৮. নক্ষত্রযান বীথিপৃতে অবতরণ

কখন যে নক্ষত্রযান বীথিপৃতে অবতরণ করেছে কিছু টের পেলাম না, ব্যক্তিটি এক সময় শুধু ঘোষণা করল, আমরা এখন বীথিপৃ পৃষ্ঠে। তারপরই সে এক অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসল, আপনার শরীরে কোনো তামাটামা নেই তো?

কেন? কেন? এই প্ৰশ্ন কেন?

আপনাকে এখন তানেহামের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। আপনি যে পদ্ধতিতে তার সমুখে উপস্থিত হবেন, সেই পদ্ধতিটি তামার ক্ষেত্রে তড়িৎ সৃষ্টি করে, ফলে প্রাণহানি অবশ্যম্ভাবী। প্রাণ নিয়ে কথা, নইলে কিছুতেই স্বীকার করতাম না, জিনিসটা বহুকালের; কাচুমাচু হয়ে বললাম, সেই সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সময় ব্রিটিশ আমলের তামার একটা ছ্যাঁদা এক পয়সা, কালো সুতো দিয়ে মা কোমরে বেঁধে দিয়েছিল, মায়ের চিহ্ন খুলে রাখবে?

ব্যক্তিটি বিস্মিত হয়ে ভ্রূ তুলল; না ভ্রূ বলে তার কিছু নেই, ভ্রূর জায়গাটা সামান্য উঠে গেল মাত্র। আমি লক্ষ না করে পারলাম না যে, যে গ্রহেরই হও বাপু কিছু কিছু মৌলিক জিনিস ছাড়া তা কিছুতেই সম্ভব নয়— যেমন এই ভ্রূ কপালে তোলার ব্যাপার।

একটু আড়াল হয়ে কোমর থেকে তামার পুরনো পয়সাটা বের করে তার হাতে দিলাম। বললাম, বহুদিনের স্মৃতি।

ব্যক্তিটি আবার নীরব বিস্ময় প্রকাশ করল ঐ ভ্রূর জায়গা কাঁপিয়ে; বলল, যাবার সময় ফেরত পাবেন।

এখন? এখন কী কর্তব্য? কোথায় যেতে হবে, নিয়ে যাও।

অচিরে আমাকে নিবস্ত্র হতে বলা হলো। ক্ষ্যাপা নাকি? বস্ত্র দেহে থাকলে তো নিবস্ত্ৰ হব? ছেঁড়া একখানা লুঙ্গি পরে ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম, আমি কি জানি সফরে বেরুচ্ছি? জানা থাকলে না হয়, সেই কবে কাফনের কাপড় কিনে রেখেছিলাম সেটা গায়ে জড়িয়ে বেরুতাম; ঈদের নামাজটা না পড়লেই নয়, অন্তত ফেত্রার পয়সাটা ছাত্ররা দেয় কাতারে দাঁড়াবার আগে, ঈদের নামাজ আজকাল ঐ কাফনের কাপড় পরেই চালিয়ে দেই; লোকে অতো বুঝতে পারে না, তারা ধরে নেয় বড় মুসল্লী হয়েছি, হজের কাপড়ে নামাজ আদায় করছি। তা সে কথা যাক।

নিবস্ত্র হতে বলছে; একেবারে আদিম হয়েই কি ওদের ঐ তানেহাম লোকটির সঙ্গে দেখা করবার রেওয়াজ নাকি? এবার আমার ভ্রূ তোলার পালা; আমার দুখানা ভ্রূ আছে এখনো স্ব-স্থানেই, ও তো আর সোনাদানা নয় যে বাধা দিয়ে খেয়ে ফেলেছি; আমি দুই ভ্রূ একসঙ্গে কপালে তুলে লুঙ্গির গেরো হাতের মুঠোয় ধরে ব্যক্তিটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। তোমার সম্মুখেই কি নিবস্ত্র হব?

ব্যক্তিটি অন্তর্হিত হয়ে গেল চোখের পলকে।

বাহ, এদের দেখছি ভদ্রতাবোধ বেশ আছে। নির্জন দেখে হাতের মুঠো আমার অলগা হয়ে গেল। তারপর, পায়ের কাছ তেকে লুঙ্গিটা কুড়িয়ে বিছানার ওপর রাখতে যাব, আবার ফিরে যেতে হবে তো, তখন কি উদোম হয়ে প্রত্যাবর্তন করব? দেখি, বিছানার ওপর পাট পাট ইস্ত্রি করা কাপড় রাখা। বহুদিন আগে, বিয়ের পর পর, তখন ছেলেপুলেও হয় নি, দেশেও আকাল পড়ে নি, সেই তখনকার কথা, আমার ইস্কুল টাইমের আগে চান বড়ুয়া আমার কাপড় ভাঁজ করে বিছানার ওপর সাজিয়ে রাখত; অবিকল সেই রকম। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি তুলতুলে নরম বস্ত্র, হাত থেকে পিছলে পড়ে যেতে চায়, দুধের মতো চাপারঙ, পাঞ্জাবি, পাজামা, ভাঁজ করা চাদর, তার আবার বাসন্তী রঙের সরু পাড়, পাশে একজোড়া ঝকঝকে কালো রঙের পাম্পস্যু। কখন এ সব এখানে কে রেখে গেছে, আমার চোখে পড়ে নি। আমার তাড়াতাড়ি বেশভূষা শেষ করে চোখ তুলেছি, নলের গায়ে দিব্যি একখানা লম্বাটে আয়না এসে হাজির। সেই আয়নায় যার ছবি পড়েছে তাকে আমি পঁচিশ বছর আগে দেখেছিলাম। সেই ডান পাশে কাত করা সিঁথি, টলটলে মুখ, জ্বলজ্বলে চোখ, বাটারফ্লাই গোঁফ, গালের সেভটা পর্যন্ত ব্রজলালের সেলুনে কামাবার মতো নিখুঁত। দেখে এত লোভ হলো, মনে মনে ইচ্ছে প্রকাশ করলাম, ফিরিয়ে দেবার সময় অন্তত এই জামা জুতো জোড়া, আর পারলে যুবক চেহারাটা আর কেড়ে রেখ না।

আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছি, হঠাৎ দেখি আয়নায় সেই ব্যক্তিটির ছবি— কখন এসে উপস্থিত হয়েছে আবার। আমি জিগ্যেস করলাম, আপনাদের বীথিতে কি পাঞ্জাবি পাজামারই রেওয়াজ নাকি?

সে বলল, না আপনারই জন্য বানানো হয়েছে বিশেষভাবে।

আমি বললাম, আহা, বানালেনই যদি, একসেট সাফারী স্যুট করিয়ে দিলেই পারতেন। আজকাল ও না হলে দেশে কোথাও পাত্তা পাওয়া যায় না।

ব্যক্তিটি উত্তর দিল, করিয়ে দিলেও তো নিয়ে যেতে পারতেন না। আমাদের বস্ত্র আপনাদের আবহাওয়ায় মুহূর্তে মাকড়সার জালের মতো ছিঁড়ে যাবে। এই পাঞ্জাবি পাজামাও এখানেই রেখে ফিরে যেতে হবে।

পা তুলে বললাম, পাম্পসু?

পৃথিবীর আবহাওয়ার সংস্পর্শে এলেই লোহার জুতোয় পরিণত হবে।

বাবা দরকার নেই। এক বিপলের মধ্যে আমাকে জলেশ্বরীতে ফিরিয়ে দেবার কথা, এযে কথায় কথায় দেরি হয়ে যাচ্ছে।

ব্যক্তিটি আমার উদ্বেগ আঁচ করেই বলল, না, আমরা তো এখন চলছি।

মানে?

বহু আগেই মূল নক্ষত্রযান থেকে নলটিকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে; এই নল এখন তানেহামের প্রাসাদের দিকে ধাবিত। অচিরেই আমরা সেখানে পৌঁছুব।

বলতে না বলতেই নলের গা স্বচ্ছ হয়ে গেল; চারদিকেই একেবারে স্বচ্ছ পরিষ্কার, যেন নল- টল কিছুই কখনো ছিল না; আমার চারদিকে এখন বিরাট এক হলঘরের পরিবেশ স্ফটিকের মতো মেঝে টলমল করছে, দূরে-দূরে নীলাভ রঙের গোল থাম, দেয়ালগুলো সোনার মতো ঝকঝক করছে, আর তীব্র পূর্ণিমার মতো আলো এসে পড়েছে দূরে একটি জায়গায়। মনে হলে পাথরে খোদাই একটি মূর্তির ওপরে আলো ফেলা হয়েছে।

আমার যাত্রা সঙ্গী, নাকি পথপ্রদর্শক বলব?— সে ইঙ্গিত করল এগিয়ে যাবার জন্যে। আমি ভরসা পেলাম না। একটু আগেই আমার চারদিক ছিল নলের দেয়াল, এখন স্বচ্ছ হলেও যদি সেই জলেশ্বরীতে বাড়ির পেছনের মতো আবার ধাক্কা খাই? বারবার বেলতলায় যেতে রাজি নই।

ব্যক্তিটি আবার হাত তুলে ইঙ্গিত করল; এবার তার মুখ রক্তাভ লক্ষ করলাম এবং বুঝতে পারলাম বিশেষ বিরক্ত হয়েছে সে— ওটাই ওদের বিরক্ত হবার রং, মনে পড়ে গেল। আমি পা বাড়ালাম, দিব্যি নল ভেদ করে বেরিয়ে এলাম; ব্যক্তিটি আমার পেছনেই রয়ে গেল, সে আমার সঙ্গে এল না, আমার ভেতর থেকে কে যেন বলে দিল— দূরে পূর্ণিমার উদ্ভাসিত ঐ মূর্তিটির দিকে অগ্রসর হও।

কিছুদূর এগিয়ে যাবার পর লক্ষ করলাম, মূর্তি নয়— মানুষ, মানুষ মানে এক্ষেত্রে ষ্যনুম একজন। হিস্ট্রি বইতে যে রকম দেখেছিলাম, অবিকল নেপোলিয়নের ভঙ্গি ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেই তেমনি আড় হয়ে, দু পায়ের গোড়ালি যুক্ত, বাঁ হাতখানা করতল পর্যন্ত জামার জোড়ের ভেতরে ঢোকান, তফাত শুধু এই যে-ডান হাতখানা কোমরের পেছনে থাকবার বদলে এই ষ্যনুমটির হাত মুখের কাছে তোলা, ভালো করে তাকিয়ে দেখি সে হাতে লম্বা এককাঠি লেবেনচুষ দিব্যি মুখে পুরে দিয়ে চুষছেন।

আমি কাছে যেতেই মুখ থেকে কাঠি সরিয়ে ষ্যনুমটি বললেন, স্বাগতম। আমার নাম তানেহাম। এই বলে কাঠি লেবেনচুষ আবার মুখে দিয়ে কিছুক্ষণ চুষলেন আর আমার দিকে মিটিমিটি চোখে তাকিয়ে রইলেন।

আমি জানি না বীথিপৃতে ভদ্রতার ধরন-ধারণ কী, পৃথিবীতে আমরা মোটামুটি পাশ্চাত্য কেতা কায়দাই ব্রহ্মাণ্ডের জন্য সত্যি বলে মেনে নিয়েছি, অতএব আমি শেকহ্যান্ড করার জন্য হাত বাড়িয়ে বললাম, আমি পরান মাস্টার, আপনার সাক্ষাৎ লাভ করে প্রীত হলাম। তানেহাম আমার বাড়ানো হাতের দিকে অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ, তারপর মাথা নেড়ে বললেন, না, আপনার মন আমি তন্নতন্ন করে দেখলাম, আপনার তো পাঞ্জা লড়বার ইচ্ছে নেই, হাত বাড়ালেন যে?

বললাম, ভিনদেশে ভিন্ন আচরণ, আপনার দেশে শেকহ্যান্ড নেই বুঝলাম।

তানেহাম তার অনুপস্থিত ভ্রূ তুলে বললেন, আচরণটি আপনার পক্ষেও তো ভিনদেশী বটে। তবু হাত বাড়ালেন যে তাই অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম।

আবার তিনি কাঠি লেবেনচুষ মুখে পুরে দিলেন।

এই দেখবার জন্য আমাকে ন’ হাজার আলোকবর্ষ দূরে এই ধাপধারা বীথিপৃতে আনা হয়েছে নাকি?

এদের এখানে আবার মনে মনেও কিছু ভাবনার জো নেই, মুহূর্তে সব টের পেয়ে যায়, তার প্রমাণ আমি পথেই পেয়েছি।

তানেহাম বললেন, আপনি আমাকে কাঠি লেবেনচুষ চুষতে দেখে অবাক হচ্ছেন। আপনি ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন বীথিপৃর আমিই প্রধান, আমি আপনাদের ভাষায় বীথিপৃর সম্রাট, আপনাদের মহা গৌরবের বস্তু মোগলদের দরবারি বর্ণনায় জিললুল্লাহ অর্থাৎ ঈশ্বরের ছায়া। তাই আমি যখন কাঠি চুষছি, আপনার বিস্মিত হবার কথাই। আপনার কাছে আমি একটা বিশেষ ব্যাপারে সাহায্যপ্রার্থী বলেই আপনার কৌতূহলও আমি উপেক্ষা করতে পারি না। অতএব আপনাকে এই কাঠি লেবেনচুষের ব্যাখ্যা দিই। মানুষ হোক, ষ্যনুম হোক বা ব্রহ্মাণ্ডের যে-কোনো সূর্যের যে-কোনো গ্রহেরই কোনো উন্নত প্রাণী হোক, সে যখন ক্ষমতার চূড়ান্ত শিখরে পৌছায়, তখন তার ইচ্ছা কাজে পরিণত হতে শুধু উচ্চারণের অপেক্ষা মাত্র। যখন যুদ্ধ, গণহত্যা, পারমাণবিক ধ্বংসলীলাও আর মোটেই উত্তেজনাকর নয়, তখন আমাদের জন্য আবার সেই শৈশবেরই দ্বারস্থ হতে হয়; শৈশবে তো আর ফিরে যাওয়া যায় না, ফিরে যাবার অভিনয় করতে হয়, তাই লক্ষ করে দেখবেন, আপনাদের পৃথিবীতে বড় বড় শক্তিমানেরা মিলে নার্সারী খেলাঘর বানায়, যার নাম জাতিসংঘ, আমাদের গ্রহে আমি একাই শক্তিমান বলে অগত্যা কাঠি লেবেনচুষা চুষি।

তানেহামের কথাগুলো শেষ দিকে আমার কানে ঠিক ভালো মতো গেল না, তার কারণ মাঝখানে তিনি বলেছেন— একটি বিশেষ ব্যাপারে তিনি আমার সাহায্যপ্রার্থী; আমি বড় ভাবিত হয়ে আছি সেই থেকে।

অবিলম্বে তিনি জামার জোড় থেকে হাত বের করে আমাকে করতল দেখিয়ে দিলেন। ভঙ্গিটার অর্থটা অনুধাবন করতে পারলাম না; বীথিপৃতে ষ্যনুমদের চালচলন আলাদা, সে এখন আমি জেনে গেছি। পরে অবশ্য তার সংলাপে অনুমান করলাম, ভঙ্গিটির অর্থ হচ্ছে— আমি কি আসন গ্রহণ করে তাকে বাধিত করব?

তার পেছনেই মর্মর পাথরের আসন দেখিয়ে তিনি বললেন, বসবেন না? আপনি আসন গ্রহণ করলেই আপনার প্রশ্নগুলোর উত্তর আমি একে একে দিয়ে যাব।

আমি পৃথিবীর চিরাচরিত ভঙ্গিতে দু হাত তুলে বললাম, দোহাই আপনার, আমাদের জন্যে এ বড় কষ্টকর। মুখ বুজে বসে আছি, আরেকজন ক্রমাগত বলেই যাচ্ছে, আমাদের তাতে পেট ফুলে ঢোল হয়। দয়া করে আমাকে প্রশ্ন করার সুযোগ দিন, আমি জানি আপনাদের বীথিতে প্রশ্ন করবার দরকার হয় না, কিন্তু আমার উদরের স্বাস্থ্যের জন্যে প্রশ্নটা করা খুবই জরুরি।

তানেহাম আমার সমুখে আসন গ্রহণ করে বললেন, বেশ, আপনি প্রশ্ন করুন, যদিও তা নিতান্তই অনাবশ্যক।

আপনি একটি বিশেষ সাহায্য প্রার্থনার কথা উল্লেখ করেছেন। সেটি কী?

আপাতত এর উত্তর দেব না। তানেহাম ঈষৎ রক্তাভ হয়ে বললেন, আপনাদের ঐ প্রশ্ন করবার রেওয়াজটির অসুবিধে কোথায় জানেন? কখন কোন প্রশ্ন করা উচিত, তা নির্ণয় করতে পারেন না। তবে, আপনি অতিথি এবং আমি আপনার সাহায্যপ্রার্থী, অতএব উপায় নেই। আপনি প্রশ্ন করে যান, প্রশ্ন যদি ধারাবহির্ভূত হয় উত্তর না দেবার অধিকার আমার রইল। হাঁ আপনার প্রশ্ন।

আমি ভালো বিপদে পড়লাম, যেটা গোড়াতেই আমার জানা দরকার সেটা নিয়ে প্রশ্ন করতে পারব না, তাহলে কেন প্রশ্ন করি? আর যে প্রশ্ন করব সেটাই যে তানেহামের বিবেচনায় ধারাবহির্ভূত হবে না, তারই বা নিশ্চয়তা কী? আমি তো তাঁর মতো বীথিপৃর ষ্যনুম নই যে বই পড়ার মতো অপরের মন পড়তে পাড়ি।

ইতস্তত করে গোড়া থেকেই শুরু করলাম।

আপনার যদি পৃথিবীর কোনো মানুষেরই সাহায্য নেবার দরকার ছিল তো এত জ্ঞানী গুণী থাকতে আমার কাছে কেন লোক অর্থাৎ ষ্যনুম পাঠালেন?

পরের প্রশ্ন!

অর্থাৎ এটিরও উত্তর তিনি এখন দেবেন না। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে আবার প্রশ্ন করলাম, পৃথিবীতে এত দেশ থাকতে আপনার নক্ষত্রযান বাংলাদেশেই নামালেন কেন?

পরের প্রশ্ন।

এটিও কি ধারাবহির্ভূত হয়ে গেল?

পরের প্রশ্ন।

আমার একমাত্র বাক্যটি কিন্তু ঠিক প্রশ্ন ছিল না। প্রশ্ন নাকচ হবার কারণে বিস্ময় প্রকাশ করছিলাম।

আপনারা এই আরেক মস্ত গোলমেলে ব্যাপার করে থাকেন। বিস্ময় প্রকাশ করতে প্রশ্নের আশ্রয় নেন। অর্থাৎ বিস্ময় সম্পর্কেও আপনারা পূর্ণ কোনো ধারণা রাখেন না। আমি না ক্ষেপে গিয়ে পারলাম না। বলেই ফেললাম, এতই যদি আপনার সমালোচনা আমাদের সম্পর্কে, তাহলে সাহায্যের জন্যে আমাদের দ্বারস্থ হয়েছেন যে?

তানেহাম স্মিত হয়ে বললেন, এ প্রশ্নের উত্তর আমি দেব। আপনাদের কিছু কিছু দুর্বলতাই আমার সাহায্য প্রার্থনার প্রসঙ্গ।

অর্থাৎ?

পরের প্রশ্ন।

আমি হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম, মহামান্য তানেহাম, আমি বাড়ি ফিরে যাবার জন্য বিশেষ ব্যাকুল, আপনার য্যনুমটি আমাকে বলেছে এক বিপলের মধ্যেই আমাকে জলেশ্বরীতে আমার পেছন বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে আসবে, সময় মতো ফিরে না গেলে আমার স্ত্রী বড় বিচলিত হয়ে পড়বেন, আমার ছোট মেয়ে গুলি এখন নিশ্চয়ই জিলিপির জন্যে কাঁদাকাটা শুরু করে দিয়েছে, আসবার পথে তাকে ডাকতেই সে জিলিপি খাবার বায়না ধরে ঘুম থেকে উঠেছিল। বুঝতেই পারছেন আমার মনের অবস্থা, আপনার জগতে তো কিছুই অজানা থাকে না। আপনি বরং নিজে থেকে নিজের মতো করে উত্তর দিয়ে যান, আমি মুখ বন্ধ রাখলাম। শুধু ঐ বিপলের মধ্যেই আমার ফিরে যাওয়াটা নিশ্চিত করবেন। অবশ্যই। বলে তানেহাম কাঠি লেবেনচুষ মুখে দিলেন।

আমাদের ঘিরে পূর্ণিমার আলোটি বেশ ছোট হয়ে এল ধীরে ধীরে, সমস্ত হলঘরের ভেতরে এখন আমরা দুটি প্রাণীই আলোকিত মাত্র এবং ভিন্ন দু সুর্যের দু গ্রহের মানুষ— তিনি সম্রাট, আর আমি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। তানেহাম মুখ থেকে লেবেনচুষ সরিয়ে বললেন, হাঁ, অবাক হবার কিছু নেই, একমাত্র শিক্ষকের কাছেই সম্রাটকে জানু পেতে বসতে হয়, যদিও সম্প্রতি শুনেছি যে পৃথিবীতে ভাবী সম্রাটতো দূরের কথা, ভাবী আর্দালিও শিক্ষককে উল্টো প্রহার করে। না, আপনার ও আমার সাক্ষাৎ মোটেই বিস্ময়কর নয়।

আমাদের এই গ্রহের পরিস্থিতি আপনাদের গ্রহ থেকে বিন্দু মাত্র ভিন্ন নয়, কেবল দুটি প্রসঙ্গ বাদে। এক, বীথিতে আমিই একমাত্র শক্তি, আপনাদের পৃথিবীতে একাধিক। দ্বিতীয় ভিন্নতা, আপনারা ধর্মে বিশ্বাস করেন, আমরা করি না। ধর্মকে আমরা একদা দুর্বলতা বলে ত্যাগ করেছিলাম— এখন দেখছি সেই দুর্বলতাটুকুই বড় শক্তি ছিল।

আমার সন্দেহ হলো, হয়ত আমাকে ডাকা হয়েছে কিছু দ্বীনি হেদায়েত করবার জন্যে। আমি অবাক হয়ে গেলাম; কারণ মনের কিছুই যদি এদের কাছে গোপন না থাকে তো এদের ভালো করেই জানবার কথা যে, ধর্মের আমি কিছুই জানি না, আল্লাহ গুনাহ মাফ করুন, নামাজটা পর্যন্ত ঠিক মতো পড়া হয়ে ওঠে না।

তানেহাম আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন, আপনার এ সংশয়ের অবসান এক্ষুণি হবে। আমাকে বলতে দিন। বীথিতে আমি একাই শক্তিমান, পুরো গ্রহই আমার সাম্রাজ্য, তাই বলে ভুলেও ভাববেন না যে, এখানে যুদ্ধ নেই, অস্ত্র ব্যবহার নেই, নির্যাতন নেই, আন্দোলন নেই। আপনাদের পৃথিবীতে যা যা আছে; এখানেও তাই আছে, বরং একা আমাকে সামাল দিতে হয় বলে, মাত্রাটা একটু বেশি প্রয়োগ করতে হয়। বাংলাদেশে শুনেছি একাত্তরের গণহত্যায় তিরিশ লাখ লোক মারা গেছে, কেউ কেউ অবশ্য পরে অনেক কমিয়ে বলে সংখ্যাটি, সে যাই হোক, আমার এখানে ওই পরশুদিনেই এক অভিযানে সাড়ে তিন কোটিকে বীথিপ্ লীলা থেকে মুক্তি দেওয়ার দরকার হয়ে পড়ল। আবার এরপর প্রতিক্রিয়া আছে। যত মরবে তত আন্দোলন হবে। বলতে গেলে আপনাদের পৃথিবীর তুলনায় এখানে তুমুল ব্যাপার। তবে আপনাদের একটা সুবিধে আছে। সব সময় মানুষ মেরে ঠাণ্ডা করবার দরকার হয় না। বস্তুত নির্বোধ শাসকরাই আপনাদের ওখানে হত্যা আর নির্যাতন চালায়। চালাক যারা তারা ধর্মকে ব্যবহার করে। পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়েও বহুগুণে ফলদায়ক এই জিনিসটি। ধর্মের দোহাই দিয়ে বলা যায়, জীবিত অবস্থায় স্বর্গ না পাও, মারা গেলে তো পাবেই, এত হা হুতাশ করছো কেন? ধর্মের দোহাই দিয়ে বুঝান যায়, এ সবই মায়া, বিশ্ব মায়া, তুমি মায়া, আমি মায়া; অতএব তোমার রক্তপাত হচ্ছে, এটিও মায়া, তুমি দরিদ্র, এও মায়া, তুমি নিচের তলায়, সেই অবস্থানটিও মায়া ভিন্ন আর কিছু নয়। জনাব আনসার আলী সাহেব; আমি অত্যন্ত খোলাখুলিভাবেই কথাগুলো বলছি; আমি আপনাকে যে সাহায্য করার কথা বলছিলাম তার সঙ্গে এই কথাগুলোরই যোগাযোগ রয়েছে।

আমি ভ্রূ তুললাম।

তানেহাম খুব চট করে লেবেনচুষের স্বাদ নিয়ে বলে চললেন, আমি আগেই বলেছি বীথিপৃর ষ্যনুমেরা ধর্ম ভুলে গেছে। রাজনৈতিক কারণে আমি তাদের ভেতরে ধর্মকে আবার ফিরিয়ে আনতে চাই। কীভাবে তা আনা যায়— বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, সমাজতত্ত্ববিদ, রাষ্ট্রবিদ ইত্যাদি বহু জনের সঙ্গে পরামর্শ করে আমি শুধু বিভ্রান্তই হয়েছি। কেউ বলেছেন, ধর্ম রক্তের ভেতরে থাকে। কেউ বলেছেন, ধর্ম মনের ভেতরে থাকে। কেউ বলেছেন, রক্ত ও নয়, মনও নয়, ধর্ম পকেটে থাকে। নানা জনের নানা মত শুনে আমি উত্যক্ত হয়ে নিজেই একটা পরীক্ষা করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। সেই পরীক্ষাটির জন্য আপনাকে প্রয়োজন। আমি কান খাড়া করে রইলাম। কোনো আঁচই এখনো পাওয়া যাচ্ছে না, এদিকে কথা ফেনিয়ে চলছে, আমার বিপল না আবার পার হয়ে যায়। চান বড় বড় অস্থির হয়ে পড়বে। তানেহাম বলতে লাগলেন, কিছু মনে করবেন না, আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটিতে জন্ম নিয়েছেন, আপনি প্রাইমারি ইস্কুলের শিক্ষক, এবং আপনি আপনার রোগব্যাধিগ্রস্ত, অনাহার ও অভাব পীড়িত পরিবারকে নিত্য আশার বাণী শোনান। এই তিনটি কারণের জন্যেই আমি পৃথিবীর যাবৎ মানুষের ভেতরে আপনাকে বেছে নিয়েছি। আপনি দরিদ্রতম একটি দেশের লোক বলে পৃথিবীতে আপনাদের কোনো কথাই কেউ বিশ্বাস করে না; অতএব ধরে নিয়েছি যে আপনি যদি ফিরে গিয়ে বলেন— বীথি পৃতে গিয়েছিলেন, ইউরোপ বা আমেরিকা হেসেই উড়িয়ে দেবে। শিল্প বলুন, সাহিত্য বলুন, অভিযান বলুন, কোনো ক্ষেত্রেই আপনাদের মতো দেশের সত্যিকার কোনো সাফল্যও তারা, অর্থাৎ পাশ্চাত্য জগতের লোকেরা, গণনায় আনে না : অতএব আপনার বীথিপৃতে আগমন অবিশ্বাস্য বলে চিহ্নিত হবে; এদিকে আমার কাজটি হাসিল হবে। ব্রহ্মাণ্ডে কেউ জানবেও না, বিশ্বাসও করবে না। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তি হিসেবে আপনি সৎ। কিছু মনে করবেন না, স‍ না হয়ে আপনার উপায় নেই। বিশ্বের দরিদ্রতম দেশের নিম্নতম বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের চেয়ে বাধ্যতামূলকভাবে সৎ আর কে? প্রাইমারি পাশ করে কারো কোনো লাভ নেই, তাই আপনাকে ঘুষ দিয়ে প্রশ্ন বের করে আনবার ব্যাপার নেই, সরকারি কোনো ব্যাপারে আপনার দেয়া সার্টিফিকেটের কোনো মূল্য নেই; অতএব আপনার সুপারিশ সংগ্রহের জন্যে কেউ আপনাকে টাকার লোভ দেখায় না। আপনার বিদ্যালয়ের সরকারি বরাদ্দও এত কম বা নেই যে তহবিল তছরুপেরও কোনো প্রশ্ন ওঠে না, ইত্যাদি কারণে এই মহাবিশ্বে আপনি এবং আপনার মতো সৎ ব্যক্তি আর নেই। আমি একজন সৎ ব্যক্তিরই সন্ধানে ছিলাম। তৃতীয়ত, আপনি আপনার পরিবারের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল, তাদের শুভাশুভের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে কিছুই করার সাধ্য আপনার নেই বলে আপনি তাদের অনরবত বলে থাকেন যে, আর দুটো দিন অপেক্ষা কর, ঈমানের জোরে পার হয়ে যাব এই বিপদ। এই তিন বিবেচনা করেই আপনাকে আমি বেছে নিয়েছি, নক্ষত্রযান পাঠিয়ে বীথিতে এনেছি। আমার পরীক্ষা কাজে আপনি সাহায্য করুন।

প্রশ্ন করবার দরকার নেই তবু পৃথিবীর মানুষ বলেই প্রশ্ন করে বসলাম, কী রকম সাহায্য? কী রকম পরীক্ষা?

সাহায্যটি আপনার পক্ষে সুখকরই হবে। অনুগ্রহণের মতোই ব্যাপারটি মানুষের কাছে খুব তৃপ্তিকর।

কিছুই বুঝতে পারছি না মহামান্য তানেহাম।

তানেহাম উঠে দাঁড়ালেন।

আমিও উঠে দাঁড়ালাম।

তানেহাম বললেন, আবার সেই হিস্ট্রি বইতে দেখা নেপোলিয়নের ভঙ্গি ধরে, আমি বিশ্বাস করি, ধর্মবোধ রক্তের ব্যাপার, রক্তের মাধ্যমেই এটা পিতা থেকে পুত্রে প্রবাহিত হয়ে যায়। আপনি লক্ষ করে দেখবেন, পৃথিবীর প্রধান প্রধান ধর্মগুলোর প্রতি প্রেরিত পুরুষেরা নিজ নিজ শাখায় পরস্পর আত্মীয়তাসূত্রে আবদ্ধ, কেউ এমন নেই যে আধ্যাত্মিক বংশতালিকা দাবি করেন নি। এ থেকেই আমি সিদ্ধান্ত করেছি, রক্তের অবশ্যই একটা ভূমিকা আছে বলে পৃথিবীতে আপনারা স্বীকার করেন। তাই যদি হয়, ধর্মহীন এই বীথিতে ধর্মবোধ সঞ্চারিত করতে হলে রক্তের মাধ্যম ছাড়া আর উপযুক্ত মাধ্যম কী হতে পারে। তবে এটা যেহেতু আমার এখনো অনুমান মাত্র, তাই আমি পরীক্ষা করে দেখতে চাই। আপনি সৎ, দরিদ্র এবং ধর্মে বিশ্বাসী, আপনাকে বীথিতে আনা হয়েছে আমার এই পরীক্ষাটি বাস্তবায়িত করার জন্য।

আমি বিমূঢ় হয়ে বললাম, তবু কিছুই আমার মাথায় ঢুকল না।

তানেহাম আবার ঈষৎ রক্তাভ হয়ে উঠলেন। বললেন, আহ্ পৃথিবীর মানুষদের নিয়ে এই এক অসুবিধে; তাদের যতক্ষণ না ভাষায় বলা হচ্ছে, মাথায় ঢুকছে না। সব কিছুই বানান করে বলে দিতে হয়।

রেগে গেলে পৃথিবীর আমরা লাল হয়ে যাই, আমার রং এক সময়ে বেশ ফর্সা ছিল, এখন সংসারের তাপে রঙটা পুড়ে গেলেও নলের ভেতরে বেশভুষা করার সময় যৌবন ফিরে পেয়েছি ক্ষণকালের জন্যে, বলা ভালো বিপলের জন্যে; আমার চেহারা যদি এখন রাগে লাল হয়ে যায়, বীথিপৃর এরা ধরে নেৰে যে আমি বিরক্ত হয়েছি, কারণ আগেই বলেছি, এদের বিরক্ত হবার রং লাল; আগের মতোই এখন আবার আমার আশঙ্কা হলো, আমাকে বিরক্ত দেখে যদি আর পৃথিবীতে ফেরত না পাঠায়? যদি আমাকে প্রাণেই মেরে ফেলে?

আমি জানি এ ধরনের আশঙ্কা একটু বাড়াবাড়ি মনে হবে, যে শুনবে তারই। কিন্তু ভুলে যাওয়া কি ঠিক, যে আমি তখন পৃথিবী থেকে ন’ হাজার আলোকবর্ষের দূরের এক গ্রহে? গ্রামের মানুষ ঢাকায় গিয়ে ভদ্রলোকদের বিরক্ত করতে সাহস পায় না, আমি তো পৃথিবী থেকে বীথিপৃতে। হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

তানেহাম তখন বললেন, আপনি অগ্রসর হয়ে পাশের ঘরে যান। আমার কিছু বলে দেবার আর দরকার হবে না।

পাশের ঘর বললেই তো আর পাশের ঘর নয়; বীথিপৃর ব্যাপার স্যাপারই আলাদা; পাশের ঘর অর্থ, একেবারে আমাদের খাঁটি সংস্কৃত শব্দের মতো, পাশ অর্থাৎ ফাঁদ বা জাল যেরূপ পাশবদ্ধ; একটা ফাঁদে গিয়ে পড়লাম।

নক্ষযানের সেই নলের মতো একটি নল, সেটাই ঘর, তবে ব্যাস কিছুটা বেশি, নক্ষত্রযানের মতোই এখানেও একটি বিছানা, আর সেই বিছানার ওপর কনুই ভর দিয়ে আধো শুয়ে আছে এক অনিন্দ্য সুন্দরী যুবতী। কাঁঠালিচাঁপার মতো গায়ের রং। জ্যোৎস্না রঙের পট্টবস্ত্র তার পায়ের কাছে লুটোচ্ছে। চোখের ভঙিতে পাখি উড়ল যেন।

নিমেষে আমার কাছে সব জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *