০১. বড় আনাড়ি তোর আনা কাস্টমার

কসবি – হরিশংকর জলদাস
প্রথম প্রকাশ – ফেব্রুয়ারি ২০১১

উৎসর্গ
সঞ্জয় গাইন আমার ঢাকাজীবনের নিত্যসঙ্গী

এক

‘অই সেলিম্যা, পোলাখোর একটারে ধইরা লইয়া আইছস ক্যান?’ ঘরের ভেতর থেকে ক্রুদ্ধ কণ্ঠ ভেসে আসে দেবযানীর।

‘কী হইছে?’ পাশের ছোট্ট ঘরটিতে বসে থাকা সেলিম জিজ্ঞেস করে।

‘বড় আনাড়ি তোর আনা কাস্টমার।’ আধো আলোর ঘরটি থেকে আলুথালু বেশে বেরিয়ে আসে দেবযানী। চোখেমুখে রাগের ঝাঁজ তখনো লেপ্টে আছে।

সেলিম দেবযানীর কথার মাহাত্ম্য কিছুই বুঝতে পারে না। বোকা বোকা চেহারা নিয়ে দেবযানীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

কখনো কখনো কাস্টমারের সঙ্গে কারবার শেষ করে দেবযানী যখন খেলাঘর থেকে বেরিয়ে আসে, তখন তার সমস্তমুখে এক ধরনের অনুরাগের প্রলেপ মাখানো থাকে। সেটা অল্প সময়ের জন্যে। দীর্ঘ বিশ বছরের অভিজ্ঞতায় সেলিম এটা বুঝে গেছে, অনুরাগের আভাটি অল্প সময়ের জন্যে হলেও খাঁটি। এই ধরনের মেয়েরা মনমতো কাস্টমার পেলে কিছু সময়ের জন্যে বাস্তবতাকে ভুলে যায়। প্রকৃত প্রেমিকার শিহরণ অনুভব করে শরীরে, কখনো কখনো মনেও। শরীরের শিহরণ বেশিক্ষণ টিকে থাকে না, অন্য কাস্টমার এসে তা দুমড়ে মুচড়ে দেয়। শরীর বেচাকেনার এই বাজারেও মনের শিহরণ অনেকক্ষণ, মাঝে মাঝে কয়েকদিনও স্থায়ী হয়। তখন দেবযানীদের মতো মেয়েদের মন থাকে ফুরফুরে, আচরণ হয় গেরস্থি নারীর মতন। হয়তো কোনো একরাত কোনো কাষ্টমার শরীরের সঙ্গে সঙ্গে দেবযানীদের মনও জাগাতে পারল। সেই কাস্টমার তার কাজ শেষ করে চলে গেল, ঘরের বউয়ের সঙ্গে বা প্রেমিকার সঙ্গে স্বাভাবিক জীবন শুরু করল, সেই কবে ক্ষণিক প্রয়োজনে বা উত্তেজনায় দেবযানীদের অতিথি হয়েছিল ও হয়তোবা ভুলে গেল। কিন্তু দেবযানীরা মন-জাগানিয়া সেই অতিথিকে ভুলতে পারে না। ক্ষণে ক্ষণে শুধু মনে পড়ে। সেই সুখ-স্মৃতি নিয়ে অনেক জঘন্য কাস্টমার পার করে তারা। আশায় থাকে, সামনের কোনো একদিন মন-জাগানিয়া অন্য কোনো কাস্টমার আসবে তার ঘরে।

দেবযানীরও মাঝেমধ্যে এরকম হয়। খেলাঘর থেকে বেরিয়ে এলে দেবযানীকে অস্বাভাবিক প্রশান্ত দেখায়। সেলিম তখন তাকিয়ে তাকিয়ে দেবযানীকে দেখে। দেবযানীর চোখে তখন কৃত্রিম ঝিলিক থাকে না, ঠোঁটের কোনায় কাস্টমার-টানা হাসি থাকে না, ডান স্তনটা আঁচলের বাইরে থাকে না। এক নিবিড় শান্ত ভাব তখন দেবযানীকে ঘিরে রাখে। মাথায় আঁচল তোলা থাকে তখন তার। কণ্ঠে উগ্রতা থাকে না। গিন্নির মতো মোলায়েম কণ্ঠে কথা বলে।

আবার যেদিন তার ঘরে শরীর-চাটা কাস্টমার আসে, পশুর মতো শক্তি প্রয়োগ করে পাওনাগণ্ডা বুঝে নিতে চায়, সেদিন দেবযানীর মন তিরিক্ষি হয়ে ওঠে। শরীরের আনাচে-কানাচে হাতাতে থাকা এই কাস্টমারদের ঘেন্না করে দেবযানী। এই ধরনের কাস্টমারকে শালার বাইচ্চা’ বলে দেবযানী। শালার বাইচ্চারা কাম শেষ করে বেরিয়ে গেলে সে ঝিম মেরে বিছানায় শুয়ে থাকে। কাদা-থিকথিকে উঠানে কেঁচো কিলবিল করতে দেখলে মনে যেরকম ঘেন্না জাগে, সেরকম ঘেন্না শরীরে জড়িয়ে দেবযানী চোখ বন্ধ করে আলো-আঁধারের ঘরটিতে শুয়ে থাকে। অন্য কাস্টমার এলে তাদের ফিরিয়ে দেয়। তারপর স্নান ঘরে ঢোকে দেবযানী, সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে গা ডলে।

আজকের ঘটনাটা অন্যরকম।

দেবযানী চট্টগ্রামের বেশ্যাপল্লি সাহেবপাড়ার নামকরা বেশ্যা। সেলিম তার দালাল। অনেক বছর আগে সে মাগির দালালি শুরু করলেও গত দু’বছর ধরে দেবযানীর সঙ্গে আছে। দেবযানী দিনে কাস্টমার বসায় না। রাতেও তিন চার জনের বেশি কাস্টমার সে ঘরে তোলে না। সাধারণ কাস্টমার তার ঘরে যেতে সাহস করে না। তার ঘরের শানশওকত, তার দেমাক, তার হাই রেইটের কথা শুনে সাধারণ কাস্টমাররা তার ঘরের দিকে চোখ তুলে তাকায় শুধু, ভেতরে ঢোকার সাহস করে না। রইস আদমিরাই দেবযানীর কাষ্টমার। অধিকাংশ কাস্টমারকে তার সেলিমই নিয়ে আসে। এইসব কাস্টমার ধনী, শিক্ষিত।

সেলিম আজ যাঁকে এনেছে তিনি একটা কলেজের অধ্যক্ষ, সেকান্দর হোসেন তাঁর নাম। সেলিম সেকান্দর হোসেনের এক সময়ের বন্ধু। নিমতলা হাইস্কুলে দু’জন একসঙ্গে ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছেন। দু’জনের মধ্যে খুব ভাব ছিল সে সময়। বাপ মারা যাওয়ায় পরিবারের নয়জনের খাবার জোগাড় করবার দায় সেলিমের ঘাড়ে এসে পড়ে। পড়া ছেড়ে দিয়ে এটা সেটা করতে করতে শেষ পর্যন্ত সাহেবপাড়ায় এসে থিতু হয় সেলিম। সেও প্রায় বিশ বছর আগের কথা। বিশ বছর ধরে মাগিপাড়ার আয় দিয়েই সেলিম পরিবারের ভরণপোষণ করছে। এজন্যে সেলিমের কোনো দোনামনা নেই, মাগির দালাল—এই ভেবে সে লজ্জাও পায় না। বাপ মারা যাবার পর কী না করেছে সে? রিকশার গেরেজে কাজ করেছে, রিকশা টেনেছে, ঠেলাগাড়ি ঠেলেছে, চা দোকানে বয়ের কাজ করেছে, বশির হাটে মাছ বেচেছে, সদরঘাট কালিবাড়ির পাশে কসাইয়ের দোকানে মাংস কেটেছে, লায়ন সিনেমায় টিকেট ব্ল্যাক করেছে। সেখান থেকে ভাসতে ভাসতে একদিন এই সাহেবপাড়ায়। এই সাহেবপাড়া সেলিমকে বাঁচবার সুযোগ দিয়েছে, পরিবারের খাই-খরচ জুগিয়েছে। যে যা-ই বলুক, তাতে সেলিম গা করে না। সে যে বেশ্যার দালাল সেটা বলতেও সে লজ্জা পায় না।

সেদিন সন্ধ্যায় বটতলি রেলস্টেশনে সেকান্দর হোসেনের সঙ্গে সেলিমের দেখা। টিকেট করতে এসেছিলেন সেকান্দর। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সেকান্দরকে দূর থেকে দেখে চেনা চেনা মনে হয়েছিল সেলিমের। কাছে এগিয়ে গিয়েছিল সে। কানের লতি চুলকাতে চুলকাতে ডান দিকে ফিরতেই সেলিমের ওপর চোখ পড়েছিল সেকান্দরের। মুহূর্তেই চিনে ফেলেছিলেন সেকান্দর।

‘আরে সেলিম না?’ সেলিমকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে সেকান্দর বলে উঠেছিলেন, ‘সেকান্দর, আরে সেকান্দর হোসেন আমি। ওই যে নিমতলা হাইস্কুল, ক্লাস নাইন।’

সবকিছু খোলসাভাবে মনে পড়ে গিয়েছিল সেলিমের। ‘ওরে সেকান্দররে, কেমন আছরে ভাই? এতদিন পরেও তুমি আমারে চিনলা ক্যামনে রে ভাই’—বলতে বলতে সেলিম প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেকান্দরের ওপর।

সেকান্দর লাইন থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। দু’জনে নিরালা জায়গা বেছে নিয়ে সেই সন্ধ্যায় অনেকক্ষণ কথা বলেছিলেন। সেকান্দর জেনেছিলেন সেলিমের জীবনকথা, আর সেলিম জেনে নিয়েছিল সেকান্দরের গত পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনিতিহাস। সে যে বেশ্যার দালাল—সেকথা সেকান্দরকে জানাতে লজ্জা করেনি সেলিম। সেকান্দরও সেলিমের সামনে নিজেকে খুলে মেলে ধরেছিলেন। বলেছিলেন—ঘরে প্রায় উন্মাদ বউ, ছেলেটি হোস্টেলে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।

‘বড় অতৃপ্ত জীবনরে ভাই। বউকে কাছে পেতে চাইলে চিৎকার করে ওঠে। শরীরে যন্ত্রণা নিয়ে কলেজের চাকরিটা করে যাচ্ছি কোনোরকমে।’ দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে সেকান্দর বলেছিলেন।

‘তুমি ঢাকা থেকে ফিরি আস। তোমাকে দেবযানীর কাছে লই যাব। শরীর ঠাণ্ডা হবে।’ সেলিম বলেছিল।

‘কে দেবযানী?’ গভীর আগ্রহে জানতে চেয়েছিলেন সেকান্দর। ‘যেদিন লই যাব সেদিন দেখবে, দিল খুস হয়ে যাবে তোমার।

.

আজ সেলিম সেই সেকান্দরকে নিয়ে এসেছিল দেবযানীর ঘরে। পরিচয় পেয়ে যত্নআত্তি করে ঘরেও ঢুকিয়েছিল দেবযানী। শেষ মুহূর্তে গিয়ে বিপত্তিটা বাধালেন সেকান্দর। কেন জানি, চূড়ান্ত সময়ে দেবযানীর মলদ্বারকে বেছে নিলেন সেকান্দর হোসেন। তারপর দেবযানীর ওই চিৎকার ‘পোলাখোর একটারে।।‘

.

সেলিম দেবযানীর খেলাঘরে উঁকি দিল। ওই নামেই ঘরটিকে ডাকে দেবযানী। সে মাঝেমধ্যে বলে পঁচিশ ত্রিশ মিনিটের খেলা যে ঘরে সাঙ্গ হয়, তাকে তো ওই নামেই ডাকা উচিত। সেলিম দেখল বিছানার চাদর এলোমেলো, কোমর-বালিশটি খাটের একপাশে ঝুলে আছে। খাটের পাশের ছোট্ট চেয়ারটিতে সেকান্দর বসে আছেন, মাথা নিচু করে হাত দুটো জড়াজড়ি করে কোলের ওপর রেখে চুপচাপ বসে আছেন তিনি। পাকা চুলগুলো এলোমেলো। এই বয়সেও সেকান্দরের ঘন চুল। একসময় কলপ দিতেন চুলে। হঠাৎ করে বুক ব্যথায় আক্রান্ত হলেন তিনি। একটা সময়ে ব্যথা মৃদু থেকে প্রবল হতে থাকল। নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করে অভিজ্ঞ ডাক্তার বললেন–আর কলপ লাগানো যাবে না। কলপ আপনার বালুবের ক্ষতি করছে। দু’ধরনের টেবলেটও খেতে দিলেন ডাক্তার।

সেই থেকে সেকান্দর চুলে কলপ দেন না। সেই থেকে তার বুকের ব্যথা বন্ধ, চুল সাদা। সাদা চুলের সেকান্দরের কাছে এগিয়ে গেল সেলিম। ঠাহর করে দেখল—সেকান্দরের শার্টের বোতাম লাগানো হয়নি। শ্যামলা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

সেলিম হাত ধরে বলে, ‘কী অইছে দোস্ত, এই রকম কইল্যা কেনো?’ সেকান্দর কোনো জবাব দেন না। শুধু চোখ তুলে তাকান সেলিমের দিকে। সেলিম দেখে—সেকান্দরের চোখে ব্যর্থতা আর লজ্জা মিলেমিশে একাকার।

‘আইচ্ছা চল, বাইরে যাই।’ সেলিম বলে।

সেকান্দর উঠে দাঁড়ান। পকেট থেকে এক গোছা নোট বের করে বালিশ চাপা দিয়ে রাখেন। সেলিমকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘চল যাই, তোমার দেবযানীকে বল আমাকে ক্ষমা করে দিতে।’ মাথা নিচু করে দেবযানীর খেলাঘর থেকে বেরিয়ে আসেন সেকান্দর হোসেন।

বাইরে তখন দরজায় দরজায় রূপের হাট বসেছে। রূপে-মুগ্ধ শরীর কিনিয়েরা দরদামে ব্যস্ত। রূপকন্যারা কাউকে হাত ধরে টানছে, কাউকে চোখমুখের ভেল্কিতে কাত করতে চাইছে। দূরের আঁধার কোণে দাঁড়িয়ে কোন মোদো অশ্লীল ভাষায় গাইছে –

সখিরে কে বলে তোমায় মন্দ–
চারিদিকে বাল মাঝখানে খাল,
সেখানে বেজায় গন্ধ।

এইসব খিস্তিখেউর আর শরীর বেচাকেনার হাট পেরিয়ে সেলিম ও সেকান্দর স্ট্র্যান্ডরোডে এসে দাঁড়ায়। সেলিমের ভেতর একটা প্রশ্ন তখনো ঘুরপাক খাচ্ছে। আঁধার মতন একটা জায়গা বেছে নিয়ে সেকান্দরকে দাঁড় করাল সেলিম। জিজ্ঞেস করল, ‘কী অইছিল সেকান্দর, পথ ছাড়ি আপথ বেছে নিলা কেনো? তুমি বিবাহিত মানুষ, পথ না চিনার কথা তো না!’

সেকান্দর কোনো জবাব দেন না; পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে একটা সিগারেট সেলিমের দিকে এগিয়ে দেন, আর একটা নিজে ধরান। জ্বলন্ত সিগারেটে একটা জোর টান মেরে নাক-মুখ দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া ছাড়েন। তারপর বলেন, ‘ওই সময়ে আমার কী হল বুঝতে পারছি না। দেবযানীর পুষ্ট স্তন, চেকনাই পেট কোমর দেখে আমার মাথাটা হঠাৎ এলোমেলো হয়ে গেল। বউয়ের চিমসে স্তন, কুঁচকানো পেট আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম দেবযানীর ওপর। তারপর কী হল সঠিক করে এখন আর বলতে পারব না। হুঁশ এল তোমার দেবযানীর চিৎকারে। আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সে ওইভাবে চিৎকার করে উঠল। কী লজ্জা!’

বিস্ময় আর কৌতুকভরা চোখে সেলিম তাকিয়ে থাকে সেকান্দরের দিকে।

দুই

দেবযানী রূপবতী।

তার মতো সুন্দরী আর ছলায়কলায় পারদর্শী বেশ্যা সাহেবপাড়ায় দু’চারজন নেই।

তার আগে, এই পাড়ায় পদ্মাবতীর খুব নামডাক ছিল। পদ্মাবতী অসাধারণ রূপসী ছিল। পদ্মাবতী যাকে তাকে ঘরে বসাত না। তার জনাকয়েক বাঁধা কাস্টমার ছিল। তারাই পদ্মাবতীর রূপে-রসে ডুবসাঁতার দিত। পদ্মাবতীর ডিমান্ডও ছিল অনেক বেশি। তার কাস্টমাররা ছিল বনেদি পদ্মাবতীর পেছনে টাকা ওড়াতে ওরা কার্পণ্য করত না। পদ্মাবতীও অকৃতজ্ঞ ছিল না। নানাজনকে নানা সময়ে আসতে বলত, যাতে এক মধুকরের সঙ্গে আরেক ভোমরার সাক্ষাৎ না ঘটে। যতক্ষণ ওরা পদ্মাবতীর ঘরে থাকত, ছলায় এবং ছলনায় তাদেরকে বিভোর করে রাখত। আগামী রাতের নিবিড় ঘোর নিয়ে তারা বর্তমান রাতে বিদায় নিত।

আবদুল জব্বার সওদাগর ছিল পদ্মাবতীর খাস নাগরদের একজন :

সেদিন সাঁঝবেলাতে পদ্মাবতীর ঘরে এক সাহেব এল ইউরোপিয়ান সুঠাম দেহ। বয়স তেত্রিশ না তেতাল্লিশ দেখে বোঝার উপায় নেই। এত সুশ্রী বিদেশি এপাড়ায় কমই দেখা যায়। রতইন্যা দালালই নিয়ে এসেছিল পদ্মাবতীর কাছে। না না করেও এক পর্যায়ে সাহেবটিকে বিছানায় নিতে রাজি হয়ে গিয়েছিল পদ্মাবতী।

চেহারা ম্যাদামারা হলেও পদ্মাবতীর বিছানায় খেলাটা দেখালো সে অবাক হবার মতো। এতদিন পদ্মাবতীর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এই বেশ্যাপাড়ায় যত মাগি আছে, তাদের মধ্যে কলাকৌশলে সে-ই সেরা। কিন্তু এই সাহেব তার সঙ্গে শুতে এসে দেখিয়ে দিল—অনেকগুলো কৌশল তার অজানা। সে বেশ উপভোগ করছিল। সাহেবটির পদ্ধতিগুলো শিখেও নিচ্ছিল। মনে মনে ভাবছিল—এই নতুন কৌশলগুলো দিয়ে বাঁধা কাস্টমারদের চমকে দেবে। একজন সাধারণ কাস্টমারকে যতটুকু সময় দেয় দামি বেশ্যারা, তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি সময় দিয়ে ফেলেছিল পদ্মাবতী, ওই সাহেবকে। সময় গড়িয়ে গিয়েছিল সন্ধে থেকে রাতের দিকে।

ঘরের বাইরে মোক্ষদার আওয়াজ শুনে বাস্তবে ফিরেছিল পদ্মাবতী। মোক্ষদা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বলেছিল, ‘সদাগর আইছে, আবদুল জব্বার সদাগর। বসার ঘরে বই রইছে।’

পদ্মাবতীর তখন রতিক্লান্ত দেহ, চেহারা আলুথালু। সাহেবের উদোম শরীরের পাশে সে তখন তার নগ্ন শরীরটি বিছিয়ে রেখেছিল।

সওদাগরের সামনে দিয়ে বিদেশিটি মাথা উঁচু করে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে পদ্মাবতীর ঠোঁটে গাঢ় চুম্বনও এঁকে দিয়েছিল সে। বাম হাতে প্যান্টের চেইন টানতে টানতে ডান হাতে পেছনের পকেট থেকে মানিব্যাগটি বের করে এনেছিল। এক গোছা ডলার পদ্মাবতীর নগ্ন স্তন দুটোর মাঝখানে রেখে গালটা আলতো করে টিপে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল সাহেবটি।

পদ্মাবতীর ঘর থেকে সাহেবটিকে বের হয়ে আসতে দেখে সওদাগরের ফুরফুরে মেজাজ খিঁচড়ে গেল। মাথার শিরাগুলো চিড়বিড় করে উঠল সাহেবটিকে বিশ্রী একটা গালি দিতে গিয়ে থেমে গেল। গালিটা পেটে চালান করে দিয়ে পদ্মাবতীর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল আবদুল জব্বার সওদাগর।

কিন্তু অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও পদ্মাবতী যখন এল না, ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে তখন প্রবল বেগে সওদাগরের মনে নোনাজল ঢোকা শুরু করল। আজকে তো তারই আসার কথা, সেজেগুজে শরীরে ঢেউ তুলে তার জন্যেই তো আজকে অপেক্ষা করার কথা পদ্মাবতীর। কিন্তু তা না করে কোন এক হারামজাদা ফিরিঙ্গির সঙ্গে লীলা করল তারই উপস্থিতিতে!

দু’দুটো বউ তার ঘরে। ছোটটির যৌবন-রস মারাত্মক। সন্ধেয় নূপুর সিনেমায় নিয়ে যেতে আবদার করেছিল। সেখানে শাবানা-রাজ্জাকের কী যেন একটা ছবি চলছে। যেমন কাহিনী, তেমন গান। কাজের মেয়েটিই এসব কথা বলেছে ছোটবউকে। বউটি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল— সওদাগরকে নিয়ে ছটা নটার শো-তে ছবিটি দেখবে। সন্ধেয় ভালো জামাকাপড় পরে ঘাড়ে- গলায়-বুকে সেন্ট মেখে বেরিয়ে আসার মুখে বউটি এসে সামনে দাঁড়িয়েছিল সিনেমা দেখার আবদার করেছিল। রাগটা মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল সওদাগরের, তবে তা মুহূর্তের জন্যে। মুখে প্রশান্ত হাসি ছড়িয়ে চিবুকটা একটু নাড়িয়ে দিয়ে সওদাগর বলেছিল, ‘আজিয়া একখান দরকারি কাম পড়ি গেইয়ে গই সোনা। হেডে যাওন পড়িবো। কালিয়া তোঁয়ার সোনা ভিজাই দিয়ম সিনেমাত্‌ লই যাইয়ম, ডায়মন্ড বিরানি খাইয়ম দোনোজনে।’

ছোটবউটি তারপরও পথ ছাড়েনি। বলেছিল, ‘আজিয়া লই গেলে ক্ষতি কী?’

সওদাগর মনে মনে বলেছিল, ‘ঘর কা মুরগি ডাল বরাবর। ভোরে লই সিনেমাত্‌ যাই সময় নষ্ট গরনর সময় আঁত্তোন করুন? আল্লাই আঁর পদ্মা বই রইয়ে। পদ্মানদীর মাঝি হওন পড়িবো আঁত্তোন। হেই নদীর ঘোলা পানিত্‌ মাছ ধরন পড়িবো।‘

প্রকাশ্যে বলেছিল, ‘হামিদা, গুরা মাইয়াপোয়ার মতো কা গ‍ইত্যা লাইগ্য? আজিয়া কাম আছে, দরকারি কাম, কালিয়া লই যাইয়ম।

হামিদাকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল সওদাগর।

পদ্মার ঘরে এসে নৌকা বাওয়া তো দূরের কথা, খোদ নদীরই দেখা পেল না এখনো। মেজাজতো খিঁচড়ে যাবেই, মেজাজের আর দোষ কি?

মোক্ষদা বসার ঘরের এককোণে কেরোসিনের স্টোভে সওদাগরের জন্যে চায়ের জল গরম করছিল। সওদাগর সোফা থেকে উঠে ঘরের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত পায়চারি করল কিছুক্ষণ। বার বার তাকাতে লাগল পদ্মার শোবারঘরের দিকে। কিন্তু পদ্মার কোনো পাত্তাই নেই। শেষ পর্যন্ত অস্থির কণ্ঠে সওদাগর মোক্ষদাকে বলল, ‘পদ্মরানিকে জিজ্ঞেস কর, সে আসবে কিনা? আমি চলে যাব কিনা?’

আবদুল জব্বার সওদাগরের আদেশ শুনে মোক্ষদা তাড়াতাড়ি ভেতরঘরের দিকে গেল। পদ্মাবতীর ঘরের দরজা ভেজানো। দরজা ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢুকে দেখল, পদ্মা শুয়ে আছে। চোখ বোজা শরীর উদেশ শুধু বালিশের পাশে অনেকগুলো ডলার জড়ো করা। মোক্ষদা ধীর পায়ে খাটের পাশে গিয়ে চাপাস্বরে বলল, ‘সদাগর রাগি গেছে গই। জিজ্ঞেস কইচ্ছে আন্নে আইবেন কিনা?’

মোক্ষদার কথা পদ্মাবতী কানে তুলল কিনা বোঝা গেল না। শুধু ডান হাত দিয়ে স্তনদুটো আড়াল করে বাম দিকে কাত হয়ে শুলো।

মোক্ষদা আবার বলে উঠল, ‘আন্নে হুইছেন নি…‘

তার কথা শেষ হবার আগেই ডান হাত ওপর দিকে তুলল পদ্মাবতী। সেই হাতের ভাষা—চুপ থাক মোক্ষদা। কথা বলিস না।

মোক্ষদা সেই হাতের ভাষা বুঝল। কিন্তু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল না। একদৃষ্টিতে পদ্মাবতীর পুষ্ট, পেলব, গোলাকার স্তন দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকল। অজান্তে নিজের স্তনের ওপর মোক্ষদার বাম হাতটা উঠে এল। একটা দীর্ঘশ্বাস মোক্ষদার বুক চিড়ে বেরিয়ে এল। ব্লাউজের নিচে চুপসে যাওয়া তার স্তন দুটো স্তূপাকার মাংসপিণ্ডের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে।

পদ্মাবতীর দেহ ক্লান্ত হলেও মন এখন একেবারে ফুরফুরে। গোটা জীবনে সে অনেককে দেহ দিয়েছে। কত সক্ষম পুরুষ দেখেছে সে। কত অক্ষম পুরুষ তার দেহ দেখে এবং ঘেঁটেই তৃপ্ত থেকেছে, পুরুষত্বের পরীক্ষা দিতে গিয়ে দরজা থেকে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে ফিরে গেছে। কত উন্মাদ পুরুষকে দেহ দিতে হয়েছে তার, যারা তার দেহকে দলিত মথিত করে নরককুণ্ডে পরিণত করেছে। আবার অনেক সভ্য-ভদ্র পুরুষ তার দেহপ্রার্থী হয়েছে, যারা অত্যন্ত মোলায়েম সুরে কথা বলেছে, স্নিগ্ধ শীলিত হাত দিয়ে তার দেহের খানাখন্দের সুলুকসন্ধান করেছে।

কিন্তু আজকের এই সাহেবের রীতিকৌশলের মধ্যে কী ছিল—তা এখনো সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারছে না পদ্মাবতী। এক সতেজ স্পর্শ, দেহে মনে জোয়ার জাগানিয়া এক প্রবল সামর্থ্য সাহেবটির মধ্যে ছিল, যা তাকে এখনো বিভোর করে রেখেছে। বিভোরতা তার কাটতে চাইছে না। তার চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না, শরীর ঢাকতে ইচ্ছে করছে না। সওদাগরের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে মন চাইছে না। আজকের সন্ধেটা এভাবেই কাটুক না, রাতটা বিভোরতার মধ্যে ফুরিয়ে যাক না! এই রাতটি না হয় শুধু তার হয়েই থাকুক! অন্য দশটি রাত থেকে এই রাতটি শুধু তার একার হোক! এই রাতে শুধু সে আছে, আর আছে নাম না জানা সাহেবটি।

এই সময় গলা খাঁকারি দিয়ে মোক্ষদা আবার তার অস্তিত্ব জানান দিল।

এবার পদ্মাবতী চোখ খুলল, বেশ বড় করেই খুলল। সে চোখ এখন আর স্নিগ্ধ নয়, কোনো শিহরণেও তার চোখ দুটো থির থির করে কাঁপছে না এখন। একটা গভীর অসহিষ্ণুতা পদ্মাবতীর দু’চোখ জুড়ে। বিরক্ত চোখে পদ্মাবতী মোক্ষদার দিকে তাকাল। চোখে চোখ রেখে মোক্ষদা থতমত খেয়ে গেল। কী বলবে ঠিক করার আগেই পদ্মাবতী স্পষ্ট উচ্চারণে বলল, ‘কী হয়েছে মোক্ষদা? তুমি আমার সঙ্গে এতদিন আছ, তুমি এখনো আমাকে বুঝতে শিখলে না?’ মনোহারী উচ্চারণের সঙ্গে পদ্মাবতীর সুরেলা কোমল কণ্ঠ মিশে এক অসাধারণ আবহ তৈরি করল সে ঘরে।

মোক্ষদা বলল, ‘না বইলছিলাম…।’

শোয়া অবস্থায় বাম হাতটি তুলে মোক্ষদাকে থামিয়ে দিল পদ্মা। তারপর বলল, ‘সওদাগর এসেছে—এই সংবাদ নিয়ে তুমি প্রথমবার এসেছিলে। আমি হাত তুলে তোমাকে আমার অসম্মতির কথা জানিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম—তুমি আমার অঙ্গভঙ্গি বোঝ?’

‘বুঝি তো। আঁই আন্নার দেহের ভাষা, মুখের ভাষা বেয়াগিন বুঝি তো!’

‘যদি বোঝ, তাহলে আবার এলে কেন?’

‘আঁই কিয়া কইত্তাম ক’ন? হেতে আঁরে ডরইংরুমে টিকতো দের না। কঅর পদ্মরানিত্তোন জিজ্ঞেস কর—আই থাকুম না যামু গই। হেতার চাপাচাপি আঁই সইয্য কইত্তে নো পারি আন্নার কাছে আবার আইছি।’ মোক্ষদা থেমে থেমে তার অসহায়তার কথা বলে গেল।

‘বুঝলাম। এখন তুমি গিয়ে সওদাগরকে বল—আজ পদ্মরানি কারও সঙ্গে দেখা করবে না।’ পদ্মার অবিচল কণ্ঠ

‘আন্নে আর ইক্কিনি বুঝি চান। আন্নার কাছের মানুষ। পইসাঅলা। আন্নারে ভালোবাসে। হেতারে ফিরান উচিত অইবো নি, আর ইক্কিনি ভাবি চান।’ পরামর্শের ভঙ্গিতে বলল মোক্ষদা।

রাগটা আর ভেতরে ধরে রাখতে পারল না পদ্মাবতী। বিরক্তিতে তার মুখ কুঁচকে গেল, চোখের কোনা লাল হয়ে উঠল। অনেকটা উচ্চকণ্ঠেই বলল পদ্মাবতী, ‘ভা-লো-বা-সা? বেশ্যার প্রতি সওদাগরের ভালোবাসা? বেশ্যাকে কে ভালোবাসে? বেশ্যাখোররা বেশ্যাকে নয় বেশ্যার শরীরটাকে ভালোবাসে। সওদাগররা কড়ি ফেলে আর আমাদের মতো খানকির শরীর থেকে যৌবন নিঙড়ে নেয়। তুমি মোক্ষদা, তোমার যৌবন শেষ করেছ এই বেশ্যাপাড়ায়, এখন জীবন শেষ হতে চলেছে তোমার। তুমি কী এতোদিনেও এই কথাটা বোঝনি?’

‘বুঝেছি। আমি যৌবন এবং জীবনের বিনিময়ে বুঝেছি।’ মোক্ষদা আবেগতাড়িত হলে শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলে। পদ্মাবতীর কথায় সে আবেগমথিত হয়েছে।

‘তা হলে যাও। গিয়ে সওদাগরকে বল—পদ্মাবতী আজ কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে না। শরীর দেওয়া তো দূরের কথা।

মোক্ষদা মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পদ্মাবতী আলনা থেকে তাঁতের শাড়িটি আলতো করে টেনে নিল। গায়ে জড়িয়ে নিয়ে আবার চোখ বুজল।

কিন্তু তখন চোখে তার আর মাদকতা নেই। কেন জানি শরীরের অনির্বচনীয় শিহরণ কোথায় উবে গেছে। রক্তকণিকায় এক গভীর আলোড়ন সে অনুভব করতে লাগল। চোরা স্রোতের মতো রাগটা শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল। অথচ তার রাগ করার কথা নয়। তার যতজন কাস্টমার আছে, তাদের মধ্যে এই আবদুল জব্বার সওদাগরকে সে বেশি পছন্দ করে। মাঝারি বয়স হলেও শরীরে যৌবনের তেজ বহন করে সওদাগর। লেখাপড়া তার বেশি না, কিন্তু একধরনের স্নিগ্ধ রুচিশীল ম্যানার তাকে ঘিরে থাকে সর্বদা। তার কণ্ঠ উঁচু নয়, সে মদ্যপ নয়। পদ্মাবতীর স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে সওদাগরের কড়া নজর।

তার কাস্টমারদের অধিকাংশই ধনী। নানা বয়সের তারা, নানা রুচিরও। একটা জায়গায় তাদের গভীর মিল। পদ্মাবতীর শরীর নিয়ে তারা যখন খেলে, তখন সবাই উন্মাদ হয়ে ওঠে। মদ তাদের উন্মাদনা বাড়ায়। মদে ও নারীতে তারা সাঁতার কাটে। তখন তাদের রুচি সিকেয় ওঠে। পদ্মাবতীর ঠোঁট নিয়ে, স্তন নিয়ে, শরীরের নানা ভাঁজ নিয়ে ওরা এতই উন্মত্ত হয়ে ওঠে যে, মানুষ পদ্মাবতীর অস্তিত্ব তাদের চিন্তা থেকে খসে পড়ে। পদ্মাবতীর কষ্ট তাদের কাছে আনন্দ বলে মনে হয়।

তারা যখন মর্দনে চুম্বনে পশু হয় ওঠে, পদ্মাবতী তখন ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে। পদ্মাবতীর কঁকিয়ে ওঠাকে ওরা শীৎকার মনে করে। ওদের দৈহিক নির্যাতনে পদ্মাবতীর শরীর যখন কুঁকড়ে যায়, ওরা তখন ভেবে নেয়—চরম শিহরণে পদ্মার শরীর বুঝি দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। দেহে অনেক কষ্ট নিয়ে, মনে নিবিড় ঘৃণা নিয়ে পদ্মাবতী অস্থিরভাবে অপেক্ষা করতে থাকে রমণেচ্ছুদের রতিপাতের।

জব্বার সওদাগর কিন্তু সেরকম নয়। তার একটা সুশোভন রুচি আছে। অথচ সে রুচি তার থাকার কথা ছিল না। খাতুনগঞ্জে ব্যবসা তার—চালের আড়ত। বিশাল আড়ত তার। গোটা ত্রিশেক মানুষ সে আড়তে খেটে খায়। চালের আড়ত বলে চুরি-চামারিও হয় বেশি। ছোটোখাটো চুরির ব্যাপারগুলো এড়িয়ে যায় আবদুল জব্বার। কিন্তু মজুরদের চালের বস্তা চুরির ঘটনা যখন ধরা পড়ে, চাল বিক্রির টাকার হিসেব ক্যাশিয়ারের ক্যাশবইতে না তোলার ব্যাপারটি যখন নজরে আসে, তখন সওদাগর মেজাজটি আর ফুরফুরে রাখতে পারে না। মুখ দিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালি বেরিয়ে আসে তখন, চোর শ্রমিকদের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করে না। কিন্তু মানুষ হিসেবে আবদুল জব্বার সওদাগর অসাধারণ। পরোপকারী। নামাজ-রোজা-জাকাত কিছুই বাদ দেয় না সে। বউ-সন্তানদের প্রতি তার ভালোবাসা-কর্তব্যের কমতি নেই। পরিবারবর্গের প্রতি আর আত্মীয়স্বজনের প্রতি তার অনুরাগ এবং কর্তব্যপরায়ণতা সুবিদিত। কিন্তু একজনের ব্যাপারে সে কারও সঙ্গে, কিছুর সঙ্গে কপ্রোমাইজ করতে রাজি নয়। সে পদ্মাবতী।

পদ্মাবতী বেশ্যা। বেশ্যাগমন গুনাহ। কবিরা গুনাহ। এই গুনাহ করলে হাবিয়া দোজখে যেতে হয়—সবই জানে সওদাগর, বিশ্বাসও করে। কিন্তু কারণে-অকারণে, সময়ে-অসময়ে পদ্মাবতীর কথা মনে পড়ে যায় সওদাগরের। সন্ধেয় তার রক্তকণিকা চঞ্চল হয়ে ওঠে। পদ্মাবতী–সম্মিলনের জন্যে তার ভেতর একধরনের আকুতি জমা হতে থাকে। সন্ধে নাগাদ সেই আকুতি প্রবল হয়ে ওঠে। সমাজ-সংসার, স্ত্রী-সন্তান, মানসম্মানের ব্যাপারটি তার মগজ থেকে বিলোপ হয়ে যায় তখন। চোখে শুধু ভাসতে থাকে পদ্মাবতীর চেহারা। একটা প্রচণ্ড আকুতি নিয়ে সে পদ্মাবতীর ঘরে উপস্থিত হয়। প্রতি সন্ধেয় পদ্মাবতীর ঘরে তার আসার নিয়ম নেই। সপ্তাহের দুটি সন্ধ্যা সওদাগরের জন্যে নির্ধারিত সেই সেই সন্ধ্যায় তো আসেই সওদাগর, কখনো কখনো অনির্ধারিত সন্ধ্যাতেও এসে পড়ে। তখন পদ্মাবতীর ঘরে থাকে অন্য বাঁধা কাস্টমার।

সওদাগরকে দেখে মোক্ষদা বলে, ‘আন্নার তো আজিয়া আইনর কথা না সদাগর।’

সওদাগর সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়, ‘জানি।’

‘তইলে আইলেন কিল্লাই?’ মোক্ষদা জানতে চায়।

‘এমনিতে।’ পদ্মাবতীর কক্ষের দরজার দিকে তাকিয়ে উদাসভাবে উত্তর দেয় সওদাগর। মনে মনে বলে, ‘তুমি তো বুঝবে না মোক্ষদা কেন ছুটে আসি আমি পদ্মাবতীর কাছে। তাকে একনজর না দেখলে মনটা যে আমার আনচান করে ওঠে। তাকে দেখলেই তৃপ্তি।’

মোক্ষদা যেন সওদাগরের মনের কথা পড়তে পারে। বলে, ‘আঁই জানি সদাগর, আন্নে পদ্মাবতীরে ভালোবাসি ফেইলছেন। হেৱে চাইবাল্লাই, হেরে ইক্কিনি ছুঁইবাল্লাই আন্নার হরানডা আঁইঠাঁই করে।’

সওদাগর চুপ করে থাকে। অতি চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস সওদাগরের বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে।

মোক্ষদা করুণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে বলে, ‘আজিয়া পদ্মাবতীর ঘরে রহমত উল্লাহ। হেতে বঅর জাউরগা। পদ্মারে কষ্ট দিব আইজ। গোড়া রাইত জ্বালাইব।’

সওদাগর ঝিম ধরে ড্রইংরুমের সোফায় বসে থাকে অনেকক্ষণ। তারপর হঠাৎ করে উঠে পড়ে। বলে, ‘আজকে যাই মোক্ষদা।’ বলে ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সওদাগর। মোক্ষদা করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে সওদাগরের যাওয়ার পথের দিকে।

সওদাগরের জন্যে নির্ধারিত সন্ধেয় পদ্মাবতী অন্যরকম সাজগোজ করে। মুখে পাউডারের সামান্য প্রলেপ, চোখে কাজলের দুটো টান, কপালে টকটকে লাল টিপ। কানে লম্বাটে দুল ঝুলায় পদ্মা। সামান্য বাতাসে দোল খায় সেই দুল। হাতওয়ালা ব্লাউজ পরে তাঁতের কোনো আনকোড়া শাড়ি যখন গায়ে জড়িয়ে নেয় পদ্মাবতী, মায়াময় অথচ মাদকতাপূর্ণ একটি ঘূর্ণি তৈরি হয় তাকে ঘিরে। অন্য কাস্টমারদের মোক্ষদা দরজা খুলে দিলেও সওদাগরকে দরজা খুলে দিয়ে স্মিত হেসে সামনে দাঁড়ায় পদ্মাবতী।

খোলা দরজায়, পদ্মাকে সামনে নিয়ে, স্থির দাঁড়িয়ে থাকে সওদাগর। হড়বড় করে অনেক কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায় সওদাগরের, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই বেরোয় না। নিষ্পলক চোখে পদ্মার দিকে তাকিয়ে থাকে সওদাগর। তার কাছে তখন স্ত্রী-সন্তান অসার মনে হয়, ব্যবসাবাণিজ্য, সামাজিক অবস্থা ও অবস্থান অর্থহীন বোধ হয়। তার চোখের চারদিকে অন্ধকার হয়ে আসতে থাকে। শুধু মণি দুটো জ্বলতে থাকে। সেই মণিতে শুধু পদ্মাবতী।

‘সওদাগর, কিছু বলছ না যে? দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি দরজায়? ভেতরে আসবে না?’

পদ্মার প্রশ্নে সংবিৎ ফিরে সওদাগরের। পদ্মাকে ছোঁয়ার, তাকে জড়িয়ে ধরার এক তীব্র আকুতি তখন অনুভব করতে থাকে সওদাগর।

পদ্মাবতীকে দু’বাহু বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরতে গেলে পদ্মা বলে ওঠে, ‘মানুষের সামনে জড়াজড়ি করবে নাকি সওদাগর?’ বলেই খিলখিল করে হেসে ওঠে পদ্মা। নিজেই এগিয়ে এসে সওদাগরকে জড়িয়ে ধরে, উন্নত স্তন দুটো দিয়ে পদ্মা সওদাগরের বুকে চাপ দেয়। তারপর সেই জড়ানো অবস্থায় সওদাগরকে নিয়ে শোবার ঘরে ঢোকে। দরজা ভেজিয়ে দেয়।

মোক্ষদা ড্রইংরুমের এক কোণে, আঁধার মতন জায়গায় দাঁড়িয়ে পদ্মা- সওদাগরের কাণ্ড দেখে। এই শেষ বয়সেও তার গা শিরশির করে ওঠে, জবুথবু স্তনের বোঁটায় কাঁপন অনুভব করে মোক্ষদা। পদ্মা-সওদাগর শোবার ঘরে ঢুকে গেলে মূল দরজায় খিল তুলে দেয় মোক্ষদা। জানে—আগামী দু’তিন ঘণ্টা মোক্ষদার কোনো ডাক পড়বে না। সে নিজের ছোট্ট ঘরটির দিকে এগিয়ে যায়।

.

পদ্মাবতীর বকা খেয়ে মোক্ষদা সওদাগরের সামনে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। মোক্ষদা কিছু বলবার আগেই জব্বার সওদাগর বলে ওঠে, ‘তাহলে মোক্ষদা, তোমার পদ্মাবতী আজকে আমাকে সাক্ষাৎ দেবে না, না?’

মোক্ষদা কোনো জবাব না দিয়ে ডান হাত দিয়ে বাম হাতের কনুই চুলকায়। সওদাগর আবার বলে, ‘কিছু বলছ না কেন, আজ আমি ফিরে যাই, এটাই কি পদ্মরানি চায়?’

‘আঁই কিয়া কইত্তাম কন সদাগর। হেতিরে আঁই কত করি বুঝাইলাম, হাত-পা ধরন বাকি রাখছি শুধু। হেতির এক কথা—আজিয়া কারও লগে দেখা কইত্তাম নো, সদাগরেরে কও আজিয়া চলি যাইতো।’ মোক্ষদা সওদাগরের দিকে না তাকিয়ে কথাগুলো বলে গেল।

‘আইচ্ছা। আমি যাই তাহলে মোক্ষদা।’ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বুক চিড়ে বেরিয়ে এল সওদাগরের।

মোক্ষদা কোনো উত্তর না দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে সওদাগরের দিকে তাকিয়ে থাকল।

আবদুল জব্বার সওদাগর তার ভেঙে পড়া শরীরটা টানতে টানতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তার চলার দিকে তাকিয়ে মোক্ষদার মনে হলো কেউ যেন তার কাঁধে দুই মণি একটা চালের বস্তা চাপিয়ে দিয়েছে।

নিচের তলায় সস্তা দেহজীবিনীদের আস্তানা। আট-দশটা বেশ্যা সেখানে থাকে। কী কারণে সেখানে আজ গানের আসর বসেছে। আশপাশ থেকেও বেশ কজন বেশ্যা এসে জুটেছে সে আসরে। সোহানা মুখে-গালে পাউডারের মোটা প্রলেপ মেখে আসরের মাঝখানে খেমটা নাচছে। তাকে ঘিরে সবাই গোল হয়ে বসেছে। কাদের মোল্লা তবলা বাজাচ্ছে। আর ক্ষীরোদ বাজাচ্ছে হারমোনিয়াম। সোহানা নাচতে নাচতে গানও গাইছে।

ধীরপায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে জব্বার সওদাগরের কানে ভেসে আসে সোহানার গান –

আশে রেখেছি রে প্রাণ, সে কি রে আসিবে ফিরে।
সুখ সাধ অবসাদ ভাসিতেছি আঁখি নীরে।।
সে মোহিনী প্রেম গান প্রণয়েরি সুখ তান
আবেশে আকুল পোড়া প্ৰাণ;
জ্বলে জ্বলে ধিকিধিকি জেগে উঠে ধীরে ধীরে।
কে আর সোহাগ ভরে, ধরিয়ে হৃদয়োপরে,
মুছাবে মরম ব্যথা আদর করে,
প্রেম ডোরে বাঁধি মোরে, পরাবে রে মোতি হীরে।।

বেশ্যাদের স্বীকৃতিবিহীন আঁধার জীবনে গানই এনে দেয় বহুবর্ণ আলোর ঝিলিক। এ ঝিলিক ক্ষণকালের, তারপরও এ ক্ষণিক আলোর ঝলকানিতে এরা পরস্পর পরস্পরের আনন্দ-স্পন্দিত মুখগুলো দেখে নেয়।

তিন

হাঁড়িধোয়া মেঘনার একটি শাখা নদী।

কোনো এককালে, মেঘনার ভরা যৌবনে, জলের একটা বলবান ধারা নরসিংদীর বোয়াকুড়ায় ঢুকে পড়েছিল। এই ধারাটি কালক্রমে হাঁড়িধোয়া নদী নামে পরিচিতি পায়। স্থানীয় মানুষরা এটিকে অবশ্য বলে হাঁড়িদোয়া। এই হাঁড়িধোয়া নদীটি নরসিংদীর পশ্চিম দিক দিয়ে ঢুকে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাসের জলে নিজেকে সমর্পণ করেছে। বোয়াকুড়ার পাশে হাজীপুর ও বীরপুর গাঁ, কাছাকাছি। এই দুটো গাঁয়ের মাঝখান দিয়ে হাঁড়িধোয়া বয়ে গেছে। হাঁড়িধোয়া আহমরি নদী নয়। সাহসী যুবকরা সাঁতরে এই নদী পেরোয়। বউ-ঝিরা নৌকায় করে এগাঁয়ে ওগাঁয়ে আত্মীয়বাড়িতে যায়।

বীরপুর হাজীপুরের যেটুকুতে হাঁড়িধোয়া বয়ে গেছে, তার দু’তীর ঘেঁষে সব মেছোপল্লি। নদীর সঙ্গে গা লাগিয়ে দাসদের বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে। এখানে যারা মাছ মারে, তাদের পদবি দাস; দু’দশ ঘর যে মল্লবর্মণ নেই এমন নয়। তবে অধিকাংশই দাস পরিবার। দাস বা মল্লবর্মণ, নামের শেষে যা-ই লিখুক না ওরা, হিন্দু বা মুসলমানরা ওদের জেলে হিসেবেই চেনে। বলে ওরা মেছো।

হাঁড়িধোয়ার উত্তরপারে বীরপুর আর দক্ষিণপারে হাজীপুর। হাজীপুরের বেশ দক্ষিণে মেঘনার মূলধারা। কী এক অজানা কারণে হাঁড়িধোয়া আর মেঘনার মাঝখানের হাজীপুর গাঁয়ে সুতা মিহি হয়, যেমন হয় শীতলক্ষ্যার দক্ষিণপারে। একদা খুব দ্রুত হাজীপুরে তাঁত শিল্প গড়ে ওঠে। তাঁতের প্রকোপে পড়ে হাঁড়িধোয়ার দক্ষিণপারের জেলেপল্লিগুলো সরে পড়তে থাকে গাঁয়ের গভীরে। আর সেখানে তৈরি হতে থাকে একের পর এক তাঁতের কারখানা। এই কারখানাগুলোকে ঘিরে স্কুল, হাটবাজার, নানা দোকানপাট। হাঁড়িধোয়া নদী দিয়ে সওদাগরি নৌকা আসে নানাস্থান থেকে; নানা কিসিমের কাপড়, সুতা খোলে ভর্তি করে নৌকাগুলো আবার পাল তোলে। সুতা- কারখানাগুলোর বর্জ্যে হাঁড়িধোয়ার জল রং হারাতে থাকে আর নদী হারাতে থাকে তার শস্য।

বীরপুরের জেলেপাড়াটি পূর্ব-পশ্চিমে প্রসারিত। হাঁড়িধোয়ার একেবারে তীর ঘেঁষেই এক সারি ঘর বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেছে। এই সারিটির মুখোমুখি অন্য একটি সারি। দুই সারির মাঝখানে মাঝখানে উঠান উঠানগুলোর কোনোটি বড়, আবার কোনোটি একচিলতে। এই জেলে পাড়াটি দাসপাড়া নামে পরিচিত। প্রায় দু’শোটি পরিবার বাস করে এই দাসপাড়ায় দু’চার দশজন এখানে ওখানে ছোটোখাটো চাকরি করলেও অধিকাংশ‍ই মাছমারা জেলে। নিকট হাঁড়িধোয়ায় বা দূর মেঘনায় মাছ মেরে এদের জীবন চলে। কেউ কেউ বটতলি বা বাঁশবাজারে মাছ বেচে। বেশির ভাগ জেলেপরিবারের একটি করে নৌকা আছে, তক্তার নৌকা। হাঁড়িধোয়ায় সেই নৌকায় করে জাল পাতে তারা। জালে কখনো মাছ পড়ে, আবার কখনো পরিবারের দু’বেলা অন্ন জোগানোর মতো মাছ ওঠে না। তখন উপোস। খেয়ে না খেয়ে দিন চলে দাসদের।

শৈলেশ দাস। বীরপুরের দাসপাড়ায় তার বাড়ি। তিন কামরার একটি টিনের ছাওয়া ঘর আর আলাদা একটা রান্নাঘর নিয়ে শৈলেশের বাড়িটি বউটি তার বেশ লম্বা। বউয়ের পাশে দাঁড়ালে শৈলেশকে বেশ বেঁটে দেখায় : পাড়ার লোকেরা তাকে বাইট্যা শৈলেশ বলে। শৈলেশ এমনিতে বেঁটে নয়, কিন্তু স্ত্রীর পাশে তাকে খুব বেঁটে মনে হয়। বাঁইট্যা শৈলেশ ডাকলে তার খুব রাগ হয়। রাগটা কার ওপর, তা শৈলেশ ঠিক করতে পারে না। মাঝে মাঝে প্রতিবেশীদের ওপর তার খুব রাগ হয়, তারাইতো তার এই বিকৃত নামটি প্রচার করেছে। আবার ভাবে—তাদেরই বা দোষ কী, বউয়ের পাশে তাকে সত্যিই তো বেশ খাটো দেখায়। প্রতিবেশীদের ওপর থেকে রাগটা যশোদার ওপর এসে স্থির হয়। যশোদা এত লম্বা হতে গেল কেন? মেয়েদের এত লম্বা হবার প্রয়োজন কী আর লম্বা হলোই যদি, তার ঘাড়ে এসে পড়ল কেন যশোদা?

যশোদাকে তো সে বিয়ে করতে চায়নি। দূর সম্পর্কের জেঠা রামকুমার যশোদাকে বিয়ে করতে মা-বাপ মরা শৈলেশকে তো অনেকটা বাধ্যই করাল। বাপ মরে যাবার সময় দুটো পাতনি জাল, দুটো খরা জাল, একটি নৌকা আর গাছগাছালিতে ভরা এই বাড়িটি রেখে গিয়েছিল। তখন তার বয়স আর কত? গভীর রাতে কোনো কিশোরীকে স্বপ্নে দেখে ঘুম ভেঙে যাবার বয়স তখন তার। স্বপ্ন দেখার কষ্টকে মনে-দেহে চেপেচুপে রেখে নদী-খালে মাছ ধরে যাচ্ছিল শৈলেশ। তারপরও মাঝেমধ্যে রাতের বেলা দেহ জেগে উঠত তার। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে সে বুঝতে পারত তার পরিধেয় ধুতি বা লুঙ্গির সামনের অংশ ভেজা ভেজা। বাঁ হাত দিয়ে সে ভেজা অংশ চটকাতে চটকাতে তার মনে পড়ে যেত—স্বপ্নে যেন কোন এক অজানা কিশোরী এসে তাকে বিব্রত করেছে, তার সামনে বিবস্ত্র হয়েছে। স্বপ্ন- দুঃস্বপ্নের মধ্যে সাঁতার কাটা জীবনের একটা সময়ে টুপ করে তার মা-টা মারা গেল।

রাতে মা-ছেলে একত্রে বসে ভাত খেয়েছিল। সেদিন বিকেলে হাঁড়িধোয়ায় খরা জাল পেতেছিল শৈলেশ। নানা মাছের সঙ্গে একটা মাঝারি আকারের ইলিশও ধরা পড়েছিল। মা বলেছিল—’ইলিশটা আজগা বাজারে লইয়া যাইছনা শৈলেশ। ইলিশ খাইছি অনেকদিন। সইষ্যা লইয়া আইছ। সইষ্যা বাইট্যা ইলিশ রানমু।’

শৈলেশ মায়ের প্রস্তাবের প্রতিবাদ করেনি। তারও ইলিশ খেতে খুব ইচ্ছে করছিল। এমনিতে টানাটানির সংসার না তাদের। বাজার থেকে ইলিশ কিনে খাওয়ার মুরোদ নেই তাদের। তাই নিজের থুতু নিজে গিলে ফেলার মতো ইলিশ খাওয়ার ইচ্ছেটাকেও গিলে রেখেছিল শৈলেশ। আজ মায়ের প্রস্তাবে বহুদিনের ইচ্ছেটা চাগিয়ে উঠল শৈলেশের মনে। মায়ের কথায় সায় দিয়ে সে বলল, ‘ঠিকই কইছো মা। ইলিশ খাইছি কতদিন! পোস্তসইষ্যা আনমু। ভালো কইরা রানবা।’

সেরাতে অনেক যত্ন করে সর্ষেবাটা ইলিশ রেঁধেছিল শৈলেশের মা। চুলা থেকে নামানোর আগে কুচি কুচি করা ধনেপাতা ছিটিয়ে দিয়েছিল, চার- পাঁচটা কাঁচা মরিচ ফালা ফালা করে আগেই মিশিয়ে দিয়েছিল।

শৈলেশ বড় তৃপ্তির সঙ্গে ভাত খেয়েছিল সেরাতে। মাছ রান্না হয়েছিল অমৃতের মতো। অমৃত কোনোদিন খায়নি শৈলেশ। অমৃত কী, তাও ভালো করে জানে না সে। শুধু জেঠা রামকুমারের কাছে শুনেছে—অমৃত স্বৰ্গীয় জিনিস। দেবতাদের খাবার এটি। দেবতারা ছাড়া আর কারও অমৃত খাবার অধিকার নেই। অমৃত খেলে নাকি কেউ আর মরে না, চিরজীবনের জন্যে অমর হয়ে যায়

এই অমৃতের অধিকার নিয়ে নাকি অসুর ও দেবতাদের মধ্যে একসময় মরণপণ লড়াই হয়েছিল। দেবতারই জিতেছিল সে লড়াইয়ে। অমৃতের অধিকার চলে গিয়েছিল দেবতাদের হাতে। সুযোগসন্ধানী দেবতারা আজ অমৃত খেয়ে অমর হয়ে গেছে। আর প্রবল প্রতাপশালী অসুররা যম দেবতার ইচ্ছাধীন থেকে গেছে।

জেঠাকে শৈলেশ জিজ্ঞেস করেছিল, ‘জেডা, অমৃত দেখতে কেমন?’

‘আমি কী জানি অমৃত দেখতে কেমন। কোনোদিন তো এই পোড়া চোখে অমৃত দেখি নাই। তবে একদিন আমি মেঘনায় মাছ ধরার এক ফাঁকে বাবাকে জিগাইছিলাম—বাপরে, অমৃত দেখতে কেমন? বাপ তখন জাল থেকে নৌকায় মাছ তুলতে ব্যস্ত। মাছ তুলতে তুলতে বলছিল—হালুয়ার মতো হইবো বোধ হয়! তবে যে খুব মিষ্টি হইবো—সেই বিষয়ে সন্দেহ নাই।’ রামকুমার শৈলেশের জিজ্ঞাসার উত্তরে বলেছিল।

শৈলেশ অবাক চোখে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তবে সত্যিই কি অমৃত হালুয়ার মতন?’

রামকুমার জেঠা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিল, ‘আমি তো জানি না বাপ। গরিব বাপ আমার, ভালা খাওনর লাইগা অনেক লোভ ছিল তার। কিন্তু পয়সার অভাবে ভালা খাবার খাইতে পারতো না। হালুয়ার লাইগা তার খুব লোভ ছিল। তাই সেই কাঠফাটা দুপুরে অমৃতের বর্ণনা দিতে গিয়া তার হয়তো হালুয়ার কথাই মনে পড়ছিল।

অমৃতের স্বাদ হালুয়ার মতো হোক বা অন্য কিছুর মতো, অমৃতের স্বাদ যে তুলনাহীন এটা বুঝে গিয়েছিল শৈলেশ। সেরাতে সর্ষেবাটা ইলিশ দিয়ে ভাত খেতে খেতে দেবতাদের অমৃত খাওয়ার তৃপ্তিই পেয়েছিল শৈলেশ। খেতে খেতে মাকে বলেছিল, ‘অমা, তোমার ইলিশ রান্নাডা অমৃতের মতো স্বাদ অইছে।’

হাজারো বলিরেখা মুখে নিয়ে মা হেসেছিল। আরেক টুকরা ইলিশ শৈলেশের পাতে তুলে দিতে দিতে বলেছিল, ‘খা, বাবা খা। পেট ভইরা খা, মনডা ভইরা খা।’

মায়ে-পুতে খাওয়া শেষ করেছিল একসময়। হাঁড়ি পাতিল গোছাতে গোছাতে মা বলেছিল, ‘পাতিলে বেশ কিছু মাছের টুকরা রয়ে গেছে। আগামীকালও সইষ্যেবাটা ইলিশ দিয়ে ভাত খেতে পারবি।’

পরদিন সর্ষেবাটা ইলিশ দিয়ে আর ভাত খাওয়া হয়নি শৈলেশের। মা- টি তার রাতের বেলায় মরে গেল। সকালে ঘুম থেকে জাগাতে গিয়ে শৈলেশ দেখল, তার মা চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে, মুখটি হাঁ করা। কাছে গিয়ে শৈলেশ বুঝল, তার মা অনেক আগেই মরে গেছে। মায়ের হাত-পা ঠাণ্ডা, শক্ত। মুখের চারপাশ ঘিরে বেশ কটি মাছি ভন ভন করছে।

মাগো তুমি আমারে ছাইড়া কই গেলারে মা!’ শৈলেশের বুকফাটা চিৎকারে পাড়ার মানুষ জড়ো হয়েছিল তাদের উঠানে, ঘরে। বউরা চোখের জল ফেলেছিল। বৃদ্ধারা হা-হুতাশ করেছিল, ‘আহারে বেচারা শৈলেশ, বাপ মারা গেইছে অনেক আগে, মা-টা ছিল লাঠি। সেই অবলম্বনও ঠুস কইরে মইরে গেল! এখন শৈলেশ কোথায় যাবে গো!’

বয়সি পুরুষরা শৈলেশের মাকে শ্মশানে নিয়ে গিয়েছিল। শৈলেশ মুখাগ্নি করেছিল মায়ের। ব্রাহ্মণ বাম কাঁধে উত্তরীয় জড়িয়ে দিয়ে, লুঙ্গির মতো করে ধুতি পরিয়ে বলেছিল, শৈলেশ, তোমাকে মায়ের লাইগা একমাস অশৌচ পালন করন লাগবো। নিরামিষ খাইতে অইবো, ধর্মকর্ম মাইন্যা চলতে অইবো।’

শৈলেশ মুখে কিছু বলেনি। নীরবে চোখের জল ফেলেছিল। মনে মনে বলেছিল, ‘মাগো, তুমি তো চইলা গেলা। আমারে কেডা রাইন্ধা খাওইবো? কেড়া আমার এখন তখন খোঁজ-খবর লইবো?’

শ্মশানে শৈলেশের মায়ের মৃতদেহটি নিয়ে যাবার পর প্রতিবেশী শিবাজীর মা পাকঘরের বাসি তরকারি-ভাত নদীপারে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিল। সর্ষেবাটা ইলিশ মাছ কাকরা ঠুকরে ঠুকরে খেল।

মাস চলে গেল। কামানি গেল, মাসিক শ্রাদ্ধ গেল। শৈলেশ হাত পুড়ে, চুলার ধোঁয়ায় চোখ লাল করে দু’বেলা রেঁধে খেতে লাগল। এইভাবে বছর গড়িয়ে গেলে জেঠা রামকুমার শৈলেশকে একদিন বলল, ‘শৈলেশ, তুই একটা বিয়া কর।’

‘কারে বিয়া করুম জেডা? কে আমারে মাইয়া দিব? মা নাই, বাপ নাই। কে তার মাইয়াটারে জলে ধাক্কা মাইরা ফেলাই দিব?’

রামকুমারের হঠাৎ দিগ্বিজয়ের কথা মনে পড়ে গেল। গত হাটবারে বাঁশবাজারে দিগ্বিজয়ের সঙ্গে দেখা। হাজীপুর থেকে মাছ বিক্রি করতে এসেছিল দিগ্বিজয়। রামকুমারও তার খরা জালের মাছ নিয়ে দিগ্বিজয়ের পাশে বসেছিল। মাছ বেচা প্রায় শেষ। দিগ্বিজয়ের কৈ, মাগুর, পুঁটি বেশ বড় ছিল। কিনিয়েরা ছেঁকে ধরেছিল তাকে। মাছ বিক্রি শেষে সে কোমর সোজা করে দাঁড়াল। খাড়াং-এর তলায় সের খানেক পুঁটি তখনো পড়ে ছিল।

‘ভালাই দাম পাইছো বলে মনে অয় দিগ্বিজয়।’ রামকুমার বলে।

দিগ্বিজয় বলে, ‘হ দাদা, নিজের জালের মাছ। গতরাতে মেঘনায় ভালা মাছ ধরা পড়ছে। দামও পাইছি আজ ভালা।’

‘তো, তোমার সংসার কেমন চইলতাছে?’ রামকুমার জিজ্ঞেস করে।

‘সংসার তো ভালাই চইলতাছে। তয় মনে বড় দুঃখ। চাইরটা মাইয়া ঘরে। বড় তিনটা বিয়ার উপযুক্ত অইছে। বিয়া অয় না।’

‘কেরে, বিয়া অয় না কেরে? সম্বন্ধ আসে না? মাইয়া কি কালা ছালা?’ রামকুমার জিজ্ঞেস করে।

দিগ্বিজয় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘সম্বন্ধ আসে দাদা। মাইয়া কালা ছালা না। আমার মাইয়ারা সোন্দর। তারপরও মাইয়া দেইখ্যা বর পক্ষ ফিরা যায় গা। জিগাইলে কয়, মাঝারো নাইলে ছোডটারে বিয়া দাও, বউ কইরা লইয়া যাই!’

‘কেরে, বড়টার কী অইছে?’

‘বড় মাইয়াডা লাম্বা ধরনের। তয়, মাইয়াডা সোন্দর। কিন্তু বেশি লাম্বা দেইখ্যা যশোদাকে কেউ বউ হিসেবে পছন্দ করে না। কয় তালগাছের মতন মাইয়া। লাম্বা বউ অলক্ষ্মী। ইত্তা শুইন্যা শুইন্যা মাইয়াডা আমার মন মরা অইয়া থাহে। তুমি দাদা আমার মাইয়াডারে একটা গতি কইরা দেও। তোমাদের পাড়ায় না অইলে যেইহানে পার আমার মাইয়া যশোদার একটা বিয়ার বাও কইরা দেও।’ রামকুমারের হাত ধরে কাকুতি মিনতি করতে থাকে দিগ্বিজয়।

রামকুমার ধীরে ধীরে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, ‘তুমি এত পাগল অইও না দিগ্বিজয়। দেহি তোমার মাইয়ার বিয়ার কোনো একটা গতি কৰ্ত্তারিনি।

আজকে শৈলেশের কথায় দিগ্বিজয়ের বড় মেয়ের কথা মনে পড়ে গেল রামকুমারের। বলল, ‘আছে, একটা মাইয়া আমার হাতো আছে। তুমি রাজি থাকলে মাইয়ার পক্ষ বিয়া দিতে রাজি অইবো। তয়, মেয়েডা একটু লাম্বা।’

যশোদাকে দেখে শৈলেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল—এত লম্বা মেয়ে, এত স্বাস্থ্যবান! যশোদাকে বিয়ে করা যাবে না। জানিয়েও দিয়েছিল রামকুমারকে, যশোদাকে সে বিয়ে করতে রাজি নয়।

‘কেরে বিয়া করতি না বাবা? লাম্বা দেইখ্যা? লাম্বাটা দেখলি — শইলের রঙডা দেখলি না। ইড়া ছাড়া বাইচ্চা অইবো মোডাতাজা। দুইহাতে সংসারডাকে ধইরা রাইখবো। বিয়া করলে ঠগতি না। রাজি অইয়া যাইগ্যা বাবা, রাজি অইয়া যাইগ্যা।’

রামকুমার রাতদিন একই কথা বলে যেতে লাগল শৈলেশের কানের পাশে।

রামকুমারের চাপাচাপিতে আর প্রলোভনে শৈলেশ শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেল। বিয়ে হয়ে গেল শৈলেশের সঙ্গে যশোদার। দ্বিতীয় বছরে কন্যা সন্তান প্রসব করে যশোদা তার মাতৃত্বের পরিচয় দিল। আর অল্প সময়ের মধ্যে রাত-দিন, সকাল-সন্ধ্যা শৈলেশের সঙ্গে, পাড়া প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করে মুখরা রমণী হিসেবে নিজেকে দাসপাড়ায় প্রতিষ্ঠিত করল।

ঝগড়াটা ঘরের মধ্যেই শুরু করেছিল যশোদা। বউ যে ঝগুড়ে সেটা প্রথমে শৈলেশ বুঝতে পারেনি, যখন বুঝল তখন বড়মেয়েটিকে বিইয়ে ফেলেছে যশোদা; দ্বিতীয় সন্তানও পেটে এসে গেছে। রাতের বেলায় পাশে শুয়ে তিব্বত জন্যে ঝগড়াটা বাঁধায় যশোদা। বেশ কদিন ধরে শৈলেশকে একটি তিব্বত স্নোর কৌটা আনতে বলেছে যশোদা। সংসারের চাপে, নানা ধান্ধায় বউয়ের সোয়ের আবদারের কথা ভুলে যায় শৈলেশ। ক্ষোভটা ভেতরে জমাট বেঁধে ছিল যশোদার। রাতে পাশে শুয়ে বুকে হাতটা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ধমকে উঠেছিল যশোদা, ‘লাজ করে না তোমার। রাতে রাতে বউয়ের সঙ্গে শোয়, রঙ্গতামাশা কর। বউয়ের আবদার রাখার মুরোদ নেই?’

‘কী অইলো আবার? এত রাইগ্যা রাইগ্যা কথা কইতাছ ক্যান?’ শৈলেশ নরম গলায় জিজ্ঞেস করে।

এক ঝটকায় ব্লাউজের তলা থেকে শৈলেশের ডান হাতটা সরিয়ে দিয়ে যশোদা তেতো গলায় বলে, ‘প্রতিদিন বউয়ের বুনি চুষতে ভালা লাগে, গাল কামড়াতে ভালা লাগে, ঠোঁট চাটতে ভালা লাগে; সেই বুনি-গাল-ঠোঁট তেলতেইল্যা রাখবার জইন্যে স্নো আইনতে বইল্যে ভুলি যাও ক্যান?’

বউয়ের কথায় শৈলেশ স্তব্ধ হয়ে যায়। ভেতরে জমে উঠা রতিক্রিয়ার আকাঙ্ক্ষাটি একেবারে মিইয়ে যায়। সেরাতেই সে খেয়াল করে তার বউ মুখরা, অকথ্য তেতো কথা গল গল করে তার মুখ দিয়ে বেরোয়। গত দুই বছরের নানা ছোটোখাটো ঝগড়ার কথা তার মনে পড়তে থাকে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে তার যে বর্তমানে খারাপ সম্পর্ক, তার সবটার জন্যেই যে যশোদা দায়ী, তা এখন অনুধাবন করতে থাকে শৈলেশ। কথায় কথায় যশোদা শৈলেশকে ম্যাদামারা বলে। কথাটি যে সত্যি অপমানের, তা যশোদার পাশে বিছানায় শুয়ে শৈলেশ অনুভব করতে থাকে।

তেমন কোনো অভাবের সংসার না শৈলেশের। হাঁড়িধোয়া বা মেঘনায় খরা জাল বা পাতনি জাল বসিয়ে যা মাছ পায় শৈলেশ, তা দিয়ে স্বচ্ছন্দে সংসার চলে তার। তাছাড়া বাড়িটি গাছগাছালিতে ভর্তি। আম-কাঁঠাল- সুপারি-নারকেল বিক্রি করেও বছরে তার কিছু টাকা হাতে আসে। কিন্তু যশোদার জন্যে সে টাকা জমিয়ে রাখতে পারে না। ফলফলাদি বিক্রির টাকা হাতে এলেই সে নানা রকম বায়না ধরে—জংলিছাপা দুটো শাড়ি লাগবে, নতুন একজোড়া স্যান্ডেল না হলে আর চলবে না তার; স্নো-পাউডার, নেইল পালিশ তো লাগবেই। সেদিন নারকেল বেচে শ’দুয়েক টাকা হাতে এল শৈলেশের। সঙ্গে সঙ্গে যশোদা বায়না ধরল তার একটা সেন্ট লাগবে। বিদেশি সেন্ট।

‘আমগো তো ভালা কইরা ভাত খাওনের টেয়া নাই, ছেন দিয়া কী অইবো?’ সেদিন শৈলেশের কণ্ঠটা উষ্ণ ছিল।

‘ছেনের কথা কইছি ছেন আইনবা। আইনবা কিনা কও?’ ঝাঁজ মেশানো স্বরে যশোদা বলে।

‘হুন, কৃষ্ণার জামা ছিঁড়া গেছে গা। হেরে একডা জামা কিন্যা দেওন দরকার। ইডা ছাড়া তুমিও অহন গর্ভবতী। অহন ছেন দিয়া কী করবা তুমি?’ বলে শৈলেশ।

‘মাইয়া জন্ম দিছ, মাইয়ারে জামা-পেন্ট কিনা দওনর দায়িত্ব তোমার, কইত্থেকে কিনে দিবা সে তুমি জান। পেড়ে বাচ্চা আইছে দেইখ্যা ছেন লাগদো না, তোমারে কেডা কইছে? পোয়াতি বলে রাতে শোয়া ছাড়ি দিছনি? রাতে কাপড় তুইলতে চাও না?’ যশোদার কথায় কাঁচা পায়খানার দুর্গন্ধ।

‘খানকি, মাগি, বজ্জাত। সবসময় মুখে খারাপ কথা। আমারে পচাই লাইছস হারামজাদি। আমার জীবনডারে তছনছ কইরা ছাড়ছত।’ শৈলেশ তিক্ত কণ্ঠে বলে।

মাগি কারে কও? মাগিরে বিয়া করছ কেরে? আমি মাগি না, তোমার চইদ্যগোষ্ঠী মাগি।’ যশোদা শৈলেশের নাকের কাছে ডান হাতের তর্জনী নেড়ে নেড়ে বলে।

শৈলেশ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। হাতের কাছের পিঁড়িটা দিয়ে ধাম ধুম দু’চারটা বাড়ি লাগাল যশোদার পিঠে।

তারপর যশোদা দাসপাড়াটা মাথায় তুলল। সমস্তদিন, গোটাটি রাত শৈলেশের পেটের ভাত চাল করে ছাড়ল। মা তুলে, গোষ্ঠী-জ্ঞাতি ভুলে যত রকম গালি দেওয়া যায়—সব রকম গালি যশোদা দিয়ে চলল শৈলেশকে। শৈলেশ পাথর হয়ে গেল।

পাথরের অনুভূতি না থাকতে পারে, কিন্তু মানুষ-পাথরের সহ্যশক্তির একটা সীমা আছে। শৈলেশ নামক মানুষ পাথরটিও যশোদার গালিগালাজের তোড়ে একসময় মোমের মতো গলে পড়তে লাগল। গভীর রাতে সে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। বীরপুরের পাশেই নরসিংদী রেলস্টেশন। স্টেশনে তখন চট্টগ্রামগামী চট্টগ্রাম মেইল দাঁড়িয়ে ছিল। সেটাতেই উঠে বসল শৈলেশ।

ভোরসকালে বটতলি স্টেশনে ট্রেন থেমেছিল। অন্য অনেক যাত্রীর মতো শৈলেশও নেমে পড়েছিল ট্রেন থেকে। হাতে তার কোনো পুঁটলিপোঁটলা নেই। তবে ফতুয়ার জেবে নারকেল বেচার দুশোটি টাকা পড়ে ছিল। ট্রেনে বসে সেই টাকা ভালো করে কোঁচড়ে বেঁধে নিয়েছিল শৈলেশ।

ধীরে ধীরে সে স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল। তার হাতে কোনো টিকেট ছিল না। টিকেট চেকাররা তাকে হেনস্তা করতে পারত। কিন্তু গেইটে জটলা ছিল। জটলার মধ্যে সে টুপ করে গেইট পার হয়ে এসেছিল।

চট্টগ্রাম শহরের কিছুই চেনে না শৈলেশ। তারপরও মন যেদিকে চায়, সেদিকেই হাঁটা ধরল সে। গোটা শহর ঘুরে বেড়াল সে। অজস্র মানুষ। যে যার মতো করে হাঁটছে। কেউ হনহন করে, কেউ ধীরে ধীরে। সে মানুষজনকে ভালো করে ঠাহর করে দেখে। কারও মুখ খুশি খুশি, কেউ আবার পেরেশান। কেউ কারও দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। যে যার মতো করে চলছে।

শৈলেশ রিয়াজউদ্দিন বাজারে ঢুকে পড়ল, নানা অলিগলি পার হয়ে আমতলি দিয়ে বের হয়ে এল। অপর্ণাচরণ স্কুলকে পাশে রেখে রাইফেল ক্লাব পেরিয়ে গেল সে। সিনেমা প্যালেস, খুরশিদ মহল অতিক্রম করে মুসলিম হাইস্কুলের গেইটে এলে তার খুব তেষ্টা পেল। সূর্য তখন প্রায় মাথার ওপর। একজন পথচারীকে পানি খাওয়ার ইচ্ছেটি জানালে লোকটি মুখে কিছু না বলে ডান হাতের তর্জনী তুলে দক্ষিণ দিকে কী যেন দেখাল। লোকটির নির্দেশ মতো হেঁটে সে একসময় সাধু মিষ্টিভাণ্ডারে পৌছাল। সাধু মিষ্টিভাণ্ডার দেখে শৈলেশের নরসিংদী রেলস্টেশন বাজারের পোদ্দার মিষ্টিভাণ্ডারের কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল সেখানে মিষ্টি, শিঙাড়া, চমুচা, পরোটা খাওয়ার স্মৃতি। শৈলেশ হঠাৎ অনুভব করল—তার খিদে পেয়েছে। সে সাধু মিষ্টিভাণ্ডারে ঢুকে পড়ল।

.

এখন শৈলেশ সদরঘাটে বসে আছে। সামনে কর্ণফুলী নদী। আপন মনে বয়ে চলেছে সে। সাম্পানের ক্যাঁ কোঁৎ ক্যাঁ কোঁৎ আওয়াজ। দূরের বন্দরে বিদেশি জাহাজে অসংখ্য উজ্জ্বল বাতি। পার থেকে একটু দূরে বরিশালগামী জীবনভেলা নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। সূর্যের লাল আভাটি মুছে যাচ্ছে পশ্চিম আকাশ থেকে। এই সদরঘাটের পাশেই পুরানা কাস্টম। ব্রিটিশ আমলে, এমনকি পাকিস্তানশাসনের প্রথম দিকেও সদরঘাট-সংলগ্ন পুরানা কাস্টম ঘাটেই পণ্যবাহী বিদেশি জাহাজগুলো ভিড়ত। কাস্টমস হাউস, বিদেশি জাহাজ, সাহেবসুবোদের উপস্থিতিতে এ অঞ্চল একসময় গমগম করত।

.

চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর তীর ঘেঁষেই সাহেবপাড়াটি গড়ে উঠেছে। সাহেবপাড়া সাহেবদের আবাসস্থল নয়, সাহেবদের মনোরঞ্জনের, দেহতৃপ্তির জায়গা। এটা বেশ্যাপল্লি। এই বেশ্যাপল্লিটির নানা নাম—সদরঘাট, চৌদ্দনম্বর, সাহেবপাড়া ইত্যাদি।

পূর্ব ও পশ্চিম মাদারবাড়ি জুড়ে তিনটি জেলেপল্লি–ফকিরপাড়া, মাইজপাড়া ও সদরঘাট জেলেপাড়া। সদরঘাট জেলেপাড়াটি একসময় বেশ্যাপল্লি হয়ে যায়।

সদরঘাটের জেলেপাড়াটি আগে থেকেই বেশ্যাপাড়া ছিল না। পঁচিশ- ত্রিশটি জেলেপরিবার ছোট ছোট ঘর তুলে এই জেলেপাড়াটিতে বাস করত। নিতান্ত দরিদ্র জেলে। এদের চালচুলা কিছু ছিল না বললেই চলে। তাদের কোনো নৌকা বা বড় জাল ছিল না। ছোট ছোট টাউঙ্গাজাল কর্ণফুলীর কূলে কূলে বেয়ে কোনোরকমে জীবন চালাত ওরা। রাস্তার ওপাশেই কাস্টমস হাউস, জাহাজ ভিড়ার জেঠি। সময়ান্তরে দেখা গেল, বিদেশি নাবিকরা এপাড়ায় যাতায়াত করছে। কোন জেলেনিটি টাকার বিনিময়ে নাবিকদের প্রথম দেহ দেওয়া শুরু করেছিল, তা কেউ জানে না। তবে একটা সময়ে দেখা গেল—গোটা জেলেপাড়াটি বেশ্যাপাড়ায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে। কোথা থেকে কোথা থেকে মেয়েরা এসে জুটে গেছে। প্রতিটি জেলেবাড়ি এক একটি মাসির বাড়িতে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রত্যেক মাসির তত্ত্বাবধানে আট- দশটি দেহজীবিনী। আর বয়স্ক-মধ্যবয়স্ক জেলেরা হয়ে গেছে এক একজন মাগির দালাল।

ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া এই বেশ্যাপল্লিটির এখন যৌবনকাল। তার অলিতে গলিতে ঘরে ঘরে যৌবনের বিকিকিনি

.

‘কী মন খারাপ? এই রকম কষ্ট কষ্ট মুখ নিয়ে এই অন্ধকারে বসে আছ কেন?’

শৈলেশ ডান দিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখল, তার একেবারে গা ঘেঁষে একজন মধ্যবয়সি লোক বসে আছে। গায়ে ফতুয়া ধরনের জামা, পরনে বাহারি লুঙ্গি। লোকটি তখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে।

‘আমারে কইতাছেন?’ শৈলেশের থতমত খাওয়া গলা।

‘তোমাকে না তো কাকে বলব? এইখানে আর কে আছে যে তাকে বলব?’ আবেগহীন কণ্ঠ লোকটির।

‘না না। মন খারাপ না।’ শৈলেশ থেমে থেমে কথাগুলো বলে।

‘মিথ্যা বলছ কেন? দেখে মনে হয়, এই শহরে নতুন।’

‘হ, নতুন। মনে অনেক কষ্ট। মনের কষ্ট মনের ভিতরে ধইরা রাখতাম পারতাছি না। হেল্লাইগ্যা নদীর পারে বইয়া রইছি।’ শৈলেশ বলে।

শামছু বলে ওঠে, ‘তো বইয়া রইছ ঠিক আছে। মাগিপাড়ার পাশে বইয়া রইছ ক্যান?’

চট করে শামছুর দিকে তাকায় শৈলেশ। অবাক চোখে বলে, ‘মাগিপাড়া মাইনে?’

‘মাগিপাড়া বুঝ না? সাহেবপাড়ার নাম শুননি? এইটা বেইশ্যাপাড়ার এলাকা। এখানে মাইয়ালোকেরা শরীর বেচে, টাকার বিনিময়ে।’ শামছু বলে।

গভীর বিস্ময় নিয়ে শৈলেশ শামছুর দিকে তাকিয়ে থাকে। শামছুর কথা শুনে তার জবান বন্ধ হয়ে গেছে। জাহাজঘাটের আবছা আঁধারে শামছু শৈলেশের বিস্মিত চোখ দেখতে পেল, সেই চোখে অনেক প্রশ্নের কিলিবিলি। খুব তৃষ্ণা পেলে মানুষের যেরকম চেহারা হয়, সেরকম চেহারায় শৈলেশ শামছুর দিকে তাকিয়ে আছে দেখতে পেয়ে শামছু বলা শুরু করল, ‘আমি একজন মাগির দালাল, বাড়ি নরসিংদীর শিবপুরে। সেই ছোটবেলায় সৎমায়ের অত্যাচারে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। বাপ সমায়ের আঁচল ধরে থাকত। ভাসতে ভাসতে এই বেশ্যাপাড়ায় এসে ভিড়েছিলাম তরুণ বয়সে। যৌবন খসিয়েছি এই মাগিপাড়ায়। কখন বিজলি বেশ্যার দালাল হয়ে গেছি মনে নেই। এখন সন্ধে হলে কাস্টমার ধরি। বিজলির ঘরে ঢুকিয়ে দিই। বিজলি আমাকে পালে। ভাতের পয়সা দেয়, সকাল-বিকাল চা-নাস্তা খাওয়ায়। কখনো কখনো সিনেমা দেখার টাকা দেয়। লায়নে গিয়ে সিনেমা দেখি। বেশ্যাপাড়ার বাইরে মাড়োয়ারিদের গুদামের পাশে একটা ঝুপড়িমতন ঘরে রাত কাটাই। শামছু আমার নাম।

শামছু হঠাৎ করে চুপ মেরে যায়। শৈলেশ তাকিয়ে দেখে শামছু নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। আনমনা। শৈলেশের ঘোর কাটতে সময় লাগল। অনেকক্ষণ পরে ঘোর পাতলা হয়ে এল। শৈলেশ বলল, ‘শামছুদা, আমার নাম শৈলেশ। নরসিংদীর বীরপুরে আমার বাড়ি। বউয়ের অত্যাচারে থাকতাম না পাইরা ঘর ছাড়ছি।’

তারপর একে একে জীবনের সব ঘটনা শামছুকে বলে গেল শৈলেশ। বলা শেষ করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ।

শামছু কিছু বলল না। দু’জন মানুষ নির্বাক বসে রইল নদীপারে। শুধু জাহাজের হুইসেল ও নিজেদের চাপা নিশ্বাসের শব্দ শুনল দুজনে।

একসময় শামছু বলে উঠল, ‘বিজলির ঘর থেকে এতক্ষণে কাস্টমার কাম সেরে বেরিয়ে গেছে। আরেকজন কাস্টমার ধরতে হবে, চল।’

‘আমি কই যামু?’

‘তোমাকে মাগিপাড়ায় নিব না। আমার ঘরে তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আমি পাড়ায় ঢুকব, চল।’ বলল শামছু।

শামছুর পিছু পিছু শৈলেশ এগোল।

পতিতালয়ের বাইরে, রাস্তার উত্তর ধার ঘেঁষে সারি সারি দোকান। কোনোটা পানের, কোনোটা চা-নাস্তার। রুস্তম আলী তার রেস্টুরেন্টে চা-নাস্তা বেচে না। দু’বেলা ভাত বেচেই লাল হয়ে গেছে রুস্তম। নানা কিসিমের তরকারি—ডাল, মুরগি, খাসি আর বিভিন্ন ভর্তাভুর্তি তো আছেই। আছে পোলাও বিরানি। মালদার কোনো পার্টিকে ভাত খাওয়ানোর প্রয়োজন পড়লে বেশ্যারা রুস্তমের দোকান থেকেই খাবার নিতে পাঠায়। এই রুস্তমের দোকানে শৈলেশকে নিয়ে ঢুকল শামছু। দোকানভর্তি কাস্টমার। ক্যাশ কাউন্টারে রুস্তম ভীষণ ব্যস্ত। তাকে ঘিরেও অনেক কাস্টমার। টাকা নিতে ব্যস্ত থাকলেও রুস্তমের চোখ কিন্তু দরজার দিকে! শামছুকে ঢুকতে দেখে ক্যাশ থেকে রুস্তম বলে ওঠে, ‘কি শামছু ভাই, আজকে এই অসময়ে দোকানে যে?’ শামছুর উত্তরের অপেক্ষা না করে টেবিলবয়ের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে, ‘অই ছিদ্দিক্যা, শামছুভাই কী চায় দাও, ভালো কইরা দিও।’ বলেই কাস্টমার নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে রুস্তম। শামছুর প্রতি রুস্তমের দুর্বলতা আছে। সপ্তাহে, পনেরো দিনে বিজলির সঙ্গে কেচ্ছা করার ব্যবস্থা করে দেয় এই শামছু।

শৈলেশকে রুস্তমের দোকানে ভাত খাওয়ালো শামছু, নিজেও খেলো। তারপর তার আস্তানায় নিয়ে গিয়ে একমাত্র চৌকিটি দেখিয়ে বলল, ‘ওই চৌকিতে তুমি শোবা, আমিও শোব তোমার পাশে। তয়, আমি আসতে অনেক রাত হবে। বাইরে থেকে দরজা খোলার ব্যবস্থা আছে। তুমি ঘুমাও।’

শামছু বেরিয়ে গেল পতিতালয়ের উদ্দেশে। পায়ে তাড়া। বেশ দেরি হয়ে গেছে। বিজলি তার ওপর চোটপাট করে কিনা কে জানে।

.

খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল শৈলেশের। দেখল—পাশে শামছু বেহুঁশ হয়ে ঘুমাচ্ছে। চিৎ হয়ে শুয়ে আছে শামছু, মুখটা সামান্য খোলা। নাক ডাকার মৃদু আওয়াজ শুনতে পেল শৈলেশ। সে শামছুকে জাগাল না। ঘরের ভেতর ড্রামে জমানো পানি দিয়ে শৈলেশ হাতমুখ ধুয়ে ফেলল। তারপর দরজাটা আধখোলা রেখে ঘরের একমাত্র মোড়াটায় বসল। এইভাবে ঘণ্টা দেড়েক কেটে যাওয়ার পর চোখ খুলে তাকাল শামছু। জিজ্ঞেস করল, ‘কখন উঠলা?’

তা হইছে একটু। রাইতে কোন সময় আইছেন?’ বলে শৈলেশ।

শুয়ে শুয়েই শামছু উত্তর দেয়, ‘তা হইছে একটু দেরি। বিজলির ঘরে এক খাণ্ডাশ কাস্টমার ঢুকছিল রাতে, শালার বেটা কিছুতেই বের হয় না। বিরানির আবদার করল—বিরানি নিয়ে গেলাম। তারপর বলল—মাল খাব। মাল বুইঝলানি? মাল মাইনে মদ। মালদার আদমি। বিজলি বুঝল – আজ ভালো দাও মারা যাবে। আমার হাতে বেটা দুইশ টাকা দিয়া কইল হুইস্কি আন। হুইস্কির দাম একশ কুড়ি টাকা। আইনলাম, আশি টাকা পকেট ঢুকাইলাম। যাওনের কালে বেহেড মাতাল। বিজলির শরীল লইয়া খেলা করার শক্তি নাই। পকেটের সব হাতাইয়া লইয়া বিজলি আমারে কইল, মনচোদারে টেক্সিতে তুইল্যা দও। এইগুলি করতে করতে বেশ দেরি অইয়া গেল কাল রাইতে। তা তোমার ঘুম কেমন অইছে?’

শৈলেশ হাঁ করে অন্ধকার জীবনের কথাগুলো শুনছিল। শামছুর শেষের কথায় তার সংবিৎ ফিরল। বলল, ‘ভালাই ঘুম অইছে। তয় আপনার এই বিজলিডা কেডা, হের পরিচয় কী?’

শামছু আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় উঠে বসল। লুঙ্গির সামনের অংশটা ঠিকঠাক করে যোগাসনে বসে দুই হাত তুলে শৈলেশকে লক্ষ করে বলল, ‘সে এক বিরাট কাহিনী। হুনবা? ধৈর্য আছে?’

শৈলেশ বলল, ‘হুনমু।’

‘তয় হুন।’ শামছু বলতে শুরু করল, ‘দারোগার মাইয়া ছিল এই বিজলি। বিজলি তার আসল নাম কিনা জানি না। কুষ্টিয়া বাড়ি এইটা ঠিক। বাপ ঘুষ খাইত বেসুমার। মা ঘুষের টাকা গুনত। মেয়েটির সঙ্গে বাপ-মায়ের তেমন যোগাযোগ ছিল না। বাপ ড্রেস পরতে পরতে সকালের নাস্তা খেত। মেয়ে যে একই টেবিলে বসে নাস্তা খাচ্ছে, সেদিকে খেয়াল নেই দারোগার। দারোগা বেরিয়ে গেলে মাও বেরিয়ে পড়ত সমাজ সেবায়। কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় নাকি বাপ এক মেডিকেল কলেজের ছাত্রকে গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করল। সেই ছেলে শিক্ষা দিতে এসে আসল শিক্ষাই দিল। পেট বেজে গেল বিজলির। ছেলেটি চম্পট দিল। দারোগা গর্ভপাত করাল মেয়ের। মা-বাপ জোর করে বিয়ে দিতে চাইল। জেদে লজ্জায় অভিমানে বিজলি বাপের বাড়ি থেকে পালাল। ঢাকায় এক মহিলা সমাজসেবীর কাছে আশ্রয় পেল বিজলি। মহিলা একজনকে বলে একটি চাকরি জুটিয়ে দিল। চাকরির সঙ্গে থাকার একটি ঘরও দিল মালিক। একটা সময়ে মালিক সুযোগ নিল। দিনের পর দিন মালিক ধর্ষণ করে যেতে লাগল বিজলিকে। অতিষ্ঠ হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল নাকি বিজলি। তারপর ভাসতে ভাসতে চট্টগ্রামের এই সাহেবপাড়ায়।’

‘এত কথা আপনি জানলেন কেমনে?’ ঢোঁক গিলে শৈলেশ জিজ্ঞেস করে।

শামছু বলে, ‘এমনিতে বিজলি মদ খায় না। কিন্তু একদিন এক কাস্টমারের পাল্লায় পড়ে মদ খেল। কাম সেরে কাস্টমার চলে গেল। মাতাল হল বিজলি। সেরাতে আমাকে সামনে পেয়ে গলগল করে নিজের অতীত জীবনের কথা বলে গেল।’

‘অ, আইচ্ছা।’ শৈলেশ বলে।

চার

ডানে বাঁয়ে বাঁক না নিয়ে কর্ণফুলী এখানে পূর্ব পশ্চিমে এক মাইলব্যাপী বয়ে গেছে।

নদীর কিনারা থেকে দুই আড়াইশ গজ উত্তর দিয়ে একটি রেললাইন চলে গেছে ঢাকার দিকে। রেললাইনের সমান্তরালে একটি পাকা রাস্তা। রাস্তার নাম স্ট্র্যান্ডরোড। এটিই চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশের মূল রাস্তা। রাস্তা এবং রেললাইনের দুদিকে মাড়োয়ারি ও পাকিস্তানিদের বড় বড় গুদাম। নানা কোম্পানির চোখ ধাঁধানো অফিসও এখানে ওখানে। বিদেশি জাহাজ থেকে মালামাল নামিয়ে গুদামগুলোতে রাখা হয়। সেখান থেকে রেলে বা ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ওইসব মালপত্র পাঠানো হয়।

স্ট্র্যান্ডরোডের একেবারে পশ্চিম প্রান্তে পাকিস্তানবাজার। পাকিস্তানবাজারের গা ঘেঁষেই রেলি ব্রাদার্সের কুলীন অফিস। এখানে আরও নানা কোম্পানির অফিস আছে। কিন্তু জৌলুসে এবং বনেদিয়ানায় রেলি ব্রাদার্সের অফিস সেরা। রেলি ব্রাদার্সের অফিস চত্বরে বারো-চৌদ্দটি সেগুন গাছ দাঁড়িয়ে আছে। গত দেড়-দু’শ বছরের সাক্ষী এরা। রেলি ব্রাদার্সের চত্বরকে পেছনে রেখে পূর্ব দিকে এগিয়ে এলে ফকিরপাড়া। এখানে ষাট-সত্তরটি জেলে পরিবার বাস করে। নদীসমুদ্রে মাছ মারাই এদের প্রধান পেশা। এরপর মাঝিরঘাট। লবণ ব্যবসার জন্যে বহুদিন আগে থেকে মাঝিরঘাট বিখ্যাত হয়ে আছে। মাঝিরঘাট ছাড়িয়ে একটু এগুলেই মাইজপাড়া জেলেপল্লি। এ পাড়ার লোকদেরও পেশা মাছ ধরা। স্ট্র্যান্ডরোডের একেবারে পূর্ব মাথায় সাহেবপাড়া। এই স্ট্র্যান্ডরোডকে চট্টগ্রামের প্রাণ বলা যায়। শহরের যত আলো এবং অন্ধকার এই স্ট্র্যান্ডরোডকে ঘিরেই আবর্তিত।

পতিতালয়টিকে এড়িয়ে পূর্বে, পশ্চিমে এবং উত্তরে ভদ্রমানুষদের আবাসস্থল গড়ে উঠেছে। ভদ্রলোকদের কেউ সরকারি অফিসের কর্মচারী- কর্মকর্তা, আবার কেউ বেসরকারি অফিসের। কেউ বা দোকানদার, ব্যবসায়ী। পতিতালয়ে শুধু বিদেশাগত সাহেবরা আসে না, ওইসব ভদ্রপল্লি থেকেও রাতের আঁধারে মুখ ঢেকে ভদ্রলোকেরা আসে তাদের রমণস্পৃহা মেটানোর জন্যে।

সাহেবপাড়াকে ছাড়িয়ে শহরের আরেকটু গভীরে গেলে লায়ন সিনেমা। চট্টগ্রাম শহরে লায়ন ছাড়া আরও সিনেমা হল আছে—রঙ্গম, সিনেমা প্যালেস, খুরশিদ মহল। লায়ন সিনেমা সাহেবপাড়ার একেবারে কাছে, গা ঘেঁষেই বলা চলে। অনতিদূরে বলে সিনেমা দেখার জন্যে পতিতারা লায়নকেই বেছে নেয়। লায়নে সিনেমা দেখতে যাওয়ার ব্যাপারে মাসিরাও তেমন বাধা দেয় না বরং স্বস্তিবোধ করে। কখনো কখনো দূরবর্তী সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে গিয়ে কেউ কেউ ফিরে আসে না। নাগরের প্রলোভন- প্রতারণায় তারা ভেগে যায় সিনেমা হল থেকে। এরকম দু’একটা ঘটনা ঘটে যাবার পর মাসিরা ওইসব মাগিদের সঙ্গে পাহারাদার হিসেবে পরিচিত দালালদের পাঠায়। তারপরও দালালদের বশ করে বা চোখকে ফাঁকি দিয়ে তরুণী পতিতারা ভেগে যাওয়ার ব্যাপারে তক্কে তক্কে থাকে।

বেশ্যা, তাদের নাগর, দালাল আর বেশ্যাপল্লির গুণ্ডামাস্তানরা লায়ন সিনেমার বেশিরভাগ দর্শক। তিনটা থেকে ছ’টার সিনেমাই বেশি দেখে বেশ্যারা। কারণ সন্ধে থেকে তাদের ঘরে কাস্টমার আসতে থাকে; কাস্টমারের যাতায়াত গভীর রাত পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। তাই কোনো কোনো বেশ্যার রাতের সিনেমা দেখার ইচ্ছে জাগলেও মাসিদের অনুমতি না মেলায় সে ইচ্ছেকে মনেই নুন খাইয়ে মারে তারা।

আর মাসিরা মাগিদের সন্ধের পরে সিনেমা দেখার অনুমতি দেবেই বা কী করে? ওই সময়েই তো তাদের ঘরে কাস্টমারের বেশে লক্ষ্মী আসে। একরাত কাস্টমার না বসানো মানে অনেক টাকার লোকসান। লোকসান শুধু মাসির নয়, লোকসান দালালের, পানবিড়ির দোকানদারের, মদভাঙের আড়তদারের, রেস্টুরেন্টের মালিকের এবং সর্বোপরি বেশ্যার নিজের। আগের রাতে কামাই না করলে পরের দিনের খাবার জুটবে কোত্থেকে, তেল-সাবান- স্নো-পাউডার-সেন্ট-লিপস্টিকের পয়সা জুটবে কোত্থেকে, সিফিলিস, গনেরিয়ার চিকিৎসাখরচ জুটবে কোত্থেকে? তাই তিনটে থেকে ছ’টার শো- তে লায়ন সিনেমা বেশ জমজমাট থাকে। সিনেমালিপ্সু বেশ্যাদের দেখার জন্যে সিনেমার এধারে ওধারে, আশপাশের কানাগলিতে তরুণ ও বয়স্কদের ভিড় জমে। এরা বেশ্যাপাড়ায় যায় না কিন্তু বেশ্যাদের একনজর দেখার জন্যে তাদের প্রবল আগ্রহ। তাই ওই সময়ে নির্লিপ্ত নয়নে তারা লায়ন সিনেমার আশপাশে ঘুর ঘুর করে। ওইসব মানুষদের প্রতি বেশ্যাদের তেমন কোনো আগ্রহ নেই।

সিনেমা হল ছাড়া দেহজীবিনীদের আগ্রহ শাহজাহান হোটেলকে ঘিরে। হুড়তোলা রিকশায় করে, কখনো কখনো বেবিটেক্সিতে করে বেশ্যারা লায়ন সিনেমায় যায়। হলে ঢোকার আগে তারা শাহজাহান হোটেলের দিকে গভীর আগ্রহে তাকায়। শাহজাহান হোটেল চট্টগ্রাম শহরের বনেদি হোটেল। শুটিং- এর জন্যে নায়ক-নায়িকারা ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এলে এই হোটেলেই ওঠে। তাদের দেখার জন্যে হোটেল গেইটে সাধারণ মানুষরা ভিড় করে। আর বেশ্যারা সিনেমা হলে ঢোকার আগে তৃষিত চোখে হোটেলের দোতলা- তিনতলার বারান্দার দিকে তাকায়। যদি একবার, ক্ষণিকের জন্যে হলেও ক্ষতি নেই, রাজ্জাক-ববিতা, সুজাতা-আজিম, কবরী-উজ্জ্বলকে দেখতে পায়, জীবন ধন্য হয়ে যাবে তাদের।

.

একটা সময়ে চট্টগ্রাম শহরে এই সিনেমা হল, এই শাহজাহান হোটেল, বনেদি রাস্তাঘাট কিছুই ছিল না। সাহেবপাড়া নামের এই বেশ্যাপল্লিটিও ছিল না। ছিল শুধু ভরা যৌবনের কর্ণফুলী, নদীপারের পার্বতীফকির পাড়া, মাইজপাড়া, আর সদরঘাটের জেলেপাড়াটি। সে আজকের কথা নয়।

এই কর্ণফুলী বেয়ে দশম শতাব্দীতে আরবীয় বণিকরা চট্টগ্রামে ঢুকেছে, ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে পর্তুগীজ হার্মাদদের চিপা নৌকাগুলো কর্ণফুলীর মোহনা বেয়ে উজানে উঠে এসেছে, নদীপারে এবং নদীপার থেকে একটু গভীরে লুটতরাজ চালিয়েছে। নদীপারের ক্লিন-ক্লিষ্ট জেলেপাড়াগুলো আরবীয় বণিক এবং হার্মাদ দস্যুরা এড়িয়ে গেছে। জেলেপল্লিগুলোর জীর্ণদশা তাদেরকে অনাগ্রহী করে তুলেছে। কিন্তু ১৭৫৭ সালে সিরাজ-উদ্-দৌলাকে হটিয়ে ইংরেজরা বাংলার শাসনভার নেওয়ার পরপরই চট্টগ্রামের চেহারা পাল্টাতে থাকে।

সিরাজকে সরিয়ে ইংরেজরা মীরজাফরকে নবাব করে, সেটা পুতুল নবাব! মীরজাফর ছিলেন লোভী এবং বিশ্বাসঘাতক। ইংরেজরা তাকে আঁস্তাকুড়ে ফেলে মীরকাসিমকে নবাব করল। দেশরক্ষার খরচ নির্বাহের অজুহাতে ইংরেজরা ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ অক্টোবর মীরকাসিমের কাছ থেকে চট্টগ্রাম কেড়ে নিল। ১৭৬১ সালে ১৫ জানুয়ারি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চট্টগ্রামে তাদের শাসনের সূচনা করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসাবাণিজ্য চলত সমুদ্রপথে; দেশের অভ্যন্তরে এবং বিদেশে মালামাল আমদানি-রপ্তানির একমাত্র মাধ্যম জলযান। ইংরেজদের শত দাড়ির পালতোলা জাহাজ তখন আরবসাগর, বঙ্গোপসাগর, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরকে এফোঁড় ওফোঁড় করছে।

মিস্টার হ্যারি ভেরলেস্ট তখন চট্টগ্রামের ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট, প্রথম ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট তিনি। কর্ণফুলীর উত্তরপার ঘেঁষে একটি পোর্ট তৈরির প্রয়োজনীয়তা তিনিই প্রথম অনুভব করলেন। সার্ভেয়ারদের দিয়ে তিনি একটি জরিপও চালালেন। সার্ভেয়ারদের পরামর্শের সঙ্গে নিজের পরিকল্পনা মিশিয়ে তিনি বর্তমানের সাহেবপাড়ার দক্ষিণ দিকে কর্ণফুলীর পারে একটি পোর্ট তৈরি শুরু করেন। একটা বড়োসড়ো কাঠের বাড়িও নির্মাণ করান তিনি, নাম দেন—কাস্টমস্ হাউস। ১৭৭১ সালে হ্যারি ভেরলেস্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। নিজের দায়িত্ব তিনি মিস্টার উইলকিন্সকে বুঝিয়ে দেন। যাওয়ার সময় হ্যারি পোর্টটিকে পূর্ণরূপ দেওয়ার জন্য উইলকিন্সকে অনুরোধ করেন। উইলকিন্সের হাতেই চট্টগ্রামের নদীবন্দরটি পূর্ণভাবে তৈরি হয়। তাঁর সময় থেকেই চট্টগ্রাম পোর্টে বড় বড় সমুদ্রপোত ভিড়তে থাকে।

.

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে কোনো এক বিকেলবেলায় মার্টিনেজ নামের একটি জাহাজ চট্টগ্রাম পোর্টে এসে ভিড়েছিল। সেদিন সকালের দিকে আকাশটা ছিল মেঘলা মেঘলা। দুপুরের দিকে ভারি বৃষ্টি হয়ে গেছে। সদরঘাট থেকে আন্দরকিল্লা পর্যন্ত বিস্তৃত ইটের রাস্তাটি ছাড়া সব রাস্তা কাদাময় হয়ে গেছে। শহরের ভিতরের এবং বাইরের অধিকাংশ রাস্তা মেটে। পাড়ার ভেতরের গলিগুলোও তথৈবচ। একপশলা বৃষ্টি হলে এইসব রাস্তা কর্দমাক্ত হয়ে যায়। ভারি বৃষ্টির কথা তো আলাদা।

বৃষ্টির পরে আকাশটা পরিষ্কার হতে শুরু করে। সূর্যের শরীর থেকে মেঘ সরে গেলে গোটা পোর্ট এলাকা ঝকমকে রোদে ঝলসে ওঠে। এই রকম অবস্থায় মানুষের মন-খারাপ ভাবটা কেটে যায়। ম্যাগ্রিজেরও তা-ই হল। খিঁচড়ে থাকা তার মনটা ঝকমকে আলো দেখে স্বস্তিতে ভরে গেল।

ম্যাগ্রিজ মার্টিনেজ জাহাজের একজন নাবিক। জাহাজের পালগুলোর তদারক করাই তার কাজ। ওই জাহাজে সে ছাড়া আরও জনা বিশেক নাবিক আছে। তাদের ক্যাপ্টেন হ্যারিসন একজন আইরিশ। হ্যারিসন স্বভাবে বড় হিংস্র, জাহাজে তার আদেশই শেষ কথা। দীর্ঘ সাঁইত্রিশ দিন ঝড়ো ঢেউবহুল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আজ বিকেলে চট্টগ্রাম পোর্টে এসে নোঙর ফেলেছে তারা। বহু দিন সময় সমুদ্র-সংগ্রামের ফলে, সামাজিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে এবং হ্যারিসনের অত্যাচারের ফলে নাবিকরা হয়ে উঠেছে রূঢ়, রুক্ষ, অমার্জিত। নাবিকরা দীর্ঘদিন নারীসঙ্গ বিবর্জিত। নারী বিবর্জিত তরুণরা ভয়াল হয়ে ওঠে। তারা অর্ধ মানব অর্ধ পশুতে পরিণত হয়। প্রতিনিয়ত বিশাল জলরাশি দেখে দেখে তাদের আচরণ অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। একটা সময়ে ভূমিতে পা রাখার জন্যে এবং নারীসঙ্গ পাওয়ার জন্যে তারা প্রচণ্ড লোভী হয়ে ওঠে।

লোলুপতাকে মনে চাগিয়ে রেখেই ম্যাগ্রিজ সেই বিকেলে কর্ণফুলীর পোর্ট এরিয়ায় পা রাখে। একা একা। দু’একজন নাবিককে আহ্বান করেছিল তার সঙ্গী হতে। কিন্তু দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় তারা কাহিল হয়ে পড়েছিল। ম্যাগ্রিজের আহ্বানে তারা সাড়া দিল না। তাই ম্যাগ্রিজ একা বেরোল।

পোর্ট এরিয়াটা ছাড়া কর্ণফুলীর এই পারে বিশাল বিশাল শিরীষ, নিম, বট গাছ। গাছগুলোর গোড়ায় গোড়ায় দুর্ভেদ্য কেয়াবন, বেতবন। ম্যাগ্রিজ কাস্টমস্ হাউসের গেইট দিয়ে বেরিয়ে পূর্বে-পশ্চিমে বিস্তৃত স্ট্র্যান্ডরোডে উঠে এল। স্ট্র্যান্ডরোডটি নামে গাম্ভীর্যময় হলে কী হবে, আসলে ইটের খোয়া বসানো সাত ফুট প্রস্থের একটি সাধারণ মানের রাস্তা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই রাস্তা দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি সহজে যাতায়াত করতে পারে। ম্যাগ্রিজ ওই রাস্তায় দাঁড়িয়ে উত্তর দিকে তাকিয়ে দেখল—একটা নিচুমতন জায়গায় পঁচিশ-ত্রিশটি জীর্ণঘর কোনোরকমে দাঁড়িয়ে আছে। একটা কাদাময় মেটে গলি ওই বাড়িগুলোর মাঝখান দিয়ে উত্তর দিকে এগিয়ে গেছে। খোঁচা খোঁচা দাড়ির গোড়ায় ডানহাতের তর্জনী চালাতে চালাতে কী যেন ভাবল ম্যাগ্রিজ। তারপর পা বাড়াল ওই কর্দমাক্ত মেটে গলির দিকে।

পঁচিশ-ত্রিশটি ঘর নিয়েই জেলেপাড়াটি। স্থানীয়দের কাছে এটি পূর্বপাড়া নামে পরিচিত। ফকিরপাড়া আর মাইজপাড়ার লোকেরা সেই নামেই সম্বোধন করে পাড়াটিকে। ম্যাগ্রিজ সেই পূর্বপাড়ার ভেতর দিয়ে হাঁটতে থাকে। বিকেলটা দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে আঁধারের দিকে। জেলেপাড়াটির অধিকাংশ পুরুষ তখন মাছ ধরতে গেছে, কর্ণফুলীতে। কারণ, ওই সময়েই নদীতে জোয়ার এসেছে। জোয়ারের সময় মাছ বেশি ধরা পড়ে বলে জেলেপুরুষরা হুরিজাল, ভাসানজাল, পাতনিজাল নিয়ে কর্ণফুলীতে গেছে। পূর্বপাড়া তখন অনেকটা পুরুষশূন্য। শুধু দু’একটি দাওয়ায় চলৎশক্তিহীন বৃদ্ধরা হুক্কুর হুক্কুর কাশছে আর ‘ওয়াক থু’ করে থুতু ফেলছে। নারীরা উঠানে ও গৃহকোণে ঘরকন্নায় ব্যস্ত। কেউ উঠান ঝাঁট দিচ্ছে, কেউ উঠানের কোণে বাসনকোসন মাজছে, কেউ লাকড়ি গোজগাছ করছে।

ম্যাগ্রিজ পাড়ার ভেতর দিয়ে হাঁটছে আর এইসব দেখছে। ন্যাংটোরা নাকে শ্লেষ্মা নিয়ে উঠানে ও রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে সাদা চামড়ার সাহেবটিকে দেখছে। আর সাহেব দেখছে নারীদের। তার ভেতরে তখন উথালমাতাল ঢেউ। প্রবল দেহতৃষ্ণা জেগে উঠছে তখন তার ভেতরে। তাকে দেখে কোনো কোনো নারী ঘরের ভেতর সেধিয়ে যাচ্ছে, আবার কেউ কেউ স্বাভাবিক কাজকর্ম করে যাচ্ছে।

হাঁটতে হাঁটতে একটা সময়ে রাইচরণের খোলা উঠানের ধারে দাঁড়িয়ে পড়ল ম্যাগ্রিজ। উঠানে তখন রাইচরণের বউ; ব্লাউজহীন, অর্ধেক শরীর উদোম রাইচরণের বউটি উঠান ঝাঁট দিচ্ছিল। হঠাৎ চঞ্চল এবং হিংস্র হয়ে উঠল ম্যাগ্রিজ। সুন্দরবনের রক্তলোভী বাঘ যেমন হরিণের পেছনে তাড়া করে, তেমনি করে এগিয়ে গেল ম্যাগ্রিজ রাইচরণের বউয়ের দিকে।

অল্পক্ষণ পরে পাড়ার নারীরা জানল—রাইচরণের বউকে বাঘে ছুঁয়েছে, জেলেরা রাতে বাড়ি ফিরে শুনল—রাইচরণের বউয়ের ইজ্জত গোৱা সাহেব লুটে নিয়েছে, গভীর রাতে রাইচরণ নদী থেকে ফিরে জানল—তার বউ আর সতী নেই।

রাইচরণ হাহাকার করে উঠল, পাড়াপ্রতিবেশীর কাছে প্রতিকার চাইল। কিন্তু অসহায় দরিদ্র শিক্ষাদীক্ষাহীন জেলেরা কী প্রতিকার করবে? রাতের বেলায় রাইচরণের দাওয়ায় বসে সবাই হা-হুতাশ করল। কিন্তু এই অন্যায়ের কোনো সুরাহা করতে পারল না। কার কাছে গিয়ে বিচার চাইবে তারা? সেই গোরা সাহেব কোত্থেকে এসেছে, সর্বনাশ করে কোথায় চলে গেছে কিছুই জানে না তারা। ধল প্রহরের সময় যার যার বাড়িতে ফিরে গেল জেলেরা। ধর্ষিতা রাইচরণের বউ জটিলা নিবিড় বেদনা নিয়ে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল, অসহায় রাইচরণ মাথা নিচু করে দাওয়ায় বসে থাকল।

পাড়াটি ছোট হলেও পূর্বপাড়ায় একটা সমাজ আছে, সেই সমাজে সর্দারমুখ্য আছে। পূর্বপাড়ার জেলেসমাজ রাইচরণের বউয়ের ধর্ষণের কোনো প্রতিশোধ নিতে পারল না। কিন্তু প্রতিশোধ নিল রাইচরণের পরিবারের ওপর। জটিলা অসতী হবার অপরাধে তারা রাইচরণের পরিবারকে একঘরে করল, আগুন-পানি বন্ধ করল তাদের।

নদীতে মাছ ধরার অধিকার হারিয়ে রাইচরণের পরিবার অভাবে ধুঁকতে লাগল। অভাব এবং সামাজিক নির্যাতনে অতিষ্ঠ হতে হতে একটা সময়ে জটিলা ঠিক করল—সমাজ যখন তাদের কোনো সাহারা দিল না, উপরন্তু ভাত কেড়ে নিল, তাহলে আর সমাজ কেন? শরীর বিকানোর কাজই করবে সে, বেশ্যাই হবে। জেদ এবং অভাবে পড়ে শেষ পর্যন্ত বেশ্যাই হলে গেল জটিলা।

জটিলাকে দিয়ে যে-কাজ শুরু হয়েছিল, সেটা থেমে গেল না। প্রথমে চুপিসারে, পরে প্রকাশ্যে পূর্বপাড়ায় এই বৃত্তি চলতে থাকল। ধীরে ধীরে এক পরিবার থেকে আরেক পরিবারে এই পেশা সংক্রমিত হল। সাদা চামড়ার নাবিকরা কখনো জোর করে কখনো বা অর্থের বিনিময়ে দেহের ক্ষুধা মিটাতে লাগল। কোনো কোনো নাবিক দেহের ক্ষুধা মিটিয়ে নারীটির পাশে মুদ্রা রেখে যেতে লাগল। এইভাবে একদিন ক্ষুদ্র এই জেলেপাড়াটি বেশ্যাপল্লিতে রূপান্তরিত হল; পূর্বপাড়ার নাম সাহেবপাড়া হয়ে গেল।

.

এই সাহেবপাড়ার বয়স এখন তিন শতাধিক বছর। এর মধ্যে এই পাড়াটির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সেই জলাভূমি নেই, সেই ঝুপড়িমতন ছনের ঘর নেই, সেই মেটে রাস্তাটিও নেই। বর্তমানের সাহেবপাড়ায় দুটো গলি— একটি পশ্চিমের গলি, অন্যটি পুবের। পশ্চিমের গলি একটু ম্লান, সস্তা দামের পতিতারা এই গলিতে থাকে। সাধারণ মানের কাস্টমাররা এই গলিতে যাতায়াত করে। গলিটা আলো ঝলকিতও নয়। বেশ্যার গালে মেচতার মতো গলির এখানে ওখানে ছোপ ছোপ আঁধার। সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বেশ্যারা কাস্টমার ধরে। কোথাও কোনো বেশ্যা কাস্টমারের লুঙ্গি ধরে টানছে, কোথাও আবার শার্টের সামনের অংশ ঝাপটে ধরে ঘরে ঢোকাবার চেষ্টা করছে। বেশি বয়সের এবং কম রূপসী বেশ্যারা কাস্টমারদের সঙ্গে এ রকম আচরণ করে।

কাস্টমাররাও চালাক। রিকশা টেনে বা চা-দোকানের চাকরি করে বা গোটাদিন কর্ণফুলীতে সাম্পান্ন বেয়ে বা জাহাজে কুলিগিরি করে আয় করা টাকা ওরা যার তার হাতে তুলে দিতে রাজি নয়। তারা এ-দরজায় ও-দরজায় কম বয়সের চেকনাইওয়ালা বেশ্যা খোঁজে। বেশি বয়সের ধ্বস্তবেশ্যাদের হাত ফসকে বেরিয়ে আসা এইসব কাস্টমাররা সামনে দিকে এগিয়ে গেলে বঞ্চিত বেশ্যারা পেছন থেকে গালি দেয়, ‘অই খানকির পোলা মাগিখোর। তুই যেইটার লোভে যাইতাছিস সেইটা আমার কাছেও আছে তো। তোর চনুতে সিফিলিস অইবো চোদমারানির পোলা।’ মোটা প্রলেপে পাউডার মাখা বিধ্বস্তবুকের এই বেশ্যাদের গালি কাস্টমাররা গায়ে মাখে না। তারা জানে–গালির উত্তর দিতে গেলে মাগিদের হাতে তাদের বেইজ্জত হতে হবে। নীরবে তারা গলির গভীরে এগিয়ে যায়।

পুবের গলিতেই যত জৌলুস, যত নষ্টামি। বেশ্যা এবং দালালে, কাস্টমার আর মাস্তানে এই গলিটি সর্বদা গম গম করে। সন্ধের আগে আগে গলির সব লাইট জ্বলে ওঠে। ঘরে ঘরে আলোর ঝলকানি। দরজায় দরজায় সারি সারি দেহজীবিনী। কিশোরী, তরুণী, মাঝবয়সি। পাতলা- পৃথুলা। কালো-ধলো। লম্বা-খাটো। নানা বয়সের, নানা সাইজের বেশ্যারা দরজায় এবং দরজার আশপাশে দাঁড়িয়ে কাস্টমারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার চেষ্টা করে। কাস্টমাররা কখনো আড়চোখে, কখনো সরাসরি তাদের দিকে তাকায়। যারা আড়চোখে তাকায় তারা নবাগত। তাদের হাবভাব ও চাহনি দেখে ঘাগু বেশ্যারা বুঝে যায়। তাদেরকেই ঘরে তুলবার জন্যে বেশ্যারা তৎপর হয়ে ওঠে। কারণ নতুন কাস্টমারদের সহজেই তুষ্ট করা যায়। তারা বিরক্তও করে কম। নতুনরা সন্ত্রস্ত থাকে। প্রয়োজন মিটিয়ে কী করে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়া যায়—এই ভাবনায় মগ্ন থাকে তারা। বেশি টাকা দিতেও তারা কার্পণ্য করে না। ঝানু কাস্টমাররা ঘরে ঢোকার আগে দরদাম সেরে নেয়, কিন্তু নতুন কাস্টমাররা মুখ লুকিয়ে ঘরে ঢুকে যায়। কাজ সেরে চাহিদার চেয়ে বেশি টাকা চুকিয়ে গলির আঁধারে মিশে যায় তারা।

ঝানু কাস্টমাররা বড়ই বিরক্ত করে। টাকা দেবে কম, কিন্তু পাওয়ার বেলায় সব লুটেপুটে নিতে চায়। শরীরের খাঁজে ভাঁজে হাত চালায়। দাঁত দিয়ে এখানে ওখানে কামড়ায়। ঠোঁটের লালা দিয়ে গণ্ড চিবুক ভিজিয়ে দিয়ে ওরা আনন্দ পায়। তারা সহজে ঘরও ছাড়তে চায় না। কাজ শেষ করার পরও নানারকম বিশ্রী আবদার করে। কখনো কখনো দালাল ডেকে তাদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিতে হয়।

পুব গলিতে আবার অন্যরকম বেশ্যাও আছে; তারা বনেদি, রূপবতী, দেমাকি। এদের মধ্যে কেউ কেউ শিক্ষিতাও। সবাই না হলেও কেউ কেউ গাইতে পারে ভালো। নাচনেওয়ালি হিসেবেও দু’একজনের নাম ডাক। তারা সহজলভ্য নয়। যার তার কাছে তারা দেহ দেয় না। তাদের বাঁধাবাবু আছে; ওই বাবুরা ধনী, শিক্ষিত এবং ক্ষমতাবান। তারা দু’তিন কামরার ঘর নিয়ে দোতলায় থাকে। দোতলায় উঠার গেইট বন্ধ থাকে। পরিচিত কাস্টমারের জন্যেই শুধু সেই গেইট খুলে দেওয়া হয়। তাদের দেখভাল করবার জন্যে একজন মাসি থাকে। দেবযানী সেরকম একজন বেশ্যা। যার একজন শক্ত- সমর্থ দালাল আছে, একান্ত ব্যক্তিগত কাজগুলো করবার জন্যে একজন মহিলা আছে, আর আছে একজন দোর্দণ্ডপ্রতাপী মাসি।

এই মাসির নাম মোহিনী – মোহিনীবালা দাসী। এই মোহিনী একজন জলদাসী। দীর্ঘদেহী। একহারা গড়ন তার। একসময়ে দুধে আলতায় জড়ানো গায়ের রং ছিল তার। এখন অবশ্য তার শরীরে চেকনাই নেই। বয়স তার পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। গলার নিচের এবং কোমরের আশপাশের চামড়া কুঁচকাতে শুরু করেছে। তবে স্তন তার নাভি বা পেটের কাছে এখনো নতজানু হয়নি। দূর থেকে তাকে দেখে কাস্টমারদের চোখ এখনো চকচক করে ওঠে। চেহারার মতোই মোহিনীর ব্যক্তিত্ব। তার কূটবুদ্ধি অসাধারণ। সোনার ফ্রেমের চশমার ওপারের চোখ দুটোতে বিচক্ষণতা ও বিষয়বুদ্ধি সহজেই চোখে পড়ে।

জটিলা এই বেশ্যাপাড়ার প্রথম মাসি। বয়স হয়ে গেলে দেহজীবিনীরাই মাসি হয়। যে জটিলা একদা ম্যাগ্রিজ দ্বারা ধর্ষিতা হয়েছিল, শরীর বেচাকেই যে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিল, শরীর থেকে যৌবন তিরোহিত হলে সেই জটিলাই মাসি হয়ে গিয়েছিল। পাঁচ-সাতজন পতিতাকে সে নিজের ঘরে আশ্রয় দিয়েছিল। তাদের দেহবিক্রির টাকাতেই জীবনটাকে মরণ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিল জটিলা।

জটিলার জীবৎকালেই এই সাহেবপাড়ায় আরও দু’চারজন নারি মাসিগিরি শুরু করেছিল। জটিলার পর কত মাস-বছর-যুগ-শতাব্দী পেরিয়ে গেছে! জটিলার মতো এই পাড়ায় কত মাসি এসেছে, গেছে। তাদের নাম কেউ মনে রাখেনি। কিন্তু মোহিনীবালা দাসীকে ভুলবে না কেউ। কারণ, মোহিনীর মতন প্রতিবাদী, অধিকার সচেতন মাসি একশ বছরেও দু’চারজন জন্মে না এ পাড়ায়।

বর্তমানের সাহেবপাড়ায় অন্তত ত্রিশজন মাসি আছে। তারা সবাই ম্যাদামারা, ভীতু, অন্যায় সহিষ্ণু। তারা পাড়ার সর্দার-মাস্তানের সঙ্গে কপ্রোমাইজ করে চলে। এই পাড়ায় একজনই মাসি আছে, যে কালু সর্দারের সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার হিম্মত রাখে।

কালু সর্দার এই পাড়ার নবাব। সে হিংস্র এবং খুনজখমপরায়ণ। খুব আমলে নেওয়া শরীর নয় তার। সে কালো, কুঁজো, টিঙটিঙে গড়ন তার। মাঝারি সাইজ। চল্লিশ পেরিয়ে গেছে সে। এই কালাকোলা টিঙটিঙে চেহারার কালুকে এই পাড়ার মাগি-মাসি-দালাল-মাস্তান-দোকানদার- ডাক্তার—সবাই সর্দার হিসেবে মেনে নিয়েছে, মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। কালুর সঙ্গে পাঁচ-ছ’জন গুণ্ডা থাকে, কালু কারও পেটে ছুরি চালাতে বা কারও মাথায় হুইস্কির বোতল ভাঙতে তিলার্ধ দ্বিধা করে না। থানা-পুলিশও তাকে সমীহ করে। শুধু সমীহ করে না মোহিনী মাসি।

সাহেবপাড়ার পুবের গলি দিয়ে ঢুকতেই মোহিনী মাসির বাড়ি দ্বিতল বাড়ি। দোতলার পশ্চিম দিকের তিনটি ঘর নিয়ে মোহিনীরা বাস করে। মোহিনীরা মানে মোহিনী, তার ছেলে কৈলাস, ছেলের বউ এবং এক নাতনি। পুব দিকের দুটো ঘর নিয়ে দেবযানী ব্যবসা চালায়। দেবযানী মোহিনী মাসির সবচাইতে দামি বেশ্যা।

নিচতলায় ছোট ছোট অনেকগুলো ঘর। প্রতিটি ঘরে দু’জন করে বেশ্যা থাকে। ওরা সস্তা দামের বেশ্যা, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাস্টমার ধরে ওরা। একজন নাগর নিয়ে ঘরে ঢুকলে অন্যজন বাইরে অপেক্ষা করে। ওর কাজ সমাধা হলে কাস্টমার নিয়ে অন্যজন ঢোকে। নিচতলায় প্রায় বিশ-বাইশজন বেশ্যা গভীর রাত পর্যন্ত দেহব্যবসা চালিয়ে যায়। আয়ের একটা অংশ মোহিনী মাসিকে দিয়ে দিতে হয়। ক’জন নাগর ঘরে ঢুকল আর বের হল তার হিসেব রাখার জন্যে লোক নিয়োগ করেছে মোহিনী। রমেশ দরজার পাশে টুলে বসে যাতায়াতকারী নাগরদের হিসেব রাখে। কোন মাগির রেইট কত সেটা রমেশের জানা। কোনো কোনো বেশ্যা আবার গোটা রাতের কাস্টমার পেয়ে যায়। মাঝরাতে এসে তারা উপস্থিত হয়। মোটা দাগের টাকার বিনিময়ে তারা প্রায় সারারাত মাগিদের সঙ্গে হুল্লুড় করে। এইসময় তারা ভাত খায়, মদ খায়। ভাত এবং মদের টাকা কাস্টমাররাই দেয়। রমেশ রুস্তমের রেস্টুরেন্ট থেকে মাংস-ভাত বা পোলাও-কোর্মা নিয়ে আসে। মোহিনী মাসির আড়ত থেকে হুইস্কি-রাম নিয়ে আসে। রাতভর কেরাইয়া নেওয়া নাগরদের কাছ থেকে ছলায় কলায় অনেক টাকা হাতিয়ে নেয় বেশ্যারা। পকেটে-গাঁইটে যা থাকে, সবই নিয়ে নেয়। সূর্য উঠার আগে, ভোরের গায়ে যখন আঁধার জড়াজড়ি করে, ঠিক তখনই ওইসব রাতের অতিথিরা মুখ ঢেকে সাহেবপাড়া থেকে বেরিয়ে যায়। তাদের কাছ থেকে পাওয়া টাকার হিস্যা নিয়ে মাঝেমধ্যে রমেশের সঙ্গে মেয়েদের কথা কাটাকাটি হয়। মাগিরা কম দেয়, রমেশ বেশি দাবি করে। এই কথা কাটাকাটি বিশ্রী গালাগালি আর মারধর পর্যন্ত গড়ায়।

মোহিনীর বাড়ির আট দশ বাড়ি পরেই কালু সর্দারের বাড়ি। সেটাও দোতলা। তবে মোহিনীর বাড়ির মতো তেমন রোশনাই নেই কালুর বাড়ির। মোহিনীর বাড়ির তুলনায় কালুর বাড়ি ম্লান। নিচতলার দেয়ালের পলস্তারা খসে পড়েছে। একসময় দেয়ালগুলো রং করা হয়েছিল। এখন রংটং সব উবে গেছে। মোহিনীর মতো কালুর নিচতলাতেও অনেকগুলো ঘর। সেখানেও অনেক মেয়ে দেহব্যবসা চালায়। তবে কালু সর্দারের দোতলার সঙ্গে মোহিনীর দোতলার কোনো মিল নেই। দোতলায় কালু মা-স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকে। সেখানে দেবযানীর মতো কোনো বেশ্যাকে ঠাঁই দেয়নি কালু। কালু বলে, ‘তাতে পরিবারের পবিত্রতা নষ্ট হয়। আমি কি মোহিনীবালা নাকি? সন্তান আর মা-স্ত্রীর সামনে বেশ্যাগিরি চালাবো?’

কালু বিশ্বাস করে- নিচতলা আর দোতলার মধ্যে দূরত্ব থাকা উচিত। নিচের পুঁজগন্ধময় জীবন থেকে স্ত্রী-সন্তানকে সর্বদা আড়াল করে রাখতে চায় কালু। ওপর তলায় ছোট্ট একটা মন্দিরও করেছে সে। সেখানে লক্ষ্মীনারায়ণের মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। স্ত্রী আর মা সকালসন্ধ্যায় ওই মন্দিরে কাঁসর ঘণ্টা বাজায়।

কালসর্দারকে এপাড়ার মানুষরা কাউল্যা সর্দার বলে ডাকে। এই কাউল্যা একজন জারজ। মা শৈলবালা এই পাড়ার মধ্যমগোছের পতিতা ছিল। বিয়ের আগে দূর-সম্পর্কের এক কাকা পেট বাজিয়ে দিলে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল শৈল। বরিশাল থেকে ভাসতে ভাসতে একসময় এই সাহেবপাড়ার নিরালা মাসির কাছে আশ্রয় পেয়েছিল শৈলবালা। কী সব ভেষজ খাইয়ে শৈলবালার পেট খালাস করেছিল মাসি। তারপর কাজে নামিয়ে দিয়েছিল। অনেক সাবধান হয়ে গিয়েছিল শৈল।

একবার এক নিগ্রো এল তার ঘরে। যেমন তার স্বাস্থ্য, তেমনি পারঙ্গমতা। এই নিগ্রোরই বাচ্চা পেটে এল শৈলের। গর্ভপাত করাল না শৈলে। এই বাচ্চাই কালু–কাউল্যা সর্দার। বয়স হয়ে গেলে কাউল্যার মা একদা মাসি হল। প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছালে শৈলবালা মাসিগিরি ছেড়ে দিল। দায়িত্ব নিল কালু সর্দার।

কালু সর্দারের সঙ্গে মোহিনীবালার ভজকট তুঙ্গে উঠল দেবযানীকে নিয়েই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *