০৫. এক দুপুরে শামছু বলল

পাঁচ

এক দুপুরে শামছু বলল, ‘শৈলেশ, তোমারে একখান কথা জিগাই?’

‘কী কথা শামছুদা?

রুস্তমের রেস্টুরেন্ট থেকে ভাত খেয়ে এসেছে দু’জনে। টিন শেইডের ছোট্ট ঘরটির চৌকিতে দু’জনে মুখোমুখি বসেছে।

‘বলতাছিলাম কি, আজ তুমি বাইর অইয়া আইছ বরাবর পনর দিন। এই পনর দিনে তোমার কি একবারও বউ-মাইয়াগোর কথা মনে পড়ে নাই?’

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শৈলেশ বলে, ‘পড়ছে, মনে পড়ছে শামছুদা। মাইয়া দুইডার কথা মনে পড়ছে। বেশি কইরা মনে পড়ছে বড় মাইয়াডার কথা।’

‘আর বউয়ের কথা?’ কৌতুকী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে শামছু।

‘না দাদা, বউয়ের কথা আমার সামনে তুইলেন না। হেই হারামজাদির লাইগ্যাই তো আমি দেশান্তরি হইছি।’ রাগত কণ্ঠে বলে যায় শৈলেশ।

‘বুইঝলাম, তোমার বউ খারাপ, তার মুখে কাঁচা টাট্টিখানা বসানো। কিন্তু মাইয়াপোলাগুন কী দোষ করছে? তোমার অবর্তমানে হেরা কী খাইতাছে না শুখাই মরতাছে—সেই কথা ভাবছনি তুমি?’ শামছু বলে।

শৈলেশ শামছুর চোখে চোখ রেখে বলে, ‘আপনি বিশ্বাস করেন শামছুদা—এই কয় দিন আমি রাতে ঘুমাইতে পারি নাই; শুধু মাইয়াগো চেহারা আমার চখে ভাইস্যা উঠছে। ছোড় মাইয়ার বাবা বাবা ডাকে কত রাইতে যে আমার ঘুম ভাইঙ্গা গেছে!’

‘তাইলে বাড়িত যাওনের কথা ভাবতাছ না ক্যান?’

শৈলেশ উষ্ণকণ্ঠে বলে ওঠে, ‘ক্যামনে ভাবমু? যাওনের কথা মাথায় আইনলেই তো হারামজাদি যশোদা লাম্বনির চেহারাখান চখে ভাইস্যা উড়ে। হেই বৈতাল আমারে দেশ ছাড়া করছে।’

শামছু ধীরে ধীরে বলে, ‘দেখ শৈলেশ, দেশ ছাড়া হে করে নাই। তুমি অতিষ্ঠ হইয়া ঘর ছাড়ছ।’ তারপর একটু থেমে শামছু আবার বলে, ‘তোমারে কইলাম—তুমি চাকরি কর। সাহেবপাড়ায় তোমারে একখান চাকরি জোগাড় করি দওনর মত ক্ষমতা এই শামছুর আছে। হুইনা তুমি কইলা কী? কইলা এই পতিতাপাড়ায় আমি চাকরি করমু? এই পাপ জায়গায় চাকরি কইরলে আমি নরকে যামু, আমার চইদ্দ গুষ্ঠি নরকে যাইবো!’

‘কী করমু কন দাদা, আমারে আপনি বুদ্দি দেন, আমি কী কইরলে ভালা অয়।’ কাকুতি মিশানো গলায় শৈলেশ বলে।

শৈলেশের কথা শুনে দীর্ঘক্ষণ চুপ মেরে থাকল শামছু। তারপর বলল, ‘আমি কই কি শৈলেশ, তুমি ফিরি যাও। তোমার বাড়িত তুমি ফিরি যাও। তোমার বউয়ের জইন্য আমি ফিরি যাইতে কই না। কইতাছি—তোমার মাইয়াগো লাইগা তুমি ফিরি যাও। মাইয়ারা বড় অইয়া উঠতাছে—এই সময় হেগোর পাশে তোমারে দরকার।’

শামছু চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল, শৈলেশের খোঁচা খোঁচা দাড়ির ফাঁক বেয়ে দু’চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে টপাটপ

একসময় ফুঁফিয়ে উঠল শৈলেশ। বলল, ‘দাদা তুমি আমার চখ খুইল্যা দিছ। হুদা বউ লইয়া তো আমার জীবন না। আমার জীবনে তো মাইয়রাও আছে। তাগো লাইগা আমি ফিরি যাব। কালই ফিরি যাব।’ আবেগের আতিশয্যে শৈলেশ আপনি তুমির পার্থক্য ভুলে গেল।

.

পরদিন দুপুরে শৈলেশ বীরপুরে ফিরে গেল। জ্যৈষ্ঠ মাস। ঝাঁ ঝাঁ রোদে আকাশ বুঝি টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। রোদ মাথায় নিয়ে বড়ো-ছোটো গাছগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। মধ্যে মধ্যে এক চিলতে কালো-সাদা মেঘ আকাশের এপার থেকে ওপারে ভেসে যাচ্ছে। হাঁড়িধোয়া নদীর জল শুকিয়ে তলায় নেমেছে। এই ঝিমধরা দুপুরে নরসিংদী স্টেশনে নেমে শৈলেশ ধীর পায়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

চলে যাওয়ার সময় তার ভেতরে যে রাগ-ক্ষোভ ছিল—এখন তা নেই। বরং একধরনের অপরাধবোধ তার মধ্যে সে অনুভব করতে লাগল। বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে সে ভাবছে—পৃথিবীতে কার বউটি মুখরা নয়? সুযোগ পেলে কোন বউটি স্বামীকে অপমান অপদস্থ করে না? যশোদাও তো বউ। সে একটু বিলাসী। বিলাস সামগ্রীর প্রতি তার খুব লোভ। আমি গরিব মানুষ, তার চাহিদা মতো স্নো-পাউডার-সেন্ট জোগান দিতে পারি না, সেতো আমারই অক্ষমতা। যশোদাকে দোষ দিয়ে লাভ কী?

এইরকম ভাবতে ভাবতে শৈলেশ একসময় তার উঠানে এসে দাঁড়ায়। দেখে—যশোদা দাওয়ার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে উদাস চোখে নারকেল

গাছের মাথার দিকে তাকিয়ে আছে। চুল তার উসকোখুসকো। আঁচলটাও ঠিকঠাক মতো গায়ে জড়ানো নেই। মেয়ে দুটোকে আশপাশে দেখা গেল না। আজ তো সাপ্তাহিক ছুটি। আজ তো তাদের স্কুলে যাওয়ার কথা নয়। গেল কোথায় তারা?

‘কৃষ্ণা, কৃষ্ণারে, কই গেলি তুই মা।’ উঠানে দাঁড়িয়ে ডাক দিল শৈলেশ। চমকে শৈলেশের দিকে ফিরে তাকাল যশোদা। তার চোখে ঘৃণা- ভালোবাসা-ক্ষোভ-দুঃখ জড়াজড়ি করছে।

বাপের আওয়াজ শুনে হন্তদন্ত হয়ে কৃষ্ণা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল। তার দু’হাতে মরিচ-হলুদের মাখামাখি। ছোট মেয়েটি ‘বাবা বাবা’ করে ঘরের ভেতর থেকে ছুটে এল। ‘কই ছিলা বাবা, তুমি এতদিন কই ছিলা?’ বলতে বলতে ফুঁপিয়ে উঠল সোমা।

শৈলেশ ছোটমেয়ের প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। স্থির দৃষ্টিতে যশোদার দিকে তাকিয়ে থাকল। যশোদা দাওয়া থেকে নামল না। শুধু বিলাপ করে উঠল, ‘ভগমানরে, তুমি আমার কপালে এই দুঃখও লিখ্যা রাখছিলা রে ভগমান।

কৃষ্ণা আর সোমা দু’হাত ধরে শৈলেশকে ঘরে নিয়ে গেল। কৃষ্ণা তার দিকে গামছা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘যাও বাবা, হাঁড়িদোয়া থেইক্যা ছান কইরা আস।’

নদীঘাটে রওনা দেওয়ার আগমুহূর্তে যশোদা একটা অদ্ভুত কাণ্ড করল। তিনটা টাকা শৈলেশের দিকে এগিয়ে ধরে বলল, ‘সোমা তোর বাপেরে ক, নাপিত্যার দোকানে গিয়া মুখের জঞ্জালটা সাফ কইরা আইতো।’

শৈলেশের মুখে এক অপূর্ব প্রশান্ত হাসি ছড়িয়ে পড়ল। মুচকি হেসে যশোদার হাত থেকে টাকাগুলো নিল শৈলেশ। জামাটা পরে নরসিংদী রেলস্টেশনের দিকে রওনা দিল।

.

ভাত খেতে বসে সোমা আবার কথাটা জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, কই গেইছিলা তুমি, এত দিন? আমাগোর কী কষ্ট অইছে! শুধু আলুর ভর্তা আর ডাইল আর শাক দিয়া ভাত খাইছি।’

যশোদা ধমকে উঠল, ‘থামবি তুই। আইছে পর্যন্ত শুধু কই গেছিলা, কেন গেছিলা?’

যশোদার কথায় কান না দিয়ে শৈলেশ বলল, ‘আর কোনো দিন যামুনারে মা। তোগোরে কথা দিতাছি—কাইল থেইক্যা আমি মাছ ধরুম হাঁড়িদোয়া আর মেঘনাতে গিয়া। তোগোরে আর শাক-আলুভর্তা খেতে হবে নারে মা।’

.

গভীর রাত। আঁধার ঘর। পাশের ঘরে কৃষ্ণা-সোমা ঘুমাচ্ছে। বহুদিন পর বাপকে ফিরে পেয়ে অথবা অন্য কোনো কারণে দুজনেই গভীর নিদ্রায় মগ্ন। শুধু জেগে আছে যশোদা আর শৈলেশ। দু’জনেই চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, দু’জনেরই চোখ খোলা।

যশোদার নিবিড় নিশ্বাস টের পাওয়া যাচ্ছে। শৈলেশ এই নিশ্বাসের মানে বুঝছে। আট মাসের পোয়াতি যশোদা। শৈলেশের সঙ্গে যে দুর্ব্যবহার করেছে যশোদা—তা ক্ষমার যোগ্য নয়। তার শরীরের অবস্থা ভালো নয়, নইলে বুকে জড়িয়ে শৈলেশের মন ভিজিয়ে দিত, শরীর জাগিয়ে তুলত। কিন্তু যশোদা নিরুপায়।

‘ঘুমাইলা নাকি?’ যশোদা জিজ্ঞেস করে।

শৈলেশ কোনো উত্তর না দিয়ে বালিশের তলায় হাত ঢুকায়। তারপর যশোদার ডান হাতটা খুঁজে নিয়ে কী যেন একটা গুঁজে দেয়।

যশোদা বলে, ‘কী, কী এইডা?’

‘কিছু না, ছেএন।’ কাঁচুমাচু হয়ে বলে শৈলেশ।

‘ছেএন!’ অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে যশোদা।

‘হ কৃষ্ণার মা, ছেএন। ছেত্রনের জইন্য তোমার মন খারাপ অইছিল। আমি গরিব মানুষ, তোমারে তোমার কথামতো ছেএন কিন্যা দিতে পারি নাই। পকেটে ডাব বেচা ঠেহাড়ি আছিল। দাড়ি কাটতে গিয়া স্টেশনবাজার থেইক্যা কিন্যা আনছি। লও, কাইল থেইক্যা গায়ে মাইখ্যো।’ ধীরে ধীরে কথাগুলো বলে যায় শৈলেশ।

অনেক কষ্টে উঠে বসে যশোদা। হাত দিয়ে শৈলেশের পা খুঁজে নেয়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, ‘তুমি আমারে মাফ কইরা দাও কৃষ্ণার বাপ। সামান্য ছেএনের জইন্য তোমারে আমি অপমান করছি। আমারে মাফ কর, মাফ কর।

ততক্ষণে শৈলেশও উঠে বসেছে বিছানায়। যশোদার হাত ধরে বলে, ‘যা হইছে হইয়া গেছে। অতীত ভুইল্যা যাও। আমাগো দুইডা মাইয়া আছে। বড়ড়া সেয়ানা হইয়া উঠছে। আর একটা আইতাছে। হেগোরে পড়াশুনা করান লাগবো। কাল থেইক্যা জীবনডা আবার নতুন কইরা শুরু করি। কী বল কৃষ্ণার মা?’

যশোদা পরম মমতায় শৈলেশকে কাছে টেনে নেয়।

.

পরদিন সকাল থেকে শৈলেশের পরিবারের অন্যরকম চেহারা। আগের মতো যশোদার চেঁচামেচি-গালিগালাজ নেই, অপ্রাপ্তির জন্য হাহাকার নেই। মেয়েদের মধ্যে কোনো ত্রাস নেই। ভোরসকালেই শৈলেশ হাঁড়িধোয়ায় জাল বাইতে যায়। দুপুর গড়িয়ে গেলে ডুলাভর্তি পাবদা, চিংড়ি, টেংরা মাছ নিয়ে ফিরে। পোয়াতি যশোদা শারীরিক কষ্টকে উপেক্ষা করে মাছ কুটে, রান্না করে, স্বামী-সন্তানের পাতে দেয়। বহুদিন পরে কন্যারা পরম তৃপ্তিতে ভাত খায়- একটু দূরে দাঁড়িয়ে প্রশান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে যশোদা। একটা সুকোমল সুবাতাস শৈলেশের পরিবারকে ঘিরে বইতে থাকে।

.

শৈলেশের জীবন এইভাবে চলতে থাকলে ভালো হতো। কিন্তু বিধাতা বুঝি তা চাইলেন না। চট্টগ্রাম থেকে নরসিংদীতে ফিরার দু’মাসের মাথায় শৈলেশের বউটি বাচ্চা বিয়োতে গিয়ে মারা গেল। নবজাতকও বাঁচল না। যশোদা মরল, শৈলেশকেও মেরে গেল।

শ্মশানক্রিয়া শেষ করে এসে গালে হাত দিয়ে সারারাত দাওয়ায় বসে থাকল শৈলেশ। মেয়েরা ডাকল, ‘বাবা, ঘরে আস, অন্ধকারে এই রকম বইস্যা থাইকো না।’

মেয়েদের কথা শৈলেশের কানে ঢুকল বলে মনে হল না। বারান্দার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে ঠায় গোটাটা রাত কাটিয়ে দিল শৈলেশ। সমস্ত দিনের ক্লান্তি আর শোকে মেয়ে দুটো জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে পড়ল।

এখন শৈলেশের মধ্যে আগের শৈলেশ নেই। মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি। একমাথা এলোমেলো চুল। কাপড়চোপড় ময়লায় ধূসর। খালি পায়ে মাথা নিচু করে হেঁটে যায়। পড়শিরা জিজ্ঞেস করে, শৈলেশ কেমন আছ, কই যাও?’

কোনো জবাব দেয় না শৈলেশ, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়। তার যে দুটো মেয়ে আছে, সেদিকেও তেমন খেয়াল নেই শৈলেশের। উদাস চোখে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকে আর আনমনে বিড়বিড় করে কী যেন বলে।

শৈলেশ এখন যথানিয়মে মাছ ধরতে যায় না। মেয়েদের তাগাদায় কখনো জাল নিয়ে বের হলেও দুপুরে খালি ডুলা নিয়ে বাড়ি ফিরে। মেয়েদের জিজ্ঞাসার উত্তরে বলে, ‘জাল বাই নাই মেঘনায়। নদীর পারে বইসা ছিলাম। জাল বাইতে ইচ্ছা করে নাই। তোদের মা নাই। কী জইন্য জাল বাইমু?’

‘ক্যান, আমাগো লাইগ্যা বাইবা, মাছ ধইরবা। তুমি মাছ না মারলে আমরা খামু কী? যামু কই?’ কৃষ্ণা বলে।

‘তোগো লাইগ্যা কী জইন্য বাইমু? যশোদা নাই, কৃষ্ণার মা নাই। গালি দেউন্যা নাই, হা হা হা।’ শৈলেশ উন্মাদের মতো হাসে।

.

একটা সময়ে শৈলেশ সত্যি পাগল হয়ে গেল। সংসারের দায়ভার এসে পড়ল কৃষ্ণার ওপর। কৃষ্ণার বয়স সতেরো। পড়শিরা প্রথম প্রথম চালটা ডালটা-লবণটা দিয়ে সাহায্য করল। কিন্তু একটা সময়ে হাত গুটিয়ে নিল তারা। দীর্ঘ সময় ধরে অন্য একটি অসহায় পরিবারকে সাহায্য করবার মতো ক্ষমতা দাসপাড়ার লোকদের যে নাই! অভাব যে তাদেরকেও যমদূতের মতো তাড়িয়ে বেড়ায়!

কৃষ্ণা মায়ের মতো দীর্ঘদেহী। দুর্ভার অভাবের মধ্যেও কৃষ্ণা বেড়ে উঠতে লাগল। তার স্তনযুগল ছেঁড়া শাড়িতে আর ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। তার দু’বাহুর সুডৌল গড়ন, তার টানা চোখের চাহনি, একমাথা ঝাঁকড়া চুল- এসব কিছু তপন দত্তের চোখে পড়তে লাগল।

তপন নরসিংদী রেলস্টেশনের ফ্লাটফরমে ফল বেচে। বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। থাকে মফজলের সঙ্গে। মফজল রেলস্টেশনের নাইটগার্ড। স্টেশনের পাশেই রেলকোম্পানির ছোট্ট একটা ঘর পেয়েছে মফজল। মাসে দুইশত টাকার চুক্তিতে তপন ওই ঘরে থাকবার সুযোগ পেয়েছে।

সকাল নয়টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ফল বেচে তপন, খায় বিষ্ণুপ্রিয়া হোটেলে। তপন শ্যামলা। ডান দিকে সিঁথি কেটে চুল আঁচড়ায় সে। প্রতিদিন শেভ করে স্টেশন-পুকুরে স্নান সেরে ফলের পসরা নিয়ে বসে। তার বাম পা-টা একটু চিমসে ধরনের। এইজন্যে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে তপন। রেলস্টেশনে সে ল্যাংড়া তপন নামে পরিচিত।

সেগুনতলা বাজারটি স্টেশনের সঙ্গে লাগোয়া, পশ্চিমদিক ঘেঁষে। অন্যপথ দিয়েও বাজারে যাওয়া যায়, তবে তা ঘুরানো। স্টেশনের ফ্লাটফরম দিয়ে সেগুনতলা বাজারে যাওয়া সহজ। সংসারের চাল-ডাল-আনাজপাতি কিনতে যাওয়ার সময় কৃষ্ণা তাই স্টেশনের পথটিই বেছে নেয়। বাপ সংসার-উদাসীন হয়ে যাওয়ার পর থেকে গাছ-নৌকা-জাল-দাড়-রশি– নারকেল-আম ইত্যাদি বিক্রি করে করে সংসারটাকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল কৃষ্ণা। একটা সময়ে শৈলেশের সংসারে বিক্রিযোগ্য বস্তু ফুরিয়ে এলে অথৈ জলে পড়ল কৃষ্ণা। ঠিক ওই সময়ে সাহায্যের হাত বাড়াল তপন।

কৃষ্ণা তপনের সাহায্য নিল, কিন্তু দিতে হল অনেক কিছু। তপন যে বিবাহিত, তার যে একটা সন্তানও আছে—সেটা কেউ জানে না, এমনকি একই ঘরে বসবাসকারী মফজলও না। মফজল প্রথম বউকে তালাক দিয়ে দ্বিতীয় বউ নিয়ে ঘর করছে। দাগনভূঁইয়ার গ্রামের বাড়িতে থাকে বউ। মফজল মদ খায়-বাংলা মদ। মাঝেমধ্যে স্টেশন থেকে সস্তা মেয়ে এনে ঘরে খিল দেয়। তপন এসব দেখে এবং উত্তেজিত হয়। এইসময় তার সঙ্গে কৃষ্ণার পরিচয় হয়। শরীর চটকাচটকি পর্যন্ত গড়ায় সে পরিচয়।

.

এক দুপুরে, সিলেটগামী ট্রেনটি সবে স্টেশন ছেড়ে গেছে, তপন কৃষ্ণাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে মফজলের ঘরে আনে। মফজল তখন খেতে গেছে। খিল দিয়ে কৃষ্ণার হাত ধরল তপন, বুক-মুখ চাটাচাটি করল। আরও এগুতে চাইলে কৃষ্ণা রাজি হল না। শ’দুয়েক টাকা কৃষ্ণার হাতে গুঁজে দিয়ে ঘরের দরজা খুলল তপন

এইভাবে বুক চাপাচাপি, ঠোঁট চাটাচাটি চলতে লাগল। সেটা কম দিন নয়, প্রায় বছর খানেক। একটা সময়ে তপন কৃষ্ণার শরীরের জন্যে কাতর হয়ে উঠল। কৃষ্ণার এককথা—বিয়ে ছাড়া তপনকে শরীর দেবে না। কিন্তু তপনের সঙ্গে দীর্ঘদিনের লীলাখেলায় কৃষ্ণার শরীরও জেগে উঠল, শরীরের আনাচেকানাচে ভাঙতে লাগল। একদিন কৃষ্ণা বলল, ‘আমারে বিয়া কর না ক্যান? তাইলে তো সব পাইতা।’

‘কিছু মনে কর না কৃষ্ণা। তুমি জেলে, আমি হিন্দু–কায়স্থ। সমাজ তো আমাদের বিয়ে মেনে নেবে না।

‘তাইলে কী করবা? প্রেম করার সময় হিসেব কর নাই।’ রাগি রাগি কণ্ঠে বলে কৃষ্ণা।

সেদিন চুপ করে থাকল তপন। রাতে মফজলের সঙ্গে পরামর্শ করল। সে যে বিবাহিত সেটাও জানাল মফজলকে। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘এখন কী করি মফজল ভাই?’

‘ধুর বেডা ভোদাই। হেতিরে লই চিটাগাং পলাই যা! কামটাম শেষ করি হেতিরে থুই চলি আইবি নরসিংদী।’ মফজল বলে।

‘আর কৃষ্ণা?’ অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে তপন।

‘আর কৃষ্ণা কৃষ্ণা করিচ্ছা। পলাই যাওনর কারণে হেতির সমাজে কলঙ্ক অইবো। হিতি আর ফিরি আইসতো নো এইখানে। চিটাগাং-এ কোনো একখান কামে লাগি যাইবো। তোর লগে যে পলাইছে—হিয়ান কেউ জাইনতো নো। তুই এই স্টেশনে আগে যেই রকম ফল বেইচতি, হেই রকম ফল বেইচবি। বুইঝ্যক্তি?’ পরামর্শ দানের পরে প্রশ্ন করে মফজল।

.

অর্থনৈতিক দুরবস্থা, পারিবারিক নিরাপত্তাহীনতা, যৌনমিলনের প্রবল আসক্তি, বিয়ের প্রলোভনের ঘূর্ণিতে পড়ে একরাতে কৃষ্ণা তপনের সঙ্গে পালাল।

.

চট্টগ্রামের জুবিলী রোডের সোনালি বোডিং-এ উঠল তপন-কৃষ্ণা। রেজিস্ট্রি খাতায় নাম লিখাল—জয়নাল ও সালমা বেগম, স্বামী-স্ত্রী, কিশোরগঞ্জ। কক্ষে ঢুকেই কৃষ্ণা জিজ্ঞেস করল, ‘মিথ্যা নাম-পরিচয় লিখালা ক্যান খাতায়।?‘

‘বুঝলে না, আমরা তো পালিয়ে এসেছি। বিয়েও করিনি আমরা। হিন্দু নাম লিখলে তোমার কপালে সিঁদুর নাই কেন, হাতে শাঁখা নাই কেন—হাজার প্রশ্ন। এই ঝামেলা থেকে বাঁচবার জন্য মুসলমানি নাম।’

‘আর স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়?’ অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে কৃষ্ণা।

‘আরে এত উত্তেজিত হচ্ছ কেন? আজ না হোক কাল তো আমরা স্বামী- স্ত্রী হচ্ছি? না হয় একটু আগে লিখালাম আর কী?’ কথার চাতুর্যে কৃষ্ণার মন ভেজাতে চাইল তপন।

স্নান সেরে, বেয়ারাকে দিয়ে নিচের রেস্টুরেন্ট থেকে ভাত-মাংস এনে খেল দু’জনে। তারপর শুয়ে পড়ল এক বিছানায়। তপন আদর করে, যৌন উত্তেজনাকর কথা বলে, কৃষ্ণার নানা গুপ্ত জায়গায় সোহাগি স্পর্শ দিয়ে কৃষ্ণাকে চাগিয়ে তুলল। বিয়ের আগে শরীর দেওয়া যাবে না—এই শর্তটি কৃষ্ণা একটা সময়ে শিথিল করল। শরীর তুলে দিল সে তপনের হাতে। তপন পূর্বের বৈবাহিক অভিজ্ঞতা এবং বর্তমানের উত্তেজনাকে পুঁজি করে কৃষ্ণার শরীরে একবার, দুবার, বারবার অবগাহন করতে লাগল। বিকেলভর, রাতভর এবং পরবর্তী তিন চার দিন ধরে অবগাহন চলল। এর মধ্যে বিয়ের কথা তুললে কৃষ্ণাকে আদরে সোহাগে ভরিয়ে দিয়ে বুকে টেনে নিয়ে তপন বলল, ‘আরে হবে হবে। একটু সবুর কর। মফজল আসুক।’

‘মফজল? মফজল ক্যান?’ বিস্ফারিত চোখে জিজ্ঞেস করে কৃষ্ণা।

‘আরে, আমাদের বিয়েতে একজন সাক্ষী লাগবে না? আসবার সময় তাকে তিন চার দিন পর আসতে বলে এসেছি। এই সোনালি বোডিং-এর নাম ঠিকানা তো মফজলই আমাকে দিয়েছে।’ কৃষ্ণার গালে-গলায়-বুকে হাত বুলাতে বুলাতে বলে তপন।

এইভাবেই চলল বেশ কিছুদিন। তপনের যা খাওয়ার চেটেপুটে খেল, যা দেখার নয়নভরে দেখল, যা নেওয়ার কড়ায়-গণ্ডায় আদায় করল

তারপর একরাতে ‘একটু নিচ থেকে আসি’ বলে তপন বেরিয়ে গেল, আর ফিরল না। ভীষণ উদ্বিগ্নতায় রাতটা কাটাল কৃষ্ণা; সকাল বয়ে গেল। দুপুরে কৃষ্ণা খিদেয় অস্থির হল। কয়েকবার দরজা খুলে বাইরে উঁকিঝুঁকি দিল। বেয়ারাকে তপনের কথা জিজ্ঞেস করল। সোনালি বোডিং-এর মালিক বদর মিঞা বুঝে গেল—এ ভাগিয়ে আনা মাল।

সে শামছু দালালকে খবর দিল। চট্টগ্রাম শহরে এমন কিছু আবাসিক হোটেল আছে, যাদের সঙ্গে সাহেবপাড়ার দালাল-মাস্তানদের দোস্তি আছে। পতিতাপল্লির অনেক মেয়েকে এই ধরনের হোটেল থেকে সংগ্রহ করা হয়। আবার কোনো হোটেলবাসী বেশ্যাপাড়ায় না গিয়ে মেয়ে ভোগ করতে চাইলে বেশি রেইটে ওই দালাল-মাস্তানরা সাহেবপাড়া থেকে এইসব হোটেলে মেয়ে সরবরাহ করে।

বদর মিঞার সঙ্গে শামছুর দোস্তি আছে। দু’জনেই বয়সি, দু’জনেই এই লাইনে ঝানু। কৃষ্ণার ব্যাপারটি বুঝতে পেরে বদর মিঞা প্রথমেই শামছুকে খবর পাঠায়। তার হাতে কৃষ্ণাকে গছিয়ে দিতে পারলে গত কয়েকদিনের হোটেল ভাড়াটা পাওয়া যাবে, আর বাড়তি টাকা তো মিলবেই।

শেষ পর্যন্ত শামছুই কিনে নিল কৃষ্ণাকে। লেনদেন চুকিয়ে চোখমুখ কাঁচুমাচু করে ভদ্রবেশে কৃষ্ণার ঘরে টোকা দিল শামছু। ঘরে ঢুকে শামছু দরদি কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কে মা? কেন এসেছ এখানে? কে তোমাকে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে?’

কৃষ্ণা গত কয়েক বেলায় বুঝে গেছে, তপন তার পাওনা আদায় করে ভেগেছে। শামছুর দরদি গলা শুনে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল কৃষ্ণা। তারপর ধীরে ধীরে সব খুলে বলল। শুধু চেপে গেল—তার বাপ মায়ের নাম। নিজের কলঙ্কিত জীবনের সঙ্গে মা-বাপের নামটা জড়াতে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল।

সব শুনে শামছু তার মুখটাকে আরও করুণ করল, তার চোখ থেকে দু’ফোঁটা অশ্ৰু বুঝি গড়াল। কাছে এগিয়ে গিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘তুই ফান্দে পড়ছস মাইয়া। ফ্রডের হাতে পড়ছস। তোর সর্বনাশ করে সে পালিয়ে গেছে।’ তারপর একটু থামল, গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করল, ‘তুই কষ্ট পাইছ না মা। এই হোটেলে অনেক টাকা বাকি। এইখানে তো তুই আর থাকতে পারবি না। হোটেলের পাওনা আমি মিটিয়ে দিচ্ছি। এই বুড়া বাপের ছোট্ট হলেও একটা আশ্রয় আছে। চল আমার সাথে। কালপরশু তোরে আমি তোর বাড়িতে পাঠিয়ে দেব।’

পরম বিশ্বাসে শামছুর সঙ্গেই কৃষ্ণা সোনালি বোডিং থেকে বেরিয়ে এল, সেই সন্ধেয়।

শামছু কৃষ্ণাকে নিয়ে গিয়ে কালু সর্দারের কাছে চড়া দামে বেচে দিল। সে সন্ধেয় কিছু বুঝতে পারেনি কৃষ্ণা। সর্দার তাকে একটা ভালো ঘরে থাকতে দিল। রেস্টুরেন্ট থেকে ভালো খাবার এনে খাওয়াল।

অবাক চোখে কৃষ্ণা শামছুকে ইতিউতি খুঁজতে লাগল। সর্দার বলল, ‘তুমি কাকে খুঁজছ বুঝতে পারছি। আছে, শামছু আছে। এখন একটু কামে গেছে। সকালে আসবে। তুমি ঘুমাও।’ বলে বাইর থেকে দরজায় তালা দিল।

ক্লান্তিতে আর বিষণ্নতায় কৃষ্ণা তখন জরজর। সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

ছয়

খুব ভোরে শয্যা ছাড়ে শৈলবালা।

‘ঠাকুর ঠাকুর’ বলে বিছানা থেকে বাম পা মাটিতে রাখে। ঘরের বাইরে এসে ‘ওঁ জবা কুসুমং’ মন্ত্রটি ভুলভাল উচ্চারণ করে ভক্তিভরে সূর্যদেবকে প্রণাম করে। তারপর স্নান ঘরে ঢোকে। স্নান শেষে পাড়ওয়ালা ধবধবে সাদা কাপড় পরে। তারপর মন্দিরে ঢোকে। কপালে-নাকে তিলকের ফোঁটা কেটে লক্ষ্মী- নারায়ণের সামনে পুজো দেয়। মূর্তির সামনে উপুর হয়ে কপাল ঘষে। বিড়বিড় করে সে সময় কী যেন বলে শৈলবালা।

আজও পুজোর কাজ শেষ করে ঘরের দেয়ালে ঝুলানো বিশেষ একটা চাবি নিয়ে নিচে নেমে গেল শৈলবালা। এই চাবিটি বিশেষ একটা ঘরের চাবি, সবসময় ব্যবহৃত হয় না। দু’চার ছয় মাস পরপর এই চাবি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে। কৃষ্ণার মতো কোনো মেয়ের চালান এলে ওই ঘরে রাখা হয়—ওই ঘরটি বশে আনার ঘর। এটাকে নবাগত মেয়েদের প্রশিক্ষণের ঘরও বলা যেতে পারে। শাস্তিঘর বললেও ভুল হবে না। যে মেয়েটি তেরিমেরি করে, বাগে আসতে চায় না, তার ওপর শারীরিক নির্যাতন ও মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হয় এই ঘরে রেখেই।

দরজা খুলে শৈলমাসি দেখল, দেয়ালের দিকে ফিরে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে কৃষ্ণা। মাসি এগিয়ে গিয়ে কৃষ্ণার গায়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘উঠ মাইয়া উঠ, আর কত ঘুমাইবা?’

ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসল কৃষ্ণা। চোখ ডলতে ডলতে বলল, ‘আমি কোন খানে? শামছু চাচা কই?’

তুমি কোনখানে মাইনে? তুমি মাসির কাছে- শৈলমাসি। এখন থেকে মা বল আর মাসি বল–এই শৈলমাসি। শামছু কেডা? সে একজন দালাল, মাগির দালাল। হের কথা ভুইলা যাও। সে তোমারে বেইচ্যা দিছে আমাদের কাছে।

‘দালাল! বেইচ্যা দিছে মাইনে?’ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে কৃষ্ণার চোখের মণি।

‘শুন মাইয়া, যা হইছে হইছে। পেছনের কথা লইয়া টানাটানি করার দরকার নাই। এখন থেকে তুমি আমার বোনঝি, মাইনে আমি তোমার মাসি।’

‘কে মাসি? মাসি মাইনে? আমি তো আপনারে কোনো দিন দেখি নাই। শামছু চাচা আমারে লই আইছে, কইছে আইজ সকালে দেশে পাড়াই দিব। হে কই?’ উদ্বিগ্ন অথচ কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে কৃষ্ণা।

‘বার বার শামছু শামছু করতাছ কেন? শামছু মাগির দালাল, একবার বলছি শুন নাই? হোটেল থেকে সে তোমারে ভাগাই আনছে। আমাদের কাছে চড়া দামে বেইচ্যা দিয়ে গেছে। এখন থেকে তুমি আমাদের, মানে শৈলমাসির আর কালু সর্দারের। আর জানতে চাইছিলা না এটা কোন জায়গা? এইটা খানকি পাড়া। বেইশ্যা পাড়া। মাইয়া পোলার শরীল বেচনের জায়গা। কাইল থেকে তুমিও শরীল বেচবা এখানে।’ সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিল শৈলমাসি।

শৈলবালার কথা শুনে কৃষ্ণা কী বলবে, কী করবে—কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। শুধু রক্তশূন্যমুখে ফ্যালফ্যাল করে শৈলবালার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর হাউমাউ করে উঠল। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে এলোমেলো স্বরে এইটুকু বলতে চাইল যে, আপনি কী বলছেন? মাগিপাড়া, বেশ্যাপাড়া——এসব কী? শরীর বেচন অৰ্থ কী?

শৈলবালা কৃষ্ণার এইসব হাউকাউয়ের জবাবে কিছুই বলল না। হাসি হাসি মুখ করে কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর ধীর পায়ে কৃষ্ণার কাছে গেল, গভীর মমতায় কৃষ্ণার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘এত আকুল হচ্ছ কেন মাইয়া? তুমি একেবারে জলে পড় নাই। এই শৈলমাসির হাতে পড়ছ। আমার দিকে চাইয়া দেখ—এই সাহেবপাড়ায় শৈলমাসির মতো এত দরদি মাসি দুইচারটা খুঁজে পাবে না। ধৈর্য ধরে দুইচারদিন থাক, কামে লেগে যাও, আস্তে আস্তে সব ভাল লাগবে।’

কৃষ্ণা শৈলমাসির কথা শুনে বুঝে গেল—সে জটিল ফাঁদে আটকে গেছে। শৈলমাসি নামের এই মহিলাটির মুখে মধু হাতে ছুরি। সে ঝুপ করে বিছানা থেকে নেমে এল। শৈলবালার দু’পা জড়িয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল, ‘আমারে বাঁচান মাসি। আমার চরিত্র নষ্ট করাইয়েন না?’

‘চরিত্র? কীসের চরিত্র? বেশ্যাপাড়ার মাগির আবার চরিত্র কী? তুমি তো মাইয়া ফুলের মতো পবিত্র না। হোটেলে পরপুরুষের সঙ্গে রাত কাটাইছ। দেহ দিছ। তার সঙ্গে লটরপটর করছ। এই মাগিপাড়ায় এসে চরিত্র বাঁচাইতে চাও?’

কৃষ্ণার কান্না আর শৈলমাসির উচ্চকণ্ঠ শুনে এই বাড়ির মেয়েরা দরজা- জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি দেওয়া শুরু করল। আয়েশা গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী অইয়ে মাসি? নয়া মাল বুঝি? কাঁদাকাটি কা গরের?’

‘তুই যা মাগি? নিজের ভদার গন্ধ পরিষ্কার কর। রাইতে বেটারা গন্ধ কইরা থুইয়া গেছে তোর শরীল, সেইটা সাফসুতরা কর। এইখানে নাক গলাইস না।’ ধমকে উঠল শৈলমাসি।

আয়েশা ভয় পেয়ে দরজা থেকে সরে গেল। জানালা থেকেও মুখগুলো আড়ালে গেল।

কৃষ্ণার হাত থেকে এক ঝটকায় পা দুটো সরিয়ে নিল শৈলবালা। বলল, ‘ভালয় ভালয় হাত মুখ ধুইয়া নাস্তা কইরা নাও। চঞ্চলা আইস্যা নাস্তা দিয়া যাইব। কালু যদি জানতে পারে তুমি তেরি মেরি করছ—তবে বিপদ হবে।’ শৈলবালা দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। দরজায় তালা আটকাল। তারপর দোতলায় উঠতে লাগল। উঠতে উঠতে গুনগুন করে গাইতে লাগল–

এখন কি আর নাগর তোমার
আমার প্রতি, তেমন আছে।
নতুন পেয়ে পুরাতনে
তোমার সে যতন গিয়েছে।
তখনকার ভাব থাকত যদি,
তোমায় পেতেম নিরবধি
এখন, ওহে গুণনিধি,
আমার বিধি বাম হয়েছে।

কিছুক্ষণ পরে ঝি চঞ্চলা ছুটে এল ওপরে, শৈলমাসির ঘরে। বলল, ‘মাসি নয়া মাইয়াডা চিৎকার কইরা কাঁদতাছে আর দরজায় মাথা ঠুকতাছে। নাস্তা নিয়া গেছিলাম, সাহস করে ঘরে ঢুকি নাই। এখন কী করব?’

‘কাঁইদলে কাঁদুক। শরীরের তেজ কমে আসলে এক সময় ঠাণ্ডা মাইরা যাইব। খিদার নাম বাবাজি। একবার চাইপা ধরলে বাপ বাপ করব। ঢুকস নাই ভালা করছস। এখন যা। নজর রাখিস নয়া মাগির উপর।’ বলল শৈল। ‘কী অইছে মা? সকালে কাকে বকতাছ? কে কাঁদতাছে?’ সদ্য ঘুমভাঙা চোখ ডলতে ডলতে মায়ের ঘরে ঢুকল কালু!

‘কিছু না বাছা, কিছু না। নয়া মাইয়ারা অই রকম একটু চিৎকার চেঁচামেচি করে। সব ঠিক অইয়া যাইব।’ ছেলেকে উদ্দেশ্য করে শৈলবালা বলে।

‘মা শুন, এই ব্যাপারে তুমি আর মাথা ঘামাইও না। আমি নিচে যাইতাছি। ব্যবস্থা নিতাছি।’ মাকে আশ্বস্ত করে কালু।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কালু শুনল, ‘ওমারে…বাবারে…। আমারে এইখান থাইক্যা লইয়া যাওরে বাবা। আমারে এই ফান্দা থাইক্যা উদ্ধার কইরা লইয়া যাওরে মা। ও—শামছু চাচারে, ও—মা-ভইনরে–।

দ্রুত নিচতলায় নেমে গেল কালু। শুনল—কৃষ্ণা ঘরের ভেতর থেকে দরজায় জোরে জোরে থাপ্পড় মারছে আর বিলাপ করছে। কালু সর্দারের চোখের কোনা লাল হয়ে উঠল, তবে তা অল্প সময়ের জন্যে। নিজেকে সে সংবরণ করল। দারোয়ান নজমুলকে ডেকে নিচুস্বরে কী যেন একটা আদেশ দিল কালু। তারপর বেরিয়ে গেল। সকাল থেকেই সর্দারের ধান্ধার সময় শুরু হয়ে যায়।

কিছুক্ষণ পর দেখা গেল কৃষ্ণার ঘরের জানালার ধারে একটি টু-ইন- ওয়ান বাজছে, সর্বোচ্চ ভল্যুমে—’বোল রাধা বোল সঙ্গম হোগা কি নেহি – 1’

শৈলমাসি দুপুরের দিকে আবার দোতলা থেকে নিচে নামল। কৃষ্ণার কান্নার রোল তখনো থামেনি। কিছুক্ষণ পরপর সে বিলাপ করছে। বিলাপের মর্মার্থ—আমাকে বাঁচান, এরা আমাকে আটকে রেখেছে। এই পাষণ্ডদের হাত থেকে কোনো দরদি মানুষ আমাকে উদ্ধার করেন।

শৈলবালা চম্পাকে খুব পছন্দ করে। চম্পা এই বাড়ির নিচতলার বারো নম্বর ঘরে থাকে। বছর দশেক আগে এই পতিতাপল্লিতে এসেছিল। সৈয়দপুর থেকে এসেছিল চম্পা। বাপ বিহারি। পাকিস্তান আমলে চম্পার বাবা বিহার থেকে পূর্বপাকিস্তানে চলে এসেছিল। ছয় বোনের একজন এই চম্পা। অভাবে ধুঁকতে ধুঁকতে জীবন চলছিল তার। শরীরে চেকনাই এলে একজনের নজরে পড়েছিল। সে নুর আলী। তারই হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল চম্পা। তারপর এই পতিতাপল্লি—সাহেবপাড়া। চম্পা তার আসল নাম নয়। আসল নামটি মনের এক কোনায় লুকিয়ে রেখে চম্পা নামটি নিয়েছে সে। শরীরবেচা টাকা চম্পা সৈয়দপুরে পাঠায়, বাবার কাছে। মা গত হয়েছে অনেক দিন আগে। সেই টাকায় বাবা অন্য বোনদের ভাত খাওয়ায়, কাপড় পরায়, বিয়ে দেয়। চম্পার বুদ্ধি বেশ প্রখর। তার আচার-আচরণ, পোশাক- পরিচ্ছদ, শারীরিক গঠন—এইসব কিছুর জন্যে চম্পাকে আলাদাভাবে চেনা যায়।

শৈলমাসি এই চম্পার শরণাপন্ন হল। নিচের তলায় অফিস ঘরের মতো ছোট্ট একটা কামরা আছে। সেখানে কালু সর্দার ষণ্ডাদের নিয়ে বসে, পাড়ার ছোটোখাটো বিচার-আচার করে। এই ঘরে বিশেষ প্রয়োজনে মাঝেমধ্যে শৈলমাসিও গিয়ে বসে। আজও বসেছে। সেই ঘরেই ডেকে পাঠাল চম্পাকে।

চম্পাকে শৈলবালা বলল, ‘চম্পারে, নয়া মাইয়াটারে নিয়া বড় বিপদে পড়লাম যে। কোনোভাবেই বাগ মানতে চাইছে না। শুধু কান্নাকাটি করতাছে। কী করি বল তো?’

‘সর্দার স্যারকে বোলেন। উনিই সবকিছু সাইজ কোরে দেবেন।’ চম্পা বলল।

তুমি বল কী মাইয়া? সর্দার আমার পোলা। তারে আমি চিনি। একটু বেচাল করলে মাইয়াটারে মারধর করবে। নির্যাতন করবে। হয়তো কোনো গুণ্ডা ছাণ্ডা ঘরে ঢুকাইয়া দিয়া সাইজ করবে।’ কৃষ্ণার জন্যে দরদ উতলে পড়ছে শৈলবালার কণ্ঠ থেকে।

‘সেইটা তো ঠিক বোলছেন। এখোন কী কোরতে বোলেন?’ চম্পা জানতে চাইল।

জোরে শ্বাস টেনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল শৈলমাসি। তারপর অত্যন্ত কোমল কণ্ঠে বলল, ‘আমি বলি কি, তুমি একটু তাকে মানে কৃষ্ণাকে বুঝাও।’

‘আমি! আমি বোঝাবো! কী বোলেন?’

‘হ, তুমি বুঝাবে। আমি তোমারে পছন্দ করি। এই সর্দারবাড়ির অন্য মাইয়ারেও দায়িত্ব দিতে পারতাম আমি। কিন্তু আমি যে তোমারে ভালোবাসি। তুমি যদি কৃষ্ণারে বুঝানোর দায়িত্ব না নাও, তাহলে সর্দার তার ওপর অত্যাচার করবে, বেড়া লাগিয়ে তারে রক্তারক্তি করাবে। ও তো তোমার মতো একজন মাইয়া। তার কষ্ট কি তোমার কষ্ট না?’ শৈলর মিষ্টি অথচ ভয় জাগানিয়া কথাগুলো চম্পার কলিজায় দেগে বসে যেতে লাগল। এটা শৈলমাসির প্রস্তাব নয়, আদেশ। এই আদেশ না মানলে কৃষ্ণার নির্যাতন চম্পা পর্যন্ত বিস্তৃত হবে-এটা ভালো করেই জানে চম্পা।

চম্পা বলল, ‘ঠিক আছে মাসি। আমি দেখি কী কোরা যায়?’

‘দেখি নয়, দেখি নয়। তুমি কৃষ্ণাকে শান্ত করাবে। ওরে কামে লাইগা যাওয়ার জন্য রাজি করাবে। এ আমার আদেশ বা অনুরোধ যা-ই বল। ঠিক আছে?’ শৈলবালার কণ্ঠ উষ্ণ।

জবাব দেওয়ার আগেই কৃষ্ণার দরজার চাবিটি চম্পার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে দ্রুত দোতলায় উঠতে শুরু করল শৈলবালা।

.

একটা সময়ে কৃষ্ণার আহাজারি কমে এল। তার দরজা থাপড়ানো থামল, মাথাকুটা থামল, বিলাপও থামল। চম্পা গা-গতর ধুয়ে, চোখে সুরমা-কাজল পরে, দুই বেণি করে চুল বেঁধে, ভালো একটা সুতির শাড়ি পরে কৃষ্ণার দরজায় উপস্থিত হল। তালা খুলল। ভেতরে ঢুকে চম্পা দেখল—কৃষ্ণা নেতিয়ে পড়েছে। বিছানায় কুকুরকুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। কাছে গিয়ে বুঝল—কৃষ্ণা জেগে আছে, চোখ অর্ধখোলা।

কৃষ্ণার গা ঘেঁষে চৌকিতেই বসল চম্পা। আলতো করে ডান হাতটা তুলে দিল কৃষ্ণার ওপর। কৃষ্ণার চোখ ঔৎসুক্যহীন, নিস্পৃহ। ক্লান্ত বিষণ্ণ অবয়ব। ক্ষুধায় জরজর। এক বোঝা চুল গোটা বালিশ এবং বিছানার বেশ কিছু অংশ আবৃত করে রেখেছে। স্থির চোখে তাকিয়ে আছে সে চম্পার দিকে।

‘এই ভুল কেনো কোরেছ তুমি। পরপুরুষের হাত ধরে পালিয়েছ? পালানোর আগে তাকে যাচাই কোরবে না? পুরুষরা হারামজাদা, শরীরখোর। ভুলাইয়া ভালাইয়া শুধু শরীর ঘাটে, শরীরে ডুব দেয়। আমরা, মাইয়ারা ও কম লোভী না। বিয়ার লোভ দেখালে, টাকার চটকদারি দেখালে আমরা আন্ধা হোইয়ে যাই। মা-বাপ ছেড়ে, ভাই-বেরাদরকে ভুলে ওই হারামজাদাদের হাত ধরে বেরিয়ে পড়ি। আমার মতো তুমিও সেই ভুল কোরেছ। লোভী হয়েছিলে তুমি কৃষ্ণা।’ ধীরে ধীরে কথাগুলো কখনো রাগি, কখনো করুণ কণ্ঠে বলে গেল চম্পা।

কৃষ্ণা বিছানা ছেড়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসল। সে ভাবল–এ কে? কোন উছিলায় এ আবার ঘরে এসেছে?

চম্পা আবার বলতে শুরু করল, ‘তুমি আমাকে ধান্ধাবাজ মনে কোরো না। আমি শৈলমাসির দালাল নোই। তোমার মোঙ্গল চাই বলে তোমার কাছে এসেছি। শুন কৃষ্ণা, তুমি খারাপ জায়গায় এসে পড়েছ। এইখানে ঢুকা যায়, বাহির হওয়া মুশকিল। এই পাড়ার নাম সাহেবপাড়া। এইটা গোশত বেচা কেনার পাড়া। এইখানে পুরুষরা গোশত কিনে, যুবতী মাইয়াদের গোশত।’

‘মাইনে?’ আকুল হয়ে জানতে চাইল কৃষ্ণা।

‘এখোন থেকে তুমি এই বাড়ির কসবি। কালু সর্দারের কেনা কসবি। শৈলমাসি এই বাড়ির মালিকান ছিল এক সোময়। এখন হর্তাকর্তা কালু সর্দার। বড় নিষ্ঠুর আদমি। ও-ই তোমাকে কিনে লিয়েছে। তুমি তার কেনা মাগি। তুমি সকাল-সন্ধ্যা কাস্টমারকে শরীর দেবে—ওই সর্দার, ওই মাসি তোমার শরীর বেচা টাকা লিবে।’ চোখ বন্ধ করে কথাগুলো বলল চম্পা।

কৃষ্ণা ঝুপ করে চম্পার পা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। ‘তুমি আমারে বাঁচাও দিদি। তুমি আমার দিদি। আমার জন্ম জন্মান্তরের দিদি। ছোট বোনকে বাঁচাও দিদি।’

পরম মমতায় কৃষ্ণার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে চম্পা বলল, ‘শুন কৃষ্ণা, এই জায়গা রুনাকে লিয়ে নেহি, জিনাকে লিয়ে। এইখান থেকে মুক্তির কোনো পথ নাই। থানা-পুলিশ-সর্দার কেউ তোমাকে এইখান থেকে মুক্তি দেবে না। তুমি শান্ত হও। গোসল কর। নাস্তা-পানি খাও।’

অসহায় চোখে কৃষ্ণা তাকিয়ে থাকল চম্পার দিকে। তার চোখে ত্ৰাস আর বিষণ্ণতা একাকার।

‘ভয় পাইও না। আজকেই এরা তোমাকে কামে লাগাবে না। স্বাভাবিক হবার জন্য দু’চার দিন সোময় দেবে।’ চম্পা কৃষ্ণাকে উদ্দেশ্য করে বলল।

কিছুক্ষণ পর চঞ্চলা ঝিকে ডেকে আনল চম্পা। কৃষ্ণাকে গোসলখানা দেখিয়ে দিতে বলল। ভালো করে নাস্তা-পানি খাওয়াতে বলল।

যাওয়ার আগে বলল, ‘তুমি আমাকে দিদি বোলেছ। আমি তোমার দিদিই হলাম। খাও দাও আর অতীতকে ভুলে যাও।’

সাত

সাহেবপাড়ার পতিতারা আধিয়া, ছুকরিকাটা, নথখোলা, কিস্তি ইত্যাদি প্রথায় তাদের দেহব্যবসা চালায়।

পতিতা মেয়েরা দেহ বেচে যে অর্থ আয় করে, তার অর্ধেক যখন মাসির হাতে তুলে দেয়, তখন তা আধিয়া প্রথা। সাহেবপাড়ায় এই প্রথাটি বহুলভাবে প্রচলিত। দু’ভাবে এই আধিয়া প্রথা চালু আছে। কোনো কোনো মেয়ে মাসির ঘরে থাকে, সেজন্যে মাসিক ঘরভাড়া দেয়। আবার প্রতিরাতের উপার্জনের অর্ধেক মাসিকে দিয়ে দিতে হয়। আবার কিছু মেয়ে মাসির খালি ঘর ভাড়া নেয়, কিন্তু ঘরে থাকে না। সন্ধেয় এসে কয়েক ঘণ্টা থাকে। কাস্টমারকে আপ্যায়ন করে উপার্জনের অর্ধেক মাসিকে দিয়ে নিজ ঘরে ফিরে যায়। এই লাইনে অভিজ্ঞ পতিতারা এই প্রথায় দেহব্যবসা চালায়।

কিন্তু নবাগতাদের জন্যে অন্য নিয়ম—সে ছুকরিকাটা। দালালদের কাছ থেকে মাসি বা সর্দাররা নতুন মেয়েদের কিনে নেয়। কেনামূল্যের সঙ্গে সুদের পরিমাণ যোগ করে একটা মূল্য নির্ধারণ করে মেয়েটির। এই পরিমাণ টাকা কাস্টমারদের কাছ থেকে তুলতে দেড় থেকে আড়াই বছর লেগে যায়। এই সময় মেয়েটি শরীর বেচে যা আয় করে, তার সম্পূর্ণ দাবিদার ওই মাসি বা সর্দার। উপার্জনের এই দাবিদারিত্বকে ছুকরিকাটা বলে। ছুকরিকাটা মেয়েটির থাকা-খাওয়া-চিকিৎসা—সবকিছুর দায়িত্ব নেয় মাসি। এই ধরনের মেয়েগুলো সব টাকা মাসির হাতে তুলে দিতে বাধ্য। শুধু বকশিসের টাকাগুলো তারা হাতে রাখতে পারে, তাও লুকিয়ে চুকিয়ে।

চম্পা কৃষ্ণাকে বোঝানোর একদিন পর খাবার টেবিলে শৈলমাসি কালুকে বলল, ‘দেখ বাছা, নতুন মেয়েটিকে নিয়া তুই অত মাথা ঘামাইস না। তাকে সাইজ করার দায়িত্বটা আমাকে দে। মেয়েটি দেখতে খুব সুন্দর। অনেক আয় করে দেবে সে আমাদের। ধীরে সুস্থে আমি তাকে রাজি করাব।’

‘তুমি যা ভালো বুঝ কর মা। তবে দেখ পালিয়ে যেন না যায়। গ্রাস মুখে তুলে দিতে দিতে বলে কালু সর্দার।

‘সে ব্যাপারে তুই ভাবিস না। চম্পারে আমি পাহারাদার নিযুক্ত করছি, মিডা কথা বলে সে তার মন ভিজাইছে। তার মাধ্যমেই আমি নতুন মাইয়াটারে লাইনে আনব।’ বলল শৈলমাসি। অ হ্যাঁ, মাইয়াটার তো একটা নতুন নাম দেয়া লাগব। দেবযানী নাম দিলে কেমন হয়?’

‘ভালো নাম। সুন্দর নাম। তা-ই দাও।’ চেয়ার থেকে উঠে যেতে যেতে সর্দার বলে।

এইভাবে প্রায় সাতদিন কেটে যায়। অবসর সময়ে চম্পা কৃষ্ণার ঘরে গিয়ে বসে। চুল আঁচড়িয়ে বেণি বেঁধে দেয়। চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক, মুখে স্নো মাখায়। খোলা পিঠে, গলার নিচে পাউডারের পাবটি হালকাভাবে বুলিয়ে দেয়। কখনো কখনো একসঙ্গে ভাত খায়। কৃষ্ণার মধ্যে আগের মতো ভীতিভাব নেই। প্রথম প্রথম শরীর বেচার যে কথাবার্তাগুলো শুনেছিল, তা তার ওপর বর্তালো না দেখে সে আশ্বস্ত হয়।

.

‘অই হালার পোয়া জামাইল্যা, আঁর ঘরত্ নয়া মাল আইস্যে। তুই দালালর বাইচ্চারে কইলাম দে, উগ্‌গা মালদার আদমি খুঁজি বাইর গর। নয়া মালর নথ খুলিবো।’ জামাল দালালের সঙ্গে কালু সর্দার চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলে।

‘জি সর্দার, আঁই খুঁজির তো।’ কাঁচুমাচু হয়ে জামাল বলে।

‘তোর খোঁজনর মারে চোদি। আজিয়া সাতদিন মাল বেকার ঘরত্ পড়ি রইয়ে। এই সাত দিনে আর কত টিয়া লস অইয়ে হিসাব গর মাগির পোয়া।’

‘একজনর খবর পা-ই। লবণ কোম্পানি। মাঝির ঘাটত্ দুইয়ান লবণ কারখানা আছে। মালদার। টিয়াও খরচ গরিবো। তই

‘তই কী?’ ধমকে ওঠে সর্দার।

‘দেইখতে বঅর বিশ্রী। পেট মোটা। কুচকুইচ্যা কালা। বাম চোখ নষ্ট। মুখত্ বসন্তর দাগ। নয়া মাইয়া। এই রইম্যা অসুররে পইল্যা বইস্ত দিলে গম অইবো না?’ জামালের কণ্ঠ বিনীত।

কটকট করে হেসে উঠল কালু সর্দার। বলল, ‘এ-ন গরি কওদ্দে যেএন তোর মাইয়ার ঘরত্ পইল্যা বেডা গল্লাওর। আঁত্তোন টিয়ার দরকার। বউত্ টিয়া। টিয়া সুন্দর অইলে হইল, বেডা সুন্দরর দরকার নাই। তুই লবণ কোম্পানির লগে কথা ক। রাজি গরাই আঁরে জানা।’

জামাল দ্রুত বলে ওঠে, ‘রাজি মাইনে, এক পায়ে খাড়া। আজিয়া বিকালেও আঁরে ডাকি পুচ গইয্যে পাড়াত্ নতুন মাল আইস্যে কিনা?’

‘নতুন মাল মাইনে, চকচইক্যা নতুন মাল। একেবারে আনকোরা, গাআত্‌ উগ্‌গা টুকা পর্যন্ত নো পড়ে।’ শামছুর কাছ থেকে শোনা তপন- কৃষ্ণার কাহিনী সম্পূর্ণ চেপে যায় সর্দার। ‘তুই কালিয়াই লই আই লবণ কোম্পানিরে। রাইত আটটার মিকে গরি লই আইচ। এখন যা।’

কিন্তু জামাল নড়ে না। আমতা আমতা করে বলে, ‘সর্দার, লবণ কোম্পানির কাছে যা চাইবা তা পাইবা। আর ভাগর টিয়া যেএন ঠিকঠাক পাই। দুই হাজার টিয়া লই দিয়ম আঁই কোম্পানিত্তোন।’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। হালার পোয়া টিয়া ছাড়া আর কিছু নো চিনস। টিয়া পাবি, লগে উগ্‌গা হুইস্কির বোতলও পাবি। এখন যা। কালিয়া ঠিক আটটা বাজে। মনত রাখিস।’ হাসতে হাসতে জামালের উদ্দেশ্যে বলে সর্দার।

.

আটটায় এল না লবণ কোম্পানি। বলল, ‘বউ মাইন্‌ষে আঁরে চিনে। সন্ধ্যাকালে মাগিপাড়া গেলে অনেকে দেখি ফেইলবো। শরমে মাথা কাড়া যাইব আঁর। ইক্কিনি রাইত করি যামু।’

দশটায় এল লবণ কোম্পানি। পরনে রোহিতপুরি লুঙ্গি—সিকস্টি ফাইভ থার্টি ফাইভ। ফিনফিনে পাঞ্জাবি গায়ে। ভুরভুর করে বিদেশি সেন্টের গন্ধ বেরোচ্ছে গা থেকে। জামাল দালাল পথ দেখিয়ে কোম্পানিকে কালু সর্দারের বাড়িতে ঢোকাল।

সেদিন সন্ধেয় বিশেষ যত্ন করে সাজগোজ করানো হল কৃষ্ণাকে। মুখে রুজ পাউডার, চোখে মায়াবি কাজল, নখে নেইল পলিশ, ঠোঁটে লিপস্টিক, কপালে বড় একটা আগুনে টিপ। দামি একটা সুতি শাড়ি পরানো হল। এ সবকিছু করানো হল চম্পাকে দিয়ে।

এক ফাঁকে কৃষ্ণা জিজ্ঞেস করল, ‘আজকে এত সাজগোজ করাইতাছ ক্যান দিদি।’

‘বোন আমার তুমি। আজকে আমার মন ভালো, তোমাকে সাজাতে ভালো লাগছে। তা-ই সাজাচ্ছি। তোমার কোনো আপত্তি আছে?’ কৃত্রিম রাগ চম্পার চোখেমুখে

‘না না। এমনি জিজ্ঞেস করতাছি আর কি।’ থৈ থৈ বিশ্বাস কৃষ্ণার কণ্ঠে।

.

‘চম্পারে, তোর নাগর আইছে। তোরে খোঁজে। তুই ছাড়া অন্য কারও ঘরে যাইতো না বলে।’ বাহির থেকে সোহেলির কণ্ঠ ভেসে আসে।

শাড়ির আঁচলটা কৃষ্ণার পিঠের দিকের ব্লাউজে সেফটি পিন দিয়ে আটকাতে আটকাতে বলে, ‘আমার কাজ শেষ। কী সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে আজকে! যাই, আমার বাঁধা নাগর এসেছে। আন্দরকিল্লার রাজনবাবু। আমারে ছাড়া অন্য কাউকে তার ভালো লাগে না।’ ডান চোখটা টিপে সে কৃষ্ণার ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

কৃষ্ণার দরজায় এখন বাহির থেকে তালা লাগানো হয় না। ভেতর থেকেই হুড়কো তোলে কৃষ্ণা। চম্পা চলে গেলে দরজার পাল্লা দুটো ভেজিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় কৃষ্ণা। ঘরে টিউবলাইটটি উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে। আয়নার কৃষ্ণাকে অচেনা লাগছে বাস্তবের কৃষ্ণার। সত্যিই কি সে এ-ত সুন্দরী! নিজের চেহারায় নিজের চোখ আটকে যাচ্ছে। হঠাৎ তার তপনের কথা মনে পড়ে যায়। হায়রে তপন, তুমি কী বেইমানিটাই না করলে! প্রেমের অভিনয় করলে! আমাকে ঘরছাড়া করলে তুমি! মধু লুটে নিলে। আমাকে পাঁকে ছুড়ে দিয়ে তুমি তুলসীপাতা হলে!

হঠাৎ করে কৃষ্ণার গলা বেয়ে এক দলা থুতু উঠে এল। যেন তপনের মুখেই থুতু দিচ্ছে এমনি করে সেই থুতু মেঝেতে ফেলল। এই সময় দরজায় খুট করে আওয়াজ হল। আওয়াজ শুনে কৃষ্ণা দ্রুত পেছনে ফিরল। দেখল—কালো মোটা ধরনের কে যেন দরজায় ভেতর থেকে হুড়কো তুলছে।

‘কে কে আপনি?’ আর্তচিৎকার করে উঠল কৃষ্ণা।

কোনো জবাব দিল না লবণ কোম্পানি। শুধু এক কদম দু’কদম করে সামনের দিকে এগিয়ে এল। অসুর শ্রেণির এক চোখা ভীমাকৃতির মানুষটিকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে কৃষ্ণা প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেল। তার মুখ দিয়ে কোনো রা বেরোল না। শুধু ত্রাসে সে পিছু হঠতে লাগল।

লবণ কোম্পানি কৃষ্ণাকে দু’বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরতে গেলে চিৎকার করে কেঁদে উঠল কৃষ্ণা, ‘দিদিরে, চম্পা দিদিরে…।’

এইসময় জানালার ধারে উচ্চ ভল্যুমে টু-ইন-ওয়ান বেজে উঠল।

.

জলের মাছকে ডাঙায় তুললে সেই মাছ বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টায় কিছুক্ষণ তড়পাতে থাকে, তারপর একটা সময়ে নিস্তেজ হয়ে যায়। কৃষ্ণাও কিছুক্ষণ তড়পাল। সর্বশক্তি দিয়ে লবণ কোম্পানিকে ধাক্কা দিল। এ ধাক্কা যেন মৈনাক পর্বতে ছাগলের চুল।

তারপর ডাঙার মাছের মতন, বাঘে ধরা হরিণের মতন কৃষ্ণা নিস্তেজ হয়ে পড়ল। লবণ কোম্পানি তার সৃজন-শিকড় দিয়ে কৃষ্ণার গভীরে জল খুঁজে বেড়াতে লাগল। টু-ইন-ওয়ানে বাজতে লাগল—বোল রাধা বোল সঙ্গম হোগা কি নেহি?

সেরাতে কৃষ্ণা দাস দেবযানীতে রূপান্তরিত হয়ে গেল।

পূর্বগলির দু’ধারে পান-সিগারেট-ফুলওয়ালার সারি সারি দোকান। পান- সিগারেটের দোকানে দেশি সিগারেট ছাড়াও বিদেশি নিষিদ্ধ সিগারেটও বিক্রি হয়। পান বিক্রি হয় দু’রকমের, দেশি পান—জর্দা আর কাঁচা সুপারি সহযোগে, অন্যটি মিঠা পান—মিষ্টি জর্দা আর চিকন সুপারি দিয়ে। এসব দোকানে মিঠা পান আসে লাভলেইন থেকে। লাভলেইনের আবুল কাশেম এই পাড়ায় পান সাপ্লাই দিয়ে লাল হয়ে গেছে। সস্তা দামের মেয়েরা ফুলের মালা খোঁপায় বেঁধে মিষ্টিপান মুখে দিয়ে গেয়ে ওঠে—

যদি সোন্দর একখান মুখ পাইতাম
মহিশখাইল্যা পানর খিলি
আমি তারে বানাই খাওয়াইতাম।

রহমানের পানের দোকানের সামনে সন্ধে থেকে ভিড় জমে ওঠে। বেশ্যা, দালাল, মাস্তান, ঝাড়ুদার, বাঁধাবাবু—সবাই ভিড় করে রহমানের পানের দোকানের সামনে। সস্তা পতিতারা আগত কাস্টমারদের হাত ধরে, জামা ধরে টানাটানি করে। চটুল বেশ্যাদের মুখে খই ফুটে—আসেন না বাবু, যা চাইবেন তা-ই দেবো, যেভাবে চাইবেন সেভাবেই হবে। বেশি টাকা দিতে হবে না আমাকে। তাদের আকুতি-আহ্বানে অনেকে রাজি হয়ে যায়। কেউ কেউ ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। তখন তাদের পিছু নেয় মাগির দালালরা। বাবুটি হেঁটে যায়—কখনো মাথা নিচু করে, কখনো এধার ওধার দেখতে দেখতে। দালালটি পিছু পিছু হাঁটে। দালাল বলে, ‘যাবেন নাকি স্যার?’ নবাগতরা বুঝতে পারে না। হেঁটে যায়। পেছন থেকে দালাল আবার বলে, ‘কাশ্মীর কি কলি স্যার। মধুতে ভরা। নতুন মাল। একদম টাটকা স্যার।’ কাস্টমার একটু থমকে দাঁড়ায়, আবার হাঁটে। দালাল এবার শেষ চেষ্টা চালায়, ‘ছবি আছে স্যার। বিহার থেকে নতুন এসেছে, দুদিন হল কাজে নেমেছে।’ এবার কাস্টমার ঘুরে দাঁড়ায়। দরাদরি হয়। দালাল নিয়ে চলে কাশ্মীর কি কলির কাছে।

দরজায় দরজায় দাঁড়ানো মেয়েদের কাস্টমারই বেশি। তারা খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। রেলস্টেশনের ফলওয়ালা, গাড়ির ড্রাইভার, হোটেলের ওয়েটার, ঠেলাওয়ালা, গরুর গাড়ির চালক, জুতা পালিশওয়ালা—এইসব। দূরগ্রামে স্ত্রীকে রেখে চট্টগ্রাম শহরে টাকা আয়ের আশায় এসেছে। পরিবারে বড়ই দারিদ্র্য। স্ত্রী-বিচ্ছিন্ন এই মানুষদের শরীরেও একটা সময়ে কাম জাগে। বন্ধুদের প্ররোচনায় বা কামের তাড়নায় তারা এই পাড়ায় আসে। যার তার হাতে তারা কষ্টে অর্জিত টাকা তুলে দিতে নারাজ। পাড়ায় ঘুরতে ঘুরতে পছন্দমতো একটা মেয়ের সামনে দাঁড়ায়। দাম জিজ্ঞেস করে।

মেয়ে বলে, ‘একশ টাকা লাগবো।’

কাস্টমার আমতা আমতা করে ত্রিশ টাকা বলে। মেয়েটি ঝামটা দিয়ে ওঠে, ‘লইট্যা মাছ নাকি? দরাদরি করতাছ। দেখতাছ যেমন টাইট, ভিতরেও টাইট। আশি টাকা দিলে আসো।’

কাস্টমার চুপসে যায়। তার পকেটে যে অত টাকা নেই। মাত্র পঞ্চাশ টাকা নিয়ে পাড়ায় ঢুকেছে সে। ওই টাকায় ভাতও যে খেতে হবে। কিছু না বলে সে সামনের দিকে এগোতে থাকে।

মেয়েটির খুব রাগ হয়। রাগি কণ্ঠে গর্জে ওঠে, ‘অই মাগির পোলা, না বসলে দর করলা ক্যান? যা যা। হাড্ডি শরীর, চিমসে বুনিওয়ালির কাছে যা। ত্রিশ টাকায় সে রাজি অইবো।’

এইভাবে শুরু হয় এই পাড়ার নিশিজীবন। ধর্ম-সমাজ-বয়স-শিক্ষা- কাম কোনো কিছুর বাধাই মানে না। এখানে আসে হিন্দু, আসে মুসলমান, আসে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান। কত বিচিত্র পেশার মানুষ যে এই পতিতাপল্লিতে আসে তার কোনো ইয়ত্তা নেই! এখানে আসে গণ্যমান্য সমাজনেতা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, সাহিত্যিক, সমাজসেবী, সাংবাদিক। এখানে তরুণ যুবকদের পাশাপাশি প্রৌঢ় আর বৃদ্ধদেরকেও নিপুণভাবে দরাদরি করতে লক্ষ করা যায়। প্রতিবন্ধীরাও আসে উদ্বেলিত যৌনাকাঙ্ক্ষাকে চরিতার্থ করতে। ছাত্র-শিক্ষক-ব্যারিস্টারের পাশাপাশি এ পাড়ায় আসে চোর-ডাকাত-খুনি- সমাজবিরোধীরা। কাস্টমার হয়ে আসে পুলিশ-গোয়েন্দারা। এদের প্রায় সবাই শরীরের লোভে এখানে আসে। তবে মাঝেমধ্যে এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। কেউ আসে শুধু বসে থাকতে। এরা চুক্তিকরা মেয়েটির পাশে শুধু চুপটি মেরে বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর মেয়েটির হিসেব মিটিয়ে দিয়ে চলে যায়।

তেমনি একজন রাজন ভৌমিক। ছড়া লেখে। থাকে আন্দরকিল্লায়। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। পোস্টঅফিসে চাকরি করে, খাম-টিকেট বিক্রির চাকরি। দশটা পাঁচটা অফিস। সকালে আসার সময় বিধবা মা টিফিন ক্যারিয়ারে ভাততরকারি গুছিয়ে দেয়। একটা থেকে দেড়টা বিরতি। ওইসময় কাউন্টারের ছিদ্রপথ মোটা একটা খাতা দিয়ে বন্ধ করে দেয় রাজন। একটু সরে গিয়ে পেছনের টেবিলে টিফিন ক্যারিয়ার খুলে বসে।

বিকেলের দিকে টিকেট-খাম কিনিয়ের সংখ্যা কমে আসে। অন্য কাউন্টারে ভিড় হলেও রাজন ভৌমিকের কাউন্টারে কোনো ক্রেতা থাকে না তখন। ঝোলা থেকে রাজন লেখার খাতাটি বের করে। ছড়া লিখতে শুরু করে–কখনো একটা, কখনো একটার পর একটা। পাঁচটা পর্যন্ত চাকরি হলেও হিসেব মিলাতে মিলাতে সাতটা বেজে যায়। বড়বাবু অফিস বন্ধ করে বের হলেই রাজন ভৌমিকের ছুটি মিলে। রাস্তার ওপারে হোটেল জামানে ডিম পরোটা খেয়ে, একটা মিষ্টিপান মুখে দিয়ে রাজন রওনা দেয়, সাহেবপাড়ার উদ্দেশে। মাইল খানেক দূরেই সাহেবপাড়া। এই পথটুকু হেঁটে যেতেই পছন্দ করে রাজন। একটা সময়ে চম্পার ঘরের দরজায় উপস্থিত হয়। চম্পার ঘরে তখন অন্য কাস্টমার। লীলায় রত। অসীম ধৈর্য নিয়ে ভেতরঘরের বারান্দায় হাতলহীন চেয়ারে বসে থাকে রাজন। মুখে কোনো বিরক্তি বা ঘৃণা নেই। শুধু কিছুক্ষণ পরপর তার দুটো চোখের শান্ত দৃষ্টি চম্পার বদ্ধ দরজায় ধাক্কা খায়।

রাজন পাজামা-পাঞ্জাবি পরে। রোগাটে চেহারা, বেঁটে। গাল বসা, চোয়াড়ে টাইপ। কিন্তু তার চোখ দুটো খুব সুন্দর। মায়াবি দৃষ্টি। চম্পার ঘরে সপ্তাহে দুটো সন্ধেয় তো সে আসেই, কখনো কখনো বেশিও আসে। চম্পা বহুবার চেষ্টা করেছে লোকটার ওপর বিরক্ত হতে, রাগ দেখাতে। কিন্তু রাজন যখন সামনে এসে দাঁড়ায়, কী এক অজানা কারণে তার রাগ উবে যায়। এক ধরনের অনুকম্পায় চম্পা তখন বিচলিত হয়ে ওঠে। এই অনুকম্পার কোনো মানে সে খুঁজে পায় না। ভাবে—অনেকের সঙ্গে তো খারাপ ব্যবহার করি, এই লোকটির সঙ্গে না-ই বা করলাম।

ঘরে একটামাত্র চৌকি। বিছানার চাদর ময়লা এবং কুঁচকানো। দুটো বালিশ, একটা বড়, অন্যটি ছোট। একটা মাথার, অন্যটি কোমরের। দুটো বালিশই ময়লায় থিক থিক। কখন কাভার বদলানো হয়েছে, তার ঠিক নেই। চাদরের এখানে ওখানে ছোপ ছোপ দাগ, সাদা খড়িমাটির মতো; কোনোটা বৃত্তাকার, কোনোটা ত্রিভুজাকৃতি, কোনোটা আবার বৃত্ত ত্রিভুজে মেশামেশি।

চৌকিতে পা গুটিয়ে বসেছে চম্পা, পাশের হাতলহীন চেয়ারে রাজন। চম্পা জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, তুমি যে প্রায় সাঁঝবেলায় এখানে আসো,

তোমার খারাপ লাগে না?’

‘কেন খারাপ লাগবে?’ রাজন জানতে চায়।

‘এই খারাপ পাড়ায় নষ্ট মেয়ের কাছে আসতে ভদ্রলোকদের তো খারাপ লাগে। তোমারও তো লাগার কোথা। লাগে না?’ চম্পার কণ্ঠে কৌতুক।

‘প্রথম প্রথম খারাপ লাগতো। এখন লাগে না।’

‘কেনো লাগে না? লাগে না কেনো? আমরা খোলা টাট্টিখানার মতন। রক্ত পুঁজ দুর্গন্ধ দুর্নাম নিয়েই আমাদের বসবাস। শুধু শুধু এই দুর্গন্ধওয়ালা জায়গায় আস কেনো তুমি—জানতে চাইছি?’ চম্পার কণ্ঠে রাগ ও অনুকম্পার মাখামাখি।

রাজন বলে, ‘শুধু শুধু মানে? আমি তো শুধু শুধু আসি না এখানে?’

‘তবে কেনো আসো? পুরুষরা এখানে আসে গোশত কিনতে, যৌবনওয়ালা মেয়েদের শরীর কিনতে। তারা আমাদের নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে, যে জায়গাটা আদর করার নোয়—–সেখানে আদর করে, যা করানো এই মাগিপাড়ায়ও ঠিক নোয়—সেই কাম আমাদের দিয়ে করাইয়া ছাড়ে। আর তুমি ….’ চম্পা বলে।

রাজন অসহায়ভাবে জিজ্ঞেস করে, ‘আমি আবার কী করলাম?’

‘বলদা হিজড়া।’ চম্পা হঠাৎ রেগে যায়। বলে, ‘তুমি একটা ভোদাই। এইখানে আমার কাছে আসো সপ্তাহে অন্তত দুইবার। অন্য পুরুষরা দরজা বাঁধার সাথে সাথে শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ন্যাংটা করে শরীর দেখে, বুনি চাটে। আর এতোদিনের মাথায়ও তুমি কোনোদিন আমার গায়ে হাত দিলা না। একটু চুমা খাইলা না। কাপড় খুলতে বইল্যা না? তাইলে কেনো আসো, কী জন্যে আসো এই খানকি পাড়ায়?’

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে রাজন। উদাসভাবে পলস্তারা খসা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, ‘কেনো আসি সেটা জানি না, হয়তো জানি।’

‘এটা কোন ধরনের কথা বললে? জান, আবার জান না? চম্পা প্রশ্ন করে।

‘দেখ, তোমার কাছে আমি প্রথম এসেছিলাম শরীরের দাবি মিটবর জন্য। স্ত্রী মারা যাবার পর কয়েক মাস সুখে-দুঃখে কাটল। তারপর জাগতে লাগল। রাতের বেলায় বিচলিত হয়ে উঠতাম। একদিন ঠিক করলাম—-পাড়ায় আসব, ক্ষুধা মিটাব। আসলাম, তোমার ঘরেই উঠলাম প্রথম দিন। তোমার মনে আছে কিনা জানি না–গায়ের পাঞ্জাবিও খুলে ফেলেছিলাম সে সন্ধেয়। পাঞ্জাবি খুলে তোমার দিকে যখন ভালো করে তাকালাম, দেখলাম তার চেহারার সঙ্গে তোমার চেহারার অদ্ভুত মিল।’ ধীরে ধীরে বলে রাজন।

‘তার চেহারা মানে? কার চেহারা?’ চম্পা জানতে চায়।

রাজন আবার বলতে শুরু করে, আমার স্ত্রী মীরার। মীরার সঙ্গে তোমার চেহারার অদ্ভুত মিল। ওই সময় আমার মনে হল—আমি মস্ত বড় পাপ কাজ করতে যাচ্ছি। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম। তোমার পাওনা টাকা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম সেদিন।

‘আমার মনে আছে। পরেও তো অনেকবার এসেছ? আসো কেন? আমাকে নিয়ে খেলা করো না, ক্ষুধা মিটাও না। তাহলে কেনো বারবার টাকা নষ্ট করো?

‘তোমার কাছে এলে আমার ভালো লাগে। দীর্ঘ দু’বছর বউয়ের শরীর তো ঘাঁটলাম। তোমাকে দেখে দেখে মনের ক্ষুধা মিটাই। তোমার সামনে এলে দেহ আর জাগে না, শুধু মনটা সতেজ হয়ে ওঠে।’ বলে রাজন।

‘কী বলতাছ বুঝতাছি না।’ চম্পা বলে ওঠে।

‘তোমার বোঝার দরকার নাই। তুমি শুধু তোমার কাছে আমাকে আসতে মানা কর না।’

‘কী হয়েছিল তোমার বউয়ের?’ হঠাৎ হাত ধরে জিজ্ঞেস করে চম্পা। রাজনের বুক চিড়ে চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। বলে, ‘বিয়ের আগে তো কিছুই বুঝতে পারিনি। সতেজ সুন্দরী মীরা। দেখেই পছন্দ হয়ে গেল আমার। বিয়ের বছর দেড়েকের মাথায় ফ্যাকাসে হতে শুরু করল। শরীর ভাঙতে লাগল। ডাক্তার বলল – থ্যালাসেমিয়া। মৃত্যু অনিবার্য। ওষুধ দিলেন, রক্ত বদলালাম বারবার।’ থেমে গেল রাজন।

‘তারপর? তারপর কী হলো?’ চম্পার কণ্ঠে ঔৎসুক্য।

তারপর একরাতের শেষ প্রহরে মারা গেল মীরা। পাশেই বসে ছিলাম আমি। আমার চোখের সামনেই তার জীবনবায়ু বেরিয়ে গেল। বড় ভালোবেসেছিল মীরা আমাকে। মৃত্যুর সময় আমার হাতটা ধরে ছিল সে।’ টপটপ করে রাজনের চোখ থেকে জল পড়তে লাগল।

তারপর দু’জনে চুপচাপ। একটা সময়ে রাজন উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘যাই।’

চম্পা কিছুই বলল না। নিস্পৃহ নির্মোহ পতিতার ভেতরটাও যে সহানুভূতিতে আলুথালু করে ওঠে, তা চম্পার চোখমুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে।

আট

পশ্চিমের গলিটা এগোতে এগোতে ডান দিকে বাঁক নিয়েছে।

বাঁক থেকেই গলিটা সরু হতে শুরু করেছে। দু’জন মানুষ কোনো রকমে পাশাপাশি হাঁটতে পারে। বেশ কিছু দূর গিয়ে এ সংকীর্ণ গলিটা পুবপাড়ার প্রশস্ত গলিতে গিয়ে হাঁপ ছেড়েছে। সরু গলিটার মাঝামাঝি এক চিলতে খোলা জায়গা। এই খোলা জায়গায় একটা পাতকুয়া; গভীর এবং বড়। এর পার বাঁধানো, বাঁধানো পারের চারদিকে সাত-আট ফুট প্রস্থের একটা চত্বর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। কুয়ার জল স্বচ্ছ। কুয়াটি এই গলির বাসিন্দাদের একমাত্র জলের আধার। এই কুয়ার জলেই পতিতারা তাদের রাতের গন্ধময় শরীরকে ধুয়ে সাফ করে। কাপড়ে-ছায়ায় লেপ্টে থাকা পুরুষবর্জ্য এই কুয়ার জলে ধুয়ে আগামী রাতের জন্যে শুকিয়ে নেয়। অপেক্ষাকৃত বেশি আয়সক্ষম মেয়েরা তাদের কামিজ-সেলোয়ার-শাড়ি-অন্তর্বাস লাক্স সাবান দিয়ে ধোয়। কম আয়ের বেশ্যারা সাঁইত্রিশ সাবান ডলে। বাঁধানো চত্বরেই তারা তাদের স্নান সারে আর কাপড়চোপড় ধোয়।

প্রতি সকালের দৃশ্য এটি। খুব সকালে মেয়েদের জটলা হয় না এখানে। শরীরে অত্যাচার এবং অশেষ ক্লান্তি নিয়ে গভীর রাতে ঘুমাতে যায় ওরা। সকালবেলায় অধিকাংশ মেয়ে ঘরে কাস্টমার তোলে না। নিতান্ত ঠেকায় না পড়লে অথবা যৌবন হারানো কুশ্রী কমআয়ের পতিতা না হলে সাধারণত এ পাড়ার পতিতারা সকালে কাউকে দেহ দেয় না। খুব পরিচিত কেউ এলে অন্য কথা। সকালে ঘরে কাস্টমার না তোলা—এ পাড়ার দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। মাসিরা বলে—দিনেও কাস্টমার তুললে মেয়েদের শরীরের সজীবতা নষ্ট হয়ে যায়। কাস্টমারদের ভরা শরীর চাই। এমনিতে রাতের অতিথিরা তাদের দেহকে চিবড়ে করে ছাড়ে। যৌবনরস, সতেজতা—সব চুষে নেয়। বিশ্রাম শরীরের হারানো সরসতাকে ফিরিয়ে দেয়। মেয়েরা যদি সকালবেলায় বিশ্রাম না নেয়, তাহলে অল্প সময়ে তাদের শরীরের চেকনাই উবে যাবে। আর যৌবনহারানো মেয়েদের যে এই বেশ্যাপাড়ায় কোনোই মূল্য নেই, সেটা মাসি-সর্দার-দালালরা যেমন জানে, তেমনি জানে পতিতারাও। তাই সচেতন মাসিরা সকালে মানে দিনের বেলায় মেয়েরা ঘরে কাস্টমার তুলুক, এটা চায় না। মেয়েরাও সহজে রাজি হয় না। গভীর রাতে ঘুমাতে যাওয়া মেয়েরা তাই সকালে দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে, তোলাপানি দিয়ে দাঁত মেজে হাত মুখ ধুয়ে মুগ ডাল বা মুরগির সুপ দিয়ে পরোটা-লুচি খায়, ভাঙা কাপে চা খায়। আবার বিছানায় কিছুক্ষণ শুয়ে-বসে শরীরের আড়মোড় ভাঙে। তারপর একে ওকে সঙ্গে নিয়ে পাতকুয়ার পারে জড়ো হয়।

খুব সকালে এই পাতকুয়ার পানি নিতে আসে বুয়ারা। জলমেয়ে ওরা, ওরা আফতাবচি; এরা পতিতাপাড়ার পানি সরবরাহকারী। গাল থোবড়ানো, বুক চুপসানো ভাঙা যৌবন তাদের। ছেঁড়া কাপড় পরা, ব্লাউজের এখানে ওখানে ফুটোফাটা। ওরাও একসময় এই পাড়ার পতিতা ছিল। যৌবন চলে যাওয়ার পর তাদের কাস্টমার কমে যায়। নিরুপায় হয়ে তারা পতিতাবৃত্তি ছেড়ে এ-ঘরের ও-ঘরের ফাইফরমাস খাটতে শুরু করে। কেউ যুবতী পতিতাদের গা-গতর টিপে দেয়, পরিপাটি করে চুল বেঁধে দেয়, কেউ তাদের কাপড়চোপড় ধুয়ে দেয়, কেউ বাড়িতে বাড়িতে পানি সরবরাহ করে। পতিতাদের দেওয়া টাকাতেই তাদের ভরণপোষণ চলে। পতিতাপল্লিতে পানি সরবরাহকারী এই মেয়েদের বেশ কদর। তাদের সরবরাহকৃত পানি দিয়ে পতিতারা রাতের অতিথিদের বর্জ্য নিম্নাঙ্গ থেকে ধুয়ে মুছে সাফ করে। প্রত্যেক পতিতার খেলাঘরের পাশেই ছোট্টমতন একটা খুপড়ি থাকে। ওখানে থাকে হয় বড় বালতি, নয় ড্রাম। জলমেয়েরা খুবসকালে পাতকুয়া থেকে জল নিয়ে ওগুলো ভরিয়ে তোলে। এইভাবে প্রত্যেক পতিতার ঘরে রাতের প্রস্তুতি, সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায়।

সূর্য পুবাকাশে বেশটুকু উঠে গেলে পশ্চিম গলির পতিতারা কুয়াপারে ভিড় করে। আসে ইলোরা, আসে আইরিন, আসে বনানী, বেবি ও মমতাজ আর আসে মার্গারেট। এ গলির মেয়েরা পুবের গলির মেয়েদের মতো ততো স্মার্ট নয়। তাদের জামাকাপড় ম্লান, চেহারাসুরত নিষ্প্রভ। পুবালি মেয়েদের চেহারায়, কাপড়ে, কথায় ঝিলিকমিলিক বেশি। তারা প্রয়োজনে শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলে, মাঝেমধ্যে দু’চারটা ইংরেজি শব্দ উচ্চারণ করে রাতের কুটুমদের চমকে দেয়। পোশাকের ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে ও কথার তুবড়ি ছুটিয়ে পুবগলির মেয়েরা নিজেদের চারদিকে একটা রহস্যময় আবহ সৃষ্টি করে রাখে। তাদের সেই আবহের ঘূর্ণিচক্রে পড়ে অনেক দুদে কাস্টমারও নাকানিচুবানি খায়। পশ্চিমগলির মেয়েরা ওসব রহস্যময়তার ধার ধারে না। কথা বলে সোজাসাপটা। তাদের মুখ পুবগলির মেয়েদের তুলনায় আলগা। এরা লুকোচুরির তোয়াক্কা করে না। এরা ঝগড়াটে ও সাহসী, স্পষ্টভাষী ও বাস্তববাদী। গতরাতের বিচিত্র অভিজ্ঞতা কুয়াপারে দাঁড়িয়ে এরা ভাগাভাগি করে।

আজ কুয়াপারে প্রথম এসেছে আইরিন ও বনানী। আইরিন পাতলা, লম্বাটে; তার তুলনায় বনানী খাটো। বনানীর স্তন সুডৌল ও আকর্ষণীয়। এজন্যে তার অহঙ্কার আছে। কথায় কথায় সে স্তনের প্রসঙ্গ নিয়ে আসে।

বনানী আইরিনকে উদ্দেশ্য করে বলল, কীরে আইরিন, বটাবুনি আসতে আজকে এত দেরি করতাছে ক্যান?’

‘বটাবুনি আবার কেডা?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে আইরিন।

‘ক্যান, মমতাজিনী। বটাবুনি কে তা বুঝি তুই জানস না?’

এরমধ্যে কুয়াপারে এসে পড়েছে বেবি, ইলোরা, সুইটি। সুইটি কল কল করে হেসে বলে ওঠে, ‘বনানীদি যে কত কিছু বানাইয়া বানাইয়া বলে! নানাজনেরে নানা নাম দেয়। মমতাজকে আবার বটাবুনি ডাকা শুরু করলা কখন থেইক্যা?’ কথা শেষ করে সুইটি আবার খিলখিল করে হেসে ওঠে সুইটি চঞ্চল, সর্বদা হাসতে সে ভালোবাসে। আনন্দেও হাসে, বেদনায়ও হাসে। অন্য পতিতারা বলে—সুইটির হাসিরোগ আছে।

সুইটির কথার রেশ ধরে কুয়াপারে সমবেত মেয়েদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার ভঙ্গিতে বনানী বলে, ‘হুন ভইনরা, আমাগো, মাইনে এই পতিতাপল্লির মাইয়াগো বুনি তিন প্রকারের।

‘সেটা আবার কেমন?’ আইরিন বলে।

‘তাইলে মনোযোগ দিয়া হুন।’ বনানী বলতে শুরু করে। ‘আমরা যখন এই পাড়ায় প্রথম আসি তখন আমাগোর বুনি সোজা থাকে। বুনি তো বুঝছো, ভদ্দরনোকরা যারে এস্তন কয়। কুত্তার বাইচ্চা হারামজাদারা রাইত দিন টাইন্যা চুইষ্যা হেইগুলির বারোটা বাজাইয়া দেয়। অত্যাচারে অত্যাচারে ঝুইল্যা পড়ে হেইগুলি। মাঝে মইধ্যে কোমরেও চইল্যা আসে।

‘আইচ্ছা বনানীদি, এই সব কথা কইতে তোমার লজ্জা করে না?’ সুইটি হাসতে হাসতে আবার জিজ্ঞেস করে।

‘লজ্জা! লজ্জা কিসের? আমরা তো চল্লিশ টাকা পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে কুত্তাগোর হাতে আমাগোর লজ্জা তুইল্যা দি প্রত্যেক রাইতে, ঘণ্টায় ঘণ্টায়। মাগিগো আবার শরম কিসের?’ রেগে যায় বনানী।

সুইটি বলে, ‘রাইগো না, রাইগো না দিদি। তুমি আমাগোর জান, তোমার কাছে আইলেই একটু হাসবার সুযোগ পাই। কও তুমি কী কইতাছিলা।

বনানী কিছুক্ষণ চুপ মেরে থাকে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘আমাগোর সম্পদ অইল আমাগোর বুনি। রাতকুটুমরা আমাগো চয়েস করে ওই বুনির লাইগ্যা। যেই মাইয়ার বুনি যত খাড়া, তার কাস্টমার তত বেশি। হুন, তোমাগোর অনেক আগে আমি এই পাড়ায় আইছি; তোমাগোর চাইতে আমার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। যে মাইয়ার বুনি পইড়া যায়, হের কোনো দাম থাকে না কাস্টমারের কাছে। মাইয়ারা তাই বুনি লইয়া চিন্তিত থাকে। সোজাবুনি দিয়া মাইয়ারা কাস্টমারদের চোখ ধাঁধানোর চেষ্টা করে।’

‘তিন প্রকারের স্তনের কথা কইতাছিলা তুমি।’ আইরিন বনানীকে মনে করিয়ে দেয়।

‘কারও কারও বুনি টাইট। ব্রেসিয়ার পরলে তার মইধ্যে আপনা-আপনি ঢুইক্যা পড়ে। কারও বুনি আবার সামান্য ঝুইল্যা যায়। ব্রেসিয়ার পইরা বুনির তলায় হাত দিয়া ব্রেসিয়ারের খোপে ঢুকাইয়া দিতে হয়। আবার অনেকের বুনি ঝুইল্যা কোমরে চইল্যা আসে। কোমর থেইক্যা বইট্যা বইট্যা হেইগুলি ব্রেসিয়ারে ঢুকাইতে হয়। আমি ওইগুলারে কই বটানো বুনি। মমতাজ ও বুনি ঝুইল্যা কোমরে নামছে। তাই হের নাম দিছি বটাবুনি।’

হি হি, হো হো, খিল খিল করে কুয়াপারে জমায়েত সব মেয়ে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে এ ওর, ও এর স্তনের দিকে তাকাতে লাগল।

ইলোরা চুপচাপ ধরনের। কী এক নিবিড় বেদনা তার চোখমুখকে সর্বদা ঘিরে রাখে। অন্য মেয়েদের জীবনকথা সবাই জানলেও ইলোরার কথা কেউ জানে না। মুখ ফুটে কোনোদিন নিজের অতীত জীবনের কথা কাউকে বলেনি সে। সবাই শুধু জানে—ইলোরা তার আসল নাম নয়।

ইলোরা চাকমা। তার আসল নাম উমা প্রু চাকমা। রাঙামাটির প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনো এক গাঁয়ের মেয়ে সে। পড়াশোনাও কিছু আছে তার। এক বাঙালিবাবুর প্রেমে পড়ে ঘর ছেড়েছিল সে। মধু সংগ্রহের পর সেই প্রেমিক তাকে এই পাড়ায় বিকিয়ে দিয়ে গেছে। প্রেমিকের বিশ্বাসঘাতকতা, মা-বাবা ত্যাগের অপরাধবোধ, মাসি আর কাস্টমারের দৈহিক নির্যাতন তাকে প্রায় বোবা করে তুলেছে। সব মেয়ে এই পাড়া থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখে, ইলোরা দেখে না। বলে, ‘কোথায় যাব? কে আমার এই পচা দুর্গন্ধময় দেহকে কাছে টেনে নেবে? এইখানেই ভালো। এইখানে থেকেই আমি প্রতিশোধ নেব, পুরুষজাতির বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ।’

আজ বেশ কিছুদিন তার দেহে সিফিলিস বাসা বেঁধেছে। কে তার শরীরে এই রোগ ছড়িয়ে দিয়ে গেছে, তা জানে না ইলোরা। গত কয়েক সপ্তাহে অনেককেই তো দেহ দিয়েছে সে। যখন সে বুঝল তার সিফিলিস হয়েছে, তখনো নির্বিকার থাকল সে। সে ঠিক করল—ডাক্তারের কাছে যাবে না।

গলির মুখেই জীবন ডাক্তারের চেম্বার। সিফিলিস, গনোরিয়া, প্রমেহ ইত্যাদি যৌনরোগের ধন্বন্তরি ডাক্তার এই জীবন দাস। পাড়ার মেয়েদের কাছে তিনি ভগবান। জীবন ডাক্তার নানাভাবে মেয়েদের সাহায্য-সহযোগিতা করেন। নামমাত্র ফি নেন, কম দামে ওষুধ দেন। গ্র্যানুলোফা ইন্‌গুইনালীর মতো কঠিন রোগের রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থাও করে দেন তিনি। ষাটোর্ধ্ব এই জীবন ডাক্তার; মাথার মাঝখানে বিরাট টাক, চারদিকে অনেক চুল থাকা সত্ত্বেও টাকটাই চোখে পড়ে বেশি।

গেল কয়েকদিন ধরে অনেকের শরীরে সিফিলিসের জীবাণু ঢুকিয়ে দিয়েছে ইলোরা। সহবাসের সময় কোনো পুরুষ সিফিলিসের জ্বালা বুঝতে পারে না। চব্বিশ ঘণ্টা যেতে না যেতেই জীবাণু কিলবিলিয়ে ওঠে তার শরীরে। যৌনাঙ্গের পথে জ্বালা অনুভব করতে থাকে। এই জ্বালা একদিন যন্ত্রণায় পরিণত হবে। যন্ত্রণায় হারামজাদা ছটফট করতে থাকবে, আত্মীয়স্বজন কাউকে বলতে পারবে না তার পতিতাগমনের কথা, সিফিলিসের কষ্টের কথা। মুখ লুকিয়ে হাঁটবে সে রাস্তায়, গোপনে যৌনরোগের ডাক্তারের সন্ধান করতে থাকবে। আঃ, এই দৃশ্য ভাবতেও সুখ! ইলোরা এই দৃশ্য স্বচক্ষে দেখছে না, কিন্তু মানসচক্ষে সে ঠিকই দেখতে পাচ্ছে।

সহবাসকালে সে ক্ষতস্থানে একটু একটু ব্যথা পাচ্ছে বটে, কিন্তু প্রতিশোধস্পৃহার কাছে তার এই ব্যথা কিছুই নয়। সে এই রোগ সারাবে না, যাবে না জীবন ডাক্তারের কাছে। সে অপেক্ষা করে আছে একজনের জন্যে। তার আশা—একদিন না একদিন ওই বাঙালিবাবু তার কাছে আসবে। তার সঙ্গে সহবাস করতে চাইবে। ভেতরে ঘৃণা কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠলেও মুখে মধুর হাসিটি ধরে রাখবে ইলোরা। শরীরটা খুলে মেলে ধরবে বাঙালিবাবুর সামনে। ভুলেও অতীত প্রসঙ্গ তুলবে না।

সে শুনেছে—সিফিলিসের প্রকোপে ঠোঁট, জিভ, আঙুল, নাভি, উরু ইত্যাদিতে ঢাকা চাকা ক্ষতের সৃষ্টি হয়। সমস্ত শরীর দূষিত হয়ে পচতে থাকে। তার সঙ্গে মিলিত হবার পর ওই বাঙালিবাবুর পচনশীল অঙ্গ খসে খসে পড়বে, মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটবে তার। ওই বেইমান বিশ্বাসঘাতকের সন্তান হবে বিকলাঙ্গ, ক্ষয়রোগী, মানসিক ভারসাম্যহীন।

যেদিন বাঙালিবাবুর শরীরে সিফিলিসের জীবাণু ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হবে, শুধু সেইদিনেই যাবে জীবন ডাক্তারের কাছে। তার আগে নয়। কিছুতেই নয়, কিছুতেই নয়।

‘কীরে ইলোরা? বিড়বিড় কইরা কী বলতােছ?’ বনানী জিজ্ঞেস করে।

‘কিছু না কিছু না।’ সংবিৎ ফিরে আসে ইলোরার। সে যে কুয়ার পারে মেয়েদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, ভুলে গিয়েছিল। বনানীর জিজ্ঞাসায় বাস্তবে ফিরে আসে সে।

‘নিশ্চয় কিছু। কিছুতেই নয়, কিছুতেই নয় করছিলি ক্যান?’ বেবি বলে। ইলোরা বুঝল—এই মেয়েরা তাকে ছাড়বে না। পেট থেকে কথা বের করে নেবেই। কিন্তু সে তো একান্ত নিজের কথা অন্য কাউকে বলবে না। যেদিন প্রতিশোধ নিতে পারবে, শুধু সেদিনই ডেকে ডেকে সবাইকে বলবে। কিন্তু এই নাছোড়বান্দাদের তো একটা জবাব দিতেই হবে।

ইলোরা নিচুস্বরে বলে, ‘গতকাল এক কুটুম এসেছিল আমার ঘরে। কলেজে না ইনভার্সিটিতে পড়ে বলল।’ বলেই চুপ মেরে গেল ইলোরা।

বনানী প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল ইলোরার ওপর। ‘তারপর, তারপর? কী করলো হেই শিক্ষিত যুবক?’

ইলোরা মুখ খুলল, ‘লম্বা চুল, টিঙটিঙে। চোখেমুখে শরম শরম ভাব। বুঝলাম—নতুন এসেছে এই লাইনে। একশ টাকা চেয়ে বসলাম। আশ্চর্য, তাতেই রাজি হয়ে গেল। দুইজনের টাকা একজনের কাছ থেকে পেয়ে আমার বেশ ভালো লাগল।’ দম নেওয়ার জন্যে একটু থামল ইলোরা।

বেবি বলল, ‘তারপর?’

‘ঘরে ঢুকেই শরমভাব চলে গেল তার। বলল—জামাকাপড় ব্রেসিয়ার সব খোল। আমি তোমার শরীরের সব কিছু দেখব।’ বলল ইলোরা।

আইরিন জিজ্ঞেস করে, ‘তুই সব খুইল্যা দেখালি?’

‘মাথা খারাপ! একশ টাকার বিনিময়ে সব খুলে দেখাব?’

‘তাহলে তুই কী করলি?’ আবার জানতে চায় আইরিন।

ইলোরা নামের চুপচাপ মেয়েটি হঠাৎ ক্ষেপে গেল। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘বিছানায় শুয়ে হারামজাদার সামনে কাপড়টা তুলে বললাম—এই কাম করতে আসছ, করে চলে যাও। একশ টাকা দিয়া বুনি দেখানো যাবে না।’

‘হেয় কী করল?’ অপার জিজ্ঞাসা বনানীর চোখে।

‘কথা বাড়াতে সাহস পেল না সেই টিঙটিঙা। কাম শেষ করে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তারপর একটু থেমে আপন মনে বলল ইলোরা, ‘বুঝবে হালারপুত। কয়েকঘন্টা পরেই বুঝবে।’

‘কী বুঝবে?’ আইরিন জিজ্ঞেস করে।

বিপন্ন বেদনাক্রান্ত মুখে হাসি ছড়িয়ে ইলোরা বলে, ‘ও কিছু না। এমনি এমনি বললাম। মনে মনে বলল, ‘হে ভগবান, তাড়াতাড়ি ওই বাঙালিবাবুকে আমার কাছে পাঠাও। তার জন্যে আমি অপেক্ষা করে আছি ভগবান।

.

সবাই নিজ নিজ কাজে মগ্ন হয়ে পড়ল। কেউ কুয়া থেকে জল তুলে স্নান করতে লাগল, কেউ শাড়ি-সেলোয়ারে সাবান ঘষতে লাগল। কুয়ার জল সুশীতল। বালতি থেকে মগ দিয়ে গায়ে মাথায় জল ঢালতে ঢালতে বনানী বলল, ‘এই কুয়ার পানি আছিল বইল্যা আমাগোর শান্তি। শরীরে পানি ঢাললে ভেতরের জ্বালা কইম্যা আসে। জানোয়ারদের দংশন, আঁচড় আর অত্যাচারের কষ্ট ভুইলতে থাকি আমি এই কুয়ার পারে আইলে, কুয়ার পানি গায়ে ঢাইলো।’

অন্যান্য মেয়েরা তার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে। কেউ কোনো প্রতিবাদ করে না। কারণ, এ অনুভব শুধু বনানীর নয়, এ অনুভূতি সবারই।

.

সন্ধে হবার সঙ্গে সঙ্গে পতিতাপল্লির বাড়িগুলো প্রাণ পেতে থাকে। মেয়েরা সেলোয়ার-কামিজ পরে, কপালে উজ্জ্বল টিপ লাগিয়ে, ওড়নাকে পিঠের দিকে ঝুলিয়ে স্তন দুটোকে আকর্ষণীয় করে ঘরের কাছে পথ জুড়ে প্রতীক্ষা করতে থাকে। হাড় কাঁপানো শীতে কিংবা জল দাঁড়ানো বর্ষায় তারা অপেক্ষা করতে থাকে রাতের ক্ষণিক অতিথিদের জন্যে। অন্ধকারের আবরণ গায়ে জড়িয়ে অতিথিরা আসে। কেউ শার্ট প্যান্ট পরে, কেউ মিহি কাপড়ের চুড়িদার পাঞ্জাবি পরে, আবার কেউ লুঙ্গিশার্ট বা পাঞ্জাবি পরে সাহেবপাড়ায় ঢোকে। দরদাম করে এই কাস্টমাররা বেছে নেয় পছন্দ মাফিক রাতবউ। অধিকাংশ পতিতা সুন্দর যুবক প্রত্যাশা করে। কিন্তু বৃদ্ধের প্রয়োজনও মিটাতে হয় তাদের।

প্রতিরাতে রাতকুটুমদের নিয়ে এই পল্লির মেয়েরা বারোয়ারি শয্যায় বিনিময়ের খেলা খেলে। একই রাতে একই শয্যায় আট দশজন সম্ভোগীকে তুষ্ট করতে হয়। মদ, বমি, সিগারেটের শেষাংশ আর বাসি ফুলের গন্ধে পতিতাদের ঘরগুলির চেহারা পাল্টে যায়। রাতের কুটুমরা লাল চোখ, পানের পিক লাগা জামা, লিপস্টিক লাগা ঠোঁট-গাল আর অবিন্যস্ত চুল নিয়ে বাড়িমুখো হয়। এলোমেলো বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ে পতিতারা। দিনের আলো ফুটতে না ফুটতে আরেকটা রাতের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় এই বেশ্যাপাড়ায়।

অনেক দেরিতে মমতাজ আসে কুয়াপারে। মলিন মুখ তার। এতক্ষণ ধরে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করলেও তার বিষণ্ণ মুখ দেখে বনানী জিজ্ঞেস করে, ‘কীরে মমতাজ, আজ এত চুপচাপ যে? দেরি কইরা আইলা ক্যান?’

এ কথার কোনো জবাব দেয় না মমতাজ। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে বনানীর দিকে।

এবার বনানী মমতাজের দিকে ভালো করে তাকায়। দেখে— মমতাজের গলার নিচে, বুকের কাছে সিগারেটের ছ্যাঁকা। বনানী ব্যাপারটা আঁচ করে। তারপরও জিজ্ঞেস করে, ‘কী অইছে? কোন হারামির পোলা তোমার এই অবস্থা করল?’ বনানীর উচ্চ কণ্ঠে স্নানেরত মেয়েরা চোখ তুলে তাকাল।

‘কাল এক বেডা আইল ঘরে, সঙ্গে তার বন্ধু। আগে দুই একবার আইছিল হে আমার ঘরে। আবদার ধরল দুইজনে এক সাথে আমার ঘরে যাবে। আমি রাজি অইলাম না। পাঁচশ টাকার লোভ দেখাইল। রাজি অইলাম। দুইজনে দুইদিক থেইক্যা আদর করা শুরু করল। তারপর হারামি বন্ধুটি সিগারেট ধরাইল। প্রথম ছ্যাঁকাটা দিল বাম বুকের বোঁটায়। তারপর ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল মমতাজ।

‘তুই এই রকম চোদমারানির পোলাদের ঘরে তোলছস ক্যান?’ ধমকের সুরে বলে বেবি।

‘কী করুম। টাকার লোভে ঘরে তুলছি। মাইয়া পড়ে ইস্কুলে। তার জামাজোড়া, বইপত্তরের টাকা জোগাইতে হয়। টাকার লোভে দুইজনরে এক লগে ঘরে তুইলছি ভইন।’ কাঁদতে কাঁদতে বলে মমতাজ।

‘মাইয়া পড়াইয়া লাভ কী? হেও তো তোমার মতো একদিন রাস্তার ধারে দাঁড়াইবো।’ নির্মম কথাটা মোলায়েম কণ্ঠে বলে বনানী।

‘না বনানীদি, হেই কথা কইও না। মাইয়াডার বাপের ঠিকানা নাই। হেরে আমি লেখাপড়া শিখাইয়া একটা ঠিকানা দিমু, লেখাপড়ার ঠিকানা। হে একদিন বড় অইবো। এই পাড়া থেইক্যা বাইর অইয়া ভদ্দর লোকদের মাইয়ার মতো জীবন কাড়াইবো। এইডাই আমার স্বপ্ন।’ বিভোর কণ্ঠে বলে মমতাজ।

মমতাজ ছাড়া আর সবাই জানে–মমতাজের এই স্বপ্ন অলীক স্বপ্ন। এই স্বপ্ন দেখা যায়, কিন্তু পূরণ করা যায় না। মেয়ে একটু সেয়ানা হয়ে উঠলে মাসির খপ্পরে পড়বে। ছলে-কৌশলে একদিন ঘরে মালদার আদমি ঢুকিয়ে তার নথ খোলাবে। দ্বিতীয় মমতাজ হয়ে মমতাজের মেয়েটি হাজার কাস্টমারের চাহিদা মিটাবে আযৌবন।

আজ দুখিনী মমতাজের মনে কষ্ট দিতে চাইল না কেউ। অলীক স্বপ্ন দেখে এই বেশ্যাপল্লির একজন সাধারণ বেশ্যা যদি অসাধারণ আনন্দ পায়, তাতে দোষ কী? বাস্তব যতই কঠিন আর রূঢ় হোক না কেন, তাকে স্বপ্নহীনতার মধ্যে টেনে এনে লাভ কী? এই ভেবে কুয়াপারে জমায়েত সকল মেয়ে চুপ করে থাকল। উজ্জ্বল চোখ তুলে মমতাজের দিকে তাকিয়ে থাকল তারা।

.

মার্গারেট আজকে কুয়াপারে আসেনি। মার্গারেট খ্রিস্টান, পুরো নাম মার্গারেট হ্যারিসন। মা জুলিয়েট। বছর ত্রিশেক আগে জুলিয়েট পাপচক্রে এই পতিতালয়ে এসে পড়েছিল। দালালরাই ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে এসেছিল এখানে। বেচে দিয়েছিল জোলেখা মাসির কাছে। তারপর বেচাকেনার জীবন; টাকা দিয়ে শরীর বেচা, ভালোবাসা কেনার বাজারে প্রতিনিয়ত পসরা সাজিয়ে বসতে হয়েছে জুলিয়েটকে।

প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও পরে গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল। প্রথমদিকে কাস্টমাররা আদর-সোহাগ করলে শরীরে শিহরণ জাগত, মনটা উলু ঢুলু করে উঠত। পরে শিহরণ টিহরণ গা-গতর থেকে উবে যায়। কাস্টমার আসে, শরীর নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে, চলে যায়। নিত্যদিন পায়খানা-প্রস্রাব করার মতো সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় দেহ দেওয়ার ব্যাপারটি।

এইভাবে বছর পাঁচেক কেটে যায় জুলিয়েটের। ক্লেদাক্ত জীবনে সে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। রাতের পর রাত ধরে পুরুষের বিকৃত কামনা প্রত্যক্ষ করে। তাদের হিংস্রতা, তাদের বিকার- এসব দেখে দেখে যখন জুলিয়েট পুরুষের ওপর বিদ্বেষপরায়ণ ও অনাগ্রহী হয়ে ওঠে, ঠিক ওই সময়ে তার ঘরে আসে জয়নাল আবেদীন। জয়নাল একটা ব্যাঙ্কের অফিসার। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। মৃতবৎসা স্ত্রী মারা গেছে। একদিন এই জয়নাল আবেদীন জুলিয়েটের খদ্দের হয়। স্বাভাবিক নিয়মে জয়নাল প্রয়োজন মিটিয়ে চলে যায়। পতিতার ঘরে কতজন আসে আর কতজন যায়! কে কাকে মনে রাখে! কিন্তু জয়নালকে জুলিয়েটের মনে রাখতে হল। জয়নাল ঘন ঘন আসতে শুরু করল জুলিয়েটের কাছে। একটা সময়ে বাঁধাবাবুতে পরিণত হল জয়নাল। একদিন জয়নাল জুলিয়েটকে বিয়ের প্রস্তাব দিল। জুলিয়েট কটকট করে হেসে ওঠে বলল, ‘জয়নাল, তুমি আমার বাঁধাবাবু আছ, ইট ইজ অল রাইট। আস, ফুর্তি কর, আমার কোনো বাধা নেই। বাট, ম্যারেজের চিন্তা মাথা থেকে বাদ দাও।’

‘কেন?’ জয়নাল জিজ্ঞেস করে।

‘আমরা রেন্ডি। আমাদের বিয়ে করে না কেউ। আমাদের নিয়ে সবাই ফুর্তি করে।’ বলে জুলিয়েট।

‘আমি তোমায় বিয়ে করতে চাই। সভ্যসমাজে নিয়ে যেতে চাই।’ জয়নালের কথায় আবেগ।

এবার জুলিয়েট যথার্থই বিরক্ত হয়। বলে, ‘সাদি? নেহি। ওসকি বাত আগলে জনমমে সোচা জায়েগা।‘

জয়নাল হতোদ্যম হয় না। সেদিন প্রসঙ্গটা থামিয়ে দিলেও জয়নাল হাল ছাড়ে না। সুযোগমতো বারবার কথাটা জুলিয়েটের সামনে তুলতে থাকে। জুলিয়েট নির্বিকার থাকে। সে জানে—এ ক্ষণিক আবেগ। একটা সময়ে কেটে যাবে। বিয়ের পর কয়েকটা দিন উন্মাদনায় কাটবে, তারপর জয়নালের মনে সংশয় দেখা দেবে। সংশয় থেকে সন্দেহ জাগবে। সন্দেহ থেকে ঝগড়া মারপিট এবং বিচ্ছেদ। এই বিচ্ছেদ অত্যন্ত নির্মম। বিচ্ছেদের অভিশাপে জুলিয়েট নামক পতিতাটি দগ্ধ হতে থাকবে আর জয়নাল নামক পুরুষটি গায়ে তুলসী জলের ছিটা দিয়ে পুজোয় বসবে, পুনরায় জুলিয়েটের স্থান হবে পতিতাপল্লিতে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত জুলিয়েটকে জয়নালের কাছে হার মানতে হয়। একদিন তাকে রাজি হতে হয় জয়নালকে বিয়ে করতে। জয়নাল তাকে বিয়ে করে ভদ্রপল্লিতে নিজের ঘরে নিয়ে যায়।

মাস কয়েকের মধ্যে জুলিয়েট টের পায় জয়নাল আসলে তাকে তার রান্নাঘরের জন্যে বিয়ে করে এনেছে। দু’বেলা রান্না করা, খাওয়া, ঘুমানো ছাড়া জুলিয়েটের জীবনে আর কোনো বৈচিত্র্য নেই। প্রচুর টাকা আর অবাধ স্বাধীনতা ছেড়ে দৈনন্দিনের বাঁধাজীবনে থাকা কঠিন হয়ে ওঠে জুলিয়েটের। রান্নাঘরের বাইরের জগৎ তাকে ক্রমশ টানতে থাকে। জয়নাল সেটা মেনে নিতে পারে না। তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে। জুলিয়েট ফিরে আসে পতিতালয়ে, জোলেখা মাসির কাছে।

এই জুলিয়েটেরই মেয়ে মার্গারেট। মার্গারেট জন্মসূত্রে পতিতা। মার্গারেটের জন্ম হয়েছে এই সাহেবপাড়ায়। বেশ্যারা সন্তান ধারণে মোটেই আগ্রহী নয়। তারা জানে—সন্তান বিয়োলে তাদের যৌবনে ভাটা পড়ে, খদ্দের কমে। তাছাড়া এখানকার অবৈধ সন্তানগুলো অবহেলিত, অবাঞ্ছিত। ভদ্রসমাজে তারা ঠাঁই পায় না। বড় হয়ে এই পাড়ারই গুণ্ডামাস্তানে পরিণত হয় তারা। জুলিয়েট এসব কিছু ভালো করে জানে। তারপরও একদিন সে সন্তান ধারণ করে, সেই সন্তান একদিন পৃথিবীর আলো দেখে। সে মার্গারেট।

সেই সন্ধেয় তার প্রথম খদ্দের ছিল একজন সাহেব। মধ্য বয়েস, কিন্তু সুঠাম দেহ। নীল চোখ, ছোট করে কামানো চুল। সরু গলিতে দীর্ঘদেহী এই সাহেবটি মাথা বাঁচিয়ে হাঁটছিল। হঠাৎ জুলিয়েটের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘হাউ মাচ?’

‘নট এ লট। নট আনটাচেবল। কাম। এনজয় মি, দেন পে।’ স্পষ্ট উচ্চারণে বলেছিল জুলিয়েট।

সাহেব চমকে জুলিয়েটের দিকে তাকিয়েছিল। মৃদু হেসে জুলিয়েটের ঘরে ঢুকে পড়েছিল। যাওয়ার সময় প্রচুর ডলার জুলিয়েটের বিছানায় ছড়িয়ে দিয়ে শুধু বলেছিল, ‘মাই নেইম ইজ হ্যারিসন, জন হ্যারিসন।’

জুলিয়েটের পেটে বাচ্চা এসেছিল। অনেকে পেট খালাসের পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু কেন জানি জুলিয়েট রাজি হয়নি। অনেককে দেহ দিয়েছে সে, কিন্তু কারও চেহারা কোনোদিন মনের কোণে ভেসে ওঠেনি। হ্যারিসন বারবার উঁকি দিয়ে যেতে লাগল তার মনের কোণে। হ্যারিসনকে মনে লালন করতে করতে মার্গারেটকে প্রসব করল জুলিয়েট। এই মার্গারেট আজ বিশ বছরের যুবতি। হ্যারিসনের মতো গায়ের রং; নীল চোখ, লালচে চুল মার্গারেটের।

সেই মার্গারেট সেদিন জুলিয়েটের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘মাম, আই ওয়ান্ট টু মেরি।’

কিসের চিন্তায় যেন বিভোর ছিল জুলিয়েট। বয়স বেড়ে যাচ্ছে। চোখের কোলে কালি জমতে শুরু করেছে। শরীরের বাঁধন আলগা হতে শুরু করেছে। খদ্দেরও কমতে শুরু করেছে তার। জোলেখা মাসি এখন তার ওপর তেমন প্রতিপত্তি খাটায় না। শেষ কাস্টমার বিদেয় করে জুলিয়েট হাতে যা তুলে দেয়, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে মাসি।

মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বুক ভরে ওঠে জুলিয়েটের। যৌবন হারানো অভাবের দিনে মার্গারেটই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে–ভাবতে ভাবতে আনন্দে চোখ চিকচিক করে ওঠে। মা-মেয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে খদ্দেরের জন্যে অপেক্ষা করে দরজার মুখে। কাস্টমার মার্গারেটকেই পছন্দ করে। সুযোগ বুঝে মার্গারেট হাই রেইট হাঁকে। মার্গারেটের রূপ-যৌবন দেখে কাস্টমাররা দরাদরি করে না। মার্গারেট খদ্দের নিয়ে ঘরে ঢোকে। মা-মেয়ে পালা করে এক ঘরে কাস্টমার তোলে। মার্গারেট কাস্টমার নিয়ে ঘরে থাকতে থাকতেই জুলিয়েটের খদ্দের জুটে যায়। অপেক্ষা করতে থাকে জুলিয়েট। মার্গারেট বেরিয়ে এলে জুলিয়েট ঢোকে। একরাতে মা-মেয়ের ইনকাম কম হয় না। গভীর রাতে খদ্দের বিদেয় করে মা-মেয়ে গলাগলি করে একই বিছানায় ঘুমায়। বড় আনন্দের দিন এখন জুলিয়েটের—বড় সুখের দিন।

‘মাম, তুমি কি আমার কথা শুনেছ?’ গলাকে একটু উঁচু করে জিজ্ঞেস করে মার্গারেট।

‘কিছু বলছিলে তুমি মার্গারেট? আমি খেয়াল করিনি।’ নরম গলায় বলে জুলিয়েট।

মার্গারেট কোনো ভূমিকা না করে আবার বলে, ‘আই সেড, আই ওয়ান্ট টু মেরি সাম ওয়ান।’

জুলিয়েট যেন তার কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। অবাক চোখে সে জিজ্ঞেস করে, ‘হোয়াট? হোয়াট ডিড ইউ সে?’

‘আই লাভ দেবাশিস। সো ডাস হি। আই ওয়ান্ট টু মেরি হিম।’ অত্যন্ত শান্ত কণ্ঠে কথাগুলো বলে যায় মার্গারেট।

অবাক বিস্ময়ে জুলিয়েট কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল মার্গারেটের দিকে। তারপর বলল, ‘দেখ মার্গারেট, উই আর প্রস্টিটিউট। আমাদের ভালোবাসতে নেই, হাসবেন্ড থাকতে নেই। উই আর ক্রিয়েটেড ফর দ্য এনজয়মেন্ট অব মেন। আমাদের জীবন বেচাকেনার জীবন। কাস্টমারস্ পে ফর আওয়ার বডিস। উই আর নাথিং বাট ইনস্ট্রুমেন্ট ফর এনজয়মেন্ট। ফরগেট এবাউট লাভ এন্ড সো কলড্ ম্যারেজ। ইউ আর ফর প্রস্টিটিউশন, নট ফর জেন্টেলম্যানস সোসাইটি। ফরগেট ইট।’ একটু থেমে দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলল জুলিয়েট। তারপর খুব ধীরে ধীরে আবার উচ্চারণ করল, ‘ফরগেট এবাউট লাভ এন্ড ম্যারেজ। ইটস্ নাথিং, না-থিং।’

‘দেবাশিস আমাকে ভালোবাসে মা। ও কথা দিয়েছে বিয়ের পর সে আমাকে অবহেলা দেখাবে না। নিয়ে যাবে সে আমাকে এখান থেকে, যথার্থ ওয়াইফের মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলবে।’ আবেগ ঝরে পড়ছে মার্গারেটের কণ্ঠ থেকে।

এবার একটু উঁচুগলায় জুলিয়েট বলল, ‘ইউ নো নাথিং এবাউট দিস কাইন্ড অব জেন্টেলম্যান। তারা এক একজন আস্ত বদমায়েস। তারা নিয়ে যায় বটে আবার ডাস্টবিনে ছুড়ে দিতে দ্বিধা করে না।’

‘মাম, তুমি যা-ই বল আর তাই বল, আই অ্যাম ডিটারমাইন্ড টু মেরি দেবাশিস।’

‘এইসব দেবাশিস আর জয়নালরা একই রকম। লোভী, সুবিধাবাদী আর শরীরখোর। ক্ষণিক মোহ। দুদিনে কেটে যায়।’ উত্তেজনায় ফেটে পড়ে জুলিয়েট।

মাম, ‘জয়নালটা আবার কে?’ উৎকর্ণ হয়ে শুনতে চায় মার্গারেট।

হঠাৎ জুলিয়েট চুপসে যায়। জয়নাল-অধ্যায়টা শুধু নিজের জন্যে। জয়নাল-সম্পৃক্ত কষ্টের কাহিনীটি সে নিজের মধ্যে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছে এতদিন। মার্গারেটকে কোনোদিন বলেনি। আজকেও বলতে চায় না।

আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে জয়নাল মানে দেবাশিস নয়। দেবাশিস যথার্থই ভালোবাসে মার্গারেটকে, সত্যিই সে মার্গারেটকে স্ত্রীর মর্যাদায় প্ৰতিষ্ঠা দেবে। সন্তান উৎপাদন করবে। তার থার্ড জেনারেশন এই পৃথিবীতে আসবে। কাছে গিয়ে আদর করার অধিকার না পেলেও দূর থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে সে নাতি-নাতনিদের। আঃ, কী সুখ, কী আনন্দ!

‘মা, বললে না তো জয়নালটা কে?’ আবার বলে মার্গারেট।

নরম গলায় জুলিয়েট বলে, ‘ও কিছু না। ফরগেট এবাউট জয়নাল।’

‘ওকে, হোয়াট এবাউট মাই ডিসিশন, হোয়াটস ইউর ওপিনিয়ন?’

বড় আকুতিভরা চোখে মেয়ের দিকে তাকাতে তাকাতে জুলিয়েট বলল, তুমি এখন বড় হয়েছ। নিজের সম্পর্কে ডিসিশন নেওয়ার সম্পূর্ণ রাইট তোমার রয়েছে। আমার যা বলার, তোমাকে বলেছি। তারপরও যদি তুমি ঠিক কর, তুমি বিয়ে করবে, দেবাশিস তোমাকে রিয়েলি ভালোবাসে—তা হলে আমার না বলার কোনো কারণ নেই।’

‘ও মামা, ইউ আর সো নাইস। মাই মাম, আই লাভ ইউ।’ বলতে বলতে জুলিয়েটের গালে মুখ ঘষতে লাগল মার্গারেট।

.

দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল জুলিয়েটের গণ্ড বেয়ে। এই অশ্রু আনন্দের না বেদনার তা বুঝতে পারল না মার্গারেট।

.

গত সন্ধেয় দেবাশিস মার্গারেটকে এ সাহেবপাড়া থেকে বধূবেশে সাজিয়ে নিয়ে গেছে। বউ-বরণের সাজে সাজিয়ে একটা কার এনেছিল সে। সংকীর্ণ গলিটা পুবপাড়ার বড় গলিতে যেখানে এসে মিশেছে, সেখানেই রেখেছিল গাড়িটি। গাড়িটি ঘিরে বেশ্যা, দালাল, পানওয়ালা, জলমেয়ে, খদ্দেরের ভিড় লেগে গিয়েছিল। দেবাশিস জোলেখা মাসির পাওনা মিটিয়ে, গুণ্ডামাস্তানের চাঁদা দিয়ে সর্দারের অনুমতি নিয়ে মার্গারেটকে গাড়িতে তুলেছিল। গাড়িতে ওঠার আগে মার্গারেট জুলিয়েটকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে উঠেছিল। দেবাশিস পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বলেছিল, ‘আশীর্বাদ করবেন মা, মার্গারেট যাতে সুখে থাকে, মর্যাদায় থাকে।’

আবেগে কণ্ঠ রোধ হয়ে এসেছিল জুলিয়েটের। মুখে কিছু বলতে পারেনি, জলে ভেসে যাওয়া চোখ দুটো তুলে ডান হাত সামনের দিকে প্রসারিত করে মনে মনে বলেছিল, ‘হে যীশু, আমার মেয়েটাকে দেখ। সে যেন আমার মতো আবার এই নরককুণ্ডে ফিরে না আসে। দেবাশিস যেন জয়নাল আবেদীনের মতো না হয়।’

সে রাতে জুলিয়েট ঘরে কাস্টমার তোলেনি। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় নির্জীব নিস্পন্দ হয়ে শুয়ে গোটা রাত কাটিয়ে দিয়েছে।

.

তাই মার্গারেট আজ সকালে গতরাতের গন্ধময় আবর্জনা শরীর থেকে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করবার জন্যে নিত্যদিনের মতো কুয়াপারে আসেনি।

নয়

পুবের গলির শেষ প্রান্তে, পশ্চিমধার ঘেঁষে মা মগধেশ্বরীর মন্দির।

কালীমন্দির এটি। পরম যত্নে এই মন্দিরে সকাল-সন্ধ্যা পুরোহিত দিয়ে পুজো করানো হয়। বছরে একবার, কার্তিক মাসের চতুর্দশী তিথিতে মহাড়ম্বরে কালীপুজো হয় সাহেবপাড়া পতিতাপল্লিতে। পতিতারা বিশ্বাস করে–মা মগধেশ্বরী এই পতিতালয়কে ছায়া দিয়ে রেখেছেন। এই পতিতালয়ে যত পতিতা আছে—সবারই রক্ষাকর্ত্রী পরম করুণাময়ী মা কালী। তাঁরই দয়ায় তাদের খদ্দের জোটে, তাঁরই করুণায় তারা এই পাড়ায় সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচেবর্তে আছে। সকালে উঠে স্নান সেরে তাই প্রত্যেক পতিতা দুই হাত জড়ো করে মগধেশ্বরীর উদ্দেশে প্রণাম জানায়। পাপবোধ, ভবিষ্যৎ- নিরাপত্তাহীনতা আর অনন্ত যৌবন লাভের আকাঙ্ক্ষা তাদেরকে ধর্মভীরু করে তুলেছে। সর্দার-মাসি-গুণ্ডা-মাস্তান-দোকানদার-দালাল—সবারই একই মনোভাব। মা কালী রুষ্ট হলে তাদের সমূহ ক্ষতি হবে, প্রতিপক্ষ প্রবল হবে, ব্যবসা লাটে উঠবে—এই বিশ্বাস সকলের। তাই, সাহেবপাড়ায় পতিতা থেকে শুরু করে সর্দার পর্যন্ত সবারই প্রণম্যস্থান এই মা কালীর মন্দির। এই মন্দিরকে সবাই মায়ের মন্দির বলে। সাহেবরা জিজ্ঞেস করে, ‘হুইস গডেসেস টেম্পল ইস দিস?’

পতিতারা বলে, ‘মাদারস্ টেম্পল। মায়ের বাড়ি এটি।’

সাহেব বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলে, ‘ও, মাদার’স বাড়ি?’

‘হ্যাঁ, মাদারবাড়ি। মায়েরই বাড়ি এই মন্দির।’

ধীরে ধীরে এই পাড়াটিকে কেউ কেউ মাদারবাড়ি বলা শুরু করে। শেষ পর্যন্ত, বেশ্যাপিল্লটি ছাড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা মাদারবাড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে।

সাহেবপাড়ায় শুধু কালীপুজো হয় না, হয় শিব পুজোও। বড় ধুন্ধুমারের সঙ্গে এই পুজো হয় শিবরাত্রিতে। শিবরাত্রিতে এক মহোৎসব লেগে যায় এই পাড়ায়। বয়স্ক অল্পবয়স্ক নির্বিশেষে এই পাড়ার পতিতারা দিনে উপবাস থাকে। উপবাস শেষে দুধ অথবা ডাব নিয়ে শিবলিঙ্গের কাছে উপস্থিত হয়। পরম ভক্তিতে ওগুলো শিবলিঙ্গের ওপর ঢালে আর মনে মনে প্রার্থনা করে। কেউ শিবের মতো বাঁধাবাবু চায়, কেউ সন্তানের মঙ্গল চায়, কেউ ধনবান খদ্দের চায়।

মা কালী বা শিব পতিতাদের কাছে এক মানসিক আশ্রয় ছাড়া আর কিছুই নয়। দেবদেবী তাদের অন্ধকার জীবনে মুক্তির আলো, দেবদেবীর চরণ তাদের কাছে স্বস্তির স্থান। তাই প্রতিটি মেয়ের রাত্রিশেষের প্রথম কাজ দেবতাকে স্মরণ করা, তাদের উদ্দেশে গভীর ভক্তি মেশানো প্রণাম জানানো! এই সাহেবপাড়ায় বাস করে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ পতিতা। দিনের পর দিন পাশাপাশি অবস্থান করে, প্রতিরাতে চরম লাঞ্ছনার শিকার হতে হতে এই মেয়েদের মধ্য থেকে সম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা উবে যায়। কথাবার্তা, আচরণ, সংস্কার ভিন্নতর হলেও ধর্ম পালন অর্থাৎ মানসিক আশ্রয় খোঁজার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। জাতের সংঘাত তাদের মধ্যে থাকে না। তাই নির্বিশেষে তারা মগধেশ্বরীর মন্দিরে যায়, দুর্গোৎসবে অংশ নেয়; শিবলিঙ্গে দুধ অথবা ডাবের জল ঢালার ক্ষেত্রেও তাদের সমান আগ্রহ, সমান ভক্তি। এছাড়া পতিতাপল্লির ঘরে ঘরে কৃষ্ণ, কালী, দুর্গা, সরস্বতী, লক্ষ্মীর মূর্তি আছে। প্রত্যেক পতিতা কার্তিকের পুজো করে পরম নিষ্ঠায়। কার্তিকের সুন্দর চেহারা হয়তো তাদের আকৃষ্ট করে; হয়তো তারা কামনা করে—প্রতিরাতে সবাই না হোক অন্তত একজন কার্তিক ঠাকুরের মতো অনিন্দ্য চেহারার খদ্দের তাদের যেন জোটে। অথবা কার্তিক চিরকুমার। চিরকুমারের আধিক্য পতিতাব্যবসার অনুকূল। সমাজে যত কার্তিক, এই পাড়ায় তত কাস্টমার। তাই হয়তো পতিতাপল্লিতে কার্তিক ঠাকুরের জন্য এরকম নিবিড় শ্রদ্ধা।

মুসলিম পতিতারা বোরকা পরে, নেকাব দিয়ে মুখমণ্ডল ঢেকে কখনো কখনো আশপাশের মাজারে যায়। অসীম ভক্তিতে ধূপকাঠি মোমবাতি জ্বালায়। বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান মেয়েদের যাওয়ার মতো তেমন কোনো ধর্মস্থান নেই। বৌদ্ধ মন্দিরে বা গির্জায় মুখ ঢেকে যাওয়ার রেওয়াজ নেই। প্রকাশ্যে গেলে কেউ না কেউ চিনে ফেলার সম্ভাবনা বেশি। কারণ মন্দির বা গির্জাগামীদের কেউ কেউ তো তাদের খদ্দের। চিনে ফেলার পর লাঞ্ছিত করার জন্যে এরাই এগিয়ে আসবে আগে। তাই অপমানিত হবার ভয়ে বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান পতিতারা তাদের ধর্মস্থানে যায় না। ঘরের মধ্যেই বুদ্ধ বা যীশুকে স্মরণ করে, ভক্তি জানায়।

ফাগুন মাস, বুধবার। শিবরাত্রির ব্রত আজ। রাত দশটায় ত্রয়োদশী ছেড়ে যাবে। এরই মধ্যে পুজো এবং শিবলিঙ্গকে ডাবের জল অথবা দুধ দিয়ে স্নান করানো সম্পন্ন করতে হবে। তিথি উত্তরে গেলে স্নান এবং পুজোর কোনো মাহাত্ম্য থাকবে না। সন্ধে লাগার সঙ্গে সঙ্গে সাহেবপাড়ার পতিতারা এবং মাসিরা মগধেশ্বরীর মন্দিরে এসে জড়ো হতে শুরু করেছে। অধিকাংশের হাতে ডাব। তবে বনেদি মাসিরা কাঁসার লোটায় করে গরুর দুধ এনেছে, লোটাগুলোর মুখে কাঁসার সরাই। ঠেলাঠেলি এড়াবার জন্যে পূজারি-ব্রাহ্মণ লাইন করে শিবলিঙ্গের দিকে এগোবার অনুরোধ করছেন। কালু সর্দার বলে দিয়েছে—আজ শিবপুজোর অনুষ্ঠান, আজ শরীর বেচা কেনা বন্ধ। আজ সব নারী পবিত্র মনে মন্দিরে আসবে, পুজো দেবে।

সাহেবপাড়ার পূর্ব আর পশ্চিমের গলির প্রায় সব পতিতা কালীমন্দিরে সমবেত হয়েছে। লাইন ধরে ধীরে ধীরে নারীরা শিবলিঙ্গের দিকে এগোচ্ছে। লাইনের প্রথমে মোহিনী মাসি। তার পরনে দামি সাদা শাড়ি। শাড়ির আঁচলটি মাথার ওপর আলতো করে তোলা। কোনো পদাধিকার বলে সে প্রথমে দাঁড়ায়নি। সে সবার আগে দুধের লোটা নিয়ে এই মন্দিরে উপস্থিত হয়েছে, তাই সবার আগে দাঁড়ানোর সুযোগ তার মিলেছে। তার পেছনে নানা বর্ণের, নানা চেহারার, নানা বয়েসের মেয়েরা পরম ভক্তিভরে দাঁড়িয়ে আছে।

শিবলিঙ্গের মূল চত্বরে প্রবেশ করবার আগমুহূর্তে কোথেকে শৈলবালা এসে মোহিনীর পাশে উপস্থিত হল। মোহিনীকে পেছনে হটিয়ে শৈল সামনে জায়গা করে নিতে চাইতেই মোহিনী উষ্ণস্বরে বলল, ‘কী শৈলদি, আমাকে ঠেলে সামনে দাঁড়াতে চাইছ কেন? অনেক আগে এসেছি। তাই প্রথমে দাঁড়িয়েছি। পরে এসেছ, সবার পেছনে গিয়ে দাঁড়াও।’

শৈলবালা শীতল কণ্ঠে বলল, ‘মোহিনী, তুমি কি ভুইল্যা গেলা—আমি কে। আমি আগে আসি বা পরে আসি, লাইনের পরথমে তো দাঁড়ানোর অধিকার আমার।’

‘কেনো? কোন ক্ষমতাবলে তুমি পরে এসে সামনে দাঁড়াবে?’ মোহিনী জিজ্ঞেস করে।

‘জান না তুমি আমি কেডা। আমি যে এই পাড়ার কালু সর্দারের মা, সেটা কী তোমারে চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিতে অইবো না বুঝাইয়া দিতে অইবো।’ মোহিনীর মুখের দিকে তর্জনী পাকিয়ে শৈলবালা বলে।

মোহিনী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। উচ্চকণ্ঠে বলে উঠল, সর্দারের মা বলে দেমাকে তোমার মাটিতে পা পড়ে না। নিয়মের তোয়াক্কা কর না। ব্রাহ্মণের আদেশ মানতেও তুমি রাজি নও।’

‘আমি সর্দারের মা। আমি যা বলব এই মন্দিরে তা-ই অইবো, আমিই সবার আগে শিবের মাথায় দুধ ঢালুম।’ বলতে বলতে মোহিনীকে পেছনে ঠেলে দিয়ে জায়গা করে নিল শৈল।

মোহিনী অন্য দশজন সাধারণ মাসির মতো কালু সর্দারকে ভয় করে না। শৈলমাসিকে সর্দারের মা বলে সমীহ করে না। অধিকার বঞ্চিত হতে দেখে ফুঁসে ওঠে মোহিনী। প্রায় গর্জন করে বলে, ‘ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দেওয়ার আগে সামনে থেকে সরে যাও শৈল। না সরলে অপমানের চূড়ান্ত হবে।’

‘কী, কী কইলা তুমি? আমারে ধাক্কা দিবা? এই কে আছিস? আমার কালুকে ডইক্যা লইয়া আয়।’ আর্তনাদ করে উঠল শৈলবালা।

ঠিক ওই সময় সেখানে কালু সর্দার উপস্থিত হল। সে পুজোর তদারক করছিল। মায়ের চিৎকার তার কানে গিয়েছিল। কাছে গিয়েই সে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হইছে মা, চিৎকার করতাছ ক্যান?’

‘আমার কথা পরে শুনবি। আগে এই মোহিনী খানকিকে এই মন্দির থেকে সরাইয়া লইয়া যাও। মাগিরে চুলের মুঠি ধইরা গেইটের বাইর কইরা দাও।’ আদেশের সুর শৈলর কণ্ঠে।

‘কী হইছে বলবা তো?’ সর্দার জানতে চায়।

‘আমারে অপমান করছে। তুমি যদি আমার পোলা হও তাইলে অপমানের পরতিশোধ লও।’

‘কী তোমারে অপমান? দেখাইতেছি—’ বলে সর্দার মোহিনীর দিকে এগিয়ে যায়।

ঠিক ওই সময় মোহিনী এবং সর্দারের মাঝখানে এসে দাঁড়ায় পাঁচ- সাতজন ষণ্ডা মতন গাট্টাগোট্টা লোক।

সর্দার তাদের ভালোমতো খেয়াল করে না। ডান হাতে তাদেরকে ঠেলে দিয়ে মোহিনীর দিকে এগিয়ে যেতে চাইলে একজন ষণ্ডা সর্দারের ডান হাত চেপে ধরে। চাপাস্বরে বলে, ‘সাবধান সর্দার। আর একপা এগোবে না। মোহিনী দিদির দিকে আর একপা এগোলে এই হাত আর তোমার শরীরের সঙ্গে থাকবে না।

অবাক বিস্ময়ে কালু সর্দার লোকটির দিকে তাকাল। কে এ কালু সর্দারের হাত ভেঙে দেওয়ার আস্পর্ধা দেখাচ্ছে? হঠাৎ গলা চিড়ে রাগ বেরিয়ে এল তার। চিৎকার করে বলল, ‘এই সুবইল্যা, জামাইল্যা, রহমাইন্যা- তোরা কোথায়? এখানে আয়। এই খানকির পোলারে তুইল্যা লইয়া যা। মোহিনীর ব্যবস্থা আমি করতাছি।’

ত্বরিত সুবল, জামাল, রহমানরা সেখানে এসে পৌঁছাল। সবাই সশস্ত্ৰ। কিন্তু তারা জানে না তাদের চেয়েও বলবান এবং চৌকস ষণ্ডারা মোহিনীকে পাহারা দেয়। চিহ্নিত লোকটির দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগে তারা ছুরি বার করে। তাদের হিংস্র চেহারা দেখে সর্দার এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা দমে যায়। সর্দারকে উদ্দেশ্য করে নেতা ধরনের লোকটি বলে ওঠে, ‘মোহিনী দিদিই সবার আগে দুধ ঢালবে শিবের মাথায়। বাধা দিলে তোমার কল্লা উড়ে যাবে সর্দার।’

কালু সর্দার অনেকটা বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই পাড়ার হর্তাকর্তা সে। সে যা বলে, তা-ই এই পাড়ার আইন। মোহিনী কেন মোহিনীর বাপও সেই আইন মানতে বাধ্য। কিন্তু এরা কারা? এদের তো এ পাড়ায় আগে কখনো দেখেনি সে। এই রকম সশস্ত্র গুণ্ডারা আগে তো কখনো তার চোখে পড়েনি। তার সাগরেদরা তো কোনোদিন এদের কথা বলেনি। মোহিনীকে তো সে তেমন করে কোনোদিন পাত্তা দেয়নি। সে এত শক্তিশালী হয়ে উঠল কখন? সর্দার স্তব্ধ হয়ে এইসব কথা ভাবছিল। আর মোহিনী শৈলবালাকে পেছনে ফেলে শিবলিঙ্গের দিকে এগিয়ে গেল। সারিবদ্ধ পতিতারা এতক্ষণ সর্দার-মোহিনীর কাণ্ড দেখছিল।

শিবলিঙ্গের ওপর দুধ ঢেলে সদলবলে মোহিনী বেরিয়ে যেতেই কলকোলাহল শুরু হল। মন্দিরের ভেতরে এবং মন্দিরের বাইরে হই চই পড়ে গেল। এ কী কাণ্ড! সর্দারের থোতা মুখ ভোঁতা করে দিয়ে গেল? সর্দারের চেয়ে মোহিনীর শক্তি কম নয়! এতদিন বোঝা যায়নি। আজকে বোঝা গেল এই পাড়ায় কে সবচাইতে শক্তিমান—সর্দার না মোহিনী। এই ধরনের নানা টুকরাটাকরা কথা সর্দারের কানে এসে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। সর্দারের ভেতরে ভিসুভিয়াসের লাভা টগবগিয়ে উঠছে। বারবার কোমরে গোঁজা ছোরাটার দিকে ডান হাতটা চলে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে কালু নিজেকে সংবরণ করে রেখেছে। তার চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে গেছে। ঘামে কপাল মুখ গলা ভেসে যাচ্ছে। তার সঙ্গী মাস্তানরা তার দিকে আদেশের জন্যে তাকিয়ে আছে। সর্দার কিছুই বলছে না। এই সময় রক্তারক্তিতে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। পুজোর সময়। পুজো ভণ্ডুল হলে সাধারণ পাবলিকরা তার ওপর অসন্তুষ্ট হবে। যা করতে হবে পরে করবে। এখন পুজোটা সম্পন্ন করা সর্দার হিসেবে তার কর্তব্য। সুবল-জামালদের উদ্দেশ্যে যেন কিছুই হয়নি এমন কণ্ঠে বলে, ‘এই তোরা লাইনের তদারক কর। যেন কোনো বিশৃঙ্খলা না হয়। তারপর মায়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে নিচুস্বরে বলে, ‘মা, তোমার অপমান, আমার অপমান। এখন এই অপমানের প্রতিশোধ লওনের সময় না। শিবের মাথায় দুধ ঢাইল্যা চলে যাও। পরে প্রতিশোধ লমু।’ তারপর উঁচু কণ্ঠে বলল, ‘মা, যাও। শিবের মাথায় দুধ ঢাল।’

শৈলবালা রাগি কিন্তু বুদ্ধিমতী। নির্বিকার চেহারা নিয়ে শিবলিঙ্গের দিকে এগিয়ে গেল।

ভেতরে তপ্ত জ্বালা নিয়ে ঘরে ফিরে এল শৈলবালা।

.

গভীর রাত। চারদিক শুনশান। মাঝেমধ্যে গলির চিপাচাপা থেকে মদো মাতালের হল্লা শোনা যাচ্ছে। দূর থেকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ ভেসে আসছে। আজ ব্যবসা বন্ধ। তাই মেয়েরা পুজো থেকে ফিরে নাকে মুখে কিছু খাবার গুঁজে শুয়ে পড়েছে। উপবাসের ক্লান্তি তাদের সমস্ত শরীর জুড়ে। কেউ কেউ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আবার কেউ কেউ বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে। রাতের দ্বিপ্রহর পেরিয়ে ঘুমানোর অভ্যেস তাদের। আজ হঠাৎ করে প্রথম প্রহরে ঘুমানোর সুযোগ পেলেও ঘুম আসছে না তাদের। কেউ অলস চোখ মেলে তাকিয়ে আছে কড়িকাঠের দিকে অথবা পলস্তারা খসানো দেয়ালের দিকে। কেউ মনে মনে বাঁধাবাবু বা মনে-ধরা কোনো কাস্টমারের সঙ্গে রতিক্রিয়ায় মগ্ন। আবার কারও মন এই নরক পেরিয়ে, দেহ ঘাঁটাঘাঁটির যন্ত্রণা এড়িয়ে দূর গ্রামে ফিরে গেছে; পুকুরঘাটে, ছড়ানো উঠানে, আমবাগানের ছায়ায় ছায়ায় হাঁটছে। ছোট বোনের সঙ্গে খুনসুটি করছে মায়ের ধমক খেয়ে বাপের পাশ ঘেঁষে দাঁড়াচ্ছে!

পুজো শেষে পুরাহিতের পাওনা মিটিয়ে সাঙাতদের সঙ্গে দু’চার গ্লাস গিলে রাতের শেষ প্রহরে কালু সর্দার বাড়িতে ফিরে এল। বাড়ির দারোয়ান দরজা খুলে দিল। বসার ঘরে আলো জ্বলতে দেখে একটু অবাক হল সর্দার। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করল, ‘বসার ঘরে আলো জ্বলতাছে ক্যান? কে ওখানে?’

‘বড়মা বই রইছে অই ঘরে, হেই সইন্ধ্যাত্তোন। মন্দিরত্তোন ফিরি উপরে উড়ে নাই। হেই ঘরেই ঠায় বইয়া রইছে। কারো লগে কোনো কথা কইতাছে না।’ ধীরে ধীরে বলে দারোয়ান।

মাথাটা ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে সর্দার অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘কী অইছে মা তোমার? এই রকম ঝিম মাইরা বইস্যা রইছো ক্যান? খাও নাই? ঘুমাইতে যাও নাই?’

‘তোরে পেড়ে ধরছিলাম কি অপমানিত হওনর লাইগ্যা? কীসের সর্দার তুই? কোন বালের সর্দার। একটা ধাড়ি মাগি তোর চক্ষের সামনে সর্দারের মায়েরে অপমান করল–আর তিনি কানে কানে বললেন শিবের মাথায় দুধ ঢাইল্যা চইল্যা যাও মা। ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দার তুমি। অপমানে আমার শরীল জ্বালা করতাছে। ক্ষুধা তৃষ্ণা সব চইল্যা গেছে আমার। মোহিনী মাগির অপমানের পরতিশোধ না লইলে আমি অন্নজল মুখে দিমু না।’ একনাগাড়ে উষ্ণ কণ্ঠে কথাগুলো বলে গেল শৈলবালা।

মায়ের ঝামটা খেয়ে খোঁয়ারি কেটে গেল কালু সর্দারের। মায়ের কাছে এগিয়ে গেল সে, ডান হাতটা ধরে বলল, ‘মা তুমি ধইরা লইছো তোমার অপমানে আমার কইলজায় দাগ পড়ে নাই। পড়ছে। কসাইয়ের দায়ের নিচে ছাগলের কইলজা যেমন কুচিকুচি অয়, আমার কইলজাও তেমন অইছে। কিন্তু মা, আমি সর্দার। আমারে বুদ্ধি কইরা চলতে অয়। সেই সময় উত্তেজনা করলে খুনাখুনি অইয়া যাইতো। এর প্রতিশোধ আমি লমু। তবে ধীরে, মানুষ বুঝতে না পারে মতো করে। প্রতিশোধের রকম দেইখ্যা তুমি হাসবা, আনন্দে ফাইট্যা পড়বা। ‘

সর্দারের কথায় শৈলবালার মন ভিজল না। আগের মতোই জ্বালা ধরা কণ্ঠে বলল, ‘তুই যা কস আর তাই কস। একজন জাইল্যনি এই দত্তবাড়ির মাইয়ারে অপমান কইল্য হাজার মানুষের সামনে! আর তুই জড় ভরত অইয়া থাকলি?’

‘জাইলানি কেডা মা?’ অবাক কণ্ঠ সর্দারের।

‘ক্যান, অই মোহিনী। উত্তর পতেংগার জাইল্যাপাড়া থেকে এক ভাদাইম্যারে সোয়ামি পরিচয় দিয়া এইখানে আইসা উঠছিল মাগি। দেহে রূপযৌবন আছিল। ক্ষমতাবান বেডারা আটকে গেল তার যৌবন বড়শিতে। চাল চুলা ছিল না। একে একে ঘর করল, দোতলা করল। দেমাক বাড়ল তার। মাগি রাখল দশ-বিশটা।’ একটু থামল শৈলবালা। তারপর ধীরে ধীরে আবার বলল, ‘তাতে কী? হে কী দত্তবাড়ির মাইয়া? আমি দত্তবাড়ির বড় মাইয়া। একজন জাইল্যনি আমারে ঠোক্কর দিয়া গেল আমার পুতের সামনে?’

‘মা, তুমি আমারে কটা দিন সময় দাও। আমি মোহিনীর পেটের ভাত চাল কইরা ছাড়মু। জীবনের সকল আরাম আমি কাইড়া লমু মাগির, তোমার গা ছুঁইয়া শপথ করতাছি।’ তারপর দরদি কণ্ঠে বলে, ‘চল মা, উপরে চল। দুই মায়ে পুতে এক লগে ভাত খামু।’

সেই গভীর নির্জন রাতের শেষ প্রহরে মায়ে ছেলে দোতলার দিকে এগিয়ে গেল। উঠতে উঠতে অনেকটা স্বগতকণ্ঠে শৈলবালা বলল, ‘মোহিনী এত সাহস পাইল কোত্থেইকা? হের লগে অই মাস্তানরা আইল কেমনে?’

তুমি রাগ সংবরণ কর মা। আমি খবর লইতাছি জাইল্যনির এত শক্তির উৎস কোনখানে?’ কালু সর্দার বলল।

.

ধবধবে ফর্সা মুখ মোহিনীর। থুতনিটা একটু লম্বাটে। ওপরের সারির দাঁত সামান্য উঁচু। ধারালো নাক। নীলাভ চোখের গভীরতা যে-কোনো কাস্টমারের মনে কম্পন জাগাবার জন্যে যথেষ্ট। উত্তর পতেংগার গুড়ামোহনের বড় ভাই শ্যামাচরণ ছিল তার স্বামী। অভাবের সংসার। সংসারের অভাব মেটানোর জন্যে আবদুল গফুরকে প্রশ্রয় দিয়েছিল মোহিনী। একদিন ধরা পড়ে ঢেন্ডেরি খেল। আবদুল গফুর ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকল। সমাজে টিকা মুশকিল হল মোহিনীর। পা-চাটা স্বামী শ্যামাচরণকে নিয়ে একদিন এই সাহেবপাড়ায় চলে এল সে। তার রূপ এবং যৌবন তাকে থিতু করাল এই বেশ্যাপাড়ায়।

এরপর পেছনে আর ফিরে তাকাতে হয়নি মোহিনীকে। অল্প সময়ে তার রূপের কথা ছড়িয়ে পড়ল দালাল আর খদ্দেরদের মধ্যে। অসংখ্য কাস্টমার তার, অজস্র আয়। অনেক বছর পর একটা ছেলে হল তার। ছেলেটি শ্যামাচরণের না কোনো খদ্দেরের—এই নিয়ে মাথা ঘামাল না কেউ। শ্যামাচরণ মারা গেল একসময়। মোহিনীর বাঁধাবাবু জুটে গেল একজন। কাস্টম হাউসের বড়বাবু। খায়রুল আহসান চৌধুরী। বিপত্নীক। পঞ্চাশ ছুঁই ছুই বয়স। দুই কন্যা তাঁর। স্বামীর সঙ্গে একজন কানাডা আর অন্যজন আমেরিকায় থাকে। বিশাল সরকারি বাড়িতে বড়বাবুর একা একা রাত কাটে, দিন যায় কর্মব্যস্ততায়। সন্ধে থেকে নিঃসঙ্গ জীবন শুরু হয়। অনেক আগে থেকেই সন্ধেয় এক প্যাক খাওয়ার অভ্যেস তাঁর। রাত দশটায় ভাত খাওয়া হলে বাবুর্চি নিজ কামরায় চলে যায়।

রাত যত গভীর হয় খায়রুল আহসানের শরীরের ভেতরে ভাঙতে থাকে। আলুথালু দেহ নিয়ে রাত কাবার করে দেন তিনি। দেহযন্ত্রণা নিয়ে রাতের পর রাত কাটানোর ফলে চোখের নিচে কালি জমতে থাকে বড়বাবুর। বাবুর্চি আইয়ূব ব্যাপারটি টের পায়। সে মাঝেমধ্যে সাহেবপাড়ায় যায়। এক রবিবারে, দুপুরে ভাত খাওয়ানোর পর আইয়ুব সাহস করে সাহেবের কাছে কথাটি পারে। মোহিনীর দেহসৌন্দর্যের বর্ণনা দেয়। সাহেব প্ৰথমে মৌন থাকলেও পরে সাড়া দেন। মোহিনী সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান। দু’চার দশ কথা বাড়িয়ে মোহিনীকে উপস্থাপন করে আইয়ুব।

আইয়ুবই একরাতে মোহিনীকে নিয়ে আসে সাহেবের বাংলোয়, আত্মীয়া পরিচয় দিয়ে। তারপর দীর্ঘ দশটি বছর এইভাবে মোহিনীর যাতায়াত চলতে থাকে। মাঝখানে বছর তিনেকের জন্যে খায়রুল আহসান খুলনায় বদলি হয়ে গিয়েছিলেন। ফিরে এসেছেন। ফিরে আসার পর মোহিনীকে আরও মোহনীয় বলে মনে হতে লাগল খায়রুলের। এই খায়রুলকেই একরাতে কালু সর্দারের বাড়াবাড়ির কথা বলেছিল মোহিনী। বডিগার্ডের প্রস্তাব দিয়েছিল খায়রুল। মোহিনী না না করে উঠেছিল। খায়রুল মোহিনীর বারণ শোনেনি। পাঁচ-ছয় জন বডিগার্ড নিয়োজিত করেছিল। বডিগার্ডের কথা এতদিন শুধু মোহিনী জানত আর খায়রুল আহসান জানতেন। আজ মন্দিরে সবাই জেনে গেল। এতদিন মোহিনী এই বডিগার্ডের গুরুত্ব বোঝেনি। আজ হাড়ে হাড়ে টের পেল।

খায়রুল আহসান নিয়োজিত বডিগার্ড না থাকলে আজ তাকে কী অপমানটাই না সইতে হতো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *