০৫. রবীন্দ্রজীবনের পঞ্চম বৎসর

পঞ্চম অধ্যায়
১২৭২ [1865-66] ১৭৮৭ শক ॥ রবীন্দ্রজীবনের পঞ্চম বৎসর

আমরা গত বৎসরের বিবরণেই দেখেছি, রবীন্দ্রনাথ ভর্তি হয়েছেন ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং একাডেমি’র শিশুশ্রেণীতে বছরের একেবারে শেষে। এখানে কী ধরনের শিক্ষা তিনি লাভ করেছিলেন, তা তাঁর মনে নেই। মনে আছে একটা শাসনপ্রণালীর কথা। পড়া না পারলে ছাত্রটিকে বেঞ্চে দাঁড় করিয়ে তার প্রসারিত দুই হাতের উপর ক্লাসের অনেকগুলি শ্লেট একত্র করে চাপিয়ে দেওয়া হত। অর্থাৎ এখানকার স্মৃতিও কেবল কিলচড় আকারেই মনে আছে। তাই স্কুলে কেবলমাত্র ছাত্র হয়ে থাকার হীনতা মোচনের জন্য তিনি বাড়ির বারান্দার এক কোণে একটি ক্লাস খুলেছিলেন, কাঠের রেলিংগুলো ছিল তাঁর ছাত্র। একটি কাঠি হাতে করে চৌকি নিয়ে তাদের সামনে বসে মাস্টারি করতেন। রেলিংগুলোর মধ্যেও ভালো ছেলে ও মন্দ ছেলের শ্রেণীবিভাগ ছিল। দুষ্ট রেলিংগুলোর উপর ক্রমাগত লাঠির ঘা পড়ে তারা বিকৃতি লাভ করত; কিন্তু কী করলে যে তাদের যথেষ্ট শাস্তি হয়, তা কিছুতেই ভেবে পেতেন না। এ-সম্পর্কে তিনি লিখেছেন : ‘শিক্ষাদান ব্যাপারের মধ্যে যে-সমস্ত অবিচার, অধৈর্য, ক্রোধ, পক্ষপাতপরতা ছিল, অন্যান্য শিক্ষণীয় বিষয়ের চেয়ে সেটা অতি সহজেই আয়ত্ত করিয়া লইয়াছিলাম।…আমার সঙ্গে আর সংকীর্ণচিত্ত শিক্ষকের মনস্তত্ত্বের লেশমাত্র প্রভেদ ছিল না।’ এই বিশ্লেষণ অবশ্যই পরিণত-বুদ্ধি রবীন্দ্রনাথের, কিন্তু শিক্ষার এই নিষ্ঠুর পদ্ধতি তাঁর শিশুমনেও প্রথমাবধি যে বিরূপতার সঞ্চার করেছিল, ক্রমশই তা পুষ্ট হয়ে তাঁকে বিদ্যালয়বিমুখ করে তুলেছিল।

ক্যালকাটা ট্রেনিং একাডেমিতে স্কুলের পড়া শুরু হলেও এখানে অবস্থান-কাল খুব দীর্ঘ নয়। এপ্রিল, মে, জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসের বেতন যথাযথ পরিশোধ করা হয়েছে—ক্যাশবহি-তে তার উল্লেখ আছে। ১৭ কার্তিক [বুধ 1 Nov] ‘সত্যপ্রসাদ বাবুর সোমবাবু ও রবিবাবুর মাহিনা ৩৲’ টাকা শোধ করা হয়েছে। [কোনো মাসের উল্লেখ করা হয়নি, সম্ভবত সেপ্টেম্বর মাসের; ‘বঃ কলিকাতা কালেজ’ লেখা হয়েছে—স্পষ্টতই তা ভুল। উল্লেখ্য, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এ-সময়ে কেশবচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত ‘কলিকাতা কলেজে’ পড়ছেন], কিন্তু একই তারিখে আর-একটি খরচও লেখা হয়েছে :

পড়িবার খরচ খাতে/ খরচ—২। ০

বঃ গোবিন্দচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

গবর্ণমেন্ট পাঠশালা

[দঃ] সত্যেপ্রসাদবাবু/সোমেন্দ্রবাবুঃ ও রবিন্দ্রবাবুর

তিনাজানার ইস্কুলের/অক্তবরমাহার/৩ বিল—২। ০

—এই হিসাব* থেকে অনুমান করা যায়, সেপ্টেম্বর মাসে পুজোর ছুটির পূর্বেই রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাজীবনে ক্যালকাটা ট্রেনিং একাডেমি-পর্ব সমাপ্ত হয়েছিল এবং ছুটি শেষ হবার পর গবর্মেন্ট পাঠশালা-পর্ব আরম্ভ হয়েছিল ১২৭২ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাস বা Nov 1865 থেকে। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন সাড়ে চার বছর মাত্র। স্কুল-পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে এইটুকু অনুমান করতে পারি যে, হয়তো এই স্কুলে শিক্ষাপদ্ধতি অভিভাবকদের ভালো লাগেনি অথবা ছোটো ছোটো শিশুদের পক্ষে জোড়াসাঁকো থেকে কর্নওয়ালিশ স্ট্রীটের দূরত্ব সম্ভবত খুবই বেশি মনে করা হয়েছিল, যেখানে গবর্মেন্ট পাঠশালা বা নর্মাল স্কুল ছিল প্রায় বাড়ির পাশেই, যদিও যাতায়াতের জন্য ‘ইস্কুল গাড়ী’র বন্দোবস্ত ছিল।

কয়েক মাসের মধ্যেই ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং একাডেমি’তে রবীন্দ্রনাথের ছাত্রজীবনের সমাপ্তি ঘটলেও, অন্যভাবে ঠাকুরপরিবারের সঙ্গে স্কুলটির যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ ছিল। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির আনুকূল্যে ও নবগোপাল মিত্রের প্রবর্তনায় প্রতিষ্ঠিত হিন্দুমেলা বা জাতীয় মেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জাতীয় সভা বা ন্যাশানাল সোসাইটির বহু অধিবেশন এই স্কুল-ভবনেই অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সেখানে দ্বিজেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রভৃতি অনেক ভাষণ প্রদান করেছেন। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই অনুষ্ঠানগুলির প্রত্যক্ষ কোন যোগ ছিল না।

গবর্মেন্ট পাঠশালা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের প্রথম স্মৃতি ক্লাস আরম্ভ হবার আগে ছাত্রেরা সমবেতভাবে যে ইংরেজি কবিতাটি সুর করে আবৃত্তি করত সেটি সম্বন্ধে। বালকদের মুখে মুখে ইংরেজি শব্দগুলি পরিবর্তিত হয়ে কিম্ভুতকিমাকার রূপ ধারণ করেছিল—‘কলোকী পুললাকী সিংগিল মেলালিং মেলালিং মেলালিং।’ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “অনেক চিন্তা করিয়া ইহার কিয়দংশের মূল উদ্ধার করিতে পারিয়াছি—কিন্তু ‘কলোকী’ কথাটা যে কিসের রূপান্তর তাহা আজও ভাবিয়া পাই নাই। বাকি অংশটা আমার বোধ হয় —Full of glee, singing merrily, merrily, merrily.’’ পরিমল গোস্বামীর ‘নেলসন্‌স ইন্ডিয়ান রীডার’ গ্রন্থে সমগ্র কবিতাটি পাঠ করার অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায় ‘কলোকী’ শব্দটির মূল হচ্ছে ‘Follow me’।*

প্রবোধচন্দ্র সেন দেশ পত্রিকার ২১ বৈশাখ ১৩৫৮ সংখ্যায় ‘রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ’ নামক প্রবন্ধে বিষয়টি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তিনি অমিয়কুমার সেনের সহায়তায় একটি পাঠ্যপুস্তক থেকে সমগ্র কবিতাটি সংগ্রহ ও উদ্ধৃত করে লিখেছেন, ‘…কবিতাটির লেখিকা…তার পুরো নাম Eliza Lee Cabot Follen (1787-1860)। তাঁর বাড়ি আমেরিকার বোস্টন শহরে। পদ্য ও গদ্য উভয়বিধ সাহিত্যেই তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থের নাম Hymns for Children (1825), আরেকখানির নাম Poems (1839)। বিখ্যাত জর্মান কবি ও দেশপ্রেমিক Karl Theodor Christian Follen (1795-1840) তাঁর স্বামী। …আমাদের আলোচ্যমান কবিতাটি সম্ভবত এলিজা ফোল্‌নের Hymns for Children গ্রন্থ থেকে সংকলিত।’ [পৃ ১১]

রবীন্দ্রনাথ গবর্মেন্ট পাঠশালাতেও সম্ভবত শিশু শ্রেণীতেই ভর্তি হয়েছিলেন, বেতন ছিল মাসিক বারো আনা। খুব সম্ভব বর্ণশিক্ষা, ধারাপাত ও লিপিশিক্ষা ছাড়া এই শ্রেণীর পাঠ্যক্রমে অন্য কিছু অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এই সময় স্কুলে প্রধান শিক্ষক ছিলেন বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকের রচয়িতা গোপালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। সুপারিন্টেণ্ডেন্ট গোবিন্দচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা পূর্বেই বলা হয়েছে।

সম্ভবত এই সময়েরই একটি স্মৃতি রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন। কৈলাস মুখুজ্যে [কৈলাসচন্দ্র মুখোপাধ্যায়] ছিলেন বাড়ির অনেকদিনের পুরোনো খাজাঞ্চি। অত্যন্ত রসিক ব্যক্তি, প্রায় ঘরের আত্মীয়ের মতো। “সেই কৈলাস মুখুজ্যে আমার শিশুকালে অতি দ্রুতবেগে মস্ত একটা ছড়ার মতো বলিয়া আমার মনোরঞ্জন করিত। সেই ছড়াটার প্রধান নায়ক ছিলাম আমি এবং তাহার মধ্যে একটি ভাবী নায়িকার নিঃসংশয় সমাগমের আশা অতিশয় উজ্জ্বলভাবে বর্ণিত ছিল। এই যে ভুবনমোহিনী বধূটি ভবিতব্যতার কোল আলো করিয়া বিরাজ করিতেছিল, ছড়া শুনিতে শুনিতে তাহার চিত্রটিতে মন ভারি উৎসুক হইয়া উঠিত।… বালকের মন যে মাতিয়া উঠিত এবং চোখের সামনে নানাবর্ণে বিচিত্র আশ্চর্য সুখচ্ছবি দেখিতে পাইত, তাহার মূল কারণ ছিল সেই দ্রুত-উচ্চারিত অনর্গল শব্দচ্ছটা এবং ছন্দের দোলা।…আর মনে পড়ে ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান।’ ওই ছড়াটা যেন শৈশবের মেঘদূত।” অত্যন্ত সংবেদনশীল কবিচিত্ত যে সেই শৈশব থেকেই সামান্য ছন্দের দোলায় অপূর্ব কল্পনাজগতের দ্বার খুলে দিত, এইটিই এখানে লক্ষণীয়।

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটি অভাবের দিকেও লক্ষ্য রাখা দরকার। বাল্যকালে মেয়েদের আদর পাওয়া শিশুদের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজন। কিন্তু জন্মের পরেই রবীন্দ্রনাথ পরিবারের রীতি-অনুযায়ী মায়ের কোল থেকে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন দাসীর কোলে। আর-একটু বড় হবার পর নিবার্সন ঘটেছে অন্দর মহল থেকে বাইরে একেবারে চাকরদের মহলে। রাত্রে শোবার সময় ছাড়া সারাক্ষণই চাকরের তত্ত্বাবধানে বাইরেই কাটাতে হত, স্নান-খাওয়াদাওয়া সবই চাকরের হাতে। এদের সম্বন্ধে স্মৃতি রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সুখের নয়। তারা নিজেদের কর্তব্যকে সহজ করবার জন্য চেষ্টা করত শিশুর খেলাধুলো দৌড়ঝাঁপ বন্ধ করে চুপচাপ বসিয়ে রাখতে এবং প্রহারের দ্বারা সমস্ত রকম চাঞ্চল্যকে দমন করতে। সেইজন্য এদের অনেকের স্মৃতি কেবল কিল চড় আকারেই রবীন্দ্রনাথের মনে ছিল—তার বেশি কিছু মনে পড়েনি। এইরূপ একজন বিস্মৃত ভৃত্য মানিক দাসের হাতে সোমেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ সমর্পিত হন এ বৎসরের ৬ বৈশাখ থেকে।

অবশ্য এই অনাদর-অবহেলা অন্তত রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে কয়েকটি দিক থেকে সুফলপ্রসূ হয়ে উঠেছিল। তিনি লিখেছেন, ‘অনাদর একটা মস্ত স্বাধীনতা—সেই স্বাধীনতায় আমাদের মন মুক্ত ছিল। খাওয়ানো-পরানো সাজানো-গোজানোর দ্বারা আমাদের চিত্তকে চারিদিক হইতে একেবারে ঠাসিয়া ধরা হয় নাই।…কত তুচ্ছ সামগ্রীও আমাদের পক্ষে দুর্লভ ছিল, তাহার ফল হইয়াছিল এই যে, তখন সামান্য যাহাকিছু পাইতাম তাহার সমস্ত রসটুকু পুরা আদায় করিয়া লইতাম, তাহার খোসা হইতে আঁঠি পর্যন্ত কিছুই ফেলা যাইত না।’ এইভাবে বাইরের অনাদর তাঁকে অন্তর্মুখী করেছিল, যেটুকু নাগালের মধ্যে পাওয়া যায়, সেটুকুর সমস্ত রস শোষণ করে আত্মস্থ করে ফেলার ক্ষমতা দিয়েছিল, আর যা পাওয়া যায়নি বা যা কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাকে নির্লিপ্তির দৃষ্টিতে দেখতে শিখিয়েছিল। পরবর্তী কালের রবীন্দ্রমানসের রূপগঠন এইভাবেই শুরু হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলায় জোড়াসাঁকো বাড়ির আবহাওয়াটি ছিল আনন্দরসে পরিপূর্ণ। বড়ো বড়ো ওস্তাদেরা এসে গান শোনাতেন, বড়ো বড়ো যাত্রাওয়ালারা এসে যাত্রাভিনয় করে যেতেন। এসব ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি উৎসাহী ছিলেন গণেন্দ্রনাথ। তাঁর কনিষ্ঠ সহোদর গুণেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন সমবয়সী বন্ধুর মতো, নানা রকম কল্পনায় তাঁদের মাথা খেলত চমৎকার। জ্যোতিরিন্দ্র বলেছেন, ‘একদিন কথা হইল, আমাদের ভিতর Extravaganza নাট্য নাই। আমি তখনই Extravaganza প্রস্তুত করিবার ভার লইলাম। পুরাতন “সংবাদ প্রভাকর” হইতে কতকগুলি মজার-মজার কবিতা জোড়াতাড়া দিয়া একটা “অদ্ভূতনাট্য“ খাড়া করিয়া, তাহাতে সুর বসাইয়া ও-বাড়ীর বৈঠকখানায় মহা উৎসাহের সহিত তাহার মহলা আরম্ভ করিয়া দিলাম।’ রবীন্দ্রনাথ ভুল করে এই ‘কিম্ভূত কৌতুকনাট্য’ [Burlesque]-টি বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের রচনা মনে করে লিখেছেন : ‘প্রতিদিন মধ্যাহ্নে গুণদাদার বড়ো বৈঠকখানাঘরে তাহার রিহার্সাল চলিত। আমরা এ-বাড়ির বারান্দায় দাঁড়াইয়া খোলা জানালার ভিতর দিয়া অট্টহাস্যের সহিত মিশ্রিত অদ্ভুত গানের কিছু কিছু পদ শুনিতে পাইতাম এবং অক্ষয় মজুমদার মহাশয়ের উদ্দাম নৃত্যেরও কিছু কিছু দেখা যাইত।’

এরপর ‘গোপাল উড়ের যাত্রা’ দেখে তাঁদের মনে বাড়িতে একটি নাট্যশালা প্রতিষ্ঠার সংকল্প জাগে। গুণেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছাড়া কেশবচন্দ্রের ভ্রাতা কৃষ্ণবিহারী সেন, কবি অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী ও সৌদামিনী দেবীর স্বামী সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা—‘কমিটি অব্‌ ফাইভ।’* জোড়াসাঁকো নাট্যশালা প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে মধুসূদনের ‘কৃষ্ণকুমারী নাটক’ এবং ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ অভিনীত হল। এরপর নতুন নাটকের খোঁজে ওরিয়েন্টাল সেমিনারির প্রধান শিক্ষক ঈশ্বরচন্দ্র নন্দীর নির্বাচিত বিষয় ‘বহুবিবাহ’ অবলম্বনে একটি নাটক লেখার জন্য দুশো টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে ‘ইন্ডিয়ান ডেলি নিউজ’-এ 22 Jun [বৃহ ৯ আষাঢ়] তারিখে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। পরীক্ষক নিযুক্ত হন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়। কিছুদিনের মধ্যেই 15 Jul [শনি ১ শ্রাবণ] ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’-এ বিজ্ঞাপন দিয়ে এই প্রতিযোগিতা প্রত্যাহার করা হয় ও সেই সময়কার প্রখ্যাত নাট্যকার পণ্ডিত রামনারায়ণ তর্করত্নের উপর এই দায়িত্ব অর্পিত হয়* অভিনয় অবশ্য হয় পর বৎসর, আমরা যথাসময়ে সে-সম্পর্কে আলোচনা করব।

এই বৎসর ৮ ফাল্গুন [রবি 18 Feb 1866] তারিখে দেবেন্দ্রনাথের চতুর্থ পুত্র বীরেন্দ্রনাথের সঙ্গে সাঁত্রাগাছী-নিবাসী হরদেব চট্টোপাধ্যায়ের কনিষ্ঠা কন্যা প্রফুল্লময়ী দেবীর বিবাহ হয়। বীরেন্দ্রনাথ তখন বেঙ্গল অ্যাকাডেমিতে এন্ট্রান্স ক্লাসের ছাত্র, বয়স কুড়ি বৎসর। উল্লেখযোগ্য, প্রফুল্লময়ী দেবীর অব্যবহিত জ্যেষ্ঠ ভগিনী নৃপময়ী বা নীপময়ী দেবীর সঙ্গে হেমেন্দ্রনাথের বিবাহ হয়। প্রফুল্লময়ী তাঁর আত্মস্মৃতি ‘আমাদের কথা’য় যে লিখেছেন, ‘আশ্বিনের ঝড়ের বছরেই আমার বিবাহ হয়’—সে-কথা অবশ্য ঠিক নয়, ‘আশ্বিনের ঝড়’ ১২৭১ বঙ্গাব্দে সংঘটিত হয়।

এই মাসেই [? ৬ ফাল্গুন শুক্র 16 Feb] দ্বিজেন্দ্রনাথের তৃতীয় সন্তান ও জ্যেষ্ঠ কন্যা সরোজাসুন্দরী দেবীর জন্ম হয়, ক্যাশবহি-তে এই দিনের হিসাবে ‘শ্রীমতিবড়বধূমাতার আঁতুড়ের খরচ ৪’ টাকা এই অনুমানের ভিত্তিস্থল।

এই বৎসরের অন্যান্য ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেবেন্দ্রনাথ-পরিচালিত ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে কেশবচন্দ্র ও তাঁর অনুবর্তীদের মনান্তরের বৃদ্ধি। এরই পরিণতিতে কেশবচন্দ্র স্ব-সম্পাদিত The Indian Mirror-সংক্রান্ত সমস্ত কাগজপত্র নিজের বাড়িতে তুলে নিয়ে যান। অবশ্য ১১ মাঘ [মঙ্গল 23 Jan] ষট্‌ত্রিংশ সাংবত্সরিক ব্রাহ্মসমাজের প্রাতঃকালীন উপাসনায় দেবেন্দ্রনাথ কেশবচন্দ্র ও দ্বিজেন্দ্রনাথকে নিয়ে বেদীর আসন গ্রহণ করেন এবং কেশবচন্দ্র ‘বিবেক ও বৈরাগ্য’ বিষয়ে বক্তৃতা দেন। উল্লেখ্য, কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজ-গৃহে এইটিই কেশবচন্দ্রের শেষ বক্তৃতা। কিন্তু এর পূর্বে ও পরে স্বতন্ত্র ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অব্যাহত গতিতে অগ্রসর হয়েছে।

The Indian Mirror পত্রিকা হস্তচ্যুত হওয়ায় কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজের ইংরেজি মুখপত্র হিসেবে দেবেন্দ্রনাথের আর্থিক সাহায্যে ও নবগোপাল মিত্রের সম্পাদনায় The National Paper সাপ্তাহিকটি? 7 Aug 1865 [? সোম ২৪ শ্রাবণ]* থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করে। পত্রিকাটি প্রতি বুধবার প্রকাশিত হত। দেবেন্দ্রনাথ মাসিক ৫৫ টাকা করে সাহায্য করতেন। এই পত্রিকায় রাজনারায়ণ বসু ‘Prospectus of Society for the Promotion of National Feeling among the Educated Natives of Bengal’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-য় চৈত্র সংখ্যার ২৫৮-৬১ পৃষ্ঠায় প্রবন্ধটি পুনর্মুদ্রিত হয়। রাজনারায়ণ মেদিনীপুরে ‘জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভা’ নামে যে সভা স্থাপন করেন, তারই কার্যাবলির উপর ভিত্তি করে এই Prospectus বা অনুষ্ঠান-পত্র রচনা করেন। একটি ক্ষুদ্র পুস্তিকাকারেও প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। পরে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক উমেশচন্দ্র দত্ত-কৃত প্রবন্ধটির একটি অনুবাদ ‘শিক্ষিত বঙ্গবাসিগণের মধ্যে জাতীয় গৌরবেচ্ছা সঞ্চারিণী সভা সংস্থাপনের প্রস্তাব’ নামে রাজনারায়ণ বসুর বিবিধ প্রবন্ধ, প্রথম খণ্ড [1882] গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়। ‘ইহাতে মোটামুটি নিন্মোক্ত বিষয়সমূহের প্রতি রাজনারায়ণ স্বদেশবাসীদের মনোযোগ দিতে বলিয়াছেন : স্বদেশীয় ব্যায়াম, সঙ্গীত, চিকিৎসাবিদ্যা, ইংরেজী শিক্ষারম্ভের পূৰ্ব্বেই বালক-বালিকাদের যথোপযুক্তরূপে মাতৃভাষা শিক্ষাদান, সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার অনুশীলন, বাংলা শব্দ ব্যবহার দ্বারা কথোপকথনে ভাষার বিশুদ্ধতা সম্পাদন, বাংলা ভাষায় পরস্পরকে পত্র লেখা, বাঙালীর সভাতে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা প্রদান, সুরাপানাদি বিদেশীয় অনিষ্টকর প্রথা এ দেশে যাহাতে প্রচলিত না হয় তাহার উপায় অবলম্বন, হিন্দুশাস্ত্র অবলম্বন করিয়া সমাজ-সংস্কারকার্য্য সম্পাদন, ভ্রাতৃদ্বিতীয়া প্রমুখ স্বদেশীয় সুপ্রথাসকল রক্ষা, নমস্কার প্রণামাদি স্বদেশীয় শিষ্টাচার পালন, বিদেশীয় রীতিতে পরিচ্ছদ পরিধান ও আহার সম্পূর্ণ বর্জ্জন, দেশীয় ভাষায় নাটকাদি অভিনয় প্রভৃতি।’১০

এই প্রবন্ধে প্রকাশের পর বৎসরই নবগোপাল মিত্রের উদ্যোগে ‘হিন্দুমেলা’ বা ‘চৈত্র মেলা’ অনুষ্ঠিত হয়।

শান্তিনিকেতনে গৃহনির্মাণের কাজকর্ম এ বছরেও অব্যাহত ছিল, তার সঙ্গে ফুলের চারা কেনার খবরও ক্যাশবহি থেকে পাওয়া যায়। ভাদ্র মাসে বোলপুর থেকে গণেন্দ্রনাথকে লেখা দেবেন্দ্রনাথের অনেকগুলি চিঠি দেখে বোঝা যায়, এই সময় তিনি শান্তিনিকেতনের নির্জনতায় কতকগুলি দিন অতিবাহিত করেছিলেন।

প্রাসঙ্গিক তথ্য : ১

রবীন্দ্রনাথের ছাত্র-জীবনে বার বার স্কুল-পরিবর্তন ঘটলেও গবর্মেন্ট পাঠশালা-পর্বই দীর্ঘতম। এটিকে রবীন্দ্রনাথ বা অন্যেরা নর্মাল স্কুল বলে উল্লেখ করলেও, নর্মাল স্কুল ও গবর্মেন্ট পাঠশালা বস্তুত দুটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান, যদিও একই কর্তৃপক্ষের অধীনে একই বাড়িতে স্কুল-দুটি পরিচালিত হত। গবর্মেন্ট পাঠশালার ইতিহাস নমাল স্কুলের চেয়ে অনেক পুরোনো। 1817-এ স্থাপিত হিন্দু কলেজে প্রধানত ইংরেজি শিক্ষার উপরই জোর দেওয়া হত এবং সমস্ত বিষয়ই পড়ানো হত ইংরেজি ভাষায়। কিন্তু রাধাকান্ত দেব, রামকমল সেন, দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রভৃতিকে নিয়ে গঠিত হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ সভা বাংলা ভাষার মাধ্যমে ছেলেদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে হিন্দু কলেজের অধীনে একটি আদর্শ বাংলা পাঠশালা স্থাপনে আগ্রহী ছিলেন। ডেভিড হেয়ার প্রমুখ ইংরেজ শিক্ষানুরাগীর সমর্থনে হিন্দু কলেজের পশ্চিম দিকে, এখন যেখানে প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলেজেরই অধিকারভুক্ত জমিতে 14 Jan 1839 তারিখে ডেভিড হেয়ার এই আদর্শ বাংলা পাঠশালার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রামকমল সেন, রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ, ডেভিড হেয়ার প্রভৃতিকে নিয়ে গঠিত একটি সাবকমিটি পাঠশালার জন্য অর্থ সংগ্রহ, ছাত্র-নির্বাচন, শিক্ষক-নিয়োগ, পাঠ্য-তালিকা-নির্ধারণ ও পুস্তক-রচনা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি সম্পন্ন করতে সচেষ্ট হন। এক বছরের মধ্যেই গৃহনির্মাণ সমাপ্ত হলে বাঙালি ও ইংরেজ বহু গণমান্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে 18 Jan 1840 তারিখে পাঠশালার উদ্বোধন হয়। প্রায় ছ-মাস রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ পাঠশালার তত্ত্বাবধায়ক বা প্রধান অধ্যাপক ছিলেন। 1 Jul 1840 থেকে স্কুল সোসাইটির স্কুল-এর [পরবর্তীকালের হেয়ার স্কুল] শিক্ষক ক্ষেত্রমোহন দত্ত তত্ত্বাবধায়ক [Superintendent] নিযুক্ত হন।

বাংলা ভাষার মাধ্যমে ভারতীয় ও য়ুরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া পাঠশালার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। 1843-44-এর শিক্ষা-বিষয়ক রিপোর্টে [p. 19] লেখা হয় : ‘The Primary object contemplated in the establishment of the patshala were to provide a system of national education, and to instruct Hindoo youths in literature, and in the sciences of India and of Europe, through the medium of the Bengali Language.’ উচ্চ ও নিম্ন শ্রেণীর বার্ষিক বেতন চার টাকা ও দু টাকা ধার্য হয় এবং কমিটি ঠিক করেন যে, বারো বছরের বেশি বয়সের বালককে পাঠশালায় ভর্তি করা হবে না। কিছু দিন পূর্বে মিশনারি উইলিয়ম অ্যাডাম প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে যে রিপোর্ট [Reports on Vernacular Education In Bengal and Bihar 1835, 1836, 1838] দেন, তাতে দেশীয় ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার উপযোগী পাঠ্যবিষয়কে চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করে সেই অনুযায়ী পাঠ্যক্রম নির্দিষ্ট করার সুপারিশ করেছিলেন। কমিটি বিষয়গুলিকে প্রায় একই রেখে অ্যাডামের চারটি শ্রেণীর পরিবর্তে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করলেন। বিষয়গুলির শ্রেণী-বিন্যাস এইরূপ : প্রথম শ্রেণীতে অক্ষর, বানান, হিতোপদেশক ইতিহাস, ব্যাকরণ ও গণিতের প্রাথমিক সূত্র, গোলাধ্যায়ের মূল প্রকরণ এবং ভারতবর্ষের সংক্ষিপ্ত বিবরণ; দ্বিতীয় শ্রেণীতে ব্যাকরণ, অঙ্ক, ক্ষেত্র-পরিমাপক বিদ্যা, গোলাধ্যায়, জ্যোতির্বিদ্যা, শুদ্ধরূপে ভাষাকথনের বিধি, ইংলণ্ড ও ভারতবর্ষের ইতিহাস এবং পত্রলিখনরীতি; তৃতীয় শ্রেণীতে শুদ্ধরূপে ভাষাকথনের নিয়ম, জমিদারী ও বাণিজ্য সম্পর্কীয় ব্যবহার, প্রাচীন ও আধুনিক ইতিহাস, জ্যোতির্বিদ্যা, বীজগণিত, রাজনীতি, নীতিবিদ্যা, ক্ষেত্র-পরিমাপক বিদ্যা, গবর্নমেন্টের আইন ও আদালতের রীতি ব্যবহার এবং হিন্দু ও মুসলমানদের ব্যবস্থা।১১

ছাত্রদের বারোটি ক্লাসে এই তিন শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক পড়াবার বন্দোবস্ত করা হয়। যৎকিঞ্চিৎ বেতন দিতে হলেও তারা বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক পেত। পাঠ্যপুস্তকগুলির সাধারণ নাম দেওয়া হয় ‘শিশু সেবধি’। রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ এই গ্রন্থমালার অন্তর্ভুক্ত দু-খণ্ডে ‘বর্ণমালা’ [‘সন ১২৪৬’] রচনা করেন। বারোটি শ্রেণীর জন্য বারো জন শিক্ষকও নিযুক্ত হন।

পাঠশালাটি প্রথমে যথেষ্ট জনসমাদর লাভ করলেও সরকারের নীতি পরিবর্তিত হওয়ায় 1843-44-এ ছাত্রসংখ্যা কমে দেড় শতের কিছু বেশিতে দাঁড়ায়। বারোটি শ্রেণী কমে সাতটি শ্রেণীতে পরিণত হল, শিক্ষক-সংখ্যাও স্বভাবতই কমে যায়।

কয়েক বছর পরে 15 May 1854 হিন্দু কলেজ বিভাগের নাম হয় প্রেসিডেন্সি কলেজ ও স্কুল বিভাগ হিন্দু স্কুল নাম ধারণ করে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তখন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ। এই কাজ ছাড়াও 1 May 1855 তারিখে দক্ষিণবঙ্গের স্কুলগুলির সহকারী ইন্‌স্পেক্টর পদে নিযুক্ত হয়ে তিনি মফস্বল-বিদ্যালয়গুলির জন্য উপযুক্ত শিক্ষকের চাহিদা মেটানোর উদ্দেশ্যে একটি নর্মাল স্কুল বা শিক্ষক-শিক্ষণ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হন। এর ফলে অক্ষয়কুমার দত্তকে প্রধান শিক্ষক ও মধুসূদন বাচস্পতিকে দ্বিতীয় শিক্ষক নিযুক্ত করে 17 Jul 1855 নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। হিন্দু কলেজের অধীন বাংলা পাঠশালা এই সময়ে সংস্কৃত কলেজের সঙ্গে যুক্ত হয়। বিদ্যাসাগরের ইচ্ছা ছিল পাঠশালার শিক্ষা দেবার ও পরিচালনার পদ্ধতি দেখে এবং কখনও কখনও নিজেরা পড়িয়ে নর্মাল স্কুলের ছাত্রেরা শিক্ষাদান-কার্যে পারদর্শী হয়ে উঠবে। তাঁর সুপরিচালনায় পাঠশালাটির ক্রমশ উন্নতি হতে থাকে, ছাত্র-সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং সাতটির জায়গায় আটটি শ্রেণী খোলা হয়, দুজন নূতন শিক্ষকও নিযুক্ত হন।

তখন থেকেই বাংলা পাঠশালা নর্মাল স্কুলের সহযোগী হিসেবে পরিচালিত হতে শুরু করে। বাংলা পাঠশালার বাড়ি ভেঙে নতুন করে তৈরি করার প্রয়োজন দেখা দেওয়ায় হিন্দু কলেজের কাছে একটি ভাড়া বাড়িতে পাঠশালাটি উঠে যায়। 1857-58-এর রিপোর্টে দেখা যায়, সেখান থেকে পাঠশালা বৌবাজারের একটি বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়েছে। নর্মাল স্কুলও হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে উঠে যায়, কারণ 1860-61-এর রিপোর্টে উল্লিখিত হয়েছে যে, 1 Jan 1860 তারিখে নর্মাল স্কুল ও বাংলা পাঠশালা উভয়েই বৌবাজারের বাড়ি থেকে ৮৩ নং চিৎপুর রোডে শ্যামাচরণ মল্লিকের প্রশস্ততর বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। এই বাংলা পাঠশালাই ক্যাশবহি-তে উল্লিখিত ‘গবর্ণমেন্ট পাঠশালা’, রবীন্দ্রনাথ যেখানে পড়েছিলেন। যদিও বিদ্যালয়-ভবনটি সাধারণভাবে ‘কলিকাতা গবর্ণমেন্ট নর্মাল বিদ্যালয়’ বা সংক্ষেপে ‘নর্মাল স্কুল’ নামে অভিহিত হত।

আমরাও রবীন্দ্রনাথের এই দ্বিতীয় বিদ্যালয়টিকে ‘নর্মাল স্কুল’ বলে অভিহিত করলেও, পাঠকদের স্মরণ রাখা দরকার, বিদ্যালয়টির আসল নাম ‘ক্যালকাটা গবর্মেন্ট পাঠশালা’ বা ‘ক্যালকাটা মডেল স্কুল’—সরকারী কাগজপত্রে সর্বত্র এই দুটি নামই ব্যবহৃত হয়েছে।

বাড়ি বদলের সমসাময়িক কালেই গবর্মেন্ট পাঠশালার পাঠক্রমে একটি পরিবর্তন সাধিত হয়। এখানে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের কথা উঠলে অভিভাবকদের কাছ থেকে মতামত নেওয়া হয়। শতকরা নব্বই জন অভিভাবকই পাঠশালায় ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের অনুকূলে মত দেন। অবশ্য ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তিত হলেও কার্যক্রমে তার জন্য খুব অল্প সময়েই বরাদ্দ করা হয়, সমস্ত বিষয় বাংলা ভাষার মাধ্যমে পড়ানোর ব্যবস্থাই অব্যাহত থাকে। ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তিত হলে তার একটি সুফল হল এই যে, এখান থেকে যে ছাত্ররা ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হত তাদের আর নিম্নতম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার দরকার ছিল না। অন্যান বিষয় বাংলায় ভালভাবে আয়ত্ত হওয়ার ফলে, ইংরেজি অল্প জানলেও তা শিখে নিতে খুব বেশি অসুবিধা হত না। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছিল, তা আমরা যথাস্থানে দেখতে পাব।*

উল্লেখপঞ্জি

জীবনস্মৃতি ১৭। ২৮০-৮১

দ্র প্রাসঙ্গিক তথ্য :১

জীবনস্মৃতি ১৭। ২৮১

দ্ৰ সংযোজন ॥ তথ্যপঞ্জী, জীবনস্মৃতি [১৩৬৮]। ২৮৫-৮৬

জীবনস্মৃতি ১৭। ২৬৫-৬৬

ঐ ১৭। ২৬৮-৬৯

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি। ৭১-৭২

জীবনস্মৃতি ১৭। ৩৩৫

দ্র যোগেশচন্দ্র বাগল : হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত [১৩৭৫]। ৯১-১১১

১০ যোগেশচন্দ্র বাগল : রাজনারায়ণ বসু, সা-সা-চ ৪। ৪৯। ৪৫

১১ দ্র সংবাদপত্রে সেকালের কথা ২। ৩০

* প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, উক্ত গোবিন্দচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন গবর্মেন্ট পাঠশালা ও কলিকাতা নর্মাল স্কুলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট, যিনি রবীন্দ্রনাথকে ‘উচ্চ অঙ্গের সুনীতি সম্বন্ধে’ করিতা লিখে আনতে আদেশ করেছিলেন। এ-সম্পর্কে আমরা পরে আরও আলোচনা করব।

* ‘হাইস্কুলে যে ইংরেজী বই প্রথম পড়েছি তার নাম যতদূর মনে পড়ে নেলসন্‌স ইন্ডিয়ান রীডার। তাতে দু চার পাতা পরপর একখানা দুখানা রঙীন ছবি ছিল। একটি রেলগাড়ির ছবি, একটি জ্যোৎস্না রাতের ছবি। পড়া ভুলে সেই ছবির দিকে চেয়ে স্বপ্নজাল বুনতাম।

‘একটা কবিতার এইটুকু এখনও মনে আছে—/Follow me full of glee/Singing merrily merrily merrily’—স্মৃতিচিত্রণ [২য় সং, ১৩৬৭]। ৩২-৩৩

ক্যাশবহি-তে দেখা যায়, মাসিক ১৫৲ টাকা বেতনে তিনি জমিদারি সেরেস্তায় কাজ করতেন।

* জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি-তে [পৃ ৯৬] লেখা হয়েছে : ‘কৃষ্ণবিহারী সেন, গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিবাবু, অক্ষয়বাবু [চৌধুরী] এবং জ্যোতিবাবুর ভগিনীপতি যদুনাথ মুখোপাধ্যায়—এই পাঁচজনে এই নাট্যসমিতির সভ্য হইলেন।’ কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথই 14 Jul 1867 গুণেন্দ্রনাথকে লেখা একটি পত্রে যদুনাথের দাবি অস্বীকার করেছেন; ‘It was Gangooly [Saradaprasad], you and I that proposed it; and I don’t think that Jadoo can claim the credit of being one of its projectors. I do think that he had no hand in the matter.’—সুশীল রায় : জ্যোতিরিন্দ্রনাথ [১৩৭০]। ৯৭

* দ্র সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা ১। ৫। ৩১; কিন্তু এই বিবরণে সম্ভবত কিছু ত্রুটি আছে, কারণ Friend of India পত্রিকার 27 Jul 1865 সংখ্যায় [Vol. XXXI, No. 1595] Sat. Jul. 22 তারিখ দিয়ে নিম্নোক্ত সংবাদটি প্রকাশিত হতে দেখা যায় : “The Committee of the Jorasanko Theatre” in Calcutta offered prizes of Rs 200 each for the best drama illustrating the condition and helplessness of Hindoo females, and the best tragedy on the evil effects of Polygamy. They offer a prize of Rs 100 for a play on the Village Zemindars. The dramas are to be in Bengali. The idea is a good one. The Miss Austen-like novels of Tek Chand show that there are capital materials for such dramas in native life, and it is time to prove that Bengalis can produce something better than the unutterably stupid Nil Durpan. [p. 868]

* Friend of India-র 10 Aug [No. 1597] সংখ্যায় Mon. Aug 7 তারিখ দিয়ে পত্রিকাটির প্রাপ্তি স্বীকার করে লেখা হয়, ‘We have received the first number of the National Paper, a native paper in English, to be published in Calcutta every Wednesday as the organ of the conservative Brahmists. The first number does not promise well.’ [p. 929] পত্রিকাটি 7 Aug প্রথম প্রকাশিত হয় বলে অনেক স্থানে উল্লিখিত হয়েছে; কিন্তু ওই দিন সোমবার ছিল, অথচ পত্রিকাটি প্রতি বুধবার প্রকাশিত হবার কথা, সুতরাং তারিখটি প্রশ্নাতীত নয়।

* অধিকাংশ তথ্যই যোগেশচন্দ্র বাগলের বাংলার জনশিক্ষা [১৩৫৬]। ৫৪-৬৩ এবং General Report on Public Instruction in the Lower Provinces of the Bengal Presidency for 1860-61 থেকে গৃহীত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *