দেউলিয়া

দেউলিয়া

ইন্দ্র দেবতা। স্বর্গের রাজা।

দেবতারা ইন্দ্রের অধীন। ইন্দ্র স্বেচ্ছাচারী। স্বেচ্ছাচারীরা ভোগী হয়। ভোগীরা লম্পট। কামুক তারা। ইন্দ্র যেমন ভোগী, তেমনি কামুক। নিজ প্রাসাদে প্রচুর রমণী। তারা অপরূপ সুন্দরী। তাদের অঙ্গগঠন মনোলোভা, কটাক্ষ বিমোহন, উন্নত কুচযুগল, পুরুষ্টু ওষ্ঠাধর। তারা ইন্দ্রের সহজলভ্যা। এমন কি ইন্দ্রের স্ত্রী যে শচী, অসাধারণ রূপময়ী। শচীর সারা অঙ্গে লাবণ্যের ছটা। এসবে কোনো আগ্রহ নেই ইন্দ্রের। ওরা যে সহজপ্রাপ্যা, ওদের শরীরের ভাঁজ-বাঁক যে ইন্দ্রের জানা হয়ে গেছে! জ্ঞাত, স্পর্শিত, সম্ভোগকৃত কোনো রমণীর প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই! ওইসব নারী তার কাছে আবর্জনা। তার চাই নতুন নতুন নারী, তার চাই সম্ভোগযোগ্যা লোভনীয় দেহের ভরাযৌবনের নারী।

ইন্দ্রের দেহরঙ পিঙ্গল। তার হাত দুটি দীর্ঘ। সেই হাতে বজ্র—অমোঘ এবং প্রাণঘাতী। ভুবনবিখ্যাত তীরন্দাজ সে। তার ভয়ে সসাগরা ভূমণ্ডল কাঁপে। ওতে সুখ নেই ইন্দ্রের। তার যত সুখ ও স্বস্তি নারীদেহে। পরনারীতে তার তীব্র আকর্ষণ। ছলে-কৌশলে অপরের কুলনারীকে তার অঙ্কশায়িনী করা চাই-ই চাই।

এজন্য ইন্দ্রকে যে মাশুল গুনতে হয়নি, এমন নয়। কিলগুঁতা তো খেয়েছে খেয়েছেই, ধরা পড়ে বড় ধরনের শাস্তিও ভোগ করতে হয়েছে ইন্দ্রকে। তাতেও তার কামুকতা কমেনি। বরঞ্চ উত্তরোত্তর বেড়েছে। তার বিশাল শরীরটা যেন রিরংসার আধার। তীব্র রমণেচ্ছার তাড়নায় মর্ত্যে ঘুরে বেড়ায় ইন্দ্র। সুযোগ বুঝে শিকারে মত্ত হয়।

কামাস্থির ইন্দ্র একদিন গহিন অরণ্যে ঘুরছিল। যদি কোনো শিকাৰ্য পাওয়া যায়! ঘুরতে ঘুরতে ঋষি গৌতমের পর্ণকুটিরে উপস্থিত হলো ইন্দ্ৰ। ওই সময় ঋষি গৌতম কুটিরে উপস্থিত ছিলেন না।

ঋষির স্ত্রী অহল্যা ইন্দ্রের চোখ ধাঁধিয়ে দিল। এমন রূপলাবণ্যেভরা নারী! এই পাতার ঘরে! এরকম জীর্ণ-দীণ অবস্থায়! মাথা ঘুরে গেল ইন্দ্রের। কামাবেগ তাকে অস্থির করে তুলল। একটা ফন্দি আঁটলো ইন্দ্ৰ। ধীর পায়ে কুটিরের দিকে এগিয়ে গেল। অহল্যা তখন পেছনফিরে প্রাঙ্গণের শিশুবৃক্ষে জলসিঞ্চনে মগ্ন।

উঠানে দাঁড়িয়ে বিনীত ভঙ্গিতে বলল, ‘একপাত্র জল পাবো? তৃষ্ণা নিবারণের জন্য।’

চকিতে ইন্দ্রের দিকে ফিরল অহল্যা। চমকে উঠল। তার এ চমকানো, ইন্দ্রের শরীরগঠনের জন্য। এমন পেশিবহুল দৃষ্টিনন্দন দেহ! এমন সুসজ্জিত অঙ্গভূষণ! দীর্ঘ শরীরের ভাঁজে ভাঁজে যেন যৌবন সুপ্ত হয়ে আছে! আহা, এরকম দেহ কতদিন দেখেনি অহল্যা! শীর্ণকায় জটাজুটধারী, কৌপীন পরিহিত গৌতমকে দেখে দেখে চোখ দুটো মরে গেছে অহল্যার।

তার স্বামী ঋষি গৌতম তেজোদীপ্ত, কিন্তু বীর্যবান নন। স্ত্রীরা চায় মর্দন, চায় সোহাগ। চায় স্বামীরা তাদের উদ্দীপিত করুক, দলিত-মথিত করুক, রমণে ভাসিয়ে দিক। কিন্তু এগুলোর ধারে-কাছে নেই গৌতম। তিনি মনে করেন, অহল্যা তার প্রস্ফুটিত কুসুম। তাকে স্পর্শ করা ঠিক নয়, তাতে তার সৌরভ নষ্ট হয়ে যাবে, তার দেহঘ্রাণ ম্লান হয়ে যাবে। তাই দূরে দাঁড়িয়ে তিনি অহল্যার দেহরূপ উপভোগ করেন। কিন্তু অহল্যা চায় দেহলগ্নতা, চায় উষ্ণ স্রোতের উজ্জ্বল অনুভব।

দীর্ঘদিনের ক্ষুধার্ত অহল্যা। ইন্দ্রকে দেখে তার দেহক্ষুধা সুতীব্র হলো। পাত্রভরা জল এগিয়ে দেওয়ার সময় অপাঙ্গে তাকাল ইন্দ্রের দিকে।

ইন্দ্রের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে অহল্যার কটাক্ষে দেহসুখের তীব্র বাসনা লুকিয়ে আছে।

জলপাত্র নেওয়ার সময় অহল্যার আঙুল ছুঁয়ে দিল ইন্দ্ৰ। অহল্যা তড়িৎ- স্পর্শিত হলো। শিহরিত হলো ইন্দ্র।

জলপান শেষ করে ইন্দ্র তৃপ্তির একটা শ্বাস ফেলল। বলল, ‘আপনি একা থাকেন বুঝি, এখানে?’

অহল্যা কটাক্ষবাণ ছুড়ে বলল, ‘একা থাকলে সুবিধা বুঝি!

ইন্দ্র অহল্যার কথা ধরতে পারল না। বলল, ‘কিছু বলছিলেন?’

অহল্যা হাসতে হাসতে বলল, ‘না, আমি একা থাকি না। আমার একজন পাহারাদার আছে। সে গৌতম। ঋষি গৌতম আমার স্বামী।’

গৌতমের নাম শুনে ইন্দ্ৰ গুটিয়ে গেল। ভাবল—এখানে তার কামনা চরিতার্থ হওয়ার নয়। যার স্বামী ঘরে, সে তো কখনো তৃপ্ত না থেকে পারে না!

‘না, আমি তৃপ্ত নই।’ অহল্যা আচমকা বলে উঠল।

চমকে অহল্যার দিকে তাকাল ইন্দ্র। কী আশ্চর্য, মনের কথা বুঝল কী করে রমণীটি! সে তো শব্দ করে কিছু বলেনি!

ভ্যাবাচেকা চোখে অহল্যার দিকে তাকিয়ে কী একটা বলতে চাইল ইন্দ্ৰ।

এই সময় অহল্যা বলে উঠল, ‘আমার নাম অহল্যা। আচ্ছা অহল্যা অর্থ জানো তুমি?

ইন্দ্ৰ আমতা আমতা করে বলল, “হল, শব্দের অর্থ তো কদর্যতা।”

‘আর অহল্যা মানে?’ জানতে চাইল অহল্যা।

একটু থতমত খেয়ে চুপ করে থাকল ইন্দ্ৰ।

অহল্যা বলল, ‘সকল প্রকার কদর্যতাশূন্য যে নারী, সে-ই অহল্যা। সে আমি।’

অহল্যার কথায় একেবারে তটস্থ হয়ে গেল ইন্দ্র। তার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, অহল্যা স্পষ্টত তাকে ধমক দিচ্ছে। বলছে—আমি সহজলভ্যা নই। কেউ ইচ্ছে করলেই তার কামাগ্নির হোম-হওয়া নারী আমি নই। তুমি হাত বাড়াতে চাইছ আমার দিকে, ও হাত যে ভস্ম হয়ে যাবে ইন্দ্ৰ!

অহল্যা বলে উঠল, ‘আমার স্বামী গৌতম সুপুরুষ। দৃষ্টিনন্দন তার অঙ্গসৌষ্ঠব। নারীর কামনাপূরণের সকল শক্তি তার দেহে বর্তমান।’

একথা যে মিথ্যেয় ভরা, এই কথাগুলো যে চাতুরিতে পূর্ণ, ইন্দ্রকে বুঝতে দিল না অহল্যা।

‘কিন্তু একটুক্ষণ আগে আপনি যে বললেন, আপনি তৃপ্ত নন!’ ইতস্তত কণ্ঠে বলল ইন্দ্ৰ।

‘ও কথায় তো মিথ্যে নেই!”

‘তাহলে!’

‘তাহলে কী?’ খল খল কণ্ঠে হেসে উঠল অহল্যা।

অহল্যার এই খলবলানি হাসি শুনে হঠাৎ আরেকজনের কথা মনে পড়ে গেল ইন্দ্রের। সে লৌহিতা।

.

লৌহিতা শবরপল্লির মেয়ে। এরকম করেই হেসে উঠেছিল লৌহিতা, ইন্দ্রের সামনে। তবে ঠিক অহল্যার মতো করে নয়। লৌহিতার হাসিতে ছিল নুড়ির ওপর দিয়ে বয়ে-যাওয়া ছোট্ট ঝরনার মৃদু সুরধ্বনি। তবে লৌহিতার সেই মৃদু লয়ের হাসি মুহূর্তেই খরতর হয়ে উঠেছিল

গৌরবর্ণী নারীদের ভোগ করতে করতে একসময় ইন্দ্রের মনে বিতৃষ্ণা জেগে উঠেছিল। সেই প্রমত্তা ভরাযৌবনের উর্বশী, সেই চোখধাঁধানো রূপের মেনকা বা সেই মাতালকরা দেহাধিকারী দেবকন্যারা! ভাল্লাগে না এদের! তখন ইন্দ্রের খুব রুচি বদল করতে ইচ্ছে করল। স্বর্গ ছেড়ে মর্ত্যে নেমে এলো সে। এবার তার গন্তব্য কোনো তপাশ্রম নয় বা আলোক-উজ্জ্বল কোনো রাজধানীর নয়নাভিরাম বাগানবাড়িও নয়। সেখানে কালো মেয়ে কোথায় যে সেসব জায়গায় যাবে! সে জানে, কোনো ইতরপল্লিতে গেলে কালোবরণ কন্যা মিলবে। ব্যাধপল্লিগুলোই কৃষ্ণাদের আবাসস্থল। মগধরাজ্যে নগরের বাইরে একটি শবরপল্লি আছে, এ ইন্দ্রের জানা।

ইন্দ্র সেই শবরপল্লিতে উপস্থিত হলো। পল্লির ঘরগুলো ছড়ানো- ছিটানো। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে এক একটি ঘর। পল্লির পুরুষেরা দিনের বেলায় মৃগয়ায় যায়। দূর-দূরান্তের অরণ্যে ওরা তীর-ধনুক-চেঁটা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। দিনশেষে কাঁধে ধৃত বা নিহত পশু ঝুলিয়ে বাড়ি ফেরে। ওই সময় শবরনারীরা সন্তনাদি লালন করে, গৃহস্থালি দেখভাল করে।

এই শবরপল্লির একজন ভল্ল। পাথর ছেনে বানানো শরীর তার। পেশিবহুল। সেই পেশিতে সমুদ্রের ঢেউ আটকানো। একমাথা ঝাঁকড়া চুল। আবলুস কাঠের মতো দেহরঙ। লৌহিতা ভল্লের বউ। তার ত্বকে অমাবস্যার অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। শ্রাবণের মেঘের মতন চুল তার। তার কালো দেহের বাঁকে বাঁকে আহ্বান—আয় আয়। কালো দেহেতেও যে পুরুষকে বিবশ করার সৌরভ থাকে, তার উদাহরণ লৌহিতা।

লৌহিতা আর ভল্লের মধ্যে গভীর ভালোবাসাবাসি। শিকারে বেরোবার আগে ভল্ল বলে, ‘সারাদিনমান মোরে না দেখ্যা তোহার ভাল লাইগবেরে লৌহিতা?’

লৌহিতা গাল ফুলিয়ে বলে, ‘হ, ভাল লাইগবেক।

‘কী!’ অভিমানছলে বলে ওঠে ভল্ল।

লৌহিতা ভল্লের গা ঘেঁষে ভল্লের দু’হাত ছুঁয়ে বলে, ‘জলদি ফিরা আসিস তুই। তোহার লাগি আমি পথ চাইয়া রব।’

খুশিতে ভল্লের মন ভরে ওঠে। তার সদ্যবিবাহিত বউটি তার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে! শিহরিত হয় সে। হঠাৎ লৌহিতাকে জাপটে ধরে ভল্ল। গায়ে-গলায় মুখ ঘষতে ঘষতে বলে, ‘অ আমার জলভরা কলস রে, অ আমার দুধাল গাই রে!

এই ভল্লের উঠানে এসে দাঁড়িয়েছিল ইন্দ্র। ভল্ল তখন শিকারে, লৌহিতা বিছানায়, অলস অবকাশে।

ডাক দিয়েছিল ইন্দ্ৰ, ‘কেউ আছে, ঘরে কেউ আছে?’

বিজাতীয় কণ্ঠস্বর শুনে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসেছিল লৌহিতা। ওই অবস্থাতেই উঠানে বেরিয়ে এসেছিল সে। নিম্নাঙ্গে স্বল্পবস্ত্র। স্তন দুটো এক টুকরা কাপড় দিয়ে বাঁধা। বস্ত্রবন্ধন থেকে বেরিয়ে আসবার জন্য কুচযুগল ছটফট করছে। টানা চোখ দুটোর ওপর বাঁকানো ধনুকের মতো ভ্রু।

মুহূর্তেই মাথা ঘুরে গেল ইন্দ্রের। এত সৌন্দর্য এই কৃষ্ণবর্ণ দেহে! এত ঢেউ বস্ত্রবদ্ধ স্তনযুগলে! আহা!

ইন্দ্রের দেহ আলুলায়িত হয়ে উঠল। পলকহীন চোখে লৌহিতার দিকে তাকিয়ে থাকল ইন্দ্র। এই সময়, ঠিক এইসময় প্রবল প্রতাপশালী একটি উষ্ণ প্রবাহ শির থেকে শিরদাঁড়া বেয়ে শিশ্ন পর্যন্ত বয়ে গেল তার

বিহ্বল অবস্থায় ইন্দ্ৰ বলল, ‘জল খাব।’

লৌহিতা থতমত খেয়ে গেল। রাজবাড়ির লোক তাদের মতো ছোটজাতের ঘরে জল খাবে!

বলল, ‘পানি খাবি তু! মোর হাতের পানি খাবি!’

ইন্দ্র উপরে-নিচে মাথা নাড়ল।

লৌহিতা দ্রুত ঘরের ভেতর গেল। মাটির ঘটিতে করে পানি নিয়ে এলো। ঘটিটি লৌহিতার হাত থেকে নেওয়ার সময় হাতটিই আঁকড়ে ধরল ইন্দ্ৰ!

গাঢ় কণ্ঠে বলল, ‘তুমি আমার আপনজন। তোমার হাতের জল খেতে আমার আপত্তি কেন থাকবে।’ বলে নিজের দিকে লৌহিতাকে সজোরে টেনে নিল।

ঠিক ওই সময় মর্মান্তিক হাসিটা হেসে উঠেছিল লৌহিতা— ছলছল, কলকল, ঝরনাধারার চলনধ্বনির মতো।

এই হাসিটা না হেসে লৌহিতার কোনো উপায় ছিল না। সে বুঝতে পেরেছিল—এই শুয়ারটা তাকে নষ্ট না করে ছাড়বে না। ওকে প্রতিহত করতো যে ভল্ল, সে-ও নেই ঘরে। আর তার শরীরে তো এমন বল নেই যে, ওকে এক ঠেলায় সরিয়ে দেয়! তাই তার এই হাসি!

লৌহিতা হাসতে হাসতে বলল, ‘আমার শরীর লিতে চাস তুই? গতর লইয়া খেইলতি চাস?’

ইন্দ্র জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাতে লাগল।

লৌহিতা বলল, ‘তাহলে তুকে একটুখান খাড়াতে হইবে। মরদ আমার যাওয়ার সময় বিছানাটা এলে-ঝেলে কইরে গেছে। ওটা এট্টু ঝেইড়ে আসি?’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে! বিছানাটা ঝেড়ে আসো তুমি। আমি অপেক্ষা করছি। তোমাকে রাজরানি করব আমি।’

লৌহিতা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, ‘হ অপেক্ষা কইরে থাক, নাগর আমার।’ বলে দ্রুত ঘরের ভেতর ঢুকে গেল।

পলকেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো লৌহিতা। হাতে তীক্ষ্ণমুখ কাটারি। রোদ পড়ে সেই কাটারি চিক চিক করে উঠল।

ইন্দ্রের দিকে দৌড়ে আসতে আসতে লৌহিতা চিৎকার করে বলল, ‘গতর লিবি মোর? খেইলবি আমার লগে! মোরে পাটে বসাবি শুয়ার! খাড়া, আমি তুর লিঙ্গ কাটি লই।’

লৌহিতার হন্তারকমূর্তি দেখে আঁতকে উঠল ইন্দ্র। দ্রুত পেছন ফিরল। পড়ি কি মরি করে দৌড় লাগাল। ওই সময়েই দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল।

দৌড়াতে গিয়ে পা হড়কে গেল ইন্দ্রের। পাহাড়ি ঢালু পথ। এবড়ো- খেবড়ো। গড়াতে গড়াতে বহু নিচ পর্যন্ত চলে এলো ইন্দ্রের দেহটা।

ক্ষত সারাবার জন্য দীর্ঘদিন রাজবদ্যির অধীনে থাকতে হয়েছিল ইন্দ্রকে। পা হড়কে যাওয়ার আগমুহূর্তে লৌহিতার কর্কশ কণ্ঠ শুনতে পেয়েছিল ইন্দ্ৰ, ‘ও-সব সস্তা মাইয়া মানুষ তোহাদের রাজবাড়িতে আছে রে শেয়ালের ছা। ইখানে সব নারী সতী আছে।’

তারপর লৌহিতার কণ্ঠের সেই ঝিকিমিকি হাসির শব্দ ভেসে এসেছিল।

.

আজ ওই লৌহিতা-ঘটনার বহুদিন পরে, ঋষি গৌতমের উঠানে দাঁড়িয়ে, ওইদিনের ঘটনাটা মনে পড়ে গিয়েছিল ইন্দ্রের। অহল্যার খলখল হাসিতে লৌহিতার মুখটি ইন্দ্রের চোখে ভেসে উঠেছিল।

‘তাহলে কী’—অহল্যার এই রহস্যময় কথার কী উত্তর দেবে, ঠিক করতে পারছিল না ইন্দ্ৰ।

ইন্দ্রকে চমকে দিয়ে অহল্যা বলে উঠল, ‘আগে আমাকে তুমি করে বলো দেবরাজ। তারপর না হয় তোমার কথার উত্তর দেব আমি!’

‘দেবরাজ!’ ইন্দ্রের বিস্ময়ের অবধি থাকে না।

‘তুমি ইন্দ্ৰ নও, বলতে চাইছ নাকি!’

‘না বলছিলাম কী, তুমি আমাকে চিনলে কী করে! অরণ্যবাসী একজন ঋষির পত্নী হয়ে স্বর্গরাজকে চেনার তো কথা নয়!

‘আচ্ছা সূর্যকে কি কেউ চিনিয়ে দেয়—উনি দিননাথ?”

‘না। সূর্যদেবকে তো চেনাতে হয় না। তিনি নিজের আলোতে উজ্জ্বল।’

‘ইন্দ্রেরও নিজস্ব আলো আছে। সেই রূপালোক চিনিয়ে দেয়, তুমি দেবরাজ ইন্দ্র। আমি তোমাকে চিনি দেবরাজ।’

‘চেন! কী করে!’ অবাক চোখে তাকিয়ে বলে ইন্দ্ৰ।

‘সেই বৃত্তান্ত না হয় আজ থাক। বলো, কেন এসেছ আমার আঙিনায়।’ কণ্ঠে মদিরা ঢেলে জিজ্ঞেস করে অহল্যা।

ইন্দ্র বলে, ‘আমি তোমাকে চাই অহল্যা। তোমার রূপযৌবনে ডুব দিতে চাই।’

ইন্দ্রের কথায় রিরংসা-স্পর্শিত হলো অহল্যা। দীর্ঘদিন স্বামী-সংসর্গ থেকে বঞ্চিত অহল্যা। পঠনে-অধ্যাপনায় সময় কাটিয়েছেন গৌতম। স্ত্রীর চাহিদা হেলায় ঠেলেছেন। ইন্দ্রের প্রার্থনায় অহল্যার দেহ জেগে উঠল অকস্মাৎ। তার দীর্ঘদিনের দেহক্ষুধা চাগিয়ে উঠল। তার পরও নারী তো সে! সহজে ধরা দিতে চাইল না অহল্যা।

বলল, ‘গৌতম গেছে অদূরের সরোবরে। অবগাহনে। শিগগির ফিরে আসবে। তুমি ফিরে যাও দেবরাজ।’

‘আমাকে ফিরিয়ে দিয়ো না লাবণ্যে। তোমার সরোবরে আমাকে অবগাহনের সুযোগ দাও।’

‘গৌতম রাগী ঋষি। ধরা পড়লে অভিশপ্ত হবে।’

‘তার আগেই অবগাহন সম্পন্ন করব আমি। তোমার পায়ে পড়ি, বঞ্চিত করো না আমায়।’

ইন্দ্রের মিষ্ট কথায় অহল্যা ভুলল। ইন্দ্রের হাত ধরল।

চঞ্চলপায়ে গৃহাভ্যন্তরে গেল দুজনে।

কামার্ত দুজনে রমণে লিপ্ত হলো।

.

ঋষি গৌতম অবগাহনশেষে ফিরে দেখলেন, পর্ণকুটিরের দরজা আধো ভেজানো। কপাট খুলে দেখলেন, অহল্যা ইন্দ্রের কামনা পরিতৃপ্ত করছে।

ক্রুদ্ধ গৌতম ইন্দ্রকে অভিশাপ দেন, ‘তোর অণ্ড খসে পড়ুক। তোর সমস্ত শরীর জুড়ে সহস্র ভগচিহ্নের উদয় হোক।

পায়ে আছড়ে পড়ল ইন্দ্র, ‘ক্ষমা করুন ঋষি, ক্ষমা করুন। সারা দেহে এই নারীচিহ্ন নিয়ে আমি দেবতাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াব কী করে! স্বর্গসিংহাসনে বসব কী করে! ক্ষমা করুন প্রভু, ক্ষমা করুন।’

ইন্দ্রের অনুনয়-বিনয়ে ঋষি গৌতম ওই ভগচিহ্নগুলো লোচনচিহ্নে রূপান্তরিত করলেন। সেদিন থেকে ইন্দ্রের আরেক নাম হলো— নেত্রযোনী।

এবার অহল্যার দিকে মুখ ঘোরান গৌতম।

রোষমাখা কণ্ঠে বলেন, ‘তুমি কামুক অহল্যা, স্বৈরিণী তুমি। তুমি স্ত্রী- কর্তব্য ভুলে পরপুরুষে দেহ দিয়েছ। তুমিও শাস্তিযোগ্যা।’

ইন্দ্রের মতো হাহাকার করে উঠল না অহল্যা বা ইন্দ্রের মতো কাকুতি- মিনতিতেও গেল না। ঋষির সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল সে।

গৌতম বললেন, ‘অস্থির তুমি। তুমি অভিশাপযোগ্যা। আগামী এক সহস্র বছর এই পর্ণকুটিরের সামনে পাষাণ হয়ে থাকবে তুমি। বুঝবে সবকিছু, কিন্তু বলতে পারবে না। খিদে পাবে তোমার, কিন্তু আহার করতে পারবে না।’

বলে নিজগৃহের দিক থেকে মুখ ফেরালেন গৌতম। গভীর অরণ্যের দিকে মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলেন ঋষি গৌতম।

অহল্যা কণ্ঠকে উঁচুতে তুলে বলে উঠল, ‘স্বর্গসুখের চেয়ে দেহসুখ লোভনীয়। আরেকবার অপার দেহতৃপ্তির বিনিময়ে আরও সহস্র বছর পাষাণ হয়ে থাকতে আমার আপত্তি নেই ঋষি গৌতম।’

অহল্যার এই কথাগুলো বাতাসে ভর করে গৌতমের কানে এসে বাজল।

থমকে গেলেন ঋষি গৌতম।

নিজেকে হঠাৎ দেউলিয়া বলে মনে হতে লাগল গৌতমের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *