৭. কোরাসে হো হো হাসির শব্দ

আমাদের পেছনে কোরাসে হো হো হাসির শব্দে আমি চমকে ফিরে তাকালাম, আমার পাশে পরান মাস্টার নদীর দিকে, অন্ধকারের দিকেই তাকিয়ে রইল।

আমি দেখলাম কয়েকজন তরুণ কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বেজায় হেসে চলেছে। আমার কোনো সন্দেহ রইল না যে পরান মাস্টারই এই হাসির লক্ষ্য। কখন নিঃশব্দে তারা আমাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, আমরা কিছুই টের পাই নি।

ভেতরে ভেতরে আমি ক্ষিপ্ত হয়ে পড়লাম এবং উঠে দাঁড়িয়ে কিছু একটা প্রতিবাদ করতে যাব, পরান মাস্টার আমার হাত চেপে ধরল এবং আমার দিকে না তাকিয়ে, সেই নদীর দিকেই দৃষ্টি রেখে। আমি তো কোনো আভাস দিই নি যে, আমি এই মুহূর্তে ওই তরুণদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম, তবু পরান মাস্টার কী করে আমার মনোভাব আঁচ করতে পারল? এবং একটু আগেই শোনা বীথিপৃর ষ্যনুমের মতো?

আমি শীতল ও নির্বাপিত হয়ে গেলাম।

পেছনে তরুণদের সাড়া পাচ্ছি এখনো; এখন আর কোরাসে নয়; কেউ হাসছে কেউ কী একটা অসভ্য শব্দ উচ্চারণ করছে, কেউ প্রস্রাব করছে।

পরান মাস্টার আমার হাতের ওপর চাপ বজায় রেখেই ফিসফিস করে বলল, ওরা এখন অপেক্ষা করছে।

আমার গলা দিয়ে চাপা আর্ত প্রশ্ন বেরুল, কীসের অপেক্ষা করছে? এর উত্তর না দিয়ে পরান মাস্টার আবার ফিসফিস করে উঠল, ওরা নিজেরাই জানে না, ওরা কীসের ভেতরে আছে।

আমার অন্তর জুড়ে আশঙ্কা লেজ বুলিয়ে গেল। আমি প্রথম প্রশ্নটিই আবার উচ্চারণ করলাম দ্বিগুণ ব্যাকুলতার সঙ্গে, ওরা কীসের অপেক্ষা করছে, পরান ভাই?

না, পেছনে তাকাসনে। ওরা এখন আমাদের অপেক্ষা করছে। আমি যদি এখন মুখ ফিরিয়ে কিছু বলি, যাই বলি না কেন, ওরা গলা ফাটিয়ে হাসবে; আমি যদি ওদের ধাওয়া করি, ওরা আমার আগে-আগে ছুটবে আর হি হি করে হাসবে; আমি যদি গাল দেই, ওরা পাগল – পাগল বলে আমাকে ক্ষ্যাপাতে শুরু করবে।

বুঝলাম এরকম অভিজ্ঞতা পরান মাস্টারের বহুবার হয়েছে। কিন্তু সে ‘আমাদের’ শব্দটি ব্যবহার করেছে গোড়াতে; আমি এখন ভ্রূ কুঞ্চিত করে রইলাম।

পরান মাস্টার অচিরেই তার ব্যাখ্যা করল, এখন তুই যদি মুখ ফিরিয়ে ওদের দিকে তাকাস, ওরা তোকে ঠাট্টা করবে— তুই আমার কাহিনী শুনছিস বলে। তুই যদি ওদের ধমক দিস, তোকেও পাগল বলবে। আর যদি তাড়া করিস তো, সারা টাউন তোকেই ওরা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে, লোকে যেমন ন্যালা ক্ষ্যাপাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। চুপ করে বসে থাক। নড়িসনে, কথা বলিসনে, শ্বাস পর্যন্ত শব্দ করে নিবিনে, বুঝলি? একটু পরে নিজেরাই বিদায় হবে।

নদীর পাড়ে আধকোষার পানি ঝুপঝুপ করে আঘাত করে চলল, আমরা ঠায় বসে রইলাম, এবং সত্যি সত্যি তরুণেরা এক সময় বিদায় নিল।

পরান মাস্টার বলল, শুধু কি ওরা? টাউনের বুড়োরা পর্যন্ত আমাকে আজকাল বদ্ধ পাগল ঠাওরে বসে আছে। দু চারজন আবার ছেলেদের মতো ক্ষ্যাপায়, জানিস? অথচ দ্যাখ, তুই নিজেই বুঝতে পারছিস, আমার মাথা ঠিক আছে, আমার কথা এক বর্ণ মিথ্যে না, যা যা ঘটেছে অবিকল বলে যাচ্ছি। কই, তুই তো অবিশ্বাস করছিস না?

হঠাৎ আমার মাথায় একটি প্রশ্ন আসে।

পরান ভাই, আপনার বাড়িতে বিশ্বাস করে? ভাবি? ছেলেমেয়েরা? ওদের আপনি বলেন নি এসব?

অম্লান বদনে পরান মাস্টার উত্তর দিল, হাঁ বিশ্বাস করে। কিন্তু আমি ওদের খুব শক্ত করে বলে দিয়েছি, বাইরে যেন স্বীকার না করে যে তারা বিশ্বাস করে।

আমি একটা ধাঁধার ভেতর পড়ে গেলাম। জানতে চাইলাম, কেন? মানা করেছেন কেন, পরান ভাই?

এই জন্যে যে, তাহলে আর রক্ষা থাকবে না। টাউনের লোক বলবে, পরান মাস্টারের গুষ্টি শুদ্ধ পাগল হয়ে গেছে। বুঝতে পারছিস না? সে ভয়াবহ ব্যাপার।

ব্যাখ্যা শুনে আমি হাঁ হয়ে গেলাম। তার চেয়েও অবাক লাগছিল, তার বাড়ির সকলের কথা ভেবে, তারা কি কেউ স্বামী, কেউ পিতা মনে করেই বিশ্বাস করেছে?

প্রশ্ন করতে হলো না, বীথিপৃর সেই ষ্যনুমের মতো প্রশ্নটা অন্তরে অনুভব করেই পরান মাস্টার বলল, আমার বাড়ির লোক বিশ্বাস করবে না কেন? তারাতো প্রমাণ পেয়েছে, যাকে বলে চোখের প্ৰমাণ।

কী রকম?

আরে তোকে বলছিলাম না? নক্ষত্রযানের সেই নলের গায়ে ওদের ছবি দেখতে পেলাম, সব ঘুমে কাতর? বীথিপৃর সেই ব্যক্তিটি আমার মুখের ভাব দেখেই ঠিক ধরতে পেরেছ যে, আমার বড় কষ্ট হচ্ছে ওদের জন্য। মনে বোধহয় দয়াও হলো, আহা, একটা ভালো মানুষকে বলা নেই কয়া নেই এ রকম উঠিয়ে নিয়ে এলাম? সে আমাকে বলল, আমি যদি চাই, আমার পরিবারের সঙ্গে এক্ষুণি কথা বলতে পারি। আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকলে ব্যক্তিটি আমাকে বলল— আপনি নাম ধরে ডাকুন, ওরা উঠে পড়বে। ঠিক ভরসা হলো না, তবু ইতস্তত করে নাম ধরে ডাকলাম— চান বড়ু, ও দুলি, ও ফুলি, ও বাবা উজির, ও নাজির, ও গুলি মানিক। সবার নাম ধরেই ডাকলাম, বুঝলি? হাজার হোক, স্পেসের ভেতর দিয়ে ওদের নামটা তো ট্রান্সমিট হচ্ছে, স্বশরীরে আমার সঙ্গে বীথিপৃতে আসবার সৌভাগ্য না-ই হলো। সকলের আগে সাড়া কে দিল জানিস? আমার ছোট মেয়ে গুলি? সেই যে একাত্তরে গুলি গোলার সময় হয়েছিল বলে যার নাম রাখা হয়েছিল গুলি, সেই গুলি। আর সে মোচড় দিয়ে উঠেই আমাকে কী বলল, জানিস?

না, না তো। আমি যে কোনো বিস্ময়ের অপেক্ষা করছি।

গুলি উঠেই ঘুম ভাঙা গলায় বলল, বাবা, জিলিপি খাব।

আমি বোধহয় ছেলেমানুষের কাণ্ড শুনে একটু হেসে উঠেছিলাম মাথা পেছনে ঠেলে দিয়ে, চোখ ফিরিয়ে এনে দেখি জায়গার সমুখের পরান মাস্টার নেই। একেবারে হিম হয়ে গেলাম। একটা জলজ্যান্ত মানুষ চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই গায়েব। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নাম ধরে ডাকলাম, পরান ভাই, পরান ভাই। সাড়া পেলাম না, তবে কে একজন আমার পাশ থেকে খন খনে গলায় বলে উঠল, এই তো হনহন করে রাস্তায় ছুটলেন। রাস্তায় উঠে দেখি, সত্যিই তাই। ছুটে গিয়ে তাকে ধরলাম।

হঠাৎ উঠে এলেন যে?

মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেল রে। জিলিপি খেতে চেয়েছিল, এখনো এনে দিতে পারি নি। দেখি। দেখি। বলতে বলতে হাত মুচড়ে ছাড়িয়ে নিয়ে সে চলে গেল। আমি পাথর-কুচি বিছানো সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে রইলাম। সড়কের ওপারে অনেকখানি আকাশ, দুদিকে ফাঁকা মাঠ কি না সেই আকাশে কয়েকটা বড় বড় তারা টকটক করছে; আমার গায়ের ওপর দিয়ে নীলাভ একটি বাতাসের শীতলতা বয়ে গেল যেন।

সামলে নিতে একটু সময় লাগল। পরান মাস্টার পয়সা পাবে কোথায় যে গুলির জন্য জিলিপি নিয়ে যাবে? আমি আকাশের তারাগুলোকে মিটমিট করতে দেখলাম। আমি ইস্টিশানের মিষ্টির দোকানের দিকে অগ্রসর হলাম।

সেখানে সেই তরুণেরা বসে আছে; আমাকে দেখে নিজেদের ভেতরে কী বলাবলি করল তারা; আমি মুখ কঠিন করে অপেক্ষা করতে লাগলাম- এই হয়ত হো হো করে হেসে উঠবে ওরা, কিন্তু না, তার বদলে খুব সৌজন্য নিয়ে একজন আমাকে সম্বোধন করে বলল, এত সহজে ছাড়া পেলেন, ভাইয়া?

আমি মুখ ফিরিয়ে হাসলাম একটু।

আরেকজন জানতে চাইল, সবটা শুনেছেন।

আমার মনে পড়ে গেল যে, পরান মাস্টার বলেছিল— কাহিনীর সবটা এদের কাছে কিম্বা জলেশ্বরীর কারো কাছেই সে এ পর্যন্ত বলে নি। আমি জিগ্যেস করলাম পাল্টা, আপনারা শুনেছেন?

ও আর শোনাশুনির কী আছে? যা শুনেছি তাতেই বোঝা গেছে, মাথাটি একেবারে গিয়েছে। অচিরেই ওদের কাছ থেকে জানতে পারি যে, পরান মাস্টার স্কুলে বহুদিন ধরে বেতন পাচ্ছিল না, বড় অভাব যাচ্ছিল তার, কোনো রকমে দু একটি টিউশানির ওপর নির্ভর করে চলছিল, এর ভেতরে তার বড় মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়; জামাইয়ের জন্য একটা টু-ইন-ওয়ান চাই, বরপক্ষের দাবি; কোনো উপায় না দেখে বাড়ির পাশে দেড় বিঘা পতিত জায়গা ছিল সেটা বিক্রি করে টাকার যোগাড় হয়, মোট সাড়ে চার হাজার টাকা নিয়ে পরান মাস্টার রংপুরের উদ্দেশে রওয়ানা হয় এবং পথে তোরশা জংশনের গুণ্ডারা সম্পূর্ণ টাকা তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়। চায়ের দোকানের এই তরুণেরা মত প্রকাশ করে যে, তারপর থেকেই মাথার গোলমাল দেখা দিয়েছে তার। মেয়ের বিয়ে যথারীতি ভেঙে যায়, টু-ইন-ওয়ানের দেবার মতো মেয়ের বাপ এদেশে বহু আছে, এবং এদেশের বহু ছেলেই এখন মেয়ের চেয়ে টু- ইন-ওয়ানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে বেশি আগ্রহী। শেষ পর্যন্ত ইস্কুলের চাকরিটাও চলে যায় পরান মাস্টারের— সেও আজ বছর ঘুরে আসতে চলল।

দোকানির হাত থেকে জিলিপির ঠোঙাটা নিয়ে বেরিয়ে যাবার আগে তরুণদের বললাম, আর, এই রকম একটা লোককে নিয়ে আপনারা হাসতে পারেন।

আমার আশঙ্কা হয়েছিল, তিরস্কার শুনে তারা তেড়ে উঠবে; নদীর পাড়ে তাদের যে নিষ্ঠুরতার পরিচয় পেয়েছি, তাতে তাদের পক্ষে যা কিছু সম্ভব বলে আমি মনে করি। কিন্তু কী আশ্চর্য, তারা আমাকে কিছুই বলল না, সকলেই এক সঙ্গে চোখ নামিয়ে নিল, একজন কেবল মিনমিন করে বলল, সকলেই তো হাসে।

ওদের নির্বাপিত চেহারা দেখে আমি বেশ উৎসাহ পেলাম, রুষ্ট গলায় প্রশ্ন করলাম, সকলে হাসে মানে?

মানে, সকলেই। শহরের সবাই। ছেলে বুড়ো বৌ মেয়ে সকলেই।

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, না, আমার মনে হয় না সকলেই হাসে। আমার মনে হয় না, যারা অভাবে আছে তারা হাসে, যারা দুঃখের ভেতরে আছে তারা হাসে।

এক তরুণ বিদ্রোহ করে বলল, আপনি কচু জানেন। সকলেই হাসে। গরিবেরাই বেশি হাসে পরান মাস্টারকে দেখে।

অবাক হয়ে আমি দোকান থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

ইস্টিশান থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে মোড় নিয়ে সোজা মাইল খানেক গেলেই গোরস্তানের পাশে বাড়ি আমি জানি; পাথরের কুঁচি বিছানো প্রশস্ত সড়কের ওপর আকাশে তারাগুলো এখন তীব্ররশ্মি বিচ্ছুরণ করে চলেছে; দ্রুত পায়ে হেঁটে চলেছি, যেন সমস্ত শহরে অট্টহাসি আমাকে তাড়া করছে; আমি পরান মাস্টারের বাড়িতে এসে দাঁড়ালাম।

কীরে? তুই? তুই কোত্থেকে?

তার বিস্ময় দেখে মনে হলো, আমার সঙ্গে তার যে কিছুক্ষণ আগেই দেখা হয়েছে, আমরা যে নদীর পাড়ে একসঙ্গে এতক্ষণ বসেছিলাম, সে সব কিছুই নয়, বহু বছর পরে আবার এই প্রথম দেখা হলো।

আমি জিলিপির ঠোঙাটা তার হাতে তুলে দিলাম।

কী? এটা কী? অ্যা, এর মধ্যে কী?

জিলিপি।

জিলিপি? যেন বস্তুটির নাম তিনি আগে কখনোই শোনেন নি।

হাঁ, গুলির জন্যে, ছেলেমেয়েদের জন্য।

জিলিপি? আবারো অবিশ্বাসের প্রতিধ্বনি করে উঠল পরান মাস্টার; পরমুহূর্তেই হঠাৎ খ্যা খ্যা করে হেসে উঠল। সে হাসি আর থামতে চায় না। লোকটা দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে নাকি? আমি তার হাতে হাত রাখলাম শান্ত করবার জন্যে, সে আমার হাতখানা খপ করে কেড়ে নিয়ে ঝাঁকুনি দিতে দিতে বলতে লাগল, খেতে পাই না, খ্যা খ্যা, জিলিপি? ভাতের বদলে, খ্যা খ্যা জিলিপি? বলিস কীরে, হো হো, জিলিপি?

আমার চোখ দিয়ে টপ করে পানি পড়ল এক ফোঁটা, পড়বি পড়, পরান মাস্টারের হাতের ওপর।

সঙ্গে সঙ্গে সে হাত ছেড়ে আকাশের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, বিষ্টির ভেতরে জিলিপি নাকি রে? সেই ছেলেবেলার মতো? কোথায় বিষ্টি?

কী পাগলের মতো বলছো? বলেই জিভ কাটলাম আমি।

ততক্ষণে যা সর্বনাশ হবার হয়ে গেছে। পরান মাস্টার আমার হাতে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, পষ্ট বিষ্টির ফোঁটা পড়ল, আর তুই বলছিস আমি পাগল? দ্যাখ, এই দ্যাখ, আমার হাতের পিঠ এখনো ভেজা।

আমি বললাম, তাই তো, আমি লক্ষই করি নি। বড় অন্যায় হয়ে গেছে, পরান ভাই। সগর্বে পরান মাস্টার বলল, এই রকম কেউ লক্ষ করে না বলেই আমাকে পাগল বলে। শালা নিজেরাও জানে না যে, আগুনের ফোঁটা টপটপ করে পড়ছে।

বললাম, ঠোঙাটা আপনি বাড়ির ভেতরে দিয়ে আসুন তো। তারপর চলুন, দু ভাই বাজারে যাব।

কেন? বাজারে কেন? জানিস না, বাজারে আগুন।

আহ, আপনি চলেন না।

জিদ করে উঠল পরান মাস্টার, না তুই আমাকে বল, আগুনের ভেতরে আমাকে নিয়ে যেতে ‘চাইছিস কেন?

কেন আবার? আমি বাজার করব, ভাবি রান্না করবেন, সবাই মিলে খাব।

আবার খ্যা খ্যা করে হেসে উঠল পরান মাস্টার, আমার পেটে সংক্ষিপ্ত একটা খোঁচা দিয়ে বলল, তুই দেখছি সরকারের মতো ব্যবহার করছিস রে। পিটিশনের পর পিটিশন, কান্নাকাটি, পায়ে ধরা, অভাবের পাঁচালী, সাত কাহন হবার পর, সরকার দয়া করে অন্তর্বর্তীকালীন মঞ্জুরি দিলেন ছেয়াত্তর টাকা নব্বই পয়সা। আর দশটা পয়সা দিলেই একটা টাকা পুরো হয়, দেবেন না কেন? অডিটের ঝামেলা।

রাখেন তো আপনি, সরকার-টরকার যা ইচ্ছে করুক।

তাহলে তুই মুসলমানের মতো করছিস।

এ আবার কী?

বুঝলি না? মিসকিনকে দান করো। দান করলে পুণ্য হবে। মিসকিন না থাকলে তুই দানই বা করবি কোথায় আর পুণ্যই বা হাতে পাবি কী করে? অতএব, শালা মিসকিন বানাও, দুনিয়া জুড়ে মিসকিন পয়দা কর।

আমি আবার তাড়া দিয়ে বললাম, দেখুন পরান ভাই, রাত হয়ে যাচ্ছে। এখন বাজার না করলে, ‘রান্নাই বা হবে কখন, আর খাবই বা কখন! বলছি তো, আমি আজ আপনাদের সঙ্গে খাব। দু ভাই একসঙ্গে বসে অনেকদিন পর খাব।

খ্যা খ্যা খাবি বৈকি। একসঙ্গে মার খেতে পেরেছি, একসঙ্গে বসে আজ দুটো অন্ন মুখে দিতে পারব না? তোর মনে আছে? সেই যে, ডগস আর বার্কিং? কুকুরেরা ভৌ ভৌ করিতেছে? খ্যা খ্যা খ্যা। চল চল।

আরে, আপনি যে জিলিপির ঠোঙা হাতে না নিয়েই চললেন। ওটা বাড়ির ভেতরে দিয়ে আসুন।

তাইতো, তাইতো।

সে রাতে বাজার নিয়ে আসবার পর, ভাবি রান্না শুরু করেছে, আমি পরান মাস্টারের হাত টেনে বললাম, চলুন, কোথাও একটু বসিগে।

বাড়ির সম্মুখেই সড়কের ওপর পুরনো একটা কালভার্ট; চমৎকার চাঁদ উঠেছে; দূরে ডাক বাংলোর টিনের ছাদ রুপোর মতো ঝকঝক করছে, দুজনে গিয়ে কালভার্টের শানে বসলাম। রান্নার তো অনেক দেরি হবে, পরান ভাই।

আবার সেই খ্যা খ্যা করে হেসে উঠে পরান মাস্টার বলল, বুঝেছি, বুঝেছি, তারপর কী হলো জানবার জন্যে ছটফট করছিস তো? আর বলতে হবে না বুঝেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *