৫. বৌমা স্বয়ং এসে হাজির

তারপর?

পরান মাস্টার আমার হাঁটুতে চাপড় দিয়ে সোৎসাহে কী বলতে যাচ্ছিল, ভেতর থেকে আমার বৌমা স্বয়ং এসে হাজির হলো।

আজ আর খাওয়া দাওয়া হবে না, দাদা?

বুঝলাম, ধৈর্যশীলার বাঁধ ভেঙে গেছে; তার গলার স্বর লক্ষ করে টের পেলাম পাগলকে তিনি নিজেই তাড়িয়ে দেবার জন্যে পণ করে বেরিয়েছেন।

পরান মাস্টার আফসোস করে উঠল, এ হে হে, তোর খাওয়া হয় নি বুঝি? ছি ছি, কী কাণ্ড। আমি মনে করলাম, বিলেতের মানুষ, সন্ধে রাতেই ডিনার ফিনার করে রেডি; তাই তো রাত করে এলাম দেখা করতে। কী কাণ্ড! এখনো দেখি বাঙালিই রয়ে গেছিস।

বললাম, বিলেতে গেলেই কি আর বিলেতি হয়ে যায়, পরান ভাই?

তার উত্তর, অত্যন্ত গম্ভীরস্বরে, হয়, অনেকে হয়। অনেকে বিলেত না গিয়েও বিলেতি হয়। বৌমা বলল, মাস্টার সাব, আজ আপনি আসুন।

সরাসরি লোকটাকে এভাবে বিদায় দেওয়াটা আমার কাছে বড় আপত্তিকর মনে হলো প্রথমে, পর মুহূর্তেই বুঝতে পারলাম যে পাগলের সঙ্গে স্পষ্ট কথা বলাই দস্তর। বাংলাদেশে লোকে সুস্থ মানুষের সঙ্গে ইশারা ইঙ্গিতে কথা বলে— এটাই নিয়ম।

তবু আমি না বলে পারলাম না— আহা, বৌমা, উনিও বোধহয় খান নি, আবার সে বাড়ি যাবেন; খাবেন; আমাদের না হয় এক সঙ্গেই দুটি দিয়ে দাও। পরান ভাই, আপনি খেয়ে দেয়ে যান।

খাব? পরান মাস্টার ইতস্তত করল কিছুক্ষণ, তারপর হাত কচলাতে কচলাতে বৌমাকে বলল, তা বৌমা যখন খেতেই দেবে, আর একটু দয়া করো না? একটা কলাপাতা টাতা ও ধরে দাও, বাড়ি নিয়ে গিয়েই খাই। আমার দিকে ফিরে বলল, মাইন্ড করিস না। বলেই সে অপ্রতিভ হয়ে হাসতে লাগল আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে।

ভেতরে এসে বৌমাকে বললাম, দুটো বেশি করেই দিও। বৌমাকে আর বলে দিতে হবে না, সে জানে পরান মাস্টারের অবস্থা; তাকে একজনের খাবার দিয়ে বিদায় করা যায় না। নিঃশব্দ বিরক্তি নিয়ে বৌমা সব বেঁধেছেদে দিতে লাগল, আমি আশেপাশে অপরাধীর মতো পায়চারি করতে থাকলাম।

তারপর নিজেই গিয়ে পরান মাস্টারের হাতে তুলে দিল খাবার জড়ানো পাতার পোঁটলা। খাবার হাতে পেয়ে বড় আনন্দ তার দেখলাম। মুখে কিছুই না, কেবল হা হা করে বৌমার দিকে তাকিয়ে হাসল খানিক, তারপর ছুটে সড়কের অন্ধকারে নেমে গেল। বৌমাকে বললাম, খাবার পড়ে টড়ে না যায়। গামলায় দিলে পারতে।

গামলায় দিলে সে গামলা ফেরত আসবে? বৌমা ভেতরে চলে গেল।

অচিরে আমিও ভেতরে গেলাম। আমার ভাইটি পেশাগত একটা দরকারে আজই রংপুরে গেছে, আগামীকাল ফিরবে; অতএব তার জন্যে অপেক্ষা নেই, হাত ধুয়ে খেতে বসে গেলাম। চমৎকার রাঁধে আমার বৌমা। প্রশংসা করতেই সে লজ্জিত হয়ে হেসে বলল, দাদা অনেকদিন দেশী রান্না খান না তো, যা খাচ্ছেন ভালো লাগছে। তারপরই প্রসঙ্গ বদলে সে যোগ করল, দাদা, এরপর রাতে যদি মাস্টার আসে, আমি কিন্তু বলে দেব— আপনি বাসায় নেই।

কেন? আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করি।

আমার ভয় করে।

ভয়? কীসের ভয়?

ওর হাতের ঐ লাঠি। যদি মেরে টেরে বসে?

বৌমার আশঙ্কা শুনে আমি হো হো করে হেসে উঠলাম।

বৌমা, বলল, আমি তো ভেতরে ভয়ে কাঁটা হয়ে আছি। শেষে কিছু যদি হয়? লণ্ঠন পাঠিয়ে দিলাম।

ও, তাই?

বৌমা ভীত চোখ তুলে বলল, কিছু বিশ্বাস নেই, দাদা। ওর ওইসব গল্প কেউ বিশ্বাস না করলে হঠাৎ হঠাৎ ক্ষেপে যায়, লাঠি নিয়ে তাড়া করে। ও পাড়ার নানটুকে এমন বাড়ি মেরেছিল, হাত প্লাস্টার করতে হয়েছিল।

আমি গভীর হয়ে ভাতের গ্রাস মুখে তুললাম।

রাতে বিছানায় শুয়ে আমার মনে পড়ে গেল, গতরাতে স্বপ্ন দেখেছিলাম যে— পুরো জলেশ্বরীর লোক ছুটছে আর তাদের ধাওয়া করে নিয়ে যাচ্ছে লাঠি হাতে পরান মাস্টার। অথচ তখনো আমি শুনি নি যে, সে কাউকে সত্যি সত্যি মেরে বসেছে। আমি ঈষৎ কৌতূহল বোধ করে উঠলাম। ঘটনাটি শোনবার আগেই আমি তার আভাস স্বপ্নে পেয়ে গেলাম কী করে? কৌতূহলটি জটিল হয়ে পড়ল, যখন আরো স্মরণ হলো যে, পরান মাস্টারের মুখে তার বীথিপৃর যাবার গল্প শোনার আগেই আমি আমার স্বপ্নে দেখেছি আকাশে একটা অদৃশ্য পাটাতনে দাড়িয়ে আছি, নিচের দৃশ্য অনেক ওপর থেকে দেখছি, আর পরান মাস্টার আমাকে বলছে, নেমে আয়, নেমে আয়। এটাই বা কী করে হলো?

পরান মাস্টারের গল্প যতই গাঁজা হোক, শুনতে তখন মন্দ লাগে নি। গাঁজা তো অবশ্যই। কে বিশ্বাস করবে এ সব? জলেশ্বরীর তরুণদের দোষ দিতে পারলাম না; তবে, আমার মন ঠিক সায় দিল না যে পরান মাস্টার বদ্ধ পাগল। আমার ক্রমশই ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকল যে, হয় পরান মাস্টার সজ্ঞানে সমস্ত কিছু বানিয়ে বলছে, অথবা সে আমূল প্রত্যক্ষ করেছে। শব্দটা কি দুর্বোধ্য মনে হলো? ইংরেজিতে প্রকাশ করলে অবশ্য প্রাঞ্জল হবে— হ্যালুসিনেশন। অর্থাৎ তার মনের ভেতরে সে যা কল্পনা করেছে সেটাই চোখে দেখতে পেয়েছে, যদিও তার বাস্তব অস্তিত্ব কিছুই নেই।

এ রকম হয়, হয়ে থাকে। ইউরোপ আমেরিকার বহু লোক দাবি করেছে যে, তারা অন্যগ্রহের স্পেসশীপ দেখেছে, উড়ন্ত পিরীচ দেখেছে, উড়ন্ত চুরুট দেখেছে; খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বর্ণনা দিয়েছে, পরে খোঁজখবর নিয়ে দেখা গেছে যে তারা হ্যালুসিনেশন দেখেছে। অনেক সময় নৈসর্গিক কারণে ভ্রম হয় যে আকাশে অদ্ভুত কোনো যান উড়ছে যেমন মেঘ দেখে মনে হতে পারে, মেঘে দূরবর্তী কোনো আলোর প্রতিফলনের দরুন এটা মনে হতে পারে, অথবা আবহাওয়া বেলুনকে ভেসে যেতে দেখেও ধারণা হতে পারে যে স্পেসশীপ চলে যাচ্ছে। ইদানীং পাশ্চাত্য জগতে মহাশূন্য নিয়ে বহু কাহিনী চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে, সিনেমার পর্দায় জীবন্ত দেখান হচ্ছে অন্য গ্রহের প্রাণী, পরিবেশ, বিশাল ব্রহ্মাণ্ডে এক সৌরজগৎ থেকে অন্য সৌরজগতে যাত্রা। ডাক্তাররা বলছেন, এইসব চলচ্চিত্র দেখে সাধারণ মানুষ অনেকেই সত্যি বলে ধরে নিতে পারে এবং মনের কোনো সূক্ষ্ম হেরফেরে নিজেদের আশেপাশেই এ সব আবার অভিনীত হতে দেখতে পারে। হয়ত পরান মাস্টারের বেলায় তাই-ই হয়েছে। কিন্তু একটি প্রশ্ন থেকে যায়— পরান মাস্টার, তো সেসব চলচ্চিত্র দেখে নি? খেতে খেতে বৌমার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সে বলছিল, আজকাল টেলিভিশনে এ ধরনের ছবি দেখান হয়। জলেশ্বরীর পাবলিক লাইব্রেরিতে টেলিভিশন আছে, সেখানে অনেকেই গিয়ে ছবি দ্যাখে। পরান মাস্টার কি তাহলে টেলিভিশনের ছবি দেখেই হ্যালুসিনেশনে ভুগছে? কিন্তু আমি যদ্দুর জানি, পাশ্চাত্যের ডাক্তারেরা বলেন, টেলিভিশনের ছোট পর্দায়, এবং শাদা কালোতে, মহাশূন্যের যে ছবি দেখান হয়, তার প্রভাব আদৌ দর্শকের ওপর হয় না। সিনেমা হলের বড় পর্দায়, উন্নত ক্যামেরা লেন্সের সাহায্যে প্রায় ত্রিমাত্রিক গভীরতা এবং অরিশ্বাস্য রকমে উজ্জ্বল রং ও স্টিরিওফোনিক শব্দ প্রক্ষেপণের ফলে যে মায়া জগৎ রচিত হয়, দুর্বল ও কল্পনাপ্রবণ মনে তার প্রভাবই হয় মারাত্মক।

অতএব, পরান মাস্টার হ্যালুসিনেশনে যে ভুগবে, তার সূত্র কোথায়? মানুষ বিভ্রম দেখলেও তার বাস্তব একটা সূত্র থাকে। ভূতের গল্প লোক শোনে বলেই ভূত দেখতে পায়। অন্য গ্রহের স্পেসশীপ আর প্রাণী দেখেছে বলে শোনা যায় ইউরোপ আর আমেরিকাতেই, কারণ ওখানে এসব নিয়ে প্রচুর বই বেরোয়, চলচ্চিত্র তৈরি হয়। আজ পর্যন্ত শোনা যায় নি যে, এশিয়া বা আফ্রিকায় কেউ মানসিকভাবে অসুস্থ হয়েও বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের আগন্তকদের হ্যালুসিনেশন দেখেছে।

তাহলে, আর একটি সম্ভাবনাই হতে থাকে— পরান মাস্টার পুরো ব্যাপারটাই সজ্ঞানে বানিয়ে বলছে।

কেন? কী উদ্দেশ্য তার থাকতে পারে? মানুষ কেন কিছু বানিয়ে বলে? কোন পরিস্থিতিতে বানিয়ে বলে? মানুষ কিছু বানিয়ে বলে দু রকম পরিস্থিতিতে। এক, আত্মরক্ষা করতে। দুই, শ্রোতার প্রতিক্রিয়া দেখে মজা পেতে। যদি আত্মরক্ষার কথাটা ধরা যায়, পরান মাস্টার কীসের থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্যে কাল্পনিক উপখ্যানের সাহায্য নিচ্ছে? যদি মজা দেখাই তার উদ্দেশ্য হয়, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য পঁচিশ বছরের পুরনো একজন ইস্কুল শিক্ষক, পাঁচ সন্তানের পিতা, সমাজে আপন অবস্থান সম্পর্কে বিশেষ সচেতন, প্রায় বৃদ্ধ এক ভদ্রলোক এহেন ছেলেমানুষি করবেন একদিন ভোরবেলায় জেগে উঠে? আমি অস্বস্তিবোধ করতে থাকি। আমার ভালো করে ঘুম আসে না।

ভোর রাতের দিকে আমার ঘুম ভেঙে গেল। এবং ঘুম ভেঙেই প্রথম যে শব্দটি আমার মনে পড়ল, তা হচ্ছে— টেলিপ্যাথি। কোনোরকম যান্ত্রিক সাহায্য না নিয়ে, শুধু ইচ্ছাশক্তির জোরে নিজের বক্তব্য অপরের মনে পৌঁছে দেয়া, এবং সেই অপর ব্যক্তিটি নিকটেও হতে পারে, হাজার মাইল দূরেও হতে পারে, এমনকি পৃথিবীর অন্য প্রান্তেও থাকতে পারে।

সন্তানের বিপদে মায়ের যে ঘুম ভেঙে যায়, প্রিয়জনের মৃত্যু হয়েছে না জেনেও আমরা যে হঠাৎ তার শূন্যতা অনুভব করে উঠি অথবা তাকে বহুদূরে থেকেও এক ঝলকের জন্যে দেখতে পাই— টেলিপ্যাথির বলেই এ সবের ব্যাখ্যা দেয়া হয়। কাল রাতে পরান মাস্টার এই টেলিপ্যাথির কথাই বলছিল। সে বলছিল, বীথিপৃর ষ্যনুমেরা টেলিপ্যাথির সাহায্যে তাকে পরবর্তী রাতে তৈরি থাকবার নির্দেশ দিয়েছিল।

আমি বড় চঞ্চল হয়ে পড়ি।

স্বপ্নে আমি নিজেকে আকাশ পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে যে দেখেছি পরান মাস্টারের মহাশূন্যে যাত্রার কাহিনী শোনাবার আগেই, এটা কি টেলিপ্যাথি ছিল? পরান মাস্টারই টেলিপ্যাথি প্রয়োগ করেছিল আমার ওপর? মনে পড়ে গেল— সে তো আমাকে প্রথম সাক্ষাতেই বলেছিল, তুই বিশ্বাস করবি, আমি জানি। তারই জন্যে সে কি আমাকে এভাবে তৈরি করে রেখেছিল?

ভোরের অন্ধকার, অন্ধকার নয়; ভোরের আলো, আলোও নয়; আলো ও অন্ধকারের মিশ্রণও নয়; ভিন্ন একটি দীপ্তি। সেই দীপ্তি আমাকে নিঃশেষে গ্রাস করে ফেলে। আমি যেন স্পষ্ট বার্তা পাই, আধকোশা নদীর পাড়ে, অপরাহ্ণে।

কী সেখানে?

পরান মাস্টার আমাকে প্রথম সাক্ষাতেই মনে করিয়ে দিয়েছিল যে, একদা, সেই সুদূর অতীতে, ‘কুকুরগুলো ভৌ ভৌ করিবার’ পর আমি ও সে ফরিদ মাস্টারের হাতে মার খেয়ে নদীর পাড়ে বসে গুড়ের মহাজনী নৌকোগুলো দেখছিলাম।

অপরাহ্ণে আমি আধকোশা নদীর পাড়ে যাই। এবং সেখানে পরান মাস্টারকে দেখতে পাই। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ যেন আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল, সে আমাকে হাত ধরে টেনে পাশে বসিয়ে বলল, জ্ঞান হারাবার কথা শুনে ভয় পাস নে। জীবনে কখনো জ্ঞান হারিয়েছিস? তাহলে আর কী জানবি? জ্ঞান হারাবার সময় তোর মনে হবে, তুই হঠাৎ ঘুমিয়ে গেলি। শুনেছি, মানুষ যখন মারা যায় তখনো তার ঐ রকমই মনে হয়, সে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ছে, হঠাৎ বড় ঘুম পাচ্ছে তার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *