২০. হেডেস্টাডে ফিরে

অধ্যায় ২০

মঙ্গলবার, জুলাই ১- বুধবার, জুলাই ২

হেডেস্টাডে ফিরে প্রথম যে কাজটি ব্লমকোভিস্ট করলো সেটা হলো ফ্রোডির বাড়ি গিয়ে জানতে চাইলো ভ্যাঙ্গারের শরীর এখন কেমন আছে। বৃদ্ধলোকটি যে বেশ উন্নতি করছে শুনে খুব ভালো লাগলো তার। এখনও বেশ দূর্বল আছে তবে বিছানায় উঠে বসতে পারে। তার অবস্থাকে আর ক্রিটিক্যাল বলা হচ্ছে না।

“ঈশ্বরকে ধন্যবাদ,” বললো সে। “আমি বুঝতে পারছি লোকটাকে আমি পছন্দ করতে শুরু করেছি।”

ফ্রোডি বললো : “আমি সেটা জানি। হেনরিকও আপনাকে বেশ পছন্দ করে। নরল্যান্ডের কি খবর?”

“সফল হলেও সন্তোষজনক বলা যাবে না। সেটা আমি পরে ব্যাখ্যা করছি, এখন আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে।”

“বলুন।”

“হেনরিক যদি মারা যায় তাহলে মিলেনিয়াম-এর ব্যাপারে আপনার সত্যিকারের আগ্রহটা কি হবে?”

“কিছুই হবে না। তার জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হবে মার্টিন।”

“আমি যদি হ্যারিয়েটের ঘটনার উপর তদন্ত করা বন্ধ না করি তাহলে কি মার্টিন মিলেনিয়াম-এ কোনো সমস্যা তৈরি করতে পারে বলে সম্ভাবনা আছে?”

তার দিকে চোখ কুচকে তাকালো ফ্রোডি।

“কি হয়েছে?”

“তেমন কিছু না, আসলে।” এর আগে মার্টিনের সাথে তার কি কথা হয়েছে সেটা বিস্তারিত বললো ফ্রোডিকে। “নরসিও’তে যখন ছিলাম তখন এরিকার সাথে আমার কথা হয়েছে। মার্টিন নাকি তাকে বলেছে এই মুহূর্তে আমার মিলেনিয়াম-এ ফিরে যাওয়াটা খুব প্রয়োজন।”

“বুঝতে পেরেছি। আমার ধারণা এর পেছনে সিসিলিয়া আছে। তবে আমার মনে হয় না এ নিয়ে মার্টিন আপনার উপর কোনো রকম চাপ সৃষ্টি করবে। তার কাণ্ডজ্ঞান বেশ ভালো। আরেকটা কথা মনে রাখবেন, মিলেনিয়াম-এর বোর্ডে কিন্তু আমিও আছি।”

“কিন্তু পরিস্থিতি যদি কঠিন হয়ে ওঠে তখন আপনি কি করবেন?”

“আমাদের মধ্যে চুক্তি আছে সে অনুযায়ীই কাজ হবে। চুক্তিটাকে আমি সম্মান করবো। আমি কাজ করি হেনরিকের পক্ষ হয়ে। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে হেনরিক আর আমি ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে আছি। হেনরিক যদি মারা যায় তাহলে সত্যি বলতে কি হেনরিকের শেয়ারের মালিক মার্টিন হবে না, হবো আমি। মিলেনিয়াম’কে তিন বছর ধরে ব্যাকআপ দেবার চুক্তি হয়েছে আমাদের সাথে। মার্টিন যদি উল্টাপাল্টা কিছু করেও আমার ধারণা সেরকম কিছু সে করবে না-সেটা বড়জোর ছোটোখাটো কয়েকটা বিজ্ঞাপন হারানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।”

“মিলেনিয়াম-এর লাইফব্লাড টিকে থাকবে।

“হ্যা। তবে ব্যাপারটা এভাবে দেখুন-এসব ব্যাপার নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়াটা সময়ের অপচয় করা ছাড়া আর কিছু না। বর্তমানে মার্টিন তাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকা নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছে, দিনে তাকে চৌদ্দ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। অন্য কিছু নিয়ে ভাবার মতো সময় তার নেই।”

“আমি কি একটা প্রশ্ন করতে পারি-জানি এটা আমার ব্যাপার নয়-কর্পোরেশনের বর্তমান অবস্থা কেমন?

ফ্রোডির মুখটা তিক্ততায় ভরে উঠলো।

“অনেক সমস্যা আছে আমাদের।”

“হ্যা, সেটা আমার মতো ছোটোখাটো ফিনান্সিয়াল রিপোর্টারও দেখতে পাচ্ছে। আমি আসলে জানতে চাচ্ছি কতোটা সিরিয়াস?”

“অফ দ্য রেকর্ড?”

“শুধুমাত্র আমাদের দু’জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।”

“বিগত কয়েক সপ্তাহে ইলেক্ট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রিজের বড় বড় দুটি অর্ডার হারিয়েছি আমরা। সেইসাথে রাশিয়ার মার্কেট থেকে প্রায় বিতারিত হয়েছি বলতে পারেন। সেপ্টেম্বরে আমাদেরকে ১৬০০ শ্রমিক ছাটাই করতে হবে। যারা এইসব কোম্পানির হয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছে তাদের জন্যে খুবই বড় একটা দুঃসংবাদ। যখনই আমরা কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করি তখনই আমাদের মনোবল আরো কমে আসতে থাকে।”

“মার্টিন বেশ চাপের মধ্যে আছে।”

“বিরাট একটি বোঝা কাঁধে নিয়ে পিচ্ছিল পথে হাটছে সে।”

.

ব্লমকোভিস্ট নিজের কটেজে ফিরে গিয়ে বার্গারকে ফোন করলো। কিন্তু সে অফিসে নেই তাই কথা বললো মামের সাথে।

“শোনো : আমি যখন নরসিও’তে ছিলাম এরিকা তখন আমায় ফোন করেছিলো। মার্টিন ভ্যাঙ্গার তাকে বলেছে আমি যেনো এডিটোরিয়ালের দায়িত্বে ফিরে আসি।”

“আমিও সেরকমই ভাবি,” বললো মাম।

“জানি। কিন্তু ঘটনা হলো হেনরিকের সাথে আমার চুক্তি আছে। সেটা আমি ভঙ্গ করতে পারবো না। আর মার্টিন চাইছে আমি এখান থেকে আমার কাজ বাদ দিয়ে শহরে চলে আসি। সুতরাং তার প্রস্তাবের পেছনে আসল উদ্দেশ্য হলো আমাকে এখান থেকে বিতারিত করা।”

“বুঝেছি।”

“এরিকাকে আমার হাই জানিও, আর বোলো আমি আমার কাজ শেষ করে স্টকহোমে ফিরে আসছি। এর আগে নয়।”

“ঠিক আছে। তুমি বেশ ক্ষেপে গেছো বুঝতে পারছি। তাকে আমি মেসেজটা পৌছে দেবো।”

“ক্রাইস্টার। এখানে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। এসব ফেলে পিছু হটার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।”

.

মার্টিন ভ্যাঙ্গারের দরজায় নক করলো ব্লমকোভিস্ট। দরজা খুলে হেসে তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালো ইভা হাসেল।

“হাই। মার্টিন কি বাড়িতে আছে?”

জবাব দেবার আগেই হাতে একটা বৃফকেস নিয়ে হাজির হলো মার্টিন। ইভার গালে চুমু খেয়ে মিকাইলকে হ্যালো বললো সে।

“আমি অফিসে যাচ্ছি। আপনি কি আমার সাথে কথা বলতে চান?

“আপনার যদি বেশি তাড়া থাকে তাহলে পরে বললেও হবে।”

“বলুন। সমস্যা নেই।”

‘হেনরিক আমাকে যে অ্যাসাইনমেন্টটা দিয়েছে সেটা শেষ না করে আমি মিলেনিয়াম-এর এডিটোরিয়াল বোর্ডে ফিরে যাচ্ছি না। এটা আপনাকে জানিয়ে রাখছি এইজন্যে যে, নতুন বছরের আগে আমাকে বোর্ডে আশা করাটা ঠিক হবে না।”

মার্টিন ভ্যাঙ্গার একটু ভাবলো।

“আচ্ছা। আপনি ভাবছেন আমি আপনাকে এখান থেকে সরিয়ে দিতে চাচ্ছি।” আবারো থামলো সে। “মিকাইল, এ নিয়ে আমরা পরে কথা বলবো। মিলেনিয়াম বোর্ডের শৌখিন কাজকারবার নিয়ে কথা বলার মতো সময় এখন আমার হাতে নেই। হেনরিকের এই প্রস্তাবটায় রাজি না হলেই আমার জন্য ভালো হতো। কিন্তু বিশ্বাস করুন-মিলেনিয়াম যাতে টিকে থাকতে পারে সেজন্যে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করে যাবো।“

“এ ব্যাপারে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই,” বললো ব্লমকোভিস্ট।

“পরের সপ্তাহে যদি সময় হয় আমরা এ নিয়ে কথা বলবো। ফিনান্সের ব্যাপারে তখন আমি আমার দৃষ্টিভঙ্গীর কথা জানাবো আপনাকে। তবে আমার অভিমত হলো মিলেনিয়াম-এর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ একজন লোক এখানে বসে বসে ফালতু সব বিষয় নিয়ে সময় নষ্ট করবে সেটা পত্রিকার জন্যেই ভালো হবে না। পত্রিকাটা আমি ভীষণ পছন্দ করি। আমার মনে হয় এটাকে আরো শক্তিশালী করা সম্ভব। তবে এ কাজের জন্য আপনাকে দরকার। এখানে আমি মারাত্মক দোটানায় পড়ে গেছি। হয় হেনরিকের ইচ্ছেকে সম্মান দিতে হবে নয়তো মিলেনিয়াম বোর্ডে নিজের দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে আমাকে।”

.

ব্লমকোভিস্ট ট্র্যাকসুট পরে দূর্গটা অতিক্রম করে গটফ্রিডের কেবিন হয়ে আবার ফিরে এলো নিজের বাড়িতে। গার্ডেন টেবিলে বসে আছে ফ্রোডি। মিকাইল তোয়ালে দিয়ে ঘাম মুছে এক বোতল পানি খেয়ে নিলো। চুপচাপ দেখে গেলো ফ্রোডি। কিছু বললো না সে।

“এই গরমে এটা তো স্বাস্থকর কোনো কাজ বলে মনে হচ্ছে না।

“কি যে বলেন না,” বললো ব্লমকোভিস্ট।

“আমার ধারণা ভুল ছিলো। সিসিলিয়া আসলে মার্টিনকে চাপ দেয় নি। এটা করেছে ইসাবেলা। সে চাচ্ছে যেভাবেই হোক আপনাকে এখান থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে। তার সাথে হাত মিলিয়েছে বার্জার।”

“ইসাবেলা?”

“মহিলা খুবই বাজে স্বভাবের। কোনো লোকজনকেই সে পছন্দ করে না। মনে হচ্ছে এ মুহূর্তে সে আপনাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করছে। এখানে সেখানে বলে বেড়াচ্ছে আপনি একজন ধূর্ত লোক, হেনরিককে পটিয়ে-পাটিয়ে এ কাজটা বাগিয়ে নিয়েছেন। আপনি তাকে এতোটাই আপসেট করেছেন যে তার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে।”

“আশা করি তার গল্পটা কেউ বিশ্বাস করে না।”

“জঘন্য গুজব বিশ্বাস করার মতো লোক সব সময়ই থাকে।

“আমি চেষ্টা করছি তার মেয়ের কি হয়েছিলো সেটা খুঁজে বের করতে-আর সে কিনা আমাকে ঘৃণা করছে। হ্যারিয়েট যদি আমার মেয়ে হতো তাহলে আমি এরকম করতাম না।”

.

দুপুর ২টার দিকে তার মোবাইল ফোনে রিং হলো।

“হ্যালো, আমার নাম কনি টরসন। হেডেস্টাড কুরিয়ার-এ কাজ করি আমি। আপনার হাতে কি সময় আছে, কয়েকটা প্রশ্ন করতাম? বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি আপনি এখন হেডেবি’তে আছেন।”

“হের টরসন, আপনার বিশ্বস্ত সূত্র নামক যন্ত্রটি একেবারে ধীরগতির। এ বছরের শুরু থেকেই আমি এখানে আছি।”

“আমি সেটা জানতাম না। আপনি হেডেস্টাডে কি করছেন?”

“লেখালেখি করছি। সেইসাথে এক রকম ছুটি কাটাচ্ছি বলতে পারেন।”

“কি নিয়ে লিখছেন?”

“ওটা যখন প্রকাশ হবে তখন দেখতে পাবেন।”

“আপনি তো কয়েক দিন আগে জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন…”

“হ্যা, তো?”

“যেসব সাংবাদিক ভুয়া তথ্য উপস্থাপন করে তাদের ব্যাপারে আপনার মতামত কি?”

“তারা গর্দভ।”

“তাহলে আপনার মতে আপনি নিজে একজন গর্দভ?”

“আমি কেন সেটা ভাবতে যাবো? আমি তো কখনও ভুয়া তথ্য উপস্থাপন করি নি।”

“আপনাকে তো মানহানি করার জন্য সাজা দেয়া হয়েছে।”

“তো?”

টরসন দ্বিধায় পড়ে গেলে ব্লমকোভিস্টই বলতে শুরু করলো।

“আমি মানহানির জন্য সাজা পেয়েছি, ভুল তথ্যের কারণে নয়।”

“কিন্তু আপনি তো সেটা প্রকাশ করেছিলেন।”

“আপনি যদি আমার বিরুদ্ধে দেয়া রায়টা নিয়ে আলোচনা করার জন্য ফোন

করে থাকেন তাহলে বলছি এ ব্যাপারে আমার কোনো মন্তব্য নেই।”

“আমি আপনার একটা ইন্টারভিউ নেবার জন্য আসতে চাচ্ছিলাম।”

“এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।”

“তাহলে আপনি মামলার ব্যাপারে কোনো আলোচনা করতে চাচ্ছেন না?”

“ঠিক,” কথাটা বলেই ফোনটা রেখে দিলো সে। কম্পিউটারে ফিরে যাবার আগে অনেকক্ষণ বসে থেকে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলো।

.

যে ইন্সট্রাকশন সে পেয়েছে সে অনুয়ায়ী নিজের কাওয়াসাকি বাইকটা নিয়ে ছুটছে সালান্ডার। হেডেবি আইল্যান্ডের বৃজটা পার হয়ে বাম দিকের প্রথম বাড়িটার কাছে এসে থামলো সে। অনেক দূর চলে এসেছে। তবে তার নিয়োগকর্তা যদি সব কিছুর ব্যয়ভার বহন করতে রাজি থাকে তাহলে সে উত্তর-মেরু পর্যন্ত যেতেও প্রস্তত আছে। তাছাড়া বাইকটার নতুন ইঞ্জিন লাগানোর পর লম্বা একটি পথ পাড়ি দেবার দরকার ছিলো। বাইকটা স্ট্যান্ডে রেখে ডাফেল ব্যাগের স্ট্র্যাপটা আলগা করে নিলো সে।

দরজা খুলে তার দিকে হাত নাড়লো ব্লমকোভিস্ট। বাড়ির বাইরে পা রেখে তার মোটরবাইকের দিকে চেয়ে রইলো বিস্ময়ে।

শিষ বাজালো সে। “তুমি বাইক চালাও!”

সালান্ডার কিছু বললো না তবে ব্লমকোভিস্ট যখন তার বাইকের হ্যান্ডেলবার আর এক্সেলেটর পরখ করে দেখতে লাগলো ভুরু কুচকে সেদিকে তাকিয়ে রইলো সে। তার জিনিস কেউ ধরুক এটা তার মোটেও পছন্দ নয়। এরপরই মিকাইলের ছেলেমানুষীসুলভ হাসি দেখতে পেলো। বেশিরভাগ বাইক চালানো লোকজন তার হালকা বাইক দেখে তাচ্ছিলভরে হেসে থাকে।

“আমার বয়স যখন ঊনিশ তখন একটা বাইক চালাতাম,” বললো মিকাইল। “এখানে আসার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। ভেতরে আসো।”

নিলসনের কাছ থেকে একটা ক্যাম্পবেড ধার করেছে সে। বাড়িটার আশেপাশে একটু ঘুরে এসে সালন্ডারকে মনে হলো স্বস্তিবোধ করছে। বিপজ্জনক কোনো ফাঁদের চিহ্ন তার চোখে পড়ে নি। ব্লমকোভিস্ট তাকে দেখিয়ে দিলো বাথরুমটা কোথায়।

“যদি শাওয়ার নিতে কিংবা ফ্রেশ হতে চাও তাহলে ব্যবহার করতে পারো।”

“আমাকে পোশাক পাল্টাতে হবে। চামড়ার জ্যাকেট পরে আমি এখানে ঘুরে বেড়াতে চাই না।”

“ঠিক আছে, তুমি পোশাক পাল্টাতে থাকো এই ফাঁকে আমি ডিনার তৈরি করি।”

সালন্ডার যখন গোসল করে পোশাক পাল্টে বাইরে এলো দেখতে পেলো সেখানে টেবিলে খাবার সাজিয়ে বসে আছে ব্লমকোভিস্ট। খালি পা, কালো রঙের কামিসল, শর্ট আর ছেঁড়াফাড়া জিন্স প্যান্ট পরেছে সে। খাবারের গন্ধটা তার বেশ ভালো লাগলো। তার পিঠে টাটুগুলো দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো ব্লমকোভিস্ট।

“পাঁচ যোগ দিন,” বললো সালান্ডার। “আপনার হ্যারিয়েটের তালিকা থেকে পাঁচটি কেস আর আমার নিজের কাছে মনে হয়েছে এই তালিকায় থাকতে পারে সেরকম তিনটি।”

“আমাকে বলো।”

“আমি মাত্র এগারো দিন ধরে এ কাজে নেমেছি। সব রিপোর্ট খতিয়ে দেখার সুযোগ এখনও পাই নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ রিপোর্টগুলো ন্যাশনাল আর্কাইভে দিয়ে দেয়া হয়েছে। বাকিগুলো এখনও স্থানীয় পুলিশের কাছেই আছে। তিন দিন ব্যয় করেছি কিছু পুলিশ দপ্তরে গিয়ে, তবে সবগুলোতে যেতে পারে নি। পাঁচটা চিহ্নিত করা হয়েছে।”

রান্নাঘরের টেবিলে সালান্ডার ৫০০ পৃষ্ঠার একটি বান্ডিল রেখে খুব দ্রুত সেই কাগজগুলোকে আলাদা আলাদা ভাগে ভাগ ক’রে রাখলো সে।

“এগুলোকে সময় অনুযায়ী সাজালে এরকম হয়।” ব্লমকোভিস্টকে একটি তালিকা দিলো সালান্ডার।

১৯৪৯-রেবেকা জ্যাকবসন, হেডেস্টাড (৩০১১২)

১৯৫৪-মেরি হোমবার্গ, কালমার (৩২০১৮)

১৯৫৭-রাকেল লুন্ডি, ল্যান্ডসক্রোনা (৩২০২৭)

১৯৬০-(মাগদা) লোভিশা সিওবার্গ, কার্লস্টাড (৩২০১৬)

১৯৬০-লিভ গুস্তাভসন, স্টকহোম (৩২০১৬)

১৯৬২-লিয়া পারসন, উদেভাল্লা (৩১২০৮)

১৯৬৪-সারা উইট, রোনিবি (৩২১০৯)

১৯৬৬-লেনা এন্ডারসন, উপসালা (৩০১১ 2 )

“এই সিরিজে প্রথম কেসটি হলো রেবেকা জ্যাকবসনের, ১৯৪৯ সালে সংঘটিত হয়েছিলো সেটা। এ ব্যাপারে বিস্তারিত সব আপনি আগেই জেনেছেন। পরের যে কেসটি আমি খুঁজে পেয়েছি সেটা হলো মেরি হোমবার্গের, কালমারের বত্রিশ বছর বয়সী এক পতিতার। ১৯৫৪ সালের অক্টোবরে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে সে খুন হয়। ঠিক কখন খুন হয়েছিলো সেটা অবশ্য নিশ্চিত করে জানা যায় নি সম্ভবত আট-দশদিন পর তার লাশটা পাওয়া যায়।“

“এর সাথে হ্যারিয়েটের তালিকার সম্পর্ক কিভাবে করলে?”

“তার হাত-পা বাধা ছিলো, বিভৎসভাবে হত্যা করা হয়েছে। শ্বাসরোধে মারা হয়েছে বলে জানা যায়। তার গলার ভেতর থেকে স্যানিটারি তোয়ালে পাওয়া গেছে।”

লেভিটিকাস ২০:১৮-এর পংক্তিটির দিকে মুখ তুলে তাকানোর আগে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইলো ব্লমকোভিস্ট।

“কোনো পুরুষ যদি কোনো নারীর ঋতুস্রাব চলাকালীন সময় তার সাথে যৌনকর্ম করে তাহলে উভয়কেই তাদের নিজেদের লোকজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে। সে পাপ করেছে কারণ সেই পুরুষ মহিলার রক্তের উৎসকে উন্মোচিত করেছে; আর সেই মহিলা তার রক্তের উৎসকে করেছে অনাবৃত।”

সালান্ডার মাথা নেড়ে সায় দিলো।

“হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গার ঠিক একই কানেকশান তৈরি করেছে। ঠিক আছে। পরেরটা কি?”

“১৯৫৭ সালের মে মাসে, পাঁচচল্লিশ বছর বয়স্ক রাকেল লুন্ডি। মহিলা পস্কিারপরিচ্ছন্নতার কাজ করতো। গ্রামে বেশ সুখি জীবনযাপন করতো সে। শৌখিন ভবিষ্যতদ্রষ্টা ছিলো লুন্ডি। টারোট কার্ড পড়তে পারতো। হাত দেখার কাজ, এইসব আর কি। ল্যান্ডসক্রোনারের এক নিরিবিলি এলাকায় বসবাস করতো, বাড়ির খুব আশেপাশে অন্য কারোর বাড়ি ছিলো না। সকালবেলায় তাকে হত্যা করা হয়। বাড়ির পেছনে বাগানে তাকে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় লন্ড্রি- ড্রাইং ফ্রেমের সাথে বাধা অবস্থায় পাওয়া যায়। মুখ টেপ দিয়ে বাধা ছিলো। অনেকগুলো ভারি পাথর নিক্ষেপ করে তাকে হত্যা করা হয়। শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।”

“হায় জিশু। লিসবেথ, এটা তো একেবারে জঘন্য।”

“আরো বেশি জঘন্য ব্যাপার আছে। আর.এল আদ্যাক্ষরটি সঠিক-আপনি বাইবেলের উদ্ধৃতিটা দেখেছেন?”

“একেবারে পরিস্কার। যদি কোনো পুরুষ কিংবা স্ত্রীলোক ডাইনী কিংবা মায়াবি হয়ে থাকে তাদেরকে অবশ্যই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে হবে। লোকজন তাদেরকে পাথর ছুড়ে হত্যা করবে। তারাই তাদের মৃত্যুর জন্য দায়ি।”

এবার রানমোর অদূরে কার্লস্টাডের সিওবার্গ। হ্যারিয়েটের তালিকায় সে মাগদা নামে আছে। তার পুরো নাম মাগদা লোভিশ। তবে লোকে তাকে লোভিশা নামেই ডাকতো।”

তার পৈশাচিক হত্যার বিবরণ শুনে গেলো ব্লমকোভিস্ট। তারপর মেয়েটা একটা সিগারেট ধরালে সেও একটা চাইলো। সালান্ডার প্যাকেটটা ঠেলে দিলো তার দিকে।

“তাহলে খুনি পশুপাখিও হত্যা করেছে?”

“লেভিটিকাসের পংক্তি বলছে কোনো স্ত্রীলোক যদি প্রাণীর সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয় তাহলে তাদের দু’জনকেই হত্যা করতে হবে।”

“এই মহিলার বেলায় গরুর সঙ্গে যৌনকর্ম করার সম্ভাবনা আছে…অবশ্য সেটা নিশ্চিত করে জানা যায় নি।”

“পংক্তিটি আক্ষরিক অর্থে পড়া যেতে পারে। একজন কৃষকের স্ত্রী হিসেবে প্রতিদিনই তাকে গরুর কাছে যেতে হতো।”

“বুঝতে পেরেছি।”

“হ্যারিয়েটের তালিকায় পরের কেসটা হলো সারা। আমি তাকে সারা উইট হিসেবে চিহ্নিত করেছি। বয়স সাইত্রিশ, রোনিবি’তে বসবাস করতো। ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে খুন হয় সে’। নিজের বিছানায় হাত-পা বাধা অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে। যৌননির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে এক্সিফিজিয়েশনের কারণে। অর্থাৎ তার শ্বাসরোধ করা হয়েছে। খুনি তাকেসহ পুরো বাড়িটা আগুনে পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করেছিলো। তবে আগুন বেশিদূর ছড়াতে পারে নি, ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন দ্রুত এসে পড়েছিলো।”

“কানেকশানটা কি?”

“এটা শোনেন। সারা উইট একজন যাজকের মেয়ে ছিলো, আবার তার বিয়েও হয়েছিলো একজন যাজকের সাথে। হত্যাকাণ্ডের সময় তার স্বামী ছিলো বাইরে।”

“কোনো যাজকের কন্যা বেশ্যাগিরি করার মাধ্যমে নিজেকে অপবিত্র করলে সে তার পিতার লজ্জার কারণ হয় সুতরাং তাকে অবশ্যই আগুনে দগ্ধ হতে হবে।”

“আমি আরো তিনজন মহলিাকে খুঁজে পেয়েছি যারা একইভাবে খুন হয়েছে। তারাও হ্যারিয়েটের তালিকার সাথে খাপ খেয়ে যেতে পারে। প্রথমজন হলো লিভ গুস্তাভসন নামের এক তরুণী। বাইশ বছর বয়সী এই মেয়ে বসবাস করতো ফারস্টায়। ঘোড়াপ্রেমী ছিলো মেয়েটি-প্রতিযোগীতায়ও অংশ নিতো। খুব প্রতিভাবান ছিলো। বোনের সাথে একটা পোষাপ্রাণীর দোকান চালাতো। বোন চলে যাবার পর একা একা হিসেব করছিলো তখনই আক্রান্ত হয় ব’লে অনুমাণ করা হয়। খুনিকে সে নিজেই তার দোকানে ঢুকতে দিয়েছিলো। তাকে ধর্ষণ করে শ্বাসরোধ করা হয়

“এটা তো হ্যারিয়েটের তালিকার সাথে খাপ খাবে ব’লে মনে হচ্ছে না?”

“তা ঠিক, তবে একটা জিনিস যদি না থাকতো। খুনি তার বর্বরতা শেষ করেছে মেয়েটার যৌনাঙ্গের ভেতর টিয়াপাখি ঢুকিয়ে দোকানের সবগুলো প্রাণী খাঁচা থেকে বের করে দিয়ে বেড়াল, কচ্ছপ, বিলেতি ইঁদুর, খোরগোশ, পাখি এসব আর কি। এমনকি অ্যাকুরিয়ামের মাছগুলো পর্যন্ত। সুতরাং তার বোন যখন পরদিন সকালে দোকানে ফিরে আসে তখন ভয়ঙ্কর একটি দৃশ্য দেখতে পায়।”

ব্লমকোভিস্ট নোটে টুকে নিলো।

“১৯৬০ সালের আগস্টে খুন হয় সে, কার্লস্টাডের মাগদা লোভিশার হত্যাকাণ্ডের চারমাস পর। উভয় ক্ষেত্রেই মহিলা দু’জন প্রাণীদের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলো এবং তাদের হত্যার সাথে সাথে প্রাণী হত্যাও করা হয়। কার্লস্টাডের গরুটা হয়তো বেঁচে গিয়েছিলো ভালো মতো ছুরিকাঘাত না করার কারণে। আসলে সামান্য একটা ছুরি দিয়ে এক আঘাতে কোনো গরু হত্যা করা সহজ কাজ নয়। সেক্ষেত্রে টিয়াপখি অনেকটাই সহজ। তাছাড়া এখানে আরো কিছু প্রাণী হত্যা করা হয়েছিলো।”

“কি?”

সালান্ডার লিয়া পারসনের ‘কবুতর হত্যার’ ঘটনাটি জানালো তাকে। ব্লমকোভিস্ট কথাটা শুনে এতো দীর্ঘ সময় ধরে চুপ মেরে বসে রইলো যে সালান্ডার অনেকটাই অধৈর্য হয়ে উঠলো।

“আমি তোমার তত্ত্বটা মেনে নিচ্ছি,” অবশেষে বললো সে। “আরেকটা কেস বাকি আছে।’

“এই কেসটা আমি ঘটনাচক্রে আবিষ্কার করেছি। আমি জানি না কতোগুলো আমার চোখ এড়িয়ে গেছে।”

“এটা সম্পর্কে আমাকে বলো।”

“উপসালায় ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। লেনা এন্ডারসন নামের সতেরো বছরের এক জিমন্যাস্ট ছিলো ভিকটিম। এক ক্লাসপার্টির পরই সে নিখোঁজ হয়ে যায়। তিন দিন পর তার লাশ পাওয়া যায় উপসালার এক ডোবায়। শহর থেকে সেটা একটু দূরে। অন্য কোথাও তাকে হত্যা করে লাশটা ওখানে ফেলে রাখা হয়েছিলো। এই হত্যাকাণ্ডটি মিডিয়াতে বেশ আলোড়ন তুলেছিলো সেসময়। তবে তার মৃত্যুর আসল কারণ কখনই রিপোর্ট করা হয় নি। মেয়েটাকে বিভৎসভাবে নির্যাতন করা হয়েছিলো। প্যাথলজিস্টের রিপোর্টটা আমি পড়েছি। আগুন দিয়ে তাকে নির্যাতন করা হয়েছিলো। হাত আর স্তনযুগল আগুনে পুড়িয়ে ফেলে খুনি। তার সারা দেহেও অসংখ্য আগুনের ছেঁকার চিহ্ন ছিলো। মোমবাতি তৈরিতে ব্যবহৃত প্যারাফিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে তার শরীরে। তবে তার হাতটা যেভাবে পুড়েছিলো তাতে মনে হয় আরো তীব্র কোনো দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছিলো এ কাজে। শেষে খুনি তার মাথাটা কেটে লাশের পাশে রেখে দেয়।

ব্লমকোভিস্টের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। “হায় ঈশ্বর,” বললো সে।

“এই অবস্থার সাথে খাপ খায় সেরকম বাইবেলের উদ্ধৃতি আমি খুঁজে পাই নি। তবে বেশ কয়েক জায়গা আগুনের নৈবেদ্য আর পাপের নৈবেদ্যের উল্লেখ আছে। কোথাও কোথাও পশু বলি দেবার কথাও বলা আছে-বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ষাড়-এমনভাবে কাটতে হবে যেনো মাথাটা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্ৰথম হত্যা, মানে রেবেকার ঘটনায় আগুনের কথাটা মনে পড়ে যাচ্ছে।”

রাতের বেলায় মশার উপদ্রবে বাইরে থেকে কটেজের ভেতরে রান্নাঘরে চলে এলো তারা। তাদের কথাবার্তা অব্যাহত রইলো সেখানেও।

“সত্যি কথা হলো, বাইবেলের উদ্ধৃতির সাথে একেবারে খাপ খেয়ে যায় সেরকম কিছু খুঁজে না পাওয়াটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটা উদ্ধৃতির ব্যাপার নয়। বাইবেলে যা লেখা আছে সেটা আসলে বিভৎসতার প্যারোডি—এটা অনেকটা উদ্ধৃতিগুলোকে প্রেক্ষাপট থেকে আলাদা ক’রে দেখার সাথে সম্পর্কিত।”

“আমিও এর সাথে একমত। এটা এমন কি যৌক্তিকও নয়। উদাহরণ হিসেবে ঋতুস্রাব চলাকালীন কোনো মেয়ের সাথে সেক্স করার শাস্তি হিসেবে তার লোকজনদের কাছ থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন ক’রে ফেলার উদ্ধৃতিটার কথা টেনে আনা যেতে পারে। এটাকে আক্ষরিক অর্থে দেখলে খুনিকে আত্মহত্যা করতে হবে।

“তাহলে এসব আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?” ব্লমকোভিস্ট কথাটা আপন মনে বললেও বেশ জোরেই উচ্চারণ করলো।

“হয় আপনার এই হ্যারিয়েটের উদ্ভট শখ ছিলো নয়তো সে জানতো এইসব হত্যাকাণ্ডের সাথে একটা কানেকশান রয়েছে।”

“১৯৪৯ থেকে ১৯৬৬ সালের মধ্যে, এবং সম্ভবত এর আগে কিংবা পরেও হতে পারে। মানসিকভাবে অসুস্থ মর্ষকামী এক সিরিয়াল কিলার সতেরো বছর ধরে একের পর এক মহিলাকে হত্যা করে গেছে সবার চোখে ধুলো দিয়ে, এমনকি কেউ এইসব হত্যাকাণ্ডের সাথে কোনো সম্পর্ক পর্যন্ত খুঁজে বের করতে পারে নি, এই আইডিয়াটা একেবারে অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে।”

চেয়ারে হেলান দিয়ে কফি খেতে লাগলো সালান্ডার। একটা সিগারেটও ধরালো সে। খেতে ইচ্ছে না করলেও মিকাইলও তার দেখাদেখি সিগারেট ধরালো।

“না, এটা মোটেও অবিশ্বাস্য নয়,” একটা আঙুল তুলে ধরে বললো মেয়েটা। “বিংশ শতাব্দীতে এই সুইডেনে কয়েক ডজন মহিলার হত্যাকাণ্ড অমীমাংসিত অবস্থায় রয়ে গেছে আজো। ক্রিমিনোলজির প্রফেসর পারসন এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন সুইডেনে নাকি সিরিয়াল কিলার প্রায় নেই বললেই চলে। তবে তার মানে এও হতে পারে যে আমরা কখনও সেরকম কাউকে ধরতে পারি নি।”

আরেকটা আঙুল তুলে ধরলো সালান্ডার।

“এইসব হত্যাকাণ্ড দীর্ঘ সময় ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত হয়েছে। দুটো ঘটেছে ১৯৬০ সালে, তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে বলতে হবে একেবারেই আলাদা ধরণের হত্যাকাণ্ড ছিলো-কার্লস্টাডের এক কৃষকের স্ত্রী আর স্টকহোমের বাইশ বছরের মেয়ে।”

তিনটা আঙুল তুলে ধরলো এবার।

‘কোনো প্যাটার্ন নেই। খুনগুলো বিভিন্ন জায়গায় সংঘটিত হয়েছে, নির্দিষ্ট কোনো সিগনেচারও ছিলো না। তবে কিছু নির্দিষ্ট জিনিস আছে। প্ৰাণী। আগুন। যৌননির্যাতন। এবং আপনি যেমনটি বলেছেন বাইবেলের উদ্ধৃতির অনুকরণ করা। তবে এইসব কেসের তদন্তে নিয়োজিত কোনো ডিটেক্টিভই হত্যাকাণ্ডগুলোর সাথে বাইবেলের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পায় নি।”

ব্লমকোভিস্ট মেয়েটাকে দেখতে লাগলো। হালকাপাতলা শরীর, কালো কামিসোল, টাট্টু, আর মুখে ফুটো করে কয়েকটা রিং পরে আছে সে। দেখতে একেবারে বেখাপ্পা লাগছে এখানে। বিশেষ করে হেডেবির কোনো কটেজে ডিনারের সময় যখন মেয়েটার সাথে একটু খাতির জমানোর চেষ্টা করলো একেবারে চুপ মেরে গেলো সালান্ডার। নির্মম কাঠিন্যতায় হতাশ করলো তাকে। কিন্তু কাজের সময় পুরোপুরি পেশাদার আচরণ করে সে। স্টকহোমে তার অ্যাপার্টমেন্টটা দেখে মনে হয় সেখানে বুঝি বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে, কিন্তু মানসিকভাবে সালান্ডার অসম্ভব রকমের সুসংগঠিত।

“উদেভাল্লার পতিতা আর রোনিবির যাজকের স্ত্রীর হত্যার মধ্যে কানেকশান খুঁজে বের করাটা খুব কঠিন বলেই মনে হয়। হ্যারিয়েট আমাদের যে চাবিটা দেয় নি সেটা হলো এটা।”

“যা কিনা আমাদেরকে পরবর্তী প্রশ্নে নিয়ে যায়,” বললো সালান্ডার।

“হ্যারিয়েট এসবের সাথে জড়িয়ে পড়লো কিভাবে? ষোলো বছরের এক মেয়ে যেকিনা বেড়ে উঠেছে একেবারেই নিরাপদ আর সুরক্ষিত এক পরিবেশে।”

“এ প্রশ্নের একটা জবাবই আছে,” সালান্ডার বললো। “অবশ্যই ভ্যাঙ্গার পরিবারের সাথে এর কোনো কানেকশান রয়েছে।’

রাত ১১টায় তারা সিরিজ হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করে কাটিয়ে দিলো। ব্লমকোভিস্টের রীতিমতো মাথা ধরে গেলো ভেবে ভেবে। এক পর্যায়ে সালান্ডারকে বললো একটু বাইরে গিয়ে হাটাহাটি করে আসবে কিনা। মেয়েটা এমনভাবে তাকালো যেনো এসব করে তার কোনো লাভ হবে না। খামোখাই সময় নষ্ট করা। তবে তাকে অবাক করে দিয়ে রাজি হলো সে। ব্লমকোভিস্ট সালান্ডারকে ফুল ট্রাউজার পরতে বললো কারণ বাইরে মশা আছে।

ছোটো নৌকার হার্বার পেরিয়ে বৃজটা অতিক্রম করে তারা চলে এলো মার্টিন ভ্যাঙ্গারের বাড়ির সামনে। বিভিন্ন বাড়ি দেখিয়ে কে কোন বাড়িতে থাকে সেসব বলে গেলো সালান্ডারকে। তবে সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গারের বাড়ির সামনে এসে একটু সমস্যায় পড়ে গেলো সে। তার দিকে তাকিয়ে চোখ কুচকে তাকালো সালান্ডার।

একটু সামনে এগিয়ে সৈকতের কাছে বড় একটা পাথরের উপর বসে সিগারেট খেতে শুরু করলো তারা।

“আর কোনো কানেকশান নেই,” হঠাৎ করেই বললো ব্লমকোভিস্ট। “হয়তো তুমি এরইমধ্যে এ নিয়ে ভেবেছো।”

“কি?”

“তাদের নামগুলো।”

কিছুক্ষণ ভেবে মাথা দোলালো সালান্ডার।

“সবগুলো নামই বাইবেলীয়।”

“সত্যি নয়,” বললো মেয়েটা। “বাইবেলের কোথায় লিভ কিংবা লেনা নামটা আছে?”

“আছে। লিভ মানে লাইভ, এর আরেক নাম হলো ইভা। আর লেনা কিসের সংক্ষিপ্ত?”

বিরক্ত হয়ে ভুরু কোচকালো সালান্ডার। তারচেয়ে ব্লমকোভিস্ট একটু বেশি দ্রুত। এটা তার পছন্দ হচ্ছে না।

“মাগদালিন,” বললো সালান্ডার।

“বেশ্যা, প্রথম নারী, কুমারি মেরি…তারা সবাই এই দলে রয়েছে..এটা এতোটাই অদ্ভুত যে, যেকোনো মনোবিজ্ঞানীর মাথা ঘুরিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। তবে নামগুলোর ব্যাপারে আমি অন্য কিছুও ভেবেছি।”

সালান্ডার অপেক্ষা করলো কথাটা শোনার জন্য।

“নামগুলোর সবই ইহুদি নাম। ভ্যাঙ্গার পরিবারে অ্যান্টি সেমিটিক আর ইহুদি বিরোধী বেশ কয়েকজন লোক ছিলো, একেবারে খাঁটি নাৎসিও ছিলো তাদের মধ্যে। হেরাল্ড ভ্যাঙ্গারের সাথে যখন আমার প্রথম দেখা হলো লোকটা তখন নিজের মেয়েকে বেশ্যা বলে গালি দিচ্ছিলো। মেয়েমানুষের ব্যাপারে লোকটার অবশ্যই সমস্যা আছে।”

ক্যাবিনে ফিরে এসে তারা হালকা স্ন্যাকস আর গরম গরম কফি পান করলো। ড্রাগান আরমানস্কির সেরা রিসার্চারের তৈরি করা ৫০০পৃষ্ঠার রিপোর্টটার উপর চোখ বোলালো মিকাইল।

“এতো অল্প সময়ের মধ্যে এতোগুলো তথ্য জোগার করাটা অসাধারণ কাজই বটে,” বললো সে। “ধন্যবাদ, তোমাকে। আরো ধন্যবাদ আমার এখানে আসার জন্য।

“এখন কি হবে?” জানতে চাইলো সালান্ডার।

“আগামীকাল আমি ডার্চ ফ্রোডির সাথে কথা বলবো, তোমাকে কতো টাকা

দিতে হবে সেটাও ঠিক ক’রে নেবো তার সাথে।’

“আমি সেটা জানতে চাই নি।”

তার দিকে তাকালো ব্লমকোভিস্ট।

“আসলে…তোমাকে যে কাজের জন্য আমি ভাড়া করেছিলাম সেটা হয়ে গেছে,” বললো সে।

“আমার কাজ শেষ হয় নি।’

ব্লমকোভিস্ট তার চোখের দিকে তাকালো। এই মেয়ের চোখের দিকে তাকালে কিছুই বোঝা যায় না। বিগত ছয়মাস ধরে হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হবার ঘটনাটি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে সে আর এখন সেই কাজে আরেকজন এসে উপস্থিত হয়েছে-অভিজ্ঞ একজন রিসার্চার-কাজটা সে ভালোমতোই ধরতে পেরেছে। সিদ্ধান্তটি হুট করেই নিয়েছিলো মিকাইল।

“আমি জানি এই কাহিনীটা আমাকেও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলেছে। ফ্রোডির সাথে আমি কথা বলবো। তোমাকে আরো দুয়েক মাসের জন্য রাখবো…একজন রিসার্চার সহকারী হিসেবে। তবে আমি জানি না তার জন্যে আগের মতো পারিশ্রমিক দিতে রাজি হবে কিনা। তবে তোমার জন্য ভালো হয় সেরকম কিছু দেবার ব্যবস্থা করবো আমরা।

আচমকা তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো সালান্ডার। মুখ খোলার কোনো ইচ্ছে তার নেই। কাজটা সে বিনা পারিশ্রমিকে করতেও রাজি ছিলো।

“আমার খুব ঘুম পেয়েছে,” আর কিছু না বলে সোজা চলে গেলো নিজের বিছানায়। বন্ধ করে দিলো তার ঘরের দরজা।

দুই মিনিট বাদে দরজা খুলে মাথা বের করলো সে।

“আমার মনে হয় আপনার ধারণা ভুল। এটা ভুলভাবে বাইবেল পড়া কোনো উন্মাদ সিরিয়াল কিলার নয়। এটা নারীবিদ্বেষী সাধারণ কোনো বাগানবিলাসী বানচোত।”

অধ্যায় ২১

বৃহস্পতিবার, জুলাই ৩-বৃহস্পতিবার, জুলাই ১০

ব্লমকোভিস্টের অনেক আগেই ভোর ৬টার দিকে ঘুম থেকে উঠে গেলো সালান্ডার। কফি বানানোর জন্য পানি গরম করতে দিয়ে গোসল করে নিলো সে। ৭:৩০-এ ব্লমকোভিস্ট উঠে দেখতে পেলো তার ল্যাপটপে হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গার সম্পর্কিত সামারিটা পড়ছে সালান্ডার। চোখ ঘষতে ঘষতে কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে রান্নাঘরে চলে এলো সে।

“স্টোভে কফি আছে,” বললো মেয়েটা।

তার দিকে ভালো ক’রে তাকালো সে।

“হায়রে! এই ডকুমেন্টটা পাসওয়ার্ড দিয়ে রাখা হয়েছিলো,” সে বললো।

তার দিকে ঘুরে চোখ পিটপিট করে তাকালো সালান্ডার।

“শব্দ দিয়ে কোনো ফাইল প্রটেকশন করে রাখলে সেটা ওপেন করার জন্য যে প্রোগ্রামের দরকার হয় তা নেট থেকে মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডে নামিয়ে নেয়া যায়।”

“তোমার আর আমার মনে এই বিষয়টা নিয়ে কি সব চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে সে ব্যাপারে আমাদের কথা বলতে হবে,” কথাটা বলেই শাওয়ার নেবার জন্য চলে গেলো ব্লমকোভিস্ট।

ফিরে এসে দেখতে পেলো তার ল্যাপটপটা বন্ধ করে আগের জায়গায় রেখে দিয়ে নিজের ল্যাপটপটা চালু করেছে মেয়েটি। ব্লমকোভিস্ট নিশ্চিত এরইমধ্যে তার কম্পিউটার থেকে কিছু জিনিস ট্রান্সফার করা হয়ে গেছে।

নাস্তা করার সময় দরজায় নক হলো। দরজা খুলে মার্টিন ভ্যাঙ্গারকে এমন বিষন্ন মুখে দেখতে পেলো যে ব্লমকোভিস্টের কাছে মনে হলো নির্ঘাত হেনরিকের মৃত্যু সংবাদ নিয়ে এসেছে সে।

“না, হেনরিক ভালোই আছে। আমি এসেছি একেবারে অন্য একটি কারণে। আমি কি একটু ভেতরে আসতে পারি?”

তাকে ভেতরে নিয়ে এসে ‘আমার রিসার্চ সহকারী’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলো লিসবেথ সালান্ডারকে। জাঁদরেল শিল্পপতির দিকে অনেকটা তাচ্ছিল্যভরে তাকিয়ে আলতো করে মাথা নেড়ে আবার নিজের ল্যাপটপের দিকে মনোযোগ দিলো মেয়েটি। মার্টিন ভ্যাঙ্গারও এমন উদাস হয়ে আছে যে মেয়েটাকে ভালোমতো খেয়ালও করলো না। তার জন্যে এক কাপ কফি দিয়ে বসতে বললো তাকে।

“কি হয়েছে?”

“আপনি হেডেস্টাড কুরিয়ার পড়েন না?”

“না। তবে সুসানের ক্যাফে’তে মাঝেমধ্যে আমি ওটা পড়ি।”

“তাহলে আজ সকালের পত্রিকাটা পড়েন নি।”

“আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে ওটা আমার পড়া উচিত ছিলো

তার সামনে টেবিলের উপর দৈনিক পত্রিকাটি রাখলো মার্টিন। ফ্রন্ট পেজে দু’কলামে ব্লমকোভিস্টের যে খবরটি ছাপা হয়েছে সেটা চতুর্থ পৃষ্ঠায় জাম্প করেছে। ‘সাজাপ্রাপ্ত সাংবাদিক এখানে লুকিয়ে আছে।’ দূর থেকে টেলিলেন্সের সাহায্যে তোলা একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে ব্লমকোভিস্ট তার কটেজে ঢুকছে।

রিপোর্টার টরসেন ওয়েনারস্ট্রম থেকে শুরু করে তার জেলখাটা নিয়ে এমনভাবে প্রতিবেদনটি লিখেছে যে এই এলাকার যেকোনো আত্মমর্যাদাজ্ঞান সম্পন্ন মানুষই মনে করবে স্টকহোমের এক কালপ্রিট তাদের এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে। মিলেনিয়াম’কে সেখানে এমনভাবে চিত্রিত করা হয়েছে যেনো পত্রিকাটি খুবই জঘন্য একটি ম্যাগাজিন। উস্কানি আর গালগল্প ছড়ানো ছাড়া তাদের আর কোনো কাজ নেই। অর্থনৈতিক বিষয়ে লেখা ব্লমকোভিস্টের বইটাকেও বিতর্কিত একটি বই হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

“মিকাইল…এই আর্টিকেলটা পড়ার পর আমার কেমন লেগেছে সেটা আপনাকে বোঝাতে পারবো না। খুবই জঘন্য।”

“এটা ফরমায়েশি কাজ,” শান্তকণ্ঠে বললো সে।

“আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন এরকম কাজের সাথে আমার বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক নেই। সকালের কফি খেতে খেতে পত্রিকাটি পড়েছি।”

“তাহলে কাজটা করেছে কে?”

“আমি কয়েক জায়গায় ফোন করেছি। টরসন গ্রীষ্মকালীন এক রিপোর্টার। বার্জারের কাছ থেকে আদেশ পেয়ে এ কাজ করেছে সে।”

“আমার ধারণা ছিলো নিউজরুমে বার্জারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। হাজারহোক সে হলো একজন কাউন্সিলর এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।”

“টেকনিক্যালি তার কোনো প্রভাব নেই। কিন্তু কুরিয়ার-এর এডিটর ইন চিফ হলো গুনার কার্লম্যান। ইনগ্রিডের ছেলে। জোহান ভ্যাঙ্গার পরিবারের লোক সে। বার্জার আর গুনার দীর্ঘদিন ধরে খুব ঘনিষ্ঠ।”

“বুঝতে পেরেছি।”

“এ কাজের জন্য টরসনকে বরখাস্ত করা হবে।”

“তার বয়স কতো?”

“সত্যি বলতে কি আমি সেটা জানি না। তার সাথে আমার কখনও দেখা হয় নি।”

“তাকে বরখাস্ত করবেন না। আমাকে যখন ফোন করেছিলো তার কণ্ঠ শুনে মনে হয়েছে ছেলেটার বয়স বেশি হবে না। অনভিজ্ঞ এক সাংবাদিক।”

“এ ধরণের কাজের জন্য তো তাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেয়া যাবে না “আপনি যদি আমার মতামত জানতে চান তো বলি, পরিস্থিতিটা আমার কাছে বেশ অদ্ভুত লাগছে। যে পত্রিকার এডিটর ইন চিফ ভ্যাঙ্গার পরিবারের লোক সে কিনা এমন একটি পত্রিকার বিরুদ্ধে বিষোদগার করলো যার আংশিক মালিক হলো হেনরিক ভ্যাঙ্গার। আপনার এডিটর কার্লম্যান আসলে আপনার এবং হেনরিকের বিরুদ্ধে আক্রমণ করেছে

“আপনি কি বলতে চাচ্ছেন সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। এরজন্যে যে-ই দায়ি হোক তার বিরুদ্ধেই আমি ব্যবস্থা নেবো। কার্লম্যান আমাদের কর্পোরেশনের একজন অংশীদার, সবসময় সে আমার বিরুদ্ধে কাজ করে। তবে এবারেরটা মনে হচ্ছে বার্জারের প্রতিশোধ। হাসপাতালে আপনার সাথে তার বাদানুবাদ হয়েছিলো। আপনি তার চক্ষুসূল।”

“আমি সেটা বিশ্বাস করি। এজন্যেই মনে করি টরসনকে পুরো দোষ দেয়া যায় না। কোনো ইন্টার্নের পক্ষে নিজের বসকে না বলাটা বেশ কঠিন কাজ।”

“আমি তাদেরকে বলতে পারি আগামীকাল আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।”

“এটা না করলেই ভালো হয়। এতে করে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।”

“তাহলে আপনি মনে করছেন আমি কিছুই করবো না?”

“করে কোনো লাভ হবে না। কার্লম্যান তখন আপনার পেছনে লাগবে। আপনাকে সে চিত্রিত করবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপকারী হিসেবে।”

“ক্ষমা করবেন আমাকে। আপনার সাথে আমি একমত হতে পারছি না। আমারও তো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। আমার মতামত হলো এই আর্টিকেলটা ছাপানো অনুচিত হয়েছে। না বলে পারছি না, বর্তমানে আমি মিলেনিয়াম বোর্ডে হেনরিকের স্থলাভিষিক্ত হয়েছি। সেক্ষেত্রে এরকম একটি আক্রমনাত্মক আর্টিকেল এভাবে পার পেয়ে যেতে পারে না।”

“তা অবশ্য ঠিক।”

“তাহলে আমি প্রতিবাদ করতে যাচ্ছি। আর আমি যদি কার্লম্যানকে গর্দভ হিসেবে তুলে ধরি তার জন্যে সে নিজেই দায়ি থাকবে।”

“আপনি যা ভালো মনে করেন তা করার অধিকার আপনার আছে!”

“আর আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন এসব জঘন্য কাজের পেছনে আমার কোনো ভূমিকা ছিলো না।”

“আমি আপনার কথা বিশ্বাস করি,” বললো ব্লমকোভিস্ট।

“আরেকটা ব্যাপার। কথাটা আমি এখন তুলতে চাই নি। সময় এসেছে মিলেনিয়াম-এর বোর্ডে আপনার ফিরে যাবার। যাতে করে আমরা সবাইকে বোঝাতে পারি আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি। আপনি যতোদিন এখানে থাকবেন এইসব গালগল্প চলতেই থাকবে। মিলেনিয়াম-এর উপর আমার আস্থা আছে। আমি নিশ্চিত আমরা একসাথে এই লড়াইয়ে জয়ী হতে পারবো।”

“আপনার যুক্তিটা আমি বুঝতে পারছি। তবে এবার আপনার সাথে আমিও দ্বিমত পোষণ করছি। হেনরিকের সাথে করা চুক্তি আমি ভঙ্গ করতে পারবো না। তাকে আমি ভীষণ পছন্দ করি। আর হ্যারিয়েটের ব্যাপারটা…”

“হ্যা?”

“আমি জানি এ ব্যাপারটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করা আপনাদের কাছে ভালো লাগে না। এও জানি হেনরিক দীর্ঘদিন ধরে এ নিয়ে বাতিকগ্রস্তের মতো আচরণ করছে।”

“আপনাকে বলে রাখছি-আমি হেনরিককে খুবই ভালোবাসি। সে আমার মেন্টর-কিন্তু হ্যারিয়েটের ব্যাপারে তার এই মাথা ঘামানোটা আমারও ভালো লাগে না।”

“এই কাজটা যখন নেই তখন আমি ভেবেছিলাম এটা একেবারেই সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমরা বিশাল অগ্রগতি লাভ করতে যাচ্ছি। সম্ভবত তার কি হয়েছিলো সেটা জানা যাবে এখন।”

মার্টিন ভ্যাঙ্গারের চোখে সন্দেহের ছটা দেখতে পেলো ব্লমকোভিস্ট। অবশেষে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো সে।

“ঠিক আছে। এক্ষেত্রে আমরা যতোদূর সম্ভব হ্যারিয়েটের রহস্যটার সমাধান করতে পারি। আমার পক্ষে যতোটুকু সম্ভব আমি আপনাকে সমর্থন দিয়ে যাবো। হেনরিকের জন্য এবং আপনার মিলেনিয়াম-এ ফিরে যাওয়া যেনো ত্বরান্বিত হয় সেজন্যে।”

“বেশ। তাহলে আপনার সাথে আমার কোনো বিরোধ নেই।”

“না। তা নেই। যখনই সমস্যায় পড়বেন আমার কাছে সাহায্য চাইতে পারেন। আপনার কাজে বার্জার যাতে কোনো রকম বাধা সৃষ্টি করতে না পারে সেটা আমি দেখবো। সেইসাথে সিসিলিয়ার সাথে কথা বলে তাকেও প্রশমিত করবো আমি।”

“ধন্যবাদ, আপনাকে। তাকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার ছিলো আমার, কিন্তু একমাস ধরে সে আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে।

মার্টিন ভ্যাঙ্গার হেসে ফেললো। “সম্ভবত অন্য কোনো ইসু নিয়ে আপনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তবে আমি এর মধ্যে নিজেকে জড়াতে চাই না। “

তারা করমর্দন করলো।

.

তাদের কথাবার্তা শুনেছে সালান্ডার। মার্টিন চলে যাবার পর টেবিলে পড়ে থাকা হেডেস্টাড কুরিয়ার তুলে নিয়ে আর্টিকেলটা পড়লো সে। কোনো মন্তব্য না করেই সে পত্রিকাটা নামিয়ে রাখলো।

চুপচাপ বসে থেকে ভাবছে ব্লমকোভিস্ট। গুনার কার্লম্যান ১৯৪৮ সালে জন্মেছে। ১৯৬৬ সালে তার বয়স ছিলো আঠারো। হ্যারিয়েট নিখোঁজ হবার সময় অন্যদের সাথে সেও এখানে উপস্থিত ছিলো।

নাস্তার পর সালান্ডারকে পুলিশের রিপোর্টগুলো পড়ে দেখতে বললো সে। তাকে দুর্ঘটনার সময় তোলা সবগুলো ছবি আর ভ্যাঙ্গারের নিজস্ব তদন্তের সামারিটাও দিয়ে দিলো।

এরপর গাড়ি চালিয়ে চলে গেলো ফ্রোডির বাড়ি। তাকে একটা চুক্তি খসড়া করার জন্য অনুরোধ জানালো যাতে করে সালান্ডারকে আরো এক মাসের জন্যে নিয়োগ দেয়া যায় এ কাজের জন্য।

কটেজে ফিরে এসে দেখতে পেলো সালান্ডার বাগানে বসে পুলিশ রিপোর্টটা নিয়ে ডুবে আছে। কফি বানানোর জন্য রান্নাঘরে চলে গেলো ব্লমকোভিস্ট। সেখান থেকে জানালা দিয়ে মেয়েটাকে দেখতে লাগলো সে। খুব দ্রুত পড়ে। এক পৃষ্ঠা পড়তে দশ থেকে পনেরো সেকেন্ডের বেশি লাগছে না। যন্ত্রের মতো পাতা উল্টে যাচ্ছে। মেয়েটার এই অমনোযোগীতা তাকে বিস্মিত করলো। রিপোর্ট লেখার বেলায় একেবারেই অন্যরকম সে। খুবই নিখুত আর বিস্তারিত থাকে তার রিপোর্টগুলো। দু’কাপ কফি নিয়ে বাগানে চলে এলো ব্লমকোভিস্ট।

“আমরা যে একজন সিরিয়াল কিলারকে খুঁজছি সেটা দেখি আপনি আগেই নোটে লিখে রেখেছেন।”

“এটা সত্যি। হেনরিককে কি প্রশ্ন করবো সেসব আগেই লিখে রাখতাম আমি। একটু এলোমেলো ছিলো আমার কাজের ধরণ। কিছু দিন আগেও আমি প্রায় অন্ধকারে ছিলাম, গল্প লেখার চেষ্টা করতাম-হেনরিকের আত্মজীবনী আর কি।”

“আর এখন?”

“এর আগে সব ধরণের তদন্ত হেডেবি আইল্যান্ডে করা হয়েছে। কিন্তু এখন আমি নিশ্চিত সবগুলো ঘটনার সূত্রপাত হয়ে অবশেষে হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হবার ঘটনাটি হেডেস্টাড থেকেই শুরু হয়েছে। এরফলে পারসপেক্টিভের বদল ঘটে গেছে।

সালান্ডার বললো : “ছবিগুলো থেকে আপনি যা আবিষ্কার করেছেন সেটা আসলেই অসাধারণ।

অবাক হলো ব্লমকোভিস্ট। প্রশংসার করার মতো মেয়ে সালান্ডার নয়। তার এই কথায় সে খুব আপ্লুত হয়ে উঠলো। সাংবাদিকতার দিক থেকে ভেবে দেখলে এটাও তো ঠিক, সে যা করেছে তা একেবারেই অসাধারণ।

“এখন ডিটেইলগুলো পূরণ করতে হবে। ছবি নিয়ে যে নরসিও’তে গেলেন তার কি খবর?”

“তুমি বলতে চাচ্ছো আমার কম্পিউটারের ছবিগুলো তুমি চেক করে দ্যাখো নি?”

“সময় পাই নি। আমার আসলে রিজিউমগুলো পড়া দরকার।”

ব্লমকোভিস্ট তার ল্যাপটপটা চালু করে ফটোগ্রাফ ফোল্ডারটা ওপেন করলো।

“এটা দারুণ। নরসিও ভ্রমণে এক ধরণের উন্নতি হয়েছে বলতে পারো। তবে সেই সাথে হতাশারও বটে। ছবিটা আমি খুঁজে পেয়েছি তবে তাতে তেমন কিছু খুঁজে পাই নি। ঐ মিলড্রেড বার্গরেন তার সব ছবিই জমিয়ে রেখেছে। আমি যে ছবিটা খুঁজছিলাম সেটাও তার কাছে আছে। সস্তা রঙ্গিন ছবির ফিল্ম ছিলো সেটা ফলে এই সাইত্রিশ বছরে একেবারে বিবর্ণ হয়ে গেছে। পুরো ছবিটা হলদেটে হয়ে গেছে এখন। বিশ্বাস করতে পারো মহিলা এখনও ছবিগুলোর নেগেটিভ সংরক্ষণ করে রেখেছে। হেডেস্টাডে তোলা সবগুলো নেগেটিভ আমাকে ধার দিয়েছে সে। আমি সেগুলো স্ক্যান করে ফেলেছি। এই যে, হ্যারিয়েট এটাই দেখছিলো।”

হ্যারিয়েট/বিডি-১৯.ইপিএস নামের একটি ছবিতে ক্লিক করলো সে।

ছবিটা দেখার সঙ্গে সঙ্গেই সালান্ডার তার আফসোসের ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। শিশুদের প্যারেডের ক্লাউনদের ঘোলাটে একটি ছবি। ছবিটার ব্যাকগ্রাউন্ডে সান্ডস্ট্রম টেইলারিং শপের কর্নারটা দেখা যাচ্ছে। সান্ডস্ট্রমের সামনের রাস্তায় দশ জনের মতো লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্যারেড দেখছে।

“আমার মনে হয় এই লোকটাকেই হ্যারিয়েট দেখছিলো। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আমি আন্দাজ করেছি। ওখানকার চৌরাস্তার মোড়ের একটি ড্রইংও একেছি আমি। এই লোকটাই শুধু ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মানে, সম্ভবত লোকটা হ্যারিয়েটের দিকেই চেয়ে আছে।”

সালান্ডার দেখতে পেলো লোকজনের ভীড়ের পেছনে ঘোলাটে একটা মনুষ্যমূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। কালো রঙের একটা জ্যাকেট পরে আছে লোকটা, কাঁধের দিকে লাল রঙের একটা প্যাচ। ফুলপ্যান্টটাও কালো। সম্ভবত জিন্সের। ছবিটা আরো জুম ক’রে অনেকটা বড় করে দেখালো ব্লমকোভিস্ট।

“একজন পুরুষ। উচ্চতা প্রায় পাঁচফুট এগারোর মতো। স্বাস্থ্য মোটামোটি। সোনালি চুল আর ক্লিনশেভ। মাঝ বয়সী থেকে কৈশোরের মধ্যে হবে তার বয়স। আপনি ছবিটা ম্যানুপুলেট করতে পারেন…”

“তা-ই করেছি। তারপরও এই অবস্থা। মিলেনিয়াম-এর ইমেজ প্রসেসিং ইউনিটে পাঠিয়েও দেখেছি।” আরেকটা নতুন ছবি ক্লিক করলো। “এরচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায় নি। ক্যামেরাটা খুবই সিম্পল ছিলো ফলে দূরে থাকা ইমেজগুলো ভালো আসে নি।”

“ছবিটা কি আপনি কাউকে দেখিয়েছেন? কেউ হয়তো লোকটাকে চিনতে পারবে কিংবা…”

“ফ্রোডিকে দেখিয়েছি। লোকটা কে সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই।”

“মি: ফ্রোডি সম্ভবত হেডেস্টাডের একমাত্র ব্যক্তি নন যাকে ভালো অবজার্ভার বলা যায়।”

“তবে আমি তার এবং হেনরিক ভ্যাঙ্গারের পক্ষে কাজ করছি। অন্য কাউকে দেখানোর আগে আমি হেনরিককে ছবিটা দেখাতে চাই

“সম্ভবত লোকটা নিছক কোনো উৎসুক দর্শক।”

“এটার সম্ভাবনা আছে। তবে সে হ্যারিয়েটের জন্যে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।

.

এরপর বেশ কয়েকটা দিন ব্লমকোভিস্ট আর সালান্ডার হ্যারিয়েটের কেসটা নিয়ে প্রচুর কাজ করে গেলো। পুলিশ রিপোর্টগুলো নিয়ে খতিয়ে দেখলো মেয়েটা, সেইসাথে প্রশ্ন করে গেলো একের পর এক। একটা সত্য নিহিত আছে কিন্তু অস্পষ্ট কোনো জবাব কিংবা অনিশ্চিত কোনো সূত্র তাদেরকে নিয়ে যেতে পারে কানাগলিতে। বৃজের দুর্ঘটনার সময় ছবিতে দেখা সব লোকের টাইমটেবিলের হিসেব নিয়ে পুরো একটা দিন কাটিয়ে দিলো তারা।

তার কাছে সালান্ডার মেয়েটা আরো বেশি রহস্যময় হয়ে উঠছে। খুব ভালো করে ডকুমেন্টের পাতাগুলো না দেখেও একেবারে অনুচ্চারিত আর বৈপরীতধর্মী প্রশ্ন করতে পারছে মেয়েটা।

গরমের প্রকোপ বেড়ে গেলে তারা বাগানে বসে কাজ করা থেকে একটু বিরতি দিয়ে নিকটস্থ খালে সাঁতার কাটতো নয়তো সুসানের ক্যাফে’তে গিয়ে বসতো। ইদানীং ব্লমকোভিস্টের সাথে সুসান বেশ শীতল আচরণ করছে, আর এই ব্যাপারটা লুকানোরও চেষ্টা করছে না সে। বুঝতে পারছে সালান্ডারের মতো এক অল্পবয়সী মেয়েকে নিয়ে দিনরাত ঘুরে বেড়াচ্ছে, একসাথে কটেজে থাকছে, এতে ক’রে সুসানের চোখে ব্লমকোভিস্ট নামের মধ্যবয়সী লোকটা নোংরা আর লম্পট হিসেবেই প্রতিভাত হচ্ছে। ব্যাপারটা স্বস্তিদায়ক নয় মোটেও।

এক সন্ধ্যায় জগিং করার জন্য বের হলো ব্লমকোভিস্ট। হাপাতে হাপাতে কটেজে ফিরে এলে সালান্ডার কোনো মন্তব্য করলো না। জগিং করা যে এ মেয়ের স্বভাব নয় সেটা বুঝতে পারলো সে।

“আমার বয়স চল্লিশের উপরে,” বললো ব্লমকোভিস্ট। “কোমর আর পেটের দিকে মেদ যাতে না জমে তার জন্যে আমাকে ব্যয়াম করতে হয়।”

“বুঝেছি।”

“তুমি কি কখনও ব্যয়াম করো না?”

“মাঝেমধ্যে আমি বক্সিং করি?”

“বক্সিং করো?”

“হ্যা। হাতে গ্লোভ পরে।”

“কোন ওয়েট ক্যাটাগরিতে বক্সিং করো তুমি?” গোসল করে ফিরে এসে জানতে চাইলো সে।

“কোনো ক্যাটাগরিতে করি না। সোডারের ক্লাবে মাঝেমধ্যে পুরুষমানুষের সাথে বক্সিং করি।”

এ ব্যাপারটাতে সে কেন অবাক হচ্ছে না? ভাবলো ব্লমকোভিস্ট। তবে শেষ পর্যন্ত মেয়েটা নিজের অজানা কিছু কথা তাকে বললো তাহলে। সালান্ডারের সম্পর্কে সে তেমন কিছুই জানে না। কোত্থেকে এসেছে? কি ধরণের লেখাপড়া করেছে? তার বাবা-মা কি করে? ব্লমকোভিস্ট যখনই তার সম্পর্কে কিছু জানতে চায় মেয়েটা একেবারে মূর্তির মতো হয়ে যায়। হয় হু-হা করে মাথা নেড়ে জবাব দেয় নয়তো তার প্রশ্নটা এড়িয়ে যায় সে।

এক দুপুরে হঠাৎ করে পুলিশের একটা ফাইলটা নামিয়ে রেখে ভুরু কুচকে তাকালো সালান্ডার।

“আপনি ওটো ফক নামের যাজক সম্পর্কে কি জানেন?”

“খুব বেশি কিছু জানি না। যতোটুকু জানতে পেরেছি ভদ্রলোক বর্তমানে হেডেস্টাডের কোথাও বসবাস করছে। আলঝেইমা রোগে আক্রান্ত সে।”

“লোকটা কোত্থেকে এসেছে?”

“হেডেস্টাড থেকে। পড়াশোনা করেছে উপসালায়।”

“লোকটা বিবাহিত ছিলো। হ্যারিয়েট তার সাথে আড্ডাও মারতো।”

“তুমি এটা কেন জানতে চাইছো?”

“মোরেল এই লোকটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় একটু বেশি ছাড় দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

“ষাটের দশকে যাজকেরা আমাদের সমাজে একটু বেশি মর্যাদা পেতো। তার বেলায় যা হয়েছে সেটা স্বাভাবিকই। লোকটা এখানকার ক্ষমতাবানদের সাথে ঘনিষ্ট ছিলো।”

“আমি ভাবছি পুলিশ তার সম্পর্কে খোঁজবর নেবার সময় কতোটা সতর্ক ছিলো। ছবি দেখে মনে হচ্ছে বেশ বড় কাঠের তৈরি একটি বাড়ি। একটা লাশ গুম করে রাখার মতো পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে সেখানে।”

“তা ঠিক। তবে আমাদের হাতে এমন কোনো তথ্য নেই যে লোকটা সিরিয়াল কিলার কিংবা হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হবার সাথে জড়িত ছিলো।”

“সত্যি বলতে কি, আছে,” রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো সালান্ডার। “প্রথম কথা হলো সে একজন যাজক। অন্য যে কারোর চেয়ে বাইবেলের সাথে যাজকের সম্পর্ক অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, হ্যারিয়েটের সাথে এই লোকটারই শেষ কথা হয়েছে।”

“কিন্তু লোকটা দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত ওখানেই ছিলো। অনেক ছবিতেই তাকে দেখা গেছে। বিশেষ করে হ্যারিয়েট যে সময়টায় নিখোঁজ হয়েছিলো বলে অনুমান করা হয় তখন।

“ঠিক আছে, আমি তার অ্যালিবাই নস্যাৎ করতে পারছি না। তবে অন্য একটা জিনিস ভাবছি আমি। এটা হলো মর্ষকামী এক নারী হত্যাকারীর কাহিনী।”

“তো?”

“আমি এই বসন্তে মর্ষকামী খুনিদের উপর বেশ পড়াশোনা করেছি। এরমধ্যে এফবিআই’র একটি ম্যানুয়াল আছে। ওটাতে দাবি করা হয়েছে বেশিরভাগ মর্ষকামী সিরিয়াল কিলার হয় অকার্যকর পরিবার থেকে এসেছে নয়তো শৈশবে জন্তুজানোয়ারের সাথে নিমর্ম আচরণ করতো তারা। আমেরিকার কিছু সিরিয়াল কিলার অন্যের ঘরে ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন দেবার অভিযোগেও অভিযুক্ত ছিলো। যেটাকে তারা বলে ‘আরসন’। হ্যারিয়েটের উল্লেখিত কয়েকটি হত্যাকাণ্ডে জন্তুজানোয়ার নির্যাতন আর আরসন-এর মতো ঘটনা আছে। তবে আমি ভাবছি সত্তর দশকে যে লোকটা আগুনে পুড়ে মারা গেছে তার কথা।”

“এটা অনেক দূরবর্তী হয়ে যাচ্ছে,” বললো ব্লমকোভিস্ট।

মাথা নেড়ে সায় দিলো লিসবেথ। “মানছি। তবে আমি পুলিশ রিপোর্টে আগুনের কারণ সম্পর্কে কিছু খুঁজে পাই নি। ষাটের দশকে এখানে আরো কিছু আগুনের ঘটনা ঘটেছে কিনা সেটা জানতে পারলে আরো ভালো হতো। এর আগে এখানে জন্তুজানোয়ার হত্যা কিংবা কাটাকাটির ঘটনা ঘটেছে কিনা সেটাও জানতে পারলে অনেক উপকার হতো।”

সালান্ডার হেডেবিতে তার সপ্তম রাত্রি যাপন করার জন্য বিছানায় চলে যাবার পর ব্লকোভিস্টের মনে কিছুটা খচখচানি শুরু হয়ে গেলো। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে এই মেয়েটার সাথে বলতে গেলে চব্বিশ ঘণ্টাই আছে। সাধারণত সাত মিনিটের বেশি কোনো লোকের সাথে এই মেয়েটা থাকলেই নাকি তার মাথা ধরা শুরু হয়ে যায়, আর এ কারণেই একাকী থাকতে অভ্যস্ত সে। মেয়েটাকে যতোক্ষণ তার মতো শান্তিতে থাকতে দেয়া হয় ততোক্ষণই সে ধাতস্থ থাকে। তবে কপাল খারাপ, সমাজ এ ব্যাপারটা বোঝে না। নিজেকে সামাজিক কর্তৃপক্ষ, শিশুকল্যাণ সংস্থা, গার্ডিয়ান অথোরিটিজ, ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট, পুলিশ, মনোবিজ্ঞানী শিক্ষক অযাচিত লোকজনের কাছে থেকে রক্ষা করতে হয় তাকে। তার বয়স পঁচিশ হলেও তার সাথে অপ্রাপ্তবয়স্কদের মতো আচরণ করা হয়। তাকে সংশোধন করার আশায় তার জীবনটা বিষিয়ে তোলা ছাড়া আর কিছু করে নি তারা।

চিল্লাফালা করে কোনো লাভ নেই সেটা সে বুঝে গেছে অনেক আগেই। আরো বুঝে গেছে কারো কাছে ব্যাখ্যা করেও কোনো লাভ হয় না, বরং পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে ওঠে। সুতরাং নিজের সমস্যা নিজেকেই সমাধান করতে হয়, তার জন্যে যা যা করার লাগে সবই করে সে। তার এই ব্যাপারটা এডভোকেট বুরম্যান বেশ ভালোমতোই বুঝতে পেরেছে।

অন্য অনেকের মতো ব্লমকোভিস্টেরও একই বদঅভ্যেস আছে। তার ব্যাপারে নাক গলাবে, তার সম্পর্কে এটা ওটা জানতে চাইবে। তবে অন্যসব পুরুষ মানুষের মতো সে প্রতিক্রিয়া দেখায় না।

তার কোনো প্রশ্ন যখন এড়িয়ে যায় তখন সে কেবল কাঁধ তুলে প্রতিক্রিয়া দেখায়। তারপর এ নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য করে না। বিস্ময়করই বটে।

ব্লমকোভিস্টের ল্যাটপটা হাতে পেতেই সালান্ডার সব তথ্য তার নিজের ল্যাপটপে ট্রান্সফার করে নিয়েছে। তাকে যেহেতু কাজে নেয়া হয়েছে তাই এ ব্যাপারটা ঠিকই আছে। এতে কোনো অন্যায় নেই।

কিন্তু সে যখন নাস্তা করার জন্য ফিরে এলো তখন তার কাছ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া আশা করেছিলো সালান্ডার। কিন্তু তার বদলে তাকে খুব একটা মাথা ঘামাতে দেখা গেলো না। শুধুমাত্র বিড়বিড় করে কী যেনো বলেছিলো অনেকটা আপন মনে। তারপরই চলে গিয়েছিলো শাওয়ার করতে। এরপর ফিরে এসে তার কাছে জানতে চেয়েছিলো ডকুমেন্টগুলো পড়ে তার কি মনে হচ্ছে। আজব এক লোক। তার কাছে এমনও মনে হয়েছিলো লোকটা বুঝি তাকে খুব বিশ্বাস করে।

সে যে একজন হ্যাকার এ কথাটা সে জানে। একজন হ্যাকারের জন্য এটা খুবই মারাত্মক একটি ব্যাপার। সালান্ডার জানে তার এই পরিচয়টা ফাঁস হয়ে গেলে তাকে জেল পর্যন্ত খাটতে হবে। হ্যাকিংয়ের মতো নিষিদ্ধ কাজের শাস্তি খুব কড়া। জেলে যাবার কোনো ইচ্ছে তার নেই। কারণ তাতে করে তার প্রিয় কম্পিউটারের সাথে বিচ্ছেদ ঘটবে। আরমানস্কিকে সে কখনই বলে নি কিভাবে এতো দ্রুত আর বিশদ তথ্য জোগার করে।

প্লেগ আর কতিপয় হ্যাকার বাদে কেউই জানে না তার পরিচয়। অবশ্য এই সব হ্যাকাররা তাকে ‘ওয়াসপ’ নামে চেনে। সে কোথায় থাকে, কি করে কিছুই তারা জানে না। একমাত্র কাল ব্লমকোভিস্টই তার সব গোপন কথা জেনে গেছে। এই লোকটা তাকে ধরে ফেলেছে তার কারণ সালান্ডার এমন একটা ভুল করে ফেলেছিলো যেটা কিনা বারো বছরের কোনো মেয়েও করবে না। এর মানে হচ্ছে তার মাথাটা ঠিকমতো কাজ করছে না। লোকটার হাতে মার খাওয়া তার প্রাপ্য ছিলো কিন্তু লোকটা তা না করে বরং নিজের কাজে তাকে ভাড়া করেছে।

এরফলে লোকটার উপর অল্পবিস্তর ক্ষেপেও আছে সে।

বিছানায় যাবার আগে হঠাৎ করে ব্লমকোভিস্ট তাকে জিজ্ঞস করেছিলো সে খুব ভালো মানের হ্যাকার কিনা।

তার জবাবটা তার নিজের কাছেই বিস্ময়কর লেগেছে। “সম্ভবত আমি সুইডেনের সেরা হ্যাকার। আমার লেভেলে বড়জোর আরো দু’তিনজন রয়েছে।”

নিজের এ দাবি নিয়ে তার মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। একবার প্লেগ নিজেই কথাটা তাকে বলেছিলো। সেটা অবশ্য অনেক আগে।

অন্যদিক থেকে এ কথাটা বলা একেবারেই হাস্যকর লাগছে তার নিজের কাছে। এর আগে কখনও এ কথা কাউকে সে বলে নি। বাইরের কোনো লোককে ইমপ্রেস করার জন্য নিজের প্রতিভার কথা বলে বেড়ানোর মতো মেয়ে সে নয়। এরপর ব্লমকোভিস্ট আরেকটা সাংঘাতিক প্রশ্ন করে বসে : হ্যাকিং করা কোত্থেকে শিখলো সে?

কি বলতে পারতো সালান্ডার? আমি মায়ের পেট থেকেই এসব শিখে বের হয়েছি। তবে কিছু না বলে সোজা বিছানায় চলে যায় সে। এমনকি গুডনাইট পর্যন্ত বলে নি।

এভাবে তার চলে আসাতেও লোকটা কোনো রকম বাজে প্রতিক্রিয়া দেখায় নি। এটা তার মনে আরো বেশি খচখচানির সৃষ্টি করেছে। বিানায় শুয়ে শুয়ে শুনতে পাচ্ছে লোকটা রান্নাঘরের টেবিল আর ডিশগুলো পরিস্কার করছে। সব সময়ই একটু দেরি করে ঘুমাতে যায় সে। বাথরুমে যাবার শব্দ পেলো। এবার শুনতে পেলো শোবারঘরের দরজা বন্ধ করার শব্দ। কিছুক্ষণ পর বিছানা থেকে ওঠার শব্দ। তার ঠিক পাশের ঘরেই থাকে ব্লুমমকোভিস্ট।

এই লোকটার সাথে প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে এক ঘরে থাকছে সে, একবারের জন্যেও তার সাথে কোনো রকম ফ্লার্ট করার চেষ্টা করে নি। একসাথে কাজ করে তারা, অনেক অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করে। তর্কবিতর্ক সবই হয়। ধ্যাততারিকা! লোকটা তো তার সাথে এমন আচরণ করছে যে সে একজন মানুষ।

বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, অন্ধকারে পায়চারি করতে শুরু করলো অস্থিরভাবে। একেবারে প্রথমবারের মতো নিজেকে নগ্ন করে কারো সামনে উপস্থাপন করাটা তার জন্যে খুব কঠিন কাজ। সে বুঝতে পারে তার হাড্ডিসার দেহটা খুব কুৎসিত। তার স্তনযুগল একেবারেই যা-তা। নিজের পাছা নিয়েও বলার মতো কিছু নেই। আবেদনময়ী হবার মতো তেমন কিছুই নেই তার। এসব বাদ দিলে সে খুবই সাধারণ এক মেয়ে, আর সব মেয়ের মতো তারও একই রকম যৌনতৃষ্ণা রয়েছে। প্রায় বিশ মিনিটের মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো সে।

দরজা যখন খুলে গেলো ব্লমকোভিস্ট তখন সারা পারেৎস্কির একটা উপন্যাস পড়ছে। বই থেকে মুখ তুলে চেয়ে দেখতে পেলো সালান্ডারকে। গায়ে একটা চাদর জড়ানো। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।

“তুমি ঠিক আছো তো?” জানতে চাইলো সে।

মাথা দোলালো সালান্ডার।

“কি হয়েছে?”

তার বিছানার কাছে এসে তার কাছ থেকে বইটা নিয়ে বেডসাইড টেবিলে রেখে দিয়ে উপুড় হয়ে প্রগাঢ়ভাবে চুমু খেলো তাকে। দ্রুত তার বিছানায় উঠে বসে সরাসরি তাকালো তার চোখের দিকে। চাদরের উপর দিয়ে তার তলপেটে হাত রাখলো মেয়েটা। ব্লমকোভিস্ট কোনো বাধা না দিলে আস্তে করে ঝুঁকে তার স্তনবৃত্তে আলতো করে কামড় দিলো।

ব্লমকোভিস্ট যারপরনাই বিস্মিত। মেয়েটার কাঁধ ধরে তাকে সরিয়ে দিয়ে সরাসরি তার চোখের দিকে তাকালো সে।

“লিসবেথ…আমি বুঝতে পারছি না এটা ভালো হচ্ছে কিনা। আমাদেরকে একসাথে কাজ করতে হবে।”

“আর আমাকে তোমার সাথে সেক্স করতে হবে। তোমার সাথে কাজ করতে আমার কোনো সমস্যা হবে না। তবে তুমি যদি আমাকে ফিরিয়ে দাও তাহলে তোমার সাথে আমার বিশাল ঝামেলা হয়ে যাবে।”

“কিন্তু আমরা একে অন্যেকে তো খুব একটা চিনি না।”

উচ্চস্বরে হেসে ফেললো সে।

“তুমি এরকম পরিস্থিতিতে কখনও কাউকে ফিরিয়ে দাও নি। এ কথাটা আমি আমার রিপোর্টে উল্লেখ করি নি অবশ্য। তুমি এমন এক পুরুষ যে কিনা কখনও মেয়েদের উপর থেকে নিজের হাত গুটিয়ে রাখতে পারে না। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? আমাকে কি তোমার কাছে সেক্সি লাগছে না?”

মাথা ঝাঁকিয়ে পরিস্কার করে ভাবার চেষ্টা করলো ব্লমকোভিস্ট। কিন্তু সে যখন কিছু বলতে পারলো না মেয়েটা তখন তার শরীর থেকে চাদরটা টেনে সরিয়ে তার উপরে উঠে বসলো।

“আমার কাছে কোনো কনডম নেই,” বললো সে।

“গুল্লি মারো কনডমের।”

.

ঘুম থেকে উঠে শুনতে পেলো মেয়েটা রান্নাঘরে কি যেনো করছে। সাতটাও বাজে নি। বড়জোর দু’ঘণ্টার মতো ঘুমাতে পেরেছে। বিছানায় শুয়ে রইলো আরো কিছুক্ষণ।

এই মেয়েটা তাকে হতভম্ব করেছে। তার প্রতি যে মেয়েটার আগ্রহ ছিলো সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি। মেয়েটার চার্নিতে সেরকম কিছু দেখতেও পায় নি সে।

“গুডমর্নিং,” দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললো সে। মেয়েটার মুখে একটু হাসির আভাস।

“হাই।”

“আমাদের দুধ শেষ হয়ে গেছে। আমি প্যাট্রল স্টেশনে যাচ্ছি। তারা সাতটার দিকে খোলে।” কথাটা বলেই সে চলে গেলো।

সামনের দরজা খোলার শব্দ পেলে সে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলো বিছানায়। কিছুক্ষণ পর আবার দরজা খোলার শব্দ। এর কয়েক সেকেন্ড পর তার ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো মেয়েটাকে। এবার আর তার মুখে হাসি নেই।

“বিছানা থেকে উঠে দেখো কি হয়েছে,” অদ্ভুত কণ্ঠে বললো সালান্ডার।

বিছানা ছেড়ে জিন্স প্যান্টটা পরে নিলো ব্লমকোভিস্ট।

রাতের বেলায় তাদের অগোচরে কেউ কটেজ ঢুকেছিলো। পোর্চের উপর বেড়ালটার আধপোড়া দেহ পড়ে আছে। বেড়ালটার পা আর মাথা কাটা। পেট চিড়ে নাড়িভুড়ি বের করে ফেলে রাখা হয়েছে ঠিক তার পাশেই। দেখে মনে হচ্ছে ওগুলো আগুনে পোড়ানো হয়েছে। তবে বেড়ালটার মাথা অক্ষত অবস্থায় রেখে দেয়া হয়েছে সালান্ডারের মোটরসাইকেলের স্যাডেলে। লালচে-বাদামি রঙের চামড়া দেখে সে চিনতে পারলো বেড়ালটাকে।

অধ্যায় ২২

বৃহস্পতিবার, জুলাই ১০

বাগানে তারা চুপচাপ নাস্তা করলো, কফি পান করলো দুধ ছাড়াই। একটা ক্যানন ডিজিটাল ক্যামেরা বের করে মৃত বেড়ালের ছবি তুলে রাখলো সালান্ডার তারপর সব কিছু পরিস্কার করে ফেললো ব্লমকোভিস্ট। বেড়ালটা রাখলো ভলভো গাড়ির বুটে। প্রাণীর প্রতি সহিংসতা আর তাদেরকে প্রচ্ছন্ন হুমকি দেবার জন্য পুলিশের কাছে রিপোর্ট করবে সে। তবে সিদ্ধান্ত নিলো কেন তাদেরকে হুমকি বা ভয় দেখানো হচ্ছে তার কারণ ব্যাখ্যা করবে না পুলিশের কাছে।

৮:৩০-এ বৃজের উপর দিয়ে হেটে গেলো ইসাবেলা ভ্যাঙ্গার। মহিলা তাদেরকে দেখলো না কিংবা বলা যায় না দেখার ভান করলো।

“তোমার কি অবস্থা?” বললো ব্লমকোভিস্ট।

“ওহ্, আমি ভালো আছি।” তার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকালো সালান্ডার। ঠিক আছে, তাহলে। সে মনে করেছে আমি আপসেট হয়ে আছি। “আমি যখন খুঁজে বের করবো কোন বানচোত একটা নিরীহ বেড়াল মেরে আমাদেরকে সতর্ক

করার চেষ্টা করেছে তখন তার মুখটা বেজবল ব্যাট দিয়ে থেতলে দেবো।’

“তুমি মনে করছো এটা এক ধরণের সতর্ক করে দেয়া?”

“তোমার কাছে কি এরচেয়ে ভালো কোনো ব্যাখ্যা আছে নাকি? এটার অবশ্যই কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে।”

“সত্য যাইহোক না কেন, আমরা কাউকে খুবই ঘাবড়ে দিতে পেরেছি, আর সেজন্যেই এই রকম অসুস্থ কাজ করেছে সে। তবে আরেকটা সমস্যা আছে।”

“জানি। ১৯৫৪ এবং ১৯৬০ সালের মতো এটা একটা প্রাণীবলির ঘটনা। আর এই পঞ্চাশ বছর পর এক খুনি এখনও সক্রিয় আছে সেটা ভাবাও কষ্টকর।

ব্লমকোভিস্ট একমত পোষণ করলো।

“এই ঘটনায় যাদেরকে সন্দেহ করা যেতে পারে তারা হলো হেরাল্ড আর ইসাবেলা ভ্যাঙ্গার। জোহান ভ্যাঙ্গারের অনেক পুরনো বংশধর আছে তবে তাদের কেউই এই এলাকায় থাকে না।

একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে গেলো ব্লমকোভিস্টের ভেতর থেকে।

“ইসাবেলা যে রকম জঘন্য চরিত্রের মহিলা তাতে করে বেড়ালটা খুন করা তার পক্ষে সম্ভব। তবে পঞ্চাশের দশকে অনেকগুলো মহিলা খুন করে বেরিয়েছে সে এটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। হেরাল্ড ভ্যাঙ্গার…আমি জানি না। তার স্বাস্থ্যের যে অবস্থা ঠিকমতো হাটতেই পারে না। গতকাল রাতে আমাদের কটেজের আশেপাশে ওৎ পেতে বেড়ালটা ধরে কেটে টুকরো টুকরো করেছে সে এরকম কিছুতে বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়।”

“যদি না দু’জন লোক হয়ে থাকে। একজন বয়স্ক আর অন্যজন তরুণ।”

একটা গাড়ি চলে যাবার শব্দ শুনে ব্লমকোভিস্ট তাকিয়ে দেখতে পেলো সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গার গাড়ি চালিয়ে বৃজ দিয়ে চলে যাচ্ছে। হেরাল্ড আর সিসিলিয়া, ভাবলো সে। কিন্তু তাদের মধ্যে খুব কমই কথাবার্তা হয়। মার্টিন ভ্যাঙ্গার যদিও বলেছে সিসিলিয়ার সাথে কথা বলবে তারপরও এখন পর্যন্ত তার কোনো ফোনই ধরছে না সে।

“এটা এমন কেউ করেছে যে জানে আমরা কি কাজ করছি এবং কতোটা অগ্রসর হতে পেরেছি,” বাড়ির ভেতরে যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে সালান্ডার বললো। ভেতর থেকে যখন ফিরে এলো দেখা গেলো তার গায়ে চামড়ার জ্যাকেট।

“আমি স্টকহোমে ফিরে যাচ্ছি। আজ রাতেই ফিরে আসবো।”

“তুমি কি করবে?”

“কিছু গ্যাজেট নিয়ে আসবো। একটা নিরীহ বেড়ালের সাথে যদি এরকম নৃশংসতা দেখাতে পারে তাহলে ধরে নিতে হবে পরের বার আমাদের উপরেই আক্রমণ করা হবে। কিংবা আমরা যখন কটেজে ঘুমিয়ে থাকবো তখন আগুন ধরিয়ে দেবে। আমি চাই তুমি আজই হেডেস্টাডে গিয়ে দুটো ফায়ার ইস্টিংগুইসার আর দুটো স্মোক অ্যালার্ম কিনে আনো। একটা ইস্টিংগুইসার যেনো হালোন হয়।”

আর কোনো কথা না বলে মাথায় হেলমেট পরে মোটর সাইকেলটা নিয়ে ছুটে চলে গেলো সালান্ডার।

.

হেডেস্টাডে গিয়ে কেনাকাটা করার আগে বেড়ালটার মাথা আর নাড়িভুড়ি পেট্রল স্টেশনের পাশে মাটি চাপা দিয়ে রাখলো ব্লমকোভিস্ট। সেখান থেকে সোজা চলে গেলো হাসপাতালে। ক্যাফেটেরিয়ায় ফ্রোডির সাথে দেখা করার কথা। বেড়ালটার কথা জানালে ফ্রোডির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।

“মিকাইল, আমি কখনও কল্পনাও করতে পারি নি এই কাহিনীটা এমনভাবে মোড় নেবে।”

কেন নয়? হাজার হোক কাজটা তো একজন খুনিকে খুঁজে বের করার, নাকি।”

“কিন্তু এটা তো জঘন্য আর অমানবিক। আপনার আর সালান্ডারের জীবনের উপর হুমকি দেখা দিলে আমরা কাজটা বন্ধ করে দেবো। হেনরিকের সাথে আমি এ নিয়ে কথা বলবো।”

“না। একদম না। আমি চাই না তার আরেকটা হার্ট অ্যাটাক হোক।”

“দেখা হলেই সে জানতে চায় কাজটার অগ্রগতি কেমন হচ্ছে।”

“আমার পক্ষ থেকে তাকে হ্যালো জানাবেন, আর তাকে বলবেন কাজটা এগিয়ে যাচ্ছে।”

“তাহলে এরপর কি?”

“আমার কিছু প্রশ্ন আছে। প্রথম ঘটনাটি ঘটেছে হেনরিকের হার্ট অ্যাটাকের পর পর, আমি তখন একদিনের জন্য স্টকহোমে গেছিলাম। আমার অনুপস্থিতিতে আমার ঘরে কেউ ঢুকেছিলো। আমি বাইবেলের পংক্তিগুলো প্রিন্ট করে রেখেছিলাম, সেই সাথে ইয়ার্নভাগসগাটানের ছবিগুলো। আমার ডেস্কের উপরেই ছিলো সবগুলো। আপনি আর হেনরিক জানতেন সেটা। মার্টিনও কিছুটা জানতো। আর কে কে জানে?

“আমি আসলে জানি না মার্টিন কার সাথে এ নিয়ে কথা বলেছে। তবে বার্জার আর সিসিলিয়া এ ব্যাপারটা জানতো। ছবি থেকে যে আপনি নতুন কিছু খুঁজে বের করেছেন সেটা নিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলেছিলো। আলেকজান্ডারও জানতো। ভালো কথা, গুনার আর হেলেনা নিলসনও জানতো। হেনরিকের সাথে দেখা করতে এসে এই প্রসঙ্গটা তুলেছিলো তারা। আনিটা ভ্যাঙ্গারও জানো ব্যাপারটা।

“আনিটা? লন্ডনে থাকে যে?”

“সিসিলিয়ার বোন। হেনরিকের হার্ট অ্যাটাকের পর সিসিলিয়ার সাথে সেও এখানে এসেছিলো তবে যে ক’দিন ছিলো হোটেলেই ছিলো এখানে থাকে নি। যতোদূর জানি এখন সে চলে গেছে। সিসিলিয়ার মতো সেও তার বাবাবে দু’চোখেও দেখতে পারে না। হেনরিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট থেকে ক্যাবিনে আসার পরই সে লন্ডন চলে গেছে।”

“সিসিলিয়া এখন কোথায় থাকছে? আজ সকালে তাকে গাড়ি চালিয়ে যেতে দেখেছি তবে তার বাড়িটা তো একেবারে অন্ধকার। ওখানে মনে হয় না কেউ থাকে।”

“সিসিলিয়া এরকম কিছু করার ক্ষমতা রাখে না, তাই না?”

“না, আমি আসলে ভাবছি সে থাকে কোথায়। “

“তার ভাই বার্জারের সাথে থাকে এখন। হেনরিক যে হাসপাতালে আছে জায়গাটা সেখান থেকে হাটা দূরত্বে।”

“আপনি কি জানেন সে এখন কোথায় আছে?”

“না। সে আর হেনরিকের সাথে দেখা করতে আসে না।”

“ধন্যবাদ,” বলেই উঠে দাঁড়ালো ব্লমকোভিস্ট।

.

পুরো হাসপাতালে ভ্যাঙ্গার পরিবারের লোকজনে গিজগিজ করছে। রিসেপশনের সামনে তাকে পাশ কাটিয়ে লিফটের দিকে চলে গেলো বার্জার। প্রবেশপথের সামনে আরেকটু হলেই মার্টিনের সাথে ধাক্কা লেগে যেতো তার। তারা একে অন্যেকে হ্যালো বলে হাত মেলালো।

“হেনরিককে দেখতে এসেছিলেন?”

“না। ডার্চ ফ্রোডির সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।

মার্টিনকে খুব ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। মিকাইলের কাছে মনে হলো এ ক’দিনে মার্টিনের বয়স যেনো আরো বেড়ে গেছে।

“আপনার কি অবস্থা, মিকাইল?” বললো সে।

“প্রত্যেকটা দিন যাচ্ছে আর ইন্টারেস্টিং সব ঘটনা ঘটছে। হেনরিক সেরে উঠলে আশা করি তার কৌতুহল মেটাতে পারবো।”

.

হাসপাতাল থেকে পাঁচ মিনিট দূরত্বে বার্জার ভ্যাঙ্গারের সাদা রঙের ইটের তৈরি বাড়িটা অবস্থিত। সাগর আর হেডেস্টাড মেরিনা দেখা যায় তার বাড়ি থেকে। ব্লমকোভিস্ট যখন দরজার বেল বাজালে কেউ সাড়া দিলো না। সিসিলিয়ার মোবাইলে ফোন করেও কোনো জবাব পেলো না সে। গাড়িতে কিছুক্ষণ বসে রইলো। বার্জার ভ্যাঙ্গার হলো তাসের পেটির সবচাইতে ক্ষ্যাপা তাস। ১৯৩৯ সালে জন্মেছে সে, রেবেকা জ্যাকবসন যখন খুন হয় তার বয়স তখন মাত্র দশ। হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হবার সময় সাতাশ।

হেনরিকের কাছ থেকে শুনেছে বার্জার আর হ্যারিয়েটের মধ্যে খুব কম‍ই দেখা হতো। উপসালায় নিজের পরিবারের সাথে বেড়ে উঠেছে সে। ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশনে যোগ দেবার পর চলে আসে হেডেস্টাডে। ভ্যাঙ্গারদের দুঃসময় ঘনিয়ে এলে কয়েক বছর আগে সেখান থেকে সটকে পড়ে, মনোযোগ দেয় রাজনীতিতে। তবে লেনা এন্ডারসন যখন উপসালায় খুন হয় তখন সে ওখানেই ছিলো।

বেড়ালের ঘটনাটি তার মধ্যে এক ধরণের অস্বস্তিকর অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। যেনো তার হাতের সময় দ্রুত শেষ হয়ে আসছে।

.

হ্যারিয়েট যখন নিখোঁজ হয় অটো ফকের বয়স তখন ছিলো ছত্রিশ। এখন বাহাত্তর বছর বয়স তার, হেনরিক ভ্যাঙ্গারের চেয়ে ছোটো হলেও তার মানসিক সুস্থতা মোটেও ভালো অবস্থায় নেই। হেডেস্টাড শহরের অপর প্রান্তের হেডি নদী থেকে অল্প দূরে সাভালান হাসপাতালটি অবস্থিত। রিসেপশনে নিজের পরিচয় দিয়ে যাজক ফকের সাথে কথা বলতে চাইলো ব্লমকোভিস্ট। সে জানে আলঝেইমা রোগে ভুগছে যাজক ফক। তার বর্তমান অবস্থা কেমন সেটাও জানতে চাইলো। এক নার্স জানালো তিন বছর আগেই যাজকের রোগটি ধরা পড়ে আর এখন তার অবস্থা খুব খারাপ। ফক কথাবার্তা বলতে পারলেও তার স্মৃতি একেবারে দূর্বল হয়ে গেছে। নিজের কোনো আত্মীয়স্বজনকেই চিনতে পারে না। সারা দিন অন্ধকারে ঘুমিয়ে থাকে। যে প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই সেরকম কিছু জানতে চাইলে লোকটা মানসিক চাপে ভোগে।

বাগানে আরো তিনজন রোগি আর একজন পুরুষ নার্সসহ ফক বসে আছে একটা বেঞ্চের উপর। একঘণ্টা ধরে ব্লমকোভিস্ট চেষ্টা করে গেলো তার সাথে কথাবার্তা বলার জন্য।

হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গারকে তার এখনও বেশ মনে আছে। তার কথা শুনেই চোখমুখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। মেয়েটাকে খুবই চার্মিংগার্ল হিসেবে আখ্যায়িত করলো সে। তবে কিছুক্ষণ কথা বলার পরই ব্লমকোভিস্ট বুঝতে পারলো বিগত সাইত্রিশ বছর ধরে যে মেয়েটা নিখোঁজ সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। তার সমন্ধে এমনভাবে কথা বলতে লাগলো যেনো কয়েক দিন আগেই তার সাথে দেখা হয়েছে। এমনকি তার সাথে দেখা হলে যেনো ব্লমকোভিস্ট তার হয়ে তাকে হ্যালো বলে এবং হাসপাতালে এসে তাকে দেখে যায় সে কথাও বললো যাজক ফক। ব্লমকোভিস্ট তাকে কথা দিলো তাই করবে।

বৃজের দুর্ঘটনার কথা তার একদম মনে নেই। তবে তাদের কথোপকথনের প্রায় শেষের দিকে সে এমন একটা কথা বললো যে ব্লমকোভিস্টের কান খাড়া হয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে।

ব্লমকোস্টি যখন হ্যারিয়েটের ধর্মকর্ম নিয়ে আগ্রহের প্রসঙ্গটি তোলার চেষ্টা করলো হঠাৎ করেই ফক কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে উঠলো। যেনো তার মুখের সামনে দিয়ে কালো মেঘ চলে যাচ্ছে। সামনে পেছনে একটু হেলেদুলে অবশেষে ব্লমকোভিস্টের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো সে কে। আবারো নিজের পরিচয় দিলো ব্লমকেভিস্ট। বৃদ্ধ কিছুক্ষণ ভেবে তারপর বললো : “সে এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার উচিত নিজের ব্যাপারে আরো বেশি যত্নবান হওয়া। মেয়েটাকে তুমি সাবধান করে দিও।”

“কিসের ব্যাপারে তাকে সাবধান করবো?”

আচমকা ফক ক্ষেপে গেলো। ভুরু কুচকে মাথা দোলাতে লাগলো সে। “মেয়েটাকে সোলা স্ক্রিপচুরা পড়তে হবে, বুঝতে হবে সাফিসিয়েন্তা স্ক্রিপচুরা। তাহলেই কেবল সোলা ফাইদ মেইনটেইন করতে পারবে সে। জোসেফ তাদেরকে অবশ্যই বাদ দেবে। তাদেরকে কখনওই পুঁথিতে গ্রহণ করা হবে না।”

এসবের কিছুই বুঝতে পারলো না ব্লমকোভিস্ট তারপরও সবটাই নোটে টুকে রাখলো। এরপরই যাজক সাহেব তার দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো, “আমার মনে হয় মেয়েটা ক্যাথলিক। সে জাদু পছন্দ করে, এখনও ঈশ্বরকে খুঁজে পায় নি। তার গাইডেন্সের খুব দরকার।

‘ক্যাথলিক’ শব্দটা যাজক ফকের কাছে অবশ্যই নেতিবাচক কিছু।

“আমার মনে হয় হ্যারিয়েট পেন্টেকোস্টাল আন্দোলনের ব্যাপারে আগ্রহী?”

“না, না, না। পেন্টেকোস্টাল নয়। সে তো নিষিদ্ধ সত্য খুঁজে বেড়াচ্ছে। মেয়েটা ভালো খৃস্টান নয়।”

এরপরই যাজক ফক যেনো ব্লমকোভিস্টকে ভুলে গেলো, পাশে বসে থাকা অন্য রোগীদের সাথে কথা বলতে শুরু করে দিলো সে.।

দুপুর ২টার পরই হেডেবি’তে ফিরে এলো ব্লমকোভিস্ট। আবারো সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গারের দরজায় নক করলো কিন্তু কোনো লাভ হলো না। মোবাইলে ফোন করেও কোনো জবাব পেলো না।

রান্নাঘরের দেয়াল আর সামনের দরজায় স্মোক অ্যালার্ম লাগালো সে। বেডরুমের পাশে ফায়ারপ্লেসের কাছে আর বাথরুমের দরজার কাছে ইস্টিংগুইসার দুটো রেখে দিলো। এরপর লাঞ্চ করে টাইপরাইটারে যাজক ফকের সাথে কথাবার্তার সবটাই লিখে রাখলো সে। কাজটা শেষ হলে চার্চের দিকে তাকালো ব্লমকোভিস্ট।

হেডেবির নতুন চার্চহাউজটি খুবই আধুনিক একটি ভবন, পুরনো চার্চহাউজ থেকে হাটা দূরত্বে অবস্থিত। ৪টার দিকে ব্লমকোভিস্ট দরজায় নক করলো। যাজক মারগারিটা স্ট্র্যান্ডকে সে জানালো ধর্মীয় বিষয়ে কিছু জানার জন্য এসেছে। মারগারিটা তার সমবয়সীই হবে, ঘন কালো চুল, জিন্স প্যান্ট আর ফ্লানেল শার্ট পরে আছে মহিলা। এর আগে সুসানের ক্যাফেতে তার সাথে বার কয়েক হাই হ্যালো হয়েছে। যাজক ফকের সম্পর্কে তখন একটু আধটু কথাও হয়েছে তার সাথে। ব্লমকোভিস্ট খেয়াল করলো মহিলা খালি পায়ে আছে, পায়ের নখে নেইলপলিশ লাগিয়েছে এইমাত্র। মহিলা তাকে আস্তরিকভাবেই অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরের প্রাঙ্গনে নিয়ে এলো।

মহিলাকে সে বললো অটো ফকের সাথে দেখা ক’রে কথা বলেছে। আর বৃদ্ধ কি বলেছে সেটাও জানালো তাকে। মনোযোগ দিয়ে যাজক ভদ্রমহিলা তার কথা শুনে গেলো, কয়েকবার নিজে থেকেই কিছু প্রশ্ন করে পরিস্কার হয়ে নিলো সে।

“আমি মাত্র তিন বছর আগে হেডেবিতে এসেছি। যাজক ফকের সাথে আমার কখনও দেখা হয় নি। আমি এখানে আসার কয়েক বছর আগেই তিনি অবসরে চলে যান। তবে আমার বিশ্বাস তিনি বেশ ভালো যাজক ছিলেন। আপনাকে তিনি যা বলেছেন সেটার অর্থ হতে পারে শুধুমাত্র পবিত্রগ্রন্থ নিয়েই থাকো’-সোলা স্ক্রিপচুরা-আর সাফিসিয়েন্ডা স্ক্রিপচুরা বলে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন বিশ্বাসীদের জন্য পবিত্রগ্রন্থই যথেষ্ট। সোলা ফাইদ মানে শুধুমাত্র ধর্ম বিশ্বাস কিংবা সত্যিকারের ধর্মবিশ্বাস।”

“ঝুঝতে পেরেছি।

“এসবই হলো সাধারণ বক্তব্য। সত্যি বলতে কি চার্চের প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে যাজকেরা এসব কথা বলে থাকেন। অস্বাভাবিক কিছু না। তিনি যা বলেছেন তা একেবারেই সহজ সরল কথা : ‘বাইবেল পড়ো—এটাই তোমাকে পর্যাপ্ত জ্ঞান দান করবে এবং সত্যিকারের ধর্মবিশ্বাসের নিশ্চয়তা দেবে।“

মিকাইল একটু বিব্রত হলো।

“এখন আপনার কাছে জানতে চাচ্ছি উনি কি প্রসঙ্গে এ কথাটা বলেছেন,“ মহিলা বললো।

“তার কাছে আমি এমন এক ব্যক্তির সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলাম যার সাথে অনেক দিন আগে তার পরিচয় ছিলো। ঐ ব্যক্তির উপর আমি এখন একটা লেখা লিখছি।”

“একজন ধর্ম অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তি?”

“অনেকটা সেরকমই।”

“ঠিক আছে। তাহলে মনে হয় কথাগুলোর অর্থ বুঝতে পারছি। আপনি বলেছেন যাজক ফক দুটো জিনিস বলেছেন—‘জোসেফ তাদেরকে অবশ্যই বাদ দেবে এবং ‘তাদেরকে কখনওই পুথিতে গ্রহণ করা হবে না। সম্ভবত আপনি জোসেফাস না শুনে ভুল করে শুনেছেন জোসেফ? অবশ্যই দুটো নাম একজনেরই।”

“তা হতে পারে,” বললো ব্লমকোভিস্ট। “আমি পুরো কথোপকথনটি টেপরেকর্ডারে রেকর্ড করে রেখেছি। আপনি চাইলে শুনতে পারেন।”

“না, আমার মনে হয় না তার দরকার আছে। এই দুটো বাক্যে আমি ভালো করেই জানি। তিনি কি বলতে চেয়েছেন বুঝতে পারছি এখন। জোসেফাস হলো একজন ইহুদি ইতিহাসবিদ, আর ‘তাদেরকে কখনওই পুথিঁতে গ্রহণ করা হবে না বলে যা বলেছেন তার মানে হলো তারা কখনওই হিব্রু পুঁথিতে ছিলো না।

“এর মানে কি?”

মহিলা হেসে ফেললো।

“যাজক ফক বলতে চাচ্ছেন এই ব্যক্তি গুহ্যবিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট, বিশেষ করে অ্যাপোক্রিফার প্রতি। গৃক শব্দ অ্যাপোক্রিফার অর্থ হলো ‘গুপ্ত’। সুতরাং অ্যাপোক্রিফা বলতে গুপ্ত কোনো পুস্তকের কথা বলা হয়েছে, যে পুস্তককে অনেকেই বিতর্কিত বলে মনে করে, আবার অনেকেই মনে করে এই পুস্তকটি ওল্ড টেস্টামেন্টে অর্ন্তভূক্ত হওয়া উচিত। এই পুস্তকগুলো হলো তোবিয়াস, জুডিথ, এস্থার, বারুচ, সিরাখ, ম্যাকাবি পুস্তকসহ এবং আরো কিছু পুস্তক।”

“আমার অজ্ঞানতার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। অ্যাপোক্রিফা সম্পর্কে আমি শুনেছি তবে সেটা কখনও পড়ি নি। এইসব পুস্তকের বিশেষত্ব কি?”

“এগুলোর আসলে কোনো রকম বিশেষত্বই নেই, শুধুমাত্র পুস্তকগুলো ওল্ড টেস্টামেন্টের পরও টিকে ছিলো, এই যা। হিব্রু বাইবেল থেকে অ্যাপোক্রিফাকে বাদ দেয়া হয়েছে-তার কারণ এই নয় যে ইহুদি পণ্ডিতেরা এসব বিষয়ের প্রতি আস্থাবান ছিলো না, আসলে এই পুস্তকগুলো ঈশ্বরের সমস্ত কর্ম জিশুর মধ্যে প্রকাশ হবার পর লেখা হয়েছিলো। তাই এগুলোকে বাদ দেয়া হয়। বাইবেলের পুরনো গৃক অনুবাদে অ্যাপোক্রিফা অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছিলো। তাদের কাছে বিশেষ করে রোমান ক্যাথলিক চার্চের কাছে এগুলোকে বিতর্কিত বলে মনে হয় নি।”

“বুঝতে পেরেছি।”

“অবশ্য প্রটেস্টান্ট চার্চের কাছে এই পুস্তকগুলো একেবারেই বিতর্কিত বিষয়। রিফর্মেশনের সময় ধর্মবেত্তারা প্রাচীন হিব্রু বাইবেল ঘেটে দেখেছেন। বাইবেলের সংস্কারের সময় মার্টিন লুথার অ্যাপোক্রিফাকে বাদ দিয়ে দেন। পরবর্তীতে ক্যালভিন ঘোষণা দেন যে অ্যাপোক্রিফা খৃস্টানদের মূল বিশ্বাসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বরং এই পুস্তকের অনেক বিষয়ই ক্লারিতাস স্ক্রিপচুরার সাথে সাংঘর্ষিক।“

“অন্য কথায় বলতে গেলে সেন্সর করা বই।”

“একদম ঠিক। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, অ্যাপোক্রিফায় বলা হয়েছে জাদুবিদ্যার চর্চা করা যেতে পারে, অনেক ক্ষেত্রেই এটা অনুমতিযোগ্য একটা বিদ্যা। কিন্তু এই বক্তব্য বাইবেলে সাথে বিরোধপূর্ণ।”

“তাহলে ধর্মের প্রতি যাদের আগ্রহ আছে, ভক্তি আছে তাদের জন্য অ্যাপোক্রিফা পড়াটা একেবারে অচিন্তনীয় ব্যাপার নয়, কিংবা যাজক ফক এ বিষয়টা নিয়ে আপসেট ছিলেন।”

“ঠিক ধরেছেন। আপনি যদি বাইবেল পড়েন তো অ্যাপোক্রিফার সাথে পরিচয় হবেই। এটা এড়ানো যাবে না। আর যারা গুপ্তবিদ্যার প্রতি আগ্রহী তাদেরকে তো আরো বেশি আকর্ষণ করবে।”

“আপনার কাছে অ্যাপোক্রিফার কোনো কপি নেই, নাকি আছে?”

আবারো হেসে ফেললো মহিলা। তবে সেটা আন্তরিক আর ইতিবাচক।

“অবশ্যই আছে। আশির দশকে বাইবেল কমিশন স্টেট রিপোর্ট হিসেবে অ্যাপোক্রিফা প্রকাশ করে।”

.

সালান্ডার যখন আরমানস্কিকে বললো তার সাথে একান্তে কথা বলতে চায় তখন সে ভাবতে লাগলো হয়েছেটা কি। তাকে দরজা বন্ধ করে তার ডেস্কের সামনে বসতে বললো আরমানস্কি। মেয়েটা জানালো মিকাইল ব্লমকোভিস্টের হয়ে যে কাজ হাতে নিয়েছিলো সেটা সে ভালোমতোই করেছে-এ মাস শেষ হবার আগেই আইনজীবি ভদ্রলোক তার পাওনা টাকা পরিশোধ করে দেবে—তবে সে ঠিক করেছে এই তদন্তের কাজটা আরো কিছুদিন চালিয়ে যাবে। এক মাসের জন্য তাকে বেশ ভালো অঙ্কের বেতন দেবে ব্লমকোভিস্ট।

“আমি এই কাজটা নিজে নিয়েছি,” সালান্ডার বললো। “এর আগে কখনওই তোমার দেয়া কাজের বাইরে কোনো কাজ আমি নেই নি। অবশ্য আমাদের মধ্যে এরকমই চুক্তি আছে। আমি জানতে চাই আমি যদি আমার নিজের পছন্দে নিজের মতো করে কোনো কাজ নেই তাহলে আমাদের সম্পর্কটার কি হবে?”

আরমানস্কি কাঁধ তুললো।

“তুমি একজন ফুল্যান্সার, চাইলে যেকোনো কাজ তুমি নিতে পারো। তুমি যে নিজের কাজ নিজে নিচ্ছো সেটা জেনে আমি খুশিই হয়েছি। তবে আমাদের মাধ্যমে পাওয়া কোনো ক্লায়েন্টের সাথে স্বাধীনভাবে কাজ করাটা অবশ্য আনুগত্য ভঙ্গ করার শামিল।”

“সেরকম কোনো কিছু করার পরিকল্পনা আমার নেই। ব্লমকোভিস্টের সাথে করা আমাদের কনট্রাক্ট অনুযায়ী আমি কাজটা শেষ করেছি। কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে এই কাজে আমি আরো কিছুদিন থেকে যেতে চাচ্ছি। এটা এমনকি বিনাপারিশ্রমিকে করতেও রাজি ছিলাম।”

“কখনও কোনো কাজ বিনাপারিশ্রমিকে করবে না।”

“তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছো আমি কি বলতে চাচ্ছি। আমি আসলে জানতে চাই এই গল্পটার শেষ কোথায়। ব্লমকোভিস্টকে আমি রাজি করিয়েছি তার আইনজীবিকে যেনো বলে আমাকে রিসার্চ সহকারী হিসেবে রেখে দিতে।”

চুক্তিপত্রটি ডেস্কের উপর দিয়ে আরমানস্কির দিকে ঠেলে দিলো সে। পুরোটা পড়ে দেখলো সিকিউরিটি প্রধান।

“যে বেতন দেয়া হবে তাতে তো মনে হচ্ছে বিনাপারিশ্রমিকেই কাজ করছো। লিসবেথ, তোমার প্রতিভা আছে। এতো অল্প টাকায় কাজ করার দরকার নেই তোমার। তুমি ভালো করেই জানো আমাদের সাথে ফুলটাইম কাজ করলে অনেক বেশি টাকা আয় করতে পারবে তুমি।”

“আমি ফুলটাইম কাজ করতে চাই না। তবে ড্রাগান, তোমার প্রতি আমার আনুগত্য আছে। শুরু থেকেই তুমি আমাক সমর্থন দিয়ে এসেছো। আমি কেবল জানতে চাই এরকম কনট্রাক্টে তোমার কোনো আপত্তি নেই, এতে করে আমাদের মধ্যে কোনো রকম মনোমালিন্য হবে না।”

“বুঝতে পেরেছি।” একটু ভাবলো সে। “এটা একশত ভাগ ঠিক আছে। আমাকে জিজ্ঞেস করার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। ভবিষ্যতে যদি এরকম ঘটনা আবারো ঘটে তাহলে তুমি আমাকে জিজ্ঞেস ক’রে নিলেই হবে। আমি বাধা দেবো না। ভুলবোঝাবুঝিরও কোনো সম্ভাবনা থাকবে না।”

আর কিছু বলবে কিনা ভেবে নিলো সালান্ডার। আরমানস্কির দিকে স্থিরচোখে তাকালো সে, তবে কিছু বললো না। কেবল মাথা নেড়ে সায় দিয়ে উঠে দাঁড়ালো চলে যাবার জন্য। যথারীতি কোনো রকম বিদায় জানানো ছাড়াই ঘর থেকে বের হয়ে গেলো সে।

তার যা জানার দরকার জেনে গেছে, তাই আরমানস্কির ব্যাপারে আগ্রহটাও তিরোহিত হয়ে গেছে সঙ্গে সঙ্গে। আপন মনেই হাসলো সালান্ডার। তার কাছ থেকে যে উপদেশ চেয়েছে এটাকে তার সামাজিকীকরণের বেলায় একটি অগ্রগতি হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।

.

মিউজিয়ামে বসে ফোল্ডার থেকে সিকিউরিটির উপর একটি রিপোর্ট বের করলো সে। এই মিউজিয়ামে ফরাসি ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের বিশাল একটি প্রদর্শনী শুরু হতে যাচ্ছে। এরপর ফোল্ডারটা রেখে দরজার দিকে তাকালো, এইমাত্র সেখান দিয়ে সালান্ডার চলে গেছে। সে ভাবতে লাগলো নিজের অফিসে গিয়ে ব্লমকোভিস্টকে নিয়ে কতোটাই না হেসেছে। আরো ভাবলো মেয়েটা অবশেষে পরিপক্ক হয়েছে কিনা, কিংবা ব্লমকোভিস্টই হলো সেই ব্যক্তি যার প্রতি মেয়েটা আকর্ষিত হচ্ছে। অদ্ভুত এক অস্বস্তিও বোধ করলো সে। লিসবেথ যে একজন ভিকটিম এই চিন্তাটা সে কোনোভাবেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না। এই তো মেয়েটা, ক্ষ্যাপাটে এক বুড়োকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

উত্তর দিকে যাবার সময় হঠাৎ করেই আপেলফিকেন নার্সিংহোমে ঢুঁ মেরে নিজের মাকে দেখে গেলো সালান্ডার। ক্রিসমাসের পর মধ্যগ্রীষ্মের ছুটিতে একবার দেখে গেছে, এরপর আর এখানে আসা হয় নি। এ নিয়ে তার মনে খেদ আছে।

তার মা বেডরুমেই ছিলো। মা’র সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে তাকে নিয়ে বাইরে হেটে আসলো সে। তার মা এখনও তার বোনের ব্যাপারে অভিযোগ করে যাচ্ছে। তবে আগেবারের চেয়ে এখন তার মাকে আরো বেশি বিপর্যস্ত ব’লে মনে হলো তার কাছে।

মা’কে যখন বিদায় জানিয়ে চলে আসবে দেখা গেলো তার হাত আর ছাড়ছে না। অবশেষে খুব জলদি আবার দেখতে আসবে এরকম কথা দিয়ে চলে আসার সময় মায়ের চোখেমুখে অস্বাভাবিক চিন্তার ছাপ দেখা গেলো।

যেনো আসন্ন কোনো মহাদুর্যোগের ব্যাপারে সতর্ক ক’রে দিচ্ছে তাকে।

.

ক্যাবিনের পেছনে বাগানে বসে বসে অ্যাপোক্রিফা নিয়ে দু’ঘণ্টা পার করে দিলো ব্লমকোভিস্ট। কিন্তু এক বিন্দুও বুঝতে পারলো না। অবশ্য তার মনে একটা চিন্তার উদ্রেক হলো। হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গার কতোটা ধার্মিক ছিলো? নিখোঁজ হবার এক বছর আগে থেকে বাইবেল নিয়ে তার আগ্রহ দেখা গেছে। কতোগুলো হত্যাকাণ্ডের সাথে বাইবেলের উদ্ধৃতি জুড়ে দিয়েছে সে, বাইবেল ছাড়াও অ্যাপোক্রিফা পড়েছে, ক্যাথলিক মতবাদের প্রতিও আগ্রহী হয়ে উঠেছিলো হ্যারিয়েট।

ব্লমকোভিস্ট আর সালান্ডার এখন যে অনুসন্ধানে নেমেছে হ্যারিয়েটও কি সাইত্রিশ বছর আগে একই কাজ করেছিলো? ধর্মের প্রতি না হয়ে কি তার সমস্ত আগ্রহ ছিলো খুনিকে ধরার ব্যাপারে? যাজক ফকের চোখে হ্যারিয়েট হলো একজন অনুসন্ধানী, ভালো খৃস্টান নয়।

তার মোবাইলে বার্গার ফোন করলে চিন্তায় ছেদ পড়লো।

“আমি আর গ্রেগর সামনের সপ্তাহে ছুটি কাটাতে চলে যাচ্ছি, সেটা বলার জন্যই তোমাকে ফোন করেছি। কয়েক সপ্তাহ বাইরে থাকবো।”

“কোথায় যাচ্ছো?”

“নিউইয়র্ক। গ্রেগরের একটা প্রদর্শনী আছে ওখানে। এরপর আমরা ক্যারিবিয়ানে যাবো। অ্যান্টিগুয়াতে গ্রেগরের এক বন্ধুর বাড়িতে থাকবো দু’সপ্তাহ।”

“শুনে তো মনে হচ্ছে দারুণ ব্যাপার স্যাপার। তোমাদের সময় ভালো কাটুক। গ্রেগরকে আমার তরফ থেকে হাই জানিয়ে দিও।”

“নতুন সংখ্যাটার কাজ শেষ, আর পরের সংখ্যার কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। আমি চেয়েছিলাম তুমি এডিটরের কাজটা তুলে নাও তবে ক্রাইস্টার বলেছে সে নাকি করতে পারবে।”

“তার যদি কোনো সাহায্যের দরকার পড়ে আমাকে যেনো ফোন করে। জেইন ডালম্যানের কি খবর?”

একটু ইতস্তত করলো বার্গার।

“সেও ছুটিতে যাচ্ছে। আমি হেনরিকে ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজিং এডিটর হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছি। সে আর ক্রাইস্টার সব দেখাশোনা করবে।

“ঠিক আছে।

“আগস্টের সাত তারিখে ফিরবো।”

.

সন্ধ্যার দিকে পাঁচ পাঁচবার সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গারকে ফোন করার চেষ্টা করলো ব্লমকোভিস্ট। অবশেষে তাকে যেনো ফোন করা হয় এরকম একটি মেসেজ লিখে পাঠিয়ে দিলো। তারপরও কোনো জবাব পেলো না সে।

অ্যাপোক্রিফা রেখে ট্র্যাকসুট পরে বাইরে বের হলো তবে তার আগে দরজায় তালা লাগাতে ভুলে গেলো না।

সৈকতের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া সরুপথ ধরে চলে গেলো বনের ভেতর। বন্ধুরপথ দিয়ে দৌড়াতে গিয়ে হাপিয়ে উঠলো সে। যখন দূর্গটা চোখে পড়লো দম ফুরিয়ে নিঃশেষ হয়ে এলো। দূর্গের কাছে এসে একটা কংক্রিটের চত্বরে হাত-পা ছড়িয়ে কয়েক মিনিট বিশ্রাম নিলো ব্লমকোভিস্ট।

হঠাৎ করে তীক্ষ্ম একটা শব্দ শুনতে পেলো আর সঙ্গে সঙ্গে তার মাথার কাছে কংক্রিটে এসে কি যেনো বিঁধলো। এরপরই মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা টের পেলো সে কারণ কংক্রিটের ধারালো টুকরো এসে বিঁধেছে মাথায়।

হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ব্লমকোভিস্ট। যেনো প্যরালাইজ হয়ে গেছে। এরপরই সম্বিত ফিরে পেয়ে পাশের পরিত্যাক্ত বাঙ্কারে লাফ দিয়ে নেমে পড়লো দ্রুত। বাঙ্কারে নামতেই দ্বিতীয় গুলিটা করা হলো তাকে উদ্দেশ্য করে। বুলেটটা গিয়ে আঘাত করলো কংক্রিটের ফাউন্ডেশনের উপর।

মাথা তুলে চারপাশটা দেখে নিলো, দূর্গের মাঝখানে আছে সে। ডানে এবং বামে এক গজের মতো গভীর একটা সংকীর্ণ পথ চলে গেছে আনুমানিক ২৫০ গজের মতো। মাথা নীচু করে সেই পথ ধরে দৌড়াতে লাগলো সে।

কিরুনার ইনফেন্ট্রি স্কুলের শীতকালীন প্রশিক্ষণ শিবিরে থাকার সময় ক্যাপ্টেন এডলফসনের কণ্ঠটার প্রতিধ্বণি শুনতে পেলো। ব্লমকোভিস্ট, নিজের মাথাটা যদি বাঁচাতে চাও মাথা নীচু করে রাখো। ক্যাপ্টেনের সেই প্রশিক্ষনের

কথা এতোগুলো বছর পরও তার মনে আছে।

একটু থেমে দম নিয়ে নিলো। তার হৃদপিণ্ডটা লাফাচ্ছে। নিজের হৃদস্পন্দন ছাড়া আর কিছু শুনতে পাচ্ছে না। আকার এবং আকৃতির তুলনায় মানুষের চোখ গতিকে দ্রুত ধরতে পারে। স্কাউটিং করার সময় আস্তে আস্তে এগোবে। বাঙ্কার থেকে একটু মাথা বের করে তাকালো ব্লমকোভিস্ট। সূর্যটা ঠিক তার চোখ বরাবর ফলে কোনো কিছু ভালো ক’রে দেখা প্রায় অসম্ভব। তবে কোনো রকম নড়াচড়া দেখতে পেলো না সে।

আবারো মাথা নীচু করে সামনের দিকে এগোতে লাগলো মিকাইল ব্লমকোভিস্ট। শত্রুর অস্ত্র কতো ভালো তাতে কিছু যায় আসে না। সে যদি তোমাকে দেখতে না পায় তাহলে তোমাকে গুলি করতে পারবে না। নিজেকে আড়াল করো। আড়াল করো। তোমাকে যে দেখতে পাচ্ছে না সেটা নিশ্চিত করো।

ওস্টারগার্ডেনের ফার্ম থেকে ৩০০ গজ দূরে আছে এখন। সামনের ৪০ গজ ঘন আর লম্বা ঘাসে ঢাকা একটি প্রান্তর। ঐ জায়গাটা পেরোতে হলে তাকে দৌড়াতে হবে। কিন্তু এটা করলে তাকে দেখে ফেলবে অদৃশ্য শত্রু। এটাই একমাত্র পথ। তার পেছনে আছে সাগর।

টের পেলো মাথার যন্ত্রণাটা বেড়ে যাচ্ছে। হাত দিয়ে দেখেতে পেলো ওখান থেকে বেশ রক্ত ঝরে পড়ছে এখন। তার টি-শার্টটা পর্যন্ত সেই রক্তে ভিজে একাকার। মাথার আঘাতে যে রক্তপাত হয়ে সেটা কখনও থামে না, ভাবলো সে। একটা গুলি দুর্ঘটনাক্রমে হতে পারে, কিন্তু দুটোর অর্থ একেবারে ভিন্ন। কেউ তাকে খুন করতে চাচ্ছে। বন্দুকবাজ লোকটি তার জন্যে অপেক্ষা করছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছে না।

নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো, যৌক্তিকভাবে চিন্তা করারও চেষ্টা করলো সেই সাথে। অপেক্ষা করা কিংবা এখান থেকে বের হয়ে যাওয়া এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার। বন্দুকবাজ লোকটি যদি তার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে তাহলে বের হওয়ার বুদ্ধিটা মোটেও ভালো হবে না। আবার সে যদি বাঙ্কারে বসে অপেক্ষা করে বন্দুকবাজ লোকটি তার অলক্ষ্যে আস্তে আস্তে হেটে চলে আসবে তার কাছে, তারপর খুব কাছ থেকে গুলি করে মেরে ফেলবে তাকে।

সে (পুরুষ অথবা নারী) জানে না আমি ডানে যাবো নাকি বায়ে যাবো। রাইফেল দিয়ে গুলি করা হয়েছে সম্ভবত। হয়তো টেলিস্কোপ আছে তাতে। তার মানে সে যদি মিকাইলকে দেখার চেষ্টার করে তাহলে তার দেখার পরিধিটা বেশি বড় নয়।

তুমি যদি কোণঠাসা হয়ে পড়ো-দ্রুত পদক্ষেপ নেবে। অপেক্ষা করার চেয়ে এটাই ভালো। চারপাশে তাকিয়ে শব্দ শোনার চেষ্টা করলো দু’মিনিট ধরে। তারপর বাঙ্কার থেকে উঠে ঘন ঘাসের মধ্য দিয়ে প্রাণপনে দৌড়াতে শুরু করলো সে।

ঘাসে ঢাকা চত্বরটির ঠিক মাঝখানে আসতেই তৃতীয় গুলিটা করা হলো। তবে এবারের শব্দটা তীক্ষ্ম ছিলো না। তার ঠিক পেছনেই ভোতা একটি শব্দ হলো কেবল। সঙ্গে সঙ্গে ঘাসের মধ্যে শুইয়ে পড়লো সে। ধারালো আর কাঁটাযুক্ত ঘাসের মধ্য দিয়ে হামাগুঁড়ি দিয়ে এগোতে লাগলো ব্লমকোভিস্ট। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে যে দিকে থেকে গুলিটা এসেছে তার বিপরীত দিক দিয়ে ছুটতে শুরু করলো। কিছু দূর দৌড়ে গেলো তো আবার কিছুটা পথ গেলো হামাগুঁড়ি দিয়ে। পঞ্চাশ গজ পর পর থামলো, কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো কোনো শব্দ পাওয়া যায় কিনা। দূর্গ আর তার মধ্যে ডালপালার মটমট শব্দ কানে এলো তার। সঙ্গে সঙ্গে ঘাসের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো।

হামাগুঁড়ি দেবার সময় বাহু আর কই ব্যবহার করবে এটা ছিলো ক্যাপ্টেন এডলফসনের আরেকটি প্রিয় বাক্য। হামাগুঁড়ি দিয়েই বাকি ১৫০ গজ পেরোলো ব্লমকোভিস্ট। দু’দুবার শুনতে পেলো তার পেছনে ঘাসের উপর কারোর পায়ের শব্দ। প্রথমটি খুব কাছের বলে মনে হলো তার কাছে, বড়জোর বিশ কদম পেছনে, ডান দিক থেকে। একেবারে জমে গেলো সে, একটুও নড়লো না।

.

কিছুক্ষণ পর কৌতুহলবশত মাথা তুলে দেখার চেষ্টা করলো কিন্তু কাউকে দেখতে পেলো না। আবারো স্থির হয়ে পড়ে রইলো অনেকক্ষণ। নিজের নার্ভকে প্রস্তত করে রাখলো, হয় দৌড়ে ছুটে পালাবে নয়তো শত্রুর মুখোমুখি হলে তার উপর পাল্টা আঘাত হানবে। পরের শব্দটা অনেক দূর থেকে এলো। তারপর আর কোনো সাড়াশব্দ নেই।

সে জানে আমি এখানে আছি। সে কি অন্য কোথাও অবস্থান নিয়েছে, আমি কখন উঠে দাঁড়াই সেই অপেক্ষা করছে? নাকি লোকটা পিছু হটে গেছে?

হামাগুঁড়ি দিতে দিতে ওস্টারগার্ডেনের বেড়ার কাছে পৌঁছে গেলো সে।

এই সময়টা খুবই ক্রিটিক্যাল। দেখতে পাচ্ছে বেড়ার ভেতরে একটা পথ চলে গেছে। মাটিতে শুয়ে থেকেই চারপাশটা আবারো দেখে নিলো। ৪০0 গজের অল্প একটু ঢালু প্রান্তর তারপরই ফার্মহাউজটি অবস্থিত। বাড়িটার ডানে দেখতে পেলো কয়েকটি গরু তাকিয়ে আছে। গুলির শব্দ শুনে কেউ বেরিয়ে আসে নি কেন? গ্রীষ্মকাল। হয়তো বাড়িতে কেউ নেই।

এই খোলা প্রান্তরটি অতিক্রম করার প্রশ্নই ওঠে না-কোনো কিছু নেই যে নিজেকে আড়াল করতে পারবে। এখান দিয়ে দৌড়ে যাওয়া মানে সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়া। হামাগুঁড়ি দিয়ে একটু পেছনে গিয়ে পাইন গাছের জঙ্গলের কাছে চলে এলো।

.

ওস্টারগার্ডেনের মাঠ পেরিয়ে সোডারবার্গেট পাহাড়ের পাদদেশ হয়ে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করলো ব্লমকোভিস্ট। ওস্টারগার্ডেন অতিক্রম করার পর দেখতে পেলো তাদের গাড়িটা নেই। সোডারবার্গেটের চূড়ায় উঠে একটু থেমে নীচের হেডেবি এলাকাটার দিকে তাকালো। সাগরের তীরে অবস্থিত পুরনো ফিশিং ক্যাবিনের আশেপাশে কিছু লোকজন আছে। এরা গ্রীষ্মকালের ভিজিটর। ডকের উপর গোসল করার পোশাক পরে মহিলারা কথা বলছে। ওখান থেকে চমৎকার একটা গন্ধ পেলো; বাইরে গূল বানানো হচ্ছে জ্বলন্ত কয়লার উপর। ডকের উপর কিছু বাচ্চাকাচ্চা একে অন্যের দিকে পানি ছুড়ে মেরে আনন্দ করছে।

ঠিক ৮টার আগে। প্রথম গুলিটা করার পঞ্চাশ মিনিট পর। শুধুমাত্র শর্টস পরে খালি গায়ে নিলসন তার বাড়ির প্রাঙ্গনটি পানি দিয়ে পরিস্কার করছে। তুমি এখানে কতোক্ষণ ধরে আছো? অ্যানা ছাড়া ভ্যাঙ্গারের বাড়িটা একেবারে ফাঁকা। হেরাল্ড ভ্যাঙ্গারের বাড়িটা অবশ্য সব সময়ই ফাঁকা মনে হয়। ওখানেই, পেছনের বাগানে ইসাবেলা ভ্যাঙ্গারকে দেখতে পেলো সে। মহিলা বসে আছে, কারো সাথে কথা বলছে নিশ্চিত। তবে কয়েক সেকেন্ড পরই ব্লমকোভিস্ট বুঝতে পারলো মহিলা আসলে কথা বলছে অসুস্থ গার্দা ভ্যাঙ্গারের সাথে। ১৯২২ সালে জন্মেছে সে, বর্তমানে তার ছেলে আলেকজান্ডারের সাথে থাকে। তার বাড়ি হেনরিকের বাড়ির ঠিক পেছনেই। তার সাথে মিকাইলের কখনও দেখা হয় নি। তবে মহিলাকে বেশ কয়েকবার দেখেছে সে। সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গারের বাড়িটা ফাঁকা বলে মনে হলেও রান্নাঘরে কারোর উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। ও বাড়িতে আছে। বন্দুকবাজ কি তবে একজন নারী? সিসিলিয়া যে বন্দুক চালাতে জানে সেটা মিকাইল জানে। তার বাড়ির সামনে মার্টিন ভ্যাঙ্গারের গাড়িটা পার্ক করা আছে। কতোক্ষণ ধরে তোমরা বাড়িতে আছো?

নাকি এমন কেউ যার কথা সে এখনও ভাবে নি? ফ্রোডি? আলেকজান্ডার? অনেক সম্ভাবনা।

সোডারবার্গেট পাহাড় থেকে নেমে গ্রামে যাবার পথ ধরে এগোতে লাগলো সে। অবশেষে কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই বাড়িতে ফিরে এলো। প্রথম যে জিনিসটা দেখতে পেলো সেটা হলো তার কটেজের দরজা একটু খোলা। সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে পা টিপে টিপে একটু এগোতেই কফির গন্ধ পেলো, রান্নাঘরের জানালা দিয়ে দেখতে পেলো সালান্ডারকে।

“অনেক রক্তপাত হলেও বিপজ্জনক কিছু না,” মেয়েটা কিছু বলার আগেই বললো ব্লমকোভিস্ট।

সঙ্গে সঙ্গে কাপবোর্ড থেকে ফার্স্টএইড বক্সটা নামিয়ে আনলো সালান্ডার। কাপড়চোপড় খুলে বাথরুমে চলে গেলো ব্লমকোভিস্ট।

তার মাথার আঘাত এতোটাই বেশি যে সেলাই না করলে রক্তপাত বন্ধ করা সম্ভব নয়। তারপরও ব্লমকোভিস্ট মনে করলো ভালো করে টেপ দিয়ে পেচিয়ে রাখলেই চলবে। ঠাণ্ডা পানিতে তোয়ালে ভিজিয়ে মুখটা মুছে নিলো সে।

শাওয়ারের নীচে মাথায় তোয়ালেটা চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ করে বাথরুমের দেয়ালে এতো জোড়ে ঘুষি মেরে বসলো যে হাতের চামড়া থেতলে গেলো কিছুটা। তুমি যে-ই হও শালা, তোমাকে আমি দেখে নেবো, মনে মনে বললো সে। তোমাকে আমি ঠিকই খুঁজে বের করবো, তোমাকে আমি ছাড়বো না।

সালন্ডার তাকে স্পর্শ করতেই সে এমনভাবে লাফ দিয়ে উঠলো যেনো তাকে ইলেক্ট্রক শক দেয়া হয়েছে। তার দু’চোখে উন্মত্ত ক্রোধ দেখে পিছু হটে গেলো মেয়েটা। তার হাতে সাবানটা দিয়ে আর কোনো কথা না বলেই চলে গেলো রান্নাঘরে।

তিনটি সার্জিক্যাল টেপ লাগালো মাথায়, তারপর ড্রয়ার থেকে জিন্স প্যান্ট আর টি-শার্ট বের করে পরে প্রিন্ট করা ছবির ফোল্ডারটা বের করে হাতে নিয়ে নিলো। প্রচণ্ড রাগে আর ক্ষোভে কাঁপতে লাগলো সে।

“তুমি এখানেই থাকো, লিসবেথ,” চিৎকার করে বললো ব্লমকোভিস্ট।

নিজের কটেজ থেকে সোজা চলে গেলো সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গারের বাড়িতে। কলিং বেল বাজালে আধ মিনিট পর দরজা খুললো সিসিলিয়া।

“আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই না,” বললো সে। এরপরই তাকালো তার মুখের দিকে, টেপ চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে সেখান থেকে।

“আমাকে ভেতরে ঢুকতে দাও। তোমার সাথে কথা আছে।”

একটু ইতস্তত করলো সে। “তোমার সাথে আমার কথা বলার কিছু নেই।

“কিন্তু আমাকে কথা বলতে হবে। তুমি চাইলে আমি এখানে দাঁড়িয়েও বলতে পারি, কিংবা রান্নাঘরে।”

ব্লমকোভিস্টের কথার মধ্যে এতোটাই জোড় ছিলো যে সিসিলিয়া তাকে ভেতরে ঢুকতে দিলো। তারা বসলো রান্নাঘরে।

“তুমি কি করেছো?” বললো সিসিলিয়া।

“আমি যে হ্যারিয়েটের ব্যাপারটা নিয়ে তদন্ত করছি সেটাকে তুমি হেনরিকের অখণ্ড অবসরের অর্থহীন এক থেরাপি হিসেবে উল্লেখ করেছো। এটা হয়তো সত্যি ছিলো কিন্তু এক ঘণ্টা আগে কেউ আমার মাথাটা প্রায় গুড়িয়ে দিতে বসেছিলো। আর গতরাতে সম্ভবত ঐ একই বদমাশ একটা বেড়ালকে বিভৎসভাবে হত্যা করে আমার কটেজের পোর্চের সামনে ফেলে রেখেছিলো।”

সিসিলিয়া মুখ খুলতে যাবে অমনি হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলো ব্লমকোভিস্ট।

“সিসিলিয়া, তোমার সমস্যা কি, কি নিয়ে তুমি উদ্বিগ্ন সেটা নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যাথা নেই। তুমি আমাকে কেন এড়িয়ে চলছো তাতেও বলার কিছু নেই আমার। আমি আর কখনও তোমার ধারেকাছেও আসবো না। ভেবো না তোমার পেছনে আমি হন্যে হয়ে লেগে থাকবো। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে তোমার সাথে আমার পরিচয় না হলেই ভালো হতো। তবে তোমাকে একটা প্রশ্ন করতেই হবে আমাকে। আজ হোক কাল হোক এই প্রশ্নের জবাব তোমাকে দিতেই হবে। যতো জলদি দেবে ততোই আমার হাত থেকে মুক্তি পাবে তুমি

“তুমি কি জানতে চাও?”

“এক : এক ঘণ্টা আগে তুমি কোথায় ছিলে?”

সিসিলিয়ার মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেলো।

“এক ঘণ্টা আগে আমি হেডেস্টাডে ছিলাম।”

“তুমি যে ওখানে ছিলে সেটা কি অন্য কেউ জানে?”

“কেউ জানে কি না জানে সেই কৈফিয়ৎ আমি তোমার কাছে দেবো না।”

“দুই : হ্যারিয়েট যে দিন নিখোঁজ হয় সেদিন কেন তার ঘরের জানালা তুমি খুলেছিলে?”

“কি?”

“আমার কথা ঠিকই শুনেছো তুমি। এতোগুলো বছর ধরে হেনরিক চেষ্টা করে গেছে ঐ দিন হ্যারিয়েটের জানালা খুলেছিলো কে। সবাই অস্বীকার করেছে। কেউ না কেউ মিথ্যে বলেছিলো জানি।”

“তুমি কি করে ভাবলে আমিই জানালা খুলেছিলাম?”

“এই ছবিটা,” তার কিচেন টেবিলের উপর একটা ছবি রেখে বললো ব্লমকোভিস্ট।

ছবিটা হাতে তুলে নিয়ে ভালো করে দেখলো সিসিলিয়া। ব্লমকোভিস্টের মনে হলো তার চেহারায় ভড়কে যাবার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। মুখ তুলে তাকালো সিসিলিয়া। তার কাছে মনে হলো মাথার ব্যান্ডেজ থেকে চুইয়ে এক ফোঁটা রক্ত তার শার্টে পড়েছে।

“ঐদিন এখানে ষাটজনের মতো লোক ছিলো,” বললো মিকাইল। “তার মধ্যে আঠাশজন ছিলো মহিলা। পাঁচ-ছয়জনের ছিলো কাঁধ অবধি সোনালি চুল। তাদের মধ্যে শুধুমাত্র একজন হালকা রঙের পোশাক পরা ছিলো

ছবিটার দিকে গভীর মনোযোগের সাথে চেয়ে আছে সিসিলিয়া।

“তুমি ভাবছো ছবির এই মেয়েটা আমি?”

“এটা যদি তুমি না হয়ে থাকো তাহলে আমি জানতে চাইবো এই মেয়েটা কে। এর আগে এই ছবিটার কথা কেউ জানতে পারে নি। কয়েক সপ্তাহ আগে এটা আমি বের করেছি। তোমার সাথে কথা বলার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। শুনতে হয়তো বোকামি বলেই মনে হবে, এই ছবির কথা আমি কাউকে বলি নি, এমনকি হেনরিককেও না। নিশ্চিত না হয়ে তোমাকে সন্দেহের তালিকায় ফেলার কোনো ইচ্ছে আমার ছিলো না। কিন্তু এখন আমাকে প্রশ্নটার জবাব জানতেই হবে।”

“তুমি তোমার প্রশ্নের জবাব পাবে।” ছবিটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো সে। “সেদিন আমি হ্যারিয়েটের ঘরে যাই নি। ছবিতে যাকে দেখা যাচ্ছে সে আমি না। তার নিখোঁজ হবার সাথে আমার বিন্দুমাত্রও কোনো সম্পর্ক ছিলো না।”

দরজার কাছে চলে গেলো সে।

“তুমি তোমার জবাব পেয়ে গেছো। এখন দয়া করে চলে যাও। তবে আমি মনে করি তোমার মাথার আঘাতটা গুরুতর, ডাক্তারের কাছে যাও।”

.

গাড়ি চালিয়ে তাকে হেডেস্টাডের হাসপাতালে নিয়ে গেলো সালান্ডার। দুটো সেলাই আর ভালো করে ব্যান্ডেজ করার পর রক্তপাত বন্ধ হলো। হাতে পায়ে যেসব জায়গায় ছিলে গেছিলো সেখানেও ওষুধ লাগিয়ে দিলো ডাক্তার।

হাসপাতাল থেকে চলে আসার পর ব্লমকোভিস্ট অনেকটা সময় ধরে বসে বসে ভাবলো পুলিশের কাছে যাবে কি যাবে না। সংবাদের শিরোনামটি দেখতে পেলো সে : “সাজা পাওয়া সাংবাদিকের গোলাগুলির নাটক।” মাথা ঝাঁকালো ব্লমকোভিস্ট। “চলো, বাড়ি যাই।

হেডেবি’তে যখন ফিরে এলো তখন বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। সালান্ডারের জন্য এটা বেশ ভালো সময়। রান্নাঘরের টেবিলের উপর থেকে একটা স্পোর্ট ব্যাগ তুলে নিলো সে।

“এগুলো আমি মিল্টন সিকিউরিটি থেকে ধার করেছি। এখন সময় এসেছে জিনিসগুলো ব্যবহার করার।”

চারটা মোশন ডিটেক্টর বাড়ির আশেপাশে স্থাপন করলো সালান্ডার। ব্লমকোভিস্টকে বোঝালো এই যন্ত্রের বিশ ফিটের মধ্যে কেউ চলে এলেই একটা অ্যালার্ম বেজে উঠে সিগনাল দেবে। শোবার ঘরে এরকম একটা অ্যালার্ম বসানো হয়েছে। একই সময় গাছ আর ক্যাবিনের পেছনে স্থাপন করা দুটো ভিডিও ক্যামেরা সচল হয়ে কম্পিউটারে ছবি পাঠাতে শুরু করবে। এরকম একটি কম্পিউটার বসানো হয়েছে সামনের দরজার পাশে। এক ধরণের কাপড় দিয়ে ক্যামেরা দুটো ক্যামোফ্লেজ করে রাখলো সে।

দরজার উপর বার্ডহাউজের ভেতর তৃতীয় ক্যামেরাটি বসালো সালান্ডার। দরজার সামনে যে পথটা চলে গেছে ক্যামেরায় সেটা ধরা পড়বে। প্রতি সেকেন্ডে ইমেজ ধারণ করে ওয়ার্ডরোবে রাখা একটি ল্যাপটপের হার্ডডিস্কে স্টোর করে রাখা হবে। এরপর দরজার কাছে একটি প্রেসার সেনসেটিভ ম্যাট বিছিয়ে রাখলো। কেউ যদি সবার অলক্ষ্যে এই বাড়িতে প্রবেশ করার চেষ্টা করে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে একটা সাইরেন বাজতে শুরু করবে। একটা নাইটভিশন স্কোপও নিয়ে এসেছে সে।

“তুমি তো দেখছি কোনো সুযোগই রাখছো না,” তার জন্য কফি ঢালতে ঢালতে বললো ব্লমকোভিস্ট।

“আরেকটা বিষয়। এই ব্যাপারটা ফয়সালা হবার আগে কোনো রকম জগিং করা যাবে না।”

“বিশ্বাস করো ব্যায়ামের ব্যাপারে আমি সব ধরণের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি।”

“আমি ঠাট্টা করছি না। আমরা হয়তো একটি ঐতিহাসিক রহস্য নিয়ে শুরু করেছিলাম কিন্তু মরা বেড়াল আর তোমার উপর গুলি চালানোর পর বুঝতে হবে কেউ আমাদের পেছনে লেগেছে।”

একটু দেরি করে ডিনার করার পর অসম্ভব ক্লান্ত হয়ে পড়লো ব্লমকোভিস্ট, মাথাটাও চিন চিন করে ব্যাথা করতে শুরু করলো। কোনো রকম কথা বলতে ইচ্ছে করলো না তাই সোজা চলে গেলো বিছানায়।

তবে সালান্ডার রাত ২টা পর্যন্ত রিপোর্ট পড়ে গেলো।

অধ্যায় ২৩

শুক্রবার, জুলাই ১১

সকাল ৬টা বাজে ঘুম থেকে উঠলো সে। জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়েছে তার মুখে। হালকা মাথা ব্যাথা এখনও আছে, তবে ব্যান্ডেজ স্পর্শ করতেই বেশ যন্ত্রণা হলো। সালান্ডার তার পাশেই উপুড় হয়ে শুয়ে আছে, তার একটা হাত ব্লমকোভিস্টের উপর। মেয়েটার পিঠের উপর ড্রাগন টাট্টুটার দিকে তাকালো সে।

গুনে দেখলো তার শরীরে ক’টা টাট্টু আছে। ঘাড়ে একটা ওয়াপ নামের পতঙ্গের, এক গোড়ালী আর বাম হাতের বাইসেপে দুটো লুপ, কোমরে একটা চায়নিজ সিম্বল আর এক হাটুর উপর গোলাপের একটা টাট্টু আছে।

বিছানা থেকে উঠে জানালার পর্দাটা টেনে দিলো যাতে করে সূর্যের আলো না আসে। বাথরুম থেকে ঘুরে এসে আবার শুয়ে পড়লো বিছানায়, তবে সালান্ডারকে ঘুম থেকে ওঠালো না।

এর কয়েক ঘণ্টা পর নাস্তা করার সময় ব্লমকোভিস্ট বললো, “তুমি এই পাজলটা সমাধান করবে কিভাবে?”

“আমাদের কাছে যেসব ফ্যাক্ট আছে তা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে পৌছাতে হবে। আরো অনেক ফ্যাক্ট খুঁজে বের করতে হবে আমাদেরকে।”

“আমার কাছে এখন একটাই প্রশ্ন : কেন? এটা কি এজন্যে যে আমরা হ্যারিয়েটের রহস্যটা সমাধা করতে যাচ্ছি, নাকি আমরা আমাদের অজ্ঞাতে একজন সিরিয়াল কিলারকে আবিষ্কার করে ফেলেছি?”

“একটা না একটা সংযোগ তো আছেই,” বললো সালান্ডার। “হ্যারিয়েট যদি একজন সিরিয়াল কিলারের ব্যাপারে জেনে থাকে তাহলে সেটা তার চেনাজানা ব্যক্তিদের মধ্য থেকেই হবে। ষাটের দশকে এখানে যেসব লোকজন ছিলো তাদের দিকে তাকালে আমরা কমপক্ষে দুই ডজন লোককে এই সন্দেহের তালিকায় ফেলতে পারি। বর্তমানে তাদের মধ্যে শুধু হেরাল্ড ভ্যাঙ্গারই বেঁচে আছে, কিন্তু তার পক্ষে বন্দুক নিয়ে বনেবাদারে ঘুরে বেড়ানো সম্ভব নয়। বাকিরা এখন এতো বেশি বৃদ্ধ হয়ে গেছে যে তাদেরকে আর বিপজ্জনক বলার উপায় নেই। এখন যাদের বয়স পঞ্চাশের কোঠায় তারা তখন অল্পবয়সী ছিলো। তাহলে আমরা আবার আগের জায়গায় ফিরে আসছি।”

“যদি না একসাথে দু’জন লোক একে অন্যেকে সাহায্য করে থাকে। একজন বৃদ্ধ আর অন্যজন অক্ষোকৃত তরুণ।”

“হেরাল্ড আর সিসিলিয়া? আমার তা মনে হয় না। আমার মনে হয় সে যখন বললো জানালার ঐ মেয়েটি সে নয় তখন সে সত্যি কথাই বলছিলো।”

“তাহলে সে কে?”

তারা ব্লমকোভিস্টের ল্যাপটপটি চালু করে আবারো ছবিগুলো বিশদভবে দেখতে শুরু করলো।

“আমার মনে হয় বৃজের দুর্ঘটনার পর গ্রামের প্রায় সবাই ঘটনাস্থলে চলে এসেছিলো। সময়টা ছিলো সেপ্টেম্বর। বেশিরভাগ লোকজনই জ্যাকেট আর সোয়েটার পরে আছে। মাত্র একজনই হালকা রঙের পোশাক পরে ছিলো আর তার ছিলো দীর্ঘ সোনালি চুল।”

“সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গার অনেক ছবিতেই আছে। মনে হয় সে সবখানেই ছিলো। ঘটনাস্থল আর তাদের বাড়ির মাঝখানের সব জায়গায়। এখানে সে ইসাবেলার সাথে কথা বলছে। আর এখানে দাঁড়িয়ে আছে যাজক ফকের সাথে। এই ছবিটাতে তাকে দেখা যাচ্ছে মেজো ভাই গ্রেগর ভ্যাঙ্গারের সাথে।’

“দাঁড়াও,” বললো ব্লমকোভিস্ট। “গ্রেগরের হাতে ওটা কি?”

“চারকোনা আকৃতির একটা জিনিস। মনে হচ্ছে বাক্স কিংবা সেরকম কিছু।”

“এটা তো হাসেলব্লাড। তার মানে তার কাছেও একটা ক্যামেরা ছিলো

ছবিগুলো আবারো ভালো করে দেখে নিলো তারা। প্রায় অনেকগুলোতেই গ্রেগর আছে। অবশ্য কোনো ছবিই স্পষ্ট নয়। একটাতে একেবারে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে তার হাতে চারকোনা বাক্সের মতো একটা জিনিস আছে।

“আমার মনে হয় তোমার কথাই ঠিক। এটা একটা ক্যামেরাই হবে।”

“তার মানে আমাদেরকে আবারো ছবির পেছনে ছুটতে হবে।”

“ঠিক আছে, তবে এখন এই ব্যাপারটা স্থগিত রাখো,” বললো সালান্ডার। “আমার একটা থিওরি আছে। বলবো?”

“বলো।”

“তরুণ জেনারেশনের কেউ যদি জেনে থাকে বয়স্কদের মধ্যে একজন সিরিয়াল কিলার আছে তাহলে কি হবে, তারা এটাকে স্বীকার করতে চাইবে না। পারিবারের মানসম্মান ইত্যাদির কারণে। তার মানে এখানে দু’জন লোক জড়িত তবে তারা একসাথে কাজ করছে না। খুনি হয়তো অনেক বছর আগেই মারা গেছে, আর আমাদের প্রতিপক্ষ শুধু চাইছে আমরা যেনো এইসব তদন্ত ফেলে রেখে এখান থেকে চলে যাই।”

“তাহলে সেক্ষেত্রে আমাদের পোর্চে একটা বেড়াল কেটে রেখে দেবে কেন? এটা তো খুনিকেই চিহ্নিত করছে।” হ্যারিয়েটের বাইবেলে টোকা মারলো ব্লমকোভিস্ট। “আবারো হোমবলির নৈবেদ্যের যে নিয়ম তার একটি বিকৃত অনুকরণ।”

চেয়ারে হেলান দিয়ে বাইরের চার্চের দিকে তাকিয়ে বাইবেল থেকে উদ্ধৃত করতে লাগলো সালান্ডার। যেনো আপন মনে কথা বলে যাচ্ছে সে।

“প্রভুর সামনেই সেই ষাড়টিকে বলি দেয়া হবে; তারপর আরোনের পুত্র যাজকেরা সমাগম তাবুতে ঢোকার মুখে অবস্থিত বেদীর কাছে অবশ্যই সেই রক্ত এনে বেদী এবং তার চারপাশে তা ছিটিয়ে দেবে। যাজক অবশ্যই প্রণীর দেহ থেকে চামড়া ছাড়িয়ে প্রাণীটিকে কেটে টুকরো টুকরো করবে।”

চুপ মেরে গেলো সালান্ডার। ব্লমকোভিস্ট যে তার দিকে প্রবল উত্তেজনায় চেয়ে আছে সেটা সে জানে। বাইবেলের লেভিটিকাসের প্রথম অধ্যায়টি খুললো মিকাইল।

“তুমি কি বারো নাম্বার পংক্তিটাও জানো?”

সালান্ডার কোনো জবাব দিলো না।

“আর যাজক…” তার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো সে।

“যাজক প্রাণীটিকে টুকরো টুকরো করে কাটবে, তারপর মাথা এবং চর্বিযুক্ত মাংস বেদীর আগুনে রাখা কাঠের উপর রাখবে।” তার কণ্ঠ শীতল হয়ে এলো।

“আর পরের পংক্তিটি?”

হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ালো সালান্ডার।

“লিসবেথ তোমার আছে ফটোগ্রাফিক স্মৃতিশক্তি,” অবাক হয়ে বললো মিকাইল। “এজন্যেই তুমি ইনভেস্টিগেশন রিপোর্টের প্রতিটি পৃষ্ঠা মাত্র দশ সেকেন্ডে পড়ে ফেলেছো।”

তার প্রতিক্রিয়াটি একেবারেই উত্তেজনায় ভরপুর। ব্লমকোভিস্টের দিকে মেয়েটা এমন রেগেমেগে তাকালো যেনো তার সম্পর্কে খারাপ কিছু বলেছে। তারপর হঠাৎ করেই যেনো সালান্ডারের অভিব্যক্তি বিষণ্নতায় বদলে গেলো, অনেকটা দৌড়ে গেটের কাছে চলে গেলো সে।

“লিসবেথ,” পেছন থেকে তাকে ডাকলো ব্লমকোভিস্ট।

পথের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটা নেই।

.

সালান্ডারের কম্পিউটারটা ভেতরে নিয়ে এসে দরজায় তালা লাগিয়ে দিলো মিকাইল। মেয়েটা কোথায় গেছে বুঝতে পারছে না। বিশ মিনিট পর সমুদ্রের কাছে এক জেটিতে খুঁজে পেলো তাকে। ওখানে বসে পানিতে পা ডুবিয়ে সিগারেট খাচ্ছে। তার আসার কথা টের পেয়ে মেয়েটা আড়ষ্ট হয়ে গেলো। তার থেকে একটু দূরে থামলো ব্লমকোভিস্ট।

“আমি জানি না আমি কি এমন বলেছি কিন্তু তোমাকে আপসেট করার মতো তো কিছু বলি নি।”

তার পাশে এসে বসে একটু দ্বিধার সাথেই তার কাঁধে হাত রাখলো সে।

“প্লিজ, লিসবেথ। কথা বলো।”

তার দিকে ফিরে তাকালো মেয়েটা।

“এ নিয়ে কথা বলার মতো কিছু নেই। আমার মাথায় ছিট আছে, হয়েছে।”

“আমার স্মৃতিশক্তি যদি তোমার মতো হতো তাহলে খুশিতে নাচতাম।“

পানিতে সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো সে।

অনেকক্ষণ ধরে তার পাশে চুপচাপ বসে রইলো মিকাইল। আমি কি বলবো? তুমি আসলে খুবই সাধারণ একটি মেয়ে। অন্যদের থেকে যে তুমি একটু আলাদা তাতে কি আর এসে যায়? আচ্ছা, নিজের সম্পর্কে তুমি কি ভাবো?

“তোমাকে যখন প্রথম দেখেছি তখন আমার মনে হয়েছে তোমার মধ্যে অন্যরকম কিছু আছে,” বললো সে। “তুমি সেটা জানো? অনেক দিন পর প্রথম দেখেই কারোর ব্যাপারে মুগ্ধ হবার ঘটনা ঘটেছিলো।”

হার্বারের অন্যদিকের কেবিন থেকে কিছু বাচ্চা ছেলে-মেয়ে ছুটে এসে পানিতে লাফ দিচ্ছে। চিত্রশিল্পী ইউজিন নরম্যান তার বাড়ির সামনে একটা চেয়ারে বসে আছে। এই লোকটার সাথে মিকাইলের এখনও কোনো কথাবার্তা হয় নি। পাইপে টান দিচ্ছে আর তাদের দিকে চেয়ে আছে লোকটা।

“আমি আসলেই তোমার বন্ধু হতে চাই, যদি তোমার কোনো আপত্তি না থাকে,” বললো সে। “আমি বাড়ি ফিরে কফি বানাচ্ছি। বাড়িতে চলে আসো

তাকে রেখেই চলে এলো ব্লমকোভিস্ট। মাঝপথে আসতেই পেছন থেকে মেয়েটার পায়ের শব্দ শুনতে পেলো সে। কোনোরকম কথাবার্তা না বলেই তারা একসাথে বাড়ি ফিরে এলো।

ঠিক বাড়ির সামনে এসেই তাকে থামালো সালান্ডার।

“মনে মনে আমি একটা থিওরি বানাচ্ছিলাম…আমরা বলেছিলাম এসবই হলো বাইবেলের বিকৃত অনুকরণ। এটা সত্য যে সে একটা বেড়ালকে কেটে টুকরো টুকরো করেছে। তবে আমার মনে হয় কোনো ষাড় ধরাটা খুব কঠিন হতো বলেই এটা করা হয়েছে। তবে সে গল্পের মূল বিষয়টা অনুসরণ করেছে। ভাবছি…” চার্চের দিকে তাকালো সে। “সমাগম তাবুতে ঢোকার মুখে অবস্থিত বেদীর কাছে অবশ্যই সেই রক্ত এনে বেদী এবং তার চারপাশে তা ছিটিয়ে দেবে…”

বৃজটা পেরিয়ে চার্চের কাছে গেলো তারা। দরজা খোলার চেষ্টা করলো ব্লমকোভিস্ট কিন্তু সেটা তালা মারা। আশেপাশে কিছুক্ষণ ঘুরে হেডস্টোনটা দেখে চ্যাপেলের কাছে চলে এলো। এটা একটু দূরে, পানির ঠিক কাছেই অবস্থিত। আচমকা ব্লমকোভিস্টের চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে উঠলো। এটা তো চ্যাপেল নয়, এটা আসলে ক্রিপ্ট-মৃতদেহ রাখার জায়গা। দরজার উপরে ভ্যাঙ্গার নামটা পাথরে খোদাই করা আছে, তার সাথে লেখা আছে একটি ল্যাটিন পংক্তি, লেখাটার অর্থোদ্ধার করতে পারলো না সে।

“শেষ সময়ের নিদ্রা,“ পেছন থেকে বললো সালান্ডার।

ব্লমকোভিস্ট পেছন ফিরে তার দিকে তাকালে মেয়েটা কাঁধ তুললো।

“আমি মনে হয় এই পংক্তিটা কোথাও দেখেছিলাম।”

অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়লো ব্লমকোভিস্ট। প্রথমে একটু আড়ষ্ট হয়ে রেগেমেগে তার দিকে তাকালো সালান্ডার কিন্তু যখন বুঝতে পারলো সে আসলে হাসছে পরিস্থিতির হাস্যকর দিকটার কথা ভেবে তখন স্বাভাবিক হয়ে এলো।

দরজা খোলার চেষ্টা করলো ব্লমকোভিস্ট। তালা মারা। একটু ভেবে সালান্ডারকে বললো এখানেই থাকতে, তারপর অ্যানা নিগ্রেনের বাড়ির দিকে চলে গেলো সে। তাকে বোঝালো ভ্যাঙ্গারদের পারিবারিক ক্রিপ্টটা সে একটু দেখতে চায়, হেনরিক এটার চাবি কোথায় রেখেছে মনে করতে পারছে না। কথাটা শুনে সন্দেহের চোখে তাকালেও অ্যানা ভেতর থেকে চাবিটা এনে দিলো তাকে।

দরজা খুলতেই তারা বুঝতে পারলো তাদের ধারণাই ঠিক। বাতাসে মৃতদেহ আর পোড়া দেহাবশেষের গন্ধ। তবে বেড়ালটাকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় নি। এক কোণে একটা মাশাল আছে, স্কিয়াররা তাদের স্কি’তে মোম গলানোর জন্য যে ধরণের মশাল ব্যবহার করে থাকে সেরকম একটি মশাল। জিন্সের পকেট থেকে ক্যামেরা বের করে কিছু ছবি তুলে নিলো সালান্ডার, এরপর সাবধানে মশালটি তুলে নিলো হাতে।

“এটা একটা এভিডেন্স হতে পারে। এটাতে হয়তো আঙুলের ছাপ আছে,” বললো সে।

“নিশ্চয়, ভ্যাঙ্গার পরিবারের সবাইকে দাঁড় করিয়ে তাদের আঙুলের ছাপ আমরা নিতে পারবো।” হেসে বললো ব্লমকোভিস্ট। “ইসাবেলার আঙুলের ছাপ তুমি কিভাবে নেবে সেটা দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছি আমি।”

“উপায় আছে,” সালান্ডার বললো।

মেঝেতে প্রচুর রক্ত পড়ে আছে, সবটাই যে শুকনো তা নয়, সেইসাথে একটি বোল্ট-কাটারও পড়ে আছে। তারা বুঝতে পারলো এটা দিয়েই বেড়ালটার মাথা কাটা হয়েছে।

চারপাশে তাকালো ব্লমকোভিস্ট। একটু উঁচুতে যে সারকোফ্যাগাসটি রয়েছে সেটা আলেকজান্ডার ভ্যাঙ্গিয়ারসাডের, আর চারটা কবর আছে মেঝেতে। এগুলো পরিবারের পূর্বপুরুষদের কবর। বর্তমানে ভ্যাঙ্গাররা নিজেদের মৃতদেহ দাহ করে থাকে। দেয়ালে ত্রিশটি স্থানে পূর্বপুরুষদের নাম লেখা আছে। সামনের দিকে যেসব নাম আছে সেগুলো খতিয়ে দেখলো ব্লমকোভিস্ট। ভাবতে লাগলো তাদের যেসব পারিবারিক সদস্যকে জায়গার অভাবে এখানে কবর দেয়া যায় নি তাদের কোথায় সমাহিত করা হয়েছে। তাদেরকে হয়তো অতোটা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয় নি।

“এখন আমরা জানতে পারলাম, বৃজটা অতিক্রম করার সময় বললো ব্লমকোভিস্ট। “আমরা একজন বদ্ধ উন্মাদ লোককে খুঁজে বেড়াচ্ছি।”

“তুমি কি বলতে চাচ্ছো?”

বৃজের মাঝখানে এসে থেমে গেলো ব্লমকোভিস্ট, রেলিংয়ে ঝুঁকে দেখলো সে।

“এটা যদি মাথামোটা অবিবেচক কেউ হয়ে থাকে, যে কিনা আমাদেরকে ভয় পাইয়ে দিতে চাইছে, তাহলে তাকে গ্যারাজে কিংবা বনের মধ্যে বেড়ালটা নিয়ে যেতে হয়েছে। তবে তাকে আবার ক্রিপ্ট-এ ফিরে আসতে হয়েছিলো। এরমধ্যে একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার আছে। ঝুঁকিটার কথা বিবেচনা করো। সময়টা গ্রীষ্মকাল, লোকজন রাতের বেলায় বাইরে ঘুরে বেড়ায়। অনেক রাত পর্যন্ত হাটাহাটি করে। কবরস্থানের ভেতর দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেটা হেডেবির প্রধান সড়ক। নিশ্চয় পোড়ার গন্ধও ছড়িয়ে পড়েছিলো।

“লোকটা?”

“আমার মনে হয় না রাতের বেলায় সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গার চোরের মতো মশাল হাতে নিয়ে এখানে এসেছিলো।”

কাঁধ তুললো সালান্ডার।

“আমি কাউকেই বিশ্বাস করি না, এমনকি ফ্রোডি আর তোমার বন্ধু হেনরিককেও। তারা সবাই এক পরিবারের সদস্য। সুযোগ পেলে তারা তোমাকে ধোকা দিতে ছাড়বে না। তাহলে এখন আমরা কি করবো?”

ব্লমকোভিস্ট বললো, “আমি তোমার সম্পর্কে অনেক সিক্রেট জেনে গেছি। উদাহরণ হিসেবে হ্যাকিংয়ের কথা বলতে পারি। আচ্ছা, কতো লোক জানে তুমি একজন হ্যাকার?”

“একজনও না।”

“মানে, আমি ছাড়া কেউ না।”

“তুমি কি বলতে চাচ্ছো?”

“আমি জানতে চাচ্ছি আমার সাথে যে তুমি আছো সেটা ঠিক আছে কিনা। আমাকে তুমি বিশ্বাস করো কিনা।”

“তার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলো সে। অবশেষে শুধু কাঁধ তুলে কথাটার জবাব দিলো।

“এ ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই।”

“আমাকে তুমি বিশ্বাস করো?” জোর দিয়ে বললো ব্লমকোভিস্ট।

“কিছু সময়ের জন্য,” সালান্ডার নির্বিকারভাবে বললো।

“ভালো। চলো, ফ্রোডির সাথে দেখা করে আসি।”

.

এডভোকেট ফ্রোডির স্ত্রী এই প্রথম সালান্ডারের সাথে পরিচিত হলো। মুখে হাসি থাকলেও তাকে দেখে যে খুব বিস্মিত হচ্ছে সেটা বোঝা গেলো মহিলার অভিব্যক্তিতে। তবে সালান্ডারকে দেখে ফ্রোডির মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। উঠে দাঁড়িয়ে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানালো ভদ্রলোক।

“আপনাদেরকে দেখে খুব ভালো লাগছে,” বললো সে। “আপনি যে আমাদের জন্য অসাধারণ কাজ করেছেন সেটার জন্য আপনাকে যথাযথভাবে কৃতজ্ঞতা জানানো হয় নি।”

তার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো সালান্ডার।

“আমাকে এজন্যে টাকা দেয়া হয়েছে,” বললো সে।

“ব্যাপারটা নিছক টাকা-পয়সার নয়। আপনাকে প্রথম যখন দেখেছিলাম তখন আপনার সম্পর্কে একটা ধারণা পোষণ করেছিলাম। সেজন্যে আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন।

ব্লমকোভিস্ট খুব অবাক হলো। পঁচিশ বছরের টাটু আঁকা, নাকে, ভুরুতে রিং পরা এক মেয়ের কাছে ফ্রোডি এমন কিছুর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছে যার কোনো দরকারই ছিলো না! আইনজীবি ভদ্রলোক ব্লমকোভিস্টের দিকে তাকালো। সালান্ডার সোজা তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে, একেবারেই পাত্তা দিলো না তাকে।

ফ্রোডি এবার ব্লমকোভিস্টের মাথার আঘাতটা দেখতে পেলো।

“আপনার মাথায় কি হয়েছে?”

তারা বসে পড়লো। বিগত চব্বিশ ঘণ্টায় কি কি ঘটেছে বিস্তারিত বলে গেলো ব্লমকোভিস্ট। কিন্তু সে যখন তাকে গুলি করার কথাটা বললো আইনজীবি ভদ্রলোক রীতিমতো দাঁড়িয়ে পড়লো কথাটা শুনে।

“এটা তো একেবারে বদ্ধ উন্মাদের কাজ।” একটু থেমে ব্লমকোভিস্টের চোখের দিকে তাকালো সে। “আমি দুঃখিত, কিন্তু এটা বন্ধ করতে হবে। আমি এটা চলতে দিতে পারি না। হেনরিকের সাথে কথা বলে আমি কনট্রাক্টটা বাতিল করে দেবো

“বসুন,” বললো ব্লমকোভিস্ট।

“আপনি বুঝতে পারছেন না…’

“আমি আর লিসবেথ যেটা বুঝতে পারছি তা হলো এসবের পেছনে যে-ই থেকে থাকুক না কেন, সে ভয় পেয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আমাদের কিছু প্রশ্ন আছে। প্রথম প্রশ্নটা হলো : ভ্যাঙ্গার পরিবারের ক্রিপ্টের কয়টা চাবি আছে, আর সেটা কার কার কাছে রয়েছে?”

“এটা তো আমার জানা কথা নয়,” বললো ফ্রোডি। “তবে আমার মনে হয় বেশ কয়েকজন পারিবারিক সদস্যের কাছেই চাবি থাকার কথা। হেনরিকের কাছে একটা আছে জানি। ইসাবেলাও মাঝেমধ্যে ওখানে গিয়ে থাকে। তবে তার কি নিজের চাবি আছে নাকি হেনরিকের কাছ থেকে ধার নিয়ে থাকে সেটা জানি না।”

“ঠিক আছে। তাদের কি কোনো কর্পোরেট আর্কাইভ আছে? লাইব্রেরি কিংবা সেরকম কিছু যেখানে তারা তাদের ফার্ম সম্পর্কে সব ধরণের পত্রপত্রিকার ক্লিপিংস সংরক্ষণ করে থাকে?”

“তা আছে। হেডেস্টাডের মেইন অফিসে।”

“ওটা আমাদের একটু দেখতে হবে। পুরনো নিউজলেটার কিংবা সেরকম কিছু কি আছে?”

“আবারো বলছি এ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। আমি নিজে প্রায় ত্রিশ বছর ধরে আর্কাইভে ঢুকি নি। বডিল লিন্ডগ্রিন নামের এক মহিলার সাথে আপনাকে কথা বলতে হবে তাহলে।”

“তাকে ফোন করে কি বলে দেবেন আজ বিকেলে যেনো লিসবেথ সেখানে প্রবেশ করতে পারে? ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশনের সব ধরণের পুরনো প্রেস ক্লিপিংস দেখা দরকার আছে তার।”

“কোনো সমস্যা নেই। আর কিছু?”

“হ্যা। বৃজের দুর্ঘটনার দিন গ্রেগর ভ্যাঙ্গারের হাতে একটা ক্যামেরা ছিলো। তার মানে ঐ ক্যামেরা দিয়ে সে তখন কিছু ছবি তুলেছে। তার মৃত্যুর পর ছবিগুলো কোথায় রাখা হয়েছে?”

“তার বিধবা স্ত্রী কিংবা ছেলের কাছেই তো থাকা স্বাভাবিক। আলেকজান্ডারকে ফোন করে জেনে নিই।”

“আমি কি খুঁজে দেখবো?” কটেজে ফেরার সময় তার কাছে জানতে চাইলো সালান্ডার।

“প্রেস ক্লিপিংস আর নিউজলেটার। আমি চাই পঞ্চাশ আর ষাট দশকে হত্যাকাণ্ডগুলো যখন ঘটেছিলো সেইসময়কার সব কিছু তুমি পড়ে দেখবে। গুরুত্বপূর্ণ কোনো কিছু পেলে নোটে টুকে রাখবে। এটা যদি করো তাহলেই ভালো হয়। তোমার স্মৃতি তো আবার…

তার পেটে ঘুষি মারলো সে।

পাঁচ মিনিট পর সালান্ডারের কাওয়াসাকি মোটরবাইকটি বৃজের উপর দিয়ে ছুটে গেলো।

.

আলেকজান্ডার ভ্যাঙ্গারের সাথে হাত মেলালো ব্লমকোভিস্ট। হেডেবিতে সে আসার পর থেকেই আলেকজান্ডার বেশিরভাগ সময় বাইরেই ছিলো। হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হবার সময় তার বয়স ছিলো বিশ।

“ডার্চ বলেছে আপনি নাকি পুরনো কিছু ছবি দেখতে চাইছেন?”

“আমার বিশ্বাস আপনার বাবার কাছে একটি ক্যামেরা ছিলো।”

“তা ছিলো। এখনও সেটা আছে তবে কেউ ব্যবহার করে না।”

“আমার ধারণা আপনি জানেন হেনরিক আমাকে হ্যারিয়েটের ব্যাপারে স্টাডি করার জন্য নিযুক্ত করেছে।”

“জানি। আর এই ব্যাপারটা নিয়ে যে এখানকার অনেক লোক সন্তুষ্ট নয় সেটাও ভালো করে বুঝি।”

“আমারও সেরকমই মনে হয়। আপনি নিশ্চয় কিছু দেখতে দেবেন না।”

“প্লিজ…আপনি কি দেখতে চান?”

“বৃজের দুর্ঘটনা আর হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হবার দিনে আপনার বাবা কোনো ছবি তুলেছিলেন কিনা। “

তারা দু’জনেই বাড়ির ভেতর চলে গেলো। কয়েক মিনিট পর একটা বাক্স নিয়ে ফিরে এলো আলেকজান্ডার। বাক্স ভর্তি ছবি।

“পুরো বাক্সটাই বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন,” বললো সে। “আপনি যা খুঁজছেন সেটা থেকে থাকলে এখানেই আছে।”

.

গ্রেগর ভ্যাঙ্গারের বাক্সে অনেক মূল্যবান ছবি আছে। এরমধ্যে রয়েছে চল্লিশ দশকের কুখ্যাত সুইডিশ নাৎসি নেতা ওলোফ সেভেন লিন্ডহোমের সাথে তোলা গ্রেগরের বেশ কয়েকটি ছবি। ওসব ছবি একপাশে সরিয়ে রাখলো সে।

পরিবারের অনেক অনুষ্ঠানে তোলা আর ইটালিতে ছুটি কাটানোর সময় তোলা অনেক ছবিই আছে বাক্সে।

বৃজের দুর্ঘটনার চারটা ছবি খুঁজে পেলো সে। ভালো একটি ক্যামেরা থাকার পরও গ্রেগর একজন বাজে ফটোগ্রাফার ছিলো বলেই মনে হচ্ছে। ট্যাঙ্কার ট্রাকের দুটো ছবি, আর দুটো তোলা হয়েছে উৎসুক দর্শকদের পেছন থেকে। মাত্র একটা ছবিতে সিসিলিয়াকে কিছুটা দেখা যাচ্ছে।

তারপরও ছবিগুলো ভালো করে দেখতে লাগলো সে, যদিও জানে তেমন কিছু খুঁজে পাবার সম্ভাবনা নেই। দেখা শেষ হলে সব ছবি বাক্সে রেখে স্যান্ডউইচ নিয়ে বসলো লাঞ্চ করার জন্য। এরপর অ্যানাকে দেখতে গেলো তার বাড়িতে।

“আপনি কি মনে করেন হ্যারিয়েটের ইনভেস্টিগেশনের জন্য জমা করা ছবি ছাড়াও হেনরিকের কাছে আরো কিছু ছবির অ্যালবাম আছে?”

“হ্যা, আছে। হেনরিক সব সময়ই ছবির ব্যাপারে আগ্রহী ছিলো—সেই তরুণ বয়স থেকেই। আমি সেরকমই শুনেছি। তার অফিসে অনেক ছবি রাখা আছে।”

“আমাকে কি সেগুলো দেখাতে পারেন?”

মহিলার অনীহা স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে। পারিবারিক ক্রিপ্টে ব্লমকোভিস্টকে ঢুকতে দেয়া এক কথা আর হেনরিক ভ্যাঙ্গারের অফিসে ঢুকতে দেয়াটা একেবারেই ভিন্ন ব্যাপার। ব্লমকোভিস্ট অ্যানাকে বললো সে যেনো ফ্রোডিকে ফোন করে। অবশেষে মহিলা তাকে ঢুকতে দিলো। একেবারে নীচের সেলফটা ছবির অ্যালবামে ঠাসা। ডেস্কে বসে প্রথম অ্যালবামটি খুললো সে।

পরিবারের সব ছবিই ভ্যাঙ্গার সংরক্ষণ করে রেখেছে। অনেকগুলো ছবি তার জন্মেরও আগেরকার। সবচাইতে পুরনো ছবিগুলো ১৮৭০ সালে তোলা। ভ্যাঙ্গারের বাবা-মা’র ছবিও আছে। একটা ছবিতে ভ্যাঙ্গারের বাবাকে বিশাল এক দলের সাথে ১৯০৬ সালের মধ্যগ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে দেখা যাচ্ছে, ছবিটা তোলা হয়েছে স্যান্ডহ্যামে। আরেকটা ছবিতে ফ্রেডরিক ভ্যাঙ্গার আর তার স্ত্রীকে দেখা যাচ্ছে। ফ্যাক্টরির শ্রমিকদেরও অনেক ছবি আছে অ্যালবামে। জার্মানি থেকে হেনরিক আর তার স্ত্রী এডিথকে যে ক্যাপ্টেন জাহাজে করে পাচার করেছিলো সেই অস্কার গ্রানাথেরও একটা ছবি আছে।

অ্যানা তার জন্য কফি নিয়ে এলো তাকে ধন্যবাদ জানালো ব্লমকোভিস্ট। এবার যে অ্যালবামটা খুললো সেটা অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক সময়ে তোলা। ভ্যাঙ্গার তখন পুরোপুরি কর্ণধার হয়ে উঠেছে তাদের প্রতিষ্ঠানে। ফ্যাক্টরি উদ্ভোধন করছে, অন্যান্য শিল্পপতিদের সাথে করমর্দন করছে, এইসব।

এই একই অ্যালবামে একটি পৃষ্ঠা খুঁজে পেলো সে যেখানে ভ্যাঙ্গার নিজের হাতে পেন্সিলে লিখে রেখেছে : ‘পারিবারিক সম্মেলন-১৯৬৬। দুটো রঙ্গিন ছবিতে দেখা যাচ্ছে লোকজন সিগারেট খাচ্ছে। হেনরিক, হেরাল্ড, গ্রেগরসহ বেশ কয়েকজনকে সে চিনতে পারলো। দুটো ডিনারের ছবি আছে। চল্লিশজনের মতো নারী-পুরুষ ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে ডিনার টেবিলে বসে। এই ছবিটা তোলা হয়েছে বৃজের ঘটনার পর তবে তখন পর্যন্ত কেউ জানতো না হ্যারিয়েটকে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রত্যেকের চেহারা ভালো করে দেখলো সে। এই ডিনারে হ্যারিয়েটেরও থাকার কথা ছিলো। এদের মধ্যে কি কেউ জানতো মেয়েটার কি হয়েছে? ছবি থেকে এর কোনো জবাব মিললো না।

এরপর হঠাৎ করেই কফিতে চুমুক দিয়ে বিষম খেলো ব্লমকোভিস্ট। একটু কেশে সোজা হয়ে বসলো চেয়ারে।

টেবিলের শেষ মাথায় হালকা রঙের পোশাক পরা সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গার বসে আছে। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসছে সে। তার ঠিক পাশেই তার মতোই হুবহু দেখতে আর একই রঙের পোশাক পরে বসে আছে আরেকটা মেয়ে। তাদের চেহারার মধ্যে এতোটা মিল আছে যে তাদেরকে যমজ বলে ভুল করাটাই স্বাভাবিক। হঠাৎ করেই রহস্যের আরেকটি পর্দা যেনো সরে গেলো চোখের সামনে থেকে। তাহলে হ্যারিয়েটের জানালায় সিসিলিয়া ছিলো না-ছিলো তার বোন আনিটা। তারচেয়ে বয়সে মাত্র দু’বছরের ছোটো, বর্তমানে লন্ডনে বসবাস করে।

সালান্ডার যেনো কি বলেছিলো? অনেক ছবিতেই সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গারকে দেখা গেছে। মোটেই না। আসলে দু’জন মেয়ে-এর আগ পর্যন্ত তাদেরকে একই ছবিতে একসাথে দেখা যায় নি। সাদাকালো ছবিতে দূর থেকে তাদেরকে একই রকম দেখায়। ভ্যাঙ্গারের কাছে দু’বোনকে আলাদা করা যতো সহজ ব্লমকোভিস্ট আর সালান্ডারের পক্ষে সেটা ততোটাই কঠিন। তাদের কাছে এই দু’জনকে একই রকম লাগবে। তাদের চেহারায় অনেক মিল, আর এই ব্যাপারটা এর আগে কেউ লক্ষ্যও করে নি।

ছবির পাতা উল্টিয়ে ব্লমকোভিস্টের গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেলো। যেনো এইমাত্র হিমশীতল একটি বাতাস বয়ে গেলো ঘরের ভেতর।

বৃজের দুর্ঘটনার পরের দিনের ছবি এগুলো। ততোক্ষণে হ্যারিয়েটকে খোঁজার কাজ শুরু হয়ে গেছে। তরুণ অফিসার মোরেল তার লোকজনকে দিক নির্দেশনা দিচ্ছে। ছবিতে হেনরিক ভ্যাঙ্গারও আছে, হাটু পর্যন্ত রেইনকোট পরে আছে সে। মাথায় ইংলিশ হ্যাট।

ছবির বাম দিকে এক কোণে এক তরুণ দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে কালো রঙের জ্যাকেট, কাঁধের দিকটায় লাল রঙের প্যাচ আছে। ছবিটা বেশ পরিস্কার। দেখেই চিনতে পারলো ব্লমকোভিস্ট-বিশেষ করে জ্যাকেটটা—তবে নিশ্চিত হবার জন্য ছবিটা অ্যালবাম থেকে বের করে অ্যানার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো ছেলেটাকে সে চিনতে পারছে কিনা।

“হ্যা, এটা মার্টিনের ছবি।”

.

বছরের পর বছর ধরে জমিয়ে রাখা প্রেসকাটিং ঘেটে গেলো সালান্ডার। ওগুলোকে সময়ানুক্রমিক সাজিয়ে রাখলো সে। ১৯৪৯ সাল থেকে শুরু করে এগোতে লাগলো সামনের দিকে। আর্কাইভের পরিমাণ বিশাল। ঐ সময়গুলোতে প্রায় প্রতিদিনই এই কোম্পানির কোনো না কোনো খবর পত্রিকায় ঠাঁই পেতো। শুধুমাত্র স্থানীয় পত্রিকায়ই নয়, জাতীয় দৈনিকগুলোতেও তাদের খবর থাকতো নিয়মিত। ফিনান্সিয়াল বিশ্লেষণ, ট্রেড ইউনিয়নের সাথে দর কষাকষি, ধর্মঘটের হুমকি, ফ্যাক্টরি উদ্ভোধন, ফ্যাক্টরি বন্ধ ঘোষণা, বার্ষিক রিপোর্ট, কর্মকর্তর বদলি, নতুন প্রোডাক্টের লঞ্চিং… রীতিমতো খবরের বন্যা। ক্লিক। ক্লিক। ক্লিক। তার মাথাটা দ্রুত কাজ করতে আরম্ভ করলো। গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্যই মাথায় গেঁথে নিলো সে।

কয়েক ঘণ্টা পর তার মাথায় একটা আইডিয়া এলো। পঞ্চাশ এবং ষাট দশকে ভ্যাঙ্গারদের কোথায় কোন্ কোম্পানি ছিলো তার কোনো চার্ট আছে কিনা জানতে চাইলো আর্কাইভ ম্যানেজারের কাছে।

বডিল লিন্ডগ্রেন কোনো রকম রাখঢাক না করেই সালান্ডারের দিকে তাকালো। এক অজানা অচেনা মেয়েকে নিজেদের আর্কাইভে ঢুকতে দেয়াতে মহিলা মোটেই খুশি নয়। এই মেয়ে যা যা দেখতে চায় সবই যেনো তাকে দেখতে দেয়া হয় এরকম আদেশ করা হয়েছে তাকে। এই ব্যাপারটা তার কাছে আরো বেশি বিরক্তিকর লাগছে। তাছাড়া এই মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে পনেরো-ষোলো বছরের বখে যাওয়া কোনো টিনএজার। কিন্তু ফ্রোডির আদেশ মানতেই হবে। এই আজব মেয়েটাকে সব ধরণের সহায়তা করতে হবে। ব্যাপারটা নাকি খুব জরুরি। সালান্ডারকে একটা প্রিন্ট করা কাগজ দিলো মহিলা। সমগ্র সুইডেনে ফার্মের ডিভিশনগুলোর তালিকা আছে এই কাগজে।

কাগজটার দিকে চোখ বুলিয়ে সালান্ডার বুঝতে পারলো ফার্মের অসংখ্য ফ্যাক্টরি, অফিস আর সেলসসেন্টার রয়েছে। যেসব জায়গায় হত্যাকাণ্ডগুলো সংঘটিত হয়েছে তার সবখানেই লাল বিন্দু দিয়ে ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশনের অবস্থান চিহ্নত করা হয়েছে। কোথাও কোথাও একাধিক বিন্দুও আছে।

১৯৫৭ সালের প্রথম হত্যাকাণ্ডটির সাথে একটা কানেকশান খুঁজে পেলো সে। ল্যান্ডসক্রোনারের রাকেল লুন্ডি নামের মেয়েটি ভি অ্যান্ড সি কন্সট্রাকশনের কয়েক মিলিয়ন ক্রোনারের কাজ পাবার পরদিনই খুন হয়। ভি অ্যান্ড সি দিয়ে বোঝানো হয়েছে ভ্যাঙ্গার এবং কারলিন কন্সট্রাকশনকে। স্থানীয় সংবাদপত্রে গটফ্রিড ভ্যাঙ্গারের একটি ইন্টারভিউ ছাপা হয় যেকিনা চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্যে ওখানে গিয়েছিলো।

সালান্ডারের মনে পড়ে গেলো ল্যান্ডসক্রোনারের আঞ্চলিক অফিসে পুলিশী তদন্তের যে রেকর্ডগুলো পড়েছিলো সেসবের কথা। রাকেল লুন্ডি ছিলো শৌখিন জ্যোতিষী, তবে ভি অ্যান্ড সি কন্সট্রাকশনে একজন অফিস ক্লিনার হিসেবে কাজ করতো সে।

.

সাতটার দিকে কয়েকবার সালান্ডারের মোবাইলে ফোন করার চেষ্টা করলো ব্লমকোভিস্ট। তার মোবাইল বন্ধ করে রাখা হয়েছে। সে চাইছে না তাকে কেউ বিরক্ত করুক।

ঘরের ভেতর অস্থিরভাবে পায়চারি করলো সে। হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হবার সময় মার্টিনের কর্মকাণ্ড আর গতিবিধি নিয়ে ভ্যাঙ্গারের যে নোট লেখা আছে সেটা বের করলো।

১৯৬৬ সালে মার্টিন উপসালা প্রিপারেটরি স্কুলে শেষ বর্ষে ছিলো। উপসালা। লেনা এন্ডারসন, প্রিপারেটরি স্কুলের সতেরো বছরের এক ছাত্রি। দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছিলো তার।

কথাটা ভ্যাঙ্গার তাকে বললেও ব্লমকোভিস্ট আবারো নোট ঘেটে দেখতে লাগলো। মার্টিন ছিলো অর্ন্তমূখী এক ছেলে। তাকে নিয়ে তারা খুব চিন্তিত ছিলো। তার বাবা পানিতে ডুবে মারা গেলে ইসাবেলা তাকে উপসালায় পাঠিয়ে দেয়-সেখানে তাকে হেরাল্ড ভ্যাঙ্গারের সাথে থাকতে হয়েছে। হেরাল্ড আর মার্টিন? মোটেও ঠিক মনে হচ্ছে না।

হেডেস্টাডের অনুষ্ঠানে যাবার সময় মার্টিন হেরাল্ডের গাড়িতে ছিলো না। সে ট্রেনটাও মিস্ করেছিলো। একটু দেরি করে বিকেলের দিকে এসে পৌছায় সে তাই বৃজের দুর্ঘটনার কারণে তাকে বৃজের ওপাড়েই থাকতে হয় অনেকক্ষণ। সন্ধ্যা ৬টার দিকে একটা নৌকায় করে এপাড়ে চলে আসে সে। হেনরিক ভ্যাঙ্গার নিজে তাকে রিসিভ করেছিলো। হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হবার সাথে মার্টিনকে একটুও সন্দেহ করে নি হেনরিক। তাকে রাখা হয় সন্দেহের তালিকার বাইরে।

মার্টিন বলেছে সে ঐ দিন হ্যারিয়েটকে দেখে নি। মিথ্যে বলেছে। ঐদিন অনেক আগেই সে হেডেস্টাডে এসে পৌছায়, ইয়ার্নভাগসগাটানের প্যারেডের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলো সে। মুখোমুখি হয়েছিলো তার বোনের। ব্লমকোভিস্ট এটা ছবি থেকেই প্রমাণ করতে পারবে। এতোগুলো বছর ধরে এই সত্যটা শত শত ছবির ভিড়ে চাপা পড়েছিলো।

হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গার তার ভাইকে দেখে ভড়কে গিয়েছিলো। হেডেবি আইল্যান্ডে ফিরে হেনরিককে সেটা বলার চেষ্টাও করেছিলো কিন্তু সময়ের অভাবে সেটা বলার আগেই লাপাত্তা হয়ে যায় সে। হেনরিককে কি বলতে চেয়েছিলে তুমি? উপসালার কথা? কিন্তু লেনা এন্ডারসন আর উপসালা তো তার তালিকায় নেই। এটা তো তোমার জানা কথা নয়।

ব্লমকোভিস্টের কাছে গল্পটার মাথামুণ্ডু এখনও বোধগম্য হচ্ছে না। বেলা ৩টার দিকে নিখোঁজ হয় হ্যারিয়েট। সেই সময়টাতে মার্টিন সন্দেহাতীতভাবেই বৃজের ওপাড়ে ছিলো। ছবিতে কোথাও তাকে দেখা যায় নি। তার পক্ষে তো হ্যারিয়েটের কোনো ক্ষতি করা সম্ভব না। পাজলের একটা অংশ এখনও মিলছে না। তাহলে কি একজন অ্যাকমপ্লিশ আছে? মানে, অপরাধীর সহযোগী? আনিটা ভ্যাঙ্গারই সেই অ্যাকমপ্লিশ?

.

আর্কাইভ ঘেটে সালান্ডার দেখতে পাচ্ছে পরের বছরগুলোতে ফার্মে গটফ্রিড ভ্যাঙ্গারের অবস্থান বদলে যাচ্ছে। বিশ বছর বয়সে তার সাথে পরিচয় হয় ইসাবেলার, তারপর খুব জলদি সে গর্ভবর্তী হয়ে পড়ে। ১৯৪৮ সালে জন্ম নেয় মাটিন। এরফলে অল্প বয়সেই তার বাবা-মা বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়।

গটফ্রিডের বয়স যখন বাইশ তখন তাকে ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশনের মেইন অফিসে নিয়ে আসে হেনরিক ভ্যাঙ্গার। ওখানেই তাকে শেখানো হয় কিভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে হয়। পঁচিশ বছর বয়সে তাকে বোর্ড মেম্বার করে নেয়া হয়, সেইসাথে কোম্পানির উন্নয়ন বিভাগের সহকারী প্রধানের দায়িত্বও অর্পণ করা হয় তার উপর। বেশ সম্ভাবনাময় ছিলো তার ক্যারিয়ার।

পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বেসামাল হয়ে পড়তে শুরু করে সে। মদ্যপান করতো। ইসাবেলার সাথে তার বিয়েটা হুমকির মুখে পড়ে যায়। এ নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে ছিলো। তার সন্তান হ্যারিয়েট আর মার্টিনের অবস্থাও ভালো ছিলো না। সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসে হেনরিক। গটফ্রিডের ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পড়ে। ১৯৫৬ সালে উন্নয়ন বিভাগে আরেকজনকে নিয়োগ দেয়া হয়। দু’জন সহকারী প্রধান : গটফ্রিড যখন মাতাল হয়ে পড়ে থাকতো, দীর্ঘদিন কাজে অনুপস্থিত থাকতো তখন অন্যজন কাজ চালাতো।

তবে তখনও গটফ্রিড প্রতিষ্ঠানের সাথে বেশ ভালোমতো জড়িত ছিলো। ১৯৫৭ সাল থেকে তার কাজকর্ম সীমাবদ্ধ থাকতো মূলত দেশের বিভিন্নস্থানে সফর করে ফ্যাক্টরির সমস্যা আর বিবাদ মেটানোর কাজের মধ্যে। আমরা আমাদের নিজেদের একজনকে পাঠিয়েছি তোমাদের সমস্যার কথা শোনার জন্য। ব্যাপারটা যে আমরা খুব সিরিয়াসলি নিয়েছি সেটা নিশ্চয় বুঝতে পারছো।

দ্বিতীয় আরেকটা কানেকশান খুঁজে পেলো সালান্ডার। গটফ্রিড ভ্যাঙ্গার কার্লস্টাডে একটি নিগোশিয়েশনে অংশ নিয়েছিলো, ওখানে ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশন একটি টিম্বার কোম্পানি কিনেছিলো তখন। এরপরের দিনই ফার্মারের স্ত্রী মাগদা লোভিশা সিওবার্গ খুন হয়।

মাত্র পনেরো মিনিট পরই তৃতীয় কানেকশানটি বের করে ফেললো সালান্ডার। ১৯৬২ সালে, উদেভিল্লায়। যেদিন লিয়া পারসন নিখোঁজ হয় সেদিনের এক স্থানীয় পত্রিকায় গটফ্রিড ভ্যাঙ্গারের ইন্টারভিউ ছাপানো হয় সম্ভাব্য হার্বার সম্প্রসারণের ব্যাপারে।

মিসেস লিন্ডগ্রেন যখন ৫:৩০-এর দিকে সালান্ডারকে জানালো আর্কাইভ বন্ধ করে সে বাড়ি চলে যাবে মেয়েটা বেশ ঝাঁঝের সাথে বললো তার কাজ এখনও শেষ হয় নি। তার যদি বাড়ি যেতে ইচ্ছে হয় সে যেনো চাবিটা তার কাছে দিয়ে চলে যায়। কাজ শেষে বন্ধ করে চলে যাবে সে। মহিলা ক্ষিপ্ত হয়ে ফ্রোডির কাছে ফোন করে নালিশ করেলো যে একটা পুচকে মেয়ে কিভাবে তার সাথে বাজে ব্যবহার করেছে, আবার বলছে চাবিটা তার কাছে রেখে যেতে। ফ্রোডি শীতল কণ্ঠে বললো মেয়েটা যদি ইচ্ছে করে সারা রাত থাকতে পারে। কোনো সমস্যা নেই। মিসেস লিন্ডগ্রেন যেনো সিকিউরিটিকে বলে যায় মেয়েটা রাতের বেলায় থাকতে পারে।

তিন ঘণ্টা পর ৮:৩০-এ সালান্ডার অনেকটা নিশ্চিত হলো যে আটটি খুনের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচটির কাছাকাছি অবস্থান করছিলো গটফ্রিড। হয় ঘটনা ঘটার আগের রাতে নয়তো পরে গেছে সে তবে ১৯৪৯ আর ১৯৫৪ সালের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে এখনও তেমন কিছু জানতে পারে নি সালান্ডার। পত্রিকায় ছাপা হওয়া গটফ্রিডের একটা ছবি ভালো করে দেখলো সে। হালকাপাতলা আর খুব হ্যান্ডসাম এক পুরুষ, দেখতে অনেকটা চল্লিশ দশকের হলিউডি নায়ক ক্লার্ক গ্যাবলের মতো।

১৯৪৯ সালে গটফ্রিডের বয়স ছিলো বাইশ। প্রথম খুনটি তার নিজের এলাকার মধ্যেই সংঘটিত হয়েছে। হেডেস্টাডে। রেবেকা জ্যাকবসন ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশনেই কাজ করতো। তোমরা দু’জন কোথায় দেখা করেছিলে? তুমি মেয়েটার কাছে কি প্রতীজ্ঞা করেছিলে?

নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরলো সালান্ডার। সমস্যাটা হলো ১৯৬৫ সালে গটফ্রিড ভ্যাঙ্গার পানিতে ডুবে মারা গেছে, আর শেষ হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে ১৯৬৬ সালের ফ্রেব্রুয়ারি মাসে উপসালায়। সালান্ডার ভাবতে লাগলো উপসালার স্কুলছাত্রি লেনা এন্ডারসনকে লিস্ট করার সময় সে কোনো ভুল করেছিলো কিনা। না। এই হত্যাকাণ্ডটি ঠিক আগেরগুলোর মতো না হলেও এটাতেও বাইবেলের অনুকরণ করা হয়েছে। অবশ্যই কোনো না কোনো কানেকশান আছে।

.

রাত ৯টার দিকে আলো কমে এসে একেবারে অন্ধকার হয়ে এলো। বাতাস খুব ঠাণ্ডা, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। রান্নাঘরের টেবিলে বসে আছে মিকাইল। এমন সময় দেখতে পেলো মার্টিন ভ্যাঙ্গারের ভলভো গাড়িটা বৃজ অতিক্রম করছে। এটা দেখে তার মাথায় একটা কিছু খেলে গেলো।

কি করবে সেটা অবশ্য মিকাইল জানে না। প্রশ্ন করার জন্য বেশ ছটফট করছে সে মুখোমুখি হতে চাচ্ছে। তার এই ইচ্ছেটা একেবারেই সুচিন্তিত নয়, কারণ সে যদি মার্টিনকে তার নিজের বোনের হত্যাকারী হিসেবে সন্দেহ করে থাকে তার মানে দাঁড়ালো লোকটা ভয়ঙ্কভাবে অসুস্থ এক খুনি। সে যে কয়েকটি মেয়েকে খুন করেছে তা-ই নয়, মিকাইলকেও হত্যা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মার্টিন একজন আকর্ষণীয় ব্যক্তি। সে জানে না ব্লমকোভিস্ট তার সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে গেছে। গটফ্রিড কেবিনের চাবিটা ফেরত দিতে এসেছে এরকম একটি ভান করে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা করে আসতে পারে সে। নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে পড়লো ব্লমকোভিস্ট।

হেরাল্ড ভ্যাঙ্গারের বাড়িটা যথারীতি নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে আছে। হেনরিকের বাড়ির সামনের ঘরটা ছাড়া সব ঘরেরই বাতি নেভানো। অ্যানা শুতে চলে গেছে। ইসাবেলার বাড়িটাও অন্ধকার। সিসিলিয়া বাড়িতে নেই। আলেকজান্ডারের বাড়ির উপর তলায় বাতি জ্বললেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

মার্টিনের বাড়ির সামনে এসে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে থমকে দাঁড়ালো সে। পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে সালান্ডারকে ফোন করার চেষ্টা করলো। কোনো সাড়া নেই। ফোনটা বন্ধ করে রাখলো যেনো কল এলে রিং বেজে না ওঠে।

নীচের তলায় বাতি জ্বলছে। লনটা পেরিয়ে রান্নাঘরের জানালা থেকে কয়েক পা দূরে থাকতেই থেমে গেলো ব্লমকোভিস্ট। কাউকে দেখতে পেলো না। আরো সামনে এগিয়ে গেলো, প্রতিটি জানালার সামনেই একটু থেমে দেখে নিলো সে, কিন্তু মার্টিনের কোনো চিহ্নও খুঁজে পেলো না। গ্যারাজের ভেতরে ছোট্ট একটা সাইড-ডোর খোলা অবস্থায় দেখতে পেলো ব্লমকোভিস্ট। বোকার মতো কাজ কোরো না। কিন্তু দেখার লোভ সংবরণ করতে পারলো না সে।

কার্পেন্টার বেঞ্চে একটা খোলা বাক্সে গুলি আর পাশে একটা শিকারী রাইফেল দেখতে পেলো সবার আগে। এরপর দেখতে পেলো বেঞ্চের ঠিক নীচে, মেঝেতে দুটো গ্যাসোলিনের ক্যান রাখা আছে। আরেকটি রাত্রিকালীন অভিযানের জন্য প্রস্তত হচ্ছো, মার্টিন?

“ভেতরে আসুন, মিকাইল। আপনাকে আমি আসতে দেখেছি।”

ব্লমকোভিস্টের হৃদপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠলো যেনো। আস্তে করে পেছন ফিরে দেখতে পেলো মার্টিন ভ্যাঙ্গার বাড়িতে ঢোকার দরজার কাছে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে।

“আপনি না এসে পারলেন না, তাই না?”

তার কণ্ঠটা বেশ শান্ত, একেবারে বন্ধুত্বপূর্ণ সেটা।

“হাই, মার্টিন,” বললো ব্লমকোভিস্ট।

“ভেতরে আসুন,” আবারো বললো মার্টিন। “এদিক দিয়ে।”

একটু সামনে এগিয়ে এসে বাম হাতটা বাড়িয়ে কাছে আসার ইশারা করলো। ডান হাতটা একটু তুললে ব্লমকোভিস্ট দেখতে পেলো তার হাতে ধরে রাখা ধাতব জিনিসটা।

“আমার হাতে একটা পিস্তল আছে। বোকার মতো কিছু করবেন না। এতো কাছ থেকে আমার নিশানা ব্যর্থ হবে না।”

আস্তে আস্তে কাছে এগিয়ে এলো ব্লমকোভিস্ট। মার্টিনের সামনে এসে তার চোখের দিকে তাকালো সে।

“আমাকে এখানে আসতেই হতো। অনেক প্রশ্ন জমে আছে।

“বুঝতে পেরেছি। দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ুন।

বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লো ব্লমকোভিস্ট। রান্নাঘরের পাশে একটা হলঘরে চলে এলো তারা, কিন্তু আরেকটু এগোনোর আগেই পেছন থেকে তার কাঁধে আলতো করে হাত রাখলো মার্টিন।

“না, ওদিকে না। ডান দিকে যান। দরজাটা খুলুন।”

এটা বেজমেন্টে যাবার দরজা। সিঁড়ি দিয়ে যখন নীচে নামছে ব্লমকোভিস্ট তখনই মার্টিন সুইচ টিপে বাতি জ্বালিয়ে দিলো। তার ডান দিকে বয়লার-রুম। সামনে থেকে লন্ড্রির গন্ধ নাকে আসছে। মার্টিন তাকে বাম দিকে একটা স্টোরেজরুমে নিয়ে গেলো। পুরনো আসবাব আর বাক্সের স্তুপ, তার পেছনেই আছে ডেড-বোল্টলকসহ স্টিলের দরজা।

“এটা,” ব্লমকোভিস্টের হাতে একটা চাবির রিং ধরিয়ে দিলে বললো, “খুলে ফেলুন।”

চাবি ঘুরিয়ে খুলে ফেললো সে।

“বাম পাশে সুইচ আছে।

ব্লমকোভিস্ট নরকের দাজাটা খুলে ফেললো।

.

রাত ৯টার দিকে কফি আর ভেন্ডিং মেশিন থেকে স্যান্ডউইচ খাওয়ার জন্য আর্কাইভের বাইরে করিডোরে গিয়েছিলো সালান্ডার। পুরনো ডকুমেন্টগুলো ঘেটে দেখলো ১৯৫৪ সালে গটফ্রিড ভ্যাঙ্গার কালমারে গিয়েছিলো কিনা। কিছুই পেলো না সে।

একবার তার মনে হলো ব্লমকোভিস্টকে ফোন করবে, তবে ঠিক করলো নিউজলেটারগুলো দেখার পরই কাজ শেষে তার সাথে কথা বলবে।

.

জায়গাটা আনুমানিক দশ বাই বিশ ফিটের মতো হবে। ব্লমকোভিস্ট আন্দাজ করলো মার্টিনের বাড়ির নীচে দক্ষিণ দিকেই হবে।

মার্টিন ভ্যাঙ্গার তার ব্যক্তিগত নির্যাতন কক্ষটি পরিকল্পনা মতোই সাজিয়ে রেখেছে। বাম দিকে আছে কতোগুলো শেকল, ছাদ আর মেঝেতে অনেকগুলো ফুটো। একটা টেবিল আর চামড়ার স্ট্র্যাপ, যেখানে তার শিকারদের ধরে এনে বেধে রাখে সে। এরপর আছে ভিডিও যন্ত্রপাতি। এটা টেপিং স্টুডিও। ঘরের পেছনে তার অতিথিদের জন্য লোহার খাঁচা। দরজার ডান দিকে একটা বেঞ্চ, একটা বিছানা আর এক কোণে ভিডিওসহ একটি টিভি।

তারা ঘরে ঢুকতেই মার্টিন ভ্যাঙ্গার ব্লমকোভিস্টের দিকে পিস্তল তাক করে মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে বললো তাকে। রাজি হলো না ব্লমকোভিস্ট।

“বেশ ভালো,” বললো মার্টিন। “তাহলে আপনার হাটুতে গুলি করবো আমি।”

নিশানা করতেই আত্মসমর্পন করলো ব্লমকোভিস্ট।

আশা করলো মার্টিন যেনো দশ সেকেন্ডের জন্য বেখেয়ালে থাকে-ভালো করেই জানে তার সাথে শারীরিকভাবে পেরে উঠবে সে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মার্টিন যখন তার কাঁধে হাত রাখলো তখন এরকম একটা সুযোগ এসেছিলো। তবে সেটা পুরোপুরি কাজে লাগানোর মতো অবস্থায় ছিলো না। এরপর আর মার্টিন তার খুব কাছে আসে নি। তার হাটুতে যদি গুলি করে ফেলে তাহলে আর কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না। মেঝেতে শুয়ে পড়লো সে।

তার কাছে এসে হাত দুটো পেছনে নেবার জন্য বললো মার্টিন। তার হাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে দিলো সে। এরপর মিকাইলের কুচকিতে সজোরে লাথি মেরে উন্মাদের মতো কিলঘুষি চালালো বেশ কিছুক্ষণ।

এরপর যা হলো সেটাকে দুঃস্বপ্ন বলা যেতে পারে। মার্টিন যেনো উন্মাদগ্রস্ততা আর স্বজ্ঞানের মাঝখানে অবস্থান করছে। হঠাৎ করে শান্ত হয়ে উঠে তো পরক্ষণেই জন্তুজানোয়ারের মতো সামনে পেছনে পায়চারি করতে শুরু করে দেয়। খাঁচায় বন্দী প্রাণীর মতো লাগে তখন। বেশ কয়েক বার ব্লমকোভিস্টকে সজোরে লাথি মারলো সে। কোনো রকম মাথাটা রক্ষা করে লাথিগুলো হজম করা ছাড়া আর কিছুই করার রইলো না তার।

প্রথম আধঘণ্টায় মার্টিন কোনো কথাই বললো না, মনে হলো কোনো রকম কথাবার্তা বলতে অক্ষম সে। এরপর মনে হলো নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হলো মার্টিন। ব্লমকোভিস্টের গলায় একটি শেকল পেচিয়ে দিয়ে মেঝের ফুটোর সাথে সেটা আর্টকে দিলো। পনেরো মিনিটের জন্য ব্লমকোভিস্টকে একা রেখে চলে গেলো সে। যখন ফিরে এলো তার হাতে একটা পানির বোতল। চেয়ারে বসে পানি পান করতে করতে চেয়ে রইলো ব্লমকোভিস্টের দিকে।

“আমি কি একটু পানি পেতে পারি?” বললো ব্লমকোভিস্ট।

একটু ঝুঁকে তার মুখে বোতলটা নীচু করে ধরলো। ঢকঢক করে পানি পান করলো সে।

“ধন্যবাদ।”

“এখনও এতো ভদ্র ব্যবহার, কাল ব্লমকোভিস্ট।”

এতো কিলঘুষি কেন?” ব্লমকোভিস্ট বললো।

“কারণ তুই আমাকে অনেক ক্ষেপিয়ে তুলেছিস। তোকে অনেক শাস্তি দিতে হবে। এটাই তোর প্রাপ্য। তুই নিজের শহরে ফিরে গেলি না কেন? তোকে তো মিলেনিয়াম-এ খুব দরকার। আমি খুব সিরিয়াস-আমরা সবাই মিলে ওটাকে ভালো একটি পত্রিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতাম। বছরের পর বছর ধরে আমরা এক সাথে কাজ করতে পারতাম সেখানে।”

তিক্ত হাসি হেসে ব্লমকোভিস্ট একটু আরামদায়ক অবস্থায় শরীরটা নেবার জন্য চেষ্টা করলো। একেবারে আত্মরক্ষাহীন অবস্থায় আছে সে। কেবল মার্টিনের কথাই শুনতে পাচ্ছে, তাকে দেখতে পাচ্ছে না।

“মনে হচ্ছে আপনি বলতে চাচ্ছেন সেই সুযোগটা শেষ হয়ে গেছে।”

উচ্চস্বরে হেসে ফেললো মার্টিন ভ্যাঙ্গার।

“আমি দুঃখিত, মিকাইল। তোকে যে এখন মরতে হবে এটা তুইও ভালো করে জানিস।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ব্লমকোভিস্ট।

“তুই আর তোর ঐ হাড্ডিসার ভুতটা, যাকে তুই এখানে নিয়ে এসেছিস, তোরা আমাকে খুঁজে পেলি কিভাবে?”

“হ্যারিয়েট নিখোঁজ হবার দিন আপনি কি করছিলেন সে ব্যাপারে মিথ্যে বলেছিলেন। শিশুদের প্যারেডের দিন আপনি হেডেস্টাডে ছিলেন। ওখানে যে ছিলেন সেটার ছবি আছে। হ্যারিয়েটের দিকে তাকিয়েছিলেন আপনি।”

“এজন্যেই কি তুই নরসিও’তে গিয়েছিলি?”

“ছবিটা নেবার জন্য গেছিলাম। এক দম্পতি মধুচন্দ্রিমা যাপন করতে গিয়েছিলো হেডেস্টাডে। তারাই তুলেছিলো ছবিটা।”

মাথা ঝাঁকালো সে।

গভীরভাবে ভেবে দেখলো ব্লমকোভিস্ট : তার মৃত্যু ঠেকানোর জন্য কি বললে ভালো হয়।

“ছবিটা এখন কোথায়?”

“নেগেটিভ? হেডেস্টাডের হ্যান্ডেলসবাঙ্কেন-এর একটি সেফ-ডিপোজিটে রেখেছি…আপনি জানেন না আমার একটা সেফ-ডিপোজিট বক্স আছে?” খুব সুন্দর করে মিথ্যে বললো সে। “বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য কপি আছে সেটার। আমার এবং ঐ মেয়েটার কম্পিউটারে, মিলেনিয়াম আর মিল্টন সিকিউরিটির সার্ভারে। মেয়েটা ওখানেই কাজ করে।”

মার্টিন অপেক্ষা করলো, ভেবে দেখলো ব্লমকোভিস্ট তাকে ধোকা দিচ্ছে কিনা।

“ঐ মেয়েটা কতোটুকু জানে?”

একটু ইতস্তত করলো ব্লমকোভিস্ট। এই মুহূর্তে সালান্ডারই তার একমাত্র ভরসা। কটেজে ফিরে এসে তাকে না পেলে মেয়েটা কি ভাববে? রান্নাঘরের টেবিলে মার্টিন ভ্যাঙ্গারের ছবিটা রেখে এসেছে সে। এটা দেখে কি মেয়েটা কিছু বুঝতে পারবে? পুলিশকে সে বলবে না এটা নিশ্চিত। সবচাইতে খারাপ হবে সালান্ডার যদি মার্টিনের বাড়িতে এসে বেল বাজায়, তার কাছে জানতে চায় ব্লমকোভিস্ট কোথায় আছে।

“আমার প্রশ্নের জবাব দে,” বরফ শীতল কণ্ঠে বললো মার্টিন।

“ভাবছি। আমি যতোটুকু জানি মেয়েটাও ততোটুকু জানে, সম্ভবত আমার চেয়ে একটু বেশিই জানে। হ্যা, আমি বলবো সে আমার চেয়েও বেশি জানে। মেয়েটা খুব বুদ্ধিমতি। সে-ই লেনা এন্ডারসনের লিঙ্কটা বের করেছে।”

“লেনা এন্ডারসন? মার্টিন একেবারে হতবিহ্বল।

“১৯৬৬ সালে যে মেয়েটাকে আপনি নির্যাতন করে খুন করেছিলেন। এটা আবার বলবেন না যে তার কথা মনে নেই।”

“আমি জানি না তুই এসব কি বলছিস।” এই প্রথম একটু কাঁপতে দেখা গেলো তাকে। অবশ্য লেনা এন্ডারসনের কানেকশানটাও এই প্রথম ধরা পড়েছে। হ্যারিয়েটের ডেটবুকেও তার উল্লেখ নেই।

“মার্টিন,” ব্লমকোভিস্ট নিজের কণ্ঠটা যতোদূর সম্ভব শান্ত করে বললো। “এটা শেষ হয়ে গেছে। আপনি আমাকে খুন করতে পারেন, কিন্তু আপনার খেল খতম হয়ে গেছে। এটা এখন অনেক লোকই জেনে গেছে।

আবারো পায়চারি করতে লাগলো মার্টিন।

আমাকে মনে রাখতে হবে সে একেবারে বদ্ধ উন্মাদ। কাণ্ডজ্ঞানহীন একজন মানুষ। বেড়ালটা। বেড়ালটা এখানে নিয়ে এসে আবার ক্রিপ্টে ফিরে গেছিলো সে। মার্টিন পায়চারি থামিয়ে দিলো।

“আমার মনে হচ্ছে তুই মিথ্যে বলছিস। তুই আর সালান্ডারই শুধু এসব জানিস। তুই কারো সাথেই কথা বলিস নি। তা না হলে এখানে পুলিশ চলে আসতো। তোর কটেজটা আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলেই সব প্রমাণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

“আর আপনার ধারণা যদি ভুল হয়?”

“আমার ধারণা যদি ভুল হয় তাহলে আমি শেষ। তবে আমার তা মনে হচ্ছে না’। বাজি ধরে বলতে পারি তুই ধোকা দিচ্ছিস। আমার কাছে এ ছাড়া আর কি উপায় আছে? একটু ভেবে নিই। ঐ শুটকি মাগিটাই একমাত্র লিঙ্ক।”

“লাঞ্চটাইমে সে স্টকহোমে গেছে।”

মার্টিন হেসে ফেললো।

“ধোকা দিচ্ছিস আমাকে। ঐ মাগিটা ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশনের আর্কাইভে বসে আছে।”

ব্লমকোভিস্টের হৃদস্পন্দন থেমে গেলো। সে জানে। সে সব জানে।

“তা ঠিক। পরিকল্পনাটা হলো আর্কাইভ থেকে সে স্টকহোমে চলে যাবে,” বললো রমকোভিস্ট। “আমি জানি না ওখানে সে এতোক্ষণ ধরে বসে আছে কেন।”

“এইসব ফালতু কথা বন্ধ কর। আর্কাইভ ম্যানেজার আমাকে জানিয়েছে ডার্চ ফ্রোডি নাকি তাকে বলেছে মেয়েটা যতোক্ষণ খুশি আর্কাইভে থাকতে পারবে। এখনও সে ওখানেই আছে। তার মানে কটেজে ফিরে আসবে সে। অফিস থেকে মাগিটা বের হলেই নাইটওয়াচম্যান আমাকে ফোন ক’রে জানাবে।”

অধ্যায় ২৪

শুক্রবার, জুলাই ১১-শনিবার, জুলাই ১২

উপুড় হয়ে মার্টিন ভ্যাঙ্গার মিকাইলের পকেট হাতরে চাবিটা নিয়ে নিলো।

“খুব স্মার্ট তুই, লকটা পাল্টে ফেলেছিস,” বললো সে। “তোর বান্ধবী কটেজে ফিরে এলেই আমি তার একটা ব্যবস্থা করে ফেলবো।”

ব্লমকোভিস্ট নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিলো মার্টিন ভ্যাঙ্গার তার ইন্ডাস্ট্রিজে অনেক অনেক নেগোশিয়েশনে অংশ নিয়েছে। এ ব্যাপারে সে অভিজ্ঞ একজন। ইতিমধ্যে তার একটা ধোকা ধরে ফেলেছে সে।

“কেন?”

“কিসের কেন?”

“এসব কেন করেছেন?” ঘরটার চারপাশে ইঙ্গিত করে বললো ব্লমকোভিস্ট। আবারো উপুড় হয়ে তার গালে হাত বোলালো মার্টিন। মাথাটা একটু উপরে তুলে ধরে তার চোখ বরাবর তাকালো সে।

“কারণ এটা খুব সহজ। সব সময়ই মেয়েরা নিখোঁজ হয়। তাদেরকে কেউ মিস করে না। অভিবাসী। রাশিয়া থেকে আসা বেশ্যার দল। প্রতি বছর হাজার হাজার লোক সুইডেনে প্রবেশ করে।”

এবার উঠে দাঁড়ালো সে।

মার্টিনের কথাটা শুনে ব্লমকোভিস্টের মনে হলো তার মুখে বুঝি কেউ ঘুষি মেরেছে।

হায় ঈশ্বর! এটা তো দেখছি ঐতিহাসিক কোনো রহস্য নয়। মার্টিন ভ্যাঙ্গার এখনও নারী হত্যা করে চলেছে। আর আমি কিনা ঠিক তার গুহায় ঢুকে পড়েছি…

“এখন আমার এখানে কোনো অতিথি নেই। তবে একটা কথা শুনে হয়তো বেশ মজা পাবি। তুই আর হেনরিক মিলে শীতকাল আর বসন্তে যখন বাল ফেলছিলি আমার এখানে তখন একটা মেয়ে বন্দী ছিলো। বেলারুসের ইরিনা। তুই যখন আমার সাথে আমার বাড়িতে বসে ডিনার করছিলি তখনও সে এখানেই ছিলো। ঐযে খাঁচাটা দেখছিস, ওটাতে আটকে রেখেছিলাম তাকে। যতোদূর মনে পড়ে সময়টা খুব চমৎকার ছিলো, তাই না?”

টেবিলে উঠে বসলো মার্টিন। চোখ বন্ধ করে ফেললো ব্লমকোভিস্ট। তার মনে হলো মুখে কিছুটা এসিড উঠে এসেছে পেট থেকে। কোনো রকম ঢোক গিলে ফেললো সে। পেট আর বুকের ব্যাথাটা বেড়েই চলেছে।

“লাশগুলো নিয়ে কি করেন?”

“বাড়ির কাছে ডকে আমার একটা বোট আছে। লাশগুলো ওটাতে করে গভীর সাগরে নিয়ে যাই। আমি আমার বাবার মতো কোনো প্রমাণ বা আলামত রাখি না। তবে সেও খুব স্মার্ট ছিলো। নিজের শিকারগুলো সমগ্র সুইডেনে ছড়িয়ে দিতো সে।

পাজলের টুকরোগুলো এবার মিলে যাচ্ছে খাপে খাপে।

গটফ্রিড ভ্যাঙ্গার। ১৯৪৯ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত। তারপর মার্টিন ভ্যাঙ্গার, ১৯৬৬ সালের উপসালার ঘটনা থেকে শুরু।

“আপনি আপনার বাবার খুব ভক্ত মনে হচ্ছে।

“বাবাই আমাকে শিখিয়েছে। আমার বয়স যখন চৌদ্দ তখন সে আমার হাতেখড়ি করিয়েছে।

“উদেভাল্লার লিয়া পারসন।

“তুই তো অনেক চালাক। হ্যা, ওখানে আমি ছিলাম। আমি শুধু দেখেছি। তবে ওখানে আমি ছিলাম।”

“১৯৬৪ সালে রোনিবির সারা উইট।”

“আমার বয়স তখন ষোলো। আমার জীবনের প্রথম নারী সে। আমার বাবা শিখিয়েছিলো। আমিই তার গলায় ফাঁস দিয়েছিলাম।”

নিজেকে জাহির করছে সে। হায় ঈশ্বর, কী জঘন্য অসুস্থ পরিবার।

“আপনার কোনো ধারণাই নেই কী বীভৎস এটা।”

“তুই খুবই সাধারণ আর তুচ্ছ একজন মানুষ, মিকাইল। কারো জীবন আর মৃত্যুর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার ঈশ্বরতুল্য অনুভূতিটা কখনও বুঝতে পারবি না তুই।”

“মার্টিন, আপনি নারীদেরকে নিযার্তন করে হত্যা করতে খুব মজা পান।”

“আমার আসলে তা মনে হয় না। আমি যদি আমার অবস্থাকে একটু বুদ্ধি দিয়ে বিশ্লেষণ করি তাহলে আমি এক ধরণের সিরিয়াল রেপিস্ট, সিরিয়াল কিলার না। সত্যি বলতে কি আমি আসলে একজন সিরিয়াল কিডন্যাপার। খুন করাটা স্বাভাবিক পরিণতি। কারণ আমাকে আমার অপরাধ লুকাতে হয়।

“অবশ্য আমার কর্মকাণ্ড সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়, তবে আমার অপরাধ প্রথমত এবং সর্বাগ্রে প্রচলিত সমাজের বিরুদ্ধে অপরাধ। আমার অতিথিরা এখানে আসার আগ পর্যন্ত খুনখারাবি হয় না। তাদের প্রতি আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেললেই সেটা ঘটে। তাদের বিস্ময় আর হতাশা দেখতে দারুণ লাগে আমার।”

“হতাশা?”

“ঠিক তাই। হতাশা। তারা ভাবে আমাকে খুশি করতে পারলে তারা বুঝি বেঁচে যাবে। ফলে তারা আমার কথামতোই কাজ করে। আমাকে বিশ্বাস করতে শুরু করে, আমার সাথে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। কিন্তু শেষে যখন বুঝতে পারে তাদেরকে ধোকা দেয়া হয়েছে তখন খুবই হতাশ হয়।

টেবিল থেকে উঠে লোহার খাঁচার দিকে চলে গেলো মার্টিন।

“তুই আর তোর বুর্জোয়া ধ্যানধারণা এসব ব্যাপার কখনও অনুধাবন করতে পারবে না। তবে অপহরণ করার পরিকল্পনা থেকে দারুণ উত্তেজনা পাওয়া যায়। এটা হুট করে করা হয় না-ওভাবে হুটহাট করে যারা অপহরণ করে তারা অবধারিতভাবেই ধরা পড়ে। আমি এক ধরণের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করি। সবার আগে আমার শিকারকে চিহ্নিত করি, তার জীবনযাপনের রূপরেখা বোঝার চেষ্টা করি, সে কে, কোত্থেকে এসেছে, কিভাবে তার সাথে যোগাযোগ করতে পারি, আমার নিজের নাম না জানিয়েই শিকারকে একাকী পাবার জন্য আমাকে কি কি করতে হবে, কিভাবে করলে পুলিশী তদন্তে ধরা পড়বো না, সবকিছু খতিয়ে দেখি।

চুপ করো, ঈশ্বরের দোহাই, ভাবলো ব্লমকোভিস্ট।

“তুই কি আসলেই এসবে আগ্রহী, মিকাইল?

উপুড় হয়ে ব্লমকোভিস্টের গালে টোকা দিলো সে, তবে একেবারে আদর করে যেনো।

“তুই বুঝতে পারছিস নিশ্চয়, এটা কেবল একভাবেই শেষ হয়? আমি যদি সিগারেট খাই তুই কি কিছু মনে করবি?”

“আপনি আমাকেও একটা সিগারেট দিতে পারেন,” বললো সে।

মার্টিন দুটো সিগারেট ধরিয়ে একটা ব্লমকোভিস্টের ঠোঁটে গুঁজে দিয়ে দীর্ঘ একটা টান দিতে দিলো তাকে।

“ধন্যবাদ,” স্বয়ক্রিয়ভাবেই বলে ফেললো ব্লমকোভিস্ট।

হা হা করে হেসে উঠলো মার্টিন ভ্যাঙ্গার।

“দেখেছিস, তুইও এরইমধ্যে আমার অধীনস্ততা মেনে নিয়েছিস। তোর জীবন এখন আমার হাতে। যেকোনো সময় তোকে শেষ করে দিতে পারি, এটাও তুই জানিস। আরেকটু অনুনয় করে তোর জীবনের গুনাগুন বাড়িয়ে নিতে পারিস। ভালো ব্যবহার আর যুক্তি দেখিয়ে তুই তাই করছিস। এরজন্যে তুই পুরস্কার পাবি।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ব্লমকোভিস্ট। তার হৃদস্পন্দন এতোটাই বেড়ে গেলো যে সেটা অসহ্য ঠেকছে নিজের কাছে।

.

রাত ১১:১৫-এর দিকে কাগজপত্র ঘাটাঘাটি করতে করতে বোতল থেকে পানি খেয়ে নিলো লিসবেথ সালান্ডার। কানেকশানটা দেখে তার চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেলো।

ক্লিক!

দু’ঘণ্টা ধরে সব ধরণের নিউজলেটার ঘেটে দেখলো সে। প্রধান নিউজলেটারটা ছিলো কোম্পানি ইনফরমেশন। ওটাতে ভ্যাঙ্গার লোগো অঙ্কিত আছে-তীর চিহ্নের পাশে সুইডিশ ব্যানার বাতাসে উড়ছে। ফার্মের বিজ্ঞাপন ডিপার্টমেন্টের কাজ এটি। এমন সব প্রচারনায় ভর্তি যাতে করে এই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা মনে করতে পারে তারা বিশাল একটি পরিবারের অর্ন্তভূক্ত।

১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারির শীতকালীন ক্রীড়ানুষ্ঠানের সময় হেনরিক ভ্যাঙ্গার তার পঞ্চাশজন কর্মচারিকে পরিবার-পরিজন নিয়ে হারিয়েডালেনের মেইন অফিসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো সপ্তাহব্যাপী স্কি খেলার জন্য। এর আগের বছর তাদের কোম্পানি রেকর্ড পরিমাণ লাভ করেছিলো। পাবলিক রিলেশন ডিপার্টমেন্টও সেখানে গিয়েছিলো সচিত্র প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য।

অনেকগুলো ছবির মজার মজার ক্যাপশন দেয়া আছে। কিছু কিছু ছবিতে কর্মচারিরা বারে বসে বিয়ার খাচ্ছে। আনন্দ করছে। দুটো ছবিতে হেনরিক ভ্যাঙ্গারকে দেখা যাচ্ছে বছরের সেরা অফিস ওয়ার্কার হিসেবে উলা-ব্রিট নামের একজনের নাম ঘোষণা করতে। মহিলাকে পাঁচশ’ ক্রোনার আর ক্রিস্টালের বোল উপহার দেয়া হচ্ছে।

অনুষ্ঠানটি এক হোটেলের টেরাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো, আর সেটা পাহাড়ের ঢালু দিয়ে স্কি করার জায়গার ঠিক সামনেই অবস্থিত। ছবিতে প্রায় বিশজনের মতো লোক রয়েছে।

ডান দিকে, হেনরিক ভ্যাঙ্গারের ঠিক পেছনে লম্বা সোনালি চুলের এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে কালো রঙের জ্যাকেট, আর কাধের দিকে লাল রঙের প্যাচ। তবে ছবিটা যেহেতু সাদাকালো তাই রঙটা লাল দেখাচ্ছে না। অবশ্য সালান্ডার জানে কাধের প্যাচটা লাল রঙেরই।

ছবির নীচে ক্যাপশনটা বলছে : সর্ব ডানে আছে মার্টিন ভ্যাঙ্গার (১৯), উপসালায় পড়াশোনা করছে সে। ইতিমধ্যেই তাকে কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় ভবিষ্যত কর্মকর্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

“পেয়েছি,” আস্তে ক’রে বললো সালান্ডার।

ডেস্কের ল্যাম্পটা বন্ধ করে নিউজলেটারগুলো ডেস্কের উপরেই ফেলে রেখে চলে গেলো সে। এই কাজটা ঐ লিন্ডগ্রেন মাগিটাই সামলাবে।

কার পার্কের কাছে এসে তার মনে পড়ে গেলো চলে যাবার সময় নাইটওয়াচম্যানকে বলে যাবার কথা ছিলো তার। চারপাশে তাকিয়ে দেখলো ওয়াচম্যানের অফিসটি ভবনের অন্যপ্রান্তে অবস্থিত। তার মানে লোকটাকে বলতে গেলে এই ভবনটা ঘুরে অপর পাশে যেতে হবে তাকে। কিন্তু তার ইচ্ছে করছে না। ঘুমন্ত কুকুরকে ঘুমিয়ে থাকতে দেয়াই ভালো, ঠিক করলো সে।

হেলমেট পরার আগে ব্লমকোভিস্টকে ফোন করলো মোবাইলে। তাকে বলা হলো এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তার মানে মোবাইলটা নেটওয়ার্কের বাইরে আছে নয়তো বন্ধ করে রেখেছে সে। কিন্তু ৩:৩০ থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ব্লমকোভিস্টও যে তাকে বারো তেরো বার ফোন করার চেষ্টা করেছিলো সেটাও দেখতে পেলো সালান্ডার। তবে শেষ দু’ঘণ্টায় কোনো কল করা হয় নি।

কটেজের নাম্বারে ফোন করলো, সেখানেও কোনো জবাব নেই। একটু অবাকই হলো, সঙ্গে সঙ্গে আর দেরি না করে ল্যাপটপের ব্যাগেটা কাঁধে তুলে নিয়ে মোটরসাইকেলটা স্টার্ট করলো সে। হেডেবি আইল্যান্ডে চলে আসতে মাত্র দশ মিনিট লাগলো তার। কটেজের রান্নাঘরের বাতি জ্বলতে দেখলো সালান্ডার।

চারপাশে তাকালো। প্রথমেই তার মনে হলো ফ্রোডির সাথে দেখা করতে গেছে ব্লমকোভিস্ট, কিন্তু চেয়ে দেখলো বৃজের ওপারে ফ্রোডির অফিসঘরের বাতি নেভানো। ঘড়ির দিকে তাকালো : ১১:৪০।

কটেজে ঢুকে ওয়ারড্রব খুলে দুটো পি.সি বের করলো সে। এ দুটো পি.সি’তে সার্ভিলেন্স ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ সংরক্ষণ করা হয়েছে। ফুটেজটা দেখতে কিছুটা সময় লাগলো তার।

১৫:৩২-এ ব্লমকোভিস্ট কটেজে ঢুকছে।

১৬:০৩-এ কফি কাপ নিয়ে বাগানে গিয়ে বসেছে সে। তার সঙ্গে একটা ফোল্ডার আছে। কফি খেতে খেতে ওটা পড়ে গেলো। বাগানে বসেই মোট তিনটি ফোন কল করলো ব্লমকোভিস্ট। সালান্ডার বুঝতে পারলো কলগুলো তাকেই করা হয়েছিলো।

১৭:২১-এ কটেজ ছেড়ে বাইরে গেলো ব্লমকোভিস্ট। পনেরো মিনিট পরই সে ফিরে এলো আবার।

১৮:২০-এ গেটের কাছে এসে বৃজের দিকে তাকালো।

২১:০৩-এ বাইরে চলে গেলো সে। এরপর আর ফিরে আসে নি।

অন্য পি.সি থেকে ফুটেজগুলো দেখে নিলো সালান্ডার। এটাতে আছে গেট আর ফ্রন্টডোরের বাইরের দৃশ্য। এখানে কে এসেছিলে, সামনে দিয়ে কে চলে গেছিলো সবই ধরা পড়বে ক্যামেরায়।

১৯:১২, বাড়িতে এলো নিলসন।

১৯:৪২, ওস্টারগার্ডেনের সাব’টা হেডেস্টাডের দিকে এলো।

২০:০২, সাব’টা আবার ফিরে গেলো যেখান থেকে এসেছিলো সেখানে। ২১:০০, মার্টিন ভ্যাঙ্গারের গাড়িটা এলো। এর তিন মিনিট পর বাড়ি ছেড়ে

বাইরে গেছিলো ব্লমকোভিস্ট।

২১:৫০, ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে মার্টিন ভ্যাঙ্গারকে দেখা গেলো। প্ৰায় এক মিনিটের মতো সময় ধরে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইলো সে। এরপর রান্নাঘরের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে একটা চাবি বের করলো মার্টিন। সে হয়তো জেনে গেছে তারা নতুন লক লাগিয়ে নিয়েছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের বাড়িতে ফিরে গেলো আবার।

সালান্ডারের গায়ের পশম কাটা দিয়ে উঠলো।

.

মার্টিন ভ্যাঙ্গার আবারো ব্লমকোভিস্টকে একা রেখে বাইরে চলে গেলো। পেছন মোড়া করে তার হাত বাধা, আর গলায় একটা শেকল পেচিয়ে মেঝেতে থাকা আটার সাথে সেটা আটকে রাখার কারণে বেশ বেকায়দা আছে সে। হ্যান্ডকাফ লাগানো হাত দুটো খোলার চেষ্টা করলো কিন্তু সে জানে এতে কোনো লাভ হবে না।

তার কোনো সুযোগই নেই। চোখ বন্ধ করে ফেললো ব্লমকোভিস্ট।

মার্টিনের পায়ের আওয়াজ যখন আবার শুনতে পেলো তখন বুঝতে পারলো না ঠিক কতোক্ষণ সময় অতিক্রম হয়ে গেছে এই ফাঁকে। মার্টিন এবার ব্লমকোভিস্টের দৃষ্টিসীমার মধ্যে চলে এলো। তাকে খুব উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে।

“অস্বস্তি লাগছে?” বললো সে।

“অনেক,” ব্লমকোভিস্ট বললো।

“এজন্যে শুধু নিজেকেই দায়ি করতে পারিস তুই। স্টকহোমেই ফিরে যাওয়া উচিত ছিলো তোর। “

“আপনি কেন খুন করেন, মার্টিন?”

“আমার ইচ্ছে। আমি কি করি সেসবের নৈতিক আর বুদ্ধিবৃত্তিক দিক নিয়ে আলোচনা করতে পারি। সারা রাত আমরা এ নিয়ে কথা বলতে পারি। তবে তাতে কোনো কিছুই বদলাবে না। ব্যাপারটা এভাবে দেখার চেষ্টা কর : একজন মানুষ চামড়া, কোষ, রক্ত আর অন্যান্য রাসায়নিক উপাদানের একটি খোলস। খুব অল্প কিছু লোকই ইতিহাসে ঠাঁই পায়। বেশিরভাগ লোক কোনো রকম চিহ্ন রেখে যাওয়া ছাড়াই মরে যায়। উধাও হয়ে যায় এ দুনিয়া থেকে।”

“আপনি মেয়েমানুষ হত্যা করেন।”

“আনন্দ পাবার জন্য যারা হত্যা করে-মনে রাখবি আমার মতো আরো অনেকেরই এরকম শখ রয়েছে—তারা একেবারে পরিপূর্ণ জীবনযাপন করে।”

“কিন্তু হ্যারিয়েটকে কেন খুন করলেন? ও তো আপনার বোন ছিলো?”

খপ করে তার মাথার চুল ধরে ফেললো মার্টিন।

“তার কি হয়েছিলো, বানচোত? বল আমাকে।”

“মানে?” বিস্ময়ে বললো ব্লমকোভিস্ট।

“তুই আর সালান্ডার। এ ব্যাপারে তোরা কি খুঁজে পেয়েছিস?”

“মাথার চুল ছাড়ন। আমরা তো কথা বলছি।”

তার মাথার চুল ছেড়ে দিয়ে তার ঠিক সামনেই দু’পা আড়াআড়ি করে মেঝেতে বসে পড়লো মার্টিন। জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা চাকু বের করলো সে। ব্লমকোভিস্টের চোখের ঠিক নীচে চাকুর তীক্ষ্ণ মাথাটা চেপে ধরলো আস্তে করে। মার্টিনের চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলো ব্লমকোভিস্ট।

“তার কি হয়েছিলো, বানচোত?”

“আমি বুঝতে পারছি না। আমি তো জানতাম আপনিই তাকে খুন করেছেন।”

অনেকক্ষণ ধরে ব্লমকোভিস্টের দিকে চেয়ে রইলো মার্টিন ভ্যাঙ্গার। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে ভাবতে লাগলো সে। চাকুটা মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে হাসতে হাসতে চলে এলো রমকোভিস্টের কাছে।

“হ্যারিয়েট, হ্যারিয়েট আর হ্যারিয়েট। সব সময়ই হ্যারিয়েট। আমরা তার সাথে…কথা বলার চেষ্টা করেছি। গটফ্রিড তাকে শিক্ষা দেবার চেষ্টা করেছিলো। ভেবেছিলাম সে আমাদেরই একজন, নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে, কিন্তু সে ছিলো একেবারেই স্বাভাবিক একজন। নগন্য এক মেয়ে…বেশ্যা। তাকে আমি আমার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছিলাম, কিংবা বলা যায় সেরকমই ভাবতাম আমি। কিন্তু সে সবকিছু হেনরিককে বলে দিতে চেয়েছিলো। বুঝতে পেরেছিলাম তাকে আর বিশ্বাস করা যাবে না। যেকোনো সময় সে কথাটা বলে দেবে

“এ কারণেই আপনি তাকে খুন করলেন!”

“আমি তাকে খুন করতে চেয়েছিলাম। এ নিয়ে ভেবেছিলামও। কিন্তু আমার আসতে একটু দেরি হয়ে যায়। আইল্যান্ডে ঠিক সময়ে পৌছাতে পারি নি।”

এই তথ্যটা হজম করতে হিমশিম খেলো ব্লমকোভিস্ট। তার কাছে মনে হলো প্রচুর তথ্যে তার মাথাটা ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। মার্টিন ভ্যাঙ্গার জানে না তার বোনের কি হয়েছিলো।

হঠাৎ করে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করলো মার্টিন। ডিসপ্লের দিকে চেয়ে চেয়ারের উপর পিস্তলের পাশে রেখে দিলো সেটা।

“সময় এসেছে সব শেষ করার। আমি তোর ঐ হাড্ডিসার মাগিটাকেও আজরাতে খতম করবো।“

কাপবোর্ড থেকে সরু একটা স্ট্র্যাপ বের করে ব্লমকোভিস্টের গলায় ফাঁসির মতো পেচিয়ে দিলো সে। তার গলায় যে শেকলটা বাধা ছিলো সেটা আলগা করে দিয়ে তাকে তার পায়ের উপর দাঁড় করালো। এবার দেয়ালের দিকে ঠেলে দিলো তাকে। স্ট্র্যাপটা ব্লমকোভিস্টের মাথার উপর একটা লুপের মধ্য দিয়ে ঢুকিয়ে টান দিলে তাকে পায়ের পাতার উপর দাঁড়িয়ে থাকতে হলো কোনোমতে।

“খুব বেশি টাইট হয়ে গেছে? শ্বাস নিতে পারছিস?” স্ট্র্যাপের অন্যপ্রান্ত টেনে দেয়ালের দিকে নিয়ে গেলো। “আমি চাই না তুই দম বন্ধ হয়ে মারা যাস।”

ফাঁসটা ব্লমকোভিস্টের গলায় এমনভাবে চেপে আছে যে চামড়া কেটে কিছুটা ভেদ করে ফেলেছে সেটা। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে। তার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালো মার্টিন।

হুট করে ব্লমকোভিস্টের প্যান্টের জিপার খুলে প্যান্ট আর ভেতরের আন্ডারওয়্যারটা নামিয়ে ফেললো সে। ওগুলো টেনে খুলে ফেলতেই ব্লমকোভিস্টের পা দুটো টলে গেলো। ফাঁসিতে ঝুলে পড়লো কিছুক্ষণের জন্য। তারপর আবারো পা দুটো মেঝেতে রাখতে সক্ষম হলো সে। কাপবোর্ড থেকে দুটো কাঁচি নিয়ে এলো মার্টিন। ব্লমকোভিস্টের টি-শার্টটা কেটে খুলে মেঝেতে ফেলে রাখলো। এরপর মিকাইলের থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে তার দিকে তাকালো সে।

“এখানে কখনও কোনো পুরুষকে নিয়ে আসি নি,” খুব গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললো মার্টিন। “সত্যি বলতে কি আমি কখনও কোনো পুরুষ মানুষকে স্পর্শ ও করি নি…শুধু আমার বাবাকে ছাড়া। ওটা আমার দায়িত্ব ছিলো।”

ব্লমকোভিস্টের মাথাটা দপ দপ করতে শুরু করলো। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। পা দুটো মেঝেতে রাখতে বেগ পেতে হচ্ছে। পেছনের কংক্রিটের দেয়ালটা আঙুল দিয়ে খামচে ধরার চেষ্টা করলো কিন্তু ধরার মতো কিছু পেলো না।

“সময় হয়েছে,” বললো মার্টিন ভ্যাঙ্গার।

স্ট্র্যাপটার অন্যপ্রান্ত ধরে সজোরে টান দিতেই ব্লমকোভিস্টের মনে হলো তার গলাটা বুঝি কেটেই গেলো।

“পুরুষমানুষের স্বাদ কেমন হয় সেটা সব সময়ই ভেবেছি আমি।”

ফাঁসটা আরো জোরে টান দিয়ে ব্লমকোভিস্টের ঠোঁটে চুমু খেতে উদ্যত হতেই শীতল একটি কণ্ঠ ঘরের পরিবেশটা বিদীর্ণ করলো যেনো।

“অ্যাই, হারামি বানচোত, ওটা কেবল আমার সম্পত্তি।”

লাল কুয়াশার ভেতর দিয়ে সালান্ডারের কণ্ঠটা শুনতে পেলো ব্লমকোভিস্ট। ভালো করে তাকিয়ে দেখলো দরজার সামনে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। নির্বিকারভাবে সে চেয়ে আছে মার্টিন ভ্যাঙ্গারের দিকে।

“না…পালাও,” অস্ফুটস্বরে বললো সে।

মার্টিনের অভিব্যক্তি দেখতে পারছে না ব্লমকোভিস্ট। কিন্তু সে যে যারপরনাই বিস্মত হয়েছে সেটা বুঝতে পারছে তার শরীরি ভাষা দেখে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য সময় যেনো স্থির হয়ে গেলো। এরপরই চেয়ারের উপর রাখা পিস্তলটা নেবার জন্য উদ্যত হলো সে।

দ্রুত তিন কদম সামনে এসে পেছনে লুকিয়ে রাখা গলফ ক্লাব দিয়ে সজোরে একটা আঘাত হানলো মেয়েটা। সরু লোহার দণ্ডটা মার্টিনের কলারবোনে আঘাত করলো খুবই জোরে, শব্দ শুনেই সেটা বুঝতে পারলো ব্লমকোভিস্ট। আর্তনাদ করে উঠলো মার্টিন।

“যন্ত্রণা খুব ভালোবাসিস, শূয়োরেরবাচ্চা?” বললো সালান্ডার।

তার কণ্ঠটা একেবারে খসখসে। আক্রমণ করার সময় তার যে মুখটা দেখলো ব্লমকোভিস্ট সেটা কোনোদিনই ভুলবে না। তার দাঁতগুলো শিকারী জন্তুজানোয়ারের মতো দেখাচ্ছে। জ্বলন্ত কয়লার মতো জ্বলে উঠেছে তার চোখ দুটো। মেয়েটা তার শিকারের উপর আবারো আঘাত করলো, তবে এবার পাঁজর লক্ষ্য করে।

চোয়ারের উপর সে হামলে পড়লে পিস্তলটা ছিটকে চলে এলো সালান্ডারের পায়ের কাছে। লাথি মেরে সেটা সরিয়ে দিলো।

মার্টিন ভ্যাঙ্গার উঠে দাঁড়ানোর আগেই তৃতীয় আঘাতটি করলো সে। এবার আরো জোরে, আর সেটা কোমরের দিকে লক্ষ্য করে। জান্তব এক চিৎকার বেরিয়ে এলো মার্টিনের মুখ দিয়ে। চতুর্থ মারটা পিঠে পড়লো।

“লিস…এথ…” অস্ফুটস্বরে বললো ব্লমকোভিস্ট।

প্রায় অজ্ঞান হতে যাচ্ছে সে, তার মাথার যন্ত্রণাটা অসহ্য ঠেকছে এখন।

তার দিকে ফিরলো সালান্ডার, দেখতে পেলো তার মুখটা টমাটোর মতো লাল হয়ে চোখ দুটো যেনো বের হয়ে যাচ্ছে কোটর থেকে। মুখ দিয়ে জিভের অনেকটা অংশ বের হয়ে আছে।

মেঝেতে চাকুটা পড়ে থাকতে দেখলো সালান্ডার, এরপর দেখতে পেলো মার্টিন ভ্যাঙ্গার হামাগুঁড়ি দিয়ে তার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। তার একটা হাত ঝুলে আছে। অসাড় হয়ে গেছে সেটা। কয়েক সেকেন্ড পর্যন্ত সে কোনো সমস্যা করতে পারবে না। গলফ ক্লাবটা ফেলে দিয়ে চাকুটা তুলে নিলো। মাথাটা ধারালো হলেও চাকুটা একেবারেই ভোতা। অনেক কষ্টে ফাঁস দেয়া চামড়ার স্ট্র্যাপটা কেটে ফেলতেই ব্লমকোভিস্ট হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ে গেলো, তবে এখনও ফাঁসটা তার গলায় পেচিয়ে আছে।

মার্টিনের দিকে তাকালো সালান্ডার। নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ালেও টলছে। চাকু দিয়ে ব্লমকোভিস্টের গলা থেকে চামড়ার স্ট্র্যাপটা সাবধানে খুলে ফেলতে সক্ষম হলো অবশেষে। পর পর কয়েকটি কাশি দিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো মিকাইল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সে টের পেলো তার দেহ আর মন একত্র হতে শুরু করেছে। তার দৃষ্টিশক্তি পরিস্কার হয়ে এলো, কথাও বলতে পারলো স্পষ্টভাবে। চারপাশের শব্দও শুনতে পেলো তবে মনে হলো সেগুলো যেনো হেডফোনের সাহায্যে শুনছে। সালান্ডারের ঘাম আর চামড়ার জ্যাকেটের গন্ধটাও টের পেলো নাকে। মাথায় রক্ত সঞ্চালন শুরু হতেই ঘোর লাগা ভাবটা কেটে গেলো পুরোপুরি।

মার্টিন ভ্যাঙ্গার দরজা দিয়ে বাইরে চলে যেতেই সেদিকে তাকালো সালান্ডার। মেঝে থেকে পিস্তলটা তুলে গুলির ম্যাগাজিনটা চেক করে সেফটি লক খুলে ফেললো সে। চারপাশে তাকিয়ে হ্যান্ডকাফের চাবিটা কোথায় আছে দেখে নিলো। টেবিলের উপর পড়ে আছে সেটা।

“আমি তাকে ধরতে যাচ্ছি,” বলেই দরজার দিকে ছুটে গেলো সালান্ডার। টেবিলটা অতিক্রম করার সময় চাবিটা তুলে নিয়ে পেছনে পড়ে থাকা ব্লমকোভিস্টের দিকে ছুড়ে মারলো সে।

তাকে থামানোর জন্য চিৎকার করার চেষ্টা করলো মিকাইল, কিন্তু মুখ দিয়ে কিছু বের হলো না। দ্বিতীয়বার চিৎকার দেবার আগেই মেয়েটা উধাও হয়ে গেলো।

.

মার্টিন ভ্যাঙ্গারের কাছে যে একটা রাইফেল আছে সে কথা ভুলে গেলো না সালান্ডার। থমকে দাঁড়িয়ে পিস্তলটা তুলে ধরলো গুলি চালানোর জন্য। উপর তলায় গ্যারাজ আর রান্নাঘরের মাঝখানে যে প্যাসেজটা আছে সেখানে চলে আসতেই কান পাতলো সে। কোনো সাড়া শব্দ নেই। তার শিকার কোথায় বুঝতে পারছে না। পা টিপে টিপে রান্নাঘরের দিকে এগোলো, ঘরে ঢুকতেই বাইরের প্রাঙ্গন থেকে গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট করার আওয়াজটা কানে এলো তার।

বাইরে বেরিয়ে এসে দেখতে পেলো হেনরিক ভ্যাঙ্গারের বাড়ির সামনে দিয়ে একটা গাড়ি চলে যাচ্ছে, অবশ্য সে শুধু হেডলাইটটাই দেখতে পাচ্ছে। গাড়িটা বৃজের দিকে মোড় নিলো। যতো দ্রুত সম্ভব দৌড়াতে লাগলো সে। দৌড়ানোর সময়ই পিস্তলটা ভরে নিলো জ্যাকেটের পকেটে। হেলমেট না পরেই মোটরসাইকেলটা নিয়ে ধাওয়া করলো মার্টিনকে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বৃজটা অতিক্রম করে ফেললো সালান্ডার।

মার্টিন সম্ভবত নব্বই সেকেন্ড এগিয়ে আছে। সালান্ডার যখন ই৪ হাইওয়ে’তে এসে পড়লো গাড়িটা আর দেখতে পেলো না। মোটরসাইকেলটা ব্রেক করে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলো ভালো করে শোনার জন্য।

আকাশ মেঘে ঢেকে আছে। দিগন্তে ভোরের আভা দেখতে পাচ্ছে সে। এরপরই ইঞ্জিনের শব্দটা কানে এলো তার, সেইসাথে ই৪ হাইওয়ের উপর আলোর বিন্দুটা। দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে মার্টিন। বাইকটা নিয়ে আবারো ছুটতে শুরু করলো সালান্ডার। রাস্তায় কোনো যানবাহন নেই বলে পূর্ণ গতিতে ছুটতে শুরু করলো সে। খুব জলদিই ৯০ মাইল গতিতে তুলে ফেললো বাইকটা। তার হালকা বাইকের এটাই হলো সর্বোচ্চ গতি। দুই মিনিট পর গাড়িটা দেখতে পেলো, তার থেকে ৬৫০ গজ সামনে আছে সেটা।

পরিণতিটা ভেবে নাও। এখন আমি কি করবো?

বাইকের গতি পচাত্তরে নামিয়ে এনে গাড়িটার সাথে সাথে চলতে লাগলো সে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য গাড়িটা তার চোখের আড়াল হলেও আবার সেটা দৃষ্টিসীমার মধ্যে চলে এলো। রাস্তাটা সোজা হয়ে এলে সালান্ডার দেখতে পেলো গাড়িটা এখন দুশ’ গজ সামনে আছে।

মার্টিন অবশ্যই তার মোটরসাইকেলের হেডলাইটটা দেখেছে। একটা মোড় আসতেই গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলো সে। সালান্ডারও গতি বাড়িয়ে তুললো কিন্তু মোড় নিতে গিয়ে একটু পিছলে গেলো তার বাইকটা।

সামনে থেকে একটা ট্রাক ধেয়ে আসতে দেখলো সালান্ডার। মার্টিন ভ্যাঙ্গারও সেটা দেখতে পেলো, কিন্তু গতি কমালো না সে। সালান্ডার দেখতে পেলো হঠাৎ করে ট্রাকটা একপাশে সরে গিয়ে হেডলাইটের বাতি জ্বালিয়ে দিলো। সংঘর্ষটা কোনোভাবেই এড়ানো সম্ভব ছিলো না। মার্টিন ভ্যাঙ্গারের গাড়ি ট্রাকটার সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলে ভয়ঙ্কর একটা শব্দ হলো।

ব্রেক কষলো সালান্ডার। ট্রাকটা দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য ঘুরে যাবার চেষ্টা করেছিলো, এখন সেটা রাস্তার উপর আড়াআড়িভাবে চলে এসেছে। গতি বাড়িয়ে বাইকটা নিয়ে এক পাশে কাত হয়ে সরে যেতে পারলো সে। ট্রাকটা অতিক্রম করার সময় মাত্র দু গজের ব্যবধান ছিলো তাদের মধ্যে। একটু পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো ট্রাকের সামনে আগুন ধরে গেছে।

কি করবে সেটা ভাবতে ভাবতে আরো দেড়শ’ গজ সামনে চলে যাবার পর ব্রেক করলো সালান্ডার। ঘুরে দেখতে পেলো ট্রাকের ড্রাইভার দরজা খুলে লাফিয়ে নেমে পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে গতি বাড়িয়ে সে আবারো ছুটতে লাগলো সামনের দিকে। আরো এক মাইল যাবার পর বাম দিকে মোড় নিয়ে পুরনো একটা রাস্তা দিয়ে উত্তর দিকে ফিরে এলো। এই রাস্তাটা ই৪ মহাসড়কের সমান্তরালে অবস্থিত। দুর্ঘটনাস্থল অতিক্রম করার সময় দেখতে পেলো দুটো গাড়ি থেমে আছে। ট্রাকের নীচে দুমড়েমুচড়ে থাকা মার্টিনের গাড়ি থেকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ছোট্ট একটা ফায়ার-ইস্টিংগুইসার দিয়ে সেই আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে এক লোক।

দ্রুত বৃজটা অতিক্রম করে কটেজের কাছে এসে বাইকটা রেখে সোজা ছুটে চললো মার্টিন ভ্যাঙ্গারের বাড়ির দিকে।

মিকাইল এখনও তার হ্যান্ডকাফ খুলতে পারে নি। তার হাত দুটো এতোটাই আড়ষ্ট হয়ে আছে যে ঠিকমতো চাবিটা ধরে খুলতে পারছে না। সালান্ডারই খুলে দিলো সেটা। তারপর শক্ত ক’রে ধরে রাখলো তার হাত দুটো যাতে রক্ত চলাচল করতে শুরু করে।

“মার্টিন?” কর্কশ কণ্ঠে বললো সে।

“মারা গেছে। কয়েক মাইল দূরে ই৪ মহাসড়কে একটা ট্রাকের সাথে তার গাড়িটা মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে।”

তার দিকে চেয়ে রইলো ব্লমকোভিস্ট। মাত্র কয়েক মিনিটের জন্যে মেয়েটা বাইরে গেছিলো। এরইমধ্যে এতোকিছু!

“আমাদেরকে…পুলিশে খবর দিতে হবে,” ফিসফিস করে বলেই কাশতে শুরু করলো সে।

“কেন?” বললো সালান্ডার।

.

দশ মিনিট পর্যন্ত দাঁড়াতে পারলো না ব্লমকোভিস্ট। মেঝেতে নগ্ন অবস্থায় পড়ে রইলো সে। ঘাড়টা ম্যাসেজ করে পানির বোতলটা তুলে নিলো। তার ধাতস্থ হবার আগপর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলো সালান্ডার। এই সময়টাতে ভেবে নিলো সে।

“প্যান্টটা পরে নাও।”

ব্লমকোভিস্টের ছেঁড়াফাড়া টি-শার্টটা ব্যবহার করে হ্যান্ডকাফ, চাকু আর গলফ ক্লাবের উপর আঙুলের ছাপ মুছে নিয়ে পানির বোতলটা তুলে নিলো সালান্ডার।

“তুমি কি করছো?”

“তাড়াতাড়ি প্যান্টটা পরে নাও। বাইরে আলো ফুটতে শুরু করেছে।”

টালমাটাল পায়ে কোনোরকম উঠে

কোনোরকম উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্টটা পরে নিলো ব্লমকোভিস্ট। তার মোজা জোড়া নিজের জ্যাকেটের পকেটে ভরে তাকে থামালো সালান্ডার।

“তুমি এখানে ঠিক কোন কোন জিনিস স্পর্শ করেছো?”

চারপাশে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করলো সে। শেষে বললো দরজা আর চাবিটা ছাড়া আর কিছু স্পর্শ করে নি। চেয়ারে রাখা মার্টিন ভ্যাঙ্গারের জ্যাকেটের পকেট থেকে চাবিটা খুঁজে পেলো সালান্ডার। দরজার হাতল আর বাতির সুইচগুলো মুছে নিয়ে বাতি নিভিয়ে দিলো সে। ব্লমকোভিস্টকে ধরে উপরে নিয়ে এসে তাকে অপেক্ষা করতে বলে গলফ ক্লাবটা জায়গা মতো রেখে আবার ফিরে এলো মার্টিনের কালো রঙের টি-শার্টটা হাতে নিয়ে।

“এটা পরো। আমি চাই না তোমাকে কেউ খালি গায়ে দেখে ফেলুক।”

ব্লমকোভিস্ট বুঝতে পারছে সে এখনও পুরোপুরি ধাতস্থ হতে পারে নি। সালান্ডার সবকিছু করছে, সে শুধু তার নির্দেশ পালন করে যাচ্ছে অক্ষরে অক্ষরে। তাকে জড়িয়ে ধরে হাটতে সাহায্য করলো, এভাবেই মার্টিনের বাড়ি থেকে ফিরে এলো নিজেদের কটেজে।

“কেউ যদি আমাদের দেখে ফেলে এবং জানতে চায় বাইরে আমরা কি করছি তাহলে বলবো তুমি আর আমি রাতের বেলায় একটু বাইরে হাটতে বেরিয়েছিলাম, আমরা বাইরে সেক্স করেছি।”

“লিসবেথ, আমি…”

“শাওয়ার নিয়ে নাও। এক্ষুণি।”

তার জামা কাপড় খুলতে সাহায্য করলো সালান্ডার, তারপর তাকে বাথরুম পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলো সে। রান্নাঘরে ফিরে এসে কফি বানাবার জন্য পানি গরম করতে দিয়ে আধ ডজনের মতো স্যান্ডউইচ বানাতে শুরু করলো এবার। শাওয়ার করে ব্লমকোভিস্ট যখন ফিরে এলো তখন দেখতে পেলো মেয়েটা টেবিলে বসে চিন্তা করছে। তার শরীরে আঘাত আর ছিলে যাওয়া দাগগুলো ভালো ক’রে দেখলো সে। ফাঁসটা তার গলায় গভীর লালচে দাগের সৃষ্টি করেছে, আর তার বাম পাঁজরের কাছে চাকুর আঘাতে একটা আঁচড় পড়ে গেছে।

“বিছানায় শুয়ে পড়ো,” বললো সালান্ডার।

হাতের কাছে যা পেলো তাই দিয়ে ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করে দিলো সে, এরপর কফি আর স্যান্ডউইচ এনে দিলো তার জন্য।

“আমার একটুও খিদে নেই,” বললো ব্লমকোভিস্ট।

“তোমার খিদে আছে কি নেই তা আমার জানার দরকার নেই। খেয়ে নাও,” নিজের স্যান্ডউইচে বড় একটা কামড় বসিয়ে আদেশের সুরে বললো সালান্ডার।

কিছুক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ করলো রমকোভিস্ট, তারপর খেতে শুরু করলো সে।

চামড়ার জ্যাকেটটা খুলে বাথরুমে রাখা তার স্পঞ্জ ব্যাগ থেকে কিছু টাইগার বাম নিয়ে এলো সালান্ডার।

“কফিটা রেখে উপুর হয়ে শুয়ে পড়ো এবার।”

পাঁচ মিনিট ধরে তার পিঠে বাম দিয়ে ম্যাসেজ করে গেলো সে, এরপর তাকে চিত করে শুইয়ে দিয়ে একই কাজ করলো।

“তোমার শরীরের অনেক জায়গা ছিলে গেছে। এটা কিছুদিন থাকবে।”

“লিসবেথ, আমাদেরকে পুলিশে খবর দেয়া উচিত।”

“না,” এতো দৃঢ়ভাবে বললো যে ব্লমকোভিস্ট খুব অবাক হয়ে গেলো। “তুমি পুলিশকে খবর দিলে আমি চলে যাবো। তাদের সাথে কোনো কিছুতে জড়াতে চাই না আমি। মার্টিন ভ্যাঙ্গার মারা গেছে। সে মারা গেছে এক গাড়ি দুর্ঘটনায়। গাড়িতে সে একাই ছিলো। এটার সাক্ষী আছে। পুলিশ কিংবা অন্য কাউকে ঐ বালের নির্যাতন করার কক্ষটি আবিষ্কার করতে দাও। এই গ্রামে অন্য সবার মতো এ ব্যাপারে তুমি আমিও কিছু জানি না

“কেন?”

তার কথাটা এড়িয়ে গিয়ে তার উরুতে ম্যাসেজ করতে লাগলো সে। “লিসবেথ, আমরা এটা করতে পারি না…”

“তুমি যদি এ নিয়ে বক বক করতে থাকো তাহলে তোমাকে আমি মার্টিনের

ঐ কক্ষে নিয়ে গিয়ে শেকল দিয়ে আবারো বেঁধে রেখে আসবো

মেয়েটা এ কথা বলার পর পরই এতোটা দ্রুত ঘুমে ঢলে পড়লো ব্লমকোভিস্ট যে মনে হবে সে বুঝি জ্ঞান হারিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *