০৯. রবীন্দ্রজীবনের নবম বৎসর

নবম অধ্যায়
১২৭৬ [1869-70] ১৭৯১ শক।। রবীন্দ্রজীবনের নবম বৎসর

1869-এর শুরু থেকে [পৌষ ১২৭৫] রবীন্দ্রনাথের নর্মাল স্কুলের চতুর্থ বৎসরের সূচনা। স্কুলের বেতনও বেড়েছে—বারো আনার জায়গায় হয়েছে মাসিক এক টাকা, সহাধ্যায়ী দ্বিপেন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে অবশ্য পুরোনো হারই বহাল থেকেছে [কিন্তু আশ্চর্য লাগে বেতন বৃদ্ধি হয়েছে জানুয়ারি মাস থেকে নয়, ফেব্রুয়ারি মাস থেকে]। মার্চ মাস থেকে দ্বিজেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পুত্র অরুণেন্দ্রনাথও একই স্কুলে যাতায়াত শুরু করেন।

গৃহশিক্ষক হিসেবে নীলকমল ঘোষাল ও ইংরেজি পড়ানোর জন্যে অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় যথারীতি ১২৭৬ বঙ্গাব্দেও নিযুক্ত থেকেছেন—নীলকমল ঘোষালের বেতন মাসিক বারো টাকা [বৈশাখ ১২৭৫ থেকে বেতন বৃদ্ধি পায়, তার আগে পেতেন মাসিক দশ টাকা] ও অঘোরনাথের বেতন মাসিক দশ টাকা।

আমরা গত বৎসরের বিবরণেই দেখেছি, অঘোরনাথ ২৩ ফাল্গুন থেকে বালকদের ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন, তার আগে এই কাজ করতেন রাখালদাস দত্ত। প্যারীচরণ সরকারের First Book of Reading দিয়ে ইংরেজি পড়া শুরু হয়েছিল কিনা সে-সম্বন্ধে আমরা আমাদের সংশয় ব্যক্ত করেছি। এই সংশয়কে আরও দৃঢ় করে বর্তমান বৎসরে ২৩ শ্রাবণ [শুক্র 6 Aug] তারিখের একটি হিসাব: ‘সোমেন্দ্র ও রবীন্দ্রবাবুর ফাষ্ট বুক অফ রিডিং ক্রয় ও বাঁধাই’, ব্যয় সাড়ে আট আনা। সোমেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এখানে যদি সত্যপ্রসাদের নামও যুক্ত থাকত, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যেত এই সময় থেকেই ‘ফার্স্ট বুক’ পড়া আরম্ভ হয়েছিল, কিন্তু তা না থাকাতে সম্পূর্ণ নিঃসংশয় হওয়া সম্ভব নয়। ১৪ কার্তিক [শুক্র 29 Oct]-এর আর একটি হিসাব ‘ছেলে বাবুদিগের কপি বহি ক্রয় ও শ্রীরামপুরে কাগজের বহি তৈয়ারি’ ইংরেজি শিক্ষার আর একটি ধাপকে চিহ্নিত করে দেয়।

অঘোরবাবু সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘এই মেডিকেল কলেজের ছাত্রমহাশয়ের স্বাস্থ্য এমন অত্যন্ত অন্যায়রূপে ভালো ছিল যে, তাঁহার তিন ছাত্রের একান্ত মনের কামনাসত্ত্বেও একদিনও তাঁহাকে কামাই করিতে হয় নাই।’* এমন-কি বর্ষার সন্ধ্যায় মুষলধারে বৃষ্টিতে রাস্তায় একহাঁটু জল দাঁড়িয়েছে, মাস্টারমশায়ের আসবার সময় দু-চার মিনিট অতিক্রম করে গেছে, ‘বর্ষাসন্ধ্যার পুলকে মনের ভিতরটা কদম্বফুলের মতো রোমাঞ্চিত’ হয়ে উঠেছে, রাস্তার সম্মুখের বারান্দাটাতে চৌকি নিয়ে গলির মোড়ের দিকে ছাত্রের দল করুণদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। ‘এমনসময় বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা যেন হঠাৎ আছাড় খাইয়া হা হতোস্মি করিয়া পড়িয়া গেল। দৈবদুর্যোগে-অপরাহত সেই কালো ছাতাটি দেখা দিয়াছে। …ভবভূতির সমানধর্ম বিপুল পৃথিবীতে মিলিতেও পারে কিন্তু সেদিন সন্ধ্যাবেলায় আমাদের গলিতে মাস্টারমহাশয়ের সমানধর্মা দ্বিতীয় আর কাহারও অভ্যুদয় একেবারেই অসম্ভব।’ বালক বয়সের এই মনোভাব সত্ত্বেও পরিণত বয়সের বিচারবুদ্ধিতে বিশ্লেষণ করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘অঘোরবাবু নিতান্তই যে কঠোর মাস্টারমশাই-জাতের মানুষ ছিলেন, তাহা নহে। তিনি ভুজবলে আমাদের শাসন করিতেন না। মুখেও যেটুকু তর্জন করিতেন তাহার মধ্যে গর্জনের ভাগ বিশেষ কিছু ছিল না বলিলেই হয়। কিন্তু তিনি যত ভালোমানুষই হউন, তাঁহার পড়াইবার সময় ছিল সন্ধ্যাবেলা এবং পড়াইবার বিষয় ছিল ইংরেজি।’ সন্ধ্যার পর ঘরে ঘরে জ্বলন্ত রেড়ির তেলের বাতি, পড়ার ঘরে জ্বলত দুই সলতের একটা সেজ। কেরোসিন তেলের আলো এর অনেক আগেই কলকাতায় এসে গেলেও ঘরে ঘরে তার বহুল প্রচলন তখনও শুরু হয়নি। তাই রেড়ির তেলের মিটমিটে আলোয় সারাদিনের দুঃখদহনের পর স্বয়ং বিষ্ণুদূতও যদি বাঙালি ছেলেকে ইংরেজি পড়াবার ভার নিতেন, ছাত্রদের পক্ষে তাঁকে যমদূত মনে করা কিছুমাত্র অস্বাভাবিক ছিল না।

ছোটোদের লেখাপড়ার খবরদারির দায়িত্ব ছিল সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথের উপর। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি বা স্বর্ণকুমারী দেবী ও জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর আত্মকথাতেও ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে হেমেন্দ্রনাথের বিশেষ মনোযোগ সম্পর্কে উল্লেখ দেখা যায়। প্রধানত তাঁরই শিক্ষাদর্শের জন্য সেকালের প্রথানুযায়ী ছেলেদের ইংরেজি স্কুলে ভর্তি না করে বাংলা শিক্ষার বনিয়াদ পাকা করার জন্য বাংলা স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির মধ্যেই শিক্ষাকে সীমাবদ্ধ রাখার পক্ষপাতী তিনি ছিলেন না। ‘আমাদিগকে বিচিত্র বিষয়ে শিক্ষা দিবার জন্য সেজদাদার বিশেষ উৎসাহ ছিল। ইস্কুলে আমাদের যাহা পাঠ্য ছিল বাড়িতে তাহার চেয়ে অনেক বেশি পড়িতে হইত।’ এরই সূত্র ধরে ‘নানা বিদ্যার আয়োজন’-এর সূচনা। অবশ্য জীবনস্মৃতি-তে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে বর্ণনা করেছেন, তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে বিচিত্র বিষয়ে শিক্ষার ভার স্তূপীকৃতভাবে তাঁদের উপর নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। ভার বাড়তে বাড়তে একসময়ে অবস্থা সেই পর্যায়ে পৌঁছলেও তার সূত্রপাত হয়েছিল ধীরে ধীরে। সেই দিক থেকে বর্তমান বৎসরে যে নূতন বিদ্যার আয়োজন করা হয়েছে, সেটি হল জিম্‌নাস্টিক শিক্ষা। হিন্দুমেলা-য় জিম্‌নাস্টিক-চর্চার একটি বিশেষ স্থান ছিল। তাছাড়া ন্যাশানাল পেপারে বা অন্যত্র ব্যায়ামাগার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে নবগোপাল মিত্রের প্রচুর উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়। হেমেন্দ্রনাথেরও কুস্তি প্রভৃতি ব্যায়ামে বিশেষ অনুরাগ ছিল। সেই সব কারণেই বালকদের উপযুক্ত শরীর গঠনের জন্য এই শিক্ষার সূচনা করা হয়। ৯ আশ্বিন [শুক্র 24 Sep] তারিখের হিসাবে দেখা যায় ‘ছেলেবাবুদিগের জিমনেসটীক শিক্ষার কাষ্ঠ তৈয়ারির ব্যয়’ বাবদ তিন টাকা দু’আনা দু’পয়সা খরচ করা হয়েছে। আবার ১২ অগ্রহায়ণ [শুক্র 26 Nov] তারিখে হিসাব লেখা হয়েছে—‘ব° বাবু নীলকমল মুখোপাধ্যায়/দ° বালকদিগের জিমনেসটীক শিক্ষার জন্য মাষ্টারের বেতন আশ্বিন কার্ত্তিক দুই মাসের শোধ দিবার জন্য দেওয়া হইল গুঃ নবিনচন্দ্র চক্রবর্তী রোক—১২৲’ অর্থাৎ নবীনচন্দ্র চক্রবর্তী [সেরেস্তার একজন কর্মচারী] মারফৎ নগদ বারো টাকা বেতন হিসেবে গণেন্দ্রনাথের ভগ্নীপতি নীলকমল মুখোপাধ্যায়কে দেওয়া হয়েছে জিম্‌নাস্টিক শিক্ষককে দেবার জন্য। এই দুটি হিসাব থেকে বোঝা যায় আশ্বিন ১২৭৬ থেকে রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্যেরা বাড়িতে জিম্‌নাস্টিক শেখা শুরু করেন। উপরের হিসাবে শিক্ষাগুরুর নামটি না থাকলেও মনে হয় তাঁর নাম শ্যামাচরণ ঘোষ*। কারণ ১৯ ভাদ্র ১২৭৭ [3 Sep 1870] তারিখের হিসাবে আছে: ‘ব° শ্যামাচরণ ঘোষ/দ° বালকদিগের জিমনেসটিক/শিক্ষার জন্য উহার বেতন/ই° ১২৭৬ সালের অগ্রহায়ণ না° ১২৭৭ সালের শ্রাবণ ৯ মাহার শোধ…৫৪৲, —মাসিক ৬ টাকা বেতনের পরিমাণটিও লক্ষণীয়। এর পরেও তিনি ব্যায়াম শিক্ষা দিতেন কিনা, তা অবশ্য জানা যায়নি। জিম্‌নাস্টিক শিক্ষার জন্য সময় নির্ধারিত ছিল বিকেল বেলা। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘সাড়ে চারটের পর ফিরে আসি ইস্কুল থেকে। জিম্‌নাস্টিকের মাস্টার এসেছেন। কাঠের ডাণ্ডার উপর ঘণ্টাখানেক ধরে শরীরটাকে উলটপালট করি। তিনি যেতে না যেতে এসে পড়েন ছবি-আঁকার মাস্টার।’ জীবনস্মৃতি-তেও রবীন্দ্রনাথ ড্রয়িং-শিক্ষকের কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু ক্যাশবহি-তে আমরা এই সময়ে কোনো ড্রয়িং শিক্ষককে শনাক্ত করতে পারিনি।

কুস্তি ও জিম্‌নাস্টিকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জন্য লাঠিখেলা শেখারও আয়োজন ছিল। শেখানোর জন্য যাকে নিযুক্ত করা হয়েছিল, সে জাতে ছিল মুচি। সাধারণ নিয়ম, শিষ্য গুরুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে—কিন্তু এক্ষেত্রে গুরু জাতে মুচি ও শিষ্য ব্রাহ্মণ। দেবেন্দ্রনাথ পুত্রকে যথারীতি প্রণাম করারই নির্দেশ দেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে শোনা এই ঘটনা Leonard K. Elmhirst [1893-1974] 25 May 1970 বিশ্বভারতীর শারীর-শিক্ষক সুবোধনারায়ণ চৌধুরীকে লিখে পাঠান: “Maharshi Devendranath appointed a low caste Hindu, a Muchi or leather worker (cobbler is all right) who was an expert lathi player, to teach the act of lathi-play to Rabindranath when he was a boy. Rabindranath not knowing how properly to greet such a low caste Hindu as a teacher, went to his father, Maharshi Devendranath, for advice. Maharshi told him to welcome him by taking the dust of his feet just in the same traditional manner of a disciple doing ‘pronam’ to his guru.”৩ক

এরই মধ্যে নবীন কবির কাব্যরচনা-চর্চা অব্যাহত গতিতে চলেছে। সেরেস্তার কর্মচারীর অনুগ্রহে প্রাপ্ত সেই নীল ফুল্‌স্‌ক্যাপের খাতাটি ‘ক্রমেই বাঁকা-বাঁকা লাইনে ও সরু-মোটা অক্ষরে কীটের বাসার মতো’ ভরে উঠতে লাগল। তাঁর কবিত্বের খ্যাতি ইতিমধ্যে পারিবারিক সীমানা অতিক্রম করে বৃহত্তর জগতে বিস্তৃত হয়ে পড়েছে। নর্মাল স্কুলের শিক্ষক ‘প্রাণিবৃত্তান্ত’ গ্রন্থের লেখক সাতকড়ি দত্ত এই সুকুমার-দর্শন ছাত্রটিকে ভালোবাসতেন। তিনি বালকের কাব্যরচনা-প্রয়াসকে উৎসাহিত করবার জন্য মাঝে মাঝে দুই-এক পদ কবিতা দিয়ে তা পূরণ করে আনতে বলতেন। এই রকম একটি কবিতা রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে উদ্ধৃত করেছেন। সাতকড়ি দত্ত মহাশয়ের প্রদত্ত—

‘রবিকরে জ্বালাতন আছিল সবাই,

বরষা ভরসা দিল আর ভয় নাই।’

—কবিতার পাদপূরণ রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন এইভাবে:

‘মীনগণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে,

এখন তাহারা সুখে জলক্রীড়া করে।’ [১৭।২৯২]

এই সময়ে রচিত একটি ‘ব্যক্তিগত বর্ণনা’—

‘আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলী দলি,

সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে—

হাপুস হুপুস শব্দ, চারিদিক নিস্তব্ধ,

পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।’ [ঐ]

স্কুলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ‘ঘনকৃষ্ণবর্ণ বেঁটেখাটো মোটাসোটা মানুষ’ গোবিন্দবাবু [গোবিন্দচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়] ছাত্রদের কাছে ভীতিজনক ছিলেন। একবার পাঁচ-ছয়টি বড়ো ছেলের উৎপীড়নে পীড়িত হয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেই সময় থেকে গোবিন্দবাবু তাঁকে ‘করুণার চক্ষে’ দেখতেন! একদিন ছুটির সময় তাঁর ঘরে বালকের ডাক পড়ল এবং ‘মনে নাই কী একটা উচ্চ অঙ্গের সুনীতি সম্বন্ধে তিনি আমাকে কবিতা লিখিয়া আনিতে আদেশ করিলেন।’ [জীবনস্মৃতি-র প্রথম পাণ্ডুলিপিতে আছে—‘সম্ভবতঃ আমার সেই পদ্যরচনার বিষয় ছিল, সদ্ভাব’]। কবিতা লিখে পরদিন তাঁকে দেখাতেই তিনি রবীন্দ্রনাথকে ছাত্রবৃত্তির ক্লাসের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে কবিতাটি পড়তে বললেন। ‘ছাত্রবৃত্তি-ক্লাসে ইহার নৈতিক ফল যাহা দেখা গেল তাহা আশাপ্রদ নহে। অন্তত, এই কবিতার দ্বারায় শ্রোতাদের মনে কবির প্রতি কিছুমাত্র সদ্‌ভাবসঞ্চার হয় নাই।’

প্রসঙ্গক্রমে নর্মাল স্কুলে রবীন্দ্রনাথের ছাত্রজীবনের দিকে একবার তাকানো যাক। এখানে অবস্থানের স্মৃতি তাঁর কাছে কিছুমাত্র মধুর নয়। তিনি লিখেছেন: ‘ছেলেদের সঙ্গে যদি মিশিতে পারিতাম, তবে বিদ্যাশিক্ষার দুঃখ তেমন অসহ্য বোধ হইত না। কিন্তু সে কোনোমতেই ঘটে নাই। অধিকাংশ ছেলেরই সংস্রব এমন অশুচি ও অপমানজনক ছিল যে, ছুটির সময় আমি চাকরকে লইয়া দোতলায় রাস্তার দিকের এক জানালার কাছে একলা বসিয়া কাটাইয়া দিতাম।’ সুযোগ-সুবিধা পেলে অন্যান্য ছেলেদের উৎপীড়ন কত তীব্র হয়ে উঠত তা গোবিন্দবাবুর কাছে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনাটিতেই প্রতিপন্ন হয়। একেবারে মরিয়া না হয়ে উঠলে সকল ছাত্রের কাছে ভীতিপ্রদ সুপারিন্টেণ্ডেন্টের ঘরে প্রবেশ করা যে সম্ভব নয়, তা সহজবুদ্ধিতেই বোঝা যায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লিখেছেনঃ ‘বাঙ্গলা ইস্কুল দুর্নীতি শিক্ষার একটি প্রধান স্থান—কুসঙ্গ যত দূর হতে পারে তা সেইখানে হয়। …ইংরাজি ইস্কুলে মারামারি ঘুসাঘুসির প্রাদুর্ভাব থাক্‌তে পারে, কিন্তু বাঙ্গালা ইস্কুলের ছাত্রদের মত ওরূপ অভদ্র আচরণ খৃষ্টীয় বালকদিগের মধ্যে দেখা যায় না। …আমাদের মধ্যে বর্ণভেদ থাকায়, প্রত্যেক বর্ণের পুরুষপরম্পরাগত সামাজিক অবস্থা ও শিক্ষাদীক্ষাভেদে—আমাদের মধ্যে নীতিগত অনেকটা বৈষম্য হয়ে পড়েছে, সভ্যতারও যেন বিভিন্ন স্তর পড়ে গেছে। ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য গরীব হলেও তাদের মধ্যে একটা স্বাভাবিক ভদ্রতা ও সভ্যতার ভাব দেখা যায়—কিন্তু নিন্মতর শ্রেণীর বালকেরা ধনীর সন্তান হলেও তারা সভ্যতার যেন একটা নিন্ম স্তরে আছে বলে’ মনে হয়। তাদের মুখে সৰ্ব্বদাই অশ্লীল কথা শোনা যেত।’ পাদটীকায় তিনি লিখেছেন, ‘অবশ্য তখনও নিম্নবর্ণের ছেলের মধ্যে সুশীল সজ্জন না দেখিয়াছি এমন নয়। তবে সাধারণ ভাবটা ঐরূপ ছিল।’ এর উপরে ছিল শিক্ষকদের আচরণ। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘শিক্ষকদের মধ্যে একজনের কথা আমার মনে আছে, তিনি এমন কুৎসিত ভাষা ব্যবহার করিতেন যে তাঁহার প্রতি অশ্রদ্ধাবশত তাঁহার কোনো প্রশ্নেরই উত্তর করিতাম না।’* তাঁর নাম হরনাথ পণ্ডিত। যখন পড়া চলত সেই অবকাশে ক্লাসে সমস্ত ছাত্রের পিছনে বসে রবীন্দ্রনাথ ‘পৃথিবীর অনেক দুরূহ সমস্যার মীমাংসাচেষ্টা’ করতেন। শিক্ষকটি ছাত্রদের অদ্ভুত নামকরণ করে তাদের লজ্জিত ও বিব্রত করতেন। এঁর কাছে পড়ার এক বৎসর পূর্ণ হলে নর্মাল স্কুলের দ্বিতীয় শিক্ষক [প্রধান পণ্ডিত] মধুসূদন বাচস্পতির কাছে তাঁদের বাংলার বাৎসরিক পরীক্ষা হল। রবীন্দ্রনাথ সর্বোচ্চ নম্বর পেলে হরনাথ পণ্ডিত কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করলেন পরীক্ষকের পক্ষপাতিত্বের। দ্বিতীয়বার পরীক্ষা হল। স্বয়ং সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট পরীক্ষকের পাশে চৌকি নিয়ে বসলেন। এবারও রবীন্দ্রনাথ উচ্চস্থান লাভ করলেন। অবশ্য ক্লাসের শিক্ষকের কোনো দোষ ছিল না; যে ছাত্র সারা বৎসর সকলের শেষে চুপ করে বসে থাকে, কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয় না, তার প্রথম হওয়ার যোগ্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ খুবই স্বাভাবিক। তার সঙ্গেই লক্ষণীয়, বাড়িতে বাংলা ভাষাচর্চার বিষয়ে যে আগ্রহ দেখানো হত, এই সময়েই রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তা কার্যকরী ফল প্রসব করতে শুরু করেছে।

প্রসঙ্গক্রমে, নর্মাল স্কুলে রবীন্দ্রনাথের একজন সহপাঠীর পরিচয় দেওয়া যায়, পরবর্তী জীবনেও যাঁর সঙ্গে তাঁর কিঞ্চিৎ যোগাযোগ ছিল। এঁর নাম অক্ষয়কুমার মিত্র [1858-1938]। তাঁর পৌত্রী উষা দত্ত লিখেছেন: ‘অক্ষয়কুমার নর্মাল স্কুলের সেরা ছাত্র ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পড়াশোনায় অক্ষয়কুমারের সমকক্ষ না-হইলেও দুইজনের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। …ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় জলপাণি পাইয়া অক্ষয়কুমার হিন্দু স্কুলে ভর্তি হন এবং এখান হইতেই এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় স্থান এবং পরে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্ররূপে বি. এ. পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান লাভ করেন।’ রবীন্দ্রভবনে উভয়ের কয়েকটি পত্র সংরক্ষিত আছে, যেগুলি রবীন্দ্রবীক্ষা ১২ [পৌষ ১৩৯১]। ১১-১৮-তে সংকলিত হয়েছে। অক্ষয়কুমার 8 May 1931 রবীন্দ্রনাথকে লেখেন: ‘তোমার সহিত বাল্যকালে নর্ম্মাল স্কুলে প্রায় দুই বৎসর একত্র অধ্যয়নকালে উভয়ে খুবই প্রণয় হয়। সেই অবধি তোমার সহিত পত্র দ্বারা কুশলাদি পাইতাম ও বাল্যকালে কতবার তোমাদের বাটী যাইতাম বেশ মনে আছে।’ রবীন্দ্রনাথ ১৬ মাঘ রবিবার [? ১৩২২: 30 Jan 1916] একটি চিঠিতে নর্মাল স্কুলের স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন:

তোমার পত্র পাইলেই সেই ইস্কুলের ছেলেবেলাকার বন্ধুদের কথা মনে পড়ে। যদিও নর্ম্যাল স্কুলের সমুখ দিয়া যাইবার সময় অসচ্চরিত্র বালকদের কথা মনে করিয়া এখনো সঙ্কুচিত হইয়া পড়ি তথাপি যখন তোমাদের মনে করি তখনি মনে করি সেইদিন আসুক, সেই আড়ি ভাব আর একদিন করি, সেই উঠা নামা আর একদিন করি। …একদিন যদি আমার কাছে আইস তবে দেখিবে, অন্যের নিকট রবি যতই গম্ভীর হউক না কেন তোমার নিকট সেই নবম বর্ষীয় বালক; অভিমান করিয়া এখনও সে আড়ি করিতে পারে, মিটমাট করিয়া পুনরায় ভাব করিতে পারে। …সেই রবি, যে, ইতিহাস, অঙ্ক বা ভূগোলের সময় শ্রেণীর সর্ব্বশেষে হাঁ করিয়া বসিয়া থাকিত, সে আজ দু’এক ছত্র কবিতা’ লিখিতে পারিয়াছে বলিয়া কি তোমার নিকট গৰ্ব্ব করিতে পারে। তুমি আমার বাল্যকালের অজ্ঞতা দেখিয়া কত হাসিয়াছ,—তোমার কাছে বিজ্ঞতা গাম্ভীর্য্য দেখাইতে লজ্জা বোধ হইবে না?

কিন্তু দুঃখের বিষয়, নর্মাল স্কুলে অক্ষয়কুমারের মতো সহপাঠী তিনি অধিক সংখ্যায় পাননি!

আমরা পূর্বেই বলেছি, ১৪ ফাল্গুন ১২৭৫ তারিখ থেকে ঈশ্বর দাস সত্যপ্রসাদের ভৃত্য রূপে বহাল হয়। বর্তমান বৎসরে বৈশাখ মাসের বেতন-গ্রহীতার তালিকায় ঈশ্বর দাসের নূতন পরিচয় লিপিবদ্ধ হয়েছে—‘সোমেন্দ্র ও রবীন্দ্রবাবুদিগের চাকর’-রূপে। মাঝে মাঝে বদলি হিসেবে অন্যান্য চাকরের আবির্ভাব ঘটলেও ঈশ্বর দাস দীর্ঘকাল তাঁদের ভৃত্যরূপে নিযুক্ত থেকেছে। এর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি ও ছেলেবেলা-য় [ছেলেবেলা-য় তার নাম ‘ব্রজেশ্বর’] বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। ‘চুলে গোঁফে লোকটা কাঁচাপাকা, মুখের উপর টানপড়া শুকনো চামড়া, গম্ভীর মেজাজ, কড়া গলা, চিবিয়ে, চিবিয়ে কথা।’ সে আগে গ্রামে গুরুমশায়গিরি করত। তার ভাষাতে এই বৃত্তির ছাপ ছিল, বাবুরা ‘বসে আছেন’ না বলে সে বলত ‘অপেক্ষা করছেন’, জনশ্রুতি ছিল যে সে বরানগরকে বরাহনগর বলে। অত্যন্ত শুচিবায়ুতার জন্য স্নানের সময় দুহাত দিয়ে অনেকক্ষণ পুকুরের উপরের জল সরিয়ে বিদ্যুদ্‌বেগে ডুব দিয়ে নিত, চলবার সময় এমন ভঙ্গীতে সে হাত বাঁকিয়ে চলত, যেন সে তার শরীরের কাপড়চোপড়গুলোকে পর্যন্ত বিশ্বাস করে না। কিন্তু এই ‘পরমপ্রাজ্ঞ রক্ষকটি’র একটি বিষয়ে দুর্বলতা ছিল। সে আফিম খেত, ফলে তার পুষ্টিকর আহারের বিশেষ প্রয়োজন ছিল। সুতরাং বালকদের জন্য বরাদ্দ দুগ্ধ পান করতে তাঁরা বিতৃষ্ণা প্রকাশ করলে সে কোনোদিন দ্বিতীয়বার অনুরোধ বা জবরদস্তি করত না। আহারের সময় আগে থাকতে খাবার সাজিয়ে রাখা তার নিয়ম ছিল না। খেতে বসলে একটি একটি করে লুচি আলগোছে দুলিয়ে সে জিজ্ঞাসা করত আর দেবে কিনা। রবীন্দ্রনাথ জানতেন কোন্ উত্তরটি তার মনঃপূত হবে। সে-ও এ নিয়ে কোনো পীড়াপীড়ি করত না। বিকেলের জলখাবার সম্বন্ধে মুড়ি প্রভৃতি লঘু পথ্য কিংবা ছোলা-সিদ্ধ বা বাদামভাজা জাতীয় সস্তা অপথ্য ফরমাশ করলে সে আপত্তি করত না। ‘দেখিতাম, শাস্ত্রবিধি আচারতত্ত্ব প্রভৃতি সম্বন্ধে সূক্ষ্মবিচারে তাহার উৎসাহ যেমন প্রবল ছিল, আমাদের পথ্যাপথ্য সম্বন্ধে ঠিক তেমনটি ছিল না।’ এতে তাঁর স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি হয়নি, বরং কম খাওয়াটাই অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল, ফলে অসুস্থতার কারণে মাস্টারমশায়ের কাছে অথবা স্কুলে ছুটি পাওয়াটাই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ব্রজেশ্বরের কাছে সন্ধেবেলায় দিনে দিনে শুনেছি কৃত্তিবাসের সপ্তকাণ্ড রামায়ণটা’। জীবনস্মৃতি-তেও অনুরূপ উক্তি আছে। কিন্তু এখানে একটু সংশয়ের অবকাশ আছে। আমরা আগেই দেখেছি, সন্ধ্যাবেলাটি ছিল ইংরেজি শিক্ষার জন্য অঘোর মাস্টারের বরাদ্দ এবং সেখানে মাস্টারমশায়ের নীরোগ স্বাস্থ্যের জন্য ছুটি পাওয়ার সুযোগ ছিল না। সুতরাং সন্ধ্যাবেলা বালকদের সংযত রাখার জন্য রেড়ির তেলের ভাঙা সেজের ক্ষীণ আলোয় রামায়ণ-মহাভারত-পাঠের আসর বসাবার সুযোগ কী করে পাওয়া যেত বা তার প্রয়োজনই বা কী ছিল—এ সম্বন্ধে প্রশ্ন জাগাই স্বাভাবিক। অবশ্য রবিবার বা অন্যান্য ছুটির দিনেই শুধু এই আসর বসে থাকলে বলার কিছু নেই। কিন্তু আমাদের ধারণা, এই আসরের ব্যাপারটি রবীন্দ্রনাথের আরো ছোটোবেলার ঘটনা। ১২৭১ বঙ্গাব্দের ক্যাশবহি-তে আমরা ‘তোষাখানার চাকর’ একজন ঈশ্বর দাসের সাক্ষাৎ পাই। [এই দুই ঈশ্বর দাস এক ব্যক্তি হওয়া সম্ভব নয়, কারণ তোষাখানার চাকর ঈশ্বরের বেতন ছিল পাঁচ টাকা—বর্তমান ঈশ্বর দাসের বেতন যেখানে সাড়ে তিন টাকা মাত্র। জীবনস্মৃতি-র প্রথম পাণ্ডুলিপিতে ‘ঘর ও ইস্কুল’ অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথ যে লিখেছেন: ‘এই সময়ে ঈশ্বর নামে একটি নূতন চাকর আমাদের কাজে নিযুক্ত হইল, সে ব্যক্তি গ্রামে গুরুমশায়গিরি করিত’, তাও আমাদের বক্তব্যকে সমর্থন করে। সম্ভবত তোষাখানার চাকর ঈশ্বর দাস বা আর কেউ রামায়ণপাঠের আসর বসাত, রবীন্দ্রনাথ স্মৃতিবিভ্রম-বশত তা বর্তমান ঈশ্বর দাসের উপর আরোপ করেছেন। [এই আসর সম্পর্কে আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি।]

এই সংশয় আরও ঘনীভূত হয় শ্যাম নামক ভৃত্যটির প্রসঙ্গে। জীবনস্মৃতি-তে তিনি এর সম্পর্কে লিখেছেন: ‘শ্যামবর্ণ দোহারা বালক, মাথায় লম্বা চুল, খুলনা জেলায় তাহার বাড়ি [ছেলেবেলা-র বর্ণনা ‘বাড়ি যশোরে’]। সে আমাকে ঘরের একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসাইয়া আমার চারিদিকে খড়ি দিয়া গণ্ডি কাটিয়া দিত।’১০ এই শ্যাম বা শ্যামদাসের সাক্ষাৎ আমরা হিসাব খাতায় প্রথম পাই বর্তমান বৎসরে ১৩ শ্রাবণ [27 Jul] তারিখে যেদিন ‘দ্বিপেন্দ্র ও অরুণেন্দ্রবাবুর চাকর শ্যাম দাস’কে ‘জ্যৈষ্ঠ মাহার বেতন শোধ’ করা হয়েছে সাড়ে তিন টাকা দিয়ে। এর পরেও তাকে আমরা প্রত্যক্ষভাবে কখনও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যুক্ত হতে দেখি না, মাঝে মাঝে স্কুলের বেতন তার মারফৎ পাঠানো ছাড়া। [অবশ্য ১২৯০ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথের বিবাহের খরচের হিসাবে ‘শ্যাম দাস চাকর’কে ‘রেপারের মূল্য’ আট টাকা দেওয়া হয়েছে দেখতে পাওয়া যায়।] ছেলেবেলা-য় গণ্ডিবন্ধন-প্রসঙ্গের কোনো উল্লেখ দেখা যায় না, আর ন’বছরের ছেলেকে সীতার পরিণতির ভয় দেখিয়ে গণ্ডিতে আবদ্ধ করাও সম্ভব ছিল না। সুতরাং আমাদের সন্দেহ, এখানেও শৈশবে অন্য কোনো ভৃত্যের কৃত আচরণ শ্যামের উপর আরোপিত হয়েছে। বরং শ্যাম সম্পর্কে ছেলেবেলা-র বর্ণনা অনেক বেশি সংগতিপূর্ণ। ছেলেদের কাছে সে ডাকাতের গল্প বলত, শোনাত রঘুডাকাত বিশুডাকাতের কথা। একবার জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ডাকাতের খেলা দেখানো হয়েছিল। তারপর ‘ডাকাতি খেলার এই ছবি শ্যামের মুখের গল্পের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে কতবার সন্ধে কাটিয়েছি দু হাতে পাঁজর চেপে ধরে।’১১ দ্বারকানাথের আমলের একখানা পুরোনো পালকি পড়ে থাকত খাতাঞ্চিখানার বারান্দার এক কোণে। একালের নামকাটা আসবাবটির প্রতি রবীন্দ্রনাথের ছিল মনের টান, রবিবারের ছুটির ফাঁকে সেই পালকির সওয়ার হয়ে শ্যামের কাছে শোনা রঘুডাকাতের গল্পের জালে জড়ানো মন কল্পনায় ভয়ের আস্বাদ গ্রহণ করত। পরবর্তীকালে ‘বীরপুরুষ’ কবিতায়১২ এই স্মৃতিই কাব্যরূপ লাভ করেছে। [বাস্তবে পালকি চড়ার অভিজ্ঞতাও অবশ্য রবীন্দ্রনাথের ছিল। স্কুলে যাতায়াতের জন্য ‘ইস্কুল গাড়ি’র বন্দোবস্ত থাকলেও মাঝে মাঝেই কখনো ঘোড়ার অসুস্থতার জন্য, কখনো কোচম্যানের অনুপস্থিতিতে পালকি করে তাঁদের স্কুলে যেতে হত। ‘সোমেন্দ্র ও রবীন্দ্রবাবুর ছাতা মেরামত’এর হিসাবও পাওয়া যায়, ছাতা মাথায় পায়ে হেঁটে স্কুলে যাওয়ার প্রয়োজনও কী দেখা দিত?]

কল্পনাপ্রবণ এই বালকটির মন এইভাবে নিজেকে নাড়াচাড়া করে বিচিত্র রস আকর্ষণের চেষ্টা করত। বাড়ির উত্তরাংশে গোলাবাড়ি নামের নিভৃত পোড়ো জায়গাটি সকলের অনাদৃত বলেই ‘বালকের মন আপন ইচ্ছামতো কল্পনায় কোনো বাধা পাইত না। রক্ষকদের শাসনের একটুমাত্র রন্ধ্র দিয়া যেদিন কোনোমতে এইখানে আসিতে পারিতাম সেদিন ছুটির দিন বলিয়াই বোধ হইত।’১৩ এরই মাঝখানে বাল্যকালের সমবয়স্কা খেলার সঙ্গিনী ইরু বা ইরাবতী (বড়ো দিদি সৌদামিনী দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা) যখন রাজবাড়ির রহস্যের অবতারণা করতেন, বালকের বিস্ময় ও কৌতূহলের আর সীমা থাকত না।

জোড়াসাঁকো বাড়ির ভিতরে বাগান তার শ্রীহীন দারিদ্র সত্ত্বেও বালক রবীন্দ্রনাথের কাছে স্বর্গোদ্যানের তুল্য ছিল। ‘বেশ মনে পড়ে, শরৎকালের ভোরবেলায় ঘুম ভাঙিলেই এই বাগানে আসিয়া উপস্থিত হইতাম। একটি শিশিরমাখা ঘাসপাতার গন্ধ ছুটিয়া আসিত, এবং স্নিগ্ধ নবীন রৌদ্রটি লইয়া আমাদের পুবদিকের প্রাচীরের উপর নারিকেলপাতার কম্পমান ঝালরগুলির তলে প্রভাত আসিয়া মুখ বাড়াইয়া দিত।’১৪ শীতের দিনের সকালে যখন আর সবাই লেপের কোমল আরামের কোলে নিদ্রামগ্ন, সেই সময়েও এই বালক বুকের কাছে দুই হাত চেপে ধরে শীতকে উপেক্ষা করে বাগানে ছুটে যেতেন পাছে এই আনন্দভোজে একটি পদও বাদ পড়ে যায়।

আবার কোনো কোনো দিন মধ্যাহ্নে বালক রবীন্দ্রনাথ হাজির হতেন বাড়ির ভিতরের ছাদে। ছাদের প্রাচীর তাঁর মাথা ছাড়িয়ে উঠত, কিন্তু প্রাচীরের রন্ধ্রের ভিতর দিয়ে চোখে পড়ত কাছের ও দূরের কলকাতার নানা আকারের ও নানা আয়তনের উচ্চনীচ ছাদের শ্রেণী। ‘সেই-সকল অতিদূর বাড়ির ছাদে এক-একটা চিলেকোঠা উঁচু হইয়া থাকিত; মনে হইত, তাহারা যেন নিশ্চল তর্জনী তুলিয়া চোখ টিপিয়া আপনার ভিতরকার রহস্য আমার কাছে সংকেতে বলিবার চেষ্টা করিতেছে।’১৫ মধ্যাহ্নের খরদীপ্ত আকাশের দূর প্রান্ত থেকে চিলের তীক্ষ্ণ ডাক ও সিঙ্গির বাগানের দিবাসুপ্ত নিস্তব্ধ বাড়িগুলির সম্মুখ দিয়ে পসারীর সুর করে ‘চুড়ি চাই, খেলোনা চাই’ হাঁক বালকের সমস্ত মনটাকে উদাস করে দিত। কোনো দিন-বা স্কুল থেকে ফিরে এসে গাড়ি থেকে নেমে পুবের দিকে তাকিয়ে চোখে পড়েছে তেতলার ছাদের উপরকার আকাশে নিবিড় হয়ে এসেছে ঘননীল মেঘের পুঞ্জ, ‘মুহূর্তমাত্রে সেই মেঘপুঞ্জের চেয়ে ঘনতর বিস্ময় আমার মনে পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে।’১৬

এইসব বর্ণনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘ছেলেবেলার দিকে যখন তাকানো যায় তখন সবচেয়ে এই কথাটা মনে পড়ে যে, তখন জগৎটা এবং জীবনটা রহস্যে পরিপূর্ণ। সর্বত্রই যে একটি অভাবনীয় আছে এবং কখন যে তাহার দেখা পাওয়া যাইবে তাহার ঠিকানা নাই, এই কথাটা প্রতিদিনই মনে জাগিত।’১৭ এই রহস্যের আকর্ষণেই দক্ষিণের বারান্দার এক কোণে ধুলোর মধ্যে আতার বিচি পুঁতে তার পরিচর্যা, গুণেন্দ্রনাথের বাগানের ক্রীড়াশৈল থেকে চুরি-করা পাথরে তৈরি নকল পাহাড়ের প্রতি বিস্ময়-মিশ্রিত আনন্দবোধ। পৃথিবীর উপরতলাটাই মাত্র দেখা যায়, মাঘোৎসবে কাঠের খুঁটি পোঁতার জন্য যে গর্ত করা হত তা আর একটু গভীর করে খুঁড়লেই তার ভিতরতলার রহস্যটির নাগাল পাওয়া যেতে পারত, এই ক্ষোভ কিছুতেই তাঁর মন থেকে যেত না! আকাশের নীলিমার পশ্চাতেই তার সমস্ত রহস্য, বোধোদয় পড়াবার উপলক্ষে নীলকমল পণ্ডিত যখন এই ধারণাকেই আঘাত করে বললেন যে ঐ নীল গোলকটি কোনো বাধাই নয়—সিঁড়ির উপর সিঁড়ি লাগিয়ে উঠে গেলেও কোথাও মাথা ঠেকবে না, তখন রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে মাস্টারমশায় সিঁড়ি সম্বন্ধে অনাবশ্যক কার্পণ্য করছেন।

এই দৃষ্টান্তগুলির তাৎপর্য রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই ব্যক্ত করা যেতে পারে: ‘বাহিরের সংস্রব আমার পক্ষে যতই দুর্লভ থাক্‌, বাহিরের আনন্দ আমার পক্ষে হয়তো সেই কারণেই সহজ ছিল। উপকরণ প্রচুর থাকিলে মনটা কুঁড়ে হইয়া পড়ে; সে কেবলই বাহিরের উপরেই সম্পূর্ণ বরাত দিয়া বসিয়া থাকে, ভুলিয়া যায়, আনন্দের ভোজে বাহিরের চেয়ে অন্তরের অনুষ্ঠানটাই গুরুতর।’১৮ অনাদরে বড়ো হওয়া শিশুটি অনাদৃত তুচ্ছ জিনিসকে অবলম্বন করেই মনের সৃজনীশক্তিকে নানাদিক থেকে কিভাবে-বিকশিত করে তোলার চেষ্টা করছে, এইটাই এখানে লক্ষণীয়।

এ তো গেল রবীন্দ্রনাথের ভাবজীবনের একটা দিক—বহিঃপ্রকৃতির সঙ্গে আদান-প্রদানের রহস্যময় রোমাঞ্চ। কিন্তু একই ধরনের রহস্য তাঁর মনকে আচ্ছন্ন করত মানব-সংস্পর্শ লাভের আকাঙক্ষায়। জোড়াসাঁকো বাড়ির বনেদিয়ানার নিয়মে নিতান্ত শৈশবেই তিনি অন্তঃপুরের স্নেহচ্ছায়া থেকে নির্বাসিত হয়েছিলেন ভৃত্যদের শাসনদগ্ধ বাহির বাড়ির মরুপ্রান্তরে। অন্তঃপুরের গতায়াত যে ছিল না তা নয়, কিন্তু সে যেন অতিথির মতো, সংসারের মাঝখানে নিজস্ব আসনে প্রতিষ্ঠিত থাকার মতো সাবলীল নয়। তাই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘বাহিরের প্রকৃতি যেমন আমার কাছ হইতে দূরে ছিল, ঘরের অন্তঃপুরও ঠিক তেমনই। সেইজন্য যখন তাহার যেটুকু দেখিতাম আমার চোখে যেন ছবির মতো পড়িত।’১৯ রাত ন’টার পর পড়া শেষ করে বাড়ির ভিতর শুতে যাবার সময় খড়খড়ি-দেওয়া লম্বা বারান্দা পার হয়ে গোটাচারপাঁচ অন্ধকার সিঁড়ির ধাপ নেমে উঠোন ঘেরা অন্তঃপুরের বারান্দায় চোখে পড়ত জ্যোৎস্নার অস্পষ্ট আলোয় বাড়ির দাসীরা পাশাপাশি পা মেলে বসে উরুর উপর প্রদীপের সলতে পাকাতে পাকাতে মৃদুস্বরে নিজেদের দেশের গল্প করছে—সমস্তটাই যেন একটা ছবি। তারপর রাত্রের আহার শেষ করে যখন বিছানায় শুতেন তখন শংকরী কিংবা প্যারী কিংবা তিনকড়ি দাসী এসে রূপকথার গল্প বলত—রবীন্দ্রনাথ ক্ষীণালোকে দেয়ালের চুন-খসা রেখার মধ্যে মনে মনে নানা অদ্ভুত ছবি উদ্‌ভাবন করতে করতে ঘুমিয়ে পড়তেন। অর্ধরাত্রে আধো-ঘুমে কোনো দিন কানে আসত বৃদ্ধ স্বরূপ সর্দারের হাঁক—এগুলি সেই ছবিরই অঙ্গ, যা অন্তঃপুরকে আধো-চেনার অস্পষ্টতায় ঘিরে রাখত।

এরই মধ্যে নূতন বধূর বেশে যখন কাদম্বরী দেবী এলেন, ‘তখন অন্তঃপুরের রহস্য আরও ঘনীভূত হইয়া উঠিল। যিনি বাহির হইতে আসিয়াছেন অথচ যিনি ঘরের, যাঁহাকে কিছুই জানি না অথচ যিনি আপনার, তাঁহার সঙ্গে ভাব করিয়া লইতে ভারি ইচ্ছা করিত।’১৯ কিন্তু কোনো সুযোগে কাছে গেলে ছোড়দিদি বর্ণকুমারী দেবীর তাড়ায় নৈরাশ্য ও অপমান বহন করে ফিরে আসতে হত। তাছাড়া তাঁর আলমারিতে কাঁচের ও চীনামাটির কত দুষ্প্রাপ্য সামগ্রী ‘অন্তঃপুরের দুর্লভতাকে আরও কেমন করিয়া রঙিন করিয়া তুলিত।’

এইভাবে অন্তর ও বাহির দুদিক থেকেই প্রতিহত হয়ে বালক রবীন্দ্রনাথের মন নিজেরই রচিত এক অবাস্তব কল্পনার জগতে বিচরণ করত, যা তাঁর কবিপ্রকৃতিকে কেমনভাবে প্রভাবিত করেছে, তা আমরা যথাস্থানে দেখতে পাব।

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ১

জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারে এ-বৎসরের প্রথম উল্লেখযোগ্য ঘটনা—৪ জ্যৈষ্ঠ ১২৭৬ [রবি 16 May 1869] দেবেন্দ্রনাথের মধ্যম ভ্রাতা গিরীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র গণেন্দ্রনাথ কলেরা রোগে মাত্র ২৮ বৎসর বয়সে পরলোকগমন করেন।২০ তিনি নানা শিল্পকলায় অনুরাগী ও পারদর্শী ছিলেন। মৃত্যুর কিছু দিন পূর্বে তাঁর কালিদাসের নাটকের গদ্য-পদ্য অনুবাদ ‘বিক্রমোর্ব্বশী নাটক’ [1 Jan 1869] ও ‘ঊনচত্বারিংশ সমাজে বিতরণের জন্য’ [১১ মাঘ ১৭৯০ শক, ১২৭৫] ‘জ্ঞান ও ধৰ্ম্মের সামঞ্জস্য’ পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। তিনি কয়েকটি ঐতিহাসিক প্রবন্ধও রচনা করেন, তারই একটি ‘আৰ্যজাতির আদি নিবাস’ তাঁর মৃত্যুর পর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-র চৈত্র [১৭৯১ শক] সংখ্যার ২৩৬-৩৭ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়। ইতিহাস-চেতনা তাঁর চরিত্রের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পারিবারিক দলিলপত্র ও বিভিন্ন জনের লেখা পত্রাদি যে-যত্নে তিনি রক্ষা করেছেন—ঠাকুরবাড়ির ইতিহাস-রচনার পক্ষে যা অমূল্য উপাদান রূপে গণ্য হতে পারে—এই যত্ন ও সচেতনতা পরিবারের আর কারোর মধ্যে খুব কমই দেখা যায়। তিনি কয়েকটি উৎকৃষ্ট ব্রহ্মসংগীতও রচনা করেন। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘চৈত্র মেলা’, আমৃত্যু তিনি ছিলেন এই মেলার সম্পাদক। এই মেলা উপলক্ষেই তিনি বিখ্যাত জাতীয়সংগীত ‘লজ্জায় ভারত যশ গাইব কি করে’ রচনা করেন। গানটি ১২৭৪ বঙ্গাব্দে মেলার দ্বিতীয় অধিবেশনে গীত হয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘যুবাবয়সেই গণদাদার যখন মৃত্যু হয় তখন আমার বয়স নিতান্ত অল্প। কিন্তু তাঁহার সেই সৌম্য-গম্ভীর উন্নত গৌরকান্ত দেহ একবার দেখিলে আর ভুলিবার জো থাকে না। তাঁহার ভারি একটা প্রভাব ছিল। সে-প্রভাবটি সামাজিক প্রভাব। তিনি আপনার চারিদিকের সকলকে টানিতে পারিতেন, বাঁধিতে পারিতেন—তাঁহার আকর্ষণের জোরে সংসারের কিছুই যেন ভাঙিয়াচুরিয়া বিশ্লিষ্ট হইয়া পড়িতে পারিত না।’২১ তাঁকে লিখিত দেবেন্দ্রনাথের পত্রাবলি, যা তিনি সযত্নে-রক্ষা করেছিলেন, তা থেকেই বুঝতে পারা যায়, দুটি পরিবারের মধ্যে রোপিত বিরোধের কাঁটাটুকু প্রধানত গণেন্দ্রনাথের চেষ্টাতেই অনেকটা উৎপাটিত হতে পেরেছিল। জোড়াসাঁকো নাট্যমঞ্চের ‘কমিটি অফ্‌ ফাইভ’-এর একজন না হয়েও প্রধানত তাঁরই উৎসাহে ও অর্থসাহায্যে ‘নব-নাটক’ অভিনয় সাফল্যমণ্ডিত হতে পেরেছিল। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই লিখেছেন: ‘ইহারাই যদি এমন দেশে জন্মিতেন যেখানে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে বাণিজ্যব্যবসায়ে ও নানাবিধ সর্বজনীন কর্মে সর্বদাই বড়ো বড়ো দল বাঁধা চলিতেছে তবে ইহারা স্বভাবতই গণনায়ক হইয়া উঠিতে পারিতেন।’২২ অপরিণত অবস্থায় একটি সন্তানের জন্মের পর তাঁর স্ত্রী স্বর্ণকুমারী অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন; এর পর তাঁদের আর কোনো সন্তান হয়নি।

দেবেন্দ্রনাথের কাছে এই ভ্রাতুষ্পুত্র অত্যন্ত স্নেহের পাত্র ছিলেন। বিশেষ করে জমিদারি ও অন্যান্য বৈষয়িক ব্যাপারে তিনি নিজের ছেলেদের চেয়েও গণেন্দ্রনাথের উপর অধিক পরিমাণে নির্ভর করতেন। সুতরাং তাঁর এই অকাল-বিয়োগ দেবেন্দ্রনাথকে যে যথেষ্ট বিচলিত করেছিল, তা বলাই বাহুল্য। হয়তো এই মৃত্যুর অভিঘাতেই ২৭ জ্যৈষ্ঠ [মঙ্গল ৪ Jun] তারিখে তিনি একটি উইল করেন। এই উইলে তিনি দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ও হেমেন্দ্রনাথকে একজিকিউটর নিযুক্ত করেন। উইলের শেষে লেখা হয়—‘ঈশ্বর না করুন যদি আমার সর্ব্ব কনিষ্ঠ পুত্র প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রাপ্তব্যবহার হইবার পূর্ব্বে উক্ত একজীকিউটরদিগের মৃত্যু হয় তবে তাঁহারা যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদিগকে এক্‌জিকিউটর নিযুক্ত করিয়া যাইবেন তাঁহারা আমার এক্‌জিকিউটর গণ্য হইবেন।’ উল্লেখ্য, এই উইল দেবেন্দ্রনাথ 28 Jun 1889 [শুক্র ১৫ আষাঢ় ১২৯৬] তারিখে ‘Cancelled/amd/Revoked’ মন্তব্য-সহ স্বাক্ষর করে বাতিল করেন।

৩০ আষাঢ় [মঙ্গল 13 Jul] তারিখে দ্বিজেন্দ্রনাথের পঞ্চম সন্তান ও চতুর্থ পুত্র সুধীন্দ্রনাথের জন্ম হয়।

৯ আশ্বিন [শুক্র 24 Sep] তারিখে হেমেন্দ্রনাথের তৃতীয় সন্তান ও দ্বিতীয় পুত্র ক্ষিতীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন।

১৬ কার্তিক [রবি 31 Oct] স্বর্ণকুমারী দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা হিরন্ময়ী দেবীর নামকরণ ও অন্নপ্রাশন ব্রাহ্মধর্মানুসারে সম্পন্ন হয়।

১৯ কার্তিক [বুধ 3 Nov] দেবেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠা কন্যা বর্ণকুমারী দেবীর সঙ্গে গোস্বামী-দুর্গাপুর নিবাসী সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘শুভবিবাহ ব্রাহ্মধর্মের বিশুদ্ধ পদ্ধতি অনুসারে সুন্দর রূপে সম্পন্ন হয়। এই বিবাহের সময় সতীশচন্দ্র কলকাতা মেডিকেল কলেজের একজন মেধাবী ছাত্র। নভেম্বর মাস থেকেই এঁর কলেজের বেতন ঠাকুর পরিবারের তহবিল থেকে দেওয়া হয়েছে। পরে স্কটল্যাণ্ডের এবারডিনে তাঁর উচ্চশিক্ষার ব্যয়ভারও দেবেন্দ্রনাথ বহন করেছেন। এঁর সম্পর্কে ইন্দিরা দেবী তাঁর স্মৃতিকথা ‘জীবনকথা’-তে লিখেছেন, ‘আমার ছোটপিসেমশায় সতীশ মুখুয্যে ছ’ফুটের উপর লম্বা ছিলেন,…তিনি বেশ ভাল ঘরের রাঢ়ী শ্রেণীর ব্রাহ্মণ ছিলেন, ও বোধহয় সেই দলের একজন যাকে বাপের কাছ থেকে শাপমুন্যি খেতে হয়েছিল।…তাঁর দৈর্ঘ্য মনে ক’রেই জ্যাঠামশায় তাঁর পারিবারিক ব্যঙ্গ কবিতায় লিখেছিলেন—

উঠানে দাঁড়াইয়া থাকি

তেতলার ঘুলঘুলি অবলীলায় খুলি

ভিতর পানে দেন আঁখি!’২৩

পারিবারিক অন্যান্য সংবাদের মধ্যে দেখা যায়, বৎসরের প্রথম থেকেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ শিলাইদহে জমিদারি দেখাশোনার কাজে নিযুক্ত হয়েছেন এবং নীলের ব্যবসা শুরু করেছেন। তাছাড়া বীরেন্দ্রনাথের বায়ুপীড়ার এমনই বৃদ্ধি ঘটে যে চিকিৎসকদের পরামর্শে আশ্বিন [Sep] মাস থেকে তাঁকে আলিপুরের Dhulendah Lunatic Asylum-এ স্থানান্তরিত করা হয়।

আর একটি কৌতূহলোদ্দীপক সংবাদ পাওয়া যায় ক্যাশবহি-র ১৫ ফাল্গুন [শুক্র 25 Feb 1870] তারিখের হিসাবে: ‘দ° বাটীর বালকদিগের টীকা দেওয়ায় টিকেদারের আসিবার গাড়িভাড়া ১০।১১।১২।১৩।১৪ পাঁচ রোজের গাড়ি ভাড়া ১৲ হিঃ ৫৲ …টিকের বীজ লইয়া যে বালক আইসে তাহাকে দেওয়া যায় ২৲’। নিঃসন্দেহে বলা যায়, যে বালকদের টিকা দেওয়া হয়েছিল রবীন্দ্রনাথও তাঁদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সম্ভবত এইটিই তাঁর প্রথম টিকা।

অনুরূপ আর একটি হিসাব পাওয়া যায় ৯ মাঘ [শুক্র 21 Jan 1870] তারিখে: ‘বড়বাবু মহাশয় ছেলেবাবুদিগের ঘোড়ার নাচ দেখিতে লইয়া যান তাহারদিগের টিকিটের জন্য ২৮৲ টাকা।’ পরবর্তী এক বৎসরের ঘোড়ার নাচের বিবরণ উদ্ধৃত করছি The Friend of India [15 Jan 1874] পত্রিকা থেকে:

On Monday, the 12th instant, the Governor General, accompanied by the Hon’ble Miss Baring, opened the Horse show at the Remount Depot, Castle Rainey, Ballygunge. …

The total number of horses entered for competition is 50, of which 5 are English, 22 Australian, 5 Country-Breds, and 18 Arabs. …His Excellency then declared the show open. The horses were then brought out, and paraded.

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ২

১১ মাঘ [রবি 23 Jan 1870] আদি ব্রাহ্মসমাজের চত্বারিংশ সাংবৎসরিক উৎসব সম্পন্ন হয়। এই উপলক্ষে পূর্বাহ্নে আদি ব্রাহ্মসমাজ গৃহে ঈশানচন্দ্র বসু, বেচারাম চট্টোপাধ্যায় ও অযোধ্যানাথ পাকড়াশী এবং সায়াহ্নে দেবেন্দ্র-ভবনে ভৈরবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, শম্ভুনাথ গড়গড়ি ও অযোধ্যানাথ পাকড়াশী বক্তৃতা করেন। দেবেন্দ্রনাথ এই সময়ে হিমালয়ের পথে কাশীতে অবস্থান করছেন।

এই প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-র কার্তিক সংখ্যার ক্রোড়পত্র-রূপে ‘সঙ্গীত লিপিবদ্ধ করিবার চিহ্নাবলী’ [য] এবং ‘তুমি বিনা কে প্রভু সংকট নিবারে’, ‘হে করুণাকর দীন-সখা তুমি’, ‘দরশন দেও_হে কাতরে’, ‘কত যে করুণা তোমার ভুলিব না এ জীবনে’ ও ‘কর তাঁর নাম গান’—এই পাঁচটি ব্রহ্মসংগীতের স্বরলিপি প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে শেষ গানটি দ্বিজেন্দ্রনাথের লেখা, বাকি চারটি সত্যেন্দ্রনাথ-লিখিত। সুর সম্ভবত বিষ্ণুচন্দ্র চক্রবর্তীর দেওয়া, কারণ গত বৎসর আমেদনগর থেকে 24 Jan 1869 [রবি ১২ মাঘ ১২৭৫] তারিখে ও সমসাময়িক অন্য কয়েকটি পত্রের মধ্যে প্রথম দুটি ও আরও সাতটি গান গণেন্দ্রনাথের কাছে পাঠিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বিষ্ণুকে দিয়ে সুর বসিয়ে নেওয়ার কথা লিখেছিলেন [দ্র ‘Tagore Family Correspondences’]। স্বরলিপিগুলি দ্বিজেন্দ্রনাথ-কৃত। এ-বিষয়ে তিনি পথিকৃতের সম্মান লাভের অধিকারী। পরবর্তীকালে বিভিন্ন রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এই পদ্ধতি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ-প্রবর্তিত আকারমাত্রিক স্বরলিপিতে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম গানটি পিতাকে গেয়ে শোনাবার কথা রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে উল্লেখ করেছেন [দ্র ১৭।৩১৭]। গানগুলি সম্ভবত এই বৎসরের মাঘোৎসবে গীত হয়েছিল এবং সুকণ্ঠের অধিকারী বালক রবীন্দ্রনাথের পক্ষে গায়কদলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

ব্রাহ্মসমাজের দিক থেকে এই বৎসরের অপর উল্লেখযোগ্য ঘটনা, ৭ ভাদ্র [রবি 22 Aug 1869] কেশবচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত ভারতবর্ষীয় ব্ৰহ্মমন্দিরে নিয়মিত উপাসনাকার্য আরম্ভ হয়। অবশ্য এর আগেই ১১ মাঘ ১৭৯০ শক [23 Jan 1869] ঊনচত্বারিংশ মাঘোৎসবের দিন এই মন্দিরের গৃহপ্রতিষ্ঠাকার্য নিষ্পন্ন হয়েছিল। ৭ ভাদ্রের উৎসবে আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ ভট্টাচার্য [শাস্ত্রী] প্রভৃতি ২১ জন যুবক ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলন একটি নূতন পথ অবলম্বন করল। এই যুবকদলের নিঃস্বার্থ সেবা, আত্মত্যাগ, সুকঠোর কৃচ্ছ্রসাধনা ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের কার্যক্ষেত্রকে বহুবিস্তৃত করে তোলে। কিন্তু ইতিহাসের পরিহাস এই যে, যে ব্যক্তিপ্রাধান্য ও সংস্কারবিমুখতাকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মসমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিল, সেই একই কারণে মাত্র দশ বছরের মধ্যেই তা ত্রিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে এবং এই যুবকদলের অনেকেই তাতে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন। বস্তুত উক্ত বিচ্ছেদের বীজ এই সময়েই রোপিত হয়ে গিয়েছিল। কেশবচন্দ্রকে কেন্দ্র করে যে বৈষ্ণবসুলভ ভক্তিপ্রবণতা ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ করেছিল এবং স্বয়ং কেশবচন্দ্র যেভাবে সব-কিছুতেই ঈশ্বরের নির্দেশ লাভ করতে থাকেন, তা স্বভাবতই যুক্তিবাদী নব্যসম্প্রদায়ের মনঃপূত হবার কথা নয়। বৎসরকাল আগে [Oct 1868] মুঙ্গেরে কেশবচন্দ্রকে প্রায় অবতার-জ্ঞানে যে ভক্তি-অর্ঘ্য দান করা হয়েছিল এবং তিনি বিনা প্রতিবাদে, প্রায় প্রশ্রয়ের সঙ্গে, যেভাবে তা গ্রহণ করেছিলেন, তাতে তাঁর অন্যতম ভক্ত বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ও যদুনাথ চক্রবর্তী কলকাতার পত্রপত্রিকায় ‘নরপূজা’র বিরুদ্ধে এক তীব্র আন্দোলন উপস্থিত করেন। সোমপ্রকাশ পত্রিকায় বেশ-কয়েকটি চিঠি এ-সম্বন্ধে প্রকাশিত হবার পর ‘বাবু কেশবচন্দ্র সেন, তাঁহার অনুচর ও পত্ৰপ্রেরকগণ’ নামে এক দীর্ঘ সম্পাদকীয় [১৫ পৌষ 28 Dec, পৃ ১০১-০৩] প্রকাশিত হয়। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-তেও ঐ মাসে ‘ব্রাহ্মধৰ্ম্ম, গুরু ও প্রচারক’ [পৃ ১৬৪-৬৮] এবং জ্যৈষ্ঠ ১২৭৫ সংখ্যায় ‘মনুষ্য পূজা’ [পৃ ২৫-২৯] প্রবন্ধে এই বিপজ্জনক প্রবণতার সমালোচনা করা হয়। অন্য দিক থেকেও প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়—‘ভারতবর্ষীয় সনাতন ধৰ্ম্মরক্ষিণী সভা’র প্রতিষ্ঠা তার প্রমাণ। তবুও কেশবচন্দ্রের অসাধারণ বাগ্মিতায় মুগ্ধ হয়ে ও কিছুটা নূতনত্বের আকর্ষণে এবং সমাজসংস্কারের প্রবণতায় একটি উচ্চশিক্ষিত যুবকগোষ্ঠী প্রবল উৎসাহে কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ব্রাহ্মধর্মপ্রচার, স্ত্রীশিক্ষাবিস্তার, স্ত্রী-স্বাধীনতা, অসবর্ণ বিবাহ, বিধবা বিবাহ, পত্রিকা প্রকাশ ইত্যাদি বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বাধীনে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ সমকালীন ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।

বর্তমান প্রসঙ্গে আর একটি উল্লেখযোগ্য জিনিস কেশবচন্দ্রের খ্রিস্টানুরক্তি। তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতা ও আচরণে এই অনুরক্তি এমন তীব্রভাবে প্রকাশ পেয়েছিল, যাতে একদিকে তাঁর পুরোনো বন্ধু আদি ব্রাহ্মসমাজীরা যেমন দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন, অপরদিকে তেমনি খ্রিস্টান মিশনারিরা এবং ইংরেজ শাসককুল অত্যন্ত উল্লসিত হয়েছিলেন, কারণ তাঁদের ধারণা হয়েছিল কেশবচন্দ্র অত্যল্পকালের মধ্যেই খ্রিস্টান হয়ে যাবেন—যা ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক উভয় দিক থেকেই ইংরেজ-স্বার্থের অনুকূল। এই অবস্থায় ৫ ফাল্গন [মঙ্গল 15 Feb 1870] কেশবচন্দ্র কলকাতা থেকে ইংলণ্ড অভিমুখে যাত্রা করেন। তাঁর পাঁচজন বাঙালি সঙ্গীর অন্যতম হচ্ছেন আনন্দমোহন বসু ও [শ্রীঅরবিন্দের পিতা] কৃষ্ণধন ঘোষ। কেশবচন্দ্র ইংলণ্ডে পৌঁছন ৯ চৈত্র [সোম 21 Mar] এবং সাদরে গৃহীত হন।

প্রাসঙ্গিক তথ্য: ৩

জাতীয় মেলা বা হিন্দু মেলার চতুর্থ অধিবেশন ২ ও ৩ ফাল্গুন [শনি-রবি 12-13 Feb 1870] আশুতোষ দেবের বেলগাছিয়া উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয়। গত বৎসরের অধিবেশনের পরেই চৈত্র-সংক্রান্তির পরিবর্তে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে কোনো সময়ে এই মেলা অনুষ্ঠিত করার প্রস্তাব ওঠে [দ্র The National Paper, Vol. V, No. 16. 21 Apr 1869] এবং সেই অনুযায়ী স্থির হয়, প্রতি বৎসর ফাল্গুন মাসের প্রথম শনি ও রবিবার জাতীয় মেলার অধিবেশন বসবে [দ্র ঐ; No. 34, Aug 25]। গণেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দেবেন্দ্র মল্লিক যুগ্ম-সম্পাদক এবং নবগোপাল মিত্র সহ-সম্পাদক হন। ‘চৈত্র মেলা’ নামটিও এই বৎসর থেকে পরিত্যক্ত হয়। ন্যাশানাল পেপার বর্তমান বৎসরের মেলার একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করে 23 Feb 1870 সংখ্যার ক্রোড়পত্রে। এই বিবরণ থেকে জানা যায় যে মেলার উদ্বোধন উপলক্ষে শনিবার গবর্মেণ্ট সমস্ত সরকারী স্কুল ও কলেজ এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করেন। বিকেল সাড়ে চারটেয় সভাপতি রাজা কমলকৃষ্ণ বাহাদুর একটি বাংলা ভাষণ দ্বারা মেলার উদ্বোধন করেন। এরপর সহ-সম্পাদক নবগোপাল মিত্র জাতীয় সভার বার্ষিক কার্যবিবরণী উপস্থিত করেন ও মেলার লক্ষ্য ও কর্মপদ্ধতি বর্ণনা করেন। সম্পাদক দ্বিজেন্দ্রনাথের ভাষণের পর কথকতা, রাজকৃষ্ণ মিত্রের বৈদ্যুতিক পরীক্ষা প্রদর্শন ও পাইকদের তরবারি খেলা ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় তিন হাজার লোক মেলায় উপস্থিত ছিলেন। দ্বিতীয় দিনে বাঙালি ও য়ুরোপীয় প্রায় কুড়ি হাজার দর্শকের সমাগম হয়েছিল। নানা ধরনের কৃষিজাতীয় দ্রব্য, যন্ত্রপাতি, শিল্পকার্যের নমুনা ইত্যাদি প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছিল। সংস্কৃত কলেজের উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর পুরস্কার-প্রাপ্ত প্রবন্ধ ‘ভীষ্মদেবের জীবনচরিত’ পাঠ করেন। আদি ব্রাহ্ম সমাজের গায়ক বিষ্ণুচন্দ্র চক্রবর্তী জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন। কথকতা, মহেন্দ্রলাল ভট্টাচার্যের রাসায়নিক পরীক্ষাদি, ভোজবাজি, বালকদের জিমনাস্টিক্‌স্‌, ঘোড়দৌড়, সাঁতার, নৌকাচালনা প্রভৃতি দর্শকদের মনোরঞ্জন করে।*

প্রাসঙ্গিক তথ্যঃ ৪

বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের মধ্যে যাঁরা এই বৎসর জন্মগ্রহণ করেন তাঁরা হলেনঃ দীনেন্দ্রকুমার রায় [১১ ভাদ্র বৃহ 26 Aug 1869], মোহনদাস করমচাঁদ [মহাত্মা] গান্ধী [১৭ আশ্বিন শনি 2 Oct], সখারাম গণেশ দেউস্কর [৩ পৌষ শুক্র 17 Dec], সুরেশচন্দ্র সমাজপতি [১৮ চৈত্র বুধ 30 Mar 1870].

উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘মৃণালিনী’ [10 Nov 1869] এবং বিহারীলাল চক্রবর্তীর ‘বঙ্গসুন্দরী’ [1 Jan 1870] ও ‘নিসর্গসন্দর্শন’ [10 Mar 1870] এই বৎসর প্রকাশিত হয়।

উল্লেখপঞ্জি

জীবনস্মৃতি ১৭।২৮৭

ঐ ১৭।২৮৫

ছেলেবেলা ২৬।৬০৮-০৯

৩ক দ্র সুধীর চক্রবর্তী: ‘ঠাকুরবাড়িতে সেকালে শরীর চর্চার দিকে খুব নজর ছিল’, খেলার আসর, শারদীয়া ১৩৮৭।২৮-২৯

জীবনস্মৃতি ১৭।২৯৩

ঐ ১৭।২৮১-৮২

‘ভুক্তভোগীর পত্র: ভারতী, শ্রাবণ ১৩২০।৪৫০-৫১

ছেলেবেলা ২৬।৫৯৫

জীবনস্মৃতি ১৭।২৮০

ছেলেবেলা ২৬।৫৯৭

১০ জীবনস্মৃতি ১৭।২৬৯

১১ ছেলেবেলা ২৬।৬০২

১২ দ্র শিশু ৯। ৩৬-৩৮ [শ্রাবণ ১৩১০/আলমোড়া]

১৩ জীবনস্মৃতি ১৭।২৭৪

১৪ ঐ ১৭।২৭৩

১৫ ঐ ১৭।২৭১-৭২

১৬ আত্মপরিচয় ২৭।২৪৪

১৭ জীবনস্মৃতি ১৭।২৭৪

১৮ ঐ ১৭।২৭২

১৯ ঐ ১৭।৩২৫

২০ দ্র The National Paper (Vol. V, No. 20), May 19

২১ জীবনস্মৃতি ১৭।৩৩৪

২২ ঐ ১৭।৩৩৫

২৩ ‘জীবনকথা’: এক্ষণ, শারদীয়া ১৩৯৯।২৭

* জীবনস্মৃতি ১৭। ২৮৬; এই মাস্টারমশাইটিকে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যেও অমর করে রেখে গেছেন, দ্র ‘অসম্ভব কথা’: গল্পগুচ্ছ ১৮। ২৭১-৭২।

৬ মাঘ ১২৭০ [সোম 18 Jan 1864]-এর সোমপ্রকাশ-এ ‘অপূৰ্ব উজ্‌জ্বলতর কিরোসিন তৈল’ ও ‘কিরোসিন ল্যাম্প সেজ অর্থাৎ দীপ’-এর বিজ্ঞাপন দেখা যায়।

* শ্যামাচরণ ঘোষ সেই সময়কার একজন বিখ্যাত ব্যায়ামবীর ছিলেন। ‘[হিন্দু মেলার আরম্ভ অবধি শ্যামাচরণ ঘোষ নামক এক ব্যক্তি কুস্তি-কসরৎ আদির জন্য প্রতি বারই পদক পুরস্কার পান। ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গের তৎকালীন ছোটলাট সর উইলিয়ম গ্রে শরীর-চর্চ্চায় উৎকর্ষের জন্য মেলার পক্ষ হইতে তাঁহাকে একটি পদক প্রদান করিয়াছিলেন।’ —হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত [১৩৭৫]। ২৬; শুধু তাই নয়, ছোটোলাট ক্যাম্পবেলের প্রতিষ্ঠিত দেশীয় সিভিল সার্ভিসে তিনি হুগলীর ব্যায়ামশিক্ষকের পদ লাভ করেন। দ্র ঐ। ৭৩

* জীবনস্মৃতি ১৭।২৮২; এঁর রূপের একটি চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায় অবনীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর ধারে [১৩৭৮] বইতে—‘তাঁর চোয়ালদুটো কেমন অদ্ভুত চওড়া, আর শক্ত রকমের। কথা যখন বলেন চোয়ালদুটো ওঠে পড়ে, মনে হয় যেন চিবোচ্ছেন কিছু।’ [পৃ ১৪] ‘হিতবাদী’তে প্রকাশিত ‘গিন্নি’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ এঁকে অমর করে রেখেছে। এ গল্পগুচ্ছ ১৫।৪১৭-২১

* চতুর্থ অধিবেশনের কার্যবিবরণ মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয়। দ্ৰ শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায়-সংকলিত ‘হিন্দু মেলার বিবরণ’: সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ৬৭ বৰ্ষ, ৩-৪ সংখ্যা, পৃ ২৯৪-৯৮। কার্যবিবরণীটিকে ন্যাশানাল পেপারের ক্রোড়পত্রটির বঙ্গানুবাদ বলা যেতে পারে। অবশ্য এই অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিত থাকার কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *