০. পূর্বকথন

মুখবন্ধ

1972-তে যখন কালানুক্রমিক ভাবে চিঠিপত্র-সহ সমগ্র রবীন্দ্র-রচনা পড়তে শুরু করেছিলাম, তখন লেখালেখির ভাবনা মনের সুদূর প্রান্তেও উপস্থিত ছিল না—পড়ার সুবিধের জন্য শ্রদ্ধেয় প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের চার খণ্ডের রবীন্দ্রজীবন ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক এবং অন্যান্য কয়েকটি গ্রন্থ অবলম্বনে শুধু পাঠসূচীর একটি রূপরেখা চিহ্নিত করে নিয়েছিলাম। কিন্তু পাঠ যতই এগোতে লাগল, সেই রূপরেখার অসম্পূর্ণতা ও অন্যান্য সমস্যা ততই প্রকট হয়ে উঠল। ফলে আমার পাঠকক্ষের নিভৃত পরিবেশ থেকে নেমে আসতে হল পাঠাগারের বিস্তৃত প্রাঙ্গণে, বিশেষত তার ধূলি-ধূসরিত প্রান্তগুলিতে। নিজের পথরেখার হদিশ রেখে যাচ্ছিলাম খাতার পাতায়। তার পর 1976-এর শেষ ভাগে যখন রবীন্দ্রনাথের ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/বিচিত্র ছলনাজালে’ কবিতায় এসে পৌঁছলাম, তখন দেখা গেল আমার পাঠের পথও বিভিন্ন অপ্রকাশিত ও অব্যবহৃত তথ্যের দ্বারা কণ্টকাকীর্ণ—খাতা জমেছে প্রচুর।

সেই খাতাগুলি নিয়ে আমার বিশেষ শিরঃপীড়া ছিল না, হয়তো একদিন ওজন দরেই তারা বিক্রীত হয়ে যেত—কিন্তু বন্ধুবর অধ্যাপক অরূপরতন ভট্টাচার্য তা হতে দিলেন না, ক্রমাগত তাগিদায় এক দুঃসাধ্য ব্রতে আমায় নিয়োজিত করলেন। তারই পরিণতি এই গ্রন্থ।

১২৬৮ থেকে ১২৮০ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত রবীন্দ্রজীবনের প্রথম তেরো বছরের খসড়া বিবরণ যখন লেখা শেষ হয়, তখন অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে কবি-অধ্যাপক শঙ্খ ঘোষের কাছে সেগুলি দিয়ে আসি। কালিদাসের একটি বিখ্যাত প্রবাদপ্রতিম শ্লোক স্মরণ করিয়ে দেবেন—এইটাই যখন প্রত্যাশিত ছিল, তখন আমাকে সম্পূর্ণ বিস্মিত করে তিনি যথেষ্ট উৎসাহ প্রকাশ করলেন। তার পর থেকে এই গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশনার প্রতিটি পর্যায়ে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। গ্রন্থের নামকরণও তিনিই করেছেন। তাঁর কাছে ঋণ আমার জীবনের বড়ো সম্পদ, অবশিষ্ট জীবনের নিষ্ঠা ও পরিশ্রম দিয়েই তা শোধ করতে হবে। সহকর্মী ও বন্ধু অধ্যাপক অচিন্ত্যপ্রিয় ভট্টাচার্যের মাধ্যমেই তাঁর সঙ্গে আমার যোগসূত্র গড়ে উঠেছিল, এই উপলক্ষে কৃতজ্ঞ চিত্তে সে-কথা স্মরণ করছি।

রবীন্দ্রজীবন-বর্ণনায় এখানে আমি একটি বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করেছি, জানি না আর-কোনো জীবনীকার এই পথ গ্রহণ করেছেন কি না। এখানে ‘পূর্বকথন’ অংশে ঠাকুরবংশের ও দেশ-কালের পরিচয় দেবার পর ‘জীবনকথা’ বর্ণিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের জীবনের প্রতিটি বৎসরের কালসীমায় এক-একটি অধ্যায়কে বিন্যস্ত করে। প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে ‘প্রাসঙ্গিক তথ্য’ অভিধায় একাধিক পরিশিষ্ট যোগ করে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ও দেশ-কাল সম্বন্ধে বিস্তৃত বিবরণ দেবার চেষ্টা করেছি। এই পদ্ধতিতে কোথাও-কোথাও পুনরুক্তি ঘটলেও রবীন্দ্রজীবনের প্রধান ঘটনাগুলিকে মোটামুটি তারিখের দ্বারা চিহ্নিত করার সুযোগ পাওয়া গেছে—যার ফলে তাঁর জীবন ও সাহিত্য বিষয়ে অনেক বিচার-বিভ্রাট এড়ানো সম্ভব হবে বলে মনে করি। এক্ষেত্রে আমি সর্বদা সচেতন ভাবে রবীন্দ্রসাহিত্যের রস-বিশ্লেষণকে লক্ষ্যের বহির্ভূত রেখেছি। সে কাজ রসজ্ঞ সমালোচকের জন্য তুলে রাখাই ভালো।

এই কাজে শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রভবনের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ড ভবতোষ দত্ত আমাকে প্রার্থিত সর্বপ্রকার সুবিধা দিয়েছেন। প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে তাঁর কাছে আমার দাবি ছিল সীমাহীন, আশাতিরিক্ত ভাবে তিনি তা পূরণও করেছেন। সেখানকার সমস্ত কর্মীও অকৃপণভাবে আমাকে সাহায্য করেছেন। তাঁদের সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। অপ্রকাশিত তথ্য প্রকাশের অনুমতি দান করে রবীন্দ্রভবন-কর্তৃপক্ষও আমাকে বাধিত করেছেন।

বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদ, জাতীয় গ্রন্থাগারের সংবাদপত্র-শাখা, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেক্রেটারিয়েট লাইব্রেরি ও স্টেট আর্কাইভ্‌স্‌, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, চাংড়িপোতা বিদ্যাভূষণ পাঠাগার প্রভৃতি স্থানে আমি দীর্ঘদিন কাজ করেছি। এই প্রতিষ্ঠানগুলির কর্তৃপক্ষ ও কর্মীদের সাহায্য কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি।

ড নরেন্দ্রনাথ কানুনগো, ড সরোজ দত্ত ও শ্ৰীচিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় উনিশ শতকে বাংলা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার রূপটি বোঝার ক্ষেত্রে কয়েকটি মূল্যবান সূত্রের সন্ধান দিয়েছিলেন। এর জন্য তাঁদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

মুদ্রণের প্রতিটি পর্যায়ে আমার সহায়ক ছিলেন শ্রীসুবিমল লাহিড়ী, দু-একটি তথ্যের ভ্রান্তি-নিরসনেও তিনি সাহায্য করেছেন। এঁর কাছে আমি সবিশেষ কৃতজ্ঞ। পরিশেষে ধন্যবাদ জানাই মুদ্রাকর শ্রীনিশিকান্ত হাটই ও তুষার প্রিন্টিং ওয়ার্কসের কর্মীদের, তাঁদের সহায়তা ছাড়া এত অল্প সময়ের মধ্যে মুদ্রণকার্য সমাপ্ত করা সুকঠিন হত।

ড ভূদেব চৌধুরীর কাছে প্রায় চার বছর কলেজের পাঠ গ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু শুধু পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করেই তিনি তাঁর দায়িত্ব সমাপ্ত করেন নি, সাহিত্যবোধে দীক্ষা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হৃদয়ও দান করেছিলেন। এই গ্রন্থ তাঁকে উৎসর্গ করে আমার গুরুদক্ষিণা নিবেদন করলাম।

প্রশান্তকুমার পাল
১০২/১ রামমোহন সরণি, কলকাতা ৭০০ ০০৯
আনন্দমোহন কলেজ
১ বৈশাখ ১৩৮৯

দ্বিতীয় সংস্করণের নিবেদন

রবিজীবনী প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হল। পরবর্তী গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে এর অনেক অংশই পুনর্লিখিত হওয়ায় একে পুনর্মুদ্রণ না বলে সংস্করণ নামে অভিহিত করাই যুক্তিযুক্ত। শ্রদ্ধেয় গোপালচন্দ্র রায় এই বইয়ের অনেক তথ্য ও মতের প্রতিবাদ করে ‘রবীন্দ্রনাথের ছাত্রজীবন’ [১৩৯৩] নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। বইটি পড়ে যথেষ্ট উপকৃত হয়েছি। তাঁর যুক্তি সর্বত্র গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি, তবু তাঁর আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক অংশ পুনর্লিখিত হয়েছে। ‘ভারতভূমি’ কবিতা রবীন্দ্রনাথের লেখা নয়, তাঁর এই সিদ্ধান্ত আমি গ্রহণ করেছি। অনাথনাথ দাস ব্যক্তিগত পত্রে অনেক সংশোধন ও সংযোজনের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ইরাবতী দেবীর জন্মসাল সম্পর্কে আমার পূর্বপ্রকাশিত মন্তব্য সম্পর্কে অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী প্রশ্ন তুলেছিলেন—বিষয়টি সংশোধিত হয়েছে। ড প্রতাপ মুখোপাধ্যায় ও মঞ্জুলা ভট্টাচার্যের লেখা কয়েকটি তথ্য সংশোধনে সাহায্য করেছে। এঁদের সকলকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

খণ্ডটির পূর্বতন প্রকাশক ভূর্জপত্র-এর স্বত্বাধিকারিণী শর্মিলা পাল এবং শিবনাথ পাল, অরিজিৎ কুমার ও অধ্যাপক স্বপন মজুমদারকে তাঁদের আনুকূল্যের জন্য ধন্যবাদ জানাই।

প্রশান্তকুমার পাল
১ কার্তিক ১৪০০

পাঠ-নির্দেশ

এই গ্রন্থ-রচনায় রবীন্দ্রনাথ-লিখিত পুস্তকের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলীর বিভিন্ন খণ্ড ব্যবহৃত হয়েছে। বিভিন্ন সংস্করণে পৃষ্ঠাঙ্কের সামান্য ব্যতিক্রম হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু তা সত্ত্বেও পাঠকের পক্ষে উদ্ধৃতি বা উল্লেখের মূল খুঁজে পেতে খুব বেশি অসুবিধা হবে না ভেবে সংস্করণ বা মুদ্রণ-তারিখ নির্দেশিত হয়নি। অন্যান্য গ্রন্থের ক্ষেত্রে উল্লেখপঞ্জি-তে প্রথম উল্লেখের স্থানে তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে প্রকাশ-সন দেওয়া হয়েছে। দণ্ড চিহ্নের পরের সংখ্যাটি পৃষ্ঠাঙ্ক-সূচক।

গ্রন্থের মূল পাঠে তৃতীয় বন্ধনীর অন্তর্গত তারিখগুলি সাধারণত পুরোনো পঞ্জিকা বা Ephimeris অবলম্বনে নির্ধারণ করা হয়েছে। উদ্ধৃতির মধ্যে এইরূপ বন্ধনী-মধ্যস্থ শব্দ বা শব্দগুলি আমরা যোগ করেছি। মূলের বানান সাধারণত অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। লেখা বা ছাপা ভুল বানানের প্রতি ‘[য]’ অক্ষর-যোগে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি, ইংরেজির ক্ষেত্রে যথারীতি ‘[sic]’ শব্দটি ব্যবহৃত। [?]-চিহ্ন সংশয়-সূচক। উদ্ধৃতি ছাড়া অন্যত্র খ্রিস্টাব্দ সর্বদাই ইন্দো-আরবীয় [1, 2, 3… ইত্যাদি] হরফে লিখিত, ‘শক’ শব্দটির ব্যবহার না থাকলে বাংলা হরফে লেখা অব্দগুলিকে বঙ্গাব্দ বুঝতে হবে।

শব্দ-সংক্ষেপণ

জীবনস্মৃতি ১৭। ২৭৩ : রবীন্দ্র-রচনাবলী ১৭শ খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থ, পৃ ২৭৩।

‘পিতৃস্মৃতি’, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ [১৩৭৫]। ১৫২ : ১৩৭৫-এ প্রকাশিত ‘মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘পিতৃস্মৃতি’ প্রবন্ধ, পৃ ১৫২।

কবি-কাহিনী অ-১। ১৩-২৮ : রবীন্দ্র-রচনাবলী অচলিত সংগ্রহ ১ম খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত ‘কবি কাহিনী’ গ্রন্থ, পৃ ১৩ থেকে ২৮।

র°র° ১৫ [শতবার্ষিক সং]। ১৩৮-৪৫ : পশ্চিমবঙ্গ সরকার-প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলীর জন্মশতবার্ষিক সংস্করণ ১৫শ খণ্ডের পৃ ১৩৮ থেকে ১৪৫।

বি.ভা.প. ১৮।৪। ৩৮৯ : বিশ্বভারতী পত্রিকা, ১৮শ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, পৃ ৩৮৯।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সা-সা-চ ৩। ৪৫।১০: সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা ৩য় খণ্ড ৪৫ সংখ্যক ‘দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর’ গ্রন্থের পৃ ১০।

অগ্র : অগ্রহায়ণ।

তত্ত্ব : তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা।

পূর্বকথন

প্রথম অধ্যায় – ঠাকুর-বংশের ইতিহাস

“কবিগুরু, তোমার প্রতি চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের সীমা নাই।”—রবীন্দ্রনাথের সপ্ততিবর্ষপূর্তি উপলক্ষে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর লিখিত প্রশস্তিপত্রের সূচনায় এই যে বাক্যটি লিখেছিলেন, তারই মধ্যে বিশ্বজনের মনের কথাটি যেন বিধৃত হয়েছে। পূর্ববর্তী সহস্র সহস্র বৎসরের মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠতম ফসলগুলি আত্মসাৎ করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবন ও সৃষ্টির মধ্যে সঞ্চারিত করে দিয়েছিলেন। সেই কারণেই তাঁর জীবনকথার বর্ণনা শুধু ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথেই সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না, বিশ্বকথায় পর্যবসিত হয়ে যায়। যিনি প্রাণসৃষ্টির আদিপর্বে এই পৃথিবীর তৃণ-লতা-তরুর হৃদয়স্পন্দনকে নিজের অন্তরে অনুভব করেন, মানবসভ্যতার বিকাশের প্রতিটি স্তরকে যাঁর হৃদয়পদ্মের পাপড়ি খোলার সঙ্গে তুলনা করা যায়, তাঁর জীবন বর্ণনার শুরু যে কোনখানে তা নির্ণয় করাই কঠিন।

রবীন্দ্রনাথ নিজেকে বলেছিলেন ব্রাত্য। তাঁর জন্মভূমি বাংলাদেশ, তাঁর পূর্বপুরুষের বংশধারা, তাঁর পরিবারের ধর্মীয় ও ব্যবহারিক আচরণও ‘ব্রাত্য নামে অভিহিত হতে পারে। কিন্তু সমাজ-পরিচয়ে ব্রাত্য হওয়ার সুবিধা এই যে, সে ক্ষেত্রে সমাজের আচার-বিধির কঠোর অনুশাসন ও সংস্কার [যার অনেকটা কু-সংস্কারও] মেনে চলার বাধ্যবাধকতা থাকে না, অথচ সমাজের যা-কিছু ভালো তা দুহাত ভরে গ্রহণ করে প্রতিভার স্পর্শে তাকে নূতন রূপ দেওয়ার স্বাধীনতা থাকে অব্যাহত। বাংলাদেশ, ঠাকুর-বংশ, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর-পরিবার এবং রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

আর্যসংস্কৃতি, যাকে আমরা ভারতীয় সভ্যতার প্রধান ভিত্তি বলে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ তার স্পর্শ পেয়েছিল অনেক পরে। রামায়ণ-মহাভারতের যুগে এই দেশকে আর্যরা খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখেননি। খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দীর বেশিরভাগ সময়েও এদেশে ব্রাহ্মণ্য আচার-অনুষ্ঠান অপেক্ষা বৌদ্ধ প্রভাবই অধিকতর পরিলক্ষিত হয়। সেই কারণেই নাকি মহারাজ আদিশূর এদেশে বেদবিহিত যজ্ঞাদি প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে কান্যকুব্জ বা কনৌজ থেকে পাঁচজন ব্রাহ্মণকে আনিয়েছিলেন। আধুনিক বাঙালি ব্রাহ্মণদের আদিপুরুষ নাকি এই পঞ্চ ব্রাহ্মণ। ঐতিহাসিকেরা অবশ্য মহারাজ আদিশূরের অস্তিত্ব সম্পর্কেই সন্দিহান; পাঁচজন ব্রাহ্মণের নাম নিয়েও মতভেদ আছে। শাণ্ডিল্য-গোত্রীয় ভট্টনারায়ণ থেকে ঠাকুরগোষ্ঠীর উদ্ভব, এমন একটি মত বহুলপ্রচারিত—তাঁদের কৌলিক পদবী নাকি বন্দ্যোপাধ্যায়।

যাই হোক, ইতিহাস অনুসরণ করে গেলে দেখা যায়, খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মুসলমান আক্রমণের পরবর্তীকালে বাংলার সমাজব্যবস্থা একটা প্রবল আলোড়নের সম্মুখীন হয়েছিল। কোথাও মুসলমান শাসকদের অত্যাচারে, কোথাও বা তাঁদের সংস্পর্শের কারণেই বহু উচ্চশ্রেণীর হিন্দু, বিশেষত ব্রাহ্মণ, সামাজিক দিক দিয়ে অখ্যাতি লাভ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আদিপুরুষেরা এইভাবেই ব্রাহ্মণ সমাজে একটি বিশিষ্ট ‘থাক’-ভুক্ত হয়েছিলেন, যার নাম ‘পিরালী থাক’। নগেন্দ্রনাথ বসুর ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’ গ্রন্থের ব্রাহ্মণ কাণ্ডের তৃতীয় ভাগে ব্যোমকেশ মুস্তফী ‘পিরালী ব্রাহ্মণ-বিবরণ’ প্রথম খণ্ডে [পরে সর্বত্র ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’ বলতে আমরা এই খণ্ডটিকেই বুঝব] কুলাচার্য নীলকান্ত ভট্টের কারিকা অবলম্বনে এই থাকের উৎপত্তি সম্পর্কে বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন [দ্র পৃ ১৫৪-৫৭]। এই বিবরণ অনুযায়ী যশোহর জেলায় চেঙ্গুটিয়া পরগনার জমিদার গুড়-বংশীয় দক্ষিণানাথ রায়চৌধুরীর চার পুত্র—কামদেব, জয়দেব, রতিদেব ও শুকদেবের মধ্যে প্রথম দুজন মামুদ তাহির বা পীর আলি নামক এক স্থানীয় শাসকের চক্রান্তে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন ও তাঁদের সংস্পর্শে অপর দুই ভাই সমাজচ্যুত হয়ে পিরালী [বা পীরালি] থাকের অন্তর্ভুক্ত হন। ব্যোমকেশ মুস্তফীর অনুমান অনুসারে এইসব ঘটনা পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কোনো সময়ে [1438] সংঘটিত হয়েছিল।

এই সমাজচ্যুতির ফলে স্বশ্রেণীর ব্রাহ্মণদের সঙ্গে পিরালীদের বিবাহাদি সামাজিক ক্রিয়াকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাধ্য হয়েই তাঁরা পুত্র-কন্যাদির বিবাহে কৌশল ও প্রলোভনের জাল বিস্তার করতে থাকেন। এইভাবেই শুকদেব ভগ্নী রত্নমালার সঙ্গে মঙ্গলানন্দ মুখোপাধ্যায় নামক এক দরিদ্র উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণের বিবাহ দিয়ে নিজ অধিকারের মধ্যেই তাঁর বসবাসের সুবন্দোবস্ত করে দেন। শুকদেবের কন্যাকে বিবাহ করেন পিঠাভোগের জমিদার জগন্নাথ কুশারী। এই অপরাধে আত্মীয়দের দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে জগন্নাথ শুকদেবের আশ্রয়ে নরেন্দ্রপুরের উত্তর-পশ্চিম কোণে উত্তরপাড়া গ্রামের সঙ্গে সংলগ্ন বায়রাপাড়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। এই জগন্নাথ কুশারীই ঠাকুর-বংশের আদি-পুরুষ। জগন্নাথ শুদ্ধ শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ ছিলেন, তাঁর আর্থিক সমৃদ্ধিও উপেক্ষণীয় ছিল না, কিন্তু যে-কোনো কারণেই হোক জাত্যংশে হীনতা স্বীকার করেও সংস্কার-মুক্তির যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করলেন তাঁর বংশের পরবর্তী ইতিহাসে তা আরও উজ্জ্বলতা প্রাপ্ত হয়েছে। তাঁর চার পুত্র—প্রিয়ঙ্কর, পুরুষোত্তম, হৃষীকেশ ও মনোহর। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ প্রত্যহ যে মন্ত্রটি আবৃত্তি করে পিতৃপুরুষদের স্মরণ করতেন তার আদিতে ছিল জগন্নাথ কুশারীর মধ্যম পুত্র পুরুষোত্তমের নাম—

পুরুষোত্তমাদ্বলরামঃ বলরামাদ্ধরিহরঃ
হরিহরাদ্রামানন্দঃ রামানন্দাম্মহেশঃ
মহেশাৎ পঞ্চাননঃ পঞ্চাননাজ্জয়রামঃ
জয়রামান্নীলমণিঃ নীলমর্ণেরামলোচনঃ
রামলোচনাদ্দারকানাথঃ নমঃ পিতৃপুরুষেভ্যো নমঃ পিতৃপুরুষেভ্যঃ।

পুরুষোত্তমের প্রপৌত্র রামানন্দের দুই পুত্র মহেশ্বর ও শুকদেব। শোনা যায়, মহেশ্বর বা তাঁর পুত্র পঞ্চানন জ্ঞাতিকলহে দেশত্যাগ করে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় উপস্থিত হন। সময়টা প্রায় জোব চার্নকের কলকাতা-পত্তনের সমসাময়িক অর্থাৎ সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগ। এর অনেক আগে থেকেই এই অঞ্চল ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রাধান্য লাভ করেছিল। পর্তুগীজ, ডাচ প্রভৃতি বিদেশী বণিকদের আসাযাওয়া, বড়বাজারের কাছে শেঠ-বসাকদের সুতাবস্ত্রের হাট বহু লোককে এই অঞ্চলের দিকে আকৃষ্ট করেছিল। সেই একই আকর্ষণে পঞ্চানন ও শুকদেব কলকাতা গ্রামের দক্ষিণে গোবিন্দপুরে আদিগঙ্গার তীরে বসতি স্থাপন করেন। সেখানে তখন মৎস্য-ব্যবসায়ী জেলে, মালো, কৈবর্ত প্রভৃতি জাতির বাস, কিছু বণিক-বৃত্তিধারী পোদও সেখানে ছিল, তারা আগ্রহভরে তাঁদের বসবাসের ব্যবস্থা করে দিল। বিদেশি যেসব জাহাজ এখানে আসত, পঞ্চানন ও শুকদেব প্রথমে সেইসব জাহাজে মালসরবরাহের কাজ শুরু করেন এবং এইভাবেই কিছু অর্থের অধিকারী হয়ে গোবিন্দপুরে গঙ্গাতীরে জমি কিনে বসতবাটী নির্মাণ ও শিবপ্রতিষ্ঠা করেন। এই সময়ে ঘটনাচক্রে তাঁদের পদবীরও পরিবর্তন ঘটে। নিম্নশ্রেণীর প্রতিবেশীদের কাছে তাঁরা ‘ঠাকুরমশাই’ অভিধায় সম্বোধিত হতেন, এদের দেখাদেখি সাহেবরাও তাঁদের ঠাকুর [Taguore, Tagoor বা Tagore] বলতে শুরু করেন। এইভাবেই পঞ্চানন ‘কুশারী’ হয়ে পড়েন পঞ্চানন ‘ঠাকুর’। এই পঞ্চানন থেকেই কলকাতার পাথুরিয়াঘাটা, জোড়াসাঁকো ও কয়লাঘাটার ঠাকুরগোষ্ঠীর উৎপত্তি এবং শুকদেব থেকে চোরবাগানের ঠাকুরগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে।

পঞ্চানন ঠাকুরের দুই পুত্র জয়রাম ও রামসন্তোষের সঙ্গে ইংরেজ বণিকদের মেলামেশা থাকায় তাঁরা কিছু কিছু ইংরেজি জানতেন, তা ছাড়া তৎকালীন রীতি-অনুসারে ফারসি ভাষায়ও ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। তখন পঞ্চানন চেষ্টায় জয়রাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পে-মাস্টারের অধীনে প্রধান কর্মচারী নিযুক্ত হন।

কলকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুর ইংরেজদের অধীনে আসার পর 1707 [১১১৪]-এ এই অঞ্চলে প্রথম জরিপ-কার্য হয়। তখন রাল্‌ফ্‌ সেল্‌ডন্‌ ছিলেন কালেক্টর। এই কার্যে দুজন আমীনের প্রয়োজন হলে পঞ্চাননের অনুরোধে সেল্‌ডন্‌ জয়রাম ও রামসন্তোষকে এই পদে নিযুক্ত করেন। জয়রাম পে-মাস্টারের অধীনে কর্মও বজায় রাখেন। এইভাবে তাঁরা ধীরে ধীরে বিত্তশালী হয়ে ওঠেন। এরপর 1717 [১১২৪]-এ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতার দক্ষিণে দশ মাইল পর্যন্ত স্থানের মধ্যে আটত্রিশটি গ্রাম ক্রয় করলে এগুলির জরিপকার্য জয়রাম ও রামসন্তোষই সম্পন্ন করেন। গ্রামগুলির পার্শ্ববর্তী অধিকাংশ ভূভাগ নবদ্বীপাধিপতি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অধীনে ছিল; এই সূত্রে তাঁর সঙ্গে জয়রামের ঘনিষ্ঠতা জন্মায়। জয়রাম যখন নিজগৃহে ‘রাধাকান্ত’ নামে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন, তখন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র দেবসেবার জন্য নিজের জমিদারির মধ্যে ৩৩১ বিঘা নিষ্কর জমি দান করেন। শোনা যায়, 1742 [১১৪৯]-তে মারাঠা খাল খননের সময়েও জয়রাম অন্যতম পরিদর্শক ছিলেন।

এর থেকে বোঝা যায়, নতুন পদবী-প্রাপ্ত পতিত পিরালী ব্রাহ্মণ ঠাকুরগোষ্ঠী ধনসম্পদ ও মান-মর্যাদার দিক থেকে কলকাতার নতুন সমাজে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা অর্জন করছিলেন। কিন্তু বিবাহাদি ব্যাপারে যশোহরের পিরালী সম্প্রদায়ের বাইরে যাওয়ার উপায় ছিল না। জয়রামের দুই স্ত্রী গঙ্গা ও রামধনি এবং রামসন্তোষের স্ত্রী সিদ্ধেশ্বরী যশোহরের মেয়ে ছিলেন। রামসন্তোষের একমাত্র কন্যারও বিবাহ হয় যশোহরের দক্ষিণডিহি-নিবাসী গুড়-বংশীয় কৃপানাথ রায়চৌধুরীর সঙ্গে।

জয়রামের চারটি পুত্র—আনন্দীরাম, নীলমণি, দর্পনারায়ণ ও গোবিন্দরাম। তাঁর জীবৎকালেই জ্যেষ্ঠপুত্র আনন্দীরামের মৃত্যু হয়; পিতার অপ্রিয় কার্য করায় মৃত্যুর কয়েক বছর আগেই তিনি পিতৃগৃহ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন।

1756 [১১৬২]-এ জয়রামের মৃত্যু হয়। ব্যোমকেশ মুস্তফী লিখেছেন, ‘জয়রাম ও রামসন্তোষ আমীনীকাৰ্য্যে বিলক্ষণ দশ টাকা উপার্জন করিয়া ধনসায়র [বৰ্ত্তমান ধৰ্ম্মতলা] নামক স্থানে বাড়ী, বৈঠকখানা, জমাজমী এবং এখন যেখানে ফোর্ট-উইলিয়ম কেল্লা আছে, ঐ স্থানে বাগানবাটী নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন।’* জয়রামের মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যেই ঠাকুর-পরিবারের বাসস্থানের পরিবর্তন ঘটে। ফোর্ট উইলিয়মের পুরোনো কেল্লা, যা বর্তমান ডালহৌসি অঞ্চলে জি. পি. ও.-র কাছে অবস্থিত ছিল, ইংরেজ গভর্নর ড্রেক যখন তার সংস্কার সাধন করছিলেন, Jun 1756-এ নবাব সিরাজদৌলা কলকাতা আক্রমণ করে তা ধ্বংস করেন। এই সময়ে ঠাকুর-পরিবারকে বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। এরপর 23 Jun 1757 পলাশীর যুদ্ধে ক্লাইভের হাতে সিরাজদ্দৌলা পরাজিত হন। মীরজাফর নবাব হবার পর কলকাতা জয়ের ক্ষতিপূরণ স্বরূপ যে টাকা দেন, জয়রামের পুত্র নীলমণি তার থেকে ১৮ হাজার টাকা পান। *

নীলমণি বাসস্থান পরিবর্তনের প্রয়োজনে ডিহি কলকাতা গ্রামে জমি কিনে বসবাসের ব্যবস্থা করেন। ২০ পৌষ ১১৭১ [1 Jan 1765*] তারিখে কালেক্টরির নিজ অধিকারভুক্ত জমি থেকে দুবিঘা তেরো কাঠা জমি বার্ষিক ৭৸৶৪ গণ্ডা সিক্কামুদ্রা খাজনায় বসবাসের জন্য পাট্টা করে নেন। এই জমিই পার্শ্ববর্তী ঘরবাড়িসমেত সাড়ে দশ কাঠা জমি জনৈক রামচন্দ্ৰ কলুর কাছ থেকে ৫২৫ টাকায় ক্রয় করেন ১৬ চৈত্র ১১৭১ সালে। এইভাবে ১১৭১ বঙ্গাব্দের শেষ দিকে [1765] পাথুরিয়াঘাটায় ঠাকুর-পরিবারের বসবাসের সূত্রপাত। কয়েক বছর পরে ২৫ অগ্রহায়ণ ১১৭৬ [Dec 1769] এইসব জমিরই সংলগ্ন চুঁচুড়া-বাসী জগমোহন দাস [সাহা]-এর ঘরবাড়িসমেত দুবিঘা সাত কাঠা জমি ৯০০০ টাকায় ক্রয় করেন। সব-ক’টি দলিলই সম্পাদিত হয় নীলমণি ঠাকুরের নামে।

এইসব ঘটনার সময়ে বা তার পূর্ব থেকেই নীলমণি ঠাকুর কোম্পানির অধীনে চাকুরি গ্রহণ করেন। ব্যোমকেশ মুস্তফীর বিবরণ অনুসারে, ১১৭২ [1765]-এ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করার পর নীলমণি উড়িষ্যার কালেক্টরেটের সেরেস্তাদার হয়ে উড়িষ্যা যান এবং সেখান থেকে উপার্জিত অর্থ কলকাতায় ভ্রাতা দর্পনারায়ণের কাছে পাঠাতে থাকেন। দর্পনারায়ণও হুইলারের দেওয়ান, নিমক ও বাজারের ইজারাদার, জমিদারির পত্তনিদার রূপে ও অন্যান্য ব্যবসায় সূত্রে বিরাট ধনসম্পত্তির অধিকারী হন। বিনয় ঘোষ তাঁর পূর্বোক্ত প্রবন্ধে বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজ থেকে দেখিয়েছেন যে, 1775-76 থেকেই দর্পনারায়ণের অগ্রগতির পরিচয় তাতে লিপিবদ্ধ হয়েছে; কিন্তু নীলমণি ঠাকুর ও তাঁর পুত্রদের উল্লেখ না দেখে মনে হয় ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্বারা আর্থিক উন্নতির উদ্যম তুলনামূলকভাবে দর্পনারায়ণ ও তাঁর পুত্রদের মধ্যেই বেশি দেখা গিয়েছিল।

ইতিমধ্যে এই পরিবারে কতকগুলি সংকট দেখা দেয়। জয়রামের কনিষ্ঠ পুত্র গোবিন্দরামের ১১৭৮ বঙ্গাব্দে [1771] নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যু হলে তাঁর স্ত্রী রামপ্রিয়া দেবী ১১৮৯ বঙ্গাব্দে [1782] সম্পত্তি বিভাগের জন্য সুপ্রীম কোর্টে একটি মামলা করেন। এর ফলে তিনি রাধাবাজারে ও জ্যাকসন ঘাটে দুটি বাড়ি লাভ করেন। হয়ত এই মামলার সূত্রেই নীলমণি ও দর্পনারায়ণের মধ্যেও সম্পত্তি নিয়ে গোলযোগ দেখা দেয়। পরে আপসে এই বিবাদ মিটিয়ে নেওয়া হয়। পাথুরিয়াঘাটার বাড়ি ও রাধাকান্ত জীউর সেবার ভার দর্পনারায়ণ গ্রহণ করেন এবং নিজস্ব উপার্জন-লব্ধ অর্থ, নগদ এক লক্ষ টাকা ও লক্ষ্মী-জনার্দন শিলার ভার নিয়ে নীলমণি গৃহত্যাগ করেন। পঞ্চানন থেকে উদ্ভূত ঠাকুর-বংশ এইভাবে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে।

এই অবস্থায় কলকাতার আদি-বাসিন্দা শেঠ-বংশীয় বিখ্যাত ব্যবসায়ী বৈষ্ণবচরণ শেঠ মেছুয়াবাজার অঞ্চলে এক বিঘা জমি নীলমণিকে দান করতে চান। শূদ্রের দান গ্রহণে নীলমণি অস্বীকৃত হওয়ায় তিনি লক্ষ্মী-জনার্দন শিলার নামে ঐ জমি দান করেন। দানপত্রটি না পাওয়ায় এই দান কবে সংঘটিত হয় বলা যায় না। ব্যোমকেশ মুস্তফীর মতে, আষাঢ় ১১৯১ [Jun 1784] থেকে জোড়াসাঁকোয় ঠাকুর-পরিবারের বসবাসের সূত্রপাত হয়। ‘জোড়াসাঁকো’ নামটি প্রাচীন নথিপত্রে পাওয়া গেলেও এ নামটি সেই সময়ে যথেষ্ট বিখ্যাত ছিল না, স্থানটিকে মেছুয়াবাজারের অন্তর্গত বলেই উল্লেখ করা হত।

প্রথমে উক্ত জমিতে নীলমণি ঠাকুর একটি আটচালা বেঁধে বাস করতে শুরু করেন। পরে তিনি পাকা বাড়ি পত্তন করেন। একতলার দেওয়ালের গভীরতা থেকে ড হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় অনুমান করেন, বর্তমান ঠাকুরবাড়ির উত্তর-পূর্ব অংশই প্রথমে নির্মিত হয়েছিল। বৃদ্ধাবস্থায় নীলমণি কলকাতায় ও অন্যত্র আরও কিছু ভূসম্পত্তির অধিকারী হয়েছিলেন। ১১৯৮ বঙ্গাব্দে [1791] নীলমণির মৃত্যু হয়।

নীলমণির কয়টি পুত্র ছিল তা নিয়ে মতভেদ আছে। কারও মতে, তাঁর পাঁচ পুত্র ছিল—রামতনু, রামরতন, রামলোচন, রামমণি ও রামবল্লভ। ব্যোমকেশ মুস্তফীর মতে, তাঁর তিনটি পুত্র—রামলোচন, রামমণি ও রামবল্লভ এবং কমলমণি নামে এক কন্যা। রামলোচনের জন্ম সাল জানা যায়নি; রামমণি ১১৬৬ সালে [1759], রামবল্লভ ১১৭৪ সালে [1767] ও কমলমণি ১১৮০ সালে [1773] জন্মগ্রহণ করেন। ১১৯২ বঙ্গাব্দে [1785] বেহালার সাবর্ণ চৌধুরী পরিবারভুক্ত হরিশ্চন্দ্র হালদারের সঙ্গে কমলমণির বিবাহ হয়। দক্ষিণডিহি নিবাসী রামচন্দ্র রায়ের দুই কন্যার মধ্যে অলকাকে রামলোচন ও মেনকাকে রামমণি বিবাহ করেন। কনিষ্ঠ রামবল্লভের সঙ্গে কার কন্যার বিবাহ হয় জানা যায়নি।

রামলোচনের শিবসুন্দরী নামে একটি কন্যা জন্মালেও শৈশবেই তার মৃত্যু হয়। মেনকা দেবীর গর্ভে রামমণির দুটি পুত্র ও দুটি কন্যা হয়—রাধানাথ [1790-1830], জাহ্নবী, রাসবিলাসী ও দ্বারকানাথ [1794-1846]। দ্বারকানাথের জন্মের এক বৎসরের মধ্যেই মেনকা দেবীর মৃত্যু হয়। এরপর রামমণি দুর্গামণি দেবীকে বিবাহ করলে তাঁর গর্ভে একটি পুত্র ও একটি কন্যা জন্মায়—রমানাথ [1800-77] ও দ্রবময়ী।

রামলোচনের কন্যাটির মৃত্যু হলে তিনি মধ্যভ্রাতা রামমণির দ্বিতীয় পুত্র দ্বারকানাথকে ১২০৫ বঙ্গাব্দে [1799] দত্তক গ্রহণ করেন। এসম্বন্ধে একটি কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। একদিন একটি সন্ন্যাসী রামলোচনের গৃহে ভিক্ষা করতে এসে শিশু দ্বারকানাথকে দেখে অলকা দেবীকে বলেন যে, সুলক্ষণাক্রান্ত এই শিশুটি থেকেই বংশের গৌরব ও ধনসম্ভ্রম বৃদ্ধি পাবে। এ কথা শুনেই নাকি অলকা দেবী দ্বারকানাথকে দত্তক নেবার জন্য স্বামীকে প্ররোচিত করেন।

রামলোচন ঠাকুর-পরিবারে কিছু শৌখিন আভিজাত্য আনয়ন করেন। অপরাহ্নে হাওয়া খেতে বের হবার প্রথা নাকি তাঁর দ্বারাই প্রবর্তিত হয়। এ ছাড়া কবিওয়ালা ও কালোয়াতদের আহ্বান করে বাড়িতে মজলিস বসাননা ও আত্মীয়স্বজনকে নিমন্ত্রণ করে শোনানো তাঁর অন্যতম ব্যসন ছিল। কিন্তু তিনি প্রখর বিষয়বুদ্ধিরও অধিকারী ছিলেন; তাই পৈতৃক সম্পত্তি রক্ষা করা ছাড়াও জমিদারি ও অনেক ভূসম্পত্তি ক্রয় করে পারিবারিক মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। রামলোচন ভ্রাতাদের সঙ্গে সম্পত্তি ভাগ করে নেবার পর দত্তক-পুত্র দ্বারকানাথকে ২২ অগ্রহায়ণ ১২১৪ [Dec 1807] তারিখে উইল করে যে সম্পত্তি দিয়ে যান, তার তালিকাটিতে দেখা যায়—

উইল করে যে সম্পত্তি দিয়ে যান, তার তালিকা

—তাঁর স্বোপার্জিত সম্পত্তিও কম নয়, যার মধ্যে বিরাহিমপুর পরগনার [এটি তখন যশোহর জেলার অন্তর্গত] জমিদারি অন্যতম। এই উইলে রামলোচন দ্বারকানাথকে নির্দেশ দেন, ‘এখনও তুমি নাবালক একারণ এই জমিদারি ওগায়রহ জে কিছু বিসয় তোমাকে দিলাম ইহার কৰ্ম্মকাৰ্য্য জাবত আমি বর্ত্তমান থাকিব তাবৎ আমিই করিব আমার অবর্ত্তমানে জাবত তুমি বয়সপ্রাপ্ত না হও তাবৎ পরগণাদিগর এ সকল বিষয়ের কর্ম্মকাৰ্য্য ও সহী দস্তখত বা বন্দবস্ত ও হুকুমহাকাম সকলি তোমার মাতা করিবেন তুমি প্রাপ্তবয়স হইলে জমিদারিদিগর আপন নামে হজুর লেখাইয়া এবং আপন এক্তারে আনিয়া জমিদারির ও সংসারের কৰ্ম্মকাৰ্য্য ও জমিদারির বন্দবস্ত ও খরচপত্র ওগয়রহ তোমার মাতার অনুমতি ও পরামৃশে তুমি করিবা এবং জাবত তোমার মাতা বর্ত্তমান থাকিবেন তাবত পরগণার মুনাফা ওগায়রহ জে কিছু আমদানির তহবিল তোমার মাতার নিকট জেমন আমি রাখিতাম তুমিও সেইমত রাখিবা।’ নিজের অবর্তমানে বিধবা স্ত্রীর নিরাপত্তার উদ্দেশ্যেই কেবল এই নির্দেশ প্রদত্ত হয়নি, অলকা দেবীর স্বাভাবিক কর্ত্রীত্বশক্তির প্রতি সম্মানও এর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। ঠাকুর-পরিবারে এটি একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল, সেটি আমার পরে দেখতে পাব।

এই উইল করার কয়েকদিন পরেই 12 Dec 1807 তারিখে রামলোচনের মৃত্যু হয়। দ্বারকানাথ তখন তেরো বৎসরের বালক মাত্র। অলকা দেবী ও দ্বারকানাথের আপন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রাধানাথ তাঁর বয়ঃপ্রাপ্তি পর্যন্ত সম্পত্তির তত্ত্বাবধান করেন।

বাল্যে দ্বারকানাথ তৎকালীন রীতি অনুযায়ী আরবি ও ফারসি ভাষা আয়ত্ত করেন। এ ছাড়াও ইংরেজি ভাষা শিক্ষার উদ্দেশ্যে বাড়ির নিকটে অবস্থিত শেরবোর্ন [Sherbourne] সাহেবের স্কুলে ভর্তি হন। তখন পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশীয়দের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রচারে আগ্রহী ছিলেন না, বরং প্রাচীন শিক্ষাপদ্ধতি টোল-মাদ্রাসার প্রসারের দিকেই তাঁদের উৎসাহ ছিল। অথচ ইংরেজ শাসনের ক্রমবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি-জানা ভারতীয়দের চাহিদা বেড়ে উঠছিল। এই কারণে প্রধানত কয়েকজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সাহেবের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে কয়েকটি ইংরেজি-শিক্ষার স্কুল গড়ে উঠেছিল, শেরবোর্নের স্কুল তাদের অন্যতম। এই সাহেবের প্রতি কৃতজ্ঞতার নিদর্শন-স্বরূপ দ্বারকানাথ তাঁকে আজীবন মাসোহারা প্রদান করেছিলেন। এ ছাড়াও পরে রামমোহনের বন্ধু উইলিয়ম অ্যাডাম্‌স এবং জে. জি. গর্ডন ও জেম্‌স্ কলডর প্রভৃতির কাছেও তিনি ইংরেজি শিক্ষা করেন।

শেষোক্ত দুজন ছিলেন তখনকার বিখ্যাত সওদাগরী প্রতিষ্ঠান ম্যাকিনটশ অ্যান্ড কোম্পানি [Mackintosh & Co.]-র অংশীদার। এঁদেরই সহায়তায় দ্বারকানাথ প্রথমে এই কোম্পানির গোমস্তা-রূপে রেশম ও নীল ক্রয়ে সাহায্য করতে থাকেন। ক্রমে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তিনি নিজেই ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসা শুরু করেন। এইসময়ে পৈতৃক বিরাহিমপুর পরগনার জমিদারি পরিচালনা-সূত্রে তিনি জমিদারি-সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন-কানুন সম্পর্কে প্রভূত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। এর ফলে তিনি বহু বিখ্যাত জমিদার ও বিশিষ্ট ব্যক্তির আইন-বিষয়ক পরামর্শদাতা হয়ে ওঠেন। পরে সুপ্রীম কোর্টের ব্যারিস্টার মিঃ ফার্গুসনের কাছে তিনি রীতিমতো আইনের পাঠ গ্রহণ করেন। এইভাবে অর্থোপার্জনের একটি নূতন পথ তাঁর সামনে খুলে যায় এবং তিনি বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সরকারী কর্মচারীর সংস্পর্শে আসেন। এর ফলে 1818-এ তিনি চব্বিশ পরগনার কালেক্টরের অফিসে সেরেস্তাদার নিযুক্ত হন। তাঁর কর্মদক্ষতা ও বিচক্ষণতার দ্বারা তিনি সহজেই কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। 1822-তে দ্বারকানাথ চব্বিশ পরগনার কালেক্টর ও নিমক মহলের অধ্যক্ষ প্লাউডেনের দেওয়ান নিযুক্ত হন। 1828-এ তিনি শুল্ক ও অহিফেন বোর্ডের দেওয়ান পদে উন্নীত হন। 1834 পর্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে এই কাজ করে স্বাধীন ব্যবসায়ে আরও বেশি মনোযোগ দেবার উদ্দেশ্যে এই পদ ত্যাগ করেন।

ম্যাকিনটশ কোম্পানির সঙ্গে দ্বারকানাথের সম্পর্কের কথা আগেই বিবৃত হয়েছে। 1828-এ কর্মকর্তারা তাঁকে এই কোম্পানির অংশীদার করে নেন। এই কোম্পানি কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের পরিচালক ছিল। দ্বারকানাথ এই ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর হন। বিখ্যাত আধা-সরকারী বেঙ্গল ব্যাঙ্ক তখন ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ঋণ মঞ্জুর করতে পারত না। প্রধানত সেই উদ্দেশ্যে 17 Aug 1829 তারিখে ষোলো লক্ষ টাকা মূলধন নিয়ে দ্বারকানাথ ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করেন।* সরকারী কর্মচারী হওয়ার জন্য দ্বারকানাথ সম্পূর্ণভাবে ব্যাঙ্কের কাজে আত্মনিয়োগ করতে না পারায় কনিষ্ঠ ভ্রাতা রমানাথকে আলিপুরের সেরেস্তাদারের অফিস থেকে ছাড়িয়ে এনে ব্যাঙ্কের কোষাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ করেন। এর পর দ্বারকানাথের সুপরামর্শে ক্রমেই ব্যাঙ্কের উন্নতি ঘটতে থাকে। এইসময়েই তিনি 1830-তে কালী গ্রাম ও 1834-এ সাহাজাদপুর পরগনার জমিদারি ক্রয় করেন।

এদিকে, 1833-তে ম্যাকিনটশ কোম্পানি ও কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের পতন ঘটে। দ্বারকানাথই একমাত্র সংগতিসম্পন্ন অংশীদার ছিলেন বলে ব্যাঙ্কের দায়শোধের ভার তাঁকেই নিতে হয়। এর পর তিনি নিজেই একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করার কথা ভাবতে শুরু করেন। এরই ফলে তিনি 1 Aug 1834 তারিখে সরকারী কর্মে ইস্তফা দেন। বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল এই পদে দ্বারকানাথের সততা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করলেও কর্তৃপক্ষ তাঁর সততায় কতখানি সন্তুষ্ট ছিলেন তার প্রমাণ পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে সদর বোর্ডের সেক্রেটারি হিসেবে হেনরি মেরিডিথ পার্কারের 7 Aug-এর সরকারী চিঠি এবং 14 Oct-এর ব্যক্তিগত চিঠি।

সরকারী কার্যভার থেকে মুক্তি পেয়ে দ্বারকানাথ উইলিয়ম কার [William Carr] নামে একজন ইংরেজকে অংশীদার করে 1834-এই কার-ঠাকুর কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক [1774-1839]-ই কার সাহেবের সঙ্গে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন ও য়ুরোপীয় আদর্শে বাণিজ্যকুঠি স্থাপনে উৎসাহিত করেন। পরে বিভিন্ন সময়ে মেজর হেন্ডারসন, মিঃ প্লাউডেন, ডাঃ ম্যাকফারসন, ক্যাপ্টেন টেলর, দেবেন্দ্রনাথ ও গিরীন্দ্রনাথ প্রভৃতি এই প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হন। দর্পনারায়ণ ঠাকুরের পৌত্র প্রসন্নকুমার ও ডি. এম. গর্ডন প্রথমে প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ছিলেন। প্রসন্নকুমার পরে সদর দেওয়ানি আদালতে ওকালতি শুরু করেন ও প্রভূত অর্থ উপার্জন করেন এবং ডি. এম. গর্ডন কোম্পানির অংশীদার পদে উন্নীত হন। কিন্তু দ্বারকানাথই ছিলেন প্রতিষ্ঠানের সর্বেসর্বা। আর্থিক দায়দায়িত্বও প্রধানত তিনিই গ্রহণ করতেন। অর্থের অভাবও তাঁর ছিল না—নিজের বিষয়সম্পত্তির আয়, ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের আনুকূল্য, অন্যান্য ব্যাঙ্ক ও বাণিজ্যকুঠির নিকট সুনাম প্রভৃতি কারণে প্রয়োজনীয় যে-কোনো পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করা তাঁর পক্ষে সহজ ছিল। ফলে কার-ঠাকুর কোম্পানির ব্যবসা বিচিত্র দিকে প্রসারিত হয়। 1833-এর সনদে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসায়ের সুযোগ লুপ্ত হওয়ায় দ্বারকানাথ কতকগুলি অতিরিক্ত সুবিধাও পেয়েছিলেন। তাঁর পৈতৃক জমিদারি বিরাহিমপুর পরগনার কুমারখালি মৌজায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেশমের কুঠিটি তিনি কিনে নেন। তা ছাড়া রামনগরে চিনির কল স্থাপন করেন ও রানীগঞ্জে খনি থেকে কয়লা তোলার জন্য বেঙ্গল কোল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। আসামের চা প্রথম কলকাতায় আমদানি করে কার-ঠাকুর কোম্পানি। অবশ্য এই কোম্পানির প্রধান ব্যবসা ছিল নীল চাষ। বাংলা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁদের নীলের কুঠি ছিল।

এতকাল দেশ থেকে দেশান্তরে যাত্রা ও মাল-পরিবহনের ক্ষেত্রে জলপথে নৌকার ব্যবহার ছিল সর্বাধিক। স্টীম ইঞ্জিন আবিষ্কারের পর বাষ্পচালিত জাহাজ এন্টারপ্রাইজ প্রথম ইংলন্ড থেকে ভারতে আসে 1825-এ। লর্ড বেন্টিঙ্কের আগ্রহে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আভ্যন্তরীণ পরিবহনে কয়েকটি স্টীমারকে নিয়োগ করে 1834-36-এর মধ্যে। এর সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ‘স্টীম টাগ অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি কোম্পানি 1837-এ দুটি ছোটো স্টীমার নিয়ে নদীমুখ থেকে জাহাজ টেনে আনার ব্যবসায় শুরু করে। কার-ঠাকুর কোম্পানি ছিল এই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং এজেন্ট। এই স্টীমারগুলির মেরামতের জন্য তাঁরা খিদিরপুরে একটি কারখানা খোলেন। সুয়েজ হয়ে ইংলন্ড ও ভারতের মধ্যে জাহাজ চলাচল শুরু করার ব্যাপারেও দ্বারকানাথ উদ্যোগী ছিলেন। পি অ্যান্ড ও কোম্পানির তিনি একজন অন্যতম অংশীদার ছিলেন। শোনা যায়, তাঁর নিজেরই একটি জাহাজ ছিল এবং ‘ইন্ডিয়া’ নামের সেই জাহাজে করেই তিনি প্রথমবার ইংলন্ডে গিয়েছিলেন।

তাঁর দৃষ্টি কেবল অর্থোপার্জনের দিকেই নিবদ্ধ ছিল না। দেশ ও সমাজের উন্নতিমূলক যে-কোনো প্রচেষ্টার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। 1814-এ রংপুরের কালেক্টরের অফিসে সেরেস্তাদারের কাজ ছেড়ে রামমোহন রায় [? 1772-1833] যখন স্থায়ীভাবে কলকাতায় চলে এলেন, তখনই দ্বারকানাথের সঙ্গে তাঁর আলাপের সূত্রপাত এবং এই পরিচয় তাঁর জীবনে দিক্‌-নির্দেশকের মতো কাজ করেছে। রামমোহন তাঁর চেয়ে প্রায় বাইশ বছরের বড়ো ছিলেন, তবু তাঁরা মিশেছেন অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো। বলা চলে, রামমোহন ও দ্বারকানাথ এই জুড়ি ঘোড়ার টানেই আধুনিক সভ্যতার রথ বাংলাদেশে প্রথম প্রবেশ করেছিল।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের ব্যাপারে প্রথম দিকে উদাসীন ছিল। অথচ রামমোহন ও দ্বারকানাথ দুজনেই অনুভব করেছিলেন ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তিত না হলে এদেশ কখনোই আধুনিক জগতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে না। তাই ‘হিন্দু কলেজ’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবে তাঁরা দুজনেই সাগ্রহ সমর্থন জানান। তাঁদের ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তির সাহায্যে 20 Jan 1817 তারিখে গরানহাটার গোরাচাঁদ বসাকের বাড়িতে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে রামমোহন যখন হেদুয়ার কাছে অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল নামে একটি ইংরেজি স্কুল স্থাপন করেন, তখন দ্বারকানাথ তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবেন্দ্রনাথকে এই স্কুলে ভর্তি করে দেন। Jun 1835-এ পাশ্চাত্য প্রথায় চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার জন্য মেডিক্যাল কলেজ স্থাপিত হলে দ্বারকানাথ দেশীয় ছাত্রদের উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে তিন বছরের জন্য বাৎসরিক দু হাজার টাকা দেবার প্রস্তাব করেন। তাঁরই উৎসাহে সংস্কৃত কলেজের আয়ুর্বেদের অধ্যাপক মধুসূদন গুপ্ত 28 Oct 1836-এ দেশীয়দের মধ্যে প্রথম শব-ব্যবচ্ছেদ করেন। দ্বিতীয়বার বিলাতযাত্রার সময়ে [1845] তিনি প্রস্তাব করেন যে দুজন ছাত্রের বিলাতযাত্রার ও সেখানে থেকে চিকিৎসাবিদ্যার উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের সমস্ত ব্যয় তিনিই বহন করবেন। সরকারও দুটি ছাত্রের জন্য বৃত্তি দেন। এই চারজন ছাত্র দ্বারকানাথের তত্ত্বাবধানে তাঁর সঙ্গেই বিলাত যান।

হিন্দুধর্মের সংস্কার ও সতীদাহ নিবারণ—রামমোহনের এই দুটি কীর্তির সঙ্গেও দ্বারকানাথ ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। রামমোহন 1815-এ একেশ্বরবাদী হিন্দুধর্ম বিষয়ে আলোচনার জন্য ‘আত্মীয় সভা’ স্থাপন করেন। দ্বারকানাথ নিজে নিষ্ঠাবান মূর্তিপূজক হিন্দু হয়েও এই সব আলোচনায় যোগ দিতেন এবং যখন ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ হয় তখন তিনি যথেষ্ট সহযোগিতা করেন ও পরে নিয়মিত উপাসনাতেও উপস্থিত থাকতেন। রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর কয়েক বছর প্রধানত তাঁর দানের উপর নির্ভর করেই ব্রাহ্মসমাজ বেঁচে থাকতে পেরেছিল। অনুরূপভাবে সতীদাহ-নিবারণের ব্যাপারেও দ্বারকানাথ সর্বপ্রযত্নে রামমোহনকে সাহায্য করেছিলেন। এ ছাড়া মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসায়ের অধিকার, বেন্টিঙ্কের প্রতি বিদায়কালীন অভিনন্দন, কালা আইন, দেওয়ানী জুরির প্রবর্তন, পুলিস-সংস্কার প্রভৃতি রাজনৈতিক আন্দোলনের কোথাও সপক্ষে বা কোথাও বিপক্ষে দ্বারকানাথকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে দেখা যায়। বাংলাদেশের জমিদারদের শক্তিকে সংহত করতে এবং তাঁদের সমস্যা সম্পর্কে সরকারকে সচেতন করার জন্য Apr 1838-এ যে জমিদার-সভা বা ল্যান্ড-হোল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন স্থাপন করা হয়, দ্বারকানাথ তার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

এর থেকেই বোঝা যায় যে, তখনকার দিনে দ্বারকানাথ কতখানি সামাজিক সম্মান ও প্রতিপত্তি লাভ করেছিলেন। তা ছাড়া তিনি ছিলেন মুক্তহস্ত পুরুষ। সুতরাং ব্যবসায়ের ও সামাজিকতার প্রয়োজনে তাঁর বাড়িতে নানাবিধ ভোজসভার আয়োজন লেগেই থাকত এবং সেখানে য়ুরোপীয় স্ত্রীপুরুষেরই প্রাধান্য ছিল। সমাচার দর্পণ-এর 20 Dec 1823 [শনি ৬ পৌষ ১২৩০] তারিখের সংবাদে দেখা যায়—“নূতনগৃহ, সঞ্চার ॥—মোং কলিকাতা ১১ ডিসেম্বর ২৭ আগ্রহায়ণ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরে শ্ৰীযুত বাবু দ্বারিকানাথ ঠাকুর স্বীয় নবীন বাটীতে অনেক ২ ভাগ্যবান্ সাহেব ও বিবীরদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনাইয়া চতুর্ব্বিধ ভোজনীয় দ্রব্য ভোজন করাইয়া পরিতৃপ্ত করিয়াছেন এবং ভোজনাবসানে ঐ ভবনে উত্তম গানে ও ইংগ্লণ্ডীয় বাদ্য শ্রবণে ও নৃত্য দর্শনে সাহেবগণে অত্যন্ত আমোদ করিয়াছিলেন। পরে ভাঁড়েরা নানা শং করিয়াছিল কিন্তু তাহার মধ্যে একজন গো বেশ ধারণপূৰ্ব্বক ঘাস চর্ব্বণাদি করিল।”১০ এই নূতন গৃহ সম্ভবত দ্বারকানাথের বৈঠকখানা বাড়ি এবং উক্ত ‘ভাগ্যবান’ শব্দটি প্রয়োগ থেকেই বোঝা যায় দ্বারকানাথের ভোজসভায় আমন্ত্রিত হওয়াকে য়ুরোপীয়েরাও সৌভাগ্য বিবেচনা করতেন।

দ্বারকানাথ নিজে ছিলেন বৈষ্ণব পরিবারের সন্তান ও অনুরূপ আহার-বিহারে অভ্যস্ত। সুতরাং প্রথম প্রথম সামাজিকতার অনুরোধে এই সব ভোজসভায় মদ্যমাংস পরিবেশিত হলেও তিনি নিজে তা স্পর্শ করতেন না। কিন্তু কালক্রমে তিনি এসব জিনিসে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে তাঁর পারিবারিক জীবনে একটি সংকট ঘনীভূত হয়ে ওঠে। আনুমানিক 1809-এ যশোহরের নরেন্দ্রপুরের রামতনু রায়চৌধুরী ও আনন্দময়ীর কন্যা দিগম্বরী দেবীর সঙ্গে দ্বারকানাথের বিবাহ হয়। তিনি নাকি আশ্চর্য সুন্দরী ছিলেন, বাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজার সময় দেবীমূর্তির মুখ নাকি তাঁরই মুখের আদলে তৈরি হত। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠাবতী ও ওজস্বিনী রমণী ছিলেন। তাই স্বামীর ভ্রষ্টাচারে অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে তিনি তাঁর সাক্ষাৎ-সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন। দ্বারকানাথও পত্নীর বিশ্বাসের উপর হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত হয়ে তদবধি বৈঠকখানা বাড়িতেই বাস করতে থাকেন এবং বেলগাছিয়ায় একটি বাগানবাড়ি কিনে বহুমূল্য আসবাবপত্রে সজ্জিত করে সেখানেই ভোজসভা, নৃত্যগীত ইত্যাদির আয়োজন করতেন। এই সব ভোজে সর্বশ্রেণীর লোককে নিমন্ত্রণ করে তাঁদের স্বচ্ছন্দে ও মন খুলে মেশবার সুযোগ করে দিতেন। তাঁর মধুর ব্যবহার ও সৌজন্যে সকলেই মুগ্ধ ও আকৃষ্ট হতেন। Calcutta Courier পত্রিকার 26 Feb 1841-সংখ্যায় দেখা যায়, দ্বারকানাথ 25 Feb [বৃহ ১৫ ফাল্গুন ১২৪৭] তারিখে গভর্নর জেনারেল লর্ড অকল্যান্ডের ভগ্নী মিস্ ইডেনের সম্মানে একটি নৃত্য ও ভোজসভার আয়োজন করেন। ইতিপূর্বে অনুরূপ একটি ভোজসভায় লেডি বেন্টিঙ্ক যোগদান করেছিলেন। এর থেকেই বোঝা যায় দ্বারকানাথ কেন য়ুরোপীয় সমাজে ‘প্রিন্স’ বলে অভিহিত হতেন।

দিগম্বরী দেবীর মৃত্যু হয় 21 Jan 1839 [সোম ৯ মাঘ ১২৪৫]; তার দুদিন পূর্বে তাঁর চতুর্থ পুত্র ভূপেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। সমাচার দর্পণ-এর 26 Jan [শনি ১৪ মাঘ]-সংখ্যায় লিখিত হয়—‘[19 Jan শনিবারের দ্বারকানাথের] ত্রয়োদশ বর্ষ বয়স্ক অতি গুণান্বিত এক পুত্রের লোকান্তর হইল এবং তাহার দুই দিবস পরেই তাঁহার ভার্য্যার পরলোক হইল।’১১ দিগম্বরী দেবীর গর্ভে দ্বারকানাথের পাঁচটি পুত্র হয়—দেবেন্দ্রনাথ [1817-1905], নরেন্দ্রনাথ, গিরীন্দ্রনাথ [1820-54], ভূপেন্দ্রনাথ [?-1839] ও নগেন্দ্রনাথ [1829-58]। এঁদের মধ্যে নরেন্দ্রনাথ ও ভূপেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয় অল্প বয়সেই। 1817-এ জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবেন্দ্রনাথের যখন জন্ম হয় তখন দ্বারকানাথের বয়স ২৩ বছর, দিগম্বরী দেবীর বয়স আনুমানিক তেরো থেকে চৌদ্দের মধ্যে। দেবেন্দ্রনাথকে তাঁর উপযুক্ত উত্তরাধিকারী রূপে গড়ে তোলবার জন্য দ্বারকানাথের তাঁকে 1834-এ ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের সহকারী কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। পরে তাঁকে এই ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর ও কার-ঠাকুর কোম্পানির এক-আনা অংশের অংশীদারও করে নেন। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথের মতিগতি ব্যবসা বাণিজ্যের অনুকূল ছিল না। প্রথমে বিলাসব্যসনে মগ্ন হয়ে ও 1834-এ পিতামহীর মৃত্যুর পর ধর্মচর্চায় লিপ্ত থেকে তিনি বিষয়কর্মে অবহেলা করতে থাকেন। দ্বারকানাথ তখন ব্যবসা ও সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাঁর অবর্তমানে উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ব্যবসার যদি পতন ঘটে তা হলে চিরকাল মহাসুখে লালিত সন্তানদের অবর্ণনীয় দুঃখকষ্টের মধ্যে পড়তে হবে, এই আশঙ্কায় তিনি 20 Aug 1840 [বৃহ ৬ ভাদ্র ১২৪৭] তারিখে একটি ট্রাস্টডীড সম্পাদন করে পৈতৃক ও স্বোপার্জিত কয়েকটি জমিদারি তার অন্তর্ভুক্ত করে যান। এইভাবে ডিহি সাহাজাদপুর, বিরাহিমপুর পরগনা, কালীগ্রাম পরগনা এবং পাণ্ডুয়া ও বালিয়া তালুককে ট্রাস্টের অন্তর্ভুক্ত করে সম্পর্কিত ভ্রাতা প্রসন্নকুমার, বৈমাত্রেয় ভাই রমানাথ ও ভাগিনেয় চন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায়ের উপর তত্ত্বাবধানের ভার অর্পণ করেন। এই ট্রাস্ট-গঠন তাঁর দূরদৃষ্টির একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

এর কিছুদিন পরেই 9 Jan 1842 [রবি ২৭ পৌষ ১২৪৮] দ্বারকানাথ বিলাতযাত্রা করেন। তাঁর ভাগিনেয় চন্দ্রমোহন এই যাত্রায় তাঁর সঙ্গী হন। ইংলন্ডে দ্বারকানাথ বিপুল সংবর্ধনা লাভ করেন। মহারানী ভিক্টোরিয়া স্বয়ং তাঁকে অভ্যর্থনা করেন এবং তাঁর অনুমতিক্রমে ইংলন্ডের মার্শাল ডিউক অব্‌ নরফোক তাঁকে একটি ‘আর্মোরিয়াল এনসাইন’ দেন। লন্ডনের মেয়র তাঁকে একটি ভোজসভায় আপ্যায়িত করেন। স্কটল্যান্ডে গেলে তাঁকে এডিনবার্গ মিউনিসিপ্যালিটির পক্ষ থেকে সেই মহানগরীর নাগরিক অধিকার প্রদান করা হয়। ফ্রান্সের সম্রাট লুই ফিলিপ তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। তিনিও একটি সান্ধ্যভোজে সম্রাট ও বিশিষ্ট অতিথিদের যথেষ্ট আপ্যায়িত করেন। দ্বারকানাথ কলকাতায় ফিরে আসেন Dec 1842-তে। ফেরার সময়ে তিনি বিখ্যাত বাগ্মী জর্জ টমসনকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে বিশিষ্ট বাঙালিদের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেন। কলকাতায় ফেরার পর দ্বারকানাথ আবার কর্মসমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়লেও মনে হয় তিনি যেন আর আগের মতো কাজে উৎসাহ পাচ্ছিলেন না, হয়তো স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়েছিল। এইজন্যই বোধহয় স্থায়ীভাবে ইংলন্ডে বাস করার উদ্দেশ্যে তিনি দ্বিতীয় বার বিলাতযাত্রার পরিকল্পনা করেন। এর আগে 16 Aug 1843 [বুধ ১ ভাদ্র ১২৫০] তারিখে একটি উইল করেন। এতে তিনি ভদ্রাসন বাড়ি দেবেন্দ্রনাথকে, বৈঠকখানা বাড়ি গিরীন্দ্রনাথকে এবং ভদ্রাসন বাড়ির পশ্চিম দিকের সমস্ত জমি ও বাড়ি তৈরির জন্য ২০,০০০ টাকা নগেন্দ্রনাথকে দিয়ে যান। কার-ঠাকুর কোম্পানির যে অর্ধাংশ তাঁর অধিকারে ছিল, তার সবটাই তিনি দেবেন্দ্রনাথকে দেন। এ ছাড়া এই উইলে দরিদ্রসেবার জন্য এক লক্ষ টাকা নির্দিষ্ট ছিল [পূর্বেও 3 Feb 1838 তারিখে তিনি ‘ডিস্ট্রিক্ট চ্যারিটেব্‌ল্‌ সোসাইটি’তে এক লক্ষ টাকা দান করেন]।

8 Mar 1845 [শনি ২৬ ফাল্গুন ১২৫১] তারিখে ‘বেন্টিঙ্ক’ নামক জাহাজে দ্বারকানাথ দ্বিতীয়বার বিলাতযাত্রা করেন। এবার সঙ্গে নিয়ে যান কনিষ্ঠপুত্র নগেন্দ্রনাথ, ভাগিনেয় নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও চিকিৎসাবিদ্যা-শিক্ষার্থী চারজন বাঙালি যুবককে। পর বৎসর 1 Aug 1846 [শনি ১৮ শ্রাবণ ১২৫৩] তারিখে লন্ডনের নিকটবর্তী সারেতে মাত্র ৫২ বৎসর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।

পরবর্তীকালে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে যে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিল, তার ভিত্তি রচনা করেছিলেন দ্বারকানাথ। অর্থ, আভিজাত্য, সম্মান ও প্রতিপত্তি দিয়ে তিনি এই পরিবারকে যে বিশিষ্টতা দান করেন, পুত্র দেবেন্দ্রনাথ তার সঙ্গে যুক্ত করেন ধর্মমহিমা; পরবর্তী পুরুষে একদিকে পৌত্র রবীন্দ্রনাথ ও অন্য দিকে প্রপৌত্র অবনীন্দ্রনাথ সাহিত্য ও শিল্পের গৌরব তার সঙ্গে যুক্ত করে এই বাড়িকে বাঙালির তীর্থস্থানে পরিণত করেছেন।

দ্বারকানাথের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে আগ্রহী পাঠক নিম্নলিখিত বইগুলি পড়তে পারেন—Blair B. Kling : Partner in Empire : Dwarakanath Tagore and the Age of Enterprise in Eastern India [1976]; Krishna Kripalani : Dwarakanath Tagore : A Forgotten Pioneer : A Life [1981]।

উল্লেখপঞ্জি

দ্র ব্যোমকেশ মুস্তফী : বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, পিরালী ব্রাহ্মণ-বিবরণ [১৩৩১]। ১৭৪

ঈশানচন্দ্র বসু : শ্ৰীমন্মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মহোদয়ের জীবন বৃত্তান্তের স্বল্প পরিচয় [1902]। ১২৮

বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস। ৩১৭

ড হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় : ঠাকুরবাড়ীর কথা [1966] ২৩

বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস। ৩১৮

ঐ। ৩২৪

কল্যাণকুমার দাশগুপ্ত-সম্পাদিত কিশোরীচাঁদ মিত্রের দ্বারকানাথ ঠাকুর [১৩৬৯]। ২৬০

দ্র ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর : দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী [১৩৭৬]। ৪২

দ্র ঐ। ৬১-৬২

১০ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় : সংবাদপত্রে সেকালের কথা ১ [১৩৭৭]। ১২৩

১১ ঐ ২ [১৩৮৪]। ৪৫০

* বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস। ২৮৩; বিনয় ঘোষ এই তথ্য সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছেন, দ্র ‘ঠাকুর-পরিবারের আদিপর্ব ও সেকালের সমাজ’ : বি. ভা. প., বৈশাখ-আষাঢ় ১৩৬৯। ৩৮৯

* Consultations, Sept. 18, 1758, Rev. Long’s Selections from Unpublished Records, 1748-1767,  p. 149. বিনয় ঘোষের উপরোক্ত প্রবন্ধ। ৩৯০

* ব্যোমকেশ মুস্তফী কর্তৃক উদ্ধৃত দলিলে ১১৭১ বঙ্গাব্দ ও 1764 খ্রিস্টাব্দ লিখিত আছে, আমরা বঙ্গাব্দটিকে সঠিক বলে ধরে নিয়েছি।

* ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর : দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী [১৩৭৬]। ১৪০; কৃষ্ণ কৃপালনী লিখেছেন : ‘Thus was founded in August-September 1828 the Union Bank with a capital of rupees twelve lakhs in 500 shares :—Dwarakanath Tagore : A Forgotten Pioneer : A Life [1981] 176

দ্বিতীয় অধ্যায় – দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

দ্বারকানাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠপুত্র দেবেন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন ৩ জ্যৈষ্ঠ ১২২৪ [বৃহ 15 May 1817] তারিখে। তাঁর রাশিচক্রটি নিম্নরূপ :

রাশিচক্র

—খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, এই দিন সূর্যগ্রহণের সময়ে তাঁর জন্ম হয়।

রামমোহনের অনুরোধে দ্বারকানাথ পুত্রকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত অ্যাংলো-হিন্দু স্কুলে ভর্তি করে দেন। 1827 ও 1828-এ দেবেন্দ্রনাথ যোগ্যতার সঙ্গে যথাক্রমে চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণীর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পুরস্কার লাভ করেন। অনুমান করা যায়, 1830 পর্যন্ত তিনি এই স্কুলে পড়েছিলেন। হিন্দু কলেজের বিখ্যাত শিক্ষক ডিরোজিওর পদত্যাগের [25 Apr 1831] অব্যবহিত পরে তিনি সেখানে ভর্তি হন ও তিন-চার, বছর অধ্যয়ন করে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময়ে কলেজ ত্যাগ করেন। এখানে পড়ার সময়ে অ্যাংলো-হিন্দু স্কুলের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রদের নিয়ে ১৭ পৌষ ১২৩৯ [রবি 30 Dec 1832] তারিখে ‘সর্বতত্ত্বদীপিকা’ নামে একটি সভা স্থাপিত হয় ও দেবেন্দ্রনাথ তার সম্পাদক নির্বাচিত হন। সভার উদ্দেশ্য ছিল ‘গৌড়ীয় ভাষার উত্তমরূপে অর্চ্চনা’ এবং সিদ্ধান্ত হয় যে ‘বঙ্গভাষা ভিন্ন এ সভাতে কোন কথোপকথন হইবেক না।’ এই সভা-সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু জানা না গেলেও একটি জিনিস লক্ষণীয়। যে-সময়ে হিন্দু কলেজে শিক্ষিত নব্যযুবকেরা ইংরেজি শিক্ষার মোহে দেশীয় ভাষা-সাহিত্য-ধর্ম-সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করতে শুরু করেছিলেন, সেই সময়েই এই সভার সভ্যেরা বাংলা ভাষা চর্চাকেই তাঁদের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে নির্দিষ্ট করেছেন। বোঝা যায়, এঁদের উপর রামমোহন রায়ের প্রভাবই অধিক কার্যকরী ছিল; আর সেই কারণেই ধর্মবিষয়ক আলোচনাও তাঁদের সভার অন্যতম লক্ষ্য হয়েছিল। এর থেকে দেবেন্দ্রনাথের মানসিক প্রবণতারও গতি নির্দেশ করা সম্ভব। বলা যেতে পারে, পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ এই সভারই উত্তরসূরি।

আনুমানিক 1834-এর মধ্যভাগে দ্বারকানাথ দেবেন্দ্রনাথকে হিন্দু কলেজ থেকে ছাড়িয়ে এনে নিজের প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়ন ব্যাঙ্কে কোষাধ্যক্ষ রমানাথ ঠাকুরের অধীনে শিক্ষানবিশ হিসেবে নিযুক্ত করেন। এই সময়ে দ্বারকানাথ সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্য নানাবিধ নৃত্য-গীত-ভোজ-সভার আয়োজন করতেন। দেবেন্দ্রনাথ এই পরিবেশে কিছুদিনের জন্য বিলাসের স্রোতে নিমগ্ন হন। কিন্তু 1838-এ পিতামহী অলকা দেবীর মৃত্যুর সময়ে তাঁর মনে যে বিচিত্র ভাবের উদয় হয়, তাইতেই তাঁর জীবনধারা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যায়। এই পিতামহীই ছিলেন তাঁর বাল্য ও কৈশোরের প্রধান আশ্রয়; তাঁর ধর্মপ্রবণতা দেবেন্দ্রনাথের মনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। পিতামহীর মৃত্যুর পর তত্ত্বজ্ঞান লাভের বাসনা দেবেন্দ্রনাথের মনে তীব্রভাবে জেগে ওঠে। মহাভারত ও য়ুরোপীয় দর্শনশাস্ত্র প্রচুর পাঠ করেও তিনি আত্মজিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে পাননি। এমন সময় ঈশোপনিষদের ‘ঈশাবাস্যমিদং সর্বং…’ শ্লোকটি আকস্মিকভাবে তাঁর হাতে আসে। ব্রাহ্মসমাজের আচার্য রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের সহায়তায় তিনি যখন শ্লোকটির অর্থ বুঝতে পারলেন, তখন থেকেই উপনিষদের প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্মায়। উপনিষদ-পাঠে মন যখন অভিষিক্ত, সেই সময়ে তিনি ২১ আশ্বিন ১২৪৬ [6 Oct 1839] রবিবার কৃষ্ণা-চতুর্দশীর দিনে জোড়াসাঁকো-বাড়ির পুষ্করিণীর ধারে একটি ছোটো ঘরে দশজন আত্মীয় ও বন্ধুকে নিয়ে ‘তত্ত্বরঞ্জিনী সভা’ স্থাপন করেন এবং নিয়ম হয় প্রতি মাসের প্রথম রবিবার সন্ধ্যায় সভার অধিবেশন হবে। দ্বিতীয় অধিবেশনে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশকে সভার আচার্য পদে অভিষিক্ত করা হয় এবং তিনিই সভার নাম পরিবর্তন করে ‘তত্ত্ববোধিনী’ রাখেন—‘ইহার উদ্দেশ্য, আমাদিগের সমুদায় শাস্ত্রের নিগূঢ় তত্ত্ব এবং বেদান্ত-প্রতিপাদ্য ব্রহ্ম-বিদ্যার প্রচার।’ ক্রমেই সভার সদস্যসংখ্যা বাড়তে থাকে। পর বৎসর অগ্রহায়ণ মাসে দেবেন্দ্রনাথ এই উদ্দেশ্যে ৫৬ নং সুকিয়া স্ত্রীটে একটি বাড়ি ভাড়া করেন। তত্ত্ববোধিনী সভা-স্থাপন বাংলার সামাজিক ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই সময়ের কিছু আগে থেকেই আলেকজাণ্ডার ডাফ প্রভৃতি মিশনারিদের প্রচারে বেশ-কিছু ইংরেজিশিক্ষিত নব্যযুবক খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন, তা ছাড়া অনেকেই প্রচলিত হিন্দুধর্মের নানাবিধ কুসংস্কারের জন্য এর উপর আস্থা হারিয়ে ফেলছিলেন। সে ক্ষেত্রে তত্ত্ববোধিনী সভা এই মনোভাবের পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করেছিল। অনেকটা একই উদ্দেশ্য নিয়ে দেবেন্দ্রনাথ Jun 1840-তে ‘তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা’ স্থাপন করেন। ‘ইংরাজী ভাষাকে মাতৃভাষা এবং খৃষ্ট ধর্ম্মকে পৈতৃক ধৰ্ম্মরূপে গ্রহণ—এই সকল সাংঘাতিক ঘটনা নিবারণ করা, বঙ্গভাষায় বিজ্ঞানশাস্ত্র এবং ধর্ম্মশাস্ত্রের উপদেশ করিয়া বিনা বেতনে ছাত্রগণকে পরমার্থ ও বৈষয়িক উভয় প্রকার শিক্ষা প্রদান করা’ ছিল পাঠশালার উদ্দেশ্য। অক্ষয়কুমার দত্ত ভূগোল ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষক নিযুক্ত হন। এই বিষয়ে তাঁর লিখিত দুটি গ্রন্থ তত্ত্ববোধিনী সভা 1841-এ প্রকাশ করে। কিন্তু পাঠশালাটি যথেষ্ট জনসমাদর লাভ না করায় 30 Apr 1843 [রবি ১৮ বৈশাখ ১২৫০] তারিখে বাঁশবেড়িয়া গ্রামে স্থানান্তরিত হয়। পিতার মৃত্যুজনিত ভাগ্যবিপর্যয়ের ফলে 1847-এ পাঠশালাটি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনে ব্ৰহ্মবিদ্যালয় স্থাপনের যে পরিকল্পনা দেবেন্দ্রনাথ অনুমোদন করেছিলেন তাকে এই পাঠশালারই অনুবর্তন বলা যেতে পারে।

এরপর দেবেন্দ্রনাথের জীবনে একটি বড়ো ঘটনা হল ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে যোগাযোগ। রামমোহনের বিলাতযাত্রা [1830]-র পর দ্বারকানাথের অর্থসাহায্যেই ব্রাহ্মসমাজ কোনোরকমে অস্তিত্ব রক্ষা করে চলছিল। দ্বারকানাথের বিলাতযাত্রার পরেই দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজ পরিদর্শন করতে গিয়ে [? Jan 1842] এর প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তাঁর আগ্রহেই ১৭৬৪ শকের [1842] বৈশাখ মাসে তত্ত্ববোধিনী সভা ব্রাহ্মসমাজের পরিচালনার ভার গ্রহণ করে। তত্ত্ববোধিনী সভা ও ব্রাহ্মসমাজের বক্তব্য প্রচারের জন্য ১ ভাদ্র ১৭৬৫ শক [বুধ 16 Aug 1843] তারিখে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ধর্মতত্ত্ব প্রচার পত্রিকার প্রধান লক্ষ্য হলেও ভূগোল, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ের আলোচনাও সেখানে প্রকাশিত হত। আধুনিক বাংলা গদ্যের রূপগঠনে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-র দান অনস্বীকার্য। অক্ষয়কুমার ও দেবেন্দ্রনাথ ছাড়াও বিদ্যাসাগর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রভৃতি মনীষীরাও এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। হেদুয়ার কাছে রামমোহনের অ্যাংলো-হিন্দু স্কুলের বাড়িতে এই পত্রিকার যন্ত্রালয় ছিল এবং এখানেই দেবেন্দ্রনাথ রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে উপনিষদ ও বেদান্তদর্শনের পাঠ গ্রহণ করতেন।

এদিকে দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের যোগ ক্রমেই ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। অবশেষে ১৮৬৫ শকের ৭ পৌষ [১২৫০ : 21 Dec 1843] বৃহস্পতিবার অপরাহ্ন তিনটের সময় ভ্রাতা গিরীন্দ্রনাথ-সহ ২১ জন বিধিপূর্বক প্রতিজ্ঞা পাঠ করে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। ঘটনাটি দেবেন্দ্রনাথের জীবনের একটি প্রধান দিক্‌-নির্দেশক ও দিনটিকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলেন রবীন্দ্রনাথ। এরপর মহা উৎসাহে দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্ম-প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। দু-বছরের মধ্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ব্রাহ্মের সংখ্যা ৫০০ হলে তিনি ৭ পৌষ ১৭৬৭ শক [১২৫২ : শনি 20 Dec 1845] তারিখে গোরিটির [গৌরীহাটির] বাগানে মহোৎসবের আয়োজন করেন।

বাংলার সামাজিক ইতিহাসে এই সব ঘটনার প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী। আলেকজাণ্ডার ডাফ প্রভৃতি খ্রিস্টান মিশনারিরা এই সময়ে খ্রিস্টধর্মপ্রচার ও হিন্দুধর্মের ত্রুটিবিচ্যুতির আলোচনায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, মহেশচন্দ্র ঘোষ, মধুসূদন দত্ত, জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর প্রভৃতি সম্ভ্রান্তবংশীয় উচ্চশিক্ষিত যুবকেরা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেন; যাঁরা তা করলেন না তাঁরাও প্রচলিত হিন্দুধর্ম সম্পর্কে তাঁদের বিতৃষ্ণা গোপন করেননি। আর এর প্রতিক্রিয়ায় রক্ষণশীল হিন্দুরা হিন্দুধর্মের সব-কিছুকেই পবিত্র ও মাহাত্ম্যপূর্ণ ঘোষণা করে যে-কোনো সংস্কারমূলক কাজকর্মেরই বিরোধিতা করতে থাকেন। দেবেন্দ্রনাথ তত্ত্ববোধিনী সভা ও পত্রিকাকে আশ্রয় করে এই দুই স্রোতেরই গতিরোধ করার প্রয়াসী হন। ‘হিন্দুহিতার্থী বিদ্যালয়’ স্থাপন এই প্রয়াসেরই কার্যকরী রূপ। খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত অবৈতনিক বিদ্যালয়গুলি খ্রিস্টধর্ম-প্রচারের প্রধান কেন্দ্র ছিল। সুতরাং অনুরূপ দেশীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমেই এর যোগ্য প্রত্যুত্তর দেওয়া যেতে পারে এই বিবেচনায় দেবেন্দ্রনাথ প্রাচীনপন্থী রাজা রাধাকান্ত দেব এবং নব্যপন্থী রামগোপাল ঘোষ প্রভৃতি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মিলিত করে এই বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্দেশ্যে 25 May 1845 [রবি ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১২৫২] তারিখে একটি সাধারণ সভার আয়োজন করেন। বহু ধনাঢ্য ব্যক্তির দানে পুষ্ট হয়ে 1 May 1846 [রবি ১৯ ফাল্গুন ১২৫২] তারিখে চিৎপুর রোডে রাধাকৃষ্ণ বসাকের বৈঠকখানায় বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়; ভূদেব মুখোপাধ্যায় প্রধান শিক্ষক ও রাজনারায়ণ বসু পরিদর্শক নিযুক্ত হন। দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন বিদ্যালয়ের অন্যতম সম্পাদক। অবশ্য নানা কারণে এর আয়ু দীর্ঘায়িত হতে পারেনি; কিন্তু এটি একটি আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়ে এবং রক্ষণশীল, সংস্কারপন্থী ও নব্যপন্থী—হিন্দুসমাজের এই তিনটি শাখাকেই একসূত্রে গেঁথে যে একটি বড় কাজ করেছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ব্রাহ্মসমাজ ও তত্ত্ববোধিনী সভার কাজে দেবেন্দ্রনাথ ক্রমেই এত বেশি জড়িত হয়ে পড়ছিলেন যে বৈষয়িক কাজকর্মে তিনি যথেষ্ট মনোযোগ করতে পারতেন না। ইতিমধ্যে খবর এল বিলাতে দ্বারকানাথের মৃত্যু হয়েছে [1 Aug 1846]। তাঁর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান দেবেন্দ্রনাথের কাছে একটি মানসিক সংকটের আকারে এল। তিনি ও গিরীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করলেও জোড়াসাঁকোর বাড়িতে চিরাচরিত হিন্দুপ্রথা অনুযায়ী পূজার্চনা অব্যাহত ছিল। কিন্তু পিতৃশ্রাদ্ধের সময় দেবেন্দ্রনাথ শালগ্রাম এনে শাস্ত্রবিধি-অনুযায়ী শ্রাদ্ধ করতে সম্মত হলেন না, তিনি ‘পৌত্তলিকতার সংস্রববর্জ্জিত দানোৎসর্গের একটি মন্ত্র’ উচ্চারণ করে দানসামগ্রী উৎসর্গ করেন। এই ব্যাপারে বিক্ষুব্ধ আত্মীয়েরা দেবেন্দ্রনাথকে সামাজিকভাবে পরিত্যাগ করেন। গিরীন্দ্রনাথ অবশ্য শাস্ত্রানুমোদিত শ্রাদ্ধক্রিয়া সম্পন্ন করেন।

দ্বারকানাথের উইল অনুযায়ী দেবেন্দ্রনাথ কার-ঠাকুর কোম্পানির যে আট আনা অংশ পান, তা তিন ভাইয়ে সমান ভাগ করে নেন। তিনি বিষয়কৰ্ম উদাসীন হলেও তাঁর মধ্যম ভ্রাতা গিরীন্দ্রনাথ বিষয়-বুদ্ধি সম্পন্ন ছিলেন। তাঁরই পরামর্শে ইংরেজ অংশীদারদের অংশ ক্রয় করে তাঁদের বেতনভোগী কর্মচারীতে পরিণত করা হয় এবং ব্যবসায়-পরিচালনার প্রধান দায়িত্ব গিরীন্দ্রনাথই গ্রহণ করেন। দেবেন্দ্রনাথ নিশ্চিন্ত হয়ে কাশীতে যান বেদ-চর্চা করতে। কিন্তু ইতিমধ্যে ব্যবসা-জগতের অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে ওঠে। পরিণামে 1848-এর গোড়াতেই ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক এবং কার-ঠাকুর কোম্পানির পতন ঘটে। ফলে দেবেন্দ্রনাথ ও গিরীন্দ্রমোহনের স্কন্ধে বিপুল ঋণভার এসে পড়ে। দেবেন্দ্রনাথ স্বভাবসিদ্ধ মহানুভবতায় সমস্ত ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব নিয়ে অনাড়ম্বরভাবে জীবনযাপন করতে শুরু করেন। তাঁর তৎকালীন মানসিক অবস্থার সঙ্গে এই জীবনযাত্রা সুসংগত হয়েছিল। অনন্যমনা হয়ে ধর্মালোচনায় সম্পূর্ণ নিবিষ্ট হবার সুযোগ পেলেন তিনি। এই সময়ে তাঁর ধর্মমতেরও যথেষ্ট পরিবর্তন হয়। পূর্বে তিনি বেদকে অভ্রান্ত মনে করতেন। কিন্তু বেদচর্চার ফলে তাতে বহুদেবতা, যজ্ঞাদির বাহুল্য, পরস্পরবিরোধী উক্তির সন্নিবেশ ইত্যাদি দেখে ঐ মত পরিত্যাগ করেন। উপনিষদের অদ্বৈতবাদী ব্যাখ্যাও তাঁর অন্তরের সায় পেল না। তখন তিনি উপনিষদ থেকে তাঁর হৃদয়ের অনুকূল শ্লোকসমূহ সংকলন করে ‘ব্রাহ্মধর্ম’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডটি প্রস্তুত করেন [1848] এবং তাকে ব্রাহ্মী উপনিষদ আখ্যা দেন। এই গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে দেবেন্দ্রনাথ বিপুল পরিশ্রমে মহাভারত, গীতা, মনুসংহিতা প্রভৃতি থেকে শ্লোক সংগ্রহ করে ব্রাহ্মধর্মের নীতি ও অনুশাসন প্রস্তুত করেন।

ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণের পর থেকেই দেবেন্দ্রনাথ দুর্গাপূজার সময় বাড়িতে না থেকে বিভিন্ন দেশ পর্যটনে ব্যাপৃত হন। এইভাবে 1849-এ আসাম, 1850-তে ব্রহ্মদেশের মৌলমীন, 1856-এ কাশী, এলাহাবাদ, আগ্রা, দিল্লি, মথুরা, বৃন্দাবন, লাহোর, অমৃতসর, সিমলা প্রভৃতি স্থান পরিভ্রমণ করেন। সিমলায় অবস্থান কালেই সিপাহি বিদ্রোহ আরম্ভ হয়। দেবেন্দ্রনাথ তখন হিমালয়ের আরও গভীরে সুঙঘ্রী প্রভৃতি স্থান পরিভ্রমণ করেন। তাঁর আধ্যাত্মিক উপলব্ধির দিক দিয়ে এই ভ্রমণ যথেষ্ট মূল্যবান। অবশেষে ১ অগ্রহায়ণ ১২৬৫ [15 Nov 1858] তারিখে তিনি কলকাতা প্রত্যাবর্তন করেন।

ইতিমধ্যে 1854-এ গিরীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। তাঁর সুপরিচালনায় পৈতৃক ঋণের অধিকাংশই শোধ হয়ে যায়। কিন্তু অবশিষ্ট ঋণ ও গিরীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত ঋণ ইত্যাদির জন্য সম্পত্তি বিষয়ে যথেষ্ট বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এমন-কি পাওনাদারের নালিশে দেবেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট বের করে তাঁকে গ্রেপ্তারও করা হয়। প্রসন্নকুমার ঠাকুর মধ্যস্থ হয়ে বাকি ঋণ পরিশোধের সুবন্দোবস্ত করেন। কিন্তু তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা নগেন্দ্রনাথ আবার ব্যক্তিগত ব্যয়ের জন্য ঋণ করতে আরম্ভ করলে দেবেন্দ্রনাথ অসন্তোষ প্রকাশ করেন, অভিমানে নগেন্দ্রনাথ গৃহত্যাগ করেন। 24 Oct 1858-এ তাঁর মৃত্যু হয়। ১৪ অগ্র ১২৬৪ [28 Nov 1857] ও ২৯ আষাঢ় ১২৬৫ [12 Jul 1858] নগেন্দ্রনাথ দুটি উইল করেন। তিনি গণেন্দ্রনাথকে সম্পত্তির ভাগ ও ২০০০০ টাকা দিয়ে যান [দ্র Deed No. 77]।

1858-এ দেশভ্রমণ করে ফিরে আসার পর দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে কেশবচন্দ্র সেনের যোগাযোগ হয়। কেশবচন্দ্র তাঁর দ্বিতীয় পুত্র সত্যেন্দ্রনাথের সহপাঠী ছিলেন এবং প্রধানত সেই সূত্রেই কেশবচন্দ্র ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ করেন। এই যুবকের দীপ্ত ধর্মবোধ ও প্রবল কর্মশক্তি দেবেন্দ্রনাথকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে। এঁরই উদ্যোগে তিনি 1859-এ ‘ব্ৰহ্মবিদ্যালয়’ স্থাপন করেন এবং সেখানে তিনি নিজে বাংলায় ও কেশবচন্দ্র ইংরেজিতে ধর্মোপদেশ দিতে আরম্ভ করেন। এর কিছুদিন পরে দেবেন্দ্রনাথ তাঁর নিয়মিত শারদ-ভ্রমণে সত্যেন্দ্রনাথ ও কেশবচন্দ্রকে নিয়ে ১২ আশ্বিন ১২৬৬ তারিখে সিংহল যাত্রা করেন। উল্লেখ্য যে, এই বৎসরের গোড়াতেই, খুব সম্ভব ২৬ বৈশাখ যে সাংবৎসরিক সভা আহূত হয়, সেখানেই, তত্ত্ববোধিনী সভার বিলোপ সাধন করে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজের হস্তে অর্পণ করা হয়। ১১ পৌষ ব্রাহ্মদের সাধারণ সভায় দেবেন্দ্রনাথ ও কেশবচন্দ্র সমাজের সম্পাদক নির্বাচিত হন।

এই সমস্ত পরিবর্তনের ফলে ব্রাহ্মসমাজে নূতন প্রাণের জোয়ার এল। এর পূর্বে দেবেন্দ্রনাথের কাছে ব্রাহ্মধর্ম ছিল তত্ত্বানুসন্ধানের অন্যতম মাধ্যম। কেশবচন্দ্র তার সঙ্গে প্রচার যুক্ত করে একে একটি সাম্প্রদায়িক ধর্মের রূপ দিলেন। ব্রাহ্মদের সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য অনুষ্ঠান-পদ্ধতি প্রণীত হল। এই পদ্ধতি অনুসারে দেবেন্দ্রনাথ ১২ শ্রাবণ ১২৬৮ [26 Jul 1861] তারিখে তাঁর দ্বিতীয়া কন্যা সুকুমারীর বিবাহ দিলেন। লক্ষণীয় যে, শালগ্রামসাক্ষী ও অগ্নিসংস্কার ব্যতীত হিন্দুবিবাহের অন্যান্য প্রত্যেকটি অঙ্গই এই বিবাহে অনুসৃত হয়েছিল। দেবেন্দ্রনাথ সমাজের সংস্কার অবশ্যই চাইতেন, কিন্তু তা প্রচলিত প্রথাগুলি বর্জন করে নয়, যুগোপযোগী পরিবর্তনের মাধ্যমে। ব্রাহ্মধর্মকে তিনি হিন্দুধর্মেরই অন্তর্গত করে দেখতেন, তার পৌত্তলিকতা ও অন্যান্য কুসংস্কার বাদ দিয়ে। তাই বিধবা-বিবাহ, অসবর্ণ-বিবাহ, উপবীত-ত্যাগ ইত্যাদি ব্যাপার তিনি সমর্থন করলেও মনেপ্রাণে স্বীকার করে নিতে পারেননি। আর সেই কারণেই কেশবচন্দ্র প্রভৃতি কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজের নব্যপন্থী সভ্যেরা যখন এইগুলিকেই প্রাধান্য দিতে শুরু করলেন, তখন তিনি তা মানতে পারলেন না। ফলে কেশবচন্দ্র ও তাঁর অনুগামীরা ২৬ কার্তিক ১২৭৩ [11 Nov 1866] তারিখে ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ’ স্থাপন করলেন; কার্যত এই বিচ্ছেদ ঘটে 1864-এর শেষে। এই ঘটনায় দেবেন্দ্রনাথ মর্মান্তিক দুঃখ পান, অথচ নানাভাবেই তিনি এই নূতন সমাজের সঙ্গে যোগ রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কেশবচন্দ্রের উগ্র ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, খ্রিস্টভক্তির বাড়াবাড়ি, বৈষ্ণবদের অনুকরণে নগরসংকীর্তন প্রভৃতি ব্যাপারের মধ্যে নূতন ধরনের পৌত্তলিকতার আভাস দেখে তাঁর পক্ষে এই যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এরপর থেকেই আমরা দেখি, তিনি ধীরে ধীরে সব-কিছু থেকেই নিজেকে সরিয়ে নিয়ে অবসর জীবন যাপন করতে থাকেন। অবশ্য জীবনের প্রায় শেষ পর্যন্তই তিনি ব্রাহ্মসমাজ ও বৈষয়িক উভয়বিধ ক্ষেত্রেই তাঁর সজাগ দৃষ্টি রেখেছিলেন, কিন্তু তাঁর সম্যক উৎসাহের অভাবে আদি ব্রাহ্মসমাজ ক্রমশই একটি সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে বদ্ধ হয়ে অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করে ফেলে।

কিন্তু সে প্রসঙ্গ এবং দেবেন্দ্রনাথের শেষ জীবন এখানে আলাদা করে আলোচনা করার প্রয়োজন নেই, কারণ তা রবীন্দ্রনাথের জীবন-বর্ণনা সূত্রেই আমরা উপস্থাপিত করতে পারব। বর্তমানে শুধু এইটুকুই উল্লেখ করা যাচ্ছে যে, ৬ মাঘ ১৩১১ [বৃহ 19 Jan 1905] তারিখে বেলা ১-৫৫ মিনিটে ৮৮ বছর বয়সে তিনি দেহত্যাগ করেন।

উল্লেখপঞ্জি

বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পারিবারিক রাশিচক্রের খাতা থেকে উদ্ধৃত [রবীন্দ্রভবন, Ms. 364]

খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়; রবীন্দ্র-কথা [১৩৪৯]।

দ্র যোগেশচন্দ্র বাগল : দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সা-সা-চ ৩। ৩৪।১০, ১২

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর : আত্মজীবনী [১৩৬৮]। ২৬

ঐ। ২৯৯-৩০০

তৃতীয় অধ্যায় – সারদাসুন্দরী দেবী

দেবেন্দ্রনাথের বিবাহ হয় যশোহর দক্ষিণডিহি-নিবাসী রামনারায়ণ চৌধুরীর কন্যা সারদাসুন্দরী দেবীর* সঙ্গে ১২৪০ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে [Mar 1834]*। তখন দেবেন্দ্রনাথের বয়স সতেরো বৎসর ও সারদা দেবীর আট [?]*। বিবাহের একটি বিবরণ দিয়েছেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী : ‘তাঁর [সারদা দেবীর] এক কাকা কলকাতায় শুনেছিলেন যে, আমার শ্বশুরমশায়ের জন্য সুন্দরী মেয়ে খোঁজা হচ্ছে। তিনি দেশে এসে আমার শাশুড়ীকে (তিনি তখন ছয় বৎসরের মেয়ে) কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়ে দিলেন। তখন তাঁর মা বাড়ী ছিলেন না—গঙ্গা নাইতে গিয়েছিলেন। বাড়ী এসে, মেয়েকে তাঁর দেওর না বলে-কয়ে নিয়ে গেছেন শুনে তিনি উঠোনের এক গাছতলায় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে লাগলেন। তারপর সেখানে পড়ে কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়ে মারা গেলেন।’

সারদা দেবীর জীবনের সম্পূর্ণ চিত্রটি আমাদের কাছে খুব স্পষ্ট নয়, সেকালের বাঙালি পরিবারের অন্তঃপুরচারিণী গৃহবধূর বৈচিত্র্যহীন জীবনে সেই স্পষ্টতা আশাও করা যায় না। তবু তাঁর বহির্জীবন ও অন্তৰ্জীবন যে গভীর সংকটের মধ্যে দিয়ে চলেছে তা নানা কারণে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। তিনি যখন বধূ হয়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে প্রবেশ করেছেন তখন দ্বারকানাথের সৌভাগ্যসূর্য মধ্যগগনে। কল্পনা করা যায় তাঁর বিবাহে যথেষ্ট ধূমধাম হয়েছিল এবং দাসদাসী-পরিবৃত খুব জমকালো পরিবেশেই তাঁর প্রথম যৌবন অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য রূপবান স্বামী-পুত্রাদি নিয়ে সারদা দেবীর ভোগাকাঙক্ষা যে-সময় পরিপূর্ণতায় পৌঁছতে পারত, সেই সময়েই দেবেন্দ্রনাথের জীবনে এক বিষয়-বৈরাগ্যের উদয় হল। এই অবস্থা সেই তরুণী বধূর কতখানি হৃদয়বেদনার কারণ হয়েছিল তার একটি করুণ চিত্র আছে দেবেন্দ্রনাথের আত্মজীবনীর এক অংশে। বিপুল ঐশ্বর্যের প্রভু না থেকে নির্জনে ঈশ্বরের পালনী-শক্তির আস্বাদ পাওয়ার জন্য দেবেন্দ্রনাথের মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। সেই নির্জনতা লাভের উদ্দেশ্যে “১৭৬৮ শকের [1846] শ্রাবণ [? ভাদ্র] মাসের ঘোর বর্ষাতেই গঙ্গাতে বেড়াইতে বাহির হইলাম। আমার ধর্ম্মপত্নী সারদা দেবী কাঁদিতে কাঁদিতে আমার নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলেন, ‘আমাকে ছাড়িয়া কোথায় যাইবে? যদি যাইতেই হয়, তবে আমাকে সঙ্গে করিয়া লও।’ আমি তাঁহাকে সঙ্গে লইলাম। তাঁহার জন্য একটা পিনিস ভাড়া করিলাম। তিনি, দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ এবং হেমেন্দ্রনাথকে লইয়া তাহাতে উঠিলেন।” এই নৌকাযাত্রার অবসান আর এক মহাসংকটের মধ্যে। পথিমধ্যে দ্বারকানাথের আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ এসে পৌঁছল; যার পরিণতি আর্থিক বিপর্যয়ে ও দেবেন্দ্রনাথ অপৌত্তলিকভাবে শ্রাদ্ধ করায় শেষ পর্যন্ত আত্মীয়-বিচ্ছেদে, যা অবশ্যই সারদা দেবীর পক্ষে মর্মান্তিক হয়েছিল। সেই সময় তিনি ছিলেন সেই বৃহৎ পরিবারের সর্বময়ী কর্ত্রী। তাই যে সমস্ত সাংসারিক কৃচ্ছ্রতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল, এতদিনের অভ্যস্ত জীবনযাত্রার সেই ব্যতিক্রম তাঁর কাছে নিশ্চয়ই খুব উপাদেয় হয়নি। আর বিবাহাদি পারিবারিক অনুষ্ঠানে ও দুর্গোৎসবাদি সামাজিক ক্রিয়াকলাপে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনদের অনুপস্থিতি তাঁর পক্ষে অবশ্যই পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছিল।

সারদা দেবীর যখন বিবাহ হয় তখন তাঁর শাশুড়ী দিগম্বরী দেবী ও দিদিশাশুড়ী অলকা দেবী দুজনেই জীবিতা। তাঁরা ছিলেন ধর্মপ্রাণ মহিলা। সুতরাং তাঁদের শিক্ষায় দেবদ্বিজে অনুরক্তি প্রভৃতি হিন্দুনারীর স্বাভাবিক বৃত্তিগুলি যে তাঁর চরিত্রের অঙ্গীভূত হয়ে যাবে, তা সহজেই অনুমেয়। দ্বারকানাথের সময় থেকেই বাড়িতে মহাসমারোহে দুর্গাপূজা ও জগদ্ধাত্রীপূজা হত। দেবেন্দ্রনাথ প্রথমেই জগদ্ধাত্রী পূজা উঠিয়ে দেন ও দুর্গাপূজার সময়ে বাড়িতে না থেকে দেশভ্রমণে বহির্গত হতে শুরু করেন। কালক্রমে দুর্গাপূজাও উঠে যায়,* পারিবারিক আচার-অনুষ্ঠানে অপৌত্তলিক পদ্ধতি অনুসৃত হতে থাকে ও গিরীন্দ্রনাথের পরিবারেও গৃহদেবতা লক্ষ্মী-জনার্দন শিলার সেবার ভার গ্রহণ করে স্বতন্ত্র হয়ে যান। এই সব ঘটনা সারদা দেবীর ধর্মজীবনে অবশ্যই সংকটের সৃষ্টি করেছিল। খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন : ‘আমরা প্রাচীনাদের মুখে শুনিছি সারদাদেবী স্বামীর কথায় নূতন ধর্ম্মানুষ্ঠান অনুশীলনে একটু দোদুল্যমান অবস্থায় পড়িয়াছিলেন। তাঁহার চিরদিনের অভ্যস্ত বাহ্যিক পূজা অনুষ্ঠান ৩৫ বৎসর বয়সে স্বামীর মতানুবৰ্ত্তিনী হইয়া ত্যাগ করিয়াছিলেন। বেদীতে বসিয়া কিন্তু নিজের ইষ্টমন্ত্র জপ ও হরিনাম জপ করিতেন এবং স্বামীর ধর্ম্মব্যাখ্যা শ্রদ্ধার সহিত শ্রবণ করিতেন। আবার চিরদিনের অভ্যাসের ফলে কখন কখন রমানাথ ঠাকুরের বাটির দুর্গোৎসবের পূজক কেনারাম শিরোমণির হস্তে, স্বামীর অজ্ঞাতে, কালীঘাটে ও তারকেশ্বরে পূজা প্রেরণ করিতেন।’

এই উদ্ধৃতি থেকেই সারদা দেবীর ধর্মজীবনের সংকটের প্রকৃত রূপটি বোঝা যাবে। অথচ স্বামীভক্তিও তাঁর জীবনের এক অন্যতম সংস্কার, বলা যেতে পারে এইটিই ছিল তাঁর জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। সৌদামিনী দেবী লিখেছেন : ‘মা আমার সতীসাধ্বী পতিপরায়ণা ছিলেন। পিতা সর্বদাই বিদেশে কাটাইতেন এই কারণে সর্বদাই তিনি চিন্তিত হইয়া থাকিতেন। পূজার সময় কোনোমতেই পিতা বাড়িতে থাকিতেন না। এইজন্য পূজার উৎসবে যাত্রা গান আমোদ যতকিছু হইত তাহাতে আর সকলেই মাতিয়া থাকিতেন কিন্তু মা তাহার মধ্যে কিছুতে যোগ দিতে পারিতেন না। তখন নির্জন ঘরে তিনি একলা বসিয়া থাকিতেন। কাকীমারা আসিয়া তাঁহাকে কত সাধ্য সাধনা করিতেন, তিনি বাহির হইতেন না। গ্রহাচার্যরা স্বস্ত্যয়নাদির দ্বারা পিতার সর্বপ্রকার আপদ দূর করিবার প্রলোভন দেখাইয়া তাঁহার কাছ হইতে সর্বদাই যে কত অর্থ লইয়া যাইত তাহার সীমা নাই।’

স্বামীর জন্য এই উদ্বেগ তাঁর চিরসঙ্গী। 1857-এ দেবেন্দ্রনাথ যখন সিমলায়, সেই সময় উত্তর ভারতে সিপাহি বিদ্রোহ আরম্ভ হয়। সৌদামিনী দেবী লিখেছেন : ‘একটা গুজব উঠিল সিপাহীরা তাঁহাকে হত্যা করিয়াছে। একে অনেকদিন চিঠিপত্র লেখেন নাই, তাহার উপর এই গুজব—বাড়ির সকলে ভাবনায় অভিভূত হইল। মা তো আহার নিদ্রা ত্যাগ করিয়া কান্নাকাটি করিতে লাগিলেন।’ সেইজন্য স্বামী যখন বাড়ি থাকতেন তখন তাঁর সেবার দিকে তিনি তীক্ষ দৃষ্টি রাখতেন। এ বিষয়ে জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর ‘স্মৃতিকথা’ থেকে কতকগুলি প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধার করছি : ‘আমার শাশুড়ীর একটু স্থূল শরীর ছিল, তাই বেশি নড়াচড়া করতে পারতেন না।…কেবল বাবামশায় যখন বাড়ী থাকতেন মা রান্নাঘরে নিজে গিয়ে বসতেন।’ [পুরাতনী। ২৩] ‘আমাদের বাড়িতে তখন রোজ উপাসনা হত,..মহর্ষি থাকলে তিনি উপাসনা করতেন, তখন মাও গিয়ে বসতেন।’ [ঐ। ২৬] ‘আমার মনে পড়ে বাবামশায় যখন বাড়ী থাকতেন আমার শাশুড়ীকে একটু রাত করে ডেকে পাঠাতেন, ছেলেরা সব শুতে গেলে। আর মা একখানি ধোয়া সুতি শাড়ি পরতেন, তারপর একটু আতর মাখতেন; এই ছিল তাঁর রাতের সাজ।’ [ঐ। ২৩] এই মনোযোগ ও প্রসাধনের বর্ণনা তাঁর আত্মনিবেদনের প্রকৃতিটিকে চিনিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট।

সারদা দেবী প্রকৃত অর্থে শিক্ষিতা ছিলেন না সত্য, কিন্তু একেবারে নিরক্ষরও ছিলেন না। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির অন্তঃপুরে লেখাপড়ার যথেষ্ট প্রচলন ছিল স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘আমাদের গৃহে অন্তঃপুর শিক্ষা ও তাহার সংস্কার’ [প্রদীপ, ভাদ্র ১৩০৬। ৩১৪-২০] প্রবন্ধে তার সুন্দর পরিচয় আছে। মায়ের সম্পর্কে তিনি লিখেছেন : ‘মাতাঠাকুরাণী ত কাজকর্ম্মের অবসরে সারাদিনই একখানি বই হাতে লইয়া থাকিতেন। চাণক্যশ্লোক তাঁহার বিশেষ প্রিয় পাঠ ছিল, প্রায়ই বইখানি লইয়া শ্লোকগুলি আওড়াইতেন। তাঁহাকে সংস্কৃত রামায়ণ মহাভারত পড়িয়া শুনাইবার জন্য প্রায়ই কোন না কোন দাদার ডাক পড়িত।’ [ঐ। ৩১৬] চাণক্যশ্লোক, দেবেন্দ্রনাথেরও খুব প্রিয় ছিল, সারদা দেবীর এই চাণক্যশ্লোক-প্রিয়তা কি স্বামীর কাছে শিক্ষালাভেরই প্রত্যক্ষ ফল?

যাই হোক, এই শিক্ষা অবশ্য তাঁকে সংস্কার মুক্তির কোনো বিশেষ দিগন্তের সন্ধান দিতে পারেনি, তা সম্ভবও নয়। সেইজন্যই দেখি তিনি সেকালের অন্তঃপুরের স্বাভাবিক সংকীর্ণ গণ্ডীর ভিতরেই আবদ্ধ থেকেছেন চিরকাল। জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর উক্তিতেও এই ধারণারই সমর্থন মেলে : ‘বিয়ের দুতিন বৎসর পরে বাবামশায় মাকে সুদ্ধ নিয়ে এসে কলকাতায় বাড়ী ভাড়া করে রইলেন। মা আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাবার জন্য পালকি পাঠালেন। কিন্তু শাশুড়ী ঠাকরুণ বল্লেন ভাড়া বাড়িতে বউ পাঠাবেন না। …বাবামশায় যখন শুনলেন মা এই কারণে আমাকে যেতে দিচ্ছেন না তখন নিজেই বাড়ির ভিতর চলে এলেন। এসে মাকে বল্লেন—সত্যেন্দ্রর বউয়ের মা তাঁকে নিতে পালকি পাঠিয়েছেন, তুমি নাকি ভাড়া বাড়ী বলে’ তাকে যেতে দাও নি? ভাড়াবাড়ী কেন, মা গাছতলায় থাকলেও মায়ের কাছে যাবে, এখনি পাঠিয়ে দাও।’ ইন্দিরা দেবী লিখেছেন : ‘শুনেছি সত্যেন্দ্র’কে বিলেত পাঠানো হয়েছে, এই অজুহাতে মেজবউমার গয়না নিয়ে কর্ত্তাদিদিমা তাঁর দুই মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন শুনে মহর্ষি রাগ করে তার বদলে মাকে হীরের কণ্ঠী দেন’,—এগুলি অবশ্যই মানসিক ঔদার্যের পরিচয় বহন করে না। এই ধরনের মনোভাবের বর্ণনা পাওয়া যায় সৌদামিনী দেবীর লেখায় : ‘আমার সেজ এবং ন বোন অধিক বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত ছিল বলিয়া আত্মীয়েরা চারি দিক হইতে মাকে এবং পিতাকে তাড়না করিতেন। মা বিচলিত হইয়া উঠিতেন’; কিংবা সত্যেন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণে : ‘আমি ছেলেবেলা থেকেই স্ত্রী-স্বাধীনতার পক্ষপাতী। মা আমাকে অনেক সময় ধমকাইতেন, “তুই মেয়েদের নিয়ে মেমদের মত গড়ের মাঠে ব্যাড়াতে যাবি না কি?” সত্যেন্দ্রনাথ এর চেয়েও বেশি দূর গিয়েছিলেন, কিন্তু তখন তাঁর মার প্রতিক্রিয়ার কথা কোথাও বর্ণিত হয়নি। কিন্তু সারদা দেবীর এই মানসিক সংকীর্ণতার জন্য তাঁকেই একমাত্র দায়ী করা উচিত নয়, আমাদের সমাজই যে তখন অনেকটা পিছিয়ে ছিল এসব তারই প্রমাণ—আমাদের সমাজের সকল শ্রেণীর শিক্ষিত পুরুষেরাই কি এর চেয়ে বেশি মুক্তদৃষ্টির পরিচয় দিতে পেরেছিলেন?

সারদা দেবী বহু-প্রসবিনী ছিলেন; সর্বমোট পনেরোটি সন্তানের—নয়টি ছেলে ও ছয়টি মেয়ে—জননী। সুতরাং সন্তানদের প্রতি যথাযযাগ্য মনোযোগ দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তখনকার দিনে অভিজাত পরিবারে তার প্রয়োজনও ছিল না—আত্মীয়-স্বজন ও দাসদাসীরাই সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্ব পালন করত। সৌদামিনী দেবী লিখেছেন : ‘আমার মা বহুসন্তানবতী ছিলেন এইজন্য তিনি আমাদের সকলকে তেমন করিয়া দেখিতে পারিতেন না—মেজকাকীমার ঘরেই আমাদের সকলের আশ্রয় ছিল। তিনি আমাদের বড় ভালোবাসিতেন, তাঁহার ’পরেই আমাদের যত আবদার ছিল।’১০ সত্যেন্দ্রনাথও অনুরূপ উক্তি করেছেন : ‘মার কাছে আমরা বেশীক্ষণ থাকতুম না—আমাদের আসল আড্ডা ছিল মেজকাকিমার ঘর; সেই আমাদের শিক্ষালয়, সেই বিশ্রাম-স্থান। বলতে গেলে মেজকাকিমাই আমাদের মাতৃস্থানীয় ছিলেন।’১১ সরলা দেবী তাঁর আত্মকথায় নিজের মা স্বর্ণকুমারীর সন্তান-বাৎসল্যের অভাবের কথা বলতে গিয়ে তাঁর দিদিমার প্রতিও কটাক্ষ করেছেন।১২ সারদা দেবীর জীবনে পারিবারিক ও সামাজিক যে সংকটের কথা পূর্বেই বলা হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এই উদাসীনতার একটা যুক্তিসংগত কারণ খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য নয়।

অবশ্য তিনি সব কিছুতেই যে উদাসীন ছিলেন, তা নয়। জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর ‘স্মৃতিকথা’য় দেখি, ‘শ্বশুরবাড়ির অন্দরমহলে যখন পালকি নামাল তখন বোধ হয় আমার শাশুড়ী আমাকে কোলে করে তুলে নিয়ে গেলেন। …আমাকে নিয়ে পুতুলের মতো এক কোণে বসিয়ে রাখলেন। …আমরা বউরা প্রায় সকলেই শ্যামবর্ণ ছিলুম। …প্রথম বিয়ের পর শাশুড়ী আমাদের রূপটান ইত্যাদি মাখিয়ে রং সাফ করবার চেষ্টা করতেন। তিনি সামনে বসে থাকতেন তক্তপোষের উপর, আর দাসীরা আমাদের ঐসব মাখাত। দিন কতক পরে যতদূর হবার হলে ছেড়ে দিতেন।…আমি বড্ড রোগা ছিলুম। একদিন কাদের বাড়ীর বউরা বেড়াতে এসেছে সেজেগুজে, তাদের বেশ হৃষ্টপুষ্ট দেখে মা বল্লেন, “এরা কেমন হৃষ্টপুষ্ট দেখ দেখি, আর তোরা সব যেন বৃষকাষ্ঠ!” তারপর আমাকে কিছুদিন নিজে খাইয়ে দিতে লাগলেন। আমার একমাথা ঘোমটার ভিতর দিয়ে তাঁর সেই সুন্দর চাঁপার কলির মত হাত দিয়ে ভাত খাওয়াতেন। আমার কেবল মনে হত মা কতক্ষণে উঠে যাবেন আর আমি দালানে গিয়ে বমি করব।’১৩

পুত্রবধূদের প্রতি এই স্নেহ, পৌত্র-পৌত্রী দৌহিত্র-দৌহিত্রীদের প্রতিও সমভাবেই বিস্তৃত ছিল, তার কিছু দৃষ্টান্ত আমরা যথাস্থানে দেখতে পাব। মমতাময়ী গৃহকর্তীর চিত্রটি সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন ঠাকুরপরিবারের এক দুর্ভাগিনী গৃহবধূ বীরেন্দ্রনাথের স্ত্রী প্রফুল্লময়ী দেবী : ‘শ্বাশুড়ীর মত শ্বাশুড়ী পাইয়াছিলাম। তাঁর মত সৌভাগ্যবতী, পতিভক্তি পরায়ণা স্ত্রীলোক এখনকার দিনে খুব কমই দেখিতে পাওয়া যায়।…ধর্মে মতি তাঁর যথেষ্ট ছিল। কেহ যদি তাঁহার সাক্ষাতে পুত্রকন্যাদের প্রশংসা করিত, তখনই তিনি মাথা নত করিয়া থাকিতেন, পাছে তাঁর মনে অহঙ্কার আসে। …অত বড় বৃহৎ পরিবারের সমস্ত সংসারের ভার তাঁহারই উপর ছিল, তিনি প্রত্যেককে সমানভাবে আদর যত্নে অতি নিপুণ ভাবে সকলের অভাব দুঃখ, দূর করিয়া চলিয়া গিয়াছেন। কাহাকেও কোনও বিষয় হইতে বঞ্চিত করিয়া মনে ব্যথা দিবার কখনও চেষ্টা করিতেন না। তাঁহার মনটি শিশুর মত কোমল ছিল। এত বড় লোকের পুত্রবধূ এবং গৃহিণী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মনে কোনরকম জাঁক, বা বিলাসিতার ছায়া স্পর্শ করিতে পারে নাই। যতদূর সম্ভব সাদাসিধে ধরণের সাজ পোষাক করিতেন, কিন্তু তাহাতেই তাঁহার দেহের সৌন্দৰ্য্যকে আরও বাড়াইয়া তুলিত।’১৪

দেবেন্দ্রনাথও পত্নীকে সংসারে একটি মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন। দ্বারকানাথ ঠাকুর এস্টেটে সারদা দেবীর নামে তিনি একটি ‘ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট’ সৃষ্টি করেছিলেন ২৪,৭০০ টাকা দিয়ে এবং তাঁর সমস্ত উপস্বত্ব সারদা দেবীই ভোগ করতেন। এর উপরে ব্যক্তিগত মাসোহারা ছাড়াও কন্যা ও জামাতাদের মাসোহারাও ‘সারদাসুন্দরী দেবী খাতে’ প্রদত্ত হত। সেই সুদূরকালেও দেবেন্দ্রনাথ অনুভব করেছিলেন মেয়েদের আর্থিক স্বাধীনতার গুরুত্ব এবং টাকার জন্য তাঁর উপর নির্ভর করার ফলে অন্তত কন্যা ও জামাতাদের সারদা দেবীর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে এবং তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য আদায় করে দেবে।

তাঁর মৃত্যু হয় ২৭ ফাল্গুন ১২৮১ [বুধ 11 Mar 1875] তারিখে রাত্রি ৩-৪৫ মিনিটে আনুমানিক ৪৯ বৎসর বয়সে। রবীন্দ্রজীবনের অনুষঙ্গে তাঁর সম্পর্কে আরও কিছু জানার সুযোগ আমাদের হবে, সুতরাং বর্তমান আলোচনা আমরা এখানেই সমাপ্ত করছি।

উল্লেখপঞ্জি

ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী : পুরাতনী [১৩৬৪]। ১৯

আত্মজীবনী। ৬৮

রবীন্দ্র-কথা। ৪০

সৌদামিনী দেবী : ‘পিতৃস্মৃতি’, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ [১৩৭৫]। ১৫২

ঐ। ১৫১

পুরাতনী। ২১-২২

ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী : জীবনকথা, এক্ষণ, শারদীয়া ১৩৯৯। ১৩

‘পিতৃস্মৃতি’। ১৫৮-৫৯

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর : আমার বাল্যকথা ও আমার বোম্বাই প্রবাস [1915] 18

১০ ‘পিতৃস্মৃতি’। ১৫৪

১১ আমার বাল্যকথা ও আমার বোম্বাই প্রবাস। ১৫

১২ দ্র সরলা দেবী চৌধুরানী : জীবনের ঝরাপাতা [১৩৮২]। ৫

১৩ পুরাতনী। ১৯-২১

১৪ প্রফুল্লময়ী দেবী : আমাদের কথা’, প্রবাসী, বৈশাখ ১৩৩৭। ১১৩-১৪; অপিচ, বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর শতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ [1972]। ২২-২৩

* ব্যোমকেশ মুস্তফী সারদা দেবীর একটি অতিরিক্ত নামের উল্লেখ করেছেন : ‘শাকন্তরী’, দ্র বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস। ৩৫৫; খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রকথা [১৩৪৯] গ্রন্থেও এই নামটির উল্লেখ আছে।

* দ্বারকানাথের নূতন গৃহপ্রবেশের বর্ণনা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলেও, তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রের বিবাহের কোনো বিবরণ বা সঠিক তারিখ আমাদের হাতে এসে পৌঁছয়নি। এ-সম্পর্কে খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন : ‘…আমাদের প্রপিতামহ ৺মদনমোহন চট্টোপাধ্যায় [দ্বারকানাথের দিদি রাসবিলাসী দেবীর জ্যেষ্ঠ পুত্র]…নিজের উপার্জ্জনের যে স্বতন্ত্র হিসাব রাখিতেন তাহাতে দেখা যায় লৌকিকতা হিসাবে মাতাঠাকুরাণীকে দেবেন্দ্রের বধূকে আশীর্ব্বাদের যৌতুক দেন (২৪ ফাল্গুন ১২৪০ ইং ১৮৩৪) [বৃহ 6 Mar] পরে ৫ই আষাঢ় ১২৪২ (ইং ১৮৩৫ ২৯শে জুন) [বৃহ 18 Jun] দেবেন্দ্রের বধূর গর্ভাধান উৎসবে আশীৰ্ব্বাদী দেওয়া হয় এবং তাহার পরে ৫ই আশ্বিন ১২৪৫ (ইং ১৮৩৮ সেপ্টেম্বর) [বৃহ 20 Sep] দেবেন্দ্রর বধূর সাধের জন্য মিঠাই খরিদ হয়। নয়মাসে সাধ দেওয়া ঠাকুরবংশের কুলপ্রথা। ইহার দুই মাসের মধ্যে সারদাদেবীর প্রথম সন্তানের (কন্যার) জন্ম হয়।’ —রবীন্দ্রকথা। ৪ [তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে সংযোজন বা সংশোধন লেখককৃত]।

* সৌদামিনী দেবীর ‘পিতৃস্মৃতি’ প্রবন্ধে [প্রবাসী, ফাল্গুন ১৩১৮। ৪৬৩; মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। ১৫৩] ও জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর ‘স্মৃতিকথা’য় [পুরাতনী। ১৯] বিবাহের সময় সারদা দেবীর বয়স ‘ছয় বৎসর’ বলে উল্লিখিত হয়েছে।

* ‘১৭১৮ শক [১২৬৬] হইতে তাঁহার বাড়ীতে দুর্গোৎসব বন্ধ হইয়াছে।’—রাজনারায়ণ বসু : ‘দেবেন্দ্রবাবুর উপদেশ, উপাসনা ও দীক্ষাপদ্ধতি’, প্রবাসী, মাঘ ১৩৩৪। ৪৬৫

চতুর্থ অধ্যায় – গিরীন্দ্রনাথের উত্তরপুরুষ

দ্বারকানাথের পাঁচ পুত্রের মধ্যে দেবেন্দ্রনাথ, গিরীন্দ্রনাথ ও নগেন্দ্রনাথ সংসার-জীবনে প্রবেশ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে নগেন্দ্রনাথ নিঃসন্তান অবস্থায় স্ত্রী ত্রিপুরাসুন্দরী দেবীকে রেখে-মাত্র ঊনত্রিশ বৎসর বয়সে 24 Oct 1858 তারিখে পরলোকগমন করেন। ঘটনাচক্রে ত্রিপুরাসুন্দরীও মূল পরিবার থেকে দূরে বাস করতে থাকেন, সুতরাং কয়েকটি মামলা-মোকদ্দমা ইত্যাদি প্রসঙ্গ ছাড়া ঠাকুর পরিবারের ইতিহাসে তাঁর বিশেষ কোনো স্থান নেই। গিরীন্দ্রনাথও মাত্র ৩৪ বৎসর বয়সে 19 Dec 1854 [মঙ্গল ৫ পৌষ ১২৬১] তারিখে মারা যান। মৃত্যুকালে তিনি পত্নী যোগমায়া দেবী, দুই পুত্র গণেন্দ্রনাথ ও গুণেন্দ্রনাথ এবং দুই কন্যা কাদম্বিনী ও কুমুদিনীকে রেখে যান। সম্ভবত 1859-এ গৃহদেবতার নিত্যপূজা ও অন্যান্য কয়েকটি বৈষয়িক কারণে দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁদের মনোমালিন্য হয়, ফলে দ্বারকানাথের উইল অনুযায়ী বৈঠকখানা বাড়ি [৫ নং দ্বারকানাথ ঠাকুর লেন] তাঁদের সম্পূর্ণ অধিকারে আসে এবং দেবেন্দ্রনাথের পরিবার ভদ্রাসন বাড়িতে [৬নং দ্বারকানাথ ঠাকুর লেন] উঠে আসেন। জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবার বলতে এই দুটি পরিবারকেই বোঝায়। যদিও চিরকাল ছেলেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, কিন্তু মেয়েদের মধ্যে যোগসূত্রটি ছিন্ন হয়ে যায়। আনুষ্ঠানিক দিক দিয়েও দুটি পরিবারের মধ্যে বিভিন্নতা লক্ষিত হয়। গিরীন্দ্রনাথের পরিবার দোল-দুর্গোৎসব ইত্যাদি সমস্ত হিন্দু পৌত্তলিক আচার আচরণকে অনুসরণ করেছে, কিন্তু দেবেন্দ্রনাথের পরিবারে পৌত্তলিকতার অংশ সম্পূর্ণরূপে বর্জিত হয়েছিল।

গণেন্দ্রনাথের জন্ম হয় 1841-এ। হিন্দু স্কুলের ছাত্র হিসেবে ভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি 1857-এ প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তাঁর বিবাহ হয় 7 Feb 1858 তারিখে স্বর্ণকুমারী দেবীর সঙ্গে ১৭ বৎসর বয়সে। পিতার বৈষয়িক বুদ্ধির সম্পূর্ণ উত্তরাধিকার তিনি লাভ করেছিলেন, এসব ব্যাপারে দেবেন্দ্রনাথ বিশেষভাবে তাঁর উপর নির্ভর করতেন। তাছাড়া সাহিত্য, শিল্প, ইতিহাস-চর্চা, নাট্যাভিনয় ইত্যাদি ব্যাপারে তাঁর যথেষ্ট উৎসাহ ও সংগঠন শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। চৈত্রমেলা বা হিন্দুমেলার প্রধান উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম ছিলেন। মাত্র ২৮ বৎসর বয়সে ৪ জ্যৈষ্ঠ ১২৭৬ [রবি 16 May 1869] তারিখে কলেরা রোগে তাঁর মৃত্যু হয়। অকালে একটি পুত্রসন্তান মৃত অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তাঁর আর কোনো সন্তানাদি হয়নি।

গিরীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় সন্তান ও জ্যেষ্ঠ কন্যা কাদম্বিনী দেবীর বিবাহ হয় যজ্ঞেশপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এঁদের প্রথম পুত্র জ্যোতিঃপ্রকাশ রবীন্দ্রজীবনীতে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী; ইনিই প্রথম তাঁকে ‘পয়ারছন্দে চৌদ্দ অক্ষর যোগাযোগের রীতিপদ্ধতি’ বুঝিয়ে কবিতা-রচনায় দীক্ষা দেন। কাদম্বিনী দেবীর অপর পুত্র ইন্দুপ্রকাশ এবং দুই কন্যা নৃপবালা ও ধীরবালা।

গিরীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠা কন্যা কুমুদিনীর বিবাহ হয় নীলকমল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। নীলকমলের এক ভ্রাতা যদুনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সেজদিদি শরৎকুমারীর বিবাহ হয়। ‘নবনাটক’-এর [1866] অভিনয়ে নীলকমল নটের ভূমিকা গ্রহণ করেন। এঁর একমাত্র পুত্র নীরদনাথ সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে রবীন্দ্রনাথের সহপাঠী ছিলেন।

কনিষ্ঠ পুত্র গুণেন্দ্রনাথের জন্ম 1847-এ, মৃত্যু ২২ জ্যৈষ্ঠ ১২৮৮ [শুক্র 3 Jun 1881] তারিখে মাত্র ৩৪ বৎসর বয়সে [‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকায় প্রকাশিত বিবরণে মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ৩২ বলে উল্লিখিত হয়েছে।] সৌদামিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় সম্ভবত ১২৭০ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে [Jan 1864]। এঁদের চারটি পুত্র ও দুটি কন্যা। পুত্র গগনেন্দ্রনাথ [1867-1938], সমরেন্দ্রনাথ [1870-1951], অবনীন্দ্রনাথ [1871-1951] ও কুমারেন্দ্রনাথ [‘র‍্যাট’—শিশুবয়সেই মারা যায়] এবং কন্যা বিনয়িনী [?-1924] ও সুনয়নী [1875-1962]। বিনয়িনীর স্বামী শেষেন্দ্রভূষণ চট্টোপাধ্যায়, এঁদেরই দ্বিতীয়া কন্যা প্রতিমা দেবীর সঙ্গে পরে রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথের বিবাহ হয়। সুনয়নীর বিবাহ হয়েছিল রজনীমোহন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে, চিত্রশিল্পের জগতে তিনি স্মরণীয়া। এঁদেরই এক কন্যা বীণাপাণির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘সকল গানের ভাণ্ডারী’ দিনেন্দ্রনাথের বিবাহ হয়েছিল প্রথম পক্ষে।

পাঠকের অবগতির জন্য গিরীন্দ্রনাথ থেকে চার পুরুষের একটি বংশলতিকা প্রদত্ত হল [রবীন্দ্রজীবনের সঙ্গে যুক্ত নামগুলিই সাধারণত গ্রহণ করা হয়েছে] :

গিরীন্দ্রনাথ থেকে চার পুরুষের একটি বংশলতিকা
গিরীন্দ্রনাথ থেকে চার পুরুষের একটি বংশলতিকা

[চিত্রা দেব-সংকলিত ‘ঠাকুরবাড়ির বংশলতিকা’ অবলম্বনে]

পঞ্চম অধ্যায় – দেবেন্দ্রনাথের উত্তরপুরুষ

দেবেন্দ্রনাথের পরিবার ছিল আরো বড়ো। পুত্র-কন্যা মিলিয়ে তাঁর সন্তান-সংখ্যা পনেরোটি—তার মধ্যে নটি পুত্র ও ছটি কন্যা—এঁদের মধ্যে প্রথম সন্তান একটি কন্যা 1838-এ জন্মের পরেই মারা যায়।

জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথের জন্ম ২৯ ফাল্গুন ১৭৬১ শক [১২৪৬ : বুধ 11 Mar 1840]। শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি নোটবুকে [Ms. 364] দ্বিজেন্দ্রনাথের রাশিচক্রটি এইভাবে পাওয়া যায় :

দ্বিজেন্দ্রনাথের রাশিচক্র

দ্বিজেন্দ্রনাথের বাল্যশিক্ষা প্রধানত বাড়িতেই হয়। পরে সেন্ট পল’স স্কুলে দু-বছর পড়ে স্কলারশিপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন, কিন্তু এক বছর পরেই তিনি কলেজ ত্যাগ করেন। 6 Feb 1858 শনিবারে যশোহর নরেন্দ্রপুর-নিবাসী তারাচাঁদ চক্রবর্তীর কন্যা সর্বসুন্দরী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। অল্প বয়সে তাঁর প্রধান ঝোঁক ছিল কাব্য-রচনায় ও চিত্রাঙ্কনে। এই আগ্রহের ফল কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যের পদ্যানুবাদ [1860]। কিন্তু এর পরে তিনি ক্রমশ দুরূহ তত্ত্ববিদ্যার চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ [1875] রূপক-কাব্য বাংলা সাহিত্যের এক আশ্চর্য কীর্তি। বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী, অথচ যথেষ্ট নিষ্ঠার অভাব—এর ফলে বাংলা দেশ ও সাহিত্য তাঁর কাছে যা পেতে পারত, তার অনেকটাই অপ্রাপ্ত থেকে গেছে। আর যেটুকু দিয়েছেন, তারও বেশির ভাগ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে রয়েছে—পুস্তকাকারে সেগুলিকে সংকলন করার প্রয়াস খুবই যৎসামান্য।

দ্বিজেন্দ্রনাথ নটি সন্তানের জনক—এদের মধ্যে দুটি পুত্রসন্তানের মৃত্যু হয় জন্মের অব্যবহিত পরেই। অপর সাতটি সন্তানের মধ্যে পাঁচটি পুত্র—দ্বিপেন্দ্রনাথ, অরুণেন্দ্রনাথ, নীতীন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ ও কৃতীন্দ্রনাথ এবং দুই কন্যা সরোজা ও ঊষা। একটি মৃত পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়ে প্রসব-জনিত অসুস্থতায় সর্বসুন্দরী দেবী মাত্র একত্রিশ বৎসর বয়সে ১২৮৫ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি [Jun 1878] পরলোকগমন করেন, দ্বিজেন্দ্রনাথের বয়স তখন আটত্রিশ বৎসর। দ্বিজেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয় ৪ মাঘ ১৩৩২ [সোম 18 Jan 1926] ছিয়াশি বৎসর বয়সে।

দেবেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ২০ জ্যৈষ্ঠ ১২৪৯ [বুধ 1 Jun 1842] তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। এঁর রাশিচক্রটি পূর্বোক্ত নোটবুক থেকে উদ্ধৃত করা হচ্ছে :

দেবেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পুত্র সত্যেন্দ্রনাথের রাশিচক্র

প্রথমে হিন্দু কলেজের স্কুল বিভাগে ও পরে সেন্ট পল্‌’স স্কুলে কিছু দিন পড়ে Apr 1957-এ সত্যেন্দ্রনাথ হিন্দু স্কুল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তিত প্রথম এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন ও এক বৎসরের জন্য বর্ধমানরাজ-প্রদত্ত সিনিয়র স্কলারশিপ মাসিক দশ টাকা হিসেবে পেয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। সম্ভবত ১২৬৬ বঙ্গাব্দের [1857] অগ্রহায়ণ মাসে যশোহরের নরেন্দ্রপুর গ্রামনিবাসী অভয়াচরণ মুখোপাধ্যায় ও নিস্তারিণী দেবীর কন্যা জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর [জন্ম ১২ শ্রাবণ ১২৫৭। শুক্র 26 Jul 1850—‘১৭৭২। ৩।১১। ৪। ৩’] সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। স্ত্রী-স্বাধীনতার বিস্তারে এই দম্পতির অবদান অসামান্য, সভাসমিতি-স্থাপন প্রভৃতি প্রচারের ঢক্কানিনাদ ছাড়াই কেবল ব্যক্তিগত আচার-আচরণেই তাঁরা এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ বন্ধু মনোমোহন ঘোষের সঙ্গে আই. সি. এস. পরীক্ষা দেবার জন্য 23 Mar 1862 তারিখে বিলাত যাত্রা করেন ও প্রথম ভারতীয় আই. সি. এস. হিসেবে বোম্বাই প্রদেশকে তাঁর কর্মক্ষেত্র-রূপে বেছে নেন। তাঁর মৃত্যু হয় ২৪ পৌষ ১৩২৯ [9 Jan 1923] তারিখে ৮২ বৎসর বয়সে।

1868-এ একটি পুত্রসন্তানের জন্মের পরেই মৃত্যু হবার পর দ্বিতীয় পুত্র [জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসেবেই পরিচিত] সুরেন্দ্রনাথের জন্ম হয় পুনায় ১২ শ্রাবণ ১২৭৯ [26 Jul 1872] তারিখে [মৃত্যু : ২০ বৈশাখ ১৩৪৭ শুক্র 3 May 1940]। একমাত্র কন্যা ইন্দিরা দেবীর জন্ম বিজাপুরের অন্তর্গত কালাদ্‌গিতে ১৫ পৌষ ১২৮০ [29 Dec 1873]; তাঁর মৃত্যু হয় ২৭ শ্রাবণ ১৩৬৭ [শুক্র 12 Aug 1960] তারিখে। অপর পুত্র কবীন্দ্রনাথের [? 1876-78] জন্ম হয় সিন্ধুপ্রদেশের শিকারপুরে। আর একটি পুত্রের জন্ম হয় 1877-এ ইংলন্ডে, কিন্তু জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। সুরেন্দ্রনাথ ও ইন্দিরা দেবী উভয়েই রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথ ৮ মাঘ ১২৫০ [শনি 20 Jan 1844] তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। লেখাপড়া ও ব্যায়ামের দিকে তাঁর অত্যন্ত আগ্রহ ছিল। চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার জন্য তিনি কিছুদিন মেডিক্যাল কলেজে অধ্যয়ন করেন। বাড়িতে শিক্ষক রেখে তিনি ফরাসি ভাষাতেও বিশেষ পারদর্শী হয়ে ওঠেন। অন্তঃপুরে ও বালকদের শিক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব তিনি স্বেচ্ছায় নিজের হাতে গ্রহণ করেছিলেন—জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতির স্মৃতিকথায় তাঁর এই আগ্রহের বিস্তৃত পরিচয় পাওয়া যায়। ১১ অগ্রহায়ণ ১২৭০ [বৃহ 26 Nov 1863] তারিখে সাঁতরাগাছি-নিবাসী হরদেব চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা নীপময়ী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। তাঁর তিন পুত্র ও আট কন্যা; পুত্রদের নাম—হিতেন্দ্রনাথ, ক্ষিতীন্দ্রনাথ ও ঋতেন্দ্রনাথ এবং কন্যাদের নাম প্রতিভা, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞা, মনীষা, শোভনা, সুনৃতা, সুষমা ও সুদক্ষিণা। প্রথম সন্তান ও জ্যেষ্ঠা কন্যা প্রতিভা দেবীকে তিনি শিক্ষা-দীক্ষা ও সংগীতে অসামান্য পারদর্শী করে তুলেছিলেন। অন্যান্য সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারেও তিনি অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। হেমেন্দ্রনাথ দীর্ঘজীবী হননি, মাত্র ৪০ বৎসর বয়সে ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১২৯১ [বৃহ 12 Jun 1884] তারিখে তাঁর মৃত্যু হয়।

দেবেন্দ্রনাথের চতুর্থ পুত্র বীরেন্দ্রনাথের জন্ম হয় ২৭ কার্তিক ১২৫২ [মঙ্গল 11 Nov 1845] তারিখে। তিনি বেঙ্গল অ্যাকাডেমি থেকে 1866-এ দ্বিতীয় বিভাগে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কিছুদিন প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়ন করেন। এর পূর্বেই ৮ ফাল্গন ১২৭২ [18 Feb 1866] তারিখে হরদেব চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা প্রফুল্লময়ী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। কিন্তু কিছুদিন পরে 1868-এর মাঝামাঝি সময়ে তিনি উন্মাদরোগে আক্রান্ত হন। তাঁর একমাত্র পুত্র বলেন্দ্রনাথের জন্ম হয় ২১ কার্তিক ১২৭৭ [6 Nov 1870] তারিখে। ২২ মাঘ ১৩০২ [4 Feb 1896] তাঁর বিবাহ হয় সাহানা দেবীর সঙ্গে। কিন্তু মাত্র ২৯ বৎসর বয়সে ৩ ভাদ্র ১৩০৬ [19 Aug 1899] তাঁর মৃত্যু হয়। বীরেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয় ২৭ বৈশাখ ১৩২২ [10 May 1915]-এ ৭০ বৎসর বয়সে।

দেবেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ কন্যা [অল্পায়ু প্রথমা কন্যাকে সাধারণত গণ্য করা হয় না] সৌদামিনী দেবীর জন্ম 1847-এ। বেথুন স্কুলের বর্তমান গৃহ নির্মিত হলে দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে পরীক্ষামূলকভাবে ওই স্কুলে প্রেরণ করেন।* তাঁর বিবাহ হয় সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্ভবত ১২৬৩ বঙ্গাব্দে [1856]। তাঁদের প্রথম সন্তান একমাত্র পুত্র সত্যপ্রসাদের জন্ম হয় ৩১ আশ্বিন ১২৬৬ [রবি 16 Oct 1859]; মৃত্যু : ১ বৈশাখ ১৩৪০ [শুক্র 14 Apr 1933] ভোর ৫-২০ মিঃ। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে প্রায় দু-বছরের বড়ো হলেও বিদ্যালয়ে সত্যপ্রসাদ তাঁর সহপাঠী ছিলেন। সৌদামিনী দেবীর আরও দুটি কন্যা হয়—ইরাবতী [1862—1918] ও ইন্দুমতী [?] ইরাবতী বা ইরু রবীন্দ্রনাথের বাল্য-সঙ্গিনী ছিলেন, জীবনস্মৃতি ও অন্যান্য কয়েকটি রচনায় তাঁর উল্লেখ দেখা যায়। সারদাপ্রসাদের মৃত্যু হয় রবীন্দ্রনাথের বিবাহের দিন ২৪ অগ্রহায়ণ ১২৯০ [9 Dec 1883] তারিখে রাত্রি ৮-৩০ মিনিটে। সৌদামিনী দেবীর মৃত্যুর তারিখ ৩০ শ্রাবণ ১৩২৭ [রবি 15 Aug 1920] রাত্রি ৪-১৫ মিঃ, তাঁর বয়স তখন ৭৩ বৎসর।

রবীন্দ্রনাথের নতুন-দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জন্ম ২২ বৈশাখ ১২৫৬ [বৃহ 4 May 1849] তারিখে। তাঁর রাশিচক্রটি এইরূপ :

রবীন্দ্রনাথের নতুন-দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের রাশিচক্র

গৃহ অবস্থিত চণ্ডীমণ্ডপে গুরুমশায়ের পাঠশালায় পড়ার পর সেন্ট পল্‌’স্‌ স্কুল, মন্টেগু’স্‌ অ্যাকাডেমি ও হিন্দু স্কুলে পড়াশোনা করে কেশবচন্দ্র সেন-প্রতিষ্ঠিত কলিকাতা কলেজ থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ 1864-এ এন্ট্রান্স পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। প্রেসিডেন্সি কলেজে কিছুদিন পড়ার পর তিনি ছাত্রজীবন শেষ করেন। ২৩ আষাঢ় ১২৭৫ [5 Jul 1868] তারিখে ১৯ বৎসর বয়সে তাঁর বিবাহ হয় কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে। প্রায় ষোলো বৎসর বিবাহিত জীবন যাপন করার পর ১২৯১ বঙ্গাব্দে কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন। রবীন্দ্রমানস-গঠনে এই দুজনের অসাধারণ ভূমিকা রয়েছে। চিত্রবিদ্যা, সংগীত, নাটকাদি রচনায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বিচিত্র প্রতিভার স্বাক্ষর দেখা যায়। সংস্কৃত, মারাঠি ও ফরাসি ভাষা থেকে নাটক, প্রবন্ধ, গল্প প্রভৃতি অনুবাদেও তিনি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ৭৬ বৎসর বয়সে রাঁচিতে ২০ ফাল্গুন ১৩৩১ [4 Mar 1925] তারিখে তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন।

দেবেন্দ্রনাথের অষ্টম সন্তান সুকুমারী দেবী [? 1850-64] দীর্ঘ জীবন লাভ করেননি। ১২ শ্রাবণ ১২৬৮ [শুক্র 26 Jul 1861] হেমেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। দেবেন্দ্রনাথ-প্রবর্তিত অপৌত্তলিক ‘অনুষ্ঠান পদ্ধতি’ অনুসারে এই বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। ব্রাহ্মধর্ম-মতানুযায়ী এইটিই প্রথম সামাজিক অনুষ্ঠান। জ্যৈষ্ঠ ১২৭১-এর [May 1864] প্রথম দিকে সুকুমারী দেবীর একমাত্র সন্তান অশোকনাথের জন্ম হয়। সম্ভবত প্রসবজনিত পীড়ায় ওই মাসেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও অপৌত্তলিকভাবে অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখযোগ্য, হেমেন্দ্রনাথ অন্যান্যদের মতো ঘরজামাই ছিলেন না।

দেবেন্দ্রনাথের নবম সন্তান পুণ্যেন্দ্রনাথ [? 1851-57] শিশু বয়সেই মারা যান। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, পুকুরের জলে ডুবে তাঁর মৃত্যু হয়।*

তৃতীয়া কন্যা শরৎকুমারী দেবীর [1854-1920] বিবাহ হয় গণেন্দ্রনাথের ভগিনীপতি নীলকমল মুখখাপাধ্যায়ের ভ্রাতা যদুনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে জ্যৈষ্ঠ ১২৭৩-এ [Jun 1866]। ঠাকুরবাড়ির বিভিন্ন জনের স্মৃতিকথায় শরৎকুমারী প্রসাধন-প্রিয় রূপে চিত্রিত হয়েছেন। তাঁর চারটি কন্যা—সুশীলা, সুপ্রভা, স্বয়প্রভা ও চিরপ্রভা এবং দুটি পুত্র—যশঃপ্রকাশ ও জ্ঞানপ্রকাশ। ১০ আষাঢ় ১৩২৭ [24 Jum 1920] ৬৬ বৎসর বয়সে শরৎকুমারী দেবীর মৃত্যু হয়।

চতুর্থ কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী বাংলার মহিলা সাহিত্যিকদের মধ্যে অগ্রগণ্যা। তাঁর জন্ম হয় ১৪ ভাদ্র ১২৬৩ [বৃহ 28 Aug 1856] তারিখে [দ্র ড পশুপতি শাশমল : স্বর্ণকুমারী ও বাংলা সাহিত্য (১৩৭৮)। ২৬] কোনো বিদ্যালয়ে না পড়েও আন্তরিক আগ্রহে কিভাবে নিজেকে স্বয়ংশিক্ষিত করে তোলা যায়, স্বর্ণকুমারীর জীবন তার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। অবশ্য এব্যাপারে তাঁর স্বামী জানকীনাথ ঘোষালের [1840-1913] কৃতিত্ব অনেকখানি, যাঁর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় ২ অগ্রহায়ণ ১২৭৪ [17 Nov 1867] তারিখে, স্বর্ণকুমারীর বয়স তখন এগারো বৎসর মাত্র। তাঁর তিনটি কন্যা—হিরন্ময়ী [1868-1925], সরলা [1872-1945] ও ঊর্মিলা [1874-79] এবং একটি পুত্র—জ্যোৎস্নানাথ [1870-1962]। স্বর্ণকুমারী দেবী ১৯ আষাঢ় ১৩৩৯ [3 Jul 1932] তারিখে ৭৬ বৎসর বয়সে পরলোকগমন করেন।

কনিষ্ঠা কন্যা বর্ণকুমারী দেবী [? 1857-1948] রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরেও জীবিত ছিলেন। তাঁর বিবাহ হয় মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ১৯ কার্তিক ১২৭৬ [3 Nov 1869] তারিখে। তাঁদের দুটি পুত্রসন্তান হয়—সরোজনাথ ও প্রমোদনাথ। সতীশচন্দ্র পরে দেবেন্দ্রনাথের ব্যয়ে স্কটল্যান্ডের অ্যাবারডিন থেকে চিকিৎসাবিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে আসেন।

রবীন্দ্রনাথের অব্যবহিত অগ্রজ দেবেন্দ্রনাথের সপ্তম পুত্র সোমেন্দ্রনাথের জন্মতারিখ ২৯ ভাদ্র ১২৬৬ [মঙ্গল 13 Sep 1859]। প্রায় দু-বছরের বড়ো হলেও ইনি রবীন্দ্রনাথের সহপাঠী এবং বাল্য ও কৈশোরে অন্যতম সঙ্গী ছিলেন। সংগীতে এঁর বিশেষ পারদর্শিতা ছিল, সংগীতরচনা ও অন্যান্য গুণও তাঁর কিছু কিছু ছিল। রবীন্দ্রনাথের কাব্যচর্চার ইনি ছিলেন অন্যতম পৃষ্ঠপোষক, তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কবি-কাহিনী’ [1878] প্রকাশের ব্যাপারে এঁর হাত ছিল, আর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘বনফুল’ [1880] ‘দাদা সোমেন্দ্রনাথের অন্ধপক্ষপাতের উৎসাহে’ই মুদ্রিত হয়েছিল। কিন্তু ১২৮৫ বঙ্গাব্দের শেষাশেষি [Feb-Mar 1879] তাঁর মধ্যে মস্তিষ্ক-বিকৃতির লক্ষণ প্রকাশিত হয়, যদিও তা কখনই বীরেন্দ্রনাথের মতো আয়ত্তের বাইরে চলে যায়নি। এই কারণেই তাঁর বিবাহ দেওয়া হয়নি, দেবেন্দ্রনাথের উইলে আজীবন মাসোহারার বিনিময়ে সম্পত্তির অধিকার থেকেও তিনি বঞ্চিত হয়েছিলেন। ৬২ বৎসর বয়সে ১৬ মাঘ ১৩২৮ 30 Jan 1922*] তারিখে তাঁর মৃত্যু হয়।

দেবেন্দ্রনাথের চতুর্দশ সন্তান ও অষ্টম পুত্র রবীন্দ্রনাথ [1861-1941]। তাঁর সঙ্গে ২৪ অগ্রহায়ণ ১২৯০ [রবি 9 Dec 1883] তারিখে যশোহরের ফুলতলি গ্রামের বেণীমাধব রায়চৌধুরীর দশমবর্ষীয় কন্যা ভবতারিণী [মৃণালিনী] দেবীর [জন্ম : ১৮ ফাল্গুন ১২৮০ রবি 1 Mar 1874] বিবাহ হয়। মাত্র ২৯ বৎসর বয়সে ৭ অগ্রহায়ণ ১৩০৯ [রবি 23 Nov 1902] তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁদের তিনটি কন্যা—মাধুরীলতা [1886-1918], রেণুকা [1891-1903] ও মীরা [1894-1969] এবং দুটি পুত্র রথীন্দ্রনাথ [1888-1961] ও শমীন্দ্রনাথ [1896-1907]। সন্তানদের মধ্যে কেবল রথীন্দ্রনাথ ও মীরা রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুকালে বর্তমান ছিলেন। রথীন্দ্রনাথের বিবাহ হয় প্রতিমা দেবীর [1893-1969] সঙ্গে, তাঁরা নিঃসন্তান ছিলেন। মীরা দেবীর পুত্র নীতীন্দ্রনাথ অল্পায়ু ছিলেন এবং কন্যা নন্দিতা দেবীরও সন্তানাদি হয়নি। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ বংশধারা এখন লুপ্ত বলা যেতে পারে।

রবীন্দ্রনাথের পরেও দেবেন্দ্রনাথের বুধেন্দ্রনাথ [1863-64] নামে একটি পুত্র হয়, কিন্তু নিতান্ত শৈশবেই তাঁর মৃত্যু হয় বলে রবীন্দ্রনাথকেই তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র বলে উল্লেখ করা হয়, আমরাও দুই একটি ক্ষেত্র বাদে সেইভাবেই বর্ণনা করব।

দেবেন্দ্রনাথ থেকে আরম্ভ করে উপরে বর্ণিত অনেকেরই বিস্তৃত জীবন-কথা রবীন্দ্রনাথের জীবনীর ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক; কিন্তু পরে তাঁর জীবন-বৃত্তান্তের অঙ্গীভূত করেই এঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে বলে এক্ষেত্রে একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েই ক্ষান্ত হওয়া গেল।

দেবেন্দ্রনাথের বংশতালিকাটি সুবৃহৎ হলেও পাঠকের সুবিধার্থে তাঁর থেকে তৃতীয় পুরুষ [কোনো কোনো ক্ষেত্রে চতুর্থ পুরুষ] পর্যন্ত সংকলন করে দিচ্ছি :

দেবেন্দ্রনাথের বংশলতিকা

ঠাকুরবাড়ির বংশতালিকা
ঠাকুরবাড়ির বংশতালিকা

৪. হেমেন্দ্রনাথ=নীপময়ী

—প্রতিভা-আশুতোষ চৌধুরী

—হিতেন্দ্র-সরোজিনী]—গায়ত্রী, মেধা, হৃদীন্দ্র=অমিয়া

—ক্ষিতীন্দ্র-ধৃতিময়ী, সুহাসিনী]—গার্গী, বাণী, ক্ষেমেন্দ্র=মেনকা

—ঋতেন্দ্র-অলকা]—ঋদ্ধিন্দ্র, সুভগেন্দ্র [সুভো], সিদ্ধেন্দ্র, বাসবেন্দ্র

—প্রজ্ঞা=লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়া

—অভিজ্ঞা

=দেবেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়

—মনীষা

—শোভনা=নগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

—সুনৃতা=নন্দলাল ঘোষাল

—সুষমা=যোগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

—সুদক্ষিণা=পণ্ডিত জওলাপ্রসাদ

ঠাকুরবাড়ির বংশতালিকা
ঠাকুরবাড়ির বংশতালিকা

[চিত্রা দেব-সংকলিত ‘ঠাকুরবাড়ির বংশতালিকা’ অবলম্বনে]

————

* ‘আমরা কোন বিশেষ বিশ্বাসি বন্ধুর প্রমুখাৎ শ্রুত হইলাম যে দেশ হিতৈষি সুবিখ্যাত মান্যবর বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় অনরবিল মেং বেথুন সাহেবের স্থাপিত “বিক্টরিয়া বালিকা বিদ্যালয়ে” আপনার কন্যা ও ভ্রাতৃ কন্যাকে [? কুমুদিনী দেবী] বিদ্যানুশীলনার্থ প্রেরণ করিবেন এমত কল্পনা স্থির করিয়াছেন এবং বেথুন সাহেবের নিকট স্পষ্টরূপে স্বীকার করা হইয়াছে।’—সংবাদ প্রভাকর, ২৪ আষাঢ় ১২৫৮; বিনয় ঘোষ-সম্পাদিত সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ২ [১৩৮৫]। ৫৩; লক্ষণীয় দেবেন্দ্রনাথের আর কোনো কন্যা বিদ্যালয়ে প্রেরিত হননি।

দেবেন্দ্রনাথ অমৃতসর থেকে ২৪ ফাল্গুন ১৭৭৮ শক [শুক্র 6 Mar 1857] রাজনারায়ণ বসুকে একটি পত্রে লিখেছেন : ‘…আমার জামাতা সারদাপ্রসাদ এই ক্ষণে হিন্দু কলেজে ভর্ত্তি হইয়াছেন। প্রথম প্রথম তাঁহার বাবুগিরির প্রবল ইচ্ছা দেখিয়া দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁর প্রতি বিরক্ত হইয়াছিলেন কিন্তু তাহার পরে দ্বিজেন্দ্র আমাকে আর এক পত্রে লিখিয়াছেন যে “মহাশয়কে পূর্ব্বে লিখিয়াছিলাম যে উত্তম পোষাক পরিধান করিতে সারদাপ্রসাদের বড় ইচ্ছা কিন্তু এইক্ষণে আমারদিগের সঙ্গে সহবাস করাতে সে ইচ্ছা ক্রমশঃ লোপ পাইতেছে।”—পত্রাবলী। ৬২; দেবেন্দ্রনাথ ১৯ আশ্বিন ১৭৭৮ শক [শুক্র 3Oct 1856] তারিখে কলকাতা ত্যাগ করে নৌকাপথে কাশী যাত্রা করেন, দ্র আত্মজীবনী। ১৭৫; এর থেকে অনুমান করা যায়, আষাঢ় বা শ্রাবণ মাসে জ্যেষ্ঠ কন্যার বিবাহ দিয়ে আশ্বিনে পূজার সময়ে তিনি পশ্চিম অভিমুখে যাত্রা করেন।

* দ্র রবীন্দ্রজীবনী ১ [১৩৯২]। ১৪; প্রভাতকুমার নামটি ‘পূর্ণেন্দ্রনাথ’ লিখেছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি-তে প্রদত্ত বংশতালিকায় ‘পুণ্যেন্দ্রনাথ’ নাম পাওয়া যায়।

বর্ণকুমারী দেবীর জন্মসালটি জীবনস্মৃতি-তে প্রদত্ত বংশতালিকায় এবং অন্যত্র 1858-রূপে উল্লিখিত হয়, কিন্তু এটি সম্পর্কে সংশয়ের কারণ আছে। দেবেন্দ্রনাথ ১৯ আশ্বিন ১২৬৩ [3 Oct 1856] তারিখে কলকাতা ত্যাগ করে পশ্চিমাভিমুখে যাত্রা করেন এবং সিপাহি বিদ্রোহের দুর্যোগের মধ্যে ১ অগ্রহায়ণ ১৭৮০ শক [১২৬৫; সোম 15 Nov 1858] তারিখে বাড়ি ফিরে আসেন। সুতরাং স্বাভাবিক কারণেই 1858-এ বর্ণকুমারী দেবীর জন্ম হতে পারে না। এই কারণেই মনে হয় 1857-এর মাঝামাঝি কোনো সময়ে তাঁর জন্ম হয়েছিল।

* সোমেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর দশম দিবসে ২৬ মাঘ ১৩২৮ তারিখে ভ্রাতুষ্পুত্র সুধীন্দ্রনাথ তাঁর শ্রাদ্ধ করেন। দ্র তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ফাল্গুন ১৮৪৩ শক [১৩২৮]। ২৮৯-৯০
[ক্রোড়পত্র; পৃ ২৮]

ষষ্ঠ অধ্যায় – দেশ কাল ও পারিবারিক পরিবেশ

রবীন্দ্রনাথ যে-সময়ে জন্মগ্রহণ করেন তখন বাংলাদেশের এক যুগ-সন্ধিক্ষণ। বাংলাদেশে ইংরেজ-শাসনের শতবর্ষ-পূর্তি ঘটেছে মাত্র চার বছর আগে 1857-এ। আর ঐ বছরেই সিপাহি বিদ্রোহের নিষ্ফল প্রয়াসের পরিণামে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে 1858-এ বাংলা তথা ভারতের শাসনভার এসেছে মহারানী ভিক্টোরিয়ার হাতে। হিন্দু কলেজ স্থাপনের পর প্রায় পঞ্চাশ বছরের সুনিয়ন্ত্রিত ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারের অন্তে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হল 24 Jan 1857 [শনি ১২ মাঘ ১২৬৩] তারিখে। মেয়েদের জন্য বেথুন সাহেব স্কুল স্থাপন করেছেন 7 May 1849 [সোম ২৬ বৈশাখ ১২৫৬]। 1851-এ ইংরেজ-শাসকদের সঙ্গে দর-কষাকষির প্রয়োজনে স্থাপিত হয়েছে ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন। 1856-এ বিধবা-বিবাহ আইন বিধিবদ্ধ হল। দেবেন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনী সভা তার আরদ্ধ কাজ সমাপ্ত করে 1859-এ ব্রাহ্মসমাজের অঙ্গীভূত হয়ে গেছে, আর কেশবচন্দ্র সেনের যোগদানের ফলে ব্রাহ্মসমাজ শুধু ব্রহ্মোপাসনা ও উপনিষদ-চর্চার কেন্দ্র না থেকে একটা প্রবল ধর্মান্দোলনের সূচনা করেছে। অপর দিকে বিদ্যাসাগর-রচিত বিভিন্ন বাংলা গদ্যগ্রন্থ, প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলাল, রামনারায়ণ তর্করত্ন-মধুসূদন-দীনবন্ধুর নাটক, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও মধুসূদনের নূতন ধরনের কাব্য বাংলা সাহিত্যের জগতেও বিরাট পরিবর্তন এনেছে। ইংরেজ-সাহচর্যে ও ইংরেজি সাহিত্যের মাধ্যমে লব্ধ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের এক জীবনদৃষ্টি আমাদের মধ্যযুগীয় স্রোতোহীন জীবনধারায় যে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে, নানা দ্বন্দ্ব-বিরোধের মধ্য দিয়ে তা অনেকটা স্তিমিত হয়ে এক বিমিশ্র সংস্কৃতির জন্মদান করল দ্বিতীয়ার্ধে। বাঙালীর মানসভূমি উনিশ শতকের প্রথম পঞ্চাশ বছর ইংরেজি সাহিত্যের ভাবরসে সিক্ত হয়ে বিদেশী চিন্তা-পদ্ধতির কর্ষণযন্ত্রে কর্ষিত হয়েছে, এইবার এল তাতে বীজ বপন করে ফসল ফলানোর পালা। অর্থাৎ, রাজনীতি শিক্ষা সমাজ ধর্ম ও সাহিত্য—মানব-সভ্যতার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ তখন এক নূতন সভ্যতার দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়েছে।

অপর দিকে, রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক পরিবেশটিও তখন এক সন্ধিক্ষণে। পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠা থেকে যদি ঠাকুরগোষ্ঠীর আভিজাত্যের সূচনা ধরা হয়, তা হলে রবীন্দ্রনাথের জন্মকালে তা প্রায় শতবার্ষিকী মুখে। এই শতবর্ষ ধরে সরকারী চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের দৌলতে ঠাকুরগোষ্ঠী ক্রমশই সম্পদ, সামাজিক সম্মান ও প্রতিপত্তির উচ্চ শিখরে আরোহণ করেছে। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠার পর সেই সম্মান ও প্রতিপত্তির হ্রাস তো হয়-ই নি, বরং দ্বারকানাথের আমলে তা চরমতম সীমা স্পর্শ করে। কিন্তু দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর, রবীন্দ্রনাথের জন্মের পনেরো বছর আগে, সেই যুগ অবসিত হয়েছে। যে ঐশ্বর্যচ্ছটায় একদিন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি দীপ্যমান হয়ে ছিল, তা ক্রমশই ম্লান হয়ে এসেছে। রবীন্দ্রনাথের জন্মের সময় এই পরিবার সম্পূর্ণরূপেই জমিদারী-নির্ভর এক উচ্চবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।

ধনগরিমার অন্তর্ধানের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের পুরোনো আচার অনুষ্ঠান ধর্মকর্মও অন্তর্হিত হয়েছে। দ্বারকানাথ রামমোহন ও ব্রাহ্মধর্মের অনুরাগী হলেও পারিবারিক পূজাপার্বণ সবই নিষ্ঠার সঙ্গে বজায় রেখেছিলেন। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মে আনুষ্ঠানিক দীক্ষা গ্রহণের পর থেকে পরিবারের পৌত্তলিক অনুষ্ঠানগুলি আস্তে আস্তে তুলে দিতে থাকেন। দ্বারকানাথের শ্রাদ্ধের সময় হিন্দুধর্মের আচার-পদ্ধতি না মানার জন্য পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরগোষ্ঠী তাঁদের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক রহিত করেন। এর পর দুর্গোৎসবও বাড়ি থেকে উঠে যাওয়ার ফলে অন্যান্য আত্মীয়দেরও আনাগোনা কমে যায়। আর এই-সব অনুষ্ঠানের স্থান করে নেয় মাঘোৎসব, বর্ষশেষ, নববর্ষ ইত্যাদি ব্রহ্মোপাসনামূলক অনুষ্ঠানসমূহ, যাতে যোগ দেন প্রধানত রক্তসম্পর্কহীন ব্রাহ্মসমাজের সভ্যেরা অর্থাৎ সামাজিক দিক থেকেও জোড়াসাঁকো ঠাকুরগোষ্ঠী তখন অন্য এক পথের যাত্রী।

সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও এই পরিবার ছিল ভিন্নপথগামী। তখনকার দিনে শিক্ষিতসমাজে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার ছিল অত্যন্ত ব্যাপক—কথাবার্তা, লেখাপড়া ও চিঠিপত্রে। বাংলাভাষা ব্যবহৃত হত অন্দরমহলে মেয়েদের শিক্ষায়—তার প্রসারও ছিল অত্যন্ত সংকীর্ণ। কিন্তু ঠাকুর-পরিবারে বাংলাভাষার প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল, তাকে ব্যবহার করা হত সর্বত্র। ‘সর্বতত্ত্বদীপিকা সভা’র ‘গৌড়ীয় ভাষার উত্তম রূপে অৰ্চনা’র আদর্শ দেবেন্দ্রনাথ প্রয়োগ করেছিলেন নিজের পরিবারে। কথিত আছে, তাঁর কোনো এক জামাতা তাঁকে ইংরেজিতে পত্র লিখেছিলেন বলে তিনি না পড়েই সে পত্র ফেরত দিয়েছিলেন। সেই যুগের পক্ষে এই আচরণ খুবই বিস্ময়কর। কিন্তু এর ফলেই পরিবারের সন্তানদের মাতৃভাষা-চর্চার ভিত হয়েছিল সুদৃঢ় এবং তাঁদের কথিত ভাষা এমন এক স্বাতন্ত্র্য অর্জন করেছিল যাকে লোকে বলত ‘ঠাকুরবাড়ির ভাষা’। শুধু ভাষাই নয়—বেশভূষা, আদবকায়দা, চালচলনেও তাঁরা ছিলেন স্বতন্ত্র। এই স্বাতন্ত্র্যকে আমরা নাম দিতে পারি সাংস্কৃতিক আভিজাত্য।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল উপনিষদের মধ্য দিয়ে প্রাচীন ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। দেবেন্দ্রনাথ তাঁর সন্তানদের ছোটোবেলা থেকেই বিশুদ্ধ উচ্চারণে উপনিষদের নির্বাচিত শ্লোক নিয়মিত আবৃত্তি করা প্রায় আবশ্যিক করে দিয়েছিলেন। আর তারই পরিণতি ঘটেছিল স্বদেশের প্রতি গভীর প্রতিবোধের উন্মেষে। পরবর্তীকালে এই স্বদেশপ্রীতিই তাঁদের বিচিত্র চিন্তা ও কর্মের প্রধান নিয়ামক শক্তি রূপে কাজ করেছে।

অনেকটা এই কারণে, আর কতকটা যুগধর্মবশত, এই পরিবারে য়ুরোপীয় সাহিত্যচর্চার আনন্দও উপেক্ষিত হয়নি। শেক্‌স্‌পীয়র, ওয়াল্টার স্কট প্রভৃতি ইংরেজি লেখকদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা হাত বাড়িয়েছেন ফরাসি কাব্যসাহিত্যের মূল্যবান সম্পদগুলির দিকেও। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তা ও সৃষ্টির সঙ্গে পরিচিত হয়ে স্বদেশীয় সাহিত্যিকে নব নব ভাবসম্পদে ও সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ করে তোলা ছিল তাঁদের ব্রত। তখনকার দিনের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যরথীদের—ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, মধুসূদন দত্ত, রাজনারায়ণ বসু প্রভৃতি— জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে আনাগোনা ছিল। এইসব মিলে রবীন্দ্রনাথের জন্মের পূর্বেই এই বাড়ির আবহাওয়ায় একটা সাহিত্যরস-সম্ভোগের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল।

রামমোহনের সময় থেকেই ব্রাহ্মসমাজে ধর্মচর্চার সঙ্গে সঙ্গে একটা সাংগীতিক ঐতিহ্যও গড়ে উঠেছিল। কৃষ্ণ ও বিষ্ণু চক্রবর্তী ব্রাহ্মণসমাজের বেতনভোগী গায়ক ছিলেন। রামমোহন হিন্দুস্থানী সংগীতের কাঠামোয় বেশ কিছু ব্ৰহ্মসংগীত রচনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে দেবেন্দ্রনাথ এই ঐতিহ্য বজায় রেখেছিলেন এবং দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ও গণেন্দ্রনাথ হিন্দি গান ভেঙে ব্ৰহ্মসংগীত রচনায় যথেষ্ট উৎসাহ দেখিয়েছিলেন। যদু ভট্টের মতো নামী সংগীতশিল্পীরা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে বসবাস করেছেন। এর ফলে তখন সেখানে একটি বিশুদ্ধ সাংগীতিক পরিবেশ গড়ে উঠেছিল।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বাহ্যিক চেহারাটিও ছিল বিচিত্র। এই বাড়ির পত্তন হয়েছিল আনুমানিক 1784-এ নীলমণি ঠাকুরের আমলে। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের জন্মের সময় তার বয়স ৭৫ বৎসরেরও বেশি। এই সুদীর্ঘ সময় ধরে অনবরতই এই বাড়িতে নতুন নতুন অংশ যোজিত হয়েছে পরিবারের ক্রমবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে, এবং তাও কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই। পিরালী ব্রাহ্মণদের সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে পুত্রকন্যার বিবাহাদি সম্বন্ধ স্থাপন খুব সহজ ছিল না। সুতরাং যশোহর-খুলনা বা অন্যত্র থেকে যখন পাত্রী সংগ্রহ করা হত, অনেক সময়েই তখন কন্যার আত্মীয়স্বজনকেও প্রতিপালনের দায়িত্ব নিতে হত। আর কন্যার বিবাহ দেবার জন্য যে পাত্র সংগৃহীত হত, তাদেরও ঘরজামাই-রূপে এই বাড়িতেই স্থান করে দেওয়া প্রায় অপরিহার্য ছিল। স্বভাবতই পৌত্র-পৌত্রী, দৌহিত্র-দৌহিত্রী-ক্রমে পরিবারের আকৃতি বৃহৎ রূপ ধারণ করেছে, আর তার সঙ্গে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িও শাখা-প্রশাখায় বর্ধিত হয়েছে। দ্বারকানাথের দ্বারা নির্মিত বৈঠকখানা বাড়িও রবীন্দ্রনাথের জন্মের পূর্ব পর্যন্ত এই বৃহৎ পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছে। পরিবারটি একান্নবর্তী ছিল গিরীন্দ্রনাথের স্ত্রী পুত্রাদি আলাদা হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত। ধান আসত জমিদারী থেকে, গোলাবাড়িতে তা মজুত হত, ঢেঁকিশালায় কোটা হত, রান্না হত এজমালি মাইনে করা ঠাকুরের হাতে। এই রান্নার চমৎকার একটি বর্ণনা দিয়েছেন সরলা দেবী তাঁর ‘জীবনের ঝরাপাতা’ গ্রন্থে। তাঁর বর্ণনা আরও পরবর্তীকালের অভিজ্ঞতা আশ্রয় করে রচিত হলেও, যে-সময়ের কথা বলা হচ্ছে তার পক্ষেও খুব একটা অপ্রযুক্ত নয় :‘সে বাড়ির রান্নাঘরে দশ-বারজন বামুন ঠাকুর ভোর থেকে রান্না চড়ায়। সে প্রকাণ্ড রান্নাঘরের দুপাশে দুভাগ করা মেঝেতে পরিষ্কার কাপড় পেতে ভাত ঢালা হয়, সে ভাত স্তূপাকার হয়ে প্রায় কড়িকাঠ স্পর্শ করে। তারই পরিমাণে ব্যঞ্জনাদি প্রস্তুত করে দিনে সেই ভাতব্যঞ্জন ও রাত্রে লুচি-তরকারি—লোক গুণে গুণে পাথরের থালাবাটিতে সাজিয়ে মহলে মহলে ঘরে ঘরে দিয়ে আসে বামুনেরা।’

তখনও কলকাতা পুরো শহুরে রূপ ধারণ করেনি। রাস্তাঘাট অধিকাংশই ছিল কাঁচা, পাশ দিয়ে বয়ে যেত কাঁচা নর্দমা। মিউনিসিপ্যালিটির কলের জলের আয়োজন তখনো হয়নি। অজস্র পুকুর ছিল এখানে ওখানে, স্নান ও পান চলত তারই জলে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘কলকাতা শহরের বক্ষ তখন পাথরে বাঁধানো হয়নি, অনেকখানি কাঁচা ছিল। তেলকলের ধোঁওয়ায় আকাশের মুখে তখনও কালী পড়েনি। ইমারত-অরণ্যের ফাঁকায় ফাঁকায় পুকুরের জলের উপর সূর্যের আলো ঝিকিয়ে যেত, বিকেলবেলায় অশথের ছায়া দীর্ঘতর হয়ে পড়ত, হাওয়ায় দুলত নারকেল গাছের পত্র-ঝালর।’ ছেলেবেলায় এই প্রাচীন কলকাতার একটি সুন্দর বর্ণনা আছে : ‘আমি জন্ম নিয়েছিলুম সেকেলে কলকাতায়। শহরে শ্যাকরাগাড়ি ছুটছে তখন ছড়্‌ছড়্‌ করে ধুলো উড়িয়ে, দড়ির চাবুক পড়ছে হাড়-বের-করা ঘোড়ার পিঠে। না ছিল ট্রাম, না ছিল বাস, না ছিল মোটরগাড়ি। তখন কাজের এত বেশি হাঁসফাঁসানি ছিল না, রয়ে বসে দিন চলত। বাবুরা আপিসে যেতেন কষে তামাক টেনে নিয়ে পান চিবতে চিবতে, কেউ বা পালকি চ’ড়ে কেউ বা ভাগের গাড়িতে। যাঁরা ছিলেন টাকাওয়ালা তাঁদের গাড়ি ছিল তকমা-আঁকা, চামড়ার আধঘোমটাওয়ালা, কোচবাক্সে কোচমান বসত মাথায় পাগড়ি হেলিয়ে, দুই দুই সইস থাকত পিছনে, কোমরে চামর বাঁধা, হেঁইয়ো শব্দে চমক লাগিয়ে দিত পায়ে-চলতি মানুষকে। মেয়েদের বাইরে যাওয়া-আসা ছিল দরজাবন্ধ পালকির হাঁপধরানো অন্ধকারে, গাড়ি চড়তে ছিল ভারি লজ্জা। রোদবৃষ্টিতে মাথায় ছাতা উঠত না। কোনো মেয়ের গায়ে সেমিজ, পায়ে জুতো, দেখলে সেটাকে বলত মেমসাহেবি; তার মানে, লজ্জাশরমের মাথা খাওয়া। …ঘরে যেমন তাদের দরজা বন্ধ, তেমনি বাইরে বেরবার পালকিতেও; বড়োমানুষের ঝিবউদের পালকির উপরে আরও একটা ঢাকা চাপা থাকত মোটা ঘেটাটোপের। দেখতে হত যেন চলতি গোরস্থান। পাশে পাশে চলত পিতলে-বাঁধানো লাঠি হাতে দারোয়ানজি। ওদের কাজ ছিল দেউড়িতে বসে বাড়ি আগলানো, দাড়ি চোমরানো, ব্যাঙ্কে টাকা আর কুটুমবাড়িতে মেয়েদের পৌঁছিয়ে দেওয়া, আর পার্বণের দিনে গিন্নিকে বদ্ধ পালকি-সুদ্ধ গঙ্গায় ডুবিয়ে আনা।’ অবশ্য এইটাই সেকালের কলকাতার সামগ্রিক রূপ নয়; তবে জোড়াসাঁকোর নিকটবর্তী অঞ্চলের ছবি এখানে অনেকটা ধরা পড়েছে। এর সঙ্গে যোগ করতে পারি হুতোমের একটি সরস মন্তব্য, ‘চিৎপুরের বড় রাস্তায় মেঘ কল্লে কাদা হয়’।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির তখনকার রূপটিও ছিল একই রকম—আধা-শহুরে, আধা-গ্রাম্য, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘তখন শহর এবং পল্লী অল্পবয়সের ভাইভগিনীর মতো অনেকটা এরকম চেহারা লইয়া প্রকাশ পাইত।’ সামনের দিকে ফটক পেরিয়ে একই প্রাঙ্গণে পাশাপাশি দুটো বাড়ি—আদি বসতবাড়ি ও তার দক্ষিণদিকে বৈঠকখানা বাড়ি, প্রথমটি দ্বিতল ও শেষেরটি ত্রিতল। অবনীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘অনেকগুলো ঘর, অনেকগুলো মহল, অনেকখানি বাগান জুড়ে দুই বাড়ি মিলিয়ে একবাড়ি ছিল ছেলেবেলার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। …একই নম্বর ছিল, ৬ নং দ্বারকানাথ ঠাকুরের গলি। একই ফটক ছিল প্রস্থান-প্রবেশের। সেই একই তালাভাঙা লোহার খোলা ফটক; তার একধারে একটি বুড়ো নিমগাছ, তার কোটরে কোটরে পাপদুয়া, টুনটুনি পাখিদের বাসা; আর-এক ধারে একটি মাত্র গোলকচাঁপার গাছ, আগায় ফুল গোড়ায় ফুল ফুটিয়ে। এই ফটককে শ্যামমিস্ত্রি মাঘোৎসবের দিনে লোহার কিরীট পরাত; তাতে আলোর শিখায় জ্বলত ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্‌’। …বাড়ির ঈশানকোণে বিশাল একটা তেঁতুলগাছ, সে যে কত দিনের কেউ বলতে পারে না। দৈত্যের হাতের মতো তার মোটা মোটা কালো ডাল। এ-বাড়িতে ও-বাড়িতে যত ছেলেমেয়ে জন্মেছি তাদের সবার নাড়ি পোঁতা ছিল ওই গাছের তলায়। সেই তেঁতুলগাছের ছায়ায় ছিরু মেথরদের ঘর। …তাদের ঘরের পিছনে জোড়াসাঁকোর বাড়ির উত্তর দিকের পাঁচিল; তার গায়ে তিনটে বড়ো বড়ো বাদামগাছ, যেন শহরের আর-সব বাড়ি আড়াল করে মাথা তুলে উত্তরদুয়ার পাহারা দিচ্ছে। …উত্তর-পশ্চিম দিকটা কথায় বোঝাতে হলে তিন-চারটে পাড়ার নাম করতে হয়—মালীপাড়া, গোয়ালপাড়া, ডোমপাড়া।’ রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ থেকে এই বাড়ির চৌহদ্দির আরও খানিকটা বর্ণনা পাওয়া যায়। বাহির-বাড়িতে দোতলায় দক্ষিণ-পূর্ব কোণে চাকরদের মহলে যে ঘরে তাঁর দিন কাটত, সেই ঘরের ‘জানলার নীচেই একটি ঘাট-বাঁধানো পুকুর ছিল। তাহার পূর্বধারের প্রাচীরের গায়ে প্রকাণ্ড একটা চীনা বট—দক্ষিণধারে নারিকেলশ্রেণী। …তাহারই ফাঁক দিয়া দেখা যাইত ‘সিঙ্গির বাগান’ পল্লীর একটা পুকুর, এবং সেই পুকুরের ধারে যে তারা গয়লানী আমাদের দুধ দিত তাহারই গোয়ালঘর; আরো দূরে দেখা যাইত, তরুচূড়ার সঙ্গে মিশিয়া কলিকাতা শহরের নানা আকারের ও নানা আয়তনের উচ্চনীচ ছাদের শ্রেণী…।’

‘বাড়ির ভিতরে আমাদের যে-বাগান ছিল, তাহাকে বাগান বলিলে অনেকটা বেশি বলা হয়। একটা বাতাবি লেবু, একটা কুলগাছ, একটা বিলাতি আমড়া ও একসার নারিকেলগাছ তাহার প্রধান সংগতি। মাঝখানে ছিল একটা গোলাকার বাঁধানো চাতাল। তাহার ফাটলের রেখায় রেখায় ঘাস ও নানাপ্রকার গুল্ম অনধিকার প্রবেশপূর্বক জবর-দখলের পতাকা রোপণ করিয়াছিল। যে-ফুলগাছগুলো অনাদরেও মরিতে চায় না তাহারাই মালীর নামে কোনো অভিযোগ না আনিয়া, নিরভিমানে যথাশক্তি আপন কর্তব্য পালন করিয়া যাইত। উত্তরকোণে একটা ঢেঁকিঘর ছিল, সেখানে গৃহস্থালির প্রয়োজনে মাঝে মাঝে অন্তঃপুরিকাদের সমাগম হইত।…

‘আমাদের বাড়ির উত্তর-অংশে আর-একখণ্ড ভূমি পড়িয়া আছে, আজ পর্যন্ত ইহাকে আমরা গোলাবাড়ি বলিয়া থাকি। এই নামের দ্বারা প্রমাণ হয়, কোনো এক পুরাতন সময়ে ওখানে গোলা করিয়া সংবৎসরের শস্য রাখা হইত।’

আগেই বলা হয়েছে, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি বলতে দুটি বাড়িকে বোঝাত—আদি ভদ্রাসন বাড়ি ও বৈঠকখানা বাড়ি। কোনো-এক সময়ে, সম্ভবত দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর, বৈঠকখানা বাড়িতেই দেবেন্দ্রনাথ, গিরীন্দ্রনাথ ও নগেন্দ্রনাথ সপরিবারে বাস করতে থাকেন। নগেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর সম্পত্তি-সংক্রান্ত গোলযোগ ও ধর্মীয় কারণে দেবেন্দ্রনাথ বৈঠকখানা বাড়ি গিরীন্দ্রনাথের পরিবারকে ছেড়ে দিয়ে আদি ভদ্রাসন বাড়িতে উঠে আসেন। সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘এক সময় ছিল যখন আমাদের বাড়ী আত্মীয় স্বজনে পূর্ণ ছিল। এ-বাড়ী ও-বাড়ীর সকলে আমরা একান্নপরিবারভুক্ত ছিলুম। ক্রমে আমরা পৃথক হয়ে পড়লুম। …আমরা তেতালার বাড়ীতে ছিলাম—দোতালায় এসে পড়লুম। এই দোতালার বাড়ীই আমাদের আদিম বসদ্বাটী, তেতালার বাড়ী নির্ম্মাণ পরে হয়। বাড়ীর বাগান ভাগ হয়ে গেল, পুকুরটা বুঝি সাধারণ রইল। একদিন দেখি হাইকোর্টের একজন জজ এসে আমাদের বাড়ী তন্নতন্ন তদারক করে দেখে গেলেন, কি প্রণালীতে বিভাগ হবে তাই ঠিক করবার জন্যে।’

এই আদি ভদ্রাসন বাড়ি রবীন্দ্রনাথের জন্মের সময় ছিল দোতলা, পরে ক্রমবর্ধমান পরিবারের স্থান-সংকুলানের প্রয়োজনে প্রথমে ভিতর-বাড়ি বা অন্তঃপুরকে এবং পরবর্তীকালে বাহির-বাড়িকে তেতলায় পরিণত করা হয়।

এই বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন। যে আঁতুড়-ঘরে তাঁর জন্ম হয় তাঁর অবস্থান নিয়ে কিছু মতদ্বৈধ আছে। অসিতকুমার হালদার লিখেছেন : ‘এই দুই মহাত্মা পিতাপুত্রের [দেবেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ] যে সূতিকাগৃহে জন্ম, তা প্রথম দেখার সুযোগ হয় যখন আমি ৯। ১০ বৎসরের বালক। বড়দিদিমা (সৌদামিনী দেবী) আমাকে কেন জানি না, একদিন নিয়ে গেলেন জোড়াসাঁকোর অন্দরমহলে আলো-আঁধারে সিঁড়ি বেয়ে উপর তলায়। সূতিকাঘরটির দ্বার সিঁড়িতে ওঠার প[ে]থও আছে আর একটি আছে দোতলা দিয়ে নেবে প্রবেশ করার অর্থাৎ ঘরটি হরিশ্চন্দ্র [?] অবস্থা—যেন ঝুলছে, দোতলায়ও নয় নিচের তলায়ও নয়। ঘরটির মাত্র দুটি এইভাবে দ্বার থাকায় বেশ একটু অন্ধকার। বড়দিদিমা বল্লেন, “অসিত, দেখ্‌, এখানে কর্তামশাই এবং আমরা সবাই জন্মেছি, তোর মা আর তুইও এই ঘরে জন্মেছিস্‌”।’*

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় এই উক্তিটি নিয়ে আলোচনা করেছেন ও ঘরটির অবস্থান নির্ণয় করার প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি দ্বিজেন্দ্রনাথের পৌত্র অজিন্দ্রনাথের স্ত্রী অমিতা দেবীর সহায়তায় একটি ঘরের সন্ধান পান। এই সম্পর্কে তিনি লিখেছেন : ‘সে ঘরটি একটি সিঁড়ির সহিত সংলগ্ন। এই সিঁড়ি বাহিরের দিকে যে বড় ঠাকুর দালানের উঠোন আছে আর বাড়ির দক্ষিণপূর্ব অংশে আর একটি যে ছোট উঠোন আছে, তাদের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত। ঘরটি ঠিক একতলায়ও নয়, বা দোতলায়ও নয়, মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত। তবে সিঁড়ির সঙ্গে তার কোন সংযোগ নেই। পূর্বে যে সংযোগ ছিল তার চিহ্ন কিন্তু বর্তমান আছে। সেটা যে পরে দেয়াল তুলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, বেশ বোঝা যায়। আমি উপরের দোতলা হতেও এ ঘরে ঢুকেছি। ঢুকে দেখেছি সত্যই ঘরটিতে দুই প্রান্তে দুটি দরজা ছাড়া আর কিছু নাই।’১০ কিন্তু দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্রবধূ হেমলতা দেবী বলেছেন : ‘জোড়াসাঁকো বাড়ীর…দক্ষিণ দিকের অংশের মাঝখানে যে উঠোনটা আছে, তার দোতলার পূর্বদিকে একটা বাথরুম ছিল। তার পাশের ঘর আঁতুড়ঘর হিসাবে ব্যবহার হত। এই ঘরেই কাকামশাই এবং অন্যান্য ছেলেরা জন্মেছেন।…পরে যখন আমাদের পরিবার আরও বড় হল, সেই সময় বাথরুম আর সেই ঘর ভেঙে নতুন ঘর তৈরী হল।’১১

যাই হোক, ড বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ পর্যন্ত অসিত হালদার-উল্লিখিত ঘরটিকেই রবীন্দ্রনাথের সূতিকাগৃহ হিসেবে মেনে নিয়েছেন এবং বর্তমানে মহর্ষি-ভবনে ঘরটি সেইভাবেই নামাঙ্কিত হয়েছে।

বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি একটি গৌরবময় ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছিল, সন্দেহ নেই। এই বাড়ির কথা ভাবতে গেলেই দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ প্রভৃতি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কগুলি আমাদের চোখে পড়ে। কিন্তু এর পাশাপাশি বাড়িটির একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকও ছিল, যার দিকে সচরাচর আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত হয় না। আমরা আগেই বলেছি, বিবাহাদি কারণে অনেক আত্মীয়স্বজনকে আশ্রয় দিতে হত এই বাড়িতে। প্রধানত গ্রামীন পরিবেশ থেকে আগত এঁদের স্থান হত ভিতরবাড়ির একতলার আলোবাতাসহীন ছোটো ঘরগুলিতে—তাঁদের জীবনযাত্রার মানও ছিল একই স্তরের। বাড়ির পরিবেশকে এঁরা কতখানি দূষিত করে তুলতেন, রবীন্দ্রনাথ তার আভাস দিয়েছেন 2 Jul 1940 [১৮ আষাঢ় ১৩৪৭] তারিখে নারী শিক্ষা সমিতিতে প্রদত্ত একটি ভাষণে :

ছেলেবেলা থেকে আমাদের বাড়ীতে দেখেছি, কত’নিঃসহায় অনাথ আশ্রয় পেয়েছে। প্রকাণ্ড বাড়ীটি তাদের বসবাসে একেবারে পায়রার খোপের মত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু অধিবাসিনীদের অবস্থা তখন অতি শোচনীয় ছিল। তাদের অশিক্ষিত মন আত্মাবমাননাতে পূর্ণ হয়ে থাকত। তারা কখনও আত্মমর্য্যাদা অনুভব করতে পারেনি। তখনকার দিনে দেশের অন্যান্য মেয়েদের মত অভ্যস্ত অজ্ঞানতা ও অন্ধকারের মধ্যে তারা জন্মগ্রহণ করেছিল। তারা পরস্পরে ঈর্ষা করেছে, নিজেদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির দ্বারা যত রকম কুচিন্তার প্রশ্রয় দিয়েছে। মানুষের জগতে তাদের স্থান কত তলায়, তা বোধ করবার শক্তি তাদের ছিল না। এর ফলে হয়েছিল বাড়ীময় অশান্তি, পরস্পরের লাগালাগি ও কলহ বিবাদ। এতে করে বাড়ীর আবহাওয়া একেবারে বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল। এটুকু বোধও তাদের হয়নি যে, যে-বাড়ীতে তারা আশ্রিত, পালিত, নিজেদের ক্ষুদ্র আচরণে তারা সেই বাড়ীরই শান্তি ভঙ্গ করচে। মাকে অনেক সময় এসে তাদের দ্বন্দ্ব মেটাতে হত। এইটাই ছিল সকলের চেয়ে আফশোষের বিষয়। জ্ঞানের যে-অসীম সম্পদ তারা বিধাতার কাছে পেয়েছিল, পদে পদে তাদের মধ্যে তার অভাব দেখা যেত। অর্থের অভাব সকলের হয়, কিন্তু মানুষের যেটা স্বাভাবিক পাওনা, তার শুভবুদ্ধি, তারই যখন অভাব হয়, তখন গৃহে ঘোরতর বিপত্তি ঘটে।১২

এই বিপত্তি জোড়াসাঁকো বাড়ির সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন অংশে প্রায়ই দেখা দিত, মাঝে মাঝে আলোকিত অংশকেও তারা আক্রমণ করত। এই কারণেই সত্যেন্দ্রনাথ স্ত্রী-পুত্রকন্যাকে এই বাড়ির পরিবেশ থেকে দূরে রাখা পছন্দ করতেন, রবীন্দ্রনাথও প্রায়শই তাঁর পরিবারকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন—পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও কন্যা মীরা দেবীকে লেখা অনেক চিঠিতে এই পরিবেশ সম্পর্কে সতর্কবাণী দেখা যায়। আমাদের ধারণা, চার অধ্যায় [১৩৪১ : 1934] উপন্যাসের একটি বর্জিত অংশে এই অভিজ্ঞতাই ভাষারূপ লাভ করেছিল :

[এলার] মায়ের নাম মায়াময়ী। তাঁর সংসারে ছিল অনেকগুলি আশ্রিত অন্নজীবী। কর্ত্তৃত্বের যথেচ্ছাচার এই রকম অসহায়দের সাহায্যেই পুরো পরিমাণ প্রশ্রয় পেয়ে থেকে ওদেরও আত্মসম্মান কেবলি বিষিয়ে ওঠে। দুর্ব্বলকে ষড়যন্ত্রে পীড়িত করে তারা নিজের দুর্ভাগ্যের শোধ নিতে চায়, সকলের কাছে তোষামোদ ও লাগালাগির জালবিস্তার করার নৈপুণ্যে তাদের হাত পাকা হয়ে ওঠে। ওদের সামনে জীবনের সকল পথই রুদ্ধ, সঙ্কীর্ণ অস্বাস্থ্যকর আশ্রয়ে পরের অনুগ্রহনিগ্রহের জুয়োখেলায় তাদের রাত্রিদিন কলুষিত।

রবীন্দ্রনাথের জীবন-আলোচনায় এই পরিবেশটির কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে।

উল্লেখপঞ্জি

জীবনের ঝরাপাতা। ৯-১০

‘অবতরণিকা’ : রবীন্দ্র-রচনাবলী ১।১৶০

ছেলেবেলা ২৬। ৫৮৯

জীবনস্মৃতি ১৭। ২৭৩

জোড়াসাঁকোর ধারে [১৩৭৮]। ৩৭

ঐ। ৪৯

জীবনস্মৃতি ১৭। ২৬৯-৭১

ঐ ১৭। ২৭৩

আমার বাল্যকথা ও আমার বোম্বাই প্রবাস। ৩৭

১০ ঠাকুরবাড়ীর কথা।১৪৪

১১ ঐ।১৪৫

১২ নারী শিক্ষা সমিতি/অষ্টবিংশতিতম বার্ষিক বিবরণী/১৯৪৬-৪৭। ৩৬, ‘রবীন্দ্রনাথের আশীৰ্ব্বচন’

* রবিতীর্থে। ৫; রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠা কন্যা মীরা দেবীর স্মৃতিকথা-র [১৩৮২] ৩৯ পৃষ্ঠায় এ-প্রসঙ্গে অন্য ধরনের বিবরণ প্রদত্ত হয়েছে, ‘বড়োপিসিমার [সৌদামিনী দেবী] কাছে শুনেছি যে বাবার অন্য ভাইরা যে ঘরে জন্মেছেন বাবা সে ঘরে হন নি। বাবা জন্মাবার কিছুদিন আগে থাকতে আমার ঠাকুমার শরীর খারাপ হওয়াতে তাঁকে আঁতুড়-ঘরে না রেখে অপেক্ষাকৃত বাসযোগ্য বড়ো ঘরে রাখা হয়েছিল এবং বাবা সেই ঘরে জন্মেছিলেন। বাবা কোন্‌ ঘরে জন্মেছেন সেটা অনেকেই জানতে চান কিন্তু তার হদিশ দেওয়া সম্ভব নয়।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *