তুমি কে হে বাপু

তুমি কে হে বাপু

‘তুমি কে হে বাপু, সুখনিদ্রায় বিঘ্ন ঘটাতে এলে?’ বেদব্যাস জিজ্ঞেস করলেন।

‘অপরাধ মার্জনা করবেন। আপনার সঙ্গে দেখা করা আমার ভীষণ প্রয়োজন। আবেগ প্রবল বলে সময়জ্ঞান বর্জিত হয়েছি।’

‘তা যাক, তোমার পরিচয় জানতে চেয়েছি, বলোনি।’

‘আজ্ঞে, আমার নাম অদ্বৈত, অদ্বৈত মল্লবর্মণ।’

‘মল্লবর্মণ! অদ্বৈত বুঝলাম, মল্লবর্মণ বুঝতে পারছি না।’ বিস্মিত কণ্ঠ

ব্যাসদেবের।

‘আজ্ঞে, এ আমার বংশধারার পদবি। আমার বংশজ্ঞাপক নাম এটি।’

‘বংশজ্ঞাপক নামাংশও আছে নাকি এখন পৃথিবীতে! কই আমার সময়ে তো এসব ছিল না!’

‘আপনার সময়ে একটা যুগ গেছে। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর—এ তিন যুগের সমাজচেহারা প্রায় একরকম ছিল।’

‘আর এখন?’

‘এখন কলিযুগ। মানুষের আসল নামের সঙ্গে পদবি জুড়তে হয়। ওই পদবিতেই যত মানমর্যাদা। এখন পৃথিবীতে মানুষের মর্যাদা তেমন নয়, যত না পদবিতে।’

‘অদ্বৈত, তোমার কথা ভালো করে বুঝতে পারছি না আমি। আমার কালে কারও তো পদবি ছিল না। দ্রোণ, ভীষ্ম, যুধিষ্ঠির, বিদুর, গান্ধারী, সত্যবতী—কারও নামের শেষে কোনো বংশজ্ঞাপক পদবি তো ছিল না! আর আমিও তো ব্যবহার করিনি! শুধু আমি কেন, ত্রেতা যুগের মহান কবি বাল্মীকি, তিনিও তো রামায়ণে কারও নামের শেষে পদবির উল্লেখ করেননি! মানুষের আসল নামটাই তো তার পরিচয় বহন করত।’

এতক্ষণ কথা বলে হাঁপিয়ে উঠলেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব। দম নেওয়ার জন্য থামলেন।

অদ্বৈত মল্লবর্মণ ব্যাসদেবের মুখের দিকে নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকলেন।

ছোট একটা শ্বাস টেনে ব্যাসদেব আবার বললেন, ‘পদবি জুড়ে একজন মানুষের নামকে লম্বা করার কারণ কী?

‘ওই পদবিতেই তার জাতিত্ব, মানে তার উচ্চতা ও নীচতা প্ৰকাশ পায়।’

‘দেখ ছোকরা, সেই প্রথম থেকেই হেঁয়ালি করে কথা বলে যাচ্ছ! বয়স হয়ে গেছে আমার। কর গুনে হিসেব রাখিনি। তবে হাজারদুয়েক বছর তো হবেই। সব হেঁয়ালির অর্থ বুঝতে পারি না এখন। একটু ঝেড়ে কাশ তো বাছা!’ ধীরে ধীরে বললেন ব্যাসদেব।

‘আপনার সময়েও তো সমাজে চারটা বর্ণ ছিল—ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য আর শূদ্র?’

‘ছিল তো। আমিই তো গীতায় শ্রীকৃষ্ণের দোহাই দিয়ে চতুর্বর্ণের কথা লিখেছি! এটাও উল্লেখ করেছি যে, গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে এই বিভাজন।’

‘এখনকার পৃথিবীতে গুণ আর কর্মকে ভিত্তি করে মানুষের বিভাজন হয় না।’

‘তাহলে!’

‘কোথায় জন্মালাম, সেটাই মুখ্য বিষয়। বিএ, এমএ পাস দিয়ে মন্ত্ৰী ব্যারিস্টার হলেও পরিচয়ের সময় ব্রাহ্মণ সন্তান শূদ্র সন্তান এসব বলে পরিচয় দেওয়া হয়। জন্মস্থানটাই আসল, গুণের মূল্য শূন্য।’

‘জন্মস্থান মানে! হস্তিনাপুর, পাঞ্চাল, অবন্তী, গান্ধার, কলিঙ্গ—এরকম স্থানের কথা বলছ তুমি? এসব স্থানে জন্মালে…।’

‘না, না, মহামহিম! এরকম স্থানগত জন্মের কথা বলছি না আমি! আমি বলতে চাইছি বংশের কথা।’ ব্যাসদেবের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন অদ্বৈত।

‘বুঝিয়ে বল।’

‘আপনার সময়ে তো চন্দ্রবংশ, সূর্যবংশ, যাদববংশ—এসব ছিল। চতুর্বর্ণের ব্যাপারটাও ছিল। তবে আজকের ভারতবর্ষের মতো প্রকট ছিল না। এখন মানুষের পরিচয় হয় ব্রাহ্মণ, শূদ্র—এসব দিয়ে। ব্রাহ্মণরা মাথায় তুলে রাখার আর শূদ্ররা পায়ে পিষে মারার। শূদ্রদের মধ্যে আবার অনেক শ্রেণিবিভাজন করে রেখেছে ব্রাহ্মণরা। উত্তম শূদ্র এবং অধম শূদ্র। আমি অধম শূদ্রের মানুষ। ‘

‘মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছে আমার! শূদ্রের মধ্যে আবার উত্তম অধম কী? শূদ্রতো শূদ্রই!’ বিচলিত কণ্ঠে বললেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন।

‘শূদ্রদের মধ্যে নমঃশূদ্র নামে আরেকটা শ্রেণি করা হয়েছে। মেথর, ব্যাধ, ধোপা, নাপিত চণ্ডাল, জেলে—এরা নমঃশূদ্রের মানুষ। এদের উল্লেখের আগে নমঃ মানে মাননীয় এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে সত্য, প্রকৃত পক্ষে এরা নরাধম।’ ম্রিয়মাণ গলায় বলে গেলেন অদ্বৈত।

ব্যাসদেবের চোখ এবার কপালে উঠল, ‘বলো কী ছোকরা! তাহলে তো আমিও নরাধম! জেলেনারীর গর্ভে যে আমার জন্ম!’

অদ্বৈত এবার মিষ্টি একটু হাসলেন। বললেন, ‘নানা যুক্তি খাড়া করে আপনাকে তাবড় তাবড় পণ্ডিতরা ব্রাহ্মণ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চালাচ্ছেন এখন পৃথিবীতে।’

‘ব্রাহ্মণ! সে কী রকম?’

‘মেছোনির পেটে আপনি জন্মালেও বাবা তো আপনার ব্রাহ্মণ, দোর্দণ্ডপ্রতাপী ঋষি পরাশর আপনার বাবা। মা যা-ই হোন, পিতৃকুলের বিচারে আপনি নাকি ব্ৰাহ্মণ!’

‘তা কী করে হয়! ভারতবর্ষে পিতার চেয়ে মায়ের মর্যাদা বেশি। মাকেই স্বর্গপ্রাপ্তির আধার হিসেবে সম্বোধন করা হয়। মায়ের স্থান পিতার চেয়েও অনেক উঁচুতে।’ বলতে বলতে উদাস হয়ে গেলেন ব্যাসদেব। তখন মা মৎস্যগন্ধার কথা মনে পড়ে গেল তাঁর।

উপরিচরবসু নামের এক রাজার কামের ফসল তার মা। স্ত্রীকে প্রাসাদে রেখে মৃগয়ায় গিয়েছিলেন তিনি। অরণ্যমধ্যেই কামাসক্ত হন। তিনি সংযমী পুরুষ ছিলেন না। বীর্য স্খলিত হলো তাঁর। তিনি যে বীর্যবান পুরুষ, স্ত্রীর কাছে তার তো প্রমাণ দেওয়া দরকার! অতঃপর বাজপাখির পায়ে বীর্যধারক পত্র বেঁধে রাজধানীতে পাঠালেন। আকাশপথে আরেকটি বাজ পাখির আক্রমণে সেই বীর্য পতিত হলো যমুনাজলে। ওই বীর্য ভক্ষণ করল বিশাল এক মৎস্যা। মাছের পেটেই বড় হতে থাকল শিশু। কালক্রমে জেলের জালে মাছটি ধরা পড়ল। পেট থেকে বের হলো এক কন্যা আর এক পুত্র। সংবাদ পেয়ে রাজা উপরিচর পুত্রসন্তানটিকে প্রাসাদে নিয়ে গেলেন। কন্যাটি থেকে গেল জেলেটির ঘরে। কন্যাটির সারা গায়ে মাছের গন্ধ, তাই তার নাম হলো মৎস্যগন্ধা। ধীবররাজের ঘরে বড় হতে লাগল কন্যাটি। কালো কিন্তু অসাধারণ সুন্দরী মৎস্যগন্ধা। বিবাহযোগ্য হয়ে উঠল ধীরে ধীরে। কিন্তু এই মেয়েকে বিয়ে করবে কে? ওর শরীর থেকে যে বিদঘুটে মাছের গন্ধ বেরোয়! চিন্তিত হলেন দাশরাজা। বাড়ির পাশেই যমুনানদী,

যমুনানদী, সেখানে লোকপারাপারের ঘাট। কত মুনিঋষির যাতায়াত ওই খেয়াঘাট দিয়ে! খেয়া পারাপার করানোর জন্য সেই ঘাটেই পাঠালেন তিনি মৎস্যগন্ধাকে। তৃপ্ত হয়ে কোনো ঋষি যদি আশীর্বাদ করেন, কন্যাটির শরীর থেকে মাছের গন্ধ দূর হতেই পারে।

অনেকদিন পর সেই আশীর্বাদের বিকেলটি এলো। সন্ধ্যা হয় হয় সময়ে পরাশর মুনি এলেন খেয়া পার হতে। ওই বিকেলে তিনি একাই যাত্রী ছিলেন। কূল থেকে একটু দূরে গেলে মুনির নজর পড়ল মৎস্যগন্ধার সজীব দেহের ওপর। মৎস্যগন্ধা আপনমনে নৌকা বাইছে আর আনমনে তার দিকে তাকিয়ে আছেন পরাশর। শ্মশ্রুধারী শীর্ণদেহী মুনির মনে তীব্রভাবে রিরংসা জাগল। এবং যমুনার মধ্যিখানে অনেকটা জোর করে উপগত হলেন তিনি মৎস্যগন্ধার সঙ্গে। ওপারে উঠে যাবার সময় অবশ্য তিনি আশীর্বাদ করে গেলেন—আজ হতে তোমার শরীর থেকে মাছের গন্ধ উধাও হয়ে যাবে। পুষ্পগন্ধী হবে তুমি।

অনেকটা আপন মনে আবার বলতে শুরু করলেন ব্যাসদেব, ‘ঋষি পরাশর ব্রাহ্মণ, মানি। কিন্তু মা তো আমার জেলেনি! মাছের পেটে জন্মেছেন, জেলের ঘরে লালিতপালিত হয়েছেন। সেই মায়ের গর্ভে জন্মানো আমি কী করে ব্রাহ্মণ হই? মায়ের পরিচয়েই তো আমার পরিচয়! জেলেনির সন্তান বলে পরিচয় দিতে পেরে আমার গর্বের কি শেষ আছে?’

অদ্বৈত মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মুনিবর পরাশরের সঙ্গে আপনার আর সাক্ষাৎ হয়নি?’

‘হয়েছে।’ উদাস গলা ব্যাসদেবের।

‘ক্ষণিক রমণেচ্ছায় উত্তেজিত হয়ে একজন পূতপবিত্র কুমারীকে যে তিনি রমণ করলেন, তার জন্য কি তাঁর মধ্যে কোনো বিবেক যন্ত্রণা জাগেনি? জিজ্ঞেস করেননি আপনি?’ উত্তেজিত গলায় বললেন অদ্বৈত।

অদ্বৈতের কথা যেন শুনতে পাননি, এমনভাবে বলতে লাগলেন ব্যাসদেব, ‘কী নিদারুণ লজ্জা আর কী দুঃসহ কষ্টের দিন যে গেছে মায়ের! দশ মাস পিত্রালয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে জীবনযাপন করে গেছেন মা। শুধু দাশরাজা আর তাঁর স্ত্রী জানতেন কন্যার লাঞ্ছনার কথা। শাড়ির আঁচলে উঁচু পেট ঢেকে প্রতি মুহূর্তে যন্ত্রণা পেতে পেতে সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে গেছেন আমার দুঃখিনী মা-টি। এক বিকেলে আমাকে প্রসব করলেন তিনি। পরাশর এসে যজন-যাজন-অধ্যয়নের দোহাই দিয়ে আমাকে তাঁর আশ্রমে নিয়ে গেলেন একদিন। তাঁর পূর্বকৃত রিরংসাপরায়ণতার কথা কতবার জিজ্ঞেস করার জন্য মনস্থ করেছি, কিন্তু তাঁর সামনে গিয়ে কুঁকড়ে গেছি আমি। তোমার জিজ্ঞাসাগুলো আমার মনে যে জাগেনি এমন নয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে জিজ্ঞেস করবার শক্তি আমার মধ্যে সঞ্চয় করতে পারিনি। তবে তাঁকে আমি সারাজীবন ক্ষমা করতে পারিনি। আমার গোটা জীবনের আরাধ্য থেকে গেছেন আমার মা।’

‘আপনার জীবনে ঋষি পরাশরের কোনোই কি প্রভাব নেই?’

‘আছে। অবশ্যই আছে। এই যে, আমার বেদ-বেদান্ত পাঠ, এই যে আমার যজন-যাজন, সর্বোপরি গীতা মহাভারত থেকে শুরু করে অষ্টাদশ পুরাণাদি লেখার এই যে জ্ঞানগম্যি, তার সবটাই তো ঋষি পরাশরের কাছ থেকে পাওয়া!’

“গীতার কথা তুললেনই যখন, একটা প্রশ্ন করি। ভারতবর্ষের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মনে যখন মৃত্যুভয় ঢোকে, পুণ্যসঞ্চয়ের আশায় যে বইটি প্রথমেই গভীর মনোযোগ দিয়ে অধ্যয়ন শুরু করে, তার নাম ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’। তাদের বিশ্বাস, এই গ্রন্থই তাদের স্বর্গে নিয়ে যাবে। শুধু তা-ই নয়, শ্মশানগামী মৃতদেহের বুকের ওপর এই গ্রন্থটি রাখা হয়। ভেবে দেখুন, আপনি এবং আপনার গ্রন্থ ভারতীয় সনাতনসমাজে কত গভীরভাবে মাননীয়। অথচ…।” কথা সম্পূর্ণ না করে থেমে গেলেন অদ্বৈত।

‘অথচ, অথচ কী অদ্বৈত?’ দ্রুত জিজ্ঞেস করলেন ব্যাসদেব।

মহাপণ্ডিত ঋষিবর ব্যাসদেবের মুখে নিজের নাম উচ্চারিত হতে শুনে বড় ভালো লাগল অদ্বৈতের। সেই ভালোলাগা কণ্ঠেই বললেন, ‘না বলছিলাম কি, সেই মাননীয় ব্যাসদেবের উত্তরাধিকারীদের প্রতি বর্তমান ভারতবর্ষে কী ভীষণরকম ঘৃণা বর্ষিত হয়, তা নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাস হবে না আপনার। আমরা নিকৃষ্ট জাতি, মাছমারার জন্যই আমাদের জন্ম, অধ্যয়ন করার অধিকার আমাদের নেই। যদিও দু-চারজন শিক্ষিত জেলেকে কৃত্রিম হাসিমুখে গ্রহণ করে ওরা, কোনো কিছু লিখতে গেলেই যত ঝঞ্ঝাট! জেলে আবার কী লিখবে? ওরা লিখতে এলে, পড়তে এলে মাছ মারবে কে, এরকমই ভাবনা ওদের।’

‘এসব কী বলছ তুমি!’ বিব্রত কণ্ঠে শুধালেন ব্যাসদেব।

‘অপরাধ নেবেন না মাননীয়। কোনোরকমে ম্যাট্রিক পাস করেছিলাম আমি। কোন ভূতে পেল আমাকে, লিখতে বসলাম একদিন!’

‘কী লিখলে তুমি?’

“কী আর লিখব ঋষিবর! আমার সমাজটাকেই তো চিনি ভালো করে! ভালো করে না চিনে তো আর লিখা যায় না! তাই আমার সমাজ নিয়ে একটা উপন্যাস লিখলাম, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ নামে।”

‘উপন্যাস কী?’

“আপনিও উপন্যাস লিখেছেন, কবিতায়, ‘মহাভারত’ নামে। আমি লিখেছি গদ্যে। সাদা কথায় কাহিনি বলা যায় উপন্যাসকে।“

‘সবাই লিখে, তুমিও লিখেছ। আপত্তিটা কোথায়?’ বললেন ব্যাসদেব।

“আপত্তিটা কোথায় ভালো করে জানি না। তবে আমার আগে জেলেদের নিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একটা উপন্যাস লিখেছিলেন, ‘পদ্মানদীর মাঝি’ নামে।

‘জেলেদের নিয়ে তুমিও লিখলে। তুমি যেহেতু জেলেসমাজের লেখক, তোমার তো লেখার দায়িত্ব ও অধিকার দুটোই আছে।’

“লিখেই আমার কাল হলো। রে রে করে উঠল সবাই। একজন ব্রাহ্মণ লিখেছে ঠিক আছে, কোথাকার কোন অদ্বৈত মল্লবর্মণ, সে লিখতে যাবে কেন? এ নিয়ে নানা কথাবার্তা? একদিন ওই উচ্চবর্ণেরই এক লিখিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ থাকতে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ লিখতে গেলে কেন? কাগজকলমের অপচয় নয় কি?”

‘তো তুমি কী বললে?’ বিস্মিত ব্যাসদেব।

‘আমি আর কী বলব মহর্ষি! বললাম, মানিক তো বাওনের পোলা আর আমি জাউলার পোলা।’

স্মিত চোখে অদ্বৈতের দিকে তাকিয়ে থাকলেন ব্যাসদেব। মনে মনে তাঁর তারিফ না করে পারলেন না। অদ্বৈত যখন আজ বিকেলে এলেন, বড়ই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন তিনি। দুপুরের আহার শেষে দিবানিদ্রা যাওয়া তাঁর দীর্ঘদিনের অভ্যেস। ডাল, আলুভর্তা আর চচ্চড়িটাও বেশ ভালো হয়েছিল আজ। প্রয়োজনাতিরিক্ত খেয়েও ফেলেছিলেন। নিদ্রাটাও এসেছিল জম্পেশ। দৌবারিক সেই নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে জানিয়েছিল, কোন এক অদ্বৈত তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান। চোখেমুখে প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে বৈঠকখানায় ঢুকেছিলেন তিনি। ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তাঁর ভেতরের বিরক্তি কখন কেটে গেছে, বুঝতে পারেননি ব্যাসদেব। এখন অদ্বৈতের সঙ্গে কথা বলতে বেশ ভালোই লাগছে তাঁর 1

চিরজীবীদের একজন তিনি। হনুমানজীও চিরজীবী। ব্যাসদেবের দুটো আবাসস্থলের পরেই হনুমানজীর আবাসস্থল। আরও গোটাদশেক চিরজীবী এই এলাকায় বসবাস করেন। এটা স্বর্গের অত্যুত্তম এলাকা। স্বর্গের দক্ষিণাংশে এই এলাকাটি। উত্তরাংশে অন্যান্য পুণ্যবানদের বসবাস। তাঁদের আবার স্বর্গবাসের সময় নির্ধারণ করা আছে। চিত্রগুপ্তের পরামর্শক্রমে যমরাজাই নির্ধারণ করেন সময়। পৃথিবীতে পুণ্যার্জনের মাত্রার ওপর সময় নিরূপণ করা হয়। পুণ্য বেশি হলে বেশিদিন স্বর্গবাসের অনুমতি মেলে, পুণ্য কম হলে কম সময়ের জন্য। কারও জন্য সহস্র বছর, কারও জন্য সহস্র সহস্র বছর। আবার কারও জন্য দু’চার পঞ্চাশ একশ বছর। যুধিষ্ঠিরাদি অন্যান্য পুণ্যবানরা সহস্র সহস্র বছরের স্বর্গবাসের অধিকার পেয়েছেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণ পেয়েছেন দুইশ বছরের স্বর্গবাসের অধিকার। সাধারণ স্বর্গবাসীরা চিরজীবীদের এলাকায় অনুমতি ছাড়া আসতে পারেন না। চিত্রগুপ্তের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। এই অনুমতি নিয়ে গান্ধারী, সত্যবতী, দ্রৌপদী, ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর, যুধিষ্ঠির—এঁরা মাঝেমধ্যে ব্যাসদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। যেমন আজকে এসেছেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ।

কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব বললেন, ‘যাক ওসব কথা। পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ সে-যুগেও ছিল, তোমাদের যুগেও তেমনি আছে, অন্যের উন্নতি সহ্য করতে পারে না তারা। যেমন অর্জুন সহ্য করতে পারেনি একলব্যের সমরকুশলতার উন্নয়ন। তোমার ক্ষেত্রেও হয়তো সেরকম কিছু একটা হয়েছে! এই ধরনের ক্ষুদ্র লোক না থাকলে মহতকে চেনা দায়। আচ্ছা, তোমাকে একটা প্রশ্ন করি—কোন পুণ্যবলে তুমি স্বর্গে আসতে পারলে?”

‘আমার যে কী পুণ্য, আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি। মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বেঁচেছিলাম আমি। আপনার যেমন যমুনানদীর দ্বীপে জন্ম, তেমনি তিতাসনদীর পারে আমার জন্ম। আমার চেয়ে ভাগ্যবান আপনি। জীবনের প্রথমে মায়ের স্নেহ এবং শেষে পিতার আশ্রয় পেয়েছিলেন। খুব কম বয়সেই মা-বাবা দুজনেই আমাকে ছেড়ে পরলোকে চলে আসেন। তারপর না ঘরকা না ঘাটকার জীবন আমার! বোন ছিল একজন। বিয়ের পর সেও মারা গেল। গোকর্ণঘাটের এক স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করলাম আমি। কুমিল্লায় এসে কলেজে পড়তে চাইলাম। পারলাম না। টাকাপয়সা ছিল না তো আমার কাছে! তার পর কলকাতা। পত্রিকা অফিসে চাকরি করতাম, থাকতাম মেসে! বেতন যা পেতাম, সামান্য আমার জন্য রেখে বাকিগুলো গাঁয়ের আত্মীয়স্বজনের সাহায্যার্থে পাঠিয়ে দিতাম। তারপর একদিন যক্ষ্মা হলো, মারা গেলাম। যম রাজার সামনে নিয়ে যাওয়া হলো আমাকে। পাশে বসা চিত্রগুপ্ত যমরাজের কানে কানে কীসব বললেন! গুরুগম্ভীর কণ্ঠে যমরাজ বললেন—বালক, পৃথিবীতে বেশকিছু ভালো কাজ করেছ তুমি। নিজের সম্প্রদায়ের সুখ-দুঃখ, বেদনাপ্রাপ্তির বিবরণ দিয়ে কী যেন একটা লিখেছ। তোমার দেশবাসীরা এজন্য ধন্যধন্য করছে তোমার নামে। আর তুমি নাকি পরোপকারী। যাও, তোমাকে দুই শতাব্দী স্বর্গবাসের অনুমতি দিলাম। সুখে স্বর্গবাস করতে থাকো তুমি। এই আমার ইতিহাস মহর্ষি।’

ব্যাসদেব ধীরে ধীরে বললেন, ‘তোমার কথায় আমি খুব তৃপ্ত হয়েছি। আমার পরে আমার বংশধারাকে বহমান রেখেছ তুমি। লেখার ব্যাপারটিও তুমি চর্চা করেছ। নিশ্চয়ই ভালো কিছু লিখেছ, না হলে গোমড়ামুখো যমরাজ তোমার প্রশংসা করবেন কেন?’

‘আপনার বংশধারা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হতে বসেছে মহর্ষি।’

‘কেন কে! ওদের প্রজননক্ষমতা কি ফুরিয়ে গেছে?

‘না, তা নয়। এই সমাজে ব্যাপকভাবে প্রজননক্রিয়া চলমান। সন্তানাধিক্য প্রতি ঘরে। সমস্যা অন্যখানে।

‘অন্যখানে! সে কেমন!’

‘পদবি দিয়েই তো এখন মানুষের বংশমর্যাদা, তাই জেলেরা তাদের মূল পদবি নামের শেষে আর লিখছে না। লিখছে উঁচু জাতের পদবি, এই যেমন সেনগুপ্ত, চৌধুরী, রায়, চক্রবর্তী এসব। এতে জেলেদের আসল পরিচয় উঁচু পদবিতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তাই বলছিলাম, আগামী দশ বিশ বছরের মধ্যে ভারতবর্ষে কোনো জেলে থাকবে না। আপনার অথবা আমার অহংকার করবার মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না ভূ-ভারতে।’ বলে হা হা করে হেসে উঠলেন অদ্বৈত। পরক্ষণেই নিজের অশোভন আচরণ টের পেলেন।

ত্বরিত বললেন, ‘ক্ষমা করবেন মহর্ষি। অশোভনভাবে হেসে উঠলাম।’

‘বালক, তোমার এ হাসির মর্মার্থ আমি বুঝি। এ হাসিতে তোমার হৃদয়ের রক্তক্ষরণের ব্যাপারটি মিশে আছে, অনুধাবন করতে পারছি আমি। তুমি ভয় পেয়ো না।’

‘যদি নির্ভয় করেন, আরেকটি প্রশ্ন করি আপনাকে।’

অদ্বৈতের দিকে প্রীতির চোখে তাকালেন ব্যাসদেব। শ্মশ্রুমণ্ডিত বিশাল আকৃতির এই কৃষ্ণকালো মানুষটির ভেতর বিরাট একটা দরদি মন আছে। ওই হৃদয় দিয়েই মানুষকে বিচার করেন তিনি। অদ্বৈতকেও হৃদয় দিয়ে বুঝবার চাইলেন। অদ্বৈতের চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘বলো, কী জানতে চাইছ তুমি?’

“মহাভারত’ জুড়ে আপনি জড়িয়ে-ছড়িয়ে আছেন। এই মহাকাব্যের পরতে পরতে আপনার আদর্শ, আপনার ভাবনা, জীবন সম্পর্কে আপনার নিজস্ব বিচার বিশ্লেষণ দৃশ্যমান। সত্য ও সততার জয়গান করেছেন আপনি। দুষ্টের বিনাশের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন মহাকাব্যটি জুড়ে। ধর্মের জয় অনিবার্য—এই কথাই বলেছেন বারবার ‘মহাভারতে’। শুধু ‘মহাভারত’ কেন ‘গীতা’তেও আপনি ন্যায় ও সত্যের জয়গান করে এসেছেন। নিজে ন্যায়বান না হলে কখনো ন্যায়ের পক্ষে কথা বলতে পারে না কেউ। কিন্তু ভাসুর হয়ে অনুজের বউদের সঙ্গম করেছেন আপনি! একজন ন্যায়ের ধ্বজাধারী হয়ে একাজ করতে গেলেন কেন?”

অদ্বৈতের প্রশ্ন শুনে দ্রুত মাথা নোয়ালেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। অনেকক্ষণ নির্বাক হয়ে অধোবদনে বসে থাকলেন তিনি। তারপর ধীরে ধীরে মাথা তুললেন। বললেন, ‘দেখ অদ্বৈত, আজ পর্যন্ত কেউ সাহস করেনি আমাকে এই প্রশ্নটি করার। তুমি দুঃসাহসী। আর দুঃসাহসী হবেই না কেন? তোমার তো একটা আদি-ঐতিহ্য আছে। সনাতনীদের ধর্মে দশ অবতারের কথা আছে না?’

প্রশ্ন করে অদ্বৈতের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলেন না তিনি। বললেন, দশ অবতারের প্রথম অবতারের নাম মৎস্য অবতার। সেই মৎস্যের সঙ্গে আমাদের নিবিড় সম্পর্ক। আমাদের বংশধারার সঙ্গে প্রথমাবতারের অবিচ্ছিন্ন নৈকট্য। তো সেই ঐতিহ্যবাহী হয়ে এরকম প্রশ্ন করার সাহস তো তোমারই হবে! তুমি বড় কঠিন প্রশ্ন করেছ আমাকে। আমার একদিকে নৈতিকতা, অন্যদিকে মাতৃ-আদেশ। মা সত্যবতী বললেন, অনুজ-বধূদের সঙ্গে রমণে রত হও, নীতিবোধ বলল—খবরদার ব্যাস, এত বড় অন্যায় করো না। আচ্ছা অদ্বৈত, এই রকম পরিস্থিতিতে পড়লে তুমি কী করতে?’

প্রশ্নটা বুমেরাং হয়ে তাঁর দিকে ফিরে আসবে, ভাবেননি অদ্বৈত। ব্যাসদেবের প্রশ্ন শুনে অদ্বৈত ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। আমতা আমতা করে বললেন, ‘আমি! আমি কী করতাম ঠিক করতে পারছি না!

ব্যাসের গম্ভীর কণ্ঠ এই সময় অদ্বৈতের কানে ভেসে এলো, ‘আমি ঠিক করতে পেরেছিলাম। মা মৎস্যগন্ধা, যিনি পরে রাজা শান্তনুর মহিষী হয়ে সত্যবতী হয়েছিলেন, আমার পৃথিবী ছিলেন। এই মায়ের সন্তুষ্টির জন্য লক্ষ বছরের নরকবাস আমার কাছে ঈপ্সিত ছিল। যতই অন্যায় হোক, মায়ের আদেশ ফেলি কী করে? মা-ও নিরুপায় ছিলেন, বংশধারা অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে যে! যাকে তাকে দিয়ে তো আর পুত্রবধূদের প্রজনন করানো যায় না। তাঁর কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলাম আমি। তাই প্রজনন নিষ্পন্ন করার জন্য আমাকেই নির্বাচন করলেন মা। বিবেককে গলা টিপে হত্যা করে তিন তিনবার অন্যায় কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলাম আমি।’ ব্যাসদেবের কণ্ঠ দিয়ে মর্মযাতনা ঝরে ঝরে পড়তে লাগল।

অনেকক্ষণ পরে অদ্বৈত প্রশ্ন করলেন, ‘ফল কি শুভ হয়েছিল?’

‘নিশ্চয়ই না। এই অন্যায় কার্যের ফল শুভ হয়নি। অম্বিকা, অম্বালিকা আর দাসীটির গর্ভে ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু আর বিদুর জন্মাল। দাসীপুত্র বলে রাজপ্রাসাদে বিদুর অবহেলিত হলো, মুনির অভিশাপে পাণ্ডু প্রজনন ক্ষমতা হারাল। ধৃতরাষ্ট্রের একশটি পুত্র ও একটি কন্যা জন্মাল। ধৃতরাষ্ট্র তো অন্যায়ের ফসল! তার সন্তানরা আর কতটুকু ভালো হবে? দুঃশাসন, দুর্যোধনরা হস্তিনাজুড়ে যুদ্ধের দামামা বাজাল। কুরুক্ষেত্রের আঠারো দিনের যুদ্ধে আঠারো অক্ষৌহিণী সৈন্য প্রাণ হারাল। ধৃতরাষ্ট্রের বংশে বাতি দেওয়ার কেউ থাকল না। একটা সময়ে যুদ্ধ শেষ হলো বটে, গোটা হস্তিনায় পোড়া-রক্তভেজা মাটি আর লক্ষ নারীর হাহাকার ছাড়া আর কিছুই থাকল না।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ব্যাসদেবের বুক চিরে বেরিয়ে এলো।

তারপর বললেন, ‘আমার দ্বারা যে পাপটা করিয়েছিলেন মা, রক্তসমুদ্রের প্লাবনে সেই পাপ ধুয়ে-মুছে গিয়েছিল পৃথিবী থেকে।’

কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের বেদনাবিলীন চেহারা দেখে আর কিছু বলতে সাহস করলেন না অদ্বৈত মল্লবর্মণ।

বাইরে তাকিয়ে দেখলেন—চারদিকে আঁধার ঘনীভূত হয়ে গেছে। মাটিতে মাথা নুইয়ে প্রণিপাত করলেন ব্যাসদেবকে। করজোড়ে বললেন, ‘যাবার অনুমতি দিন মহর্ষি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *