১৪. রবীন্দ্রজীবনের চতুর্দশ বৎসর

চতুর্দশ অধ্যায়
১২৮১ [1874-75] ১৭৯৬ শক ॥ রবীন্দ্রজীবনের চতুর্দশ বৎসর

আমরা গত বৎসরের বিবরণে দেখেছি, রবীন্দ্রনাথ ও সহপাঠীদ্বয়ের শিক্ষাজীবনে বেঙ্গল অ্যাকাডেমি-পর্ব সমাপ্ত হয়েছে; তারপর ‘বিদ্যাসাগরের ইস্কুল’ বা মেট্রোপলিটন স্কুলে ভর্তি হলেও সম্ভবত একদিনও তাঁরা সেই স্কুলে যাতায়াত করেননি। বাড়িতে বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁদের পড়ানোর দায়িত্ব গ্রহণ করে সুফল লাভ করছেন, একথা তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও গুণেন্দ্রনাথকে পত্রে জানিয়েছেন এও আমরা জানি। কিন্তু তিনি কতদিন এই উৎসাহ বজায় রেখেছিলেন, বলা শক্ত; সম্ভবত খুব বেশি দিন নয়। ফলে বর্তমান বৎসরের শুরু থেকেই অন্য ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। ইংরেজি পড়াবার জন্য গৃহশিক্ষক জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য তো ছিলেন-ই, তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন একজন সংস্কৃত শিক্ষক। ‘নিজ হিসাবের কেস বহি/১২৮১-র ১ জ্যৈষ্ঠ [বৃহ 14 May] তারিখের হিসাবে দেখা যায়—‘ব° হরিনাথ ভট্টাচার্য্য/দ° সোম রবী সত্যপ্রসাদবাবুদিগের/পণ্ডিত/বৈশাখ মাসের বেতন শোধ… ৮৲’ [অন্যত্র ‘সংস্কৃত পড়াইবার পণ্ডিত’ কথাটি উল্লিখিত হয়েছে] অর্থাৎ বৈশাখ ১২৮১-র শুরু থেকেই তিনি এই কাজে নিযুক্ত হয়েছেন। অবশ্য খুব বেশি দিন তিনি কাজ করেননি, হিসাবের খাতা থেকে দেখা যায় তিনি কার্তিক মাস পর্যন্ত বেতন পেয়েছেন, অর্থাৎ মাত্র সাত মাস তিনি সংস্কৃত পড়াবার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিলেন। জীবনস্মৃতি বা অন্যত্র এই শিক্ষকের কথা রবীন্দ্রনাথ লেখেননি। তাঁর সংস্কৃত-শিক্ষা সম্পর্কে এ-পর্যন্ত যে বিবরণ পাওয়া যায় তাতে দেখি জনৈক হেরম্ব তত্ত্বরত্নের কাছে ‘মুকুন্দং সচ্চিদানন্দং’ থেকে আরম্ভ করে মুগ্ধবোধ ব্যাকরণের সূত্র মুখস্থ করেছিলেন এবং তারপর পিতার কাছে বোলপুরে, অমৃতসরে ও হিমালয়ে বিদ্যাসাগর-প্রণীত ‘উপক্রমণিকা’ ও ‘ঋজুপাঠ দ্বিতীয় ভাগ’ পড়তে শুরু করেছিলেন। হরিনাথ ভট্টাচার্য তাঁকে কী পড়াতেন তা বলা সম্ভব নয়, কিন্তু ২১ আশ্বিন [মঙ্গল 6 Oct] ‘রবীবাবুর জন্য রিজুপাট’ কেনার হিসাব দেখে মনে হয়, তখনো পর্যন্ত স্কুলপাঠ্য সংস্কৃত গ্রন্থের মধ্যেই পঠন-পাঠন সীমাবদ্ধ রয়েছে, জীবনস্মৃতি-র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে বর্ণিত ‘কুমারসম্ভব’ বা ‘শকুন্তলা’ পড়ার পর্যায়ে পৌঁছয়নি।

সংস্কৃত শিক্ষার সময় হয়তো ছিল সন্ধ্যাবেলা। কারণ এযাবৎ-প্রাপ্ত সর্বাপেক্ষা প্রাচীন রবীন্দ্র-পাণ্ডুলিপি ‘মালতীপুঁথি’-র [এই পাণ্ডুলিপিটি সম্পর্কে পরে আমরা বিস্তৃত আলোচনা করব] 50/ ২৬খ পৃষ্ঠায় দেখা যায় ইংরেজিতে লেখা একটি সাপ্তাহিক পাঠক্রমের তালিকায় প্রত্যহই প্রথম পর্বটি ইংরেজি ও শেষ পর্বটি সংস্কৃত পড়ার জন্য নির্ধারিত হয়েছে। পাঠক্রমের এই তালিকাটি কখন রচিত হয়েছিল নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও, অনুমান করা যায় এটি আমাদের আলোচ্য সময়েরই পাঠক্রম। পাঠকদের অবগতির জন্য রুটিনটি উদ্ধৃত করছি:

Monday—Eng Prose—Geomet—Eng History—Sanskrit
Tuesday—Grammar—Algebra—Hist of India—Sanskrit
Wednessday—Eng Prose—Arith—Geography Phys.—Do
Thursday—Grammar—Mensuration & Algebra—England history—Do
Friday—Eng….[?]Arthimetic—General geography—Do
Saturday—Do—Geomet—History of IndiaDo
Sunday—Exercises—   

শুক্রবারের প্রথম পিরিয়ডে ‘…’ চিহ্নিত অংশটি সঠিকভাবে পড়া শক্ত বলে আমরা জিজ্ঞাসা চিহ্নাঙ্কিত করেছি।

প্রবোধচন্দ্র সেন লিখেছেন: “সাপ্তাহিক পাঠক্রমটি এই ‘ঘরের পড়া’ যুগেরই পাঠক্রম বলে মনে হয়। কারণ এটিতে সংস্কতশিক্ষার উপরে যতখানি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, বেঙ্গল একাডেমি বা সেন্ট জেভিয়ার্সের মতো ইস্কুলে তা প্রত্যাশিত নয়।…তা ছাড়া, ওই পাঠক্রমে দেখা যায় শনিবারের পাঠব্যবস্থা অন্যান্য দিনের সমানই, কিছুমাত্র লঘু নয়। এটাও খ্রীস্টানপরিচালিত উক্ত দুই ইস্কুলের পক্ষে স্বাভাবিক নয়।’

পাঠক্রমটি ‘ঘরের পড়া’র জন্যই যদি রচিত হয়, তাহলেও লক্ষণীয়, এখানে এন্ট্রান্সের পাঠ্যসূচিই অনুসৃত হয়েছে এবং এটি সারাদিনের পাঠক্রম—সকালে জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য ইংরেজি পড়াতেন, দুপুরে অঙ্ক শেখাতেন দ্বিজেন্দ্রনাথ, সন্ধ্যায় হরিনাথ ভট্টাচার্য সংস্কৃত শিক্ষা দিতেন; তার আগে ছাত্রদেরই ইতিহাস ও ভূগোলের পড়া করে নিতে হত। অবশ্য এটি নিছকই অনুমান, আমরা পরের অনুচ্ছেদেই এই অনুমানের কয়েকটি ফাঁক দেখতে পাব।

আমরা বলেছি, জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য সম্ভবত সকালেই পড়াতে আসতেন [দ্বিজেন্দ্রনাথের পত্রেও সেইরকম ইঙ্গিত আছে। সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথদের জন্য তিনি ছাড়া আর কোনো গৃহশিক্ষক ছিলেন না, আর বাংলায় অর্থ করে তাঁর ‘কুমারসম্ভব’ পড়ানোর কথা রবীন্দ্রনাথই উল্লেখ করেছেন—সুতরাং তাঁকে ‘পণ্ডিত’ বলায় কোনো ভুলও হয়নি] এবং সন্ধ্যায় উক্ত হরিনাথ ভট্টাচার্যের কাছে সংস্কৃত পড়তে হত। [লক্ষণীয়, অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে ইংরেজি শিক্ষার সময় সন্ধ্যাবেলা নির্দিষ্ট করে অভিভাবকেরা যে ভুল করেছিলেন, এবার আর সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি হয়নি!] কিন্তু দুপুরবেলায় বালকদের পড়ানোর দায়িত্ব দ্বিজেন্দ্রনাথ ত্যাগ করলে সেই সময়ে তাঁদের আটকে রাখার জন্য ব্যবস্থা করার প্রয়োজন দেখা দিল। এইজন্যে একজন শিক্ষক নিয়োগ করার সংবাদ জানা যায় ক্যাশবহি-র ৬ ভাদ্র [শুক্র 21 Aug] তারিখের হিসাবে: ‘ব° গিরীশচন্দ্র মজুমদার/সোম রবীবাবুদিগের দুপুরবেলা ইংরাজি পড়াইবার মাষ্টার/তাহার বেতন ই° ৫ শ্রাবণ না° ৩১ রোজ/২০ হিঃ বিঃ এক বৌচর/গুঃ খোদ/রোক ১৭।৵৬’ অর্থাৎ ৫ শ্রাবণ [সোম 20 Jul ] থেকে তিনি এই কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত তিনি বেতন পেয়েছেন অর্থাৎ ঐ মাসেই তাঁর কর্মকাল শেষ হয়। এর আগেও আষাঢ় মাসে মাত্র বারো দিনের জন্য উমাচরণ ঘোষ নামে জনৈক ব্যক্তি ‘সোমবাবুদিগের মাষ্টার’ রূপে কাজ করে যান। এর থেকেই বোঝা যায় এই তিনটি বালককে নিয়ে কী করা যায় সে-বিষয়ে অভিভাবকেরা কিছুতেই মনঃস্থির করতে পারছিলেন না, আর সেই কারণেই এই সব পরীক্ষা। এঁরা কেউই রবীন্দ্রনাথের মনে কোনো দাগ কাটতে পারেননি বলেই এঁদের কথা তাঁর কোনো স্মৃতিমূলক রচনায় স্থান পায়নি।

এই বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে একমাত্র জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য অব্যাহতভাবে কাজ করে গেছেন। তাঁর ছাত্রেরা স্কুলে না গেলেও স্কুলের পাঠ্যতালিকা-ভুক্ত পুস্তকগুলি অবলম্বনেই তিনি তাঁদের ইংরেজি ভাষা শেখাবার চেষ্টা করেছেন। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে Douglus Series-এর Poetical Selection, Hiley’s Grammar ও Wilson’s Etymology অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরবর্তীকালে এগুলির সঙ্গে অন্য বইও যুক্ত হয়। ১৮ কার্তিক [মঙ্গল 3 Nov] তারিখের হিসাবে দেখি: ‘ব° জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য্য/দ° সোম রবী সত্যপ্রসাদবাবু দিগের/জন্য লেথব্রিজের সিলেকসন চারি খানা/ও উহার কি একখানা ক্রয়ের মূল্য শোধ… ১০৲’।* উক্ত হিসাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি বইটির চারটি খণ্ড কেনা একখানি অর্থপুস্তক-সহ—তিনটি খণ্ড তিনজন ছাত্রের জন্য, অপর খণ্ডটি সম্ভবত শিক্ষকের নিজের প্রয়োজনে। এই বইটি কেনা থেকে অনুমান করা যায় বাড়িতেই ছাত্রদের এন্ট্রান্স পরীক্ষার উপযোগী করে প্রস্তুত করার একটি উদ্দেশ্য জ্ঞানচন্দ্র বা অভিভাবকদের মনে কাজ করছিল। কিন্তু শিক্ষক এবং অভিভাবকেরা যতই সদুদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা করুন-না কেন, ছাত্রেরা, বিশেষত রবীন্দ্রনাথ, সেগুলি ব্যর্থ করার জন্যই যেন বদ্ধপরিকর ছিলেন। তার পরের কথা রবীন্দ্রনাথই লিখেছেন: ‘ইস্কুলের পড়ায় যখন তিনি কোনোমতেই আমাকে বাঁধিতে পারিলেন না, তখন হাল ছাড়িয়া দিয়া অন্য পথ ধরিলেন। আমাকে বাংলায় অর্থ করিয়া কুমারসম্ভব পড়াইতে লাগিলেন। তাহা ছাড়া খানিকটা করিয়া ম্যাকবেথ আমাকে বাংলায় মানে করিয়া বলিতেন এবং যতক্ষণ তাহা বাংলা ছন্দে আমি তর্জমা না করিতাম ততক্ষণ ঘরে বন্ধ করিয়া রাখিতেন। সমস্ত বইটার অনুবাদ শেষ হইয়া গিয়াছিল।’১৭ শ্রাবণ [শনি 1 Aug] তারিখের হিসাবে দেখা যায় ‘সোম রবীবাবুদিগের জন্য মেকবেথ পুস্তক ক্রয়…গুঃ রবীবাবু ১।।o’ অর্থাৎ শ্রাবণ মাসের মাঝামঝি সময় থেকে ম্যাকবেথ পড়া ও অনুবাদ শুরু হয়েছিল এবং সম্ভবত সেন্ট জেভিয়ার্সে ভর্তি হবার আগে মাঘ মাসের [Jan 1875] মধ্যেই বইটি পড়া ও অনুবাদ শেষ হয়ে গিয়েছিল।

এই সময়ের মধ্যেই হরিনাথ ভট্টাচার্যের জায়গায় মেট্রোপলিটান স্কুলের শিক্ষক রামসর্বস্ব বিদ্যাভূষণ [ভট্টাচার্য] বালকদের সংস্কৃত পড়াবার কাজে নিযুক্ত হন। ৯ পৌষ [বুধ 23 Dec] তারিখের হিসাবে দেখা যায়: ‘ব° রামসর্ব্বস্ব বিদ্যাভূষণ/দ° সোমবাবুদিগের পড়াইবার পণ্ডিতের বেতন কার্ত্তিক মাসের সাত দিন/ও অগ্রহায়ণ মাহার শোধ/১০৲ হিসাবে/বিঃ এক বৌচর/গুঃ রামগোপাল বিদ্যাবাগিশ১২/৴৬’ অর্থাৎ ২৪ কার্তিক [সোম 9 Nov ] থেকে তিনি সংস্কৃত অধ্যাপনা শুরু করেন। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ঠাকুরপরিবারের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তাই দেখা যায় Jan 1875-এ যখন দ্বিপেন্দ্রনাথ, অরুণেন্দ্রনাথ, নীতীন্দ্রনাথ ও সুধীন্দ্রনাথকে [এঁদের সঙ্গে বিমান ও বিজয় এই দুটি নাম পাওয়া যায়; এঁদের পরিচয় উদ্ধার করতে পারিনি] নর্মাল স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনে মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউসনে ভর্তি করা হয়, তখন রামসর্বম্বের মারফৎ বেতন প্রেরিত হয়েছে [পরেও দেখা যাবে তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে নাটকের প্রুফ-সংশোধনে সাহায্য করছেন]। তিনি তাঁর ছাত্রের ব্যাকরণ শিক্ষায় অমনোযোগিতার জন্য যতই ক্ষুব্ধ হোন না কেন, বালকের কবিপ্রতিভা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। তাই তিনি একদিন রবীন্দ্রনাথ-কৃত ম্যাকবেথের তর্জমা বিদ্যাসাগর মহাশয়কে শোনাবার জন্য বালককে তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন। মেট্রোপলিটান নস্টিটিউশন সেই সময়ে অবস্থিত ছিল ২৬ নং সুকিয়া স্ট্রিটে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘তখন তাঁহার কাছে রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়* বসিয়া ছিলেন। পুস্তকে-ভরা তাঁহার ঘরের মধ্যে ঢুকিতে আমার বুক দুরুদুরু করিতেছিল—তাঁহা মুখচ্ছবি দেখিয়া যে আমার সাহস বৃদ্ধি হইল তাহা বলিতে পারি না। ইহার পূর্বে বিদ্যাসাগরের মতো শ্রোতা আমি তো পাই নাই—অতএব, এখান হইতে খ্যাতি পাইবার লোভটা মনের মধ্যে খুব প্রবল ছিল। বোধকরি কিছু উৎসাহ সঞ্চয় করিয়া ফিরিয়াছিলাম। মনে আছে, রাজকৃষ্ণবাবু আমাকে উপদেশ দিয়াছিলেন, নাটকের অন্যান্য অংশের অপেক্ষা ডাকিনীর উক্তিগুলির ভাষা ও ছন্দের কিছু অদ্ভুত বিশেষত্ব থাকা উচিত।’

ম্যাকবেথের এই অনুবাদটি-সম্পর্কে জীবনস্মৃতি-র মুদ্রিত গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ যদিও লিখেছেন, ‘সৌভাগ্যক্রমে সেটি হারাইয়া যাওয়াতে কর্মফলের বোঝা ওই পরিমাণে হালকা হইয়াছে’, কিন্তু পাণ্ডুলিপির বর্ণনা অন্যরূপ: ‘সেই অনুবাদের আর সকল অংশই হারাইয়া গিয়াছিল কেবল ডাকিনীদের অংশটা অনেকদিন পরে ভারতীতে বাহির হইয়াছিল।’ আশ্বিন ১২৮৭ সংখ্যা [পৃ ২৯২-৯৩] ‘সম্পাদকের বৈঠক’-এ ‘(ডাকিনী। ম্যাক্‌বেথ)’ শিরোনামায় এই রচনাটি প্রকাশিত হয়। এটি পড়লেই বোঝা যায়, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের উপদেশ রবীন্দ্রনাথ পালন করেছিলেন। জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্যের কাছে অনুবাদের সময় সম্ভবত সমগ্র নাটকটি মোটামুটি একই ভাষা ও ছন্দে লিখিত হয়েছিল [এবং হয়তো প্রবহমান অমিল পয়ার বা অমিত্রাক্ষর ছন্দে], রাজকৃষ্ণবাবুর উপদেশে বালক কবি হয়তো এই অংশটি লৌকিক ভাষায় ও লৌকিক ছন্দে পুনরায় লেখেন। সজনীকান্ত দাস সাক্ষ্য দিয়েছেন, বৃদ্ধ বয়সেও তিনি এই রচনার একটি পঙ্‌ক্তি ঈষৎ পরিবর্তিত আকারে স্মরণ করতে পেরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের এই অনুবাদ প্রায় আক্ষরিক বলা চলে। ম্যাকবেথ নাটকের প্রথম অঙ্ক প্রথম দৃশ্যটি সম্পূর্ণ, তৃতীয় দৃশ্যের প্রথম অংশ [একটি উক্তি খণ্ডিত, সমবেত মন্ত্রপাঠ ও ভবিষ্যদ্‌বাণীর অংশ সম্পূর্ণ বর্জিত] এবং চতুর্থ অঙ্ক প্রথম দৃশ্যের প্রথম অংশ অবিশ্বাস্য দক্ষতায় অনূদিত হয়েছে। এ-ব্যাপারে এই বালক কবির সার্থকতা কতখানি, তা যে-কেউ মূল নাট্যাংশ ও ম্যাকবেথ নাটকের সমসাময়িক অন্যান্য অনুবাদের সঙ্গে এই রচনাটি তুলনা করলে বুঝতে পারবেন।

[এখানে একটি বিষয়ের প্রতি পণ্ডিতজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ম্যাকবেথ নাটকের তৃতীয় অঙ্ক পঞ্চম দৃশ্য ও চতুর্থ অঙ্ক প্রথম দৃশ্যে Hecate নামে একটি ডাকিনীকে দেখতে পাওয়া যায়। এই নামটি নিয়ে নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা হয়েছে। সে-প্রসঙ্গ আমরা পরে আলোচনা করব। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ম্যাকবেথ পাঠের সমকালীন ‘মালতীপুঁথি’ নামে বিখ্যাত যে খাতাটিতে তিনি কবিতা লিখতেন, সেই খাতাটির 39/২১ক পৃষ্ঠায় Hecate Thacroon কথাটি তিনবার লিখিত আছে দেখা যায়। এই যোগাযোগের কী কোনো তাৎপর্য আছে? থাকলে বলতে হয়, রবীন্দ্রনাথের ম্যাকবেথ পাঠের ফলেই কাদম্বরী দেবী এই ডাক নামটি লাভ করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য, বিলাতপ্রবাসকালে সত্যেন্দ্রনাথও বালিকা-বধূ জ্ঞানদানন্দিনীকে অনেকগুলি পত্রে ‘বর্জিনি’ বলে সম্বোধন করেছেন।]

জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য কেবল শেকস্‌পিয়রের ম্যাকবেথ নয়, কালিদাসের কুমারসম্ভব-ও বাংলায় অর্থ করে রবীন্দ্রনাথকে পড়িয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পাণ্ডুলিপিতে লিখেছিলেন: ‘[কুমারসম্ভব] তিন সৰ্গ যতটা পড়াইয়াছিলেন তাহার আগাগোড়া সমস্তই আমার মুখস্থ হইয়া গিয়াছিল।’ অর্থাৎ জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য এই ভাবী মহাকবির সঙ্গে জগতের আরও দুই মহাকবির পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কবি-জীবনে এই দুজনেরই গভীর প্রভাব আছে, বিশেষত কালিদাসের প্রভাব তাঁর কবিমানসে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। যাই হোক, উপরোক্ত উদ্ধৃতি থেকে দেখা যাচ্ছে, এই পর্যায়ে গৃহশিক্ষকের কাছে রবীন্দ্রনাথ সমগ্র কুমারসম্ভব পাঠ করেননি, প্রথমে তিনটি সর্গই তিনি আয়ত্ত করেছিলেন। ম্যাকবেথের মতো কুমারসম্ভব-এর পঠিত অংশ জ্ঞানচন্দ্র ছাত্রকে দিয়ে অনুবাদ করিয়েছিলেন, কিনা, রবীন্দ্রনাথ সে-সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করেননি। কিন্তু তিনি তৃতীয় সর্গের অনেকগুলি শ্লোকের পদ্যানুবাদ করেছিলেন, তার নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে পূর্বোক্ত মালতীপুঁথি-তে। সেখানে দেখা যায় এই সর্গের ২৫-২৮, ৩১, ৩৫-৩৯, ৪১-৪৯, ৫১-৫৮ ও ৬০-৭২—মোট ৪০টি শ্লোক তিনি অমিল পয়ারে অনুবাদ করেছেন, এর মধ্যে কয়েকটি শ্লোকের অনুবাদ পূর্ণাঙ্গ নয়; পাণ্ডুলিপির জীর্ণ অবস্থার জন্য কয়েকটি শ্লোকের সম্পূর্ণ পাঠও উদ্ধার করা যায় না। অনুবাদটির সম্পর্কে আর একটি বিশেষ তথ্য হল, ৬২, ৬৩ ও ৭২ সংখ্যক শ্লোক তিনটিতে অন্য একটি হস্তাক্ষরে কিছু কিছু সংশোধনের চিহ্ন রয়েছে এবং এই সংশোধনগুলি একই হস্তাক্ষরে পূর্ণাঙ্গরূপ লাভ করেছে মালতীপুঁথি-রই 43/২৩ক থেকে 48/২৫খ এই ছটি পৃষ্ঠায়। আবার এই অংশটিরই পরিমার্জিত রূপ ভারতী পত্রিকার মাঘ ১২৮৪ সংখ্যায় ৩২৯-৩১ পৃষ্ঠায় ‘সম্পাদকের বৈঠক/অনুবাদ’-এ ‘মদনভস্ম’ শিরোনামায় প্রকাশিত হয়েছে, পাণ্ডুলিপিতে শিরোনাম ছিল ‘কুমারসম্ভব’। প্রবোধচন্দ্র সেন মনে করেন, এই সংশোধন ও পরিমার্জনের ব্যাপারে ‘বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের হাত কাজ করেছে বহুল পরিমাণে’।কানাই সামন্তও লিখেছেন: ‘হস্তাক্ষরের বিচারে ও ভাষার বিচারে, বাহ্য এবং আভ্যন্তরীণ প্রমাণে, আমরা মনে করি যে, সম্ভবতঃ এটির রচয়িতা দ্বিজেন্দ্রনাথ।’ প্রখ্যাত গবেষকদ্বয় সিদ্ধান্তে একটু সংশয়ের আভাস রেখে দিয়েছেন, কিন্তু দ্বিজেন্দ্রনাথের হস্তাক্ষরের সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে, তাঁরাই মালতীপুঁথি-র এই হস্তাক্ষরকে দ্বিজেন্দ্রনাথের বলে শনাক্ত করতে পারবেন; আর ‘লয়্যে’, ‘এড়ায়্যে’, ‘হয়্যে’ ইত্যাদি বানান এবং ‘হোতা’ ‘হেতা’ ধরনের শব্দপ্রয়োগ দ্বিজেন্দ্রনাথকে অবিসংবাদিতভাবে চিনিয়ে দেয় [প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ‘লোয়ে’ ‘হোয়ে’ প্রভৃতি বানানে অভ্যস্ত ছিলেন]। কিন্তু দ্বিতীয় অনুবাদটি অনেক বেশি মূলানুগ হলেও রচনাভঙ্গি খুবই আড়ষ্ট, সে তুলনায় রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ অনেক স্বচ্ছন্দ। কয়েকটি দৃষ্টান্তের সাহায্যে বিষয়টি স্পষ্ট করা যেতে পারে। ৬২ ও ৬৩ সংখ্যক শ্লোক-দুটি রবীন্দ্রনাথ প্রথমে অনুবাদ করেছিলেন:

উমাও সে পদতলে হইলেন নত

সহসা অলক হোতে পড়িল খসিয়া

নব কর্ণিকার ফুল মহেশচরণে! [৬২]

[অন্য] নারী-অনুরক্ত নহে যেই জন

[হেন] পতি লাভ কর, আশীষিলা দেব,

[যাঁহার ক]থায় কভূ হয় না অন্যথা। [৬৩]।

কিন্তু এই শ্লোক দুটি পরিমার্জিত রূপ—

উমাও যেমন তাঁরে করিলা প্রণা[ম]

সুনীল অলক শোভি নবক[র্ণিকার]

খসিয়া অবনিতলে পড়িল [অমনি] [৬২]

অনন্যভাজন পতি লাভ কর বলি

আশিষিলা মহাদেব; যথার্থ আশীষ

উচ্চারিত হৈল যদি ঈশ্বরের বাণী।

কভু বিপরীত অর্থ না হয় ঘটন।[৬৩]

—অনেক বেশি মূলানুগ হলেও, কবিতা হিসেবে ততখানি সার্থক হয়নি বলে মনে করি।

একই কথা বলা যেতে পারে শেষ শ্লোকটি [৭২ সংখ্যক] সম্বন্ধে। পাশাপাশি দুটি অনুবাদ উদ্ধৃত করছি:

রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ দ্বিজেন্দ্রনাথের অনুবাদ

ক্রোধ সম্বরহ প্রভু ক্রোধ সম্বরহ ক্রোধ প্রভু সংহর সংহর এই বাণী

স্বর্গ হোতে দেবতারা কহিতে কহিতে দেবতা সবার হোতা চরুক্‌ বাতাসে

হইল মদন তনু ভষ্ম অবশেষ হেতায় মদনতনু ভস্ম অবশেষে।

এমনকি ভারতী-তে প্রকাশিত পুনঃ-সংস্কৃত অনুবাদে—

“ক্রোধ প্রভু সংহর সংহর বাণী

দেবতা সবার হোথা চরিছে বাতাসে,

হেথায় সে হুতাশন ভবনেত্র-জাত

করিল মদনতনু ভস্ম-অবশেষ।

— ‘তাবৎ স বহ্নির্ভবনেত্ৰজন্মা’ এই অংশটির অনুবাদ যুক্ত হলেও ‘দেবতা সবার হোথা চরিছে বাতাসে’ এই শ্রুতিকটু ও অর্থহীন বাক্যটি রসোত্তীর্ণতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। [লক্ষণীয়, রবীন্দ্রনাথের ‘কভূ’ ও ভষ্ম’ শব্দদুটির বানান শুদ্ধ নয়। এমন অশুদ্ধ বানান মালতীপুঁথি-তে আরও আছে, যেমন—‘ম্রিয়মান, ‘বধু’, ‘সায়াহ্ন’, ‘চিহ্ন’, ‘মধ্যাহ্ন’, ‘বিষ্ময়’ ইত্যাদি। অনেক বড়ো বয়স পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ এই অশুদ্ধি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না।]

এখন প্রশ্ন, এই অনুবাদটি রবীন্দ্রনাথ কোন্‌ সময়ে করেছিলেন? কুমারসম্ভবের এই অনুবাদ রবীন্দ্রনাথ-কৃত কিনা সে-বিষয়েই অবশ্য জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় নিঃসন্দেহ হতে পারেননি। তিনি লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথ কি ‘কুমারসম্ভব’ বাংলায় তর্জমা করিয়াছিলেন; জীবনস্মৃতিতে তাহার কোনো ইঙ্গিত নাই। যদি উহার অনুবাদ তিনি করিয়া থাকেন তবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও রাজকৃষ্ণ মুখখাপাধ্যায়কে কেবলমাত্র ম্যাকবেথ অনুবাদ শুনাইলেন—কুমারসম্ভবের কোন কথা নাই।” জীবনস্মৃতি-তে রবীন্দ্রনাথ অনেক কিছুরই উল্লেখ বা ইঙ্গিত করেননি, সুতরাং যুক্তি হিসেবে তা গ্রাহ্য নয়। আর দ্বিতীয় যুক্তিটি সম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য এই যে, রামসর্বস্ব পণ্ডিতের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যখন বিদ্যাসাগরকে ম্যাকবেথের অনুবাদ শোনাতে গিয়েছিলেন, তখন কুমারসম্ভবের অনুবাদ প্রস্তুতই হয়নি: কিংবা প্রস্তুত হলেও তা যখন বড়োদাদা দ্বিজেন্দ্রনাথকেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি, তখন তা বিদ্যাসাগরকে শোনাবার যোগ্য বিবেচিত না হওয়াই স্বাভাবিক। এর মধ্যে প্রথম কারণটি আমাদের কাছে অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হয়। কারণ মালতীপুঁথি-তে দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথ যে-পৃষ্ঠায় [5/৩ক] কুমারসম্ভবের অনুবাদ শুরু করেছিলেন, তার শীর্ষে চারটি পঙ্‌ক্তি আছে, যেগুলি পূর্ব পৃষ্ঠায় [4/২খ] অনূদিত একটি কবিতার অনুবৃত্তি। কবিতাটি হল ইংরেজি কবি Byron [Lord George Noel Gordon Byron, 1788-1824]-এর Childe Harold’s Pilgrimage [1812-18] কাব্যগ্রন্থের একটি স্তবক [Canto II, XV] অবলম্বনে লিখিত ‘ভালবাসে যারে তার চিতাভষ্ম পানে’ প্রথম ছত্র-যুক্ত বারো ছত্রের একটি কবিতা। এই পৃষ্ঠাটিতে আরও কতকগুলি ইংরেজি কবিতার অনুবাদ দেখা যায়, যার চারটি Thomas Moore [1779-1852]-এর লেখা Irish Melodies [1807] কাব্যগ্রন্থ থেকে এবং একটি Byron থেকে অনূদিত। সুতরাং বোঝা যায়, আগে এই অনুবাদগুলি হয়েছে, তার পরেই রবীন্দ্রনাথ কুমারসম্ভবের অনুবাদে হাত দিয়েছেন। আমাদের মনে হয়, ইংরেজি কবিতা থেকে এই অনুবাদগুলি কিছু পরবর্তীকালের রচনা। রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ ম্যাকবেথ অনুবাদ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য সে ক্ষেত্রে প্রতি পদে তাঁর সঙ্গী ছিলেন। কিন্তু অন্য ইংরেজি কবিতার অর্থ বুঝে তার যথাযথ অনুবাদ নিজে করার শক্তি তিনি সেই সময় অর্জন করেছিলেন, একথা মনে হয় না। এ ব্যাপারেও অন্যের সাহায্য তাঁর কাছে অপরিহার্য ছিল। রবীন্দ্রনাথের নিজেরই স্বীকৃতি আছে ইংরেজি সাহিত্যচর্চায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বন্ধু অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী তাঁর প্রধান সঙ্গী ছিলেন। কিন্তু অক্ষয় চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর অসমবয়সী বন্ধুত্ব আরও কিছুকাল পরে গড়ে উঠেছিল। যথাসময়ে আমরা সে বিষয়ে আলোচনা করব। আমাদের এই বক্তব্যের সমর্থনে আমরা আর-একটি তথ্য উপস্থিত করতে পারি। উপরে উল্লিখিত ‘ভালবাসে যারে তার চিতাভষ্ম পানে’ অনুবাদ-কবিতাটির পাশে ও আলোচ্য কুমারসম্ভবের অনুবাদের শেষে কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ নাটকের একটি শ্লোকের [প্রথম অঙ্ক, ৩১ সংখ্যক শেষ শ্লোক] দুটি অনুবাদ দেখা যায়, যেটি রামসর্বস্ব ভট্টাচার্যের কাছে শকুন্তলা পড়ার সার্থকতার প্রমাণ। কিন্তু রামসর্বস্ব ‘অনিচ্ছুক ছাত্রকে ব্যাকরণ শিখাইবার দুঃসাধ্য চেষ্টায় ভঙ্গ’ দেবার পরই অর্থ করে শকুন্তলা পড়াতে শুরু করেছিলেন। ব্যাকরণ শিক্ষা ও সংস্কৃত অনুবাদে তার প্রয়োগে রবীন্দ্রনাথের কতখানি অগ্রগতি [?] ঘটেছিল, তার প্রমাণ রয়ে গেছে মালতীপুঁথি-র প্রথম পৃষ্ঠায় কথামালা-র প্রথম গল্পটি* [‘বাঘ ও বক’—‘একদা এক বাঘের গলায় হাড় ফুটিয়াছিল’] সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদ ও দেবনাগরী লিপিতে তা লেখার দুটি প্রচেষ্টার মধ্যে। এই সব প্রাথমিক প্রচেষ্টার পরই রামসর্বস্ব শকুন্তলা পড়াতে শুরু করেছিলেন, এমন অনুমান অযৌক্তিক নয়। আমরা জানি রামসর্বস্ব কার্তিক মাসের শেষ সপ্তাহে [Nov 1874] গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। সুতরাং শকুন্তলা-পাঠের সময় আমরা সচ্ছন্দে ১২৮২ বঙ্গাব্দের প্রথম দিক বলে নির্ধারণ করতে পারি। ইংরেজি কবিতাগুলির ও কুমারসম্ভবের অনুবাদ তারই অব্যবহিত পরবর্তীকালের—এইরূপ সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত।

এই বৎসর অগ্রহায়ণ সংখ্যা তত্ত্ববোধিনী-তে [৮ম কল্প ৪র্থ ভাগ, ৩৭৫ সংখ্যা, পৃ ১৪৮-৫০], ‘অভিলাষ’ নামে ৩৯টি স্তবকে রচিত একটি দীর্ঘ কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটির নামের তলায় লেখা ছিল ‘দ্বাদশ বর্ষীয় বালকের রচিত’, কিন্তু রচয়িতার নাম দেওয়া হয়নি। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই সজনীকান্ত দাস এটি ‘আবিষ্কার’ করেন [Nov 1939]। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই আবিষ্কার-প্রসঙ্গে লেখেন: ‘রবীন্দ্রনাথের নিকট উপস্থাপিত করিলে তিনি উহা নিঃসংশয়ে আপনার রচনা বলিয়া স্বীকার করিয়াছিলেন।… কবিতাটি মুদ্রণকালে কবির বয়স তেরো বৎসর সাত মাস, ইহা আরও এক বৎসর পূর্বের রচনা।’ রবীন্দ্রনাথের এই স্বীকৃতির ফলে রচয়িতার পরিচয় নিয়ে সংশয় সৃষ্টির কোনো অবকাশ এখানে ছিল না, ফলে রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত কবিতার গৌরব খুব সহজেই তা লাভ করতে পেরেছিল। কিন্তু এতেই সব সংশয়ের অবসান ঘটেছে এমন মনে করা যায় না। সংশয়টি সৃষ্টি হয়েছে কবিতাটির রচনাকালকে কেন্দ্র করে। ‘দ্বাদশ বর্ষীয় বালকের রচিত’ এই সংকেতটি অবলম্বন করে ব্রজেন্দ্রনাথ কবিতাটির রচনাকাল নির্ণয় করেছেন প্রকাশের এক বৎসর পূর্বে অর্থাৎ অগ্রহায়ণ ১২৮০ [Nov-Dec 1873] বা এর কাছাকাছি কোনো সময়। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ও এই মত সমর্থন করে লিখেছেন: ‘খুব সম্ভব উহা ১২৮০ শীতকালে রচিত হয়।’ অন্যত্রও তিনি লিখেছেন: “১৮৭৩ সালে যখন জ্ঞানচন্দ্রে নিকট ‘ম্যাকবেথ’ পড়িতেছিলেন, তাহার পর লিখিত হইলে লেখকের বয়স ‘দ্বাদশবর্ষ’ হয়,… এই কবিতার মধ্যে সদ্য ম্যাকবেথ-পাঠের প্রভাব রহিয়া গিয়াছে।…।” কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি, জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্যের কাছে ম্যাকবেথ পড়া ১২৮১ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি [Aug 1874] থেকে শুরু হয়েছিল এবং বাংলায় অর্থ করে পুরো গ্রন্থটি পড়ানো ও অনুবাদ করানোর কাজে নিশ্চয়ই দু-এক মাস সময় লেগেছিল। সুতরাং উপরোক্ত যুক্তি অনুসরণ করলে কবিতাটির রচনাকাল কিছুতেই আশ্বিন ১২৮১-র পূর্বে হওয়া সম্ভব নয় অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন প্রায় সাড়ে তেরো বৎসর। অন্য এক যুক্তির আশ্রয় নিয়ে ড সংঘমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায় কবিতাটির রচনাকাল ‘১২৮১ সালের শ্রাবণ মাসের পরে’ নির্ধারণ করেছেন,১০ যা আমাদের সিদ্ধান্তকে প্রকারান্তরে সমর্থন করে। কিন্তু তাঁর প্রদত্ত যুক্তিটির পুনর্বিচারের প্রয়োজন আছে, কারণ রবীন্দ্রনাথের এই সময়কার মানসিকতা বোঝার পক্ষে তা সহায়ক হবে। শ্রীমতী বন্দ্যোপাধ্যায় কবিতাটির মধ্যে লক্ষ্য করেছেন, এতে কবির নিজস্ব কোনো অভিলাষ নয়, ‘জনমনোমুগ্ধকর উচ্চ অভিলাষ’ যা শেষ পর্যন্ত মানুষকে অধর্ম ও বিনাশের দিকে চালিত করে তার প্রতি ধিক্কারই প্রকাশিত হয়েছে। এই ধিক্কারের কারণ নির্ণয় প্রসঙ্গে তিনি অধ্যাপক প্রবোধচন্দ্র সেনের মত১১ অনুসরণ করে বলেছেন, বঙ্গদর্শন-এর শ্রাবণ ১২৮১ (পৃ ১৪৫-৫৪] সংখ্যায় প্রকাশিত ‘বাঙ্গালির বাহুবল’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র উচ্চাভিলাষকে খুব উচ্চ স্থান দিয়ে বাঙালিকে খুব জোরের সঙ্গেই ওদিকে যে প্রবর্তনা দিয়েছিলেন, ‘অভিলাষ’ কবিতাটি সম্ভবত বঙ্কিমের ওই প্রবন্ধেরই প্রতিবাদ। তিনি তাতে বলেছেন, বঙ্কিমের বক্তব্যের মধ্যে ধর্মের প্রবর্তনা মোটেই স্থান পায়নি। অথচ সেটি ঠাকুরবাড়িতে যথেষ্ট গুরুত্ব লাভ করত। “তাই স্বভাবতঃই এই কবিতাটিতে সুখাভিলাষকে ধিক্কৃত করে ধর্মের জয় ঘোষণা করা হয়েছে। আর, কবিতাটি প্রকাশিতও হল ধর্মচিন্তার বাহক ‘তত্ত্ববোধিনী’তে।”

কিন্তু আমাদের কাছে এই যুক্তির ভিত্তি খুব দুর্বল বলে মনে হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে বাঙালি যেন জাতীয় সুখের অভিলাষে [লক্ষণীয় ব্যক্তিগত সুখের অভিলাষের কথা তিনি বলেননি] উদ্যম, ঐক্য, সাহস এবং অধ্যবসায়কে একত্রিত করতে পারে, বাঙালির বাহুবল বলতে বঙ্কিমচন্দ্র একটি ‘মানসিক অবস্থা’কে বুঝিয়েছেন শারীরিক বলের কথা বলেননি, বরং প্রকারান্তরে তার নিন্দাই করেছেন—‘মনুষ্য অদ্যাপি অনেকাংশে পশুপ্রকৃতিসম্পন্ন, এজন্য শারীরিক বলের আজিও এতটা প্রাদুর্ভাব। শারীরিক বল উন্নতি নহে। উন্নতির উপায় মাত্র।’ একথা ঠিকই যে বঙ্কিমচন্দ্র এই প্রবন্ধে কোনো ধর্মীয় প্রবর্তনার কথা বলেননি। কিন্তু ধর্মীয় প্রবর্তনার ভিত্তি যে নৈতিকতা উক্ত উদ্ধৃতির মধ্যে তার প্রকাশ যথেষ্ট পরিমাণেই আছে। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ বা ঠাকুরবাড়ির পক্ষে এই প্রবন্ধের প্রতিবাদ করার মতো কোনো কারণ থাকতে পারে বলে মনে হয় না। আর ব্রাহ্মধর্মের পৃষ্ঠপোষক ঠাকুরবাড়ির চিন্তাধারা এত সংকীর্ণও ছিল না; থাকলে বঙ্কিমচন্দ্রের উদ্দিষ্ট লক্ষ্যের অনুসারী হিন্দুমেলা বা জাতীয় মেলার আনুকূল্য করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হত না।

প্রকৃতপক্ষে, ম্যাকবেথ পাঠের প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণায় কবিতাটি রচিত। জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্যের তাড়নায় রবীন্দ্রনাথ আক্ষরিকভাবে ম্যাকবেথের পদ্যানুবাদ করেছিলেন। কিন্তু গীতিকবির মন তাতেই তৃপ্ত হয়নি, তাই উচ্চাভিলাষ কেমন করে মানব-চিত্তবৃত্তির সামঞ্জস্য নষ্ট করে দিয়ে তাকে বিষাদময় পরিণতির পথে টেনে নিয়ে যায়—ম্যাকবেথ নাটকের এই ভাববস্তু অবলম্বন করে একটি গীতিকবিতা রচনায় তিনি প্রবৃত্ত হয়েছেন। ‘অভিলাষ’ কবিতার ২৪, ২৫, ২৬ ও ৩১ সংখ্যক স্তবক পর পর পাঠ করলে ম্যাকবেথ নাটকের কথা-ও ভাব-বস্তু সংক্ষিপ্ত আকারে আমাদের কাছে স্পষ্টভাবে ধরা দেয়। এই ভাবটিকেই রামায়ণ ও মহাভারতের দৃষ্টান্ত সহযোগে বৃহত্তর তাৎপর্যে মণ্ডিত করার চেষ্টাও কবিতাটিতে লক্ষ্য করা যায়। আর সেই কারণেই অভিলাষের উপকারী ‘সোপান’গুলি চিত্রিত করার প্রয়াস কবিতাটির শেষ তিনটি স্তবকে দেখতে পাই। কিন্তু ভাবটি যথাযথভাবে পরিস্ফুট হবার আগেই কবিতাটি হঠাৎ শেষ হয়ে গেছে বলে মনে হয়।

কিন্তু কেবলমাত্র ম্যাকবেথ-পাঠের অনুপ্রেরণাই কবিতাটির পিছনে কার্যকরী ছিল না, এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের পারিপার্শ্বিক ও নিজের সম্পর্কে মনোভাবের কিছু ছায়াপাত ঘটেছে বলে মনে হয়। দেবেন্দ্রনাথের সান্নিধ্য-ধন্য হিমালয়-প্রত্যাগত যে বালকটি বাড়ির সকলের মনে তাঁর সম্পর্কে উচ্চাভিলাষের জন্মদান করেছিল, তাঁর পরবর্তী আচরণ তার সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে সংগতিপূর্ণ ছিল না। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘দাদারা মাঝে মাঝে এক-আধবার চেষ্টা করিয়া আমার আশা একেবারে ত্যাগ করিলেন। আমাকে ভর্ৎসনা করাও ছাড়িয়া দিলেন। একদিন বড়দিদি কহিলেন, “আমরা সকলেই আশা করিয়াছিলাম বড়ো হইলে রবি মানুষের মতো হইবে কিন্তু তাহার আশাই সকলের চেয়ে নষ্ট হইয়া গেল।” আমি বেশ বুঝিতাম, ভদ্রসমাজের বাজারে আমার দর কমিয়া যাইতেছে…।’১২ উক্তিটি রবীন্দ্রনাথ সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল প্রসঙ্গে করলেও তার আগের পর্বেও তাঁর সম্পর্কে আত্মীয়স্বজনের মনোভাব ভিন্নতর ছিল বলেই মনে হয়। এই আত্মগ্লানিই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথকে উচ্চাভিলাষের প্রতি বিরূপ করে তুলেছিল, ‘অভিলাষ’ কবিতাটির মধ্যেও তার আভাস আছে:

ঐ দেখ পুস্তকের প্রাচীর মাঝারে

দিন রাত্রি আর স্বাস্থ্য করিতেছে ব্যয়

পছিতে তোমার ও দ্বারের সম্মুখে

লেখনীরে করিয়াছে সোপান সমান। [৬ষ্ঠ স্তবক]।

—ভদ্রসমাজের উপযুক্ত হবার জন্য ‘চারিদিকের জীবন ও সৌন্দর্যের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন জেলখানা ও হাঁসপাতাল-জাতীয় একটা নির্মম বিভীষিকা, তাহার নিত্য-আবর্তিত ঘানির সঙ্গে’ নিজেকে জুড়ে দেবার অক্ষমতা ও সেই কারণে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধিক্কারের নিত্য বর্ষণ রবীন্দ্রনাথকে কতখানি বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল, তার একটি সুন্দর প্রকাশ আছে সমকালীন একটি রচনায়। মালতীপুঁথি-র একেবারে প্রথমে সংস্কৃত-শিক্ষার নিদর্শন-যুক্ত পৃষ্ঠাটির পরেই ‘প্রথম সর্গ’ শিরোনামে একটি অসমাপ্ত কবিতা আছে। প্রবোধচন্দ্র সেন কবিতাটি এই পাণ্ডুলিপির-ই অন্তর্গত ‘শৈশবসঙ্গীত’ [রচনাকাল: ২৪ আশ্বিন ১২৮৪ মঙ্গলবার 9 Oct 1877 ] শীর্ষক কবিতার কাছাকাছি সময়ের রচনা বলে অনুমান করেছেন। আমরা তা মনে করি না। মালতীপুঁথি-র পাতাগুলির পৌর্বাপর্য যথাযথভাবে রক্ষিত হয়নি এ তথ্য মনে রেখেও আমাদের ধারণা, কবিতাটি এই পাণ্ডুলিপি-খাতাতে রচনারম্ভের সমসাময়িক কালে লেখা। স্মরণ রাখতে হবে, যে পৃষ্ঠায় এই ‘প্রথম সর্গ’ কবিতাটির লেখা [পৃ 3/২ক] তার পরের পৃষ্ঠাতেই [পৃ 4/২খ] পূর্ব-কথিত Irish Melodies ও Byron-এর কবিতার অনুবাদ করা হয়েছে, যার সমাপ্তি কুমারসম্ভবের অনুবাদের ঠিক উপরে। ইংরেজি কাব্যানুবাদগুলি যদি 4/২খ পৃষ্ঠাতেই শেষ হয়ে যেত, তাহলে এই পাতা-ক’টি পৌর্বাপর্য থেকে বিশ্লিষ্ট বলে অনুমান করা চলত। কিন্তু 5/৩ক পৃষ্ঠায় বায়রনের কবিতা অনুবাদের ক্রমানুসৃতি সেইরূপ অনুমানের কোনো সুযোগ রাখেনি। আর অধ্যাপক সেন ‘প্রথম সর্গ’ কবিতাটিকে ‘পৃথ্বীরাজের পরাজয়’ কাব্যের ‘কবিকৃত দ্বিতীয় সংস্করণের অসমাপ্ত অংশ’ বলে অভিহিত করে প্রকারান্তরে আমাদের সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করেছেন।

যাই হোক, উক্ত কবিতাটির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের এই সময়কার মানসিকতাটি ধরা পড়েছেন বলে মনে হয়। তিনি লিখেছেন:

তবে হে ঈশ্বর! তুমি কেন গো আমারে

ঐশ্বর্য্যের আড়ম্বরে করিলে নিক্ষেপ;

যেখানে সবারি হৃদি যন্ত্রের মতন;

স্নেহ প্রেম হৃদয়ের বৃত্তি সমুদয়

কঠোর নিয়মে যেথা হয় নিয়মিত।…

হৃদয় বিহীন প্রসাদের আড়ম্বর

গর্ব্বিত এ নগরের ঘোর কোলাহল

কৃত্রিম এ ভদ্রতার কঠোর নিয়ম

ভদ্রতার কাষ্ঠ হাসি, নহে মোর তরে।

এই জগতের ‘হৃদয়হীন উপেক্ষা’ ও ‘দ্বেষ ঘৃণা মিথ্যা অপবাদ’ থেকে মুক্ত হয়ে তিনি যে-জীবনের স্বপ্ন দেখেন তার ছবিটিও এঁকেছেন এই কবিতায়:

কেন আমি হলেম না কৃষক বালক,

ভয়ে ভয়ে মিলে মিলে করিতাম খেলা,

গ্রাম প্রান্তে প্রান্তরে পর্ণের কুটীরে

পিতামাতা ভাইবোন সকলে মিলিয়া

স্বাভাবিক হৃদয়ের সকল উচ্ছাসে,

মুক্ত ওই প্রান্তরের বায়ুর মতন

হৃদয়ের স্বাধীনতা করিতাম ভোগ।

—কবিতাটি ঠিক কোন্‌ সময়ে লেখা তা আমরা জানি না বটে, কিন্তু এখানে বর্ণিত মনোভাবটি রবীন্দ্রনাথের পরবর্তীকালে রচিত বহু কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে—যা নিছক কবি-কল্পনা নয়, তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা। আমাদের মনে হয় পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির সংঘাতে সৃষ্ট এই মানসিকতা থেকেই তিনি ‘অভিলাষ’ কবিতায় ‘জনমনোমুগ্ধকর উচ্চ অভিলাষ’-কে ধিক্কার দিয়েছেন ও দরিদ্র কুটীর মাঝে বিরাজে সন্তোষ’-এই সত্যকে ঘোষণা করেছেন।

তত্ত্ববোধিনী-তে ‘অভিলাষ’ প্রকাশের পরের মাসেই পৌষ সংখ্যায় [পৃ ১৬১-৬৩] ‘গ্রহগণ জীবের আবাস-ভূমি’ শীর্ষক জ্যোতির্বিদ্যা-বিষয়ক প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধটি সম্পর্কে আমরা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করেছি, সুতরাং এখানে আর-কিছু বলা নিষ্প্রয়োজন।

এর পরে বৃহত্তর জনসমাজের সম্মুখে রবীন্দ্রপ্রতিভার প্রকাশ ঘটল হিন্দুমেলার নবম বার্ষিক অধিবেশন উপলক্ষে। এই অধিবেশনের উদ্বোধন দিবসে রবীন্দ্রনাথ একটি স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে তাঁর নাম-সহ এই সংবাদটি পরিবেশিত হয়। ইতিপূর্বে হিমালয়যাত্রার সময়ে সোমপ্রকাশ পত্রিকা-য় নাম ছাড়া তাঁর গতিবিধির সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল; তারপর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-য় মুদ্রিত আকারে তাঁর নাম প্রকাশিত হয়—এ-সব তথ্য আমরা পূর্বেই সরবরাহ করেছি। বর্তমান ক্ষেত্রে বহুজন-পঠিত ইংরেজি দৈনিক ও সাপ্তাহিক সংবাদপত্রে তাঁর নাম মুদ্রিত হয়েছে, তথ্য হিসেবে এটির গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।

ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় Indiand Daily News নামক দৈনিক পত্রিকার 15 Feb 1875 [সোম ৪ ফাল্গুন) সংখ্যা থেকে সংবাদটি সংকলন করে দেন: ‘“The Hindoo Mela.”. The Ninth Anniversary of the Hindoo mela was opened at 4 P.M. on Thursday, the 11th instant, at the well-known Parseebagan…on the Circular Road, by Rajah Kamal Krishna, Bahadoor, the President of the National Society…/Baboo Robindra Nath Tagore, the youngest son of Baboo Debendro Nath Tagore, a handsome lad of some 15, had composed a Bengali poem on Bharut (India) which he delivered from memory; the suavity of his tone much pleased his audience.’১৩ এই বিবরণ অনুযায়ী ৩০ মাঘ ১২৮১ বৃহস্পতিবার 11 Feb 1875 রাজা কমলকৃষ্ণ বাহাদুরের সভাপতিত্বে হিন্দুমেলার নবম বার্ষিক অধিবেশনের উদ্বোধন হয়েছিল এবং রবীন্দ্রনাথ [তাঁকে প্রায় ১৫ বৎসর বয়সের বালক বলে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে তাঁর বয়স তখন তেরো বছর ন-মাস] সেখানে ‘ভারত’ বিষয়ে কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। যোগেশচন্দ্র বাগল তাঁর হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত [১৩৭৫] গ্রন্থে উক্ত উদ্ধৃতির দ্বিতীয় বাক্যটি উদ্ধার করেছেন এবং লিখেছেন, ‘এবারেই সর্বপ্রথম কিশোর রবীন্দ্রনাথ (রবীন্দ্রনাথ তখন চতুর্দ্দশবর্ষীয় বালক) সাধরণ সমক্ষে দাঁড়াইয়া “হিন্দুমেলার উপহার” শীর্ষক স্বরচিত একটি কবিতা আবৃত্তি করেন।’ [পৃ ৪২]

জীর্ণ হয়ে যাবার জন্যে Indian Daily News-এর ফাইল দেখার সুযোগ আমাদের হয়নি; কিন্তু Bengalee পত্রিকার 20 Feb 1875 সংখ্যায় [Vol. XIV, No. 8, p. 57] উপরোক্ত বিবরণটি হুবহু একই ভাষায় প্রকাশিত হয়। বিবরণটি অবশ্য অনেক দীর্ঘ, [হয়তো Indian Daily News-এর প্রতিবেদনও অনুরূপ দীর্ঘ ছিল, ব্রজেন্দ্রনাথ তার থেকে কেবল প্রাসঙ্গিক অংশটুকু সংকলন করেছিলেন] কিন্তু শুরুতেই একটি ছোটো অথচ গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য দেখা যায়: ‘The Ninth Anniversary of the Hindoo mela was opened at 4 P.M. of Friday last’ অর্থাৎ উদ্বোধন অনুষ্ঠানটি হয় শুক্রবার ১ ফাল্গুন 12 Feb তারিখে। সোমপ্রকাশ পত্রিকা-য় [১৮। ১৫, ১১ ফাল্গুন, পৃ ২৩৪] ৬ ফাল্গুন বুধবার তারিখ দিয়ে এই সংবাদটি প্রকাশিত হয়: ‘গত পূৰ্ব্ব শুক্রবার সারকিউলার রোড পারসী বাগানে মহা সমারোহে হিন্দুমেলা হইয়া গিয়াছে। প্রায় ৩০০ হিন্দু ভদ্র লোক মেলার স্থলে উপস্থিত হন। বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র একটী উৎকৃষ্ট বাঙ্গালা কবিতা রচনা করিয়া উহা মুখস্থ পাঠ করিয়া সকলের চিত্ত রঞ্জন করেন এবং বাবু রাজনারায়ণ বসু একটী উৎকৃষ্ট বক্তৃতা করেন। সভাপতির বক্তৃতার পর গীত বাদ্য হইয়া অপরাহু ৬ ঘটিকার সময় সভা ভঙ্গ হয়।’ এখানেও শুক্রবারের উল্লেখ দেখা যাচ্ছে। অথচ উক্ত পত্রিকার ৪ ফাল্গুন সংখ্যায় লিখিত হয়: ‘৩০এ মাঘ ইহার কাৰ্য্য আরম্ভ হইয়া আজ শেষ হইবে।’ সুতরাং সংবাদগুলির এই পরস্পর-বিরোধী বিবরণের জন্য উদ্বোধন দিবসের তারিখটি সম্পর্কে একটু সংশয় থেকে যাচ্ছে। অবশ্য এ কথা মনে রাখা দরকার যে, পূর্ববর্তী বৎসরে অষ্টম বার্ষিক অধিবেশনও আরম্ভ হয়েছিল ৩০ মাঘ ১২৮০ [বুধ 11 Feb 1874 ] তারিখে এবং চলেছিল বর্তমান বৎসরের মতোই ৪ ফাল্গুন পর্যন্ত।

বহুদিন পর্যন্ত জানা ছিল, এই উদ্বোধন দিবসে রবীন্দ্রনাথ ‘হিন্দুমেলায় উপহার’ শীর্ষক একটি দীর্ঘ কবিতা আবৃত্তি করেন এবং কবিতাটি কয়েকদিন পরে দ্বিভাষিক সাপ্তাহিক অমৃতবাজার পত্রিকা-য় ১৪ ফাল্গুন ১২৮১ বৃহস্পতিবার 25 Feb 1875 তারিখে ‘শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ নাম স্বাক্ষরিত হয়ে প্রকাশিত হয়।* ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় অমৃতবাজার পত্রিকা-র পুরোনো ফাইল থেকে কবিতাটি আবিষ্কার করে মাঘ ১৩৩৮ [Jan 1932] সংখ্যায় প্রবাসী-তে [পৃ ৫৮০-৮১] পুনর্মুদ্রিত করেন। সাময়িক পত্রে এটিই রবীন্দ্রনাথের নাম-স্বাক্ষরিত প্রথম মুদ্রিত কবিতা। এই কবিতাটির কথা রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি বা অন্য কোথাও উল্লেখ করেননি।

কিন্তু কয়েক বৎসর পূর্বে রথীন্দ্রনাথ ঘটক চৌধুরী ‘রবীন্দ্রনাথের একটি দুষ্প্রাপ্য কবিতা’-শীর্ষক প্রবন্ধে১৪“হোক্‌ ভারতে জয়” নামের ৮০টি পঙ্‌ক্তিতে রচিত একটি কবিতা পুনর্মুদ্রিত করে এতদিনকার স্বীকৃত ধারণা পরিবর্তিত করে দিয়েছেন। উক্ত কবিতাটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত কালীপ্রসন্ন ঘোষ-সম্পাদিত বান্ধব মাসিক পত্রিকাটির মাঘ ১২৮১ সংখ্যায় [১। ৮, পৃ ২০২-০৩] প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতাটির শেষে ‘(র)’ অক্ষরটি লেখা আছে এবং পাদ-টীকায় উল্লিখিত হয়েছে: ‘হিন্দুমেলা উপলক্ষে এই কবিতাটি রচিত হইয়াছিল।’ শ্রীঘটক চৌধুরী মনে করেন, হিন্দুমেলা উদ্বোধন দিবসে এই কবিতাটিই রবীন্দ্রনাথের দ্বারা ‘পঠিত’ হয়েছিল— ‘হিন্দুমেলায় উপহার’ [প্রবন্ধে সর্বত্র কবিতাটি ‘হিন্দুমেলার উপহার’ নামে অভিহিত হয়েছে, স্পষ্টতই তা ভুল] নয়। তাঁর সিদ্ধান্তের সপক্ষে তিনি যে যুক্তি দিয়েছেন তা হল এই যে, এটি ‘হিন্দুমেলা উপলক্ষে রচিত কবিতা’ এবং কবিতাটির ‘এস এস ভ্রাতৃগণ! সরল অন্তরে’, ‘এসেছে জাতীয় মেলা ভারতভূষণ’, ‘এস এস এস করি প্রিয় সম্ভাষণ’, ‘এই দেখ হিন্দুমেলা’ প্রভৃতি পঙ্‌ক্তিগুলির মধ্যে কোনো সভাকে উদ্দেশ করে ভাষণ দেওয়ার একটা ভাব আছে। এটি যে রবীন্দ্রনাথেরই রচনা সেটি প্রমাণ করতে তিনি সমকালীন রচনা ‘হিন্দুমেলায় উপহার’ ও ‘প্রকৃতির খেদ’-এর সঙ্গে কবিতাটির ‘ভাব-ভাষা ও ছন্দ-সাদৃশ্য’ তুলনা করে দেখিয়েছেন। আরও দু-একটি যুক্তি তথ্য তিনি উপস্থিত করেছেন, কিন্তু সেগুলি ছাড়াই কবিতাটিকে রবীন্দ্ররচনা বলে স্বীকার করে নেওয়া যেতে পারে। তিনি লিখেছেন: ‘“হিন্দুমেলা উপলক্ষে’ রচিত সত্যেন্দ্রনাথের ‘মিলে সবে ভারত সন্তান’ গানটি সে যুগে রবীন্দ্রনাথকে স্বাদেশিকতার প্রচুর প্রেরণা জুগিয়েছিল”—এর সঙ্গে আমরা বলতে পারি বর্তমান কবিতাটি যেন সত্যেন্দ্রনাথের রচনাটি সামনে রেখেই লেখা, এমন-কি “হোক্ ভারতের জয়” এই শিরোনামটি এবং কবিতার মধ্যে তার প্রয়োগ সরাসরি উক্ত রচনাটি থেকে গৃহীত হয়েছে, শিরোনামে উদ্ধৃতি-চিহ্নের ব্যবহারটিও লক্ষ্য করার মতো। এই কবিতাটিই যে হিন্দুমেলার উদ্বোধনী দিবসে রবীন্দ্রনাথ আবৃত্তি করেছিলেন, তার প্রমাণ Indian Daily News ও Bengalee-র প্রতিবেদনেই আছে— সেখানে কবিতাটি সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘a Bengali poem on Bharut (India)’, যা এই শিরোনামটিকে লক্ষ্য করে লেখা হয়েছিল। তখনকার দিনে খুব কম বাংলা মাসিক পত্রিকা নির্দিষ্ট সময়ে প্রকাশিত হত, সুতরাং কবিতাটি মাঘ-সংখ্যা বান্ধব-এ প্রকাশিত হয়েছিল এ-নিয়ে কোনো সংশয় সৃষ্টি করা যুক্তিযুক্ত হবে না। বান্ধব-সম্পাদক কালীপ্রসন্ন ঘোষের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির দীর্ঘকালীন সম্পর্কের বহু প্রমাণ আছে। দ্বিজেন্দ্রনাথ পত্রিকাটির গ্রাহক ছিলেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পুরুবিক্রম ও সরোজিনী নাটকের এবং দ্বিজেন্দ্রনাথের স্বপ্নপ্রয়াণ কাব্যের উৎকৃষ্ট সমালোচনা পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হয়, আর রবীন্দ্রনাথের কবিকাহিনী কাব্যের সমালোচনার কথা তো রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং জীবনস্মৃতি-তে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং হিন্দুমেলায় কবিতা আবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকাটির জন্য সেটি সংগ্রহ করা তাঁর পক্ষে মোটেই কঠিন ছিল না। *

আমরা পূর্বেই বলেছি, ‘হিন্দুমেলায় উপহার’ নামে একটি কবিতা রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষর-যুক্ত হয়ে অমৃতবাজার পত্রিকা-য় প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতাটি মেলার কোনো অনুষ্ঠানে পঠিত বা আবৃত্তি করা হয়েছিল কিনা তার নিঃসন্দিগ্ধ উল্লেখ কোথাও দেখা যায় না। তবে যাঁরাই এ-বিষয়ে আলোচনা করেছেন্‌, তাঁরাই কবিতাটি যে রবীন্দ্রনাথ শ্রোতাসাধারণকে শুনিয়েছিলেন এ-বিষয়ে একমত। জীবনস্মৃতি [১৩৬৮]-র গ্রন্থপরিচয়ে লেখা হয়েছে: ‘১৮৭৫ খ্রীস্টাব্দে ১১ ফেব্রুয়ারি তারিখে পার্শীবাগানে অনুষ্ঠিত হিন্দুমেলায় তিনি স্বরচিত কবিতা প্রথম পাঠ করেন; অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন রাজনারায়ণ বসু’—উদ্ধৃতির দ্বিতীয় অংশটি অবশ্যই ভুল, কারণ সংবাদপত্রের প্রতিবেদনেই প্রকাশিত হয়েছে যে সেদিন রাজা কমলকৃষ্ণ বাহাদুর সভাপতিত্ব করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে রাজনারায়ণ বসু যে আত্মচরিত-এ লিখেছেন: ‘১৮৭৫ সালে যে মেলা হয় তাহার সভাপতির কার্য আমি সম্পাদন করি। …এই মেলা উপলক্ষে বরদাবাসী সুবিখ্যাত মৌলাবক্সের গান হয়’, সেটি মেলার চতুর্থ ও প্রধান দিবস অথাৎ ৩ ফাল্গুন [রবি 14 Feb ] তারিখের অধিবেশনের কথা, কারণ মৌলাবক্সের গান এই দিনই পরিবেশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ যদি রাজনারায়ণ বসুর সভাপতিত্বে ‘হিন্দুমেলায় উপহার’ কবিতাটি পাঠ বা আবৃত্তি করে থাকেন, তাহলে তিনি তা করেছিলেন এই দিনের অধিবেশনেই। রবীন্দ্রনাথ যে এদিন হিন্দু মেলা-ক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ক্যাশবহি-র ৭ ফাল্গুন [বৃহ 18 Feb ] তারিখের হিসাব থেকে: ‘সোম রবীবাবুদিগের/হিন্দুমেলায় জাতাতের গাড়ি ভাড়া/৩ ফাল্গুনের ২ বৌচর শোধ/২৸°’। তাছাড়া ‘হিন্দুমেলায় উপহার’ যে কেবলমাত্র ব্যঞ্জনাৰ্থে উপহার ছিল না, একেবারে আক্ষরিক অর্থে ‘উপহার’ ছিল, এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটিও আমরা ক্যাশবহি থেকে জানতে পারি। এতে ২ আষাঢ় ১২৮২ [মঙ্গল 15 Jun 1875 ] তারিখের হিসাবে দেখা যায়: ‘ব° বাবু নবগোপাল মিত্র/দ° গত হিন্দু মেলায় রবীবাবুর একটী লেখা/ছাপান হয় তাহার ব্যয়…৫৲’ অর্থাৎ কবিতাটি কেবল পাঠ বা আবৃত্তি করা হয়েছিল তাই নয়, এটিকে মুদ্রিত করে ‘উপহার’ হিসেবে সমবেত দর্শকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল। অনুমান করা চলে, এরই একটি কপি থেকে অমৃতবাজার পত্রিকা-য় কবিতাটি পুনর্মুদ্রিত হয়ে বৃহত্তর জনসমাজের কাছে পৌঁছে। গিয়েছিল।

এই দিনের অনুষ্ঠানের একটি বিবরণ দিয়েছেন খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘রবীন্দ্র কথা’ গ্রন্থে [পৃ ৩৫৮]: ‘আমরা প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক মন্মথনাথ ঘোষ মহাশয়ের পিতা অতুলচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের মুখে শুনিয়াছি যে তিনি সেদিন পার্শীবাগানে হিন্দুমেলায় উপস্থিত ছিলেন, কোন সাল তাহা তাঁহার স্মরণ নাই। কবির বয়স তখন ১৩। ১৪ বৎসর হইবে। সভাপতি রাজনারায়ণ বসু হিন্দিতে বক্তৃতা করেন। একজন পণ্ডিত রবীন্দ্রনাথকে উপস্থিত জনমণ্ডলীর নিকট এই বলিয়া পরিচিত করাইয়া দেন যে, “ধৃতরাষ্ট্র বিলাপ” লিখিয়া কবি তখন যথেষ্ট খ্যাতি অর্জ্জন করিয়াছেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা একখানি চৌকা কাগজের এক পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হইয়া হিন্দুমেলার উপহার বলিয়া বিতরিত হইয়াছিল।… মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও পার্শীবাগানের সেই অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। কথাপ্রসঙ্গে তিনিও অতুলবাবুর বিবরণ সমর্থন করেন। অধিকন্তু বলেন যে, কবিতাটির কিয়দংশ রবীন্দ্রনাথ পাঠ করিবার পর তাঁহার সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথ বেশ উচ্চকণ্ঠে উহা পাঠ করিয়া শোনান।’ রাজনারায়ণ বসুর পক্ষে হিন্দিতে বক্তৃতা করা খুবই স্বাভাবিক, কারণ এই দিনের কর্মসূচিতে নির্ধারিত ছিল ‘এ বৎসর কলিকাতার নেপালী, পাঞ্জাবী, হিন্দুস্থানী, মহারাষ্ট্রী প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর হিন্দুদিগকে একত্রিত করা হইবে। সকলে মিলিয়া হিন্দুসাধারণের সর্বপ্রকার উন্নতির বিষয় কথোপকথন ও আলোচনা করিবেন।’১৫ কিন্তু রবীন্দ্রনাথের লিখিত ‘ধৃতরাষ্ট্র বিলাপ’ নামে কোনো কবিতার সংবাদ আমাদের জানা নেই, অথচ উক্ত পণ্ডিত জনমণ্ডলীর কাছে তাঁকে এই বলে পরিচিত করেছিলেন যে, তিনি কবিতাটি লিখে তখন যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন অর্থাৎ কবিতাটি নিশ্চয় কোনো সাময়িক পত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর গ্রন্থের অন্যত্র খগেন্দ্রনাথ লিখেছেন [পৃ ১৮৭]:‘কবির স্বরচিত কবিতা “ধৃতরাষ্ট্র বিলাপ” চৈত্রমেলার প্রকাশ্য সভায় তাঁহার সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথ কর্তৃক পঠিত হয়’—এ বিষয়েও নির্দিষ্ট কোনো তথ্য আমাদের হাতে নেই।

খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে ‘ধৃতরাষ্ট্র বিলাপ’ সম্পর্কে শুনে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন। তাঁর উত্তর তিনি লিখে রেখেছেন পূর্বোল্লিখিত নোটের খাতায়:

লর্ড লিটনের সময়ের কবিতা [৩০/১/১৯৩২ কথাবার্তা] এ কবিতাটা খুব ভালো। বিষয়টা হচ্ছে যে যুধিষ্ঠিরের সময় রাজসূয় যজ্ঞে সমস্ত ভারতবর্ষ থেকে রাজারা কাকে সম্মান দেখাতে এসেছিল? [কৃষ্ণ, অথাৎ ভগবানকে লক্ষ্য ক’রে), আর এখনই বা কাকে সম্মান দেখাতে আস্‌ছে? কম বয়সের পক্ষে ideaটা মন্দ ছিল না, আর বেশ ঝাঁঝ ছিল। এইটীই বোধহয় “ধৃতরাষ্ট্রের বিলাপ”।

31 Jan 1932 তিনি এবিষয়ে আবার লেখেন:

‘ধৃতরাষ্ট্রের বিলাপ’ লেখাটা সত্যি ভালো হয়েছিল বল্‌লেন। কবির সব ঠিক মনে নেই তবে ওর ভাবখানা হ’চ্ছে এই যে, একদিন ইন্দ্রপ্রস্থে ভারতবর্ষের রাজারা এসেছিলো রাজসূয় উপলক্ষ্যে কাকে সম্মান দেখাবার জন্য— (অর্থাৎ কৃষ্ণকে), আর আজ (দিল্লী-দরবার উপলক্ষ্যে) রাজন্য-সমাগমই বা কাকে সম্মান দেখাবার জন্য? স্বর্গ থেকে ধৃতরাষ্ট্র এই কথা ভাবছেন।

[মন্তব্য: —কবি যা বলছেন সে হিসাবে ‘ধৃতরাষ্ট্র-বিলাপ’ লেখা হয় দিল্লী-দরবার উপলক্ষ্যে অথাৎ ১৮৭৭ (?) সালে; ব্রজেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ‘যে-কবিতা বের করেছেন হিন্দুমেলায়, রাজনারায়ণবাবুর সভাপতিত্বে, পঠিত—তার তারিখ হচ্ছে ফেব্রুয়ারি, ১৮৭৫।, তা হলে অতুলকৃষ্ণ ঘোষ যে বলেছেন, যে, হিন্দু-মেলায় কবির পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়, এই ব’লে, যে, ইনি ‘ধৃতরাষ্ট্র-বিলাপ’ কবিতা রচনা ক’রে খ্যাতিলাভ করেছেন, তা সম্ভবপর হয় কী ক’রে?]

অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত ‘মন্তব্য’ —কিন্তু রচনাটি যতদিন না উদ্ধার করা যাচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত সমস্যাটির সমাধান করা দুরূহ। উল্লেখ্য, সাধারণী-র ২৮ বৈশাখ ১২৮১ ও ৪ জ্যৈষ্ঠ ১২৮১ সংখ্যায় ‘ধৃতরাষ্ট্র বিলাপ’ নামে একটি গদ্য রস-রচনা মুদ্রিত হয়—কিন্তু রচনাটি অক্ষয়চন্দ্র সরকারের লেখা [দ্র রূপক ও রহস্য, অক্ষয় সাহিত্যসম্ভার-শেষার্ধ। ৫২৬-২৮], তার বিষয়ও আলাদা।

ক্যাশবহি আমাদের আর-একটি বিচিত্র সংবাদ দেয়, যা সকলের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে পারে। ৬ ফাল্গুন ১২৮১ [বুধ 17 Feb] তারিখের হিসাবে লিখিত হয়েছে: শ্ৰীযুক্ত রবীবাবুর কৃত/ছবি এক খানা বাঁধাইবার ব্যয়/এক বৌচর ২৴°/গুঃ যদুনাথ চট্টোপা-[ধ্যায়]’। আমরা জানি, কৃষি শিল্প ও চিত্র প্রদর্শনী হিন্দুমেলার একটি অন্যতম অঙ্গ ছিল, বর্তমান বৎসরেও যে তার আয়োজন ছিল সংবাদপত্রের বিবরণে তার উল্লেখ আছে। রবীবাবুর ‘কৃত’ যে ছবিটি বাঁধাবার উল্লেখ উক্ত হিসাবে পাওয়া যায়, সেটি কি হিন্দুমেলায় প্রদর্শিত হয়েছিল? দুঃখের বিষয়, এই সম্ভাবনার উল্লেখটুকু করা ছাড়া এ-বিষয়ে আর কোনো তথ্য আমাদের হাতে নেই। রবীন্দ্রনাথ যে ড্রয়িং শিক্ষকের কাছে এ সময়ে চিত্রাঙ্কনের পাঠ নিতেন সে-বিষয়ে ক্যাশবহি-র ৩১ আষাঢ় [বুধ 14 Jul ] তারিখের একটি হিসাব আমাদের অবহিত করে: ‘ব° বাবু হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর/দ° সোম রবীবাবুদিগের ড্রইং শিক্ষার/সাবেক মাষ্টারের বেতন ছয়মাসের ৫৲, হিঃ/৩০৲, টাকা উক্ত বাবুকে দেওয়া যায়’—এ-প্রসঙ্গে ‘সাবেক’ শব্দটি লক্ষণীয়, আষাঢ় ১২৮২-তে উক্ত ড্রয়িং-শিক্ষক ‘সাবেক’-এ পরিণত হয়েছিলেন, কিন্তু সম্ভবত মাঘ ১২৮১-তে তিনি নিয়োজিত ছিলেন এবং তাঁরই অধীনে রবীন্দ্রনাথ যে ছবি এঁকেছিলেন তারই একটি বাঁধানো ও হিন্দুমেলায় প্রদর্শিত হয়েছিল এমন সম্ভাবনার কল্পনাই আমাদের পুলকিত করে। এই অনুমান যদি যথার্থ হয়, তাহলে রবীন্দ্রনাথের চিত্র-প্রদর্শনীর ইতিহাসে একটি নূতন অধ্যায় যোগ করা দরকার হবে।

আমরা পূর্ব বৎসরের বিবরণে উল্লেখ করেছি, 1874-এ রবীন্দ্রনাথ সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন বলে সজনীকান্ত দাস যে অনুমান করেছেন, সেটি যথার্থ নয়। এই অনুমানটি বহু রবীন্দ্র-গবেষককে ভুল পথে পরিচালিত করেছে। প্রকৃত তথ্যটি পাওয়া যায় ক্যাশবহি-র ২৪ আষাঢ় ১২৮২ [বুধ 7 Jul 1875 ] তারিখের হিসাব থেকে:

—এই হিসাব থেকে বোঝা যায় 1874-এ নয়, Feb 1875-এ [মাঘ ১২৮১] সোমেন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদ মাসের শুরুতেই এবং রবীন্দ্রনাথ কয়েকদিন পরে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের স্কুল বিভাগে [দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৬] ভর্তি হন। পুরো 1874 বৎসরটি তাঁরা স্কুলের বন্ধন থেকে মুক্ত ছিলেন এবং গৃহশিক্ষকদের অধীনে পড়াশুনোর এই অধ্যায়টিকেই রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে ‘ঘরের পড়া’ বলে অভিহিত করেছেন। উপরের হিসাবটি আমাদের কিছু অতিরিক্ত সংবাদও জ্ঞাপন করে। লক্ষণীয়, রবীন্দ্রনাথকে সোমেন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদের ভর্তি হওয়ার কয়েকদিন পরে উক্ত স্কুলে ভর্তি করা হয়। এর থেকে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথকে পুনরায় স্কুলে পাঠানো সুবিবেচনার কাজ হবে কিনা এ-বিষয়ে অভিভাবকেরা প্রথমেই মনঃস্থির করে উঠতে পারেননি। স্কুলটির পঠন-পাঠনের সুনাম, বিচক্ষণ মিশনারি অধ্যাপকদের যত্ন এবং বিস্তৃত প্রাঙ্গণ-সহ সুন্দর স্কুলবাড়ি হয়তো বন্ধনভীরু এই বালকের কাছে খুব দুঃসহ হবে না এই ভেবেই সম্ভবত অভিভাবকেরা শেষ পর্যন্ত তাঁকে স্কুলে ভর্তি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অভিভাবকদের প্রাথমিক আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না, রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী আচরণ থেকে তা প্রমাণিত হয়েছে। সে-সম্পর্কে তিনি জীবনস্মৃতি-তে যা লিখেছেন, তাছাড়াও কিছু অতিরিক্ত তথ্য আমরা যথাস্থানে সরবরাহ করব।

আরও একটি জিনিস লক্ষণীয় যে, ভর্তি ফি সহ পাঁচ মাসের বেতন [Feb থেকে Jun ] শোধ করা হয়েছে 7 Jul তারিখে এবং রবীন্দ্রনাথ কয়েকদিন পরে ভর্তি হয়েছিলেন বলে ৫৲ টাকা বাদ দেওয়া হয়েছে [এই ধরনের ঠিকা প্রথায় বেতন পরিশোধ করার রীতি আমরা আগেও দেখেছি, হিমালয়ভ্রমণের কয়েকমাসের বেতন বেঙ্গল অ্যাকাডেমিকে দেওয়া হয়নি]! এমন নয় যে কয়েক মাসের বিল একত্রিত করে একসঙ্গে হিসাব লেখা হয়েছে। উপরোক্ত হিসাবটি ১২৮২ সালে ‘PERSONAL ACCOUNT /খতিয়ান বহি’র ‘বিদ্যাভ্যাস খাতা’ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে, কিন্তু ঐ একই বৎসরের ‘নিজ হিসাবের ক্যাশবহি’ নামক খাতায় উক্ত হিসাবের সঙ্গে একটু অতিরিক্ত তথ্য পাওয়া যায়: নোট ১০০৲ ও রোক [খুচরো টাকা] ২১৲’-এর থেকে বোঝা যায় পুরো টাকাটাই এক সঙ্গে শোধ করা হয়েছিল। * এখনকার দিনে স্কুল-কলেজের বেতন শোধের ক্ষেত্রে এরকম রীতির কথা ভাবাই সম্ভব নয়। তাঁরা যে Feb 1875-এর শুরু থেকেই স্কুলে যাতায়াত করতে শুরু করেছিলেন, সে খবর জানা যায় ৭ বৈশাখ ১২৮২ [সোম 19 Apr] তারিখের হিসাব থেকে: ‘ব° এলাইবক্স/দ° সোম রবীবাবুদিগের/ইস্কুলের গাড়ি/উক্ত এলাইবক্সের জায়গায় থাকে/ঐ জায়গার ভাড়া ই° ১৬ মাঘ না° ৩০ চৈত্র/মাসিক ২৲ হিঃ শোধ দেওয়া যায়…৫৲’ [১৬ মাঘ কিন্তু খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডার অনুযায়ী 28 Jan; সম্ভবত হিসাবের সুবিধের জন্য ৪ দিনের ভাড়া অতিরিক্ত দেওয়া হয়েছিল]। ‘সোম রবী বাবু দিগের ইস্কুলে যাইবার জন্য নূতন কেম্পাস ঘোড়া একটা ক্রয়’ করা হয়েছে ২০০ টাকা দিয়ে, এ হিসাব আমরা ক্যাশবহি-তে পাই ৬ ফাল্গুন [বুধ 17 Feb] তারিখে।

রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর দুই সহপাঠী সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের স্কুল বিভাগে যে-শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন, তখনকার দিনে তার নাম ছিল ‘Fifth Year’s Class’, এর পরের শ্রেণীটিই ছিল Entrance Class, সুতরাং এখনকার হিসেবে Fifth year’s class ছিল নবম শ্রেণীর সমতুল। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের স্কুল বিভাগের 1875-এর মুদ্রিত তালিকায়১৬ [Calender of St. Xavier’s College, 1976] দেখা যায় এই ক্লাসে মোট ৪০টি ছাত্র, তার মধ্যে Gangoolee Suttyaprosad, Tagore, Nubindronath [রবীন্দ্রনাথের নাম ভ্রমক্রমে ‘নবীন্দ্রনাথ’ মুদ্রিত হয়েছে, এবং পরের বৎসরেও সংশোধিত হয়নি] ও Tagore, Sumendronath-এর নাম বর্ণানুক্রমে ছাপা হয়েছে: রবীন্দ্রনাথের রোল নাম্বার ছিল ৩৬। এই শ্রেণীতে তাঁদের সহপাঠীদের মধ্যে বাঙালি ছিলেন তিন জন—দেবেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, প্রিয়নাথ দত্ত ও নরেন্দ্রনাথ মুখার্জি। স্কুলের পাঠ্যপুস্তক ক্রয়ের বিস্তৃত কোনো হিসাব পাওয়া যায় না [ক্যাশবহি-র ৮ ফাল্গুন থেকে ৩০ চৈত্র পর্যন্ত হিসাব-সংবলিত পাতাগুলি হারিয়ে গেছে], কেবল জানা যায় ২৮ মাঘ [মঙ্গল 9 Feb] চার টাকা বারো আনা দিয়ে ‘সোম রবী সত্যপ্রসাদ বাবু দিগের পুস্তক ক্রয়’ করা হয়েছে এবং ৭ ফাল্গুন [বৃহ 18 Feb] ‘সোম রবী বাবু দিগের জন্য উডস আলজেবরা একখানা ক্রয়’ বাবদ ব্যয়িত হয়েছে ছ’টাকা চার আনা। বর্তমান অধ্যায়ের কালসীমায় রবীন্দ্রনাথ মাত্র আড়াই মাস সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়াশুনো করেছেন, সুতরাং প্রসঙ্গটির আলোচনা আমরা পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য স্থগিত রাখছি।

এ বৎসর জোড়াসাঁকোর ঠাকুরপরিবারে ও রবীন্দ্রনাথের জীবনে সব চেয়ে বড় ঘটনা সারদা দেবীর মৃত্যু। [দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য: ২] ২৭ ফাল্গুন ১২৮১ বুধ 10 Mar 1875 তারিখে আনুমানিক ৪৯ বৎসর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয় [সত্যপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর হিসাব-খাতায় লিখেছেন: ‘কর্ত্তাদিদিমাতা ঠাকুরাণীর স্বর্গারোহণ ২৭ ফাল্গুন ১২৮১ বুধবার রাত্রি ৩-৪৫ মিনিট’]। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন মাত্র তেরো বৎসর দশ মাস। তিনি জীবনস্মৃতি-তে মায়ের মৃত্যুর বর্ণনাটি দিয়েছেন এই ভাবে:

অনেকদিন হইতে তিনি রোগে ভুগিতেছিলেন, কখন-যে তাঁহার জীবনসংকট উপস্থিত হইয়াছিল তাহা জানিতেও পাই নাই। এতদিন পর্যন্ত যে-ঘরে আমরা শুইতাম সেই ঘরেই স্বতন্ত্র শয্যায় মা শুইতেন। কিন্তু তাঁহার রোগের সময় একবার কিছুদিন তাঁহাকে বোটে করিয়া গঙ্গায় বেড়াইতে লইয়া যাওয়া হয়—তাহার পরে বাড়িতে ফিরিয়া তিনি অন্তঃপুরের তেতালার ঘরে থাকিতেন। যে-রাত্রিতে তাঁহার মৃত্যু হয় আমরা তখন ঘুমাইতেছিলাম, তখন কত রাত্রি জানি না, একজন পুরাতন দাসী আমাদের ঘরে ছুটিয়া আসিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, “ওরে তোদের কী সর্বনাশ হল রে।” তখনই বউঠাকুরানী তাড়াতাড়ি তাহাকে র্ভৎসনা করিয়া ঘর হইতে টানিয়া বাহির করিয়া লইয়া গেলেন—পাছে গভীর রাত্রে আচমকা আমাদের মনে গুরুতর আঘাত লাগে এই আশঙ্কা তাঁহার ছিল। স্তিমিত প্রদীপে, অস্পষ্ট আলোকে ক্ষণকালের জন্য জাগিয়া উঠিয়া হঠাৎ বুকটা দমিয়া গেল, কিন্তু কী হইয়াছে ভালো করিয়া বুঝিতেই পারিলাম না। প্রভাতে উঠিয়া যখন মা’র মৃত্যু সংবাদ শুনিলাম তখনো সেকথাটার অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলাম না। বাহিরের বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম, তাঁহার সুসজ্জিত দেহ প্রাঙ্গণে খাটের উপরে শয়ান। কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর সে-দেহে তাহার কোনো প্রমাণ ছিল না;—সেদিন প্রভাতের আলোকে মৃত্যুর যে-রূপ দেখিলাম তাহা সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর।… কেবল যখন তাঁহার দেহ বহন করিয়া বাড়ির সদর দরজার বাহিরে লইয়া গেল এবং আমরা তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ শ্মশানে চলিলাম তখনই শোকের সমস্ত ঝড় যেন একেবারে এক-দমকায় আসিয়া মনের ভিতরটাতে এই একটা হাহাকার তুলিয়া দিল যে, এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘরকরনার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না। বেলা হইল, শ্মশান হইতে ফিরিয়া আসিলাম; গলির মোড়ে আসিয়া তেতলায় পিতার ঘরের দিকে চাহিয়া দেখিলাম—তিনি তখনো তাঁহার ঘরের সম্মুখের বারান্দায় স্তব্ধ হইয়া উপাসনায় বসিয়া আছেন।১৭

সারদা দেবীর মৃত্যুর পর ৩০ ফাল্গুন [শনি 13 Mar] সৌদামিনী দেবী ও অন্যান্য কন্যাগণ চতুর্থী শ্রাদ্ধ করেন। তাঁর আদ্য শ্রাদ্ধ হয় ৭ চৈত্র [শনি. 20 Mar] তারিখে। ধর্মতত্ত্ব পত্রিকা ১৬ চৈত্র [৮। ৬, পৃ ৬৮] সংখ্যায় ‘সংবাদ’ শিরোনামায় সংক্ষেপে লেখে: ‘প্রধান আচার্য্য শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের বনিতা পরলোকগমন করিয়াছেন। বিশেষ সমারোহের সহিত তাঁহার শ্রাদ্ধ ক্রিয়া সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। এই উপলক্ষে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদিগকে যথেষ্ট বিদায় দেওয়া হইয়াছিল।’ মনে হয় বৃশ্চিকের পশ্চাদ্দেশের হুলের মতো এই শেষ বাক্যটি লেখার জন্যই যেন সংবাদটি পরিবেশিত হয়েছিল!

রবীন্দ্রনাথের রচনায় মায়ের উল্লেখ অবিশ্বাস্য রকমে কম। সুরেশচন্দ্র সমাজপতি-সম্পাদিত শারদীয়-সংকলন আগমনী [১৩২৬]-র জন্য ‘মাতৃবন্দনা’ শিরোনামে তিনি ৬টি ছোটো কবিতা [তার মধ্যে ‘জননি, তোমার করুণ চরণখানি’ ১৩১৫-তে লিখিত ও গীতাঞ্জলি-তে মুদ্রিত] পাঠিয়ে দেন (দ্র র°র°৩ [প, ব, ১৩৯০]। ১২৯৫-৯৬)। অনেকের মতে, এগুলির মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ মায়ের বন্দনা করেছেন—কিন্তু কবিতাগুলির মধ্যে দেশজননী বা জগজ্জননীর ভাবই মুখ্য হয়ে উঠেছে।

ছেলেদের দেখাশোনার ভার সারদা দেবীর উপর ছিল না, এবং প্রায় এক বৎসর যাবৎ অসুস্থতার জন্য মায়ের সঙ্গে আগে বালক রবীন্দ্রনাথের যেটুকু যোগাযোগ ছিল সেটুকুও অনেকখানি ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। তাছাড়া বৃহৎ পরিবারের মধ্যে চাকর-দাসীদের তত্ত্বাবধানে থাকার জন্য রবীন্দ্রনাথের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় মায়ের অভাব খুব একটা বোধ করার কথা নয়। কিন্তু মাতৃহীন বালকদের প্রতি স্বাভাবিক সহানুভূতি-বশত বাড়ির কনিষ্ঠা বধূ কাদম্বরী দেবী তাঁদের ভার গ্রহণ করলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নতুন বউঠাকরুনের অন্তরঙ্গ সম্পর্কের সূত্রপাত এখানেই। হিমালয় থেকে ফিরে আসবার পর ‘বাড়ির যিনি কনিষ্ঠ বধূ ছিলেন তাঁদের কাছ হইতে প্রচুর স্নেহ ও আদর’ তিনি পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু বর্তমানে সহানুভূতি ও মমতার মাধুর্য মিশ্রিত হয়ে তাঁদের সম্পর্ক অন্য এক স্তরে পৌঁছে গেল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘তিনিই আমাদিগকে খাওয়াইয়া পরাইয়া সর্বদা কাছে টানিয়া, আমাদের যে কোনো অভাব ঘটিয়াছে তাহা ভুলাইয়া রাখিবার জন্য দিনরাত্রি চেষ্টা করিলেন।’১৮ হিমালয় ভ্রমণের পর অন্তঃপুরের রুদ্ধ দ্বার রবীন্দ্রনাথের কাছে খুলে গিয়েছিল, এখন নারী-হৃদয়ের রহস্যলোকে তাঁর প্রবেশের সুযোগ ঘটল। সেই উপলব্ধিই সম্ভবত কিছু দিনের মধ্যে কাব্যরূপ লাভ করেছে এই ছত্রগুলির মধ্যে:

‘অনন্ত-প্রণয়ময়ী রমণী তোমরা

পৃথিবীর মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।

তোমাদের স্নেহধারা যদি না বর্ষিত

হৃদয় হইত তবে মরুভূমি সম

স্নেহ দয়া প্রেম ভক্তি যাইত শুকায়ে।

তোমরাই পৃথিবীর সঙ্গীত, কবিতা,

স্বর্গ, সে ত তোমাদের হৃদয়ে বিরাজে…’১৯

রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে দেবেন্দ্রনাথ ফাল্গুন ১২৭৯-তে হিমালয়ের উদ্দেশে কলকাতা ত্যাগ করেছিলেন, সারদা দেবীর অসুস্থতার জন্য প্রায় দু-বছর পরে এই বৎসর পৌষ মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। এবার তিনি লেনু সিং নামে একটি পাঞ্জাবী ভৃত্যকে সঙ্গে করে আনেন। ১৭ পৌষ [বৃহ 31 Dec] ‘শ্রীযুক্ত কর্ত্তাবাবু মহাশয়ের বেহারা লেনু চাকরের ইজের ও কোরতা তৈয়ারির ব্যয় ও উড়ানী একজোড়া ও কোমরবন্দ’ বাবদ চার টাকা বারো আনা খরচ দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিতে এই ভৃত্যটি স্থান করে নিয়েছিল তার মধ্যে দূরের রহস্য লুকিয়ে ছিল বলে। তিনি লিখেছেন:

সে আমাদের কাছে যে-সমাদরটা পাইয়াছিল তাহা স্বয়ং রণজিতসিংহের পক্ষেও কম হইত না। সে একে বিদেশী তাহাতে পাঞ্জাবি—ইহাতেই আমাদের মন হরণ করিয়া লইয়াছিল। পুরাণে ভীমার্জুনের প্রতি যেরকম শ্রদ্ধা ছিল, এই পাঞ্জাবি জাতের প্রতিও মনে সেই প্রকারের একটা সম্ভ্রম ছিল। ইহারা যোদ্ধা—ইহারা কোনো কোনো লড়াইয়া হারিয়াছে বটে, কিন্তু সেটাকেও ইহাদের শত্রুপক্ষেরই অপরাধ বলিয়া গণ্য করিয়াছি। সেই জাতের লেনুকে ঘরের মধ্যে পাইয়া মনে খুব একটা স্ফীতি অনুভব করিয়াছিলাম।২০

কাদম্বরী দেবীর ঘরে কাঁচের আবরণে ঢাকা একটি খেলার জাহাজ ছিল, তাতে দম দিলেই রঙকরা কাপড়ের ঢেউ ফুলে ফুলে উঠত এবং জাহাজটা অর্গানের বাজনার সঙ্গে সঙ্গে দুলতে থাকত। অনেক অনুনয়ে বউঠাকুরানীর কাছ থেকে আশ্চর্য জিনিসটি সংগ্রহ করে আনতেন আশ্চর্যতর জগতের মানুষ এই পাঞ্জাবিকে চমৎকৃত করে দিতে। [এই খেলনাটির স্মৃতি গোরা উপন্যাসের মধ্যেও স্থান করে নিয়েছে,২১ সেখানে অবশ্য লেনুর কথা নেই।] তিনি লিখেছেন, ‘ঘরের খাঁচায় বদ্ধ ছিলাম বলিয়া যাহা-কিছু বিদেশের, যাহা-কিছু দূরদেশের, তাহাই আমার মনকে অত্যন্ত টানিয়া লইত। তাই লেনুকে লইয়া ভারি ব্যস্ত হইয়া পড়িতাম।’২২

কিন্তু হিমালয় থেকে ফিরে আসার পর রবীন্দ্রনাথ ঠিক ঘরের খাঁচায় বদ্ধ ছিলেন না। শ্ৰীকণ্ঠ সিংহের সঙ্গে বালিগঞ্জ হেদুয়া প্রভৃতি অঞ্চলে বেড়াতে যাওয়ার কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। আলিপুরে ফ্যানসি ফেয়ারে যাওয়া তো একটা বাৎসরিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল। বর্তমান বৎসরেও এইরূপ বেড়ানো বা আমোদপ্রমোদে যোগদানের অনেকগুলি সংবাদ ক্যাশবহি থেকে পাওয়া যায়। ২৫ বৈশাখ [বৃহ 7 May] তারিখের হিসাবে দেখি: ‘ছেলেবাবুরা থিএটর দেখিতে জান/টিকিট ক্রয়… ৮৲’; তখনকার দিনে বৃহস্পতিবারে অভিনয়ের প্রথা ছিল না, অভিনয় হত বুধ ও শনিবারে। সুতরাং তাঁরা ২০ বৈশাখ শনিবার কিংবা ২৪ বৈশাখ বুধবার অভিনয় দেখতে গিয়েছিলেন, সম্ভবত গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে।*

৩০ আষাঢ় [সোম 13 Jul] তারিখের হিসাবে দেখা যায়: ‘সোম রবিবাবুর দিগের/মুলাজোড় বাগানে জাওয়া আশায়/ব্যায়…৪।৵৬’। শ্যামনগর স্টেশনের কাছে গঙ্গার তীরে অবস্থিত এই বাগান তখন পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়ির যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সম্পত্তির অন্তর্গত ছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘আমার নিতান্ত শিশুকালে মূলাজোড়ে গঙ্গার ধারের বাগানে মেঘোদয়ে বড়দাদা ছাদের উপরে একদিন মেঘদূত আওড়াইতেছিলেন, তাহা আমার বুঝিবার দরকার হয় নাই এবং বুঝিবার উপায়ও ছিল না—তাঁহার আনন্দ-আবেগপূর্ণ ছন্দ-উচ্চারণই আমার পক্ষে যথেষ্ট ছিল।’২৩ যে-সময়ের কথা এখানে বলা হচ্ছে তাকে রবীন্দ্রনাথের ‘নিতান্ত শিশুকাল’ কিছুতেই বলা যায় না, কিন্তু আমাদের মনে হয় তিনি এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতাই লিপিবদ্ধ করেছেন, কারণ ১২৭৯ বঙ্গাব্দে পেনেটিতে ‘প্রথম বাহিরে যাত্রা’র পর মুলাজোড়ে এইটিই তাঁর প্রথম আগমন এবং পেনেটিতে অবস্থানও ‘নিতান্ত শিশুকালে’র ঘটনা নয়। অন্যত্র রবীন্দ্রনাথ এই ঘটনারই যে স্মৃতিচারণ করেছেন, তার বর্ণনা অনেকটা যথাযথ:

অনেক দিন হইল, বাল্যকালে গঙ্গার ধারের এক বাগানে বসিয়া দাদার মুখে যখন শুনিয়াছিলাম,-“আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং”—তখন বোধ হয় উপক্রমণিকা পড়িতে আরম্ভ করিয়াছি; সংস্কৃত শব্দগুলি কানে কতকটা পরিচিত ঠেকে, মনে হয় যেন ভাবটা একটু একটু ধরিতে পারিতেছি, কিন্তু তবু কিছুই পরিষ্কার বুঝা যাইতেছে না। অর্থাৎ, যে দুটা একটা শব্দ বুঝা যায়, তাহার সহিত সংস্কৃত ছন্দের ঝঙ্কার মিশ্রিত হইয়া মনের মধ্যে কেবল একটা সঙ্গীত উৎপন্ন করিত; তাহাকে ভাষায় পরিণত করা দুরূহ। মেঘদূতের মেঘমন্দ্র ছন্দ এবং “আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং” এই ছত্রটি শুনিয়া প্রাচীন কালের এক ঘন বর্ষার দিন আমার উপরে ঘনাইয়া আসিল। যেমন দূর হিমালয়ের শিখরে যে দিন বর্ষা নামিয়া আসে, সে দিন হঠাৎ গ্রামের প্রান্তে সৈকতশয্যাশায়ী শীর্ণ নদীস্রোতটুকুর মধ্যে একটা স্ফীতি উপস্থিত হয়, তেমনি সেই উজ্জয়িনীর অতি পুরাতন কোন্ এক প্রথম আষাঢ়ের বর্ষা এই এক যুগপ্রান্তবর্তী বালকের হৃদয়ে আপনার সংবাদ প্রেরণ করিল। হঠাৎ পরিপূর্ণ ছন্দের স্রোতে এবং ধ্বনির গাম্ভীর্য্যে হৃদয়ের দুই কূল নিমগ্ন হইয়া গেল।২৩ক

এছাড়া ৬ শ্রাবণ ‘সোম রবীবাবুদিগের আহিরিটোলা জাতাতের’, ১৯ অগ্রহায়ণ ‘জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের বাটীতে’ এবং ২৬ পৌষ [শনি 9 Jan 1875] ‘ঠাকুদ্দাস পণ্ডিতের বাটী জাতাতের’ জন্য গাড়ি ভাড়া পরিশোধের হিসাব দেখা যায়। ‘ঠাকুদ্দাস পণ্ডিতের’ পরিচয় আমাদের জানা নেই, কিন্তু এখানে যদি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বোঝানো হয়ে থাকে, তাহলে বিদ্যাসাগরকে ম্যাকবেথের অনুবাদ শোনাবার সময়টি সুনির্দিষ্ট হয়ে আসে।

অন্যান্য বারের মতো এবারেও ১৮ পৌষ [শুক্র 1 Jan 1875] ‘সোম রবী সত্যপ্রসাদবাবুদিগের ফেনসি ফেয়ার দেখিতে যাইবার টিকিট ইত্যাদি’ বাবদ দশ টাকা এবং ১০ পৌষ [বৃহ 24 Dec] ‘সোম রবী সত্ত্যপ্রসাদবাবুদিগের ক্রিসমস উপলক্ষে উইলসেনর বাটির খাবার ক্রয় জন্য’ পাঁচ টাকা ব্যয় করা হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের কবি-জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের শুরু এই বৎসরেই—সেটি হল বৈষ্ণব পদাবলি-সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয়। বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস-পাঠকদের জানা আছে, চৈতন্যপরবর্তী মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখাই কিভাবে রাধাকৃষ্ণ প্রেম-গীতির থেকে রস আকর্ষণ করে নিজেদের পুষ্ট করে তুলেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে বৈষ্ণব আখড়াগুলির নৈতিক অধঃপতনে ও কবিওয়ালাদের কুরুচিপূর্ণ ব্যবহারে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা-বর্ণনা এমন এক কুৎসিত রূপ ধারণ করেছিল যে, ইংরেজি-শিক্ষিত নব্য বাঙালিরা বৈষ্ণবপদাবলির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল। এই প্রেমকে অশ্লীলতার গহ্বর থেকে প্রথম মুক্তি দেন মধুসূদন তাঁর ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ [1861]-তে। এর পর বৈষ্ণব-বংশোদ্ভূত নব্য ব্রাহ্মনেতা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী প্রভৃতির প্রভাবে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে যখন বৈষ্ণবদের অনুকরণে সংকীর্তন-সহ নগর পরিক্রমা ইত্যাদির প্রবর্তন হল, তখন ধীরে ধীরে শিক্ষিত বাঙালি আবার বৈষ্ণব পদাবলির প্রতি আকৃষ্ট হল। এরই প্রথম ফল জগদ্বন্ধু ভদ্র [1842-1906] সম্পাদিত ‘মহাজনপদাবলী সংগ্রহ’ [১২৮০]*। এর পর সাধারণী-সম্পাদক অক্ষয়চন্দ্র সরকার [1846-1917], সারদাচরণ মিত্র [1848-1917] ও বরদাকান্ত মিত্রের সম্পাদনায় ১২৮১ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাস থেকে প্রতি মাসে ধারাবাহিকভাবে ‘প্রাচীন কাব্যসংগ্রহ’ নামে বিদ্যাপতির পদাবলি টীকা-সহ প্রকাশিত হতে থাকে। পরে অক্ষয়চন্দ্রের সম্পাদনায় এই পর্যায়ে ‘চণ্ডীদাস-কৃত পদাবলি’ [১২৮৫], ‘রামেশ্বরী সত্যনারায়ণ অর্থাৎ শ্রীরামেশ্বর ভট্টাচাৰ্য্য বিরচিত সত্যনারায়ণের পালা’, ‘গোবিন্দদাস কৃত পদাবলি’ [১২৮৫] প্রভৃতি প্রকাশিত হয়। শেষোক্ত গ্রন্থগুলির রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক ব্যবহৃত খণ্ডগুলি শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে সুরক্ষিত আছে। এদের মধ্যে বিদ্যাপতি পদাবলির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এরই মাধ্যমে তিনি বৈষ্ণব কাব্য-জগতে প্রবেশ করেন, যা নানাভাবে তাঁর কাব্যভাবনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তিনি জীবনস্মৃতি-র পাণ্ডুলিপিতে লিখেছিলেন: ‘আমার পূজনীয় দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের কাছে এই সংগ্রহের অনিয়মিত ভাবে প্রকাশিত খণ্ডগুলি আসিত। তাঁহাদের পড়া হইলেই আমি এগুলি জড় করিয়া আনিতাম।’২৪ মুদ্রিত গ্রন্থে বর্ণনাটি এইরূপ: ‘শ্ৰীযুক্ত সারদাচরণ মিত্র ও অক্ষয় সরকার মহাশয়ের প্রাচীন-কাব্যসংগ্রহ সে-সময়ে আমার কাছে একটি লোভের সামগ্রী হইয়াছিল। গুরুজনেরা ইহার গ্রাহক ছিলেন কিন্তু নিয়মিত পাঠক ছিলেন না। সুতরাং এগুলি জড়ো করিয়া আনিতে আমাকে বেশি কষ্ট পাইতে হইত না। বিদ্যাপতির দুর্বোধ বিকৃত মৈথিলী পদগুলি অস্পষ্ট বলিয়াই বেশি করিয়া আমার মনোযোগ টানিত। আমি টীকার উপর নির্ভর না করিয়া নিজে বুঝিবার চেষ্টা করিতাম। বিশেষ কোনো দুরূহ শব্দ যেখানে যতবার ব্যবহৃত হইয়াছে সমস্ত আমি একটি ছোটো বাঁধানো খাতায় নোট করিয়া রাখিতাম। ব্যাকরণের বিশেষত্বগুলিও আমার বুদ্ধি অনুসারে যথাসাধ্য টুকিয়া রাখিয়াছিলাম।’২৪ এইটিই বালক রবীন্দ্রনাথের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। যে-কোনো রহস্যের আভাস তাঁকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করত। যে বিস্ময় ও ঔৎসুক্যের জন্য দক্ষিণের বারান্দার কোণে আতার বিচি পুঁতে তাতে রোজ জলসেচন করতেন বা পিতার পাঞ্জাবি বালকভৃত্য লেনু সিং যে সুদূরতার রহস্যের জন্য তাঁর সমাদর লাভ করেছিল, সেই একই কারণে বিদ্যাপতির মৈথিলী-মিশ্রিত দুর্বোধ্য ভাষা তাঁকে আকর্ষণ করেছিল—‘গাছের বীজের মধ্যে যে-অঙ্কুর প্রচ্ছন্ন ও মাটির নিচে যে-রহস্য অনাবিষ্কৃত, তাহার প্রতি যেমন একটি একান্ত কৌতূহল বোধ করিতাম, প্রাচীন পদকর্তাদের রচনা সম্বন্ধেও আমার ঠিক সেই ভাবটা ছিল।’২৫ তাছাড়া তাঁর বন্ধনভীরু যে মন বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তককে সযত্নে এড়িয়ে চলেছে, সেই মনই আবার ‘শুধু অকারণ পুলকে’ দুরূহ শব্দের তালিকা ও তাদের ব্যাকরণগত বিশেষত্বগুলি টুকে রাখার পরিশ্রম স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হয়নি—এর মধ্যেও তাঁর স্বভাব-বৈশিষ্ট্য নিহিত আছে। পরবর্তীকালে তিনি গদ্যরীতিতে ছাপা শ্রীরামপুর মিশন প্রেস-প্রকাশিত জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্যের বিচিত্র ছন্দকে নিজের চেষ্টায় আবিষ্কার করার প্রয়াস করেছেন বা সমগ্র কাব্যটিকে একটি খাতায় নকল করে নিয়েছিলেন, সে-ও এই একই মানসিকতা থেকে।

যাই হোক, তাঁর এই সাধনা ব্যর্থ হয়নি। এর প্রথম ফল দেখা যায় বিদ্যাপতির অনুকরণে ভানুসিংহের কবিতা রচনার মধ্যে। জীবনস্মৃতি-তে বা অন্যত্র এই কবিতাগুলিকে তিনি একটু লঘু করে দেখানোর প্রয়াস করলেও এগুলির সম্পর্কে তাঁর দুর্বলতার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ সন্ধ্যাসংগীত-এর পূর্ববর্তী কৈশোরক-পর্বের সমস্ত কবিতাকে তিনি রচনাবলি থেকে নির্বাসিত করতে চাইলেও ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’-কে সেই দুর্ভাগ্য বরণ করতে হয়নি।

তাছাড়া বিদ্যাপতির পদাবলি নিয়ে দীর্ঘকাল তিনি চর্চা করেছেন, তার নিদর্শন রয়ে গেছে বিভিন্ন বয়সে লেখা অনেকগুলি প্রবন্ধে। George A. Grierson যখন প্রধানত বিদ্যাপতিকে অবলম্বন করে তাঁর বিখ্যাত An Introduction to the Maithili Language of North Bihar containing a Grammar, Chrestomathy & Vocabulary [1882] গ্রন্থ প্রকাশ করলেন, রবীন্দ্রনাথ কত যত্নে সেই গ্রন্থটি পাঠ করেছিলেন তার প্রমাণ আছে রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত উক্ত গ্রন্থের পাতায় পাতায় তাঁর স্বহস্ত-লিখিত বাংলা ও ইংরেজি শব্দার্থ, গদ্য ও পদ্যানুবাদের মধ্যে। এমন-কি বিদ্যাপতির পদাবলির একটি সংস্করণ সম্পাদনা করতেও তিনি ব্রতী হয়েছিলেন, কোনো অজ্ঞাত কারণে সেই গ্রন্থ বিজ্ঞাপিত হওয়ার পরও প্রকাশিত হয়নি। বহুকাল পরে রবীন্দ্র-রচনাবলী-র দ্বিতীয় খণ্ডে [পৌষ ১৩৪৬] ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী-র ‘সূচনা’য় তিনি লিখেছিলেন: ‘পদাবলীর যে ভাষাকে ব্রজবুলি বলা হোত আমার কৌতুহল প্রধানত ছিল তাকে নিয়ে। শব্দতত্ত্বে আমার ঔৎসুক্য স্বাভাবিক। টীকায় যে শব্দার্থ দেওয়া হয়েছিল তা আমি নির্বিচারে ধরে নিই নি। এক শব্দ যতবার পেয়েছি তার সমুচ্চয় তৈরি করে যাচ্ছিলুম। একটি ভালো বাঁধানো খাতা শব্দে ভরে উঠেছিল। তুলনা করে আমি অর্থ নির্ণয় করেছি। পরবর্তীকালে কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ যখন বিদ্যাপতির সটীক সংস্করণ প্রকাশ করতে প্রবৃত্ত হলেন তখন আমার খাতা তিনি সম্পূর্ণ ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। তাঁর কাজ শেষ হয়ে গেলে সেই খাতা তাঁর ও তাঁর উত্তরাধিকারীর কাছ থেকে ফিরে পাবার অনেক চেষ্টা করেও কৃতকার্য হতে পারিনি।’ এটা আমাদেরও দুর্ভাগ্য, রবীন্দ্র-প্রতিভার একটি বিশেষ দিক আমাদের কাছে যথেষ্ট স্পষ্ট হবার সুযোগ পেল না!

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ১

১৬ চৈত্র ১২৮০ [শনি 28 Mar 1874] সত্যেন্দ্রনাথ দু’ মাসের ছুটি নিয়ে সপরিবারে কলকাতায় এসে পৌঁছন। ফার্লো ছুটি নিয়ে ইংলন্ড যাবার ইচ্ছা হয়তো তখনই তাঁর মনে জেগে থাকবে। ইংলণ্ডে স্ত্রী-স্বাধীনতার আবহাওয়ায় পত্নী জ্ঞানদানন্দিনীকে সব রকমের সংস্কারমুক্ত করে নিজের প্রকৃত সহধর্মিণীতে পরিণত করার আকাঙ্ক্ষা আই. সি. এস. পড়ার সময় থেকেই তিনি পোষণ করে আসছিলেন। এবারে বাড়িতে এলেন হয়তো তারই আয়োজন করতে। এমন-কি তাঁর সেই ইচ্ছা সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হল: ‘বাবু সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সি, এস, (ইনি এক্ষণে কলিকাতায় আছেন) পুত্র কলত্র সহিত শীঘ্র ইংলণ্ড গমন করিবেন।’ [সোমপ্রকাশ, ১৭ | ২২, ৮ বৈশাখ] কিন্তু যে-কোন কারণেই হোক এখনই তাঁর সেই বাসনা পূর্ণ হয়নি। তার পরিবর্তে এখানে অবস্থানকালে তিনি একটি সাংস্কৃতিক ও একটি সামাজিক অনুষ্ঠান সমাধা করলেন। তাঁর ও দ্বিজেন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ৬ বৈশাখ [শনি 18 Apr] ‘বিদ্বজ্জন-সমাগম’-এর প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হল। [দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৩] আর বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি পঞ্চম মাসে উপনীতা কন্যা ইন্দিরার অন্নপ্রাশন দিলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথের পঞ্চম পুত্র কৃতীন্দ্রনাথের অন্নপ্রাশনও একই সঙ্গে হয়।

২৭ শ্রাবণ [মঙ্গল 11 Aug] দ্বিজেন্দ্রনাথের একটি পুত্র-সন্তান জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু জন্মের পরেই তার মৃত্যু হয়।

ভাদ্র মাসের শেষ সপ্তাহে [Sep 1874] স্বর্ণকুমারী দেবীর চতুর্থ সন্তান ও তৃতীয়া কন্যা ঊর্মিলা জন্মগ্রহণ করে।

অপ্রহায়ণ মাসের শেষ সপ্তাহে [Dec 1874] শরৎকুমারী দেবীর তৃতীয় সন্তান ও জ্যেষ্ঠ পুত্র যশঃপ্রকাশ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম হয়।

পৌষ মাসে বর্ণকুমারী দেবীর পুত্র প্রমোদনাথ, স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা ঊর্মিলা ও হেমেন্দ্রনাথের কন্যা মনীষার অন্নপ্রাশন একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। সোমেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদের উপর দায়িত্ব পড়ে উপাসনান্তে শিশুদের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার। এই উদ্দেশ্যে ৭ পৌষ [সোম 21 Dec] ‘সোম রবী ও সত্যপ্রসাদবাবুদিগের জন্য চেলির জোড় তিনটা ক্রয়’ করা হয় ছেচল্লিশ টাকা ছ’ আনায়। এই ধরনের কাজ তাঁদের আগেও করতে হয়েছে, যথাস্থানে আমরা সেকথা উল্লেখ করেছি।

এই বৎসর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বহিবাটীর প্রাঙ্গণের চেহারার কিছু বদল হয়। ৪ চৈত্র ১২৭৮ [শনি 16 Mar 1872] ‘বাবু দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর খাতে’ ১৫০০৲ টাকা খরচ লেখা হয়েছিল; এই টাকা দিয়ে জনৈক মহেন্দ্রনাথ সেনের বাড়ির সামনের খানিকটা জায়গা কেনা হয়। সেই জায়গায় একটি বাগান তৈরি করা হয়েছিল। ৩ আশ্বিন [শুক্র 18 Sep 1874] তারিখের হিসাবে দেখা যাচ্ছে ‘বাটীর সম্মুখের জায়গার বাগানের গোলপ্রাচীর দেওয়া ও বাগানের ভিতর বেড়াইবার পথ তৈয়ারি করা ও আস্তাবল সমুদায়ের সম্মুখে প্রাচীর দেওয়ার জন্য’ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের শ্বশুর শ্যামলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে ১০০ টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়। এই গোলপ্রাচীর দেওয়া বাগানের কথা অবনীন্দ্রনাথ বলেছেন জোড়াসাঁকোর ধারে-তে, তখন অবশ্য সেখানে বাগান ছিল না, জুড়িগাড়িতে জোতবার আগে সেখানে ঘোড়ার গা গরম করানো হত: ‘যেখানে রবিকার লালবাড়ি সে জায়গা জোড়া ছিল চক্কর প্রাচীরঘেরা। একপাশে ছোট্ট একটি ফটক। সহিসরা ঘোড়া দুটো চক্করে ঢুকিয়ে ফটক বন্ধ করে দিল। সমশের [কোচোয়ান] লম্বা চাবুক হাতে প্রাচীরের উপর উঠে দাঁড়িয়ে বাতাসকে চাবুক লাগাল—শট্‌। সেই শব্দ পেয়ে ঘোড়া দুটো কান খাড়া করে গোল চক্করে চক্কর দিতে শুরু করলে। একবার করে ঘোড়া ঘুরে আসে আর চাবুকের শব্দ হয়ে শট্‌ শট্‌। যেন সার্কাস হচ্ছে।’২৬

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ২

আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, সারদা দেবীর মৃত্যু হয় ২৭ ফাল্গুন ১২৮১ বুধবার 10 Mar 1875 তারিখের শেষ রাত্রে। তাঁর মৃত্যুর কারণটি সম্পর্কে নানা ধরনের বিবরণ পাওয়া যায়। পুত্রবধূ প্রফুল্লময়ী দেবী লিখেছেন: ‘হাতের উপর একবার একটি লোহার সিন্দুকের ডালা পড়িয়া যাওয়াতে সেই অবধি হাতের ব্যথাতে প্রায়ই কষ্ট পাইতে থাকেন। পাঁচ ছয়জন বড় বড় ডাক্তার দেখানোর পর ভাল না হওয়াতে পুনরায় অস্ত্রোপচার করিতে হইয়াছিল। ক্ষতটি যখন শুকাইতেছিল সেই সময় একজন আচার্যিনীর পরামর্শে তেঁতুলপোড়া বাটিয়া ক্ষতের চারিদিকে লাগাইবার পর বিষাক্ত হইয়া আবার পাকিয়া উঠে। সেইটাই ক্রমশঃ ভিতরে দৃষিত হইয়া তাঁহার মৃত্যু ঘটে।’২৭ দেবেন্দ্রনাথের জীবনীকার অজিতকুমার চক্রবর্তী লিখেছেন: ‘হাতে ক্যানসার হওয়াতে তিনি দীর্ঘকাল ধরিয়া ভুগিতেছিলেন, মৃত্যুর পূর্বে ক্ষণে ক্ষণে চেতনা হারাইতেছিলেন। যে ব্রাহ্মমুহূর্তে তাঁহার মৃত্যু হয়, তাহার পূর্বদিন সন্ধ্যার সময় দেবেন্দ্রনাথ হিমালয় হইতে বাড়ি ফিরিয়া আসিয়াছিলেন।’২৮ অবনীন্দ্রনাথের বর্ণনাটি একটু ভিন্ন: ‘কর্তাদিদিমা আঙুল মটকে মারা যান। বড়পিসিমার ছোটো মেয়ে [ইন্দুমতী], সে তখন বাচ্ছ, কর্তাদিদিমার আঙুল টিপে দিতে দিতে কেমন করে মটকে যায়। সে আর সারে না, আঙুলে আঙুলহাড়া হয়ে পেকে ফুলে উঠল। জ্বর হতে লাগল কর্তাদিদিমা যান-যান অবস্থা। কর্তাদাদামশায় ছিলেন বাইরে—কর্তাদিদিমা বলতেন, তোরা ভাবিস নে, আমি কর্তার পায়ের ধুলো মাথায় না নিয়ে মরব না।… একদিন তো কর্তাদিদিমার অবস্থা খুবই খারাপ, বাড়ির সবাই ভাবলে আর বুঝি দেখা হল না কর্তাদাদামশায়ের সঙ্গে। অবস্থা ক্রমশই খারাপের দিকে যাচ্ছে, এমন সময়ে কর্তাদাদামশায় এসে উপস্থিত। খবর শুনে সোজা কর্তাদিদিমার ঘরে গিয়ে পাশে দাঁড়ালেন, কর্তাদিদিমা হাত বাড়িয়ে তাঁর পায়ের ধুলো মাথায় নিলেন। ব্যস, আস্তে আস্তে সব শেষ।’২৯ সৌদামিনী দেবীও প্রায় একই কথা লিখেছেন: “যে ব্রাহ্মমুহূর্তে মাতার মৃত্যু হইয়াছিল পিতা তাহার পূর্বদিন সন্ধ্যার সময় হিমালয় হইতে বাড়ি ফিরিয়া আসিয়াছিলেন। তাহার পূর্বে মা ক্ষণে ক্ষণে চেতনা হারাইতেছিলেন। পিতা আসিয়াছেন শুনিয়া বলিলেন, ‘বসতে চৌকি দাও।’ পিতা সম্মুখে আসিয়া বসিলেন। মা বলিলেন, ‘আমি তবে চললাম।’ আর কিছু বলিতে পারিলেন না। আমাদের মনে হইল, স্বামীর নিকট হইতে বিদায় লইবার জন্য এ পর্যন্ত তিনি আপনাকে বাঁচাইয়া রাখিয়াছিলেন। মার মৃত্যুর পরে মৃতদেহ শ্মশানে লইয়া যাইবার সময় পিতা দাঁড়াইয়া থাকিয়া ফুল চন্দন অভ্র দিয়া শয্যা সাজাইয়া দিয়া বলিলেন ‘ছয় বৎসরের সময় এনেছিলেম, আজ বিদায় দিলেম’।”৩০ অজিতকুমার চক্রবর্তী প্রধানত সৌদামিনী দেবীর এই রচনা অবলম্বন করে সারদা দেবীর মৃত্যুর বর্ণনাটি লিখেছিলেন। এই সব বর্ণনায় কয়েকটি অসংগতি পাঠকদের নিশ্চয়ই চোখে পড়েছে। আমরা ক্যাশবহি অবলম্বনে যে তথ্য পরিবেশন করব, তাতে আরও কতকগুলি ভ্রান্তির নিরসন হবে।

সারদাদেবীর অসুস্থতার বিষয়ে উল্লেখ ক্যাশবহি-তে প্রথম দেখা যায় ২০ জ্যৈষ্ঠ ১২৮১ [মঙ্গল 2 Jun 1874] তারিখে: ‘কত্রিমাতাঠাকুরাণীর হাতে বেদনা হওয়ায় পাণিহাটীর বাগান হইতে আসিবার ব্যয়… ৩৴৬’ এবং ‘উহার হাতের পীড়ার জন্য আরনিকা ঔষধ ও অইল ক্লথ ইত্যাদি…৩৸৩ অথাৎ হাতের উপর লোহার সিন্দুকের ডালা পড়ে যাওয়া বা আঙুল মটকে যাওয়া যে-কারণটিই হোক তার সূচনা পানিহাটির বাগানে থাকার সময় এবং প্রথম দিকে আর্নিকা ইত্যাদি হোমিওপ্যাথিক ঔষধের মাধ্যমেই হাতের বেদনা উপশম করানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তাতে কোনো উপকার না হওয়াতে গৃহচিকিৎসক ডাঃ নীলমাধব হালদার ও মেডিকেল কলেজের সার্জারির অধ্যাপক Dr. S.B. Partridge, M.D., F.R.C.S. ৪ আষাঢ় [বুধ 17 Jun] তাঁকে পরীক্ষা করেন। কিন্তু তাঁর স্বাস্থ্যের ক্রমশই অবনতি হওয়ায় ২৭ শ্রাবণ [মঙ্গুল 11 Aug] ড্যালহৌসিতে দেবেন্দ্রনাথের কাছে টেলিগ্রাম করা হয়। দেবেন্দ্রনাথ কী উত্তর দিয়েছিলেন আমাদের জানা নেই, কিন্তু তাঁকে ফিরে আসতেও দেখা যায় না। কয়েকদিনের মধ্যেই মেডিকেল কলেজের পাঁচজন বিখ্যাত য়ুরোপীয় ডাক্তার [প্রত্যেকের ফী ৩২ টাকা করে] একত্রে চিকিৎসা-বিষয়ে পরামর্শ করেন। তাঁরা হচ্ছেন মেডিকেল কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ও মেডিসিনের অধ্যাপক Dr. N. Chevers, M.D., জেনারেল অ্যানাটমি ও ফিজিওলজির অধ্যাপক Dr. J. Ewart, M.D., রসায়নের অধ্যাপক Dr. W.J. Palmer, M.D., F.R.C.S.E., সার্জারির অধ্যাপক Dr. S.B. Partridge, M.D., F.R.C.S. এবং ধাত্রীবিদ্যার অধ্যাপক Dr. T.E. Charles, M.D.—এঁদের ফী শোধ করার তারিখ ৩০ শ্রাবণ [শুক্র 14 Aug]। চিকিৎসায় যাতে কোনো ত্রুটি না থাকে তার জন্যে হোমিওপ্যাথির বিখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ বিহারীলাল ভাদুড়ি ও ডাঃ সালাজারও সারদা দেবীকে পরীক্ষা করেন। ক্যাশবহি অবশ্য কেবল এই ধরনের সংবাদই আমাদের সরবরাহ করতে পারে, কিন্তু ঠিক কী রীতিতে চিকিৎসা করা হয়েছিল, অপারেশন করা হয়েছিল কিনা এসব প্রশ্নের উত্তর তার কাছ থেকে পাওয়া যায় না। প্রফুল্লময়ী দেবীর বর্ণনা থেকে মনে হয়, তাঁর হাতে অন্তত দুবার অপারেশন করা হয়। এই অপারেশন প্রসঙ্গে আমরা একটি অসাধারণ ঘটনার উল্লেখ পাই ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর-সম্পাদিত হেমেন্দ্রনাথের রচনাবলী ‘হেমজ্যোতি’-র [১৩১১] ভূমিকায়: ‘আপনার প্রাণকে তুচ্ছ করিয়া তাঁহার মাতার জন্য যে তিনি নিজ বাহুমূল হইতে এক বৃহৎ মাংসখণ্ড কাটিয়া দিয়াছিলেন, তাহা তাঁহার জীবনে এক মহা হেমকীর্ত্তিরূপে (Golden deed) পরিগণিত হইবে।’ হেমেন্দ্রনাথের অপর পুত্র ক্ষিতীন্দ্রনাথও দ্বারকানাথ-প্রসঙ্গে অনুরূপ বর্ণনা দিয়েছেন: ‘এই দ্বারকানাথেরই পৌত্র হেমেন্দ্রনাথ, যিনি স্বীয় মাতার জীবনরক্ষার্থে নিজের বাহু হইতে মাংস খণ্ড কাটিয়া দিতেও দ্বিধা করেন নাই।’৩১

এরপর চিকিৎসকদের পরামর্শে গঙ্গার বায়ু সেবনের জন্য সম্ভবত ১০ কার্তিক [সোম 26 Oct] ‘কোম্পানির বাগানের নিচে’ [বিডন স্কোয়ার বা রবীন্দ্রকাননের নিকটবর্তী গঙ্গায়?] একখানি বোটে তিনি কিছুদিন বাস করেন। ১৬ অগ্রহায়ণ ঠাকুরবাড়ির ভূতপূর্ব গৃহচিকিৎসক ডাঃ দ্বারিকানাথ গুপ্ত বোটে গিয়েই তাঁকে পরীক্ষা করেন। তিনি নিশ্চয়ই কোনো আশা দিতে পারেননি, তাই ১৮ অগ্রহায়ণ [বৃহ 3 Dec] ‘শ্রীযুক্তা কত্রীমাতাঠাকুরাণীর পীড়ার জন্য কর্ত্তাবাবু মহাশয়কে বাটী আগমনের জন্য বড়বাবু মহাশয় অমৃতসরে টেলিগ্রাফ করেন।’ এই টেলিগ্রাম পেয়ে দেবেন্দ্রনাথ সেখান থেকে রওনা হয়ে পথিমধ্যে শান্তিনিকেতনে কয়েকদিন অবস্থান করে জোড়াসাঁকো এসে পৌঁছন পৌষ মাসের প্রথম সপ্তাহে। ধর্ম্মতত্ত্ব পত্রিকায় ১৬ পৌষ সংখ্যায় [৭। ২৪, পৃ ২৮৬] ‘সংবাদ’ স্তম্ভে লেখা হয়: ‘… বহু দিনান্তে আমাদের ভক্তিভাজন প্রাচীন আচার্য্য শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় পুনরায় গৃহে প্রত্যাগমন করিয়াছেন। আশা করি আগামী ব্ৰহ্মাৎসব পৰ্য্যন্ত তিনি এখানে থাকিয়া ব্রাহ্মদিগকে উৎসাহিত করিবেন। … গত বুধবারে [৯ পৌষ 23 Dec] তিনি এবং তাঁহার প্রথম ও পঞ্চম পুত্র, রাজনারায়ণ বাবু এবং জামাতা ‘কুটুম্বগণ অনেকে সমাজে আসিয়াছিলেন।’ সুতরাং তিনি সারদা দেবীর মৃত্যুর পূর্ব দিন হিমালয় থেকে প্রত্যাগমন করেন, এই তথ্য যে সঠিক নয় তা আমরা স্পষ্টই বুঝতে পারছি। স্বামী-সন্দর্শনের জন্য সারদা দেবী বোট থেকে চলে আসেন এবং ১০ পৌষ থেকে ১৬ পৌষ গৃহে অবস্থান করেন, আমরা ক্যাশবহি-র হিসাবে তার উল্লেখ দেখতে পাই। এর পরে তিনি আবার বোটে ফিরে যান। এদিকে দেবেন্দ্রনাথ ৯ মাঘ ব্রাহ্মসম্মিলন ও ১১ মাঘের উৎসবে যোগদানের পর মাঘ মাসের শেষ সপ্তাহে শিলাইদহ অঞ্চলে জমিদারি পরিদর্শনার্থে গমন করেন। ধর্ম্মতত্ত্ব পত্রিকা ১ ফাল্গুন সংখ্যায় এই সংবাদুটিও পরিবেশন করে: ‘শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া মফস্বল জমিদারী পরিদর্শনার্থে বহির্গত হইয়াছেন।’ এখান থেকেই হয়তো তিনি সারদা দেবীর মৃত্যুর পূর্ব দিন তাঁর শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত হয়েছিলেন, যেটিকে সৌদামিনী দেবী বিস্মৃতিবশত হিমালয় থেকে বাড়ি ফিরে আসা বলে অভিহিত করেছেন। দ্বিতীয়বার বোটে অবস্থানের পর সারদা দেবীকে কবে বাড়ি ফিরিয়ে আনা হয়, তা জানা যায়নি। কিন্তু ৭ ফাল্গুন [বৃহ 18 Feb 1875] তারিখের হিসাবে দেখা যায়: ‘কর্ত্রীমাতাঠাকুরাণীর/বাতাষের বিছানা দুরস্ত করিয়া/আনিতে উইলসন হোটেলে গত রোজ/শ্যামবাবুর জাতাতের গাড়ি ভাড়া [আধুনিক কালের পাঠকদের অবগতির জন্য জানাই, বর্তমান গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলকেই তখনকার দিনে উইলসনের হোটেল বলা হত এবং তখন সেখানে হোটেল ব্যবসায়ের সঙ্গে বড়ো আকারে বিদেশী স্টেশনারি জিনিসের ব্যবসায়ও চালানো হত]—এর থেকে বোঝা যায়, সারদা দেবী তার আগেই জোড়াসাঁকোয় ফিরে রবীন্দ্রনাথের বর্ণানুযায়ী অন্দর মহলে তিনতলার একটি ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং সম্ভবত তখন তাঁর শরীরে যন্ত্রণাদায়ক শয্যা ক্ষত [bedsore] দেখা দেওয়ার জন্যই এই ‘বাতাষের বিছানা’-র [air-cushion] ব্যবস্থা।

৭ ফাল্গুনের পর ক্যাশবহি-র পাতাগুলি না পাওয়ায় আর বেশি-কিছু তথ্য দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ৩০ ফাল্গুন [শনি 13 Mar] কন্যারা তাঁর যে চতুর্থী শ্রাদ্ধ করেন, সৌদামিনী দেবী সেই উপলক্ষে উপাসনা করতে গিয়ে বলেন: ‘… আমি মাতৃহীনা হইয়া সংসারের অনেক সুখে বঞ্চিত হইলাম। তাঁহ্বার সেই কোমল শান্ত মূৰ্ত্তি আর এ পৃথিবীতে দেখিতে পাইব না এবং তাঁহার সেই স্নেহময় বাক্য আর শুনিতে পাইব না। তাঁহাকে যেমন সংসারের সকল সুখে সুখী করিয়াছিলে, এখন তাঁহার আত্মাকে তোমার অমৃত ক্রোড়ে রাখিয়া আরও সুখী কর।’৩২

৭ চৈত্র [শনি 20 Mar] মহাসমারোহে সারদা দেবীর আদ্যশ্রাদ্ধ নিষ্পন্ন হয়। এই উপলক্ষে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের বিদায় দেওয়া হয়, তা আমরা ধর্ম্মতত্ত্ব-প্রদত্ত বিবরণ থেকে জানতে পেরেছি। বলা বাহুল্য, শ্রাদ্ধক্রিয়া দেবেন্দ্রনাথ-প্রবর্তিত অপৌত্তলিক অনুষ্ঠান-পদ্ধতিকে অনুসরণ করে। জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ এই উপলক্ষে প্রার্থনা করেন: ‘… এখানে আর আমরা তাঁহাকে দেখিতে পাইব না, তাঁহার আহ্বান আর শুনিতে পাইব না। আমাদের স্নান ভোজনের একটুকু বিলম্ব হইলে তাহার প্রতিবিধানের জন্য তেমন আগ্রহ আর দেখিতে পাইব না। কোন বিষয়ে অনিয়ম করিলে তেমন মিষ্ট র্ভৎসনা আর আমরা শুনিতে পাইব না। কোন প্রতিষ্ঠার কাৰ্য্য করিলে তেমন উজ্জ্বল হাস্যমুখ আর দেখিতে পাইব না। পীড়ার সময় তেমন হস্তের স্পর্শ আর আমাদিগকে আরোগ্য প্রদান করিবে না।… এখানে যেমন তাঁহার দয়া, হিতৈষণা ও ধৰ্ম্মনিষ্ঠা সকলের মন আকর্ষণ করিত, সেখানে তোমার প্রসাদে সে সকল হইতে যেন মধুময় ফল প্রসূত হইতে থাকে।…’৩৩

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৩

দ্বিজেন্দ্রনাথ ও সত্যেন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে ৬ বৈশাখ [শনি 18 Apr] তারিখে বিদ্বজ্জন সমাগম-এর প্রথম অধিবেশন হয় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথই এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন।৩৪ জন বীম্‌স 1872-তে যে ধরনের অ্যাকাডেমি স্থাপনের প্রস্তাব করেছিলেন, সে ধরনের না হলেও, ‘সাহিত্যসেবীদের মধ্যে যাহাতে পরস্পর আলাপ-পরিচয় ও তাঁহাদের মধ্যে সদ্ভাব বর্ধিত হয় এই উদ্দেশ্যে ‘বিদ্বজ্জনসমাগম’ সভা স্থাপিত হয়। আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ এই সভার নামকরণ করেন। ‘এই উপলক্ষ্যে অনেক রচনা ও কবিতাদিও পঠিত হইত, গীতবাদ্যের আয়োজন থাকিত, নাট্যাভিনয় প্রদর্শিত হইত এবং সর্বশেষে সকলের একত্র প্রীতিভোজনে এই সাহিত্য-মহোৎসবের পরিসমাপ্তি হইত।’৩৫

এই বৎসরে অনুষ্ঠিত প্রথম অধিবেশনের একটি বিবরণ প্রকাশিত হয় ভারত-সংস্কারক সাপ্তাহিকের ১২ বৈশাখ [শুক্র 24 Apr] সংখ্যায় [২। ২, পৃ ১৪-১৫]: ‘… বাবু দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সিবিলিয়ান বাবু সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আহ্বানে বাঙ্গলা গ্রন্থকার ও সংবাদপত্রের সম্পাদকদিগের অনেকে তাঁহাদিগের জোড়াসাঁকোর ভবনে সমবেত হন। অন্যান্য প্রসিদ্ধ ব্যক্তির মধ্যে আমরা এই কয় ব্যক্তিকে দর্শন করিলাম—রেবরন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যো, বাবু রাজেন্দ্রলাল মিত্র, বাবু রাজনারায়ণ বসু, বাবু প্যারীচরণ সরকার, বাবু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যো। সৰ্বশুদ্ধ ন্যূনাধিক ১০০ ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন।’ একজন যুবক প্রথমে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কয়েকটি উদ্দীপনাময় কবিতা আবৃত্তি করেন। পর প্যারীমোহন কবিরত্ন স্বর্গত বিচারপতি দ্বারকানাথ মিত্রের স্তুতিমূলক একটি সংগীত করেন এবং বিলাতী দ্রব্যের সঙ্গে এদেশীয় দ্রব্যের বিনিময়ে ভারতবর্ষের সর্বনাশ হল বলে ইংলণ্ডেশ্বরীর কাছে ক্রন্দন এই বিষয়ে স্বরচিত একটি গান করেন। ‘অতঃপর ঠাকুর পরিবারের ছোট ছোট কয়েকটি বালক-বালিকা চৌতাল প্রভৃতি তালে তানলয় বিশুদ্ধ সঙ্গীত করিয়া সভাস্থবর্গকে চমৎকৃত করিল। … পরে জ্যোতিরিন্দ্রবাবু এক অঙ্ক নাটক পাঠ করিলেন, তাহাতে পুরুরাজা যখন শত্রু নিপাত করিবার জন্য সৈন্যদলকে উত্তেজিত করিতেছেন এবং সৈন্যদল তাঁহার বাক্যের প্রতিধ্বনি করিয়া বীরমদে মাতিতেছে। [দ্র পুরুবিক্রম নাটক, ৩য় অঙ্ক, ১ম গর্ভাঙ্ক] তদনন্তন দ্বিজেন্দ্র বাবু স্বরচিত স্বপ্ন বিষয়ক একটি সুন্দর কবিতা [স্বপ্নপ্রয়াণ] পাঠ করিলে শিশুরা সঙ্গীত করিতে লাগিল এবং পান, গোলাপের তোড়া, পুষ্পমালা প্রভৃতি দ্বারা নিমন্ত্রিতগণের প্রতি সমাদর প্রদর্শন পূর্ব্বক সভাকার্য্য শেষ হইল।’

এই বিবরণের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ অনুষ্ঠানটিতে কোনো স্বতন্ত্র ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন কিনা তার উল্লেখ নেই। বালকবালিকা যাঁরা সংগীতে অংশ গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের অন্তর্ভুক্তি স্বাভাবিক, অবশ্য নিশ্চিত করে বলার মতো তথ্যপ্রমাণ নেই। কিন্তু অনুষ্ঠানে এই বালক-কবি উপস্থিত ছিলেন ঠিকই এবং যাঁদের রচনার সঙ্গে ছাপার অক্ষরের মাধ্যমে পরিচিত ছিলেন, তাঁদের চাক্ষুষ-দর্শন তাঁকে পুলকিত করেছিল এ-বিষয়ে সন্দেহ থাকতে পারে না। ভবিষ্যতে এই ‘বিদ্বজ্জন সমাগম’-এর বার্ষিক অধিবেশনে তিনি আরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করবেন, এমনকি তিনিই অনুষ্ঠানের কেন্দ্রীয় পুরুষ হয়ে দাঁড়াবেন, এই প্রসঙ্গে আমরা সে-কথা স্মরণ করতে পারি।

প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৪

১১ মাঘ [শনি 23 Jan 1875] তারিখে আদি ব্রাহ্মসমাজের পঞ্চচত্বারিংশ সাংবৎসরিক উৎসব পালিত হয়। প্রাতে সমাজমন্দিরে আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ বক্তৃতা করেন এবং সন্ধ্যায় দেবেন্দ্র-ভবনের বহির্বাটার প্রাঙ্গণে ভৈরবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বেচারাম চট্টোপাধ্যায় ও রাজনারায়ণ বসু বক্তৃতা করেন। উভয় অনুষ্ঠান মিলিয়ে নিম্নলিখিত মোট দশটি ব্রহ্মসংগীত গীত হয়:

পঞ্চম বাহার—ধামাল। প্রথম সমাজে আজু মহোৎসব;

ভৈরব—সুরফাঁকতাল। সব দুঃখ দূর হইল তোমারে দেখি [দ্বিজেন্দ্রনাথ]

ভৈরবী—কাওয়ালি। অকূল ভব সাগরে তারহে তারহে [ঐ]

জয়জয়ন্তী—ঝাঁপতাল। গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে [রবীন্দ্রনাথ]

গারা—কাওয়ালি। কি মধুর তব করুণা প্রভো [জ্যোতিরিন্দ্রনাথ]

দেশ—”। পরমেশ্বর একতুহি ভজরে প্রাণ

নারায়ণী—জৎ। ভজোরে ভজরে ভব-খণ্ডনে [দ্বিজেন্দ্রনাথ]

রাজবিজয়ী—সুরফাঁকতাল। নিখিল-ভুবন-পতি, পরম-গতি ব্রহ্ম

কেদারা—চৌতাল। এক প্রথম জ্যোতি, অতি শুভ্র, পরম, [দ্বিজেন্দ্রনাথ]

বেহাগ—”। ওহে দীনবন্ধু, প্রেমসিন্ধু, তুমি প্রাণেশ্বর, [জ্যোতিরিন্দ্রনাথ]

—তত্ত্ববোধিনী, ফাল্গুন ১৭৯৬ শক। ২০৮-১০

—এর মধ্যে প্রথম তিনটি গান প্রাতঃকালীন অধিবেশনে গীত হয়। ‘গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে গানটি সম্পর্কে আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ-রচিত ‘কি মধুর তব করুণা প্রভো গানটির সঙ্গে শ্রীকণ্ঠ সিংহের স্মৃতি জড়িত রয়েছে; রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘তাঁহার কন্যার কাছে শুনিতে পাই, আসন্ন মৃত্যুর সময়েও ‘কী মধুর তব করুণা প্রভো’ গানটি গাহিয়া চির-নীরবতা লাভ করেন।’৩৬

তত্ত্ববোধিনী-তে প্রকাশিত বিবরণে বালক-বালিকাদের সংগীত-অনুষ্ঠানে যোগ দেবার কথা উল্লিখিত হয়নি, সুতরাং নিশ্চিত করে বলা যাবে না রবীন্দ্রনাথ গানের দলে ছিলেন কিনা।

এই বৎসরের মাঘোৎসবের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। ধর্ম্মতত্ত্ব পত্রিকায় লিখিত হয়: ‘কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজের তৃতীয়তল গৃহের পূর্ব্ব দিকে স্ত্রীলোক উপাসকদিগের জন্য স্বতন্ত্র স্থান করা হইয়াছে। এজন্য নূতন একটি দীর্ঘ সোপান প্রস্তুত করা হইয়াছে। গত উৎসবে তথায় কোন কোন ভদ্রমহিলা উপস্থিত ছিলেন। [৮। ২-৩, ১৬ মাঘ ও ১ ফাল্গুন, পৃ ৩২] বোঝা যায়, ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে তাল রাখার প্রয়োজনীয়তা আদিসমাজও উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। আর এই ঘটনা ঘটেছে যখন ‘কিঞ্চিৎ জলযোগ’-প্রণেতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক, যাঁর স্ত্রী-স্বাধীনতা বিষয়ে মনোনাভাবের ক্রমবিবর্তন পরবর্তীকালের লিখিত একটি পত্রে প্রকাশ পেয়েছে : ‘আমার মনে পড়ে, প্রথমে যখন মেয়েরা গাড়ি করে বেড়াতে আরম্ভ করেন—গাড়ির দরজা খুলতে আমি কিছুতেই দিতেম না—ক্রমশঃ একটু একটু খুলে দিতে আরম্ভ করলেম—সিকিখানা—আধখানা—ক্রমে ষোল আনা। তখন বাহিরের কোন পুরুষ আমাদের মেয়েদের মুখ দেখলে আমার যেন মাথা কাটা যেত; প্রথমে দরজা বন্ধ ঢাকা গাড়ি, পরে দরজা-খোলা ঢাকা গাড়ি, পরে টপ-ফেলা ফিটেন গাড়ি—ক্রমে একেবারে খোলা ফিটেন গাড়ি ধরা গেল—গুটিপোকা ক্রমে প্রজাপতিতে পরিণত হ’ল।’৩৭

মাঘোৎসবের দু-দিন পূর্বে ৯ মাঘ [বৃহ 21 Jan] অপরাহ্নে আদি ব্রাহ্মসমাজ ও ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের সদস্যেরা দেবেন্দ্র-ভবনে একটি সভায় সম্মিলিত হন। ধর্ম্মতত্ত্ব পত্রিকার উপরোক্ত সংখ্যায় এ-সম্বন্ধে লেখা হয়: ‘উভয় ব্রাহ্মদলের মধ্যে সদ্ভাব বিস্তারের জন্য অদ্য অপরাহ্ন চারি ঘটিকার সময় শ্রীযুক্ত বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের ভবনে এক সভা হয় অহাতে নগরবাসী, প্রবাসী এবং বিদেশস্থ ব্রাহ্মগণ অধিকাংশই উপস্থিত ছিলেন। ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মমন্দিরের উপাসক সভার বিগত মাসিক অধিবেশনে সাধারণের সম্মতিতে আমাদের প্রিয় বন্ধু শ্ৰীযুক্ত বাবু আনন্দ মোহন বসুর প্রতি ভার দেওয়া হইয়াছিল যে তিনি দেবেন্দ্র বাবুর নিকট পুনঃসম্মিলনের বিষয় প্রস্তাব করেন এবং তাঁহার দ্বারা এক সাধারণ সভা আহ্বান করিয়া সকলকে একত্রিত করেন। প্রথমবারের উদ্যোগ নিষ্ফল হইয়া যায়, শেষ আনন্দ বাবুর দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় এই সভাটী আহূত হইয়াছিল। অনুমান চারিশত লোক তৎকালে উপস্থিত ছিলেন। এই সভায় সদ্ভাব-স্থাপনের জন্য কোনো বিশেষ উপায় নির্ধারিত করা সম্ভব হয়নি, কিন্তু উক্ত পত্রিকা আশা করে : ‘মধ্যে মধ্যে এরূপ সভা করিয়া তদনুসারে কিছু কাৰ্য্য করিলে, অন্ততঃ বিদ্বেষ হিংসা প্রভৃতি নীচ ভাব সকল হ্রাস হইতে পারে।’

দুই সমাজের মধ্যে সম্ভাব-স্থাপনের চেষ্টা চললেও কেশবচন্দ্রের ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ তখন অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত। ২৩ মাঘ ১২৭৮ [5 Feb 1872] কেশবচন্দ্র বেলঘরিয়ার বাগানে ‘ভারত-আশ্রম’ স্থাপন করেন। দুবার স্থান পরিবর্তন করে এই আশ্রম মির্জাপুর স্ট্রীটের একটি বাড়িতে উঠে আসে। প্রথমাবধিই আশ্রমটি বিরেধী সমালোচনার লক্ষ্যস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছিল, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘কিঞ্চিৎ জলযোগ’ প্রহসন একেই ব্যঙ্গ করে লেখা। কিন্তু ভারত-আশ্রমের আভ্যন্তরীণ পরিবেশও খুব সুশৃঙ্খল ছিল না। অবস্থা চরমে উঠল যখন জনৈক আশ্রমবাসী হরনাথ বসু সপরিবারে আশ্রম ত্যাগ করে সংবাদপত্রে একটি চিঠি প্রকাশ করলেন [আষাঢ় ১২৮১]। সাপ্তাহিক সমাচার নামক একটি পত্রিকায় এই বিষয়ে একটি পত্র প্রকাশিত হলে কেশবচন্দ্র এই পত্রিকার বিরুদ্ধে আদালতে মানহানির মোকদ্দমা রুজু করেন; শেষ পর্যন্ত অবশ্য মামলাটির আপসে নিষ্পত্তি হয়। কিন্তু স্ত্রী-স্বাধীনতা, স্ত্রীশিক্ষা, কেশবচন্দ্রের প্রত্যাদেশ-বিষয়ক মতবাদ ও সমাজ-পরিচালনায় সাধারণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে নানা ধরনের মতবিরোধ ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের ভিত্তি দুর্বল করে তুলছিল। শিবনাথ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় অগ্রহায়ণ ১২৮১ থেকে ‘সমদর্শী OR LIBERAL’ নামে দ্বিভাষিক একটি মাসিকপত্রে প্রকাশিত হয়। ক্ষণজীবী এই পত্রিকাটি মতবিরোধে যথেষ্ট পরিমাণে ইন্ধন সরবরাহ করেছিল।

প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৫

আমরা বর্তমান বৎসরের আলোচনায় বার-বার ‘মালতীপুঁথি’ নামক রবীন্দ্র-পাণ্ডুলিপির উল্লেখ করেছি। রবীন্দ্র-জীবন ও রচনার আলোচনায় এই পাণ্ডুলিপিটি একটি অমূল্য উপাদান রূপে গণ্য হবার যোগ্য। আমরা জানি, সেরেস্তার কোনো কর্মচারীর কৃপায় সংগৃহীত একটি নীল ফুল্‌স্‌-ক্যাপ খাতা রবীন্দ্ররচনার প্রথম পাণ্ডুলিপি। হিমালয় যাত্রার সময়ে একটি বাঁধানো লেট্‌স্ ডায়ারি হয়েছিল তাঁর দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপি, যাতে তিনি বোলপুরে থাকার সময়ে ‘পৃথ্বীরাজের পরাজয়’ নামক বীররসাত্মক কাব্যটি রচনা করেছিলেন। হিমালয় থেকে ফিরে এসে বিভিন্ন কবিতাও হয়তো এই বিলুপ্ত পাণ্ডুলিপিতেই লেখা হয়েছিল। এরই পরবর্তীকালের তৃতীয় পাণ্ডুলিপি হচ্ছে এই ‘মালতীপুঁথি’, মহাকালের ভ্রূকুটি এড়িয়ে আমাদের হাতে এসে পৌঁছননা প্রাচীনতম রবীন্দ্র-পাণ্ডুলিপি। 1943-এর প্রথম দিকে দিল্লির লেডি আরউইন স্কুলের অধ্যাপিকা মালতী সেন বিশ্বভারতীর প্রাক্তন অধ্যক্ষ ধীরেন্দ্রমোহন সেনের হাত দিয়ে পাণ্ডুলিপিটি রবীন্দ্রভবনকে উপহার দেন। তাঁরই নামানুসারে এটিকে ‘মালতীপুঁথি’ নামে অভিহিত করা হয়। শ্রীমতী সেনের ভ্রাতা সুধীন্দ্রকুমার সেন [মৃত্যু 1919] ছিলেন একজন রবীন্দ্র-অনুরাগী এবং তাঁকে কেন্দ্র করে তাঁদের তৎকালীন বাসস্থান লাহোরে একটি সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। তাঁর মৃত্যুর দীর্ঘকাল পরে কোনো এক সময়ে তাঁর পুস্তকসংগ্রহের মধ্যে পুঁথিটি আবিষ্কৃত হয়। এটি কিভাবে সুধীন্দ্রকুমারের হাতে গেল, সে-সম্পর্কে রবীন্দ্রজীবনী-কার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় অনুমান করেছেন, রবীন্দ্রনাথের কৈশোরের সাহিত্য-সহায় অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর স্ত্রী লাহোর-নিবাসিনী শরৎকুমারী চৌধুরানীকে রবীন্দ্রনাথের হয়তো কোনো সময়ে এই পাণ্ডুলিপিটি উপহার দেন এবং তাঁর কাছ থেকেই এটি সুধীন্দ্রকুমারের হস্তগত হয়।৩৮

পাণ্ডুলিপিটি রবীন্দ্রভবনে আসার অল্পকাল পরে অধ্যাপক প্রবোধচন্দ্র সেন “রবীন্দ্রনাথের বাল্যরচনা” প্রবন্ধে এর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে লেখেন, ‘পাণ্ডুলিপিখানি স্পষ্টতঃই একখানি বৃহৎ বাঁধানো খাতা ছিল। কিন্তু এখন সেটির সেলাই খুলে গিয়েছে এবং খোলা পাতাগুলিও অত্যন্ত জীর্ণদশা প্রাপ্ত হয়েছে। এক দিকের শক্ত রঙিন মলাটও পাওয়া গিয়েছে। অন্য দিকের মলাট ও কতকগুলি পাতা পাওয়া যায় নি।৩৯ বর্তমানে রবীন্দ্রভবন-অভিলেখাগারে প্রতিটি পাতা অভঙ্গুর স্বচ্ছ পত্রাবরণে আচ্ছাদিত (laminated) করে নূতন মলাট দিয়ে বাঁধানো এই পাণ্ডুলিপিটির অভিজ্ঞান-সংখ্যা ২৩১। নূতন করে বাঁধানো অবস্থায় এর মলাটের মাপ image ইঞ্চি এবং পাতাগুলির মাপ image ইঞ্চি। প্রথম থেকে যথেষ্ট সতর্কতার অভাবে পাতাগুলির পৌর্বাপর্য ঠিকমতো রক্ষিত হয়নি। কতকগুলি পাতা হারিয়ে গেছে, অনেকগুলি পাতার প্রান্তদেশ কিছু কিছু ভেঙে যাওয়ায় স্থানে স্থানে লিখিত অংশের পার্শ্ববর্তী অংশ লুপ্ত হয়ে গেছে, কালের প্রভাবে লেখাগুলিও অনেক জায়গায় অস্পষ্ট। এটি একটি খসড়া খাতা বলে প্রচুর কাটাকুটি আছে, সংশোধিত পাঠগুলিও ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে লেখা। বর্তমানে সমগ্র পুঁথিটি মাইক্রোফিল্ম করে রাখা হয়েছে। কিন্তু পুঁথিটির ক্ষেত্রে যেটি সর্বাধিক প্রয়োজন—ফোটোকপি নয়— Zerox পদ্ধতিতে এর প্রতিলিপি প্রস্তুত করে ও মুদ্রিত করে রবীন্দ্ৰজিজ্ঞাসু পাঠকদের হাতে তুলে দেওয়া এবং পাতাগুলির পৌবাপর্য সঠিকভাবে নির্ধারণ করা। শেষোক্ত কাজটি অত্যন্ত কঠিন; কারণ সন্দেহ হয় যে, পরবর্তীকালের মতো এই সময়েও একটানা লিখে যাওয়া রবীন্দ্রনাথের স্বভাব-বিরোধী ছিল। পুঁথিটি যে-অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল তাতে তার মোট পত্রসংখ্যা ৩৮ ও পৃষ্ঠাসংখ্যা ৭৬। প্রথমে প্রতিটি পৃষ্ঠায় পেনসিল দিয়ে ইংরেজিতে পত্রাঙ্ক বসানো হয়, কিন্তু তাতে যথেষ্ট ভুল থেকে যায়। বর্তমানে প্রতিটি পাতাকে বাংলা সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত করে সম্মুখের ও পিছনের পৃষ্ঠা যথাক্রমে ক ও খ বলে অভিহিত করা হয়েছে। সেইভাবে পুঁথিটি শুরু ১ক সংখ্যা দিয়ে, শেষ ৩৮খ সংখ্যায়। রচনাগুলির বেশির ভাগ কালিতে লেখা, কিছু কিছু আবার পেনসিলেও। কবিতাগুলি বেশির ভাগই দুইস্তম্ভে লিখিত, কোথাও কোথাও এক স্তম্ভও আছে। এর অনেক রচনা পরবর্তীকালে ঈষৎ বা বহুলভাবে সংশোধিত হয়ে সাময়িকপত্রে ও গ্রন্থে স্থান লাভ করেছে; অনেকগুলির আবার সে সৌভাগ্য ঘটেনি। কার্তিক ১৩৭২-এ ড বিজনবিহারী ভট্টাচার্যের দ্বারা সম্পাদিত হয়ে এই পাণ্ডুলিপিটি বিস্তৃত টীকা-সহযোগে মুদ্রিত হয়েছে রবীন্দ্র-জিজ্ঞাসা ১ম খণ্ডে। অধ্যাপক প্রবোধচন্দ্র সেনের ‘পাণ্ডুলিপি পরিচয়’ ও চিত্তরঞ্জন দেব-কৃত তথ্যপঞ্জী [যার পরিশিষ্ট অগ্রহায়ণ ১৩৭৫-এ প্রকাশিত রবীন্দ্র-জিজ্ঞাসা ২য় খণ্ডে মুদ্রিত] এই গ্রন্থটির অমূল্য সম্পদ। উপরে প্রদত্ত তথ্যের বেশির ভাগ প্রথমোক্ত প্রবন্ধ থেকে নেওয়া।

অধ্যাপক সেন তাঁর উক্ত প্রবন্ধে এই পাণ্ডুলিপিতে কাব্যরচনার ঊর্ধ্বসীমা ও নিম্নসীমা নির্ণয় প্রসঙ্গে বহু যুক্তি-তর্ক উপস্থাপিত করে সিদ্ধান্ত করেছেন: “মালতীপুঁথির রচনাকালের ঊর্ধ্বসীমা ১৮৭৪ সালের পূর্ববর্তী নয়, হয়তো অল্প কিছু পরবর্তী। আর বোধ করি বউঠাকুরানীর হাট উপন্যাসের ‘উপহার’ কবিতাটি রচনার সময়কে (১৮৮২) তার নিম্নসীমা বলে আপাততঃ গ্রহণ করা যায়।” এই সিদ্ধান্ত নির্ভুল বলেই মনে হয়। তিনি অনুমান করেছেন, এর পরেও পুঁথিটি অন্তত 1886 পর্যন্ত তাঁর অধিকারে ছিল, কারণ বালক পত্রিকার চৈত্র ১২৯২ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘অবসাদ’ কবিতাটি গৃহীত হয়েছিল এই পুঁথি থেকেই। এর পরে কবে পাণ্ডুলিপিটি তাঁর হাতছাড়া হয়, সে-সম্পর্কে অনুমান করা শক্ত।

প্রাসঙ্গিক তথ্য : ৬

আমরা আগেই জেনেছি, রবীন্দ্রনাথ মাঘ ১২৭৯ [Feb 1875]-তে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের স্কুল বিভাগে ভর্তি হন। ইংরেজ জেসুইটদের দ্বারা কলেজটি প্রথম স্থাপিত হয় 1 Jun 1835 তারিখে মুর্গিহাটায় পর্তুগীজ চার্চ স্ট্রীটে। প্রথম রেক্টর ছিলেন ফাদার চাড়উইক [Father Chadwick]। এর পর নানা স্থান ঘুরে ও বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বেলজিয়ান জেসুইটদের হাতে আসে। ঐতিহাসিক ‘সাঁ সুসি’ [‘Sans Souci’] থিয়েটার যেখানে অবস্থিত ছিল সেই ১০ নং পার্ক স্ট্রীটে মাত্র ৮৩টি ছাত্র নিয়ে কলেজের পুনরুদ্বোধন হয় 16 Jan 1860 তারিখে। ফাদার ডেপেলচিন [Depelchin] রেক্টর পদে নিয়োজিত হন। 1862-তে কলেজটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন [affiliation] লাভ করে। মনে রাখা দরকার, সেই সময়ে ও আরও অনেকদিন পর পর্যন্ত বহু স্কুল এন্ট্রান্স পরীক্ষার জন্য ছাত্র পাঠাতে পারলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুমোদন-প্রাপ্ত স্কুল-কলেজের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম। ভারতবর্ষে বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম পথিকৃত ফাদার ইউজিন লাফোঁ [Eugene Lafont, 26 Mar 1837-10 May 1908] 10 Oct 1871 তারিখ থেকে কলেজের রেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ 1875-এ যখন ভর্তি হন, বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বসু তখন এখানকার এন্ট্রান্স ক্লাসের ছাত্র। রবীন্দ্রনাথ 1932-তে দুবৎসরের জন্য বিশেষ শর্তে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক নিযুক্ত হন; কিছুদিন তিনি প্রাক্তন ছাত্রদের অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ 1893-তে এই কলেজ থেকে বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। [তথ্যগুলি John Pinto M.A. লিখিত ‘A Brief History of St. Xavier’s College 1860-1935’ প্রবন্ধ থেকে গৃহীত; দ্র Saint Xavier’s College Magazine, Jubilee Number, 1935. Vol. IV]

রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে এই স্কুলের একজন শিক্ষক ফাদার ডি পেনেরাণ্ডার সম্বন্ধে গভীর শ্রদ্ধা ব্যক্ত করেছেন। তাঁর পুরো নাম Alphonsus de Penaranda [1834-96] 1875-তে তিনি Fifth year’s class-এর অন্যতম শিক্ষক ছিলেন ও ফাদার হেনরি [Revd. J. Henry] ছিলেন স্কুলের পাঠ-পরিচালক (Prefect of Studies)। পরের বৎসর ফাদার ডি পেনেরাণ্ডার হাতে নিজের দায়িত্ব তুলে দিয়ে ফাদার হেনরি এন্ট্রান্স ক্লাসে পড়ানো শুরু করেন।৪০

রবীন্দ্রনাথ যে শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন, তাকে বলা হত ‘প্রিপারেটরি এন্ট্রান্স ক্লাস’ অর্থাৎ এন্ট্রান্স পরীক্ষার সিলেবাসই এই শ্রেণীর পাঠ্য ছিল। কৌতুহলী পাঠকের জন্য তখনকার সিলেবাস বিষয়ে কিছু আলোচনা করা হচ্ছে। তখন ইংরেজির জন্য কোনো নির্দিষ্ট পাঠ্যপুস্তক ছিল না। গ্রামার, ইডিয়ম ও কম্পোজিশন ছিল অন্যতম পরীক্ষণীয় বিষয়। ল্যাটিন, গ্রীক, সংস্কৃত, বাংলা প্রভৃতি যে-কোনো একটি ভাষা পড়তে হত। বাংলায় পাঠ্য ছিল রেভারেও কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়-কৃত Selections —এই গ্রন্থটির সঙ্গে সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ছিল, তখনকার দিনের স্ত্রীলোক ও বালকদের জন্য রচিত ‘পুস্তকের সরলতা ও পাঠযোগ্যতা সম্বন্ধে যাঁহাদের জানিবার ইচ্ছা আছে তাঁহারা রেভারেণ্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়-রচিত পূর্বর্তন এন্ট্রেন্স-পাঠ্য বাংলা গ্রন্থে দন্তস্ফুট করিবার চেষ্টা করিয়া দেখিবেন’৪১—এই মন্তব্য তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা-প্রসূত বলেই মনে হয়। অন্যান্য বিষয়গুলি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের Calendar থেকে উদ্ধৃত করে দিচ্ছি :

“II. History and Geography. The outlines of the History of England and of the History of India. The Elements of Physical Geography, as in Blandford’s Physical Geography, Chapters I, II, III, VIII, IX, and so much of General Geography as is required to elucidate the Histories. [Calendar 1877-এ ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক হিসেবে Lethbridge-এর History of England ও Easy Introduction to the History of India নির্দিষ্ট হয়েছে।]

‘III. MATHEMATICS./Arithmetic. The four Simple Rules; Vulgar and Decimal Fractions; Reduction; Practice; Proportion; Simple Interest; Extraction of Square Root.

‘Algebra. The four Simple Rules; Proportion; Simple Equations; Extraction of Square Root; Greatest Common Measure; Least Common Multiple.

‘Geometry and Mensuration. The first four books of Euclid, with easy deductions. The mensuration of plane surfaces, including the theory of surveying with chain, as in Todhunter’s Mensuration, Chapters 1 to 8 and 10 to 15 inclusive, and Chapters 44 to 47 inclusive.

বলা বাহুল্য বাংলা ছাড়া সমস্ত বিষয়ই পড়তে ও পরীক্ষা দিতে হত ইংরেজি ভাষায়।

গোপালচন্দ্র রায় 1875-এর Programme of Studies অর্থাৎ পাঠ্যপুস্তকের তালিকাটি ‘রবীন্দ্রনাথের ছাত্রজীবন’ [পৃ ৭৫]-এ উদ্ধৃত করেছেন:

Butler’s Catechism, throughout

Angus. Handbook of the English Tongue, Chap. V-VIII

Letter Writing, Paraphrases, Resumes etc.

Latin University Course, 1876

Geography: Southern Europe and Asia

History: Lethbridge’s India and Collier’s British Empire

Arithmetic: Miscellaneous Examples.

Hamblin Smith’s Algebra, Chap. XV-XVIII

Hamblin Smith’s Euclid, Book II-IV

Todhunter’s Mensuration.

উল্লেখপঞ্জি

ড বিজনবিহারী ভট্টাচার্য-সম্পাদিত রবীন্দ্র-জিজ্ঞাসা ১. [১৩৭২]। ১৩৯

জীবনস্মৃতি ১৭। ৩৩০

দ্র ঐ [১৩৬৮]। ১৭৪-৭৫

‘ভোরের পাখি’: শতবার্ষিক জয়ন্তী উৎসর্গ [১৩৬৮]

‘রবীন্দ্র প্রতিভার নেপথ্যভূমি’: রবীন্দ্রপ্রতিভা [১৩৬৮]। ২৪৯-৫০

রবীন্দ্রজীবনী ১ [১৩৯২]। ৪৪, পাদটীকা ১

রবীন্দ্র-গ্রস্থ পরিচয় [১৩৫০]। ৬৬

রবীন্দ্রজীবনী ১। ৪৫, পাদটীকা ১

‘রবীন্দ্রনাথের বাল্যরচনা: কালানুক্রমিক সুচী’: রবীন্দ্র-জিজ্ঞাসা ১। ২৩১

১০ দ্র রবীন্দ্রসাহিত্যের আদিপর্ব। ১২২-২৪

১১ দ্র ‘ভোরের পাখি’: শতবার্ষিক জয়ন্তী উৎসর্গ

১২ জীবনস্মৃতি ১৭। ৩২৮

১৩ রবীন্দ্র-গ্রন্থ পরিচয়। ৭৫

১৪ দেশ, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৩৮৩ [29 May 1976]। ৩০৯-১১

১৫ দ্র হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত গ্রন্থে উদ্ধৃত সোমপ্রকাশ-এ প্রকাশিত কাৰ্যসূচি [পৃ ৪০]।

১৬ দ্র ‘সেন্ট জেভিয়ার্সে’—সংগ্রাহক: সুবল বন্দ্যোপাধ্যায়: আনন্দবাজার পত্রিকা, রবীন্দ্র শতবার্ষিকী সংখ্যা, ২৫ বৈশাখ ১৩৬৮ [সোম 4 May 1961], পৃ ‘জ’

১৭ জীবনস্মৃতি ১৭। ৪২১-২২

১৮ ঐ ১৭। ৪২২

১৯ রবীন্দ্র-জিজ্ঞাসা ১। ৩

২০ জীবনস্মৃতি ১৭। ৩০৪

২১ দ্র গোরা ৬। ১৫০

২২ জীবনস্মৃতি ১৭। ৩০৪-০৫

২৩ ঐ ১৭। ৩০৭

২৩ক ‘মেঘদূত’: সাহিত্য, অগ্র ১২৯৮। ৩৬৪

২৪ ঐ ১৭। ৩৩৩

২৫ ঐ ১৭। ৩৬৪

২৬ জোড়াসাঁকোর ধারে [১৩৭৮]। ৪৭

২৭ প্রবাসী, বৈশাখ ১৩৩৭। ১১৪; অপিচ, বলেন্দ্রনাথ শতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ। ২৩

২৮ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকর। ৪৫৯

২৯ ঘরোয়া [১৩৭৭]। ৬৮-৬৯

৩০ ‘পিতৃস্মৃতি’: মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। ১৫২-৫৩

৩১ দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী। ১৯

৩২ তত্ত্ব, বৈশাখ ১৭৯৭ শক [১২৮২]। ১৬

৩৩ ঐ। ১৭।

৩৪ দ্ৰ সা-সা-চ ৬। ৬৮। ২০

৩৫ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি। ১৫৮

৩৬ জীবনস্মৃতি ১৭। ২৯৬

৩৭ ‘ভুক্তভোগীর পত্র’ (২৯ জ্যৈষ্ঠ ১২৯৩ তারিখে লিখিত]: ভারতী, শ্রাবণ ১৩২০। ৪৫৩

৩৮ রবীন্দ্রজীবনী ১। ৫২৮

৩৯ বি. ভা, প., বৈশাখ ১৩৫০। ৬৫৪

৪০ সুবল বন্দ্যোপাধ্যায় : ‘সেন্ট জেভিয়ার্সে’

৪১‘বঙ্কিমচন্দ্র’ : আধুনিক সাহিত্য ৯। ৪০১

* এই বইটির পূর্ণ পরিচয় The Bengal Magazine [Mar 1874]-এর সমালোচনা (pp. 349-52) থেকে উদ্ধার করে দিচ্ছি: ‘Selections from Modem English Literature for the Higher Classes in Indian Schools. By E. Lethbridge, M.A., Late Scholar of Exeter College, Oxford; Professor of History and Political Economy in Presidency College, Calcutta. Calcutta: Thacker, Spink & Co, 1874’. উক্ত সমালোচনাতেই লিখিত হয়েছে, বইটি ছিল বড়ো আকারের আট পেজী ৪০০ পৃষ্ঠার ও তার দাম ছিল দু টাকা।

* সজনীকান্ত দাস এই নামটির উল্লেখে একটি ভুল লক্ষ্য করেছেন: তাঁর মতে ইনি রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় [1845-86] নন, রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়[?]—‘ভুলটি বিগত ৫০ বৎসর ধরিয়া চলিতেছে।’—রবীন্দ্রনাথ: জীবন ও সাহিত্য। ২২৮। ড সংঘমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার এই বক্তব্যে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, দ্র রবীন্দ্রসাহিত্যের আদিপর্ব। ১০৩-০৪, পাদটীকা ৭। আমরাও তাঁর যুক্তিই সমর্থন করি। রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় অনেকগুলি কাব্যগ্রন্থের লেখক, পাঠ্যপুস্তক-রচয়িতা ও বঙ্গদর্শনের একজন প্রধান লেখক। তাঁর মৃত্যুর পর সাবিত্রী লাইব্রেরিতে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের সুযোগ অনেক বেশি ছিল। তাছাড়া বর্তমান সময়ে বিদ্যাসাগরের সঙ্গেও তাঁর যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা ছিল। ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১২৮২ [31 May 1875] তারিখে বিদ্যাসাগর যে উইল করেন রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় তার অন্যতম সাক্ষী ছিলেন।

* কথামালা-র গল্পটি রবীন্দ্রনাথ অবশ্য আক্ষরিক অনুবাদ করেননি। তাঁর অনুবাদের অন্য কোনো আদর্শ ছিল কিংবা স্বাধীনভাবে তিনি গল্পটি সংস্কৃতভাষায় রচনা করেছিলেন কিনা, তা নিঃসংশয়ে বলা কঠিন। মালতীপুঁথি-র সম্পাদক ড বিজনবিহারী ভট্টাচার্য লিখেছেন: ‘যে মূল থেকে অনুবাদ করা হচ্ছিল তার ভাষা ইংরেজি নয় ব’লে মনে হচ্ছে।’ এই প্রসঙ্গে ড ভট্টাচার্য অনুবাদটি সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন, দ্র রবীন্দ্র জিজ্ঞাসা ১ [১৩৭২]। ২৮০-৮১

* যোগেশচন্দ্র বাগল তাঁর হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত [১৩৭৫] গ্রন্থে অমৃতবাজার পত্রিকা-র ঐ পৃষ্ঠাটির আলোকচিত্র মুদ্রিত করেছেন। আলোকচিত্রটি থেকে জানা যায়: ‘এই পত্রিকা কলিকাতা বাগবাজার আনন্দচন্দ্র চাটুয্যের গলি ২ নং বাটি হইতে প্রতি বৃহস্পতিবার শ্রীচন্দ্রনাথ রায় দ্বারা প্রকাশিত হয়।’

* উল্লেখযোগ্য, বান্ধব-এর বর্তমান সংখ্যাতে সম্পাদক কালীপ্রসন্ন ঘোষের ‘নীরব কবি’ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় (পৃ ১৮৫-৮৯]। প্রবন্ধটি তাঁর প্রভাত চিন্তা [১২৮৪] গ্রন্থে সংকলিত হবার কয়েক বৎসর পরে রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক ভারতী, ভাদ্র ১২৮৭ সংখ্যায় ‘বাঙ্গালি কবি নয়’ ও আশ্বিন সংখ্যায় ‘বাঙ্গালি কবি নয় কেন?’ দুটি প্রবন্ধে সমালোচিত হয়। প্রথম প্রবন্ধটি পরে ‘নীরব কবি ও অশিক্ষিত কবি’ নামে পূনর্লিখিত হয়ে সমালোচনা [১২৯৪] গ্রন্থে প্রকাশিত হয়। দ্র অ-২। ৭৯-৮৬

* গোপালচন্দ্র রায় লিখেছেন, অন্য-কেউ মাসে-মাসে বেতন দিয়ে পরে একসঙ্গে সরকারী তহবিল থেকে টাকাটা শোধ করে নিয়েছিলেন [দ্র রবীন্দ্রনাথের ছাত্রজীবন। ৭৩]; এমন হতেও পারে, কিন্তু সাধারণত এরূপ ক্ষেত্রে ‘বঃ’ বা ‘গুঃ’ সংকেত-সহ কোনো ব্যক্তির নাম লেখার রীতি ক্যাশবহিতে দেখা যায়।

গোপালচন্দ্র রায় লিখেছেন: ‘পরে নামে N কেটে কালি দিয়ে করা আছে R’ —কিন্তু আনন্দবাজার পত্রিকা-য় মুদ্রিত প্রতিলিপিতে সংশোধনের কোনো চিহ্ন নেই। গোপালবাবু রবীন্দ্রনাথ ও সোমেন্দ্রনাথের নামের বানান যা লিখেছেন, উক্ত প্রতিলিপির সঙ্গে তা মেলে না।

* ‘কাম্য কানন’ নাটক অভিনয়ের মাধ্যমে উদ্বোধন হয় ১৭ পৌষ ১২৮০ [বুধ 31 Dec 1873] তারিখে।

* ‘মহাজনপদাবলী সংগ্রহ।/বিদ্যাপতি।/ বহুবাজার, স্মিথ এণ্ড কোম্পানীর যন্ত্রে মুদ্রিত’। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় সাক্ষ্য দিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থটি পড়েছিলেন; পুরাতন বইয়ের দোকান থেকে পৃথ্বীসিংহ নাহার-কর্তৃক সংগৃহীত রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরিত একটি বই তিনি দেখেছিলেন। দ্র রবীন্দ্রজীবনী ১ [১৩৯২]। ৭২; কিন্তু এই গ্রন্থ রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত পরবর্তীকালে পড়েছিলেন।

‘চণ্ডিদাস কৃত পদাবলি’-তে ১২৯-৩৬ পৃষ্ঠাগুলি নেই; রবীন্দ্রনাথ পেন্সিলে মন্তব্য করেছেন: ‘এখানে গোটা আষ্টেক/পাতা দেখিতেছি না’। ‘গোবিন্দদাস কৃত পদাবলির ২৩৭ পৃষ্ঠার উপরে একটি মুখের প্রোফাইল আঁকা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *