১০. প্রতীক্ষা

প্রতীক্ষা

আমি একজন ভূ-তাত্ত্বিক। অন্য গ্রহের ভূ-তত্ত্ব সম্পর্কে গবেষণা করতে আমি খুবই আগ্রহী। গত গ্রীষ্মকালে চাঁদে এসেছি একটি ভূ-তাত্ত্বিক অভিযানের নেতা হিশেবে। আমার সাথে রয়েছে বেশ বড় একটা দল। মহাকাশের প্রধান সরবরাহ স্টেশন এখান থেকে পাঁচশো মাইল দূরে। ওখান থেকে আমাদের বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে।

আমরা এখন রয়েছি চাদের সমতল ভূমির দক্ষিণ দিকে। যাতায়াতের জন্যে আমাদের সাথে রয়েছে তিনটি রকেট। যাতে করে সহজেই অল্প দূরত্ব অতিক্রম করতে পারি। চাঁদের বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার জন্যে ব্যবহার করি কাটারপিলার ট্রাক্টর। উঁচু নিচু জমিতে এই যানটি সহজেই চলতে পারে।

চাঁদের এই জায়গাটা হলো তিনশো মাইল ব্যাসের একটি সমতল ভূমি। চারদিকে পাহাড়। পূর্ণিমার সময় দক্ষিণ দিকে যখন চাঁদ ওঠে তখন ডান প্রান্তরের উপরে লম্বাটে গোল আকারের একটি ছোট ছায়া দেখা যায়। এ অঞ্চলে চাদের অন্য অংশের মতো আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ নেই।

এখানে উৎসাহের সাথে গবেষণার কাজ করছি। এক সময় এখানে সমুদ্র ছিল। কোটি কোটি বছর আগে। যখন পৃথিবীতে সবেমাত্র প্রাণের সূচনা হচ্ছে তখন এখানে শেষ সময় ঘনিয়ে এলো। পানি নেমে গেল বিশাল খাড়ি থেকে। জমা হলো চাঁদের গভীর প্রদেশে। শুকিয়ে গেল সমুদ্র। পাহাড়গুলো এরই চারপাশে। পাহাড়ের ধার ঘেঁষে সাবধানে আমরা চলেছি।

চাদের সময় অন্য রকমের। এখানে অনেকক্ষণ ভোর থাকে। সূর্য ডোবার সময় আসে অনেক পর। এই সময়ে পৃথিবীর হিশেব হলো এক সপ্তাহ। আমরা ট্রাক্টর চালিয়ে যাই। সকলের পরনে স্পেস স্যুট। খনিজ পদার্থের খোজ করি। যে পথ দিয়ে এগিয়ে যাই সেখানে চিহ্ন রেখে যাই। যাতে ভবিষ্যতের অভিযাত্রীরা সহজেই পথ নির্দেশ পায়।

আমাদের ট্রাক্টরগুলো হলো চাপ নিয়ন্ত্রিত। এর ভেতরে সহজেই মাস খানেক সময় অনায়াসে থাকা যায়।

এদিককার পাহাড়গুলো খাঁজকাটা। দেখতে রুক্ষ। এই অভিযানে এক ধরনের রোমাঞ্চও রয়েছে। যখন পাহাড়ি অঞ্চলের একটা করে বাঁক পেরোই ভাবি এই বুঝি সামনে কোনো অজানা সৌন্দর্য রয়েছে। এই রহস্যের আকর্ষণে পেরিয়ে যাই দূর্গম রুক্ষ পথ।

এখানকার সমতল ভূমির দক্ষিণ দিকটা হলো এক বিরাট ব-দ্বীপ । অনেকগুলো নদী এক সময় এখানে প্রবাহিত হতো। নদীগুলো গিয়ে মিশতো সমুদ্রে।

শুকনো খাতের উপর দাঁড়িয়ে আমি অতীতের সেই দৃশ্যটা ভাবার চেষ্টা করি। আগ্নেয়গিরিগুলো তখন সক্রিয়। জ্বালামুখ থেকে বেরুচ্ছে লাভাস্রোত । মুষলধারে ঝরছে বৃষ্টি। নদীগুলো ফুলে উঠেছে।

আমার খুব ইচ্ছে করে এই নদীখাত দিয়ে সামনে এগিয়ে যাই। দূরের পাহাড়ে অভিযান চালাই। কিন্তু জরিপের কাজ এখনো অনেক বাকি। আরো একশো মাইল আমাদের জরিপ করতে হবে। আমাদের ট্রাক্টরে যে ঘড়িটা আছে তাতে রয়েছে পৃথিবীর সময়ের হিশেব। কাজ শেষে রাত দশটায় এখানকার প্রধান: বেস’-এ শেষ বেতার সংকেত পাঠানো হয়। বাইরে তখন গনগন করছে সূর্য। প্রখর তাপে ঝলসে যাচ্ছে প্রান্তর। ট্রাক্টরের ঘড়ির সময়ে তখন রাত। এই উজ্জল তাপের মধ্যেও আমরা ঘুমাতে যাব। আমাদের ঘুমের জন্যে সময় হলো আট ঘণ্টা।

ঘুম থেকে ওঠার পর তৈরি হবে সকালের খাবার। সসেজ ভাজা হবে। শর্ট ওয়েভে বাজতে থাকবে পৃথিবীর বেতার কেন্দ্র।

আমার মনে পড়ছে সেদিনের কথা। বেতারে প্রিয় একটা সুর শুনছি। ড্রাইভার গেছে গাড়ির চাকা দেখতে । সহযাত্রী গার্নেট লগ বুকে গতকালের বিবরণ লিখছে। সসেজ ভাজা হচ্ছে। বাইরের পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে আছি। সবচাইতে কাছের পাহাড়টাও এখান থেকে কুড়ি মাইল দূরে। তবু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি পাহাড়টা। চাঁদে দূরত্বের জন্যে দৃষ্টি খর্ব হয় না। পৃথিবীর মতো দূরের জিনিস এখানে ঝাপসা দেখায় না।

সমতল থেকে পাহাড়গুলো খাড়া উঠে গেছে। কোনো ভূমিকম্পে মাটির স্তর দুমড়ে এভাবে উপরে উঠে গিয়েছিল। সমতল ভূমির দু’দিকের ঢাল দেখা যায়। ঐসব পাহাড় চুঁড়াতে এখনো কোন মানুষ যায়নি। অতীতের অনেক ঘটনার সাক্ষী এই পাহাড়গুলো। এখানকার উত্তাল সমুদ্র থেকে পানি নেমে যেতে দেখেছে। দেখেছে কিভাবে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যত জীবনের সম্ভাবনা।

রোদে পাহাড়গুলো ঝকমক করছে। অনেক সময় তীব্র আলোর ঝলক। অথচ খানিক উপরেই ঘন কালো আকাশ। সেখানে ঝিকমিক করছে তারাপুঞ্জ।

আমি সেদিন তাকিয়েছিলাম পশ্চিম সমুদ্রের পাহাড়শ্রেণির দিকে। হঠাৎ চোখে পড়ল পাহাড়শ্রেণির উপরে রহস্যময় আলো। কেমন ধাতব আলোর বিচ্ছুরণ। মনে হচ্ছে বেশ মসৃণ পাথরের গা থেকে আলোর প্রতিফলন হচ্ছে। কৌতূহলী হলাম। কোন জাতীয় পাথর থেকে এ ধরনের প্রতিফলন সম্ভব? পর্যবেক্ষণ মঞ্চে উঠলাম। সেখানে বসানো চার ইঞ্চি টেলিস্কোপ। সেটার মুখ পশ্চিম দিকে ঘোরালাম।

পাহাড় চূড়োটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। যে বস্তুতে প্রতিফলন হচ্ছিল সেটা খুব ছোট। টেলিস্কোপে ঠিকমতো ধারণা করা গেল না। বুঝতে পারলাম জিনিশটার আকার আশ্চর্য রকমের সুষম । তার শরীর চেপ্টা। জ্বলজ্বল করছে। কি এই রহস্যজনক বস্তু!

কিছুক্ষণ পর আমরা জরিপ কাজে বেরিয়ে গেলাম। স্পেস স্যুট পরা বলে কথাবার্তা চলছে বেতারে। আমার সহযাত্রীরা বলছে চাঁদে কোনোদিন বুদ্ধিমান প্রাণির অস্তিত্ব ছিল না। এই গ্রহের একদম প্রাথমিক স্তরে কিছু উদ্ভিদ ছিল। ওটাই ছিল একমাত্র প্রাণের চিহ্ন।

আমার কৌতূহল ক্রমশ বাড়ছে। সিদ্ধান্ত নিলাম, পশ্চিমের ঐ পাহাড়ে আমি যাব। রহস্যময় বস্তুটি আমাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করছে। চাঁদের ঐ পাহাড়টা হবে বারো হাজার ফুটের কম। পৃথিবীর মহকার্ষে যা হবে দু’হাজার। ঐ অঞ্চলটা ঘুরে আসতে আমার চব্বিশ ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে না। গার্নেট আমাকে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করল।

যদি এখানে উঠতে গিয়ে তোমার ঘাড় ভেঙে যায়। পা মচকে যায়। তুমি যদি আহত হও। বেস্ এর অন্যেরা তখন উপহাস করবে।

আমার কিছু হবে না। ভুলে যেও না এখানে হেলিক চূড়াতে আমিই প্রথম উঠেছিলাম।

গার্নেটকে আমার পাহাড়ে চড়ার অভিযানে সঙ্গী করে নিলাম। আমাদের গাড়িটা পাহাড়ের আধ মাইলের মধ্যে এসে পৌছালো। চালক থাকবে গাড়িতে।।

হঠাৎ করে ঐ খাড়া উঠে যাওয়া পাহাড় দেখে ওখানে চড়া অসম্ভব বলে মনে হবে। এখানে একটা সুবিধে হলো সব ওজনই ছয় ভাগের এক ভাগ। পাহাড়ে চড়াও এখানে অনেক সহজ।

আমি আর গার্নেট ওঠা শুরু করলাম। সমতল থেকে চার হাজার ফুট উপরে উঠলাম। সেখানে চাতালের মতো একটা জায়গা। সেখানে খানিক বিশ্রাম নিলাম। নিচে আমাদের ট্রাক্টরটাকে একটা ধূসর পোকার মতো দেখাচ্ছে। চালকের সাথে বেতার বার্তা বিনিময় করলাম। স্পেস স্যুটের ভেতরটা বেশ ঠাণ্ডা।

যত সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি ততই বিশাল দৃশ্যপট দেখছি। আমার ভেতরে তখন রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি। আমি এমন এক স্থানের দিকে চলেছি যেখানে পৃথিবীর কোনো মানুষের আগমন ঘটেনি।

এক সময় এসে পৌছালাম সেই খাড়া পাথরের দেয়ালের কাছে। মাথার উপর প্রায় পঞ্চাশ ফুট যাবার পর হঠাৎ করেই যেন দেয়ালটা শেষ হয়ে গেছে। এর উপরেই সেই সমতল জায়গা। যেখান থেকে সেই রহস্যময় আলো প্রতিফলিত হচ্ছিল।

কি সেই প্রতিফলক বস্তুটা? হয়তো প্রাচীনকালের কোনো উল্কাপাতের ফলে পাথরের ভগ্নাংশ। এখানে কোনো কিছুর ক্ষয় হয় না তাই সেগুলো দীর্ঘদিন অবিকৃতভাবে রয়েছে।

মসৃণ পাথর বেয়ে ওঠা অসম্ভব। পাথরের কোনো খাঁজও নেই। সাথে রয়েছে লম্বা দড়ির মুখে তিন মাথা হুক। সেটাই ছুঁড়ে দিলাম । এক সময় আটকে গেল হুকটা।

আমি দড়ি বেয়ে ওঠা শুরু করলাম। হাতের ভর দিয়ে উঠতে লাগলাম। একেবারে শেষ প্রান্তে এসে থামলাম। আমার সামনে সেই রহস্যময় অধিত্যকা। উপত্যকার প্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছি। সমতল জমি। উল্কা বর্ষণে এর মসৃণ শরীর কোথাও ফুটো হয়েছে। আমি সেখানে এক বিস্ময়কর জিনিশ দেখলাম। পিরামিডের আকারের একটি স্তম্ভ। স্তম্ভটি পাথরের গায়ে বসানো। উচ্চতা দুমানুষ সমান। কাটা রত্নের মতো বস্তুটি। সেখানে ঝলসে উঠছে সূর্যের আলো।

সেই রহস্যময় স্তম্ভটির দিকে তাকিয়ে আমি বিস্মিত হলাম। অন্য এক ধরনের অনুভূতি সঞ্চারিত হলো আমার মাঝে।

এখন মনে হচ্ছে, চাঁদে উন্নত সভ্যতা বলে কিছু ছিল। এতোদিন জানতাম এখানে শুধু আদিম জাতীয় কিছু শ্যাওলা ছিল। এখন সে ধারণা ভুল বলে প্রমাণিত হবে। এই বিস্ময়কর, উত্তেজনাপূর্ব খবরটি আমি প্রথম পৃথিবীতে প্রচার করব।

কি এই রহস্যময় বস্তুটা! এটা কি কোনো উপাসনা গৃহ নাকি বাড়ি, বাড়ি হলে এ রকম দূর্গম স্থানে বানাবে কেন? এটা হয়তো ধর্মীয় প্রার্থনার স্থান। এখানকার প্রাচীন বিচিত্র আকারের সভ্য প্রাণিরা হয়তো এখানে এসে আকুল প্রার্থনা করেছিল। চাঁদ থেকে দ্রুত অপসৃয়মান জীবনের সাথে তারাও যেন বিলুপ্ত না হয়। বস্তুটি খুব নিখুঁত। যারা এটি নির্মাণ করেছে তারা যথেষ্ট উন্নত সভ্যতার অধিকারী ছিল।

একটি অদ্ভুত জিনিশ দেখলাম। উল্কাপাতের ফলে এখানকার পাথুরে জমি ঝাঝরা। তার ওপর মিহি ধূলোর আস্তরণ । যেহেতু বাতাস নেই তাই ধুলো সরতে পারে না। যেখানে ধূলো পরে সেখানেই জমতে থাকে। অনন্ত কাল ধরে। আমি বিস্মিত হয়ে দেখলাম এই মহাজাগতিক ধুলো আর উল্কাপাতের গর্তগুলো একস্থানে এসে হঠাৎ মিলিয়ে গেছে ঐ বস্তুটি ঘিরে একটি বৃত্তাকার লাইন বরাবর। মনে হবে কোনো অদৃশ্য দেয়াল বুঝি পিরামিড আকারের বস্তুটিকে মহাকাশের ধুলো থেকে উল্কাপাতের আঘাত থেকে রক্ষা করতে চাইছে। গার্নেট নিচ থেকে বেতার বার্তায় আমার সাথে যোগাযোগ করছে। ওকে উপরে উঠে আসতে বললাম। আমি এক টুকরো পাথর নিয়ে সেই অদৃশ্য বৃত্তের দিকে ছুঁড়ে দিলাম। নুড়ি পাথরটা একটা গোল দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল।

আমি তখন অনুভব করলাম আমার সামনে একটি যন্ত্র রয়েছে। এই যন্ত্রটি প্রচণ্ড এক শক্তি দিয়ে সুরক্ষিত। এমনভাবে এই সুরক্ষার ব্যবস্থা যাতে অনন্ত কাল ধরে এটি সক্রিয় রয়েছে। সময়ের কোনো থাবা একে থামাতে পারে নি।

বিস্ময়কর এক অনুভূতি তখন আমাকে অনেকটা যেনো আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। আমি হয়তো সেই প্রবল ক্ষমতাধর শক্তির পরিমণ্ডলের অনেক বেশি কাছাকাছি চলে এসেছি।

গার্নেট উঠে এসেছে। সেও বস্তুটি দেখে বিস্মিত। নির্বাক হয়ে গেছে। আমি একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভাবছি। নিচে দেখা যাচ্ছে চাঁদের সমতল ভূমি। অগণিত নক্ষত্রের আড়ালে দেখা যাচ্ছে ছোট্ট পৃথিবী।

যখন এখানে রহস্যজনক পিরামিডের নির্মাতারা কাজ করছিল তখন আমাদের পৃথিবীর অবস্থা কি রকম ছিল! কোন সময়কে অতিক্রম করছিল পৃথিবী? তখন কি সেখানে ছিল সভ্য জনপদ! নাকি প্রাগৈতিহাসিক মানুষ! নাকি ছিল শুধু বৃষ্টি ভেজা অরণ্য। সেখানে দর্পিতভাবে ঘুরেছে বিশাল সরীসৃপগুলো। আকাশে উড়ছে দাঁতওয়ালা পাখি।

হঠাৎ আমার মাথায় একটা চিন্তা এলো। আমি কেন ভাবছি এই বস্তুটি চাঁদের আদি সভ্য প্রাণিদের তৈরি? এমনওতো হতে পারে অন্য গ্রহের কোনো প্রাণিরা এই বিচিত্র যন্ত্রটিকে এখানে স্থাপন করে গেছে।

গত তিন দশক ধরে চাঁদে অনেকগুলো অভিযান করেছি। সংগ্রহ করেছি প্রচুর তথ্য। কিন্তু এতোগুলো অভিযানে প্রাণের চিহ্ন হিসেবে চোখে পড়েছে অল্প কিছু আদিম গুল্ম। শ্যাওলা । চাঁদে অন্য কোনো উন্নত সভ্যতার চিহ্ন পাই নি। যদি উন্নত, বুদ্ধিমান প্রাণিরা এখানে থাকত তবে তাদের আর কোনো নিদর্শন নেই কেন?

আমার সামনে সেই রহস্যময় তিন কোনা বস্তুটি। চাঁদের এই রুক্ষ পাথুরে পরিবেশের সাথে জিনিশটা একেবারে বেমানান। কোনোমতেই খাপ খায় না।

এরপর থেকে শুরু হলো আমাদের এক সংগ্রাম। ঐ অদৃশ্য, স্বচ্ছ পাথরের দেয়ালটা ভেদ করতে আমাদের এরপরে আরো কুড়ি বছর লাগল। ঐ দেয়াল ভাঙতে আমাদের শেষ পর্যন্ত পরমাণু শক্তি ব্যবহার করতে হলো। তারপর পৌছাতে পারলাম সেই বিচিত্র যন্ত্রটার কাছে।

যন্ত্রটার টুকরোগুলো এখন আমাদের হাতে। এর জটিল প্রযুক্তি বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই। সম্ভবত ভৌত জগতের বাইরের কোনো নিয়ম দিয়ে এই প্রযুক্তি তৈরি ।

এখন তো সৌর জগতের সব গ্রহেই মানুষ আসা যাওয়া করছে। পৃথিবী ছাড়া এখনো অন্য কোথাও বুদ্ধিমান প্রাণিদের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় নি। এতে চাদের পিরামিড রহস্য আরো বেড়েছে। ঐ উপত্যকার উল্কাপাতের ফলে যে ধূলো জমেছে তার বয়স চিহ্নিত করা গেছে। সময়ের হিশেব করে জানা গেছে ঐ পিরামিডটি যখন এখানে স্থাপন করা হয় তখন পৃথিবীতে স্থলভাগেরই সৃষ্টি হয়নি। তরল পৃথিবীর বুকে তখনো শক্ত ডাঙ্গা জেগে ওঠেনি।

ধারণা করছি সুদূর নক্ষত্রলোক থেকে তারা সৌর জগতের মধ্য দিয়ে তীব্র বেগে ছুটে যাবার সময় চাঁদে এই নিদর্শনটি রেখে গেছে।

কিন্তু এতদিন ধরে যন্ত্রটা এখানে কি কাজ করছিলো? আমি এই রহস্য ভেদ করার জন্যে গবেষণা শুরু করলাম। পুরো ব্যাপারটি আমাকে যথেষ্ট আলোড়িত করেছিল। গবেষণা করে আমি বেশ কয়েকটি অনুমান করতে পারলাম। এই অনুমানগুলো হলো, বিশাল এই ছায়াপথের বৃত্তাকার পথে লক্ষ কোটি তারা আবর্তিত হচ্ছে। আজকে আমরা সভ্যতার যে স্তরে এসে পৌছাতে পেরেছি নিশ্চয়ই অন্য সব নক্ষত্রলোকের প্রাণিরা সেই অবস্থায় পৌছে গিয়েছিল। সে অনেক…কাল আগের কথা। এমনও হতে পারে তাদের সভ্যতা হয়তো আমাদেরও অতিক্রম করে গিয়েছিল। সৃষ্টির আদিপর্বে গুটিকয় জাতি তখন সভ্যতার উচ্চ শিখরে উঠেছিল।

তখন বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের অন্যত্র সবেমাত্র প্রাণের সূচনা শুরু হয়েছে। তখন নিশ্চয়ই সেই গ্রহগুলোর সভ্য প্রাণিরা অন্য সব নক্ষত্র খুঁজে দেখেছে। উন্নত সভ্য প্রাণের অনুসন্ধান করেছে। তখন নক্ষত্রলোকের অন্যান্য গ্রহে বিরাজ করছে বুদ্ধিহীন সরীসৃপ জাতীয় প্রাণি । কোথাও জলচর প্রাণি। যাদের চিন্তা করার কোনো রকম ক্ষমতা তো নেই। বার্তা বিনিময় করার কোনো রকম কৌশল জানা নেই। এমনও হতে পারে গ্রহগুলো একেবারেই প্রাণহীন। আমাদের পৃথিবীও তখন ছিল ঐ অবস্থায়। জ্বলন্ত এক পিণ্ড । ধোয়ায় ঢাকা আগ্নেয়গিরিগুলো টগবগ করছে।

এই রকম এক সময়ে পুটো গ্রহের ওপার থেকে এলো তাদের সেই মহাকাশযান। সূর্য থেকে দূরের শীতল গ্রহগুলো পার হয়ে এলো তারা। উষ্ণ গ্রহগুলোতে তারা অনুসন্ধান চালাতে চায়। তারা খুঁজে ফিরছে আখাঙ্ক্ষিত সঙ্গীদের।

তখন হয়তো তারা পৃথিবীর চারপাশও ঘুরেছিল। তারা হয়তো বুঝতে পেরেছিল এক সময় এই গ্রহটিতে প্রাণের উন্মেষ ঘটবে। বুদ্ধিমান প্রাণিরা আসবে। কিন্তু সে তো অনেক পরের কথা। তাদের যে অপেক্ষা করার মতো সময় নেই। সামনে অগণিত নক্ষত্রলোক।

তাদের পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পথ। তারা সেখানে একটি প্রহরী রেখে যেতে চায়।

এ ধরনের অনেক প্রহরী তারা ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে রেখে এসেছে। তাদের যেখানে মনে হয়েছে প্রাণের সম্ভাবনা রয়েছে সেখানেই প্রহরী রেখে এসেছে।

স্বচ্ছ পাথরের যন্ত্রটিকে তখন তারা চাঁদের বুকে একস্থানে স্থাপন করল। তাদের এ রকম ধারণা ছিল যদি কোনোদিন পৃথিবীর মানুষ নিজেদের ক্ষমতায়, যোগ্যতায় চাঁদে আসতে সক্ষম হয় তবে তাদের সম্পর্কে আগ্রহী হবে।

মহাকাশের কঠিন যাত্রাপথ অতিক্রম করা এক উন্নত প্রযুক্তির ব্যাপার। যারা এগুলো করতে পারবে তারা এই জ্ঞান অর্জনের অধিকার অর্জন করতে পারবে। এ পর্যন্ত আসতে হলে পরমাণু শক্তিকে করায়ত্ব করতে হবে।

ঐ সভ্য প্রাণিরা এ কথা বিশ্বাস করেছিল চাঁদে গিয়ে এক সময় এই অদৃশ্য দেয়াল ভাঙা হবে। তারপর ভেতরের যন্ত্রটিকে টুকরো করা হবে।

শেষ পর্যন্ত হলো তাই। ভাঙার পর এখন ঐ যন্ত্রটি সংকেত পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। বুদ্ধিমান প্রাণিরা এতোদিন ঐ সংকেত বিশেষ পদ্ধতিতে গ্রহণ করছিল। এখন তারা পৃথিবী নামের গ্রহটির ওপর মনোযোগ দেবে। তারা হয়তো আমাদের সভ্যতার সাথে যোগাযোগ করতে চাইবে।

আমি প্রায়ই তাকিয়ে থাকি বিশাল ছায়াপথের দিকে। ভাবি, কারা বুঝি এগিয়ে আসছে মেঘের আড়াল থেকে আমাদের দিকে।

আমাদের এখন প্রতীক্ষা করে থাকতে হবে। কতদিন? কত কাল?

আর্থার সি ক্লার্কের কাহিনি অবলম্বনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *