০৫. বৃদ্ধ তার গল্প বলতে শুরু করার পর

অধ্যায় ৫

বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ২৬

বৃদ্ধ তার গল্প বলতে শুরু করার পর এই প্রথম ব্লমকোভিস্ট অবাক হলো। যে কথাটা সে শুনেছে সেটা ঠিক কিনা তার জন্যে বৃদ্ধকে আবারো জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে নিয়েছে কিন্তু খুনের কোনো ইঙ্গিতই তাতে নেই।

“১৯৬৬ সালের সেপ্টেম্বরের ২৪ তারিখের ঘটনা সেটি। হ্যারিয়েটের বয়স তখন ষোলো, মাত্র প্রিপারেটরি স্কুলে ভর্তি হয়েছে। দিনটি ছিলো শনিবার, আমার জীবনের সবচাইতে বাজে একটা দিন। ঐ দিনটি নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি, এর প্রতিটি মুহূর্ত আমি মনে করতে পারি এখনও শুধুমাত্র সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস বাদে।”

ঘরের একটা দিকে ইঙ্গিত করলো সে। “এখানে আমার পরিবারের অনেক সদস্য একত্র হয়েছিলো। ওটা ছিলো আমাদের লোভনীয় বার্ষিক ডিনার। আমার দাদা এটির প্রবর্তন করেছিলেন। প্রায়শই এই সময়টাতে বাজে কিছু ঘটনা ঘটতো। আশির দশকে এই পারিবারিক ঐতিহ্যটি শেষ হয়ে যায় যখন মার্টিন ঘোষণা করে সব ধরণের ব্যবসায়ীক আলোচনা বোর্ড মিটিং আর ভোটের মাধ্যমে হবে। এটা তার নেয়া সেরা সিদ্ধান্ত।”

“আপনি বললেন হ্যারিয়েট খুন হয়েছিলেন….”

“একটু অপেক্ষা করুন। কি ঘটেছে সেটা আগে আমাকে বলতে দিন। দিনটি ছিলো শনিবার। ঐ দিন আরেকটা পার্টি ছিলো, অন্যান্য অনুষ্ঠানের মধ্যে বাচ্চাদের একটি ডে-প্যারেডও ছিলো, হেডেস্টাডের স্পোর্টক্লাব এটির আয়োজন করেছিলো। হ্যারিয়েট তার স্কুলের বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঐ প্যারেড দেখতে গিয়েছিলো। দুপুর ২টার মধ্যে সে ফিরে আসে হেডেবি আইল্যান্ডে। ডিনারটা হওয়ার কথা ছিলো বিকেল ৫টায়। পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে তারও অংশ নেবার কথা ছিলো।”

ভ্যাঙ্গার উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গিয়ে ব্লমকোভিস্টকেও তার কাছে আসার জন্য ইশারা করলো।

“হ্যারিয়েট বাড়িতে আসার কিছুক্ষণ পর, ২:১৫ মিনিটে ঐ ব্রিজে একটা নাটকীয় ঘটনা ঘটে যায়। ওস্টারগার্ডেনের এক কৃষকের ছেলে গুস্তাভ আরোনসনের মাথা ফেঁটে যায় ঐ বৃজের উপর একটা তেলের ট্রাকের আঘাতে। ট্রাকের ড্রাইভার তাকে রক্ষা করার জন্য স্টিয়ারিং ঘোরালে বৃজের রেলিং ভেঙে ট্যাঙ্কারটা রেলিংয়ে কোনো যতে আঁটকে ঝুলে থাকে। তবে রেলিংয়ের আঘাতে তেলের ট্যাঙ্কারটি ফুটো হয়ে গেলে উত্তপ্ত তেল চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এরইমধ্যে আরোনসন উঠে বসতেই নিজেকে গাড়ির নীচে দেখতে পায়। ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠে সে। ট্যাঙ্কারের ড্রাইভারও আঘাত পেয়ে আহত হয়েছিলো তবে সে গাড়ি থেকে বের হতে সক্ষম হয়।”

বৃদ্ধ আবার নিজের চেয়ারে ফিরে গেলো।

“দুর্ঘটনার সাথে হ্যারিয়েটের কোনো সম্পর্ক ছিলো না। তবে সেটা খুব তাৎপর্যময় ছিলো। একটা বিপদ ধেয়ে আসে : বৃজের দু’পাশে থাকা লোকজন দ্রুত সাহায্যের জন্য ছুটে যায় সেখানে। আগুনের ঝুঁকিটা খুব মারাত্মক ছিলো। সবাই বেশ সতর্ক হয়ে ওঠে। পুলিশের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, উদ্ধারকারী দল, ফায়ার ব্রিগেড, রিপোর্টার আর দর্শনার্থীরা জড়ো হয় সেখানে। স্বাভাবিকভাবেই সবাই পাশের একটা খালি জায়গায় জড়ো হয়েছিলো। আমাদের এখান থেকে আমরা আরোনসনকে গাড়ির নীচ থেকে বের করার চেষ্টা করলাম। গাড়ির নীচ থেকে তাকে উদ্ধার করাটা খুব কঠিন কাজ ছিলো। ছেলেটাও ছিলো মারাত্মক আহত, অবস্থায়।

“খালি হাতে তাকে টেনে বের করার চেষ্টা করলেও পারলাম না। ঝুঁকি বাড়তে থাকলেও আমরা তাকে বের করতে ব্যর্থ হলাম কারণ টানতে গেলে তার শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে যাবার সম্ভাবনা ছিলো। আমরা ট্যাঙ্কারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ওটা যদি বিস্ফোরিত হতো আমরা সবাই মারা যেতাম। সাহায্যকারী দল থেকে সাহায্য পেতে আমাদের অনেক সময় লাগলো। ট্রাকটা বৃজের উপর আড়াআড়িভাবে পড়ে ছিলো ফলে ওটা ডিঙিয়ে আসা সহজ ছিলো না। ওটার উপর দিয়ে আসা মানে বোমার উপর দিয়ে হেটে আসার শামিল।”

বৃদ্ধ যে আবেগঘনভাবে গল্পটা বলার জন্য অনেক রিহার্সেল করেছে এই ভাবনাটা ব্লমকোভিস্টের মনে উদয় না হয়ে পারলো না। লোকটা বেশ ভালো গল্পবলিয়ে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তারচেয়ে বড় কথা গল্পটার শেষ কোথায়?

“দুর্ঘটনার ফলে বৃজটা চব্বিশ ঘণ্টার জন্য বন্ধ হয়ে থাকলো। পর দিন রোববার সন্ধ্যায় ক্রেন এসে ট্যাঙ্কারটা তুলে নেবার পরই সেটা আবার মানুষ চলাচলের উপযোগী হয়ে ওঠে। এই চব্বিশ ঘণ্টায় হেডেবি বাকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলো। আমাদের এখানে আসার একমাত্র পথ ছিলো উদ্ধারকারী দলের আনা ছোট্ট ফায়ারবোটে করে যাতায়াত করা। কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত সেই বোট কেবল উদ্ধারকারীদলের লোকেরাই ব্যবহার করেছে। শনিবারের শেষ রাতে একটা ফেরি আনা হলে বাকিরা পারাপার হতে পেরেছিলো। তুমি কি এর তাৎপর্যটা বুঝতে পেরেছো?”

“ধারণা করছি হ্যারিয়েটের কিছু হয়েছিলো,” বললো ব্লমকোভিস্ট। “আর সন্দেহের তালিকায় ছিলো এখানে আঁটকে পড়া অসংখ্য লোকজন। লক-রুম মিস্ট্রি ফর্মুলার গল্পের মতো?”

তিক্ত হাসি হাসলো ভ্যাঙ্গার। “মিকাইল, তুমি জানো না কতোটা ঠিক বলেছো। এ হলো আসল ঘটনা : হ্যারিয়েট এখানে চলে আসে ২:১০-এ। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ঐ দিন আমাদের এখানে মোট অতিথির সংখ্যা ছিলো চল্লিশজনের মতো। তবে কাজের লোকজন হিসেবে নিলে চৌষট্টিজন হবে। তাদের মধ্যে যারা রাতে থাকবে বলে ঠিক করেছিলো তারা ফার্মের আশেপাশে কিংবা গেস্টরুমে নিজেদের ঘর গোছাতে ব্যস্ত ছিলো।

“হ্যারিয়েট এর আগে রাস্তার ওপারে থাকতো। তবে বাবা-মা বিহীন একা একা থাকতো বলে সে খুব বিষন্ন থাকতো, পড়াশোনাও ক্ষতি হচ্ছিলো তাই ১৯৬৪ সালে আমি তাকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসি। তার মা ইসাবেলা হয়তো ভেবেছিলো ভালোই হলো, দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া গেলো। হ্যারিয়েট এখানে দু’বছর থেকেছে। তো ঐ দিন সে এখানেই চলে এসেছিলো। আমরা জানি এখানে আসার পর সে আমার এক ভাই হেরাল্ডের সাথে বাগানে কিছু কথা বলেছিলো। তারপর সে চলে আসে উপরতলায়। আমাকে হ্যালো বলে জানায় আমার সাথে নাকি একটা ব্যাপারে সে কথা বলতে চায়। ঐ সময়টাতে আমি আমার পরিবারের কিছু সদস্যের সাথে জরুরি বিষয়ে কথা বলছিলাম তাই তার সাথে কথা বলার সময় আমার ছিলো না। তবে তাকে খুব উদ্বিগ্ন দেখে আমি তাকে বলি এদের সাথে কথা বলা শেষ করে তার ঘরে আসছি। দরজা দিয়ে সে বের হয়ে গেলে সেটাই হয়ে গেলো তাকে দেখা আমার শেষ দৃশ্য। এর এক মিনিট পরই বৃজের ঐ ঘটনাটি ঘটলে আমাদের ডিনারের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।”

“উনি কিভাবে মারা গেলেন?”

“এটা খুব জটিল। আমাকে সময়ানুক্রমিক গল্পটা বলতে হবে। দুর্ঘটনা ঘটলেও সবাই ওখানে চলে যায়। আমিও কয়েক ঘণ্টা ওখানে ছিলাম সব কিছু তদারকি করতে। হ্যারিয়েটও উপরতলা থেকে নেমে চলে আসে বৃজের কাছে-অনেকেই তাকে দেখেছে-তবে বিস্ফোরণ হবার ভয়ে আমি সবাইকে যার যার ঘরে ফিরে যেতে আদেশ করলাম, শুধুমাত্র যারা গাড়ির নীচে চাপা পড়া ছেলেটাকে উদ্ধার কাজে ব্যস্ত তারা বাদে। আমরা মাত্র পাঁচজন রয়ে যাই। আমি আর আমার ভাই হেরাল্ড, ম্যাঙ্গাস নিলসন নামের আমাদের এক শ্রমিক, বৃজের নীচে ফিশিং হারবারে এক স’মিল শ্রমিক সিক্সটেন নর্ডল্যান্ডার আর জাকার আরোনসন নামের ছেলেটি। তার বয়স ছিলো মাত্র ষোলো। তাকে আমি ওখান থেকে সরিয়ে দিতাম কিন্তু সে ছিলো গাড়ির ড্রাইভার গুস্তাভের ভাগ্নে।

“২:৪০-এ হ্যারিয়েট এখানকার রান্নাঘরে ছিলো। এক গ্লাস দুধ খেয়ে সে আমাদের বাবুর্চি অ্যাস্ট্রিডের সাথে কিছু কথা বলে। জানালা দিয়ে বৃজের ঘটনাটা দেখে তারা।

“২:৫৫-এ হ্যারিয়েট বাড়ির প্রাঙ্গণ পেড়িয়ে চলে যাবার সময় তার মা ইসাবেলা তাকে দেখে। এক মিনিট পর সে হেডেবির যাজক অটো ফকের কাছে দৌড়ে ছুটে যায়। ঐ সময় চার্চটা ছিলো ঠিক এখন যেখানে মার্টিনের ভিলাটা আছে সেখানে। যাজক সাহেব থাকতেন বৃজের পাশেই। তার সেদিন সর্দি ছিলো, বিছানায় শোয়া ছিলেন তিনি। বৃজের দুর্ঘটনা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না। তবে কেউ তাকে ফোন করে ঘটনাটি জানালে বিছানা ছেড়ে বৃজের কাছে চলে আসার সময় মাঝপথে হ্যারিয়েট তাকে থামিয়ে কিছু বলতে চায়। তবে তিনি তার কথা না শুনে বৃজের দিকে এগোতে থাকেন। ফকই তাকে শেষবার জীবিত দেখেছেন।”

“উনি কিভাবে মারা গেলেন?” আবারো বললো ব্লমকোভিস্ট।

“আমি জানি না,” ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো ভ্যাঙ্গার। “৫টার আগে আরোনসনকে আমরা গাড়ির নীচ থেকে বের করতে পারি নি। সে বেঁচে গেলেও তার অবস্থা খুব খারাপ ছিলো। আর ৬টার আগপর্যন্ত আগুন লাগার আশংকা দূর হয় নি। আমরা তখনও বিচ্ছিন্ন ছিলাম তবে সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। রাত আটটার দিকে আমরা ডিনার করতে বসেলে খেয়াল করলাম হ্যারিয়েট নেই। আমি আমার এক চাচাতো ভাইকে ওর ঘরে পাঠালে ফিরে এসে জানালো হ্যারিয়েট তার ঘরে নেই। এ নিয়ে অবশ্য আমি বেশি কিছু ভাবি নি। হয়তো সে একটু হাটাহাটি করতে বাইরে গেছে, আমরা যে ডিনার করছি সেটা হয়তো সে এখনও জানে না। রাতে আমি আমার আত্মীয়স্বজনদের সাথে অনেক আলাপ আলোচনা করলাম তাই পর দিন সকালে যখন ইসাবেলা তার মেয়েকে খুঁজতে শুরু করলো তখনই জানতে পারলাম হ্যারিয়েটকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।” নিজের হাত দুটো দু’পাশে ছড়িয়ে দিলো সে। “সেদিন থেকে তার আর কোনো হদিশ পাওয়া যায় নি।”

“নিখোঁজ?” কথাটা ব্লমকোভিস্ট প্রতিধ্বনি করলো।

“এতোগুলো বছর ধরে তার কোনো খোঁজ পাই নি।”

“কিন্তু আপনি যেমনটি বললেন, উনি যদি উধাও হয়ে থাকেন তার মানে তো এই নয় যে উনি খুন হয়েছেন।”

“তোমার কথাটা আমি বুঝতে পেরেছি। আমিও এরকম ভেবেছি। কোনো মানুষ যখন উধাও হয়ে যায় তখন চারটা সম্ভাবনা দেখা দেয় : স্বেচ্ছায় চলে গেছে সে, লুকিয়ে আছে কোথাও। কোনো দুর্ঘটনায় সে মারা গেছে। কিংবা আত্মহত্যা করেছে। আর শেষটা হলো সে হয়তো কোনো অপরাধের শিকার হয়েছে। সবগুলো সম্ভাবনাই আমি ভেবে দেখেছি।”

“তবে আপনি বিশ্বাস করেন কেউ হ্যারিয়েটকে হত্যা করেছে। কেন?”

“কারণ এটাই একমাত্র যৌক্তিক কারণ।” আঙুল তুলে বললো ভ্যাঙ্গার। “শুরুতে ভেবেছিলাম সে হয়তো ঘর পালিয়েছে। তবে অনেক দিন অতিবাহিত হবার পর বুঝতে পারলাম ঘটনা সেরকম কিছু নয়। ষোলো বছরের এক মেয়ে কিভাবে নিজের মতো করে চলতে পারবে? নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে কিভাবে লুকিয়ে রাখবে? টাকা-পয়সা পাবে কোত্থেকে? অন্য কোথাও গিয়ে যদি কাজও করতে চায় তো সোশ্যাল সিকিউরিটি কার্ড আর ঠিকানা পাবে কোথায়?”

এবার সে দুই আঙুল তুলে ধরলো।

“আমার পরবর্তী চিন্তা ছিলো তার বুঝি কোনো দুর্ঘটনা হয়েছে। তুমি কি একটা কাজ করবে? ডেস্কের কাছে গিয়ে সবার উপরের ড্রয়ারটা একটু খোলো তো। ওখানে একটা মানচিত্র আছে।”

ব্লমকোভিস্ট ড্রয়ার থেকে ম্যাপটা বের করে কফি টেবিলের উপর মেলে . রাখলো। হেডেবি দ্বীপটি দুই মাইল দীর্ঘ আর এক মাইলের মতো প্রশ্বস্ত। দ্বীপটির বেশিরভাগ অংশ বনে জঙ্গলে পরিপূর্ণ। বৃজ আর হারবারের আশোপাশেই কেবল মনুষ্য বসতি। দ্বীপের বাকি দিকটায় অস্টারগার্ডেন নামের ছোটোখাটো একটা জনবসতি এলাকা আছে যেখান থেকে আরোনসন নামরে হতভাগ্য যুবকটি গাড়ি চালিয়ে আসছিলো।

“মনে রাখবে হ্যারিয়েট দ্বীপ ছেড়ে যেতে পারে নি,” ভ্যাঙ্গার বললো। “অন্য সব জায়গার মতো হেডেবি দ্বীপের এখানেও তুমি দুর্ঘটনায় মারা যেতে পারো। বজ্রপাত পড়তে পারে তোমার উপর-তবে ঐ দিন কোনো বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে নি। তুমি ঘোড়ার পায়ের নীচে পিষ্ট হয়েও মারা যেতে পারো, পড়ে গিয়ে অথবা কোনো খাদে আটকা পড়েও মরতে পারো। এখানে এভাবে একশটা দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যায়। আমিও সেসব নিয়ে ভেবে দেখেছি।”

এবার সে তিন আঙুল উঁচিয়ে ধরলো।

“তবে একটা মাত্র ব্যাপারই মনে হয়েছে। এটা তৃতীয় সম্ভাবনা হিসেবেও দেখা যেতে পারে—মেয়েটা যেভাবেই হোক আত্মাহুতি দিয়েছে। তার মৃতদেহ হয়তো এই দ্বীপের কোথাও আছে।

ভ্যাঙ্গার মানচিত্রের উপর মুষ্টিবদ্ধ হাত দিয়ে আঘাত করলো।

“তার উধাও হয়ে যাবার পর দিন থেকেই আমরা এই দ্বীপের সবখানে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছি। অনেক লোক লাগিয়ে তাকে খোঁজা হয়েছে। বনে জঙ্গলে, বাড়িঘরে, সবখানে।”

বৃদ্ধ কথা থামিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার কণ্ঠ এবার আরো নীচে নেমে গেলো, আরো বেশি আন্তরিক শোনালো।

“পুরো শরৎকাল আমি তাকে খুঁজেছি, এমনকি তাকে খোঁজার জন্য যে দল নিয়োজিত করেছিলাম তারা হাল ছেড়ে দেবার পরও। আমার হাতে যখন কাজ কম থাকতো আমি এই দ্বীপের এখানে সেখানে তাকে খুঁজে বেড়াতাম। শীতকাল এসে পড়লো তারপরও তাকে পাওয়া গেলো না। বসন্ত চলে এলে আবার খোঁজা শুরু করলাম কিন্তু বুঝতে পারলাম তাকে খোঁজাটা অর্থহীন। গ্রীষ্মকালে আমি তিনজন বনবিহারিকে নিয়োগ করলাম তাদের শিকারী কুকুরসহ খোঁজার জন্য। তারাও ব্যর্থ হলো। ততোদিনে আমি বুঝে গেছি কেউ হয়তো তাকে খুন করে ফেলেছে। তাই কবর খোঁজা শুরু করলাম এবার। এক মাস খুঁজেও তার টিকিটাও পাওয়া গেলো না। যেনো বাতাসে মিলিয়ে গেছে সে।”

“আমি অবশ্য কয়েকটা সম্ভাবনার কথা ভাবতে পারছি,” ব্লমকোভিস্ট বললো।

“শুনি তাহলে।”

“উনি হয়তো পানিতে ডুবে মারা গেছেন। দুর্ঘটনাবশত নয়তো কেউ ইচ্ছে করে সেটা করেছে। এটা হলো দ্বীপ এলাকা, চারপাশে পানি।”

“সত্যি, তবে সম্ভাবনাটা খুব ভালো নয়। এটা বিবেচনা করলেই বুঝতে পারবে : হ্যারিয়েট যদি পানিতে পড়ে যাওয়ার মতো দুর্ঘটনায় পড়তো তাহলে সেটা হতো গ্রামের খুব কাছাকাছি এলাকায়। মনে রাখবে ঐ সময় বৃজের উপর যে ঘটনাটি ঘটেছিলো সেরকম ঘটনা এই এলাকায় অনেক যুগ ধরে ঘটে নি। প্রচুর লোকজনের সমাগম হয়েছিলো এখানে এবং আশেপাশে। এরকম একটি সময় কোনো মেয়ে দ্বীপের অন্য অংশে যাওয়ার চিন্তাও করবে না।

“তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো,” বললো সে।। “এখানকার নদনদীতে খুব বেশি স্রোত থাকে না। সেই সময়টাতে বাতাসও খুব একটা বয় না। কোনো কিছু যদি পানিতে পড়ে যেতো তাহলে সেটা সৈকত আর মেইনল্যান্ডের আশেপাশে ভেসে উঠতোই। মনে করবে না আমরা এ নিয়ে ভাবি নি। পানিতেও তাকে খোঁজা হয়েছে। সবগুলো তীর আর জলাশয়ে আমরা লোক দিয়ে খুঁজে দেখেছি। এখানে যে স্কুবা ডাইভিং ক্লাব আছে তাদেরকেও ভাড়া করেছিলাম। তারা কয়েক মাস খুঁজেও কিছু পায় নি। আমি নিশ্চিত সে পানিতে পড়ে নি। যদি পড়তো আমরা তাকে খুজে পেতাম।”

“উনি কি অন্য কোথাও দুর্ঘটনার শিকার হতে পারেন না? বৃজটা ব্লক করা ছিলো, ঠিক আছে, তবে এটা তো মেইনল্যান্ড থেকে খুব অল্প দূরত্বে অবস্থিত। উনি হয়তো সাঁতা কেটে কিংবা নৌকা চালিয়ে চলে গেছেন।

“তখন সেপ্টেম্বর মাস, অনেক ঠাণ্ডা ছিলো। হ্যারিয়েট ওভাবে এতো লোকজনের ভীড়ে সাঁতার কেটে যেতে পারতো না। তারপরও যদি সে সাঁতার কেটে যাওয়ার চেষ্টা করতো কেউ না কেউ তাকে দেখতে পেতো। আর ডুবে গেলে তো অনেকের চোখেই সেটা পড়তো। বৃজের উপর কয়েক ডজন লোক ছিলো, বৃজের আশেপাশে দাঁড়িয়ে দুর্ঘটনার দৃশ্য দেখছিলো আরো কয়েকশ’।”

“বাইচের নৌকায় করে?

“না। ঐ দিন হেডেবি’তে মোট তেরোটি নৌকা ছিলো। সবগুলোই তখন বৃজের কাছে নিয়ে আসা হয়েছিলো উদ্ধারকাজে সাহায্য করার জন্য। সামার ক্যাবিনের কাছে ছোটো নৌকার হারবারে দুটো প্যাটারসন বাইচের নৌকা ছিলো। গুগুলো টানতে মোট পাঁচজন লাগে। তাদের একটা ছিলো তীরে অন্যটা পানিতে। অস্টারগার্ডেনে একটা বাইচের নৌকা আর মোটরবোট ছিলো। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি দুটোই তখন জায়গা মতো ছিলো। বাইচের নৌকায় করে যদি সে পালাতো তাহলে একটা নৌকা পাওয়া যেতো নদীর ওপাড়ে।”

ভ্যাঙ্গার চার আঙুল উপরে তুলে ধরলো।

“তার মানে একটাই সম্ভাবনা বাকি থাকে। হ্যারিয়েটকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কেউ তাকে খুন করে মৃতদেহটা গুম করে ফেলেছে।”

*

লিসবেথ সালান্ডার ক্রিসমাসের পুরোটা সকাল কাটালো মিকাইল ব্লমকোভিস্টের লেখা ফিনান্সিয়াল জার্নালিজমের উপর বিতর্কিত বই দ্য নাইট টেম্পলার পড়ে। কভারটা স্টকহোমের স্টকএক্সচেঞ্জের একটা ছবি দিয়ে করা হয়েছে। আর সেটা করেছে ক্রিস্টার মাম। ছবিটা দেখ মনে হচ্ছে ভবনটি শুন্যে ভাসছে।

সালান্ডার বইটি পড়ে বুঝতে পারলো ব্লমকোভিস্ট খুব ভালোই লেখে। ফিনান্সিয়াল ইকোনোমিকের ব্যাপারে যার কোনো আগ্রহ নেই সেও এই বই পড়তে পারবে। খুব তীক্ষ্ণ আর ব্যাঙ্গাত্মক ভাষায় লেখাটা লেখা হয়েছে। তারচেয়ে বড় কথা পড়লে বিশ্বাযোগ্য মনে হয়।

প্রথম অধ্যায়ে ব্লমকোভিস্ট রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছে শব্দ আর বাক্য দিয়ে। বিগত বিশ বছর ধরে সুইডেনে ফিনান্সিয়াল সাংবাদিকতা যে কতোটা অপটু আর অদক্ষ লোকজনের হাতে পড়েছে সেসবের ফিরিস্তি দেয়া আছে। একগাদা আত্মম্ভরি আর মূর্খ লোকেরাই স্টকএক্সচেঞ্জের খবরাখবর রিপোর্ট করে থাকে। তাদের ভুল খবরে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সে ব্যাপারে যেনো কারোর কোনো বিকার নেই। ব্লমকোভিস্ট দাবি করেছে নিজেকে সে ফিনান্সিয়াল রিপোর্টার পরিচয় দিতে লজ্জিত বোধ করে। আর এজন্যে তার অনেক সহকর্মী, যাদেরকে সে রিপোর্টার হিসেবে গন্য করে না, তার ক্ষতি করার জন্য মুখিয়ে থাকে।

সে ফিনান্সিয়াল রিপোর্টারদেরকে অনেকটা ক্রাইম রিপোর্টার আর ফরেন করেপন্ডেসদের কাজের সাথে তুলনা করেছে। বইটির বাকি অংশে বিবৃত হয়েছে একজন ফিনান্সিয়াল রিপোর্টারকে কি কি করতে হবে না করতে হবে।

সালান্ডার বুঝতে পারলো ব্লমকোভিস্ট অনেকগুলো বিতর্কিত বিষয় তুলে এনেছে। এটা করতে গিয়ে তার অনেক শত্রু যে আছে সেটাও বুঝতে বাকি রইলো না। ওয়েনারস্ট্রম মামলায় আদালতে যে অনেকে আজেবাজে মন্তব্য করেছে সেটার কারণ এই বই।

বইটা বন্ধ করে সে পেছনে ব্লমকোভিস্টের ছবিটা দেখলো। ব্লমকোভিস্টের ঘনকালো চুল এলোমেলো হয়ে কপালের উপর ছড়িয়ে আছে, যেনো বাতাসে উড়ছে সেগুলো। কিংবা এমনও হতে পারে ক্রিস্টার মাম তাকে দিয়ে এমন পোজ দিয়েছে। ক্যামেরার সামনে বাঁকা হাসি দিয়ে চেয়ে আছে সে। তবে তার মুখের অভিব্যক্তি অনেকটা ছেলেমানুষী টাইপের। খুব সুদর্শন একজন পুরুষ। তিন মাস জেল খাটতে যাওয়া এক লোক।

“হ্যালো, কাল ব্লমকোভিস্ট,” আপন মনে বললো সালান্ডার। “তুমি নিজেকে নিয়ে খুব সন্তুষ্ট, তাই না?”

*

লাঞ্চের সময় সালান্ডার তার আই-বুক ওপেন করে একটা মেইল লিখলো : “তোমার কি সময় আছে?” ওয়াপ নামে স্বাক্ষর করে সেটা সেন্ড করে দিলো পিজিপি এনক্রিপশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে [email protected] ঠিকানায়।

এরপর সে কালো জিন্স, ভারি উইন্টার বুট, পোলো শার্ট আর কালো জ্যাকেট সেই সাথে হাতে ম্যাচিং করা দস্তানা আর গলায় স্কার্ফ পরে নিলো। ভুরু আর নাক থেকে রিং খুলে ঠোঁটে গোলাপি লিপস্টিক লাগিয়ে বাথরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে নিলো সে। উইকেন্ডে বের হওয়া যেকোনো মেয়ের মতো লাগছে তাকে। নিজের এই বেশভুষাকে শত্রুপক্ষের ডেরায় চুঁ মারার কাজে একটি ক্যামোফ্লেজ হিসেবেই দেখছে। টানেলবানা দিয়ে জিঙ্কেসডাম থেকে অস্টারমামস্টগে চলে এলো তারপর স্ট্রান্ডভাজেনের উদ্দেশ্যে হাটতে শুরু করলো সে। সারি সারি বাড়ির সামনে এসে সেগুলোর নাম্বার দেখতে লাগলো সালান্ডার। ইয়োরগার্ড বৃজের ঠিক আগে একটা বাড়ির দরজার সামনে এসে থেমে গেলো। এই বাড়িটাই সে খুঁজছিলো। রাস্তাটা পার হয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে।

সে লক্ষ্য করলো ক্রিসমাসের পরদিন বেশিরভাগ লোকজন নদীর তীর ধরে হাটছে, অল্পসংখ্যক হাটছে রাস্তা দিয়ে।

ইয়োরগার্ডেন থেকে লাঠি হাতে এক বৃদ্ধমহিলা আসার আগ পর্যন্ত সে প্রায় আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করলো। মহিলা তাকে দেখে আচমকা থেমে সন্দেহের চোখে তাকালো। জবাবে তার দিকে তাকিয়ে বন্ধুসুলভ হাসি হাসলো সালান্ডার। মহিলা তার হাসি দেখে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে এমনভাবে তাকালো যেনো এই মেয়েটাকে শেষ কবে দেখেছে সেটা মনে করার চেষ্টা করছে। সালান্ডার ঘুরে দরজার কাছ থেকে কয়েক পা পেছনে চলে এলো, যেনো কারো জন্য অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছে সে। একুট পয়চারি করে দরজার সামনে ফিরে এসে দেখতে পেলো বৃদ্ধমহিলা দরজার পাশে থাকা কোডলক-এ কিছু নাম্বার টিপে যাচ্ছে। কম্বিনেশনটা যে ১২৬০ সেটা দেখতে কোনো কষ্ট হলো না সালান্ডারের।

আরো পাঁচ মিনিট পর দরজার কাছে গিয়ে নাম্বারগুলো পাঞ্চ করলে লকটা খুলে গেলো। সিঁড়ির দিকে উঁকি মারলো সালান্ডার। একটা সিকিউরিটি ক্যামেরা দেখতে পেলেও সেটাকে পাত্তা দিলো না। এটা মিল্টন সিকিউরিটির একটি মডেল। দরজা ভেঙে কেউ ঢুকলে কিংবা ভেতরে ঢুকে কোনো ভাঙচুর চালালে সেই শব্দেই কেবল ওটা চালু হবে। সিঁড়ির বায়ে একটা লিফট আছে। লিফটের পাশে রয়েছে আরেকটা কোডলক। ১২৬০ নাম্বার আবারো ব্যবহার করলে ওটা খুলে গেলো। রাবিশ রুম হিসেবে পরিচিত একটা ঘরে ঢুঁ মারলো সে। একেবারেই পিচ্ছিল। সেলার লেভেলটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য তিন মিনিট সময় নিলো সে। ওখানে একটা আনলক করা লন্ড্রিরুম আর রিসাইক্লিংরুম দেখতে পেলো। এরপর মিল্টন সিকিউরিটি থেকে ‘ধার’ করা একটি পিকলক দিয়ে লক করা দরজাটা খুলে ফেলা সে। ঘরটা দেখে মনে হলো এক ধরণের মিটিংরুমের মতো। সেলারের পেছন দিকে একটা হবিরুম আছে। অবশেষে যা খুঁজছিলো সেটা পেয়ে গেলো : ভবনের ছোট্ট ইলেক্ট্রক্যাল রুম। সে ফিউজবক্স, মিটার আর জাংশান বক্সগুলো দেখে সিগারেটের প্যাকেটের আকৃতির একটি ক্যানন ডিজিটাল ক্যামেরা বের করে পর পর তিনটা ছবি তুললো।

বের হবার সময় লিফটের পাশে রাখা ভবনের বাসিন্দাদের তালিকাটা দেখে নিলো একবার। টপ ফ্লোরের বাসিন্দাদের নামগুলোতে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিলো। ওয়েনারস্ট্রম।

এরপর ভবন থেকে বের হয়ে ন্যাশনাল মিউজিয়ামের দিকে হাটতে লাগলো দ্রুতপায়ে। ওখানে এক ক্যাফেটারিয়ায় গিয়ে কফি খেয়ে শরীরটা উষ্ণ করে নিলো। আধ ঘণ্টা পর ফিরে এলো সোডারে অবস্থিত নিজের অ্যাপার্টমেন্টে।

[email protected] থেকে একটা জবাব এসেছে। পিজিপি দিয়ে সেটা যখন ডিকোডেড করলো তখন একটা লেখা ভসে উঠলো : ২০

অধ্যায় ৬

বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ২৬

ব্লমকোভিস্ট যে সময়সীমা বেধে দিয়েছিলো সেটা অতিক্রম হয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন ৪:৩০, বিকেলের ট্রেন ধরার আর কোনো আশা নেই। তবে রাতের ট্রেন ধরার সুযোগ এখনও তার আছে। জানালা দিয়ে বাইরে বৃজের পাশে আলোকিত চার্চের প্রাঙ্গণটির দিকে তাকিয়ে ঘাড়টা একটু ম্যাসেজ করলো সে। ভ্যাঙ্গার তাকে স্থানীয় সংবাদপত্র আর ন্যাশনাল মিডিয়ায় প্রকাশিত আর্টিকেলের ক্লিপিংস দেখিয়েছে। ঐ সময়টাতে মিডিয়া এই ঘটনা নিয়ে বেশ আগ্রহী ছিলো—নামকরা শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিবারের এক মেয়ে নিখোঁজ। তবে কোনো মৃতদেহ যখন পাওয় গেলো না, পাওয়া গেলো না কোনো হদিশ তখন সেই আগ্রহে ভাটা পড়ে গেলো। আর ছত্রিশ বছর পর এই নিখোঁজ মেয়ের কেসটা একেবারেই বিস্মৃত হয়ে গেছে। ষাট দশকে পত্রিকাগুলো আর্টিকেল পড়লে একটা মতবাদ পাওয়া যায় আর সেটা হলো মেয়েটা পানিতে ডুবে মারা গেছে। তার মৃতদেহ ভেসে গেছে সাগরে-ট্র্যাজেডি, সন্দেহ নেই তবে সেটা যেকোনো পরিবারেই হতে পারে।

ব্লমকোভিস্ট বুড়োর গল্পে বিমোহিত কিন্তু ভ্যাঙ্গার যখন বাথরুমে যাবার জন্য এক্সকিউজ চাইলো তার সন্দেহটা আবার ফিরে এলো। বৃদ্ধ এখনও গল্পটার শেষ বলে নি, ব্লমকোভিস্টও চাচ্ছে শেষটা শুনতে।

“উনার ভাগ্যে কি ঘটেছিলো বলে আপনি মনে করেন?” বাথরুম থেকে ভ্যাঙ্গার ফিরে এলে সে জানতে চাইলো।

“এখানে বছরে ঘুরে ফিরে মোট পচিশ জন লোক বসবাস করে তবে ঐ দিন পার্টি ছিলো বলে ষাটজনের মতো ছিলো এই বাড়িতে। তাদের মধ্যে বিশ থেকে পঁচিশজনকে বাদ দেয়া যেতে পারে। আমার বিশ্বাস বাকিদের মধ্যে কেউ একজন-আর সেটা অবশ্যই পরিবারের ভেতরের কেউই হবে-হ্যারিয়েটকে হত্যা করে তার লাশ গুম করে ফেলেছে।”

“এ ব্যাপারে আমার কাছে এক ডজনের মতো অবজেকশন আছে।

“সেগুলো কি, একটু শুনি তাহলে।”

“প্রথমটি হলো, কেউ যদি তার লাশ গুম করে রাখতো তাহলে আপনাদের তল্লাশি দলের কেউ না কেউ অবশ্যই সেটা খুঁজে পেতো। আপনিই তো বলেছেন তল্লাশীটা বেশ ব্যাপকভাবে করা হয়েছিলো।”

“সত্যি বলতে কি আমি তোমাকে যতোটুকু বলেছি তল্লাশীটা তারচেয়েও ব্যাপক আকারে করা হয়েছিলো। হ্যারিয়েট যে খুন হয়েছে সেটা আমার ধারণা, এটা আমি প্রমাণ করতে পারবো না। তবে এটা একটা বড় সম্ভাবনা।”

“আমাকে বলুন।”

“আনুমানিক বেলা ৩টার দিকে হ্যারিয়েট নিখোঁজ হয়। যাজক ফক যখন তাকে দেখেছিলো তখন ২:৫৫ বাজে। ঠিক ঐ সময়টাতে স্থানীয় এক পত্রিকার ফটোগ্রাফার বৃজের কাছে এসে পৌছায়। সে ঘটনাস্থলে অনেকগুলো ছবি তোলে। আমরা এবং পুলিশ উভয়ে ছবিগুলো দেখেছি, কোথাও হ্যারিয়েটের উপস্থিতি নেই। তবে শহরের অন্য সবাইকে একবারের জন্য হলেও ছবিতে দেখা গেছে।”

আরেকটা অ্যালবাম হাতে নিয়ে কফি টেবিলের উপর রাখলো ভ্যাঙ্গার।

“এই ছবিগুলো ঐদিনের তোলা। প্রথমটি হেডেস্টাডের বাচ্চাদের প্যারাডের ছবি। ঐ একই ফটোগ্রাফার ছবিগুলো তুলেছিলো আনুমানিক ১:১৫ মিনিটে। হ্যারিয়েটকে ছবিতে দেখা যাচ্ছে।”

ছবিগুলো তিন তলা ভবনের উপর থেকে তোলা হয়েছে। নীচের রাস্তার প্যারেডের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। দর্শকেরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সারিবদ্ধভাবে। লোকজনের ভীড়ের দিকে আঙুল দিয়ে ইঙ্গিত করে দেখালো ভ্যাঙ্গার।

“এইযে হ্যারিয়েট। সে নিখোঁজ হবার প্রায় দু’ঘণ্টা আগে এটা তোলা হয়েছিলো। শহরে তার কিছু স্কুলবন্ধুর সাথে আছে। এটাই তার শেষ তোলা ছবি। তবে আরেকটা ইন্টারেস্টিং শট আছে।”

অ্যালবামের পাতা ওল্টাতে লাগলো ভ্যাঙ্গার। পেশাদার ফটোগ্রাফারের তোলা মোট ১৮০টি ছবি আছে এটাতে-পাঁচটি রোল-বৃজের দুর্ঘটনার উপর। বৃজের উপর উল্টে পড়ে থাকা ট্যাঙ্কারের চারপাশে লোকজনের ভীড় আর ছুটাছুটির একটি ছবি। হিটিংঅয়েলে ভেজা তরুণ হেনরিক ভ্যাঙ্গার হাত দিয়ে ইশারা করার দৃশ্যটি ব্লমকোভিস্টের চোখে খুব সহজেই ধরা পড়লো।

“এ হলো আমার ভাই হেরাল্ড।” হাফহাতা শার্ট পরা এক তরুণ হাটু মুড়ে ট্যাঙ্কারের নীচে কী যেনো দেখাচ্ছে সেটার দিকে ইঙ্গিত করলো বৃদ্ধ। “আমার ভাই হেরাল্ড একজন অপ্রীতিকর ব্যক্তি হতে পারে তবে আমার মনে হয় তাকে আমরা সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে পারি, তবে একটা ঘটনা বাদ দিলে। নিজের পায়ের জুতো বদলানোর জন্য সে ফার্মে চলে এসেছিলো, পুরো বিকেল সে বৃজের উপরেই কাটায়।”

আরো কয়েকটি পৃষ্ঠা ওল্টালো ভ্যাঙ্গার।

“এটা খুব ইন্টারেস্টিং ছবি,” বললো ভ্যাঙ্গার। “যতোটুকু জানা গেছে এই ছবিটা তোলা হয়েছে ৩:৪০ থেকে ৩:৪৫-এ, হ্যারিয়েট যাজক ফকের ওখানে দৌড়ে চলে যাবার পর। বাড়িটার দিকে তাকাও, মাঝখানের তৃতীয় তলার জানালাটা দেখো। ওটা হ্যারিয়েটের ঘর। আগের ছবিতে জানালাটা বন্ধ ছিলো। এখানে খোলা।”

“নিশ্চয় হ্যারিয়েটের ঘরে কেউ ছিলো।”

“আমি সবাইকে জিজ্ঞেস করেছি, কেউই জানালা খোলার কথা স্বীকার করে নি।”

“তার মানে সে নিজেই ওটা করেছে, তখন পর্যন্ত সে বেঁচে ছিলো। কিংবা কেউ আপনার কাছে মিথ্যা বলেছে। কিন্তু একজন খুনি তার ঘরে গিয়ে জানালা খুলবে কেন? আর কেউ এটা করে থাকলে মিথ্যে কেন বলবে?”

ভ্যাঙ্গার মাথা ঝাঁকালো। কোনো ব্যাখ্যা নেই।

“হ্যারিয়েট ৩টার দিকে নিখোঁজ হয়, কিংবা তার একটু পরেই। এইসব ছবি দেখে বোঝা যায় কে কোথায় ছিলো ঐ সময়। এজন্যেই আমি সন্দেহের তালিকা থেকে অনেককে বাদ দিয়েছি। আবার একই কারণে আমি এসব ছবিতে যাদের দেখা যাচ্ছে না তাদেরকে সন্দেহের তালিকায় রাখতে চাইবো।”

“আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না। মৃতদেহটা কিভাবে সরানো হলো। আমি বুঝতে পারছি এ ব্যাপারে সম্ভাব্য একটা ব্যাখ্যা রয়েছে। এক ধরণের পুরনো ঐন্দ্রজালিক ট্রিকের মতো আর কি।”

“আসলে বেশ কয়েকটি বাস্তবসম্মত উপায়ে এটি করা যেতে পারে। ৩টার দিকে খুনটা হয়। যে-ই খুন করে থাকুক সে কোনো অস্ত্র ব্যবহার করে নি। তা না হলে আমরা রক্ত খুঁজে পেতাম। আমার ধারণা হ্যারিয়েটকে শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে আর সেটা করা হয়েছে এখানেই প্রাঙ্গনের দেয়ালের ভেতর। ফটোগ্রাফারের লেন্সের সীমার বাইরে কোথাও। এই বাড়িরই কোনো লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা স্থানে। তুমি যদি শর্টকাটে চাও তো বলি—তাকে শেষ যেখানে দেখা গেছে আজ সেখানে ছোট্ট ফুলের একটি বাগান আছে। তবে ষাটের দশকে ওখানে পাথর বিছানো প্রাঙ্গণ ছিলো, গাড়ি পার্ক করার কাজে ব্যবহৃত হোতো সেটা। খুনিকে শুধুমাত্র গাড়ির পেছনের ডালা খুলে হ্যারিয়েটকে ওটার ভেতর ভরে নিয়ে যেতে হয়েছে। পরদিন আমরা যখন তাকে খোঁজা শুরু করি তখনও কেউ খুনখারাবির কথা ভাবে নি। আমরা সাগর আর নদী তীর, বিভিন্ন ভবন আর জঙ্গলে তাকে খুঁজেছি।”

“তার মানে কেউ কোনো গাড়ির পেছনে বুট খুলে চেক ক’রে দেখে নি।”

“পর দিন রাতে খুনি তার গাড়ি নিয়ে বৃজটা পার হয়ে চলে যেতে পেরেছে খুব সহজেই। তারপর সে হয়তো লাশটা গুম করে ফেলেছে কোথাও।”

“একেবারে তল্লাশী করা দলের নাকের ডগার উপর দিয়ে। যদি এভাবেই ঘটনাটা ঘটে থাকে তাহলে আমরা একজন ঠাণ্ডা মাথার খুনির কথা বলছি।”

তিক্ত হাসি হাসলো ভ্যাঙ্গার। “তুমি আসলে আমাদের পরিবারের কিছু সদস্যের বর্ণনা দিয়ে দিলে।”

৬টার দিকে খাওয়াদাওয়া করার পরেও তারা কথাবার্তা অব্যাহত রাখলো। তাদের জন্য খোরগোশের রোস্ট আর আলু ভাজা সার্ভ করলো অ্যানা। খাওয়া শেষে ভ্যাঙ্গার রেড ওয়াইন অফার করলো অতিথিকে। শেষ ট্রেন ধরার জন্য ব্লমকোভিস্টের হাতে এখনও যথেষ্ট সময় রয়েছে। তার ধারণা পুরো গল্পটার পরিসমাপ্তি হতে যাচ্ছে।

“আপনি আমাকে যে গল্পটা বললেন স্বীকার করতেই হচ্ছে, সেটা খুবই চমকপ্রদ একটি গল্প। তবে এখনও বুঝতে পারছি না আপনি এসব আমাকে কেন শোনাচ্ছেন।”

“সেটা তোমাকে বলেছি। আমি হ্যারিয়েটের খুনিকে ধরতে চাই। আর সেই খুনিকে ধরার কাজে তোমাকে নিযুক্ত করতে চাই আমি।”

“কেন?”

“মিকাইল, ছত্রিশ বছর ধরে আমি এই ভেবে ভেবে পাগল হয়ে গেছি হ্যারিয়েটের আসলে কি হয়েছে। এ কাজে আমি আমার অনেক বেশি সময় অপচয় করেছি দিনের পর দিন।”

একটু চুপ থেকে চোখে চশমা পরে নিয়ে ব্লমকোভিস্টের দিকে তাকালো সে।

“সত্যি কথা বলতে কি, হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হবার কারণেই আমি আস্তে আস্তে ফার্মের কাজকর্ম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিই। সব ধরণের কাজের আগ্রহ আমি হারিয়ে ফেলি। বুঝতে পারি আমার খুব কাছেই খুনি আছে। এটা আমাকে উদ্বিগ্ন করে রাখে সব সময়। সবচাইতে বাজে ব্যাপার হলো অনেক দিন পরেও এই বোঝাটা কমে নি, বরং বেড়ে গেছে। ১৯৭০ সালের দিকে আমার মনে হোতো সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে চলে যাবো। এরপরই মার্টিন বোর্ড অব ডিরেক্টরে যোগ দিয়ে আস্তে আস্তে আমার কাজগুলোর দায়িত্ব নিতে শুরু করে। ১৯৭৬ সালে আমি পুরোপুরি অবসরে চলে যাই, আমার স্থলাভিষিক্ত হয় মার্টিন। এখনও আমি বোর্ডে আছি তবে ফার্মের ব্যাপারে মোটেও নাক গলাই না। বিগত ছত্রিশ বছর ধরে একটা দিনও বাদ যায় নি যেদিন আমি হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে ভাবি নি। তুমি হয়তো ভাববে আমি এ নিয়ে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছি-অন্তত আমার বেশিরভাগ আত্মীয়স্বজন তাই মনে করে।”

“ওটা খুবই ভয়ঙ্কর ঘটনা ছিলো।”

“তারচেয়েও বেশি। এটা আমার জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে। তোমার সেন্স কি খুব ভালো?”

“মনে হয়।”

“আমারও। কি ঘটেছে সেটা আমি ভুলতে পারি না। তবে এ কয়েক বছরে আমার মোটিভ বদলে গেছে। প্রথমে সেটা ছিলো বেদনার। আমি চাইতাম তাকে খুঁজে বের করতে, তার লাশটা কবর দিতে। এর মাধ্যমেই হ্যারিয়েটের প্রতি সুবিচার করা হবে।

“আপনার মোটিভ কোন্ দিক থেকে বদলে গেছে?”

“এখন চাই যে বানচোত কাজটা করেছে তাকে খুঁজে বের করতে। তবে হাস্যকর ব্যাপার হলো যতোই বুড়ো হচ্ছি ততোই এটা আমার ভেতর আরো বেশি করে জেঁকে বসছে।”

“শখ?”

“হ্যা। আমি এই শব্দটাই ব্যবহার করতাম। পুলিশি তদন্ত শেষ হয়ে গেলে আমি আমার নিজের তদন্ত শুরু করি। সিস্টেমেটিক্যালি এবং বৈজ্ঞানিকভাবে এসব করতে গিয়ে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমি সম্ভাব্য সব ধরণের তথ্য জোগার করেছি-ছবিগুলো, পুলিশ রিপোর্ট, ঐ দিন লোকজন কে কি করেছে কোথায় ছিলো সব তাদের কাছ থেকে জেনে লিখে রেখেছি। বলতে পারো আমি আমার জীবনের অর্ধেক ব্যয় করেছি মাত্র একটা দিনে কী ঘটেছিলো সে সম্পর্কে সব কিছু জোগার করার কাজে।

“আপনার কি মনে হয় না, এই ছত্রিশ বছরে হয়তো খুনি নিজেও মারা গেছে?”

“আমি সেটা বিশ্বাস করি না।

ব্লমকোভিস্ট তার কথাটা শুনে ভুরু কপালে তুললো।

“আগে ডিনার শেষ করে উপর তলায় ফিরে যাই। আমার গল্পের আরেকটা জিনিস আছে। সেটা না বললে গল্পটা শেষ হবে না। এটা হলো সবচাইতে হতবুদ্ধিকর দিক।”

*

সালান্ডার তার কোরোলাটা পার্ক করলো সান্ডবিবার্গের কমিউটার ট্রেন স্টেশনের সামনে। মিল্টন সিকিউরিটি মোটর পুল থেকে এই গাড়িটা সে ধার নিয়েছে। ঠিক অনুমতি নিয়ে যে কাজটা করেছে তা নয়, তবে আরমানস্কি তাতে কিছু মনে করবে না। আজ হোক কাল হোক আমার নিজের একটা গাড়ি হবে, ভাবলো সে। তার একটা সেকেন্ডহ্যান্ড কাওয়াসাকি বাইক আছে, ওটা সে গ্রীষ্মকালে ব্যবহার করে। শীতকালে তার স্টোররুমে ওটা লক করা থাকে।

হগলিন্টাভাগেনে হেটে গেলো সে, ছয়টার দিকে বাজালো বেলটা। কয়েক সেকেন্ড পরই দরজা খুলে গেলে আরো দু’তলার উপর উঠে সেভেনসন লেখা একটা দরজায় বেল বাজালো। সেভেনসন লোকটা কে অথবা এরকম কোনো লোক এখানে আদৌ থাকে কিনা সে ব্যাপারে তার কোনো ধারণাই নেই।

“হাই প্লেগ,” বললো সে।

“ওয়াস্‌প। কেবল দরকার পড়লেই তোমার আগমন ঘটে।”

সব সময়ের মতো অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরটা গাঢ় অন্ধকার। শোবার ঘর থেকে একটা ল্যাম্পের আলো আসছে কেবল। ওই ঘরটা সে তার অফিস হিসেবে ব্যবহার করে। সালান্ডারের চেয়ে তিন বছরের বড় লোকটি ছয় ফিট দুই ইঞ্চি লম্বা আর ৩৩০ পাউন্ড ওজনের। সালান্ডার নিজে অবশ্য চার ফিট এগারো। আর ওজন বলতে গেলে মাত্র ৯০ পাউন্ড। প্লেগের সামনে নিজেকে সব সময়ই বামন মনে হয়। ঘরটা ভ্যাপসা আর কটু গন্ধে ভরা।

এর কারণ তুমি কখনও গোসল করো না, প্লেগ। তোমার ঘরে আসলে মনে হয় বানরের খাঁচায় ঢুকেছি। তুমি যদি কখনও বাইরে যাও আমি তোমাকে সাবান কেনার জন্য টাকা দেবো।

তার দিকে তাকিয়ে আন্তরিকভাবে হাসলো সে, তবে কিছু বললো না। তাকে তার সঙ্গে রান্নাঘরে আসার জন্য ইশারা করলো প্লেগ। বাতি না জ্বালিয়েই রান্নাঘরের একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লো সে। ঘরের একমাত্র আলোর উৎস হলো জানালা দিয়ে বাইরে থেকে আসা স্ট্ট ল্যাম্পের আলো।

“বলতে চাচ্ছিলাম, আমিও বাড়ি পরিস্কার করার কাজের রেকর্ডের মালিক নই। তবে আমার কাছে পুরনো দুধের কার্টন থাকলে সেগুলো থেকে নর্দমার পোকাদের গন্ধ বের হতেই বাইরে ফেলে দেই

“আমি কোনো অক্ষম ব্যক্তি নই,” বললো প্লেগ। “আমি আসলে সামাজিকভাবে অযোগ্য।”

“এজন্যেই সরকার তোমার জন্য একটা থাকার জায়গা দিয়ে তোমাকে ভুলে বসে আছে। তোমার প্রতিবেশীরা ইন্সপেক্টরের কাছে গিয়ে তোমার ব্যাপারে নালিশ করতে পারে সে ব্যাপারে কি তোমার কোনো ভয় নেই? তখন তো তোমাকে হাস্যকর কোনো ফার্মের সাথে কাজ করতে হবে।

“তুমি কি আমার জন্য কিছু এনেছো?”

সালান্ডার জ্যাকেট পকেটের জিপার খুলে পাঁচ হাজার ক্রোনার তার হাতে তুলে দিলো।

“এটুকুই আমি বাঁচাতে পেরেছি। এটা আমার নিজের টাকা। আর আমি তোমাকে মোটেও নির্ভরযোগ্য কেউ মনে করি না।”

“তুমি কি চাও?”

“দু’মাস আগে তুমি যে ইলেক্ট্রনিক হ্যান্ডকাফের কথা বলেছিলে। সেটা কি পেয়েছো?”

মুচকি হেসে সে একটা বাক্স রাখলো টেবিলের উপর।

“এটা কিভাবে কাজ করে সেটা আমাকে দেখাও।”

পরবর্তী কয়েক মিনিট সালান্ডার এক মনে কথা শুনে গেলো। এরপর পরীক্ষা করে দেখলো হ্যান্ডকাফটি। প্লেগ সামাজিকভাবে যোগ্য না হতে পারে তবে সে যে একজন জিনিয়াস তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

*

ব্লমকোভিস্টের মনোযোগ আকর্ষণ করার আগ পর্যন্ত ভ্যাঙ্গার অপেক্ষা করলো। হাত ঘড়ি দেখে ব্লমকোভিস্ট বললো, “একটা হতবুদ্ধিকর ঘটনা।”

ভ্যাঙ্গার বললো : “আমি নভেম্বরের ১ তারিখে জন্মেছি। হ্যারিয়েটের বয়স যখন আট বছর তখন সে আমাকে আমার জন্মদিনে প্রেসড করা ফুলের ফ্রেম উপহার দিয়েছিলো।”

ডেস্কের কাছে গিয়ে দেয়ালে রাখা একটা ফুলের ফ্রেমের দিকে ইঙ্গিত করলো ভ্যাঙ্গার। ব্লুবেল।

“এটা ছিলো প্রথম। ১৯৫৮ সালে এটা আমি পেয়েছিলাম।” পরের ফ্রেমটা দেখালো সে। “১৯৫৯ সালে।” বাটারকাপ। “১৯৬০।” ডেইজি। “এটা রীতিমতো নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে এখন। হ্যারিয়েট অনেক সময় গ্রীষ্মকালে ফ্রেমটা বানিয়ে রেখে দিতো আমার জন্মদিনের আগপর্যন্ত। এই ঘরেই আমি ফ্রেমগুলো সব সময় টাঙিয়ে রাখতাম। ১৯৬৬ সালে সে নিখোঁজ হয়ে গেলে এর ব্যত্যয় ঘটে।”

ফ্রেমের সারিগুলোর মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গা দেখালো ভ্যাঙ্গার। ব্লমকোভিস্ট টের পেলো তার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেছে। পুরো দেয়াল জুড়ে প্রেস করা ফুলের ফ্রেম।

“১৯৬৭ সালে, তার নিখোঁজ হবার এক বছর আগে আমি আমার জন্মদিনে এই ফুলটা পাই। এটা ভায়েলেট।”

“ফুলটা আপনার কাছে কিভাবে আসে?”

“গিফট পেপারে মোড়ানো অবস্থায়, এনভেলপে স্টকহোমের পোস্টেড সিল থাকে। কোনো রিটার্ন ঠিকানা থাকে না। কোনো মেসেজও থাকে না।”

“আপনি বলতে চাচ্ছেন…” ব্লমকোভিস্ট হাত দিয়ে ফুলগুলোর দিকে ইশারা করলো।

“ঠিক। প্রতিবছর আমার জন্মদিনে একটা করে আসে। তুমি জানো আমার কেমন লাগে? এটা একেবারে আমার দিকেই আঙুল তুলে দেখায় যেনো খুনি আমাকে নির্যতন করতে চায়। আমি এ নিয়ে ভেবে ভেবে অসুস্থ পড়েছি যে, হ্যারিয়েটকে এমন কেউ হয়তো খুন করেছে যে আমাকে স্বস্তিতে থাকতে দিতে চায় না। হ্যারিয়েটের সাথে যে আমার বিশেষ একটি সম্পর্ক ছিলো সেটা কোনো গোপন ব্যাপার ছিলো না। আমি যে তাকে নিজের মেয়ে ভাবতাম সেটা সবাই জানতো।”

“তাহলে আপনি এখন আমার কাছ থেকে কি চান?” বললো ব্লমকোভিস্ট।

*

সালান্ডার মিল্টন সিকিউরিটির গ্যারাজে কোরোলা গাড়িটা রেখে উপরতলার অফিসে যে টয়লেট আছে সেখানে যাবার জন্য পা বাড়ালো। দরজায় কার্ড-কি’টা ব্যবহার করে লিফটে করে সোজা চলে এলো চতুর্থ তলায়। প্রধান প্রবেশদ্বার এড়িয়ে চলে গেলো সে, ওখানে ডিউটি অফিসার কাজ করে। টয়লেট থেকে বের হয়ে এসপ্রেসো কফির মেশিন থেকে এক কাপ কফি ঢেলে নিয়ে নিজের অফিসে এসে জ্যাকেটটা ঝুলিয়ে রাখলো চেয়ারের পেছনে।

এই অফিসটা সাড়ে ছয় বাই দশ ফিটের একটি গ্লাসের কিউবিকল। একটা ডেস্ক আর পুরনো মডেলের ডেল পিসি, একটা ফোন, একটা অফিস চেয়ার, পেপার বাস্কেট আর একটা বইয়ের শেলফ আছে সেখানে। বইয়ের শেলফে আছে কতোগুলো ডিরেক্টরি আর তিনটি নোটবুক। জানালায় ছোট্ট একটা টবে পাতা বাহার গাছ আছে। গাছটার দিকে এমনভাবে তাকালো সালান্ডার যেনো এটা সে প্রথম দেখছে। এরপর গাছসহ টবটা ফেলে দিলো বাস্কেটে।

নিজের অফিসে খুব একটা আসে না। বছরে খুব বেশি হলে আধ ডজন বার হবে। সাধারণত কোনো রিপোর্ট লেখার জন্য এখানে আসে সে। আরমানস্কি অবশ্য তাকে এখানে আসার জন্য তাড়া দিয়ে থাকে। যুক্তি হিসেবে সে বলে তাতে করে নিজেকে এই ফার্মের একজন বলে মনে হবে তার। যদিও সে কাজ করে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে। সালান্ডারের অবশ্য সন্দেহ আরমানস্কি তাকে চোখে চোখে রাখার জন্য, তার কাজকর্মে নাক গলানোর জন্যেই তাকে এখানে আসতে বলে। প্রথমে তাকে করিডোরের ওখানে জায়গা দেয়া হয়েছিলো, বড় একটা ঘর, সেখানে অন্য কলিগদের সাথে তাকে অফিস শেয়ার করতে হোতো। কিন্তু ওখানে কখনও অফিস করে নি সে। ফলে আরমানস্কি তাকে এখানে শিফট করে দিয়েছে।

সালান্ডার হ্যান্ডকাফটা বের করে সেটা ভালো করে দেখে নিলো। ভাবনায় ডুবে গিয়ে সে কামড়ে ধরলো নীচের ঠোঁট।

এগারোটা বেজে গেছে। আর এই অফিসে সে এখন একা। হঠাৎ করেই তার খুব বোরিং লাগলো।

কিছুক্ষণ পর উঠে আরমানস্কির অফিসের দরজার সামনে গিয়ে খোলার চেষ্টা করলো কিন্তু সেটা লক করা। আশেপাশে তাকালো সে। ডিসেম্বরের ২৬ তারিখের রাত এগারোটার পর অফিসে কারো আসার কথা নয়। সেই সম্ভাবনা একেবারেই কম। কোম্পানির কার্ড-কি’র পাইরেট করা একটা কপি তার কাছে আছে। সেটা দিয়ে দরজাটা খুলে ফেললো সে। কয়েক বছর আগেই এটা সে বানিয়ে নিয়েছে।

আরমানস্কির অফিসটা বেশ বড়সড় : ডেস্কের সামনে অনেকগুলো বসার চেয়ার। ঘরের এক কোণে আটজন লোকের বসার মতো একটা কনফারেন্স টেবিল আছে। একেবারে পরিস্কার আর ঝকঝকে। অনেক দিন ধরে সে তার অফিসে ঢুঁ মারে নি। ডেস্কের নীচে একটা জিনিস খুঁজলো। জানে এখানে চোরধরার একটা রিং বসানো আছে। কোম্পানিতে তারই এক কলিগ এটা ইনস্টল করেছে। ক্লায়েন্টের সাথে কথাবার্তা রেকর্ড করে রাখরও ব্যবস্থা আছে এখানে।

অবশেষে কাগজগুলো ঠিক জায়গামতো রেখে দরজা লক ক’রে বাড়ি ফিরে এলো। আজকের দিনটা নিয়ে সে খুবই সন্তুষ্ট।

*

“আমি জানি না আমরা সত্যটা খুঁজে বের করতে পারবো কিনা, তবে আমি শেষ চেষ্টা না করে কবরে যেতে চাই না,” বৃদ্ধ বললো। “আমি চাই তুমি এসব এভিডেন্স আরেকবার চেক করে দেখো।”

“এটা তো পাগলামি,” বললো ব্লমকোভিস্ট।

“কেন এটা পাগলামি বলে মনে হচ্ছে?”

“আমি যথেষ্ট শুনেছি। হেনরিক, আপনার দুঃখটা আমি বুঝি, তবে আপনার সাথে আমি কোনো অসততা করবো না। আপনি আমাকে দিয়ে যা করাতে চাইছেন সেটা সময় আর টাকা-পয়সার অপচয় ছাড়া আর কিছু না। আপনি আমাকে এমন একটি রহস্য উদ্ঘাটন করতে বলছেন যেটা কিনা এতোগুলো বছর ধরে পুলিশ আর অভিজ্ঞ ইনভেস্টিগেটররা করতে ব্যর্থ হয়েছে। চল্লিশ বছর আগের একটি ক্রাইমের সমাধান করতে বলছেন আমাকে। এটা আমি কি করে করবো?”

“আমরা এখনও তোমার ফি নিয়ে কোনো আলোচনা করি নি,” বললো ভ্যাঙ্গার।

“সেটা করার কোনো দরকারও নেই।”

“আমি তোমাকে জোর করতে পারবো না তবে আমি কি বলি সেট। আে শোনো। ফ্রোডি ইতিমধ্যেই একটা চুক্তির খসড়া করে ফেলেছে। ডিটেইলগুলো নিয়ে আমরা আলাপআলোচনা করতে পারি। তবে চুক্তিটা খুবই সহজ সরল। তোমার স্বাক্ষরের দরকার।”

“হেনরিক, এটা একেবারেই অনর্থক। হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হওয়ার সমাধান করতে পারবো ব’লে আমি বিশ্বাস করি না।”

“চুক্তিমতো সেটা তোমাকে করতেও হবে না। কেবল নিজের সেরা চেষ্টাটা করবে। তুমি যদি ব্যর্থ হও তবে সেটা ঈশ্বরেরই ইচ্ছে, অথবা যদি তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাস না করো—ওটাকেই নিয়তি বলে মেনে নেবো।”

ব্লমকোভিস্ট দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ক্রমাগত তার মধ্যে একটা অস্বস্তি ভাব বেড়েই চলেছে, হেডেবি ভ্রমণটা শেষ করতে চাচ্ছে সে কিন্তু পারছে না।

“ঠিক আছে, তাহলে শুনি প্রস্তাবটা কি।”

“আমি চাই তুমি এখানে এই হেডেবিতে একবছর থেকে কাজটা করো। হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হবার উপরে এক পাতার একটি রিপোর্ট দেবে আমাকে। আমি চাই সম্পূর্ণ নতুন চোখে সব কিছু নিরীক্ষা করবে তুমি। পুরনো সব মতামতকে প্রশ্ন করে নতুন একটা সমাধানে পৌছানোর চেষ্টা করবে। পুলিশ, ইনভেস্টিগেটর আর আমার চোখে এড়িয়ে গেছে এরকম কিছু খুঁজে বের করবে সেটাও চাই।”

“আপনি আমাকে দিয়ে আমার জীবনযাপন, ক্যারিয়ার সব একপাশে সরিয়ে রেখে পুরো একটা বছর এমন একটা কাজে নিয়োজিত করতে চান যা কিনা এক কথায় সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছু না।”

হাসলো ভ্যাঙ্গার। “তোমার ক্যারিয়ারের কথা বলতে গেলে তুমি নিশ্চয় মানবে ওটা কিছুদিনের জন্য স্থগিতই থাকবে।”

এ কথার কোনো জবাব দিলো না ব্লমকোভিস্ট।

“আমি তোমার জীবনের একটা বছর কিনতে চাই। তোমাকে একটা কাজ দিতে চাই। তুমি তোমার জীবনে যতোগুলো চাকরি করেছো তারচেয়ে এখানে অনেক বেশি বেতন পাবে। আমি তোমাকে মাসে দু’লক্ষ ক্রোনার দেবো-তুমি যদি কাজটা করতে রাজি থাকো তাহলে এক বছরে পাচ্ছো’ ২.৪ মিলিয়ন ক্রোনার।

ব্লমকোভিস্ট একেবারে হতবাক।

“আমি কোনো বিভ্রান্তির মধ্যে নেই। তোমার সফল হবার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে সব বাধা ডিঙিয়ে তুমি যদি শেষ পর্যন্ত রহস্যটার সমাধান করে ফেলতেই পারো তাহলে তার জন্যে আমি তোমাকে বোনাস হিসেবে দ্বিগুন টাকা দেবো। মানে ৪.৮ মিলিয়ন ক্রোনার। ঠিক আছে, আরেকটু উদারতা দেখাই। একেবারে রাউন্ড ফিগার করে দেই। পাঁচ মিলিয়ন।”

চেয়ারে হেলান দিয়ে ভ্যাঙ্গার মাথাটা সামান্য উঁচু করলো।

“তুমি চাইলে আমি টাকাগুলো কোনো ব্যাঙ্ক একাউন্টের মাধ্যমে পরিশোধ করবো। পৃথিবীর যেকোনো ব্যাঙ্ক হতে পারে সেটা। তুমি যদি চাও টাকাগুলো একটা সুকেসে করে নেবে, ইনকাম ট্যাক্স অফিসে সেটা রিপোর্ট করবে কি না করবে সেটা তোমার ব্যাপার, তাহলে সেটাও সম্ভব।”

“এটা তো…ভালো কথা হলো না,” ব্লমকোভিস্ট চট করে বললো।

“কেন?” শান্ত কণ্ঠে বললো ভ্যাঙ্গার। “আমার বয়স বিরাশি, এখনও আমার অনেক কিছু আছে। আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ খুব ভালো। আমার যেভাবে খুশি সেভাবেই টাকাগুলো খরচ করতে পারি। আমার নিজের কোনো সন্তান নেই, আর যে আত্মীয়স্বজনকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করি তাদের জন্য এসব সম্পত্তি রেখে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আমি আমার শেষ ইচ্ছে আর টেস্টামেন্ট তৈরি করে ফেলেছি। আমি আমার বিশাল পরিমাণের সম্পত্তি ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডে দান করে যাবো। আমার খুব ঘনিষ্ঠ কিছু লোক বেশ বড় অঙ্কের টাকা পাবে-এরমধ্যে অ্যানাও আছে।”

মাথা ঝাঁকালো ব্লমকোভিস্ট।

“আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করো,” বললো ভ্যাঙ্গার। “আমি এমন একজন মানুষ যে কিনা খুব জলদিই মারা যাবে। এ দুনিয়াতে একটামাত্র জিনিসই আমি চাই-যে প্রশ্নে জবাব আমি অর্ধেকটা জীবন ধরে খুঁজে চলেছি। যে প্রশ্নটি আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমি প্রত্যাশা করি না এর জবাব খুঁজে পাওয়া যাবে, তবে শেষবারের মতো চেষ্টা করে দেখার মতো আমার কাছে যথেষ্ট টাকাপয়সা আছে। এটা কি অযৌক্তিক? হ্যারিয়েটের প্রতি আমার একটা দায় আছে। আমার নিজের কাছেও দায় আছে।”

“আপনি আমাকে খামোখা কয়েক মিলিয়ন ক্রোনার দেবেন। আমার কেবল দরকার চুক্তিতে স্বাক্ষর করে নাকে তেল দিয়ে এক বছর ঘুরে বেড়ানো।”

“তুমি সেটা করবে না। বরং তুমি এ জীবনে যতো পরিশ্রম করেছো তারচেয়ে অনেক বেশি পরিশ্রম করবে এ কাজে।”

“আপনি এতোটা নিশ্চিত হচ্ছেন কি করে?”

“কারণ আমি তোমাকে এমন একটি প্রস্তাব দিচ্ছি যেটা তুমি টাকা দিয়ে কিনতে পারবে না, তবে সেটা তুমি যেকোনো কিছুর চেয়ে বেশিই চাও।”

“সেটা কি?”

ভ্যাঙ্গারের চোখ দুটো কুচকে গেলো।

“আমি তোমার কাছে হান্স-এরিক ওয়েনারস্ট্রমকে তুলে দেবো। আমি প্ৰমাণ করতে পারবো সে একজন জোচ্চোর। পয়ত্রিশ বছর আগে সে আমার সাথেই তার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলো। তার মুণ্ডুটা আমি তোমার কাছে একটা প্লেটে করে উপহার দিতে পারবো। রহস্যটা সমাধা করো, তাহলে আদালতে যে পরাজয় বরণ করেছো সেটা পাল্টে দিতে পারবে।

অধ্যায় ৭

শুক্রবার, জানুয়ারি ৩

এরিকা তার কফির কাপটা টেবিলের উপর রেখে জানালার কাছে গিয়ে গামলা স্টানের দৃশ্য দেখতে লাগলো। সকাল ৯টা বাজে। নতুন বছরের বৃষ্টিতে জমে থাকা সব তুষার ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে।

“আমি সব সময় এখান থেকে দৃশ্য দেখতে পছন্দ করি,” বললো সে। “এ রকম একটি অ্যাপার্টমেন্ট থাকলে সল্টসইয়োবাডেন ছাড়ার কথাও ভাবতে পারি।”

“তোমার কাছে তো চাবি আছেই। চাইলে তুমি তোমার আপার-ক্লাস এলাকা ছেড়ে যখন খুশি এখানে এসে থাকতে পারো,” বললো ব্লমকোভিস্ট। সুটকেসটা বন্ধ করে দরজার সামনে রাখলো সে।

বার্গার তার দিকে অবিশ্বাসে তাকিয়ে রইলো। “তুমি সিরিয়াস হতে পারো না, মিকাইল,” বললো সে। “আমরা একটা বাজে সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, আর তুমি কিনা তিওত্তাহেইতি’তে গিয়ে থাকতে চাইছো।”

“হেডেস্টাড! এখান থেকে ট্রেনে করে গেলে কয়েক ঘণ্টার পথ। আর আমি তো সারাজীবনের জন্য যাচ্ছি না।”

“আরে ওটা উলান বাটোরও হতে পারে। তুমি কি বুঝতে পারছো না পুরো ব্যাপারটা এমন দেখাবে যে, তোমার দু’পায়ের ফাঁকে তোমার লেজটা গুটিয়ে হচ্ছে?”

“আমি ঠিক সেটাই করতে যাচ্ছি। তাছাড়া আমাকে গাউলেও কিছু সময় কাটাতে হবে।”

ক্রিস্টার মাম সোফায় বসে আছে, অস্বস্তিতে ভুগছে সে। মিলেনিয়াম প্রতিষ্ঠা করার পর সে এই প্রথম ব্লমকোভিস্ট আর বার্গারকে কোনো বিষয় নিয়ে প্রচণ্ড দ্বিমত পোষণ করতে দেখছে। এতোগুলো বছর ধরে তারা একেবারে অবিচ্ছিন্ন ছিলো। কখনও কখনও তারা ঝগড়া যে করে নি তা নয়, তবে সেসবই হয়েছে ব্যবসা আর কাজের বিষয় নিয়ে। তবে সব সময়ই তারা একে অন্যেকে জড়িয়ে ধরে ঝগড়ার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে নিজের কাজে ফিরে গেছে, কিংবা সোজা বিছানায়। গত শরটা ভালো কাটে নি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তাদের দু’জনের মধ্যে বিরাট একটা ফাঁক সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। মাম ভাবতে লাগলো সে মিলেনিয়াম- এর শেষ অধ্যায়ের সূচনা দেখছে কিনা।

“আমার আর কোনো উপায় নেই,” বললো ব্লমকোভিস্ট। “আমাদেরও এছাড়া কোনো উপায় নেই।”

কাপে কফি ঢেলে রান্নাঘরের টেবিলে বসে পড়লো সে। বার্গার মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বসলো ঠিক তার বিপরীতে।

“তুমি কি ভাবছো, ক্রিস্টার?” বললো সে।

এই প্রশ্নটা যে করা হবে সেটা সে জানতো। নিজের স্ট্যান্ডের কথা জানাতেও সে উদগ্রীব হয়েছিলো। সে হলো তৃতীয় পার্টনার তবে সবাই জানে মিলেনিয়াম মানে ব্লমকোভিস্ট আর এরিকা বার্গার। তারা নিজেরা যখন একমত হতে পারে না তখনই কেবল তার কাছ থেকে মতামত জানতে চাওয়া হয়।

“সত্যি বলতে কি, তোমরা দু’জন একে অন্যেকে এতো ভালোমতো চেনো যে আমি কি মনে করলাম তাতে কিছু যায় আসে না,” মাম বললো।

চুপ মেরে গেলো সে। ছবি বানাতে ভীষণ পছন্দ করে। গ্রাফিকস নিয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। নিজেকে সে কখনও আর্টিস্ট হিসেবে বিবেচনা করে না। তবে জানে সে একজন ভালো ডিজাইনার। কোনো রকম নীতি নির্ধারণী ব্যাপারে সে একেবারেই অসহায়।

বার্গার আর ব্লমকোভিস্ট একে অন্যের দিকে তাকালো। এরিকা বাইরে দিয়ে শীতল থাকলেও ভেতরে ভেতরে তেতে আছে। ব্লমকোভিস্ট দ্রঢ়প্রত্যয়ী।

এটা নিছক কোনো তর্ক বিতর্ক না, ভাবলো মাম। এটা আসলে ডিভোর্স। “ঠিক আছে, আমাকে আমার অবস্থা আরেকবার উপস্থাপন করতে দাও,” বললো ব্লমকোভিস্ট। “এর মানে এই নয় যে মিলেনিয়াম-এর সাথে আমার সম্পর্ক শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমরা এতো দিন এক সঙ্গে কাজ করেছি যে এটা ভাবাও সম্ভব নয়।

“কিন্তু এখন তুমি অফিসেও থাকছো না-ক্রিস্টার এবং আমাকে সব সামলাতে হবে। এটা কি বুঝতে পারছো না? তুমি স্বেচ্ছায় দেশান্তরী হবার মতো কাজ করছো।’

“এটা হলো দ্বিতীয় ঘটনা। আমার একটা ছুটির দরকার, এরিকা। আমি আর ঠিকমতো কাজ করতে পারছি না। আমি নিঃশেষ হয়ে গেছি। হেডেস্টাডে বেতনসহ ছুটি কাটানোটা আমার জন্য খুব দরকার।

“পুরো জিনিসটাই বোকামি, মিকাইল। এরচেয়ে তোমার উচিত সাকার্সে যোগ দেয়া।”

“আমি জানি। তবে আমি বসে বসে এক বছরে ২.৪ মিলিয়ন ক্রোনার পাচ্ছি। আমি মোটেও সময় নষ্ট করবো না। এটা হলো তৃতীয় বিষয়। ওয়েনারস্ট্রমের সাথে লড়াইটা মাত্র শেষ হয়েছে। সে আমাকে নকআউট করেছে। দ্বিতীয় রাউন্ড এবার শুরু হয়ে গেছে-সে এখন মিলেনিয়াম’কে চিরতরে ডোবানোর চেষ্টা করবে কারণ এখানে একজন আছে যে তার সব জোচ্চোরি জেনে গেছে। ম্যাগাজিন আর ঐ লোকটা যতো দিন থাকবে ততোদিন তার জন্যে এটা একটা সমস্যা।”

“আমি জানি সে কি করছে। বিগত ছয় মাসে পত্রিকার বিজ্ঞাপনের হার যেভাবে কমে গেছে সেটা তো আমি ভালো করেই জানি।”

“এজন্যেই আমি অফিস থেকে বের হয়ে যেতে চাচ্ছি। আমি হলাম তার মতো পাগলা ষাড়ের সামনে দুলতে থাকা লাল কাপড়। আমি যতোটুকু জানি সে একজন প্যারানয়েড। আমি যতোদিন এখানে থাকবো ততোদিন সে ক্ষতি করার জন্য হন্যে হয়ে লেগে থাকবে। এখন আমাদেরকে তৃতীয় রাউন্ডের জন্য প্রস্তত হতে হবে। ওয়েনারস্ট্রমের সাথে যদি আমাদের জয় লাভ করার কোনো আশা থাকে তাহলে এখন একটু পিছিয়ে যেতেই হবে। সম্পূর্ণ নতুন একটি স্ট্র্যাটেজি প্রণয়ন করতে হবে। তাকে ধরাশায়ী করার জন্য একটা উপায় বের করতে হবে। এই বছর সেটাই হবে আমার কাজ।”

“আমি সবই বুঝলাম, বললো বার্গার। “তাহলে ছুটি নিয়ে কিছুটা সময় আসে বিদেশের কোনো সৈকতে গিয়ে কয়েক মাস কাটিয়ে আসো। কোস্টা ব্রাভা’র লাভ লাইফ উপভোগ করো। স্যান্ডহ্যামে গিয়ে সাগরের ঢেউ দেখো।”

“আমি যখন ফিরে আসবো কোনো কিছুই বদলাবে না। ওয়েনারস্ট্রম মিলেনিয়াম’কে ছাড়বে না যতোক্ষণ পর্যন্ত সে আমাকে পরাজিত হতে না দেখবে। তাকে থামানোর একটাই পথ খোলা আছে, তাকে ধরাশায়ী করার মতো কিছু খুঁজে বের করতে হবে।”

“তুমি মনে করছো সেটা তুমি হেডেস্টাডে গিয়ে পেয়ে যাবে?”

“আমি চেক করে দেখেছি। ওয়েনারস্ট্রম সত্যি সত্যি ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত ভ্যাঙ্গারের সাথে কাজ করেছে। সে ম্যানেজমেন্টে ছিলো, স্ট্র্যাটেজিক প্লেসমেন্টের দায়িত্ব ছিলো তার উপর। খুব দ্রুতই সে ওটা ছেড়ে দেয়। হেনরিক ভ্যাঙ্গারের কাছে তার ব্যাপারে কিছু একটা আছে সেটা আমরা বাতিল করে দেই কিভাবে?”

“তবে ত্রিশ বছর আগে সে কি করেছে সেটা আজকের দিনে প্রমাণ করাটা খুবই কঠিন হবে।”

“ভ্যাঙ্গার যা জানে সেটাই তোমাকে বলবে বলে কথা দিয়েছে। সে আসলে ঐ মেয়েটার ঘটনা নিয়ে বাতিকগ্রস্ত হয়ে আছে-মনে হয় ঐ একটা ব্যাপারেই সে আগ্রহী। এর মানে যদি হয় সে ওয়েনারস্ট্রমের বারোটা বাজাবে তাহলে আমি মনে করি সে তাই করবে। আমরা সুযোগটা অবহেলায় ফিরিয়ে দিতে পারি না। সে-ই একমাত্র ব্যক্তি যে নিজ থেকে ওয়েনারস্ট্রমের বিরুদ্ধে কিছু প্রমাণ হাজির করার কথা বলেছে

“তুমি যদি এমন প্রমাণ নিয়ে হাজির হও যে ঐ মেয়েটাকে ওয়েনারস্ট্রম নিজ হাতে গলা টিপে মেরেছে তারপরেও সেটা আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবো না। এতোগুলো বছর পর এটা করা সম্ভব হবে না। সে আমাদেরকে আদালতে তুলাধুনা করে ছাড়বে।”

“এই ভাবনাটা আমার মনেও উকি দিয়েছিলো, তবে এটা ভালো কিছু না : সে তখন স্টকহোম স্কুল অব ইকোনোমিকসে পড়তো। মেয়েটা যখন নিখোঁজ হয় তখন তার সাথে ভ্যাঙ্গার কোম্পানির কোনো সম্পর্ক ছিলো না।” ব্লমকোভিস্ট থামলো। “এরিকা, আমি মিলেনিয়াম ছেড়ে যাচ্ছি না, তবে সবার কাছে যেনো সেরকমই মনে হয়। এটা খুবই জরুরি। তুমি আর ক্রিস্টার মিলে পত্রিকাটা চালাবে। যদি সেটা করতে পারো… ওয়েনারস্ট্রমের সাথে যদি…একটা সিজফায়ারের ব্যবস্থা করতে পারো তাহলে সেটাই কোরো। আমি যদি সম্পাদকীয় বোর্ডে থাকি তাহলে সেটা করা সম্ভব হবে না।”

“ঠিক আছে, কিন্তু এটা খুবই বাজে পরিস্থিতি, আমার মনে হচ্ছে তুমি খড়কুটো আঁকড়ে ধরার জন্য হেডেস্টাডে যাচ্ছো।”

“তোমার কাছে কি এরচেয়ে ভালো কোনো আইডিয়া আছে?”

বার্গার কাঁধ তুললো। “আমাদেরকে এখন সোর্সের পেছনে ছোটা উচিত। শুরু থেকে গল্পটা পুণঃনির্মাণ করতে হবে। আর সেটা এক্ষুণি করা দরকার।”

“রিকি-ঐ গল্পটা এখন মরে গেছে।”

তার কথাটা পাত্তা না দিয়ে বার্গার তার হাতের উপর মাথাটা রাখলো। কিন্তু কথা বলতে শুরু করলো ব্লমকোভিস্টের দিকে না তাকিয়ে।

“আমি তোমার উপর খুবই রেগে আছি। এজন্যে নয় যে তুমি যে রিপোর্টটা করেছিলে সেটা ভিত্তিহীন ছিলো। ওটার ব্যাপারে তোমার মতো আমিও দায়ি। আবার এজন্যেও নয় যে তুমি এখানকার রিপোর্টিং আর প্রকাশকের দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছো-এই পরিস্থিতিতে এটা খুবই স্মার্ট সিদ্ধান্ত। তোমার সাথে আমার ক্ষমতার লড়াই হচ্ছে, আমাদের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে এরকম ভান করতে আমি পারবো। ওয়েনারস্ট্রমের চোখে আমি নিরীহ একজন হিসেবে প্রতিপন্ন হওয়া আর তোমাকে একমাত্র হুমকি হিসেবে তার সামনে তুলে ধরার যুক্তিটাও আমি বুঝি।” একটু থেমে এবার তার চোখের দিকে তাকালো বার্গার। “তবে আমার মনে হচ্ছে তুমি একটা ভুল করছো। এতে করে ওয়েনারস্ট্রম মোটেও ক্ষান্ত দেবে না। সে মিলেনিয়াম’কে ধ্বংস করতে ঠিকই লেগে থাকবে। পার্থক্যটা হলো সেটা আজ থেকে শুরু হচ্ছে। আমাকে তার বিরুদ্ধে একাই লড়তে হবে। আর আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন তোমাকে পত্রিকার সম্পাদকীয়তে অনেক বেশি দরকার। ঠিক আছে, আমি ওয়েনারস্ট্রমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাতে পছন্দই করবো, তবে আমার আক্ষেপ থাকবে তুমি আচমকা জাহাজ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েছো। একটা বাজে পরিস্থিতে তুমি আমাকে একা ফেলে রেখে চলে যাচ্ছো।”

তার কাছে গিয়ে ব্লমকোভিস্ট তার চুলে হাত বোলালো।

“তুমি মোটেও একা নও। তোমার পেছনে ক্রিস্টার আর সব এপ্লয়িরা আছে।”

“জেইন ডালম্যানকে নয়। ভালো কথা, আমার মনে হয় তাকে নিয়োগ দেয়াটা তোমার একটা ভুল ছিলো। লোকটা যোগ্য হলেও ভালোর চেয়ে খারাপই বেশি করে। তাকে আমি বিশ্বাস করি না। পুরো শরৎকাল জুড়ে সে তোমার সমস্যাটা নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলেছে এখানে সেখানে। আমি জানি না সে কি তোমার জায়গা নেবার কথা ভাবছে কিনা।

“বলতে বাধ্য হচ্ছি তোমার কথাই ঠিক, বললো ব্লমকোভিস্ট।

“তাহলে আমি কি করবো? তাকে বরখাস্ত করবো?

“এরিকা, তুমি এডিটর ইন চিফ এবং সেই সাথে মিলেনিয়াম-এর বেশিরভাগ অংশের মালিক। দরকার হলে তাকে বরখাস্ত করতেই পারো।”

“আমরা কখনও কাউকে বরখাস্ত করি নি, মিক। এই কাজটা করার ভার তুমি আমার উপরে দিয়ে দিলে। সকালবেলা অফিসে যাওয়াটা আর মজার কোনো ব্যাপার হবে না।”

ঠিক এই সময় মাম উঠে দাঁড়ালে তারা দু’জনেই অবাক হয়ে গেলো।

“ট্রেনটা যদি ধরতে চাও তাহলে এক্ষুণি রওনা দিতে হবে আমাদের।” বার্গার বিরোধীতা করতে নিলে হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলো সে। “দাঁড়াও, এরিকা। তুমি জানতে চেয়েছিলে আমি কি ভাবছি। আমার মনে হয় পরিস্থিতিটা খুবই বাজে। তবে মিকাইল যা বললো ব্যাপারটা যদি আদতে সেরকমই হয় তাহলে তাকে সেই মতো কাজ করতে দিলেই আমাদের সবার ভালো হবে। আমাদের কাছ থেকে সে এটা পাবার দাবি রাখে।

তারা দু’জনেই মামের দিকে বিস্ময়ে চেয়ে থাকলে সে ব্লমকোভিস্টের দিকে তাকিয়ে বিব্রত হয়ে গেলো।

“তোমরা দু’জনেই জানো মিলেনিয়াম বলতে তোমাদের দু’জনকেই বোঝায়। আমি একজন পার্টনার, তোমরা সব সময় আমার সাথে ভালো আচরণ করেছো, পত্রিকাটা আমি ভালোবাসি তবে তোমরা আমার জায়গায় অন্য কোনো আর্ট ডিরেক্টর খুঁজে নিতে পারতে। যেহেতু আমার মতামত জানতে চেয়েছিলে তাই বলছি : ডালম্যানের ব্যাপারে আমি তোমার সাথে একমত। তুমি যদি তাকে বরখাস্ত করতে চাও, এরিকা, তাহলে তোমার হয়ে আমিই সেই কাজটা করবো। মিকাইল চলে যাচ্ছে সেটা অবশ্য দুর্ভাগ্যজনক তবে আমার মনে হয় না এছাড়া আমাদের অন্য কোনো উপায় আছে। মিকাইল, তোমাকে আমি স্টেশন পর্যন্ত ড্রাইভ করে দিয়ে আসবো। তুমি ফিরে আসার আগ পর্যন্ত আমি আর এরিকা এই দূর্গটা রক্ষা করে যাবো।”

“আমার ভয় হলো মিকাইল আর ফিরে আসবে না,” শান্ত কণ্ঠে বললো বার্গার।

আরমানস্কি দুপুর ১:৩০-এ ফোন করলে সালান্ডারের ঘুম ভেঙে গেলো।

“কি হয়েছে?” ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললো সে।

“আমি আমাদের ক্লায়েন্ট মি: ফ্রোডির সাথে এইমাত্র কথা বলেছি।”

“তো?”

“সে আমাকে ফোন করে বললো ওয়েনারস্ট্রমের ব্যাপারে ইনভেস্টিগেশনটা বাদ দিতে।”

“বাদ দিতে? আমি তো কাজ শুরু করে দিয়েছি।”

“ফ্রোডি আর এ ব্যাপারে আগ্রহী নয়।”

“তাই নাকি?”

“সে-ই তো সিদ্ধান্ত নেবার মালিক।”

“আমরা তো ফি নিয়ে একমত হয়েছিলাম।”

“তুমি এ কাজে কতোটুকু সময় ব্যয় করেছো?“

সালান্ডার একটু ভেবে নিলো। “পুরো তিনদিন।”

“আমরা চল্লিশ হাজার ক্রোনারে রাজি হয়েছিলাম। আমি তাহলে দশ হাজার ক্রোনার ইনভয়েস করার জন্য লিখে পাঠাই। তুমি এর অর্ধেক পাবে। এটা তোমার তিন দিনের কাজের জন্য যথেষ্টই। সে এই পরিমাণ টাকা দেবে কারণ পুরো ব্যাপারটা সে-ই শুরু করেছে।’

“আমি যেসব ম্যাটেরিয়াল জোগার করেছি সেগুলোর কি হবে?”

“খুব উল্লেখযোগ্য কিছু কি আছে?”

“না।”

“ফ্রোডি কোনো রিপোর্ট চায় নি। সে যদি আবার কখনও কাজটা করতে বলে সেজন্যে শেলফে রেখে দাও। তা না হলে তুমি নষ্ট করে দিতে পারো। আগামী সপ্তাহে তোমার জন্য নতুন একটা কাজ দিচ্ছি।

আরমানস্কি ফোনটা রেখে দেবার পরও সালান্ডার অনেকক্ষণ সেটা হাতে নিয়ে বসে থাকলো। লিভিংরুমে নিজের কাজের ডেস্কে ফিরে গেলো সে, দেয়ালে যেসব নোট আর কাগজ পিন দিয়ে লাগিয়ে রেখেছে আর ড্রয়ারে যেসব পেপার আছে সেগুলো দেখে নিলো। তার জোগার করা জিনিসপত্রের মধ্যে বেশিরভাগই হলো ইন্টারনেট থেকে প্রেসকাটিং আর আর্টিকেলের ডাউনলোড করা প্রিন্ট সবগুলো কাগজ এক করে ড্রয়ারে রেখে দিলো সে।

খুব অবাক হলো সালান্ডার। আদালতে ব্লমকোভিস্টের অদ্ভুত আচরণ একটা কৌতুহলোদ্দীপক চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলো। কোনো অ্যাসাইনমেন্ট শুরু করার পর সেটা বাদ দিতে ভীষণ অপছন্দ করে সালান্ডার। সব মানুষেরই গোপন ব্যাপার স্যাপার থাকে। শুধু সেগুলো কি সেটা খুঁজে বের করাটাই হলো আসল কথা।

অধ্যায় ৮

শুক্রবার, জানুয়ারি ৩-রবিবার, জানুয়ারি ৫

ব্লমকোভিস্ট যখন দ্বিতীয়বারের মতো হেডেস্টাডের ট্রেনে চেপে বসলো তখন আকাশের রঙ নীল আর বাতাস বরফের মতো ঠাণ্ডা। স্টেশনের দেয়ালে থার্মোমিটার বলছে শূন্য ডিগ্‌ ফারেনহাইট। তার পায়ে ওয়াকিং সু যা কিনা এই পরিবেশের সাথে বেমানান। আগের মতো আজকের এই ভ্রমণে তার জন্যে কোনো গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবে না মিঃ ফ্রোডি। কবে সে আসছে সেটা ব্লমকোভিস্ট তাদেরকে জানালেও কোন্ ট্রেনে করে আসছে সেটা বলে নি। ট্রেন থেকে নেমে একটা বাসে চেপে হেডেস্টাডে চলে যাবে বলে ঠিক করেছিলো। তবে সঙ্গে থাকা দুটো সুটকেসের জন্য সোজা ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে পা বাড়ালো সে।

ক্রিসমাস থেকে নতুন বছরের শুরু পর্যন্ত ভারি তুষারপাত হয়েছে পুরো এলাকায়। রাস্তায় জমে থাকা বরফ পরিস্কার কাজে নেমে পড়েছে পরিচ্ছন্নকর্মীরা। গাড়ির জানালায় ড্রাইভারের যে আইডি লাগানো আছে তাতে দেখা যাচ্ছে ট্যাক্সি ড্রাইভারের নাম হুসেন। আবহাওয়া কি খুব বাজে ছিলো কথাটা ব্লমকোভিস্ট তাকে জিজ্ঞেস করতেই মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। লোকটা আরো জানালো গত এক দশকে সবচাইতে ভারি তুষারপাত হয়েছে। ক্রিসমাসে গূসে গিয়ে ছুটি না কাটানোর জন্য সে অনেক আক্ষেপও করলো তার কাছে।

হেনরিক ভ্যাঙ্গারের বাড়ির সামনে এসে ব্লমকোভিস্টকে নামিয়ে দিয়ে ট্যাক্সিটা চলে গেলে তার কাছে আচমকা নিজেকে খুব একা আর দ্বিধাগ্রস্ত বলে মনে হলো।

তার পেছনে দরজা বন্ধ করার শব্দ শুনতে পেলো সে। মোটা ফারকোট, ভারি বুট আর মাথায় টুপি পরে আছে ভ্যাঙ্গার। ব্লমকোভিস্ট পরে আছে জিন্স প্যান্ট আর চামড়ার জ্যাকেট।

“তুমি যদি এখানে থাকতে চাও তাহলে বছরের এই সময়টাতে আরো বেশি শীতপোশাক পরে থাকতে হবে।” তারা করমর্দন করলো। “তুমি কি নিশ্চিত মেইন হাউজে থাকবে না? না? তাহলে তোমাকে নতুন লজে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।”

ভ্যাঙ্গার আর ডার্চ ফ্রোডির সাথে করা তার চুক্তির একটা শর্ত ছিলো সে নিজের কোয়ার্টারে থাকবে, নিজের হাউজকিপিং নিজেই করবে আর ইচ্ছেমতো যখন খুশি যাবে আসবে। ভ্যাঙ্গার তাকে রাস্তার ওপারে বৃজের দিকে আরেকটা নতুন কাঠের তৈরি বাড়ির সামনে নিয়ে গেলো। বাড়িটাতে কোনো তালা লাগানো নেই। ভেতরে ঢুকে ব্লমকোভিস্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুটকেস দুটো নামিয়ে রাখলো।

“এটাকে আমরা গেস্টহাউজ বলি। দীর্ঘ সময় কেউ থাকতে চাইলে তাকে আমরা এখানে এনে রাখি। এখানেই তোমার বাবা-মা ১৯৬৩ সালে থাকতেন। গ্রামের সবচাইতে পুরনো বাড়ি এটা। তবে এটাকে আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। আমি আমার কেয়ারটেকার নিলসনকে আজ সকালে এখানকার ফায়ারপ্লেসে আগুন ধরানোর ব্যবস্থা করতে বলেছি।”

বাড়িটাতে বিশাল রান্না ঘর আর ছোট্ট আরো দুটো ঘর আছে। সব মিলিয়ে ৫০০ বর্গফুটের মতো হবে।

“খুব বেশি ঠাণ্ডা না পড়লে তোমার কাঠের আগুন ধরানোর দরকার নেই। এই শরতে বাড়িটা অব্যবহৃত হয়ে পড়েছিলো। ইলেক্ট্রক হিটারও আছে। ওগুলোর কাছে কাপড়চোপড় রাখবে না। নইলে আগুন ধরে যাবে।”

চারপাশটা দেখে নিলো ব্লমকোভিস্ট। তিন দিকে অনেকগুলো জানালা আছে। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বৃজটাও দেখা যায়। সেটা এখান থেকে একশ ফুট দূরেই হবে।

অপরিসর দুটো দরজা দিয়ে ছোট্ট দুটো ঘরে ঢোকা যায়। একটা ডান দিকে আর অন্যটা হলওয়ে এবং ছোট্ট অফিসের মাঝখানে অবস্থিত। শোবার ঘরটা বেশ ছোটো, একটা ডাবল বেড আছে সেখানে, সেইসাথে বেডসাইড টেবিল আর ওয়ারড্রব। দেয়ালে ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টিং টাঙানো। ঘরের সব ফার্নিচার পুরনো হলেও ঝকঝকে করে রাখা হয়েছে। ফ্লোরটা নিয়মিত পরিস্কার করা হয়। শোবার ঘরের আরেকটা দরজা আছে যা দিয়ে হলওয়েতে যাওয়া যায়। একটা স্টোররুমকে বাথরুমে রূপান্তরিত করা হয়েছে। শাওয়ার করার চমৎকার ব্যবস্থা আছে।

“পানি নিয়ে হয়তো তোমার সমস্যা হতে পারে,” ভ্যাঙ্গার বললো। “আজ সকালে আমরা চেক করে দেখেছি, পাইপগুলো খুব বেশি মাটির নীচ দিয়ে টানা হয় নি ফলে আরো কিছুদিন ঠাণ্ডা থাকলে হয়তো ভেতরের পানি জমে যেতে পারে। হলওয়েতে একটা বাকেট রাখা আছে, চাইলে ওখান থেকে পানি নিয়ে ব্যবহার করতে পারবে।

“আমার একটা টেলিফোন দরকার,” বললো ব্লমকোভিস্ট।

“আমি ইতিমধ্যে অর্ডার দিয়ে দিয়েছি। আগামী পরশু তারা ইনস্টল করে দিয়ে যাবে। তো, কি ভাবছো তুমি? সিদ্ধান্ত বদলালে মেইন হাউজে এসেও থাকতে পারো যেকোনো সময়।

“এখানেই ভালো থাকবো,” ব্লমকোভিস্ট বললো।

“বেশ। দিনের আলো আর মাত্র এক ঘণ্টার মতো বাকি আছে। তুমি কি আমার সাথে একটু বাইরে হেটে আসবে? মানে গ্রামটার সাথে পরিচিত হবার জন্যে বলছি। আমি কি তোমাকে মোটা মোজা আর ভারি বুট পরতে বলতে পারি? সামনের দরজায় ওগুলো পাবে তুমি।

ব্লমকোভিস্ট তাই করলো।

.

ব্লমকোভিস্টকে নিয়ে বৃদ্ধ বের হলো ঘুরতে। প্রথমেই তাকে জানালো তার খুব কাছে থাকে গুনার নিলসন নামের এক লোক। যাকে একটু আগে ভ্যাঙ্গার কেয়ারটেকার বলেছে। তবে ব্লমকোভিস্ট বুঝতে পারলো লোকটা হেডেবি আইল্যান্ডের সব ভবনের একজন সুপারিন্টেডেন্টের মতো।

“তার বাবা ম্যাঙ্গাস নিলসন, সে ষাট দশকের দিকে আমার কেয়ারটেকার ছিলো। বৃজের ঐ দুর্ঘটনায় সেও আমাকে বেশ সাহায্য করেছিলো তখন। ম্যাঙ্গাস এখন অবসরে আছে, হেডেস্টাডেই থাকে। গুনার এখানে থাকে তার বউ হেলেনাকে নিয়ে। তাদের ছেলেমেয়েদের অন্যখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।”

একটু থেমে ভ্যাঙ্গার কিছুটা সময় ভেবে বললো : “মিকাইল, তোমার এখানে থাকার অফিশিয়াল ব্যাখ্যাটা হলো তুমি আমাকে আমার আত্মজীবনি লেখার কাজে সাহায্য করতে এসেছো। এতে করে সবখানে গিয়ে সব ধরণের ব্যাপারে প্রশ্ন করা, নানান জায়গায় চুঁ মারা তোমার জন্য সহজ হয়ে যাবে। আসল অ্যাসাইনমেন্টটা শুধুমাত্র তুমি, আমি আর ডার্চ ফ্রোডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।”

“বুঝতে পেরেছি। আগেও বলেছি, এখনও বলছি কথাটা : আমার মনে হয় না আমি এই রহস্যটার সমাধান করতে পারবো।”

“আমি শুধু তোমার সেরা প্রচেষ্টাটা চাই। তবে অন্য লোকজনের সামনে একটু সতর্ক থাকতে হবে। একটা প্রশ্নের কোনো জবাব আমি কখনও পাই নি-হ্যারিয়েট এবং গুনার খুব ভালো বন্ধু ছিলো। আমার মনে হয় তাদের মধ্যে শিশুতোষ রোমান্স চলছিলো ঐ সময়টাতে। গুনার তার ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলো। তবে হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হবার দিন সে হেডেস্টাডে ছিলো না। সে ছিলো মেইনল্যান্ডের কোথাও। তাদের মধ্যেকার সম্পর্কের কারণে তাকে খুব কড়াভাবে জেরা করা হয়। তার ব্যাপারে ভালোমতো খোঁজখবরও নেয়া হয়। ব্যাপারটা তার জন্য একেবারেই অপ্রীতিকর ছিলো। সারাদিন বন্ধুবান্ধব নিয়ে ছিলো সে, রাতের আগে এখানে ফিরে আসে নি সে। পুলিশ তার বন্ধুবান্ধবদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে নিশ্চিত হয়েছে তার কথাই ঠিক।”

“মনে হচ্ছে ঐ দিন এই আইল্যান্ডে কে কি করেছে, কোথায় ছিলো সবই আপনার জানা আছে।”

“ঠিক। আমরা কি আরেকটু সামনে এগোতে পারি?”

পাহাড়ের উপরে চার রাস্তার এক মোড়ে এসে পড়লো তারা। নীচে পুরনো ফিশিং হার্বারের দিকটা দেখালো ভ্যাঙ্গার, এখন সেটা ছোটো ছোটো নৌকা রাখার জেটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

“হেডেবি আইল্যান্ডের সব জায়গা-জমি ভ্যাঙ্গার পরিবারের সম্পত্তি-অথবা ঠিক করে বলতে গেলে আমার নিজেরই বলতে পারো। কেবলমাত্র ওস্টারগার্ডেনের ফার্ম আর সেখানকার গ্রামের কিছু বাড়িঘর বাদে। ফিশিং হার্বারের ওখানে যে কেবিনগুলো আছে সেগুলো সামার কটেজ, শীতকালে একেবারে খালি পড়ে থাকে। শুধুমাত্র দূরের ঐ বাড়িটা বাদে-চিমনি থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখছো যেটা সেটা।”

ব্লমকোভিস্ট সেটা দেখতে পেলো। ঠাণ্ডায় তার হাড়ে কাঁপন ধরে যাচ্ছে।

“ওখানে থাকে ইউজিন নরম্যান। তার বয়স সত্তুরের উপরে হবে, সে একজন পেইন্টার। আমার কাছে মনে হয় তার তেমন একটা প্রতিভা নেই তবে ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টার হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে। তুমি তাকে এই গ্রামের উদ্ভট একা দায় হিসেবে বিবেচনা করতে পারো।”

ভ্যাঙ্গার আরো কিছু বাড়িঘর দেখালো। গ্রামটার যে রাস্তা আছে সেটার পশ্চিম দিকে ছয়টি আর পূর্ব দিকে রয়েছে চারটা বাড়ি। ব্লমকোভিস্টের গেস্টহাউজের খুব কাছে যেটা আছে সেটা ভ্যাঙ্গারের ভাই হেরাল্ডের বাড়ি। দোতলার একটি পাথরের বাড়ি, প্রথম দেখাতে মনে হবে পরিত্যাক্ত। তবে ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে দরজার সামনে জমে থাকা তুষারে মানুষের পায়ের ছাপ আছে।

“হেরাল্ড নিঃসঙ্গতা ভালোবাসে। আমার সাথে তার খুব একটা দেখা হয় না, দেখা হলেও চোখে চোখ রেখে কথা বলে না সে, শুধুমাত্র ফার্মে তার শেয়ার নিয়ে একটা বচসার সময়টা বাদে। ষাট বছর ধরে আমাদের মধ্যে খুব একটা কথাবার্তা হয় নি বললেই চলে। তার বয়স এখন বিরানব্বই। সে-ই হলো আমার একমাত্র ভাই যে এখনও বেঁচে আছে। বিস্তারিত সব পরে বলবো তোমাকে। তবে সে একজন মেডিক্যাল ডক্টর, উপসালায় প্র্যাকটিস করেই জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছে। সত্তুর বছর বয়সে হেডেবিতে ফিরে আসে সে।”

“আপনারা প্রতিবেশী হলেও কেউ কারোর সাথে যোগাযোগ রাখেন না।’ “তাকে আমি পছন্দ করি না। আমি চাইতাম সে উপসালায় থাকুক। কিন্তু ঐ বাড়িটা তার নিজের। আমার কথা শুনে কি আমাকে একজন স্কাউড্রেল মনে হচ্ছে?”

“আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি আপনার ভাইকে পছন্দ করেন না।”

“আমি আমার জীবনের প্রথম পঁচিশ বছর শুধু হেরাল্ডের মতো মানুষের জন্য লোকজনের কাছে ছোটো হয়ে থেকেছি কারণ সে আমার পরিবারের সদস্য। এরপরই আমি বুঝতে পারলাম এতো কিছু করেও আমি তাদের কাছ থেকে ভালোবাসা পাবো না, আর হেরাল্ডের পক্ষে সাফাই গাওয়ার মতো সঙ্গত কোনো কারণও নেই।

পরের বাড়িটা হ্যারিয়েটের মা ইসাবেলার।

“এ বছর তার বয়স হবে পচাত্তর। এখনও সে আগের মতোই স্টাইলিস আর অকর্মা রয়ে গেছে। এই গ্রামে সে-ই একমাত্র ব্যক্তি যে কিনা হেরাল্ডের সাথে কথা বলে এবং মাঝেমধ্যে তার ওখানে যায়। তবে তাদের মধ্যে খুব বেশি মিলও নেই।”

“তাদের সাথে হ্যারিয়েটের সম্পর্ক কেমন ছিলো?”

“ভালো প্রশ্ন। মহিলাদেরকেও সন্দেহের মধ্যে রাখতে হবে। তোমাকে তো আগেই বলেছি সে নিজের সন্তানদেরকে খুব একটা দেখাশোনা করতো না। আমি নিশ্চিত নই তবে আমার মনে হয় তার মন মানসিকতায় কোনো সমস্যা নেই। শুধুমাত্র দায়িত্বজ্ঞানহীন একজন মহিলা বলতে পারো তাকে। হ্যারিয়েটের সাথে তার খুব একটা ঘনিষ্ঠতা ছিলো না। তবে তারা একে অন্যের শত্রুও ছিলো না। ইসাবেলা টাফ হতে পারে কিন্তু কখনও কখনও সে বেখেয়ালি হয়ে যায়। তার সঙ্গে যখন দেখা করবে তখন আমার কথাটা বুঝতে পারবে।’

ইসাবেলার পাশেই থাকে হেরাল্ডের মেয়ে সিসিলিয়া।

“বিয়ে করে সে হেডেস্টাডেই থাকতে শুরু করে তবে বিশ বছর আগে স্বামীর সাথে সেপারেশন হয়ে গেছে। বাড়িটা আমার তবে তাকে ওখানে থাকতে দিয়েছি। সে একজন শিক্ষক। অনেক দিক থেকেই সে তার নিজের বাবার ঠিক বিপরীত। দরকার না পড়লে তার বাবার সাথে তার কোনো কথাবার্তা হয় না বললেই চলে।”

“তার বয়স কতো?”

“১৯৪৬ সালে জন্মেছে। হ্যারিয়েট যখন নিখোঁজ হয় তখন তার বয়স ছিলো বিশ। ঐ দিন আমাদের এখানে যেসব গেস্ট এসেছিলো তার মধ্যে সেও ছিলো। তোমাকে আরেকটা কথা বলতে পারি, আমার আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে তার ব্যাপারে আমি সবচাইতে ভালো ধারণা পোষণ করি।”

“তার মানে কি আপনি তাকে সন্দেহ করেন না?”

“আমি সেটা বলি নি। আমি চাই তুমি তোমার মতো করে পুরো ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখবে। আমি কি ভাবলাম না ভাবলাম সেটটা নিয়ে মাথা ঘামাবে না।”

সিসিলিয়ার খুব কাছে যে বাড়িটা আছে সেটাও হেনরিক ভ্যাঙ্গারের সম্পত্তি। তবে সেটা ভ্যাঙ্গার কোম্পানির সাবেক এক কর্মকর্তার কাছে লিজ দেয়া হয়েছে, ভদ্রলোক সস্ত্রীক ওখানে থাকে। আশির দশকে তারা এখানে এসে থাকতে শুরু করে সুতরাং হ্যারিয়েটের ঘটনার সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। পরের বাড়িটা সিসিলিয়ার ভাই বার্গার ভ্যাঙ্গারের বাড়ি। ওটা এখন পরিত্যাক্তই বললা যায় কেন না বার্গার অনেক দিন আগেই হেডেস্টাডের আধুনিক একটা বাড়িতে উঠে গেছে।

রাস্তার পাশে সারিবদ্ধ বাড়িগুলোর বেশিরভাগই বিংশর শতাব্দীর তৈরি করা পাথরের বাড়িঘর। শেষের বাড়িটা একটু অন্য ধরণের। আধুনিক স্থাপত্যরীতিতে সাদা রঙের ইট দিয়ে বাড়িটা তৈরি করা হয়েছে, জানালার ফ্রেমগুলো কালো রঙের। খুবই সুন্দর দেখতে। ব্লমকোভিস্ট দেখতে পেলো টপ ফ্লোরটা আরো বেশি মনোমুগ্ধকর। বাড়ির সম্মুখভাগ সাগরের দিকে।

“ওখানেই হ্যারিয়েটের ভাই এবং বর্তমানে ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশনের সিইও মার্টিন থাকে। ওরা এখানেই থাকতো কিন্তু সত্তুর দশকে আগুন লেগে ভবনটি ধ্বংস হয়ে গেলে মার্টিন ১৯৭৮ সালে এটি নির্মাণ করে। ঐ সময়ই সে সিইও হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়েছিলো।”

রাস্তার পূর্ব দিকের শেষ বাড়িতে থাকে গার্দা ভ্যাঙ্গার আর তার ছেলে আলেকজান্ডার। হেনরিকের ভাই গ্রেগরের বিধবা স্ত্রী সে।

“গার্দা অসুস্থ থাকে সব সময়। রিউমেটিক রোগে ভুগছে। ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশনে আলেকজান্ডারের অল্প কিছু শেয়ার আছে। তবে তার নিজেরও কিছু ব্যবসা রয়েছে, তার মধ্যে আছে রেস্তোরাঁ ব্যবসা। প্রতিবছর কয়েক মাস সে বার্বাডোজে কাটায়। ওখানে পর্যটন ব্যবসায় বেশ ভালো বিনিয়োগ করেছে।”

গার্দা আর হেনরিকের বাড়ির মাঝখানে ছোটো ছোটো দুটো বাড়ির একটি প্লট আছে, দুটোই খালি। এগুলো পরিবারের অতিথিদের জন্য ব্যবহার করা হয়। হেনরিকের বাড়ির অন্যপাশে আরেকটা বাড়ি আছে, সেখানে থাকে আরেকজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারি। তবে সেই লোক সস্ত্রীক স্পেনে গেছে বলে বাড়িটা খালি আছে।

রাস্তার মোড়ে এসে পড়লে তাদের টুরের পরিসমাপ্তি ঘটলো। সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। ব্লমকোভিস্টই প্রথম বললো।

“হেনরিক, আমাকে যেজন্যে ভাড়া করা হয়েছে সেটা আমি করবো। আমি আপনার জীবনীটা লিখবো, হ্যারিয়েট সম্পর্কে আপনার কাছে থাকা সবগুলো জিনিসই খতিয়ে দেখবো। তবে আমি চাই আপনি এই সত্যটা জেনে রাখুন, আমি কোনো প্রাইভেট ডিটেক্টিভ নই।

“আমি তোমার কাছ থেকে কিছুই প্রত্যাশা করছি না।”

“বেশ।”

“আমি রাতের পেঁচা,” বললো ভ্যাঙ্গার। “সুতরাং লাঞ্চের পর আমি যেকোনো সময় তোমার কাছে আসতে পারবো। আমি তোমার জন্য ওখানে একটা অফিস করার ব্যবস্থা করছি। যখন খুশি তখনই ওটা ব্যবহার করতে পারবে তুমি।”

“না, ধন্যবাদ। গেস্টহাউজেই আমার একটা অফিস আছে। ওখানেই কাজ করবো।”

“তোমার যেমন খুশি।”

“আমার যদি তোমার সাথে কথা বলার দরকার পড়ে তাহলে তোমার অফিসে চলে যাবো। তবে আজরাতে তোমাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করা কোনো ইচ্ছে আমার নেই।“

“বুঝতে পেরেছি।” মনে হলো বৃদ্ধ অবিশ্বাস্যরকম ভড়কে গেলো। “সবগুলো কাগজ পড়তে কয়েক সপ্তাহ লেগে যাবে। আমরা দুটো ফ্রন্টে কাজ করবো। প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টার জন্য আমরা দেখা করবো যাতে করে আপনার ইন্টারভিউ নেয়া যায়, আপনার জীবনীর জন্য ম্যাটেরিয়াল জোগার করা যায়। হ্যারিয়েটের সম্পর্কে কখন প্রশ্ন করা শুরু করবো সেটা আমি আপনাকে আগেই বলে দেবো।

“খুবই সুবিবেচকের মতো কথা বলেছো।”

“আমার কাজের জন্য একেবারে ফ্রি হ্যান্ড থাকতে হবে, কাজের জন্য কোনো সময়সূচী রাখবো না।”

“কিভাবে কাজ করবে সেটা তুমি নিজেই ঠিক করে নেবে।”

“আমার মনে হয় আপনি জানেন আমাকে কয়েকটা মাস জেলে কাটাতে হবে। সেটা ঠিক কখন আমি জানি না। তবে আমি কোনো আপিল করবো না। সেটা এই বছরের যেকোনো সময়ে হতে পারে।”

ভ্যাঙ্গার ভুরু তুললো। “খুবই দুঃখের কথা। যখন পারবে তখনই সমস্যাটা সমাধান করবে। আর যেকোনো সময় তুমি এটা বাদ দিয়ে দেবার অনুরোধও করতে পারো।”

“যদি অনুমতি পাওয়া যায় আর পর্যপ্ত ম্যাটেলিয়াল হাতে থাকে তাহলে আমি জেলে বসে আপনার জীবনী লেখার কাজটা করতে চাইবো। আরেকটা জিনিস আছে : আমি এখনও মিলেনিয়াম-এর অংশীদার। পত্রিকাটি বর্তমানে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমাকে যদি পত্রিকার প্রয়োজন পড়ে তাহলে কাজ স্থগিত করে স্টকহোমে যেতে হবে।”

“এতে কোনো সমস্যা হবে না। আমি তোমাকে কাজটা দিয়ে দিয়েছি। তুমি নিজের মতো করেই সময়-সূচী নির্ধারণ করতে পারবে। যদি কাজ থেকে কিছু দিনের বিশ্রাম নেবার দরকার পড়ে সেটাও করতে পারবে। তবে আমি যদি দেখতে পাই তুমি কাজটা করছো না তাহলে আমি ধরে নেবো চুক্তির বরখেলাপ করছো।”

বৃজের দিকে তাকালো ভ্যাঙ্গার। রোগাপাতলা একজন লোক সে। এই মুহূর্তে ব্লমকোভিস্টের কাছে মনে হলো সে কোনো বিষন্ন কাকতাড়ুয়ার দিকে চেয়ে আছে।

“মিলেনিয়াম-এর ব্যাপারে আমাদেরকে আলোচনা করে নিতে হবে কি ধরণের সংকটের মধ্য দিয়ে পত্রিকাটি যাচ্ছে, আর আমি কিভাবে এ কাজে সাহায্য করতে পারি

“আপনি ওয়েনারস্ট্রমের মাথাটা একটা প্লেটে করে এখন আমার হাতে তুলে দিলেই সবচাইতে বড় সাহায্য হবে।”

“ওহ্ না। সেটা করার কথা ভাবছি না আমি।” ব্লমকোভিস্টের দিকে শক্ত চোখে তাকালো বৃদ্ধ। “এ কাজটা তুমি একটা মাত্র কারণেই গ্রহণ করেছো আর সেটা হলো ওয়েনারস্ট্রমের জোচ্চুরি আমি ফাঁস করে দেবো। সেটা যদি আমি এখনই করি তাহলে তুমি তোমার কাজ বন্ধ করে দেবে। এই তথ্যটা আমি তোমাকে এক বছর পর দেবো।”

“হেনরিক, কথাটা বলার জন্য ক্ষমা করবেন আমাকে, কিন্তু আমি নিশ্চিত হতে পারছি না আপনি এক বছর বেঁচে থাকবেন কিনা।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভ্যাঙ্গার চিন্তিতভাবে ফিশিং হার্বারের দিকে তাকালো।

“তা অবশ্য ঠিক বলেছো। আমি ফ্রোডিকে বলবো একটা উপায় বের করার জন্য। তবে মিলেনিয়াম-এর ব্যাপারে আমি অন্যভাবেও সাহায্য করতে পারি। জানি তোমাদের বিজ্ঞাপন অনেক কমে গেছে।”

“বিজ্ঞাপনের ব্যাপারটা এ মুহূর্তের সমস্যা কিন্তু আসল সংকটটা আরো গভীরে। এটা আস্থার ব্যাপার। পত্রিকাটি যদি কোনো পাঠক না কেনে তাহলে কি পরিমাণ বিজ্ঞাপন পেলাম না পেলাম তাতে কিছু যায় আসে না।’

“বুঝতে পারছি। এখনও আমি বিশাল একটি কর্পোরেশনের বোর্ড মেম্বার। যদিও আমি খুব একটা নাক গলাই না। তবে আমাদেরকে তো কোথাও না কোথাও বিজ্ঞাপন দিতেই হয়। এ নিয়ে এক সময় কথা বলা যাবে। এখন কি তুমি ডিনার করবে…?”

“না। আমি একটু জিনিসপত্র কেনাকাটা করবো। চারপাশটাও ঘুরে দেখতে চাই। আগামীকাল আমি হেডেস্টাডে যাবো শীতের কাপড় কেনার জন্য।”

“বেশ, ভালো কথা।”

“আমি চাই হ্যারিয়েটের ফাইলটা আমার কাছে দিয়ে দেয়া হোক।”

“বেশ…”

“সাবধানে রাখতে হবে-জানি।”

ব্লমকোভিস্ট গেস্টহাউজে ফিরে এলো। বাইরে পা বাড়াতেই দাঁতে দাঁত ঠোকাঠোকি হতে শুরু করলো তার। বাইরের জানালার থার্মোমিটার বলছে তাপমাত্রা ৫ ডিগ্‌ ফারেনহাইট।

নিজের ঘরে এসে একটু থিতু হলো সে। এটাই হবে আগামী এক বছরের জন্য তার বাড়ি। শোবার ঘরের ওয়ারড্রবে কাপড়চোপড় রেখে দিলো ব্লমকোভিস্ট। তার দ্বিতীয় সুটকেসটা চাকাওয়ালা ট্রাঙ্ক বিশেষ। ওটা থেকে কিছু বই, সিডি, সিডি প্লেয়ার, নোটবুক, একটা টেপ রেকর্ডার, একটা মাইক্রোটেক স্ক্যানার, বহনযোগ্য প্রিন্টার, একটা মিনোল্টা ডিজিটাল ক্যামেরা আর এক বছরের নির্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় যেসব জিনিসপত্র লাগবে সেগুলো রের করলো সে।

অফিস হিসেবে ব্যবহার করবে যে ঘরটা সেখানকার বুক শেলফে বই আর সিডিগুলো রেখে দিলো। তার পাশে দুটো বাইন্ডিং করা ফাইল। হান্স-এরিক ওয়েনারস্ট্রমের উপর রিসার্চের ম্যাটেরিয়াল। এগুলো এখন কোনো কাজে লাগবে না তারপরেও সে এগুলো ফেলে দেবার পক্ষপাতি নয়। এই দুটো ফাইলকে নিজের ক্যারিয়ার অব্যাহত রাখার কাজে ব্যবহার করতে হবে।

কাধের ব্যাগ থেকে তার প্রিয় আই-বুকটা বের করে অফিসের ডেস্কের উপর রাখলো ব্লমকোভিস্ট। তারপরই বুঝতে পারলো নিজের ভুলটা। এই গেস্টহাউজে থাকার সুবিধাটা হাড়ে হাড়ে টের পেলো এখন। ব্রডব্র্যান্ড ইন্টারনেট কানেকশানের কোনো ব্যবস্থা এখানে নেই। পুরনো ডায়াল-আপ কানেকশান যে নেবে তারও কোনো উপায় নেই। এখানে এখন পর্যন্ত টেলিফোন সংযোগ দেয়া হয় নি।

ব্লমকোভিস্ট তার মোবাইল ফোনে টেলিয়া টেলিফোন কোম্পানিতে ফোন করে জেনে নিলো ভ্যাঙ্গারের অর্ডার দেয়া সংযোগটি কতোদিনে পাওয়া যাবে। তারা জানালো কয়েক দিনের মধ্যে সেটা সম্ভব হবে।

.

৪টার পরই ব্লমকোভিস্ট প্রস্তত হয়ে গেলো। মোটা মোজা, পায়ে বুট আর গায়ে একটা উলের সোয়েটার পরে নিলো সে। ফ্রন্টডোরের নামনে এসে একটু সময়ের জন্য থামলো। এই বাড়ির কোনো চাবি তাকে দেয়া হয় নি। শহুরে মানুষ হিসেবে নিজের ঘরের দরজা আনলক করে যাওয়াটা তার কাছে অসম্ভব একটি কাজ বলে মনে হলো। রান্নাঘরে ফিরে গিয়ে ড্রয়ারে চাবি খুঁজতে লাগলো সে। অবশেষে চাবিটা পেয়ে গেলো ওখানে।

তাপমাত্রা ১ ডিগ্‌তে নেমে গেছে। বৃজ অতিক্রম করে চার্চটাও পেরিয়ে গেলো সে। তিনশ’ গজ দূরেই একটা স্টোর আছে, ওখান থেকে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে বাড়িতে রেখে আবারো পা বাড়ালো বৃজের দিকে। এবার সুসান্স বৃজ ক্যাফে’তে থামলো। কাউন্টারের পেছনে যে মহিলা আছে তার বয়স পঞ্চাশের মতো হবে। মহিলাকে জিজ্ঞেস করলো সে-ই কি সুসান নাকি, তারপর এটাও জানিয়ে দিলো এখন থেকে এখানে নিয়মিত আসবে সে। এ মুহূর্তে অবশ্য ক্যাফের একমাত্র কাস্টমার রমকোভিস্ট। স্যান্ডউইচ, রুটি আর কফির অর্ডার দিলো। নিউজ র‍্যাক থেকে এক কপি হেডেস্টাড কুরিয়ার তুলে নিয়ে এমন একটা জায়গায় বসলো যেখান থেকে বৃজ আর চার্চটা দেখা যায়। চার্চের প্রাঙ্গন আলোকিত হয়ে আছে, দেখতে একেবারে ক্রিসমাসের কার্ড বলে মনে হচ্ছে। মাত্র চার মিনিট লাগলো পত্রিকাটা পড়ে ফেলতে। একমাত্র আগ্রহের খবর হলো বার্গার ভ্যাঙ্গার নামের স্থানীয় এক রাজনীতিবিদ হেডেস্টাডে আইটি টেক-সেন্টার স্থাপনের জন্য বিরাট অঙ্কের বিনিয়োগ করার ঘোষণা দিয়েছে। ৬টা বাজে ক্যাফেটা বন্ধ হবার আগ পর্যন্ত মিকাইল সেখানে বসে রইলো।

৭:৩০-এ বার্গারকে ফোন করলেও পেলো না। এই নাম্বারটি এখন বন্ধ আছে বলে জানানো হলো তাকে। রান্নাঘরের বেঞ্চে বসে একটা উপন্যাস পড়ার চেষ্টা করলো, বইয়ের পেছনের মলাটের ভাষ্যমতে এক টিনএজ নারীবাদীর প্রথম উপন্যাস এটি। লেখিকার প্যারিস সফরের সময় যৌনজীবনের কাহিনী হলো বইটির মূল বিষয়। ভাবতে লাগলো সে যদি হাইস্কুল পড়ুয়াদের মতো করে নিজের যৌন জীবন নিয়ে একটা বই লেখে তাহলে তাকে নারীবাদী বলা হবে কিনা। সম্ভবত না। প্রকাশকের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনে বইটি কিনেছিলো, তবে কিছুটা পড়ার পর তার কাছে মনে হলো এটা পড়ার যোগ্য নয়। বইটা রেখে মধ্য পঞ্চাশের রেকর্ডম্যাগাজিনেট পত্রিকার এক সংখ্যায় ছাপানো হোপালঙ্গ কাসিডির একটি গল্প পড়তে শুরু করলো সে।

আধ ঘণ্টা পর পর চার্চের মৃদু শব্দে বেজে ওঠা ঘণ্টাধ্বণি শুনতে পেলো ব্লমকোভিস্ট। রাস্তার ওপাশে কেয়ারটেকারের বাড়ির জানালা দিয়ে আলো জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। তবে ব্লমকোভিস্ট বাড়ির কোনো লোকজনকে দেখতে পেলো না। হেরাল্ড ভ্যাঙ্গারের বাড়িটা অন্ধকার। ৯টার দিকে একটা গাড়ি বৃজ দিয়ে চলে এসে উধাও হয়ে গেলো অন্ধকারে। মাঝরাতে চার্চের প্রাঙ্গনের সমস্ত আলো নিভিয়ে দেয়া হলে হেডেবির চারপাশের পরিবেশ একেবারে ভৌতিক হয়ে গেলো মুহূর্তে।

আবারো বার্গারকে ফোন করার চেষ্টা করলো সে তবে এবার পেলো শুধু তার একটি ভয়েসমেইল। তাকে একটা মেসেজ রেখে যেতে বলা হলে বার্গারের জন্য একটা মেসেজ রেখে বাতি বন্ধ করে বিছানায় চলে গেলো সে। ঘুমিয়ে পড়ার আগে তার শেষ চিন্তাটা ছিলো হেডেবিতে এসে কোনো ঝুঁকি নিচ্ছে না তো।

পুরোপুরি নিস্তব্ধতার মধ্যে জেগে ওঠাটা অদ্ভুত ব্যাপারই। গভীর ঘুম থেকে মুহূর্তেই সজাগ হয়ে উঠলো ব্লমকোভিস্ট। চুপচাপ শুনে গেলো সে। ঘরটা বেশ ঠাণ্ডা হয়ে আছে। বিছানার পাশে একটা টুলের উপর রাখা তার হাতঘড়িটার দিকে তাকালো। ৭:৮ মিনিট-এতো সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস তার নেই। তার উপর দু’দুবার অ্যালার্ম না শুনলে তার ঘুম খুব সহজে ভাঙে না। কিন্তু আজ সে এমনিতেই উঠে গেছে। তার মনে হচ্ছে অনেক বিশ্রাম নিয়েছে সে।

শাওয়ার নেবার আগে কফি বানানোর জন্য কিছু পানি গরম করতে দিলো সে। নিজের এই পরিস্থিতির কথা মনে করে আচমকাই সে মজা পেলো। কাল ব্লমকোভিস্ট-এক রিসার্চ ট্রিপে মফশ্বলে গেছে।

শাওয়ার করে এসে দেখে রান্নাঘরের টেবিলে কোনো পত্রিকা নেই। মাখনগুলো ঠাণ্ডায় জমে শক্ত হয়ে আছে। রান্নাঘরের ড্রয়ারে পনির কাটার জন্য কোনো চাকুও খুঁজে পেলো না। বাইরে এখনও গাঢ় অন্ধকার। থার্মোমিটার বলছে মাইনাস ৬ ডিগ্‌। আজ শনিবার।

হেডেস্টাডের বাসস্টপটি কনসাম নামক একটি এলাকায় অবস্থিত। শহরে একটু কেনাকাটা করার মাধ্যমে নিজের নির্বাসন জীবন শুরু করলো ব্লমকোভিস্ট। রেলস্টেশনের কাছে বাস থেকে নেমে শহরের কেন্দ্রে ঘুরে বেড়ালো সে। ঘোরাঘুরি করার সময়ই ভারি চামড়ার বুট, দুই জোড়া লম্বা আন্ডারওয়্যার, কয়েকটি ফ্লানেল শার্ট, শীতের জ্যাকেট, একটা উলের টুপি আর হাতমোজা কিনে নিলো। এক ইলেক্ট্রনিক দোকান থেকে বহনযোগ্য একটি টিভিও কিনলো সে। দোকানি তাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বললো যে অন্তত সরকারী টিভি চ্যানেলটি দেখতে পাবে। তবে সেটাও যদি না দেখতে পারে তাহলে টিভিটা ফেরত দিয়ে যাবে বলে জানালো ব্লমকোভিস্ট।

একটা বইয়ের লাইব্রেরিতে গিয়ে কার্ড করিয়ে নিয়ে এলিজাবেথ জর্জের দুটো রহস্য উপন্যাস ধার করলো সে। কলম আর নোটবুকও কিনলো। সেইসঙ্গে এইমাত্র কেনা সব জিনিসপত্রের জন্য একটা ব্যাগও কিনে নিলো সেগুলো বহন করার জন্য।

দশ বছর আগে সিগারেট ছেড়ে দিলেও এক প্যাকেট সিগারেট কিনে নিলো। শেষে একটা চশমার দোকানে গিয়ে কনট্যাক্ট লেন্স আর সলিউশন কিনে নতুন আরেক জোড়া লেন্সের অর্ডার দিয়ে দিলো মিকাইল।

দুটোর মধ্যে ফিরে এলো হেডেবি’তে। নতুন কেনা জামাকাপড় থেকে প্রাইস ট্যাগগুলো যখন খুলছে তখনই দরজা খোলার শব্দ পেলো। সোনালি চুলের এক মহিলা-সম্ভবত পঞ্চাশের কোঠায় তার বয়স-রান্নাঘরের খোলা দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকে পড়লো মহিলা। একটা প্লেটে করে স্পঞ্জ কেক নিয়ে এসেছে সে।

“হ্যালো। আপনার সাথে পরিচিত হতে এসেছি। আমার নাম হেলেনা নিলসন। রাস্তার ওপারে থাকি। শুনলাম আপনি আমাদের প্রতিবেশী হতে যাচ্ছেন।”

তারা করমর্দন করার পর নিজের পরিচয় দিলো ব্লমকোভিস্ট।

“ওহ্ হ্যা, আপনাকে টিভি’তে দেখেছি। রাতের বেলায় এখানে আলো জ্বলতে দেখলে ভালোই লাগবে।”

মহিলার জন্য কফি বানাতে গেলে মৃদু বাধা দিলেও রান্নাঘরের টেবিলে বসে চোরা চোখে জানালার দিকে তাকালো সে।

“আমার স্বামীকে নিয়ে হেনরিক আসছে। মনে হচ্ছে আপনার জন্য কিছু বাক্স নিয়ে এসেছে।”

ভ্যাঙ্গার আর গুনার নিলসন একটা ডলি নিয়ে তার বাড়ির সামনে আসতেই ব্লমকোভিস্ট এগিয়ে গিয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে চারটা বাক্স বহন করতে সাহায্য করলো। স্টোভের পাশে তারা বাক্সগুলো রেখে দিলে তাদের সবার জন্য কফি আর ফ্রোকেন নিলসনের আনা স্পঞ্জ কেক পরিবেশন করলো ব্লমকোভিস্ট।

নিলসনরা বেশ ভালো। ব্লমকোভিস্ট কেন এখানে এসে থাকবে সে ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করলো না তারা। যেনো এ নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। সে যে হেনরিক ভ্যাঙ্গারের হয়ে কাজ করছে এটাই তাদের জন্য যথেষ্ট। ভ্যাঙ্গার আর নিলসন অনেক গল্পসল্প করলো। শেষে ব্লমকোভিস্টের নতুন কেনা টিভির দিকে চোখ কুচকে তাকিয়ে তাকে বললো সে যেনো ভালো কোনো প্রোগ্রাম দেখতে চাইলে তাদের বাসায় এসে দেখে।

নিলসন চলে যাবার পরও ভ্যাঙ্গার কিছুক্ষণ থাকলো। সে জানালো ব্লমকোভিস্ট নিজে নিজেই যেনো সব ফাইল গোছগাছ করে নেয়, সেটাই ভালো হবে তার জন্য। আর কোনো সমস্যায় পড়লে সে যেনো অবশ্যই তার বাড়িতে চলে আসে।

সবাই চলে গেলে ব্লমকোভিস্ট বাক্সগুলো খুলে দেখে নিলো ভেতরে কি কি আছে।

*

ভ্যাঙ্গারের ভায়ের মেয়ের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর ছত্রিশ বছর কেটে গেছে। ব্লমকোভিস্ট ভেবে পেলো না এতোগুলো বছর পর এ ব্যাপারটা নিয়ে তদন্ত করতে যাওয়াটা কি বুড়োর বাতিকগ্রস্ততা নাকি এই দীর্ঘ সময়ে ব্যাপারটা এক ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক খেলায় পরিণত হয়েছে। তবে এটা স্পষ্ট যে বুড়ো একজন শৌখিন আর্কিওলজিস্টের মতো এই তদন্তের ব্যাপারটি বেশ সিস্টেমেটিকভাবেই এগিয়ে নিয়ে গেছে এতোগুলো বছর ধরে। কেসের উপর তার জোগার করা ফাইলগুলো বিশ ফিট লম্বা শেলফ ভরিয়ে তুললো।

সবচাইতে বড় যে ফাইলগুলো আছে তা ছাব্বিশটি বাইন্ডিং করা ফাইল। সবটাই পুলিশের ইনভেস্টিগেশনের কপি। একজন সাধারণ ব্যক্তির নিখোঁজ

হওয়ার কেসে এতো ব্যাপক সংখ্যক কাগজপত্র থাকাটা অবিশ্বাস্যই বটে। হেডেস্টাড পুলিশ ডিপার্টমেন্টে যে ভ্যাঙ্গারের অনেক প্রভাব আছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

আরো আছে অনেকগুলো স্ক্র্যাপবুক, ছবির অ্যালবাম, ম্যাপ, হেডেস্টাডের উপর বইপত্র, আর্টিকেল, ভ্যাঙ্গার ফার্মের খুঁটিনাটি তথ্য, হ্যারিয়েটের ডায়রি(অবশ্য খুব বেশি পাতা নেই তাতে), তার স্কুলবুক এবং মেডিক্যাল সার্টিফিকেট। তদন্তটির উপর ভ্যাঙ্গারের লগবুকগুলো বেশ বড়-এ ফোর সাইজের কাগজে প্রায় একশ পৃষ্ঠার মতো মোট ষোলোটি ভলিউম। এইসব লগবুকে ভ্যাঙ্গার নিজের হাতে বিশদ বিবরণ, অনুমাণ আর নিজস্ব বিশ্লেষণ তুলে ধরেছে কেসটার ব্যাপারে। পাতা উল্টিয়ে দেখলো ব্লমকোভিস্ট। লেখাগুলোর সাহিত্যমান আছে। তার কাছে মনে হলো আগের অনেক নোটবুক থেকে এগুলো কপি করা হয়েছে। দশটি বাইন্ডিং করা ফাইলে ভ্যাঙ্গার পরিবারের সদস্যদের তথ্য সন্নিবেশিত করা আছে। এগুলো অবশ্য টাইপ করা। সবটাই যেনো ভ্যাঙ্গারের নিজের পরিবারের উপর নিজস্ব ইনভেস্টিগেশন।

৭টার দিকে ফ্রন্টডোর থেকে জোরে জোরে মিউ মিউ শব্দ শুনতে পেলো সে। লালচে রঙের এক বেড়াল উষ্ণতার জন্য তার ঘরে ঢুকে পড়েছে।

“বুদ্ধিমান বেড়াল,” বললো সে।

মিকাইল তার জন্য এক বাটিতে দুধ ঢেলে দিলে তার এই অতিথি সেটা নিমেষে সাবার করে রান্নাঘরের টেবিলের উপর গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো।

১০টার পরে সবগুলো ম্যাটেরিয়াল শেলফে সাজিয়ে রেখে দুটো স্যান্ডউইচ বানিয়ে খেয়ে নিলো ব্লমকোভিস্ট। সারা দিনে সে যথেষ্ট খাবার খায় নি। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো খাবারের ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহই তৈরি হচ্ছে না। এক কাপ কফি পান করার পর একটা সিগারেট ধরালো।

নিজের মোবাইল ফোনটা চেক করে দেখলো। বার্গার তাকে ফোন করে নি। আবারো তাকে ফোন করার চেষ্টা করলো কিন্তু সেই একই ফল। তার ভয়েসমেইলটা মেসেজ রেখে যেতে বলছে।

ব্লমকোভিস্ট প্রথমেই ভ্যাঙ্গারের কাছ থেকে নেয়া হেডেস্টাডের মানচিত্রটি ভালো করে দেখে নিলো। সবগুলো নামই তার মনে আছে, তাই প্রতিটি বাড়িতে কে কে থাকে তাদের নামগুলো লিখে রাখলো সে। ভ্যাঙ্গার পরিবার আর তাদের লোকজনের সংখ্যা এতোটাই বেশি যে কে কার কি হয় সেটা মনে রাখাটা সহজ কোনো কাজ নয়।

মাঝরাতের আগে সোয়েটার আর বুট পরে বৃজের কাছে চলে এলো সে। বৃজটা পার হয়ে রাস্তা দিয়ে হাটার সময় শুনতে পেলো চার্চের ঘণ্টাধ্বনি। পুরনো হার্বারের পানি ঠাণ্ডায় জমে বরফ হতে শুরু করেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে পানির দিকে তাকাতেই চার্চের প্রাঙ্গনে জ্বলে থাকা বাতিগুলো নিভে গেলো। হঠাৎ করেই তার চারপাশটা ডুবে গেলো ঘন অন্ধকারে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আবহাওয়া, রাতের আকাশে অসংখ্য তারার মেলা।

আচমকাই ব্লমকোভিস্টের মনটা বিষন্ন হয়ে উঠলো। এই অ্যাসাইনমেন্টটা কেন যে নিলো সেটা এখনও বুঝে উঠতে পারছে না। বার্গার ঠিকই বলেছিলো : তার এখন স্টকহোমেই থাকা উচিত-তার সাথে উষ্ণ বিছানায় সময় কাটানো আর ওয়েনারস্ট্রমের বিরুদ্ধে নতুন করে লড়াই করার পরিকল্পনা করা দরকার। তবে এটাও তার কাছে যৌক্তিক বলে মনে হয় নি। এ মুহূর্তে পাল্টা স্ট্র্যাটেজি কিভাবে নেবে সে ব্যাপারে তার কোনো ধারণাই নেই।

দিনের বেলা হলে এখনই সে সোজা ভ্যাঙ্গারের বাড়িতে চলে যেতো। অ্যাসাইনমেন্টটা বাতিল করে দিয়ে ফিরে যেতো নিজের বাড়ি। চার্চের পেছন দিকটা একটু উঁচু হওয়াতে সবগুলো বাড়ি তার নজরে পড়লো। হেরাল্ড ভ্যাঙ্গারের বাড়িটা অন্ধকারে ঢেকে থাকলেও সিসিলিয়ার বাড়ি, মার্টিনের ভিলা এবং তার পাশে লিজ দেয়া বাড়ি থেকেও আলো জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। ছোটো নৌকার হার্বারের পাশে যে কেবিনটাতে একজন আর্টিস্ট থাকে সেটাও আলোকিত। ওটার চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। ক্যাফের টপ ফ্লোরেও আলো জ্বলতে দেখলো সে। ব্লমকোভিস্ট ভাবলো সুসান কি ওখানেই থাকে কিনা, আর যদি থাকে তো সে একা থাকে কিনা।

রবিবারের সকালে প্রচণ্ড শব্দের কারণে তার ঘুম ভেঙে গেলে একটু ভড়কে গেলো সে। তবে একটু পরই বুঝতে পারলো চার্চের ঘণ্টা বাজছে। আজ রবিবার, সবাইকে সকালের প্রার্থনার জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে। প্রায় ১১টা বাজে। বেড়ালটার মিউ মিউ আওয়াজ করা আগ পর্যন্ত সে বিছানায়ই শুয়ে রইলো। তারপর বিছানা ছেড়ে বাড়ির বাইরে যেতে দিলো বেড়ালটাকে

দুপুরের মধ্যে গোসল করে নাস্তা করে নিলো সে। হেলেদুলে নিজের অফিসে গিয়ে পুলিশের একটা ইনভেস্টিগেশন ফাইল নিয়ে পড়তে বসে গেলো সেখানে। কিন্তু জানালা দিয়ে বৃজের পাশে সুসান্স ক্যাফের দিকে চোখ যেতেই ফাইলটা কাঁধের ব্যাগে ভরে সোয়েটার পরে বাইরে পা বাড়ালো। ক্যাফে’তে ঢুকেই দেখতে পেলো কাস্টমারে গিজগিজ করছে। তার মনে যে প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছিলো সেটার জবাব পেয়ে গেলো সেখানে : হেডেবির মতো নিরিবিলি একটি এলাকায় এরকম একটি ক্যাফে কি করে টিকে থাকতে পারে? চার্চগামী লোকজন সুসানের বড় ক্রেতা। শেষকৃত্য এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের জন্যেও সে কেক আর কফি বানিয়ে থাকে।

ভেতরে না ঢুকে বাইরে হাটতে লাগলো সে। রবিবার দিন বলে কনসাম নামের স্টোরটা বন্ধ আছে। আরো কয়েকশ’ গজ সামনে এগিয়ে গেলো হেডেস্টাডের অভিমুখে। শহরটার সব কিছু মনে রাখার চেষ্টা করলো সে। চার্চের কাছে এবং কনসামের পরই শহরের কেন্দ্রস্থল বলা যায়। ওখানে অনেকগুলো পুরনো ভবন রয়েছে। শহরের উত্তর দিকে যে সড়কটি চলে গেছে সেখানে কতোগুলো আধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট আছে, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে আনেকগুলো পরিবার বসবাস করে সেখানে। চার্চের দক্ষিণে বয়ে যাওয়া জলরাশির তীর ঘেষে যেসব বাড়ি আছে সেগুলোর বেশিরভাগ ছোটো, একক পরিবার বসবাস করে। হেডেস্টাডের কর্তাব্যক্তি আর সিভিলসার্ভেন্টদের কাছে হেডেবি বসবাসের জন্য বেশ ভালো জায়গা বলেই মনে হচ্ছে।

বৃজের কাছে যখন ফিরে এলো দেখতে পেলো ক্যাফেটা প্রায় খালি, তবে সুসান এখনও টেবিল থেকে ডিশগুলো নিয়ে পরিস্কার করে যাচ্ছে।

“রবিবারে অনেক ভীড় থাকে?” ঢুকতে ঢুকতে বললো সে।

কানের দু’পাশ থেকে চুলগুলো সরিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিলো সুসান। “হাই মিকাইল।”

“আমার নামটা দেখি আপনার মনে আছে।”

“ভোলা সহজ না,” বললো সে। “টিভি’তে আপনার মামলাটা আমি দেখেছি।”

“তাদের উচিত ছিলো অন্য কিছু দিয়ে সংবাদ ভরিয়ে রাখা,” বিড়বিড় করে বলে একটা কর্নার টেবিলে বসে পড়লো সে। ওখান থেকে বৃজটা দেখা যায়। সুসানের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই হেসে ফেললো।

৩টার দিকে সুসান জানালো আজকের দিনের মতো ক্যাফেটা বন্ধ করে দেবে। চার্চের সময়টা বাদে রবিবার খুব বেশি কাস্টমার আসে না। ওখানে বসে বসে ব্লমকোভিস্ট পুলিশ ফাইলের এক পঞ্চমাংশ পড়ে ফেললো। ফাইলটা ব্যাগে ভরে নিয়ে বৃজটা পার হয়ে চলে এলো নিজের ঘরে।

দরজার কাছে সিঁড়ির ধাপে বেড়ালটা তার জন্য অপেক্ষা করছে। চারপাশে তাকিয়ে দেখে ভাবলো, এটা কার বেড়াল হতে পারে। বাড়ির ভেতর ওটাকে ঢুকতে দিলো। হাজারহোক এই বেড়ালটা তো তার এক ধরণের সঙ্গি হবে।

বার্গারকে ফোনে পাবার আরেকটা ব্যর্থ চেষ্টা করলো সে। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটা এখনও তার উপর ভীষণ চটে আছে। ইচ্ছে করলে সে অফিসের ফোনে কিংবা তার বাড়িতে ফোন করে তাকে সরাসরি পেতে পারে কিন্তু এরইমধ্যে অনেকগুলো মেসেজ রেখে দিয়েছে। তাই সেটা না করে নিজের জন্য এক কাপ কফি বানাতে শুরু করলো। বেড়ালটাকে রান্নাঘরে রেখে টেবিলের উপর ফাইলটা নিয়ে বসে পড়লো আবার।

খুব সাবধানে আর আস্তে আস্তে পড়লো সে, কোনো কিছুই যেনো বাদ না পড়ে। সন্ধ্যার দিকে ফাইলটা বন্ধ করে নিজের নোট বুকের কয়েক পৃষ্ঠা লিখে নিলো-কিছু রিমাইন্ডার আর সে কি কি প্রশ্নের জবাব খোঁজার প্রত্যাশা করে সেসব টুকে নিলো। এরপর খুললো পরবর্তী ফাইলটা। ফাইলে ঘটনার সময়ানুক্রমিক বর্ণনা দেয়া আছে, সে ভেবে পেলো না এটা কি হেনরিক ভ্যাঙ্গার নিজে সাজিয়েছে নাকি এখানকার পুলিশ ডিপার্টমেন্ট এভাবেই কাজ করে থাকে।

প্রথম পৃষ্ঠায় হেডেস্টাডের পুলিশ ডিপার্টমেন্টের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার হাতে লেখা রিপোর্ট। নাম হিসেবে স্বাক্ষর করেছে ডি.ও রিথিঙ্গার। ব্লমকোভিস্ট বুঝতে পারলো ডি.ও দিয়ে আসলে ডিউটি অফিসার কথাটা বোঝানো হয়েছে। পুলিশকে ডেকেছিলো হেনরিক ভ্যাঙ্গার নিজে। তার ঠিকানা আর টেলিফোন নাম্বার দেয়া আছে। রিপোর্টটা ১৯৬৬ সালের সেপ্টেম্বরের রবিবার সকাল ১১:১৪-তে করা হয়েছিলো। খুবই ডিটেইলে লেখা হয়েছে সেটা :

হেনরিক ভ্যাঙ্গারের কাছ থেকে কলটা আসে, তিনি জানান তার ভায়ের মেয়ে(?) হ্যারিয়েট উলরিকা ভ্যাঙ্গার, যার জন্ম ১৫ই জানুয়ারি ১৯৫০ সালে(বয়স ১৬) হেডেবি আইল্যান্ডের নিজের বাড়ি থেকে শনিবার বিকেলের পর পরই নিখোঁজ হয়েছে। যিনি ফোন করেছিলেন তিনি খুবই উদ্বিগ্ন বোধ করছেন ব্যাপারটা নিয়ে।

১১:২০-এ একটি নোট পাঠানো হয়, তাতে উল্লেখ করা হয়েছে পি-০১৪ (পুলিশের গাড়ি? টহলগাড়ি? বোটের পাইলট(?) পাঠানো হয়েছে ঘটনাস্থলে।

আরেকটা নোট ১১:৩৫-এ পাঠানো হয়। সেটা অবশ্য প্রাসঙ্গিক নয়। ম্যাগনাসনের রিপোর্ট থেকে জানা গেছে হেডেবির বৃজটা এখনও ব্লক হয়ে আছে। বোটে করে যাতায়াত করা হোক। মার্জিনে একটা অস্পষ্ট স্বাক্ষর আছে।

১২:১৪-তে রিথিঙ্গার ফিরে আসে : হেডেবির ম্যাগনাসনের কাছ থেকে ফোনে জানা গেছে ১৬ বছরের হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গার শনিবারের বিকেল থেকে নিখোঁজ। তার পরিবার খুবই উদ্বিগ্ন। মেয়েটা তার নিজের বিছানায় রাতে ঘুমিয়েছে বলে বিশ্বাস হচ্ছে না। বৃজ ব্লক থাকার কারণে আইল্যান্ড ছেড়ে যেতে পারে নি। তার বর্তমান অবস্থানের ব্যাপারে তার পরিবারের কোনো ধারণাই নেই।

১২:১৯-এ : জি.এম টেলিফোনে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিয়েছেন।

শেষ নোটটা রেকর্ড করা হয়েছে ১:৪২-এ : জি.এম হেডেবির ঘটনাস্থলে আছেন। আমরা ব্যাপারটা দেখছি।

পরের পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে জি.এম বলতে আসলে ডিটেক্টিভ ইন্সপেক্টর গুস্তাফ মোরেলকে বোঝানো হয়েছে। একটা বোটে করে তিনি হেডেবি আইল্যান্ডে গেছিলেন। হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গারের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে তিনি একটা রিপোর্ট করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সেখানে। মোরেলের রিপোর্টটা টাইপরাইটারে লেখা। পরের পৃষ্ঠায় কি কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তার বর্ণনা দেয়া আছে। এতোটা বিস্তারিত বর্ণনা দেখে ব্লমকোভিস্ট খুবই অবাক হলো।

মোরেল সবার আগে হেনরিক ভ্যাঙ্গার, ইসাবেলা ভ্যাঙ্গার আর হ্যারিয়েটের মায়ের ইন্টারভিউ নেন। এরপর উলরিকা ভ্যাঙ্গার, হেরাল্ড ভ্যাঙ্গার, গ্রেগর ভ্যাঙ্গার, হ্যারিয়েটের ভাই মার্টিন ভ্যাঙ্গার আর আনিটা ভ্যাঙ্গারের ইন্টারভিউ নেন তিনি।

উলরিকা ভ্যাঙ্গার হলেন হেনরিক ভ্যাঙ্গারের মা, বোঝাই যাচ্ছে পরিবারে তিনি রাণীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। ভ্যাঙ্গারদের এস্টেটে তিনি থাকতেন তবে কোনো রকম তথ্য তিনি দেন নি। আগের দিন রাতে তিনি খুব জলদি বিছানায় চলে যান, তাছাড়া হ্যারিয়েটকে তিনি বেশ কয়েক দিন ধরে দেখেন নিও। তবে পুলিশকে তিনি একান্তে বলেছেন তারা যেনো দ্রুত ব্যবস্থা নেয়।

হেরাল্ড ভ্যাঙ্গারকে লিস্টে দু’নাম্বারে রাখা হয়েছে। হেডেস্টাডের প্যারেড থেকে ফিরে আসার সময় হ্যারিয়েটকে সে অল্প কিছু সময়ের জন্য দেখেছিলো, তবে বৃজের দুর্ঘটনার পর থেকে তাকে দেখে নি। সে তখন কোথায় ছিলো সে ব্যাপারেও তার কোনো ধারণা ছিলো না।

হেনরিক আর হেরাল্ডের ভাই গ্রেগর ভ্যাঙ্গার বলেছে হ্যারিয়েটকে সে হেনরিক ভ্যাঙ্গারের স্টাডিরুমে শেষ দেখেছে হেডেস্টাডের প্যারেড দেখে ফিরে আসার পর পরই। সে নাকি বলছিলো হেনরিক ভ্যাঙ্গারের সাথে সে কথা বলতে চায়। গ্রেগর বলেছে সে নিজে তার সাথে মুখে কিছু বলে নি ঐ সময়টাতে, শুধু মাথা নেড়ে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলো। তবে সে বলেছে, হ্যারিয়েট হয়তো কাউকে না বলে তার কোনো বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেছে। খুব জলদিই সে ফিরে আসবে। তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় বৃজ ব্লক থাকায় তারপক্ষে কি করে আইল্যান্ডের বাইরে চলে যাওয়া সম্ভব হলো তখন সে কোনো জবাব দিতে পারে নি।

মার্টিন ভ্যাঙ্গারকে সামান্য জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সে তখন উপসালা প্রিপারেটরি স্কুলে ফাইনাল ইয়ারে ছিলো। হেরাল্ড ভ্যাঙ্গারের সাথে বসবাস করতো সে। হেরাল্ডের গাড়িতে তার জন্যে কোনো জায়গা ছিলো না বলে বাসে ক’রে হেডেবিতে গিয়েছিলো সে। একটু দেরি করে আসাতে বৃজের দুর্ঘটনার জন্য সে ওপারে আটকা পড়ে যায়। সন্ধ্যার পর নৌকায় করে এ পারে চলে আসে। তাকে এজন্যে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তার বোন হয়তো তার কাছে এমন কোনো কথা বলে গিয়ে থাকবে যা তাকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে কিংবা তার বোন হয়তো তাকে জানিয়ে গেছে সে কোথায় কার সঙ্গে ভেগেছে। হ্যারিয়েটের মা নিজের মেয়ের পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটায় ঘোরতর আপত্তি জানালেও সেই মুহূর্তে ইন্সপেক্টর মোরেলের কাছে মনে হয়েছিলো হ্যারিয়েটের উধাও হয়ে যাবার ঘটনায় এটাই সবচাইতে ভালো ব্যাখ্যা হতে পারে। তবে মার্টিন জানায় গ্রীষ্মের ছুটির পর বোনের সাথে তার কোনো কথা হয় নি। মূল্যবান কোনো তথ্যই তার কাছে নেই।

হেরাল্ড ভ্যাঙ্গারের মেয়ে আনিটা ভ্যাঙ্গারকে ভুলবশত হ্যারিয়েটের ‘চাচাতো বোন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সে সময় স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো সে, হেডেবিতে গ্রীষ্মকালের ছুটি কাটিয়ে গিয়েছিলো। হ্যারিয়েট আর তার বয়স প্রায় সমান হওয়াতে তাদের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব ছিলো। সে জানিয়েছে শনিবার দিন বাবার সাথে আইল্যান্ডে এলেও হ্যারিয়েটকে দেখার সুযোগ তার হয় নি। আনিটা জানায় তার কাছে খুবই অস্বস্তিকর লাগছে ব্যাপারটা, কারণ হ্যারিয়েট কখনই কাউকে না বলে বাড়ির বাইরে যায় না। হেনরিক এবং ইসাবেলাও একই কথা বলেছে।

ইন্সপেক্টর মোরেল যখন পরিবারের সদস্যদের ইন্টারভিউ নিচ্ছিলেন তখন তিনি ম্যাগনাসন আর বার্গম্যানকে তল্লাশী শুরু করার নির্দেশ দিয়েছিলেন যেহেতু তখনও দিনের আলো ছিলো। বৃজটা বন্ধ থাকার কারণে আরো ফোর্স পাঠানোটা খুব কঠিন ছিলো সে সময়। তল্লাশী দলটি গঠন করা হয় বিভিন্ন বয়সের মোট ত্রিশজন নারী-পুরুষ নিয়ে। ঐ দিন বিকেলে তারা ফিশিং হার্বারের কাছে জনমানবহীন অবস্থায় থাকা বাড়িগুলোতে, উপকূলীয় এলাকা, গ্রামের আশোপাশে ঝোঁপঝাঁর আর ফিশিং হার্বারের পেছনে সোডেবার্গেট নামের একটি পাহাড়ে অভিযান চালায়। পাহাড়ে অভিযান চালানো হয় এ কারণে যে, কেউ একজন নাকি বলেছিলো হ্যারিয়েট সম্ভবত বৃজের ঘটনাটা ভালো করে দেখার জন্য পাহাড়ে উঠে থাকবে। ওস্টারগার্ডেন আর দ্বীপের অন্য অংশে গটফ্রিডের কেবিনেও আরেকটা টহল দল পাঠানো হয়েছিলো, ওখানে মাঝে মধ্যেই হ্যারিয়েট যেতো।

তবে সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়। রাত দশটার পর তল্লাশী বন্ধ করে দেয়া হয় কারণ তাপমাত্রা আচমকা জিরোতে নেমে গেছিলো।

বিকেলের দিকে ইন্সপেক্টর মোরেল তার হেডকোয়ার্টার স্থানান্তরিত করেন হেনরিক ভ্যাঙ্গারের ড্রইংরুমে। ওখানে বসে তিনি বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেন।

ইসাবেলাকে সাথে নিয়ে তিনি হ্যারিয়েটের ঘরটা তল্লাশী করে দেখেন কোনো কিছু খোয়া গেছে কিনা : জামাকাপড়, সুটকেস অথবা এরকম কিছু যাতে করে মনে হতে পারে হ্যারিয়েট বাড়ি থেকে পালিয়েছে। একটা নোটে লেখা হয়েছে ইসাবেলা খুব একটা সহায়তাপরায়ণ ছিলো না, আর নিজ মেয়ের ওয়ারড্রবটা পর্যন্ত মহিলা ঠিকমতো চেনে না। সে প্রায়ই জিন্স পরে, কিন্তু ওগুলো তো দেখতে প্রায় একই রকম লাগে, তাই না? হ্যারিয়েটের পার্সটা তার ঘরের ডেস্কের উপর পাওয়া যায়। ওটাতে তার আইডি, ওয়ালেটে নয় ক্রোনার পঞ্চাশ অরি, একটা চিরুণী, আয়না আর রুমাল খুঁজে পায় ইন্সপেক্টর। ইন্সপেকশন শেষে হ্যারিয়েটের ঘরটা তালা মেরে রাখা হয়।

আরো অনেক লোককে ইন্টারভিউ করার জন্য মোরেল ডেকে পাঠায়, পরিবারের সদস্য এবং কর্মচারিরাও ছিলো তার মধ্যে। সবগুলো ইন্টারভিউই নিখুঁতভাবে বর্ণিত আছে রিপোর্টে।

প্রথম সার্চ পার্টি যখন খালি হাতে ফেরত এলো ইন্সপেক্টর তখন আরো সিস্টেমেটিক্যালিভাবে তল্লাশী করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই রাতেই আরো ফোর্স চেয়ে পাঠানো হলো। মোরেল নিজে অনেক জায়গায় যোগাযোগ করেন, হেডেস্টাডের অরিয়েন্টিয়ারিং ক্লাবের চেয়ারম্যানকে তল্লাশী দলের জন্য আরো স্বেচ্ছাসেবক পাঠাতে অনরোধ করেন তিনি। মাঝরাতের মধ্যে তাকে জানানো হয় তিপান্ন জন সদস্য পরদিন সকাল ৭টার মধ্যে ভ্যাঙ্গার এস্টেটে পাঠিয়ে দেয়া হবে। হেনরিক ভ্যাঙ্গার তার পেপার মিলের সকালের শিফটের পঞ্চাশজন শ্রমিককে ডেকে পাঠায়। সবার জন্য খাবার আর পানীয়ের ব্যবস্থাও সে করে নিজ দায়িত্বে।

ঐ দিনগুলোতে ভ্যাঙ্গার এস্টেটের দৃশ্য কেমন ছিলো সেটা কল্পনা করতে পারলো ব্লমকোভিস্ট। প্রথম দিকে বৃজের দুর্ঘটনা পুরো ব্যাপারটাকে গুলিয়ে ফেলেছিলো-লোকজন জোগার করে তল্লাশী চালানোটাও হয়ে পড়েছিলো কঠিন একটি কাজ। যেহেতু প্রায় একই জায়গায় একই দিনে দু’দুটো ঘটনা ঘটে গিয়েছিলো সেজন্যে ঘটনা দুটোর মধ্যে অনিবার্যভাবেই সংযোগ খোঁজাটা স্বাভাবিকই ছিলো। বৃজ থেকে ট্যাঙ্কারটা সরিয়ে ফেলা হলে ইন্সপেক্টর মোরেল বৃজের উপর গিয়ে ধ্বংসস্তুপের মধ্যে ভালো করে তল্লাশী চালালেন। বেচারি হ্যারিয়েট অসাবধানবশত এই দুর্ঘটনার শিকার হয় নি তো! ইন্সপেক্টরের কাজের মধ্যে এই একটি কাজই মিকাইলের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকলো, কেননা এটা

স্পষ্ট যে, দুর্ঘটনা হবার অনেক পরেও হ্যারিয়েটকে দেখা গেছে।

চব্বিশ ঘণ্টা পর থেকেই সবার মনে আশংকা বাড়তে থাকে। দুটো থিওরি দাঁড় করানো হয়। বৃজের ঘটনার কারণে সবার অলক্ষ্যে আইল্যান্ড ছেড়ে যাওয়াটা প্রায় অসম্ভব হলেও ইন্সপেক্টর মোরেল ঘর পালানোর ব্যাপারটা বাতিল করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি সিদ্ধান্ত নেন হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গারের উপর একটা বুলেটিন প্রচারের জন্য। হেডেস্টাডের সব পুলিশকে বলে দেন এক নিখোঁজ মেয়ের ব্যাপারে যেনো তারা চোখকান খোলা রাখে। ক্রিমিনাল ডিভিশনে তার কিছু কলিগকেও পাঠিয়ে দেন বাসড্রাইভার আর রেলস্টেশনের স্টাফদের জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য তারা কেউ হ্যারিয়েটকে দেখেছে কিনা।

সব দিক থেকে যখন নেতিবাচক খবর আসতে লাগলো তখন এই ধারণাটি বদ্ধমূল হতে শুরু করলো যে হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গার কোনো বাজে ঘটনার শিকার হয়েছে। পরের দিনগুলোতে এই ধারণাটিই সব ধরণের তল্লাশী আর তদন্তের উপর প্রভাব ফেলতে শুরু করে।

তার নিখোঁজ হবার দু’দিন পর যে বড়সড় তল্লাশী দলটি অনুসন্ধানে নামে সেটা খুব কার্যকরী ছিলো বলেই ব্লমকোভিস্টের ধারণা। পুলিশ আর ফায়ারফাইটারদের মধ্যে যারা এ রকম অনুসন্ধান চালানোর অভিজ্ঞ ছিলো তারাই পুরো তল্লাশীটি পরিচালনা করে। হেডেবি আইল্যান্ডে এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে কেউ কোনোদিন পা ফেলে নি তবে সেটা খুব বেশি বড় এলাকা নয়। এক দিনেই পুরো এলাকাটি চিরুণী তল্লাশী করার জন্য যথেষ্ট। আইল্যান্ডের চারপাশে পানিতেও তল্লাশী চালানো হয় একটি পুলিশ বোট আর দুটো ভলান্টিয়ার বোটে করে। সারাদিন ধরে তারা খুঁজে দেখে।

পরের দিন থেকে তল্লাশী দলে লোকবলের সংখ্যা কমতে শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বাঙ্কার হিসেবে তৈরি করা পরিত্যাক্ত একটি এলাকা আছে হেডেবিতে, সেখানেও টহল দল পাঠিয়ে অনুসন্ধান করা হয়। পানির কূয়া, পাহাড়িগুহা, ফসল রাখার গুদাম আর গ্রামের অনেক ভেতরে থাকা বাড়িগুলোও বাদ যায় নি।

তৃতীয় দিন অনুসন্ধানের ফলাফল নিয়ে যে বেশ হতাশা প্রকাশ করা হয়েছিলো সেটাও অফিশিয়াল নোটে উল্লেখ করা আছে। ইন্সপেক্টর মোরেলও এই তদন্তের ব্যাপারে হতাশ ছিলেন। পরবর্তী পদক্ষেপ কি নেবেন কিংবা তার তদন্তকাজটি কিভাবে পরিচালিত হবে সেটা যেনো বুঝে উঠতে পারছিলেন না। মনে হয় হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গার বাতাসে মিলিয়ে গেছে। সেই সাথে শুরু হয় হেনরিক ভ্যাঙ্গারের দুঃসহ দিনগুলো।

অধ্যায় ৯

সোমবার, জানুয়ারি ৬-বুধবার, জানুয়ারি ৮

ব্লমকোভিস্ট প্রায় একটানা পড়ে গেলো, এপিফেনি ডে’র আগপর্যন্ত উঠলো না সে। ভ্যাঙ্গারের বাড়ির সামনে একটা পুরনো মডেলের নেভি-ব্লু ভলভো পার্ক করলে দরজার হাতল ধরার আগেই দরজা খুলে এক লোক বেরিয়ে এলো বাইরে। ফলে আরেকটুর জন্য তাদের মধ্যে ধাক্কা লেগে যাবার উপক্রম হয়েছিলো। গাড়ি থেকে যে লোকটা বের হলো তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব তাড়ায় আছে।

“হ্যা? আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”

“আমি হেনরিক ভ্যাঙ্গারের সাথে দেখা করতে এসেছি,” বললো ব্লমকোভিস্ট।

লোকটার চোখ চকচক করে উঠলো। হেসে হাত বাড়িয়ে দিলো সে। “আপনি নিশ্চয় মিকাইল ব্লমকোভিস্ট, যে হেনরিককে তার পরিবারের ইতিহাস লিখতে সাহায্য করার জন্য এখানে এসেছে, ঠিক?”

তারা করমর্দন করলো। মনে হচ্ছে ভ্যাঙ্গার ব্লমকোভিস্টের সম্পর্কে এই মিথ্যে গল্পটা বেশ ভালো মতোই ছড়িয়ে দিতে পেরেছ। লোকটা বেশ মোটাসোটা-সন্দেহ নেই, অনেক বছর ধরে অফিসে বসে বসে কনফারেন্স আর আলাপ আলোচানার ফল এটি—তবে ব্লমকোভিস্টের কাছে লোকটাকে বেশ ভালোই লাগলো, এটাও তার চোখ এড়ালো না যে লোকটার সাথে হ্যারিয়েটের চেহারার বেশ মিল আছে।

“আমি মার্টিন ভ্যাঙ্গার,” বললো সে। “আপনাকে হেডেস্টাডে স্বাগতম।”

“ধন্যবাদ আপনাকে।”

“কিছু দিন আগে আপনাকে আমি টিভিতে দেখেছি।”

“মনে হচ্ছে সবাই আমাকে টিভিতে দেখে ফেলেছে।”

“ওয়েনারস্ট্রম…এই বাড়িতে খুব বেশি জনপ্রিয় নয়।”

“হেনরিক সেটা আমাকে বলেছে। আমি বাকি গল্পটা শোনার জন্য অপেক্ষা করছি।”

“কয়েক দিন আগে সে আমাকে বলেছে আপনাকে এ কাজে নিয়োগ দিচ্ছে।” মার্টিন হেসে ফেললো। “সে বলেছে আপনি নাকি কাজটা কারতে রাজি হয়েছেন ওয়েনারস্ট্রমের জন্য।”

সত্যি কথাটা বলার আগে ব্লসকোভিস্ট একটু ইতস্তত করলো। “ওটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ। তবে সত্যি বলতে কি, আমি কিছু দিনের জন্য স্টকহোম ছাড়তে চেয়েছিলাম। ঠিক সেই সময় এই প্রস্তাবটা চলে এলো। শেষে অনেক ভেবে রাজি হয়ে গেলোম। আমি ভান করবো না যে আদালতের কেসটা কখনই ঘটে নি। যাইহোক না কেন, আমাকে অবশ্য কিছুদিনের জন্য জেলে যেতে হবে।”

মার্টিন ভ্যাঙ্গার মাথা নেড়ে সায় দিয়ে আচমকা সিরিয়াস হয়ে গেলো। “আপনি কি আপিল করবেন?’

“এতে কোনো লাভ হবে না।”

ভ্যাঙ্গার তার হাতঘড়িটা দেখলো।

“আজরাতে আমাকে স্টকহোমে যেতে হবে, সেজন্যে আমাকে একটু তাড়াহুড়ো করতে হচ্ছে। কয়েক দিন পরই ফিরে আসবো। আমার বাড়িতে একদিন আসবেন, ডিনারের আমন্ত্রণ রইলো। মামলাটা চলার সময় কি কি হয়েছিলো সেসব কথা আমি শুনতে চাই। হেনরিক উপরতলায় আছে। সোজা চলে যান।”

ভ্যাঙ্গার তার অফিসের সোফায় বসে আছে। হেডেস্টাড কুরিয়ার, ডাগেন্স ইন্ডাস্ট্রি, সেভেনস্কা ডাগব্লাডেট এবং দুটো সান্ধ্যকালীন জাতীয় দৈনিক কফি টেবিলের উপর রাখা আছে।

“বাইরে মার্টিনের সাথে আরেকটুর জন্য ধাক্কা লেগে যাচ্ছিলো।”

“সাম্রাজ্য রক্ষা করার জন্য বেশ তাড়াহুড়ার মধ্যে আছে,” বললো ভ্যাঙ্গার। “কফি চলবে?”

“হ্যা।” বসে পড়লো ব্লমকোভিস্ট। ভ্যাঙ্গারকে কেন এতো খুশি দেখাচ্ছে ভেবে পেলো না।

“আপনি পত্রিকায় উল্লেখ করেছিলেন। “

একটি সান্ধ্যকালীন পত্রিকা হাতে তুলে নিলো ভাঙ্গার। ‘মিডিয়া শর্টসার্কিট’ শিরোনামের একটি সংবাদের দিকে আকর্ষণ করলো সে। এর আগে মনোপলি ফিনান্সিয়াল ম্যাগাজিনে কাজ করতো এরকম একজন কলামিস্ট আর্টিকেলটা লিখেছে। এই লেখক মিকাইল ব্লমকোভিস্টকে তার লেখায় একজন গর্দভ হিসেবে উল্লেখ করেছে। আর এরিকা বার্গারকে বলেছে, সে নাকি মিডিয়ার সবচেয়ে অযোগ্য ব্যক্তি।

একটা গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে মিলেনিয়াম বন্ধ হবার দ্বারপ্রান্তে উপণীত হয়েছে। এর নারীবাদী এডিটর ইন চিফ যতোই মিনিস্কার্ট পরুক আর টিভি’তে সেজেগুঁজে উপস্থিত হোক না কেন ম্যাগাজিনটি টিকে থাকতে পারবে না। বিগত কয়েক বছর ধরে পত্রিকাটি নিজের ইমেজ রক্ষা করে চলেছিলো। যে সব তরুণ ইনভেস্টিগেটিভ-জার্নালিজমকে পেশা হিসেবে নিতে আগ্রহী তারা এই পত্রিকায় কাজ করে বড় বড় ব্যবসায়ীক কেলেংকারি ফাঁস করে দিয়ে হাত পাকাতো। এটা হয়তো নৈরাশ্যবাদীদের কাছে প্রিয় ছিলো যারা কেবল নোংরা খবর শুনে গালাগালি দিতে অভ্যস্ত কিন্তু আদালতে তাদের কোনো কথাই ধোপে টেকে নি। কাল ব্লমকোভিস্টও এটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছে।

ব্লমকোভিস্ট তার মোবাইলের সুইচ অন করে দেখলো বার্গার কোনো কল করেছিলো কিনা। না। সে কোনো কল করে নি। ভ্যাঙ্গার কিছু না বলে অপেক্ষা করে গেলো। ব্লমকোভিস্ট বুঝতে পারলো বৃদ্ধ চাচ্ছে সে-ই আগে নীরবতা ভাঙুক।

“সে একটা মাথামোটা লোক,” বললো ব্লমকোভিস্ট।

ভ্যাঙ্গার হেসে ফেললো। “তা হতে পারে। তবে সে কোনো সাজাপ্রাপ্ত লোক নয়।”

“তা ঠিক বলেছেন। তার কখনও সাজা হবেও না। সে কখনও আসল কথা বলে না। গা বাঁচিয়ে চলে সব সময়, আর নিরীহ লোক পেলেই কেবল ক্ষতি করতে মরিয়া হয়ে ওঠে।

“আমারও অনেক শত্রু ছিলো। আমি একটা জিনিস শিখেছি, যদি তুমি নিশ্চিত থাকো যে হেরে যাবে তাহলে সেই লড়াইয়ে না নামাই ভালো। কখনও দুর্বল অবস্থায় থেকে লড়াই করবে না। নিজের অবস্থান আগে ঠিক করে নিয়ে সুবিধামতো সময়ে আঘাত হানতে হয়। তোমার যদি আঘাত হানার ইচ্ছে নাও থাকে তারপরও এই নিয়মটা মানা উচিত।’

“আপনার প্রজ্ঞাময় উপদেশের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এবার আপনার পরিবার সম্পর্কে আমাকে বলুন।” টেবিলের উপর একটা টেপ রেকর্ডার রেখে চালু করে দিলো সে।

“তুমি কি জানতে চাও?”

“আমি প্রথম ফাইলটা পড়েছি। নিখোঁজ হওয়া আর অনুসন্ধান সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেছি ওখান থেকে। তবে এতো বেশি ভ্যাঙ্গারদের কথা ওখানে বলা হয়েছে যে তাদেরকে চিহ্নিত করার জন্য আপনার সাহায্য লাগবে।”

.

বেল বাজানোর আগে প্রায় দশ মিনিট ধরে সালান্ডার হলওয়ের পিতলের নেমপ্লেটের দিকে স্থিরচোখে চেয়ে রইলো। ওটাতে লেখা আছে : এডভোকেট এন.ই বুরম্যান। এন্ট্রিডোরের লকটা ক্লিক করে উঠলো।

আজ মঙ্গলবার। এটা তাদের দ্বিতীয় মিটিং, সালান্ডারের খুব বাজে অনুভূতি হচ্ছে।

বুরম্যানকে সে ভয় পায় না-ভয় পাওয়াটা সালান্ডারের জন্য বিরল ঘটনা। আসলে এই নতুন গার্ডিয়ানের ব্যাপারে তার মধ্যে একটা অস্বস্তি কাজ করছে। এই লোকটার পূর্বসূরী এডভোকেট হোলগার পামগ্রিন একেবারেই ভিন্ন ধরণের ব্যক্তি ছিলো : দয়ালু আর বিনয়ী। ব্যবহার খুবই চমৎকার। তবে তিন মাস আগে হোলগার পামগ্রিন হার্ট স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে তার স্থলাভিষিক্ত হয় নিলস বুরম্যান।

বারো বছর ধরে সালান্ডার সোশ্যাল এবং সাইকিয়াট্রিক গার্ডিয়ানশিপে ছিলো, তার মধ্যে দু’বছর ছিলো শিশুদের ক্লিনিকে। একবারের জন্যেও সে কখনও সহজ একটি প্রশ্নে জবাব দেয় নি : “তো, আজ তুমি কেমন আছো?”

তার বয়স যখন তেরো আদালত অপ্রাপ্ত বয়স্কদের অভিভাবক আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত দিলো তাকে উপসালায় অবস্থিত সেন্ট স্টেফান সাইকিয়াট্রিক ক্লিনিক ফর চিল্ড্রেন-এর একটি লক-ওয়ার্ডে রাখা হবে। এই সিদ্ধান্তের পেছনে কারণ ছিলো সালান্ডারের মানসিক অবস্থা বিপর্যস্ত এবং তার ক্লাসমেটদের প্রতি মারাত্মক হিংস্র আচরণ। সম্ভাব্য সে তার নিজের প্রতিও হিংসাত্মক কিছু করতে পারে বলে আদালত আশংকা করে এই সিদ্ধান্ত দেয়।

তার মানসিক ও শারিরীক অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য শিক্ষক কিংবা হাসপাতালের ডাক্তার তার সাথে কথা বলার অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু ভয়াবহ মৌনতা অবলম্বন করে মেঝে, দেয়াল কিংবা ছাদের দিকে তাকিয়ে থেকে সেসব প্রশ্নের জবাব দিয়েছে সে। বুকের উপর দু’হাত ভাঁজ করে যেকোনো ধরণের সাইকিয়াট্রিক পরীক্ষায় অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানাতো। এমন কি স্কুলে ক্লাস করতে পর্যন্ত যেতে চাইতো না। তাকে জোর করে কোলে তুলে ক্লাসরুমে নিয়ে বেঞ্চের সাথে শিকল দিয়ে বেধে রাখা হোতো। তবে শিক্ষকের কোনো কথা কানে তুলতো না। কলম তুলে একটা শব্দও লিখতো না। নয় বছর কম্পালসারি স্কুলে সার্টিফিকেট ছাড়াই কাটিয়ে দেয় সে।

সব মিলিয়ে একটা কথাই বলা যায় : লিসবেথ সালান্ডারকে সামলানোটা কঠিন কাজ।

তার তেরো বছরের সময় আরেকটা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগ পর্যন্ত তার সমস্ত স্বার্থ আর সম্পত্তি দেখাশোনা করার জন্য একজন ট্রাস্টিকে নিয়োগ দেয়া হয়। সেই ট্রাস্টি ছিলো এডভোকেট পামগ্রিন, শুরুতে ভীষণ বেগ পেলেও ডাক্তার আর মনোবিজ্ঞানীরা যে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছিলো এই আইনজীবি ভদ্রলোক সেটা করতে সক্ষম হয়। ক্রমান্বয়ে সে কেবল মেয়েটির কাছ থেকে আস্থাই অর্জন করলো না সেইসাথে তার কাছ থেকে উষ্ণ ব্যবহার আর মায়ামমতাও লাভ করলো ভদ্রলোক।

তার বয়স যখন পনেরো তখন ডাক্তাররা কমবেশি একমত হলো যে সে আর অতোটা হিংস্র নয়। নিজের প্রতিও কোনো হিংসাত্মক কাজ করবে ব’লে মনে হলো না তাদের কাছে। তার পরিবারকে অকার্যকর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিলো, তার এমন কোনো আত্মীয়স্বজনও ছিলো না যে তার দেখাশোনা করবে। ফলে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো লিসবেথ সালান্ডারকে উপসালার সাইক্রিয়াট্রিক ক্লিনিক থেকে রিলিজ দিয়ে সামাজিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য কোনো পরিবারের অধীনে দিয়ে দেয়া হবে পালক সন্তান হিসেবে।

এটা অবশ্য খুব সহজ কাজ ছিলো না। মাত্র দু’সপ্তাহের মাথায় প্রথম যে পরিবারটি তাকে দত্তক নিয়েছিলো সেখান থেকে পালিয়ে যায় সে। দ্বিতীয় আর তৃতীয় পরিবার দুটোর পরিণতিও একই রকম হয়। এমন সময় পামগ্রিন তার সাথে সিরিয়াস একটি আলোচনা করে, তাকে বোঝায় এরকম করতে থাকলে তাকে আবারো ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হবে। এই হুমকিতে কাজ হলে চতুর্থবারের মতো আরেকটি পরিবারে ঠাঁই হয় তার। মিডসোমারক্রানসেনে বসবাস করা বয়স্ক এক দম্পতির পরিবার ছিলো সেটি।

তবে তার মানে এই নয় যে এরপর থেকে সে ভালো আচরণ করতে শুরু করে। সতেরো বছর বয়সে সালান্ডারকে চার চারবার পুলিশ গ্রেফতার করে। দু’বার এতোটাই বেশি ড্রাগ নিয়েছিলো যে তাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যেতে হয়েছিলো, আর একবার মাদক নিয়ে ধরা পড়ে সে। একবার একেবারে বদ্ধ মাতাল অবস্থায় তাকে পাওয়া যায় সোডার মালাস্ট্রান্ডের কাছে একটা পার্ক করা গাড়ির পেছনের সিটে, পরনের জামাকাপড় আলুথালু ছিলো তখন। এক বৃদ্ধ মাতালের সাথে ছিলো সে।

তার আঠারোতম জন্মদিনের তিন মাস আগে শেষ গ্রেফতারটা হয়েছিলো, গামলা স্টান টানেলবানা স্টেশনের গেটে এক পুরুষ প্যাসেঞ্জারের মাথায় সজোরে লাথি মেরেছিলো সে। তাকে পুলিশ কিছুটা মার দেয়, ব্যাটারি দিয়ে ইলেক্ট্রক শকও দেয়া হয় তাকে। সালান্ডার দাবি করে লোকটি তার শরীরে অসৎ উদ্দেশ্যে হাত দিয়েছিলো। তার এই দাবিটির পক্ষে কিছু সাক্ষী পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে মামলাটি খারিজ করে দেয়া হয়, তবে তার অতীত রেকর্ডের কারণে ডিস্টিক্ট কোর্ট তার একটি সাইকিয়াটুক পরীক্ষা করার আদেশ দেন। স্বভাবসুলভভাবেই আগের মতো এই পরীক্ষায় কোনো রকম প্রশ্নের জবাব দেয়া থেকে বিরত থাকে সে ফলে তার আচরণ পর্যবেক্ষণ করেই রিপোর্ট দেয়া হয়। তবে নিশ্চুপ একটি মেয়ে যে কিনা চেয়ারে বসে বুকের কাছে দু’হাত রেখে এদিক ওদিক শুধু তাকিয়ে গেছে তাকে কি দেখে কি মূল্যায়ন করা হলো সেটাও একেবারেই অস্পষ্ট। তবে একটা কথা নিশ্চিত করে বলা হয়েছিলো যে, তার মানসিক অবস্থা পুরোপুরি সুস্থ নয়। এর চিকিৎসা করা দরকার। রিপোর্টে তাকে সাইকিয়াটুক ট্রিটমেন্ট দেবার কথা বলা হয়।

তার ব্যক্তিগত রেকর্ড মূল্যায়ন করে মতামত দেয়া হয় মদ্যপান আর মাদকাসক্ত হবার ঝুঁকি আছে, আর তার মধ্যে নিজের প্রতি অবহেলাও প্রকট। তার কেসবুকে অর্ন্তমুখী, অসামাজিক, নিরাবেগ, অহংকারী, সাইকোপ্যাথিক, অসামাজিক আচরণ, অসহযোগীতাপরায়ণ এবং শিক্ষাগ্রহনের ব্যাপারে অনাগ্রহী শব্দগুলো ঠাঁই পায়। যেকেউ তার কেসবুক পড়লে মনে করবে সালান্ডার একজন মাথামোটা মেয়ে। রাস্তায় টহল দেয়া পুলিশের ভাষ্য মতে তার বিরুদ্ধে আরেকটা অভিযোগ হলো তাকে নাকি বিভিন্ন ধরণের পুরুষ মানুষের সাথে ম্যারিয়াটোরগেট এলাকায় ঘুরতে দেখা যায়। তাকে আরেকবার পুলিশ পথে থামিয়ে তল্লাশী করতে গিয়ে বয়স্ক এক লোকের সাথে আবিষ্কার করেছিলো। ফলে এই আশংকা করা হয়েছিলো যে, সালান্ডার একজন পতিতা হিসেবে কাজ করছে হয়তো।

তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণকারী ডিক্ট কোর্ট যখন তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য উপনীত হয় তখন দেখা গেলো এর ফলাফল আগের মতোই। মেয়েটা অবশ্যই প্রবলেম চাইল্ড, ফলে কোর্ট নতুন কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়ে তাকে আগের মেডিকেল রিপোর্ট মোতাবেক সাইকিয়াটুক ট্রিটমেন্টের জন্যে সুপারিশ করে।

কোর্টে যে সকালে হিয়ারিং হবার কথা সেদিন সালান্ডারকে সাইকিয়াটুক ক্লিনিক থেকে নিয়ে আসা হয়। তাকে দেখ মনে হয়েছিলো কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের একজন বন্দী : সেদিন তার আর কোনো আশা ছিলো না। আদালতে প্রথম যে লোকটিকে সে দেখতে পেয়েছিলো সে আর কেউ নয়, পামগ্রিন। তবে এবার আর সে তার ট্রাস্টি হিসেবে নয়, তার আইনজীবি হিসেবে উপস্থিত হয়েছে।

তাকে অবাক করে দিয়ে তাকে কোনা ইন্সটিটিউটে পাঠানোর তীব্র বিরোধীতা করে ভদ্রলোক। এসব কথা শুনে সে ভুরু কপালে তোলে নি, বরং গভীর মনোযোগের সাথে পামগ্রিনের বলা প্রতিটি কথা শুনে গেছে। ফিজিশিয়ান ডাক্তার জেসপার এইচ. লোডারম্যানকে দু’ঘণ্টা ধরে বেশ ভালোমতোই জেরা করেছিলো সে। তার কঠোর জেরার মুখে ডাক্তার স্বীকার করে যে সালান্ডার তাদেরকে কোনো পরীক্ষা করতে দেয় নি। তাদের অভিমত আসলে অনুমানের উপর ভিত্তি করে দেয়া হয়েছে।

পামগ্রিন তার হিয়ারিংয়ের শেষে বলেছিলো, সে আশংকা করছে তাকে কোনো ইন্সটিটিউটে রাখাটা হবে পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তেরও বরখেলাপ। সুতরাং এর বিকল্প কিছু খুঁজে বের করতে হবে।

আদালত সব শুনে অবশেষে এই বলে মত প্রকাশ করে যে, সালান্ডার অবশ্যই মানসিকভাবে ডিস্টার্ব তবে তার অবস্থা এতোটা খারাপ নয় যে তাকে সাইকিয়াট্রিক ক্লিনিকে রাখতে হবে। পক্ষান্তরে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের চেয়ারম্যান তাকে আবারো অভিভাবকের অধীনে রাখার সুপারিশ করে। .. আদালতের প্রধান হোলগার পামগ্রিনের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিয়ে জানায়, সে-ই যখন সালন্ডারের বর্তমান ট্রাস্টি তার অধীনেই মেয়েটাকে দিয়ে দেয়া যেতে পারে। আদালত হয়তো ভেবেছিলো পামগ্রিন প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দেবে কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে দায়িত্বটা মাথায় পেতে নেয়। যেনো ফ্রোকেন সালান্ডারের অভিভাবক হতে পেরে সে খুশিই হবে এমনই ছিলো তার ভাবসাব। তবে একটা শর্ত দেয় সে : “আমার প্রতি ফ্রোকেন সালান্ডারের অবশ্যই বিশ্বাস থাকতে হবে। সেই সাথে আমাকে যদি স্বেচ্ছায় তার অভিভাবক হিসেবে মেনে নেয় তাহলে আমি এই প্রস্তাবে রাজি হবো।

পামগ্রিন তার দিকে তাকালে লিসবেথ সালান্ডার খুবই অবাক হয়। এর আগে কখনও কেউ তার মতামত জানতে চায় নি। অনেকক্ষণ ধরে সে হোলগার পামগ্রিনের দিকে চেয়ে থেকে অবশেষে মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিলো।

পাসগ্রিনের মধ্যে জুরি আর সোশ্যাল ওয়ার্কারের আজব এক মিশ্রণ ছিলো। প্রথমে তাকে রাজনৈতিকভাবে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার বোর্ডে একজন সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো। নিজের জীবনের প্রায় অর্ধেকটা সময় সে যুব সমাজের সমস্যা আর অবক্ষয় নিয়ে কাজ করে কাটিয়ে দিয়েছে। তার মধ্যে এক ধরণের প্রচ্ছন্ন শ্রদ্ধাবোধ আর বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব ছিলো। তারপরও সালান্ডারের সাথে কাজ করাটা ছিলো তার জন্য সবচাইতে কঠিন।

তাদের এই সম্পর্কটা এগারো বছর পর্যন্ত টিকে ছিলো। সালান্ডারের তেরোতম জন্মদিনের দিন, ক্রিসমাসের কিছু দিন আগে পামগ্রিনের বাড়িতে চলে আসে সে তার সাথে দেখা করার জন্য। পামগ্রিন প্রতিমাসে তার সাথে দেখা করতে যেতো, সে মাসে কোনো একটা কারণে আর যাওয়া হয় নি তার।

দরজা খুলতে পামগ্রিনের দেরি হওয়াতে সালান্ডার ড্রেনের পাইপ বেয়ে পাঁচতলা উপরে উঠে পড়ে। ঘরে ঢুকে দেখে মেঝেতে পড়ে আছে সে। তখনও জ্ঞান ছিলো তবে নড়াচড়া আর শব্দ করার ক্ষমতা ছিলো না। একটা অ্যাম্বুলেন্স ডেকে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় সালান্ডার। সে এতোটা ভয় পেয়েছিলো যে তার পেট পর্যন্ত গুলিয়ে এসেছিলো সে সময়। তিনদিন ধরে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের করিডোরে পড়ে ছিলো সে। পাহাড়াদার কুকুরের মতো পামগ্রিনকে চিকিৎসা করতে আসা ডাক্তার-নার্সদের কড়া নজরদারী করে। তার এই অবস্থা দেখে অবশেষে এক ডাক্তার তাকে একটা রুমে নিয়ে গিয়ে পামগ্রিনের সংকটজনক অবস্থার কথা তাকে বুঝিয়ে বলে। তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। ডাক্তাররা চেষ্টা করে যাচ্ছে তার জ্ঞান ফেরানোর জন্য। তবে তাদের কাছে মনে হচ্ছে না জ্ঞান ফিরে আসবে। তার বয়স মাত্র চৌষট্টি। সালান্ডার কথাটা শুনে একটুও কাঁদে নি, এমনকি তার মুখের অভিব্যক্তি পর্যন্ত সামান্য বদলায় নি। সেই যে হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেলো আর ফিরে যায় নি সেখানে।

পাঁচ সপ্তাহ পর গার্ডিয়ানশিপ এজেন্সি সালান্ডারকে ডেকে পাঠায় তার নতুন গার্ডিয়ানের সাথে মিটিং করার জন্য। প্রথমে সালান্ডার তাদের এই আহ্বানে সাড়া দেয় নি তবে পামগ্রিন তার মাথায় এটা ঢোকাতে পেরেছিলো যে প্রতিটি কাজেরই একটা পরিণাম ভোগ করতে হয়। তাদের ডাকে সাড়া না দিলে কি হবে সেটা বুঝতে পেরে সে সিদ্ধান্ত নেয় গার্ডিয়ারশিপ এজেন্সিকে নিজের ব্যবহারের মাধ্যমে বোঝাতে হবে তার উদ্যোগের ব্যাপারে সে যথেষ্ট সচেতন আর এতে তার পূর্ণ সম্মতিও আছে।

ফলে মিকাইল ব্লমকোভিস্টের উপর রিসার্চ বাদ দিয়ে ডিসেম্বরে সে হাজির হয় সেন্ট এরিকপ্লানে অবস্থিত বুরম্যানের অফিসে, সেখানে এক বয়স্ক মহিলা তাকে জানায় তার ফাইলটি এডভোকেট বুরম্যানের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সেই মহিলা তাকে ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করে তার দিনকাল কেমন যাচ্ছে। তার জবাবে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে এডভোকেট বুরম্যানের অধীনে দিয়ে দেয়া হয়।

সালান্ডার অবশ্য বুরম্যানকে পছন্দ করলো না। তার কেসবুকটা পড়ার সময় বুরম্যানকে সে ভালোভাবে দেখে নিয়েছে। বয়স : পঞ্চাশোর্ধ। হালকা পাতলা গড়ন। মঙ্গল আর শুক্রবারে টেনিস খেলে। মাথার সোনালি চুল খুব পাতলা। হুগো বস আফটার শেভ ব্যবহার করে। নীল রঙের সুট, লাল রঙের টাই পরে, সাথে সোনালি টাইপিন আর চকচকে কাফলিন যাতে এনইবি লেখা। স্টিল রিমের চশমা। বাদামী চোখ। তার সাইড টেবিলে রাখা ম্যাগাজিনগুলো দেখে বোঝা যায় তার প্রিয় শখ হলো শিকার করা আর শুটিং।

1

পামগ্রিনের সাথে তার দেখা হলে সে তাকে কফি খেতে দিয়ে আলাপ করতো। তার আচরণ যাইহোক না কেন, এমনকি অভিভাবকদের বাড়ি থেকে পালানোর পরও এর ব্যত্যয় ঘটতো না। কেবলমাত্র গামলা স্টানের ঐ ঘটনায় যখন তাকে ব্যাটারি দিয়ে চার্জ করা হয়েছিলো তখনই পামগ্রিন তার উপর একটু নাখোশ হয়েছিলো। তুমি কি বুঝতে পারছো কি করেছো? তুমি আরেকজন মানুষকে আঘাত করেছো, লিসবেথ। তার কথা শুনে মনে হয়েছিলো বয়স্ক কোনো শিক্ষক বুঝি কথা বলছে। তার সমস্ত উপদেশমূলক কথাবার্তা সে ধৈর্য ধরে এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিয়েছিলো।

বুরম্যানের অবশ্য অতো প্যাচাল পাড়ার সময় নেই। সঙ্গে সঙ্গে সে তাকে জানায় যে, পামগ্রিন তার চুক্তির কিছুটা বরখেলাপ করেছে কারণ সালান্ডারকে নিজের আয়ে চলা এবং নিজের ঘরের কাজ নিজে করতে দিয়েছে সে। বুরম্যান তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আরম্ভ করে এরপর : তুমি কি পরিমাণ আয় করো? তোমার আর্থিক রেকর্ডের একটি কপি আমি চাই। তুমি কার সাথে সময় কাটাও? তুমি কি মদ পান করো? তোমার চেহারায় যেসব রিং পরেছো সেটা কি পামগ্রিন তোমাকে পরতে দিয়েছে? তুমি কি পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সচেতন?

তোমার নিকুচি করি।

সমস্ত বাজে জিনিসগুলো ঘটার পর থেকেই পামগ্রিন তার ট্রাস্টি হিসেবে ছিলো। মাসে একবার সে সালান্ডারের সাথে মিটিং করতোই। কখনও কখনও মাসে দু’তিনবারও মিটিং করতো সে। লুন্ডাগাটানে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য চলে আসার পর তো পামগ্রিন তার প্রতিবেশীই হয়ে ওঠে, সে কয়েক ব্লক দূরে হর্নসগাটানে থাকতো। ঐ সময়টাতে তাদের প্রায়ই দেখা হোতো, কাছের কোনো ক্যাফে’তে বসে প্রায়ই কফি খেতো তারা। পামগ্রিন কখনওই জোর করে কিছু চাপিয়ে দিতো না। তার কয়েকটা জন্মদিনে কিছু উপহারও নিয়ে এসেছিলো সে। ওদিকে সালান্ডার চাইলে যেকোনো সময় পামগ্রিনের সাথে দেখা করার জন্য তার বাড়িতে যেতে পারতো। তার জন্য পামগ্রিনের দরজা সব সময়ই খোলা থাকতো তবে এই সুযোগটা সে খুব কমই নিয়েছে। সালান্ডার যখন সোডারে চলে এলো তখন নিজের মায়ের সাথে দেখা করে পামগ্রিনের সাথে ক্রিসমাস ইভের সময়টা কাটাতো। তারা ক্রিসমাস হ্যাম খাওয়ার পর দাবা খেলে সময় কাটাতো। এই. খেলাটায় তার কোনো আগ্রহ না থাকলেও খেলার নিয়মকানুন শেখার পর থেকে আর কখনই হারে নি। পামগ্রিন একজন বিপত্নীক তাই সালান্ডার মনে করতো লোকটার ছুটির দিনের একাকীত্ব ঘোচানো তার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।

এটাকে সে তার ঋণ মনে করতো, আর নিজের ঋণ শোধ করার ব্যাপারে সব সময়ই সচেষ্ট ছিলো সে।

পামগ্রিন লুন্ডাগাটানে তার মায়ের অ্যাপার্টমেন্টটি সালান্ডারের কাছে সাবলেট দিয়েছিলো যতোদিন না তার নিজের থাকার কোনো জায়গা ব্যবস্থা করেছিলো সে। অ্যাপার্টমেন্টটি যে খুব ভালো অবস্থায় ছিলো তা বলা যাবে না তবে নিদেনপক্ষে মাথার উপর একটা ছাদ তো ছিলো, সেটাই বা কম কিসের।

এখন পামগ্রিন নেই, সমাজের সাথে তার গাটছড়া বাধার আরেকটি অবলম্বন ছিঁড়ে গেলো বলা যায়। নিলস বুরম্যান একেবারেই ভিন্নরকম একজন মানুষ। তার বাড়িতে তার সঙ্গে কোনোভাবেই ক্রিসমাস ইভ কাটানো যাবে না। তার হ্যান্ডেলসব্যাঙ্কেনে যে একাউন্টটা আছে সেটার ব্যাপারে নতুন একটা নিয়ম জারি করেছে বুরম্যান। পামগ্রিন কখনও তার টাকা-পয়সা নিয়ে মাথা ঘামাতো না। নিজের খরচ নিজেই করতো সে, টাকা বেচে গেলে সেটা জমাতেও পারতো।

বুরম্যানের সাথে ক্রিসমাসের এক সপ্তাহ আগে তার মিটিংটার জন্য সে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলো। সেই মিটিংয়ে শুরুতেই সে বলে দেয় পামগ্রিন কখনও তার নিজের ব্যাপারে নাক গলাতো না।

“এটাই তো একটা সমস্যা,” তার কেসবুকে টোকা মেরে বললো বুরম্যান। এরপর গার্ডিয়ারশিপের ব্যাপারে সরকারের নিয়মকানুন আর নীতিমালা সম্পর্কে লম্বা একটা বক্তৃতা দিলো সে। “তোমাকে সে মুক্তভাবে সব কিছু করতে দিয়েছে। ভেবে পাই না সে এটা কি করে করলো।”

কারণ উনি একজন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট ছিলেন, যিনি সারাটা জীবন কাজ করে গেছেন সমস্যায় জর্জরিত শিশু-কিশোরদের নিয়ে।

“আমি আর বাচ্চা নই,” বললো সালান্ডার যেনো এটাই সব কিছুর জবাব।

“তা ঠিক। তুমি আর শিশু নও। তবে আমাকে তোমার অভিভাবক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, সুতরাং যতোদিন আমি তোমর অভিভাবক থাকবো ততোদিন তোমার অর্থনৈতিক আর আইনগত ব্যাপারে আমার দায় দায়িত্ব থাকবে।

তার নামে একটা নতুন একাউন্ট খুলে দিলো সে। আর তাকে সেটা মিল্টন- এর পারসোনেল অফিসে রিপোর্ট করে এখন থেকে সেই একাউন্টেই সব ধরণের লেনদেন করতে হবে ব’লে বলা হলো। ভালো দিনগুলোর সমাপ্তি হলো। ভবিষ্যতে বুরম্যানই তার সমস্ত বিল পরিশোধ করবে আর তাকে মাসে কিছু হাতখরচের টাকাও দেয়া হবে। সালান্ডারকে আরো জানিয়ে দেয়া হলো যাবতীয় খরচের রিসিপ্ট যেনো তার কাছে জমা দেয়া হয়। মাসে ১৪০০ ক্রোনার পাবে সালান্ডার-”খাবার, কাপড়চোপড়, সিনেমা দেখা এরকম কাজের জন্য।”

সালান্ডার বছরে ১৬০০০০ ক্রোনারেরও বেশি আয় করে। আরমানস্কির প্রস্তাব দেয়া সবগুলো অ্যাসাইনমেন্ট গ্রহণ করে ফুলটাইম কাজ করলে এর দ্বিগুন আয় করতে পারবে সে। তবে তার খরচ খুব একটা বেশি হয় না তাই বেশি বেশি আয় করারও দরকার পড়ে না। তার অ্যাপার্টমেন্টের মাসিক ভাড়া ২০০০ ক্রোনার, ফলে তার যে আয় সেটা থেকে খরচ করার পরও ৯০০০০ ক্রোনার জমাতে পেরেছে সেভিংস একাউন্টে। এখন আর ঐ একাউন্টটা সে ইচ্ছেমতো চালাতে পারবে না।

“আমি তোমার সব ধরণের আর্থিক ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত বলে এটা করা হয়েছে,” বললো সে। “তোমাকে ভবিষ্যতের জন্য টাকা-পয়সা জমিয়ে রাখতে হবে। তবে এ নিয়ে চিন্তা কোরো না, আমার কাছে সেটা ভালোমতোই থাকবে।”

বানচোত, আমি দশ বছর বয়স থেকে নিজের সব কিছু নিজে নিজেই করি!

“সোশ্যাল টার্ম অনুযায়ী তোমার কাজকর্ম ভালো হচ্ছে বলে তোমাকে কোনো ইন্সটিটিউটে পাঠানো হচ্ছে না, তারপরও তোমার প্রতি এই সমাজেরও কিছু দায়িত্ব আছে।”

মিল্টন সিকিউরিটি তাকে কি ধরণের কাজ দিয়ে থাকে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলো। নিজের কাজকর্মের ব্যাপারে বেশ ভালোমতোই মিথ্যে বলে গেলো সে। মিল্টন সিকিউরিটিতে সে কফি বানায় আর চিঠিপত্র বিলিবণ্টন করে। তার মতো অলস আর অকর্মরা জন্য এরকম কাজই ভালো। মনে হলো তার এই জবাব শুনে বেশ সন্তুষ্ট হলো বুরম্যান।

সালান্ডার জানে না সে কেন মিথ্যে বললো তবে সে নিশ্চিত তার এই সিদ্ধান্তটি খুবই বুদ্ধিদীপ্ত।

.

ব্লমকোভিস্ট প্রায় পাঁচ ঘণ্টা কাটালো ভ্যাঙ্গারের সাথে। ভ্যাঙ্গার পরিবারের সবার নাম আর কার সাথে কার কি সম্পর্ক সেটা টাইপ করে লিখে রাখতে মঙ্গলবারের পুরো রাত লেগে গেলো। তার পরিবারের সম্পর্কে যেসব কথা শোনা যায় তারচেয়ে ভ্যাঙ্গারের বলা কাহিনীটা একেবারেই ভিন্ন।

ব্লমকোভিস্ট নিজেকে বার বার স্মরণ করিয়ে দিলো তার আসল কাজ ভ্যাঙ্গার পরিবারের ইতিহাস লেখা নয়, তার আসল কাজ হলো হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গারের কি হয়েছিলো সেটা খুঁজে বের করা। ভ্যাঙ্গার পরিবারের ইতিহাস আসলে মুখ্য ব্যাপার নয় এখানে। এক বছর পর তার সাথে করা ভ্যাঙ্গারের চুক্তিটি শেষ হয়ে গেলে তাকে তার পারিশ্রমিক দিয়ে দেয়া হবে। তবে সে মনে করে তার আসল পুরস্কার হলো ওয়েনারস্ট্রম সম্পর্কে মূল্যবান কিছু তথ্য, যা কিনা মি: ভ্যাঙ্গারের দাবি অনুযায়ী তার কাছে রয়েছে। ভ্যাঙ্গারের কাছ থেকে তার পরিবার সম্পর্কে কিছু জানার পর এখন আর মনে হচ্ছে না একটা বছর খামোখাই গচ্চা যাবে। ভ্যাঙ্গার পরিবারের উপর একটি বই খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু হবে। সোজা কথায় এটা হবে চমকপ্রদ একটি গল্প।

হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গারের খুনির ব্যাপারে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই-তার ধারণা তাকে হত্যা করা হয়েছে, নিছক কোনো দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয় নি। ভ্যাঙ্গারের সাথে ব্লমকোভিস্ট একমত পোষণ করেছে। কোনো ষোলো বছরের মেয়ের পক্ষে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে সব ধরণের সরকারী বেসরকারী লোকজনের চোখের আড়ালে থেকে ছত্রিশ বছর কাটিয়ে দেয়া প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। আবার মি: ভ্যাঙ্গার হ্যারিয়েটের বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাটাও বাতিল করে দেয় নি। হয়তো সে স্টকহোমের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছিলো, এরপর তার কপালে খারাপ কিছু ঘটে—মাদকাসক্তি, পতিতাবৃত্তি, ধর্ষণ কিংবা নিছকই কোনো দুর্ঘটনা।

তবে ভ্যাঙ্গার মনে করে হ্যারিয়েটকে খুন করা হয়েছে আর সেটা করেছে তার নিজের পরিবারেরই কেউ—সম্ভবত বাইরের কারো সহায়তায়। তার এই যুক্তির পেছনে একটা বড় কারণ হলো হ্যারিয়েট এমন সময় নিখোঁজ হয়েছে যখন তাদের আইল্যান্ডটা দুর্ঘটনার জন্য বিচ্ছিন্ন ছিলো, ওরকম একটা হট্টগোলের সময় সবাই ছিলো ব্যস্ত।

তার এই কাজটার মূল উদ্দেশ্য যদি একটি হত্যারহস্য উদঘাটন হয়ে থাকে তাহলে বার্গার ঠিকই বলেছে। তার মতে এই কাজটা নেবার কোনো যুক্তিই নেই। এটা সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষও বুঝতে পারবে। তবে ব্লমকোভিস্ট এখন দেখতে পাচ্ছে এই পরিবারে হ্যারিয়েটের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে হেনরিক ভ্যাঙ্গারের বেলায় এটি বেশি প্রযোজ্য। তার অভিযোগ সত্যি হোক মিথ্যে হোক, নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে ভ্যাঙ্গারের এই অভিযোগ তার পরিবারের ইতিহাসের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। এই অভিযোগটি বিগত ত্রিশ বছর ধরে প্রায় প্রকাশ্যেই করা হচ্ছে। এরফলে পরিবারের মধ্যে এক ধরণের অনৈক্য আর অবিশ্বাসের আবহ গড়ে ওঠে যার পরিণতিতে বিশাল শিল্পপরিবারের আজ এই ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা। হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হবার রহস্য উদঘাটন করা যেমন পুরনো একটি অমীমাংসিত বিষয়ের মীমাংসা করা হবে সেই সাথে ভ্যাঙ্গার পরিবারের সঠিক ইতিহাস লিখতেও এটা সহায়ক হবে। এই ঘটনা বাদ দিয়ে কিংবা রহস্যটা সমাধান না করে ভ্যাঙ্গারদের ইতিহাস লেখাটা যথার্থ হবে না। প্রচুর তথ্য উপাত্ত আছে তাদের পরিবারের উপর। এখন সহজ একটি প্রশ্ন-তার প্রথম কাজ কি হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গারের রহস্য সমাধান করা নাকি ভ্যাঙ্গার পরিবারের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা। ঐ দিন ভ্যাঙ্গারের সাথে প্রথম দীর্ঘ আলাপের পর এই হলো সারবত্তা।

তাদের পরিবারের সদস্য সংখ্য প্রায় একশ’র মতো। এতো বড় পরিবার যে তাকে তার আই-বুকে একটি ডাটাবেইজ তৈরি করতে হলো। সে নোটপ্যাড প্রোগ্রাম (www dot ibrium dot se) ব্যবহার করলো, রয়্যাল টেকনিক্যাল কলেজের দু’জন এটা তৈরি করেছে ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের জন্য। ডাটাবেইজে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের তথ্য ইনপুট করে রাখলো সে।

তাদের পরিবারের বৃক্ষটি ষোড়শ শতাব্দীতে প্রোথিত। তখন এদের নাম ছিলো ভ্যাঙ্গিয়ারসাড। ভ্যাঙ্গারদের মতে তাদের পরিবারের নামটি সম্ভবত ডাচ ভ্যান গিয়ারস্টার্ট থেকে উদ্ভুত হয়েছে। সেটা যদি হয়ে থাকে তাহলে এই পরিবারের উৎস বারো শতক পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে।

আধুনিককালে পরিবারটি এসেছে উত্তর ফ্রান্স থেকে, উনবিংশ শতাব্দীতে রাজা জ্যঁ ব্যাপস্তিত বার্নাদোত্তের সাথে সুইডেনে চলে আসে তারা। আলেকজান্ডার ভ্যাঙ্গিয়ারসাড একজন সৈনিক ছিলো, রাজার সাথে তার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিলো না। তবে একটা গ্যারিসনের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলো সে। ১৮১৮ সালে তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তাকে হেডেবি এস্টেটটা দিয়ে দেয়া হয়। আলেকজান্ডার ভ্যাঙ্গিয়ারসাড নিজেও বেশ উপার্জন করেছিলো, নরল্যান্ডের প্রচুর বনজঙ্গল কিনে ফেলে সে। তার ছেলে এড্রিয়ার ফ্রান্সে জন্মালেও বাবার নির্দেশে সে হেডেবির নরল্যান্ডের প্রত্যন্ত বনভূমি অঞ্চলে এসে বসবাস করতে শুরু করে। পুরো এস্টেটের দায়িত্ব বুঝে নেয়। বনাঞ্চলে কৃষিকাজ প্রবর্তন করে সে, ইউরোপ থেকে নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আসে। হেডেস্টাডে কাগজ আর মণ্ড তৈরির কারখানার সূত্রপাতও ঘটে তার হাতে। আর এই পেপারমিলকে কেন্দ্র করেই শিল্পপরিবার হিসেবে ভ্যাঙ্গার পরিবারের যাত্রা শুরু হয় এবং তৈরি করা হয় হেডেস্টাড নামের এলাকাটি।

আলেকজান্ডারের নাতির নাম হেনরিক, সে-ই নিজের পারিবারিক পদবী সংক্ষেপ করে ভ্যাঙ্গার করে। রাশিয়ার সাথে সে ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করে, ছোটোখাটো একটি বাণিজ্যিক ফ্লিট তৈরি করে বাল্টিক আর জার্মানির সাথেও ব্যবসা আরম্ভ করে সে। ১৮০০ সালের দিকে ইংল্যান্ডের সাথে স্টিল ইন্ডাস্ট্রি স্থাপন করে হেনরিক। বড় হেনরিক বিভিন্ন ধরণের ব্যবসাবাণিজ্য করার পাশাপাশি আধুনিক খনি ব্যবসারও প্রচলন করে। তার ছিলো দু’ছেলে, বার্জার এবং গটফ্রিড। তারাই পরবর্তীতে ভ্যাঙ্গার পরিবারকে আরো অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যায়। দেশের সবচাইতে বড় শিল্পপরিবার হিসেবে ভ্যাঙ্গারদের প্রতিষ্ঠিত করে তারা।

“তুমি কি পুরনো উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে কিছু জানো?” জানতে চাইলো ভ্যাঙ্গার।

“না।”

“আমি নিজেও খুব একটা ভালো জানি না। আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য অনুযায়ী বার্জার আর গটফ্রিড বেড়ালের মতো লড়াইয়ে লিপ্ত হয়-তাদেরকে আমাদের পরিবারের ক্ষমতা আর প্রভাব নিয়ে ঐতিহাসিক লড়াইয়ের দু’জন কিংবদন্তী বলতে পারো। তাদের এই লড়াইয়ে আমাদের পুরো সাম্রাজ্যটা হুমকির মুখে পড়ে গিয়েছিলো। এ কারণে আমার বাবা মৃত্যুর কিছুদিন আগে একটা সিস্টেম প্রবর্তন করে যান-যেখানে পরিবারের সব সদস্য উত্তরাধিকার সূত্রে ব্যবসার একটি অংশ লাভ করবে। সন্দেহ নেই এর উদ্দেশ্য ছিলো মহৎ, তবে এর ফলে দক্ষ লোকজন আর বাইরে থেকে সম্ভাব্য পার্টনারদের আগমন বন্ধ হয়ে গেলো, বোর্ডে শুধু পরিবারের সদস্যরাই থাকলো।

“আজ পর্যন্ত সেটা বহাল আছে?”

“একেবারে আগের মতোই আছে। পরিবারের কোনো সদস্য যদি তার অংশের শেয়ার বিক্রি করতে চায় তো তাকে পরিবারের মধ্যেই থাকতে হবে। বর্তমানে শেয়ার হোল্ডারদের বার্ষিক মিটিংয়ে ৫০ শতাংশই পরিবারের সদস্য। মার্টিনের অধীনে ১০ শতাংশেরও বেশি শেয়ার আছে। কিছু শেয়ার মার্টিন আর অন্যদের কাছে বিক্রি করে দেয়ার পর আমার বর্তমান শেয়ারের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ শতাংশের মতো। আমার ভাই হেরাল্ড ৭ শতাংশের মালিক। শেয়ার হোল্ডারদের মিটিংয়ে বাকি যারা আসে তাদের শেয়ারের পরিমাণ এক থেকে দেড় শতাংশের বেশি হবে না।”

“মধ্যযুগীয় কাজকারবার বলে মনে হচ্ছে।”

“এটা একেবারেই হাস্যকর। এর মানে বর্তমানে মার্টিন যদি কোনো পলিসি প্রণয়ন করতে চায় তাহলে তাকে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ শেয়ার হোল্ডারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে লবিং করতে হবে। এটা আসলে পুরো ব্যবসার মধ্যে নোংরা রাজনীতি চালু করে দিয়েছে।”

ভ্যাঙ্গার তার ইতিহাস বলতে শুরু করলো :

“গটফ্রিড ভ্যাঙ্গার নিঃসন্তান হিসেবে ১৯০১ সালে মারা যান। সত্যি কথা বলতে কি তার চার চারটি মেয়ে ছিলো তবে ঐসব দিনে মেয়েদের হিসেবের মধ্যে রাখা হোতো না। তারাও শেয়ার পেতো তবে সেটা তার পরিবারের পুরুষ যদি তাদের নামে লিখে দিয়ে যেতো তখন। বিংশ শতাব্দীতে নারীদের ভোটাধিকার অর্জনের আগে তারা বোর্ড মিটিংয়ে পর্যন্ত উপস্থিত থাকতে পারতো না।”

“খুবই উদার ব্যাপার স্যাপার।”

“ব্যঙ্গ করার কোনো দরকার নেই। ঐ সময়গুলো খুব কঠিন ছিলো। গটফ্রিডের ভাই বার্গারের ছিলো তিন ছেলে : জোহান, ফ্রেডরিক আর গিডিওন ভ্যাঙ্গার। তারা সবাই উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে জন্মেছিলো। গিডিয়নকে আমরা বাদ দিতে পারি কারণ সে তার সমস্ত শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে আমেরিকায় চলে যায় স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য। এখনও সেখানে আমাদের পরিবারের শাখা রয়েছে। জোহান আর ফ্রেডরিক মিলে আমাদের এই কোম্পানিকে আধুনিক একটি কোম্পানিতে পরিণত করে।”

ভ্যাঙ্গার একটা ছবি বের করে ব্লমকোভিস্টকে দেখালো, যাদের সম্পর্কে কথা বলছে এটা তাদেরই ছবি। ১৯০০ সালের প্রথম দিকে তোলা। শক্ত চোয়ালের দু’জন মানুষ কোনো রকম হাসি হাসি মুখ না করেই ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

“জোহান ভ্যাঙ্গার ছিলো আমাদের পরিবারের একজন জিনিয়াস। একজন ইঞ্জিনিয়ার ছিলো সে, নিজের কিছু আবিষ্কার নিয়ে ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিজ করেন তিনি। তার কারণেই স্টিল আর আয়রন আমাদের ব্যবসার মূল ভিত্তি হয়ে ওঠে। তবে পরবর্তীতে টেক্সটাইল ব্যবসার দিকেও ঝুঁকে পড়েন তিনি। জোহান ১৯৫৯ সালে মারা যান। তার তিন মেয়ে ছিলো : সোফিয়া, মারিট আর ইনগ্রিড। তারাই আমাদের কোম্পানির প্রথম নারী শেয়ার হোল্ডার হয়, বার্ষিক মিটিংয়ে উপস্থিত হওয়া প্রথম নারীও তারাই।”

“অন্য ভাই ফ্রেডরিক ভ্যাঙ্গার আমার বাবা হন। তিনি একজন ব্যবসায়ী আর ইন্ডাস্ট্রি লিডার ছিলেন, জোহানের আবিষ্কারগুলো ব্যবহার করে প্রচুর মুনাফা করার ব্যবস্থা তিনিই করেন। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত উনি বেঁচে ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি কোম্পানিতে সক্রিয় ছিলেন, যদিও শেষের দিকে, মানে পঞ্চাশের দশকে নিত্যদিনের কাজকারবার আমার উপরেই দিয়ে দিয়েছিলেন।”

“জোহানের একটি মাত্র মেয়ে ছিলো।” বিশাল বক্ষা আর বড়সড় টুপি পরা এক মহিলার ছবি দেখালো ভ্যাঙ্গার। “আর আমার বাবা ফ্রেডরিকের শুধুমাত্র ছেলে সন্তান ছিলো। আমরা পাঁচ ভাই। রিচার্ড, হেরাল্ড, গ্রেগর, গুস্তাভ আর আমি।’

কয়েকটি এ-ফোর সাইজের কাগজ টেপ দিয়ে লাগিয়ে নিয়ে তার উপর পরিবারের বৃক্ষটি আঁকলো ব্লমকোভিস্ট। ১৯৬৬ সালে হেডেবিতে তাদের পরিবারের যেসব সদস্য উপস্থিত হয়েছিলো তাদের সবার নামের নীচে দাগ দিয়ে রাখলো সে। এদের মধ্যেই কেউ হয়তো হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গারের নিখোঁজ হওয়ার সাথে জড়িত।

বারো বছরের নীচে শিশুদের অবশ্য তালিকা থেকে বাদ দিলো। সন্দেহভাজনের সংখ্যা অনেক কমিয়ে আনতে হবে। কিছুক্ষণ ভাবার পর তালিকা থেকে হেনরিক ভ্যাঙ্গারকেও বাদ রাখলো সে। যদি সে তার ভায়ের মেয়ের নিখোঁজ হবার সাথে জড়িত থেকে থাকে তবে লোকটা বিগত ছত্রিশ বছর ধরে মনোবৈকল্যে ভুগছে বলে ধরে নেয়া হবে। কোনো সাইকোপ্যাথ ছাড়া এ কাজ করা সম্ভব নয়। ভ্যাঙ্গারের মা ঐ সময়টাতে একাশি বছরের বৃদ্ধা ছিলেন, সঙ্গত কারণে তাকেও বাদ দেয়া হলো। বাকি থাকলো তেইশজন পারিবারিক সদস্য, ভ্যাঙ্গারের মতে তাদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আসল খুনি। তবে এই তালিকার সাতজন ইতিমধ্যে মারা গেছে আর বেশ কয়েকজনের বয়স হয়ে গেছে অনেক বেশি।

হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হবার পেছনে যে পরিবারের কোনো সদস্য জড়িত ভ্যাঙ্গারের এমন ধারণার সাথে একমত পোষণ করতে ইচ্ছুক নয় ব্লমকোভিস্ট। সন্দেহভাজনের তালিকায় আরো অনেককে রাখতে হবে।

১৯৬২ সালের বসন্তকাল থেকে ডার্চ ফ্রোডি একজন আইনজীবি হিসেবে ভ্যাঙ্গারের সাথে কাজ করছে। পরিবারের সদস্য ছাড়া হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হবার সময় বাড়ির কাজের লোক কারা ছিলো? গুনার নিলসন-সে কোনো অ্যালিবাই হতে পারে আবার নাও হতে পারে-তার বয়স তখন মাত্র ঊনিশ ছিলো সে সময়, তার বাবা ম্যাঙ্গাস সম্ভবত হেডেবিতেই ছিলো তখন, ঠিক যেমনটি ছিলো আর্টিস্ট নরম্যান আর যাজক ফক। ফক কি বিবাহিত ছিলো? ওস্টারগার্ডেনের কৃষক আরোনসন আর তার ছেলে জার্কার আরোনসন আইল্যান্ডেই থাকতো, হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গার যেখানে বেড়ে উঠেছিলো তার খুব কাছেই থাকতো তারা তাদের মধ্যে কি ধরণের সম্পর্ক ছিলো? আরোনসন কি তখন বিবাহিত ছিলো? ঐ সময়টাতে কি ফার্মে আরো অনেক লোকজন ছিলো?

ব্লমকোভিস্ট সবার নাম লিখে রাখার পর দেখা গেলো মোট সংখ্যা চল্লিশ জনের মতো দাঁড়ালো। রাত ৩:৩০ বাজে, থার্মোমিটার বলছে মাইনাস ৬ ডিগ্রি। বেলমাঙ্গসগাটানের নিজের বিছানায় গিয়ে ঘুমানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলো সে।

*

টেলিয়া ফোন কোম্পানি থেকে একজন লোক এসে তার ঘুম ভাঙালো। ১১টার দিকে লোকটা কাজ শুরু করলেও তার ভাবসাব দেখে মনে হলো না সে পেশাদার একজন লোক। বরং তার নিজের ফোনটাও কাজ করলো না। মাথা মোটা লোকটা নিজের অফিসে পর্যন্ত ফোন করলো না।

যাইহোক শেষ পর্যন্ত ফোন লাইনটা চালু করা হলো। ব্লমকোভিস্ট তার মেইল খুলতেই দেখতে পেলো ৩৫০ টি মেসেজ জমা হয়েছে গত এক সপ্তাহে। এক ডজনের মতো সেভ করে বাকিগুলো ডিলিট করে দিলো কারণ ওগুলো স্পাম অথবা সাবস্ক্রাইবার মেইল। প্ৰথম ই-মেইলটা এসেছে demokrat88 at yahoo.com থেকে : বসে বসে ধন চোষো, শালার বানচোত শুয়োর। সে এটা ‘বুদ্ধিদীপ্ত সমালোচনা’ নামের একটা ফোল্ডার তৈরি করে সেভ করে রাখলো।

এরিকা বার্গারকে সে মেইল করলো : “হাই রিকি। শুধু বলতে চাচ্ছিলাম আমার নেট কানেকশান চালু হয়ে গেছে, ক্ষমা করতে পারলে যখন খুশি যোগাযোগ কোরো। হেডেবি জায়গাটা একবোরে গ্রামীণ একটি এলাকা। বেড়াতে আসার জন্য আমন্ত্রণ রইলো। এম।”

লাঞ্চটাইমে আই-বুক আর ব্যাগটা হাতে নিয়ে সুসানের বৃজ ক্যাফে’তে চলে এলো সে। বসলো ক্যাফের একেবারে কোণের একটা টেবিলে। সুসান তার জন্য কফি আর স্যান্ডউইচ নিয়ে এলে তার কম্পিউটার দেখে ভুরু কুচকে তাকিয়ে জানতে চাইলো সে কি কাজ করে। এই প্রথম ব্লমকোভিস্ট নিজের কভার স্টোরিটা বললো কাউকে। কথাটা শুনে খুশি হলো মহিলা, তাকে তাড়া দিলো আসল সত্য জানতে চাইলে যেনো তার সাথে যোগাযোগ করে সে।

“আমি তো পয়ত্রিশ বছর ধরে ভ্যাঙ্গারদের সেবা করে আসছি। তাদের পরিবারের প্রায় সব গালগল্পই আমার জানা,” কথাটা বলেই তাড়াহুড়া করে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো সুসান। বাচ্চা-কাচ্চা, নাতি-নাতনিদের নিয়ে-যাদেরকে সে সন্দেহভাজনের তালিকায় রাখে নি-ফ্রেডরিক আর জোহান ভ্রাতৃদ্বয়ের বংশধরের সংখ্যা বর্তমানে পঞ্চাশজনের মতো হবে। পরিবারটির বেশিরভাগ সদস্যই বেশ দীর্ঘ আয়ুর অধিকারী। ফ্রেডরিক ভ্যাঙ্গার আটাত্তুর বছর বেঁচেছিলেন, তার ভাই জোহান বাহাত্তুর বছর। ফ্রেডরিকের ছেলেরা এখনও বেঁচে আছে। হেরাল্ডের বয়স বিরানব্বই আর হেনরিকের বিরাশি

ব্যাতিক্রম কেবল গুস্তাভ, মাত্র সাইত্রিশ বছর বয়সে ফুসফুসের এক রোগে সে মারা যায়। ভ্যাঙ্গার তাকে বলেছে গুস্তাভ নাকি সব সময় নিজের মতো জীবনযাপন করতো। বছরের বেশিরভাগ সময় অসুস্থ থাকতো সে। পরিবারের বাকিদের সাথে সে একেবারেই খাপ খেতো না। বিয়ে করে নি তাই বাচ্চাকাচ্চাও ছিলো না।

বাকি যারা অল্প বয়সে মারা গেছে তারা অসুখবিসুখে মারা যায় নি, তাদের মৃত্যুর কারণ ছিলো অন্য কিছু। রিচার্ড ভ্যাঙ্গার মাত্র তেত্রিশ বছরে মারা যান উইন্টার যুদ্ধে। হ্যারিয়েটের বাবা গটফ্রিড মেয়ের নিখোঁজ হবার এক বছর আগে পানিতে ডুবে মারা যান। আর হ্যারিয়েট নিজে নিখোঁজ হয় মাত্র ষোলো বছর বয়সে। পরিবারের নির্দিষ্ট কয়েকজনের অদ্ভুত মৃত্যুগুলো নোট করে রাখলো মিকাইল-দাদা, বাবা আর কন্যা; সবাই দুর্ভাগ্যের শিকার। রিচার্ডের বেঁচে থাকা একমাত্র বংশধর মার্টিন ভ্যাঙ্গারের বয়স চুয়ান্ন, তবে সে এখনও বিয়ে করি নি। হেনরিক ভ্যাঙ্গার বলেছে তার এই ভাতিজার সাথে হেডেস্টাডের এক মহিলার সম্পর্ক আছে।

পারিবারিক বৃক্ষের উপর দুটো ফ্যাক্টর লিখে রাখলো ব্লমকোভিস্ট। প্রথমটি হলো কোনো ভ্যাঙ্গার ডিভোর্স অথবা পুণরায় বিয়ের পথে পা বাড়ায় নি, এমনকি নিজেদের স্ত্রী কিংবা স্বামী অল্পবয়সে মারা গেলেও। পরিসংখ্যানের দিক থেকে দেখলে সেটা কতোটা কমন সেটা নিয়ে ভাবলো। দু’বছর ধরে সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গার স্বামীর সাথে সেপারেশনে আছে, তবে এখনও তাদের মধ্যে ডিভোর্স হয় নি।

অন্য ব্যাপারটা হলো, ফ্রেডরিকের বংশধরেরা যেখানে পারিবারিক ব্যবসায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে এবং হেডেস্টাডের আশেপাশেই বসবাস করেছে সেখানে জোহানের বংশধর অর্থাৎ তার একমাত্র কন্যা বিয়ে করে স্টকহোম, মামো, গোথেবর্গ অথবা অন্য কোথাও চলে গেছে। তারা কেবল গ্রীষ্মকালে কিংবা গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক মিটিংয়ে উপস্থিত হবার জন্য হেডেস্টাডে আসে। ব্যাতিক্রম কেবল একজন, ইনগ্রিড ভ্যাঙ্গার, যার ছেলে গুনার কার্লম্যান বসবাস করে হেডেস্টাডে। হেডেস্টাড কুরিয়ার-এর চিফ এডিটর সে।

একজন প্রাইভেট ডিটেক্টিভ হিসেবে ভাবলে ভ্যাঙ্গার মনে করে হ্যারিয়েটের হত্যার পেছনে যে মোটিভ সেটা সম্ভবত তাদের কোম্পানির গঠনের মধ্যেই নিহিত আছে। আগেই সে জানিয়েছিলো হ্যারিয়েট তার কাছে স্পেশাল কিছু ছিলো। হেনরিক ভ্যাঙ্গারের কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্যেও হয়তো এটা করা হয়ে থাকবে, কিংবা হ্যারিয়েট হয়তো এমন কোনো স্পর্শকাতর তথ্য জেনে গিয়েছিলো যার সাথে কোম্পানির সম্পর্ক আছে, ফলে তাকে হুমকি মনে করে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এগুলো হলো অনুমান। যে ত্রিশজন সন্দেহভাজনের তালিকা করা হয়েছে কোম্পানিতে তাদের সবারই স্বার্থ রয়েছে।

ব্লমকোভিস্টের সাথে ভ্যাঙ্গারের যে কথাবার্তা হয়েছে তাতে করে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শুরুতে বৃদ্ধ তার পরিবারের অনেক সদস্যের বিরুদ্ধে যে বিষোদগার করেছিলো সেটা খুব অদ্ভুত মনে হয়েছিলো ব্লমকোভিস্টের কাছে। সে ভেবেছিলো হয়তো হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হবার ঘটনায় বুড়ো সন্দেহবশত তার পরিবারের অনেকের বিরুদ্ধে খারাপ ধারণা পোষণ করা শুরু করেছিলো। তবে এখন বুঝতে পারছে ভ্যাঙ্গার একেবারে নিরপেক্ষ আর বেশ ভদ্রভাবেই এসব মূল্যায়ণ করেছে।

সবার কাছে এ পরিবারটি সামাজিক আর আর্থিকভাবে সফল একটি পরিবার হিসেবেই চিহ্নিত। কিন্তু আদতে এটা একেবারেই অকার্যকর পরিবার।

হেনরিক ভ্যাঙ্গারের বাবা একজন শীতল আর কম অনভূতিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন, জন্ম দেবার পর পরই নিজের সন্তানদের সমস্ত ভরণপোষণ আর ভালোমন্দ ছেড়ে দেন স্ত্রীর হাতে। ষোলো বছরের আগে তার সন্তানেরা নিজের বাবাকে শুধুমাত্র পারিবারিক কিছু বিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া খুব একটা চোখেও দেখতে পায় নি। তার বাবা তার দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন কখনও এরকম কোনো স্মৃতি হেনরিক ভ্যাঙ্গারের নেই। বরং ছেলেকে তিনি মাঝেমধ্যেই তীব্র সমালোচনা করতেন, বলতেন অকর্মা আর অযোগ্য। প্রায়শই শারিরীকভাবে সন্তানদের মারপিটও করতেন তিনি যদিও সেসবের কোনো দরকারই ছিলো না। পরবর্তীতে ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশনে সাফল্যজনক অবদান রাখার পরই জীবনে প্রথমবারের মতো বাবার কাছ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছিলো হেনরিক।

তার বড় ভাই রিচার্ড অবশ্য বিদ্রোহ করেছিলো। কোনো একটা বিষয় নিয়ে বাবা ছেলের মধ্যে বাদানুবাদের পর সে পড়াশোনার জন্য উপসালায় চলে যায়। কী বিষয় নিয়ে তাদের এই বাদানুবাদ সেটা তারা কখনই জানতে পারে নি। ভ্যাঙ্গার অবশ্য উল্লেখ করেছিলো সেখানেই তাদের পরিবারে নাৎসি বীজ রোপিত হয় আর এর ফলেই ফিনিস ট্রেঞ্চের ঐ ঘটনাটি ঘটে। তবে বৃদ্ধ ঐ দিন যা বলে নি সেটা হলো তার বাকি দু’ভাইয়ের ক্যারিয়ারও আসলে একই রকম ছিলো।

১৯৩০ সালে হেরাল্ড আর গ্রেগর বড় ভাই রিচার্ডকে অনুসরণ করে উপসালায় চলে যায়। তারা দু’জন বেশ ঘনিষ্ঠ থাকলেও রিচার্ডের সাথে ঠিক কোন্ কারণে তারা সময় কাটিয়েছিলো সে ব্যাপারে একদম নিশ্চিত নয় সে। তবে এটা নিশ্চিত তার ভায়েরা পার ইংডাল, অর্থাৎ নতুন সুইডেন নামের ফ্যাসিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলো। বিগত বছরগুলোতেও হেরাল্ড পার ইংডালের প্রতি অনুগত ছিলো। নব্বই দশকে সংগঠনটির মৃত্যু হবার আগপর্যন্ত এর সদস্য হিসেবে বহাল ছিলো সে। একটা সময় সে ছিলো সুইডিশ ফ্যাসিস্ট আন্দোলনের প্রধান অর্থদাতা।

উপসালায় হেরাল্ড ভ্যাঙ্গার মেডিসিনের উপর পড়াশোনা শেষ করার পর পরই ফ্যাসিজমের সাথে জড়িয়ে পড়ে। কিছুদিন সুইডিশ রেস ইন্সটিটিউটে জনসংখ্যার মধ্য থেকে অনাকাঙ্খিত-অযাচিত এলিমেন্ট বাদ দিয়ে বিশুদ্ধ করার কাজে একজন ফিজিশিয়ান হিসেবে কাজ করেছে সে।

উদ্ধৃতি, হেনরিক ভ্যাঙ্গার, টেপ ২, ০২৯৫০ :

হেরাল্ড আরো বেশি গভীরে ঢুকে পড়েছিলো। ১৯৩৭ সালে ছদ্মনামে সে অন্য আরেকজন লেখকের সাথে পিপল্স নিউ ইউরোপ নামের একটি বই লেখে। সত্তুর দশকের আগে এটার সম্পর্কে আমি নিজেও কিছু জানতাম না। আমার কাছে এর একটা কপি আছে, চাইলে তুমি ওটা পড়তে পারো। এটা সুইডিশ ভাষায় লেখা অন্যতম একটি আলোচিত বই। হেরাল্ড কেবল বিশুদ্ধকরণের পক্ষেই যুক্তি দেখায় নি বরং euthanasia, অর্থাৎ ভালোর জন্য মৃত্যুর পক্ষেও অভিমত তুলে ধরে। এর মানে হচ্ছে যেসব লোকজনের মেধা এবং রুচি নিম্নমানের এবং বিশুদ্ধ সুইডিশ ইমেজের সাথে যারা খাপ খায় না তাদেরকে হত্যা করা। অন্য কথায় সে নিজের এমন একটি বই লিখে গণহত্যা চালাতে পরামর্শ দেয় যেটা কিনা একেবারে বিশুদ্ধ একাডেমিক জ্ঞান আর চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাহায্যে লিখিত। যারা প্রতিবন্ধী তাদেরকে মেরে ফেলা আর কি। অযোগ্য লোকজনদেরকে বংশ বিস্তার করতে দিও না। মানসিকভাবে যেসব লোক দুর্বল আর বিপর্যস্ত তাদেরকে মুক্তি দেবার জন্যই মেরে ফেলা ভালো, তাই নয় কি? স্বধীনচেতা নারী, ভবঘুরে, যাযাবর আর ইহুদি-বুঝতেই পারছো। আমার ভায়ের কারণে কুখ্যাত অসভিচ এই ডালারনা’তেও হতে পারতো।

যুদ্ধের পর গ্রেগর ভ্যাঙ্গার সেকেন্ডারি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে, পরে হেডেস্টাডের প্রিপারেটরি স্কুলের প্রধানশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পায় সে। ভ্যাঙ্গার মনে করে যুদ্ধের পর সে কোনো পার্টির সাথে জড়িত ছিলো না, নাৎসি মতবাদও পরিত্যাগ করে। ১৯৭৪ সালে সে মারা গেলে তার ভায়ের চিঠিপত্র থেকে সে জানতে পারে পঞ্চাশের দশকে গ্রেগর রাজনৈতিকভাবে প্রভাবহীন এবং একেবারেই অনুল্লেখযোগ্য দল নরডিক ন্যাশনাল পার্টিতে যোগ দিয়েছিলো। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই দলেরই সদস্য ছিলো সে।

উদ্ধৃতি, হেনরিক ভ্যাঙ্গার, টেপ ২, ০৪১৬৭ :

ফলে আমার তিন ভাই রাজনৈতিকভাবে উন্মাদ ছিলো বলা যায়। অন্য বিষয়ে তারা কতোটা অসুস্থ ছিলো?

ভ্যাঙ্গারের চোখে তার যে ভাইটি কিছুটা সহমর্মিতা পেয়েছে সে হলো অসুস্থ গুস্তাভ। ১৯৫৫ সালে ফুসফুসের রোগে মারা যায় সে। গুস্তাভ কখনই রাজনীতিতে আগ্রহী ছিলো না। একটু বৈরাগ্য ধরণের লোক ছিলো সে। ব্যবসায়ও কোনো মনোযোগ ছিলো না। ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশনে কোনো কাজ করার ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ দেখা যায় নি।

ভ্যাঙ্গারের কাছে ব্লমকোভিস্ট জানতে চাইলো : “এখন আপনি আর হেরাল্ডই শুধু বেঁচে আছেন। সে কেন হেডেবিতে ফিরে এলো?”

“১৯৭৯ সালে ফিরে এসেছে সে। তার নিজের বাড়িতে।”

“যে ভাইকে এতোটা ঘৃণা করেন তার কাছাকাছি বসবাস করাটা আজব এক ধরণের অনুভূতি লাগে নিশ্চয়?”

“আমি আমার ভাইকে ঘৃণা করি না। তার জন্যে আমার মনে শুধু করুণা আছে। সে আস্ত একটা গর্দভ। সে-ই একমাত্র ব্যক্তি যে আমাকে ঘৃণা করে।”

“আপনাকে ঘৃণা করে?”

“হ্যা। আমার মনে হয় এজন্যেই সে এখানে ফিরে এসেছিলো। যাতে করে খুব কাছে থেকে আমাকে ঘৃণা করতে পারে।”

“আপনাকে সে ঘৃণা করে কেন?”

“কারণ আমি বিয়ে করেছিলাম।”

“মনে হচ্ছে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে হবে আপনাকে

অনেক আগে ভ্যাঙ্গারের সাথে তার বড় ভায়ের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো। হেনরিকই ছিলো একমাত্র ভাই ব্যবসার প্রতি যার আগ্রহ দেখা যেতো। সে ছিলো তার বাবার শেষ আশা ভরসা। রাজনীতিতেও তার কোনো আগ্রহ ছিলো না। স্টকহোমে গিয়ে অর্থনীতিতে পড়াশোনা করে সে। আঠারো বছর বয়স হবার পর থেকেই ছুটিছাটায় বাড়ি এসে নিজের পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতো হেনরিক। পারিবারিক ব্যবসার নানান ব্যাপার-স্যাপার তার চেনা হয়ে যায় বহু আগেই।

১৯৪১ সালের ১০ই জুন যুদ্ধের মাঝপর্যায়ে তাকে জার্মানিতে পাঠানো হয় হামবুর্গে অবস্থিত ভ্যাঙ্গার কোম্পানির একটি ব্যবসায়িক অফিসে। তার বয়স তখন মাত্র একুশ, ভ্যাঙ্গারদের জার্মান এজেন্ট ছিলো খুবই অভিজ্ঞ ব্যক্তি হারম্যান লোবাখ। ঐ লোকই তার সব কিছু দেখাশোনা করেছিলো জার্মানিতে থাকার সময়।

“সব ঘটনা বিস্তারিত বলে আমি তোমাকে বিরক্ত করবো না। আমি যখন ওখানে যাই তখনও স্টালিন আর হিটলার ভালো বন্ধু ছিলো। ইস্টার্ন ফ্রন্ট নামের কোনো ফ্রন্টের জন্মও তখন হয় নি। ঐ সময় সবাই বিশ্বাস করতো হিটলার অপরাজেয়। বলতে পারো একই সাথে আশা আর নিরাশার সময় ছিলো সেটা। আজ পঞ্চাশ বছর পরও ঐ সময়টাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে অনেক বেগ পেতে হয়। আমার কথা শুনে আবার আমাকে ভুল বোঝো না আমি কোনো নাৎসি সমর্থক নই। আমার চোখে হিটলার হলো কোনো অপেরার অর্থহীন একটি চরিত্র। তবে হামবুর্গের লোকজন বেশ আশাবাদী ছিলো তখনও। যুদ্ধ যে খুব সন্নিকটে ঘনিয়ে আসছে, হামবুর্গে যে বেশ কয়েক বার বোমা বর্ষণ করা হয়েছে সেটা জানার পরও আমি ওখানেই ছিলাম সেই সময়টাতে। লোকজন মনে করতো এটা একেবারেই সাময়িক একটি দুর্ভোগ-খুব জলদি হিটলার যুদ্ধে জয় লাভ করবে এবং প্রতিষ্ঠিত করবে তার নিউরোপা। লোকজন হিটলারকে ঈশ্বর হিসেবে বিশ্বাস করতে চাইতো। অন্তত প্রোপাগান্ডা শুনে তাই মনে হতো তখন।”

ভ্যাঙ্গার তার কাছে থাকা অনেকগুলোর ফটো অ্যালবামের একটি খুললো।

“এ হলো লোবাখ। ১৯৪৪ সালে সে নিখোঁজ হয়ে যায়। এক বোমাবর্ষণের পর তাকে আর পাওয়া যায় নি। তার ভাগ্যে কী ঘটেছিলো কখনও জানতে পারি নি। হামবুর্গে কয়েক সপ্তাহ থাকার সময় তার সাথে আমার বেশ ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিলো। হামবুর্গে এক অভিজাত এলাকার বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে তার পরিবারের সাথে আমি থাকতাম। প্রতিদিনই আমরা প্রচুর সময় একসাথে কাটাতাম। সে কোনো নাৎসি ছিলো না। একদমই না। তবে সুবিধার খাতিরে নাৎসি পার্টির সদস্য ছিলো সে। তার এই সদস্যপদের কারণে ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশনের জন্য অবারিত দ্বার খুলে যায়। আমরা অনেক বাড়তি সুবিধাও পেয়ে যাই। তবে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমরা শুধু ব্যবসাই করেছি। তাদের ট্রেনের জন্য আমরা ফ্রেইট ওয়াগন বানাতাম-আমি সব সময়ই ভাবি আমাদের তৈরি কোনো ওয়াগন পোল্যান্ডে গিয়েছিলো কিনা। তাদের সৈন্যদের জন্য ইউনিফর্ম আর রেডিওর জন্য টিউবও বানাতাম আমরা। অবশ্য অফিশিয়ালি আমরা জানতাম না তারা আমাদের তৈরি জিনিস দিয়ে আসলে কী করতো। লোবাখ জানতো কিভাবে এসব চুক্তি করতে হোতো। সে খুব আমুদে আর রুচিবান একজন মানুষ ছিলো। খাঁটি নাৎসি। ক্রমেই আমি জানতে পারলাম সে নিজের সম্পর্কে একটি সিক্রেট লুকিয়ে রেখেছে।

“১৯৪১ সালের ২২শে জুন খুব সকালে সে আমার ঘরের দরজায় নক করলো। তার স্ত্রীর শোবার ঘরের পাশের ঘরেই থাকতাম আমি। আমরা দু’জন নীচে নেমে স্মোক করার ঘরে বসলাম। সারা রাত জেগেছিলো লোবাখ। তার কাছে থাকা একটা রেডিও চালু ছিলো তখনও। বুঝতে পারলাম সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে হয়তো। অপারেশন বারবারোসা শুরু হয়ে গেছে। জার্মানি গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে বসে।” একটু থামলো ভ্যাঙ্গার। “লোবাখ আমাদের জন্য দু’গ্লাস মদ ঢাললো। থরথর করে কাঁপছিলো সে। তাকে যখন জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে জবাবে সে আমাকে জানালো সে নাকি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছে জার্মানি আর নাৎসিবাদের পতন হতে যাচ্ছে। তার কথা আমি অবশ্য পুরো বিশ্বাস করলাম না। হাজার হোক তখনও হিটলারকে অপরাজেয় মনে হতো আমাদের কাছে। মদ পান করার পর সে আসল কথায় চলে এলো।

তাকে তার গল্প বলে যাবার জন্য মাথা নেড়ে ইশারা করলো ব্লমকোভিস্ট

“প্রথমত নির্দেশ নেবার জন্য আমার বাবার সাথে যোগাযোগ করার মতো কোনো সম্ভাবনা ছিলো না তার। তবে জার্মানিতে আমার ভ্রমণ সংক্ষেপ করে আমাকে দেশে ফেরত পাঠানোর একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে। দ্বিতীয়ত সে আমাকে তার জন্যে একটা কাজ করে দিতে বলে।”

একটা হলুদ রঙের ছবির দিকে ইঙ্গিত করলো ভ্যাঙ্গার। কালো চুলের এক মহিলার ছবি সেটা।

“চল্লিশ বছর ধরে লোবাখ বিবাহিত ছিলো, তবে ১৯১৯ সালে নিজের বয়সের অর্ধেক অসম্ভব এক সুন্দরী মেয়ের সাথে তার পরিচয় ঘটে। ঐ মেয়ের প্রেমে পড়ে যায় সে। মেয়েটি খুব গরীব ঘরের ছিলো, সহজ-সরল আর সাধারণ এক মেয়ে। অন্য অনেক ধনীর মতো লোবাখও তাকে নিজের কর্মস্থলের খুব কাছে একটা অ্যাপার্টমেন্ট কিনে তাকে ওখানে রেখে দেয়। মেয়েটা হয়ে ওঠে তার রক্ষিতা। ১৯২১ সালে তাদের ঘরে এক মেয়ের জন্ম হয়, তাকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করে নাম দেয়া হয় এডিথ।”

“ধনী বৃদ্ধলোক, গরীব এক তরুণী আর তাদের ভালোবাসার এক সন্তান-এটা তো চল্লিশের দশকে অতোটা কেলেংকারীর ব্যাপার ছিলো না,” বললো ব্লমকোভিস্ট।

“ঠিক বলেছো। তবে মেয়েটা ছিলো ইহুদি। আর লোবাখ ছিলো নাৎসি জার্মানিতে এক ইহুদি কন্যাসন্তানের পিতা। তাদের ভাষায় সে হোতো ‘জাতির সাথে বেঈমানি করা এক বিশ্বাসঘাতক। “

“আহ্…….তা অবশ্য ঠিক। পুরো পরিস্থিতিটাই বদলে গেলো দেখছি। তো কি হয়েছিলো?”

“এডিথের মাকে ১৯৩৯ সালে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর থেকে তার আর কোনো হদিশ পাওয়া যায় নি। বুঝতেই পারছো তার ভাগ্যে কি ঘটেছিলো। এটা সবাই জানতো যে ঐ মহিলার এক মেয়ে আছে যাকে এখনও তুলে নেবার তালিকায় যোগ করা হয় নি। গেস্টাপো বাহিনী তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছিলো তখন, যাদের কাজই ছিলো ফেরারি ইহুদিদের খুঁজে বের করে ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া। ১৯৪১ সালের গ্রীষ্মে, আমি হামবুর্গে গেলাম যে সপ্তাহে, এডিথের মায়ের সাথে লোবাখের যে সম্পর্ক সেটা কর্তৃপক্ষের কাছে ফাঁস হয়ে যায়। তাকে জেরা করার জন্য ডেকে পাঠানো হলে সে বিয়ে এবং সন্তানের পিতৃত্ব সবই স্বীকার করে নেয়, তবে তার মেয়ে কোথায় আছে সে ব্যাপারে কিছু জানে না বলে জানায়। আরো জানায় মেয়ের সাথে দশ বছর ধরে তার কোনো যোগাযোগ নেই।”

“তাহলে তার মেয়ে কোথায় ছিলো?”

“লোবাখের বাড়িতে তাকে আমি প্রতিদিনই দেখতাম। খুবই সুন্দরী আর শান্তশিষ্ট বিশ বছরের এক তরুণী। আমার ঘর পরিস্কার আর বিছানা ঠিক করে দিতো সে। রাতের ডিনারও সার্ভ করতো আমাদের জন্য। ১৯৩৭ সালের মধ্যে ইহুদি নিধন বেশ ভালোমতোই শুরু হয়ে যায়, এডিথের মা লোবাখের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলে সেও সাহায্য করেছিলো-লোবাখ তার অন্য সন্তানদের মতো এই অবৈধ মেয়েকেও সমান ভালোবাসতো। তাকে খুবই অদ্ভুত এক জায়গায় সে লুকিয়ে রাখে একেবারে সবার নাকের ডগায়। কিছু জাল কাগজপত্র জোগার করে নিজের মেয়েকে বাড়ির কাজের মেয়ে হিসেবে রেখে দিয়েছিলো সে।”

“তার স্ত্রী কি জানতো মেয়েটা কে?”

“না। মনে হয় সে ব্যাপারে তার কোনো ধারণাই ছিলো না। চার বছর ধরে এভাবে চলছিলো, তবে সে সময় লোবাখের কাছে মনে হলো ব্যাপারটা আর এভাবে চলতে পারে না। যে কোনো সময় গেস্টাপো বাহিনী তার দরজায় নক করে বসবে। এরপরই সে তার মেয়েকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। মেয়েটা এতোটাই লাজুক ছিলো যে আমার চোখের দিকে তাকাতেও পারছিলো না। তাকে মাঝরাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছিলো লোবাখ, তারপর আমার কাছে এসে নিজের মেয়ের জীবন বাঁচানোর জন্য অনুরোধ করে।”

“কিভাবে?”

“সব কিছু সে ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। আরো তিন সপ্তাহ ওখানে থেকে রাতের ট্রেনে ক’রে কোপেনহেগেনে চলে যাবার কথা ছিলো আমার, সেখান থেকে ফেরি পার হয়ে দেশে। যুদ্ধের সময় হলেও মোটামোটি নিরাপদ একটি ভ্রমণ ছিলো সেটা। তবে আমাদের মধ্যে কথা হবার দু’দিন পর ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশনের একটি ফ্রেইটার হামবুর্গ থেকে সুইডেন চলে আসার কথা ছিলো। লোবাখ আমাকে সেই ফ্রেইটারে করে চলে যাবার জন্যে বলে। জামার্নিতে থাকাটা নিরাপদ নয় বলে মনে করেছিলো সে। আমার ভ্রমণ পরিকল্পনার এই পরিবর্তন সিকিউরিটি সার্ভিস কর্তৃক অনুমোদনের দরকার তবে সেটা নিতান্তই আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপার। অনুমোদন পেতে কোনো সমস্যাই হবে না। লোবাখ আমাকে সেই ফ্রেইটারে করে চলে যেতে তাগাদা দিতে লাগলো

“ধরে নিচ্ছি এডিথের সাথে।”

“এডিথকে সেই ফ্রেইটারের শত শত মেশিনের বাক্সের একটিতে লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। আমার কাজ ছিলো জার্মানির জলসীমার মধ্যে থাকার সময় যদি তল্লাশীতে এডিথ ধরা পড়ে যায় তাহলে আমি যেনো তাকে রক্ষা করি। জার্মানি থেকে বেরিয়ে আসার পর তাকে বাক্স থেকে বের করার কথা।’

“ভয়ঙ্কর ব্যাপার।”

“আমার কাছে ব্যাপারটা অবশ্য খুব সহজ মনে হয়েছিলো তবে এই ভ্রমণটি আমাদের জন্য একটি দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠে। জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলো ওস্কার গ্রানাথ, নিজের মালিকের ছোটো ছেলের এই ঝুঁকিপূর্ণ বোঝা বহন করার দায়িত্ব নিয়ে মোটেও খুশি ছিলো না সে। জুনের এক রাতে, ৯টার দিকে আমরা হামবুর্গ ছাড়ি। আমরা মাত্র হার্বারের কাছে পৌছেছি তখনই বিমান হামলার সাইরেন বাজতে শুরু করে। বৃটিশরা বিমান হামলা চালাতে যাচ্ছিলো-আমার অভিজ্ঞতায় সেটা ছিলো সবচাইতে মারাত্মক একটি হামলা। আর সত্যি বলতে কি হার্বারটা ছিলো সেই বিমান হামলার প্রধান টার্গেট। তবে শেষ পর্যন্ত আমরা জাহাজে করে রওনা দিতে পেরেছিলাম। অসংখ্য মাইন থাকা সাগর আর সামুদ্রিক ঝড় পেরিয়ে আমরা চলে আসি কার্লসক্রোনায়। তুমি হয়তো জানতে চাইবে মেয়েটার কি হয়েছিলো।”

“আমার মনে হয় আমি সেটা জানি।”

“আমার বাবা বোধগম্য কারণেই রেগেমেগে একাকার। আমি বোকার মতো নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছি। মেয়েটাকে যেকোনো সময় সুইডেন থেকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হতে পারে। কিন্তু এরইমধ্যে আমি মেয়েটার প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করে দিয়েছি। আমি মেয়েটাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে আমার বাবাকে একটা আল্টিমেটাম দিয়ে দেই-হয় তিনি আমাদের বিয়েটাকে মেনে নেবেন নয়তো পারিবারিক ব্যবসার জন্য অন্য কোনো মাথা মোটা গর্দভকে খুঁজে নেবেন। তিনি হাল ছেড়ে দেন।”

“কিন্তু ঐ মেয়েটা তো মরে গেলো?”

“হ্যা। অনেক অল্পবয়সে। ১৯৫৮ সালে। জন্মগতভাবেই তার হৃদযন্ত্রে সমস্যা ছিলো। এজন্যে আমাদের কোনো সন্তানও হয় নি। আমার ভাই ঠিক এই কারণেই আমাকে ঘৃণা করে।”

“কারণ আপনি তাকে বিয়ে করেছিলেন।”

“তার ভাষায় আমি এক জঘন্য ইহুদি বেশ্যাকে বিয়ে করেছি।”

“কিন্তু তিনি তো উন্মাদ ছিলেন।”

“আমারও তাই মনে হয়।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *