১০. মগধেশ্বরী মন্দিরের পেছনে

দশ

মগধেশ্বরী মন্দিরের পেছনে একচালা একটা টিনের ঘর।

মন্দিরের গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়েই দাঁড়িয়ে আছে ঘরটি। সবাই জানে – ওই ঘরে দেবীর পুজোর উপকরণ রাখা হয়। মাঝেমধ্যে ধনী কোনো বাঁধাবাবু মন্দিরের জন্যে প্রচুর পরিমাণে চাল-ডাল-চিনি-সাগু-কলা ইত্যাদি পাঠিয়ে দেয়। আবার কখনো কখনো কোনো মালদার বেশ্যা প্রচুর প্রসাদী-উপকরণ পাঠিয়ে স্বৰ্গীয় তৃপ্তি পায়। এগুলো মন্দিরের পেছনের ওই একচালা ঘরটিতে রাখা হয়। পুজোর কাজে ধীরে ধীরে ব্যবহার করেন পুরোহিত মশাই।

কিন্তু ঘরটির প্রকৃত পরিচয় তা নয়। এটি এই সাহেবপাড়ার নীতিনির্ধারণী ঘর। রাতের আঁধারে কালু সর্দার আর তার সাঙাতরা এই ঘরে বসে। কোন বেশ্যার দেমাক কমাতে হবে, কোন মাস্তানকে সাইজ করতে হবে, কোন বাঁধাবাবুকে ধমকে দিতে হবে আর কোন নবাগত পতিতার ঘরে সর্দারের কোন সাঙাত ঢুকে ফষ্টিনষ্টি করবে—তা এই ঘরে বসেই কালু সর্দার ঠিক করে দেয়। তার ইচ্ছানুসারে কাজগুলো সমাধা হয়েছে কী না পরের রাতে সাঙাতরা এসে রিপোর্ট করে এই মন্দিরলগ্ন চালাটিতেই।

সাহেবপাড়াটি চুরি, বাটপাড়ি, মারপিট, ছিনতাই, অন্যায়-অত্যাচার, ধর্ষণ, মেয়ে বিক্রি, বেআইনি মদ ও মাদকদ্রব্য বিক্রি—সবেরই অবাধ দুর্গ। এটি চোর, ডাকাত, খুনি, গুণ্ডা, মান্তানদের স্বাধীন বিচরণক্ষেত্র আর নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রও। জোরাখুনের আসামি কোর্ট থেকে পালিয়ে এখানে আশ্রয় নেয়। সুন্দরবনের দস্যু পুলিশের তাড়া খেয়ে এই পতিতালয়ে লুকিয়ে থাকে, শহরের নামকরা গুণ্ডারা রাজনৈতিক পালাবদলে এইখানে আশ্রয় খোঁজে। আশ্রয় দেয় কালু সর্দার। প্রচুর টাকার বিনিময়ে এইসব খুনি-মাস্তান- ডাকাতদের এই পাড়ায় আশ্রয় দেয় কালু। মন্দিরের পেছনের একচালায় লুকিয়ে রাখে তাদের। সাঙাতদের দু’একজন তাদের দেখাশোনা করে তাদের ভরণ এবং পোষণের কোনো অভাব হয় না। রাতে কোনো পতিতার ঘরে গিয়ে দেহের জ্বালা মিটায় এরা। বিপদ কেটে গেলে বা বিপদ ঘনিয়ে এলে খুনি ডাকাত গুণ্ডারা এই আশ্রয় থেকে সটকে পড়ে। সর্দারের এই দুষ্কর্মের কথা অন্য কেউ না জানলেও মন্দিরের পুরোহিত জানেন। কিন্তু বলার সাহস পুরোহিতের নেই। তাঁর ঘাড়ে কটি মাথা আছে যে, তিনি সর্দারের দুষ্কর্মের প্রতিবাদ করবেন?

আজ এই চালাঘরে একটা কেঠো চেয়ারে বসে আছে কালু সর্দার। চোখ মুখ থমথমে। তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মোড়ায়, টুলে, হাতলহীন চেয়ারে বসে আছে পাঁচসাতজন গুণ্ডা–সুবল, জামাল, রহমান, ইউনুছ, বলরাম এরা।

‘বলরাম, ল্যাংড়া রহিজ্যারে লইয়া আয়।’ থমথমে গলায় বলে সর্দার।

সবাই একযোগে কালু সর্দারের দিকে তাকায়। অবাক তারা। ল্যাংড়া রহিজ তো আধা পাগল। গায়ে গতরে ছেঁড়া জামা লুঙ্গি। ধুলায় ধূসরিত। গলির এধারে ওধারে পড়ে থাকে। কেউ কিছু দিলে খায়; দিনে সে একেবারে চুপচাপ। সন্ধে লাগতেই সে সরব হয়। ওই সময় প্রবল বেগে খিস্তিখেউড় বেরিয়ে আসে তার মুখ থেকে। যেদিন কারও হাতে-পায়ে ধরে একটু মদ গিলতে পারে, সেদিন গান বেরোয় তার গলা দিয়ে, অশ্লীল সেসব গান। এই রকম একজন পাগলকে কেন দরকার সর্দারের, ভেবে কূল পায় না সাঙাতরা।

বলরাম বলে, ‘ল্যাংড়া রহিজ্যাতো ছিঁড়া পাগল। তাকে তোমার দরকার কী ওস্তাদ?’

‘তোরে লইয়া আইতে কইতাছি—লইয়া আসবি। হেরে কী কারণে দরকার, সেইডা কি তোরে কইতে অইবো?’ তারপর একটু থেমে আবার বলল, ‘রহিজ্যারে দিয়া আমার চনুর বাল তোলাবো, আমার বিচা চিপাবো যা, যেইখানে পাস, লইয়া আয় ল্যাংড়ারে।’

সর্দারের মেজাজ দেখে বলরাম আর কথা বাড়াল না। কাঁচুমাচু মুখ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পেছন থেকে ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে উঠল জামাল। তার সঙ্গে যোগ দিল অন্যরা। সর্দারের নির্বিকার চেহারা দেখে সাঙাতদের হাসি উবে গেল।

মিনিট পনের পর প্রায় ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে ল্যাংড়াকে নিয়ে এল বলরাম। মোহিনীর গেইটের সামনে কুকুরকুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ছিল সে।

‘একটা বড় পাউরুটি, দুইটা সিদ্ধ ডিম আর একটা কোকের বোতল লইয়া আয় রহমান।’ সর্দার আদেশ দিল।

রহমান নিয়ে এলে ওগুলো রহিজ্যা পাগলাকে খেতে দিল সর্দার। খাওয়া শেষ হলে এক গ্লাস বাংলা মদ তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘শুন রহিজ্যা, কাইল থেইক্যা সইন্ধ্যা অইলে একখান গান গাইয়া বেড়াবি তুই, মোহিনীর ঘরের আশপাশে ঘুইরা ঘুইরা গানটা গাইবি। পারবি না?’

খাদ্য এবং পানীয় পেটে যাবার পর রহিজ এখন অনেকটা স্বাভাবিক। সর্দারের প্রশ্নের জবাবে বলল, ‘পারব সর্দার, একশবার পারব। তই গানটা কী?’

কালু সর্দার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে সুবলের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘সুবল, তুই তো শিক্ষিত। এই কাগজে গান লেখা আছে। বইস্যা বইস্যা আজকে রাইতের মইধ্যে রহিজ্যারে গানটা শিখাই লইবি।’ তারপর রহিজের দিকে ফিরে আদেশের সুরে বলল, ‘ওই চোদমারানির পোলা লেঙ্গাইয়া, কাইল সইন্ধ্যা থেইকা সুর কইরা গহিন রাইত পর্যন্ত গাইয়া যাবি, মনে আছে তো মোহিনী মাসির দরজার সামনে হাঁইট্যা হাঁইট্যা গাইবি। প্রত্যেক দিন এই রকম খাওন পাবি। কী গাইতে পারবি না?’

রহিজ জোরে জোরে উপরে নিচে মাথা নাড়ল। সাঙাতরা রহিজকে দিয়ে গান গাওয়ানোর মর্মার্থ কিছুই বুঝল না। বোকা বোকা চেহারা নিয়ে এ ওর দিকে তাকাতে লাগল।

.

লালবাতির এরিয়ার বাড়িগুলোর ভেতরে উজ্জ্বল সাদা বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। পুগলির দু’ধার জুড়ে লাইটপোস্টে ম্লান আলোর সরকারি বাতিগুলো ঝুলে আছে। ঘরের ভেতরে ফকফকা আলো কিন্তু দরজায় দরজায় আলো-আঁধারের জড়াজড়ি। সুন্দরী পতিতারা উজ্জ্বল আলোর তির্যক ছটা মুখে নিয়ে কাস্টমারদের লক্ষ করছে। রঙচটা গালভাঙা পতিতারা আঁধারে দাঁড়িয়েছে। তাদের বুকে মেকি স্তন। সূচিমুখ স্তন দুটোকে খদ্দেরের নজরে ফেলবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।

সন্ধে থেকেই মোহিনীর দরজায় খদ্দেরদের ভিড়। মোহিনী মাসির মেয়েরা বাছা মেয়ে, চোখ দিলে চোখ ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছে করে না ওই মেয়েদের ওপর থেকে। মোহিনী দোতলায় ঘর পরিষ্কার করাতে ব্যস্ত। ওই ঘরে রীতাকুমারী নামের যে রূপসী বেশ্যাটা ছিল, সে এক নাগরকে বিয়ে করে পাড়া ছেড়ে গেছে। যাওয়ার আগে অবশ্য আশার চেয়েও বেশি টাকা দিয়ে গেছে নাগরটি। নানা ময়লা আর ঝুল ঘরটির ভেতরে বাইরে। রীতাকুমারী চলে যাওয়ার তিন দিনের মাথায় কক্ষগুলো পরিষ্কার করানোর জন্যে লোক লাগিয়েছে মোহিনী। তদারকির কাজ শেষ করে সে নিচে নামবে একবার। ব্যবসার গতি-জোয়ার দেখে ওপরে উঠে আসবে সে। রীতাকুমারীর ঘরের পাশেই ছোট্ট একটা কক্ষকে অফিস বানিয়েছে মোহিনী! ঘণ্টা-আধ ঘণ্টা পরপর প্রেমদাশ মাসির প্রাপ্যের অংশ ওপরে নিয়ে আসে। মোহিনী মনোরম টেবিলটির ড্রয়ার টেনে পতিতাদের দেহবেচা টাকা রাখে।

প্রেমদাশ মোহিনীর বাড়িতে এসেছে বেশিদিন হয়নি। আঠারো-বিশ বছরের এই যুবকটি উত্তর পতেংগা থেকে এসেছে। মোহিনীর দেবরপুত্র সে, গুড়ামোহনের পাঁচ ছেলের মধ্যে জ্যেষ্ঠ। দেবরপুত্র হলেও মোহিনী তাকে দোতলায় থাকতে দেয়নি। পতিতাদের খুপরির সামনে একটা চাতাল আছে। ওপরে এসে ভাত খেয়ে রাতে ওই চাতালেই শুয়ে পড়ে সে। গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে তাকে দেওয়া দায়িত্বগুলো পালন করে যাচ্ছে প্রেমদাশ। নিচতলার নিম্ন আয়ের পতিতাদের ফাইফরমাস যেমন সে খাটে, তেমনি বড়মার স্বার্থরক্ষার দিকেও সে কড়া নজর রাখে।

প্রেমদাশ এসেছে ওপরে টাকা দিতে। ওই সময় দু’জনের কানে এল

‘কি প্রেম শিখাইলি জাইল্যারে –
জাইল্যা গেছে মাছ মারিতে
জাইলানি গেছে চাইতো
লাঙের বেটা খাপ দি রইছে
জাইল্যনির দেহখান খাইতো রে
কি প্রেম শিখাইলি জাইল্যারে।’

কর্কশ ভাঙা ভাঙা গলা। নির্ভুল উচ্চারণে গেয়ে চলেছে গায়ক। লাঙের বেটা আর জাইল্যনি শব্দ তিনটির ওপর শ্বাসাঘাত দিয়ে ক্লান্তিহীনভাবে গেয়ে চলেছে ল্যাংড়া রহিজ। তাকে ভালোই তালিম দিয়েছে সুবল। গলিমুখ থেকে শুরু করে মোহিনীর দরজায় এসে একটুখানি থেমে আবার উচ্চকণ্ঠে গেয়ে গেয়ে গলির দিকে এগিয়ে যায় রহিজ। মোহিনী মাসি এবং প্রেমদাশ দুজনেই শুনছে গানখানি। একসময় মোহিনী জিজ্ঞেস করল, ‘প্রেমদাশ, গানটি কে গাইছে রে?’ প্রেমদাশ কান পেতে শুনল একটুক্ষণ। তারপর বলল, ‘ল্যাংড়া রহিজ্যা গান গাইতেছে বড়মা।’

‘কী গান যেন গাইছে রহিজ?’

‘জাইল্যা জাইল্যনির কথাই তো বারবার বলতেছে।’ প্রেমদাশ বলে।

কী যেন ভাবল মোহিনী মাসি। তারপর বলল, ‘থাক, পাগলা কিসিমের মানুষ। এক এক সময় এক এক গান গায়। আজকে এইটা ভালো লাগছে, গাইছে। কালকে হয়তো অন্য গান ধরবে।’ নির্বিকার কণ্ঠে কথাগুলো বলে গেল মোহিনী।

কিন্তু কাল অন্য গান গাইল না রহিজ পাগলা। সন্ধে লাগতে না লাগতেই ওই একই গান মোহিনীর বাড়ির সামনে দিয়ে গেয়ে গেল। তৃতীয় দিনও তা-ই, চতুর্থ পঞ্চম দিনও। ষষ্ঠ দিন মোহিনী আর নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। রহিজ অশ্লীল শ্লীল গান গায়। তাতে মোহিনীর কিছু যায় আসে না। কিন্তু জাইল্যা-জাইল্যনিকে নিয়ে এই বিশেষ গানটি কেন গত কয়েক দিন ধরে গেয়ে যাচ্ছে রহিজ? সে তো জেলে ফ্যামিলির মেয়ে। তাকে অপমান করার জন্য কি এই গান গাওয়ানো হচ্ছে? এটা কোনো ষড়যন্ত্র? কারও কারসাজিতে রহিজ পাগলা গানটা গাইছে নাতো? মোহিনীর মাথা গরম হয়ে উঠল একসময়। একবার মনে হল—ল্যাংড়াকে ধরে নিয়ে এসে আচ্ছাসে ধোলাই দিলে ভালো হবে।

কিন্তু মোহিনী বুদ্ধিমতী। ষষ্ঠ সন্ধেয় রহিজকে ওপরে নিয়ে আসতে বলল মোহিনী।

‘ওপরে আনার আগে রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে রহিজকে পেট ভরে ভাত খাওয়াবে প্রেমদাশ। তারপর কোনো হইচই না করে ওপরে নিয়ে আসবে।’ প্রেমদাশকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলল মোহিনী

‘ঠিক আছে বড়মা।’ বলল প্রেমদাশ।

.

‘রহিজ, বল কে তোমাকে এই গান গাইতে বলেছে?’ রাগটা মাথার মধ্যে চেপে রেখে মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করে মোহিনী।

দুই হাতের আঙুল দিয়ে উসকোখুসকো নোংরা চুলের মাথাটি ঘষাং ঘষা করে চুলকাতে চুলকাতে রহিজ বলল, ‘কেউ না কেউ না। আমি এমনি এমনি গাই। মনের সুখে গাই। ভালো লাগলেও গাই, না লাগলেও গাই।

মোহিনী এবার চোখ গরম করে বলল, ‘লুকান চাপান কর না রহিজ। সত্যি সত্যি বল, কার অর্ডারে জাইল্যা-জাইল্যনির গান গাইছ কয়েক সন্ধ্যা ধরে?’

মোহিনীর বসার ঘরের মেঝেতে বসেছে রহিজ। পেছনে প্রেমদাশ দাঁড়িয়ে আছে। মেঝেতে ডান হাতের থাপ্পড় মেরে রহিজ পাগলা বলল,

‘সত্যি কইতাছি। মিথ্যা বলুম ক্যান? আল্লার কসম খাইয়া কইতাছি কেউ গাইতে কয় নাই।’

মোহিনী বলল, ‘প্রেমদাশ, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না দেখছি। কী করা যায় বলতো?’

মোহিনীর কথা শেষ হতে না হতেই প্রেমদাশ কষে একটা লাথি কষাল রহিজ পাগলার পিঠে।

‘ও মারে…। কইতাছি কইতাছি। কাউল্যা সর্দার আমারে গান গাওনর কাজে লাগাইছে। আপনি বলে জাইলানি। হেরা নাকি দত্ত। আপনি ছোড় জাত, শৈলমাসিরা বড় জাত। আপনার ওপর প্রতিশোধ লওনর লাইগ্যা জাইল্যা-জাইল্যনির গান গাওয়াচ্ছে।’ কাঁদতে কাঁদতে বলে গেল রহিজ।

‘অ আচ্ছ, বুঝলাম। তুমি তো পাগলা কিসিমের মানুষ। এইগুলো করতে গেলে কেন?’ কৃত্রিম কোমলতা মোহিনীর কণ্ঠে।

‘মফতো মফতো খাই, তাই গান গাইয়া যাই। সর্দার লোভ দেখাইল দুইবেলা ভাত দেব, মদ দেব। বিনিময়ে শুধু একখান গান গাইবিজাইল্যা- জাইলানির গান। খাওনর লোভে রাজি অইয়া গেলাম। গান গাইতে তো আমার কষ্ট হয় না। খাইতে না পাইলে বড় কষ্ট হয় আমার।’ বলল রহিজ। ‘আমি তোমাকে দুই বেলা ভাত দেব। টাকাও দেব। এই গান তুমি আর গাইবে না।’ আদেশের সুরে মোহিনী বলল।

‘আইচ্ছা।’

মোহিনী চেয়ার ছেড়ে দু’কদম এগিয়ে এল রহিজের দিকে। সামনে ঝুঁকে বলল, ‘কালকে থেকে তুমি আমার জন্যে একটা কাম করবে। পারবে না?’

‘পারব। ভাত খাওয়ালে পারব। পেটে বড় ক্ষুধা, ভাতের জইন্য জান দিতে রাজি আমি।’ জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল রহিজ।

মোহিনী মৃদু হেসে ধীরে ধীরে বলল, ‘জান দিতে হবে না তোমাকে। ভাত আমি তোমাকে দেব দুই বেলা। তবে কামটা মন দিয়ে করে দিতে হবে তোমাকে। কাল সন্ধে থেকে কাস্টমাররা যখন আসতে শুরু করবে, তখন সর্দারের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলবে–সর্দারবাড়ির মাইয়াগোর শরীলে সিফিলিস। নির্ভয়ে বলবে, চিৎকার করে বলবে। পারবে না?’ তারপর প্রেমদাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রহিজ পাগলারে ট্রেনিং দিয়ে তৈয়ার করে নাও প্রেমদাশ।’

প্রেমদাশ বিস্মিত চোখে মোহিনীর দিকে তাকিয়ে থাকল। মোহিনীর বুদ্ধিমত্তায় সে হতবাক হয়ে গেল। মারপিট না, হইচই বা পাল্টা গালিগালাজ না, কালুর ওপর শক্তি প্রয়োগও না। শুধু বুদ্ধির খেলা! বুদ্ধিকে একটু মোচড় দেওয়া। কী আশ্চর্য!

ঘোর একটু পাতলা হয়ে এলে প্রেমদাশ বলল, ‘ঠিক আছে বড়মা, নিচে নিয়া গিয়া ট্রেনিং দিতেছি।’

.

পরদিন সন্ধেয় হু হু করে কাস্টমার ঢুকছে পূর্বগলি দিয়ে। মোহিনীর মেয়েদের জালে আটকে যাচ্ছে অনেকে। বাকিরা এগিয়ে যাচ্ছে গলির ভেতরের দিকে। সর্দারবাড়ির পতিতারাও রূপসী। দশ বারোজন মেয়ে সর্দারের গেইটের সামনে খদ্দের ডাকছে। মেয়েদের সামনে খদ্দেরদের জটলা। পাঁচ সাতজন ঘরের ভেতর কাস্টমার নিয়ে ব্যস্ত। ওই সময় রহিজ চিৎকার করে উঠল, ‘ওই হারামজাদা ইবিলিস, সর্দারের ঘরে সিফিলিস, ঘরের ভিতর যাইস না, পোকা আম খাইস না।’ নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করে এই কথাগুলো রহিজ পাগলা বারবার বলে যেতে লাগল।

প্রথমে খদ্দেররা রহিজের কথা খেয়াল করেনি। জটলার মধ্য থেকে এক খদ্দের বলে উঠল, ‘কী বলছে ওই মানুষটা? সর্দারের বাড়িতে সিফিলিস মাইনে? মাইয়াগো সোনায় সিফিলিস?’

এবার সব কাস্টমার এবং সর্দারবাড়ির মেয়েরা উৎকর্ণ হয়ে রহিজের কথা শুনতে লাগল। রহিজ আগের মতো বলে যেতে লাগল, ‘ওই হারামজাদা ইবিলিস, সর্দারের ঘরে সিফিলিস…।’

সর্দারের গেইটের সামনে থেকে সকল কাস্টমার একে একে সটকে পড়ল। মেয়েরা বোকা বোকা চেহারা নিয়ে একে অপরের দিকে তাকাতে লাগল। ভাবতে লাগল—কার সিফিলিস, কাদের সিফিলিস? পাগলটাই বা জানল কী করে? সেরাতে তাদের ঘরে আর কোনো খদ্দের এল না। গাঁইটের টাকা খরচ করে কে সিফিলিস কিনে নেবে? পাগলা রহিজ সমান তালে ওই ছড়াটি কেটে যেতে লাগল।

সেরাতে সাহেবপাড়ায় কালু সর্দার ছিল না। সাঙাতদের নিয়ে কী একটা ঝামেলা মিটাবার জন্যে তাকে টানবাজার যেতে হয়েছে। একসময় কথাটি শৈলমাসির কানে গেল। নিচে নেমে এল মাসি। রহিজকে উদ্দেশ্য করে কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ওই কুত্তার বাইচ্চা রহিজ্যা। তোরে এই কথা কে শিখাইছে? এই সজল, সজল্যারে রহিজ্যা খানকির পোলারে ধইরা লইয়া আয়। পোঁদ দিয়া তেল মাখা লাঠি ঢুকাইয়া দে।

সজল ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে রহিজ পাগলা পালিয়ে গেল।

.

তিনদিন পর ভোরসকালে সবাই মোহিনীর গেইটের সামনে রহিজ পাগলার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখল।

পুলিশ এল, দারোগা এল। খোঁজ খবর নিল। সবাই বলল- রহিজ পাগল। রাস্তাঘাটে পড়ে থাকে। তার আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। বেওয়ারিশ লাশ নিয়ে থানা মাথা ঘামাল না। রহিজের মৃতদেহ মর্গে পাঠিয়ে দিল।

.

কালু সর্দারের যা ক্ষতি হবার তা হয়ে গেছে। কাস্টমাররা সযত্নে তার দরজা এড়িয়ে সাহেবপাড়ায় ঢোকে। সর্দারের গেইটের সামনে দাঁড়ানো মেয়েদের দিকে ভুলেও তাকায় না। একান ওকান হয়ে কথাটা এই বেশ্যাপাড়ায় রাষ্ট্র হয়ে গেছে—সর্দারবাড়ির পতিতাদের শরীরে সিফিলিস বাসা বেঁধেছে। যমে ছাড়লেও ছাড়তে পারে, সিফিলিস কাউকে ছাড়ে না। সর্দার এবং তার সাঙাতরা রটনাটা যে মিথ্যে, তা প্রমাণ করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগল। রহমান মাথা গরম করে সেরাতে রহিজ্যার গলা টিপে না ধরলে সিফিলিসের রহস্য উদ্ঘাটন করা যেত। রহিজ্যাকে দিয়ে অন্য একটা চাল চালানো যেত। খানকির পোলা রহমাইন্যা। চোদমারানির পোলা মাথা গরম করার কারণেই তো সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে গেল।

সর্দারের করোটির নিচে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। কিন্তু কিছুই করতে পারছে না সর্দার। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় সর্দার বুঝে গেছে যে, এই ঘটনার মধ্যে বেডা ঠাবানি মোহিনীর হাত আছে। কিন্তু প্রমাণ করার উপায় নেই। মাগির পোলা রহমাইন্যা সকল পথ বন্ধ করে দিল! রাগে ক্ষোভে দুঃখে নিজের হাত নিজে কামড়াতে লাগল সর্দার।

আর দোতলায় নিজের ঘরটিতে বসে মোহিনী মুচকি হেসে আপন মনে বলে যেতে লাগল, ‘জাইল্যনির বুদ্ধি তো টের পাওনি শৈলবালা দত্তের পোলা? এখন বসে বসে নিজের বুড়ো আঙুল চোষ আর কুত্তার বিচা কচলাও।’

এগারো

সর্দারবাড়ির আয় ইনকাম শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।

দু’চার জন নতুন খদ্দের ঘরে ঢুকলেও ওই আয় দিয়ে মেয়েদের চলে না। বাঁধবাবুরা ওই বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। বিপুল অসহায়তা নিয়ে কালু সর্দারের বাড়িটি সাহেবপাড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। অন্যান্য বাড়িতে খদ্দেরদের সমাগম থাকলেও সর্দারবাড়িতে ভূতের বাড়ির ভীতি ও নির্জনতা। কাস্টমারদের তো আর পিটিয়ে ঘরে ঢুকানো যাবে না! কার সঙ্গে শোবে—তা ঠিক করার অধিকার কাস্টমারের আছে। অহেতুক হাঙ্গামা করলে বা জোর খাটাতে গেলে ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না। এখনো যে দু’চার জন কাস্টমারের কাছে বদনামটা গোপন আছে, হুজ্জতি করলে তা-ও আর গোপন থাকবে না। তখন মিঠাও যাবে, ছালাও যাবে। সকালের নাস্তার টেবিলে বসে এই সব কথা ভাবছিল সর্দার।

শৈলমাসি নীরবে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা সময়ে শৈলমাসি জিজ্ঞেস করল, ‘কী অইছে পোলা? কী ভাবতাছ?’

‘রহিজ পাগলা কী ক্ষতিটাই না কইরা গেল আমাদের!’

‘বাঁইচা থাকলে হেরে দিয়াই বলানো যাইতো কথাটা মিথ্যা।’ শৈল বলল।

‘হেই দিন যদি মাথাটা গরম না করতা মা! পরে দুধ ঢাললে কী অইতো?’ ক্ষোভের সঙ্গে বলল কালু সর্দার।

শৈল বুঝল, কালুর কণ্ঠে রাগের আঁচ। মুখে কিছু বলল না শৈল। কিন্তু সে বলতে চাইল—তুই এই বেশ্যাপাড়ার সর্দার, হর্তাকর্তা বিধাতা। আগে তোর মা ঢালবে না তো দুই টাকার মোহিনী কসবি ঢালবে? কিন্তু ছেলের মাথা গরম দেখে নরম সুরে বলল, ‘যাউগ্যা, যা হওনর হইয়া গেছে। ঠাকুরে আমাগোর দিন ফিরাইবো, শিগগির ফিরাইবো। কাস্টমারের ভিড় লাগবো আমাগোর বাড়ির সামনে। আমাগো মাইয়ারা এই বেশ্যাপাড়ায় সেরা।’

কালু সর্দার স্মিত হেসে মায়ের দিকে তাকাল। এই ফাঁকেই কথাটি পারল শৈলবালা। বলল, ‘একটা কথা কওনর আছিল তোরে?’

‘কী কথা আবার?’

‘অত ভয়ের না। তবে একটু চিন্তার।’ শৈল বলল।

‘এত ভূমিকা করতাছ ক্যান? যা কইবার সরাসরি কইয়া ফালাও।’

স্পষ্ট উচ্চারণে শৈলবালা বলল, ‘দেবযানীর সিফিলিস অইছে, কঠিন সিফিলিস।

কালু সর্দার চমকে মায়ের দিকে তাকাল। তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল, কেউ যেন তার তলপেটে আচমকা ছুরি চালাল, পেছন থেকে বড় ডাণ্ডা দিয়ে তার মাথায় বাড়ি দিল যেন কেউ। হতবাক হয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকল কালু। তারপর রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘জীবন ডাক্তারের কাছে লইয়া যাও নাই? ও তো এইসব রোগের ধন্বন্তরি। তার কাছে লইয়া যাও ভাল কইরা দিব!’

শৈল বলে, ‘লইয়া গেছিলাম। অসুখটা অইছে পেরাই একমাস। দুইবার তিনবার লইয়া গেছি ডাক্তারের কাছে। জীবন ডাক্তার কইল—কঠিন সিফিলিস, সাংঘাতিক পর্যায়ে গেছে। ভালা করা মুশকিল।’

‘তই, এখন কী করবা?’ সর্দারের কণ্ঠ অসহিষ্ণু।

শৈল যেন কালু সর্দারের প্রশ্ন শোনেনি। অনুচ্চ স্বরে বলে যেতে লাগল, ‘সেই দেবযানী আর নাই। শরীল টরিল চিমসা অইয়া গেছে। চোখ গত্তের ভিতর ঢুইক্যা গেছে। গতকাল ডাক্তার কইল—এই মাইয়া থেইকা অন্য মাইয়াতে রোগ ছড়াইতে পারে। রোগের যে অবস্থা বাঁচব না দেবযানী। কানে কানে কইল—পারলে বিদায় কর দিদি।

‘মিথ্যা সিফিলিসের ধাক্কায় পরান যায় যায়। সত্যটা জানাজানি অইলে লাটে উঠবে বেবসা। বেবসা লাটে উঠলে সর্দারগিরিও যাইবো। না খাইয়াও মরবো।’ উত্তেজিত কণ্ঠে কথাগুলো বলে গেল কালু।

‘মাথা গরম কইরো না। শুন, ডাক্তার যখন কইছে দেবযানীরে বাঁচান যাইবো না, তারে বিদায় করতে অইবো। তই, রোগের দোহাই দিয়ে না। কালকে সকালে চম্পার লগে দেবযানীর ঝগড়া লাগবো, তুমি মাথা গরম কইরা দেবযানীর চুলের মুঠি ধইরা রাস্তায় ধাক্কা মাইরা ফেলাইয়া দিবা। মানুষে বুঝবো—ঝগড়াঝাঁটির জইন্য সর্দার এই হাড়গিলা মাগিরে ঘরের বাইরে ধাক্কাইয়া ফেলছে।’

কালু সর্দার বিস্মিত চোখে বলল, ‘মা, তোমার অর্ধেক বুদ্ধিও যদি থাকত আমার মগজে!’

.

পরদিন সকাল নয়টায় পুগলির অধিবাসীরা শুনল—সর্দারের নিচতলায় প্রচণ্ড চেঁচামেচি। চম্পা চিৎকার করে কাকে যেন বলছে, ‘খানকি মাগি। রূপের দেমাকে পা পড়ে নাই তোর মাটিতে। অখন গোস্তগাস্ত সব শেষ। এই পাড়ায় গোস্ত বিক্রি হয়। হাড্ডি কিনে না কেউ। এবার তোর সোনার দেমাক ভাঙবে আমার সোনামণি।’

আর দেখল—দেবযানী রাস্তার ওপর তার দীর্ঘ এলোমেলো চুল ছড়িয়ে দিয়ে গুমরে গুমরে কাঁদছে। তার কাপড় ছেঁড়া, ব্লাউজ জীর্ণ। চোখের নিচে কালি। একসময়ের সাহেবপাড়া ঝাঁকিয়ে-দেওয়া রূপসী দেবযানী আজ পেত্নীর মতো হাড্ডিসার।

দালানের ভেতর থেকে সর্দারের গালিগালাজ শোনা যাচ্ছে, খানকি মাগি, হরদম ঝগড়াঝাঁটি চুলাচুলি করতাছ। সোনার দাম তো কইম্যা গেছে, বেড়া ঢুকে না আর তোর ঘরে। তারপরও দেমাক কমে নাই খানকির। এখন রাস্তায় শুইয়া শুইয়া বেড়া ধর।’

প্রেমদাশ বাজারে যাচ্ছিল। গলির উত্তর মাথায় মাছ-মাংস তরকারির বাজার। সর্দারবাড়ি পেরিয়ে বাজারে যেতে হয়। সর্দারবাড়ির সামনে রাস্তার ওপর মেয়েটাকে আলুথালু অবস্থায় কাঁদতে দেখে পানের দোকানদার সমরকে প্রেমদাশ জিজ্ঞেস করে, ‘ঘটনাটা কী সমর? কার বাড়ির মাইয়া? নাম কী? রাস্তার উপর পইড়া পইড়া কান্দে কেন?’

সমর বলল যে, মেয়েটির নাম দেবযানী। ঝগড়াঝাঁটির দোহাই দিয়ে সর্দার লাথি মেরে বের করে দিয়েছে কিছুক্ষণ আগে।

প্রেমদাশ এই পাড়ায় এসেই দেবযানীর রূপ-যৌবনের কথা শুনেছে। এই মেয়েটা যে, সাহেবপাড়ার এক নম্বর বেশ্যা সেটা শুনতেও বাকি থাকেনি তার। তড়িদ্‌বেগে প্রেমদাশের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। বাজারে না গিয়ে মোহিনীর কাছে ফিরে গেল সে। মোহিনীর সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ চাপাস্বরে কথা বলল প্রেমদাশ।

মোহিনী আবেগি কণ্ঠে বলল, ‘এই সুযোগ আমি ছাড়ব না প্রেমদাশ। তুই ভালো বুদ্ধি দিয়েছিস আমাকে। দেবযানীকে যত্ন করে নিয়ে আয়। দোতলায় নিয়ে আসবি।’

‘ঠিক আছে বড়মা। আমি এখনই নিয়া আসতেছি।’ প্রেমদাশ তৃপ্তির কণ্ঠে বলল।

.

মোহিনী মাসির দোতলায় রীতাকুমারীর খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছে দেবযানী। ধূলিমলিন আঁচল পিঠ থেকে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে। দীর্ঘ কোঁকড়ানো কালো চুল দু’কাঁধ ছাপিয়ে মেঝে ছুঁই ছুঁই করছে। চুলের ফাঁক দিকে দেবযানীর শীর্ণ ক্লান্ত বিপন্ন মুখটি দেখা যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছে—তার গভীর নিবিড় চোখ দুটো। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মোহিনী দেবযানীর দিকে। এই মুহূর্তে দেবযানীর চোখ মেঝেতে নিবদ্ধ। খাট থেকে একটু দূরে দেয়াল ঘেঁষে প্রেমদাশ দাঁড়িয়ে আছে।

অত্যন্ত শান্ত মরমি কণ্ঠে মোহিনী বলল, ‘দেখ মেয়ে, তোমাকে আমি কখনো দেখিনি, কিন্তু তোমার কথা আমি শুনেছি। তোমার রূপের কথা আমার কান পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। কিন্তু সেই রূপসী মেয়ের এই হাল–আমি স্বপ্নেও ভাবিনি! আমরা, এই পাড়ার মাসিরা তোমাদের দেহবেচা টাকায় বেঁচে আছি। আমাদের দেমাক-প্রতিপত্তি সব তোমাদের অবদানের জন্যে। তোমাদের দুঃখের ভাগিদার হওয়াও আমাদের কর্তব্য। তোমাদের অসুখ হলে বিবেকবান মাসিরা নিজেদের টাকা খরচ করে ডাক্তার দেখিয়ে ভালো করে তোলে। কেন যে শৈলবালা বা কালু সর্দার এটা করল না, বুঝতে পারছি না। যা-ই হোক, তোমাকে দুটো কথা বলব। মনোযোগ দিয়ে শোন।’ বলে থামল মোহিনীবালা

দেবযানী মুখ তুলে মোহিনীর দিকে তাকাল। দেখল—মোহিনীর চোখ দুটো টলটলে স্নেহে সিক্ত।

দম নিয়ে মোহিনী আবার বলতে শুরু করল। এবার কাটা কাটা কণ্ঠে, ‘তোমাকে আমি দরদ দেখাচ্ছি বিনা স্বার্থে নয়। যত টাকা লাগে, যত নামকরা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয়—খরচ করব, নিয়ে যাব। কিন্তু একটা শর্তে তুমি ভালো হয়ে উঠলে ব্যবসা চালিয়ে যাবে। তোমার আয়-ইনকামের অংশীদার হব আমি। ও হ্যাঁ, এখন থেকে এই ঘরেই থাকবে তুমি, একজন আয়া তোমার দেখাশোনা করবে। মনে রেখ—সম্পূর্ণ সুস্থ না হলে, তোমার আগের স্বাস্থ্য ফিরে না এলে, তোমাকে ব্যবসার কাজে লাগাব না আমি। রাজি তুমি?’

দেবযানীর চোখ থেকে গণ্ড বেয়ে টপটপ করে জল ঝরে যাচ্ছে। অশ্রু মোছার কোনো চেষ্টাই করছে না দেবযানী।

প্রেমদাশ কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘বল দেবযানী, তুমি রাজি?’

দেবযানীর গলা দিয়ে ‘হ্যাঁ’ জাতীয় দুর্বোধ্য একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল। দেবযানীর ওপরে-নিচে মাথা দোলানো দেখে মোহিনী বুঝে নিল, দেবযানীর সম্মতি আছে তার প্রস্তাবে!

সে রাতেই জীবন ডাক্তারকে ডেকে আনাল মোহিনীবালা। দেবযানীকে মোহিনীর ঘরে দেখে চমকে উঠলেন ডাক্তার। কিন্তু চোখেমুখে অবাক হবার কোনো চিহ্নকে প্রশ্রয় দিলেন না তিনি। ডাক্তার জানেন—এই বেশ্যাপাড়াটি একটা রঙের জগৎ। কত বিচিত্র ঘটনার জন্ম হয় এই পাড়ায়! ডাক্তার বলে অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী তিনি। কিন্তু জীবন ডাক্তার কখনো মুখ খোলেন না। আজও খুললেন না। শুধু দেবযানীকে দেখিয়ে মোহিনীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এই মেয়েটিকে আমি দেখেছি। শৈলবালা আমার কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সিফিলিস হয়েছে তার, কঠিন পর্যায়ে চলে গেছে। আমি তাকে ভালো করে তুলতে পারব না।’

‘তা হলে কী উপায় ডাক্তারবাবু? আমি মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। যত টাকা লাগে। আমাকে বুদ্ধি দেন।’ মোহিনী বলে।

‘আপনি দেবযানীকে ডাক্তার মোহাম্মদ বিন কাশেমের কাছে নিয়ে যান। যৌনরোগের অভিজ্ঞ ডাক্তার তিনি। উনি যদি দায়িত্ব নেন এবেলায় মেয়েটি বেঁচে যেতেও পারে।’ দরদি কণ্ঠে বললেন ডাক্তার।

‘তাই হবে। আমি দেবযানীকে ডাক্তার মোহাম্মদ বিন কাশেমের কাছেই নিয়ে যাব।’ তারপর চাপাস্বরে মোহিনী বলল, ‘ঈশ্বর এতদিন পর কালু সর্দারকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়ার সুযোগটা আমাকে দিলেন, আর আমি সেই সুযোগ নেব না?’

.

নারীদের দেহবেসাতি পৃথিবীর আদিমতম ব্যবসা। দিনে দিনে মানুষ সভ্য হয়েছে, সমাজের অনেক কুপ্রথাকে ঘৃণায় ডাস্টবিনে ছুড়ে দিয়েছে। কিন্তু সভ্য- শিক্ষিত মানুষরা দেহব্যবসাকে প্রশ্রয় দিয়ে গেছে। সমাজের উপরিতলের অনেক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু ভেতরের এই কদর্য রূপটিকে বদলানোর জন্যে কেউ মরণপণ অভিযানে নামেনি। এই ব্যবসায়ে লিপ্ত মেয়েরা হতভাগ্য, সমাজের করুণার পাত্র তারা; আর এই মেয়েরাই ধনী, শিক্ষিত অথচ উচ্ছৃঙ্খল মানুষের ফুর্তি ও তৃপ্তির খোরাক যুগিয়ে নিঃশেষ হয়। বিনিময়ে তারা সামান্য টাকা পায়। প্রাপ্ত টাকার আবার নানা অংশীদার—মাসি, দালাল, সর্দার, গুণ্ডা, থানা ইত্যাদি। সমাজমানুষ এই পতিতাদের ঘৃণা করে আবার তারাই রাতের আঁধারে মুখ ঢেকে পতিতার বুকে মুখ রাখে, তাদের যৌবন চাটে। পতিতাই হল দেহব্যবসার কেন্দ্র। তাদের ঘিরে আবর্তিত হয় মাসি-দালাল-মাস্তানরা। এদের হারানোর কিছু নেই; হারাতে হয় পতিতাকেই। তাকে ঘিরে যারা আবর্তিত হয়, তারা শোষণকারী। শোষণকাজ শেষ হলে যৌবনহীন পতিতাকে আঁস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলতে তারা একমুহূর্ত দ্বিধা করে না। পতিতাপল্লির কোনো ঘর কখনো খালি থাকে না; এক পতিতা যায় তো অন্য পতিতা এসে সে জায়গা পূরণ করে।

মোহিনী মাসি কালু সর্দারের ছুড়ে ফেলা পতিতা দেবযানীকে ঘরে তুলল। দুটো বিশেষ কারণে সে দেবযানীকে আশ্রয় দিল। কালু এই পাড়ার সর্দার হবার পর থেকে কী এক অলিখিত কারণে মোহিনীকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে আসছে। নানা সময়ে তার সুনাম ও প্রতিপত্তিতে হাত বাড়িয়েছে। তার ছুড়ে ফেলা মেয়েটিকে যদি সুস্থ করে তোলা যায়, তাহলে কালু সর্দার হারানোর হাহাকারে জর্জরিত হবে। মোহিনী আগে কালু সর্দারের ওপর যে প্রতিশোধগুলো নিয়েছে, তা ক্ষণস্থায়ী। দেবযানীকে দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী একটা প্রতিশোধ নেওয়া যাবে শৈলবালা আর কালু সর্দারের ওপর। আর বেশ্যাপল্লির দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞ চোখ দিয়ে মোহিনী বুঝেছে—দেবযানী যথার্থ সুন্দরী। তাকে সুস্থ সজীব করে তুলতে পারলে সে আগামী অনেক বছরের মূলধন হবে তার। যা খরচ হবে, তার বহু বহু গুণ ফেরত দেবে দেবযানীর দেহ।

মোহিনীই দেবযানীকে ডাক্তার মোহাম্মদ বিন কাশেমের কাছে নিয়ে গেল, অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালে। ডাক্তারের কাছে নিজের কন্যা বলে পরিচয় দিল, দিল না নিজের প্রকৃত পরিচয়। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ডাক্তারকে বলল, ‘নষ্ট স্বামী। কোথায় কোন অপথে কুপথে গেছে। বাহির থেকে আনা এই রোগটি মেয়ের শরীরে ছড়িয়ে দিয়েছে। বনেদি পরিবার। কোথাও বলতেও পারছি না। এদিকে মেয়ের জীবন-সংশয়, শ্বশুরপক্ষ নিষ্ক্রিয়। বাধ্য হয়ে আমাকেই নিয়ে আসতে হল ডাক্তারসাহেব। এখন আপনিই মা-বাপ। আপনি দয়া করলে আমার কলিজার টুকরাটি বেঁচে যাবে।’

মোহিনীর অভিনয়-কৌশল দেখে দেবযানী হতবাক। কী দারুণভাবে মিথ্যের মোড়কে আরও বড় মিথ্যেকে উপস্থাপন করল এই মোহিনী মাসি। ঝানু লোকও মোহিনীর অভিনয়ে কোনো খুঁত বের করতে পারবে না। ডাক্তার মোহাম্মদ বিন কাশেম তো কোন ছাড়।

ডাক্তার গম্ভীর মুখে দেবযানীকে পরীক্ষানিরীক্ষা করলেন, দু’চারটা টেস্ট দিলেন। সামান্য দুটো ওষুধ প্রেসক্রাইব করে বললেন, ‘টেস্টের রেজাল্ট নিয়ে কাল আসুন।’

‘আমার মেয়ে বাঁচবে তো ডাক্তারসাহেব?’ চোখেমুখে গভীর আকুলতা ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করল মোহিনী।

ডাক্তার হেসে বললেন, ‘হতাশ হবেন না। ফেলনা ডাক্তারের কাছে আসেননি।’

ডাক্তার কাশেমের ট্রিটমেন্টে আর মোহিনী মাসির নিখুঁত তদারকিতে এক মাসের মাথায় দেবযানীর শরীর ভাঙা থামল। স্তনবৃন্তে, আঙুল আর নাভির ফাঁকে, ঠোঁটে-জিভে যোনিদেশে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল তা লালচে হতে শুরু করল। ডাক্তার বললেন—ভালো হওয়ার লক্ষণ, ওষুধে কাজ দিচ্ছে।

মোহিনী মাসি দেবযানীর জন্যে সার্বক্ষণিক একজন আয়া রেখে দিয়েছে। দেবযানীকে স্নান করিয়ে দেওয়া, মাথায় তেল ঘষে দেওয়া, কাপড়চোপড় ধুয়ে দেওয়া, কক্ষ ঝাঁট থেকে শুরু করে চা-নাস্তা পরিবেশন করা পর্যন্ত সবকিছু এই আয়াই করে।

প্রেমদাশ ওষুধপত্র এনে দেয়, পথ্যাদি এনে দেয়। মোহিনী মাসি সকালে বা বিকালে অথবা সন্ধেয় অবসর মতো সময়ে দেবযানীর কক্ষে আসে। নানা আলাপ করে। সান্ত্বনা দেয়। বেঁচে থাকা যে কত মধুময়, সেটা বলে। মাঝেমধ্যে এটাও বলে যে, এই মোহিনী তোমার আর জনমের মা ছিল। ছিল কিনা বল মেয়ে?

দেবযানী এখন কিছুটা সুস্থ বোধ করছে। এই ক’দিন আগেও পৃথিবীকে তার আঁধার আঁধার মনে হতো। অতীত জীবনের কথা সে মনে করতে চায় না। সর্দারবাড়িতে বেশ্যাজীবনও এক সময়ে গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল। শেষরাতের দিকে বালিশে মুখ লুকিয়ে আকুল হয়ে কাঁদলেও সকালে দেবযানীর চেহারা স্বাভাবিক থেকেছে। কত ভোগীর বীর্য তার যোনিপ্রদেশ ধারণ করেছে—তার কোনো ইয়ত্তা নেই। বেশ্যাপাড়ায় সকাল, রাত আর সন্ধের রুটিনে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। কোন পোড়াকপালে তার শরীরে এই রোগটি ঢুকিয়ে দিয়ে গেল কে জানে? এক রাতে তো তাকে অনেকের সঙ্গে শুতে হতো। সেই লবণ কোম্পানির প্রথম রাত উদযাপনের পর থেকে তো আর বিরাম নেই। হারামজাদারা ঝাঁকে ঝাঁকে আসত। ওই বাড়িতে অনেক মেয়ে থাকা সত্ত্বেও শুধু তাকেই পছন্দ করত। কোনো কোনো রাতে সে বমি করে দিত; ক্লান্তিতে, অবসন্নতায় আর ঘৃণায় তার সমস্ত শরীর রি রি করত। কীটগুলোর সঙ্গে মিলিত হতে তার ইচ্ছে করত না। একজন নারী এক রাতে কত জনের কাছে দেহ দিতে পারে? একটি নারী-শরীরের কতটুকুই বা সক্ষমতা? আট-দশজনের সঙ্গে শোবার পর ভালোমতো পদক্ষেপ দিত পারত না দেবযানী। কিন্তু কালু সর্দারের এক কথা—যতজন কাস্টমার আসবে ততো জনের সঙ্গে শুতেই হবে দেবযানীকে। আমার টাকা চাই।

এইভাবে রাতের দ্বিপ্রহরে নিজের শরীরটাকে ছেঁচড়িয়ে ছেঁচড়িয়ে বিছানায় তুলত দেবযানী। অত্যধিক বহুগামিতা সহ্য করছিল না শরীরটি। তেমন ভালো খেতেও পাচ্ছিল না দেবযানী। সব টাকা কেড়ে নিত সর্দার বা শৈলমাসি। ওই সময় থেকে শরীর একটু একটু জানান দিতে শুরু করেছিল। শরীরে পূর্ণ ভাঙন লাগল সিফিলিস হবার পর।

ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল শৈলমাসি। তাকে ভালো করে তোলার জন্যে আকুল হয়ে অনুরোধও করেছিল। কিন্তু একদিন জীবন ডাক্তার জবাব দিল। ওই দিন থেকেই সর্দারবাড়িতে তার কদর কমে গেল। ঠিকমতো ভাত পাঠাল না, নাস্তা দিল না তারা। তুচ্ছতাচ্ছিল্য চরমে উঠল। যে বান্ধবী চম্পা, সেও কিনা চোখ ফিরিয়ে নিল! সেদিন সকালে পায়ে পা জড়িয়ে ঝগড়াটা বাঁধাল চম্পা। মা-বোন তুলে শুধু শুধু গালাগাল শুরু করল। তারপর তো কোমর বরাবর সর্দারের লাথি। চড়থাপ্পড় দিতে দিতে রাস্তায় কাগুজে ঠোঙার মতো ছুড়ে ফেলে দিল। ভাগ্যিস প্রেমদাশ দেখেছিল! ভাগ্যিস মোহিনী মাসির দয়া হয়েছিল! নইলে কোথায় কোন আঁস্তাকুড়ে তার ঠিকানা হতো কে জানে!

‘কই বললে না তো মেয়ে, মা ছিলাম কিনা আমি আর জনমে?’ মোহিনী অন্যমনস্ক দেবযানীকে আবার জিজ্ঞেস করে।

দেবযানী করুণ চোখ তুলে বলে, ‘ তুমি আমার মাসি না, তুমি আমার মা। আর জনম বুঝি না, এই জনমে তুমি আমার মা।’

নিজের চোখকে একটু ভিজা ভিজা মনে হল মোহিনীর। পোড়া চোখ দিয়ে আবার জল গড়াচ্ছে নাকি? তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে চোখের কোনা মুছে নিল। এগিয়ে এসে দেবযানীর মাথায় হাত রাখল। মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোল না মোহিনীর।

দেবযানীকে সুস্থ করে তুলবার কাজটি চলতে লাগল অতি সংগোপনে। তিনজন মানুষ শুধু জানে—মোহিনী, প্রেমদাশ আর আয়াটি। মোহিনী কঠিন কণ্ঠে বলেছে, ‘খবরদার, দেবযানীর বিষয়টি যাতে এই চার দেয়ালের বাইরে না যায়। গেলে তোমরা দু’জন দায়ী থাকবে।’

প্রেমদাশ আর আয়াটি মাথা নেড়েছে সীমাহিনীর নিবিড় তত্ত্বাবধানে দেবযানী সুস্থ হতে শুরু করেছে।

সময়ান্তরে কালু সর্দারের বাড়ির দুর্নামটিও ধীরে ধীরে কেটে গেল। এক দুই করে করে আবার আগের মতো কাস্টমাররা সর্দারবাড়ির পতিতাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করল। শারীরিক অস্বস্তি আর মানসিক অসুস্থতা নিয়ে পতিতারা স্বাভাবিক ও বিকারগ্রস্ত সম্ভোগীদের নিত্যনতুন মর্জির খেসারত দিতে লাগল। কারও সারা গায়ে সিগারেটের ছ্যাঁকা পড়তে লাগল, কেউ কেউ শরীরে পিন ফুটানোর যন্ত্রণা পেতে থাকল।

রম্ভা, মেনকা, উর্বশীর মাধ্যমে স্বর্গে বেশ্যাবৃত্তি শুরু হয়েছিল। রামায়ণ মহাভারতীয় যুগেরও আগে শুরু হওয়া বেশ্যাবৃত্তি পৌরাণিক যুগ পেরিয়ে, মুঘল-পাঠান-ব্রিটিশ যুগ অতিক্রম করে আজ আধুনিক যুগেও সগৌরবে চলছে। স্বর্গ থেকে বেশ্যাদের পতন হয়েছে আজ এই জটিল মর্ত্যে। রম্ভা, উর্বশী, বসন্তসেনা, কামমঞ্জরী, মদনমালা, আম্রপালীরা আজ পৃথিবীর নানা বেশ্যাপল্লিতে ইলোরা, সালমা, মমতাজ, মোহিনী, দেবযানী, বনানী, মার্গারেট, জুলিয়েট নামে তাদের দেহগুলো তুলে দিচ্ছে মানুষ নামধারী কামান্ধ পশুদের হাতে। জাকার্তার কালিজোড়া, সিঙ্গাপুরের গেলাঙ, টোকিওর কাবিকুচো, সিডনির কিংসক্রস, আমস্টার্ডামের ওয়ালেন, বেজিং-এর দাসিলান, কায়রোর ওয়াঘ-এল-বির্কতের মতো চট্টগ্রামের এই সাহেবপাড়ায় সুধারানিরা অশেষ বেদনা বুকে চেপে রেখে হাসিমুখে সুধা বিলিয়ে যাচ্ছে।

বারো

কৈলাস জন্মানোর পর মোহিনীর বেলেল্লাপনা অনেকটা কমে এল।

তার মধ্যে যে বেপরোয়া ভাব ছিল, যে উদ্দামতা ছিল—ধীরে ধীরে তা স্তিমিত হয়ে এল। কাস্টমার বিদেয় করে ছেলে কোলে নিয়ে বসে থাকতে লাগল মোহিনী। অনেক বাঁধা কাস্টমার মুখ ভার করে অন্য মেয়ের কাছে যাওয়া শুরু করল। মোহিনীর সেদিকে খেয়াল নেই। শুধু একদৃষ্টিতে ছেলে কৈলাসের দিকে তাকিয়ে থাকা, রাতে বুকের কাছে ছেলেকে টেনে নিয়ে শুয়ে থাকা। তার এই পাগলামি দেখে শ্যামাচরণ একদিন বলল, ‘তুমি কি পাগলা হইয়া গেলা? কাস্টমাররা যে ফিরে যাচ্ছে!’

‘যাক গে। আমার টাকার দরকার নাই। যা দরকার ছিল, তা আমার হাতে এসে গেছে।’ স্বামীর বেজার মুখ দেখে হাসতে হাসতে মোহিনী বলে, ‘ভয় পেও না, না খেয়ে মরবে না। বেঁচে থাকার জন্যে যত টাকা দরকার, তা আমার হাতে আছে। তুমি তোমার মতো করে চল।’

একদিন শ্যামাচরণ মারা গেল। মোহিনীর তেমন কোনো ভাবান্তর হল না। ছেলেকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরল। মোহিনীর কিছু বাঁধাবাবু আছে। তাদের প্রচুর টাকা আছে। মোহিনীর জীবনে কোনো অভাব থাকল না। এরপর তার জীবনে এল খায়রুল আহসান চৌধুরী। মোহিনীর জীবনে প্রাচুর্যের সঙ্গে নিরাপত্তা এল। ছেলেকে কর্ণফুলীর ওপারে পাহাড়ি এলাকা জলধির মরিয়ম একাডেমিতে পড়তে পাঠিয়ে দিল মোহিনী। খ্রিস্টান পরিচালিত স্কুল। ওখান থেকে এসএসসি পাস করল কৈলাস। কৈলাস ফিরে এল সাহেবপাড়ায়। মোহিনীর দোতলার নির্জন ঘরে দিন কাটে কৈলাসের। ঘরে বইয়ের স্তূপ। চোখে ভারি চশমা নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত বইগুলো পড়ে যায় কৈলাস। মোহিনী দূর থেকে দেখে আর গর্বে বুক ফুলায়।

এইভাবে বছর চারেক কাটে। একদিন ধুম করে ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দেয় মোহিনী। ঠোঁটকাটা জাহাঙ্গীরই মেয়েটাকে নিয়ে এসেছিল বেচবার জন্যে। মোহিনী কিনে নিয়েছিল। মেয়েটিকে খুব ভালো লেগে গিয়েছিল মোহিনীর। ওই নির্মলার সঙ্গেই কৈলাসের বিয়ে দিয়েছিল মোহিনী। যথাসময়ে ঘরে নাতনি এলে মোহিনী নিজেকে পৃথিবীর সবচাইতে সুখী মানুষ ভাবতে শুরু করল।

সাহেবপাড়ার নষ্টামি কৈলাসকে স্পর্শ করে না, মেয়েদের কামুক কটাক্ষ তাকে কাহিল করে না। পতিতাদের খোলা শরীর আর চটুল কথায় কৈলাস বিচলিত হয় না। দুপুরের দিকে এই পাড়ায় যত জারজ সন্তান আছে, তাদের প্রায় সবাইকে নিয়ে মন্দির চত্বরে বসে কৈলাস। তাদের সঙ্গে গল্প করে, রবীন্দ্র-নজরুলের কথা বলে; মার্টিন লুথার কিং-এর কাহিনী শোনায় তাদের। রামায়ণ-মহাভারতের বীরযোদ্ধাদের গল্প শোনায়, শোনায় কারবালার বিষাদময় করুণ মৃত্যুর কাহিনী। এই অবোধ সন্তানরা কৈলাসের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে। কৈলাসের কাঁধে সর্বদা একটা কাপুড়ে ব্যাগ থাকে। সেই ব্যাগে থাকে রামসুন্দর বসাকের আদি বাল্যশিক্ষা। কোনো কোনো দিন সেই ব্যাগ থেকে বই বের করে বালক বালিকাদের হাতে দিয়ে বলে, ‘পড়—। অ, আ, ই, ঈ…।’

কৈলাসের এই কাণ্ড দেখে পুরোহিত মুচকি হাসেন। মাস্তানরা বলে, ‘শালার ব্যাটার আর কাম নাই।’

কালু সর্দার বলে, ‘মায়ে রান বেইচ্যা বেইচ্যা টাকা কামায়, পোলা বইস্যা বইস্যা খায়। আর আকামের কাম বিদ্যা বিলায়। কসবিগোর পোলামাইয়ারে শিক্ষিত কইরা ছাড়বো দেখি।’

এক দুপুরে ওই মন্দিরচত্বরেই কালু আর তার সাঙাতরা কৈলাসকে পেয়ে গেল। কৈলাস তখন পড়াচ্ছে, ‘দুর্জনের সহবাস ত্যাগ কর, মানীর অপমান বজ্রপাত তুল্য, কুলোকের সংস্রবে থাকিও না।’

সুবল এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘কৈলাসবাবু, নমস্কার। কী পড়াইতেছিলেন যেন? দুর্জনের সহবাস পরিত্যাজ্য? আপনার সাগরেদদের মা-জননীরা দুর্জনের লগে সহবাস না করলে ওরা অইল কেমনে? এই পাড়ায় তো সুজনরা আসে না। দুর্জন মাইনে খবিসরাই তো এইখানে আসে। হেগো লগে লীলা করনর পরেই তো এরা অইছে। এই মাইয়ারা বড় অইলে অগো মায়ের মতো ওরাও দুর্জনের লগে সহবাস করবো। আরও পোলা মাইয়া অইবো। তখন অবশ্য আপনার ইস্কুল ভইরা যাইবো। মাস্টারি ভালই চলবো তখন।

কৈলাস এদের চেনে না; সুবলকে চেনে না, রহমান, জামাল, কিসলু কাউকেই চেনে না। চেনে শুধু কালু সর্দারকে। এই রকম নোংরা ব্যাখ্যা শুনে অসহায়ভাবে সর্দারের দিকে তাকাতে লাগল কৈলাস। দেখল— পুরোহিতের এনে দেওয়া চেয়ারে পা তুলে বসে ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছে সর্দার। হাসি থামলে উচ্চস্বরে বলল, ‘সুবইল্যারে চইল্যা আয়। মাস্টারবাবুরে কেলাস কইত্তে দে। মোহিনী মাসির ঘরে পেলাদ আইছে।’

তারপর কৈলাসের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘পড়াইয়া যাও কেলাস মাস্টর। পড়াইয়া বিএ, এমএ পাস করাও। অই হালারপুতরা শুন, আজ থেইক্যা পাঁচ- দশ বছর পর দেখবি এই বেশ্যাপাড়ার সকল বেশ্যা বিএ, এমএ পাস। অশিক্ষিত কাস্টমাররা ভয়ে তখন এই পাড়ায় ঢুকবো না। শুধু জজ, ব্যারিস্টার, পরফেচার, ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ার আইবো মাগিগো লগে ফুইতো। সর্দারের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সাঙাতরা উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠল।

কৈলাস পড়ুয়াদের ছুটি দিয়ে দিল। মাথা নিচু করে চত্বর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কালু সর্দার আবার বলল, ‘কৈলাসবাবু, একটু এইদিকে আস।’ কৈলাস কাছে এগিয়ে এলে চাপাস্বরে বলল, ‘দেখ, তুমি এই পাড়ার শিক্ষিত যুবক। মানী লোক। তোমারে এই হারামখোর সুবইল্যা অপমান করছে, অ‍ই সুবইল্যা, শিক্ষিত যুবকের লগে সহবাসের কথা কইছস না তুই? বিয়াদবি করছে সে। হেরে মাফ কইরা দেও।’

সাঙাতরা তফাতে দাঁড়িয়ে দমফাটা হাসিকে ঠোঁট দিয়ে চেপে রেখেছে।

কৈলাস মাথা নিচু করে গেইটের দিকে রওনা দিল। পেছন থেকে জামাইল্যার কণ্ঠস্বর কৈলাসের কানে এল, ‘ওস্তাদ, কু-লোকের সঙ্গে না থাকবার জন্য কী মধুর উপদেশটাই না দিচ্ছিল ছোট ছোট কোমল মনের বাচ্চাদের, হে ব্যাপারে কিছু কইলা না?’

‘কী আর কমু? কেলাস মাস্টর থাকে কু-পাড়ায়। হের বাড়িভর্তি কু- মাইয়ারা। কু-মানুষরা তার বাড়িতে যাওন আসন করে। তারপরও যদি আমাগো মাস্টরসাব কু-লোকেরে এড়াইয়া চলনর উপদেশ দেয়, আমার বলার কী আছে? তোমরাই কও। সর্দার বলল।

রহমান বলে উঠল, ‘তোমার কইতে যদি শরম করে তইলে আমিই কইয়া দি?’

‘কও।’ কালু সর্দার ডান হাতের কড়ে আঙুলটি ডান কানে ঢুকিয়ে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল।

‘তখন কেলাসবাবুর মতো মানী মাস্টরর মাথায় অপমানের বজ্রাঘাত নাইম্যা আইব।’ পান চিবানো গলায় রহমান বলল।

তাদের অপমান কৈলাস গায়ে মাখল না। সে এই পাড়ার গুণ্ডা মাস্তানদের প্রকৃতি জানে। তারা মানুষকে অহেতুক অপমান করতে ভালোবাসে। শিক্ষাকে তারা শত্রু ভাবে। শিক্ষিত মানুষ প্রতিবাদী হয়। অশিক্ষিতদের সহজে শোষণ করা যায়। অশিক্ষিতরা নির্বিরোধী। পতিতার সন্তানরা শিক্ষিত হয়ে উঠলে তারা সচেতন হবে, অধিকার সম্পর্কে সোচ্চার হবে। তখন মাসি-সর্দার-দালাল-মান্তানদের শোষণযন্ত্র বিকল হয়ে পড়বে। এই কারণে কালু সর্দার আর তার সাঙাতরা তাকে অপমান করছে। এই অপমান গায়ে মাখলে চলবে না। তাকে এগিয়ে যেতে হবে। গায়ে সঞ্চরমান বিষাক্ত পিঁপড়াকে টোকা মেরে ফেলে দেওয়ার মতো করে এই অপমানকে মাথা থেকে ওই মন্দিরচত্বরেই ঝেড়ে ফেলে গেইট দিয়ে বেরিয়ে গেল কৈলাস।

.

‘কোথায় কোথায় ঘোর তুমি? সকালে বেরিয়ে গিয়ে এই এত বেলায় এলে? এতক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি?’ নির্মলা জিজ্ঞেস করল।

কৈলাস শান্ত চোখ তুলে নির্মলার দিকে তাকাল। স্মিত হেসে বলল, ‘এই পাড়াতেই ছিলাম, মন্দিরে ছিলাম। কেন ছিলাম তা তোমাকে এই মুহূতে বুঝিয়ে বলতে পারব না।’ তারপর অনেকটা স্বগতকণ্ঠে বলল, ‘এই পাড়ার ছোট ছোট বাচ্চারা অসহায়। এই পাড়ার মেয়েরা বড় কষ্টে জীবন কাটায়। তাদের বর্তমান বলে যা-ও আছে, ভবিষ্যৎ বলে কিছুই নেই।’

নির্মলা বলল, ‘কী বলছ তুমি? কিছুই বুঝছি না।’

‘তুমি বুঝবে না নির্মলা। তুমি ঘরে আছ। বাইরের নোংরামি তোমাকে ছুঁতে পারে না। যারা বাইরে আছে, তারা যে কী কষ্টে আছে, তা তুমি আন্দাজ করতে পারবে না। তাদের জন্য কিছু করতে চাই আমি।’

নির্মলা বলে, ‘স্নান করে আস। এক সঙ্গে খাবে বলে মা বসে আছে।’

‘তাই নাকি? আগে বলবে তো।’ গামছা কাঁধে স্নানঘরে ঢোকে কৈলাস।

.

মাস তিনেকের মাথায় ডাক্তার মোহাম্মদ বিন কাশেম বললেন, ‘আর আসতে হবে না। প্রেসক্রিপশনে দুটো টেবলেটের নাম লিখে দিলাম। আগামী পনের দিন খেলে চলবে। তারপর আপনার মেয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ। কী, খুশি না আপনি?

মোহিনী গদগদ কণ্ঠে বলল, ‘আপনি আমাকে বাঁচালেন ডাক্তারসাহেব। সমাজের অপমান থেকে আমার মেয়েকে রক্ষা করলেন। শ্বশুরের পরিবার তো তাদের ছেলের অপরাধ মানত না। দুর্নাম ছড়াও আমার মেয়ের নামে। মা যাও, ডাক্তারসাহেবের পা ছুঁয়ে সালাম কর।।

‘ঠিক আছে ঠিক আছে’ বলে ডাক্তার পা সরিয়ে নিলেন। মিষ্টি হেসে দেবযানীকে বললেন, ‘যাও, স্বামীর সঙ্গে নতুনভাবে জীবন শুরু কর। তবে সাবধানে থাকবে ভবিষ্যতে। স্বামীকে সতর্ক করবে।’

এরই মধ্যে দেবযানী মোহিনীকে দেখে দেখে অনেক কৌশল শিখে নিয়েছে। মুখটা করুণ করে বলল, ‘ঠিক আছে চাচা। দোয়া করবেন।’

মোহিনী ও দেবযানী মনে গভীর একটা ফুর্তির ভাব নিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল। দেবযানীর আনন্দ—নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেল বলে। মোহিনীর ফুর্তি আগামী কদিনের মধ্যে দেবযানীকে দিয়ে ভালো একটা ইনকামের সূচনা হবে বলে।

.

দেবযানী এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। সজীব। তার বাহু, গণ্ড, গলা, আঙুল, পা, কোমর—সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কামদ হয়ে উঠেছে। স্তন পুষ্ট, ভারে ঈষৎ নমিত। এতে বুকের সৌন্দর্য আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এখন তার চোখের নিচে কালি নেই, মুখে ম্লান হাসি নেই। দীর্ঘ চুলে যত্নের চিহ্ন। দেবযানী এখন যথার্থ কাম উদ্রেককারী রমণীতে পরিণত হয়ে গেছে। সে এখন সক্ষম।

এক বিকেলে দেবযানীর কক্ষে চা খেতে খেতে মোহিনী বলল, ‘আমি আমার কথা রেখেছি মেয়ে। এখন তুমি কী তোমার কথা রাখবে?’

দেবযানী মোহিনীর কথার ইঙ্গিত বুঝল। মায়ের চেহারা দেবযানীর মন থেকে মুছে গেছে। সে জায়গায় মোহিনীর চেহারা জ্বলজ্বল করে। মোহিনী না হলে কোন্ ভাগাড়ে তার স্থান হতো! এই জীবন থেকে মুক্তির কোনো পথ নেই। কালু সর্দারের হাত থেকে মোহিনী মাসির হাতে, ভবিষ্যতে হয়তো মোহিনী মাসির হাত থেকে আরেক কোনো মাসি বা মাস্তানের হাতে বন্দি হয়ে থাকতে হবে তাকে। ঘূর্ণয়মান এই বন্দি খাঁচাতেই একদিন মৃত্যু হবে তার। মোহিনী মাসি অনেক টাকা খরচ করে, অনেক যত্ন দিয়ে তাকে ভালো করে তুলেছে। সে বেইমানি করবে কীভাবে?

মোহিনীর কথায় দেবযানী বলল, ‘তুমি যা ভালো বোঝ, তা-ই কর মাসি। আমি রাজি।’

মোহিনী প্রেমদাশকে রীতাকুমারীর পরিত্যক্ত দোতলার ঘর দুটোকে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলার দায়িত্ব দিল। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দেয়ালে নীলাভ রঙ করাল। ফার্নিচারে বার্নিশ করাল।

এক সন্ধ্যায় সেলিমকে ডেকে পাঠাল মোহিনী।

সেলিম বলল, ‘সালাম দিদি। কেমন আছেন? রীতাকুমারী চলে যাবার পর আমার কথা একেবারে ভুলে গেছেন।

‘ভুললে কি তোমাকে ডাকালাম? শোন, তুমি আমার বাড়ির পুরনো দালাল। এই বাড়ির সঙ্গে দীর্ঘদিন তোমার জানাশোনা। তোমাকে পছন্দ করি আমি। দায়িত্বটা অন্য কাউকে দিতে পারতাম আমি।’ মোহিনী বলল।

সেলিম ঝানু দালাল। যৌবনটাই কাটিয়ে দিল সে এই পাড়ায়। মাগি- মাসিদের রহস্যময় ভাষা বুঝতে তার অসুবিধা হয় না। মোহিনীর কথার মর্মার্থ সে আঁচ করল। বলল, ‘নতুন মাইয়া আসছে বুঝি দিদি আপনার বাড়িতে? মালদার আদমি লাগবে—এই তো!’

মোহিনী বলল, ‘সেলিম, এই জন্যে আমি তোমাকে পছন্দ করি। বুদ্ধিমান তুমি। আকলমন্দকে লিয়ে ইশারা কাফি হ্যায়। তুমি ঠিকই বুঝেছ। একজন মালদার আদমি লাগবে। তবে শিক্ষিত ও ভদ্র হতে হবে তাকে। প্ৰথম ভোগ করার অধিকার পাবে সে।’

‘মাইয়া কে, সোন্দর বুঝি?’ সেলিম জিজ্ঞাসা করল।

‘পারস্যের গোলাপ, জাহাঙ্গীরের নূরজাহান, স্বর্গের উর্বশী। আনকোরা। সন্ধান কর। প্রথমবার তো! প্রচুর টাকা দিতে হবে কিন্তু।’ মোহিনী হাসতে হাসতে বলল।

কোনো এক রবিবার রাতে সেই মালদার আদমিকে নিয়ে এল সেলিম দালাল। সেই রাত থেকে দেবযানী তার পতিতাজীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করল।

সেই থেকে সেলিম দেবযানীর দালাল হয়ে গেল।

এক পড়ন্ত বিকেলে মোহিনী দেবযানীর ঘরে ঢুকল, পেছনে লম্বা ঘোমটা টানা এক নারী।

দেবযানী সবেমাত্র তার আজানুলম্বিত চুলে চিরুনি বসিয়েছে। মোহিনীকে দেখে দেবযানী বলল, ‘এই অসময়ে? কোনো দরকার ছিল মাসি? ঘোমটা দেওয়া এ কে?

‘বস বস। এত উতলা হচ্ছ কেন? নিশ্চয় কোনো কারণ আছে, নইলে এই অসময়ে কেন এলাম?’ মোহিনীর মুখে মৃদু হাসি।

লম্বা সোফাটিতে গা ছেড়ে বসল মোহিনী। ঘোমটাপরা নারীটিকে উদ্দেশ্য করে সোফা দেখিয়ে বলল, ‘তুমিও বস।

মোহিনী থেকে দূরত্ব বজায় রেখে নারীটি বসল। দূরের ছোট বিছানাটিতে বসল দেবযানী। কে এই নারী? তার মাথায় এত লম্বা ঘোমটা কেন? এখানে তো কোনো পুরুষ নেই। তা হলে? নারীটির দুটো হাত ও দুটো পা দেখা যাচ্ছে। হাত-পায়ের রং গৌরবর্ণ। ওই বর্ণের কাছে মোহিনীর গায়ের রঙকে অনেক নিষ্প্রভ মনে হচ্ছে। নিঃসার হাত। রগগুলো নীলচে হাতের চামড়া কুঁচকানো। হাতের আঙুলগুলো এক সময় ভীষণ সুন্দর ছিল, বোঝা যাচ্ছে। এখন সে আঙুলে মরচে আভা। একদৃষ্টিতে আগন্তুকের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে দেবযানী।

মোহিনী বলল, ‘তুমি কী ভাবছ আমি বুঝতে পারছি। এ পদ্মা। পদ্মাবতী নামে এক সময় এই পাড়ায় পরিচিত ছিল।’

প্রায় চিৎকার করে উঠল দেবযানী, ‘পদ্মাবতী! সেই বিখ্যাত রূপসী পদ্মা? এই পাড়ায় আসার পর থেকে যার রূপের কথা আমি শুনে আসছি?’

‘হ্যাঁ, এ সেই পদ্মা। এক সময়ের রাজরানি আজ ঘুঁটে কুড়োনি। ও দুর্ভাগ্যের শিকার, বেজন্মা সওদাগরের ক্রোধের শিকার। যাকগে সে কথা। একদিন ওর কাছ থেকে শুনে নিও সব।’

মোহিনী একটু থেমে কণ্ঠকে আরও মোলায়েম করে আবার বলল, ‘ও বড় অসহায়। এক সময় গোটা চিটাগাং শহর ওকে একনজর দেখার জন্যে এক পায়ে খাড়া থাকত। আজ ফিরোজা মাসির ঘরে বড় কষ্টে দিন কাটছে ওর।’

‘বড় কষ্টে দিন কাটছে!’ দেবযানীর কণ্ঠে অপার বিস্ময়।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোহিনী বলল, ‘হ্যাঁ, বড় কষ্টে। না খেয়ে না খেয়েই ফিরোজা মাসির ঘরে দিন কাটছে পদ্মাবতীর। যাক গে, যে কথা বলতে এসেছিলাম তোমার কাছে—আজ থেকে পদ্মা তোমার এখানেই থাকবে। তোমার দেখাশোনা করবে। তোমাকে করণকৌশল শেখাবে।

‘করণকৌশল শেখাবে মানে?’ অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে দেবযানী।

মোহিনী বলে, ‘রূপে গুণে ছলায় কলায় ঠাঁটে ঠমকে এই সাহেবপাড়ার এক নম্বর বেশ্যা ছিল এই পদ্মাবতী। আমরা তার নখের যোগ্যিও ছিলাম না। বেশ্যাদের ষোলকলায় পারদর্শী হতে হয়। এই পাড়ায় শুধু পদ্মারই জানা ছিল ওসব। আমি চাই তুমি পদ্মার মতো সর্বগুণান্বিত হয়ে উঠ। ও তোমাকে ওই ছলাকলাগুলো শেখাবে। বিনিময়ে তার ভরণপোষণ করবে তুমি। কী পারবে না?’

‘তা পারব! কিন্তু এত বড় নাম করা একজন মহিলা আমার আশ্রিত হয়ে থাকবে?’

‘এই কারণেই পদ্মাদি এইখানে থাকবে।’ বলেই এক ঝটকায় মোহিনী গদ্মাবতীর ঘোমটাটা সরিয়ে ফেলল।

দেবযানী ‘ইস’ বলে আর্তচিৎকার করে উঠল। দু’হাত দিয়ে মুখ ঢাকল দেবযানী। পদ্মার সমস্ত মুখমণ্ডল জুড়ে পোড়া মাংসের পিণ্ড। ঝলসানো চামড়া। কালো কালো ছোপের মাঝখানে মাঝখানে শ্বেত চিহ্ন। নারকীয় চেহারার মাঝখানে দুটো নিখুঁত চোখ—গভীর, শান্ত, মায়াময়।

পদ্মাবতী ঘোমটাটা আবার টেনে দিল।

মোহিনী বলে চলেছে, তুমি ভয় পেও না দেবযানী। ও কখনো তোমার বা অন্য কারও সামনে ঘোমটা খুলবে না। দুর্ঘটনার পর কথাও কম বলে পদ্মা। তোমার কোনো অসুবিধা হবে না। শিবঠাকুরের দয়ায় তোমার এখন অনেক রইস কাস্টমার। একজন অসহায় অথচ সম্মানিত নারীকে আশ্রয় দিতে নিশ্চয় তোমার আপত্তি নেই।’

অতি দূর থেকে যেন দেবযানীর কণ্ঠ ভেসে এল, ‘নিশ্চয়ই আপত্তি নেই। পদ্মাদি এখানেই থাকবে। আমার কাছেই থাকবে।’

সেই থেকে পদ্মাবতী দেবযানীর সঙ্গে থাকা শুরু করল।

ধীরে ধীরে দেবযানীর যৌবনরসের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। দেবযানীর জন্যে মোহিনী মাসির দরজায় খদ্দেরদের ভিড় বাড়ল। দেবযানী দু’একজনকে ঘরে তুলল। অধিকাংশ নিচতলার মেয়েদের নিয়েই সন্তুষ্ট থাকল। খানদানি কাস্টমারদের আনাগোনায় মোহিনী মাসির দোতলা গমগম করতে লাগল।

দেবযানীর নব রূপে আবির্ভূত হবার কথা কালু সর্দারের কানে গেল। সুবল বলল, ‘ওস্তাদ, শুনছি সেই চিমসে মাগি আর চিমসে নাই। গোলাপি আপেল এখন। ভিতরে আঙুরের রস। রেইট নাকি অনেক হাই। যারে তারে ঘরেও তোলে না নাকি? মাগিরে বিদায় কইরা কী ভুলটাই না করছ ওস্তাদ।

কালু সর্দার নিজের হাত এখন নিজে কামড়ায়। কত বড় আয় থেকে বঞ্চিত হলাম—ভাবে সর্দার। রাগে গরগর করতে করতে বলে, ‘জীবন ডাক্তারে কইছে—আর ভালা অইবো না, কঠিন সিফিলিস। বেটি ভালা কইরা না ভাইবা আমারে পরামর্শ দিল—বাইর কইরা দে খানকি মাগিরে। আমি ভোদাইও মহিলার কথা বিশ্বাস কইরা দেবযানীর পাছায় লাথি মারলাম। তিন মাসের মাথায় লাখিটা আমার পাছায় ফিরা আইল। হেই মোহিনী হারামজাদি, দেবযানীরে ভালা কইরা তোলে নাই? রাজশাহীর টসটইস্যা লিচু বানায় নাই? তুমি পারলা না ক্যান? তোমার কুবুদ্ধিতেই তো হেরে আমি ঘরের বাইর কইরা দিলাম।’

‘কার কুবুদ্ধির কথা কইতাছ ওস্তাদ।’ রহমান জিজ্ঞেস করে।

‘কে আবার! ওই বুড্ডি মাগি। আমার ভোদাই মায়ের কুপরামর্শের লাইগ্যাই তো এখন নিজের হাত নিজে কামড়াইতেছি।’ সর্দারের মাথায় আগুন লেগেছে যেন।

কয়েক বোতল এর মধ্যে খাওয়া হয়ে গেছে। সর্দারের ভয় দেখিয়ে পশ্চিম গলির পতিতাদের কাছ থেকে কয়েকশ টাকা চাঁদা তুলে এনেছে জামাল আর শফি। ওই টাকা দিয়েই মদের আসর বসিয়েছে ওরা। মন্দিরের পেছনের চালাঘরেই বসেছে তারা।

শফি বলল, ‘একখান্ কাম গইল্যে কেএন অয় ওস্তাদ?’

‘কী কাম?’ জিজ্ঞেস করে কালু সর্দার।

‘দেবযানী তো তোঁয়ার মাল। রাগ গরি ঘরত্তোন বাইর গরি দিও কী অইয়ে? মোহিনী মাসির কাছে যাই দেবযানীরে দাবি গর। আঁরা তোঁয়ার লগে আছি।’ শফি নাকিসুরে বলল।

শফি ঠিক বলছে ওস্তাদ। আমরা তোমার লগে আছি।’ মাতালরা সমস্বরে বলে উঠল।

অন্যরা মাতাল হলেও কালুর মাথা স্থির। সে মদ খায়, কিন্তু মদ তাকে খেতে পারে না। অটল কণ্ঠে বলে, ‘তোরা ঠিকই কইছস। দেবযানী তো আমার সম্পত্তি। মোহিনী মাগির কী অধিকার আছে দেবযানীকে রাখার। চল যাই। হুজ্জত কইরা হলেও দেবযানীকে আমার পাওয়া চাই।’

সেই রাতে দলবল নিয়ে কালু সর্দার মোহিনীর দরজায় উপস্থিত হলো। হইচই শুনে মোহিনী নিচে নেমে এল।

‘কী চাই?’ কঠিন কণ্ঠে কালুকে জিজ্ঞেস করে মোহিনী।

‘দেবযানী আমার মাল। হেরে ফিরাইয়া দাও।’ কালু ভূমিকা না করে বলে।

মোহিনী অনুচ্চ কণ্ঠে বলে, ‘মদ খাইয়া বেহেড অইছ সর্দার সাহাব। কোন দেবযানীরে দাবি করতাছ, যে দেবযানীরে লাথি মাইরা রাস্তায় ফেইল্যা দিছিলা।’ তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘ডাস্টবিন থেকে তাকে আমি নিয়ে এসেছি। দেবযানীকে ফিরে পাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভেব না।’

কালু সর্দার আর মাথা ঠিক রাখতে পারল না। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোরা হাতে কালু চিৎকার করে উঠল, ‘কী কইলি মাগি, দেবযানীরে ফিরাইয়া দিবি না? রক্তগঙ্গা বহাইতে চাইতাছ?’

চুপ শৈল দত্তর জারজ সন্তান। তুই কারে মাগি কস। দুই পাটি দাঁত এখনই তুইল্যা লমু তোর। এই প্রেমদাইশ্যা ওপরে গিয়া চৌধুরীরে ফোন কর। শিবমন্দিরের ঘটনা শৈল খানকির পোলার মনে নাই। ওদের তাড়াতাড়ি পাড়াইতে ক।’ ধমকে ওঠে মোহিনী।

সাঙাতরা মোহিনীকে আক্রমণ করার জন্যে ছোরা বেল্ট হাতে সামনে এগিয়ে আসতে চাইলে কালু হাত তুলে থামিয়ে দেয়। মোহিনীকে উদ্দেশ্য

করে বলে, ‘ভুল করলা মোহিনী। দেবযানীর জইন্য তোমারে অনেক বড় খেসারত দিতে অইবো।’

মোহিনী বলে, ‘ওই চোদমারানির পোলা, বাল লম্বা কইরা রাখছি, কাইট্যা দিয়া যাইস। অখন ওরা আসার আগে ঘরে গিয়া হান্ধা। নইলে রক্তগঙ্গা না কী কইছিলি হেইডা বইবো।’

কালু সর্দার সাঙাতদের বলল, ‘চলরে তোরা চল।’ কয়েক কদম এগিয়ে পিছন ফিরে কালু উচ্চস্বরে বলল, ‘মোহিনী তৈয়ার থাইকো। বিপদ আইতাছে তোমার।’

‘যা যা মাগির পুত। যা কত্তে পারছ কর গিয়া।’ ধমকে উঠল প্রেমদাশ।

.

সর্দার ও মোহিনীর বিবাদ দেখে আশপাশের পানবিড়ির দোকানে ঝপাঝপ ঝাঁপ পড়ল। রাস্তায় দাঁড়ানো পতিতারা খদ্দের ধরা থামিয়ে দিয়ে যার যার ঘরে ঢুকে গেল। রক্তারক্তির ভয়ে কাস্টমাররাও যে যেদিকে পারল কেটে পড়ল।

তেরো

‘সেলিম, একজন মানুষকে যেখানে পাও আমার কাছে নিয়ে আসতে হবে।’

আজকাল শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলে দেবযানী। মোহিনী মাসি বলে দিয়েছে নামি বেশ্যাদের শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলতে হয়। আঞ্চলিক উচ্চারণ নারীদের সৌন্দর্য কমায়।

সেলিম হাতলহীন চেয়ারে দেবযানীর ঘরে বসে আছে। দেবযানীর কথা শুনে জিজ্ঞেস করে, ‘কোন মানুষ? কারে লই আসতে বল তুমি?’

‘শামছু, শামছু তার নাম।’ দেবযানীর কণ্ঠে মৃদু উত্তেজনা।

‘কোন শামছু?’

‘শামছুকে চিন না? মাগির দালাল হয়ে মাগির দালালকে চিন না? মাগির দালাল ছিল সেই হারামজাদা এই বেশ্যাপাড়ার।’ ডান হাতে একটা ছোরা নাড়াচাড়া করতে করতে বলে দেবযানী। এই ছোরা প্রেমদাশকে দিয়ে কিনিয়ে এনেছে দেবযানী। গোড়ায় টিপ দিলে কড়কড় করে বেরিয়ে আসে তিন ইঞ্চির ছোরাটি।

সেলিম একটু অবাক হল। এ পর্যন্ত কোনোদিন দেবযানীকে মুখ খারাপ করতে দেখেনি সেলিম। আজ কী হল তার? শামছুকেই বা এনে দিতে বলছে কেন? সেলিম বলে, ‘দীর্ঘদিন এই পাড়ায় আমি দালালি করতেছি। শামছু দালালরে না চিনার কোনো কারণ নাই। তই, সে তো এখন আর দালালি করে না। মাঝেমইধ্যে আসে পাড়ায়।

দেবযানী উষ্ণকণ্ঠে বলল, ‘অতশত বুঝি না। শামছুকে আমার চাই-ই চাই। যেখান থেকে পার এনে দেবে।’

‘ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করব।’ বিদায় নেবার আগে সেলিম বলল।

.

কালীমন্দিরের চত্বরের মাঝখানে বিশাল একটি বটগাছ। গাছের চারদিকে গোলাকার করে শান বাঁধানো। শিবপুজো বা দুর্গোপুজোর সময় সেখানে দর্শনার্থীরা শুয়ে বসে সময় কাটায়। অন্য সময় ফাঁকা থাকে। বিকেলে কিছু বুড়োবুড়ি ওই গাছতলায় এসে বসলেও সকালের দিকে জনশূন্য থাকে ওই চত্বর। আজ সকাল দশটার দিকে এখানে অনেক পতিতার সমাবেশ হয়েছে। বাচ্চারাই তাদের মাকে এখানে টেনে এনেছে। কৈলাস মাস্টার তাদের মাদের নিয়ে আসবাব জন্যে বলেছে।

গতকাল সকালের দিকে পশ্চিমগলির পাতাকুয়ার ধারে গিয়েছিল কৈলাস। মেয়েরা তখন গা-গতর ধোয়ায় ব্যস্ত। পতিতারা এমনিতে নিজেদের শরীরকে খোলামেলা রাখতে অভ্যস্ত। পুরুষবর্জিত এই কুয়াপারে স্নানের সময় তারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আজও তাই হয়েছে। মেয়েদের শরীরে কাপড়চোপড়ের তেমন বালাই নেই। ওই সময় কৈলাসকে থলে কাঁধে কুয়াপারে উপস্থিত হতে দেখে বনানী বলে ওঠে, ‘কি কেলাস মাস্টার, কী চাই? মাইয়াদের দিকে পিটির পিটির কইরা কী তাকাইতেছেন?’

অসহায় ভঙ্গিতে কৈলাস বলল, ‘কিছু না, কিছু না। আপনাদের সঙ্গে একটা কথা বলতে এলাম।’

‘শুধু কথা, দেখতে নয়?’ মুখ আলগা বনানী বলে।

‘আমাগো লগে কথা কইতে চাইলে তো পয়সা লাগবো।’

‘শুধু কথা কইবেন? আর কিছু কইরবেন না?’

‘হুনছি ঘরের বউ সুন্দরী। হেরে ছাইড়া এই সময় আমাগো লগে শুধু কথা কইতে আইছেন?’

পতিতারা এই রকম নানা মন্তব্য করে যেতে লাগল আর হি হি খিলখিল করে হাসতে লাগল।

কৈলাস ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এরকম মন্তব্যের সম্মুখীন সে আগে কখনো হয়নি। কী বলতে এসেছিল তা ভুলে গিয়ে সে আমতা আমতা করতে লাগল। তার অসহায় অবস্থা দেখে বনানী ধমকে উঠল, ‘চুপ থাক তোরা। এত কথা কইতাছস ক্যান? আমগো পাড়ার শিক্ষিত্ লোক। তয় কী বলতে আইছেন কৈলাসবাবু?’

‘না, বলছিলাম কী আগামীকাল সকালে মন্দিরের উঠানে আপনারা যদি একবার আসতেন, তাহলে ভালো হতো।’ ধীরে ধীরে বলে কৈলাস।

‘কেন আসব?’

‘আসলে জানতে পারবেন। আসবেন তো?’

‘কেলাসবাবু, আবার কোনো ফাঁদ পাততেছেন নাতো? এমনিতে মাসি- মাস্তানদের ফাঁদে পইড়া জান যায়।’ ইলোরা বলে ওঠে।

‘না না, আপনাদের ক্ষতি হবে এমন কিছু নয়। আমি যাই তাহলে, আসবেন কিন্তু কাল সকালে, মন্দির চত্বরে। নমস্কার।’ বলে পিছন ফিরে হাঁটা দিল কৈলাস।

মমতাজ বলে উঠল, ‘আরে আরে বলে কী— নমস্কার! হারা জীবন চোদানি, চোদমারানি, খানকি-মাগি ছাড়া কিছুই শুনলাম না, এখন মোহিনী মাসির পোলা তোগোরে কয়— নমস্কার।’

সবার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। ওরা ঠিক করল— আগামীকাল মন্দিরে যাবে। কৈলাসবাবু কী বলতে চায় শুনতে হবে।

.

কৈলাস বটগাছের গোড়ায় শানবাঁধানো জায়গাটিতে পা ঝুলিয়ে বসেছে। পতিতাদের কেউ কেউ ঘাসেঢাকা মাটিতে বসেছে, কেউ এধার ওধার ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের জারজ সন্তানরা কৈলাসের সামনে সারিবদ্ধভাবে বসে পড়েছে। দূরে দাঁড়িয়ে উৎসুক নয়নে পুরোহিতমশাই কী হচ্ছে—এর সুলুকসন্ধান করবার চেষ্টা করছেন।

হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল কৈলাস। বলতে শুরু করল, ‘শুনেন আপনারা, এই সাহেবপাড়া চোর-গুণ্ডার আড্ডাখানা। মারপিঠ-ছিনতাই এখানে হরহামেশা লেগে আছে। মদভাঙের কথা বাদই দিলাম। এই পাড়ার প্রধান পণ্য আপনারা। রোগশোক সব আপনাদের জন্যে। সর্দার-মাস্তান- মাসিরা আপনাদের শোষণ করে। আপনাদের দেহবেচা টাকা ওরা কেড়ে নেয়। বিল্ডিং তোলে, জোশ করে। আর মাংস-মাছ-বিরানি-হালুয়া খায়।। আপনারা থাকেন অন্ধকার রঙচটা খুপরিতে।’

সুইটি বেবির গায়ে ঠেলা দিয়ে বলে, ‘কয় কী বেড়া? মাসির পোলা অইয়া মাসিদের খেতায় আগুন দিতাছে বলে মনে অয়।’

ইলোরা বলে, ‘চোষণ ঘোষণ কী যেন কইতাছে? আরে চুষি তো আমরা। চুষতে বাইধ্য হই। সর্দার-মাস্তানরা কোন দুঃখে চুইষতে যাইবো?’

চাপাস্বরে খিলখিল করে হেসে উঠল সবাই।

কৈলাসের কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। সে বলে চলেছে, ‘ রামায়ণ– মহাভারতের কালেও বেশ্যা ছিল। তবে তারা সমাজের মানুষের কাছে সম্মান পেত। রাজারা মর্যাদা দিত তাদের। এই সেদিনও মন্দিরে মন্দিরে সেবাদাসী নামে আপনারা ছিলেন। দেবতার সঙ্গে সঙ্গে সেবাদাসীদেরও মূল্য দিত মানুষ কিন্তু আজ আপনাদের কোনো দাম নেই। শুধু ভোগের সামগ্রী আপনারা।’

তারপর একটু থেমে আপন মনে আবার বলতে শুরু করল কৈলাস, ‘কী বলব আপনাদের, শুনেছি আমাদের এত বড় কবি রবীন্দ্রনাথ, তাঁর পূর্বপুরুষরাও বেশ্যালয়ে ঘর বেঁধে দিয়েছিলেন। একচল্লিশটি ঘর থেকে মাসে মাসে ভাড়া নিতেন তাঁরা। কী দুর্ভাগ্য আমাদের, আপনাদের! শুনুন দিদিরা মাসিরা, পৃথিবীতে এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি এই দেহব্যবসার বিরুদ্ধে প্রবলভাবে সোচ্চার হয়েছিলেন। চীনের মাও সে তুঙ পতিতালয়ের মাসি ও দালালদের গুলি করে মারতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

বনানী চট করে দাঁড়িয়ে পড়ল। চিৎকার করে বলল, ‘কেলাসবাবু ধুত্তুরি কৈলাসবাবু, এইসব হিস্টোরিকেল কথা আমাগো শুনাইয়া লাভ কী?’

‘লাভ নাই, আবার লাভ আছে।’ ধীরে ধীরে আবার বলতে শুরু করল কৈলাস। ‘লাভ নাই এইজন্য যে, আমি একা কিছুই করতে পারব না। এই বক্তৃতার কোনো দাম নাই, যদি আপনারা আমার কথা বিবেচনায় না আনেন। আবার লাভ আছে, যদি আমার এই কথাগুলো আপনাদেরকে নিজেদের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে, অধিকার সম্বন্ধে, শোষণ সম্বন্ধে একটু সচেতন করে।’

সমবেত পতিতাদের মধ্য থেকে কে যেন বলল, ‘কইয়া যান, কইয়া যান কৈলাসবাবু, আমরা হুনতাছি।’

‘পুরুষ নামক বুদ্ধিমান জীবের জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্যে পতিতালয়ের সৃষ্টি হয়েছে। আপনারা হয়েছেন যৌনব্যভিচারের আদিম পুতুল। ফ্রান্স, আমেরিকা, ইরান, রাশিয়া, ব্রিটিশ সরকার পতিতাবৃত্তির বিরদ্ধে যতই পদক্ষেপ নিক না কেন, নারী পাচার আর পতিতাপেশা বন্ধ করতে পারেনি। আমরাও কিছুই করতে পারব না।’

‘কিছুই করতে পারব না?’ ভিড়ের মধ্য থেকে কে যেন বলে উঠল।

জিজ্ঞাসাটি যেন কানে যায়নি কৈলাসের। ‘আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, আমাদের মেয়েদের যথেচ্ছা ভোগ করে সমাজের শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা, কিন্তু তাদের পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ নেয় না। উদ্যোগ নেবে কী করে? তখন যে ভোগের দ্রব্যের শর্ট পড়বে। আপনাদের এই সন্তানদের পড়ালেখার কোনো ব্যবস্থা নেই। থাকার কোনো ভালো ঘর নেই। মোড়ে মোড়ে ডাস্টবিনের দুর্গন্ধ। পানীয়জলের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। পাতকুয়াটি না হলে পশ্চিমগলির মেয়েরা শুকিয়ে মরতেন। ডাক্তার নেই, পথ্য নেই, কিছু নেই, কিছুই নেই।’

এবার মমতাজ দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমাগো রেস্ট লইতে অইবো। বিকালে ব্যবসা আছে। আপনার আর কিছু কি বলার আছে?’

কৈলাস বলল, ‘আছে। আপনারা আপনাদের ইনকামের বিশভাগ মাসি- সর্দারকে দিয়ে আশি ভাগ রেখে দেবেন? সপ্তাহে একদিন ব্যবসা বন্ধ রাখবেন। শরীরের রেস্টের প্রয়োজন। আর আপনাদের মাসিদের বলবেন পনর দিনে অন্তত একবার আপনাদের ডাক্তার দেখাতে হবে?’

সমবেত মহিলাদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। একদল বলল, ‘সব অবাস্তব আজগুবি কথা। এইগুলো হুনাইবার জন্য আমাগোরে ডাইক্যা আনছে কৈলাসবাবু?’

বনানী উচ্চকণ্ঠে বলে উঠল, ‘আজগুবি নয়। কৈলাসবাবু ঠিকই কইছে। মাসি-মাস্তানরা আমাগো শোষণ করে। আমরা বিশ্রামের সুযোগ পাই না। দিন রাত বেড়া ঢুকাই ঘরে, আর টাকা গনে ওই সর্দার আর মাসিরা। এইটা হতে দেওন যায় না। এই সপ্তাহ থেকে আমরা শুক্রবার ব্যবসা বন্ধ রাখুম। হেই দিন বিশ্রাম নিমু, সিনেমা দেখমু।’

আওয়াজ উঠল, ‘ঠিকই কইছ বনানীদি। আমরা হগলে তা-ই করুম।’

.

সবাই চলে গেলে বুকে একটা চাপা শিহরণ নিয়ে মন্দিরের চাতালে বসে থাকল কৈলাস। চোখ বন্ধ তার। মেয়েরা যে তার কথা এত সহজে মেনে নেবে, স্বপ্নেও ভাবেনি সে। বড় আনন্দ হচ্ছে আজ তার।

‘কী কেলাসবাবু, নেতা অইয়া গেছেন বলে?’

কৈলাস চোখ খুলে তাকাল। কখন সর্দার ও সর্দারের সাঙাতরা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি কৈলাস। তাকিয়ে দেখল—সুবলই কথাগুলো বলছে, ‘মাইয়াগোরে সীতা, সাবিত্রী বানাইতে চাইতাছেন? ব্যবসা বলে লাটে তুলবার চাইতাছেন এই পাড়ার?’

কৈলাস তাকিয়ে দেখল, কালু সর্দারের চোখ বাঘের মতো জ্বলজ্বল করছে। সর্দারের দিকে চোখ রেখে কৈলাস বলল, ‘আমি আবার কী করলাম? শুধু মেয়েদের একটু সচেতন হবার কথা বলেছি।’

‘আপনি বললেন, সর্দার আর মাস্তানরা, মাসি আর দালালরা মাইয়াগোরে শোষণ করে। হেগো বিশ্রাম চাই। সপ্তাহে একদিন ব্যবসা বন্ধ রাখতে অইব—এইসব আগডুম বাগডুম কথা কইয়া মাথা বিগড়াইয়া দিছেন তাদের।’ রহমান বলে।

কৈলাস নিৰ্ভীক কণ্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ বলেছি।’

বোমা ফাটার আওয়াজে ধমকে উঠল কালু সর্দার, ‘তুই বেডা মাসির পোলা অইয়া মাসিদের পোন্দে দাড়া দিতে চাইতাছস। আশি ভাগ টাকা মাগিরা রাইখ্যা দিব, না? আরে বেটা, আশি পার্সেন রাইখ্যা দিলে তোর মা চলবো ক্যামনে? সপ্তাহে একদিন ব্যবসা বন্ধ রাখলে খাবি কীরে মাগির পুত ‘

শান্তকণ্ঠে কৈলাস বলল, ‘গালি দিচ্ছেন কেন? গালি দিবেন না।’

‘গালি না দিয়া তোরে কী কোলে তুইল্যা চুম্মা খামু জাইল্যনির পোলা? হুন, তেরিমেরি করবি না। এই পাড়ার সর্দার আমি, কী কইতাছি হুন। এই রকম আবুল-তাবুল কথা বলা বন্ধ রাখবি। এই মন্দিরে তোরে য্যান আর না দেখি। বাড়িতে বইয়া বইয়া মায়ের রান্ধের কামাই খাবি আর লালটু বউয়ের বুনি চুষবি, বুঝছস?’

‘খবরদার শুয়োরের বাচ্চা। মুখ সামলে কথা কইবি হারামজাদা। গর্জে উঠে কৈলাস। ‘তুই ভাবছস আমি ম্যাদামারা গোবর গণেশ! ইটের বদলে পাটকেলটি মারব আমি। আমার কাজে বাধা দিয়া দেখিস, বারোটা বাজাইয়া দিমু আমি তোর!’

কৈলাসের কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ কৈলাসের দিকে তাকিয়ে থাকল কালু সর্দার। কোমরে গোঁজা ছোরাটার ওপর ডান হাত বুলাতে বুলাতে হিমশীতল কণ্ঠে বলল, ‘আর একটা কথাও না বলে এইখান থেইক্যা বাইর অইয়া যা চোদমারানির পোলা। দিনের বেলা বইল্যা বাইচা গেলি। নইলে…।

‘নইলে, নইলে কী করবি তুই মাগির সর্দার। ভালো কাজ একটাও করছস তুই এই পাড়ায়? মাইয়াদের দেহবেচা টাকা দিয়া মদ গিলছস আর মাস্তানি করছস।’ কৈলাস যেন হুঁশজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।

পেছন থেকে জামাল বলল, ‘ওস্তাদ, এই হারামির বহুত বাড় বাইড়া গেছে। হেরে থামাই দেওন দরকার। আমগো হাতে ছাইড়া দেও। ভুঁড়ি বাইর কইরা দি।’

পেছন ফিরে সর্দার গর্জে উঠল, ‘চুপ, একদম চুপ। আমার কাজ আমারে করতে দে জামাইল্যা।’

তারপর কৈলাসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সাবধানে থাইকো কৈলাস। তোমার মায়ের অপমান আমার বুকে জ্বলতাছে। তোমার গালি হেই বুক ছেদা কইরা দিছে।’

কৈলাস মাথা উঁচু করে মন্দির চত্বর থেকে বের হয়ে এল।

.

‘আসতে চায়নি, মিথ্যা কথা বলি নিয়া আসছি। নাও এই তোমার শামছু।’ সেলিম দেবযানীর উদ্দেশ্যে বলে।

‘মিথ্যা বলেই তো আনবে। শামছু তো শুধু মাগির দালাল না, মিথ্যাবাদী শয়তানও। কী বলেন শামছু চা-চা। দেবযানী বলে।

শামছু কিছুই বুঝতে পারছে না। এই মেয়েটি কে? তাকে তো আগে কোনোদিন দেখেনি সে। সেলিম বলেছে—মোহিনীবালা তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। বেচাকেনার কী যেন একটা কথা আছে। কিন্তু মোহিনীবালা কই? এই সুন্দরী মেয়েটি কেন তাকে মিথ্যেবাদী বলছে? দেবযানীর ড্রইংরুমে দাঁড়িয়ে শামছু নিজেকে এইসব প্রশ্ন করে যাচ্ছে।

‘বসেন বসেন শামছু মিঞা।’ ঘরের নড়বড়ে চেয়ারটা দেখিয়ে দিয়ে দেবযানী শ্লেষ্মামিশ্রিত কণ্ঠে বলল, ‘কেমন আছেন আপনি?’

জবাব দেবে কী শামছু মিঞা, বোকা বনে তাকিয়ে থাকল দেবযানীর দিকে। স্মৃতির পাতাগুলো হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছে শামছু, কিন্তু সেখানে দেবযানীর মতো কোনো রূপসীকে খুঁজে পাচ্ছে না। এক দুই পাঁচ সাত বছর পিছিয়ে গিয়েও দেবযানীকে পেল না সে। পাবে কী করে? যে কৃষ্ণাকে সোনালি হোটেল থেকে মিথ্যেয় ভুলিয়ে এই সাহেবপাড়ায় বিক্রি করে দিয়েছিল, সে কৃষ্ণার সঙ্গে তো এই দেবযানীর মিল নেই। তার খোল নলচে একেবারে পাল্টে গেছে যে। গ্রাম্য সরলতায় মেশানো যে কৃষ্ণা, স্নিগ্ধ কোমলতায় মোড়ানো যে কৃষ্ণা, সেতো এ নয়। প্রদীপের জায়গায় যেন হাজার পাওয়ারের বৈদ্যুতিক বাতি। যে প্রদীপে অভ্যস্ত, সে তো উজ্জ্বল আলোর বাতি দেখে হতভম্ব হবেই।

সত্যি শামছু আজ হতভম্ব। দেবযানীর প্রশ্নের কী জবাব দেবে তা বুঝতে পারছে না শামছু। তাই আমতা আমতা করে বলে, ‘ভাল আছি। কিন্তুক আপনারে তো চিনতে পারতেছি না আমি।’

‘অ——, চিনবার পারতাছেন না? তই, চিনবেন কেমনে? ভুলাইয়া ভালাইয়া কত মাইয়ারে আপনি এই পথে নামাইছেন, খবিসপাড়ায় আইন্যা বিক্রি করছেন, কয় জনেরে মনে রাখবেন আপনি?’ বিকৃত কণ্ঠে চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করল দেবযানী।

‘না মাইনে, আমি আপনারে ঠিক…।’

শামছু কথা শেষ করবার আগে দেবযানী ঘৃণামাখা কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘ঠিক চিনবার পারতাছেন না। তাই না? তুমি একটা আস্ত হারামজাদা, কুত্তার বাইচ্চা তুমি? মাগির দালাল তুই, আর তোর মা মাগি। এই খানকি পাড়ার বেশ্যা তোর মা, তোর চৌদ্দ গোষ্ঠীর সব মেয়েরা।’ বলতে বলতে সেই ছোট্ট বিছানায় ভেঙে পড়ল দেবযানী। প্রচণ্ড আবেগে কেঁদে উঠল সে। প্রথমে ফুঁপিয়ে পড়ে চিৎকার করে।

সেলিম দেবযানীর কাণ্ড দেখে হতবাক। কী বলবে, কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না সে।

আর পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শামছু। তার চোখ স্থির, নিজের নিশ্বাসের শব্দ সে শুনতে পাচ্ছে।

আপনমনে দীর্ঘক্ষণ কেঁদে একটা সময়ে থামল দেবযানী। তারপর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করল, ‘চাচা, তোমার কি মনে আছে সোনালি হোটেল হতে, আজ থেকে অনেক বছর আগে, এক সন্ধ্যায় একটা অসহায় মেয়েকে নিয়ে এসে কালু সর্দারের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলে? মনে আছে নরসিংদীর কৃষ্ণা তোমার নাম ধরে আকুল হয়ে কেঁদে কেঁদে তোমার সাহায্য চেয়েছিল? সেই কান্না তোমার কানে ঢোকেনি। দালালির সামান্য টাকা তোমার কাছে অনেক বড় ছিল। সেই কৃষ্ণা আমি, আজকের দেবযানী। মানুষে বলে—এই বেশ্যাপাড়ার সেরা বেশ্যা। আজ আমি অনেক ক্ষমতাবান। ইচ্ছে করলে তোমার মুণ্ডটা তোমার শরীর থেকে আলাদা করে ফেলার ব্যবস্থা করতে পারি আমি। কী, করব?’

শামছুর মুখ দিয়ে কোনো রা বের হয় না। বিস্ফারিত চোখে দেবযানীর দিকে শুধু তাকিয়ে থাকে শামছু। তার চুল দাড়ি সাদা। চুলের পরিমাণ কম, মাথায় চুলের চেয়ে তালুই দেখা যাচ্ছে বেশি। পিঠটা বয়সের ভারে বেঁকে গেছে। গায়ে হাফ হাতা ছেঁড়া সাদা ফতুয়া।

শামছুর মুখ দিয়ে হড়বড়িয়ে বেরিয়ে এল, ‘কৃষ্ণা! কৃষ্ণা তুমি?’

‘হ্যাঁ, আমিই সেই কৃষ্ণা। তপনের সঙ্গে পালিয়ে আসা যে কৃষ্ণাকে তুমি বেশ্যা হতে বাধ্য করেছিলে। তোমাকে বলেছিলাম—আমার বাড়ি নরসিংদী। শুধু সেদিন তোমাকে বলিনি—-আমি একজন সাধারণ জেলের মেয়ে। বলিনি শৈলেশ নামের একজন পাগল বাপকে অসহায় অবস্থায় ফেলে, বোনকে পথে বসিয়ে দিয়ে নিজের দেহের ক্ষুধা মিটাবার জন্য পালিয়ে এসেছিলাম। আমি…।’

শামছু হুড়মুড় করে মেঝেতে ভেঙে পড়ে গেল। দু’হাত দিয়ে কপাল থাপড়াতে থাপড়াতে বলতে লাগল, ‘হায় খোদা! হায় খোদা! কী কথা শুনাইলা তুমি? তুমি শৈলেশের মাইয়া? খোদারে, শৈলেশের মাইয়া তো আমার মাইয়া। নিজের মাইয়ারে আমি বেশ্যাপাড়ায় বেচি দিছিরে আল্লাহ। আল্লাহ তুমি আমার গুনাহ কোনোদিন মাফ কইরো না।’ শামছু কপাল থাপড়াচ্ছে আর এই কথাগুলো বারবার করে বলে যাচ্ছে।

এবার দেবযানীর অবাক হবার পালা। টাট্টিখানার এই কীটটি তার বাবার নাম ধরে বিলাপ করছে কেন? শামছু তার বাপকে চিনে নাকি? না ভয়ে অভিনয় করছে?

এই সময়ে অনেকটা হামাগুড়ি দিয়ে শামছু দেবযানীর পায়ের কাছে পৌঁছে যায়। ঝট করে দেবযানীর দু’পা জড়িয়ে ধরে শামছু, ‘মারে, তোর কাছে মাফ চাওনর অধিকার আমার নাই। তুই আমারে মাফ কইরা দে–এইটা আমি চাই না। শুধু আমার কথাগুলো শুন।’

ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ে দেবযানী। মেঝেতে অসহায় ভঙ্গিতে বসে শামছু বলে যেতে লাগল সেদিন সন্ধেয় শৈলেশের সঙ্গে কর্ণফুলীর পারে তার পরিচয়ের কথা, শৈলেশকে নিজঘরে আশ্রয় দানের কথা, কৃষ্ণার মা যশোদার অত্যাচারের কথা, মেয়েদের প্রতি শৈলেশের গভীর টানের কথা, বুঝিয়ে সুঝিয়ে শৈলেশকে নরসিংদীর বীরপুরে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা। কথা শেষ করে হাহাকার করে ওঠে শামছু। বলে, ‘মা, তুমি আমারে যে শাস্তি দিবা সেই শাস্তি আমি মাথা পাইত্যা লমু। বল মা, কী শাস্তি দিবা তুমি আমারে? আমারে তুমি শাস্তি দাও, শাস্তি দাও, শাস্তি দাও।’ বলতে বলতে খাটের খুঁটিতে মাথা আছড়াতে লাগল শামছু।

সেলিম এসে তাকে ধরে ফেলল। মেঝে থেকে তুলে চেয়ারে বসাল।

দীর্ঘ সময় স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে দেবযানী। কাকে কী শাস্তি দেবে সে? এই শামছু একদিন তার অসহায় বাবাকে আশ্রয় দিয়েছিল। ঘরবিমুখ বাবাকে বুঝিয়ে তাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেই সন্ধ্যায় দেবযানী যদি বলত, সে বীরপুরের শৈলেশের মেয়ে, তাহলে হয়তো তার জীবনে এই দুর্ভোগ নেমে আসত না। সেদিন শামছু নির্ঘাত তাকে তার বাপের কাছে পৌঁছে দিত।

তাছাড়া, দালালদের এই তো জীবন। তারা নরকের কীট, গুয়ের পোকা। তাদের কানে কোনো অসহায় নারীর হাহাকার পৌঁছে না। নারীর দৈহিক পবিত্রতার কোনো মূল্য নেই তাদের কাছে। তাদের কাছে নারী মানে বেচাকেনার পণ্য। শামছুও এর ব্যতিক্রম নয়। কোন এক কৃষ্ণার আহাজারি সেদিন শামছু দালালের কানে পৌঁছবে কেন? পৌঁছালেও সেই আহাজারি তার মনে দাগ কাটবে কেন? দালালদের চিরাচরিত নিয়মেই সেদিন শামছু কৃষ্ণাকে টাকার লোভে কালু সর্দারের কাছে বেচে দিয়েছিল। এখন দেবযানী ইচ্ছে করলে জুতিয়ে এই শামছুর হাড়মজ্জা এক করে ফেলতে পারে, ইচ্ছে করলে মাস্তান দিয়ে পিটিয়ে আধমরা করে রাস্তায় ছুড়ে ফেলতে পারে, খুনও করাতে পারে এই শামছুকে। কিন্তু তাতে লাভ কী হবে? কৃষ্ণার যা হারানোর তা-তো হারিয়েই ফেলেছে। কোনো কিছুরই বিনিময়ে সেই হারানো জিনিস আর ফিরে পাবে না দেবযানী।

নিজের মাথাকে জোরে জোরে ডানে বাঁয়ে ঝাঁকাতে থাকে দেবযানী তারপর উঠে দাঁড়ায়। শামছুকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘চাচা, তোমাকে একটা শাস্তি পেতে হবে।’

‘কী মা? আমি মাথা পাইত্যা লমু।’

দীর্ঘদিন আমি আমার বাপ-বোনের খবর জানি না। আমার যাওয়ার কোনো উপায় নেই। তুমি নরসিংদী যাবে। আমার বাপ-বোনের খবর আনবে। কী পারবে না?’ দেবযানী জিজ্ঞেস করে।

ওপরে নিচে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে শামছু বলে, ‘পারমু মা, পারমু। হাজারবার পারমু।’

‘একটু দাঁড়াও।’ বলে দেবযানী ভেতরকক্ষে ঢুকল। একতাড়া নোট নিয়ে বেরিয়ে এল। শামছুর হাতে দিয়ে বলল, ‘আমার বাপের হাতে দিও। বল— টাকাটা তুমি দিচ্ছ। এই কলঙ্কিনীর টাকা আমার বাপ কখনো ছুঁয়েও দেখবে না। বল চাচা, পারবে তুমি? এই কাজটা তুমি করতে পারবে?’

‘ই পারুম। নিগ্‌্যাত পারুম। কাইকাই আমি রওনা দিমু। আল্লাহ, তুমি কী দয়ালু, গুনাহ মাফের একটা সুযোগ তুমি আমারে দিলা!’ শামছু কাঁদতে কাঁদতে বলল।

‘ও হ্যাঁ চাচা, আরেক হারামির খবর তুমি আনবা? তপইন্যা কুত্তার বাইচ্চার খবর না পাওয়া পর্যন্ত আমার চোখে ঘুম আইবো না।’ দেবযানীর কণ্ঠ দিয়ে তীব্র ঘৃণা ঝরে ঝরে পড়ছে।

চোখ মুছে শামছু উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, ‘আনুম মা, আনুম।’

চৌদ্দ

পদ্মাবতী দেবযানীর কাছে এসেছে অনেকদিন হয়ে গেল।

ঘোমটার আড়ালেই নিজেকে গুটিয়ে রাখল সে। নিতান্ত দায়ে না ঠেকলে কথাও বলে না তেমন। কারও সামনে আসে না, সে কাষ্টমার বা সেলিম যে-ই হোক না কেন। প্রেমদাশের সামনে আসতে হয় তাকে। প্রেমদাশ দেবযানীদের দৈনন্দিনের বাজার করে দেয়। ব্যবসা শুরু করার আগ পর্যন্ত দেবযানীর খাবার মোহিনী মাসির ঘরের ভেতর থেকে আসত। প্রেমদাশই নিয়ে আসত। অন্দরমহলে যাবার বা মোহিনী মাসির পুত্র-পুত্রবধূর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অধিকার দেবযানীর ছিল না।

ব্যবসা শুরুর দিন মোহিনী বলেছিল, ‘আজ থেকে তুমি নিজ ইনকামের টাকা দিয়ে নিজে রান্না করিয়ে খাবে। রাঁধার লোক পেয়ে যাবে। প্রেমদাশ তোমার নিত্য প্রয়োজনীয় বাজারসাজার করে দেবে।’

পদ্মাবতী আসার পর রান্নার দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে। ধোয়ামোছার কাজগুলো অবশ্য একটা ছুটা বুয়া এসে করে যায়।

দেবযানীর সঙ্গেও খুব বেশি ব্যক্তিগত কথা হয় না পদ্মাবতীর। যা হয় বেশ্যাদের ছলাকলা বিষয়ে। পদ্মাবতী বলে, ‘পতিতার রূপই প্রধান সম্পদ নয়। কুরূপা বেশ্যারা সুন্দরীদের চেয়েও অধিক উপার্জন করতে পারে। শুধু কৌশল জানতে হয়। লম্পটদের চাহিদা নানা রকম। কোনো কোনো খদ্দের গৃহস্থ স্বভাবের রমণী চায়ও, ঘরে ঢুকে পতিতার কাছে স্ত্রীর মতো আচরণ কামনা করে। কেউ চায় ঠোঁটে হাসি মাখা চটুল স্বভাবের মেয়ে। কোনো কাস্টমার পতিতার মধ্যে গ্রাম্য আদিম সরল ছন্দ খোঁজে, আবার অনেক কাস্টমার শহুরে চটকদারিতে মুগ্ধ। খদ্দর ঘরে এলেই দু’এক মিনিট কথা বলে বুঝে নেবে—সে কোন ধরনের মেয়ে চায়। তার চাহিদা মতো স্বভাব নিজের মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে হবে। ফুটিয়ে তুলবার জন্যে শেখা চাই অভিনয় কৌশল। সেই অভিনয় কৌশল তোমার জানা। এ ব্যাপারে মোহিনী মাসি তোমাকে অনেকটা শিক্ষিত করে তুলেছে।’

কোনো কোনো সময় দীর্ঘদিন কথা বলে না পদ্মা। দিন সপ্তাহও পেরিয়ে যায়। নিজের কাজে মগ্ন থাকে সে। কোনো গভীর চিন্তায় বিভোর থাকে কিনা—তা বোঝার কোনো উপায় নেই দেবযানীর। দেবযানীর সামনেও ঘোমটা খোলে না পদ্মা। আবার কোনো কোনো দিন মুখর হয়ে ওঠে পদ্মাবতী। এক মুখরদিনে দেবযানী হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, ‘পদ্মাদি, জানি তুমি অত্যন্ত রূপসী ছিলে। তোমার শরীর, তোমার গান, তোমার ছলাকলা, তোমার সুমধুর উচ্চারণ দিয়ে এই পাড়ায় ঝড় তুলেছিলে তুমি। তুমি নাকি যাকে তাকে শরীর দিতে না। তোমার কয়েকজন বাঁধাবাবু ছিল। তারা বেশ রুচিশীল ছিল বলেও শুনেছি। সওদাগর না কোন একজনকে তুমি ভালোও বেসে ফেলেছিলে বলে লোকে জানে।’

‘বন্ধ কর, বন্ধ কর দেবযানী, এসব কথা। সওদাগরের নাম আমার সামনে কোনোদিন উচ্চারণ কর না।’ প্রায় চিৎকার করে উঠল পদ্মাবতী।

দেবযানী চুপ মেরে গেল। অপরাধী ভঙ্গিতে ঘোমটার দিকে তাকিয়ে থাকল। খেয়াল করে দেখল—পদ্মাবতীর হাতের আঙুলগুলো থির থির করে কাঁপছে। এই কাঁপন ক্রোধের না বেদনার বুঝতে পারছে না দেবযানী কারণ, পদ্মাবতীর মুখ ঘোমটার অন্তরালে।

একসময় আঙুলের কাঁপন থামল। পদ্মাবতী বলতে শুরু করল, ‘পুরানাকালে কৌটিল্য বলে একজন জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। তিনি সমাজের নানা মানুষের কথা নাকি লিখে গেছেন তাঁর বইতে। তিনি পতিতাদের কথাও বলতে ভোলেননি। তিনি বলেছেন—পতিতা তিন প্রকার—–উত্তম, মধ্যম ও কনিষ্ঠ।’

দেবযানী ভেবে কূল পাচ্ছে না সওদাগর-প্রসঙ্গ এড়িয়ে পদ্মাবতী এসব কথা বলছে কেন? এসব কথা তাকে শুনিয়েই বা লাভ কী?

পদ্মাবতী বলে যাচ্ছে, ‘বাৎস্যায়নের নাম তো শুনেছ। প্রত্যেক শিক্ষিত বেশ্যার বাৎস্যায়নের নাম না শোনার কারণ নেই। ঋষি ছিলেন তিনি 1 আমাদের মতো পতিতাদের সম্পর্কে বই লিখে বিখ্যাত হয়েছেন। তো তিনিও গণিকাদের তিন ভাগে ভাগ করেছেন—একজন পরিগ্রহা, বহুজন পরিগ্রহা আর অপরিগ্রহা। তিনিও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওই কথাই বলেছেন—বেশ্যা তিন ধরনের—উত্তম, মধ্যম ও অধম।’

‘দিদি, এসব কথা তুমি আমাকে বলছ কেন? এসব আজকালকার বেশ্যাপাড়ায় অচল। এখানে চলে—ধর তক্তা মার পেরেক। খাও, শোও, ফুর্তি কর—এই-ই হল সাহেবপাড়ার রীতি।’ বলে দেবযানী।

‘এই রীতি সবার জন্যে নয়, অধিকাংশের জন্যে। প্রত্যেক বেশ্যাপাড়ায় দু’চারজন একটু অন্যরকম বেশ্যা থাকে। তারা শরীরের সৌন্দর্যের সঙ্গে ছলাকৌশলকে মেশায়, মুখে সর্বদা মিষ্টিকথা থাকে তাদের। চোখে থাকে প্রাণঘাতী কটাক্ষ। এই ধরনের বেশ্যারাই যুগে যুগে উত্তমের পর্যায়ে পড়েছে। আমি ছিলাম—এই উত্তম ধরনের বেশ্যা। কী, আমাকে অহংকারী মনে হচ্ছে?’

দেবযানী তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘ননা, না দিদি। শুনেছি তুমি হিংসে করার মতো রূপসী ছিলে। তোমার মতো আকর্ষণীয় নারী এই তল্লাটে ছিল না। খদ্দেররা নাকি তোমার বিল্ডিং-এর নিচে দিয়ে যেতে একবার তোমার ঘরের দিকে তাকাত।

দেবযানীর কথার কোনো জবাব না দিয়ে পদ্মা বলল, ‘তো, সেই রূপসী পদ্মাবতীর মুখে টগবগে গরম পানি ছুঁড়ে দিল সওদাগর।’

‘আবদুল জব্বার সওদাগর? সে না তোমাকে ভালো বাসতো। দেবযানী জিজ্ঞেস করে।

অনেক দূর থেকে যেন পদ্মাবতীর কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘বাসতো, একটু বেশি ভালো বাসত আমায় সওদাগর। সেই বেশি ভালোবাসার খেসারত দিতে হল আমাকে। তার সর্বগ্রাসী ভালোবাসার আগুনে ঝলসে দুমড়ে মুচড়ে যেতে হল আমাকে। সওদাগর আমাকে পাটরানি করেছিল। তার ভালোবাসার দাম চুকাতে গিয়ে আমাকে দাসীতে পরিণত হতে হল। রাঁধুনি দাসী, ঘুঁটে কুড়োনি দাসী।’

দেবযানী বুঝল—পদ্মাবতী আবেগায়িত হয়ে উঠেছে। এই সুযোগে আসল ঘটনাটি জানা যাবে। দুখী দুখী মুখ করে দেবযানী জিজ্ঞেস করে, ‘আসলে কী হয়েছিল সেদিন?’

‘সেদিন?’ বলে দীর্ঘসময় চুপ করে থাকল পদ্মা। ‘আসলে সেদিন তো তেমন কোনো ঘটনা ঘটেনি! শুধু সওদাগর গরমজলের মগটি আমার মুখের দিকে ছুড়ে দিয়েছিল। সেদিনের আগে তো অনেক ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনাগুলো সেদিনের ঘটনাটা ঘটাতে সাহায্য করেছিল।’

‘কেমন?’ দেবযানী জিজ্ঞেস করে।

পদ্মাবতীর মুখের অর্গল খুলে গেল। এতদিন এই ঘটনাগুলো কাউকে বোঝানোর সুযোগ পায়নি পদ্মা। শুধু বেদনার প্রচণ্ড একটা চাপকে বুকে নিয়ে রাত দিন সপ্তাহ মাস বছর কাটিয়েছে। আজ কেন জানি, তার মনে হল দেবযানীর কাছে ওইসব ঘটনা খুলে বললে তার বুকের ভার কিছুটা লাঘব হবে। পদ্মাবতী বলল, ‘সওদাগরকে কলাপ্‌সবল গেইট খুলে দিয়ে আমার কাছে মোক্ষদা আবার ফিরে এসেছিল। আমি আগের মতো মনে এবং দেহে গভীর বিভোরতা নিয়ে শুয়ে ছিলাম। ঘরে ঢোকার পর আমি মোক্ষদার দিকে ফিরে তাকালাম। দেখলাম—তার চোখেমুখে রুক্ষতা। মুখের কুঁচকানো পেশিগুলো অনেক শক্ত। আমার চোখে চোখ রেখে কোনো ভূমিকা না করে কঠিন কণ্ঠে সেদিন মোক্ষদা বলেছিল, ‘আন্নে ঠিক করেন নাই পদ্মাদি। সদাগরেরে আন্নে এই রকম অপমান না কইল্যেও পাইত্তেন। বেচারা কী করুণ মুখ করি যে চলি গেল, আন্নে না দেইখলে বিশ্বাস কইত্তেন নো! আন্নে ভুল কইচ্ছেন, ভুল কইচ্ছেন আন্নে।’

আমি তার রাগি রাগি চেহারা দেখে বললাম, ‘মোক্ষদা, সওদাগর তোমার হাতে ঘুষ দিয়ে গেছে বুঝি? দেখছি, আমার চেয়ে সওদাগরের প্রতি তোমার টান বেশি।’ তারপর হাসতে হাসতে বললাম, ‘চিন্তা কর না মোক্ষদা! সওদাগর সত্যি আমাকে ভালোবাসে। সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখ, সে কালকে আবার সেজেগুজে এই পদ্মাবতীর কাছে উপস্থিত হবে।’

কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, পরের দিন জব্বার সওদাগর পদ্মাবতীর ঘরে এল না। তারপরের দিন, পরের সপ্তাহেও না। কিন্তু ওই যে পদ্মাবতী বলেছে—সওদাগর তাকে সত্যি ভালোবাসে। এই কয়েকটা দিন সওদাগর অশেষ বেদনার মধ্যে কাটাল। ওই সন্ধেয় সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সওদাগর ঠিক করেছিল—আর না। এই পদ্মাবতীর কাছে আর না, এই বেশ্যাপাড়ায়ও আর না। উচিত শিক্ষা হয়েছে তার। পদ্মার চেয়ে ঘরের বউ ভালো, হামিদা ভালো। এখন থেকে হামিদাকে নিয়ে সিনেমায় যাবে, নদীর পারে ঘুরতে যাবে। জান গেলেও আর পদ্মামুখী হবে না সে।

এই ভাবেই সওদাগর বেশ ক’দিন কাটিয়ে দিল। একটা সময়ে মনটা কৈছালি শুরু করল সওদাগরের। সন্ধে হতে না হতে মনটা আনচান করতে লাগল। মন বলতে লাগল—গিয়ে দেখ না একবার, তোমাকে ছাড়া পদ্মারানির দিন কেমন কাটছে!

এই ক’দিনে পদ্মাবতী টের পেয়ে গেছে—সওদাগর সত্যি রাগ করেছে। এক দুই করে এতটা দিন কেটে গেল! কই, সওদাগর তো এল না! সে আনমনা হয়ে গেল। এই কদিনে বেশ ক’জন মালদার কাস্টমার এল। রুটিন মাফিক তাদের দেহ দিল পদ্মা। আশাতীত টাকা দিল তারা। কিন্তু পদ্মার মনটা খুশিতে ভরে উঠল না। বাঁধা খদ্দেররাও তাদের রুটিন মাফিক এল গেল। কেউ তাকে তেমন করে আগের মতো জাগাতে পারল না। যে পদ্মা বিছানায় এত চৌকস ও সক্রিয়, এত ছলাকলাময়ী, সেই পদ্মা বিছানায় আনমনে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকল। বাঁধা খদ্দেররা যাওয়ার সময় বলে গেল, ‘পদ্মা, আজকে তোমার মধ্যে আগের পদ্মাকে খুঁজে পেলাম না। তুমি আজকে বেশ আনমনা আর নিষ্ক্রিয় ছিলে।’

পদ্মা মুখে কিছু বলে না, স্নান একটু হাসে। সন্ধে হতে না হতে পদ্মা জানালা দিয়ে বারবার বাইরে তাকায়। মোক্ষদাকে বলে, ‘দেখতো মোক্ষদা, কে এল? সওদাগর না তো!’

এক সন্ধেয়, সন্ধে না বলে বলা যায় সন্ধেটা গড়িয়ে যখন রাতের দিকে গেছে, সওদাগর পদ্মার ড্রইংরুমে এসে উপস্থিত হল।

মোক্ষদা বলে উঠল, ‘সদাগর সাব। আন্নে কত্তুন? এতদিন কোথায় আছিলেন? আঙ্গো কথা ভুলি গেছিলেন আন্নি! পদ্মাদিকে আন্নি এইভাবে ভুলি গেলেন?’

সওদাগর ম্লান মুখে বলল, ‘ভুলি নাই। ভুললে কি আজকে আসতাম?’ তারপর উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, ‘কই, ডাক তোমার পদ্মাদিকে। আমি না হয় ভুলেছি, পদ্মাও তো আমাকে মনে রাখেনি! ডাক তাকে, জিজ্ঞেস করি সে কী করে এত নিষ্ঠুর হল!

মোক্ষদার মুখ অন্ধকারে ছেয়ে গেল। সওদাগরের উচ্ছ্বাসের কোনো জবাব দিল না। শুধু করুণ চোখে পদ্মার বদ্ধ খেলাঘরের দিকে তাকিয়ে থাকল। আজ পদ্মার ঘরে বাঁধাবাবু রহমত উল্লাহ। মোক্ষদার ভাষায়— জাউরগা রহমইত্যা। রহমত উল্লাহ নিজের স্বার্থের ব্যাপারে বড় সচেতন। পদ্মার পেছনে সে পয়সা ঢালে প্রচুর। কিন্তু পাওয়ার বেলাও এক বিন্দু সুধা পাত্রের বাইরে পড়তে দিতে নারাজ। যেরাতে সে আসে, গোটা রাতের জন্যে আসে। সেরাতে পদ্মা নামের সুধারানির সকল সুধা সে নিংড়ে নেয়। ভোরের দিকেই চলে যায় সে। পরদিন সকালে পদ্মাকে দেখায় বিধ্বস্ত আর বিপর্যস্ত, বিপন্নও। তার শরীরের সকল আড় চষে বেড়ায় রহমত উল্লাহ গোটা রাত। তার নাম রহমত হলেও ভোগের সময় পদ্মাকে কোনোরূপ রহমত করে না। আজ এই কিছুক্ষণ আগে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে দরজায় খিল দিয়েছে দু’জনে। বাইরে বোমা ফাটলেও দরজা খুলবে না আর, সেই ভোরসকাল ছাড়া।

‘কই মোক্ষদা, ডাক তোমার পদ্মাদিকে। এত তাড়াতাড়ি দরজায় খিল দিয়ে ঘুমাচ্ছে নাকি পদ্মারানি? সেদিন তো অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল, আজও তাই করবে নাকি?’ কৌতুক মিশ্রিত কণ্ঠে বলল সওদাগর

মোক্ষদা কোনো জবাব দিল না। তার চোখে বোবা চাহনি। হায়রে কপাল, কী দুর্ভাগা সময়ে তুমি এলে সওদাগর! কী বেদনা নিয়ে পদ্মাদি এই কটা দিন কাটিয়েছে সে আমি জানি। শুধু ছটফট করেছে। যে পদ্মাবতী এত চাপা স্বভাবের, সে পদ্মাবতীও উথালপাথাল করতে শুরু করেছে এক সময়। উদ্বেগ নিয়ে বারবার রাস্তার দিকে তাকিয়েছে। বারবার আমাকে বলেছে— দেখতো মোক্ষদা কে এল? আমি দেখে এসে যখন বলতাম—কই কেউ নাতো! তখন কী মলিনটাই না হয়ে যেত পদ্মার মুখটি, সে আমি সাক্ষী। আজ তুমি এলে সওদাগর। তোমাকে দেখে কী খুশিই না হতো আজ পদ্মাদি কিন্তু তোমার পদ্মারানি যে আজ খাঁচায় বন্দি! ঘর থেকে তার যে আজ আর বেরিয়ে আসার উপায় নেই! তোমার উচ্ছ্বাসের কী জবাব দেব আমি? আমি কী করে বলব—সওদাগর, তুমি ভুল সময়ে এসেছ, পদ্মার আজকের রাতটা রহমত উল্লাহ কিনে নিয়েছে? হাজার চেষ্টা করেও তুমি আজ পদ্মারানির নাগাল পাবে না সওদাগর। না পাওয়ার গভীর ব্যথা বুকে নিয়ে ফিরে যাও তুমি, ফিরে যাও সওদাগর।

‘কী মোক্ষদা, ডাকছ না কেন তোমার পদ্মাদিকে? ডেকে আন।’ মোক্ষাদাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সওদাগর আবার বলে।

‘আজকে তো আন্নে পদ্মারানির সাক্ষাৎ পাইতোন নো সদাগর।’ ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বলে মোক্ষদা।

‘কেন? এখনো বুঝি পদ্মার রাগ পড়েনি। আচ্ছা বাবা, ডেকে আন তাকে। দরকার হলে তার পায়ে ধরে মাফ চাইব আমি।’

মোক্ষদা বলল, ‘কথা সেইডা না। কথা অইল আজ হেতির ঘরে রহমত উল্লাহ। আইজকা বলে হেতার আইনর দিন। দরজায় খিল দিছে। অহন বাইর অইতো নো।’

‘রহমত উল্লাহ, রহমত উল্লাহ। রহমত উল্লাহ ছাড়া পদ্মার জীবনে আর কেউ নাই? জিজ্ঞেস কর তোমার পদ্মাদিকে।’ বলেই তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল সওদাগর। বিষণ্ন চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকল মোক্ষদা।

.

‘আরেকদিন এসেছিল সওদাগর। সে-সন্ধেয় ড্রইংরুমে বসেছিলাম আমি। টাঙ্গাইলের তাঁতের একটি হলুদ শাড়ি পরেছিলাম। শাড়িটি সওদাগরই উপহার দিয়েছিল আমাকে। একটা টকটকে লাল টিপও পরেছিলাম কপালে। রাগী রাগী চেহারা নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল সওদাগর। আমি গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসেছিলাম। গত ক’দিন ধরে আমার শরীরটা খারাপ যাচ্ছিল। একমাস মাসিক বন্ধ ছিল আমার। দু’দিন আগে হঠাৎ ব্লিডিং শুরু হলো। মনে করলাম মেয়েলি ব্যাপার, ঠিক হয়ে যাবে একসময়। রজঃস্বলা হলে আমি কাস্টমার বসাই না। ওই সময় প্রবেশদ্বার অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় থাকে। সেদিনও প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছিল আমার। কিছুক্ষণ পরপর কাপড় বদলাচ্ছিলাম।

সন্ধের দিকে চায়ের বড় তৃষ্ণা জাগল। মোক্ষদাকে চা বানাতে বললাম। মোক্ষদা ঘরের কোনার স্টোভে চায়ের জল চড়িয়েছে। টগবগ করে জল সিদ্ধ হচ্ছে কেটলিতে।’ এতদূর বলে থামল পদ্মাবতী।

গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছিল দেবযানী। শেষটা শুনবার জন্যে তার মন তড়পাচ্ছে। থামার সঙ্গে সঙ্গে দেবযানী বলে উঠল, ‘তারপর, তারপর কী হল পদ্মাদি?’

‘তারপর রাগী রাগী চেহারা নিয়ে সওদাগর আমার সামনের সোফায় বসল। তাকিয়ে দেখলাম সওদাগরের মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথার চুল উসকোখুসকো। গায়ের জামাকাপড়ও তেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নয়। আমি তার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললাম—জানি সওদাগর, তুমি আমার ওপর রাগ করে আছ। প্রথম দিনের ফিরিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গটি বেমালুম চেপে গিয়ে আরও বললাম—সেদিন নাকি তুমি এসেছিলে। দেখ সওদাগর, আমরা তো বেশ্যা। পরের কেনা বাঁদি। খাঁচার বন্দি পাখি। সেদিন আমি রহমত উল্লাহর বন্দি পাখি ছিলাম। তুমি শুধু শুধু আমার ওপর রাগ করে চলে গেছ। কথাগুলো সওদাগরের কানে গেল বলে আমার মনে হল না। তাকে আনমনা এবং রুক্ষ মনে হচ্ছিল।’

সওদাগর সোফা ছেড়ে পদ্মার পাশে এসে বসল। আজ তার বড় ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়ে গেছে। চালের আড়তে দামি চিকন চালের সঙ্গে মোটা চাল মিশাচ্ছিল কুলিরা। ওই সময় পুলিশ উপস্থিত হয়েছিল। অনেক হুজ্জতির পর মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিয়ে তারপর রেহাই পেয়েছে সওদাগর। এই হুজ্জতির মধ্যেও আজ সওদাগরের পদ্মাবতীর কথা মনে পড়েছে। তাই লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে উপস্থিত হয়েছে পদ্মার ঘরে।

‘যা-ই হয়েছে, তা-ই হয়েছে। সব ভুলে যাও। চল ভিতরে যাই।’ সওদাগর বলল।

‘মৃদু হেসে আমি বললাম, আজ তো ভিতরে যেতে পারব না সওদাগর।’

‘কেন, কেন যেতে পারবে না।’ রূঢ় কণ্ঠে বলে উঠল সওদাগর।

‘তোমাকে তো কারণ বলা যাবে না।’ আগের হাসিটা মুখে ঝুলিয়ে রেখেই বললাম। কী করে তাকে বলি—গত কয়েকদিন ধরে আমার খুব কষ্টের সময় যাচ্ছে। প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে আমার। তুমি যে সুখ পাওয়ার জন্যে আমাকে ঘরে ঢুকাতে চাইছ, সেই যন্ত্রটি যে অকেজো হয়ে আছে। ভিতরে গিয়ে তুমি বিমুখ হবে—এটা আমি চাই না।

‘কেন কারণ বলা যাবে না?’

‘আমার অসুখ করেছে।’

এবার ফেটে পড়ল সওদাগর। ‘যখন সাহেবকে নিয়ে লীলা কর, তখন তোমার অসুখ হয় না। যখন রহমত উল্লাহর সামনে বিবস্ত্র হয়ে শরীরের প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখাও, তখন তোমার অসুখ করে না। আমি, এই জব্বার সওদাগর যখন আসি, তখন তোমার যোনিতে যত অসুখ—তাই না, তাই না পদ্মা? তুমি ভুলে গেছ আমি তোমাকে পছন্দ করি, তুমি এও ভুলে গেছ আমি তোমার জন্যে হাজার হাজার টাকা খরচ করি!’ তারপর কণ্ঠকে যতটুকু উঁচুতে তোলা যায় তুলে বলল, ‘বেশ্যাপাড়ার মাগিরা এই রকমই। বর্তমানে বিশ্বাসী। টাকায় বিশ্বাসী। প্রেমট্রেম খানকি পাড়ায় অচল—এটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম।’

‘আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি সেদিন। উচ্চস্বরে বলেছি, ‘চোপড়াও সওদাগর, যার মুখে কাঁচা টাট্টিখানার দুর্গন্ধের মতো এত অশ্লীল কথা, তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। মাগিখোরদের আবার কীসের প্রেম? তুমি তো মাগিখোর। ঘরে দুই দুইটা বউ রেখে মাগি খেতে আস এই সাহেবপাড়ায়।’

‘আমার কথা শুনে সওদাগর যেন উন্মাদ হয়ে গেল। অগ্নিঝরা গোল গোল চোখ দিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। ঘরের কোনায় মোক্ষদা সবেমাত্র কেটলি থেকে মগে টগবগে গরম পানি ঢেলেছে। চোখের পলকে সওদাগর সেদিকে এগিয়ে গেল। গরমজলের মগটা হাতে নিল। তারপর, তারপর তো আমার এই অবস্থা!’

‘সওদাগরের কিছু হল না?’ দেবযানী জিজ্ঞেস করে।

পদ্মাবতী ধীরে ধীরে বলল, ‘ওরা পয়সাওয়ালা। পয়সাওয়ালাদের কিছু হয় না। টাকা দিয়ে থানা ম্যানেজ করল। প্রচুর টাকা খাওয়াল পাড়ার গুপ্তা- মাস্তানদের। তার কিছু হল না। যা গেল, তা সবই আমারই গেল।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে পদ্মাবতী বলল, ‘এখন আমি না ঘরকা, না ঘাটকা। ঘুঁটে কুড়োনি আমি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *