১৫. বীরপুর জাইল্যাপাড়া

পনেরো

‘বীরপুর জাইল্যাপাড়াটা কোন দিকে বলতে পারেন?’ একজন ট্রেনযাত্রীকে জিজ্ঞেস করে শামছু মিঞা।

দুপুর দেড়টার দিকে নরসিংদী রেলস্টেশনে নেমেছে সে। সকাল সাড়ে সাতটায় চট্টগ্রাম থেকে মহানগর প্রভাতি ছেড়েছিল।

স্টেশনে অপেক্ষমাণ যাত্রীটি ডানে বাঁয়ে মাথা নেড়ে জানালেন—তিনি চিনেন না। মুখে বললেন, কিশোরগঞ্জ থেকে আসছি, ঢাকা যাব।’ স্টেশনের বাইরে থেমে থাকা একটি ট্রেন দেখিয়ে বললেন, ‘ইঞ্জিন খারাপ হয়ে গেছে। অন্য গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি।’

শামছু চিন্তিত মুখে বলল, ‘অ।’

শামছু চোখ মেলে চারদিকে তাকাল। এই স্টেশন, এই ব্রাহ্মন্দী, এই স্টেশনবাজার তার অচেনা নয়। নরসিংদীর শিবপুরে বাড়ি ছিল তার। এই স্টেশন দিয়েই বহু বছর আগে সে জন্মস্থান ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল চট্টগ্রামে। স্টেশনচত্বর অনেক সুন্দর হয়েছে, চারদিক ঝকঝকে পরিষ্কার। রেললাইনের উত্তর পাশে, স্টেশনের সামনে নুরুল কবিরের সেই দোকানটি এখনো আছে। আশপাশে অবশ্য বেশ কয়েকটি ঝিলিকমারা দোকান গড়ে উঠেছে। দোকানে দোকানে বাহারি জিনিসের পসরা। সেই মেঘলাদিনের দুপুরে স্টেশনে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে চোখ তুলল শামছু। নরসিংদী সরকারি কলেজ ভবন দেখতে পেল সে। তার মনের চোখে ভেসে উঠল কলেজের টলটলে জলের সরোবরটি। এই সরোবরের দু’দিকে দুটো বিরাট খেলার মাঠ। মাঠের মাঝখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে শহীদ মিনার। এইসব দৃশ্য একের পর এক তার চোখের সামনে ছায়াছবির মতো ভেসে উঠতে লাগল। শামছু হঠাৎ খুব খিদে অনুভব করল। স্টেশনের দক্ষিণ গেইট দিয়ে বের হয়ে সে জগবন্ধু রেস্টুরেন্টে ঢুকল। দুপুরের ভাত খাওয়া শেষ করে কাউন্টারে টাকা দিতে গিয়ে শামছু জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, বীরপুরের জাইল্যা পাড়াটা কোথায়?’

টাকা নেওয়া থামিয়ে বয়োবৃদ্ধ লোকটি শামছুর দিকে তাকালেন। বললেন, ‘আপনি মনে হয় দাসপাড়ার কথা বলতাছেন? মাছ ধরে যারা হেগো কথা কইতাছেন তো?’

‘হ, মাছমারা জাইল্যাগোর কথা কইতাছি।’

‘মাছমারাদের এইখানে জাইল্যা বলে না, বলে দাস। যাই হোক বীরপুরের দাসপাড়াটা এইখান থেইকা আধা মাইল পূর্ব দিকে। হাঁড়িদোয়ার পাশ দিয়া দিয়া আগাইয়া গেলেই পাইয়া যাবেন। তয়, দাসপাড়া খুঁইজতাছেন ক্যান জানতে পারি কি?’ খুচরা টাকা ফেরত দিতে দিতে জিজ্ঞেস করেন বৃদ্ধটি।

‘আছে কাম একটা।’ বলে শামছু দোকান থেকে বের হয়ে এল।

দাসপাড়ার মুখে রামকুমারের সঙ্গেই দেখা হয়ে গেল শামছু মিঞার। গামছা কাঁধে হাঁড়িধোয়ায় স্নান করতে যাচ্ছিল রামকুমার। বাঁশবাজারে মাছ বিক্রি করে ফিরতে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল তার। রামকুমারের পায়ে তাড়া।

হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে উঠেছিল শামছু। রামকুমারের সামনে কোমরদাঁড়াটা টান টান করে জিজ্ঞেস করল, ‘আদাব দাদা, এই পাড়ায় শৈলেশের বাড়ি কোনটা বলতে পারেন?’

রামকুমারের পেটে প্রচণ্ড খিদে। প্রশ্নকর্তার দিকে চোখ কুঁচকে তাকাল রামকুমার। বিরক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কোন্ শৈলেশ, এইপাড়ায় এখন দুইজন শৈলেশ, একজন নরসিংদী কলেজে চাকরি করে, অন্যজন পাগল।’

শামছু দোটানায় পড়ে গেল। শামছু ভাবল-কলেজে চাকরিকরা শৈলেশ কৃষ্ণার বাপ হতে পারে না। শৈলেশ বলেছিল সে লেখাপড়া জানে না। বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, ‘পাগল শৈলেশের বাড়ি?’

‘সামনে হাঁইট্যা গেলে সাত ঘর পরের বাড়িটি। বেশ কটি নারকেল গাছ আছে উঠান ঘিরা।’ বলেই হন হন করে হাঁটা দিল রামকুমার।

শামছু ধীরপায়ে হেঁটে শৈলেশের উঠানে গিয়ে দাঁড়াল। দেখল—দাওয়ায় একজন লোক আলুথালু হয়ে বসে আছে। গায়ে-গতরে ময়লাছয়লা কাপড়চোপড়। মাথায় এক বোঝা কাঁচাপাকা চুল, মুখে লম্বা দাড়ি। উদাস চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।

গলা খাঁকারি দিয়ে শামছু বলল, ‘এই যে ভাই, এইটা কি শৈলেশের বাড়ি?’

লোকটি কোনো উত্তর দিল না। নির্বিকার বসে থাকল। শামছু বিরক্ত মুখে এবার বলল, ‘ঘরে কেউ আছেন নাকি? শৈলেশেরে পাওন যাইবো এই বাড়িতে?’

শামছুর উচ্চকণ্ঠ শুনে এবার ঘর থেকে একজন নারী বেরিয়ে এল। বিশ- বাইশ বছর হবে তার বয়স। তার শাড়ি-ব্লাউজ জানান দিচ্ছে কত দরিদ্র সে। দাওয়া থেকে নামতে নামতে নারীটি জিজ্ঞেস করে, ‘কেডা আপনি? কারে চান?’

‘শৈলেশকে।’ ক্লান্ত কণ্ঠে বলে শামছু।

‘বাবারে চান আপনি? ওই তো বাবা।’ দাওয়ায় বসে থাকা লোকটিকে দেখিয়ে নারীটি বলে।

‘তুমি সোমা, তাই না?’ শামছু বলে।

‘হ, আপনারে তো চিনলাম না, আপনি আমার নাম জানেন কেমনে?’

‘বলতাছি, বলতাছি। তার আগে আমারে একটু বসতে দাও, এক গেলাম পানি দাও।’

বিস্মিত সোমা শামছুকে দাওয়ায় বসতে দিল। পানি আনতে ভিতরে গেল।

শামছু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল লোকটির দিকে! এই কি শৈলেশ! না না, এ শৈলেশ হতে যাবে কেন? শৈলেশ এত বুড়িয়ে যাবে কেন? আর একে তো পাগল পাগল মনে হচ্ছে। শৈলেশ পাগল হতে যাবে কেন?

সোমা পানি নিয়ে ফিরে এল। শামছুর হাতে দিতে দিতে বলল, ‘ওইতো আমার বাবা। আপনি যারে খুঁজতাছেন। মানুষে কয় –বাবা নাকি পাগল অইয়া গেছে।’

‘আমি বিশ্বাস করি না।’ শামছু তড়িদ্‌বেগে শৈলেশের কাছে গেল, হাতদুটো ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, ‘শৈলেশ, অ শৈলেশ। তোমার শামছু দাদা আইছি। কথা কও।’

শৈলেশ নির্বিকার। উদাস চোখে শামছুর দিকে তাকিয়ে থাকল শুধু।

‘বাবা কথা কয় না। কাউরে চিনে না। সকাল থেইক্যা দাওয়ায় বইসা থাকে। কিছু দিলে খায়, না দিলেও দাবি করে না।’ করুণ কণ্ঠে সোমা বলল।

শৈলেশ তো এই রকম আছিল না। এই রকম অইল কেমনে?’ ভেঙেপড়া গলায় শামছু জিজ্ঞেস করে।

‘মায় মারা যাওয়ার পর বাবার মাথা একটু আউলা-ঝাউলা অইয়া উঠছিল। দিদি পালিয়ে যাবার পর একেবারে ছিঁড়া পাগল অইয়া গেল। একে তাকে মারতে চাইত, নানারকম গালিগালাজ করত। তারপর কেন জানি না, একদিন বাবার লাফানি-ঝাঁফানি থাইম্যা গেল। কথা বলাও বন্ধ কইরা দিল বাপে।’

‘আর তুমি? তোমার কী হল?’

‘আর আমি! পাড়ার মানুষরা একদিন কমলহরির লগে আমার বিয়া দিয়া দিল। কমলহরির ঘরবাড়ি নাই, কোথা থেইক্যা ভাইস্যা ভাইস্যা এই দাসপাড়ায় আইসা পড়ছিল। বিয়ার পরে হে এইখানে থাকে। হাঁড়িদোয়ায়, মেঘনায় জাল বায়।’ অশ্রুভরা চোখ নিয়ে কথাগুলো বলে গেল সোমা।

শামছু এবার ভালো করে তাকিয়ে দেখল—চারদিকে গরিবিয়ানা। জীর্ণ ঘরদুয়ার। শৈলেশ আর সোমার জামাকাপড় ফকিরের মতো। শামছুর মনটা হঠাৎ করে ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। সোমার স্বামী এখন কোথায়, ওরা ঠিকঠাক মতো দু’বেলা খেতে পায় কিনা এসব জানতে মন চাইল না শামছুর। শুধু ভাবতে লাগল—কী জঘন্য গুনাহটাই না করেছে সে! এই রকম গরিব আর সরল ঘরের একটা মেয়েকে সে মাগিপাড়ায় বেচে দিয়েছে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ।

একটা সময়ে মুখ খুলল শামছু। কর্ণফুলী নদীর পারে শৈলেশের সঙ্গে দেখা হবার কথা, তার বাসায় আশ্রয় দেওয়ার কথা, বেশ কয়েকটা দিন ও রাত এক সঙ্গে কাটানো আর মেয়েদের কথা বলে শৈলেশকে বীরপুরে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা—সবই বিস্তারিত বলে গেল সোমার কাছে। শুধু বলল না সে কী কাজ করত আর বলল না এই শৈলেশের বড় মেয়েটাকে বেশ্যাপাড়ায় সামান্য টাকার বিনিময়ে বেচে দেওয়ার কথা।

কৃষ্ণা যে তাকে এখানে পাঠিয়েছে—সেটাও বেমালুম চেপে গেল শামছু। কথা শেষ করে শামছু গভীর দৃষ্টিতে শৈলেশের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর আবেগিকণ্ঠে বলল, ‘শৈলেশ, তাকাইয়া দেখ তোমার শামছু দাদা আইছে, তুমি কইছিলা—একদিন আমার বাড়িতে যাইও দাদা। আমি আইছি। তাকাইয়া দেখ তুমি। কথা কও শৈলেশ, কথা কও।’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলল শামছু।

এই নিরপরাধী নির্বিরোধী লোকটির হাতে কী করে তার বড়মেয়ের শরীরবেচা টাকা তুলে দেবে শামছু! জীবনে অনেক অনেক গুনাহ করেছে সে। এই পাপটি সে আর করতে চায় না। কিন্তু শৈলেশদের পরিবারের যে দুরবস্থা, তাতে টাকার ভীষণ প্রয়োজন। তাছাড়া, কৃষ্ণা বলে দিয়েছে যে করেই পার টাকাটা বাপের হাতে গছিয়ে এস শামছু চাচা। না না, সে বাপের হাতে মেয়ের দেহবেচা টাকা তুলে দিতে পারবে না। কোমর থেকে টাকার বান্ডেলটা বের করল শামছু। সোমার দিকে এগিয়ে ধরে বলল, ‘এই গুলা রাখ সোমা। তোমাগোর কামে লাগবো।’

‘আপনার টাকা আমি নিমু ক্যান?’

‘ধর, ছোটভাই শৈলেশকে বড়ভাই শামছু দিয়া যাইতাছে। লও।’ টাকাটা সোমার হাতে গুঁজে দিল শামছু। মুখে বলল না—এই টাকা তোমাদের সোমা। তোমার বোনই এই টাকা পাঠিয়েছে। তোমরা নিদারুণ অপমান বা গভীর দুঃখে কৃষ্ণার কথা ভুলে থাকতে চাইছ, আমি আসার পর থেকে একবারের জন্যেও তেমন করে কৃষ্ণার কথা পাড়নি। কিন্তু কৃষ্ণা তোমাদের ভোলেনি। সে-ই এই টাকাটা তোমাদের হাতে গছিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে আমাকে এই বীরপুরে পাঠিয়েছে।

সোমা হাত পেতে টাকাটা নিল। শৈলেশের হাত ধরে শামছু বলল, ‘এবার যাই শৈলেশ। একটা দায়িত্ব শেষ করলাম। আর একটা কাজ বাকি রইয়া গেছে। সেটা শেষ করতে অইবো।’

সোমা জিজ্ঞেস করল, ‘কী কাজ চাচা?’

‘তুমি বুঝবা না, তোমাকে বলা যাইবো না। যাই মা।’ একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাওয়া থেকে উঠানে নেমে এল শামছু।

নরসিংদী স্টেশনে এসে স্থির হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল শামছু। এবার দ্বিতীয় কাজটি শেষ করতে হবে তাকে।

কিন্তু কোথায় পাবে তাকে? কোথায় পাওয়া যেতে পারে তপইন্যারে। শামছুর মনে পড়ল-কৃষ্ণা বলেছিল, নরসিংদী রেলস্টেশনে ফল বেচত তপন। কিন্তু তপনকে তো শামছু চিনে না। তেমন করে তপনের শারীরিক বিবরণও বলেনি কৃষ্ণা। আচ্ছা, তপন তো ফল বেচত, ফলবিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়? তাকিয়ে দেখল—স্টেশনের চত্বরে টিন শেইডের নিচে সারি সারি ফলবিক্রেতা। সেদিকে এগিয়ে গেল শামছু বুড়োমতন একজনের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা ভাই, তপন বলে একজন এইখানে ফল বেচতো না? হেরে কোথায় পাই বলেন তো?’

লোকটি একজন ক্রেতাকে লটকন মেপে দিচ্ছিল। দাম বুঝে নিয়ে এবার শামছুর দিকে তাকাল। ‘তপনের কথা কইতাছেন? আছে এইখানে। তবে অহন হে ফল বেচে না, ভিক্ষা করে।’

‘মাইনে?’ অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে শামছু।

রেললাইনের উত্তর দিকে লাল ইটের একটি ঘর দেখিয়ে ফলবিক্রেতা বলল, ‘ওই ঘরেই মফজল নামের একজনের লগে থাকত তপন। গত বছরের আগের বছর ফল বেইচ্যা ওই ঘরে যাওনর সময় ‘গোধূলি’ আইয়া পড়ল তার উপর। অন্যমনস্ক আছিল বোধ হয়। জানে মারা গেল না তপন। তয়, ডান পা আর বাম হাতের কব্জি কাটা গেল তার। ফল বেচা বন্ধ অইল। মফজল ঘর থেইক্যা বাইর কইরা দিল। অহন ভিক্ষা করে স্টেশনে বইস্যা বইস্যা।’

‘কোন খানে তারে পামু?’

‘ও-ই, সেগুন গাছটা পইড়া কাইত অইয়া আছে না? ওই খানেই ভিক্ষা করে তপন।

‘আইচ্ছা ভাই, উপকার করলেন, আছসালামালাইকুম ভাইজান।’ বলে সেগুন গাছটার দিকে হন হন করে হাঁটা শুরু করল শামছু

‘দুইটা পইসা দেনগো বাজান, এই ভাই, একটা টাকা দিয়া যান। গত দুইবেলা কিছু খাই নাই। দয়া করেনগো মা-খালারা।’

কাছে পৌছাবার আগেই তপনের কাকুতি শামছুর কানে পৌঁছে। কাছে গিয়ে কোনো ভূমিকা না করে শামছু জিজ্ঞেস করে, তুমি তপন? নারায়ণগঞ্জ না তোমার বাড়ি? মফজলের সঙ্গে থাকতা না তুমি?’

এতগুলো প্রশ্নে তপন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, ‘হ, আমিই তপন। তয়, আপনি কেডা?’

তপনের কথার কোনো উত্তর দিল নূচ শামছু। বলল, ‘তুমি দুইবেলা ধইরা কিছুই খাও নাই, না?’

তপনের মুখে ক্ষুধার যন্ত্রণা ফুটে উঠল। থুতু গিলে বলল, ‘হ, খাই নাই।’

‘চল, আমি তোমারে খাওয়ামু।’

তপন অবাক হয়ে শামছুর দিকে তাকিয়ে থাকল। বলল, আপনি খাওয়াইবেন? ভাত?’

‘হ, তোমারে আমি ভাত খাওয়ামু। চল।’

তপন ব্র্যাচে ভর দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে ধপাস করে পড়ে গেল। তার জামাকাপড় নোংরা। দুর্মর একটা দুর্গন্ধ তাকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। তাকে জগবন্ধু রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল শামছু। কিন্তু রেস্টুরেন্টের মালিক তপনকে ভেতরে ঢুকতে দিতে রাজি হল না। তবে দোকানের বাইরে উঁচুমতন একটা জায়গায় বসার ব্যবস্থা করে দিল মালিক শ্যামলাল সাহা। হোটেলবয় এসে তপনের সামনে থালাভর্তি ভাত-মাছ-মাংস রাখল। গোগ্রাসে খেতে লাগল তপন।

একটা সময়ে তপন খাওয়া শেষ করল। তৃপ্তির ঢেকুর তুলল একটা। চারদিকে কৌতূহলী মানুষের ভিড় জমে গেল। শামছুর পরনেও তত ভালো কাপড়চোপড় নেই। তাকেও দরিদ্রের মতন দেখাচ্ছে। এক দরিদ্র আরেক ভিক্ষুককে ভাত খাওয়াচ্ছে। এই মফস্বল শহরে এই দৃশ্য সাধারণ মানুষকে তো কৌতূহলী করবেই!

শামছু জিজ্ঞেস করল, ‘খাইলা তপন, তৃপ্তি মতন খাইলা?’

তপন ময়লা জামায় হাত মুচতে মুচতে বলল, ‘হ খাইলাম। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক।’

শামছু কিছু না বলে পকেট থেকে একশ টাকার একটা নোট বের করে তপনের হাতে দিল। তপন পরম আগ্রহে হাত পেতে নিল টাকাটা। তার মন আনন্দে ভরে উঠল।

এই সময় হঠাৎ বেমক্কা একটা লাথি কষাল শামছু তপনের মাথা বরাবর। লাথিটা খেয়ে ঘুরে পড়ে গেল তপন। কৌতূহলী মানুষরা আরও কৌতূহলী হয়ে উঠল। ঘটনা কী? খাইয়ে দাইয়ে বেমক্কা লাথি!

শামছু তখন বলছে, ‘খানকির পোলা তপইন্যা। মাগির রান বেচা টাকায় ভাত খাইলি তুই আজ।’ বলেই স্টেশনের দিকে হন হন করে হেঁটে গেল শামছু।

স্টেশনে তখন চট্টগ্রামগামী ‘গোধূলি’ শেষ হুইসেল বাজাচ্ছে।

.

আজ সকল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে আড়মোড় ভাঙতে ভাঙতে অনেক বেলা হয়ে গেল। বেশি বেলাতেই পশ্চিমগলির পতিতারা কুয়াপারে এসেছে। সবসময় জানালাহীন গুমোট ঘরে থাকতে থাকতে তাদের দম আটকে যায়। জোরে ফ্যান ঘুরিয়েও ঘরের গুমোটভাব যায় না। মগ-কাটা পানিতে স্নান করতে করতে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এই সব মেয়েরা বৃষ্টি হলে তাই খুশি হয়, বৃষ্টিতে ভিজতে তাদের অশেষ আনন্দ। আজ এই আনন্দ নিয়েই ইলোরা, বনানী, বেবিরা কুয়াপারে জমায়েত হয়েছে। বৃষ্টি মাঝেমধ্যে ঝাঁপিয়ে আসছে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ইলোরা গান ধরেছে-

মাটিতে পড়িলে বীর্য রোদ্দুরে শুকায়।
জলেতে পড়িলে বীর্য পুঁটি মাছে খায়।
সেই বীর্য খেয়ে বিধবা গর্ভবতী হয়।
তাহার সন্তানেরে লোকে বোকাচোদা কয়।

গান থামলে বেবি বলে ওঠে, ‘আইচ্ছা ইলোরাদি, কৈলাসবাবুরে আমার হাবা হাবা মনে হয়, বোকাচোদা যেন।’

বনানী বাধা দিয়ে বলে, ‘বেবি, কৈলাসবাবুকে নিয়ে ঠাট্টা মসকরা কইরো না। তুমি বুঝতে পারছো না উনি আমাগোর স্বার্থের জন্য খাটতাছেন?’

‘হ, উনি আমাগোর কথা চিন্তা করতাছেন বইল্যা মনে অইতাছে। তই, উনি বেশি বেশি গাম্ভীর্য অইয়া থাকেন, অধ্যাপকগো মতন।

ইলোরার মুখ আবার ঝলসে ওঠে। বলে, ‘বেবি, জানসনি গাম্ভীর্য কারে কয়?’

বেবি ইলোরার দিকে তাকিয়ে থাকে। ইলোরা বলে, ‘গামলা ভরা বীর্যরে কয় গাম্ভীৰ্য।’

‘কীরে ইলোরা তোর মুখ দিয়া আইজকা শুধু ময়লা ময়লা কথা বাইর অইতাছে, ঘুইরা ফিরা বারবার বীর্যর কথা চলে আসতাছে তোর কথায়। বনানী বলে।

বনানীর কথার কোনো জবাব না দিয়ে বেবিকে উদ্দেশ্য করে ইলোরা আবার বলে, ‘অধ্যাপক মানে জানসনি? অর্ধেক ঢুকিয়ে ফকাফক মারাকে অধ্যাপক বলে।’

বনানী এবার গম্ভীর হয়ে থাকতে পারল না। হি হি করে হেসে উঠল হাসতে হাসতেই বনানী বলল, ‘আইচ্ছা, যারে লইয়া এত হাসিঠাট্টা করতাছস হেই কৈলাসবাবুর কথা কিছু ভাবছস?’

‘কোন কথা?’ ইলোরা জিজ্ঞেস করে।

‘ওইযে আশিভাগ টাকা রাইখ্যা দেওয়া, সপ্তাহে একদিন ছুটি।’ বনানী মনে করিয়ে দেয়।

সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বেবি বলে, ‘সর্দার-মাসিরা আমাগো ওই রকম করতে দিব? করতে দিব না।’

‘চেষ্টা করতে দোষ কি। চল, আগামী শুক্রবার থেইকা আমরা এই দুইটা কাম শুরু করি—আশিভাগ টাকা রাইখ্যা দেওন আর সপ্তাহে একদিন কাস্টমার না বসান।

সবাই বলল, ঠিক আছে। আগামী শুক্রবার থেইক্যা।’

.

‘তুমি নাকি এই পাড়ায় মিটিং করে বেড়াচ্ছ? আশিভাগ টাকা রেখে দেওয়া, সপ্তাহে একদিন ছুটি—এইসব?’ দুপুরে খাবার টেবিলে মোহিনী মাসি জিজ্ঞেস করে কৈলাসকে।

‘হ্যাঁ মা, মিটিং করেছি। এই পাড়ায় অভাগা মেয়েদের মন্দিরচত্বরে আমি ডেকে এনে বলেছি, মাসি আর সর্দারকে কুড়ি পারসেন্ট টাকা দেওয়ার জন্য। প্রত্যেক কাজে সপ্তাহে একদিন ছুটি পাওয়া যায়। এই পাড়ার মেয়েদের সারাটা সপ্তাহ কাজ করতে হয়। আমি মিটিং-এ একদিন ছুটির কথা বলেছি।’ ধীরে ধীরে কৈলাস বলে।

মোহিনী বলল, ‘তুমি ঠিকই বলেছ। তবে বাইরের জগতের নিয়ম এই পাড়ায় খাটবে না। বাইরের আইন এখানে চলতে দেবে না সর্দার আর মাসিরা।’

তুমি মেনে নেবে কিনা বল মা?’ কৈলাস জানতে চায়।

‘আমি একজনে মানলে চলবে না। সবাইকে মানতে হবে। সবাই না মানলে আমি একা এই নিয়ম এই পাড়ায় চালু করতে পারব না। জোর করে চালু করতে চাইলে সবাই মিলে আমার বড় ক্ষতি করে বসবে।’ মোহিনী বলে।

অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকল কৈলাস। মোহিনী কৈলাসের অসহায়তা বুঝতে পারল। বলল, ‘বাবা, আমি কোনোদিন তোমার কাজে বাধা দেব না। তবে তুমি বাধা পাবে, অন্যরা বাধা দেবে।’

‘আমি সেটা জানি মা।’

শেষ গ্রাস মুখে তুলে দিতে দিতে মোহিনী বলে, ‘একটু সাবধানে থাকিস বাবা, সর্দার তোর পিছনে লেগেছে। রাতবিরাতে ঘরের বাইরে যাসনে।’

প্রেমদাশ বলেছে—বড়মা, কালু সর্দার তোমার বড় ধরনের ক্ষতি করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে। মন্দিরে তার মায়ের সেদিনের অপমান সে ভুলতে পারেনি। আর দেবযানীকে হারানোর ব্যথা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। দেবযানীকে দিয়ে তুমি যে এত এত টাকা কামাচ্ছ, সেটা কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না সর্দার। কেউ দেবযানীর কথা তার সামনে তুললে ক্ষেপে যাচ্ছে কালু সর্দার। হায়েনার মতো চোখ লাল করে তাকিয়ে থাকছে। আর ইদানীং কৈলাসদাদা নাকি পাড়ায় কী কী করছে। জারজ সন্তানদের বলে শিক্ষা দিচ্ছে। এই পাড়ার পতিতাদের নাকি সর্দার আর মাসিদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে। সেদিন নাকি মন্দিরের উঠানে দাদাকে সর্দার আর তার মাস্তানরা কী কী সব বলেছে। সব মিলে তোমার উপর খুব রেগে গেছে কালু সর্দার। কোনো ক্ষতি করে বসবে বলে আমার খুব ভয় করছে বড়মা। তুমি দাদাকে সাবধান করে দাও। পাড়ায় এসব কথাবার্তা বলতে মানা করে দাও। তুমি আমার কথাকে হালকাভাবে নিও না বড়মা। আমার কাছে পাক্কা খবর আছে। দাদাকে রাতবিরাতে ঘরের বাইরে যেতে মানা করে দিও।

সেদিন খাবার টেবিলে মোহিনীর কথা শুনে হেসে উঠেছিল কৈলাস। বলেছিল, ‘আমার তো কোনো শত্রু নেই মা। কে আমার ক্ষতি করবে?’

‘আমার আছে, শত্রু আমার আছে।’ বলে চেয়ার ঠেলে উঠে পড়েছিল মোহিনী মাসি।

বেসিনের দিকে যেতে যেতে বলেছিল, ‘এই পাড়ায় সবাই সবার শত্রু। মেয়েদের শত্রু সর্দার-মাসি-মাস্তানরা। আবার মাসিদের শত্রু সর্দার- মাস্তানরা। সর্দার নিরীহ ম্যাদামারা মাসিদের পছন্দ করে। আমি ম্যাদামারা নই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলি আমি। এই জন্যে কালু সর্দার আমাকে শত্রু মনে করে। মনে করে—আমি তার বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছি। আমার ক্ষতি করতে তাই সে উঠেপড়ে লেগেছে। সে জানে—আমার সবচাইতে বড় দুর্বলতা তুমি। সেই দুর্বল জায়গায় আঘাত দিতে সে দ্বিধা করবে না। তাই বলছিলাম, সাবধানে চলাফেরা করিস বাবা। তোর জন্যে যাতে আমাকে চোখের জল ঝরাতে না হয়।’

কৈলাস এতক্ষণ মায়ের কথা চুপচাপ শুনল। তারপর বলল, ‘তুমি অস্থির হয়ো না মা। আমি সাবধানে থাকবো।’

সেরাতে দোতলায় তার অফিসঘরে বসেছিল মোহিনী। মেয়েদের কামাইয়ের টাকা দিতে এসেছে প্রেমদাশ। টাকা দিয়ে চলে যাবার সময় পেছন থেকে ডাকল মোহিনী, ‘প্রেমদাশ, শুনে যাও।’

প্রেমদাশ ঘুরে দাঁড়ালে মোহিনী বলল, ‘কালু সর্দারকে বেশি বাড়তে দেওয়া যাবে না। সে আমার বড় ধরনের ক্ষতি করার জন্যে ঠিক করেছে। কিন্তু আঘাত দেওয়ার আগে শত্রুকে আঘাত করা আমার ধর্ম। তুমি খবর নাও, সর্দারের দুর্বলতা কোথায়।’

‘খবর আমার কাছে একটা আছে বড়মা। মন্দিরের পুরোহিত বলেছেন- মন্দিরের পিছনের একচালাতে কালু সর্দার ধামা-ফারুইক্কাকে লুকাই রাখছে। ফারুইক্কাকে পুলিশে খুঁজতেছে। সীতাকুণ্ডের জসিম মেম্বারকে খুন করেছে এই ফারুইক্কা। অনেক টাকার বিনিময়ে নাকি ফারুইক্কাকে আশ্রয় দিছে কালু সর্দার। সর্দারের আকাম-কুকাম পুরোহিত পছন্দ করেন না। প্রতিবাদও করতে পারেন না। সেদিন একা পাইয়া গজরাতে গজরাতে খবরটা দিলেন আমাকে।’ বলে গেল প্রেমদাশ।

মোহিনী চোখ ছানাবড়া করে বলল, ‘তাই নাকি? জব্বর খবর তো? কাউকে বল না এই সংবাদ।

কী যেন চিন্তা করে মোহিনী আবার বলল, ঠিক আছে প্রেমদাশ, তুমি এখন যাও।’

ষোলো

সকাল এগারোটার বেশি হবে না।

ড্রইংরুমের ছোট্ট বিছানাটিতে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে দেবযানী। তার দু’গণ্ড বেয়ে অশ্রুর ধারা গড়িয়ে পড়ছে। গত রাতে লম্বা চুলে বেণি করেছিল দেবযানী। আজ এই এত বেলা পর্যন্ত বেণি খোলেনি। চোখের কাজল ছড়িয়ে গেছে চারদিকে।

আজ সকালে আলস্য জড়িয়ে ধরেছিল তাকে। গত রাতে তাকে চারজন কাস্টমারকে দেহ দিতে হয়েছে। চতুর্থ জনকে ঘরে তুলতে গড়িমসি করেছিল দেবযানী। পদ্মাবতীকে দিয়ে অনুরোধ পাঠিয়েছিল মোহিনী—— সরকারি বড় অফিসার। ঢাকা থেকে বন্ধুর বাসায় বেড়াতে এসেছে। দেবযানীর কাস্টমার হতে খায়েস হয়েছে তার। তাকে ঘরে তুললে খুশি হবে মোহিনী মাসি।

শরীর যতই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ুক না কেন, মোহিনী মাসির ইচ্ছেকে কখনো অবহেলা দেখাবে না দেবযানী। কোথা থেকে কোথায় তুলে এনেছে তাকে এই মোহিনী মাসি। কালু সর্দারের ঘরে পঞ্চাশ টাকার মাগি ছিল সে। আজ তার নর্মাল ভিজিট হাজার টাকা। কাশুড়ে বুড়া থেকে সাম্পানের ল্যাংড়া মাঝিকে পর্যন্ত শরীর দিতে বাধ্য হয়েছে সে। এক রাতে কতজনকে যে দেহ দিতে হয়েছে! সে সময় আয়ের একটা টাকাও হাতে পায়নি দেবযানী। সব কেড়েকুড়ে নিয়ে যেত কালু সর্দার।

আর আজ? আয়ের টাকার অর্ধেকের মালিক সে। তার হাতে যে আজ এত টাকা, তার চারদিকে যে আজ এত জৌলুস, তার কব্জায় যে আজ এত প্রতিপত্তি—সবই তো মোহিনী মাসির দয়ায়। ডাস্টবিনের কাছে একদিন ধুঁকে ধুঁকে মরত সে, যদি না সেদিন রাস্তা থেকে তাকে কুড়িয়ে না আনাত মোহিনী মাসি। ডাক্তারের পেছনে কত টাকা খরচ করেছে! এই মাসির জন্যে দেবযানী জান দিতে প্রস্তুত। অতিরিক্ত একজন খদ্দেরকে ঘরে তোলা তো সাধারণ ব্যাপার। রাজি হয়ে গিয়েছিল দেবযানী।

অফিসারটি বিছানায় এসে বুঝিয়ে দিয়েছিল সে মহা বুভুক্ষু। দু’দুবার ভোগ করার পরও সে শান্ত হয়নি। তৃতীয়বার দেবযানীকে প্ররোচিত করতে শুরু করেছিল। দেবযানী রাজি হয়নি। অফিসারটি চলে গেলে শরীরে অশেষ ক্লান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল দেবযানী। সকালে উঠতে উঠতে তাই দেরি হয়ে গিয়েছিল।

হাতমুখ ধুয়ে দেবযানী চা খেতে না খেতেই শামছু এসে হাজির হয়েছে। শামছু ড্রইংরুমের হাতলহীন চেয়ারে বসে আদ্যপ্রান্ত সব ঘটনা বলতে শুরু করেছে। বাপের কথা, বোনের কথা শুনতে শুনতে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে দেবযানী। একসময় কান্না থামল দেবযানীর। জিজ্ঞেস করল, ‘সত্যিই কি আমার বাবা পাগল হয়ে গেছে চাচা?’

‘আমার কিন্তু তা মনে হয় নাই। কোনো হইচই নাই, গালিমালি দেয় না কাউরে। শুধু বইয়া থাকে, নির্জীব বইয়া থাকে। আমি এতক্ষণ আছিলাম একবারের জন্যও কোনো কথা কইল না। যার লগে এত খাতির, সেই আমি যখন হের হাত ধইরা ঝাঁকাইলাম, একবারের জইন্যও ফিরা তাকাইল না আমার দিকে, কী আচ্ছায্য?’ বলল শামছু

‘আর সোমা?’ জানতে চাইল দেবযানী।

শামছু বলল, ‘আমার মনে অইল অভাবের চাপে মাইয়াডা চেপ্টা অইয়া গেছে। তারে দেইখ্যা আমার মনে অইল গত দুইবেলা পাতে ঠিকঠাক মতো ভাত পড়ে নাই। জামাইডারেও আশপাশে দেখলাম না। টাকাগুলো পাইয়া চোখমুখ যে কী রকম চিকচিক কইরা উঠল তোমারে বুঝাইতে পারমু না।’

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেবযানী বলল, ‘হায়রে টাকা! এই টাকার আসল রহস্য যদি সোমা জানতে পারত, তা হলে কখনো এই টাকা ছুঁয়েও দেখত না সে। বড় জেদি মেয়ে সোমা।’

‘তোমারে না জানাইয়া আমি একটা অন্যায় কাম কইরা ফালাইছি। রতইন্যারে লাথি মারছি একটা, মাথা বরাবর।’ শামছু প্রসঙ্গান্তরে গেল।

তপনের নাম শুনে দেবযানীর চোখ জ্বলে উঠল। সেই চোখে শুধু ঘৃণা— থিকথিকে ঘৃণা। তারপর দেবযানী উৎসুক হয়ে উঠল। বলল, ‘ওই শুয়োরের বাচ্চাকে খুঁজে পেলে তুমি?’

‘শুধু খুঁইজ্যা পাইনি, ভাতও খাওয়াইছি ওই ভিক্ষুকের বাইচ্চারে।’ তারপর দম নিয়ে শামছু তপন-সংক্রান্ত সকল ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ বলে গেল। কথা শেষ করে শামছু বলল, ‘ঠিক করিনি মা? আমি কি অন্যায় করেছি?’

‘চাচা, এতদিন তোমার ওপর আমার যে ক্ষোভ ছিল, তা আজ ধুয়ে মুছে গেল। এই হারামির পোলার জন্য আজ আমার এই দশা! আমার বাবা পাগল হয়ে গেছে ওই কুত্তার বাচ্চার জন্যে। বেশ্যার কামাইয়ের টাকা দিয়া সেই হারামিকে গু খাইয়ে এসেছ, তার মাথায় লাথি মেরে এসেছ, তাকে আবার একশ টাকা দিয়ে এসেছ, সেই টাকা দিয়ে ওই মাগির ছেলে আবার ভাত খাবে, চা-বিস্কুট খাবে! কী আনন্দ হচ্ছে আমার! তোমার সব অপরাধ ক্ষমা করে দিলাম আমি। সব অপরাধ।’ বলতে বলতে হাউমাউ করে উঠল দেবযানী।

শামছু পাথর হয়ে বসে থাকল। লম্বা ঘোমটা টেনে পদ্মা ঘরের টুকটাক কাজ করে যেতে লাগল। সাহেবপাড়ার এই ক্ষুদ্র ঘরটিতে একজন বেশ্যার জীবনকাব্য এভাবে রচিত হতে থাকল।

আর বেশ্যাপাড়ার বাইরের জীবনপ্রবাহ যথারীতি প্রবাহিত হতে থাকল। এ জীবনে আছে বেশ্যা- খদ্দেরের খিস্তিখেউর, বেশ্যা বেশ্যার খিটিমিটি, আছে পতিতাদের একক, নিঃসঙ্গ, নিরাপত্তাহীন জীবনযাপনের অসহায়তা, আছে চুরি-ছিনতাই, গুণ্ডা-মাস্তানদের চাঁদা তোলা। এ জীবন অস্থির, অপরাধপ্রবণ, ক্ষণস্থায়ী।

এই রকম একটা বিপন্ন-বিপর্যস্ত গণ্ডিবদ্ধ জীবনবৃত্তের মধ্যে অন্যমাত্রার জীবন তৈরির কাজে মগ্ন হয়ে পড়েছে কৈলাস। বেশ্যাপাড়ার কলুষতাকে এড়িয়ে ছোট ছোট জারজ সন্তানদের নিয়ে সে একটা স্বপ্নজগৎ তৈরি করতে চাইল। নিরাপত্তাহীন অভাবী পতিতাজীবনে কিছুটা স্বস্তি আনতে চাইল। এ তার একক প্রচেষ্টা। তার চারদিকে অন্য আরেকজন কৈলাসকে সে খুঁজে পেল না। পাড়ার বয়স্ক ও যুবকদের মধ্য থেকে কেউ তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়াল না। বরং তাকে নিয়ে সবাই ঠাট্টা মশকরা শুরু করল। বাচ্চাদের পড়ানোর কাজটিকে, বেশ্যাদের সচেতন করার ব্যাপারটিকে পাগলামি বলতে লাগল। সে যখন গলি দিয়ে হেঁটে যায়, উপগলির চিপাচাপা থেকে ভেসে আসে—’কে-লা-স মাস্ট-র।’

এটা যে উপহাসের ধ্বনি সেটা বুঝতে কৈলাসের বেগ পেতে হয় না। সর্দারের সাঙাতরা মাঝে মাঝে তার গায়ে এসে ধাক্কা খায়, মুখে ক্রূর হাসি ছড়িয়ে সরি বললেও কৈলাসের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এটা সর্দারের কারসাজি। তারপরও হাল ছাড়ে না কৈলাস। পড়ুয়াদের নিয়ে মন্দিরচত্বরে বসে, নিজের মতো করে তাদের পড়িয়ে যায়।

কালু সর্দার এটা সহ্য করে না। এক সন্ধ্যায় পুরোহিতকে বলে, কৈলাসেরে কইয়া দিবেন, এটা মন্দির, ধর্মকর্মের জায়গা। পবিত্ৰস্থান এইডা। বেশ্যাগো পোলামাইয়া আইনা এই পবিত্র জায়গা অপবিত্র করনর চেষ্টা যাতে না করে মোহিনীর পোলা। হে এই মন্দিরেরে বিশ্ববিদ্যালয় বানাইতে চায়। কৈলাসেরে কইয়া দিবেন এই পাড়াড়া বিশ্ববিদ্যালয় না, বেশ্যাবিদ্যালয়।’

পুরোহিত বিরক্ত কণ্ঠে বলেন, কৈলাস তো খারাপ কাজ কিছু করছে না। এই পাড়ার অসহায় সন্তানদের পড়ালেখা শেখাচ্ছে।’

‘রাখেন আপনার পড়ালেখা। বেশ্যার সন্তানদের আবার লেখাপড়া! যা কইছি, হেইডা শুনেন, এইখানে পড়ালেখা শিখানো বন্ধ।’ উষ্ণ কণ্ঠে বলে

উঠে কালু।

‘আমি তো কৈলাসের কাজের মধ্যে কোনো অন্যায় দেখছি না। বরং তাকে নিষেধ করাটা অন্যায়।’ অকম্পিত কণ্ঠ পুরোহিতের।

‘চুপরাও দুই টেইক্যা ব্রাহ্মণ। যা বলতাছি, তা করবা। তালবেতালের কথা কইতাছ ক্যান?’ গর্জে ওঠে সর্দার।

আজকে কেন জানি পুরোহিতের সকল ভয় কেটে গেছে। সর্দারের সামনে এলে পুরোহিতের বুকে দুরু দুরু কাঁপন জাগত। আজকে বুকে কোনো কাঁপন অনুভব করলেন না পুরোহিত। বরং সর্দারের এই অন্যায় আদেশের প্রতিবাদ করার জন্যে মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল। সাহসে ভর করে পুরোহিত একেবারে বরফশীতল কণ্ঠে বললেন, ‘সর্দার, তুমি ভুলে গেছ আমি এই পাড়ার কুলগুরু। আমার যে অনেক বয়স হয়েছে, সেটাও অহংকারের ঠেলায় স্বীকার করছ না। মনে রেখ- আমি কালু সর্দারের পুরোহিত নই। এই পাড়ার সকল অধিবাসীর পুরোহিত আমি। তোমার ওই অন্যায় আদেশ মানতে বাধ্য নই আমি।

কালু সর্দার সামান্য একজন পুরোহিতের দুঃসাহস দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল। সে এলে যে-পুরোহিত থরথর করে কাঁপে, চেয়ার এগিয়ে দেয়, নানারকম তোষামুদে কথা বলে, তার আজ এত দুঃসাহস হল কীভাবে? এ নিশ্চয়ই মোহিনী খানকির জারজ পোলার উস্কানি। রাগ তার মাথায় চাগিয়ে উঠতে চাইল। বামুনের টুটি চেপে ধরতে ইচ্ছে করল, পাছা বরাবর একটা লাথি মারতে ইচ্ছে হল সর্দারের। কিন্তু বামুনকে এই পাড়ার বেশ্যা- মাস্তান-দালাল সবাই শ্রদ্ধা করে। বামুনের গায়ে হাত তুললে সবাই ক্ষেপে যাবে।

অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করল সর্দার। পুরোহিতের কানের কাছে মুখ নিয়ে চাপাস্বরে কালু বলল, ‘বেশি বাড় বাইরো না বামুনের বেটা। পাখা গজাইছে তোমার? তোমার পাখনা কাটার ব্যবস্থা করতাছি আমি।

এই সময় মন্দিরের গেইট দিয়ে অনেকটা ছুটে এল সুবল। সর্দারের কানের কাছে মুখ নিয়ে কী যেন বলল। সর্দার পুরোহিতের কাছ থেকে দূরে সরে এল। তারপর গর্জে উঠল, ‘কী কস তুই সুবইল্যা, মাগিগো এত বড় সাহস!’

‘হ ওস্তাদ, পশ্চিমগলির মাইয়ারা কইতাছে আজ শুক্রবার হেরা কোনো কাস্টমার তুলবো না ঘরে। বলতাছে আজকে নাকি হেগোর বিশ্রামের দিন।’ সুবল বলে।

‘কী কস তুই, হাঁচা কইতাছস?’ ক্রোধ এবং বিস্ময় মাখানো কণ্ঠ কালু সর্দারের।

‘পশ্চিমগলির মাসিরাই তোমার কাছে আইতাছিল। আমি আর জামাল তোলা তুইলতে যাইতাছিলাম হেই দিকে। মাসিগো লগে দেখা। কইলাম – চল, ওস্তাদের কানে তোলার দরকার নাই। আমরাই সমাধান করুম।’

কালু অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল, ‘তারপর কী করলি, তাড়াতাড়ি ক। পারছস সমাধান দিতে? হারামজাদিরা কাস্টমার তুলতেছে তো ঘরে?’

সুবল বলল, ‘না ওস্তাদ। খানকিদের একথা আজকে বেডা ঢুকামু না ঘরে। ইলোরা আর বনানী নামে দুই মাখি) আছে না, হেৱাই লিডারগিরি চোদাইতেছে।’

‘রহমান, শফি, ইকবাল, দুলালরে ডাইক্যা ল। চল আমার লগে। খাননিগো সোনায় সিগারেটের আগুন দিতে অইবো। কাস্টমারের চনু ঢুকাইবো না, ভাইজ্যাবাঁশ ঢুকাইয়া দিমু আমি।’ সর্দারের উত্তেজিত কণ্ঠ।

দলবল নিয়ে কালু সর্দার উপস্থিত হল পশ্চিমগলিতে। ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল সর্দার বনানীর গালে। ‘চোদমারানি বেহেনচোদ, দশ টেইক্যা সস্তা খানকি, তুই চাইতাছস ছুটি – সাপ্তাহিক ছুটি? মাগি, বড় অফিসের অফিসার হইছস, ভদার বিশ্রামের লাইগ্যা ছুটি চাস?’

অবিরাম গালি দিয়ে যেতে লাগল সর্দার। তার গর্জন শুনে পাশের ঘর থেকে ইলোরা বেরিয়ে এল। সর্দারকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘গালি দিয়েন না সর্দার। আমাগোর শরীরও শরীর। আপনাগো শরীর যদি বিশ্ৰাম চায়, আমাগোর শরীর চায় না?’

ইকবাল বলে ওঠে, ‘তোরা শরীর বেইচ্যা ভাত খাওয়া মাগি। শরীর বেচা বন্ধ রাখলে খাবি কী?’

এবার বনানী চিৎকার করে উঠল, ‘সে আমরা দেখুম। খাইতে না পারলে তোমাগোর কাছে হাত পাতুম না

মাগির তো চোপা বাড়ছে। মুখে মুখে তর্ক করতাছে। থাপ্পড় খাইয়াওতো হুঁশ হইল না চোদানির।’ সর্দার বলে।

‘তুমি সর্দার, মারতে পার। তোমার গুণ্ডা-মাস্তান আছে। কিন্তু আমাগোর এককথা—শুক্রবার আমরা কাস্টমার ঢুকামু না ঘরে।’ বনানী আবার বলে।

‘হ হ, ঢুকামু না।’ সর্দার চেয়ে দেখে, আশপাশে সাত-আট জন পতিতা জড়ো হয়ে গেছে। তাদের সবার চোখেমুখে প্রতিহিংসা।

একজন মাসি বলে উঠল, ‘দেখছ সর্দার, কী আস্পর্ধা! তোমার মুখের উপর কথা!’

কালু বলল, ‘দাঁড়াও, আমি বনানী খানকির লিডারগিরি দেখাইয়া দিতাছি। অই সুবইল্যা পারবি তুই? লিডারনির ঘরে ঢুক। দুইপার ভাইঙ্গা দিয়া আয়। এমনভাবে করবি যাতে চাইর পাঁচ দিন বিছানা থেইক্যা উঠতে না পারে।’ তারপর ইকবালের দিকে ফিরে বলল, ইকবাইল্যা, তুইও যা। সুবইল্যার পর তুই উঠবি।’

‘খবরদার সর্দার, বেশি বাড়াবাড়ি করবে না। ভালো হবে না কিন্তু।’ চশমা ঠিক করতে করতে কোত্থেকে এগিয়ে এল কৈলাস। সর্দারের সামনে বুক চেতিয়ে বলল, ‘সাবধান হয়ে যাও তুমি।’

সর্দার মুহূর্তেই কৈলাসের নাক বরাবর একটা ঘুসি কষাল। চশমা চুরমার হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। কৈলাস মাটিতে বসে চশমা হাতড়াতে লাগল। সুবল-ইকবাল বনানীর ঘরে ঢুকে গেল। শফি আর রহমান কৈলাসকে ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে কুয়াপারে নিয়ে গেল।

পেছন থেকে বনানীর আর্তচিৎকার ভেসে এল—’আমি দেইখ্যা লমু বেশ্যার পোলা কালু সর্দার তোরে।’

.

ডাক্তার নাকে ব্যান্ডেজ করে বেরিয়ে গেলে মোহিনী মাসি বলল, ‘কালু সর্দার মানুষ ভালো না। হিংস্র। নিজের স্বার্থের জন্য যেকোনো দুষ্কর্ম করতে সে পিছপা হয় না। তোমাকে বলেছিলাম—সাবধানে থাকতে, তুমি শোননি 1 প্রেমদাশরা সময় মতো কুয়ার পারে না পৌঁছালে আজ কী অঘটনটাই না ঘটে যেতো! তুমি এসব কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নাও কৈলাস।’

এতক্ষণ মায়ের কথার কোনো প্রতিবাদ করেনি কৈলাস। শেষ কথায় চুপ থাকল না। বলল, ‘মা, তুমি বল—এই অসহায় মেয়েদের জন্য কে আছে? তোমরা তাদের শুধু শোষণ করে যাচ্ছ, তাদের ভালোর জন্য কী করছ তোমরা? এই নিঃস্ব মেয়েগুলোর পাশে কেউ যদি না দাঁড়ায়, তাহলে ভবিষ্যতে কী নিদারুণ কষ্টে পড়বে ওরা ভেবে দেখেছ? তাদের দুরবস্থার কথা ভেবেছ একবার?’

মোহিনী তার ছেলেকে খুব ভালোবাসে। ছেলের এই সত্য কথার কোনো জবাব নেই তার কাছে। সে একজনে পতিতাদের পক্ষ নিলে কী হবে? পাড়ার সর্দার–মাসিরা তো বিরোধিতা করবে। তারপরও ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আমি অন্য মাসিদের মতো নই। আমার বাড়িতে মেয়েরা ঠকে না। কিন্তু আমার বাড়ির মেয়ে ছাড়া তো সমস্ত পাড়ার মেয়েরা ঠকছে। এটার কোনো সমাধান তুমি যেমন করতে পারবে না, আমিও পারব না। পতিতাদের রক্ত-মজ্জা শোষণ করাই এই পাড়ার রীতি। বহু বছর থেকে এটা চলে আসছে, আরও বহু বছর চলবে। ব্যাপারটি নিয়ে তুমি আর মাথা ঘামিও না। ভাত খেয়ে শুতে যাও। আজ আমি তোমার সঙ্গে খাব না। আজ রাতে আমার কিছু কাজ আছে।’

কৈলাসকে আর কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মোহিনী।

.

গভীর রাতে টেলিফোন তুলল মোহিনী, ‘হ্যালো খায়রুল, কেমন আছ তুমি?’

তারপর দীর্ঘক্ষণ ধরে মোহিনী খায়রুল সাহেবের সঙ্গে কথা বলল। একটা সময়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে গেল মোহিনীবালা।

পরদিন সকালে সাহেবপাড়ার সবাই দেখল—মগধেশ্বরী মন্দির চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে পুলিশ। কৌতূহলী লোকের ভিড় জমে গেছে মন্দিরের গেইটে। কে নেই সেখানে? পানবিড়ির দোকানদার, জলমেয়ে, রিক্সাওয়ালা, পতিতা, হঠাৎ গজানো পাতি মাস্তান, বেশ্যার দালাল সবাই আছে। চোখ মুছতে মুছতে দু’চারজন মাসিও উপস্থিত হয়েছে সেখানে। খুব ভোর বলে মন্দিরের গেইট ভেতর থেকে বন্ধ। নির্দিষ্ট বেলায় মন্দিরের গেইট খুলে দেওয়া হয়। সময় হয়নি বলে পুরোহিত এখনো গেইট খুলে দেননি।

দারোগা একজন পুলিশকে আদেশ দিলেন, ‘ইব্রাহিম, তুমি গেইটে জোরে জোরে ধাক্কা মার, পুরোহিতকে ডাক।’

পুলিশ অনেকক্ষণ ধরে দরজা ধাকাচ্ছে, কিন্তু কেউ গেইট খুলে দিচ্ছে না। পুরোহিত মন্দিরের পশ্চিম দিকের একটা ছোট্ট ঘরে থাকেন। গেইট ধাক্কানোর আওয়াজ তাঁর কানে পৌঁছাচ্ছে না। পুলিশের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাবে যাবে মুহূর্তে হঠাৎ করে গেইট খুলে গেল। পুরোহিতের চোখ ঘুমে ঢুলু ঢুলু। সামনে পুলিশ দেখে পুরোহিত মশাই ভড়কে গেলেন। ভীত সন্ত্রস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার দারোগা সাহেব? এত সকালে আপনারা মন্দিরের গেইট ধাক্কাচ্ছেন!’

‘পথ ছাড়ুন। বেশি কথা বলবার সময় নেই। আমাদের কাছে পাক্কা খবর আছে।’ দারোগা বললেন।

পুরোহিত কাঁচুমাচু মুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী খবর?’

‘ধরা পড়লে জানতে পারবেন।’ পুলিশকে উদ্দেশ্য করে দারোগা বললেন, ‘এই, তোমরা মন্দিরের আনাচে কানাচে সব জায়গায় পাত্তা লাগাও। কোনো ঘর বাদ দিও না।’

ভিড়ের মধ্যে আওয়াজ উঠল—ব্যাপার কী? মন্দিরে পুলিশ! মন্দির ধর্মস্থান। এইখানে আবার পুলিশ কেন? কেউ কেউ বলছে—নিশ্চয় ডাল মে কুচ কালা হ্যায়! পুলিশ বলছে—তাদের হাতে পাক্কা খবর আছে। নিশ্চয়ই সাংঘাতিক কিছু।

পুরোহিত জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী খুঁজছেন আপনারা? এখানে তো আমি ছাড়া আর কেউ থাকে না। কাকে খুঁজছেন আপনারা? কী খুঁজছেন?

দারোগা বললেন, ‘না জানার ভান করছেন পুরোহিত মশাই? কিছুক্ষণ পরেই টের পাবেন কী খুঁজছি।’

এই সময় ভেতর থেকে একজন পুলিশের্ আওয়াজ ভেসে এল, ‘স্যার, এই ঘরের দরজায় তালা মারা। খুলতে পারতাছি না।’

পুরোহিতকে নিয়ে দারোগা সেই টিনের চালার দরজার সামনে উপস্থিত হলেন। বললেন, ‘দরজা খোলেন পুরোহিত।’

পুরোহিত বললেন, ‘এই ঘরের চাবি আমার কাছে নেই। কালু সর্দারের কাছে থাকে চাবি ‘

‘আপনি এই মন্দিরের পুরোহিত। আপনার কাছে চাবি না থেকে সর্দারের কাছে কেন?’ দারোগা জিজ্ঞেস করেন।

পুরোহিত অসহায় ভঙ্গিতে বলেন, ‘আমি হলাম এই মন্দিরের পুঁটো জগন্নাথ। আমি নামে পুরোহিত। সবকিছু চলে কালু সর্দারের আদেশে। ও বলে—এই ঘরের চাবি আমার কাছে থাকবে। সেই রকমই চলছে, এতদিন।’

‘দেখাচ্ছি সর্দারের আদেশ। এই তোমরা তালা ভাঙো।’ উচ্চ কণ্ঠে আদেশ দিলেন দারোগা।

উত্তরে-দক্ষিণে প্রসারিত গোটা পূর্বগলিতে তখন জনতার ভিড়। লোকারণ্য বলা যায়। নারী পুরুষ সবাই রাস্তায় নেমে এসেছে। শুধু নাকে ব্যান্ডেজ বাঁধা কৈলাসকে নিয়ে মোহিনী মাসি খাবার টেবিলে নাস্তা খাচ্ছে। কৈলাস জানে না বাইরে কী হচ্ছে। মোহিনী সব জানে। মোহিনীর চোখেমুখে সন্তুষ্টির মৃদু আভা।

কিছুক্ষণ পর গেইটের বাইরে আর মন্দিরচত্বরে সমবেত মানুষরা দেখল— পুলিশরা দু’জনের হাতে হাতকড়া পরিয়ে গেইটের দিকে এগিয়ে আসছে। সুবলকে সবাই চিনল, কিন্তু ধামা-ফারুককে কেউ চিনে উঠতে পারল না। সবার আগে দারোগা, দারোগার পাশে কুঁজো হয়ে হাঁটছেন পুরোহিত। গেইটের কাছাকাছি এসে দারোগা বললেন, ‘পুরোহিত, আপনিও চলেন থানায়, আপনিও এই ঘটনার মদতদাতা।’

পুরোহিত কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘আমি কী করলাম! ওই ঘরে কালু সর্দারইতো ফারুইক্কারে থাকতে দিয়েছে। আমি এর কিছুই জানি না।’

দারোগা এবার রেগে গেলেন। প্রায় গর্জে উঠে বললেন, ‘টাকা খেয়ে ধামা-ফারুইক্কাকে কালু সর্দার মন্দিরের পিছনঘরে আশ্রয় দিয়েছে, আর আপনি মন্দিরের চব্বিশ ঘণ্টার বাসিন্দা হয়ে জানেন না–এই মিথ্যা কথাটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন পুরোহিত?’ তারপর একটু থেমে বললেন,

‘আপনি পুরোহিত, এই পাড়ার সম্মানিত ব্যক্তি। আপনাকে হাতকড়া পরালাম না। চুপচাপ আমাদের সঙ্গে হাঁটুন।’

এই সময় একজন পুলিশ এসে বলল, ‘স্যার, আমরা অনেক খুঁজলাম, কালু সর্দারকে তার বাড়িতে অথবা আশপাশে কোথাও পাওয়া গেল না। পলাইছে বোধ হয় স্যার।’

‘কয়দিন পালিয়ে থাকবে। মেম্বারের খুনিকে আশ্রয়! এই ধামা ফারুইক্কারে?’ অনেকটা স্বগতকণ্ঠে কথাগুলো বললেন দারোগা।

অপ্রশস্ত গলি বলে পুলিশের গাড়ি গলির ভেতরে ঢুকতে পারেনি। গলির মুখেই গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে ছিল। পুলিশরা সুবল আর ধামা-ফারুককে টানতে টানতে গলির মুখের দিকে এগিয়ে গেল। দারোগা হাঁটলেন পুরোহিতের পাশে পাশে।

দারোগার মুখে বাধাপ্রাপ্ত হবার আতঙ্ক। কিন্তু কেউ বাধা দিল না। কালু সর্দারের প্রতি এই পাড়ার মানুষদের মনে ঘৃণা দানা বেঁধে উঠেছিল। তাই পুরোহিত হওয়া সত্ত্বেও কালু সর্দারের মদতদাতা বলে পুরোহিতের জন্যেও কেউ এগিয়ে এল না।

মন্দিরের গেইট ছাড়িয়ে, বাজার মাড়িয়ে, সর্দারের বাড়ির সামনে দিয়ে সুবল, ফারুক আর পুরোহিতকে নিয়ে পুলিশের দল এগিয়ে চলল। উপগলির মুখে মুখে, দরজায় দরজায় উৎসুক পতিতাদের মুখ। সর্দারবাড়ির দরজা নির্জন, কিছুক্ষণ আগে পুলিশ এ-বাড়ি তছনছ করে গেছে। আঁচলে মুখ লুকিয়ে দোতলা থেকে শৈলবালা তাকিয়ে আছে চলমান জনতার দিকে।

খেলাঘরের পুবের জানালাটা সাধারণত দেবযানী খোলে না, আজ খুলেছে। ওই জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখতে গিয়েই সুবইল্যার ওপর চোখ পড়ল দেবযানীর। এই সুবলই তো কালু সর্দারের ঘরে তার ওপর অসহনীয় অত্যাচার চালিয়েছে! দু’চার দিন পরপর তার ঘরে উপস্থিত হতো এই সুবল। পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ত তার ওপর। গোপনস্থানে এখনো তার অত্যাচারের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে দেবযানী। কেন জানি তার হাত দুটো নিশপিশ করতে শুরু করল। চোখের কোনাটা জ্বলে উঠল ।

ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে মোহিনী আর কৈলাস। কৈলাসের চোখে বিস্ময়। মোহিনী নির্বিকার। শুধু চোখ দুটোতে তার কিসের যেন খেলা! ক্রোধ আর তৃপ্তির জড়াজড়ি মোহিনীর দু’চোখে।

সতেরো

ধামা ফারুক আর সুবলকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পাঁচদিন পর পাতকুয়ার মধ্যে কৈলাসের লাশ পাওয়া গেল।

ভোরসকালে জলমেয়েরা জল আনতে গিয়েছিল পাতকুয়ায়। রোজিই বালতিটি প্রথম ফেলেছিল কুয়ার মধ্যে। দড়িবাঁধা বালতিটি ঘর্ঘর করে নেমে গিয়েছিল নিচে। কিন্তু ঝপাস করে আওয়াজ হল না। বালতি জলে পড়লে এই রকমই আওয়াজ হয়। ধুপ করে বিশ্রী একটা আওয়াজ রোজির কানে ভেসে এল। তার পাশে দাঁড়িয়েছিল কুলসুম, সুরভি, অনিতা, রোকেয়ারা। তারাও কুয়া থেকে জল নিতে এসেছে। অদ্ভুত আওয়াজ শুনে এদের দিকে তাকাল রোজি। তারপর বালতিটি টেনে তুলল। আশ্চর্য! বালতিতে এক ফোঁটা জল নেই। আবার ফেলল রোজি, আবার একই রকম আওয়াজ। আবার জলহীন বালতি। এবার সবাই কুয়ার মধ্যে উঁকি দিল। কুয়ার ভেতর কিছুদূর পর নিরেট অন্ধকার। কিছুই দেখল না জলমেয়েরা।

কথাটি দ্রুত চাউর হয়ে গেল—প্রথমে আশপাশে, তারপর পশ্চিমগলিতে, তারপর পুবগলিতে, তারপর গোটা সাহেবপাড়ায়। কুয়ার চারধারে ভিড়ে ভিড়ে একাকার। সবারই জিজ্ঞাসা—কী হতে পারে কুয়ায়, কে হতে পারে?

.

দীর্ঘদিন পর, গতরাতে খায়রুল আহসান চৌধুরী মোহিনীকে কাছে পেতে চেয়েছিলেন। ফোন করেছিলেন খায়রুল আহসান। মোহিনী না করেনি। তার শরীরও চনমন করে উঠেছিল। কত বিপদে আপদে না এগিয়ে এল এই খায়রুল! সাহায্য চাইলে ও-ই সেদিন পুলিশ পাঠানোর ব্যবস্থা করল। তারই জন্যে তো সুবইল্যা-ফারুইক্কা ধরা পড়ল। ছেলের গায়ে হাত তোলার প্রতিশোধ নিতে পারল। খায়রুলের সাহায্যের কারণেই তো আজ কালু সর্দার ঘরছাড়া। তার বাড়ির দরজায় মেয়েরা এখন সেজেগুজে খদ্দের ধরার জন্যে দাঁড়ায় না। খদ্দেররাও পুলিশ-খোঁজা আসামির বাড়িতে ঢুকতে ভয় পায়। লাটে উঠেছে সর্দারবাড়ির ব্যবসা। আহা! শৈলবালার মুখটি যদি এই সময় একবার দেখা যেতো! কেমন মুখ করে রেখেছে এখন দত্তবাড়ির বড় মেয়েটি!

মোহিনী বলেছিল, ‘আমি আসব খায়রুল। তুমি ডাকলে আমি কি না এসে পারি?’

একটু তাড়াতাড়িই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিল মোহিনী। খায়রুল আহসান চৌধুরী গাড়ি পাঠিয়েছিলেন। স্ট্র্যান্ডরোডের ধারে বড় শিরীষ গাছটির নিচে অন্ধকারে গাড়িটি দাঁড়িয়ে ছিল। যাওয়ার সময় ছেলের ঘরে ঢুকে মোহিনী বলেছিল, ‘একটা জরুরি কাজে আমি এখন বেরোচ্ছি। বউ- মেয়ে নিয়ে তুমি খেয়ে নিয়ো। আমার ফিরতে একটু দেরি হতে পারে।’

পড়ার টেবিল থেকে মুখ তুলে কৈলাস বলেছিল, ঠিক আছে মা। তাড়াতাড়ি ফির।’

তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে পারেনি মোহিনী। খায়রুল আদরে-সোহাগে তাকে উন্মাতাল করে তুলেছিলেন। গভীর রাতে ফিরে সরাসরি নিজের বিছানায় গিয়েছিল মোহিনী।

সেরাতে ভাত খাবার পর কৈলাস ‘একটু আসি বলে’ বাইরে যেতে উদ্যত হয়েছিল। নির্মলা সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, ‘তুমি এখন বাইরে যাবে না। মা নেই। বাইরে শত্রু। এত রাতে বাইরে যাবার দরকার নেই তোমার।’

কৈলাস মৃদু হেসে বলেছিল, ‘এই যাব আর আসব। সুবলরা নাকি বনানী মেয়েটার ওপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছে। শুনলাম, বিছানা থেকে উঠতে পারছে না সে। একটু দেখে আসি তাকে।’

‘না, তুমি দিনের বেলায় যেও।’ নির্মলা বলে।

এবার অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গে কৈলাস বলে ওঠে, ‘গত পাঁচদিন ধরে মা আমাকে ঘরের বাইরে যেতে দিয়েছে? যখন যেতে চেয়েছি, বলেছে এখন না বাছা, বাইরে দুশমন। একটু ঠাণ্ডা হোক, তারপরে যেয়ো। আমার জন্যেই বনানীর এই দশা! তাকে সান্ত্বনা আর সাহস দেওয়া কী আমার কর্তব্য নয়?’

‘আমি অতশত বুঝি না। মা রাতবিরাতে বের হতে মানা করেছে, তাই তুমি এখন বের হবে না, ব্যস।’ রূঢ় কণ্ঠে বলে নির্মলা।

কৈলাস নির্মলার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘দেখ, আজ যদি বনানী তোমার বোন হতো বা আমার বোন হতো তুমি কিছুতেই বাধা দিতে না। বলতে—যাও এই দুঃসময়ে মেয়েটির পাশে দাঁড়ানো তোমার দায়িত্ব। বনানী পরের মেয়ে বলে তার কষ্ট তোমাকে আকুল করছে না। মনে রেখ–বনানীর জায়গায় তুমিও হতে পারতে।’

স্বামীর যুক্তির কাছে নির্মলা হার মানতে বাধ্য হল। সামনে থেকে সরে যেতে যেতে বলল, ‘ঠিক আছে। যাও। তবে দেরি করবে না। যাবে আর আসবে।’

স্ত্রীর থুতনিটা একটু নেড়ে কৈলাস বলল, ‘আচ্ছা।’

সেরাতে কৈলাস আর ফিরে আসেনি। স্বামী এবং শাশুড়ির জন্যে অপেক্ষা করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিল নির্মলা। মৃত্যুঘুম যেন। ভোরের আজানে ঘুম ভাঙল নির্মলার। দেখল—বিছানায় কৈলাস নেই। বাথরুমে, বারান্দায় কৈলাসকে না পেয়ে শাশুড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়াল নির্মলা। মোহিনীকে জাগিয়ে রাতের কথা সব খুলে বলল সে।

মোহিনী বড় বড় চোখ করে শুধু চিৎকার করে উঠেছিল, ‘ও মারে-

তারপর মোহনীর কাছে খবর এসেছিল তার কৈলাস আর নেই। কারা যেন মেরে পশ্চিমগলির কুয়াতে ফেলে দিয়েছে তাকে। তার লাশ তোলা হয়েছে কুয়া থেকে।

.

স্তব্ধ নিস্পন্দ হয়ে বসে আছে মোহিনী। অপলক চোখে তাকিয়ে আছে কৈলাসের দিকে। একফোঁটা জল নেই তার চোখে। কৈলাসের চোখে আজ চশমা নেই। গায়ের জামা-প্যান্ট ভেজা। নিচতলার খোলামতন জায়গাটিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে কৈলাসের মৃতদেহটিকে। নিথর দেহটি থেকে চোখ ফিরাচ্ছে না মোহিনী। পাশে আকুল হয়ে কেঁদে যাচ্ছে নির্মলা। নাতনিটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মৃত্যু বিষয়ে তার মধ্যে কোনো ধারণা তৈরি হয়নি এখনো। পদ্মাবতী দাঁড়িয়ে আছে ঘোমটা মাথায়। তার অভিব্যক্তি বোঝার উপায় নেই।

প্রেমদাশ মাথা থাপড়াচ্ছে। গোঙাতে গোঙাতে কী যেন বলে যাচ্ছে সে। নিচতলার পতিতারা লাশ থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই কাঁদছে—কেউ নীরবে, কেউ ফুঁপিয়ে, কেউবা উচ্চস্বরে। খোলামতন জায়গাটিতে মানুষে মানুষে ঠেসাঠেসি। গেইটে রাস্তায় হাজার মানুষের ভিড়।

লাশের পাশে সবাই এসেছে, দেবযানী আসেনি। খেলাঘরের খাটের ওপর ঝিম ধরে বসে আছে সে। পুবের জানালাটি খোলা। সূর্যের তির্যক আলো দেবযানীর চোখেমুখে এসে পড়েছে। দেবযানীর চোখভরা অশ্রু। গল গল করে গণ্ড বেয়ে অশ্রু নামছে তার। শরীরে কোনো কাঁপুনি নেই। নিচতলা থেকে হাহাকার ভেসে আসছে। মন একটুও চাইছে না নিচে যেতে। এই মুহূর্তে মোহিনীর মুখোমুখি হতে তার ইচ্ছে করছে না।

সে জানে মোহিনী মাসি কৈলাসবাবুর পাশে নিথর হয়ে বসে আছে। শক্ত গোছের নারী মোহিনী মাসি। ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে, কিন্তু মচকাবে না। মোহিনীরা এমন জাতের নারী, যারা ভেতরে ভেতরে জ্বলে নিঃশেষ হয়, সেই আগুনের আঁচ বাইরের মানুষদের বুঝতে দেয় না।

কৈলাসবাবু মোহিনী মাসির জীবনের অবলম্বন ছিল। ছেলের জন্যে চাপা গৌরবও ছিল তার অন্তরে। খুব কাছে বসে যখন কৈলাসের কথা বলত মাসি, তখন অন্য কেউ না বুঝলেও দেবযানী টের পেত। আর গর্ব করবেই না বা কেন? এই পাড়ায় বা আর দু’দশটা বেশ্যালয়ে কৈলাসের মতো ক’জন শিক্ষিত যুবক আছে? বেশ্যার ঘরে জন্ম নেওয়া ক’জন ছেলেই বা পতিতাদের স্বার্থের কথা চিন্তা করেছে? যা করেছে, এই কৈলাসই করেছে। তার জন্যে মোহিনী মাসির গর্ব করা তো স্বাভাবিক। এই রকম সন্তান হারানোর পর মাসির ভেতরে যে কী রকম তোলপাড় হচ্ছে, সেটা এই নির্জন ঘরে একাকী বসে থেকেও টের পাচ্ছে দেবযানী।

মাসি আজ একা হয়ে গেল। কৈলাসকে নিয়ে মাসি কী স্বপ্ন দেখত কে জানে? কিন্তু এই পাড়ার সাধারণ পতিতারা কৈলাসবাবুকে ঘিরে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল। মাসির স্বপ্ন আর পতিতাদের স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দিল কালু সর্দার। দেবযানী নিশ্চিত—কালু সর্দারই মোহিনী মাসির এতবড় সর্বনাশ করেছে। বারবার অপমানিত হয়ে, মাসির বুদ্ধি আর শক্তির কাছে হেরে গিয়ে কালু ক্ষেপে উঠেছিল। সুবল আর ধামা-ফারুইক্কাকে ধরিয়ে দিয়ে মাসি কালুর লেজে পা দিয়েছিল। কৈলাসবাবুকে হত্যা করে প্রাণঘাতী ছোবলটা মারল কালু। এই ক্ষতির কোনো শোধবোধ নেই। কালুর কী ক্ষতি করলে পুত্রহত্যার প্রতিশোধ নেওয়া যাবে। কালুর কোনো ছেলে নেই। কালুও এখন কোথায় গা ঢাকা দিয়ে আছে কে জানে?

একটা সময়ে কৈলাস হত্যার হইচই স্তিমিত হয়ে আসবে। কালু টাকা দিয়ে থানা বশ করবে, উকিলদের মুখ বন্ধ করবে। দু’চার ছয় মাস কেটে গেলে কালু আবার এই পতিতাপাড়ায় সাঙাতদের নিয়ে ঘুরবে। ঘরে ঘরে চাঁদা তুলবে, একে তাকে মারবে, ধমকাবে। আর মোহিনী মাসির বাড়ির সামনে এসে ওপর দিকে তাকিয়ে শেষের হাসি হাসবে। তখন মোহিনী মাসির করার কিছুই থাকবে না, রাবণ যেমন যুদ্ধে এক লক্ষ পুত্র আর সোয়া লক্ষ নাতি হারিয়ে দরবারে মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিল, মোহিনী মাসিও এই বাড়ির ধ্বংসস্তূপে গালে হাত দিয়ে বসে থাকবে।

দেবযানীর খুব ইচ্ছে ছিল কৈলাসবাবুর সঙ্গে একবার কথা বলার। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে কৈলাসবাবুকে একবার দেখার ইচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে দেবযানীর মধ্যে আকুলিবিকুলি করেছে। যে যুবকটি পতিতা মেয়েদের জন্যে, তাদের জারজ সন্তানদের জন্যে এত কিছু করছে—তাকে একবার ছুঁয়ে দেখতে পারলে জীবন ধন্য হয়ে যেতো। কিন্তু দেবযানীর সে ইচ্ছে কখনো পূর্ণ হয়নি, পূর্ণ হবার নয়ও সে ইচ্ছে।

দোতলায় উঠার দুটো সিঁড়ি। একটি দিয়ে দেবযানীর কাছে কাস্টমাররা আসত, অন্যটি ছিল শুধু পারিবারিক সিঁড়ি। একাত্ত পারিবারিক মানুষ ছাড়া কারও ওই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠার অধিকার ছিল না। দোতলার ছাদের মাঝবরাবর মাথা উঁচু দেয়াল, সেই দেয়ালে আবার কাঁটাতারের ঘেরা। দেয়ালের মাঝখানে ছোট্ট একটা দরজা। লোহার তৈরি। মোহিনী মাসির ওদিক থেকে বন্ধ থাকে সে দরজা। দরজার চাবি থাকে মোহিনী মাসির কাছে। প্রয়োজন হলে ওই দরজা দিয়ে মোহিনী দেবযানীর ঘরে বা অফিস ঘরে আসত।

ওই পারিবারিক সিঁড়ি দিয়েই উঠা-নামা করত কৈলাসবাবু। কোনোদিন তার মুখোমুখি হবার সুযোগ হয়নি দেবযানীর। কখনো কখনো জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখত—পুরু লেন্সের চশমা পরে কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে মাথা নিচু করে হেঁটে যাচ্ছে কৈলাসবাবু। নিজের অজান্তে এই লোকটির উদ্দেশ্যে মাথা নত হয়ে আসত দেবযানীর। আজ সেই কৈলাসবাবু নেই।

পুলিশ কৈলাসের মৃতদেহ নিয়ে যেতে এসেছে—পোস্টমর্টেম করতে হবে। মোহিনী বলল, ‘কাটাছিড়া না করলে হয় না?’ যেন বহুদূর থেকে অসহায় জবুথবু এক নারীর কণ্ঠ ভেসে এল।

দারোগা বললেন, ‘পোস্টমর্টেম করতে হবে। কীভাবে মারল—তা বেরিয়ে আসবে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে। হত্যাকারীকে ধরতে সুবিধা হবে।’

মোহিনী আর বাধা দিল না। মনে মনে বলল- হত্যাকারী যে কে, সেটা তো আমি জানি, তোমরাও জান। একটা খুনে তোমাদের যে কত লাভ হয় সেও আমি জানি। ভয় দেখিয়ে কালুর কাছ থেকে বিপুল টাকা খাবে তোমরা, খুনিকে ধরার আশ্বাস দিয়ে দিয়ে আমাকেও সর্বস্বান্ত করবে।

.

পরদিন বিকালে লাশ ফেরত দিল পুলিশ। সাদা কাপড়ে আবৃত ছিল দেহটি। পুলিশ বলেছে—মাথার পেছনে শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করার ফলে কৈলাসের মৃত্যু হয়েছে।

ফেরত আনার পর ছেলের মুখ দেখেনি মোহিনী, কাউকে দেখতেও দেয়নি। প্রেমদাশকে বলেছিল, ‘কৈলাসকে শ্মশানে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা কর প্রেমদাশ।

.

ওইদিন জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ পুরোহিতকে ছেড়ে দিয়েছিল। পুলিশ বুঝেছে—অভাবী পুরোহিতটি কালুর সামনে বড় অসহায়। কালুর ইচ্ছের ওপরই পুরোহিতের বর্তমান-ভবিষ্যৎ নির্ভর করত। পুলিশ এও আন্দাজ করতে পারল যে পুরোহিত কালুকে ঘৃণা করে, কালুর কর্মকাণ্ডকে ঘৃণা করে। চলে আসার সময় পুরোহিতকে ডেকে ওসি বললেন, ‘দেখেন পুরোহিত মশাই, আপনাকে আমরা আপাতত ছেড়ে দিচ্ছি। প্রয়োজনবোধে আপনাকে আবার থানায় আসতে হবে। ও হ্যাঁ, আর একটা কথা—কালুর কোনো খোঁজ পেলে আমাদের জানাবেন।’

পুরোহিত থানা থেকে ফিরে আসার ছয় দিনের মাথায় কৈলাস খুন হল। যেন আপন সন্তান মারা গেছে পুরোহিতের। অস্থির বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে বারবার সেই বটগাছের বাঁধানো গোড়ায় আসেন পুরোহিত। যেখানে কৈলাস বসে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াত, সেই স্থানটায় পরম মমতায় হাত বুলান আর বিড়বিড় করে কী যেন বলেন। সকাল-সন্ধে দু’বেলা পুজোয় বসেন পুরোহিত। আগের মতো মন্দিরে পুজারিরা আসে, ধূপকাঠি-মোমবাতি জ্বালায়, হাতখুলে দক্ষিণা দেয়। কিন্তু আগের মতো পুজোয় মন বসে না পুরোহিতের। পুজোয় বসলে বারবার কৈলাসের মুখ ভেসে ওঠে পুরোহিতের চোখে। তিনি পৈতে ধরে রাম রাম রাম করেন। গভীর রাতে তার মনে হয়- কে যেন গেইট ধাক্কাচ্ছে, কৈলাস যেন বলছে—ও পুরোহিত মশাই, এতক্ষণ কি ঘুমাচ্ছেন? কখন সকাল হয়েছে। পড়ুয়ারা এসে গেছে, গেইট খোলেন। তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠে পড়েন পুরোহিত। বাইরের বাতি জ্বালিয়ে গেইটের কাছে এসে দেখেন—কই, কেউ তো কোথাও নেই, চারদিক সুনসান। ভুল শুনেছেন। বিছানায় ফিরে যান তিনি। নির্ঘুম রাত কাটান।

এর মধ্যে পুলিশ কয়েকবার কালু সর্দারকে খুঁজে গেছে। সর্দারবাড়ির একতলা-দোতলায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কালুকে পায়নি তারা। পুলিশরা যতবার এসেছে ঘরের কাপড়চোপড়, আসবাবপত্র সব তছনছ করে দিয়ে গেছে। নিচতলার পতিতাদের ঘরগুলোও পুলিশি-তাণ্ডব থেকে রেহাই পায়নি। সন্ধের সময় হয়তো দু’একজন খদ্দের আসতে শুরু করেছে, ওই সময় পুলিশ এসে হাজির। পুলিশের ভয়ে ঘরের এবং বাইরের কাস্টমাররা পালিয়ে বাঁচে। পুলিশরা অনুসন্ধানের দোহাই দিয়ে কাস্টমারদের টানাটানি করে; অপমানের হাত থেকে বাঁচার জন্যে পুলিশের হাতে টাকা গুঁজে দেয় খদ্দেররা।

একটা সময়ে সর্দারবাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পড়ল। কালুর মস্তানির টাকা আর মেয়েদের দেহবেচা টাকা দিয়ে শৈলবালার যত শান- শওকত। আজ দুটোই বন্ধ—কালু ফেরারি, বেশ্যারা কাস্টমারবঞ্চিত।

কালুর অনুপস্থিতি, পুলিশি হয়রানি, টাকাপয়সার টানাটানি – এসব কারণে শৈলবালার মনমেজাজ ভালো নেই। একে তো ধামা-ফারুইক্কার সঙ্গে কালুর সংশ্লিষ্টতা, তার ওপর কৈলাস-হত্যার ব্যাপারে কালুর ওপর পুলিশের সন্দেহ সর্দারবাড়ির স্বাভাবিক জীবনকে অস্বাভাবিক করে তুলেছে। এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে ভরণপোষণের টাকাতেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

সবার সঙ্গে খিটখিটে আচরণ করছে শৈল। সবচেয়ে বেশি ক্ষেপেছে নিচতলার মেয়েদের ওপর। ওদের দেহবেচা টাকা সর্দারবাড়ির জৌলুসের মূল উৎস। মেয়েদের ঘরে কাস্টমার না আসায়, সেই উৎসেই টান পড়েছে। সবকিছু ছাপিয়ে নিচতলার পতিতাদের ওপর শৈলর রাগটা গিয়ে পড়ল।

সেদিন নিচে নেমে যা-তা গালিগালাজ শুরু করল শৈলবালা, ‘তোরা চোদমারানি মাগির জাত। শরীর বেইচ্যা বেইচ্যা খাস। যেদিন বেডা ঢুকাস ঘরে, হেইদিন বিড়বিড়ানি থামে। টাকা পাস। ভাত চা নাস্তা খাস। এই কদিন যে কাস্টমার ধরতাছস না, চুলকাচ্ছে না তোদের ভদা? বেডা না ঢুকাইলে খাবি কী? চুলকানি থাইমবো কেমনে তোদের?’

শৈলবালার চিৎকার চেঁচামেচি আর গালাগালিতে মেয়েরা যার যার ঘর থেকে বেরিয়ে এল। চোখ মুখ কুঁচকে শৈলমাসির দিকে তাকিয়ে থাকল। তারা যে ভেতরে ভেতরে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে, তা তাদের চোখমুখ-হাতের ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু মুখ ফুটে প্রতিবাদ করার সাহস করছে না কেউ। শৈলবালা ওখানেই থেমে থাকল না। নানারকম অশ্রাব্য ভাষায় অসহনীয় অঙ্গভঙ্গি করে গালি দিয়ে যেতে লাগল।

একটা সময়ে চম্পা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। মৃদু অথচ শক্ত গলায় বলল, ‘আপনি সর্দারের মা আছেন। এই রকম গালিগালাজ আপনার মুখে সাজে না মাসি।’

‘রাখ তোর সদ্দার-মুদ্দারের মা। আমার টাকা চাই, শরীর বেচা টাকা।’ উত্তেজিত কণ্ঠে বলে শৈলবালা।

শরীর বেচুম ক্যামনে কাস্টমার যদি না আসে? আর কাস্টমার আইসবো ক্যামনে, আপনার লেড়কা মাইনে আমাগো সর্দারসাব যে আকাম কুকাম কইরা রাখছে!’ শ্লেষের সঙ্গে বলে চম্পা।

শৈলবালা এবার শাসিয়ে ওঠে, কিয়ের আকামরে মাগির বেটি? আমার পোলা কী কুকাম করছে?’

সবাই জানে—আপনার লেড়কা ধামা-ফারুইক্কার কাছ থেকে টাকা খাইয়া তারে মন্দিরে থাকতে দিছে। কৈলাসবাবুরে খুনও করছে!’ নিৰ্ভীক কণ্ঠে কথাগুলো বলে গেল চম্পা।

চম্পার কথা শুনে অন্যান্য মেয়েরাও বলে উঠল, ‘হ হ। সকলে ওই কথাই কয়।’

আচমকা শৈলবালা ঝাঁপিয়ে পড়ল চম্পার ওপর! খামচে খামচে চম্পাকে রক্তাক্ত করে তুলল। শৈলবালা চম্পার সেলোয়ার কামিজ ছিঁড়ে ফেলল। থাপ্পড় দিতে দিতে চম্পাকে মাটিতে শুইয়ে দিল শৈলবালা। মেয়েরা ছুটে এসে চম্পাকে উদ্ধার না করলে কোনো একটা বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলত শৈল।

শৈলর হাত থেকে রেহাই পেয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল চম্পা। ভাবতে লাগল—এই-ই কী সেই শৈলমাসি, যে মিথ্যা বলিয়ে কৃষ্ণাকে তার হাত দিয়ে সাজিয়েছে। অসহায় একটা মেয়ের ঘরে লবণ-কোম্পানির মতো জানোয়ারকে ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে রক্তাক্ত হতে সহযোগিতা করতে এই শৈলই তো তাকে প্ররোচিত করেছে! এই শৈল হারামজাদির কুপরামর্শেই তো সেদিন সকালে নিরপরাধী দেবযানীর সঙ্গে শুধু শুধু ঝগড়াটা বাঁধিয়েছিল চম্পা। তার চোখের সামনেই তো কালু সর্দার পাছায় লাথি মেরে দেবযানীকে ঘরের বাইরে ফেলে দিয়েছিল। তাহলে এই-ই শৈলবালার আসল রূপ! প্রয়োজনে পুতু পুতু, প্রয়োজন ফুরালে মুখে থুতু। দাঁড়া শৈল, আমি তোকে দেখে নিচ্ছি। তোর বারোটা বাজিয়ে ছাড়ব আমি। নইলে আমার নাম চম্পা মাগি নয়।

কিল খেয়ে কিল হজম করে চম্পা ধীরে ধীরে তার ঘরে ঢুকে গেল। গজরাতে গজরাতে শৈল দোতলায় উঠে গেল।

বহুদিন পর সে-সন্ধেয় রাজন এল চম্পার ঘরে। নাকেমুখে আঁচড়ের দাগ আর বিমর্ষভাব দেখে রাজন কিছু হয়েছে কিনা জানতে চাইল। চম্পা গাঁইগুঁই করে কী একটা জবাব দিল, যার মর্মার্থ রাজন বুঝল না। আলাপ-আড্ডা জমল না। চম্পাকে অন্যমনস্ক দেখে একসময় বিদায় নিল রাজন।

রাত দশটা হবে তখন, চম্পা তার বিছানায় বসে আছে। দরজা আলতো করে খোলা। হঠাৎ চম্পা দেখল—কাজের ঝি চঞ্চলা তিন তাকওয়ালা একটা টিফিন ক্যারিয়ার হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আগেও চঞ্চলাকে এইভাবে কয়েকবার বেরিয়ে যেতে দেখেছে। সেসময় ব্যাপারটা চম্পা আমলে নেয়নি।

.

এত রাতে টিফিন ক্যারিয়ার হাতে কোথায় যায় চঞ্চলা? নিশ্চয় কোনো ঘটনা আছে এর পেছনে। চট করে গায়ে ওড়নাটা জড়িয়ে চঞ্চলার পিছু পিছু বেরিয়ে পড়ল চম্পা। সর্দারের ঘরে খদ্দেরের আনাগোনা কমে গেছে বলে মূল দরজার বাইরে আঁধার আঁধার ভাব। নিজেকে আড়ালে রেখে চম্পা চঞ্চলাকে অনুসরণ করতে লাগল। একটা সময়ে দেখল——চঞ্চলা দ্রুত মঞ্জুমাসির ঘরে ঢুকে পড়ল।

কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে ঘরে ফিরে এল চম্পা। তাহলে এই কথা—সর্দার লুকাইয়া রইছে মঞ্জুমাসির ঘরে। সেখানে ভাত তরকারি যায় সর্দারবাড়ি থেইক্যা। দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা।’

ভোরসকালেই ঘুম থেকে উঠে পড়ল চম্পা। শিউলির গায়ে ঠেলা দিয়ে বলল, ‘উঠরে শিউলি, আজকে একটু সকাল সকাল উইঠা পড়রে ‘

শিউলি বলে, ‘ক্যান? চম্পারে, ক্যান এত সকালে বিরক্ত করতাছস?’

‘শিউলিরে, মন্দিরে যাওয়ার জন্য আজকে আমার খুব মন চাইতাছে। উঠ, আমারে একটু মন্দিরে লইয়া যা।’

শিউলি তড়াক করে বিছানায় উঠে বসে, ‘তুই মন্দিরে যাবি? কই, আগে তো কোনোদিন মন্দিরে যাইতে চাস নাই তুই। বলছস—হিন্দুগো মন্দিরে মুছলমান অইয়া যামু ক্যান?’

‘অত শত তোমারে বুঝাইতে পারব না। আমি একা গেলে নানারকম কথা উঠব। তুই আমারে লইয়া চল।’ অনুনয়ের সুরে কথাগুলো বলল চম্পা। ‘স্নানটা তো করতে দিবি। তুই তো জানস গত রাতে বেডা আছিল আমার ঘরে। খানকির পোলা গোড়া রাত সমস্ত গা চুইষ্যা বেড়াইছে।’ বলেই স্নানঘরের দিকে গেল শিউলি।

মূর্তির সামনে শিউলি পূজার্ঘ্য অর্পণ করতে ব্যস্ত। এই ফাঁকে চম্পা দ্রুত পুরোহিতের কাছে সরে গেল। কানে কানে বলল, ‘পুরোহিত মোশায়, কালু সর্দার মঞ্জুমাসির আস্তানায় লুকাইয়া রইছে। মোহিনী মাসিরে খবর দেন।

পুরোহিত স্তম্ভিত চোখ তুলে তাকাল চম্পার দিকে। মুখে কিছু বলল না, শুধু ওপরে নিচে মৃদু মাথা নেড়ে যেতে লাগল।

.

ওইদিন বিকালেই মঞ্জুমাসির ঘর থেকে কালু সর্দারকে গ্রেপ্তার করল পুলিশ। মঞ্জু আর কালু সর্দারকে হাতকড়া পরিয়ে পাশাপাশি হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গোটা সাহেবপাড়া ভেঙে পড়েছে পুবগলিতে। বেশ্যাপাড়ার অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি এই কালু সর্দার। তার ইচ্ছেতেই এই পল্লিটি উঠত আর বসত। কতজনকে যে ঘরছাড়া করেছে এই কালু, কত পতিতা-মাসি-মাস্তান-গুণ্ডা তার হাতে লাঞ্ছিত হয়েছে, কতজনের রক্তে কালুর হাত যে লাল হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। আজ সেই হাতে হাতকড়া। বিপজ্জনক ভেবে পিছমোড়া করেই হাতকড়া পড়ানো হয়েছে কালুকে। তার চারপাশে এতগুলো মানুষ থিক থিক করছে, কালুকে গ্রেপ্তার করার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করছে না। সবার মুখে রাগ, ক্ষোভ এবং কৌতূহল।

আকাশটা মেঘলা আজ। কিছুক্ষণ আগে ধুমসে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। বৃষ্টি একেবারে থেমে যায়নি। ঝিরঝিরে বৃষ্টি লেগে আছে। সর্দারবাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় শৈলবালা ছুটে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুই চিন্তা করিস না কালু। যত টাকা লাগে আমি তোরে ছাড়াইয়া আনমু। দরকার অইলে এই বাড়ি বেচুম, গয়না বেচুম। মোহিনীর দেমাক ভাইঙ্গা যেকোনো মূল্যে আমি তোরে ছাড়াইয়া আনমুই। তুই পাড়ার সর্দার। সর্দারেরে বাইন্ধ্যা রাখে কোন বাপের পুত?

দারোগা এক ঝটকায় কালুর কাছ থেকে শৈলবালাকে সরিয়ে দিলেন। হঠাৎ ভিড় থেকে আওয়াজ উঠল, ‘শৈলমাগির বিচার চাই, কালু সর্দারের ফাঁসি চাই।’

.

দোতলার বারান্দায় বসে নিথর মোহিনী ভাবছিল—কার বিচার? কিসের বিচার? বিচারের প্রহসন সে জানে। হাওয়া ঠাণ্ডা হয়ে এলে কালু একদিন বেরিয়ে আসবে। পৃথিবী টাকার গোলাম। টাকা দিয়েই কালু সবাইকে বশ করবে। ফিরে আসবে এই পাড়ায়। ধামা-ফারুইক্কার মতো ডজন ডজন খুনিকে আশ্রয় দেবে, বনানী-বেবিরা নির্যাতিত হবে, কৈলাসরা খুন হবে, কালু সর্দাররা বহাল তবিয়তে শাসন করে যাবে এই বেশ্যাপাড়া।

হঠাৎ মোহিনীর চোখ পড়ল—একজন তরুণী ভিড় ঠেলে কালুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে ভালো করে ঠাহর করতে পারছে না মোহিনী। দেবযানী নাকি?

‘পদ্মাবতী দেখ তো, ওই মেয়েটি কে? দেবযানী নাতো?’ চিৎকার করে বলল মোহিনী।

পদ্মাবতী ভেতরঘর থেকে দৌড়ে এল বারান্দায়। নিচে চেয়ে দেখে বলল, ‘দেবযানীই তো! ভিড়ের মধ্যে দেবযানী কী করছে? সর্দারের দিকেই বা যেতে চাইছে কেন ভিড় ঠেলে?’

ততক্ষণে কালু সর্দারের কাছে পৌঁছে গেছে দেবযানী। অত রূপসী একজন তরুণীকে দেখে বেশ ভড়কে গেল বেষ্টনরত পুলিশরা। পুলিশ কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই দেবযানী কালুকে জড়িয়ে ধরল।

কালুর মুখ দিয়ে ‘ঘোঁৎ’ করে একটা আওয়াজ বেরোল। পুলিশ তড়িদ্‌বেগে কালুর কাছ থেকে দেবযানীকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল।

সবাই দেখল—দেবযানীর হাতে একটা ছোরা। সেই ছোরা এবং দেবযানীর হাত-বুক-পেট রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কালু সর্দার হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে। কালুর সামনে, রাস্তায়, তারই নাড়িভুঁড়ির জড়াজড়ি।

দেবযানী গলা ফাটিয়ে বলল, ‘কালুর মামলা এইখানে খতম।’

পুলিশ ঝাপটে ধরার আগে মোহিনীর দিকে ফিরে দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে দেবযানী উচ্চস্বরে বলল, ‘আমাকে মাফ করে দিও মা।’

তারপর পদ্মবতীর দিকে ফিরে করুণ কণ্ঠে বলল, ‘পদ্মাদি, আমাকে ভুলে যেও। মোহিনী মাকে দেখিও, তার যত্ন নিও।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *