১১. জিকা এলো না

জিকা এলো না

অন্তুর পড়ার টেবিলের সামনেই জানালা। সকালের চিলচিলে নরম রোদ ছড়িয়ে আছে। দূরে বিভিন্ন বাড়ির ছাদে টিভি এন্টেনা ঝকঝক করছে। জানালার ওপাশে একটি বড় নিম গাছ। কয়েকটি পাখি সেখানে বাসা বেঁধেছে। নিম গাছের কচি সবুজ পাতা ঝিরঝির করে দুলছে। পায়ের গোড়ালিতে হঠাৎ নরম স্পর্শ পায় অন্তু। শরীর ঘষছে পুষি। অন্তু একটু ঝুঁকতেই তার শিরদাঁড়া চিনচিন করে উঠল। আবার সেই অসহ্য ব্যথাটা স্রোতের মতো সারা শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তার এমন হয়। এখন অন্তুকে ট্যাবলেট খেতে হবে। পাখির নীল ডিমের মতো ট্যাবলেট। সেই মারাত্মক দুর্ঘটনার পর থেকে অস্তু আর বেশি বাইরে যায় না। মাঠে গিয়ে দুরন্তভাবে খেলতে পারে না। সব সময় বাড়িতে থাকে। আব্বু প্রচুর বই কিনে দিয়েছেন। একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে। সেই দুর্ঘটনা ছিল তার জীবনে এক আতঙ্ক। স্কুলে যাচ্ছিল। রাস্তা পার হবার সময় পেছন থেকে একটা গাড়ির প্রচণ্ড ধাক্কা। তারপর আর কোনো কিছু মনে নেই। চোখের সামনে নিকষ অন্ধকার। জ্ঞান ফেরার পর দেখেছিল সে শুয়ে আছে ক্লিনিকের বিছানায়।

নিম গাছের পাতায় বাতাস ঝিরঝিরিয়ে শব্দ তুলছে। রোদের ভেতরে কচি কচি নিম পাতাগুলো দেখতে সুন্দর লাগছে।

জ্যামিতির উপপাদ্যের একটি কঠিন সমস্যার মধ্যে এতক্ষণ ডুবে ছিল অন্তু। হঠাৎ টুই টুই টুই শব্দ। পাশে যেন জলতরঙ্গ বেজে উঠল। কী ব্যাপার। কলিংবেলের শব্দ তো এ ঘর থেকে শোনা যাবার কথা না। তাকিয়ে দেখে, জানালার শিক ছুঁয়ে যে নিমডালটা খানিক বেঁকে গেছে সেখানে ঝলমলে একটা ছোট পাখি বসে ডাকছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অন্তু। চমৎকার তো ওই পাখিটা। এত সুন্দর রঙের পাখি এর আগে দেখে নি সে। দেখেই বোঝা যায় পাখিটার পালকগুলো শার্টিনের মতো নরম। কিছুদিন আগে বিদেশি একটি পত্রিকায় পাপুয়া নিউগিনির গহিন জঙ্গলের দুষ্প্রাপ্য স্বর্গীয় পাখির ছবি দেখেছিল। এটা যেন দেখতে অনেকটা সেই পাখির মতো।

পাখি আবার ডাকে, টুই টুই টুই। অন্তুর মনে হয় পাখিটি যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। লাল চুণির মতো চোখ। সে চোখ থেকে আলো ঠিকরে আসছে। মাথাটি ঝিমঝিম করে উঠল। চোখের সামনে লাল, নীল, সবুজ, বেগুনি রঙের বুঁদঁবুদ উড়ছে। এমন কেন হচ্ছে? বুঁদবুঁদগুলো উড়ছে, ভাসছে চারপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। সেই রঙিন আলোর ফুলঝুরির ভেতরে পাখিটিকে দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে পাখিটির শব্দ আলোর কাঁপা কাঁপা তরঙ্গের মতো তার মস্তিষ্কের কোষের ভেতরে চলে যাচ্ছে। অন্তু সেই শব্দের অর্থ যেন বুঝতে পারছে। শব্দগুলো অনেকটা ভিডিও ইমেজের ডিজিটাল গ্রাফিক অক্ষরের ছবি নিয়ে তার কাছে ধরা দিচ্ছে। পাখিটি বলছে বিপ বিপ বিপ বিপ। সময় হয়েছে। সময় হয়েছে। জিকা ৩২৭০ আসবে। তাকে তুমি পাবে জিরো আওয়ারে। প্রবাল দ্বীপে সে আসবে।

অন্তুর আচ্ছন্ন ভাবটা ধীরে ধীরে কেটে যায়। হঠাৎ দেখল উপর থেকে একটা নীল সুতোর ফাঁস নেমে আসছে। ফাঁসটা এসে পাখির গলায় আটকে গেল। তারপর পাখিটাকে কেউ যেন টেনে তুলে নিল।

এই ফ্ল্যাট বাড়ির উপরে থাকে এক বৃদ্ধ। শুনেছে তিনি নাকি জৈন্তা রাজার বংশধর। বিচিত্র ধরনের লোক। কারো সাথে খুব একটা মেশেন না। তার ঘরে অনেকগুলো এ্যাকুরিয়াম। রঙিন মাছ পোষার শখ ভদ্রলোকের। মাছের ওপর শব্দের প্রভাব দেখার জন্যে নানা পরীক্ষা করেন। এ্যাকুরিয়ামে বসানো আছে নানা ধরনের যন্ত্র। কিভাবে সমুদ্রে মাছের ঝাঁককে শব্দের পাঁচিলে আটকে রাখা যায় তা নিয়ে ইদানীং চিন্তা-ভাবনা করছেন। অন্তু এসব টুকরো খবর পেয়েছে ড্রাইভারের কাছ থেকে। বুড়োর বাড়ির কাজের লোকটির সাথে অন্তুদের ড্রাইভারের বেশ ভাব।

অন্তু বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে কয়েকদিন দেখেছে খাবার কিনে আনতে। সেদিন সিঁড়ির গোড়ায় দেখা। বৃদ্ধের হাতে সবুজ পাতার পুঁটুলি। অন্তুর ভারি কৌতূহল লোকটির প্রতি।

-এর মধ্যে কী এনেছেন?

-পাতা ফড়িংয়ের ডিম। মাছদের খাওয়াব। এবার তিনটি খুব দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির মাছ পেয়েছি। চীন সাগরের মাছ। অনেক বছর আগে এদের দেখা যেত। ডানা আছে। এখন সহজে পাওয়া যায় না। বিভিন্ন ঋতুতে এ মাছের রঙ বদলায়।

-সিলাকান্থ নাকি?

-না। একদিন এসে দেখে যেও।

অন্তুর আর যাওয়া হয় নি। বৃদ্ধ লোকটি বেশির ভাগ সময় ঘর বন্ধ করে থাকেন। অন্তু ওর আব্বুর কাছে শুনেছে বৃদ্ধ ভদ্রলোক প্রচুর দেশ ঘুরেছেন। প্রশান্ত মহাসাগরের বিভিন্ন দ্বীপে কাটিয়েছেন অনেক বছর। ইস্টার দ্বীপেও নাকি ছিলেন।

কিন্তু এই আশ্চর্য রঙের পাখিটাকে এমন করে ফাঁস লাগিয়ে তুলে নিল কে? সেই বৃদ্ধ লোকটি বুঝি।

অন্তু পড়ার টেবিল থেকে উঠে যায়। সে এখন পা ঘষটে ঘষটে উপরে যাবে। ওই বৃদ্ধের কাছে গিয়ে খানিক আগে দেখা পাখিটির খোজ করবে। পাখিটি তার মনকে নাড়া দিয়েছে।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলো অন্তু। জৈন্তা রাজার বংশধর তাকে কয়েক বার আসতে বলেছিলেন। কিন্তু তার আসা হয় নি।

কলিং বেলটা টিপতেই পাখির শিসের মতো শব্দ। দরজা খুললেন সেই বৃদ্ধ। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। গায়ে ছোপ ছোপ বাটিকের শার্ট। গলায় সবুজ চেন।

-আরে, তুমি যে! কী ব্যাপার। কখনও তো আসো না।

-আজকে এলাম।

-ভেতরে এসো।

বৃদ্ধ অন্তুকে ঘরের ভেতরে নিয়ে যায়। সমস্ত ঘরটা পুরু ভেলভেটের পর্দা দিয়ে ঢাকা। কোণায় একটা বেগুনি পাথরের বাতি জ্বলছে। দিনের বেলাতেও ঘরের ভেতরটাকে কেমন রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে। আবছা আলোতে এ্যাকুরিয়ামের ভেতরে ঝিকমিক করছে মাছগুলো। ঘরে মৃদুভাবে স্টোরিওতে বিদেশি সঙ্গীত বাজছে। মেঝেতে ঘাস রঙের পুরু কার্পেট। হাঁটতে গেলে পা যেন আলতোভাবে ডুবে যায়।

অন্তু ভাবতেই পারে নি তাদের এই ফ্ল্যাট বাড়িটিতে এমন এক আশ্চর্য সুন্দর ঘর রয়েছে। ভেতরে ঢুকেই অন্তু বলে ওঠে, বাহ!

সুরটা অন্তুকে রীতিমতো আন্দোলিত করছে। প্রজাপতির ডানার মতো কাঁপছে। সে জানতে চায় ওটা কোন মিউজিক।

-এটা হলো স্যাম্পেলস দ্বীপের মাঝিদের সুর। ওরা যখন প্রবাল দ্বীপে মাছ ধরতে যায়, ঝিনুক কুড়াতে যায় তখন এ ধরনের গান গায়। ভালো করে শুনলে এ গানে পাবে অদ্ভুত রকমের এক শব্দ। স্যাম্পেলসের জঙ্গলে এক ধরনের প্রাণির হাড় দিয়ে তৈরি করা হয় বাঁশি। যে প্রাণিরা বছরের এক সময় সমুদ্রে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। সেই হাড়ের বাঁশির সুর আছে এতে। তুমি কী শুনতে পাচ্ছ?

অন্তু যেন হঠাৎ করেই অন্য এক পৃথিবীতে এসে গেছে। যেখানে তার এতদিনের চেনা জগতের মিল নেই। এ যেন আলাদা এক ভুবন। সেখানে মিশে রয়েছে রহস্য। আর এই বৃদ্ধ লোকটি হচ্ছে সেই রহস্যময় ভুবনের বাসিন্দা।

বৃদ্ধ লোকটি অন্তুর কাছে নিজের পরিচয় মেলে ধরছেন।

সারা জীবন পৃথিবীর বহু দেশের বনে পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে বিচিত্র সব জিনিশ সংগ্রহ করেছি। আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে এ জন্যে। একেবারে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি কয়েকবার। এখন ওসব নিয়েই থাকি। একাই থাকি। দেখ না, কেউ আসে না আমার কাছে। আর আমিও একা থাকতে ভীষণ ভালোবাসি।

-আমি এসেছিলাম একটা পাখির খোঁজ করতে।

-পাখি!

একটু আগে দেখলাম ওই নিম গাছটার ডালে ফুড়ুত করে এসে বসল। অদ্ভুত গায়ের রঙ। তারপর ….

একটা নীল সুতোর ফাঁস নেমে এসে পাখিটিকে তুলে নিল। এই তো। বলে বৃদ্ধ লোকটি মিটিমিটি হাসতে লাগল।

বৃদ্ধ লোকটি ফিসফিসিয়ে কথাগুলো বললেন। তার কথা শুনে অবাক হয়ে যায় অন্তু। লোকটি তার মনের কথা জানল কিভাবে।

টেলিপ্যাথি জানে নাকি!

-ওটা আমারই পাখি। ইস্টার দ্বীপ থেকে অনেক কষ্ট করে এনেছিলাম। পোষমানা পাখি। তবে খুব দুষ্টু। মাঝে মাঝে ফুড়ত করে পালিয়ে যায়। তখন তাকে ওভাবে ধরে আনতে হয়।

-ওই পাখিটা টুই টুই টুই করছিল। কিন্তু… কিন্তু আমি যেন…

-কিন্তু কী খোকা? বৃদ্ধ লোকটি অন্তুর কাছে ঝুঁকে পড়লেন।

-আমার কাছে মনে হলো আমি যেন ওই পাখিটির ডাকের অর্থ বুঝতে পেরেছি।

-মানে!

বৃদ্ধের গলায় স্পষ্ট উত্তেজনার আভাস। তিনি অন্তর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।

-পাখিটার ডাকের ভেতরে আমি কিছু কথা খুঁজে পেলাম।

-কী বলছিল ওই পাখি?

বৃদ্ধ আরেকটু ঝুঁকে আসে অন্তুর দিকে। তাকে বেশ অস্থির দেখাচ্ছে।

-বলছিল যে সময় হয়েছে। জিকা ৩২৭০ আসবে।

-কখন আসবে বলেছে?

-জিরো আওয়ারে।

-কোথায়?

-প্রবাল দ্বীপে?

-আর কিছু? কোথায় সেই প্রবাল দ্বীপের অবস্থান? কোন তারিখের জিরো আওয়ার?

-আর কিছু বলার আগেই তো পাখিটার গলায় ফাঁস নামল।

বৃদ্ধ ছটফট করে পায়চারি করতে থাকে। তার চোখ দুটো তখন শিয়ামিজ বিড়ালের মতো জ্বলছে।

-আমি তাহলে এখন যাই।

অন্তু চট করে উঠে দাঁড়ায়। মা হয়তো তাকে খুঁজছে। বৃদ্ধ তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অন্তুর দিকে। এই তাহলে সেই ছেলে। সেই শক্তি। যার মাধ্যমে দূর গ্রহের অধিবাসীদের খবর আসবে তার কাছে। এই শক্তির খোঁজেই তিনি এখানে এসেছেন। ইস্টার দ্বীপের রহস্যময় পুঁথি থেকে যেটুকু উদ্ধার করতে পেরেছিলেন তার গাণিতিক হিশেব কষে বুঝতে পেরেছিলেন এই এলাকার একহাজার গজের মধ্যেই সে বিশেষ শক্তিসম্পন্ন মানুষটি রয়েছে। কিন্তু তিনি ভাবতেই পারেন নি যে তার নিচের তলার এই কিশোর ছেলেটিই হচ্ছে সেই শক্তি। যে শক্তির তিনি অনুসন্ধান করছেন।

অন্তু খুঁড়িয়ে হাঁটছে।

-কী ব্যাপার? তোমার পায়ে কোনো অসুবিধে আছে নাকি?

-আমার একবার সাংঘাতিক একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। তারপর থেকে…

বৃদ্ধ অন্তুর দিকে তাকাল। কই, ছেলেটিকে তো, তার কাছে তেমন অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না। তিনি জানতেন, যে রহস্যময় শক্তির মাধ্যমে তিনি সাঙ্কেতিকভাবে খবর পাবেন তার শরীরে বিশেষ এক ধরনের ব্যবস্থা থাকবে। ওই শরীরের রাসায়নিক গঠন হবে আলাদা। অন্তুর কি তা আছে?

সন্ধেবেলায় ওর বাবার কাছে গিয়ে খোঁজ নিতে হবে। অন্তু চলে গেছে।

বৃদ্ধ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। এতদিন তার স্বপ্ন তাহলে সার্থক হতে চলেছে। তিনি দূর গ্রহের অধিবাসীদের আসার খবর পেয়েছেন। এই খবরটি পাওয়ার জন্যে গত চল্লিশ বছর ধরে তিনি অপেক্ষা করছেন। পুঁথির সব লেখার অর্থ তিনি অবশ্য উদ্ধার করতে পারেন নি। ইস্টার দ্বীপের এক পাথুরে গুহাতে তিনি পেয়েছিলেন সেই পুঁথিটি। সেই পুঁথিটির এক জায়গায় লেখা ছিল, তারা আবার আসবে। সময় হলেই চলে আসবে। আসার সময় সাঙ্কেতিক খবর পাঠাবে। সেই খবরটি আসবে বিশেষ এক মাধ্যমে। এই মাধ্যম হবে একটি মানুষের মস্তিষ্কের কোষ। যে মানুষের শরীর বিশেষ রাসায়নিক বিভাজনে গঠিত হবে। সেই মাধ্যমে জানিয়ে দেবে কখন এবং কোথায় নেমে আসবে তারা।

তারা কারা? তারা সিগনাস-এক্স গ্রহের অধিবাসী। একবার পৃথিবীতে এসেছিল। তারা প্রশান্ত মহাসাগরের একটি দ্বীপে তখন অবতরণ করেছিল। সেখানে তাদের কিছু নিদর্শন রেখে গেছে। লাখ লাখ আলোকবর্ষ দূরের এক গ্রহ থেকে তারা এসেছিল। তাদের ফিরে আসার সময় জানাবে পাখি আহুয়া মারাং। এই পাখি থাকে ইস্টার দ্বীপে। ইস্টার দ্বীপেই নেমেছিল সিগনাস এক্স গ্রহণের অধিবাসীরা। তাদের অবতরণের চিহ্ন রয়েছে সেখানে।

আহুয়া মারাং পাখির ডাকের কিছু অর্থ আজ বুঝতে পেরেছে এ বাড়ির অন্তু নামের ছেলেটা। জিরো আওয়ারে আসবে জিকা ৩২৭০। বাকি তথ্যগুলো ওর কাছ থেকে জেনে নিতে হবে।

বৃদ্ধ উঠে খানিকক্ষণ পায়চারি করলেন। অতীতের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে তার বারবার। চল্লিশ বছর কেটে গেছে এর মাঝে। তখন তার দেশ ঘোরার নেশা। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ঘুরছেন। আন্দিজের এলাকায় অনেকদিন ছিলেন। যত ঝোঁক ছিল তার রহস্যের দিকে। ব্রাজিলের গহিন অরণ্যে প্রাচীন মায়া সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের খোঁজে ঘুরেছেন।

একবার গেলেন দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের চিলিতে।

শহরতলির এক সরাইখানায় বসে কফি আর কাজুবাদাম খাচ্ছেন। এমন সময় এক নাবিক তাকে জানাল, ইস্টার দ্বীপের কথা। চিলি থেকে আড়াই হাজার মাইল দূরের এক নির্জন দ্বীপ। সেখানে রয়েছে কয়েকটি রহস্যময় অতিকায় পাথুরে মূর্তি। মূর্তিগুলোর মুখের অংশটাই নির্মিত হয়েছে। সেই মুখগুলো তাকিয়ে আছে দূর আকাশের দিকে।

সেই মূর্তির কথা শুনে তার ভেতরে সেখানে অভিযানে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছে জাগল।

দুর্গম ইস্টার দ্বীপের দিকে জাহাজে করে যাত্রা করলেন।

জাহাজ তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি বৃদ্ধ ক্যাপ্টেনের কাছে শোনেন নানা তথ্য। ক্যাপ্টেন বহুবার এসেছেন ইস্টার দ্বীপে।

১৭২২ সালে এক ওলন্দাজ এ্যাডমিরাল রাগগেভিন প্রথম এই দ্বীপটি আবিষ্কার করেন। সেই দ্বীপে রয়েছে পাথরের তৈরি সমাধিমঞ্চ। অনেকগুলো বেদী। বিশাল আকারের মূর্তি। এই অতিকায় মূতিগুলোই হচ্ছে যত রহস্য।

এক সময় চোখে পড়ল পিটকাইরন দ্বীপ। সেখান থেকে আরও ১১০০ মাইল পেরিয়ে ইস্টার দ্বীপ ।

তারা যত পিটকাইরন দ্বীপের কাছাকাছি হচ্ছেন তত বাড়ছে গাঙচিলদের সংখ্যা। এই দ্বীপ থেকে প্রচুর পাখির ডিম, কচ্ছপের ডিম রপ্তানি করা হয়। পিটকাইরন থেকে তারা নোনা মাংস সংগ্রহ করেন।

বৃদ্ধ ক্যাপ্টেনের কাছে বিস্ময় হলো ইস্টার দ্বীপের মূর্তিগুলো।

সমুদ্রের সমান্তরাল অবস্থিত তিনশ ফুট পর্যন্ত লম্বা। উচ্চতায় পনেরো ফুট। এ ধরনের মঞ্চ আছে ৬০টি। স্থানীয় লোকেরা একে বলে আহু।

সবার মনে একই প্রশ্ন, কারা বানিয়েছিল এসব মঞ্চ?

একশটা মঞ্চ তৈরি হয়েছে মূর্তি রাখার জন্যে। মূর্তিগুলো উচ্চতায় বার ফুট থেকে বিশ ফুট পর্যন্ত। মাথায় তাদের লাল টুপি| অতিকায় সব মূর্তি। সবই এক সাইজের। সরু মাথা। বড় নাক। লম্বা কান। চোখ দুটি ঢাকা হাতের আঙুল চারটি। জমাটবাঁধা লাভা কেটে এসব মূর্তি বানানো।

দ্বীপের আরেক নাম হচ্ছে পাখিমানবের দ্বীপ। দ্বীপের এক কোণায় ওরোংগো নামে একটি গ্রাম আছে। সেখানে রয়েছে পঞ্চাশটি পাথরের ঘর। প্রতিবছর আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে অতিথি পাখিরা এসে সেই দ্বীপে ডিম পাড়ত। প্রথম ডিমটি সংগ্রহের জন্যে একদল প্রতিযোগী সেখানে যেত। তারা ওই পাথরের ঘরগুলোতে সমবেত হতো। প্রথম যে ডিম আহরণ করত সে এক বছরের জন্যে পাখি মানব বলে স্বীকৃতি পেত। তাদের দেবতার নাম মাকেমাকে।

গ্রামটির কাছেই একটি খাড়া পাহাড়। যেখানে পাখির মূর্তি খোদাই করা আছে। যাদের মাথা মানুষের মতো। কারো হাতে পাখির ডিম।

দ্বীপের অধিবাসীরা বলে ওদের উপকথায় আছে, তাদের আদি পুরুষ এসেছিল আকাশ দিয়ে উড়ে।

জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন চুরুটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলেন, বুঝলেন ওই মূর্তিগুলোর কী নাম দিয়েছে গ্রামের লোকেরা?

-কী?

-হোয়া হাকা নান ইয়া।

-এর মানে?

-ঢেউ ভঙ্গকারী।

-দ্বীপটির কোনো নাম দেয় নি?

-দিয়েছে। পাসকুয়া।

এক সময় তাদের চোখে পড়ল ইস্টার দ্বীপ। প্রথমে আবছা রেখা। দ্বীপে বেশি গাছপালা নেই। ক্যাপ্টেন চিৎকার করে বলল, ওই যে দেখা যাচেছ পাসকুয়া।

রহস্যময় দ্বীপ পাসকুয়াতে তাদের ক’দিন কেটে গেল দারুণ উত্তেজনায়। মূর্তিগুলোকে খুব কাছ থেকে দেখলেন। কয়েকটি মূর্তির গলায় রয়েছে কাঠের ফলক। দু’পিঠে প্রতীকী নকশা। স্থানীয় ভাষায় বলে কোহাউ রংগো রংগো। সেসব প্রতীকের অক্ষরে রয়েছে পাখি, মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি জ্যামিতির চিহ্ন জাতীয় আঁচড়।

তার মনে হলো এগুলোর ভেতর কোনো অর্থ রয়েছে। মূর্তিগুলো সমুদ্রের তীরে দ্বীপের দিকে মুখ ফিরিয়ে রয়েছে।

একদিন। আকাশ মেঘলা। তিনি একটি পাথরের মূর্তির কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ দেখেন সামনের ঘাস ঝোপের কাছে একটি বৃদ্ধ মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। কাছে গিয়ে বুঝলেন লোকটির খিচুনি রোগ। ঘাস মুঠো করে ধরে আছে। তার পকেটে কয়েক ধরনের ওষুধ ছিল। সেখান থেকে এই রোগের ওষুধ বের করে বৃদ্ধকে খাইয়ে দিলেন। খানিকক্ষণের মধ্যে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠল বৃদ্ধ। তার দু’চোখে কৃতজ্ঞতা। তার দুটি হাত ধরে আকুলভাবে বলে উঠল,

-কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব। আপনি এবার আমাকে বাঁচিয়েছেন।

-ওষুধটা সাথে ছিল।

-আমার বাবাকেও এরকমভাবে বাঁচিয়েছিল এক সাহেব। সেই সাহেব এসেছিল পেরু থেকে। একদিন সেই সাহেব হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমাদের কাছে তার একটা বাক্স এখনও আছে। আপনাকে আমি সেটা দিতে চাই।

-আমাকে কেন দেবেন? আমি সেটা দিয়ে কী করব?

-ওই সাহেব আপনার মতোই দিন রাত এ দ্বীপের মূর্তি নিয়ে কী সব ভাবতেন। পাথর পরীক্ষা করতেন। খাতায় অনেক কিছু লিখতেন। নকশা আঁকতেন। মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে কী যেন ভাবতেন। সেই সাহেব কোথায় যে হঠাৎ চলে গেলেন। ভাবলাম ওই বাক্স হয়তো আপনার কোনো কাজে লাগবে। আমরা তো ওইসব নকশা কিছু বুঝি না।

কৌতূহলী হয়ে বৃদ্ধের সাথে গেলাম।

বৃদ্ধ থাকে দ্বীপের হাংগারোয়া গ্রামে। সেখানে গিয়ে দেখলেন তার জন্যে অপেক্ষা করছে বিচিত্র এক বিস্ময়। সেই বাক্সে পাওয়া গেল এক ডায়েরি। ড. আলবারোজ সানসিদার লেখা। পেরুর এক নামকরা বৈজ্ঞানিক। ভূতত্ত্ববিদ। ১৮৪২ সালে লেখা ডায়েরিটি।

সেই ডায়েরির ভেতরে রয়েছে বিস্ময়কর কিছু কথা। নতুন এক ধারণা। ড. আলবারোজ লিখেছেন, এ দ্বীপে অনেকদিন গবেষণা করে আমি একটি ধারণায় এসেছি। অন্য এক দূর গ্রহের একদল উন্নত বুদ্ধির প্রাণি এখানে এক সময় অবতরণ করেছিল। তাদের উড়ন্ত যানের যান্ত্রিক কোনো গোলযোগে এই দ্বীপে আটকা পড়েছিল। তারা ছিল খুব বৃদ্ধিমান। তাদের ছিল উন্নত অস্ত্রপাতি।

দূর গ্রহের অধিবাসীরা তাদের সময় কাটাবার জন্যে আগ্নেয়শিলা থেকে অস্ত্র দিয়ে মাখনের মতো পাথরের চাঙর কেটে বিশালাকার মূর্তি তৈরি করল। এসব বিরাট মূর্তি সমুদ্রের তীরে পাথরের মঞ্চে স্থাপন করল। যাতে অনেক দূর থেকেও এদের চোখে পড়ে। এই মূর্তিগুলোকে এমনভাবে রাখা হয়েছে যাতে তারা যদি আবার আগামীতে কখনও আসতে পারে তবে সেই চিহ্ন দেখে সহজে অবতরন করতে পারবে।

তারপর তাদের গ্রহ থেকে যান আসে। রহস্যময় প্রাণিরা তাদের অচেনা গৃহে আবার ফিরে যায়। গ্রামের অধিবাসীদের উপকথায় আছে আকাশ থেকে নেমে আসা রহস্যময় মানবদের কথা।

ডায়েরির এক জায়গায় আছে, আমি এক গুহার ভেতরে কিছু পুঁথি পেয়েছিলাম। তার অর্থ অনেক কষ্টে উদ্ধার করেছি। সেখানে বলা হয়েছে ভিন গ্রহের অধিবাসীরা আবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসবে। এই দ্বীপের এক ধরনের পাখি সেই সঙ্কেতের কথা জানতে পারবে। সেই সঙ্কেত ট্রান্সমিট করতে পারবে এমন লোকের মস্তিষ্কের কোষ, যার শরীরের রাসায়নিক গঠনে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। তার ক্রোমোজোমে কার্বনের যৌগিক থাকবে স্বতন্ত্র এক গাণিতিক নিয়মে। কারো শরীরে যদি এই অস্বাভাবিক বিন্যাস থেকে থাকে তবে সেই পাখির শব্দের অর্থ সে বুঝতে পারবে। অনুধাবন করবে পারবে। বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হবে। কারো দেহে রেডিও এ্যাকটিভের প্রতিক্রিয়া হলে এ রহস্যময় পরিবর্তন ঘটতে পারে।

বৃদ্ধ ঘরের পর্দা সরিয়ে দিলেন। কাচের বাইরে ঝকঝকে নীল আকাশ। কয়েকটা পাখি এলোমেলো উড়ছে। পাসকুয়া দ্বীপ এখান থেকে যেন দেখতে পাচ্ছেন ড. আলবারোজ সানসিদা। একাকী সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে বিশাল মূর্তিগুলোর ওপর তৈরি নকশার অর্থ বোঝার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তার নিচ তলার কিশোর ছেলে অন্তু পাখির ডাকের সাঙ্কেতিক অর্থ বুঝতে পেরেছে। অন্তু সম্পর্কে এখন তাকে বিশেষভাবে খোঁজ নিতে হবে। তিনি অন্তুদের ঘরের দিকে নেমে এলেন।

দরজা খুললেন অন্তুর বাবা। উপর তলার বৃদ্ধকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু বিস্মিত হলেন। লোকটিকে তার কাছে অদ্ভুত স্বভাবের মনে হয়। কারো সাথে মেশে না লোকটি। এ ধরনের মানুষ তার অপছন্দের।

-একটা বিশেষ ব্যাপারে আপনার কাছে এসেছি।

-আসুন।

বৃদ্ধ ভেতরে এসে বসেন। অন্তুর বাবা চুপচাপ বসে থাকেন। তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না কী বলে কথা শুরু করবেন। বৃদ্ধ একটু কেশে বলেন, দেখুন, আমি আপনার ছেলে অন্তুর ব্যাপারে কিছু জানতে চাইছি।

অন্তুর বাবা এ কথা শুনে চমকে উঠেন।

-কী… কী জানতে চাইছেন?

ছেলেটাকে আমার কাছে খুব ইন্টিলিজেন্ট বলে মনে হলো। ও এমন কিছু কথা আমাকে বলল যে আমি রীতিমতো স্তম্ভিত হয়েছি। এসব কথা তো ওর জানার কথা না। আপনার ছেলে দারুণ জিনিয়াস। ওর আইকিউ এত তীক্ষ হলো কী করে তা জানতে আমি আগ্রহী। আমি ওর বৈশিষ্ট্য জানতে চাইছি।

অন্তুর বাবা কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইলেন। তার চোখ দুটো ছলছল করছে।

-দেখুন, অন্তুর ব্যাপারে আমার বলতে কিন্তু খুব কষ্ট হবে। ওর একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল।

-জানি।

-অপারেশেনের সময় ডাক্তার মারাত্মক একটি ভুল করে বসে। এ ভুলের খেসারত দিতে গিয়ে আমার ছেলে এখন নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

অন্তুর বাবার চোখ ছলছল করে।

-মানে?

-এক সময় ওর শরীরে লেসার বিম দিয়ে একটি পরীক্ষার দরকার হয়। কিন্তু ডাক্তার যান্ত্রিক একটি ভুল করেন। সুইচ টিপতে ভুল হয়। এর ফলে ওর সমস্ত শরীর রেডিও অ্যাকটিভ হয়ে যায়। ওকে শোয়ানো হয়েছিল অন্য যন্ত্রের নিচে।

বৃদ্ধ বুঝতে পারেন এর ফলে অস্তুর শরীরের ক্রোমোজোমে কার্বনের যৌগিকের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। ফলে তার শরীরের রাসায়নিক গঠন অন্য রকমের হয়ে যায়। তাই অন্তু মস্তিষ্কের কোষে সেই পাখির ডাক ভিডিও ইমেজের ছবি হয়ে ধরা দেয়া। পাসকুয়া দ্বীপের রহস্যের জট ধীরে ধীরে খুলে যায়।

অন্তুর বাবার কণ্ঠ তখন বিষন্ন শোনায়।

-আমার ছেলেকে অপারেশনের টেবিলে নিয়ে ডাক্তার ওর এমন একটা মারাত্মক ক্ষতি করে দিল। জানেন, এর ফলে আমার ছেলের কী হয়েছে?

-কী?

-ব্রেন ক্যানসার।

-ক্যানসার!

অন্তুর বাবার দিকে ঝুঁকে পড়লেন বৃদ্ধ লোকটি। বৃদ্ধের সামনে ভেসে উঠল অন্তর দুটো ডাগর চোখ। মায়াবী কোমল মুখ।

-আর মাত্র তিন মাস তার আয়ু আছে। কিন্তু একথা অন্তুকে জানানো হয় নি। ওকে আমরা বুঝতে দেই নি।

-সেই ক্রিমিনাল ডাক্তার?

-সেই ডাক্তার ভুল বুঝতে পেরে ভীষণ অনুতপ্ত হয়। কদিন পর আত্মহত্যা করে। খবরের কাগজে নিউজটা চোখে পড়েছে হয়তো।

ঘরের পরিবেশটা কেমন থমথমে হয়ে যায়। বৃদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, দেখুন, আমি অনেক দেশ ঘুরেছি। অন্তুকে শেষ সময়ে আমার বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়ে যেতে চাই। আমার রোমাঞ্চকর সব অভিযান কাহিনি শুনে হয়তো ও কিছুটা আনন্দ পাবে।

-আমরা তো তাই চাই। ও যেন একটু হাসি খুশিতে থাকে। ওর দিকে তাকাতে পারি না পর্যন্ত। বুকটা মুচড়িয়ে ওঠে।

-ওকে তাহলে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। আমার এ্যাকুরিয়াম ভর্তি চমৎকার রঙিন মাছ। ও দেখে মজা পাবে। বিশেষ প্রজাতির মাছ রয়েছে।

-পাঠাব। কিন্তু অন্তুকে কখনও ওর রোগের কথা বলবেন না। ওর তিন মাস আয়ুর কথাও ওকে বলবেন না। ওকে আর দুশ্চিন্তায় রাখতে চাই না।

অন্তুর বাবার চোখের কোণা চিকচিক করছে।

রাত নটা বাজে। টিভিতে একটি বিদেশি ছবি দেখানো হচ্ছে। ছবিটা দেখতে অন্তুর কাছে তেমন ভালো লাগছে না। হঠাৎ তার মাথায় একটা প্রশ্ন আসে। ত্রিস্তান-দ্য-কুনহা দ্বীপটা কোথায়? খুব নাকি নির্জন দ্বীপ। উপর তলার ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করতে হবে। তিনি অনেক দ্বীপের খবর জানেন। অন্তু খুঁড়িয়ে হেঁটে উপর তলায় যায়। কলিংবেলে হাত দেয়। জল তরঙ্গের মতো শব্দ বেজে ওঠে।

-এসো। আমি তোমার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম।

-বা রে! আপনি কী করে জানলেন যে আমি এখানে আসব।

-মনে হলো তুমি আসবে। তুমি আজ আমার সাথে খাবে। স্পেশাল এক ধরনের স্যুপ বানিয়েছি। এই স্যুপটা বানানো আমি শিখেছি ত্রিস্তান-দ্য-কুনহা দ্বীপের এক শেফের কাছ থেকে। যে প্যারিসের নামকরা এক রেস্তোরায় কাজ করত।

-কী আশ্চর্য! আমি তো এখন আপনার কাছে ওই দ্বীপটা সম্পর্কেই জানতে এসেছি।

-টেলিপ্যাথি বলতে পারো।

স্যুপটা খেতে চমৎকার লাগে অন্তুর। সবুজাভ রং। চিংড়ির টুকরোর সাথে দেয়া হয়েছে এক ধরনের সামুদ্রিক পাখির ডিমের কুসুম। যে কুসুম বিশেষভাবে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছিল।

খাওয়ার পর বৃদ্ধ ভদ্রলোক অন্তুকে কোণার সোফাটায় বসতে বললেন। এখন তিনি পাসকুয়া দ্বীপের পাখিটিকে আনবেন। অন্তুর মাধ্যমে আরও কিছু তথ্য জানা চাই তার। সিগনাস-এক্স গ্রহের অধিকারী জিকা ৩২৭০ কখন এবং কোথায় আসবে। ঘরের আলো একটু কমিয়ে দেন।

টেবিলের ওপর সেই বিচিত্র রঙের ঝলমলে পাখি। অল্প আলোতে পাখিটিকে কেমন রহস্যময় দেখাচ্ছে। অন্তুর দিকে তাকিয়ে পাখি ডেকে ওঠে টুই টুই টুই।

অন্তু দেখে পাখির চোখ থেকে ঠিকরে আসছে আলো। ওর মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে ওঠে। চোখের সামনে তখন লাল, নীল, বেগুনি, সবুজ বুঁদবুঁদ উড়তে থাকে। নানা রঙের ঝিলিক। রঙগুলো বুনোট তৈরি করছে।

ধীরে ধীরে অন্তু আচ্ছন্ন হয়ে যায়। পাখির শব্দ ওর মস্তিষ্কের কোষে ট্রান্সমিট হচ্ছে। শব্দগুলো ক্রমশ রূপান্তরিত হচ্ছে ভিডিও ইমেজে। মিশরীর হায়ারোগ্লিফিক চিত্রলিপির মতো ভাষা ফুটে উঠেছে। অন্তু কয়েকটি শব্দ আর সংখ্যা বলতে থাকে। বৃদ্ধ সেগুলো ঝটপট লিখে নেন। এগুলো থেকেই সব তথ্য পাওয়া যাবে। বৃদ্ধটির চোখে মুখে তখন যেন সব পাওয়া গেছে এরকম একটা ভাব। তাকে খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছে।

সে রাতে বৃদ্ধ, অন্তুর বলা শব্দ আর সংখ্যাগুলোকে সাজিয়েছেন। সেখান থেকে যে তথ্য জানা যাচ্ছে তা হলো আগামী ২৭ ডিসেম্বর রাত তিনটা তেরো মিনিটে জিকা ৩২৭০ সেন্টমার্টিন দ্বীপের একস্থানে আসবে। সেই অবস্থানের স্পষ্ট নির্দেশও পাওয়া গেল অঙ্কের জটিল সূত্র থেকে।

২৭ ডিসেম্বর ভোরেই বৃদ্ধ সেন্টমার্টিনে এসে পৌঁছালেন। কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে আছে প্রবাল দ্বীপটি। ককুইনার স্তূপ পেরিয়ে যেতে হবে বৃদ্ধকে। একটা মানচিত্র করেছেন। হিশেব করে দেখছেন জিকা ৩২৭০ আসবে ছেড়াদ্বীপের উত্তর দক্ষিণে। সেখানে কেয়ার ঘন ঝোপ।

আকাশে ঝিকমিক করছে তারা। ঘড়ি দেখলেন বৃদ্ধ রাত তিনটা। সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে। ছেড়াদ্বীপের মাঠে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। একটু পরেই তার চোখের সামনে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটবে। দূর গ্রহের অধিবাসী আসবে। ভেতরে চাপা উত্তেজনা। অনেক বছর আগে পাসকুয়া দ্বীপে একবার এসেছিল তারা।

রেডিয়াম দেয়া ঘড়িতে দেখা যাচ্ছে রাত ৩ টা বেজে বারো মিনিট। আর মাত্র আট সেকেন্ড বাকি। ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটাটি টিকটিক করে এগিয়ে যাচ্ছে।

যেই তিনটা তেরো বাজল অমনি বৃদ্ধ দেখলেন কিছু দূরে একটা নীল আলোর বল যেন গড়িয়ে নামল। মৃদু শিসের মতো একটা শব্দ হচ্ছে। বলটা কিছুক্ষণ ঘুরে এক জায়গায় স্থির হলো। তারপর বলটা থেকে নীল আলোর শিখা ক্রমশ ছড়িয়ে যেতে লাগল। শিখাগুলো যেন একটা আকার নেবার চেষ্টা করছে। কিন্তুর আকার পাচ্ছে না। হঠাৎ চুপসে গেল নীল আলোর বলটা। তারপর ছোট হতে শুরু করল।

এক সময় বিন্দু হয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। সমুদ্রের একটানা গর্জনের শব্দ শুধু। ছেড়াদ্বীপের মাঠের ওপর দিয়ে রাতের বাতাস হুহু করে বয়ে যাচ্ছে।

বৃদ্ধ হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। জিকা ৩২৭০ তাহলে আসতে আসতে পৃথিবীতে এলো না কেন? এর উত্তর আবার পাওয়া যাবে পাসকুয়া দ্বীপের পাখির শব্দে, অন্তুর মাধ্যমে। হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই ধক করে উঠল বৃদ্ধের বুক। অন্তুর বাবা বলেছিলেন আর মাত্র তিন মাস আয়ু আছে ছেলেটির। সেই তিন মাস শেষ হতে আর মাত্র তিন দিন আছে।

অন্তু এখন খুব অসুস্থ। ওর চেহারা কেমন মলিন হয়ে এসেছে বাড়ির সবাই বুঝতে পারছে, অন্তুর চূড়ান্ত বিদায়ের সময় এসে গেছে। অন্তু শুধু একবার জিজ্ঞেস করেছিল ওপর তলার বৃদ্ধের কথা। অন্তুর বাবা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন ভদ্রলোক সেন্টমার্টিনে গিয়েছেন।

৩১ ডিসেম্বরের সকালে এসে পৌঁছালেন বৃদ্ধ। অন্তু আরও নিস্তেজ হয়ে গেছে। ডাক্তাররা জানিয়ে গেছেন আজকের দিনটি সম্ভবত শেষ দিন। অন্তুর আম্মা আর বড় বোন জায়নামাজে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন।

বৃদ্ধ তার পাখিটি নিয়ে আসে। শেষ মূহূর্তে যদি জিকা ৩২৭০-এর পৃথিবীতে না আসার কারণ জানা যায়।

ঘরে অন্তু আর বৃদ্ধ ছাড়া আর কেউ নেই। পাখি ডাকে টুই টুই টুই। বিবর্ণ চোখে অন্তু তাকায় পাখির দিকে। তারপর বিড়বিড় করে কী যেন বলে। বৃদ্ধ ঝুঁকে আসেন অন্তুর কাছে। অন্তুর কথাগুলোকে মনে হয় যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে।

…আমি আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তোমাদের পৃথিবী এখন অনেক বিষাক্ত হয়ে গেছে। পরিবেশ দূষিত হয়ে গেছে। এসিড বৃষ্টি হয়। তাই এই ভয়ঙ্কর পরিবেশে আমার শরীরের কাঠামো অবয়ব পেল না। আমি ভেঙে অণু-পরমাণু হয়ে গেলাম। অথচ আমরা যখন আরেকবার এ পৃথিবীতে এসেছিলাম তখন পৃথিবী অনেক নির্মল ছিল। স্বচ্ছ ছিল। এখন তোমরা পরিবেশকে দূষিত করে ফেলেছো।

অস্তুর কণ্ঠস্বর নিস্তেজ হয়ে আসছে। ওর যেন কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

অন্তুর বাবা আর বড় ভাই এসে ঘরে ঢুকে। পাখিটা চুপ করে আছে। এক সময় চোখ খোলে অন্তু। বৃদ্ধের হাত দুটো ধরে বলে, আমাকে আপনি সমুদ্রে নিয়ে যাবেন?

-যাব।

বৃদ্ধের চোখে তখন ভাসছে জাহাজের বিষাক্ত তেলে সমুদ্রের ওপর কালো স্তর জমছে। মরে যাচ্ছে পাখি আর মাছ।

-আমাকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে নিয়ে যাবেন?

-যাব ।

বৃদ্ধের চোখে ভাসছে, প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো নির্জন দ্বীপে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে মানুষ। ঝলসে যাচ্ছে সবুজ প্রকৃতি। দগদগে ক্ষতের মতো হয়ে উঠছে মাটি।

বৃদ্ধের মনে হলো জিকা ৩২৭০ আসতে পারেনা বিষাক্ত পরিবেশের জন্যে। পৃথিবীর মতো অন্তুর শরীরটাকেও বিষিয়ে দিয়েছে মানুষ। বৃদ্ধের চোখ টলটল করে উঠল। অন্তু সেদিকে তাকিয়ে বলল, একি, আপনি কাঁদছেন?

-কই না তো, চোখে বোধহয় কিছু একটা পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *