কুন্তীর বস্ত্রহরণ

কুন্তীর বস্ত্রহরণ

এক

সেরাতে ‘মহাভারত’ পাঠের আসর বসেছে মালোপাড়ায়।

চাঁপাতলা গাঁয়ের একটেরে মালোপাড়টি। শ’খানেক মালোপরিবারের বসবাস এ পাড়ায়। ক’শ বছর ধরে এই চাঁপাতলা গাঁয়ে মালোরা বসবাস করছে, তার সঠিক সুলুকসন্ধান দিতে পারে না কেউ। এক এক জনের এক এক দাবি।

সুনীল সরকার বলে, ‘শ’তিনেক বছর তো হইবেই।’

অজয় মণ্ডল বলে, ‘কী যে কও না ভাইপো! কত যুগ যুগ ধইরে যে এই চাঁপাতলায় আমাদের পূর্বপুরুষরা বাস কইরে আইসছে, তার কোনো হিসেব-নিকেশ আছে! কম কইরে অইলেও তো পাঁচশ বছরের মালোকাহিনি এই পাড়ার আকাশে-বাতাসে। ওই যে বড় তেঁতুল গাছটা দেইখছ, বাবা বইলছিল ছোড়বেলায়, ওই গাছটা লাগাইছিল আমার বাপের দাদার দাদার দাদায়। তয়, আমার বয়স চাইর কুড়ি পুরাইল সেই দিন। ভাইবে দ্যাখ, এই পাড়ার বয়স কত হইল!’

অজয় মণ্ডল আবেগি মানুষ। বিয়েথা করেনি। প্রথম যৌবনে মাছ ধরত ভৈরব নদে। বয়স যৌবনের ওপারে গেলে গান-কীর্তনে ঝুঁকে পড়ল। কীর্তনীয়াদল নিয়ে এগাঁয়ে ওগাঁয়ে নামকীর্তন করে বেড়াত। তারপর তো বয়সটা চেপে ধরল অজয়কে। কীর্তন গাওয়া ছেড়ে দিল। মশগুল হলো ‘মহাভারত’ নিয়ে।

সন্ধ্যায় নিজ দাওয়ায় ‘মহাভারত’ খুলে বসত। গুন গুন করে কাশীরাম দাসের ‘মহাভারত’ পড়ত। সেই পাঠে এসে উপস্থিত হলো শান্তনু। শান্তনু সরকারের বয়স চল্লিশের আশেপাশে। বড় সুরেলা কণ্ঠ শান্তনুর। যেন কণ্ঠে সরস্বতী বসা! এক সন্ধ্যায়, অনেক মানুষের সামনে ‘মহাভারত’টা শান্তনুর দিকে ঠেলে দিয়ে অজয় মণ্ডল বলেছিল, “আইজ থেইকে ভাইপো তুই-ই পাঠ করবি ‘মহাভারত’। বড় অহংকার ছিল মনে। ভাবতাম—আমার মতো গাইয়ে নেই এই ভূমণ্ডলে। ভগবান তোরে পাঠায়ে আমার দর্প চূর্ণ কইরল। তোর মতো সুরদাসকে পাঠায়ে দিল আমাদের কাছে। আজ থেইকে এই আসরে তুই ‘মহাভারত’ পাঠ কইরবি আর আমি বুঝাইয়া দিব মানুষেরে।”

সেই সন্ধ্যা থেকে ‘মহাভারত’ পাঠ করে শান্তনু, ব্যাখ্যা করে অজয় মণ্ডল, মানে এ পাড়ার অজয় জেঠা।

আগে আগে অজয় মণ্ডলের দাওয়াতেই শুধু পাঠের আসর বসত। এখন তা ছড়িয়ে গেছে গোটা পাড়ায়। এক এক সন্ধ্যায় এক এক জনের বাড়িতে ‘মহাভারত’ পাঠ হয়। শ্রোতাও কম হয় না, এ আসরে। চাঁপাতলার মালোপাড়ায় এখন ‘মহাভারত’ পাঠ হয় ঘটা করে।

.

আজ ‘মহাভারত’ পাঠ হচ্ছে কুন্তীর উঠানে।

কুন্তীর বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশ। কুন্তীর স্বামীর নাম ভীষ্ম। মালোদের নাম পুরাণঘেঁষা। ‘রামায়ণ’-’মহাভারত’ তাদের নামের উৎস। গৌর, নিতাই, দ্বারকা, মথুরা, রাধা, যশোদা, বলরাম, কৃষ্ণ, উর্বশী, সুমিত্রা—এরকমই নাম রাখে তারা। তাই কুন্তীর স্বামীর নাম ভীষ্ম হওয়া খুব অবাক হবার ব্যাপার নয়। ‘মহাভারতে’র ভীষ্ম চিরকুমার। মালোভীষ্ম চিরকুমার নয়। বিয়ের বয়স হলে মালোভীষ্মের সঙ্গে কুন্তীর বিয়ে হয়।

ভীষ্মের ঘরে চার পুত্র। কুন্তী তার পুত্রদের নাম রেখেছে—যুধিষ্ঠির, অর্জুন, নকুল, সহদেব।

হাসতে হাসতে কুন্তী বলে, ‘আরেকটা ছাওয়াল অইলে নাম রাইখতাম ভীম।’

মথুরাবালা মুচকি হেসে বলে, ‘তোমারে মানা করে কে?’

কুন্তী হাসিকে চোখ পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়ে নিজের পেটের দিকে ইশারা করে বলে, ‘জমি ঠা ঠা অইয়ে গেছে। আর হওনর সুযোগ নাই।’

.

কুন্তীর বাপ ছিল পালাকার। দেশে দেশে রাবণ বধ, কর্ণকুন্তী সংবাদ, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু, ভীষ্মের শরশয্যা—এসব পালা গেয়ে বেড়াত কুন্তীর বাপ। বাপের রক্ত কুন্তীর শরীরে। ‘মহাভারতে’র কাহিনি তাকে হাসায়, কাঁদায়। কাহিনি শুনতে শুনতে তার মধ্যে কত শত প্রশ্ন জাগে! প্রশ্ন জাগলেই অজয় জেঠাকে জিজ্ঞেস করে। অজয় জেঠার উত্তরে কুন্তী সবসময় সন্তুষ্ট হয় না। অনেক অমীমাংসিত প্রশ্ন তার মনের মধ্যে গুমরে মরে।

কুন্তী অজয় জেঠার মহাভারত-আসরের নিয়মিত শ্রোতা। খুব বড় অসুখবিসুখ না করলে বা পারিবারিক কোনো কঠিন সমস্যায় না পড়লে, কুন্তী উপস্থিত থাকে প্রতিটি আসরে।

আজ শান্তনু পড়ছে ‘সভাপর্ব্ব’। গত কয়েকদিন ধরে বড় বেদনা শ্রোতাদের মনে। ক’দিন ধরে ‘সভাপর্ব্ব’ পাঠ চলছে আসরে। এই পর্বে মহাভারতের যত বেদনা, যত বিষাদ। এই পর্বেই মহাভারতের যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। শ্রোতারা গেল ক’দিন ধরে কুরুদের চালাকি, শকুনির ধূর্তামি, যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চপাণ্ডবের অসহায়তা আর নিষ্ক্রিয়তার কথা শুনেছে। ধর্মের যতই দোহাই দেওয়া হোক, বলা হোক নিয়মনীতির কথা, যুধিষ্ঠির যে একজন জুয়াড়ি এবং অদক্ষ জুয়াড়ি, সেটা অন্যরা না মানুক, কুন্তী মানে। যে অধ্যায়ে যুধিষ্ঠির অন্য চার ভাইসহ দ্রৌপদীকে বাজি ধরেন, সেই অধ্যায়েই, পাঠের মাঝখানে, কুন্তী বলে ওঠে, ‘যুধিষ্ঠির তো জুয়াড়ি! লজ্জাশরম নাই তার। থাকলে কী আর বউয়েরে বাজি ধরে!

সেরাতে শান্তনু পাঠ করছিল। জেঠা বুঝাচ্ছিল—যুধিষ্ঠির একে একে সব ভাইকে পাশায় হারালেন। তারপর নিজেকে বাজি ধরলেন। যুধিষ্ঠিরের মতিভ্রম হয়েছে। নইলে শকুনির চাল বুঝতে পারবেন না কেন? নিজেকে হারানোর পর শকুনি দ্রৌপদীকে বাজি ধরার জন্যে যুধিষ্ঠিরকে প্ররোচিত করল। প্রথমে দোনামনা করলেও শেষ পর্যন্ত দ্রৌপদীকে বাজি ধরলেন যুধিষ্ঠির। শান্তনু সুর করে পড়ছে—

এতেক শুনিয়া কহিলেন যুধিষ্ঠির।
পাশা ফেল আরবার সেই পণ স্থির ॥
এতেক শুনিয়া দুষ্ট পাশা ফেলাইল।
হাসিয়া শকুনি বলে জিনিল জিনিল ॥
শুনি কর্ণ দুর্যোধন হাসে খল খল।
মহা আনন্দিত কুরু-সোদর সকল ॥

কুন্তীর মন্তব্যের কোনো উত্তর দিতে পারেনি অজয় জেঠা, সে বেলায়। বড় কঠিন প্রশ্ন কুন্তীর, বড় যৌক্তিক জিজ্ঞাসা! আবেগমথিত হয়ে কুন্তীর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়। বলা যায়—যুধিষ্ঠির ধর্মপুত্র। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির কখনো ভুল করেন না। তিনি যা করেছেন—ধর্মানুকূলে থেকেই করেছেন। সেখানে কোনো প্রশ্ন করা যায় না।

কিন্তু কুন্তী তো বাস্তবতার নিরিখে উত্তরটা জানতে চেয়েছে! বাস্তবতা আর অন্ধ আবেগের মধ্যে বিস্তর ফারাক। কুন্তীর মন্তব্যকে মেনে নিলে ধর্মকে অপমান করা হয়, আর পুরাণকে মেনে নিলে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হয়। বড় দোটানায় পড়ে গেল অজয় মণ্ডল।

নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কুন্তী, তোমার প্রশ্ন বড়ই বাস্তব, বড়ই কঠিন। আজ তোমার এ প্রশ্নের উত্তর আমি দিব না। আর একদিন, অন্য কোনো আসরে তোমার মন্তব্যের উত্তর দিব আমি।’

দুই

ওখানেই সমাপ্ত হয়েছিল সেদিনের পাঠ

আবুল কাশেম চেঙ্গুটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। পাজামা-পাঞ্জাবি পরে আবুল কাশেম। সর্বদা টুপি রাখে মাথায়। গালিগালাজের সময় টুপি মাথা থেকে নামিয়ে নেয়। বলে, ‘টুপি মাথায় রেইখে শাসন করা যায় না। শাসন করার সময় তো আর মুখ দিয়া মিডা মিডা কথা বাইর অয় না!’

একাত্তরের রাজাকার এই আবুল কাশেম। এখন ধোয়া তুলসীপাতা। যুদ্ধের শেষদিকে গ্রাম থেকে পালিয়েছিল। পঁচাত্তরে হাওয়া বদলে গেল। রাজাকাররা দেশকর্তা হলো। আর দেশপ্রেমিকরা কোলাবরেটরের কলঙ্ক নিয়ে এলাকা ছাড়ল। ক্রমে ক্রমে আবুল কাশেম মাথা তুলল। পালিয়ে যাওয়া অথবা চুপ মেরে থাকা আলবদর আলশামসরা আবুল কাশেমের চারদিকে একটা বলয় তৈরি করল। আবুল কাশেম প্রথমে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার হলো। পরের বার চন্দ্রকান্ত চৌধুরীকে জানের ভয় দেখিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলো। সেই থেকে অনেক বারের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম। কেউ সাহস করে না, তার বিরুদ্ধে ইলেকশনে দাঁড়াতে। চেঙ্গুটিয়া ইউনিয়ন তার কথায় ওঠে, তার ইচ্ছেতেই বসে।

আবুল কাশেম চেয়ারম্যানের চোখ পড়েছে মালোদের শ্মশানের ওপর। ভৈরব নদের পাড়ে শ্মশানটি। বহু বহু বছর পূর্ব থেকে এখানে মালোরা দাহকার্য সম্পন্ন করে আসছে। বড় সুন্দর জায়গা! নানা ধরনের গাছ শ্মশান জুড়ে। সেগুন গাছই বেশি। গাছের দাম বর্তমান বাজারমূল্যে কোটি টাকার কাছাকাছি। চেয়ারম্যান চায়—ও জায়গায় একটা বাগানবাড়ি বানাতে। বিপুল গাছগাছড়ার মাঝখানে সুন্দর একটা চৌচালা বাগানবাড়ি। সামনে বিরাট উঠান। উঠানে নরম ঘাস। একটা পুকুরও কাটাবে আবুল কাশেম। পড়ন্ত বিকেলে পুকুরপাড়ে বসে তসবি পড়তে পড়তে মাছেদের খেলা দেখার বড় সাধ আবুল কাশেমের।

একদিন মালোপাড়ায় উপস্থিত হলো আবুল কাশেম। মালোদের ডেকে বলল, ‘দ্যাখ মালোর পো-রা। ওই জায়গাটা আমার খুব পছন্দ হইয়েছে। ওইখানে আমি একটা এবাদতখানা কইরব। মানুষ পোড়াবার জইন্য তো অত বড় জায়গার দরকার নাই! আমি তোমাদের জইন্য একটা শ্মশানখানা গইড়ে দিচ্ছি। দেয়ালও কইরে দিমু চাইরদিকে। কাছে তো নদী থাইকবেই। কী বলো মালোর পুতরা, রাজি তো তোমরা?’

অজয় মণ্ডল, শান্তনু, সুধাংশু, দুলাল বিশ্বাসরা চুপ করে থাকে। ওরাই মালোপাড়ার মাথা। মাথাদের মাথা হেঁট দেখে আবুল কাশেমের জোশ বেড়ে যায়।

বলে, ‘চুপ থাইকো না তোমরা। ভাবাভাবির দরকার নাই। যা বইলেছি রাজি অইয়া যাও। লাভ ছাড়া লোকসান অইব না তোমাদের।’

হঠাৎ করে ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে আসে কুন্তী। সামান্য ঘোমটা টেনে বলে, ‘এ কী কইতাছেন চেয়ারম্যান সাব! পুস্তপুরুষের শ্মশান আমাদের! আমাদের বাপ-দাদা, তাদের মা-বাপ, কত শত আত্মীয়স্বজনের স্মৃতি জড়াইয়া আছে ওই শ্মশানের লগে! আপনি কী কইরে বলেন ওই শ্মশান ছেইড়ে দিতে!’

আবুল কাশেম ভ্যাবাচেকা খায়। কেউ, বিশেষ করে কোনো নারী তার প্রস্তাবের বিরোধিতা করবে, আশা করেনি আবুল কাশেম। চোখের কোনা জ্বলে ওঠে তার। তবে তা সামান্য সময়ের জন্যে। নিজেকে সামলে নিয়ে পাশে দাঁড়ানো ফখরে আলমের দিকে তাকায়।

ফখরে আলম কাশেমের পদলেহি। ভীষণ বুদ্ধি রাখে সে। বড় বড় সংকটে এই ফখরে আলমের বুদ্ধিতে পার পেয়ে গেছে আবুল কাশেম। ফখরে আলম যেন ‘মহাভারতে’র শকুনি! শকুনি যেমন সর্বদা দুর্যোধনের পাশে পাশে থেকে কুবুদ্ধি জোগাত, ফখরে আলমও আবুল কাশেমের সঙ্গে সঙ্গে থেকে বুদ্ধি আর কুবুদ্ধি জোগায়।

ফখরে আলম বলে ওঠে, ‘ভীষ্মের বউ কুন্তী হুজুর।

তারপর চাপা স্বরে বলে, ‘মালোপাড়ার জয়নাব হুজুর। বাচ্চাকাচ্চা অইলে কী অইবে, দেইখতে কচি ডাব হুজুর। ‘

তার পর গলা উঁচু করে বলে, ‘এই পাড়ার মালোরা কুন্তীরে বড় মানে হুজুর।’

যা বোঝার আবুল কাশেম বুঝে গেল। কণ্ঠকে একেবারে খাদে নামিয়ে বলল, ‘দ্যাখ বেটি, যদিও পুরুষ থাইকতে মাইয়া মাইনষের লগে কথা কওয়া আমি পছন্দ করি না, তারপরও শুইনলাম—তোমারে এপাড়ার মালোরা ভক্তি শ্রদ্ধা করে, তাদের শ্রদ্ধায় আস্থা রাইখাই বইলছি—তোমাদের শ্মশানটা অতি জংলা, সাপখোপের আস্তানা। এখানে ওখানে জলজলা। একপাশে নদীভাঙন। বলি কী, ইটার পরিবর্তে বাঁধানোশ্মশান বানাইয়া দিব তোমাদের।’

‘দরকার নাই আমাদের বাঁধানো শ্মশানের! পূর্বপুরুষের শ্মশান আমাদের মাথায় থাক। ওই শ্মশানের দিকে কুনজর দিবেন না চেয়ারম্যান সাব।’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল কুন্তী।

অবাক বিস্ময়ে চোখ বেরিয়ে আসতে চাইছে আবুল কাশেমের। কী বলবে কিছুই ঠিক করতে পারছে না সে!

পাশ থেকে ফখরে আলম চাপা স্বরে বলল, ‘সাবধান হুজুর, মাথা গরম কইরবেন না। যা বইলবেন ঠান্ডা মাথায় বইলবেন।

এই সময় মালোদের মধ্যথেকে আওয়াজ উঠল, ‘কুন্তী ঠিক বইলেছে চেয়ারম্যান সাব। ওইটা আমাদের পবিত্র জায়গা। ওইটার দিকে চোখ দিবেন না।

মিষ্টি হেসে আবুল কাশেম বলল, ‘তোমাদের পালস বুঝি আমি। দ্যাখ, মানুষ ভালাই চায়। একটা খারাপকে ছেইড়ে একটা খুব ভালারে পাইতে তোমাদের আপত্তি ক্যান বুইঝলাম না! আর তুমিও মাইয়া, এতগুলা পুরুষ থাইকতে তুমিও ক্যান যে মাঝখানে কথা বইলতে গেলা, বুইঝতে পাইরলাম না!’ কুন্তীর দিকে চোখ রেখে কথা শেষ করল চেয়ারম্যান।

‘ওরে ধমকাইবেন না চেয়ারম্যান সাব। কুন্তী মাসি আমাদের মনের কথাই বইলেছে!’ সুনীল সরকার ভিড় থেকে বলে উঠল।

‘শোনো মালোর পুত। যতই হই চই কর, তোমাদের হাঁড়ির খবর রাখি আমি। এই যে মালোপাড়ায় তোমরা বসবাস কইরতেছ, বাস্তুভিডার কোনো দলিল-দস্তাবেজ আছেনি তোমাদের কাছে? নাই। শ্মশানের দলিলের কথা নাই-বা বইল্লাম।’

তারপর মাথা থেকে টুপিটা খুলে নিল আবুল কাশেম। সমবেত জেলেদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওই ভূমি আমার। আমার বাবায় একসময় জমিদার নগেনবাবুর কাছ থেইকে কিন্যা নিছিল ওই শ্মশানটা। দলিল আছে আমার কাছে। তোমাদের চার মাস সময় দিয়া গেলাম। ওই জায়গা ছাইড়বে তোমরা। আর হ্যাঁ, আজ থেইকে কোনো মড়া পোড়াইবে না তোমরা ওইখানে।’

কথা শেষ করে পেছন ফিরল আবুল কাশেম। তার পেছনে ফখরে আলম। ফখরে আলমের পেছন পেছন সাঙ্গাতরা।

দল থেকে দু’কদম এগিয়ে তৌহিদ জিজ্ঞেস করে, ‘ফখরে ভাই, এই যে চেয়ারম্যান সাহেব কইলেন, ওনার বাবা জমিদারবাবুর কাছ থেইকে শ্মশানডা কিইনে নিছেন, কথাটা সইত্য নাকি? বাপের কাছে শুইনেছি— চেয়ারম্যানের বাবা নাকি কামলাগিরি কইরত বেলেডাঙ্গার শ্যামসুন্দরবাবুর জমিতে।’

‘খবরদার হারামির বাইচ্চা! আর একটা কথা বইলছস তো জিহ্বা বাইর কইরা নিমু। না-ও কিনে যদি, কিনতে কতক্ষণ রে হারামজাদা! দ্যাশ আমাদের। সামনের ইলেকশনে আমাদের দলই ক্ষেমতায় আইবো। দলিল বানাইতে কতক্ষণ লাগে রে হালারপোত!’ ফখরে আলম গর্জে ওঠে।

ফখরে আলমের গলা শুনে আবুল কাশেম পেছন ফিরে। জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।

ফখরে আলম বলে ওঠে, ‘ও কিছু না হুজুর। তৌহিদ্যার এলেম কম তারে এলেম দিচ্ছিলাম। গলাটা উঁচু অইয়ে গেল একটু। মাফ করেন হুজুর।’

আবুল কাশেম মুচকি হাসে। হাঁটতে হাঁটতে দুজনের কথা শুনেছে সে। ফখরে আলমের কথা শুনে দিল খুশ হয়ে গেল তার। ফখরের উপস্থিত বুদ্ধি অতি চমৎকার। এজন্য পছন্দ করে সে ফখরে আলমকে।

তিন

তাঁরা তিন ভাই—ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং বিদুর। তিনজনই অবৈধ সন্তান। কিন্তু রাজমাতা সত্যবতী কর্তৃক স্বীকৃত। পিতা একজন—মহাভারতরচয়িতা কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস। ধৃতরাষ্ট্র আর পাণ্ডু রাজবধূর গর্ভে জন্মালেও বিদুরের মা দাসী। রাজসভায় তাই বিদুর অবহেলিত। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ, পাণ্ডু প্ৰজনন ক্ষমতারহিত।

ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্র। পাণ্ডুর পাঁচ। এই পাঁচজনের জন্ম আবার পাণ্ডুর ঔরসে নয়। পাণ্ডুর পুত্রদের পাণ্ডব বলা হয়। ধৃতরাষ্ট্রের শাসনে থাকলে কী হবে—রাজ্যাধিকার পাণ্ডবদেরও আছে। ধৃতরাষ্ট্র পুত্রান্ধ। জ্যেষ্ঠপুত্র দুর্যোধনের ধমকানিতে সবার বড় হওয়া সত্ত্বেও পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজ করতে অস্বীকৃতি জানালেন ধৃতরাষ্ট্র। ইন্ধন জোগাল শকুনি।

পাণ্ডুর মৃত্যু হয়েছে অনেক আগে। পাণ্ডবরা যৌবনপ্রাপ্ত হলে রাজ্যাধিকার চাইলেন। পাঁচখানি গ্রাম দিতেও রাজি হলেন না ধৃতরাষ্ট্র। উপরন্তু ধনে-প্রাণে নিঃস্ব করতে চাইলেন পাণ্ডবদের। এ কাজে প্রধান ভূমিকা রাখল দুর্যোধন। শকুনির প্ররোচনায় পাশাখেলার আয়োজন করা হলো। রাজসভায় আনা হলো পঞ্চপাণ্ডবকে। কুযুক্তি ও কূট ভাষার মারপ্যাচে যুধিষ্ঠিরকে পাশাখেলায় মগ্ন করানো হলো।

খেলায় দক্ষ ছিলেন না যুধিষ্ঠির। শকুনি পাশাবিদ। তার চালে যুধিষ্ঠির একে একে ধন, রাজ্য, হর্ম্য—সবই হারালেন। বাকি থাকলেন স্বয়ং তিনি, অন্য চার ভাই এবং স্ত্রী দ্রৌপদী।

শকুনি জিজ্ঞেস করল, ‘অতঃপর কীসের পণ করবে ভাগনে?’

যুধিষ্ঠির বললেন, ‘ভাইদের অঙ্গে যত অলঙ্কার আছে, তা সবের পণ করলাম।’

পাশার চালে শকুনি তাও জিতে নিল। ক্রূর হাসি ছড়িয়ে পড়ল দুর্যোধন ও অন্যান্য কুরুভ্রাতার মুখে।

শকুনি বলল, ‘অতঃপর?’

‘আমার কাছে পণ করার মতো আর কিছুই নেই।’ করুণ কণ্ঠে যুধিষ্ঠির বললেন।

‘আছে, আছে তো ভাগনে! তোমার ভাইয়েরা আছে না!’ শকুনি ত্বরিত বলল।

তারপর যুধিষ্ঠির একে একে ভাইদের পণ ধরলেন। হারলেন। তারপর নিজকে পণ ধরলেন। পাশাখেলায় নিজেকে হারিয়ে চার ভাইসহ কুরুবংশের দাসে পরিণত হলেন।

কর্ণ উচ্চৈঃস্বরে হেসে বলল, ‘এবার কাকে পণ করবে যুধিষ্ঠির?’

দুর্যোধন বলল, ‘কী যে বলো না মিত্র! দ্রৌপদীর মতো সুন্দর স্ত্রী থাকতে জ্যেষ্ঠের আবার চিন্তা কীসের! এবার নিশ্চয়ই জ্যেষ্ঠভ্রাতা দ্রৌপদীকে বাজি ধরবেন।’

এই সময় শকুনি বলে উঠল, ‘ভাগনে দুর্যোধন, তোমার মতিভ্রম হয়েছে। রূপেতে লক্ষ্মীর সম যাহার বর্ণনা/ অসংখ্য যাহার গুণ না হয় গণনা—সেরকমের দ্রৌপদীকে যুধিষ্ঠির কখনো পণ করবে না। আর যদি দ্রৌপদীকে বাজি ধরেও-বা আমাদের পরাজয় নিশ্চিত। কারণ দ্রৌপদী কখনো হারানোর নয়।’

যুধিষ্ঠির বুদ্ধি হারালেন। দ্রৌপদীকে বাজি ধরলেন। শকুনির কূটচালে দ্রৌপদীকেও হারালেন যুধিষ্ঠির।

দুর্যোধন প্রতিকামী পাঠাল দ্রৌপদীকে আনবার জন্যে।

দ্রৌপদী তখন ইন্দ্রপ্রস্থে। ইন্দ্রপ্রস্থ পাণ্ডবদের রাজধানী। প্রতিকামী ইন্দ্রপ্রস্থে গিয়ে দ্রৌপদীকে সভাস্থলে নিয়ে এলো।

দুর্যোধন দ্রৌপদীর রূপে বিভোর। কামাগ্নিতে তার ভেতরটা পুড়ছে তখন। ভাই দুঃশাসনকে বলল, ‘নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে আছো কেন দুঃশাসন? বিবস্ত্র করো দ্রৌপদীকে। নয়নের সুখ মিটাই।

তারপর জানুর বস্ত্র উন্মোচন করে সেখানে ডান হাতে মৃদু আঘাত করে দুর্যোধন আবার বলল, ‘তারপর দ্রৌপদীকে এখানে বসিয়ে দেহের তাপ কমাব।’

চার

আসরের সবাই অশ্রুসজল। বাকরুদ্ধ অজয় মণ্ডল। কুন্তীর ক্রোধান্বিত চোখ। শান্তনু পড়ছে —

একবস্ত্র পরিহিতা দ্রৌপদী সুন্দরী।
দুঃশাসন টানিতেছে বসনেতে ধরি ॥
ছাড় ছাড় বলি কৃষ্ণা ঘন ডাক ছাড়ে।
সভামধ্যে ধরি তার অঙ্গ-বস্ত্র কাড়ে ॥
সংকটে পড়িয়া দেবী না দেখি উপায়।
আকুল হইয়া কৃষ্ণা স্মরে যদুরায় ॥
ঝরঝর ঝরে অশ্রুজল দু’নয়নে।
কাতরেতে কৃষ্ণা ডাকে দেব নারায়ণে ॥

কুন্তী চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘থাম, থাম শান্তনু। আর পইড়ো না। আর শুইনতে ভালো লাগে না।’

তারপর অজয় মণ্ডলের দিকে ফিরে বলে, ‘নারীর অপমানের কথা ব্যাখ্যা কইরো না জেঠা।’ বলতে বলতে কেঁদে দিল কুন্তী।

অজয় মণ্ডল শান্ত স্বরে বলল, ‘শান্ত হও কুন্তী, শান্ত হও। কাঁইদো না

‘কী ভাবে কও তুমি জেঠা আমারে শান্ত অইতে! স্বামীদের সামনে স্ত্রী এরকমভাবে অপমানিত হইচ্ছে, আর অথর্ব স্বামীরা তাকাইয়া তাকাইয়া দেইখছে সে দৃশ্য! ধিক তোমাদের জেঠা, ধিক পুরুষদের।’

‘তোমার কথা মানি কুন্তী। কিন্তু ধর্মের কথাও তো তুমি মাইনবে!’ মৃদু স্বরে বলে অজয় জেঠা।

‘ধর্মের কথা! কীসের ধর্মের কথা? স্ত্রীর ওপর স্বামীর অধিকার আছে। অধিকার আছে বইলে স্বামী স্ত্রীকে যা ইচ্ছা তা-ই কইরতে পারে—এই তো বইলতে চাইতাছ তুমি! আমি মানি না সেই ধর্মকথাকে।’ কুন্তী আকুল হয়ে বলে।

এই সময় শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে—সত্যিই তো! স্ত্রী বলে কি তাঁর কোনো অস্তিত্ব নেই! স্বামীর অন্যায় ইচ্ছেয় সায় দিতে হবে নাকি দ্রৌপদীকে?

অনীল সরকার বলে উঠল, ‘কুন্তী ঠিকই বইলেছে জেঠা। যুধিষ্ঠির বড় অন্যায় কইরেছেন দ্রৌপদীর উপর।’

‘বস্ত্রহরণে যদি দ্রৌপদী লজ্জা পায়, নারীকুল যদি অপমানিত অয়—তবে তার সকল দায় ওই যুধিষ্ঠিরের, ওই পুরুষজাতির উপর বর্তায় সমস্ত দায়। এই আমার শেষ কথা।’ শ্লেষ মেশানো গলায় বলে উঠল কুন্তী।

অপ্রস্তুত হয়ে অজয় মণ্ডল সবার দিকে তাকিয়ে থাকল। তার কিছু বলতে ইচ্ছে করল না। কী বলবে অজয় মণ্ডল? এতজন সভাষদ, যেখানে ভীষ্ম-ধৃতরাষ্ট্রের মতন মানুষেরা উপস্থিত আছেন, উপস্থিত আছেন দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী, তাঁদের সামনে দ্রৌপদীকে বিবস্ত্র করা হচ্ছে, একজন পুরুষও জ্বলে উঠলেন না! জনসমক্ষে একজন রাজবধূর এতবড় অপমানে কেউ প্রতিবাদ করলেন না! কেউ তাকিয়ে থাকলেন, কেউ-বা থাকলেন অধোবদনে! ওই কুরুসভায় প্রকৃতপক্ষে নারীজাতির অপমান হয়নি, হয়েছে তো পুরুষজাতির! দ্রৌপদীর নগ্ন বক্ষ, উদোম শরীর দেখার ইচ্ছে কি তাহলে সকল সভাজনের মনে জেগেছিল? নইলে নির্বাক থাকলেন কেন সকলে? কুন্তী সত্যি বলেছে— দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সকল দায় পুরুষজাতির।

সেরাতে আর ‘মহাভারত’পাঠ জমল না। শান্তনুও পড়তে উৎসাহ হারাল। অজয় মণ্ডলের ব্যাখ্যা কেন জানি নিষ্প্রভ হয়ে গেল সেরাতে।

আস্তে আস্তে সবাই উঠে গেল আসর থেকে।

পাঁচ

অজয় মণ্ডলের বড় উঠান। ওই উঠানে মিটিং-এর আয়োজন করা হয়েছে। প্রধান বক্তা আবুল কাশেম। তার চারদিকে সাঙ্গাতরা। সামনে বিছানো চাটাইয়ে মালোরা বসা। মালোরা যে ইচ্ছে করে এই মিটিং-এ এসেছে, এমন নয়। যারা আসতে চায়নি, তাদের ওপর জোর খাটানো হয়েছে। এক পাশে নারীরা আরেক পাশে পুরুষেরা বসেছে।

আবুল কাশেম বলছে, ‘দ্যাখ মালোর পুতরা, সামনে ইলেকশন। ইলেকশন মাইনে নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচন। তোমাদের দলও দাঁড়াইছে। আমাদের পার্টির লোকও খাড়াইছে। স্বাধীনতার পর থেইকে বহুত ভোট দিছ ওই ভারতমার্কা দলরে। এইবার ভোট দিবা আমাদের পার্টির কেন্ডিডেটরে। বুঝছ?’

সমবেত মালোরা চুপচাপ থাকে। চোরা চোখে একজন অন্যজনের দিকে তাকায়।

ফখরে আলম বলে ওঠে, ‘কীরে বেটারা, কিছু বইলছ না ক্যান? হুজুরে কী বইলেছেন শুইনতে পাও নাই? কী অজয় মণ্ডল, কিছু বলো।’

‘কী আর বইলবো হুজুর!’ কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে অজয় জেঠা বলে।

‘কী বইলবে মাইনে! কাকে ভোট দিবা সে কথা বইলবে!’ ফখরে আলমের পাশে দাঁড়ানো শহীদুল বলে ওঠে |

‘আহ শহীদুইল্যা, মাথা গরম করস ক্যান? ওদের ভাইবতে দে। তা অনেকক্ষণ তো ভাইবলে, এবার কও আমার প্রস্তাবে রাজি আছ কি না তোমরা?’ আবুল কাশেম মাথা ঠান্ডা রেখে কথাগুলো বলে গেল।

কুন্তী দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনে ডান হাত ছড়িয়ে বলল, ‘আপনার প্রস্তাবে আমরা রাজি না। কারে ভোট দিব তা আমরা ঠিক কইরবো। কারে ভোট দিব, তা নির্ধারণ কইরে দেওয়ার আপনি কে?’

‘কে জানস না মাগি? চেয়ারম্যান সাহেব! তোর বাবা। তেরিমেরি করস ক্যান? তেল অইছে গায়ে! তেল চেঁছে নিব শরীর থেইকে।’ মাথাগরম শহীদুল গর্জে উঠল।

ফখরে আলম শহীদুলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। চড় দিতে দিতে বলল, ‘হারামজাদা, মুখে টাট্টিখানা বসানো তোর? খারাপ কথা বলস হারামির পুত?’

আবুল কাশেম নরম সুরে বলে, ‘বড় অন্যায় কইরে ফেইলেছে শহীদুল। ওরে মাফ কইরে দেও তোমরা। আর হ্যাঁ, যা বইলেছি, তার ব্যতিক্রম যাতে না হয়। মনে রাইখ আমার কথা। মিটিং এখানে শ্যাষ। আগামী পরশু ভোট। ব্যতিক্রম কইরবে না মালোর পুতরা।’ কুন্তীর ওপর কড়া চোখ রেখে কথা শেষ করে আবুল কাশেম।

পথে যেতে যেতে আবুল কাশেম ফখরে আলমকে চাপা স্বরে বলল, ‘আমাদের কেন্ডিডেট যদি হারে তাইলে ওই মাগির জইন্য হাইরবে। মালোদের ভোট ছাড়া জেতার উপায় নাই। বড় বাড় বেইড়ে গেছে রে কুন্তীর! দেমাক ভাঙার বেবস্থা কর।’

ছয়

সেরাতে অজয় মণ্ডলের দাস্ত হলো। দাস্তের সঙ্গে ভেদবমি। শেষরাতে মারা গেল অজয় জেঠা। পাড়া ভেঙে মানুষ জড়ো হলো অজয় জেঠার উঠানে।

.

অজয় জেঠাকে শ্মশানে নিয়ে আসা হয়েছে। ভৈরব নদের জলে স্নান করানো হয়েছে তাকে। সবাই শোকার্ত। চাঁপাতলার মালোপাড়ার একজনও আজ ঘরে বসে নেই। আতুর রাধারানি, সেও এসেছে ছেঁচড়িয়ে ছেঁচড়িয়ে।

চিতায় তোলা হয়েছে অজয় জেঠার মরদেহ। চিতার চারদিকে বৃত্তাকারে দাঁড়িয়েছে মালোরা। ব্রাহ্মণ তার প্রস্তুতিকার্য নিষ্পন্ন করছে। অশ্রুসিক্ত চোখে কুন্তী ব্রাহ্মণকে সাহায্য করছে। প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে মুখাগ্নি করা হবে অজয় জেঠার। শান্তনুই জেঠার মুখাগ্নি করবে। শান্তনুর চেয়ে আপনজন আর কে ছিল জেঠার!

.

এই সময় হই হই করে শ্মশানে ঢুকে পড়ল আবুল কাশেম চেয়ারম্যান। সঙ্গে দলবল।

আবুল কাশেম চিৎকার করে বলল, ‘তোদের তো সাহস কম না মালাউনের বাইচ্চারা! নিষেধ করা সত্ত্বেও মড়া লইয়া এইসেছিস এখানে? তোদের বলি নাই, এই জায়গা আমার? বন্ধ কর এইসব।’

‘বন্ধ কইরবো না। এইটা আমাদের জায়গা, আমাদের শ্মশান। এইখানেই অজয় জেঠাকে পোড়ানো অইবে। দেখি কী কইরতে পারেন!’ চিৎকার করে বলল কুন্তী।

আবুল কাশেম মাথার টুপি খুলে বলল, ‘বেশি বাড় বাইড়ো না বেটি 1 ভালা অইবে না কিন্তু।’

‘কী ভালা অইবে না, হ্যাঁ? কী ভালা অইবে না?’ চেয়ারম্যানের দিকে দু’কদম এগিয়ে কুন্তী তর্জনী নাড়িয়ে বলল।

আবুল কাশেম হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘ফখরে আলম রে—!’

.

আবুল কাশেমের দল মালোদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এত কিরিচ, এত লাঠিসোঁটা কোথায় ছিল কে জানে! সবার হাতে হাতে লাঠিসোঁটা আর কিরিচ।

কিছু মালো পালিয়ে বাঁচল, কিছু মাটিতে লুটিয়ে কঁকাতে লাগল। দাঁড়িয়ে থাকল শুধু কুন্তী।

আবুল কাশেম বলল, ‘ফখরে, দ্যাখ কিছু কইরতে পারিস কিনা।

.

ফখরে কাছে গেলে কুন্তী দূরে সরে যেতে চাইল। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারল না। শহীদুল এসে জুটল ফখরে আলমের সঙ্গে। শহীদুল একটানে কুন্তীর শাড়ি খুলে ফেলল।

কুন্তীর পরনে শুধু পেটিকোট আর ব্লাউজ। কুন্তীর নিতম্বে হাত দিল শহীদুল।

এইসময় কোত্থেকে লাঠি হাতে দৌড়ে এলো শান্তনু। ফখরে আলম এক বাড়িতে শুইয়ে দিল শান্তনুকে।

শহীদুল ততক্ষণে কুন্তীর পেটিকোটের ফিতে ধরে টান দিয়েছে।

গিঁট খুলে গেছে। কুন্তীর পেটিকোট খুলে নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছে।

কুন্তী চোখ বন্ধ করল।

তার গলা চিরে বেরিয়ে এলো, ‘ভগবান রে…।‘

শ্মশানের পাশ দিয়ে বহমান ভৈরব নদে ঝাঁপিয়ে পড়ল কুন্তী।

কুন্তীর পেটিকোট সামনে নিয়ে হা হা করে হেসে উঠল আবুল কাশেম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *