১৩. রহস্য

রহস্য

সকাল থেকেই পিকলুর মনে চাপা একটা উত্তেজনার ভাব। আজ ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবে। ও তো ভালো করেই জানে কি প্রচণ্ড রকম খারাপ পরীক্ষা দিয়েছে। বিকেল বেলায় অফিস থেকে ফিরে বাবা যখন রেজাল্ট জানতে চাইবেন তখন কোন্ মুখে সামনে গিয়ে দাঁড়াবে সে। এবারও বুঝি নির্ঘাত ফেল করবে। অথচ তার জন্যে তিন তিনটে জাঁদরেল মাস্টার রাখা হয়েছিল। পরীক্ষার দু’মাস আগে থেকে হরলিক্স ওভালটিন দুটোই খাওয়ানো হয়েছে। সকালের নাস্তায় দুটো করে ডিম পোচ দেয়া হতো। বাড়ির কাজের লোক রহমত ভাই শুধু মুচকি হেসে বলত, বড় সাব দেহি আপনার জন্যে খুব চিন্তা করে। আমারে খালি কয় ভালা ভালা খাওন দিতে। বেশি কইরা খান।

পিকলু ওদের কি করে বোঝাবে শুধু হালি হালি ডিম গিললেই মাথা সাফ হয় না। বুদ্ধি লকলক করে বাড়ে না। অঙ্কের কঠিন কঠিন সূত্রগুলোর সমাধান করা যায় না। আর বাংলা থেকে ইংরেজির ট্রান্সলেট করা যায় না। উফ কি সব ভয়ঙ্কর ব্যাপার। ওর মাথায় কেন জানি অঙ্ক একদম আসতেই চায় না। অনেকদিন ভেবেছে অঙ্ক জাতীয় ব্যাপারটা না থাকলে এই পৃথিবীর কি এমন ক্ষতিটা হতো। জ্যামিতির উপপাদ্যের সমাধান না করতে পারলে এই সমাজ সংসার কি রসাতলে যাবে? ক্লাসের অন্য ছেলেগুলো কি ট্যারা। দেখলেই মনে হয় এইমাত্র কোত্থেকে জানি ঘুসাঘুসি করে এসেছে। ডিমও তেমন খায় না। অথচ অঙ্কে কি দারুণ তুখোড়। স্যাররা বলেন, পলু আমাদের স্কুলের ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। পিকলুর খুব হিংসে হয় পলুর জন্যে। একদম ওর সুনাম সহ্য করতে পারে না পিকলু। অনেকদিন ভেবেছে স্কুল ছুটির পর তাকে রাস্তায় একলা পেয়ে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়ে আচ্ছামত পেটাবে। কিন্তু তার এ ইচ্ছেটা এখনও বাস্তবায়িত করতে পারেনি। আর বাড়ির লোকগুলোও যেন কি। সারাক্ষণ খালি পড়াশোনার কথা জিজ্ঞেস করবে। বাবা যা রাশভারী। বেশ কয়েকবার তার পিঠে বেত ভেঙেছেন। অথচ পিকলুর খুব ইচ্ছে করে চিলেকোঠার ঘরে বসে রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের বইগুলো মুখ গুঁজে পড়তে। কি সব লোমহর্ষক লেখা। পড়তে পড়তে রীতিমতো গায়ের রোম শিউরে ওঠে। কখনও বুকের স্পন্দন যায় বেড়ে। রুদ্ধশ্বাসে এগিয়ে চলে কাহিনির গতি। প্রচণ্ড সাসপেন্স আর থ্রিলার। পাহাড়ের খাদে গড়িয়ে যাচ্ছে নায়ক। কুমির ছুটে এসে তাকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। পড়তে পড়তে বুক দুরদুর করে ওঠে। চারপাশের সবকিছু ভুলে তখন রহস্য বইয়ের পাতায় ডুব দিয়ে থাকে। কিন্তু না। নায়ক পড়ে নি। গড়িয়ে নামার অবস্থাতেই দুঃসাহসী নায়ক একটা বুনো ঝোপ হ্যাঁচকা মেরে ধরে ফেলেছে। নিজের শরীরটাকে কায়দা করে পাহাড়ের খাঁজে কোনোমতে আটকে ফেলেছে। উফ, কি টেনশনেই না ছিল এতক্ষণ পিকলু। এবার বড় বাঁচা বেঁচে গেছে নায়ক। পাড়ার পাঠাগার থেকে রোমাঞ্চ সিরিজের আরও বেশকটি বই যোগাড় করা হয়েছিল। কিন্তু বাবার কাছে এসব খবর কুইক পাচার করে দিল ছোট বোন টুম্পা। মেয়ে তো নয় যেন একটা বিচ্ছু। সারাক্ষণ ওর পিছে লেগে আছে। ব্যস, টুম্পার দেয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে অনুসন্ধান চলল। পিতার নির্দেশে শুরু হলো অভিযান। পিকলুর ড্রয়ার থেকে আবিষ্কৃত হলো চারটি নতুন গোয়েন্দা কাহিনি। সেবার মারের চোটে পিকলুকে তিনদিন সটান বিছানায় পড়ে থাকতে হয়েছিল। বাবা হুঙ্কার ছেড়ে বলেছিলেন এই রকম অপগণ্ড ছেলেকে তিনি সোজা বনে পাঠিয়ে দেবেন।

আহা, বাবা সত্যি যদি তাই করতেন। কি চমৎকার আর উত্তেজনাময় ব্যাপারই না তাহলে হতো। বনজঙ্গল হচ্ছে পিকলুর কাছে এক দারুণ রহস্যময় জায়গা। অজস্র গাছপালা। ছায়া ছায়া অন্ধকার। পাখির কিচমিচ ডাক। পাতার ফাঁক দিয়ে আলো চুইয়ে নামছে। কোনো গাছের ডালে লাফালাফি করছে সোনালি পশমের বাঁদরের দল। রাতেরবেলা হরিণের ঝাঁক আসবে ঝিলে পানি খেতে। চাদের রুপোলি আলো ছড়িয়ে থাকবে চারপাশে। রহস্যময় শব্দ। নিশাচর পাখিদের ডানা ঝাপটে উড়ে চলা। এসব দৃশ্যের কথা ভাবতে গিয়ে পিকলু তো রীতিমতো রোমাঞ্চিত হয়। কিন্তু বাবা শুধু প্রহার করেই খালাস। বনেজঙ্গলে পাঠাবার আর কোনোরকম উদ্যোগ গ্রহণ করলেন না। খুব একরোখা মানুষ এই বাবা। পিকলু যত অঙ্কে খারাপ করছে ততই যেন তার রাগ চেপে যাচ্ছে। তিন তিনটি মাস্টার রাখলেন। ছেলেকে তিনি ভালো ছাত্র বানিয়ে ছাড়বেনই। অথচ অঙ্ক করতে বসলেই পিকলুর মাথা শুধু ঝিমঝিম করে। কপালের দু’পাশের রগ দপদপ করতে থাকে। বুক কেমন শুকিয়ে যায়। শুধু পানির তেষ্টা পেতে থাকে। জ্যামিতিকে মনে হয় চিরতার মতো তেতো। একদিন পিকলুতো হাউমাউ করে কেঁদেই ফেলল।

বলি তোমরা পেয়েছ কি আমাকে? আমার কোনটা ভালো লাগে আর কোনটা ভালো লাগে না তাও বুঝতে চাইবে না। খালি নিজেদের ইচ্ছেগুলোকে আমার ওপর জোর করে চাপিয়ে দেবে?

মা তো পিকলুর ওই রকম ফ্যাকাসে মলিন চেহারা দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। তার চোখ দুটো ছলছল করে উঠেছিল। তিনি বাবাকে বোঝাতে গেলেন পিকলুর সেই অসহায় অবস্থার কথা। ব্যস তোপে যেন আগুন লাগল। গরম তেলে যেন বেগুন পড়ল। হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন বাবা। সোফা থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন। সেই ধাক্কায় টেবিল থেকে পিতলের ফুলদানিটা ঝনাৎ করে পড়ে গেল। পুষিটা লেজ তুলে পালাল। বাজখাই গলাই চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি।

-ভেবেছে কি ওই স্টুপিডটা। ওর ইচ্ছেমতো কি আমাকে চলতে হবে? ওর কথামতো আমাকে ধেই ধেই করে নেচে অঙ্কের মাস্টারগুলোকে প্রত্যাহার করে নিতে হবে। এত কষ্ট করে ওর পেছনে যে কাড়ি কাড়ি টাকাগুলো ঢালছি সেটা নবাবপুত্তর আমলই দিচ্ছে না। নিজের ভালোটাও বোঝে না। আমি স্রেফ বলে দিলাম ও একটা হনুমান হয়ে গাছে গাছে ঝুলবে। এটাই হলো ওর ভবিষ্যৎ।

বাবা রীতিমতো একটা লেকচার ঝেড়ে দিলেন। পাশের ঘরে বসে সব শুনল পিকলু। টুম্পা এ্যাকুরিয়ামে মাছের খাবার দিতে দিতে সুর করে গান গাইল, মাসিগো মাসি পাচ্ছে হাসি। নিম গাছেতে ধরছে শিম।

পিকলু যেন স্পষ্ট দেখতে পেল টুম্পা মুচকি হাসছে। তার শরীরে যেন কেউ বিছুটি লাগিয়ে দিল। ওদিকে বাবার তড়পড়ানি আর এদিকে টুম্পার গা জ্বালানো হাসি। আশ্চর্য পাজি তো এই মেয়েটা। পিকলুকে কোনো বেকায়দায় পড়তে দেখলেই তার যত খুশি। চিবিয়ে চিবিয়ে পিকলু বলল।

টুম্পা নির্বিকারভাবে এ্যাকুরিয়ামে ধীরে টোকা দিয়ে বলল,

-বা রে, আমি আবার হাসলাম কোথায়? পরশু স্কুলে ফাংশান হবে। সুকুমার রায়ের লেখা গানটার একটু প্র্যাকটিস করছিলাম। আমাকে যে সেখানে গাইতে হবে।

টুম্পার এই অভিনয়টুকু অসহ্য। পিকলুর এখন ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে গিয়ে টুম্পার গালে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় বসিয়ে দিতে। কিন্তু এমন হলে টুম্পা যে চিলচিৎকার করবে। বাড়ি মাথায় তুলবে সে ব্যাপারে পিকলু নিশ্চিত।

তখনকার মত রাগটাকে কোনোমতে পুষে রাখে পিকলু। এরকম আগেও বারকয়েক তাকে রাগ পুষে রাখতে হয়েছে।

পিকলুর বুক ঢিপ ঢিপ করছে। যতই স্কুলে যারার সময় হচ্ছে ততই অস্থিরতা বাড়ছে। এই রেজাল্ট বের হওয়ার দিনটা কি যে ভয়াবহ। সবাই কেমন নিষ্ঠুর হয়ে যায়। ওর এখন ইচ্ছে করছে নীল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কোনো নির্জন দ্বীপে চলে যেতে। যেখানে কোনো চেনা মুখ আর তাকে খুঁজে পাবে না। তাকে দেখে অনুকম্পা করবে না। কিন্তু বাস্তব পৃথিবীটা বড় কঠিন। রহমত ভাই দরজার ফাঁক দিয়ে মুখ বের করে বলে।

-ছোড সাব অহনো তৈরি হন নাই। বড় সাব অফিসে যাওয়ার আগে আমারে বারবার কইয়া গেছে আপনেরে যেন আইজ তাড়াতাড়ি স্কুলে লইয়া যাই।

কাটা ঘায়ে যেন নুনের ছিটে। পিকলু কি কচি খোকা নাকি যে রহমত ভাই তার হাত ধরে তাকে স্কুলে নিয়ে যাবে। বাবার কাণ্ড শুনে ভীষণ রাগ হচ্ছে। রহমত ভাই নিশ্চয়ই বাবার স্পাই। লোকটাকে একদম বিশ্বাস করা চলে না। চেহারা দেখে মনে হয় সাতেও নেই পাঁচেও নেই। গোয়েন্দা বইতে পড়েছে এইসব চেহারার লোকেরাই খুব ডেঞ্জারাস ধরনের হয়ে থাকে।

-রহমত ভাই, আমার যে পেট কামড়াচ্ছে।

-অষুদ আনতাছি।

সর্বনাশ! মিথ্যে বলতে গিয়েও ফ্যাসাদ। এখনি রহমত ভাই টপাটপ করে ঝাঁজালো ওষুধ গিলিয়ে দেবে। তার চাইতে স্কুলে যাওয়া অনেক নিরাপদ। যা থাকে কপালে। ঝটপট তৈরি হয়ে নেয় পিকলু।

স্কুলে যাবার পথটা খুব দীর্ঘ মনে হচ্ছে। অনেকটা পথ শিরীষ গাছের ছায়ায় ঢাকা। ফুরফুর করে হাওয়া বইছে। কিন্তু পিকলু রীতিমতো ঘামছে।

যা ভেবেছিল তাই। রেজাল্ট শিট হাতে নিয়ে ঠাণ্ডা হয়ে গেল পিকলু। সে পরীক্ষায় ফেল করেছে। অঙ্কে পেয়েছে মাত্র তেরো। চোখের সামনে ভেসে উঠল বাবার লাল চোখ। হাতে লিকলিক করছে বেত। টুম্পা হাসিমুখে গানের প্র্যাকটিস করছে। এখন যদি এই শহর ছেড়ে পিকলু পালিয়ে যেতে পারত। তাকে আর কেউ খুঁজে পেত না। রহমত ভাইটা খপ করে ধরে ফেললেন পিকলুর হাত। মনে হয় এইবারও ছোট সাব ডাব্বু পাইছেন।

ইস। কথার কি ছিরি। ডাব্বু একটা শব্দ হলো? আচ্ছা এ লোকটার সহানুভূতি বলেও কি কোনো কিছু নেই। দেখতে পাচ্ছে পিকলু এখন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। তারপরে তাও দেখে বলছে ডাব্বু পাওয়ার কথা। মন খারাপ করে বাড়ির পথ ধরল পিকলু। যা থাকে কপালে। সে বিবাগী হয়ে যাবে। বাউল হয়ে চলে যাবে। দু’টাকা ছ’আনা দিয়ে একটা নারকেল খোলের দোতারা কিনে রেখেছে। ওটাই টুং টুং করে বাজাতে বাজাতে মেঠো পথ দিয়ে যাবে। ছায়াছবির একটা গান তো মুখস্থ আছেই, তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়।

চুল থাকবে উসখুস। পা হবে ধূলিধূসর। পথের শেষ নেই জানার। যা একটা চমৎকার দৃশ্য হবে না। রহমত ভাই যেভাবে শক্তভাবে ধরে রেখেছে তাতে আপাতত বাউল হওয়ার সাধটি পরিত্যাগ করতে হলো। আশ্চর্য, বিকেলে অফিস থেকে বাবা ফিরে রেজাল্ট শিট দেখে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন না। দাঁত কিড়মিড় করে বেত হাতে নিলেন না। কান দুটো মুচড়ে লাল করে দিলেন না। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। সেই নীরবতাটুকু পিকলুর কাছে ভয়াবহ মনে হচ্ছিল। শান্ত গলায় বাবা বললেন,

-বুঝতে পেরেছি তোমাকে দিয়ে শুধু চাষাবাদ হবে। গ্রামের বাড়িতে আমার কিছু জমি খালি পড়ে আছে। সেখানে গিয়ে তোমাকে চাষাবাদ করতে হবে। আজ রাতের ট্রেনেই চলে যাবে।

একথা শুনে পিকলুর শরীর হিম হয়ে যায়। বাবা যখন শান্তভাবে কথা বলেন তখন সেটাই হয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। তাকে সে সিদ্ধান্ত থেকে নাড়ানো যাবে না। মা শুধু বলতে চাইলেন, ওর কাছে। কিন্তু পারলেন না।

-কিরে পিকলু রবিশস্যের চাষ করতে পারবি না? পিকলু ঢোক গিলে কোনোমতে বলে, পারব বাবা। বাবা খুব প্রসন্নভাবে মায়ের দিকে তাকালেন।

-দেখলে, তোমার ছেলে কেমন প্রত্যয়ের সঙ্গে বলছে পারব। আমি জানি চাষাবাদটাই হচ্ছে ওর একমাত্র কর্ম। কইরে রহমত ওর মালপত্র গুছিয়ে দে। আজ রাতেই তোদের রওনা হতে হবে। পিকলুকে গ্রামে রেখে আসবি।

বাবা আস্তে করে উঠে পাশের ঘরে চলে গেলেন। সবাই জেনে গেল বাবার এই সিদ্ধান্ত আপাতত পাল্টাবে না।

রাতের ট্রেনেই রওনা হতে হলো পিকলুকে। ঝকর ঝকর করে ট্রেন চলেছে।

মা পরোটা আর ভুনা মাংস টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে দিয়েছে। এমন আদরের খাবার কপালে আর বেশিদিন নেই। গ্রামে গিয়ে না জানি কি হবে। দূর সম্পর্কের এক চাচা থাকে সেখানে। শুনেছে ছোট একটা ঘর বানিয়ে থাকেন। ওখানে উঠতে হবে তাকে।

কাঁকনডিহি স্টেশনে শেষ রাতে এসে থামল গাড়ি। ওখানেই নামল পিকলু আর রহমত। আবছা অন্ধকার তখনও চারদিকে। প্লাটফর্মে কিছু লোক গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। কাঁকনডিহি থেকে তাদের গ্রাম মহিশাকুড়া প্রায় তিন মাইলের রাস্তা। যেতে হবে গরুর গাড়িতে। ভয়ানক খারাপ রাস্তা। ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দ তুলে যাবে গাড়ি। রহমত ভাই এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন,

-আলোডা একটু ফুডলেই আমরা রওনা দিমু।

অজস্র গাছ স্টেশনের চারপাশে। পাখি ডাকছে। ভোরের নরম আলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। কোণার ছোট চায়ের দোকানে চুলো জ্বালা হচ্ছে। স্টেশনের বাইরে কয়েকটা ছইঅলা গরুর গাড়ি দেখা গেল। পেছনে আখ ক্ষেত। দরদাম ঠিক করে একটা গাড়িতে উঠে পড়ল ওরা। এবড়োখেবড়ো রাস্তা। গরুর গাড়ি চলছে হেলেদুলে। বেশ ঝাঁকুনি খেতে হচ্ছে।

পিকলুর মনে হলো গরুর গাড়ির চাকা দুটো তাকে বুঝি বলছে,

-কিহে শহর ঢাকার স্মার্ট ঝকঝকে ছেলে পিকলু। ভিডিও দেখা কমিকস বই পড়া, থ্রিলার পড়া, ক্যাসেটে রক মিউজিক শোনা তুখোড় ছেলে। চলেছ কোথায়? মাটি কোপাতে? হালের বলদের পেছনে পাচন হাতে হেঁই হেঁই করে ছুটতে?

দু’পাশে আখের খেত। ভোরের স্নিগ্ধ আলো চারদিকে। সবুজ গাছপালা। পাখিদের ঝাঁক উড়ে যায়। ফুরফুর করে বাতাস বইছে। বেশ ভালোই লাগছে পিকলুর। তালগাছে ঝুলছে বাবুই পাখির বাসা। মাথায় আনাজপাতির ঝাঁকা নিয়ে গ্রামের লোকেরা যাচ্ছে। কোনো কোনো বাড়ির উঠোনে হাঁসমুরগি চড়ছে।

গাড়োয়ান হাত তুলে বলল। হুই যে। মহিশাকুড়া গাঁও।

একটু উঁচু ঢিবির মতো জায়গা দেখা যাচ্ছে। কেমন অদ্ভুত আকৃতির মনে হলো।

-এটা কি?

-কান্তি রাজার গড়।

-মানে?

তাতো জানি না সাব। ছোডবেলা থেইকা দেইখা আইছি। খুব আজব জায়গা।

-আজব কেন?

ওই গড়ের উপর দিয়ে কখনও কোনো পাখি উইড়া যায় না। আরও আজব কথা ওই গড়ে কোনো পশুও যায় না।

পিকলু তাকিয়ে থাকে উঁচু ঢিবিটার দিকে। গাড়োয়ান যা যা বলছে তা কি সত্য? যেন রহস্য মিশে আছে ওখানে। মনে মনে পিকলু রোমাঞ্চিত হয়। ভালোই হলো। মহিশাকুড়া গ্রামে আসতে আসতেই একটা রহস্যের সাধ পাওয়া গেল।

পিকলুদের বাড়িতে থাকে ওর দূর সম্পর্কের এক ছোট চাচা। রহমত ভাই তাকে বুঝিয়ে বলল পিকলু ক’দিন এখানে থাকবে। মাঠে কাজ করবে। ব্যাপারটা ছোট চাচার কাছে বিস্ময়কর। তিনি এটাকে শহরের বড়লোকদের একটা আজব খেয়াল হিশেবে ভেবে নিলেন। পিকলুর জন্যে দক্ষিণের ঘরটা ঠিক করে দিলেন। বাড়ির গাছের শবরিকলা আর ঘনদই চিড়ের সঙ্গে মিশিয়ে চমৎকার সকালের খাওয়া হলো। অন্যরকমের আনন্দ পাচ্ছে পিকলু। এত ঘন দই এর আগে দেখে নি সে। এ অঞ্চলে মহিষের ভালো দই পাওয়া যায়।

ছোট চাচা ডোবা থেকে মাছের নৌকো টেনে তুললেন। ঘাস লতা পাতা দিয়ে ঢাকা। বড় বড় জিয়োল মাছ পাওয়া গেল। ছোট চাচী মাগুর মাছের ভাজি রাঁধলেন। সঙ্গে মাষকলাইয়ের ডাল। ভাতে মেশানো হলো ঘরে তৈরি ঘি। দুপুরের খাবার হলো তোফা। পিকলু এর মধ্যেই ওর ঘরটা গুছিয়ে নিয়েছে। রহমত ভাই দুদিন পর চলে যাবে। বাবার দেয়া কৃষিবিজ্ঞানের বইগুলো বের করল। জেদ চেপে যাচ্ছে পিকলুর। সে আর অন্য কিছু ভাববে না। বাবার নির্দেশ মাথা পেতে নিয়েছে। মন ঢেলে এখন থেকে শুধু চাষাবাদের কাজ করবে কমিউনিষ্ট চীন দেশের ছেলে মেয়েরা নাকি প্রচুর চাষের কাজ করে। শহর থেকেও স্কুলের লম্বা বন্ধের দিনগুলোতে গ্রামে যায় চাষাবাদের কাজ করতে নতুন উৎসাহ নিয়ে।

বিকেলবেলায় হাঁটতে হাঁটতে উঁচু ঢিবিটার কাছে এলো পিকলু। কান্তি রাজার গড়। সুনসান করছে জায়গাটা। সবুজ গাছপালার ফাঁকে লাল ইটের দেয়াল দেখা যাচ্ছে। সত্যিই তো কোনো পাখি তো এর উপর দিয়ে উড়ছে না। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সে। ছোট একটা দরজা দেখা যাচ্ছে। সাপের ফিনফিনে খোলস ঝুলছে ঝোপের ভেতরে। পিকলু দরজাটা ধাক্কা দেয়। ক্যাঁচক্যাঁচ করে শব্দ হয়। দরজাটা খুলে যায়। পিকলু ভেতরে ঢোকে। শেষে বিকেলের ম্লান আলো তখন চারদিকে ছড়িয়ে আছে। পিকলু বিস্মিত চোখে দেখে একটা নীলাভ পাথরে বাঁধানো চত্বর চকচক করছে। কেমন রহস্যময় মনে হলো পিকলুর। কে বানিয়েছে এরকম চত্বর।

রাতেরবেলা হারিকেনের আলোতে কৃষিবিজ্ঞানের বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিল পিকলু। বারেবারেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল শেষ বিকেলে দেখা গড়ের ভেতরের সেই নীলাভ পাথরের চত্বরটি। একটা তীব্র আকর্ষণ অনুভব করছে সে। রাতেরবেলায় খাবার সময় পিকলু ছোট চাচাকে জিজ্ঞেস করে,

-ওই কান্তি রাজার গড়ের কথাটা কি?

ছোট চাচা কেমন ভীত হয়ে বলেন,

-আমরা ওদিকে যাই না। গায়ের কোনো লোকই যায় না। খুব বদনাম আছে ওই জায়গাটার। একবার দুটো লাশ পাওয়া গিয়েছিল সেখানে। সারা শরীর ছিল খুবলানো।

-শুনেছি সেখানে নাকি কোনো প্রাণি থাকে না।

-ঠিক। কোনো প্রাণিই যায় না সেখানে। অদ্ভুত এক জায়গা।

সে রাতে মহিশকুড়া গ্রামের একটি ছোট ঘরে শুয়ে পিকলু স্বপ্ন দেখল আকাশ থেকে একজন নীল রঙের দেবদূত যেন নেমে এসেছে। দেবদূত এসে নামল কান্তি রাজার গড়ের পাথরের চত্বরে। হাঁটু গেড়ে বসে আছে পিকলু। দেবদূত তার মাথায় ফুল স্পর্শ করছে। ঘুম ভেঙে গেল পিকলুর। পরদিন খুব ভোরেই পিকলু চলে গেল কান্তি রাজার গড়ে। সেই চত্বরটার কাছে গিয়ে দেখল তার ওপর কয়েকটি নকশা। কিসের নকশা এগুলোর? সে এড়িক ফন দানিকেনের কয়েকটি বই পড়েছিল। একটি বইতে দেখেছিল, এ ধরনের নকশার কিছু ছবি। দানিকেন লিখেছিলেন, ‘গ্রহান্তরের মানুষেরা পৃথিবীতে এসে কিরিবাতি দ্বীপের পাথরে এসব নকশা এঁকে গেছে। এগুলো তাদের সাঙ্কেতিক চিহ্ন। আবার পিকলুর শরীর শিরশির করে উঠল।

সারাদিন মহিশকুড়া গ্রামের মাঠে মাঠে আচ্ছন্নের মতো ঘুরল পিকলু। দুপুরে শুনল জংলা ঘুঘুদের একটানা ডাক। বেতঝোপের ভেতরে দেখল ডাহুকের লাল ছানা।

মহিশকুড়া গ্রামের মাঠের চাষিরা অবাক হয়ে দেখল শহর থেকে আসা পিকলুকে। তাদের অনেকেই শুনেছে এখন থেকে এই ছেলেটি নাকি তাদের মতোই মাঠে কাজ করবে। গ্রামে নতুন কোনো কথা সহজেই ছড়িয়ে যায়। পিকলুর কথাটিও এভাবে ছড়িয়ে গেছে।

সে রাতে পিকলু বিছানায় চুপচাপ শুয়ে আছে। ঘুম আসছে না। অনেক রাতে জানালার বাইরে তাকালো। আকাশকে কেমন রহস্যময় দেখাচ্ছে। হঠাৎ পিকলুর মনে হলো একটা নীল আলোর শিখা যেন নেমে আসছে। দারুণ কৌতূহলী হয়ে তাকালো সে। শিখাটি যেন কান্তি রাজার গড়ের ওপর খানিকক্ষণ স্থির হয়ে রইল। তারপর টুপ করে নেমে গেল গড়ের ভেতরে। দৃশ্যটা দেখতে দেখতে পিকলুর মনে পড়ল একটা সায়েন্স ফিকশনের ছবির কথা। এ রকম আলোর বিন্দু নেমে এসেছিল আকাশ থেকে। কি এক তীব্র আকর্ষণে পিকলু বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। তাকে প্রবলভাবে টানছে কান্তি রাজার গড়। শুনশান রাত। গাছের পাতা ঝিরঝির করে কাঁপিয়ে বাতাস বইছে। পিকলু টর্চটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। তাকে এখন কান্তি রাজার গড়ের দিকে যেতে হবে।

টর্চের আলো ফেলে এগুচ্ছে পিকলু। রাতের মহিশকুড়া গ্রাম নিস্তব্ধ হয়ে আছে। একসময় সে এসে দাঁড়ায় গড়ের সামনে। তার বুকটা অনবরত কাঁপছে। পিকলু একটা গাছের পেছনে দাঁড়িয়ে দেখে গড়ের ভেতর থেকে আবছা নীলাভ আলো বেরিয়ে আসছে। পা টিপে টিপে ভেতরে ঢুকল। সেই চত্বরের ওপর একটা স্ফটিক গোলককে দেখতে পেল। এটাই কি তবে নীল আলোর শিখা হয়ে কিছুক্ষণ আগে আকাশ থেকে নেমে এসেছে। গোলকটি পিকলুকে টানছে চুম্বকের মতো। হঠাৎ পিকলুর মনে হলো গোলকটির ভেতর থেকে একটা যন্ত্র যেন বিড়বিড় করে উঠল। আশ্চর্য পিকলু এই শব্দের অর্থ বুঝতে পারছে। যন্ত্রটি যেন বলছে, আমরা জিরাকন গ্রহ থেকে এসেছি। এখানে মাঝে মাঝে আসি আমরা। আমাদের গ্রহের বৈজ্ঞানিকরা অঙ্কে আর রসায়নে অত্যন্ত দক্ষ। আমরা পৃথিবীতে আসি উদ্ভিদের উপাদান সংগ্রহ করতে। আমাদের গ্রহে উদ্ভিদের চাষ করতে চাই।

পিকলুর সমস্ত শরীর শিহরিত হচ্ছে। সে এখন দাঁড়িয়ে আছে গ্রহান্তরের এক অদ্ভুত যানের কাছে। ভিডিওতে এটি ছবিতে এমন একটি দৃশ্য দেখেছিল। কে জানত এক অদ্ভুত রহস্যময় ঘটনা তার জীবনেও ঘটবে। পিকলুর মনে হলো সেই যন্ত্রটি তাকে বলছে, তুমি অঙ্কে খুব কাঁচা ছেলে। এখনি তোমার মস্তিষ্কে আমরা অঙ্কের জ্ঞান ট্রান্সফার করে দিচ্ছি। তোমার আর কোনো চিন্তা থাকবে না। কিন্তু সাবধান আমাদের কথা কখনও ফাঁস করতে পারবে না। যখনি ফাঁস করবে তুমি, তোমার এই জ্ঞান তোমার মস্তিষ্ক থেকে অবলুপ্ত হয়ে যাবে। আর এই জ্ঞান নিয়ে তুমি মানুষের মঙ্গল করবে। কল্যাণ করবে। যখনি কোনো অমঙ্গলের পরিকল্পনা আঁটবে তখনি তোমার কাছ থেকে জ্ঞান চলে যাবে।

স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে পিকলু। গোলকটি থেকে আলোর একটি শিখা তার মস্তিষ্কে যেন প্রবেশ করে। পিকলুর মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে। তার সমস্ত শরীরের ভেতরে তীব্র আলোড়ন হচ্ছে। মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে যায় সে।

কিছুক্ষণ পর চত্বর থেকে স্ফটিক গোলকটি উঠে শাঁ করে আকাশে মিলিয়ে যায়। ভোরবেলায় মূৰ্ছা ভাঙে পিকলুর। শরীরটা এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে। পিকলু তাড়াতাড়ি হেঁটে আসে ছোট চাচার বাড়িতে। রহমত ভাই ঢাকায় যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে। পিকলু তার সামনে গিয়ে বলে,

-আমিও তোমার সঙ্গে ঢাকা যাব।

-কন কি?

-ঠিকই বলছি।

-বড় সাব আমারে ঠিক মাইরা ফালাইব।

কিছু করবে না। পিকলুর কণ্ঠস্বরে তখন কেমন প্রত্যয় শোনা যায়।

ঢাকায় পিকলুকে ফিরে আসতে দেখে সবাই অবাক। তার চোখে খুশি। বাবা গম্ভীর গলায় তাকিয়ে বললেন।

-ফিরে এলি যে। চাষাবাদের কি হলো?

-ওসব আমার কাজ না।

-তবে কি তোমার কাজ শুনি।

বাবা ধীরে ধীরে রেগে যাচ্ছেন।

-আমার কাজ অঙ্ক করা। জটিল জটিল সব অঙ্কের সমাধান করা।

-ফাজলামো করছ আমার সঙ্গে?

-মোটেই না।

-লজ্জা করে না এ কথা বলতে? তিন তিনটি মাস্টার রাখার পরেও তো এবার অঙ্কে পেয়েছ তেরো।

-আপনি আমাকে যেকোনো কঠিন অঙ্ক দিয়ে দেখতে পারেন বাবা।

পিকলুর বাবা গণিত বিভাগের প্রথম শ্রেণি পাওয়া ছাত্র। পিকলু তখন গড় গড় করে বেশ কিছু কঠিন অঙ্কের থিয়োরি বলে গেল। ওর বাবা বিস্মিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

-বাবা আপনি আমাকে যেকোনো বড় অঙ্কের পূরণফল করতে দিন। আমি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর বলে দেব।

ওর বাবা কয়েকটি পূরণফলের কথা জিজ্ঞেস করলেন। কম্পিউটারের মতো উত্তর দিয়ে গেল পিকলু।

বাড়ির সবাই তখন চারপাশে বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এই রহস্যের কথা তো পিকলু তাদের কাছে ফাঁস আর করতে পারবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *