০২. ভয়ঙ্কর এক দানব

ভয়ঙ্কর এক দানব

ছোটবেলা থেকেই ফ্রাঙ্কের ছিল বিচিত্র ধরনের কৌতূহলী স্বভাব। বনে পাহাড়ে সে ঘুরে বেড়াত অদ্ভুত আকৃতির জীব জন্তুদের দেখার জন্যে। নিশাচর পাখিরাও তাকে বেশ আগ্রহী করে তুলেছিল। রাতেরবেলায় কোনো কোনো প্রাণির চোখ ঝোপেঝাড়ে ধকধক করে জ্বলত। সেদিকে তাকিয়ে কেমন এক ধরনের শিহরণ অনুভব করত ফ্রাঙ্ক। সে ছুটে যেত প্যাঁচার কুৎসিত ছানা দেখার জন্যে। তাদের বাড়িটি ছিল শহরতলিতে। পেছনে বনের সীমানার শুরু। রাতেরবেলায় সেখানে শোনা যেত নেকড়ের চিৎকার। তাদের কাঠের বাড়ির ছোট্ট ঘরে শুয়ে ফ্রাঙ্ক ভাবত নেকড়ের ছানা সংগ্রহের কথা। এ রকম একটি ছানাকে খুঁচিয়ে হত্যা করে তার লাল কলজেটা দেখতে চেয়েছিল।

ফ্রাঙ্কের আগ্রহ ছিল গবেষণার প্রতি। জীববিজ্ঞানের রহস্যের প্রতি তার যথেষ্ট ঝোঁক ছিল। সে প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের পশুপাখি সংগ্রহ করে কাটাছেড়া করত।

ফ্রাঙ্কের মা মারা যাবার পর থেকে ফ্রাঙ্ক একটু উদাস হয়ে গিয়েছিল। ওর ছোট ভাই আরনেস্টের গলায় একটি লকেট ঝুলত। সেই লকেটে ছিল ওদের মায়ের ছবি। ফ্রাঙ্কের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল এলিজাবেথের সাথে।

একদিন ওরা সবাই গেছে বনভোজনে। চমৎকার আবহাওয়া। মৃদু বাতাস বইছে। ঝলমলে রোদে ওরা সারাদিন ছুটোছুটি করল সবুজ প্রান্তরে।

এলিজাবেথ, আরনেস্ট, ফ্রাঙ্ক আর তার বাবা। মাঠে সেবার প্রচুর উজ্জ্বল ফুল ফুটেছে। এলিজাবেথ বেতের ছোট ঝুড়িতে সংগ্রহ করেছে এক ধরনের ব্যাঙের ধূসর ছাতা। সে চমৎকার স্যুপ বানাতে পারে এক ধরনের বাদামি সবজির নরম ডগা দিয়ে। বনভোজনের একটি প্রধান আকর্ষণ হবে সেই স্যুপ।

হঠাৎ আকাশ ভীষণ কালো হয়ে এলো। ঝলসে উঠল বিদ্যুৎরেখা। সবাই তাড়াতাড়ি ছুটল বাড়ির দিকে। ফ্রাঙ্ক যেতে চাইল না। সে তুমুল বৃষ্টির ভেতরে পাহাড়ি পথে ঘুরবে বলে জানাল। সবাই অবশ্য জানে তার অস্বাভাবিক আচরণের কথা। ফ্রাঙ্ককে রেখেই তারা চলে গেল। আকাশ ঝলসে দিয়ে বিদ্যুৎ চমকাল। শুরু হলো অঝোর ধারায় বৃষ্টি। ফ্রাঙ্ক সেই তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে পাহাড়ে ঘুরতে লাগল। সে গভীরভাবে ভাবছে বিদ্যুৎ আর বৃষ্টির কথা। তার নতুন গবেষণার কথা।

বাড়িতে তার বাবা উদ্বিগ্নভাবে অপেক্ষা করছিল। বনে কত ধরনের হিংস্র জন্তু রয়েছে। অনেক রাতে পাহাড় থেকে ফিরে এলো ফ্রাঙ্ক। শব্দ পেয়ে বাতি হাতে দরজা খুললেন ফ্রাঙ্কের বাবা। ভিজে সপসপ করছে ফ্রাঙ্ক। চুলের ডগা বেয়ে পানি নামছে। তার চোখ দুটো কি রকম অস্বাভাবিক লাগছে। বাতির আলোতে কেমন রহস্যময় দেখাচ্ছে ফ্রাঙ্ককে।

-একি অবস্থা হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ হয়ে যাবে যে।

-আমার কিছু হবে না বাবা।

-এই প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টিতে পাহাড়ে কি করছিলে তুমি?

-আমার নতুন গবেষণাটির কথা ভাবছিলাম। সে এক দারুণ ব্যাপার হবে। আমি কালই শহরে চলে যেতে চাই।

-কালই?

-অনেক রকম চিন্তা এখন আমাকে প্রচণ্ড আলোড়িত করছে। আমি শহরে গিয়ে শিগগির আমার গবেষণাটা শুরু করতে চাই।

ফ্রাঙ্কের বাবা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ফ্রাঙ্কের দিকে। বড্ড জেদি তার এই ছেলে। যা বলে সেটাই সে করে।

-বেশ, যাবে।

পরদিন ভোরে বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শহরের দিকে রওনা হলো ফ্রাঙ্ক। তাকে অনেকটা দুর্গম পথ পেরিয়ে যেতে হবে। পাহাড়ি ঢলে সামনের রাস্তা গেছে ভেঙে। অনেকটা পথ হাঁটলে তবে শহরে যাওয়ার গাড়ি পাওয়া যাবে। পথে ফ্রাঙ্কের ছোটবেলার বন্ধু হেনরিদের বাড়ি। হেনরির সাথে কথা হলো তার নতুন গবেষণার পদ্ধতি নিয়ে। ফ্রাঙ্কের চোখমুখ আনন্দে জ্বলজ্বল করছে। সে এবার যেতে পারছে শহরের বিখ্যাত গবেষণাগারে।

শহরের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাল ফ্রাঙ্ক। ধূসর পাথুরে দেয়াল দিয়ে ঘেরা বিশ্ববিদ্যালয়টিকে অনেকটা দুর্গবাড়ির মতো দেখায়। জীববিজ্ঞানের গবেষণাগারে কাজ করার সুযোগ পেল ফ্রাঙ্ক। ছাত্র হিশেবে সে ছিল যথেষ্ট মেধাবী।

ফ্রাঙ্কের গবেষণার বিষয়টি ছিল বিচিত্র। সে সেটা গোপন রেখেছিল। তার ভেতরে কাজ করছিল এক অদ্ভুত, রহস্যময় চিন্তা। সে চেয়েছিল কোনো মৃতদেহে প্রাণের সঞ্চার করে তাকে জাগিয়ে তুলতে। তার এই বিচিত্র অদ্ভুত ইচ্ছের কথা গোপন রেখে সে গবেষণাগারে দিন রাত কাজ করত। শারীরবিদ্যায় ক্রমশ দক্ষ হয়ে উঠল সে। নিপুণভাবে কাটাছেঁড়া করত। বেশিরভাগ সময় গবেষণাগারে রাতে একাকী কাজ করত ফ্রাঙ্ক। গবেষণাগারটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কোণে। জায়গাটি বেশ নির্জন। কেমন ছমছম একটা পরিবেশ সেখানে। ওষুধের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ।

দু’বছর গবেষণা করে ফ্রাঙ্ক অনুভব করল যে অবশেষে যে সফল হতে চলেছে। সে আবিষ্কার করল উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অদ্ভুত এক রাসায়নিক বস্তু। যার ফলাফল ছিল অবিশ্বাস্য। এই রাসায়নিক তরল ইনজেকশনের সাহায্যে কোনো মৃতদেহে প্রয়োগ করলে মৃতদেহে আবার প্রাণের সঞ্চার হবে। এই আবিষ্কারের সাফল্যে প্রচণ্ড উত্তেজনায় কয়েকরাত ঘুমাতে পারল না ফ্রাঙ্ক। কতদিনের সাধনা তার। মৃতের শরীরে প্রাণ সঞ্চার করা। মৃত জীবকোষগুলোকে পুনরায় সজীব করে তোলা। কি একাগ্র চিত্তে এই গবেষণায় এতদিন ডুবে থাকতে হয়েছে তাকে। বিষয়টা তাকে নেশার মতো পেয়ে বসেছিল।

আজ রাতেই ফ্রাঙ্ক তার গবেষণার সাফল্য বুঝতে পারবে। আজই সে ইনজেকশন প্রয়োগ করবে একটি মৃতদেহে। অনেক কষ্টে সে শহরতলির কবরস্থান থেকে একটি মৃতদেহ সংগ্রহ করেছে। মৃতদেহটি বেশ অস্বাভাবিক। প্রায় দানব আকৃতির। ভীষণ কদাকার চেহারা। এ ধরনের বীভৎস, বিশাল চেহারার মানুষ সহজে দেখা যায় না। মৃতদেহটা রয়েছে এক কোণায়। রাত গভীর হলেই ফ্রাঙ্ক তার কাজ শুরু করবে। ইনজেকশনটা প্রস্তুত করা হয়েছে। চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে যাচ্ছে ফ্রাঙ্কের শরীরে। আজকের রাতটি হয়তো তার জীবনকে সম্পূর্ণভাবে পালটে দেবে। ফ্রাঙ্ক সেই দানব আকৃতির মৃতদেহটির সামনে এসে দাঁড়ায়। বাতির স্বল্প আলোতে কেমন ভুতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। কি বিকট চেহারা মৃতদেহটির! দেখলে চমকে উঠতে হয়। গবেষণাগারে আর কেউ নেই। ওষুধের তীব্র গন্ধ। ফ্রাঙ্ক ধীরে ধীরে তার এতদিনের সাধনায় তৈরি ইনজেকশন বের করে। মৃতদেহের বাহুতে সুচ ঢুকিয়ে দেয়। তারপর ইনজেকশনের সাহায্যে মৃতদেহে ওষুধ সঞ্চার করে। ফ্রাঙ্ক অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে মৃতদেহটার দিকে। প্রতিটি মুহূর্তকে তখন তার কাছে মনে হচ্ছে ধারালো ছুরির মতো। ফ্রাঙ্ক বিস্মিত হয়ে দেখে তার আবিষ্কৃত ওষুধ ক্রিয়া করছে। তার এতদিনের গোপন স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। মৃতদেহটির শরীর ক্রমশ উষ্ণ হয়ে উঠছে। তার জীবকোষ সজীব হচ্ছে। তার ভেতরে আবার প্রাণের সঞ্চার হয়।

ফ্রাঙ্ক বিমুগ্ধভাবে তাকিয়ে রইল সেই মৃতদেহটির দিকে। অবশেষে তাহলে সে সার্থক হতে চলেছে। মৃতকে জীবিত করেছে।

ধীরে ধীরে মৃতদেহটি চোখ খুলেছে। চোখের মণি একটু একটু নড়ছে। সেখানে তিরতির করছে আলোর রেখা। কি ভয়ঙ্কর ধরনের চোখ। কোটরের ভেতর থেকে যেন অনেকটা ঝুলে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। এখন ক্রমশ জেগে উঠছে দানব মানুষটা। তার একটা হাত উপরের দিকে উঠল। ফ্রাঙ্ক তখন চমকে উঠে ভাবল, এ আমি কি করলাম। নিজ হাতে একটি দৈত্য তৈরি করলাম।

শোয়া অবস্থা থেকে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল দানবটা। তার ভেতরে তখন সঞ্চারিত হয়েছে দানবীয় শক্তি। দীর্ঘ দিনের ঘুমন্ত অবস্থার অবসান ঘটেছে। দানব মানুষটা উঠে দাঁড়াল। কেমন টলোমলোভাবে পা ফেলে হাঁটছে।

ফ্রাঙ্ক আর এ দৃশ্য দেখতে পারছে না। অস্ফুট চিৎকার করে উঠল সে, উহ, এ আমি কি তৈরি করলাম। আমি যে এখন আর এটার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছি না। আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। আমাকে এখন ঘুমাতে হবে। এভাবে জেগে থাকলে মনে হবে আমি বুঝি দুঃস্বপ্ন দেখছি। আমি যে আর এ দৃশ্য মোটেই সহ্য করতে পারছি না।

ফ্রাঙ্ক দৌড়ে গেল তার বিছানার কাছে। সেই দানবটাও তখন তার পিছু পিছু এলো। ফ্রাঙ্ক ক্লান্তভাবে এলিয়ে পড়েছে বিছানায়। দানবটা তার সামনে দাঁড়িয়ে। অস্পষ্ট ভাষায় কি যেন বলার চেষ্টা করছে। ঘরঘর শব্দ আসছে তার গলা থেকে। ফ্রাঙ্ক অবশ্য কিছু বুঝতে পারছে না।

সে প্রচণ্ড ভয় পেল। তার সামনে এখন দানবটা দাঁড়িয়ে। ভয়ঙ্কর এক শয়তান। যাকে সে নিজ হাতে তৈরি করেছে। দানবটা মরে গিয়েছিল সে তাকে পুনরায় জাগিয়ে তুলেছে। ফ্রাঙ্ক ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে বলল, শয়তান, আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যা।

দানবটা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ফ্রাঙ্ক যেন তার প্রভু। ফ্রাঙ্ক বুঝল তাকে এর হাত থেকে নিস্তার পেতে হলে পালাতে হবে। তাকে পালিয়ে যেতে হবে অনকে দূরে। চট করে সিদ্ধান্ত নিল ফ্রাঙ্ক। তাকে এখনি পালাতে হবে। ফ্রাঙ্ক দৌড়ে চলে গেল পেছনের বাগানে। এ পথ দিয়েই তাদের বাড়িতে যাওয়া যাবে। কতদিন সে বাড়িতে যায় নি। অদ্ভুত এক নেশার ঘোরে যেন সে এতকাল আচ্ছন্ন হয়েছিল। ফ্রাঙ্ক হাঁফাতে হাঁফাতে এসে উঠল হেনরিদের বাড়িতে। তার সবসময় ভয় হচ্ছিল দানবটা বুঝি তাকে অনুসরণ করছে।

হেনরি এতদিন পর ফ্রাঙ্ককে দেখে তো অবাক। ফ্রাঙ্ক এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। না, সেই দানবটাকে তখন আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

হেনরি তার ছেলেবেলার বন্ধু। কত স্মৃতি রয়েছে তার সাথে। ফ্রাঙ্কের এখন শুধু বাড়ির কথা গভীরভাবে মনে হচ্ছে। মা মরা ছোট ভাই আরনেস্ট, বাবা, এলিজাবেথ। কতদিন তাদের সাথে দেখা নেই। ফ্রাঙ্ক তখন প্রচণ্ডভাবে আবেগতাড়িত। যেন অনেক দিনের বন্ধ দরজা খুলে গেছে তার সামনে। সে এত দিন মাথা গুজে ছিল এক অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে। এখানে আলোর তীব্র স্রোত। হু হু বাতাস।

কী যেন হলো ফ্রাঙ্কের। সে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। হেনরি তাড়াতাড়ি গাঁয়ের চিকিৎসককে ডেকে আনে। চিকিৎসক ফ্রাঙ্ককে দেখে জানায় খুব বেশি মানসিক পরিশ্রমের জন্যে এ অবস্থা হয়েছে। তার উপর প্রচণ্ড স্নায়বিক চাপ গেছে। সে জন্যে এখন দরকার বিশ্রাম আর হাসিখুশি থাকা।

কয় দিনের সেবাযত্নে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠল ফ্রাঙ্ক। চিঠি লিখল বাড়িতে।

বাড়ি থেকে একটি ভয়াবহ উত্তর পেল ফ্রাঙ্ক। চিঠিতে লেখা, তার ছোট ভাই আরনেস্টকে কারা যেন গলা টিপে হত্যা করেছে বনের ভেতরে। চিঠিটা পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল ফ্রাঙ্ক। কে তার অমন নিস্পাপ কিশোর ভাইকে হত্যা করেছে? কেন করেছে?

তাড়াতাড়ি হেনরির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথ ধরল ফ্রাঙ্ক। তার ভেতরে তখন প্রচণ্ড অস্থিরতা। মাথার শিরা দপদপ করছে। শুধু চোখের সামনে ভেসে উঠছে আরনেস্টের সরল মায়াবী মুখ। আরনেস্ট ছোটবেলায় দৌড়ে এসে হাসি মুখে বলত, ভাই, আমার জন্যে রবিন পাখির নীল ডিম এনে দিবি না?

ফ্রাঙ্কের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। বনপথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। বুনো ফুলের তীব্র গন্ধ। কোথাও তিরতির করে বয়ে চলেছে ঝরনার স্বচ্ছ পানি। প্রজাপতিদের অবাধ ওড়াউড়ি।

তাদের গ্রামে পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে গেল। ততক্ষণে গ্রামে প্রবেশ করার দরজাটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। গ্রামটি পাথুরে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। গ্রামে ঢোকার জন্যে তোরণ রয়েছে।

এদিকে ঝোড়ো বাতাস বইতে শুরু করেছে। দূরের পাহাড় থেকে বুনো ঘোড়ার মতো বাতাস ছুটে আসছে। তুমুল বৃষ্টি আসবে। ফ্রাঙ্ক ভাবল, ভোরে দরজা না খোলা পর্যন্ত আর গ্রামে প্রবেশ করা যাবে না। বাকি রাতটা তাকে কাটাতে হবে গ্রামের বাইরের হ্রদের তীরে।

ততক্ষণে বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। ফ্রাঙ্ক হ্রদের তীরে এসে দাঁড়ায়। রাতের অন্ধকারে হ্রদকে রুপোলি পাতের মতো লাগছে। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকাল। ঝলসে উঠল আকাশ। সেই আলোতে ফ্রাঙ্ক দেখল একটা বিশাল ছায়ামূর্তি। সেই দানবটা তার সামনে কেমন ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রাঙ্ক চিনতে পারল তার ভাইয়ের হত্যাকারীকে। চিৎকার করে উঠল, শয়তান, আবার এসেছ। আমি বুঝতে পারছি তুমি আমার ছোট ভাইকে হত্যা করেছ তুমিই হলে সেই নিষ্ঠুর ঘাতক। আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝি পালিয়ে গেছ আলপোস পর্বতের দিকে। আর সেখানে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় তোমার করুণ মৃত্যু হয়েছে।

দানবটা কেমন গরগর শব্দ করে উঠল। ফ্রাঙ্কের মনে হলো দানবটা বুঝি বলছে, প্রভু, আমি যে আপনাকেই খুঁজছি।

ফ্রাঙ্ক প্রচণ্ডভাবে চিৎকার করতে লাগল। কষ্টে আর যন্ত্রণায় তার বুকটা ফেটে যেতে চাইছে। দানবটা এ রকম চিৎকার শুনে ওখান থেকে পালিয়ে গেল। দুর্যোগ ভরা রাতে ফ্রাঙ্ক আর তাকে অনুসরণ করতে পারল না। ফ্রাঙ্কের অবিরাম চিৎকারে তাদের গ্রামের প্রহরীর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সে বাতি হাতে বেরিয়ে এলো। ফ্রাঙ্কের কাছে এসে বলল,

-আমি এখুনি গ্রামে ঢোকার দরজা খুলে দিচ্ছি। বুঝতে পেরেছি আপনার ছোট ভাইয়ের মৃত্যুতে আপনি খুব দুঃখ পেয়েছেন। মুষড়ে পড়েছেন।

ফ্রাঙ্ক ফিরে এলো তার বাড়িতে। পুরো বাড়ি আরনেস্টের অপঘাতে মৃত্যুতে তখন শোকাচ্ছন্ন। সবাই সন্দেহ করছে আয়া জাসটিনকে। তার কাছে পাওয়া গেছে আরনেস্টের গলার সোনার লকেটটি। ফ্রাঙ্ক ভালোভাবেই জানে হত্যাকারী কে। তার কাছে কখনও মনে হচ্ছে সে নিজেই বুঝি হত্যাকারী। কারণ ঐ ভয়ঙ্কর দানবটিকে সেই সৃষ্টি করেছে। তার গবেষণার অশুভ পরিণাম হচ্ছে গিয়ে ঐ দানব।

বিচারে জাসটিনের ফাঁসির আদেশ হলো। এতে ফ্রাঙ্কের অনুশোচনা বাড়ল আরও। অদ্ভুত ব্যাপার, কোর্টে জাসটিন নিজের দোষ স্বীকার করেছে। এ ঘটনায় বিস্মিত হলো ফ্রাঙ্ক। সে জেলখানায় গিয়ে দেখা করল জাসটিনের সাথে। ঘরটিতে আবছা অন্ধকার। স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। এক কোণায় মুখ গুঁজে বসেছিল আয়া জাসটিন। ফ্রাঙ্ক এসে দাঁড়ায় গরাদের পাশে।

-জাসটিন, আমি ভালো করেই জানি যে তুমি আরনেস্টকে হত্যা করনি। তবে কেন এই খুনের দায়ভার তুমি নিজের উপর নিলে?

-আমি সরল আরনেস্টকে খুব ভালোবাসতাম। ও ছিল নিস্পাপ। আমি চাই ফাঁসিতে আমার মৃত্যু হোক। তাহলে মৃত্যুর পর পরলোকে ওর সাথে দেখা হবে।

-তোমার কাছে আরনেস্টের গলার লকেটটি এলো কি করে?

-সে আমি জানি না।

ফ্রাঙ্কের দুঃখ তখন আরও তীব্র হলো। সে নিজেকে দায়ী করল দু’জনের মৃত্যুর জন্যে। এরপর থেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ল ফ্রাঙ্ক। সারাক্ষণ কী যেন চিন্তা করত। মনে হতো অসহ্য এক যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তাদের পরিবার নিজেদের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে দূরের এক পাহাড়ি শহরের বাগান বাড়িতে উঠল। যদি এই নতুন পরিবেশে ফ্রাঙ্ক সুস্থ হয়।

এক সন্ধ্যেবেলায় আবহাওয়া ঝড়ো হয়ে উঠল। গাছের ডালপালা শব্দ করে নড়তে লাগল। শোঁ শোঁ করে বাতাস বইছে। ফ্রাঙ্কের মনে হলো একটা অশরীরী শক্তি এসে বুঝি উপস্থিত হচ্ছে। সে দুর্যোগের আভাস পেল। জানালার বাইরে তাকাল ফ্রাঙ্ক। বাইরে ঘন থিকথিকে অন্ধকার। সে দেখল একটি ছায়ামূর্তি সেখানে নড়ছে। কেউ যেন তাকে ফিসফিস করে ডাকছে। বুনোপথের কোথাও ধকধক করে জ্বলছে নেকড়ের চোখ। ফ্রাঙ্ক বেরিয়ে পড়ল সেই ভয়ানক দুর্যোগের রাতে। তাকে যেন একটি অশরীরী শক্তি তীব্রভাবে আকর্ষণ করছে। প্রবল বাতাস আর বৃষ্টির মধ্যে ফ্রাঙ্ক ছুটতে লাগল পাহাড়ি পথ ধরে। কাটাঝোপে লেগে তার শরীর রক্তাক্ত হচ্ছে। কখনও পা পিছলে যাচ্ছে। বিদ্যুতের আলোতে সে পথ দেখে চলেছে। হঠাৎ এক জায়গায় গিয়ে থমকে গেল সে। সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই দানব। ফ্রাঙ্ক চিৎকার করে উঠল,

-আমি তোমাকে শেষ করব। তোমার জন্যে দুটো নিস্পাপ প্রাণ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। আমি তোমাকে সৃষ্টি করেছি। তোমার জন্যে এখন আমার তীব্র অনুশোচনা হচ্ছে।

দানবটা তখন একটু সামনের দিকে এগিয়ে এলো।

-আপনি হচ্ছেন আমার সৃষ্টিকর্তা। তাই আপনাকে কিছু বলছি না। নইলে আমার এক আঘাতই যথেষ্ট ছিল আপনাকে শেষ করে ফেলার জন্যে। কিন্তু প্রভু, আমার সব কথা যে আপনাকে শুনতে হবে।

-কী কথা তোমার, বলো, শুনি।

দানবটা তখন ফ্রাঙ্কের কাছে তার কাহিনি বলা শুরু করল। বনের ভেতরে তখন আধো আলো আধো ছায়ার এক ছমছমে পরিবেশ।

-আপনি আমাকে তৈরি করলেন। জীবন দিলেন। আমার সে সময় ভীষণ ঠাণ্ডা লাগছিল। প্রচণ্ড শীতে যেন কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। এক ঘন অন্ধকার জগতের পর্দা ছিড়ে বেরিয়ে এলাম আমি। বেরিয়ে গেলাম বনের পথে। আমি তখন প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত। বাইরের পৃথিবীর সম্পর্কে তখনও আমার ভেতরে তেমন কোনো ভালো জ্ঞান নেই। দেখলাম একজন বৃদ্ধ লোক শীতের রাতে শুকনো ডালপালা জ্বেলে আগুন পোহাচ্ছে। আমি পায় পায় তার দিকে এগিয়ে গেলাম।

বনের একপাশে শুকনো ডালপালা জ্বেলে আগুন পোহাচ্ছিল বৃদ্ধ চাষি এ্যালবন। না, এবারের শীতটা প্রচণ্ড। হিমেল বাতাসের ঝাপটা। হাড়ের ভেতর সুদ্ধ কেঁপে যায়। হঠাৎ মচমচ শব্দ শুনে তাকায় এ্যালবন। আগুন পোহাতে কেউ বুঝি এগিয়ে আসছে। ভালোই হবে, তার সাথে গল্পগুজব করা যাবে। অন্ধকারে তাকায় এ্যালবন। দারুণ চমকে যায় সে আগন্তুককে দেখে। কি ভয়ঙ্কর চেহারা! বুঝিবা হ্রদের নিচ থেকে সেই সবুজ জলরাক্ষসটা এবার উঠে এসেছে। আগুনের আভায় দানবটার মুখ লালচে দেখাচ্ছে। চোখ দুটো কোটর ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। ভয়ে চিৎকার করে উঠল এ্যালবন। তারপর পড়িমরি করে দৌড়ে পালাল।

দানবটা বসে পড়ল আগুনের কাছে। হাত দুটো মেলে দিল। আগুনের তাপে নিজেকে সেঁকে নিল। রাতচরা পাখিরা ডাকছে। কিছুটা সুস্থ বোধ করল দানব মানুষটা। খিদের জ্বালা অনুভব করল। উঠে গ্রামের দিকে হাঁটতে শুরু করল। একটা কুটিরে আলো জ্বলছে। দানব মানুষটা এগিয়ে গেল কুটিরের কাছে। কাঁচের শার্সিটা তুলতে লাগল। শব্দ শুনে জানালার দিকে তাকাল ভেতরের লোকটা। যে দৃশ্য দেখল তাতে তার হাত থেকে খাবার পড়ে গেল। বীভৎসা চেহারার একটা প্রাণি জানালার শার্সি তোলার জন্য চেষ্টা করছে। লোকটা আতঙ্কে চিৎকার করে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেল। দানব মানুষটা ততক্ষণে ঘরের ভেতরে ঢুকে খাবার খেতে শুরু করেছে। কচি ভেড়ার ঠ্যাং সে ছিড়ে ছিড়ে খেতে লাগল।

-বুঝলেন প্রভু, আমার তখনও নিজের সম্পর্কে কোনোরকম বোধশক্তি গড়ে ওঠে নি। আমি যেন তখন শুধু খিদে আর শীতের প্রভাবকে অনুভব করছি।

ফ্রাঙ্ক বিস্মিত হয়ে শুনতে লাগল ভয়ঙ্কর দানবের কাহিনি।

-এরপর আমি গ্রামের পথে বেরুলাম। গ্রামবাসীরা আমাকে দেখে ভয়ে, আতঙ্কে চিৎকার জুড়ে দিল। কেউ কেউ আবার মূৰ্ছা গেল। শিশুরা চিৎকার শুরু করল। যুবকরা লাঠি নিয়ে আমাকে প্রচণ্ড আঘাত করতে লাগল। অনেকেই পাথরের টুকরো আমার দিকে ছুঁড়ে মারতে লাগল। আমি চারপাশ থেকে অবিরাম আঘাত পেতে লাগলাম। আমাকে যেন ঐ গ্রামের কেউ সহ্য করতে পারছিল না। বাধ্য হয়ে তাই পালিয়ে গেলাম সেই গ্রাম থেকে। গ্রামের পাশের এক পরিত্যক্ত কুটিরে গিয়ে আশ্রয় নিলাম।

রাতেরবেলায় শুনলাম পাশের ঘরে শব্দ হচ্ছে। আমি সাবধান হয়ে গেলাম। সেখানে মানুষ থাকে। একটি দরিদ্র পরিবার। ছোট কাঠ সরিয়ে আমি লুকিয়ে দেখলাম পাশের ঘরের জীবনযাত্রা। দেখলাম মানুষ কত কষ্ট আর সংগ্রাম করে বেঁচে থাকে। লোকটি সারা দিন কাজ করে বাড়ি ফিরত। বউটি বন থেকে শাকসবজি সংগ্রহ করে রান্না করত। আগুন পোহাবার জন্যে কাঠকুটো দরকার। আমি রাতের অন্ধকারে চুপিচুপি বন থেকে ওদের জন্যে কাঠ জোগাড় করে দিয়েছি। বুঝতে পারছিলাম আমার ভেতরে একটা পরিবর্তন হচ্ছে। জীবনের বোধগুলো একটু একটু করে অনুভব করতে পারছিলাম। এক সময় ঐ বাড়িতে বিদেশ থেকে কিছু লোক এলো। তারা পড়াশোনা করত। সেগুলো শুনে আমিও কিছুটা পড়াশোনা করলাম। আপনার কোটের পকেটে গবেষণার কাগজপত্র পেলাম। সেগুলো পড়ে জানতে পারলাম আমার সৃষ্টির গোপন রহস্য। তারপর থেকে আমি যে আপনাকেই খুঁজছি। আমি আপনার খোঁজে পথে বেরুলাম। সূর্যের ছায়া দেখে আমার ভূগোলের জ্ঞান হয়েছে। একদিন বনের ভেতর দিয়ে চলেছি। বনের ভেতরে তখন একদল মানুষ আনন্দে ছুটোছুটি করছে। তারা বনভোজনে এসেছে। দানব মানুষটা একটা বড় গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইল। লোকজনের হাসিখুশি ভাব তাকে আনন্দিত করছে। তারও ইচ্ছে করছে ওদের মাঝে ছুটে গিয়ে মিশে যেতে। হাত ধরাধরি করে খেলতে। হঠাৎ দলের একটি ছোট মেয়ে দৌড়ে আসার সময় পাথরে ধাক্কা খেয়ে ঝরনার পানিতে পড়ল। ঝরনাটিতে বেশ স্রোত। মেয়েটি ডুবে যাচ্ছিল। দানবটা এ দৃশ্য দেখে ভীষণ কষ্ট পেল। সে মেয়েটিকে বাঁচাবার জন্যে দৌড়ে এসে ঝরনাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর মেয়েটিকে এক হাতে জাপটে ধরে তীব্র স্রোতের হাত থেকে রক্ষা করল। আর একটু হলেই ধারালো পাথরের আঘাতে মেয়েটি ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেত। দানব মানুষটি মেয়েটিকে পাঁজাকোলা করে ঝরনা থেকে উঠে এলো।

দলের সবাই তখন ছুটে এসেছে ঝরনার কাছে। দানবের মতো কদাকার, বীভৎস একটি মানুষকে ওভাবে উঠে আসতে দেখে একজন বন্দুক দিয়ে গুলি করল। তারা ভেবেছিল দানবটি মেয়েটিকে মেরে ফেলতে চাইছে। দানব মানুষটার কাঁধে গুলি লাগল। দরদর করে রক্ত পড়া শুরু হলো। কোনোমতে মেয়েটিকে মাটিতে রেখে দৌড়ে পালাল। তার ভয় হচ্ছিল লোকগুলো বোধহয় আরও গুলি চালাবে।

দানবটা অনেকটা পথ দৌড়ে জঙ্গলের গভীরে চলে গেল। দুঃখ আর যন্ত্রণায় তার বুকটা ফেটে যেতে চাইছে। সবাই তাকে দেখে ভীষণ ভয় পায়। আতঙ্কিত হয়। চিৎকার করে। আঘাত করে। হত্যা করতে চায়। কিন্তু কেউ তার মনটাকে বুঝতে চায় না। সে তো ঝরনার স্রোত থেকে ঐ ছোট মেয়েটিকে আসলে বাঁচাতে চেয়েছিল। অথচ সবাই ভুল বুঝল তাকে। গুলি করল। মেরে ফেলতে চাইল।

দানবটি একটা গাছকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে লাগল। শুধু বলতে লাগল আমার কোনো বন্ধু নেই। বন্ধু নেই।

দানব মানুষটির দুঃখ আর যন্ত্রণাকে অনুভব করতে পারলেন ফ্রাঙ্ক। বনের গাছগুলোর পাতা তখন বাতাসে ঝিরঝির করছে। রঙিন পালকের পাখিরা উড়ে যাচ্ছে হ্রদের দিকে।

দানবটাকে অত্যন্ত বিষন্ন দেখাচ্ছে।

-প্রভু। এক দিনের কথা শুনুন। একটি ছোট ছেলে একদিন আমার সামনে এসে দাঁড়াল। কেন জানি আমাকে দেখে সে অন্যদের মতো ভয় পেল না। আমি তাকে আদর করে কোলে তুলে নিলাম। আমার খুব মায়া লাগল। ছেলেটিকে আমি আদর করতে চাইলাম। তখন সে জেদ ধরল তাকে নামিয়ে দেয়ার জন্যে। চিৎকার করতে চাইল। আমি জানি ছেলেটির চিৎকার শুনে ছুটে আসবে লোকজন। আর এসে আমাকে আঘাত করবে। আমি ছেলেটির চিৎকার থামাবার জন্যে ওর মুখ শক্ত হাতে চেপে ধরলাম। কিছুক্ষণ পর ছেলেটির আর কোনোরকম সাড়াশব্দ পেলাম না। সে আমার হাতে নেতিয়ে পড়ল। আমি বুঝলাম ছেলেটির করুণ মৃত্যু হয়েছে। অনুশোচনায় আমি জর্জরিত হলাম। ভাবলাম এবার আমাকে পালাতে হবে। বনের পথে খানিক এগিয়ে যেতেই দেখি একটা ঝোপের কাছে একজন তরুণ ঘুমিয়ে আছে। আমি সেই ছোট ছেলেটির গলার লকেটটি সেই তরুণীর কাছে রেখে চলে গেলাম। পরে জেনেছি ঐ ছেলেটি ছিল আপনার ভাই। আর আমার অপরাধের জন্যে ঐ তরুণীর ফাঁসি হয়েছিল।

প্রভু, আমি অনুতপ্ত। ভীষণভাবে অনুতপ্ত। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, আমাকে কেউ কখনও দয়া দেখায় নি। সবাই আমার প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠুর আচরণ করেছে। অন্যায় ব্যবহার করেছে। ঘৃণা করেছে। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আপনাকে অনুসরণ করে আমি এই পাহাড়ে এসেছি। আমার এখন একটি সঙ্গী চাই। স্ত্রী চাই। একমাত্র আপনিই পারবেন তাকে তৈরি করে দিতে। আপনার পক্ষেই তা সম্ভব ।

ফ্রাঙ্ক বললেন, -কখনও না। আমি কখনও তোমার জন্যে একটি দানবী সৃষ্টি করব না। আমি আর এ রকমের কোনো ভুল করব না। যে ভুল করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।

দানবটা তখন অনুনয় করে বলল, -একাকী এই জীবন আমার জন্যে অভিশপ্ত হয়ে উঠেছে। আপনি শুধু আমার জন্যে একটি স্ত্রী গড়ে দিন। আমি তাহলে চিরদিনের জন্যে ইউরোপ ছেড়ে চলে যাব। চলে যাব মানুষের বসতিহীন নির্জন কোনো জায়গায়। সেখানে গিয়েই বাকি জীবনটা কাটাব। আমি কারোর জন্য ক্ষতির কারণ হব না। আমিও যে অন্যদের মতো বেঁচে থাকতে চাই।

ফ্রাঙ্ককে তখন চিন্তিত দেখায়।

-তুমি যদি ইউরোপ ছেড়ে চলে যাবার প্রতিশ্রুতি দাও তাহলে আমি ভেবে দেখব।

-ধন্যবাদ। আমি কিন্তু আপনার আশপাশেই থাকব।

দানবটা অদৃশ্য হয়ে গেল বনের ভেতরে। ততক্ষণে ফ্রাঙ্কের খোঁজে বাতি হাতে লোকজন নিয়ে পাহাড়ে উঠে এসেছে তার বাবা।

এরপর ফ্রাঙ্ক বিভিন্ন দেশে অস্থিরভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগল। তার সাথে ছিল বন্ধু হেনরি। ফ্রাঙ্ক জানতো দানবটা গোপনে তার লক্ষ্য রাখছে।

ফ্রাঙ্ক এক সময় এসে পৌঁছাল স্কটল্যান্ডে। একটি নির্জন কুটির ভাড়া করল। সেখানেই সে তার গবেষণার কাজ করবে। ফ্রাঙ্ক যখন সাগর তীরে হাঁটতো তখন দাবনের এক জোড়া চোখ গাছপালার আড়াল থেকে তাকে লক্ষ্য করত।

ফ্রাঙ্ক তার নতুন গবেষণায় আত্মনিয়োগ করল। দিন রাত সে কাজ শুরু করে দিল। একদিন তার গবেষণাগারে দানবটি এসে হাজির। তাকে দেখেই ফ্রাঙ্ক চমকে উঠল।

এই দানবটি মারাত্মক ঘাতক। তার হাতে এ পর্যন্ত অনেক কিছু ধ্বংস হয়েছে। কদর্য স্বভাবের প্রাণিটি যেকোনো মানুষের কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্ক বিভীষিকা। বহু শহরের আর গ্রামের লোকের কাছে দানবটি তখন দুঃস্বপ্নের মতো। ফ্রাঙ্ক ভাবল, এ আমি আবার কি করতে চলেছি। এ ধরনের আরেকটি ভয়ঙ্কর প্রাণিকে তৈরি করছি। এ রকম ভুল করা আর ঠিক হবে না। এ ধরনের ভুল বিপর্যয় ডেকে আনবে।

দানবটি এগিয়ে আসে ফ্রাঙ্কের দিকে।

-প্রভু, আমাদের চুক্তির কি হলো?

-আমি কোনোভাবেই তোমার সঙ্গীকে তৈরি করতে পারব না।

-আপনি কিন্তু চুক্তি ভঙ্গ করেছেন। এর পরিণাম অত্যন্ত ভয়ঙ্কর হবে।

-হোক। তুমি আমাকে হত্যা করতে পার। তবে আমি কিছুতেই আরেকটি দানবী তৈরি করব না। তোমার মতো দানব সৃষ্টি করেই যে ভুল আমি করেছি।

-আমি তাহলে আপনার জীবনটাকে শূন্যতায় ভরিয়ে দেব।

দাবন হিংস্র আক্রোশে চলে গেল। ফ্রাঙ্ক তাকাল তার গবেষণাগারের দিকে। কোণার জারে টগবগ করে ফুটছে বাদামি তরল। ঝাঁঝালো গন্ধ চারপাশে। এই আবছা অন্ধকারেই সৃষ্টি হবে আরকটি দানব। যার নিষ্ঠুর থাবা গুড়িয়ে ফেলবে অনেক কিছু। ক্ষোভে, হতাশায় ফ্রাঙ্ক যেন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। সে তার মাথার চুল টানতে লাগল। তারপর আগুন ধরিয়ে দিল গবেষণাগারে। দাউ দাউ করে আগুনের শিখা নিমিষেই গ্রাস করে ফেলল কুটিরটিকে। ফ্রাঙ্ক একটি নৌকা করে কুয়াশাভরা নদীপথে যাত্রা করল।

ফ্রাঙ্কের জীবন ক্রমশ বিড়ম্বিত হয়ে উঠল। তার মাঝে দেখা দিল প্রচণ্ড অস্থিরতা। তার কাছে মনে হতো এক জোড়া হিংস্র চোখ বুঝি সব সময় তাকে অনুসরণ করে চলেছে। তার জীবন ভরে উঠল অস্বস্তিতে।

ফ্রাঙ্কের বাবা জেনেভাতে ফ্রাঙ্কের সাথে এলিজাবেথের বিয়ে ঠিক করলেন। ফ্রাঙ্কের বাবা চাইছিলেন তাকে আবার স্বাভাবিক, সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে। তাদের বিয়ে হলো একটি বাগান বাড়িতে। চারদিকে ছিল আলোর ঝলকানি। ফ্রাঙ্ক যেন দেখছিল একটা ধূসর ছায়া এসে আলোগুলোকে ঢেকে দিচ্ছে। আঁধার ঘনিয়ে উঠছে।

দানবটা আবছা অন্ধকারে এসে দাঁড়াল বাগান বাড়িটির পেছনে। নতুন বধূ এলিজাবেথের ঘরে আলো জ্বলছে। বাতাসে উড়ছে রেশমি পর্দা। দানবটি জানালার শিক বেঁকিয়ে সেই ঘরে প্রবেশ করল। এলিজাবেথ তাকে দেখে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। দানবটার হিংস্র আঙুল এগিয়ে গেল এলিজাবেথ গলা লক্ষ্য করে। দানবটার শক্ত থাবা এলিজাবেথের নরম গলা টিপে ধরল। বিস্ফারিত হয়ে এলো এলিজাবেথের চোখ। ফ্রাঙ্ক আর্ত চিৎকার শুনে দৌড়ে এসে দেখে তার স্ত্রীর মৃতদেহ পড়ে রয়েছে মেঝেতে।

-আমি আমার প্রতিশোধ নিয়েছি।

দানবটা ভাঙা জানালা দিয়ে নেমে বাগানে ঝুপ করে পড়ল। তারপর মিশে গেল ঘন অন্ধকারে। ফ্রাঙ্ক এলাজাবেথের মৃত শরীর স্পর্শ করে বিড়বিড় করে বলল, -আমাকেও যে এর প্রতিশোধ নিতে হবে।

ফ্রাঙ্কের কথাবার্তা এরপর থেকে সবার কাছে অস্বাভাবিক মনে হতে লাগল। ফ্রাঙ্ক তাদের কাছে বলে ভয়ঙ্কর আকৃতির এক দানবের কথা। তার সে কথা কেউ সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। ভাবে সে অপ্রকৃস্থ অবস্থায় এসব বলছে।

ফ্রাঙ্ক কখনও তার স্ত্রীর কবরস্থানে যায় ফুল দিতে। এলোমেলোভাবে হাঁটে। তার চোখ দুটো সবসময় লাল টকটকে দেখায়।

একদিন ফ্রাঙ্ক বসে রয়েছে কবরস্থানে। হঠাৎ শুকনো পাতায় মচমচ শব্দ শোনে। ফ্রাঙ্ক ঝাপসা চোখে তাকায়। দেখে দূরে দানবটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠে ফ্রাঙ্কের মাঝে। তার স্ত্রীর হত্যাকারী এখন তার সামনে। ফ্রাঙ্ক তাকে ধরতে চায়। তাড়া করে। আক্রোশে বলতে থাকে, -এবার আমার হাত থেকে কোনোভাবেই নিস্তার নেই তোমার। আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। বুঝিয়ে দেব মৃত্যুর স্বাদ কী রকম।

দানবটা দৌড়ে পালাতে থাকে। ফ্রাঙ্ক দানবের পায়ের ছাপ লক্ষ্য করে ছোটে। ছুটতে ছুটতে এক সময় দেখে এক স্থানে গাছের গুঁড়িতে দানবটি লিখে গেছে, আমি বরফের রাজ্যে উত্তর দিকে চলে গেলাম।

ফ্রাঙ্ক তখন মরিয়া। যে করেই হোক দানবটিকে এবার শেষ করতেই হবে। যেখানেই সে পালিয়ে যাক তাকে খুঁজে বের করতে হবে। ফ্রাঙ্ক মনস্থির করে সুদূর উত্তরের বরফের দেশে যাবার। দুর্গম পথ। শ্লেজগাড়ি সংগ্রহ করে। হাসকি কুকুরটানা গাড়ি। কয়েক মাসের খাবার নিয়ে ফ্রাঙ্ক শ্লেজগাড়িতে করে রওনা দেয়। দানবটাও এগিয়ে চলেছে বরফের দেশের দিকে। তীব্র হিমেল বাতাস বইছে। দানবটাও ব্যবহার করছে শ্লেজ। বরফের কুচি উড়ছে বাতাসে। একসময় ফ্রাঙ্ক দেখতে পায় দানবটিকে। ফ্রাঙ্কের গাড়ির একটি হাসকি কুকুর মরে গেল প্রচণ্ড পরিশ্রমে। আর মাত্র দুটো কুকুর রয়েছে। এ দিয়ে সেই দুর্গম পথে এগুনো কোনোমতেই সম্ভব না। এছাড়া বরফের সমুদ্রে ফাটল ধরেছে মাঝে মাঝে। প্রচণ্ড শীতে ফ্রাঙ্কের পা জমে অবশ হয়ে গেছে। একদম অসাড় অনুভূতি এখন ফ্রাঙ্কের। সে আর এগিয়ে যেতে পারছে না। কুকুর দুটোও ভীষণ ক্ষুধার্ত। অবসন্ন ফ্রাঙ্ক এক সময় শাদা বরফের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল।

দূরের একটি জাহাজের ডেক থেকে দূরবিন দিয়ে নাবিকেরা ফ্রাঙ্ককে দেখল। তারা আগে দেখেছিল দানবটির ছুটে যাওয়ার দৃশ্য। জাহাজটি বরফের মাঝে আটকে গেছে। বরফ কেটে কেটে অগ্রসর হচ্ছে। নাবিকেরা ফ্রাঙ্ককে তুলে জাহাজে নিয়ে এলো। সেবাযত্নে দুর্বল ফ্রাঙ্ককে কিছুটা সুস্থ করে তোলা হলো। বহু দিন পর ফ্রাঙ্ক গরম খাবার পেয়েছে।

জাহাজটি এগিয়ে চলেছে। কখনও বরফের দেশে দেখা যায় দানবটির বিশাল ধূসর ছায়া। সেও চলেছে হিমশীতল দেশে।

ফ্রাঙ্ক কোনোমতে কথা বলার শক্তি অর্জন করতে পেরেছে। শরীরে একটু বল ফিরে পেয়েছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,

-আমি এখন কোথায়?

জাহাজের ক্যাপ্টেন জানায়, -আপনি এখন গ্রিনল্যান্ডে। একটি জাহাজে।

নাবিকদের কাছে সে শোনে বরফের দেশে বিশাল প্রাণিটির ছুটে যাওয়ার কথা। উত্তেজনায় উঠে বসে ফ্রাঙ্ক।

যে করেই হোক আমি ঐ দানবটিকে শেষ করব। তাকে বিনাশ করতে হবে।

জাহাজের চিকিৎসক জানায়, আপনি খুবই অসুস্থ। আপনার পা দুটো হিমে অবশ হয়ে গেছে। আপনি চলাফেরা করতে অক্ষম। দুর্বল ফ্রাঙ্কের ঠোট দুটো থরথর করে কাঁপে। তীব্র যন্ত্রণায় তার চোখমুখ নীল হয়ে যায়। ফ্রাঙ্ক দুর্বল স্বরে জাহাজের নাবিকদের কাছে তার দানব তৈরির রোমাঞ্চকর গল্পটি বলে। দানবের বিভিন্ন নিষ্ঠুর ঘটনাগুলোর কথা উল্লেখ করে। নাবিকেরা বিস্মিতভাবে শোনে সেই রহস্যময় কাহিনি।

প্রবল শ্বাসকষ্ট হতে থাকে ফ্রাঙ্কের। শুধু অস্থিরতা আর উদ্বেগে কেটে গেছে তার জীবন। এক সময় সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

তখন বরফ ভাঙা শুরু হয়েছে। জমাটবাঁধা অবস্থাটা কেটে যায়। স্বচ্ছ টলটলে পানি দেখা যায়। স্কুয়া পাখিরা তীক্ষ্ণ স্বরে ডেকে যায়। জাহাজ যাত্রার জন্যে তৈরি। নাবিকেরা বরফের মাঝে সমাধিস্থ করার জন্যে ফ্রাঙ্কের শবদেহটিকে নিয়ে যায়। জাহাজটিতে তখন কেউ নেই।

সে সময় জাহাজের পাটাতনে একটি ধূসর ছায়া দেখা যায়। ছায়াটি ক্রমশ দীর্ঘ হতে থাকে। বিশাল ছায়াটি ঢোকে ফ্রাঙ্কের ঘরে। দানবটি মুখের কাপড় সরায়।

-প্রভু, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই। তোমার ব্যর্থতা যে আমারই ব্যর্থতা। তোমার করুণা আমার জন্য বিভীষিকা। আমি তোমার সৃষ্টি। আমার যা কিছু অপরাধ, মন্দ কাজ সব তোমারই সৃষ্টি। তোমার জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ার সাথে সাথে আমার সব শেষ হয়ে গেল।

জাহাজের লোকেরা তখন ফ্রাঙ্কের সমাধিস্থ করে ফিরে এসেছে। তারা নিচ থেকে শুনল ফ্রাঙ্কের কেবিন থেকে শব্দ আসছে। তারা সেখানে দৌড়ে যায়। গিয়ে দেখে শূন্য কেবিন। কোথাও কেউ নেই। ফ্রাঙ্কের বিছানার কাছে কে যেন একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখে গেছে। মোমবাতির শিখা থরথর করে কাঁপছে।

ক্যাপ্টেন জাহাজ ছাড়ার আদেশ দেয়। তরতর করে এগিয়ে যেতে থাকে জাহাজটি। ডেকে দাঁড়িয়ে থাকা নাবিকেরা তখন দেখতে পেল সেই রহস্যময় মানুষটিকে। দূরে ভাসমান এক খণ্ড বরফের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি দানবাকৃতি মূর্তি। সবাই তখন বলাবলি করল, বরফ গলে যাবার সাথে সাথে সে ধ্বংস হয়ে যাবে।

ম্যারী ডরু শেলীর কাহিনি অবলম্বনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *