১৪. শালডুংরির আতঙ্ক

শালডুংরির আতঙ্ক

দৈনিক কাগজের এক কোণায় ছাপা হয়েছে খবরটা। তাও মফস্বল পাতায়। হয়তো আমার চোখেই পড়ত না। বাইরে শীতের বিকেল তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে আসছে। জাফরানি রঙ রোদ্দুর শুধু যাই যাই করে। কি এক অচেনা পাখি জানালার ওপাশের কড়ই গাছের ডালে বসে ডাকছে। ডাকের শব্দটা অন্যরকম। দূর পাহাড়ি দেশের পাখি বোধহয়। পাহাড়ি পাখিদের ডাক অনেকটা এরকম।

আমি টেবিলে একটু ঝুঁকে পাখিটাকে দেখতে গিয়েই খোলা পত্রিকার কোণায় সেই খবরটা চোখে পড়ল। হত্যার দায়ে যুবক গ্রেফতার। সম্প্রতি শালডুংরি শহরের কুশল নামের এক যুবককে শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মন্তাজ আলীকে হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রকাশ্য দিবালোকে বাজারের মাঝখানে কুশল মন্তাজ আলীকে ছুরিবিদ্ধ করে। খবরে আরো জানা গেছে, কুশল বিগত কয়েক মাসে বেশ কয়েকজনকে ছুরিকাহত করেছে। ঘটনাটি এলাকায় প্রচণ্ড চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। খবরটা আমি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। শালডুংরি! ভীষণ চমকে উঠলাম। ছেলেবেলায় বাবার বদলির চাকরির সুবাদে শালডুংরিতে ছিলাম দু’বছর। সীমান্তের কাছাকাছি গাছপালায় ঘেরা জায়গা শালডুংরি। সেখানে কুশল নামের একটি কিশোর ছেলের সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু সেই কুশল তো ছিল খুব শান্ত স্বভাবের। কবিতা লিখত। ফুল ভালোবাসতো। আমাদের নিয়ে যেত শালবনে। কত ফুল আর গাছ চেনাত উৎসাহ নিয়ে। অনেকদিন যোগাযোগ নেই কুশলের সাথে। তাকেই কি হত্যাকারী হিশেবে গ্রেফতার করা হয়েছে? ব্যাপারটা কেমন যেন বিশ্বাসই হতে চাইছে না। অমন শান্ত, সরল ছেলেটা খুনি হবে।

পাহাড়ি পাখিটা উড়ে গেছে। আমার কেমন জানি অস্থির লাগল। নিচে তাকিয়ে দেখি ডাস্টবিনে একটা মরা বেড়াল ঝুলে আছে।

সে রাতে ভালো করে আর ঘুমুতে পারলাম না। মনে হলো শালবনের আলো আঁধারির মাঝে আমি আর কুশল হেঁটে যাচ্ছি। চারদিকে শুকনো শালপাতা খসে খসে পড়ছে। কুশল আমাকে পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা কোনো পাখি দেখাচ্ছে।

শালডুংরি জলতরঙ্গ বেজে ওঠার মতো একটা নাম। বুকটা কেমন করে রিনরিন ওঠে। সেই ছোট্ট, নিরিবিলি শহর। অজগরের পিঠের মতো কালো পিচের চকচকে একটাই রাস্তা। দূরের বন থেকে আদিবাসীরা কাঠ কেটে আনে।

শীতের সময় শালডুংরিতে অনেকেই বেড়াতে আসে। চমৎকার তাজা সবজি পাওয়া যায়। কাছেই রয়েছে বিরাট চিরুলি কৃষি খামার। সেখানকার কাঁকরোল খুব সুন্দর। আর রয়েছে শীতের বগড়ি পাখি। তেলে ভরা মাংশ। ভেজে খাওয়া যায়। ভাজার পর পাখিগুলো বেশ মচমচে হয়ে যায়। শালডুংরির কাছেই রয়েছে একটি পাহাড়ি ঝরনা। যার পানিতে ডুবে থাকলে শরীরের অনেক ব্যথা সেরে যায়। সে জন্যেও আসে অনেকে। ঝরনার পাশে একটি বাংলো আছে। এক রাত সে বাংলোতে ছিলাম। একটা চিতাবাঘ দেখেছিলাম সে রাতে। সেই শালডুংরি। সেই আমার কিশোরবেলার ছটফটে দিনগুলো মিশে আছে যেখানে। সেই নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে শাঁই শাঁই করে সাইকেল চালিয়ে ছুটে যাওয়া। রাত জেগে পড়া দুঃসাহসী অভিযানের কাহিনির নায়কদের মতো নিজেদের ভাবা। কুশল চমৎকার মাউথ অর্গান বাজাত। ও যখন মাউথ অর্গানে সুর তুলে সাইকেল চালাত তখন ওকে খুব সুন্দর লাগত। বাতাসে ওর চুল ফুলে উঠত।

সেই কুশলকে কি গ্রেফতার করা হয়েছে? আমার কপালের শিরা দপদপ করছে। এ যে আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। কুশল, সেই লাজুক স্বভাবের কিশোর।

কখনো বিকেলে আমাদের বাংলোর সামনে এসে সাইকেলের বেল বাজাত।

-এই, পাহাড়িদের গ্রামে যাবি? আজ সেখানে পরব আছে।

-কিসের পরব?

-করম পূজা হবে। শালবনে। যা মাদল বাজায় না সাঁওতালরা। শুনলে রক্তে একেবারে কাঁপন জাগবে।

-ফিরতে কি খুব রাত হবে?

-হলোই বা। আমি আঙ্কেলকে বুঝিয়ে বলব। আরে এরকম একটা উৎসব দেখাও তো অভিজ্ঞতা।

বাবাকে কুশল সহজেই রাজি করিয়ে ফেলল। বাবা শুধু বললেন, দেখ খুব বেশি আবার রাত কর না যেন। শুনেছি পাহাড় থেকে নাকি ভালুক নেমেছে।

আদিবাসীদের গ্রামে মশাল জ্বালিয়ে উৎসব। কি চমৎকার মাদল বাজায় ওরা। হাত ধরাধরি করে গোল হয়ে নাচে। কুশল ওদের কাছ থেকে অনায়াসে বুনোপাখির ঝলসানো মাংশ চেয়ে খেল। শালপাতায় মোড়া সেই মাংশ খেতে বেশ লাগছিল। কেমন অন্য রকমের একটা অনুভূতি।

শীতের ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে ফিরছিলাম আমি আর কুশল। ও কখনো মৃদু শিস দিচ্ছে।

-জানিস, আমি মাউথ অর্গানে একটা স্প্যানিশ সুর তুলেছি। স্পেনের পাহাড়ি গ্রামের সুর। মায়েরা তাদের ছেলেদের ঘুম পাড়াবার সময় এই গান গায়। বলে, খোকন সোনা, তোমাকে কিন্তু মস্ত বীর হতে হবে। পাহাড়ে গিয়ে লড়াই করতে হবে।

আমি জানি কুশলের মা নেই। কথাটি বলার সময় ওর গলা কেমন ভিজে গেল। কুয়াশার ভেতরে আমাদের সাইকেলের হেডলাইটের আলোতে হঠাৎ সামনে দেখি কি যেন একটা কালো মতো রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। সেই কালো ছায়াটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে।

কুশল সাইকেল থামায়। ফিসফিস করে বলে, সেই ভালুকটা বোধহয়।

আমার শরীরের ভেতর দিয়ে তখন একটা শীতল স্রোত বয়ে যায়। জন্তুটা এখন থপথপিয়ে এগিয়ে আসছে। কুশল আমার দিকে তাকিয়ে বলে, রাস্তার বাঁ দিক ঘেঁষে কান্নি মেরে জোরে সাইকেল চালিয়ে যা। একদম থামবি না।

আমরা তাই করেছিলাম। সেই শীতের রাতেও আমাদের শরীর থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরছিল। কুশল হেসে বলছিল,

-আরে ভালুক এসেছে মধু খেতে। আমরা তো আর মৌচাক না। দেখতিস, আমাদের কিছু করত না। টেবিলের উপর সেই দৈনিকটি খোলা। বাতির আলোতে হেডিংটা জ্বলজ্বল করছে। হত্যার অভিযোগে শালডুংরিতে যুবক গ্রেফতার। কুশল।

বিছানায় শুয়ে কেমন ছটফট করতে থাকি। দু’চোখের পাতা এক করতে পারি না। শুধু কুশলের সেই কোমল মুখটা ভেসে ওঠে। ডাগর দুটো চোখের মায়াবী চাউনি।

ভোররাতের দিকে একটা ট্রেন আছে। তাতে করে শালডুংরি যাওয়া যায়। আমি ঠিক করে ফেলি, ওটাতেই যাব।

ভোররাতের কুয়াশার জমাট পর্দা ছিড়ে শাঁই শাঁই করে ট্রেন ছুটে চলেছে। কামরার কোণায় খয়েরি শাল জড়িয়ে যিনি বসে আছেন তার মুখের আদলটা কেমন জানি চেনা চেনা লাগছে। থুতনির নিচে ভাঁজ। চোখ দুটো কালো চশমায় ঢাকা আছে বলে ঠিক ধরতে পারছি না। ভদ্রলোকও কি আমাকে দেখছেন? ট্রেনের ঝাঁকুনিতে অল্প অল্প দুলছি। কালো চশমা একটু ঝুঁকে আসে। ট্রেন চলেছে যেন গজারী বনের ভেতর দিয়ে।

-তুমি অন্তু না?

এ কণ্ঠ যে আমার ভীষণ রকমের চেনা। স্মৃতির পর্দা দুলে উঠল। কালো চশমা আমার হাত ধরেছে।

-তুমি শালডুংরির মিশন স্কুলে পড়তে না? এবার আমি চিনতে পারি।

-লেবুভাই, আপনি?

শালডুংরির লাল ইটের মিশন স্কুলের পলাশ গাছগুলোর কাছেই ছিল ভাস্কর পাঠাগার। লেবুভাই ছিলেন তার লাইব্রেরিয়ান। নতুন কোনো বই এলেই আমাদের উৎসাহে খবর দিতেন।

-লেবুভাই কেমন আছেন?

-ভালো না রে। চোখ দেখাতে এসেছিলাম। অপারেশন হয়েছে।

এই প্রথম লেবুভাইকে একটু বিষন্ন দেখলাম। শালডুংরির মাঠে হাসি মুখে ছুটোছুটি করে ফুটবল খেলত। লেবুভাই একবার আমাদের ডাকাত কালীর জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে গিয়েছিল রক্ত চন্দন গাছের খোঁজে।

-ইস, আপনার সাথে কতদিন পর দেখা হলো লেবুভাই। কত যে চমৎকার সব বই পড়াতেন।

সেই শালডুংরির টিনের চালের ভাস্কর পাঠাগারে কখনো ক্রিকেট বল ছুটে এসে পড়লে ঝমঝম শব্দ হতো। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদার কোনো নতুন বইয়ের খোঁজ পেলেই লেবুভাই আমাদের জানাত।

বুঝলি, ঘনাদার মতো চরিত্র আর হয় না। কোথায় কোথায় যে চলে যায়। এই কামচাটস্কার সাখালিন দ্বীপ তো সেই পেরুর আন্দিজ পাহাড়। কখনো পলিনেশিয়ার কোনো দ্বীপ নয়তো মধ্যএশিয়ার টাকাল মাকানের মরুভূমি। দারুণ সব ব্যাপার।

লেবুভাই ঘনাদার গল্প শুনিয়ে আমাদের তখন আচ্ছন্ন করে রাখত।

-তা অন্তত কোথায় চলেছ?

-শালডুংরি।

-হঠাৎ! তোমাদের কেউ তো সেখানে নেই।

-একটা বিশেষ ব্যাপারে খোঁজ নিতে যাচ্ছি।

-কি বল তো

পত্রিকায় দেখলাম খুনের অভিযোগে শালডুংরিতে কুশল নামের একটি যুবক গ্রেফতার হয়েছে। আমি জানতে চাচ্ছি এ কোন কুশল। আমার সাথে এ নামে একটি ছেলে পড়ত।

-হ্যাঁ, সেই কুশল। তোমার সাথে মিশন স্কুলে পড়ত। পাঠাগারে আসত।

-সেই কুশল! আশ্চর্য, সেই শান্ত ছেলেটা।

-অবাক কি আমরাও কম হয়েছি। এর আগে আরো চার-পাঁচ জনকে ছুরি মেরেছে সে।

-ব্যাপারটা হয়েছিল কি লেবুভাই? আমি যে ঘটনাগুলো একদম বিশ্বাস করতে পারছি না।

-প্রথম ঘটনাটি ঘটল কাঁকনতলি ব্রিজে। দুপুরবেলায়। শালডুংরির ঠিকাদার কাদু চৌধুরীকে তো চেন। সে আসছিল জিপ চালিয়ে। ব্রিজের কাছে এসে হঠাৎ তার জিপটা নষ্ট হয়ে যায়। কাদু চৌধুরী রাস্তার কয়েকটি বাচ্চাকে ধরে মারছিল। তার ধারণা ওরা রাস্তায় পেরেক ফেলে জিপের চাকা নষ্ট করেছে। ওই পথ দিয়ে তখন কুশল যাচ্ছিল। হঠাৎ নাকি সে ব্রিজের পাশে বসে থাকা ফলঅলার টেবিল থেকে ছুরিটা নিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকে কাদু চৌধুরীকে। সেদিনই কুশলকে গ্রেফতার করা হয়। আমরা তো ঘটনা শুনে রীতিমতো স্তম্ভিত।

আমার মাথাটা কেমন ঝিনঝিন করতে থাকে। যে কুশল রূপসী বাংলা পড়ে উতলা হয়ে বলত, আমি যে কিশোরীর ছাইরঙা হাঁস হতে চাই, সে কি করে ছুরি দিয়ে মানুষকে আঘাত করবে?

-এর পর কি ঘটল?

জামিনে ছাড়া পেয়ে কুশল আরেক দিন জব্বর বেপারিকে হাটের মাঝখানে আঘাত করল লোহার এক রড দিয়ে। রডটা রাস্তার পাশেই পড়েছিল।

-জব্বর বেপারি তখন কি করছিল? হাটের মধ্যে আদিবাসীদের কাছ থেকে জিনিশ কিনছিল।

-কুশল আর কাকে মেরেছে?

-তিমু বাউরিকে।

-সে তো ভয়ঙ্কর লোক।

-সেটাই তো অবাক। কেউ যে তিমু বাউরিকে প্রকাশ্যে আঘাত করতে পারে সেটাই আশ্চর্য।

তিমু বাউরি ছিল শালডুংরির ত্রাস। শালবনের ভেতরে একটি গোপন দল ছিল তার। ব্যবসায়ীদের ট্রাকগুলো পাহাড়ি নদী থেকে পাথর নিয়ে নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে ফিরত। সেখানে আক্রমণ চালাত তিমু বাউরির লোক। আদিবাসীদের গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দিত। ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করত সাঁওতালদের। ওরা কান্নাভেজা চোখে শহরে ছুটে আসতো দল বেঁধে বিচার চাইতে। থানায় কেস করত। কিন্তু তিমু বাউরিকে ধরার সাহস কারোর ছিল না। এতো অন্যায় করেও লোকটা বুক ফুলিয়ে হাঁটত। সেই তিমু বাউরিকে লোহার শিক দিয়ে পর পর আঘাত করে সাংঘাতিকভাবে আহত করেছে কুশল। বাউরি সারা জীবনের জন্যে পঙ্গু হয়ে গেছে। যেদিন তিমু বাউরি আহত হয় সেদিন নাকি আদিবাসীদের গ্রামে উৎসব হয়েছিল।

-একটা জিনিশ লক্ষ্য করেছেন লেবুভাই?

-কি?

-কুশল যাদের আঘাত করেছে তাদের মুখগুলো একবার ভাবুন তো। কাদু চৌধুরী, জব্বর বেপারি, তিমু বাউরি, মন্তাজ আলী। এরা প্রত্যেকেই কিন্তু এক একজন মস্ত ক্রিমিন্যাল।

ট্রেন চলেছে ঘন শালবনের ভেতর দিয়ে। চারদিকে আলো ছায়ার ঝিলিমিলি। বাতাসে শুকনো শালপাতা উড়ে যাচ্ছে। কুশল শালবনের ভেতরে গিয়ে ছবি আঁকতে ভালোবাসতো। সাঁওতাল পাড়ায় যেত ছবি আঁকতে। তকতকে উঠোন। মাটির দেয়ালে লতাপাতা, পাখি আঁকা। সাঁওতালদের নাদুস-নুদুস ছেলেমেয়েগুলো হাসি মুখে ছুটোছুটি করছে। ঝাঁকড়া মাথা গাছটার নিচে বসে গান গাইত কনি বুড়ি। কি চমৎকার সে সব গানের কথা।

পলাশ বনে ফুল ফুটেছে। আহ, পাহাড়ে যেন আগুন লেগেছে এখন কি আর ঘরে থাকা যায়? মাছেরা ছুটছে নদীতে। পাখিরা উড়ছে আকাশে। আমরাও যাব ঐ পাহাড়ে।

ছবি আঁকা সেরে আমরা যখন পাহাড়ি ঝরনার পাশ দিয়ে ফিরে আসতাম তখন কুশলকে উদাস লাগত। জানিস, এত রঙ রয়েছে আমাদের জীবনের চারপাশে। আমরা তার কিছুই দেখলাম না। আমাদের চোখে প্রকৃতির এত সব অপূর্ব রঙের ছোঁয়া বুঝি ধরাই পড়ল না।

শালডুংরিতে নেমেই সোজা থানায় চলে গেলাম। মিশন স্কুলের কাছ দিয়ে যাবার সময় বুকটা থরথর করছিল। মাঠ চড়ইগুলো সবুজ মাঠে ছুটোছুটি করছে।

থানাটি শহরের এক কোণায়। কুশলকে শিগগিরই কেন্দ্রীয় কারগারে নিয়ে যাওয়া হবে। থানার অফিসার প্রথমে ওর সাথে আমাকে দেখা করতে দিতে চাচ্ছিল না। গম্ভীর মুখে বলল,

-দেখুন, খুনের আসামিদের আলাদা রাখা হয়। ওদের সাথে আমরা সাধারণত কাউকে দেখা করতে দেই না। আর এ লোকটিকে তো আমার কাছে উন্মাদ বলে মনে হচ্ছে। কি যে সব আবোল তাবোল বলে। আমাকে দেখে সেদিন ভালুক ভালুক বলে চিৎকার করে উঠেছিল। দেখুন তো কি কাণ্ড!

থানার অফিসার কেমন লাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

-আমি বেশিক্ষণ থাকব না। ঢাকা থেকে ছুটে এসেছি। ওর সাথে শুধু কয়েকটা কথা বলেই চলে আসব।

আমার চেহারায় বোধহয় এক ধরনের আকুতি ফুটে উঠেছিল। তিনি সেন্ট্রিকে ডেকে আমাকে ভেতরে নিয়ে যেতে বললেন।

কুশল মাথা নিচু করে এক কোণায় বসে ছিল। ঘুলঘুলি দিয়ে এক চিলতে আলো এসে পড়েছে মুখে। সেই মায়াবী মুখ। কিন্তু চোখ দুটোকে কেমন অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে। দরজা খোলার শব্দে তাকালো। আমাকে চিনতে পেরে মুখের কোণায় একটু হাসি ফুটল।

-তুই, কদ্দিন পর। কেমন আছিস?

আমি কোন কথা বলতে পারছিলাম না। বুকের ভেতরটা কেউ যেন খামচে ধরেছে।

-কুশল, আমি… আমি কোনোমতেই বিশ্বাস করতে পারছি না যে তুই।

কুশল আমার দিকে তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকালো।

-একটা কথা বিশ্বাস করবি?

-কি?

-কেউ বিশ্বাস করছে না। আমি কিন্তু কয়েকটি জন্তুকে আঘাত করেছি।

-মানে?

-বিশ্বাস কর, সেদিন কাদু চৌধুরীকে আমার কাছে একটা মস্ত বড় অজগর সাপের মতো লাগছিল। আমি যেন দেখলাম অজগরটা ভয়ঙ্করভাবে তেড়ে আসছে। তাই লোহার শিকটাকে তুলে ভয়ে আঘাত করলাম।

-জব্বার বেপারি, তিমু, বাউরি?

-জব্বার বেপারির জায়গায় আমি দেখলাম একটি চিতাবাঘকে। তিমু বাউরিকে মনে হলো দাঁতাল শুয়োর। কি করব বল, ভয় পেয়ে এ দু’টো প্রাণিকে আমি আঘাত করলাম।

-মন্তাজ আলীকে তুমি খুন করেছ?

-আমি কিছু জানি না। আমি যেন দেখলাম একটা বুনো মোষ আমাকে ফেঁড়ে ফেলতে ছুটে আসছে। আমি আতঙ্কিত হয়ে ফল কাটার ছুরি দিয়ে আঘাত করলাম।

সেন্ট্রি জানাল আমার নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেছে। আমি তাকিয়ে ছিলাম কুশলের অস্থির দুটো চোখের দিকে। এই চোখের রেটিনাতে কি নতুন কোন সঙ্কেতের ভাষা জন্ম নিয়েছে? যে ভাষায় প্রাণির সত্যিকারের অবয়ব ফুটে ওঠে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *