০১. রবীন্দ্রজীবনের প্রথম বৎসর

প্রথম অধ্যায়
১২৬৮ [1861-62] ১৭৮৩ শক ॥ রবীন্দ্রজীবনের প্রথম বৎসর

রবীন্দ্রনাথের জন্মের সময়ে বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশটি কেমন ছিল তা আমরা আগেই আলোচনা করে এসেছি। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বাহ্যিক রূপটিও বর্ণিত হয়েছে। এই সময়ে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের [১৭৮৩ শকাব্দ] ২৫ বৈশাখ সোমবার [ইংরেজি মতে 7 May 1861 মঙ্গলবার] রাত্রি ২টা ২৮ মিনিট ৩৭ সেকেন্ড গতে জোড়াসাঁকোর ভদ্রাসন বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয়। পিতা দেবেন্দ্রনাথের বয়স তখন চুয়াল্লিশ বৎসর ও মাতা সারদা দেবীর বয়স আনুমানিক পঁয়ত্রিশ বৎসর। রবীন্দ্রনাথ পিতামাতার চতুর্দশ সন্তান ও অষ্টম পুত্র।

রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-র প্রথম পাণ্ডুলিপিতে তাঁর জন্মকালটি ঠিকুজি থেকে নিম্নরূপে উদ্ধৃত করেছেন :

রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-র প্রথম পাণ্ডুলিপিতে তাঁর জন্মকালটি ঠিকুজি

শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রভবনের অভিলেখাগারে রক্ষিত বলেন্দ্রনাথের দ্বারা সংকলিত রাশিচক্রের বিবরণ-সংবলিত খাতায় কিছু অতিরিক্ত তথ্য পাওয়া যায় :

‘…কৃষ্ণপক্ষ ত্রয়োদশী সোমবার রেবতী মীন

শুক্রের দশা ভোগ্য ১৪।৩।১১। ৩৯

৭ই মে (ইংরাজী মতে) প্রভাতে ২-৩৮-৩৭ সেকেন্ড গতে জন্ম’

—শেষের লাইনটি ভিন্ন হস্তাক্ষরে লেখা।

রবীন্দ্রনাথের জন্মকালীন কোষ্ঠীটি অবশ্য হারিয়ে গিয়েছিল। দেবেন্দ্রনাথের পারিবারিক হিসাবের খাতায় ১২ অগ্রহায়ণ ১২৮৬ [27 Nov 1879] তারিখে লেখা আছে, জনৈক রামচন্দ্র আচার্যকে—‘শ্ৰীযুত বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুষ্ঠী/হারাইয়া যাইবায় নূতন কুষ্ঠী তৈয়ারির জন্য/উক্ত আচার্য্যকে মূল্য দেওয়া যায়’—বারো টাকা নূতন কোষ্ঠী তৈরির জন্য দেওয়া হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তখন ইংলণ্ডে।

ধনীগৃহের তৎকালীন রীতি অনুযায়ী জন্মের পরেই মাতার কোল থেকে তিনি স্থানান্তরিত হন ধাত্রীমাতার কোলে। এই প্রসঙ্গে সরলা দেবী চৌধুরানী লিখেছেন, ‘সেকালের ধনিগৃহের আর একটি বাঁধা দস্তুর জোড়াসাঁকোয় চলিত ছিল—শিশুরা মাতৃস্তন্যের পরিবর্তে ধাত্রীস্তন্যে পালিত ও পুষ্ট হত। ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্র মায়ের কোল-ছাড়া হয়ে তারা এক একট দুগ্ধদাত্রী দাই ও এক একটি পর্যবেক্ষণকারী পরিচারিকার হস্তে ন্যস্ত হত, মায়ের সঙ্গে তাদের আর কোন সম্পর্ক থাকত না।’ রবীন্দ্রনাথের ধাত্রীমাতার নাম ছিল দিগম্বরী ওরফে দিগ্‌মী। এই দাই সম্বন্ধে একটি বিশেষ খবর হল, দেবেন্দ্রনাথের পারিবারিক হিসাব-খাতায় ৯ ফাল্গুন ১২৭৯ [19 Feb 1873] তারিখে রবীন্দ্রনাথাদির উপনয়নের খরচের মধ্যে লেখা হয়েছে : ‘রবীবাবুর দাইকে বিদায় কাপড়ের মূল্য ৪৲ ’।

সরলা দেবী নিজের সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘ব্রাহ্মধর্মের নূতন পদ্ধতিক্রমে “জাতকর্ম” সংস্কার ও উপাসনাদি হল, আবার আটকৌড়েও হল, ঘরে ঘরে বন্টিত খইমুড়ি বাতাসাসন্দেশ ও আনন্দ নাড়ুতে ছোট ছেলেমেয়েদের আনন্দধ্বনি নতুন শিশুটিকে স্বাগত করলে।’ অনুমান করা যায়, রবীন্দ্রনাথের জন্মের পরও অনুরূপ আচার-অনুষ্ঠান হয়েছিল, কারণ পৌত্তলিকতাবর্জিত নির্দোষ মেয়েলি প্রথাগুলি রক্ষা করতে দেবেন্দ্রনাথ কুণ্ঠিত ছিলেন না।

রবীন্দ্রনাথের জন্মের কিছু পূর্বে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ইতিহাসে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটে যায়—সেটি হচ্ছে গিরীন্দ্রনাথের পরিবারের সঙ্গে বিচ্ছেদ। এতদিন পর্যন্ত দুই পরিবারই একই বসতবাড়িতে একান্নবর্তী হয়ে বাস করতেন। দেবেন্দ্রনাথের ও গিরীন্দ্রনাথের সন্তানেরা একই সঙ্গে থাকতেন। সেই কারণেই গণেন্দ্রনাথ কনিষ্ঠদের কাছে ‘মেজদাদা’ রূপে সম্বোধিত হতেন ও সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন সেজদাদা। সত্যেন্দ্রনাথ, সৌদামিনী দেবী, স্বর্ণকুমারী দেবী প্রভৃতি অনেকেই বলেছেন নিজের মায়ের চেয়ে মেজ কাকীর কাছেই তাঁদের সময় কাটত বেশি। কিন্তু পরিবারে গোলমাল দেখা দিল অন্য দিক থেকে। 20 Oct 1858 তারিখে দেবেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ ভ্রাতা নগেন্দ্রনাথের নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যু হলে তাঁর স্ত্রী ত্রিপুরাসুন্দরী গিরীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র গুণেন্দ্রনাথকে দত্তক হিসাবে গ্রহণ করতে চান। এর ফলে গুণেন্দ্রনাথ দ্বারকানাথের ট্রাস্ট-ভুক্ত সম্পত্তির বেশিরভাগ উত্তরাধিকার-সূত্রে লাভ করতেন। এই আশঙ্কাতেই দেবেন্দ্রনাথ 29 Jun 1859 সুপ্রীম কোর্টে এক মোকদ্দমা করেন। 15 May 1860-তে মোকদ্দমার ডিক্রী অনুযায়ী ত্রিপুরাসুন্দরীর দত্তক গ্রহণের অধিকার অস্বীকৃত হয় এবং নগেন্দ্রনাথের অংশের এক-তৃতীয়াংশ দেবেন্দ্রনাথ এবং এক-তৃতীয়াংশ গণেন্দ্রনাথ ও গুণেন্দ্রনাথ লাভ করেন, অপর এক-তৃতীয়াংশ সম্বন্ধে রায়দান স্থগিত থাকে। এই ঘটনা উভয় পরিবারের মধ্যে সম্ভবত কিছু মনোমালিন্য সৃষ্টি করে থাকবে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় দেবেন্দ্রনাথের ধর্মসংস্কার-সম্পর্কিত কার্যকলাপ। তিনি পৌত্তলিকতার বিরোধী হলেও এতদিন পর্যন্ত পরিবারে দুর্গোৎসব ও গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দ্দন শিলার নিত্যপূজা প্রচলিত ছিল। দেবেন্দ্রনাথ যখন এগুলি রহিত করতে চাইলেন তখনই সংঘাত দেখা দিল। এ-সম্পর্কে খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন : ‘দেবেন্দ্রনাথের ভ্রাতা গিরীন্দ্রনাথের বিধবা পত্নী যখন শুনিলেন যে গৃহদেবতা ৺ লক্ষ্মীজনার্দ্দনকে বাটি হইতে স্থানান্তরিত করা স্থির হইয়াছে, তখন তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র গণেন্দ্রনাথকে পাঠাইয়া দেবেন্দ্রনাথকে জানাইলেন যে গৃহদেবতা ৺ লক্ষ্মীজনার্দ্দনশিলা তাঁহাকে দেওয়া হউক, তিনি যথোচিত সেবার ব্যবস্থা করিবেন। ইহার ফলে তিনি সপরিবারে দেবেন্দ্রনাথের গৃহ ত্যাগ করিলেন এবং দ্বারকানাথ ঠাকুরের উইলে তাঁহার স্বামীকে প্রদত্ত নূতন বৈঠকখানা বাটিতে দুই পুত্র ও পুত্রবধূ, দুই কন্যা ও জামাতা, দৌহিত্র ও দৌহিত্রী সহ গিয়া বাস করিতে লাগিলেন। অন্দরমহলের জন্য বৈঠকখানা বাটির তেতালার আবশ্যক মত পরিবর্ত্তন হইল। নূতন ঘর প্রস্তুত না হইলে বাটিতে ঠাকুর রাখা সম্ভব হইবে না বলিয়া মহর্ষির সেজ পিসির পুত্র নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের নিকটবর্তী বাটিতে ৺ লক্ষ্মীজনার্দ্দনকে রাখিয়া সেবার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করিলেন। তাহার পরে বাটির সংলগ্ন দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে পাঁচী ধোবানীর গলির উপরে জমি খরিদ করিয়া নূতন ঠাকুরবাটি প্রস্তুত হয়। ছয়মাস পরে ৺ লক্ষ্মীজনার্দ্দন সেখানে সুপ্রতিষ্ঠিত হইলেন।’

অবশ্য এই বর্ণনায় কিছু ত্রুটি আছে। আমরা পূর্বেই দেখেছি, দেবেন্দ্রনাথ সপরিবারে ত্রিতল বৈঠকখানা বাটিতেই বাস করতেন ও এই সংঘর্ষের পরিণামে তিনিই গৃহত্যাগ করে আদি ভদ্রাসন বাড়িতে উঠে আসেন। ৺ লক্ষ্মীজনার্দন শিলা সম্ভবত এই ভদ্রাসন-বাড়ির ঠাকুরদালানে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং দুর্গোৎসবাদি সেখানেই অনুষ্ঠিত হত। এইগুলি স্থানান্তর সম্বন্ধে উপরোক্ত উদ্ধৃতিতে যা বলা হয়েছে, সেগুলি যথার্থ বলেই মনে হয়।

এই বিচ্ছেদ আরও গভীর হল দেবেন্দ্রনাথের দ্বিতীয়া কন্যা সুকুমারী দেবীর বিবাহ উপলক্ষে [১২ শ্রাবণ শুক্র 26 Jul]। এইটিই ব্রাহ্মধর্মমতে প্রথম বিবাহ-অনুষ্ঠান। এই বিবাহ পৌত্তলিক অনুষ্ঠানগুলি ছাড়া হিন্দুরীতি প্রায় সমস্তই রক্ষিত হয়েছিল। অজিতকুমার চক্রবর্তী লিখেছেন : ‘বিবাহসভায় দানসজ্জাদি সাজানো ছিল। স্বস্তি বাচন করিয়া অর্ঘ্য, অঙ্গুরীয়, মধুপর্ক ও বস্ত্রাদি দ্বারা কন্যাকা দেবেন্দ্রনাথ বরের অভ্যর্থনা করিয়াছিলেন। স্ত্রী-আচার প্রভৃতি বাদ দেওয়া হয় নাই। নূতন অনুষ্ঠানের মধ্যে, কেবল ব্ৰহ্মাপাসনা ও উপদেশ। ব্রহ্মোপাসনার পর সম্প্রদান হিন্দুরীতি অনুসারেই সম্পন্ন হয়। শুভদৃষ্টি, গ্রন্থিবন্ধন প্রভৃতি হিন্দুবিবাহের সুন্দর অনুষ্ঠানগুলিও কিছুই বাদ পড়ে নাই।’ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-য় সংবাদটি এইভাবে পরিবেশিত হয় : ‘ব্রাহ্মবিবাহ। গত ১২ শ্রাবণ শুক্রবার ব্রাহ্ম ধর্ম্মের ব্যবস্থানুসারে শ্ৰীযুক্ত রাজারাম মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের পুত্র শ্রীযুক্ত হেমেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সহিত শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের কন্যার শুভ বিবাহ অতি সমারোহ পূৰ্ব্বক সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। বঙ্গদেশে ব্রাহ্মধৰ্ম্মানুযায়ী বিবাহের এই প্রথম সূত্রপাত হইল। বিবাহ সভায় লোকের বিস্তর সমারোহ হইয়াছিল। আর আহ্লাদের বিষয় এই যে প্রায় দুই শত ব্রাহ্ম সভাস্থ হইয়া যথা-বিধানে কাৰ্য্য সম্পাদন করিয়াছিলেন। যথা-নিয়মে পাত্রের অভ্যর্থনা হইলে পর ব্রহ্ম-বিষয়ক একটী সঙ্গীত সহকারে ব্রহ্মোপাসনা আরম্ভ হইল। চতুর্দ্দিক নিস্তব্ধ হইল; জন-কোলাহল আর কিছুমাত্র রহিল না—কেবল ব্রহ্মনামের মঙ্গল-ধ্বনি উঠিতে লাগিল। তৎপরে কন্যাদান কার্য্য সম্পন্ন হইলে উপাচার্য্য শ্ৰীযুক্ত আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ মহাশয় দম্পতীকে…উপদেশ করিলেন।’ উক্ত পত্রিকার ভাদ্র সংখ্যার ৮১-৮৪ পৃষ্ঠায় অনুষ্ঠানটির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ প্রকাশিত হয়। রাখালদাস হালদার লণ্ডনে চার্লস ডিকেন্‌স্‌-সম্পাদিত All the Year Round পত্রিকার 5 Apr 1862 তারিখের সংখ্যায় (Vol. VII, p. 80) ‘A Brahmo Marriage’ প্রবন্ধে এই বিবাহের বিস্তৃত বিবরণ প্রকাশ করেন।* ব্যোমকেশ মুস্তফী লিখেছেন, ‘এই বিবাহ স্বগোষ্ঠী মধ্যেই হয়। দর্পনারায়ণ ঠাকুর-বংশীয় শ্যামলাল ঠাকুরের দৌহিত্র হেমেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সহিত।’

এই বিবাহের ফল সুদূরপ্রসারী হয়েছিল। দেবেন্দ্রনাথ রাজনারায়ণ বসুকে একটি চিঠিতে [২৫ ভাদ্র] লেখেন : ‘ইহাতে আমার আর আর জ্ঞাতি কুটুম্ব সকলেই আমাকে পরিত্যাগ করিয়াছেন। গণেন্দ্ৰ পৰ্য্যন্ত সেই বিবাহের দিনে উপস্থিত ছিলেন না।’১০ পিতৃশ্রাদ্ধের গোলমালে পাথুরিয়াঘাটার আত্মীয়স্বজন তাঁকে ত্যাগ করলেও প্রসন্নকুমার ঠাকুর ও রমানাথ ঠাকুর তা করেননি। কিন্তু এই বিবাহের পর তাঁরাও দেবেন্দ্রনাথকে ত্যাগ করেন। রবীন্দ্রনাথ যে লিখেছেন, ‘আমাদের পরিবার আমার জন্মের পূর্বেই সমাজের নোঙর তুলে দূরে বাঁধা-ঘাটের বাইরে এসে ভিড়েছিল’, এই ঘটনায় তা সম্পূর্ণ হল। এর পর অনাত্মীয় ব্রাহ্মবন্ধুরাই তাঁদের আত্মীয়ের স্থান গ্রহণ করলেন। অবশ্য এর শুভফল ঘটেছে এই যে, এর পর থেকে দেবেন্দ্রনাথ ও তাঁর পুত্রেরা পরিবারে যে-সমস্ত সংস্কার-সাধন ও নূতন প্রথার প্রবর্তন করেছেন তার জন্য আত্মীয়স্বজনের মুখাপেক্ষী হতে হয়নি।

এর পর রবীন্দ্রনাথের অন্নপ্রাশন ও নামকরণ উৎসব হয়। সৌদামিনী দেবী সে-সম্বন্ধে লিখেছেন : ‘রবির জন্মের পর হইতেই আমাদের পরিবারে জাতকর্ম হইতে আরম্ভ করিয়া সকল অনুষ্ঠান অপৌত্তলিক প্রণালীতে সম্পন্ন হইয়াছে। পূর্বে যে-সকল ভট্টাচার্যেরা পৌরোহিত্য প্রভৃতি কার্যে নিযুক্ত ছিল রবির জাতকর্ম উপলক্ষে তাহাদের সহিত পিতার অনেক তর্কবিতর্ক হইয়াছিল আমার অল্প অল্প মনে পড়ে। রবির অন্নপ্রাশনের যে পিঁড়ার উপরে আলপনার সঙ্গে তাহার নাম লেখা হইয়াছিল সেই পিঁড়ির চারিধারে পিতার আদেশে ছোটো ছোটো গর্ত করানো হয়। সেই গর্তের মধ্যে সারি সারি মোমবাতি বসাইয়া তিনি আমাদের তাহা জ্বালিয়া দিতে বলিলেন। নামকরণের দিন তাহার নামের চারিদিকে বাতি জ্বলিতে লাগিল—রবির নামের উপরে সেই মহাত্মার আশীর্বাদ এইরূপেই ব্যক্ত হইয়াছিল।’১১ এই অনুষ্ঠান সম্ভবত অগ্রহায়ণ মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তত্ত্ববোধিনী-র মাঘ সংখ্যায় ঐ মাসের দানপ্রাপ্তির বিবরণে ‘শুভকর্ম্মের দান।/শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর…১৬’ টাকা উল্লেখ দেখা যায়।

১১ মাঘ ১২৬৮ [বৃহ 23 Jan 1862]-র দ্বাত্রিংশ সাম্বৎসরিক ব্রহ্মোৎসব রবীন্দ্রনাথের জীবনের প্রথম মাঘোৎসব। এইদিন কেশবচন্দ্র সেনের স্ত্রী প্রথম জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আসেন। অন্তঃপুরের বিশেষ উপাসনায় কেশবচন্দ্র উপাসনা করেন এবং দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে ব্রহ্মানন্দ উপাধিতে ভূষিত করেন। এই সময়কার মাঘোৎসবের একটি চিত্র পাওয়া যায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি-তে :

এই সময়ে প্রতি বৎসর ১১ই মাঘ তারিখে ইঁহাদের জোড়াসাঁকোর বাড়ীতে ব্রাহ্মোৎসবের খুব ঘটা হইত। সমস্ত বাড়ী পুষ্পমালায় ভূষিত হইত। প্রত্যূষে যখন রশুন্‌চৌকিতে প্রভাতী বাজিয়া উঠিত তখন তাঁহার যে কি আনন্দ হইত তাহা তিনি কথায় বর্ণনা করিতে পারেন না। আদিব্রাহ্মসমাজে প্রাতঃকালের উপাসনা সমাপ্ত হইয়া গেলে দলে দলে ব্রাহ্মেরা জোড়াসাঁকোর বাটীতে আসিয়া সমবেত হইতেন। টেবিলের উপর বড় বড় দরবেশী মিঠাই ও কমলা লেবুর পিরামিড সাজান’ থাকিত। …মধ্যাহ্নভোজনের পর বৈঠকখানার ঘরে গগনভেদী উচ্চকণ্ঠে “সবে মিলে মিলে গাও”, “আজ আনন্দের সীমা কি”, “আজি সবে গাও আনন্দে” প্রভৃতি সত্যেন্দ্রনাথের রচিত গানগুলি সকলে মিলিয়া গাহিতেন। জ্যোতিবাবু বলিলেন, “সর্ব্বশেষে হরদেব চট্টোপাধ্যায় মহাশয় যখন মহা উৎসাহের সহিত স্বরচিত ‘ব্রাহ্মধৰ্ম্মের ডঙ্কা বাজিল’ প্রভৃতি গান গাহিতেন, তখন যে কি পবিত্র স্বর্গীয় আনন্দে আমাদের মন ভরিয়া উঠিত, তাহা বর্ণনাতীত…।১২

২৭ চৈত্র [মঙ্গল 8 Apr 1862] ব্রাহ্মসমাজের সাধারণ সভাতে দেবেন্দ্রনাথকে ‘ব্রাহ্মসমাজপতি ও প্রধানাচার্য’ উপাধি প্রদান করা হয়। এই সভার উদ্দেশে লিখিত একটি পত্রে দেবেন্দ্রনাথ কেশবচন্দ্রকে আগামী ১ বৈশাখ ১২৬৯ [রবি 13 Apr 1862] থেকে আচার্যপদে অভিষিক্ত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এই পত্রের প্রস্তাব অধিকাংশের মতে গৃহীত হয়। ঘটনাটির সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য আছে। এতদিন পর্যন্ত ব্রাহ্মসমাজের আচার্য বা উপাচার্য পদে ব্রাহ্মণ ছাড়া কাউকে নিযুক্ত করা হত না। কিন্তু কেশবচন্দ্রের ব্যক্তিত্ব ও কমোৎসাহ দেবেন্দ্রনাথকে এমনভাবে অভিভূত করেছিল যে তিনি এতদিনকার প্রথা বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত হলেন না। এর কিছুদিন পূর্বে তিনি কেশবচন্দ্রেরই প্রভাবে নিজের উপবীত ত্যাগ করেছিলেন।১৩

১৮ শ্রাবণ [বৃহ 1 Aug] তারিখে Indian Mirror পত্রিকা কেশবচন্দ্র সেনের উদ্যোগে ব্রাহ্মসমাজ থেকে পাক্ষিক আকারে প্রকাশিত হয়। সত্যেন্দ্রনাথের প্রিয় বন্ধু মনোমোহন ঘোষ পত্রিকা-সম্পাদনে সেই সময়ে অন্যতম সহায়ক ছিলেন।

সত্যেন্দ্রনাথ ও মনোমমাহন ঘোষ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেবার উদ্দেশ্যে ১১ চৈত্র [রবি 23 Mar 1862] প্রাতঃকালে ইংলণ্ড যাত্রা করেন। ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’-এর সংবাদ উদ্ধৃত করে এ-সম্পর্কে ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ লেখে, ‘The Indian Mirror states that two young Natives will proceed to England by the next mail steamer for the purpose of competing for the Civil Service Examination. The are very respectably connected. One of them is the grandson of the late Baboo Dwarakanath Tagore and the other the son of Baboo Ramlochun Ghose, the pensione Principal Sudder Ameen of Nuddea. We trust many more will follow their examples’১৪

সৌদামিনী দেবী ও সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠা কন্যা ইরাবতী এ বৎসর—মাসটি নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি—জন্মগ্রহণ করেন। সম্ভবত চৈত্র মাসে তাঁর অন্নপ্রাশন হয়—এরূপ অনুমানের কারণ, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-র ১৭৮৪ শকের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত আয় ব্যয়ের হিসাবে দেখা যায় : “চৈত্র মাসের দানপ্রাপ্তির বিবরণ। /শুভকর্ম্মের দান।/শ্রীযুক্ত বাবু সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়…৪।’ এইরূপ শুভকর্ম উপলক্ষে ব্রাহ্মসমাজে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা দান করা ঠাকুর-পরিবারে একটি প্রথারূপে পরিগণিত হয় এবং তা তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-য় প্রকাশিত হত। এইসব হিসাব থেকে আমরা অনেক সময়েই ঠাকুর-পরিবারের অনেকগুলি শুভানুষ্ঠানের কাল নির্ধারণ করতে পারি।

এই বছরের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-র আশ্বিন সংখ্যায় [পৃ ৯৬-৯৭] মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘আত্মবিলাপ’ [‘আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়’] কবিতাটি প্রকাশিত হয়। পত্রিকায় রচয়িতার নামের পরিবর্তে ‘কোন বন্ধু হইতে প্রাপ্ত’ উল্লেখ দেখা যায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বলেছেন : ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহাশয় তখন আমাদের বাড়ি প্রায়ই আসিতেন। আমার ভগিনীপতি শ্রীযুক্ত সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বিশেষ আলাপ-পরিচয় ছিল।…তাঁহার গলার আওয়াজ ছিল একটু ভাঙা-ভাঙা। আমার মনে পড়ে, একদিন তিনি মেঘনাদবধ কাব্যের পাণ্ডুলিপি তাঁহার সেই ভাঙা গলায় সারদাবাবুকে শুনাইতেছিলেন। তখনও মেঘনাদবধ কাব্য প্রকাশিত হয় নাই।‘১৫ সম্ভবত এই আলাপের সূত্রেই ‘আত্মবিলাপ’ কবিতাটি তত্ত্ববোধিনী-র জন্য সংগৃহীত হয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, মেঘনাদবধকাব্য দুই খণ্ডে 1861-এ প্রকাশিত হয়।

বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে এই বৎসর জন্মগ্রহণ করেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় 11 Feb 1861 [১২৬৭] ও অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় 1 Mar 1861 [ফাল্গুন ১২৬৭]; এঁরা দুজনেই রবীন্দ্রনাথের চেয়ে কয়েক মাসের বড়ো হলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে উভয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বন্ধুত্ব-ভাবাপন্ন ছিল। এ ছাড়া কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ [২৭ জ্যৈষ্ঠ রবি 9 Jun], শরৎকুমারী চৌধুরানী [১ শ্রাবণ সোম 15 Jul], আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় [১৯ শ্রাবণ শুক্র 2 Aug], ডাঃ নীলরতন সরকার [১৬ আশ্বিন মঙ্গল 1 Oct], কবি বিজয়চন্দ্র মজুমদার [১২ কার্তিক রবি 27 Oct] প্রভৃতি এই বৎসর জন্মগ্রহণ করেন, যাঁদের সকলের সঙ্গেই কোনো-না-কোনো সূত্রে রবীন্দ্রনাথের অল্পবিস্তর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

উল্লেখপঞ্জি

জীবনের ঝরাপাতা। ১

জগদীশ ভট্টাচার্য : কবিমানসী ১ [১৩৭৭]। ৫৬ [‘সংবাদটি ঠাকুর-পরিবার থেকে শ্রীমতী রাধারানী দেবী কর্তৃক সংগৃহীত’]

জীবনের ঝরাপাতা। ১

দ্র আমার বাল্যকথা ও আমার বোম্বাই প্রবাস। ৩৫

দ্র ঠাকুরবাড়ীর কথা। ১০১

রবীন্দ্র-কথা। ২৬-২৭

অজিতকুমার চক্রবর্তী : মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর [১৩৭৭]। ২৬১

তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, শ্রাবণ ১৭৮৩ শক। ৬৭-৬৮

বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস। ৩৫৬

১০ প্রিয়নাথ শাস্ত্রী-সম্পাদিত মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পত্রাবলী। ৩৩

১১ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। ১৫২

১২ বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় : জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি [১৩২৬]। ৪৮-৫১

১৩ উপাধ্যায় গৌরগোবিন্দ রায় : আচাৰ্য কেশবচন্দ্র ১ [1938]। ১৫৭

১৪ The Hindoo Patriot, 24 Mar 1862 / 89

১৫ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি। ৬৪-৬৫

* খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় : ‘প্রথম ব্রাহ্মবিবাহের বিবরণ—বিলাতী সংবাদপত্রে’, তত্ত্ববোধিনী, ফাল্গুন ১৮৫৪ শক [১৩৩৯]। ৩০১-০৫। বিবরণটি সূচিপত্রে ‘Brahma Marriage, A’ বলে উল্লিখিত, কিন্তু বিবরণের শীর্ষে আছে ‘A Curious Marriage Ceremony’।

অবশ্য তত্ত্ববোধিনী-র চৈত্র সংখ্যায় [পৃ ২০৯-১০] ‘ব্রাহ্মদিগের অনুষ্ঠান ব্যবস্থা।/নামকরণ’ প্রসঙ্গে ‘অভিনব জাত কুমারের যষ্ঠ মাসে নামকরণ কর্ত্তব্য’ বলে নির্দেশ করা হয়েছে। কিন্তু এই নিয়ম সর্বদা মানা হত না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *