১১. রবীন্দ্রজীবনের একাদশ বৎসর

একাদশ অধ্যায়
১২৭৮ [1871-72] ১৭৯৩ শক ॥ রবীন্দ্রজীবনের একাদশ বৎসর

১২৭৭ বঙ্গাব্দের পৌষ মাস [Jan 1871] থেকে রবীন্দ্রনাথের বিদ্যালয়জীবনে নর্মাল স্কুল পর্বের ষষ্ঠ বৎসরের সূচনা। রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে একটি ঘটনার বর্ণনা করেছেন: ‘ইস্কুলে আমি কোনোদিন প্রাইজ পাই নাই, একবার কেবল সচ্চরিত্রের পুরস্কার বলিয়া একখানা ছন্দোমালা বই পাইয়াছিলাম। আমাদের তিনজনের মধ্যে সত্যই পড়াশুনায় সেরা ছিল। সে কোনো-একবার পরীক্ষায় ভালোরূপ পাস করিয়া একটা প্রাইজ পাইয়াছিল। সেদিন ইস্কুল হইতে ফিরিয়া গাড়ি হইতে নামিয়াই দৌড়িয়া গুণদাদাকে খবর দিতে চলিলাম। তিনি বাগানে বসিয়া ছিলেন। আমি দূর হইতেই চীৎকার করিয়া ঘোষণা করিলাম, “গুণদাদা, সত্য প্রাইজ পাইয়াছে।” তিনি হাসিয়া আমাকে কাছে টানিয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি প্রাইজ পাও নাই?” আমি কহিলাম, “না, আমি পাই নাই, সত্য পাইয়াছে।” ইহাতে গুণদাদা ভারি খুশি হইলেন। এটি কোন্ বৎসরের ঘটনা রবীন্দ্রনাথ তা উল্লেখ করেননি। অবশ্যই 1868-এর পরের ঘটনা, কারণ উক্ত ‘ছন্দোমালা’ ঐ বৎসরই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। যাই হোক, বর্তমান শ্রেণীতে পড়ার জন্য আরও অনেক নূতন বই কেনার হিসাব ক্যাশবহি-তে পাওয়া যায়, কিন্তু কোনো পুস্তকের নাম না করে কেবল ‘পুস্তক খরিদ’ অভিধায় খরচ দেখানো হয়েছে বলে পাঠ্যসূচি সম্বন্ধে কোনো ধারণা করা মুশকিল।

নূতন শিক্ষাবর্ষের শুরুতে আর একটি জিনিস লক্ষ্য করা যায়, মাঘ ১২৭৭ [Jan-Feb 1871] থেকে ইংরেজি-শিক্ষক অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বেতন-বৃদ্ধি—এর আগে তিনি বেতন পেতেন মাসিক দশ টাকা, উক্ত মাস থেকে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় মাসিক পনেরো টাকা [অবশ্য নীলকমল ঘোষালের বেতন বাড়েনি]—এর কারণ হয়তো ছাত্ৰশ্রেণীতে দ্বিপেন্দ্রনাথের অন্তর্ভুক্তি। সম্ভবত এই সময়কার ইংরেজি-পাঠ সম্পর্কেই রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-র প্রথম পাণ্ডুলিপিতে লিখেছিলেন: ‘কিন্তু প্যারী সরকারের ফার্ষ্ট বুক সেকেণ্ড বুকের পরেই আমাদিগকে অতিব্যগ্রতাবশত এমন শক্ত ইংরাজি বই পড়ানো আরম্ভ হইল যে আমরা কোনোমতে দন্তস্ফুট করিতে পারিতাম না।’ মুদ্রিত গ্রন্থে বিষয়টি আরো স্পষ্ট: ‘প্যারি সরকারের প্রথম দ্বিতীয় ইংরেজি পাঠ কোনোমতে শেষ করিতেই আমাদিগকে মকলক্‌স্ কোর্স অফ রীডিং* শ্রেণীর একখানা পুস্তক ধরানো হইল। একে সন্ধ্যাবেলায় শরীর ক্লান্ত এবং মন অন্তঃপুরের দিকে, তাহার পরে সেই বইখানার মলাট কালো এবং মোটা, তাহার ভাষা শক্ত এবং তাহার বিষয়গুলির মধ্যে নিশ্চয়ই দয়ামায়া কিছুই ছিল না,…প্রত্যেক পাঠ্যবিষয়ের দেউড়িতেই থাকে-থাকে-সারবাঁধা সিলেবল্‌-ফাঁক-করা বানানগুলো অ্যাক্‌সেণ্ট-চিহ্নের তীক্ষ্ণ সঙিন উঁচাইয়া শিশুপালবধের জন্য কাওয়াজ করিতে থাকিত। ইংরেজি ভাষার এই পাষাণদুর্গে মাথা ঠুকিয়া আমরা কিছুতেই কিছু করিয়া উঠিতে পারিতাম না।’ সুতরাং যেমনি পড়া শুরু করতেন অমনি নিদ্রাকর্ষণের বেগে মাথা ঢুলে পড়ত। চোখে জল দিয়ে, বারান্দায় দৌড় করিয়ে কোনো স্থায়ী ফল পাওয়া যেত না। ‘এমনসময় বড়দাদা যদি দৈবাৎ স্কুলঘরের বারান্দা দিয়া যাইবার কালে আমাদের নিদ্রাকাতর অবস্থা দেখিতে পাইতেন তবে তখনই ছুটি দিয়া দিতেন। ইহার পরে ঘুম ভাঙিতে আর মুহূর্তকাল বিলম্ব হইত না।’

‘নানা বিদ্যার আয়োজন’-এর অন্তর্গত একটি শিক্ষার সূচনা বর্তমান বৎসরে হয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুলের একটি ছাত্রের কাছে কোনো-এক সময়ে অস্থিবিদ্যা শিখিতে আরম্ভ করিলাম। তার দিয়া জোড়া একটি নরকঙ্কাল কিনিয়া আনিয়া আমাদের ইস্কুলঘরে লটকাইয়া দেওয়া হইল।’ ছেলেবেলা-য় বিষয়টি তিনি এইভাবে বর্ণনা করেছেন: ‘কুস্তির আখড়া থেকে ফিরে এসে দেখি মেডিক্যাল কলেজের এক ছাত্র বসে আছেন মানুষের হাড় চেনাবার বিদ্যে শেখাবার জন্যে। দেয়ালে ঝুলছে আস্ত একটা কঙ্কাল। রাত্রে আমাদের শোবার ঘরের দেয়ালে এটা ঝুলত, হাওয়ায় নাড়া খেলে হাড়গুলো উঠত খট খট করে। তাদের নাড়াচাড়া করে করে হাড়গুলোর শক্ত শক্ত নাম সব জানা হয়েছিল, তাতেই ভয় গিয়েছিল ভেঙে।’ এই কঙ্কালের স্মৃতি পরবর্তীকালে লিখিত ‘কঙ্কাল’ গল্পের [দ্র সাধনা, ফাল্গুন ১২৯৮।২৮৭-৯৮; গল্পগুচ্ছ ১৬।৩২১-২৮] পটভূমিকা রচনা করেছে। আমাদের আলোচনার প্রয়োজনে ঐ গল্পের প্রাসঙ্গিক অংশটি উদ্ধৃত করছি: ‘আমরা তিন বাল্যসঙ্গী যে ঘরে শয়ন করিতাম, তাহার পাশের ঘরের দেয়ালে একটি আস্ত নরকঙ্কাল ঝুলানো থাকিত। রাত্রে বাতাসে তাহার হাড়গুলা খটখট শব্দ করিয়া নড়িত। দিনের বেলায় আমাদিগকে সেই হাড় নাড়িতে হইত। আমরা তখন পণ্ডিতমহাশয়ের নিকট মেঘনাদবধ এবং ক্যাম্বেল স্কুলের এক ছাত্রের কাছে অস্থিবিদ্যা পড়িতাম।’ ১২৭৮ সালের ক্যাশবহি-তে ১৬ পৌষ [শনি 30 Dec 1871] তারিখের হিসাবে দেখা যায় ‘ছেলেবাবুদিগের ডাক্তারি শিখিবার জন্য/হাড় খরিদ’ বাবদ ছ’টাকা দু’আনা ব্যয় হয়েছে। সুতরাং বোঝা যায় অস্থিবিদ্যা শিক্ষার ব্যাপারটি এই সময়কার; যদিও বেতন-গ্রহীতার তালিকা থেকে শিক্ষকটিকে শনাক্ত করা যায়নি। তাছাড়া উপরে যে তিনটি উদ্ধৃতি আমরা দিয়েছি, তাতে কতকগুলি বিষয়ে পার্থক্য ও অসংগতি লক্ষ্য করা যায়। জীবনস্মৃতি ও ‘কঙ্কাল’ গল্পের বর্ণনায় শিক্ষকটি ‘ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুল’-এর ছাত্র এবং ছেলেবেলা-র বর্ণনায় তিনি ‘মেডিক্যাল কলেজের এক ছাত্র’। আমাদের মতে, এ ক্ষেত্রে ছেলেবেলা-র বর্ণনাই গ্রহণযোগ্য, কারণ ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুল স্থাপিত হয় 1873-র সেপ্টেম্বর মাসে। তার আগে মেডিকেল কলেজে ইংরেজি, বাংলা ও মিলিটারি [এই ক্লাসে শিক্ষার মাধ্যম ছিল উর্দু]—এই তিনটি বিভাগ ছিল। ৭ আশ্বিন ১২৮০ [22 Sep 1873] তারিখের সোমপ্রকাশ পত্রিকায় [১৫ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা] লিখিত হয়: ‘মেডিকাল কালেজের ছাত্র সংখ্যা ১৪০০ হওয়াতে লেপ্টনান্ট গবর্ণর বাঙ্গালা ক্লাসগুলি শিয়ালদহে স্থাপন করিয়াছেন।’ The Bengalee পত্রিকার 17 Jan 1874 সংখ্যায় [Vol. XIII, No. 3] The Indian Daily News-এর সংবাদ উদ্ধৃত করে লেখা হয়: ‘…The New Medical School attached to the Municipal Pauper Hospital at Sealdah has been named and will in future be known as “The Campbell Medical School”, in compliment to our Lieutenant-Governor, Sir George Campbell, who established it.’ সুতরাং অস্থিবিদ্যা-শিক্ষক মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন—হয়তো বাংলা বিভাগে পড়তেন—বছর দেড়েক বাদে স্থানান্তরের ফলে তিনি যখন ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুলে চলে যান তখনও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ ছিল, সেইজন্যেই তাঁকে ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুলের ছাত্র বলে অভিহিত করেছেন, এইরূপ সিদ্ধান্ত করাই যুক্তিযুক্ত। দ্বিতীয়ত কঙ্কালটিকে কোথায় রাখা হয়েছিল, তিনটি উদ্ধৃতিতে তার তিন রকম বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জীবনস্মৃতি-র বর্ণনাই—‘আমাদের ইস্কুলঘরে’—গ্রহণযোগ্য মনে হয়। শোবার ঘর বা তার পাশের ঘরের অবস্থান ছিল অন্তঃপুরের মধ্যে—সেখানে কঙ্কাল ঝুলিয়ে রাখা সারদা দেবী বা অন্যান্য অন্তঃপুরিকাদের সমর্থন পাবে এমন আশা করা যায় না; আর প্রত্যহ স্কুলঘর থেকে শোবার ঘর বা তার পাশের ঘরে কঙ্কালটি নাড়াচাড়া করা হত—বালকদের ভয়-ভাঙানোর মহৎ উদ্দেশ্যে [?]—অবাস্তব বলে মনে হয়।

তৃতীয় যে সমস্যাটি দেখা দেয় তা ছেলেবেলা-য় বর্ণিত ‘কুস্তির আখড়া থেকে ফিরে এসে দেখি’ বাক্যাংশটিকে কেন্দ্র করে। এই বর্ণনা মেনে নিলে বলতে হয় ইতিমধ্যেই ‘নানা বিদ্যার আয়োজন’ সূত্রে কুস্তিশিক্ষার সূচনাও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু হিসাব-খাতায় বালকদের কুস্তির প্রসঙ্গটি আমরা পাই আরও পরে ১৩ ভাদ্র ১২৭৯ [বুধ 28 Aug 1872] তারিখে—‘সোম রবীবাবুদিগের কুস্তি করার জন্য কা… [?] তৈয়ারির ব্যয়’ সাত টাকা সাড়ে চোদ্দ আনা। অবশ্য কুস্তি ঠাকুরবাড়িতে কিছু নতুন ব্যাপার নয়। সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন অল্পবয়সে তিনি হীরা সিং নামে এক পালোয়ানের কাছে কুস্তি শিক্ষা করে ওস্তাদ হয়ে উঠেছিলেন। হেমেন্দ্রনাথও কুস্তিতে যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন, জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর ‘আত্মকথা’য় তার সাক্ষ্য মেলে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘শহরে এক ডাকসাইটে পালোয়ান ছিল, কানা পালোয়ান, সে আমাদের কুস্তি লড়াত। দালানঘরের উত্তর দিকে একটা ফাঁকা জমি, তাকে বলা হয় গোলাবাড়ি। …এই পাঁচিল ঘেঁষে ছিল কুস্তির চালাঘর। এক হাত আন্দাজ খুঁড়ে মাটি আলগা করে তাতে এক মোন সরষের তেল ঢেলে জমি তৈরি হয়েছিল। সেখানে পালোয়ানের সঙ্গে আমার প্যাঁচ কষা ছিল ছেলেখেলা মাত্র। খুব খানিকটা মাটি মাখামাখি করে শেষকালে গায়ে একটা জামা চড়িয়ে চলে আসতুম।’১০ রোজ সকালে এত মাটি মাখা মা সারদাদেবীর আবার ভালো লাগত না, তাঁর ভাবনা হত ছেলের রঙ ময়লা হয়ে যাবে। ফলে বাদাম-বাটা, দুধের সর, কমলালেবুর খোসা প্রভৃতির দ্বারা প্রস্তুত মলম দিয়ে রবিবারে চলত দলন-মলন—বালকের মন অস্থির হয়ে উঠত ছুটির জন্যে।

এর থেকে আমরা রবীন্দ্রনাথের এই সময়কার প্রাত্যহিক জীবনচর্যার একটি ছক তৈরি করতে পারি। ভোরে অন্ধকার থাকতে উঠে লংটি পরে কানা পালোয়ানের সঙ্গে কুস্তি; মাটিমাখা শরীরের উপর জামা চাপিয়ে মেডিকেল কলেজের জনৈক ছাত্রের কাছে অস্থিবিদ্যা-শিক্ষা; সাতটার সময় বই ও শ্লেট নিয়ে নীলকমল ঘোষালের কাছে গিয়ে ন’টা পর্যন্ত পদার্থবিদ্যা, মেঘনাদবধকাব্য, পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদির পাঠগ্রহণ; এরপর স্নান-খাওয়া সেরে নিয়ে ঘোড়ায় টানা ইস্কুল-গাড়ি বা পালকি চেপে স্কুল; সাড়ে চারটেয় স্কুল থেকে ফিরে জিম্‌নাস্টিক ও ড্রয়িং শিক্ষা; সন্ধ্যার পর আসেন অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় ইংরেজি পড়াতে; রাত্রি ন’টার পর ছুটি। রবিবার ছুটির দিন হলেও বিষ্ণুচন্দ্র চক্রবর্তীর কাছে গান শিখতে হত, আর কোনো-কোনো দিন আসতেন সীতানাথ ঘোষ যন্ত্রসহযোগে প্রাকৃত-বিজ্ঞান শিক্ষা দিতে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: “ইহারই মাঝে এক সময়ে হেরম্ব তত্ত্বরত্ন মহাশয় আমাদিগকে একেবারে ‘মুকুন্দং সচ্চিদানন্দং’ হইতে আরম্ভ করিয়া মুগ্ধবোধের সূত্র মুখস্থ করাইতে শুরু করিয়া দিলেন।”১১ তাঁর বর্ণনার সূত্র অনুসরণ করলে মনে হয় এটি অস্থিবিদ্যা-শিক্ষার সমসাময়িক, কিন্তু আমরা হেরম্ব তত্ত্বরত্নের অস্তিত্বের কোনো সাক্ষ্য পাইনি। অবশ্য ১২৯০ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথের বিবাহের হিসাবে জনৈক হেরম্বনাথ তর্করত্নকে দক্ষিণা দেওয়ার কথা জানা যায়, কিন্তু এঁরা একই ব্যক্তি কি না বলা শক্ত।

এই বছর পৌষ মাসে [Dec 1871] নর্মাল স্কুলে রবীন্দ্রনাথের ষষ্ঠ বৎসরের সমাপ্তি এবং সপ্তম বৎসরের সূচনা। কিন্তু এরই মধ্যে হঠাৎ এই স্কুলের পাঠ্যজীবন ও বাংলা শিক্ষার অবসান ঘটে। কারণটি খুবই কৌতুকজনক। আমরা ১২৭৭ বঙ্গাব্দের বিবরণে ‘প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৪’-এ কিশোরীচাঁদ মিত্রের লেখা Memoir of Dwarakanath Tagore গ্রন্থটির সম্পর্কে কিছু সংবাদ দিয়েছি। নর্মাল স্কুলের কোনো-একজন শিক্ষক বইটি পড়তে চেয়েছিলেন। মাঘ মাসের শেষে [Feb 1872] দেবেন্দ্রনাথ বক্রোটা পাহাড় থেকে নেমে অমৃতসর ও লাহোর হয়ে বাড়ি ফিরে এলে রবীন্দ্রনাথের ভাগিনেয় ও সহপাঠী সত্যপ্রসাদ সাহস করে তাঁর কাছে বইটি চাইতে যান। সত্যপ্রসাদ মনে করেছিলেন সর্বসাধারণের সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলা যায়, তাঁর কাছে সেভাবে বলা চলে না। ‘সেইজন্য সাধু গৌড়ীয় ভাষায় এমন অনিন্দনীয় রীতিতে সে বাক্যবিন্যাস করিয়াছিল যে, পিতা বুঝিলেন, আমাদের বাংলাভাষা অগ্রসর হইতে হইতে শেষকালে নিজের বাংলাত্বকেই প্রায় ছাড়াইয়া যাইবার জো করিয়াছে।’১২ এরই ফলে পরদিন সকালে নীলকমলবাবুর কাছে পাঠারম্ভের সময়ে দেবেন্দ্রনাথের তেতালার ঘরে তিনজনের ডাক পড়ল ও তিনি বাংলা পড়া বন্ধ করার নির্দেশ জারি করলেন। উৎফুল্ল রবীন্দ্রনাথের কাছে যে-মেঘনাদবধের প্রত্যেকটি অক্ষরই অমিত্র বলে মনে হত, এই মুক্তির মুহূর্তে তাকেও মিত্র বলে মনে করা অসম্ভব ছিল না। নীলকমল পণ্ডিত বিদায় নেবার সময় বলে গেলেন কর্তব্যের অনুরোধে অনেক সময় রূঢ় ব্যবহার করলেও তাঁর প্রদত্ত শিক্ষার মূল্য ভবিষ্যতে বোধগম্য হবে। এ-প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘ছেলেবেলায় বাংলা পড়িতেছিলাম বলিয়াই সমস্ত মনটার চালনা সম্ভব হইয়াছিল। শিক্ষা-জিনিসটা যথাসম্ভব আহার-ব্যাপারের মতো হওয়া উচিত। …বাঙালির পক্ষে ইংরেজি শিক্ষায় এটি হইবার জো নাই। তাহার প্রথম কামড়েই দুইপাটি দাঁত আগাগোড়া নড়িয়া উঠে…বানানে ব্যাকরণে বিষম লাগিয়া নাক-চোখ দিয়া যখন অজস্র জলধারা বহিয়া যাইতেছে, অন্তরটা তখন একেবারেই উপবাসী হইয়া আছে। অবশেষে বহুকষ্টে অনেক দেরিতে খাবারের সঙ্গে যখন পরিচয় ঘটে তখন ক্ষুধাটাই যায় মরিয়া। প্রথম হইতেই মনটাকে চালনা করিবার সুযোগ না পাইলে মনের চলৎশক্তিতেই মন্দা পড়িয়া যায়।’১৩ এই কারণেই ইংরেজি শিক্ষার বিপুল আগ্রহের যুগে যিনি সাহস করে তাঁদের বাংলা শেখাবার ব্যবস্থা করেছিলেন সেই সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথের প্রতি রবীন্দ্রনাথ গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন।

উপরোক্ত ঘটনাটি ঘটেছিল বর্তমান বৎসরের ফাল্গুন মাসের প্রথম দিকে [Feb 1872]। আগেই বলেছি, দেবেন্দ্রনাথ মাঘের শেষে হিমালয় থেকে ফিরে আসেন—২৯ মাঘ [শনি 10 Feb] ‘শ্রীযুক্ত কর্ত্তাবাবু মহাশয়ের শুভ আগমন উপলক্ষে’ কতকগুলি জিনিস কেনার হিসাব পাওয়া যায়। সুতরাং Feb 1872-তেই রবীন্দ্রনাথের নর্মাল স্কুল-পর্বের সমাপ্তি। ক্যাশবহি-র সাক্ষ্যও এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করে। ২৭ মাঘ [বৃহ ৪ Feb] তারিখের হিসাব: ‘ছেলেবাবুদিগের বিদ্যালয়ের ফেবরূয়ারি মাহার/ফি শোধ/গুঃ শ্যামদাস/বিঃ ৫বিল/রবীবাবুর—১৲/সোমবাবুর ১৲/সত্যপ্রসাদবাবুর ১৲/দ্বিপেন্দ্রবাবুর ১৲/অরুণেন্দ্রবাবুর৸° /৪৸°; কিন্তু ৩০ ফাল্গুন (মঙ্গল 12 Mar]-এর হিসাবে দেখি: ‘দ্বিপেন্দ্র অরুণেন্দ্রবাবুদিগের/বিদ্যালয়ের মার্চ্চ মাহার ফি শোধ/১৸°’ অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ-প্রমুখ তিনজনের নাম বাদ পড়েছে। এখানে একটি তথ্য অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। যদিও নর্মাল স্কুল-পর্বের সমাপ্তি ঘটল আকস্মিকভাবে হাস্যকর পরিস্থিতির মধ্যে, কিন্তু বহু পূর্বেই স্কুল-পরিবর্তনের ভাবনা অভিভাবকদের মনে এসেছিল তার প্রমাণ ৮ বৈশাখ [বৃহ 20 Apr 1871] তারিখের একটি হিসাব: ‘সেন্ট জেবিয়ার্স কলেজ হইতে সেজ বাবুর আদেশ মতে ছেলেবাবুদিগের পুস্তক আনিতে যদুনাথ চট্টোর গাড়িভাড়া’। পুস্তক বলতে এখানে নিশ্চয় পাঠ্যপুস্তকের তালিকা বোঝানো হয়েছে, কিন্তু এই হিসাবটিই বুঝিয়ে দেয় যে অভিভাবকেরা, বিশেষ করে হেমেন্দ্রনাথ, বালকদের সেই সময়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি করে দেবার কথা ভেবেছিলেন; হয়তো মনে করেছিলেন বাংলা-শিক্ষার ভিত্তি যথেষ্ট সুদৃঢ় করেই গড়া হয়েছে, এবারে কালোপযোগী ইংরেজি শিক্ষা দেওয়া দরকার। কিন্তু যে-কোনো কারণেই হোক এই ভাবনা তখন কার্যকরী রূপ লাভ করেনি।

নর্মাল স্কুল ত্যাগ করে রবীন্দ্রনাথরা কিন্তু সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হলেন না, হলেন বউবাজার অঞ্চলে অবস্থিত বেঙ্গল অ্যাকাডেমি নামের এক ফিরিঙ্গি স্কুলে। এই স্কুল থেকেই রীরেন্দ্রনাথ এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করেছিলেন 1866-এ এবং শরৎকুমারী দেবীর স্বামী যদুনাথ মুখোপাধ্যায় কিছুদিন এখানকার ছাত্র ছিলেন। বেঙ্গল অ্যাকাডেমিতে রবীন্দ্রনাথেরা ভর্তি হলেন Mar 1872-তে। ক্যাশবহি-তে এই ভর্তির হিসাবটি অবশ্য উঠেছে পরবর্তী বৎসরে ২ বৈশাখ ১২৭৯ [শনি 13 Apr 1872] তারিখে—

‘বিদ্যাভ্যাস খাতে/খরচ—১৫৲

ব° Bengal Academy

দ° সোম রবী ও সত্যপ্রসাদ

বাবুদিগের মার্চ মাহার ফি শোধ

বিঃ ৩ বিল—৫৲ হিঃ

গুঃ ঈশ্বরদাস—১৫৲

একই দিনে আরও একটি হিসাব আছে: ‘ব° ডিকরূজ সাহেব Bengal Academy/দ° উহার জন্মতিথি উপলক্ষে/ছোটবাবু মহাশয়ের অনুমতিক্রমে/সবস্কৃপসন, দেওয়া যায়/গুঃ ঈশ্বর দাস-৬৲’। এই খরচটি পরবর্তী বৎসরেও দেখা যায়।

যাই হোক, বিদ্যাভ্যাসখাতে খরচটি বৈশাখ ১২৭৯-তে লিখিত হলেও সম্ভবত চৈত্র মাস থেকেই রবীন্দ্রনাথেরা বেঙ্গল অ্যাকাডেমিতে যাতায়াত শুরু করেছিলেন। ২৮ চৈত্র [মঙ্গল 9 Apr] যেমন ‘সোম, রবী ও সত্যপ্রসাদ বাবুর পুস্তক ক্রয়’ করা হয়েছে ১৭ টাকার, তেমনি ফিরিঙ্গি স্কুলের উপযোগী পোশাক-পরিচ্ছদের জন্য ১০ চৈত্র [শুক্র 22 Mar] ‘সোম, রবী ও সত্যপ্রসাদবাবুদিগের/তিন জনার পেনটুলেন আলপাকার চাপকান/জোব্বা তৈয়ারির ব্যয়’ পড়েছে ৪৭ টাকা ১০ আনা; এমন-কি ‘সোম ও রবীবাবু দিগরের কাপড় রাখিবার জন্য ছোট পাঁচ ফুটে আলমারি’ও একটা ১৫ টাকায় কেনা হয়েছে এবং সোম ও রবি দুই ভাইয়ের জন্য দু-জোড়া করে চার জোড়া জুতো কেনার হিসাবও পাওয়া যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ যে লিখেছেন: ‘নর্মাল স্কুল ত্যাগ করিয়া বেঙ্গল একাডেমি নামক এক ফিরিঙ্গি স্কুলে ভর্তি হইলাম। ইহাতে আমাদের গৌরব কিছু বাড়িল’১৪—ইজের ও কামিজ থেকে ‘পেনটুলেন’, চাপকান ও জোব্বায় উত্তরণ এই গৌরব-বৃদ্ধির একটি অন্যতম বহিরঙ্গ কারণ বলে আমরা মনে করতে পারি!

বর্তমান বর্ষের একেবারে শেষে তাঁরা বেঙ্গল অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হয়েছিলেন, সুতরাং এ-সম্পর্কে আলোচনা আমরা পরবর্তী বর্ষের জন্য স্থগিত রাখছি।

রবীন্দ্রনাথের গুণাবলি যে ধীরে ধীরে বিস্তৃততর ক্ষেত্রে প্রকাশিত হচ্ছিল, তার কয়েকটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিবরণ বিভিন্ন সূত্রে লাভ করা যায়। ব্রাহ্মসমাজের বিখ্যাত নেতা বেচারাম চট্টোপাধ্যায়কে ১৭ পৌষ ১৭৯৩ শক [রবি 31 Dec 1971] তারিখে অমৃতসর থেকে একটি পত্রে দেবেন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘রবীন্দ্র প্রভৃতি বালকেরা বেহালাতে পারায়ণে যে যোগ দিয়াছিল তাহা শুনিয়া আহ্লাদিত হইলাম। তাহাদের ব্রাহ্মধর্ম্ম কি প্রকার শিক্ষা হইতেছে তাহা আমি কিছু শুনি নাই।…’১৫

এই পত্র থেকে জানা যায় ৩০ কার্তিক [বুধ 15 Nov] তারিখে বেহালা ব্রাহ্মসমাজের অষ্টাদশ সাংবৎসরিকে রবীন্দ্রনাথ যোগ দিয়েছিলেন, সম্ভবত গায়ক হিসেবেই। ক্যাশবহি-তেই সংবাদটি পাওয়া যায় ৩ অগ্র [শনি 18 Nov] তারিখের হিসাবে: ‘দ° বেহালা ব্রাহ্মসমাজের সাম্বৎসরিক সভায় বড়বাবু মহাশয় ও ছেলেবাবুরা জাতাতের দুই খানা গাড়ি ভাড়া শোধ’। এই অনুষ্ঠানের কোনো বিবরণ চোখে পড়েনি, কিন্তু অনুমান করা যায়, বড়োবাবু অর্থাৎ দ্বিজেন্দ্রনাথ উপাসনা বা বক্তৃতা করেছিলেন এবং ছেলেবাবুরা হচ্ছেন সম্ভবত সত্যপ্রসাদ, সোমন্দ্রনাথ, দ্বিপেন্দ্রনাথ, অরুণেন্দ্রনাথ ও হিতেন্দ্রনাথ—আর রবীন্দ্রনাথ তো ছিলেন-ই। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-র কার্তিক সংখ্যার ‘বিজ্ঞাপন’ থেকে জানা যায়, এই উৎসবে বিকেল ৩টের পরে ব্রাহ্মধর্মের পারায়ণ [‘ব্রাহ্মধর্ম’ গ্রন্থ থেকে শ্লোক পাঠ ও ব্যাখ্যা] ও ৭টায় ব্রহ্মোপাসনা অনুষ্ঠিত হয়। পত্রটি থেকে আরও অনুমান করা যায়, এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্যদের জন্য ব্রাহ্মধর্ম শিক্ষারও বিশেষ আয়োজন ছিল, অন্তত দেবেন্দ্রনাথের সেইরকমই নির্দেশ ছিল।

১১ মাঘ বৃহস্পতিবার 24 Jan 1872 তারিখে আদি ব্রাহ্মসমাজের দ্বাচত্বারিংশ সাংবৎসরিক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। আদি ব্রাহ্মসমাজগৃহে প্রাতঃকালীন উপাসনায় ঈশানচন্দ্র বসু, রাজনারায়ণ বসু ও বেচারাম চট্টোপাধ্যায় বক্তৃতা করেন। দেবেন্দ্র-ভবনে সায়ংকালীন উপাসনায় সত্যেন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রনাথ ভাষণ প্রদান করেন। এই উৎসবের বিবরণ দিতে গিয়ে ন্যাশানাল পেপার-এ লিখিত হয়, ‘The evening service commenced at 8 P.M. with the chanting of a beautiful hymn by little children’ [Vol. VIII, No. 5, Jan 31, p. 54]. এই ‘little children’-এর একজন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন, একথা মনে করা কষ্টকল্পনা নয়। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-র ফাল্গুন সংখ্যায় [পৃ ১৮০] তিনটি ব্ৰহ্মসংগীত প্রকাশিত হয়—

বেহাগ—ঝাঁপতাল। মঙ্গল নিদান, বিঘ্নের কৃপাণ, মুক্তির সোপান, অন্য কেবা [সত্যেন্দ্রনাথ]

জয়জয়ন্তী—ঝাঁপতাল। ইচ্ছা হয় সৰ্ব্ব ভুলে ছাড়ি মোহ কোলাহলে [ঐ]

ভৈরব—চৌতাল। মোর দুখ-নিশা প্রভাত কর।

—এই তিনটি গানেরই একটি বালকদের দ্বারা গীত হয়েছিল, এমন অনুমান করা চলে।

৩০ মাঘ [রবি 11 Feb] রাজা বৈদ্যনাথ রায়ের কাশীপুরের বাগানবাড়িতে ‘হিন্দু মেলা’র ষষ্ঠ বার্ষিক অধিবেশন আরম্ভ হয়ে ২ ফাল্গুন [মঙ্গল 13 Feb] পর্যন্ত চলে। অবশ্য শেষ দিনে আন্দামানের পোর্টব্লেয়ারে লর্ড মেয়োর নিহত হবার সংবাদ ঘোষিত হলে সম্পাদক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের শোকপ্রস্তাবের মাধ্যমে অধিবেশনের অকাল-সমাপ্তি ঘটে। এই অধিবেশনের বিবরণ দিতে গিয়ে ন্যাশনাল পেপার-এ এক জায়গায় লিখিত হয়েছে, ‘…A young lad also rose and chanted extempore verses dwelling upon the great virtues of Rama. Then rose also many other young lads and read little excellent pieces of poems’ [Vol. VIII, No. 8, Feb 21, pp. 91-92]. এর বেশি কিছু লেখা নেই এবং অন্য কোনো পত্রিকার সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্যের অভাবে নিশ্চিত করে বলবার উপায় নেই যে ঐ বিশেষ ‘young lad’-টিই রবীন্দ্রনাথ, কিংবা অন্তত ‘other young lads’-এর মধ্যেও তিনি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন; কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই পরিচিত মহলে তাঁর কবিখ্যাতি যেরূপ বিস্তৃত হয়েছিল তাতে এইরূপ পরিবার-সম্পৃক্ত অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ার সুযোগ থেকে তিনি বঞ্চিত হবেন, এটা আশা করা যায় না। ৪ ফাল্গুন [বৃহ 15 Feb] ক্যাশবহি-তে একটি হিসাব দেখা যায়, ‘হিন্দুমেলায় ছেলেবাবুদিগের খেলানা ক্রয় করিয়া দিবার জন্য এক বৌচর’-এ দুটাকা সাড়ে চোদ্দ আনা খরচ করা হয়েছে—এর থেকে অনুমান করা যায়, পরিবারস্থ বালকেরা—রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই তার মধ্যে ছিলেন—হিন্দুমেলায় গিয়েছিলেন। এই অনুমান যদি সঠিক হয়, তাহলে বলতে হবে এই বৎসরই প্রথম রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হিন্দুমেলার প্রত্যক্ষ যোগায়োগ স্থাপিত হল।

রবীন্দ্রনাথের গুণাবলির পরিচয় প্রসঙ্গে আর একটি ঘটনার কথা বলে নেওয়া যাক, এটিও হয়তো সমসাময়িক কালেরই ব্যাপার। গুণেন্দ্রনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগের একটি বিবরণ আমর এই অধ্যায়ের শুরুতেই দিয়েছি। মধ্যাহ্নে আহারের পর গুণেন্দ্রনাথ দেবেন্দ্রনাথের বাড়ির একতলায় জমিদারি কাজকর্মের জন্য আসতেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথও এই সময়ে একই কাজের ভারপ্রাপ্ত। এই দুই প্রায়-সমবয়সী ভ্রাতা [জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দু-বছরের ছোটো] বন্ধুর মতো ঘনিষ্ঠ ছিলেন, ‘নব-নাটক’ অভিনয়-প্রসঙ্গে তা আমরা দেখেছি। সুতরাং ‘কাছারি তাঁহাদের একটা ক্লাবের মতোই ছিল—কাজের সঙ্গে হাস্যালাপের বড়োবেশি বিচ্ছেদ ছিল না’১৬—রবীন্দ্রনাথের এই বর্ণনা খুবই বাস্তবানুগ। গুণেন্দ্রনাথ কাছারিতে এসে একটা কৌচে হেলান দিয়ে বসলে ছুটি-ছাটার সুযোগে বালক রবীন্দ্রনাথ তাঁর কোলের কাছে এসে বসতেন। গুণেন্দ্রনাথ প্রায়ই তাঁকে ভারতবর্ষের ইতিহাসের গল্প বলতেন। ভারতে ব্রিটিশসাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ক্লাইভ দেশে ফিরে গলায় ক্ষুর দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন, গুণেন্দ্রনাথের কাছে এই কাহিনী শুনে ‘বাহিরে যখন এমন সফলতা অন্তরে তখন এত নিষ্ফলতা’ কেমন করে থাকে, মানব-হৃদয়ের অন্ধকারে বেদনার এই প্রচ্ছন্ন রহস্য নিয়ে সেদিন তিনি অনেকক্ষণ চিন্তা করেছিলেন। এক-একদিন নবীন কবির ভাবগতিক দেখে গুণেন্দ্রনাথ অনুমান করতে পারতেন যে তাঁর পকেটে একটা খাতা লুকোনো আছে। সামান্য প্রশ্রয়েই খাতাটি আত্মপ্রকাশ করত। গুণেন্দ্রনাথ সমালোচক-হিসেবে আদৌ কঠোর ছিলেন না, এমন-কি তাঁর অভিমত বিজ্ঞাপনেও ব্যবহারযোগ্য ছিল। কিন্তু কোনো-কোনোদিন কবিত্বের মধ্যে ছেলেমানুষির মাত্রা এত বেশি থাকত যে তাঁর পক্ষেও হাস্যসংযম অসম্ভব হত। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: “ভারতমাতা সম্বন্ধে কী-একটা কবিতা লিখিয়াছিলাম। তাহার কোনো একটি ছত্রের প্রান্তে কথাটি ছিল ‘নিকটে’, ওই শব্দটাকে দূরে পাঠাইবার সামর্থ্য ছিল না অথচ কোনোমতেই তাহার সংগত মিল খুঁজিয়া পাইলাম না। অগত্যা পরের ছত্রে ‘শকটে’ শব্দটা যোজনা করিয়াছিলাম। সে-জায়গায় সহজে শকট আসিবার একেবারেই রাস্তা ছিল না—কিন্তু মিলের দাবি কোনো কৈফিয়তেই কর্ণপাত করে না; কাজেই বিনা কারণেই সে জায়গায় আমাকে শকট উপস্থিত করিতে হইয়াছিল। গুণদাদার প্রবল হাস্যে, ঘোড়াসুদ্ধ শকট যে দুর্গম পথ দিয়া আসিয়াছিল সেই পথ দিয়াই কোথায় অন্তর্ধান করিল এ-পর্যন্ত তাহার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নাই।”১৭ গুণেন্দ্রনাথের হাস্যের তোড়ে কবিতাটি উড়ে গেলেও, এই হাস্য ঘটনাটিকে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিতে অঙ্কিত করে দিয়েছিল, সন্দেহ নেই। ফলে আমরা একটি অমূল্য তথ্য লাভ করি, যা রবীন্দ্রনাথের কাব্যভাবনার ক্রমবিকাশের একটি সূত্র ধরিয়ে দিতে সাহায্য করে। এর আগে আমরা তাঁর কবিতার বিষয়বস্তুর যে পরিচয় পেয়েছি তার প্রায় সবটাই জুড়ে ছিল পদ্মকে কেন্দ্র করে প্রকৃতি-বর্ণনা। মাঝখানে সদ্ভাব বিষয়ে লিখিত ফরমায়েশি কবিতা এবং সাতকড়ি দত্ত-প্রদত্ত ছত্রের পাদপূরণ ও ফলারের ব্যক্তিগত বর্ণনা ছাড়া আর কোনো কবিতার খবর আমরা পাই না। কিন্তু এখানে যে কবিতাটির কথা বলা হয়েছে, তার বিষয় ছিল ‘ভারতমাতা’। হিন্দুমেলার জাতীয়তার প্রেরণা বালক-কবির অন্তরে ইতিমধ্যেই কার্যকরী রূপ পরিগ্রহ করতে শুরু করেছে, সংবাদটি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করি।

এতদিন রবীন্দ্রনাথের বিদ্যালয়-কেন্দ্রিক পড়াশোনার যে চিত্রটি আমরা পেয়েছি, স্বীকার করতে বাধা নেই যে তা নিতান্তই হতাশাব্যঞ্জক। কিন্তু এরই সমান্তরাল আরও একটি জীবনের পরিচয় পাওয়া যায়, যা তাঁর লেখকজীবনের ভূমিকাস্বরূপ। এই জীবনে এই বালক-পাঠকের সর্বগ্রাসী ক্ষুধায় তখনকার দিনে প্রচলিত প্রায় কোনো গ্রন্থই অপঠিত ছিল না। তিনি লিখেছেন: ‘আমার বাল্যকালে বাংলাসাহিত্যের কলেবর কৃশ ছিল। বোধকরি তখন পাঠ্য অপাঠ্য বাংলা বই যে-কটা ছিল সমস্তই আমি শেষ করিয়াছিলাম।’১৮ অন্যত্র তিনি লিখেছেন: ‘কৃত্তিবাস, কাশীরাম দাস, একত্র বাঁধানো বিবিধার্থসংগ্রহ, আরব্য উপন্যাস, পারস্য উপন্যাস, বাংলা রবিনসন ক্রুসো, সুশীলার উপাখ্যান, রাজা প্রতাপাদিত্য রায়ের জীবনচরিত, বেতাল পঞ্চবিংশতি প্রভৃতি তখনকার কালের গ্রন্থগুলি বিস্তর পাঠ করিয়াছিলাম।’১৯

বিবিধার্থ সংগ্রহ* ছাড়াও আরও একটি মাসিক পত্র তাঁর মনোহরণ করেছিল, তার নাম অবোধ-বন্ধু/

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘রাজেন্দ্রলাল মিত্র মহাশয় বিবিধার্থ-সংগ্রহ বলিয়া একটি ছবিওয়ালা মাসিকপত্র বাহির করিতেন। তাহারই বাঁধানো একভাগ সেজদাদার আলমারির মধ্যে ছিল। সেটি আমি সংগ্রহ করিয়াছিলাম। বারবার করিয়া সেই বইখানা পড়িবার খুশি আজও আমার মনে পড়ে। সেই বড়ো চৌকা বইটাকে বুকে লইয়া আমাদের শোবার ঘরের তক্তাপোশের উপর চিত হইয়া পড়িয়া নর্হাল তিমিমৎস্যের বিবরণ, কাজির বিচারের কৌতুকজনক গল্প, কৃষ্ণকুমারীর উপন্যাস পড়িতে কত ছুটির দিনের মধ্যাহ্ন কাটিয়াছে।’২০

বিবিধার্থ সংগ্রহ রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সম্পাদনায় ছ’টি পর্বে প্রকাশিত হয়। সম্ভবত তার সব-কটি পর্ব রবীন্দ্রনাথ পড়েননি; তিনি যেটি পড়েছিলেন সেটি হল চতুর্থ পর্ব ৩৭ খণ্ড থেকে ৪৮ খণ্ড, ১৭৭৯ শক [১২৬৪ বঙ্গাব্দ: 1857-58] বৈশাখ থেকে চৈত্র সংখ্যাগুলি। এর মধ্যে যে তিনটি রচনার তিনি উল্লেখ করেছেন, তার প্রথমটি আশ্বিন সংখ্যায় [পৃ ১২১-২৩; নামটির উল্লেখে ভুল আছে, প্রকৃত নাম ‘নর্বাল বা দীর্ঘদন্ত তিমি’, ১২১ পৃষ্ঠায় এর একটি চিত্রও দেওয়া আছে], দ্বিতীয়টি ভাদ্র সংখ্যায় (পৃ ১১৭; প্রকৃতপক্ষে ঐ নামে কোনো রচনাই এতে নেই—রচনাটির নাম ‘রুশীয়দেশের রাজদণ্ড’, তবে এতে যে ধরনের বিচার ও দণ্ডের বর্ণনা আছে তাকে কাজির বিচার বলে রবীন্দ্রনাথ কিছু ভুল করেননি], এবং তৃতীয়টি পৌষ সংখ্যায় [পৃ ২০৫-১৪; রচনাটির মূল নাম ‘কৃষ্ণকুমারীর ইতিহাস’, লেখক রবীন্দ্রনাথের মধ্যমাগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর] প্রকাশিত হয়েছিল।

অবোধ-বন্ধু প্রথমদিকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র আকারের পত্রিকা ছিল। এর বিভিন্ন সংখ্যাগুলি কতক বাঁধানো কতক-বা খণ্ড আকারে দ্বিজেন্দ্রনাথের বইয়ের আলমারিতে আরও অনেক মূল্যবান গ্রন্থের সঙ্গে রক্ষিত ছিল। এই কারণেই আলমারিতে চপলপ্রকৃতি বালকদের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ‘অবোধবন্ধুর বন্ধুত্ব-প্রলোভনে মুগ্ধ’ বালক সেই নিষেধ লঙ্ঘন করতে দ্বিধা বোধ করেননি। তারপর ‘ইস্কুল ফাঁকি দিয়া একটি দক্ষিণদ্বারী ঘরে সুদীর্ঘ নির্জন মধ্যাহ্নে অবোধবন্ধু হইতে পৌল-বর্জিনীর* বাংলা অনুবাদ পাঠ করিতে করিতে প্রবল বেদনায় হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইত। তখন কলিকাতার বহির্বর্তী প্রকৃতি আমার নিকট অপরিচিত ছিল—এবং পৌল-বর্জিনীতে সমুদ্রতটের অরণ্যদৃশ্যবর্ণনা আমার নিকট অনির্বচনীয় সুখস্বপ্নের ন্যায় প্রতিভাত হইত, এবং সেই তরঙ্গঘাতধ্বনিত বনচ্ছায়াস্নিগ্ধ সমুদ্রবেলায় পৌল-বর্জিনীর মিলন এবং বিচ্ছেদবেদনা হৃদয়ের মধ্যে যেন মূর্ছনাসহকারে অপূর্ব সংগীতের মতো বাজিয়া উঠিত।’২১ এর সঙ্গে যোগ করা যায় প্রথম খসড়ার এই পাঠটি: ‘সেই পৌল্‌বর্জ্জিনী পড়ার পর হইতে সমুদ্র ও সমুদ্রতীর আমার অন্তরের সামগ্রী হইয়াছিল। আরো বড় হইয়া যখন কপালকুণ্ডলা [প্রথম প্রকাশ: 1866] পড়িলাম তখন সমুদ্রতীরের সৈকটতটপ্রান্তবর্ত্তী অরণ্যচ্ছবি আমার মনে সেই জাদু করিয়াছিল।’ এই পত্রিকার মাধ্যমেই বিহারীলাল চক্রবর্তীর কবিতার সঙ্গে২২ তাঁর প্রথম পরিচয়। ‘তখনকার দিনের সকল কবিতার মধ্যে তাহাই আমার সবচেয়ে মন হরণ করিয়াছিল। তাঁহার সেই-সব কবিতা সরল বাঁশির সুরে আমার মনের মধ্যে মাঠের এবং বনের গান বাজাইয়া তুলিত।’২৩

যে-সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেই সময়েই দীনবন্ধু মিত্রের প্রহসন ‘জামাই বারিক’ প্রকাশিত হয় [20 Mar 1872]। রবীন্দ্রনাথের দূরসম্পৰ্কীয়া কোনো আত্মীয়া বইটি পড়ছিলেন। সে বই পড়ার বয়স তখনও তাঁর হয়নি বলে অনেক অনুনয় সত্ত্বেও বইটি আদায় করা সম্ভব হল না, বরং লুব্ধ বালককে প্রতিহত করার জন্য তিনি বইটি বাক্সে চাবিবন্ধ করে রাখেন। এই নিষেধ বালককে আরো উত্তেজিত করে তুলল, তিনিও শাসালেন যে এ বই তিনি পড়বেনই। মধ্যাহ্নে আত্মীয়াটি যখন তাস খেলছিলেন তখন তাঁর পৃষ্ঠে আলম্বিত আঁচলে বাঁধা চাবির গোছা খুলে নেবার চেষ্টা করে বালক ধরা পড়ে গেলেন। আত্মীয়াটি মৃদু হেসে চাবির গোছা কোলে রেখে আবার খেলায় মন দিলেন। বাধ্য হয়ে বালককে আরও কুটিল পথের আশ্রয় নিতে হল। দোক্তার নেশা-গ্ৰস্তা মহিলাটির হাতের কাছে তিনি পানদোক্তার পাত্র সরবরাহ করলেন। পরিকল্পনা সফল হল। পিক ফেলতে গিয়ে চাবি-সমেত আঁচল কোল থেকে ভ্রষ্ট হয়ে নিচে পড়ল এবং অভ্যাসবশত তিনি সেটি আবার পিঠে ফেললেন। ‘এবার চাবি চুরি গেল এবং চোর ধরা পড়িল না। বই পড়া হইল। তাহার পরে চাবি এবং বই স্বত্বাধিকারীর হাতে ফিরাইয়া দিয়া চৌর্যাপরাধের আইনের অধিকার হইতে আপনাকে রক্ষা করিলাম। আমার আত্মীয়া র্ভৎসনা করিবার চেষ্টা করিলেন কিন্তু তাহা যথোচিত কঠোর হইল না; তিনি মনে মনে হাসিতেছিলেন—আমারও সেই দশা।’২৪

এইভাবেই বালক রবীন্দ্রনাথ পাঠ্য-অপাঠ্য বিবেচনা না করে হাতের কাছে যে বই২৫ পেয়েছেন, তা-ই পড়েছেন। তাতে কোনো ক্ষতি হয়েছে বলে তিনি মনে করেননি। তিনি লিখেছেন: ‘আমরা ছেলেবেলায় একধার হইতে বই পড়িয়া যাইতাম—যাহা বুঝিতাম এবং যাহা বুঝিতাম না দুই-ই আমাদের মনের উপর কাজ করিয়া যাইত।’২৬ অবশ্য অন্য প্রতিক্রিয়াও যে হত না তা নয়; সেইজন্যই জীবনস্মৃতি-র প্রথম পাণ্ডুলিপিতে লিখেছিলেন: ‘এই সকল বই [জামাইবারিক] পড়িয়া জ্ঞানের দিক হইতে আমার যে অকাল পরিণতি হইয়াছিল বাংলা গ্রাম্য ভাষায় তাহাকে বলে জ্যাঠামি;— প্রথম বৎসরের ভারতীতে প্রকাশিত আমার বাল্যরচনা ‘করুণা’ নামক গল্প তাহার নমুনা।’

যাই হোক, অল্পবয়সে রবীন্দ্রনাথের এইটিই বই পড়ার রীতি ছিল। বাংলা তো তিনি ভালোই জানতেন, সুতরাং বাংলা বইয়ের অনেকটাই তাঁর বোধগম্য হত, সন্দেহ নেই। কিন্তু ইংরেজি বই, যার প্রায় কিছুই তিনি বুঝতেন না, বালক-পাঠকের আগ্রাসী ক্ষুধা থেকে তারও নিস্তার ছিল না। তিনি লিখেছেন: ‘ছেলেবেলায় যখন ইংরেজি আমি প্রায় কিছুই জানিতাম না তখন প্রচুর-ছবিওয়ালা একখানি Old Curiosity Shop২৭ লইয়া আগাগোড়া পড়িয়াছিলাম। পনেরো-আনা কথাই বুঝিতে পারি নাই—নিতান্ত আবছায়া-গোছের কী একটা মনের মধ্যে তৈরি করিয়া সেই আপন মনের নানা রঙের ছিন্ন সূত্রে গ্রন্থি বাঁধিয়া তাহাতেই ছবিগুলা গাঁথিয়াছিলাম’।২৮ কেবলমাত্র বোঝার সীমানায় আবদ্ধ না থেকে, আপন মনের কল্পনাকে উদ্দীপিত করার এই প্রবণতা কিশোর রবীন্দ্রনাথের মানসিকতাকে বুঝতে আমাদের সাহায্য করে।

জীবনস্মৃতি-র প্রথম পাণ্ডুলিপিতে রবীন্দ্রনাথ একটি প্রসঙ্গের উল্লেখ করেছেন, সেটি হয়তো এই সময়কার ঘটনা। তিনি লিখেছিলেন: ‘যখন আমার বয়স নিতান্তই অল্প ছিল এবং দূষিতবুদ্ধি আমার জ্ঞানকেও স্পর্শ করে নাই, এমনসময় একদিন বড়দাদা তাঁহার ঘরে ডাকিয়া ইন্দ্রিয়সংযম ও ব্রহ্মচর্যপালন সম্বন্ধে আমাদিগকে স্পষ্ট করিয়া সতর্ক করিয়া দিয়াছিলেন। তাঁহার উপদেশ আমার মনে এমনি গাঁথিয়া গিয়াছিল যে, ব্রহ্মচর্য হইতে স্খলন আমার কাছে বিভীষিকাস্বরূপ হইয়াছিল। বোধ করি, এইজন্য বাল্যবয়সে অনেক সময়ে আমার জ্ঞান ও কল্পনা যখন বিপদের পথ দিয়া গেছে তখন আমার সংকোচপরায়ণ আচরণ নিজেকে ভ্রষ্টতা হইতে রক্ষা করিবার চেষ্টা করিয়াছে।’২৯ সংযমশুভ্র শুচিতা রবীন্দ্রনাথের চরিত্রের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য, হয়তো দ্বিজেন্দ্রনাথের এই উপদেশ তার ভিত্তি রচনা করে দিয়েছিল।

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ১

বর্তমান বৎসরে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা এখানে বিবৃত করছি।

বর্ণকুমারী দেবী ও সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের প্রথম পুত্র সরোজনাথের জন্ম হয় সম্ভবত এই বৎসরের আশ্বিন মাসে। জন্মমাসটি নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই ক্যাশবহি-র হিসাবগুলি বিক্ষিপ্তভাবে লেখার জন্য। ৭ ভাদ্র [22 Aug] তারিখে ‘বর্ণকুমারীর আঁতুড়খরচ ৪৲’, ১ কার্তিক [17 Oct] ‘দ° সতীশবাবুর প্রথম পুত্র হওয়ায় নাড়ি কাটা দাই বিদায় ১৬৲’ এবং ১৭ অগ্র [2 Dec] ‘সতীশবাবুর পুত্রের জাতকৰ্ম্ম’ বাবদ ব্যয়ের হিসাব দেখা যায়, কিন্তু তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-য় প্রথানুযায়ী ‘শুভকর্মের দান’ শিরোনামায় এ-সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই। ঠাকুরবাড়িতে অপৌত্তলিকভাবে হলেও সমস্ত স্ত্রী-আচার পালিত হত, তার প্রমাণ ১৬ আষাঢ় [29 Jun] তারিখের একটি হিসাব—‘বর্ণকুমারী দেবীর পঞ্চামৃত দেওন জন্য শ্রীখণ্ডি কাপড় একখানা ১৸°’, এই ধরনের হিসাব অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেখা যায়। যেমন ৩০ চৈত্র [11 Apr 1872] তারিখের হিসাবে দেখি, ‘মেজ বধু ঠাকুরাণীর [জ্ঞানদানন্দিনী দেবী] নিকট সাধের সওগাদ আনে লোক বিদায়’ ও ‘সাঁতরাগাছির বাটী হইতে মেজ বধু ঠাকুরাণীর সাধ আনে’ অর্থাৎ এই ধরনের লৌকিকতাও ঠাকুরবাড়িতে প্রচলিত ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য সত্যেন্দ্রনাথ সস্ত্রীক মাঘোৎসবের পূর্বেই কলকাতায় এসেছিলেন।

২৩ শ্রাবণ [সোম 7 Aug 1871] গুণেন্দ্রনাথের তৃতীয় পুত্র অবনীন্দ্রনাথের জন্ম হয়। আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার এই যুগপুরুষ রবীন্দ্রনাথের চেয়ে দশ বছর তিন মাসের ছোটো।

এই শ্রাবণ মাসেই বীরেন্দ্রনাথের একমাত্র পুত্র বলেন্দ্রনাথের অন্নপ্রাশন দেওয়া হয়। এই সময়ে বীরেন্দ্রনাথ অপেক্ষাকৃত সুস্থ অবস্থায় বাড়িতেই ছিলেন, কিন্তু কিছুদিন পরেই আশ্বিন মাসের গোড়ায় তাঁকে আবার ল্যুনাটিক অ্যাসাইলামে পাঠিয়ে দিতে হয়।

ফাল্গুন মাসে হেমেন্দ্রনাথের তৃতীয় পুত্র ঋতেন্দ্রনাথের অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠিত হয়। এই অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানগুলি সম্বন্ধে লক্ষণীয় যে, এ ক্ষেত্রে হিন্দুরীতি-অনুযায়ী জাতক-জাতিকার বয়সের হিসাব সম্ভবত গণনা করা হত না, সুবিধামত অনুষ্ঠানটি করা হত। দেবেন্দ্রনাথ যে ‘একেশ্বরবাদসম্মত অনুষ্ঠান পদ্ধতি’ প্রচার করেছিলেন, তাতে ‘অন্নপ্রাশন’ নামে কোনো অনুষ্ঠান ছিল না, তার পরিবর্তে ছিল ‘নামকরণ’ এবং ‘ছয় মাস হইতে এক বর্ষ বয়স পর্য্যন্ত নামকরণের কাল’ বলে নির্দেশিত হয়েছে। কিন্তু ক্যাশবহি-তে এ-সংক্রান্ত হিসাবগুলিতে ‘অন্নপ্রাশন’ কথাটিই পাওয়া যায়।

জোড়াসাঁকোর ভদ্রাসন বাড়িতে কিছু কিছু সংযোজনের খবরও এই বছরের ক্যাশবহি থেকে পাওয়া যায়। ১২ বৈশাখ [24 Apr 1871] তারিখের হিসাবে দেখি, ‘দ° তেতালায় কর্ত্তাবাবু মহাশয়ের স্নানের ঘর তৈয়ারির চিক ও জাফরির এক বিল ৩০৸৬ মধ্যে গত ১৬ পৌষ এড্‌বানস্ ১১৲ বাদে বাকী ১৯৸৬ মধ্যে নিজ রোজ শোধ/গুঃ উমর চিকওয়ালা ১৮৸৬’ অর্থাৎ বহিবাটীর তিনতলায় দেবেন্দ্রনাথের কক্ষের সংলগ্ন স্নানঘরের জন্য এই খরচ করা হয়েছে।

আগেই বলা হয়েছে, পৌষ ১২৭৬ [Jan 1870] থেকে পলতা ওয়াটার ওয়ার্কস্ চালু হয় এবং ১২৭৭ বঙ্গাব্দের শুরু থেকেই বাড়িতে বাড়িতে জলের পাইপ সংযোগ করা আরম্ভ হয়ে যায়। Jan 1871-এ বাড়িতে জলের পাইপ আনার জন্য ম্যাকিনটস্ বার্‌ন অ্যাণ্ড কোম্পানির সঙ্গে কথাবার্তা বলা হয়। সেই অনুযায়ী বর্তমান বৎসরের মধ্যেই এই কাজ সমাধা হয়ে যায়, সেটি বোঝা যায় ২১ পৌষ [4 Jan 1872] তারিখের হিসাব থেকে: ‘ব° Messr. Mackintosh Burn & Co/দ° বাটীতে কলের জলের পাইপ আনিবার/ব্যয়ের একবিল ১২৪৬৸০ মধ্যে/নিজ রোজ দেওয়া যায়…২০০৲’। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘তখন সবেমাত্র শহরে জলের কল হইয়াছে। তখন নূতন মহিমার ঔদার্যে বাঙালিপাড়াতেও তাহার কার্পণ্য শুরু হয় নাই। শহরের উত্তরে দক্ষিণে তাহার দাক্ষিণ্য সমান ছিল। সেই জলের কলের সত্যযুগে আমার পিতার স্নানের ঘরে তেতালাতেও জল পাওয়া যাইত।’৩০ এই জল একসময়ে রবীন্দ্রনাথ মনের আনন্দে অকাল স্নানের কাজে লাগিয়েছেন, কিন্তু সে আরও কিছুকাল পরের ঘটনা।

তেতালার এই ঘর ও তার সম্মুখস্থ বিরাট ছাদের কিছু সৌন্দর্যবৃদ্ধির চেষ্টাও লক্ষিত হয়; ২৫ চৈত্র [6 Apr 1872]-এর হিসাবে দেখি: ‘তেতালার ছাদে ফুলের টব দেওয়ায় টবের মূল্য ও টব আনিবার গাড়ি ভাড়া…৮।৵°’। এই সূচনা পরে এই ছাদটিকে বাগান করে তুলেছিল; কিন্তু সে অনেক পরের কথা, তখন দেবেন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বসবাস ত্যাগ করেছেন ও তাঁর শূন্যস্থানে এসেছেন কাদম্বরী দেবী-সহ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।

এ বছর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সীমানাও কিছুটা বৃদ্ধি পায়। ৪ চৈত্র [শনি 16 Mar 1872] তারিখের হিসাবে দেখা যায়—‘বাবু দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের খাতে/খরচ ১৫০০৲/ব° মহেন্দ্রনাথ সেন/দ° বাটীর সম্মুখের জায়গা ক্রয়ের জন্য শোধ…১৫০০৲’।

বাড়ির ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার আয়োজনের দিকে তাকালে দেখা যায়, হেমেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠপুত্র হিতেন্দ্রনাথ Feb 1871-এ নর্মাল স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন, আর Apr 1871-এ বেথুন স্কুলে ভর্তি হন তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা প্রতিভা দেবী—২৯ চৈত্র ১২৭৭-এর [11 Apr 1871] হিসাবে দেখি ‘ব° Supdt. Bethune School/ শ্রীমতী প্রতিভাসুন্দরী দেবীর/বেথুন ইস্কুলের এপ্রিল মাহার ফি ১৲/ও এনন্ট্রান্স ফি ১৲ একুনে শোধ/বিঃ একবিল-২৲’। দীর্ঘকাল পরে প্রতিভা দেবীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাঁর ভাই ক্ষিতীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: ‘৺হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁহার পুত্রকন্যাদিগকে সর্ব্ববিষয়ে সুশিক্ষিত করিবার জন্য যে বিপুল আয়াস পাইতেন, তাহা সংসারে, বিশেষত সে কালে ভারতবাসীগণের মধ্যে নিতান্ত বিরল ছিল। তিনিই সৰ্ব্বপ্রথম বালিকাগণের মধ্যে উচ্চশিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে প্রতিভা দেবীকে বেথুন স্কুলে প্রেরণ করেন।’৩১ উক্তিটি যথার্থ নয়, কারণ অন্যেরা তো বটেই—এমন-কি দেবেন্দ্রনাথ তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা সৌদামিনী দেবীকে বেথুন স্কুলে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেই শিক্ষা খুব অল্পদিনই তিনি পেয়েছিলেন, সেদিক থেকে প্রতিভা দেবী ঠাকুর পরিবারে একটি নূতন যুগের সূচনা করেন। তাঁর চেয়ে কয়েক বছরের বড়ো ইরাবতী দেবীর জন্যও এ-ধরনের শিক্ষার বন্দোবস্ত করা হয়নি। প্রতিভা দেবীর আদর্শে কয়েকমাস পরে দ্বিজেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠা কন্যা সরোজা Aug 1871-এ এবং ওই বছরেরই Nov মাসে সৌদামিনী দেবীর কনিষ্ঠা কন্যা ইন্দুমতী [এঁর নাম প্রথমে দিদি ইরাবতীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয়েছিল ইন্দ্রাবতী] বেথুন স্কুলে ভর্তি হন।

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ২

আদি ব্রাহ্মসমাজের দ্বাচত্বারিংশ সাংবৎসরিকের কিছু বিবরণ আমরা এই অধ্যায়েরই অন্যত্র দিয়েছি, সুতরাং এখানে পুনরুক্তির প্রয়োজন নেই। কিন্তু এই বৎসর আদি ও ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে ব্রাহ্মবিবাহ-পদ্ধতি নিয়ে বিতর্কের যে ঝড় উঠেছিল, তার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার। ব্রাহ্মসমাজের ইতিহাসে, যার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জীবনও নানাভাবে যুক্ত, এই ঘটনা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

ব্রাহ্মদের জন্য যে অনুষ্ঠান-পদ্ধতি দেবেন্দ্রনাথ রচনা করেন, সেখানে বিবাহানুষ্ঠানে হিন্দুরীতির অধিকাংশই গৃহীত হলেও পৌত্তলিকতা-দুষ্ট বলে শালগ্রামশিলা আনয়ন ও হোমাদি অগ্নি-সংস্কার বর্জিত হয়। 1861-এ দেবেন্দ্রনাথের দ্বিতীয়া কন্যা সুকুমারী দেবীর বিবাহ থেকে আরম্ভ করে পরবর্তী কালের ব্রাহ্মবিবাহসমূহ এই রীতি অনুসারেই নিষ্পন্ন হচ্ছিল। কিন্তু কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ পদ্ধতিটির আরও সংস্কার করে নান্দীশ্রাদ্ধ, সপ্তপদীগমন, কুশণ্ডিকা প্রভৃতি অঙ্গও বাদ দেয় এবং পদ্ধতিটি আইনসম্মত কিনা এই প্রশ্ন নিয়ে 20 Oct 1867-এর একটি সভায় আলোচনা করে এবং পরবর্তী 5 Jul 1868-এর সভায় গবর্মেন্টের কাছে এ-বিষয়ে আবেদন করার সিদ্ধান্ত করে, আমরা যথাস্থানে এ-প্রসঙ্গ আলোচনা করেছি। কেশবচন্দ্র-প্রমুখকে প্রশ্নটি বিশেষভাবে বিচলিত করেছিল, কারণ তাঁরা প্রচলিত হিন্দুধর্মের বিরোধী অসবর্ণ-বিবাহের ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন, অথচ এই ধরনের বিবাহের আইনগত বৈধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ারও দরকার ছিল।

10 Sep 1868 তারিখে গভর্নর জেনারেলের ব্যবস্থাপক সভার আইন-সদস্য মিঃ হেনরি সাম্‌নার মেইন [Mr. Henry Sumner Maine] যে বিবাহ-বিধির খসড়া [‘A Bill to legalize marriages between persons not professing the Christian Religion and objecting to marry according to the orthodox rites of any of the existing religions of India.’] সভার বিবেচনার জন্য উপস্থিত করেন, বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের বিরোধিতার ফলে তা আইনে পরিণত না হয়ে সংশোধনের জন্য সিলেক্ট কমিটিতে প্রেরিত হয়। ইতিমধ্যে কেশবচন্দ্র ইংলণ্ডে চলে যাওয়ায় ব্যাপারটি তখনকার মতো চাপা পড়ে যায়। কিন্তু ইংলণ্ড থেকে ফিরে এসে তিনি সম্পূর্ণ গোপনে এ-বিষয়ে আবার উৎসাহ দেখাতে থাকেন। ফলে খসড়াটি সংশোধিত হয়ে, নিয়মানুযায়ী গেজেটে প্রকাশিত না হয়েই, কেবলমাত্র ব্রাহ্মদের বিবাহ আইন-সিদ্ধ করবার জন্য নূতন নামে [‘A Bill to legalize mariages between the members of the sect called the Brahma Samaj’] 3 Mar 1871 [শুক্র ১৮ চৈত্র ১২৭৭] তারিখে বিধিবদ্ধ হবার ব্যবস্থা পাকা হয়ে যায়। আকস্মিকভাবে আদি ব্রাহ্মসমাজের কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জানতে পারেন এবং নবগোপাল মিত্র ও সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় গবর্নর হাউসে গিয়ে প্রতিবাদপত্র জমা দিয়ে আসেন, ফলে বিলটি বিধিবদ্ধ করা স্থগিত রাখা হয়।

এর পর দুই ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে এবং সংবাদপত্রগুলিতে তুমুল বিতর্কের ঝড় শুরু হয়। অবশ্য এ-ব্যাপারে আদি সমাজ যে সংযম দেখিয়েছিলেন, ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের পক্ষে তা দেখানো সম্ভব হয়নি, ধর্মতত্ত্ব পত্রিকার এই সময়কার বিভিন্ন সংখ্যায় কটূক্তির মাত্রা কখনও কখনও শালীনতার সীমাও অতিক্রম করে গেছে। ঠিক হয়েছিল July 1871-এ সিমলায় ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশনে ‘ব্রাহ্মবিবাহ বিল’ বিধিবদ্ধ হবে। ঐ মাসেই নবগোপাল মিত্র ও সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় সিমলায় গিয়ে প্রায় দু-হাজার লোকের স্বাক্ষর-সহ একটি আবেদনপত্র তৎকালীন আইন-সদস্য মিঃ স্টিফেনের হস্তে প্রদান করেন। আবেদনপত্রটি ‘Memorial against the Brahmo Marriage Bill to the Viceroy’ নামে The National Paper-এর 19 Jul 1871 [Vol. VII, No. 28] সংখ্যায় ৪ পৃষ্ঠার একটি ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হয় [দ্র তত্ত্ববোধিনী, জ্যৈষ্ঠ ১৭৯৪ শক (১২৭৯)।৪০-৪২]। এঁদের প্রদর্শিত যুক্তিগুলি সংক্ষেপে এইরকম: (১) বিলে নির্দিষ্ট ব্যবস্থাগুলি সকল ব্রাহ্মদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, অথচ অধিকাংশ ব্রাহ্মই এইরূপ বিধির জন্য আবেদন করেননি; ব্রাহ্মসমাজে বিজাতীয় মতাদি প্রচলন করার চেষ্টার ফলে মূল সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কেশবচন্দ্র ও তাঁর অনুগামীরা সমস্ত ব্রাহ্মসমাজের প্রতিনিধি নন। (২) এই বিল আইনে পরিণত হলে ব্রাহ্মেরা মূল হিন্দুসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন, অথচ তাঁদের উদ্দেশ্য হিন্দুসমাজের মধ্যে থেকে তার সংস্কারসাধন—আইনটি তাঁদের সেই চেষ্টার প্রতিবন্ধক। (৩) হিন্দুদের মধ্যে বহুপূর্ব থেকেই সামাজিক প্রথাসমূহ সমাজ-প্রধানদের দ্বারা পরিবর্তিত হয়ে জনসাধারণের সম্মতিতে গৃহীত হয়েছে, এর জন্য কোনো আইন করার দরকার হয়নি। তাছাড়া হিন্দুরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত, তাদের মধ্যে বিবাহাদি সামাজিক কৃত্য সম্পর্কে বিভিন্ন প্রণালী প্রচলিত আছে, সেগুলির আইনগত বৈধতা নিয়ে কখনও কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। ব্রাহ্মেরা যে বিবাহপ্রণালী অনুসরণ করেন, পৌত্তলিকতা-দুষ্ট অঙ্গগুলি বর্জন ছাড়া শাস্ত্রসম্মত বিবাহপ্রণালীর সঙ্গে তার কোনো গুরুতর প্রভেদ নেই। সুতরাং ব্রাহ্মবিবাহকে বৈধ করার জন্য আইন-প্রণয়ন অনাবশ্যক। (৪) বিলটিতে বিবাহের রেজিস্ট্রিকরণের যে ধারা সংযুক্ত হয়েছে, তাতে বিবাহ একটি চুক্তিমাত্রে পর্যবসিত হবে, কোনোরকম ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা না থাকায় বিবাহের পবিত্র ধর্মীয় চরিত্রটি এর দ্বারা ক্ষুণ্ণ হবে। (৫) বিবাহের বয়স সম্পর্কে যে ধারা বিলটিতে রয়েছে, তা দেশীয় প্রথার বিরোধী। ভারতে বিবাহযোগ্যা কন্যার বয়স চোদ্দ বছরের কম বলেই মনে করা হয়। (৬) দুই বা ততোধিক বিবাহ আইনের সাহায্যে বন্ধ করার চেষ্টা অযৌক্তিক, কারণ অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষাপ্রসার ও জনমতের চাপে বহুবিবাহ এমনিতেই বিলুপ্ত হওয়ার মুখে। (৭) ‘ব্রাহ্ম’ শব্দটির সংজ্ঞা অত্যন্ত ব্যাপক—বোম্বাইয়ের প্রার্থনাসমাজ, ইংলণ্ড ও আমেরিকার একেশ্বরবাদী সম্প্রদায় প্রভৃতিও এই ব্যাপক অর্থে ব্রাহ্মসমাজের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু উক্ত সম্প্রদায়গুলি সামাজিক ক্ষেত্রে যেমন নিজ দেশীয় প্রথারই অনুসারী, বাংলার ব্রাহ্মেরাও তেমনি সামান্য সংস্কার-সহ দেশীয় বিবাহপদ্ধতিকে গ্রহণ করেছে—তাঁদের বিশ্বাস তাঁরা প্রচলিত হিন্দুবিবাহপদ্ধতির যে অংশগুলি বাদ দিয়েছেন সেগুলি ঐ বিবাহের বৈধতার পরিপন্থী নয়। (৮) এই বিল আইনে পরিণত হলে উত্তরাধিকার সম্পর্কিত সমস্যা অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠবে।

আদি ব্রাহ্মসমাজের এই আবেদনের ফলে বিলটির সম্পর্কে বিবেচনা Dec 1871-এ কলকাতায় ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশন পর্যন্ত স্থগিত হয়ে যায়। কিন্তু ইতিমধ্যে পত্রপত্রিকায় বিতর্ক চলতে থাকে। ভারতবর্ষীয় সমাজ অভিযোগ করে, আদি সমাজ ‘যাহারা ব্রাহ্ম নহে তাহাদিগের নিকট এক খানা সাদা কাগজ লইয়া গিয়া এই রূপ প্রকাশ করেন যে, পথ ঘাট ভাল করিবার জন্য কৌলীন্য প্রথা রক্ষা করিবার জন্য দেশের মঙ্গলের জন্য আবেদন করা হইবে। ইহা শুনিয়া অনেক পৌত্তলিক তাহাতে স্বাক্ষর করিয়াছেন, তাঁহারা সেইগুলি ব্রাহ্মদের স্বাক্ষর বলিয়া ব্যবস্থাপক সভায় অৰ্পণ করিয়াছেন’ [ধর্মতত্ত্ব, ৪।১৩, ১ শ্রাবণ ১৭৯৩ শক।৪২৬]; বিদ্যালয়ের পৌত্তলিক ছাত্রদের কাছ থেকেও স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে, ইণ্ডিয়ান মিরর-এ এ-সম্পর্কে কতকগুলি পত্রও প্রকাশিত হয়। মেয়েদের বিবাহযোগ্য বয়স সম্বন্ধেও খ্যাতনামা চিকিৎসকদের মতামত গ্রহণ করা হয়। সর্বাধিক বিতর্ক ও পারস্পরিক দোষারোপ উপস্থিত হয় হিন্দুশাস্ত্রমতে ব্রাহ্মবিবাহ বৈধ কিনা এই প্রশ্নে শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের মতামতকে কেন্দ্র করে। উভয় পক্ষই এই বিষয়ে বিভিন্ন পণ্ডিতের মতামত গ্রহণ করেন এবং সেগুলির যাথার্থ্য সম্বন্ধে বিতর্ক করতে থাকেন। কিন্তু আমাদের মনে হয়, ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের সভ্যেরা—যাঁরা নিজেদের হিন্দু বলে মনে করতেন না—হিন্দু-বিবাহের রীতি-পদ্ধতি নিয়ে এতটা মাথা না ঘামালেই পারতেন, যখন 30 Sep টাউন হলের বক্তৃতায় কেশবচন্দ্র স্পষ্টই বলেন যে, এই বিবাহবিধির জন্য যদি ব্রাহ্মদের হিন্দুসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয় তাতেও কোনো ক্ষতি নেই। বিধবাবিবাহ হিন্দুশাস্ত্রানুমোদিত—এই বিষয়ে বিদ্যাসাগর যেমন সদর্থক আন্দোলন উপস্থিত করেছিলেন, অসবর্ণ বিবাহকে সেইরূপ শাস্ত্রসম্মত প্রমাণ করার চেষ্টা করলে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ হিন্দুদের মধ্যে একটি বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হতেন। কিন্তু তার বদলে ব্রাহ্মবিবাহকে অহিন্দু প্রমাণিত করার চেষ্টা করে ও নিজেদের অহিন্দু ঘোষণা করে এই শ্রেণীর ব্রাহ্মেরা নিজেদের একটি সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ ও শেষপর্যন্ত বিনষ্টির সূত্রপাত করেন।

যাই হোক, কলকাতায় 29 Nov-এর [বুধ ১৪ অগ্র] অধিবেশনে মিঃ স্টিফেন কেশবচন্দ্রের অহিন্দু ঘোষণার সুযোগ নিয়ে ‘ব্রাহ্মবিবাহ’ নামের পরিবর্তে ‘সাধারণ বিবাহ বিধি’ [Civil Marriage Act] নামে বিলটি আইনে পরিণত করার প্রস্তাব করেন। এই প্রস্তাব অনুসারে 21 Dec 1871 [৭ই পৌষ] সিলেক্ট কমিটি ‘সিভিল ম্যারেজ বিল’টি সভায় উপস্থাপিত করেন ও গেজেটে প্রকাশিত হয়। এই বিবাহবিধি যাঁরা খ্রিস্টান, ইহুদি, হিন্দু, মুসলমান, পার্সি, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন নন তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট হওয়ায় আদি ব্রাহ্মসমাজ, হিন্দু বা অন্যান্য সম্প্রদায় এর বিরোধিতা করেননি। কিন্তু 16 Jan 1872 [৪ মাঘ] বিলটি আইনে পরিণত হবে স্থির হলেও মিঃ ইংলিশ [Mr. Inglis]-এর প্রতিরোধে তা হতে পারেনি। এর পর ৪ Feb [২৬ মাঘ] তারিখে আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ারে জনৈক শের আলির ছুরিকাঘাতে গবর্নর জেনারেল লর্ড মেয়োর মৃত্যু ঘটায় এক্ষেত্রে আরও বিলম্ব ঘটে। শেষে ৭ চৈত্র ১২৭৮ মঙ্গলবার 19 Mar 1872 তারিখে প্রায় চারঘন্টা বিতর্কের পর বিলটি আইনে পরিণত হয় এবং Civil Marriage Act বা Act III of 1872, i.c. কিংবা সাধারণভাবে ‘তিন-আইনের বিবাহ’ নামে প্রচলিত হয়। আইনের বিধানগুলি মোটামুটি এইরকম: (১) দেশীয় বা বিদেশি, যাঁরা খ্রিস্টানাদি প্রচলিত ধর্মসম্প্রদায়ভুক্ত নন, তাঁরা এই আইন অনুযায়ী বিবাহ করতে পারবেন; (২) বরের বয়স আঠারো এবং কন্যার বয়স চোদ্দ বছর হওয়া চাই। বর-কন্যা একুশ বছরের কমবয়স্ক হলে অভিভাবকের সম্মতি প্রয়োজন, বিধবা সম্পর্কে এই সম্মতির দরকার নেই; (৩) সগোত্রে বিবাহে বাধা না থাকলেও অবিবাহ্য নিকটসম্বন্ধগুলি মানতে হবে। মাতৃ- বা পিতৃ-পক্ষে বিবাহ হতে পারে, কিন্তু সে ক্ষেত্রে চার পুরুষের অধস্তন হওয়া আবশ্যক; (৪) ভিন্ন জাতির মধ্যে বিবাহ হলে পিতৃপক্ষ যে বিধানের অধীন, সন্তানেরাও সেই বিধানের অধীন হবে; (৫) গবর্মেন্ট-নিযুক্ত রেজিস্ট্রারের কাছে নোটিশ দেওয়ার চোদ্দ দিনের মধ্যে প্রতিরোধের কারণ উপস্থিত না হলে বিবাহ হতে পারে; (৬) রেজিস্ট্রার ও তিন জন সাক্ষীর সামনে বিবাহ নিষ্পন্ন হবে—বর ও কন্যা নিজেদের ইচ্ছামত পদ্ধতিতে বিবাহ করতে পারে, কিন্তু পদ্ধতিতে ‘আমি অমুক তোমায় বৈধ পত্নীত্বে (বা বৈধ স্বামিত্বে) গ্রহণ করলাম’ এই কথার উল্লেখ থাকা চাই; (৭) রেজিস্ট্রারের অফিসে বা অন্যত্র বিবাহ হতে পারবে, তবে অন্যত্র বিবাহ হলে অধিক ফী লাগবে; (৮) এই আইনে যাঁরা বিয়ে করবেন, তাঁরা স্বামী বা পত্নীর জীবৎকালে অপর বিবাহ করলে অথবা এই বিবাহের আগে এক বা তদধিক স্বামী বা পত্নী থাকলে, দণ্ডবিধির ব্যবস্থামত দণ্ডিত হবেন, কোনো একজন ধর্মান্তর গ্রহণ করলেও এ নিয়মের বহির্ভূত গণ্য হবেন না; (৯) এই আইনমতে বিবাহে ভারতবর্ষীয় ত্যাগবিধির [divorce] বিধান প্রযুক্ত হবে; (১০) যে সব বিবাহ পূর্বেই নিষ্পন্ন হয়েছে, 1 Jan 1873-র পূর্বে সেগুলিকে এই আইন অনুযায়ী রেজিস্ট্রি করা যাবে।

এই আইন ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের আকাঙিক্ষত রূপে বিধিবদ্ধ না হলেও, দীর্ঘকালের প্রচেষ্টা জয়যুক্ত হওয়াতে তাঁদের আনন্দের সীমা রইল না। কিন্তু সেই আনন্দ অবিমিশ্র ছিল না; ১৬ চৈত্রের ধর্মতত্ত্ব [৫।৬]-তেই লিখিত হয়: ‘এই বিধির কোন কোন নিয়ম আপাততঃ ব্রাহ্মদিগের পক্ষে অত্যন্ত কঠোর হইয়া পড়িয়াছে। পাত্র পাত্রীর ২১ বৎসর বয়ঃক্রম না হইলে তাঁহাদিগকে অভিভাবকের মত লইয়া বিবাহ করিতে হইবে। বর্ত্তমান সময়ে ব্রাহ্মদিগের যেরূপ অবস্থা তাহাতে অনেক স্থলেই পিতা মাতার অমতে ব্রাহ্মদিগকে বিবাহ করিতে হইবে। সুতরাং তাঁহাদের পক্ষে এ নিয়মে বড় কঠিন ব্যবহার হইবে। ২১ বৎসর বয়সে উপনীত না হইলে আর তাঁহারা স্বাধীন ভাবে বিবাহে অধিকার পাইবেন না।’ মাত্র ছ’বছর পরে কেশচন্দ্রের কন্যা সুনীতি দেবীর সঙ্গে কুচবিহারের রাজার বিবাহে এই বিধির বিধান ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের পক্ষে আরও কঠোরতর লেগেছিল, যখন বর-কন্যার নিম্নতম বয়সের প্রশ্নকে কেন্দ্র করেই ঐ সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালেও ‘হিন্দু নই’ এই ঘোষণা করা অনেক ব্রাহ্মের পক্ষেই কত বেদনাদায়ক হয়েছিল, দেবেন্দ্রনাথের জীবনীকার অজিতকুমার চক্রবর্তী তার দীর্ঘ বিশ্লেষণ করেছেন [দ্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ৪২৬-২৮], কিন্তু তখন অনেক চেষ্টাতেও আইনের এই ধারাটি সংশোধন করা সম্ভব হয়নি। আবার 29 Jul 1881-এ কৃষ্ণকুমার মিত্রের সঙ্গে রাজনারায়ণ বসুর কন্যা লীলা দেবীর বিবাহে কিংবা স্বর্ণকুমারী দেবীর একমাত্র পুত্র জ্যোৎস্নানাথ ঘোষালের সঙ্গে কুচবিহারের রাজকুমারীর বিবাহে [1899] আদি ব্রাহ্মসমাজ-ভুক্ত আত্মীয়েরা যোগদান করতে পারেননি, এমন বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটতে পেরেছিল এই বিবাহবিধি-সংক্রান্ত মতভেদকে কেন্দ্র করে, রবীন্দ্রনাথও সেই বেদনার অংশীদার হয়েছিলেন।

এই বৎসর কেশবচন্দ্র ২৩ মাঘ ১২৭৮ [সোম 5 Feb 1872] তারিখে বেলঘরিয়ায় জয়গোপাল সেনের বাগানে ‘ভারত আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন। ইংল্যাণ্ডে অবস্থানকালে ইংরেজদের জীবনযাত্রা দেখে তিনি মুগ্ধ হন। শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন: ‘তাঁহার মনে হইল, কতকগুলি ব্রাহ্ম পরিবারকে একত্র রাখিয়া, কিছুদিন সময়ে আহার, সময়ে বিশ্রাম, সময়ে কাজ, সময়ে উপাসনা, এইরূপ নিয়মাধীন রাখিয়া, শৃঙ্খলামতো কাজ করিতে আরম্ভ করিলে, তাহারা সেই ভাব লইয়া গিয়া চারিদিকের ব্রাহ্ম পরিবারে ব্যাপ্ত করিতে পারে। এই ভাব লইয়া তিনি ভারত আশ্রম স্থাপন করিলেন।’৩২ তাঁর সংকল্প মহৎ ছিল, কিন্তু মধ্যবিত্ত বাঙালি মানসিকতা বোঝার অক্ষমতায় কিছুদিনের মধ্যে এই আশ্রমের জন্যই তাঁকে বহু বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৩

রবীন্দ্রনাথ বাল্যকালে বিদ্যালয়ের পাঠ্য-তালিকার বাইরে যে পুস্তকগুলি পাঠ করেছিলেন, তার মধ্যে কয়েকটির কথা তিনি নানা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন। এই বইগুলির সম্পর্কে পাঠকদের কৌতূহল থাকতে পারে, সেইজন্য কতকগুলি পুস্তকের মোটামুটি পরিচয় এখানে দেওয়া হল। এর মধ্যে বেশির ভাগ বই বাড়ির মেয়েদের দ্বারা সংগৃহীত। এ-সম্বন্ধে স্বর্ণকুমারী দেবী লিখেছেন: ‘মনে আছে, বাড়ীতে মালিনী বই বিক্রী করিতে আসিলে মেয়েমহল সেদিন কি রকম সরগরম হইয়া উঠিত। সে বটতলার যত কিছু নূতন বই, কাব্য, উপন্যাস, আষাঢ়ে গল্প অন্তঃপুরে আনিয়া দিদিদের লাইব্রেরীর কলেবর বৃদ্ধি করিয়া যাইত। …বড় হইয়া সে-কালের বইগুলি যথেষ্ট নাড়াচাড়া করিয়াছি,—মানভঞ্জন, প্রভাস-মিলন, দূতী-সংবাদ, কোকিলদূত, রুক্মিণীহরণ, পারিজাতহরণ, গীতগোবিন্দ, প্রহ্লাদচরিত্র, রতিবিলাপ, বস্ত্রহরণ, অন্নদামঙ্গল, আরব্যোপন্যাস, পারস্যোপন্যাস, চাহার-দরবেশ, হাতেমতাই, গোলেবকায়লী, লয়লামজনু, বাসবদত্তা, কামিনীকুমার ইত্যাদি।’৩৩ মনে হয়, এর সবগুলি না হলেও, বেশির ভাগই রবীন্দ্রনাথও পাঠ করেছিলেন। আমরা অবশ্য রবীন্দ্রনাথ-উল্লিখিত বইগুলি সম্পর্কেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।

বেতালপঞ্চবিংশতি—ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর-কর্তৃক ‘বৈতালপচীসীনামক প্রসিদ্ধ হিন্দী পুস্তক অবলম্বন’ করে লিখিত। প্রথম প্রকাশ: 1847, পৃ ১৬৩। ‘বেতালপঞ্চবিংশতি। কালেজ্‌ আফ্‌ ফোর্ট উইলিয়ম নামক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ শ্ৰীযুত মেজর জি. টি: মার্শাল মহোদয়ের আদেশে প্রসিদ্ধ হিন্দী পুস্তক অনুসারে লিখিত শ্ৰীযুত পি. এস. ডি. রোজারিও কোম্পানির মুদ্রাযন্ত্রে প্রকাশিত সংবৎ ১৯০৩।’৩৪

রবিনসন ক্রুসো—Daniel Defoe [1660-1731]রচিত Robinson Crusoe [1719]-র জন রবিনসন-কৃত অনুবাদ। জেমস্ লঙ-এর A Descriptive Catalogue of Bengali Works [1855]এ প্রদত্ত গ্রন্থটির বিবরণ: ‘63. (E.T.) ROBINSON CRUSOE—1st part, Robinson Krushu, pp. 261. 8as., Roz. & Co. This “master-piece of fiction” was translated into plain Bengali by the Rev. J. Robinson, for the Vernacular Literature Committee—a second edition is now in the press…It is illustrated by 18 wood cuts.’ উক্ত কমিটির দ্বারা প্রকাশিত মধুসূদন মুখোপাধ্যায়ের ‘কুৎসিত হংসশাবক ও খর্ব্বকায়ার বিবরণ’ [1858] গ্রন্থে প্রদত্ত তালিকায় কিন্তু বিবরণের সামান্য পার্থক্য দেখা যায়—‘রবিন্সন ক্রুশোর ভ্রমণ বৃত্তান্ত,/বারখানি চিত্রযুক্ত…[পৃ] ৩২৬ [মূল্য] ৷৵°’—এটি হয়তো দ্বিতীয় সংস্করণের বইটির বিবরণ। ‘গার্হস্থ্য বাঙ্গালা পুস্তক সঙ্গহ’ সিরিজের এইটিই প্রথম বই। বইটির একটি বিশেষত্ব এই যে, এতে চরিত্র ও দেশের নামগুলি এবং আনুষঙ্গিক বর্ণনার পরিবর্তন ঘটানো হয়েছিল।

আরব্য উপন্যাস—নীলমণি বসাক [? 1808-64) কর্তৃক অনূদিত। লঙ-এর ক্যাটালগে গ্রন্থটির বিবরণ—‘327. (E.T.) ARABIAN NIGHTS, tr. by N.M. Baisak, 1st ed. 1850, 2nd ed., S.P. [Sanskrit Press], 1854, pp. 576. Tales 52 in number written in a simple style, giving much innocent amusement in the perusal, besides making the Hindus better acquainted with Moslem manners, and modes of thought.’ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, গ্রন্থটির প্রথম খণ্ড ১২৫৬ সালে এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড ১২৫৭ সালে প্রকাশিত হয়; 1854-এর প্রথম ভাগে তিনটি খণ্ড ‘পুনঃ সংশোধিত এবং তাহাতে আর আর কয়েক উৎকৃষ্ট গল্প সংযোজিত করিয়া’ একত্রে প্রকাশিত হয়।৩৫ বইটি জনপ্রিয় হয়েছিল, ৪র্থ সংস্করণ প্রকাশিত হয় Aug 1870-তে, ৫০০ পৃষ্ঠার গ্রন্থটির দাম ছিল দু-টাকা। ১২৫৬ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত গ্রন্থটির প্রথম খণ্ডের আখ্যাপত্রটি এইরূপ: ‘আরব্য উপন্যাস।/প্রথম খণ্ড/ইংরাজী প্রসিদ্ধ আরেবিয়ান নাইট হইতে/বাঙ্গলা ভাষায়/শ্রীযুক্ত নীলমণি বসাক কর্তৃক/অনুবাবাত [য] হইয়া/কলিকাতার কলুটোলায় হিন্দুস্থান যন্ত্রে মুদ্রাঙ্কিত হইল।/১২৫৬’। পৃ ৪+১৬৬+২। এই গ্রন্থের অন্তর্গত ‘সিন্ধবাদের নাবিকের কথা’ [পৃ ১২১-৬৬]-র উল্লেখ রবীন্দ্রনাথ করেছেন।

পারস্য উপন্যাস—নীলমণি বসাক 1834-এ ‘পারস্য ইতিহাস’ নামে গ্রন্থটি পদ্যানুবাদে প্রকাশ করেন; 1856-এ ‘গদ্যের অধিক গৌরব’-হেতু পুনরায় এটিকে গদ্যে অনুবাদ করেন। 1867-এ প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণে গ্রন্থটির পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ৩৯৩ ও দাম দেড় টাকা।৩৬

সুশীলার উপাখ্যান—মধুসূদন মুখোপাধ্যায় কর্তৃক তিন খণ্ডে রচিত সুশীলা নামের একটি মেয়ের উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে আদর্শ কন্যা, পত্নী ও মাতা হয়ে ওঠার কাহিনী। গ্রন্থটির প্রথম ভাগের আখ্যাপত্র: BENGAL FAMILY LIBRARY/গার্হস্থ্য বাঙ্গলা পুস্তক সঙ্গহ। সুশীলার উপাখ্যান।/প্রথম ভাগ। /বঙ্গদেশীয় গৃহস্থবালিকাদিগের ব্যবহারার্থ/শ্রীযুক্ত মধুসূদন মুখোপাধ্যায়/কর্ত্তৃক/প্রণীত।/CALCUTTA/BAHIR MIRZAPORE/PRINTED FOR THE VERNACULAR LITER-/ATURE COMMITTEE* AT THE/VIDYARATNA PRESS/By Girisha Chandra Sarma./1859/Price 3 annas.—মূল্য৺° তিন আনা।’ বইটির পৃষ্ঠাসংখ্যা ৭৪। গ্রন্থটির দ্বিতীয় ভাগ [মূল্য চার আনা, পৃ ১০৮] Dec 1859-এ এবং তৃতীয় ভাগ [মূল্য পাঁচ আনা, পৃ ১৩৪] Sep 1860-তে প্রকাশিত হয়। এটি সেযুগের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় গ্রন্থ, প্রায় প্রত্যেক বালিকা-বিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল।

মৎস্যনারীর কথা—এটিও ‘গার্হস্থ্য বাঙ্গালা পুস্তক সংগ্রহ’ সিরিজের অন্তর্গত মধুসূদন মুখোপাধ্যায় কর্তৃক অনূদিত একটি রূপকথার কাহিনী [1857]। বইটির মূল নাম অবশ্য সামান্য পৃথক। এর আখ্যাপত্রটি—এইরূপ—‘মরমেত/অর্থাৎ/মৎস্যনারীর উপাখ্যান/শ্রীযুক্ত মধুসূদন মুখোপাধ্যায়/কর্ত্তৃক/ইংরাজি ভাষা হইতে/অনুবাদিত।/CALCUTTA/PRINTED FOR THE VERNACULAR LITERATURE/COMMITTEE/BY Annund Chunder Vedantuvagees./AT THE TUTTOBODHINEE PRESS./1857./Price 9 Pice. মূল্য ৵ ৫ নয় পয়সা।’ ৭৮ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে একটি কাঠখোদাই ছবি আছে—‘মৎস্য নারীর সাহায্যেতে/এই রাজ কুমার রক্ষা পাইয়া ছিলেন/শ্রীরামধন দাস স্বর্ণকারের খোদিত সাং সিমুল্যা’। হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যাণ্ডারসন [1805-75]-এর বিখ্যাত ‘Mermaid’ গল্পটি এই গ্রন্থে অনূদিত হয়েছে। মধুসূদন মুখোপাধ্যায় এই সিরিজে অ্যাণ্ডারসনের আরও তিনটি গল্প ‘চীন দেশীয় বুলবুল পক্ষীর বিবরণ’ [1857] ও ‘কুৎসিত হংসশাবক ও খর্ব্বকায়ার বিবরণ’ [1858] গ্রন্থে অনুবাদ করেছিলেন। এই দুটি বইও হয়তো রবীন্দ্রনাথ পড়েছিলেন।

গোলেবকাওলি—উমাচরণ মিত্র কর্তৃক অনূদিত। লঙ-এর ক্যাটালগে গ্রন্থটির এইরূপ বিবরণ দেওয়া হয়েছে: ‘331. (P.T.) Gole Bakaoli, by Umachurn Mittre, Bi. B.P. 1855, pp. 113, 2 as. A very popular work, a fairy tale: adventure of a blind Persian King, in search of a rose, said to have the property of restoring the sight.’ বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদ গ্রন্থাগারে বইটির পরবর্তী কোনো সংস্করণের একটি খণ্ডিত কপি আছে; তার আখ্যাপত্রটি এইরূপ: ‘গোলেবকাঅলি।/অর্থাৎ।/পারস্ব বকাঅলি গ্রন্থ হইতে বঙ্গভাষায়/পয়ারাদি নানাবিধ ছন্দে/শ্রীযুক্ত উমাচরণ মিত্র। ও/শ্রীযুক্ত প্রাণকৃষ্ণ মিত্র। /দ্বারা অনুবাদিত। ইদানীং/শ্রীইন্দ্রনারায়ণ ঘোসের সুধানিধি যন্ত্রে মুদ্রিত হইল/কলিকাতা।/চিৎপুর রোড বটতলা ২৪৪-১ নং বাটি।/সন ১২৬৭ সাল তারিখ ১৬ আশাড়। শকাব্দাঃ ১৭৮২।’

বিজয়-বসন্ত—হরিনাথ মজুমদার [‘কাঙাল হরিনাথ’, 1833-96] প্রণীত সংস্কৃত ‘কথা’-জাতীয় উপাখ্যান [প্রথম প্রকাশ: ১৭৮১ শক, ১২৬৬ বঙ্গাব্দ]। ‘প্রথম বারের বিজ্ঞাপন’-এ হরিনাথ লিখেছিলেন, ‘…এক্ষণে কামিনীকুমার, রসিকরঞ্জন, চাহারদরবেশ, বাহারদানেশ প্রভৃতি যে সমুদয় রূপক ইতিহাস প্রচারিত আছে, সে সমুদয়ই অশ্লীল ভাব ও রসে পরিপূর্ণ। তৎপাঠে উপকার না হইয়া বরং সর্ব্বতোভাবে অনর্থের উৎপত্তি হয়। এই সমুদায় অবলোকনে বালকদিগের রূপক-পাঠের নিমিত্ত কতিপয় বন্ধুর অনুরোধে আমি বিজয়-বসন্ত নামক এই গ্রন্থ প্রণয়নে প্রবৃত্ত হই। ইহা কোন পুস্তক হইতে অনুবাদিত নহে, সমুদয় বিষয়ই মনঃকল্পিত। ইহার আদ্যন্ত কেবল করুণরসাশ্রিত ও নীতিগর্ভ বিষয়ে পরিপূর্ণ।’ কোনো-কোনো বিদ্যালয়ে পাঠ্য-তালিকাভুক্ত হওয়া ছাড়াও বইটি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল—১৭৮৪, ১৭৮৭ ও ১৭৯১ শকে আরও তিনটি সংস্করণ প্রকাশিত হওয়া তারই প্রমাণ। ১৩০৮ বঙ্গাব্দে বসুমতী প্রতিষ্ঠান থেকে জলধর সেনের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘হরিনাথ গ্রন্থাবলী’তে ‘বিজয়-বসন্ত’ অন্তর্ভুক্ত হয়।

রাজা প্রতাপাদিত্য রায়ের জীবন-চরিত—হরিশ্চন্দ্র তর্কালঙ্কার-রচিত গ্রন্থটির প্রকৃত নাম ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ [1853]। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের শিক্ষক রামরাম বসুর এই নামেরই বইটি [1801] বঙ্গাক্ষরে মুদ্রিত প্রথম মৌলিক গদ্যগ্রন্থ। বর্তমান গ্রন্থটি বিষয়ের দিক থেকে রামরাম বসুর বইটির কাছে ঋণী হলেও ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গীর ক্ষেত্রে উন্নততর। গ্রন্থটির আখ্যাপত্রটি এইরূপ—‘BENGALI FAMILY LIBRARY./গার্হস্থ্য বাঙ্গালা পুস্তকসংগ্রহ।/THE HISTORY OF/RÁJÁ PRATAPADITYA/ “THE LAST KING OF SAUGUR ISLAND”/BY/HARISH CHANDRA TARKALANKAR/EX-STUDENT OF THE SANSKRIT COLLEGE./ রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র। /CALCUTTA:/PRINTED FOR THE VERNACULAR LITERATURE SOCIETY,/AND SOLD BY MESSRS. D’ROZARIO & CO.; AND AT/THE TATTWABODHINI PRESS./1853.’ ৪+৬৩ পৃষ্ঠার এই বইটির দাম ছিল দু’আনা। জীবনস্মৃতি-র ‘গ্রন্থপরিচয়’-এ [১৭।৪৬৮] বইটি প্রসঙ্গে সংশয়-চিহ্ন-যোগে ‘বঙ্গাধিপ পরাজয়’-এর উল্লেখ করা হয়েছে। ‘বঙ্গাধিপ পরাজয়’ দু’খণ্ডে প্রকাশিত [1868, 1884] প্রতাপচন্দ্র ঘোষের লেখা সুবৃহৎ ঐতিহাসিক উপন্যাস; রবীন্দ্রনাথ এটি পড়েছিলেন এবং নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীকে পড়ে শোনাতেন সেকথা লিখেছেন ছেলেবেলা-য় [২৬|৬১০], কিন্তু বাল্যকালে পড়া গ্রন্থের যে-তালিকা তিনি দিয়েছেন সেটি ‘বঙ্গাধিপ পরাজয়’ নয়।

এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ-পঠিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পাঠ্যপুস্তকের বিবরণও আমরা সংকলন করতে পারি। আমরা পূর্বেই বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় [1855], মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা [1849] ও শুভঙ্কর দাস পণ্ডিতের শিশুবোধক ও অন্যান্য কয়েকটি গ্রন্থের পরিচয় উদ্ধার করেছি। এখানে রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক উল্লিখিত কয়েকটি বিদ্যালয়পাঠ্য পুস্তকের বিবরণ দেওয়া হচ্ছে।

বোধোদয়—ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত; প্রথম প্রকাশ: Apr 1851, ‘বিজ্ঞাপন’-এর তারিখ—২৫ চৈত্র, ১২৫৭ [6 Apr 1851]। বইটি ‘শিশুশিক্ষা—চতুর্থ ভাগ’-রূপে বিভিন্ন ইংরেজি পুস্তক অবলম্বনে সংকলিত হয়। পারিপার্শ্বিক জগতের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে শিশুমনের কৌতূহল মেটানোর চেষ্টা গ্রন্থটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

সীতার বনবাস—ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত; প্রথম প্রকাশ: Apr 1860, ‘বিজ্ঞাপন’-এর তারিখ—১৯১৭ সংবৎ [১২৬৭] ১ বৈশাখ। ভবভূতির উত্তরচরিত নাটকের প্রথম অঙ্ক ও রামায়ণের উত্তরকাণ্ড অবলম্বনে লিখিত।

চারুপাঠ—অক্ষয়কুমার দত্ত প্রণীত; প্রথম প্রকাশ: ১ম ভাগ—৪ শ্রাবণ ১৭৭৫ শক [1853], ২য় ভাগ—শ্রাবণ ১৭৭৬ শক [1854] ও ৩য় ভাগ—২২ আষাঢ় ১৭৮১ শক [1859]। ১ম ভাগের ‘বিজ্ঞাপন’-এ লিখিত হয়: ‘এ গ্রন্থ যে নানা ইঙ্গরেজি পুস্তক হইতে সঙ্কলিত, ইহা বলা বাহুল্য। যে সকল প্রস্তাব ইহাতে সংগৃহীত হইল, তাহার অধিকাংশ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতে এবং একটী প্রস্তাব প্রভাকর পত্রে প্রথম প্রকটিত হয়, অবশিষ্ট কয়েকটি বিষয় নূতন রচিত হইয়াছে।’ Rev. J. Long তাঁর বিখ্যাত Catalogue-এ প্রথম ভাগটির এইরূপ বিবরণ দিয়েছেন—‘184. Charu pat, pt. 1, by Akhaykumar Dut, T.P., 1853, pp. 104, 8 as. Roz. & Co., with miscellaneous information on knowledge, and its pleasures, on philanthropy, the passions, treats of the following subjects: volcanoes, the walrus, beaver, Russian mica, polypus, laws of vegetation, attraction, atoms, fire-flies of South America, ourang outang, cataract, boiling springs with wo cuts of Vesuvius, the river horse, beaver, flowers, fire-fly, ourang-outang.’ ২য় ভাগের বিবরণ: ‘185. Charu Pat, pt. 2, T.P., pp. 102, 8 as. 1853. Besides Literature and Ethics, treats of Corals, Icebergs, Balloons, the Compass, the Moon, Solar System, Thermo-meter, Comets.’

‘চারুপাঠ—২য় ভাগ’-এর ‘বিজ্ঞাপন’-এ লিখিত হয়েছিল—‘…বিশ্বান্তৰ্গত বহুপ্রকার প্রাকৃত বিষয়ের বৃত্তান্ত, জনসমাজের শ্রীবৃদ্ধি-সম্পাদক কতিপয় শিল্প-যন্ত্রের বিবরণ, নানাপ্রকার প্রয়োজনোপযোগী নীতিগর্ভ প্রস্তাব ইত্যাদি হিতকর বিষয়-সমুদায় ইহাতে নিবেশিত হইয়াছে।…’ গ্রন্থের সূচিপত্রটিও যথেষ্ট আকর্ষণীয়:

প্রথম পরিচ্ছেদ। নীতি-চতুষ্টয়; বল্মীক; সন্তোষ ও পরিশ্রম, হিম-শিলা; মুদ্রা-যন্ত্র।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। ব্যোম-যান; মাতাপিতার প্রতি ব্যবহার; দিগদর্শন; অসাধারণ অধ্যবসায়; প্রবাল; অসাধারণ স্মারকতা-শক্তির উদাহরণ; পরিশ্রম।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ। চন্দ্র; জান্ ফ্রেড্‌রিক্‌ ওবর্লিন; আলেয়া; প্রভু ও ভৃত্যের ব্যবহার; আত্মসংযম।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ। সৌর জগৎ; গ্রহ ও উপগ্রহ; ধূমকেতু; সৎকথন ও সদাচার; তাপমান; জন্ম-ভূমি;

পঞ্চম পরিচ্ছেদ। মানস-সরোবর; আলোকচিত্র; মেরু-জ্যোতিঃ; দিব্য-বিহঙ্গ; আত্মোন্নতিবিধান; সিংহ; ব্যাঘ্র; ভল্লুক; হস্তী; গণ্ডার; গরিলা; কাশ্মীর; ভূমিকম্প; তাড়িত-বল; পূৰ্ত্ত-বৈজ্ঞানিক-ব্ৰনেল্‌-কীৰ্ত্তি; রাজভক্তি।

পদার্থ বিদ্যা—অক্ষয়কুমার দত্ত প্রণীত; প্রথম প্রকাশ: শ্রাবণ ১৭৭৮ শক [1856]। পরবর্তী একটি সংস্করণের আখ্যাপত্রটি এইরূপ: ‘ELEMENTS/OF/NATURAL PHILOSOPHY/IN BENGALI/MATTER AND MOTION/BY UKKHOYCOOMAR DUTT./…/ পদার্থ বিদ্যা।/জড়ের গুণ ও গতির নিয়ম। /শ্রীঅক্ষয়কুমার দত্ত প্রণীত।/…’ বিষয়সূচিটিও কৌতূহলোদ্দীপক: জড় ও জড়ের গুণ; পরমাণু; বিস্তৃতি; আকৃতি; স্থিতি-বিরোধ; বিভাজ্যতা; অনশ্বরত্ব; জড়ত্ব; আকর্ষণ; মাধ্যাকর্ষণ; বিষমযোগাকর্ষণ; কৈশিক আকর্ষণ; অন্তর্ব্বাহ ও বহির্ব্বাহ; রাসায়ণিক আকর্ষণ; চৌম্বকার্ষণ; তাড়িতাকর্ষণ; তেজ; পরিচালকতা; বিকিরণ; শোষকতা; বিয়োজন; সঞ্চারণ; আপেক্ষিক তেজ; নৈমিত্তিক গুণ; ঘনত্ব; কাঠিন্য; স্থিতিস্থাপকতা; ভঙ্গপ্রবণতা; ঘাতসহত্ব; তান্তবতা; ভিদাবরোধকতা; ভাসুরতাপাদন; সান্তরতা; বিস্তাৰ্য্যতা; সঙ্কোচ্যতা; গতির নিয়ম; শক্তি; বেগ; সমগতি; সরলগতি; বিবৃদ্ধগতি; হ্রসমান গতি; অনপেক্ষ গতি ও আপেক্ষিক গতি; সাধারণ গতি; বক্র গতি; চক্রাবৰ্ত্ত; ঘাত ও প্রতিঘাত; পরাবৰ্ত্তিত গতি; মিশ্র গতি; ভার কেন্দ্র; জড় ও জড়ের গুণ; পরিদোলক। বইটি সচিত্র।

বস্তুবিচার—রামগতি ন্যায়রত্ন প্রণীত; প্রথম প্রকাশ: পৌষ, সংবৎ ১৯১৫ [1859]। হুগলী নর্মাল স্কুলের দ্বিতীয় শিক্ষক-রূপে কাজ করার সময় বইটি লিখিত হয়। ‘বিজ্ঞাপন’-এ আছে: ‘এতদ্দেশীয় সাহায্যকৃত বাঙ্গালা বিদ্যালয়সমূহে বস্তুবিদ্যার অনুশীলন অতিশয় আবশ্যিক হইয়াছে। কিন্তু বাঙ্গালাভাষায় ঐ বিষয়ের একখানিও পুস্তক নাই। এই বিবেচনা করিয়া কয়েকখানি ইঙ্গরেজী পুস্তক হইতে সঙ্কলনপূৰ্ব্বক সচরাচরপ্রচলিত ও শুশ্রূষাজনক-গুণ-সম্পন্ন কতিপয় বস্তুর আকার প্রকার প্রয়োজন ও উৎপত্তির বিবরণ প্রভৃতি কিঞ্চিৎ লিখিয়া এই গ্রন্থমধ্যে নিবেশিত করিলাম।’

প্রাণিবৃত্তান্ত—সাতকড়ি দত্ত প্রণীত; প্রথম প্রকাশ: 1859 [১২৬৬]। বইটি আমরা দেখিনি, কিন্তু 1875-এ প্রকাশিত Catalogue of Bengali Books থেকে জানা যায় 1874-এ হিতৈষী প্রেস থেকে বইটির দশম সংস্করণের ২০০০ কপি মুদ্রিত হয়েছে, ১৩৪ পৃষ্ঠার বইটির দাম ছিল আট আনা।

ছন্দোমালা—মধুসূদন বাচস্পতি প্রণীত; প্রথম প্রকাশ: ১২৭৫ [1868], ‘বিজ্ঞাপন’-এর তারিখ—‘কলিকাতা নর্ম্ম্যাল্‌ বিদ্যালয়/৩১শে বৈশাখ ১২৭৫ সাল’। গ্রন্থটির আখ্যাপত্র: ‘ছন্দোমালা।/প্রথম ভাগ।/শ্রীমধুসূদন বাচস্পতি প্রণীত।/কলিকাতা;/বারাণসী ঘোষের স্ত্রীটের ৪৫।২ নং বাটীতে/হিতৈষী যন্ত্রে/শ্রীগোবিন্দচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কর্ত্তৃক মুদ্রিত।/সন ১২৭৫।’ ১০৪ পৃষ্ঠার এই বইটি পদ্য ও গদ্যে লেখা, স্বরচিত কিছু উদাহরণও আছে। রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন, ‘সচ্চরিত্রের পুরস্কার’ হিসেবে তিনি স্কুল থেকে একবার এই বইটি প্রাইজ পেয়েছিলেন।

বাঙ্গলা ব্যাকরণ—লোহারাম শিরোরত্ন প্রণীত; প্রথম প্রকাশ: সংবৎ ১৯১৭ [1860], ‘বিজ্ঞাপন’-এর তারিখ—‘কৃষ্ণনগর, ২৮শে জ্যৈষ্ঠ, সংবৎ ১৯১৭’। এই বিখ্যাত ব্যাকরণ-গ্রন্থে প্রথমে ছন্দ ও অলংকার অংশ ছিল না, দশম সংস্করণে [‘বহরমপুর ট্রেনিং স্কুল, ২০শে শ্রাবণ সংবৎ ১৯২৪’ (1867)] এই অংশটি যুক্ত হয়। রবীন্দ্রনাথ পাঠ্যপুস্তক হিসেবে বইটির নাম না করলেও এটি যে তিনি স্কুলে পড়েছিলেন তার প্রমাণ আছে। ‘ছন্দের বিবরণ’ অধ্যায়ে বাংলা ও সংস্কৃত ছন্দের ‘অক্ষরসংখ্যানুক্রমে তাহাদিগের স্থূল স্থূল বিবরণ’ দিতে গিয়ে গ্রন্থকার লিখেছেন:

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘আমাদের পাঠ্য ব্যাকরণে কাব্যালংকার অংশে যে-সকল কবিতা উদাহৃত ছিল তাহাই মুখস্থ করিয়া মাকে বিস্মিত করিতাম। তাহার একটা আজও মনে আছে।’ [জীবনস্মৃতি ১৭।৩২৬]—বলে তিনি উপরোক্ত উদাহরণটি উদ্ধৃত করেছেন।

বহুদিন পরে 21 Nov 1933 কবি কালিদাস রায়কে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বইটিকে স্মরণ করেছিলেন: ‘এককালে সমাসদর্পণ ও লোহারামের ব্যাকরণ আমাদের পড়তে হয়েছে সেটাতে সংস্কৃত শিক্ষার ভূমিকা হয়েছিল।’৩৭

উল্লেখপঞ্জি

দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৩

জীবনস্মৃতি ১৭।৩৩৬

ঐ ১৭|২৮৮

ঐ ১৭।২৮৯

ঐ ১৭। ২৮৫-৮৬

ছেলেবেলা ২৬।৬০৭

গল্পগুচ্ছ ১৬।৩২১

আমার বাল্যকথা ও আমার বোম্বাই প্রবাস। ৪৬

দ্র পুরাতনী। ২৮

১০ ছেলেবেলা ২৬।৬০৬-০৭

১১ জীবনস্মৃতি ১৭।২৮৬

১২ ঐ ১৭।২৯৭

১৩ ঐ ১৭।২৯৮

১৪ ঐ ১৭।২৯৮

১৫ ‘মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের অপ্রকাশিত পত্রাবলী’: প্রবাসী, আশ্বিন ১৩৩৪।৮১১-১২, পত্র ৮

১৬ জীবনস্মৃতি ১৭।৩৩৬

১৭ ঐ ১৭।৩৩৭

১৮ ঐ ১৭।৩৩০

১৯ ‘বঙ্কিমচন্দ্র’: সাধনা, বৈশাখ ১৩০১।৫৪০; গ্রন্থপরিচয় ৯।৫৫০; অপিচ দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৩

২০ জীবনস্মৃতি ১৭|৩৩২

২১ ‘বিহারীলাল’:আধুনিক সাহিত্য ৯।৪১১

২২ ‘প্রেম প্রবাহিণী কাব্য’, ‘বন্ধুবিয়োগ কাব্য’, ‘সুরবালা কাব্য’, ‘বঙ্গসুন্দরী’, ‘নিসর্গ সন্দর্শন’ প্রভৃতি।

২৩ জীবনস্মৃতি ১৭।৩৩২

২৪ ঐ ১৭।৩৩১-৩২

২৫ দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৩

২৬ জীবনস্মৃতি ১৭।৩৩১

২৭ Charles Dickens [1812-70]-রচিত বিখ্যাত উপন্যাস [1840-41]।

২৮ জীবনস্মৃতি ১৭।৩০৭

২৯ গ্রন্থপরিচয় ১৭।৪৬৯

৩০ জীবনস্মৃতি ১৭।২৭২

৩১ তত্ত্ব, মাঘ ১৮৪০ শক [১৩২৮]। ২৬৩

৩২ রাজনারায়ণ বসু: আত্মচরিত [সাক্ষরতা প্রকাশন সং, ১৩৮৩]। ৮৩

৩৩ ‘সেকেলে কথা’: স্বর্ণকুমারী গ্রন্থাবলী ৪

৩৪ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়: ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’, সা-সা-চ ১৮ [১৩৭৭]।১১৩

৩৫ দ্র ‘নীলমণি বসাক’ সা-সা-চ ২৭ [১৩৬১]।৯

৩৬ দ্র Catalogue of Bengali Books for Schools, Vernacular Medical Classes, Normal Schools, & C. [1875]

৩৭ রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত প্রতিলিপি

* M’Culloch’s Course of Reading সেই সময়ে কলকাতার ‘Day and Company’ এই সিরিজের অনেক বই আমদানি করত।

* ‘বিবিধার্থ-সঙ্গহ,/ অর্থাৎ/ পুরাবৃত্তোতিহাস-প্রাণিবিদ্যা-শিল্প-সাহিত্যা-/ দি-দ্যোতক মাসিক পত্র।/…/ বাপ্তিস্ত-মিশন যন্ত্রে মুদ্রিত।/ কলিকাতা/…’। প্রথম প্রকাশ: কার্তিক ১৭৭৩ শক [Nov 1851]। বঙ্গভাষানুবাদক সমিতির আনুকূল্যে প্রকাশিত পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র।

যোগেন্দ্রনাথ ঘোষ ১২৭০ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে অবোধবন্ধু প্রকাশ করেন। কিন্তু কয়েক মাস পরেই তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ফাল্গুন ১২৭৩ থেকে পত্রিকাটি পুনঃপ্রকাশিত হতে থাকে। ১২৭৫ সালের পৌষ-সংখ্যা থেকে কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী এটির স্বত্বাধিকারী হন। কিন্তু ১২৭৬ চৈত্র সংখ্যার পর পত্রিকাটি আর প্রকাশিত হয়নি।

* Jacques Henri Ber nardin de Saint-Pierr [1737-1824] রচিত Paul et Virginie [1787]. এখানে একটি তথ্য উল্লেখযোগ্য, বিলেত থেকে বালিকা স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীকে লিখিত বহু পত্রে সত্যেন্দ্রনাথ তাঁকে ‘বর্জিনি’ বলে সম্বোধন করেছেন।

‘পৌল ভর্জ্জীনী’, কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য [1840-1932] মূল ফরাসি ভাষা থেকে অনুবাদ করেন; অবোধবন্ধু-র পৌষ-চৈত্র ১২৭৫ এবং পৌষ-চৈত্র ১২৭৬—এই আটটি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। খুবই আশ্চর্যের বিষয় এমন একটি সুন্দর বই কোনোদিন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, গ্রন্থটির প্রথম বাংলা অনুবাদ Bengal Family Library বা ‘গার্হস্থ্য বাঙ্গলা পুস্তক সঙ্গহ’-এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে সুচারু প্রেস থেকে রামনারায়ণ বিদ্যারত্ন-কর্তৃক অনূদিত ‘পাল এবং বর্জিনিয়ার জীবন বৃত্তান্ত’ নামে 1856-এ প্রকাশিত হয়েছিল।

* Vernacular Literature Committee বা বঙ্গভাষানুবাদক সমাজ 1851-এ প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যাসাগর, রাধাকান্ত দেব, হজসন্ প্র্যাট্‌, সীটনকার, রেভারেণ্ড লঙ, জন্‌ রবিনসন, রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রভৃতি পণ্ডিতবর্গ এই সমাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মধুসূদন মুখোপাধ্যায় ছিলেন সমাজের সহ-সম্পাদক। কমিটির উদ্দেশ্য ছিল: ‘to publish translations of such woks as are not included in the design of the Tract of Christian Knowledge Societies on the one hand, or of the School Book and Asiatic Societies on the other, and likewise to provide a sound and useful Vernacular Domestic Literature for Bengal.’ এই সমাজের আর্থিক সাহায্যে রাজেন্দ্রলাল মিত্র-সম্পাদিত বিবিধার্থসংগ্রহ মাসিক পত্রিকা কার্তিক ১২৫৮ থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। অনুবাদ-গ্রন্থ প্রকাশ করা সমাজের ঘোষিত উদ্দেশ্য হলেও মৌলিক রচনার জন্য তাঁরা পুরস্কার ঘোষণা করেন। ‘সুশীলার উপাখ্যান’ এইভাবে পুরস্কৃত হয়। দ্র ‘রাজেন্দ্রলাল মিত্র’, সা-সা-চ ৪০ [১৩৬৮]।১২-১৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *