১০. রবীন্দ্রজীবনের দশম বৎসর

দশম অধ্যায়
১২৭৭ [1870-71] ১৭৯২ শক ॥ রবীন্দ্রজীবনের দশম বৎসর

পৌষ ১২৭৬ [Jan 1870] থেকে রবীন্দ্রনাথ নর্মাল স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। পাঠ্যপুস্তকের বোঝা যে বেড়েছে ক্যাশবহি-তে তার কিছু উল্লেখ দেখা যায়। ৩ পৌষ [শুক্র 17 Dec 1869] ‘পদার্থবিদ্যা ৩ খানা ও ওয়ানস্ এরিথমেটীক এক সেট’ কেনা হয়েছে। ‘পদার্থবিদ্যা’*অক্ষয়কুমার দত্তের দ্বারা রচিত। এই গ্রন্থখানি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘পদার্থবিদ্যা পড়িয়াছিলাম কিন্তু পদার্থের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না, কেবল পুঁথির পড়া—বিদ্যাও তদনুরূপ হইয়াছিল। সে-সময়টা সম্পূর্ণ নষ্ট হইয়াছিল। আমার তো মনে হয়, নষ্ট হওয়ার চেয়ে বেশি; কারণ, কিছু না করিয়া যে-সময় নষ্ট হয় তাহার চেয়ে অনেক বেশি লোকসান করি কিছু করিয়া যে-সময়টা নষ্ট করা যায়।’ এই মন্তব্য থেকে মনে হয়, গ্রন্থটি নিয়মিত পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল না, ‘নানা বিদ্যার আয়োজন’-এর অন্তর্গত হয়ে এটি পঠিত হয়। এইভাবে আরও একটি বই পঠিত হয়েছিল—মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’*। এই কাব্যটি পাঠের স্মৃতিও খুব সুখকর নয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘মেঘনাদবধকাব্যটিও আমাদের পক্ষে আরামের জিনিস ছিল না। যে-জিনিসটা পাতে পড়িলে উপাদেয় সেইটাই মাথায় পড়িলে গুরুতর হইয়া উঠিতে পারে। ভাষা শিখাইবার জন্য ভালো কাব্য পড়াইলে তরবারি দিয়া ক্ষৌরি করাইবার মতো হয়—তরবারির তো অমর্যাদা হয়ই, গণ্ডদেশেরও বড়ো দুর্গতি ঘটে। কাব্য-জিনিসটাকে রসের দিক হইতে পুরাপুরি কাব্য হিসাবেই পড়ানো উচিত, তাহার দ্বারা ফাঁকি দিয়া অভিধান ব্যাকরণের কাজ চালাইয়া লওয়া কখনোই সরস্বতীর তুষ্টিকর নহে।’ উদ্ধৃতিটি থেকেই বোঝা যায় নীলকমল ঘোষাল কোন্ পদ্ধতিতে তাঁর ছাত্রদের মেঘনাদবধ পড়িয়েছিলেন। ছেলেবেলা-য় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, সাহিত্যে ‘সীতার বনবাস’ থেকে তাঁদের একেবারে চড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল মেঘনাদবধ-এ। আরম্ভ এই সময়ে হলেও বইটি অনেক দিন ধরেই পড়া হয়েছিল, জীবনস্মৃতি-র বর্ণনা থেকে মনে হয় নর্মাল স্কুলের ছাত্র থাকার সময়েই [মাঘ ১২৭৮-এর পূর্বে] মেঘনাদবধ পড়া শেষ হয়ে গিয়েছিল, কারণ পিতার আদেশে যেদিন ‘বাংলাশিক্ষার অবসান’ ঘটল, সেদিন ‘মেঘনাদবধ কাব্যখানা বোধ করি পুনরাবৃত্তির সংকল্প চলিতেছে।’ অনেকে মনে করেছেন, এই করুণ অভিজ্ঞতার পরিণতি ঘটেছিল ভারতী পত্রিকার প্রথম বর্ষে প্রকাশিত ‘মেঘনাদ-বধ কাব্য’ প্রবন্ধে বিরূপ সমালোচনার আকারে।

‘পদার্থবিদ্যা’ ও ‘মেঘনাদবধ ছাড়াও ২৫ পৌষ ১২৭৬ [শনি 8 Jan 1870] সাড়ে আট টাকা দিয়ে ‘সোম, রবী, সত্যপ্রসাদবাবু দিগের পুস্তক ক্রয়’ করা হয়েছে এবং ১৯ মাঘ [সোম 31 Jan] ‘বালকদিগের গ্রামার তিনখানা ও নিতীবোধ তিনখানা ও বর্ণশিক্ষা’ কেনা হয়েছে—‘বর্ণশিক্ষা’ নিশ্চয়ই অরুণেন্দ্রনাথের জন্য এবং গ্রামার ও ‘নীতিবোধ’*তিনখানার উল্লেখই বুঝিয়ে দেয় এগুলি রবীন্দ্রনাথদের জন্য ও স্কুলের পাঠ্যপুস্তক হিসেবেই কেনা হয়েছে, অবশ্য গ্রামার অঘোরবাবুর কাছে ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনেও ক্রীত হয়ে থাকতে পারে।

অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে ইংরেজি শিক্ষায় এ বৎসর অবশ্যই কিছু অগ্রগতি হয়েছিল। সম্ভবত প্যারীচরণ সরকারের First Book of Reading শেষ করে Second Book পর্যন্ত পাঠ এগিয়ে গিয়েছিল। ইংরেজি গ্রামারের সঙ্গে পরিচয়ের পালাও শুরু হয়েছে তা আমরা একটু আগেই লক্ষ্য করেছি। কিন্তু ইংরেজি ভাষার সঙ্গে বালকদের আত্মীয়তা রচনা করে দেওয়া তাঁর পক্ষে দুরূহ ছিল। এই বাধা অতিক্রম করার জন্য নানারকম চেষ্টাও তিনি করেছেন। ইংরেজি ভাষাটা যে নীরস নয় ছাত্রদের কাছে তার প্রমাণ দেবার জন্য খানিকটা ইংরেজি রচনা তিনি মুগ্ধভাবে আবৃত্তি করেছিলেন। কিন্তু সমস্তটাই বালকদের কাছে এত অদ্ভুত মনে হয়েছিল যে তাঁদের সমবেত প্রবল হাস্যে অঘোরবাবুকে সে চেষ্টায় ক্ষান্ত হতে হয়েছিল। তখন তিনি ইংরেজি ভাষার সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপনের প্রয়াস ত্যাগ করে নিজেকেই ছাত্রদের আত্মীয় করে তুলতে চাইলেন। তিনি মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন। একদিন তিনি কাগজের মোড়ক থেকে মানুষের একটি কণ্ঠনালী বার করে বিধাতার সেই আশ্চর্য সৃষ্টির কৌশল ব্যাখ্যা করতে লাগলেন। সমস্ত মানুষটাই কথা কয়, সেই মানুষটিকে বাদ দিয়ে কেবল কথা-কওয়া ব্যাপারটাকে এমন টুকরো করে দেখাতে ‘মনটা কেমন একটু ম্লান হইল; মাস্টারমশায়ের উৎসাহের সঙ্গে ভিতর হইতে যোগ দিতে পারিলাম না।’ আর একদিন তিনি ছাত্রদের মেডিকেল কলেজের শব-ব্যবচ্ছেদের ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন। টেবিলের উপর একটি বৃদ্ধার মৃতদেহ শোয়ানো ছিল, সেটি দেখে রবীন্দ্রনাথের মন তেমন চঞ্চল হয়নি; কিন্তু মেজের উপর একখণ্ড কাটা পা পড়ে থাকতে দেখে তাঁর সমস্ত মন একেবারে চমকে উঠেছিল। ‘মানুষকে এইরূপ টুকরা করিয়া দেখা এমন ভয়ংকর, এমন অসংগত যে সেই মেজের উপর পড়িয়া-থাকা একটা কৃষ্ণবর্ণ অর্থহীন পায়ের কথা আমি অনেক দিন পর্যন্ত ভুলিতে পারি নাই।’ বোঝাই যায় ছাত্রের মনোরঞ্জনের প্রয়াসে অঘোরবাবু সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিলেন; কিন্তু ঘটনা-দুটির মধ্য দিয়ে বালক রবীন্দ্রনাথের যে মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়, পরবর্তীকালের কবিমানসকে বোঝার পক্ষে তা একটি অমূল্য সূত্রের সন্ধান দেয়।

‘নানা বিদ্যার আয়োজন’ পর্বে আর একটি শিক্ষার শুরু সম্ভবত এই বৎসরেই। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘প্রায় মাঝে মাঝে সীতানাথ দত্ত মহাশয় আসিয়া যন্ত্রতন্ত্রযোগে প্রাকৃতবিজ্ঞান শিক্ষা দিতেন।’ জীবনস্মৃতি ও ছেলেবেলা উভয় গ্রন্থেই রবীন্দ্রনাথ শিক্ষকের নামটি ভুল লিখেছেন। তাঁর নাম সীতানাথ দত্ত নয়—সীতানাথ ঘোষ। সীতানাথ দত্ত বিভিন্ন দার্শনিক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, তত্ত্ববোধিনী বা ভারতী-তে তাঁর কয়েকটি গ্রন্থের সমালোচনাও প্রকাশিত হয়েছিল—কিন্তু প্রাকৃতবিজ্ঞানের সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া যায় না। অপরপক্ষে ‘ব্রাহ্মধর্মপ্রচার খাতে’ সীতানাথ ঘোষকে প্রতি মাসে ঠাকুরবাড়ির সরকারী তহবিল থেকে দীর্ঘকাল মাসোহারা দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া বস্ত্রবয়নযন্ত্রের আবিষ্কর্তা হিসেবে তিনি হিন্দুমেলা ও তৎসংশ্লিষ্ট জাতীয় সভার সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ২৫ বৈশাখ ১২৭৮ [রবি 7 May 1871] তারিখে ও পরে আরও কয়েক দিন তিনি জাতীয় সভায় ‘বিদ্যুৎ’ সম্পর্কে আকর্ষণীয় বক্তৃতা করেন এবং পরবর্তীকালে বৈদ্যুতিক চিকিৎসার সাহায্যে বহু দুরারোগ্য ব্যাধি নিরাময়ের ব্যাপারে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। ইনি যন্ত্রপাতি সহযোগে বিজ্ঞানের যে পরীক্ষাগুলি প্রদর্শন করতেন, রবীন্দ্রনাথের কাছে সেগুলি বিশেষ ঔৎসুক্যজনক ছিল। উত্তাপ দিলে পাত্রের নীচের জল হালকা হয়ে উপরে ওঠে ও উপরের ভারী জল নীচে নামতে থাকে, এইটি যেদিন তিনি কাঁচপাত্রে জলে কাঠের গুঁড়ো দিয়ে আগুনে চড়িয়ে প্রত্যক্ষ দেখিয়ে দিলেন, সেদিনকার বিস্ময় রবীন্দ্রনাথ জীবনে ভোলেননি। দুধের মধ্যে জল একটি আলাদা জিনিস, উত্তাপে সেই জল বাষ্পীভূত হয় বলে দুধ গাঢ় হয়, এই কথাটা যেদিন স্পষ্ট বুঝেছিলেন সেদিনও যথেষ্ট আনন্দ পেয়েছিলেন। এই আনন্দও কোনো স্বতন্ত্র বস্তু নয়, প্রকৃতির রহস্য নিকেতনের মধ্যে প্রবেশ করার যে আনন্দ তিনি সন্ধান করে বেড়াতেন তার সঙ্গে যুক্ত করে দেখলে তাঁর মনটিকে ঠিকভাবে দেখা সম্ভব। আর এইজন্যই ‘যে-রবিবারে সকালে তিনি না আসিতেন, সে-রবিবার আমার কাছে রবিবার বলিয়াই মনে হইত না।’

জিম্‌নাস্টিক শিক্ষা এ বৎসরেও অব্যাহত ছিল। জিম্‌নাস্টিক শিক্ষক শ্যামাচরণ ঘোষকে অন্তত এ বৎসর শ্রাবণ মাস পর্যন্ত বেতন দেওয়া হয়েছে, তা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। এর পরেও ২৮ মাঘ [বৃহ 9 Feb 1871] উক্ত শ্যামাচরণ ঘোষকে ‘ছেলেবাবুদিগের জিমনেসটিক শিক্ষার জন্য যে সমস্ত কাষ্ঠের থাম প্রভৃতি তৈয়ার হইয়াছিল তাহার ব্যয়ের অর্দ্ধেকাংশ শোধ করা হয়েছে। কিন্তু তাঁকে বা অন্য কাউকে বেতন বাবদ কোনো অর্থ দেওয়া হয়েছে, এমন উল্লেখ আর দেখা যায় না।

এই বৎসরের ক্যাশবহি-র একটি হিসাব আমাদের কাছে কিছুটা কৌতুককর সমস্যার সৃষ্টি করেছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘বেশ মনে আছে, আমাদের ছেলেবেলায় কোনো-এক সময়ে ইংরেজ গবর্মেন্টের চিরন্তন জুজু রাসিয়ান কর্তৃক ভারত-আক্রমণের আশঙ্কা লোকের মুখে আলোচিত হইতেছিল। কোনো হিতৈষিণী আত্মীয়া আমার মায়ের কাছে সেই আসন্ন বিপ্লবের সম্ভাবনাকে মনের সাধে পল্লবিত করিয়া বলিয়াছিলেন। পিতা তখন পাহাড়ে ছিলেন। ..এইজন্য মার মনে অত্যন্ত উদ্বেগ উপস্থিত হইয়াছিল।’ বাড়ির পরিণতবয়স্কেরা তাঁর এই উৎকণ্ঠা সমর্থন না করায় সারদা দেবী শেষে কনিষ্ঠপুত্রকেই আশ্রয় করে তাঁকে বললেন রাশিয়ানদের খবর দিয়ে পিতাকে একখানা চিঠি লিখতে। ‘মাতার উদ্বেগ বহন করিয়া পিতার কাছে সেই আমার প্রথম চিঠি। কেমন করিয়া পাঠ লিখিতে হয়, কী করিতে হয় কিছুই জানি না। দফতরখানায় মহানন্দ মুনশির [মুখোপাধ্যায়]* শরণাপন্ন হইলাম। পাঠ যথাবিহিত হইয়াছিল সন্দেহ নাই। কিন্তু ভাষাটাতে জমিদারি সেরেস্তার সরস্বতী যে জীর্ণ কাগজের শুষ্ক পদ্মদলে বিহার করেন তাহারই গন্ধ মাখানো ছিল।’ দেবেন্দ্রনাথ চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন; লিখেছিলেন তিনিই রাশিয়ানদের তাড়িয়ে দেবেন, সুতরাং ভয়ের কিছু নেই। এই আশ্বাসে মায়ের ভীতি কতটা দূর হয়েছিল বলা যায় না, কিন্তু পিতা সম্বন্ধে পুত্রের সাহস এত বেড়ে উঠল যে, তাঁকে পত্র লেখবার জন্যে তিনি রোজই মহানন্দের দফতরে হাজির হতে লাগলেন। বালকের উপদ্রবে অস্থির হয়ে মহানন্দ কয়েকদিন খসড়া করে দিলেন বটে, কিন্তু তাঁর বয়স অনেক বেশি ছিল, সুতরাং চিঠিগুলি হিমালয়শিখরে পৌঁছয়নি। প্রবোধচন্দ্র সেন অনুমান করেছেন, ‘সম্ভবত ১৮৭১ সালে যখন বাদাকসানের অধিকার নিয়ে ইংরেজের সঙ্গে রাশিয়ানদের মনোমালিন্য উপস্থিত হয়।’ সেই সময়ে এই পত্র লেখা হয়েছিল। জীবনস্মৃতি-র তথ্যপঞ্জীতে বলা হয়েছে, ‘ইং ১৮৬৮ মে হইতে ১৮৭০ ডিসেম্বরের মধ্যে কোন এক সময় পত্রটি লিখিত হয়।’ সময়নির্দেশটি অনাবশ্যক দীর্ঘ ও অস্পষ্ট করে ফেলা হয়েছে; হিমালয়-অঞ্চলে দেবেন্দ্রনাথের অবস্থান-কাল হিসেব করে এটিকে আরও সুনির্দিষ্ট করা সম্ভব—May-Oct 1868 ও Mar-Nov 1870; আর প্রবোধচন্দ্র সেনের অনুমান গ্রহণীয় হলে May-Nov 1871-র মধ্যে কোনো এক সময়ে পত্রটি লেখা হয়েছিল। কিন্তু এই তিনটি পর্বের কোন্‌টিতে পত্রটি লিখিত হয় তা নির্ধারণ করা খুবই মুশকিল। কারণ উনিশ শতকের চতুর্থ দশক থেকেই মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি ইংরেজদের মাথাব্যথার কারণ হয়েছিল। 1863-তে ইংরেজ-মিত্র আফগানিস্থানের শাসক দোস্ত্‌ মহম্মদের মৃত্যুর পর সিংহাসন নিয়ে সেখানে যে গৃহযুদ্ধের সূচনা দেখা দিল, তাতে এই আশঙ্কা আবার ঘনীভূত হয়ে ওঠে। একদিকে এই গৃহযুদ্ধে ইংরেজ সরকারের নিরপেক্ষতা, অন্যদিকে রুশ সেনাবাহিনীর বোখারা সমরখন্দ প্রভৃতি জয় এই সময়কার সংবাদপত্রের অন্যতম আলোচ্য বিষয় হয়েছিল। 1865-66 থেকে আমরা যে-সব বাংলা ও ইংরেজি সংবাদপত্র দেখেছি, তাতে এ-বিষয়ে বহু সংবাদ ও সম্পাদকীয় রচনা আমাদের চোখে পড়েছে। কিন্তু অন্তত সংবাদপত্রের সাক্ষ্য থেকে একথা বলা চলে না যে, ব্রিটিশ ভারতের উপর রুশ আক্রমণের আশঙ্কা কখনও গুজবের আকার ধারণ করেছিল। তাই আমাদের ধারণা, ‘হিতৈষিণী আত্মীয়া’টি (সম্ভবত ইনি কোনো আত্মীয়া নন, জনৈক ‘ব্রজ আচার্যির বোন’—যাঁর কথা জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, প্রফুল্লময়ী দেবী ও রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন] কোনো বিক্ষিপ্ত সংবাদ থেকে গুজবের সৃষ্টি নিজেই করেছিলেন। কিন্তু তার চেয়েও গুরুতর আশঙ্কার কারণ সংবাদপত্রেই প্রকাশিত হয়েছিল। ৩১ শ্রাবণ [15 Aug] সংখ্যার সোমপ্রকাশ-এ একটি সংবাদ বেরোয়: ‘বাবু দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর সংসার ত্যাগ করিয়া হিমালয়ের নিকটস্থ ধর্মশালায় জীবন যাপন করিবার মানস করিয়াছেন।’ পত্রিকাটির কাছে এই সংবাদের সূত্র কী ছিল আমরা জানি না, কিন্তু অনুমান করতে পারি সারদা দেবীর মনে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টির পক্ষে সংবাদটি যথেষ্ট ছিল। [বাড়িতে অন্য কয়েকটি পত্রিকার সঙ্গে সোমপ্রকাশ-ও নিয়মিত নেওয়া হত।] কিন্তু এই উদ্বেগ পরিণতবয়স্ক পুত্রদের কাছে প্রকাশ করতে তাঁর পক্ষে সংকোচ অনুভব করা স্বাভাবিক, আর সেই কারণেই রাশিয়ান ভীতির ছদ্মবেশে কনিষ্ঠ পুত্রকে দিয়ে স্বামীকে পত্র লেখানোর চেষ্টা! এর কয়েকদিনের মধ্যেই ৮ ভাদ্র [মঙ্গল 23 Aug] তারিখের হিসাবে দেখা যায়: ‘শ্রীযুক্ত কর্ত্তাবাবু মহাশয়ের নিকট ইংলিসমেনু, সোমেন্দ্রবাবুর এক পত্র…পাঠাইবার টিকিট ব্যয়’ বাবদ দশ পয়সা খরচ করা হয়েছে। দেবেন্দ্রনাথ যেখানেই থাকুন-না-কেন, তাঁকে নিয়মিত বিভিন্ন পত্রিকা, জরুরী কাগজপত্র ও চিঠি জমিদারি-সেরেস্তা থেকে প্রেরিত হত, তার ডাকমাশুলের ব্যয় ‘বাজে খরচ খাতে’ বিবরণ-সহ লিখিত হত। [হিসাবগুলি মূল্যবান—এর থেকে আমরা দেবেন্দ্রনাথের অবস্থান ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক তথ্যাদি পেতে পারি।] যাই হোক, হিসাবটিতে আমরা সোমেন্দ্রনাথের নাম পাই, রবীন্দ্রনাথের নয়। এইটিকেই আমরা বর্তমান অনুচ্ছেদের সূচনায় ‘কৌতুককর সমস্যা’ বলে, অভিহিত করেছি। পত্রটি যদি শুধু রবীন্দ্রনাথের নামে প্রেরিত হত, তাহলে হিসাব-খাতায় তাঁর নাম লিখিত হওয়াই স্বাভাবিক ও সংগত হত। তাই মনে হয়, মহানন্দ মুনশির দরবারে সোমেন্দ্রনাথও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গী হয়েছিলেন, এবং পরিণত-বুদ্ধি মহানন্দ দশ বছরের বালক রবীন্দ্রনাথের চিঠি কর্তাবাবুমহাশয়ের কাছে পাঠানোর হিসাব লেখার চাইতে বারো বছরের কিশোর সোমেন্দ্রনাথের নাম ব্যবহার করাই যুক্তিযুক্ত মনে করেছিলেন। কিংবা এও হতে পারে পত্রটি সোমেন্দ্রনাথেরই লেখা, কিন্তু পিতাকে চিঠি লেখার মতো রোমাঞ্চকর দুঃসাহসিক কাজে কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে তিনি এমনই ওতপ্রোতভাবে যুক্ত করে নিয়েছিলেন যে রবীন্দ্রনাথ চিঠিটিকে নিজের লেখা বলে সহজেই ভেবে নিতে পেরেছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ অবশ্য অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামাঝি শান্তিনিকেতন হয়ে পৌষের প্রথম সপ্তাহেই জোড়াসাঁকোয় ফিরে আসেন।

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ১

বর্তমান বৎসরে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে সংঘটিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রসঙ্গ এখানে সংকলিত হল।

Sep 1869-এ বীরেন্দ্রনাথের চিকিৎসার জন্য তাঁকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। ছ-মাস সেখানে থেকে অপেক্ষাকৃত সুস্থ হয়ে Feb 1870 নাগাদ তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। এর কয়েক মাস পরে তাঁর একমাত্র সন্তান বলেন্দ্রনাথের জন্ম হয় ২১ কার্তিক [রবি 6 Nov 1870]। বলেন্দ্রনাথ তাঁর রাশিচক্রের খাতায় জন্মসময়টিকে উদ্ধৃত করেছেন: ‘১৭৯২।৬।২০।২৭|৩৭/ইং বেলা ৫।৩০’। তাঁর মা প্রফুল্লময়ী দেবী লিখেছেন: ‘সে ভূমিষ্ঠ হইবার পর একেবারেই কোনও কান্নার শব্দ পাওয়া যায় নাই। নিস্তেজ অবস্থায় পড়িয়াছিল। তাহার পর ডাক্তারেরা নানা উপায়ে তাহাকে কাঁদাইতে সক্ষম হন। আমারও সেই সময় খুবই অসুখ। নাড়ী ছাড়িয়া কয়েকদিন অজ্ঞান অবস্থায় পড়িয়াছিলাম। আমার নানারকম মনের অশান্তির মধ্যে জন্ম হইয়াছিল বলিয়া তাহারও শরীরটা তেমন সুস্থ ছিল না, দুটি পাও একটু বাঁকা মতন হইয়াছিল। তাহার দরুন অনেকদিন পর্যন্ত পা ঘসিয়া ঘসিয়া চলিত।’ এই দুর্ভাগিনী বধূটির প্রতি সারদা দেবীর আন্তরিক সহানুভূতি ছিল। সুতরাং তাঁর পুত্রলাভ সারদা দেবীর যথেষ্ট আনন্দের কারণ হয়েছিল, তারই বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় ১৪ অগ্র [সোম 28 Nov] তারিখের হিসাবে: ‘ব° শ্ৰীমতীকত্রিমাতাঠাকুরাণী/দ° নবাবু মহাশয়ের প্রথম পুত্র হওয়ায়/২১ দিনের দিন বাটীর চাকরাণীদিগকে/বাটী বিতরণ করার জন্য বাটীর মূল্য ধরিয়া/দেওয়া যায়—১৫৲’। প্রফুল্লময়ী দেবীও অনুরূপ বর্ণনা দিয়েছেন। পরবর্তীকালে বলেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের যথেষ্ট প্রীতিভাজন হয়েছিলেন।

১৩ অগ্র [রবি 27 Nov] হেমেন্দ্রনাথের চতুর্থ সন্তান ও তৃতীয় পুত্র ঋতেন্দ্রনাথের জন্ম হয়।

২৬ পৌষ [সোম 9 Jan 1871] ‘শ্রীমতী স্বরৎকুমারী দেবীর দ্বিতীয়া কন্যার অন্নপ্রাসন খাতে খরচ’-এর হিসাব দেখে মনে হয়, সম্ভবত এই বৎসরেরই প্রথম দিকে [1870] সুপ্রভা দেবীর জন্ম হয়।

এছাড়া অন্যান্য আনন্দানুষ্ঠানের মধ্যে আষাঢ় মাসে দ্বিজেন্দ্রনাথের চতুর্থ পুত্র সুধীন্দ্রনাথের ও অগ্রহায়ণ মাসে হেমেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পুত্র ক্ষিতীন্দ্রনাথের অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠিত হয়।

ফাল্গুন মাসে [? ১৬ ফাল্গুন সোম 27 Feb 1871] দেবেন্দ্রনাথের মধ্যম ভ্রাতা গিরীন্দ্রনাথের প্রথমা কন্যা কাদম্বিনী দেবী ও যজ্ঞেশপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠপুত্র, রবীন্দ্রনাথের কাব্যগুরু জ্যোতিঃপ্রকাশের বিবাহ হয়।

জোড়াসাঁকোর ভদ্রাসন বাড়ির কিছু কিছু পরিবর্তন এ-বৎসর সংঘটিত হয়। বাড়ির মধ্যে অর্থাৎ অন্দরমহলে তেতালার ঘর প্রস্তুত হয়* এবং বাহির বাড়ির দোতালায় সাম্বক তোষাখানার [জীবনস্মৃতি-র বর্ণনানুযায়ী যেখানে শৈশবে রবীন্দ্রনাথের বেশির ভাগ সময় কাটত চাকরদের তত্ত্বাবধানে] তিনটি ঘর বৈঠকখানায় পরিণত হয় [৬ কার্তিক শনি 22 Oct তারিখের হিসাব]। এগুলি বড়ো সংযোজন ও পরিবর্তন বলে এখানে উল্লেখ করা হল, কিন্তু পাঠকদের জানা দরকার যে নানা ধরনের ব্যবহারিক প্রয়োজনে ছোটোখাটো সংস্কার এই বাড়িতে প্রায় প্রতি বৎসরেই লেগে থাকত। ফলে আজকের দিনের মহর্ষিভবন দেখে সেই যুগের বাড়ির সঠিক রূপটি কিছুতেই মনে আনা যায় না।

বর্তমান বৎসরে আরও একটি সংযোজন এই বাড়িতে ঘটেছে কলের জলের আয়োজনের দ্বারা। Jan 1867-এ কলকাতা থেকে ১৬ মাইল উত্তরে পলতায় হুগলী নদীর জল পরিস্রুত করে পাইপের সাহায্যে সেই জল কলকাতায় পাঠানোর কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। 1870-র শুরুতেই কাজটি সম্পন্ন হয় এবং কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটি কয়েকটি উপনিয়ম প্রবর্তন করে বিভিন্ন বাড়িতে পাইপের সাহায্যে জল সরবরাহ করতে আরম্ভ করেন। ৬ মাঘ ১২৭৬ [মঙ্গল 18 Jan 1870] তারিখের হিসাবে দেখছি, ‘পুষ্করিণীতে জল আনাইবার জন্য মিউনিসিপল কমিসনর আপিসে’ যাতায়াতের জন্য নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে গাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়েছে; জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ওয়াটার ট্যাক্স দেওয়া হয়েছে একশো সাড়ে বারো টাকা ৭ জ্যৈষ্ঠ ১২৭৭ [শুক্র 20 May 1870] তারিখে। এর আগের অবস্থার কথা বর্ণনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ: ‘তখন রাস্তার ধারে ধারে বাঁধানো নালা দিয়ে জোয়ারের সময় গঙ্গার জল আসত। ঠাকুরদার আমল থেকে সেই নালার জলের বরাদ্দ ছিল আমাদের পুকুরে। যখন কপাট টেনে দেওয়া হত ঝরঝর কলকল করে ঝরনার মতো জল ফেনিয়ে পড়ত। মাছগুলো উলটো দিকে সাঁতার কাটবার কসরত দেখাতে চাইত। দক্ষিণের বারান্দার রেলিঙ ধরে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতুম।’১০ কলের জল প্রবর্তিত হওয়ায় এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটল। অন্দরমহলে স্নানের জন্য আগে জল-বওয়া ভারী পুকুর থেকে জল নিয়ে গিয়ে স্নানের ঘরের চৌবাচ্চা পূর্ণ করে দিয়ে আসত। পানীয় জলের জন্য অন্য ব্যবস্থা ছিল: ‘বেহারা বাঁখে ক’রে কলসি ভ’রে মাঘ-ফাগুনের গঙ্গার জল তুলে আনত। একতলার অন্ধকার ঘরে সারি সারি ভরা থাকত বড়ো বড়ো জালায় সারা বছরের খাবার জল।’১১ এই নিয়মেরও পরিবর্তনের সূচনা বর্তমান বৎসরে, ২০ পৌষ [মঙ্গল 3 Jan 1871] তারিখের হিসাবে দেখা যায় জনৈক কর্মচারীকে ‘বাটীতে কলের জলের পাইপ আনাইবার জন্য উহার মেকিটস বরণ কো° [Mackintosh Burn & Co.] আপীসে জাতাতের গাড়িভাড়া’ দেওয়া হয়েছে।

গুরুজনদের সঙ্গে বাড়ির বালকদের দূরত্বেব কথা রবীন্দ্রনাথ সবিস্তারে লিখেছেন: ‘আমাদের চেয়ে যাঁহারা বড়ো তাঁহাদের গতিবিধি, বেশভূষা, আহারবিহার, আরাম-আমোদ, আলাপ-আলোচনা, সমস্তই আমাদের কাছ হইতে বহুদূরে ছিল। তাহার আভাস পাইতাম কিন্তু নাগাল পাইতাম না।’১২ আমাদের আলোচ্য সময়ে এ অবস্থারও কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। গত বৎসরের বিবরণেই আমরা দেখেছি দ্বিজেন্দ্রনাথ বালকদের ঘোড়ার নাচ দেখাতে নিয়ে গিয়েছেন—ঐ বৎসরেই ‘রবী সোম, সত্যপ্রসাদ দ্বিপু অরুণ ও বড় বাবুর কন্যা সরজা দিগকে কর্ত্তামহাশয় দেন ৫৷৷০’ ১৪ কার্তিক শুক্র 5 Nov 1869 তারিখে। বাড়ির ছোটোরা যে বড়োদের চোখে পড়ছে—তাদের একটু বেড়াতে নিয়ে যাওয়া কিংবা নিজস্ব কিছু কেনা-কাটার জন্য নগদ অর্থ উপহার দেওয়া—এই তথ্যটুকুও কম মূল্যবান নয়। বর্তমান বৎসরেও এই ধরনের তথ্য নজরে আসে; ২৩ পৌষ শুক্র 6 Jan 1871 তারিখের হিসাব: ‘ছেলেবাবুদিগের ফেনসিফেয়ার/দেখিতে যাইবার টিকিট ও খেলানা ক্রয়’ কিংবা ২১ ফাল্গুন শনি 4 Mar তারিখে ‘ছেলেবাবুদিগের ইস্কুলে বাজি দেখিবার টিকিট ৬ জনার’ [ষষ্ঠ জন হচ্ছেন হেমেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র হিতেন্দ্রনাথ, যিনি Feb 1871-এ নর্মাল স্কুলে ভর্তি হন, তাঁর দিদি প্রতিভা এপ্রিল মাস থেকে বেথুন স্কুলে যাতায়াত শুরু করেন]—বালকদের বহির্জগতের আমোদপ্রমোদের আস্বাদ দেওয়ার জন্য বড়োদের মনোযোগের প্রমাণ।

হয়তো এই মনোযোগের সূত্রেই রবীন্দ্রনাথ এই সময়ে প্রথম যাত্রাভিনয় দেখার সুযোগ পান। ঠাকুরপরিবারে যাত্রাভিনয়ের ঐতিহ্য অনেক পুরোনো; গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই ছিলেন এক শৌখিন যাত্রাদলের পৃষ্ঠপোষক, ‘বাবুবিলাস’ নামে একটি নাটকও তিনি লিখেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর পুজো নিয়ে বিরোধে জোড়াসাঁকো ঠাকুরপরিবার যখন বিভক্ত হয়ে গেল, তখন গিরীন্দ্রনাথের পরিবারে দোল-দুর্গোৎসব অব্যাহত থেকেছে—এইসব উপলক্ষে কথকতা, যাত্রা প্রভৃতি দেশীয় আনন্দ-উপকরণকেও সেখানে জায়গা দেওয়া হয়েছে। এইভাবেই এবার গোপাল উড়ের যাত্রা দেখে জোড়াসাঁকো নাট্যশালার জন্ম। সেই নাট্যশালা দীর্ঘায়ু হয়নি, কিন্তু প্রতি বৎসর যাত্রাদল ভাড়া করে এনে অভিনয় করানোর রীতি অব্যাহত ছিল। রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে এই প্রসঙ্গ আলোচনা করেননি—তার স্মৃতিচারণ করেছেন ছেলেবেলা [দ্র ২৬|৫৯৯-৬০১]-তে: ‘আমাদের বাড়িতে যাত্রাগান হয়েছে মাঝে মাঝে। কিন্তু রাস্তা নেই, ছিলুম ছেলেমানুষ। আমি দেখতে পেয়েছি তার গোড়াকার জোগাড়যন্তর।’ আত্মীয়-স্বজন পাড়াপ্রতিবেশী সকলেরই অবারিত অধিকার ছিল সেখানে, ছিল না শুধু রবীন্দ্রনাথদের মতো বালকদের। রাত্রি ন’টা বাজলেই শ্যামের শক্ত হাতের মুঠি টেনে নিয়ে যেত শোবার ঘরে। ‘কিন্তু একবার কী কারণে তাঁদের [অভিভাবকদের] মন নরম হয়েছিল, হুকুম বেরল, ছেলেরাও যাত্রা শুনতে পাবে। ছিল নলদময়ন্তীর পালা।’ সেবারে বড়োদের সঙ্গে বসে তিনি যাত্রা দেখা শুরু করেছিলেন, রুমালে-বাঁধা বকশিসও ছুঁড়ে দিয়েছিলেন—কিন্তু তার শেষ দেখা হয়নি, ‘মাঝখানে নেতিয়ে-পড়া দেহটাকে আড়কোলা করে কে যে কোথায় নিয়ে গেল জানতেও পারিনি।’ সুতরাং এই যাত্রা-দেখার অভিজ্ঞতা তাঁর প্রথমজীবনের নাট্যচর্চায় ছাপ ফেলতে পারেনি, তাঁর নাটক বাংলা ও য়ুরোপীয় থিয়েটারের আদর্শকেই অনুসরণ করেছে। কিন্তু পরে শান্তিনিকেতনে পৌষমেলায় ও হয়তো অন্যত্রও তিনি সচেতনভাবেই যাত্রার দর্শক হয়েছেন, আর ধীরে ধীরে যাত্রার আঙ্গিক তাঁর নাট্যচিন্তায় প্রবিষ্ট হয়েছে—যার প্রমাণ পাওয়া যাবে তাঁর পরবর্তী জীবনে রচিত নাটকগুলিতে।

প্রসঙ্গক্রমে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রোগের চিকিৎসার আয়োজনটি কি রকম ছিল একটু দেখে নেওয়া যাক। পারিবারিক হিসাব-খাতা থেকে আমরা দেখতে পাই একজন ইংরেজ ডাক্তার ও একজন বাঙালি ডাক্তার বাৎসরিক চুক্তিতে নিযুক্ত হতেন। ইংরেজ ডাক্তারের বার্ষিক ফী ছিল ৫০০ টাকা ও বাঙালি ডাক্তারের ফী ছিল ৩০০ টাকা। দুজনেরই ফী-এর অর্ধেক দিতেন দেবেন্দ্রনাথ এবং অর্ধেক দিতেন গণেন্দ্রনাথ-গুণেন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের জন্মের পূর্ব থেকে ডাঃ এইচ বেলি এম. ডি. [Dr. H. Baillie M.D.] ও ডাঃ দ্বারকানাথ গুপ্ত [‘ডি. গুপ্ত’ নামে অধিক পরিচিত] ছিলেন ঠাকুরবাড়ির পারিবারিক চিকিৎসক। দ্বারকানাথ সম্বন্ধে সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘জ্বর হ’লেই ডাক্তার দ্বারি গুপ্ত আমাদের দেখতে আসতেন, কে জানে তাঁকে দেখলেই প্রাণ উড়ে যেত। তাঁর ব্যবস্থা ছিল—প্রথম দিন তেল (Castor Oil) ও তেলের চেয়েও বিস্বাদ জলের সাগু; দ্বিতীয় দিন এলাচদানার মত সামান্য কিছু পথ্য; তৃতীয় দিন ফুলকো রুটি; চতুর্থ দিন ভাত—সেই জ্বরের এই ক্রম ছিল।’১৩ ডাঃ বেলি সম্বন্ধে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বলেছেন: ‘ডাক্তার বেলি অতি সদাশয় লোক ছিলেন। …বেলিসাহেব বালক রবীন্দ্রকে বড় ভালবাসিতেন, দেখা হইলেই রবিকে “Robin, Robin” করিয়া আদর করিতেন।’১৪ দ্বারকানাথ গুপ্তের পরে বাঙালি ডাক্তার হিসেবে আসেন নীলমাধব হালদার 1866-এ। তিনি দীর্ঘদিন পারিবারিক চিকিৎসক রূপে ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এঁর সম্পর্কে লিখেছেন: ‘দৈবাৎ কখনো আমার জ্বর হয়েছে; তাকে কেউ জ্বর বলত না, বলত গা-গরম। আসতেন নীলমাধব ডাক্তার, থার্মোমিটার তখন চক্ষেও দেখি নি। ডাক্তার একটু গায়ে হাত দিয়েই প্রথম দিনের ব্যবস্থা করতেন ক্যাস্টর অয়েল আর উপোস। জল খেতে পেতুম অল্প একটু, সেও গরম জল। তার সঙ্গে এলাচদানা চলতে পারত। তিন দিনের দিনই মৌরলা মাছের ঝোল আর গলা ভাত উপপাসের পরে ছিল অমৃত।’১৫ বোঝা যাচ্ছে, চিকিৎসার পদ্ধতিতে দ্বারকানাথ গুপ্ত ও নীলমাধব হালদারে বিশেষ কিছু পার্থক্য ছিল না! ডাঃ বেলি বর্তমান বৎসরে Aug 1870 পর্যন্ত এই কাজে নিযুক্ত ছিলেন। এঁর পর সাহেব ডাক্তার হিসেবে সেপ্টেম্বর মাস থেকে নিযুক্ত হন ডাঃ ই. চার্লস্ এম. ডি. [Dr. E. Charles M.D.]। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার এম. ডি. [1833-1904] চিকিৎসা করেছেন, এমন দৃষ্টান্তও দেখা যায়। কবিরাজি ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাও ঠাকুরবাড়িতে প্রচলিত ছিল। বউবাজারের বিখ্যাত দত্ত পরিবারের প্রসিদ্ধ হোমিওপ্যাথ ডাঃ রাজেন্দ্র দত্ত সত্যেন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন এবং তাঁর বাতব্যাধির চিকিৎসা তিনিই করেছিলেন, অন্যরাও তাঁর দ্বারা চিকিৎসিত হতেন এমন উল্লেখও পাওয়া যায়।

মেয়েদের প্রসব ও অন্যান্য ব্যাধির ক্ষেত্রে ‘কলেজের দাই’ অর্থাৎ মেডিকেল কলেজের শিক্ষিতা নার্স ও জনৈকা Miss Murphyকে প্রায়শই আহ্বান জানানো হয়েছে। অবশ্য প্রয়োজনের ক্ষেত্রে পুরুষ ডাক্তারের দ্বারা মেয়েরা চিকিৎসিত হয়েছেন, এমন দৃষ্টান্তেরও অভাব নেই!

ওষুধের জন্য বিখ্যাত Bathgate & Company-র সঙ্গে বার্ষিক বন্দোবস্ত ছিল। প্রতি ইংরেজি বৎসরের শুরুতে একটি মোটা টাকার বিল মেটানোর উল্লেখ প্রায়ই দেখা যায়।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য, বর্তমান বৎসরের পূর্ব পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের অসুস্থতার কোনো উল্লেখ ক্যাশবহি-তে দেখা যায় না। এই বছর ১১ আশ্বিন [সোম 26 sep] এ-সম্পর্কে প্রথম উল্লেখ দেখা যায়: ‘সোম রবী সত্যপ্রসাদ বাবু ও শ্রীমতী বৰ্ণর পীড়া হওয়ায় পামরূটী’ বরাদ্দ হয়েছে—বোঝাই যায় অসুস্থতাটি উদর-সংক্রান্ত এবং এই পাইকারী চিকিৎসার প্রয়োজন হয়েছিল দলবদ্ধভাবে কোনো দুষ্পাচ্য আহার গ্রহণের ফলে!

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ২

১১ মাঘ [সোম 23 Jan 1871] একচত্বারিংশ সাংবৎসরিক ব্রাহ্মসমাজে প্রাতে আদি ব্রাহ্মসমাজ গৃহে উদ্বোধনের পর বেচারাম চট্টোপাধ্যায় বক্তৃতা করেন ও দেবেন্দ্রনাথ উপদেশ দেন। সায়ংকালে দেবেন্দ্র-ভবনে উদ্বোধনের পর শম্ভুনাথ গড়গড়ি বক্তৃতা করেন ও প্রার্থনা করেন আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ। [তত্ত্ববোধিনী-তে প্রকাশিত বিবরণে সংগীতের কোনো উল্লেখ দেখা যায় না।]

কেশবচন্দ্র গত বৎসর ৫ ফাল্গুন [মঙ্গল 14 Feb 1870] কলকাতা থেকে ইংলণ্ড অভিমুখে যাত্রা করে ৯ চৈত্র [সোম 21 Mar] লণ্ডনে পৌঁছন। ছ’মাস ইংলণ্ডে অবস্থান করে তিনি বহু বক্তৃতা করেন এবং মহারানী ভিক্টোরিয়া, ম্যাক্সমুলার, জন স্টুয়ার্ট মিল, গ্ল্যাডস্টোন প্রভৃতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ভারতবর্ষ বিষয়ে অনেক কথাবার্তা বলেন। ২ আশ্বিন ১২৭৭ [শনি 17 Sep 1870] সাউদাম্পটন থেকে যাত্রা করে তিনি ৩০ আশ্বিন [শনি 15 Oct] বোম্বাই পৌঁছন এবং ট্রেনে ৪ কার্তিক [বৃহ 20 Oct] কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। বিলেত থেকে তিনি যেন নূতন প্রাণশক্তি বহন করে আনলেন। পক্ষকালের মধ্যেই তাঁর সভাপতিত্বে ইণ্ডিয়ান রিফর্ম অ্যাসোসিয়েশন বা ভারতসংস্কারক সভা স্থাপিত হল এবং ২২ কার্তিক [সোম 7 Nov] সভার প্রথম অধিবেশনে স্ত্রীজাতির উন্নতিসাধন, সাধারণ ও ব্যবসায়-সম্পৰ্কীয় জ্ঞানশিক্ষা, সুলভ-সাহিত্য-প্রকাশ, সুরাপান-নিবারণ ও দাতব্য এই পাঁচটি বিভাগ সৃষ্টি করে এক বহুমুখী কার্যধারার সূত্রপাত ঘটল। এর প্রথম ফল ১ অগ্রহায়ণ [মঙ্গল 15 Nov] থেকে এক পয়সা মূল্যের সাপ্তাহিক সুলভ সমাচার-এর প্রকাশ। পত্রিকাটি অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এর কিছুদিন পরে ১৮ পৌষ [রবি 1 Jan 1871] থেকে সাপ্তাহিক Indian Mirror নরেন্দ্রনাথ সেনের সম্পাদনায় দৈনিকে পরিণত হয়। বাঙালি পরিচালিত ও সম্পাদিত এইটিই প্রথম ইংরেজি দৈনিক। স্ত্রীশিক্ষার প্রয়োজনে ২০ মাঘ [বুধ 1 Feb] ‘স্ত্রীশিক্ষয়িত্রীবিদ্যালয়’ [Native Ladies Normal Adult Institution নাম পরিবর্তন করে পরে Victoria Institution রাখা হয়] প্রতিষ্ঠিত হয়। এইভাবে বিচিত্র কর্মধারার মধ্য দিয়ে, ধর্মকে বাদ দিয়েও, কেশবচন্দ্র সমাজে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করেন।

পৌষ মাসের প্রথম দিকে দেবেন্দ্রনাথ কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করলে কেশবচন্দ্র কয়েকটি উপহার নিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন। এর পরেই ১১ পৌষ [রবি 25 Dec] তিনি ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজমন্দিরে উপাসনায় যোগ দেন। তার পরে তিনি কেশবচন্দ্রকে দু’বার নিজের বাড়িতে আহ্বান করেন এবং বলেন: ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের কার্য্যপ্রণালী, সংকীৰ্ত্তন ও ভক্তির ব্যাপারের প্রতি তাঁহার পূর্ব্বের ন্যায় আর অশ্রদ্ধা নাই, বরং তাহাতে অনুমোদন আছে। কেবল তাঁহার এই আপত্তি যে, ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ খ্রীষ্টের প্রতি অধিক ভক্তি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন। তাঁহার মতে সেই খ্রীষ্টই সকল বিবাদের মূল। …এই সকল কথাবার্ত্তার পর প্রস্তাব হইল যে, এমন কোন একটি সন্ধিপত্র লিখিয়া সাধারণ্যে প্রচার করা হউক, যাহাতে ব্রাহ্মগণের মনে সদ্ভাবের সঞ্চার হইতে পারিবে।’১৬ কেশবচন্দ্র এই সন্ধিপত্র রচনা করেন, যার পাঁচটি সূত্র হল:

১। ব্রাহ্মেরা ঈশ্বর ব্যতীত কাহারও উপাসনা করিতে পারেন না, এবং কোন মনুষ্যকে উপাস্য দেবতা অথবা পরিত্রাণের একমাত্র সোপান বলিয়া বিশ্বাস করিতে পারেন না।

২। ব্রহ্মেরই অব্যবহিত সহবাসলাভ ব্রহ্মোপাসনার প্রাণ, ব্যক্তিবিশেষের মধ্যবর্তিত্ব স্বীকার করা ইহার বিরুদ্ধ।

৩। অদ্বিতীয় ব্রহ্মের উপাসনা ব্রাহ্মদিগের মূল বিশ্বাস ও ঐক্যস্থল, অতএব এইটী অবলম্বন করিয়া উভয় পক্ষের যোগ রাখা কৰ্ত্তব্য।

৪। সমাজসংস্কারসম্বন্ধে পৌত্তলিকতা ও অপবিত্রতা পরিহার ব্যতীত অন্যান্য ব্যাপারে ব্রাহ্মদিগের স্বাধীনতা আছে।

৫। আদি ব্রাহ্মসমাজ যথাসাধ্য হিন্দুজাতির সহিত যোগ রাখিয়া পুরাতন প্রণালীতে ব্রহ্মোপাসনা প্রচার করিতেছেন, ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ সকল জাতির মধ্যে ব্রাহ্মধর্ম প্রচার এবং যাবতীয় সামাজিক কার্য্যে ব্রাহ্মধৰ্ম্মের মতানুসারে অনুষ্ঠান করিতে যত্নবান্‌ হইয়াছেন; প্রত্যেকে আপন স্বতন্ত্রতা ও স্বাধীনতা রক্ষা করিয়া পরস্পরের সহিত যোগ দিবেন।’১৭

১ মাঘের [শুক্র 13 Jan] এই সন্ধিপত্রের উত্তরে ২ মাঘ ‘পরস্পরের সহিত আন্তরিক প্রণয় সঞ্চার’ করার জন্য সম্মিলিত ব্রহ্মোপাসনার প্রস্তাব করে দেবেন্দ্রনাথ লিখলেন, ১১ মাঘ আদি ব্রাহ্মসমাজমন্দিরে এবং ১০ বা ১২ মাঘ ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজমন্দিরে সাংবৎসরিক উৎসব অনুষ্ঠিত হোক। কেশবচন্দ্র এই প্রস্তাবে সম্মত না হলেও ১০ মাঘ [রবি 22 Jan] ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজমন্দিরে তাঁকে উপাসনার জন্য আহ্বান জানালেন। তদনুযায়ী দেবেন্দ্রনাথ প্রাতঃকালে ‘প্রেম’ সম্বন্ধে দীর্ঘ উপদেশ দেন। কিন্তু উপদেশের শেষাংশে ব্রাহ্মধর্মের মধ্যে খ্রিস্টের ভাব আনতে নিষেধ করেন। তিনি বলেন, ‘খ্রীষ্টের নামে ইউরোপ শোণিতে প্লাবিত হইয়াছে, দুর্ব্বল ভারতবর্ষে একবার আসিলে, তাহার অস্থিচর্ম্ম চূর্ণ হইবে। স্বাধীনতার বিপরীত যাহা কিছু, তাহাই খ্ৰীষ্টধর্ম্ম।’১৮ দেবেন্দ্রনাথের এই খ্রিস্ট-সমালোচনা অপরপক্ষের মনে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করে এবং দুই সমাজের মিলনের আশা আপাতত বিফল হয়ে যায়।

বৎসরের শেষ ভাগে আদি ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে ‘ব্রাহ্মধর্মবোধিনী সভা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্পাদক হন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও নবগোপাল মিত্র।

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৩

হিন্দুমেলা বা জাতীয় মেলার পঞ্চম অধিবেশন হয় এই বৎসর ৩০ মাঘ, ১ ও ২ ফাল্গুন [শনি-সোম 11-13 Feb 1871] কলকাতা থেকে তিন ক্রোশ দূরে নৈনানে হীরালাল শীলের বাগানে। এই অনুষ্ঠানের বিবরণ ন্যাশানাল পেপার-এর যে-সংখ্যায় প্রকাশিত হয়, তা না পাওয়াতে অন্যান্য পত্রিকার বিক্ষিপ্ত বর্ণনার সাহায্য ছাড়া এই অধিবেশনের কার্যধারার পরিচয় দেওয়া সম্ভব নয়। এর থেকে আমরা জানতে পারি প্রদর্শনীর অংশটি খুবই সমৃদ্ধ ছিল। মেয়েদের তৈরি কার্পেটের অনেকগুলি নমুনা, নানাধরনের বিচিত্র বাদ্যযন্ত্র, শস্য ও ফল-ফুলের গাছ ও তিনকড়ি মুখোপাধ্যায় কর্তৃক ‘কুমারসম্ভব’ অবলম্বনে অঙ্কিত দুটি চিত্র প্রদর্শনীর বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তাছাড়া ‘ডাকাতে বাজী, ভোজবাজী, ব্যায়াম প্রদর্শন, ঘোড় দৌড়, বোট কৌতুক, কথকতা, রাসায়নিক ক্রিয়া’ প্রভৃতিও প্রদর্শিত হয়। কিন্তু বক্তৃতা, আবৃত্তি, গান—যা মেলার প্রধান দিবসের কার্যসূচির অংশ, সে-সম্পর্কে কোনো বিবরণ পত্রিকাগুলিতে পাওয়া যায় না।

এই বৎসর জাতীয় মেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘জাতীয় সভা’-র [‘National Meeting’] অনেকগুলি অধিবেশন হয়। ন্যাশানাল পেপার থেকে 1 Dec 1870 পর্যন্ত আমরা আটটি অধিবেশনের কথা জানতে পারি। অধিবেশনগুলি সাধারণত বসত রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিদ্যালয় ১৩নং কর্নওয়ালিশ স্ট্রীটস্থ ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং অ্যাকাডেমি’ ভবনে। হিন্দুমেলার চতুর্থ বার্ষিক অধিবেশনের পর জাতীয় সভার কার্য আরম্ভ হয়। প্রথম বক্তৃতা দেন চৈত্র ১২৭৬-এ [Mar 1870] সীতানাথ ঘোষ যন্ত্র বিষয়ে, এখানে তিনি তাঁর আবিষ্কৃত এয়ার পাম্প ও একটি যন্ত্রচালিত তাঁত প্রদর্শন করেন। দ্বিতীয় বক্তৃতা দেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ‘ভারতীয় বাণিজ্য’ বিষয়ে ১২ বৈশাখ ১২৭৭ [রবি 24 Apr 1870] তারিখে। উল্লেখ্য যে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এর পূর্ব থেকেই পাটের ব্যবসায়ে লিপ্ত হয়েছেন। এই অনুষ্ঠানেও সীতানাথ ঘোষ গিরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়-কৃত একটি বয়নযন্ত্র প্রদর্শন ও তার কার্যকারিতা ব্যাখ্যা করেন। ৯ জ্যৈষ্ঠ [রবি 22 May] শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর ‘ভারতীয় সঙ্গীত’ বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ করেন। ২০ আষাঢ় [রবি 3 Jul] যোগেন্দ্রনাথ ঘোষ মুদ্রাযন্ত্র-বিষয়ে চতুর্থ বক্তৃতা দেন। রাজকৃষ্ণ মিত্র ২৩ শ্রাবণ [রবি 7 Aug] তারিখে ‘জীবন ও বহির্জগতের সঙ্গে তার সম্বন্ধ’ বিষয়ে পরীক্ষা-সহযোগে আলোচনার সূচনা করেন। ১০ আশ্বিন [রবি 25 Sep] তারিখের ষষ্ঠ অধিবেশনে তিনি এই বিষয়েই আলোচনা করেন। সীতানাথ ঘোষ তাঁর আবিষ্কৃত বয়নযন্ত্র প্রদর্শন করেন এবং কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কষ্ট ও যন্ত্র-সঙ্গীত সহযোগে ‘ছয় রাগ’ বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ করেন। ২৯ পৌষ [বৃহ 12 Jan 1871] পাইকপাড়া নার্সারীর অধ্যক্ষ নিত্যগোপাল চট্টোপাধ্যায় কৃষিকার্যের উন্নতি বিষয়ে বক্তৃতা করেন ও হরিনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় এ-বিষয়ে আলোচনা করেন। অধিবেশনটি প্রায় একটি কৃষিমেলার আকার ধারণ করে, কারণ ফল, ফুল, তরিতরকারীর প্রদর্শন ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা এই অনুষ্ঠানের একটি অঙ্গ ছিল। বর্তমান বৎসরে নিশ্চয় আরও কয়েকটি অধিবেশন হয়, কিন্তু আমরা তার বিবরণ সংগ্রহ করতে সমর্থ হইনি।

প্রাসঙ্গিক তথ্য শিরোনামে ব্যবহৃত উপরোক্ত তথ্যগুলি পাঠকের কাছে অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হতে পারে, যেখানে রবীন্দ্রজীবনের সঙ্গে ঘটনাগুলির কোনো দিক থেকেই প্রত্যক্ষ যোগ নেই। কিন্তু পাঠককে একটি জিনিস লক্ষ্য করতে বলি যে, এইসব ঘটনার সঙ্গে যুক্ত অনেক ব্যক্তির সান্নিধ্যই নানাভাবে রবীন্দ্রনাথ লাভ করেছেন এবং তাঁদের এইসব বিচিত্র উদ্যম প্রত্যক্ষভাবে না হোক, পরোক্ষভাবেও তাঁকে প্রভাবিত করেছে। উদাহরণস্বরূপ আমরা সীতানাথ ঘোষের কথা উল্লেখ করতে পারি। এই অধ্যায়েই আমরা দেখেছি তাঁর নানাধরনের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা বালক রবীন্দ্রনাথকে কী তীব্রভাবে আকর্ষণ করত। হিন্দুমেলা ও তৎসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলির কার্যকলাপের মধ্যে যে আত্মনির্ভরতার আদর্শ অনুস্যূত ছিল, পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের সামাজিক ও রাজনৈতিক মতসমূহের তা অন্যতম ভিত্তি বলে আমাদের ধারণা। প্রধানত এই কারণেই আমরা উপরোক্ত ধরনের তথ্যগুলির বিস্তৃত উপস্থাপনাকে প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি।

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৪

কিশোরীচাঁদ মিত্র [1822-73]-রচিত Memoir of Dwarakanath Tagore [1870] গ্রন্থটি ঘটনাচক্রে রবীন্দ্রজীবনের সঙ্গে জড়িত হয়ে যাওয়ায় বিশেষ প্রাসঙ্গিকতা লাভ করেছে। কিভাবে এই বইটির সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথের নর্মাল স্কুলে বাংলা শিক্ষার অবসান ঘটে, তা আমরা যথাস্থানে আলোচনা করব। এই গ্রন্থ রচনার সূচনায় আছে কিশোরীচাঁদ-প্রদত্ত দুটি বক্তৃতা। তার প্রথমটি প্রদত্ত হয় ১৫ বৈশাখ ১২৭৭ বুধবার 27 Apr 1870 তারিখে হাওড়ার সেন্ট টমাস স্কুলে। বক্তৃতাটি সম্পর্কে সোমপ্রকাশ [১২ বর্ষ ২৫ সংখ্যা, ২০ বৈশাখ] পত্রিকায় এই সংবাদটি বেরোয়: ‘বুধবার বাবু কিশোরিচাঁদ মিত্র হাবড়ার ইনস্টিটিউটে দ্বারকানাথ ঠাকুরের বিষয়ে এক উপদেশ দিয়াছেন। যদিও গ্রীষ্মাতিশয্য তথাপি বিস্তর লোক উপদেশ শ্রবণ করিতে গমন করিয়াছিলেন। আমরা অবগত হইলাম, ইহা উত্তমও হইয়াছিল।’ দ্বিতীয় বক্তৃতাটি হেয়ার অ্যানিভার্সারি উপলক্ষে ১৯ জ্যৈষ্ঠ বুধবার 1 June তারিখে টাউন হলে প্রদত্ত হয়। ন্যাশানাল পেপার বক্তৃতাটির গুণাগুণ সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততই ভালো বলে মন্তব্য করলেও [‘…of the merits of the lecture, the less we say the better’—Vol. VI, No. 22, Jun 8] ঠাকুরপরিবার বক্তৃতাটি সম্বন্ধে উৎসাহ প্রকাশ করেন। ১৫ শ্রাবণ [শনি 30 Jul] বাবু নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ‘স্বর্গীয় কর্ত্তা মহাশয়ের লাইফ লেখার জন্য কিশোরীচাঁদ মিত্রের নিকট’ যান, ক্যাশবহি-তে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। গ্রন্থাকারে বক্তৃতাটি প্রকাশের ব্যাপারে ঠাকুরবাড়ির পক্ষ থেকে আর্থিক সাহায্য দেবার বিষয়ে হয়তো কিছু কথাবার্তা হয়েছিল। কিন্তু এ-সম্বন্ধে কিছু ভুল বোঝাবুঝির ফলে সমস্ত মুদ্রিত পুস্তক ঠাকুরবাড়িতে প্রেরিত হলে সেগুলি প্রেসে ফেরৎ পাঠানো হয়। অনেক দিন পরে ১ জ্যৈষ্ঠ ১২৭৯ [সোম 13 May 1872] তারিখে এই সংকটের সমাধান হয়েছে দেখা যায়: ‘বঃ কিশোরীচাঁদ মিত্র/দঃ স্বর্গীয় কৰ্ত্তামহাশয়ের/জীবন চরিত ছাপাইবার জন্য/উক্ত মিত্রের সমুদায় দাবি/শোধ/৮০০৲ টাকার চেকের মধ্যে/নিজাংশ/অর্দ্ধেক শোধ—৪০০৲’। সম্ভবত অপর অর্ধাংশ শোধ করেন গুণেন্দ্রনাথ।

উল্লেখপঞ্জি

জীবনস্মৃতি ১৭।২৯৬-৯৭

ঐ ১৭।২৯৭

প্রথম প্রকাশ: Apr 1860

জীবনস্মৃতি ১৭।২৮৮

ঐ ১৭।২৮৫

ঐ ১৭।৩০৫

প্রবোধচন্দ্র সেনঃ ‘রবীন্দ্রনাথের বাল্যরচনা’, বি.ভা.প., বৈশাখ ১৩৫০।৬৪৯

জীবনস্মৃতি [১৩৬৮]। ২৪৩, টীকা ৩৯ ৷৷১

‘আমাদের কথা’: বলেন্দ্রনাথ শতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ। ২১-২২

১০ ছেলেবেলা ২৬।৫৯১

১১ ঐ ২৬।৫৯০

১২ জীবনস্মৃতি ১৭।২৬৮

১৩ আমার বাল্যকথা ও আমার বোম্বাই প্রবাস। ৫৫

১৪ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি। ৫৮

১৫ ছেলেবেলা ২৬।৫৯৬

১৬ আচাৰ্য্য কেশবচন্দ্র ২।৮৫২

১৭ ঐ ২।৮৫৩

১৮ ঐ ২।৮৫৭

* প্রথম প্রকাশ: শ্ৰবণ ১৭৭৮ শক [1856]। ‘পদার্থ বিদ্যা নানা ইংরেজী গ্রন্থ হইতে সংগৃহীত ও অনুবাদিত হইয়াছে এ কথা বলা বাহুল্য। উহার এক এক অংশ প্রথমে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।’—বিজ্ঞাপন। দ্র সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা ১।১২।৩৬

* প্রথম প্রকাশ: ১ম খণ্ড [Jan 186l], ২য় খণ্ড [? Apr 1861]। জীবনস্মৃতি-র প্রথম পাণ্ডুলিপিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমরা যখন মেঘনাদবধ পড়িতাম তখন আমার বয়স বোধ করি নয় বছর হইবে।’

* রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত, প্রথম প্রকাশ: 1851, ‘বিজ্ঞাপন’-এর তারিখ—৪ শ্রাবণ ১৯০৮ সংবৎ [১২৫৮]। ইংরেজি Moral Class Book অবলম্বনে বিদ্যাসাগর বইটি লিখতে শুরু করেন, কিন্তু সময়াভাববশত রাজকৃষ্ণবাবুকে গ্রন্থটির স্বত্ব ও অবশিষ্ট অংশ লেখার ভার প্রদান করেন।

* এঁকে নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি ছড়ার কথা উল্লেখ করেছেন অবনীন্দ্রনাথ:

‘মহনন্দ নামে এ কাছারিধামে।

আছেন এক কর্মচারী,

ধরিয়া লেখনী লেখেন পত্রখানি

সদা ঘাড় হেঁট করি।…

হস্তেতে ব্যজনী ন্যস্ত,

মশা মাছি ব্যতিব্যস্ত—

তাকিয়াতে দিয়ে ঠেস—’ —ঘরোয়া।১৭

* ‘ব° বাবু জানকীনাথ ঘোসাল/দ° বাটীর মধ্যের তেতালার ঘর তৈয়ারির ব্যয় শোঁধ/বিঃ এক বাউচর/গুঃ ছোটবাবু মহাশয়/৩৭৪ ন° বাঙ্গাল বেঙ্কের এক চেক/৯৬০৲’—২৯ ভাদ্র মঙ্গল 13 Sep তারিখের হিসাব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *