০১. তারার দেশের হাঁস

তারার দেশের হাঁস

পত্রিকা অফিসের টেবিলে ঝুঁকে একমনে লিখছিলেন প্রধান সংবাদদাতা রাফারতি। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। একজন উত্তেজিতভাবে জানাচ্ছে সবুজ প্রান্তরের খামার বাড়ির কাছে সে একটি উড়োজাহাজকে ভেঙে পড়তে দেখেছে। রাফারতি সাথে সাথে গাড়িতে উঠলেন। অন্য সাংবাদিকরা জানার আগেই তাকে এই দুর্ঘটনার খবর সংগ্রহ করতে হবে।

শহর ছাড়িয়ে ছুটল গাড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবুজ প্রান্তরের সীমানায় এসে পড়লেন। দূরে দেখা যাচ্ছে একটি খামার বাড়ি। হলুদ বুনো ফুলের ঝোপ দুলছে বাতাসে। ফোনের তথ্য অনুযায়ী সেখানেই উড়োজাহাটি ভেঙে পড়েছে। কিন্তু সেদিকে কোনো ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে না। আশেপাশের ঘাসবনও পুড়ে যায় নি। কেমন শুনশান পরিবেশ। স্থানটিকে দুর্ঘটনাকবলিত বলে মোটেই মনে হচ্ছে না।

খামার বাড়িটির কাছে এসে থামল রাফারতির গাড়ি। কোথাও লোকের ভিড় নেই। অ্যাম্বুলেন্স নেই। কোনোরকম সাড়াশব্দ নেই। পুরানো একটি বাড়ি। ভাঙা বেড়া। মুরগির ঘরে কক কক করে ডাকছে মুরগিগুলো। বাড়িটি বুড়ো চাষি আলসোপের। রাফরতি কাঠের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন। কয়েকটা কাঠবেড়ালি ছুটে গেল। না, দুর্ঘটনার কোনো চিহ্নই তো সেখানে দেখা যাচ্ছে না। তবে কি টেলিফোনে কেউ মিথ্যে খবর দিল? রসিকতা করল? সবুজ প্রান্তরে তো আর কোনো খামার বাড়ি নেই।

বুড়ো আলসোপ রাফারতিকে দেখে এগিয়ে এলেন। এতক্ষণ বাগানে গাজর আর লেটুস পাতা তুলছিলেন।

রাফারতি জিজ্ঞেস করে,

-আচ্ছা, এ বাড়ির কাছাকাছি কি কোনো উড়োজাহাজ ভেঙে পড়েছে?

-কই, না তো।

এমন সময় ভেতর থেকে মিসেস আলসোপ বেরিয়ে এলেন। রাফারতি খানিকটা বিস্মিত।

-একজন লোক আমাকে ফোন করে জানাল এই মাঠে নাকি একটি জ্বলন্ত বিমান ভেঙে পড়েছে। মৃদু হাসলেন মিসেস আলসোপ।

-এই কথা। খবরটা সত্যি। তবে বিমানটা ভেঙে পড়ে নি। নিজের থেকেই এ মাঠে নেমে এসেছে। আর ওটা তো কোনো বিমান নয়। কারণ ওটার কোনো ডানা নেই।

রাফারতি কথাগুলো ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না।

-আপনি বলছেন এখানে বিমান নেমেছে। আবার বলছেন তার ডানা নেই।

-তা আপনি নিজে গিয়েই দেখে আসুন না ওটার ডানা আছে কি নেই। ঐ তো গোলাবাড়ির কাছেই রয়েছে ওটা। ওটার মালিকেরা কিন্তু আবার অদ্ভুত ধরনের। দেখতে বিচিত্র। ওরা হাতুড়ি দিয়ে লোহাকে বাঁকিয়ে দিতে পারে।

ঝানু সাংবাদিক রাফারতি এবার ব্যাপারটার ভেতরে একটা রহস্যজনক খবরের সূত্র খুঁজে পেলেন। মিসেস আলসোপ স্বামীকে বললেন, -তুমি ভদ্রলোককে গোলাবাড়ির কাছে নিয়ে যাও। সাবধানে যেও কিন্তু। জায়গাটা আবার কাদায় ভরা। কাঠের তক্তার উপর দিয়ে যাবে।

নড়বড়ে কাটের তক্তার উপর দিয়ে যেতে যেতে বুড়ো আলসোপ বলতে লাগল,

-বুঝলেন, আমার খামারে রয়েছে উন্নত জাতের মুরগি। খুব চাহিদা এদের। আপনার কী মনে হয় উপরের তারার দেশে ওগুলো বেশ ভালো চলবে?

কথাটা ঠিক বুঝতে পারলেন না রাফারতি। একবারে তাকালেন আকাশের দিকে।

-আপনি কোন দেশের কথা বলছেন? আমি বলছি উপরের তারার দেশের কথা। রাফারতির তখন মনে হলো বুড়ো চাষি তার সাথে নির্ঘাত রসিকতা করছে। নয়ত তার মাথায় ছিট রয়েছে।

গোলাবাড়ির দরজার কাছে এসে তারা পৌঁছালো। পুরানো জংধরা দরজা। পাল্লায় মরচে পড়েছে। মি. আলসোপ বললেন,

-একটু জোরে ধাক্কা দিতে হবে যে। তা নইলে খুলবে না। রাফারতি বেশ জোরে ধাক্কা দিলেন। ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে খুলে গেল দরজাটা। ভেতরে তাকিয়ে রীতিমতো বিস্মিত হলেন রাফারতি। একি দেখতে পাচ্ছেন তিনি! ঘরের মধ্যে রয়েছে একটা বিরাট আকারের প্লাস্টিকের বেলুন। মাথার দিকটা গোল। নিচের দিকটা চ্যাপটা। নিচের অংশটা রয়েছে বড় বিছানো মেঝেতে। রাফারতির মনে হলো তিনি একটি মহাকাশযান দেখছেন। পত্রিকার জন্যে বেশ একটা জবর খবর হবে। স্থানীয় চাষি কর্তৃক চাঁদে অভিযানের জন্যে মহাকাশযান তৈরি।

রাফারতি কৌতূহলী।

-আপনি এই বেলুনযানটি তৈরি করেছেন?

-মোটেই না। আমার ক্ষমতাই হবে না এ রকম একটি জিনিশ বানাতে। এতে করে আমাদের কয়েকজন বন্ধু এসেছে উপর থেকে।

-বন্ধু এসেছে কথাটা বুঝতে পারলেন রাফারতি। কিন্তু খটকা লাগল তারা উপর থেকে এসেছে শুনে। কি সব উদ্ভট কথা বলে তার মাথাটাকে একদম ঘুলিয়ে দিতে চাইছে এই বুড়ো চাষিটা।

-তা আপনার এই বন্ধুদের পরিচয়টা কি?

আলসোপ কথা বলে মাথা ঝাকিয়ে।

-তাদের পরিচয় এখনো জানতে পারি নি। তারা কথা বলে না। দেখতে ভীষণ অদ্ভুত।

বিশাল বেলুনটা ঝকঝক করছে। কেমন রহস্যময় এক ধরনের চাপা আলো বেরুচ্ছে ওটা থেকে। রাফারতি এ ধরনের জিনিশ আগে আর কখনো দেখেন নি। বেলুনটা ঠিক কি দিয়ে যে তৈরি তাও তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না। তবে প্লাস্টিক যে নয় তাতে নিশ্চিত। রাফারতি আরেকটু কাছে যেতেই ব্যথায় চিৎকার করে উঠলেন। তিনি একটি শক্ত জিনিশের সাথে ধাক্কা খেয়েছেন। তার মনে হলো তিনি যেন একটা বৈদ্যুতিক শক খেলেন। শরীরটা তখনো কাঁপছে।

বৃদ্ধ আলসোপ লজ্জিত স্বরে বলে

-আমি বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম ঐ বেলুনের চারপাশে একটা অদৃশ্য দেয়ালের মতো জিনিশ রয়েছে। ওতে ধাক্কা খেলে বেশ যন্ত্রণা হয়। দেয়ালটা আবার চোখেও দেখা যায় না।

অদৃশ্য দেয়াল! তার সামনে। রাফারতির বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ছে। দূর থেকে মুরগির ডাক শোনা যাচ্ছে।

-আপনার ঐ অদ্ভুত বন্ধুরা কোথায়?

-বাড়ির ভেতরে আছে। ইচ্ছে করলে দেখা করতে পারেন। তবে তাদের সাথে কোনোরকম কথাবার্তার আদান প্রদান করা যায় না।

-চলুন তো দেখে আসি। কোন দেশের লোক তারা।

ওরা দু’জন খামার বাড়ির দিকে চলা শুরু করল। কাদাতে পুরো আঙিনা থিকথিক করছে। কাঠের তক্তাগুলোর ওপর দিয়ে খুব সাবধানে হেঁটে যেতে হচ্ছে।

বৃদ্ধ আলসোপ রাফারতিকে বোঝাতে চাইছে, -আপনি ওদের দেখলে অবশ্যই চমকে যাবেন। আশ্চর্য হয়ে যাবেন। প্রথমে ওরা এলো ছ’বছর আগে। এসে কিছু ডিম চাইল। আমরা তো ডিমেরই ব্যবসা করি। এদের ধারণা যেখানে ওরা থাকে সেখানে ডিমগুলো নিয়ে গিয়ে উন্নত জাতের মুরগির বাচ্চা তৈরি করা যাবে।

-ওরা থাকে কোথায়?

-সেটাই তো বিস্ময়ের কথা। ওরা যেখানে থাকে সেখানে যেতে লাগে তিন বছর।

-মানে! আলসোপ তাকায় আকাশের দিকে।

ঐ তারার দেশ থেকে এসেছে তারা। সে বারের যাত্রার সময় ডিমগুলো পচে গিয়েছিল। তাই এবার আবার এসেছে নতুনভাবে ডিম নিতে। আমি এবার খুব শক্ত একটা বাক্স তৈরি করে দিয়েছি। এতে যাবার পথে ডিম ফুটে বাচ্চা হতে পারবে। কোনো অসুবিধা হবে না।

বৃদ্ধ আলসোপের কণ্ঠে তখন আবেগ।

-ভাবনু তো একবার দৃশ্যটা। আকাশপথে তীব্র গতিতে ছুটে যাচ্ছে ওদের বেলুন। তার ভেতরে রয়েছে আমার খামারের ডিম থেকে বেরুনো মুরগির বাচ্চার দল। চিকচিক করছে। ওরা চলেছে মহাশূন্যের পথে তারার দেশে।

রাফারতির তখন মনে হলো বুড়ো চাষিটার মাথা খারাপ।

খামার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিলেন মিসেস আলসোপ। হাতে ধরা বেতের ঝুড়িতে রঙিন ব্যাঙের ছাতা। খাবারের স্যুপ তৈরির জন্যে মাঠ থেকে তুলে এনেছে। রাফারতিকে দেখে বললেন,

-দেখেছেন তো ওদের বেলুনটা। চমৎকার না?

মি. আলসোপ বললেন, -আপনি ওদের সাথে দেখা করার সময় আমার স্ত্রীর সাথে যাবেন। আমার স্ত্রী আবার ওদের সাথে ভাবের আদান প্রদান করতে পারে। ওরাও তাকে যথেষ্ট পছন্দ করে।

ঘরের ভেতর ঢুকে ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন রাফারতি। এ তিনি কাদের দেখতে পাচ্ছেন! ঘরে দু’জন আগন্তুক বসে আছে। একজন পুরুষ অন্য জন নারী। বিচিত্র তাদের আকৃতি। তাদের দেহে সরু শুঁড় লিকলিক করে দুলছে। তাদের মুখের রঙ বেগুনি। মুখে কোনো আবেগের চিহ্ন নেই। প্রত্যেকের মুখে বড় বড় দুটি গোল চোখ। মনে হয় ওরা বুঝি মুখে বিচিত্র মুখোশ সেঁটে রেখেছে।

রাফারতি তার অভিজ্ঞ চোখ দিয়ে বুঝতে পারলেন এই আগন্তুক পৃথিবীর কোনো বাসিন্দা নয়। এরা গ্রহান্তরের প্রাণি। দারুণ বিস্ময়ে সে হতবাক হয়ে গেছে। এই রকম একটি দুর্লভ দৃশ্য জীবনে দেখবে কখনো ভাবে নি। দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে কম উত্তেজনাময় দৃশ্য দেখে নি। সব কিছু এই ঘটনার কাছে যেন ম্লান হয়ে গেল।

মিসেস আলসোপ বললেন,

-এরাই এসেছে ঐ বিমানে করে। অদ্ভুত আগন্তুকেরা তখন শুঁড় বাঁকালো। মিসেস আলসোপ এগিয়ে এলেন।

-বুঝলেন মি. রাফারতি, এরা কিন্তু কথা বলতে পারে না। কেবল ছবি তৈরি করতে পারে। এই যে দেখছেন মাথার উপর দুটো শুঁড় সে দুটো কারো দিকে লক্ষ্য করে এগিয়ে দিয়ে ওরা যা চিন্তা করে তাই ভাবতে থাকে। ওদের প্রশ্ন করলে উত্তরে ওরা আপনার চিন্তার ক্ষেত্রে ছবি পাঠিয়ে দেবে।

রাফারতি বুঝলেন এই আশ্চর্য পদ্ধতির মাধ্যমেই গ্রহান্তরের প্রাণিরা সংযোগ স্থাপন করবে। রাফারতি তাদের কাছে জানতে চাইলেন ওরা কোথা থেকে এসেছে। মেয়ে আগন্তুক তখন সাড়া দিল। তার মাথার শুঁড় রাফারতির কপালের মাঝখানের জায়গাটা লক্ষ্য করল।

তখন রাফারতির ভেতরে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেল। রাফারতির মনে হলো তার মস্তিষ্কে বেশ কিছু ছবির জন্ম হচ্ছে। ধীরে ধীরে রঙ রেখা ফুটে উঠছে। সে দেখতে পাচ্ছে সীমাহীন মহাশূন্য। নক্ষত্র, গ্রহ আর উল্কাপিণ্ডগুলো তীব্র গতিতে ছুটে যাচ্ছে। রাফারতিও ছুটে যাচ্ছে সেই সাথে। তার শরীর শিহরিত হচ্ছে। এক সময় এসে পড়ল এক উজ্জ্বল তারার জগতে। আলোতে ঝলমল করছে চারদিক। তারপর ছবিটা অদৃশ্য হয়ে গেল।

রাফারতি আবার ফিরে এলো খামার বাড়িতে। তার শরীর তখন থরথর করে কাঁপছে। স্নায়ুর উপর প্রবল চাপ পড়েছে।

রাফারতির মনে হলো পৃথিবীর ইতিহাসের এক বিস্ময়কর ঘটনাকে সে আজ প্রত্যক্ষ করল। সবচাইতে মূল্যবান, উত্তেজনাময়, শিহরণমূলক খবরটি সে এখন সংগ্রহ করল। নিরিবিলি সবুজ প্রান্তরের ছোট্ট খামার বাড়িটির একটি ঘরে ঘটে গেল এই চরম বিস্ময়কর ঘটনাটি। নাটকীয়তার দিক থেকে যার কোনো তুলনা হয় না। তখনো বিস্ময়ের ঘোর কাটে নি রাফারতির। এই অকল্পনীয় খবরটা জানাতে হবে পাঠকদের। তারা রুদ্ধশ্বাসে এটা পাঠ করবে। উত্তেজনায় তখন কাঁপছে রাফারতির শরীর।

-মি. আলসোপ, আপনাদের ফোনটা কোথায়? আমাকে এখনি অফিসে খবর পাঠাতে হবে।

-দুঃখিত, আমাদের কোনো ফোন নেই। কিছু দূরে পেট্রোল পাম্প রয়েছে। সেখান থেকে ফোন করা যেতে পারে। কিন্তু এরা যে কয়েক মিনিটের মধ্যেই চলে যাবে। ওদের বেলুনে মুরগির বাচ্চা আর ডিমগুলো তুলে দেয়া হয়েছে। ওদের আর কোনো কাজ নেই এখানে। আকাশে উড়বে এখনি।

রাফারতি ওদের চলে যাওয়ার কথা শুনে চমকে উঠলেন। কি করে এদের কিছুক্ষণ এখানে আটকে রাখা যায়। অন্তত ছবি তোলা বা পত্রিকার অফিসে খবর দেয়া পর্যন্ত। ঘটনাটার একটা সাক্ষ্য প্রমাণ তো রাখতে হবে পাঠকদের বিশ্বাসযোগ্যতার জন্যে।

-মিসেস আলসোপ, ওদের কিন্তু এখন যেতে দেবেন না। আরো কিছুক্ষণ থাকতে বলুন।

-বৃথা চেষ্টা হবে। একটা নির্দিষ্ট সময়ে ওদের যাত্রা করতেই হবে। আকাশের এই বিশেষ জায়গায় চাঁদ এসে পড়লেই ওদের বেলুন আকাশে উড়বে।

গ্রহান্তরের রহস্যময় প্রাণিরা চুপচাপ বসে আছে। তারা এখন কোনো পৃথিবীবাসীর মস্তিষ্কে তাদের চিন্তার তরঙ্গ প্রেরণ করছে না।

রাফারতি অস্থির হয়ে উঠলেন। এত বড় খবর প্রকাশের একটা সুযোগ এভাবে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এরকম সুযোগ এখন পর্যন্ত কোনো সংবাদদাতার কাছে আসে নি। চিৎকার করে উঠলেন রাফারতি।

-মি: আলসোপ, আমাকে একটা ক্যামেরা এনে দিন। যে কোনো ক্যামেরা।

মাথা চুলকে বললেন আলসোপ।

-তাই তো, কোথায় যে রেখেছি আমার বক্স ক্যামেরাটাকে। দেখি খুঁজি।

রাগে, হতাশায় নিজের মাথার চুল তখন ছিড়তে ইচ্ছে করছে রাফারতির। একটি সুবর্ণ সুযোগ তার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। গ্রহান্তরের প্রাণিদের ছবি তুলে রাখতে পারলে এক অবিস্মরণীয় ব্যাপার হতো। পৃথিবীর লোকেরা এসব ছবি দেখে স্তম্ভিত হয়ে যেত।

গ্রহান্তরের প্রাণিরা বসে আছে। আর কিছুক্ষণ পর এরা উড়ে যাবে মহাশূন্যে। সুদূর এক তারার গ্রহজগৎ থেকে এসেছে ওরা।

পাশের কক্ষ থেকে মি, আলসোপের গলা শোনা গেল। বক্স ক্যামেরাটা খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু ফিল্ম যে নেই। কাজেই ছবি তোলা যাবে না।

গ্রহান্তরের প্রাণিরা চট করে উঠে পড়ল। তারপর জোনাকির মতো উড়ে ঘর থেকে বাইরে গেল। ওরা গেল গোলাবাড়ির দিকে। রাফারতি ছুটল ওদের পিছু পিছু।

আঙিনায় যেতে যেতেই দেখল গোলাবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে বিশাল বেলুনটা। হিসহিস শব্দ হচ্ছে। একটা চক্কর মেরে সাঁই করে বেলুনটা উড়ে গেল। নিমিষেই মেঘের আড়ালে চলে গেল।

প্রবল হতাশা এসে গ্রাস করল রাফারতিকে। গ্রহান্তরের প্রাণিদের আগমনের কোনো চিহ্ন তিনি রাখতে পারলেন না। কেউ এখন তার এই সংবাদকে বিশ্বাস করবে না। এই প্রাণিরা সবুজ প্রান্তরের মি. আলসোপের খামার বাড়ি থেকে অনেকগুলো মুরগির ডিম নিয়ে গেছে। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে ঐ প্রাণিরা আলসোপ দম্পতির কাছে কোনো নিদর্শন রেখে গেছে।

রাফারতি ছুটে এলেন মি, আলসোপের কাছে।

-আচ্ছা, ওরা কি কখনো আপনাদের কিছু দিয়েছে? কোনো উপহার?

-ছ’বছর আগে যখন প্রথম এসেছিল তখন আমাদের কিছু ডিম দিয়েছিল। ওদের দেশের ডিম।

-কি রকমের ডিম?

-অদ্ভুত আকারের। ওদের ডিম থেকে যখন বাচ্চা হলো তখন সেগুলোর নাম দিলাম তারার দেশের হাঁস। ডিমগুলো আকার ছিল তারার মতো ছুঁচলো।

-ঐ তারা হাঁস কি রকম ছিল?

-বিচ্ছিরি দেখতে। অনেকটা সোয়ালো পাখি আর ছোট জলহস্তীর মতো। ঐ অদ্ভুত প্রাণিদের পা ছিল তিন জোড়া। মাত্র দুটো তারার হাঁস বেঁচে গিয়েছিল।

-কোথায় সে দুটো? আমরা খেয়ে ফেলেছি। বড় দিনের উৎসবের সময়।

না, কোনোমতেই এখান থেকে কোনো রকমের নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে না।

শেষ চেষ্টা করলেন রাফারতি। ঐ তারার হাঁস দুটোর কঙ্কাল কোথায় রয়েছে? দেখতে চাই। ঐ হাঁস দুটোর হাড় আমাদের পোষা কুকুরকে দিয়েছিলাম।

রাফারতি হতাশ হয়ে খামার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। মেঘলা আকাশ। সবুজ প্রান্তরের বুকে হু হু করে বাতাস বইছে। দুলছে ঘাসবন। আকাশের দিকে তাকালেন রাফারতি। মহাকাশযানটা এতক্ষণে বহু দূর চলে গিয়েছে। পৃথিবীতে তাদের আসার কোনো প্রমাণ নেই।

মাথার উপর দিয়ে এক ঝাঁক বুনোহাঁস উড়ো গেল। রাফারতি একবার পেছন ফিরে তাকালেন খামার বাড়িটির দিকে। ঐ বাড়িতে জন্মেছিল তারার দেশের হাঁস।

নিজের গাড়ির দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন রাফারতি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *