্ৰেয়ী পই প ই করে বলেছিল বটে যে সবসময়ই নিজেকে টেস্ট করে দেখে বুঝে নিতে হবে। কিন্তু প্রথম রান্নার উত্তেজনায় ভুলেই মেরে দিয়েছে। এখন এই নুনপোড়া বিরিয়ানি কে খাবে! স্যারকে তো আর দেওয়া যায় না!

‘কী হল অর্ণব?’

অধিরাজের কণ্ঠস্বরে সম্বিত ফেরে অর্ণবের। সে করুণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। বিরিয়ানি খেতে অধিরাজ খুব ভালোবাসে। কিন্তু এই অখাদ্য বিরিয়ানি খেয়ে হয়তো সে-ও পবিত্র-র মতোই থু থু করে ফেলে দেবে।

অধিরাজ হাত বাড়িয়ে দিল, ‘দাও’।

অর্ণব কী করবে ভেবে পায় না। তার এখন উভয় সংকট। অধিরাজকে ‘না’ বলাও সম্ভব নয়। আবার ওই নুন-পোড়া বিরিয়ানি খেতে দেওয়াও সম্ভব নয়। সে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। তার আগেই অধিরাজ ফের বলে উঠল, ‘কই? দাও!

অগত্যা! ভয়ে ভয়ে সে নিজের টিফিন ক্যারিয়ারটা এগিয়ে দেয়। বুকের মধ্যে ধুক পুকানি। ভগবান জানেন, অধিরাজ খেয়ে কী বলবে! হয়তো খেতেই পারবে না! হয়তো কেন, অর্ণব খুব ভালোভাবেই জানে যে এ জিনিস খাওয়া যায় না। একেই নুনপোড়া, তার ওপর আবার ঠান্ডা!

‘বাঃ, দারুণ গন্ধ।‘

বাটিটা নিজের নাকের কাছে নিয়ে খাদ্যবস্তুর গন্ধ শুঁকল অধিরাজ। বিরিয়ানির সুগন্ধ মুহূর্তের মধ্যেই ঝাপটা মেরেছে তার নাকে। সে একটা শ্বাস টেনে বলল, ‘ফ্যান্টাস্টিক।’ পরক্ষণেই চামচ দিয়ে বেশ কিছুটা মুখে পুরল।

অর্ণব ভয়ের চোটে চোখ বুজে ফেলেছে। নির্ঘাৎ এবার ছুটে আসবে কোনও ব্যঙ্গবঙ্কিম মন্তব্য! কিংবা পবিত্র-র মতোই সে ও বলবে, ‘এ জিনিস মানুষে খেতে পারে?’ আফসোসে নিজের গালেই কয়েকটা থাপ্পড় মারার ইচ্ছে হচ্ছিল তার। কেন যে সে একবার টেস্ট করে দেখেনি! যদি একবারও নিজে মুখে দিয়ে দেখত, তাহলে হারগিস এই অখাদ্য বিরিয়ানি নিয়ে আসত না। অর্ণবের রীতিমত কান্না পেয়ে গেল! আজ মানুষটার জন্মদিন। অথচ যথারীতি তার মনেই নেই।

অধিরাজের মা-বাবা সারপ্রাইজ দেবেন বলে ছেলেকে কিছু মনে করিয়েও দেননি। রাতে ওদের বাড়িতে খুবই ছোট করে একটা সারপ্রাইজ পার্টির বন্দোবস্ত করেছিলেন ওঁরা। সেখানে অর্ণবও আমন্ত্রিত। সে চেয়েছিল তার আগেই এই ছোট্ট গিফটটা স্যারকে দিতে। মনে মনে পরিকল্পনা করেছিল, লাঞ্চ আওয়ারে নিজের হাতে রাঁধা বিরিয়ানি খাইয়ে তাকে চমকে দেবে। কিন্তু সব কিছুই ভেস্তে গেল! এমনকি পার্টির প্ল্যানও।

‘বাঃ!’

একটা প্রশংসাসূচক শব্দ শুনে বিস্মিত হল অর্ণব। এই শব্দটা তো সে আদৌ আশাই করেনি! ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে পরিস্থিতিটা মেপে নেওয়ার চেষ্টা করল সে। যা দেখল তাতে চক্ষু চড়কগাছ! অধিরাজ মহানন্দে সেই নুনপোড়া বিরিয়ানি খাচ্ছে! এর মধ্যেই বেশ খানিকটা খেয়েও ফেলেছে! তার মুখে তৃপ্তির ছাপ প্রকট! মুখ দেখলে বোঝাও যায় না যে খাবারটা আদতে জঘন্য! বরং বড় বড় হোটেলের বিরিয়ানি খেয়েও বোধহয় মানুষ এত খুশি হয় না।

‘করেছ কী! একটা রেস্টোর‍্যান্ট খুলে ফেলো অর্ণব! দাদা-বউদির বিরিয়ানি!’ কথাটা বলেই জিভ কাটল অধিরাজ, ‘সেরেছে! বউদি তো আবার নেই। শুধু দাদার বিরিয়ানি হলেও অবশ্য চলবে। দুর্দান্ত!

অর্ণব এবং পবিত্র, দু-জনেই স্তম্ভিত! সত্যি সত্যিই এই বিরিয়ানি মানুষ খেতে পারে কি না সে বিষয়ে অর্ণবেরও সন্দেহ আছে। অথচ অধিরাজ রীতিমতো সার্টিফিকেট দিয়ে বসল! তার অপূর্ব সুন্দর মুখে অনাবিল আনন্দ খেলা করছে। এখন চামচ বাদ দিয়ে, হাত দিয়ে চেটেপুটে বিরিয়ানি খাচ্ছে সে। এমন যত্ন করে খাচ্ছে যেন বিরিয়ানি নয়, অমৃত! একদানাও নষ্ট করতে সে নারাজ। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাটিটা ফাঁকা করে দিয়ে আঙুল চাটতে চাটতে বলল, ‘ডেলিশিয়াস!’

‘রাজা…।’ তার দিকে কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থেকে পবিত্র বলল, ‘তোমার কি আদৌ টেস্টবাড বলে কোনও বস্তু আছে?’

‘নো ডাউট আছে!’

পবিত্র আমতা আমতা করে বলে, ‘বিরিয়ানিটা যে ভয়ংকর নুনপোড়া সেটা বুঝতে পারছ না?‘

অধিরাজ মুচকি হাসল, ‘শুধু নুন বেশি হওয়াটাই দেখলে? বাদবাকি ইনগ্রেডিয়েন্টস যে পারফেক্ট সেটা বুঝলে না?’

সত্যিই বাদবাকি ইনগ্রেডিয়েন্টস পারফেক্ট। অন্তত রান্না করতে গেলে যে যত্ন, যে মমতা, ভালোবাসা আর আন্তরিকতা লাগে, তাতে কোনো ত্রুটি ছিল না। কিন্তু সবাই সেটা বোঝে না। অর্ণবের মনে হল তার পরিশ্রমের এর থেকে বড় পুরস্কার আর কিছু হতেই পারে না। সে মৃদুস্বরে বলল, ‘হ্যাপি বার্থ ডে স্যার।’

এবার বিস্মিত হওয়ার পালা অধিরাজের। সে সবিস্ময়ে অর্ণবের দিকে তাকায়, ‘বার্থ ডে! কার? তোমার?’

মনে মনে কপাল চাপড়াল অর্ণব। এই লোকটার কিছুই মনে থাকে না! পবিত্র বিরক্ত হয়, ‘হ্যাঁ, অর্ণবের বার্থ ডে-তে ও তোমাকে উইশ করছে! হোমিসাইডে তেমনই নিয়ম কি না! এখানে নিজেদের জন্মদিনে অন্যকে উইশ করতে হয়। কারণ হোমিসাইডের লোকেরা সব পাগল!’

এতক্ষণে নিজের ভুলটা বুঝতে পারল অধিরাজ। সবিস্ময়ে বলল, ‘ও! আজ বোধহয় আমারই বার্থ ডে! ‘

‘বোধহয় আবার কোথা থেকে এল!’ পবিত্র হেসে ফেলে, ‘তোমার জন্মদিন নিয়ে এত কনফিউশন কেন মামা? কবে জন্মেছ মনে করতে পারছ না? না এখনও জন্মাওনি?’

অধিরাজ এর উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই কিছু একটা দেখে থমকে গেল। তার দৃষ্টি প্রখর হয়ে ওঠে। আস্তে আস্তে বলল, ‘গেট রেডি বয়েজ!’

একটা বাক্যই যথেষ্ট। অর্ণব ও পবিত্র দু-জনেই দেখল যে একটা লোক অত্যন্ত সাবধানী পদক্ষেপে রয়্যাল হাইটসের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মাস্কে মুখ অর্ধেক ঢাকা। তার লক্ষ্য সম্ভবত রয়্যাল হাইটসই। কিন্তু প্রথমেই সেদিকে গেল না। বরং চুপ করে দাঁড়িয়ে কিছুর জন্য যেন অপেক্ষা করছে। হাবভাব অত্যন্ত সন্দেহজনক। পবিত্র ফিসফিস করে বলল, ‘অব তেরা ক্যায়া হোগা কালিয়া!

অর্ণব আর অধিরাজের দু-জোড়া চোখ ঠিক নব্বই ডিগ্রি ঘুরে গেল তারই দিকে। পবিত্র ঢোঁক গিলল, ‘নিজেকে মোটিভেট করার জন্য ডায়লগ দিচ্ছি।’

‘এটা আদৌ কালু কি?’ অধিরাজ চাপা স্বরে বলে, ‘মাস্কের তলায় কালু আর এডিজি সেন, দু-জনই যমজ ভাই!’

সত্যিই তাই! এই করোনাকালে সব মানুষকেই প্রায় একরকম দেখায়। চতুর্দিকে মাস্ক-পরা একরাশ নির্লিপ্ত মুখের ছড়াছড়ি। শুধু একজোড়া চোখ আর কপাল দৃশ্যমান। কোনোরকম প্রকাশভঙ্গি, হাসি, কান্না কিছুই নেই! সেইটুকু দেখে কোনো মানুষকে চেনা অসম্ভব!

‘ধরব?’

পবিত্র-র কথায় মাথা নাড়ল অধিরাজ, ‘না। আরেকটু দেখি।’

তিনজোড়া চোখ এবার লোকটার প্রতিটা পদক্ষেপ সতর্কদৃষ্টিতে জরিপ করছে। মানুষটা খানিকটা ইতস্ততঃ করছে। যেন কোন্দিকে যাবে বুঝতে পারছে না। একবার বহুতলের দিকে তাকাল। পরক্ষণেই তার মুখ ঘুরে গিয়েছে অন্যদিকে। সন্ধানী দৃষ্টি যেন কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে। ভারী আলস্যভরে সে আস্তে আস্তে একবার পার্কিং লটের ডানদিক থেকে বাঁদিকে এল। কিছুক্ষণ দাঁড়াল একটা বন্ধ দোকানের সামনে। প রক্ষণেই আবার হেঁটে গেল ডানদিকে। ভঙ্গিটা এমন যেন পায়চারি করছে!

‘শালা এত রাতে ক্যাটওয়াক করছে কেন?’ পবিত্র অধৈর্য, ‘এখানে ফ্যাশন শো হচ্ছে?’

‘শো এখনও শুরু হয়নি পবিত্র।’ অধিরাজ মৃদু স্বরে বলল, ‘তবে হবে বলেই মনে হয়। রেডি?’

‘রেডি বস্।’

ওরা তিনজনেই আস্তে আস্তে গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে এল লোকটার দিকে। অধিরাজ লম্বা লম্বা পা ফেলে স্মার্টলি গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল একদম আগন্তুকের সামনে। কোনো ভূমিকা ছাড়াই আচমকা গম্ভীর গলায় বলল, ‘কী ব্যাপার রে? আজকাল তোকে দেখাই যায় না! ভি.আই.পি হয়েছিস না হলোম্যান? ‘

অর্ণবের সন্দেহ ছিল যে লোকটা আদৌ কালু কি না। কিন্তু কথাটা শুনে যা প্রতিক্রিয়া হল তা অভাবনীয়। তার হাতে ঝিকিয়ে উঠল একটা শাণিত ধারালো অস্ত্র। সাঁৎ করে একটা ধারালো জিনিসের হাওয়া কাটার শব্দ। পরক্ষণেই অর্ণব বিস্ময়বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখল অধিরাজের গলা স্পর্শ করতে এগিয়ে যাচ্ছে ছুরিটা। দুর্বৃত্ত একদম কণ্ঠনালী লক্ষ্য করে আক্রমণ করেছে!

অধিরাজ যেন এরকম কিছুর জন্য প্রস্তুতই ছিল। তার শরীরটা স্প্রিং-এর মতো ছিটকে গেল। সে বিদ্যুৎগতিতে ডাক করে তার মুখে জোরদার এক ঘুষি বসিয়ে দিয়েছে। কালু এরকম জোরালো প্রত্যুত্তরের আশা করেনি। সে একটা কাতরোক্তি করে উলটে পড়ে। তার হাতের ছুরিটা মাটিতে পড়ে ধাতব ঝনঝন শব্দ তুলেছে। কিন্তু সেকেন্ডের ভগ্নাংশেই সে আবার লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। অর্ণব আর পবিত্র-র হাতে উঠে এসেছে আগ্নেয়াস্ত্র। তা দেখেই কালু মরিয়া হয়ে দৌড় লাগাল সোজা রয়্যাল হাইটসের দিকে! পেছন পেছন অফিসাররাও। অর্ণব আর পবিত্রর রিভলভার থেকে থেকে গর্জে উঠছে। তার পা লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছে ওরা। কিন্তু সবই মিস্ হল।

তড়িৎবেগে দৌড়ে কালু ঢুকে পড়েছে রয়্যাল হাইটসের নিজস্ব পার্কিং গ্যারাজে। এখানে স্থানীয় বাসিন্দাদের গাড়িগুলো দাঁড় করানো। দ্রুতগতিতে সে কভার নিল একটা থামের পেছনে। অর্ণব দেখল তার হাতেও ফণা তুলেছে কুচকুচে কালো রঙের মসৃণ রিভলভার!

‘কভার নাও!’

অধিরাজ চেঁচিয়ে ওঠে, ‘গাড়ির পেছনে কভার নাও সবাই…।’

অফিসাররা পশ্চাৎপসরণ করল। অর্ণব তার সামনের গাড়িটার পেছনে চলে গেল। পবিত্র কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রচণ্ড আওয়াজে তার কানে তালা লেগে যায়! কানের পরদা প্রায় ফেটে যাওয়ারই উপক্রম! সে বুঝতে পারল একটা বুলেট তার কানের প াশ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

‘শুয়োরের বাচ্চা!’

দাঁতে দাঁত চেপে পালটা ফায়ারিং করল পবিত্র। সে এবার একটা টাটাসুমোর পে ছনে চলে যায়। রাতের নিস্তব্ধ পরিবেশ মুহূর্তের মধ্যে সচকিত হয়ে ওঠে ফায়ারিং ও পালটা ফায়ারিঙের শব্দে। দু-পক্ষই সমান তেজে ফায়ার করে চলেছে। কালু এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়। সে এমনভাবে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে যে তার নাগাল পাওয়া মুশকিল! প্রচণ্ড শব্দে বারবার কেঁপে উঠছে গোটা চত্বর। জনশূন্য প ার্কিং গ্যারাজে চলছে গুলির যুদ্ধ!

অধিরাজ আর অর্ণব পাশাপাশিই কভার নিয়েছিল। অধিরাজ অর্ণবের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছে। অর্ণব তার চোখের দিকে তাকিয়েই যেন বুঝে গেল কী করতে হবে। সে আলগোছে মাথা ঝাঁকায়। পরক্ষণেই কিছুটা বেরিয়ে এসে ফায়ার করল। যেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল কালুকে লক্ষ্য করে। কালুও দমবার লোক নয়। সে পালটা বুলেটে জোরাল উত্তর দেয়। বুলেটটা একদম অর্ণবের সামনের গাড়িটাতে লেগে ধাতব ‘ঠং’ শব্দ করে ওঠে।

‘এ মাল তো র‍্যাম্বোর জ্যেঠা দেখছি!’

পবিত্র একটা জোরাল শ্বাস টেনে বলল, ‘ফায়ারিং থামানোর নামই নিচ্ছে না!

অধিরাজ কোনো উত্তর না দিয়ে আস্তে আস্তে গুঁড়ি মেরে গাড়ির পেছন দিয়ে এগিয়ে গেল। হাবেভাবেই স্পষ্ট কালুর মতো শাপশ্যটার এত সহজে ধরা দেবে না। তার জন্য অন্য কিছু পরিকল্পনা করতে হবে। অর্ণব এবার কোনোরকম বিরতি না দিয়ে একের পর এক ফায়ারিং শুরু করল। কালুকে নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগও দিচ্ছে না। কালু থামের পেছনে নিজের শরীরটাকে লুকিয়ে রেখেছে ঠিকই। কিন্তু র‍্যান্ডম ফায়ারিঙে সেও বিচলিত। অর্ণবের সঙ্গে এবার পবিত্রও যোগ দিয়েছে। সম্ভবত অর্ণবের লাগাতার ফায়ারিং দেখে কিছু আঁচ করতে পেরেছে। দুজনে মিলে হিস্ট্রিশিটারটিকে প্রায় ব্যতিব্যস্ত করে তুলল! কালু পালটা জবাব দেওয়ার আগেই এ প্রান্ত থেকে বুলেট ছুটে যাচ্ছে তার দিকে। এর যেন কোনও বিরাম নেই! কোনও সমাপ্তি নেই! বুলেটের ঘায়ে গাড়িগুলো ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। তাদের ঝকঝকে শরীরে দগদগে ঘায়ের মতো বুলেটের দাগ। শ্বাসরোধকারী বারুদের কটু গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। কিন্তু কোনোপক্ষই থামছে না।

অধিরাজ বুঝতে পারল, অর্ণব আর পবিত্র মিলে তাকে চমৎকার কভার দিয়েছে। সামনের গাড়িগুলোও তাকে কালুর দৃষ্টিপথ থেকে আড়াল করছে। সে দীর্ঘদেহটাকে যতটা সম্ভব ঝুঁকিয়ে অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে কালুর দিকে। কালু এখন দম ফেলার ফুরসতও পাচ্ছে না! অন্যদিক থেকে মুহুর্মুহু গর্জন করে উঠছে আগ্নেয়াস্ত্র।

অর্ণব আড়চোখে দেখল তাদের কভারের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে অধিরাজ সরীসৃপের মতো এগিয়ে যাচ্ছে দুষ্কৃতীর কাছে। লক্ষ্য থেকে খুব বেশি দূরে নেই! আর ত্রিশ সেকেন্ড কালুকে ব্যস্ত রাখতে পারলেই সে ধরে ফেলবে। অর্ণব ফায়ারিঙে বিরতি দিল না। এইমুহূর্তে একটুও ঢিলেমি দেওয়ার জায়গা নেই! কালুর মনোযোগ এদিকেই ধরে রাখতে হবে। সে যেন টের না পায় যে একজন একটু একটু করে তার দিকে এগোচ্ছে।

‘অর্ণব, দেখো!’

পবিত্র-র ইশারা লক্ষ্য করে অর্ণব দেখল ফায়ার করতে করতে কালু একটু অসাবধান হয়ে পড়েছে। তার গোটা দেহ থামটা আড়াল করেছে ঠিকই, কিন্তু কাঁধের সামান্য অংশ একপাশ দিয়ে উঁকি মারছে। ওই অংশটুকু সম্পূর্ণ অরক্ষিত। ওরা এখান থেকে লক্ষ্যভেদ করতে পারবে না ঠিকই, কিন্তু অধিরাজ পারবে। অর্ণব দৃশ্যটা দেখেই উত্তেজিতভাবে অধিরাজের দিকে তাকায়। তারপর অবিকল মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণের মতো ইঙ্গিতে নিজের কাঁধ চাপড়াল। তার ইশারা বুঝতে পেরেছে অধিরাজ। সে মৃদু হেসে মাথা ঝাঁকায়।

কালু তখনও প্রবল বিক্রমে অর্ণব ও পবিত্র-র সঙ্গে লড়ে যাচ্ছে। র‍্যান্ডম ফায়ারিঙে একটু সন্ত্রস্ত ঠিকই, কিন্তু হাল ছাড়ার লক্ষণই নেই! অধিরাজ একটা গাড়ির গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে পজিশন নিল। লোকটার কাঁধ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সে একদমই তাড়াহুড়ো করল না। কভার নিয়ে শ্যুট করা যাবে না। বেরিয়ে গিয়ে গুলি চালাতে হবে। তাই আগে ভালো করে কালুর পজিশন বুঝে নিল সে।

অর্ণবের বন্দুক থেকে একটা গুলি ছিটকে এসে থামের চলটা তুলে দিল। তারই ধাক্কায় কালু তড়িৎগতিতে একটু পিছিয়ে আসে। অধিরাজ দেখল তার দিকেই তাকাচ্ছে কালু। সর্বনাশ! দেখতে পেয়ে গিয়েছে!

মুহূর্তের ভগ্নাংশের স্থিরতা! পরক্ষণেই কালু চিৎকার করে উঠে অধিরাজকে লক্ষ্য করে গুলি চালাল। অধিরাজের শরীরটা চিতার মতো নমনীয়ভঙ্গিতে বিদ্যুৎগতিতে সামনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সে হাওয়ায় ভেসে থাকতে থাকতেই কালুর কাঁধ লক্ষ্য করে ফায়ার করল। প্রচণ্ড শব্দ! সঙ্গে সঙ্গেই কালু লুটিয়ে পড়ল মাটিতে!

‘লেগেছে!’

অর্ণব উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথাটা বলেই ছুটে গেল সেদিকে। পবিত্রও ছুটল। ততক্ষণে আহত কালুর বুকের ওপর চড়ে বসেছে অধিরাজ। তার মাথার চুল মুঠো করে ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, ‘সি.আই.ডি মানে বুঝিস? চলো ইঁদুর ধরি! অনেক ইঁদুর বিড়াল খেলেছিস। এখন খাঁচায় ঢোকার সময় হয়ে গেছে!

কালু তখন কাতরাচ্ছে। তার কাঁধের হাড় ভেঙে গিয়েছে। ওর মাস্কটা টেনে খুলে ফেলে অধিরাজ। দাঁতে দাঁত পিষে বলে, ‘মাস-মার্ডারের সুপারি নেওয়া হচ্ছে! কার সুপারি খেয়েছিস বল! এখানে কী করতে এসেছিলি?’

‘জানি না। বলব না।

উদ্ধত ভঙ্গিতে উত্তর এল। কালুর চোখদু-টো দপদপ করে জ্বলছে। মুখভঙ্গিতেই পষ্ট, এত সহজে মুখ খুলবে না। অধিরাজ উত্তরে একটা পেল্লায় ঘুঁষি তুলতেই যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই…!

‘বাঁ-চা—ও!… বাঁ-চা-ও!’

আচমকা একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে এল! পরক্ষণেই ওরা সবিস্ময়ে দেখল শূন্য থেকে একটা দেহ সবেগে নীচের দিকে পড়ছে। যেন এইমাত্রই তাকে কেউ রয়্যাল হাইটসের ছাদ থেকে ছুঁড়ে দিয়েছে! মানুষটা নীচে পড়তে পড়তে অসহায়ভাবে হাত- পা ছুঁড়ছে! হাওয়ায় কিছু ধরার জন্য হাঁকপাক করছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হওয়ার নয়। মাধ্যাকর্ষণের প্রবল টানে লাট খেতে খেতে মাটির দিকেই পড়ছে সে।

‘বাঁ—চা—ও!’

ওরা তিনজনেই হতচকিত! শো যে এদিকে টার্ন নেবে তা কে জানত! কিছু করার আগেই দেহটা এসে সপাটে আছড়ে পড়ল মাটিতে। অধিরাজ ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গিয়েছে। অর্ণব ও পবিত্রও কিংকর্তব্যবিমূঢ়! এটা কী হল! এই লোকটা এল কোথা থেকে! রয়্যাল হাইটস থেকে ঝাঁপ দিয়েছে? আত্মহত্যা?

মুহূর্তের মধ্যেই মানুষটার রক্তে আশেপাশের মাটি লাল হয়ে গেল! কালুকে পবিত্র-র জিম্মায় রেখে ভূপতিত দেহটার দিকে ছুটে গেল অধিরাজ ও অর্ণব। লোকটার সারা শরীর তখনও মৃত্যু-যন্ত্রণায় থরথর করে কাঁপছে! সে কোনোমতে আঙুল তুলে কিছু যেন নির্দেশ করে। অধিরাজ দেখল সে রয়্যাল হাইটসের ছাদের দিকেই দেখাচ্ছে!

‘ওই… ওই!’

মানুষটা কিছু বলার চেষ্টা করতে করতেই স্থির হয়ে গেল। অধিরাজ সবেগে দৌড়ল রয়্যাল হাইটসের দিকে। অর্ণব সন্তর্পণে লোকটার নাকের নীচে, ঘাড়ের কাছে হাত রেখে পরীক্ষা করল। নিঃশ্বাস পড়ছে না! ও আর বেঁচে নেই। সতেরোতলা থেকে প ড়লে বাঁচার সম্ভাবনাও কম।

রয়্যাল হাইটসের লিফ্ট কাজ করছে না। অধিরাজ সিঁড়ি দিয়েই ওপরের দিকে ছুটল। বহুতলের বাসিন্দাদের মধ্যে ততক্ষণে অনেকেই বাইরে বেরিয়ে এসেছে। একটু আগেই গুলির লড়াইয়ের আওয়াজে সম্ভবত তাদের ঘুম ভেঙে গিয়েছে। সবার চোখেই বিস্ময়। তার ওপর একজন বাইরের মানুষকে পড়িমরি করে ছাদের দিকে ছুটতে দেখে আরও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল! অনেকেই তার পেছন পেছন, ‘কী হয়েছে, কী হয়েছে’ বলতে বলতে দৌড়ল ঠিকই, কিন্তু বেগে আর দমে তাল মেলাতে পারল না। কয়েকটা ফ্লোর গিয়েই তারা হাঁফাতে শুরু করে!

অধিরাজ যখন হুড়মুড়িয়ে ছাতে গিয়ে পৌঁছল, তখন ছাত সম্পূর্ণ শুনশান। আদৌ কেউ এখানে ছিল কি না বলা মুশকিল। সে মোবাইলের টর্চ জ্বেলে চতুর্দিকটা খুঁজে দেখল। নাঃ, কোথাও কেউ লুকিয়ে নেই। যদি কেউ লোকটাকে ধাক্কাও মেরে থাকে, তবে এতক্ষণে সে পালিয়ে যেতে পেরেছে। লিফট না থাকার ফলে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসতে তার অনেকটা সময়ই নষ্ট হয়েছে। যে কোনও লোকের পক্ষে সেই সুযোগটুকুই যথেষ্ট।

খুঁজতে খুঁজতেই তার চোখে পড়ল ছাদের একপাশে একটা ওষুধের ফয়েল পড়ে রয়েছে। অধিরাজের টর্চের আলো তার ওপরে পড়তেই রুপোলি ফয়েলটা ঝকঝক করে ওঠে। দেখলেই মনে হয় সদ্যব্যবহৃত। কোনোরকম ধুলোবালি বা ময়লা নেই-একদম ফ্রেশ! অধিরাজ হাতে গ্লাভস পরে আলতো করে তুলে নিল ফয়েলটা। এটায় এখন কোনও ওষুধ নেই। কিন্তু কেউ খালি ওষুধের ফয়েল ছাদেই বা ফেলবে কেন!

আপনমনেই সে উচ্চারণ করল তার পরিচিত লজটা, ‘স্ট্রেঞ্জ!’

(৩)

‘ডক্… ইউ আর সিম্পলি নর্ম্যান্ডিক্যালি গৰ্যান্ডেড! আমরা স্পষ্ট দেখলাম লোকটা ওপর থেকে নীচে পড়ল, আর আপনি বলছেন ওর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল!’

‘দ্যাটস নট দ্য হোল্ ট্রুথ!’ ডঃ অসীম চ্যাটার্জী গম্ভীর মুখে বললেন, ‘নো ডাউট লোকটা সতেরো তলা থেকে লাফ মেরে নীচে পড়ার জন্যই মরেছে, কিন্তু না পড়লেও মরত।’

অর্ণব আড়চোখে ডঃ চ্যাটার্জীর নতুন অ্যাসিস্ট্যান্টটিকে দেখছিল। ফরেনসিকের ও পর ক্রমাগত চাপ বাড়ছে বলে আহেলি মুখার্জী ছাড়াও আরেকজন ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টকে সম্প্রতি অ্যাপয়েন্ট করা হয়েছে। মেয়েটির নাম আইভি ভট্টাচার্য। মেয়েটি কতখানি কাজের তা এখনও বোঝা যায়নি। কিন্তু মানতেই হবে যে প্ৰায় ডানাকাটা পরী! গায়ের রং এককথায় তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ। হেনা-করা ঢেউ খেলানো লম্বা চুল। চোখের মণি কালো নয়, গোল্ডেন ব্রাউন। থেকে থেকে চোখদুটো ঝকঝক করে ওঠে। নাক-মুখ অত্যন্ত ধারালো। দেখলে বাঙালি নয়, পাঞ্জাবি মনে হয়।

অর্ণব মনে মনে মুখ টিপে হাসে। আইভি অর্ণবকে আগে দেখেছে, কিন্তু অধিরাজকে আজই প্রথম দেখছে। তার রি-অ্যাকশনটাও দেখার মতো। সে পুরো হাঁ করে অধিরাজের দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখদুটো যেন চুম্বকের মতো আটকে গিয়েছে! মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছে মেয়েটা! একবারের জন্যও চোখ সরে না! চোখের পলকও পড়ে না!

অধিরাজ কিন্তু আইভিকে লক্ষ্যও করেনি। এটাই তার স্বভাব। সে প্রয়োজনের বাইরে কাউকে নোটিস করে না। মেয়েদের ব্যাপারে চিরকালই উদাসীন। এই মুহূর্তে তার সমস্ত মনোসংযোগ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ডঃ অসীম চ্যাটার্জির দিকে ন্যস্ত। তবে আইভির এই মুগ্ধতা অর্ণব ছাড়া আরও একজনের চোখে পড়েছে। মিস্ আহেলি মুখার্জি যেভাবে কট্‌ট্ করে আইভিকে দেখছে, তাতে স্পষ্ট যে এই আদেখলেপনা তার একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না। কিছুটা ঈর্ষাও আছে কি?

আজ ফরেনসিক ল্যাবে শুরু থেকেই নাটক চলছে। অধিরাজ আর অর্ণব যখন এসে পৌঁছল তখন ডঃ চ্যাটার্জি ভোম্ মেরে বসে আছেন। আহেলি’র কাছ থেকে জানা গেল গত সাতদিন ধরে তিনি নাকি স্নান করছেন না! দাঁতও মাজছেন না! খালি কাপের পর কাপ বোর্নভিটা, আর কফিই খেয়ে চলেছেন। অ্যাশট্রেটা প্রায় উপছে প ড়েছে সিগারেটের দেহাবশেষে। ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে সত্যিই মায়া হল অর্ণবের। বেচারি! কাজের চাপে এর মধ্যেই যেন অর্ধেক হয়ে গিয়েছেন! লাল লাল চোখদুটোও বিনিদ্র রাত্রি জাগরণের সাক্ষ্য দেয়। লকডাউনে সাধারণ ক্রাইমের রেট অনেকটা কমে গেলেও ক্রিমিন্যালরা আদৌ ছুটি নেয়নি। তারা তাদের কাজ চালিয়েই যাচ্ছে। ফলস্বরূপ ডঃ চ্যাটার্জির নাওয়া-খাওয়া মাথায় উঠেছে!

‘সে কী ডক্! আপনি স্নান করছেন না! এমনকি দাঁতও মাজছেন না! হল কী!’

অধিরাজের কথা শুনে আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন ডঃ চ্যাটার্জি। গলার গভীরে গরগর করে বললেন, ‘বাঘকে কি কেউ কখনও দাঁত মাজতে দেখেছে!’

বাঘ! কথাটা শুনে ভয়ংকর বিষম খেল অর্ণব! কাশতে কাশতে তার প্রায় দম আটকে যাওয়ার জোগাড়। অনেকসময়ই তার মনে হয় ডঃ চ্যাটার্জিকে যেন খুব পরিচিত কিছুর মতো দেখতে। আজ বুঝতে পারল তার মাথাটা অনেকটা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মতোই।

‘একটা কনফিউশন আছে।’

অধিরাজের মুখে দুষ্টু হাসি। মনে মনে প্রমাদ গুণল অর্ণব। নির্ঘাৎ এবার কিছু বেফাঁস

মন্তব্য আসছে।

‘কীসের কনফিউশন? ‘

‘বাঘকে কেউ দাঁত মাজতে দেখেনি ঠিকই, কিন্তু বাঘের মাথায় টাকও কি কেউ দেখেছে? আই মিন… টাকলু বাঘ …?’

‘ফের টাক!’ ডঃ চ্যাটার্জি তিনটে হাইজাম্প ও দুটো লংজাম্প মেরে গাঁক গাঁক করে বললেন, ‘বেসুরো কাক, রক্তচোষা বাদুড়, লেজকাটা ইঁদুর কোথাকার! মেরে ফেলব! একদম মেরে ফেলব!’

অধিরাজ এরকম ভয়ংকর হুমকিতেও ঘাবড়াল না। বরং আড়চোখে টেবিলের ওপ রে রাখা ধোঁয়া ওঠা বোর্নভিটার কাপটার দিকে তাকায়, ‘বাঘকে বোর্নভিটা খেতেও বোধহয় কেউ দেখেনি।

ডঃ চ্যাটার্জি কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে অধিরাজের দিকে তাকিয়ে থেকে নাক দিয়ে ফোঁৎ ফোঁৎ আওয়াজ করলেন। তারপর বিনাবাক্যব্যয়ে ব্রাশ আর পেস্টের টিউব নিয়ে অ্যাটাচড বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলেন! অধিরাজ চোখ কপালে তুলে বলল, ‘সে কী! বাঘ শেষে দাঁত মাজতে চলল!’

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ অধিরাজের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালেন, ‘ভেবে দেখলাম, বাঘ সিগারেটও খায় না, এমনকি হুঁকোও টানে না!’

বলেই সুট করে টয়লেটে ঢুকে গেলেন। অর্ণব এতক্ষণে সুযোগ পেয়ে বিড়বিড় করে, ‘ওঁর মুখখানা কিন্তু অনেকটা বাঘের মতোই।’

অধিরাজের চোখে কৌতুক নেচে ওঠে। ঠোঁট টিপে হেসে বলল, ‘ডকে তুমি কায়দা করে হাঁড়িমুখো বলছ অর্ণব?’

অর্ণব আবার একটা মোক্ষম বিষম খেল। এতক্ষণ আহেলি চুপ করে দুই অফিসার ও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের খুনসুটি উপভোগ করছিল। এবার মুখ খুলল, ‘অফিসার সরকার খুব ভুল বলেননি। অন্তত হাঁকডাকটা বাঘের মতোই!’

অধিরাজ তার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায়, ‘সেনোরিটা, কথাটা শুনতে পেলে উনি কিন্তু আপনার মুণ্ডুটা স্রেফ মুখে ফেলে বাঘের মতোই চিবোতে শুরু করে দেবেন’।

আহেলি স্মিত হাসল। কিছু বলতেও যাচ্ছিল। তার আগেই ডঃ চ্যাটার্জি ফিরে এসেছেন। রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘এখনও গজল্লা করে যাচ্ছ! পোস্টমর্টেমের রেজাল্ট ব্রিফ করবে কে? আইভি?’

আইভি এতক্ষণ মুগ্ধদৃষ্টিতে অনিমেষে অধিরাজের দিকে তাকিয়েছিল। যে মুহূর্তে লোকটা তার সামনে এসে দাঁড়াল সে মুহূর্তেই তার বুকের মধ্যে রক্ত ছলাৎ করে উঠেছিল। এত রূপ মানুষের হয়! অধিরাজ ব্যানার্জি যে হোমিসাইডের হিরো তা এখানে আসার আগেই তার জানা ছিল। কিন্তু এরকম মারকাটারি হ্যান্ডসাম তা কে জানত! দমবন্ধ করে সে প্রায় পুতুলের মতোই দাঁড়িয়েছিল। অধিরাজ ডঃ চ্যাটার্জীর দৃষ্টি অনুসরণ করে এতক্ষণে আইভি’র দিকে তাকায়। আইভি আরও ঘাবড়ে গেল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে পতন ও মূৰ্চ্ছার অভিনয় করতে বললে সে সবচেয়ে খুশি হত। কোনোমতে বলল, ‘অ্যাঁ?’

‘পোস্টমর্টেমের রেজাল্ট বলতে বলতে আমি টায়ার্ড।’ ডঃ চ্যাটার্জি ধূমায়িত বোর্নভিটার কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘এবার তুমি ব্রিফ করো।’

‘আ-মি… মানে… আমি বলব!’

ডঃ চ্যাটার্জীর গোল গোল চোখ আরও গোল গোল হল, ‘না, তুমি বলবে না, আমি বলব। কারণ আমার নাম আইভি। য-ত্ত-স-ব!’

খোঁচাটা খেয়ে আইভি আরও ঘাবড়ে যায়। একদিকে অধিরাজ তার দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছে, অন্যদিকে ডঃ চ্যাটার্জির তাড়া। অর্ণব দেখল, রূপসী ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট রীতিমতো ঘামতে শুরু করেছে। সে আমতা আমতা করে থেমে থেমে বলে, ‘মৃতের নাম উৎপল মিত্র, মানে… হাইট পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি, … আর… আর… বয়েস চল্লিশ বছর…!’

‘এমন পজ দিচ্ছ যে হাতিও গলে যাবে’। ডঃ চ্যাটার্জি আইভি-র শ্লথ গতিতে কথা বলার ভঙ্গিতে চটে উঠেছেন, ‘এত হিস্ট্রি জিওগ্রাফি বলার কী হল! এখনও লোকটার বয়েস চল্লিশ। কিন্তু তোমার ব্রিফ শেষ হতে হতে যে একচল্লিশ হয়ে যাবে দেখছি।’

লজ্জায়, অপমানে আইভি-র মুখ লাল হয়ে ওঠে। অর্ণব লক্ষ্য করল, তার চোখ ছলছল করে উঠেছে। সে মাথা হেঁট করে ফেলে। অধিরাজের চোখ আইভিকে ছেড়ে আবার ফিরে গেল ডঃ চ্যাটার্জির দিকে, ‘দয়া করে আপনিই বলুন।’

‘সবসময়ই আসল কাজ আমাকেই করতে হয়! যতসব অপদার্থ আমার কপালেই জোটে। আইভি’র দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন ডঃ চ্যাটার্জি, ‘আমিই বলছি। মন দিয়ে শোনো। লোকটার শরীরে মাল্টিপল ফ্র্যাকচার আছে। স্পাইনাল কর্ড কয়েক টুকরো হয়ে গিয়েছে। ফিমার বোনও তিন টুকরো। মাথার খুলি জায়গায় জায়গায় ভাঙা। অপটিক নার্ভ ইনজিওরড়। অবধারিত ট্রম্যাটিক অপটিক নিউরোপ্যাথি। পড়ার জন্যই মৃত্যু হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার আগে ওর একটা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনও হয়েছিল। ব্লাড গ্লুকোজ মারাত্মকভাবে বেড়েছে। লোকটার ব্লাড সুগারের হিস্ট্রি নেই।

অন্তত ওর ব্লাডে ডায়াবেটিসের কোনও মেডিকেশনের ট্রেস নেই। প্রচুর পরিমাণে ক্যাটিকোলামাইনও আছে শরীরে। এক্সট্রা অ্যাড্রিনালিনের ট্রেসও পাওয়া গেছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হয় স্ট্রেস কার্ডিওমায়োপ্যাথির চান্স প্রবল। লোকটা সম্ভবত মরার আগে ফাইট অর ফ্লাইট পজিশনে ছিল।’

‘এবার আপনি কোন্ ভাষায় কথা বলছেন ডক্?’ অধিরাজ উদ্ভট মুখভঙ্গি করে বলল,

‘একবর্ণও মাথায় ঢুকল না! আবার বলবেন না, বাঘ বাংলাভাষায় কথা বলে না!’

ডঃ চ্যাটার্জি দাঁত কিড়মিড় করলেন, ‘সবসময়ই উৎপটাং কথাবার্তা না বলতে

পারলে তোমার শান্তি হয় না? কথার মাঝখানে ফের যদি উৎপাত করো, ঘুষি মেরে চিৎপাত করে দেব!’

অধিরাজ ইঙ্গিতে নিজের মুখের জিপার টেনে বন্ধ করল। ডঃ চ্যাটার্জী বাঘের মতোই খানিকটা গরগর করে নিয়ে বললেন, ‘মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনকে তোমাদের ভাষায় হার্ট অ্যাটাক বলে। লোকটা যদি ওপর থেকে নীচে না-ও পড়ত, তবু বাঁচত কী না সন্দেহ আছে। যখন একটা মানুষ প্রচণ্ড ভয় পায়, তখন হার্টরেট, ব্লাড প্রেশার আর ব্লাড গ্লুকোজ চড়চড়িয়ে বাড়তে থাকে। স্ট্রেস বা ফিয়ার হার্টের ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেমকে প্রভাবিত করে। যার ফলে অ্যারিদমিয়া হয়। সেখান থেকে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বা কার্ডিয়াক ফেইলিওর। লোকটার সেটাই হয়েছিল।’

‘তার মানে সহজ ভাষায় লোকটা মারা যাওয়ার আগে ভয় পেয়েছিল।’

‘ইয়েস। স্কেয়ারড্ টু ডেথ বলতে পারো। ভয় পেয়েছিল, অথবা মারাত্মক কোনও স্ট্রেসে ছিল।’ ডঃ চ্যাটার্জি বলেন, ‘যখন একটা লোক কোনও বিপর্যয় বা আতঙ্কের সামনে পড়ে তখন শরীর প্রচুর এক্সট্রা অ্যাড্রিনালিন বা ক্যাটিকোলামাইন ক্ষরণ করে। এই হরমোনগুলো ইমিডিয়েট ফিজিওলজিক্যাল চেঞ্জ করে বডিকে ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স করাতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ এই হরমোনগুলোর প্রভাবে পড়েই ব্রেন বডিকে সিগন্যাল দেয় যে সে এই পরিস্থিতি থেকে পালাবে কি না, কিংবা লড়াই করবে কি না। এ-ক্ষেত্রে লোকটা পালিয়েছে। আই মিন, নো ডাউট—এটা সুইসাইড!’

‘সুইসাইড!’ অধিরাজের মুখে বিস্ময়ের ছাপ প্রকট, ‘কিন্তু যে আত্মহত্যা করতে চাইবে সে ভয় পাবে কেন?’

‘ডিপ্রেড্ বা স্ট্রেড্ থাকলেও এই একই জিনিস হয়। আর মানুষ আত্মহত্যাও করে নানান ভয় থেকেই। এটাও একরকমের ফ্লাইট বা পালিয়ে যাওয়া!’ ডঃ চ্যাটার্জি একটু উদাসীনতা মাখিয়ে বললেন, ‘মানুষের জীবন একটা বিরাট যুদ্ধক্ষেত্র। সেখানে প্রায়ই এমন ডু অর ডাই সিচুয়েশন আসে….!’

‘যাঃ কচু!’ অধিরাজ ফিক্ করে হেসে ফেলেছে, ‘আপনি তো মিস্ কাটামুণ্ডুর পাল্লায় পড়ে কবি হলেন দেখছি’।

‘শাট-আ-প ইউ রোগা ম্যামথ!’ বিরক্ত হয়ে তিনি বলেন, ‘আমার পেছনে না লেগে তুমি থাকতে পারো না? বলছি সুইসাইডের কথা, এর মধ্যে মিস কাটামুণ্ডু এসে টপকে পড়লেন কোথা থেকে?’

‘তিনি কি আর টপকে পড়েছেন? টপকে পড়েছি তো আমরা!’ অধিরাজ ভ্রূভঙ্গি করেছে, ‘তিনি তো আপনার শয়নে, স্বপনে, জাগরণে! আমরা আসার আগে আপনি তো গভীর মনোযোগে ওঁর উপন্যাসই পড়ছিলেন! টেবিলের ওপরে ওঁর বই-ই দেখছি না?’

অর্ণব তাকিয়ে দেখল সত্যিই টেবিলের ওপর উক্ত লেখিকার লেখা বই, ‘চুপি চুপি খাচ্ছে’ পেজ মার্ক দিয়ে রাখা আছে। বুড়ো এবার লজ্জার চোটে লাল হয়ে গেল। টাক চুলকাতে চুলকাতে বলল, ‘না… মানে… ওই আর কী…!’

‘ভেবে দ্যাখো অর্ণব…!’ অধিরাজ ঠোঁট টিপে হাসল, ‘একপাশে বোর্নভিটার কাপ, তার সঙ্গে চুপি চুপি খাচ্ছে! কী কম্বিনেশন! চুপি চুপি কী খাচ্ছেন ডক্…? আমরা তো এমনি এমনিই খাই!

‘তুমি চুপ করবে!’ অধিরাজকে অগ্নিদৃষ্টিতে প্রায় শিক কাবাব বানিয়ে দিয়ে বললেন ডঃ চ্যাটার্জি, ‘আমি আমার কোটা কমপ্লিট করি, তারপর যতখুশি বকবক কোরো।’

‘ফাইন, বলুন।’

যে ওষুধের ফয়েলটা এনেছ, সেটা কী করতে এনেছ তুমিই জানো। যাই হোক, সেখান থেকে কোনও ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়নি

‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়নি! সে কী!’ অধিরাজের কপালে ভাঁজ পড়ল, ’কিউরিঅঙ্গ -সার অ্যান্ড কিউরি-অ-সার!’

‘ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত। ফয়েল থেকে কেউ নিজের ফিঙ্গারপ্রিন্ট কেন মুছবে তা বুঝলাম না। যদিও কিছুটা স্কিন সিক্রিয়েশন অর্থাৎ ঘাম রয়েই গিয়েছে। সেই সোয়েট স্যাম্পলটা একদমই পুরনো নয়, বরং বেশ তাজা। টাইমিং খুনটার সমসাময়িক। খুন হওয়ার অব্যবহিত আগে বা পরে কেউ ওই ফয়েল থেকে লাস্ট ওষুধটা খেয়েছিল।’

‘এই লোকটা ওষুধটা খায়নি তো? বা এমনও হতে পারে যে কেউ ওকে খাইয়ে দিয়েছে।’

‘না। সেসব কারিকুরি নেই। ফয়েলটা যে ওষুধের, ওর রক্তে তার কোনও ট্রেস নেই। সে বিষয়ে আহেলি পরে বুঝিয়ে বলবে। আপাতত আমি এইটুকু বলছি, সোয়েট স্যাম্পল দেখে মনে হচ্ছে যে লোকটা এই ওষুধটা খেয়েছিল সে অসম্ভব ঘামছিল। কারণ এমনিতে আমাদের শরীরে ছ-শো পঞ্চাশটা সোয়েট গ্ল্যান্ডস আছে। তার থেকে যতখানি ঘাম স্বাভাবিক অবস্থায় থাকা উচিত, তার থেকে অনেক বেশিই আছে ফয়েলটায়। যে কোনও কারণেই হোক, সে ঘেমে নেয়ে একসা হয়েছিল। আর সোয়েট স্যাম্পল থেকে আরও একটা কথা বলা যায়। যখন লোকটা ঝাঁপ দিচ্ছিল, তখন সে একা ছাদে ছিল না, আরও একজন ছিল যার সোয়েট স্যাম্পল ফয়েলে পাওয়া গিয়েছে। কারণ এর স্যাম্পলের সঙ্গে মৃত ব্যক্তির স্যাম্পল একদমই মিলছে না।’

‘মানে!’ অধিরাজ বিস্মিত, ‘আমি তো ভাবছিলাম যে এই লোকটারই ওষুধের ফয়েল!’

‘এ তো আশ্চর্য হালুয়া!’ ডঃ চ্যাটার্জি ভ্রূকুটি করেছেন, ‘পৃথিবীতে এমন কোন্ বুদ্ধিমান লোক আছে যে সুইসাইড করার আগে ওষুধ খেতে ভুলবে না!

‘কিন্তু সোয়েট স্যাম্পল তো ঘামই। আপনিই তো বললেন যে লোকটা ভয় পেয়েছিল। হয়তো ভয় পাওয়ার কারণেই ওর ঘাম ওষুধের ফয়েলে লেগেছে।’

অর্ণব মিনমিন করে বলে কথাটা। তার কথা শুনে ভয়ংকর চটলেন তিনি, ‘ওরে আমার আদর গেলা কোঁৎকা রে! তোমায় ডাক্তারির এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ মার্ক কে দিয়েছিল সবজান্তা গেঞ্জিওয়ালা!’

বেচারি কোনোমতে একটা হেঁচকি তুলেই থেমে গেল। অধিরাজ ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলে। ডঃ চ্যাটার্জি যখন একবার বলতে শুরু করেছেন, তখন পুরোটাই বলবেন। আপাতত তাকে বলার সুযোগ দেওয়াই ভালো।

‘সোয়েটকে খুব সহজ এভিডেন্স ভেবো না। অনেক ক্রাইম সিনে ফিঙ্গারপ্রিন্ট না পাওয়া গেলে সোয়েট স্যাম্পল নেওয়া হয়। ঘামই ডিটারমিন করে যে ক্রাইম সিনে ক-জন লোক ছিল। এক না একাধিক। কারণ ঘাম অনেকটা ফিঙ্গারপ্রিন্টের মতোই। দু-জনের কখনই এক হয় না!’

অধিরাজ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে তাঁর দিকে। ডঃ চ্যাটার্জি বুঝিয়ে বলেন,’সচরাচর স্কিন সিক্রিয়েশনে বেশ কয়েকটা জিনিস থাকে, তার মধ্যে প্রধান হল অ্যামাইনো অ্যাসিড এবং ল্যাকটেট, ইউরিয়া আর গ্লুটামেটের মতো মেটাবোলাইটস। প্রত্যেকের লাইফ স্টাইল, আর নানান অভ্যাস, মেডিকেশনের ওপর এই চারটে জিনিসের পরিমাণ ভ্যারি করে। প্রত্যেকের ক্ষেত্রে অ্যামাইনো অ্যাসিড, ল্যাকটেট, ইউরিয়া আর গ্লুটামেটের লেভেল আলাদা আলাদা হয়। এক্ষেত্রে ফয়েলের ওপরে যে স্যাম্পলটা আছে, তার মধ্যে অ্যামাইনো অ্যাসিড আর মেটাবোলাইটসের পরিমাণের সঙ্গে মৃত ব্যক্তির স্কিন সিক্রিয়েশনে এই জিনিসগুলোর পরিমাণ মিলছে না। অর্থাৎ এক কথায় আত্মহত্যার সময়ে ছাদে মৃত ব্যক্তি ছাড়া আরও কেউ ছিল।’

‘কিন্তু কেউ ছাদে বসে ওষুধ খাবে কেন!’

ডঃ চ্যাটার্জি একটু ভেবে বললেন, ‘তাছাড়া ওষুধটাও কিন্তু খুব সাধারণ নয় রাজা আহেলি… প্লিজ…।’

আহেলি মুখার্জি যেন তৈরিই ছিল। সে বলল, ‘এই ওষুধটা বেসিক্যালি সিটালোপ্র্যাম গ্রুপের। কোনোরকম বিষ, বা ক্ষতিকর ওষুধ কিছু নয়। এস.এস.আঙ্গ র.আই। সিলেক্টিভ সেরেটোনিন রি আপটেক ইনহিবিটরস। মূলত ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি বা প্যানিক ডিস-অর্ডারের ক্ষেত্রে প্রেসক্রাইব করা হয়। অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট। মৃত ব্যক্তি যে স্ট্রেসড ছিলেন বা ভয় পেয়েছিলেন তা স্যার আগেই বলেছেন। স্বাভাবিকভাবেই এই ওষুধটা তার হওয়ার চান্সই প্রবল ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি। সুতরাং ধরে নিতে হবে যে ছাদে আরও একজন কেউ ছিল যার স্ট্রেস বা ডিপ্রেশনের প্রবলেম আছে।’

‘এই এস.এস.আর.আই জিনিসটা ঠিক কী?

‘এটা আমাদের ব্রেনে সেরেটোনিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। সেরেটোনিন একজাতীয় নিউরোট্রান্সমিটার যা আমাদের মুডকে কন্ট্রোল করে।’ আহেলি একটু থেমে থেকে বলে, ‘মৃত ব্যক্তির প্রোফাইলের সঙ্গে ওষুধটা যায়। কিন্তু এ ওষুধ তার নয়!

‘আর কিছু?’

‘আমরা ভদ্রলোকের জামাকাপড় ভালো করে পরীক্ষা করেছি। বড়িও। কিন্তু কোথাও কোনও ফাউল প্লে নেই। জামাকাপড়ে ভিকটিমের নিজের ছাড়া আর কারোর ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই। নেই ধস্তাধস্তির কোনও চিহ্নও। যে ইনজুরিগুলো দেখা যাচ্ছে সেগুলো সতেরোতলার ছাদ থেকে নীচে পড়ার ফলে হয়েছে। এ-ছাড়া আর কোথাও কোনও সোয়েলিং বা ব্রুইজেস নেই। লোকটাকে কেউ ধাক্কা মারেনি, বা তুলে ফেলে দেয়নি। তেমন কিছু হলে কোথাও না কোথাও চিহ্ন থাকত। সম্ভবত এটা সিম্পল সুইসাইড।’

সিম্পল! কতটা সিম্পল? অধিরাজের মুখে চিন্তার ছাপ। এ আবার কী জাতীয় ধাঁধা! যে সুইসাইড করল সে ডিপ্রেসড বা স্ট্রেসড থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওষুধের ফয়েলটা যে অন্য গল্প বলছে! যে ভয়ের কথা ডঃ চ্যাটার্জি বলছেন সেটাই বা কী জাতীয়! মুহূর্তের মধ্যেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই দৃশ্যটা। লোকটা মাটিতে পড়ার পর আঙুল তুলে ছাদের দিকে নির্দেশ করেছিল। সেই ইশারার মাধ্যমে কিছু বলার চেষ্টা করছিল কি? ঠিক কী বলতে চেয়েছিল সে? ওপরে কি কেউ ছিল তখন? ডঃ চ্যাটার্জি ও আহেলির থিওরি মেনে নিলে অন্তত আরও একজন ছিল সেখানে। তার দিকেই ইঙ্গিতটা ছিল কি? তাহলে কি এটা খুন, সুইসাইড নয়? কিন্তু ফরেনসিক যে বলছে ‘সিম্পল সুইসাইড’।

আপনমনেই মাথা নাড়ল সে। মিলছে না! অঙ্কটা কিছুতেই মিলছে না। কোথাও কিছু একটা জট আছে যা আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে না। যতটা সহজ মনে হচ্ছে ব্যাপারটাকে, আদৌ অতটা নয়। যে আত্মহত্যা করতে চায় সে ‘বাঁচাও… বাঁচাও’ করে চিৎকারই বা করবে কেন! এমন নয়তো যে, কেউ তাকে বাধ্য করেছে সতেরোতলার ছাদ থেকে ঝাঁপ দিতে? কিন্তু তাই বা কীভাবে সম্ভব!

অধিরাজ নিজের চিন্তাতেই আত্মমগ্ন হয়ে গিয়েছিল। আচমকা তার মোবাইলে সশব্দে সেতারে দেশ রাগ বেজে উঠল। সে আড়চোখে দ্যাখে পবিত্র ফোন করছে।

‘হ্যালো।’

‘রাজা, কালু শেষপর্যন্ত মুখ খুলেছে।’ পবিত্র-র স্বর উত্তেজিত, ‘তুমি ভাবতেও পারবে না যে ও কী বলেছে!’

‘কী আর বলবে! সম্ভবত ও বলেছে যে রয়্যাল হাইটসে ও উৎপল মিত্রকে খুন করতে গিয়েছিল।’

‘যাঃ কলা!’ ও-প্রান্তে পবিত্র অবাক, ‘তুমি জানলে কী করে?’

‘ওয়াইল্ড গেস! এর থেকে মারাত্মক কথা এই মুহূর্তে আর কিছু হতেই পারে না। আর তোমার গলায় যে উত্তেজনা পাচ্ছি তাতে মনে হয়েছিল যে এই কথাটাই হবে। কালু আর যাই হোক, হাপু গাইতে তো রয়্যাল হাইটসে যায়নি।’

‘না। খুন করতে গিয়েছিল। কিন্তু ব্যাটা কিছু করার আগেই উৎপল মিত্র মারা পড়লেন।’ পবিত্র একটু থেমে যোগ করল, ‘ও শুধু একজনেরই সুপারি নেয়নি। আরও কয়েকজনকে মারার কথা ছিল। ওর প্রথম শিকারের নাম সৌমিত্র চৌধুরী। মাসখানেক আগে তাকে মারার কথা ছিল। কিন্তু…!

‘দাঁড়াও… দাঁড়াও…! কী নাম বললে?’ অধিরাজ উত্তেজিত, ‘সৌমিত্র চৌধুরী? ইঞ্জিনিয়ার? সল্টলেকে থাকে?’

‘থাকে নয়, থাকত। ইনি ও…!’

‘মারা গিয়েছেন!’ অধিরাজের কণ্ঠস্বর উত্তেজনায় ভরপুর, ‘ওঁর লাশ একটা মর্গে পাওয়া গিয়েছে! খবরটা আমি দেখেছি। ভদ্রলোক মর্গে কী করতে গিয়েছিলেন বা কী করছিলেন তা জানা নেই! যদিও পোস্টমর্টেমে রহস্যজনক কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি। হার্টফেল করেই মৃত্যু হয়েছে।’

‘হ্যাঁ। তিনিই। কালু তারও সুপারি নিয়েছিল। কিন্তু কিছু করার আগেই লোকটা নিজেই মারা গেল!’

‘আর কারোর সুপারি নিয়েছে?’

‘হ্যাঁ। মৃন্ময় দত্তরায়!

‘মা-ই গুডনেস!’ উপর্যুপরি বিস্ময়ের আঘাতে স্তম্ভিত অধিরাজ, ‘এই লোকটাও একসপ্তাহ আগেই মারা গিয়েছে। ফের হার্টফেল! এক বেসরকারি নার্সিংহোমের এম.আর.আই মেশিনের মধ্যে এর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু সেখানকার টেকনিশিয়ানরা কেউ লোকটাকে আইডেন্টিফাই করতে পারেনি।’

‘হ্যাঁ। তিনিই।’

‘কালুকে ভালো করে জিজ্ঞাসাবাদ করো পবিত্র। দরকার পড়লে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে দাও। কিন্তু এর পেছনের রহস্যটা আমি জানতে চাই।’ অধিরাজ বলল, ‘যার সু পারিই ও খায়, সে-ই এমন অদ্ভুতভাবে মারা যায় কীকরে সেটা জানতেই হবে। হার্টফেল করিয়ে মারা আর যা-ই হোক, সুপারি কিলারের স্টাইল নয়। আর উৎপল মিত্রকে আমরা নিজের চোখে মরতে দেখেছি। কালু ওঁর ধারেকাছেও ছিল না। ও আর কারোর সুপারি নিয়েছে?’

‘হ্যাঁ। সব মিলিয়ে সাতজনের সুপারি পেয়েছে। কিন্তু বাকি চারজনের নাম বলছে না।

‘ওর বাপ বলবে।’ সে জোরের সঙ্গে বলে, ‘আরও কিছুক্ষণ প্রহারেণ ধনঞ্জয় চালিয়ে যাও। কিচ্ছু জিজ্ঞাসা করবে না, কিছু বললে শুনবেও না। স্রেফ ঠেঙিয়ে যাও। আমি আসছি।’

‘ওকে।’

পবিত্র লাইন কেটে দেয়। অধিরাজ মুখ তুলে তাকায়। তার দিকে তখন উপস্থিত চারজনই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।

‘ডক, একটা ফেভার চাইব?’

ডঃ চ্যাটার্জির চোখে সন্দিগ্ধ দৃষ্টি, ‘নির্ঘাৎ আমায় এক্সট্রা খাটানোর কল করেছ!’

অধিরাজ কিছু বলতে গিয়েও হেসে ফেলল, ‘সবসময়ই এমন উদ্ভট সন্দেহ করেন কেন?’

‘কারণ তোমার মতো লেভেলের বদমায়েশ পৃথিবীতে খুব কমই আছে।’ ডঃ চ্যাটার্জী খ্যাঁক করে উঠলেন, ‘আমি জানি না তুমি কোন্ কাননের ফুল, কোন্ বাঁশবনের বাঁশ?’

অর্ণব অতিকষ্টে হাসি চাপার চেষ্টা করে। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে ডঃ চ্যাটার্জীর রিষ্টি ছিল। এমন চমৎকার গানটাকে নষ্ট করার কোনও মানে হয়!

‘খুব বেশি কষ্ট দেব না, জাস্ট আরও দুটো বডির স্যাম্পল একটু খতিয়ে দেখবেন?’ সে বিনীত কণ্ঠে বলে, ‘আর আপনার যদি খুব অসুবিধে হয় তবে মিস মুখার্জি নয় একটু হেল্প করে দেবেন!

মিস মুখার্জির নাম শুনে আইভি-র মুখ ম্লান হয়ে গেল। সে আড়চোখে আহেলির দিকে তাকায়। আহেলির ঠোঁটে বিশ্বজয়ের হাসি।

‘হ্যাঁ, সব কাজই তো মিস মুখার্জি করেন।’ গোমড়া মুখে বললেন তিনি,’আমি তো এখানে বসে দস্যু রত্নাকরের মতো ‘রাম রাম’ গাইতে গিয়ে ‘মড়া মড়া’ গাইছি। পাপী তাপী মানুষ! মড়া দেখতে আমার খুব ভালো লাগে কি না! তাই দিন রাত এক করে লাশের মুখ দেখছি! বউয়ের মুখও মানুষ এত দেখে না, যত আমি ডেডবডির মুখ দেখি! এত কাজ করি, তবু তোমাদের পোষায় আর না। দিনরাত কুলি-কামিনের মতো খাটছি, তবু তোমাদের মন পাওয়া যায় না! সবই আমার কপালের দোষ। নয়তো এখানে এসে পড়লামই বা কেন?’

এই রে! বুড়োর অভিমান হয়েছে। সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে! ওরা স্পষ্ট বুঝল যে এবার আর কথা বাড়ালে নির্ঘাৎ ধাঁতানি খেতে হবে। অর্ণব ফিসফিস করে অধিরাজকে বলল, ‘ডঃ চ্যাটার্জি যে অবিকল আমার মায়ের মতো ডায়লগ দিচ্ছেন!’

অধিরাজ অবাক, ‘তোমার মা-ও এই কথাগুলো বলেন!’

‘হ্যাঁ স্যার।’ অর্ণব মৃদু হাসল, ‘যখনই বাবা মায়ের কোনও কথা শোনেন না, ঠিক তখনই মা এই ডায়লগটা দেন। আর এখন ডঃ চ্যাটার্জি দিচ্ছেন।’

‘ফুল্লরার বারোমাস্যা আনপ্লাগড! ‘

কথাটা বলেই অধিরাজ স্মিত হাসল। একা অর্ণবের মা নয়, তার মা-ও মাঝেমধ্যে এই একই কথা বলে থাকেন। সম্ভবত পৃথিবীর সব মায়ের বক্তব্য একই। সংসার সকলের জীবনই ছারখার করে দিয়েছে। সবারই কপাল সমান খারাপ।

অধিরাজ আর কথা না বাড়িয়ে এবার আইভি-র দিকে ফিরেছে, ‘নাইস ট্রাই সেনোরিটা। বেটার লাক নেক্সট টাইম।’

নাইস ট্রাই! কীসের ট্রাই? সে তো কিছুই বলতে পারেনি! উলটে ঝুলিয়েছে। সে থতমতো খেয়ে বলল, ‘কিন্তু… আমি তো…!’

‘আপনি বলতে পারেননি। কিন্তু চেষ্টা করেছেন’। অধিরাজ মিষ্টি হাসল,’প্রথম প্রথম ওরকম হয়। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। ডোন্ট ওরি মাদমোয়াজেল’।

আইভি যেন ওই কয়েকটা কথাতেই সম্মোহিত হয়ে গেল! তার দৃষ্টি অধিরাজকে ছেড়ে একটুও নড়ছে না। অধিরাজের কোনও মেয়ের নাম মনেই থাকে না বলে ইদানিং সে ‘সেনোরিটা’, ‘মাদমোয়াজেল’ জাতীয় সম্বোধন করতে শুরু করেছে। এতে নাম বলার ঝুঁকি নেই। যাকে বলা হয় সে-ও কিছু মনে করে না। অন্তত মিস…. কী যেন, বা মিস হোয়াট এভারের থেকে অনেক ভালো।

‘আইভি…!’ ডঃ চ্যাটার্জী গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ওদের পোস্টমর্টেমের রিপোর্টটা দিয়ে দাও।’

‘থ্যাংকস ডক।’ অধিরাজ অর্ণবের দিকে তাকায়, ‘তুমি রিপোর্টটা নিয়ে এসো। আমি ততক্ষণ কালুর খবর নিই। ‘

‘ওকে স্যার।’

অধিরাজ জুতোর আওয়াজ তুলে স্মার্টলি গটগটিয়ে ল্যাব থেকে বেরিয়ে গেল। অর্ণব এবার আইভি-র দিকে তাকায়। আইভি তখনও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাকে দেখে এখন মার্বেলের মূর্তি মনে হচ্ছে। হাবেভাবেই স্পষ্ট যে ডঃ চ্যাটার্জির কথা তার কানেই ঢোকেনি।

‘যাঃ কলা!’ ডঃ চ্যাটার্জি তার অবস্থা দেখে বললেন, ‘এ তো পুরো লাশ! নট নড়ন চড়ন নট কিস্যু! এ পাবলিকও হার্টফেল করল না কি!’

হার্টের ব্যাপার নিঃসন্দেহে! অধিরাজের গমনপথের দিকে উদ্ভাসিত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল আইভি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঁপা স্বপ্নমেদুর স্বরে বলল, ‘হি ইজ মাইন্ডব্লোয়িং!’ কথাটা শুনেই মিস আহেলি মুখার্জির মুখে ফের অসন্তোষের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অর্ণবের রীতিমতো হাসি পাচ্ছিল। কোনোমতে হাসি চেপে সে ডঃ চ্যাটার্জির দিকে তাকায়।

‘লে হালুয়া! ক্রিজে নামতে না নামতেই ক্লিন বোল্ড!’ডঃ চ্যাটার্জি টাক চাপড়ালেন, ‘রাজা প্রতিজ্ঞা করেছে প্রত্যেকবার আমার অ্যাসিস্ট্যান্টদের স্পয়েল করবেই! আমার কী হবে অর্ণব!

অর্ণব আড়চোখে দেখল, অধিরাজ দৃষ্টিপথ থেকে মিলিয়ে গেলেও আইভি এখনও সেদিকেই মন্ত্রমুগ্ধ দৃষ্টিতে অপলকে তাকিয়ে আছে। তার নিঃশ্বাসে তখনও ফরাসী সৌরভ। কর্ণেন্দ্রিয়ে উষ্ণ কণ্ঠস্বর! কে জানে মাথার ভেতরে শত শত ভায়োলিন ও বাজছে কি না!

সে সুন্দরী মেয়েটির চোখের সামনে প্রায় অসভ্যের মতো হাত নেড়ে বলে,

‘উনি চলে গিয়েছেন ম্যাডাম। আপনি কি আজ রিপোর্টটা দেবেন? না দু-হাজার বাইশে আসতে হবে?’

(৪)

বেশ কিছুদিন আগে থেকেই শহরে আচমকা হার্টফেল ও সুইসাইডাল অ্যাটেম্পটের সংখ্যা বেড়েছে। কোভিড পরিস্থিতির চাপ অনেকেই নিতে পারছে না। সাধারণ জনজীবন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। সরগরম কলকাতা শহর এখন থমকে দাঁড়িয়েছে। লকডাউনের জেরে অনেকের রোজগার বন্ধ। বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহু বেসরকারি কোম্পানি। মানুষকে প্রতিনিয়ত বেকারত্ব, রোগ, অভাব, মৃত্যু ও আতঙ্কের সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। ফলস্বরূপ হতাশায় ডুবছে জনসাধারণ। অসুস্থ হয়ে পড়লে ডাক্তারের দেখা মিলবে না, মিলবে না কোনওরকম চিকিৎসাও। হসপিটালে ভর্তি হলে কোভিড টেস্ট না হওয়া পর্যন্ত রোগীকে বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখা হচ্ছে। স্কুল, কলেজ সব বন্ধ! কেউ ভাবেনি যে জীবন এভাবেও থমকে যেতে পারে। কিন্তু এই স্তব্ধ জীবনের সঙ্গে পাঞ্জা কষতে কষতে অনেকেই সাহস হারিয়ে ফেলছে। তাই সুইসাইড প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠেছে। খবরের কাগজে রোজই একাধিক আত্মহত্যার খবর দেখা যায়। একদিকে কোভিডের করাল থাবায় পোকা মাকড়ের মতো মানুষ মরছে, অন্যদিকে হতাশায় দমবন্ধ করা পরিবেশের সঙ্গে যুঝছে গোটা দেশ।

কিন্তু তার মধ্যেও দুটো মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে মিডিয়া হইচই করেছিল। প্রথম মৃত্যুটা ভারী অদ্ভুত। এক হসপিটালের মর্গে পাওয়া গেল অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তির লাশ। ভদ্রলোকের পরিচয় পরে পাওয়া গিয়েছিল। তাঁর নাম সৌমিত্র চৌধুরী। পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বয়েস চল্লিশ। তিনি কী করতে মর্গে গিয়েছিলেন তা কেউ জানে না। হসপিটালের ওয়ার্ডবয়, নার্স বা ডাক্তারেরা কেউই লোকটিকে শনাক্ত করতে পারেনি। মর্গের দায়িত্ব যার ওপরে থাকে সেই বনোয়ারিলাল জানায় যে গত রাতে কোনও লাশ আসেনি, তাই তার মর্গে ঢোকার প্রয়োজনও পড়েনি। পরদিন ভোর ভোর একটি লাশের পোস্টমর্টেম হওয়ার কথা ছিল। শেষরাতে সেই দেহটি আনতে গিয়ে সে সৌমিত্র’র মৃতদেহ দরজার সামনে পড়ে থাকতে দেখে। সে কখন, কেন মর্গের ভেতর প্রবেশ করেছিল তা সবারই অজানা।

ঘটনাটা মিডিয়ায় উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল। মর্গের ভেতরে কীভাবে জ্যান্ত মানুষ ঢুকে যায়, তা নিয়ে প্রচুর চর্চাও হয়েছিল। সমস্ত পণ্ডিত ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞরা লাইন দিয়ে আলোচনায় বসে গিয়েছিলেন। খুনের সম্ভাবনাও দেখেছিল অনেকে। কিন্তু সমস্ত আলোচনা থেমে গেল, যখন ফরেনসিক জানাল যে লোকটির মৃত্যু কার্ডিয়াক ফেইলিওরে ঘটেছে। তাঁর মৃত্যু অস্বাভাবিক নয়। সৌমিত্র-র স্ত্রী জানিয়েছিলেন তাদের কোনও শত্রু নেই, বা সাংসারিক পরিস্থিতিতেও বিশেষ জটিলতা কিছু ছিল না। সৌমিত্র সম্প্রতি নিজের চাকরি খুইয়েছিলেন। সেজন্য একটু মনমরাও থাকতেন। কিন্তু এছাড়া তেমন উল্লেখযোগ্য কোনও সমস্যা ছিল না।

ঘটনাটা আস্তে আস্তে মানুষের মন থেকে মুছে যাচ্ছিল। যখন জীবন কঠোর সংগ্রাম নিয়ে আসে তখন অন্য কোনও দিকে তাকানোর সময় থাকে না। নানা দুঃসংবাদ ও দুর্ঘটনার মধ্য দিয়েই মানুষের জীবন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু আবারও একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। জনৈক মৃন্ময় দত্তরায় নামক ব্যক্তির মৃতদেহ পাওয়া গেল এক বেসরকারি নার্সিংহোমের এম.আর.আই মেশিনের মধ্যে। টেকনিশিয়ানরা প্রত্যেকেই জানাল যে তারা লোকটিকে চেনে না ও আদৌ লোকটি কখনও এম.আর.আই করতে আসেনি। এই রহস্যময় মৃত্যু নিয়েও বেশ কিছুটা জলঘোলা হল। নানারকম থিওরির অবতারণাও ঘটল। কিন্তু ফের সমস্ত খুনের সম্ভাবনাকে নিশ্চিহ্ন করে ফরেনসিক জানায় যে লোকটির মৃত্যু কার্ডিয়াক ফেইলিওরের দরুণ হয়েছে। এই মৃত্যুটাতেও কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। মৃন্ময়ের স্ত্রী জানান যে তারাও আর্থিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। মৃন্ময় ইঞ্জিনিয়ার ও তাঁর নিজস্ব কনসালটেন্সি আছে। কিন্তু কোভিডের ফলে ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছিল। তিনি প্রবল মানসিক চাপের মধ্যে ছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বাস্থ্য ভালো ছিল। রীতিমতো ‘ফিটনেস ফ্রিক’ ছিলেন ভদ্রলোক। সেই মানুষের কীভাবে কার্ডিয়াক ফেইলিওরে মৃত্যু হয় তা নিয়ে সন্দেহপ্রকাশ করেছিল অনেকেই। কিন্তু পুলিস গোটা ব্যাপারটার মধ্যে কোনও ফাউল প্লে পায়নি। তাই দুটো মৃত্যুই ক্লিন চিট পেয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু এখানেই ঘটনা শেষ হল না। উৎপল মিত্র-র মৃত্যু এখন আবার প্রশ্ন জাগিয়ে তুলেছে! কালু এই তিনজনেরই সুপারি পেয়েছিল! অথচ তার হাতে এদের মৃত্যু হল না। তবে আদৌ কি এই মৃত্যুগুলো ততটাই স্বাভাবিক যতটা ফরেনসিক বলছে!

‘আমি জানি অফিসার, উনি আত্মহত্যা করেননি। করতেই পারেন না। বারবার আপনাদের বলছি। কিন্তু আপনারা কিছুতেই বিশ্বাস করছেন না! উনি হাইটে ভয় পেতেন! একবার রোপওয়েতে চড়ে নীচের দিকে তাকিয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। সেই লোক কী করে এত উঁচু থেকে ঝাঁপ মারবে!’

বলতে বলতেই উৎপল মিত্র-র স্ত্রী চোখ মুছলেন। এই ভদ্রমহিলার ওপর দিয়ে প্রায় ঝড় বয়ে চলেছে। কাল রাতের ঘটনাটা এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না। সব কিছুই তো ঠিকঠাক ছিল। রাতের খাওয়ার পর অভ্যাসবশত ছাদে হাঁটতে গিয়েছিলেন ভদ্রলোক। আগে রীতিমতো নিয়ম করে নাইটওয়াক করতে যেতেন। কিন্তু কোভিড-১৯ আর লকডাউনের জ্বালায় এখন বেরোনোর উপায় নেই। তাই কিছুদিন ধরেই ছাদেই হাঁটছিলেন। কালও রাতের খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকে গেলে ছাদের দিকেই চলে গিয়েছিলেন। তখন কে জানত যে এরপর এমন অঘটন ঘটবে!

‘মিঃ মিত্র কি কোনও কারণে আপসেট ছিলেন?’

অধিরাজের প্রশ্নের উত্তরে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মৃদু স্বরে জানালেন মিসেস মালবিকা মিত্র, ‘একটু আপসেট ছিলেন।’

‘একটু আপসেট মানে?

আবার একটু সময় নিয়ে বললেন তিনি, ‘ওঁর চাকরিটা চলে গিয়েছিল, তাই নিয়ে ওরিড ছিলেন। কোম্পানি লোক ছাঁটাই করছিল। আর এই পরিস্থিতিতে নতুন চাকরি পাওয়াও মুশকিল। রয়্যাল হাইটসের ফ্ল্যাটটা কেনার জন্য ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়েছিলেন। তার ই.এম.আই দিতে হত। মেয়েটা নামি দামি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। তার জন্য মোটা খরচ আছে। ওঁর বাবা, আই মিন আমার শ্বশুরমশাইও অসুস্থ, তাঁর চিকিৎসাও জরুরি। কোনদিক দিয়ে কী সামাল দেবেন তা ভেবে পাচ্ছিলেন না।’

অর্ণব অধিরাজের দিকে তাকায়। এই পরিস্থিতিতে যে কোনও মানুষের আত্মহত্যা করার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। ডঃ চ্যাটার্জী যা বলছিলেন অবিকল সেই ফাইট অর ফ্লাইট পজিশন। অথবা বলা যায় যে ডু অর ডাই সিচুয়েশন। সে বুঝতে পারে যে সুইসাইডের পাল্লা ভারী হল।

‘উনি কি কোনোরকম অ্যান্টিডেপ্রেসান্ট নিতেন?

‘না’। ভদ্রমহিলা জানালেন, ‘ডিপ্রেশনে ছিলেন ঠিকই, কিন্তু কোনও ওষুধ খেতেন না। প্রয়োজন ছিল না।’

‘উনি পেশায় কী ছিলেন?’

‘সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।’

‘ওঁর কোনোরকম শত্রু ছিল?’

এই প্রশ্নটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না মালবিকা। বললেন, ‘পাৰ্ডন?’

অধিরাজ তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটার পুনরাবৃত্তি করে, ‘আপনার স্বামীর কারোর সঙ্গে সিরিয়াস রাইভ্যালরি ছিল?’

‘না!’ তিনি অবাক, ‘আমরা মধ্যবিত্ত মানুষ। নিজেদের নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকি। কারোর সঙ্গে শত্রুতা করার প্রশ্নই ওঠে না।’

অধিরাজ একটু চুপ করে থাকে। যে মানুষের কোনো শত্রু নেই, তার জন্য কেউ সুপারিকিলার ফিট করবে কেন! নাকি ভদ্রমহিলাই কিছু চেপে যাচ্ছেন! অদ্ভুত ধোঁয়াশা-ভরা একটা কেস! কোনো মাথা মুণ্ডুই নেই। তবে কি ডঃ চ্যাটার্জির কথাই সঠিক? এটা সাধারণ একটা সুইসাইড কেসই। খামোখাই তারা মাথা ঘামাচ্ছে! কিন্তু কালুর বয়ানকেও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

‘আপনি নিজে বা আপনার পরিচিত অন্য কেউ অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট নেন?’

‘আমার শ্বশুরমশাই নেন।’ তিনি জানান, ‘ওঁর অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার আছে।’

‘ওঁরও কি ছাদে হাঁটা অভ্যাস?’

‘না।’ ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন, ‘উনি বাতের ব্যথায় প্রায় শয্যাশায়ী। তার ওপর হার্টের প্রবলেমও আছে। বিশেষ চলাফেরা করেন না।’

অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল অধিরাজ। এটা কি আদৌ কোনও কেস, না বুনো হাঁসের পেছনে দৌড়চ্ছে ওরা! আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হয়, সাধারণ আত্মহত্যাই। মিঃ মিত্র-র চাকরি চলে গিয়েছিল। তার ওপর সংসারের নানান খরচ, ই.এম.আই-এর চাপ। হয়তো হতাশায় ডুবে গিয়েছিলেন। তার হাত থেকে মুক্তি পেতেই এই পদক্ষেপ!

কিন্তু তাহলে কালু! ওর কথাগুলো এখনও কানে বাজছে অধিরাজের। যখন সে গিয়ে পৌঁছল ততক্ষণে পবিত্র তার টিম নিয়ে কালুর ওপর একরাউন্ড হাতসাফাই করে ফেলেছে। কালুর দিকে একঝলক তাকিয়েই অধিরাজ বুঝতে পেরেছিল ও এবার পুরোপুরিই ভাঙবে। ওর সামনের চেয়ারে বসে পড়ে ঠান্ডা গলায় বলেছিল, ‘আর কতজনকে খুন করেছিস বা করবি?’

কালু তার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। সে প্রবল মার খেয়ে এখন ঝিমিয়ে পড়েছে। তার ডান চোখের ওপর একটা বড়সড় কালশিটে। ঠোঁট বেয়ে রক্ত পড়ছে। কোনোমতে বলল, ‘আমি কাউকে খুন করিনি। আমি শুধু সুপারি নিয়েছিলাম!’

‘তুই সুপারি নিয়েছিলি আর খুনগুলো তোর পোষা বেতাল ফ্রি-তে করেছে?’ অধিরাজ গম্ভীর স্বরে বলে, ‘ফাজলামি হচ্ছে! আমাদের বোকা পেয়েছিস!’

‘বিশ্বাস করুন, আমি ওদের মারার সুপারি পেয়েছিলাম। অ্যাডভান্স নিয়েছি। কিন্তু কিছু করার আগেই মাঝখানে আচমকা লকডাউন পড়ে গেল। তা সত্ত্বেও আমি ওদের মারার প্ল্যানিং করেছিলাম। কিন্তু…!’

‘শালা! তুই ধর্মপুত্তুর যে তোর সব কথা বিশ্বাস করতে হবে!’ অধিরাজ সশব্দে চেয়ারটাকে সরিয়ে দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়ায়। সে কথা নেই বার্তা নেই লোকটার চুঁটি টিপে ধরে তাকে নৃশংসভাবে প্রায় এক ফুট ওপরে তুলে দেওয়ালে ঠেসে ধরেছে, ‘তোর ইতি গজটা কী? কীভাবে মেরেছিস ওদের? বল!’

তার জোরালো ধমক লক-আপের প্রতিটা দেওয়ালে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। প্রচণ্ড শক্তিশালী হাতের পেষণে প্রায় হাঁকপাক করছে কালু। অতবড় সুপারি কিলার ছোট্ট ইঁদুরের মতো অধিরাজের থাবায় ঝুলছে। শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘আমি ওদের মারিনি স্যার, তার আগেই ওরা একে একে মরতে শুরু করল। কীভাবে জানি না…!’

অধিরাজের চোয়াল লৌহকঠিন, ‘সৌমিত্র চৌধুরী, মৃন্ময় দত্তরায় আর উৎপল মিত্র ছাড়া আর কার সুপারি পেয়েছিলি?’

কালু হাঁসফাঁস করছে, ‘জানি না! একসঙ্গে সবারটা পাইনি…!’

সে যা বলল তার মর্মার্থ অনেকটা এইরকম। মাসখানেক আগে তার কাছে একটা অজ্ঞাত নম্বর থেকে ফোন আসে। সচরাচর তাদের বিজনেসে আননোন নাম্বার থেকেই বেশি ফোন আসে। তাই কলটা রিসিভ করেছিল সে। অন্যপ্রান্তে এক পুরুষকণ্ঠ তাকে সাতজনকে মার্ডার করার নির্দেশ দেয়। প্রথমে প্রস্তাবটা শুনে হকচকিয়ে গিয়েছিল কালু। কারণ এতবড় সুপারি সচরাচর কেউ দেয় না। সে ঠিক তার আগেই এই লাইন ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছিল। কিন্তু টাকার পরিমাণটা লোভনীয় হওয়ার দরুণ রাজি হয়ে যায়। অথচ একজনকেও মারতে পারেনি সে। কিছু করার আগেই তার শিকাররা আচমকা একে একে মরতে শুরু করল। দু-জন হার্টফেল করল। আর তৃতীয়জনের কী পরিণতি হয়েছে তা অফিসাররাও জানে।

‘লোকটা কে?’

‘লোকটা কে আমি তা জানি না স্যার। ও নাম বলেনি। আলাদা আলাদা নম্বর থেকে ফোন করত! কখনও দেখাও করেনি।’

‘তবে কাকে মারতে হবে তা জানাত কী করে?‘

অধিরাজের প্রশ্নের উত্তরে সে জানায়, ‘পোস্টে শিকারের ছবি, নাম-ঠিকানা সব আসত। আর সুপারির অ্যাডভান্সের টাকাটা আমার আড্ডার পাশের ভাঙা বাড়িটাতে রোকড়ায় রেখে গিয়েছিল। আমি তুলে নিয়েছি।’

অধিরাজ বুঝতে পারল যে যে লোক সুপারি দিয়েছে সে যথেষ্টই সতর্ক। এমনভাবে টাকা দিয়েছে যে ট্র্যাক করা প্রায় অসম্ভব। হয়তো ফোন নম্বরগুলোও নকল। তবুও একটা চান্স নিয়ে দেখা যেতে পারে।

‘এরপর কার নম্বর? কাকে খুন করার কথা ছিল?’

‘জানি না।’কালু হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, ‘প্রথম দফায় ও তিনজনেরই ছবি আর নাম ঠিকানা পাঠিয়েছিল। পরের দফায় হয়তো বাকি চারজনের ছবি আর নাম পাঠাত। কিন্তু তার আগেই আপনারা আমায় ধরে ফেললেন।’

অধিরাজ জোরালো শ্বাস টানে। কালুর গ্রেফতার হওয়ার খবরটা অলরেডি মিডিয়ায় ছড়িয়ে গিয়েছে। যে সুপারি দিয়েছিল, সে-ও নিশ্চয়ই জানে। এখন আর বাকি চারজনের ডিটেলস পাওয়ার উপায় নেই! সে কালুকে ছেড়ে দিয়ে পবিত্র-র দিকে তাকায়। শান্তস্বরে বলে, ‘তুমি ওর ফোন থেকে নম্বরগুলো নিয়ে খোঁজ লাগাও যে ওগুলো কার নম্বর’।

‘পাবেন না স্যার’। কালু নির্লিপ্ত মুখে বলে, ‘আমিও চেষ্টা করেছিলাম। সুপারি দেনেওয়ালার ঘাঁৎঘোতের খবর আমরা রাখি। কিন্তু এ পাবলিক মহা চালু। সবকটাই প্রি-পেইড সিম। তাও বেনামে!

‘এ শালা তো সায়েন্টিস্ট দেখছি। আমরা কিছু করার আগেই সব আবিষ্কার করে বসে আছে!’ অগ্নিদৃষ্টিতে কালুর দিকে তাকাল অধিরাজ। পরক্ষণেই এক পেল্লায় থাপ্পড় মেরে বলল, ‘তোর কাছ থেকে অ্যাডভাইস চেয়েছি? হ্যাঁ?’

কিন্তু কালু যা বলেছিল, তা-ই সত্যি বলে প্রমাণিত হল! মিস আত্রেয়ী দত্ত, নতুন লেডি অফিসার কৌশানী বোস এবং পবিত্র নম্বরগুলোর ব্যাপারে খোঁজখবর করতে গিয়েছিল। তারা ফিরে এসে জানাল যে নম্বরগুলো প্রত্যেকটা প্রি-পেইড! কোনোটা থেকেই একটার বেশি কল করা হয়নি। আর সবগুলোই বেনামে কেনা হয়েছে। একটু খোঁজখবর করতেই জানা গেল যে যাদের নামধাম দেওয়া হয়েছে তারা কেউ পশ্চিমবঙ্গে থাকেই না! প্রত্যেকেই অবাঙালি এবং ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে থাকে। এদের মধ্যে দু একজন সম্প্রতি করোনায় মারাও গিয়েছে। বাকি যারা আছে, মৃতদের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্কই নেই। এমনকি যে একাধিক ব্যক্তির ডকুমেন্টস আছে, তারা পরস্পরকে চেনেও না!

‘ব্যস! ফের ডেড এন্ড!’ পবিত্র হতাশভাবে বলে, ‘এটা স্রেফ ওয়াইল্ড গুজ চেজিং হচ্ছে রাজা! এই কোভিডের মধ্যে অনেকেই হার্টফেল করে মারা যাচ্ছে বা হতাশায় সুইসাইড করছে। এক্ষেত্রেও নির্ঘাৎ তাই হয়েছে, আর আমরা ভেবে মরছি।’

‘তোমার ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগছে না?’ অধিরাজ আস্তে আস্তে বলল, ‘যে লোকগুলোর সুপারি দেওয়া হল, একে একে তারাই মরতে শুরু করল! কেন? এখন আবার বলে বোসো না যে সুপারিওয়ালার পয়সা বাঁচানোর জন্য লোকগুলো দয়া করে নিজে নিজেই মরেছে! অত দয়ার শরীর এ যুগে কারোর নেই!’

মিস আত্রেয়ী দত্ত ফিক্ করে হেসে ফেলে। নতুন অফিসার কৌশানীর মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই যে মনের মধ্যে কী হচ্ছে। পবিত্র একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘কো-ইনসিডেন্সও হতে পারে।’

মৃদু হাসল সে, ‘তাহলে বলতে হবে আশ্চর্য কো-ইনসিডেন্স! আমি যতদূর জানি সৌমিত্র চৌধুরী সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, এইমাত্র মিসেস মিত্র জানালেন যে উৎপল মিত্রও সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। মৃন্ময় দত্তরায়ের পেশা কী ছিল?’

‘সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।’ কথাটা বলেই চোখ বড়বড় করে ফেলেছে পবিত্র, ‘মা–ই গু-ড-নে-স!’

‘তাহলেই বোঝো! শুধু কো-ইনসিডেন্স নয়, একেবারে কো-ইনসিডেন্সের বাপ ঠাকুর্দা চোদ্দপুরুষ চলে এসেছে।’ অধিরাজ একটু চিন্তিতভাবে বলে,’কেউ বেছে বেছে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের সুপারিই বা দেবে কেন? শুধু তাই নয়, প্রত্যেকেরই বয়েস চল্লিশ! উৎপল মিত্র এবং সৌমিত্র চৌধুরীর বয়স চল্লিশ। মৃন্ময় দত্তরায়েরও সম্ভবত তাই।’

‘এরা সবাই এক এজ গ্রুপের, আর শিক্ষাগত যোগ্যতাও এক।’ মিস আত্রেয়ী দত্ত আস্তে আস্তে বলে, ‘লিঙ্ক থাকা অসম্ভব নয়। বন্ধু হতে পারে।’

‘শুধু বন্ধু কেন, শত্রুও হতে পারে।’ অধিরাজ বলল, ‘আমি খুব আশ্চর্য হব না যদি এরা সহপাঠীও হয়!’

‘ক্লাসমেট?’

কৌশানী কৌতূহলী স্বরে জানতে চায়। সে মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ। চান্স আছে। বিশেষ করে প্রত্যেকেই যখন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর স্টুডেন্ট।’

‘আপনার কী মনে হয় স্যার? খুন?’

অধিরাজ একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। এবার ভাসা ভাসা চোখ তুলে তাকাল কৌশানীর দিকে, ‘মিস…!’

সর্বনাশ! এই ‘মিস কী যেন’র ফাঁড়া আবার এসে পড়েছে। অধিরাজ ফায়ার করার আগেই পেছন থেকে ট্রিগার টেনে ধরল অর্ণব, ‘মিস বোস।’

‘ইয়েস… ইয়েস!’ অধিরাজ সামলে নেয়, ‘এখন বলা খুব মুশকিল। কিন্তু কিছু গোলমাল তো আছেই। এমন কিছু আছে যা চোখে পড়ছে না। এমন কোনও মিসিং লিঙ্ক যা সবগুলো ডেথকে কানেক্ট করে। যতক্ষণ না আমার প্রশ্নের জবাব পাচ্ছি, ততক্ষণ কিছু বলা মুশকিল। কিন্তু আমার গাট ফিলিংস বলছে এই সবে শুরু…

‘কীসের শুরু?’ পবিত্র বিস্মিতভাবে প্রশ্ন করে, ‘তুমি বলছ আরও লোক মরবে?’

‘আমি বলছি না। ইনফ্যাক্ট বলতে চাইছি না। কিন্তু হাই চান্স আছে আরও চারটে লোকের শিয়রে শমন ঘনিয়ে আসার! অথচ আমরা এখনও কিছুই জানি না!’ অধিরাজ অসহায়ভঙ্গিতে বলে, ‘কী করব, কোনদিকে যাব ভেবেই পাচ্ছি না!

‘কিন্তু কালু তো আমাদের হেফাজতে।’ অর্ণব খুব মৃদুস্বরে বলল, ‘ও তো আর কিছু করতে পারবে না।’

‘কালু ফ্যাক্টরই নয় অর্ণব।’ সে আত্মমগ্নভাবে বিড়বিড় করে, ‘কালু ওদের ছোঁয়ার সুযোগই পায়নি। সাতজনের সুপারি দেওয়া হল। তার মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হল! কিন্তু কালু কাউকেই মারেনি। দু-জন হার্ট ফেল করে মরল। একজন সতেরোতলা থেকে ঝাঁপ মারল! কীভাবে! বাকিরা কারা! এরা প্রত্যেকেই একই এজ গ্রুপের, একই শিক্ষাগত যোগ্যতার! বন্ধু না শত্রু? কেউ কতগুলো নিরীহ মানুষের সুপারি কেন দেবে? তাও একসঙ্গে সাতজনের! ওষুধের ফয়েলটার গল্প কী? উৎপল মিত্র মৃত্যুর আগে কার দিকে ইশারা করেছিলেন? ফরেনসিক বলেছে, ওপরে আরও একজন থাকার সম্ভাবনা প্রবল। সে গেল কোথায়? কোনও প্রশ্নেরই উত্তর নেই আমাদের কাছে!’

‘তবে?’

পবিত্র-র প্রশ্নের উত্তরে অন্যমনস্ক চোখে তাকিয়ে বলল অধিরাজ, ‘খোঁজ লাগাও পবিত্র। তুমি আর মিস বোস, অর্ণব আর মিস দত্ত দুটো টিমে ভাগ হয়ে খোঁজখবর শুরু করো। এদের জিওগ্রাফি, হিস্ট্রি, সব খুঁজে বের করো। অতীত, বর্তমান সব জানতে চাই আমি। মর্গের দায়িত্বে যে লোকটা থাকত, বনোয়ারিলাল, ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করো। নার্সিংহোমের টেকনিশিয়ানদের জেরা করো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাকি চারজনের খোঁজ লাগাতেই হবে পবিত্র। মৃতদের বাড়ির লোকদেরও ছাড়বে না। কে বলতে পারে, হয়তো ওদের প্রাণও বিপন্ন। কারণ বাকি চারজন কারা আমরা এখনও জানি না। তাদের ভাগ্য এখন আমাদের হাতে

‘ওকে।’

ওরা আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে গেল। অধিরাজ চিন্তিত দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকায়। আকাশে তখন ঘন মেঘ জমেছে। থরেথরে কালো মেঘ পুঞ্জীভূত হয়ে ধরেছে এক ভয়ানক রূপ। ঈশান কোণে বারবার ঝলসে উঠছে বিদ্যুৎ!

সম্ভবত কোনও দুর্যোগ আসার পূর্বাভাস!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *