০৫. পৃথিবীর শেষ

পৃথিবীর শেষ

মাইকের বাড়িটা খুব সুন্দর। বাংলো ধাঁচের বাড়ি। সামনে বিরাট বাগান। পেছনে ঘন জঙ্গল। বাগানে অজস্র গাছ। বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য ফুলের গাছ রয়েছে। সবুজ ঘাসে বসে চমৎকার গল্পের আসর জমে। চাঁদনি রাতে ঐ বাগানটা অপরূপ হয়ে ওঠে। রুপোলি আলোতে বাড়িটা ফকফক করে।

সে দিন সন্ধে বেলাতেও এমনি এক আসর বসেছে। মাইকের প্রিয় বন্ধুরা বিভিন্ন শহর থেকে এসেছে এই আসরে। বন্ধুদের সাথে রয়েছে তাদের স্ত্রীরা। নিককে খুব উচ্ছল দেখাচ্ছে। সে কমলার ঠাণ্ডা রস খেতে খেতে একটি অভিনব খবর জানাল।

-জানো, গত সপ্তাহে আমরা কোথায় গিয়েছিলাম? দারুণ এক অভিজ্ঞতা হয়েছে আমাদের।

-কোথায় গিয়েছিলে?

-বিশ্বাস করবে? ঘুরে এলাম একেবারে পৃথিবীর শেষ থেকে।

-কী বললে?

-পৃথিবীর শেষ থেকে। নিকের চোখ দুটো যেন নতুন এক অভিজ্ঞতায় জ্বলজ্বল করছে।

হেনরী অবাক হয়। হেনরীর স্ত্রী সিনথিয়া জিজ্ঞেস করে, তোমরা পৃথিবীর শেষ দেখতে গিয়েছিলে? গেলে কেমন করে?

-কেন, এই আশ্চর্য, রোমাঞ্চকর ভ্রমণের কথাটা শোননি। গত মার্চ মাস থেকেই তো এটা শুরু হয়েছে। আমেরিকান এক্সপ্রেসের একটি বিভাগ চালাচ্ছে এটা।

নিকের কথায় আসরের অনেকেই বেশ কৌতূহলি হয়ে ওঠে। নিক তাদের কাছে ঐ উত্তেজনাময় আশ্চর্য ভ্রমণের ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলে।

-এটা হলো চমৎকার এক যাত্রা। যথেষ্ট শিহরণমূলক। একটা ছোট্ট সাবমেরিনের মতো যন্ত্রের ভেতরে বসতে হয়। সামনে রয়েছে প্লাস্টিকের দেয়াল। তার উপরে হাতল। নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে সুইচ টিপে পাঠিয়ে দেয় ভবিষ্যতে।

-এই যাত্রায় নিশ্চয়ই অনেক খরচ। জানতে চায় মারশা।

-খরচ অবশ্য পর্যায়ক্রমে কমে আসছে। আরও কমবে। গত বছর তো শুধুমাত্র কোটিপতিরা এতে যেতে পেরেছিল।

-এই যাত্রায় কী দেখতে পেলে তোমরা? হেনরী জানতে চায়। নিক একটু নড়ে বসে।

-বেশ কিছু সময় তো কিছুই দেখা গেল না। ওধারে কেবল আবছা অন্ধকার। এক সময় ঝাপসা ভাবটা কেটে গেল। স্পিকারে শোনা গেল, আমরা এখন সময়ের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছি। পৃথিবীতে যখন প্রাণ আর জীবন টিকে থাকা অসম্ভব।

আমরা দেখছিলাম সাবমেরিনের মতো যন্ত্রঘরে বসে। দেখছি সমুদ্রের তীরে এসে গেছি। কোথাও কেউ নেই। সমুদ্রের পানি কেমন ঘোলাটে। সেখান থেকে বেরোচ্ছে গোলাপি আভা। এরপর সূর্য উঠল। টকটকে লাল সূর্য। আকাশের মাঝামাঝি যাওয়া পর্যন্ত সূর্যটা লালই রইল। তারপর এক সময় কেমন থলথলে হয়ে গেল। দেখলাম সূর্যের ধারগুলো কেমন ঝুলে পড়ছে। দেখলাম তীরের বালি প্রবলভাবে উড়ছে। সমুদ্রের পানির রঙ কেমন ছাই ছাই ধরনের হয়ে গেল।

নিকের স্ত্রী জেন বলল ওপাশ থেকে, কাঁকড়াটার কথা বলো। নিকের সাথে জেনও ছিল সেই যাত্রায়।

ও হাঁ, সেই কাঁকড়াটার কথা তো বলতেই হবে। কাঁকড়া হলো পৃথিবীর শেষ জীবিত প্রাণি। ঠিক যে ধরনের কাঁকড়া আমরা চিনি সেটা কিন্তু ও রকম নয়। দুহাত চওড়া। একহাত উঁচু। শিঙ বাঁকানো। বারোটা পা। পিঠে চকচকে খোলস। ধীরে ধীরে ডান দিক থেকে বাঁ দিকে যাচ্ছিল প্রাণিটা। সূর্যাস্তের সময় মরে গেল। ওর শিংগুলো গেল নেতিয়ে। এরপর জোয়ারের সাথে প্রাণিটা সমুদ্রে ভেসে গেল। সূর্য ডুবে গেল। চাঁদ নেই। স্পিকারে ঘোষণা হলো, আপনারা এইমাত্র পৃথিবীর শেষ জীবিত প্রাণির মৃত্যু দেখলেন।

নিকের কথা শুনে সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। রকি জানতে চায়- কতক্ষণ ছিলে তোমরা?

-তিন ঘণ্টা। তবে ইচ্ছে করলে কয়েকদিনও কাটানো যায়। এ জন্যে বেশি দামের টিকিট কাটতে হয়।

টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে। নিকের কাছে ভালো লাগছে সে এই আসরের বন্ধুদের তার বিচিত্র ভ্রমণের কথা বলে বেশ অবাক করে দিতে পেরেছে। আজকাল আর মানুষ যেন সহজে বিস্মিত হয় না।

নিক তাদের জানিয়েছে ঝুলে পড়া সূর্য, পৃথিবীর শেষ জীবিত প্রাণি বিরাট এক কাঁকড়ার কথা।

এমন সময় ঘরে ঢোকে মাইকের বারো বছরের ছেলে টিম। সে ঢুকেই জানায়, এইমাত্র টিভির খবরে বলল সরকারি গবেষণা কেন্দ্র থেকে কতগুলো অ্যামিবা ছাড়া পেয়ে মিশিনগান হ্রদে নেমেছে। এই অ্যামিবাগুলোর উপর টিস্যু গলিয়ে ভাইরাস নিয়ে পরীক্ষা চলছিল। ঘোষণায় বলা হয়েছে আশপাশের সাতটি রাজ্যের সবাই যেন পুনরায় ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত পানি ফুটিয়ে খায়।

টিম তাদের এ খবরটি দিয়ে চলে যায়।

এমন সময় ঘরে প্রবেশ করে এডি আর ফ্র্যান।

-ইস, তোমরা নিক আর জেনের আশ্চর্য ভ্রমণের গল্পটা শুনতে পেলে না। জানো, ওরা পৃথিবীর শেষ দেখে এসেছে।

-আরে আমরাও তো গত বুধবার ঐ ভ্রমণ করে এসেছি। হাসিমুখে বলল এডি।

নিক একটু হতাশ হলো। ও ভেবেছিল আসরের আর কেউ বুঝি এই বিচিত্র ভ্রমণে যায়নি।

রকি জিজ্ঞেস করে এডিকে- তোমরা সব দেখেছ? বিশাল কাঁকড়া?

-না তো। আমরা তো কাঁকড়া দেখি নি। পলা বলল, তাহলে ততক্ষণে ওটা বোধহয় মরে গিয়েছিল। নিক আর জেন তো সেটা দেখেছে।

-তোমরা কত দিন আগে গিয়েছিলে? এডি জিজ্ঞেস করে নিককে।

-রোববার বিকেলে।

এডি বলে, খুব দারুণ রকমের অভিজ্ঞতা হয়। যখন শেষ পাহাড়টা সেখানে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে সমুদ্রে পড়ে যায়।

জেন বলল, কই, আমরা তো কোনো পাহাড়কে সেখানে ভেঙে পড়তে দেখিনি। তোমরা তাহলে কাঁকড়াটা দেখনি।

মাইক এগিয়ে আসে। আচ্ছা, এডি, তোমরা কী দেখলে? তোমাদের অভিজ্ঞতার কথা শুনি।

-আমাদের প্রথমে একটা ক্যাপসুলের ভেতরে পুরে দিল। তারপর আমাদের পাঠিয়ে দেয়া হলো একেবারে পৃথিবীর শেষ সময়ে। আমরা দেখলাম চারদিকে শুধু পানি আর পানি থইথই করছে। আকাশে দেখা যাচ্ছে একই সাথে সূর্য আর চাঁদ।

-জেন বলল, কই, আমরা তো চাঁদ দেখিনি।

এডি বলতে লাগল, সূর্যটা ছিল এদিকে আর চাঁদটা ওদিকে। চাঁদের যেখানে থাকা উচিত তার চাইতে অনেক বেশি কাছে ছিল। সমুদ্রের পানি শুধু বাড়ছিল। ফুলে ফেঁপে উঠছে। আমরা পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে গেলাম। পানি ছাড়া আর কোনো কিছুই দেখলাম না। শুধু এক জায়গায় দেখি ঢিবির মতো উঁচু একটি স্থান। গাইড বলল ওটা হলো গিয়ে এভারেস্টের চুড়ো। মানুষের কত বুদ্ধি। এমন যন্ত্র তৈরি করেছে যাতে লক্ষ লক্ষ বছর সামনে পেছনে যাওয়া যায়। কিন্তু পৃথিবীর শেষ সময় গিয়ে কী দেখবে? শুধু থইথই পানি।

-ভারি অদ্ভুত ব্যাপার। আমরাও সমুদ্র দেখেছি। কিন্তু তীরে বালি ছিল। তার উপর দিয়ে ঐ বিশাল কাঁকড়াটা চলছিল। সূর্যটা ছিল টকটকে লাল। তোমাদের সময় সূর্যটা দেখতে কেমন ছিল?

-হালকা সবুজ। জানায় ফ্রান।

এমন সময় ঘরে ঢোকে টম আর হ্যারিয়েট। এদের কথা শুনতে পেয়েছে ওরা।

তোমরা কি পৃথিবীর শেষ সময়ের কথা বলছ? ও সে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর দৃশ্য। টম বলে।

-তোমরাও বুঝি দেখে এসেছ?

-ঠিক। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে।

-তোমরা কি সমুদ্রের ধারে সেই বিশাল কাঁকড়াটা দেখতে পেয়েছিলে? নাকি শুধু পানি আর পানি।

এর কোনোটাই না। আমরা দেখেছি বরফ যুগ। শুধু বরফ আর বরফ। সমস্ত পৃথিবীটা যেন ধপধপে শাদা বরফে ঢাকা। ফ্লাড লাইটের আলোতে দেখলাম ঝকঝক করছে। সূর্য ততক্ষণে নিভে গেছে।

হ্যারিয়েট বলল, আমার মনে আছে তখনও সূর্যের রেশ ছিল।

হেনরী জিজ্ঞেস করে, এটা কী করে হচ্ছে? প্রত্যেকে অন্যরকম দেখছে। পৃথিবীর শেষ একই রকমভাবে হওয়ার কথা।

টম জানায়, সমস্ত ব্যাপারটাই বিশ্বাসযোগ্য। সূর্য নিভে গেছে। পৃথিবী ঢাকা বরফে। এমনিভাবেই শেষ হয়ে গেছে পৃথিবী।

মাইকের আরও বন্ধুরা আসছে। ফিল আর ইসাবেল এলো। তারা এসে জানাল মাত্র গত পরশু দিনই তারা পৃথিবীর শেষ দেখে এসেছে।

-দেখলাম সূর্য ফেটে গিয়ে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আমাদের যান গেল সূর্যের পাশ দিয়ে। ওরা আমাদের নিয়ে গেল বিস্ফোরণের দু’ঘণ্টা আগে। আজ থেকে লক্ষ লক্ষ বছর পরে। গাছগুলো সব আঁশওয়ালা। ডালগুলো দড়ির মতো পাকানো। জন্তুগুলো একপেয়ে। লাফিলে চলে। কোথাও কোনো জনপ্রাণি নেই। আমরা দেখলাম সূর্যটা ফুলে উঠতে শুরু করল। তারপর সূর্যটা বড় হতে লাগল। হঠাৎ বাঁ দিক থেকে হাতের মতো লম্বা কী একটা যেন বেরিয়ে এলো। সমস্ত আকাশজুড়ে সেই আনুনের হাত। কালো কাচের ভেতর দিয়ে দেখছি। এরপর ওরা আমাদের কয়েক বছর এগিয়ে দিল। সূর্য আবার ঠিক হয়ে গেছে। তবে আকারে ছোট হয়েছে। সারা পৃথিবীতে সব কিছু পুড়ে ছাই। পাহাড়গুলো গলে হয়েছে থিকথিকে সাদা। সমুদ্র শুকনো খটখটে। একপেয়ে জন্তুগুলো মরে গেছে।

-আচ্ছা, প্রত্যেকেই কী করে আলাদা আলাদা ঘটনা দেখল? বরফ জমছে। পানিতে সব ঢাকা। সূর্য টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। বিরাট কাঁকড়া। একপেয়ে জন্তু।

নিক বলল, ভবিষ্যতের যে রূপ দেখলাম সব ক্ষেত্রেই তা ঠিক। মানে পৃথিবীতে নানা রকম বিপর্যয় হতে পারে। ঠিক একই রকমভাবে পৃথিবী যে শেষ হয়ে যাবে তা নাও হতে পারে।

ভ্রমণ আয়োজকরা এক একটা দলকে এক এক রকম বিপর্যয় দেখাতে পাঠিয়েছে।

মাইকের বন্ধুরা সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প করছে। সবাই ভাবছে পৃথিবীর শেষ সময়ের কথা। তাদের অনেকেই দেখছে চাঁদকে ফেটে যেতে। পৃথিবীর খুব কাছে এসে পড়েছিল। বড় বড় টুকরো বৃষ্টির মতো ঝরে পড়তে লাগল। একটা তো যানের কাছেই এসে গিয়েছিল। ফ্রান বলল, আমাদের যাত্রাটা ছিল চমৎকার। কোনো ধরনের ভাঙচুর নয়। শুধু লাল টকটকে সূর্য আর জোয়ারের পানি। বিশাল বড় কাঁকড়া।

টিভিতে দেখা যাচ্ছে সময় ভ্রমণ কোম্পানির এক কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার। তিনি বললেন, এই যাত্রা ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে। আগামী বছর সময় ভ্রমণ সবচাইতে দ্রুত বর্ধমান একটি শিল্প হয়ে উঠবে। পৃথিবীর অধিবাসীরা ভয়াবহ ভবিষ্যতের চেহারা দেখতে চাইছে।

চাঁদের স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে আছে মাইকদের বাগানে। পেছনের জঙ্গল থেকে রাতচরা পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছে। ঐ আসরের উপস্থিত মানুষদের তখন মনে হলো, পৃথিবী নামের এই সুন্দর, সবুজ গ্রহটি একসময় ধ্বংস হয়ে যাবে। কোনো প্রাণি আর বেঁচে থাকবে না।

রাতচর পাখিরা তখনও ডেকে চলছে।

রবার্ট সিলভারবার্গ এর কাহিনি অবলম্বনে

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *