৬. জ্ঞান ফিরে আসা

জ্ঞান ফিরে আসাই হোক, আর ঘুম থেকে জেগে ওঠাই হোক, আমি চোখ মেলে তাকালাম। দেখতে পেলাম নীলাভ রঙের নিস্তেজ আলো আমার চারদিকে; সেই আলোয় আমি শুয়ে আছি সরু একটি বিছানায়; বিছানার চাদর জ্যোৎস্নার মতো ধবধবে শাদা ও দ্যুতিময়, স্পর্শের অনুভব— যেন শরৎকালের মেঘ। মেঘ কখনো হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি নি সত্যি, কিন্তু মেঘের অনুভব এ রকমই বলে আমার ধারণা হলো তখন।

চোখ মেলে তাকাবার সঙ্গে সঙ্গে নীলাভ আলোও যেন চোখ মেলে তাকাল; আলো উজ্জ্বলতর হলো। আমি আবিষ্কার করলাম আমার চারদিকে প্রচলিত অর্থে কোনো দেয়াল নেই, উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম নেই, একটি গোল নলের ভেতরে আমি শুয়ে আছি, নলটির মুখ কোথায় গিয়ে মিশেছে বা শেষ হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না, বিছানা থেকে নিচে যতটুকু দেখা যাচ্ছে, কোনো তল পাওয়া যাচ্ছে না; নলের দেয়াল মসৃণ, খুব পালিশ করা শাদা কোনো ধাতুর পাতের মতো, কোনো দরোজা জানালা নেই, আদৌ আমি এর ভেতরে স্থাপিত হলাম কোন পথে বুঝতে না পেরে এই প্রথম বিচলিত হয়ে পড়লাম। উঠে বসবার চেষ্টা নিতেই বাধা পেলাম; আমি যেন শয্যার সঙ্গে হাতে পায়ে আটকান; অথচ তাকিয়ে দেখি, কোনোকিছু দিয়ে আমাকে বাঁধা হয় নি। আমার মনে পড়ে গেল, সেদিন রাতে আমার বাড়ির পেছনে একবার এই রকম পক্ষাঘাত অনুভব করেছিলাম। হঠাৎ আমার সমুখে একটি শূন্যতা ঝিলমলি করে উঠল; পাশে এক হাত, লম্বায় হাত তিনেক একটি দীপ্তির শিহরণ; আমি অচিরেই সেখানে অবিকল আমাদেরই মতো এক মানুষকে নির্মিত হয়ে উঠতে দেখলাম। অবিকল; কেবল তার মুখের রং ঈষৎ নীলাভ।

আবির্ভূত হয়ে সে আমার দিকে স্মিত মুখে স্থির তাকিয়ে রইল।

আমি বিহ্বল চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

আমাদের দুজনের ভেতরে দিয়ে অতি ক্ষীণ স্রোতে সুম সুম জাতীয় একটি শব্দ অবিরাম প্রবাহিত হতে লাগল। যতক্ষণ সেই শব্দ উপস্থিত রইল, আমরা নীরব রইলাম; অচিরে শব্দ উধাও হয়ে গেল, ব্যক্তিটি বলল, ‘সংযোগ স্থাপিত হয়েছে, আপনাকে আরো একবার স্বাগত করছি।’ আমি এবার লক্ষ করলাম, যদিও তার কথা আমি বাংলাতেই শুনতে পেলাম, আর ঠোঁট ভিন্ন ভাষায় উচ্চারিত সংলাপের মতো নড়ছিল।

ঈষৎ বিস্ময় সত্ত্বেও আমি স্বাভাবিক কণ্ঠেই প্রশ্ন করলাম, আমি কোথায়? এবং আমি লক্ষ করলাম যে, প্রশ্নটি মনের মধ্যে বাংলা ভাষায় রচনা করলেও আমি অজ্ঞাত একটি ভাষায় তা উচ্চারণ করে বসেছি।

ঠিক এই ব্যাপারটিই আমার বাড়ির পেছনে একবার হয়েছিল, আমি যখন অন্তরাল থেকে কণ্ঠ শুনেছিলাম এবং প্রশ্ন করেছিলাম। এখন আমার আর কোনো সন্দেহ রইল না যে, আমরা কোনো এক আশ্চর্য পন্থায় আমাদের নিজ নিজ ভাষাকেই অপরের সুবিধার্থে অনুবাদ করে চলেছি সাবলীল ও তাৎক্ষণিকভাবে।

আপনি এখন নভোযানে রয়েছেন।

আমি তাহলে যাকে বিশাল একটি শোলা হ্যাট মনে করেছিলাম, আসলে তা নভোযান? আমি প্রশ্ন করলাম, আপনি কে?

আমি একজন ষ্যনুম।

ষ্যনুম?

হাঁ, বীথিপৃর অধিবাসী।

বীথিপৃ?

হাঁ, একটি গ্রহ। নুভা নামে একটি সূর্যের গ্রহ। সেই সূর্য আপনাদের সৌরজগৎ থেকে ন হাজার আলোকবর্ষ দূরত্বে অবস্থিত।

ব্যক্তিটি হাত তুলল এবং আমি তখন স্বচ্ছন্দে উঠে বসতে পারলাম। আমার ধারণা হলো, এতক্ষণ বন্দি ছিলাম, ব্যক্তিটি আমাকে মুক্ত করল। আমি প্রশ্ন করলাম, আমি কি বন্দি ছিলাম?

না। আমাদের নভোযান মহাশূন্যের কালিক মাত্রা ঝাঁপ দিয়ে পার হচ্ছিল, আপনার নিরাপত্তার জন্যেই আপনাকে শায়িত এবং স্থির রাখা হয়েছিল। আমরা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বীথিপৃতে অবতরণ করতে যাচ্ছি।

বলে কী?

আমি লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামলাম।

বীথিতে অবতরণ করতে যাচ্ছি মানে? আমরা এখন কি মহাশূন্যের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছি? পৃথিবী ছেড়ে এসেছি? কখন?

আমার ধারণা ছিল যে নভোযানটি এখনো আমার বাড়ির পেছনেই আমাদের ঝোপের ভেতর হামা দিয়ে আছে, আমি বাইরে পা বাড়ালেই আবার এক্ষুণি মাটি ছুঁতে পারব। ব্যক্তিটি আমার এতগুলো প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে বাঁ হাত ঈষৎ তুলল, সঙ্গে সঙ্গে নলের একটি অংশ স্বচ্ছ হয়ে গেল এবং আমি ঘোর কালো পটভূমিতে কোটি কোটি আলোকবিন্দু বিজ বিজ করছে দেখতে পেলাম। এত নক্ষত্র এর আগে আমি কখনো দেখি নি, আর আকাশ ও এমন জ্বলজ্বলে ভেলভেটের মতো গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ দেখি নি।

আমার বর্তমান পরিস্থিতি ভুলে গিয়ে আমি হতবাক হয়ে সেই জ্যোতিঃস্রোত দেখতে লাগলাম। অচিরে, অতি ধীরে নল অস্বচ্ছ হয়ে গেল, মহাবিশ্বের অবিশ্বাস্য সেই সৌন্দর্য অন্তর্হিত হয়ে গেল, কিন্তু তখনো আমার চোখ থেকে সম্পূর্ণ অপসৃত হয়ে গেল না। আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ষ্যনুমকে আমি নক্ষত্রখচিত বলে কিছুকাল বোধ করলাম, আগাগোড়া চুমকির কাজ করা একটি পোশাক সে পরে রয়েছে।

হাত দিয়ে অনুভব করে আমি আবার বিছানায় বসে পড়লাম।

আমার মনে এখন অনেকগুলো প্রশ্ন ছুটোছুটি করছে, পাল ভাঙা পিঁপড়ের মতো। কিন্তু কোনো প্রশ্নই আমাকে করতে হলো না, কোনো এক উপায়ে প্রশ্নগুলো অনুধাবন করে ব্যক্তিটি একের পর এক উত্তর দিয়ে চলল।

হে আমাদের সম্মানিত অতিথি, বিশিষ্ট মানব, নিবেদিতপ্রাণ স্কুল শিক্ষক জনাব মোহাম্মদ আনসার আলী, ওরফে পরান মাস্টার, আপনি এই মুহূর্তে আমাদের নভোযানে উপস্থিত। নভোযান সঠিক বর্ণনা নয়, কিন্তু আপনাদের ভাষায় নভোযান শব্দটি অধিক প্রচলিত বলেই ব্যবহার করলাম; অধিকতর সঙ্গত বটে নক্ষত্রযান বলা। অতঃপর নক্ষত্রযানই ব্যবহার করব। এই নক্ষত্রযান, আগেই যেমন বলেছি, বীথিপৃর।

আপনাদের পৃথিবীতে সবচেয়ে উন্নত প্রাণীর নাম মনুষ্য, আমাদের গ্রহে সবচে’ উন্নত প্রাণীর নাম ষ্যনুম? আপনার প্রশ্ন, ভিন্ন সূর্যের ভিন্ন গ্রহের উন্নত প্রাণী অবিকল আপনাদেরই মতো দেখতে, এটা কী করে হলো? তার উত্তর বড় জটিল ও দীর্ঘ। সংক্ষেপে এই মাত্র বলি যে, মহাপ্রকৃতির মতো এত ক্লান্তিকরভাবে পুনরাবৃত্তিকারক আর কেউ নয়। শিশু যেমন একবার বাংলা অক্ষর ‘দ’ এর পা টেনে লম্বা করে পাখি আঁকা যায় এটা আবিষ্কার করতে পারলে ঘরের যাবতীয় খাতাপত্তর, মেঝে, দেয়াল, উঠোন জুড়ে সেই পাখিই আঁকে, মহাপ্রকৃতির ব্যাপারটাও ঠিক সেই রকম। অবশ্য, এই লঘু উদাহরণই কোনো কথা নয়। আপনি লক্ষ করে দেখুন, ব্রহ্মাণ্ডের যেখানেই কোনো প্রাণীকে উন্নত হতে নয়, তার কতগুলো ব্যবহারিক সুবিধে শরীর ধারণ করতেই হয়। যেমন, তাকে চলাফেরা করতে হয়, অতএব পা দরকার, এবং পা শরীরের নিচে না হলে পায়ের কোনো উপযোগিতাই থাকে না। বলতে পারেন, সব উন্নত প্রাণীরই কি পা দুটো হবে? চারটে বা চারশ হতে বাধা কোথায়? আছে, বাধা আছে। দু’পায়ে চলাফেরার যান্ত্রিক দিকটা সরল এবং জটিলতামুক্ত। পায়ের হাঁটুতে ভাঁজ জরুরি, কারণ আপনাকে উঠতে হবে, নামতে হবে, বসতে হবে, দাঁড়াতে হবে, ছুটতে হবে— হাঁটুর ভাঁজ আপনাকে এসব ক্ষেত্রে চমৎকার সাহায্য করবে। আসুন হাতের কথায়, একই কারণে হাত দুটো হওয়াই সবচে’ সরল ও যুক্তিসম্মত; হাতের অবস্থান দেহের মধ্যভাগেই ব্রহ্মাণ্ডে সর্বত্র হবে; কারণ, হাত আপনাকে ওপরে তুলে কিছু পাড়তে হবে, আবার নিচু করে কিছু তুলতে হবে। চোখের কথা ধরুন, চোখ দুটো থাকতেই হবে, এক চোখেও দেখা যায়, আপনি তো জানেন বহু কানা ব্যক্তি এক চোখেই কাজ সারেন, কিন্তু দুটো থাকার সুবিধে এই যে, চোখের মতো অতি জরুরি জিনিস দুটো থাকলে একটি নষ্ট হলেও একেবারে অকেজো হয়ে পড়বেন না, আর, সবচে’ বড় কথা, চোখ দুটি থাকার ফলে আপনি বস্তুর তল বেধ ও ব্যাস এবং আপনার চোখ থেকে বস্তুটি কতদূরে অবস্থিত তা নির্ণয় করতে পারবেন। মস্তিষ্ক দেহের সবচেয়ে ওপরেই থাকতে হবে, এই কারণে যে, ওটাই সবচে’ নিরাপদ অবস্থান, একই কারণে মস্তিষ্ক করোটি বন্দি হতে হবে, এবং করোটিতে চোখ, নাক ও কান থাকবে এই জন্যে যে, দেহের সবচে’ উঁচুতে থেকে বহুদূর পর্যন্ত দেখতে পাবে, শুনতে পাবে, ঘ্রাণ পাবে। আগেই বলেছি, বিষয়টি অত্যন্ত দীর্ঘ ও জটিল, সামান্য আভাস দিলাম মাত্র, যাতে আপনি বুঝতে পারেন— কেন আমাদের শরীর, গড়ন ও অঙ্গ সংস্থাপন অবিকল আপনাদেরই মতো।

হাঁ, আপনার মনে প্রশ্ন জেগেছে, আমরা ন’ হাজার আলোকবর্ষ দূরত্বের গন্তব্যে যাচ্ছি, অথচ এত শিগগিরই কী করে সেখানে পৌঁছুচ্ছি? প্রথমত, সময় বলে আসলে কিছু নেই, সময় একটি ধারণামাত্র এবং সেই ধারণা পৃথিবীতে আপনাদের মনোগত, বীথিতে আমাদের মনোগত এবং এই ব্রহ্মাণ্ডে অন্যান্য যারা উন্নত প্রাণী রয়েছে তাদের প্রত্যেকের মনোগত এবং প্রত্যেকের সূর্য কক্ষপথ পরিক্রমা, দিবস ও রজনী, ইত্যাদির সঙ্গে সম্পর্কিত। আপনি যাকে এক প্রহর বলেন, আমার কাছে তা এক প্রহর নয়; এবং আমি যাকে এক রহস্র বলি আপনার কাছে তা এক রহপ্রের অনুরূপ সময় নয়। আপনাদের পৃথিবীর এক বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন বিষয়টা খানিক আঁচ করতে পেরেছিলেন, তবে পুরো অনুধাবন করার আগেই তিনি দেহত্যাগ করেন। আমার বিশ্বাস— তিনি, আপনাদের সময় হিসেবে আর দুশ বছর জীবিত থাকলে মহাশূন্যের কালিক মাত্রাটি শনাক্ত করতে পারতেন। এই কালিক মাত্রা যেমন সরল তেমনি জটিল। যে বোঝে সে পৃথিবীর অত্যাবশ্যকীয় তরল পদার্থ জলের মতোই বোঝে, যে বোঝে না তার করোটিতে পৃথিবীর মনুষ্য জাতির প্রথম উদ্ভাবিত হাতিয়ার সেই হাতুড়ি মারলেও বুঝবে না। আপনার কৌতূহল হচ্ছে এবং আপনি আমাদের সম্মানিত ও আমন্ত্রিত অতিথি, তাই সংক্ষেপে এইটুকুই বলি, যে, এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ডে কোনো কিছুই সরল অথবা ঋজু নয়; সমস্ত কিছুই সমস্ত কিছুকে যত ক্ষীণ বা প্রবলভাবেই হোক না কেন অনবরত আকর্ষণ করে থাকে, এবং এই আকর্ষণের ফলেই সমস্ত কিছুই সমস্ত কিছুর প্রতি অবনত, বস্তুতই একটি কাল্পনিক সরল রেখার তুলনায় প্রতিটি বস্তুই বঙ্কিম। এবং এই ব্রহ্মাণ্ডও বঙ্কিম। যেহেতু ব্রহ্মাণ্ড কল্পনা অবসন্নকারী বিশাল, তাই তার বঙ্কিমতাও বিকট। পৃথিবীতে আপনারা, বা বীথিপৃতে আমরা, কিম্বা কোটি কোটি অন্যান্য গ্রহে যেখানেই যে উন্নত প্রাণী আছে তারা যে দূরত্ব নির্ণয় করে থাকে তা ঐ কাল্পনিক সরল রৈখিক দূরত্ব। অথচ দূরত্বও বঙ্কিম। আমরা এই সত্যটি কিছুকাল আগে আবিষ্কার করেছি, অনুমান করি অচিরে পৃথিবীতে আপনারাও আবিষ্কার করবেন যে, কোনো কিছুই নিতান্ত আলঙ্কারিকভাবে উচ্চারণ করি নি; বস্তুত, নিঃশ্বাস হচ্ছে প্রাণ স্পন্দন এবং স্পন্দিত প্রাণই হচ্ছে দূরত্ব পরিমাপের একমাত্র একক, সে দূরত্ব স্থানিক হোক, কালিক হোক অথবা মনস্তাত্ত্বিক হোক। সে যাই হোক এরই জন্যে যে দূরত্ব হাজার আলোকবর্ষ বলে কাগজপত্রে হিসেবে বের হয়, সেই দূরত্ব আমরা নিঃশ্বাস পতনের ব্যবধানে অতিক্রম করে এসেছি।

আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে জলেশ্বরী থেকে বীথিতে তো এক নিঃশ্বাসেই পৌঁছে যাবার কথা, আপনার পৃথিবীর হিসেবে ঘণ্টা নয়েকের মতো সময় লাগছে কেন? তার উত্তর এই যে, পৃথিবীর আকর্ষণ ক্ষেত্রে পৃথিবীর কাল মানতে হয়, বীথিপৃর আকর্ষণ ক্ষেত্রে বীথিপৃর কাল; মধ্যবর্তী পথ এক নিঃশ্বাসে আমরা অতিক্রম করলেও পৃথিবী ত্যাগ করতে এবং বীথিতে প্রবেশ করতে কিছু সময় লাগে।

মাননীয় শিক্ষক সাহেব, আপনার কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন রয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় আপনি এই প্রশ্নগুলোর কারণে অত্যন্ত বিচলিত বোধ করতেন, আপনার হৃৎপিণ্ড বিদীর্ণ হয়ে মৃত্যু হওয়াও বিস্ময়কর ছিল না, কিন্তু আমরা আগেই তার ব্যবস্থা নিয়েছি, আপনার স্নায়ু শান্ত রয়েছে, অতএব আপনি নিজেকে পরিবারের প্রতি উদাস গৃহস্থ বলে ভাববেন না। আমরা এ সংবাদ রাখি, আপনি আপনার পরিবারকে এতটা ভালোবাসেন যে, খাদ্য সংস্থানে ক্রমাগত অপরাগ হয়ে আপনি একদা তাদের একত্রে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। আপনি তারপরও জীবিত আছেন পৃথিবীর মানুষের দুর্বল একটি ধারণার জন্যে; সেই ধারণাটি হচ্ছে কালিকে ধারণা, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের ধারণা, যা বস্তুত অমূলক সর্বাংশে; আপনি ভবিষ্যতের দিকে এখনো আশা করতে পারেন বলেই জীবিত আছেন, যদিও সেই ভবিষ্যৎ অতীত থেকে ভিন্ন বলে ভাববার কোনো যুক্তি সঙ্গত কারণই নেই।

সম্মানিত পরান মাস্টার, আপনার একটি প্রশ্ন— আপনাকে কি আমরা অপহরণ করেছি? না, তাহলে আপনাকে আমরা সম্মানিত ও আমন্ত্রিত অতিথির মর্যাদা দিতাম না। আপনার দ্বিতীয় প্রশ্ন আপনাকে তাহলে আমরা কেন বীথিতে নিয়ে যাচ্ছি? এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। আমার প্রতি কেবল এই নির্দেশ রয়েছে, আপনাকে জলেশ্বরী থেকে সংগ্রহ করে তানেহামের কাছে উপস্থিত করতে হবে।

তানেহাম? এতক্ষণ পরে আমি একটি প্রশ্ন করি, আমি একটু অবাকও হই যে, আমার মনের এত প্রশ্ন এই ব্যক্তি অনুমান করতে পেরেছে, আর এটি পারল না?

ব্যক্তিটি বোধহয় লজ্জিত হলো; তার মুখ ঝলক দিয়ে সবুজ হয়ে উঠল একবার, ঠিক যেভাবে আমরা অপ্রতিভ হলে রাঙা হয়ে যাই। ব্যক্তিটি ইতস্তত কণ্ঠে বলল, আমাদের গ্রহে তাঁর অস্তিত্ব, অবস্থান, বা বর্ণনা সম্পর্কে আমাদের মস্তিষ্কের স্মৃতিকোষ কোনো তথ্য ধারণ করতে অক্ষম; ফলত তার বিষয় কোনো প্রশ্ন হতে পারে, আমরা ধারণা করতে পারি না; আপনার প্রশ্নও তাই আমি অনুমান করতে পারি নি এবং প্রশ্নটা প্রকাশিত হবার পরও আপনার কৌতূহল মেটাতে পারছি না।

এরপর ব্যক্তিটি দ্রুত বলে যেতে লাগল, আপনার পরবর্তী প্রশ্ন, আপনাকে কি চিরতরে বীথিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? আপনি স্মরণ করবেন, আপনাকে অতিথি বলে সম্মোধন করেছি, অতিথি কখনো স্থায়ী বাসিন্দা হয় না। আপনি পৃথিবীতে ফিরে যাবেন। যেভাবে আপনাকে আনা হয়েছে সেভাবেই আপনাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। কবে? আপনি কি বীথিপৃর সময়ের হিসেব অনুভব করতে পারবেন? যদি বলি, তসা নদি, কী বুঝবেন? যদি বলি, সতা সমা, কী হিসেবে করবেন? আর যদি বলি, তসা রজাহা রসত্ব, তাহলে? না, আপনি আমাদের কাল মাত্রা অনুধাবন করতে পারবেন না। আমাকে বলা হয়েছে, আপনার মনে এই প্রশ্ন জাগবে, এবং তখন যেন আপনাকে আমি এই উত্তর দিই যে— পৃথিবীর হিসেবে আপনি এক বিপলের ভেতরেই আবার জলেশ্বরীতে ফিরে যাবেন, আপনি ফিরে গিয়ে দেখতে পাবেন, আপনার পেছনে বাড়ির যে ভাটুই ঘাসটি মাথা নত করেছিল আপনার হেঁটে যাবার সময় লুঙ্গির ধাক্কায় সেই ঘাস তখনো সম্পূর্ণ মাথা তুলে দাঁড়ায় নি। আমার ঠিক বোধগম্য হলো না। আমি প্রশ্ন করলাম, কিন্তু বিপলটা কী?

ব্যক্তিটি এবার সবুজ হয়ে গেল না; তার মুখ রক্তাভ হয়ে উঠল। বোধহয় ওদের ওটা বিরক্ত হবার রং। ব্যক্তিটি অচিরে সেই রং গোপন করে, স্বাভাবিক নীলাভ মুখ নিয়ে বলল, ওহো, আপনারা তো পাশ্চাত্যের কতগুলো হিসেব একেবারে আত্মস্থ করে বসে আছেন, নিজেদের অনেক কিছুই ভুলে গেছেন বহু আগে। বিপল হচ্ছে, আপনাদেরই পৃথিবীর বর্তমান প্রভু পাশ্চাত্য জগতের সময় পরিমাপের সেকেন্ড নামক এককের পাঁচভাগের দুভাগ পরিমাণ কাল।

এবার আমিই রাঙা হলাম। এবং আমার আশঙ্কা হলো ব্যক্তিটি না আমার অভিব্যক্তিকে বিরক্ত হবার অভিব্যক্তি বলে ধরে নেয়। ফলে, যদি কিছু মনে করে বসে, যদি শেষ পর্যন্ত আমাকে ঠিকঠাক আবার জলেশ্বরীতে পৌঁছে না দেয়, আমি বড় বিচলিত হয়ে পড়লাম। আমার বাড়ির কথা মনে পড়তে লাগল। চান বড়ুর মুখ ভেসে উঠল আমার চোখে। আমার ছেলেমেয়েরা ভিড় করে এল চারদিক থেকে। আমি ব্যাকুল হয়ে ব্যক্তিটির দিকে তাকালাম। ব্যক্তিটি ডান হাত ঈষৎ তুলে ধরল, এবং সঙ্গে সঙ্গে আমি নলের গায়ে আমার পরিবারের ছবি দেখতে পেলাম। তারা সবাই মেঝেতে অঘোর ঘুমে গড়াচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *