১৩. রবীন্দ্রজীবনের ত্রয়োদশ বৎসর

ত্রয়োদশ অধ্যায়
১২৮০ [1873-74] ১৭৯৫ শক ॥ রবীন্দ্রজীবনের ত্রয়োদশ বৎসর

চৈত্র ১২৭৯-র শেষে অমৃতসর থেকে যাত্রা শুরু করে পাঠানকোট হয়ে সানুচর দেবেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ ড্যালহৌসি পাহাড়ে অবস্থিত বক্রোটা শিখরে পৌঁছন সম্ভবত বৈশাখ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের গোড়াতেই। ১৪ বৈশাখ [শুক্র ২৫ Apr 1873] ‘বক্রোটা’ থেকে দেবেন্দ্রনাথ রাজনারায়ণ বসুকে এক পত্রে লেখেন: ‘আমি অমৃতসর হইতে আবার সেই আমার বাক্রোটা শেখরে আসিয়া পহুঁছিয়াছি। এখানে তোমার ৭ই বৈশাখের পত্র পাইয়া অতীব আনন্দিত হইলাম। … রবীন্দ্র এখানে ভাল আছে এবং আমার নিকট সংস্কৃত ও ইংরাজি অল্প অল্প পাঠ শিখিতেছে। ইহাকে ব্রাহ্মধৰ্ম্মও পড়াইয়া থাকি।’

বক্রোটায় তাঁদের বাসা ছিল একটি পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায়। বৈশাখ মাস হলেও শীত অত্যন্ত প্রবল। এমন-কি পথের যে-অংশে রোদ পড়ত না, সেখানে তখনও বরফ গলেনি। বাসার নিম্নবর্তী অধিত্যকায় যে বিস্তৃত পাইন গাছের অরণ্য ছিল, রবীন্দ্রনাথ একটি লৌহফলকবিশিষ্ট লাঠি নিয়ে সেখানে প্রায়ই বেড়াতে যেতেন। ‘বনস্পতিগুলা প্রকাণ্ড দৈত্যের মতো মস্ত মস্ত ছায়া লইয়া দাঁড়াইয়া আছে; তাহাদের কত শত বৎসরের বিপুল প্রাণ! কিন্তু এই সেদিনকার অতি ক্ষুদ্র একটি মানুষের শিশু অসংকোচে তাহাদের গা ঘেঁষিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, তাহারা একটি কথাও বলিতে পারে না! বনের ছায়ার মধ্যে প্রবেশ করিবামাত্রই যেন তাহার একটা বিশেষ স্পর্শ পাইতাম। যেন সরীসৃপের গাত্রের মতো একটি ঘন শীতলতা এবং বনতলের শুষ্ক পত্ররাশির উপরে ছায়া-আলোকের পর্যায় যেন প্রকাণ্ড একটা আদিম সরীসৃপের গাত্রের বিচিত্র রেখাবলী।’ রবীন্দ্রনাথের এই অভিজ্ঞতা কিছুদিনের মধ্যেই ‘বনফুল’ কাব্যের মধ্যে রূপ নিয়েছিল। কোনো কেনো দিন দুপুরে বালক লাঠি হাতে একলা এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড়ে চলে যেতেন। দেবেন্দ্রনাথ কোনো দিনই বালকের এই স্বেচ্ছাভ্রমণে উদ্বেগ প্রকাশ বা বাধা-নিষেধের নিগড়ে তাঁকে বাঁধবার চেষ্টা করেননি। হয়তো জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এই বালকের প্রতি যে অবিচার করা হচ্ছিল, এইভাবেই তিনি তার প্রতিকারের চেষ্টা করেছেন। রবীন্দ্রনাথও এই হঠাৎ-পাওয়া স্বাধীনতার সদ্‌ব্যবহারের কোনো সুযোগ ত্যাগ করেননি। এই নিরঙ্কুশ বিচরণের মধ্যে তাঁর একটি মজা ছিল মনে মনে ভয় বানিয়ে তোলাতে। তিনি লিখেছেন: ‘একদিন ওৎরাই পথে যেতে যেতে পা পড়েছিল গাছের তলায় রাশ-করা শুকনো পাতার উপর। পা একটু হড়কে যেতেই লাঠি দিয়ে ঠেকিয়ে দিলুম। কিন্তু না ঠেকাতেও তো পারতুম। ঢালু পাহাড়ে গড়াতে গড়াতে অনেকদূর নীচে ঝরনার মধ্যে পড়তে কতক্ষণ লাগত। … তা ছাড়া ঘন পাইনের বনে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ ভালুকের সঙ্গে দেখা হলেও হতে পারত,… ঘটবার মতো কিছুই ঘটে নি, কাজেই অঘটন সব জমিয়েছিলুম মনে।’ কল্পনাপ্রবণ বালক সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিংবা বিনা উপলক্ষেই কেমন করে নিজের মনের মধ্যেই একটি কল্পজগত সৃষ্টি করে নিতেন, তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত আগে আমরা দেখেছি—পরেও তা দেখতে পাব। রবীন্দ্রনাথের প্রথম বয়সের কাব্য-ভাবনার এটি একটি বৈশিষ্ট্য বলা যেতে পারে। হিমালয় থেকে ফিরে মায়ের সান্ধ্যসভায় বা অন্যত্র সত্য ভ্রমণকাহিনীর সঙ্গে এই কাল্পনিক সম্ভাবনার গল্পও সমভাবে তিনি পরিবেশন করেছেন।

বক্রোটার বাসায় রবীন্দ্রনাথের শোবার ঘর ছিল একটি প্রান্তে। রাত্রে বিছানায় শুয়ে জানলার ভিতর দিয়ে নক্ষত্রের অস্পষ্ট আলোয় ‘পর্বতচূড়ার পাণ্ডুরবর্ণ তুষারদীপ্তি’ দেখতে পেতেন। এক-একদিন গভীর রাত্রে ঘুম ভেঙে গেলে দেখতেন পিতা একটা লাল রঙের শালে সর্বাঙ্গ ঢেকে হাতে একটা মোমবাতির সেজ নিয়ে নিঃশব্দচরণে কাঁচ দিয়ে ঘেরা বাইরের বারান্দায় উপাসনায় চলেছেন। রাত্রির অন্ধকার থাকতেই তিনি পুত্রকে ডেকে তুলতেন, উপক্রমণিকার শব্দরূপ মুখস্থ করার সেইটিই ছিল নির্দিষ্ট সময় ‘শীতের কম্বলরাশির তপ্ত বেষ্টন হইতে বড়ো দুঃখের এই উদ্‌বোধন।’ আমরণ এটি তাঁর অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল।

সূর্যোদয়ের সময়ে দেবেন্দ্রনাথ তাঁর প্রভাতের উপাসনার শেষে এক বাটি দুগ্ধ পান করে পুত্রকে পাশে নিয়ে উপনিষদের মন্ত্রপাঠ করে আর-একবার উপাসনা করতেন। তারপর তাঁকে নিয়ে বেড়াতে বেরোতেন। দেবেন্দ্রনাথের বয়স তখন ছাপ্পান্ন বৎসর, তবু তাঁর সঙ্গে দ্বাদশবর্ষীয় বালক তাল রাখতে পারতেন না, পথিমধ্যেই কোনো-একটা জায়গায় ভঙ্গ দিয়ে পায়ে-চলা পথ বেয়ে বাড়িতে ফিরে আসতেন।

ভ্রমণশেষে দেবেন্দ্রনাথ বাড়ি ফিরে এসে পুত্রকে একঘণ্টা ইংরেজি পড়াতেন। রবীন্দ্রনাথ পাণ্ডুলিপিতে লিখেছিলেন, এখানে বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের ইংরেজি জীবনী তাঁর পাঠ্য ছিল। তারপর দশটার সময় বরফগলা ঠাণ্ডা জলে স্নান, তাঁর আদেশের বিরুদ্ধে ঘড়ায় গরমজল মেশাতে ভৃত্যদের সাহস হত না। পুত্রকে উৎসাহ দেবার জন্য গল্প করতেন, যৌবনে তিনি নিজে কেমন দুঃসহশীতল জলে স্নান করতেন। তিনি নিজে প্রচুর পরিমাণে দুধ খেতেন। কিন্তু অহিফেনসেবী ঈশ্বর ভৃত্যের দুগ্ধের চাহিদা মেটাতে গিয়ে দুধ-না-খাওয়াটাই রবীন্দ্রনাথের পক্ষে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং পিতার সঙ্গে প্রতিবার দুগ্ধপান করা তাঁর কাছে প্রীতিপ্রদ না হওয়াই স্বাভাবিক। বাধ্য হয়ে তাঁকে ভৃত্যদের শরণাপন্ন হতে হল, ‘তাহারা আমার প্রতি দয়া করিয়া বা নিজের প্রতি মমতাবশত বাটিতে দুধের অপেক্ষা ফেনার পরিমাণ বেশি করিয়া দিত।’

দুপুরে খাবার পর দেবেন্দ্রনাথ আর-একবার পুত্রকে পড়াতে বসতেন। কিন্তু প্রত্যুষের নষ্টঘুম তার অকালব্যাঘাতের শোধ নিত। তাঁকে ঘুমে ঢলে পড়তে দেখে পিতা ছুটি দিয়ে দিলে ঘুমও কোথায় ছুটে যেত। ‘তাহার পরে দেবতাত্মা নগাধিরাজের পালা।’

অবসর সময়ে পিতাপুত্রে নানারকম গল্প হত। দেবেন্দ্রনাথ প্রবাসেই বেশিদিন কাটাতেন, সুতরাং পুত্রের কাছে সংসারের যে ছবিটি পেতেন সেটি অন্য কারোর কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব ছিল না। বাড়ি থেকে কারোর চিঠি পেলে রবীন্দ্রনাথ সেটি পিতাকে দেখাতেন। তেমনি দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ প্রভৃতি পুত্রেরা পিতাকে চিঠি লিখলে তিনি সেই চিঠি রবীন্দ্রনাথকে পড়তে দিতেন। পিতাকে কিভাবে চিঠি লেখা উচিত, এইভাবেই সেই শিক্ষা তাঁর আয়ত্ত হয়েছিল। এই সমস্ত ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন দেবেন্দ্রনাথ শিক্ষার অঙ্গ বলে মনে করতেন।

একবার সত্যেন্দ্রনাথের একটি চিঠিতে ছিল, ‘কর্মক্ষেত্রে গলবদ্ধরজ্জু’ হয়ে খেটে মরছেন—সেই জায়গায় কয়েকটি বাক্যের অর্থ দেবেন্দ্রনাথ পুত্রকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। পুত্র যে অর্থ করলেন, পিতার তা মনোনীত হল না—তিনি অন্য অর্থ করলেন। কিন্তু বালক তাঁর ধৃষ্টতায় সেই অর্থ স্বীকার না করে বহুক্ষণ পিতার সঙ্গে তর্ক করেছিলেন। আর-কেউ হলে নিশ্চয় ধমক দিয়ে তাঁকে নিরস্ত করতেন,—কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত পরম ধৈর্যের সঙ্গে পুত্রকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন।

এই ভ্রমণকালে দেবেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথকে আর-একটি বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছিলেন—যা আমরা পূর্বে উল্লেখ না করে একসঙ্গে আলোচনার জন্য রেখে দিয়েছি—সেটি হল জ্যোতির্বিদ্যা। জ্যোতির্বিদ্যা তাঁর অত্যন্ত প্রিয় বিষয় ছিল। স্বর্ণকুমারী দেবীও পিতার নিকট জ্যোতির্বিদ্যা-শিক্ষার কথা উল্লেখ করেছেন।*১ ‘পিতৃদেব সম্বন্ধে আমার জীবনস্মৃতি’তে জ্যোতিরিন্দ্রনাথও অনুরূপ কথা লিখেছেন।*২ শান্তিনিকেতনে অবস্থানকালেই দেবেন্দ্রনাথের কাছে রবীন্দ্রনাথের এই শিক্ষার সূত্রপাত হয়েছিল—‘সন্ধ্যাবেলা খোলা আকাশের নীচে বসে সৌরজগতের গ্রহমণ্ডলের বিবরণ বলতেন আমাকে, আমি শুনতুম একান্ত ঔৎসুক্যের সঙ্গে। মনে পড়ে আমি তাঁর মুখের সেই জ্যোতিষের ব্যাখ্যা লিখে তাঁকে শুনিয়েছিলুম।’ অমৃতসরেও তিনি Richard A. Proctor-এর লিখিত ‘সরলপাঠ্য ইংরেজি জ্যোতিষগ্রন্থ হইতে অনেক বিষয় মুখে মুখে আমাকে বুঝাইয়া দিতেন। আমি তাহা বাংলায় লিখিতাম।*৩ বক্রোটা যাত্রার পথে ‘ডাকবাংলায় পৌঁছিলে পিতৃদেব বাংলার বাহিরে চৌকি লইয়া বসিতেন। সন্ধ্যা হইয়া আসিলে পর্বতের স্বচ্ছ আকাশে তারাগুলি আশ্চর্য সুস্পষ্ট হইয়া উঠিত এবং পিতা আমাকে গ্রহতারকা চিনাইয়া দিয়া জ্যোতিষ্ক সম্বন্ধে আলোচনা করিতেন।’ অন্যত্র তিনি এ-সম্বন্ধে লিখেছেন: ‘বয়স তখন হয়তো বারো হবে… পিতৃদেবের সঙ্গে গিয়েছিলুম ড্যালহৌসি পাহাড়ে। সমস্ত দিন ঝাঁপানে করে গিয়ে সন্ধ্যাবেলায় পৌঁছতুম ডাকবাংলায়। তিনি চৌকি আনিয়ে আঙিনায় বসতেন। দেখতে দেখতে, গিরিশৃঙ্গের বেড়া-দেওয়া নিবিড় নীল আকাশের স্বচ্ছ অন্ধকারে তারাগুলি যেন কাছে নেমে আসত। তিনি আমাকে নক্ষত্র চিনিয়ে দিতেন, গ্রহ চিনিয়ে দিতেন। শুধু চিনিয়ে দেওয়া নয়, সূর্য থেকে তাদের কক্ষচক্রের দূরত্বমাত্রা, প্রদক্ষিণের সময় এবং অন্যান্য বিবরণ আমাকে শুনিয়ে যেতেন। তিনি যা বলে যেতেন তাই মনে ক’রে তখনকার কাঁচা হাতে আমি একটা বড়ো প্রবন্ধ লিখেছি। স্বাদ পেয়েছিলুম বলেই লিখেছিলুম, জীবনে এই আমার প্রথম ধারাবাহিক রচনা, আর সেটা বৈজ্ঞানিক সংবাদ নিয়ে।’ বঙ্গবাসী কার্যালয় থেকে প্রকাশিত ‘বঙ্গভাষার লেখক’ [১৩১১] গ্রন্থে সম্পাদক হরিমোহন মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের যে ‘সংক্ষিপ্ত পরিচয়’ লেখেন, সেখানে এ-বিষয়ে একটু অতিরিক্ত সংবাদ পাওয়া যায়—‘রবীন্দ্রনাথ প্রক্টরের রচিত সহজপাঠ্য ইংরাজী জ্যোতিষগ্রন্থের সহজ অংশগুলি বাঙ্গলায় অনুবাদ করিতেন। ইহাই তাঁহার বাঙ্গলা গদ্যরচনার সূত্রপাত।’ [পৃ ৯৮৫]

একই প্রসঙ্গে এতগুলি উদ্ধৃতি দিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করার একটি বিশেষ কারণ আছে। রবীন্দ্রনাথ বক্রোটায় থাকার সময়েই তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-র জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় [পৃ ৩০-৩২] ‘ভারতবর্ষীয় জ্যোতিষশাস্ত্র’ নামে একটি ধারাবাহিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে শুরু করে, এবং আষাঢ় [পৃ ৬৪-৬৭], আশ্বিন [পৃ ১২৫-২৮], কার্তিক [পৃ ১৪২-৪৮], পৌষ [পৃ ১৮৪-৮৮] ও মাঘ [পৃ ২০৪-০৭] সংখ্যায় প্রকাশিত হয়ে ‘ক্রমশঃ প্রকাশ্য’ অবস্থাতেই বন্ধ হয়ে যায়। 12 Oct 1939 [বৃহ ২৫ আশ্বিন ১৩৪৬] তারিখে প্রখ্যাত গবেষক ও সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাস এ-বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চিঠি লিখলে, তিনি 15 Oct [রবি ২৮ আশ্বিন] উত্তরে লেখেন:

পিতৃদেবের মুখ থেকে জ্যোতিষের যে বিদ্যাটুকু সংগ্রহ করে নিজের ভাষায় লিখে নিয়েছিলুম সেটা যে তখনকার কালে তত্ত্ববোধিনীতে ছাপা হয়েছে এই অদ্ভুত ধারণা আজ পর্যন্ত আমার মনে ছিল। এর দুটো কারণ থাকতে পারে। এক এই যে, সম্পাদক [আনন্দচন্দ্র] বেদান্তবাগীশ মহাশয় ছাপানো হবে বলে বালককে আশ্বাস দিয়েছিলেন, বালক শেষ পর্যন্ত তার প্রমাণ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে নি। আর একটা কারণ এই হতে পারে যে, অন্য কোনো যোগ্য লেখক সেটাকে প্রকাশযোগ্য রূপে পূরণ করে দিয়েছিলেন। শেষোক্ত কারণটিই সঙ্গত বলে মনে হয়। এই উপায়ে আমার মন তৃপ্ত হয়েছিল এবং কোনো লেখকেরই নাম না থাকাতে এতে কোন অন্যায় করা হয় নি। এ না হলে এমন দৃঢ়বদ্ধমূল সংস্কার আমার মনে থাকতে পারত না।

সজনীকান্ত এই চিঠি উদ্ধৃত করে লিখেছেন: ‘আমাদের মনে হয়, ইহার পর আর কাহারও মনে এ বিষয়ে সংশয় থাকিতে পারে না।‘ কিন্তু সংশয় যে ছিল, সেই কারণেই তিনি পূর্বে লিখেছিলেন: ‘এ প্রবন্ধ সম্বন্ধে আমরা নিঃসন্দিগ্ধ নহি বলিয়া নমুনা দিলাম না।’ বস্তুত নিঃসন্দিগ্ধ হওয়া সম্ভবও নয়। রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, তাঁর পিতা প্রক্টরের গ্রন্থ অবলম্বনে তাঁকে জ্যোতিষ বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি ভারতীয় জ্যোতিষ সম্পর্কে কিছু বললেও ‘ভারতবর্ষীয় জ্যোতিষশাস্ত্র’ প্রবন্ধের লক্ষ্য একান্তভাবেই শিরোনামের অনুসারী। তারই ভূমিকা-স্বরূপ প্রথম দুটি কিস্তিতে পাশ্চাত্ত্য জ্যোতিষ প্রসঙ্গে কিছু মন্তব্য করলেও লেখক তাঁর উদ্দেশ্যটি ব্যক্ত করেছেন আশ্বিন-কিস্তির শেষ অনুচ্ছেদে:

সৰ্ব্ব সাধারণ মধ্যে পূৰ্ব্ব কালীন সিদ্ধান্ত জ্যোতিষের জ্ঞান বিস্তার করণাভিপ্রায়ে আমরা সৰ্ব্ব প্রধান গ্রন্থ সূৰ্য্য-সিদ্ধান্তের বিশদ অনুবাদ প্রচার করিবার মানস করিয়াছি। কিন্তু সেই গ্রন্থোল্লিখিত সিদ্ধান্ত সকল এরূপ সঙেক্ষপে রচিত, যে শ্রীমৎ ভাস্করাচার্য্য কৃত সিদ্ধান্ত শিরোমণি নামক পুস্তকের গোলাধ্যায়ের সাহায্য ব্যতিরেকে তৎসমুদায় বিশদ রূপে হৃদয়ঙ্গম করিতে পারা যায় না। এই হেতু আমরা প্রথমে উক্ত অধ্যায়ের অনুবাদ শেষ করিয়া তাহার পর সূৰ্য্য-সিদ্ধান্তের অনুবাদে প্রবৃত্ত হইব। উক্ত গ্রন্থদ্বয়ের অনুবাদ যাহাতে সর্ব্ব সাধারণের বোধ গম্য হইতে পারে তাহার নিমিত্ত আমরা আধুনিক জ্যোতির্ব্বিৎগণকৃত টীকা সমুদায়ের অনুবাদ করিতে ত্রুটি করিব না।

লেখক পাদটীকায় লেখেন, বারাণসী সংস্কৃত কলেজের গণিতধ্যাপক বাপুদের শাস্ত্রী সূর্য-সিদ্ধান্তের এবং তিনি ও ল্যান্সিনট্‌ উইল্‌কিন্‌সন একত্রে গোলাধ্যায়ের যে ইংরেজি অনুবাদ ও টীকা করেছেন সেইটিই তাঁর প্রধান অবলম্বন। এরপর তিনি দুটি কিস্তিতে ‘ভাস্করাচার্য্যের সিদ্ধান্ত শিরোমণি গ্রন্থের গোলাধ্যায় স্থিত ভুবনকোষ পরিচ্ছেদ’-এর একাদিক্রমে অনুবাদ করেছেন। মাঘ-কিস্তিতে তিনি অনুবাদ করেন ‘সূৰ্য্য সিদ্ধান্ত’ প্রথম পরিচ্ছেদ—লক্ষ্য-পরিবর্তন সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যাটি হল:

আমরা প্রথমে মনে করিয়াছিলাম যে ভাস্করাচার্য্য কৃত সিদ্ধান্ত শিরোমণি গ্রন্থের গোলাধ্যায় প্রকাশ করিয়া সূর্য্যসিদ্ধান্ত গ্রন্থে হস্তাৰ্পণ করিব, কিন্তু এক্ষণে দেখিতেছি যে উক্ত গোলাধ্যারের অধিকাংশ স্থান এ রূপ দুর্ব্বোধ যে তাহার অবিকল অনুবাদ কখনই সাধারণ পাঠক মণ্ডলীর তৃপ্তিজনক হইবে না। উক্ত অধ্যায়াপেক্ষা সূৰ্য্যসিদ্ধান্ত অনেকাংশে সরল; সুতরাং আমরা আপাতত তাহাই প্রকাশ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। সূৰ্য্য সিদ্ধান্তের যে সকল বিষয় সম্বন্ধে ভাস্করাচার্য্য তাঁহার গোলাধ্যায়ে কোন নূতন কথা বলিয়াছেন আমরা তাহা টীকাকারে প্রকাশ করিতে ত্রুটি করিব না।

এর পরে ‘ক্রমশঃ প্রকাশ্য’ লেখা থাকলেও রচনাটির আর-কোনো অংশ পত্রিকাটিতে মুদ্রিত হয়নি।

এখন প্রশ্ন, এই জিনিসকে কি রবীন্দ্র-রচনা ‘অন্য কোনো যোগ্য লেখক’ দ্বারা ‘প্রকাশযোগ্য রূপে পূরণ’ করে দেওয়া বলা যেতে পারে? এখানে লেখকের লক্ষ্যটিই ভিন্নতর এবং তিনি সেই লক্ষ্যেও স্থির থাকতে পারেননি। পিতার কাছে লব্ধ শিক্ষা ও বর্তমান রচনাটি এতই আলাদা ধরনের যে, এই রচনা প্রকাশে রবীন্দ্রনাথের মন তৃপ্ত হওয়ার কথা নয়। সজনীকান্ত কোথাও লেখেননি, প্রবন্ধটি তিনি রবীন্দ্রনাথকে দেখিয়েছিলেন—আমাদের ধারণা, তিনি যদি দেখাতেন [এমন অনেক অ-নামা রচনা তিনি দেখিয়ে তাঁর মতামত সংগ্রহ করেছিলেন] রবীন্দ্রনাথ সুস্পষ্টভাবেই অস্বীকার করতেন।

তাহলে রবীন্দ্রনাথের মনে এরূপ বদ্ধমূল ধারণা কি করে জন্মাল যে তাঁর কাঁচা হাতের লেখা কোনো যোগ্য লেখক দ্বারা সংস্কৃত হয়ে তত্ত্ববোধিনী-তে প্রকাশিত হয়েছিল? অনেকে মনে করেছেন, তত্ত্ববোধিনী-র পৌষ ১৭৯৬ শক [১২৮১: Dec 1874] সংখ্যায় ‘গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি’ [পৃ ১৬১-৬৩] ‘ক্রমশঃ প্রকাশ্য’ এই প্রবন্ধটিই রবীন্দ্রনাথের রচিত সেই জ্যোতিষ-সম্পর্কিত রচনা। জীবনস্মৃতি [১৩৬৮]-র তথ্যপঞ্জীতে সংশয়-চিহ্নিত ভাবে প্রবন্ধটির উল্লেখ করা হয়েছে.[দ্র পৃ ২৪৪, টীকা ৫১॥২]। প্রবন্ধটির শেষে ‘ক্রমশঃ প্রকাশ্য’ লেখা থাকলেও পরবর্তী কোনো সংখ্যায় এই ক্রমানুসৃতি দেখা যায় না। সাম্প্রতিক আলোচনায় সুশান্তকুমার মিত্র ‘রবীন্দ্রনাথের প্রথম গদ্যরচনা’ প্রবন্ধে এই রচনাটিই যে রবীন্দ্র-রচিত জ্যোতিষবিষয়ক প্রবন্ধ এই মত জোর দিয়ে সমর্থন করেছেন এবং সংঘমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রবীন্দ্রসাহিত্যের আদিপর্ব [১৩৮৫] গ্রন্থে তা নিঃসংশয়ে মেনে নিয়েছেন। শ্রীমিত্রের মতে, এই প্রবন্ধেই প্রক্টর-বর্ণিত গ্রহ-নক্ষত্রের পরিচয় এবং তাঁর Half-hours with the Telescope [1868] ও The Orb Around Us [1872]* গ্রন্থ দুটির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তিনি রচনাটির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ‘কবিকল্পনা’ বা ‘ঐশ্বরিক চিন্তা’র বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ্য করলেও এর কাঁচা ভাষার জন্যই তত্ত্ববোধিনী-তে ক্রমানুসৃত হয়নি বলে অনুমান করেছেন। শ্রীমতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে কবিকল্পনা বা ঐশ্বরিক চিন্তার বৈশিষ্ট্যগুলি এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব নয়, দেবেন্দ্রনাথের কাছ থেকে ধার করা, আর এর ভাষাকে খুব কাঁচাও বলা যাবে না। বরং এই প্রবন্ধের বহু ভাবনার পরিণত রূপ বিশ্বপরিচয় [১৩৪৪] গ্রন্থে পাওয়া যায়। ক্রমানুসৃতির অভাব সম্পর্কে তিনি অনুমান করেছেন, হয়তো যে-সব গ্রহ-উপগ্রহের সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ যোগ নেই সেগুলি জীবের আবাসভূমি কিনা, তা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা তত্ত্ববোধিনী-র পাঠক বা সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যান্য সদস্যরা সমর্থন করেননি। কিন্তু আরও কিছু গ্রহণযোগ্য তথ্য না পাওয়া গেলে এটি রবীন্দ্রনাথের রচনা কিনা এ-সম্পর্ক সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা খুবই কঠিন। তবে ‘ভারতবর্ষীয় জ্যোতিষশাস্ত্র’র চেয়ে ‘গ্রহগণ জীবের আবাস-ভূমি’ প্রবন্ধের দাবি অনেক বেশি।

ইংরেজি, সংস্কৃত ও জ্যোতির্বিদ্যার সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথ হয়তো পুত্রকে ইতিহাসও পড়াতে চেয়েছিলেন। ২১ বৈশাখ [শুক্র 2. May] তারিখের হিসাবে দেখা যায় তাঁর কাছে দুখানা বই পাঠানো হয়েছে—‘ভারতবর্ষের পুরাবৃত্ত’ ও Lethbridge-এর লেখা History of India। হয়তো আরও কিছু কিছু বিষয় পড়ানোর আয়োজনও ছিল, যে-পরিমাণ বই হিমালয়-যাত্রায় পূর্বাহ্নে রবীন্দ্রনাথের জন্য কেনা হয়েছিল, তাতে এমন মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সে-বিষয়ে কোনো উল্লেখ না করায় নিশ্চিত করে কিছু বলবার উপায় নেই।

হিমালয় অবস্থান-কালে দেবেন্দ্রনাথের দীর্ঘদিনের অনুচর ও ভ্রমণসঙ্গী কিশোরীনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। তিনি এককালে পাঁচালির দলের গায়ক ছিলেন। ‘সে আমাকে পাহাড়ে থাকিতে প্রায় বলিত, “আহা দাদাজি, তোমাকে যদি পাইতাম তবে পাঁচালির দল এমন জমাইতে পারিতাম, সে আর কী বলিব।” শুনিয়া আমার ভারি লোভ হইত—পাঁচালির দলে ভিড়িয়া দেশদেশান্তরে গান গাহিয়া বেড়ানোটা মহা একটা সৌভাগ্য বলিয়া বোধ হইত।‘* এঁর কাছে দাশরথি রায়ের লেখা অনেকগুলি পাঁচালির গান রবীন্দ্রনাথ শিখে নিয়েছিলেন—“ওরে ভাই, জানকীরে দিয়ে এসো বন’, ‘প্রাণ তো অন্ত হল আমার কমল-আঁখি’, ‘রাঙা জবায় কী শোভা পায় পায়’, ‘কাতরে রেখো রাঙা পায়, মা অভয়ে’, ‘ভাবো শ্রীকান্ত নরকান্তকারীরে নিতান্ত কৃতান্ত ভয়ান্ত হবে ভবে’ ইত্যাদি। এই কিশোরী চট্টোপাধ্যায়ই তাঁর শৈশবে ভৃত্যদের কৃত্তিবাসী রামায়ণ পাঠের আসরে হঠাৎ এসে দাশরথি রায়ের পাঁচালির ‘অনুপ্রাসের ঝক্‌মকি ও ঝংকারে’ তাঁদের হতবুদ্ধি করে দিতেন।

আমাদের একটি ভুল ধারণা আছে যে, রবীন্দ্রনাথ কিশোরীনাথের সঙ্গে আষাঢ় মাসের প্রথম দিকে হিমালয় থেকে কলকাতা প্রত্যাবর্তন করেন। এই বিভ্রান্তির কারণ ‘হিমালয় বক্রোটাশেখর’ থেকে ১৪ আষাঢ় [শুক্র 27 Jun] রাজনারায়ণ বসুকে লেখা দেবেন্দ্রনাথের একটি পত্রাংশ: ‘রবীন্দ্রকে একটি জীবন্ত পত্র স্বরূপ করিয়া তোমাদের নিকট পাঠাইয়াছি—তাহার প্রমুখাৎ এখানকার তাবৎ বৃত্তান্ত চুম্বকরূপে জানিতে পারিয়াছ,…।’ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ১১ জ্যৈষ্ঠ [শুক্র 23 May] তারিখের পূর্বেই যে কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন, তার প্রমাণ উক্ত তারিখে ক্যাশবহি-তে লিখিত একটি হিসাব: ‘কর্ত্তাবাবু মহাশয়ের নিকট নিজ হিসাবের বার্ষিক জমাখরচ/মোট হিসাব এস্টেটের চেক রবীবাবু সেজবাবু [হেমেন্দ্রনাথ] কিশোরীনাথ চট্টো/প্রসন্নকুমার বিশ্বাসের ১ পত্র ও সেজবাবুর দেওা কুশুমাঞ্জলি এক দফা/সমুদায় এক লেফেফায় রেজেষ্টারির ব্যয় ১৷৷’। লক্ষ্য করবার বিষয়, এখানে অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে ‘রবীবাবু’ ও ‘কিশোরীনাথ চট্টো’-র দুখানি চিঠিও পাঠানো হয়েছে। নিরাপদে কলকাতা প্রত্যাবর্তনের সংবাদই চিঠি-দুটির বিষয়বস্তু ছিল, এ কথা সহজেই অনুমান করা যায়। রাশিয়ানদের সংবাদ দিয়ে মায়ের নির্দেশে পিতাকে চিঠি লেখার কথা রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতে বর্ণনা করেছেন: কিন্তু আমরা তথ্য-প্রমাণ দিয়ে সেই বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি, সে কথা আগেই আলোচিত হয়েছে। সেই হিসেবে বর্তমান চিঠিটির ঐতিহাসিক মূল্য যথেষ্ট এবং আশা করা যায় পিতার কাছে শিক্ষালাভের পর যথাবিহিত পাঠ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেই চিঠিটি লিখতে পেরেছিলেন, এর জন্য মহানন্দ মুনশি বা আর কারোর সহায়তার প্রয়োজন তিনি বোধ করেননি। এখানেই শেষ নয়, কয়েকদিন পরে ২৮ জ্যৈষ্ঠ [সোম 9 Jun] রবীন্দ্রনাথের আরও একটি পত্র দেবেন্দ্রনাথের কাছে প্রেরিত হয়েছে। পত্র দুটি মহাকালের গ্রাস থেকে আত্মরক্ষা করতে পারেনি এটা আমাদের দুর্ভাগ্য—কিন্তু সন-তারিখযুক্ত পত্রদ্বয়ের সংবাদলাভ করাটাকে আমরা সৌভাগ্য জ্ঞান করতে পারি।

এইখানে একটি কৌতূহলজনক তথ্য উদ্ধার করা দরকার। তত্ত্ববোধিনী-র ভাদ্র ১৭৯৫ শক [১২৮০: Aug 1873] সংখ্যার ১১২ পৃষ্ঠায় আদি ব্রাহ্মসমাজের আষাঢ় মাসের ‘আয় ব্যয়’-এর হিসাবে ‘শুভকর্ম্মের দান’ শিরোনামায় রাজারাম মুখোপাধ্যায় [রবীন্দ্রনাথের মেজদি ৺সুকুমারী দেবীর শ্বশুর] ১০ টাকা, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ৪ টাকা, তার সঙ্গে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২৸৴১৫’ লেখা আছে। দানের অঙ্কটি কৌতুককর এবং কৌতূহলোদ্রেককারী। কী কারণে এই অঙ্কের টাকা রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজে দান করেছিলেন, এ প্রশ্ন সহজেই মনে জাগতে পারে। এর উত্তরের ব্যাপারে পত্রিকাটি নীরব হলেও, ক্যাশবহি আমাদের সঠিক কারণটি জানিয়ে দেয়। ২৬ আষাঢ় [বুধ 9 Jul] তারিখের হিসাবে দেখা যায়: ‘ব° বাবু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর/দঃ উহার ডেলহাউসী হইতে আগমন জন্য/পাথেয়র উদ্বর্ত্ত্য [উদ্ধৃত্ত] ৮৸৴৯ যাহা গত ১২ আষাঢ়/আমানত খাতায় জমা দেওয়া হইয়াছে/ তাহা নিজ রোজ কর্ত্তাবাবু মহাশয়ের/লিখিত আদেশমতে রবিন্দ্রবাবুকে/ছয় টাকা ফেরত দেওয়া হয়/ও উক্ত বাবুর নামে ব্রাহ্মসমাজে/২৸৴ ৯ দান দেওয়া বাবদ/৮৸৴ ৯’। হিসাবটি থেকে বোঝা যায় দানের পূণ্যলাভের সঙ্গে সঙ্গে এই অর্থলাভ তখন রবীন্দ্রনাথকে রীতিমত ধনী করে তুলেছিল, যেখানে সৌদামিনী দেবী প্রভৃতি দিদিদের মাসোহারা ছিল মাত্র দশ টাকা!

কিন্তু প্রসঙ্গটি উত্থাপনের অন্য তাৎপর্যও আছে। রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-র এক জায়গায় লিখেছেন: ‘বেশ মনে আছে, ব্রাহ্মসমাজের ছাপাখানা অথবা আর-কোথাও হইতে একবার নিজের নামের দুই-একটা ছাপার অক্ষর পাইয়াছিলাম। তাহাতে কালি মাখাইয়া কাগজের উপর টিপিয়া ধরিতেই যখন ছাপ পড়িতে লাগিল, তখন সেটাকে একটা স্মরণীয় ঘটনা বলিয়া মনে হইল।’১০ আর বর্তমান ক্ষেত্রে যখন মাসিক পত্রিকায় ছাপার অক্ষরে তাঁর নাম প্রকাশিত হল, তা নিশ্চয়ই আরও রোমাঞ্চকর ব্যাপার, কিন্তু তখন তা দেখে বালক রবীন্দ্রনাথের মনে কী ধরনের অনুভূতি হয়েছিল, তা তিনি কোথাও উল্লেখ করেননি। উপনয়নের অনুষ্ঠান-পদ্ধতি যখন তত্ত্ববোধিনী-তে প্রকাশিত হয়, তাতে শুধু তাঁর দাদা সোমেন্দ্রনাথের নাম মুদ্রিত হয়েছিল; সোমপ্রকাশ-এ তাঁর গতিবিধির যে সংবাদ বেরিয়েছিল, তাতেও নাম ছাপা হয়নি। সুতরাং পরবর্তীকালে যে-রবীন্দ্রনাথের নাম স্থানে-অস্থানে কোটি-কোটি বার মুদ্রিত হয়েছে, বর্তমান প্রসঙ্গে তা প্রথমতম, এইখানেই তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব।

এই সবই রবীন্দ্রজীবনে হিমালয়ভ্রমণের পরোক্ষ ফল, কিন্তু এই ভ্রমণ তাঁর প্রত্যক্ষ জীবনযাত্রায় এক গুরুতর পরিবর্তন সাধন করেছে। এতদিন শাসনের বেড়া তাঁকে সবার দৃষ্টির অন্তরালে রেখে দিয়েছিল, কিন্তু এখন তাঁর অধিকার অনেক প্রশস্ত হয়ে গেল, তিনি বাড়ির লোকের চোখে পড়লেন। পূর্বেই বলেছি, দেবেন্দ্রনাথ এর আগে অন্য কোনো পুত্রকে হিমালয়ে তাঁর নির্জন সাধনার সঙ্গী করেননি, সেদিক দিয়ে রবীন্দ্রনাথই প্রথম ব্যতিক্রম। দীর্ঘ তিনমাস পিতার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যলাভের এই দুর্লভ মর্যাদা লাভ করে তিনি সবার কাছেই আদরের সামগ্রী হয়ে উঠলেন।

ফেরবার সময় রেলের পথেই তাঁর ভাগ্যে আদরের সূত্রপাত। সঙ্গে কেবল একটি ভৃত্য নিয়ে মাথায় জরির টুপি পরে স্বাস্থ্যের প্রাচুর্যে পরিপুষ্ট একা বালক ট্রেনে ভ্রমণ করছিলেন—‘পথে যেখানে যত সাহেবমেম গাড়িতে উঠিত আমাকে নাড়াচাড়া না করিয়া ছাড়িত না।’১১

বাড়িতে পরিবর্তনটা আরও স্পষ্ট—‘বাড়িতে যখন আসিলাম তখন কেবল যে প্রবাস হইতে ফিরিলাম তাহা নহে—এতকাল বাড়িতে থাকিয়াই যে-নির্বাসনে ছিলাম সেই নির্বাসন হইতে বাড়ির ভিতরে আসিয়া পৌঁছিলাম। অন্তঃপুরের বাধা ঘুচিয়া গেল, চাকরদের ঘরে আর আমাকে কুলাইল না। মায়ের ঘরের সভায় খুব একটা বড়ো আসন দখল করিলাম। তখন আমাদের বাড়ির যিনি কনিষ্ঠ বধূ [কাদম্বরী দেবী] ছিলেন তাঁহার কাছ হইতে প্রচুর স্নেহ ও আদর পাইলাম।’১১

এই পরিবর্তনের মানসিক প্রতিক্রিয়া রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন তাতে তাঁর পরিণত মনের ছাপ থাকলেও, বালকের মনস্তত্ত্ব বোঝার পক্ষে অত্যন্ত জরুরি। শিশুরা শৈশবে মেয়েদের স্নেহযত্ন অযাচিত ভাবে পেয়ে থাকে, আলো হাওয়ার মতো স্বাভাবিকভাবেই তা তাদের প্রতি বর্ষিত হয়, এই পাওয়া সম্পর্কে তাদের সচেতনতার কোনো কারণ ঘটে না, বরং কোনো-কোনো ক্ষেত্রে এই আদরের জাল কেটে বেরিয়ে পড়াই তাদের লক্ষ্য হয়ে পড়ে। ‘কিন্তু, যখনকার যেটি সহজপ্রাপ্য তখন সেটি না জুটিলে মানুষ কাঙাল হইয়া দাঁড়ায়। আমার সেই দশা ঘটিল। ছেলেবেলায় চাকরদের শাসনে বাহিরের ঘরে মানুষ হইতে হইতে হঠাৎ এক সময়ে মেয়েদের অপর্যাপ্ত স্নেহ পাইয়া সে জিনিসটাকে ভুলিয়া থাকিতে পারিতাম না।’১১ যা প্রতিদিন একটু একটু করে পেলে সহজ হয়ে যেত, তা হঠাৎ একদিনে সুদে-আসলে পরিশোধ হয়ে যাওয়ায় সেই বিপুল ঐশ্বর্যের ভার বহন করা তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল!

পাহাড় থেকে ফিরে আসার পর প্রথম কিছুদিন গেল ঘরে ঘরে ভ্রমণের গল্প করে। কিন্তু বহুকথনের মাধ্যমে ভ্রমণের কাহিনী যতই বৈচিত্র্য হারাচ্ছিল, ততই কল্পনার দ্বারা তাকে পূরণ করতে গিয়ে মূল বৃত্তান্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যের অভাবও প্রকট হয়ে উঠছিল।

কিন্তু তাতে মায়ের সায়ংকালীন বায়ুসেবনসভায় প্রধান বক্তা হয়ে ওঠার পথে কোনো বাধা সৃষ্টি হয়নি। পূর্বেও নর্মাল স্কুলে পড়ার সময় সূর্য যে পৃথিবীর চেয়ে লক্ষ গুণ বড়ো এই সংবাদ মায়ের কাছে পরিবেশন করেছেন বা ব্যাকরণের কাব্যালংকার অংশে উদাহৃত কবিতা আবৃত্তি করে তাঁকে বিস্মিত করেছেন। আর এখন তো সে তুলনায় জ্ঞানসম্পদে তিনি অনেক ধনী। সুতরাং প্রক্টরের গ্রন্থ থেকে আহৃত গ্রহতারা বিষয়ক জ্ঞান সেই ‘দক্ষিণাবায়ুবীজিত সান্ধ্যসমিতি’র মধ্যে বিবৃত হতে লাগল। অবশ্য কিশোরী চাটুজ্যের কাছে শেখা পাঁচালির গানে আসর যেমন জমে উঠত, সূর্যের অগ্নি-উচ্ছ্বাস বা শনির চন্দ্রময়তার আলোচনায় তেমন হত না, এ কথা বলাই বাহুল্য।

কিন্তু মাকে তিনি যে সংবাদে সবচেয়ে বেশি বিচলিত করতে পেরেছিলেন সেটি হল, যেখানে ‘পৃথিবীসুদ্ধ’লোক কৃত্তিবাসের বাংলা রামায়ণ পড়ে জীবন কাটায় সেখানে তিনি পিতার কাছে ‘স্বয়ং মহর্ষি বাল্মীকির স্বরচিত’ অনুষ্টুভ ছন্দের রামায়ণ পড়ে এসেছেন! সুতরাং পুত্রগর্বে গরবিনী মাতা পুত্রের কণ্ঠে বাল্মীকির রামায়ণ শুনতে উৎসুক হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু হায়, একে ঋজুপাঠের দ্বিতীয় ভাগে উদ্ধৃত কৈকেয়ীদশরথসংবাদের সামান্য পঠিত অংশ, তাও তার অনেকটাই আবার বিস্মৃতিবশত অস্পষ্ট হয়ে এসেছে—মায়ের কাছে আত্মগৌরব রক্ষার্থে সেটুকু পড়ে যাওয়া ছাড়া তাঁর কোনো গত্যন্তরও ছিল না; কিন্তু বাল্মীকির রচনা ও বালকের ব্যাখ্যার মধ্যে অনেকটা অসামঞ্জস্য থেকে গেল। এর উপর যখন বড়োদাদা দ্বিজেন্দ্রনাথকেও এই পাঠ ও ব্যাখ্যা শোনাবার প্রস্তাব করলেন রবীন্দ্রনাথ স্বভাবতই প্রচুর আপত্তি জানালেন। কিন্তু সারদা দেবী তা শুনবেন কেন, এ তো কেবল পাঠে অমনোযোগের জন্য সবার কাছে ধিক্কৃত কনিষ্ঠ পুত্রের বিদ্যাবুদ্ধির উন্নতির পরিচয়মাত্র নয়, স্বামী দেবেন্দ্রনাথের শিক্ষার গুণেই এই উন্নতি—এমন অভিমানও তাঁর মনে দেখা দিতে পারে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ভাগ্য ভালো—‘দয়ালু মধুসূদন তাঁহার দর্পহারিত্বের একটু আভাসমাত্র দিয়া আমাকে এ-যাত্রা ছাড়িয়া দিলেন। বড়দাদা বোধহয় কোনো-একটা রচনায় নিযুক্ত ছিলেন—বাংলা ব্যাখ্যা শুনিবার জন্য তিনি কোনো আগ্রহ প্রকাশ করিলেন না। গুটিকয়েক শ্লোক শুনিয়াই ‘বেশ হইয়াছে’ বলিয়া তিনি চলিয়া গেলেন।’১২

কিন্তু হিমালয়-ভ্ৰমণ ঘরে বাইরে অনেক বেড়া ভেঙে দিলেও আছে বেঙ্গল অ্যাকাডেমি, আছে তার নিপ্রাণ শিক্ষাপদ্ধতি। গরমের ছুটির পর আবার সেখানেই ফিরে যেতে হল। Feb 1873-র পর মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে কেবল সোমেন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদের বেতন-ই দেওয়া হয়, ৯ শ্রাবণ [মঙ্গল 15 Jul] তারিখের হিসাবে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের নামও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে: ‘সোমেন্দ্র ও রবিন্দ্র ও সত্যপ্রসাদ/বাবুর ইস্কুলের জুন মাহার ফি শোদ/গুঃ ঈশ্বর দাষ/ বিঃ ৩ বিল—১৮৲’ [বেতন-হারের এই বৈচিত্র্য একটু কৌতূহল উদ্রেক করে। বেঙ্গল অ্যাকাডেমির বেতন ছিল মাসিক পাঁচ টাকা—সেই হিসেবে তিন জনের বেতন পনেরো টাকা করেই সাধারণত পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু গত বৎসর Nov 1872 ও বর্তমান মাসে অর্থাৎ Jun 1873-তে বেতন দেওয়া হয়েছে আঠারো টাকা করে। Nov 1872-র ক্ষেত্রে উল্লেখ করাই ছিল, ‘গান শিখিবার দরূণ বেশী ১৲ হিঃ ৩৲’; বর্তমান ক্ষেত্রে অনুরূপ কোনো উল্লেখ না থাকলেও অনুমান করা যেতে পারে, একই কারণে তিন টাকা বেশি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ-হঠাৎ এক মাস করে কী গান তাঁরা শিখতেন, এই কৌতূহল মেটাবার কোনো উপায় নেই।] শ্রাবণ [Jul] মাসে বেতনের হিসাব লিখিত হলেও আষাঢ় মাসের [Jun 1873] শুরু থেকেই রবীন্দ্রনাথ আবার স্কুলে যাওয়া আরম্ভ করেছেন, এমন অনুমান করা যেতে পারে। কিন্তু পিতার সান্নিধ্যে তিন মাস যেভাবে তিনি শিক্ষা লাভ করেছিলেন তার সঙ্গে বেঙ্গল অ্যাকাডেমির পার্থক্য সুদুস্তর। সুতরাং তাঁর পক্ষে স্কুলে যাওয়া আগের চেয়েও কঠিন হয়ে উঠল। নানা ছলনায় তিনি আবার স্কুল থেকে পালাতে শুরু করলেন। আগেই বলা হয়েছে, অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পরিবর্তে আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশের পুত্র জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য ফাল্গুন মাস থেকে তাঁদের ইংরেজি পড়াবার জন্য গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য হিমালয় ভ্রমণের পর তাঁর ছাত্ৰশ্রেণীভুক্ত হয়েছেন। কিন্তু তিনিও অন্তত বর্তমান বৎসরে কিছু অবস্থান্তর ঘটাতে পেরেছিলেন, এমন মনে হয় না।

এই সময়কার দুই-একটি কৌতুকজনক ঘটনার কথা রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে উল্লেখ করেছেন। ম্যাজিশিয়ান প্রোফেসর হরিশ্চন্দ্র হালদারের সঙ্গে আমাদের পূর্বেই পরিচয় হয়েছে। তিনি দ্রব্যগুণ সম্পর্কে আশ্চর্য আশ্চর্য কথা বলতেন, কিন্তু দ্রব্যগুলির দুর্লভতার জন্য সেগুলি পরীক্ষা করে দেখার কোনো সুযোগ ছিল না। একবার প্রোফেসর অপেক্ষাকৃত সহজসাধ্য একটি পদ্ধতির উল্লেখ করে ফেললেন। মনসাসিজের আঠা একুশবার বীজের গায়ে মাখিয়ে শুকিয়ে নিলে সে-বীজ থেকে এক ঘণ্টার মধ্যেই গাছ জন্মে ফল ধরতে পারে, তাঁর মুখে একথা শুনে মালীর সাহায্যে আঠা সংগ্রহ করে এক রবিবার ছুটির দিনে তেতলার ছাদে তার পরীক্ষা চলল। তারপর থেকেই প্রোফেসর রবীন্দ্রনাথকে এড়িয়ে চলতে লাগলেন। অবশ্য তার কারণ তখনই তাঁর বোধগম্য হয়নি, কিছুদিন সময় লেগেছিল।

একদিন মধ্যাহ্নে তাঁদের পড়বার ঘরে প্রোফেসর প্রস্তাব করলেন বেঞ্চের উপর থেকে লাফিয়ে দেখা যাক কার কি রকম লাফাবার প্রণালী। সবাইয়ের মতো রবীন্দ্রনাথও লাফালেন। প্রোফেসর একটি ‘অন্তররুদ্ধ অব্যক্ত হুঁ’ বলে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন, অনেক অনুনয়েও এর চেয়ে ‘স্ফুটতর কোনো বাণী’ তাঁর কাছ থেকে বার করা গেল না।

একদিন তিনি বললেন কোনো সম্ভ্রান্ত বংশের ছেলেরা তাঁদের সঙ্গে আলাপ করতে চায়। অভিভাবকেরা আপত্তি না করায় সেখানে যেতেই কৌতূহলীরা তাঁদের ঘিরে ধরে রবীন্দ্রনাথের গান শুনতে চাইল। তিনি দু-একটা গান শুনিয়ে কণ্ঠের মিষ্টত্বের প্রশংসাও পেলেন। তার পরে আহারের সময় সকলে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে আহারপ্রণালী পর্যবেক্ষণ করতে লাগল—‘যেরূপ সূক্ষ্মদৃষ্টিতে সেদিন সকলে নিমন্ত্রিত বালকের কার্যকলাপ নিরীক্ষণ করিয়া দেখিল, তাহা যদি স্থায়ী এবং ব্যাপক হইত, ‘তাহা হইলে বাংলাদেশে প্রাণিবিজ্ঞানের অসাধারণ উন্নতি হইতে পারিত।’১৩

প্রকৃতপক্ষে, ভাগিনেয় সত্যপ্রসাদ তাঁর অঘটনঘটনপটিয়সী প্রতিভার তাড়নায় আমের আঁটিতে জাদু প্রয়োগের সময় প্রোফেসরকে বুঝিয়েছিলেন যে বিদ্যাশিক্ষার সুবিধের জন্যই অভিভাবকেরা বালকবেশে রবীন্দ্রনাথকে বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছিলেন, কিন্তু সেটি তাঁর ছদ্মবেশমাত্র। আর সেই কারণেই যে লাফাবার প্রণালী পরীক্ষা ও এত সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের ঘটা তা কিছুদিন পরে জাদুকরের কাছ থেকে দু-একটি অদ্ভুত পত্র পেয়ে তবেই রবীন্দ্রনাথের বোধগম্য হল।

এ-সব যাই হোক, বেঙ্গল অ্যাকাডেমির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কিছুতেই সহজ হল না। নানা ছুতোয়, কখনো-বা মুনশির সহায়তায়, সেখান থেকে পালানো অব্যাহত রইল। এই চুরি-করে-পাওয়া ছুটির সদ্‌ব্যবহার তিনি কী করে করতেন, তার বর্ণনা দিয়েছেন জীবনস্মৃতি-তে। দেবেন্দ্রনাথ কিশোরীনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়ে হিমালয় অঞ্চলেই বাস করছিলেন, সেখান থেকে দীর্ঘদিন পরে জোড়াসাঁকোয় ফেরেন পৌষ ১২৮১ [Dec 1874]-র প্রথম সপ্তাহে। সুতরাং বাহির-বাড়ির তেতলায় তাঁর বসবাসের ঘর বন্ধই থাকত। স্কুল-পালানো বালক সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে খড়খড়ির ফাঁকে হাত গলিয়ে ছিটকিনি টেনে দরজা খুলতেন এবং ঘরের দক্ষিণপ্রান্তে একটি সোফার উপরে চুপ করে বসে মধ্যাহ্ন কাটাতেন। ‘একে তো অনেক দিনের বন্ধ-করা ঘর, নিষিদ্ধপ্রবেশ, সে-ঘরে যেন একটা রহস্যের ঘন গন্ধ ছিল। তাহার পরে সম্মুখের জনশূন্য খোলা ছাদের উপর রৌদ্র ঝাঁ ঝাঁ করিত, তাহাতেও মনটাকে উদাস করিয়া দিত।’১৪ ছেলেবেলা থেকেই মধ্যাহ্নের এই রূপটি তাঁর মনকে আকর্ষণ করেছে—‘ও যেন দিনের বেলাকার রাত্তির, বালক সন্ন্যাসীর বিবাগি হয়ে যাবার সময়।’১৫ এ ছাড়া অন্য আকর্ষণও ছিল। দেবেন্দ্রনাথের এই শোবার ঘরের সংলগ্ন ছিল একটি স্নানের ঘর—তৈরি হয়েছিল 1871-এর প্রথম দিকে এবং ঐ বছরেরই শেষের দিকে বা 1872-এর প্রথমে পলতা ওয়াটার ওয়ার্কসের পাঠানো জলের পাইপ থেকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে জল সরবরাহের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হয়। সুতরাং ‘সেই জলের কলের সত্যযুগে আমার পিতার স্নানের ঘরে তেতালাতেও জল পাওয়া যাইত। ঝাঁঝরি খুলিয়া দিয়া অকালে মনের সাধ মিটাইয়া স্নান করিতাম। সে-স্নান আরামের জন্য নহে, কেবলমাত্র ইচ্ছাটাকে লাগাম ছাড়িয়া দিবার জন্য। একদিকে মুক্তি, আর-একদিকে বন্ধনের আশঙ্কা, এই দুইয়ে মিলিয়া কোম্পানির কলের জলের ধারা আমার মনের মধ্যে পুলকশর বর্ষণ করিত।’১৪ রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গটির কোনো সময় নির্দেশ করেননি, কিন্তু আমাদের ধারণা এটি বর্তমান বৎসরেরই ঘটনা।

বাহির-বাড়ির তেতালার ছাদ যেমন তাঁর মধ্যাহ্ন-অবকাশযাপনের জায়গা ছিল, ভিতর-বাড়ির ছাদও কখনো-কখনো তেমন কাজে ব্যবহৃত হত। এটি ছিল আগাগোড়া মেয়েদের দখলে—বড়ি দেওয়া, আমসি শুকোনো, ইঁচড়ের আচার ও আমসত্ত তৈরির জায়গা। ‘শীতের কাঁচা রৌদ্রে ছাদে বসে গল্প করতে করতে কাক তাড়াবার আর সময় কাটাবার একটা দায় ছিল মেয়েদের। বাড়িতে আমি ছিলুম একমাত্র দেওর, বউদিদির [কাদম্বরী দেবী] আমসত্ত পাহারা, তা ছাড়া আরও পাঁচরকম খুচরা কাজের সাথি। পড়ে শোনাতুম ‘বঙ্গাধিপ পরাজয়।’* কখনো কখনো আমার উপরে ভার পড়ত জাঁতি দিয়ে সুপুরি কাটবার। খুব সরু করে সুপুরি কাটতে পারতুম। আমার অন্য কোনো গুণ যে ছিল, সে কথা কিছুতেই বউঠাকরুন মানতেন না, এমন-কি চেহারারও খুঁত ধরে বিধাতার উপর রাগ ধরিয়ে দিতেন। কিন্তু আমার সুপুরি-কাটা হাতের গুণ বাড়িয়ে বলতে মুখে বাধত না। তাতে সুপুরি কাটার কাজটা চলত খুব দৌড়বেগে।’১৬

এই সময়ের একটি কাব্যরসসম্ভোগের স্মৃতি রবীন্দ্রনাথ সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। সেটি হল বড়োদাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ রচনা। তিনি তখন দোতালায় দক্ষিণের বারান্দায় বিছানা পেতে সামনে একটি ডেস্ক নিয়ে এই কাব্যরচনায় ব্যাপৃত। তাঁর কবিকল্পনার প্রচুর প্রাণশক্তিতে তিনি যতটা প্রয়োজন তার চেয়ে লিখতেন অনেক বেশি। ফলে এত লেখা তিনি ফেলে দিতেন, যেগুলি কুড়িয়ে রাখলে বঙ্গসাহিত্যের একটা সাজি ভরে তোলা যেত। সেই কাব্যরসের ভোজে রবীন্দ্রনাথের মতো বালকেরাও বঞ্চিত হতেন না। এই কাব্যের রচনা ও আলোচনার হাওয়ার মধ্যেই ছিলেন বলে তার সৌন্দর্য তাঁর হৃদয়ের তন্ত্রীতে জড়িত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের রচনায় এই কাব্যের প্রভাবের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম। জীবনস্মৃতি-র প্রথম পাণ্ডুলিপিতে তিনি লিখেছিলেন: ‘বড়দাদার আশ্চর্য্য ভাষা, তাঁহার বিচিত্র ছন্দ, তাঁহার ছবিতে ভরা পাকা হাতের রচনা আমার মত বালকের অনুকরণ চেষ্টারও অতীত ছিল। আশ্চর্য্য এই যে স্বপ্নপ্রয়াণ বারম্বার শুনিয়া তাহার বহুতর স্থান আমার মুখস্থ হইয়া গিয়াছিল এবং উহা যে একটি অত্যাশ্চর্য্য কাব্য তাহাতেও আমার সন্দেহ ছিল না—তথাপি আমার লেখায় তাঁহার নকল ওঠে নাই।’১৭

কিন্তু এসব সত্ত্বেও, হিমালয়-প্রত্যাগত বালক রবীন্দ্রনাথ যে অকস্মাৎ সকলের কাছে মূল্যবান হয়ে উঠেছিলেন, স্কুলের পড়াশুনোর নমুনা সেই মূল্য বেশিদিন রক্ষা করতে দিল না। যদিও রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘পাস-করা ভদ্রলোকের ছাঁচে ছেলেদের ঢালাই করতেই হবে, এ কথাটা তখনকার দিনের মুরুব্বিরা তেমন জোরের সঙ্গে ভাবেন নি। সেকালে কলেজি বিদ্যার একই বেড়াজালে ধনী অধনী সকলকেই টেনে আনবার তাগিদ ছিল না। আমাদরে বংশে তখন ধন ছিল না কিন্তু নাম ছিল, তাই রীতিটা টিকে গিয়েছিল। লেখাপড়ার গরজটা ছিল ঢিলে’১৮—তবু অভিভাবকদের পক্ষে একেবারে হাল ছেড়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না। ‘একদিন বড়দিদি কহিলেন, “আমরা সকলেই আশা করিয়াছিলাম বড়ো হইলে রবি মানুষের মতো হইবে কিন্তু তাহার আশাই সকলের চেয়ে নষ্ট হইয়া গেল”।’১৯ তাই নিতান্ত অকালে দু’বছরেরও কম সময়ের মধ্যে Dec 1873-তে বেঙ্গল অ্যাকাডেমি-র পর্ব সমাপ্ত হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, এর পর তাঁদের সেন্ট জেভিয়ার্সে ভর্তি করে দেওগা হল। সজনীকান্ত দাস সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের খাতাপত্র অনুসন্ধান করে লিখেছেন: ‘১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দের খাতাপত্র কলেজ হইতে খোয়া গিয়াছে, তবে ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দের খাতায় নূতন ভর্তি হওয়ার সংবাদ না থাকাতে মনে হয়, তিনি ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দেই ভর্তি হইয়াছিলেন।২০ কিন্তু অনুমানটি যথার্থ নয়। ক্যাশবহি-তে ১৬ মাঘ [বুধ 28 Jan 1874] তারিখের একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে:

‘সোম রবি সত্ত্যপ্রসাদবাবু—

দিগের বিদ্যাসাগরের ইস্কুলে—

ভোরতি হওয়ায় ফি—

গুঃ সত্তপ্রসাদবাবু ও সোবারাম সীং—

বিঃ ৩ বিল——-৯৲

ডিবজিট———-৯৲

—————-

————১৮৲

—সংবাদটি আমাদের বিস্মিত করে। বেঙ্গল অ্যাকাডেমি ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ পর্বের মধ্যে ‘বিদ্যাসাগরের ইস্কুলে’ অর্থাৎ মেট্রোপলিটান স্কুলে ভর্তি হবার কথা রবীন্দ্র-রচনায় কোথাও উল্লিখিত হয়নি বা অন্য কোনো সূত্রেও আমাদের জানা ছিল না। এই স্কুলের শিক্ষক রামসর্বস্ব পণ্ডিত [ভট্টাচার্য, বিদ্যাভূষণ] এক সময়ে রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত শিক্ষার ভার নিয়েছিলেন ও তাঁর সঙ্গে ম্যাকবেথের অনুবাদ শোনাবার জন্য রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরের কাছে গিয়েছিলেন কিংবা পরবর্তীকালে স্কুলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্রজনাথ দে বালকদের গৃহ-শিক্ষকতার কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন, এসব সংবাদ আমরা জানি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথেরা কোনোদিন সেই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন, এই তথ্যটি একেবারেই অজানা ছিল।

শুধু ভর্তি হওয়াই নয়, বেশ-কিছু বই কেনার হিসাব পাওয়া যাচ্ছে পরের দিন অর্থাৎ ১৭ মাঘ [বৃহ 29 Jan] তারিখে: ‘সোম রবি সত্ত্যপ্রসাদবাবুর/পুস্তক ক্রয়—/ডগলস সিরিজ [Progressive English Reading Senes] ৪ খান পইটিকেল/সিলেকসন ৪ খান হাইলিষ [Hiley’s?] গ্রামার /৩ খান উইলসেন ইটিমলোজি [Wilson’s Etymology] ৩ খান/আউট লাইসন অব মডরেন জিওগ্রাফি [Outlines of Modern Geography] /পাটমালা ৪ খান/ গুঃ রবিন্দ্রনাথবাবু/বিঃ ১ বৌচর ১৭৸৵°। এই বইগুলি নিশ্চয়ই মেট্রোপলিটান স্কুলের পাঠ্যতালিকা অনুযায়ী কেনা হয়েছিল [তিনজন ছাত্রের জন্য কোনো-কোনো বই চারখানা করে কেনা হয়েছে, একটি সম্ভবত গৃহশিক্ষকের ব্যবহারের জন্য]। এর আগের মাসেও বই কেনার হিসাব পাওয়া যায় ৩ পৌষ [বুধ 17 Dec] তারিখে: ‘সোম রবিবাবুর টড হণ্ডার মেটিরি [Todhunter’s Geometry?] ৩ খান ৫।০/সত্ত্যপ্রসাদবাবুর আলজাপরা বিগীন [Beginner’s Algebra?] ১ খান ১।০’—এগুলি কি বেঙ্গল অ্যাকাডেমির জন্যে?

কিন্তু নতুন স্কুলে ভর্তি হলেও কোনোদিন তাঁরা স্কুলে গিয়েছিলেন, এমন সংবাদ অন্তত ক্যাশবহি থেকে পাওয়া যায় না। [অন্যান্য স্কুলের বেলায় ঘরের গাড়ি থাকা সত্ত্বেও মাঝে মাঝেই গাড়ি ভাড়া, পালকি ভাড়া ইত্যাদির জন্য খরচ দেখা যায়, কিন্তু বর্তমান ক্ষেত্রে এমন কোনো ব্যয়ের নিদর্শন পাওয়া যায় না।] বরং তাঁরা স্কুলে না গিয়ে বাড়িতেই পড়াশুনো করতেন এমন ধারণা হয় জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে লেখা দ্বিজেন্দ্রনাথের ২৫ মাঘ [শুক্র 6 Feb] তারিখের একটি পত্র থেকে: ‘জ্যোতি/স্কুলে বালকেরা টেঁকিতে পারিল না। আমি দুই প্রহর হইতে ৪টা পর্য্যন্ত এবং পণ্ডিত সকাল বেলায় তাহাদিগকে পড়াইতেছি—ছেন। তাহাদের স্কুল অপেক্ষা ভাল পড়া হইতেছে/শ্রীদ্বিজেন্দ্রনাথ শৰ্ম্মণ’২১ [এই সময়ে জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁহদের গৃহশিক্ষক, ‘পণ্ডিত’ বলতে কি তাঁকেই বোঝানো হয়েছে? জীবনস্মৃতি-র ‘তথ্যপঞ্জী’তে জিজ্ঞাসা-চিহ্ন দিয়ে ‘রামসর্বস্ব’ পণ্ডিতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে২২ কিন্তু সেটি ঠিক নয়, কারণ তাঁকে ২৪ কার্তিক ১২৮১ থেকে নিয়োগ করা হয়]। গুণেন্দ্রনাথকে লিখিত [তারিখহীন] একটি পত্রে তিনি লিখেছেন, ‘… বালকদিগকে আমি যে প্রণালীতে পড়াইতেছি তাহাতে যদি জমিদারী কাছারির কার্য্যে মনোযোগ দিবার পক্ষে কিঞ্চিৎ ব্যাঘাত হয়, তথাপি সেই অল্প ক্ষতি স্বীকার করিয়াও আমি প্রত্যহ তাহাদিগকে রীতিমত পড়াইতেছি। …শ্রীযুক্ত কর্ত্তা মহাশয়কেও লিখিয়াছি তিনি কি আদেশ করেন তাহারও প্রতীক্ষা করিতেছি। সে দিন বিদ্যাসাগরের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া স্কুল বিষয়ে কথোপকথন করাতে তিনি আমার শিক্ষা প্রণালীর সম্পূর্ণ অনুমোদন করিলেন।…’২৩ বালকদের শিক্ষাদান-ব্যাপারে তিনি কতটা উৎসাহিত হয়ে উঠেছিলেন তার একটি প্রমাণ, স্কুলের পূর্বোক্ত পাঠ্যতালিকা-ভুক্ত বইগুলি তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি; ২৪ মাঘ ‘রবীবাবু ও সোমবাবুদিগের পুস্তক ক্রয় জন্য বড়বাবু মহাশয় নিজে নিউমেন কো° বাটী [এসপ্লানেডে অবস্থিত এক সময়ের বিখ্যাত বিদেশী পুস্তক-বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান] গমন করেন’। দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁর প্রবর্তিত শিক্ষা প্রণালীতে বালকদের কত দিন পড়িয়েছিলেন এবং তার ফল কী দাঁড়িয়েছিল, সে-সম্পর্কে আমরা আর কিছুই জানতে পারিনি। তবে পরবর্তী বৎসর অর্থাৎ ১২৮১ বঙ্গাব্দের শুরু থেকেই তাঁদের শিক্ষার জন্য অন্য ধরনের বন্দোবস্ত হয়েছিল, সে-প্রসঙ্গ আমরা যথাস্থানে আলোচনা করব।

জোড়াসাঁকোর বাড়িতে রায়পুরের শ্রীকণ্ঠ সিংহের আবির্ভাবের উল্লেখ আমরা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে করেছি। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রকৃত পরিচয়ের সূত্রপাত বর্তমান বৎসরে। শ্ৰীকণ্ঠ সিংহ গত বৎসর মাঘ মাসে যখন জোড়াসাঁকো বাড়িতে বাস করতে আসেন, তখন রবীন্দ্রনাথ উপনয়ন ও তৎপরবর্তী হিমালয়যাত্রার আয়োজনে উত্তেজিত, সুতরাং এই বৃদ্ধের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হওয়ার সুযোগ তাঁর ছিল না। হিমালয় থেকে ফিরে এসেও শ্রীকণ্ঠ সিংহকে তিনি সম্ভবত বাড়িতে পাননি, কারণ এই সময়ের হিসাবপত্রে তাঁর কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। তাঁর সাক্ষাৎ আমরা আবার পাই ৮ ফাল্গুন [বৃহ 18 Feb 1874] তারিখের হিসাবে: ‘ছেলেবাবুদিগের ও শ্ৰীকণ্ঠবাবুর বালীগঞ্জে বেড়াইতে জাতাতের গাড়িভাড়া…. ২৲’ ও পুনশ্চ ১২ চৈত্র [মঙ্গল 24 Mar] ‘শ্রীকণ্ঠবাবু ও রবীবাবুদিগরের হেদুয়ার নিকট বেড়াইতে জাতাতের গাড়ি ভাড়া…১৷৷°৴’। এর থেকেই বোঝা যায়, বালকদের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা ইতিমধ্যে যথেষ্ট পরিমাণেই বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তিনি তাঁদের সঙ্গী হয়ে কলকাতার কখনো উত্তরে কখনো দক্ষিণে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ এঁর একটি অপূর্ব ভাষাচিত্র অঙ্কন করেছেন, যা থেকে তাঁর অন্তর ও বাহিরের রূপটি আমাদের সামনে উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয়: ‘বৃদ্ধ একেবারে সুপক্ক বোম্বাই আমটির মতো—অম্লরসের আভাসমাত্রবর্জিত—তাঁহার স্বভাবের কোথাও এতটুকু আঁশও ছিল না। মাথা-ভরা টাক, গোঁফদাড়ি-কামানো স্নিগ্ধ মধুর মুখ, মুখবিবরের মধ্যে দন্তের কোনো বালাই ছিল না [শ্রীকণ্ঠবাবুর দাঁত বাঁধাবার জন্য ১৭৫ টাকা ব্যয়ের কথা আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি], বড়ো বড়ো দুই চক্ষু অবিরাম হাস্যে সমুজ্জ্বল। তাঁহার স্বাভাবিক ভারী গলায় যখন কথা কহিতেন তখন তাঁহার সমস্ত হাত মুখ চোখ কথা কহিতে থাকিত।… তাঁহার বামপার্শ্বের নিত্যসঙ্গিনী ছিল একটি গুড়গুড়ি, কোলে কোলে সর্বদাই ফিরিত একটি সেতার, এবং কণ্ঠে গানের আর বিশ্রাম ছিল না।’২৪

জীবনস্মৃতি-র ‘রবীন্দ্র-রচনাবলী’ সংস্করণে [১৭শ খণ্ড] “শ্রীকণ্ঠ সিংহ ও ‘আমরা তিনটি বালক’ ” চিত্র-পরিচয় সমন্বিত ইন্দিরা দেবীর সৌজন্যে প্রাপ্ত একটি আলোকচিত্রে উপবিষ্ট শ্ৰীকণ্ঠ সিংহের সঙ্গে দণ্ডায়মান রবীন্দ্রনাথ, সোমেন্দ্রনাথ ও সত্যপ্রসাদকে দেখা যায়। চিত্রটিতে সংশয়চিহ্ন-সহযোগে ‘১৮৭৩’ সালটি নির্দেশ করা হলেও, আমাদের ধারণা চিত্রটি বর্তমান সময়ে অর্থাৎ 1874-এর কোনো সময়ে তোলা। এই ছবি-তোলার ঘটনাটি রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে বর্ণনা করেছেন। শ্রীকণ্ঠ সিংহ একদিন তাঁর তিনজন বালকসঙ্গীকে নিয়ে এক ইংরেজ ফোটোগ্রাফারের দোকানে ছবি তোলাতে গিয়েছিলেন। তখনকার দিনে আলোকচিত্র গ্রহণের ব্যয় খুব কম ছিল না। কিন্তু শ্ৰীকণ্ঠ সিংহ সাহেবের সঙ্গে হিন্দি ও বাংলাতে আলাপ জমিয়ে অত্যন্ত পরিচিত আত্মীয়ের মতো জবরদস্তি করে তাঁকে দিয়ে সস্তায় ছবি তুলিয়ে নিলেন। ‘কড়া ইংরেজের দোকানে তাঁহার মুখে এমনতরো অসংগত অনুরোধ যে কিছুমাত্র অশোভন শোনাইল না, তাহার কারণ সকল মানুষের সঙ্গেই তাঁহার সম্বন্ধটি স্বভাবত নিষ্কণ্টক ছিল—তিনি কাহারও সম্বন্ধেই সংকোচ রাখিতেন না, কেননা তাঁহার মধ্যে সংকোচের কারণই ছিল না।’২৫

ছবিটি সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য একটি তথ্য উদ্ধার করেছেন সিদ্ধার্থ ঘোষ। রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত মূল আলোকচিত্রটি [RFr. 238, F48] দেখে তিনি লিখেছেন:

ফোটোগ্রাফটি যে ৩ নং ওয়াটার্লু স্ট্রিটে তোলা হয়েছিল, এটি সম্ভবত তার একমাত্র সাক্ষী।

মাউন্ট বোর্ডে সাঁটা ফোটোগ্রাফটির তলায় লেখা আছে ‘ক্যাবিনেট পোট্রেট’। ৪ ইঞ্চি x ৫ ১/২ ইঞ্চি মাপের শক্ত বোর্ডে সাঁটা ফোটোগ্রাফকে তখন এই নামেই অভিহিত করা হতো। মাউন্ট বোর্ডের উল্টো পিঠে ছাপা রয়েছে স্টুডিওর পরিচয়—

Artists in Photography

WESTFIELD & COY.

3, Waterloo Street.

Calcutta.২৬

গান সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ শ্রীকণ্ঠ সিংহের প্রিয়শিষ্য ছিলেন। তাঁর একটি প্রিয় গান ‘ময়্‌ ছোড়োঁ ব্রজকি বাসরী’ রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে সকলকে শোনাবার জন্য তিনি তাঁকে ঘরে ঘরে টেনে নিয়ে বেড়াতেন। বালক গান ধরতেন, তিনি সেতারে ঝংকার দিতেন এবং গানের প্রধান ঝোঁক ‘ময় ছোড়োঁ’তে এসে পৌঁছলে তিনি নিজেও যোগ দিতেন ও ‘অশ্রান্তভাবে সেটা ফিরিয়া ফিরিয়া আবৃত্তি করিতেন এবং মাথা নাড়িয়া মুগ্ধদৃষ্টিতে সকলের মুখের দিকে চাহিয়া যেন সকলকে ঠেলা দিয়া ভালোলাগায় উৎসাহিত করিয়া তুলিতে চেষ্টা করিতেন।’২৫16 Jul 1920 [মঙ্গল ৪ শ্রাবণ ১৩২৭] দ্বিজেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে লণ্ডনে রবীন্দ্রনাথকে লিখিত এক পত্রে এই দৃশ্য স্মরণ করেছেন, ‘… তোমাকে যখন আমি শ্ৰীকণ্ঠবাবুর ক্রোড়ে “ছোড় ব্রজকী বাঁশরী” কপচাইতে দেখিয়াছিলাম…”২৭—এই বর্ণনা যদি আক্ষরিকভাবে যথাযথ হয়, তাহলে প্রসঙ্গটিকে বর্তমান কাল-সীমা থেকে একটু পিছিয়ে নিয়ে যাবার দরকার হবে। কারণ ১ আশ্বিন ১৭৯২ শক [১২৭৭ শুক্র 16 Sep 1870] দেবেন্দ্রনাথ ধর্মশালা থেকে শ্রীকণ্ঠ সিংহকে একটি পত্রে লেখেন: ‘মধ্যে আপনি কৃপা করিয়া আমাদের বাটীতে যাইয়া দ্বিজেন্দ্র ও হেমেন্দ্রকে যে উৎসাহ ও আনন্দ প্রদান করিয়া আসিয়াছিলেন, ইহা শ্রবণে আমি পরম সন্তোষ লাভ করিলাম।’২৮ এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের বয়স নয় বৎসর পূর্ণ হয়েছে। ওই সময়ে যদি এই সুকণ্ঠ বালকটিকে তিনি প্রিয়শিষ্য করে নিয়ে থাকেন, তাহলে তাঁদের ঘনিষ্ঠতার ইতিহাস আরো পুরোনো বলে ধরে নিতে হবে। কিন্তু সম্ভবত তার প্রয়োজন নেই।

বঙ্গদর্শন পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষের দশম সংখ্যা মাঘ ১২৮০-তে ৪৫৬-৫৮ পৃষ্ঠায় অস্বাক্ষরিত ২২টি শ্লোকে নিবদ্ধ ‘ভারত-ভূমি’ নামে একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। টীকায় লিখিত হয়: ‘এই কবিতাটি এক চতুর্দ্দশ বর্ষীয় বালকের রচিত বলিয়া আমরা গ্রহণ করিয়াছি। কোন/কোন স্থানে, অল্পমাত্র সংশোধন করিয়াছি। এবং কোন কোন অংশ পরিত্যাগ করিয়াছি। /বং সম্পাদক’। বিষয়টি সম্পর্কে প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ড সুকুমার সেন তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের কথা’ [৩য় সং, ১৩৪৯] গ্রন্থের ‘বিজ্ঞাপন’-এ [ পৃ ১৵°- ১।°]। ড সেন তাঁর অনুমানের সপক্ষে বলেছিলেন, কবিতাটির মধ্যে ঘরে পণ্ডিতের কাছে পড়া মেঘনাদবধকাব্য-এর কিছু প্রভাব আছে ও ‘সে সময়ে বালক রবীন্দ্রনাথের কবিতার বিষয় ছিল প্রধানতঃ patriotism বা দেশানুরাগ, এবং ভাব ছিল বিষাদময়’—এই লক্ষণগুলিও কবিতাটিতে দেখা যায়। তাছাড়া তিনি বলেন, বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাসূত্রে বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথই কনিষ্ঠের কবিতাটি তাঁকে প্রকাশার্থ দিয়েছিলেন এবং ‘কবিতাটির রচনারীতি বালক রবীন্দ্রনাথের রচনা-রীতির অনুরূপ। বিশেষতঃ যে কালে কবিতাটি প্রকাশিত হইয়াছিল সেকালে চৌদ্দ বছরের আর কোন কবির কলম হইতে

“যবে দুই ফুলবালা গলে ধরি করে খেলা

দোলাইয়া যায় যদি মলয় পবন;”

অথবা

“জ্বলিতে চন্দ্রের ছায়া নদীর উপরি”

এমন ছত্র বাহির হওয়া অসম্ভব ছিল। কিশোর রবীন্দ্রনাথের রচনাকে “ফুলবালা”র যুগ বলিয়া নির্দিষ্ট করা যায়।’

ড কালিদাস নাগ তাঁর ‘রবীন্দ্রসাহিত্যের আদিপর্ব্ব’ [প্রবাসী, ফাল্গুন ১৩৪৯] প্রবন্ধে কবিতাটির পুনর্মুদ্রণ করে মন্তব্য করেন, ‘“ভারতভূমি” কাঁচা রচনা হলেও কাব্যসরস্বতীর পাদপীঠে শিশু রবীন্দ্রনাথের কচি হাতের প্রথম আল্‌পনা।’ ‘কিন্তু বড়দাদা রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন নিশ্চিত ভাবে বার বছর জেনে বঙ্কিমের মন্তব্যে “চতুর্দ্দশ বর্ষীয় বালকে”র রচনা কি ক’রে ছাপালেন সেটা বোঝা যায় না’—এই সংশয় প্রকাশ করেও ড নাগ উল্লেখ করেছেন যে, বয়সের তুলনায় রবীন্দ্রনাথকে যে বড়ো দেখাত পিতার সঙ্গে অমৃতসর যাত্রার সময় ট্রেনে যে ঘটনাটি ঘটেছিল সেটিই তার প্রমাণ, সুতরাং বারো বছরের বালককে চতুর্দশবর্ষীয় মনে করার সেটিও একটি কারণ হতে পারে।

ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বহু পূর্ব থেকেই সজনীকান্ত দাসের সহযোগিতায় রবীন্দ্রনাথের রচনাপঞ্জী তৈরি করার কাজে লিপ্ত ছিলেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, তত্ত্ববোধিনী, অগ্রহায়ণ ১৭৯৬ শক [১২৮১] সংখ্যায় প্রকাশিত ‘অভিলাষ’ কবিতাটিই রবীন্দ্রনাথের প্রথম মুদ্রিত রচনা। সুতরাং ব্রজেন্দ্রনাথ প্রবাসী, বৈশাখ ১৩৫০ [পৃ ৩৬] সংখ্যায় ‘আলোচনা/ “রবীন্দ্রনাথের প্রথম মুদ্রিত কবিতা”—শীর্ষক প্রসঙ্গে ড সেন ও ড নাগের অভিমতের প্রতিবাদ করলেন। তাঁর এই রচনাটিই কিছুটা পরিবর্তিত আকারে ‘রবীন্দ্র-গ্রন্থ-পরিচয়’ [‘পরিবর্ত্তিত ও পরিবর্দ্ধিত দ্বিতীয় সং—১০ মাঘ ১৩৫০’; ১ম সং-২ পৌষ ১৩৪৯] পুস্তিকায় [পৃ ৭১-৭৪] প্রকাশিত হয়। এখানে তিনি ড সেনের অনুমান-এর বিপক্ষে দুটি যুক্তি দেন। তিনি লেখেন, ‘এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের বয়স বারো বৎসর সাত মাস,… সাড়ে বারো বৎসরের বালককে বঙ্কিমচন্দ্র “চতুর্দ্দশ বর্ষীয়” বলিয়া উল্লেখ করিবেন—ইহা কষ্টকল্পনা।’ দ্বিতীয় যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন যে, বঙ্গদর্শন সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে অত্যন্ত সশ্রদ্ধ মনোভাব প্রকাশ করেছেন, এ-হেন বঙ্গদর্শন-এ তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হলে তিনি নিশ্চয়ই সে-কথা কোথাও উল্লেখ করতেন। এর পর তিনি বলেন, কবিতাটি বঙ্কিমচন্দ্রের দাদা সঞ্জীবচন্দ্রের পুত্র জ্যোতিশ্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘প্রথম রচনা’, একথা তিনি জ্যোতিশ্চন্দ্রের স্বহস্তলিখিত ডায়ারি পাঠ করে জানতে পেরেছেন। ডায়ারির ১৬ পৃষ্ঠায় ‘মৎকর্ত্তৃক লিখিত কবিতাবলী’-র প্রথমেই ‘ভারতভূমি’-র উল্লেখ করেছেন এবং বিভিন্ন পত্রিকায় স্বনামে বেনামে বা নাম না দিয়ে লিখিত কবিতার তালিকাতেও ‘anonymous’ আখ্যা দিয়ে এই কবিতাটিকে প্রথম স্থান দিয়েছেন। ডায়ারিতে প্রদত্ত তাঁর জন্মতারিখ ‘১ জানুয়ারি ১৮৬০’ অনুযায়ী কবিতাটি প্রকাশের সময়ে তাঁর বয়স পূর্ণ চৌদ্দ বৎসর, সুতরাং সেদিক দিয়েও বঙ্গদর্শন-এ প্রদত্ত তথ্যের সঙ্গে মেলে। এইসব তথ্য দিয়ে ব্রজেন্দ্রনাথ প্রায় চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন, ‘জ্যোতিশ্চন্দ্রের অন্যতম পুত্র শ্ৰীযুক্ত শতঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের নিকট তাঁহার পিতার ডায়ারিগুলি আছে; যে কেহ ইচ্ছা করিলে উহা দেখিতে পারেন।’

দীর্ঘদিন পরে সুশান্তকুমার মিত্র ‘রবীন্দ্রনাথের সর্বপ্রথম রচনা’-শীর্ষক পুস্তিকায় [আশ্বিন ১৩৮২]* বিষয়টির পুনরালোচনার সূত্রপাত করেন। তাঁর আলোচনার সর্বাধিক মূল্যবান অংশ একটি আবিষ্কার—১৭ মাঘ ১২৮০ [বৃহ 29 Jan 1874] তারিখে অমৃতবাজার পত্রিকা-য় প্রকাশিত সম্পাদক শিশিরকুমার ঘোষ-লিখিত ‘মাভৈঃ শীর্ষক একটি সম্পাদকীয় প্রবন্ধ যাতে আলোচ্য ‘ভারতভূমি’ কবিতাটির ১, ২, ৩, ৪, ৬, ৯, ১০ ও ১২ সংখ্যক স্তবকগুলি উদ্ধৃত করেন এবং লেখেন: ‘মাঘ মাসের বঙ্গদর্শনে একটি কবিতা পাঠে আমাদের অনেক আশার সঞ্চার হইল। এই কবিতাটী একটী চতুর্দ্দশ বর্ষ বালকের রচিত। আমরা বোধহয় এই বালকটিকে চিনি।’

সুশান্তকুমারের বক্তব্য, ‘আমরা বোধহয় এই বালকটিকে চিনি’ এই কথা লিখে শিশিরকুমার ঘোষ রবীন্দ্রনাথকেই ইঙ্গিত করেছেন, কারণ ঠাকুর-পরিবারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল, সে-তুলনায় নৈহাটিতে বসবাসকারী বালক জ্যোতিষচন্দ্রকে চেনার সুযোগ অনেক কম ছিল—বিশেষ করে বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক যখন যথেষ্ট মধুর ছিল না। এছাড়া তিনি ব্রজেন্দ্রনাথ-কথিত জ্যোতিষচন্দ্রের ডায়ারিকে ‘অলীক’ আখ্যা দিয়ে নানা বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ তথ্য বিচার করে ‘ভারতভূমি’ কবিতা যে রবীন্দ্রনাথেরই লেখা—জ্যোতিষচন্দ্রের নয়—প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছেন। সমস্ত যুক্তি-তর্কের বর্ণনা ও বিশ্লেষণে যাবার প্রয়োজন নেই, উৎসাহী পাঠক পুস্তিকাটি এবং এ-সম্পর্কে ড সংঘমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্রসাহিত্যে আদিপর্ব’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা [পৃ ১০৮-২১] দেখে নিতে পারেন। এই যুক্তি-পরম্পরাঅনুসরণ করে আমরাও পূর্বে কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের লেখা বলে সিদ্ধান্ত করেছিলাম। পরে মহানগর পত্রিকার Jul 1982 সংখ্যায় গোপালচন্দ্র রায় ‘ভারতভূমি কবিতার রচয়িতা কে?’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে কবিতাটি যে বঙ্কিমচন্দ্রের ভ্রাতুষ্পুত্র জ্যোতিশ্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা, রবীন্দ্রনাথের নয়, প্রমাণ করার জন্য বিভিন্ন যুক্তি-তথ্যের সমাবেশ করেন; পরে এই বিষয়টিই পরিবর্ধিত আকারে তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথের ছাত্রজীবন’ [পৃ ৮৯-১১৬] গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। এখানে তিনি অন্যান্য প্রমাণের সঙ্গে লিখেছেন:

বঙ্কিমচন্দ্রের বন্ধুপুত্র (সাবজজ দিগম্বর বিশ্বাসের পুত্র) ও বিশেষ স্নেহভাজন এবং জ্যোতিশেরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু…তারকনাথ বিশ্বাস বহুকাল আগে জ্যোতিশের জীবিত কালেই তাঁর ‘বঙ্কিমবাবুর জীবন কথা’ গ্রন্থে লিখেছেন—‘…তাঁহার (বঙ্কিমচন্দ্রের) ভ্রাতুষ্পুত্র আমার প্রিয় সুহৃদ শ্রীযুক্ত জ্যোতিশ্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়…বাল্যে বিশেষ মেধাবী ছাত্র ছিল। বঙ্গদর্শনে তাহার চতুর্দশ বর্ষকালে লিখিত একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। তখনকার দিনে তাহার বড় আদর হইয়াছিল।’

১৩২৬ সালে হিতবাদী কার্যালয় থেকে প্রকশিত ‘তারকনাথ গ্রন্থাবলী’ ৩য় খণ্ডের ২৫৭ পৃষ্ঠায় এই কথাগুলি লেখা আছে।২৯

বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদে রক্ষিত গ্রন্থটির একটি কপির সঙ্গে আমরা উক্ত পাঠ মিলিয়ে দেখেছি, সেখানে ঠিক ঐ কথাগুলিই আছে। সুতরাং আমাদের পূর্বমত পরিবর্তন করতে কোনো দ্বিধা নেই—কবিতাটি জ্যোতিশ্চন্দ্রেরই রচনা, রবীন্দ্রনাথের নয়।

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ১

বর্তমান বৎসরে জোড়াসাঁকো ঠাকুরপরিবারের সম্বন্ধে কতকগুলি উল্লেখযোগ্য প্রসঙ্গ এখানে সংকলিত হল।

জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি [May 1873] দ্বিজেন্দ্রনাথের সপ্তম সন্তান ও পঞ্চম পুত্র কৃতীন্দ্রনাথের জন্ম হয়।

পৌষ মাসের প্রথম দিকে [Dec 1873] বর্ণকুমারী দেবীর দ্বিতীয় পুত্র প্রমোদনাথ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম হয়। ক্যাশবহি থেকে জানা যায়, ২৬ পৌষ পুত্রের জাতকর্ম উপলক্ষে ব্রাহ্মসমাজে ৪ টাকা দান করা হয়।

১৫ পৌষ [সোম 29 Dec 1873] বোম্বাই প্রদেশের বিজাপুরের অন্তর্গত কালাদ্‌গিতে সত্যেন্দ্রনাথের একমাত্র কন্যা ইন্দিরা দেবীর জন্ম হয়। এই সময়ে সত্যেন্দ্রনাথ সেখানে সিনিয়র অ্যাসিস্টান্ট জজ ও সেসন্স জজ (অস্থায়ী) হিসেবে কর্মরত। বলেন্দ্রনাথ তাঁর রাশিচক্রের খাতায় ইন্দিরা দেবীর জন্মসময়, রাশি, নক্ষত্র ইত্যাদি এইভাবে লিখে রেখেছিলেন: ‘১৭৯৫। ৮। ১৪। ৩৪। ২৮। ৩০ সোমবার, শিত পক্ষ, একাদশী। ইং ৮। ৩০ সময় রাত্রি, ভরণী মেষ রাশি; শুক্রের দশা ভোগ্য’। মাতা জ্ঞানদানন্দিনী কন্যার জন্ম-সম্পর্কে বলেছেন: ‘সে সময় আমার খুব অসুখ করেছিল ও একজন মেম খুব যত্ন করেছিল মনে আছে। তাই আমার মেয়েকে এক মুসলমানী দাইয়ের দুধ খেতে হয়েছিল তার নাম আমিনা। … পশ্চিমের হিন্দুস্থানী চাকর-দাসী ছোট ছেলেমেয়েদের বলে বিবি, তাই থেকে আমার মেয়েকে আজ পর্যন্ত আপনার লোক সকলে বিবি বলেই ডাকে।’৩০ সত্যেন্দ্রনাথ কয়েকমাস পরে ১৬ চৈত্র [শনি 28 Mar 1874] দুমাসের ছুটি নিয়ে সপরিবারে কলকাতায় আসেন, শিশুকন্যা ইন্দিরার বয়স তখন ঠিক তিন মাস।

ইন্দিরা দেবীর জন্মের পনেরো দিন পরে [? ১ মাঘ ১২৮০ মঙ্গল 13 Jan 1874] হেমেন্দ্রনাথের ষষ্ঠ সন্তান ও তৃতীয়া কন্যা অভিজ্ঞার জন্ম হয়। ইন্দিরা দেবী লিখেছেন: ‘অভি আমার চেয়ে মোটে পনেরো দিনের ছোটো ছিল’ [রবীন্দ্রস্মৃতি। ২৮] এবং সেই কারণেই অভিজ্ঞা তাঁকে ‘বোনদিদি’ বলে ডাকতেন।

১৮ ফাল্গুন [রবি 1 Mar 1874] রবীন্দ্রনাথের ভাবী-পত্নী ভবতারিণী [মৃণালিনী] দেবীর জন্ম হয়। পূৰ্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘কবিপত্নী-মৃণালিনী’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘তাঁর সঠিক জন্ম তারিখের উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায় না। তবে সম্প্রতি মৃণালিনী দেবীর ভ্রাতা নগেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরীর পুত্র বিশ্বভারতীর জনসংযোগ বিভাগের কর্মী শ্রীধীরেন্দ্রনাথ [বীরেন্দ্রনাথ] রায়চৌধুরী জানিয়েছেন মৃণালিনী দেবী ১২৮০ সালের ১৮ ফাল্গুন (১ মার্চ ১৮৭৪) জন্মগ্রহণ করেন।’৩১

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ২

১১ মাঘ শুক্রবার 23 Jan 1874 আদি ব্রাহ্মসমাজের চতুশ্চত্বারিংশ সাংবৎসরিক অনুষ্ঠিত হয়। এবারেও সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ সংগীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-র বিবরণে দেখা যায়, ‘প্রাতঃকালে আদি ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে বালকদিগের সুমধুর ব্রহ্ম-সঙ্গীত সহকৃত অর্চ্চনাদি স্বাধ্যায়ান্ত ব্রহ্মোপাসনা সমাপ্ত হইলে শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বেদীর সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া…বক্তৃতা করিলেন।’ [তত্ত্ববোধিনী, ফাল্গুন। ২১৪] এই বালকদিগের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ অন্তর্ভুক্ত হওয়াই স্বাভাবিক। বেচারাম চট্টোপাধ্যায়ও এই অধিবেশনে বক্তৃতা করেন।

‘সায়ংকালে শ্রীযুক্ত প্রধান আচাৰ্য মহাশয়ের ভবনে সঙ্গীতাদি স্বাধ্যায়ান্ত উপাসনা হইলে পর শ্রীযুক্ত সীতানাথ ঘোষ বেদীর সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া…বক্তৃতা করিলেন।’ [ঐ। ২২০] রাজনারায়ণ বসু অতঃপর বক্তৃতা করেন।

উভয় অনুষ্ঠানে নিম্নলিখিত ব্রহ্মসংগীতগুলি গীত হয়:

আলাইয়া—একতালা। দেহ জ্ঞান—দিব্য জ্ঞান [দেবেন্দ্রনাথ]

আসোয়ারি—ঝাঁপতাল। জাগো সকল অমৃতের অধিকারী [দ্বিজেন্দ্রনাথ]

আলাইয়া-কাওয়ালী। অন্তরতর অন্তরতম তিনি যে [জ্যোতিরিন্দ্রনাথ]

গৌড় সারঙ্গ—চৌতাল। প্রেমময় সে যে, তাঁরে দেখ, হৃদয়ে রাখ,

” — ”। ভূমা, অনন্ত, জগ-জীবন,

দেশকার—ঝাঁপতাল। হে দেব পরসাদ দেও হে ভকত হৃদয়ে, [জ্যোতিরিন্দ্রনাথ]

কেদারা—চৌতাল। কি অনুপম তোমার আনন্দ মূরতি হে নাথ;

বেহাগ—সুর ফাঁকতাল। পরব্রহ্ম সত্য সনাতন [জ্যোতিরিন্দ্রনাথ]

দেশ মল্লার—ঝাঁপতাল। হরি তোমা-বিনা কেমনে এ ভবে জীবন ধরি [ঐ]

—তত্ত্ববোধিনী, ফাল্গুন ১৭৯৫ শক। ২২৭-২৮

এর মধ্যে তৃতীয় গানটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি জড়িত হয়ে আছে। তিনি লিখেছেন: “ইহারই [শ্রীকণ্ঠ সিংহ] দেওয়া হিন্দিগান হইতে ভাঙা একটি ব্রহ্মসংগীত আছে—‘অন্তরতর অন্তরতম তিনি যে—ভুলো না রে তাঁয়।’ এই গানটি তিনি পিতৃদেবকে শোনাইতে শোনাইতে আবেগে চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইতেন। সেতারে ঘন ঘন ঝংকার দিয়া একবার বলিতেন—‘অন্তরতর অন্তরতম তিনি যে’—আবার পালটাইয়া লইয়া তাঁহার মুখের সম্মুখে হাত নাড়িয়া বলিতেন—‘অন্তরতর অন্তরতম তুমি যে।”’৩২ এই ঘটনা নিশ্চয়ই অনেক পরবর্তী কালের, কারণ অগ্রহায়ণ ১২৮১-র পূর্বে দেবেন্দ্রনাথের পশ্চিম ভারতে অবস্থান-হেতু তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগই ছিল না—কিন্তু এর মধ্যে দেবেন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর ভক্তির লক্ষণটি খুব স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছে, যার মধ্যে ‘তিনি’ ও ‘তুমি’র ভেদ লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। মাঘোৎসবের প্রাতঃকালীন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ অন্তত এই গানটিতে কণ্ঠদান করেছিলেন এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে, কারণ শ্ৰীকণ্ঠ সিংহের সাহচর্যে মূল হিন্দি গানটি ও তার রূপান্তর তাঁর আয়ত্তে থাকাই স্বাভাবিক।

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৩

এই বৎসর মাঘ সংক্রান্তি [৩০ মাঘ বুধ 11 Feb 1874] থেকে ৪ ফাল্গুন [রবি 15 Feb] পর্যন্ত সারকুলার রোডে পার্সিবাগানে [‘মৃজাপুর ৮২ নং অপর সারকুলার রোড’] হিন্দুমেলা বা জাতীয় মেলার অষ্টম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। অন্যান্য বার কলকাতার বাইরে কোনো উদ্যানে এই মেলার আয়োজন করা হত। কিন্তু শহরের অভ্যন্তরে এত দীর্ঘকালব্যাপী মেলার অনুষ্ঠান এই প্রথম। প্রবেশ-দক্ষিণার প্রবর্তনও এইবারের মেলার বৈশিষ্ট্য। ভারত সংস্কারক পত্রিকায় লিখিত হয়েছিল: ‘রবিবার মেলা দর্শন জন্য৷৷° আনা করিয়া টিকিট হইয়াছে, ইহাতে যে আয় হইবে, তাহার কিয়দংশ দুর্ভিক্ষের সাহায্যার্থে প্রদত্ত হইবে।’ [১। ৪৩, ২ ফাল্গুন। ৫০৫] পরের সংখ্যায় ঐ পত্রিকা লেখে: ‘দুঃখের বিষয় কলিকাতার নিকটে হইয়াও এ বৎসর লোক সমাগম অল্পতর হইয়াছিল। অনেকে বলেন আনার প্রবেশ টিকিট না করিলে ভাল হইত।’ [পৃ ৫১৮] সোমপ্রকাশ পত্রিকা-ও [১৬। ১৪, ৫ ফাল্গুন] প্রবেশদক্ষিণা-প্রবর্তনের সমালোচনা করে। প্রথম দিন অপরাহ্নে জাতীয় সভার সাংবৎসরিক অধিবেশনে রাজা কমলকৃষ্ণ দেব সভাপতি; রাজা চন্দ্রনাথ রায়, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রাজনারায়ণ বসু সহকারী সভাপতি; নবগোপাল মিত্র ও প্রাণনাথ পণ্ডিত সম্পাদক এবং ভুজেন্দ্রভূষণ চট্টোপাধ্যায় ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সংশ্লিষ্ট সম্পাদক নির্বাচিত হন। শুক্রবার জাতীয় বিদ্যালয়ের ছাত্রদের পারিতোষিক বিতরণ করা হয়। শনিবার অমৃতবাজার-সম্পাদক শিশিরকুমার ঘোষ ‘বর্তমান দুর্ভিক্ষ ও তন্নিবারণের উপায়’ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। রবিবার মেলার প্রধান দিবসে দ্বিজেন্দ্রনাথ সভাপতিত্ব করেন। মধ্যস্থ-সম্পাদক মনোমোহন বসু জাতীয় ভাব ও জাতীয় অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে দীর্ঘ বক্তৃতা করেন। এই দিন শস্য ও শিল্প প্রদর্শনী, ‘বেদের ভেল্‌কি, সাপ-খেলানো, ভালুক-লড়াই প্রভৃতি তামাসা’, ব্যায়াম কুস্তি প্রভৃতি এবং আতসবাজি প্রদর্শিত হয়। জাতীয় নাট্যশালা নাটক অভিনয় করে, তবে এর জন্য স্বতন্ত্র এক টাকার টিকিট হয়েছিল।

এই অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ কোনো সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন বা উপস্থিত ছিলেন এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না, অথচ এই সময়ে তিনি যখন মেটেবুরুজের মেলা, চিরানিজ সার্কাস প্রভৃতি দেখতে গিয়েছেন, সেখানে হিন্দুমেলায় উপস্থিত না থাকা অস্বাভাবিক বলে মনে হতে পারে।

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৪

বাংলা সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রনাথের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ রূপক-কাব্য [18 Oct 1875: ২ কার্তিক ১২৮২]। প্রথম যৌবনে ‘মেঘদূত’-এর পদ্যানুবাদ [1860] ও কিছু খণ্ড কবিতা রচনার পর তিনি তত্ত্ব-লোকে প্রয়াণ করেছিলেন। ‘তত্ত্ববিদ্যা’ গ্রহের চারটি খণ্ড [1866, 1867, 1868, 1869] এই তত্ত্ব-বৃক্ষের ফল, সুযোগ-সন্ধানী ছাড়া সেই ফল আস্বাদন করার লোকের অভাব ছিল। [‘একটি সঙ্গী বড়দাদার জুটেছিলেন, তাঁর নাম জানি নে, তাঁকে সবাই ডাকত ফিলজফার ব’লে। অন্য দাদারা তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করতেন কেবল তাঁর মটনচপের ’পরে লোভ নিয়ে নয়, দিনের পর দিন তাঁর নানা রকমের জরুরি দরকার নিয়ে।’৩৩ —রবীন্দ্রনাথের ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ প্রহসনের বৈকুণ্ঠ ও কেদার চরিত্র দুটির উৎস এখানেই পাওয়া যায়। এছাড়া তাঁর শখ ছিল গণিতের সমস্যা বানানোয়, বিলিতি বাঁশি বাজিয়ে ‘অঙ্ক দিয়ে এক-এক রাগিণীতে গানের সুর মেপে’৩৩ নেওয়ায়। পরবর্তীকালে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল গাণিতিক সূত্র দিয়ে কাগজের বাক্স বানানোর শাস্ত্র ‘বক্সোমেট্রি’ ও বাংলা শর্টহ্যান্ড ‘রেখাক্ষর-বর্ণমালা’।৩৪ বর্তমানে ১২৭৯-র চৈত্র মাসে বোম্বাই থেকে ফেরার পর তিনি আবার কাব্য রচনায় মন দিলেন। দার্শনিক ও গাণিতিক দ্বিজেন্দ্রনাথের কাব্যরচনা অন্যান্য কবিদের পদ্ধতিতে সম্পন্ন হতে পারে না। তাই গোড়ায় শুরু হল কাব্যের উপযোগী ছন্দ বানানো। তার জন্যে ‘সংস্কৃত ভাষার ধ্বনিকে বাংলা ভাষার ধ্বনির বাটখারায় ওজন করে’৩৩ সাজিয়ে তুললেন, যার অনেকগুলিই তিনি রক্ষা করেননি, দু-একটি ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ কাব্যে আছে, কয়েকটি সংকলিত হয়েছে পরে অন্যত্র। ছন্দোরচনার পর শুরু করলেন কাব্য রচনা করতে। যা লিখতেন তা সহজে পছন্দ হত না, সুতরাং লেখার যতটা রক্ষা করতেন, ফেলে দিতেন তার বেশি—‘বসন্তে আমের বোল যেমন অকালে অজস্র ঝরিয়া পড়িয়া গাছের তলা ছাইয়া ফেলে, তেমনি স্বপ্ন-প্রয়াণের কত পরিত্যক্ত পত্র বাড়িময় ছড়াছড়ি যাইত তাহার ঠিকানা নাই।’৩৫ গুণেন্দ্রনাথ ও অন্যেরা দক্ষিণের বারান্দায় তাঁর পাশে জড়ো হতেন, তিনি যেমন লিখতেন সকলকে শুনিয়ে যেতেন ও তাঁর ঘন ঘন উচ্চহাস্যে বারান্দা কেঁপে উঠত—‘সেই হাসির ঝোঁকের মাথায় কেউ যদি হাতের কাছে থাকত তাকে চাপড়িয়ে অস্থির করে তুলতেন।’৩৬

স্বপ্নপ্রয়াণ-এর প্রথম সর্গ ‘মনোরাজ্য প্রয়াণ’ বঙ্গদর্শন-এর শ্রাবণ সংখ্যায় [পৃ ১৮৪-৮৭] প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় অতঃপর আর-কোনো সর্গ প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু প্রাণনাথ দত্ত সম্পাদিত রহস্য সন্দর্ভ পত্রিকার ‘নবপৰ্ব্বাবলী’ পর্যায়ের প্রথম পর্ব, পঞ্চম খণ্ডে [? ভাদ্র ১২৮০] ৭২-৭৪ পৃষ্ঠায় পুনরায় ‘স্বপ্নপ্রয়াণ/প্রথম সর্গ/ মনোরাজ্যপ্রয়াণ’ মুদ্রিত হয় ও তৎসঙ্গে ৭৪-৮১ পৃষ্ঠায় এই কাব্যের দ্বিতীয় সর্গ ‘বিলাসপুর প্রয়াণ’ প্রকাশিত হয়। বাকি সর্গগুলি কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল কিনা জানা যায় না। অল্পকালের ব্যবধানে দুটি পত্রিকায় প্রথম সর্গটি দুবার প্রকাশের কারণটি রহস্যাবৃত। দ্বিজেন্দ্রনাথ স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গে বলেছেন: “আমি যখন প্রথম ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ রচনা করিতে আরম্ভ করি, তাহার কোনও কোনও অংশ বঙ্কিমবাবুকে পাঠাইয়াছিলাম, তাঁহার ‘বঙ্গদর্শনে’ প্রকাশ করিবার জন্য।… আমার পুস্তকে কতকগুলো কাল্পনিক ছবির সমাবেশ ছিল। বঙ্কিমবাবু বোধ হয় সেগুলো ছাপান নাই, এক-আধটা ছাপাইয়াছিলেন কি না আমার স্মরণ নাই। কিন্তু তাঁহার ‘বিষবৃক্ষের’ মধ্যে ঠিক সেই রকম ছবির অবতারণা করিয়া বসিলেন।’৩৭ দ্বিজেন্দ্রনাথের উক্তি থেকে মনে হতে পারে, বঙ্কিমচন্দ্র ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’-এর প্রথম সর্গটি যথাযথ ছাপেননি বলেই হয়তো তিনি ‘রহস্য সন্দর্ভ’-তে সেটি পুনর্মুদ্রিত করেন। কিন্তু দুটি পত্রিকার পাঠ মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে উভয়ের পার্থক্য খুবই নগণ্য অর্থাৎ বঙ্কিমচন্দ্র কিছুই বর্জন বা পরিবর্তন করেননি। মুদ্রিত গ্রন্থে যে পার্থক্য দেখা যায় সেটি পরবর্তীকালে দ্বিজেন্দ্রনাথই করেছিলেন এবং প্রথম সংস্করণে যেটুকু পাঠান্তর দেখা যায় তা খুবই সামান্য। আর উক্তিটির দ্বিতীয় অংশ সম্পর্কে বলা যায়, বিষবৃক্ষ ১২৭৯ বঙ্গাব্দের বৈশাখ-ফাল্গুন সংখ্যা বঙ্গদর্শন-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়ে ‘স্বপ্নপ্রয়াণ-প্রথম সর্গ’ প্রকাশের পূর্বেই 1 Jun 1873 গ্রন্থাকারে প্রচারিত হয়েছিল। সুতরাং বিষবৃক্ষের উপর উক্ত কাব্যের কোনোরকম প্রভাব না পড়ারই কথা। মনে হয়, এব্যাপারে দ্বিজেন্দ্রনাথের স্মৃতি তাঁকে বিভ্রান্ত করেছিল।

প্রসঙ্গক্রমে আর একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। কেউ কেউ বলেছেন,* এই সময়ে দ্বিজেন্দ্রনাথ ও বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দিয়েছিল। কিসের ভিত্তিতে এমন ধারণা করা হয়েছে সে-কথা কেউ উল্লেখ করেননি। ৬ বৈশাখ ১২৮১ তারিখে জোড়াসাঁকোয় ‘বিদ্বজ্জন সমাগম’-এর যে প্রতিবেদন ভারত সংস্কারক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, যদিও তাতে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের তালিকায় বঙ্কিমচন্দ্রের নাম ছিল না, তবু পরবর্তীকালের বঙ্কিমচন্দ্র বেশ কয়েকবার ঠাকুরবাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলেন, এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই।

এই বৎসরে আর-একটি কাব্য প্রকাশিত হয়, রবীন্দ্রনাথের কৈশোরক কবি-জীবনে যার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। সেটি হল অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর লেখা ‘উদাসিনী’ গাথা-কাব্য [9 Feb 1874: সোম ২৮ মাঘ] অক্ষয় চৌধুরী [1850—5.9.1898] ঠাকুরবাড়ির ‘ধর্মপাঠশালা’য় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। ১২৭৪ বঙ্গাব্দের চৈত্র-সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত চৈত্রমেলা [হিন্দুমেলা]-য় তিনি ‘ভারত’ নামে একটি কবিতা পাঠ করেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথও ঐ অনুষ্ঠানে ‘উদ্বোধন’ নামে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন। পরেও জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তাঁর গতায়াত অব্যাহত ছিল। সংগীত ও সাহিত্যচর্চায় দুই বন্ধুর ক্লান্তি ছিল না। অক্ষয়চন্দ্র ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ.। সেই সাহিত্যে তাঁর শুধু অধিকার ছিল না, অনুরাগও ছিল। অপর দিকে বাংলা সাহিত্যের বৈষ্ণব পদাবলি, কবিকঙ্কণ, রামপ্রসাদ, ভারতচন্দ্র প্রভৃতি মধ্যযুগীয় অংশের সঙ্গে প্রাক-আধুনিক যুগের হরুঠাকুর, রামবসু, নিধুবাবু, শ্রীধর কথক প্রভৃতি কবিওয়ালাদের রচনার প্রতিও তাঁর আগ্রহের অভাব ছিল না। বাংলা বহু উদ্ভট গান তাঁর মুখস্থ ছিল, সেগুলি তিনি মরিয়া হয়ে সুরে-বেসুরে গেয়ে যেতেন। শ্রোতারা আপত্তি করলেও তাঁর উৎসাহ ক্ষুন্ন হত না। সঙ্গে সঙ্গে তাল দেবার জন্যে টেবিল, বই যা কিছু সামনে পেতেন, তাকেই কাজে লাগাতেন। ‘আনন্দ উপভোগ করিবার শক্তি ইঁহার অসামান্য উদার ছিল। প্রাণ ভরিয়া রসগ্রহণ করিতে ইঁহার কোনো বাধা ছিল না এবং মন খুলিয়া গুণগান করিবার বেলায় ইনি কার্পণ্য করিতে জানিতেন না।’৩৮ গান ও কবিতা তিনি অসামান্য ক্ষিপ্রতায় রচনা করতে পারতেন, অথচ সেগুলি সম্পর্কে তাঁর কোনো মমত্ব ছিল না। এদিক দিয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য ছিল, অবশ্য তিনি দার্শনিক ছিলেন না।

‘উদাসিনী’ [‘কলিকাতা বাল্মীকি যন্ত্রে মুদ্রিত। সংবৎ ১৯৩০। মূল্য এক টাকা’, পৃ ১০৮] গ্রন্থকারের নাম ছাড়াই প্রকাশিত হয়। বাংলা সাহিত্যের এই প্রথম উল্লেখযোগ্য রোম্যান্টিক গাথা-কাব্যটি অলিভার গোল্‌ডস্মিথ [1724-78]-এর Edwina and Angelina বা Hermit অবলম্বনে লিখিত। এই কাব্যের ভাষা, ছন্দ ও আদর্শ রবীন্দ্রনাথের কৈশোরক কাব্য ও গাথাগুলিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। সোমপ্রকাশ [১৬। ১৬, ১৯ ফাল্গুন], ভারত সংস্কারক [১। ৪, ২৩ ফাল্গুন], বঙ্গদর্শন [জ্যৈষ্ঠ ১২৮১] প্রভৃতি সমসাময়িক পত্রিকাগুলিতে কাব্যটি উচ্চ-প্রশংসিত হয়।

এই বৎসর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ উড়িষ্যার জমিদারি পরিদর্শন করার জন্য মাঘ ও ফাল্গুন মাসে কিছুদিন [Feb 1874] কটকে অবস্থান করেন। এই সময়েই তিনি তাঁর প্রথম ঐতিহাসিক নাটক ‘পুরুবিক্রম’ রচনা করেন। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বলেছেন: ‘জমিদারী পরিদর্শন উপলক্ষ্যে একবার গুনুদাদার সঙ্গে আমাকে কটক যাইতে হইয়াছিল। হিন্দুমেলার পর হইতে, কেবলই আমার মনে হইত—কি উপায়ে দেশের প্রতি লোকের অনুরাগ ও স্বদেশ-প্রীতি উদ্বোধিত হইতে পারে। শেষে স্থির করিলাম, নাটকে ঐতিহাসিক বীরত্ব-গাথা ও ভারতের গৌরবকাহিনী কীৰ্ত্তন করিলে, হয়ত কতকটা উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইলেও হইতে পারে। এই ভাবে অনুপ্রাণিত হইয়া, কটকে থাকিতে থাকিতেই, আমি “পুরু-বিক্রম” নাটকখানি রচনা করিয়া ফেলিলাম।’৩৯ ভ্রাতার এই নাট্যরচনার সংবাদ পেয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথ কটকে অবস্থানরত গুণেন্দ্রনাথকে লেখেন: ‘… জ্যোতির নাটক কিরূপ হইয়াছে দেখিবার জন্য আগ্রহান্বিত আছি।’ নাটকটি কয়েক মাস পরে 9 Jul 1874 [২৬ আষাঢ় ১২৮১] তারিখে প্রকাশিত হয়:‘পুরুবিক্রম নাটক।/ “অভিভূতিভয়াদসূনতঃ।/ মুখমুজ্‌ঝন্তি ন ধাম মানিনঃ ॥”/ কিরাতার্জ্জুনীয়ম।/ কলিকাতা/ বাল্মীকি যন্ত্রে/ শ্রীকালীকিঙ্কর চক্ৰবৰ্ত্তি কর্তৃক/মুদ্রিত।/ শকাব্দা ১৭৯৬।’ এক টাকা দামের ১৫০ পৃষ্ঠার বইটি উৎসর্গীকৃত হয়েছিল গুণেন্দ্রনাথকে: ‘সোদর-সদৃশ/শ্রীযুক্ত বাবু গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর/ভ্রাতৃবরেষু।/ভ্রাতঃ।/ আপনার করে আমার এই যত্ন-সঞ্চিত ক্ষুদ্র প্রণয়ো-/পহার সাদরে অর্পণ করিলাম।’ সত্যেন্দ্রনাথ-কৃত বিখ্যাত জাতীয় সংগীত ‘মিলে সবে ভারত-সন্তান’ নাটকটিতে উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্য ব্যবহৃত হয়। পরবর্তী সংস্করণে [1879] কিশোর রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন’ গানটি নাটকে সংযুক্ত হয়, সে-প্রসঙ্গ আমরা যথাস্থানে আলোচনা করব।

প্রাসঙ্গিক তথ্যঃ ৫

রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে তাঁদের ইংরেজি পড়ানোর গৃহশিক্ষক অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় সম্বন্ধে লিখেছেন যে, তাঁর স্বাস্থ্য এমন অন্যায় রকম ভালো ছিল যে ছাত্রদের একান্ত কামনা সত্ত্বেও তাঁকে একদিনও কামাই করতে হয়নি, ‘কেবল একবার যখন মেডিকেল কলেজের ফিরিঙ্গি ছাত্রদের সঙ্গে বাঙালি ছাত্রদের লড়াই হইয়াছিল, সেইসময় শত্রুদল চৌকি ছুঁড়িয়া তাঁহার মাথা ভাঙিয়াছিল।’৪০ আমরা আগেই দেখেছি, অঘোরনাথ ১২৭৭ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসে পনেরো দিন কামাই করে ছাত্রদের ‘একান্ত মনের কামনা’ পূরণ করেছিলেন, কিন্তু তার কারণটি আর যাই হোক এই ধরনের মাথা ফাটাফাটির ব্যাপার নিশ্চয় ছিল না, থাকলে সংবাদপত্রে তার বিবরণ পাওয়া যেত। প্রকৃতপক্ষে ঘটনাটি ঘটেছিল বর্তমান বৎসরের ৭ শ্রাবণ [সোম 21 Jul 1873] তারিখে এবং সবচেয়ে কৌতুকের বিষয় এই যে, রবীন্দ্রনাথ তখন তাঁর ছাত্র ছিলেন না—তার আগেই জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্যের কাছে হস্তান্তরিত হয়ে গিয়েছিলেন এবং এই ঘটনায় অঘোরনাথ যদি মাথা ফাটিয়ে শয্যাগ্রহণে বাধ্য হয়েও থাকেন, তার জন্যে তাঁর কোনো বেতন কাটা যায়নি, পরের মাসে তিনি পুরো বেতনই পেয়েছেন।

সোমপ্রকাশ-এ ১৪ শ্রাবণ [28 Jul, ১৫। ৩৭] সংখ্যায় ‘সংবাদ’ স্তম্ভে দেখা যায়: ‘গত সোমবার কলিকাতা মেডিকাল কালেজের মিলিটারি ক্লাশের ইউরোপীয় ছাত্রদিগের সহিত ইংরাজী ক্লাশের বাঙ্গালি ছাত্রদিগের ঘোরতর দাঙ্গা হইয়া গিয়াছে। বাঙ্গালি ছাত্রেরা যে পড়িয়া মার খাইয়াছেন তাহা বলা বাহুল্য।‘ ঐ একই তারিখে প্রকাশিত একটি ‘প্রেরিত’ পত্রে [পৃ ৫৮৮-৮৯] ঘটনাটির বিবরণ এই ভাবে দেওয়া হয়েছে: ‘… গত কল্য মেডিকেল কলেজের গ্যালারীতে কেমেস্ট্রীর লেকচারের সময় মিলিটারি ক্লাসের ছাত্রদিগের সহিত বাঙ্গালী ছাত্র দিগের ভয়ানক দাঙ্গা হইয়া গিয়াছে। মিলিটারী ক্লাসের জনৈক ছাত্র স্বীয় সঙ্গীর নিমিত্ত পার্শ্বস্থ স্থান নির্দ্দিষ্ট করিয়া রাখিয়াছিল। একজন বাঙ্গালী ছাত্র সেই স্থান অধিকার করাতে দাঙ্গা উপস্থিত হয়। দাঙ্গার প্রারম্ভে ম্যাকনামারা [কেমিস্ট্রির অধ্যাপক] উপস্থিত ছিলেন না। এই দাঙ্গাতে কএকজন বাঙ্গালী ছাত্র গুরুতর রূপে আহত হইয়াছে। অদ্য এতন্নিবন্ধন মহা গোলযোগ উপস্থিত। মিলিটারী ক্লাসের ছাত্রগণ কালেজ স্ট্রীটে সমবেত হইয়া রাস্তায় যাহাকে পাইতেছে, তাহাকেই প্রহার করিতেছে। হিন্দু ও হেয়ার স্কুলের দুই জন ছাত্র এই রূপ প্রহৃত হওয়াতে উক্ত স্কুলদ্বয়ের সমস্ত ছাত্র দলবদ্ধ হইয়া মিলিটারী ক্লাসের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থিত হইয়াছে। লাঠি ইহাদিগের প্রধান শস্ত্র। পুলিষ যথোচিতরূপে গোলযোগ নিবারণে সমর্থিত হইতেছে না। কালেজ স্ট্রীট দিয়া লোক যাতায়াত প্রায় বন্ধ হইয়াছে।…’ ‘শ্ৰীঃ—’ স্বাক্ষরিত এই পত্রের তারিখটি—‘সম্বৎ ১৯২৯/৭ই শ্রাবণ’—অবশ্য ভুল; কারণ মূল ঘটনার পরের দিনে পত্রটি লেখা হয়েছে। The Bengalee [Vol. XII, No. 30, Jul 26] Indian Minor-এর সংবাদ অবলম্বনে কলেজ স্ট্রিটের ঘটনাটির বিবরণ দিয়ে লেখে, ‘… the squabble in the Medical College assumed a serious aspect on Tųesday last. There was quite a scene in College Street. The European students of the Apothecary class desperately carried their depredations in the streets, and assaulted almost everybody they came across. The native pupils who were threatened kept away in a body from the Hospital and the College.’

রবীন্দ্রনাথের মনে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত দুটি ঘটনা কিভাবে সংমিশ্রিত হয়ে জীবনস্মৃতি-তে প্রকাশিত হয়েছে, এই দৃষ্টান্তটি তার একটি উপভোগ্য নিদর্শন।

লক্ষণীয়, এই ঘটনার পরই ৭ আশ্বিন [সোম 22 Sep] তারিখের সোমপ্রকাশ-এ সংবাদ প্রকাশিত হয়: ‘মেডিকাল কলেজের ছাত্র সংখ্যা ১৪০০ হওয়াতে লেপ্টনান্ট গবর্ণর বাঙ্গালা ক্লাসগুলি শিয়ালদহে স্থাপন করিয়াছেন।’ তখন সেখানে Municipal Pauper Hospital অবস্থিত ছিল। ছোটলাট স্যার জর্জ ক্যাম্বেলের নামে এই নূতন প্রতিষ্ঠানের নাম হয় ‘ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুল।’ ডাঃ স্যার নীলরতন সরকারের নামানুসারে বর্তমানে এর নাম ‘নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ।’

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৬

এই বৎসরটি বাংলাদেশ ও সাহিত্যের পক্ষে একটি দুর্বৎসর। ১৬ আষাঢ় [রবি 29 Jun] অত্যন্ত দুঃখজনক অবস্থার মধ্যে কবি মধুসূদন দত্তের মৃত্যু হয় একটি দাতব্য চিকিৎসালয়ে। কিশোরী চাঁদ মিত্রের মৃত্যু হয় ২৩ শ্রাবণ [বুধ 6 Aug]। আদি ব্রাহ্মসমাজের প্রাক্তন উপাচার্য ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-র ভূতপূর্ব সম্পাদক অযোধ্যানাথ পাকড়াশীর মৃত্যু হয় ১৫ ভাদ্র [শনি 30 Aug] তারিখে।* ১৭ কার্তিক [শনি 1 Nov] তারিখের নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের মৃত্যু হয়। ১৫ ফাল্গুন. [বৃহ 26 Feb 1874] হাইকোর্টের অন্যতম বিচারপতি দ্বারকানাথ মিত্র পরলোকগমন করেন এবং রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের নেতা ও ‘সনাতন ধর্মরক্ষিণী সভা’র প্রতিষ্ঠাতা রাজা কালীকৃষ্ণ দেব ৩০ চৈত্র [শনি 11 Apr] মৃত্যুমুখে পতিত হন।

উল্লেখপঞ্জি

পত্রাবলী। ১০৫-০৬, পত্র ৭৬

জীবনস্মৃতি ১৭। ৩২০

ছেলেবেলা ২৬। ৬২৬

আশ্রমের রূপ ও বিকাশ ২৭। ৩৩৫

জীবনস্মৃতি ১৭। ৩১৯

বিশ্বপরিচয় ২৫। ৩৪৯

সজনীকান্ত দাস: রবীন্দ্রনাথ: জীবন ও সাহিত্য [সুবর্ণরেখা-সং, ১৩৯৫]। ১৮৬

দ্র অমৃত, ১৮ আষাঢ় [পৃ ২৪-২৮] ও ২৫ আষাঢ় ১৩৮৩ [পৃ ৩৫-৩৬] সংখ্যা

দ্র ‘প্রথম গদ্যরচনা’ অধ্যায়, পৃ ৩১০-১৪

১০ জীবনস্মৃতি ১৭। ৩০১-০২

১১ ঐ ১৭। ৩২৪

১২ ঐ ১৭। ৩২৮

১৩ ঐ ১৭। ৩০৩

১৪ ঐ ১৭। ২৭২

১৫ ছেলেবেলা ২৬। ৬১২

১৬ ঐ ২৬। ৬১০-১১

১৭ দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৪

১৮ ছেলেবেলা ২৬। ৬২৯-৩০

১৯ জীবনস্মৃতি ১৭। ৩২৮

২০ ‘রবীনর-জীবনীর নূতন উপকরণ’: রবীন্দ্রনাথ: জীবন ও সাহিত্য। ৭৩

২১ Tagore Family Correspondences, Vol. 5, p. 83

২২ দ্র জীবনস্মৃতি [১৩৬৮]। ২৪৫, তথ্যপঞ্জী ৬০ ॥১

২৩ Tagore Family Correspondences, Vol. 5, p. 91

২৪ জীবনস্মৃতি ১৭। ২৯৪

২৫ ঐ ১৭। ২৯৬

২৬ সিদ্ধার্থ ঘোষ: ছবি তোলা [1988]। ১৯১-৯২

২৭ জীবনস্মৃতি [১৩৬৮]। ১৬৪

২৮ পত্রাবলী। ২১৯, পত্র ১৪৩

২৯ রবীন্দ্রনাথের ছাত্রজীবন। ১০৭-০৮

৩০ পুরাতনী। ৩৬

৩১ দেশ, ৩২ শ্রাবণ ১৩৮১। ১৭৭

৩২ জীবনস্মৃতি ১৭। ২৯৬

৩৩ ছেলেবেলা ২৬। ৬২৫

৩৪ দ্র আমার বাল্যকথা ও আমার বোম্বাই প্রবাস। ২৩

৩৫ জীবনস্মৃতি ১৭। ৩৩৭

৩৬ ছেলেবেলা ২৬। ৬২৬

৩৬ বিপিনবিহারী গুপ্ত: পুরাতন প্রসঙ্গ [২য় বিদ্যাভারতী সং, ১৩৭৩]। ২৮৯

৩৮ জীবনস্মৃতি ১৭। ৩৩৯

৩৯ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি। ১৪১

৪০ জীবনস্মৃতি ১৭। ২৮৬

* ‘তিনি মধ্যে মধ্যে অন্তঃপুরে আসিয়া আমাদিগকে সরল ভাষায় জ্যোতিষ প্রভৃতি বিজ্ঞান শিক্ষা দিতেন। তিনি যাহা শিখাইতেন তাহা আমাদিগকে নিজের ভাষায় লিখিয়া তাঁহারই নিকট পরীক্ষা দিতে হইত।’—সাহিত্য-স্রোত, ‘স্বর্ণকুমারী ও বাংলা সাহিত্য’ [পৃ ৫৬] গ্রন্থে উদ্ধৃত।

* ‘তাঁহার তেতলার বসিবার ঘরে দিনকতক তিনি আধুনিক জ্যোতিষশাস্ত্র সম্বন্ধে আমাদিগকে ধারাবাহিকরূপে মৌখিক উপদেশ দিতে আরম্ভ করিলেন।’—প্রবাসী, মাঘ ১৩১৮।৩৮৭

* জীবনস্মৃতি ১৭।৩১৮; প্রথম পাণ্ডুলিপিতে এই অংশটি এইভাবে লিখিত হয়েছিল: ‘প্রক্টরের লিখিত সরল-পাঠ্য জ্যোতিষ গ্রন্থ হইতে তিনি আমাকে স্থানে স্থানে বুঝাইয়া দিতেন আমি তাহাই বাংলায় লিখিতাম। বাংলা ভাষায়, তখন আমার যতটা অধিকার ছিল ততটা তিনি আশাও করেন নাই।

* বিশ্বভারতীর কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে Richard A. Proctor-এর Half Hours with the Telescope ও Our Place among the Infinities বই দুটি আছে। প্রক্টরের লিখিত একটি গ্রন্থ Myths and Marvels of Astronomy [1878]-তে তাঁর পরিচয় দেওয়া হয়েছে এইভাবেঃ “Author of ‘Other World than Ours’, ‘The Expanse of Heaven’, ‘The I finities Around Us’, ‘The Sun’, ‘The Moon’, ‘The Universe’ etc.”

* জীবনস্মৃতি ১৭।৩২৭; বর্ণনাটি ডাকঘর [১৩১৮] নাটকের অমলকে মনে করিয়ে দেয়।

পত্রাবলী। ১০৭; জীবনস্মৃতি-র প্রথম পাণ্ডুলিপিতে কিন্তু সঠিক তথ্য নির্দেশিত হয়েছিল: ‘এইরূপে তিন মাস প্রবাসভ্রমণের পর পিতৃদেব তাঁহার অনুচর কিশোরী চাটুর্জের সঙ্গে আমাকে কলিকাতায় পাঠাইয়া দিলেন।’

* ‘বঙ্গাধিপ পরাজয়’ [প্রথম খণ্ড: ১৭৯১ শক, 1869; দ্বিতীয় খণ্ড: ১৮০৬ শক, 1884] প্রতাপচন্দ্র ঘোষ [1840-1921] কর্তৃক রাজা প্রতাপাদিত্যের জীবনকাহিনী অবলম্বনে রচিত সুবৃহৎ ঐতিহাসিক উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথ এখানে অবশ্য কেবল প্রথম খণ্ডটি পড়ার কথাই লিখেছেন।

* সাপ্তাহিক অমৃত পত্রিকায় ১৫ বর্ষ ৬-১০ সংখ্যা [20 Jun-18 Jul 1975]-তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত।

* ‘বিশেষতঃ বঙ্কিমের সঙ্গে দ্বিজেন্দ্রনাথের তো তার পূর্বেই মনোমালিন্য শুরু হয়েছিল।’—সংঘমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রসাহিত্যের আদিপর্ব [১৩৮৫]। ১১৩; শ্রীমতী বন্দ্যোপাধ্যায় এই উক্তির পাদটীকায় ‘সাহিত্য-সাধক চরিতমালা ৬। ৬৬ দ্বিজেন্দ্রনাথ’ গ্রন্থটির উল্লেখ করেছেন। সম্ভবত উপরে ‘পুরাতন প্রসঙ্গ’ থেকে যে উদ্ধৃতিটি আমরা তুলে দিয়েছি, সেটিই তাঁর সিদ্ধান্তের কারণ। কিন্তু ঐ উক্তিতে মনোমালিন্যের কোনো প্রসঙ্গ নেই। আর আমরা এই মাত্র আলোচনা করেছি বৃদ্ধ দ্বিজেন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণে এই অংশটিই ভ্রমাত্মক।

* এঁর মৃত্যু তারিখটি বিতর্কিত বিষয়। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা-য় [৯৫। ৩২] ভারত-সংস্কারক পত্রিকা-র অনুসরণে ১৩ ভাদ্র [28 Aug] তাঁর মৃত্যু তারিখ বলে উল্লেখ করেছেন। তত্ত্ববোধিনী, আশ্বিন সংখ্যায় লেখা হয় ‘১৬ ভাদ্র শনিবার’; ধর্ম্মতত্ত্ব [১৬ ভাদ্র] লেখে ‘বিগত শনিবার’ এবং সোমপ্রকাশ [১৫। ৪৩] পত্রিকায় লিখিত হয় ‘৩০ এ আগষ্ট শনিবার’। আমরা ‘শনিবার’ এই তথ্যটিকে গ্রহণ করে বর্তমান তারিখটি নির্দিষ্ট করেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *