১৬. রবীন্দ্রজীবনের ষোড়শ বৎসর

যোড়শ অধ্যায়
১২৮৩ [1876-77] ১৭৯৮ শক ॥ রবীন্দ্রজীবনের ষোড়শ বৎসর

আমরা আগেই বলেছি, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে যদিও Mar 1876 পর্যন্ত বেতন দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত ঐ বছরের শুরু থেকেই স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন; আর এপ্রিল মাস থেকে তো বেতন দেওয়াই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং বর্তমান বৎসরে রবীন্দ্রনাথ বিধিবদ্ধ পড়াশুনোর সমস্ত বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে পড়লেন। অবশ্য সোমেন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদ যথারীতি ঐ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হিসেবে এন্ট্রান্স ক্লাসে থেকে গিয়েছিলেন। উপরন্তু জুন মাস থেকে দ্বিপেন্দ্রনাথ ও অরুণেন্দ্রনাথকেও সেখানে ভর্তি করে দেওয়া হয়। গৃহশিক্ষকের ক্ষেত্রেও কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ২০ মাঘ ১২৮২ তারিখে রামসর্বস্ব বিদ্যাভূষণ কর্মত্যাগ করায় চৈত্র মাস থেকে দিননাথ ন্যায়রত্ন সংস্কৃত শিক্ষক নিযুক্ত হন। জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্যও ৯ বৈশাখ [বৃহ 20 Apr] পর্যন্ত কাজ করে কর্মত্যাগ করেন*; পরের দিনই মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্রজনাথ দে ‘সোমবাবুদিগের ইংরাজি পড়াইবার মাষ্টার’ হিসেবে মাসিক কুড়ি টাকা বেতনে নিযুক্ত হন। স্কুলের বন্ধন থেকে মুক্ত হলেও গৃহশিক্ষক রবীন্দ্রনাথকে মুক্তি দিতে চাননি। তিনি লিখেছেন : ‘তিনি [ব্রজবাবু] আমাকে প্রথমদিন গোল্‌ড্‌স্মিথের ভিকর অফ ওয়েক্‌ফীল্‌ড্‌ হইতে তর্জমা করিতে দিলেন। সেটা আমার মন্দ লাগিল না; তাহার পরে শিক্ষার আয়োজন আরও অনেকটা ব্যাপক দেখিয়া তাঁহার পক্ষে আমি সম্পূর্ণ দুরধিগম্য হইয়া উঠিলাম।’ রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-র দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপিতেও লিখেছিলেন : ‘[ব্রজবাবু] কয়েকদিন আমাকে পড়াইবার অসাধ্য চেষ্টাও করিয়াছিলেন।‘ অথচ মানুষ হিসেবে ব্রজবাবু খুব আকর্ষণীয় ছিলেন; সরলা দেবীর স্মৃতিকথায় তাঁর একটি চিত্র পাই: ‘ওঁদের [দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্র-কন্যাদের] মাস্টারমশায় ছিলেন “স্যর্‌”—মেট্রপলিটনের হেডমাস্টার [সুপারিন্টেন্ডেন্ট] ব্রজবাবু। অতি সরস, অতি সহাস্য, অতি মজাড়ে লোক। তাঁর কোনোই শাসন ছিল না, বরঞ্চ অহেতুক পুরস্কার ছিল। তাঁর শাসনপ্রবৃত্তি মেট্রপলিটনের ছাত্রদের উপর দিয়েই নিঃশেষিত হত। তাদের কাছ থেকে শাস্তিস্বরূপ বাজেয়াপ্ত করা ছুরি, রঙীন পেন্‌সিল প্রভৃতি কিছু না কিছু পকেট থেকে ফস্ করে বাড়ির পড়ুয়াদের দেখিয়ে ও দিয়ে তিনি তাদের আনন্দে আনন্দ পেতেন।’ [রবীন্দ্রনাথও তাঁর সম্বন্ধে অনুরূপ বর্ণনা দিয়েছেন, তা আমরা পরে দেখব।] বোঝা যায়, অভিভাবকেরা সম্পূর্ণ হাল ছেড়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন না, স্কুলের বন্ধন থেকে মুক্তি দিলেও অন্যভাবে পড়াশোনার গণ্ডির মধ্যে তাঁকে বেঁধে রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সকলের পক্ষেই ‘দুরধিগম্য’ হবার জন্য রবীন্দ্রনাথ সহজ পথটাই বেছে নিয়েছেন, তিনি জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি আবার শিলাইদহে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করলেন—১৯ জ্যৈষ্ঠ [বুধ 31 May 1876]-এর হিসাবে দেখি ‘রবীবাবু মহাশয় বিরাহিমপুর/বেড়াইতে জাওয়ার ট্রেণ ভাড়া…৭।৵৹’। ১৪ জ্যৈষ্ঠ ‘ছোট বাবুর [জ্যোতিরিন্দ্রনাথ] নিকট সেলাইদহায় নূতন বধু ঠাকুরাণীর এক পত্র পাঠান টিকিট’ বাবদ ব্যয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়—যা সেখানে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উপস্থিতিরই প্রমাণ। সম্ভবত এবারেও রবীন্দ্রনাথ সেখানে প্রায় মাসখানেক ছিলেন, কারণ ‘ভবানীপুর ব্রাহ্মসমাজের সাম্বৎসরিক সভায়/গত ৯ আষাঢ় বড় বাবু মহাশয়ের ও/সত্যবাবু ও সোমবাবু মহাশয়দিগের/জাতাতের দুইখানা গাড়ি ভাড়া’—এই হিসাবের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। আবার আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সময়েই তিনি ফিরে এসেছিলেন বলে মনে হয়, তার কারণ জুলাই মাসে তাঁর জন্যে একজন ড্রয়িং শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছেন বলে দেখা যায় ১৬ ভাদ্রের হিসাবে : ‘ব° কালীদাস পাল ড্রইং মাষ্টার/রবিবাবুর ড্রইং শিক্ষার জন্য/উক্ত মাষ্টারের ১৮৭৬ সালের জুলাই/বেতন শোধ বিঃ এক বৌচর/গুঃ খোদ ৮৲’ জুলাই মাসের পুরো বেতনই যখন তাঁকে দেওয়া হয়েছে, তখন মনে হয় মাসের শুরু থেকেই তিনি শিক্ষকতা কার্যে ব্রতী হয়েছিলেন, নতুবা ঠাকুরবাড়ির রীতি অনুযায়ী পুরো বেতন তিনি পেতেন না। কিন্তু সম্ভবত তিনি এই এক মাসই রবীন্দ্রনাথকে ড্রয়িং শিক্ষা দিয়েছিলেন, কারণ এই খরচের পুনরাবৃত্তি আর দেখা যায় না। চিত্রবিদ্যার দিকে ঝোঁক রবীন্দ্রনাথের বরাবরই ছিল, পরবর্তীকালে ইন্দিরা দেবীকে ৩০ আষাঢ় ১৩০০ [13 Jul 1893] তারিখে লেখা একটি চিঠিতে তার ইঙ্গিত রয়েছে :‘লজ্জার মাথা খেয়ে সত্যি কথা যদি বলতে হয় তো এটা স্বীকার করতে হয় যে, ঐ-যে চিত্রবিদ্যা ব’লে একটা বিদ্যা আছে তার প্রতিও আমি সর্বদা হতাশ প্রণয়ের লুব্ধ দৃষ্টিপাত করে থাকি—কিন্তু আর পাবার আশা নেই, সাধনা করবার বয়স চলে গেছে। অন্যান্য বিদ্যার মতো তাঁকে তো সহজে পাবার জো নেই—তাঁর একেবারে ধনুক-ভাঙা পণ; তূলি টেনে টেনে একেবারে হয়রান না হলে তাঁর প্রসন্নতা লাভ করা যায় না।’ বর্তমান সময়ে হয়তো এরূপ হয়রান হয়েই তিনি ড্রয়িং-চর্চা ত্যাগ করেছিলেন, শুধু কিছু কিছু নিদর্শন থেকে গেছে ‘মালতীপুঁথি’ নামক সমসাময়িক পাণ্ডুলিপির কোনো কোনো পৃষ্ঠায়। এর আগে রবীন্দ্রনাথের চিত্রবিদ্যার চর্চা সম্পর্কে ১২৮১ বঙ্গাব্দের বিবরণে আমরা কিছু কিছু তথ্য উল্লেখ করেছি।

বর্তমান বৎসরের ক্যাশবহি-র রবীন্দ্রনাথ-সংক্রান্ত হিসাবগুলি খুঁটিয়ে পর্যালোচনা করলে যে-জিনিসটি আমাদের সর্বাধিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সেটি হল তাঁর চিকিৎসার প্রসঙ্গটি। ১২৮২ বঙ্গাব্দেও রবীন্দ্রনাথ ব্ৰজেন্দ্র কবিরাজের [ব্রজেন্দ্রকুমার সেন] চিকিৎসাধীনে ছিলেন, সেকথা আমরা যথাস্থানে উল্লেখ করেছি এবং মন্তব্য করেছি যে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে পালাবার উপায় হিসেবেই তিনি হয়তো অসুস্থতার ছলনা সৃষ্টি করে থাকবেন। কিন্তু বর্তমান বৎসরে তো স্কুলের উপদ্রব ছিল না, ব্রজবাবু যেটুকু অসুবিধা ঘটিয়েছিলেন তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বৎসরব্যাপী অসুস্থতার ভান করার দরকার ছিল না। সুতরাং বিশ্বাস করতে হয় যে সত্য সত্যই তাঁর ক্ষেত্রে দীর্ঘ চিকিৎসার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। কিন্তু বাল্য ও কৈশোরের নীরোগ স্বাস্থ্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথ এতবার এত জায়গায় গর্ব প্রকাশ করেছেন যে, তার সঙ্গে এই তথ্যকে খাপ খাওয়ানো মুশকিল হয়ে পড়ে। তাছাড়া ক্যাশবহি-র শুষ্ক হিসাবগুলি আমাদের চিকিৎসার খবরটুকুই শুধু জানায়, কী রোগের জন্য চিকিৎসা সে-সম্পর্কে আন্দাজ করবার মতো কোনো সুযোগ দেয় না। এই সব হিসাব থেকে জানা যায় জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় [Jun 1876] মাসে রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহে ছিলেন, তখন কলকাতা থেকে ডাকে ওষুধ পাঠানো হয়; ভাদ্র মাসে ব্রজেন্দ্রকুমার সেন কবিরাজকে ‘রবিবাবুর চিকিৎসার ঔষধ’ ও দ্বারকানাথ রায় কবিরাজকে ‘রবিবাবুর চিকিৎসার জন্য ঘৃতের মূল্য’ দেওয়া হয়, একটি খলও কেনা হয় ‘রবীবাবুর পীড়ার জন্য’; ১৯ আশ্বিন হিসাবে লেখা হয় ‘রবিবাবুর পীড়ার চিকিৎসার জন্য/কবিরাজের জাতাতের গাড়িভাড়া/এক বৌচর ৪ ভাদ্র না° ২ আশ্বিন শোধ/১০।।০ ও ঔষধের মূল্য ১৫ ভাদ্র না°/১১ এগারই আশ্বিন শোধ দ্বারকানাথ রায়/কবিরাজকে দেওয়া হয় এক বৌচর/১৬, একুনে…২৬॥০’; কার্তিক মাসেও দুবার ঔষধ ক্রয়ের উল্লেখ দেখা যায়। অগ্রহায়ণ মাস থেকে একটি নূতন ধরনের খরচ দেখা যায়; ৪ অগ্র হিসাবে দেখি : ‘রবীবাবুর জন্য বিয়ার ক্রয়/এক ডজন মায় মুটে…8।৴ ৬’, ২৪ ফাল্গুনের হিসাব : ‘রবীবাবুর বিয়ার ক্রয় ২। ১৯ মাঘ ও ১০ ফাল্গুন তিন ডজন ক্রয়/১২।৴৹’, আবার ১২ চৈত্রের হিসাবে দেখা যায় ‘রবীবাবুর পীড়া হওয়ায়/সোডাওয়াটার লেমনেড বরফ ও হোমিয়পাথী/ঔষধ ক্রয় বিঃ এক বৌচর/৭৸৴৹০’ এবং ‘উক্ত বাবুর বিয়ার ক্রয়/২৬ ফাল্গুনের এক বৌচর শোধ/৪ ৵৹’। প্রচুর পরিমাণে বিয়ার কেনা হয়েছে; যদিও কী উদ্দেশ্যে এগুলি কেনা তার কোনো উল্লেখ নেই, তবু আমরা অনুমান করতে পারি এগুলি নেশার প্রয়োজনে নয়, ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হবার জন্যেই আনা হয়েছিল—সোডাওয়াটার লেমনেড বরফ ও হোমিয়পাথী ঔষধ ক্রয়ের উল্লেখ এই অনুমানকেই সমর্থন করে। চিকিৎসা-বিদ্যা সম্পর্কে অভিজ্ঞ আমাদের এক বন্ধু জানিয়েছেন, সেই সময়ে বিয়ার স্নায়বিক রোগের ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হত। কবিরাজী ঔষধ ও ঘৃতও একই কারণে ব্যবহৃত হতে পারে। সম্ভাবনাটি আমাদের চমকিত করে। রবীন্দ্রনাথের মামা ব্রজেন্দ্রনাথ রায়ের মস্তিষ্কবিকৃতি ছিল, তাঁর দাদা বীরেন্দ্রনাথ ও সোমেন্দ্রনাথও উন্মাদরোগে আক্রান্ত হন, ভ্রাতুষ্পুত্র কৃতীন্দ্রনাথও সাময়িকভাবে এর শিকার হয়েছিলেন। প্রতিভা ও উন্মত্ততার মধ্যে পার্থক্য সামান্যই। রবীন্দ্রনাথ ‘পাগল’ প্রবন্ধে খ্যাপা-মহেশ্বরের প্রশস্তি করে লিখেছেন : ‘পাগলও ইঁহারই কীর্তি এবং প্রতিভাও ইঁহারই কীর্তি। ইঁহার টানে যাহার তার ছিঁড়িয়া যায় সে হয় উন্মাদ, আর যাহার তার অশ্রুতপূর্বে সুরে বাজিয়া উঠে সে হইল প্রতিভাবান।’ এ সবই জল্পনা—কিন্তু যেটি আমাদের বিস্মিত করে, সেটি হল পারিবারিক চিকিৎসক হিসেবে ইংরেজ চিকিৎসক ডাঃ কেলী ও বাঙালি চিকিৎসক ডাঃ নীলমাধব হালদার নিযুক্ত থাকা সত্ত্বেও তাঁদের চিকিৎসার কোনো উল্লেখ না থাকা। অবশ্য ঔষধ হিসেবে বিয়ার ব্যবহারের নির্দেশ তাঁরাও দিয়ে থাকতে পারেন।

আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন হয়েছিল ২৫ মাঘ ১২৭৯ [বৃহ 6 Feb 1873) তারিখে। দেবেন্দ্রনাথ পুত্রদের ও দৌহিত্রের উপনয়ন দিয়েছিলেন অনেকটা কেশবচন্দ্রের বর্ণাশ্রমবিরোধী ক্রিয়াকলাপের প্রতিক্রিয়ায়। নতুবা ব্রাহ্মদের জন্য তিনি যে অনুষ্ঠান-পদ্ধতি রচনা করেন, সেখানে ব্রাহ্মণসন্তানদের জন্যও উপনয়ন-সংস্কারের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সেখানে উপনয়ন নামে যে ক্রিয়ার বর্ণনা আছে, তা কেবল ব্রাহ্ম-উপদেষ্টার কাছে কোনো বালককে এনে তাঁর উপর তার ধর্মশিক্ষার ভার অর্পণ করা। এই পদ্ধতি অনুসারে প্রথম ব্ৰহ্মদীক্ষার আয়োজন করা হয় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে ১০ আষাঢ় ১২৭১ [27 Jun 1864] তারিখে। ঠাকুরপরিবারে দ্বিতীয় বার এই আয়োজন করা হল এই বৎসর রবীন্দ্রনাথ, সোমেন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদের বেলায়। এর আগে অবশ্য বর্ণকুমারীর এবং বর্তমান বৎসরে দ্বিজেন্দ্রনাথের কন্যা সরোজার বিবাহের সময় জামাতাদের ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করতে হয়েছিল, কিন্তু তা ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ, ব্রহ্মদীক্ষার সঙ্গে তার কিছু পার্থক্য আছে। রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ ত্রয়ীর ব্ৰহ্মদীক্ষা হয় সম্ভবত অগ্রহায়ণ মাসে। ঠিক কোন্ তারিখে এই অনুষ্ঠান হয়, তা নির্দিষ্ট করে বলার মতো তথ্য আমাদের হাতে নেই। ক্যাশবহি-তে এ-সম্পর্কে তিনটি হিসাব দেখতে পাওয়া যায় : ২৫ কার্তিক [বৃহ 9 Nov]‘সোম রবীবাবুর দিক্ষা উপলক্ষে খরচ জন্য—৩০৲’, অগ্রিম দেওয়া হয়, ১ অগ্রহায়ণ [বুধ 15 Nov] ‘সোমবাবুদিগের দীক্ষার ব্যয় ১৩৬৲’ এবং ১৪ অগ্রহায়ণ [মঙ্গল 28 Nov] ‘ব° বেণীমাধব রায়/দ° সোম রবী ও সত্যপ্রসাদবাবুদিগের/দীক্ষার ব্যয়…৩৯৮ ৸৵ ৩’। [প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, এই বেণীমাধব রায়-ই মৃণালিনী দেবীর পিতা, রবীন্দ্রনাথের ভাবী শ্বশুর। বর্তমান বৎসরে তিনি ২৬ কার্তিক থেকে ১৫ অগ্রহায়ণ এই কুড়ি দিন মাসিক বারো টাকা বেতনে ঠাকুরবাড়ির সেরেস্তায় কাজ করেন। পরে অবশ্য তিনি আরও একবার দীর্ঘতর সময়ের জন্য এই কাজে ফিরে এসেছিলেন।] দীক্ষা-উপলক্ষে আদি ব্রাহ্মসমাজে তাঁদের দানের সংবাদ প্রকাশিত হয় তত্ত্ববোধিনী-র ফাল্গুন ১৭৯৮ শক সংখ্যাতে ২০৮ পৃষ্ঠায়। আদি ব্রাহ্মসমাজের কার্তিক-পৌষ মাসের ‘আয়ব্যয়’-এর বিবরণে দেখা যায় ‘শুভকর্ম্মের দান’ উপলক্ষে সোমেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদ প্রত্যেকে বারো টাকা করে দান করেছেন।

এই একই সময়ে রবীন্দ্রনাথকে আমরা আর একটি অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হতে দেখি। ঘটনাটি অতি তুচ্ছ, কিন্তু এই তুচ্ছ ঘটনাটির দীপালোকে অন্তঃপুরের মাধুর্যলোকের এমন একটি চিত্র উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে যে তাকে অবহেলা করাও শক্ত। ৩ অগ্রহায়ণের একটি হিসাব এইরকম : ‘ব° নূতন বধু ঠাকুরাণী/দ° সোম রবীবাবু ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার সময়/বড়দিদি ঠাকুরাণীকে প্রণাম করেন/ঐ প্রণামী টাকার হা° [হাওলাত, ঋণ] শোধ…৮৲’। পৌত্তলিকতার তীব্র বিরোধী হলেও দেবেন্দ্রনাথ ভ্রাতৃদ্বিতীয়া ইত্যাদির মতো পারিবারিক আনন্দানুষ্ঠানগুলিকে হিন্দু-গন্ধী বলে বর্জন করতে চাননি। এখানে তারই একটি নিদর্শন দেখতে পাই। মাতার মৃত্যুর পর বড়দিদি সৌদামিনী দেবী জোড়াসাঁকোর বৃহৎ পরিবারের কর্ত্রীর আসনটি অধিকার করেছিলেন। ইনি এবং নতুন বধূঠাকুরাণী কাদম্বরী দেবী তাঁদের নারী প্রাণের গভীর মমতায় মাতৃহীন বালকদের মায়ের স্থান পূর্ণ করে রেখেছিলেন। উপরের হিসাবে এই দুটি নারীকে একটি চিত্রেরই অঙ্গীভূত করে দেখা যায়। ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার অনুষ্ঠানে বড়দিদিকে প্রণাম করে ভাইয়েরা প্রণামী দিয়েছেন, আর সেই প্রণামীর টাকা ভ্রাতৃবধূ নিজের মাসোহারা থেকে সরবরাহ করেছেন—এর চেয়ে মধুর দৃশ্য আর কী হতে পারে!

এইবার রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক-জীবনের দিকে একটু দৃষ্টি ফেরানো যাক। আমরা গত বৎসরের বিবরণে দেখেছি, ‘জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব’ পত্রিকায় তাঁর ‘বনফুল’ কাব্যোপন্যাস ও ‘প্রলাপ’ কবিতাগুচ্ছ প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল। চৈত্র ১২৮২-র মধ্যেই ‘বনফুল’-এর তিনটি সর্গ ও ‘প্রলাপ’-এর দুটি গুচ্ছ প্রকাশিত হয়েছিল। বর্তমান বৎসরে এইগুলির প্রকাশতালিকাটি এই রকম:

৪। ৬, বৈশাখ,পৃ ২৭৮-৮০‘প্রলাপ’দ্র র°র°৩ [প.ব.]।১১০৮-১০
৪।৭, জ্যৈষ্ঠ,পৃ ৩১৬-১৮‘বনফুল’। ৪র্থ সর্গদ্র বনফুল,অ-১। ৭৯-৮৩
 পৃ ৩১৮-১৯‘বনফুল’। ৫ম সর্গদ্র ঐঅ-১। ৮৪-৮৬
৪। ৯, শ্রাবণ,পৃ ৪২০-২৫‘বনফুল কাব্য’। ৬ষ্ঠ সর্গদ্র ঐঅ-১। ৮৬-৯৯
৪।১০, ভাদ্র,পৃ ৪৫৮-৬১‘বনফুল কাব্য। ৭ম সর্গ’দ্র ঐঅ-১।৯৯-১০৬
৪।১২, কার্তিক,পৃ ৫৬৭-৭১‘অষ্টম স্বৰ্গ[য]। বন-ফুল কাব্য’দ্র ঐঅ-১।১০৬-১৬

[পত্রিকায় ‘স্বর্গ’ বানান আছে, ইতিপূর্বে চৈত্র সংখ্যায়ও ‘৩য় স্বর্গ’ মুদ্রিত হয়েছিল।]

পত্রিকার সংখ্যাগুলি যথাসময়ে প্রকাশিত হত বলে মনে হয় না। ১২৮৩ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ-ভাদ্র ও আশ্বিন-কার্তিক সংখ্যা যুগ্ম-সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। সাধারণী ৫ আষাঢ় [৬।১০] সংখ্যায় [পৃ ১১৫] লেখে, ‘ফাল্গুনের জ্ঞানাঙ্কুর পূর্ব্ব কয় মাসের অপেক্ষা কিছু ভাল। শেষ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত শ্রীরবীন্দ্র ঠাকুর প্রণীত “প্রলাপ” পদ্যটী সুন্দর।’ রবীন্দ্রনাথের নামোল্লেখ করে তাঁর কবিতা সম্পর্কে মন্তব্যের এইটিই প্রথম নিদর্শন। উক্ত পত্রিকার ২ শ্রাবণ [৬। ১৪] সংখ্যার ১৬৬ পৃষ্ঠায় বনফুল-এর সমালোচনা প্রকাশিত হয় : ‘চৈত্রের জ্ঞানাঙ্কুর। …“বনফুল” অতি সুন্দর। জয়দেবের লালিত্য ও শেলীর সুগন্ধ, বনফুলের ছত্রে ছত্রে পত্রে পত্রে বিরাজ করিতেছে। দুর্ভাগা বাঙ্গালায় এরূপ আলুলায়িত-কুন্তলা, স্খলিত-বসনা ললিত রচনার অভাব নাই। জয়দেবের পর্ণকুটীরে জন্মগ্রহণ করিয়া এই রচনা ক্রমে ইন্দ্রজালে প্রায় সমস্ত দেশই মুগ্ধ করিয়াছিল, এখন আবার শেলীর গীতিকাব্যের সহিত মিলিত হইয়া দ্বিগুণতর বল সঞ্চয় করিয়াছে। এবার আর বাঙ্গালির নিস্তার নাই। বাঙ্গালি তাহার স্বরচিত কাব্যের মত কর্পূরস্বভাবে, আকাশকুসুমের সহিত, নিশীথ স্বপ্নের সহিত, মিশিয়া যাইবে। এই মৃদুরসপ্লাবিত দেশে বালকে পৰ্য্যন্ত মধুর রসের ধারা ঢালিতে লাগিল, মধুসূদনের হেমচন্দ্রের ফুৎকারে আর কি ভিজা কাঠে আগুণ ধরে?’

‘প্রলাপ’ ও ‘বনফুল’ সম্পর্কে আমাদের মূল বক্তব্য আমরা আগেই বলেছি। ‘প্রলাপ’ রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে কোনো গ্রন্থভুক্ত হয়নি। ১২৯১ বঙ্গাব্দে [1884] তিনি যখন ‘শৈশব সঙ্গীত’ কাব্যগ্রন্থে তাঁর ‘তেরো হইতে আঠারো বৎসর বয়সের কবিতাগুলি প্রকাশ’ করেন, তখন ‘অভিলাষ’ ‘হিন্দুমেলায় উপহার’ ‘প্রকৃতির খেদ’ প্রভৃতি বিখ্যাত কবিতার সঙ্গে ‘প্রলাপ’-কেও তার অন্তর্ভুক্ত করেননি। রবীন্দ্র-জন্ম-শতবার্ষিকীর সময় পশ্চিমবঙ্গ সরকার-প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলী-তে ‘প্রলাপ’ সর্বপ্রথম গ্রন্থভুক্ত হয়। ‘বনফুল’ গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় 9 Mar 1880 [২৭ ফাল্গুন ১২৮৬; তারিখ বেঙ্গল লাইব্রেরির ক্যাটালগ অনুযায়ী]। গ্রন্থপ্রকাশ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-র পাণ্ডুলিপিতে লিখেছিলেন : ‘বছর তিন চার পরে দাদা সোমেন্দ্রনাথ অন্ধ পক্ষপাতিত্বের উৎসাহে এটি গ্রন্থ আকারে ছাপাইয়াও ছিলেন।‘ এর পরে কাব্যটি পুনরায় গ্রন্থভুক্ত হয় রবীন্দ্র-রচনাবলী অচলিত সংগ্রহ প্রথম খণ্ডে [আশ্বিন ১৩৪৭ : 1940]। পুস্তকাকারে মুদ্রিত কাব্যটি সম্পর্কে অন্যান্য তথ্য আমরা যথাসময়ে উপস্থিত করব।

‘বনফুল’ কাব্য জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব পত্রিকার যে-সংখ্যায় সমাপ্ত হয় [অর্থাৎ ৪।১২, কার্তিক ১২৮৩] সেই সংখ্যাতেই রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্য-সমালোচনামূলক গদ্যরচনা ‘ভুবন মোহিনী প্রতিভা, অবসর সরোজিনী/ও দু[ঃ]খ সঙ্গিনী’ [পৃ ৫৪৩-৫০] প্রকাশিত হয়। তিনি লিখেছেন : ‘প্রথম যে-গদ্যপ্রবন্ধ লিখি তাহাও এই জ্ঞানাঙ্কুরেই বাহির হয়। তাহা গ্রন্থসমালোচনা।’ [দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৩] রচনাটি তাঁর প্রথম ‘গ্রন্থসমালোচনা’ একথা ঠিক, কিন্তু ‘প্রথম গদ্যপ্রবন্ধ’ নয়, সে-মর্যাদা সম্ভবত তত্ত্ববোধিনী-তে প্রকাশিত জ্যোতিষ-বিষয়ক রচনা ‘গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি’ নামক প্রবন্ধটির প্রাপ্য।

এই প্রবন্ধটিও রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে কোনো রচনা-সংগ্রহে গৃহীত হয়নি। দীর্ঘকাল পরে বিশ্বভারতী পত্রিকা-র ১৮ বর্ষ ৪ সংখ্যা-তে [বৈশাখ-আষাঢ় ১৩৬৯। ৩১৭-২৩] পুনর্মুদ্রিত হয়। পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার-প্রকাশিত শতবার্ষিক সংস্করণ রবীন্দ্র-রচনাবলীর ১৫শ খণ্ডে ১০৬-১২ পৃষ্ঠায় ‘সম্পূরুণ’ অংশে গ্রন্থভুক্ত হয়েছে।

জীবনস্মৃতি-তে রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধটি রচনার একটি ইতিহাস দিয়েছেন। 28 Dec 1875 [১৪ পৌষ ১২৮২] ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। বইটি ভুবনমোহিনী-নাম্নী কোনো মহিলার লেখা বলে সকলের ধারণা হয়। অক্ষয়চন্দ্র সরকার-সম্পাদিত সাধারণী ও ভূদেব মুখোপাধ্যায়-সম্পাদিত এডুকেশন গেজেট সাপ্তাহিক পত্র কাব্যটির ও কবির যথেষ্ট প্রশংসা করেন।

রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বয়সে বড়ো এক বন্ধু* তাঁকে মধ্যে মধ্যে ‘ভুবনমোহিনী’ সই-করা চিঠি এনে দেখাতেন। ‘ভুবনমোহিনী’র কবিতায় তিনি মুগ্ধ হয়ে প্রায়ই কাপড় বা বই ভক্তি-উপহাররূপে পাঠিয়ে দিতেন। [আমাদের ধারণা বন্ধুর সঙ্গে কৌতুক করার প্রলোভনে রবীন্দ্রনাথ এখানে একটু অতিরঞ্জন করেছেন।] কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ধারণা ছিল অন্যরকম :‘এই কবিতাগুলির স্থানে স্থানে ভাবে ৪ ভাষায় এমন অসংযম ছিল যে, এগুলিকে স্ত্রীলোকের লেখা বলিয়া মনে করিতে আমার ভালো লাগিত না। চিঠিগুলি দেখিয়াও পত্ৰলেখককে স্ত্রীজাতীয় মনে করা অসম্ভব হইল।’ রবীন্দ্রনাথ এই বইটি এবং হরিশ্চন্দ্র নিয়োগীর ‘দুঃখসঙ্গিনী’ [20 Oct 1875] ও রাজকৃষ্ণ রায়ের ‘অবসর সরোজিনী’ [13 May 1876] অবলম্বনে এই সমালোচনা-প্রবন্ধটি রচনা করেন। ‘খুব ঘটা করিয়া লিখিয়াছিলাম।‘ খণ্ডকাব্যেরই বা লক্ষণ কী, গীতিকাব্যেরই বা লক্ষণ কী, তাহা অপূর্ব বিচক্ষণতার সহিত আলোচনা করিয়াছিলাম।’ সুবিধে ছিল এই যে, ছাপার অক্ষরে রচনা দেখে লেখকের বয়স বা বিদ্যাবুদ্ধির পরিমাণ নির্ণয় করা শক্ত। কিন্তু উক্ত বন্ধুটি উত্তেজিত হয়ে এসে জানালেন যে, একজন বি.এ. এই লেখার জবাব লিখছেন। স্কুল-পলাতক কিশোর রবীন্দ্রনাথের তখনকার মনোভাবটি অনুমেয় : ‘আমি চোখের সামনে স্পষ্ট দেখিতে লাগিলাম খণ্ডকাব্য গীতিকাব্য সম্বন্ধে আমি যে-কীর্তিস্তম্ভ খাড়া করিয়া তুলিয়াছি বড়ো বড়ো কোটেশনের নির্মম আঘাতে তাহা সমস্ত ধূলিসাৎ হইয়াছে এবং পাঠকসমাজে আমার মুখ দেখাইবার পথ একেবারে বন্ধ।’ কিন্তু তাঁর সৌভাগ্যবশত কোনো বি.এ. সমালোচক এই প্রবন্ধটির সমালোচনা করতে অগ্রসর হননি।

রবীন্দ্রনাথ এই গদ্যরচনাটি নিয়ে যে-ধরনের পরিহাস করেছেন, তা প্রবন্ধটির প্রাপ্য নয়। এতদিন ধরে কৃশকায় বাংলাসাহিত্যের পাঠ্য-অপাঠ্য প্রায় সমস্ত বই, রামায়ণ-মহাভারত, কালিদাসের কাব্য-নাটক, জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য, রাজনারায়ণ বসু ও অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর সাহায্যে পঠিত ইংরেজি কাব্যসাহিত্য চর্চার ফলে রবীন্দ্রনাথের মানস-গঠন কত পরিণত হয়ে উঠেছিল, প্রবন্ধটিতে তার পরিচয় আছে। রবীন্দ্রজীবনী-কার লিখেছেন : ‘এই প্রবন্ধে বালক-সমালোচককে মেঘদূত, ঋতুসংহার, Lalla Rookh, Irish Melodies প্রভৃতির উল্লেখ করিতে দেখি। এইসব মতামত স্বল্প ইংরেজি জ্ঞানসম্পন্ন চৌদ্দ বৎসরের বালকের লেখনী-নির্গত হওয়া সহজ নহে। আমাদের মনে হয় এই রচনায় অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর হাত না থাকিলেও তাঁহার উপদেশ ও উদাহরণমালা সরবরাহ বিষয়ে অকৃপণতা যে ছিল, তাহা প্রবন্ধটি পাঠ করিলে স্পষ্ট হইবে।’ এই মন্তব্য মেনে নিতে আমাদের আপত্তি আছে। এই পর্বে বিশেষত ইংরেজি সাহিত্যপাঠে অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর সাহায্য রবীন্দ্রনাথের কাছে কতটা মূল্যবান ছিল, তা তিনি স্বয়ংই অকুণ্ঠভাবে স্বীকার করেছেন; কিন্তু সেখানে তিনি একথাও উল্লেখ করতে ভোলেননি যে অক্ষয়চন্দ্রের কাছে যেমন ‘কত ইংরেজি কাব্যের উচ্ছ্বসিত ব্যাখ্যা’ শুনেছেন, তেমনি তাঁকে নিয়ে ‘তর্কবিতর্ক আলোচনা-সমালোচনা’ করতেও ছাড়েননি। আসলে অক্ষয়বাবুর ‘সাহিত্যভোগের অকৃত্রিম উৎসাহ’ রবীন্দ্রনাথের ‘সাহিত্যবোধশক্তিকে সচেতন’ করে তুলেছিল। বর্তমান প্রবন্ধে সেই সচেতন বোধশক্তির স্বাধীন প্রকাশ ঘটেছে। এ-প্রসঙ্গে একথাও স্মরণীয়, রবীন্দ্রনাথ ইতিপূর্বেই ‘মালতীপুঁথি’-র পৃষ্ঠায় Irish Melodies ও Byron-এর Childe Harold’s Pilgrimage থেকে কবিতা অনুবাদ করেছেন। সুতরাং প্রবন্ধটি লেখার সমকালে তাঁর মানসিক পরিণতির মাত্রা নিতান্ত কম ছিল না।

সেই যুগে পত্র-পত্রিকায় গ্রন্থ-সমালোচনার দুটি রীতি দেখা যেত। একটি রীতি ছিল ‘সংক্ষিপ্ত সমালোচন’, অপ্রধান বা বিশেষ গুণবর্জিত পুস্তকগুলি এই শিরোনামায় সাধারণভাবে সমালোচিত হত। কিন্তু অপর রীতিতে সমালোচনার জন্য গ্রহণ করা হত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলিকে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সমালোচ্য গ্রন্থ অবলম্বন করে সমালোচক কোনো বিষয়ে তাঁর নিজস্ব মতামত বিশ্লেষণ করতেন। বঙ্গদর্শন-এর পৃষ্ঠায় বঙ্কিমচন্দ্র উভয় রীতিতেই সমালোচনা করেছিলেন, বিশেষত দ্বিতীয় রীতির সমালোচনা তাঁর হাতেই বিশিষ্ট চেহারা লাভ করেছিল। রবীন্দ্রনাথ বঙ্গদর্শন ও বঙ্কিমচন্দ্রের বিমুগ্ধ পাঠক ছিলেন। স্বভাবতই তাঁর এই প্রথম সমালোচনামূলক প্রবন্ধ বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবর্তিত রীতিকে অনুসরণ করেছে। বঙ্কিমচন্দ্রের মতোই তিনি প্রবন্ধের শুরুতে মহাকাব্য, খণ্ডকাব্য, গীতিকাব্য প্রভৃতির সম্বন্ধে সাধারণ আলোচনা করে পরে সমালোচ্য বিষয়ে প্রবেশ করেছেন, বঙ্কিমের মতো সাহিত্য-উপদেষ্টার উচ্চাসন থেকে ‘উপদেশ’ দেবার ভঙ্গিতে আলোচনা করেছেন, যদিও তাঁর বয়স তখন পনেরো বছর পাঁচ মাস মাত্র। বাংলাদেশে গীতিকাব্যের বাহুল্য সম্পর্কে তাঁর মতামত অনেক পরিমাণে বঙ্কিম-প্রভাবিত। কিন্তু তা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব গদ্যরচনারীতিও প্রবন্ধটির মধ্যে যথোচিত সৌন্দর্য ও স্বাতন্ত্র্য নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে তিনি আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।

প্রবন্ধটি সম্বন্ধে প্রবোধচন্দ্র সেন পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করেছেন তাঁর ‘অগ্রদূত’ প্রবন্ধে [দ্র বি. ভা, প., বৈশাখ-আষাঢ় ১৩৬৯। ৩৯৮-৪১৮]। অনুসন্ধিৎসু পাঠককে এই মূল্যবান আলোচনাটি পড়তে অনুরোধ করে বর্তমান প্রসঙ্গ সমাপ্ত করছি।

জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব পত্রিকার ফাল্গুন ১২৮২ [পৃ ১৫৯-৬৩], চৈত্র ১২৮২ [পৃ ২০৫-১০] এবং ১২৮৩ বঙ্গাব্দের বৈশাখ [পৃ ২৫৫-৫৯], আষাঢ় [পৃ ৩৪৬-৫০] ও আশ্বিন-কার্তিক [পৃ ৪৮৪-৮৬]-সংখ্যায় নামহীন কোনো লেখকের ‘প্রলাপ-সাগর’ নামক একটি রচনা প্রকাশিত হয়। ড সুকুমার সেন আনন্দবাজার পত্রিকা, বার্ষিক সংখ্যা ১৩৮৮-তে ‘রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত গদ্য-রচনা’ শীর্ষক প্রবন্ধে রচনাটি রবীন্দ্রনাথের লেখা বলে দাবি করেন, পরে প্রবন্ধটি তাঁর ‘রবীন্দ্রের ইন্দ্রধনু’ [১৩৯০] গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয় [পৃ ১৬৪-৮০]। তাঁর দাবির সপক্ষে যুক্তি দুটি : “প্রথম হল প্রবন্ধের—আসলে প্রবন্ধমালার—নাম। দ্বিতীয় হল প্রবন্ধমালার বস্তু ও ভাষা।… ‘প্রলাপসাগর কাঁচা হাতের লেখা, সন্দেহ নেই। কিন্তু ভাবে ও ভাষার ঢঙে যে বুদ্ধির ও কৌশলের ছাপ আছে তা যে রবীন্দ্রনাথেরই নিজস্ব সে কথা বুঝতে এতটুকুও দেরি হবে না তাঁদের যাঁরা রবীন্দ্রনাথের লেখা মন নিয়ে পড়েছেন।” এর পরে ড সেন পাঁচটি সংখ্যা থেকেই প্রচুর পরিমাণে উদ্ধৃতি দিয়েছেন [অবশ্য উদ্ধৃতিগুলি মুদ্রণপ্রমাদে কণ্টকিত]।

পাঁচটি ‘উচ্ছ্বাস’-এ লেখক ‘আভিধানিক তরঙ্গ’, ‘সাহিত্যিক তরঙ্গ’, ‘বৈয়াকরণ তরঙ্গ’, ‘ঐতিহাসিক তরঙ্গ ও ‘ভৌগোলিক তরঙ্গ’ আখ্যায় কৌতুকের সুরে বিভিন্ন প্রসঙ্গ আলোচনা করেছেন। পরবর্তীকালে এই শ্রেণীর অনেক রবীন্দ্র রচনা প্রকাশিত হয়েছে; ড সেন ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের জীবনী’ ও ‘রসিকতার ফলাফল’ রচনার কথা উল্লেখ করেছেন—১২৮৮ বঙ্গাব্দে লিখিত ‘গোলাম চোর’, ‘চর্ব্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয়’, ‘জীবন ও বর্ণমালা’, ‘রেলগাড়ি প্রভৃতি প্রবন্ধের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। উল্লেখ্য মনে হতে পারে ‘অমিত্রাক্ষর লেখার আদর্শ হিসেবে রচিত আঠারো ছত্রের নমুনাটি—মধুসূদন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কিছু পরে প্রকাশিত মনোভাবের সঙ্গে তা যথেষ্ট সংগতিপূর্ণ। দেশীয় সংবাদপত্রের রুচিহীনতা, ইতিহাস ও ভূগোলে বিদেশি নকল সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ পরেও তীব্র সমালোচনা করেছেন।

গোপালচন্দ্র রায় “‘প্রলাপ সাগর’ কি রবীন্দ্রনাথের লেখা” [রবীন্দ্রনাথের ছাত্রজীবন। ১৪৫-৫০] প্রবন্ধে ড সেনের মতের প্রতিবাদ করেছেন। তাঁর যুক্তি, এই রচনা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কোথাও উল্লেখ করেননি এবং অভিজাত ও ধর্মনিষ্ঠ পরিবারে বেড়ে-ওঠা বালক রবীন্দ্রনাথের পক্ষে এইরকম ‘অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ’ রচনা লেখা ‘কল্পনার অতীত’। কিন্তু ‘নাটক লেখার আদর্শ’ অংশে একটি যৌন-ইঙ্গিত ও দেশীয় সংবাদপত্র প্রসঙ্গে ‘বেশ্যাসক্ত’ শব্দটি ব্যবহার করা ছাড়া আর-কোনো অশালীনতা বা কুরুচির পরিচয় রচনাটিতে নেই।

তবে রচনাটিকে নিশ্চিতভাবে রবীন্দ্রনাথের নামে চিহ্নিত করা সত্যই কঠিন, বিশেষত তাঁর বয়সের বিচারে।

হিন্দুমেলার একাদশ অধিবেশন এই বৎসর ৮ ফাল্গুন রবিবার [18 Feb 1877] রাজা বদনচাঁদের টালার বাগানে অনুষ্ঠিত হয়। মেলা উপলক্ষে বক্তৃতাদি অবশ্য শুরু হয় মাঘসংক্রান্তি-র [২৯ মাঘ শনি 10 Feb] দিন থেকেই। ঐদিন ১নং শঙ্কর ঘোষ লেনে দ্বিজেন্দ্রনাথ বক্তৃতা করেন ও রাজনারায়ণ বসু ভগবদ্‌গীতা থেকে পাঠ করেন। কিন্তু মেলার প্রধান দিন ৮ ফাল্গুন মেলা-স্থলে পুলিশী তাণ্ডবের ফলে অনুষ্ঠান পণ্ড হয়ে যায় [দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৪]। রবীন্দ্রনাথ এবারের অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন এবং এখানে পরিবেশন করার জন্য একটি গান ও সদ্যসমাপ্ত দিল্লী-দরবার [দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৫] অবলম্বনে একটি কবিতাও রচনা করেছিলেন। কিন্তু অনুষ্ঠান পরিত্যক্ত হওয়ায় সেখানে তা পরিবেশন করা সম্ভব হয়নি। অবশ্য সভাস্থলে না হলেও, মেলা-প্রাঙ্গণেই তিনি কবিতাটি পাঠ করে ও গানটি গেয়ে শুনিয়েছিলেন। এ-সম্পর্কে সাধারণী-র প্রতিবেদক লেখেন : ‘আমরা নিরাশ মনে নবগোপাল বাবুকে অভিসম্পাত করিয়া ফিরিয়া আসিতেছিলাম, এমন সময়ে মহর্ষি দেবেন্দ্র বাবুর পুত্র জ্যোতিরিন্দ্র এবং রবীন্দ্রের সহিত সাক্ষাৎ হয়। রবীন্দ্র বাবু ‘দিল্লীর দরবার’ সম্পর্কে একটি কবিতা এবং একটি গীত রচনা করিয়াছিলেন। আমরা একটি প্রকাণ্ড বৃক্ষ ছায়ায় দুর্ব্বাসনে উপবিষ্ট হইয়া তাঁহার কবিতা এবং গীতটি শ্রবণ করি। রবীন্দ্র এখনও বালক, তাঁহার বয়স ষোল কি সতর বৎসরের অধিক হয় নাই [রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন পনেরো বছর ন’মাসের কিছু বেশি]। তথাপি তাঁহার কবিত্বে আমরা বিস্মিত এবং আর্দ্রিত হইয়াছিলাম, তাঁহার সুকুমার কণ্ঠের আবৃত্তির মাধুর্য্যে আমরা বিমোহিত হইয়াছিলাম। যখন দেখিলাম যে বঙ্গের একটি সুকুমারমতি শিশু ভারতের জন্য এরূপ রোদন করিতেছে, যখন দেখিলাম যে তাহার কোমল হৃদয় পৰ্য্যন্ত ভারতের অধঃপতনে ব্যথিত হইয়াছে, তখন আশাতে আমাদের হৃদয় পরিপূর্ণ হইল। তখন ইচ্ছা হইল রবীন্দ্রের গলা ধরিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলি—আয় ভাই “আমরা গাইব অন্য গান।” এক জন সুপরিচিত কবিও সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তিনি দ্রবিত হৃদয়ে বলিলেন যখন এই কলি প্রস্ফুটিত কুসুমে পরিণত হইবে, তখন দুঃখিনী বঙ্গের একটি অমূল্য রত্ন লাভ হইবে। কিন্তু আর এক জন বন্ধু বলিলেন, “পাছে কাঁচা-মিঠা আঁম হয়, এই আশঙ্কা। ঈশ্বর করুন এ আশা অমূলক হউক।”

এই ‘সুপরিচিত কবি’ হচ্ছেন নবীনচন্দ্র সেন। তিনিও স্মৃতিকথায় ঘটনাটির উল্লেখ করেছেন: ‘স্মরণ হয় ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দে [1877 হবে] আমি কলিকাতায় ছুটিতে থাকিবার সময় কলিকাতার উপনগরস্থ কোনও উদ্যানে ‘ন্যাশনাল মেলা’ দেখিতে গিয়াছিলাম। …একজন সদ্য-পরিচিত বন্ধু মেলার ভিড়ে আমাকে ‘পাকড়াও’ করিয়া বলিলেন যে, একটি লোক আমার সঙ্গে পরিচিত হইতে চাহিতেছেন। তিনি আমার হাত ধরিয়া উদ্যানের এক কোণার এক প্রকাণ্ড বৃক্ষতলায় লইয়া গেলেন। দেখিলাম, সেখানে সাদা টিলা ইজার চাপকানপরিহিত একটি সুন্দর নব-যুবক দাঁড়াইয়া আছেন। বয়স ১৮।১৯, শান্ত, স্থির। বৃক্ষতলায় যেন একটি স্বর্ণ-মূর্তি স্থাপিত হইয়াছে। বন্ধু বলিলেন—“ইনি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র রবীন্দ্রনাথ।” তাঁহার জ্যেষ্ঠ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রেসিডেন্সী কলেজে আমার সহপাঠী ছিলেন। দেখিলাম, সেই রূপ, সেই পোষাক। সহাসিমুখে করমর্দ্দন কাৰ্য্যটা শেষ হইলে, তিনি পকেট হইতে একটি ‘নোটবুক’ বাহির করিয়া কয়েকটি গীত গাহিলেন ও কয়েকটি কবিতা গীতকণ্ঠে পাঠ করিলেন। মধুর কামিনী-লাঞ্ছন কণ্ঠে, এবং কবিতার মাধুর্য্যে ও স্ফুটোম্মুখ প্রতিভায় আমি মুগ্ধ হইলাম। তাহার দুই এক দিন পরে বাবু অক্ষয়চন্দ্র সরকার মহাশয় আমাকে নিমন্ত্রণ করিয়া তাঁহার চুঁচুড়ার বাড়ীতে লইয়া গেলে আমি তাঁহাকে বলিলাম যে, আমি ‘ন্যাশনাল মেলা’য় গিয়া একটি অপূৰ্ব্ব নব-যুবকের গীত ও কবিতা শুনিয়াছি, এবং আমার বিশ্বাস হইয়াছে যে, তিনি একদিন একজন প্রতিভাসম্পন্ন কবি ও গায়ক হইবেন। অক্ষয়বাবু বলিলেন—“কে? রবি ঠাকুর বুঝি? ও ঠাকুরবাড়ীর কাঁচা মিঠা আঁব।”১০

এই-প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘লর্ড কর্জনের সময় দিল্লিদরবার সম্বন্ধে একটা গদ্যপ্রবন্ধ১১ লিখিয়াছি—লর্ড লিটনের সময় লিখিয়াছিলাম পদ্যে। তখনকার ইংরেজ গবর্মেন্ট রুসিয়াকেই ভয় করিত, কিন্তু চৌদ্দপনেরো বছর বয়সের বালক কবির লেখনীকে ভয় করিত না। এইজন্য সেই কাব্যে বয়সোচিত উত্তেজনা প্রভূত পরিমাণে থাকা সত্ত্বেও তখনকার প্রধান সেনাপতি হইতে আরম্ভ করিয়া পুলিসের কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত কেহ কিছুমাত্র বিচলিত হইবার লক্ষণ প্রকাশ করেন নাই। …সেটা পড়িয়াছিলাম হিন্দুমেলায় গাছের তলায় দাঁড়াইয়া। শ্রোতাদের মধ্যে নবীন সেন মহাশয় উপস্থিত ছিলেন। আমার বড়ো বয়সে তিনি একদিন একথা আমাকে স্মরণ করাইয়া দিয়াছিলেন।১২

কবিতাটি সম্ভবত সমকালীন কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। অনেকে বলেছেন, লর্ড লিটন-প্রবর্তিত Vernacular Press Act [দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৬] বা দেশীয় সংবাদপত্র-সংক্রান্ত আইনের কঠোর বিধিব্যবস্থার জন্য কবিতাটিকে পত্রিকায় প্রকাশ করা যুক্তিযুক্ত বিবেচিত হয়নি। বহুকাল পরে সজনীকান্ত দাসের প্রশ্নের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ 15 Oct 1939 [রবি ২৮ আশ্বিন ১৩৪৬] মংপু থেকে এ-সম্পর্কে লিখেছিলেন : ‘প্রথম লর্ড লিটনের রাজসূয় যজ্ঞ উপলক্ষ্যে যে কবিতা লিখেছিলুম হিতৈষীদের সতর্কতা মান্য করে সেটা লোপ করে দেওয়া হয়েছিল। মনে আছে, কেউ কেউ সেটা হাতে লিখে প্রচার করে বেড়াতেন।’১৩ পরে সজনীকান্ত কবিতাটির ‘একটি রূপান্তরিত মুদ্রিত রূপ শ্ৰীযতিনাথ ঘোষের ইঙ্গিতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘স্বপ্নময়ী নাটকে’র (১৮৮২ খ্রীঃ) চতুর্থ অঙ্কের চতুর্থ গর্ভাঙ্কে শুভসিংহের একটি স্বগত উক্তির মধ্যে আবিষ্কার’১৪ করেন। সেখানে নাটকের প্রয়োজনে কবিতাটিতে ‘ব্রিটিশ’ শব্দটি বদলে ‘মোগল’ শব্দটি বসানো হয়। কবিতাটির প্রথম দুটি পঙ্‌ক্তি হল:

‘দেখিছ না অয়ি ভারত-সাগর, অয়ি গো হিমাদ্রি দেখিছ চেয়ে,

প্রলয়-কালের নিবিড় আঁধার, ভারতের ভাল ফেলেছে ছেয়ে।’১৫

লক্ষণীয়, কবিতাটির শেষ পঙ্‌ক্তিতে ‘আমরা ধরিব আরেক তান’ অংশটি সাধারণী-র প্রতিবেদকের হাতে ‘আমরা গাইব অন্য গান’-এ পরিণত হয়েছে। কবিতাটির আর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য, এতেও রবীন্দ্রনাথের এই সময়ে প্রিয় পর্ব-বিন্যাস ৬+৬+৬+৫ সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, অবশ্য যুক্তাক্ষরের বহুল ব্যবহারও লক্ষ্য করবার মতো যা বঙ্গসুন্দরী-র ছন্দ থেকে সারদামঙ্গল-এর ছন্দে উত্তীর্ণ হবার প্রয়াসটিকে চিহ্নিত করেছে।

সাধারণী-র উক্ত প্রতিবেদনে ‘দিল্লীর দরবার’ কবিতাটির সঙ্গে একটি গীত রচনা ও গেয়ে শোনানোর কথাও বর্ণিত হয়েছে [নবীনচন্দ্র সেন অবশ্য ‘কয়েকটি গীত’ গাওয়ার কথা লিখেছেন]। এই গীতটি কী? রবীন্দ্রজীবনী-কারের মতে, গানটি হল ‘ভারত রে, তোর কলঙ্কিত পরমাণুরাশি’ [গীতবিতান। ৮১৫]।১৬ তিনি অবশ্য তাঁর এই সিদ্ধান্তের সপক্ষে কোনো যুক্তি প্রদর্শন করেননি। আবার গীতবিতান-সম্পাদক অনুমান করেছেন, ‘অয়ি বিষাদিনী বীণা’ [গীতবিতান। ৮১৬] গানটিই হিন্দুমেলায় গীত সেই গান। এও নিছক অনুমান, যথেষ্ট যুক্তি-প্রয়োগে প্রমাণিত নয়। বস্তুত ‘জাতীয় সঙ্গীত’ [২য় সং, 30. Aug, 1878] গ্রন্থে সংকলিত নিম্নোক্ত চারটি গানের মধ্যে ভাব এবং কোথাও কোথাও বাক্য গঠনে ও শব্দপ্রয়োগে এমন সাদৃশ্য দেখা যায় যে, মনে হয় গানগুলি একই সময়ে লেখা—এর মধ্যে যে-কোনো একটি বা একাধিক গান হিন্দুমেলার উক্ত গাছতলার আসরে গীত হয়ে থাকতে পারে। গানগুলির তালিকা ও অন্যান্য বিবরণ দেওয়া হল:

১। ‘ঢাকো রে মুখ, চন্দ্রমা, জলদে’ দ্র রবিচ্ছায়া [বৈশাখ ১২৯২, ‘জাতীয় সঙ্গীত’। ১]। ১৫৯, রাগিণী গৌড়মল্লার; গীতবিতান ৩ | ৮১৮; স্বরবিতান ৪৭।

২। ‘তোমারি তরে, মা, সঁপিনু এ দেহ’ দ্র ভারতী, আশ্বিন ১২৮৪। ১৪৪, ‘উৎসর্গগীতি’, জয়জয়ন্তী—চৌতাল; রবিচ্ছায়া [জাতীয়। ২]। ১৬০; গীতবিতান ৩। ৮১৯; স্বরবিতান ৪৭; নরেন্দ্রনাথ দত্ত [স্বামী বিবেকানন্দ]-সম্পাদিত ‘সঙ্গীত কল্পতরু’ [১২৯৪] গ্রন্থের ‘জাতীয় সঙ্গীত’ বিভাগে গানটি সংকলিত হয়েছিল।

৩। ‘অয়ি বিষাদিনী বীণা, আয় সখী’ দ্র সঙ্গীত কল্পতরু; রবিচ্ছায়া-তে গানটি নেই; দুর্গাদাস লাহিড়ী সম্পাদিত ‘বাঙ্গালীর গান’ [১৩১২] গ্রন্থে এটি রবীন্দ্রনাথের নামেই সুরতাল উল্লেখ-সহ মুদ্রিত হয়; গীতবিতান ৩। ৮১৬; স্বরলিপি নেই।

৪। ‘ভারত রে, তোর কলঙ্কিত পরমাণুরাশি’ দ্র সঙ্গীত কল্পতরু; রবিচ্ছায়া-তে গানটি নেই; গীতবিতান ৩ । ৮১৫; স্বরলিপি নেই।

উপরোক্ত রচনাগুলি সম্পর্কে সজনীকান্ত দাস লিখেছেন : “ওই পুস্তকের [‘জাতীয় সঙ্গীত’] ১৮৭৬ সনের ১৭ই ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রকাশিত প্রথম সংস্করণে রচনা চারিটি ছিল না। তাই অনুমান হয় এইগুলি ১৮৭৬ ফেব্রুয়ারি হইতে ১৮৭৮ আগস্টের মধ্যে রচিত [রবীন্দ্রনাথ May 1878-এর মাঝামাঝি সময়ে আমেদাবাদ যাত্রা করেন, সুতরাং সময়ের নিম্নসীমাটিকে কমিয়ে Apr 1878 করা যায়।…শেষের দুইটি কবিতা যে রবীন্দ্রনাথের স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সে বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়াছেন, অন্য প্রমাণও পাওয়া গিয়াছে। ‘ভারতীয়-সঙ্গীতমুক্তাবলী’, ২য় সং ১৮৮৬, পৃ ৪৩-৪৪, ‘সঙ্গীত-কোষ’, ২য় সং ১৩০৬, পৃ ৯৯১ ‘জাতীয়-সঙ্গীত’ প্রভৃতি সঙ্গীত-সংগ্রহ-গ্রন্থে এইগুলি তাঁহার নাম সংযুক্ত হইয়া বাহির হইয়াছে।”১৭ ‘ভারতীয় সঙ্গীতমুক্তাবলী’ নবকান্ত চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক সম্পাদিত।

গানগুলি সম্ভবত ‘সঞ্জীবনী সভা’র অনুপ্রেরণায় লেখা। ‘সঞ্জীবনী সভা’ কবে স্থাপিত হয়েছিল এবং তার উত্তেজনার আগুন পোহানো কতদিন স্থায়ী হয়েছিল, সে-সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলার মতো তথ্যের অভাব। তবে বৈশাখ ১২৮৩ [Apr 1876]-এর আগে এর প্রতিষ্ঠা হয়নি, একথা জোর করেই বলা যায়—কেননা মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্রজনাথ দে এই সভার একজন উৎসাহী সভ্য ছিলেন এবং তিনি ১০ বৈশাখ তারিখেই ঠাকুরবাড়ির গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। তাছাড়া এর পূর্বে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ উভয়েই শিলাইদহে ছিলেন এবং ১২৮৩ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসেরও অনেকটা যে তাঁরা সেখানেই কাটিয়েছিলেন, তার বিবরণ আমরা পূর্বেই দিয়েছি। সংঘমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘হিন্দুমেলায় উপহার’ কবিতায় ‘ভারতকঙ্কাল আর কি এখন/ পাইবে হায় রে নূতন জীবন;/ ভারতের ভস্মে আগুন জ্বালিয়া,/ আর কি কখন দিবে রে জ্যোতি’ ইত্যাদি পঙ্‌ক্তির সঙ্গে সঞ্জীবনী সভার ‘মৃতভারতে প্রাণসঞ্চার’-এর উদ্দেশ্যের সাদৃশ্য লক্ষ্য করে 1874-এর শেষাংশ বা 1875-এর একেবারে প্রথম দিকে সঞ্জীবনী সভার প্রতিষ্ঠা-সম্পর্কে যে অনুমান করেছেন,১৮ তা আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, যে ধরনের স্বাদেশিকতার উত্তেজনা সঞ্জীবনী সভার মতো গুপ্তসমিতি স্থাপনের পিছনে কার্যকরী ছিল, তা বাংলাদেশে প্রধানত সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্টি। আমরা আগেই বলেছি, Jul 1875-এ বিলেত থেকে ফিরে তিনি আনন্দমোহন বসু প্রতিষ্ঠিত স্টুডেন্টস’ অ্যাসোসিয়েশনে যোগদান করেন ও বিভিন্ন জায়গায় মাৎসিনির জীবনাদর্শ প্রচার করতে থাকেন। তাঁরই অনুপ্রেরণায় যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ ভাদ্র ১২৮২ [Aug-Sep 1875] থেকে আৰ্য্যদর্শন পত্রিকায় ‘জোসেফ ম্যাট্‌সিনি ও নব্য ইতালী’ প্রায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেন। এর ফলে তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, তারই প্রতিক্রিয়ায় ইতালির কার্বোনারি সম্প্রদায়ের অনুকরণে অনেকগুলি গুপ্তসমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিপিনচন্দ্র পাল এ-সম্পর্কে লিখেছেন :

সে সময়ে সুরেন্দ্রনাথ নব্য ইতালীর স্বাধীনতার ইতিহাসের কথা আমাদিগের মধ্যে প্রচার করিতে আরম্ভ করিয়াছেন। কি করিয়া ম্যাট্‌সিনি এবং ইয়ং ইতালী (Young Italy) সমাজের সত্যেরা নিজেদের মাতৃভূমিকে অষ্ট্ৰীয়ার শাসনশৃঙ্খল হইতে মুক্ত করিবার চেষ্টা করেন, সুরেন্দ্রনাথের মুখে এই কাহিনী শুনিয়া আমাদের অন্তরে একটা নূতন স্বদেশপ্রেমের প্রেরণা আসে। ম্যাট্‌সিনি প্রথমে ইতালীর প্রাচীন বিপ্লববাদী কারবনারাইদিগের (Carbonari) সঙ্গে জুটিয়া পড়েন। কারবনারাই-দল দেশময় বহুসংখ্যক গুপ্ত রাষ্ট্রীয় সমিতির গঠন করিয়াছিলেন। ম্যাট্‌সিনি গুপ্তষড়যন্ত্র ও গুপ্তহত্যার দ্বারা দেশ উদ্ধার হইবে না, ইহা বুঝিয়া অল্পদিন মধ্যেই তাহাদিগকে ছাড়িয়া চলিয়া যান। কিন্তু কারবনারাইদিগের কথা কলিকাতার ছাত্ৰমণ্ডলীকে একরূপ পাগল করিয়া তুলিয়াছিল। দলে দলে মিলিয়া তাঁহারা কারবনারাইদিগের অনুকরণে নিজেদের মধ্যে ছোট্ট ছোট্ট গুপ্ত-সমিতি (বা Secret Society) গড়িবার চেষ্টা করেন। এ সকলের পিছনে কোনো প্রবল বিপ্লববাদের প্রেরণা ছিল না।১৯

শিবনাথ শাস্ত্রী এই সময়ে বিপিনচন্দ্র, কালীশংকর সুকুল, আনন্দচন্দ্র মিত্র, শরৎচন্দ্র রায়, তারাকিশোর চৌধুরী ও সুন্দরীমোহন দাসকে নিয়ে এই ধরনের একটি সমিতি গড়েন। বিপিনচন্দ্র লিখেছেন, তখন শাস্ত্রী মহাশয় হেয়ার স্কুলে নিযুক্ত ছিলেন ও ঘটনার ছ-মাস পরে সরকারী কর্মে ইস্তফা দিয়ে তিনি, গগনচন্দ্র হোম ও উমাপদ রায় দীক্ষা গ্রহণ করেন। শিবনাথ 15 Feb 1878 [৪ ফাল্গুন ১২৮৪] ইস্তফা-পত্র দেন ও 1 Mar থেকে তা কার্যকরী হয়। সুতরাং এই সমিতি প্রতিষ্ঠার সময় সম্ভবত ভাদ্র ১২৮৪ [Aug-Sep 1877] বা তার কাছাকাছি। সঞ্জীবনী সভা যদি এর পূর্বেও প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে, তাহলেও 1876-এর শেষ বা 1877-এর প্রথমে অর্থাৎ পৌষ ১২৮৩-এর কাছাকাছি সময়েই তা হয়েছিল। এছাড়াও শ্রীমতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুমানের বিরুদ্ধে বলা যায়, ‘সরোজিনী’ প্রকাশের [অগ্রহায়ণ ১২৮২ : Nov 1875] পরেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে তাঁদের সমশ্রেণীতে ‘প্রমোশন’ দিয়েছিলেন, ‘সঞ্জীবনী সভা’-র সূত্রে উভয়ের যে ঘনিষ্ঠতা লক্ষ্য করা যায়, এর পূর্বে তা গড়ে ওঠেনি।

গগনচন্দ্র হোম উক্ত সমিতিতে দীক্ষাগ্রহণের যে বিবরণ দিয়েছেন, তা খুবই কৌতূহলজনক : ‘আমার দীক্ষার দিনে বরাহনগরে গঙ্গাতীরে এক বাগানে গভীর রাত্রে তাঁহারা সকলে [পূর্বদীক্ষিত ছ’জন সভ্য] দীক্ষার্থী উমাপদ রায় ও আমাকে বেষ্টন করিয়া বসিলেন; সম্মুখে অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলিত করা হইল। আমরা বুক চিরিয়া রক্ত দিয়া বটপত্রে লিখিয়া নিজেদের প্রবৃত্তির কাম ক্রোধ লোভ হিংসা, ধর্মবিশ্বাসে প্রতিমাপূজা, সমাজে জাতিভেদ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরাধীনতা অগ্নিতে আহুতি দিলাম। তাহার পর বটপত্রগুলি পুড়িয়া নিঃশেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গে প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের সম্মুখে জানু পাতিয়া বসিয়া প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করিলাম।’*

এর সঙ্গে সঞ্জীবনী সভার দীক্ষাগ্রহণের ও সভানুষ্ঠানের রীতি-প্রকৃতির অনেক মিল আছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বলেছেন: ‘যেদিন নূতন কোনও সভ্য এই সভায় দীক্ষিত হইতেন সেদিন অধ্যক্ষমহাশয় লাল পট্টবস্ত্র পরিয়া সভায় আসিতেন। …আদি-ব্রাহ্মসমাজ পুস্তকাগার হইতে লাল-রেশমে জড়ানো বেদ-মন্ত্রের একখানা পুঁথি এই সভায় আনিয়া রাখা হইয়াছিল। টেবিলের দুইপাশে দুইটি মড়ার মাথা থাকিত, তাহার দুইটি চক্ষুকোটরে দুইটি মোমবাতি বসানো ছিল। মড়ার মাথাটি মৃত ভারতের সাঙ্কেতিক চিহ্ন। বাতি দুইটি জ্বালাইবার অর্থ এই যে, মৃত-ভারতে প্রাণসঞ্চার করিতে হইবে ও তাহার জ্ঞানচক্ষু ফুটাইয়া তুলিতে হইবে। এ ব্যাপারের ইহাই মূল কল্পনা। সভার প্রারম্ভে বেদমন্ত্র গীত হইত—সংগচ্ছধ্বম্ সংবদধ্বম্। সকলে সমস্বরে এই বেদমন্ত্র গান করার পর তবে সভার কার্য্য (অর্থাৎ কিনা গল্পগুজব) আরম্ভ হইত।’২০ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উদ্ভাবিত এক গুপ্তভাষায় সভার কার্যবিবরণী লিখিত হত, এই ভাষায় ‘সঞ্জীবনী সভা’ নামটির রূপ ছিল ‘হামচুপামূহাফ্‌।‘ [দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৭]

ঠন্‌ঠনের একটি গলির মধ্যে একটা পোড়ো বাড়িতে এই সভা বসত। বৃদ্ধ রাজনারায়ণ বসু ছিলেন তার সভাপতি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, ব্রজনাথ দে প্রভৃতি তার সভ্য ছিলেন, পরে নবগোপাল মিত্রকেও সভ্যশ্রেণীভুক্ত করা হয়েছিল। সভার আসবাবপত্রের মধ্যে ছিল একটি ভাঙা ছোটো টেবিল, কয়েকটা ভাঙা চেয়ার ও আধখানা ছোটো টানাপাখা—তারও আবার একদিক ঝুলে পড়েছিল। জাতীয় হিতকর ও উন্নতিকর সমস্ত কার্যই এই সভায় অনুষ্ঠিত হবে, এই ছিল সভার প্রধান উদ্দেশ্য।

এই সব কাজের জন্য সভ্যেরা তাঁদের আয়ের এক-দশমাংশ সভায় দান করতেন। স্বদেশে দেশলাই-এর কারখানা স্থাপন করা জাতীয় উন্নতিকর কাজের অঙ্গ ছিল। অনেক পরীক্ষার পর কয়েক বাক্স দেশলাই প্রস্তুত হল। কিন্তু তার এক বাক্সে যে-খরচ পড়তে লাগল তাতে একটি পল্লী সারা বছর উনুন ধরাতে পারত। ‘আরও একটু সামান্য অসুবিধা এই হইয়াছিল যে, নিকটে অগ্নিশিখা না থাকিলে তাহাদিগকে জ্বালাইয়া তোলা সহজ ছিল না। দেশের প্রতি জ্বলন্ত অনুরাগ যদি তাহাদের জ্বলনশীলতা বাড়াইতে পারিত, তবে আজ পর্যন্ত তাহারা বাজারে চলিত।’২১ [দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৮]

শোনা গেল, একটি অল্পবয়স্ক ছাত্র* কাপড়ের কল তৈরি করবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত। সেটি কোনো কাজের জিনিস হচ্ছে কি না তা বোঝা সভার কারোর পক্ষেই সম্ভব ছিল না। কিন্তু যন্ত্রটি প্রস্তুত করতে যে ঋণ হয়েছিল, তাঁরা তা শোধ করে দিলেন। অবশেষে ব্রজবাবু একদিন মাথায় একটি গামছা বেঁধে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে উপস্থিত এবং তাঁদের কলে এই গামছার টুকরো তৈরি হয়েছে বলে তাণ্ডব নৃত্য জুড়ে দিলেন—তখন তাঁর মাথার চুলে পাক ধরেছে!

ভারতবাসীর সর্বজনীন পোশাক কী হতে পারে তা নিয়েও সভা, বিশেষ করে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, প্রচুর গবেষণা করেছেন। অবশেষে পায়জামার উপর একখণ্ড কাপড় পাট করে একটা স্বতন্ত্র কৃত্রিম মালকোঁচা জুড়ে ও সোলার টুপির সঙ্গে পাগড়ির মিশ্রণে একটি পদার্থকে শিরোভূষণ করে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মধ্যাহ্নের প্রখর আলোয় গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। ‘দেশের জন্য অকাতরে প্রাণ দিতে পারে এমন বীরপুরুষ অনেক থাকিতে পারে কিন্তু দেশের মঙ্গলের জন্য সর্বজনীন পোশাক পরিয়া গাড়ি করিয়া কলিকাতার রাস্তা দিয়া যাইতে পারে এমন লোক নিশ্চয়ই বিরল।’২২

রবিবার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সদলবলে শিকারে বেরোতেন। রবাহূত অনাহূত নানা শ্রেণীর অপরিচিত ব্যক্তিও দলে এসে জুটতেন। এই শিকারে রক্তপাতটাই সবচেয়ে নগণ্য ছিল। বউঠাকুরানী কাদম্বরী দেবী প্রাতে শিকারে বেরোবার সময় রাশিকৃত লুচি তরকারি সঙ্গে দিয়ে দিতেন। মানিকতলার কোনো পোড়ো বাগানবাড়িতে ঢুকে পুকুরের বাঁধানো ঘাটে বসে লুচিগুলির সদ্ব্যবহার করা হত। ব্রজবাবুর বুদ্ধিতে একদিন ডাবের জলে পানীয়ের অভাবও মিটেছিল।

দলে একজন নিষ্ঠাবান হিন্দু মধ্যবিত্ত জমিদার ছিলেন। তাঁর গঙ্গার ধারের বাগানে একদিন সভ্যেরা জাতিবর্ণনির্বিচারে আহার করলেন। অপরাহ্নে বিষম ঝড়ে সকলে গঙ্গার ঘাটে দাঁড়িয়ে চীৎকার শব্দে গান জুড়ে দিলেন। ‘রাজনারায়ণবাবুর কণ্ঠে সাতটা সুর যে বেশ বিশুদ্ধভাবে খেলিত তাহা নহে কিন্তু তিনিও গলা ছাড়িয়া দিলেন, এবং সূত্রের চেয়ে ভাষ্য যেমন অনেক বেশি হয় তেমনি তাঁহার উৎসাহের তুমুল হাতনাড়া তাঁর ক্ষীণকণ্ঠকে বহুদূরে ছাড়াইয়া গেল; তালের ঝোঁকে মাথা নাড়িতে লাগিলেন এবং তাঁহার পাকা দাড়ির মধ্যে ঝড়ের হাওয়া মাতামাতি করিতে লাগিল।’২৩ অনেক রাত্রে গাড়ি করে তাঁরা বাড়ি ফেরেন।

উক্ত গান-সম্পর্কে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতি-তে “‘আজি উন্মদ পবনে’ বলিয়া রবীন্দ্রনাথের নবরচিত গান” বলে উল্লেখ করেছেন। অনুমান করা হয়, এটি ভারতী, আশ্বিন ১২৮৪ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘সজনি গো,/অঁধার রজনী ঘোর ঘনঘটা’ প্রথম পঙ্‌ক্তি-যুক্ত ‘ভানুসিংহের কবিতা’-শীর্ষক গান, যার পঞ্চম পঙ্‌ক্তিটি হল ‘উন্মদ পবনে যমুনা উথলত’। এই তথ্য থেকে কেউ কেউ সিদ্ধান্ত করতে পারেন যে, উপরোক্ত ঘটনাটি ১২৮৪ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ-ভাদ্র মাসের কোনো সময়ে ঘটেছিল এবং গানটি সেই সময়েই রচিত। এরূপ সিদ্ধান্তের সপক্ষে যুক্তি অবশ্যই প্রবল, কিন্তু আমাদের ধারণা, দুটি-একটি সুবুদ্ধি লোক তার আগেই দলে ভিড়ে ও জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাইয়ে সঞ্জীবনী সভার ‘স্বর্গলোক’ ভেঙে দিয়েছিলেন। এবং সম্ভবত এই উত্তেজনার অবসান ঘটার পরই নতুন উত্তেজনার সন্ধানে শ্রাবণ ১২৮৪ থেকে ভারতী পত্রিকার আবির্ভাব হয়। কারণ ভারতী প্রকাশের পরিকল্পনা গৃহীত হবার পর এইসব ছেলেমানুষিতে মেতে থাকার মতো অবকাশ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের ছিল বলে মনে হয় না। তাছাড়া সঞ্জীবনী সভা যে মন্ত্রগুপ্তির আদর্শে দীক্ষিত ছিল, সেখানকার কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত গান পত্রিকায় প্রকাশ করলে সেই আদর্শচ্যুতির সম্ভাবনা। বিশেষত, ভারতীর উক্ত সংখ্যাতেই ‘উৎসর্গ-গীতি’ শিরোনামে ‘তোমারি তরে মা সঁপিনু দেহ’ —রবীন্দ্রনাথের লেখা এই গানটি প্রকাশিত হয়, যেটি স্পষ্টতই উক্ত সভার আদর্শে লিখিত—হয়তো ওই সভার জন্যই লেখা। সঞ্জীবনী সভার যদি ইতিমধ্যেই বিলোপ না ঘটত, তাহলে এগুলি পত্রিকায় প্রকাশ করা সম্ভব হত না বলেই মনে হয়। সুতরাং অনুমান করা যায় সঞ্জীবনী সভার আয়ুষ্কাল মোটামুটি ছ’মাস—পৌষ ১২৮৩ থেকে জ্যৈষ্ঠ ১২৮৪ পর্যন্ত বিস্তৃত।

এই প্রসঙ্গে আরও একটি গান সম্বন্ধে আলোচনা করা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে ‘স্বাদেশিকতা’ অধ্যায়ের শেষে সঞ্জীবনী সভার সভাপতি রাজনারায়ণ বসুর উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে লিখেছেন : ‘দেশের সমস্ত খর্বত দীনতা অপমানকে তিনি দগ্ধ করিয়া ফেলিতে চাহিতেন। তাঁহার দুইচক্ষু জ্বলিতে থাকিত, তাঁহার হৃদয় দীপ্ত হইয়া উঠিত, উৎসাহের সঙ্গে হাত নাড়িয়া আমাদের সঙ্গে মিলিয়া তিনি গান ধরিতেন—গলায় সুর লাগুক আর না লাগুক সে তিনি খেয়ালই করিতেন না—

এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন,

এক কার্যে সঁপিয়াছি সহস্র জীবন।‘২৪

গানটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পুরুবিক্রম নাটক-এর দ্বিতীয় সংস্করণ [১৮০১ শক (১২৮৬) : 1879 পৃ ৮৮-৮৯]-এ প্রথম মুদ্রিত হয় [১৩০৭ বঙ্গাব্দের সংস্করণে অবশ্য গানটি বর্জিত হয়েছে। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ [ফাল্গুন ১৮০২ শক (১২৮৭): 12 Feb 1881] গীতিনাট্যে দস্যুদলের মুখে ‘এক ডোরে বাঁধা আছি মোরা সকলে’ গানটির মধ্যে এর ভাব ও ভাষার কিছুটা প্রতিধ্বনি এবং সুর ও তালের [খাম্বাজ—দাদরা] যথেষ্ট ঐক্য দেখা যায়। বালক পত্রিকার শ্রাবণ ১২৯২ সংখ্যায় [পৃ ১৭৮] গানটির অন্য একটি পাঠ দেখা যায়, সেখানে রচয়িতার কোনো উল্লেখ নেই। এই সময়ে প্রকাশিত ‘রবিচ্ছায়া’ গীতিসংগ্রহ-গ্রন্থে কিন্তু গানটি সংকলিত হয়নি। এর পর ভারতী ও বালক পত্রিকার কার্তিক ১২৯৬ সংখ্যায় প্রকাশিত স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘স্নেহলতা’ উপন্যাসে ‘এক সূত্রে গাঁথিলাম সহস্র জীবন’ [পৃ ৩৬৫] গানটির সঙ্গেও আলোচ্য গানটির অনেক সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তী পর্যায়ে গানের বহি [১৩০০], কাব্য গ্রন্থাবলী [১৩০৩], কাব্যগ্রন্থ-এর অন্তর্গত ‘গান’ [১৩১০]—গীতি-সংকলনগুলির কোনোটিতেই এই গানটিকে দেখা যায় না। অতঃপর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ-সম্পাদিত সঙ্গীতপ্রকাশিকা-র অগ্রহায়ণ ১৩১২ সংখ্যায় গানটি রবীন্দ্রনাথের রচনা-রূপে স্বরলিপি-সহ মুদ্রিত হয়, সেখানে ‘বন্দে মাতরম্‌’ ধুয়াটি নতুন যুক্ত হয়েছে [সম্ভবত স্বদেশী-আন্দোলনের পটভূমিকায়]। কিন্তু যোগীন্দ্রনাথ সরকার-সম্পাদিত ‘গান’ [১৩১৫] কিংবা ইণ্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস-প্রকাশিত গান’ [১৩১৬] গ্রন্থে এটিকে পাওয়া যায় না। অবশেষে সঙ্গীতপ্রকাশিকা-য় প্রকাশিত পাঠটি দীর্ঘকাল পরে গীতবিতান ৩য় খণ্ডে [আশ্বিন ১৩৫৭ : 1950] সংকলিত হয়েছে।

গানটির এই দীর্ঘ জটিল ইতিহাসকে জটিলতর করেছেন ঐতিহাসিকেরা। রবীন্দ্রজীবনী-কার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন : ‘আমাদের বক্তব্য যে, রবীন্দ্রনাথের কোনো গীতগ্রন্থে এই গানটি নাই এবং তিনি ইতিপূর্বে কোনো পত্রে বা প্রবন্ধে এই গান তাঁহার বলিয়া স্বয়ং দাবী করেন নাই। …সুতরাং এই গানটির রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ কিনা তদ্বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।’২৫ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘রবীন্দ্র-গ্রন্থ-পরিচয়’ [১৩৪৯]-এ লিখেছেন : ‘গানটি যে রবীন্দ্রনাথেরই রচনা, ইহা আমরা কবির নিজের মুখেই শুনিয়াছি।’ শান্তিদেব ঘোষও লিখেছেন : ‘সন্দেহগ্রস্ত মন নিয়ে একদিন গুরুদেবের কাছে উপস্থিত হই। তাঁকে জিজ্ঞাসা করি সত্যই গানটি তাঁর রচিত কি না। তিনি বলেছিলেন গানটি তাঁরই রচনা।’২৬ রবীন্দ্রজীবনী-কার এই উক্তিগুলি সম্পর্কে অবহিত হয়েও উক্ত সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কোনো গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে, বা কোনো পত্রে-প্রবন্ধে নিজের লেখা বলে দাবি করেছেন—তাঁর বাল্য ও কৈশোরের রচনার স্বত্ব নির্বাচনের এই যদি মাপকাঠি হয়, তাহলে স্বয়ং প্রভাতবাবুর দ্বারা স্বীকৃত বহুসংখ্যক রবীন্দ্র-রচনাই আমাদের আলোচনার বহির্ভূত হয়ে পড়ে। সেইজন্যই জীবনস্মৃতি-র উদ্ধৃতি, সঙ্গীতপ্রকাশিকা-র উল্লেখ এবং ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও শান্তিদেব ঘোষের সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করে আমরা গানটিকে রবীন্দ্র-রচনা বলে গ্রহণ করছি।

উপরে আমরা স্বর্ণকুমারী দেবীর লেখা ‘স্নেহলতা’ উপন্যাসের কথা উল্লেখ করেছি। প্রসঙ্গটি আরও একটু বিস্তারিত আলোচনার অপেক্ষা রাখে। ভারতী ও বালক পত্রিকার কার্তিক ১২৯৬ সংখ্যায় এই উপন্যাসের যে অংশটি প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানে চারু নামের এক কবি-বালক ও একটি গুপ্ত সভার যে চিত্র আঁকা হয়েছে তা রবীন্দ্রনাথ ও সঞ্জীবনী সভার একটি প্রতিচিত্র বলে মনে হয়।

স্বর্ণকুমারীর বর্ণনায় ‘চারু এখন ষোড়শ বর্ষীয় বালক’ এবং এই গুপ্তসভার সভ্যগণ সম স্বরে যে গানটি গাইত, সেটি হল :

একসূত্রে গাঁথিলাম সহস্র জীবন

জীবনে মরণে রব শপথ বন্ধন

ভারত মাতার তরে সঁপিনু এ প্রাণ

সাক্ষী পুণ্য তরবারি সাক্ষী ভগবান

প্রাণ খুলে আনন্দেতে গাও জয় গান

সহায় আছেন ধর্ম্ম কারে আর ভয়।

সঞ্জীবনী সভা-পর্বে রবীন্দ্রনাথও ‘ষোড়শবর্ষীয় বালক’ এবং সভার সভ্যগণ রবীন্দ্রনাথ-রচিত গান প্রবল উৎসাহের সঙ্গে গাইতেন—এ-প্রসঙ্গে এই তথ্যগুলি আমরা স্মরণ করতে পারি। আরও একটি জিনিস লক্ষণীয় যে, স্বর্ণকুমারী কী কৌশলে ‘একসূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্র জীবন’ ‘তোমারি তরে, মা, সঁপিনু প্রাণ ‘ত্রিভুবনমাঝে আমরা সকলে কাহারে না করি ভয়—/ মাথার উপরে রয়েছেন কালী, সমুখে রয়েছে জয়’ প্রভৃতি পঙ্‌ক্তি থেকে শব্দ চয়ন করে উপরোক্ত গানটির রূপ গঠন করেছেন। উল্লেখযোগ্য যে, রবীন্দ্রনাথের ‘তোমারি তরে, মা, সঁপিনু এ দেহ’ গানটি স্বর্ণকুমারীর ‘বিচিত্রা’ [১৩২৭] উপন্যাসের সপ্তম পরিচ্ছেদে ঈষৎ পরিবর্তিত ও সংক্ষিপ্ত রূপে ব্যবহৃত হয়েছে। তাছাড়া, সঞ্জীবনী সভার সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগ না থাকলেও তিনি এ-সময়ে ‘জ্যোতি’র্মণ্ডলেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন—জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণায় ও সাহায্যে এই কালপর্বেই তাঁর ‘দীপনির্বাণ’ উপন্যাস প্রকাশিত হয় [15 Dec 1876]; সুতরাং সেই ‘খ্যাপামির তপ্ত হাওয়া’র আঁচ তাঁর গায়েও নিশ্চয়ই লেগেছে, তারই প্রকাশ হয়েছে উপরোক্ত রচনায়। এই পর্বে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও স্বর্ণকুমারী দেবীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের প্রমাণ আছে ক্যাশবহি-র পাতায়, রবীন্দ্রনাথকে বহুবার ‘জানকীবাবুর বাটী’ যাতায়াত করতে দেখা যায়। এ-প্রসঙ্গে এ-কথাও স্মরণ করা যেতে পারে যে, রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাহিনীকাব্য ‘বনফুল’ যা জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, তার প্রথম সর্গটির নাম ছিল ‘দীপ-নির্ব্বাণ।‘

বর্তমান বৎসরের শেষে আৰ্য্যদর্শন পত্রিকার চৈত্র ১২৮৩ [৩।১২] সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের ‘ফুলবালা/গীতিকা’র একাংশ প্রকাশিত হয় ৫৩৫-৩৮ পৃষ্ঠায়। রচনার শেষে ‘ক্রমশঃ প্রকাশ্য’ লেখা থাকলেও পরবর্তী অংশ এই পত্রিকায় মুদ্রিত হয়নি, দীর্ঘকাল পরে ভারতী পত্রিকার কার্তিক ১২৮৫ [২।৭] সংখ্যার ২৯৮-৩০৬ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়। সম্পূর্ণ রচনাটি পরে সংকলিত হয় রবীন্দ্রনাথের ‘শৈশব সংগীত’ [১২৯১: 29 May 1884] কাব্য-গ্রন্থে; বর্তমানে রবীন্দ্র-রচনাবলীর ‘অচলিত সংগ্রহ প্রথম খণ্ডে পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। এই গ্রন্থের ৪২৯-৩৪ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত ‘তরল জলদে বিমল চাঁদিমা…কহে কলপনাদেবী’ অংশটি আৰ্য্যদর্শন-এ প্রকাশিত হয়েছিল। এই পাঠটি ‘শৈশবসঙ্গীত’-এ পুনর্মুদ্রিত হবার সময়ে একটি পাঠান্তর ও দুটি জায়গায় মোট বারোটি পঙ্‌ক্তি বর্জিত হয়। পাঠক ও গবেষকদের অবগতির জন্য বর্জিত পঙ্‌ক্তিগুলি নিয়ে সংকলিত হল :

‘অচলিত সংগ্রহ’-তে ৪৩০ পৃষ্ঠায় ‘সকল ভুলিয়া হৃদয় খুলিয়া/আকাশে তুলিয়া করিব গান’-এর পরে—

একই নিমিখে হেরিব দুজনে

আকাশ পাতাল স্বরগ ধরা

তাই বলি বালা বীণাখানি লয়ে

মনে প্রাণে ঢালো সুধার ধারা। [আৰ্য্যদর্শন। ৫৩৬]

৪৩২ পৃষ্ঠায় ‘ঘুমঘোরে আঁখি মুদিয়া রহিল/দিকের বালিকা সব’ পঙ্‌ক্তিটির প্রথম প্রকাশিত রূপ হল : ‘ঘুম ঘোর হতে জাগিয়া উঠিল/দিকের বালিকা সব।’ এর পরবর্তী আটটি পঙ্‌ক্তি পরে বর্জিত হয়েছে :

ধীরে ধীরে ধীরে উঠিলরে তান

সুর বালা এল ফেলিয়া কেলী

শুনিতে লাগিল অবাক হইয়া

পৃথিবীর পানে নয়ন মেলি!

ধীরে ধীরে ধীরে উঠিলরে ধ্বনি

মধুরে ছাপিয়া নদীর গান

আকাশ ছাইয়া, স্বরগ ছাইয়া

কোথায় উড়িল মধুর তান। [আৰ্য্যদর্শন। ৫৩৭]

আশ্চর্যের ব্যাপার, ড সুকুমার সেন আৰ্য্যদর্শন-এ ‘ফুলবালা’ গীতিকার প্রথমাংশ প্রকাশের কথা উল্লেখ করলেও২৭ পরবর্তী গবেষকেরা সেই তথ্যটিকে উপেক্ষা করেছেন। এর ফলে রবীন্দ্ররচনার কালক্ৰম নির্ণয়ের ক্ষেত্রে যেমন ত্রুটি ঘটেছে, তেমনি ঐতিহাসিক বিচারবিভ্রাটও ঘটেছে। স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘গাথা’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১২৮৭ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে [20 Dec 1880], এতে চারটি গাথা সংকলিত হয়েছে : সাধের ভাসান [ভারতী, পৌষ ১২৮৬], খড়্গ-পরিণয় [ঐ, চৈত্র ১২৮৬], সাশ্রু-সম্প্রদান [ঐ, বৈশাখ ১২৮৭] ও অভাগিনী। ড পশুপতি শাশমলের মতে, অভাগিনী লেখিকার প্রথম দিকের রচনা যা রবীন্দ্রনাথের রচনারও পূর্ববর্তী। ড শাশমল তাঁর মতের সমর্থনে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি-র লিপিকার বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন : ‘এখানে বলিয়া রাখা আবশ্যক যে, স্বর্ণকুমারীই বঙ্গসাহিত্যে সর্বপ্রথম গাথা রচনা করেন। গাথা-রচনায় রবীন্দ্রনাথ তাঁহার জ্যেষ্ঠা ভগিনীর পদানুসরণ করিয়াছেন।’২৮ বাংলা সাহিত্যের প্রথম গাথা-কবিতা স্বর্ণকুমারীই রচনা করেছিলেন কিনা, সেই বিতর্কে না গিয়ে এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জ্যেষ্ঠার পদানুসরণ করেছেন এই মত মেনে নিলে বলতে হয় ‘অভাগিনী’ ১২৮৩ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসেরও পূর্বে লেখা। কিন্তু এতখানি অনুমানের যথার্থ কোনো ভিত্তি সত্যই আছে কি?

তথ্যের দিক থেকে ‘ফুলবালা’ গীতিকাটি সম্পর্কে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর প্রয়োজন। প্রথমত, এটি কোন্ সময়ে রচিত হয়েছিল; দ্বিতীয়ত, সমস্ত কবিতাটি একই সঙ্গে লিখিত কিনা এবং তৃতীয়ত, শেষাংশটি আৰ্য্যদর্শন-এ প্রকাশিত হয়নি কেন। আমরা আগেই বলেছি, কবিতাটির দুটি অংশের প্রকাশকালের মধ্যে ব্যবধান সুদীর্ঘ—প্রথমাংশটি চৈত্র ১২৮৩-তে এবং শেষাংশটি কার্তিক ১২৮৫-তে প্রকাশিত হয়েছিল। আৰ্য্যদর্শর্ন-এ মুদ্রিত অংশের শেষে ‘ক্রমশঃ প্রকাশ্য’ লেখা দেখে মনে হতে পারে, সমস্ত কবিতাটিই হয়তো একই সঙ্গে লিখিত হয়েছিল এবং ধারাবাহিকভাবে দুটি বা ততোধিক সংখ্যায় প্রকাশ করার পরিকল্পনা ছিল—কিন্তু ইতিমধ্যে নিজেদের পত্রিকা ভারতী প্রকাশের আয়োজন শুরু হয়ে যাওয়ায় পরিকল্পনাটি পরিবর্তিত হয়। যদিও ভারতী প্রথম প্রকাশিত হয় ১৫ শ্রাবণ ১২৮৪ [রবি 29 Jul 1877] তারিখে, কিন্তু সংবাদটি বিজ্ঞাপিত হয় অনেক আগে ৫ আষাঢ় [সোম 18 Jun] তারিখে, আলাপ-আলোচনা-আয়োজন নিশ্চয়ই আরও আগেকার। তাছাড়া চৈত্র ১২৮৩ সংখ্যা আৰ্য্যদর্শন চৈত্র মাসের মধ্যেই প্রকাশিত হয়েছিল বলে মনে হয় না [সাধারণী-র সংবাদ থেকে জানা যায়, পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল জ্যৈষ্ঠ ১২৮৪-রও পরে]। কিন্তু এতে তৃতীয় প্রশ্নটির উত্তর মিললেও দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে সংশয় থেকে যায়। ‘ফুলবালা’ গাথাটির কোনো সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি আমাদের হাতে না থাকলেও একেবারে শেষে যে গানটি আছে—‘দেখে যা—দেখে যা—দেখে যা লো তোরা/সাধের কাননে মোর’—তার প্রাথমিক রূপটি আমরা মালতীপুঁথি-র 24/১৩খ পৃষ্ঠায় পাই। এই পাণ্ডুলিপি থেকে মনে হয় গানটি এই সময়ে রচিত নয়, অনেক পরে ১২৮৫ অব্দের জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে রবীন্দ্রনাথ যখন আমেদাবাদে ছিলেন তখনকার লেখা; কারণ এই পাতারই অপর পৃষ্ঠায় [23/১৩ক] কয়েকটি অনুবাদ-কবিতা পাওয়া যায়, যেগুলি শ্রাবণ ১২৮৫ সংখ্যা ভারতী-তে ‘স্যাক্‌সন জাতি ও অ্যাঙ্গলো স্যাক্‌সন সাহিত্য [পৃ ১৭১-৮৪] প্রবন্ধের অন্তর্গত হয়ে প্রকাশিত হয়। সুতরাং অনুমান করা যায়, ‘ফুলবালা’র শেষাংশ যে-সময়েই লিখিত হয়ে থাক্‌-না কেন, আমেদাবাদে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচনাটির পরিমার্জনা করেছিলেন এবং সেই সময়েই এই গানটি তাতে যুক্ত হয়েছিল। এই গাথার অন্তর্ভুক্ত অপর গানটিও—‘গোলাপ ফুল ফুটিয়ে আছে,/মধুপ হোথা যাস্ নে’—তাঁর এই পর্বে রচিত ‘বলি ও আমার গোলাপ বালা’ প্রভৃতি গানের আদর্শে লেখা বলে, মনে হয়, এটিও আমেদাবাদে থাকার সময়েই রচিত। তাছাড়া দুটি অংশের মধ্যে ছন্দ ও রচনারীতির যথেষ্ট পার্থক্য আছে; প্রথম অংশটি অনেকটা ‘প্রলাপ’ কবিতাগুচ্ছের ভাষায় ও ছন্দে লেখা, কিন্তু শেষাংশটির ছন্দও যেমন বিচিত্র পরীক্ষার পরিচয় বহন করে, ভাষাও তেমনই অনেকটা পরিণত। তাই দুটি অংশকে একই সময়ে লেখা বলে মনে হয় না। সেইজন্য আমাদের অনুমান, প্রথম অংশটি ১২৮৩ বঙ্গাব্দের শেষের দিকে লিখিত হলেও, শেষাংশটি তিনি অনেক পরে আমেদাবাদে থাকার সময়েই রচনা করেছিলেন। এটি যে উক্ত সময়েই লেখা তার সুনিশ্চিত প্রমাণ আমরা যথাস্থানে উপস্থিত করব।

এই বৎসরে প্রকাশিত আর একটি কবিতা রবীন্দ্রনাথের লেখা বলে দাবি করা হয়েছে। সজনীকান্ত দাস লিখেছেন : “১৭৯৮ শকের মাঘ মাসের (৯ম কল্প, ২ ভাগ, ১৮৭৭ খ্রীষ্টাব্দ জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র ১৮২-৮৩ পৃষ্ঠায় একটি ছোট অনুবাদ-কবিতা প্রকাশিত হইয়াছে; অনুবাদটি রবীন্দ্রনাথের বলিয়া মনে হয়। রবীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। তিনি আমার নিকট একটি পত্রে জানাইয়াছিলেন যে, তিনি নিশ্চিত সাক্ষ্য দিতে পারেন না, তবে ভাষাটা যে তাঁহার সেকেলে ভাষারই মত, তাহা অস্বীকার করিতে পারেন না; তিনি লেখেন, সেকালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় ঠিক এই জাতীয় “কবিতা লিখিয়ে” আর কেহ ছিলেন না।”২৯

‘তারকা-কুসুমচয় ছড়ায়ে আকাশময়’—প্রথম পঙ্‌ক্তিযুক্ত ৮ ছত্রের এই অনুবাদ-কবিতাটি ‘রূপান্তর’ [১৩৭২] গ্রন্থের পরিশিষ্ট ২-তে ‘রবীন্দ্রনাথ-কৃত রূপান্তর বলিয়া অনুমিত’ মন্তব্য-সহ মুদ্রিত হয়েছে [পৃ ১৯২-৯৩]। এখানে পঙ্‌ক্তিগুলি অন্যভাবে বিন্যস্ত হওয়ার জন্য কাব্যরূপটি অনেক বেশি স্পষ্ট।

একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোচনা আমরা স্থগিত রেখেছিলাম, সেটি হল ভানুসিংহের কবিতা রচনার সূচনা-পর্বটি—কারণ এটিকে নির্দিষ্ট কালানুক্রমে বিন্যস্ত করা কঠিন। অক্ষয়চন্দ্র সরকার ও সারদাচরণ মিত্র-সম্পাদিত ‘প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ’ নামক খণ্ডাংশে প্রকাশিত বৈষ্ণব-পদাবলি সাহিত্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয়ের প্রসঙ্গ পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে। বিদ্যাপতির মৈথিলীমিশ্রিত ব্রজবুলি ভাষার দুর্ভেদ্য অরণ্যে অনেক অধ্যবসায়ে তিনি প্রবেশের পথ তৈরি করে নিয়েছিলেন। এই পদগুলির ভাষা ও ছন্দ তাঁকে আকর্ষণ করেছিল বেশি; রাধাকৃষ্ণ-প্রেমলীলার আধ্যাত্মিক ভাবজগতে প্রবেশ করবার চাবিকাঠি তাঁর আয়ত্তে ছিল না, সুতরাং এই প্রেমের বহিরঙ্গ রূপটিই কেবল তাঁর আশ্রয় হয়েছিল। বৈষ্ণব পদাবলির ভাব ভাষা ছন্দ ও রূপকল্পের যে অনুষঙ্গ রবীন্দ্রনাথের পরবর্তীকালের কবিতার ভাব ও রূপের মধ্যে ছড়িয়ে আছে, নিছক অনুকরণের মধ্য দিয়ে তার পদসঞ্চার রবীন্দ্রকাব্যে ঘটল এই সময়ে। তিনি লিখেছেন : ‘এই রহস্যের মধ্যে তলাইয়া দুর্গম অন্ধকার হইতে রত্ন তুলিয়া আনিবার চেষ্টায় যখন আছি তখন নিজেকেও একবার এইরূপ রহস্য-আবরণে আবৃত করিয়া প্রকাশ করিবার একটা ইচ্ছা আমাকে পাইয়া বসিয়াছিল।’৩০ এর আগেই তিনি অক্ষয় চৌধুরীর কাছে ইংলণ্ডের বালককবি চ্যাটার্টনের জীবনকথা শুনেছিলেন। চ্যাটার্টনের কবিতার সঙ্গে তাঁদের কারোরই পরিচয় ছিল না, কিন্তু প্রাচীন কবিদের ভাষা ও ছন্দ অনুকরণ করে লিখিত তাঁর Rowley Poems কিভাবে পণ্ডিতদেরও প্রতারিত করতে সক্ষম হয়েছিল, সেই নাটকীয় কাহিনী রবীন্দ্রনাথের ‘কল্পনাকে খুব সরগরম করিয়া তুলিয়াছিল’। চ্যাটার্টন মাত্র আঠারো বছর বয়সে [‘ষোলো বছর বয়সে’—জীবনস্মৃতি] আত্মহত্যা করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘আপাতত ওই আত্মহত্যার অনাবশ্যক অংশটুকু হাতে রাখিয়া, কোমর বাঁধিয়া দ্বিতীয় চ্যাটার্টন হইবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইলাম।’৩১ ব্রজবুলি ভাষার অনুকরণে লিখিত তাঁর প্রথম কবিতা ‘গহন কুসুম-কুঞ্জ মাঝে—অন্তঃপুরের কোণের ঘরে শ্লেটের উপর লেখা। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় কবিতাটির জন্ম-বৃত্তান্ত : ‘একদিন মধ্যাহ্নে খুব মেঘ করিয়াছে। সেই মেঘলাদিনের ছায়াঘন অবকাশের আনন্দে বাড়ির ভিতরে এক ঘরে খাটের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া একটা স্লেট লইয়া লিখিলাম ‘গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে’। লিখিয়া ভারি খুশি হইলাম।‘ খুশি হওয়ারই কথা—এটি ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’র একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা, পরবর্তীকালে লিখিত অনেকগুলি পদে দুরূহ অপ্রচলিত এবং কিছুটা কর্কশ যে-সব শব্দ ব্যবহারের লোভ তিনি সংবরণ করতে পারেননি, এই প্রথম পদটি তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এটি লিখে তিনি এমন একজনকে [?] পড়ে শোনালেন ‘বুঝিতে পারিবার আশঙ্কামাত্র যাহাকে স্পর্শ করিতে পারে না’। সুতরাং সহজেই তাঁর কাছ থেকে বাহবাও পাওয়া গেল।

কবিতাটি সম্ভবত এই বৎসরের গোড়ার দিকেই লিখিত হয়েছিল। ‘কাব্য গ্রন্থাবলী’ [১৩০৩]-র ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ভানুসিংহের অনেকগুলি কবিতা লেখকের ১৫। ১৬ বৎসর বয়সের লেখা’। তাই মনে হয়, উপরোক্ত কবিতাটি লেখার খুশিতে তিনি পর পর এই জাতীয় অনেকগুলি পদ লিখে ফেলেন। প্রায় চ্যাটার্টনের অনুকরণেই তিনি তাঁর একটি বন্ধুকে [? প্রবোধচন্দ্র ঘোষ] বললেন যে, আদি ব্রাহ্মসমাজের লাইব্রেরি খুঁজতে খুঁজতে বহুকালের জীর্ণ একটি পুঁথি পেয়ে তা থেকে ভানুসিংহ-নামক কোনো প্রাচীন কবির পদ কপি করে এনেছেন এবং তাঁকে স্বরচিত ‘কবিতাগুলি’ শোনালেন। বন্ধুটি যখন বিষম বিচলিত হয়ে বললেন যে, এমন কবিতা বিদ্যাপতি-চণ্ডীদাসের হাত দিয়েও বের হতে পারত না সুতরাং এ পুঁথি অক্ষয়চন্দ্র সরকারকে প্রাচীন কাব্যসংগ্রহে ছাপাবার জন্য দেওয়া নিতান্তই দরকার—‘তখন আমার খাতা দেখাইয়া স্পষ্ট প্রমাণ করিয়া দিলাম, এ লেখা বিদ্যাপতি-চণ্ডীদাসের হাত দিয়া নিশ্চয় বাহির হইতে পারে না, কারণ এ আমার লেখা।’৩১

‘গহির নীদমে অবশ শ্যাম মম’ [‘শ্যাম, মুখে তব মধুর অধরমে’—ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী ২।১৭, ১২ নং] পদটি ছাড়া অন্যগুলির কোনো পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি, সুতরাং কবিতাগুলিকে কালানুক্রমিকতায় বিন্যস্ত করার সুযোগ নেই। ভারতী পত্রিকায় বা মুদ্রিত গ্রন্থে [১২৯১]-ও কালানুক্রম রক্ষা করা হয়নি। অবশ্য উপরোক্ত পদটি আলোর্চ্য সময়ের অনেক পরে ১২৮৫ বঙ্গাব্দে আমেদাবাদে লেখা হয়েছিল, এ-সম্পর্কে প্রমাণ যথাস্থানে উপস্থাপিত হবে। তাছাড়া ‘মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান’, ‘কো তুঁহুঁ বোলবি মোয়’, ‘আজু সখি মুহুমুহু’ প্রভৃতি কয়েকটি পদ রবীন্দ্রনাথের অপেক্ষাকৃত পরিণত বয়সে লেখা।

প্রাসঙ্গিক তথ্য : ১

বৎসরের শুরুতেই, সম্ভবত ১৯ বৈশাখ [রবি 30 Apr 1876] তারিখে, দ্বিজেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠা কন্যা সরোজার সঙ্গে ললিতমোহন চট্টোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র মোহিনীমোহনের বিবাহ হয়। ললিতমোহন রাজা রামমোহন রায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র রাধাপ্রসাদের দৌহিত্র। বিবাহের পূর্বে ১৮ বৈশাখ মোহিনীমোহন ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। বিবাহ-সম্পর্কে নানারকম নির্দেশ দিয়ে দেবেন্দ্রনাথ হিমালয়ের ‘বক্রোটা শেখর’ থেকে ৮ বৈশাখ [19 Apr] বেচারাম চট্টোপাধ্যায়কে একটি পত্র লেখেন। পত্রটির কিছুটা অংশ আমরা উদ্ধৃত করছি, এর থেকে বোঝা যাবে সংসার থেকে দূরে থাকলেও সামান্যতম খুঁটিনাটি বিষয়েও তিনি কতখানি সচেতন ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যে লিখেছেন : ‘ছোটো হইতে বড়ো পর্যন্ত পিতৃদেবের সমস্ত কল্পনা এবং কাজ অত্যন্ত যথাযথ ছিল।…তিনি যাহা সংকল্প করিতেন তাহার প্রত্যেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তিনি মনশ্চক্ষুতে স্পষ্টরূপে প্রত্যক্ষ করিয়া লইতেন। এইজন্য কোনো ক্রিয়াকর্মে কোন্ জিনিসটা ঠিক কোথায় থাকিবে, কে কোথায় বসিবে, কাহার প্রতি কোন্‌ কাজের কতটুকু ভার থাকিবে, সমস্তই তিনি আগাগোড়া মনের মধ্যে ঠিক করিয়া লইতেন এবং কিছুতেই কোনো অংশে তাহার অন্যথা হইতে দিতেন না।‘৩২—সেই বর্ণনা যে কতটা সঠিক এই পত্রই তার প্রমাণ। দেবেন্দ্রনাথ লিখছেন : দ্বিজেন্দ্রর কন্যা সরোজার শুভবিবাহ উপস্থিত। তুমি, জ্ঞানচন্দ্র ও [শম্ভুনাথ] গড়গড়িকে লইয়া বেদীতে আসন গ্রহণ করিবে এবং আচার্য্যের কাৰ্য্য সমাধা করিয়া এই শুভবিবাহ সুসম্পন্ন করিয়া দিবে। স্ত্রী আচার হইয়া বরকন্যা দালানে আইলে তবে ব্রহ্মোপাসনা আরম্ভ হইবে, তোমরা সেই সময়ে বেদীতে বসিবে, তাহার পূর্ব্বে তাহাতে বসিবে না। দ্বিজেন্দ্রের সঙ্গে বরযাত্রদিগকে অভ্যর্থনা করিয়া দরদালানে বসাইবে। পরে বিবাহের লগ্ন উপস্থিত হইলে বরযাত্রদিগকে দালানের বেদীর পশ্চিমভাগে সমাদর পূর্ব্বক বসাইবে। এবং বরকে গদি হইতে উঠাইয়া আনিয়া কাৰ্য্য আরম্ভ করিয়া দিবে। গদি খালি হইলে সেই গদি বরের জন্য বাটীর ভিতর পাঠাইয়া দিবে এবং তাহার দুই পার্শ্বের বৈঠকীসেজ বেদীর দুই পার্শ্বে বসাইয়া দিবে। তাহা হইলে বেদীতে আলো কম হইবে না। এবং তুমি পুঁথি বেশ দেখিতে পাইবে।…’৩৩ এই পত্র থেকে ঠাকুরবাড়ির বিবাহ-বাসরেরও একটি স্পষ্ট ছবি পাওয়া যায়। ৩ বৈশাখ ‘শ্রীমতো সরোজাসুন্দরির বিবাহের এস্টিমেট’ দেবেন্দ্রনাথের নিকট পাঠানো হয়, এটিও একটি অবশ্যপালনীয় রীতি ছিল।

শ্রাবণ মাসের গোড়ার দিকে হেমেন্দ্রনাথের একটি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু ১৪ শ্রাবণ [28 Ju] তারিখে তার মৃত্যু হয়।

১২ ফাল্গুন [বৃহ 22 Feb 1877] তারিখে সৌদামিনী দেবীর একমাত্র পুত্র সত্যপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিবাহ হয় ইরাবতী দেবীর ননদ মৃত্যুঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের কন্যা নরেন্দ্রবালা দেবীর [জন্ম : ১২ অগ্রহায়ণ ১২৭১ বুধ 16 Nov 1864]* সঙ্গে। বিবাহ-সংবাদটি সাধারণী [৭। ২০, ২৯ ফাল্গুন]-তে প্রকাশিত হয় : ‘১২ই ফাল্গুন বৃহস্পতিবার দিবসে বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম কন্যার পুত্র বাবু সত্যপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের সহিত এলাহাবাদের মুন্সেফ বাবু মৃত্যুঞ্জয় মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের কন্যার শুভ বিবাহ হইয়া গিয়াছে। বিবাহটী ব্রাহ্মমতে হইয়াছিল। পাত্রটির বয়ঃক্রম অনুমান ১৮ বৎসর হইবে। ইনি সত্বরেই কুপার্স হিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যয়নের জন্য বিলাতে যাইবেন। পাত্রীটির বয়স অনুমান ১৪ বৎসর [১২] হইবে। সঙ্গীত ও উপাসনাদির সহিত বিবাহ কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। বিবাহ স্থলে স্বয়ং দেবেন্দ্র বাবু উপস্থিত ছিলেন।‘ সত্যপ্রসাদ এর কিছুদিন পূর্বেই এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়েছেন, বিবাহের সময় তাঁর বয়স ১৯ বৎসর ৪ মাস [জন্ম : ৩১ আশ্বিন ১২৬৬, 16 Oct 1859]* মাত্র। [প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ৮ কার্তিক 23 Oct সত্যপ্রসাদের এন্ট্রান্স পরীক্ষার ফী বাবদ দশ টাকা জমা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাঁর সহপাঠী সোমেন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে এরূপ কোনো খরচ দেখা যায় না। সত্যপ্রসাদ এই পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজেই এফ. এ. পড়া শুরু করেন।]

ফাল্গুন মাসে সত্যেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পুত্র কবীন্দ্রনাথের [তার ডাক নাম ছিল চোবি] অন্নপ্রাশন হয়। সত্যেন্দ্রনাথ সিন্ধুপ্রদেশে হায়দ্রাবাদের অন্তর্গত শিকারপুরে ডিস্ট্রিক্ট ও সেসন্স জজ (অস্থায়ী) রূপে কাজ করার সময়ে সেখানেই তাঁর এই পুত্রের জন্ম হয়। মাঘ মাসের শুরুতেই [Jan 1877] ছুটি নিয়ে তিনি কলকাতা আসেন। ফার্লো [Furlough] ছুটি নিয়ে সপরিবারে ইংলণ্ডে যাবার আয়োজন করাই হয়তো তাঁর কলকাতায় আসার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। কানাঘুষোয় এই সংবাদ পেয়ে সমাচার চন্দ্রিকা [৬৫। ১৬৪, ১২ ফাল্গুন 22 Feb] লেখে : ‘শুনিলাম, সিভিলিয়ান বাবু সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর পুনশ্চ ইংলণ্ড যাইতেছেন। কেন যাইবেন তাহা কিছু প্রকাশ হয় নাই। বোম্বায়ের জজিয়তী পদ কি ত্যাগ করিয়া যাইবেন?’ সংবাদটি সাধারণী [৭।১৮, ১৫ ফাল্গুন]-ও কিছু অতিরিক্ত তথ্য-সহ প্রকাশ করে : ‘আহমদাবাদের জজ সিবিল বাবু সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিলাতে যাইবেন। তাঁহার একটি সহোদর ও ভ্রাতুষ্পুত্রকে সূক্ষ্মশিল্পাদি অধ্যয়নার্থ সেইখানে রাখিয়া আসিবেন।‘ সত্যপ্রসাদ-সংক্রান্ত যে-সংবাদটি ইতিপূর্বেই উদ্ধৃত হয়েছে, তাতে মনে হয় ভ্রাতুষ্পুত্র শব্দটি ভাগিনেয়-র বদলে ভুল ভাবে প্রযুক্ত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন, সহোদরটি কে? আমাদের ধারণা, এই সহোদর রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কেউ নন। শিক্ষার বাঁধা-পথে তাঁকে কিছুতেই চালাতে না পেরে অভিভাবকেরা কতখানি চিন্তিত ছিলেন, তার কিছু আভাস পূর্বেই দেওয়া হয়েছে। সেই কারণেই হয়তো তাঁর সম্পর্কে বর্তমানে এই পরিকল্পনাটি গৃহীত হয়েছিল। অবশ্য তাঁর ও সত্যপ্রসাদের ক্ষেত্রে এখনই এই প্রস্তাব কার্যকরী করা কোন কারণে সম্ভব হয়নি, এক বছর পরে রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত আই. সি. এস. পরীক্ষা দেবার ঘোষিত সংকল্প নিয়ে বিলাতযাত্রার জন্য তৈরি হন, সত্যপ্রসাদের ক্ষেত্রে প্রস্তুতিটি সম্পূর্ণ হয় আরও পরে, ১২৮৮ বঙ্গাব্দে। সত্যেন্দ্রনাথও কোনো কারণে তাঁর সংকল্প পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি কিছুদিনের মধ্যেই স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে ইংলণ্ডে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ এবার কলকাতায় খুব ব্যস্ত জীবন যাপন করেন। মাঘোৎসবে ভাষণ দেওয়া ছাড়াও ২২ মাঘ [শনি 3 Feb] তিনি হিন্দু স্কুল থিয়েটারে ‘বঙ্গ-ভাষা-সমালোচনীসভা’র দ্বিতীয় বৎসরের ত্রিংশ অধিবেশনে কেশবচন্দ্র সেনের সভাপতিত্বে ‘বঙ্গদেশ ও বোম্বাই’ সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা করেন। ফাল্গুন মাসের শুরুতে সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও জানকীনাথ ঘোষাল [সম্ভবত সপরিবারে] বোলপুর যান; এই সময়ে ‘সোমবাবুদিগের’ও বোলপুরে যাওয়ার হিসাব পাওয়া যায় ক্যাশবহি-তে—রবীন্দ্রনাথের নাম বিশেষভাবে কোথাও উল্লিখিত না হলেও সম্ভবত তিনিও এই দলের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। আর তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে তাঁর এই দ্বিতীয়বার বোলপুর পরিক্রমায় তিনি শান্তিনিকেতনে কিছু পরিবর্তন দেখেছিলেন। তিনি ফাল্গুন ১২৭৯-তে যখন সেখানে প্রথম গিয়েছিলেন, তখন ‘শান্তিনিকেতন’ গৃহটি ছিল একতলা—তার একটি ছোটো ঘরে তিনি থাকতেন, আর-একটিতে থাকতেন পিতা দেবেন্দ্রনাথ। কিন্তু ১২৮২ বঙ্গাব্দের মাঝামাঝি থেকে বাড়িটিকে প্রশস্ত ও দ্বিতল করার কাজ শুরু হয়। ২৪ কার্তিক ১২৮৩ [8 Nov 1876] তারিখের হিসাবে দেখা যায়, ঐ সময় পর্যন্ত নির্মাণ-ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৯৮৩১ ৵ ৩ পাই। এর পরে কত দ্রুতগতিতে এই নির্মাণ-কার্য অগ্রসর হয়েছে, কয়েকটি তারিখ ও ব্যয়ের হিসাব উদ্ধৃত করলে তা স্পষ্ট বোঝা যাবে : ১১ অগ্ৰ [25 Nov] ১০৩৭৭ ॥৶ ৩, ২৩ পৌষ [6 Jan 1877] ১১১৫৯৶° ও বৎসরের শেষ দিনটিতে ৩০ চৈত্র [11 Apr] তারিখে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ১৩০১৫। ৬ পাই।

এই বৎসর জোড়াসাঁকোর সম্পত্তির ক্ষেত্রেও কিছু পরিবর্তন হয়। পাঠক অবগত আছেন, দেবেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ ভ্রাতা নগেন্দ্রনাথ মাত্র ২৯ বছর বয়সে 24 Oct 1858 তারিখে মারা যান। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন বলে তাঁর বিধবা পত্নী ত্রিপুরাসুন্দরী দেবী মৃত গিরীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র গুণেন্দ্রনাথকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করতে চান। সম্পত্তি-সংক্রান্ত গোলযোগের আশঙ্কায় 29 Jan 1859-এ দেবেন্দ্রনাথ সুপ্রীম কোর্টে যে মামলা করেন, তাতে 1860-র ডিক্রি অনুযায়ী ত্রিপুরাসুন্দরী দেবীর দত্তক গ্রহণের অধিকার অস্বীকৃত হয় এবং নগেন্দ্রনাথের সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ দেবেন্দ্রনাথ ও এক-তৃতীয়াংশ গিরীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারীরা লাভ করেন। 1874-এ ত্রিপুরাসুন্দরী এই ডিক্রি বাতিল করতে চেয়ে হাইকোর্টে একটি মামলা করেন [৩৮৪ নং মকদ্দমা]। 17 Jul 1876 তারিখে এই মামলার রায় দেওয়া হয়; তাতে নগেন্দ্রনাথের সম্পত্তির যে এক-তৃতীয়াংশের উত্তরাধিকারের প্রশ্ন অমীমাংসিত ছিল, তাতে ত্রিপুরাসুন্দরীর জীবনস্বত্ব স্বীকার করা হয়। দেবেন্দ্রনাথ এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপসে স্থির হয় এককালীন দশ হাজার টাকা ও আজীবন বার্ষিক এক হাজার টাকা বৃত্তির বিনিময়ে ত্রিপুরাসুন্দরী তাঁর স্বত্ব দেবেন্দ্রনাথের অনুকূলে ছেড়ে দেবেন।৩৪ এই চুক্তি অনুযায়ী ২৩ ভাদ্র [7 Sep] ত্রিপুরাসুন্দরীকে দশ হাজার টাকা দেওয়া হয় : ‘ব° ত্রিপুরাসুন্দরী দেবী/দ° ১৮৭৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বরের/ডিক্রি অনুযায়ী স্বর্গীয় বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর/মহাশয়ের বিষয়ের উপর উক্ত দেবীর সমুদায়/ স্বত্ব বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্রয় করার/মূল্য শোধ…১০০০০৲’।

ক্রমবর্ধমান পরিবারের ভরণপোষণ ও বাসস্থান-সমস্যার জন্য এরূপ ব্যবস্থা-গ্রহণ দেবেন্দ্রনাথের পক্ষে অপরিহার্য ছিল। দ্বারকানাথ তাঁর উইলে ভদ্রাসন বাড়ির পশ্চিম দিকের সমস্ত জমি নগেন্দ্রনাথকে দিয়ে গিয়েছিলেন, এই ডিক্রি অনুযায়ী সেই জমির বেশির ভাগ অংশই দেবেন্দ্রনাথের অধিকারে আসে—যা তিনি পরবর্তীকালে কনিষ্ঠপুত্র রবীন্দ্রনাথকে দান করেন ও সেখানে বিখ্যাত ‘বিচিত্রা’ লালবাড়ি তৈরি হয়।

এ ছাড়াও ২৪ চৈত্র [বৃহ 5 Apr 1877] তারিখে তিনি জনৈক রাজকৃষ্ণ অধিকারীর কাছ থেকে ৩২৫০ টাকায় জোড়াসাঁকোয় অবস্থিত একটি বাড়ি ক্রয় করেন।

প্রাসঙ্গিক তথ্য : ২

১১ মাঘ [মঙ্গল 23 Jan 1877] আদি ব্রাহ্মসমাজের সপ্তচত্বারিংশ সাংবৎসরিক অনুষ্ঠিত হয়। প্রাতঃকালীন উপাসনার ‘উদ্বোধন’ হয় দ্বিজেন্দ্রনাথ-রচিত ‘জাগো সকল অমৃতের অধিকারী’ গান দিয়ে। বেচারাম চট্টোপাধ্যায় ও রাজনারায়ণ বসুর বক্তৃতার পর ব্রহ্মসংগীত গীত হয়:

ভৈরবী—ঝাঁপতাল। তৎসৎ ব্ৰহ্মপদ প্রণমি হে দণ্ডবৎ [সত্যেন্দ্রনাথ]।

খট্‌—সুরফাঁকতাল। মঙ্গল তোমার নাম, মঙ্গল তোমার ধাম [ঐ]

সায়ংকালে বেচারাম চট্টোপাধ্যায়ের বক্তৃতা ও নিম্নোক্ত ব্ৰহ্মসংগীতগুলি গাওয়া হয় :

গৌরী—কাওয়ালি। আহা আজি পুলকে পূরিল দিক চারি [জ্যোতিরিন্দ্রনাথ]

গুজরাটী ভজন—যৎ। সৎচিদ্‌ঘন প্রভু পরব্রহ্ম পাবন

ঝিঁঝিট—একতালা। ধন্য ধন্য ধন্য আজি দিন আনন্দকারী [জ্যোতিরিন্দ্রনাথ]

বেহাগ—আড়াঠেকা। বিমল রজত ভাসে, পূর্ণ করি নীলাকাশে [ঐ]

মিশ্র—একতাল। জয় দেব জয় দেব জয় মঙ্গলদাতা [সত্যেন্দ্রনাথ]

ধর্মতত্ত্ব [১১।১, ১৬ মাঘ ও ১ ফাল্গুন] এই অনুষ্ঠান-সম্পর্কে কতকগুলি অতিরিক্ত সংবাদ পরিবেশন করে : ‘ব্রহ্মানুরাগী শ্ৰীযুক্ত বাবু সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপস্থিতিতে কলিকাতা সমাজের কার্য্যপ্রণালী সম্প্রতি কিছু জীবন্ত ভাব ধারণ করিয়াছে। তিনি গত উৎসব রজনীতে একটি উৎসাহকর বক্তৃতা পাঠ করিয়াছিলেন। বিশ্বাসানুযায়ী অনুষ্ঠান এবং স্ত্রীলোকদিগের স্বাধীনতা ভিন্ন সমাজের প্রকৃত উন্নতি হইবে না একথা তিনি স্পষ্টাক্ষরে বলিয়াছেন। সত্যেন্দ্র বাবু যাহা বলেন তাহাতে সার আছে, কারণ তাঁহার জীবন আছে। তিনি এবার সমাজমন্দিরে ঠাকুর পরিবারস্থ মহিলাগণকেও উপাসনার জন্য আনিয়াছিলেন। এই কাৰ্য্যটী উক্ত পরিবারের বহুদিনের পুরাতন বদ্ধভাবকে মুক্ত করিয়া দিয়াছে।’

লক্ষ্য করার বিষয়, আদি ও ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে নানা বিষয়ে যতই বিরোধ থাকুক-না কেন, অন্তত দেবেন্দ্রনাথ ও সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে কেশবচন্দ্রের সুসম্পর্ক আগাগোড়াই বজায় থেকেছে; উপরে উদ্ধৃত অংশে সত্যেন্দ্রনাথ-সম্পর্কে ধর্ম্মতত্ত্ব পত্রিকার মন্তব্য এরই একটি প্রমাণ। আরও একটি প্রমাণ দেখা যায় ২২ মাঘ [শনি 3 Feb] সত্যেন্দ্রনাথ যখন হিন্দু স্কুল থিয়েটারে ‘বঙ্গ-ভাষা-সমালোচনী সভা’য় ‘বঙ্গদেশ ও বোম্বাই’ সম্বন্ধে বক্তৃতা করেন, তখন কেশবচন্দ্র স্বয়ং সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন।

প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৩

নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’, রাজকৃষ্ণ রায়ের ‘অবসর-সরোজিনী’ এবং হরিশ্চন্দ্র নিয়োগীর ‘দুঃখসঙ্গিনী’ কাব্যত্রয় রবীন্দ্রনাথের প্রথম সমালোচনা-মূলক প্রবন্ধের অবলম্বন হয়েছিল। একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে, প্রধানত তাঁর সমালোচক-রূপে আত্মপ্রকাশের উপলক্ষ হওয়ার কারণেই কাব্য তিনটির নাম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত হবার গৌরব লাভ করেছে। বস্তুত ‘রাজকৃষ্ণ রায় ছাড়া অপর দুজনের ‘সাহিত্য-সাধক’ পরিচয় এই প্রবন্ধের উপজীব্য হবার সৌভাগ্যের উপরই প্রতিষ্ঠিত।

নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় [২২ আষাঢ় ১২৬০, 5 Jul 1853–১১ ভাদ্র ১৩২৯, 28 Aug 1922]-এর ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ ১ম ভাগ প্রথম প্রকাশিত হয় অগ্রহায়ণ ১৭৯৭ শকে [28 Dec 1875]। কাব্যটির দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয় ভাদ্র ১৭৯৯ শকে [18 Nov 1877]। অবশ্য প্রথম ভাগটিই রবীন্দ্রনাথের সমালোচনার উপলক্ষ ছিল। ১১৩ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থে সতেরোটি কবিতা ছিল : ১। পিঞ্জরের বিহঙ্গিনী, ২। অকৃতজ্ঞ যুবক, ৩। হিমালয় বিলাপ, ৪। অলস-যুবক, ৫। দরিদ্র-যুবক, ৬। জন্ম-ভূমি, ৭। শৈশব-স্বপন, ৮। কেন এত ভালবাসি? ৯। ১৯এ এপ্রেল ১৮৭৫, ১০। দুঃখিনী মহিষী, ১১। আর্য্যসঙ্গীত, ১২। বাঙ্গালীর জ্ঞানালোক, ১৩। উন্মাদিনী, ১৪। নীলাম্বরে কাল মেঘ, ১৫। বঙ্গ-দম্পতির পরিণাম, ১৬। শারদীয় প্রদোষ, ১৭। ভারতে গোলাপ।৩৫ এই কবিতার অনেকগুলি অক্ষয়চন্দ্র সরকার-সম্পাদিত সাধারণী-তে প্রকাশিত হয়, বস্তুত তিনি ‘ভুবনমোহিনী দেবী’র কবিতার একজন অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। নবীনচন্দ্র তাঁর ‘আত্মজীবনী’তে লিখেছেন : “ভুবনমোহিনী প্রতিভা” প্রচারিত হইলে বঙ্গীয় সাহিত্য সংসারে একটা বিশেষ আন্দোলন উপস্থিত হইল। তাহার কারণ, ইহা ভুবনমোহিনী দেবী নামিকা কোন বঙ্গীয় স্ত্রী লোকের রচিত, এই সংস্কারের বশবর্তী হইয়া নানা জনে নানা প্রকার সমালোচনা আরম্ভ করিল।’৩৬ ১৬ ফাল্গুন ১২৮২-র সাধারণী-তে ও ২৬ চৈত্র ১২৮২-র এডুকেশন গেজেট-এ কাব্যটির সপ্রশংস সমালোচনা করা হয়। রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে এই দুটি সমালোচনার উল্লেখ করেছেন। তিনি তাঁর প্রবন্ধে এই গ্রন্থ থেকে যে কাব্যাংশটি উদ্ধৃত করেছেন, তা ‘পিঞ্জরের বিহঙ্গিনী’ কবিতার অন্তর্গত। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, রবীন্দ্রনাথ শ্রাবণ ১২৯০ সংখ্যা ভারতী-তে নবীনচন্দ্রের ‘সিন্ধুদূত’ [22 Jun 1883] কাব্যের ‘সংক্ষিপ্ত সমালোচনা’ করেন।

রাজকৃষ্ণ রায় [21 Oct 1849-11 Mar 1894]-রচিত ‘অবসর-সরোজিনী’ ১ম ভাগ প্রকাশিত হয় বৈশাখ ১২৮৩ [13 May 1876]-তে। কাব্যটির দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয় ১২৮৬ সালে [18 Sep 1879]; তৃতীয় ও চতুর্থ ভাগ গ্রন্থাবলীর দ্বিতীয় ও চতুর্থ ভাগের অন্তর্গত হয়ে যথাক্রমে ১২ পৌষ ১২৯২ [1885] ও ১ ফাল্গুন ১২৯৫ [1889] প্রকাশিত হয়। রাজকৃষ্ণ রায় বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী ছিলেন—কবিতা, নাটক, প্রহসন, গীতিনাট্য, উপন্যাস, ছোটোগল্প, রামায়ণ ও মহাভারতের পদ্যানুবাদ প্রভৃতি ছাড়াও তিনি ‘ভারতকোষ’ নামক অভিধান সম্পাদনা ও ‘রুসিয়ার ইতিহাস’ রচনা করেছিলেন; এছাড়া বীণা মাসিক পত্রিকার সম্পাদনা ও ‘বীণা-রঙ্গভূমি’র পরিচালনা তাঁর অন্যতম কীর্তি। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতি-তে রাজকৃষ্ণ-সম্পর্কে একটি কৌতুককর কাহিনী উল্লেখ করেছেন, তাছাড়া ১৬ ফাল্গুন ১২৮৭ [26 Feb 1881] ‘বিদ্বজ্জন-সমাগম’ উপলক্ষে অভিনীত বাল্মীকি প্রতিভা-র তিনি অন্যতম দর্শক ছিলেন ও অভিনয়-দর্শনে মুগ্ধ হয়ে ‘বালিকা-প্রতিভা’ নামে একটি কবিতা লেখেন। এই পরিচিতির সূত্রেই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে ‘অবসর সরোজিনী’ সম্পর্কেই দীর্ঘতর আলোচনা করেছেন। সমালোচনার সুরটি অবশ্য কঠোর : ‘রাজকৃষ্ণবাবু যশপ্রাপ্তির জন্য কবিতা লিখিয়াছেন, নহিলে তিনি বিদেশীয় কবিতার ভাব সংগ্রহ করিয়া নিজের বলিয়া দিতেন না এই মন্তব্য করে তিনি Herrick ও Moore-এর কবিতার সঙ্গে রাজকৃষ্ণের কবিতার সাদৃশ্য দীর্ঘ উদ্ধৃতি সহযোগে প্রদর্শন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘রাজকৃষ্ণবাবু তাঁহার কবিতার নিন্দা শুনিলে মর্ম্মান্তিক ক্ষুব্ধ হইবেন’—তাঁর আশঙ্কা ভিত্তিহীন ছিল না। রবীন্দ্রনাথের সমালোচনার পিছনে অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর প্রভাব অনুমান করেই ‘উদাসিনী’ প্রকাশের [1874] দীর্ঘকাল পরে রাজকৃষ্ণ স্ব-সম্পাদিত বীণা পত্রিকায় [১২৮৬] গ্রন্থটির সমালোচনা করেন : ‘…তিনি উচ্চ দরের লেখক না হইলেও একজন ভাল লেখক বটেন। … কিন্তু উদাসিনীর গল্পটি চোরাই মাল। গ্রন্থকার কবিবর গোল্ডস্মিথের সন্ন্যাসী (Hermit) নামক পদ্যটি সাজাইয়াছেন। পাঠকগণ উদাসিনীর সহিত ইংরাজ কবির সন্ন্যাসী মিলাইয়া দেখিবেন।’৩৭ হুল ফোটানোর উদ্দেশ্য না থাকলে এতদিন পরে গ্রন্থটির এ ধরনের সমালোচনা—তাও ‘গ্রন্থখানি ক্রয়’ করে—একটু অস্বাভাবিক মনে হয়।

হরিশ্চন্দ্র নিয়োগী [1854-5 Apr 1930]-রচিত ‘দুঃখসঙ্গিনী’ ১২৮২ সালে [20 Oct 1875] প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন পত্রিকায় কাব্যগ্রন্থটি সপ্রশংসভাবে সমালোচিত হয়েছিল।

প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৪

এ বৎসর হিন্দুমেলার একাদশ বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় রাজা বদনচাঁদের টালার বাগানে। মাঘ-সংক্রান্তি [২৯ মাঘ শনি 10 Feb] থেকে উৎসবের সূচনা হলেও মূল অধিবেশনের জন্য ৮ ফাল্গুন [রবি 18 Feb 1877] তারিখটি নির্দিষ্ট ছিল। কিন্তু অপ্রত্যাশিত গোলযোগের জন্য সভা ও অন্যান্য অনুষ্ঠান পরিত্যক্ত হয়। বিষয়টি নিয়ে একটু বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজন, কারণ যথার্থ অনুসন্ধানের অভাবে এই গোলযোগটি পূর্ব বৎসরে [1876] সংঘটিত হয়েছিল বলে অনেকের ধারণা হয়েছে, যোগেশচন্দ্র বাগলও ‘হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে সেইভাবেই বর্ণনা করেছেন; অথচ বর্তমান বৎসরের মেলার বর্ণনা-প্রসঙ্গে সাধারণী-র প্রতিবেদন থেকে ‘আমরা নিরাশ মনে নবগোপাল বাবুকে অভিসম্পাত করিয়া ফিরিয়া আসিতেছিলাম’ উক্তিটি বিভিন্ন স্থানে উদ্ধৃত হয়েছে, কিন্তু প্রতিবেদকের নৈরাশ্য ও অভিসম্পাতের কারণটি খুঁজে দেখা হয়নি। এই ভ্রান্তির মূলে আছে বিপিনচন্দ্র পালের আত্মজীবনী Memories of My Life and Times in the Days of My Youth [1932] গ্রন্থের ২৬৬-৬৮ পৃষ্ঠায় [‘নবযুগের বাংলা’ (১৩৬২) গ্রন্থে সংকলিত ‘হিন্দু মেলা ও নবগোপাল মিত্র’ প্রবন্ধের ১৪৬-৪৯ পৃষ্ঠাতেও ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে] ঘটনার বিবরণে একটি ভুল তারিখের ব্যবহার। তিনি লিখেছেন, ‘In 1876, I joined his [Nabogopal Mitra’s) gymnastic class at 1, Sankar Ghosh’s Lane. Early in the spring of this year, the Hindu Mela was held in the Garden House of Raja Badan Chand at Tala. …It was here at this Mela that I first came into conflict with Anglo-Indian arrogance and police agression.’ বিপিনচন্দ্র ঘটনাটির যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে কোনো ভুল নেই, কিন্তু ঘটনাটি 1876-এ নয়, 1877-এর মেলায় ঘটেছিল। এ সম্পর্কে সমাচার চন্দ্রিকা-য় [৬৫।১৬২, ১০ ফাল্গুন 20 Feb 1877] লেখা হয়:

গত রবিবার রাজা বদনচাঁদের টালার বাগানে হিন্দুমেলা হইয়া গিয়াছে। আমরা এই মেলায় উপস্থিত ছিলাম না বটে, তবে আমরা আমাদিগের দুই তিন জন বন্ধুর নিকট শুনিলাম যে মেলায় লঙ্কাকাণ্ডের অভিনয় হইয়াছিল।…যে স্থলে ব্যায়াম ক্রীড়া হইতেছিল, তথায় কোন এক জন সম্ভ্রান্ত সাহেব বিবি লইয়া উপস্থিত হন। শুনিলাম ঐ সাহেব নাকি একজন ক্যান্টনমেন্ট মাজিস্ট্রেট। তিনি এবং তাঁহার বিবি ক্রীড়া স্থলে উপবেশন করিবার জন্য দুইটী এদেশীয় যুবককে কাষ্টাসন পরিত্যাগ করিতে বলিলেন। যুবকদ্বয় সাহেবের কথা গ্রাহ্য করিল না। ইহাতে প্রথমত বাক্‌বিতণ্ডার অভিনয় হয়, শেষে হাতাহাতি হইয়া থানা পুলিস পর্যন্ত এই অভিনয় গড়াইয়াছে। সাহেবকে নাকি উত্তম প্রহার করা হইয়াছিল। তিনি প্রহার খাইয়াই পুলিসের আশ্রয় লন। তৎপরে দুই তিন জন কনষ্টেবল আসিয়া একজন নিরপরাধী যুবককে ধৃত করিয়া লইয়া যাইতেছিল, এমত সময় উনবিংশ শতাব্দির জন কয়েক বাঙ্গালী বীর উহাকে পুলিসের হস্ত হইতে ছড়াইয়া লইবার জন্য চেষ্টা করিতে যান। তাঁহাদের চেষ্টা নিতান্ত বিফল হয় নাই। কিন্তু সেই চেষ্টায় রাম রাবণের পালা আরম্ভ হইল। একজন কনষ্টেবল এই সংবাদ থানায় দেওয়ায় থানার যাবতীয় কনষ্টেবল এবং প্রধান প্রধান কর্ম্মচারী ক্রোধে প্রজ্বলিত হইয়া রণবেশে বাগান আক্রমণ করিল। তৎকালে, আমরা যাহাদিগকে উনবিংশ শতাব্দির বীর বলিয়া উল্লেখ করিয়াছি, তাহারা চম্পট দিয়াছিল। শেষে পুলিসের লোকেরা বাগান মধ্যে হল্লা করিয়া প্রবেশ করত দুইজন নিরপরাধী যুবককে ধৃত করিয়া লইয়া গিয়াছে।

প্রায় এক মাস পরে উক্ত পত্রিকাতেই [৬৫।১৮৬, ৮ চৈত্র 21 Mar] সংবাদ দেওয়া হয়, ‘শুনা গেল, হিন্দুমেলার দাঙ্গা ঘটিত মোকর্দ্দমার চুড়ান্ত নিষ্পত্তি হইয়া গিয়াছে। এই মোকর্দ্দমায় সাহেব ফরিয়াদী, এদেশীয় আসামী। সাহেবের জয় সর্ব্বত্রই। আসামীর মধ্যে একজনের [‘নবগোপাল নিত্ৰ মহাশয়ের কুটুম্ব, তাঁহার জামাতার সহোদর। ইনি হাওড়া গভর্ণমেন্ট স্কুলের ব্যায়াম শিক্ষক বা জিমন্যাষ্টিক মাষ্টার ছিলেন’ —নবযুগের বাংলা। ১৫৯] ৫০ টাকা এবং আর একজনের [বিপিনচন্দ্র] ২০ টাকা জরিমানা হইয়াছে।’ বিপিনচন্দ্র পালের প্রদত্ত বর্ণনা আরও বিস্তৃত, কিন্তু মূল ঘটনার বিবরণ—এমন-কি জরিমানার পরিমাণও—উভয়ত এক। সুতরাং সাধারণী-র প্রতিবেদকের নৈরাশ্য ও অভিসম্পাতের এইটিই কারণ।

বালক অবনীন্দ্রনাথও এই দিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। মেলার একটি নিখুঁত বর্ণনা তিনি দিয়েছেন ঘরোয়া [পৃ ৮৬-৮৮]-তে। অবশ্য তাঁর বর্ণনায় ‘স্বর্ণবাঈ ছিল সেকালের প্রসিদ্ধ বাঈজী, তারই জন্য কী একটা হাঙ্গামার সূত্রপাত হয়’ উক্তিটি ঠিক নয়—হাঙ্গামার উৎপত্তি কিভাবে ঘটেছিল, তা আমরা আগেই জেনেছি।

প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৫

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে 1876-এ একটি আইন বিধিবদ্ধ হয় যার দ্বারা যুক্তরাজ্য ও তার অধীনস্থ দেশগুলির রানী ভিক্টোরিয়া অন্যান্য উপাধিতে ভূষিত হবার অধিকার লাভ করেন [‘to enable Her Most Gracious Majesty to make an addition to the Royal Style and Titles appertaining to the Imperial Crown of the United Kingdom and its dependencies’] এবং সেই অধিকারবলে 28 Apr 1876 তারিখে একটি ঘোষণা [‘Proclamation’] দ্বারা তিনি ‘ভারত-সম্রাজ্ঞী’ [‘Empress of India’] উপাধি গ্রহণ করেন। সাম্রাজ্যবাদী বড়োলাট লর্ড লিটন এই সুযোগে 18 Aug 1876-এ ঘোষণা করেন 1 Jan 1877 [সোম ১৮ পৌষ ১২৮৩] তারিখে ভিক্টোরিয়ার নূতন উপাধি গ্রহণ উপলক্ষে ভারতের পূর্বর্তন রাজধানী দিল্লিতে একটি রাজকীয় দরবার অনুষ্ঠিত হবে। এই বিরাট দেশের প্রতি মহারানীর বিশেষ আগ্রহ এবং বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যের রাজা ও প্রজাদের আনুগত্য সম্বন্ধে তাঁর পূর্ণ বিশ্বাস আছে বলেই তিনি এই নূতন উপাধি গ্রহণ করেছেন—এইটি প্রতিপন্ন করাই দরবারের ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল [‘to hold at Delhi, on the first day of January 1877, an Imperial Assemblage for the purpose of proclaming to the Queen’s subjects throughout India the gracious sentiments which have induced Her Majesty to make to Her Sovereign Style and Titles an addition specially intended to mark Her Majesty’s interest in this great Dependency of Her Crown, and Her Royal Confidence in the loyalty and affection of the Princes and Peoples of India.’) । ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষত মাদ্রাজে, তখন দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তারই মাঝখানে প্রভূত অর্থব্যয়ে দিল্লিতে রাজকীয় দরবার এবং অন্যান্য প্রাদেশিক রাজধানীতে ‘ছোটা দরবার’ ও বিভিন্ন জেলাশহরে ঘোষণা-পাঠ ও আনন্দানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সমাচার চন্দ্রিকা-য় [৬৫।১২৪, ২১ পৌষ, 4 Jan] ‘তারের খবর’-এ দিল্লির দরবারের নিম্নলিখিত বর্ণনা প্রকাশিত হয়:

গবর্ণর জেনেরলের তাঁবুর দেড় ক্রোশ উত্তরে দরবারের তাঁবু সংস্থাপিত হয়। এই দরবারে ৬৩ জন দেশীয় রাজা, মান্দ্রাজ এবং বোম্বায়ের গবর্ণরদ্বয় এবং পঞ্জাব, বঙ্গদেশ ও উত্তরপশ্চিম প্রদেশের লেপ্টেনান্ট গবর্ণরগণ, কমাণ্ডার ইন চিফ বাহাদুর এবং এতদ্ব্যতীত বিস্তর নিমন্ত্রিত ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। এতদুপলক্ষে ১৫ হাজার সৈন্য উপস্থিত ছিল।…গবর্ণর জেনের ঠিক মধ্যাহ্ন সময়ে দরবার স্থলে উপস্থিত হয়েন। তিনি উপনীত হইয়া সিংহাসনে উপবেশন করিলে মহারাজ্ঞীর রাজ রাজেশ্বরী উপাধি ইংরাজী ও উর্দু ভাষায় পঠিত হয়…গবর্ণর জেনেরলের বক্তৃতা শেষ হইলে সিন্ধিয়া, কাশ্মীর, জয়পূরের মহারাজারা ভূপালের বেগম এবং স্যার সালার জঙ্গ বাহাদুর অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করেন। অন্যান্য কতকগুলি রাজা, এতৎসম্বন্ধে আপনাপন অভিপ্রায় ব্যক্তি করিবার ইচ্ছা করিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহাদের মনোভিলাষ সিদ্ধ হয় নাই।—৩৯ জনকে ভারত নক্ষত্র উপাধি দেওয়া হইয়াছে, এবং বিস্তর মুসলমান ও হিন্দুকে মাননীয় উপাধি প্রদত্ত হইয়াছে।

কলকাতায় গড়ের মাঠে একটি বিরাট মণ্ডপ নির্মাণ করে প্রায় চার হাজার আমন্ত্রিত ব্যক্তির উপস্থিতিতে ‘ছোটা দরবার’ অনুষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্সি বিভাগের কমিশনার মিঃ বাকলাণ্ড [C.E. Buckland, C.I.E.] ঘোষণাপত্র পাঠ করেন ও বক্তৃতা দেন। কৃষ্ণদাস পাল বাংলায় ও মীর মহম্মদ আলী উর্দু ভাষায় লিখিত ভাষণ পাঠ করেন। সমাচার চন্দ্রিকা-র [৬৫।১২২, ১৯ পৌষ, 2 Jan] বিবরণ অনুযায়ী ৬১ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি মিঃ বাকলাণ্ডের হাত থেকে বিশেষ সম্মান-পত্র গ্রহণ করেন, যাঁদের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাম হল : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, কেশবচন্দ্র সেন, মহেন্দ্রলাল সরকার, কৃষ্ণদাস পাল, মানকজি রুস্তমজী, কানাইলাল দে, তারকনাথ প্রামাণিক, জগদানন্দ মুখোপাধ্যায়, শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভৃতি। সৈন্যদের কুচকাওয়াজ, ১০১ বার তোপধ্বনি ও সন্ধ্যার পর প্রায় পনেরো হাজার টাকার আতশবাজি পুড়িয়ে এই মহোৎসব সমাধা হয়। বিভিন্ন জেলাশহরেও দিনটি বিশেষভাবে পালিত হয়।

উপরের তালিকায় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে দেবেন্দ্রনাথের নামও দেখা যায়। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ নিজে দরবারে উপস্থিত থেকে সম্মান-পত্র গ্রহণ করেছিলেন কিনা সে-সম্বন্ধে আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। খুব সম্ভব তিনি দরবারে হাজির হননি, কারণ রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত কাগজপত্রের মধ্যে 6 Jan 1877 তারিখে লিখিত Under Secretary to the Government of Bengal, Political Department-এর একটি পত্র পাওয়া যায়, যাতে দেবেন্দ্রনাথকে জানানো হয়েছে ভিক্টোরিয়ার ভারত-সম্রাজ্ঞী উপাধি গ্রহণ উপলক্ষে তাঁকে একটি Certificate of Honour দেওয়া হবে; তিনি দরবারে উপস্থিত থাকলে এই পত্র লেখার কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখা দিত না। সম্মান-পত্রটিও উপরোক্ত কাগজপত্রের মধ্যে পাওয়া গেছে:

By command of his Excellency the Viceroy and Governor-General this certificate is presented in the name of Her Most Gracious Majesty Victoria, Empress of India, to Baboo Debendra Nath Tagore in recognition of his position as son of the late esteemed Baboo Dwaraka Nath Tagore. Head of the Conservative Brahmoo.

January 1st, 1877

Sd/- Richard Temple.

প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৬

দেশীয় সংবাদপত্র সংক্রান্ত আইন বা Vernacular Press Act (Act IX of 1878) লর্ড লিটনের শাসনকালের অনেকগুলি কলঙ্কের অন্যতম। 14 Mar 1878 [বৃহ ২ চৈত্র ১২৮৪] বড়োলাটের কাউন্সিলের একটিমাত্র অধিবেশনে বিশেষ আলোচনা ছাড়াই আইনটি গৃহীত হয়। এই আইনের বলে গবর্মেন্ট কোনো মামলা-মোকদ্দমা ছাড়াই বিদ্রোহাত্মক [অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে সরকার-বিরোধী] রচনার জন্য দেশীয় সংবাদপত্রের সম্পাদক, মুদ্রাকর বা প্রকাশককে শাস্তি দেবার অপ্রতিহত ক্ষমতা লাভ করেন। ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলি এই আইনের আওতায় পড়েনি।

1878-এ আইনটি বিধিবদ্ধ হলেও এর প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল অনেক আগেই। 1870-তে বিদ্রোহাত্মক লেখা বন্ধ করার জন্য ভারতীয় দণ্ডবিধিতে একটি নূতন ধারা Section 124A যুক্ত হয়। কিন্তু বাংলার লেফটেনান্ট গভর্নর সার জর্জ ক্যাম্বেল কঠিনতর আইন প্রণয়নের জন্য লর্ড নর্থব্রুকের কাছে সুপারিশ করেন। ক্যাম্বেলের বিচিত্র খামখেয়ালিপনা, বিশেষত তাঁর শিক্ষানীতির জন্য তিনি দেশীয় সংবাদপত্রগুলির কঠোর সমালোচনার লক্ষ্য হয়েছিলেন। লর্ড নর্থব্রুক এই সুপারিশ গ্রহণ করেননি। কিন্তু 1875-এ বরোদার গাইকোয়াড়ের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ রেসিডেন্ট কর্নেল ফেয়ারকে বিষপ্রয়োগের হত্যার চেষ্টার অভিযোগ উপস্থিত হলে শিশিরকুমার ঘোষ-সম্পাদিত দ্বিভাষিক অমৃতবাজার পত্রিকা-য় দুটি সমালোচনা-মূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধ দুটি Pall Mall Gazette-এ উদ্ধৃত হলে সেক্রেটারি অব স্টেট লর্ড সলিসবেরি বড়োলাট লর্ড নর্থব্রুককে লেখেন, যদি সম্ভব হয় ও প্রয়োজন দেখা দেয়, তবে অমৃতবাজারের সম্পাদককে গ্রেপ্তার করা উচিত। লর্ড নর্থব্রুক অবশ্য সরকারি কর্মচারীদের সম্বন্ধে কয়েকটি নিষেধাজ্ঞা প্রচার ছাড়া এ-বিষয়ে অধিকদূর অগ্রসর হননি। 1876-এ তিনি পদত্যাগ করলে তাঁর জায়গায় এলেন সাম্রাজ্যবাদের গোঁড়া প্রতিনিধি লর্ড লিটন। বাংলার নবনিযুক্ত [8 Jan 1877] ছোটোলাট সার অ্যাসলি ইডেন বাংলা সংবাদপত্রের রাজদ্রোহমূলক লেখার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে অমৃতবাজার, সোমপ্রকাশ, সাধারণী, ভারত মিহির প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি আপত্তিকর অংশের অনুবাদ লিটনের কাছে প্রেরণ করেন। তিনি সব প্রাদেশিক গবর্মেন্টের কাছে মতামত চেয়ে পাঠালে মাদ্রাজের গবর্নর ডিউক অব বাকিংহাম লেখেন যে, তাঁর মতে এ ধরনের আইনের কোনো প্রয়োজন নেই—কেননা প্রজার মুখ বন্ধ করার চেয়ে তাকে স্বাধীনভাবে রাজার কার্যকলাপ সম্বন্ধে সমালোচনা করতে দেওয়া সভ্য ও বুদ্ধিমান রাজা মাত্রেরই কর্তব্য। কেউ কেউ প্রস্তাবিত আইন দেশীয় ও ইংরেজি সংবাদপত্রের উপর অপক্ষপাতে প্রয়োগের পরামর্শ দেন। কিন্তু সব কিছু উপেক্ষা করে লর্ড লিটন কেবলমাত্র দেশীয় সংবাদপত্রসমূহের কণ্ঠরোধ করার আয়োজন করেন।

সার অ্যাসলি ইডেনের মূল লক্ষ্য ছিল অমৃতবাজার-সম্পাদক শিশিরকুমারকে দমন করা। কিন্তু শিশিরকুমার দ্বিভাষিক অমৃতবাজার-কে প্রায় রাতারাতি ইংরেজি সাপ্তাহিকে পরিণত করে এই আইনের বেড়াজালের বাইরে চলে যান। সোমপ্রকাশ-সম্পাদক মুচলেকা [Bond] দিতে অস্বীকার করে পত্রিকা বন্ধ করে দেন। পরে Apr 1880 থেকে অবশ্য পত্রিকাটি পুনঃপ্রকাশিত হতে থাকে। এই আইনের প্রতিবাদে ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে 17 Apr 1878 [বুধ ৫ বৈশাখ ১২৮৫] তারিখে টাউন হলে একটি বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে প্রেরিত বহু সমর্থনসূচক পত্র ও টেলিগ্রাম এই সভায় পঠিত হয়। সভার প্রস্তাব-অনুযায়ী এই আইন রদ করার প্রার্থনা জানিয়ে একটি দরখাস্ত ইংলণ্ডের পার্লামেন্টে বিরোধী দলের নেতা গ্ল্যাডস্টোন [1809-98]-এর নিকট প্রেরিত হয়। তিনি পালামেন্টে একটি বিরোধী প্রস্তাব আনলে অনেক বিচার-বিতর্কের পর ১৫২-২০৮ ভোটে প্রস্তাবটি বাতিল হয়। অবশ্য বিলাতে মন্ত্রীসভা পরিবর্তিত হলে লর্ড রিপনের [1880-84] শাসনকালে 1882-তে এই আইন রদ হয় ও দেশীয় সংবাদপত্রগুলি তাদের স্বাধীনতা ফিরে পায়।

কিন্তু তথ্যানুসন্ধানী পাঠক সতর্কতা-সহকারে উপরে বর্ণিত ইতিহাসটি পর্যালোচনা করলে বুঝতে পারবেন, রবীন্দ্রনাথের ‘দিল্লী দরবার’ কবিতাটি সাময়িকপত্রে প্রকাশিত না হওয়ার কারণ হিসেবে Vernacular Press Act-কে অন্তত দায়ী করা যায় না। কারণ কবিতাটি হিন্দুমেলায় পঠিত হয় ৮ ফাল্গুন ১২৮৩ [রবি 18 Feb 1877] তারিখে এবং আইনটি বিধিবদ্ধ হয় ২ চৈত্র ১২৮৪ [বৃহ 14 Mar 1878] তারিখে অর্থাৎ এক বৎসরেরও বেশি সময় পরে। সুতরাং কবিতাটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে না থাকলে তার কারণ অন্যবিধ বলে অনুমান করতে হবে; মেলার দিনে যে মারামারি হয়েছিল এবং একটি মামলা পুলিস-আদালতে বিচারাধীন ছিল, কবিতাটি প্রকাশিত হলে এটিই সেই উত্তেজনা-সৃষ্টির মূল কারণ রূপে ব্যাখ্যাত হতে পারে—এমন আশঙ্কা থেকেই হয়তো হিতৈষীরা এটি অপ্রকাশিত রাখা বাঞ্ছনীয় মনে করেছিলেন।

প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৭

পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উদ্ভাবিত একটি গুপ্তভাষায় সঞ্জীবনী সভা-র কার্যবিবরণী লিখিত হত। ইটালির কার্বোনারি-সম্প্রদায়ের মধ্যেও এইরূপ গুপ্তভাষার প্রচলন ছিল। যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ লিখেছেন : ‘[বন্ধুবান্ধবদিগের] সহিত ম্যাটসিনির এরূপ সঙ্কেত ছিল যে, তিনি জননীকে যে চিঠি লিখিবেন, তাহার একটি অন্তর প্রত্যেক পদের প্রথম অক্ষরগুলি একত্র করিলে যে লাটিন্ পদগুলি প্রস্তুত হইবে, সেইগুলিই তাঁহাদিগের মনোযোগের বিষয়।’৩৮ এই ধরনের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যে গুপ্তভাষা সৃষ্টি করলেন, তার কৌশলটি এইরূপ:

আকার স্থানে অকার ॥ অকার স্থানে আকার ॥ই স্থানে উ॥ঈ স্থানে ঊ॥উ স্থানে ই॥ঊ স্থানে ঈ ॥এ স্থানে ঐ॥ঐ স্থানে এ ॥ও স্থানে ঔ ॥ঔ স্থানে ও।। ক খ গ ঘ স্থানে গ ঘ ক খ ॥চ ছ জ ঝ স্থানে জ ঝ চ ছ ॥ট ঠ ড ঢ স্থানে ড ঢ ট ঠ।। ত থ দ ধ স্থানে দ ধ ত থ।। প ফ ব ভ স্থানে ব ভ প ফ।। শ ষ স স্থানে হ ॥হ স্থানে স।। র স্থানে ল ॥ল স্থানে র॥ম স্থানে ন ॥ন স্থানে ম ॥

এই পদ্ধতি অনুসারে:

স ন্ জী ব নী স ভা

হা ম্‌ চূ পা মূ হা ফ্‌।৩৯

উল্লেখ্য, ১৩২১ বঙ্গাব্দে ভারতী-তে ‘জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হওয়ার সময়ে অগ্র-সংখ্যায় অনুলেখক বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় সাংকেতিক ভাষার পাঠোদ্ধার করার জন্য পাঠকদের আহ্বান জানালে [পৃ ৭৬২] কৃষ্ণপ্রসন্ন পাল ফাল্গুন-সংখ্যায় [‘সাঙ্কেতিক ভাষা’, পৃ ১০৩২-৩৩] এই লিপির পাঠোদ্ধার করেন।

প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৮

এই স্বদেশী দেশলাই-প্রসঙ্গে সমাচার-চন্দ্রিকা-র ১১ ফাল্গুন বুধ 21 Feb 1877 [৬৫। ১৬৩] সংখ্যায় একটি দীর্ঘ সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয় :

একটি শুভ চিহ্ন।/আজ আমরা একটি নূতন দেশলায়ের বাক্স দেখিলাম। বাক্সটীর আকার বিলাতি ব্রায়ান্ট এবং মের সেফটিম্যাচের ছোট বাক্সের ন্যায়। পাতলা দেবদারু কাঠেই সুন্দর রূপে বাক্সটী নির্মিত হইয়াছে। দুই ধারে দেশলাই ঘষিবার মসলা মাখান। কাঠিগুলি দেবদারু কাঠের না হইয়া বাঁসের করা হইয়াছে, ঘর্ষণ মাত্রেই উত্তম জ্বলিয়া উঠিল, কিন্তু একটু ঠাণ্ডা লাগিলে বাঁসের কাষ্ঠ যেমন সহজেই শীতল হইয়া জ্বলন শক্তির হ্রাস হয় এগুলিকেও সে দোষ হইতে মুক্ত দেখিলাম না। নির্ম্মাতারা আজিও বাজারে বাহির করিতে পারেন নাই, বোধ হয় শীঘ্রই বাহির হইবে। সাধারণকে আমাদের বিশেষ অনুরোধ যেন সকলেই এখন হইতে এই দেশলাই ক্রয় করেন, এখন যে দোষ আছে অবশ্যই নূতন অবস্থায় দুই একটি দোষ দেখিতে পাইবেন, কোন কাৰ্য্যই প্রথমে একেবারে নির্দ্দোষ হইতে পারে না, লোকের উৎসাহ পাইলে ক্রমে অবশ্যই সে সমস্ত দোষ চলিয়া যাইবে। …আমরা এই দেশলাই প্রস্তুতকারী বাবু মহেন্দ্রনাথ নন্দিকে তাঁহার বিপুল পরিশ্রমের জন্য অন্তরের সহিত ধন্যবাদ দিয়া একটি অনুরোধ করি যেন তিনি অগ্রে উত্তম রূপে পরীক্ষা করিয়া বাজারে বাহির করেন।

এর পরে লেখক এই স্বদেশী দেশলাই দ্বারা কিভাবে দেশের অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামাজিক উন্নতি সম্ভব হবে এ-সম্বন্ধে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন।

আমরা সঞ্জীবনী সভার প্রতিষ্ঠা ও আয়ুষ্কাল সম্পর্কে যে সময় নির্দেশ করেছি, তার যাথার্থ্য এই সম্পাদকীয়টি দ্বারা প্রতিপন্ন হতে পারে।

কাপড়ের কল সম্পর্কেও উক্ত পত্রিকায় কিছু সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। ১ চৈত্র মঙ্গল 13 Mar 1877 [৬৫। ১৮০] সংখ্যায় ‘সংবাদসার’ শিরোনামায় লিখিত হয়: ‘হিন্দু হিতৈষিণী বলেন, বাবু দীননাথ সেনের বস্ত্রের কল ক্রয় করিবার জন্য কুমারখালী হইতে দীনবন্ধু প্রামাণিক আমাদিগকে পত্র লিখিয়াছেন।… বাবু মহেন্দ্রনাথ নন্দীও একটি বস্ত্রের কল প্রস্তুত করিয়াছেন, তাহাতে এক ঘণ্টায় একখানি বস্ত্র হইতে পারে, ইহা হইলে দীন বাবুর যন্ত্র অপেক্ষা উহার উৎকৃষ্টতা স্বীকার করিতে হয়।…’

বোঝা যায়, উক্ত মহেন্দ্রনাথ নন্দী-ই সঞ্জীবনী সভা-র পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। কিন্তু তিনি ছাড়াও আরও অনেকে যে যন্ত্রবিদ্যা আয়ত্ত করার চেষ্টা করছিলেন, তার কথা আমরা জানতে পারি উক্ত পত্রিকার ২৪ চৈত্র বৃহ5 Apr 1877 [৬৫।১৯৯] সংখ্যায় প্রদত্ত একটি সংবাদ থেকে:

আমরা শুনিয়া সন্তুষ্ট হইলাম বাবু দেবেন্দ্রনারায়ণ বসাক কলিকাতায় একটি তেলের কল বাষ্প দ্বারা চেষ্টা পাইতেছে, বাবু সীতানাথ ঘোষ, বাবু মহেন্দ্রনাথ নন্দী ও বাবু দীননাথ সেন, বস্ত্র বুনিবার কল প্রস্তুত করিয়াছেন—পাথুরিয়াঘাটার বাবু আনন্দচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মুদ্রাযন্ত্ৰ নিৰ্মাণ করিয়াছেন, বাবু গিরীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সূতার কল প্রস্তুত করিয়াছেন বাবু মহেন্দ্র নাথ নন্দী দেশলাই প্রস্তুত করিয়াছেন। কোন বিষয়ই এদেশীয় বুদ্ধির অগম্য নয়। ইঁহারা যদ্যপি বিজ্ঞান চর্চা করেন তাহা হইলে আমাদিগকে বিদেশীয়দিগের বশতপন্ন থাকিতে হয় না।

এই পরিপ্রেক্ষিতে সত্যপ্রসাদকে কুপার্স হিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে এবং রবীন্দ্রনাথকে ‘সূক্ষ্মশিল্পাদি অধ্যয়নার্থ’ বিলেতে পাঠানোর পরিকল্পনা একটি অতিরিক্ত তাৎপর্য লাভ করে।

উল্লেখপঞ্জি

জীবনস্মৃতি ১৭। ৩৪২

জীবনের ঝরাপাতা। ১৫

ছিন্নপত্রাবলী। ২২৯, পত্র ১০৭

‘পাগল’ : বিচিত্র প্রবন্ধ ৫। ৪৪৭

দ্র জীবনস্মৃতি ১৭। ৩৪৫

ঐ ১৭। ৩৪৬

রবীন্দ্রজীবনী ১। ৬২

দ্র জীবনস্মৃতি ১৭। ৩৪০

সাধারণী, ৭।১৯, ২২ ফাল্গুন [রবি 4 Mar 1877]। ২২২-২৩

১০ ‘আমার জীবন’ ৪র্থ ভাগ : নবীনচন্দ্র রচনাবলী ৩ [সাহিত্য পরিষৎ সং, ১৩৬৬]। ৫৮-৫৯

১১ দ্র ‘অত্যুক্তি’ : ভারতবর্ষ ৪। ৪৪১-৫৫; বঙ্গদর্শন, কার্তিক ১৩০৯। ৩৭৬-৯১

১২ জীবনস্মৃতি ১৭।৩৪৯

১৩ সজনীকান্ত দাস : আত্মস্মৃতি [১৩৮৪]। ৫৩৩

১৪ রবীন্দ্রনাথ : জীবন ও সাহিত্য। ২০৪

১৫ ‘স্বপ্নময়ী’ : জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নাট্যসংগ্রহ [১৩৭৬]। ৫২১-২৩

১৬ দ্র রবীন্দ্রজীবনী। ৫৬

১৭ রবীন্দ্রনাথ : জীবন ও সাহিত্য। ২০৬

১৮ দ্র রবীন্দ্রসাহিত্যের আদিপর্ব। ২৬১-৬২

১৯ বিপিনচন্দ্র পাল : ‘অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা’, বি.ভা.প., কার্তিক-পৌষ ১৩৬৫।১৫৮

২০ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি। ২৬৬

২১ জীবনস্মৃতি ১৭। ৩৫২

২২ ঐ ১৭ | ৩৫০-৫১

২৩ ঐ ১৭। ৩৫১-৫২

২৪ ঐ ১৭। ৩৫৩

২৫ রবীন্দ্রজীবনী ১। ৫১

২৬ রবীন্দ্রসংগীত। ২৮৫

২৭ দ্র বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস ৩। ৩৬, পাদটীকা ৩

২৮ স্বর্ণকুমারী ও বাংলা সাহিত্য। ৩৩১

২৯ রবীন্দ্রনাথ : জীবন ও সাহিত্য। ২৩৩

৩০ জীবনস্মৃতি ১৭। ৩৪৬

৩১ ঐ ১৭। ৩৪৭

৩২ ঐ ১৭। ৩১০

৩৩ পত্রাবলী। ১৫৫-৫৬, পত্র ১১৫

৩৪ দ্র ঠাকুর বাড়ীর কথা। ১০১-০২

৩৫ সা-সা-চ ৩। ৪৪। ১৭

৩৬ ঐ। ১২।

৩৭ সা-সা-চ ৪। ৫০।১৪ থেকে উদ্ধৃত

৩৮ জোসেফ ম্যাটসিনি ও নব্য-ইতালী : যোগেন্দ্র গ্রন্থাবলী ১ [বসুমতী সং]। ১২

৩৯ দ্ৰ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি। ১৬৭

* আমাদের পূর্বশিক্ষক জ্ঞানবাবু আমাকে কিছু কুমারসম্ভব, কিছু আর দুই-একটা জিনিস এলোমেলোভাবে পড়াইয়া ওকালতি করিতে গেলেন।’জীবনস্মৃতি ১৭। ৩৪১-৪২; রবীন্দ্রজীবনীকার লিখেছেন, তিনি ওকালতি পাস করেন নাই বা শেষ পর্যন্ত পড়েন নাই; কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের B.L. পাসের তালিকায় তাঁহার নাম পাই নাই। ১৯১০ কি ১৯১১ সালে তিনি কয়েক মাসের জন্য শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতা করিতে আসেন। তখন তিনি জরাগ্রস্ত।’ রবীন্দ্রজীবনী ১। ৪৩

এর পুরো নাম ব্রজনাথ দে সরকার। এর পুত্রবধূ মিনতি দে রবীন্দ্রভবনকে জানিয়েছেন : জন্ম ১৮৪৩ সালে হাওড়া জেলার ঝাকড়দহ মাকড়দহ গ্রামে। পিতা জমিদার সনাতন দে সরকার বিদ্যাসাগরের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। ব্রজবাবু হালতু নিবাসী মনমোহন ঘোষের তৃতীয়া কন্যা কাদম্বিনী দেবীকে বিবাহ করেন। তাঁর দুই কন্যা ও এগারো পুত্র। ব্রজবাবু কলিকাতা গবর্মেন্ট সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করে সংস্কৃতে অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েট হন। বিদ্যাসাগর তখন প্রিন্সিপ্যাল। তিনিই মেট্রোপলিটান স্কুল ও কলেজের প্রথম সুপারিন্টেন্টে। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ২৬ ডিসেম্বর ১৯০৭ রাত্রি ১-১০ মিনিটে মারা যান।

* ‘? প্রবোধচন্দ্র ঘোষ’—জীবনস্মৃতি [১৩৬৮]-র ‘তথ্যপঞ্জী’তে প্রদত্ত টীকা, দ্র পৃ ২৪৭, ৭৫॥৪

* গগনচন্দ্র হোমের ‘জীবন-স্মৃতি’ [১৩৩৬] থেকে বিশ্বভারতী পত্রিকা-র কার্তিক-পৌষ ১৩৬৫ সংখ্যায় উদ্ধৃত, পৃ ১৫৯; শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘আত্মচরিত’ [১৩২৫]-এও অনুরূপ বর্ণনা আছে।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি-র অনুলেখক বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন: ‘এ বাড়ীতে পূর্ব্বে নাকি একটা স্কুল ছিল, জ্যোতিবাবুরা শুনিয়াছিলেন; কিন্তু এ বাড়ীর যে কে মালিক, তাহা তাঁহারা তখন ত জানিতেনই না, আজ পর্য্যন্তও জানেন না।’—পৃ ২৬৬; আমাদের অনুমান, রবীন্দ্রনাথের প্রথম স্কুল ক্যালকাটা ট্রেনিং অ্যাকাডেমির পূর্বসূরী ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুল শংকর ঘোষ লেনের যে বাড়িটিতে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, খেলাতচন্দ্র ঘোষের মালিকাধীন সেই বাড়িটির একটি ঘরেই সঞ্জীবনী সভার অধিবেশন বসত।

* বিপিনচন্দ্র পাল ‘হিন্দুমেলা ও নবগোপাল মিত্র’ প্রবন্ধে লিখেছেন : ‘ত্রিপুরা জেলার সরাইল পরগণার অন্তর্গত কালীকচ্ছের খ্যাতনামা ডাঃ মহেন্দ্র নন্দী মহাশয় তখন কলিকাতায় ছিলেন, মেডিক্যাল কলেজ ছাড়িয়া—অথবা কলেজ হইতে বিতাড়িত হইয়া—মহেন্দ্রবাবু তখন পটুয়াটুলি লেনে থাকিয়া একটা নূতন কলের তাঁত উদ্ভাবন করিবার চেষ্টায় ছিলেন। … এরূপ শুনিয়াছি যে শ্রীযুক্ত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় এই তাঁতে তৈয়ারী গামছা মাথায় বাঁধয়া হিন্দুমেলায় উপস্থিত হইয়াছিলেন—লোকে বলে নাচিয়াছিলেন।’—নবযুগের বাংলা [১৩৬২]।১৪৫

তখনও অস্ত্র-আইন লিপিবদ্ধ হয় নাই। সুতরাং বন্দুক-ছোঁড়া বা তরোয়াল-খেলা অভ্যাস করা কঠিন ছিল না। ধাপার মাঠে যাইয়া হিন্দুমেলার বিশিষ্ট কর্মকর্ত্তারা পাখী শিকারের ভান করিয়া বন্দুক-ছোঁড়া অভ্যাস করিবার চেষ্টা করিতেন।’—নব যুগের বাংলা। ১৪৫

* সত্যপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের হিসাব-খাতা থেকে তারিখটি গৃহীত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *