গ্রন্থভূক্ত কবিতা (কাব্যগ্রন্থ)
গান
অগ্রন্থিত কবিতা
গল্প
চলচ্চিত্র কাহিনী ও চিত্রনাট্য
সম্পাদকীয়, গদ্য ও বক্তৃতা
সাক্ষাৎকার
1 of 2

নিসঙ্গতা

নিসঙ্গতা

ভাগ্যরেখাহীন করতলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় ওর হাতটাকে আর হাত মনে হয় না, হাতের অন্যান্য সব রেখাগুলো ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে। ভেসে উঠতে থাকে একটি বিশাল মাঠ, যার বুকের ওপর ঘন লোমের মত রাশি রাশি ঘাসের চুড়াগুলো রোদের কড়া ঝাঁজে হলদে হয়ে উঠেছে—তবু ওদের দেখতে সজীব মনে হয়। যতো দূর চোখ যায় কোথাও কোনো একটি গাছও নেই। শুধু হাতের রেখার মতো আঁকাবাঁকা তামাটে মাটির কতোগুলো রাস্তা কোনোটা আয়ুরেখার মতো, কোনোটা শিররেখার মতো ঝলমল করছে। ওই হাতের রেখার মতো মাঠের মাটির রাস্তাগুলোকে সে সাজাতে চেষ্টা করে। সাজাতে সাজাতে এক সময় সে আর ভাগ্যরেখাটাকে খুঁজে পায় না। ভাগ্যরেখার মতো ঐ রকম কোনো রাস্তাও ওই মাঠে সে কোথাও দেখতে পায় না। তার খুব কষ্ট হয়। মনে হয়— শৈশবে বাগানে আমলকি পাড়তে গিয়ে সে বহুবার পথ হারিয়ে ফেলতো, ছোটদি-কে ডাকতে ডাকতে তার কান্না পেতো, কন্ঠস্বর ভেজা মনে হতো। পাশে সারি সারি গাছ, বাঁশের ঝাড়, হলুদ লতার ঝোঁপ সবকিছুই ঝাপসা হয়ে আসতো। তার গলা ফাটিয়ে চিৎকার কোরে ডাকতে ইচ্ছে হতো : ছোটদি আমি পথ হারিয়ে ফে-লে-ছি…

শৈশবের মতো তার কন্ঠস্বর ভেজা হয়ে আসে— কন্ঠের নিচে খুব ব্যথা করে। সেই নিশব্দ শূন্যতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে তার চিৎকার কোরে কাউকে ডাকতে ইচ্ছে হয়— কিন্তু সে সারা বিশাল মাঠের কোথাও ভাগ্য রেখার মতো রাস্তাটিকে দেখতে পায় না। এক সময় সে ছুটতে শুরু করে। তার পায়ের আঘাতে ঘাসগুলো দুমড়ে মুচড়ে যায়। কখনো ছোট ছোট মাটির ঢেলা ছিটকে পড়ে আশেপাশে। তবু সে ছুটতে থাকে। টের পায় না, কপালের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জ’মে উঠছে। উদ্বিগ্ন চুলগুলো চমকে চমকে ছড়িয়ে পড়ছে মাথার চারপাশে। সে বুঝতে পারে না তার পায়ের কোনো- কোনো স্থান ছ’ড়ে গেছে, চিকোন লাল ফিতের মতো রক্তের ধারা নেমে আসছে। সে কিছুই বুঝতে পারে না। সে কিছুই টের পায় না।

হঠাৎ গানের শব্দে সে দ্যাখে সে তার হাতের তালুতে তাকিয়ে আছে। ভাবে, হাতের ভেতর সে এসব কী দেখছিলো! কতোখন ধ’রে সে তার হাতের দিকে এইভাবে তাকিয়ে রয়েছে! কেউ তাকে এ অবস্থায় দেখলে নিশ্চয়ই পাগল ভাবতো! মনে মনে খুশি হয়, যাক কেউ দেখতে পায়নি। মাঝে মাঝে নিজেকে পাগল মনে হয় তার। একদিন ক্লাস শেষে বন্ধুরা বসে গল্প করছিলো। প্রথম থেকেই ও কোনো কথা বলছিলো না। বন্ধুদের কেউ একজন বলেছিলো : আমরা একটা নষ্ট যুগের মধ্যে জন্ম নিয়েছি। না পারছি শিকড়ের পচা প্রশাখাগুলোর মায়া ছাড়তে, না পারছি নতুন মাটিতে শিকড় গাঁথতে। কে যেন প্রতিবাদ করেছিলো : শিকড়ের পচা প্রশাখা বলছো কেন? পুরো মূলটাই তো পচা, নষ্ট। প্রথম বন্ধুটি বোলে উঠেছিলো : তাহলে কি তুমি বলতে চাও তোমার জন্মও নষ্ট? তুমি তো তোমার ঐতিহ্যকে অস্বীকার করছো তাহলে!

আমি তো তা বলছি না— আমি কেন, পৃথিবীর প্রতিটি শিশুর জন্মই সঠিক এবং শুদ্ধ। কিন্তু যে মাটিতে সে শিকড় গাঁথছে সেই মাটিই তো রোগাক্রান্ত, সেই মাটিই তো ব্যাধি। কয়েক মুহূর্তের জন্যে নিরবতা নেমে এসেছিলো ওদের আলোচনায়। হঠাৎ লক্ষহীনভাবে ও বোলে উঠলো : আমি ছোট বেলায় প্রায়ই বাগানে আমলকি পাড়তে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলতাম। আমার কান্না পেতো। অন্য সবাই ঠিকই পথ চিনে বাড়ি আসতো, কিন্তু আমি পারতাম না। একা একা চোখ মুছতে মুছতে হলদে পাখির ডাক শুনতাম, টুনটুনির ছুটোছুটি দেখতাম কিন্তু কিছুতেই কন্ঠের নিচের কষ্টটা কমতো না। চারিদিকে ধীরে ধীরে সন্ধার অন্ধকার নেমে আসতো। আমার গলা ফাটিয়ে চিৎকার কোরে ডাকতে ইচ্ছে হতো— ছোটদি আমি পথ হারিয়ে ফে-লে-ছি…

সেদিন সবাই ওর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো। ওদের নির্বিকার চোখের দিকে তাকিয়ে ওর মনে হয়েছিলো— ওরা কেউই ওকে বুঝতে পারে না।

গানের শব্দ আরো স্পষ্ট হয়। পাশের বাসার আইবুড়ো মেয়েগুলো রেকর্ড প্লেয়ার বাজাচ্ছে। ও বুঝতে পারে না মানুষেরা গান শোনে কেন! গান শুনে কী হয়! ও কোনোদিন গান শুনতে ভালোবাসে না। গানের সুরগুলো যখন বেজে বেজে, কখনো হালকা অস্পষ্ট, কখনো বা উচ্চগ্রামে আসতে থাকে তখন ওর মনে হয় কয়েকশো চিকোন কালো-কালো সাপ ফনা তুলে এঁকেবেঁকে তাকে গ্রাস করতে এগিয়ে আসছে। আবার তার মনে হয় পাশের বাসার ওইসব সুন্দর বুক আর নিতম্বধারী মেয়েরা সারাদিন কী করে! ওদের বিয়ে হয় না কেন! ওরা কি কোনো পুরুষকে আজো ভালোবাসতে পারেনি! ওরা কীভাবে অমন সুন্দর দেহখানা বিছিয়ে ঘুমায়— ওর ভীষন দেখতে ইচ্ছে করে। স্নানঘরে যখন ওদের শরীর থেকে একটা একটা কোরে শেষ কাপড়টি পর্যন্ত খ’সে যায় তখন কি ওরা নিজের দেহের সুন্দর রেখাগুলো ভাঁজগুলো মসৃন ত্বক ইত্যাদি দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে যায়! অথবা ওরা কী করে!

মীমাংসাহীন চিন্তাগুলো ওকে কুচি কুচি কোরে কাটতে থাকে। ওর ইশা কসাইয়ের কথা মনে হয়। ময়দার বস্তার মতো কী রকম ভোটকা মোটা শরীর। সারামুখে দাড়ি না কামানোর চিহ্নগুলো শুঁয়োপোকার কাঁটার মতো দেখতে। নিচের ঠোঁটটি ঈষৎ ঝোলানো। দেখতেই ভীষন কুৎসিত লাগে, মনে হয় যেন পাগলা কুকুর— জিব বেয়ে লালা ঝরছে। এই ইশা কসাই মুক্তিযুদ্ধের সময় এতো মানুষ খুন করেছিলো। ভাবতে শিউরে ওঠে ও। তাড়ি আর শস্তা বাংলা মদ খেয়ে ইশা তার মাংশ কাটার লম্বা ভোজালি নিয়ে ঘুরতো রাস্তায়। কোনো হিন্দুকে পেলে অথবা কাউকে মুক্তিবাহিনী সন্দেহ হলে তার চুল ধরে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যেতো নদীর পাশে, তারপর… আর ভাবতে পারে না সে। দু তিনজনকে এভাবে সে মারতেও দেখছে। ও বুঝতে পারে না কেন মানুষ মানুষকে খুন করে! একজন মানুষকে কিংবা কয়েকশো, কয়েক লক্ষ কোটি মানুষকে খুন কোরে ফেল্লে কি পৃথিবীতে শান্তি হয়! পৃথিবীতে কি কোনো দুঃখ থাকে না তাহলে!

কিন্তু কই, মহাযুদ্ধে তো কয়েক লক্ষ লোক মারা হলো, হিরোশিমায় মারা হলো, বাংলাদেশে মারা হলো, ইন্দোনেশিয়ায় মারা হলো— চিলিতে, ভিয়েতনামে, পানিপথে, ট্রয়ে… তবু পৃথিবীর শান্তি হয় না কেন! স্বস্তি হয় না কেন! তাহলে কী লাভ এতো মানুষ খুন কোরে?

.

পাশের বাসায় কে যেন কাউকে চিৎকার কোরে ডেকে উঠলে ওর আচ্ছন্নতা কেটে যায়। বিস্মিত চোখে তাকায় ঘরের ভেতরের চারদিকে। দুহাতের তালু দিয়ে চোখ মোছে। উপরে হাত তুলে আলসেমি ঝেড়ে টেবিল থেকে সিগারেট নিয়ে আগুন জ্বালায় তাতে। সেসময় সে কিছু ভাবে না। তার কেমন ফাঁকা ফাঁকা মনে হয়। চারদিক খুব শূন্য শূন্য লাগে।

একগাল ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সামনের দেয়ালের দিকে তাকায়। অনেকদিন চুনকাম হয়নি বোলে দেয়ালের রঙ ঝ’রে গেছে, ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে মেটে রঙের বালির পলেস্তারা। দেয়ালে একটা টিকটিকি দেখতে পায় ও। টিকটিকিটা শিকার ধরার জন্যে গুম মেরে সেঁটে আছে দেয়ালের সাথে। একটু একটু লেজ নাড়াচ্ছে কখনো, একটু এগিয়ে থামছে। মাথা নেড়ে দেখছে চারদিকে। ঘরের লালচে আলোয় ওই টিকটিকিটাকে ওর একটা হত্যাকারীর মতো মনে হয়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ইশা কসাইয়ের রগরগে লাল চোখ। হাতে ভোজালি। অত্যাধিক নেশায় টলটলায়মান শরীর।

হঠাৎ একটা নীলচে প্রজাপতি পত্ পত্ করতে করতে ঘরে ঢুকে পড়ে। উড়তে থাকে এলোমেলো। নীলচে ডানার নিচে হলুদ শরীরটা খুব মোলায়েম আর তুলতুলে দেখতে। শান্ত হয়ে প্রজাপতিটা এবার দেয়ালে বসে। ন’ড়ে ওঠে টিকটিকির শরীর। গুটিগুটি এগোতে থাকে। ওটাকে দেখতে সেইসব সতর্ক খুনিদের মতো মনে হচ্ছে। চমকে ওঠে ও। ওই সুন্দর প্রজাপতিটিকে খুন করবে ওই টিকটিকিটা।

কলেজে পড়া অনীল। কেবল গোঁফ গাঢ় হচ্ছে। চোখে মুখে উজ্জ্বল প্রত্যয়। ননীর মতো টকটকে রঙ। এইতো ওর দিকে ইশা কসাই এগিয়ে যাচ্ছে। প্রজাপতির খুব কাছে এসে পড়েছে টিকটিকিটা। ওর সমস্ত শরীরে রক্ত হিম হয়ে যেতে থাকে। ওর মধ্যে প্রবল একটা ইচ্ছা হাত-পা বাঁধা অবস্থায় চিৎকার করতে থাকে। এই হত্যা ঠেকানো উচিত।

ওই টিকটিকিটাকে এই মুহূর্তে তাড়া দেয়া উচিত। নইলে সুন্দর নীলচে প্রজাপতিটাকে ওটা খুন কোরে ফেলবে। প্রজাপতিটিকে বাঁচানো যাবে না।

অনীলকে পালাতে বলছে না কেন কেউ! কেউ ইশা কসাইকে বাধা দিচ্ছে না কেন! ইশা অনীলকে খুন কোরে ফেলবে। এভাবে ও অনেক মানুষ খুন করেছে। গ্রাম থেকে আক্কাস এসেছিলো ওর মা-র জন্যে ওষুধ নিতে। ইশা তাকেও খুন করেছিলো। ওকে কেউ বাধা দিচ্ছে না কেন! সবাই তো জানে ও খুনি। ও মানুষ খুন করে। গহর মাঝিকে তো ও-ই খুন করেছিলো। গোবিন্দর বউকে তিনদিন আটকে রেখে সকাল বেলায় সবার সামনে ফেরিঘাটের জেটিতে জবাই করেছিলো— কেউ ওকে বাধা দেয়নি। সবাই বুঝতে পারছে এখনই একটা খুন হবে। ইশা কসাইয়ের ওই পশুর মাংশকাটা ভোজালিটা এক মুহূর্ত পরেই অনীলকে কেটে টুকরো টুকরো কোরে ফেলবে। অনীল বুঝতে পারছে না তাকেই খুন করা হবে। ও কেমন হাসছে। কথা বলছে। হাত নেড়ে নেড়ে কী যেন বোঝাচ্ছে দোকানিকে। দোকানি তুমি তো জানো সব, তবু অনীলকে পালাতে বলছো না কেন! তোমার মুখ তো ফ্যাকাশে পান্ডুর হয়ে উঠেছে। কন্ঠ শুকিয়ে আসছে অথচ অনীল কেমন সুন্দর হাসছে। কথা বলছে। ও-তো জানে না ওর দিকে হত্যার ষড়যন্ত্র ছুটে আসছে। মৃত্যু ওর পাশটিতে এসে দাঁড়িয়েছে, কাঁধে হাত রেখেছে। তবুও ও বুঝতে পারছে না— সুন্দর হাসছে, কথা বলছে।

পাখা দোলাচ্ছে কি চমৎকার প্রজাপতি। পাখায় আলো প’ড়ে চিক চিক করছে রুপোর মতো। ওকে ওই নৃশংস টিকটিকিটা খুন করবে। ওকে ওই ঘৃন্য ইশা কসাই খুন করবে। সবাই রক্ত উঠে যাওয়া মুখ আর শুকনো কাঠ হয়ে যাওয়া কন্ঠ নিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে এই হত্যাকান্ড। কেউ কোনো প্রতিবাদ করবে না। বাধা দেবে না। সভ্যতার প্রকাশ্য রাজপথে একজন ইশা কসাই, একজন টিকটিকি একটি অনীলকে একটি প্রজাপতিকে হত্যা করবে। অথচ ইশা কসাইর থেকে শত গুনে বলবান মানুষেরা— টিকটিকির চেয়ে শত গুনে বলবান এই মানুষটি তার বাধা দেবে না। অনায়াসে একটি নির্মম হত্যাকান্ড ঘটে যেতে সাহায্য করবে এইসব মানুষেরা। এই মানুষটি।

চরকার মতো সমস্ত পৃথিবীটা ওর চোখের সামনে ঘুরতে থাকে। ও দ্যাখে হিরোশিমা থেকে কুন্ডলি পাকিয়ে পাকিয়ে কালো ধোঁয়া উড়ে ঢেকে দিচ্ছে ওর মুখ শত শত লাশের পাশে ওর অক্ষম দাঁড়িয়ে থাকা। শকুন এসে বসেছে ওর মাথায়। ঠুকরে ঠুকরে মাথার ঘিলু বের কোরে যাচ্ছে। অসংখ্য কালো কালো কুকুর ওর দেহ থেকে ছিঁড়ে খাচ্ছে মাংশ, কামড় বসাচ্ছে হাড়ে।

ও কাউকেই ঠেকাতে পারছে না। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে বর্বর ইশা কসাইয়েরা আদর্শের দেশি মদ আর ধর্মের তাড়ি খেয়ে বর্ন সম্প্রদায়ের নেশায় বুঁদ হয়ে ভোজালি হাতে ছুটে আসছে তার দিকে। সমস্ত পৃথিবীতে ও একা। হাত-পা বাঁধা। যাতে চিৎকার করতে না পারে তার জন্যে মুখে গুঁজে দেয়া কাপড়। ও কথা বলতে পারে না— ও বাধা দিতে পারে না— ও প্রতিবাদ করতে পারে না। নিজেকে ওর বস্তির পাশে প’ড়ে থাকা মৃত বিড়ালের মতো ঘৃন্য মনে হয়। নিজেকে ওর পলাশির মাঠে কয়েক সহস্র সৈন্য নিয়ে নিষ্কর্ম দাঁড়িয়ে থাকা মীরজাফর মনে হয়। ও অনীলকে বাঁচাতে পারে না— একটি সামান্য প্রজাপতিকেও বাঁচাতে পারে না।

টিকটিকিটা এক লাফে ধ’রে ফ্যালে প্রজাপতির নীল ডানা। পত পত কোরে দাপাদাপি করতে থাকে ওটা। আর নিশ্চিন্ত নির্বিকার মনে টিকটিকিটা ধীরে ধীরে গিলতে থাকে সমস্ত প্রজাপতিটাকে। ওর পাখার আঘাতে শব্দময় হয়ে ওঠে নিশব্দ ঘরখানা। ওর আর্ত চিৎকারে ভেঙে পড়তে থাকে জনপদের সমস্ত ইমারত। ইশা কসাইয়ের ভোজালি ফেড়ে ফ্যালে অনীলকে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুতে থাকে। মুমূর্ষু অনীল বাঁচবার ব্যাকুল প্রার্থনা নিয়ে ডাকতে থাকে আশেপাশে জড়ো হওয়া মানুষদের নির্বিকার সমস্ত মানবগোষ্ঠী, সম্পূর্ন নির্বিকার এই মানুষটি তাকিয়ে তাকিয়ে এই হত্যাকান্ড দেখতে থাকে। অনীলের ক্ষত-বিক্ষত শরীরটা সভ্যতাকে ব্যঙ্গ কোরে প’ড়ে থাকে পথের ওপর।

ওর হিম হয়ে যাওয়া রক্তের গভীরে ও শুনতে পায় সমুদ্রের গর্জন। পৃথিবীর সমস্ত হত্যার বেদনাভারে ক্লান্ত ও প’ড়ে যায় খরায় চৌচির শস্যক্ষেতের মাঝে। ওর সামনে কোনো পথ নেই। ওর হাত-পা বাঁধা, মুখে কাপড় গোঁজা। ঝাঁঝালো রোদের মধ্যে প’ড়ে থাকা ওর ক্লান্ত শরীর। কোথাও জল নেই, ঘাস নেই, ফুল নেই, পাখি নেই—কোথাও কোনো সবুজ নেই। সে দিগন্ত বিস্তৃত শূন্যতার মাঝে, নিশব্দের মাঝে, ক্লান্তির মাঝে একা একা প’ড়ে আছে। ওর গলা শুকিয়ে আসে, কন্ঠের নিচে ব্যথা করতে থাকে। ওর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে হয় : ছোটদি আমি পথ হারিয়ে ফে-লে-ছি… আমি প-থ হা-রি-য়ে ফে-লে-ছি…

১৮.০৮.৭৭ সিদ্ধেশ্বরী ঢাকা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *