গ্রন্থভূক্ত কবিতা (কাব্যগ্রন্থ)
গান
অগ্রন্থিত কবিতা
গল্প
চলচ্চিত্র কাহিনী ও চিত্রনাট্য
সম্পাদকীয়, গদ্য ও বক্তৃতা
সাক্ষাৎকার
1 of 2

সোনালি শিশির

সোনালি শিশির

কিবরিয়া চলচ্চিত্রের ব্যবসায় নামবে।

কাহিনী রচনার জন্যে প্রথমেই সে নির্বাচন করলো গল্পকার ইসহাক খানকে মুক্তিযোদ্ধা এই তরুন গল্পকার রাজনীতি সচেতন লেখার জন্যে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে। তবে বাজারে পরিচিতি কম। ছাত্রজীবনে উভয়ে প্রায় একই আড্ডায় ছিলো বোলে বোধহয় কিবরিয়ার এই নামটিই প্রথম মনে পড়েছে। তাছাড়া কেনই বা সে ইসহাককে নির্বাচিত করবে। ব্যবসার জন্যে যে চলচ্চিত্র এখানে তৈরি হচ্ছে, ইসহাক তো সেই ধারার বিরুদ্ধ শিবিরের লোক।

তবে ইসহাক সম্মত হলো। ভাবলো, যদি কিছু বাড়তি টাকার বন্দোবস্ত হয় মন্দ কি! জীবন-যাপনটা একটু মসৃন হবে। ঝলমলে পৃথিবীর আলো-ছায়ায় কিছুদিন বেশ স্বচ্ছন্দে সোনালি শিশির পান করা যাবে। এই তো, এর বেশি আর কি চাই! তো খালি মুখে তো আর ছবির কাহিনী নিয়ে আলাপ করা যায় না, চলো সাকুরা যাওয়া যাক।

বন্ধুর প্রযোজিত চলচ্চিত্রে যে কোনো একটি চরিত্র জুটিয়ে নেবার আশা এবং সোনালি শিশির পানের নিশ্চয়তা নিয়ে আমিও ওদের সাথে শরিক হয়ে পড়লাম। আহ্ কতোদিন বিলেতি খাই না!

গুরুত্বহীন অতিথি হিশেবে আমাকেই রিকশার হেলানে উঁচু হয়ে বসতে হলো। পশ্চাদ্দেশের জন্যে জায়গাটি মোটেই সুখপ্রদ নয়। তবু নিকটবর্তী সৌভাগ্যের স্বপ্নে পশ্চাদ্দেশের কষ্টটুকু হজম কোরে নিলাম।

এক রিকশায় তিনজন এবং রাস্তা শর্টকাট করার জন্যে উল্টোপথে আসা— ট্রাফিক আইনে এই দুটি অপরাধ কোরে আমরা যখন সাকুরায় পৌঁছলাম তখন মাইকে এশার নামাজের আজান বাজছে। হে বিশ্বাসীগন সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো—

আমি আপাতত কিবরিয়ার জন্যে কৃতজ্ঞ চিত্তে বারের প্রবেশ দরোজা খুলে দিলাম। জমজমাট অবস্থা ভেতরে। সারাদিন সবাই যেন মুখে ঠুলি বেঁধে কথা বন্ধ কোরে রেখেছিলো। স্যাম্পেনের ছিপি খোলার মতো সবাই এখন উথলে পড়ছে। মহিলা ও আছে কয়েকজন, অনুজ্জ্বল আলোয় বয়স বোঝা যায় না। তারকাবিহীন এই একটিই বার, যেখানে মহিলাদের সঙ্গে বসা যায়। আর সবকটিতে হোমো-সেক্সচুয়াল পরিবেশ।

কোনের দিকে একটু নিরিবিলিতে আমরা জায়গা নিলাম। পাশের টেবিলে একদল নাট্যকর্মী, সাথে একজন জনপ্রিয় নাট্যকার। এই নাট্যকার শ্রমিকদের জীবন নিয়ে বেশ কয়েকটি নাটক রচনা করেছেন। তার সব নাটকের শেষ দৃশ্যে লাল সূর্য উদিত হয়। একটু দূরে একজন বিদেশিনীর সাথে দুজন তরুন তরুনী। দুজন অভিনেতা আর জনা তিনেক কবি গলা সপ্তমে তুলে গান গাচ্ছে। কিছু ব্যবসায়ী, দু-একজন তরুন আমলা ছাড়াও বেশ কজন মস্তানও বিভিন্ন টেবিল ঘিরে বোসে আছে। দু-চার মিনিটেই আমরা ধাতস্থ হলাম।

আমি ভিক্ষুকের কাকুতি মেশানো কণ্ঠে বললাম— ‘কিবরিয়া, দোস্ত প্রথম পেগটা কালো কুত্তা নে।’

কিবরিয়া জবাব না দিয়ে চুপ কোরে কি যেন ভাবছে। আমি চোখের ইশারায় ইসহাককে দলে টানার চেষ্টা করলাম। ইসহাক বল্লো— ‘কালো কুত্তা দিয়ে শুরু করতে পারলে মন্দ হয় না। কি, কিবরিয়া, এত ভাবনার কি আছে? ভালো জিনিশ পেটে পড়লে কাহিনীটাও জম্পেশ বেরুবে।’

কিবরিয়া মুখে হাসি এবং কণ্ঠে কৃত্রিম হতাশা এনে বল্লো—’বুছি, আমারে ধসানোর প্লান। ঠিক আছে, কালো কুত্তা দিয়ে শুরু হোক। কিন্তু পরেরগুলো বংশীবাদক।’

আমরা উল্লাসে ‘মারহাবা, মারহাবা’ ধ্বনি দিয়ে উঠলাম। দীর্ঘদিন অন্তজ পাড়ায় মাতৃভাষা মানে কেরু কোম্পানির পানি মেশানো বাই প্রোডাক্ট খেয়ে খেয়ে আমার জিভের প্লাস্টার খ’সে গেছে। কালো কুত্তার সুরভি আর সোনালি রঙ দেখে পান করার আগেই আমি উল্টো পাল্টা বকতে শুরু করলাম।

‘আহ থাম তো, বকর বকর করিস না।’ কিবরিয়া চাপা ধমক লাগায় আমাকে। ইসহাক পরম করুনাময়ের নামে গ্লাসে ঠোঁট স্পর্শ করলো। আমরাও ওকে অনুসরন করলাম। হঠাৎ এক ধরনের বিষণ্নতা গ্রাস করলো আমাকে।

অভিনেতা হবার জন্যে সেই ছাত্রজীবন থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি অথচ তেমন কোনো সুবিধাই করতে পারলাম না এখনো। নিজের জীবন-যাপনের জন্যে যে সামান্য উপার্জনটুকু দরকার তা-ও সম্ভব হচ্ছে না। সবাই শুধু আশা দিয়ে ঘোরাচ্ছে। সৌভাগ্যের ঘোড়ায় চড়া তো দূরের কথা, ঘোড়াটারই দ্যাখা পেলাম না আজো। অথচ কিবরিয়া পারিবারিক ব্যবসায় ঢুকে পড়েছে। সংবাদপত্রে চাকরি আর গল্প লিখে ইসহাকও মন্দ করছে না। আমি শালা কুফা।

.

ইতিমধ্যে ওরা ব্যবসায়িক আলাপ শুরু কোরে দিয়েছে। ইসহাক বেশ অনুভূতি-প্রবন কন্ঠে কাহিনীর কাঠামো বর্ননা কোরে যাচ্ছে আর কিবরিয়া মনোযোগের সাথে শুনছে। মন্তব্য করছে মাঝে মধ্যে। আমরা কালো কুত্তার সঙ্গ ছেড়ে বংশীবাদকের পেছনে ছুটে চলেছি। আমি ইসহাকের কথায় মনোযোগ দিলাম।

‘হ্যাঁ প্রথম খুনটা সে করেনি। মিথ্যে খুনের মামলায় জেল খাটতে হয়েছে তাকে। এরপর সাজা খেটে জেল থেকে বেরিয়েই তাকে জেলে পাঠানোর নায়ককে সে খুন করে এবং গা ঢাকা দেয়। আর ফেরারি জীবন-যাপন করার সময়েই সে ভাড়াটে খুনিতে পরিনত হয়। টাকা পেলে সে যে কাউকেই খুন করতে প্রস্তুত।’

কিবরিয়া ন’ড়ে চ’ড়ে বোসে প্রশ্ন করে ‘তার মানে লোকটা একটা ক্রিমিনাল হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, তাই না?’

ইসহাক গ্লাসের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে ‘হ্যাঁ, ক্রিমিনাল হিশেবেই চরিত্রটা দাঁড়াচ্ছে এবং এটাই মূল চরিত্র।’

‘এন্ডিং-এ তাহলে কি হচ্ছে? মানে মূল চরিত্রের পরিনতি কি?’ কিবরিয়া জিগ্যেস কোরেই গ্লাসে চুমুক দেয়। সিগারেট ধরায়।

ইসহাক একটু ভেবে উত্তর দেয় ‘পরিনতিটা আমি ভেবেছি— লোকটা পুলিশ ইনেস্পেক্টরকে খুন কোরে উধাও হয়ে যাবে। কেউ জানবে না সে কোথায় গেল। এটাই শেষ দৃশ্য।’

‘পুলিশ ইনেস্পেক্টর ক্যারেক্টারটা কখন ইন্ করছে?’ কিবরিয়া প্রশ্ন করে। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়ার রিং বানানোর চেষ্টা করতে থাকে।

‘এটা আসলে প্যারালাল ক্যারেক্টার। খুনির বোনের সাথে এই ইনেস্পেক্টরের একটা এ্যাফেয়ার দ্যাখাতে হবে। রোমান্টিক নায়ক নায়িকা এরা দুজন, বুঝলি?’ কথা শেষ কোরে ইসহাক লম্বা শ্বাস টানে তারপর গ্লাসে চুমুক দেয়।

কিবরিয়া প্রশ্ন করে ‘ভাড়াটে খুনিটা পুলিশ ইনেস্পেক্টরকে খুন করবে কেন?

নিজের অজান্তেই আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল ‘আরে ইনেস্পেক্টরকে খুন করবে না তো কি তোকে খুন করবে? ইনেস্পেক্টরকে তো সে খুন করবেই। সে একটা ভাড়াটে খুনি। নিশ্চয়ই কেউ তাকে টাকা দিয়েছে; তা না হলে সে ইনেস্পেক্টরকে মারবে কেন?’

কিবরিয়া কিছুটা উষ্ণ হয়ে ওঠে ‘না হয় বুঝলাম ভাড়াটে খুনি, কিন্তু সে ইনেস্পেক্টরকে খুন করবে কেন? একটা কজ থাকবে না? কজটা কি?’

আমি চটপট উত্তর দিই ‘নিশ্চয়ই লেনদেন নিয়ে গোলমাল। শালার পুলিশ মারও না বাপেরও না। ভালোই করছে খুন….

‘থাম হালার পো, কিয়ের মধ্যে কি কস্?’ ইসহাক আমাকে ধমকে থামিয়ে দেয়। ‘ব্যাপারটা ওরকম না। শোন কিবরিয়া, ইনেস্পেক্টরের মৃত্যুর পেছনে অবশ্যই কারন আছে। মানে দর্শকদের একটা কজ তো আমরা দ্যাখাবো, সেটা হলো…’

কথা বলা থামিয়ে ইসহাক চুমুক দেয় গ্লাসে। কেশে গলা পরিষ্কার কোরে টেবিলের উপর থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বাম হাতের তর্জনী দিয়ে প্যাকেটের উপরে দুইবার টোকা দেয়। একটা সিগারেট বের কোরে ঠোঁটে লাগিয়ে লাইটার জ্বালে কিন্তু সিগারেট জ্বালায় না। লম্বা নীল আগুনের শিখাটিকে খুব চমৎকার দেখায়।

‘কি হলো?’ কিবরিয়া ও আমি ওর কথার অপেক্ষায় চাতক পাখির মতো চেয়ে আছি।

‘হ্যাঁ, মানে’–এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে ইসহাক টেবিলে ফিরে এলো। ‘কজটা এইভাবে সাজাতে হবে— ধর, খুনিটা যে এলাকায় থাকে এই ইনেস্পেক্টরও সেই এলাকায় বদলি হয়ে নোতুন এসেছে…’

কথা কেড়ে নিয়ে কিবরিয়া বলতে শুরু করে ‘ইয়েস, ইয়াং অফিসার, সৎ, দেশকে ভালোবাসে। মানে ক্রিমিনালদের বিরুদ্ধে…

‘ঠিকই’ ইসহাক মাইক্রোফোন কেড়ে নেয় ‘চরিত্রটা একটা পজিটিভ মানে পজিটিভ সাইডটা। সততা, ন্যায়পরায়নতা, দেশপ্রেম এগুলো একটা চরিত্রের মধ্যে দ্যাখাতে হবে তো! সংঘাতের শুরু এইখানে।’ ইসহাক উচ্চস্বরে শেষ বাক্যটি বোলেই টেবিলে চাপড় মেরে একভাবে কিবরিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ‘মানে, ঘটনাটা দাঁড়াবে— নোতুন ইনেস্পেক্টর এলাকায় আসাতে স্থানীয় একজন বস ক্রিমিনালের বিপদের সম্ভাবনা দ্যাখা দেয়। আর সে-ই ভাড়া করে ওই খুনিকে। ইতিমধ্যে খুনির বোনের সাথে ইনেস্পেক্টরের মহব্বত জ’মে উঠেছে। বুঝলি?’

আমি আর বিলম্ব করতে পারি না ‘দোস্ত, নায়ক নায়িকার নাচাগানা, ধস্তাধস্তি এসব হবে না?’

‘হবে, হবে, সব হবে।’ কিবরিয়া যেন শিষ্যের প্রতি গুরুর আশ্বাস জানায়। আমি আরো এগিয়ে যাই ‘নায়িকার গায়ে ব্লাউজ না থাকলে ব্যাপারটা দারুন জমবে। একেবারে নোতুন আইডিয়া।’ ‘তুই থাম তো’ ইসহাক ধমক দিয়ে আমাকে থামিয়ে দিতে চায় কিন্তু এবার আমি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠি ‘ওই হমুন্দির পো, এ্যাতো থাম থাম করস ক্যান্? আমি কি তোর পয়সায় মদ খাই নাকি?’ ইসহাকও জবান খুলে দেয় ‘মদ না তুই মুত খা— কতা কস। চোপা খুইলা হাতে ধরায়া দিমু। হালায় খবিশ!’

‘এখন মাইর হবে কিন্তু। মুখ খারাপ করবি তো খোমা পাল্টায়া ফালাবো চুতমারানি।’

ব্যাপারটা হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই কিবরিয়া দুই হাতে আমাদের দুজনকে চেপে দুদিকে বসিয়ে ফেল্লো। ওর কন্ঠে ক্ষোভ ‘মারামারি রাস্তায় করবি। পয়সা দিয়া মদ খাওয়াইয়া তোমাগো ফাইটিং দেখতে বসি নাই। আমার কাম আছে। বোলে কিবরিয়া ডান দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে ডাকলো ‘ভিনসেন্ট, ওই ভিনসেন্ট, আর এক রাউন্ড লাগাও।’

তিনজনে এক সাথে নিশ্চুপ হয়ে গেলাম আমরা। বারের গুঞ্জন ক্রমশ চিৎকারে রূপান্তরিত হচ্ছে। আমরাও টলোমলো। আমি একটা সিগারেট ধরাতে গিয়ে ফিল্টারের দিকে আগুন লাগিয়ে নষ্ট কোরে ফেললাম। দেখলাম ওরা কেউ দ্যাখেনি। নিশব্দে সিগারেটটা এ্যাস্ট্রেতে গুঁজে দিয়ে গুন গুন কোরে গান ধরলাম— ‘জ্বালাইয়া চান্দেরও বাতি, জেগে রবো সারা রাতি গো…’

কিবরিয়া দুচুমুক বংশীবাদক খেয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে ইসহাকের দিকে তাকায় ‘আচ্ছা, আমরা আবার শুরু করি, কি বলিস?’

চোখ মুখ ঝাঁ ঝাঁ করছে আমার। মনে হচ্ছে, ওরা অনেক দূরে বোসে কথা বলছে। আমি কান খুলে থাকলাম। ইসহাক মাথা উঁচু কোরে ঝাঁকি দিয়ে শয়তানকে ঘাড় থেকে নামালো। ইবলিশটা ঘাড়ে বোসে এতোক্ষন ওর মাথা বুকের সাথে চেপে রেখেছিলো। ‘হু, ইনেস্পেক্টর— প্রেম করছে— খুনির বোনের সাথে…’

একটানে চোখ থেকে চশমা খুলে ফ্যালে কিবরিয়া, বলে ‘ইয়েস, আচ্ছা, আমরা এইখানে কিছু ইন্‌টিমেট সীন দ্যাখাতে পারি।’ আমি উল্লাস চেপে রাখতে পারি না ‘মাইরি দোস্ত, একটা খোলামেলা রেপসীন্।’

“না, না, রেপ না,—খোলামেলা— তবে সফ্ট। আমরা বেডরুম দৃশ্য মানে বিছানায় হ্যাঁ সফ্ট আর কি!’ কিবরিয়া হাত নেড়ে নেড়ে বলে। তার কন্ঠস্বর জড়িয়ে যাচ্ছে।

আমি ক্ষেপে যাই ‘বোল্লেই হলো! অবিবাহিত নায়ক নায়িকাকে বিছানায় নেয়া আপত্তিজনক কাজ, ধর্ম বিরোধী।’

কিবরিয়া গলায় ভারিক্কি ভাব আনে ‘এটেই রিয়েলিটি, বাবা— বাস্তবে এটাই ঘটছে।’

‘কে বলেছে এসব? যাও না— চামড়া চালান হয়ে যাবে।’ আমার কন্ঠস্বরে ক্ষোভ আরো বাড়ে। ইসহাক কেশে গলা পরিষ্কার করে, গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলে ‘এই তুই বাজে বক্‌ছিস, তোর হয়ে গেছে।’

আমি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ‘না-না’ কোরে উঠি।

পাশের টেবিলগুলোর কোলাহল আমাদেরও গ্রাস করে। আমরা শুনতে বাধ্য হোই ‘সাইয়া দিলমে আনা রে’ বিকৃত কণ্ঠে এই গানটি। জনপ্রিয় অভিনেতা হিজড়া নাচের ভঙ্গিতে হাত পা নেড়ে গানটি গাচ্ছে।

ইসহাক উচ্চকণ্ঠে একাত্মবোধক ধ্বনি করে ‘দে মা, দে—’

‘ভাও কোরে দে মুরশিদ’ আমিও যোগ করি।

পুরো বারটি এবার দুলতে শুরু করে চিৎকারে, গানে, হাততালিতে। যেন ঝড়ে পড়েছে জাহাজ। এখনি উল্টে পড়বে, ডুবে যাবে। টেবিলের পাশের খোলা জায়গাটুকুতে আমরা নাচতে শুরু করি।

.

খানিকক্ষন হাত পা ছোড়াছুঁড়ি আর গলার ব্যায়ামে কিছুক্ষনের মধ্যেই প্রায় সকলেই পোতায়ে যায়। যে যার আসনে বোসে পড়তে থাকে। রেখে যাওয়া গ্লাস কার কোনটি তা নিয়ে সামান্য বিতর্কও হয়। এক সময় বেশ নিরবতা নেমে আসে। কেন্দ্ৰীয় ক্যাসেটে তখন ‘ঝিলমিল ঝিলমিল ঝিলের জলে ঢেউ খেলিয়া যায় রে…’

আমার মাথার মধ্যে ঝিলমিল ঝিলমিল ‘একটা গনঅভ্যুত্থান খাই দোস্ত?’ আমি মিনতি জানালাম। কিবরিয়া হাত তুলে ডাকে ‘এই ভিনসেন্ট, দুইটা গনঅভ্যুত্থান’ ভিনসেন্ট কিছুটা ছুটে পাশে আসে ‘জী স্যার?’

আমি তর্জনী নাচিয়ে বলি ‘গনঅভ্যুত্থান— দুইটা, ইসহাক চলবে নাকি?’ ইসহাক মাথা নাড়ে।

ইবলিশটা আবার ওর ঘাড়ে চেপেছে। ইসহাকের মাথাটা ঝুলে রয়েছে বুকের উপর।

হঠাৎ ভিনসেন্ট খুশিতে বোলে ওঠে ‘ওহ্ স্যার, ভ্যাট সিক্সটি নাইন!’ প্ৰথমে বুঝতে পারি নাই। এটাই লাস্ট? দশটা পঁচিশ বাজে।’ কিবরিয়া ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আঙুল তুললো ‘হ্যা লাস্ট, বিল দাও। ওহ্ লাস্ট— গন অভ্যুত্থান–’

বেশ কিছুদিন থেকে আমরা প্রায় প্রতিটি মদের ডাক নাম দিয়ে ফেলেছি। সোনালি শিশির হলো হুইস্কি। হানড্রেড পাইপার্স হলো বংশীবাদক। ব্লাক ডগ— কালো কুত্তা। নেপোলিয়ান ব্র্যান্ডি-নেপো কাকা। জীন হলো পরী। আর বাংলা মদ হলো মাতৃভাষা আমরা গনঅভ্যুত্থানে ঠোঁট ছোঁয়ালাম, কিবরিয়া ইসহাকের সাথে আগামী সাত দিনের প্রোগ্রাম ঠিক করতে থাকলো।

আমি বিদেশিনীর দিকে চোখ মেলে রাখলাম ‘ওহ্ বেহেস্তবাসিনী!

আমরা যখন রাস্তায় বেরোলাম তখন মধ্যরাত হতে আর চল্লিশ মিনিট মাত্র বাকি। রাত দশটায়ই ঢাকায় মধ্যরাত নেমে আসে। সুবিধাভোগীরা যে যার কোলাসিবল মোড়া খাঁচায় ফিরে যায়। সুবিধাহীনেরা উন্মুক্ত খাঁচায়।

আগে মাঝরাতের পর রাস্তায় পুলিশ এবং গনিকাদের সাথে দ্যাখা হতো। এখন কারো সাথেই দ্যাখা হতে চায় না। ‘ওই রিশকা খাড়াও।’

ইসহাকের মাথা বুকের উপর ঝুলে পড়েছিলো। আমি আর কিবরিয়া উচ্চস্বরে গল্প করছিলাম। রিকশার ব্রেক আমাদের চমকে দিয়ে থেমে গেল। ‘তিন জোন উঠছেন ক্যাঁ? হালায় নামেন।

ডাইনে তাকিয়ে দেখি তিনজন পুলিশ। একজন কাঁচাপাকা দাড়ি সম্রাট শাজাহানের মতো কোরে ছাঁটা। অন্যজন ঢ্যাঙা। তার ঘাড়ের উপর অনর্থক লম্বা গলাসহ একটি মাথা যেন পুঁতে আছে। বাকি জন ছোটখাটো সুদর্শন। কাঁচাপাকা দাড়ি কথা বলছে।

কিবরিয়া চাঙ্গা হয়ে উঠলো। এ ব্যাপারে শরাবের কার্যকারিতা কিংবদন্তির মতো। ‘খবরদার গালাগালি করবেন না। আমরা ভদ্রলোক। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছি।’

‘রাখেন মিয়া, আপনি তো মদ খাইছেন। ভদ্রলোকে মদ খায় নাহি? কাঁচাপাকা অস্থির হাত নাড়ে। তার মুখগহ্বর থেকে চর্বিত পানের ভগ্নাংশ ছিটকে আমার গালে এসে লাগে।

ঢ্যাঙা সামনে এগিয়ে আসে ‘নামেন আপনারা। থানায় যাতি হবে।

ইসহাকের মাথা ইতিমধ্যে টনটনে সোজা। আমারও মাথা পরিষ্কার। প্রবীনদের কাছে শুনেছি পুলিশ সামনে এলে নেশা ছুটে যায়— আজ হাড়ে হাড়ে তার প্রমান পেলাম।

‘কেন, থানায় যাবো কেন? আমরা কি চোর ডাকাত নেকি?’ ইসহাক কথা বলে।

‘কি করেন আপনি?’ ঢ্যাঙা ইসহাকের দিকে মনোযোগ দেয় এবার।

‘লেখক।’

‘কি লেখেন? সাংবাদিক? কোন পত্রিকায় লেখেন?

‘গল্প লিখি। সংগ্রাম আর ইনকিলাব ছাড়া অন্য সব কাগজে লিখি।’ ইসহাক কণ্ঠে অনুরোধ মেশায় ‘দ্যাখেন, রাত অনেক হইছে, আমরা এবার যাই।’

কাঁচাপাকা ধমকে ওঠে ‘থানায় চলেন’।

কিবরিয়া তর্কের অবতারনা ঘটায় ‘আমরা কি নুইসেন্স করেছি নাকি? থানায় নেবেন কেন?’

‘আপনি কি করেন?’ ঢ্যাঙার প্রশ্ন।

‘সিনেমার প্রডিউসার।’ কিবরিয়া উত্তর দেয়।

এবার আমার দিকে ফেরে ঢ্যাঙা ‘আপনি?’

আমি কাচুমাচু ‘হবু নায়ক। মানে অহনও চান্স পাই নাই।’

‘মদ খাওয়া নিষেদ আপনারা জানেন না?’ ছোটখাটো এতোক্ষনে মুখ খোলে।

‘জানবো না কেন। আমরা যারা মাথার কাজ করি তাদের এ জিনিশ না হলে চলে না— বুঝলেন। আমাদের থানায় নিয়ে কোনো লাভ হবে না। তারচে’ চা খাওয়ার জন্যে কিছু নেন।’ ইসহাক নিম্ন কন্ঠে এবার কিবরিয়াকে বলে ‘দোস্ত, তিরিশটা টাকা দিয়ে দে।’

‘তিরিশ টাকা দিলে রিকশা ভাড়া কম পড়বে। বিশ টাকা দিই?’ কিবরিয়া কিছুটা সংকুচিত।

ঢ্যাঙা খ্যাক খ্যাক কোরে ওঠে ‘ভিক্ষুক পালেন নাকি আমাদের? চলেন, থানায় চলেন।’

ইসহাক নম্রতা বাড়ায় কন্ঠে ‘আমাদের কাছে আর টাকা নেই। এই বিশ টাকাই দেয়া যায়, নেন। ‘

হঠাৎ আমার কানের পাশে ছোটখাটোর ফ্যাশ ফ্যাশ ‘শ তিনেক টাকার ব্যবস্থা করেন। বাসা কই আপনার?’

আমি পারলে শুয়ে পড়ি এরকম কাকুতি ঢালি গলায় ‘বিশ্বাস করেন, আর টাকা নেই আমাদের কাছে। বাসায় গেলেও টাকা পাওয়া যাবে না।’ কাঁচাপাকার দিকে আঙুল তুলে বলি ‘ওনারে একটু বোঝান, আমরা শিল্পী মানুষ, থানায় নিয়ে শুধু শুধু ঝামেলা করবেন কেন? আর আমরা তো কোনো অন্যায় করিনি।’

‘এই রিকা যা’—কাঁচাপাকা রিকশাটি বিদায় করলো। ‘আপনারা দাঁড়ান এখানে।’

আমার মাথার মধ্যে আবার ঝিলমিল শুরু হয়ে গেছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে এবং কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। তাকিয়ে দেখি ইসহাকের মাথা আবার ঝুলে পড়েছে বুকের উপর। কিবরিয়া ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ, পুলিশের হয়রানি এসব বিষয়ে বক্তৃতা শুরু কোরে দিলো। আর আমি তারস্বরে সরকারি নিষেধাজ্ঞা এবং সামাজিক অনুশাসনকে গালিগালাজ করতে লাগলাম।

আমি কাঁচাপাকার কাছাকাছি এগিয়ে গেলাম ‘চাচা, বেহেস্তে গেলে তো শরাবুন তহুরা খাইতে দেবে তাই দুনিয়া থিকাই অভ্যাসটা পাকা কইরা যাইতাছি। শেষে খাইতে বইসা যাতে লজ্জায় না পড়ি। বুঝলেন।’

কাঁচাপাকা কিছু না বোলে কটমট কোরে আমার দিকে তাকালো, আমি বিনীত হলাম ‘জানাশোনা কোনো হুরি আছে নাকি চাচা?’

‘ইয়ার্কি করেন আমার লগে? একদম চুপ যান। শালার পেট্রোলটা আহে না কেন?’

অদৃশ্য নিয়তি যেন কাঁচাপাকার প্রার্থনা শুনতে পেয়েই একটা লরি পাঠিয়ে দিলেন। আমাদের গা ঘেঁষে ব্রেক কষলো লরিটি। সামনের জানলা দিয়ে একটি পুলিশ অফিসারের ক্যাপ পরা মুখ বের হয়ে আমার দিকে তাকালো, আমিও চেয়ে আছি। ‘আরে বিশ্ব!’ ‘আরে তুই!’ ক্যাপ এবং আমি দুজনেই বিস্ময়, আনন্দ আর উল্লাস মেশানো গলায় চেঁচিয়ে উঠলাম। বিশ্বজিৎ আমার সহপাঠী ছিলো।

সিনেমার নায়িকারা সংকটে পড়লে নায়কগন যেভাবে ঠিক সময়টিতে উপস্থিত হয়ে বিপদমুক্ত করে, পুলিশ লরিতে বিশ্ব-র উপস্থিতি আমার কাছে অনেকটা সেরকম মনে হলো। হাঁফ ছাড়লাম, মনে মনে বল্লাম ‘যাক বাবা এ যাত্রা বাঁচা গেল। হাজতে আর মশার কামড় খেতে হচ্ছে না।’

‘ব্যাপার কি?’ বিশ্ব মূল প্রসঙ্গে ঢোকে।

আমি কিছুটা হে হে, কিছুটা বন্ধুসুলভ কণ্ঠে বলি ‘বুঝতেই তো পারছিস। সাকুরা থেকে আসছিলাম— এরা ডেকে আটকেছে।’

‘ফাউল টাউল করিস নি তো কিছু? বিশ্ব আমার কাছে জানতে চায়। আমি কিছু বলার আগেই সে ঢ্যাঙার দিকে ফিরে বলে—’কি ব্যাপার রহিম?’

ঢ্যাঙা গলায় এক ধরনের ঝাঁজ নিয়ে আসে ‘স্যার, এরা মদ খাইছে। মাতলামি করতিছিলো। এহনও গালিগালাজ করছে’।

‘আরে বাদ দাও, এরা ভদ্রলোক। এই লেখক শিল্পী তো—’ বিশ্ব বাক্যটি অসম্পূর্ন রেখে এক বিশেষ অভিব্যক্তি দিয়ে বাকিটা বোঝাতে চায় এবং ওদের কিছু বলার আগেই সে আমাদের লক্ষ্য কোরে ডাক দেয় ‘এই যে, আপনারা ওঠেন। কোথায় যাবি তোরা? খবর টবর কি তোর? সেই আগের মতোই আছিস এখনো!’

বিশ্বের কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শুধু বল্লাম ‘মগবাজার মোড়ে নামায়ে দিস।’ বোলেই আমি লরির পেছনে ছুটে গিয়ে লাফিয়ে উঠে পড়লাম। কিবরিয়া, ইসহাক আমার আগেই উঠে পড়েছে। লরিটা চলতে শুরু করলো।

পরস্পরের দিকে পরম স্বস্তিতে আমরা তাকালাম। কিবরিয়া ফোঁস কোরে সিগারেট ধরালো। দ্যাখাদেখি আমি আর ইসহাকও সিগারেট জ্বেলে সুখটান দেয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। ‘আচ্ছা দোস্ত, আমাদের আজকের এই কাহিনীটা নিয়েই তো একটা ছবি করা যায়, তাই না?’ আমি বেশ বুদ্ধিদীপ্ত হয়ে উঠি।

ইসহাক ন’ড়ে চ’ড়ে বসে। কিবরিয়া প্রথমে ঠোঁট কামড়ে গম্ভীর হয় তারপর বলে ‘মন্দ হয় না। শুধু বারে একটা হিরোইন ক্যারেক্টর সেট কোরে দিলেই, ব্যাস।’

সময় এসে গেছে। আমার ব্যাপারটা কনফার্ম করা দরকার। আমি নিবেদিত কন্ঠে বলি ‘দোস্ত, এই ছবিতে আমার ক্যারেক্টারটা কি আমাকে দিয়ে করানো যায় না??

০২ চৈত্র ১৩৯৬ মিঠেখালি মোংলা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *