২. জলেশ্বরীতে ফিরে আসি

অনেকদিন পরে আবার আমি জলেশ্বরীতে ফিরে আসি; ব্যবধান শুধু দিনের নয়, ব্যবধান অভিজ্ঞতারও বটে; পুরো সাতটি বছর লন্ডনে কাটিয়ে, যে সাতটি বছরকে আমি ইউসুফের সেই স্বপ্নে দেখা সাতটি শীর্ণ গাভী এবং সাতটি শস্যহীন গমশীষের সঙ্গে তুলনা করে থাকি, আবার আমি ফিরে এসেছি আমার জলেশ্বরীতে।

এই সাত বছরে বদলে গেছে অনেক কিছুই, ভেতরের কথা ছেড়েই দিলাম, যা চোখে দেখা যায় তারই কথা বলছি; ঢাকার নতুন বিমানবন্দরে নামা থেকে শুরু করে ট্রেন ধরে উত্তরের দিকে যাত্রা করে, ফেরীতে শীর্ণ ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে, তোরশা জংশন হয়ে জলেশ্বরী পর্যন্ত কেবল বদলে যাওয়া দেখতে দেখতেই এসে পৌছুলাম; জলেশ্বরী ইস্টিশানও বদলে গেছে, সেই ছন ছাওয়া ঘরটি নেই, মরা লাল রং দেয়া টিনের চাল এখন, ইস্টিশানের বাইরে ফাঁকা মাঠ আর নেই, সারি সারি দোকান এখন, বুড়ো কদম গাছাটা উধাও, আমার আশঙ্কা হলো আমি নিজেও এত বদলে গেছি যে, আমাকে হয়ত এখানে কেউ আর চিনতে পারবে না আজ।

টিকিট দিয়ে বেরুবার পথেই হাত ধরে টান দিল পরান মাস্টার; যেন আমারই জন্যে সে ইস্টিশানের পেছনের বারান্দায় অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে ছিল।

হাত ধরে টান দিয়েই আমার নাম উচ্চারণ করে সে বলল, ঠিক ধরেছি না?

আমি তাকে চিনতে পেরেছি, তবু অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম। কারণ, পরান মাস্টার এখন দাড়ি রেখেছে, কিম্বা দাড়িই তাকে রেখেছে বলা ভালো, গ্রামে পাকা আধপাকা দাড়ি অযত্নে অবহেলায় বাড়তে বাড়তে এখন উদ্ধত হয়ে চারদিকে খাড়া হয়ে আছে গাল চিবুক জুড়ে। গায়ের হাফহাতা জামায় চিতে পড়েছে, হরেক রঙের তালি পড়েছে, পরনের লুঙ্গি ছেঁড়া ও ময়লা, পা খালি, হাতে একটি ছোট লাঠি। পরান মাস্টারকে শেষ যখন দেখেছিলাম, নিয়মিত দাড়ি কামাতে না পারলেও দাড়ি সে তখন রাখত না এবং দশ পনের দিনের বেড়ে ওঠা খোঁচা খোঁচা দাড়িতে সে অনবরত হাত বুলোেত, যেন সংস্কার করতে না পারবার জন্যে নীরব ক্ষমা প্রার্থনা করে চলেছে; তার গায়ের জামা সস্তা কাপড়ের হলেও সব সময় সে ধোয়া পরিষ্কার রাখত এবং লুঙ্গি বদলে মার্কিন কাপড়ের পাজামা দেখেছিলাম, পায়ে রবারের ডিঙি পাম্পু স্যু; আর, পথে কখনো জিগা গাছের কাঁচা ডাল ভাঙা লাঠি কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ল না।

আমাকে অবাক চোখে তাকাতে দেখে পরান মাস্টার বলল, দেখে পাগল মনে করছিস না? আমি লজ্জিত হয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, তা কেন? অনেকদিন পরে আপনাকে দেখলাম তো, তাই।

পরান মাস্টার আমার হাত আরো জোরে চেপে ধরে বলল, ঠিক বলছিস তো? পাগল মনে করিস নি?

না, না,।

বল, তুই বল, পাগল কেউ মানুষ চিনতে পারে?

না। আমি মাথা ঝাঁকায়ে বললাম।

পাগল কেউ অতীতের কথা মনে করতে পারে?

না।

তাহলে? আমি তো বেশ মনে করতে পারছি; বলব একটা কথা? পুরনো কথা?

বলুন না?

তোর দু ক্লাস উপরে পড়তাম।

মনে আছে।

একদিন তুই ফরিদ মাস্টারের ক্লাসে ‘ডগস আর বার্কিং’ কথাটার বাংলা বলতে পারিসি নি মনে আছে?

আমার ঠিক মনে পড়ল না, কিন্তু হতেও পারে তো; আমি হাসি মুখে পরান মাস্টারের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

পরান মাস্টার বলে চলল, ফরিদ মাস্টার পিটিয়ে তোর পাছা লাল করল?

আমি অপ্রতিভ হয়ে কাঁধ ঝাড়া দিয়ে উঠলাম।

পরান মাস্টার হা হা করে হেসে উঠে বলল, পাশের ক্লাসে আমি ছিলাম, বেড়ার ফাঁক দিয়ে সব দেখছিলাম, তার পর যেই আমি বললাম— কুকুরেরা ভৌ ভৌ করিতেছে— ফরিদ মাস্টার বাঘের মতো এসে আমাকে ক্লাস থেকে টেনে বের করে, তোকে আমাকে এক সঙ্গে আমলকির ডাল দিয়ে পেটাতে শুরু করল। মনে নেই? সেই থেকে তোর সঙ্গে আমার ভাব। সেদিন দুজনে নদীর পাড়ে বসে গুড়ের নৌকোগুলো দেখলাম সারা বিকেল। হে হে, আমি ভুলি নি, তুই ভুলে গেছিস। আমি কিচ্ছু ভুলি নি। পাগল কি এত পুরনো কথা মনে রাখতে পারে? তোকে দেখেই সব পরিষ্কার মনে পড়ে গেল। তুই-ই বল, আমি পাগল? আমি হেসে বললাম, কী যে বলেন। আমার মুখ থেকে ফসকে প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছিল, কী যে পাগলের মতো বলেন, পরান ভাই? সামলে নিয়ে তার হাত ধরে বললাম, কে বলল আপনি পাগল?

সঙ্গে সঙ্গে আমার হাত ছাড়িয়ে, হাতের লাঠি বাতাসে সপাং করে বাজিয়ে, সেই লাঠি দিয়ে দূরে দোকানগুলোর দিকে দেখিয়ে পরান মাস্টার বলল, ঐ ওরা বলে। আয় তুই আমার সঙ্গে অর্থে। তুই নিজেই শুনতে পাবি, ওরাই তোকে বলবে, আমি নাকি পাগল, আমার মাথা খারাপ।

আমাকে এতটুকু অবকাশ না দিয়ে পরান মাস্টার আমাকে টানতে টানতে নিয়ে যায় একটা মিস্টির দোকানে, সেখানে কতগুলো তরুণ বসে আড্ডা দিচ্ছিল, তাদের আমি চিনি না, হয়ত চেনাই, কিন্তু এই সাত বছরে তারা বালক থেকে যুবকে পরিণত হয়েছে বলে অচেনা ঠেকছে, তাদের সমুখে আমাকে ঠেলে দাঁড় করিয়ে দিয়ে পরান মাস্টার যেন টেক্কা দিয়ে বলে উঠল, এই যে ইয়াংম্যানেরা, আমার বাল্য বন্ধু, আপনাদের চেয়ে অনেক জ্ঞানীগুণী, অনেক দেখেছে, দুনিয়া চষে ফেলেছে, এর সামনে বলুন দেখি, আমি পাগল?

পরান মাস্টার অচিরে মাথা দুলিয়ে হাসতে হাসতে যোগ করল, আমার হিস্ট্রি শুনে আমাকে পাগল বলেন তো? এক বর্ণ বিশ্বাস করেন না? এই তো? আমার এই বাল্য বন্ধু হান্ড্রেড পার্সেন্ট বিশ্বাস করেছে শুনে, জানেন? সে আমাকে পাগল বলে নি।

আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। কখন কী হিস্ট্রি শুনলাম, আর কীসের ওপরই বা হান্ড্রেড পার্সেন্ট আমার বিশ্বাস হলো, কিছুই বুঝতে না পেরে আমি হা হয়ে গেলাম। আমার এই প্রথম সত্যি সত্যি সন্দেহ হলো যে পরান মাস্টারের মাথা আসলেই বিগড়ে গেছে।

তরুণদের একজন আমাকে প্রশ্ন করল, আপনি সব শুনেছেন?

আমি ঢোক গিললাম।

আরেকজন জানতে চাইল, সব বিশ্বাস করেছেন?

এবং আরেকজন আমার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে ঘোষণা করল, যদি বিশ্বাস করে থাকেন তাহলে আপনিও একটি পাগল।

তরুণেরা সঙ্গে সঙ্গে হেসে উঠল

আমি তখন প্রতিবাদ করে বলে উঠলাম, আমি এখনো কিছুই শুনি নি, উনি আমাকে কিছুই বলেন নি।

সঙ্গে সঙ্গে পরান মাস্টার আমার কাঁধ খামচে ধরে নিজের দিকে আমাকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ওহো হো, তোকে তো বলাই হয় নি। এই দ্যাখো, তুই তো এই মাত্র এসে নামলি। জানিস? এতজনকে বলেছি, এতবার বলেছি, যে আমার এখন মনেই থাকে না কাকে বলেছি, আর কাকে বলি নি। তুই এখন বাসায় যাবি তো? যা, খাওয়া দাওয়া করে রেস্ট নে, আমি ও বেলায় এসে তোকে সব বলব।

তরুণেরা আমার মুখভাব লক্ষ করতে থাকে কৌতুকভরা চোখে। আমি পরান মাস্টারকে বলি, আচ্ছা আচ্ছা, সে হবেখন। আমি আশা করি যে, দোকান থেকে আমারই সঙ্গে পরান মাস্টারও বেরুবে, কিন্তু না, পরান মাস্টার তরুণদের পাশেই বসে পড়ল যে।

আমি বেরিয়ে আসতে আসতে শুনলাম, পরান মাস্টার তরুণদের বলছে, এক কাপ চা খাওয়ান দেখি। পেছন ফিরে দেখি, পরান মাস্টার বেঞ্চের ওপর একটা পা তুলে হেলান দিয়ে বসেছে, আর এক তরুণ তাকে হাতের আধ খাওয়া সিগারেট দান করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *