০১. মামলাটি শেষ হয়ে গেলো

দ্য গার্ল উইথ দি ড্রাগন ট্যাটু / মূল : স্টিগ লারসন / অনুবাদ : মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন / স্টিগ লারসন-এর আলোড়ন সৃষ্টিকারী থৃলার / প্রথম প্রকাশ : মে, ২০১০

উৎসর্গ :

আমার প্রথম মৌলিক থূলার নেমেসিস-এর সকল পাঠককে

মুখবন্ধ

নভেম্বরের এক শুক্রবার

এটা প্রতি বছরই ঘটে, অনেকটা রীতিতে পরিণত হয়েছে যেনো। আজ তার বিরাশিতম জন্মদিন। যথারীতি ফুলটা ডেলিভারি দেয়া হলে র‍্যাপিং পেপার খুলে ডিটেক্টিভ সুপারিন্টেডেন্ট মোরেলকে ফোন করলো সে। ডিটেক্টিভ এখন অবসরে আছে, ডালারনায় অবস্থিত লেক সিলিয়ানে বসবাস করে। তারা কেবল সমবয়সীই নয়, একই দিনেও জন্মেছে—সব কিছু বিবেচনা করলে ব্যাপারটা পরিহাসেরই বটে। বৃদ্ধপুলিশ কফির মগ নিয়ে বসেছিলো প্রত্যাশিত ফোনকলের জন্য।

“ওটা এসেছে।”

“এ বছর কি পাঠিয়েছে?”

“এটা কি জাতের সেটা আমি জানি না। কাউকে দেখালে বলতে পারবে হয়তো। জিনিসটা সাদা রঙের।”

“ধরে নিচ্ছি কোনো চিঠি পাঠায় নি।”

“শুধু ফুল। ফ্রেমটা গত বছরের মতোই। নিজের হাতে বানানো মনে হয়।”

“পোস্টমার্ক?”

“স্টকহোম।”

“হাতে লেখা?”

“সব সময় যেমনটি হয়। সবটাই ক্যাপিটাল লেটারে, একেবারে পরিস্কার আর গোটা গোটা অক্ষরে লেখা।

এ কথা বলেই সে হাপিয়ে উঠলো। পরবর্তী এক মিনিট পর্যন্ত কেউ কোনো কথা বললো না। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের লোকটি চেয়ারে হেলান দিয়ে পাইপে টান দিলো। সে জানে এই কেসে নতুন কিছু আলোকপাত করতে পারে সেরকম কোনো মন্তব্য কিংবা কঠিন প্রশ্ন করা হবে না। সেসব করার দিন অনেক আগেই অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এই দুই বৃদ্ধের মধ্যে এই যে কথোপকথন সেটাও যেনো অনেকটা রীতিতে পরিণত হয়েছে, যার সাথে জুড়ে আছে একটি রহস্য, সেই রহস্যের ব্যাপারে কৌতুহল কিংবা এটা উন্মোচন করার আগ্রহ এ বিশ্বের কারোরই নেই।

লাতিন নামটা হলো লেপটোসপারমাম (মারটাকিয়া) রুবিনেট। চার ইঞ্চি লম্বা একটি গাছ এবং এক ইঞ্চি দৈঘের পাঁচ পাপড়ির সাদা রঙের একটি ফুল।

এই গাছটি অস্ট্রেলিয়ার বনে-জঙ্গলে ঘাসের মধ্যে পাওয়া যায়। সেখানে এটাকে ডাকা হয় মরুভূমির তুষার নামে। উপসালার বোটানিক্যাল গার্ডেনের কেউ একজন পরবর্তীতে নিশ্চিত করে বলেছে, এই বৃক্ষটি সুইডেনে খুব একটা চাষ করা হয় না। সেই বোটানি মহিলা তার রিপোর্টে লিখেছে, এটা চা গাছের গোত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট। প্রায়শই এটাকে তার সমগোত্রীয় Leptospermum scoparium-এর সাথে গুলিয়ে ফেলা হয় যা কিনা নিউজিল্যান্ডে জন্মায়। এটার ডাক নাম রুবিনেট। মহিলা আরো বলেছে, রুবিনেটের বিশেষত্ব হলো এর পাপড়িতে বিন্দু বিন্দু গোলাপি ফুটকি থাকার কারণে এটাতে হালকা গোলাপি আভা দেখা যায়।

রুবিনেট একেবারেই সাদামাটা একটি ফুল। এর কোনো ঔষুধি গুণাবলী নেই, নেই কোনো সুগন্ধ। এটা খাওয়ার অযোগ্য, ভেষজ রঙের কাজেও ব্যবহার করা যায় না। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা এই ফুলের প্রাপ্তিস্থান এবং আয়ার্স রক অঞ্চলকে পবিত্র জ্ঞান করে থাকে।

বোটানি বলেছে, সে নিজের চোখে এর আগে এই ফুল কোনোদিন দেখে নি। তবে তার সহকর্মীদের সাথে আলাপ আলোচনা করার পর জানিয়েছে গোথেবর্গ নার্সারিতে এই ফুলের চাষ করার চেষ্টা করা হয়েছিলো। অবশ্য সেটা করেছিলো সৌখিন বোটানিস্টরা। সুইডেনে এটা চাষ করা খুব কঠিন কারণ এর জন্য চাই শুষ্ক আবহাওয়া, তাছাড়া ক্যালসিয়াম কার্বোনেট সমৃদ্ধ মাটিতে ছয় মাস ইনডোরে রাখতে হয় এটাকে। নিয়মিত পানি দেয়া এবং পরিচর্যারও দরকার হয়।

ফুলটি বিরল হওয়াতে এটা ট্রেস করা সহজ হওয়ার কথা কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো কাজটা একেবারেই অসম্ভব। কোনো রেজিস্ট্রি নেই যে খোঁজ নেয়া যাবে, কোনো লাইসেন্সও নেই যে খতিয়ে দেখা হবে। এখানে সেখানে হয়তো হাতেগোনা কয়েকশ’ উৎসাহী লোক এটার বীজ অথবা চারা সংগ্রহ করে রোপন করে থাকবে। তারা হয়তো বন্ধুদের সাথে এটা বিনিময় করে থাকবে কিংবা ইউরোপের কোথাও থেকে মেইল করে কেনার অর্ডার দিয়ে থাকবে।

কিন্তু এটা প্রতিবছর রহস্যময়ভাবে নভেম্বরের প্রথম দিনে পোস্টের মাধ্যমে পাঠানো হয়ে থাকে। ফুলগুলো সব সময়ই খুব সুন্দর হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওয়াটার-কালারের র‍্যাপিং পেপার দিয়ে মোড়ানো থাকে ছয় বাই এগারো ইঞ্চির সাদামাটা একটি ফ্রেমের ভেতর।

ফুলের এই অদ্ভুত গল্পটি কখনই প্রেসের কাছে রিপোর্ট করা হয় নি। খুব অল্প কয়েকজন লোকই এ সম্পর্কে জানে। ত্রিশ বছর আগে যখন প্রথমবারের মতো ফুলটা এলো তখন অনেকেরই আগ্রহের বিষয় ছিলো সেটা-ন্যাশনাল ফরেনসিক ল্যাবরেটরি, ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্ট, গ্রাফোলজিস্ট, অপরাধ তদন্তকারী এবং গ্রহীতার দুয়েকজন আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধব এর মধ্যে পড়ে। এখন এই নাটকের অভিনেতার সংখ্যা মাত্র তিনজন : বয়স্ক সেই লোক যার জন্মদিনে ফুলগুলো এসে থাকে, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার আর যে ব্যক্তি এই ফুল পাঠায়। প্রথম দু’জনের বয়স এতোটাই বেশি হয়ে গেছে যে, খুব জলদিই আগ্রহীর সংখ্যা আরো কমে আসবে।

পুলিশের লোকটা বেশ কঠিন একজন মানুষ। নিজের প্রথম কেসটার কথা সে কখনও ভুলবে না যেখানে একটি ইলেক্ট্রিক্যাল সাবস্টেশনের এক মাতাল আর হিংস্র শ্রমিককে গ্রেফতার করেছিলো কারো কোনো রকম ক্ষতি করার আগেই। কর্মজীবনে মাছচোর, বউপেটানো স্বামী, প্রতারক, গাড়িচোর, মাতাল ড্রাইভারের মুখোমুখি হয়েছে সে। সিঁধেলচোর, মাদকব্যবসায়ী, ধর্ষণকারী এবং একজন বোমাবাজেরও মোকাবেলা করতে হয়েছে তাকে। নয় নয়টি হত্যাকাণ্ডের কেসেও সে জড়িত ছিলো। এরমধ্যে পাঁচটি হত্যার ঘটনায় খুনি নিজেই পুলিশকে ফোন করেছিলো। নিজের বউ, ভাই কিংবা আত্মীয়কে খুন করে নিজেই স্বীকার করে নেয় খুনের দায়। দুটো হত্যার ঘটনায় কিছুদিনের মধ্যেই সমাধান করেছিলো সে। অন্যটির জন্যে ন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশের সাহায্য লেগেছিলো, আর সময়ও লেগেছিলো দু’বছর।

নবম কেসটি পুলিশের জন্যে আত্মতুষ্টির ছিলো, ওটাতে তারা জানতো কে খুন করেছে, কিন্তু খুনির বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণের স্বল্পতার কারণে মামলাটি বেশিদিন চলে নি। তবে মোটের উপর নিজের ক্যারিয়ারের দিকে পেছন ফিরে দেখলে তার ভালোই লাগে। খুবই উজ্জ্বল একটি কর্মময় জীবন ছিলো তার।

তারপরও সে সন্তুষ্ট নয়।

ডিটেক্টিভের জন্যে ‘ফুলের কেস’টি অনেক বছর ধরেই একটি আত্মপীড়া হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে-তার শেষ, অসমাপ্ত, সমাধানহীন আর হতাশাজনক একটি কেস। অফ আর অন ডিউটিতে হাজার হাজার ঘণ্টা ব্যয় করেও কোনো সামাধান করা যায় নি। নিশ্চিত করে বলা যায় নি কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিনা।

এ দু’জন মানুষ জানে যে-ই ফুলগুলো পাঠিয়ে থাকুক না কেন সে হাতে দস্তানা পরে থাকে। ফ্রেম এবং কাঁচে কোনো আঙুলের ছাপ পাওয়া যায় নি। এরকম ফ্রেম সারা বিশ্বের যেকোনো স্টেশনারি দোকান কিংবা ছবি তোলার স্টুডিওতে পাওয়া যায়। একেবারেই সাদামাটা একটি জিনিস। ট্রেস করার মতো কিছু নেই। বেশিরভাগ সময়ই পার্সেলটা স্টকহোম থেকে পোস্ট করা হয়েছে, তবে তিনবার করা হয়েছে লন্ডন থেকে, দু’বার প্যারিস আর কোপেনহেগেন এবং একবার মাদ্রিদ, বন, পেনসাকোলা আর ফ্লোরিডা থেকে।

ফোনটা নামিয়ে রেখে বিরাশি বছরের বৃদ্ধ চেয়ারে বসে দীর্ঘক্ষণ ধরে এখন পর্যন্ত নাম না-জানা ফুলটার দিকে চেয়ে রইলো, এরপর তাকালো তার ডেস্কের উপরের দেয়ালের দিকে। ওখানে তেতাল্লিশটি প্রেড করা ফুলের ফ্রেম টাঙানো আছে। দশটি করে মোট চারটি সারিতে চল্লিশটি আর নীচের সারিতে চারটি। সবার উপরে থাকা সারির নবম ফুলটি নেই। ‘মরুভূমির তুষার’ নামে পরিচিত ফুলটি হবে চোচৌল্লিশ নাম্বার।

আচমকা কাঁদতে শুরু করলো সে। প্রায় চল্লিশ বছর পর আচমকা নিজের এই আবেগীয় বর্হিপ্রকাশে নিজেই বেশ অবাক হলো।

অধ্যায় ১

শুক্রবার, ডিসেম্বর ২০

মামলাটি চিরতরের জন্যে শেষ হয়ে গেলো। যা বলার তা বলা হয়ে গেছে, তবে সে যে হেরে যাবে সে-ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিলো না তার। শুক্রবার সকালে লিখিত রায় দেয়া হলো, বাকি রইলো কেবল ডিস্ট্ক্ট কোর্টের করিডোরে অপেক্ষমান রিপোর্টারদের কাছ থেকে প্রশ্নবানে জর্জরিত হওয়া।

“কাল,” মিকাইল ব্লমকোভিস্ট তাদেরকে দরজার কাছে দেখে হাটার গতি কমিয়ে ফেললো। রায় নিয়ে আলোচনা করার কোনো ইচ্ছে না থাকলেও প্রশ্নের হাত থেকে রক্ষা নেই, অন্য সবার মতো সেও জানে তাকে প্রশ্ন করা হবে, আর তার জবাবও দিতে হবে। একজন অপরাধী হলে এমনই হয়, মনে মনে ভাবলো সে। একটু সোজা হয়ে মুখে হাসি আঁটার চেষ্টা করলো। তার প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন আর ব্রিত একটি অভ্যর্থনা জানালো উপস্থিত রিপোর্টাররা।

“আচ্ছা…আফটোনব্লাডেট,

এক্সপ্রেসেন, টিটিওয়্যার সার্ভিস, টিভি৪, আর…আপনি কোত্থেকে?…ওহ্, বুঝেছি, ডাগেন্স নিটার। আমি মনে হয় সেলিব্রেটি হয়ে গেছি,” বললো ব্লমকোভিস্ট।

“আমাদের কিছু চমৎকার তথ্য দিন, কাল ব্লমকোভিস্ট।” এক সান্ধ্যকালীন পত্রিকার সাংবাদিক বললো।

ব্লমকোভিস্ট নিজের ডাক নামটা শুনলেও যথারীতি জোর করে বিরক্তিটা লুকালো। তার বয়স যখন মাত্র তেইশ তখন একজন সাংবাদিক হিসেবে তার প্রথম কাজ শুরু হয়েছিলো টানা দু’বছর ধরে পাঁচ-পাঁচটি ব্যাঙ্ক ডাকাতির দলকে ধরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে। সবগুলো ডাকাতিই যে ঐ গ্যাং করেছে সেটা নিশ্চিত ছিলো। ঐ ডাকাত দলের ট্রেডমার্ক ছিলো একসাথে নিখুঁত দক্ষতায় দুটো ব্যাঙ্ক ডাকাতি করা। তারা ডিজনি ওয়ার্ল্ডের মুখোশ ব্যবহার করতো, ফলে পুলিশ সঙ্গত কারণেই দলটির নাম দেয় ‘ডোনাল্ড ডাক গ্যাং।’ তবে পত্রিকাগুলো পুণঃনামকরণ করে বিয়ার গ্যাং হিসেবে। এই নামটি অবশ্য বেশি সঙ্গত ছিলো কারণ দলটি দু’দুবার কৌতুহলী পথচারীদের দিকে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিলো তাদেরকে তাড়ানোর জন্য।

তাদের ছয় নাম্বার ডাকাতিটা ছিলো হলিডে মওসুমে ওস্টারগোটল্যান্ডের একটি ব্যাঙ্কে। স্থানীয় রেডিওর এক রিপোর্টার ঐ সময় ঘটনাচক্রে ব্যাঙ্কেই অবস্থান করছিলো। ডাকাতেরা ডাকাতি করে চলে যেতেই সেই রিপোর্টার কাছের এক ফোনবুথ থেকে পুরো ঘটনাটি লাইভ রিপোর্ট করে।

ব্লমকোভিস্ট তখন কাটরিনহোমে তার মেয়েবন্ধুর বাবা-মা’র একটি ক্যাবিনে সময় কাটাচ্ছিলো। সেই কারণেই সে কানেকশানটি কিভাবে করতে পেরেছিলো সেটা কখনও কাউকে, এমনকি পুলিশকেও ব্যাখ্যা করে নি। তবে সংবাদটি প্রচার হবার সময় ক্যাবিনে বসে যখন শুনছিলো তখন মনে পড়ে গেলো তার কেবিন থেকে কয়েকশ ফিট দূরে অন্য আরেকটি ক্যাবিনে চারজন লোক আছে। তাদেরকে সে ব্যাডমিন্টন খেলতে দেখেছে : চারজন সোনালি চুলের শক্তসামর্থ্য শরীরের শর্ট পরা খালি গায়ের যুবক। তারা অবশ্যই বডিবিল্ডার। তাদের মধ্যে এমন কিছু ছিলো যার জন্যে তাদের দিকে ভালো ক’রে লক্ষ্য করেছিলো সে হয়তো প্রখর রোদে তারা খেলছিলো বলে। তার কাছে মনে হয়েছিলো এভাবে খেলার জন্য প্রচণ্ড স্ট্যামিনার দরকার হয়।

তাদেরকে ব্যাঙ্ক ডাকাত হিসেবে সন্দেহ করার কোনো কারণই ছিলো না। তারপরেও সে তাদের ক্যাবিনের দিকে গেলো খোঁজ নেবার জন্যে। কেবিনটা একেবারে খালি। ক্যাবিনের প্রাঙ্গনে একটা ভলভো পার্ক করার চল্লিশ মিনিট আগের ঘটনা এটি। যুবকেরা তাড়াহুড়ো ক’রে গাড়ি থেকে নেমে এলো, তাদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে স্পোর্টিংব্যাগ। সে ভাবলো তারা হয়তো সুইমিংপুলে সাঁতার কেটে ফিরে এসেছে। তবে তাদের মধ্যে একজন আবারো গাড়ির কাছে ফিরে গিয়ে পেছনের ডালা থেকে একটা জিনিস নিয়ে জ্যাকেটের ভেতর লুকিয়ে রেখে ফিরে এলো। অনেক দূর থেকে দেখলেও ব্লমকোভিস্টের বুঝতে বাকি রইলো না জিনিসটা একে-৪৭ রাইফেল ছাড়া আর কিছু না। কারণ মিলিটারি সার্ভিসে থাকার সময় এটা তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলো।

পুলিশকে সে ফোন করে জানালে তিনদিনব্যাপী কেবিন সিজ করার ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। মিডিয়ায় পুরো ঘটনাটি লাইভ প্রচার করা হয়েছিলো। এক পত্রিকা ব্লমকোভিস্টকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে রিপোর্টার হিসেবে ভাড়া করে। কারণ ব্লমকোভিস্ট যে ক্যাবিনে ছিলো তার কাছেই পুলিশ অস্থায়ী স্টেশন স্থাপন করেছিলো।

বিয়ার গ্যাংয়ের পতন তাকে রাতারাতি তারকা বানিয়ে ফেলে আর সেই সাথে শুরু হয়ে যায় সাংবাদিক হিসেবে তার কর্মজীবন। সেলিব্রেটি হওয়ার খেসারতও তাকে দিতে হয়েছে। অন্য এক পত্রিকা শিরোনাম করেছিলো : ‘কেসটার জট খুলেছে কাল ব্লমকোভিস্ট।’ তার মুখ থেকে পুরো কাহিনীটা লিখে ফেলে এক বয়সী মহিলা কলামিস্ট, আর এই গল্পটা তরুণ ডিটেক্টিভ অ্যাস্ট্রিড লিন্ডগ্রিনের বাচ্চাদের একটি বইয়েও ঠাঁই পায়। ব্যাপারটা আরো খারাপ হয়ে যায় যখন পত্রিকাটি তর্জনী তুলে মুখ হা-করা তার একটি ছবি ছাপিয়ে দেয় প্রথম পৃষ্ঠায়।

ব্লমকোভিস্ট যে তার জীবনে কখনও কার্ল নামটি ব্যবহার করে নি তাতে কিছুই এলো গেলো না। সেই থেকে তার প্রবল আপত্তি থাকা সত্ত্বেও ডাক নাম হয়ে গেলো কাল ব্লমকোভিস্ট। অ্যাস্ট্রিড লিন্ডগ্রিনের বই তার পছন্দের হলেও ঐ ডাক নামের কারণে সেটাও তার কাছে বিরক্তিকর বলে মনে হয়। এই নামটি বিস্মৃত হতে অনেক বছর লেগে গিয়েছিলো। তবে এখনও যদি কেউ এ নামে তাকে ডাকে তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।

মুখে কৃত্রিম হাসি এঁটে সান্ধ্যকালীন পত্রিকার সেই রিপোর্টারকে বললো সে : “ওহ্, তুমি নিজেই ভেবে নাও না। সব সময় তো তাই করো।

তার কণ্ঠে কোনো রাগ নেই। তারা সবাই একে অন্যেকে কম বেশি চেনে। অবশ্য ব্লমকোভিস্টের সবচাইতে কড়া সমালোচক আজ আসে নি। সেই লোকের সাথে এক সময় সে কাজও করেছে। কয়েক বছর আগে এক পার্টিতে টিভি৪-এর শি অনুষ্ঠানের এক মহিলা রিপোর্টারকে প্রায় বাগিয়ে ফেলেছিলো।

“আজ আপনি বেশ বিপাকে পড়ে গিয়েছিলেন,” ডাগেন্স নিটার-এর সাংবাদিক বললো। বোঝাই যাচ্ছে এক তরুণ পার্টটাইমার সে। “কেমন লাগছে আপনার?

পরিস্থিতির গভীরতা সত্ত্বেও ব্লমকোভিস্ট আর সেই পুরনো সাংবাদিক না হেসে পারলো না। টিভি৪-এর সাংবাদিকের দিকে তাকালো সে। আপনার কেমন লাগছে? বেরসিক স্পোর্টস জার্নালিস্ট ফিনিশিংলাইন অতিক্রম করার পর দম ফুরিয়ে যাওয়া ক্রীড়াবিদের মুখের সামনে মাইক্রোফোন ধরেছে যেনো।

“আদালতের রায় ভিন্ন রকম হয় নি বলে আমার আক্ষেপ আছে,” সে বললো।

“তিন মাস কারাবাস আর ১৫০০০০ ক্রোনার জরিমানাটা তো একটু বেশিই হয়ে গেলো,” টিভি৪-এর মহিলা রিপোর্টার বললো তাকে।

“সমস্যা নেই, আমি টিকে থাকতে পারবো।”

“আপনি কি ওয়েনারস্ট্রমের কাছে ক্ষমা চাইবেন? তার সাথে হাত মেলাবেন?”

“মনে হয় না।”

“তাহলে আপনি এখনও তাকে একজন জোচ্চোরই বলবেন?” ডাগেন্স নিটার জানতে চাইলো।

আদালত কিছুক্ষণ আগে রায় দিয়েছে ব্লমকোভিস্ট বিশিষ্ট ধনী ব্যাঙ্কার হান্স এরিক ওয়েনারস্ট্রমের মানহানি করেছে। মামালাটি শেষ হয়ে গেছে, আপিল করার কোনো পরিকল্পনা তার নেই। তাহলে আদালতের বাইরে এসে সেই কথাটা আবার বললে কি হতে পারে? ব্লমকোভিস্ট সিদ্ধান্ত নিলো সেটা না করার জন্যে।

“আমি ভেবেছিলাম আমার কাছে থাকা তথ্য প্রকাশ করার সঙ্গত কারণ রয়েছে। আদালত অবশ্য অন্য রকম রায় দিয়েছেন। আমাকে আদালতের রায়ই মেনে নিতে হচ্ছে। আমরা কি করবো না করবো সেটা ভেবে দেখার আগে আমাদের সম্পাদকীয় স্টাফরা এ নিয়ে আলোচনা করবেন। আমার আর কিছু বলার নেই।”

“কিন্তু আপনি কি করে ভুলে গেলেন সাংবাদিকেরা তাদের উদ্ধৃতির ব্যাকআপ রেখে থাকেন?” টিভি৪-এর রিপোর্টার জানতে চাইলো। মহিলার ভাবভঙ্গী দেখে কিছু বোঝা না গেলেও ব্লমকোভিস্টের মনে হলো তার চোখে একধরণের হতাশা বিরাজ করছে।

ডাগেন্স নিটার-এর ছেলেটা বাদে উপস্থিত রিপোর্টারদের সবাই বেশ ঝানু সাংবাদিক। তাদের কাছে তার জবাবটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। “আমার আর কিছু বলার নেই,” আবারো বললো সে। সব রিপোর্টার তার কথা মেনে নিলেও টিভি৪-এর মেয়েটা দরজা আঁটকে দাঁড়িয়ে থেকে ক্যামেরার সামনে প্রশ্ন করলো। যতোটা আশা করেছিলো মেয়েটি তারচেয়েও বেশি মমত্ব দেখাচ্ছে। বাকি রিপোর্টাররা এখনও সেই মেয়ের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, তারা পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারে নি। খবরটা শিরোনামে যাবে তবে সে এও জানে এটা এ বছরের সেরা খবর নয়। রিপোর্টারদের যা পাওয়ার দরকার ছিলো তারা তা পেয়ে গেছে এখন সবাই ছুটছে যার যার নিউজরুমের দিকে।

একটু হাটার কথা ভাবলো সে কিন্তু সময়টা ডিসেম্বরের প্রচণ্ড শীতের, ইতিমধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে ঠাণ্ডায় জমে গেছে। আদালতের সিঁড়ি দিয়ে নামতেই দেখতে পেলো উইলিয়াম বৰ্গ গাড়ি থেকে বের হচ্ছে। এতোক্ষণ সে নিশ্চয় গাড়িতে বসে বসে সাংবাদিকদের সাথে তার ইন্টারভিউ দেখছিলো। তাদের চোখাচোখি হতেই বর্গ হেসে ফেললো।

“তোমার হাতে ঐ কাগজটা দেখে খুব দারুণ লাগছে।”

ব্লমকোভিস্ট কিছু বললো না। তাদের দু’জনের মধ্যে পনেরো বছরের সম্পর্ক। একটি পত্রিকায় তারা দু’জনেই কাব-রিপোর্টার হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছে। এটা হতে পারতো চমৎকার বোঝাপড়ার একটি সম্পর্ক কিন্তু তাদের মধ্যেকার সম্পর্কের ভিত্তিটা হলো আজীবনের শত্রুতা। ব্লমকোভিস্টের চোখে বৰ্গ একজন তৃতীয় শ্রেণীর রিপোর্টার এবং বিরক্তিকর ব্যক্তি যে কিনা তার চারপাশের লোকজনকে টিটকারি আর টিপ্পনি মেরে অতীষ্ঠ করে রাখে সারাক্ষণ। ঝানু সাংবাদিকদেরকেও সে উল্টাপাল্টা কথা বলতে ছাড়ে না। মনে হয় বয়স্ক মহিলা রিপোর্টারদের সে একটু বেশি অপছন্দ করে। তাদের সাথে তার সব সময়ই ঝগড়া লেগে থাকে। ব্যাপারটা একেবারে ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে যায়।

অনেক বছর ধরেই তাদের মধ্যে তিক্ততার সম্পর্ক বিরাজ করেছে তবে নব্বই দশকে এসে ব্যাপারটা চরম শত্রুতায় রূপ নেয়। ব্লমকোভিস্ট ফাইনান্সিয়াল সাংবাদিকতার উপর একটি বই লিখেছিলো তাতে বর্গের লেখা বেশ কয়েকটি গর্দভমার্কা আর্টিক্যালের উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছিলো সে। এ নিয়ে দু’জনার মধ্যে রীতিমতো মারামারি হবার উপক্রম হয়েছিলো তখন। এরপর বর্গ সাংবাদিকতা ছেড়ে পাবলিক রিলেশন্স অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করে-রিপোর্টারের চেয়ে বেতন-ভাতা বেশ ভালো—এমন একটি ফার্মে যারা ঘটনা জট পাকাতে বেশি পারঙ্গম। সেই প্রতিষ্ঠানটি এরিক হান্স ওয়েনারস্ট্রমেরই একটি প্রতিষ্ঠান।

ব্লমকোভিস্ট ঘুরে চলে যাবার আগে স্থির চোখে তারা দু’জনেই একে অন্যের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। কোর্টে এসে তাকে টিপ্পনি মারাটা বর্গের চরিত্রের সাথে যায়।

বর্গের সামনে ৪০ নাম্বার বাসটা এসে ব্রেক কষলে ব্লমকোভিস্ট যেনো পালিয়ে যাবার একটা মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেলো। ফ্রিডমপ্লানে নেমে গেলেও বুঝতে পারলো না কী করবে, কোথায় যাবে। তার হাতে এখনও রায়ের কপিটা আছে। অবশেষে পুলিশ স্টেশনের পাশে ক্যাফে আনা’তে ঢুকে পড়লো সে।

কফি আর স্যান্ডউইচ অর্ডার দেবার আধ মিনিট পরই রেডিওতে লাঞ্চটাইম নিউজ শুরু হয়ে গেলো। জেরুজালেমে আত্মঘাতি বোমা বিস্ফোরণ আর কনস্ট্রাকশন শিল্পে দুর্নীতি তদন্তের জন্যে সরকার কর্তৃক গঠিত নতুন তদন্ত কমিটির খবরের পরেই তারটা দেখানো হলো।

শিল্পপতি হান্স-এরিক ওয়েনারস্ট্রমের বিরুদ্ধে মানহানিকর সংবাদ পরিবেশনের দায়ে মিলেনিয়াম ম্যাগাজিনের সাংবাদিক মিকাইল ব্লমকোভিস্টকে আদালত ৯০ দিনের কারাবাসের শাস্তি দিয়েছেন। এ বছরের শুরুতে এক আর্টিকেলে ব্লমকোভিস্ট দাবি করেছিলো, শিল্পপতি ওয়েনারস্ট্রম সরকারী শিল্পখাতের তহবিল ব্যবহার করে পোল্যান্ডে অস্ত্রব্যবসায় বিনিয়োগ করেছে। ব্লমকোভিস্টকে ১৫০০০০ ক্রোনার জরিমানাও করা হয়েছে। ওয়েনারস্ট্রমের আইনজীবি বার্টিল ক্যামনারমার্কার বলেছে, তার মক্কেল আদালতের রায়ে খুশি। এটি একটি অসাধারণ মানহানির মামলা ছিলো বলে সে মন্তব্য করেছে।

রায়টি ছাব্বিশ পৃষ্ঠায় লিখিত। আদালত দেখেছেন ব্লমকোভিস্ট মোট পনেরো রকমের মানহানির অভিযোগে অভিযুক্ত তাই প্রতিটির জন্যে দশ হাজার ক্রোনার জরিমানা দিতে হবে তাকে আর ছয় দিন কাটাতে হবে জেলে। তার উপরে বাদী এবং তার নিজের আইনজীবির সমস্ত ফি’ও তাকেই পরিশোধ করতে হবে। কতো টাকা হতে পারে সেটা ভেবে পেলো না। তবে জানে সেটার পরিমাণ অনেক বেশি হবে। আদালত তাকে বাকি সাতটি অভিযোগ থেকে অব্যহতি দিয়েছেন।

রায়টি পড়তেই এক ধরণের অস্বস্তি টের পেলো সে আর পেটটাও কেমন জানি মোচড় দিয়ে উঠছে। অবাক হলো। মামলা যখন শুরু হয় তখনই জানতো এ থেকে মুক্তি পাওয়া অলৌকিক ব্যাপার হবে। রায়ের জন্যে সে প্রস্ততই ছিলো। মামলা চলাকালীন সময়টাতে বেশ শান্তই ছিলো সে, শেষ এগারো দিন তো রীতিমতো অনুভূতিহীন হয়ে গিয়েছিলো। অথচ রায় হবার পর এখন কিনা তার মধ্যে এরকম অস্বস্তি একটি অনুভূতি বয়ে যাচ্ছে।

স্যান্ডউইচে কামড় বসাতেই সেটা খুব বিস্বাদ লাগলে কোনোরকম ওটা গিলে পেটটা সরিয়ে রাখলো।

এই প্রথম ব্লমকোভিস্ট কোনো মামলায় অভিযুক্ত হলো বলা চলে। এটা অবশ্য খুব বড়সড় কোনো অপরাধ নয়। রায়েও সেটা বলা আছে। সশস্ত্র ডাকাতি কিংবা খুন-ধর্ষণের মতো কিছু না। টাকা-পয়সার দিক থেকে দেখলে এটা অবশ্য খুবই মারাত্মক একটি অপরাধ-মিলেনিয়াম ম্যাগাজিন মিডিয়া জগতে এমন কেউকেটা কিছু নয়—বরং বলা যায় সেটা টাকা-পয়সার টানাটানিতে এমনিতেই জর্জরিত হয়ে আছে। আসল সমস্যা হলো ব্লমকোভিস্ট শুধুমাত্র ম্যাগাজিনটার রিপোর্টারই নয়, সে এটার একজন অংশীদারও বটে। পত্রিকায় লেখালেখি করার পাশাপাশি সে এটার প্রকাশকও। ১৫০০০০ ক্রোনারের যে জরিমানা সেটা তাকেই পরিশোধ করতে হবে। এটা করতে গেলে তার সমস্ত সঞ্চয় নিঃশেষ হয়ে যাবে সেটা সে জানে। ম্যাগাজিন অবশ্য কোর্টের খরচটা মেটাতে পারবে বলে মনে হয়। বুঝেশুনে বাজেট করলে এটা করা যাবে।

নিজের অ্যাপার্টমেন্টটা বিক্রি করার কথাও ভাবলো সে। যদিও এটা করতে গেলে তার অনেক খারাপ লাগবে। আশির দশকের শেষ দিকে তার সময় যখন বেশ ভালো যাচ্ছিলো তখন নিজের থাকার মতো একটি জায়গার জন্যে সে মুখিয়ে ছিলো। অনেক খুঁজেটুজে শেষে বেলমাঙ্গসগাটানে একটা ৭০০ বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্ট পছন্দ করে। এর আগের মালিক আচমকা চাকরির সুবাদে বাইরে চলে যাওয়াতে ব্লমকোভিস্ট সেটা কিনে নেয় বেশ ভালো দামে।

অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরটা সে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছিলো। বাথরুম আর রান্নাঘরটা অনেক টাকা খরচ করে ঠিক করেছে। অ্যাপার্টমেন্টের দুটো বিশাল জানালা আর একটি বেলকনি আছে যা দিয়ে স্টকহোমের পুরনো এলাকা গামলা স্টন আর রিডাইয়ারডেন নদীটা দেখা যায়। স্লাসেন লকের পাশে লেকটা এবং সিটি হলের কিছু অংশও দেখা যায় সেখান থেকে। আজকের দিন হলে এরকম একটি অ্যাপার্টমেন্ট কেনার ক্ষমতা তার হোতো না। যেকোনোভাবেই হোক এটা সে ধরে রাখতে চায়।

তবে সে যদি অ্যাপার্টমেন্টটা হারায়ও সেটা তার পেশাদার জীবনের বিপর্যয়ের চেয়ে বেশি কিছু হবে না। এই ক্ষতিপূরণ হতে অনেক সময় লাগবে-অবশ্য শেষ পর্যন্ত যদি সেটা পূরণ করা যায় তো।

দ্য গার্ল উইথ দি ড্রাগন টাট্টু

ব্যাপারটা আস্থার। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে সম্পাদক সাহেব তার নামে কোনো সংবাদ ছাপাতে ইতস্তত বোধ করবেন সেটাই স্বাভাবিক। এই লাইনে তার অনেক বন্ধুবান্ধব আছে যারা মনে করবে সে মন্দভাগ্য কিংবা বিরল পরিস্থিতির শিকার। তবে এটাও তো ঠিক, এরপর তার পক্ষে সামান্যতম ভুলও করা সম্ভব হবে না।

সবচাইতে বেশি কষ্টের ব্যাপার হলো নাজেহাল হওয়া। অবমাননার শিকার হওয়া। সব প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আর্মানি সুট পরা এক সেমি-গ্যাংস্টারের কাছে হেরে গেছে সে। স্টকমার্কেটের এক জুয়ারি, যার পকেটে থাকে সেলিব্রিটি লইয়ার। পুরো মামলায় তারা তাকে সহায়তা করেছে।

কিভাবে সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেলো?

.

ওয়েনারস্ট্রম ঘটনাটি দেড় বছর আগে মধ্যগ্রীষ্মে সাইত্রিশ ফিট লম্বা মালার-৩০ বিমানের ককপিটে বেশ সম্ভাবনার সাথেই শুরু হয়েছিলো। শুরুটা হয়েছিলো কাকতালীয়ভাবেই, কারণ এক সাবেক সাংবাদিক বন্ধু, যে কিনা কাউন্টি কাউন্সিলে তখন পাবলিক রিলেশন্সে কাজ করতো, সে তার নতুন মেয়েবন্ধুকে মুগ্ধ করতে চেয়েছিলো। স্টকহোমের আর্কিওপেলাগে কয়েক দিন নৌভ্রমণ করে রোমান্টিক সময় কাটাতে চেয়েছিলো সে। তার মেয়েবন্ধুটি কেবলমাত্র পড়াশোনা করার জন্য হালস্টামার থেকে স্টকহোমে চলে আসে। বাইরে ঘোরার জন্যে সে রাজি হয় এক শর্তে : যদি তার বোন আর তার ছেলেবন্ধুকেও সাথে নিয়ে যাওয়া হয়। হালস্টামারের ঐ তিনজনের কারোরই নৌভ্রমণের অভিজ্ঞতা ছিলো না। আর দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো ব্লমকোভিস্টের সেই কলিগের অভিজ্ঞতার থেকে বেশি ছিলো উৎসাহী। ভ্রমণের তিন দিন আগে তাদের সাথে পঞ্চম ব্যক্তি হিসেবে যোগ দেবার জন্যে বলা হয় তাকে, যেহেতু তার রয়েছে নেভিগেশনের অভিজ্ঞতা।

ব্লমকোভিস্ট খুব একটা না ভেবেই রাজি হয়ে যায় ভালো খাবারদাবার, একটু ভ্রমণ আর সঙ্গীদের সাথে আড্ডা দেবার লোভে। কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই আনন্দের বদলে মহাবিপর্যয়ে পরিণত হয়। তারা কেবলমাত্র নয় নটিক্যাল মাইল ভ্রমণ করে ফরুসান্ড থেকে বুলান্ডোথে গিয়ে পৌছাতেই বন্ধুর নতুন মেয়েবন্ধুটি সি-সিকনেসে আক্রান্ত হয় আর তার বোন নিজের ছেলেবন্ধুর সাথে ঝগড়া শুরু করে দেয়, তাদের কারোরই যে নৌভ্রমণের ব্যাপারে কোনো জ্ঞান নেই সেটা বোঝা গিয়েছিলো। ব্লমকোভিস্ট বাকিদের অযাচিত উপদেশ কানে না তুলে বোটের হাল তুলে নেয় নিজের কাঁধে। আঙ্গসো উপসাগরে প্রথম রাত কাটানোর পর সে ঠিক করে ফুরুসান্ডে নোঙর করে একটা বাসে চেপে বাড়ি চলে আসবে। তবে সবার অনেক অনুরোধে বোটে থেকে যায় সে।

পরের দিন বিকেলে তারা আরোহোমা দ্বীপের একটি জেটিতে নোঙর করে। লাঞ্চের সময় ব্লমকোভিস্ট দেখতে পেলো হলুদ রঙের একটি ফাইবারগ্লাসের এম-৩০ বিমান উপসাগরের দিকে নেমে আসছে তাদের জেটির দিকে। ব্লমকোভিস্ট আরো দেখতে পেলো তাদের বোটের পাশে যে সংকীর্ন জায়গা আছে সেখানে উভচর বিমানটির স্থান সংকুলান হয়ে যাবে। মাস্তলের সামনে এসে সে বিমানের লোকটাকে হাত দিয়ে ইশারা করলে লোকটা তাকে হাত নেড়ে ধন্যবাদ জানিয়ে জেটির দিকে এগোতে থাকলে একা একা দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে থাকে ব্লমকোভিস্ট। জেটির কাছে আসতেই বিমানের পাইলট এমনভাবে তার দিকে তাকিয়ে হাসি দেয় যেনো তাদের মধ্যে অনেক দিনের পরিচয় আছে।

“হাই, রোবান। তুমি তোমার ইঞ্জিনটা ব্যবহার করছো না কেন, তাহলে তো আর হার্বারের অন্যসব বোটের গায়ে আঁচড় লাগে না?”

“হাই, মিকি। ভেবেছিলাম তোমাকে বোধহয় আমি চিনি।”

রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে তারা এক অন্যের সাথে হাত মেলায়।

সত্তুর দশকে কুঙ্গসহোমেন স্কুলে ব্লমকোভিস্ট আর রবার্ট লিন্ডবার্গ পড়াশোনা করতো, তারা বেশ ভালো বন্ধু ছিলো। যেমনটি হয়ে থাকে, স্কুল ছাড়ার পর দু’জন দু’দিকে চলে যায়, বন্ধুত্বও ফিকে হয়ে আসে সেইসাথে। বিগত বিশ বছরে তাদের মধ্যে অবশ্য আধ ডজন বার দেখা হয়েছিলো, শেষ দেখা হয়েছিলো সাত আট বছর আগে। এবার তারা একে অন্যকে বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখতে থাকে। লিন্ডবার্গের চুল কোকড়ানো আর গায়ের চামড়া রোদে পোড়া। মুখে তার দু’সপ্তাহের দাড়ি।

ব্লমকোভিস্টের অবশ্য খুব ভালো লাগলো। পাবলিক রিলেশন্সের বন্ধু আর তার মেয়েবন্ধু যখন ডিস্কোতে চলে গেলো তখন ব্লমকোভিস্ট তার পুরনো স্কুল বন্ধুর সাথে এম-৩০’র ককপিটে বসে বসে ভালো সময় কাটাতে শুরু করে।

সেই দিন রাতে আরহোমার বিরক্তিকর মশার সাথে যুদ্ধে ক্ষান্ত দিয়ে তারা যখন ক্যাবিনে চলে আসে তখন একটু আধটু মদ পান করার পর নিজেদের বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা মোড় নেয় কর্পোরেট দুনিয়ার হাস্যকর সব নীতি নিয়ে। লিন্ডবার্গ স্কুল শেষে স্টকহোমের স্কুল অব ইকোনমিক্সে চলে গিয়েছিলো, সেখান থেকে পাস করে ঢুকে পড়ে ব্যাংকিং ব্যবসায়। ব্লমকোভিস্ট স্কুল শেষে ভর্তি হয়েছিলো স্টকহোম স্কুল অব জার্নালিজমে, কর্ম জীবনের বেশিরভাগ সময় সে ব্যাংকিং দুনিয়ার দুর্নীতি উন্মোচন করেই কাটিয়ে দিয়েছে। নব্বই দশকের গোল্ডেন প্যারাসুট এগ্রিমেন্টে সন্তুষ্টির কি আছে সেটা দিয়ে শুরু হয় তাদের কথাবার্তা। লিন্ডবার্গ স্বীকার করে যে তাদের ব্যবসায়ীক জগতে দু’তিনজন বানচোত আছে। আচমকা সে ব্লমকোভিস্টের দিকে সিরিয়াস দৃষ্টিতে তাকায়

“তুমি হান্স-এরিক ওয়েনারস্ট্রমের উপর কেন লিখছো না?”

“তার সম্পর্কে লেখার মতো কিছু তো আমি জানি না।”

“একটু খোড়াখুড়ি করো, বন্ধু। AIA প্রোগ্রাম সম্পর্কে কতোটুকু জানো?”

“ওটা মধ্য নব্বই দশকে এক ধরণের সহায়তাকারী প্রোগ্রাম যা কিনা ইস্টার্ন ব্লকের সাবেক কমিউনিস্ট দেশগুলোকে শিল্পখাতে নিজের পায়ে দাঁড়াবার জন্যে নেয়া হয়েছিলো। কয়েক বছর আগে সেটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে আমি কখনও মাথা ঘামাই নি।”

“এজেন্সি ফর ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাসিসটেন্স প্রোগ্রামটি সরকার এবং এক ডজনের মতো সুইডিশ ফার্মের সহায়তায় পরিচালিত হোতো। AIA পোল্যান্ড এবং বাল্টিকে অনেকগুলো প্রোগ্রামের সরকারী অনুমোদন লাভ করেছিলো। সুইডিশ ট্রেড ইউনিয়নও এই প্রোগ্রামে যোগ দেয় গ্যারান্টার হিসেবে যাতে করে ইস্টের শ্রমিক আন্দোলন আরো জোরদার করা যায় এবং সেটা সুইডিশ মডেলে পরিচালিত হয়। এই প্রোগ্রামের ফলে ইস্টের দেশগুলো যেনো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে সেটাই ছিলো মূল লক্ষ্য। বাস্তবে দেখা গেলো সুইডিশ কোম্পানিগুলো সরকারী অর্থের আনুকূল্য পেয়ে ইস্টার্ন ইউরোপের দেশগুলোর বিভিন্ন কোম্পানিতে নিজেদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে দিলো। ঐ ক্রিশ্চিয়ান পার্টির মিনিস্টার ছিলো AIA-এর একজন কট্টর সমর্থক। কারকো’তে একটি কাগজ মিল, রিগাতে নতুন নতুন শিল্পস্থাপনের জন্যে যন্ত্রপাতি সাপ্লাই দেয়া, তালিনে একটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি নির্মাণ এরকম কিছু কাজ চলছিলো তখন। সমস্ত ফান্ড AIA-এর বোর্ড কর্তৃক বণ্টন করা হোতো। ওটার অনেক সদস্য ছিলো ব্যাংকিং এবং কর্পোরেট দুনিয়ার হোমড়াচোমড়া ব্যক্তি।”

“তাহলে সেটা ছিলো জনগনের ট্যাক্সের টাকা?”

“অর্ধেকের মতো টাকা সরকার দিয়েছিলো আর ব্যাংক কর্পোরেটগুলো দিয়েছিলো বাকিটা। তবে সেটা মোটেও কোনো আদর্শ অপারেশন ছিলো না। ব্যাংক আর ইন্ডাস্ট্রিজগুলো সহজ মুনাফা করার জন্যে হন্যে হয়ে ওঠে। এছাড়া অন্য কিছু নিয়ে তারা মোটেও মাথা ঘামাতো না।

“কি পরিমাণ টাকা-পয়সা নিয়ে আমরা কথা বলছি?”

“দাঁড়াও। আমার কথাটা আগে শোনো। AIA মূলত বড় বড় সুইডিশ ফার্মের সাথে মিলে ইস্টার্ন ইউরোপের মার্কেটে ঢুকতে চেয়েছিলো। ভারি শিল্প যেমন, ASEA Brown Boveri এবং Skanska কন্সট্রাকশনের মতো কিছু আর কি। অন্য কথায় বলতে পারো কোনো স্পেকুলেশন ফার্ম নয়,।”

“তুমি কি বলতে চাচ্ছে Skanska স্পেকুলেশন করে না?”

“অবশ্যই করে। সব কোম্পানিতেই গর্দভ থাকে। আমি কি বলতে চাচ্ছি বুঝতে পেরেছো নিশ্চয়। অন্তত যে সব কোম্পানি কিছু উৎপাদন করে থাকে। সুইডিশ ইন্ডাস্ট্রিজের মেরুদণ্ড এবং সেসবের কথা বলছি।”

“তাহলে এই ঘটনায় ওয়েনারস্ট্রম এলো কোত্থেকে?”

“ওয়েনারস্ট্রম হলো তাসের পেটির জোকার। মানে লোকটা উড়ে এসে জুড়ে বসে। ভারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড ছিলো না তার। ঐ প্রজেক্টে তার কোনো স্থানও ছিলো না। তবে সে প্রচুর টাকা কামায় স্টক মার্কেট থেকে, সেই টাকা দিয়ে সলিড কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে। বলতে পারো সে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকেছিলো।”

বোটে বসে নিজের গ্লাসে আরো মদ ঢেলে ব্লমকোভিস্ট ভাবতে লাগলো ওয়েনারস্টর্ম সম্পর্কে সে কি কি জানে। নরল্যান্ডে বেড়ে উঠেছে। সত্তুর দশকে ওখানেই সে একটি ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি খুলে বসে। প্রচুর টাকা কামানোর পর চলে আসে স্টকহোমে। এখানেই আশির দশকে তার ব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠে। সে ওয়েনারস্ট্রম গ্রুপেন অর্থাৎ ওয়েনারস্ট্রম গ্রুপ গঠন করে। তারা যখন লন্ডন আর নিউ ইয়র্কে অফিস স্থাপন করলো তখন তাদেরকে বেইয়ার নামে অভিহিত করা শুরু হয়। ক্রমেই সে সুইডেনের অন্যতম বিলিয়নেয়ার হয়ে ওঠে, স্ট্র্যান্ডভাগেনে একটা বাড়ি আর ভারমডো দ্বীপে চমৎকার একটি গ্রীষ্মকালীন ভিলার মালিক হয় সে। বিরাশি ফুট লম্বা একটি মোটার ইয়ট কিনে নেয় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া সাবেক এক টেনিস খেলোয়াড়ের কাছ থেকে। এতো কিছুর পরও ওয়েনারস্ট্রম লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে যায়। অন্যসব ধনীদের মতো সে ট্যাবলয়েডের শিরোনাম হয় নি, তাকে নিয়ে কোনো কেচ্ছাকাহিনীও রটে নি। রিয়েল এস্টেট ব্যবসাকে বিদায় জানিয়ে বিশাল অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে ইস্টার্ন ইউরোপে। নব্বই দশকে যখন একের পর এক ম্যানেজিং ডিরেক্টর তার গোল্ডেন প্যারাসুটে নগদ টাকা দিতে বাধ্য হতে লাগলো ওয়েনারস্ট্রমের কোম্পানি তখন বেশ ভালো অবস্থায় পৌছে গেলো। ফিনান্সিয়াল টাইমস যাকে ‘একটি সুইডিশ সফলতার কাহিনী’ হিসেবে অভিহিত করেছিলো।

“১৯৯২ সালে,” লিন্ডবার্গ বললো। “ওয়েনারস্ট্রম AIA-এর সাথে যুক্ত হয় এবং সেখানে ফান্ডিং করতে আগ্রহ দেখায়। পোল্যান্ডে একটি খাদ্যদ্রব্য প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ করার প্ল্যান উপস্থাপন করে সে।”

“তার মানে বলতে চাচ্ছো টিনের ক্যানের ইন্ডাস্ট্রিজ।”

“ঠিক সেরকম কিছু না। আমি জানি না AIA-এর মধ্যে কাকে সে চিনতো তবে সে ষাট মিলিয়ন ক্রোনার নিয়ে এগিয়ে আসে।”

“আমার আগ্রহ জন্মাতে শুরু করেছে। আমাকে আন্দাজ করতে দাও : পরিমাণ টাকা দিয়ে নিশ্চয় কিছু করা হয় নি।”

“ভুল।” ব্র্যান্ডিতে চুমুক দেবার আগে লিন্ডবার্গ মুচকি হেসে বললো। “এরপর যা হলো সেটাকে তুমি ক্লাসিক বুককিপিং বলতে পারো। ওয়েনারস্ট্রম সত্যি সত্যি পোল্যান্ডের লজ নামক এলাকায় একটি প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ স্থাপন করে। কোম্পানির নাম হয় মিনোস। আচমকা সেটার পতন হয়ে যায়।”

লিন্ডবার্গ তার খালি গ্লাসটা নামিয়ে রেখে বাঁকা হাসি হাসলো।

“AIA-এর মধ্যে সত্যিকারের যে সমস্যাটি ছিলো সেটা হলো কোনো প্রজেক্টেরই রিপোর্টিং করার সিস্টেম ছিলো না। তোমার নিশ্চয় মনে আছে ঐসব দিনের কথা : বার্লিন ওয়ালের পতনের পর সবাই খুব বেশি আশাবাদী হয়ে উঠেছিলো। গণতন্ত্রের প্রচলন শুরু করা হবে। আণবিক যুদ্ধের হুমকি চিরতরের জন্যে শেষ হয়ে যাবে আর বলশেভিকরা রাতারাতি ছোটোখাটো পুঁজিপতিতে পরিণত হয়ে যাবে। সরকার ইস্টার্ন ইউরোপে গণতন্ত্রকে নিশ্চিত করতে চাইলো আর সবাই সেই মিশনে উৎসাহী হয়ে নেমে পড়লো নতুন ইউরোপ গঠনের জন্যে।

“আমি জানতাম না পুজিঁপতিরা মানবসেবায় এতো বেশি আগ্রহী ছিলো।”

“বিশ্বাস করো, ওটা ছিলো পুজিঁপতিদের স্বপ্নদোষ। চায়নার পর রাশিয়া এবং ইস্টার্ন ইউরোপ হয়তো সবচাইতে বড় আর সম্ভাবনাময় বাজার। সরকারে সাথে হাত মেলানোর ব্যাপারে ইন্ডাস্ট্রির কোনো সমস্যা ছিলো না, বিশেষ করে কোম্পানিগুলোকে যখন নামমাত্র ইনভেস্টমেন্ট করতে হোতো। সব মিলিয়ে AIA ট্যাক্সপেয়ারদের মোট ত্রিশ বিলিয়ন ক্রোনার গিলে ফেলে। ভবষ্যিতের মুনাফার আশায় এটা করা হয়। কাগজে কলমে AIA একটি সরকারী পদক্ষেপ ছিলো কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির প্রভাব এতোটাই বেড়ে যায় যে সত্যি বলতে কি AIA বোর্ড স্বাধীনভাবেই কাজ করতো।”

“তো এরমধ্যে কি আর কোনো গল্প আছে নাকি যা বললে তাই?”

“ধৈর্য ধরো। প্রজেক্টটা যখন শুরু হয় তখন ফিনান্স নিয়ে কোনো সমস্যা ছিলো না। সুইডেন তখনও ইন্টারেস্ট-রেট এর মারাত্মক বৃদ্ধির সংকটে পড়ে নি। সরকার ইস্টার্ন ইউরোপে গণতন্ত্র প্রমোট করার জন্য AIA-কে নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট ছিলো।”

“এসবই ঘটেছে রক্ষণশীল দলের সময়ে?

“এর সাথে রাজনীতিকে গুলিয়ে ফেলো না। এটা হলো টাকার খেলা। কে রক্ষণশীল আর ডেমোক্র্যাটিক তাতে কিছুই যায় আসে না। যা হবার তাই হোতো। তো পুরোদমে এগোতে লাগলো প্রজেক্টটি। এরপরই ফরেন-এক্সচেঞ্জ সমস্যার উদ্ভব হলে কতিপয় নতুন ডেমোক্রেট AIA-এর মধ্যে তদারকির দারুণ অভাব আছে ব’লে শোরগোল তুলতে শুরু করলো। তাদের এক নেতা সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কর্তৃপক্ষের সাথে AIA-কে গুলিয়ে ফেলে। সে মনে করে তাঞ্জানিয়ার মতো এটাও বেশ ভালো একটি প্রজেক্ট। ১৯৯৪ সালের বসন্তে একটি কমিশন গঠন করা হয় ব্যাপারটা তদন্তের জন্যে। প্রথমে কয়েকটি

প্রজেক্টের উপর তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় আর সবার আগে তদন্ত করা হয় মিনোস-এর।”

“ওয়েনারস্ট্রম নিশ্চয় দেখাতে পারে নি যে ফান্ডের টাকা ব্যবহার করা হচ্ছে।“

“মোটেই না। বরং সে চমৎকার একটি রিপোর্ট দেয় যাতে দেখানো হয় চুয়ান্ন মিলিয়ন ক্রোনার ব্যয় করা হয়েছে মিনোস-এর প্রজেক্টে। তবে এটাও দেখানো হয় যে পোল্যান্ড এরকম প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ চালানোর মতো উপযুক্ত স্থান নয়। কার্যক্ষেত্রে ফ্যাক্টরিটি প্রতিদ্বন্দ্বী জার্মান কোম্পানিগুলোর সাথে টিকতে পারছিলো না।”

“তুমি বলতে চাচ্ছো তাকে ষাট মিলিয়ন ক্রোনার দেয়া হয়েছিলো।”

“ঠিক। ঐ টাকাটা একেবারে সুদমুক্ত ঋণ ছিলো। কয়েক বছর পর কোম্পানি সেই টাকা ফেরত দেবে এরকম ভাবনা থেকে টাকাগুলো দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু মিনোস সুবিধা করতে পারে নি আর এজন্যে ওয়েনারস্ট্রমকে দায়ি করা যায় না। এখানেই স্টেট গ্যারান্টির কথা এসে পড়ে, ফলে ওয়েনারস্ট্রমকে দায়মুক্তি দেয়া হয়। তার কেবল দরকার ছিলো টাকাগুলো ফেরত দেয়া। সে এও দেখায় যে এ কাজ করতে গিয়ে তার নিজের অনেক টাকা গচ্চা গেছে।

“আমি ঠিকমতো বুঝতে পারলাম কিনা দেখো তো। সরকার ট্যাক্সপেয়ারদের বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা সরবরাহ করলো, ডিপ্লোম্যাটদের জন্যে সব দরজা খুলে দেয়া হলো। ইন্ডাস্ট্রিজগুলো সে টাকা নিয়ে যৌথ বিনিয়োগে নেমে পড়লো মুনাফা করার জন্যে। অন্য কথায় বলতে গেলে বিজনেস অ্যাজ ইউজুয়াল।”

“তুমি একটা সিনিক। ঋণ করা টাকা সরকারকে ফেরত দেয়ার কথা ছিলো।”

“তুমিই না বললে সুদমুক্ত ছিলো। তাহলে এ কাজে ট্যাক্সপেয়াররা তো কিছুই পায় নি। ওয়েনারস্ট্রম পেলো ষাট মিলিয়ন তা থেকে চুয়ান্ন মিলিয়ন বিনিয়োগ করা হয়, বাকি ছয় মিলিয়নের কি হলো?”

“যখন স্পষ্ট হয়ে উঠলো AIA প্রজেক্টটি তদন্ত করা হবে তখন ওয়েনারস্ট্রম হিসেব মেলানোর জন্যে ছয় মিলিয়ন ক্রোনারের একটি চেক পাঠিয়ে দিলো AIA-তে। ফলে ব্যাপারটা আইনত সেটেল্ড হয়ে যায়।”

“তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে ওয়েনারস্ট্রম AIA-এর অভ্যন্তরে অল্পকিছু টাকা ঢেলেছিলো। কিন্তু Skanska অথবা ABB-এর CEO’র যে গোল্ডেন প্যারাসুট যাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ক্রোনারের গরমিল ছিলো তার তুলনায় তো এটা এমন কিছু না। এটা নিয়ে লেখালেখির কী আছে বুঝতে পারছি না,” ব্লমকোভিস্ট বললো। “বর্তমান সময়ের পাঠকেরা এসব পড়ে পড়ে ক্লান্ত। এই গল্পে আরো কিছু আছে কি?”

“তারচেয়েও বেশি কিছু আছে।

“আচ্ছা, পোল্যান্ডে ওয়েনারস্ট্রমের এইসব কাজকারবারের কথা তুমি কি ক’রে জানলে?”

“নব্বই দশকে আমি হান্ডেলবাঙ্কেনে কাজ করতাম। আন্দাজ করো তো AIA-এর ব্যাঙ্ক রিপ্রেজেনটিভদের জন্য কে রিপোর্ট করতো?”

“আহ্। আমাকে আরো বলো।

“AIA তাদের রিপোর্ট পেতো ওয়েনারস্ট্রমের কাছ থেকে। ডকুমেন্টগুলো তৈরি করা হোতো। টাকার ব্যালান্স পরিশোধ করা হয়েছিলো। খুব চাতুর্যের সাথেই ফেরত দেয়া হয়েছিলো ছয় মিলয়ন।”

“আসল কথায় আসো।”

“আরে ব্লমকোভিস্ট, এটাই হলো আসল কথা। AIA ওয়েনারস্ট্রমের রিপোর্টে সস্তুষ্ট ছিলো। এটা এমন একটি ইনভেস্টমেন্ট যা কিনা গচ্চায় গেছে। তবে এটা যেভাবে ম্যানেজ করা হয়েছে তা নিয়ে কোনো সমালোচনা হয় নি। কাগজেকলমে সবকিছুই ঠিকঠাক ছিলো। আমিও সেটা বিশ্বাস করতাম, আমার বসও সেটা বিশ্বাস করতেন। AIA-ও আমাদের মতোই বিশ্বাস করতো। সরকারের তাই কিছুই বলার ছিলো না।”

“তাহলে গিট্টুটা লাগলো কোথায়?

“এখানেই গল্পটার আসল জায়গা,” লিন্ডবার্গকে বেশ ভদ্রই দেখালো। “তুমি যেহেতু একজন সাংবাদিক তাই এটা অফ দ্য রেকর্ড বলছি।’

“আহা। তুমি আমাকে এতোসব কথা বলে এটা বলতে পারো না যে পুরোটা আমি ব্যবহার করতে পারবো না।”

“অবশ্যই পারি। এ পর্যন্ত যা বলেছি তা সবাই জানে। এটা জনগণের সম্পত্তি। যেকোনো জায়গায় গিয়ে তুমি এটা খতিয়ে দেখতে পারো। বাকি যে গল্পটা তোমাকে এখনও বলি নি সেটা তুমি লিখতে পারো তবে সেক্ষেত্রে আমাকে একজন অজ্ঞাতসূত্র হিসেবে উল্লেখ করতে হবে।”

“ঠিক আছে। তবে এইমাত্র অফ দ্য রেকর্ড বলে যে বাক্যটি বললে সেটার মানে হলো আমি এর কোনো কিছুই লিখতে পারবো না।

“গুল্লি মারি তোমার বাক্যবিশ্লেষণ। তোমার যা ইচ্ছে তাই লিখতে পারো। তবে আমি হলাম তোমার অজ্ঞাতসূত্র। রাজি?”

“অবশ্যই,” ব্লমকোভিস্ট বললো।

কার্যত এটা ছিলো বিরাট একটি ভুল।

“ঠিক আছে তাহলে। মিনোস-এর গল্পটা এক যুগ আগের। ঠিক বার্লিন দেয়ালের পতনের পর পরই যখন বলশেভিকরা খাঁটি পুঁজিপতিদের মতো আচরণ করতে শুরু করলো। ওয়েনারস্ট্রমের ব্যাপারে যারা তদন্ত করেছে আমি তাদের মধ্যে একজন। আমার কাছে মনে হয়েছে এই গল্পটার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু আছে।”

“তার রিপোর্টে যখন তুমি স্বাক্ষর করলে তখন কেন এ কথা বললে না?”

“আমি আমার বসের সাথে কথা বলেছিলাম। তবে সমস্যা হলো এ ব্যাপারে কোনো জোড়ালো প্রমাণ ছিলো না। কাগজেকলমে সবই ঠিক ছিলো। রিপোর্টে স্বাক্ষর না করে উপায় ছিলো না আমার। এর কয়েক বছর পর আমাদের ব্যাঙ্ক ওয়েনারস্ট্রমের সাথে কিছু কাজ করে। বলতে পারো বেশ বড়সড় ব্যবসা। তবে সেটার ফল ভালো হয় নি।”

“তোমাদের সাথে সে প্রতারণা করেছে?”

“না। সেরকম কিছু না। এ কাজে আমাদের উভয়েরই বেশ লাভ হয়েছিলো। এটা তারচেয়েও বেশি…কিভাবে এটা ব্যাখ্যা করবো বুঝতে পারছি না। এখন তো সে আমার চাকরিদাতা। এটা আমি করতে চাই না। তবে আমার কাছে যেটা সবচাইতে বেশি নাড়া দেয় সেটা মোটেও ইতিবাচক কিছু না। বলতে পারো নেতিবাচক। ওয়েনারস্ট্রমকে মিডিয়ায় একজন মেধাবী ব্যবসায়ী হিসেবে তুলে ধরা হয়। এটাই তার আসল পুঁজি। আস্থা আর বিশ্বাস।”

“তুমি কি বলতে চাইছো বুঝতে পেরেছি।”

“আমার মনে হয় লোকটা একেবারেই ধাপ্পাবাজ। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে সে মোটেও মেধাবী নয়। বরং আমার কাছে মনে হয়েছে অনেক বিষয়ে সে একেবারেই মূর্খ। তবে তার তরুণ উপদেষ্টারা বেশ চালাকচতুর। সত্যি বলতে কি, ব্যক্তিগতভাবে তাকে আমি একদমই পছন্দ করি না।”

“তো?”

“কয়েক বছর আগে আমি অন্য একটা কাজে পোল্যান্ডে গিয়েছিলাম। লজে আমাদের দলটির একটি ডিনার ছিলো। ওখানে শহরের মেয়রের সাথে আমার পরিচয় হয়। তার সাথে কথায় কথায় মিনোস-এর প্রসঙ্গটি চলে আসে। আমার কথা শুনে মেয়রকে বেশ অবাক হতে দেখলাম। যেনো এ নামের কোনো কোম্পানির কথা তিনি শোনেন নি। আমাকে তিনি জানালেন এটি তুচ্ছ একটি প্রজেক্ট, তেমন বড় কিছু না। তুমি আমার কথা বুঝতে পারছো।”

“হ্যাঁ। বলে যাও।”

“পরদিন আমার হাতে তেমন কোনো কাজ ছিলো না। নিজে গাড়ি চালিয়ে বন্ধ হওয়া মিনোস-এর ফ্যাক্টরিটা পরিদর্শন করতে গেলাম। গিয়ে দেখি ছোটো ছোটো কতোগুলো টিনের ঘর ছাড়া আর কিছু নেই। ওখানকার কেয়ারটেকারের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম তার এক কাজিন মিনোস-এ কাজ করতো। খুব কাছেই তার বাড়ি। ওখানে গিয়ে যা শুনলাম তা কি শুনতে চাও?”

“আমার তো তর সইছে না।”

“১৯৯২ সালের শরৎকালে মিনোস যাত্রা শুরু করে মাত্র পনেরোজন শ্রমিক নিয়ে। বেশিরভাগই বৃদ্ধমহিলা। তাদের মাসিক বেতন দেড়শ’ ক্রোনারের মতো ছিলো। প্রথমে সেখানে কোনো মেশিনপত্র ছিলো না। শ্রমিকেরা শুধু জায়গাটা পরিস্কার করার কাজ করতো। অক্টোবরের দিকে তিনটি কার্ডবোর্ড বক্স মেশিন চলে আসে পর্তুগাল থেকে। ওগুলো ছিলো একদম পুরনো আর একেবারেই রদ্দামাল। তবে মেশিনগুলো কাজ করলেও মাঝেমধ্যেই বিকল হয়ে পড়তো। স্পেয়ার যন্ত্রপাতি ছিলো না বলে মিনোস-এর উৎপাদন দারুণভাবে ব্যাহত হোতো।”

“এখন মনে হচ্ছে গল্পটা শুরু হতে যাচ্ছে,” বললো ব্লমকোভিস্ট। “মিনোস – এ তারা কি উৎপাদন করতো?”

“১৯৯২ থেকে ৯৩ পর্যন্ত ওয়াশিং পাউডার আর ডিমের কাডবোর্ড বাক্স বানানো হোতো। তারপর তারা কাগজের ব্যাগ বানাতে শুরু করে। তবে পর্যাপ্ত কাচামালের অভাবে খুব বেশি পরিমাণ উৎপাদনে যেতে পারে নি।”

“কথা শুনে তো মনে হচ্ছে না বিশাল পরিমাণের টাকা ইনভেস্ট করা হয়েছে।”

“আমি মোট টাকার হিসেবটা বের করেছি। দু’বছরে মোট ভাড়া দিতে হয়েছে ১৫০০০ ক্রোনার। বেতনভাতা সম্ভবত ১৫০০০০ ক্রোনারের মতো। মেশিন, যানবাহনের খরচ…২৫০০০০। অনুমতির জন্যে ফি এবং এজন্যে কিছু লোকের বিমানে যাতায়াতের খরচ-সব মিলিয়ে পুরো অপারেশনে দুই মিলিয়নেরও কম খরচ হয়েছে। ১৯৯৩ সালের গ্রীষ্মে ফোরম্যান এসে ফ্যাক্টরিটা বন্ধ ঘোষণা করে। এরপর হাঙ্গেরিয়ান লরি এসে সমস্ত যন্ত্রপাতি নিয়ে চলে যায়। বাই বাই মিনোস।”

মামলা চলাকালীন সময়ে ব্লমকোভিস্ট বার বার সেই মধ্যগ্রীষ্মের কথা মনে করেছে। সেদিন রাতের তাদের দুই বন্ধুর কথাবার্তায় তার কাছে মনে হয়েছিলো তারা বুঝি আবার স্কুলের সেই সব দিনে ফিরে গেছে। সেইসময় তারা একে অন্যের দায়ভার বহনে অংশ নিতো। ঐ বয়সে এটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু বড় হবার পর তারা বদলে যায়। অচেনা হয়ে যায়। একেবারে অন্য মানুষ হয়ে যায় তারা। তাদের মধ্যে যখন কথাবার্তা হচ্ছিলো তখন ব্লমকোভিস্টের মনে হয়েছিলো ঠিক কোন কারণে লিন্ডবার্গের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়েছিলো সেটা সে ভুলে গেছে। তার কেবল মনে পড়েছিলো লিন্ডবার্গ একজন চুপচাপ আর লাজুক টাইপের ছেলে ছিলো। বড় হয়ে সে-ই কিনা হয়ে গেলো প্রচণ্ড সফল একজন মানুষ…ব্যাংকিং জগতের একজন পুরোধা।”

খুব কমই সে মদ খেতো। সেদিন রাতে তার সাথে কথা বলে সেই জঘন্য নৌভ্রমণটি তার কাছে হয়ে উঠেছিলো বেশ আনন্দময়। তবে প্রথমে সে লিন্ডবার্গের কাছ থেকে শোনা ওয়েনারস্ট্রমের কাহিনীটাকে পাত্তা দেয় নি। আস্তে আস্তে পেশাদারি আগ্রহের কারণে এটা তার কাছে কৌতূহলের বিষয় হয়ে ওঠে শেষে তার কাছে পুরো কাহিনীটা যুক্তিযুক্ত বলেই মনে হয়।”

“দাঁড়াও,” সে বলেছিলো। “ওয়েনারস্ট্রম হলো মার্কেট স্পেকুলেশনে একজন শীর্ষস্থানীয় নাম। বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা সে কামিয়েছে। তাই না?”

“ওয়েনারস্ট্রম গ্রুপ আনুমানিক দুই বিলিয়ন ক্রোনার আয় করেছে। তুমি হয়তো বলবে একজন বিলিয়নেয়ার কেন পঞ্চাশ মিলিয়নের জন্যে এতোটা ঝুঁকি নিতে যাবে।”

“সেটাই। তো কেন সে এরকম ঝুঁকি নিতে গেলো?”

“তা ঠিক। তবে ভেবে দেখো : ওয়েনারস্ট্রম গ্রুপ হলো ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি, যারা সম্পত্তি, সিকিউরিটি, ফরেন এক্সচেঞ্জ…এরকম জিনিস নিয়ে কাজ করে। ওয়েনারস্ট্রম AIA-তে যোগ দেয় ১৯৯২ সালে। ১৯৯২ সালের শরৎকালের কথা কি তোমার মনে আছে?”

“আমার মনে আছে কিনা? আমি আমার অ্যাপার্টমেন্টটা ভেরিয়েবল-রেটে মর্টগেজে দিয়েছিলাম, তখন অক্টোবরে সুদের হার পাঁচশ শতাংশে গিয়ে পৌছেছিলো। এক বছর ধরে আমাকে ঊনিশ শতাংশ সুদ দিয়ে যেতে হয়েছে।”

“দিনই ছিলো সেসব,” লিন্ডবার্গ বললো। “আমিও অনেক টাকা খুইয়েছিলাম। অন্যসবার মতো হান্স-এরিক ওয়েনারস্ট্রমও এই সমস্যায় জর্জরিত ছিলো। তার কোম্পানি বিলিয়ন বিলিয়ন ক্রোনারের মালিক ছিলো ঠিকই তবে ক্যাশ টাকা তেমন ছিলো না তাদের কাছে। হঠাৎ করেই তারা আর ইচ্ছেমতো টাকা ধার করতে পারলো না। এরকম পরিস্থিতিতে নিজেদের কিছু সম্পত্তি বিক্রি করে বোঝা কমানোই সঙ্গত ছিলো। কিন্তু ১৯৯২ সালে রিয়েল এস্টেট কেনার মতো খুব বেশি লোক ছিলো না।”

“ক্যাশ-প্রবাহের সমস্যা।”

“ঠিক। ওয়েনারস্ট্রম একা ছিলেন না। সব ব্যবসায়ীরই এই সমস্যা ছিলো।”

“ব্যবসায়ী শব্দটা ব্যবহার কোরো না। অন্য কিছু বলো। তাকে ব্যবসায়ী বললে একটা সিরিয়াস পেশাকে অপমান করা হয়।”

“ঠিক আছে। সব স্পেকুলেটরেরই ক্যাশ-প্রবাহের সমস্যা ছিলো। ব্যাপারটা এভাবে দেখো : ওয়েনারস্ট্রম ষাট মিলিয়ন ক্রোনার পেয়ে ছয় মিলিয়ন ফেরত দিয়ে দিলো তবে সেটা তিন বছর পর। মিনোস-এর সত্যিকারের খরচ দুই মিলিয়নের বেশি ছিলো না। তিন বছরে সুদই ছিলো ঘাট মিলিয়ন। বেশ ভালো অঙ্কের টাকা। সে এই টাকা কোন্ খাতে বিনিয়োগ করেছিলো সেটা জানা যায় নি তবে AIA-এর টাকা সে দ্বিগুন করেছিলো, সম্ভবত দশগুনও হতে পারে। এখন কি মনে হচ্ছে না আমরা বেড়ালের হাগু নিয়ে কথা বলছি না।”

অধ্যায় ২

শুক্রবার, ডিসেম্বর ২০

ড্রাগান আরমানস্কি আজ থেকে ছাপান্ন বছর আগে ক্রোয়েশিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলো। তার বাবা ছিলো এক আর্মেনিয়ান ইহুদি আর মা একজন বসনিয়ান মুসলিম। তার লেখাপড়া এবং ভরণপোষণ করে তার মা ফলে তাকে একজন মুসলিম হিসেবেই দেখা হয়। তবে সুইডিশ ইমিগ্রান্ট কর্তৃপক্ষ অদ্ভুত এক কারণে তাকে একজন সার্বিয়ান হিসেবে রেজিস্ট্রি করে। তার পাসপোর্ট মতে সে একজন সুইডিশ নাগরিক। চেহারা যথেষ্ট আরব আরব বলে তাকে প্রায়ই একজন ‘আরব’ হিসেবে অভিহিত করা হয় যদিও তার শরীরে এক ফোঁটাও আরব রক্ত নেই।

দেখতে সে আমেরিকান গ্যাংস্টার সিনেমার বসের মতো তবে সত্যি বলতে কি সে একজন প্রতিভাবান ফিনান্সিয়াল ডিরেক্টর যে সত্তুর দশকের শুরুতে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলো মিল্টন সিকিউরিটিতে একজন জুনিয়র একাউন্টেন্ট হিসেবে। তিন দশক পর সে ঐ কোম্পানির সিইও এবং সিওও হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়।

সিকিউরিটি ব্যবসায় সে বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠে। এটা অনেকটা যুদ্ধ খেলার মতো—হুমকিগুলো চিহ্নিত করা, পাল্টা স্ট্র্যাটেজি প্রণয়ন করা আর সব সময় ইন্ডাস্ট্রিয়াল গুপ্তচর, ব্ল্যাকমেইলার আর চোরবাটপারদের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকা। নিজের মেধা খাটিয়ে সে মিল্টন সিকিউরিটিকে সুইডেনের অন্যতম প্রধান এবং বিশ্বস্ত ফার্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

৩৮০জন সার্বক্ষণিক কর্মচারি এবং আরো ৩০০জন অস্থায়ী কর্মচারি রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানে। এটা অনেকটা ফালাক অথবা সুইডিশ গার্ড সার্ভিসের সাথেই তুলনীয়। আরমানস্কি যখন এই ফার্মে যোগ দেয় তখন এটার নাম ছিলো ফ্রেডারিক মিল্টন’স জেনারেল সিকিউরিটি, হাতে গোনা কিছু শপিংসেন্টার ছিলো এর ক্লায়েন্ট। তার নেতৃত্বে মিল্টন সিকিউরিটি অত্যাধুনিত সব যন্ত্রপাতির প্রচলন করে, প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে আর্ন্তজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। আনাড়ি লোকজনের বদলে আরমানস্কি দক্ষ এবং পুলিশের সাবেক কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়েছে অপারেশন চিফ হিসেবে। আর্ন্তজাতিক সন্ত্রাসে অভিজ্ঞ পলিটিক্যাল সায়েন্টিস্ট, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল গুপ্তচরদের দিয়ে কাজ করায়। সবথেকে বড় কথা সেরা টেলিকমিউনিকেশন টেকনিশিয়ান আর আইটি বিশেষজ্ঞ ভাড়া করে। সোলোনা থেকে কোম্পানি স্টকহোমের প্রাণকেন্দ্র স্লাসেনের অত্যাধুনিক অফিসে স্থানান্তরিত হয়েছে তারই প্রচেষ্টায়।

নব্বই দশকের শুরুতে মিল্টন সিকিউরিটি মিডিয়াম সাইজের কর্পোরেশন, ভালো ব্যবসা করা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান আর এক্সক্লুসিভ ক্লায়েন্টদের হয়ে কাজ শুরু করে। বিদেশে অবস্থানরত, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে সুইডিশ ফার্মগুলোতেও তারা প্রটেকশন এবং নিরাপত্তারক্ষী সরবরাহের কাজ করে থাকে। বর্তমানে এইসব এলাকা থেকে যে আয় হয় সেটা তাদের মোট আয়ের সত্তুর শতাংশ। আরমানস্কির অধীনে কোম্পানির আয় চল্লিশ মিলিয়ন ক্রোনার থেকে প্রায় দুই বিলিয়নে উন্নীত হয়েছে। সিকিউরিটি সরবরাহ করাটা হয়ে উঠেছে আকর্ষণীয় ব্যবসা।

অপারেশনগুলো কয়েকটি প্রধান ভাগে বিভক্ত : সিকিউরিটি কনসালটেশন, যেখানে সত্যিকারের এবং কাল্পনিক হুমকিগুলো চিহ্নিত করা হয়। কাউন্টার মিসার, যেখানে সাধারণত সিকিউরিটি ক্যামেরা, সিঁধেল চোরদের ধরার যন্ত্রপাতি, ফায়ার অ্যালার্ম, ইলেক্ট্রনিক লকিং আর আইটি সিস্টেম স্থাপনের কাজ করা হয়। সবশেষে আছে পারসোনাল প্রটেকশন, প্রাইভেট কোম্পানি অথবা ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষার কাজ। এই মার্কেটটি বিগত দশ বছরে চল্লিশগুন বেড়ে গেছে। পরে আরো একটি ক্লায়েন্ট গ্রুপের আবির্ভাব ঘটেছে : সাবেক বয়ফ্রেন্ড, স্বামী কিংবা নারী শিকারীদের হাত থেকে অনেক মহিলা নিরাপত্তা লাভের জন্যে তাদের দ্বারস্থ হচ্ছে। এছাড়াও মিল্টন সিকিউরিটি ইউরোপ আমেরিকার একই কাজে নিয়োজিত সুনামী প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথভাবেও কাজ করে থাকে। সুইডেনে আসা অনেক আর্ন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের নিরাপত্তার কাজও করে আরমানস্কির এই প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে এক আমেরিকান অভিনেত্রি রয়েছে যে কিনা ট্রলহাটানে দুই মাস ছবির শুটিংয়ে এসেছিলো। তার এজেন্ট মনে করেছিলো এরকম একজন সেলিব্রেটি পথেঘাটে কিংবা হোটলে চলাফেরা করার সময় বডিগার্ডের সহায়তা লাগবে।

চতুর্থ ক্ষেত্রটি অপেক্ষাকৃত বেশ ছোটো। এ কাজে খুব অল্প কিছু কর্মচারি নিযুক্ত আছে। এটাকে বলা হয় পিআই। এর কাজ হলো কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে তদন্ত করা

এই কাজে অবশ্য কিছুটা ঝুঁকি আছে। সেটা আরমানস্কিও জানে। কর্মচারির বিচারবিবেচনার উপরেই অনেকাংশে নির্ভর করে এই কাজের সফলতা। এখানে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি কিংবা আইটি জ্ঞানের চেয়ে মেধা আর মননশীলতার প্রয়োজন বেশি। তাকে খুব সাবধানে থাকতে হয়। তা না হলে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। আমার মেয়ে কোন্ ধরণের বেয়াদপের সাথে ডেটিং করছে সেটা আমি জানতে চাই…আমার মনে হয় আমার বউ অন্য কারো সাথে প্রেম করছে…লোকটা ভালোই কিন্তু তার সঙ্গিসাথীরা খুবই বাজে…আমি ব্লাকমেইলের শিকার…এরকম ক্লায়েন্টদের আরমানস্কি সব সময়ই সোজা না করে দেয়! আপনার মেয়ে যদি প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে থাকে তাহলে যেকোনো বেয়াদপের সাথে সে ডেটিং করার অধিকার রাখে। আর তার কাছে মনে হয় অবিশ্বস্ততার ব্যাপারটি স্বামী-স্ত্রী নিজেরা সমাধান করাই ভালো। এরকম কাজের বেলায় আইনী ঝামেলা আর বদনামের সম্ভাবনা বেশি থাকে। আরমানস্কি তাই মোটা অঙ্কের লাভের কথা জেনেও এসব ক্ষেত্রে বেশ সচেতন আর সজাগ।

.

আজকের সকালের টপিকটা ব্যক্তি সম্পর্কিত একটি তদন্তের। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে তার কলিগ লিসবেথ সালান্ডারের দিকে সন্দেহের চোখে চেয়ে আছে আরমানস্কি। এই মেয়েটি তার চেয়ে বত্রিশ বছরের ছোটো। কম করে হাজার বার সে ভেবেছে এই মেয়েটা তার প্রতিষ্ঠানের মতো অভিজাত একটি ফার্মে একেবারেই বেখাপ্পা। তার এই অনাস্থাটি সুবিবেচনা এবং একই সাথে অযৌক্তিকও বটে। আরমানস্কির চোখে সালান্ডার তার কর্মজীবনে দেখা সবচাইতে মেধাবী ইনভেস্টিগেটর। এ ব্যাপারে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই। চার বছর ধরে এই মেয়েটি তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করে যাচ্ছে, একবারের জন্যে হলেও সে ব্যর্থ হয় নি। কোনো কাজে তার কোনো গাফিলতি নেই। তার দেয়া রিপোর্ট সব সময়ই বিশ্বাসযোগ্য।

সত্যি বলতে কি তার রিপোর্টগুলো খুবই উঁচুমানের। মেয়েটির মধ্যে যে অনন্য প্রতিভা আছে সে ব্যাপারে আরমানস্কির কোনো সন্দেহ নেই। যে কেউ বিশ্বাসযোগ্য তথ্য কিংবা পুলিশ রেকর্ড থেকে চেকিংয়ের কাজ করতে পারে তবে সালান্ডারের রয়েছে কল্পনাশক্তি। সব সময়ই এই মেয়েটি তার প্রত্যাশার চেয়ে ভিন্ন কিছু নিয়ে হাজির হয়। কিভাবে মেয়েটি এই কাজ করে সেটা সে কখনও বুঝতে পারে না। কখনও কখনও তার কাছে মনে হয় মেয়েটি বোধহয় জাদু জানে। বুরোক্রেটিক আর্কাইভের সব কিছুই মেয়েটির নখদর্পনে। তারচেয়ে বড় কথা হলো যে লোকের সম্পর্কে সে তদন্ত করছে তার চামড়ার নীচে কি আছে সেটাও সে বের করে আনতে পারে। পাওয়ার মতো কোনো তথ্য যদি থাকে তো সে ক্রুজ মিসাইলের মতো ভেদ করে সেটা বের করে আনবে।

যেভাবেই হোক না কেন এ কাজে মেয়েটার প্রতিভা আছে।

তার রাডারে ধরা পড়া লোকের সম্পর্কে তার রিপোর্টটা হতে পারে মারাত্মক! একটি ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির রিসার্চার সম্পর্কে তদন্ত করার জন্যে আরমানস্কি তাকে যখন নিয়োগ দিয়েছিলো সেই সময়কার কথা সে কখনও ভুলতে পারবে না। কাজটা তিন সপ্তাহের মধ্যে করার কথা থাকলেও সেটা চার সপ্তাহে গিয়েও শেষ হলো না। অনেকবার রিমাইন্ডার দেয়া হলেও সালান্ডার পাত্তাই দেয় নি। অবশেষে রিপোর্ট নিয়ে হাজির হয় সে। ঐ রিসার্চার নাকি একজন পেডোফাইল। তালিনে অবস্থিত শিশুযৌনপল্লীতে গিয়ে বার কয়েক এক অল্পবয়সী মেয়ের সাথে সম্ভোগে লিপ্ত হয়েছে সে। বর্তমানে যে মহিলার সাথে বসবাস করছে তার মেয়ের সাথেও এরকম অনৈকিত কাজে সে জড়িত।

আরমানস্কিকে খুব ভোগানোর অভ্যেস ছিলো সালান্ডারের, এই কেসে সেরকম কিছু করেছে সে। আরমানস্কিকে কোনো রকম ফোন করে নি, এমনকি তার অফিসে এসে তার সাথে দুটো কথাও বলে যায় নি। রিপোর্টটাতে যে বিস্ফোরকজাতীয় কিছু তথ্য আছে দুয়েক শব্দে সেসবের কোনো ইঙ্গিতও ছিলো না তাতে। এক সন্ধ্যায় তার ডেস্কে রিপোর্টটা রেখে চলে যায় মেয়েটি। পরে, রাতের কোনো এক সময় লিডিঙ্গোর নিজের বাড়িতে স্ত্রীর সাথে টিভি দেখার সময় সেটা পড়ে দেখে সে।

সব সময় যেমনটি হয় সেই রিপোর্টটিও ছিলো একেবারে বৈজ্ঞানিকভাবে নিখুঁত আর যথার্থ। ফুটনোট, কোটেশন আর সোর্সেরও উল্লেখ ছিলো তাতে। প্রথম পৃষ্ঠায় লোকটির ব্যাকগ্রাউন্ড, ক্যারিয়ার, শিক্ষাগতযোগ্যতা আর অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরা হয়। ২৪ পৃষ্ঠায় এসে সালান্ডার বোমাটা ফাটায়। একরকম নিস্পৃহ ভাষায় সে লেখে লোকটা সোলেনটুনায় থাকে আর গাঢ় নীল রঙের ভলভো গাড়ি চালায়। ডকুমেন্টের সাথে তেরো বছরের সেই মেয়ের সাথে তার একটা ছবিও জুড়ে দেয়া ছিলো। তালিনের এক হোটেল করিডোরের ছবি সেটা। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে লোকটার হাত মেয়েটার সোয়েটার নীচে। সালান্ডার ঐ মেয়েটাকেও খুঁজে বের করেছিলো, তাকে জিজ্ঞাসাবাদের একটি অডিও টেপও দিয়ে দিয়েছে রিপোর্টের সাথে।

রিপোর্টটা এমন একটি কেওজের জন্ম দেয় যা আরমানস্কি মোটেও চায় নি। প্রথমেই সে আলসারের জন্যে কিছু ট্যাবলেট খেয়ে নেয় তারপর ক্লায়েন্টকে ফোন করে একটা মিটিংয়ের জন্যে বলে। অবশেষে ক্লায়েন্টের প্রবল চাপে সে পুরো ব্যাপারটা পুলিশকে জানাতে বাধ্য হয়। এরমানে মিল্টন সিকিউরিটি মারাত্মক এক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাওয়া। সালান্ডারের প্রমাণগুলো সত্যি না হলে তার ফার্ম মানহানির মামলার শিকার হোতো। গচ্চা দিতে হোতো বিশাল অঙ্কের টাকা।

তবে যাইহোক লিসবেথ সালান্ডারের চালচলন আর আবেগহীন ব্যাপারটা নিয়ে আরমানস্কি হতাশ ছিলো। মিল্টনের ইমেজ ছিলো কিছুটা রক্ষণশীল। সেদিক থেকে সালান্ডার একেবারেই বেমানান। আরমানস্কির সবচাইতে উজ্জ্বল রিসার্চার দেখতে হাড্ডিসার এর ফ্যাকাশে এক তরুণী। তার চুলগুলো ছেলেদের মতোই ছোটো ছোটো করে ছাটা। নাক আর ভুরু ফুটো করে রিং পরে। তার ঘাড়ে এক ইঞ্চির মতো লম্বা একটি wasp টাট্টু আছে, আরেকটা আছে তার বাম হাতের বাইসেপ আর অন্যটি বাম পায়ের গোড়ালী পেঁচিয়ে। যখন ট্যাঙ্ক-টপ পরে তখন আরমানস্কি দেখেছে তার বাম কাঁধের ব্লেডের উপর ড্রাগনের একটি টাট্টুও আছে। তার চুলের রঙ লালচে কিন্তু ডাই করে সেটাকে কালো কুচকুচে করে রাখে। তাকে দেখে মনে হবে হার্ডরকারদের সাথে এক সপ্তাহের একটি যৌনভ্রমণ করে এসেছে।

তাকে দেখে অ্যানারেক্সিয়া রোগি মনে হলেও খাওয়াদাওয়া নিয়ে তার কোনো সমস্যা নেই। এ ব্যাপারে আরমানস্কি একদম নিশ্চিত। বরং মনে হয় মেয়েটি সব ধরণের চাঙ্কফুডই বুঝি সাবাড় করতে পারে। জন্মগতভাবেই মেয়েটি আসলে হালকাপাতলা গড়নের, ফলে তাকে দেখে বালিকাসুলভ বলে মনে হয়। রোগাপাতলা হাত-পা, সরু কোমর আর কিশোরীদের মতো স্তন। তার বয়স চব্বিশ তবে তাকে দেখে চৌদ্দ বছরের মনে হয়।

বড় মুখ, ছোটো নাক আর উঁচু গালের হাড়ের কারণে এশিয়ান বলেও মনে হয় তাকে। তার চালচলন খুব দ্রুত আর মাকড়ের মতো নিঃশব্দের। সে যখন কম্পিউটারে কাজ করে তার হাতের আঙুলগুলো কিবোর্ডের উপর রীতিমতো খই ভাজতে থাকে। খুব বেশি হাড্ডিসার হওয়ার কারণে মডেলিংয়ে তার ক্যারিয়ার শুরু করা সম্ভব না। তবে ঠিকভাবে মেকআপ করলে পৃথিবীর যেকোনো বিলবোর্ডে তার মুখের ছবি ঠাঁই পাবে। কখনও কখনও সে কালো রঙের লিপস্টিক ব্যবহার করে তখন তাকে দেখতে একেবারেই অন্যরকম আর বেশ আকর্ষণীয় লাগে।

ড্রাগান আরমানস্কির হয়ে সালান্ডারের কাজ করাটা বিস্ময়করই বটে। এরকম কোনো মেয়ের সাথে তার পরিচয় হওয়ারও কথা নয়।

তাকে ভাড়া করা হয়েছিলো ছোটোখাটো সব ধরণের কাজের জন্যে। মিল্টন ফার্মের পুরনো এক কর্মচারি-আইনজীবি হোলগার পামগ্রিন আরমানস্কিকে বলেছিলো লিসবেথ সালান্ডারের আচার আচরণ যাইহোক না কেন মেয়েটি তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন। পামগ্রিনই তার কাছে অনুনয় করেছিলো তাকে একটা সুযোগ দেবার জন্যে। আরমানস্কি নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই মেয়েটাকে সুযোগ দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো কারণ পামগ্রিন হলো এমন একজন মানুষ যাকে ‘না’ বলার মানে হচ্ছে নাছোরবান্দার মতো আরো বেশি উৎসাহী হয়ে লেগে থাকবে সে। তাই তাকে ‘হ্যা’ বলাটাই সবচাইতে সহজ কাজ। আরমানস্কি জানতো পামগ্রিন উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেমেয়ে আর বিপথগামীদের সুপথে আনার কাজে নিবেদিতপ্রাণ একজন তবে শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো এই মেয়েটার সম্পর্কে তার বিচার সঠিকই ছিলো।

মেয়েটির সাথে দেখা হতেই সে নিজের সিদ্ধান্তের জন্যে মনে মনে বেশ আফসোস করেছিলো। মেয়েটা কেবল কঠিন চিজই না-তার চোখে এই মেয়েটা আপাদমস্তকই কঠিন। স্কুল শেষ না করেই পড়াশোনা শেষ করে দিয়েছে। তেমন উচ্চশিক্ষিত নয় মোটেও।

প্রথম কয়েক মাস মেয়েটি প্রায় ফুলটাইমই কাজ করতো। মাঝেমধ্যেই অফিসে এসে কফি বানাতো, পোস্টঅফিসে যেতো কিংবা কপি করার কাজ করতো। তবে প্রচলিত অফিস আওয়ার কিংবা রুটিনওয়ার্কের ব্যাপারে তার প্রবল অনীহা। তাছাড়া অন্য কর্মচারিদেরকে জ্বালাতন করার প্রতিভাও আছে মেয়েটির। কিছুদিনের মধ্যেই তার পরিচয় হয়ে গেলো ‘দুই মস্তিষ্কের মেয়ে’ হিসেবে-একটা শ্বাস নেবার জন্যে অন্যটা দাঁড়ানোর জন্যে। নিজের সম্পর্কে সে কখনই কথা বলে না। যেসব কলিগ তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছিলো তারা তার কাছ থেকে শীতল আচরণ পেয়ে ওপথে আর পা বাড়ায় নি। তার আচার ব্যবহার না বিশ্বস্ত না বন্ধুত্বসুলভ। খুব দ্রুতই সে একজন বহিরাগত হয়ে গেলো। মিল্টনের করিডোরে ঘুরে বেড়ানো অনাহুত বেড়ালের মতো। সাধারণভাবে তাকে নিয়ে সবাই হতাশ।

একমাস পর সমস্যা ছাড়া আর কিছু না পেয়ে আরমানস্কি তাকে ডেকে পাঠায়। তার ইচ্ছে ছিলো মেয়েটাকে বিদায় করে দেয়া। মেয়েটি তার কাছ থেকে যাবতীয় অভিযোগ এক মনে শুনে গেলো কোনো রকম প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে। তার ভুরু পর্যন্ত কুচকে গেলো না। ‘তার আচার আচরণ ঠিক না’ এই বলে শেষ করে আরমানস্কি। মাত্র বলতে যাবে যে তার জন্যে অন্যত্র চাকরি করাটাই ভালো হবে ঠিক তখনই মেয়েটি মুখ খুললো।

“আপনি যদি একজন কেরাণী চান তো সেটা আপনি টেম্প এজেন্সি থেকে পেতে পারেন। আপনি যাকে চাইবেন তাকেই আমি সামলাতে পারবো। আর আপনি যদি আমাকে ভালো কোনো কাজে ব্যবহার করতে না পারেন তো আপনি একজন গর্দভ ছাড়া আর কিছু না।”

হতবিহ্বল হয়ে রেগেমেগে আরমানস্কি বসে রইলো। তবে মেয়েটি থামলো না।

“আপনার এখানে একজন লোক আছে যে কিনা তিন সপ্তাহ ধরে এক ডট- কম কোম্পানির একটি তদন্তের উপর একেবারে বস্তাপচা রিপোর্ট লিখে যাচ্ছে। গতরাতে আমি তার জন্যে সেই বস্তাপচা জিনিসটা কপি করেছি, এখন দেখতে পাচ্ছি সেটা আপনার ডেস্কের উপর পড়ে আছে।”

আরমানস্কির চোখ গেলো ডেস্কের রিপোর্টটার দিকে। দেখেই তার ভুরু কপালে। গলা চড়িয়ে কথা বললো এবার।

“এইসব কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্ট তো তোমার পড়া ঠিক হয় নি।”

“তা ঠিক। কিন্তু আপনার ফার্মের সিকিউরিটি রুটিন একেবারেই অপর্যাপ্ত। আপনার অফিসের নিয়ম অনুযায়ী এ রকম জিনিসের কপি তার নিজেরই করার কথা। কিন্তু গতকাল রাতে সে বারে যাওয়ার আগে আমার কাছে এটা কপি করার জন্যে দিয়ে গেছে। ভালো কথা, তার আগের রিপোর্টটা ক্যান্টিনে খুঁজে পেয়েছি।”

“কি বললে তুমি?”

“শান্ত হোন। সেটা আমি তার বক্সে রেখে দিয়েছি।”

“সে কি তোমাকে তার বক্সের কম্বিনেশন দিয়েছে নাকি?” আরমানস্কি যারপরনাই বিস্মিত

“ঠিক তা না। সে ওটা এক টুকরো কাগজে লিখে রেখেছিলো। তার সাথে তার কম্পিউটারের পাসওয়ার্ডটাও। কিন্তু আসল কথা হলো আপনার ঐ জোকার প্রাইভেট ডিটেক্টিভ যে ব্যক্তির সম্পর্কে ইনভেস্টিগেশন করছে সেটা একেবারেই মূল্যহীন। লোকটার যে পুরনো জুয়া খেলার ঋণ আছে এবং গোগ্রাসে কোকেইন সেবন করে সেটা সে বের করতে পারে নি। অথবা তার মেয়েবন্ধুকে এমন বেদম পিটিয়েছিলো যে বেচারিকে উইমেন ক্রাইসিস সেন্টারের দ্বারস্থ হতে হয়েছিলো

আরমানস্কি কয়েক মিনিট ধরে রিপোর্টটা পড়ে গেলো। একেবারে গোছানো আর চমৎকার একটি রিপোর্ট। অবশেষে মুখ তুলে তাকিয়ে কেবল দুটো কথা বললো সে : “প্রমাণ করো।”

“আমি কতোটা সময় পাবো?”

“তিন দিন। শুক্রবার বিকেলের মধ্যে যদি তুমি প্রমাণ করতে না পারো তাহলে তোমাকে বরখাস্ত করা হবে

তিন দিন পর সে রিপোর্টটা ডেলিভারি দিলো। দেখা গেলো যার সম্পর্কে সে তদন্ত করছে সে আস্ত একটা বানচোত। সপ্তাহান্তে আরমানস্কি রিপোর্টটা বেশ কয়েকবার পড়ে দেখলো, সোমবার অনেকটা সময় ব্যয় করলো কিছু তথ্য ডাবল- চেক করার কাজে। অবশ্য সে ভালো করেই জানতো সালান্ডারের দেয়া তথ্য একদম নির্ভুল।

একই সাথে বিস্মিত আর নিজের উপর ভীষণ রেগে গেলো আরমানস্কি কারণ মেয়েটা সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করেছিলো তা একদমই ভুল। সে ভেবেছিলো মেয়েটা স্টুপিড ধরণের। যে মেয়ে স্কুল শেষ করতে পারে নি সে যে নির্ভুল ব্যাকরণে রিপোর্ট লিখতে পারবে সেটা সে আশা করে নি। রিপোর্টে অবজার্ভেশন আর তথ্যের বিস্তারিত বিবরণও ছিলো। এসব জিনিস মেয়েটা কিভাবে জোগার করলো সেটা তার মাথায়ই ঢুকলো না।

উইমেন্স ক্রাইসিস সেন্টারের ডাক্তারের গোপন জার্নাল থেকে তথ্য বের করাটা মিল্টন সিকিউরিটির কারো পক্ষে সম্ভব কিনা ভেবেও পেলো না সে। তবে সে যখন মেয়েটার কাছে জানতে চাইলো সে কিভাবে এসব করতে পারলো তখন সে স্পষ্ট করে বলে দিলো যে সে তার সোর্সের ব্যাপারে কোনো কিছু বলতে অপারগ। সালান্ডার তার কাজের পদ্ধতি নিয়ে কারো সাথে আলোচনা করতে চায় না সেটা বোঝা গেলো। এটা অবশ্য আরমানস্কিকে ভাবিয়ে তুলেছিলো-তারপরও মেয়েটাকে পরীক্ষা করার লোভ সে সামলাতে পারে নি।

ব্যাপারটা নিয়ে বেশ কয়েকদিন সে ভাবলো। হোলগার পামগ্রিন যখন মেয়েটাকে তার কাছে পাঠিয়েছিলো তখন কি বলেছিলো সেটা মনে করলো সে, ‘সবাই একটা সুযোগ আশা করে।’ নিজের মুসলিম শৈশবের কথা ভাবলো সে, যা তাকে শিখিয়েছে সমাজচ্যুতদের সাহায্য করাটা তার দায়িত্ব। অবশ্য সে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, টিনএজ বয়স থেকে কোনোদিন মসজিদেও যায় নি, তবে সে মনে করলো লিসবেথকে সালান্ডারকে সাহায্য করতে হবে। মেয়েটাকে সুপথে আনার জন্যে তাকে সাহায্য করাটা জরুরি। এরকম কাজ সে বিগত কয়েক দশকে করে নি।

সালান্ডারকে বিতারিত না করে তাকে ডেকে পাঠালো একটা মিটিংয়ের জন্য যাতে করে সে বুঝতে পারে এই মেয়েটার আচার আচরণ এমন কেন। তার নিশ্চিত ধারণা ছিলো মেয়েটা মারাত্মক কোনো আবেগীয় সমস্যায় আছে, তবে সে দেখতে পেলো মেয়েটার রুক্ষ্ম আচার আচরণের আড়ালে অনন্যসাধারণ বুদ্ধিমত্তা রয়েছে। তার কথাবার্তা বেশ চাছাছোলা হলেও সে বুঝতে পারলো মেয়েটাকে তার ভালো লাগতে শুরু করেছে।

পরবর্তী মাসগুলোতে আরমানস্কি সালান্ডারকে নিজের ডানার নীচে নিয়ে নিতে সক্ষম হলো। সত্যি কথা বলতে কি মেয়েটাকে তার ছোটোখাটো একটি সোশ্যাল প্রজেক্ট হিসেবে নিয়েছিলো সে। তাকে রিসার্চ করার কাজ দিয়ে সেইসাথে কিভাবে কাজ করতে হবে তার একটি গাইডলাইনও দিয়ে দিলো আরমানস্কি। নিজের মতোই কাজ করতে শুরু করলো মেয়েটি। মিল্টনের টেকনিক্যাল ডিরেক্টরকে ডেকে মেয়েটাকে আইটি সায়েন্সে কোর্স করার জন্যে বললো সে, কিন্তু মেয়েটার সাথে কথা বলে ডিক্টের তাকে জানালো তার আইটি জ্ঞান মিল্টনের যে কোনো কর্মচারির চেয়ে অনেক ভালো।

কিন্তু এসব উন্নয়ন আর প্রশিক্ষণের ব্যাপারটায় সালান্ডারের কোনো আগ্রহ দেখা গেলো না। মিল্টনের নিজস্ব যে অফিস রুটিন সেটার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে তার মারাত্মক অনীহা। এটা আরমানস্কিকে কঠিন এক অবস্থায় ফেলে দিলো।

তার কোনো কর্মচারি নিজের ইচ্ছায় অফিসে যাবে আসবে সেটা তার কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। অন্য কারোর বেলায় হলে মেয়েটাকে সে নিজের বদঅভ্যেস বদলাতে বলতো। কিন্তু সে বেশ ভালো করেই জানতো এরকম কিছু করার জন্যে সালান্ডারকে চাপ দিলে সে সোজা চাকরি ছেড়ে চলে যাবে।

তারচেয়ে বড় সমস্যা হলো এই তরুণীর প্রতি তার নিজের অনুভূতিটা আসলে কী সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত হতে পারছিলো না। মেয়েটাকে নিয়ে তার মধ্যে একটা খচখচানি ছিলো আবার তার প্রতি এক ধরণের আকর্ষণও বোধ করতো সে। এটা অবশ্য যৌন আকর্ষণ নয়। অন্তত সে এরকম কিছু ভাবতো না। তার স্বপ্নের নারীরা হলো সোনালী চুল আর আকর্ষণীয় দেহবল্লরীর অধিকারী। ফোলা ফোলা ঠোঁট হতে হবে তাদের। দেখলেই যেনো কামনা বাসনা জেগে ওঠে। তাছাড়া বিশ বছর ধরে সে রিটভা নামের এক ফিনিশীয় নারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ। তার স্ত্রী এখনও তার সমস্ত কামনাবাসনা মেটাতে সক্ষম। এ জীবনে সে কখনই অবিশ্বস্ত ছিলো না…তবে একটা ঘটনা অবশ্য ঘটেছিলো, তার বউ যদি সেটা জেনে যায় তবে তাকে ভুল বুঝবে। তারা বেশ সুখি। সালান্ডারের বয়সী দুটো মেয়ে আছে তাদের। যাইহোক না কেন, সে কোনো সমতল বুকের মেয়ে যাকে দূর থেকে খুব সহজেই ছেলে হিসেবে ভুল করবে যে কেউ তার প্রতি তার কোনো আকর্ষণ তৈরি হবে না। এটা তার স্টাইল নয়।

তারপরও লিসবেথ সালান্ডারকে নিয়ে উল্টাপাল্টা দিবাস্বপ্ন দেখে ফেললো সে। বুঝতে পারলো মেয়েটার প্রতি সে একদম নির্মোহ থাকতে পারছে না। তবে তার মনে হলো সালান্ডারের প্রতি তার এই আকর্ষণটার মূল কারণ মেয়েটি তার কাছে একেবারেই অচেনা একজন। যেনো ভিন্ন কোনো জগত থেকে এসেছে সে। যেনো সে কোনো নিম্ফের পেইন্টিং অথবা গৃক অ্যাম্ফোরার প্রেমে পড়েছে। সালান্ডার যে জীবনের প্রতিনিধিত্ব করে সেটা তার কাছে সত্যিকারের বলে মনে হয় না। এটা তাকে মুগ্ধ করে, আকর্ষণ করে কিন্তু এতে সে অংশ নিতে চায় না-অবশ্য মেয়েটাও তাকে অংশগ্রহণ করতে দিতে অপারগ।

একবার গামলা স্টানের স্টরটরগেট ক্যাফে’তে বসেছিলো আরমানস্কি ঠিক তখনই সালান্ডার তার টেবিল থেকে কয়েক টেবিল পরের একটি টেবিলে এসে বসে। তার সাথে ছিলো আরো তিনজন মেয়ে আর একটি ছেলে। তাদের বেশভুষা আর পোশাক সালান্ডারের মতোই। আগ্রহ নিয়ে আরমানস্কি তাদের দেখতে লাগলো। অফিসে যেমন ঠিক তেমনি চুপচাপ আর শান্ত রইলো মেয়েটি তবে বন্ধুদের প্রতিটি হাসির কথায় হেসে হেসে প্রতিক্রিয়া দেখালো সে।

সে বসেছিলো তার দিক থেকে পেছন ফিরে, একবারের জন্যেও পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে নি মেয়েটি। এটা ঠিক যে সে জানতো না আরমানস্কি ওখানে আছে। মেয়েটার উপস্থিতিতে আরমানস্কিও বিব্রতবোধ করতে লাগলো। অবশেষে সে যখন তার অলক্ষ্যে টেবিল থেকে উঠে বের হতে উদ্যত হলো তখন হঠাৎ করেই মেয়েটা সোজা তার দিকে তাকালো যেনো সে যে এখানে ছিলো সেটা সে জানতো। তার চাহনি দেখে মনে হলো সে খুব অবাক হয়েছে, এটা আরমানস্কির কাছে আক্রমণের মতো মনে হলো, সেও তাকে না দেখার ভান করে ক্যাফে থেকে তাড়াহুড়া করে বের হয়ে যায়।

সালান্ডার খুব কমই হাসে। তবে অনেক দিন কাজ করার পর আরমানস্কির কাছে মনে হলো মেয়েটার মধ্যে কোমল একটি স্বভাব আছে। তার হাস্যরস একেবারেই শুকনো। বাঁকা হাসি আর আলগোছে একটা কিছু বলার মধ্যেই সেটা সীমাবদ্ধ।

মেয়েটার মধ্যে আবেগের ঘাটতি দেখে আরমানস্কির মাঝে মধ্যে মনে হয় তাকে জড়িয়ে ধরে প্রবলভাবে ঝাঁকি দেবে। মেয়েটাকে তার নিজের খোলস থেকে বের করে আনা, তার বন্ধুত্ব অর্জন করা অথবা নিদেনপক্ষে তার কাছ থেকে কিছুটা সম্মান আদায় করা।

মাত্র একবারই তার সাথে এ ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছিলো আরমানস্কি। সেটা ছিলো মিল্টন সিকিউরিটির ক্রিসমাস পার্টিতে। আর সেই একবারই সে একটু বেসামাল ছিলো বলা যায়। উল্টাপাল্টা কিছু ঘটে নি-তাকে কেবল বলার চেষ্টা করেছিলো সে তাকে ভীষণ পছন্দ করে। তারচেয়ে বড় কথা তার প্রতি সে খুব প্রটেক্টিভ ফিল করে। তার যদি কখনও কোনো সাহায্যের দরকার পড়ে সে যেনো বিন্দুমাত্র সংকোচ না করে তার কাছে চলে আসে। মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরারও চেষ্টা করেছিলো সে। সবটাই অবশ্য বন্ধুসুলভভাবে।

তার এসব কথাবার্তা বলার পরও মেয়েটি নির্বিকার ভাব তাকে বিব্রত করেছিলো। ঘটনার পর পরই সে পার্টি ছেড়ে চলে যায়। এরপর অনেক দিন আর অফিসে আসে নি। তার মোবাইলে কল করেও তাকে পাওয়া যায় নি I মেয়েটার অনুপস্থিতি তার কাছে এক ধরণের অত্যাচারের মতো লাগছিলো। যেনো বক্তিগতভাবে সে তাকে শাস্তি দিচ্ছে। এ নিয়ে কারো সাথে কথা বলার মতো কেউ ছিলো না যে ব্যাপরটা শেয়ার করবে। আর সেই প্রথম আরমানস্কি টের পেলো তার উপরে মেয়েটার ধ্বংসাত্মক একটি প্রভাব রয়েছে।

তিন সপ্তাহ পর এক রাতে আরমানস্কি যখন নিজের অফিসে বসে কাজ করছে তখন সালান্ডার এসে হাজির হয়। অনেকটা ভুতের মতো নিঃশব্দে আসে সে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে দরজার কাছে। কতোক্ষণ ধরে ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখে যাচ্ছিলো সেটা অবশ্য আরমানস্কি বুঝতে পারে নি।

“আপনি কি একটু কফি খাবেন?” জিজ্ঞেস করেছিলো মেয়েটি। ক্যান্টিন থেকে নিয়ে আসা এক কাপ কফি বাড়িয়ে দিলো সে। চুপচাপ কফিটা হাতে নিয়ে একই সাথে স্বস্তি যেমন পেলো তেমনি এক ধরণের ভীতি জেঁকে বসলো তার মধ্যে কারণ মেয়েটি দরজা বন্ধ করে তার কাছে এগিয়ে আসে স্থির চোখে। এরপর ঠিক তার বিপরীতে বসে যে প্রশ্নটা করে সেটা না হেসে উড়িয়ে দেয়া যায়, না এড়ানো যায়।

“ড্রাগান, তুমি কি আমার প্রতি আকর্ষণ বোধ করো?”

আরমানস্কি টের পেলো তার হাত পা অসাড় হয়ে গেছে। কী বলবে ভেবে পেলো না সে। সে যে অপমাণিত বোধ করছে না সেটার জন্যে একটু ভান করলো। এরপর মেয়েটির ভাবভঙ্গি দেখে একটু আশ্বস্ত হলো আর এও বুঝতে পারলো এই প্রথম সে কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করেছে। আর সেটা একেবারেই সিরিয়াস একটি প্রশ্ন। মনে মনে ভাবলো এ ধরণের প্রশ্ন করার জন্যে মেয়েটার যে সাহসের দরকার সেটার জন্যে কতো দিন লেগেছে তার। আস্তে করে হাতের কলমটা রেখে চেয়ারে হেলান দিলো সে। একটু রিল্যাক্স বোধ করলো আরমানস্কি।

“তোমার এরকম ভাবার কারণটা কি?” জানতে চাইলো সে।

‘যেভাবে তুমি আমার দিকে তাকাও এবং না তাকানোর চেষ্টা করো। অনেক সময় তুমি আমাকে স্পর্শ করার জন্য হাত বাড়াও কিন্তু নিজে থেকেই থেমে যাও।”

মুচকি হাসলো সে। “আমি জানি তোমার দিকে হাত বাড়ালে তুমি আমার হাত কামড়ে দেবে।”

মেয়েটি এমন ঠাট্টায়ও হাসলো না। জবাব পাওয়ার আশায় সে অপেক্ষায় থাকলো।

“লিসবেথ, আমি তোমার বস্। আমি যদি তোমার প্রতি কখনও আকর্ষণ অনুভব করিও তা মনের ভেতরই চেপে রাখবো। সেটা প্রকাশ করবো না

এরপরও মেয়েটা অপেক্ষা করতে লাগলো। যেনো এ জবাবে সে সন্তুষ্ট নয়। “হ্যা, অনেক সময় আমি তোমার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করি। সেটা আমি ব্যাখ্যা করতে পারবো না। তবে সেটা হয়। কী কারণে হয় আমি জানি না। তোমাকে আমি অনেক পছন্দ করি। তবে সেটা শারীরিক কোনো ব্যাপার নয়।”

“ভালো। কারণ এরকম কিছু কখনও ঘটবে না।”

আরমানস্কি হেসে ফেললো। এই প্রথম মেয়েটি ব্যক্তিগত কিছু বললো আর সেটা অবধারিতভাবে যেকোনো পুরুষের জন্য হৃদয়ভঙ্গের শামিল। কোন্ কথাটা বলবে ভাবতে লাগলো আরমানস্কি।

“লিসবেথ, আমি বুঝতে পারছি তুমি পঞ্চাশোর্ধ কোনো বুড়ো লোকের ব্যাপারে আগ্রহী নও।”

“আমি পঞ্চাশোর্ধ এমন কোনো লোকের ব্যাপারে আগ্রহী নই যে কিনা আমার বস্।” হাত তুলে সে বললো। “দাঁড়াও, আমাকে বলতে দাও। তুমি মাঝেমধ্যে একেবারে স্টুপিড আর উন্মাদগ্রস্ত আমলাদের মতো আচরণ করো। তবে সত্যি বলতে কি তুমি বেশ আকর্ষণীয় একজন পুরুষ…আমিও সেটা অনুভব করতে পারি…কিন্তু তুমি আমার বস্, আর তোমার স্ত্রীর সাথে আমার পরিচয় আছে। আমি আমার কাজটা হারাতে চাই না। তোমার সাথে কাজ করতে চাই। তোমার সাথে জড়িয়ে পড়াটা হবে আমার জন্য একেবারেই বোকার মতো একটি কাজ।”

আরমানস্কি কিছুই বললো না। তার নিঃশ্বাস যেনো বন্ধ হয়ে গেছে।

“তুমি আমার জন্য যা করেছো সে ব্যাপারে আমি সচেতন আছি, আমি অকৃতজ্ঞ নই। আমাকে সুযোগ দেবার জন্য তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তবে আমি তোমাকে আমার প্রেমিক হিসেবে চাই না, আর তুমি আমার বাবাও নও।”

কিছুটা সময় পর আরমানস্কি অসহায়ের মতো হাফ ছাড়লো। “তুমি আমার কাছ থেকে ঠিক কি চাও?”

“আমি তোমার সাথে কাজ করতে চাই। যদি তোমার কোনো আপত্তি না থাকে।”

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে যতোটা সম্ভব সততার সাথে তার প্রশ্নের জবাব দিলো। “আমিও চাই তুমি আমার জন্যে কাজ করো। তবে আমি এও চাই তুমি আমাকে একজন বন্ধু ভাববে, আমার উপর আস্থা রাখবে।”

সালান্ডার মাথা নেড়ে সায় দিলো।

“তুমি বন্ধুভাবাপন্ন মেয়ে নও,” বললো সে। “আমি বুঝি তুমি চাও না কেউ তোমার ব্যাপারে নাক গলাক। তোমার লাইফস্টাইল নিয়ে মাথা ঘামাক। আমি ও সেটা না করার চেষ্টা করবো। তবে আমি যদি তোমাকে পছন্দ করা অব্যাহত রাখি সেটাতে কি তোমার আপত্তি আছে?

কিছুটা সময় ভেবে নিলো সালান্ডার। তারপর আচমকা উঠে দাঁড়ালো সে। তার ডেস্কের কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে। আরমানস্কি একেবারে ভড়কে গেলো। যখন তাকে ছেড়ে দিলো মেয়েটার হাত ধরলো সে।

“আমরা বন্ধু হতে পারি তো?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো সালান্ডার।

কেবলমাত্র ঐ একবারই তার মধ্যে সে মায়ামমত্ব দেখতে পেয়েছিলো। আর ঐ একবারই সে তাকে স্পর্শ করেছিলো নিজ থেকে। এই মুহূর্তটার কথা মনে পড়লে আরমানস্কির বেশ ভালো লাগে।

চার বছর কাজ করার পরও নিজের ব্যক্তিগত জীবন আর ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে কিছুই বলে নি সালান্ডার। একবার আরমানস্কি তার উপর নিজের পিন্ডার্স আর্টের জ্ঞান প্রয়োগ করেছিলো। হোলগার পামগ্রিনের সাথেও এ নিয়ে দীর্ঘ আলাপ করেছে-তাকে দেখে অবশ্য পামগ্রিন মোটেও অবাক হয় নি-তার কাছ থেকে সে যা শুনতে পেলো তাতে করে মেয়েটার উপর তার আস্থা মোটেও বাড়াতে সাহায্য করলো না। সে যে তার সম্পর্কে কিছু জানে অথবা তার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছে সে ব্যাপারে তাকে কিছুই বলে নি, তাকে সেটা জানতেও দেয় নি। তার বদলে সে নিজের অস্বস্তি লুকিয়ে মেয়েটার উপর নজরদারি আরো বাড়িয়ে দেয়।

.

সেই অদ্ভুত রাত শেষ হবার আগেই আরমানস্কি আর সালান্ডার একটি ঐক্যমতে পৌছেছিলো। ভবিষ্যতে সে তার ফার্মের হয়ে একজন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে রিসার্চের কাজ করবে। কোনো অ্যাসাইনমেন্ট না করলেও প্রতি মাসে অল্পকিছু টাকা পাবে সে। তবে প্রতি অ্যাসাইনমেন্টের জন্য তাকে মোটা অঙ্কের টাকা দেয়া হবে। তার যেভাবে খুশি সেভাবেই কাজ করতে পারবে। তবে বিনিময়ে মিল্টন কোনো বিব্রতকর কিংবা ঝামেলার মধ্যে যেনো না পড়ে সেটার দিকে তাকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।

এতে করে আরমানস্কি, কোম্পানি আর সালান্ডার সবার জন্যেই সুবিধা হবে। পিআই নামের ঝামেলাপূর্ণ ডিপার্টমেন্টটির লোকবল কমিয়ে একজন ফুলটাইম কর্মচারিতে নামিয়ে আনলো সে। আর সেই কর্মচারি হলো তারই এক সময়কার পুরনো কলিগ। সবধরণের জটিল আর উদ্ভট অ্যাসাইনমেন্ট সালান্ডার এবং অল্প কয়েকজন ফ্রিল্যান্সারের কাছে দিয়ে দেয় সে। তারা স্বাধীনভাবেই মিল্টন সিকিউরিটিতে কাজ করলেও তাদের কাজের দায়দায়িত্ব ফার্মের উপর বর্তায় না। সালান্ডারকে নিয়মিত কাজে লাগানোর পর থেকে মেয়েটাও বেশ মোটা অঙ্কের টাকা কামাতে শুরু করলো। তবে সেটা আরো বেশি হতে পারতো কিন্তু সালান্ডার কেবল তখনই কাজ করে যখন তার মনে হয় কাজটা সে করবে।

মেয়েটি যেভাবে আছে সেভাবেই আরমানস্কি তাকে মেনে নিলো। তবে কোনো ক্লায়েন্টের সাথে তার দেখা করার অনুমতি দেয়া হলো না। অবশ্য আজকের অ্যাসাইনমেন্টটা ব্যতিক্রম।

সালান্ডার আজ কালো রঙের একটি টি-শার্ট পরেছে তাতে স্টিভেন স্পিয়েলবার্গের আশির দশকে সাড়া জাগানো সিনেমা ই.টি’র একটি ছবি আছে। ছবিটার নীচে একটা ক্যাপশন : আমিও একজন বর্হিজীব। তার কালো স্কার্টটা দেখে মনে হয় ছেড়াফাড়া। সেইসাথে মিডলেন্থের চামড়ার জ্যাকেট, বেল্ট আর ভারি মার্টিন ডক বুট জুতো। পায়ের মোজাটা সবুজ-লাল রঙের খাড়া স্ট্রাইপের। মুখে এমন আজব রঙের মেকআপ দিয়েছে যে কেউ হয়তো ভাববে মেয়েটা কালার ব্লাইন্ড। একেবারেই আজব গোছের সাজসজ্জা।

আরমানস্কি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার সু-টাই আর ভারি কাঁচের চশমা পরা রক্ষণশীল ক্লায়েন্টের দিকে তাকালো। ডার্চ ফ্রোডি একজন আইনজীবি, সে নাছোরবান্দার মতো চাপাচাপি করেছে যে কর্মচারি রিপোর্টটা তৈরি করবে তার সাথে নাকি তাকে মিটিং করতে হবে। তার কাছ থেকে সে সামনাসামনি কিছু জেনে নিতে চায়। আরমানস্কি এই মিটিংটা না হবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। বার বার বলেছে সালান্ডারের সর্দি লেগেছে, শহরের বাইরে আছে সে, অথবা অন্য একটা কাজে ব্যস্ত আছে কিন্তু আইনজীবি ভদ্রলোকের এক কথা, সমস্যা নেই। এটা খুব আর্জেন্ট কিছু না। সময় হলে যেনো মিটিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। কয়েকদিন অপক্ষো করতে তার কোনো আপত্তি নেই। অবশেষে মিটিংটা না করার আর কোনো উপায় রইলো না। এখন ষাটোর্ধ ফ্রোডি লিসবেথ সালান্ডারের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আর সালান্ডার যেভাবে কটমট চোখে তার জবাব দিচ্ছে সেটা মোটেও আন্তরিকতার প্রকাশ নয়।

আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এইমাত্র সালান্ডার যে ফোল্ডারটি টেবিলের উপর রেখেছে তার দিকে তাকালো আরমানস্কি। ফোল্ডারের উপর বড় বড় করে লেখা : কার্ল মিকাইল ব্লমকোভিস্ট। নামের পাশে সোশ্যাল সিকিউরিটি নাম্বারটাও দেয়া আছে। নামটা সে জোরে জোরে উচ্চারণ করলো। ফ্রোডি তার বিস্ময় জাগানো ভাবটি ঝেড়ে ফেলে তাকালো আরমানস্কির দিকে।

“তাহলে মিকাইল ব্লমকোভিস্টের সম্পর্কে আপনি আমাকে কি বলবেন? জানতে চাইলো সে।

“এ হলো মিস্ সালান্ডার, রিপোর্টটা সে-ই তৈরি করেছে।” একটু থেমে মুচকি হেসে আবার বলতে লাগলো সে। তার বয়স কম দেখে তাকে খাটো করে দেখবেন না। সে আমাদের সবচাইতে সেরা রিসার্চার।”

“সেটা আমি মেনে নিলাম,” শুকনো কণ্ঠে বললো ফ্রোডি যার অর্থ একেবারেই তার বলা কথাটার বিপরীত। “তাহলে বলুন মেয়েটা কি খুঁজে পেলো।

স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সালান্ডারের সাথে কিভাবে কথা বলতে হবে সে বিষয়ে ফ্রোডির কোনো ধারণা নেই। সে প্রশ্ন করছে আরমানস্কিকে যেনো মেয়েটা এ ঘরেই নেই। সালান্ডার তার মুখের চুইংগাম দিয়ে বড়সড় একটা বাবল তৈরি করলো। আরমানস্কি কিছু বলার আগেই সে বলতে শুরু করলো, “তুমি কি তোমার ক্লায়েন্টকে জিজ্ঞেস করবে সে লম্বা নাকি সংক্ষিপ্ত ভার্সনটা শুনতে চায়?”

বিব্রতকর একটি নীরবতা নেমে এলো ঘরে। অবশেষে ফ্রোডি ঘুরে তাকালো সালান্ডারের দিকে, বন্ধুত্বপূর্ণ একটা হাসি দিয়ে ক্ষতিপূরণ করার চেষ্টা করলো সে।

“এই ইয়াং লেডি যদি আমাকে সংক্ষিপ্তভাবে তার ফলাফলগুলো মুখে জানায় তো আমি খুব খুশি হবো।”

কয়েক মুহূর্তের জন্যে মেয়েটার এক্সপ্রেসন এমন শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠলো যে ফ্রোডির মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল একটি প্রবাহ বয়ে গেলো। তারপর আচমকাই তার অভিব্যক্তি কোমল হয়ে গেলে ফ্রোডি মনে মনে ভাবতে লাগলো একটু আগে দেখা অভিব্যক্তিটা তার দেখার ভুল কিনা। মেয়েটা যখন বলতে শুরু করলো তার কথা শুনে মনে হলো সে বুঝি একজন সিভিল সার্ভেন্ট।

“প্রথমেই আমাকে বলতে দিন এটা কোনো জটিল অ্যাসাইনমেন্ট নয়। কেবলমাত্র কাজটার যে উদ্দেশ্য সেটাই একটু অস্পষ্ট এই যা। তার সম্পর্কে যতোটুকু জানা যায় তা জানতে চান আপনি কিন্তু ঠিক কোন দিকগুলো জানতে চান সেটা আমাকে বলেন নি। এ কারণে এই রিপোর্টটা তার জীবনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের মতোই হয়ে গেছে। রিপোর্টটা ১৯৩ পৃষ্ঠার, তবে ১২০ পৃষ্ঠ হলো তার লেখা বিভিন্ন আর্টিকেল এবং পেপার ক্লিপিংস। ব্লমকোভিস্ট একজন পাবলিক পারসন, যার সিক্রেট বলতে তেমন কিছু নেই। লুকানোর মতো ঘটনাও বেশি আছে বলে মনে হয় না

“কিন্তু তার তো কিছু সিক্রেট আছে?” ফ্রোডি বললো।

“সবারই কিছু না কিছু সিক্রেট আছে,” নির্বিকারভাবে বললো সালান্ডার। “কেবল সেগুলো খুঁজে বের করে দেখতে হয় সেগুলো আসলে কি।”

“তাহলে শুনি।”

“মিকাইল ব্লমকোভিস্ট ১৯৬০ সালের ১৮ই জানুয়ারিতে জন্মগ্রহণ করে, তার মানে বয়স এখন বিয়াল্লিশ। বোরল্যাঙ্গে জন্মালেও সেখানে কখনও বসবাস করে নি। সে যখন জন্মায় তখন তার বাবা-মা কুর্ট এবং আনিটা ব্লমকোভিস্টের বয়স প্রায় পয়ত্রিশের ঘরে ছিলো। তারা দু’জনেই এখন মৃত। তার বাবা একজন মেশিনারি ইনস্টলার ছিলো ফলে বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করেছে। আর আমি যতোটুকু জানতে পেরেছি, তার মা একজন সাধারণ গৃহিনী। মিকাইল যখন স্কুলে পড়ে তখন তাদের পরিবার স্টকহোমে চলে আসে। তার থেকে তিন বছরের ছোটো এক বোন আছে, নাম আনিকা, সে একজন আইনজীবি। ব্লমকোভিস্টের কিছু জ্ঞাতি ভাইবোনও রয়েছে। তুমি কি আমাদেরকে কফি দেবার কথা ভাবছো?”

শেষ কথাটা আমানস্কির উদ্দেশ্যে বলা। একটু ইতস্তত করে সে ফ্লাস্ক থেকে তিন কাপ কফি ঢেলে সালান্ডারের দিকে ইশারা করলো কথা বলে যেতে।

“১৯৬৬ সালে তাদের পরিবার বসবাস করতো লিলা এসিঙ্গেনে। ব্লমকোভিস্ট প্রথমে রোমা এবং পরে কুঙ্গসহোমেনে পড়াশোনা করে। বেশ ভালোরকম মার্ক পেয়ে সে গ্র্যাজুয়েট হয়—ওগুলোর কপি ফোল্ডারে আছে। স্কুলে পড়ার সময় শেষের দিকে সে বুটস্ট্র্যাপ নামের একটি রকব্যান্ড গঠন করে। ওখানে সে বেজ গিটার বাজাতো। তাদের ব্যান্ডের একটি গান ১৯৭৯ সালের দিকে রেডিও’তে বেশ বাজতো। স্কুল শেষ করে সে টানেলবানা’তে একজন টিকেট কালেক্টরের কাজ করে কিছু টাকা জমায়, সে টাকা দিয়ে বিদেশ ভ্রমণে যায় সে। প্রায় এক বছরের মতো বাইরে ছিলো। এশিয়ার ইন্ডিয়া, থাইল্যান্ড হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যায়। একুশ বছর বয়সে স্টকহোমে সাংবাদিকতার উপর পড়াশোনা করতে শুরু করে তবে প্রথম বছরেই মিলিটারি সার্ভিস করার জন্যে তার পড়াশোনায় ছেদ পড়ে। মিলিটারিতেও সে বেশ ভালো করেছিলো। মিলিটারি সার্ভিস শেষে সাংবাদিকতার ডিগ্‌ লাভ করে। তারপর থেকেই মূলত রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু করে। আর কি কি ডিটেইল শুনতে চান আমার কাছ থেকে?”

“আপনার কাছে যা যা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় সেগুলো বলুন

“দ্য থূ লিটল পিস নামের শিশুদের যে বই আছে তাতে তার একটি কাহিনী আছে। এ পর্যন্ত সে একজন চমৎকার সাংবাদিক হিসেবেই পরিচিত সবার কাছে। আশির দশকে সে অনেকগুলো অস্থায়ী চাকরি করেছে। ওসবের তালিকা ফোল্ডারে দেয়া আছে। তার সবচাইতে বিরাট সাফল্য হলো কুখ্যাত ব্যাঙ্ক ডাকাতদল বিয়ার গ্যাংকে চিহ্নিত করা।”

“কাল ব্লমকোভিস্ট।”

“সঙ্গত কারণেই এই ডাক নামটি সে খুবই অপছন্দ করে। কেউ যদি আমাকে পিপ্পি লঙ্গস্টকিং ব’লে ডাকে তবে আমি তার থোতা মুখ ভোতা করে দেবো।

আরমানস্কির দিকে সে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে তাকালে সে আস্তে করে ঢোক গিললো। একবার সে মনে মনে সালান্ডারকে পিপ্পি লঙ্গস্টকিং বলে ভেবেছিলো। তাকে কথা বলে যাওয়ার জন্যে হাত নেড়ে ইশারা করলো সে।

“এক সোর্স জানিয়েছে সেই তখন থেকেই নাকি সে ক্রাইম রিপোর্টার হতে চেয়েছিলো-একটি সান্ধ্যকালীন পত্রিকায় ক্রাইম রিপোর্টারের পদে কিছু দিন চাকরিও করেছে। তবে পরবর্তীতে সে একজন পলিটিক্যাল আর ফিনান্সিয়াল রিপোর্টার হিসেবেই ব্যাপক পরিচিতি পায়। মূলত সে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করতো তবে আশির দশকে একটি পত্রিকায় ফুলটাইম চাকরি করেছিলো কিছুদিন। ঐ চাকরিটা ছেড়েই মিলেনিয়াম নামের ম্যাগাজিনে যোগ দেয়। ম্যাগাজিনটা একেবারেই অখ্যাত ছিলো। বড় কোনো প্রকাশকের পৃষ্ঠপোষকতা পায় নি। তবে তার যোগ দেবার পর এর সার্কুলেশন বেড়ে মাসিক ২১০০০ কপিতে গিয়ে পৌছেছে। এর এডিটোরিয়াল অফিস এখান থেকে মাত্র কয়েক ব্লক দূরে গোথগাতানে অবস্থিত।”

“একটি বামপন্থী পত্রিকা।”

“এটা নির্ভর করে আপনি কিভাবে ‘বামপন্থী’ কনসেপ্টটা সংজ্ঞায়িত করছেন তার উপর। মিলেনিয়াম সাধারণত এ সমাজের সমালোচনা করে থাকে। তবে আমি আন্দাজ করতে পারি নৈরাজ্যবাদীরা একে পেটি বুর্জোয়া ম্যাগাজিন হিসেবে দেখে। তবে মডারেট স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন একে বলশেভিক হিসেবেই গন্য করে। ব্লমকোভিস্ট কখনও রাজনীতি করেছে বলে কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি। সাংবাদিকতায় পড়ার সময় সে এক মেয়ের সাথে বসবাস করতো, ঐ মেয়েটি অবশ্য সিন্ডিক্যালিস্ট হিসেবে সক্রিয় রাজনীতি করতো, বর্তমানে সে পার্লামেন্ট মেম্বার। সেই মেয়ের কাছ থেকে হয়তো বামপন্থী রাজনীতির কিছু কিছু জিনিস তার মধ্যে ঢুকে গিয়ে থাকবে কারণ ফিনান্সিয়াল রিপোর্টার হিসেবে সে কর্পোরেট দুনিয়ার দুর্নীতি নিয়ে অসংখ্য তদন্তমূলক প্রতিবেদন করেছে। এ কাজে সে বিশেষ পারদর্শী। তার রিপোর্টের কারণে অনেক রাজনীতিক আর কোর্পোরেট হোমড়াচোমড়াকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। কর্পোরেট দুনিয়ার দুর্নীতি নিয়ে কিছু বললে তাকে বামপন্থী বলাটা সাধারণ ব্যাপার।”

“আপনি কি বলতে চাচ্ছেন বুঝতে পেরেছি। আর কিছু?”

“দুটো বই সে লিখেছে। একটা হলো আরবোর্গা অ্যাফেয়ার নিয়ে আর অন্যটি ফিনান্সিয়াল জার্নালিজমের উপরে যার টাইটেল দ্য নাইটস টেম্পলার, যা কিনা তিন বছর আগে প্রকাশিত হয়। বইটা আমি পড়ে দেখি নি তবে রিভিউ পড়ে বুঝতে পারছি সেটা খুব বিতর্কিত। এ নিয়ে মিডিয়াতে বেশ সমালোচনা হয়েছে।”

“টাকা-পয়সা?” ফ্রোডি জানতে চাইলো।

“খুব একটা নেই। তাকে ধনী বলা যাবে না। তবে অভাবি বলাও ঠিক হবে না। তার ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন রিপোর্টের সাথে অ্যাটাচ করা আছে। ব্যাঙ্কে ২৫০০০০ ক্রোনারের মতো জমা আছে তার। আরেকটা একাউন্টে আছে ১০০০০০ ক্রোনার তবে সেটা ম্যাগাজিন চালানোর খরচ মেটানোর জন্য। বেলমাঙ্গসগাটানে ৭০০ বর্গফুটের একটি অ্যাপার্টমেন্ট আছে তার। কোনো ঋণ কিংবা ধারদেনা নেই। তার আরেকটা সম্পত্তি আছে-স্যান্ডহামে একটি স্থাবর সম্পত্তি। ২৭০ বর্গফুটের একটি সামার কটেজ। নদীর তীরে সেটা অবস্থিত। চল্লিশের দশকে তার চাচা এটা কিনেছিলো, তার কোনো ছেলেপুলে না থাকাতে ওটা এখন ব্লমকোভিস্টের হাতে চলে এসেছে। নিজের বাবা-মা’র অ্যাপার্টমেন্টটি তার ছোটো বোনকে দিয়ে সে এই কেবিনটা নিয়ে নিয়েছে। এর বর্তমান বাজার দর কতো সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই তবে আন্দাজ করতে পারি কয়েক মিলিয়ন হবে। মনে হয় এটা বিক্রি করার কোনো ইচ্ছে তার নেই। মাঝেমধ্যেই সে ওখানে যায়।”

“আয়রোজগার?

“মিলেনিয়াম-এর কিছু অংশের মালিক সে। তবে সে কেবল মাসিক ১২০০০ ক্রোনার বেতন ছাড়া আর কিছু নেয় না। তার বাকি আয়ের টাকা আসে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ থেকে। মোট কতো সেটা নির্ভর করে কাজের পরিমাণের উপর। তিন বছর আগে তার আয় বেশ ভালো ছিলো। ৪৫০০০০ আয় করেছিলো সেই বছর। গত বছর কেবল ১২০০০০ ক্রোনার ছিলো ফ্রিল্যান্স কাজ থেকে।

“তাকে তো ১৫০০০০ এবং আইনজীবিদের ফি’য়ের টাকা পরিশোধ করতে হবে,” বললো ফ্রোডি। “ধরা যেতে পারে সব মিলিয়ে অনেক বেশি টাকা তাকে পরিশোধ করতে হবে। গাউল-এ সার্ভিস দেবার সময়ও তাকে আরো কিছু টাকা খোয়াতে হবে।

“তার মানে তার পকেট একেবারে খালি করে ফেলা হবে,” বললো সালান্ডার।

“সে কি সৎ?”

“বলা হয়ে থাকে এটাই তার ট্রাস্ট ক্যাপিটাল। ব্যবসায়ী মহলে তার ইমেজ হলো নীতিবান একজন হিসেবে। টিভি টকশোগুলোতে তাকে প্রায়ই ডাকা হয়।”

“আজকের বিচারের যে রায় হয়েছে তারপর তার সেই ক্যাপিটালের খুব বেশি কিছু অবশিষ্ট থাকবে বলে মনে হয় না,” বললো ফ্রোডি।

“সেটা আমি ঠিক বলতে পারবো না। তবে এটা বুঝি এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে মাস্টার ডিটেক্টিভ ব্লমকোভিস্টের অনেক বছর লেগে যাবে। এবার সে বেশ ভালো বোকামিই করে ফেলেছে,” বললো সালান্ডার। “আমি যদি একটি ব্যাক্তিগত মন্তব্য করি…”

আরমানস্কির চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে গেলো। সালান্ডার কখনই কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে তদন্ত করতে গিয়ে বক্তিগত মন্তব্য করে নি।

“আমার অ্যাসাইনমেন্টে ওয়েনারস্ট্রমের মামলাটির ব্যাপারে কিছু নেই তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি সেটা ফলো করেছি। স্বীকার করছি আমি খুবই হতবাক হয়েছি। মনে হয় পুরো ব্যাপারটি ভুল, আর এটা…ব্লমকোভিস্টের চারিত্রিক বৈশিষ্টের একদম বিপরীত একটা কাজ।

নিজের ঘাড় চুলকালো সালান্ডার। ধৈর্য ধরে চেয়ে আছে ফ্রোডি। আরমানস্কির কাছে মনে হলো সালান্ডার কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। কিন্তু যে সালান্ডারকে সে চেনে সে তো কখনও ইতস্তত করে নি কোনো কিছু বলতে গিয়ে।

“অফ দ্য রেকর্ডে বলছি কথাটা…আমি ওয়েনারস্ট্রমের মামলাটি ভালোভাবে স্টাডি করে দেখি নি, তবে আমি মনে করি মিকাইল ব্লমকোভিস্টকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে। আদালত যে রায় দিয়েছে ঘটনা আসলে সেরকম না। এর পেছনে অন্য কিছু আছে।”

আইনজীবি ভদ্রলোক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সালান্ডারের দিকে চেয়ে রইলো। আরমানস্কির মনে হলো ওয়েনারস্ট্রমের মামলার ব্যাপারে ফ্রোডির বেশ ইন্টারেস্ট আছে। এটা সে মনে মনে টুকে রাখলো। সত্যি বলতে কি ফ্রোডির আসলে ওয়েনারস্ট্রমের মামলার ব্যাপারে আগ্রহ ছিলো না তবে যেই মুহূর্তে সালান্ডার বললো ব্লমকোভিস্টকে ফাঁসানো হয়েছে তখন থেকেই তার আগ্রহের শুরু।

“আপনি ঠিক কি বলতে চাচ্ছেন?” বললো ফ্রোডি।

“এটা আমার ধারণা। তবে আমি নিশ্চিত কেউ তাকে ফাঁদে ফেলেছে।”

“আপনার এরকম মনে হওয়ার কারণ?”

“ব্লমকোভিস্টের ব্যাকগ্রাউন্ড ঘেটে দেখেছি সে প্রমাণ ছাড়া কোনো রিপোর্ট প্রকাশ করে না। একদিন কোর্টে গিয়ে আমি তাকে দেখেছিলাম, মনে হয়েছে সে একেবারে হাল ছেড়ে দিয়েছে। লড়াই করার কোনো আগ্রহ তার মধ্যে নেই। এটা তার চরিত্রের সাথে যায় না। প্রমাণ ছাড়া সে ওয়েনারস্ট্রমের বিরুদ্ধে এরকম কোনো রিপোর্ট করবে না। এটা হবে তার মতো একজন সাংবাদিকের জন্যে আত্মঘাতি একটি মিশন। এটা ব্লমকোভিস্টের স্টাইল নয়।”

“তাহলে কী ঘটেছে ব’লে আপনি মনে করেন?”

“আমি শুধু আন্দাজ করতে পারি। ব্লমকোভিস্ট তার গল্পটায় বিশ্বাস করেছিলো কিন্তু কিছু একটা ঘটলে সে দেখতে পায় তার তথ্যগুলো ভুল। মনে হয় সে তার সোর্সকে খুব বিশ্বাস করতো, আর সে-ই ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে ভুল তথ্য দিয়ে ফাঁসিয়েছ। খুবই জটিল শোনাচ্ছে জানি। আরেকটা বিকল্প কারণও থাকতে পারে। তাকে হয়তো মারাত্মক কোনো হুমকি দেয়া হয়েছিলো যার ফলে সে আত্মসমর্পণ করেছে এভাবে। তবে আগেই বলেছি এটার আমার নিজের অনুমাণ।”

সালান্ডার যখন আরো বলতে যাবে ফ্রোডি তখন হাত তুলে তাকে বিরত করলো। কিছুটা সময় আইনজীবি ভদ্রলোক চুপ থেকে ইতস্ততার সাথে তাকালো মেয়েটার দিকে।

“আমরা যদি আপনাকে ওয়েনারস্ট্রমের মামলার আসল সত্য উদঘাটনে নিয়োজিত করি…তাহলে সেখানে অন্য কিছু খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা কতোটুকু?”

“এটার জবাব আমি দিতে পারবো না। হয়তো কিছুই পাওয়া যাবে না।”

“তবে আপনি চেষ্টা করে দেখবেন কি?”

কাঁধ তুললো সালান্ডার। “এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেবার এখতিয়ার আমার নেই। আমি হের আরামানস্কির হয়ে কাজ করি। তিনিই ঠিক করে দেবেন আমি কোন্ অ্যাসাইনমেন্টে কাজ করবো। আর সেটা নির্ভর করে আপনি কি ধরণের তথ্য চাচ্ছেন তার উপর।”

“তাহলে আমাকে বলতে দিন…আমি ধরে নেবো পুরো ব্যাপারটা গোপন থাকবে?” আরমানস্কি মাথা নেড়ে সায় দিলো। “এই ব্যাপারটা সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। তবে আমি নিশ্চত করে বলতে পারি ওয়েনারস্ট্রম একজন অসৎ ব্যক্তি। ওয়েনারস্ট্রম কেসটা মিকাইল ব্লমকোভিস্টের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। আপনার অনুমাণের কোনো ভিত্তি আছে কিনা সে ব্যাপারে আমার যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে।”

তাদের কথাবার্তা অপ্রত্যাশিতভাবেই অন্য দিকে মোড় নিলো। আরমানস্কি ও সজাগ হয়ে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে। ফ্রোডি চাইছে মিল্টন সিকিউরিটি এমন একটি মামলার ব্যাপারে তাদের নাক গলাক যেটার রায় ইতিমধ্যে দেয়া হয়ে গেছে। তারা যদি এই কাজটা হাতে নেয় তাহলে ওয়েনারস্ট্রমের আইনজীবিদের যে রেজিমেন্ট আছে তাদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। আরমানস্কি চাচ্ছে না এরকম একটা ঝুঁকির মধ্যে নিজের ফার্ম আর তার প্রিয়পাত্রী সালান্ডারকে নিক্ষেপ করতে। এটা হবে নিয়ন্ত্রণহীন ক্রুইজ মিসাইলের মতো।

সালান্ডারের সাথে তার যে চুক্তি হয়েছিলো তাতে মেয়েটি স্পষ্ট ক’রে বলে দিয়েছিলো সে যেনো তার সাথে কখনও বাবার মতো আচরণ না করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই মেয়েটাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে সে পারে না। মাঝে মধ্যে সে সালান্ডারকে নিজের মেয়ের সাথে তুলনা করে বসে আপন মনে। নিজেকে সে ভালো বাবা হিসেবেও বিবেচনা করে যে কিনা সন্তানদের ব্যাপারে অযাচিত নাক গলানো মোটেও পছন্দ করে না। তবে সে এও জানে তার নিজের মেয়ে যদি সালান্ডারের মতো আচরণ করে কিংবা তার মতো জীবনযাপন করে সেটা সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারবে না।

তার হৃদয়ের গভীরে-ক্রোয়েশিয়ান, বসনিয়ান কিংবা আর্মেনিয়ান যাইহোক না কেন-একটা কথাই বাজে, সালান্ডারের জীবনে যেনো কোনো বিপর্যয় নেমে না আসে। সব সময় সে আশংকা করে এক সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনতে পাবে মেয়েটার বড়সড় কোনো ক্ষতি হয়ে গেছে।

“এরকম একটি ইনভেস্টিগেশনে প্রচুর খরচ হবে,” ফ্রোডিকে এ কাজ করা থেকে বিরত রাখার জন্যে বললো আরমানস্কি।

“তাহলে আমাদেরকে পারিশ্রমিকটা ঠিক করে নিতে হয়,” বললো ফ্রোডি। “আমি অসম্ভব কিছু দাবি করছি না। তবে এটা তো ঠিক আপনি যেমনটি একটু আগে বলেছিলেন, আপনার এই কলিগ এরকম কাজে খুবই যোগ্য একজন মানুষ!”

“সালান্ডার?” আরমানস্কি মেয়েটার দিকে ভুরু তুলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো।

“এ মুহূর্তে আমার হাতে কোনো কাজ নেই।”

“ঠিক আছে। তবে আমি এই কাজের সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে ঐক্যমত্য চাই। তার বাকি রিপোর্টটা আগে শুনি।”

“তার ব্যক্তিগত জীবনের কিছু কাহিনী ছাড়া রিপোর্টে আর কিছু নেই। ১৯৮৬ সালে মনিকা আব্রাহামসন নামের এক মেয়েকে সে বিয়ে করে, ঐ বছরেই তাদের এক সন্তান জন্মায়, নাম পারনিলা। বিয়েটা বেশি দিন টেকে নি। ১৯৯১ সালে তারা ডিভোর্স হয়ে যায়। আব্রাহামসন আবার বিয়ে করলেও তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব অটুট আছে। তাদের মেয়ে নিজের মায়ের কাছেই থাকে। ব্লমকোভিস্টের সাথে তার খুব একটা দেখাসাক্ষাত হয় না। “

ফ্রোডি আরো কফি চেয়ে সালান্ডারের দিকে ফিরলো।

“আপনি বলেছেন সবারই সিক্রেট আছে। সেরকম কিছু কি খুঁজে পেয়েছেন?”

“আমি বোঝাতে চেয়েছি সব লোকেরই এমন কিছু ব্যাপার রয়েছে যা তারা প্রকাশ করতে চায় না। ব্লমকোভিস্টের অবশ্যই নারীঘটিত অনেক ব্যাপার আছে। অনেকগুলো প্রেম-ভালোবাসা ছিলো তার তবে একজনই কেবল তার জীবনে বার বার ফিরে এসেছে। এটা একটু অন্যরকম সম্পর্ক।”

“কোন্ দিক থেকে?”

“মিলেনিয়াম-এর এডিটর ইন চিফ এরিকা বার্গার। উঁচুতলার মেয়ে। সুইডিশ মা আর বেলজিয়ান বাবা। বার্গার এবং ব্লমকোভিস্টের মধ্যে সম্পর্কের শুরু সেই জার্নালিজমে পড়ার সময় থেকে। মাঝেমধ্যে ছেদ পড়লেও তাদের সম্পর্কটা দীর্ঘদিন ধরে টিকে আছে।”

“এটা তো অন্য রকম হলো না,” ফ্রোডি বললো।

“না, তা নয়। তবে বার্গার বিয়ে করেছে পেইন্টার গ্রেগর বেকম্যানকে। ছোটোখাটো একজন সেলিব্রেটি সে। কিছু পাবলিক ভেনুতে বস্তাপচা কাজ করেছে লোকটা।”

“তাহলে মহিলা একজন অবিশ্বস্ত স্ত্রী?”

“বেকম্যান তাদের এই সম্পর্কের কথাটা জানে। এটি এমন একটি সম্পর্ক যা সংশ্লিষ্ট সবাই জানে। মহিলা কখনও ব্লমকোভিস্টের অ্যাপার্টমেন্টে রাত কাটায়, আবার কখনও নিজের বাড়িতে। তাদের সম্পর্কটা কিভাবে কাজ করে সেটা আমি ঠিক ক’রে বলতে পারবো না। তবে মনে হয় এই সম্পর্কের কারণেই ব্লমকোভিস্টের সাথে আব্রাহামসনের বিয়েটা টেকে নি।”

অধ্যায় ৩

শুক্রবার, ডিসেম্বর ২০-শনিবার, ডিসেম্বর ২১

বিধ্বস্ত হয়ে মিলেনিয়াম-এর এডিটোরিয়াল অফিসে ব্লমকোভিস্ট ঢুকতেই এরিকা বার্গার ভুরু কুচকে তার দিকে তাকালো। তাদের এই অফিসটি গোথগাতানে গ্রিনপিসের অফিস ভবনের উপরতলায় অবস্থিত। এটার ভাড়া ম্যাগাজিনটার জন্যে একটু বেশি হলেও জায়গাটা তারা রেখে দিয়েছে।

ঘড়ির দিকে তাকালো সে। ৫: ১০ বাজে। স্টকহোমের উপর সন্ধ্যার ছায়া নেমে এসেছে ইতিমধ্যে। লাঞ্চটাইমেই তার অপেক্ষায় ছিলো এরিকা।

“আমি দুঃখিত,” এরিকা কিছু বলার আগেই সে বললো। “রায়ের ভার বহন করতে হিমশিম খাচ্ছিলাম, একটুও ভালো লাগছিলো না। অনেকক্ষণ হেটেছি আর ভেবেছি কি করবো এখন।”

“রেডিও’তে আমি রায়টা শুনেছি। টিভি৪-এর ঐ মহিলা ফোন করেছিলো

আমার মন্তব্য নেবার জন্যে।

“তুমি কি বললে?”

“আমরা আগে জাজমেন্টেটার কপি পড়ে দেখবো তারপর এ ব্যাপারে যা বলার বলবো। তাই তাকে কিছুই বলি নি। আমি আবারো বলবো : এটা ভুল স্ট্র্যাটেজি। মিডিয়াতে আমারা বেশ দুর্বল হয়ে যাবো। তারা তো আজ রাতে এ নিয়ে কিছু না কিছু দেখাবেই।”

ব্লমকোভিস্টকে আরো বিধ্বস্ত দেখালো।

“তোমার কি অবস্থা? “

কাঁধ তুললো সে। এরিকার অফিসে জানালার পাশে তার প্রিয় আর্মচেয়ারটায় বসে পড়লো। বাইরে গোথগাতান শহরটার দিকে তাকালো আনমনে। লোকজন ক্রিসমাসের জন্যে কেনাকাটা করতে ব্যস্ত।

“মনে হয়েছিলো কাটিয়ে উঠতে পারবো,” বললো সে। “তবে এখন মনে হচ্ছে খুবই বাজে অবস্থায় পড়ে গেছি।”

“হ্যা। আমিও সেটা কল্পনা করতে পারি। আমাদের সবার অবস্থাও একই রকম। জেইন ডালম্যান আজ খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে গেছে।”

“ধরে নিচ্ছি সে রায়টা নিয়ে খুব বেশি মুষড়ে পড়ে নি।”

“আর যাইহোক সে কোনো ইতিবাচক মনোভাবের লোক নয়।”

মাথা ঝাঁকালো মিকাইল। বিগত নয় মাস ধরে ডালম্যান তাদের ম্যানেজিং ডিরেক্টর। ওয়েনারস্ট্রম অ্যাফেয়ার্সটা শুরু হবার সময় থেকেই সে এখানে জয়েন্ট করেছে। এরিকা কেন তাকে নিয়োগ দিয়েছিলো সে কারণটা মনে করার চেষ্টা করলো ব্লমকোভিস্ট। লোকটা যোগ্য সন্দেহ নেই, তবে বাতাসের বিরুদ্ধে চলতে ভয় পায়। গতবছর তো ব্লমকোভিস্ট তাকে নিয়োগ দেবার জন্যে আফসোসও করেছে। লোকটা সবকিছুই নেতিবাচক হিসেবে দেখে থাকে।

“ক্রিস্টার কি তোমাকে ফোন করেছিলো?” রাস্তা থেকে চোখ না সরিয়েই ব্লমকোভিস্ট জানতে চাইলো।

ক্রিস্টার মাম হলো তাদের ম্যাগাজিনের আর্ট ডিরেক্টর। বার্গার আর ব্লমকোভিস্টের সাথে সেও পত্রিকার কিছু অংশের মালিক। এখন সে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে বিদেশ সফরে আছে।

“সে তোমাকে হ্যালো বলার জন্য ফোন করেছিলো।”

“প্রকাশক হিসেবে অধিষ্ঠিত হতে পারে সে।”

“এ কথা ভুলে যাও, মিক। একজন প্রকাশককে সব সময় নাকে ঘুষি নেবার জন্যে প্রস্তত থাকতে হয়। এটা তার কাজেরই অংশ।”

“তুমি ঠিক বলেছো। তবে আমি এমন একজন রিপোর্টার যে কিনা নিজেও মালিক। এরফলে পুরো ব্যাপারটা আচমকা বদলে গেছে।”

সারা দিন ধরে বার্গার যে চুপচাপ ছিলো এবার যেনো সেটার অবসান হবার সময় এসেছে। মামলা শুরু হবার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই ব্লমকোভিস্ট নিজেকে আড়ালে আবডালে রেখে চলেছে। তবে মামলায় হেরে যাবার পর তাকে এতোটা বিষণ্ন আর বিষাদগ্রস্ত হতে আগে কখনও দেখে নি। উঠে এসে তার কোলে বসে পড়লো এরিকা। দু’হাতে তার গলা জড়িয়ে আদর করতে শুরু করলো সে।

“মিকাইল, আমার কথা শোনো। আমরা দুজনেই জানি কি ঘটেছে। তোমার মতো আমিও সমান দোষি। আমরা আসলে ঝড়ের পিঠে সওয়ার হয়েছিলাম।”

“সওয়ার হবার মতো কোনো ঝড় ছিলো না সেটা। মিডিয়ার ভাবসাব দেখলে মনে হয় এই রায়টা যেনো আমার মাথায় গুলি করার শামিল। আমি আর মিলেনিয়াম-এর প্রকাশক হিসেবে থাকছি না। ম্যাগাজিনটার বিশ্বাসযোগ্যতা আর এর রক্তক্ষরণ বন্ধ করাই হবে এখন সবচাইতে বড় কাজ। এটা আমি যেমন জানি তুমিও জানো।”

“তুমি যদি মনে করে থাকো আমি তোমাকে এরকম কাজ করতে দেবো তাহলে ধরে নেবো এতোগুলো বছর আমার সাথে থেকেও আমাকে চিনতে পারো নি।”

“আমি জানি তুমি কিভাবে কাজ করো, রিকি। তুমি তোমার কলিগদের প্রতি শতভাগ অনুগত। তুমি চাইলে নিজের সুনামের বারোটা বাজিয়ে হলেও ওয়েনারস্ট্রমের আইনজীবিদের বিরুদ্ধে লড়ে যেতে। আমাদেরকে এরচেয়েও বেশি স্মার্ট হতে হবে।

“তুমি মনে করছো এ মুহূর্তে জাহাজ থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়াটাই হবে স্মার্ট কাজ, যাতে করে সবাই মনে করবে আমি তোমাকে বরখাস্ত করেছি?

“মিলেনিয়াম টিকে থাকবে কিনা সেটা এখন তোমার উপর নির্ভর করছে। ক্রিস্টার খুব ভালো কিন্তু সে প্রকাশকের দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। এটা তার কাজ নয়। একজন বিলিয়নেয়ারের সাথে লড়াই করার ক্ষমতা তার নেই। কিছুদিনের জন্য আমি একজন প্রকাশক, রিপোর্টার এবং বোর্ড মেম্বার হিসেবে দৃশ্যপট থেকে উধাও হয়ে যাবো। ওয়েনারস্ট্রম জানে সে কি করেছে সেটা আমি জেনে গেছি। আমি নিশ্চিত আমি যদি মিলেনিয়াম-এর সাথে জড়িত থাকি সে পত্রিকাটার পেছনে লাগবে এটা ধ্বংস করার জন্য।’

“তাহলে আমরা যা জানি সেসব প্রকাশ করছি না কেন? ডুববো নয়তো ভাসবো?

“কারণ আমরা কোনো কিছু প্রমাণ করতে পারবো না। আর এ মুহূর্তে আমার কোনো বিশ্বাসযোগ্যতাও নেই। আসো মেনে নেই, এই রাউন্ডে ওয়েনারস্ট্রমই জয়ী হয়েছে।”

“ঠিক আছে। তোমাকে আমি বরখাস্ত করবো। তুমি কি করবে?”

“সত্যি বলতে কি আমার কিছু দিন ছুটি চাই। আমি একেবারে হাপিয়ে উঠেছি। কিছুটা সময় চাই আমার। এরমধ্যে কিছুটা সময় আবার জেলে থাকতে হবে। তারপর দেখবো কি করা যায়।

বার্গার তাকে আরো ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ধরে তার মাথাটা নিজের স্তনের

সাথে চেপে ধরলো।

“আজ রাতে আমাকে চাও?”

ব্লমকোভিস্ট সায় দিলো।

“বেশ। আমি এরইমধ্যে গ্রেগরকে বলে দিয়েছি আজরাতটা আমি তোমার ওখানেই থাকবো।”

*

জানালা দিয়ে বাইরের ল্যাম্পপোস্ট থেকে যে আলো ভেতরে ঢুকেছে সেটাই ঘরের একমাত্র আলো। বার্গার রাত দুটোর দিকে ঘুমিয়ে পড়লে ব্লমকোভিস্ট জেগে উঠে তাকে দেখতে লাগলো। চাদরটা তার কোমরের নীচে নেমে আছে। তার স্তনের মৃদু ওঠানামা দেখলো সে। এখন সে বেশ রিল্যাক্স। পেটের মধ্যে অস্বস্তির যে গিটটা পাকিয়েছিলো সেটা আর নেই। তার উপরে মেয়েটার বেশ ভালো প্রভাব আছে। সে জানে এই মেয়েটার উপর তারও রয়েছে একই রকম প্রভাব।

বিশ বছর, ভাবলো সে। এতোটা দীর্ঘ সময় ধরেই এটা চলছে! তার মনে হয় অন্তত আরো বিশ বছর তারা এভাবে একসাথে শুতে পারবে। তারা নিজেদের এই সম্পর্কের ব্যাপারটা কখনই লুকায় নি।

জার্নালিজমে দ্বিতীয় বর্ষে যখন পড়ে তখনই এক পার্টিতে তাদের পরিচয় হয়। সেই রাতে বিদায় জানানোর আগেই একে অন্যের ফোন নাম্বার বিনিময় করে তারা। দু’জনেই জানতো শেষ পর্যন্ত তাদের সম্পর্কটা খুব জলদি বিছানা পর্যন্ত গড়াবে।

ব্লমকোভিস্ট জানে বিয়ে, ক্রিসমাস ট্রি, বাচ্চাকাচ্চা আর যাবতীয় সব শেয়ার করাটা পুরনো ধাঁচের প্রেমের পরিণতি নয়। আশির দশকে তারা একবার একসঙ্গে থাকার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো কিন্তু শেষের দিকে এসে এরিকা মত পাল্টে ফেলে। তার মতে তারা যদি প্রেমে পড়ে যায় তাহলে তাদের এই সম্পর্কটা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। আসল কথা হলো তারা দু’জনে বেশ ভালোমতোই এক সঙ্গে আছে। হেরোইনের আসক্তির মতো তারা একে অন্যের প্রতি আসক্ত।

কখনও কখনও তারা এতোটা ঘন ঘন দেখা করে যে মনে হয় তারা বুঝি বিবাহিত দম্পতি। কখনও কখনও সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস তাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ হয় না। তবে শেষ পর্যন্ত তারা একে অন্যের কাছে ফিরে আসে বার বার।

এ ধরণের সম্পর্কে অনেক বেশি যন্ত্রনা থাকে। তারা দু’জনেই প্ৰতিশ্ৰুতি ভঙ্গ করেছে, পেছনে ফেলে এসেছে অনেক অসুখি প্রেমিক-প্রেমিকা। তার নিজের বিয়েটা টেকে নি কারণ এরিকা বার্গারের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে নি সে। এরিকার প্রতি তার এই অনুভূতির কথা নিজের স্ত্রীর কাছেও লুকাতে পারে নি। এ নিয়ে কোনো মিথ্যেও বলতে পারে নি তাকে। তার স্ত্রী মনিকা ভেবেছিলো সন্তান হবার পর হয়তো স্বামীর এই মোহটা কেটে যাবে। সেটা হয় নি। সে যখন বিয়ে করে ঠিক একই সময় এরিকাও বিয়ে করে গ্রেগার বেকম্যানকে। বিয়ের এক বছরে তাদের মধ্যে তেমন একটা দেখা হয় নি। শুধুমাত্র পেশাদার কাজে দুয়েক বার দেখা হয়েছিলো। এরপর তারা দু’জনে শুরু করে মিলেনিয়াম। আর একসাথে কাজ করতে গিয়ে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তাদের দু’জনের শুভবুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়। এক রাতে নিজের অফিসের ডেস্কের উপরেই এরিকার সাথে ভয়াবহ রকমের সেক্স করে ফেলে সে। এরপর থেকে ব্লমকোভিস্ট দোটানায় পড়ে যায়। এক দিকে নিজের বিয়ে টিকিয়ে রেখে নিজের মেয়েকে গড়ে তুলতে যেমন চাচ্ছিলো অন্য দিকে এরিকার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণও অনুভব করছিলো সে। সালান্ডার যেমনটি অনুমাণ করেছিলো, এরিকার প্রতি তার এই অব্যহত আকর্ষণই তাদের বিয়েটা ডির্ভোসে গড়ায়।

অদ্ভুত ব্যাপার হলো বেকম্যান তাদের এই সম্পর্কটা মেনে নিয়েছে। মিকাইলের প্রতি নিজের ফিলিংসের ব্যাপারে এরিকা সব সময়ই খোলামেলা ছিলো। ব্লমকোভিস্টের সাথে সেক্স করা শুরু হবার পর পরই স্বামীকে ব্যাপারটা জানিয়ে দেয় সে। একজন শিল্পী হবার কারণেই হয়তো বেকম্যান পুরো ব্যাপারটা উদারভাবে মেনে নেয়। যদিও ব্যাপারটা ব্লমকোভিস্টের কাছে অদ্ভুত লাগে মাঝেমধ্যে। এরিকা বার্গার আর বেকম্যানের মধ্যে যে ভালোবাসা সেটাও সে বুঝতে পারে না। তবে সে ভীষণ খুশি যে লোকটা নিজের স্ত্রীর একই সময় দু’দুজন পুরুষকে ভালোবাসার ব্যাপারটি মেনে নিয়েছে।

রমকোভিস্ট ঘুমাতে পারলো না। ভোর ৪টায় উঠে পড়লো। রান্নাঘরে গিয়ে আদালতের রায়টা বার বার পড়ে দেখলো সে। আরোমা’তে বাল্যকালের বন্ধুর সাথে আচমকা দেখা হওয়াটা দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছু নয় বলে মনে করে। লিন্ডবার্গ তার কাছে নিছক গল্পের ছলে ওয়েনারস্ট্রমের কেচ্ছাকাহিনী বলেছিলো কিনা সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত হতে পারলো না।

আবার এও মনে হয় নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য লিন্ডবার্গ তার সাংবাদিক বন্ধুকে হয়তো ব্যবহার করে থাকবে।

আরোমায় তাদের মিটিংটা যদি এক ধরণের ফাঁদ হয়ে থাকে তাহলে লিন্ডবার্গ অসাধারণ অভিনয় করেছে। তবে সে জানে তাদের দেখা হয়েছিলো ঘটনাচক্রে।

তার মামলার যেদিন রায় হলো সেদিন যে কিছু কিছু পত্রিকা অফিসে লোকজন শ্যাম্পেন খুলে ফুর্তি করেছে সে ব্যাপারে ব্লমকোভিস্টের মনে কোনো সন্দেহ নেই।

তবে একজন সাংবাদিকের ভূমিকা কি হওয়া উচিত সে ব্যাপারে তার মতোই এরিকা একই মত পোষণ করে। তারা জার্নালিজমে পড়ার সময়ই কাল্পনিক একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করার পরিকল্পনা করতো।

মিকাইল মনে করে এরিকা তার দেখা সেরা বস। কর্মচারিদের সাথে তার সম্পর্ক বেশ ভালো। সব ম্যানেজ করার ক্ষমতা রয়েছে তার। যেমন নরম তেমনি দরকার পড়লে কঠিন হতেও তার সমস্যা হয় না। অনেক বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে যৌক্তিক তর্ক হয় তবে একে অন্যেকে তারা বেশ ভালোমতোই বুঝতে পারে। দু’জনের মধ্যে আস্থাও আছে বেশ। তাদের টিমটা একেবারেই অপ্রতিরোধ্য। সে যখন মাঠেময়দানে ঘুরে রিপোর্ট করতে ব্যস্ত এরিকা তখন প্রকাশনা আর পত্রিকার মার্কেটিং দিক নিয়ে দৌড়ঝাপ করে।

মিলেনিয়াম তাদের যৌথ সৃষ্টি। তবে এরিকা যদি পর্যপ্ত টাকা-পয়সার ব্যবস্থা না করতো পত্রিকাটা আলোর মুখ দেখতো না। একজন ওয়ার্কিংক্লাস পুরুষ আর অভিজাত পরিবারের মেয়ের এই বন্ধনটি চমৎকার ঐক্যের সৃষ্টি করেছে। এরিকার পরিবার বেশ পুরনো ধনী। প্রাথমিক পুঁজি সে-ই জোগার করেছে। পরবর্তীতে নিজের পরিচিত আর আত্মীয়দের কাছ থেকে আরো অনেক ক্যাপিটালের ব্যবস্থাও করেছে সে।

মিকাইল মাঝেমধ্যেই ভাবে এরিকা কেন মিলেনিয়াম-এর মতো একটা ম্যাগাজিন নিয়ে পড়ে আছে। এটা সত্যি যে পত্রিকাটির একজন অংশীদার এবং এডিটর ইন চিফ হওয়ার সুবাদে সে বেশ সম্মান পেয়ে থাকে। মিকাইলের মতো এরিকা অবশ্য জার্নালিজমে পাস করে টিভি বিমুখ হয় নি। একটা টিভি স্টেশনে সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করে সে। ক্যামেরার সামনে তাকে বেশ আকর্ষণীয় লাগতো। আমলাতন্ত্রের সাথেও তার ভালো যোগাযোগ আছে। টিভি’তে লেগে থাকলে এতোদিনে সে কোনো টিভি স্টেশনের ম্যানেজেরিয়াল পোস্টে চলে যেতো আর বেতনও পেতো এখনকার চেয়ে অনেক বেশি।

ক্রিস্টার মামকেও পত্রিকার অংশীদার করতে রাজি করিয়েছিলো বার্গার। লোকটা সমকামী হিসেবে ছোটোখাটো একজন সেলিব্রেটি। মাঝেমধ্যেই টিভি’তে সমকামী অধিকার নিয়ে হাজির হয়।

ছত্রিশ বছরের মাম একজন পেশাদার আলোকচিত্রি। মিলেনিয়ামকে আধুনিক রূপ দিয়েছে সে-ই।

মিলেনিয়াম-এর তিনজন ফুলটাইম কর্মী আর একজন ফুলটাইম ট্রেইনি আছে, সেইসাথে আছে দু’জন পার্ট-টাইমার। খুব বেশি লাভজনক না হলেও দিন দিন তাদের সার্কুলেশন বেড়ে চলেছে আর বেড়ে যাচ্ছে বিজ্ঞাপনের রেভিনু। আজকের দিনের আগ পর্যন্ত তাদের পত্রিকাটা উদারপন্থী আর বিশ্বস্ত সম্পাদকীয়ের জন্য বিশেষ পরিচিত ছিলো।

এখন পরিস্থিতি সম্ভবত পাল্টে যাবে। বার্গারের সাথে বসে যে প্রেসরিলিজটা তৈরি করেছে সেটা পড়ে দেখলো ব্লমকোভিস্ট। এটা মেইল করেও দেয়া হবে খুব শীঘ্রই।

*

দোষি রিপোর্টার মিলেনিয়াম ছেড়ে যাচ্ছে

স্টকহোম (টি.টি)-সাংবাদিক মিকাইল ব্লমকোভিস্ট মিলেনিয়াম-এর প্রকাশক পদ থেকে ইস্তফা দিতে যাচ্ছে, এডিটর ইন চিফ এবং পত্রিকাটির বেশিরভাগ শেয়ারের মালিক এরিকা বার্গার এ কথা জানিয়েছেন।

ব্লমকোভিস্ট স্বেচ্ছায় মিলেনিয়াম ছেড়ে যাচ্ছে। “সাম্প্রতিক সময়ে যে ড্রামা হলো তাতে করে সে হাপিয়ে উঠেছে, তার বিশ্রামের দরকার,” বলেছেন বার্গার নিজে। তিনি এখন প্রকাশকের দায়িত্ব পালন করবেন।

ব্লমকোভিস্ট মিলেনিয়াম-এর একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৯০ সালে তারা এই পত্রিকাটি প্রকাশ করতে শুরু করে। বার্গার মনে করেন না তথাকথিত ‘ওয়েনারস্ট্রম অ্যাফেয়ার্স’-এর কারণে তাদের পত্রিকার উপর কোনো প্রভাব পড়বে।

সামনের মাসেই ম্যাগাজিনটির পরবর্তী সংখ্যা বের হবে, বলেছেন বার্গার।

“মিকাইল ব্লমকোভিস্ট এই পত্রিকার জন্যে অনেক করেছেন এখন আমরা নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছি।”

বার্গার মনে করেন ওয়েনারস্ট্রম অ্যাফেয়ার্স কতোগুলো ধারাবাহিক ঘটনার দুর্ভাগ্যজনক ফলাফল ছাড়া আর কিছু না। হান্স-এরিক ওয়েনারস্ট্রমকে হেয় করার জন্য তাদের অনুশোচনা আছে বলেও তিনি জানান। এ ব্যাপারে মন্তব্য করার জন্য ব্লমকোভিস্টকে অবশ্য পাওয়া যায় নি।

*

“এটা দেখে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে,” প্রেসরিলিজটা যখন মেইল করা হবে তখন বার্গার বললো। “বেশিরভাগ লোকে মনে করবে তুমি একটা গর্দভ আর আমি হলাম এমন এক কুত্তি যে কিনা তোমাকে বরখাস্ত করার তালে ছিলো।”

“অন্তত আমাদের বন্ধুরা হাসার মতো কিছু একটা তো পেলো।” ব্যাপারটা হালকা করার জন্য বললো ব্লমকোভিস্ট কিন্তু এরিকা মোটেও খুশি হলো না।

“আমার কাছে অন্য কোনো পরিকল্পনা নেই তারপরও আমার মনে হচ্ছে আমরা বিরাট কোনো ভুল করতে যাচ্ছি,” বললো এরিকা।

“এটাই একমাত্র পথ। ম্যাগাজিনটা যদি ধ্বংস হয়ে যায় তো আমাদের এতোগুলো বছরের সব পরিশ্রমই শেষ হয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই আমরা বিজ্ঞাপনের রেভিনু হারাতে শুরু করেছি। আচ্ছা, ঐ কম্পিউটার কোম্পানির ব্যাপারটা কি?”

একটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো এরিকার ভেতর থেকে। “আজ সকালে তারা আমাকে বলেছে আগামী সংখ্যায় বিজ্ঞাপন দেবে না।”

“ঐ কোম্পানিতে ওয়েনারস্ট্রমের অনেক বড় একটা শেয়ার আছে সুতরাং এটাকে কোনো দুর্ঘটনা বলা যাবে না।”

“আমাদেরকে নতুন কিছু ক্লায়েন্ট খুঁজে নিতে হবে। ওয়েনারস্ট্রম হয়তো অনেক বড় ধনী কিন্তু সে সুইডেনের সব কিছুর মালিক না। আমাদেরও কিছু পরিচিত কানেকশান আছে।

তাকে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিলো ব্লমকোভিস্ট।

“একদিন আমরা মিঃ ওয়েনারস্ট্রমকে এমনভাবে ধরাশায়ী করবো যে ওয়ালস্টটের শেয়ার বাজারে ধ্বস নেমে যাবে। তবে এখন মিলেনিয়ামকে পাদপ্রদীপের আলো থেকে দূরে থাকতে হবে।”

“আমি সব জানি, তবে নিজেকে একজন কুত্তি হিসেবে তুলে ধরতে ভালো লাগছে না। বাধ্য হয়ে এমন একটা ভান করতে হচ্ছে যে তোমার আর আমার মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।”

“রিকি, যতোক্ষণ পর্যন্ত তুমি আর আমি একে অন্যেকে বিশ্বাস করবো ততোক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কোনো সমস্যা হবে না। আমাদের সুযোগ থাকবেই। এখন আমাদেরকে এরকমই করতে হবে। একটু পশ্চাদপসারণ আর কি।”

তার এই যুক্তিটা অনিচ্ছায় মেনে নিলো এরিকা।

অধ্যায় ৪

সোমবার, ডিসেম্বর ২৩-বুধবার, ডিসেম্বর ২৬

পুরো সপ্তাহান্তটি থেকে গেলো বার্গার। বাথরুম আর খাবারের জন্যেই কেবলমাত্র তারা বিছানা ছেড়ে উঠলো। শুধু যে সঙ্গম করে কাটালো তা নয়। নিজেদের ভবিষ্যত, সম্ভাবনা আর সমস্যাগুলো নিয়ে বিস্তারিত কথা বলে গেলো। সোমবারের সকাল হতেই এরিকা তাকে চুমু খেয়ে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো কারণ তার পরদিনই ক্রিসমাস ইভ। গাড়ি চালিয়ে সোজা নিজের বাড়ি ফিরে গেলো সে।

ব্লমকোভিস্ট ডিশওয়াশ আর অ্যাপার্টমেন্টটা পরিস্কার করে নিজের অফিসে চলে এলো পায়ে হেটে। অফিসের ডেস্কে নিজের সব জিনিসপত্র তুলে নিলো সে। ম্যাগাজিনের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করার কোনো ইচ্ছে তার নেই তবে বার্গারকে সে বোঝাতে পেরেছে কিছু দিনের জন্য তার সাথে ম্যাগাজিনের সম্পর্ক না থাকাটাই ভালো হবে তাদের সবার জন্য। সে বাড়িতে বসেই কাজ করবে।

ক্রিসমাসের ছুটির কারণে অফিসে কেউ নেই। নিজের জিনিসপত্র গোছগাছ করে বাক্সে রাখার সময় তার ফোনটা বেজে উঠলো।

“আমি মিকাইল ব্লমকোভিস্টকে চাচ্ছিলাম,” একটা অপরিচিত কণ্ঠ বললো।

“বলছি।”

“এভাবে ফোন করার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার নাম ডার্চ ফ্রোডি।”

ব্লমকোভিস্ট নামটা শুনে ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। “আমি একজন আইনজীবি। আমার একজন ক্লায়েন্ট আপনার সাথে কথা বলতে চায়।”

“বেশ। তাহলে আপনার ক্লায়েন্টকে বলুন আমাকে ফোন করতে।”

“উনি আপনার সাথে সামনাসামনি দেখা করতে চান।”

“ঠিক আছে, তাহলে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে তাকে আমার অফিসে পাঠিয়ে দিন। তবে একটু তাড়াতাড়ি করতে হবে। আমি এখন আমার অফিসের মালপত্র গোছগাছ করছি।”

“আমার ক্লায়েন্ট চান আপনি তার সাথে তার বাসভবনে দেখা করেন। সেটা হেডেস্টাডে। এখান থেকে মাত্র তিনঘণ্টার পথ।”

ব্লমকোভিস্ট একটা অ্যাস্ট্রে সরিয়ে ভাবতে লাগলো। মিডিয়ার কারণে আজব আজব সব লোকজন তার সাথে এখন যোগাযোগ করতে চাইবে। ষড়যন্ত্রতাত্ত্বিকেরাও বসে থাকবে না। নতুন নতুন থিওরি নিয়ে হাজির হবে। সে ভাবতে লাগলো ফ্রোডিও হয়তো সেরকম একজন।

“আমি কারো বাসায় গিয়ে দেখা করি না,” বললো সে।

“আমার মনে হয় আমি আমার ক্লায়েন্টের অবস্থার কথা আপনাকে বললে আপনি আপনার সিদ্ধান্ত বদলাবেন। আমার ক্লায়েন্টের বয়স বিরাশি। স্টকহোমে আসাটা তার জন্যে একটু বেশি পরিশ্রমের কাজ হয়ে যায়। তার শরীর ভালো না। আপনি চাইলে বাধ্য হয়ে সেটা হয়তো করা যাবে। তবে সত্যি বলতে কি আপনি যদি তার ওখানে চলে আসেন তাহলে সবচাইতে ভালো হয়…”

“আপনার ক্লায়েন্ট কে?”

“আমার মনে হয় আপনি তাকে চেনেন। হেনরিক ভ্যাঙ্গার।

অবাক হয়ে ব্লমকোভিস্ট চেয়ারে হেলান দিলো। অবশ্যই সে তাকে চেনে। একজন নামকরা শিল্পপতি। ভ্যাঙ্গার কোম্পানির প্রধান। এক সময় তার কোম্পানিটি দেশের সবচাইতে নামকরা প্রতিষ্ঠান ছিলো। অনেকগুলো ব্যবসা আছে তাদের। বলা হয় সুইডেন যে আজ ওয়েলফেয়ার স্টেট তার পেছনে ভ্যাঙ্গার গ্রুপের অবদান আছে। ভ্যাঙ্গার কোম্পানিটি এখনও তাদের পারিবারিক মালিকানায় রয়েছে। তবে হেনরিক ভ্যাঙ্গারের সম্পর্কে ব্লমকোভিস্ট তেমন কিছু জানে না। বিশ বছর আগে এক টিভি সাক্ষাতকারে তাকে দেখছিলো।

“হেনরিক ভ্যাঙ্গার আমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছেন কেন?”

“আমি দীর্ঘদিন ধরে তার আইনজীবি হিসেবে কাজ করছি। তবে তিনি কি চান সেটা আপনাকে নিজ মুখে বলবেন। আমি কেবল বলতে পারি তিনি আপনার জন্য একটা কাজের প্রস্তাব দেবেন।

‘কাজ? ভ্যাঙ্গার কোম্পানির হয়ে কাজ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। তাদের একজন প্রেসসেক্রেটারির দরকার নাকি?”

“ঠিক তা নয়। আসলে উনি একটা ব্যক্তিগত কাজে আপনার সাথে দেখা করার জন্যে মুখিয়ে আছেন।”

“এরচেয়ে বেশি আপনি বলতে পারবেন না, তাই না?”

“সেজন্যে আপনার কাছে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। তবে আমরা যদি আপনার ভ্রমণের খরচ বহন করি আর ফি হিসেবে কিছু টাকা দেই তাহলে কি আপনি কিছু মনে করবেন?”

“আপনি বড্ড অসময়ে ফোন করেছেন। আমাকে এখন অনেক কাজ করতে হবে…আশা করি পত্রিকায় খবরটা দেখেছেন।।

“ওয়েনারস্ট্রম অ্যাফেয়ার্সের কথা বলছেন?” ফ্রোর্ডি জানতে চাইলো। “হ্যা, সেটা অবশ্য পাঠককে বিনোদন দিয়েছে। সত্যি বলতে কি এই মামলার প্রচারণার কারণেই হের ভ্যাঙ্গার আপনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছেন। উনি আপনাকে একটা ফ্রিল্যান্স অ্যাসাইনমেন্ট দিতে চান। আমি কেবল একজন বার্তাবাহক। কাজটা কি সেটা উনি আপনার সাথেই শুধু আলোচনা করবেন।”

“অনেক দিন পর্যন্ত এরকম উদ্ভট ফোন কল আমি পাই নি। আমাকে একটু ভাবতে দিন। আপনার সাথে কিভাবে যোগাযোগ করবো আমি?”

*

ব্লমকোভিস্ট বসে আছে তার এলোমেলো ডেস্কের দিকে তাকিয়ে। ভ্যাঙ্গার তাকে কি ধরণের কাজের অফার দেবে সেটা ভেবে পাচ্ছে না সে। তবে আইনজীবি ভদ্রলোক তার মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে।

ভ্যাঙ্গার কোম্পানি সম্পর্কে সে গুগল-এ খোঁজখবর নিলো।

মার্টিন ভ্যাঙ্গার ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশনের সিইও। আর তার আইনজীবি ফ্রোডির সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানা গেলো না। লো প্রোফাইলের একজন লোক। হেনরিক ভ্যাঙ্গারের নাম মাত্র একজায়গায় পাওয়া গেলো, তাদের কোম্পানির উপর এক আর্টিকেলে। হেডেস্টাড কুরিয়ার দু’বছর আগে তার আশিতম জন্মদিন উপলক্ষ্যে একটি ট্রিবিউট প্রকাশ করেছিলো, সেটা প্রিন্ট করে নিলো ব্লমকোভিস্ট। তারপর ডেস্কটা খালি করে কার্টুনটা সিলগালা করে নিজের বাড়িতে ফিরে এলো সে।

*

সালান্ডার ক্রিসমাস ইভটা কাটালো ভাসবিতে অবস্থিত আপেলভিকেন নার্সিংহোমে। সঙ্গে করে কিছু উপহার নিয়ে গেলো সেখানে : ক্রিশ্চিয়ান ডিওর’র এক বোতল অদি তয়লেত্তি আর আলেনের ডিপার্টমেন্ট স্টোর থেকে কেনা ইংলিশ ফ্রুটকেক। উপহারের বাক্সটা যখন ছেচল্লিশ বছরের এক মহিলা তার দুর্বল আঙুল দিয়ে খুলতে শুরু করলো তখন সে কফি খেতে খেতে সেটা দেখলো। সালান্ডারের চোখে মুখে মমতার রেশ দেখা গেলেও তার সামনে বসে থাকা তার মা সেটা খেয়ালই করছে না। তার মায়ের সাথে চেহারা এবং চারিত্রিক কোনো দিক থেকেই তার মিল নেই। একটুও না।

বাক্সের রিবনটা খুলতে না পেরে অসহায়ের মতো তার মা তার দিকে তাকালো। তার দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। সালান্ডার একটা কেঁচি বাড়িয়ে দিলো তার মায়ের দিকে।

“তুমি হয়তো ভাবছো আমি একটা স্টুপিড।”

“না, মাম। তুমি স্টুপিড নও। তবে তোমার সময়টা ভালো যাচ্ছে না।”

“তুমি কি তোমার বোনকে দেখেছো?”

“অনেক দিন ধরে দেখা নেই।”

ও তো এখানে কখনও আসে না।

“আমি সেটা জানি। সে আমাকেও দেখতে আসে না।”

“তুমি কি কাজ করছো?”

“হ্যা। বেশ ভালো একটা কাজ।”

“থাকো কোথায়? তুমি যে কোথায় থাকো সেটা পর্যন্ত আমি জানি না “লুন্ডাগাথানে তোমার যে পুরনো অ্যাপার্টমেন্ট আছে সেখানেই থাকি। কয়েক বছর ধরেই তো ওখানে আছি। ওটার সব পেমেন্ট আমি দিচ্ছি।”

“গ্রীষ্মে হয়তো তোমাকে দেখতে ওখানে যাবো।”

“অবশ্যই যাবে। গ্রীষ্মকালেই ভালো হবে।”

তার মা অবশেষে ক্রিসমাস উপহারটা বাক্স থেকে বের করে সুগন্ধীটা নাকের সামনে নিয়ে ঘ্রাণ নিলো। “ধন্যবাদ তোমাকে, ক্যামিলিয়া,” বললো মহিলা।

“লিসবেথ। আমার নাম লিসবেথ।”

তার মাকে একটু বিব্রত হতে দেখা গেলো। সালান্ডার বললো তাদের এখন টিভিরুমে যাওয়া উচিত।

*

ক্রিসমাস ইভটা নিজের মেয়ে পারনিলার সাথে তার সাবেক স্ত্রীর স্বামীর বাড়িতে ওয়াল্ট ডিজনির একটি ক্রিসমাস স্পেশাল ছবি দেখে কাটিয়ে দিলো ব্লমকোভিস্ট। পারলিনার মায়ের সাথে আলোচনা করে অবশেষে তাকে রাজি করিয়ে আইপড আর এমপিথ্রি উপহার দিয়েছে তাকে।

উপরতলায় বাবা-মেয়ে সময় কাটালো বেশ ভালোভাবেই। মেয়েটার বয়স যখন মাত্র পাঁচ তখন তাদের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। আর তার বয়স যখন সাত তখন পেয়ে যায় নতুন বাবা। পারলিনা তখন মাসে একবার তার স্যান্ডহামের বাড়িতে এসে সপ্তাহান্তটি কাটিয়ে যেতো। তবে পরবর্তীতে ব্লমকোভিস্ট মেয়ের উপরেই ছেড়ে দেয় কখন সে দেখা করতে আসবে, কতোদিন পর পর আসবে। মায়ের বিয়ের পর পর সে খুব ঘন ঘন আসতো। তবে টিনএজ বয়সে বেশ কয়েক বছর তাদের মধ্যে কোনো দেখাসাক্ষাত হয় নি। বিগত দু’বছর ধরে মনে হচ্ছে মেয়ে আবার দেখা করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

বাবার বিচার কাজটি বেশ আগ্রহ নিয়ে ফলো করেছে সে, আর বাবা যেমনটি বলেছে ঠিক তাই বিশ্বাস করেছে : সে নিদোষি। তবে সেটা প্রমাণ করতে পারবে না।

তাকে রাতে ডিনার করে যাওয়ার জন্যে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এখানে তবে সেটা সম্ভব না। তার নিজের বোন অপেক্ষা করছে, স্টার্কেট নামের এক মফশ্বল শহরে যেতে হবে তাকে।

আজকে তার আরো একটি ক্রিসমাসের দাওয়াত ছিলো। বেকম্যানের সাথে ক্রিসমাস উদযাপন করার সেই আমন্ত্রণ বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিয়েছে।

আনিকা ব্লমকোভিস্ট, বর্তমানে আনিকা গিয়ান্নি যেখানে থাকে সেই বাড়িতে চলে এলো সে। ইটালিয়ান স্বামী আর বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে তার বোন এখানে বসবাস করে। ঢুকেই দেখতে পেলো একগাদা আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে হৈহল্লা হচ্ছে। ডিনারের সময় তার মামলা নিয়ে অসংখ্য প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলো তাকে, আর শুনতে হলো অর্থহীন সব উপদেশ।

আদালতের রায় নিয়ে একমাত্র যে ব্যক্তিটি কোনো কথা বললো না সে হলো তার বোন, যদিও ঘরে সে-ই একমাত্র আইনজীবি। নারী অধিকার বিষয়ক একটি সংস্থায় লিগ্যাল অ্যাডবাইজার হিসেবে কাজ করে সে।

কফি বানানোর সময় বোনকে সাহায্য করার সময় সে তার কাঁধে হাত রেখে জানতে চাইলো তার এখন কেমন লাগছে। সে জানালো জীবনে এতোটা খারাপ তার কখনই লাগে নি।

‘পরের বার সত্যিকারের একজন আইনজীবি নিয়োগ দেবে,” বললো তার বোন।

“এই মামলায় ভালো আইনজীবি নিয়োগ দিলেও কোনো কাজ হোতো না। তবে এ নিয়ে তোমার সাথে বিস্তারিত কথা বলবো, সব কিছু যখন সেটেলড হয়ে আসবে তখন।”

তাকে জড়িয়ে ধরে তার গালে একটা চুমু খেলো তার বোন। ক্রিসমাস কেক আর কফি নিয়ে সবার সামনে চলে এলো ব্লমকোভিস্ট তারপর সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে রান্নাঘরের টেলিফোনটা ব্যবহার করার জন্য পা বাড়ালো সে। হেডেস্টাডের সেই আইনজীবিকে ফোন করে হৈহল্লা শুনতে পেলো অপরপ্রান্ত থেকে।

“মেরি ক্রিসমাস,” ফ্রোডি বললো। “মনে হচ্ছে আপনি আপনার সিদ্ধান্ত বদল করেছেন?

“আসলে আমি কোনো সিদ্ধান্ত নেই নি। আরো কিছু জানতে চাচ্ছিলাম। ক্রিসমাসের পরের দিন আমি আপনার ওখানে আসতে চাচ্ছিলাম, অবশ্য আপনার যদি সমস্যা না থাকে।”

“চমৎকার। আমি অসম্ভব খুশি। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার ছেলেপুলে আর নাতিনাতনিদের হৈচৈয়ে আপনার কথা শুনতে কষ্ট হচ্ছে। কোন্ সময় দেখা করবো সেটার জন্যে কি আমি আপনাকে কাল ফোন করতে পারি? আপনাকে পাবো কিভাবে?”

*

বাড়ি থেকে বের হবার আগেই নিজের এই সিদ্ধান্তের জন্য মনে মনে আক্ষেপ করলো সে। তবে এখন মিটিংটা ক্যান্সেল করা ঠিক হবে না। অদ্ভুত দেখাবে। তো ডিসেম্বরের ২৬ তারিখে সে ট্রেনে চেপে বসলো হেডেস্টাডে যাবার জন্য। তার ড্রাইভার লাইসেন্স থাকলেও নিজের একটা গাড়ির প্রয়োজন কখনও অনুভব করে নি সে।

ফ্রোডির কথাই ঠিক, ভ্রমণটা খুব বেশি দীর্ঘ নয়।

ক্রিসমাসের রাতে প্রচণ্ড তুষারপাত হলেও আজকের সকালটা রোদঝলমলে। তবে বাতাস খুব ঠাণ্ডা। মোটা সোয়েটার না পরাটা ভুল হয়ে গেছে বলে মনে করলো সে। ফ্রোডি জানে সে দেখতে কেমন, ফলে প্লাটফর্ম থেকে তাকে বিলাসবহুল মার্সিডিজে তুলে নিতে তার কোনো সমস্যা হলো না। ছোটো শহরটার ভেতর দিয়ে গাড়িটা ছুটে চললে ব্লমকোভিস্টের কাছে মনে হলো অন্য কোনো গ্রহে এসে পড়েছে সে। একেবারেই অন্যরকম একটি শহর। পাশে বসে থাকা আইনজীবির দিকে তাকালো : তীক্ষ্ম মুখ, সাদা ধবধবে অবিন্যস্ত চুল আর খাড়া নাকের উপর ভারি কাঁচের চশমা।

“এই প্রথম হেডেস্টাডে এলেন বুঝি?” ফ্রোডি জানতে চাইলো।

সায় দিলো ব্লমকোভিস্ট।

“এটা খুবই পুরনো শিল্পাঞ্চল। শহরে একটা বন্দরও আছে। ২৪০০০ হাজারের বেশি লোক থাকে না। তবে লোকজন এখানে থাকতে ভালোবাসে। হের ভ্যাঙ্গার থাকেন হেডিবি’তে—শহরের দক্ষিণপ্রান্তে সেটা।”

“আপনিও কি ওখানেই থাকেন?”

“এখন থাকি। আমার জন্ম দক্ষিণের স্কানে। তবে ১৯৬২ সালে গ্র্যাজুয়েট করার পর পরই আমি মি: ভ্যাঙ্গারের সাথে কাজ করছি। দীর্ঘদিন কাজ করতে করতে আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেছি বলতে পারেন। আমি একজন কর্পোরেট আইনজীবি। বর্তমানে অবসর জীবনযাপন করছি। হের ভ্যাঙ্গারই এখন আমার একমাত্র ক্লায়েন্ট। তিনিও অবসরে আছেন। এখন আর আমার সার্ভিসের খুব একটা দরকার পড়ে না তার।

“কেবল সুনামহানি হওয়া সাংবাদিকদের খুঁজে বেড়ানো ছাড়া।”

“নিজেকে এতো তুচ্ছ ভাববেন না। হান্স-এরিক ওয়েনারস্ট্রমের সাথে যুদ্ধে যাওয়া আপনিই একমাত্র ব্যক্তি নন।”

ব্লমকোভিস্ট ফ্রোডির দিকে ফিরলো, কি বলবে বুঝতে পারছে না।

“আমাকে যে নিমন্ত্রণ দেয়া হচ্ছে সেটার সাথে কি ওয়েনারস্ট্রমের কোনো সম্পর্ক আছে?” বললো সে।

“না। মি: ভ্যাঙ্গারের সাথে ওয়েনারস্ট্রমের দূরবর্তী কোনো সম্পর্কও নেই। তবে তিনি আপনাদের মামলাটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। একেবারে ভিন্ন একটি বিষয়ে আপনার সাথে দেখা করতে চাচ্ছেন তিনি।

“আর সেটা আপনি আমাকে বলতে চাচ্ছেন না

“বলার মতো অবস্থানে আমি নেই। আমরা ভ্যাঙ্গারের বাড়িতে আপনার থাকার ব্যবস্থা করেছি। তবে আপনি যদি সেখানে থাকতে না চান তাহলে ভালো কোনো হোটেলে আপনার রুম বুক করে দেবো।”

“আমি হয়তো রাতের ট্রেনে করে স্টকহোমে ফিরে যেতেই বেশি পছন্দ করবো।”

তাদের গাড়িটা চলছে। যাবার সময় পথের পাশে একটা পাথরের বাড়ির সামনে গাড়িটা থামলে সেদিকে ইঙ্গিত করলো ফ্রোডি।

“এটা ভ্যাঙ্গারদের ফার্ম। এক সময় এটা লোকে লোকারণ্য ছিলো তবে বর্তমানে কেবল হেনরিক এবং একজন হাউজকিপার থাকে। এখানে অনেক গেস্টরুম আছে।”

গাড়ি থেকে তারা নেমে পড়লো। এবার উত্তর দিকে ইঙ্গিত করলো ফ্রোডি। “ঐতিহ্যগতভাবে ভ্যাঙ্গার পরিবারের যে নেতৃত্ব দেয় তারই এখানে থাকার কথা তবে মার্টিন ভ্যাঙ্গার আরো বেশি আধুনিক কিছু চেয়েছিলেন তাই তিনি নিজের জন্যে এই বাড়িটা বানান।

ব্লমকোভিস্ট সেদিকে তাকালো। তবে এখানে আসার নিজের সিদ্ধান্তের জন্য মনে মনে নিজেকে গালমন্দ করলো সে। ঠিক করলো সম্ভব হলে রাতেই স্টকহোমে ফিরে যাবে। বাড়িটার দরজার সামনে আসতেই দরজাটা খুলে গেলো। দেখামাত্রই হেনরিক ভ্যাঙ্গারকে চিনতে পারলো ব্লমকোভিস্ট। এখানে আসার আগে ইন্টারনেটে তার কাছে ছবিটা পোস্ট করে দিয়েছিলো ফ্রোডি।

ছবিতে অবশ্য তাকে অনেক কম বয়সী দেখা গেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার বয়স আসলেই বিরাশি। একেবারেই ভঙ্গুর শরীর আর ধূসর চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করা। কালো প্যান্ট আর সাদা শার্ট পরে আছে, তার উপর পুরনো

একটি বাদামি রঙের জ্যাকেট। পাতলা গোঁফ আর স্টিল-রিমের চশমা চোখে।

“আমি হেনরিক ভ্যাঙ্গার,” বললো সে। “আমার এখানে আসার জন্যে রাজি হওয়াতে আপনাকে ধন্যবাদ।”

“হ্যালো। প্রস্তাবটা পেয়ে খুবই অবাক হয়েছি আমি।”

“ভেতরে আসুন, বাইরে অনেক ঠাণ্ডা। আপনার জন্য আমি একটা গেস্টরুম ঠিক করে রেখেছি। আপনি কি ফ্রেশ হয়ে নেবেন? আমরা একটু দেরি করে ডিনার করি। এ হলো অ্যানা নিগ্রেন, আমার দেখাশোনা করে।

ব্লমকোভিস্ট হাত মেলালো মহিলার সাথে। ষাট বছরের মতো হবে, তবে বেশ শক্তসামর্থ্য। তার কোটটা খুলে নিয়ে তাকে এক জোড়া স্লিপান এনে দিলো সে।

মিকাইল তাকে ধন্যবাদ দিয়ে হেনরিকের দিকে ফিরলো। “ডিনারের জন্য অপেক্ষা করবো কিনা নিশ্চিত নই। এটা নির্ভর করছে খেলাটা কি রকম সেটার উপর।”

ভ্যাঙ্গার আর ফ্রোডি একে অন্যের দিকে তাকালো। তাদের দু’জনের মধ্যে যে বোঝাপড়া আছে সেটা ব্লমকোভিস্টের কাছে বোধগম্য নয়।

“আমার মনে হয় আমার এখন চলে যাওয়াই উচিত। আপনারা কথা বলুন, “ফ্রোডি বললো। “বাড়ি ফিরে গিয়ে আমার নাতি-নাতনিদের হাত থেকে জিনিসপত্র ভাঙচুর থামাতে হবে। আমি না গেলে তারা বাড়িটাই শেষ করে ফেলবে।”

মিকাইলের দিকে ফিরলো সে।

“আমি খুব কাছেই থাকি। ঐ যে বৃজটা আছে তার ওপারে। পাঁচ মিনিটে হেটে যেতে পারবেন। দরকার হলে ফোন করবেন আমাকে।

ব্লমকোভিস্ট তার জ্যাকেটের পকেটে হাত দিয়ে টেপ রেকর্ডারটা চালু করে দিলো। ভ্যাঙ্গার কি চায় সে ব্যাপারে তার কোনো ধারণা নেই। তবে ওয়েনারস্ট্রমের সাথে যা হয়েছে তারপর থেকে সতর্ক না হয়ে উপায় নেই।

ফ্রোডির কাঁধে চাপড় মেরে তাকে বিদায় জানিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলো ভ্যাঙ্গার।

“তাহলে আসল কথায় চলে আসি। এটা কোনো খেলা নয়। আমার কথা আগে মনোযোগ দিয়ে শুনবেন তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন, এটাই আমার অনুরোধ। আপনি একজন সাংবাদিক, আপনাকে আমি একটি ফ্রিল্যান্স অ্যাসাইনমেন্ট দিতে চাই। অ্যানা উপর তলায় আমার অফিসে কফি দিয়েছে।”

অফিসটা আয়তক্ষেত্র আর সেটা ১৩০০ বর্গফুটের কম হবে না। একটা দেয়াল জুড়ে শুধু বইয়ের শেলফ। প্রচুর বই আছে সেখানে। তবে সেগুলো কোনো ক্যাটাগরিতে সাজানো নেই। বোঝা যাচ্ছে এটা অনেক ব্যবহৃত হয়। এর বিপরীত দিকের দেয়ালের কাছে কালো রঙের কাঠের একটি ডেস্ক আছে। ডেস্কের পেছনের দেয়ালটা জুড়ে আছে প্রেসড করা ফুলের অনেকগুলো ফ্রেমের সারি।

ডেস্কের পাশে জানালা দিয়ে বাইরের বৃজ আর একটা চার্চ দেখা যায়। একপাশে একটি সোফা আর কফি টেবিল আছে, একটু আগে সেখানে হাউজকিপার কফি, রোল আর প্যাস্ট্রি রেখে গেছে।

ট্রে’র দিকে ইঙ্গিত করলো ভ্যাঙ্গার তবে ব্লমকোভিস্ট ভান করলো সে ওটা দেখতে পায় নি। ঘরটা ভালো করে দেখে বইয়ের শেলফের কাছে চলে গেলো সে, তারপরই দেয়ালে রাখা প্রেস্ড করা ফুলের ফ্রেমগুলো দেখতে লাগলো। ডেস্কটা সুন্দর করে সাজানো, একেবারে ছিমছাম। কিছু কাগজপত্র আর সিলভারফ্রেমের একটা ছবি আছে তাতে। কালো চুলের এক মেয়ের। সুন্দর কিন্তু মুখে ক্রুড় হাসি। এক তরুণী যে কিনা বিপজ্জনক হতে শুরু করেছে মাত্র, ভাবলো ব্লমকোভিস্ট। ছবিটা অনেক বছর আগের কারণ সেটা বিবর্ণ হয়ে গেছে।

“আপনি কি তাকে চিনতে পেরেছেন, মিকাইল?” বললো ভ্যাঙ্গার।

“তাকে আমি চিনি?”

“হ্যা। তার সাথে আপনার পরিচয় ছিলো। সত্যি বলতে কি আপনি এই ঘরে আগেও এসেছিলেন।”

ব্লমকোভিস্ট বিস্ময়ে তাকালো তার দিকে। মাথা দোলালো সে।

“না। আপনি কিভাবে চিনবেন। আপনার তো মনে থাকার কথা নয়। আপনার বাবাকে আমি চিনতাম। পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে আপনার বাবা কুর্টকে আমি মেশিনারি ইনস্টল করার জন্যে অনেকবার হায়ার করেছিলাম। বেশ প্রতিভাবান ছিলেন। পড়াশোন চালিয়ে একজন ইঞ্জিনিয়ার হবার জন্য তাকে আমি রাজি করিয়েছিলাম। ১৯৬৩ সালের গ্রীষ্মের পুরোটা সময় আপনি এখানে ছিলেন। তখন হেডেস্টাডে আমরা নতুন একটি কাগজের মিল করছিলাম। আপনার পরিবারের জন্য থাকার জায়গা খুঁজে পেতে সমস্যা হলে আমি আপনাদেরকে রাস্তার ওপারে কাঠের বাড়িটাতে থাকার ব্যবস্থা করে দেই। জানালা দিয়ে আপনি সেটা দেখতে পাবেন।”

ভ্যাঙ্গার ছবিটা তুলে নিলো।

“এ হলো হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গার, আমার ভায়ের মেয়ে। সেই গ্রীষ্মে ও আপনার অনেক যত্ন নিয়েছিলো। আপনাকে সে খুব আদর করতো। আপনার বয়স তখন দুই কি তিন হবে। ঠিক মনে করতে পারছি না। ওর বয়স ছিলো তেরো।”

“আমি দুঃখিত, আপনি যা বলছেন সে সম্পর্কে আমার কিছুই মনে নেই।” ভ্যাঙ্গার যে সত্যি কথা বলছে তাতেও নিশ্চিত হতে পারছে না ব্লমকোভিস্ট।

“আমি বুঝতে পারছি। তবে আপনার কথা আমার মনে আছে। আপনি হ্যারিয়েটের সাথে পুরো ফার্মে দৌড়ে বেড়াতেন। মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ে গেলে যেভাবে কেঁদে উঠতেন সেটাও স্পষ্ট মনে আছে। আমার ছোটোবেলায় ব্যবহার করা হলুদ রঙের একটি খেলনার ট্রাক্টর আপনাকে দিয়েছিলাম সেটাও মনে আছে।। ওটা নিয়ে আপনি সারাদিন মেতে থাকতেন।”

ভেতরে ভেতরে ব্লমকোভিস্টের শীতল একটি প্রবাহ বয়ে গেলো। হলুদ রঙের ট্রাক্টরের কথাটা অবশ্য তার মনে আছে। তার শৈশবে ওটা তার শোবার ঘরে রাখা ছিলো।

“ঐ খেলনাটার কথা কি আপনার মনে আছে?”

“আছে। আপনি শুনে খুশি হবেন সেই ট্রাক্টরটা এখনও অক্ষত আছে, স্টকহোমের খেলনা জাদুঘরে। দশ বছর আগে তারা পুরনো আর আসল খেলনার জন্য বিজ্ঞাপন দিলে আমি সেটা দিয়ে দেই।”

“তাই নাকি?” খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠলো ভ্যাঙ্গারের চোখ দুটো। “আমাকে দেখাতে দিন…”

বৃদ্ধ বুকশেলফ থেকে একটা পুরনো ছবির অ্যালবাম বের করে কফি টেবিলের উপর রাখলো। সাদাকালো একটি ছবি বের করলো সেটা থেকে। একটা বাচ্চা ছেলের ছবি। ক্যামেরার দিকে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে চেয়ে আছে।

“এটা আপনার ছবি। পেছনে বাগানের বেঞ্চে আপনার বাবা-মা বসে আছে। আপনার মায়ের পেছনে আছে হ্যারিয়েট। আপনার বাবার বামে যে ছেলেটাকে দেখছেন সে হলো হ্যারিয়েটের ভাই মার্টিন, যে কিনা এখন ভ্যাঙ্গার কোম্পানিটা দেখভাল করছে।”

ব্লমকোভিস্টের মা অবশ্যই গর্ভবতী ছিলো-তার বোন তখন তার মায়ের পেটে। ভ্যাঙ্গার যখন কাপে কফি ঢালতে লাগলো তখন সে মিশ্র একটা অনুভুতি নিয়ে চেয়ে থাকলো ছবিটার দিকে।

“আপনার বাবা মারা গেছে আমি জানি। আপনার মা কি এখনও বেঁচে আছে?”

“তিন বছর আগে মারা গেছেন,” বললো ব্লমকোভিস্ট।

“খুবই চমৎকার মহিলা ছিলো সে। তার কথা আমার বেশ ভালোমতোই মনে আছে।

“আমি নিশ্চিত আপনি আমাকে পুরনো দিনের কথা শোনানোর জন্য এখানে ডেকে আনেন নি।”

“ঠিক বলেছেন। আপনাকে যে কথাটা বলবো সেটা নিয়ে আমি বিগত কয়েক দিন অনেক ভেবে দেখেছি। কিন্তু এখন আপনি এখানে আসার পর বুঝতে পারছি না কোত্থেকে শুরু করবো। আমি জানি আপনি কিছু রিসার্চ করেছেন। তো আপনি নিশ্চয় জানেন এক সময় সুইডেনের শিল্পকারখানা আর কাজের বাজারে আমার বেশ ভালো প্রভাব ছিলো। আজ আমি বৃদ্ধ একজন মানুষ, খুব জলদিই মারা যাবো। আর আমাদের কথোপকথনে মৃত্যু নামক জিনিসটা চমৎকার একটি সূচনাবিন্দু হবে।”

ব্লমকোভিস্ট কফিতে চুমুক দিয়ে ভাবতে লাগলো এসবের গন্তব্য কোথায়।

“আমার কোমরে ব্যথা আছে, দীর্ঘ সময় ধরে হাটা এখন আমার কাছে অতীত স্মৃতি। এক দিন আপনিও বুঝবেন জীবনের ক্ষয়ে যাওয়া কাকে বলে। তবে আমি মৃত্যু নিয়ে বেশি ভাবি না। তবে জানি এমন একটা সময়ে এসে উপস্থিত হয়েছি যেকোনো সময় মৃত্যু এসে হানা দেবে। তাই সব ধরণের লেনদেন মিটিয়ে দিতে চাইবো সেটাই স্বাভাবিক। যতো অসমাপ্ত কাজ আছে শেষ করে যেতে ইচ্ছে করবেই। আমার কথা কি আপনি বুঝতে পারেছেন?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ব্লমকোভিস্ট। “আমি আসলে উদগ্রীব হয়ে আছি আমাকে এখানে কেন ডেকে আনা হয়েছে,” আবারো বললো সে।

“কারণ আমার এইসব লেনদেন মেটানোর জন্য আপনার সাহায্যের দরকার।”

“আমি কেন? আপনার কেন মনে হলো এ কাজে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারবো?”

“কারণ যখনই কাউকে হায়ার করার কথা ভাবতে নিয়েছিলাম আপনার নামটা সংবাদে দেখতে পেলাম। আমি জানতাম আপনি কে। হয়তো আপনি যখন ছোটো ছিলেন তখন আমার কোলে অনেকবার বসেছিলেন সেই কারণে। আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি আবেগের কারণে আপনার কাছ থেকে সাহায্য চাইছি না। আপনার সাথে যোগাযোগ করার একটি তাড়া অনুভব করেছি এই যা।

মিকাইল হেসে ফেললো। “আপনার কোলে বসার কথা আমার অবশ্য মনে নেই। কিন্তু কানেকশানটা কিভাবে বের করতে পারলেন? ওটা তো ষাটের দশকের ঘটনা।

“আপনি আমার কথা বুঝতে পারেন নি। আপনার বাবা জারিন্ডার মেকানিক্যালে কাজ পাবার পর আপনার পুরো পরিবার স্টকহোমে চলে যায়। আমিই তাকে সেই চাকরিটা পাইয়ে দিয়েছিলাম। সে যে খুব দক্ষ সেটা আমি জানতাম। জারিন্ডারের সাথে আমাদের অনেক ব্যবসা ছিলো, তাই ওখানে প্রায়ই যেতে হোতো। আমরা যে খুব ভালো বন্ধু ছিলাম তা নয়। তবে আমাদের মধ্যে নিয়মিত কথাবার্তা হোতো। তার মৃত্যুর আগের বছর তার সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিলো। তখনই সে আমাকে বলেছিলো আপনি নাকি জার্নালিজমে ডিগ্রি নিয়েছেন। আপনাকে নিয়ে সে খুব গর্বিত ছিলো। তারপরই আপনি সেই ব্যাঙ্ক ডাকাতদের ধরিয়ে দিয়ে বিখ্যাত হয়ে উঠলেন। বিগত বছরগুলোতে আমি আপনার লেখা আর আর্টিকেলগুলোও পড়েছি। সত্যি বলতে কি আমি নিয়মিত মিলেনিয়াম পড়ি।”

“ঠিক আছে, আমি আপনার সাথে আছি। কিন্তু আপনি ঠিক কি চাচ্ছেন আমার কাছ থেকে?”

ভ্যাঙ্গার নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে কফিতে চুমুক দিলো। যেনো সে কি চায় সেটা মনে মনে ভেবে নেবার জন্য তার একটু সময় দরকার।

“মিকাইল, আমি শুরু করার আগে একটা চুক্তি করতে চাই আপনার সাথে। আমি চাইবো আপনি আমার জন্য দুটো জিনিস করবেন। একটা হলো প্রেক্ষাপট, আর অন্যটা আমার আসল কাজ।

“কি ধরণের চুক্তি?”

“আমি আপনাকে দু’পর্বের একটি গল্প বলবো। প্রথমটি ভ্যাঙ্গার পরিবার নিয়ে। এটা হলো প্রেক্ষাপট। এটি বেশ লম্বা আর ডার্ক স্টোরি। আমি চাইবো সত্যি কথা বলতে। গল্পের দ্বিতীয় পর্বে আসলে আমার আসল উদ্দেশ্য নিহিত আছে। আপনি হয়তো মনে করবেন কিছু কিছু গল্প একেবারেই…উদ্ভট। আমি চাইবো আপনি আগে মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনুন। সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমি কি চাই এবং কি প্রস্তাব করি সেটা আগে বুঝুন।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ব্লমকোভিস্টের মুখ দিয়ে। ভ্যাঙ্গার তাকে রাতের ট্রেনে করে স্টকহোমে ফিরে যেতে দেবে না বলেই মনে হচ্ছে। সে নিশ্চিত মিঃ ফ্রোডিকে যদি স্টেশনে নিয়ে যাবার জন্য গাড়ি পাঠাতে বলে তবে অজুহাত দেখানো হবে। বলা হবে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না!

ব্লমকোভিস্টের কাছে মনে হচ্ছে তাকে আঁটকে রাখার জন্য আগে থেকেই পরিকল্পনা করা হয়েছে। এখানে আসার পর থেকে যা কিছু ঘটছে সবটাই যে সাজানো নাটক সেটাও মনে হচ্ছে তার কাছে। পুরো পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে নেবার ক্ষমতা আছে ভ্যাঙ্গারের। এই না হলে এতো বড় শিল্পপতি কিভাবে হলেন?

ব্লমকোভিস্ট ঠিক করলো ভ্যাঙ্গার তাকে দিয়ে যা করাতে চাইছে সে সেটা করবে না। কোনোভাবেই না। সব শুনে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে না করে দেবে। সম্ভব হলে রাতের ট্রেন ছাড়ার আগেই সেটা করবে।

“আমাকে ক্ষমা করবেন, মি: ভ্যাঙ্গার,” বললো সে। “আমি এখানে এসেছি বিশ মিনিটের মতো হয়ে গেছে। আপনি কি চান তার জন্যে আমি আপনাকে আরো ত্রিশ মিনিট দিলাম। তারপর আমি সোজা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি চলে যাবো।”

কিছুক্ষণের জন্য ভ্যাঙ্গারের মধ্য থেকে ভদ্র আচরণটা লোপ পেয়ে গেলো। তার মধ্যে দেখা গেলো এক ধরণের নির্মমতা। যেনো আগের সেই জাঁদরেল শিল্পপতির সময়ে ফিরে গেছে সে। তিক্ত হাসিতে তার ঠোঁট দুটো বেঁকে গেলো।

“বুঝতে পেরেছি।”

“আমার সাথে চোর-পুলিশ খেলার দরকার নেই আপনার। কি চান সেটা সোজা বলে ফেলুন যাতে আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারি কাজটা করবো কি করবো না।”

“আপনি মনে করছেন আমি যদি আপনাকে আধ ঘণ্টার মধ্যে কনভিন্স করতে না পারি তাহলে সেটা এক মাসেও করতে পারবো না।”

“সেটাই।”

“কিন্তু আমার গল্পটা তো বেশ দীর্ঘ আর জটিল।”

“সংক্ষেপ আর সহজ করে বলুন। আমরা সাংবাদিকেরা এভাবেই কাজ করি। ঊনত্রিশ মিনিট বাকি আছে।”

হাত তুললো ভ্যাঙ্গার।। “যথেষ্ট হয়েছে। আমি আপনার কথা বুঝতে পেরেছি। আমার দরকার এমন একজন যে কিনা রিসার্চ করতে পারে, বিশ্লেষণ করতে পারে। আবার তার সততাও থাকতে হবে। আমার মনে হয় আপনার সেটা আছে। আমি আপনাকে পটানোর জন্য বলছি না। একজন ভালো সাংবাদিকের এরকম গুন থাকা জরুরি। আপনার দ্য নাইট টেম্পলার বইটি আমি পড়েছি। আপনার বাবাকে আমি চিনি এজন্যে আপনাকে বেছে নিয়েছি কথাটা সত্য, তবে এটাও সত্য আমি আপনাকেও চিনি। আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, আপনি ওয়েনারস্ট্রম অ্যাফেয়ারের কারণে আপনার পত্রিকা ছেড়ে দিয়েছেন। তার মানে আপনার হাতে এখন কোনো কাজ নেই। সম্ভবত আপনার আর্থিক অবস্থাও অতোটা ভালো নয়।”

“তাহলে আপনি আমার দুরাবস্থার সুযোগ নিচ্ছেন, তাই না?”

“সম্ভবত। তবে মিকাইল-আমি কি তোমাকে মিকাইল বলে ডাকতে পারি? – আমি তোমার কাছে মিথ্যে বলবো না। মিথ্যে বলার জন্য আমার বয়স একটু বেশিই হয়ে গেছে। আমি যা বললাম সেটা যদি তোমার পছন্দ না হয় তবে আমাকে সরাসরি বলবে। আমি অন্য কাউকে খুঁজে নেবো।”

“ঠিক আছে। তাহলে বলুন কাজটা কি নিয়ে?”

“তুমি ভ্যাঙ্গার পরিবার সম্পর্কে কতোটুকু জানো?”

“মি: ফ্রোডি আমাকে ফোন করার পর নেট থেকে যতোটুকু সম্ভব জেনেছি। এক সময় ভ্যাঙ্গার কোম্পানি সুইডেনের প্রথম সারির একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছিলো। বর্তমানে এর অবস্থা একটু পড়তির দিকে। মার্টিন ভ্যাঙ্গার এটা দেখাশোনা করে এখন। আরো কিছু হয়তো জানি কিন্তু সেটা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।”

“মার্টিন একজন ভালো মানুষ, তবে সে হলো শান্ত সাগরের নাবিক। সংকটের সময় সে একেবারে তালগোল পাকিয়ে ফেলে। সে আধুনিকীকরণ আর স্পেশালাইজ করতে চায়—এটা অবশ্য ভালো চিন্তা-কিন্তু এই চিন্তা বাস্তবায়নের সামর্থ্য তার নেই। তার ম্যানেজমেন্টও বেশ দুর্বল। পঁচিশ বছর আগে ভ্যাঙ্গার কোম্পানির সাথে ওয়ালেনবার্গদের মারাত্মক এক প্রতিযোগীতা হয়েছিলো। সুইডেনে আমাদের চল্লিশ হাজার কর্মচারি ছিলো তখন। আজ এইসব কাজগুলোর বেশিরভাগই কোরিয়া আর ব্রাজিলে চলে গেছে। দু’এক বছরের মধ্যে আমরা দশ হাজার কর্মচারিতে নেমে আসবো। মার্টিন যদি ঠিকমতো হাল ধরতে না পারে তাহলে সেটা পাঁচ হাজারেও নেমে আসতে পারে। খুব জলদি ভ্যাঙ্গার কোম্পানি ইতিহাসের পাতায় চলে যাবে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ব্লমকোভিস্ট। নেট থেকে সে যা ডাউনলোড করেছে এর সাথে তার বেশ মিল আছে।

“এই দেশে যেসব পরিবার এখনও শিল্পপ্রতিষ্ঠান ধরে রেখেছে ভ্যাঙ্গার পরিবার তাদের মধ্যে অন্যতম। ত্রিশটি পরিবারের সদস্যরা সংখ্যালঘু শেয়ারহোল্ডার। এটাই ছিলো আমাদের কোর্পোরেশনের আসল শক্তি, আবার এটাই হলো আমাদের প্রধান দুর্বলতা।” একটু থেমে ভ্যাঙ্গার বেশ তাড়না অনুভব করে বলতে শুরু করলো। “মিকাইল, তুমি পরে প্রশ্ন কোরো। আমার একটা কথা মনে রেখো, আমি আমার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যকে ঘৃণা করি। তাদের বেশিরভাগই হলো চোরবাটপার, প্রতারক, হামবড়া ভাবের লোক আর অযোগ্য। আমি পয়ত্রিশ বছর এই কোম্পানিটি চালিয়েছি। তারা ছিলো আমার এক নাম্বার শত্রু। আমার প্রতিপক্ষ কোম্পানি আর সরকারের চেয়ে তারাই ছিলো অনেক বেশি বাজে আর ভয়ঙ্কর।

“আমি তোমাকে বলেছি আমি চাই তুমি আমার জন্য দুটো কাজ করবে। প্রথমত, তুমি ভ্যাঙ্গার পরিবারের ইতিহাস লিখবে, অনেকটা জীবনী লেখার মতো আর কি। সোজা কথায় বলতে গেলে সেটা হবে অনেকটা আমার আত্মজীবনীর মতো। আমি তোমার কাছে আমার সমস্ত জার্নাল আর আর্কাইভ দিয়ে দেবো। তুমি আমার কাছ থেকে যা জানতে চাইবে জেনে নিতে পারবে। কোনো নোংরা ইতিহাস খুঁজে বের করতে পারলে তাও প্রকাশ করবে। আমার মনে হয় এই গল্পটা হবে অনেকটা শেক্সপিয়ার ট্র্যাজেডির মতো।”

“কেন?”

“আমি কেন ভ্যাঙ্গার পরিবারের কেচ্ছাকাহিনী প্রকাশ করতে চাইছি? কেন তোমাকে দিয়ে লেখাতে চাইছি?”

“দুটোই।”

“সত্য কথা বলতে কি, বইটা প্রকাশ হবে কি না হবে সেটা নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। তবে আমার মনে হয় গল্পটা লেখা উচিত। যদি মাত্র এক কপিও প্রকাশ করা হয় সেটা যেনো রয়্যাল লাইব্রেরিতে দেয়া হয়। আমি চাই আমার মৃত্যুর পর এই গল্পটা মানুষ জানুক। আমার উদ্দেশ্য খুবই সহজ সরল : প্রতিশোধ।”

“কিসের জন্য প্রতিশোধ নিতে চান?”

“আমি চাই আমার নাম বলতে মানুষ যেনো বোঝে আমি কথা রাখার মানুষ, নিজের প্রতিজ্ঞার কথা আজীবন মনে রাখার একজন মানুষ। আমি কখনও রাজনৈতিক খেলা খেলি নি। ট্রেড ইউনিয়নদের সাথে আলোচনা আর সমঝোতায় আমার কখনও সমস্যা হয় নি। এমন কি এক সময়কার প্রধানমন্ত্রী আরলান্ডার আমাকে শ্রদ্ধা করতেন। আমার কাছে এটা নৈতিকতার ব্যাপার। হাজার হাজার লোকের জীবিকা আমার উপর ন্যস্ত। আমি আমার সমস্ত কর্মচারিদের চিন্তা মাথায় রাখি। অদ্ভুত ব্যাপার হলো মার্টিনও একই রকম চিন্তা করে যদিও সে একেবারেই ভিন্ন এক চরিত্রের মানুষ। দুঃখজনক হলো মার্টিন আর আমি হলাম আমার পরিবারের ব্যতিক্রমী দু’জন মানুষ। ভ্যাঙ্গার কোম্পানি যে আজ এতো বাজে অবস্থায় পড়েছে তার অনেক কারণ আছে। তবে তার মধ্যে অন্যতম কারণ হলো আমার আত্মীয় পরিজনদের দ্রুত মুনাফা আর আর প্রচণ্ড লোভী মনমানসিকতা। তুমি যদি আমার কাজটা করতে রাজি হও তাহলে তোমাকে বলবো তারা কিভাবে ফার্মটাকে ধ্বংস করছে।

“আমিও আপনার কাছে মিথ্যে বলবো না,” বললো ব্লমকোভিস্ট। “এরকম একটি বই লেখা আর রিসাচের কাজ করতে কয়েক মাস লাগবে। এটা করার মতো ইচ্ছে কিংবা শক্তি আমার নেই।”

“আমার বিশ্বাস আমার কথা শোনার পর সেটা কোনো সমস্যা হবে না।

“আমার তাতে সন্দেহ আছে। তবে আপনি বলেছেন দুটো জিনিস আছে। বইটা হলো প্রেক্ষাপট। আসল উদ্দেশ্যটা তাহলে কি?”

ভ্যাঙ্গার উঠে দাঁড়িয়ে ডেস্ক থেকে হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গারের ছবিটা তুলে নিয়ে ব্লমকোভিস্টের সামনে রাখলো।

“তুমি যখন আমাদের পরিবারের ইতিহাস লিখতে থাকবে তখন আমি চাইবো একজন সাংবাদিকের চোখে আমাদের পরিবারকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে নেবে। এই পরিবারের ইতিহাস জেনে নেবে গভীর পর্যবেক্ষণের সাহায্যে। তবে আমি চাই সবার আগে তুমি একটা রহস্য সমাধান করবে। এটাই হলো তোমার আসল কাজ।”

“কিসের রহস্য?”

“হ্যারিয়েট আমার ভায়ের নাতনি। আমরা পাঁচ ভাই। রিচার্ড হলো সবার বড়। ১৯০৭ সালে সে জন্মায়। আমি সবার ছোটো। ১৯২০ সালে জন্মাই। আমি বুঝতে পারি না ঈশ্বর কিভাবে এরকম একগাদা ভাই সৃষ্টি করলো যারা…” একটু থেমে গেলো সে। মনে হয় কথার খেই হারিয়ে ফেলেছে। প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললো এবার। “আমার ভাই রিচার্ডের সম্পর্কে কিছু বলি। এটাকে আমাদের পরিবারের একটি ছোট্ট ইতিহাস হিসেবে দেখো আর আমি চাইবো এটাও তুমি লিখে নেবে।”

নিজের কাপে আরো কফি ঢাললো সে।

“১৯২৪ সালে রিচার্ডের বয়স ছিলো সতেরো। সে ছিলো অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদী আর অ্যান্টি-সেমিটিক। সুইডিশ ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট ফ্রিডম লিগে যোগ দেয় সে। যা কিনা সুইডেনের প্রথম দিককার একটি নাৎসি পার্টি। নাৎসিরা যে সব সময় ফ্রিডম শব্দটা ব্যবহার করে সেটা কি লক্ষ্য করেছো?”

ভ্যাঙ্গার আরেকটা ফটো অ্যালবাম হাতে তুলে নিয়ে একটা ছবি বের করলো। “এই যে রিচার্ড, সঙ্গে কুখ্যাত বাজার ফুরুগার্ড। যে কিনা ফুরুগার্ড মুভমেন্ট নামের একটি দলের লিডার হয়েছিলো। ত্রিশের দশকে এরা নাৎসি আন্দোলনের অগ্রপথিক ছিলো। তবে রিচার্ড তার সাথে বেশি দিন ছিলো না। কয়েক বছর পর সে সুইডিশ ফ্যাসিস্ট ব্যাটল অর্গানাইজেশন-এ যোগ দেয়। সংক্ষেপে ওটাকে এসএফবিও বলে। ওখানেই তার সাথে পরিচয় হয় পার ইংডাল এবং অন্যদের সাথে যারা আমাদের দেশকে অসম্মান করেছিলো।

অ্যালবামের পাতা ওল্টাতে লাগলো সে : রিচার্ড ভ্যাঙ্গারকে ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে।

“ও আমাদের বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ত্রিশের দশকে নাৎসি বাহিনীতে যোগ দেয়। ১৯৩৩ সালে লিন্ডহোম আন্দোলন শুরু হয়, এটা হলো ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টি। তুমি সুইডিশ নাৎসিদের সম্পর্কে কতোটুকু জানো?”

“আমি তো কোনো ইতিহাসবিদ নই। তবে আমি কিছু বইপত্র পড়েছি।”

“১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, আর ১৯৪০ সালের শীতকালে সেটা ফিনল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ে। লিন্ডহোম আন্দোলনে প্রচুর সংখ্যক ফিনল্যান্ডের স্বেচ্ছাসেবক যোগ দেয়। রিচার্ড ছিলো তাদের মধ্যে একজন। সে সময় সুইডিশ সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলো। ১৯৪০ সালে সে নিহত হয়। ঠিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে শান্তি চুক্তি করার আগ মুহূর্তে। এজন্যে তার নামে একটি ব্যাটেলগ্রুপের নামকরণ করা হয় তখন। এমন কি আজকের দিনে ও হাতে গোনা অল্প কিছু গর্দভ তার মৃত্যুবার্ষিকীতে স্টকহোমের সমাধিতে উপস্থিত হয়ে তাকে সম্মান জানায়

“বুঝতে পেরেছি।”

“১৯২৬ সালে তার বয়স যখন ১৯ বছর তখন সে ফালুনের এক শিক্ষকের মেয়ে মার্গারিটার সাথে জড়িয়ে পড়ে। রাজনীতিতে জড়িয়ে তাদের মধ্যে পরিচয় হলেও সেটা প্রেমে পরিণত হয় আর তার ফলে তাদের এক ছেলে জন্মায় যার নাম গটফ্রিড। ১৯২৭ সালে তার জন্ম হয়। ছেলের জন্মের পর পরই তারা বিয়ে করে ফেলে। ত্রিশের দশকের প্রথম দিকে আমার ভাই যখন গাভল-এ পোস্টিং হয় তখন তার বউ আর ছেলেকে হেডেস্টাডে রেখেছিলো। সে অবসর সময়ে ভ্রমণ করতো আর নাৎসিবাদ প্রচারে সাহায্য করতো। ১৯৩৬ সালে আমার বাবার সাথে তার তুমুল ঝগড়া বাধলে বাবা তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেন। এরপর থেকে রিচার্ড নিজের অন্ন নিজেই সংস্থান করতো। নিজের পরিবার নিয়ে সে স্টকহোমে চলে যায়, ওখানে অনেকটা দারিদ্রের মধ্যে বসবাস করতে শুরু করে।”

“তার নিজের তেমন টাকা-পয়সা ছিলো না?”

“উত্তরাধিকারী সূত্রে পাওয়া ফার্মের অংশ পরিবারের বাইরে বিক্রি করার বিধান ছিলো না। তারচেয়ে বড় কথা রিচার্ড খুবই নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিলো। নিজের বউকে বেধরক পেটাতো, বাচ্চাটাকেও মারধোর করতো। তার ছেলে গটফ্রিড ভীতু হিসেবে বড় হতে লাগলো। তার বয়স যখন তেরো তখন রিচার্ড নিহত : হয়। আমার ধারণা সেটা তার জন্য সবচাইতে আনন্দের দিন ছিলো। আমার বাবার খুব মায়া হলো, তিনি তার বিধবা স্ত্রী আর ছেলেকে হেডেস্টাডে নিয়ে এলেন। মার্গারিটা আর ছেলেটার জন্য তিনি একটা অ্যাপার্টমেন্ট বানিয়ে দেন। তারা ওখানে বেশ ভালোভাবেই জীবনযাপন করতে লাগলো।

“রিচার্ড যদি পরিবারের অন্ধকার আর উগ্র দিকটাকে তুলে ধরে থাকে তো তার ছেলে গটফ্রিড অলসতাকে তুলে ধরেছিলো। তার বয়স যখন আঠারো হলো আমি ঠিক করলাম তাকে আমার অধীনে নিয়ে নেবো। হাজার হোক সে আমার মৃতভায়ের ছেলে। আর তুমি হয়তো লক্ষ্য করে থাকবে গটফ্রিড আর আমার বয়সের ব্যবধান খুব বেশি না। আমি তারচেয়ে মাত্র সাত বছরের বড়। তবে সে সময় আমি ফার্মের বোর্ডে ছিলাম আর আমার বাবার থেকে এর পরিচালনার দায়িত্ব আমারই নেবার কথা। সেক্ষেত্রে গটফ্রিড একজন বহিরাগতের মতোই ছিলো।”

ভ্যাঙ্গার কিছুক্ষণ ভেবে নিলো।

“নিজের নাতির সাথে কিভাবে ডিল করবে সেটা আমার বাবা জানতো না। তাই আমিই তাকে কোম্পানিতে একটা কাজ জুটিয়ে দেই। এটা যুদ্ধের পরের ঘটনা। সে কাজটা করার চেষ্টা করলেও খুব অলস ছিলো। একটু নারীঘেষা আর হাস্যরস প্রিয় ছিলো সে। মাঝেমধ্যে একটু বেশি পান করে বেসামাল হয়ে পড়তো। তার সম্পর্কে আমার অনুভূতির কথা বর্ণনা করাটা খুব সহজ কাজ নয়…সে আসলে অকর্মার ঢেকি ছিলো। মাঝে মাঝেই সে আমাকে হতাশ করতো। এক নাগারে অনেকগুলো বছর মদে আসক্ত হবার পর ১৯৬৫ সালে দুর্ঘটনাক্রমে মাতাল হয়ে পানিতে ডুবে মারা যায় সে। ওটা হেডেবি আইল্যান্ডে ঘটে। ওখানে তার একটা কেবিন ছিলো। লুকিয়ে লুকিয়ে মদ খাওয়ার জন্য সে ওটা বানিয়েছিলো।”

“তাহলে সে হ্যারিয়েট আর মার্টিনের বাবা?” ব্লমকোভিস্ট বললো, কফি টেবিলের উপর রাখা ছবিটার দিকে ইঙ্গিত করে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে মানতেই হলো বৃদ্ধের গল্পটা কৌতুহলোদ্দীপক।

“ঠিক বলেছো। চল্লিশের দশকে ইসাবেলা কোয়েনিগ নামের এক জার্মান মহিলার সাথে গটফ্রিডের পরিচয় হয়, মহিলা সুইডেনে চলে এসেছিলো যুদ্ধের পর। খুব সুন্দরি ছিলো সে-মানে তার ছিলো গ্রেটা গার্বো আর ইনগ্রিড বার্গম্যানের মতো সৌন্দর্য। হ্যারিয়েট তার বাবা থেকে মার জিনই বেশি পেয়েছে। ছবি দেখে বুঝতে পারছো নিশ্চয়, চৌদ্দ বছরেও সে খুব সুন্দরি ছিলো।”

ব্লমকোভিস্ট আর ভ্যাঙ্গার ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো।

“আচ্ছা, আবার গল্পে ফিরে আসি। ইসাবেলা ১৯২৮ সালে জন্মেছিলো। যুদ্ধ শুরুর সময় তার বয়স ছিলো এগারো। বার্লিনে বিমান হামলার সময় একজন টিনএজার হিসেবে তার কেমন লেগেছিলো সেটা নিশ্চয় আন্দাজ করতে পারছো। সুইডেনে আসার পর তার কাছে মনে হয়েছিলো সে বুঝি স্বর্গে চলে এসেছে। দুঃখের বিষয় হলো গটফ্রিডের কিছু বদঅভ্যেস তার মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছিলো। সে ছিলো অলস পার্টিবাজ মহিলা। সুইডেন আর পৃথিবীর অনেক দেশে সে ঘুরে বেড়াতো। একেবারে দায়িত্বজ্ঞানহীন। এটা বাচ্চাদের মধ্যেও প্রভাব ফেলেছিলো। মার্টিনের জন্ম হয় ১৯৪৮ সালে, আর হ্যারিয়েটের ১৯৫০- এ। তাদের শৈশব ছিলো খুবই বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। বিদেশে ঘুরে বেড়ালো মা আর মদ্যপ বাবা।

“১৯৫৮ সালে আমি মনে করলাম অনেক হয়েছে। এই দুষ্টচক্র ভাঙতে হবে। সে সময় গটফ্রিড আর ইসাবেলা হেডেস্টাডে থাকতো, আমি তাদেরকে অনেকটা জোর করেই এখানে নিয়ে আসি।”

ভ্যাঙ্গার ঘড়ির দিকে তাকালো।

“আমার ত্রিশ মিনিট সময় তো প্রায় শেষ। তবে আমি আমার গল্পের সমাপ্তি টানছি। তুমি কি আমাকে আরেকটু সময় দেবে?”

“বলে যান,” বললো ব্লমকোভিস্ট।

“তাহলে সংক্ষেপে বলি। আমি নিঃসন্তান-আমার অন্য ভাই আর পরিবারের সদস্যদের বাধা সত্ত্বেও আমি তাদেরকে এখানে নিয়ে আসি। গটফ্রিড আর হ্যারিয়েট এখানে চলে এলেও তাদের বিয়েটা হুমকির মুখে পড়ে যায়। এক বছর পরই গটফ্রিড তার ক্যাবিনে চলে যায়। ওখানেই সে একা একা সময় কাটাতো, কেবল বেশি ঠাণ্ডা পড়লে চলে আসতো ইসাবেলার কাছে। আমিই মার্টিন আর হ্যারিয়েটের দেখাশোনা করতাম। তারা হয়ে উঠলো আমারই সন্তান।

“মার্টিন ছিলো…সত্যি বলতে কি, তার যৌবনে আমি আশংকা করতাম ছেলেটা বুঝি বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে যাচ্ছে। দুর্বল, ভগ্নস্বাস্থ্যের আর চুপচাপ স্বভাবের ছিলো সে। তবে হাস্যোচ্ছল আর প্রাণোচ্ছলও ছিলো। টিনএজ বয়সে একবার সমস্যায় পড়ে, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর সব ঠিক হয়ে আসে। এসব সত্ত্বেও এখন সে ক্ষয়িষ্ণু ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশনের সিইও। এজন্যে আমি তাকে কৃতিত্ব দেবো।”

“আর হ্যারিয়েট?”

“হ্যারিয়েট ছিলো আমার চোখের মণি। তাকে আমি সুশিক্ষায় শিক্ষিত করি, সুন্দরভাবে গড়ে তুলি। আমরা একে অন্যেকে খুব পছন্দ করতাম। তাকে আমি নিজের মেয়ে বলেই মনে করতাম। সেও নিজের বাবা-মা থেকে আমার সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলো। তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছো, হ্যারিয়েট ছিলো খুবই স্পশাল। একটু চুপচাপ স্বভাবের ছিলো। ঠিক তার ভায়ের মতোই। টিনএজ বয়স থেকেই সে আমাদের পরিবারের অন্য সবার মতো না হয়ে খুব ধার্মিক হয়ে ওঠে। তবে তার বুদ্ধি ছিলো খুব প্রখর। প্রতিভাও ছিলো বেশ। নীতি আর দৃঢ়তা দুটোই ছিলো তার। যখন তার বয়স চৌদ্দ কিংবা পনেরো তখন আমি নিশ্চিত হয়ে উঠি যে ভবিষ্যতে ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশনের দায়িত্ব তার উপরেই ন্যস্ত হবে

“তাহলে কি হলো?”

“যে কারণে তোমাকে আজ এখানে নিয়ে আসা হয়েছে এখন সে বিষয়ে বলছি। আমি চাই তুমি খুঁজে বের করবে আমাদের পরিবারে কে হ্যারিয়েটকে খুন করেছিলো, আর কে বিগত চল্লিশ বছর ধরে আমাকে পাগল করার চেষ্টা ক’রে যাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *